Thursday 5 October 2017

চোরা পূর্ণিমা


আজ কোজাগরি লক্ষ্মী পুজো। শোভাবাজারের চট্টরাজ পরিবারে বিশাল ধুমধাম করে পুজো হয়। চট্টরাজদের বিশাল পরিবার। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীতে গমগম করে বাড়ি। এই প্রজন্মের বড় বউ অদিতি ডাকসাইটে রূপসী। লাল পাড় গরদ, মানানসই সোনার গয়নায় ঝলমলাচ্ছে, তার মধ্যে অদিতির গলার বিশাল সীতাহারে সকলের চোখ আটকে যাচ্ছে। কি অসাধারণ ডিজাইন। সাবেকী গয়না বোঝাই যায়। অনেক মহিলাই লোলুপ দৃষ্টিতে নেড়ে দেখছে,এ ব্যাপারে অদিতি অত্যন্ত উদার। জনে জনে বলে বেড়াচ্ছে “ঠাকুমার হার গো। ওণাকে ওণার শাশুড়ী দিয়েছিলেন। এখন ভাইবউয়ের সম্পত্তি।  এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঐ আব্দার করল, পড়তেই হবে। আমার তো বেশ ভয় লাগছে,পরের জিনিস বাবা। ” অদিতির বাপের বাড়ি নিউ আলিপুর, ওরা বিশাল ধনী এবং অভিজাত পরিবার।
শ্যামলা, এ বাড়ির মেজ বউ পিছন ফিরে পুজোর জোগাড় করতে করতে মুখ ভ্যাঙালো। অদিতি মোটেই এত উদার নয়। বিয়ে হওয়া ইস্তক শ্যামলার পিছনে লেগে আছে। শ্যামলার নামের মতই গাত্রবর্ণ। বাবা জুটমিলের বড় বাবু ছিল। জুট মিল বন্ধ হয়ে যাবার পর মায়ের সব গয়না বিক্রি করে দুবেলা পেট আর দুই বোনের পড়াশোনা চলেছে। সময়মত শ্যামলা প্রাইমারি টিচারের চাকরীটা না পেলে আর বেচার মতও কিছু থাকত না। আন্দুলের মেয়ে শ্যামলার সাথে এবাড়ির মেজ ছেলে শুভাশিসের প্রেমের বিয়ে। শ্যামলারা জাতেও বামুন না। সোজা কথায় অদিতির যা যা আছে শ্যামলার তার কিছুই নেই। এমনকি অদিতির বর নামি মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানীর হোমরাচোমরা অফিসার আর শ্যামলার বর ছাপোসা পুলিশের সাবইন্সপেক্টর।
এত কিছু থাকা সত্ত্বেও অদিতির যদি একটু মানসিক উদারতাও থাকত।
শ্যামলার সব কিছুতে শুধু খুঁত ধরেই ক্ষান্ত  হয় না অদিতি সেই নিয়ে শাশুড়ি খুড়শাশুড়ি ননদদের সাথে হাসাহাসি করে। প্রতিটা অনুষ্ঠানে শ্যামলার সাজপোশাক নিয়ে তাচ্ছল্যপূর্ণ মন্তব্য করে। যেমন আজই সবার সামনে বলল,“একটা ভালো শাড়িও কি পড়তে নেই আজকের দিনে?” অথচ এই লালপাড় হলুদ তাঁতের শাড়িটা শ্যামলার কছে যে পরম মূল্যবান সেটা অদিতি ভালোই জানে। শ্যামলার গরীব বাপ ওকে পুজোয় দিয়েছে এটা। শ্যামলারই বেতনের পয়সায় ওদের সংসার চলে, তবু তার মধ্যে থেকেই কিছু টাকা বাঁচিয়ে আন্দুল বাজারের আনন্দমহল বস্ত্রালয় থেকে এই শাড়িটা কিনে বাবা ওকে দিয়েছিল শ্যামলার চোখ উপছে পড়েছিল অশ্রুজল। পুজোয় অদিতির বাপের বাড়ির মত তত্ত্ব আসেনি বলেও শ্যামলাকে উপহাস শুনতে হয়েছিল।
এসব তো ছাড়ুন,অদিতি শ্যামলাকে চোর বদনাম দিতেও ছাড়েনি। ভাইবউয়ের একটা ডিজাইনার শাড়ি অদিতি বাপের বাড়ি থেকে এনেছিল বরের অফিসের পার্টিতে পরবে বলে। সেটা সাবেকী আলনায় রেখে স্নান করতে ঢুকেছিল, বেরিয়ে দেখে নেই। শ্যামলা সবে স্কুল থেকে ফিরে মুখহাত ধুয়ে খাবার নিয়ে বসেছিল, অদিতি হাউসকোট জড়িয়ে ডাইনিং রুমে এসে সে কি চিৎকার। কে নিয়েছে ওর দামী শাড়ি, সে যেন এখুনি স্বীকার করে, না হলে অদিতি সবার ঘর সার্চ করবে। আর ধরতে পারলে---
শ্যামলার গলায় খাবার আটকে গিয়েছিল।কি শাড়ি, কত দাম কিছুই জানে না শ্যামলা। একটু বেশী কথা বলে, এক কাপড়ে বিয়ে হয়ে এসেছে, কোনদিন নিজের বাপের বাড়ির অবস্থা লুকোয়নি। তাই বলে চোর?বাড়িতে সেই সময় কোন কাজের লোকও ছিল না। অদিতি নিশ্চয় শ্বশুর শাশুড়ী খুড়শ্বশুর,খুড়শাশুড়ী বা দেওর ননদদের বলেনি। এবাড়িতে নতুন লোক তো একটাই। টপটপ করে ঝরে পড়ছিল চোখের নোনতা জল। কেউ প্রতিবাদও করল না। শুধু অদিতির বর বলল,“কি ছেলেমানুষি হচ্ছে অদিতি। ভালো করে খুঁজে দেখেছো?তুমি বাড়ির লোকের ঘর সার্চ করতে পারো না।”
শাড়িটা কোথায় পাওয়া গিয়েছিল জানেন?আলনার পিছনে। হড়হড়ে শাড়ি নির্ঘাত হড়কে পিছনে পড়ে গিয়েছিল। অদিতি কিন্তু কোনদিন সরি বলেনি শ্যামলাকে।
শ্যামলা একমনে পুজোর যোগাড় করে চলেছে, ঠাকুরমশাই এলেন বলে। শাশুড়ি মা অদিতিকে চাপা স্বরে বললেন,“অদিতি হারটা হয় খুলে এসো,নয়তো গায়ে চাপা দাও। এত লোকের ভিড়, কে কাকে খবর দেবে। তোমার জন্য সবার বিপদ হবে।” অনিচ্ছাসত্ত্বেও দোতলায় উঠে গেল অদিতি।
পুজো শুরু হয়েছে, ঠাকুরঘর ভিড়ে ভিড়াক্কার। অদিতি যথারীতি শ্যামলাকে সরিয়ে ঠাকুরমশাই এর পাশে জায়গা করে নিয়েছে। মৃন্ময়ী লক্ষ্মীর সামনে চিন্ময়ী লক্ষ্মী। বড় বউদির সাথে সেলফির জোয়ার বইছে দেওর ননদদের মধ্যে। পিসতুতো ননদ তো বলেই দিল, “প্রাচী দেশাইয়ের মত লাগছে বউদি তোমায়। ”শ্যামলার ওপর নির্দেশ হয়েছে আরেক ঠাকুরমশাইয়ের তদারক করার,অর্থাৎ হেঁসেলে গিয়ে দেখতে হবে, খাবার কতদূর রেডি হয়েছে। মোটামুটি সাড়ে আটটা নটা থেকেই ব্যাচ বসবে।
রাঁধুনী ঠাকুরের কাছে যাবার পথ,  দোতলার সিঁড়ির সামনে দিয়েই যেতে হয়। টুক করে দোতলায় উঠে গেল শ্যামলা। অদিতির ঘরে তালা দেওয়া। যবে থেকে শুভাশিস আর শ্যামলা পাশের ঘরে থাকতে শুরু করেছে অদিতি কোথাও গেলেই ঘরে চাবি মারে। শুধু শ্যামলা ছাড়া এতবড় চট্টরাজ পরিবারের কারো কখনও মনে হয়না তা আদৌ অশোভন। টুক করে বুক থেকে বার করল ডুপ্লিকেট চাবি। তক্কে তক্কেই ছিল শ্যামলা,বিনা দোষে চোর বদনাম দেবার মাস দুই তিন পর একদিন সুযোগ বুঝে চাবির ছাপ তুলে নিয়েছিল।
বুকের ভিতর ড্রাম পিটছে কেউ। যদি কেউ উঠে আসে এই মুহূর্তে চিরদিনের মত চট্টরাজ পরিবার থেকে বিতাড়িত হবে শ্যামলা।ভিতরে ঢুকে টুক করে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। জানলা দিয়ে আসা অাবছা আলোকে হাতড়ে হাতড়ে গিয়ে হাজির হল, ড্রেসিং টেবিলের সামনে। আলতো হাতে টানল ড্রয়ার। এই তো জ্বলজ্বল করছে ভারী সীতাহার।
ছাতের ওভারহেড ট্যাঙ্কে টুপ করে ডুবে গেল হারটা। আকাশে তখন পূর্ণচন্দ্র। জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। ট্যাঙ্কের জলে চাঁদ আর শ্যামলার প্রতিচ্ছবি মিলেমিলে একাকার হয়ে যাচ্ছে।  আশৈশব শুনে এসেছে কোজাগরী পূর্ণিমা হল চোরা পূর্ণিমা। এদিন কিছু চুরি করতে হয়। জীবনে কোনদিন কিছু চুরি করেনি শ্যামলা, আজও করল কি? মুখ বুজে অপবাদ সহন করাও তো পাপ?
রাধুনী বামুন ঠাকুরের পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু হাঁপাতে হাঁপাতে শ্যামলার মুখে হাল্কা হাসি খেলে গেল,মনে মনে বলল“দিদিভাই আজ প্লিজ আমার ঘরটা সার্চ করো কিন্তু। ”
©Anindita's Blog

