অনির ডাইরি ১১ই আগস্ট, ২০২৫
#অনিরডাইরি
কিছু ছবির বোধহয় কোন ক্যাপশন লাগে না। বাবা পঁচাশি, পিসি নব্বই। এমন অমৃত মুহূর্তের যে একটা ভালো করে ছবি তুলব, তার উপায় আছে নাকি? যা অগোছাল হয়ে আছে বাড়িটা। চাটুজ্জেরা জন্ম অগোছাল। এ বাড়ির যে কোন প্রান্তে গেলেই টের পাবেন। আমিই কম অগোছাল নাকি? পনেরো ষোল বছর ধরে জ্বলছে শৌভিক।
একটা জিনিস খেয়াল করেছি, যাঁরা খুব গোছানো হন, তাদের মনের ভিতরটা ও গোছালো হয়। স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব সব কিছু গোছানো থাকে স্তরে স্তরে। পরিমিতি বোধ হয় মারাত্মক। এবাড়িতে অবশ্য ও সবের বালাই নেই। সব কিছুই অবারিত, অসীম।
শুধু যে বাড়িটা অগোছাল তাই নয়, পিসি নিজেও যে শাড়িটা পরেছিল, বিশ্বাস করুন রাস্তায় ফেলে দিলেও কেউ কুড়িয়ে নেবে না। পিসি ওমনই। স্তরে স্তরে জমে থাকে পিসির শাড়ি, ম্যাচ করে ব্লাউজ। অঙ্গে তোলে না পিসি। আমাদের ছেলে এবং মেয়েবেলায় বাবা রঙ্গ করে বলত, পিসির দেরাজ খুঁজলে সব পাওয়া যাবে, ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে বাদশা আকবর পর্যন্ত যে যা দিয়েছে সব যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছে পিসি।কেবল সম্রাট অশোকের দেওয়া জামাটা ছিঁড়ে গেছে, এই যা।
পিসিকে কি বলব, আমার বাবা কিছু ফেলে নাকি? চাকরী পেয়ে এক বোতল সেন্ট কিনে দিয়েছিলাম, তার অর্ধেকটা আজও আছে। আমি অফিস যাবার সময় মাঝে মধ্যে লাগাই, যত বার স্প্রে করি কেঁপে ওঠে বাবা। মায়ের কিনে দেওয়া প্রথম শার্ট, ছোটমাসি চাকরি পেয়ে কিনে দেওয়া জামা ইত্যাদি প্রভৃতি সব রেখে দিয়েছে বাবা। এবং মাও। মাঝে মধ্যে আমি বিরক্ত হয়ে কিছু বাতিল করি।সুযোগ বুঝে বাতিল করা জামাকাপড়ের পুঁটলি ঘেঁটে বিবর্ণ শাড়ি গুলো পুনরায় নিয়ে চলে যায় পিসি।
বলতে গেলেই বলে, " কেন ফেলে দিবি? কোথাও তো ছেঁড়েনি, ফাটেনি। আমরা অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছি রে। এমনও বছর গেছে তোর বাবা কাকার একটা জামা হয়নি। আমার শাড়ি কেটে পাঞ্জাবি বানিয়ে দিয়েছি ওদের। আমি সেসব দিন ভুলতে পারি না রে -"। ৪৬ এর মন্বন্তরের গল্প শোনায় পিসি, " এক হাতা ফ্যান আর এক খাবলা নুনের জন্য আস্তাকুঁড়ের কুকুরের মত কামড়াকামড়ি করত মানুষ। নারী, পুরুষ,শিশু। সেসব দিন তোরা দেখিস নি।"
নাহ্ সে সব দিন আমি/আমরা দেখিনি। 'মনে আছে বিশ্বাস', নরকের আগুনে ভালো মত ঝলসানো হচ্ছে উইনস্টন চার্চিল নামক শয়তানটাকে। নৈতিকতার, মনুষ্যত্বের যত অবনমনই ঘটুক না কেন, সেই দিন আর ফিরে আসবে না। ঈশ্বর করুন যেন নাই আসে, পেটে না খেলে, পিঠে সইবে কি করে মশাই।
যাই হোক আপাতত ফিরে আসি, ভাইবোনের এই অমৃত উৎসবে। বার বার ফিরে আসুক দিনটা এই অশীতিপর ভাইবোনের জীবনে, বয়ে আনুক আরো আরো অবারিত, অগোছাল ভালোবাসা। ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি?
