জুলাই মাস, দুপুর
আড়াইটা, আকাশের মুখ ভার, তাই রোদের সেই তাপ নেই। মৃদু হাওয়া দিচ্ছে, অন্যমনস্ক হয়ে
পড়েছিলাম, হঠাৎ রিক্সাওয়ালার ডাকে চমকে উঠলাম, “দেখেন দিদি, এই হোটেলটা ঠিক আপনার
পছন্দ হবে।” রিক্সায় চড়ার সময় বলেছিলাম,
জনপদ থেকে দূরে, কোন ফাঁকা হোটেল দেখে দিতে। যেখানে নিরিবিলিতে কটা দিন কাটানো যায়।
সত্যি কথা বলতে কি জীবনের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। একটু শান্তি চাই। মানুষ জন আর
সহ্য হচ্ছে না। পরিচিত পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের সাথে কিছু সময় কাটাতে
চাই। কিছু বোঝাপড়া করা বাকি।
অনেক ভেবেচিন্তে এই স্থান নির্বাচন
করেছি। এই অঞ্চলটি খুবই স্বল্প পরিচিত এক পর্যটন কেন্দ্র। কয়েক বছর আগেও কেউ এই
জায়গাটার নাম জানত না। রাজনৈতিক পালাবদলের পর ভ্রমণ পিপাসুদের চোখে পশ্চিমবঙ্গকে
আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এইরকম বেশ কয়েকটি স্থানকে সরকারি ভাবে গড়ে তোলা হয়। সেই
প্রচেষ্টা খুব যে সফল হয়েছে বলা চলে না, তবে সপ্তাহান্তে কিছু বঙ্গসন্তান অবশ্যই
আসে।
পাছে কোন পরিচিত মুখ চোখে পড়ে যায়, তাই
ইচ্ছে করেই সপ্তাহের শুরুতে এসেছি। আজ সোমবার। এক নজরে হোটেলটা মন্দ লাগল না। বরং
বেশ ঝকঝকে। ভাড়া কত হবে? সাধ্যাতীত হয়ে
যাবে না তো? ইতস্ততঃ করছি দেখে রিক্সাওয়ালা
অভয় দিল, “ যান না দিদি, এই সময় লোক হয় না বলে, ওরা হাফ-প্রাইসে ঘর দেয়।”
ভাড়া চুকিয়ে হোটেলে
ঢুকলাম। সামনে কেয়ারী করা বাগান, গাড়ি রাখার জায়গা, নুড়ি বসানো পথ ধরে তিনটি সিঁড়ি
টপকে রিসেপশন রুম। সামনেই ম্যানেজারের
ডেস্ক, কিন্তু ফাঁকা। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, অ্যাকোরিয়ামের লাল-নীল মাছ গুলি
ছাড়া অভ্যর্থনা জানানোর কেউ নেই। মিনিট তিন চার পরে হাঁফাতে হাঁফাতে এক ভদ্রলোক
এলেন, বুশ শার্টের বোতাম আটকাতে আটকাতে। প্রৌঢ় মানুষ, মনে হল আমাকে দেখে বেশ হতাশ
হয়েছেন। একে তো একলা মেয়ে, তায় পরনে ম্লান সুতির সালয়ার-কামিজ, কাঁধে একটা
লাল-কালো কাপড়ের ব্যাগ, তাতে ‘রেমন্ড’ লেখা। সব মিলিয়ে মোটেই আকর্ষণীয় নয়।
জিজ্ঞাসা করলেন,
“ক’দিন থাকবেন?” “তিন-চার দিন”। “হুঁ। ভাড়া ১২০০ টাকা, তবে অফসিজিনে ৬০০ টাকা
লাগবে, প্রতিদিন। আর হাঁ দিনের বেলা আর রাতে আটটার পর জেনারেটার চলবেনি।” মাথা
নাড়লাম। সকাল আটটায় চা, সাড়ে নটায় ব্রেকফাস্ট, রাত আটটায় ডিনার।“ আবার বাধ্য
ছাত্রীর মত মাথা নাড়লাম। “নাম ঠিকানা লিখুন।“ ছদ্মনাম ভেবেই রেখেছিলাম, ঠিকানাও।
ফোন নম্বরটা ফাঁকা রাখলাম। ওঠা ভুল লেখার রিস্ক নিতে পারলাম না।
জনৈক আব্দুলকে ডেকে ম্যানেজার বাবু আমায় ঘরে পাঠিয়ে
