What ever I like...what ever I feel.... form movies to books... to music... to food...everything from my point of view.
Thursday, 9 October 2025
Thursday, 14 August 2025
অনির ডাইরি আগষ্ট, ২০২৫
অনির ডাইরি ২০ শে আগস্ট, ২০২৫
#অনিরডাইরি
গত শনিবার ছিল আমার প্রথম প্রেমের জন্মদিন। ইদানিং অবশ্যি প্রেমট্রেম আর কিছু অবশিষ্ট নেই ভদ্রলোকের প্রতি, তবে সখ্য রয়েই গেছে। ভদ্রলোক তালের বড়া খেতে বড় ভালোবাসেন। শাশুড়ি মাতার আয়া দিদি কথাও দিয়েছিলেন সাহায্য করবেন, কিন্তু সেদিন তাল কিনতে গিয়ে যেন আগুনের ছ্যাঁকা খেলাম। সকালে শ্রীমতী তুত্তুরীকে স্কুলের গাড়িতে তুলে দিতে গিয়ে যে তাল ৬০/- দর করে এলাম। পয়সার ব্যাগ নিয়ে নেমে দেখি, তালের দাম ৮০/- হয়ে গেছে। ধুৎ, শাশুড়ি মাতা ঠিকই বলেন, এ শহরে 'কোন কিছুই সুবিধামত নয়'।
সুবিধা মত তো নয়ই, সেদিন চেক বই হারালাম, আজ এটিএম কার্ডটা। আজকাল এটিএম তেমন লাগে কোথায়? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তো অনলাইন ট্রানজেকশন হয়। ব্যালেন্স ও ইউপিআই মারফৎই দেখে নিই। কাল রাতে বালেন্সটা দেখে কেমন যেন কম কম মনে হল। এত কিসে খরচ করলাম ঠাকুর? শৌভিক সদ্য আপিস থেকে ফিরেছে, আমার ভেবলে যাওয়া আর মাথা চুলকানি দেখে বলল, "ইন্টারনেট ব্যাংকিং থেকে স্টেটমেন্ট নামিয়ে দেখে নে না।" দেখতে গিয়ে দেখি, লগইন পাসওয়ার্ড খানা ভুলে বসে আছি।
বার দুয়েক ভুল করার পর আর রিস্ক নিলাম না। এর আগেও অনেকবার ভুলেছি, আমি ভুলতেই থাকি। প্রত্যেকবার ফরগেট পাসওয়ার্ড করে, এটিএম কার্ড ডিটেইলস দিয়ে খুলি। এবারে দেখি হারিয়ে বসে আছি কার্ডটাই। গোটা ব্যাগ তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। দরজার পিছনে আর দুটো ব্যাগ ঝোলানো আছে, একটার চেন কাটা, আরেকটা ভিখিরির ঝোলার মত দেখতে হয়ে গেছে। তাও প্রাণে ধরে ফেলিনি, একে তো ব্র্যান্ডেড ব্যাগ, তায় আমার বরের দেওয়া উপহার। মাঝে মধ্যেই নিয়ে বেরোই, সেগুলোকেও উল্টো করে ঝাড়লাম। বাঘ ভাল্লুক বাদে সবকিছুই বেরোলো, প্রায় এক ডজন সেফটি পিন, স্ক্রাঞ্চি, ক্ল্যাচার, গোটা চারেক লিপস্টিক, দুটো পুঁচকে পারফিউম, এত চুইংগাম, পেন, গুচ্ছের কাগজ, টফি, রাখি, চকলেটের র্যাপার, ঝালমুড়ির ভাঁজ করা ঠোঙা, প্লাস্টিক (কিছুই রাস্তায় ফেলি না কিনা, ব্যাগে রাখি বাড়ি ফিরে আবর্জনার বালতিতে ফেলব বলে, তারপর যথারীতি ভুলে যাই)। বেরোল না শুধু কার্ডটা।
শৌভিক হুলো বেড়ালের মত মুখ করে বলল, " ফরগেট পাসওয়ার্ড করে, প্রোফাইল পাসওয়ার্ড দিয়ে খোলার চেষ্টা কর।" তাই করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, সেটাও ভুলে বসে আছি। ধপ করে বসে পড়ল শৌভিক, "সেটাও ভুলে গেছিস?"
হাতে পায়ে ধরলাম, হে ধরিত্রী দ্বিধা হও। কচু হল। আজ সকাল সকাল বেরোলাম ব্যাংকের উদ্দেশ্যে। আপদ ব্যাংকটাও কি হেথায়? সেই ডালহৌসি। আট মাস LDC ছিলাম রাইটার্সে, কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ দপ্তরে, তৎকালীন সহকর্মী দিলীপ দা কান ধরে খুলিয়েছিল। আজও সেই ব্যাংকেই রয়ে গেছে একাউন্টটা। অনেকবার ভেবেছি বাড়ির কাছে ট্রান্সফার করে নেব, তারপর ঐ যা হয় আর কি। সেটাও ভুলে গেছি।
বহুবছর আগের এক বর্ষণ মুখর দুপুরে একাউন্ট খুলতে যে পথে গিয়েছিলাম, আজও রাইটার্স বিল্ডিং এর পাঁচ নাকি ছয় নম্বর গেটের পাশ দিয়ে ঐ পথ ধরেই হাঁটি। রাইটার্সে কর্মজীবন শুরু করতে পেরেছিলাম বলে আজও গর্ব হয় আমার। কি ভালোই যে কেটেছিল ঐ আটটা মাস। তৈরি হয়েছিল অসম্ভব ভালো কিছু বন্ধু। হয়তো অসমবয়সী, তাও বন্ধু। কি গমগম করত তখন এলাকাটা। ভাবতে ভাবতেই ধপাস।
কেন যে মরতে আজকেই গোলাপী হিল তোলা জুতোটা পরে এলাম। এতটা হাঁটতে হবে, এটাও ভুলে গিয়েছিলাম। ভাগ্যে এই অঞ্চলটা আপাতত জনশূন্য। দূর থেকে লোকজন দেখলেও কেউ এগিয়ে এল না। প্রাথমিক ঝটকা কাটিয়ে নিজেই উঠে পড়লাম হড়বড় করে। ভাগ্যে মোটা জিন্সটা পরে এসেছিলাম, নইলে এই পাথুরে ফুটপাথে এমন পপাত চ মমার চ হলে আর হাঁটু বলে কিছু থাকত না। তাও যে ডান হাঁটুটা গেছে বেশ বুঝতে পারছি, জ্বালা করছে। তার থেকেও বেশি ব্যথা করছে বাম পায়ের গোড়ালি খানা। ওটাই আসল আপদ, ওটাই মচকেছে ব্যাটা।
" এই ভাবে সবার সামনে আমায় ফেলে দিলে ঠাকুর", মনে মনে ওপরওয়ালার সঙ্গে বিস্তর ঝগড়া করতে করতে, ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে গোটা দুয়েক পা এগিয়েছি, পিছন থেকে সস্নেহে কে যেন বলল, " একটু বসে যান। একটু বসে যান। খুব লেগেছে তো -"।
তাকিয়ে দেখি এক বয়স্ক মানুষ, শ্যামবর্ণ, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, মাথা জোড়া টাকের ফাঁকফোকর গলে শরতের কাশ ফুলের মত ফুটেছে কিছু কাঁচাপাকা চুলের গোছা। একমাথা পরনে সস্তার মেরুন রঙের শার্ট আর ছিট কাপড়ের প্যান্ট। কাঁধে একটা কালো ক্যাম্বিসের অফিস ব্যাগ। সামনে একটা উঁচু মত জায়গায় একটা পাগল বসে উকুন বাছছিল, তার পাশেই একটু বসলাম। ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রইলেন আমার সামনে। ওনার ঐ সামান্য উষ্ণতা, সামান্য সৌজন্য যেন মলমের মত কাজ দিল। মিনিট পাঁচেক পরেই উঠে পড়লাম, ওনাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা দিলাম ব্যাংকের উদ্দেশ্যে।
ব্যাংকের ছেলেমেয়ে গুলোতো বিশ্বাসই করতে পারছিল না, এমন স্যাম্পল ও হয়। ঘণ্টা খানেক বাদে একে একে সব উদ্ধার হল। বিরাপ্পনের মত গোঁফ আর দুই হাতে দুটো গাবদা কঙ্কালের আংটি পরা ছেলেটি তো বলেই ফেলল, " আর এত ভুলে যাবেন না কেমন? সাবধানে বাড়ি যান।" বাড়ির পথে রওনা হয়েই আগে প্রিয় বন্ধুদের বললাম, রাস্তায় কি হয়েছে। বেচারারা কাল রাত থেকে আমার জন্য উদ্বিগ্ন ছিল। এবার বরকে বলার পালা। উফ্ শুনে তার কি হাসি। " হিহি, হাহা, হোহো আমি খালি দৃশ্যটা visualise করার চেষ্টা করছি -"।
প্রিয়জনের এ হেন ব্যবহারে আহত হয়ে আজ কিনেই ফেললাম তালটা। আজ তিরিশ টাকা নিল ছেলেটা। সঙ্গের নারকেলটা অবশ্যি ৫০/- চাইছিল। বিস্তর দরাদরি করে পাঁচ টাকা কমাল মাত্র। অবশেষে বানানো হল তালের বড়া। আমার ডান হাঁটু, বাম গোড়ালি এবং বাম কাঁধ যেহারে শত্রুতা শুরু করেছে, শাশুড়ি মাতার আয়া দিদি এসে ঝাঁপিয়ে না পড়লে আজ অন্তত হত না কিছুই।
আলমারি থেকে একটা নতুন বাটি বার করে, স্বহস্তে ধুয়ে মেজে যত্ন করে বড়া গুলো সাজিয়ে নিয়ে গেলাম তার কাছে। আমার প্রথম প্রেম, আপাতত তাঁর চিরন্তন প্রেমে আকন্ঠ নিমজ্জিত। লজ্জাও নেই ছোঁড়ার, পরের বউয়ের সাথেই প্রেম করে। যাক গে, সে ওদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। বললাম দুজনেই খেও। আর খুব ভালো থেকো। বিলম্বিত হলেও শুভ জন্মদিন প্রথম প্রেম, তুমি তো অনন্ত প্রেমের আধার, দাও না তার কিছুটা ছড়িয়ে, এই প্রেমহীন ধরায়।
অনির ডাইরি ১৫ই আগস্ট, ২০২৫
#অনিরডাইরি
খুব রেগে আছে দিদিটা। যখন থেকে এসেছে, ঘর ঝাঁট দিতে-দিতে, বাসন মাজতে-মাজতে উচ্চ স্বরে ফোনে কাউকে নালিশ করেই যাচ্ছে, "আমিও বলে এয়েছি, কাল থিকে আর আসব না। আল্লা যদি দয়া করেন, আমার কাজের অভাব হবে না-।" একই কথা একাধিক বার বলেই যাচ্ছে।
এমনিতে বেশ হাসিখুশি দিদিটা। আমার তো ভালো লাগেই, শাশুড়ি মাতা এবং তাঁর নাতনীও দেখি বেশ পছন্দ করে দিদিকে। বিশ্বাস করুন, এই দুজনের একসাথে কাউকে পছন্দ হওয়া এবাড়িতে বিরাট বড় ব্যাপার। কোনটা যে বেশি খুঁতখুঁতে মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না বাপু।
দিদির আজ যা মেজাজ, কি হয়েছে আর জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয় না। চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকি, খানিক বাদে, তিনি নিজেই এসে দাঁড়ান ঘরের দরজার সামনে, " অ বৌদি, জানো তো আজ আমি রাগ করি একটা কাজ ছেড়ে এয়েছি-"। বলি, সে তো অন্তত পঁচিশ বার শুনলাম, কিন্তু কেন?
চৌকাঠের পাশে ধপ করে বসেই পড়ে দিদিটা, " আমি উদিকে একটা ফেলাটে কাজ করি। যখন ঢুকিছিলাম, ঘরবাসন করব বলিই ঢুকিছিলাম। বুড়ো কাকু, তার ছেলে আর বউয়ের সংসার। বৌদি চাকরী করে সেই ধনীয়াখালী। কাকু আর দাদা থাকেন। কাকুর অনেক বয়স, ইদানিং কিছুই পারেন না। আমিই চান করিয়ে দিই। হাগিজ পরিয়ে দিই দুই বেলা। খাবার বেড়ে দিই -
ইদানিং দেখছি, হাগিজ পরি,পরি কাকুর এই কুঁচকির কাছটা হেজে যাচ্ছে। আমি ভালো করে পাউডার দিয়ে পরাই, তাও কমে না। রোজ বলি, অ কাকু, দাদাকে বলি, একটা কিরিম, লোশন কিছু এনে দিক, কিছুতে বুড়োটা আমায় বলতে দিবে না। খালি বলে, " না, না। ওকে কিছু বলো না। খামোকা ব্যস্ত হয়ে পড়বে। গরম একটু কমলেই এটা কমে যাবে"।
তুমি বল বৌদি, আমি কি করি। বাড়িতে কোন মেয়েছেলে থাকে না, একটা পুরুষ মানুষকে এসব বলতে তো আমারও সংকোচ হয় -। তো আজ, লজ্জার মাথা খেইয়ে আমি ঠিক করলাম, দাদাকে বলতেই হবে। বললাম, দাদা, কাকুর এই কুঁচকির কাছটা একটু কেল্টে কেল্টে গেছে, একটা ওষুধ কিনে আনবা তো।
ব্যাস যেই বলিছি, বৌদি গো, কি তার তড়পানি। "কেন এতদিন আমায় বলো নি, বাড়াবাড়ি হলে কে ভুগবে তুমি না আমি?"তো আমি বললাম, বেশি বাড়াবাড়ি হবে না। গরম কালে আমাদেরও ওমন কেল্টে কেল্টে যায় -। তো আজ আর এবেলা হাগিজটা পরাব না। বিছানায় আমি অয়েল ক্লথ পেতে দিইছি। তো আমায় বলে কি না, "তোমায় বেতন দিয়ে কে রেখেছে? সামনের মাসে দেখি কে তোমায় বেতন দেয় -"। বলাতে আমার এমন রাগ হয়ে গেল, বললাম, লাগবে না তোমার বেতন। আমিও আর কাল থিকে আসব না।রাগ করে চলে আসছি যখন, বলছে, " যাও যাও, পয়সা দিলে কাজের লোকের অভাব হবে না"।
এতদিন ওদের বাড়ি কাজ করছি, তুমি বলো। এই তো বৌদির টেরান্সফার হয়েছে ধনীয়াখালি থেকে আরো অনেক দূরে কোথায় যেন। দাদা যাবে বৌদির ভাড়া বাড়ি গুছিয়ে দিয়ে আসতে, বারো দিন আমায় রাতে বুড়োটার কাছে থাকতে বলেছিল। এখন কি হবে কে জানে?' বলতে বলতে খানিক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। আমি জানতে চাই, বৃদ্ধ ভদ্রলোক কি একেবারে শয্যাশায়ী? দিদি বলে, " না না, চলাফেরা করতে পারেন তো।" বলি তাহলে সবসময় হাগিজ পরিয়ে রাখে কেন?