অনির ডাইরি ৩রাআগস্ট, ২০২৫
#অনিরডাইরি
কোনদিনই খুব বেশী বন্ধুবান্ধব আমার ছিল না,আজও বন্ধু বলতে যাদের বদন মুদিত নয়নের সম্মুখে ভেসে ওঠে, তাদের সংখ্যা বেশ সীমিত। অন্তত জুকুদার ফেসবুক যে এগারোশ কত বন্ধু দেখাচ্ছে তার এক দশমাংশের থেকেও বেশ অনেকটাই কম। মোটামুটি সারাদিন যারা অনুপস্থিত থেকেও ঘিরে থাকে আমার দিনটাকে, তাদেরই বন্ধু বলে ধরি আর কি-।
যাদের সকলকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে হাড়ে হাড়ে চিনি, কারো কপালে সহকর্মীর ছাপ্পা তো কারো গায়ে সহপাঠী বা ক্ষেত্রবিশেষে সহযাত্রীর উল্কি। ভালোমত চেনা পরিচয় না হলে আবার মৈত্রী হয় নাকি?
মুস্কিল হল,এই চেনাবৃত্ত-চেনাছকের বাইরেও বেশ কিছু মানুষ ধূমকেতুর মত আচমকা প্রবেশ করেই বেরিয়েগেছেন আমার জীবনের কক্ষপথ থেকে, আর রেখে গেছেন একরাশ সৌহার্দ্যের সুখস্মৃতি।
তা প্রায় বছর তেরো চোদ্দ হল, তুত্তুরী তখন সদ্য পূর্ণ করেছে এক বৎসর। শিশুকন্যার দোহাই দিয়ে মহানগর পোস্টিং পেয়েছি। চার্চ লেনের পাঁচ তলায় আপিস। বড়সাহেব মহঃ আমানুল হক। আপিস তো নয়, হাওদাখানা, দুবার ফোন চুরি হয়েছে খাস বড়সাহেবেরই, সবাই প্রায় বগলদাবা করে ঘোরে নিজের মুঠোফোন আর আলমারির চাবি। আর আমি এমনি ট্যালা, যে টেবিলে মোবাইল ফেলে ফাইল বগলে ঢুকেছিলাম বড় সাহেবের ঘরে। শুভাকাঙ্ক্ষী বড় সাহেবের পিতৃসুলভ ধমক খেয়ে ছুটতে ছুটতে নিজের চেম্বারে ঢুকে দেখি দিব্যি ফাইলের ওপর শুয়ে আড়ামোড়া ভাঙছেন তিনি। বেশী না মাত্র দুটো মিস কল এসেছে আমার অনুপস্থিতিতে।কোন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি দুবার ফোন করেছেন।
সাধারণতঃ অচেনা নম্বরে ঘুরিয়ে ফোন করি না। কিন্তু কেন জানি না, সেদিন করলাম। ওপার থেকে এক প্রৌঢ় কণ্ঠ বলে উঠল, ‘হ্যালো অনিন্দিতা? আমি প্রসেনিজিৎ দা বলছি-’। তৎকালে প্রসেনজিৎ নামক দুজন ব্যক্তিকে কেবল চিনতাম, প্রথমতঃ দি প্রসেনজিৎ, সুপারস্টার। তিনি থোড়াই অধমের মত তুচ্ছ ব্যক্তিকে ফোন করবেন?
