Thursday 10 May 2018

অনির ডাইরি

অনির ডাইরি ১০/০৮/১৮
-শাড়ি পরেছো? কি সুন্দর লাগছে। কাল ছিলে না বুঝি?
-ছিলাম তো।
-ও মা,কোথায় বসেছিলে? আমি ভাবলুম, রোজই তো থাকে। আজ কি হল-
(কিছুক্ষণ পরে)
-ঘুম পাচ্ছে? আহা মুখটা শুকিয়ে গেছে গো।
-না।  না। 
-ঘুমিয়ে পড়ো না। আমি ডেকে দেব খন।
- না।  না। সকালে গাড়িতে ঘুমিয়েছি। ঘুম পাচ্ছে না। আপনার কি নাইট ডিউটি?
-হ্যাঁ গো। আমার নাইট।
-ও তাহলে? রাতে ঘুমাতে পান না?
- পাই। পাই না, তা নয়। দু তিন ঘন্টা ঘুম হয়। তারপর আর ঘুমাতে সাহস হয় না। বড় ভয় লাগে।
-কিসের ভয়?
- এতবড় বাড়ি। খাঁ খাঁ করছে। শুধু দুটি প্রাণী।
-পেশেন্ট আছে না?
-হ্যাঁ।  আছে তো। ওণার অনেক বয়স। ৮৮। কিছুদিন আগে ওণার স্ত্রী মারা গেছেন। ঘুমালেই ভয় হয় যে তিনি বোধহয় হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন। এণার তো কোনদিকে নজর নেই, তিনি সবদিক খেয়াল রাখত। যত রাতই হোক, বেতো মানুষ শোবার আগে সিঁড়ি ভেঙে একবার অন্তত একতলা থেকে তিনতলা ঘুরে দেখে আসত, সব দরজা জানলা বন্ধ আছে কিনা। সব তালা দেওয়া কি না। তালা গুলোকেও টেনে দেখতো। আহা তিনি মারা গেল,এণার সেরিব্রাল হল। প্যারালিসিস হয়ে কি অবস্থা। পুরো শয্যাশায়ী ছিলেন কত্ত দিন।
-ইশ্। ছেলেমেয়ে?
-সে বড় বেদনার গো। একমাত্র ছেলে,মাত্র বাইশ বছর বয়সে আমেরিকায় বাইক এ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়।
-হে ভগবান।
-হ্যাঁ গো। মেয়ে আছে। দিদি আমেরিকায় থাকেন। আমেরিকার ইস্কুলের দিদিমণি। খুব শিক্ষিত। জামাই ও। পিএইচডি করতে গেছে আমেরিকায়। ওরা ওখানেই থাকে। দিদি আসে, বছরে একবার। মাস দুয়েক ছুটি নিয়ে। এসে সব ঠিকঠাক করে। এই ঠাকুরঘরের আলো জ্বলছিল না,ঠিক করাল। ঘরদোর  রঙ করালো। প্রতি বচ্ছর বাড়ি রঙ করায়।
-বাঃ।
-হ্যাঁ গো। উনিও খুব শিক্ষিত। শিবপুর থেকে এঞ্জিনিয়ার। বিশ বচ্ছর নাইজেরিয়াতে ছিলেন। আমেরিকা, বিলেত, রাশিয়া হেন দেশ নেই যেখানে যাননি। কত টাকা বাপরে। টাকার গদির ওপর শুয়ে থাকেন।
-বাঃ।
-হ্যাঁ গো। হেন ব্যাঙ্ক নেই, যেখেনে ওণার অ্যাকাউন্ট নেই। কত গিফ্ট আসে ওণার নামে। সারাদিন শুধু বই পড়েন। বাড়ি ভর্তি শুধু বই আর বই। আর সন্ধ্যে হলেই টিভি। ছটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত। টিভি দেখতে দেখতে মদ খান। রোজ। দু গেলাশ।আলমারি ভর্তি বিলিতি মদের বোতল। দিশী জিনিস পত্র ছুঁয়েও দেখেন না। কি সুন্দর সব বোতল।  এগারোটায় ঐ সিরিয়ালটা শেষ হয়। তারপর ঘুমের ওষুধ খান, আর ঘুমিয়ে পড়েন।
-বাঃ। তাহলে আপনি ঘুমান না কেন?
-ঐ যে ভয় লাগে। মনে হয় বুড়ি বোধহয় ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়ি ময়। তাছাড়া তিনি রাত বারোটা আর তিনটেয় ওঠেন। ঘুমিয়ে পড়লে ডাকেন ও না। একা একাই বাথরুম যাবার চেষ্টা করেন। যদি পড়ে যান কি হবে?
-তো আপনি অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমোলেই তো পারেন।
-দিদি মানে ওণার মেয়েও তাই বলে। আমিই পারি না গো। এই ভাবে পনেরো বছর রাত জাগছি। আজকাল বড় অসুস্থ হয়ে পড়ি। খাবার হজম হয় না। পেসার বেড়ে যাচ্ছে।
-আহা। দিনের বেলা ঘুমান?কটায় বাড়ি ফেরেন?
-ঐ সাড়ে আটটা নটার ট্রেনটা ধরি।
-তারমানে এগারোটা তো বেজেই যায়?
-তাও যায় মাঝেসাঝে। কি আর করা। বাড়ি গিয়ে রান্নাবান্না করা। বাসন মাজা। কাপড় ধোয়া। কত্ত কাজ। চাট্টি ভালোমন্দ রেঁধে রাখি। ছেলেটার জন্য। আমার বর ছেলে রাতেই ভালোমন্দ খেতে পায়। সকালে বাসি পান্তা খেয়ে বেরোয়। কি করব বলো? ওদের টিপিনটাও বানাই। এই করতে করতে বিকাল চারটে। তারপর আর কখন ঘুমাব? আবার তো সোয়া ছটার ট্রেন ধরে ছোটা।
-ইশ্। ধকল তো কম নয়। আপনার বয়সে।
-হেঃ। হেঃ। কি করব বলো। কতদিন যে ছেলেটার সাথে প্রাণভরে গল্প হয় না।
-কেন ছুটির দিন?
-কার ছুটি? আমার?হেঃ হেঃ হেঃ। বলে কি?আমি কি তোমার মত অফিসে কাজ করি? গুমুত ফেলা আয়া মাসিদের কোন শনিবার রবিবার পরিবার নেই গো সোনামণি। যতদিন গতর চলে, ততোদিনই রোজগার। না গেলেই পয়সা কাটবে। সারা বছরে আমি শুধু একদিন ছুটি নি,লক্ষ্মী পুজো করি তো। একটা মেয়ে আছে,ও ডবল করে দেয়। তবে আর পারিনি গো। ছেলেটার কিছু হয়ে গেলে ভাবছি ছেড়ে দেব। (অন্যমনস্ক ভাবে, উদাস সুরে)তবে ওণার জন্য বড় কষ্ট হয়। বড় নিঃসঙ্গ উনি। কত গল্প করেন জানো। দেশ বিদেশ,কোরান, উপনিষদ,বেদ সব নিয়ে ওণার অগাদ পাণ্ডিত্য। বড় শ্রদ্ধা করি ওণাকে। এত ভালো মানুষ। এতটাকা। তাও শেষ বয়সে এত নিঃসঙ্গ-
(এরপর নৈহাটি লোকালের ঝিমানো লেডিজ কামরায় ঘুরে বেড়ায় একরাশ দীর্ঘশ্বাস)
অনির ডাইরি ২৪/০৭/১৮
দৃশ্য-১
"ম্যাডাম!" "বলুন?"
“ট্রেড ইউনিয়নের কি জেনারেল ম্যানেজার হয় ম্যাডাম?”
“কেন বলুন তো?কি হল আবার?এটা জানতে ফোন করেছেন সক্কাল সক্কাল?”
“আপনার পাঠানো চিঠির খামে ঠিকানা লেখা, প্রতি, জেনারেল ম্যানেজার, অমুক ট্রেড ইউনিয়ন-”
সর্বনাশ। কে লিখেছে? সোমনাথ? প্রীতি? রণিত? মান সম্মান আর রাখলে না দেখছি, জুট মিলেরটা জেনারেল ম্যানেজার আর ট্রেড ইউনিয়নেরটা জেনারেল সেক্রেটারি, তেলে আর জলে মিশিয়ে দিয়ে বসে আছো? আমার চিঠি দেখে টুকতে গিয়েও ভুল? কাজের সময় মন কোথায় থাকে?
দৃশ্য-২
“ম্যাডাম, আমি এত কম টাকা কেন পেলাম?”
“উ?”
“আমি জানতে চাই, আমায় এত কম টাকার অর্ডার করলেন কেন?”
“আরে বাবা, আপনি যা কাগজপত্র দিয়েছেন, তার ওপরেই তো ক্যালকুলেট করব? ফাইন্ডিংস্ টা পড়ে দেখুন, তাতে সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মত সব বলে দেওয়া আছে, কিভাবে আমি নির্ধারণ করলাম, আপনি কত টাকা পেতে পারেন।“
“আপনি তো শুধু ম্যানেজমেন্টের আর্গুমেন্ট শুনলেন, গরিবকে তো সুযোগই দিলেন না। উনি আমাকে জেরা করলেন, অথচ আমি ওনাকে করতে পারলাম না।“
“আপনার উকিল করল তো? আপনার সামনে প্রশ্নোত্তর চলল, আপনি সই করলেন?”
“সে তো আমার উকিল করল। উনি তো আর আমার কথা জানেন না?” 
“উফ ভগবান!”
দৃশ্য-৩
“ম্যাডাম আসব?”
“বলুন এবার আপনার কি চাই?”
“ম্যাডাম আপনার লোক তো কই জানালো না? কটা মাল চাই। কিনে ছাপাতে হবে তো, আমার লোক মাল আনতে কলকাতায় গিয়ে বসে আছে।“
“কি যন্ত্রণা। রমেশ? শ্যামা বাবুকে জানাও নি? একটা কাজ কি কেউ সম্পূর্ণ কর না? সব আমার মাথায় চাপাতে হবে?”
“আচ্ছা। ম্যাডাম। সরি ম্যাডাম। আপনি রেগে যাবেন না ম্যাডাম এখুনি জানাচ্ছি।”
“সেটা ছাড়ো। এখনও জানানো হয়নি কেন? জবাব দাও?”
“কি করব ম্যাডাম, প্রমিত বাবু বললেন, ‘মেলে আছে দেখে নে।‘”
“বাঃ। কি আনন্দ। আমিই দেখি তাহলে? যত সব-”
দৃশ্য-৪
“ম্যাডাম, আপনার চা নিয়ে আসি?”
“হু।“
“সাদা না কালো?”
“যা খুশি। প্রচন্ড মাথা ধরেছে, একটু কড়া হয় যেন। আর পুঁচকে কাপে নয়।”
“বুঝতে পেরেছি। আমার খাবার গ্লাসটা মেজে আপনাকে দিচ্ছি দাঁড়ান।“
“আরে ধুর বাবা। অতো চা কি করব? স্নান?”
দৃশ্য-৫
“আসছি?ম্যাডাম।”
“বলুন?এই আপনারা এই সেদিনই ডেপুটেশন দিয়ে গেলেন না?”
“ হ্যাঁ। সেগুলো সব পেয়ে গেছি ম্যাডাম। আজ আরো কয়েকটা কেস দিলাম, একটু বলে দেবেন যেন ছেড়ে দেয়।“
“সে তো এমনি দেবে। সব কাগজ পত্র ঠিক থাকলে আর কি চাপ?”
“তবু ম্যাডাম, আপনি জানেন না কি করুণ অবস্থা ওদের, রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে গরম পিচের ড্রাম উল্টে পড়েছিল, ছেলেটি গায়ে।বেঘোরে মারা গেছে। “
“ইশ।”
“আরো শুনবেন ম্যাডাম? ছয় বছরের বাচ্ছা মেয়ের মাথায় টিউমার, বাবা-মায়ের কি মানসিক অবস্থা ভাবুন। সর্বস্বান্ত  হতে বসেছে ম্যাডাম।লোকটি রিক্সা চালায়। বউটি সেলাই দিদিমণি। কোথায় পাবে? সাড়ে চার লাখ টাকা খরচা হয়ে গেছে, আবার ভেলোর যাবে-”।
দৃশ্য-৬
-ম্যাডাম, লাইফ সার্টিফিকেট সই করাব, এখন আসব? না কি টিফিন হয়ে গেলে?
-টিফিন তো আসেই নি। আপনিই আসুন। কি করতেন?
- বাস চালাতাম।
-এখন চালান না?
-উ হু।
-কেন? চোখ?
- চোখ নয় ম্যাডাম, আমি ৩৫ বছর অমুক রুটে বাস চালিয়েছি, কিন্তু তখন এতো ছোট গাড়ি ছিল না ম্যাডাম, আর ছেলেপুলেও এতো বিপজ্জনক ভাবে বাইক চালাতনি।
-হু। তা আপনি ৩৫ বছর বাস চালিয়েছেন, কটা লোককে টপকেছেন?
- হেঁহেঁ, না ম্যাডাম, মানুষ না, তবে বার কয়েক গরু-
দৃশ্য-৭
-“ম্যাডাম, টাকা ঢুকে গেছে, অসংখ্য ধন্যবাদ।“
“অ্যাঁ? টাকা? কিসের টাকা?”
“দুলাখ টাকা? অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ।“
- “আরেঃ বাঃ। খুব ভালো? তা বেনিফিশিয়ারি কোথায়? তার তো একটা ছবি তুলে রাখতে হবে, নোটিশ বোর্ডে।“
- “সে তো স্বর্গে চলে গেছে ম্যাডাম। তার বউ চলবে?
দৃশ্য-৮
- ম্যাডাম আসছি?
- কি চাই?
- ম্যাডাম চিনতে পারছেন? সেই যে দেখা হয়েছিল? অমুক দপ্তর-
- অ। বলুন কি চাই?
- ম্যাডাম, শুনুন না, আগের বার আপনি অনেক হেল্প করেছিলেন, এবারো একটু করে দিন না। বেচারা বুড়ো মানুষ, কটা টাকার জন্য দরজায় দরজায় ঘুরছেন।
- কিসের টাকা?
- পি এফ।
- এই ভাগো। পি এফ আমার অফিসের দায়িত্ব নয়।
- জানি ম্যাডাম। আপনি তো আগের বার বলে দিলেন পিএফ কমিশনারের অফিসে যেতে। আমরা গিয়েছিলাম, ওনারা একটা ফর্ম দিয়েছেন, ইনি বুঝতে পারছেন না, কি করে ফিল আপ করে। একটু বলে দিন না-।”
দৃশ্য-৯
- আবার আপনারা? না। না। আমি আর কোন মানুষের দুঃখ দুর্দশার গপ্প শুনব না। প্রচুর কাজ।
- শোনেন না ম্যাডাম, একটা প্রতিকার তো চাই, একজনের বই হারিয়ে গেছে।
- ইন্সপেক্টরকে বলুন ও ডুপ্লিকেট বার করে দেবে। এই জন্য আমায় জ্বালানোর কি কোন দরকার আছে?
- জানি ম্যাডাম। আমি কি আর আজ থেকে ট্রেড ইউনিয়ন করছি? আপনি হয়তো তখনও জন্মাননি, তখন থেকে এই গরীব মানুষ গুলোর জন্য খাটছি। ডুপ্লিকেট বার করতে হলে তো বইটার নম্বর চাই।
- -ও। তাও নেই? ভালো। টাকা দেবার রসিদ? তাও নেই? অসাধারণ।যে বলবে কাক এ কান নিয়ে গেছে, অমনি আপনি এসে আমায় জ্বালাবেন?
- কি করব ম্যাডাম, এসব নিয়েই আছি। জানেন তো আদিতে আমরা পূর্ববঙ্গের অধিবাসী, বাবা সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে ১৯৪২এ এদেশে চলে এসে ডানলপে চাকরী নেন, তাই আমাদের ভাইবোনেরা আজ সবাই মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছি, মাঝে মাঝে ভাবি, জানেন, যদি বাবা, বাড়ি জমি আঁকড়ে পড়ে থাকত, কি হত? ৭২এ পালিয়ে আসতে হত এক কাপড়ে। তখন আমার মা হয়তো লোকের বাড়ি বাসন মাজত আর বাবাকে ভ্যান রিক্সা চালাতে হত-
এতরকম মানুষ আর এত ধরণের আবেগ অনুভূতিস্নাত হয়ে বাড়ি ফেরার পথে ভুলেই যাই, আজ ভোরে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে কাঁচা ঘুম চটকে যাবার হতাশায় মনে হয়েছিল কি সাংঘাতিক বর্ণহীন আমার।কাজের সাথে ভালোলাগা আর ভালোবাসার নিবিড় সম্পর্কের ফলে আপাতত পূর্ণ এ ঝুলি।  আপাততঃ বড় বেশী রঙীন এ জীবন।  কাল সকাল অবশ্য আবার অন্য বার্তা বহন করে আনবে- এই তো জীবন কালি দা।
অনির ডাইরি ১৪ই জুলাই ২০১৮
আশির দশক বিদায় নিচ্ছে, ধীরে ধীরে পাখনা মেলছে সহস্রাব্দের শেষ দশক। ছাপোষা মধ্যবিত্ত শহর,আজ যার পুঁচকে গলি দিয়েও দৌড়য় মূল্যবান বিদেশী গাড়ি, তখন চলত শুধুই সাইকেল আর স্কুটার। ছোটকাকুর সাইকেলের সামনে আবার আলো লাগানো ছিল। পুরোনো বাড়ি আমাদের,নিপাট মধ্যবিত্ত সংসার। আলসে ফাটিয়ে হুড়মুড় করে বৃদ্ধি পাচ্ছে বট আর অশ্বত্থ  গাছের চারা। কড়ি বরগা ওলা ছাতে প্রতি বর্ষাতে সিমেন্ট সোডা আর গোবরের প্রলেপ পড়ে, তাও জল পড়ে। লোহার শিক দেওয়া জানলা আর বারন্দার আগল উপেক্ষা করে যথেচ্ছ উড়ে বেড়ায় চড়াই। বাসা করে ঘুলঘুলিতে। কার্নিশে বাস বাঁধে,ডিম পাড়ে পায়রা আর ঘুঘু।
সন্ধ্যা নামলেই ঝুপ করে লোডশেডিং। ক্লান্ত হাতে ঠাকুমার হাতপাখা বিজন। মাদুর পেতে রোয়াকে শুয়ে আকাশের তারা দেখতে দেখতে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর মধুর গল্প শোনা।
এরই মাঝে রথযাত্রা। সারা বছর রথ বা জগন্নাথদেবকে নিয়ে আদৌ ভাবনা চিন্তা করতাম না আমরা। কিন্তু রথের সময়, তাঁকে অগ্রাহ্য করে সাধ্য কার? পুঁচকে রথে পুরী থেকে আনা গোলাকার চাকতি, তাতে সহোদর সহোদরাসহ আসীন কেলে জগন্নাথ। বাবা মায়েরা ছিল সাক্ষাৎ  হিটলার। অফিসে বেরিয়ে গেলেই আমরা তিন গুড়গুড়ি ভাইবোন শুরু করতাম উপদ্রব। বৃদ্ধ ঠাকুমা অস্থিসার কিন্তু মানসিক এবং শারীরিক সক্ষমতা অতুলনীয়। আর ছিল মেজো পিসি। আর মায়া দি। বাঁশবেরিয়ার কোন ধনাঢ্য পরিবারের বন্ধ্যা এবং পরিত্যক্তা গৃহবধু। রথ সাজানো হত  বাড়ির বাগানের দোপাটি,কৃষ্ণচুড়া আর নীল অপরাজিতা দিয়ে। জ্যাঠাইমার হাতে গাঁথা মালা পরে তৈরি তিনভাইবোন, এবার আমাদের তিনভাইবোনের পালা রথ টানার। সাথে ঠোঙায় মোড়া সাদা বাতাসা। রথ যায়। রথ যায়। আমাদের গলি টপকে, গয়লাপাড়ার সরুর রাস্তা ধরে, তালপুকুর হয়ে কালিপ্রসাদ ব্যানার্জী লেন ধরে, ক্ষীরের তলা বারোয়ারিকে পাস কাটিয়ে রেশন দোকানের সামনে দিয়ে লেবুতলা গলি হয়ে বড়পুকুরকে চক্কর মেরে হৃদয়কৃষ্ণ ব্যানার্জী লেন। পথে খানাখন্দ, জলকাদার ওপর দিয়ে গড়গড়িয়ে চলে অয়ন-অনিন্দ্য আর অনিন্দিতার রথ। পথে দেখা হয় অন্য রথটানা বাচ্ছাদের সাথে,বিনিময় হয় বাতাসা, আড়চোখে গম্ভীর ভবে পর্যবেক্ষণ চলে, ওদেরটা বেশী সুন্দর নয় তো? নাঃ।