Tuesday 3 October 2017

অনির চিকমাগালুরের ডাইরি

অনির চিকমাংলুরের ডাইরি ২৯শে সেপ্টেম্বর  ২০১৭
পুজো মানেই হাওড়া। পাড়ায় পাড়ায় ছোট বড় মণ্ডপে সপরিবার সুসজ্জিতা মা দুর্গা, ৬৫ডেসিবেলকে কাঁচকলা প্রদর্শন পূর্বক মাইক্রোফোনের  গগনবিদারী চিৎকার, ঝকঝকে পুজো স্পেশাল আলোয় ধুয়ে যাওয়া রাস্তাঘাট, কাতারে কাতারে মানুষ, ফুচকা,রোল,বিরিয়ানি, আইসক্রীম,ঝালমুড়ির হরির লুট, বন্ধুদের সাথে দেদার আড্ডা আর সর্বোপরি আমার বৃদ্ধ বাবা-মা আর পিসি। এসব ছেড়ে যাওয়া তাও আবার মহাষ্টমীর অঞ্জলি দিয়েই,যে কি যন্ত্রণাদায়ক,তুত্তুরী তো কান্নাকাটিই জুড়ে দিল। কি করি?কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। শৌভিক স্বয়ং ফিরিয়ে নিয়ে এল আমাদের, অতঃপর চটজলদি ব্যাগ গুছানো, কারণ পরদিন সকাল ৬টা ৫৫এ আমাদের ফ্লাইট।
আবার দেবুরা আর আমরা একসাথে বেড়াতে যাব, এই নিয়ে তৃতীয় বছর। দেবু লেবার সার্ভিসে আমার ব্যাচমেট, এবং অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মূল আইডিয়া যদিও শৌভিকের তবে তাকে বাস্তবে রূপদান করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব  দেবুর। প্লেনের টিকিট কাটা থেকে হোটেল বুক করা সব দেবুই করে,আমরা শুধু এনইএফটি করেই খালাস।
যাই হোক নবমীর দিন ভোর পৌনে চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে, কাকস্নান করে,শৌভিকের নির্দেশানুসারে মুএসলি আর ঠাণ্ডা দুধ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা যখন বার হলাম,সারা রাত জেগে ঠাকুর দেখে ক্লান্ত মহানগর তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। নীচে নেমে খেয়াল করলাম,ঘড়ি পড়তে ভুলে গেছি। শৌভিককে করজোড়ে মিনতি করলাম,“চাবিটা দে,তিন মিনিটে ঘড়ি পড়ে নেমে আসব। ” শৌভিক পাত্তাই দিল না। “ঘড়ি পড়িসনি আর ঘড়ি পড়ে কি হবে?সবসময়ই তো হাতে মোবাইল নিয়ে ঘুরিস। ”
অগত্যা বিনা ঘড়িতেই রওনা দিলাম আরো একবার দক্ষিণ ভারতের উদ্দেশ্যে।
স্পাইস জেটের ফ্লাইট,ব্যাঙ্গালোর পৌছানোর কথা সাড়ে নটা নাগাদ, এদিকে দিন কয়েক ধরেই ব্যাঙ্গালোর ভেসে যাচ্ছে। ব্যাঙ্গালোরের ওপরও দেখলাম থকথকে গাঢ় মেঘ চাঁদোয়া টাঙিয়েছে। প্লেন বেশ কিছুক্ষণ ধরে চক্কর টক্কর মেরেও যখন আমাদের নামাল ঘড়িতে তখন সকাল ৯টা বেজে ১১মিনিট মাত্র। ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার পদার্পণ। কলকাতার সাথে একটা ব্যাপারেই বৈপরীত্য চোখে পড়ে, ইন্টারন্যাশানাল টারমিনালে আমার যাবার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু ডোমেস্টিক টারমিনালের টয়লেট অন্তত মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট গুলি অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন।  ভোরের ফ্লাইট হলে প্রতিবারই দেখি একটি টয়লেট বন্ধ এবং অন্যটিতে প্রাণান্ত ভিড়। জলে ভেসে যাওয়া টয়লেট, বদগন্ধযুক্ত। পানীয় জলের জায়গায় ডিসপোসেবল গ্লাস থাকে না এবং চতুর্পাশ এত আবর্জনাময় যে জল খেতে ঘেন্না করবে।
যাই হোক, ব্যাঙ্গালোরে গাড়ি বুক করাই ছিল, দশটার মধ্যে বামালসমেত আমরা যখন গাড়িতে চাপলাম, পেটে ছুঁচোয় পুরোদমে ডনবৈঠক শুরু করেছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া শৌভিকের ভোডাফোন দেহ রেখেছে। ড্রাইভারকে বলা হল, আগে প্রাতরাশ , তারপর কোন ভোডাফোন স্টোর দেখে দাঁড় করাতে।
দক্ষিণ ভারতে এলে প্রথম যে সমস্যাটা হয়,তা হল বোধগম্য ভাষায় বার্তালাপ করা। হিন্দি এরা বলে না, আর এদের সাথে ইংরাজিতে বার্তালাপ করতে হলে কাঁদতে হয়। কি যে বোঝে,কি যে বলে ওরাই বোঝে। আমাদের ড্রাইভার দেখলাম নূন্যতম হিন্দি বোঝে। প্রাতরাশের জন্য আমাদের নামাল, আনন্দমহল ভেজ রেস্টুরেন্টে। ভেজ দেখেই সবাই মুখ ভ্যাটকালো,কাল অষ্টমী ছিল, সবাই নিরামিশ খেয়েই কাটিয়েছে, আজ আবার নিরামিষ?পাশেই একটা বিরিয়ানী মহল রয়েছে বটে, তবে শুনশান, টেবিলের ওপর চেয়ারগুলি তুলে লাট লাগানো। আশহত হয়ে নিরামিষ রেস্তরাঁতেই গেলাম। সারাদিন লম্বা ট্যুরের পরিকল্পনা আছে,তাই শৌভিকে হুকুম, ভরপেট প্রাতরাশ সেরে নিতে হবে, পথে কোথাও লাঞ্চ খেতে থামা যাবে না। খামোকা সময় নষ্ট করা যাবে না।
সব বুঝলাম, কিন্তু খাব কি?ইডলি আর ডোসা?কলকাতায় যে ইডলি-ডোসা খেয়ে আমরা তওবা তওবা করি,তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন এখানকার খাবারে পেলাম না। কি ভয়ানক খেতে বাপরে বাপ। আমি আর অন্বেষা অর্থাৎ তুত্তুরীর দেবু মামি যতই ধমকে মেয়েদের খাওয়ানোর চেষ্টা করি না কেন,নিজেদেরই গলা দিয়ে নামছিল নারে বাবা। কুচ্ছিত কদাকার প্রাতরাশ সেরে বমি চেপে,চিকেন প্যাটিস আর চকলেট প্যাস্টি কিনে যখন গাড়িতে উঠলাম ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটার ঘর ছাড়িয়েছে। গন্তব্য শ্রবণবেলগোলা।