আর দ্বিতীয়জন সার্ভিসতুতো সিনিয়র দাদা শ্রী প্রসেনজিৎ কুণ্ডু ওরফে পিকে দা। তিনি মাঝেমধ্যেই ফোন করেন থুড়ি করতেন নানা কাজে। নম্বরটা অচেনা যদিও, সে তো হতেই পারে।ব্যস্ত কেজো সুরে জানতে চাইলাম, ‘ হ্যাঁ প্রসেনজিৎ দা বলো? তোমার ক্লেমের ফাইল স্যারের ঘরে। ’ ওপারের গলাটা কিঞ্চিৎ থতমত খেয়ে বলল, ‘আরেঃ আমি প্রসেনজিৎ দা বলছি ব্যাঙ্ক থেকে। ’ ও হরি। ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি আরেক প্রসেনজিৎকেও চিনি। তবে তাঁকে কোনদিন দাদা বলে ডাকা বা ভাবার ধৃষ্টতা দেখাইনি।
প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সাথে ব্যাঙ্কেই আলাপ।কিছুদিন আগেই আমি গিয়েছিলাম অ্যাকাউন্টে ঠিকানা বদল করতে, যাঁর টেবিলে পাঠানো হয়েছিল, সেই সৌম্য দর্শন অতি গৌর বর্ণ প্রৌঢ়, আদতে ছিলেন অত্যন্ত সদাশয় তথা অমায়িক ব্যক্তি। পাশে বসিয়ে, চা খাইয়ে স্নেহশীল ভঙ্গিমায় অনেক খোশগল্প করেছিলেন। না বলতেই কে ওয়াই সি ঠিক করে দিয়েছিলেন, আর সব কি কি করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ আমার নম্বরটা নিয়ে যাও, কোন দরকার হলে ফোন করে দিও, কাজ হয়ে যাবে। কষ্ট করে আর আসতে হবে না। তবে যদি আসো, অবশ্যই এই বুড়োটার সাথে দেখা করে যেও।’
তাই করতামও। ফোন কখনও করিনি, তবে গেলে দেখা করতাম। বেশ কিছুদিন আর ব্যাঙ্কে যেতে হয়নি, তাই দেখাসাক্ষাৎও হয়নি। ভাবলাম তাই বোধহয় কুশল বিনিময় করতে ফোন করেছেন ভদ্রলোক। উৎফুল্ল স্বরে জানতে চাইলাম, ‘ও প্রসেনজিৎ বাবু আপনি? কেমন আছেন?’ ওপার থেকে ভেসে এল মৃদু ধমক, ‘কেমন আছি, পরে জানলেও চলবে। আগে বলো তোমার এটিএম কার্ডটা কোথায়?’ থতমত খেয়ে জানালাম, কার্ডটা যেখানে থাকার সেখানেই আছে, হাতব্যাগের ভিতর পয়সার থলের মধ্যে, ওণারই উপহার দেওয়া ব্যাঙ্কের নাম লেখা ‘ফ’ লেদারের পাউচের ভিতর। ওদিকের গলায় ফুটে উঠল, চাপা উত্তেজনা,‘ তাই নাকি? আমি ফোনটা ধরছি, তুমি খুঁজে দেখো তো। ’
হাতব্যাগ উপুড় করে টেবিলের ওপর ঢেলেও পেলাম না, এটিএম কার্ড। সবেধন নীলমণি একটিই অ্যাকাউন্ট,তার একমাত্র কার্ড। আমার সিন্দুকের চাবি। কি করি? রীতিমত আতঙ্কিত সুরে জানতে চাইলাম ফোন করে ব্লক করাব কি? করাতে হলেও বোধহয় কার্ড নম্বরটা লাগবে,যা আমার মুখস্থও নেই, কোথাও টোকাও নেই।
ওদিক থেকে স্নেহময় বড়দার ধমক ভেসে এল, ‘কাল হাওড়া ময়দান থেকে টাকা তুলেছিলে?’ আলবাৎ তুলেছিলাম। বেশ মনে আছে টাকা তুললাম, টাকা গুণলাম,পয়সার থলে তে ঢোকালাম। থলেটা হাত ব্যাগে ঢোকালাম, তারপর মায়ের ভাষায় ধেইধেই করতে করতে বাড়ি গেলাম। উনি জানালেন, ওখানেই হয়েছে গড়বড়, টাকা গোণার সময়, ফ লেদারের পাউচে ভরা কার্ডটা রেখেছিলাম এটিএম কাউন্টারে। তারপর তাঁকে সেখানে রেখেই ধেইধেই- ।
