-
দৃশ্য-১
“ম্যাডাম,একজন আপনার সাথে দেখা করবে বলে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে। ”
“দাঁড়িয়ে আছে কেন? আমি তো সকাল থেকেই এখানে। ”
“মিটিং চলছিল তো। তাই আসেনি। একা কথা বলতে চায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন। পাঠাব?”
দৃশ্য-২
-বলুন।
-নমস্কার ম্যাডাম। খুব বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।
-ব্যাপার কি?
-আমি অমুক কোম্পানীতে কাজ করতাম। মানে নৌকরি। হঠাৎ একদিন বলে দিল আর আসতে হবে না।
-কেন? নোটিশ দিয়েছিল?
-না ম্যাডাম। হামি সুপারভাইজার ছিলাম। লেবারদের মধ্যে ঝামেলা সামলাতাম। হামি বাঘ আর গরুকে একসাথে এক মেশিনে কাম করবাতাম। একদিন হল কি,একদল লেবার আমায় যাচ্ছেতাই ভাষায় অপমান করল। জাত-ধরম-ভাষা সবকিছু নিয়ে যাতা বলল ম্যাডাম। এতো গালি এ কোম্পানীতে কুনদিন খাইনি ম্যাডাম। শরীল খারাপ হয়ে গেল। প্রায় পচ্চিশ বছরের চাকরী জীবন হামার ম্যাডাম, এ ভাষায় কেউ আমার সাথে কথা বলার হিম্মত পায়নি এতদিন। দুদিন পর যখন জয়েন করলাম অমুক বাবু পুছলেন তুমি তো ছুট্টি নাও না, তাহলে অ্যাবসেন্ট হলে কেনো? আমি উনাকে বলছিলাম ম্যাডাম,মা কসম। সেই সময় প্রোডাকশন ম্যানজার সাহেব আমাদের পিছন দিয়ে যাচ্ছিলেন। হামি জানতামই না,যে উনি সব শুনছেন। উনার কি মনে হল, যে হামি বোধহয় উনাকে গাল দিয়েছি। হামাকে ডেকে বললেন, কাল থেকে তোকে চৌহদ্দির মধ্যে না দেখি। একটা কথাও শুনলেন না ম্যাডাম-
-কি যন্ত্রণা। আপনি কাঁদছেন কেন। আমার যা করার নিশ্চয়ই করব।
-পচাশ বছরের বুড়ো আদমি কুথায় কামধান্ধা পাবে ম্যাডাম। বালবাচ্ছাওয়ালা আদমি ম্যাডাম-
দৃশ্য-৩
-অমুক বাবু, আপনি না ঐ কোম্পানির এইচ আর ম্যানেজার। আপনি থাকতে এক কথায় কারো চাকরি চলে যায়?
-(দীর্ঘশ্বাস ফেলে)সত্যি বলছি ম্যাডাম, আমি জানতাম না। আপনার চিঠি পেয়ে খোঁজ নিলাম। ও গালাগাল করেছে শুনলাম। ব্যাপারটা বাবু অবধি গেছে।
-বাবু কে? আপনাদের ব্লকের সভাপতি।
-না। না। ম্যাডাম। বাবু মানে মালিক।
-মালিককে আপনারা বাবু বলেন?
-(দীর্ঘশ্বাস চেপে টাক চুলকে)যস্মিন দেশে যদাচার ম্যাডাম।
-হুঁ। তা গালাগালির গপ্পটা একটু শুনি। কে কাকে গাল দিয়েছে?
-আপনার বাদী,শ্রীমান অমুকচন্দ্র। তার উর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে অমুক তুসুক বলে গালি দিয়েছে। আপনার সামনে সেসব উচ্চারণও করতে পারব না।
-তা বেশ। কিন্তু দিল কেন?
-তা জানি না ম্যাডাম।
-সাক্ষী কে?
-আছে। তমুক বাবু।
-(বাদীর দিকে ফিরে) এই তমুক বাবুই না জানতে চেয়েছিল আপনি আসেননি কেন দুদিন।
-জী ম্যাডাম।
-বাঃ। তিনি তো দেখছি আপনার বিরোধী পক্ষে যোগ দিয়ে, তাঁদের সাক্ষী হচ্ছেন।
-(বাদী) কি করবে ম্যাডাম। সবাই ভয়ে আছে। যদি ওকেও তাড়িয়ে দেয়। (ম্যানেজারের দিকে ফিরে) স্যার আপনি হামাকে এতদিন ধরে চেনেন। হামি কি এটা করতে পারি? কখনও করেছি স্যার?
