অনির
(পুজোর) ডাইরি ৭ই অক্টোবর ২০১৬
একদম
ছোট বেলায় পুজো ছিল নিখাদ আনন্দের উৎসব। পুজোয় প্রতিবছর আমরা দিদার বাড়ি যেতাম।
আমার দিদার বাড়ি অর্থাৎ মায়ের বাপের বাড়ি ছিল সুদূর মুর্শিদাবাদ। ভোরবেলা বাড়ি
থেকে বেড়িয়ে হলুদ ট্যাক্সি চেপে ফাঁকা হ্যারিসন রোড (এম জি রোড নামটা তখন জানতামই
না। )ধরে সাঁইসাঁই করে শিয়ালদা। শিয়ালদা থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ধরে ঢিকিধাঁই
ঢিকিধাঁই করতে করতে সেই পলাশী। পলাশীতে নেমে বাস (যাতে বাবা কখনই চাপায়নি) বা
রিক্সা করে গঙ্গার ঘাট। ঘাট বেড়িয়ে ওপারে ছিল আমাদের গ্রাম, “রামনগর।” আজও মনে আছে
মায়ের এক সহপাঠী নিবারণ মামা ঐ ঘাটে নৌকা বাইত। বিত্তগত ভাবে দুজনের মধ্যে যতই
তফাৎ থাকুক না কেন, দুজনের বার্তালাপ থেকে তা কখনই বোঝা যেত না।
ঐ
সময় দিদার বাড়ি গমগম করত। মায়েরা চার বোন, তিন ভগ্নীপতি, আর আমরা পাঁচ ভাইবোন।
এছাড়া খুড়তুতো পিসতুতো মামা মাসী ছিল উনিশ জন। কি হুল্লোড়ে যে কটা দিন কাটত তা বলে
বোঝাতে পারব না। আমাদের প্রজন্মের আমি প্রথম কন্যা সন্তান তার ওপর আমার জন্মও
রামনগরে, ফলে আমার খাতিরই ছিল আলাদা। মামা মাসিদের কোলে কোলেই ঘুরতাম। সময় থেমে
থাকে না। মামাদের অনেকে আর্মিতে যোগ দিয়ে গ্রাম ছাড়ল। মাসিরা বিয়ে করে দূরে দূরে
সরে গেল। দাদারাও কবে যেন হঠাৎ করে বড় হয়ে গেল। বড়দা ছাড়া আর কেউ যেত না পুজোয়।
ফলতঃ আমার পুজো হয়ে পড়ল এক নিরানন্দ অত্যাচার বিশেষ। ক্লাশ সিক্সের পর আর পুজোয়
রামনগর যাইনি।
পুজোর
হাওড়া ছিল অপরূপা। ঐ আলোকসজ্জা, জনসমাগম, বিভিন্ন আঙ্গিকের প্রতিমা, রোল, ফুচকা,
চাউমিন- কিন্তু তা সত্বেও আমার পুজো নিরানন্দময়ই রয়ে গেল। মা ছিল পোস্টাফিসের
বড়দিদিমণি। পুজোয় ছুটি ছিল মাত্র দুদিন- অষ্টমী আর দশমী। সকাল বিকাল রান্নাঘর এবং
আনুসাঙ্গিক গৃহকর্মাদি সামলে অফিস করে বাড়ি ফিরে মা এতটাই ক্লান্ত থাকত যে ঠাকুর
দেখতে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা দুটো বার্তালাপ করার মত শক্তিও অবশিষ্ট থাকত না। আর
বাবা? বাবার গোটা পুজো জুড়ে থাকত হিরেন কাকু। বাবার সহপাঠী, জাহাজে রেডিও অফিসার
ছিলেন। পুজোর ছুটিতে বাড়ি আসতেন এবং এলেই বাবাকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়তেন না।
আড্ডা মেরে অপরাধীর মত বাবা বাড়ি ঢুকত রাত সাড়ে দশটায়। সন্ধা থেকে ঠাকুর দেখতে যাব
বলে সেজে গুজে বসে থাকতাম আর বাবা বাড়ি ঢুকলেই জুড়তাম প্রবল কান্নাকাটি। শেষে
রেগেমেগে বাবা হিরেণ কাকুকে বলেই দিল,“ আমাকে পুজোর সময় একদম ডাকবি না। তোর জন্য
ওকে সময় দিতে পারি না। ” কিন্তু কাকু ছিল নাছোড়বান্দা। সে বছরই ডিসেম্ব্যার মাসে
উনি মারা যান। সেটা ছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার বছর।