জনৈক ব্যক্তি পরে রাতে ঐ এটিএমে টাকা তুলতে গিয়ে কার্ড সমেত পাউচটা পান। উনি তৎক্ষণাৎ এটিএমের রক্ষীর কাছে সেটি জমা করতে উদ্যত হন, এই আশঙ্কায় যে,যার কার্ড সে হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছুটে আসবে। রক্ষী হাই তুলে দায়সারা ভাবে জানান,তিনি নিতে পারবেন না। হয় থানায় জমা করুন, নাহলে ওখানেই পড়ে থাকুক। যার কার্ড সে বুঝে নেবে।
এত সহজে দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেননি ভদ্রলোক, উনি তখন ফ লেদার পাউচটি ঘেঁটে দেখেন ভিতরে কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বর আছে কি না। ছোট্ট চিরকৃটে প্রসেনজিৎ বাবুর স্বহস্তে লেখা ফোন নম্বরটি আমি ভাগ্যে ঐ পাউচটাতেই রেখেছিলাম, গতকাল রাত নটা নাগাদ ভদ্রলোক প্রসেনজিৎ বাবুকে ফোন করে সব জানান। কার্ডের নামটা শুনেই উনি চিনতে পারেন, কিন্তু আমার নম্বর না থাকায় আর ফোন করতে পারেননি। আজ আপিসে এসে, ডেটাবেস ঘেঁটে আমার নম্বর খুঁজে সকাল থেকে চেষ্টা করছেন যোগাযোগ করার।
শুনে স্বস্তি পেলাম। সাথে সাথে ভদ্রলোকের নাম আর নম্বরটাও। প্রসেনজিৎ বাবু জানালেন, ভদ্রলোক কাল রাতেই ওণাকে জানিয়ে রেখেছেন আজ সারাদিন উনি কাজের জন্য হাওড়ার কোন প্রত্যন্ত গ্রামে থাকবেন, যেখানে টাওয়ার থাকবে না। ফলে রাত আটটা নটার আগে ওণাকে পাওয়া যাবে না। তখন ফোন করলে উনি জানাবেন কখন উনি কার্ডটা ফেরৎ দিতে পারবেন।
সত্যিই ওণাকে পাওয়া গেল না রাত নটা অবধি। টেনশনে কত সহস্রবার যে ডায়াল করলাম ওণার নম্বর। রাত নটার পর বাজল ফোনের রিং, ওপাশ থেকে ভেসে এল এক ক্লান্ত পুরুষকণ্ঠ। পরিচয় দিতেই , চিনতে পারলেন। মার্জনা চাইলেন এতক্ষণ ফোনে না পাওয়ার জন্য। জানালেন পেশায় ছোটখাট কন্ট্রাক্টর। কাজের ধান্ধায় প্রায়ই এমন দূরদূরান্তে যেতে হয়। আগামী কালও যেতে হবে। যদি আমি সকাল সকাল একটু হাওড়া ময়দানের ঐ এটিএমে আসি, তো উনি কার্ডটা আমায় দিয়ে যেতে পারেন।
কৃতজ্ঞতায় বুঝে আসছিল গলা। কে বলে আমরা কলি যুগে বাস করি? এখনও কত যে সৎ মানুষ ছড়িয়ে আছেন, এই সমাজে। তাই না এতকিছুর পরও জিতে যায় মানুষ। নিশ্বাস চেপে কোন মতে কাটল রাত, ভোর ভোর পৌঁছালাম এটিএমে। ফোন করতেই এক সৌম্য দর্শন বছর ত্রিশের ব্যক্তি এগিয়ে এলেন, নমস্কার বিনিময়ের পর আমার কার্ডটা আমার হাতে দিয়ে ওণার শান্তি হল। তাড়া ছিল ওণার, তবুও দুদণ্ড কথা বললেন আমার সাথে। ভুল বললাম, আমিই বলে গেলাম একতরফা। জানালাম অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা। জানালাম