Thursday 9 April 2015

ভাল থেকো চয়ন



মন ভাল নেই। কিচ্ছু ভাল লাগছে না চয়নের। অফিসের সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ দাঁড়িয়ে এক টা সিগারেট ধরালো। বুক ভরে পড়ন্ত বিকালের ঠাণ্ডা হাওয়া টানলো, তাও যেন চাপটা কাটছে না।
সিঁড়ির দেওয়ালের না না দেব-দেবীর ছবি, যাতে এই ঝকঝকে দেওয়াল কেউ থুথু ফেলে নোংরা না করে। ঐ হাসি মুখের অভয় দেওয়া ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে রাগ আরও বেড়ে গেল। কেন? এত লোক থাকতে কেন চয়নের সাথেই এত অন্যায় করলেন ভগবান। দম বন্ধ হয়ে আসছে, মাথা ছিড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।
চয়নিকা মধ্য তিরিশ, অবিবাহিত, মাঝারি উচ্চতা, ছোটো করে কাটা চুল, পরনে ডেনিম আর কুর্তা, সেক্টর ফাইভের এক নামি বেসরকারি সংস্থায় মোটামুটি ভাল পদে কর্মরতা। মাইনে পত্র খারাপ পায় না। আপন বলতে দুই বোন আর এক কাকা। দুই বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। কাকা এক চূড়ান্ত বাউন্ডুলে লোক। তবু এই কাকাই চয়নের একমাত্র অবলম্বন।
দুই বোনেরই শ্বশুর বাড়ির লোকজন অত্যুৎসাহী চয়নের বিয়ের ব্যাপারে, কৌতুহল পাড়াপড়শির ও কিছু কম না। সবার ওপর অফিস কলিগেরা তো আছেই। সবার প্রশ্ন একটাই চয়ন কেন বিয়ে করছে না? আর কবে করবে? চয়ন সব সময় কাকাকেই শিখণ্ডী খাড়া করে, দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলে, “ আমি তো বিয়ে করে চলে যাব, কাকাকে দেখবে কে?”।
খুড়ো মশাই অতি ধুরন্ধর। অন্য লোক হলে, নির্ঘাত বলত, “আমার জন্য কেন নিজের জীবন বরবাদ করছিস? আমার ঠিক চলে যাবে।” কিন্তু কাকা কিছুই বলে না। শুধু মিটিমিটি হাসে। চয়ন প্রচুর খোঁটা দেয়, মাঝে মাঝে মুখঝামটাও মারে। কিন্তু কাকা যেন সর্বংসহ। কাকার উপস্থিতি আর ভালবাসাই চয়নের বেঁচে থাকার রসদ।
কষ্ট হয় চয়নের, ভীষণ কষ্ট হয়। ভয় করে। ভুলে থাকার চেষ্টা করে। ভুলেও যায়। মেতে ওঠে জীবনের রঙে। সাধ্যাতীত পরিশ্রম করে। দশ জনের কাজ একা করার চেষ্টা করে, ক্লান্তির শেষ সীমানায় টেনে নিয়ে যেতে চায় নিজেকে। যাতে করে, রাত্রে বিছানায় গা দিলেই অতল ঘুমে তলিয়ে যেতে পারে। রাতকে চয়নের বড় ভয়। কিন্তু চয়নের দেহ এক্ষেত্রেও বিশ্বাসঘাতকতা করে।
দেহ-মনের এই দ্বৈরথে আজ বড় ক্লান্ত, নিঃস্ব, রিক্ত চয়ন। যখন শিশু ছিল, অবোধ ছিল তখনই ভাল ছিল। জীবনের এক মাত্র সুখের সময়। নারীত্বের লক্ষন যেমন যেমন প্রকাশ পেতে লাগলো, আতঙ্কে ভুগতে লাগলো চয়ন।স্কুলে ওর প্রিয় বান্ধবী ছিল তিস্তা। কতদিন ওরা হাত ধরাধরি করে ঘুরেছে। মেয়েদের স্কুলে বাচ্ছারা তাই করে। আদপে দৃষ্টিকটু না। কিন্তু আঙ্গুলে আঙ্গুলে যে এত কথা হতে পারে, প্রতিটা স্পর্শ যে এত বাঙময় হয় আগে তো বুঝত না চয়ন। তিস্তার আলিঙ্গন এত মোহময় আগে কখনও লাগেনি। কথায় কথায় তিস্তার ওকে জড়িয়ে ধরা, সে শিহরণ আজো চাইলেই অনুভব করতে পারে চয়ন। তিস্তার সাথে ওর শারীরিক নৈকট্য বোধহয় শালীনতার সীমা স্পর্শ করব করব করছিল, মৃদু গুঞ্জন কানে আসতেই চয়ন নিজেকে সরিয়ে নেয়। সবথেকে বেদনাদায়ক ছিল তিস্তার আচরণ,ও কোনদিনই কিছু বোঝেনি। চয়ন শুধুমাত্র ওর প্রিয় বান্ধবী ছিল। আজো যেমন আছে।