-(ম্যানেজারের দুই চোখে মায়ার ঘোর কৃষ্ণ মেঘ) তুই একটু বাইরে যাবি ভাই?ম্যাডামের সাথে দু মিনিট কথা বলি।
-(ঘর ফাঁকা হতে) কি আর বলবেন? কেউ কান শুনতে ধান শুনলেও আপনারা তার চাকরী খেয়ে নেন। কত ক্ষমতা মশাই আপনার।
-ম্যাডাম, আপনি আমাকে এত মাস ধরে চেনেন। কতবার কত কেসে এসেছি আপনার ঘরে, আমি হুকুমের চাকর,কিন্তু শ্রমিক অদরদী বলতে পারলেন? আমি কিচ্ছু জানতামই না ম্যাডাম। এইচ আর সেকশন্ জানে না,প্রোডাকশন কাকে তাড়াচ্ছে। এ মৎসন্যায় পূর্বে ছিল না ম্যাডাম। নতুন মালিক সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে নতুন চামচা বাহিনী। পুরাতন চাকর যারা ছিল,তাদেরও অনেকে তৈল মর্দনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে এদের সাথে। ঐ ম্যানেজারটা ম্যাডাম, এখানকার প্রাক্তন অমুক নেতার ভায়রা ভাই। এরা কি মনে করে নিজেদের কে জানে? এক কথায় লোকের চাকরী খেয়ে নেয়। আমি দেখছি ম্যাডাম কি করতে পারি।
দৃশ্য-৪
-বলুন ম্যানেজার সাহেব। কি বলবেন।
-ম্যাডাম ওর চাকরী আর ফেরৎ দেওয়া সম্ভব নয়। মালিক হেব্বি চটে গেছে ওর ওপর। অমুক নেতা বাবুকে ফোন করে বলেছে, ওর কেসটা দেখতে।
-হুঁ। ইগোয় নিয়ে নিয়েছেন?
-হ্যাঁ। ম্যাডাম। অমুক বাবু এটা কি করলেন। আমার ওপর ভরসা নেই। যাঃ বাবা কাঁদছেন কেন?
-ম্যাডাম। পোড়া কপাল আমার। বিকালে চায়ের দোকানে গিয়ে বসেছিলাম। দুচারজন বন্ধু যারা জানে, জানতে চাইল কি হচ্ছে। আমি আপনার গল্প করছিলাম। খেয়াল করিনি যে গাট্টু বাবু কখন এসে বসেছে।
-গাট্টু বাবু?ও হেরে যাওয়া সভাপতি।
-জী ম্যাডাম। উনি আমার কাঁধ চাপড়ে বললেন, নো চিন্তা। আমি ম্যাডামকে বলে দেব। বললেন আমি দেখছি কি করে তোমায় তাড়ায়।
-উফ্ অমুক বাবু, আপনি একটা রত্নধারণ করুন মাইরি। লোকের সাথে খোশ গপ্প করার সময় এবার থেকে চোখটা অনুগ্রহ করে খুলে রাখবেন। একবার এই কারণে আপনার চাকরী গেল। দ্বিতীয় বার সাজানো খেলা বিগড়ে গেল। গাট্টু বাবু,নিজের ছাড়া কোন জম্মে কার কাজে এসেছেন?আমায় ফোন করেছিল। আমি পাত্তা দিইনি। মালিককে খুঁচিয়ে দিয়েছেন। এবার কি হবে?
-(ম্যানেজার)ম্যাডাম, যদি আপনি চাপ দেন,ওকে নেবে হয়তো,কিন্তু দুদিন বাদে আবার-
-সে কি আর জানি না। এত রাগ হচ্ছে আপদ গাট্টুর ওপর। সাজানো বাগান শুকিয়ে দিল শালা। বলুন বাদী বাবু এবার কি করি?
-ম্যাডাম আমি একটা কথা বলি?