হিরেন কাকুর না থাকা আমার পুজোয় বিশেষ কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। মায়ের ক্লান্তি কমে তো নিই, উল্টে মেজাজ আরো খিটখিটে হয়ে উঠতে লাগল। আর বাবাকে দখল করে নিল বাবার স্কুলের বন্ধুদের গ্রুপ। ২০০২ সাল থেকে আমার পুজোর রাশ আমি নিলাম। এক সিনিয়র দিদির সাথে শুরু হল কলকাতার ঠাকুর দেখা। ষষ্টিতে নর্থ আর সপ্তমীতে সাউথ। বেলা নটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে জড়ো হতাম আর তারপর বাসে করে আর নয়তো পদব্রজে চলত পুজো পরিক্রমা। সন্ধ্যাবেলায় কাতারে কাতারে সুসজ্জিত নরনারী যখন ঠাকুর দেখতে বের হত, কালিঝুলি মেখে ক্লান্ত শরীরে ফোস্কা পড়া পায়ে আমরা তখন বাড়ি ফিরতাম। বছর খানেক পর সঙ্গী বদল হল অপর্ণাদির পরিবর্তে পম্পা কিন্তু রুট বদলাল না। বোসপুকুরের সেই ভাঁড়ের প্যান্ডেল, বিস্কুটের প্যান্ডেল, সিংহীপার্কের কাঁচের চুড়ির প্যান্ডেল এদের সাথেই দেখা। ২০০৮ থেকে বিগত আট বছর শুধুই সঞ্চিতার সঙ্গে-
হিরেন কাকুর না থাকা আমার পুজোয় বিশেষ কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। মায়ের ক্লান্তি কমে তো নিই, উল্টে মেজাজ আরো খিটখিটে হয়ে উঠতে লাগল। আর বাবাকে দখল করে নিল বাবার স্কুলের বন্ধুদের গ্রুপ। ২০০২ সাল থেকে আমার পুজোর রাশ আমি নিলাম। এক সিনিয়র দিদির সাথে শুরু হল কলকাতার ঠাকুর দেখা। ষষ্টিতে নর্থ আর সপ্তমীতে সাউথ। বেলা নটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে জড়ো হতাম আর তারপর বাসে করে আর নয়তো পদব্রজে চলত পুজো পরিক্রমা। সন্ধ্যাবেলায় কাতারে কাতারে সুসজ্জিত নরনারী যখন ঠাকুর দেখতে বের হত, কালিঝুলি মেখে ক্লান্ত শরীরে ফোস্কা পড়া পায়ে আমরা তখন বাড়ি ফিরতাম। বছর খানেক পর সঙ্গী বদল হল অপর্ণাদির পরিবর্তে পম্পা কিন্তু রুট বদলাল না। বোসপুকুরের সেই ভাঁড়ের প্যান্ডেল, বিস্কুটের প্যান্ডেল, সিংহীপার্কের কাঁচের চুড়ির প্যান্ডেল এদের সাথেই দেখা। ২০০৮ থেকে বিগত আট বছর শুধুই সঞ্চিতার সঙ্গে-
গত
বছর থেকে আমার পুজোয় নতুন সংযোজন অন্তু অর্থাৎ অন্তরা। সারারাত জেগে ঠাকুর দেখার
ইচ্ছাটা ছিল আমার কিন্তু অন্তুুর পূর্ণ সমর্থন তথা সহযোগিতা না থাকলে ব্যাপারটা
পুরো ঘেটে যেত। ঠাকুর দেখে বেড়িয়ে গাড়ি খুঁজে বের করার ব্যাপারে অন্তুর সুবিশেষ
দক্ষতা আছে। আলোকসজ্জিত মধ্য বা ভোর রাত্রে আমার কলকাতার সব রাস্তাকেই একই রকম
লাগে তথা সব গাড়িকেই “এই তো আমাদের গাড়ি” বলে বোধ হয়। গত বছর সঞ্চিতা, অন্তরা এবং
আমার সাথে চৈতালীর ও যাবার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ডেঙ্গুর আক্রমণ সব
প্ল্যান কেঁচিয়ে দিয়েছিল। এবছর বিশেষ করে চৈতালীর জন্যই আমরা বেড়োলাম আর সারাদিন
অফিস করে রাত দশটায় বাড়ি ঢুকে চৈ বের হল শুধু আমাদের জন্য।