মায়ামাখা স্বরে বলে দিদিটা, " উনি প্রস্রাব ধরে রাখতে পারেন না গো বৌদি। আপনি আপনি চুঁইয়ে বেরিয়ে আসে -"। শুনতে শুনতে আমার প্রিয়তম বৃদ্ধের জন্য মনটা খারাপ হয়ে যায়। বয়স হলেই পুরুষদের যে একি জ্বালা। বৃদ্ধের কথায় যতটা নরম হয়েছিল গলার স্বর, তার ছেলের কথায় আবার চড়ে যায়, " এর আগেও যখন যখন বাইরে গেছে, আমিই তো থাকতাম কাকুর কাছে। উফ সে যে কি জ্বালা। রান্নার দিদি এসে দাদাকে ফোন করে, কি রাঁধব? দাদা ফোনে বলে এইটুকু চাল নাও। একটা আলু নাও ---। এইসব দিয়ে যা রান্না হয়, বুড়ো আর আমি, দুটো মানুষের একবেলাই খাওয়া হয় না, তো দুবেলা। আমরা গেরামের মানুষ বউদি, ভাতটা একটু বেশি খাই। সে প্রায় আধপেটা খেয়ে থাকতে হয় আমারে -।"
বলতে বলতে গলার স্বর আবার করুণ হয়ে ওঠে, " এই যে আমি রাগ দেখিয়ে চলে এলাম না বৌদি, বুড়োটার ওপর এর ঝাল ঝাড়বে তুমি দেখে নিও। এমনিতেও যে কি মার, মারে -"। বুড়োটাকে মারে? আঁতকে উঠি আমি। দিদিটা করুণ সুরে বলে, " হ্যাঁ গো বৌদি। মাঝে মাঝেই দেখি। আমি চান করাই তো, দেখি পিঠে, হাতের ওপর লাল লাল রক্ত জমে আছে। জিজ্ঞাসা করি, এগুলো কি হয়েছে কাকু? বুড়োটা ফিসফিস করে বলে, ' আমায় মেরেছে রে মা -"।
বলতে বলতে উঠে পড়ে দিদিটা, " নাহ এতটা রাগ দেখানো বোধহয় ঠিক হয়নি বলো বৌদি -। বুড়োটার জন্য সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। দেখি কাল মনমেজাজ কেমন থাকে, তারপর ভাবব -"।
এটা ছিল গতকালের বার্তালাপ। আজ আসেনি দিদিটা,সাড়ে নটা নাগাদ কাঁধতে কাঁদতে ফোন করেছে, দেশ থেকে খবর এসেছে সক্কাল সক্কাল পতাকা তুলতে গিয়ে ওর দাদা তড়িদাহত হয়ে মারা গেছেন। আজ স্বাধীনতা দিবস কি না -
অনির ডাইরি ১১ই আগস্ট, ২০২৫
#অনিরডাইরি
কিছু ছবির বোধহয় কোন ক্যাপশন লাগে না। বাবা পঁচাশি, পিসি নব্বই। এমন অমৃত মুহূর্তের যে একটা ভালো করে ছবি তুলব, তার উপায় আছে নাকি? যা অগোছাল হয়ে আছে বাড়িটা। চাটুজ্জেরা জন্ম অগোছাল। এ বাড়ির যে কোন প্রান্তে গেলেই টের পাবেন। আমিই কম অগোছাল নাকি? পনেরো ষোল বছর ধরে জ্বলছে শৌভিক।
একটা জিনিস খেয়াল করেছি, যাঁরা খুব গোছানো হন, তাদের মনের ভিতরটা ও গোছালো হয়। স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব সব কিছু গোছানো থাকে স্তরে স্তরে। পরিমিতি বোধ হয় মারাত্মক। এবাড়িতে অবশ্য ও সবের বালাই নেই। সব কিছুই অবারিত, অসীম।
শুধু যে বাড়িটা অগোছাল তাই নয়, পিসি নিজেও যে শাড়িটা পরেছিল, বিশ্বাস করুন রাস্তায় ফেলে দিলেও কেউ কুড়িয়ে নেবে না। পিসি ওমনই। স্তরে স্তরে জমে থাকে পিসির শাড়ি, ম্যাচ করে ব্লাউজ। অঙ্গে তোলে না পিসি। আমাদের ছেলে এবং মেয়েবেলায় বাবা রঙ্গ করে বলত, পিসির দেরাজ খুঁজলে সব পাওয়া যাবে, ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে বাদশা আকবর পর্যন্ত যে যা দিয়েছে সব যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছে পিসি।কেবল সম্রাট অশোকের দেওয়া জামাটা ছিঁড়ে গেছে, এই যা।
পিসিকে কি বলব, আমার বাবা কিছু ফেলে নাকি? চাকরী পেয়ে এক বোতল সেন্ট কিনে দিয়েছিলাম, তার অর্ধেকটা আজও আছে। আমি অফিস যাবার সময় মাঝে মধ্যে লাগাই, যত বার স্প্রে করি কেঁপে ওঠে বাবা। মায়ের কিনে দেওয়া প্রথম শার্ট, ছোটমাসি চাকরি পেয়ে কিনে দেওয়া জামা ইত্যাদি প্রভৃতি সব রেখে দিয়েছে বাবা। এবং মাও। মাঝে মধ্যে আমি বিরক্ত হয়ে কিছু বাতিল করি।সুযোগ বুঝে বাতিল করা জামাকাপড়ের পুঁটলি ঘেঁটে বিবর্ণ শাড়ি গুলো পুনরায় নিয়ে চলে যায় পিসি।
বলতে গেলেই বলে, " কেন ফেলে দিবি? কোথাও তো ছেঁড়েনি, ফাটেনি। আমরা অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছি রে। এমনও বছর গেছে তোর বাবা কাকার একটা জামা হয়নি। আমার শাড়ি কেটে পাঞ্জাবি বানিয়ে দিয়েছি ওদের। আমি সেসব দিন ভুলতে পারি না রে -"। ৪৬ এর মন্বন্তরের গল্প শোনায় পিসি, " এক হাতা ফ্যান আর এক খাবলা নুনের জন্য আস্তাকুঁড়ের কুকুরের মত কামড়াকামড়ি করত মানুষ। নারী, পুরুষ,শিশু। সেসব দিন তোরা দেখিস নি।"
নাহ্ সে সব দিন আমি/আমরা দেখিনি। 'মনে আছে বিশ্বাস', নরকের আগুনে ভালো মত ঝলসানো হচ্ছে উইনস্টন চার্চিল নামক শয়তানটাকে। নৈতিকতার, মনুষ্যত্বের যত অবনমনই ঘটুক না কেন, সেই দিন আর ফিরে আসবে না। ঈশ্বর করুন যেন নাই আসে, পেটে না খেলে, পিঠে সইবে কি করে মশাই।
যাই হোক আপাতত ফিরে আসি, ভাইবোনের এই অমৃত উৎসবে। বার বার ফিরে আসুক দিনটা এই অশীতিপর ভাইবোনের জীবনে, বয়ে আনুক আরো আরো অবারিত, অগোছাল ভালোবাসা। ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি?
অনির ডাইরি ৩রাআগস্ট, ২০২৫
#অনিরডাইরি
কোনদিনই খুব বেশী বন্ধুবান্ধব আমার ছিল না,আজও বন্ধু বলতে যাদের বদন মুদিত নয়নের সম্মুখে ভেসে ওঠে, তাদের সংখ্যা বেশ সীমিত। অন্তত জুকুদার ফেসবুক যে এগারোশ কত বন্ধু দেখাচ্ছে তার এক দশমাংশের থেকেও বেশ অনেকটাই কম। মোটামুটি সারাদিন যারা অনুপস্থিত থেকেও ঘিরে থাকে আমার দিনটাকে, তাদেরই বন্ধু বলে ধরি আর কি-।
যাদের সকলকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে হাড়ে হাড়ে চিনি, কারো কপালে সহকর্মীর ছাপ্পা তো কারো গায়ে সহপাঠী বা ক্ষেত্রবিশেষে সহযাত্রীর উল্কি। ভালোমত চেনা পরিচয় না হলে আবার মৈত্রী হয় নাকি?
মুস্কিল হল,এই চেনাবৃত্ত-চেনাছকের বাইরেও বেশ কিছু মানুষ ধূমকেতুর মত আচমকা প্রবেশ করেই বেরিয়েগেছেন আমার জীবনের কক্ষপথ থেকে, আর রেখে গেছেন একরাশ সৌহার্দ্যের সুখস্মৃতি।
তা প্রায় বছর তেরো চোদ্দ হল, তুত্তুরী তখন সদ্য পূর্ণ করেছে এক বৎসর। শিশুকন্যার দোহাই দিয়ে মহানগর পোস্টিং পেয়েছি। চার্চ লেনের পাঁচ তলায় আপিস। বড়সাহেব মহঃ আমানুল হক। আপিস তো নয়, হাওদাখানা, দুবার ফোন চুরি হয়েছে খাস বড়সাহেবেরই, সবাই প্রায় বগলদাবা করে ঘোরে নিজের মুঠোফোন আর আলমারির চাবি। আর আমি এমনি ট্যালা, যে টেবিলে মোবাইল ফেলে ফাইল বগলে ঢুকেছিলাম বড় সাহেবের ঘরে। শুভাকাঙ্ক্ষী বড় সাহেবের পিতৃসুলভ ধমক খেয়ে ছুটতে ছুটতে নিজের চেম্বারে ঢুকে দেখি দিব্যি ফাইলের ওপর শুয়ে আড়ামোড়া ভাঙছেন তিনি। বেশী না মাত্র দুটো মিস কল এসেছে আমার অনুপস্থিতিতে।কোন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি দুবার ফোন করেছেন।
সাধারণতঃ অচেনা নম্বরে ঘুরিয়ে ফোন করি না। কিন্তু কেন জানি না, সেদিন করলাম। ওপার থেকে এক প্রৌঢ় কণ্ঠ বলে উঠল, ‘হ্যালো অনিন্দিতা? আমি প্রসেনিজিৎ দা বলছি-’। তৎকালে প্রসেনজিৎ নামক দুজন ব্যক্তিকে কেবল চিনতাম, প্রথমতঃ দি প্রসেনজিৎ, সুপারস্টার। তিনি থোড়াই অধমের মত তুচ্ছ ব্যক্তিকে ফোন করবেন?
