এটা পশ্চিমবঙ্গ আর ঝাড়খণ্ডের সীমানা। মাঝখান থেকে উঁকি মারছে একখণ্ড উড়িষ্যা। স্টেশন থেকে আসার পথে সামসূল মিঞা রানিং কমেন্টারি দিয়ে চলেছেন, “এই আমরা আছি পশ্চিমবঙ্গে, এই পা রাখলুম ঝাড়খণ্ড, এই এই এই মাথা গলালো ওড়িশা। ” ভাদ্র মাসের চোখ ধাঁধানো স্বচ্ছ নীল আকাশে ইতি উতি পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘের জটলা। সূর্যের প্রখর প্রতাপে তাকানো যাচ্ছে না। গাড়ি বলতে পাতি জিপ। তাও কবেকার কে জানে। জিপের বয়স বেশী না ড্রাইভারের বোঝা দায়। ড্রাইভারের নাম ইন্দিরা গান্ধী সোরেন। মহিলা নয়, দিব্যি গুঁফো বুড়ো একটা। সক্কাল সক্কাল মহুয়া না হাঁড়িয়া কি টেনেছে যম জানে,হাল্কা একটা মিষ্টি মিষ্টি পচা গন্ধে ম ম করছে জিপের ভিতরটা। গাড়ি প্রায় হাওয়ায় উড়ে চলেছে।
বাড়ির নাম, “গুলাব বাগান”। আমাদের কাছে এটা পশ্চিমের বাড়ি। বাবাদের ছোট বেলায় কারো তবিয়ৎ বিগড়োলে তাকে পশ্চিমের বাড়িতে পাঠানো হত। এখানকার টাটকা বাতাস, তরতাজা সব্জিপাতি আর সিড়িঙে অথচ সুস্বাদু দিশী মুরগির গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি আমরা চার খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। বাড়িটা আদতে আমার ঠাকুমার পিসেমশাই এর। উনি পরাধীন ভারতে বিশাল বড় সরকারী আমলা ছিলেন। দেশবিদেশ ঘুরে থিতু হয়েছিলেন এই গুলাব বাগানে এসে। গুলাব বাগান নাকি কোন উত্তর ভারতীয় ঠাকুরের রঙ মহল ছিল। এত লাম্পট্যের সাক্ষী এ বাড়ি যে ঠাকুর সাহেবের এন্তেকাল হওয়া মাত্র তাঁর বিধবা স্ত্রী ঠাকুর সাহের এক ডজন রাখেইল (উপপত্নী) সমেত দিলেন এ বাড়ি বেচে। কিনে নিলেন ঠাকুমার পিসেমশাই।যতদিন ঠাকুমার পিসি পিসেমশাই জীবিত ছিলেন বছরে অন্তত একবার সবৎসা ঠাকুমা দাদু আসতেন এবাড়িতে। তারপর কি যে হল, পিসতুতো ভাইদের কোন আচরনে ভয়ানক ক্রদ্ধ হলেন ঠাকুমা,ব্যাস তারপর আর পিসির বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি ঠাকুমা। কারণটা কেউ জানে না। এমনকি দাদুকেও কখনও বলেনি ঠাকুমা। এদিক থেকেও যোগাযোগ রাখার কোন চেষ্টা কখনও কেউ করেনি। এর মাঝে মারা গেছেন ঠাকুমা-দাদু। মারা গেছে জেঠু-কাকুও। আচমকা মাস তিনেক আগে উকিলের চিঠি, ঠাকুমার শেষ পিসতুতো ভাইটিও মারা গেছেন এবং মৃত্যুর পূর্বে সমস্ত সম্পত্তি দানপত্র করে গেছেন ঠাকুমা এবং তাঁর অবর্তমানে তাঁর সন্তানদের।
পড়ে পাওয়া এই সম্পত্তি আপাততঃ রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়েছে আমার বাবা-দিদিভাই আর খুড়তুতো দুই ভাইয়ের। মগের মু্লুকে কে দেখভাল করবে এই সম্পত্তি। রোজ মিটিং হচ্ছে, বিনদাস একমাত্র আমি।এত খাটাবার মত মাথার জোর আমার নেই। তবে পশ্চিমের বাড়িকে দেখার লোভ সামলাতে না পেরে, হঠাৎ পাওয়া তিনদিনের ছুটিতে তাই পাড়ি দিয়েছি গোলাপ বাগান।