তিস্তার পর দোলা। দোলনচাঁপা। কথায় কথায় বলত, “চয়ন, তোকে আমি বড্ড ভালবাসি রে।” চয়ন, ঘরপোড়া গরু, বলতো, “ভাগ শালা।” কিন্তু দোলার সেই স্ফুরিত অধর, ব্যথা-বিদুর চোখ, তাড়িত করতো বিশ্বাস করতে। আজকাল তো লোকে ধন্যবাদ না বলেও “আই লাভ ইউ” বলে। কি করে বিশ্বাস করতো চয়ন? চয়নও  অবশ্য কোনদিন বলে উঠতে পারেনি। ক্ষুব্ধ দোলা বলতো, “দেখিস, যে দিন আমি থাকব না, সেদিন তুই বুঝবি।”
আজ দোলা কোথায়? দিব্যি মায়ের চাপে বিয়ের পিঁড়িতে উঠেছে। কি যেন বলছিল বিয়ের আগে, “ মন থেকে সাড়া পাচ্ছি না। বিয়ে না করলে দাদার বিয়ে হচ্ছে না।” ইত্যাদি ইত্যাদি। ও রকম সবাই বলে। দোলার বিয়েতে কি খাটাই না খেটেছে চয়ন, দোলা এক বার তাকায়নি পর্যন্ত। ঘাড় শক্ত করে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিল। অন্য বন্ধুদের সাথে দিব্যি মিষ্টি হেঁসে কথা বলেছে, চয়ন ওর হাত ধরে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিল, ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়েছে। কিসের এত ক্ষোভ ওর? বিয়ের পর দোলার একটা ফোন ধরেছে? আছে অথচ নেই। ফেসবুক থেকে জানতে পারে ওরা কোথায় বেড়াতে গেছে, চয়ন অনাহুতের মত কমেন্ট, ইনবক্স মেসেজ করে, দোলা নিরুত্তর। প্রতি পদে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে বুঝিয়ে দেয় দোলা ওর পরোয়া করে না। ঞ্জানতঃ চয়ন কারো মনে কোনদিন কষ্ট দেয়নি, অথচ দোলা যেন ওর হৃদপিণ্ডটাই ফুটো করে দিয়েছে। কাঁদতে পারে না, এটাই ওর সবথেকে বড় দুর্বলতা।
ফেসবুকে লোকে সমকামীদের নিয়ে কত কিছু লেখে, প্রচণ্ড রাগ হয় চয়নের, “ শালারা আয়, আমার জুতোয় পা গলিয়ে দেখ। যত ভণ্ডের দল। কটা গল্প, উপন্যাস লেখা হয় চয়নদের নিয়ে? একটা সিনেমা ওঠে? আর যা তোলা হয়, টা দেখে ওর হাসি পায়। ওর এক সুন্দরী সহকর্মী তার পুরুষ বন্ধুর দেওয়ালে একবার লিখেছিল, “উফ! ভাল ছেলে পাওয়া এত কষ্টকর জানলে আমি লেসবিয়ান হতাম।” সাঁটিয়ে একটা চড় কসাতে ইচ্ছে করছিল চয়নের। আজ যেমন অফিসে দীপক আর রণিত, দুই মেয়েবাজ গল্প করছিল, “ও সব সমকাম-টাম কিস্যু না। ছেলে গুলোকে চাবকানো উচিত, আর মেয়েদের জন্য তো আমরা আছিই।” আজ আর সহ্য করতে পারলো না চয়ন, বাথরুমের নিভৃতে উগরে দিল নিজের সমস্ত ক্ষোভ। বহুদিন বাদে কাঁদল চয়ন, ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগলো সব ব্যথা – বেদনা, নিস্ফল আক্রোশ, অক্ষম রাগ। তীব্র ধিৎকারে ভরে ওঠে ওর মন, প্রতিবাদ না করতে পারার অক্ষমতার গ্লানিতে নিজেকে কৃমিকীটের অধম বলে মনে হয়।  