গড়গড়িয়ে চলে মহাকালের রথও। কেটে গেছে কত বছর। সেদিনের বাচ্ছা গুলো ব্যস্ত পিতামাতা। সপ্তাহব্যাপী রগড়ানির পর আরামের শনিবার। কিন্তু ক্রন্দনশীল কন্যার আব্দার আর তার নাস্তিক পিতার নাসিকা কুঞ্চনে ঝালাপালা আমার সপ্তাহান্ত। মেয়ের রথ চাই। আর বাবা কিছুতেই কিনে দেবে না। রথ কি হবে? আজ একটু দড়ি ধরে টানবে, তারপর সারাবছর কোথায় পড়ে থাকবে? আর মেয়ে অতি ধান্ধাবাজ, ইচ্ছে করেই নাকি কান্নাকাটি  করছে, বন্দুক দিয়ে অ্যাটেনশন শিকার আর কি।
সত্যি বলছি মনে হচ্ছিল স্বয়ং হিটলারের সাথে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বাস করছি। শৈশব থোড়াই এত দূরদর্শিতা বা হিসেবী হবার সময়? ভাগ্যিস শ্বশুরমশাই ছিলেন। অসুস্থ শরীরে বিকাল তিনটের সময় বেরিয়ে গলদঘর্ম  হয়ে নাতনীর রথ আর মাটির জয় জগন্নাথ নিয়ে হাজির। বলতে ভুলে গেছি আমার দু নম্বর বাবাও কিন্তু ভয়ানক নাস্তিক। তবে দুই পুত্রবধু আর নাতনীর জন্য বাবা সব করতে রাজি।
তো যা বলছিলাম, আমরা মা মেয়েতে যখন রথ সাজাতে ব্যস্ত, মেয়ের পিতা তখন এসে হাজির রথ সহ। বিকালে হাঁটতে যাবার নাম করে, তিনি গিয়েছিলেন রথের সন্ধানে। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে রথ কিনে হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন। রথ দেখা আর শরীরচর্চা বুঝলেন কি না।
এসেই যথারীতি- সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী। ওসব কথায় কান দিই না। সত্যিই তো আমি দায়ী। আমার পরিবারের প্রতিটি মানুষের জীবনের যাবতীয় রঙের জন্য আমি ছাড়া আর কেই বা দায়ী হবে শুনি।

তো যাই হোক, টলটলে মহানাগরিক নীলাকাশে তখন পুঞ্জ মেঘের আঁকিবুকি , আর আমাদের আবাসনের ছাতে গড়িয়ে চলেছে দাদুর আনা রথের চাকা, সাথে তুত্তুরী অবিশ্রাম বকবক্। ”চল। আরে থামলি কেন? যাঃ বাবা, সুভদ্রা তুই উল্টে গেলি? মাসি অপেক্ষা করে বসে আছে, চল চল। মা তুমি এদের মাসি বেশ?” মনে মনে বললাম, ঐটাই বাকি আছে বাপ।
অনির সাপ্তাহিক রোজনামচা (পর্ব-১) ২ই জুলাই ২০১৮
কত কিছুই যে ঘটে যাচ্ছে  প্রতিটি মুহূর্তে, চোখ ধাঁধান শত বর্ণের বিচ্ছুরণে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে জীবন, শুধু লিখে ওঠার মত সময়ের বড় অভাব। আর কিঞ্চিৎ সঙ্কোচ,চতুর্দিকে মেধার ঝলকানির মধ্যে আমার আপাত সাধারণ রোজনামচা হাসির খোরাক হবে না তো? দেশ, ধর্ম, রাজনৈতিক সঙ্কট অথবা ক্রীড়াঙ্গনের মহারণ, কোন কিছু নিয়েই লেখার মত মেধার জোর আমার নেই। বড় সাধারণ আমি, তবু এই অতি সাধারণ সবকিছু নিয়েই চূড়ান্ত মুগ্ধতার জাল বোনা আমার বরাবরের অভ্যাস। আপাত রুক্ষ বাস্তব জগতেও কত যে মুগ্ধতার মণিমুক্তো ছড়ানো। শুধু দেখার মত চোখ আর অনুভব করার মত হৃদয় থাকলেই হল।সেই হৃদয়টুকুই এই অধমের সম্বল। আমাকে নিয়ে প্রাণ খুলে হাসাহাসি করুন, আমি স্বয়ং অংশীদার হব সেই উপহাসের, শুধু আমার লেখার পাত্রপাত্রীদের নিয়ে কোন কথা হবে না, দোহাই-

যেমন ধরুন ট্রেনে আনারদানা বিক্রি করে বেরানো সেই অশীতিপর বৃদ্ধ, তাহলে বরং খুলেই বলি,অফিস যাবার পথে ট্রেনে আমার একটি দোসর আছে, হুগলী জেলার তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের আধিকারিক, মন্দাক্রান্তা। ট্রেনেই আমাদের আলাপ এবং ট্রেনেই জমে ওঠা বন্ধুত্ব। অফিস টাইমে দৌড়তে দৌড়তে বিধাননগর স্টেশনে পৌঁছে যেদিন মন্দাক্রান্তার দেখা পাই না, সেদিনই সক্কাল থেকেই মেজাজটা যায় তেঁতো হয়ে। মুখে অবশ্য স্বীকার করি না, বরং প্রায়ই বলি, “এই শেষ আর তোমার সঙ্গে যাচ্ছি না।“ আসলে আমরা এককাট্টা হলেই কত কি যে কিনি তার ইয়ত্তা নেই। ঝুটো গয়নার প্রায় মিউজিয়াম হয়ে গেছে আমাদের বাড়িটা। গত পরশু দিন আমরা একসাথে যাচ্ছি, হঠাৎ তিনটে বল লাগানো লাঠি হাতে বৃদ্ধের আগমন। চলন্ত ট্রেনে উনি আমলকি, আনারদানা ইত্যাদি ফিরি করেন। পোশাকআশাক বলতে ধোপদুরস্ত সাদা হাফ শার্ট আর প্যান্ট। জনে জনে ফ্রি স্যাম্পল বিলি করছেন, আমাদেরও দিতে এলেন, আমরা দুজনে হাত নেড়ে জানালাম, চাই না। ও বাবা, বৃদ্ধের কি গোঁসা, মন্দাক্রান্তাকে লাঠি দেখিয়ে বললেন, “কি রে মা? খা। খা বলছি। নাহলে এই লাঠি দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব।“ হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। থুড়থুড়ে বুড়ো, লাঠি ঠুকঠুক করে হাঁটে, বলে কি না মারবে। এবার আমাকে বললেন, “তুই ও খারে মা। এই দাদুভাই নে ধর। খা বলছি।“ দাদুভাই বলতে আমার পাশে বসা একজন দিদিমণি।মুখে মুখ টিপে হেসে আমরা তিনজনই বাধ্য ছাত্রীর মত হাত বাড়িয়ে দিলাম। বুড়ো  বিগলিত হয়ে মন্দাক্রান্তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “রাগ করলি মা? বুড়ো ছেলেটা তোকে লাঠি দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেবে বলেছে, তাই কি রেগে গেলি মা?” মুখে কাঁচা আম দেওয়া আনারদানা চুষতে ব্যস্ত মন্দাক্রান্তার হয়ে জবাব দিলাম আমি,” রাগ করবে কি? ও তো পুলকিত হয়ে গেছে। কি তাই না?” প্রায় ৪৫ ডিগ্রি কোণে মাথা বেঁকিয়ে সম্মতি জানালো মন্দাক্রান্তা।
অনির সাপ্তাহিক রোজনামচা (পর্ব-২) ৫ই জুলাই ২০১৮
কত কিছুই যে ঘটে যাচ্ছে  প্রতিটি মুহূর্তে, চোখ ধাঁধান শত বর্ণের বিচ্ছুরণে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে জীবন, শুধু লিখে ওঠার মত সময়ের বড় অভাব। আর কিঞ্চিৎ সঙ্কোচ,চতুর্দিকে মেধার ঝলকানির মধ্যে আমার আপাত সাধারণ রোজনামচা হাসির খোরাক হবে না তো? দেশ, ধর্ম, রাজনৈতিক সঙ্কট অথবা ক্রীড়াঙ্গনের মহারণ, কোন কিছু নিয়েই লেখার মত মেধার জোর আমার নেই। বড় সাধারণ আমি, তবু এই অতি সাধারণ সবকিছু নিয়েই চূড়ান্ত মুগ্ধতার জাল বোনা আমার বরাবরের অভ্যাস। আপাত রুক্ষ বাস্তব জগতেও কত যে মুগ্ধতার মণিমুক্তো ছড়ানো। শুধু দেখার মত চোখ আর অনুভব করার মত হৃদয় থাকলেই হল।সেই হৃদয়টুকুই এই অধমের সম্বল। আমাকে নিয়ে প্রাণ খুলে হাসাহাসি করুন, আমি স্বয়ং অংশীদার হব সেই উপহাসের, শুধু আমার লেখার পাত্রপাত্রীদের নিয়ে কোন কথা হবে না, দোহাই-