অনির চিকমাগালুরের ডাইরি ৩০শে সেপ্টেম্বর  ২০১৭(পর্ব-২)
ব্যাঙ্গালোর থেকে শ্রবণবেলগোলার দূরত্ব ১৪৪কিলোমিটার। কর্ণাটকের হাসান জেলায় অবস্থিত। এখানেই নাকি চন্দ্রগুপ্ত শেষ বয়সে জৈনধর্ম গ্রহণ করেন অনশনে দেহত্যাগ করেন। বেলগোলা শব্দের অর্থ হল শ্বেতসরোবর পাতি বাংলায় দুধপুকুর। শ্রবণবেলগোলা হল শ্রবণের দুধপুকুর।শ্রবণবেলগোলা যদিও শৌভিকের পরিকল্পিত ট্যুরে ছিল না। ব্যাঙ্গালোর থেকে চিকমাংলুরের পথেও পড়ে না, মাঝে বেঁকে যেতে হয় অনেকটা। কিন্তু একে তো ড্রাইভার বলল,তারওপর আগের বার ব্যাঙ্গালোর এসেছিলাম,কিন্তু শ্রবণবেলগোলা দেখিনি বলে সুকন্যা হায়হায় করেছিল।

১৪৪কিমি রাস্তা,সারাদিনই গাড়িতে কাটবে, আপাতত তা যদিও অত্যন্ত  স্বস্তিকর। গতকাল রাতে চাপা উত্তেজনায় কারোরই ঘুম হয়নি। অন্বেষা তো সারা রাতই জেগেছিল,এবার ঘুমোনোর তাল করলাম । শৌভিক চটজলদি তুত্তুরীকে অ্যাবুমিন খাইয়ে দিল।বমি বন্ধ করার ওষুধ বটে,তবে তুত্তুরীর জন্য ওটা হল ঘুমের ওষুধ। লোকে মদ-গাঁজা খেয়ে নেশা করে, আমার মেয়ে অ্যাবুমিন খেয়ে নেশা করে। মাঝে মাঝেই বাবার কাছে বায়না ধরে,“একটা অ্যাবুমিন দাও না, খেয়ে ঘুমোব। ”

