কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে অনাম্নী স্রোতোস্বিনী। বইছে মৃদুমন্দ পবন। ঘণ বনানীর মাঝে এক বিশাল পিপ্পলী বৃক্ষতলে ধ্যানমগ্ন জনৈক তাপস। পরণে শ্বেতবস্ত্র, উর্ধ্বাঙ্গে পীতাভ উত্তরীয়, উভয়ই অতি সাধারণ। অসাধারণ শুধু তাঁর দীপ্তি। অপরূপ রূপময় তাপসের মুখমণ্ডলে খেলা করে চলেছে অদ্ভূত প্রশান্তি, ইনি যে অত্যন্ত অভিজাত বংশীয় অসীম জ্ঞানের অধিকারী তা এঁণার মুখমণ্ডল তথা দেহবিভঙ্গে সুস্পষ্ট। যদিও চোখের নীচের মৃদু কালিমা একথা লুকাতে অক্ষম যে আপাততঃ ইনি কিঞ্চিৎ কায়ক্লেশে আছেন। স্বীয় ক্লেশকে অদ্যাবধি বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেননি উনি, কিন্তু প্রিয়জনের বেদনায় বড় দ্রুত কাতর হয়ে পড়েন আজকাল। বিশেষতঃ সেই প্রাণাধিকা নারী, যাঁর যাবতীয় কায়ক্লেশের মূল হোতা এই দুর্ভাগা তাপস, এমনকি তাঁরই অবিমৃষ্যকারিতার জন্য জনসমক্ষে আর্যকন্যাকে বিবস্ত্র হতে হয়েছে, যতবারই সেই দৃশ্যাবলী চোখের সামনে ভেসে ওঠে কেঁপে ওঠেন তাপস। ছিঃ। ছিঃ। যে পুরুষ নিজের স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, কি প্রয়োজন তার প্রাণধারণে?
এই যে রাজনন্দিনী সর্ব বিলাস ত্যাগ করে তাঁর অনুগামিনী হয়ে এই গভীর জঙ্গলে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন, এর জন্য দায়ী কে? কোনদিন শিকার জোটে, কোনদিন নিকটস্থ জনপদ থেকে জোটে ভিক্ষালব্ধ কয়েকমুঠি যব, কোনদিন শুধুই বনের ফল আর কোনদিন শুধুই শীতল জলে নৈশাহার সমাধা করেন তাঁরা। কতদিন প্রিয়ার মুখে হাসি দেখেননি তিনি। মাটির কুঁড়ে ঘরকে সহস্তে নিকিয়ে কি অপরূপ বিন্যাসে সাজিয়ে রাখেন প্রিয়া, প্রিয়ার হাতের মায়াজালে সামান্য যবও যেন পরিণত হয় দেবভোগ্য অমৃতে। এত গুণের অধিশ্বরীর এই পরিণতি কেন? সুদূর মাতুলালয়ে সযতনে থাকা নিজ শিশুপুত্রদের স্মরণ করে প্রায় প্রতিটি রজনীই নিঃশব্দ অশ্রুমোচনে যাপন করেন আর্যা। ভাবেন তাপস বুঝি উপলব্ধি করতে অক্ষম, অথচ বিগত একবছরে এক পলের জন্যও তিনি বিস্মৃত হননি তাদের। তাঁর জন্যই পাঁচটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে পিতৃমাতৃহীন হয়ে মাতুলালয়ে কাটাতে হবে আরো দ্বাদশ বর্ষ, ভাবতেই সিক্ত হয়ে উঠল আঁখিপল্লব।
আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন তাপস,আচমকা কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু অথচ বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বরে কে যেন ডেকে উঠল,“ মহারাজ!মহারাজ? আপনি কি সংজ্ঞা হারিয়েছেন?” অন্য কেউ এই সম্বোধন করলে তাপস ভাবতেন নির্ঘাত ব্যঙ্গ, কিন্তু তাঁর এই বিশালদেহী ভ্রাতাটি যে আদৌ ব্যঙ্গ নয়,বরং পরম শ্রদ্ধা তথা ভালোবাসায় তাঁকে এই চরম দুর্দিনেও মহারাজ বলে ডাকেন, তা তাপসের অনবগত নয়। মৃদু হেসে বললেন,“নাঃ। সামান্য ধ্যানের প্রচেষ্টা। ”