জীপটা প্রায় ভল্ট খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। জীপ থেকে নেমে জুড়িয়ে গেল চোখ। বিশাল দোতলা বাড়ি, তিনদিকে বাগান, আর পূবদিকে একটা মরা নদীর লালচে খাত। যা আপাততঃ জোয়ান হয়ে কুলকুল করে বইছে। সামসূল মিঞাই দেখভাল করেন। কোন কালে ওণার ঠাকুরদা, আমার ঠাকুমার পিসেমশাইয়ের খাস বাবুর্চী ছিলেন। সেই সময় থেকেই মুখোপাধ্যায় পরিবারের সাথে এদের আত্মীয়তার সূত্রপাত। সামসূল মিঞা অবিবাহিত। কাছেই থাকেন। বয়স সত্তরের মাঝামাঝি, তবে ভীষণ কর্মঠ। স্টেশনে উনি আমাদের ব্যাগ বইবার জন্য ঝোলাঝুলি করছিলেন, কিছুতেই শৌভিককে বইতে দেবেন না।“ জামাই মানুষ বলে কতা”। সেখানে একচোট শৌভিকের ধমক থেকে ঠাণ্ডা হন। আবার জিপ থামতেই দৌড়লেন ব্যাগ বইবেন বলে। দৌড়ল শৌভিকও,যথারীতি ওই জিতল।
দোতলায় আমাদের ঘরটা পূব মুখো। একটা জিনিস দেখলাম এত বড় বাড়ি, ঘর সাকুল্যে জনা ছয়েক। একতলায় তিন, দোতলায় তিন। বিশাল বারন্দা, সাদা কালো মার্বেলের নক্সা করা। ঘরগুলো বেশ বড়,চুনকাম করা। আবলুস কাঠের পালিশ চটা বিশাল খাটের পায়ের দিকে সুন্দরী পরীর হাতে ধরা প্রমাণ সাইজের আয়না। খাস বেলজিয়াম গ্লাস। শৌভিক বলল,“নাঃ ঠাকুর সাহেব বেশ রঙ্গীন মেজাজ ছিলেন। খাটেও আয়না?” ঘরে মানুষ সমান তিনটে জানলা। জানলা দিয়ে মরা নদী আর জঙ্গল দেখা যায়। এককালে কাপড়ের পাখা ছিল, এখন অবশ্য সাবেকী ডিসি পাখার গায়ে কনভার্টার লাগানো।
দুপুরে মাংস ভাত খেয়ে ছোট্ট একটু গড়িয়ে নিয়ে পড়ন্ত রোদে একটু হেঁটে এলাম। গরম বেশ ভালোই। তবে ঘাম তেমন হচ্ছে না। গ্রামটা বেশ কিছুটা দূরে। ফিরে এসে চা আর পকোড়া খেয়ে সামসুল চাচার গল্প শুনতে শুনতেই রাত ঘনিয়ে এল। রান্নার মাসির নাম মঙ্গলা। তিনি রান্নাবান্না করে, খাবার টেবিলে রেখে চলে গেলেন সন্ধ্যা ছটার মধ্যেই। চাচার গপ্প আর থামে না। বুঝলাম কথা বলার কাউকে পাননা। শৌভিক উঠে গেল দোতলায়। মোবাইলে কোন টাওয়ার নেই। তুত্তুরীকে রেখে এসেছি মা বাবার কাছে। খবর নেবার কোন উপায় নেই। উসখুস করছি দেখে উঠে পড়লেন চাচা, “চললাম গো বেটি। তুমি বারন্দায় তালা দিয়ে দাও। এদিকে চোর ছ্যাঁচড় তেমন নেই। তবু বলা যায় না। কাল সকাল হলেই চলে আসব। আমার কাছে চাবি আছে। উঠোন টপকে এগিয়ে দিলাম চাচাকে। চাচা সাইকেলে প্যাডেল শুরু করতেই, বন্ধ করে দিলাম সদর দরজা। ভারি খিল লাগিয়ে দেওয়া মাত্রই যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম বাকি দুনিয়া থেকে। বিশাল উঠোন,দুপাশের বাগানে চাপ চাপ দম বন্ধ করা অন্ধকারে জ্বলছে নিভছে পুঞ্জ পুঞ্জ জোনাকী। আকাশে মরা চাঁদের আলোয় দমবন্ধ-করা নিস্তব্ধতা। আচমকা ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে উঠল,পলকের জন্য মনে হল, আমি একা নই। ঠিক আমার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে কেউ। প্রতীক্ষা করছে আমার পরবর্তী পদক্ষেপের। বিনবিন করে ঘেমে উঠল কপাল, কি অপরিসীম আতঙ্ক যে গ্রাস করল বলে বোঝাতে পারলাম না। প্রাণ চাইছে চিৎকার করে ডাকি শৌভিককে, গলা শুকিয়ে কাঠ।