গতবছরের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। চেতলা অগ্রণী হয়ে সুরুচি যেতেই লেগেছিল প্রায় তিন ঘন্টা । তার মধ্যে দেড় ঘন্টা শুধু অভেদ্য জ্যামেই আটকে ছিলাম আমরা। এবার তা হল না, সৌভাগ্যবশত রাস্তা ছিল বেশ ফাঁকা। মিনিট পনেরোর মধ্যেই চেতলা। তুলনামূলক ফাঁকায় দেখে, ওখান থেকে বাদামতলা আষাঢ় সংঘ,৬৬ পল্লী হয়ে, বাঁশের ফাঁক দিয়ে গলে দেশপ্রিয় পার্কের হাজারহাত ও নির্বিঘ্নে হয়ে গেল। আমরা ফাঁসলাম ত্রিধারায়। কি অসম্ভব ভিড়, আর একটিও পুলিশ নেই। লাইনের বালাই নেই, ঠেলাঠেলি, লোকে নির্লজ্জ ভাবে সেল্ফি তথা ঠাকুরের ছবি তুলেই যাচ্ছ, কেউ তাড়া দেবার নেই। বাচ্ছাগুলো ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বিরক্ত হয়ে উঠল, ভিড় আর এগোয় না।
গতবছরের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। চেতলা অগ্রণী হয়ে সুরুচি যেতেই লেগেছিল প্রায় তিন ঘন্টা । তার মধ্যে দেড় ঘন্টা শুধু অভেদ্য জ্যামেই আটকে ছিলাম আমরা। এবার তা হল না, সৌভাগ্যবশত রাস্তা ছিল বেশ ফাঁকা। মিনিট পনেরোর মধ্যেই চেতলা। তুলনামূলক ফাঁকায় দেখে, ওখান থেকে বাদামতলা আষাঢ় সংঘ,৬৬ পল্লী হয়ে, বাঁশের ফাঁক দিয়ে গলে দেশপ্রিয় পার্কের হাজারহাত ও নির্বিঘ্নে হয়ে গেল। আমরা ফাঁসলাম ত্রিধারায়। কি অসম্ভব ভিড়, আর একটিও পুলিশ নেই। লাইনের বালাই নেই, ঠেলাঠেলি, লোকে নির্লজ্জ ভাবে সেল্ফি তথা ঠাকুরের ছবি তুলেই যাচ্ছ, কেউ তাড়া দেবার নেই। বাচ্ছাগুলো ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বিরক্ত হয়ে উঠল, ভিড় আর এগোয় না।
ত্রিধারা
দেখে যখন বেড়োলাম তুত্তুরী কাঁদতে লাগল। বেচারা আর হাঁটতে পারছে না। টিনটিন অর্থাৎ
অন্তুর পুত্রের যাবতীয় সদুপদেশ আমাদের সম্মিলিত আদর সব বিফল। শেষে অন্তুর কোলে উঠে
মুখে আবার হাসি ফিরে এল। অন্তরা মাসির কোলে চেপে বেশ খানিকটা যাবার পর আবার
পূর্ণোদ্যমে হাঁটতে লাগল। একটু দূরেই হিন্দুস্তান পার্কে আর আমরা মা মেয়ে নামলাম
না। সঞ্চিতাও রয়ে গেল গাড়িতেই। টিনটিনদাদা তুত্তুরীর জন্য ছবি তুলে আনতে ভোলেনি
অবশ্য।
পরবর্তী
গন্তব্য মুদিয়ালী। মুদিয়ালী, শিবমন্দির, লেক ইয়ুথ ক্লাব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল
নির্বিঘ্নে। পরবর্তী গন্তব্য হরিদেবপুর ৪১ পল্লী, অজেয় সংহতী( এইরে নামটা ভুলে গেছি)
এছাড়াও বেশ কয়েকটি ক্লাব, যারা মণ্ডপ সজ্জা তথা প্রতিমার নিরিখে কলকাতার অনেক নামি
পুজোকে হেলায় হারিয়ে দিতে পারে।
শেষ
গন্তব্য সুরুচি সংঘ। ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে ৫টা ছুয়েছে। আকাশ ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে
যাচ্ছে, ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে আকাশের রঙ। বিমোহিত হয়ে দেখছিলাম আমরা, হঠাৎ পিছন
থেকে অন্তরা জিজ্ঞাসা করল, “হ্যাঁরে অনি তোর বর কবে আসবে?” চমকে উঠলাম আমি, ‘বর’?