যেমন সুদীপা। তখন পড়ন্ত বিকেল, ঘড়ির কাঁটা উর্ধবশ্বাসে দৌড়চ্ছে সাড়ে পাঁচটার দিকে। একঘর লোককে সদ্য দুসপ্তাহ পরের ডেট দিয়ে বিদায় জানিয়েছি,দরজা খুলে মুখ বাড়ালেন দেবী দি। শ্রীমতী দেবী দাস আমাদের পোলবা-দাদপুর ব্লকের একজন এসএলও। তারওপর আমাদের রমেশের মা। আমাদের দপ্তরে কদাচিৎ এলে অবশ্যই দেখা করে যান। তাই প্রীতি সম্ভাষণ জানাতে যাব, দেখি দেবী দি’র পিছনে আর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। ভয়ে ভয়ে ইশারায় অনুমতি নিয়ে ঢুকল। এসব ক্ষেত্রে প্রথমেই যা মনে হয় আর কি, হয়তে হবু পুত্রবধুকে আলাপ করাতে এনেছেন। দেবী দি সে রাস্তাতেই গেলেন না, উল্টে বললেন,“ম্যাডাম এ আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। আমরা এসেছি অনেকক্ষণ, আপনার ঘর আর খালিই হয় না। ” আমার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে শুনলেই মনে হয়, নির্ঘাত আবেদন করা সত্ত্বেও কোন অনুদানের টাকা পায়নি, তাই অভিযোগ জানাতে খোদ আমার দরবারে।
আমার দিকে তাকিয়ে দেবী দি হেসে বললেন,“ম্যাডাম আপনি একে চিনতে পারছেন তো?” ভ্যাবাচাকা খেয়ে মাথা নাড়লাম। দেবী দি বললেন,“ সেই যে ম্যাডাম গত বছর আমাদের নারী স্বশক্তিকরণ শিবিরে এসেছিল। ” প্রসঙ্গতঃ ২০১৭র মার্চ মাসে জনা পঞ্চাশেক মহিলাকে নিয়ে আমরা চুঁচুড়া মিউনিসিপ্যালিটিতে দুই দিন ব্যাপী এক “এমপাওয়ারমেন্ট অব উইমেন ইন ওয়ার্কপ্লেস” বলে ওয়ার্কশপ করেছিলাম। তাতে বিভিন্ন শ্রমআইন পড়িয়েছিলেন আমাদের ডেপুটি লেবার কমিশনার চন্দননগর শ্রী আশিস সরকার , ডোয়েস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট পড়িয়েছিলেন তৎকালীন হুগলী জেলা আইনি সহায়তা কেন্দ্রের সচীব শৌনক বাবু, হাত বাড়ালেই প্রশাসন বুঝিয়েছিল আমার প্রিয়তম বিডিও এষা আর সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট পড়িয়েছিল আমার অন্যতম প্রিয়বন্ধু দেবশ্রী দি। মাঝে সর্বঘটে কাঁঠালী কলা ছিলাম আমি।
তো হতেই পারে সেই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল মেয়েটি। কেজো গলায় বললাম,“বাঃ। ভালো আছো তো?” মেয়েটি সলজ্জ ভাবে ঘাড় নাড়ল। দেবী দি অবাক হয়ে বললেন,“ম্যাডাম আপনি কি ওকে চিনতে পারছেন না?সেই সময় ওর মা মারা গিয়েছিল। ও একদম ভেঙে পড়েছিল মানসিক ভাবে। পড়াশোনাও বন্ধ করে দেয়। আমিই জোর করে ধরে এনেছিলাম স্বশক্তিকরণ শিবিরে। সেই যে আপনি কত অনুপ্রেরণা দিলেন,বললেন ‘মা নেই সেটা মেনে নিয়ে উঠে দাঁড়াও। লড়াই কর। নিজের পরিচয় বানাও। আপনিই তো ওকে বলেছিলেন, যে আজকালকার দিনে নারীর শিক্ষিত এবং উপার্জনশীল হওয়া অবশ্যকরণীয়। বলেছিলেন পরনির্ভরশীল হওয়ার থেকে বা চুরি বাটপাড়ি করার থেকে স্বেচ্ছায় দেহব্যবসা করাও অধিক সম্মানের।শুধু মাত্র বিবাহযোগ্য সুপাত্রী হওয়া অথবা সুগৃহিনী হওয়া বা সন্তানগতপ্রাণা জননী হওয়াই একজন নারীর জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। নিজের পায়ে দাঁড়াও।’ আপনার কথা শুনেই ও সচেষ্ট হল, তারপর কত দৌড়দৌড়ি করে সদ্য একটা চাকরী পেয়েছে।”
সিরিয়াসলি এইসব কথা বা জ্ঞান আমি প্রায়ই দিয়ে থাকি এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস করি,কিন্তু কেউ যে তা আদৌ শোনে তা আমিও বিশ্বাস করি না। কেমন যেন অভিভূত হয়ে গেলাম। সত্যিই আমি কাউকে অনুপ্রাণিত করেছি!তাও এক সদ্য মাতৃহারা শোকাতুর তরুণীকে, ভাবতেই পুলক জাগছিল। বললাম,“চা বিস্কুট খাও। এত ভালো খবর। ”আমাদের কালেক্টরেটের সুজয় বাবুর তিতকুটে কালো চা আর দুটো সুজির বিস্কুট ছাড়া ঐ পড়ন্ত বিকালে আর কিছুই পেলাম না। মেয়েটি অনুমতি নিয়ে বাইরে গিয়ে নিজের চাকুরীতে যোগ দেবার চিঠিটি নিয়ে এল। ফিসফিস করে দেবীদির কানে কানে কি যেন বলল,দেবী দি একগাল হেসে বলল,“ম্যাডাম ও আপনার জন্য মিষ্টি আনছিল,আমি বললাম আজ ওদের অফিসে খাওয়া দাওয়া আছে। তাই স্প্রাইট এনেছে।” সে কি?কেন?  তুমি চাকরী পেয়ে যে জানাতে এসেছ তাতেই আমি অভিভূত। উঠে পড়লাম খানিক গপ্প করে না হলে ট্রেন মিস হবে, মেয়েটিকে বললাম , এখানেই থেমো না। আরো পড়াশোনা কর। আরো বড় হও।দয়া করে বিয়েটাকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য করো না। মেয়েটি হঠাৎ ঠক করে প্রণাম করে বসল, লাফিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আজকালকার মেয়ে প্রণাম করে নাকি? এখন তো “হাগ” এর যুগ। দেবী দি বলল,“ম্যাডাম এই প্রণামটা অন্যরকম। ” কি রকম কে জানে?শুধু এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে অফিস ছাড়লাম, মানুষের এত অনাবিল ভালোবাসা একদিকে গলিয়ে দিচ্ছিল করকর করছিল চোখ আর অপরদিকে এক অদ্ভুত গর্বে টানটান হয়ে উঠছিল শিরদাঁড়া,হ্যাঁ অন্তত একজন নারীকে আমরা শক্তিশালী করে তুলতে পেরেছি।

(আর একটু চলবে, আরো কয়েকজন বাকি যে)

অনির ডাইরি ২৪শে জুন ২০১৮
আমাদের শৈশবে “মাসকাবার” শব্দটি ছিল গভীর আনন্দের দ্যোতক। মাসকাবার মানে যে ঠিক কি তা না বুঝলেও এটা বুঝতাম যে আমাদের নিপাট মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে এই সময় আনন্দের ঝোড়া বাতাস বয়ে যায়, যার স্থায়িত্ব যদিও অতি স্বল্প তাও-। মাসকাবার মানেই অফিস থেকে ফিরে কালো রোয়াকে বসে, হ্লুদ বাল্বের আলোয় বাবা আর ঠাকুমার মাসকাবারির তালিকা তৈরি। একটা কালো মোটকা ডাইরির পাতায় সবিস্তারে লেখা ছিল, একটা সংসারের অবশ্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির নাম। চাল, আটা, ময়দা থেকে যাবতীয় ডাল, মশলা, সর্ষের তেল, রেপ্সিড, গুড় (রুটি আর ভেলি গুড় ছিল নিত্য জলখাবার), সাবান, সোডা – বাবা একে একে নামোচ্চারণ করত, আর ঠাকুমা জানাত কতটা লাগবে, আদৌ লাগবে কি না।

অতঃপর বাবার সাথে সোজা কালিবাবুর বাজারে সাধু শেঠের দোকান। বিশাল মনিহারী দোকান, ঢুকলেই পাঁচমিশালি মশলার ঝাঁঝালো গন্ধ। মাড়োয়ারিদের মত সাদা গদিতে, তাকিয়া নিয়ে সার দিয়ে বসে থাকতেন শেঠেরা, দোকানে সব সময় জব্বর ভিড়। তখন গোটা মশলার যুগ। শেঠেদের খাঁটি তেল-মশলা, সঠিক ওজন এবং বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল সুপ্রসিদ্ধ। হেন জিনিষ ছিল না, যা ওদের দোকানে পাওয়া যেত না। ভালো জিনিষ পাবেন, ভালো দাম দিতে হবে- তাতে তৎকালীন মধ্যহাওড়ার মধ্যবিত্তদের তেমন আপত্তি ছিল না। লিস্ট মিলিয়ে টাকা দিয়ে আসতে হত, পরের দিন ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে, ঝাঁকামুটের মাথায়, আসত মাসকাবারি। প্রতিবারই বৃদ্ধ অবাঙালী মুটেই আসত,  তাদের গায়েও লেগে থাকত মশলার গন্ধ। পঞ্চাশ পয়সা বা একটাকা পেলে স্যালুটের ভঙ্গিমায় প্রণাম জানিয়ে যেত।
সোনালী নস্টালজিয়ায় ভরিয়ে দিয়ে বিদায় নিল আশির দশক। নব্বইয়ের দশক নিয়ে এল ভাঙন। খণ্ডিত ছোট পরিবারের জন্য আর ঝাঁকামুটের মাসকাবারি লাগে না। বড় চটের ব্যাগেই হয়ে যায়। কবে যে সাধু শেঠকে ত্যাগ করলাম আমরা আর মনে পড়ে না। তার বদলে কদমতলার মধু শেঠ। ব্যাগে করে মাসকাবারি নিয়ে বাপমেয়েতে রিক্সা করে ফেরা। পাঁচ টাকা রিক্সাভাড়া, অগ্নিমূল্য, তবে মাসকাবারে এইটুকু বিলাসিতা তো চলতেই পারে?
নব্বইয়ের দশক শেষ হতে হতে, পাড়ায় গজিয়ে উঠল হরেক দোকান। পাড়ারই ছেলেপিলে সব, দাদা দিদিদের বন্ধুবান্ধব। কি করবে? কলকাতার সহোদরা শিল্পনগরীতে ততদিনে জাঁকিয়ে বসেছে শনি। ঝপাঝপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জুট মিল-কলকারখানা। অথচ সারি সারি বন্ধ মৃত কলকারখানার সমাধিতে নিরন্তর ফুটে চলেছে প্রেমের ফুল। একদিকে তীব্র বেকারত্ব, অন্যদিকে জাজ্বল্যমান প্রেম।পারিবারিক আভিজাত্যকে গুলি মেরে দোকান খুলে বসতে লাগল পাড়ার ছেলেরা, কারো চালের দোকান, তো কারো মনিহারি, কেউ বা সব্জি বেচে তো কেউ রবিবারে মুর্গি কাটে। মধু শেঠকেও ত্যাগ করলাম আমরা। পাড়ার জনি-লাল্টু-পল্লু জিন্দাবাদ।
নতুন সংসার শুরু করার অব্যবহিত পূর্বে, নিজের জাব্দা খাতা দেখে, একটা বাঁধানো খাতায় পুরো লিস্টটা টুকে দিয়েছিল বাবা। সংসার করব, অথচ মাসকাবারি আনাব না? এ আবার হয় নাকি? এখনও মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় দিন, মেয়ের মাসি আর আমি মিলে তৈরি করি মাসকাবারির তালিকা। পুঁচকে সংসার, একটা প্যাডের পাতাতেই হয়ে যায়, তাও আমাদের ঝাঁ চকচকে মার্কেটের ট্যাটুওলা,ব্রান্ডেড জামাকাপড় পরা দোকানদার সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে, ঐ লিস্টের জন্য। কোন কারণে, লিস্ট তৈরি না হলে, তাগাদা দেয়, “দিদি একটা ছেলে পাঠাব? লিস্টটা নিয়ে আসবে?” যদি কোন মাসে, একটু কম মালপত্র নেওয়া হয়, শৌভিককে নালিশ করে, “এত কম খেলে কি করে চলবে দাদা? আমাকেও তো খেতে হবে।“ তা বেশ, দিব্যি চলছিল, মাসের শেষে মাসকাবারির গল্প, মুস্কিল বাঁধাল মাসি। মাসির ওদের কোন জিনিসই পছন্দ হয় না। নিত্য ঘ্যানঘ্যান, “এক কাঁড়ি দাম নেয়। চিনিতে ধুলো। ডালে এত পাউডার কেন? মুগ কড়াইএ পোকা।“ উত্যক্ত হলেও তেমন পাত্তা দিতাম না। মুস্কিল হল, সপ্তাহান্তে মাসি যখন নৈমিত্যিক ছুটিতে, রান্না ঘর যখন শুধুই আমার একার, তখন হঠাত একদিন আবিষ্কার করলাম, চা পাতার সাথে একটি প্রকান্ড আরশোলার ঠ্যাং। ঈশ! ছিঃ!মাগোঃ!ওয়াক থুঃ। এই চা এতদিন খাচ্ছিলাম?এরই দাম আগে ৮০০ ছিল এখন ৯০০টাকা কেজি?তুলকালাম অশান্তি হল বাড়িতে, শৌভিকের ধারণা ওটা আমাদের বাড়ির আরশোলা। মাসি আর আমি জোর গলায় বললাম, লাল হিটকে কলা দেখিয়ে কিছু বিচ্চু বাচ্ছা আরশোলা মাঝেমাঝেই পেশী আস্ফালন করে বটে,আমাদের বাড়িতে এত বড় আরশোলা? নৈব নৈব চ।বললাম ছেড়ে দে, বিগ বাস্কেট করি, তো জবাবে শুনতে হল, দাম তো একই পড়বে, এরা করে খাচ্ছে। খামোখা এদের পেটে লাথি কেন মারবি?”
দাঁড়ান এখানেই গপ্প শেষ নয়, পরের সপ্তাহে, আমার বরের প্রিয় ডিশ রাঁধতে গেছি, তড়কা! মুগ কড়াইকে ধোবার জন্য জলে দিতেই থিকথিকে পোকার আস্তরণ পড়ে গেল জলের ওপর। কত পোকা রে ভাই? একটা আধটা মানা যায়, যত ডাল ততো পোকা? কে মানবে মশাই? আবার দাম্পত্য কলহ। পোকাগুলো আশা করি আমার পোষা নয়। শৌভিক হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “এ মাস থেকে নো মাসকাবারি। যেমন যেমন লাগবে,আশেপাশের দোকান থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অল্পবিস্তর নিয়ে আসব।বাঁধা খদ্দের আর হচ্ছি না।এমনিতেই তো রোজ  দোকান যেতে হয়।“ সঙ্গে সঙ্গত করল মাসি।
খুব ভালো কথা। তাহলে তুমি/তোমরা দায়িত্ব নাও।দিন দুয়েক ঠিকই চলল। দুকেজি চাল আর এক কেজি  চিনি দিয়ে নতুন ব্যবস্থার শুভারম্ভ হল। তবে চলল দিন তিনেক। মুখে যাই বলুক, সপ্তাহের মাঝে চাল-আটা-তেল- মশলা আনা মুখের কথা নয়। অত মনে করে বলা আরো শক্ত। ফলতঃ সপ্তাহান্তে রান্না চাপিয়ে দেখি, সর্ষের তেল এবং নুন দুই ফুরিয়েছে। মাসি বাড়ি যাবার আনন্দে বলতে ভুলে গেছে। এবার আর কোন ওজর আপত্তি শুনলাম না। দুদিন বাক্যালাপ বন্ধ রইল, তাও সই, সোজা অনলাইন মাসকাবারি অর্ডার করলাম। দুপুরে অর্ডার করা মাল, সযত্নে প্যাক করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল রাত দশটার মধ্যে। ঝকঝকে প্যাকিং। তকতকে মালপত্র। মাসিও খুশি। দাম ও বেশী নয়। প্রতিটা জিনিসের দাম বাবাকে দিয়ে যাচাই করিয়ে কেনা। প্রথম চোটে গাইগুই করা বরও আজকাল আর তেমন কিছু বলে না- এককথায় মাসকাবারির “মেটামরফসিস”। তবু কেন যে প্রতিমাসে লিস্ট করার সময়,স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠি বুঝি না। বাবার হাত ধরে অবাকবিস্ময়ে মাসকাবারি আনতে যাওয়া সেই বাচ্ছা মেয়েটাকে বড় হিংসে হয়-।
অনির ডাইরি,মে, ২০১৮