ঝাঁ চকচকে রাস্তা এবং কয়েক কিলোমিটার ছাড়াছাড়াই টোল প্লাজা। কর্ণাটকে এসে একটা ব্যাপার প্রত্যক্ষ করলাম,যে রাস্তাগুলিতে টোল প্লাজা আছে, শুধু সেগুলিই ভালো। বাকি রাস্তাগুলিকে আমাদের বাঁকুড়া-পুরুলিয়াও এক ডজন গোল দিতে পারে।  যখন  শ্রবণবেলগোলায় পৌছলাম,ঘড়ির কাঁটা বেলা একটা ছাড়িয়ে দেড়টার দিকে দৌড়চ্ছে। তুত্তুরী তখনও গভীর ঘুমে অচেতন। পুটপুট অর্থাৎ দেবুর মেয়েও অ্যাবুমিন না খেয়েই তুত্তুরীর সাথে পাল্লা দিচ্ছে। আর ঐ রোদে খালি পায়ে এত উঁচুতে চড়তে অন্বেষা মোটেই উৎসুক ছিল না। সুতরাং  তিনজনেই রওনা দিলাম।
ক্ষয়প্রাপ্ত পাহাড়, নাঃ আসলে পাহাড় বললে পাহাড় খেপে যেতে পারে, ঢিপি। একনজর দেখলে আমাদের অতি পরিচিত খণ্ডগিরি বলে বোধ হবে। সামনে বিশাল সাদা কারুকার্য  খচিত গেট,গেট টপকালেই জুতো খুলে রাখতে হয়। একটা প্লাস্টিকের বাজার ব্যাগে ভরে জুতো গুলি রেখে দেয় এরা। একাধিক হকার মোজা বিক্রি করছে,ইতস্ততঃ করে কিনেই ফেললাম তিনজোড়া মোজা।
উঠতে শুরু করার পর,প্রথমে মনে হল, এ আর এমন কি? দেবু কোথায় পড়েছিল হাজারখানা সিঁড়ি,পাশ দিয়ে কারা বলতে বলতে নামল ৬১৩টা। সংখ্যা যাই হোক, বেশ চাপ। একে মাথার ওপর গনগনে সূর্য,পায়ে নাইলনের হড়হড়ে মোজা।
সরু, দুজোড়া খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে, একটা দিয়ে পুণ্যার্থীরা উঠছে, অন্যটা দিয়ে নামছে। ওঠার সিঁড়ির বাঁপাশে আরও একটা নির্মিয়মান সিঁড়ি আপাতত বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। দুজোড়া সিঁড়ির মাঝখানে ঢালু এবড়ো খেবড়ো পাহাড়, আদিতে বোধহয় ঐ দিয়েই ওঠানামা করা হত, জনা কয়েক নগ্ন জৈন সন্ন্যাসী এবং সাদা শাড়িতে আপাদমস্তক আবৃত মাতাজী বেতো পায়ে ঐ পথেই নামল। এভাবে চোখের সামনে নগ্ন সন্ন্যাসী জীবনে দেখিনি। সকলেই বয়স্ক,এক হাতে কমণ্ডুলের মত একটা পাত্র,অপর হাতে ময়ূরের পেখম গোল করে বেঁধে ইয়া মোটকা একটা ঝাড়ুর মত বস্তু। গোটা সিঁড়ি দেবুতে আর আমাতে হাঁপাতে হাঁপাতে রিসার্চ করতে করতে উঠলাম ঐটি কি কাজে লাগে। দেবুর মতে ঠাণ্ডা লাগলে প্রাইভেট পার্ট চাপা দেয়,অথবা মহিলা দেখলেও চাপা দিতে পারে। যদিও চতুর্দিকে প্রচুর মহিলা ছিল সেই মুহূর্তে। একটা জিনিস প্রত্যক্ষ করলাম এরা পুরুষ পুণ্যার্থীদের প্রণাম দিব্যি নেয়,মহিলা হলে লাফিয়ে সরে যায়,সে যত দূর থেকেই প্রণাম করা হোক না কেন।
উঠতে উঠতে দূরে নীচে দুধপুকুরটিকেও প্রত্যক্ষ করলাম। দক্ষিণ ভারতের মন্দির গুলিতে যে ধরণের বড় চৌকোণা বাঁধানো চৌবাচ্চা থাকে, ওমনি। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে চারদিক দিয়ে। চার কোণে চারটি দুয়ার। জলের রঙ শ্যাওলা সবুজ। বেশ অপরিচ্ছন্ন।
হাঁফাতে হাঁফাতে ওপরে উঠলাম,প্রায় ১০০০ফুট তো হবেই। উপরে একটি বড় মন্দির আছে,তাতে মহাবীর পূ্র্ববর্তী তিনজন তীর্থঙ্করের মূর্তি আছে। বেশ অন্ধকার ভিতরটা,ততোধিক ফাঁকা। আধো অন্ধকারে তিনটি মূর্তি একই রকম লাগল। মন্দিরের বাইরে ঢালু পাহাড়, ব্যাঙ্গালোর আসেপাশে সবকটা পাহাড়ই এই রকম। ঢালু এবং মসৃণ। ঢালু পাহাড়ের গায়ে কিছু শিলাশিপিআছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু এক কলম। প্রতিটি লিপি কাঁচের শিট দিয়ে ঢাকা,যাতে কেউ ভুল করে পদার্পন না করে বসে।
তিন তীর্থঙ্করের পাশ দিয়ে লম্বা সিঁড়ি উঠে গেছে, তার ওপর ৫৮ফুট উঁচু গোমতেশ্বরের মূর্তি। পৃথিবীর দীর্ঘতম মনোলিথিক স্ট্যাচু। প্রতি ১২ বছর অন্তর দেশ বিদেশ থেকে জৈন পুণ্যার্থীরা এখানে এসে জমায়েত হয় এবং গোমতেশ্বরের মূর্তিকে দুধ,হলুদ বাটা, শ্বেত চন্দন,মধু, চালগুঁড়ো,আখের রস ইত্যাদি দিয়ে ধোয়া হয় এবং সোনা রূপার ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। এই উৎসবের নাম “মহামস্তকাভিষেক”। পরবর্তী মহামস্তকাভিষেক আছে ২০১৮এ। যাবেন নাকি? ও হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি,জৈনরা কিন্তু গোমতেশ্বরকে বলে “বাহুবলি। ”
শ্রবণবেলগোলা থেকে যখন  নামলাম,ঘড়ির কাঁটা আড়াইটে ছাড়িয়েছে। পরবর্তী গন্তব্য হ্যালেবিড বা হ্যালেবিডু তারপর বেলুরের চিন্নাকেশভা মন্দির ঘুরে তারপর চিকমাংলুর বা চিকম্যাঙ্গালুর। ফিসফিসিয়ে শৌভিককে জিজ্ঞাসা করলাম,“সব হবে তো আজকে?” শৌভিক আশ্বস্ত করল, ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে আছি,এখানে সূর্য অনেক দেরীতে অস্ত যায়।
হ্যালেবিড যখন পৌছলাম,পাঁচটা বেজে গেছে,সূর্যদেব পাটে না বসলেও আলো কিন্তু বেশ কম।

অনির চিকমাগালুরের ডাইরি ১লা অক্টোবর ২০১৭ (পর্ব-৩)
হ্যালেবিডের হয়সলেশ্বরা মন্দিরে যখন পৌছলাম, ঘড়িতে তখন পাঁচটা। আকাশে সূর্য থাকলেও তার সেই তেজ নেই। নাই থাক, কি অপরূপ সুন্দর মন্দির,চোখ জুড়িয়ে গেল।এটি দক্ষিণ ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিবমন্দির।  বিশাল পরিচর্চিত ঘণ সবুজ বাগানের মধ্যে উঁচু বেদীর ওপর মন্দির, কথিত আছে বেলুরের চেন্নাকেশভা মন্দিরের সাথে তীব্র রেষারেষি করে এই মন্দির গড়ে তোলা হয়।যদিও মন্দির গড়ে ওঠে স্থানীয় সম্পত্তিশালী  শৈব জনগোষ্ঠীর উদ্যোগ এবং অর্থে কিন্তু নামকরণ হয়  তৎকালীন হয়সল বংশীয় রাজা বিষ্ণুবর্ধণ হয়সলেশ্বরের নামানুসারে।  
কালচে সবুজ সিস্ট নামক পাথর দিয়ে তৈরি মন্দিরটি আসলে গড়ে উঠেছে দুটি বিশাল শিব মন্দিরকে নিয়ে, একটি শিবের নাম হয়সলেশ্বর বলাইবাহুল্য রাজার নামানুযায়ী এবং অপরটির নাম শান্তালেশ্বর, রাণী শান্তালা দেবীর নামানুসারে। দুটি মন্দিরের সামনে বিশাল কারুকার্য খচিত মণ্ডপ। এই ধরণের স্থাপত্যরীতিকে নাকি দ্বিকূট বিমান বলা হয়। 

