Sunday 26 August 2018

রাখী -

সকাল থেকে রিন্টির মেজাজ সপ্তমে। বার চারেক বরকে খেঁচিয়েছে, বার দুয়েক মেয়েকে। একে রাখি, তায় রবিবার। সপুত্র ননদ এসে হাজির সকাল সকাল, তারপর থেকে শুধু ফরমাইশের বন্যা। মুচমুচে সোনালী আলু ভাজা করে দাও, লাঞ্চে মুড়ি ঘণ্ট করো, বাচ্ছা গুলোর ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন চাই। শুধু চাই,চাই আর চাই। সামান্যতম বিরক্তি প্রকাশ করলেই আহ্লাদী ননদ নকল সহানুভূতির সুরে শোনায়, “আহারে বেচারীর ভাই নেই তো। তাই ভাইবোনের টান বুঝবে কি করে?” শুনে রিন্টির কান ঝাঁ ঝাঁ করে, কে বলেছে? কোন শালা বলেছে রিন্টির ভাই নেই? এই লাইনটা ভাবা মাত্রই অসীম বিষাদে ডুবে যায়। হাঁপিয়ে ওঠা প্রাণ চায়, ছুটে চলে যায় সোবাসপুর। হাওড়া জেলার সীমানা বরাবর রূপনারায়ণের ধারে রিন্টিদের গ্রাম সোবাসপুর। নিকটবর্তী রেল ষ্টেশন দেউলটি। সোবাসপুর যেন এক স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন জুড়ে রাজত্ব করে তিন ভাইবোন রিন্টি-মিন্টি আর সোনা। ছোট বেলায় কেউ রিন্টিকে বলেইনি যে সোনা আর মিন্টি আসলে ওর জেঠতুতো দাদা-দিদি। তিন ভাইবোন যেন হরিহর আত্মা। সোনা ওরফে দাদাভাই ছিল রিন্টির জান,রিন্টির সুপারহিরো। কি না পারতো দাদা, বাতিল সাইকেলের চাকাকে একটা তারের আঙটার সাহায্যে কি সুন্দর গোটা গাঁয়ে ঘোরাত সোনা। পাড়ে বেঁধে রাখা জেলে ডিঙি খুলে দুই বোনকে সওয়ারি করে  এপাড় ওপাড় করত দাদা। উঁচু গাছের মগডাল থেকে সটান ডাইভ মেরে জলে ঝাঁপাত দাদা। পিঁপড়ের ডিম দিয়ে চার করে মাছ ধরত দাদা। আবার হাইস্কুল থেকে ফিরে এসে, দুই বোনের সাথে পুতুল খেলত দাদা। দাদা আর দিদিময় জগত ছিল রিন্টির। জেঠিমাকে মা বলে ডাকত আর নিজের মাকে চম্পা বলত রিন্টি।
কি সব দিন ছিল। দাদা কলেজে ভর্তি হল। ফিরে এসে কি সব রোমহর্ষক গল্প। প্রথম বার বিপরীত লিঙ্গের সাথে অবাধ মেলামেশা, উফ দাদার গপ্প শুনে গায়ে রীতিমত কাঁটা দিত। কলেজ ভর্তি মেয়ে, যার সাথে খুশি, যেখানে খুশি, যতক্ষণ খুশি কথা বলা যায়। দাদার বান্ধবীদের নাম রীতিমত মুখস্থ ছিল রিন্টি-মিন্টির। অথচ দাদা প্রেমে পড়ল, গাঁয়েরই পিয়ালীদির। কত রাত যে তিনজনে এইসব গল্প করে কাটিয়েছে। তারপর আর্মিতে চাকরী পেয়ে গেল দাদা। পিয়ালীদি গেল মাস্টার্স করতে বর্ধমান। একা রয়ে গেল রিন্টি আর মিন্টি। সেরাতের কথা