“আমার ভিনদেশী তারা একা রাতেরই আকাশে-”

হাওড়া ব্রীজ টপকেই থমকে গেল ওলা। সবে সকাল নটা।বৃহস্পতিবারের সকাল এখনও সাবালক হয়নি। গঙ্গার বুকে আলস্যে মোড়া হাল্কা ধোঁয়াশা। তর সইছে না, আর। উল্টোদিকের গাড়ির সারি মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে, থমকে শুধু আমরা।

“তুমি বাজালে একতারা আমার চিলেকোঠার পাশে”-

ব্যাপারটা কি?সাতসকালে অবরোধ? অবাঙালী ড্রাইভারের কানে ফোন- কাকে যেন বলছে,“আগে ড্রপ করি। তবে না শেয়ার। ” সবকিছুই গতিমান,স্থবির কেবল আমাদের সামনের নীল বাস। দুজন পুলিশ কর্মী দক্ষ হাতে ওদিকের গাড়ির রাশ ধরে -, অথচ আমরা? সামনের বাস আচমকা নড়ে উঠল-পলকে দৌড়ল আমাদের পক্ষীরাজ। বেশ খনিকটা গিয়েই গাড়ি ব্যাক গিয়ারে। হু হু করে পিছু হঠছি- ভুল লেনে ঢুকে পড়েছিলাম যে। গালি দিতে গিয়েই দেখি পাশের লেনে ভুল করে ঢুকে পড়া গাড়িওলাকে খপ করে পাকড়াও করল পুলিশ।

“ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে/ মুখ লুকিয়ে কার বুকে তোমার গল্প বল কাকে?”

পঞ্চাননতলা রোডে ঢুকলেই গঙ্গাপারের ড্রাইভাররা যেন কেমন প্যানিকড্ হয়ে যায়। সরু রাস্তা জুড়ে গদাইলস্করি চালে চলে বাস। পাতি গাড়িকে পাত্তাই দেয় না। তারস্বরে  হর্ণ বাজায় মোটরবাইক আরোহীরা। রাস্তাটা তাদের পৈতৃক সম্পত্তি। সেই হর্ণে কর্ণপাত না করলে খিস্তির ঝাঁপি খুলে বসে- রাস্তাটা রিক্সা এবং টোটো ওলাদেরও পৈতৃক সম্পত্তি। খিস্তিখেউড়ের ঝুলি তাদেরও কিছু ছোট নয়। তারওপর আছে ট্রলির দৌরাত্ম্য। পুঁচকে ভ্যানে চাপানো বিশাল বাঁশ বা লোহার রড অথবা স্প্রিং এর মত বাররির স্তুপ। এদের সকলকে নীরবে সয়ে নিয়ে এগিয়ে চলুন, রাস্তা আটকাবে কর্পোরেশনের ময়লা তোলার গাড়ি। একবার করে রাস্তার ওপাড় থেকে ক্রেনটা ওপাশে যাবে, খামচা মেরে এক খাবলা আবর্জনা তুলবে, অতঃপর ব্যাক।এই সিলসিলা চলতেই থাকবে।  স্তব্ধ ট্রাফিকে থমকে থাকবে আপনার জীবন। সব সামলে দেখা গেল রাস্তা খোঁড়া। কতদিন পর নিজের শহর ফিরলাম। থাকব তিন তিনটে দিন। এসব গায়ে মাখলে চলে? এখানে বাতাসে বহিছে প্রেম-
অঞ্জলি জুয়েলার্সের দোকান পেরোতেই বাবাকে ফোন,“বাবা গলির মুখে এস তো। মানি ব্যাগটা আনতে ভুলো না যেন। আমার খুচরো নেই। ” কি বলবেন ঘোড়া দেখে খোঁড়া? হ্যাঁ তাই।
বড় রাস্তারই যদি ঐ হাল, তাহলে আমাদের ক্ষীরেরতলা গলির কি অবস্থা হতে পারে ঐ সময়?দেখলাম গলির মুখ আলো করে ঝাড়পিট চলছে, টোটোওলা ভার্সেস সাইকেল ওলা। গোটা বিশেক লোক জড়ো হয়ে “কেলাকেলি” দেখছে,পাশের মিষ্টির দোকানের বৃদ্ধ কর্মচারী তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছে,“প্যাঁদাও সালাকে”।
দূরে বাবা সতৃষ্ণ নয়নে আগত গাড়িগুলিকে পর্যবেক্ষণ করছে। একমুখ পাকা দাড়ি, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ব্যস্তহাতে পয়সার ব্যাগ বার করছে শুধু আমার জন্য।

“আমার রাতজাগা তারা তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ি
আমার ভয় পাওয়া চেহারা আমি আদতে আনাড়ি”-

একটুও বদলায়নি আমার পাড়া। বিশাল বড় বড় ব্যানার টাঙানো আর্জেন্টিনার। ব্রাজিল কই? তারা বড় লেট লতিফ। আর দিন কয়েকের মধ্যেই ব্রাজিল আর্জিণ্টিনার হলুদ নীল পতাকায় মুড়ে যাবে পাড়া। মাঠে মাঝেমাঝেই লেগে যাবে মারপিট। হারা দলের খেলোয়াড়দের ছবির গলায় ঝুলবে জুতোর মালা, আর জেতা দল পাবে (ঋতু বিশেষে)গাঁদার মালা।  ক্লাবের টিভির সামনে আগে ভিড় জমাতো ছেলেরা। মাইকে কমেন্টারি শুনতো গোটা পাড়া। এখন কি হয় কে জানে?এখন তো পকেটে পকেটে টিভি।

“আমার চোখ বেঁধে দাও আলো দাও শান্ত শীতলপাটি
তুমি মায়ের মতই ভালো আমি একলাটি পথ হাঁটি”-

সদর দরজা হাট করে খোলা। উঠোনের ওপাড়ে রক টপকে দালানের দরজা খুলে মা অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য। কাল বাবাকে সাতবার দোকানে পাঠিয়েছে আজ এখনও অবধি পাঁচবার বেরিয়েছে বাবা। আদরের নাতনী আসছে-। অথচ বলেই এসেছি, এ যাত্রা মাছ মাংস কিচ্ছু খাবনা। ওসব তো রোজই খাই। যা খেতে পাই না তাই রাঁধো মা- পাঁচফোড়ন শুকনো লঙ্কা দিয়ে সাঁতলানো গরম মুশুর ডালে,কুচি কুচি কাঁচা পেঁয়াজ আর লঙ্কা দিয়ে মাখা মুড়ি, নুন ছড়িয়ে তেলে ভাজা চিনাবাদাম আর শুকনো লঙ্কা, অল্প কাঁচা দুধ দিয়ে নামিয়ে নেওয়া শুক্তো,কুমড়ো দিয়ে পুঁই শাকের চচ্চড়ি,দেদার বাটা পোস্ত, পেঁয়াজ দিয়ে পোস্তর বড়া, সর্ষেপোস্ত বাটা দিয়ে পাঁপড়ের ঝাল-উলস্। তা বললে হয় নাকি? নিজে হাতে বাছাই করা হিমসাগর নিয়ে এসেছে না বাবা? এই রোদে। আর মিষ্টি লিচু। কিন্তু লিচু তো আমার প্রিয় নয়? “আহা তোমার মা লিচু খেতে বড় ভালোবসে। আর সোনার তুত্তুরীও। ”

“আমার বিচ্ছিরি এক তারা তুমি নাওনা কথা কানে
তোমার কিসের এত তাড়া রাস্তা পার হবে সাবধানে”-

আজ এবং আগামী দুদিন শুধুই ল্যাদ খাবার। ব্যস্ত দ্বিপ্রহরে নিস্তব্ধতার শব্দ শোনার। খুলে দাও সব বাতায়ন। হু হু করে ঝাঁপিয়ে পড়ুক মেঘ। জানলার কাঁচে জলকন্যার নূপুর নিক্কন। ভারি হয়ে আসা চোখের পাতাকে প্রাধান্য দিয়ে অসময়ের ঘুম। মেঘলা দিনে সোঁদা হাওয়া আর মাথার ওপর পাখার ঘরঘরও যেন কবিতা।
ভরা পেটে, সব জানলা বন্ধ করে, প্রায়ন্ধকার কক্ষে সাবেকী বার্মাটিকের খাটে তিন প্রজন্ম। বাবা গড়িয়ে গেল সাবেকী চকচকে লাল মেঝেতে। প্রত্যেকেরই ঝুলিতে ভরা অভিমান। “তুই তো আমায় ফোন করিস না। ” তুমি ফোন চেক করো মা? রোজ অফিসে বেরিয়ে তোমার দুটো ফোনেই ঘন্টা বাজাই। ধর? “তোর যত কথা বাপের সাথে।” যার নম্বরেই করি না কেন, বাবাই তো ধরে ফোন। আর তুমি? তুমিও তো কথা বলতে চাও না মা। জানতেই চাও না আমি কেমন আছি। বললাম জ্বর এসেছে, তুমি জানতে চাইলে তুত্তুরী স্কুলে গেছে? বললাম হাতে গরম ফ্যান ফেলেছি, তুমি বললে, তুত্তুরীকে যেন বেশী বকিস না। পড়া পড়া করে ওর মাথাটা খারাপ করে দিসনা। সানশেডে টুংটাং  বৃষ্টির আওয়াজে কখন হারিয়ে যায় সব অভিমান, মায়ের পেটের কাছে কুণ্ডলী  পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তার ছা। তুত্তুরী নেমে যায় দাদুর কোলের কাছে।

“রাখো শরীরে হাত যদি আর জল মাখো দুই হাতে
প্লিজ ঘুম হয়ে যাও চোখে আমার মন খারাপের রাতে”-

“ওঠ। চা খাবি।” পাগল নাকি? বাপের বাড়িতে কেউ সকাল আটটায় ঘুম থেকে ওঠে?গতকাল  রাত দুটো অবধি ভ্যাম্পায়র ডাইরি দেখেছি।শুরু করেছিলাম শুধু ডেমন সালভাটর ওরফে ইয়ান সামারহোল্ডারকে এক ঝলক দেখব বলে। জনৈকা প্রাণাধিকা বান্ধবী সেদিন বলল, “I would walk a thousand miles to sleep with Damon Salvatore though....”।
কানে বালিশ চাপা দিয়ে শুলাম, গায়ে পিসির আদরের হাত-“ওঠ। টাটকা তালশাঁস এনেছি। খাবি আয়। ” জলখাবারে বাবার আনা সিঙারা জিলিপি। অ্যাসিড কেন যে হয় না এখানে?