তাঁর এই ভ্রাতাটি অন্যান্য ভাইদের তুলনায় দর্শন বা বুদ্ধিবৃত্তিতে বেশ সাধারণ। তবে অমিত বলশালী এবং শিশুর মতই সরল। সুখের দিনে প্রজারা আড়ালে বলতেন এই রাজকুমার শুধুমাত্র “দাদা আর গদা” ছাড়া কিছুই বোঝেন না। কথাটা মিথ্যা নয়। ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও ইনি গদা ছাড়া অন্যান্য কোন শস্ত্রচালনাতেই তেমন দক্ষ নন। রাজনীতি, কূটনীতির জটিলতাও তেমন বোঝেন না।রাজপাট ত্যাগ করে বনবাস কালে ইনি ব্যাপক অশান্তি করেন শিশুদের মত। না রাজকীয় ভোগবিলাসে তেমন যে আসক্তি আছে তা নয়, তবে ইনি বড় জলদি ক্ষুধাকাতর হয়ে পড়েন। ইতিপূর্বে কিয়ৎকাল বনবাসের অভিজ্ঞতা থেকে ভালই জানতেন যে জঙ্গলে অর্ধেক দিবস অভুক্ত থাকতে হয়, তাই কিছুতেই এযাত্রা বনবাসে আসতে আগ্রহী ছিলেন না। শেষে তাপস ক্রুদ্ধ হয়ে, এই ভ্রাতাকে ত্যাগ করেই সপরিবারে বনবাস যাত্রা করেন। বেশ কিছুটা পথ গিয়ে পিছন ফিরে দেখেন, শিশুর মত মাটিতে পা ঘষতে ঘষতে তাঁদের অনুসরণ করছেন মধ্যমকুমার।
শুধু কি তাই, বনবাসে এসে সকলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শিকার এবং ভিক্ষাবৃত্তি সম্পন্ন করেন, কিন্তু এণাকে শিকারে পাঠালেও বিপদ ভিক্ষাবৃত্তিতে নিযুক্ত করলেও বিপদ।শিকারে গেলে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও অনাবশ্যক বেশী জীবজন্তু বধ করে নিয়ে আসেন কুমার। যাতে সকলের পেট ভরে যাওয়ার পর অবশিষ্টাংশ তাঁর উদরপূর্তিতে যেতে পারে। আর ভিক্ষা করতে গিয়ে একমুঠি যব প্রদান করা গৃহস্থের দিকে এমন কটমট করে তাকান যে তাঁরা প্রাণভয়ে ভাঁড়ার উপুড়হস্ত করে দেন। খবর আসতে বিলম্ব হয়নি তাপসের কানে। ফলে আপাততঃ শিকার এবং ভিক্ষা দুই নিষেধ।
সারাদিন বাতাসে গদাযুদ্ধ আর গৃহিণীকে গৃহকর্মে সহায়তা করেই দিন কাটে তাপসের। রাতে সকলের পাতে যখন একমুঠি যবের মণ্ড তুলে দেন প্রিয়া, শিশুর মত হস্ত এবং পাত্র লেহন করেন মধ্যম কুমার। মাটিতে পড়ে থাকা গুঁড়াও অঙ্গুলি স্পর্শে তুলে নিয়ে মুখে দেন। তাপস জানেন প্রিয়া তথা অন্যান্য কুমারেরা তাঁদের অংশ থেকেও কিছুটা সস্নেহে তুলে দেয় মধ্যমকুমারের পাত্রে। দেন তিনিও, এক চুটকি উদ্বৃত্ত যবের মণ্ড পেয়ে কুমারের দুই চোখ চিকচিকিয়ে ওঠে। নিভৃতে বিড়বিড় করেন তাপস,“যাঁদের জন্য তোমায় এই জঠরাগ্নি সহন করতে হচ্ছে, ইন্দ্রের বজ্র নেমে আসুক তাদের মাথায়। ”
“মহারাজ?” আবার অসহিষ্ণু হয়ে প্রশ্ন করলেন মধ্যম কুমার
“কি ভ্রাতা?”সস্নেহে জানতে চাইলেন তাপস।
“মহারাজ,চলুন ফিরে যাই। আমাদের রাজ্যে। ফিরিয়ে আনি আমাদের শিশুগুলিকে। আবার পাটরাণী হয়ে রাজপ্রাসাদ আলো করে বসুন আর্যকন্যা। ”
“ভ্রাতা,তুমি কি বিস্মৃত হয়েছ?বারো বছর এই বনভূমিই আমাদের রাজপাট,ঐ মৃৎকুটির আমাদের রাজপ্রাসাদ। তারপর,এই বনভূমি ত্যাগ করে আমাদের আশ্রয় নিতে হবে কোন সম্পূর্ণ অচেনা অনাত্মীয় গৃহে।লুকিয়ে রাখতে হবে নিজেদের ছদ্মবেশ তথা ছদ্মপরিচয়ের অবগুণ্ঠনে। যেখানে আমাদের কেউ না চিনতে পারে। যদি ধরা পড়ে যাই,তো আরো বারো বছরের বনবাস সুনিশ্চিত। ”