একে নবমী তায় শনিবার বলে প্রচণ্ড ভিড় ছিল। জুতো খুলে বেদীর ওপর উঠতে হয়। অবাক হয়ে দেখলাম দর্শনার্থীদের মধ্যে বেশ কয়েকটি হিজাব পড়া সুন্দরী মেয়েও আছে। চমকে গেলাম বিশ্বাস করুন। একজন আস্তিক হিন্দু হিসাবে আমার মাঝে মাঝে খুব লজ্জা করে, আমরা স্বচ্ছন্দে ইমামবাড়ায় ঢুকতে পারি, ব্যাণ্ডেল চার্চে ঢুকতে পারি। কিন্তু অধিকাংশ হিন্দু মন্দিরেই অহিন্দু দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ। এখানে শুধু ঐ কয়েকটি মেয়েই নয়, আরো কয়েকজন বোরখা পরা মহিলাকেও দেখলাম দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, বেদীর ওপরও উঠছে, ঈশ্বরের পবিত্রতা তাতে বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত হচ্ছে না। 
দুটি মন্দিরের সামনের মণ্ডপে দুটি বিশাল কৃষ্ণকায় নন্দীর মূর্তি। মন্দিরের মূখ্য প্রবেশধারের দুই পাশে সুন্দরী লাস্যময়ী যক্ষ্মিণী মূর্তি আপনাকে স্বাগত জানাবে। ভিতরে বিশাল শিবলিঙ্গ।তবে ভিতরটা বড় বেশী অন্ধকার, পাথুরে মেঝে এত মসৃণ যেন তেল ফেলেছে কেউ। মাত্র একঘন্টায় কতটুকুই বা দেখতে পেলাম। মনই ভরল না। 
বেলুরের চিন্নাকেশভা মন্দির দেখা আপাতত স্থগিত। পৌছতে পৌছতেই অন্ধকার নেমে আসবে। চিকমাগালুর কফি গ্রুভ রিসর্ট থেকেও দেবুকে ফোন করে জানাল আজ না যেতে কারণ ছটার পর মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। গাঢ় অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ১২০কিমি বেগে দৌড়তে লাগল গাড়ি। জিপিএস এতক্ষণ রাস্তা প্রদর্শন করলেও চিকমাগালুর শহর ছাড়াতেই ঝুপ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।  গতকাল রাত থেকে এই উত্তেজনা আর পরিশ্রম আর নিতে পারছিল না শরীর। অন্বেষা এবং আমি পর্যায়ক্রমে দেবুর মুণ্ডপাত করতে লাগলাম। চিকমাগালুর শহর ছাড়িয়ে বহুদূর চলে এলাম,  ফাঁকা অন্ধকার কফি আর গোল মরিচ গাছের জঙ্গল আর উপুর্যান্তে বৃষ্টি কফি গ্রুভ রিসর্টের নাম ও নেই আর গন্ধও নেই। রাস্তায় কোন বোর্ডও নেই আর একটা লোকও নেই। অতিকষ্টে ঘসটে ঘসটে যখন আমরা পৌছলাম, তখনও বৃষ্টি ধরেনি।বিশাল এলাকা জুড়ে ফাঁকা ফাঁকা নয়নাভিরাম কটেজ। কেয়ারী করা ফুলের বাগান, নকল ঝর্ণা আর সুদৃশ্য সুইমিং পুল, ব্যাডমিন্টন  কোর্ট, বাচ্ছাদের পার্ক। ঝকঝকে রিসেপশন আর রেস্তরাঁ, এমন প্রত্যন্ত  জায়গা যেখানে কারো মোবাইলে কোন টাওয়ার নেই,নেট তো দূরের কথা সেখানে এমন ঝাঁ চকচকে রিসর্ট কল্পনার অতীত। কটেজে ঢুকে মন ভরে গেল। বিশাল বিলাসবহুল ঘর, কাঠের চৌকোনো ছাদ, দুপাশে নিজস্ব বারন্দা, যার একটা উল্টো দিকের জঙ্গলের দিকে খোলে। বারন্দায় সোফা, ইজি চেয়ার কি নেই। আর বাথরুম?বাথটাব আর হেয়ার ড্রায়ার বাদে যেকোন পাঁচতারা হোটেলের মতই। তবে রিশেপসন রেস্তোরাঁ যত উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হোক, ঘর গুলি ততোটাই আলো আঁধারির রূপকথা। শুনলাম ইচ্ছা করেই নাকি জোরালো আলো লাগানো হয়নি,যাতে রাত্রিবেলা জঙ্গলের অসীম প্রশান্তি শহুরে আলোর চকচকানিতে বিঘ্নিত না হয়। 

গরমাগরম কফি খেয়ে ফ্রেশ হয়ে, একটু রেস্ট নিয়েই রাত নটা নাগাদ ডিনার। এখানে বোধহয় রাত দশটা সাড়ে দশটার পর কেউ জেগে থাকে না। আমরাও বেশি ক্ষণ জাগতে পারব বলে মনে হয় না, কাল সকালে ওঠার কোন তাড়া নেই, বারোটা নাগাদ বেরোব, হিরেকোলা লেক আর মুথুডি ফরেস্ট সাফারিতে। আপাতত শুভরাত্রি। আজ নবমী, আনন্দময়ীর শেষ রাত কলকাতায়, এখানে বিন্দুমাত্র তাপোত্তাপ নেই কারোর। লোকজনই বা কোথায়? শুধু আসার পথে দেখলাম কিছু বাস আর গাড়ির সামনে কলা গাছ আর পার্পল রঙের গুঁড়িগুঁড়ি ফুলের মালা ঝুলছে। একই দেশ অথচ কত বৈচিত্র তাই না?
(চলবে)


অনির চিকমাগালুরের ডাইরি ২রা অক্টোবর  ২০১৭(পর্ব-৪)

আজ ঘুম থেকে ওঠার কোন তাড়া নেই, তবু কেন জানি না ঘুমটা ভেঙে গেল। সারারাত অঝোরে ঝরার পর বৃষ্টি একটু থেমেছে। যে কোন ভাল হোটেলের মত ঘরেই ইলেকট্রিক কেটলি, কাপ,টিব্যাগ,কফি-দুধ আর চিনির পাউচ দেওয়া ছিল, চাইলেই বানিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু চিকমাগালুরে এসে কে আর ফিল্টার্ড কফি খায়?
আটটা থেকেই প্রাতরাশ শুরু হয়ে যায়। সাড়ে আটটার মধ্যে না গেলে ওরা ফোন করে বিনীত ভাবে জানায়, গরম গরম প্রাতরাশ তৈরি, শুধু আপনারই প্রতীক্ষা। প্রাতরাশ কমপ্লিমেন্টারি। এই কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট গুলি সাধারণত এলাহী হয়। এখানেও আয়োজন কিছু কম ছিল না। থরে থরে সাজানো ছিল, হোয়াইট ব্রেড, তার পাশেই গরম টোস্টার, আপনারই প্রতীক্ষারত। তার পাশে মাঝারি বাটিতে ডুমো ডুমো করে কেটে রাখা মাখন, তার পাশের বাটিতে লাল রঙের জ্যাম, তার পাশে বড় জুসের কন্টেনার উল্টে রাখা আছে। একদিন ফুটির জুস থাকত তো পরের দিন তরমুজের জুস। পাশেই ছোট কাঁচের গ্লাস সাজানো থাকত, গ্লাস তুলুন, উল্টানো কন্টেনারের কল খুলুন আর গ্লাসে ভরে নিন, হাল্কা কমলা বা লাল রঙের জুস। এছাড়া ফল থাকত, একদিন তরমুজ  তো আর একদিন ডুমো ডুমো করে কাটা সাংঘাতিক মিষ্টি পাকা পেঁপে। 
এবার বাঁদিকে ঘুরে যান,লম্বা সাদা কাপড় ঢাকা টেবিলে স্টীলের বড় ক্যাসারোলে রাখা আছে গরমাগরম দোসা, যা দেখতে অনেকটা সরুচাকলি বা রুটির মত। পাশে বিশাল পোর্সেলিনের বাটিতে সাদা নারকেলের চাটনী। তার পাশে বিশাল ট্রেতে সাম্বার, তার পাশে আটার ফুলকো লুচি বা পুরী, তার পাশে ডাল বা ভাজি,তারপাশে কলাইয়ের ডালের মুচমুচে বড়া। আবার বাঁদিকে ঘুরে যান এবার পাবেন ভেজ নুডলস্ আর কারি রাইস না হলে উপমা। তারপর সিদ্ধ ডিম, অবশেষে চা বা কফি আপনি যা চান, ঢেলে নিন। 
এত খাবার দেখলে আমি ঘাবড়ে যাই। বেশীর ভাগ দিনই ফল,জুস,ডিম সিদ্ধ আর উপমা বা ভেজ নুডলস্ খেতাম তুত্তুরী আর আমি। এরা ভেজ নুডলসেও কারি পাতা আর সর্ষে ফোড়ন দেয়। যাই হোক ব্রেকফাস্ট করে বাচ্ছা গুলো গেল ট্রাম্পুলিনে চড়ে নাচতে। সুইমিং পুল দেখলে আমার আর তুত্তুরীর আর সবুর সয় না। আর এত সুন্দর ঘণ নীল পুল দেখলে তো আর কথাই নেই।  সাধারণ আমরা যেখানেই যাই, আর কিছু নি বা না নি, সাঁতারের পোশাকগুলি প্যাক করতে ভুলি না। এবারও তুত্তুরীর পোশাক নেওয়া হয়েছে কিন্তু তাড়াহুড়ো  করে আমারটা আনতে ভুলে গেছি। অনেক হোটেল যেমন মেফেয়ার গোপালপুরে ওরা কস্টিউম ভাড়া দেয়। কিন্তু এদের সে ব্যবস্থা নেই। কাছে পিঠে কোন মল বা মার্কেটও নেই,কি হবে?দেবু বলল,“ভাবিস না। এদের ওসব নিয়ম নেই যে সুইমিং কস্টিউম না পড়লে জলে নামা যাবে না। এমনি জামাকাপড় পরেই নামা যাবে। ”সে তো যাবে, কিন্তু যা ঠাণ্ডা জল। পা ডুবিয়েই সাঁতার কাটার আশা ত্যাগ করলাম, আমি যাও বা সামলে নেব,তুত্তুরী নামলে নিউমোনিয়া অবধারিত। 
বেলা বারোটা নাগাদ বেরোলাম সবাই মিলে, পথে কোথাও লাঞ্চ পাওয়া যায় না, তাই গ্রীলড্ চিকেন স্যাণ্ডউয়িচ আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই প্যাক করে দিতে বলা হয়েছিল। এরা চিকেন স্যাণ্ডউয়িচ পারেনি, তাই ভেজ স্যাণ্ডউয়িচই প্যাক করে দিল। 
প্রথম গন্তব্য হিরেকোলালে লেক। এটা আদিতে শৌভিকের পরিকল্পিত ট্যুরে ছিল না। কিন্তু ড্রাইভার বলল, চিকমাগালুর শহর থেকে মাত্র ১০কিমি দূরে অপার্থিব সুন্দর এই মিষ্টি জলের হ্রদ। গোটা চিকমাগালুর শহরে নাকি জল সরবরাহ করা হয় এই হ্রদটি থেকে। 
ক্ষয়ে যাওয়া পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে পাণ্ডববর্জিত টলটলে জলের লেক,সেদিন যদিও বেশ ভালোই জনসমাগম ছিল, কিন্তু তাতেও পরিবেশের গভীর প্রশান্তি বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত হয়নি। লেকের জলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শনশনে হাওয়া। যদিও ঠাণ্ডা সেভাবে আর লাগছে না। বেশ ভাল,কিন্তু সত্যি বলছি স্বপ্নময় উমিয়াম লেক বা স্বচ্ছ সবুজ আয়নার মত লেক ডাওকি ছাড়ুন আমাদের পুরুলিয়ার বড়ন্তী ও একে স্বচ্ছন্দে দশ গোল দিতে পারে।