দুপুরে প্রবল বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে খোলা উঠোনে তুত্তুরীর দৌড়োদৌড়ি। থাক না বাপু। একটু রোদ বৃষ্টিতে শক্তপোক্ত হবে। ভাগ ধন্নু ভাগ,দাদুর আসকারা। স্নানের সময় মেয়ে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে চিৎকার জুড়েছে,“দাদু প্যান্টটাও খুলে যাব কি?” মাথায় থাক সালভাটর ব্রাদারস্, মোবাইল বন্ধ করে দৌড়লাম,  বাগানে আমার কন্যা চাড্ডি পরে “আরা হিলে বালিয়া হিলে, ছাপড়া হিলে লাল- মোরি লচকি যব কমরিয়া” করে তুমুল নাচছে, আর আমার বাপ গাছে জল দেবার পাইপটা দিয়ে তার গায়ে জল ঢালছে। কি অনুপম দৃশ্য মাইরি! তুত্তুরী আর বাবা একসাথে ইশারায় ডাকল- হাত জোড় করে আবার ডুবে গেলাম সালভাডোরদের প্রেমে। শুধু ইয়ান নয় পল উজলিকেও আমার দারুণ পছন্দ।দুজনকে সঙ্গে করে নিয়েই যাব বাড়ি। বর কিছু বলবে না জানি। আমার এমন উটকো প্রেম ঘনঘন  হয়।

সন্ধ্যায় তুমুল অশান্তি। মায়ের চোখে জল- তুত্তুরীকে বকাঝকা  চলবে না। আমার মেয়ে অশিক্ষিত মূর্খ হলে হবে, গেছো বাঁদর হয়ে গাছে চড়লে চড়বে, তার গায়ে হাত তুললে চরম অশান্তি। তুমি তো আর আমায় ভালোইবাসো না মা। তুত্তুরীই তোমার সব। আমায় কেউ ভালোবাসে না। বৃদ্ধ বাপ ছাড়া। বাবা বলল,“আহাঃ মন খারাপ করিস না। তোর জন্য দরবেশ নিয়ে আসি। খা। ”

মন তবু বড় খারাপ। ঘরের মধ্যেই কালো মেঘ। ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত্রি ছুঁল, যাকে নিয়ে অশান্তি সে নীরবে তিনটে আইসক্রীম নিয়ে এসে হাজির। ভাব করে নাও না মা-মামমাম্। প্রাতঃরাশে সিঙারা- জিলিপি, সন্ধ্যায় দরবেশ আর দানাদার আর মাঝ রাত্রে আইসক্রীম? বর জানলে নির্ঘাত তালাক। ধুর ওসব ভেবে কি লাভ- আপাততঃ চা করতে যাই, এতরাতে বাবার ইচ্ছা,“এক কাপ চায়ে আমি তোমাদের তিনজনকে চাই। ”চলুক আড্ডা-জমুক গপ্প-ঘনাক অভিমান। কাল সকালের ওলা তো আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবে নৈমিত্তিক জীবনের একঘেয়েমিতে। নবমীর নিশি না হয় নাই পোহালো আজ-
অনির ডাইরি, ১৫ই মে,২০১৮
তীব্র রোদ আর ভ্যাপসা গরম। ঘড়ির কাঁটা মধ্যাহ্ন অতিক্রম করেছে ঘন্টা খানেক আগেই। ছাতাটাও গাড়িতে রয়ে গেছে, অগত্যা সরু রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রৌদ্রপক্ক হচ্ছি। গোটা দুই সাইকেল রিক্সাওয়ালা লোলুপ দৃষ্টিতে টিং টিং করতে করতে পেরিয়ে গেল। তৃতীয়জন জিজ্ঞাসাই করে বসল,“যাবে নাকি?” হাত ঝেড়ে ইশারায় বললাম,“আগে বাড়ো। ” আমি দাঁড়িয়ে আছি অফিসের গাড়ির জন্য। বড় সাহেবের জরুরী তলবে আসতে হয়েছিল, এবার অফিস ফেরার পালা। প্রিয় শহর চুঁচুড়া।
বড় সাহেবের অফিসের সামনের রাস্তাটা যে অপ্রশস্ত তা নয়, তবে সংলগ্ন কর্পোরেশনের ঘেরা বাজার কে কাঁচকলা দেখিয়ে ফুটপাতেই বসে পড়ে লোকজন সওয়ারি নিয়ে। ফলতঃ আমাদের রাজীব সক্কালসক্কাল এন্তার গালমন্দ খেয়ে এবং দিয়েও মস্তানী করে গাড়ি কোনমতে ঢোকাতে পারলেও, রাখতে পারে না।
এই রোদে রাজীব গেছে গাড়ি আনতে আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মধ্যাহ্নের তপনের তেজে দগ্ধাচ্ছি। এখন অবশ্য রাস্তা ফাঁকা। তাই এত রিক্সার উৎপাত। চতুর্থ জনও যখন জানতে চাইল কোথায় যাব, এবং আমি ইশারায় বললাম, নিজের রাস্তা দেখ- পিছন থেকে কাঁপা স্বরে কে যেন বলে উঠল,“যাও না। বেশী ভাড়া লিবে না। ” তাকিয়ে দেখি আমর পিছনেই রাস্তার ধার ঘেঁষে প্লাস্টিক পেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে এক খুনখুনে বুড়ি। পরনে অবাঙালিদের মত সামনে আঁচল করে পরা সস্তা ছাপা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, চোখে মোটা চশমা। বুড়ির সামনে কয়েকছড়া কাঁঠালী, গুটি কয়েক কাঁচা পেঁপে, শশা আর একটু শাক। হেসে বললাম, “আমি যেখানে যাব, তোমার রিক্সা যাবে না গো মাসি। ”
বেশ খানিকক্ষন নীরবতা। তারপর বুড়ি সসঙ্কোচে জানতে চাইল,“মা তুমি হিন্দুস্থানী?” হাতে সময় থাকলে মাসিকে হিন্দুস্থানীর সংজ্ঞাটা অবশ্যই বোঝাতাম, কিন্তু জলতেষ্টায় বেদম হয়ে আর অত বকতে ইচ্ছা করল না। শুধু একটু জোরের সাথে বললাম,“না গো মাসি। আমি খাঁটি বাঙালী।পাক্কা ঘটি। ” মাসি লাজুক হেসে বলল,“তাহলে তোমার হাতে ঐটি কেন?”কোনটি? ফাইলটি? ঘড়িটি? নোয়াটি? নাকি ট্রেন থেকে সদ্য কেনা গোলাপী রুলিটি? আমার হতভম্ব  অবস্থা দেখে মাসি আঙুল দিয়ে দেখালো, বাঁ হাতে ঘড়ি চুড়িতে প্রায় ঢাকা ট্যাটুটা।
বললাম, ওটা তো এমনি এমনি। বুড়ি উৎসাহী হয়ে জানালো,“আমার দুটো আছে। এই দেখো, এইটা বাপের ঘরের আর এটা শ্বশুরঘরের। আমাদের জাতে হাতে এইগুলা না থাকলে কেউ আমাদের হাতে জল খাবে না।” জানলাম মাসির আসল ঘর বিহার। বিবাহসূত্রে  বঙ্গবাসীনি। মাসি সগর্বে জানালো বাঁহাতেরটা করতে চারআনা লেগেছিল আর ডান হাতেরটা পাঁচ আনা। কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় ফ্যাকাশে নীল উল্কিদ্বয় প্রায় মিশে গেছে পোড়া গাত্রবর্ণের সাথে। মাসি বোধহয় জানতে চাইছিল আমারটা করতে কত  লেগেছে। ঢোঁক গিললাম, থাক, বললে হয়তো মাসি ভড়কে যাবে। কথা ঘুরিয়ে জানতে চাইলাম,“তোমার বাড়ি কোথায় মাসি?” মাসি হেসে বলল “পালপাড়া। ” “বাড়ি যাও। এই রোদে তুমি আর আমি ছাড়া তো কাকপক্ষীটি নেই। সওদা করবে কে?” মাসি ঘোমটা টেনে ফিক করে হেসে বলল,“ টিফিন টাইমে যদি কেউ কেনে। ”
ভালো। আবার বেশ খানিকটা  সময় কেটে গেল। আমি উসখুস  করছি, মাসি জানতে চাইল,“তুমি কুথায় যাচ্ছ মা?” বুড়ো আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম চেঁচে বললাম,“খাটতে যাচ্ছি। ” মাসি বলল,“ধেৎ।মাসির সাথে মজাকি? ”  দুজনেই ফিকফিক করে হেসে উঠলাম। জানালাম অফিস যাচ্ছি।
মাসি একটা নোংরা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল থেকে খানিকটা  ঘোলাটে জল ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে বলল,“খাটা ভালো রে মা। খেটে খাওনই ভালো। এই দেখ না, আমি এই বয়সেও বাজারে এসে বসি। ক টাকাই বা রোজগার হয়? এর থিকা  ভিক্ষে করলে একটু বেশীই রোজগার হত। আমার মেয়ে রোজই বলে, স্টেশন গিয়ে বসতে। কিন্তু আমিই পারি না। ভিখ মাঙব?। সারাজীবন মাথা উঁচু করে কামিয়েছি। সব্জি বেচে ছেলেমেয়ে মানুষ করিছি। এককামরার খোলার বাড়ি বানিয়েছি। ভিখ মাঙব?” কি বলি বুঝতে পারলাম না। রাজীবও আসছে না। বুড়ি ক্রমেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে,কান্নাকাটি  জুড়লেই মুস্কিল। বুড়ি আবার জল খেল,“তোমাদের দেখে ভালো লাগে। কত লিখাপড়া জানো। আমি দেহাতী অনপড় বিহারী অউরৎ। ছেলে বউমা একদিন বলল, বুড়ি এ কাগজটায় অঙ্গুঠা লাগা, কি সব সরকারী কাগজ। অত বুঝিও না। দিলাম অঙ্গুঠা বিশোয়াস করে। পরে বলে বাড়ি থিকা বেরিয়ে যা। যে নাতিকে কোলে কাঁখে বড় করিছি,বাজার বিক্রির পয়সা থেকে চকোজ, মিষ্টি কিনে নিয়ে যেতাম,  তাকে ধরলাম,দেখ বাপ, তোর মা বাপ মিলে আমায় উৎখাত করছে ঘর থেকে, এই বুড়া বয়সে কুথায় যাব বাপ নিজের ঘর ছেড়ে? তো সেই ছেলে বলে কি না,তুই তো কবরে এক পা লটকে বসে আছিস রে বুড়ি, তোর আর ঘরের কি দরকার?স্টেশনে শুবি। আর সব পয়সা তো বুয়ার ঘরে দিয়ে আসিস, যা তার কাছে-। মেয়ের কাছে আশ্রয় পেলাম বটে, সেও কত কথা শোনায় বুড়ি মাটাকে। তাও তো, নিজের রুটির পয়সা নিজে খেটে জোগাড় করি। মেয়ে বলে টিরেনে ভিখ মাঙতে। অনেক বুড়িই মাঙে- আমিই পারি না। মেয়ের ঘরের লাতি বলে, বুড়ির খুব গুমোর।”
গাড়ি এসে গেল, উঠেও পড়লাম,“চলি গো মাসি বলে,“ বেশ খানিকটা  চলে আসার পর মনে হল ইশ্ মাসির থেকে কিছু কেনা তো হল না। মাসিও বলল না কিনতে। সাধারণত এই ধরণের আলাপচারিতার পর কিছু কেনার আব্দার করাটাই দস্তুর। মাসি বোধহয় খোশ গল্পই করতে চেয়েছিল, সত্যিই বুড়ির খুব গুমোর।
অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০১৮
“বললাম, গাড়ি করে যাই-” গজগজিয়ে উঠলেন বৃদ্ধা। দমদম থেকে ট্রেনে উঠেছেন সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ দম্পতি, বৃদ্ধর বয়স সম্ভবতঃ আশির দোরগোড়ায়, বৃদ্ধাও সত্তরোত্তীর্ণা। একজনের গাত্র বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম,অপরের টকটকে ফর্সা। বৃদ্ধা উঠেই হাপরের মত হাঁপাচ্ছেন, হাঁপাচ্ছেন বৃদ্ধও মুখে যদিও দুষ্টু হাসি। রুমাল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছতে লাগলেন মুখ।
হাঁপাতে হাঁপাতে বৃদ্ধা আবার শুরু করলেন,“বললাম, গাড়ি ভাড়া করো। ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় যাই, তা নয় ট্রেনে চল।” বৃদ্ধ সহাস্যে বললেন,“গাড়ি ভাড়া করলে হাজার টাকার ধাক্কা, তারওপর ছ ঘন্টা কেটে গেলেই শালারা বারো পনেরো যা খুশি চায়। চলো না, ট্রেন চললেই হাওয়া আসবে। নেমে অটোয় চাপাব না, রিক্সা ধরে নেব। ” বৃদ্ধা মুখ ঝামটা দিলেন। বৃদ্ধ গদগদ সুরে বলতে লাগলেন,“আরে আগে তো ট্রেনেই যাতায়াত করেছি। তোমার বাবা কাকা দাদা যা ছিল সব একএকটা। নামি গুণ্ডা। তাদের ভয়ে ভিড় ট্রেনে চেপে কোন ফাঁকা স্টেশনে নেমে দেখা করতে হত। বাপসঃ। ” এবার সত্যিই কুরুক্ষেত্র লেগে গেল। আমার যদিও প্রচণ্ড মজা লাগছিল, ওণাদের ডেটিং এর গল্প শুনতে।
বেশ খানিক ঝগড়ার পর নেতিয়ে পড়লেন বৃদ্ধা। এই গরমে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আঁচল প্রান্ত গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। এই লাইনে অনেক মধ্যবয়সীই হিজাবের পরিবর্তে শাড়ির আঁচল জড়ান। বৃদ্ধ চটজলদি ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে দিলেন।গায়ের চাপা খুলে দিতে অনুরোধ করলেন।  জল খেয়ে খানিক ধাতস্থ হয়ে আবার ঝগড়া।
বৃদ্ধ রীতিমত গলার শির ফুলিয়ে বৃদ্ধাকে অভিযুক্ত  করতে লাগলেন, বৃদ্ধা নাকি  ঠিকঠাক ওষুধ খান না। বৃদ্ধাও সমান তেজী। বেশ খানিক তর্কের পর ওষুধের হিসেব নিতে বসলেন বৃদ্ধ। কোন ওষুধ কটা পড়ে আছে। গো হারান হেরে গেলেন বৃদ্ধা।
সাময়িক শান্তি। তারপর বৃদ্ধ শুরু করলেন,“ওদের বাড়িতে যতই বলুক, বুঝলে পেট ভরে খাবো না। ফেরার পথে স্টেশন রোডের ফুচকা।” মহিলা বোধহয় ঝাল নিয়ে কিছু বললেন, বৃদ্ধ বললেন,“তুমি ঝাল ছাড়াই খেয়ো। তেমন হলে শুকনোই খেয়ো। একটা খেয়ো অন্তত। না হলে-”।  বলে এমন অভিমানী ভঙ্গীতে মাথা নত করে বাইরের দিকে তাকালেন, যে বোঝাই গেল গিন্নী ব্যতীত উনি ফুচকায় স্বাদ পাবেন না। বৃদ্ধা ফিসফিস করে কিছু আব্দার করলেন, বৃদ্ধ খুশি হয়ে বললেন,“বেশ। হবে। ফুচকাও হবে, আইসক্রীম ও হবে। তুমি গায়ের চাপাটা এবার খোলো। সিদ্ধ হয়ে মরবে।  কেউ কিচ্ছু বলবে না। আরেঃ আমি বলছি,”।  ট্রেন বেশ ফাঁকা, বৃদ্ধা এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরে ভীরে মাথা এবং গা থেকে আঁচল সরিয়ে জড়সড় হয়ে লাজুক নবোঢ়া বধূর মত স্বামীর গায়ে গা লাগিয়ে বসলেন। চমকে গেলাম, বৃদ্ধার মাথা ভর্তি চকচকে টাক। দুহাতে অজস্র সূঁচ ফোটানোর  কালো দাগ। কেমো চলছে অথবা কেমো হয়েছে। বৃদ্ধ মজা করে বলে চলেছেন,“আমার বউ টেকো হতে পারে তাই বলে কি কম সুন্দর নাকি-”। বৃদ্ধা মুখ বেঁকিয়ে বোধহয় বললেন মরণ। চোখের কোণটা এত কড়কড় করছে কি বলব, প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। দিন কয়েক আগে বোধহয় আমিও ভাবছিলাম এ শহর বিস্মৃত হয়েছে প্রেম। আজ এদের দেখে মনে হচ্ছে, সত্যিই, ফুল ফুটুক না ফুটুক আমার শহরে বিরাজমান  চিরবসন্ত।
অনির ডাইরি ১০ই মে, ২০১৮
মাস ছয় সাত আগের কথা, বাজারে গেছি, শাহদাব বলল,“অ বৌদি মাছ লিবেন না?” বললাম মাছ কিনতে দাদা বড় ভালোবাসে, সেই আসবে শনিবার সকালে, আমায় ক্ষ্যামা দে বাপ। তাতে শাহদাব এক্কেবারে ৩২ পাটি বার করে বলল,“শোনেন না বৌদি, নতুন ফোন লিয়েছি। আপনার নম্বরটা এট্টু দেন না, ভালো মাছ এলি জানাব। ” দিলাম নম্বর।
পরদিন সকালে বর তিরিক্ষি মেজাজে জানতে চাইল,“শাহদাবকে আমার নম্বর তুই দিয়েছিস? সকাল থেকে ব্যাটা মাছের ছবি পাঠাচ্ছে। আর লিখছে, ‘হেলো দিদি। ওয়ান্ট ফিশ? ” আসলে হয়েছে কি, যে মাছ কিনতে ভালোবাসে তার নম্বরটাই দিয়ে এসেছিলাম। আর শৌভিকের হোয়াটস্ অ্যাপের ডিপিতে যুগলের দন্তরুচি কৌমদী মার্কা একটা ঝিংচ্যাক ছবি ছিল। ফলে শাহদাব কিচ্ছু ভুল লেখেনি।
রোজ সক্কালে শাহদাবের “হেলো দিদি,ওয়ান্ট ফিশ” মার্কা মেসেজে আমার বর প্রথম চোটে যতই চটে যাক না কেন, ধীরে ধীরে মাছের ছবি গুলো বেশ ভালো লাগতে লাগল। মন দিয়ে তথা খুঁটিয়ে দেখে ফরমাইশও করা শুরু হল, যথা-“কাল ২/৩ কিলো সাইজের কাতলা এনে রেখো।” বা “কাল সকালে যাব। ভালো ভেটকী আর পাবদা চাই।” যদিও শৌভিক বাংলায় লেখে, শাহদাব পড়েও কিন্তু কোন জবাব দেয় না। শাহদাব শুধু একটা লাইনই লিখতে পারে, “হেলো দিদি, ওয়ান্ট ফিশ। ” শৌভিক অবশ্য দাবী করে, ওর ফরমাইশ মত মাছ এনে রাখে শাহদাব।
দিন দুয়েক আগে অফিস ফেরত ডিম কিনতে গেছি, আবু পাকড়াও করল,“বউদি ব্যাপারটা কি বলেন তো? আমি কি গুণাহ করিছি, দাদা আজকাল আর আমার থিকি মাছ লেয়ই না। ” বলাইবাহুল্য আবু শাহদাবের প্রতিপক্ষ এবং আমার শ্বশুরের পেয়ারের মাছওয়ালা। বললাম, কেন দাদা আজকাল শাহদাব ছাড়া কাউকে দেখতে পায় না। আবুর চোখ গোল গোল হয়ে গেল,“উরিঃ ব্যাটা! তাই ভাবি। এভাবে আমার কাস্তমার কেড়ে নেওয়া। দিয়েন বৌদি দিয়েন- আপনার ফোন নম্বরটা দিয়েন। শাহদাবের পো কে একবার দেখি। ”
আজ সকালে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে বাড়ি ফিরে দেখি,বর গভীর মনোযোগ সহকারে ফোন ঘাঁটছে, সামনে কালো কফির কাপটা ঠক করে রাখতে চমকে উঠে বলল,“আবুকেও আমার নম্বর নির্ঘাত তুই দিয়েছিস? আবু একটা হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপই খুলে ফেলেছে, নাম দিয়েছে,‘ফিস ফিস।’” জয় বাবা ডিজিট্যাল ইণ্ডিয়া।