আজো ভোলেনি রিন্টি, দুই বোনে জড়াজড়ি করে ঘুমচ্ছিল, আচমকা মা ঢুকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল রিন্টিকে। সেই রাতেই বাবা ঘোষণা করল, মিন্টিকে একদম বর্জন করতে হবে। জেঠিমাকে আর মা বলে ডাকা চলবে না। ওদের ঘরে টিভি দেখতে যাওয়া চলবে না। কারণ? বাবা নাকি পঞ্চায়েত থেকে জানতে পেরেছে, সব সম্পত্তি গোপনে সোনাদার নামে করে নিতে উঠে পড়ে লেগেছে জেঠু, বংশের একমাত্র ছেলে বলে কথা।
এর পরের দিন গুলো মূর্তিমান দুঃস্বপ্ন। বাড়ির উঠোনটা হয়ে দাঁড়াল আখড়া। দিনরাত খেস্তাখিস্তি, ঝগড়া- ঝগড়ি। স্কুলেও মিন্টি আর কথা বলে না রিন্টির সাথে। সিঁড়িতে দেখা হলে রিন্টি হ্যাংলার মত তাকায় দিদি- জেঠিমা-জেঠুর দিকে। কেউ ফিরেও তাকায় না। রান্নাঘর বরাবর কাপড় টাঙানো হল, যাতে মা আর জেঠিমাকে একে অপরের মুখ না দেখতে হয়। এদের রান্নাঘরে মাংসের সৌরভ তো ওদের ডিমের ঝোল। ওদের ইলিশ তো এদের সিদ্ধ ভাত। কান্না পেত রিন্টির, ইচ্ছে করত কোথাও হারিয়ে যেতে। এরই মধ্যে সোনাদা ফিরল ছুটিতে। কি গম্ভীর বাপরে। কি সব নিয়ে এল,চকলেট লজেন্স। মিন্টি বারন্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেত, এদিক থেকে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে থাকত রিন্টি। দাদা একটাও কথা বলল না, একদিন রাতে খেয়ে দুজনেই সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, রিন্টিই সাহস করে ডাকল, “দাদা!” সোনা থেমে গেল, পিছন ফিরে তাকাল না। রিন্টি কোনমতে কান্না গিলে বলল, “ কেমন আছিস দাদা? কথা বলবি না?” সোনা কোন কথা বলল না, পিছনে ফিরেও তাকাল না। গটগট করে উঠে গেল নিজের ঘরে। দড়াম করে বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজা, যেন চাবুক হয়ে পড়ল ক্লাস সিক্সের রিন্টির মুখে। 
সেবারে ফিরে যাবার আগেই সোনাদার উদ্যোগে সম্পত্তি তিন ভাগে ভাগ হল। সনা-মিন্টি আর রিন্টির নামে।দু ভাগ পেল জেঠু, আর এক ভাগ বাবা। এত অশান্তি,করে পাওয়া সম্পত্তি বাবার কপালে সইল কোথায়? ক্যান্সার ধরা পড়ল। বাবা যেদিন  মারা গেল, রিন্টির টেস্টের রেজাল্ট বেরিয়েছে। মৃত বাবার বুকের ওপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতেও রিন্টি শুনতে পেল, জেঠিমা কাকে যেন বলছে, “ভগবান ঠিকই আছেন। দেবতুল্য দাদার নামে মিথ্যা অপবাদ? সইল এই সম্পত্তি তোর?”