আর দ্বিতীয়জন সার্ভিসতুতো সিনিয়র দাদা শ্রী প্রসেনজিৎ কুণ্ডু ওরফে পিকে দা। তিনি মাঝেমধ্যেই ফোন করেন থুড়ি করতেন নানা কাজে। নম্বরটা অচেনা যদিও, সে তো হতেই পারে।ব্যস্ত কেজো সুরে জানতে চাইলাম, ‘ হ্যাঁ প্রসেনজিৎ দা বলো? তোমার ক্লেমের ফাইল স্যারের ঘরে। ’ ওপারের গলাটা কিঞ্চিৎ থতমত খেয়ে বলল, ‘আরেঃ আমি প্রসেনজিৎ দা বলছি ব্যাঙ্ক থেকে। ’ ও হরি। ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি আরেক প্রসেনজিৎকেও চিনি। তবে তাঁকে কোনদিন দাদা বলে ডাকা বা ভাবার ধৃষ্টতা দেখাইনি।
প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সাথে ব্যাঙ্কেই আলাপ।কিছুদিন আগেই আমি গিয়েছিলাম অ্যাকাউন্টে ঠিকানা বদল করতে, যাঁর টেবিলে পাঠানো হয়েছিল, সেই সৌম্য দর্শন অতি গৌর বর্ণ প্রৌঢ়, আদতে ছিলেন অত্যন্ত সদাশয় তথা অমায়িক ব্যক্তি। পাশে বসিয়ে, চা খাইয়ে স্নেহশীল ভঙ্গিমায় অনেক খোশগল্প করেছিলেন। না বলতেই কে ওয়াই সি ঠিক করে দিয়েছিলেন, আর সব কি কি করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ আমার নম্বরটা নিয়ে যাও, কোন দরকার হলে ফোন করে দিও, কাজ হয়ে যাবে। কষ্ট করে আর আসতে হবে না। তবে যদি আসো, অবশ্যই এই বুড়োটার সাথে দেখা করে যেও।’
তাই করতামও। ফোন কখনও করিনি, তবে গেলে দেখা করতাম। বেশ কিছুদিন আর ব্যাঙ্কে যেতে হয়নি, তাই দেখাসাক্ষাৎও হয়নি। ভাবলাম তাই বোধহয় কুশল বিনিময় করতে ফোন করেছেন ভদ্রলোক। উৎফুল্ল স্বরে জানতে চাইলাম, ‘ও প্রসেনজিৎ বাবু আপনি? কেমন আছেন?’ ওপার থেকে ভেসে এল মৃদু ধমক, ‘কেমন আছি, পরে জানলেও চলবে। আগে বলো তোমার এটিএম কার্ডটা কোথায়?’ থতমত খেয়ে জানালাম, কার্ডটা যেখানে থাকার সেখানেই আছে, হাতব্যাগের ভিতর পয়সার থলের মধ্যে, ওণারই উপহার দেওয়া ব্যাঙ্কের নাম লেখা ‘ফ’ লেদারের পাউচের ভিতর। ওদিকের গলায় ফুটে উঠল, চাপা উত্তেজনা,‘ তাই নাকি? আমি ফোনটা ধরছি, তুমি খুঁজে দেখো তো। ’
হাতব্যাগ উপুড় করে টেবিলের ওপর ঢেলেও পেলাম না, এটিএম কার্ড। সবেধন নীলমণি একটিই অ্যাকাউন্ট,তার একমাত্র কার্ড। আমার সিন্দুকের চাবি। কি করি? রীতিমত আতঙ্কিত সুরে জানতে চাইলাম ফোন করে ব্লক করাব কি? করাতে হলেও বোধহয় কার্ড নম্বরটা লাগবে,যা আমার মুখস্থও নেই, কোথাও টোকাও নেই।
ওদিক থেকে স্নেহময় বড়দার ধমক ভেসে এল, ‘কাল হাওড়া ময়দান থেকে টাকা তুলেছিলে?’ আলবাৎ তুলেছিলাম। বেশ মনে আছে টাকা তুললাম, টাকা গুণলাম,পয়সার থলে তে ঢোকালাম। থলেটা হাত ব্যাগে ঢোকালাম, তারপর মায়ের ভাষায় ধেইধেই করতে করতে বাড়ি গেলাম। উনি জানালেন, ওখানেই হয়েছে গড়বড়, টাকা গোণার সময়, ফ লেদারের পাউচে ভরা কার্ডটা রেখেছিলাম এটিএম কাউন্টারে। তারপর তাঁকে সেখানে রেখেই ধেইধেই- ।
জনৈক ব্যক্তি পরে রাতে ঐ এটিএমে টাকা তুলতে গিয়ে কার্ড সমেত পাউচটা পান। উনি তৎক্ষণাৎ এটিএমের রক্ষীর কাছে সেটি জমা করতে উদ্যত হন, এই আশঙ্কায় যে,যার কার্ড সে হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছুটে আসবে। রক্ষী হাই তুলে দায়সারা ভাবে জানান,তিনি নিতে পারবেন না। হয় থানায় জমা করুন, নাহলে ওখানেই পড়ে থাকুক। যার কার্ড সে বুঝে নেবে।
এত সহজে দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেননি ভদ্রলোক, উনি তখন ফ লেদার পাউচটি ঘেঁটে দেখেন ভিতরে কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বর আছে কি না। ছোট্ট চিরকৃটে প্রসেনজিৎ বাবুর স্বহস্তে লেখা ফোন নম্বরটি আমি ভাগ্যে ঐ পাউচটাতেই রেখেছিলাম, গতকাল রাত নটা নাগাদ ভদ্রলোক প্রসেনজিৎ বাবুকে ফোন করে সব জানান। কার্ডের নামটা শুনেই উনি চিনতে পারেন, কিন্তু আমার নম্বর না থাকায় আর ফোন করতে পারেননি। আজ আপিসে এসে, ডেটাবেস ঘেঁটে আমার নম্বর খুঁজে সকাল থেকে চেষ্টা করছেন যোগাযোগ করার।
শুনে স্বস্তি পেলাম। সাথে সাথে ভদ্রলোকের নাম আর নম্বরটাও। প্রসেনজিৎ বাবু জানালেন, ভদ্রলোক কাল রাতেই ওণাকে জানিয়ে রেখেছেন আজ সারাদিন উনি কাজের জন্য হাওড়ার কোন প্রত্যন্ত গ্রামে থাকবেন, যেখানে টাওয়ার থাকবে না। ফলে রাত আটটা নটার আগে ওণাকে পাওয়া যাবে না। তখন ফোন করলে উনি জানাবেন কখন উনি কার্ডটা ফেরৎ দিতে পারবেন।
সত্যিই ওণাকে পাওয়া গেল না রাত নটা অবধি। টেনশনে কত সহস্রবার যে ডায়াল করলাম ওণার নম্বর। রাত নটার পর বাজল ফোনের রিং, ওপাশ থেকে ভেসে এল এক ক্লান্ত পুরুষকণ্ঠ। পরিচয় দিতেই , চিনতে পারলেন। মার্জনা চাইলেন এতক্ষণ ফোনে না পাওয়ার জন্য। জানালেন পেশায় ছোটখাট কন্ট্রাক্টর। কাজের ধান্ধায় প্রায়ই এমন দূরদূরান্তে যেতে হয়। আগামী কালও যেতে হবে। যদি আমি সকাল সকাল একটু হাওড়া ময়দানের ঐ এটিএমে আসি, তো উনি কার্ডটা আমায় দিয়ে যেতে পারেন।
কৃতজ্ঞতায় বুঝে আসছিল গলা। কে বলে আমরা কলি যুগে বাস করি? এখনও কত যে সৎ মানুষ ছড়িয়ে আছেন, এই সমাজে। তাই না এতকিছুর পরও জিতে যায় মানুষ। নিশ্বাস চেপে কোন মতে কাটল রাত, ভোর ভোর পৌঁছালাম এটিএমে। ফোন করতেই এক সৌম্য দর্শন বছর ত্রিশের ব্যক্তি এগিয়ে এলেন, নমস্কার বিনিময়ের পর আমার কার্ডটা আমার হাতে দিয়ে ওণার শান্তি হল। তাড়া ছিল ওণার, তবুও দুদণ্ড কথা বললেন আমার সাথে। ভুল বললাম, আমিই বলে গেলাম একতরফা। জানালাম অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা। জানালাম কি চাকরী করি আমি এবং শৌভিক, জানালাম এছাড়াও আছে বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব, যে কোন প্রয়োজনে উনি যেন নিঃসঙ্কোচে জানান আমাদের। এই উপকারের কোন প্রতিদান তো হয় না, তবুও চেষ্টা করব পাশে থাকার। উনিও কথা দিলেন, অবশ্যই জানাবেন। পরে বাড়ি ফিরে একই কথা জানিয়েছিলাম প্রসেনজিৎ বাবুকেও। মজার কথা হল না উনি কখনও কোন সাহায্য চেয়েছিলেন না প্রসেনজিৎ বাবু। দ্বিতীয় ব্যক্তির সাথে এরপরও বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল, প্রথমজনের সাথে আর কখনও যোগাযোগই হয়নি।
নাই হোক দেখাসাক্ষাৎ, নাই থাকুক যোগাযোগ, ওই যে স্বর্গীয় চাণক্য বলে গেছেন না, বন্ধুত্বের প্রথম শর্তই হল বিপদে পাশে থাকা, এনারা যদি বন্ধু না হন, তাহলে আর বন্ধু কে? প্রতিটি বন্ধুদিবসে তাই একটি বার অন্তত স্মরণ করি এইসব মানুষকে, আর ইথার তরঙ্গে পাঠিয়ে দিই, একরাশ শুভকামনা। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আপনাদের মত ভালো মানুষদের বড় দরকার এই পোড়া সমাজে।
অনির ডাইরি ২রা আগষ্ট, ২০২৫
#অনিরডাইরি
ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারলাম, ঈশ্বর আমায় ত্যাগ করেছেন। নইলে কালরাতে অমন সকাতর অনুরোধের পরও এমন বৃষ্টি হয়! বর্ষা আমার বরাবরের প্রিয় ঋতু। বন্ধুবান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ীরা নির্ঘাত ঠ্যাঙাবেন, তাও বলি, বৃষ্টি আমার আজও ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে। ভালো লাগে না কেবল জলজমা। ওটা এক্কেবারে যমের অরুচি -
কপালের এমন গেরো যে আমার পিত্রালয় এবং শ্বশুরালয় উভয় এলাকাই ইদানিং কথায় কথায় জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। কলকাতার জমা জল তাও একরকম, সেদিনও ঐ জলে স্থানীয় বস্তির কয়েকটা বাচ্ছাকে স্নান করতে দেখেছি। কিন্তু হাওড়ার জমা জল এক্কেবারে বিভীষিকা। রাস্তার ধারেই খোলা নর্দমা। বৃষ্টি হলেই রাস্তার জমা জলের সাথে নর্দমার জল মিলেমিশে একাকার। তার ওপর আছে চড়া মূত্রের কুবাস। রাস্তায় দাঁড়িয়ে হিসি করাটাই এখানে দস্তুর। সেই তরল ও মিশে যায় ঐ জলে। ঐ জল মাড়িয়ে বাড়ি ফিরে গতকাল মনে হচ্ছিল শুধু সাবান বা ডেটল নয়, মিউরিয়েটিক অ্যাসিড দিয়ে ধুই, দুই পা আর জুতো জোড়াকে।
ঘুম ভাঙার প্রাথমিক বিরক্তিটা কেটে গেল বাইরের রোয়াকে এসে। রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। ঘন সবুজ গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে মুক্তোর মত জলকণা। বাতাসে একটা অদ্ভুত মন ভালো করা ভিজে সুবাস। আমি আর লতা দি ছাড়া, এখনও কেউ ওঠেনি এবাড়িতে। এখনও খিল খোলা হয়নি, আমাদের শতাধিক বছরের পুরান সদর দরজাটার। কয়েকমাস আগেও কাক ডাকা ভোরে উঠে বাবা'ই খুলত ভারী লোহার খিলটা। ইদানিং লতাদিই খোলে।
দালান থেকে বেরিয়ে সাবেকি লাল রোয়াক, রোয়াক থেকে চার ধাপ সিঁড়ি নেমে একফালি এজমালি উঠোন। উঠোন পেরিয়ে ভারী বার্মাটিকের সদর দরজা। উঠোনময় ছড়িয়ে আছে কাঁচাপাকা পেয়ারা। রাতভর বৃষ্টিতে খসে পড়েছে গাছ থেকে। ফলের ভারে ঝুঁকে থাকে মায়ের সাধের গাছটা। দুর্ভাগ্যবশতঃ এক ঝাঁক টিয়া ছাড়া কেউ খাই না আমরা পেয়ারা। কাকার দোতলার বারান্দা থেকে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় পেয়ারা, তাও খাই না কেউ। বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছে মা -
শুধু কি পেয়ারা! মায়ের হাতে লাগানো কাঁঠাল গাছ থেকে এখনও ঝুলছে অন্তত গোটা ছয়েক মস্ত পাকা কাঁঠাল। গোটা এগারো ধরেছিল এবার। সবই বিশাল বিশাল আয়তনের। কিন্তু পাড়বে কে? গেল বার, আমাদের হক বাবু আর বিমল ড্রাইভার মিলে পেড়ে দিয়েছিল সব কাঁঠাল। গোটা দুয়েক মাকে দিয়ে বাকি সব কাঁঠাল পূব মেদিনীপুরে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। এ বছর বিমল নেই, ঘটেছে উত্তমকুমারের প্রত্যাবর্তন। তাকেও কম জপাইনি হক বাবু আর আমি। কিন্তু উত্তমকুমারের একটাই কথা, " ম্যাডাম আমি গাছে চড়তে পারি। কিন্তু নামতে পারিনি -"।
এ কেমন কথা হল বাপু? তুমি পূব মেদিনীপুরের ভূমিপূত্র। জমিজমা আছে, নিয়মিত চাষাবাদ করো, আছে পুকুর, গাছপালা আর এটা পারিস না? অগত্যা কাঁঠাল গুলো গাছেই পাকছে আর নিজেদের মর্জি মত ধুমধাম করে খসে পড়ছে। গোটা বাড়ি সুরভিত হয়ে উঠছে খসে পড়া পাকা কাঁঠালের গন্ধে। পাড়ার ঝাড়ুদারের দেশোয়ালী ভাইকে আলাদা করে ডেকে টাকা দিয়ে সাফ করাতে হচ্ছে সেই থ্যাঁতলানো কাঁঠালের ভূতি। হায় হায় করছে মা -
গতকাল রাতেও একটা দামড়া কাঁঠাল পড়েছে ধপাস করে, সেটাই দেখছিলাম, পিছন থেকে ভেসে এল বাবার মোলায়েম কন্ঠস্বর, " কখন উঠেছিস? আমায় ডাকিসনি কেন?" পেশার টানে আপাতত পিত্রালয়ে থেকে আপিস করি আমি। হাওড়া থেকে তমলুক তাও সহনীয়। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরি, পরিযায়ী পাখির মত। রোজ সন্ধ্যায় ফোন করে আমার বর, তরল স্বরে শুধায়, " বেরাইছিস? কোথায় ফিরবি আজ রাতে -"। "বাড়ি" বললে বলে, বাড়ি তো দুটোই। হাওড়ার বাড়ি না কলকাতা। এটা শুনলেই দ্রব হয়ে যায় আমার হৃদয়। সত্যিই তো, এটাও তো আমারই বাড়ি। জীবনের প্রথম তিন দশক কাটিয়েছি যে বাড়িতে, কেন যে তার থেকে মাত্র এক দশক কাটানো বাড়িটা এত বেশি প্রিয় বুঝি না। বোঝার চেষ্টা করলেই মন আর মাথা জুড়ে নামে কুয়াশা।