কি চাকরী করি আমি এবং শৌভিক, জানালাম এছাড়াও আছে বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব, যে কোন প্রয়োজনে উনি যেন নিঃসঙ্কোচে জানান আমাদের। এই উপকারের কোন প্রতিদান তো হয় না, তবুও চেষ্টা করব পাশে থাকার। উনিও কথা দিলেন, অবশ্যই জানাবেন। পরে বাড়ি ফিরে একই কথা জানিয়েছিলাম প্রসেনজিৎ বাবুকেও। মজার কথা হল না উনি কখনও কোন সাহায্য চেয়েছিলেন না প্রসেনজিৎ বাবু। দ্বিতীয় ব্যক্তির সাথে এরপরও বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল, প্রথমজনের সাথে আর কখনও যোগাযোগই হয়নি।
নাই হোক দেখাসাক্ষাৎ, নাই থাকুক যোগাযোগ, ওই যে স্বর্গীয় চাণক্য বলে গেছেন না, বন্ধুত্বের প্রথম শর্তই হল বিপদে পাশে থাকা, এনারা যদি বন্ধু না হন, তাহলে আর বন্ধু কে? প্রতিটি বন্ধুদিবসে তাই একটি বার অন্তত স্মরণ করি এইসব মানুষকে, আর ইথার তরঙ্গে পাঠিয়ে দিই, একরাশ শুভকামনা। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আপনাদের মত ভালো মানুষদের বড় দরকার এই পোড়া সমাজে।
অনির ডাইরি ২রা আগষ্ট, ২০২৫
#অনিরডাইরি
ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারলাম, ঈশ্বর আমায় ত্যাগ করেছেন। নইলে কালরাতে অমন সকাতর অনুরোধের পরও এমন বৃষ্টি হয়! বর্ষা আমার বরাবরের প্রিয় ঋতু। বন্ধুবান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ীরা নির্ঘাত ঠ্যাঙাবেন, তাও বলি, বৃষ্টি আমার আজও ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে। ভালো লাগে না কেবল জলজমা। ওটা এক্কেবারে যমের অরুচি -
কপালের এমন গেরো যে আমার পিত্রালয় এবং শ্বশুরালয় উভয় এলাকাই ইদানিং কথায় কথায় জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। কলকাতার জমা জল তাও একরকম, সেদিনও ঐ জলে স্থানীয় বস্তির কয়েকটা বাচ্ছাকে স্নান করতে দেখেছি। কিন্তু হাওড়ার জমা জল এক্কেবারে বিভীষিকা। রাস্তার ধারেই খোলা নর্দমা। বৃষ্টি হলেই রাস্তার জমা জলের সাথে নর্দমার জল মিলেমিশে একাকার। তার ওপর আছে চড়া মূত্রের কুবাস। রাস্তায় দাঁড়িয়ে হিসি করাটাই এখানে দস্তুর। সেই তরল ও মিশে যায় ঐ জলে। ঐ জল মাড়িয়ে বাড়ি ফিরে গতকাল মনে হচ্ছিল শুধু সাবান বা ডেটল নয়, মিউরিয়েটিক অ্যাসিড দিয়ে ধুই, দুই পা আর জুতো জোড়াকে।
ঘুম ভাঙার প্রাথমিক বিরক্তিটা কেটে গেল বাইরের রোয়াকে এসে। রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। ঘন সবুজ গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে মুক্তোর মত জলকণা। বাতাসে একটা অদ্ভুত মন ভালো করা ভিজে সুবাস। আমি আর লতা দি ছাড়া, এখনও কেউ ওঠেনি এবাড়িতে। এখনও খিল খোলা হয়নি, আমাদের শতাধিক বছরের পুরান সদর দরজাটার। কয়েকমাস আগেও কাক ডাকা ভোরে উঠে বাবা'ই খুলত ভারী লোহার খিলটা। ইদানিং লতাদিই খোলে।