মাধ্যমিক হয়ে যাবার পরপরই মা মেয়ে চলে এল মামার বাড়ি। বাকি পড়াশোনা এখান থেকেই। এরপর দুবারই মাত্র সোবাসপুর গেছে রিন্টি, দাদা আর দিদির বিয়েতে।  দাদার বিয়ের সময় জেঠু নিজে নিমন্ত্রণ করতেও আসেনি, কূল পুরোহিত নিমাই কাকার হাতে কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিল। মা যেতেও চায়নি। রিন্টির আগ্রহেই যাওয়া। রিন্টির ধারণা ছিল এতদিনে নিশ্চয় সবাই সব ভুলে গেছে। গিয়ে বেদম আহত হয়েছিল রিন্টি। কতখানি অনাহুত ওরা মা আর মেয়ে প্রতি পদক্ষেপে বুঝেছিল সেদিনের রিন্টি। তখনও উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোয়নি। ওর সামনে জেঠিমা নতুন বউয়ের সাথে মিন্টিদির আলাপ করিয়ে দিল, “তোমার তো এই একটিই ননদ। দুজনে মিলে মিশে থেকো।“ রিন্টির সাথে কেউ কারো আলাপ করালো না।
মিন্টির বিয়ের আগে অবশ্য জেঠু স্বয়ং এসেছিল।সঙ্গে সোনাদাও। কি সৌভাগ্য যে ঠিক সেই সময়ই কলেজ থেকে সুপ্রিম কোর্ট ভিজিটে নিয়ে গিয়েছিল রিন্টিদের। ততদিনে কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। ইতিমধ্যে গাঁয়ের  বাড়ি জমির অংশ সব জেঠুকেই বেচে দিয়েছে মা। কে যাবে? কে তত্ত্বতলাশ করবে? কি আশ্চর্য ভাবে ওদের ক্ষমা করে দিয়েছিল মা। বারবার বলত, “আমি না থাকলে ওরাই তো থাকবে। ওরাই তো তোর আপনজন।“ হাসি পেত রিন্টির আজও পায়। নিয়মিত ফোন করত জেঠু শেষের দিকে। এখন মাও করে। খবরাখবর দেওয়া নেওয়া চলে।
মিন্টির বিয়েতে কিছুতে যেতে চায়নি রিন্টি। দাদার বিয়ের কথা ভাবলে আজও বুক টনটন করে। দাদা আর পিয়ালীদির মধ্যে কম চিঠি দেওয়া নেওয়া করেছে রিন্টি? অথচ কেউ চিনল না সেদিন ওকে? মা জবরদস্তি নিয়ে গিয়েছিল দিদির বিয়েতে। রিন্টির শর্ত মেনে বিয়ের দিন সন্ধ্যায় গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া হয়েছিল। যাব- খাব- চলে আসব, এই শর্তে গিয়েছিল রিন্টি। লাল বেনারসি, ফুল আর সোনার গয়নায় ঝলমল করছিল মিন্টি। দিদি তুই চলে যাচ্ছিস? বুক চিরে এই কথা গুলো বেরিয়ে আসতে চাইছিল আর চোখ ফেটে জল। মিন্টির মুখটা কি শুকনো লাগছিল। রিন্টিকে দেখে এক গাল হেসে ডাকল, “এই তোর সময় হল, বোন?” রিন্টির ইচ্ছে করছিল কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁপিয়ে পড়ে দিদির বুকে। ক্লাস সিক্স অবধি যাকে জড়িয়ে ঘুমাত, সে আজ চিরকালের মত পর হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পারল কই? হাল্কা মাথা নেড়ে, অনেক দূরে একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। মিন্টির দুচোখে কি সেদিন ঘনিয়ে এসেছিল ব্যথার বাদল?কে জানে?রিন্টি তখন ব্যস্ত ছিল নিজের ঝাপসা দৃষ্টিকে অগোচরে রাখতে।
খেয়ে বেরোচ্ছে, গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে, দৌড়ে এল দাদা।“কাকিমা? চলে যাচ্ছ?” মা দাদাকে বুকে জড়িয়ে কত কথা বলল। রিন্টির অবাক লাগছিল, মা’ই না বুঝিয়েছিল, এরা আমার নিজের না জেঠতুতো দাদা-দিদি? দাদা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, “ওকে যেন তাড়াতাড়ি বিয়ে দিও না।“ রিন্টির বিয়েতে ওর আপত্তি সত্ত্বেও মা জেঠুদের ডেকে ছিল। কন্যা কর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল জেঠু। দাদা- বৌদি আর দিদির অথিতি আপ্যায়নের সুখ্যাতি রিন্টির শ্বশুর বাড়ির লোক আজও করে। সবই হল, শুধু রিন্টি কাউকে ক্ষমা করতে পারল কই?