তাই ওসব নিয়ে আর ভাবি না। চাকরী মানেই তো চাকরগিরি। তবে এটা বেশ বুঝতে পারি, আমার এই টানাপোড়েনে আমার বাবা মা একটু হলেও খুশিই হয়। বাড়িতে পা রাখার সাথেসাথেই যেন ঝলমলিয়ে ওঠে সবকিছু। শুধু কি বাবা মা, দোতলা থেকে ধরে ধরে নেমে আসে নব্বই বছরের বুড়ি পিসি। " আহা রে, তোর কত কষ্ট" বলে হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়। শুধু আমার জন্য অর্ডার দিয়ে ইলিশ মাছ কিনে আনে বাবা। কদমতলা বাজার থেকে লতা দি স্বয়ং গিয়ে কিনে আনে টোপা টোপা চিংড়ি, পুকুরের ডিম ভরা পার্শে, সাবিরের দোকানের খাসি। আসে দেশপ্রিয়র দরবেশ/ পান্তুয়া/ কালোজাম আর এলাচ দেওয়া লাল দই।
সত্যিই যদি এত খাওয়ার সময় থাকত আমার। সকাল আটটায় এত খাওয়া যায় নাকি? মন হলে অফিস থেকে ফিরে চায়ের সাথে মাছ/ মাংস বা মিষ্টি এক আধটা খাই বটে। তাতেই গলে যায় বাবা। আজও গতকালের ইলিশ মাছের ঝালটা গরম করতে বসিয়েছিল লতা দি, শুরু করেছিল প্রেশারে ভাত বসানোর তোড়জোড়। নিষেধ করতে কালো হয়ে গেল বাবার মুখটা। "কিছুই খাবি না? তোর জন্যই ইলিশটা - ।" মা বলে, "কৌটোয় ভরে দাও তো লতা, তুত্তুরীর জন্য নিয়ে যাবে"।
এই না হলে আমার মা। আজ সপ্তাহ শেষ, বর মেয়ের কাছে ফিরব বটে, কিন্তু ফিরতে বাজবে খুব কম করেও রাত আটটা। বারো ঘণ্টা ভালো থাকবে তো, মায়ের গতকালের রাঁধা ইলিশ। তুত্তুরীর জন্য এত চকলেট বেঁধে দেয় লতা দি। যাযাবরের ঝোলা, যাতে দু জোড়া পোশাক, ময়েশ্চারাইজার, সানস্ক্রিন, লিপস্টিক, কাজল আর টিপের পাতা নিয়ে সপ্তাহের শুরুতে বাড়ি ছেড়েছিলাম আমি, আবার সেটাই কাঁধে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ি। এই তো জীবন কালী দা। রাস্তায় নেমে পুনরায় অনুধাবন করলাম, নাহ সর্বশক্তিমান সত্যিই আমাকে ত্যাগ দিয়েছেন। গলির মুখ থেকে জল থৈথৈ। সামনের মেয়েটি ফুলপ্যান্টটাকে গুটিয়ে হাফপ্যান্ট করে নিয়ে স্মার্টলি জলে নেমে পড়ল। কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ নিয়ে, ধোপদুরস্ত ফুলহাতা শার্ট আর ঢলঢলে বিবর্ণ হাফ প্যান্ট করে গোটা দুই অফিস বাবুও নেমে পড়ল তার পিছন পিছন। এই ভাবে ফর্মাল শার্টের সাথে দোল খেলার পাতলা গেঞ্জির হাফ প্যান্ট যে আদৌ পরা যায় স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হত না। নাহ্ ঈশ্বর কেবল একা আমাকেই ত্যাগ করেননি, আরও লোক আছে আমার দলে। "জয় মা" বলে নেমেই পড়লাম জলে। একটা শিরশিরে শিহরণ খেলে গেল পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত। সারাদিন এই জল মেখেই আজ কাটবে ঠাকুর - ।
Friday, 11 July 2025
অনির ডাইরি জুন, ২০২৫
অনির ডাইরি ২৮ শে জুন, ২০২৫
#অনিরডাইরি
যাবেন নাকি? রথের মেলায়? মেলা বসেছে আমাদের হাওড়া ময়দানে। টানা হবে মস্ত বড় রথ, রথে আসীন সহোদর সহোদরা সমেত জগন্নাথ দেব। কত কি যে বিক্রি হয় সেই মেলায় - গরম গরম জিলিপি, পাঁপড় ভাজা, খোলায় ভাজা বাদাম, চুড়ো করে রাখা নিমকি, কুচো গজা আরও কত কি। বিক্রি হয় বঁটি, কুরুনি, লোহার কড়া, চাটু, ,রুটি বেলার চাকিবেলুন, হাতা- খুন্তি, সাঁড়াশি এমন কি টিয়াপাখি, খরগোশও। আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই, জ্যান্ত টিয়া পাখি।
সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। ফি বছর রথের দিনে কেন যে বৃষ্টি হয়। দুপুর যত নিশুতি হয়, ততোই বাড়ে বৃষ্টির দাপট। জ্যাঠাইমা বলে, "তোদের এবছর রথ দেখা হয়েছে আর কি - এই আবহাওয়ায় ছোট বউ কি করে তিনটে বাচ্ছাকে নিয়ে বেরোবে বাপু!" ছোট বউ অর্থাৎ ছোট কাকী, পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। আপিস টাইমে বসত কাকিদের স্কুল, ছুটি হতে গড়িয়ে যেত দুপুর। অধীর আগ্রহে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে বসে থাকি আমরা তিন খুড়তুতো জেঠুতুতো ভাইবোন। গায়ে এসে লাগে মিহি বৃষ্টির ঝাঁট। তিন নাটিনাতনীকে শান্ত করতে জগু- বলু আর সুভুর গল্প শোনাতে বসে ঠাকুমা।
নির্দিষ্ট সময়েই বাড়ি ফেরে ছোট কাকী। সঙ্গে দিতু মাসি আর তাঁর দুই পুত্র। দিতু মাসি সম্পর্কে কাকিমার বড় দিদি। পাঁচপাঁচটা গেঁড়িগুগলি বাচ্ছাকে নিয়ে রথ দেখতে বেরোয় দুই বোন। হাওড়া ময়দানে আজ দমচাপা ভিড়, আমাদের দুই চোখে উছলে পড়া লোভ। কাগজের পাখা থেকে তালপাতার বাঁশি যাই দেখি তারই প্রেমে হাবুডুবু খাই। দূর থেকে শোরগোল শোনা যায়, "রথ আসছে, রথ আসছে।" চেপে আমাদের হাত ধরে ছোট কাকী আর দিতু মাসি। নখ কামড়ে থুতু দেওয়া হয় সবার গায়ে, আহা নজর লাগে যদি। বুবাই দাদা সবথেকে বড়, কেউই আঙুল কামড়ায় না ওর। বেচারা নিজেই নিজের আঙুল কামড়ে থুতু দিতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়।
রাজার মত চলে যান জগন্নাথ দেব। আমাদেরও সুযোগ জোটে রথের দড়ি টানার। একরাশ ভালোলাগা নিয়ে বাড়ি ফিরেই গরম গরম জিলিপি। দুর্যোগের মধ্যেই কখন যেন বেরিয়ে কিনে এনেছে জেঠাইমা। অফিস ফেরৎ ঋষি ময়রার জিলিপি কিনে আনে বাবা। সর্ষের তেলে ভাজা ইয়া মোটা মোটা জিলিপি - সুগার ভুলে টপাটপ জিলিপি সাঁটায় জেঠু। আজ রথ বলেই বোধহয় নীরব থাকে জেঠাইমা। বেঁচে যাওয়া জিলিপি রাখা থাকে বাবার জন্য, রাতে দুধ দিয়ে ফুটিয়ে দেবে মা।
"একটা টিয়া পাখি কিনে দাও বাবা" বলে পিছন পিছন ঘুরি আমি। মাসের শেষ, হাত খালি বাবার। ঝুপ করে নিভে যায় আলো, একটু ঝড়ো হাওয়া দিলেই চলে যায় আমাদের ডিসি কারেন্ট। নিকষ আঁধারে সাময়িক ডুবে যায় শতাধিক বছরের পুরান ভাঙ্গা বাড়িটা। লম্ফ ধরায় ঠাকুমা। খালি ওষুধের শিশির ঢাকায় ফুটো করে ছেঁড়া কাপড়ের সলতে গলিয়ে বানানো ঘরোয়া লম্ফ। একটু ভুষো বেশি পড়ে বলে ঘরে নয় রোয়াকে রাখা হয়, আলো দেয় ফাটিয়ে। ঘরের ভিতর হ্যারিকেন ধরিয়ে পড়তে বসায় মা। আজ যেন একদম মন বসে না পড়ায়। খালি ভুল করি -
মায়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাবা বলে, "চল আরেকবার ঘুরে আসি, রথের মেলা থেকে -"।রাত আটটার ভাঙ্গা মেলা, তাও কি ভিড়। ফুচকা খাই আমরা বাপমেয়েতে। একটাকায় দশটা ফুচকা। শেষে একটা ফাউ -। ফেরার সময় একটা টিয়া নিয়েই ফিরি আমরা। ঘন সবুজ তার গায়ের রং, গলায় লাল কণ্ঠী। তেলাকুচো খায় কিনা জিজ্ঞাসা করি আমি। আমাদের পশ্চিমের বাগান জোড়া তেলাকুচো গাছের ঝাড়। সকাল বিকেল কত যে পাখি আসে খেতে -।
পাখি না, ও আমার প্রাণ। সাধ করে নাম রাখি মদনমোহন। পাক্কা কুড়ি টাকা দিয়ে কিনে দিয়েছে বাবা। রাতে খেতে বসে মা বলছিল, এক সপ্তাহের বাজার হয়, কুড়ি টাকায়- । ভোর বেলায় স্কুল আমার, ছুটি হতে হতে গড়িয়ে যায় আপিস টাইম। দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরি আজকাল আমি, আমার অপেক্ষায় আছে যে আমার মদনমোহন। জল দিই, ভিজে ছোলা দিই। স্নান করাই, বেড়াল তাড়াই যাতে ভয় না পায় আমার মদনমোহন। সারা দুপুর তার সাথে গল্প করি। আমার নিঃসঙ্গ দুপুরগুলো যেন আচমকাই হয়ে ওঠে গোলাপী।
আর তারপর? তারপর যা হয় আর কি, কেউ কথা রাখে না। মদনমোহন ও একদিন চলে যায়। আত্মা মিলিয়ে যায় পরমাত্মায়। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলি আমি, খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিই আমি। আমাকে শান্ত করতে কতগুলো যে পাখি কিনে আনে জেঠাইমা, তার ইয়ত্তা নেই। কারো লাল রঙের মাথা তো কারো নীল, কারো বা মাথার রং হলুদ। সবাই সুন্দর, কিন্তু এরা কেউ আমার মদনমোহন নয়। কেমন যেন নির্মোহী হয়ে পড়ি আমি, বুকের ভিতর চাপা কষ্টটা যেন আর যায়ই না। তারপর একদিন ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি, খাটের ওপর রাখা আছে সাদা ধপধপে একটা খাম। খামের ওপর গোটা গোটা করে লেখা আমার নাম। খামের এক কোনায় আটকানো ডাকটিকিটে নিশ্চিন্দিপুরের ঠিকানা। আমার মদনমোহনের বর্তমান সাকিন। বড় ভালো আছে সেথা মদনমোহন। ছত্রে ছত্রে নিশ্চিন্দিপুরের গল্প শোনায় সে। "সে এক রূপকথারই দেশ, ফাগুন সেথা হয় না কভু শেষ-"। সেথা নেই কোন অভাব, কেউ ভোগে না নিঃসঙ্গতায় শোনায়- । মদনমোহন বলে, সেই স্বপ্নের দেশেও তার মন কেমন করে, শুধু আমার জন্য। আমি যে তার প্রথম বন্ধু, আমি কাঁদলে, আমি উদাস থাকলে কি করে ভালো থাকবে আমার পাখি।
পড়তে পড়তে কখনও হাসি, কখনও কাঁদি আমি। বোধহয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন, দুপুরবেলা লুকিয়ে সিনে এডভ্যান্স, আলোকপাত পড়ি, মৃত পোষ্য যে আমায় চিঠি লিখতে পারে না, সেটা খুব ভালোমত বুঝি। তাও কানায় কানায় ভরে ওঠে মন। যে ছেড়ে গেছে সে আর ফিরে আসবে না, তার শোকে, যারা আমায় ঘিরে আছে এত ভালোবাসা অগ্রাহ্য করি কেমনে - ।
অনির ডাইরি ২৫শে জুন, ২০২৫
#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা
দরজা খুলে মুখ বাড়াল সৌম্য, " ম্যাডাম, ওনারা এসে গেছেন। আসতে বলব?" ইশারায় সম্মতি জানিয়ে, গুছিয়ে বসি। চেম্বারে প্রবেশ করেন সাদাসিধে করে শাড়ি পরা এক বৃদ্ধা, বাজারের ব্যাগ হাতে এক মধ্যবয়সী পুরুষ আর দুই প্রবীণ ব্যক্তি। প্রবীণ দ্বয় আমার পূর্ব পরিচিত, কোন একটি ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য। প্রায়ই হানা দেন আমাদের আপিসে।
ইশারায় বলি বসুন। ভদ্রমহিলা থতমত খেয়ে বসে পড়েন, বসে পড়েন প্রবীণ নেতাদ্বয় ও। মধ্যবয়সী ব্যক্তিটি তখনও দণ্ডায়মান, দাঁড়িয়ে আছে আজকের নাটকের নায়ক, আমার কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর শ্রী সৌম্য মুখোপাধ্যায় ও। উভয়কেই পুনরায় বসতে বলে, ভদ্রমহিলার দিকে তাকাই, প্রশ্ন করি, " আপনিই নিদ্রা সামন্ত?" পান খাওয়া খয়াটে দাঁত বার করে হাসেন বৃদ্ধা, দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানান। মধ্যবয়সী ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে শুধাই, " আপনি?" সৌম্য এবং লোকটি একসাথে বলে ওঠে, উনি বৃদ্ধার জ্যেষ্ঠ পুত্র। সৌম্য আরও একধাপ এগিয়ে জানায়, " উনিই আসতেন ম্যাডাম, ব্লকে নিয়মিত খোঁজখবর নিতে।" ভদ্রমহিলা মিনমিন করে বলেন, " বুড়ো হইছি মা, আমি আর অত ছুটাদৌড়া পারিনি -"।
'ছুটাদৌড়া' ই বটে, বাপরে বাপ! কি যে গেছে বিগত কিছু দিন। কোলাঘাট সাগরবার পঞ্চায়েতের বাসিন্দা শ্রীমতী সামন্ত পেশায় ছিলেন একজন নির্মাণ কর্মীর সহায়িকা। ষাট বছর অতিক্রান্ত হবার পর তিনি হলেন পেনশনের হকদার। সে অনেক কাল আগের কথা, তৎকালীন কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর সাহেব সেই মত ওনার কাগজ পত্র চেক করে পাঠালেন আমাদের আপিসে। আমার কোন এক পূর্বসুরী সেই আবেদন পত্র পুনরায় চেক করে, পেনশনের অনুমোদন দেবার সুপারিশ সহ পাঠালেন মহানগর। মহানাগরিক অধিকর্তাবৃন্দও দেখলেন সব ঠিক আছে, মঞ্জুর হল ওনার পেনশন।