ইএম বাইপাসের এক নামি বেসরকারি হাসপাতালের ওপিডিতে মাথা নীচু করে বসে আছে চয়নিকা। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে আজ এখানে এসেছে ও। শেষ চেষ্টা, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার। ওর ডাক আসতে দরজা ঠেলে ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকল চয়ন, ডাঃ ইশারায় ওকে বসতে বললেন। ডাঃ সুতপা সেন, মনোবীদ, প্রায় পঞ্চাশ, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ, দোহারা চেহারা, হেনা করা লালচে চুল, রিমলেস চশমার আড়ালে এক জোড়া সহমর্মী চোখ, কালো দামি সুতির শাড়িতে সোনার ব্রোচ আটকানো দেখে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল চয়নের। ডাক্তার উৎসুক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন, হঠাৎ ওর মনে হল, এখানে আসাটা খুব ভুল হয়ে গেছে। কি চায় ও? কেন এল? কি বলবে ডাক্তারকে? অস্ফুটে নিজেকে অশ্রাব্য গালি দিতে লাগল চয়ন। মাথা নীচু করে ফোনটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল, এক, দুই, তিন মিনিট কাটছে না ঘণ্টা? ডাঃ ও কিছু বলছে না কেন? নাঃ আর বসা যায় না। “দুঃখিত, আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য। চলি” উঠে দাঁড়িয়ে বলল চয়ন। ডাঃ এর ভ্রূ দ্বয় সামান্য কোঁচকাল, খর হল চোখের দৃষ্টি। পরিষ্কার বাংলা এবং ইংরাজি উচ্চারনে কেটে কেটে বললেন, “ মাঝে মাঝে দু এক জন অপোগণ্ড আসে তাদের কিশোর পুত্রকন্যা কে নিয়ে, আমি তাদের ঘাড় ধরে বার করে দি। আমি ডাক্তার চয়নিকা, ভগবান নই।”
অনেক কথা হল, তর্ক- বিতর্ক, খেলা, বিনোদন, রাজনীতি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা, হল না শুধু চয়নকে নিয়ে কোনো কথা। বহুদিন বাদে হাল্কা লাগছিল, আরও বসতে ইচ্ছে করছিল, ডাঃ সেন ও উঠতে বলছিলেন না। তবু উঠল ও। আরও পেশেন্ট অপেক্ষা করছে।  আসার সময় সুতপাদি বললেন, “ভালো থেকো চয়ন।” মাথা নেড়ে বেরিয়ে এল, ও।
হাল্কা লাগছিল। লিফটের লাইনে না দাঁড়িয়ে সিঁড়ি ধরল। পুরো দেওয়ালটাই স্বচ্ছ কাঁচের, বাইরে ঝকঝকে সোনা রোদ, নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘের নকশা সোচ্চারে ঘোষণা করছে মা আসছেন। মনটা আরও খুশিতে ভরে উঠল চয়নের। খুব ইচ্ছা করছিল একটা সিগারেট ধরাতে, নিদেন পক্ষে একটা বিড়ি হলেও চলবে, জোর করে নিজের অবুঝ মনকে শান্ত করে নীচে নেমে এল। দেরি হয়ে যাচ্ছে, অফিসে বলা আছে যদিও। একতলার ঝাঁ চকচকে ক্যাফেটেরিয়াটা দেখে আর লোভ সামলাতে পারলো না, চয়ন। “ধুত্তোর, নিকুচি করেছে” বলে এক কাপ কফি আর বানানা ওয়ালনাট ব্রেড নিয়ে আরাম করে জানলার ধারে বসল।
সত্যি শরৎ কালের যাদু আছে, আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল চয়নিকা, হঠাৎ বুক পকেটে মুঠো ফোনটা সজোরে কাঁপতে লাগল। এক পলকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল ওকে, নির্ঘাত অফিস। মুখটা মুহূর্তের জন্য তেতো হয়ে গেল। ধরবেই না আজ ও, যত পারে কাঁপুক। কিন্তু কম্পনের কি রকমফের আছে? তা না হলে এ কম্পন কেন এভাবে চয়নের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছে? স্থির থাকতে দিচ্ছে না ওকে, হঠাৎ এক জুয়া খেললতে ইচ্ছে করল চয়নের, চোখ বুজে আন্দাজে ফোনটা বার করে, কানে দিয়ে, বিপক্ষকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ও বলে উঠল, “ দোলা, আমি ভাল আছি রে।”
image courtesy Google

No comments:

Post a Comment