বিয়ের পর কেটে গেছে এক দশক। মেয়ের বয়স প্রায় আট। একটি বারও দাদা- দিদিকে ফোন করেনি রিন্টি। যোগাযোগও রাখেনি। জেঠু মারা যেতে যায়ও নি। কেঁদে ছিল খুব। কিন্তু যায়নি। কখন যে চোখ দিয়ে জল ঝরতে শুরু করেছে খেয়াল করেনি রিন্টি। সুপ্রতিম এসে হাতটা বাড়িয়ে দিল। চোখ মুছে, ভ্রূ কুঁচকে রিন্টি বলল, “কি?” সুপ্রতিমের অন্য হাতে একটা রাখি। “নে। বেঁধে দে।“ রিন্টি চোখ মুছে বলল, ন্যাকামি হচ্ছে? নিজের বরকে কেউ রাখি পরায়?” “কেন? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তো এমনি তেই গাধার ইয়ে, যাই হোক, আর নেই। তোমার গায়ে হাত দিলেই তোমার ঘুম পায়, না হলে হাড় মড়মড়ি ব্যামো হয়। রাখি বাঁধলেই দোষ? কেউ তো দেখছে না, বেঁধেই দাও। আর কাউকে না কাউকে বাঁধার জন্য এমনি তেই ছটপট করছিস, তো আমিই সই।“ রিন্টি ঠোঁট বেঁকিয়ে ফোঁৎ করে একটা শ্বাস ফেলে, এক ধাক্কা মারল বরকে। সুপ্রতিম হাসতে হাসতে বলল, “এত ইগো কিসের? যার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছিস, তাঁকে নাহয় একবার ফোনই করলি?” “নম্বর জানি না। তাছাড়া দাদাও তো কখনও ফোন করেনি।” কান্না চেপে বলল রিন্টি। সুপ্রতিম হাসি চেপে ব্রেনি।সে দ্যাখ তোকে ভয় পায় নির্ঘাত। যা রাগী তুই। আমিই ভয় পাই, গায়ে হাত দিতে।তাই রাখি নিয়ে এসেছি-“ যুগলে হেসে উঠল। সুপ্রতিম কিছু ভেবে টুসকি মেরে বলল, ফেসবুকে আছে তো? মেসেজ কর।“ রিন্টি গলা ঝেড়ে বলল, “আমায় তো রিকোয়েস্ট পাঠায়নি।“ সুপ্রতিম অধৈর্য হয়ে বলল, “ঐ রোগেই মরেছে বাঙালী। কি সস্তা ইগো মাইরি। দাদা তো বড়। গুরুজন। উনি কেন পাঠাবেন? যাতে তুই নাকচ করে দিতে পারিস? মর শালা। তোকে ভালো বুদ্ধি দিয়েও লাভ নেই। গাড়ল কাহিকা।“ সুপ্রতিম রেগে ঘর থেকে চলে গেছে, মিনিট পনেরো হল। রিন্টি কিছুক্ষণ গুমরে বসে রইল, তারপর বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। তারপর দৌড়ে ফিরে এল। পাগলের মত মোবাইলে ঘেঁটে বার করল দাদাকে,তারপর কাঁপা হাতে লিখল,” সোনা দা” মুছে দিয়ে আবার লিখল, “দাদা। দাদারে, কেমন আছিস দাদা? কথা বলবি না?” বহুদূরে আম্বালায় সৈন্য ছাউনিতে এক প্রৌঢ়ের চোখে নামল অকাল প্লাবন, অনভ্যস্ত হাতে টাইপ করতে লাগল,” রিন্টি? কেমন আছিস বোনু? আমি এতদিন ভালো ছিলাম না রে, হঠাৎ মনে হচ্ছে খুব ভালো আছি।“ রিন্টি আবার লিখল, “তোর জন্য অনেক গুলো রাখী জমিয়ে রেখেছি রে দাদা, কবে আসবি?” আসবে। সোনা জলদিই আসবে তার রিন্টি আর মিন্টির কাছে।
©Anindita's blog

No comments:

Post a Comment