আমার বর? তার তো পুজো বলে কিছু নেই। সে তো ওসি ডকুমেন্টেশন। তার কাজ আপাততঃ
সিঙ্গুরের টাটাদের কারখানা ভাঙাভাঙির ছবি তোলা, অ্যালবাম বানানো এবং আর কি তা সে
নিজেও জানে না। কাল দুপুর পৌনে চারটে থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা অবধি চুপ করে একাকী
বসেছিল সিঙ্গুরের বিডিওর ফাঁকা চেম্বারে কখন অ্যালবাম প্রিন্ট হয়ে আসবে তার
প্রতীক্ষায়। কি চুড়ান্ত মন খারাপের সঙ্গে তাকে তারই এককালে বলা কথাগুলো ফিরিয়ে
দিচ্ছিলাম, “চাকরী মানেই চাকরগিরি”। আবার কি?সব পেশারই কিছু দাবী থাকে। এই আমাদের
চৈতালী কাল রাত দশটায় বাড়ি ঢুকে সাড়ে দশটায় আমাদের সাথে বেড়িয়ে ভোর সাতটায় বাড়ি
ঢুকবে। বাড়িতে পদার্পণ করে নাওয়া খাওয়া সেরেই সকাল আটটায় দৌড়বে, বেলা দশটায়
ক্লায়েন্ট মিটিং তারপর পাহাড় প্রমাণ কাজ। আর পুলিশ গুলো? আমার এক সদ্য পরিচিত
পুলিশ বন্ধুকে (দাদাই বলা যায়) মজা করে বলেছিলাম,“পুজোয় ডিউটি করেন বলেই তো পুজোর
লেটেস্ট ফ্যাশন তো আপনারাই সর্বাগ্রে দেখতে পান। ” উনি বিমর্ষ ভাবে বলেছিলেন,
“বিশ্বাস কর, কিচ্ছু রেজিস্টার করে না মাথায়। যন্ত্র হয়ে যাই। নিষ্প্রাণ রোবট। ”
আজ আনন্দময়ীর শুভাগমনে আশা করব এদের পুজোও ভাল কাটুক। শুভ ষষ্ঠী
(চলবে গোটা পুজো জুড়ে, আশা করি)
(চলবে গোটা পুজো জুড়ে, আশা করি)
অনির(পুজোর) ডাইরি ১০ অক্টোবর ২০১৬
ঘুম পাচ্ছে, কি প্রচণ্ড
ঘুম পাচ্ছে। পুজোর ধকল কি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ইচ্ছা ছিল মেয়ে নিয়ে আজ সকালে
শোভাবাজার রাজবাড়ি যাব। সাথে চৈতালীর প্রস্তাবিত পাথুরিয়াঘাটার খেলাৎ ঘোষের
বাড়িটাও ঘুরে নেব। গাড়ি নেই, বাস বা ওলাই ভরসা। সেই মত ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠলামও
কিন্তু তুত্তুরীকে কিছুতেই ঘুম থেকে তোলা গেল না। চেষ্টা করা মাত্রই আমার মেয়ে এমন
হাঁউমাউ জুড়ে দিল, সাথে যথাযথ সঙ্গতে আমার মা। অবশেষে মায়ের ফরমান,“মেয়েকে নিয়ে যাবি
না।” ভাল কথা। তাহলে আমি একা যাই? “মেয়েকে ছেড়ে কোথাও যাবি না।”
অবস্থা সুবিধার নয় বুঝে
পরিকল্পনা বাতিল করলাম। এমনিতেই কাল থেকে যা অশান্তি চলছে। আমার নতুন মূল্যবান
লিপস্টিকটির পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটিয়েছে আমার কন্যা। শখ করে কিনে প্রতিজ্ঞা
করেছিলাম, সারা বছর আর লিপস্টিক না কিনলে উশুল হয়ে যাবে, গোটা মাসই চলল না। এই