আবার গড়ালো গাড়ির চাকা, এবার মুথুডি ফরেস্ট সাফারি। দুবার নাকি সাফারি হয়, একবার সকাল ৭টায় আর একবার বিকাল ৩টায়। আমরা সোয়া দুটোর মধ্যেই পৌছে গেলাম,পথে লেখা আছে আস্তে চালান, আওয়াজ করবেন না। বাঘকে রাস্তা ছেড়ে দিন। যাঃ বাবা!খামোকা বাঘ রাস্তায় নেমে হাঁটতে যাবেই বা কেন?এলিফ্যান্ট করিডর দেখেছি অনেক জায়গায়, বাঘেরও করিডর লাগে নাকি? একটা জ্বলজ্যান্ত বাঘ রাস্তা দিয়ে রাজকীয় ভঙ্গীতে হেলে দুলে গাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছে, ব্যাপারটা কেমন অদ্ভূতুড়ে না?তুত্তুরী এবং পুটপুট প্রবল ক্যাঁওম্যাও জুড়েদিল, বাঘে যদি ধরে? সাথে তাল মেলালো অন্বেষাও। আশ্বস্ত করার জন্য বললাম,যদি বাঘমামার সাথে দেখাও হয়,নির্ঘাত আমাকেই আগে উদরস্থ  করার তাল করবে। শৌভিককে জিজ্ঞাসা করলাম,“হ্যাঁ গো আমাকে বাঘ ধরলে তুমি বাঘের সঙ্গে হাতাহাতি করবে তো?” শৌভিক অত্যন্ত উদাসী ভাবে বলল,“নাঃ। আমি বরং একটা দুরন্ত ছবি তুলে দেব। তারপর ফেসবুকে আপলোড করে লিখব- লাস্ট মোমেন্টস্ অব অনিন্দিতা।তারপর দেখবি কত যে স্যাড ইমোজির বন্যা বয়ে যাবে। ” দেবু পাশ থেকে ফিচকের মত বলল,“হ্যাঁ সবাই লিখবে-রিপ। আর আই পি অনিন্দিতা। ” শৌভিক আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বিজ্ঞের মত বলল, “তরপর চারদিন বাদে লিখব, মরেনি। হাসপাতালে আছে। ওজন একটু কমেছে। ” প্রবল হাসির জলতরঙ্গে চমকে উঠল নিস্তব্ধ জঙ্গল। 
(চলবে)