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না, আচমকা চটি ফটফটিয়ে নেমে এল শৌভিক,“কি ব্যাপার?তখন থেকে ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন?” দৌড়ে বারন্দায় গিয়ে উঠলাম,শৌভিককে জড়িয়ে কাঁপুনী আর কমে না। সব শুনে আমার বরের কি হাসি। “আরেঃ আমি তো ওপরের বারন্দায় পায়চারি করছিলাম। দেখলাম গপ্পে বুড়ো চলে গেল। তুই দরজা বন্ধ করলি, তারপর দেখি আর নড়েও না চড়েও না। বারন্দা থেকে বার দুয়েক চিৎকার করলাম,এই,চলে আয়। নট নড়নচড়ন। তখন নামতেই হল। ” হাউমাউ করে উঠলাম, আমি এখানে আর থাকব না। শৌভিক পাত্তাই দিল না। “দারুন জায়গা। আমার তো আর ফিরতেই ইচ্ছে করছে না। এত নিস্তব্ধতা, কানের আরাম। এই পরিবেশ তো স্বপ্ন। শুধু ড্রাই আসা উচিত হয়নি। কাল দেখি গপ্প দাদুর সাইকেলটা নিয়ে বেরোব। মহুয়া যদি পাই। ”
সেই মুহূর্ত থেকে শৌভিককে একদণ্ড ছাড়িনি। ও যেখানে আমি সেখানে। বার পঁচিশেক শৌভিক বলেছে,“ঘাড়ে পড়বি না। ”আমি নিরুপায়।
কত রাত কে জানে। লোডশেডিং। পাখা বন্ধ। তাতে সমস্যা নেই, ফুরফুরে হাওয়া আসছে নদী থেকে। তার সাথে পচা ভ্যাপসা একটা গন্ধ। শৌভিক অকাতরে ঘুমোচ্ছে,তাকে ধাক্কা মেরে জাগালাম,“কিছু কি পচেছে?” শৌভিক ঘুম চোখে কান্না জুড়ল,“উফ্ বাবারে!শান্তিতে ঘুমোতে দে অন্তত। কি পচবে এত রাতে?বৃষ্টি নেমেছে বোধহয়। সোঁদা গন্ধ পাচ্ছিস হয়তো। ”
আবার শুলাম। শৌভিকের আপত্তি সত্ত্বেও ওর হাতটা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। ঘুম আসছে না। পচা গন্ধ আবার ফেরত এসেছে। ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক জোড়া জোনাকী। এমন ভাবে ঘুরছে যেন কারো আগুন জ্বলা দুই চোখ। আচমকা কানের কাছে কার যেন নিশ্বাস পড়ল। গরম নিশ্বাস।
গায়ের সব রোম খাড়া হয়ে উঠল। তীব্র আতঙ্কে ছাপিয়ে উঠল দুই চোখ। কোথাও কোন শব্দোচ্চারিত হল না,অথচ মাথার ভিতর কে যেন গুনগুনিয়ে উঠল।
কখন যে বারন্দায় উঠে এসেছি জানি না। শৌভিক এখনও ঘুমোচ্ছে। বাইরে নিকষ কালো আঁধার। নিজের হাত পাও দেখা যায় না। দুই দিকের বাগানেও কোন জোনাকী নেই। সব জোনাকী যেন উড়ে এসছে দোতলার বারন্দায়। থোকা থোকা জোনাকীর আবডালে যেন কার অবয়ব। আমার পাশে উড়ে বেড়ানো এক জোড়া জোনাকী উড়ে গেল ঐ দঙ্গলের মাঝে। তারপর ঝুপ করে নিভে গেল সব জোনাকী।
এই তো দিব্যি দেখতে পাচ্ছি তাকে। বেশ সুদর্শন পুরুষ। বয়স কত হবে?তিরিশের কোটায় মনে হয়। মাথায় বাবরি চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে। চোখে গোল সোনালী চশমা। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। গায়ে কাশ্মীরি দোশালা। টকটকে ফর্সা রঙ। তীক্ষ্ণ নাসা। এই অন্ধকারে এত কিছু দেখা সম্ভব নয়। তাহলে কি করে দেখছি জানি না। দুচোখে সৌম্য অথচ দিশেহারা দৃষ্টি।