নিয়ে পঞ্চম লিপস্টিক ভাঙার জন্য বেশ কয়েক ঘা (আড়াই ঘার বেশি নয়) উত্তমমধ্যম দিলাম।
ফলশ্রুতি মেয়ের থেকেও প্রবল বেগে আমার মা কাঁদতে লাগল এবং বাবা পাঞ্জাবি চড়িয়ে
গৃহত্যাগে উদ্যত হল। শৌভিকের সাথে ফোনে গৃহযুদ্ধের কথাটা আর বলছি না।
তাই আজ আর অবাধ্য হতে
সাহস হল না। মা আর মেয়ের সাথে ঝগড়া নিয়ে কোন চাপ নেই, রোজ হয়। কিন্তু আমার বাবা
এবং আমার বর আমার সবথেকে বড় সমর্থক। এদের আমি কখনই চটাই না। বর তো ১৫ মিনিট বাদে
সরি বলতেই মাপ করে দিল। কিন্তু বাবা দেখি সকাল থেকে একটাও বার্তালাপ করছে না। থেকে
থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। গায়ে পড়েই ভাব করতে গেলাম।
১৯৫৮ সালে হাওড়ার
আইজ্যাক রাফায়েল বেলিলিয়াস স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল( তখন ম্যাট্রিক ছিল কি? এই রে
ভুলে গেছি) পাশ করেছিল বাবারা ৩৬ জন। কমতে কমতে বর্তমানে জীবিত আছেন মাত্র ৮ জন।
যাদের মধ্যে তিন জন বাইরে থাকেন এবং তাঁরা আদৌ জীবিত নাকি কোন অঘটন ঘটে গেছে এ
সম্পর্কে বাকিরা অন্ধকারে। এককালে বাবাদের বিশাল গ্রুপ ছিল। যারা ঐ বছর স্কুল
ফাইনাল পাশ করেছিল এবং যারা পাশ করেননি বা বিভিন্ন ক্লাশে অকৃতকার্য হয়ে পিছিয়ে
পড়েছিল সকলকে নিয়ে জমাটি আড্ডা বসত পুজোর কটা দিন। নাওয়া খাওয়া ভুলে আড্ডায় দৌড়ত
বাবা। বিত্তগত বা রাজনৈতিক মতাদর্শগত ফারাক বাবাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে পারেনি।
রোজ একাধিক ব্যক্তি কিছু না কিছু খাওয়াত। সুগার প্রেশার প্রস্টেট কোলেস্টরল হওয়া
প্রৌঢ়- বৃদ্ধের দল নিজ নিজ গৃহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন পূর্বক কদিন সর্বভূক
হয়ে উঠত- চিংড়িমাছের চপ, বড় বড় বেগুনী, মোচার চপ, বাগনানের ছানাপোড়া, রসগোল্লা,
আমতার পান্তুয়া, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, হাওড়ার বিখ্যাত দুলাল ঘোষের রাবড়ি, ভুরভুরে
ঘিয়ের গন্ধ ওঠা মোহনভোগ, ভীম নাগের সন্দেশ, শেঠ সুইটসের কালো গজা, খাস্তার গজা,
খাস্তার কচুরী টক মিষ্টি চাটনী দিয়ে,প্যাটিস, পেস্ট্রী, কোল্ড ড্রিক্স ইত্যাদি
ইত্যাদি। সব একদিনে হত না বটে তবে হত অবশ্যই। যে যেমন পারত, সাধ্য তথা সামর্থ্য
অনুসারে নিয়ে আসত এবং পরম তৃপ্তি ভরে বাকিরা তা সেবন করত। বাবা যখন বাড়ি ফিরে খোশ
মেজাজে গল্প করত, ঈর্ষায় আমি আর মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতাম।