এক ঝলক আগুন চলকে উঠল কুমারের দুইচোখে,পর মুহূর্তেই তার স্থান অধিকার করল একরাশ সরলতা। দুষ্টু হাসি হেসে কুমার বললেন,“জানি ভ্রাতাঃ। জানি। তাই তো এক সুপ্রস্তাব এনেছি। দেখুন কৃষক যেমন স্বল্প বীজবপন করে, আহরণ করে বিপুল পরিমাণ শস্য,বুদ্ধিমান ব্যক্তি যেমন বিপদে অল্প ধর্ম বিসর্জন দেন বৃহত্তর ধর্মরক্ষার স্বার্থে, সোমলতার প্রতিনিধি যেমন পূতিকা,তেমনি বৎসরের প্রতিনিধি মাস। চলুন আমরা এই জঙ্গলে অতিবাহিত তের মাসকেই গণ্য করে তের বৎসর হিসাবে। ব্যাস হয়ে গেল আমাদের বারো বৎসরের বনবাস আর এক বৎসর অজ্ঞাতবাস। দেখুন এই অন্তিম এক মাসে তো কোন কৌরব বংশীয় চর আমাদের সন্ধানে আসেনি, তো এই একমাস অজ্ঞাতবাস হল কি না?”
কুমারের কুযুক্তিতে হো হো করে হেঁসে উঠলেন তাপস। সেই অট্টহাসের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে উড়ে গেল পিপ্পলী-বৃক্ষের শাখাপ্রশাখায় আয়েস রত জনা কয়েক বায়স। রীতিমত আহত চক্ষে মধ্যমকুমার বললেন,“জানতেম। জানতেম আপনি মানবেন না। তাই আরো একটি উত্তম প্রস্তাব আছে। একটা ভালো ধর্মের ষণ্ড জোগাড় করে, তাকে ভরপেট খাইয়ে, হস্তপদ মর্দন করে যথাবিহিত সেবা করে, তাকে প্রীত করতে পারলেই সব পাপক্ষলন হয়ে যাবে। আমি একটা ষণ্ড জুটিয়েও এনেছি। আবডালে রাখা আছে। মহানন্দে ঘাস চিবোচ্ছে। এবার আপনিও মেনে নিন ভ্রাতা। এযাতনা আমার যাও সহ্য হয়, প্রিয়া বা কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের কষ্টে বুক ফেটে যায় আমার। ”
স্নেহের ভ্রাতাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন তাপস, এই কুমারের শ্মশ্রুগুম্ফের বৃদ্ধি বড়ই স্বল্প, নেই বললেই চলে, অঙ্গরাজ তো জনসমক্ষে তাঁর এই স্নেহের ভ্রাতাটিকে পেটুক এবং তূবরক(মাকুন্দ) বলে গালি দিতেন। কেশরাজি অবশ্য খুব একটা কম না,বরং বেশ ঘণ। ভাইয়ের চুলে সস্নেহে বিলি কাটতে কাটতে বললেন,“ভীমসেন,তুমি জানো, আমি তোমার প্রস্তাব রক্ষা করতে অপারগ। এবার বলো তো,এই ভয়ানক হাস্যকর প্রস্তাব তোমার মগজে কে ঢুকিয়েছে। ” পিছন থেকে অদ্ভূত মোহক গলায় কে যেন বলে উঠল,“আমি”। চমকে করজোড়ে উঠে দাঁড়ালেন তাপস, সম্মুখে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন,তিনি এক অনিন্দ্যসুন্দর পুরুষ। তাঁর গাত্রবর্ণ ঘণ নীল,মস্তকে শোভা পাচ্ছে শিখিপুচ্ছ। একজোড়া লালচে ভেজা ওষ্ঠ এবং অধরে খেলা করছে মোহন হাসি। তার রূপে আলোকিত এই বনানী। নতজানু হয়ে প্রণাম করতে গেলেন বনবাসী ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা যুধিষ্ঠির, খপ করে তাঁকে ধরে বুকে যিনি জড়িয়ে ধরলেন, তাঁর মূল মন্ত্র বুঝি, “কোন খেলা যে খেলব কখন-”। আর নাম? তাও কি বলার অপেষ্কা রাখে? তিনি দীনবন্ধু। তিনিই জগৎপতি।