উনি চুপ। চুপ আমিও। চুপ গোটা ঐরাচর। অথচ সিনেমার মত ঘটে যাচ্ছে না না ঘটনা। বাবু ঋষিকেশ বন্দোপাধ্যায়। কাশীর ধনাঢ্য বাঙালী পরিবারের কনিষ্ট পুত্র। বড় দুই ভাই বিলেত ফেরত ব্যারিষ্টার। ঋষি বাবু হলেন গান্ধীজীর অনুগামী। সাহেবী পোশাক ত্যাগ করে ধরলেন খাদি। বিলেত ফেরৎ নয় বলেই বোধহয় পসার তেমন জমল না। বড় দুই ভাই তারকা। ঋষি বাবু ঢুব দিলেন জ্ঞানের সাগরে। শুধু বই আর বই। মাঝেসাঝে বন্ধুবান্ধবদের ডাকাডাকিতে যোগ দেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। অচীরেই বুঝে যান এই দলাদলির নোংরা রাজনীতি আর ক্ষমতা দখলের লড়াই ওণার জন্য নয়। বাবার সঞ্চিত অর্থ আর নিজের সীমিত উপার্জনে দিব্যি চলে যায় ঋষি বাবুর। একে একে চলে গেলেন বাবা এবং মা। মার মৃত্যুর মাস তিনেকের মাথায় একদিন বড়দা আর মেজদা এসে হাজির ঋষির ঘরে। সঙ্গে এক অবাঙালী ডাক্তার। বই থেকে মুখ তুললেন ঋষি,একে?এবাড়ির বাঁধা ডাক্তার তো ডঃ ঘোষাল। আর তার ঘরে কেন? তিনি তো দিব্যি আছেন। এই মাত্র শরীরচর্চা করে উঠলেন।
পিছন পিছন ঢুকল চারচারটে মুস্কো বেহারী পহেলওয়ান। চারজনে মিলে চেপে ধরল ঋষি বাবুকে, কি যেন একটা ইনঞ্জেকশন প্যাঁক্ করে ফুটিয়ে দেওয়া হল ঋষি বাবুর শরীরে। আর তারপর নিকষ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হল ঋষি বাবুর চরাচর।
ঘুম ভাঙল গুলাব বাগানের দোতলার দক্ষিণের ঘরে। দুই হাত,দুই পায়ে মোটা লোহার বেড়ি। গালে দিন কয়েকের না কামানো দাড়ি। ঋষি বাবু গুলাব বাগান চিনতেন না। প্রথমে বুঝতেই পারলেন না কোথায় আছেন,বিস্তর টানাটানি করেও ছিঁড়ল না শিকল। বেশ খানিকক্ষণ বাচ্ছাদের মত হাউমাউ করে কাঁদলেন ঋষি বাবু। চিৎকার করলেন কেউ শুনল না। দরজা খুলল না। দুপুরে একপাল্লা দরজা খুলে ঢুকল মেজদার ছোট শালা। সাক্ষাৎ মহিষাসুরের মত চেহারা। ঠক করে নাবিয়ে রাখল অ্যালুমিনিয়ামের শানকিতে খানিক ভাত আর ডাল। আর একটা বাটিতে জল। মনকষ্টে দিন দুয়েক অভুক্ত রইলেন ঋষি বাবু। চিৎকার করে করে গলা চিরে ফেললেন। বদলে মহিষাসুর পিঠে বসিয়ে দিল দুচার ঘা লাঠির বাড়ি। “চুপ কর পাগল। নইলে মেরে মাটিতে পুঁতে দেব। কেউ জানতেও পারবে না। ” ভয়ে চুপ করে থাকেন ঋষি বাবু। শৌচাগারে যাবেন কি করে?ফলতঃ ঐ অবস্থাতেই ত্যাগ করতে বাধ্য হন মলমূত্র। ক্ষুধা চেপে কদিন থাকবেন?প্রাণধারনের তাগিদে ঝাঁপিয়ে পড়ে খান একবেলা একমুঠো চালের ভাত। শুধু বোঝেন না কেন?কেন এই যাতনা দেওয়া হচ্ছে তাঁকে? একদিন মেজদা এল,ঘরে ঢুকেই নাকে দামী রুমাল চাপা দিতে বাধ্য হল। ঋষি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,“মেজদা আমি পাগল নই। বিশ্বাস কর মেজদা আমি পাগল নই।”মেজদার সাথে সাথে ঢুকল তার তিন শালা। মেজদা তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে বলল, “দলিলে সই করে দে। তোর ভাগের সবটুকু টাকা পয়সা আমার আর দাদার নামে লিখে দিলে,ভেবে দেখা যাবে।”