দালান থেকে বেরিয়ে সাবেকি লাল রোয়াক, রোয়াক থেকে চার ধাপ সিঁড়ি নেমে একফালি এজমালি উঠোন। উঠোন পেরিয়ে ভারী বার্মাটিকের সদর দরজা। উঠোনময় ছড়িয়ে আছে কাঁচাপাকা পেয়ারা। রাতভর বৃষ্টিতে খসে পড়েছে গাছ থেকে। ফলের ভারে ঝুঁকে থাকে মায়ের সাধের গাছটা। দুর্ভাগ্যবশতঃ এক ঝাঁক টিয়া ছাড়া কেউ খাই না আমরা পেয়ারা। কাকার দোতলার বারান্দা থেকে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় পেয়ারা, তাও খাই না কেউ। বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছে মা -
শুধু কি পেয়ারা! মায়ের হাতে লাগানো কাঁঠাল গাছ থেকে এখনও ঝুলছে অন্তত গোটা ছয়েক মস্ত পাকা কাঁঠাল। গোটা এগারো ধরেছিল এবার। সবই বিশাল বিশাল আয়তনের। কিন্তু পাড়বে কে? গেল বার, আমাদের হক বাবু আর বিমল ড্রাইভার মিলে পেড়ে দিয়েছিল সব কাঁঠাল। গোটা দুয়েক মাকে দিয়ে বাকি সব কাঁঠাল পূব মেদিনীপুরে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। এ বছর বিমল নেই, ঘটেছে উত্তমকুমারের প্রত্যাবর্তন। তাকেও কম জপাইনি হক বাবু আর আমি। কিন্তু উত্তমকুমারের একটাই কথা, " ম্যাডাম আমি গাছে চড়তে পারি। কিন্তু নামতে পারিনি -"।
এ কেমন কথা হল বাপু? তুমি পূব মেদিনীপুরের ভূমিপূত্র। জমিজমা আছে, নিয়মিত চাষাবাদ করো, আছে পুকুর, গাছপালা আর এটা পারিস না? অগত্যা কাঁঠাল গুলো গাছেই পাকছে আর নিজেদের মর্জি মত ধুমধাম করে খসে পড়ছে। গোটা বাড়ি সুরভিত হয়ে উঠছে খসে পড়া পাকা কাঁঠালের গন্ধে। পাড়ার ঝাড়ুদারের দেশোয়ালী ভাইকে আলাদা করে ডেকে টাকা দিয়ে সাফ করাতে হচ্ছে সেই থ্যাঁতলানো কাঁঠালের ভূতি। হায় হায় করছে মা -
গতকাল রাতেও একটা দামড়া কাঁঠাল পড়েছে ধপাস করে, সেটাই দেখছিলাম, পিছন থেকে ভেসে এল বাবার মোলায়েম কন্ঠস্বর, " কখন উঠেছিস? আমায় ডাকিসনি কেন?" পেশার টানে আপাতত পিত্রালয়ে থেকে আপিস করি আমি। হাওড়া থেকে তমলুক তাও সহনীয়। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরি, পরিযায়ী পাখির মত। রোজ সন্ধ্যায় ফোন করে আমার বর, তরল স্বরে শুধায়, " বেরাইছিস? কোথায় ফিরবি আজ রাতে -"। "বাড়ি" বললে বলে, বাড়ি তো দুটোই। হাওড়ার বাড়ি না কলকাতা। এটা শুনলেই দ্রব হয়ে যায় আমার হৃদয়। সত্যিই তো, এটাও তো আমারই বাড়ি। জীবনের প্রথম তিন দশক কাটিয়েছি যে বাড়িতে, কেন যে তার থেকে মাত্র এক দশক কাটানো বাড়িটা এত বেশি প্রিয় বুঝি না। বোঝার চেষ্টা করলেই মন আর মাথা জুড়ে নামে কুয়াশা।