সে আড্ডা আজ আর নেই।
কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র আট জনে। সকলেই পচাত্তর ঊর্দ্ধ। বাবার ভাষায় একে একে
নিভিছে দেউটি(ভুল হলে মাপ করবেন। আমি কোটেশন ব্যবহারে বিশেষ দড় নই )। কিন্তু এই আট
জন বৃদ্ধ জেদের বশে আজো পুজোর প্রতিটা দিন আড্ডা দেয়। সময় হলেই ঝনঝনিয়ে বেজে ওঠে
একসাথে বাবার মোবাইল এবং বাড়ির ল্যাণ্ডফোন। এক যোগে একাধিক বৃদ্ধ ডেকে ওঠে,“ কি রে
অলোক,আয়? তুই না এলে জমছে না যে”। বাবাও ওমনি গুটি গুটি পুজোর জামা বা পাঞ্জাবি
গলিয়ে চুলে ব্যাক ব্রাশ করে নিজের অভিমানিনী স্ত্রী তথা নাতনীকে বলে, “যাই
সোনা(তুত্তুরী অবশ্যই। মাকে সোনা বললে তৎক্ষণাৎ জবাই)। এবছর আট সামনের বছর কজন
থাকি? ”
বাবাদের সেই সাধ্য বা
পাচন ক্ষমতা আর নেই। খাবার বহর ও অনেক কমে গেছে তবু পালা করে রোজ কেউ কিছু আনে। আজ
বাবার পালা। বন্ধুরা প্যাটিস খেতে খেয়েছে। দশটায় সবাই সমবেত হবে, তাই সাতটায় বাবা
বেরোচ্ছিল সুগার এণ্ড স্পাইস থেকে আটটা প্যাটিস কিনতে। ফিরে এসে চান করে দাড়ি
কামিয়ে সেজেগুজে বেরোবে।
ভাব করার তাগিদে বললাম
আমিই কিনে এনে দিচ্ছি। তবে সুগার এণ্ড স্পাইস কেন? খাওয়ালে মিও আমোরে বা ক্যাথলিন
খাওয়াও। বাবা অনেক মাথা চুলকে বলল, “ ঠিক আছে। এনে দিলে তো খুব ভালই হয়। তোর যা
ইচ্ছে কিনে আন। তবে আটটা এক জিনিস আনিস। ”
তৈরি হয়ে যখন বেড়োলাম
ঘড়ির কাঁটা সোয়া আটটা দেখাচ্ছে। ফাঁকা ফাঁকা পথঘাট। কে বলবে কাল গলির মুখ থেকে
আমাদের বাড়ি ঢুকতে চার মিনিটের রাস্তা তুত্তুরী আর আমি বারো মিনিটে পেরিয়েছি এবং
তাও গোটা পনেরো লোককে দুহাতে ঠেলে বা কনুইয়ের গুঁতো মেরে। বাবা টাকা দিয়েছিল
রিক্সা করে যাওয়ার(মহানন্দে হাত পেতে নিলাম, ডি এর যা হাল আর পুজোর মাসের যা খরচা)
জন্য। একটাও রিক্সা নেই। ভুল বললাম, রিক্সা আছে রিক্সাওয়ালা নেই। একটি রিক্সা
দেখতে পেলাম যার চালক লম্বা ঠ্যাং বার করে রিক্সায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে, বেশ কয়েকবার ,“
দাদা? ভাই? এই? ভাড়া যাবে?” বলাতেও সাড়া শব্দ করল না।
হাঁটতে হাঁটতে গেলাম বড়
রাস্তায়। অন্য সময় টোটো আর বাইকের ভিড়ে রাস্তা পেরোনো যায় না। তাজ্জব হয়ে গেলাম
সাড়ে আটটা বাজছে আজ একটাও বাইক নেই। মিনিট পনেরোয় মাত্র দুটি টোটো গেল। এবং দুটিই
সংরক্ষিত। বয়স্ক ঠাকুমা দিদিমাদের নিয়ে ভোরবেলা নাতনীদের দল(আজ্ঞে হ্যাঁ একটিও