দিলেন। ঘরে ঢুকে অভিভূত হয়ে গেলাম, আমার জানলা দিয়ে সমুদ্র ডাকছে। হোটেলটিই প্রায়
বেলাভুমি ঘেঁষেই উঠেছে। ঠিক নীল দামাল সমুদ্র নয়, কেমন যেন কালচে বুড়ো সমুদ্র। ঢেউ
গুলো যেন অসীম ক্লান্তি নিয়ে পাড়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ছে। হোক বুড়োটে, তাও সমুদ্র তো।
সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসলাম।
কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। ভাল লাগছে কি? কি জানি? সব অনুভূতি কেমন ভোঁতা হয়ে আসছে।
আজকাল কিছুই ভাল লাগে না। মাত্র তিরিশেই নিজেকে ফুরিয়ে যাওয়া ক্ষয়াটে বৃদ্ধা মনে
হয়। হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল। ঠিক কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। ঘোর কাটতে দেখি
সূর্য কখন পাটে বসেছে, সন্ধ্যা নামছে।
ফাঁকা ধূধূ বালুকাবেলায় শুধু আমি একা। না ভুল বললাম, দূরে একটা আবছা অবয়ব দেখা
যাচ্ছে, তা কোন মানব না ছায়ামানব জানি না। কি বা যায় আসে।
হোটেলে ঢুকতেই আব্দুল বলল, “মেমসাহেব,
চা খাবেননি?” ‘মেমসাহেব’?? হাসি চেপে ডাইনিং রুমে বসলাম। ডাইনিং রুমে আরও এক জন
বসে আছেন। সম্ভবত বোর্ডার , বেশ সুদর্শন, গৌর বর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসা, চোখে রিমলেস
চশমা। আমাকে দেখে মৃদু হেঁসে বললেন, “ম্যাডাম কে আজ এসেছেন?” প্রমাদ গুনলাম। এই রে
,এই শুরু। এবার নাম- ধাম, পরিচয় সেখান থেকে কত যে শাখা প্রশাখা বেরোবে? একা মেয়ে
দেখে ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা না করাটাই অস্বাভাবিক। যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে, সৌজন্যমূলক
ভাবে ঘাড় নাড়লাম শুধু। ঊনিও আর কিছু বললেন না। আমিও কথা বাড়ালাম না। তবে অনার
আওয়াজ বহুক্ষণ আমার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, একেই বোধহয় ব্যারিটোন ভয়েস বলে।
এখানে ইলেক্ট্রিসিটি
নামকাওয়াস্তে থাকে। থাকলেও ভোল্টেজ খুবই অল্প। রাত্রে প্রায় কোনদিনই থাকে না।
সপ্তাহান্তে হোটেল ভর্তি থাকলে সাড়া রাত জেনারেটর চলে, না হলে রাত আটটার মধ্যে
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে, সাড়ে আটটার মধ্যে জেনারেটর বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে সময় যে
হতভাগ্যরা থাকে, তাদের হোটেলের তরফ থেকে
হ্যারিকেন আর প্রয়োজন হলে টর্চ দেওয়া হয়। নৈশ ভোজ চলাকালীন আমাদেরকেও হাতে হ্যারিকেন
ধরানো হল। ওনার টর্চ আছে, তাই আমাকে একটা টর্চ ও দেওয়া হল। খেতে খেতে দেখলাম,
ম্যানেজার বাবু আর আব্দুল ওনাকে খুব খাতির করে।
খেয়ে ঘরে ফিরছি, উনি বললেন, ‘
ম্যাডাম, এখনি ঘরে গিয়ে কি করবেন? চলুন পিছনের আঙিনায় গিয়ে বসি। জোয়ারের সময়,