বেশ কিছুদিন পর উনি এলেন ব্লকে খোঁজ নিতে, " সার আমার ট্যাকা কবে ঢুকবে?" ইন্সপেক্টর সাহেব আধার নম্বর দিয়ে সার্চ করে দেখলেন, পেনশন তো নিয়মিত ছাড়ছে কলকাতা। সেই পেনশন ঢুকছেও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এ, কারণ সাকসেস ফেলিয়র রিপোর্ট নিয়মিত পাঠায় কলকাতা আর তাতে ওনার পাশে সফলতার টিক চিহ্ন জ্বলজ্বল করে। ওনাকে বলা হয়, টাকা তো ঢুকছে, আপনি বুঝতে পারছেন না। গ্রামের দিকে একেক জনের একাউন্টে একসাথে অনেকগুলো পেনশন বা অনুদান ঢোকে,ফলে জট পাকিয়ে যাওয়াটাই দস্তুর। কখনও আমরা ভাবি হয়তো লাইফ সার্টিফিকেট দেননি, তাই ঢোকেনি। নতুন করে নেওয়া হয় লাইফ সার্টিফিকেট।
এই ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে, কিন্তু সুরাহা হয় না কিছুতেই। শেষে বিরক্ত হয়ে সৌম্য একদিন বলে," কাল পাশবইটা নিয়ে আসবেন, আমি নিজে দেখব। " দীর্ঘ দুই তিন বছরের হিসেব নিকেশের পাতা উল্টে ও নজরে আসে না পেনশনের খতিয়ান। কেস টা কি হল? এই নিয়ে আমার ঘরে যেদিন প্রথম আলোচনায় বসলাম আমরা, সব শুনে বেদজ্যোতি বলল, " সৌম্য দা একটা কাজ করো দিকি, পোর্টালে ওনার একাউন্ট নম্বরটা একবার চেক করো তো -"। চেক করতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। খুব ছোট্ট একটা ভুল উল্টেপাল্টে গেছে দুটি সংখ্যা আর তার জেরে টাকা ঢুকে গেছে অন্য কারো খাতায়। দুই চারশ টাকা নয়, ৬৪ হাজার টাকা।
কি ভুল, কার ভুল সেই চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আগে মহানগরে চিঠি লিখি আমি, এই মুহূর্তে বন্ধ করা হোক নিদ্রা সামন্তের পেনশন। মহানগর সাফ জানিয়ে দেয়, আগে উদ্ধার করো ঐ টাকা, তারপর অন্য কথা। উদ্ধার করো বললেই তো আর উদ্ধার করা যায় না, আমরা নিছক সিভিল লোকজন, না আমরা অস্ত্রধারী পুলিশ না রিকভারি এজেন্ট। যাই হোক, অনেক খুঁজে পেতে দেখা যায় যে একাউন্টে টাকা ঢুকেছে, সেটি কোলঘাটের দেউলিয়া বাজারের ইন্ডিয়ান ব্যাংকের। ব্যাংকের সাথে কথা বলে বেরোয় একাউন্ট মালিকের নাম ঠিকানা। দেখা যায় তিনিও কোলাঘাটেরই বাসিন্দা, পঞ্চায়েতের নাম পুলসিটা।
এত বড় পঞ্চায়েত এলাকা, হাজার হাজার মানুষ, এর মধ্যে একজনকে খুঁজে বার করা কি মুখের কথা। পুলসিটা পঞ্চায়েতের SLO মিতাংশু বাবুর শরণাপন্ন হই আমরা। অসামান্য দক্ষতায় শুধু লোকটিকে খুঁজে বার করেন উনি তাই নয়, যোগাড় করে আনেন তাঁর ফোন নম্বর ও। অতঃপর? আমি বলি, চিঠি পাঠাও, যা হয়েছে তাতে তোমার আমার প্রত্যক্ষ কোন ভূমিকা নেই বটে, তবে আমরা যে সব জেনেও ফেলে রাখিনি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ থাকা জরুরী। সৌম্য কাকুতিমিনতি করতেই থাকে, " প্লিজ ম্যাডাম, একবার ফোন করি? মিতাংশু বাবু বললেন লোকটিও আমাদের স্কিমের বেনিফিশিয়ারি, বললে নির্ঘাত শুনবে -"।
শোনা তো দূরের কথা, লোকটির ভাই নাকি দাদা ফোন কেড়ে নিয়ে যাচ্ছেতাই কথা শোনায় সৌম্যকে। " দেব না টাকা, কি করবেন করে নিন"। দেয় হুমকি ও। সৌম্য নিরুত্তাপ গলায় একটাই কথা বলে যায়, " আপনার যা করার আপনি করতে পারেন,তবে সরকারের টাকা হজম করা এত সোজা নয়। আজ নয়তো কাল আপনাকে টাকা ফেরৎ দিতেই হবে। আমি ভালো কথায় বলছি, ম্যাডামের কানে গেলে উনি কিন্তু পুলিশ পাঠাবেন। গ্রামে থাকেন আপনারা, সকলের সামনে পুলিশ গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লে আপনাদের পরিবারের সম্মান থাকবে তো -"।
সত্যিই পুলিশের হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে আর পঞ্চায়েতকে জড়িয়ে একজনের টাকা উদ্ধার করেছিলাম আমরা। দিন তিনেক বাদে লোকটি ঘুরে ফোন করে সৌম্যকে, " স্যার আমার ভাই আপনার সাথে খুব খারাপ আচরণ করে ফেলেছে সেদিন। ক্ষমা করবেন আজ্ঞে -। কিন্তু ট্যাকা তো নাই। সে আমি খরচ করে ফেলিচি। ফেরৎ দিতে অপারগ - ।"
সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না বুঝে ওনার আধার নম্বর দিয়ে স্থানীয় ব্যাঙ্ক গুলিতে খোঁজ নিতে থাকি আমরা। একটা একাউন্ট উনি ফাঁকা করে দিয়েছেন তার মানে এই নয় অন্য কোন একাউন্ট নেই। দীর্ঘ সাড়ে তিন বছরে কিছু তো চিনেছি আমরা এই জেলার মানুষগুলোকে। এরা পূর্ব মেদিনীপুর হতে পারে, সৌম্য আর আমিও হাওড়া। পাশের জেলা, হাড়ে হাড়ে চিনি এদের। ঠিক বেরোয় অন্য একাউন্ট, সেখানে ঢোকে কৃষকবন্ধু ইত্যাদি প্রকল্পের টাকা। চিঠি দিয়ে ফ্রিজ করানো হয় সেই একাউন্ট। এবার যাবে কোথায় বাছাধন -
লোকটি এসে কেঁদে পড়ে সৌম্যর কাছে। সৌম্য বলে, " মনে করুন আপনি ধার নিয়েছেন সরকারের থেকে। শোধ আপনাকে দিতেই হবে। তফাৎ হল এক্ষেত্রে আপনাকে সুদটা দিতে হচ্ছে না।" লোকটি নিমরাজি হয়ে জানান, ফেরৎ দেবেন বটে, তবে গোটাটা নয়, কিছু কমসম করে দেবেন, দেবেন ১২টা কিস্তিতে। একেকটা কিস্তি জমা হবে তিন চার মাস ছাড়া ছাড়া। ইল্লি আর কি -
শেষে অনেক কাণ্ড করে তিন কিস্তিতে পুরো টাকাটা ফেরৎ দেয় লোকটি। তার জন্য অনেক অনুনয়-বিনয়, হুঙ্কার-চিৎকার, ইড়িমিড়ি বাঁধনের গপ্প ফাঁদতে হয় অবশ্য আমাদের। সে সব এখন অতীত। আপাতত মহানগর টাকা ফেরৎ পেয়ে, পুনরায় চালু করেছে নিদ্রাদেবীর পেনশন। ঐ ৬৪ হাজার টাকা শুধু তাই নয়, উনি পেতে চলেছেন বন্ধ করে রাখা বছর গুলির পেনশন এরিয়ারটাও।
যার জন্য এত লড়াই, তাঁকে একবার স্বচক্ষে দেখার লোভ যেমন আমার ছিল, আজ শুনলাম উনিও আমাকে দেখার জন্য ততোটাই ব্যগ্র ছিলেন। সৌম্য বলল, " আপনি কাল ফোন করে না আসতে বললে আমিই ফোন করতাম আপনাকে। টাকা ঢোকা ইস্তক এই মাসিমা রোজ ফোন করছেন আর আপনার কথা জিজ্ঞাসা করছেন।" আমরা হলাম পরিযায়ী পাখি, আজ এই জেলায়, কাল না জানি কোন জেলায়। উড়ে যাবার আগে এত জটিল একটা গ্রন্থি যে খুলে যেতে পারলাম এটাই সবথেকে আনন্দের। সৌজন্য অবশ্যই আমার টিম। টিমে খেলার এটাই মজা -
ছবিতে শ্রীমতী নিদ্রা দেবী এবং তার টাকা উদ্ধারকারী লোকজন 😊
অনির ডাইরি ২৪ শে জুন, ২০২৫
#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা
অনির ডাইরি জুলাই, ২০২৫
অনির (চুঁচুড়ার) ডাইরি ৩০শে জুলাই, ২০১৯
#ফিরেদেখা #অনিরডাইরি
প্রতিটা দিন, শুরু হয়, ঠিক একই রকম ভাবে। সেই ঘুম জড়ানো ভারি চোখ, মনের মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছা, আজ বেশ রবিবার। আর তারপর? ট্রেনে বিক্রি হওয়া মুচমুচে কচুভাজার মত ঝাল-নুন ছিটোতে থাকে জীবন।
সকাল ১১টা- “ম্যাডাম, কাল তারা এসেছিল। ঠিক আপনার অসাক্ষাতে। পাক্কা দেড় ঘন্টা ধরে, কি চিৎকার। বলেছে, এবার বেনিফিশিয়ারিদের এনে, আপনার চেম্বারে বসিয়ে বিক্ষোভ দেখাবে?”
“মানে? আমার ঘরে লোক ঢোকাবে? কে ভাই, সেই মহাপুরুষ? ঘরে লোক ঢোকাতে চাওয়াটা দেখছি গাঙ্গেয় হুগলীর মুদ্রাদোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
সকাল ১১টা ১৫- প্রবল ইচ্ছে করছিল বরকে ফোন করে নালিশ করতে,কিন্তু সক্কাল সক্কাল কাউকে ভুঁড়ি নাচিয়ে হাসাতে চাই না। তাই তীব্র ইচ্ছে দমন করে, তাঁকে ফোন লাগালাম, যাঁর ভয়ে আমার তিন তিনটে ইন্সপেক্টরের মুখ কালো হয়ে আছে। ব্যাটারা আবার বলছিল, আমায় নাকি ট্রেনিং করে রোগা এবং কালো লাগছে। ভদ্রলোকের ফোনটা বেজে গেল, যাই হোক।
১১টা ৩০- “ম্যাডাম, আঠারোটা ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয় হারিয়ে গেছে।”
- মানে? কোথায় গেছে? বেড়াতে? ১৮জন একসঙ্গে বেড়াতে গেল? খুঁজেছো?
- “ম্যাডাম শুভজিৎ ধীমানকে দিয়েছিল।”
-“না ম্যাডাম আমায় দেয়নি। আমায় দিলে আমি কোনদিন হারাই? আমি সব গুছিয়ে রেখেদি কি না বলুন? নির্ঘাত রমেশকে দিয়েছিল।”
-“বাঃ তা শুভজিৎ, রমেশ এণারা সব কোথায়?”
-“শুভজিৎ পুজো করছে।”
-মানে?
-“ছুটি নিল যে, হোয়াটস্অ্যাপে।”
বাঃ। তা ফাইলগুলো দিয়ে কি ধুনো দিচ্ছে?
-“ম্যাডাম আমি কতবার বলেছি, আমায় দিতে, আমি সব গুছিয়ে রাখি।”
ঝগড়া থামাবে তোমরা? আমি বলে সদ্য শিখে এলাম-নো ব্লেম গেম- নো স্কেপগোট। কোথায় কোথায় খুঁজেছো? চল আমার সামনে খুঁজবে চলো।
১২টা- “হ্যালো ম্যাডাম,আপনি ফোন করেছিলেন, সরি আমি ধরতে পারিনি, একটু ইয়ে করছিলুম। ”
“বেশ করছিলেন। আরে আয়াম সরি, আপনি আমার অসাক্ষাতে আমার অফিসে ডেপুটেশন দিয়ে গেলেন, আমি থাকতে পারলুম না। আপনি একাই আমার তিন তিনজন ইন্সপেক্টরকে আমার অসাক্ষাতে চমকে গেলেন, হ্যাঁ গো,তা আপনারা নোটিশ দিয়েছিলেন? কই দেখিনি তো? মারের আগে ধাক্কা তো দেবেন?”
- “কি যে বলেন ম্যাডাম। আপনাদের সঙ্গে আমার কত ভালো সম্পর্ক। আপনারা কত হেল্প করেন।” “তাই বলে ওসব ছেলেপিলে ঢোকানোর গল্প করে যাবেন? আমি না হয়, মজা পেয়েছি,তবে,আমি আর কদ্দিন বলুন তো। এবার ট্রেনিং এ পাঠাক, আমি আর ফিরব না। ”
-“হেঃ হেঃ! ম্যাডাম আপনাকে যেতে দিলে তো।রাগ করছেন কেন? ও তো কথার কথা। ওসব একটু বলতে টলতে হয়। বুঝলেন কি না। আপনি ট্রেনিং এ ছিলেন, তাই দেখা হল না। আপনি মিষ্টি খেতে চেয়েছিলেন, এবার গেলে নিয়ে যাব। রাগটাগ করবেন না। ”
১২টা৩০- “সঞ্চিতা, চিন্তা নেই,অমুক বাবু মিষ্টি নিয়ে আসছেন। ছেলেপিলে আনছেন না। এই, তুমি পাহাড়ে চড়ে কি করছ?”
- “ফাইল খুঁজছি ম্যাডাম। আপনি বললেন তো।”
-"তাই বলে ধুলোর পাহাড়ে কে চাপতে বলল। শেষে বস্তা চাপা পড়ে মরবে নাকি?”
-“না ম্যাডাম, এই দেখুন ছটা ফাইল পেয়েছি।"
- "বাঃ গুড গার্ল। ধীমান-কৌশিক কিছু শেখো মাইরি তোমরা। সঞ্চিতা আমার একাই দশ শ।”
- কৌশিক বলে “ম্যাডাম, দাঁড়ান। কাল আমি ময়দানে নামব। সব বস্তামস্তা বিদেয় করে ছাড়ব। ধুলোর আখড়া যত।”
বেলা ১.৩০- "রমেশ তোমাকে যে ফাইলটার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেটা রেডি হয়েছে?“
-"শুনুন না ম্যাডাম, আমি সব গুছিয়ে সঞ্চিতা ম্যাডামকে দেখিয়ে ফাইলটা রাখলাম, আর খুঁজে পাচ্ছি না।
-” বাঃ। এটা তাহলে উনিশ নম্বর। সাত দিন। মাত্র সাতদিনের জন্য ট্রেনিংএ গেছিলাম রে বাপ, তোমরা তার মধ্যে আর কি কি হারিয়েছো? একটা লিস্ট করে দাও হ্যাঁ। বার বার আমি জানতে চাইব, তোমরা এক এক করে শোনাবে,~ কাঁহাতক সহ্য হয় বাপ?
বেলা ২.৩০- “হ্যালো ম্যাডাম, চিঠি পেয়েছেন?"
- "আবার? আর কত চিঠি লিখবেন অমুক বাবু? আমি চাপা পড়ে যাব যে। ডিসপিউট চলছে তো। একটু ভরসা রাখুন না। উল্টো পার্টিকেও একটু ভাবতে দিন। এভাবে পত্রাঘাত করলে খেপে যাবে না? ”
-“না ম্যাডাম। চিঠি আমারই। তবে আইনটা আলাদা।”
-“ওরে বাবা, আবার নতুন আইন পড়াবেন?”
বেলা ৩.৩০-“হ্যালো সুকন্যা। এই আইনে কাজ করেছো?”
-“হ্যাঁ। ”
- বাঃ। সাধে কি তোমায় ফোন করি। শালা সবজান্তা মাইরি। এবার বলো দেখি সোনামণি কি করতে হবে। ”
-“পড়ে দেখ। ”
- ছিঃ এমন করে দর বাড়াতে আছে? পড়েছি তো। বুঝতে পারলে আর তোমার কি প্রয়োজন। বলো না বাপ-।”
৪টে- “হ্যালো অমুক বাবু, শুনুন। আপনার এই পাঁচ গণ্ডা চিঠির ওপর আরো গুটি ছয়েক অ্যাপ্লিকেশন লাগবে। ফর্মটা কাল এসে নিয়ে যাবেন।”
-“ আরো ছয় কপি? আমায় যে অমুক বলল-”।
-“ধুর বাবা। আপনাকে কে বলেছে জানি না, আমায় খোদ আইনের বই বলেছে। জ্যান্ত সরস্বতী বাবা। ভুল বলে না। এবার দয়া করে,আপনি আসুন। আর একদম চিঠি লিখবেন না। ”
৫টা৩০-“দিদি, কাল আসব।”
- “আচ্ছা। কেন বলো তো?”