অনির ডাইরি, ৯ই মে, ২০১৮
ঘোর বর্ষা কাল, মধ্যরাত্রি সদ্য অতিক্রান্ত, গভীর নিদ্রায় মগ্ন এ গৃহের সকল অধিবাসী। বৃদ্ধা মালকিন তাঁর দুই পুত্র, এক কন্যাকে নিয়ে ঘুমিয়ে নিচ্ছিলেন জীবনের শেষ নিশ্ছিদ্র ঘুম। মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হবার আগেই এ গৃহে এসে উপস্থিত হল সাত-আট জন অনুপ্রবেশকারী, প্রত্যেকের হাতেই শোভা পাচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। দরজা ভেঙে ঘুমন্ত বৃদ্ধাকে টেনে হিঁচড়ে প্রাঙ্গণে আছড়ে ফেলে বন্দুকের নিশানায় প্রশ্ন করা হল, “বল বুড়ি, মেয়েকে কোথায় লুকিয়েছিস?” আচমকা আঘাতে বিধ্বস্ত বৃদ্ধার হাউমাউ কান্না শুনে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল তাঁর বছর বত্রিশের কন্যা। নিপাট শান্ত, ভদ্র, অন্তর্মুখী একটি মেয়ে, আত্মীয়-পড়শি কোনদিন কারো সাথে গলা তুলে কথা পর্যন্ত বলেনি, তাকে অভিযুক্ত করা হল রাষ্ট্রদোহীর গুরুতর অভিযোগে। আগত একদল লেগে পড়ল বৃদ্ধার নিকানো গৃহকোণ তছনছ করতে, যার পোশাকি নাম তল্লাশি। আর একদল, বন্দুকের নিশানায় বৃদ্ধা এবং তাঁর পুত্রদের নিয়ে গেল বাড়ির পিছন দিকে।
ঘড়ির কাঁটা যেন নড়ে না, সামনের অঙ্গন থেকে উড়ে আসছে, মেয়েটার আর্ত চিৎকার, ভয়ানক নির্যাতন চলছে এক রাষ্ট্রদোহী নারীর ওপর। পিছনে কাতর কাকুতিমিনতি জুড়েছে তাঁর মা, “বাবারা ও কিছু জানে না। ওর সাথে কারো কোন যোগাযোগ নেই। ওকে ছেড়ে দাও।“ রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ টেনে হিঁচড়ে মেয়েটাকে নিয়ে চলল ওরা গাড়িতে তুলবে বলে, প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল, দুই ভাই আর মা। জবাবে মিলল বন্দুকের কুঁদো, বুটের লাথি। যাবার আগে, দলের নেতা এক টুকরো কাগজে বুড়িকে দিয়ে জোর করে সই করিয়ে নিতে ভুলল না, যাতে লেখা, আগন্তুকরা কোন মহিলার সাথে কোন অশোভন আচরণ করেনি।
পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, পাওয়া গেল মেয়েটার খবর। বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরে, ক্ষেতের ওপর ফেলে দিয়ে গেছে তার রক্তাক্ত মৃতদেহ। গোটা শরীরে পাশবিক অত্যাচারের অসংখ্য নিদর্শন। নখের দাগ, কালশিটে, উরুতে বেয়নেটের খোঁচা এবং ছটি গুলি। বলা হল, পালিয়ে যাচ্ছিল, তাই গুলি করা হয়েছে। নিরস্ত্র একটি মেয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল বলে তার ব্যক্তিগত অঙ্গে গুলি করাটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য। উপরন্তু আসেপাশে কোথাও কোন রক্তের দাগ বা বন্দুকের শেলও মেলেনি, সোজাসাপ্টা কথা, তুলে নিয়ে গিয়ে, গণধর্ষণ করে, হত্যা করে ফেলে দিয়ে গেছে আগন্তুকরা।
রাতারাতি দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল খবর। ক্ষোভে, শোকে উত্তাল হয়ে উঠল মেয়েটার দেশ। ঘরে ঘরে অরন্ধন, বহুবছর যাবত এই অঞ্চলের মেয়েরা সহন এবং বহন করে আসছে এই রকম বহু বিকৃতি এবং তাদের উত্তরাধিকার। কিন্তু আর না। দিকে দিকে গঠিত হল প্রতিবাদী মঞ্চ। বিক্ষোভ দেখাতে লাগল পুরুষ এবং তরুণ-তরুণীর দল। এগিয়ে আসতে চাইলেন মধ্যবয়সী থেকে প্রৌঢ়া এমনকি বৃদ্ধারাও।“ ও তো আমাদেরও মেয়ে, আমরা সকলে ওর মা।“ থামিয়ে দেয় নব্য প্রজন্ম,গৃহবধূ, অর্ধ বা অশিক্ষিত অশক্ত বৃদ্ধারা আবার কবে প্রতিবাদ করেছে? “কি করতে পারো তোমরা?কে শুনবে? কে পাত্তা দেবে অবলা বৃদ্ধাদের প্রতিবাদের?”
কে শুনবে? তাই বলে এ ভাবে সব সয়ে মুখ বুজে মরে যাব? কি জবাব দেব নিজেদের বিবেককে? সকল সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে, গণধর্ষিত মৃত মেয়েটির জন্য রুখে দাঁড়ালেন জনা বারো হতদরিদ্র পরিবারের গৃহবধূ। যাঁদের বয়স ৪৫- ৭৩। মেয়েটির মৃত্যুর ঠিক চারদিন পরের কথা, তখনও সূর্য ওঠেনি, স্নান করে, তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়লেন ওনারা, কেউই বাড়িতে কিচ্ছু জানাননি। পরিণতি কি হতে পারে ভেবে ভারী হয়ে আসছিল শরীর। ঘুমন্ত স্বামীর পায়ে আঙুল ঠেকিয়ে গোপনে প্রনাম করে নিলেন কেউ, কেউ বা আলতো করে চুম্বন করে নিলেন ঘুমন্ত নাতি বা নাতনীর মুখ। তারপর ৪৬টা বাচ্ছার মা আর ৭৪ জন নাতিনাতনির ঠাকুমা দিদিমারা বেরিয়ে পড়লেন,বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জীবনের অন্তিম অভিসারে।  
খবর ঠিক পৌঁছে গিয়েছিল, বিপক্ষের কানে, শহর জুড়ে কার্ফু। পায়ে হেঁটে কোনমতে পৌঁছে দেখেন ওনারা, রক্ষী-পুলিশে ছয়লাপ প্রতিবাদ স্থল। একজন দুজন করে বৃদ্ধা ভিড়ে মিশে পৌছতে লাগলেন প্রতিপক্ষের সদর দপ্তরের সামনে। আর তারপর? তারপর উপস্থিত প্রতিবাদী মারমুখী জনতা এবং যুযুধান প্রতিপক্ষ সাক্ষী রইল এক অভূতপূর্ব প্রতিবাদের। ঠিক বেলা দশটা নাগাদ, মুহূর্তে পটু হাতে সমস্ত বস্ত্র উন্মোচন করে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াল বারো জন বয়স্কা রমণী। দরদর করে ঝরে পড়ছে চোখের জল, আজন্ম রক্ষণশীল পরিবেশে বড় হওয়া কুলনারী সব,আজীবন আপাদমস্তক কাপড়ে ঢেকে রাখা দেহ এ ভাবে জন সমক্ষে নগ্ন হবাব লজ্জায় নুয়ে পড়ছে শির, ভারী হয়ে উঠছে জিভ, আচমকা এক বৃদ্ধা চিৎকার করে উঠলেন,“মারবি? ধর্ষণ করবি? আয় আমাদের ধর্ষণ কর। আমরা সবাই ওর মা। যা আমাদের মেয়ের সাথে করেছিস, আয় আমাদের সাথেও কর।“ ভাঙা ইংরাজিতে চিৎকার করতে করতে এই মায়েরা ঢুকতে গেল, দপ্তরে, পলকে দরজা বন্ধ করে, বন্দুকের নিশানা তাগ করল সেন্ট্রি, নগ্ন বুকে চাপড় মেরে জনৈক মা চিৎকার করে উঠল, “ মারবি বাবা? মার। এখানে গুলি মার। একেবারে মরে যাই। এভাবে প্রতিনিয়ত সন্তানের ধর্ষিত মৃত দেহ বহন করার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভালো।“ নেমে এল বন্ধুকের নল, দুহাতে চোখ ঢেকে অশ্রু সংবরণে বৃত হল ছাপোষা সেপাই।
৪৫ মিনিট চলেছিল মায়েদের এই প্রতিবাদ, চোখের জলে ভেসে গিয়েছিল উপস্থিত জনগণ, এমনকি উর্দিধারী বেতনভুক সেপাইরাও। ততোক্ষণে দূরদর্শন মারফৎ সমগ্র পৃথিবী সাক্ষী হয়ে গেছে এই যুগান্তকারী ঘটনার। নড়ে চড়ে বসে প্রশাসন, তাতে কত বড় অশ্বডিম্ব প্রসুত হয়, সেটা আলোচনা তথা বিতর্ক সাপেক্ষ। এই মহিলাদের মধ্যে ৯ জনকে হাজতবাসও করতে হয় পরবর্তীকালে তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের জন্য। তবে রক্ষণশীলতার গোঁড়া ধরে আমূল ঝাঁকুনি দিয়ে যায় এই বৃদ্ধারা, শিক্ষা দিয়ে যায়, যে নিরন্তর বিবেকের দংশন সহন না করে প্রতিবাদ করাই যায়, করতেই পারি। করার সামর্থ্য তথা শক্তি বোধহয় সকলেরই থাকে, প্রয়োজন হয় শুধুমাত্র একটি অণুঘটকের।
আর হ্যাঁ, ধর্ষিত মেয়েটির নাম আমি বলব না, একটু স্মৃতির গোঁড়ায় ধোঁয়া দিয়ে দেখুন তো, চিনতে পারেন কি না?