সমুদ্র প্রায় আঙিনা অবধি চলে আসে। কপাল ভাল থাকলে, আপনার পদস্পর্শও করে যেতে পারে।
’ লোভ সামলাতে পারলাম না। পিছনের আঙিনায় বেশ কিছু গার্ডেন চেয়ার পাতা আছে, তার
একটায় গিয়ে বসলাম। উনিও বসলেন, তবে আমার থেকে বেশ কিছুটা দূরে। ঝুপ করে আলো নিভে
গেল। নিভু নিভু হ্যারিকেনের আলোয়, সে এক
অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ। ঝিঁঝিঁর ডাক, আর জলের ছলাৎ ছলাৎ, সাথে শিহরণ জাগানো নোনতা
সোঁদা বাতাস। কত ব্যেস হবে ওনার, মধ্য চল্লিশ তো বটেই, পঞ্চাশের কাছাকাছিই হবে।
একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম, অন্ধকার চরাচরের সুযোগ নেবেন কি না? কিন্তু উনি কিছুই
বললেন না। আমি ঘড়ি পরিনি। উনি টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখে বললেন, “চলুন, এগারোটা বাজে।”
ওনার পিছন পিছন হোটেলে ঢুকলাম। আমাকে শুধু আমার ঘর অবধি এগিয়ে দিলেন তাই না,
আমার ঘরের সামনে আমার টর্চ আর হ্যারিকেনটাও ধরলেন, যাতে আমি তালা খুলতে পারি। তালা
খুলে, ঘরে ঢুকে ওনার দিকে তাকালাম, উনি একটা হাত কপালে ঠেকিয়ে, বললেন, “ওককে
ম্যাডাম। শুভরাত্রি।“
দরজা বন্ধ করে পুরো বেকুব
লাগছিলো, নিজেকে চড় কসাতে ইচ্ছে করছিল; কি চাইছিলাম আমি? আমাকে পাত্তা দেবেন উনি?
আমার সাথে ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করবেন? কোন মূর্খের স্বর্গে বাস করি আমি? এককালে আমি
মনে করতাম, আমার থেকে কুরূপা কোন মেয়ে এই পৃথিবীতে নেই, সেই অনুভূতিটা আবার ফিরে
আসছিলো। জীবনে কোন কিছুকেই সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারি না। প্রেম প্রস্তাব কম পাইনি,
কিন্তু একটাও বিশ্বাস হয়নি। আমার দৃঢ় ধারণা আমি পুরুষদের অভিসন্ধি খুব ভাল বুঝতে
পারি। এই প্রথম হিসেব মিলল না।
ভোরের নরম আলো মুখে এসে পড়তেই
ঘুমটা ভেঙে গেল। দৌড়ে গেলাম সমুদ্রকে দেখতে। কিন্তু কোথায় সে? ভাটার টানে বেশ
পিছিয়ে গেছে। ওনাকে দেখতে পেলাম, প্রাতভ্রমণে বেড়িয়েছেন। ব্যালকনিতে আমাকে দেখে,
হেঁসে হাত নাড়লেন। ঈশারায় ডাকলেন, নেমে আসতে। হঠাৎ মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেল। দৌড়ে
গেলাম সৈকতে ওনার কাছে। ঈশ! কি দামি ট্রাক প্যান্ট আর রাউন্ড নেক টিশার্ট পরেছেন।
হাতের ঘড়িটাও দুর্মূল্য, সুইস তো বটেই। ওনার পাশে কি অস্মভব বেমানান আমি। দু একটা
ভালো জামা কাপড় ও আনিনি। মনটা আবার তেতো হয়ে গেল।
how to read?
ReplyDeleteIts in Bengali ...
DeleteThank you so much Sir, for your blessings
ReplyDeleteBeautiful!
ReplyDeleteBeautiful.
ReplyDeletebah...khub sundor
ReplyDeletebah...khub sundor
ReplyDeleteThank you so much
Delete