-“সেই যে সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্টের কেসটা-”।
- “অ্যাঁ? কোন কেস? কে কাকে হ্যারাজ করল। ধুর বাবা, মনে পড়ছে না কেন?”
- “না। না। দিদি, হ্যারাজমেন্ট অ্যাট ওয়ার্ক প্লেস অ্যাক্টটা নিয়ে বলতে বলেছিলাম না, রেকর্ড করে নেব। ”
-ওঃ। বাঁচলাম।
এইভাবেই অর্ধেকটা দিন কেটে গেল, এবার বোধহয় বাড়ি যাবার পালা। সেখানে আবার অঘটনঘটনপটিয়স তথা তাঁর কন্যা, কি পাকিয়ে রেখেছেন কে জানে? তবে সে তো অন্য গল্প। আপাততঃ অনেক হয়েছে বাপ। বাড়ি যাই।
(ছবিতে সেদিনের পাত্রপাত্রী বৃন্দ )
অনির ডাইরি ২৬ শে জুলাই, ২০২৫
#অনিরডাইরি
জন্মদিন নিয়ে আমার মেয়ের আবেগপ্রবণতা বরাবরই একটু বেশী। মধ্যরাতে চমকে দেওয়া সেলিব্রেশন, দূরাভাসে আপনজনেদের আশীর্বাদ মাখা উষ্ণ কণ্ঠস্বর, বন্ধুদের টুকটাক মেসেজ, দুপুরে মায়ের হাতের পঞ্চব্যঞ্জন, সস্তা হলেও ছুটকোছাটকা কিছু উপহার এই আর কি। কিন্তু তার জন্য একটা ঠিকঠাক দিনে জন্মাতে হয় বাপু। ফি বছর তেনার জন্মদিনে ডুবে বসে থাকেন কল্লোলিনী। বিগত চার বছর পূর্ব মেদিনীপুরে থাকার দরুণ, জলমগ্ন কলকাতার অভিজ্ঞতা আমরা ভুলতে বসেছিলাম প্রায়। তাই এবার বুঝি সুদেআসলে বুঝিয়ে দিল প্রকৃতি।
দুদিন আগে থেকেই ঘোর নিম্নচাপ, কত সাধ করে লিস্ট বানিয়েছিলাম আমি, কি কি রান্না হবে, কি কি কিনতে হবে, ভেস্তে গেল সবকিছু। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত তাঁর ইস্কুল ঘোষণা করল, জন্মদিনের দিনই হবে পেরেন্টস টিচার মিটিং। যাঃ বাবা, তাহলে রান্না করব কখন? আর যাবই বা কি করে, বিগত দুই দিন ধরে তো আমাদের ফ্যান্সি আবাসনের সামনে এক হাঁটু জল। রান্নার দিদি, বাসন মাজার দিদি কেউ আসতে পারছে না।
ঠিক করলাম, যাবই না। এমনিতেই তিনি পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা, তারওপর সবে নতুন ইস্কুলে ভর্তি হয়েছেন, এখনই আর অত কি জানাশোনার আছে। কিন্তু কমলি ছাড়লে তো! দিদিমনি খোদ আগের দিন ফোন করে অনুরোধ করলেন, " প্লিজ আসুন।"
শৌভিক বলল, "ছেড়ে দে, এবার আর অত কিছু করতে হবে না। স্কুলে যেতেই হবে যখন, বাইরে কোথাও খেয়ে আসব।" তিনি মুখে বললেন বটে, " তোমরা যা ভালো বোঝ" মনে মনে যে খুশি হলেন না, সেটা একটা গোলাপী তুলোর ভাল্লুককে পেটে চিমটি কাটা দেখেই বুঝতে পারলাম। শৌভিক পুনরায় প্রস্তাব দিল, " ঠিক আছে, তাহলে রবিবার সেলিব্রেশন হোক। আবহাওয়া দপ্তর তো বলছে ঐ দিন কেটে যাবে নিম্নচাপ। আপাতত তো বাড়িতে কিছুই তেমন নেই -"। বেচারী গোলাপী ভাল্লুক, কথা বলতে পারলে নির্ঘাত, " বাবা গো" বলে চিৎকার করত। মোদ্দা কথা এই প্রস্তাব ও নাকচ।
এই করতে করতে দুপুর গড়িয়ে হল সন্ধ্যা, সন্ধ্যা বিদায় নিয়ে নামল রাত্রি। আমাজন থেকে জোমাটো সকলেই জানিয়ে দিলে আমাদের বন্যাপ্লাবিত ন্যুভরিশ এলাকায় ডেলিভারি দিতে তাঁরা অপারগ। কাঁদকাঁদ তিনি, এরই মাঝে তাঁর ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষক মহাশয় ফোন করে জানালেন, জল জমেছে তাই তিনি আসতে অপারগ বটে, তবে পড়ার ছুটি নেই। আজকের পড়া হবে গুগল মিট এ। আকাশ, বাতাস, মেঘ, কলকাতা, সুইগি, জোমাটো হয়তো বা শৌভিক আর আমার মুণ্ডুপাত করতে করতে তিনি ঘরের দোর দিয়ে পড়তে বসলেন।
ইত্যবসরে আমি শৌভিককে বললাম, " যা বাবা, গিয়ে অন্তত দুধ আর গোবিন্দ ভোগ চালটা তো নিয়ে আয়। লম্বা লোক আছিস, আমার মত ডুবে তো যাবি না।" তিনি জানতেও পারলেন না, বাবা কখন প্যান্ট গুটিয়ে ছাতা বগলে বাজার করতে বেরোল। শুধু মা নয়, বাপ হওয়া ও কি মুখের কথা!
পড়া শেষে নিমপাতা চিবানো মুখে বেরিয়ে যখন দেখলেন ঘন দুধ আর সুগন্ধী গোবিন্দভোগ চালের মিশ্র গন্ধে সারা বাড়ি সুরভিত, ঘোর কৃষ্ণ মেঘের ফাঁকে ফুটল হাল্কা আলোর রেখা, " যাক পায়েসটা অন্তত হচ্ছে।"
শুধু কি পায়েস, হচ্ছিল আরও অনেক কিছু। এলুমিনিয়ামের কড়াইয়ে চাপাচুপি দিয়ে বেক হচ্ছিল কেক। আলমারির মধ্যে খচমচ করছিল তাঁর প্রিয় ফ্লেভারের নাচো চিপস্। আপিসের ব্যাগে ঘাপটি মেরে বসে ছিল তমলুক থেকে কিনে আনা একরাশ রংবেরঙের টফি আর চকলেট। শৌভিকের জামাকাপড়ের তাকে লুকিয়ে ছিল প্লাস্টিকে মোড়া সস্তার লাবুবু পুতুলখানা। ডিনারে ছিল তাঁর মন মত প্রচুর চীজ দেওয়া গার্লিক বাটার চিকেন। ফ্রিজে যেটুকু মাংস ছিল করেই ফেললাম, কালকের চিন্তা কাল করব ক্ষণ।
মধ্যরাতে যখন সবকিছু সাজিয়ে দিলাম, তাঁর আনন্দের আর সীমা পরিসীমা রইল না। তারওপর আবার পাক্কা বারোটায় কাকিমা আর বোনের ফোন, শ্রীমতী ফুলঝুরি যে ঝুঁটি নাড়িয়ে কি বললেন, তুত্তুরী দিদি তো গলে পড়েই গেলেন। একরাশ আশীর্বাদ আর ভালবাসা নিয়ে হাওড়া থেকে ফোন করল বৃদ্ধ দাদু,দিদা আর মাসি। বুড়োবুড়ির জীবনটাই যে আবর্তিত হয় শ্রীমতী তুত্তুরীকে কেন্দ্র করে। ফটোক্রাউড এর একবছরের মেম্বারশিপ উপহার দিল বাবা। নে ব্যাটা, যত খুশি ছবি তোল আর পোস্ট কর। সারা বছর এই ভাবেই আপনজনদের ভালোবাসায় সিক্ত থাকুক মেয়েটা, সর্বশক্তিমানের কাছে এটাই কামনা। থাক না আরও কিছু বছর এমনি শিশু হয়ে, আমার বুকের কাছে। বড় হবার জন্য তো পড়ে আছে, অনন্ত জীবন।
পুনশ্চঃ শ্রীমতী গুগল লেন্সে ফেলে দেখে জানালেন, গোলাপী ভদ্রমহিলাটি লাবুবু নয়, এমনকি তার সস্তার প্রতিরূপ লাফুফু ও নয়। তিনি এমনি গোলাপী প্লাশ টয় বটেক। তাতেও তাঁর উল্লাসের সীমা নেই বটে, তবে মাইরি আমাজন, গরীব মানুষকে এমন ভাবে বোকা বানাবে ভাই 👹।
অনির ডাইরি ১৫ই জুলাই, ২০২৫
#অনিরডাইরি
একদম ইচ্ছে করছিল না বেরোতে। সারাটা সপ্তাহ তো বাড়ির বাইরেই ছিলাম, শনিবারও অধিবেশনে সমবেত হতে হয়েছিল। বর- মেয়ের সাথে একটা দিনও কাটাতে পারলাম না এই সপ্তাহে, ভেবেই বুকের মধ্যে জমছিল ভরা শ্রাবণের মেঘ।
ঠিক ছিল বারোটায় জমায়েত হবে, ঘড়ি ধরে বারোটায় নামল মুষল ধারে বৃষ্টি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে স্নানে গেলাম, এযাত্রা দোষটা অন্তত বৃষ্টির ঘাড়ে চাপানো যাবে। পৌনে একটা নাগাদ যখন একটা দুরন্ত সেলফি দিয়ে মেসেজ করল সঞ্চিতা, " কি রে তোরা কোথায়"? আমি তখন সবে জুতোয় পা গলিয়েছি, শৌভিক পিছন থেকে বলেই যাচ্ছে, " শোন কিপটেমি করিস না। ভালো কথা বলছি, ক্যাব নিয়ে নে। আমার একটা ৫০০ টাকার কুপন আছে, ওতে তোর হয়ে যাবে -"।
রাজপথে নেমে দেখি পিলপিল করছে মানুষ আর গাড়ি। হে ঈশ্বর রবিবার দুপুরে এত মানুষ রাস্তায় বেরোয়? ক্যাব নেব কি নেব না ভাবতে ভাবতেই বাসটা এসে গেল, L মার্কা লিমিটেড স্টপের বাস, আমার সামনে দাঁড়াবার কথা নয়, তাও যখন দাঁড়িয়ে গেল আর কন্ডাক্টরটা এক গাল হেসে বলল, " দিদি যাবে নাকি, হাওড়া হাওড়া -", উঠেই পড়লাম। ওঠার সাথে সাথেই বাসটা যেন পক্ষীরাজ হয়ে উঠল, আর একটু হলে পড়েই যাচ্ছিলাম।
দিন কয়েকের জন্য হাওড়া যাচ্ছি, এবেলা বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ, ওবেলা বাবার জন্য গলা ফাটাতে হবে এক বৈঠকে, কাল থেকে অফিস। তাই এক কাঁধে আমার আপিস ব্যাগ, অন্য কাঁধের ভারী ব্যাগে ঠুসেঠুসে ভরেছি ঘরে, বাইরে পরার পোশাক আর দৈনন্দিন আবশ্যক সামগ্রী। শৌভিককে জানিয়ে দিই বাস পেয়ে গেছি, বন্ধুদের ধারাবিবরণী দিতে থাকি কতদূর এলাম, " লেকটাউন - উল্টোডাঙ্গা - মানিকতলা - গিরিশপার্ক "।
হাওড়া স্টেশনে যখন নামলাম, ঘড়ি বলছে বেলা দুটো। আবার মুখ ভার হচ্ছে আকাশের, বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে মিহি জলকণা। অস্বাভাবিক ফাঁকা হাওড়া, যাও দুই একটা বাস আসছে, কয়েকজন ঢুলঢুলে যাত্রী নামছে আর গায়েব হয়ে যাচ্ছে স্টেশনের ভিতর। আমার বাড়ির বাস আর একটা আসে না। শৌভিক বলে, "সে নাই আসুক, তোর পয়সা তো বাঁচল 😡।" অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে হাওড়া ময়দানের বাস ধরি, বাকিটা না হয় টোটো করে যাব। শৌভিক মেসেজ করে, " আমরা খেয়ে উঠলাম, তবে তুই আর আজ খেতে পাবি না। তিনটে অবধি কে তোর জন্য না খেয়ে বসে থাকবে -!"