Thursday 3 May 2018

প্রাণস্বরূপিনী-


সুনিবিড় বনানীর মর্মস্থলে লুক্কায়িত এক পুষ্পদ্যান। প্রাথমিক দর্শনে ভ্রম হওয়া অস্বাভাবিক নহে, দেব যন্ত্রবিদ্ বিশ্বকর্মা অথবা দানবকূলশ্রেষ্ঠ ময় স্বয়ং স্বহস্তে  নির্মাণ করেছেন এই উদ্যানের। আপাততঃ উদ্যানের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এক সুবিশাল বট বৃক্ষতলে গভীর আলাপচারিতায় মগ্ন দুই সুবেশ যুবক। যুবক ঠিক নয়, যৌবন অস্তাচলে গমন করতে উদ্যত হয়েছে কিন্তু যেতে পারেনি। দুই একটি শ্বেত কেশ বা শ্মশ্রু রাজিই তার একমাত্র প্রমাণ, অন্যথা দুই যুবকই অনুপম সৌন্দর্যের অধীশ্বর। ঋজু দীর্ঘ দেহে বলিষ্ঠ পেশীদের আঁকিবুকি, উন্নত নাসা, গভীর আঁখি, ঘণ আঁখিপল্লব। শুধু একজনের গাত্রবর্ণ দুধে আলতা অপরজনের নবজলধরশ্যাম। শ্যামল যুবকের দুই চোখে মাখামাখি আজব দুষ্টুমি, শ্বেতাঙ্গ যুবকের দুই আঁখি যেন বেদনার কবিতা।
বৃক্ষতলে ভগ্নপ্রায় বেদীর উপর কিছুটা উচ্চ আসনে আসীন শ্যামল যুবক, তার পদতলে নতমুখে আসীন শ্বেতাঙ্গ যুবক। শ্যামল যুবক তাকে কিছু বোঝাবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, অপরজনও বুঝতে চায়, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক হৃদয় বারবার ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। অবশেষে সস্নেহে শ্বেতাঙ্গ যুবককে বুকে আঁকড়ে ধরলেন শ্যামল যুবক। আলিঙ্গনাবদ্ধ  অবস্থায় কেটে গেল বেশ অনেকটা সময়, শ্বেতাঙ্গ যুবক কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে গুমরে অশ্রু বিসর্জন করলেন, তারপর  ধীরে ধীরে মেনে নিলেন শ্যামল যুবার বক্তব্য।
ঘণ বনানীর ভিতর থেকে কয়েকজোড়া বিষাক্ত  চোখ এতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছিল দুজনারে। এবার ডালপালা সরিয়ে বেরিয়ে এল তারা। সকলের অগ্রভাগে যিনি, তিনিও যথেষ্ট রূপবান,শুধু দুই চোখে ধিকিধিকি জ্বলছে ঈর্ষার সবুজ আগুন। সঙ্গী যুবকও ততোধিক রূপবান, তার দুই চোখে তীব্র ব্যঙ্গ।  আলিঙ্গনাবদ্ধ  দুই যুবক ওণাদের পদস্পর্শে সচকিত হয়ে তাকিয়ে আগত যুবকদের দ্রুত প্রীতি সম্ভাষণ জানালো।
শ্যামল এবং গৌর উভয় যুবাই ঈষৎ  নত হয়ে করজোড়ে বলে উঠলেন,“প্রণাম মহরাজ। ” মহারাজ অর্থাৎ যাঁর দুই চোখে খেলে বিষ, যিনি বিদ্রুপের সুরে তাঁর সঙ্গে আগত সঙ্গী যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন,“অঙ্গরাজ, ঠিক কতদিনের বন্ধুত্ব আমাদের?” অঙ্গরাজ বিদ্রুপাত্মক স্বরে বললেন,“মনে নেই সখা। সেই যে হস্তিনাপুরে শস্ত্র প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল, সে হল অনেক কাল। তোমরা তখন সদ্য শস্ত্রচালনা শিখেছ। তৃতীয় পার্থর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যজুড়ে। আমারও কানে এল বটে, ভাবলেম, আমিও পরশুরামের শিষ্য বটে, যিনি না জানি কতবার ক্ষত্রিয়শূণ্য করছেন এ ধরা, তাঁর সুশিষ্য হয়ে একবার দেখাই যাক না, কত বড় ধনুর্ধর এই তৃতীয় পার্থ। ” মহারাজ হো হো করে হেসে বলে উঠলেন, “তা কি দেখলে হে? কতবড় বীর কৌন্তেয়?” অঙ্গরাজ জিহ্বা ভর্তি বিষ নিয়ে উচ্চারণ করলেন,“উফ্ মস্ত বড় বীর বটে। আমার সাথে লড়লেনই না। আমি সূতপুত্র কি না। তবু ভালো আমার অঙ্গুলি গুলি অবিকৃত আছে, শোনা যায় এক নিষাদ পুত্রকে তো-। ”।  মহারাজ আবার অট্টহাস্য করে বললেন,“আসলে ভয় পায় । ভয়। সখা। আমি তৎক্ষণাৎ তোমায় অঙ্গরাজ্যের অধীশ্বর রূপে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। তাও-”। দুই সখার অট্টহাস্যে উড়ে গেল বটে আশ্রয় নেওয়া পাখির দল। শ্বেতাঙ্গ যুবক অর্থাৎ তৃতীয় পার্থ নীরব এবং অবনতমস্তক রইলেন, কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে মহারাজ দুর্যোধন আবার শুরু করলেন,“তা সখা এত বৎসরে কতবার তোমায় এভাবে আলিঙ্গন করেছি আমি?” ছলছল চোখে পার্থ তাকালেন উপহাসরত দুই প্রতিপক্ষের দিকে। হ্যাঁ প্রতিপক্ষই তো। আগামী কাল প্রভাতে শুরু হতে চলেছে এক চিলতে রাজসিংহাসনের অধিকার দিয়ে কুরু পাণ্ডব যুদ্ধ। উভয় পক্ষের সব আয়োজন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। পড়ন্ত বিকালে নিজ শিবিরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে যুযুধান প্রতিপক্ষের নেতৃবর্গকে দেখে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত তৃতীয় পার্থ। এরা কারা?এদের বিরুদ্ধে ধারণ করতে হবে শস্ত্র? পিতামহ ভীষ্ম যাঁর কোলে চেপে কেটেছে শৈশব?গুরু দ্রোণ? যাঁকে পিতৃ অধিক শ্রদ্ধা করেন পার্থ,ভালোবাসেন।ভ্রাতা দুর্যোধন? বিকর্ণ? যাদের সাথে পিঠোপিঠি খুনসুটি করে কেটেছে শৈশব? জয়দ্রথ? একমাত্র ভগিনী দুঃশলার স্বামী? মাতুল শল্য? না অসম্ভব। একমাত্র অঙ্গরাজ কর্ণ ব্যতিরেকে এঁদের কারো বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ অসম্ভব। কর্ণকে মারতে অবশ্য হাত কাঁপবে না পার্থর।
যাই হোক পার্থর এই চিত্তবৈকল্য প্রত্যক্ষ করেই সখা কৃষ্ণ তাকে টেনে এনেছে কুরুক্ষেত্র প্রান্তর থেকে বহুদূর এই বনানীর অভ্যন্তরে। পাপাচারী দুর্যোধন নির্ঘাত চর মারফৎ খবর পেয়ে পশ্চাৎধাবন করেছে। একাকী এসেছে না সৈন্যদল সমেত? যুদ্ধ শুরুর প্রারম্ভেই যদি ঘায়েল করা যায় কৃষ্ণ আর অর্জুনকে, বাকি পাণ্ডবদের পরাস্ত করা এক পলকের ব্যাপার। হতাশায়, বেদনায় চিন্তাশক্তিহীন হয়ে পড়ল।

অর্জুনকে খুব একটা পাত্তাও দিলেন না মহারাজ দুর্যোধন। সজোরে করতালি  বাজাতেই, অরণ্যের গাছপালা সরিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল শয়ে শয়ে সুসজ্জিত  যোদ্ধা। পলকে ঘিরে ফেলল কৃষ্ণার্জুনকে। অক্ষম ক্রোধে গুমরে উঠল অর্জুন, গাণ্ডীব!সাধের গাণ্ডীবকে হেলায় ফেলে এসেছেন শিবিরে। আচমকা ঘিরে ধরা সৈন্যরা দুভাগ হয়ে গেল, জঙ্গলের রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হলেন, এক সুদেহী পুরুষ,  তামাটে গাত্রবর্ণ, পেশীবহুল শরীর।  কাঁধ পর্যন্ত কেশরাজি, পুষ্প মালিকা সহযোগে চুড়া করে বাঁধা। মস্তকে সুবর্ণ মুকুটে শোভা পাচ্ছে শিখি পুচ্ছ। চন্দন চর্চিত দেহ সুবাসে পরিপূর্ণ। কোমরবন্ধনীতে আটকে আছে একটি ধাতব চক্র। একহস্তে ভারী গদা, অপর হস্তে একটি সদ্য উৎপাটিত রক্তকমল এবং শঙ্খ। সহসা শ্রী বিষ্ণু বলে ভ্রম হওয়া দুষ্কর নয়। তিনি বাসুদেবের উদ্দেশ্য কটু মন্তব্য করে বললেন,“ঐ ধূর্ত বাসুদেব, শুনি তুই নাকি নিজেকে স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার বলে দাবী করিস?” শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে হাসি চেপে রাখা ক্রমেই দুষ্কর হয়ে উঠছিল, তাও দাঁতে দাঁত চেপে তিনি কইলেন,“এমন দুর্মতি আমার কেন হবে আর্য?” আর্য শুনেই সেই ব্যক্তি পুনরায় দন্ত কিড়মিড়িয়ে বললেন,“আর্য? আমি কোন সাধারণ আর্য নহি, আমি হলাম বঙ্গ-কিরাত-পৌণ্ড্রের অধিপতি পৌণ্ড্রক। আমি স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু। দুর্যোধনের পরম সুহৃদ।” অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন পার্থ এবং পার্থসারথী উভয়ই। ছদ্ম ভক্তিতে ডগমগ হয়ে উভয়ে প্রণাম করলেন, “প্রণাম শ্রীবিষ্ণু!“ দুর্যোধন ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন,“ আরেঃ বাসুদেব,তোর সাহস হয় কি করে,আমার পরম সুহৃদের অবমাননা করিস?তুই কে? মথুরারাজ কংসের মামুলী ভৃত্য। কৌশলে প্রভুকে হত্যা করে তার রাজপাট দখল করতে গিয়েছিলি। এত ধূর্ত তুই যে সিংহাসনে স্বয়ং বা অধিস্থান করে, পুতুলরাজা বসালি? জরাসন্ধের ভয়ে যুদ্ধ ছেড়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে এলি দ্বারকা,।  ধিক্। ধিক্। শত ধিক্ তোরে। ক্ষত্রিয় কূলের কলঙ্ক। রমণীমোহন, প্রেমলীলায় পারদর্শী, নারীদের ও অধম তুই। নিজেকে শ্রীবিষ্ণুর অবতার বলে দাবী করিস তুই? থুঃ। ”
শ্রীকৃষ্ণের ওষ্ঠে এবং অধরে তখনও খেলা করছে পড়ন্ত কমলা রোদের মত এক চিলতে নির্মল হাসি। সখা মানহানির  প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন পার্থ। কি কুৎসিত  ভাষায়ই না তাকে অসম্মান করল দুর্যোধন এবং কর্ণ। দেবী কুন্তীর ক্ষেত্রজ পুত্রকে পিতৃপরিচয় তথা বাকি ভাইদের সাথে দ্রৌপদীকে ভাগ করে নেওয়া, বৃহণ্ণলা সেজে উত্তরের সঙ্গলিপ্সার মত হীন কটুক্তি শুনতে হল। তখনও নীরব কেশব। ক্রোধে ফুঁসছে পার্থ।
পৌণ্ড্রক নাটুকে ভঙ্গীতে বলতে লাগলেন,“শুধু কি তাই? আপনি কি জানেন মহারাজ, কেশবের একটি রক্ষিতা আছে।” পলকে কঠিন হয়ে গেল কেশবের দৃষ্টি। দুর্যোধন এবং কর্ণ উল্লসিত  হয়ে জানতে চাইল, “কে? নির্ঘাত কোন বহুভোগ্যা নারী?”  উত্তরে মিচকে হেঁসে পৌণ্ড্রক বলল,“ না জানি নে বাপু। গোকুলে বসবাসের দিনগুলিতে দুইজনের প্রেম তথা রমনের গল্প পোষা গবাদি  পশুগুলির মুখে মুখে ফিরত। সে নারী কিন্তু বিবাহিতা ছিলেন। ”
“স্তব্ধ হও মূর্খ। ” গর্জে উঠলেন কেশব। কেঁপে উঠল ধরিত্রী। “ তাঁর সম্পর্কে একটি কুবাক্য উচ্চারণ করলে জিহ্বা উৎপাটিত করব। ” পৌণ্ড্রক কর্ণপাত না করে বলে চলল,“আমি সম্প্রতি তাকে খুঁজে বার করেছি। এই মহাশয়, গোকুল ত্যাগ করার পর একটি বারও তার তত্ত্বতল্লাশ পর্যন্ত করেনি জানেন? সেদিন হতে নাকি সেই নারী মূক এবং বধির হয়ে কোন মতে স্বামীর অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছে। কি অপরূপ রূপসী সে নারী কি কইব মহারাজ। কেশব বধের অন্তে আমিই হব তার নতুন কেশব। ঐ নারী দেবভোগ্যা।  নাম -”। কথা শেষ করতে পারল না,  পৌণ্ড্রকের কাটা মুণ্ড গড়িয়ে এল কেশবের রক্তিম চরণতলে। ঘুরন্ত সুদর্শন চক্র থেকে ছুটছে আগুনের ফুলকি।আগুন ঝরানো  স্বরে কেশব বলে উঠলেন,“মূঢ় মতি । তোদের এত দুঃসাহস, আমার প্রাণস্বরূপিনীকে নিয়ে কুৎসা রটাস? কোন অষ্টাদশ দিন ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রয়োজন নেই, আমি এই মুহূর্তে ধ্বংস করব কুরু বংশ এবং তাদের অনুগামী সকলকে। ” কেশবের রূপ দেখে আতঙ্কিত হয়ে দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিল দুর্যোধনের সৈন্যদল। সহসা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ ঢেকে দিল, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঠিক আগের দিনের সূর্য। লকলকে জিহ্বা বার করে ছুটে এলেন পবন এবং অগ্নিদেব। জঙ্গলে লেগে গেল দাবানল, সমুদ্রে বাড়্বানল। প্রবল ভূকম্পে কেঁপে উঠল মেদিনী। সমগ্র বিশ্ববাসী ত্রাহি মধুসূদন ডাক ছাড়ল। কেশবের ঐ ভয়ানক রূপ দর্শন করে কাপুরুষের মত দৌড়ে পালাতে লাগলেন কুরুরাজ এবং অঙ্গরাজ। সুদর্শনকে পুনরায় অঙ্গুলিতে ধারণ করলেন কেশব, এমন সময় তাঁর চরণতলে আছড়ে পড়লেন তৃতীয় পার্থ,“তিষ্ঠ প্রভু। তিষ্ঠ। ” একাগ্র চিত্তে সমস্ত উপাসনা করতে লাগলেন তাঁর চিরসখার, সুগভীর সখ্যতার আবডালে যাঁকে প্রাণাধিক ভালোবাসেন পার্থ। দরদর করে দুই চোখ দিয়ে ঝরে পড়তে লাগল অশ্রুকণা।
কতক্ষণ সময় এইভাবে কেটেছে পার্থ জানেন না, আচমকা একজোড়া উষ্ণ হাতের স্নেহস্পর্শে চোখ খুললেন তিনি। সম্মুখে কেশব। সেই চিরপরিচিত সদাহাস্যপরায়ণ  কেশব। “চল সখা। ”  বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে পড়লেন পার্থ। কিছুই মনে পড়ছে না। এতক্ষণ তাঁরা জঙ্গলে কি করছিলেন?কেশবও নীরব। রথে উঠলেন পার্থ, আসন গ্রহণ করলেন পার্থসারথী। রথ ছাড়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন,“কোন সংশয় নেই তো সখা?” পার্থ অবাক হয়ে বললেন,“নাঃ। কিসের সংশয় সখা?” নিরুত্তর রইলেন কেশব। ছুটল চতুঃঅশ্বের রথ, পার্থ শুধু অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন তাঁর বাল্যসখার দুই আঁখি টলটলায়মান, মাঝে মাঝে ঝরে পড়ছে মুক্তার মত দু একটি অশ্রুকণা।