এত দিনে বোকা ঋষি বাবুর মাথায় ঢুকল, তাই। তাই জন্যই ওকে এভাবে পাগল প্রতিপন্ন করা। ছোটভাই পাগল বলে সব সম্পত্তি নিজেদের নামে করে নিতে চায় বড় দুভাই। নিজের মায়ের পেটের দুভাই। দুচোখ দিয়ে দরদর করে ঝরে পড়ল জল। এই ছিল তোদের মনে?টাকা?টাকা জমিই সব। নিয়ে আয় দাদা, সই করেদি। মুখে বললেই তো পারতিস। এত যাতনা দেবার কি প্রয়োজন ছিল? নোংরা হাতে খসখস করে সই করলেন বাবু ঋষিকেশ বন্দোপাধ্যায়। এবার তো ছেড়ে দে। কিচ্ছু না বলে বেরিয়ে গেল তিন শালা আর মেজদা। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ঋষিকেশ, আচমকা হ্যাঁচকা টানে ঘুম ভাঙল।চতুর্দিকে চাপ চাপ অন্ধকার। গভীর নিশুতি রাত, মহিষাসুর টানতে টানতে নিয়ে চললেন ঋষি বাবুকে। “চলরে পাগল। আজ তোর মুক্তি। ”নিজের কানকেই বিশ্বাস হয়না যে। মুক্তি। আহঃ মুক্তি। আগে স্নান করতে হবে। নিজেরই মলমূত্রে আবৃত ঋষিকেশ। তারপর একজোড়া কাচা ধুতিচাদর চাই। তারপর আর পিছু ফিরে তাকাবেন না। এসব বলতে বলতে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নামলেন।নিচের দালানকে আড়াআড়ি পেরিয়ে নামলেন উঠোনে,তারপর সদর দরজার দিকে না এগিয়ে,মহিষাসুর টানতে টানতে নিয়ে চলল বাগানের দিকে। ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলেন প্রথমে তারপর বুঝলেন ব্যাপার কি। বাগানের দখিন পূব কোণে খোঁড়া হয়েছে বিশাল গর্ত। তারপাশে দাঁড়িয়ে আছে বড়দা আর মেজদা। ঋষি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলেন,দীর্ঘ অনাহারে দুর্বল দেহ। পারলেন না। দমাদম লাঠি আর মুগুরের বাড়ি। চিৎকার করতে পারলেন না। মুখে গুঁজে দেওয়া হল দলা পাকানো গামছা। জ্ঞান লোপ পাবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ঋষিবাবু ফুসফুসে ভরে নিলেন কামিনী আর হাস্নুহানার সৌরভে, আর দুই নয়নে পুঞ্জ পুঞ্জ জোনাকীর মায়াময় আলো।
কখন দুচোখ দিয়ে ঝরতে শুরু করেছে প্লাবন বুঝিনি। এতক্ষণ যাঁর উপস্থিতি জাগাচ্ছিল সীমাহীন আতঙ্ক, আচমকা তার জন্যই করুণায় আচ্ছন্ন আমার হৃদয়। তিনি ডান হাত তুলে দেখালেন,পূব দক্ষিণকোণের বিশাল স্থলপদ্ম গাছের তলে নিদ্রিত আছেন বাবু ঋষিকেশ বন্দ্যো। সম্পত্তির ওপর সত্ত্বাধিকার ত্যাগ করা সত্ত্বেও যাকে বিশ্বাস করতে পারেনি তারই আপন সহোদরেরা। যদি কাল আদালতের শরণাপন্ন হন তিনি?তাই জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। কোন মতে জানতে চাইলাম,“কি চান?” উনি অন্যমনস্ক ভাবে বললেন,“আর বাস্তুচ্যুত হতে চাই না। ”
ফিরে চলেছি বাড়ির পথে, কথা দিয়েছি ঋষি বাবুকে আবার আসব ফিরে। আর আমি জীবিত থাকতে আর বাস্তুচ্যুত হতে হবে না তাঁকে। আমি বোঝাব। আপ্রাণ বোঝাব আমার আপনজনকে। বেচতে দেব না গুলাব বাগান কিছুতেই।
©Anindita Bhattacharya ©Anindita's Blog