হাওড়া ময়দানে যখন নামলাম, আড়াইটে বাজছে। ভালো মত বৃষ্টি পড়ছে। সত্যি কেউ আর অপেক্ষা করবে না আমার জন্য, বাকিদের বাড়ি ফেরার সময় গিয়ে পৌঁছাব আমি। বিমর্ষ ভাবে একটা টোটো ধরি। "কেদামতল্লা কেদামতল্লা" হেঁকেই যাচ্ছে বৃদ্ধ রিকেটি অবাঙালি টোটোয়ালা, গাড়ি আর ছাড়েই না। অবশেষে বিশাল বড় গিটার নিয়ে ওঠে একটা মেয়ে, একটু পরে বাজারের ব্যাগ হাতে ওঠে এক দম্পতি তবে ঘোরে চাবি। পঞ্চাননতলা দিয়ে ঢোকার সাথে সাথে দৌড়ে আসে গোটা তিনেক লাল গেঞ্জি পরা অবাঙালি ছেলে। " কিধার যাস" বলে একজন চেপে ধরে টোটোর হ্যান্ডেল, অন্যজন বুড়োর শতছিন্ন কালো গেঞ্জির গলা। আর একজন হিন্দি মিশ্রিত বাংলায় আমাদের বলে, " এটা এই রুটের গাড়ি নয়। নেমে যান, ঐ গাড়িতে বসুন।" বাজার ব্যাগ হাতে দম্পতি সুড়সুড় করে নেমে যায়। গিটার হাতে মেয়েটি আর আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। এই ভীমভবানী দুটো ব্যাগ আর ভিজে ছাতা নিয়ে নামা বেশ কষ্টের।
ভাবতে ভাবতেই একটা ছেলে এগিয়ে এসে টোটোর চাবি খুলে নিতে যায়। এতক্ষণ দুর্বল তর্ক করা বৃদ্ধের গায়ে হঠাৎ যেন সওয়ার হয় সহস্র সিংহের বল, " আব্বে চল, কালকে ছোকরে -" বলে গেঞ্জির গলা চেপে ধরা ছেলেটার হাত মুচড়ে, টোটোর হ্যান্ডেল চেপে ধরা ছেলেটার গালে সপাটে এক চড় মেরে ছুটিয়ে দেয় গাড়ি। পিছন পিছন দৌড়োয় তিন লাল গেঞ্জি, বর্ষিত হয় অসংখ্য "চ" ওয়ালা শব্দ, কিন্তু আমরা ততক্ষণে সব ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
শৌভিকের ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যে প্রমাণ করে পৌনে তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাই গন্তব্যে। নামার সময় বুড়োকে বলি, "ভাগ্যে তুমি গাড়ি ছেড়েছিলে দাদা, নইলে এখনও বসে থাকতে হত ওদের টোটোয়।" বুড়ো হেসে বলে, " ঘুরিয়ে গালি হামিও দিতে পারতাম দিদি, তুমাদের দুজনের জন্য দিই নাই। মেয়েদের সামনে গালি দিতে হাম শিখা নাহি।"
বুড়োকে 'খুব ভালো থেকো' বলে, গুটি গুটি এগোই দেবুর বাড়ির দিকে। দেবু আমার ছোট্টবেলার ইস্কুলের বন্ধু। আমাদের গলির উল্টোদিকে বিশাল খাঁয়েদের বাড়ি। আমাদের সাবেকি মহল্লার অন্যতম অভিজাত পরিবার ওরা। খুব ছোটবেলায় একবার এসেছিলাম ওদের বাড়ি জেঠু আর জেঠিমার সাথে। কার যেন অন্নপ্রাশন ছিল। ধূসর হলেও সেই স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে বিশাল সিংহদুয়ার, চক মেলানো উঠান, উঠানকে ঘিরে গথিক প্যাটার্নের বাড়ি, বার্মাটিকের সাবেকি আসবাবপত্র। সেই বিশাল বাড়ি আপাতত ভাগ হয়েছে নানা শরিকে, অনেকেই বদলে ফেলেছেন তাদের প্রাক্তন রূপ, বদলায়নি কেবল দেবুদের অংশটা। আমার বাবার মতই, কাকু অর্থাৎ দেবুর বাবাও বাঁচিয়ে রেখেছেন সাবেকিয়ানাটুকু। নাই ডুবুক ঘটি, তাও তো তালপুকুর।
রাজপথ থেকেই উঠে গেছে চারধাপ সিঁড়ি, সিঁড়ি দিয়ে উঠে একফালি লম্বা রোয়াক, রোয়াকের ওপর গাঢ় খয়েরি রঙের ভারী দরজা। দরজার পাশে একটা ঝলমলে পোশাকের দোকান। দোকানটা নতুন হয়েছে। আগে এটাই ছিল কাকু অর্থাৎ দেবুর বাবার ওষুধের দোকান। দেবুর ঠাকুমার নামে দোকানের নাম ছিল রাধা, ফার্মেসি না মেডিক্যাল আজ আর মনে নেই। আমাদের মেয়েবেলায় এই গোটা চত্বরে একটাই ওষুধের দোকান ছিল। ডাক্তারও ছিলেন একজন, ডঃ দলুই। আমার পিসতুতো ভাই বলত 'দৈলে ডাক্তার '। আদতে তিনি ছিলেন হাড়ের ডাক্তার, তবে জ্বর, জ্বালা, পেটখারাপ সবেতেই সবাই ভিড় করত ওনার চেম্বারে। তারপর ওনার প্রেসক্রিপশন নিয়ে সোজা রাধায়। উঁচু চৌকাঠ ডিঙিয়ে একটা মস্ত ঘর, ছাদ জোড়া কড়ি আর বরগা আর দেওয়াল জোড়া কাঁচ লাগানো কাঠের আলমারি। আলমারি ভর্তি ওষুধ।ঘরটাতেও ছিল একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধ। একটা আধ মানুষ সমান মস্ত কাঠের পার্টিশনের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকতেন কাকু, গেলেই জুড়তেন গল্প। সবথেকে বেশী ভাব ছিল আমার পিসির সঙ্গে। বুড়ি পিসি আজও বলছিল,' দীননাথের বাড়ি যাবি! খুব ভালো ছিল রে ছেলেটা। নিজের দিদির মত ভালবাসত আমায় -"।
মিহি বৃষ্টির স্পর্শে শৈশব থেকে বাস্তবে ফিরি, ভারী কাঠের দরজা ঠেলে ঢুকি খাঁয়েদের বৈঠক খানায়।সেই উঁচু করিবড়গা ওলা ছাত, সাদা ধপধপে চুনসুরকির মোটা দেওয়াল। মেঝেতে ফরাশ পেতে বসেছে তারাদের জমজমাট আড্ডা। আমাদের ইস্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন, আমরা প্রাক্তনীরা আজও নিজেদের "তারা" বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। চৌকাঠ ডিঙানোর সাথেসাথেই পড়ে যায় শোরগোল, "এত দেরী করলি কেন?" জুতো খুলে, ভারী ব্যাগটা রেখে, জমিয়ে মাটিতে বসতে বসতে বলি, " বলছি, বলছি সব বলছি। আগে বলতো ব্যাটারা, আমায় ফেলে খেয়ে নিসনি তো?"
ছবিতে - এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যা নামার মুখে দেবুদের সাবেকি বাড়ির দোতলায় আমরা
অনির ডাইরি ১২ই জুলাই, ২০২৫
#অনিরডাইরি
সময় বড় অমূল্য। মুঠোয় ভরা বালির মত কোথা দিয়ে যে হারিয়ে যায় ব্যাটা। বুকের মধ্যে রেখে যায় এক অচেনা ধড়ফড়ানি। এক কাপ কালো কফি নিয়ে বসেছি মেয়ের রুটিন বানাতে। স্কুলের নয়, বাড়িতে পড়ার রুটিন। দিন বারো হল তিনি নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছেন। মাস পুরোলেই তাঁর ষাণ্মাষিক পরীক্ষা, বিশাল তার সিলেবাস, কি যে করবে মেয়েটা ভেবে আমার হাত পা পেটে ঢুকে যাচ্ছে।
যা হোক একটা বানিয়ে, তাঁকে বুঝিয়ে উঠতে উঠতেই বেজে গেল বেলা সাড়ে নয়। এখনও স্নান, পুজো, প্রাতরাশ কিস্যু হয়নি। এদিকে সাড়ে দশটায় বেরোনোর কথা, এগারোটা নাগাদ শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে অপেক্ষা করবে সুকন্যা। আজ আমাদের আধিকারিক সংগঠনের বার্ষিক অধিবেশন। ভেবেছিলাম শাশুড়ি মাতার দেওয়া ঘি রঙের সিল্কের শাড়িটা পরে যাব, কিন্তু গত সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সেই পরিকল্পনা ত্যাগ করেছি। গোটা মহানগর জুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে মেট্রোরেলের জাল আর সেই সৌজন্যে আমাদের বাড়ির সামনে পচপচ করছে মাটি আর কাদা। কি যে পরি, গাঢ় রঙের গোটা দুই শাড়ি বার করে রাখি, শেষ সিদ্ধান্ত আমার বর নেবে। শৌভিককে গোটা দুয়েক শাড়ি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলে ও ঠিকঠাক বলে দেয়, তবে তার বেশি দেখালেই মাথা চুলকায় আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রেগেও যায় অনেক সময় -
বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, রান্নার দিদি বার দুই জিজ্ঞাসা করল, " কি রান্না হবে বৌদি? মাছ তো নেই -"। মাছ আনতেই তো গেছে আমার বর, সেই সাত সকালে থলে হাতে নাচতে নাচতে। মাছ দেখলে পাগল হয়ে যায় লোকটা, প্রচুর দরাদরি করে, তারপর একগাদা বিভিন্ন রকমের মাছ কিনে আনে। আজ এত দেরী হচ্ছে মানে নির্ঘাত মাছ কেনার সাথে সাথে শরীরচর্চাটাও করে নিচ্ছে, হাঁটতে হাঁটতে গেছে দূরের বড় বাজারে।
স্নান করতে যাবার আগে বাবাকে ফোনটা করে নিই। নানা কারণে বিগত সপ্তাহ থেকে খুব বিমর্ষ আছে বাবা, তাকে খানিক ভোকাল টনিক খাওয়াই। বয়স হয়ে গেলেই কেন যে মানুষ এত অসহায় বোধ করে। দুই তিন রকম মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরেন আমার বর। " আজ দুবেলাই মাছ ভাত হোক, ওবেলারটা তুই রাঁধবি" গদগদ হয়ে বলেন তিনি। স্নান সেরে বেরোতেই সাড়ে দশ, এখনও পুজো, প্রাতরাশ, তৈরি হওয়া কত কিছু বাকি। মনখারাপ করে ব্যাচের গ্রুপে সুকন্যাকে মেসেজ করি, " তুমি চলে যাও, আমি যে কখন বেরোব -"।
জবাবী মেসেজ আসে, " আরে চাপ নিও না। আমি এখন ছেলের টিফিন পৌঁছাতে যাচ্ছি সল্টলেক, আমারও অনেক টাইম লাগবে।" সরস্বতী মেসেজ করে, " আরে টেনশন করিস না। আমি সবে হাসপাতালে এসেছি শ্বশুরমশাইকে দেখতে, আমারও পৌঁছাতে বহু দেরী।" মনটা ভালো হয়ে যায়, সাধে আমাদের তিনজনের এত মিল।
অবশেষে বেরোলাম বটে, রাস্তায় অকথ্য জ্যাম। মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে দেখি সেন্ট্রাল স্টেশনে কেউ আত্মহত্যা করেছে, আপাতত স্তব্ধ কলকাতার জীবনরেখা। ভাগ্যিস সুকন্যা ছিল - ।
আড্ডা গল্প, ভুরি ভোজে দিনটা কিভাবে যে কেটে গেল। একসাথে অনেকটা পথ হেঁটে মেট্রোয় উঠলাম প্রায় জনা পঁচিশ জন। কে যেন হেসে বলল, একটা কামরা রিসার্ভ করে নিলে মন্দ হত না।পৌনে পাঁচটা নাগাদ বাড়ি ফিরে দেখি এরা বাপমেয়েতে বাতনুকূল যন্ত্র চালিয়ে মহানন্দে দিবানিদ্রা যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি ফেরায় শাশুড়ি মাতা অবশ্য বেপোট খুশি - ।
সন্ধ্যার চা বানাতে গিয়ে দেখি, আমার সাধের কাপের সেটের একটি কাপ ভাঙা। বছর ছয়েক আগের বিবাহবার্ষিকীতে সেটটা উপহার হয়েছিলেন স্বর্গীয় শ্বশুরমশাই। এতদিন তুলেই রেখেছিলাম সেটটা, কেন যে বার করতে গেলাম। আয়াদিদি নিজেও অত্যন্ত লজ্জিত, বার বার বলছেন, " খুব ভুল হয়ে গেছে দিদি, একটা টানতে গিয়ে আরেকটা পড়ে গেল-"।
একরাশ মন খারাপ নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। বুকের কাছে ঝনাৎ করে কি যেন পড়াতে ভেঙে গেল ঘুমটা। চোখ খুলে দেখি ঠাকুরের মিছরি। তিনদিন ধরে তাকে আনতে বলছি, আর তিনি বলছেন, " কেন তুই রাস্তায় বেরোস না? তুইও তো আনতে পারিস -"। 'তুমি, না আমি'র চক্করে কাল থেকে উপোসী থাকতে হত ঠাকুরকে। বুঝতে বাকি থাকে না, নেহাৎ আমার মন খারাপ, তাই এনে দিল -
ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা, ঘুম চোখে ফ্রিজ থেকে মাছ বার করি। হে ভগবান এতো পুরো পাথর হয়ে আছে প্রভু। সময়মত বর বাচ্ছাকে খেতে দিতে পারব তো -। "গরম জল ঢেলে দে না" পেছন থেকে বিশেষজ্ঞ মতামত দেয় আমার বর। ঘুমটা এখনও কাটেনি, টলমল করছে মাথা, তাও পড়তে বসাই মেয়েটাকে। আমি গর্বিত বাংলা মিডিয়াম, পলিনেশন এন্ড ফার্টিলাইজেশন পড়াতে গিয়ে বারবার পরাগ, পরাগরেণু, পরাগধানি বলে ফেলি আমি। গর্ভমুণ্ড শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ে তুত্তুরী - ।
এনভায়রনমেন্ট অ্যাপ্লিকেশন পড়াতে পড়াতেই বেজে যায় সাড়ে আট। মুঠোয় বালি ধরার অনুভূতিটা পুনরায় ফিরে আসে আমার বুকের মধ্যে। হে ভগবান এখনও কত কাজ বাকি, আলুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে চিপকো আন্দোলন বোঝাই আমি। ভাতের হাঁড়ি চড়াতে চড়াতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্যের সম্পর্ক খোলসা করে বলি আমি। তাও যেন হয় না। মাছের কড়া চাপিয়ে দৌড়ে যাই তার কাছে, যার আমি অর্ধাঙ্গিনী, যিনি ঘণ্টা দেড়েক আগে মিছরির প্যাকেট ছুঁড়ে আমার ঘুম ভাঙিয়ে ছিলেন, তাঁর কাছে। তিনি আপাতত বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে জমিয়ে ইংক ব্ল্যাক হার্ট পড়ছেন। গিয়ে বলি, " ওগো প্লিজ একটা উপকার করে দাও। আমি তোমার জন্য বেগুন, কালো জিরে আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে পাতলা মাছের ঝোল বসাচ্ছি, তুমি প্লিজ মেয়েটাকে একটু ডাইরেকটিভ প্রিন্সিপলস অফ স্টেট পলিসিটা পড়িয়ে দাও।"
তিনি একগাল হেসে জবাব দেন, " কাল পড়িয়ে দেব বেশ।" বলি মেয়েটা যে ফেল করবে পরীক্ষায়, তিনি সাধুসন্তের মত প্রবচন দেন," আরে পাশ তো সবাই করে। ফেল কে করে বলতো? ঐ একজন দুজন, ভাব ও সেই একজন দুজনের মধ্যে থাকবে-"। এই কথার কি জবাব দিই আমি।এই কথার কোন জবাব হয়? হয় না। তবে বেগুন - কালো জিরে - কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাছের ঝোলে হিং, দারচিনি আর ছোট এলাচ তো দেওয়াই যায়, একটু বেশী করে। বিশেষ করে তার জন্য, যে এগুলো দুচক্ষে দেখতে পারে না -।
অনির ডাইরি ১০ই জুলাই, ২০২৫
#অনিরডাইরি
অবশেষে ট্রেন পেলাম। ঝাড়া আধ ঘন্টা পুতিগন্ধময় দাশনগর স্টেশনে পায়চারি করার পর। মাইরি,এর জন্য সাতসকালে উঠে কাকস্নান সেরে, নাকে মুখে গুঁজে দৌড়ে আসা? বিগত আঠারো বছরে স্টেশনটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, নতুন প্লাটফর্ম হয়েছে, পুরান প্লাটফর্মগুলো দৈর্ঘ্যে এবং উচ্চতায় বেড়েছে, নতুন সিঁড়ি, বসার জায়গা, শৌচালয়, পানীয় জলের কল সব হয়েছে। শুধু পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমটা একই আছে। আগেও কোন ঘোষণা হত না, আজও হয় না। হুড়োহুড়ি করে ফাঁকা ট্রেনে উঠে সিট দখল করে খেয়াল হল, একবার শুধিয়েই নিই, মেদিনীপুর লোকাল এত ফাঁকা কেন!