ছেলে ছিল না। বাবুরা বোধহয় সারারাতের ধকল সামলে কেউ ঘুম থেকেই উঠতে পারেননি)। আরো
দশ মিনিট পর একটি বাস পেলাম। ৬৩ নম্বর ডোমজুড় গামী বাস হাওড়ার বাসিন্দাদের কাছে
সাক্ষাৎ বিভীষিকা। ব্যস্ততম মুহূর্তেই ওদের যা গতি থাকে, বিরক্ত অফিস যাত্রীরা
চিৎকার করে কন্ডাকটরের গুষ্টি উদ্ধার করে দেয়, “ আর বাস চালিয়ে কাজ নেই। গামছা
পেতে ভিক্ষে কর গে যা। কিরে ? হাওড়া হাওড়া করলি তাও উঠল না? যা কোলে করে তুলে নিয়ে
আয়”। কখনও কখনও যাত্রী নিজেরাই লোক ডাকে, “ আসুন দাদা আসুন। দেখছেন না আপনার জন্য
দাঁড়িয়ে আছে? আপনি দয়া করে বাসে উঠে এদের উদ্ধার করুন” ইত্যাদি কত যে মজার সংলাপ
শোনা যায় ৬৩ নম্বর বাসে উঠলে। আমার কপালে সেই ৬৩ই জুটল?
শম্বুকে লজ্জিত করে বাস
যখন নামালো কপালে করাঘাত করে দেখি মিও আমোরে বন্ধ। এটা হাওড়ার ব্যস্ততম মিও আমোরে,
আমার দৈহিক বিভঙ্গে হতাশা লক্ষ্য করে এক বয়স্ক প্রাতঃভ্রমণকারী বললেন, “ সারা রাত
ধরে লোকে এত খেয়েছে-”। বাস টোটো কিচ্ছু নেই। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম ক্যাথলিন। এটা
খোলা। সত্যিই হাট করে খোলা। এসি চলছে না। একটা ফ্যান ঘুরছে মাত্র। এবং দোকানে কেউ
নেই। দোকানদার ও না। সারি সারি শোকেশ ভর্তি খালি ট্রে। কেবল গোটা তিনেক শুকনো কেক
আর গোটা দশেক ক্রীম রোল পড়ে আছে। দেখেই অভক্তি হয়। বুঝলাম কেন বাবা সুগার এণ্ড
স্পাইসে যাচ্ছিল। উল্টো দিকেই দোকান, খোলা এবং বন্ধ। অর্থাৎ দোকান খোলা কিন্তু
দরজা বন্ধ, বাতানুকূল যন্ত্র চলছে। রাস্তা পেরিয়ে যাব কি? লম্বা লাইন, নারী পুরুষ
নির্বিশেষে বাইক স্কুটার সাইকেল সহ লাইন দিয়েছে রেয়াজী খাসির মাংস কিনবে বলে।
দোকানটা ৫০০মিটার দূরে তো হবেই বা আরো বেশি। আজ নবমী কি না? রাত তিনটে থেকে ঐ
দোকানে লাইন পড়ে।
লাইন টপকে চিকেন
প্যাটিস এবং মায়ের ফরমাইশ অনুসারে এক ব্যাগ মিষ্টি কিনে যখন বাড়ি ফিরলাম বাবা তৈরি
হয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে। আপাততঃ যা এনেছি তাতে উভয়েই খুব খুশি বাবা গরম প্যাটিশ
আর মা পান্তুয়া (আজ্ঞে হ্যাঁ খাঁটি বাঙালি রস জবজবে কালো পান্তুয়া ঐ খোট্টা গুলাবজামুন
নয়), খাস্তার গজা আর তুত্তুরীর প্রিয় মিষ্টি চাউমিন ( সীতাভোগ) পেয়ে। আপাততঃ শান্তিপূর্ণ
গৃহকোণ, যদিও কতক্ষণ এই শান্তি স্থায়ী হবে আমি জানি না। কারণ আমরা চাটুজ্যেরা খুব একটা
শান্তিপূর্ণ হই না কি না !😈