তাই ওসব নিয়ে আর ভাবি না। চাকরী মানেই তো চাকরগিরি। তবে এটা বেশ বুঝতে পারি, আমার এই টানাপোড়েনে আমার বাবা মা একটু হলেও খুশিই হয়। বাড়িতে পা রাখার সাথেসাথেই যেন ঝলমলিয়ে ওঠে সবকিছু। শুধু কি বাবা মা, দোতলা থেকে ধরে ধরে নেমে আসে নব্বই বছরের বুড়ি পিসি। " আহা রে, তোর কত কষ্ট" বলে হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়। শুধু আমার জন্য অর্ডার দিয়ে ইলিশ মাছ কিনে আনে বাবা। কদমতলা বাজার থেকে লতা দি স্বয়ং গিয়ে কিনে আনে টোপা টোপা চিংড়ি, পুকুরের ডিম ভরা পার্শে, সাবিরের দোকানের খাসি। আসে দেশপ্রিয়র দরবেশ/ পান্তুয়া/ কালোজাম আর এলাচ দেওয়া লাল দই।
সত্যিই যদি এত খাওয়ার সময় থাকত আমার। সকাল আটটায় এত খাওয়া যায় নাকি? মন হলে অফিস থেকে ফিরে চায়ের সাথে মাছ/ মাংস বা মিষ্টি এক আধটা খাই বটে। তাতেই গলে যায় বাবা। আজও গতকালের ইলিশ মাছের ঝালটা গরম করতে বসিয়েছিল লতা দি, শুরু করেছিল প্রেশারে ভাত বসানোর তোড়জোড়। নিষেধ করতে কালো হয়ে গেল বাবার মুখটা। "কিছুই খাবি না? তোর জন্যই ইলিশটা - ।" মা বলে, "কৌটোয় ভরে দাও তো লতা, তুত্তুরীর জন্য নিয়ে যাবে"।
এই না হলে আমার মা। আজ সপ্তাহ শেষ, বর মেয়ের কাছে ফিরব বটে, কিন্তু ফিরতে বাজবে খুব কম করেও রাত আটটা। বারো ঘণ্টা ভালো থাকবে তো, মায়ের গতকালের রাঁধা ইলিশ। তুত্তুরীর জন্য এত চকলেট বেঁধে দেয় লতা দি। যাযাবরের ঝোলা, যাতে দু জোড়া পোশাক, ময়েশ্চারাইজার, সানস্ক্রিন, লিপস্টিক, কাজল আর টিপের পাতা নিয়ে সপ্তাহের শুরুতে বাড়ি ছেড়েছিলাম আমি, আবার সেটাই কাঁধে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ি। এই তো জীবন কালী দা। রাস্তায় নেমে পুনরায় অনুধাবন করলাম, নাহ সর্বশক্তিমান সত্যিই আমাকে ত্যাগ দিয়েছেন। গলির মুখ থেকে জল থৈথৈ। সামনের মেয়েটি ফুলপ্যান্টটাকে গুটিয়ে হাফপ্যান্ট করে নিয়ে স্মার্টলি জলে নেমে পড়ল। কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ নিয়ে, ধোপদুরস্ত ফুলহাতা শার্ট আর ঢলঢলে বিবর্ণ হাফ প্যান্ট করে গোটা দুই অফিস বাবুও নেমে পড়ল তার পিছন পিছন। এই ভাবে ফর্মাল শার্টের সাথে দোল খেলার পাতলা গেঞ্জির হাফ প্যান্ট যে আদৌ পরা যায় স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হত না। নাহ্ ঈশ্বর কেবল একা আমাকেই ত্যাগ করেননি, আরও লোক আছে আমার দলে। "জয় মা" বলে নেমেই পড়লাম জলে। একটা শিরশিরে শিহরণ খেলে গেল পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত। সারাদিন এই জল মেখেই আজ কাটবে ঠাকুর - ।