ওঃ হরি, এটা আমতা লোকাল। যে দিদিমনিকে শুধিয়েছিলাম, তিনি সাবধান করলেন, "এখনি ছাড়বে, নামতে যাবেন না। রামরাজাতলায় নেমে যাবেন।" দক্ষিণ পূর্ব রেলের ওপর ভরসা রেখে নেমেই পড়লাম, পিছন পিছন আরেক ভদ্রমহিলাও নামলেন। নেমে চোখে চোখ পড়তেই একগাল হেসে শুধালেন, " কোথায় যাবে দিদি?" সাতসকালে এই জঘন্য নোংরা ইস্টিশনে দাঁড়িয়ে খেজুরে গল্প করতে একদম ইচ্ছে করছে না, কেজো গলায়, " মেছেদা" বলে সরে গেলাম।
ভদ্রমহিলাকে দেখেই মনে হয়েছিল গপ্পে বুড়ি, কর্মক্ষেত্রেও দেখলাম আমার অনুমান নির্ভুল। কপাল বৈগুণ্যে তিনি আমার ট্রেনেই উঠলেন এবং গুঁতোগুঁতি করে আমার পাশেই বসলেন। " মেচেদায় তোমার বাড়ি দিদি?" ঘাড় নেড়ে বললাম, নাহ্ আপিস। অযাচিত ভাবেই জানালেন, ওনার বাড়ি মেদিনীপুর লাইনে একটা ছোট স্টেশনে। স্টেশনে নেমে আগে হাঁটতে হত, এখন টোটো যায়। ওনার শ্বশুরবাড়ি গাঁয়ের খুব সম্ভ্রান্ত পরিবার। গোপাল আছে, তিনি মন্দিরে অধিষ্ঠাত। তাঁর নিত্য সেবা করতে হয় শরিকদের।
"আমি আর পারি না দিদি, মূল্য ধরে দিই।শ্বশুরশাশুড়ি যতদিন জীবিত ছিলেন, অনেক করেছি। এখন গিয়ে বামুন ঠাকুরকে টাকা দিয়ে আসি। তিনিই ফল দুধটুধ কিনে পুজো করেন।" সস্তার কাপড়ের ব্যাগ থেকে বেরোয় একটি বিবর্ণ সাদা প্লাস্টিকের কৌটো, কৌটোর ওপর লেখা রেস্টুরেন্টের নামটা বিবর্ণতর। কৌটো ভর্তি মুড়ি, " খাবে দিদি? খাও না?" সভয়ে মাথা নাড়ি। আমি ট্যালা বটে, এতটাও নয়।
ভদ্রমহিলা নিজেই একগাল মুখে দেন, খানিক চিবোন তারপর বলেন, "এই কাজটা নতুন, তাও একটা দিন ছুটি করতে হল -"। এত বোর হচ্ছি যে ভাবছি কি করি, ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি, নাকি কানে হেড ফোন গুঁজে বসি।
হে ঈশ্বর, কার মুখ দেখে যে আজ বেরিয়েছি, না আছে ব্যাগে হেড ফোন, মটকা মেরে থাকলেও ইনি ডেকে কথা বলছেন। কত কিছু যে জেনে ফেললাম উলুবেড়িয়া আসতে আসতে। ভদ্রমহিলার শ্বশুরমশাই হোটেলের রাঁধুনী ছিলেন, উনি রান্নাবান্না যা শিখেছেন স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইযের থেকেই শিখেছেন। স্বর্গীয় শ্বশুর লোকটি দেবতুল্য ছিলেন, জীবনে মদ বিড়ি সিগারেট কিচ্ছু স্পর্শ করেননি। পরনারীর দিকে চোখ তুলে তাকাননি। সবটুকু পুষিয়ে দিয়েছে অবশ্য ওনার ছেলে, ভদ্রমহিলার সোয়ামী। "দুটো ছোট বাচ্ছা সমেত আমায় ফেলে চলে যায় দিদি, কি কষ্ট করে যে বাচ্ছাদের মানুষ করেছি --"। বলতে বলতে চোখ মোছেন ভদ্রমহিলা।
সাতসকালে এই কান্নাকাটি, ফ্যাঁচফ্যাঁচানির ভয়টাই আমি পাচ্ছিলাম। এত বছরের পাবলিক সার্ভিস, কম মানুষের সাথে তো মিশিনি, সমস্যার গন্ধ আমি দূর থেকে পাই। মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা, হাত ভর্তি শাঁখাপলা, সিঁথি ভর্তি ডগডগে সিঁদুর, সস্তার সোয়েটের টিপ, ছিট কাপড়ের রং জ্বলা সালোয়ারকামিজ, মুখ চোখে জেবড়ে বসা কালিমা, আর "হৃদয়ের কথা কহিতে ব্যাকুল" মনোভাব আমার কাছে অন্তত বহুক্ষণ আগেই প্রকাশ করেছে ওনার পরিচয়।
"এক ডাক্তার বাবুর বাড়িতে কাজ করতাম দিদি। কাজ করতে করতে আমি নিজেও অনেক ডাক্তারি শিখে গেছি -"। বলতে বলতে হেঁহেঁ করে হাসেন মহিলা। " চার বছর ছিলাম ওদের বাড়ি, ওনার বাবা খুব অসুস্থ, শয্যাশায়ী, নাক দিয়ে নল ঢুকিয়ে খাওয়াতে হয়। সব আমি করতাম। ডাক্তার বাবু আর বৌদি আমায় ভালবাসত কত! সেই কাজ ছেড়ে দিলাম -, কেন বল তো? আমার মেয়ে একদিন রাতে হঠাৎ এসে হাজির হল দুটো বাচ্ছা সমেত। বরের সাথে ঝগড়া করে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছে। তাদের আমি অতরাতে কোথায় পাঠাই? বুড়ি মাসিমাকে জিজ্ঞাসা করে, ওদের দুটি খেতে দিলাম আর রাতে একটু শুতে দিলাম। ব্যাস পরদিন ডাক্তারবাবুর বোন এসে আমায় কি কথা যে শোনাল দিদি, কি বলি -"।
ডাক্তারবাবু কিছু বললেন না, শুধাই আমি। " উনি তো কলকাতায় থাকেন। মাঝে মাঝে আসেন। বাবামায়ের দেখাশোনা বোনই করে। আমার এত দুঃখ হল দিদি, যাদের জন্য এত করি, তারা আমার এত বড় বিপদে, এইটুকু করল না। পরদিন আমিও বেরিয়ে এলাম ওদের বাড়ি ছেড়ে -।"
"চুপি চুপি তোমায় বলি, বেরিয়ে এসে খুব ভয় পাচ্ছিলাম দিদি। যদি আর কাজ না পাই। ঠাকুরের দয়ায় এটা পেয়ে গেছি এই আর কি। বেতন ও ভালোই দেয়, এখুনি ছুটি করতে চাইছিলাম না, কিন্তু আমার মেয়েটা এত জ্বালাচ্ছে দিদি তোমায় কি বলব। "
তোমার মেয়ে আবার ফিরে গেছে তার বরের কাছে? জানতে চাই আমি। " না,না যেতে চাইলেও আমি যেতে দেব না।" এই প্রথম রাগতস্বরে কথা বলেন ভদ্রমহিলা। " তোমায় কি বলব দিদি, জঘন্য নোংরা লোক একটা -"। গায়ে হাত তোলে? আবার জিজ্ঞাসা করি আমি। ভদ্রমহিলার মুখে ফুটে ওঠে অবিমিশ্র ঘৃণা। " আরে দিদি লোকটার বয়স প্রায় ষাট।"
মুখে অভাব আর সময় যতই বলিরেখা কেটে যাক না কেন,এই ভদ্রমহিলার বয়স মেরেকেটে পঞ্চাশ হবে। আর এনার জামাতার বয়স ষাট! তিতকুটে ঘৃণায় ভরে ওঠে আমার মন। মনের ছাপ বোধহয় মুখে পড়েছিল, ভদ্রমহিলা ঘাড় নাড়েন। জানতে চাই, " সম্বন্ধ করে?" উনি রেগে বলেন, " না, না। প্রেম।পনেরো বছর বয়সে উনি প্রেম করে পালিয়ে যান ঐ ঘাটের মড়ার সাথে। যার কত গুলো যে বিয়ে আর কতগুলো যে সম্পর্ক তার ঠিক নেই,জমিজমা ট্যাকাপয়সা কিস্যু নাই, ভাড়া বাড়িতে থাকে, কি কাজ করে ঠাকুর জানে, এমন মিনসের সাথে কেউ পালায় দিদি? তারপর দুই দুটা বাচ্ছা নিয়ে এখন ফিরে এসেছেন মায়ের ঘাড়ে। এখন নাকি তিনি আর এই লোকটার সাথে থাকতে পারছেন না। কি বলবে তুমি বল -"।
আমি আর কি বলব, ভদ্রমহিলা বলতে দিলে তো। "আমি বলেছি দিদি, প্রেম করার সময় মনে ছিল না? কোথায় বুড়ি মাকে তুই দেখবি, না আমাকে তোকে দেখতে হচ্ছে। তুমি বললি বিশ্বাস করবে না দিদি, বাচ্ছা গুলো হওয়া ইস্তক সব দায়িত্ব আমি পালন করে এসেছি। ওদের দুধ, হাগিস, জামাকাপড়, বইখাতা, ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া সব আমি করেছি। সেই বইখাতা গুলো পর্যন্ত বরের ঘরে ফেলে এসেছে। একটা জামা কাপড় পর্যন্ত নিয়ে আসেনি। আমার ভালো সালোয়ার, নাইটি যা ছিল সব দিলাম। একটা বাড়ি ভাড়া করে রেখে এলাম, যে এখানে থেকে নতুন করে জীবন শুরু কর।"
"বললাম, ভালো রান্না জানিস, ঠাকুরদার থেকে শিখেছিলি, তুই বরং লোকের বাড়ি রান্না করে খা। ও বাবা, বলে কিনা, রান্নার লোক আমি হবনি। আমি রুগী দেখব। রুগী দেখবে ও? রুগী দেখার কাজে হ্যাপা কম? আর চাইলেই সে কাজ পাবে কোথায়? কে রাখবে ওকে?"
ট্রেন ঝমঝম করে রূপনারায়ণ পেরোয়। আড়মোড়া ভাঙি আমি, কোলাঘাট আসছে, এবার উঠতে হবে। ভদ্রমহিলা করুণ ভাবে আমার হাতটা চেপে ধরেন, " শোন না দিদি, কাল কি হয়েছে। নাতিনাতনী দুটোকে যে দিদিমণির কাছে পড়তে দিয়েছি, তিনি আমায় ফোন করে বললেন কি, যে, ' কাকিমা, তোমার মেয়ে এসে বাচ্ছাগুলোকে মাঝপথে নিয়ে চলে গেল।' আমি বলি, এ আবার কি। মেয়েকে ফোন করি, সে ধরে না। ধরে না। তারপর বলে কি, যে জামাই তাকে ফোন করে ডেকেছে, তার পরিচিত লোকজনের উপস্থিতিতে সালিশী করার জন্য। আমার মেয়ে তখন বলেছে, ঠিক আছে, তবে যা কথা হবে বাচ্ছাদের সামনে হবে। বলে বাচ্ছা গুলোকে পড়া থেকে টেনে নিয়ে গেছে ঐ সভায় -"।
মানে? জানতে চাই, তোমার নাতিনাতনীর বয়স কত? " দশ এগারো। কি মিষ্টি ওরা দিদি কি বলব। পড়ালেখায় কি ভালো -"। আর তাদের পড়া থেকে তুলে নিয়ে গেছে বাবামায়ের নোংরা কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি দেখার জন্য? ভদ্রমহিলা এই প্রথম একজনের সমর্থন পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, " এই কথাটাই আমি বলেছি দিদি। বলল, না ওর বাচ্ছা তো ওর মতোই হবে।ওদের জানা দরকার ওদের বাপ কেমন -"
গা গুলিয়ে ওঠে আমার, আর তোমার মেয়ের বাচ্ছা নয়? ঈশ্বর এদের কেন বাচ্ছা দেয় কে জানে। বলেই বুঝি অনধিকার চর্চা করে ফেললাম। জিভ কেটে সরি বলে উঠে পড়ি, এমনিতেই মেছেদা আসছে, ভদ্রমহিলা খপ করে ধরে ফেলেন আমার দুটো হাত, " সরি বলো না দিদি। আমিও এটাই বলি ঠাকুরকে। এদের তুমি কেন দাও ঠাকুর। কত মানুষ সারাজীবন চেয়েও সন্তানসুখ পায় না। আর এরা পেয়েও তার মর্যাদা দেয় না। বাচ্ছা মানুষ করার জন্য আমি যে কি করিনি তুমি জানো না। এমন অনেক কাজ করেছি, যা বললে তুমি ঘেন্নায় কুঁকড়ে যাবে, কিন্তু আমার কোন উপায় ছিল না দিদি। দুটো বাচ্ছা, বুড়ো শ্বশুর শাশুড়ির জন্য অনেক নীচে নেমেছি দিদি -"।
এতবছরের অভিজ্ঞতা চিৎকার করে বলে আর একটু সময় পেলেই ভদ্রমহিলা তাঁর নৈতিক অবনমনের কথাটা বলে বসবেন। এবার আমি ওনার হাতে মৃদু চাপ দিই, বলি, যা করেছ বেশ করেছ। তোমার প্রিয়জনদের জন্যই তো করেছ? আর তোমার কাজের ফল অন্য কারো ওপর তো চাপাও নি? তাহলে কি? তুমি এখন যাও, গিয়ে নাতিনাতনি সামলাও।
আবেগে গলে পড়ে বলেন ভদ্রমহিলা, " আশীর্বাদ করো দিদি, যেন পারি। মেয়ের প্রতি আমার আর কোন দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু ওরা তো নিষ্পাপ শিশু। আমি খুব চেষ্টা করছি ওদের একটা হোস্টেলে ভর্তি করে দেবার।" ঝমঝম করে ট্রেন মেছেদা ঢোকে, হেসে হাত ছাড়িয়ে নিই আমি। এবার নামতে হবে, সামনে আবার অন্য যুদ্ধ।