-আপনি আর কি বলবেন?বাবুর কথার ওপর আপনি যেতেই পারবেন না।
-ম্যাডাম, আমিও নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে ম্যাডাম। রবি ঠাকুর নজরুল পড়ে বড় হয়েছি। কোন বড় কোম্পানীতে এইচ আর ম্যানেজার হতে পারিনি। এই কোম্পানীতেও কোনদিন এক নম্বর হতে পারব না। কারণ শ্রমিকের মেরে মালিকের অস্থানে তৈলমর্দন করতে আমি অপারগ।
জানেন তো ম্যাডাম একবার চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে গেছি, আমার পরিচিত আর একজনও গেছে। সে ইন্টারভিউ দিয়ে বেরোবার পর জানতে চাইলাম,“কেমন দিলি?” বলল, দারুন। জানতে চাইলাম,“ওরা কি জানতে চাইল?” বলল,“আমার অ্যাচিভমেন্ট। আমি বললাম,এতজন শ্রমিকের এতটাকা গ্রাচুইটি মেরে দিয়েছি। ” আমি হতবাক। এটা অ্যাচিভমেন্ট-
-হ্যাঁ জানি। তারপর আপনি ইন্টারভিউ না দিয়েই কেটে পড়লেন। পঁচিশ বার শুনেছি। এই কেসে কি হবে?কি রিলিফ দিতে পারেন?
-ম্যাডাম ও সব টাকা পয়সা আগে তুলে নিক। না হলে ছুঁতোনাতায় ওর ন্যায্য প্রাপ্য আটকে দেবে।
-সে তো বেশ বুঝতে পারছি। আপনি একটু বাইরে যাবেন প্লিজ। বাদীর সাথে একান্তে একটু কথা বলি? দেখুন বাদীবাবু, আপনি ভেবে বলুন। আপনি কি চান। যদি চাকরী ফেরৎ চান, তাহলে আরও কটা দিন কেস গড়াবে। আমার ক্ষমতায় মিটবে না, হয়তো আমার বড় সাহেবের কাছে যেতে হবে। যা বুঝছি, ওণার সাথে কথা বলেও এটা মিটবে না।ফলে ফেলিওর রিপোর্ট পাঠাতে হবে সদর দপ্তরে। সেখান থেকে কোর্ট। কেস চলবে। মালিকের কোটি টাকা আছে,কেস চালাতে সমস্যা নেই। আপনি কি চান মনঃস্থির করুন। ব্যাপারটা আর আমার হাতে নেই। যদি আপনি লড়তে চান, আমি পাশে আছি। আমার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই আদালত সিদ্ধান্ত নেবে। আমার রিপোর্ট পুরোপুরিভাবে আপনার পক্ষে থাকবে। বড় সাহেবের ঘরে ডেট ফেলি?
দৃশ্য -৫
-বলুন বাদী বাবু কি সিদ্ধান্ত নিলেন।
-লড়তে পারব না ম্যাডাম। ছেলের দিল্লী মে অ্যাডমিশনের জন্য কিছু টাকা লোন চেয়েছিলাম ওটা জলদি পাইয়ে দিতে পারেন?ছেলেটার বছর বরবাদ হোয়ে যাবে।
-বিবাদী বাবু শুনছেন?ওর চাকরী চাই না। টাকা পয়সা গুলো মিটিয়ে দিন।
-ম্যাডাম বাবু খুব খেপে আছে। বলছে কোর্টে গেছে যখন ওখানেই বুঝে নিক।
-বাঃ। তাহলে তো এবার আমাকে বুঝতে হয়।আপনি ভালো করে বোঝান, ওর প্রাপ্যগুলো যেন আমার সামনে মিটিয়ে দেওয়া হয়।
-(বাদী কাঁদতে কাঁদতে)ম্যাডাম কোয়ার্টার খালি করে দিতে বলছে। আমি বেকার বসে আছি। কিছু টাকা না দিলে বাড়ি কোথায় পাব? আর ছেলের অ্যাডমিশন?
দৃশ্য-৬
-নাও হে,বুঝে নাও। ম্যাডামের সামনে তোমায় ক্যাশ দিলাম ষাট হাজার টাকা। সই করে নাও।
-এই বিবাদী বাবু,এই না আপনি সেদিন বললেন, আপনার বাবু ক্ষেপে আছে। তাহলে টাকা দিলেন কি করে?