Monday 25 September 2017

অনির (পুজোর) ডাইরি ২০১৭

অনির (পুজোর) ডাইরি ২৫শে সেপ্টেম্বর  ২০১৭
শুভ পঞ্চমী। পুজো মানেই হাওড়া। আমার শহর,প্রাণের শহর। আর কি সুন্দরই না সেজেছে আমার শহর। আলোর রোশনাইয়ে ধুয়ে যাচ্ছে কানা গলি থেকে রাজপথ। মণ্ডপে মণ্ডপে শানাই এর সুর,কোথাও বা বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে দেবব্রত বিশ্বাস গেয়ে উঠছেন, “আগুনের পরশমণি।”সুসজ্জিত নারী-পুরুষ-শিশুদের আনন্দ কলতানে মুখরিত রাজপথে হাঁটা দায়।
এক নামী মলে বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মেরে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম হঠাৎ কে খপ করে কাঁধটা চেপে ধরল, “এই তুই অর্চনার ভাইঝি না?”
চমকে তাকিয়ে দেখি, এক ক্ষয়াটে বৃদ্ধা, মাথায় আমার সমানই হবে, পরনে একটা ম্যাড়ম্যাড়ে তাঁতের শাড়ি,যার একদিকটা মাটিতে লুটোচ্ছে, আর একদিকটা গোড়ালির ওপর উঠে গেছে, বেঢপ একটা লাল ব্লাউজ, সেফটিপিন দিয়েও শেপে আনা যায়নি, কাঁধ থেকে প্রায় ঢলে পড়ব পড়ব করছে, কাঁধে একটা ঢাউস ব্যাগ, পায়ে হাওয়াই চপ্পল আর কপালে একটা লাল টিপ। দেখেই চিনতে পারলাম, টুসি (নামটা পাল্টে দিলাম) পাগলী।
বহুদিন বাদে দেখলাম, সেই স্কুলের দিনগুলোতে প্রায়ই দেখা হত। ভীষণ রক্ষণশীল পরিবার আমাদের, পিসিই স্কুলে দিতে এবং ছুটির পর আনতে যেত। পথে প্রায় দিনই টুসি পাগলীর সাথে দেখা হত। দূর থেকে দেখতে পেলেই টুসি চিৎকার করে উঠত, “অসিমা দি! ও অসিমা দি! কেমন আছ?” অসিমা আদতে আমার পিসির নাম নয়, বড় জেঠুর নাম ছিল অসীম, পাগলী আর কাকে বলে, পিসির নাম ভুলে জেঠুর নামেই ডাকত।টুসি যে পাগল ছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহ সেই বয়সে আমার ছিল না, কি রকম বেশবাস সে তো আগেই বর্ণনা দিয়েছি, তারওপর নিজের মনে সোচ্চারে বকবক করতে করতে রাস্তা হাঁটত। পাড়ার বা রাস্তার লোকজনের সাথে গায়ে পড়ে কথা বলত, যারা কেউই প্রায় জবাব দিত না।
আশ্চর্য হয়ে যেতাম, আমার পিসির কিন্তু টুসি পাগলীর সাথে কথা বলতে কোন আপত্তি ছিল না। প্রতিবার কথা বলার পর টুসি পাগলী চলে গেলে পিসি একটা কথাই বলত,”আহারে বড় অভাগা মেয়েটা।“ অর্চনা মানে আমার ছোট পিসির সাথে কোন এক মান্ধাতার আমলে একসাথে পড়াশোনা করত, আমাদের বাড়ি বহুবার খেলতেও এসেছে, টুসি। ছোট পিসির সাথে সাথে টুসির চুল বেঁধে দিয়েছে পিসি বহুবার, তারপর যা হয়, শৈশবকে সরিয়ে চুপি চুপি একদিন যৌবনের প্রবেশ। ১৩ বছর বয়সে পালিয়ে বিয়ে এবং ১৭ বছর বয়সে স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে যখন টুসি বাপের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালো, তখন গা ভর্তি মারের দাগ ছাড়াও বরের দেওয়া আরো দুটি জিনিষ সে সঙ্গে করে নিয়ে এল, দুই শিশুকন্যা। যার একটি ছিল সদ্যজাত।
সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে স্বামী পরিত্যক্তা কন্যাকে যাও বা মেনে নিত, সাথে আরো দুটি পেট? প্রথম চোটে নাকি বাড়িতেই ঢুকতে দেয়নি টুসির বাবা-দাদারা। দুই বাচ্ছা কে কোলে নিয়ে বাড়ির দরজায় বসে কেঁদেছিল  টুসি আধবেলা। তারপর বাড়িতে মাথা গোঁজার জায়গা দিলেও বলা হল, নিজেদের খাবার জোগাড় নিজেকেই করতে হবে। ফাইভ- সিক্স পাশ মেয়েকে কে আবার চাকরী দেবে? অগত্যা আয়া গিরি।
যতদিন বাবা বেঁচে ছিল, তাও চলছিল, বাবার মৃত্যুর পর দাদারা দিল ভিন্ন করে, দুই মেয়ের লেখাপড়া, সংসারের খরচ চালাতে দুবেলা আয়া গিরি করতে শুরু করল টুসি। সাথে সাথে শুরু হল স্বভাব চরিত্র নিয়ে মৃদু গুঞ্জন, যে মেয়ের রাতে বাড়ি ফেরার ঠিক ঠিকানা নেই, তার স্বভাব চরিত্র নিয়ে রসালো আলোচনা হবে না? কবে থেকে যে টুসির মাথা বিগড়োতে লেগেছিল ঠিক নেই, তবে আমি যখন দেখেছি, নব্বই এর দশকে তখন টুসি পুরদস্তুর টুসি পাগলী।
আজ এত বছর বাদে এই আলোর উৎসবে সুসজ্জিতা নরনারীর মাঝে টুসি পাগলী বড়ই বেমানান, মূর্তিমতী বিষাদ। কত বছর তো কেটে গেল, এতটুকু পরিবর্তন হল না টুসি পাগলীর? শুধু চুল গুলো শনের নুড়ির মত পেকে গেছে, আর সামনের বেশ কয়েকটা দাঁত নেই। তাজ্জব হয়ে গেলাম, আমায় চিনল কি করে? আবার সেই প্রশ্ন,” তুই অর্চনার ভাইঝি না?এত রাতে রাস্তায় কি করছিস অ্যাঁ?” এর আগে কখনও কথার জবাব দিইনি, ভয় পেতাম, কামড়ে দেয় যদি, তবে মাঝে অনেক বছর কেটে গেছে, আজ আর সে ভয় নেই। বললাম, “হ্যাঁ গো পিসি। এই একটু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরছি। তা তুমি আছ কেমন?” কেমন আছ, জিজ্ঞেস করাতে কি যে খুশি হল, বুঝলাম, কেউ বোধহয় বহুদিন এই প্রশ্নটা করেনি। “ভালো আছি মা। তুই কেমন আছিস? বিয়ে থা করেছিস? সিঁদুর টিদুর কিছুই তো পড়িস না তোরা আর আজকাল। আমার মেয়েরাও—“। বলতে বলতে হঠাৎ বলল, “বড্ড খিদে পেয়ে গেছেরে। বাড়ি গিয়ে আর রাঁধতে পারব না, বাজার টাজারও কি যে আছে কে জানে? চল খাই।“ কি খাব? বাড়িতে মা রান্না করে বসে আছে, পইপই করে বলে দিয়েছে, বন্ধুদের সাথে যেন খেয়ে না ফিরি, কিন্তু পাগলী বুঝলে তো। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে বসালো একটা ফাটা বেঞ্চে, দুপ্লেট পাউরুটি আর আলুর দম এল। বুঝলাম পাগলী প্রায় রোজ রাতেই এই খায়। পাতলা হ্লুদ ঝোলে ভাসমান চার টুকরো জ্যোতি আলু আর একটা সেঁকা কোয়াটার পাউন্ড রুটি। একটা কুকুর অমনি এসে পাগলীর গায়ে মুখ ঘষতে লাগল, তাকে আবার খানিক ছিঁড়ে দিল, সাথে সাথে কিছু গালমন্দও করল অবশ্য। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, “খা নারে মেয়েটা। ভাল লাগছে না? মামলেট খাবি?” হাতজোড় করে বললাম, এই খেতে পারছি না, চোখটা করুণ করে বলল, “ এরা এটা ভালোই করে বুঝলি। আমি রোজই খাই। অসুখ-বিসুক তো কিছু করে না। আর করলেই বা কি? মরে পড়ে থাকলেও কেউ জানতে পারবে না।“ চুপ করে দুজনের মুখ চলছে, শেষে আর থাকতে না পেরে বললাম, “পিসি তোমার মেয়েরা?” “ভালো আছে রে। একজন তো ইস্কুলে পড়ায়, জামাই ও টিচার। আর একজন কিছু করে না, ঘর সংসার সামলায়। ওর বর খুব বড় চাকরী করে।“ তাহলে? বলতে পারলাম না, তোমায়  এখনও খেটে খেতে হচ্ছে?