Wednesday 2 May 2018

কোন এক দিন -

কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে অনাম্নী স্রোতোস্বিনী। বইছে মৃদুমন্দ পবন। ঘণ বনানীর মাঝে এক বিশাল পিপ্পলী বৃক্ষতলে ধ্যানমগ্ন জনৈক তাপস। পরণে শ্বেতবস্ত্র, উর্ধ্বাঙ্গে পীতাভ উত্তরীয়, উভয়ই অতি সাধারণ। অসাধারণ শুধু তাঁর দীপ্তি। অপরূপ রূপময় তাপসের মুখমণ্ডলে খেলা করে চলেছে অদ্ভূত প্রশান্তি, ইনি যে অত্যন্ত অভিজাত বংশীয় অসীম জ্ঞানের অধিকারী তা এঁণার মুখমণ্ডল তথা দেহবিভঙ্গে সুস্পষ্ট। যদিও চোখের নীচের মৃদু কালিমা একথা লুকাতে অক্ষম যে আপাততঃ ইনি কিঞ্চিৎ  কায়ক্লেশে আছেন। স্বীয় ক্লেশকে অদ্যাবধি বিন্দুমাত্র  গুরুত্ব দেননি উনি, কিন্তু প্রিয়জনের বেদনায় বড় দ্রুত কাতর হয়ে পড়েন আজকাল। বিশেষতঃ সেই প্রাণাধিকা নারী, যাঁর যাবতীয় কায়ক্লেশের মূল হোতা এই দুর্ভাগা তাপস, এমনকি তাঁরই অবিমৃষ্যকারিতার জন্য জনসমক্ষে আর্যকন্যাকে বিবস্ত্র হতে হয়েছে, যতবারই সেই দৃশ্যাবলী চোখের সামনে ভেসে ওঠে কেঁপে ওঠেন তাপস। ছিঃ।  ছিঃ। যে পুরুষ নিজের স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, কি প্রয়োজন তার প্রাণধারণে?
এই যে রাজনন্দিনী সর্ব বিলাস ত্যাগ করে তাঁর অনুগামিনী হয়ে এই গভীর জঙ্গলে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন, এর জন্য দায়ী কে? কোনদিন শিকার জোটে, কোনদিন নিকটস্থ জনপদ থেকে জোটে ভিক্ষালব্ধ কয়েকমুঠি যব, কোনদিন শুধুই বনের ফল আর কোনদিন শুধুই শীতল জলে নৈশাহার সমাধা করেন তাঁরা। কতদিন প্রিয়ার মুখে হাসি দেখেননি তিনি। মাটির কুঁড়ে ঘরকে সহস্তে নিকিয়ে কি অপরূপ বিন্যাসে সাজিয়ে রাখেন প্রিয়া, প্রিয়ার হাতের মায়াজালে সামান্য যবও যেন পরিণত হয় দেবভোগ্য অমৃতে। এত গুণের অধিশ্বরীর এই পরিণতি কেন? সুদূর মাতুলালয়ে সযতনে থাকা নিজ শিশুপুত্রদের স্মরণ করে প্রায় প্রতিটি রজনীই নিঃশব্দ অশ্রুমোচনে যাপন করেন আর্যা। ভাবেন তাপস বুঝি উপলব্ধি করতে অক্ষম, অথচ বিগত একবছরে এক পলের জন্যও তিনি বিস্মৃত হননি তাদের। তাঁর জন্যই পাঁচটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে পিতৃমাতৃহীন হয়ে মাতুলালয়ে কাটাতে হবে আরো দ্বাদশ বর্ষ, ভাবতেই সিক্ত হয়ে উঠল আঁখিপল্লব।

আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন তাপস,আচমকা কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু অথচ বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বরে কে যেন ডেকে উঠল,“ মহারাজ!মহারাজ? আপনি কি সংজ্ঞা হারিয়েছেন?”  অন্য কেউ এই সম্বোধন  করলে তাপস ভাবতেন নির্ঘাত ব্যঙ্গ, কিন্তু তাঁর এই বিশালদেহী ভ্রাতাটি যে আদৌ ব্যঙ্গ নয়,বরং পরম শ্রদ্ধা তথা ভালোবাসায় তাঁকে এই চরম দুর্দিনেও মহারাজ বলে ডাকেন, তা তাপসের অনবগত নয়। মৃদু হেসে বললেন,“নাঃ। সামান্য ধ্যানের প্রচেষ্টা। ”
তাঁর এই ভ্রাতাটি অন্যান্য ভাইদের তুলনায় দর্শন বা বুদ্ধিবৃত্তিতে বেশ সাধারণ। তবে অমিত বলশালী এবং শিশুর মতই সরল। সুখের দিনে প্রজারা আড়ালে বলতেন এই রাজকুমার শুধুমাত্র “দাদা আর গদা” ছাড়া কিছুই বোঝেন না। কথাটা মিথ্যা নয়। ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও ইনি গদা ছাড়া অন্যান্য কোন শস্ত্রচালনাতেই তেমন দক্ষ নন। রাজনীতি, কূটনীতির জটিলতাও তেমন বোঝেন না।রাজপাট ত্যাগ করে বনবাস কালে ইনি ব্যাপক অশান্তি করেন শিশুদের মত। না রাজকীয় ভোগবিলাসে তেমন যে আসক্তি আছে তা নয়, তবে ইনি বড় জলদি ক্ষুধাকাতর হয়ে পড়েন। ইতিপূর্বে কিয়ৎকাল বনবাসের অভিজ্ঞতা থেকে ভালই জানতেন যে জঙ্গলে অর্ধেক দিবস অভুক্ত  থাকতে হয়, তাই কিছুতেই এযাত্রা বনবাসে আসতে আগ্রহী ছিলেন না। শেষে তাপস ক্রুদ্ধ হয়ে, এই ভ্রাতাকে ত্যাগ করেই সপরিবারে বনবাস যাত্রা করেন। বেশ কিছুটা পথ গিয়ে পিছন ফিরে দেখেন, শিশুর মত মাটিতে পা ঘষতে ঘষতে তাঁদের অনুসরণ করছেন মধ্যমকুমার।
শুধু কি তাই, বনবাসে এসে সকলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শিকার এবং ভিক্ষাবৃত্তি সম্পন্ন করেন, কিন্তু এণাকে শিকারে পাঠালেও বিপদ ভিক্ষাবৃত্তিতে নিযুক্ত করলেও বিপদ।শিকারে গেলে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও অনাবশ্যক বেশী জীবজন্তু বধ করে নিয়ে আসেন  কুমার। যাতে সকলের পেট ভরে যাওয়ার পর অবশিষ্টাংশ তাঁর উদরপূর্তিতে যেতে পারে। আর ভিক্ষা করতে গিয়ে একমুঠি যব প্রদান করা গৃহস্থের দিকে এমন কটমট করে তাকান যে তাঁরা প্রাণভয়ে ভাঁড়ার উপুড়হস্ত করে দেন। খবর আসতে বিলম্ব হয়নি তাপসের কানে। ফলে আপাততঃ শিকার এবং ভিক্ষা দুই নিষেধ।
সারাদিন বাতাসে গদাযুদ্ধ আর গৃহিণীকে গৃহকর্মে সহায়তা করেই দিন কাটে তাপসের। রাতে সকলের পাতে যখন একমুঠি যবের মণ্ড তুলে দেন প্রিয়া, শিশুর মত হস্ত এবং পাত্র লেহন করেন মধ্যম কুমার। মাটিতে পড়ে থাকা গুঁড়াও অঙ্গুলি স্পর্শে তুলে নিয়ে মুখে দেন। তাপস জানেন প্রিয়া তথা অন্যান্য কুমারেরা তাঁদের অংশ থেকেও কিছুটা সস্নেহে তুলে দেয় মধ্যমকুমারের পাত্রে। দেন তিনিও, এক চুটকি উদ্বৃত্ত   যবের মণ্ড পেয়ে কুমারের দুই চোখ চিকচিকিয়ে ওঠে। নিভৃতে বিড়বিড় করেন তাপস,“যাঁদের জন্য তোমায় এই জঠরাগ্নি সহন করতে হচ্ছে, ইন্দ্রের বজ্র নেমে আসুক তাদের মাথায়। ”
“মহারাজ?” আবার অসহিষ্ণু হয়ে প্রশ্ন করলেন মধ্যম কুমার
“কি ভ্রাতা?”সস্নেহে জানতে চাইলেন তাপস।
“মহারাজ,চলুন ফিরে যাই। আমাদের রাজ্যে। ফিরিয়ে আনি আমাদের শিশুগুলিকে। আবার পাটরাণী হয়ে রাজপ্রাসাদ আলো করে বসুন আর্যকন্যা। ”
“ভ্রাতা,তুমি কি বিস্মৃত হয়েছ?বারো বছর এই বনভূমিই আমাদের রাজপাট,ঐ মৃৎকুটির আমাদের রাজপ্রাসাদ। তারপর,এই বনভূমি ত্যাগ করে আমাদের আশ্রয় নিতে হবে কোন সম্পূর্ণ অচেনা অনাত্মীয় গৃহে।লুকিয়ে রাখতে হবে নিজেদের ছদ্মবেশ তথা ছদ্মপরিচয়ের অবগুণ্ঠনে।  যেখানে আমাদের কেউ না চিনতে পারে। যদি ধরা পড়ে যাই,তো আরো বারো বছরের বনবাস সুনিশ্চিত। ”
এক ঝলক আগুন চলকে উঠল কুমারের দুইচোখে,পর মুহূর্তেই তার স্থান অধিকার করল একরাশ সরলতা। দুষ্টু হাসি হেসে কুমার বললেন,“জানি ভ্রাতাঃ। জানি। তাই তো এক সুপ্রস্তাব এনেছি। দেখুন কৃষক যেমন স্বল্প বীজবপন করে, আহরণ করে বিপুল পরিমাণ শস্য,বুদ্ধিমান ব্যক্তি যেমন বিপদে অল্প ধর্ম বিসর্জন দেন বৃহত্তর ধর্মরক্ষার স্বার্থে, সোমলতার প্রতিনিধি যেমন পূতিকা,তেমনি বৎসরের প্রতিনিধি মাস। চলুন আমরা এই জঙ্গলে অতিবাহিত তের মাসকেই গণ্য করে তের বৎসর হিসাবে। ব্যাস হয়ে গেল আমাদের বারো বৎসরের বনবাস আর এক বৎসর অজ্ঞাতবাস। দেখুন এই অন্তিম এক মাসে তো কোন কৌরব বংশীয় চর আমাদের সন্ধানে আসেনি, তো এই একমাস অজ্ঞাতবাস হল কি না?”
কুমারের কুযুক্তিতে হো হো করে হেঁসে উঠলেন তাপস। সেই অট্টহাসের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে উড়ে গেল পিপ্পলী-বৃক্ষের শাখাপ্রশাখায় আয়েস রত জনা কয়েক বায়স। রীতিমত আহত চক্ষে মধ্যমকুমার বললেন,“জানতেম। জানতেম আপনি মানবেন না। তাই আরো একটি উত্তম প্রস্তাব আছে। একটা ভালো ধর্মের ষণ্ড জোগাড় করে, তাকে ভরপেট খাইয়ে, হস্তপদ মর্দন করে যথাবিহিত সেবা করে, তাকে প্রীত করতে পারলেই সব পাপক্ষলন হয়ে যাবে। আমি একটা ষণ্ড জুটিয়েও এনেছি। আবডালে রাখা আছে। মহানন্দে ঘাস চিবোচ্ছে। এবার আপনিও মেনে নিন ভ্রাতা। এযাতনা আমার যাও সহ্য হয়, প্রিয়া বা কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের কষ্টে বুক ফেটে যায় আমার। ”
স্নেহের ভ্রাতাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ  করলেন তাপস, এই কুমারের শ্মশ্রুগুম্ফের বৃদ্ধি বড়ই স্বল্প, নেই বললেই চলে, অঙ্গরাজ তো জনসমক্ষে  তাঁর এই স্নেহের ভ্রাতাটিকে পেটুক এবং তূবরক(মাকুন্দ) বলে গালি দিতেন। কেশরাজি অবশ্য খুব একটা কম না,বরং বেশ ঘণ। ভাইয়ের চুলে সস্নেহে বিলি কাটতে কাটতে বললেন,“ভীমসেন,তুমি জানো, আমি তোমার প্রস্তাব রক্ষা করতে অপারগ। এবার বলো তো,এই ভয়ানক হাস্যকর প্রস্তাব তোমার মগজে কে ঢুকিয়েছে। ” পিছন থেকে অদ্ভূত মোহক গলায় কে যেন বলে উঠল,“আমি”। চমকে করজোড়ে উঠে দাঁড়ালেন তাপস, সম্মুখে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন,তিনি  এক অনিন্দ্যসুন্দর পুরুষ।  তাঁর গাত্রবর্ণ ঘণ নীল,মস্তকে শোভা পাচ্ছে শিখিপুচ্ছ। একজোড়া লালচে ভেজা ওষ্ঠ এবং অধরে খেলা করছে মোহন হাসি। তার রূপে আলোকিত এই বনানী। নতজানু হয়ে প্রণাম করতে গেলেন বনবাসী ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা যুধিষ্ঠির, খপ করে তাঁকে ধরে বুকে যিনি জড়িয়ে ধরলেন, তাঁর মূল মন্ত্র বুঝি, “কোন খেলা যে খেলব কখন-”। আর নাম? তাও কি বলার অপেষ্কা রাখে? তিনি দীনবন্ধু। তিনিই জগৎপতি।