-(তোতলাতে তোতলাতে)ম্যাডাম এটা একটু লিবার্টি নিলাম। এটা ওর কোঅপারেটিভের টাকা। আমি সামলাই কোঅপারেটিভ। মালিক জানতে পারলে আর আমার গর্দান থাকবে না। ভুল টিমে খেলি বটে,তবে শিরদাঁড়া বাঁচিয়ে। বেকার মানুষের জ্বালা আমি বুঝি। একদিন অফিসে গেছি, আমার মেন্টর বলল,“তুমি রিজাইন করো। আজই। ”সন্দেহ করত যে আমি ওর পাওয়ারে ভাগ বসাতে চাই, তাই। আমির বউ সরকারী বাড়ির মেয়ে। শ্বশুর,শালারা সবাই সরকারী চাকুরে। ভাবতেই পারত না, সকালে ভাত খেয়ে অফিস বেরোলাম আর বিকালে আমি বেকার। নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে গেল বউয়ের। ছেলেকে সবে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। কি করি? (ধরা গলা ঝেড়ে) তো যাই হোক, আপনি ম্যাডাম আসলে আপনাদের প্রজন্ম বড় অধৈর্য । জীবন কি এখানে শেষ নাকি। বড় মানুষদের রাগ এই আছে,দুসপ্তাহ বাদে আর নেই। আমি রইলাম, বাবুর মাথা ঠাণ্ডা হলে জানাব। ও যেন তখন গিয়ে আবার চাকরী চায়।
-এই আমি ওসবে ভুলছি না। ওর প্রাপ্য টাকা-
-দেব ম্যাডাম দেব। আপনার সামনে সব দেব। ও শুধু মালিকের দাবী মত বাড়িটা খালি করে দিক।
দৃশ্য-৭
- আরে ম্যানেজার বাবু? আজ কি কোন কেস আছে নাকি?
-না ম্যাডাম। এমনি এলাম দেখা করতে। কতদিন আপনার বকাঝকা খাইনি।
-কেন আপনার বাবু বকছে না বুঝি।
-এঃ কার নাম করলেন? ও ভালো কথা সেই বাদী বাবুর কথা মনে আছে?সেই যে কথায় কথায় কাঁদত।
-হুঁ। তার তো সব পাওনাগণ্ডা আপনারা মিটিয়ে দিয়েছেন। ফাইলও বন্ধ। বছর ঘুরে গেল। আজ হঠাৎ তাঁর কথা কেন?
- (দরজা খুলে) আয় হতভাগা। আয়। ম্যাডামকে প্রণাম কর।
-এই এসব কি?
-ম্যাডাম হামার ছেলে কম্বাইনড্ ডিফেন্স পেয়েছে।
-বাঃ। অভিনন্দন।
-ম্যাডাম আমিও চাকরী ফিরে পেয়েছি।
-সেকি? কনগ্রাচুলেশনস্। ওখানেই? কি করে?
-(ম্যানেজার বাবু)বলেছিলাম না আপনাদের প্রজন্ম বড় অধৈর্য। ঘা শুকোতে সময় দিতে হয়। আমার গল্পটা বলতে গেলাম, শুনলেন না তো। চাকরী হারিয়ে কি কষ্টে যে কাটিয়েছি। এক জায়গায় ইন্টারভিউ দিলাম, মালিক বলল, “আপনার আগের মালিক আপনার খুব তারিফ করছিল। তবে উনি ক্যাটেগোরিক্যালি বললেন, যে আপনি যে স্যালারি পেতেন বলে জানিয়েছেন, তার থেকে অনেক কম দিতেন আপনাকে। ” লজ্জায় ব্রিফকেস নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমায় মিথ্যাবাদী বলল?তবে বউ বটে একটা আমার। সব স্যালারি স্লিপ গুছিয়ে রেখেছিল। নিয়ে গিয়ে দেখালাম,বললাম,“আমি চাকরী ছাড়তে বাধ্য হয়েছি বটে, তবে আমার মালিককে নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। আর হ্যাঁ উনি আমি তো দূরের কথা আমার বসের বস্ কত বেতন পান তাও বলতে পারবেন না। ” শালা -অ্যাল্ মাপ করবেন ম্যাডাম। তো যা বলছিলাম, আমি ধৈর্য ধরেছি, চেষ্টা করে গেছি। তারপর পেলাম এখানে চাকরী। প্রাক্তন মেন্টর, যে আমায় খেদিয়েছিল, একদিন ফোন করে বলল,“অমুক ফরগিভ এন্ড ফরগেট?” বলল, “তোমার কোয়ার্টারে যাব”। বললাম আসুন। উনি এলেন। এখনও আসেন। আমার বউ ওণাকে দেখে ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি কিন্তু সদাহাস্যময়। আপনি উঁচু চেয়ারে বসে আছেন তো কি, কন্যাসমা। বড় ভালোবাসি আপনাকে। তাই বলি ধৈর্য ধরে খেলুন, জীবন বড় মধুর। দেখবেন প্রতিপক্ষেও কোন না কোন বন্ধু পেয়েই যাবেন। আর এই ব্যাটা প্রাক্তন বাদী, মিষ্টি কে খাওয়াবে?