কিছুতে পয়সা দিতে দিল না, ভিড় কাটিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছি দুজনে টুসি পাগলী বলল, “একদিন তোদের বাড়ি যাব জানিস। সেই যে ছেলেবেলায় কত গেছি, অর্চনার সাথে খেলতে, অসিমা দি জলখাবারের রুটি করত, আমাদের জন্য একটা করে রুটি কড়করে সেঁকে দিত জানিস, আর একটু খানি আখের গুড়, মাঝে মাঝে ভেলি গুড় ও দিত।“ দুজনেই নীরবে হাঁটছি, আশেপাশের আলোর রোশনাই কি হঠাৎ ম্লান হয়ে গেল? লাউড স্পিকার কি বিষাদের সুর ছড়াচ্ছে? এত কষ্ট হচ্ছে ? ভিড় এড়াতে একটা প্রায়ান্ধকার গলির মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করতে গেলাম, প্রবল বকুনি দিল,টুসি পাগলী, ‘সোমত্থ মেয়ে, অন্ধকার গলি দিয়ে কেউ যায়? তোদের কবে বুদ্ধি হবে বাপু? আমার মেয়েদুটোও তোরই মত আকাট। তা না হলে, কেউ মায়ের পরিচয় দিতে লজ্জা পায়? বল?” টুসির গলা ধরে এল, আমার নজর মাটিতে, কষ্টটা হঠাৎ দমচাপা হয়ে উঠল, টুসি পাগলী এবার কাঁদতে লাগল, “ নাহয় আমার মাথার ঠিক নেই, না হয় আমি লোকের গু-মুত ঘাঁটি, নাহয় আমার স্বভাব- চরিত্র সীতার মত নয়, কিন্তু সে কাদের জন্য? তোরা বুঝলি না? কাদের জন্য খেটে খেটে আমার এই হাল, আর তারাই আজ বলে, তুমি আমাদের বাড়ি এস না? আরে তোরা নিজের মা কি খেল, কি পড়ল সে খবর রাখিস না, আর মাটির মা দুর্গাকে আট রকম ফল, নতুন শাড়ি দিয়ে পুজো দিয়ে ভাবিস মা তোদের মঙ্গল করবে?”
কখন বাড়ি পৌঁছে গেছি, খেয়ালই করিনি, আমাকে বাড়ির গেটে ঢুকিয়ে টুসি পাগলী বলল, ‘চলিরে মা, কাল আবার সকাল ছটার মধ্যে ডিউটিতে ঢুকতে হবে, মরণাপন্ন শ্বশুরকে আমার হেফাজতে রেখে সব ঠাকুর দেখতে বেরোবে।হেরে গেলে তো হবে না বল? লড়াই করতে হবে। করি, যতদিন পারি।“ গ্রীলের গেটটা বন্ধ করে  জানি না মনে হল, পঞ্চমীতেই মায়ের দর্শন হল,মৃন্ময়ী নন, সাক্ষাৎ চিন্ময়ী, এ রকম কত মা প্রতিনিয়ত নিজের রক্ত-মাংস-যৌবন বিক্রি করে চলেছে, শুধু সন্তানদের খাদ্য শিক্ষা আর নিরাপত্তার স্বার্থে, সন্তান হয়ে যদি তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে বসেন, তবে দেবীর আরাধনার বৃথা চেষ্টা না করাই বোধহয় ভালো।
©anindita's blog
অনির (পুজোর) ডাইরি ২৬শে সেপ্টেম্বর  ২০১৭
কি লিখব বুঝতে পারছি না, বহু বছর বাদে আবার অনিন্দিতা চ্যাটার্জীর সাথে দেখা। সেই যে হোৎকা মত মেয়েটা, যার লিখতে ভালো লাগে, বেশ কিছুদিন লিখতে না পারলে যার মাথা ধরে যায়,চেনেন কি তাকে? ২০১৫থেকে মাথায় পোকা নড়েছে আর লিখে গেছে একটার পর একটা গল্প। শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলেছে,“ফেবুতে লেখা অনেক হয়েছে, এবার ছাপার অক্ষরে দেখতে চাই। ” শুভ্র দাস নামক দাদা মার্কা বন্ধু আছে, অনিন্দিতার নীতিনিষ্ঠ পাঠক, উনি তো ২০১৬র পুজোয় বলেই দিলেন,“আমরা(উনি এবং ওণার বিদুষী স্ত্রী) বলাবলি করছিলাম,এবার যে কটা শারদীয়া গল্প উপন্যাস পড়েছি, তার একটাও তোমার লেখার মত মনোগ্রাহী নয়। ” এই শুনে তো অনিন্দিতার ওজনই বেড়ে গেল ৫কেজি।
আর সেবার সেই যে চৈতালী বলে একটা আধপাগল বন্ধু বলেছিল,“কি ভাবে ছাপাতে হয় বল?আমরা চাঁদা তুলে ছাপাব।”
কি ভাবে ছাপাতে হয়, তা অনিন্দিতা কি জানে?খুঁজে খুঁজে যোগাড় করল এক নামী পাক্ষিক পত্রিকার মেল আই ডি। পাঠালো তার লেখা প্রথম গল্প, পরদিনই মেলের জবাব এল, ওয়ার্ড নয়, পিডিএফ ফাইল পাঠান। তাই পাঠালো, এবার জবাব এল ৩০০০শব্দের গল্প চাই। শব্দের লিমিট বেঁধে দিলে হয়?তাই সই। এবার আর কোন জবাব নেই। বেশ কয়েকটা অন্য পত্রিকার মেল আইডি যোগাড় করে পাঠালো- ধুস্ কিচ্ছু হয় না।
গোল্লায় যাক। অনিন্দিতার বাবা বলল,“লেখার আনন্দে লিখে যাও। ছাপা হবে কি হবে না তাতে কি আসে যায়?” লিখতে লিখতে কখনও সখনও হতাশ হয়ে পড়ত অনিন্দিতা,তখন তার নাক উঁচু বিশ্ব পাকা বরটা তাকে জ্ঞান দিত,“স্বয়ং কীটসই জীবিতাবস্থায় তার প্রাপ্য যশ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, না খেতে পেয়ে টিবি হয়েছিল ওণার। আর ঘরের পাশে আমাদের জীবনানন্দ?জীবিত অবস্থায় এই খ্যাতি প্রচার কিছুই দেখে যেতে পাননি। মাণিক বন্দোপাধ্যায় পেয়েছিলেন? আর তুই ঘ্যানঘ্যান করে আমার মাথাটাই খারাপ করে দিলি। ”
তারপর একদিন ভুলেই গেল অনিন্দিতা। কত কিছুই তো ভুলেছে, যেমন কি ভাবে খাদ্যকৃচ্ছতা করতে হয়, কিভাবে রোগা হতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। ২০১৭র পুজোর দিনকয়েক আগের কথা হঠাৎ একদিন নবনীতা ফোন করল অনিন্দিতাকে। নবনীতাকে চেনেন না?অনিন্দিতার প্রাণের বন্ধু, দুজনেই হোৎকা এবং বিন্দুমাত্র  নিজেদের ওজন নিয়ে ভাবিত নয়। কোন এককালে ওরকুটের জমানায় ওরা ঠিক করেছিল একটা “মোটি কমিউনিটি” খুলবে, “দুনিয়ার মোটি এক হও”  এই শিরোনামে। সেসব তো সত্য ত্রেতা যুগের গপ্প,পরে কখনও হবে। আপাতত নবনীতা আব্দার করল,“শোননা তোর লেখা একটা গল্প দিবি?মেদিনীপুরে একটা বিরাট বড় পুজো হয়, বিধাননগর সার্বজনীন দুর্গোৎসব, তাদের স্মরণিকায় ছাপা হবে। ” আহাঃ অনিন্দিতা দেখল, কুয়ো স্বয়ং গটগট  করে মহম্মদের কাছে এসে উপস্থিত। জানতে চাইল,“শব্দ সংখ্যা কত?” আগের বারের ছ্যাঁকা ভোলেনি আমাদের অনিন্দিতা। নবনীতা জানাল, পুজো কমিটির হর্তাকর্তা আনন্দ বাবুকে অনিন্দিতার মেল আইডি দিয়ে দেবে তিনি জানাবেন শব্দ সংখ্যা কত। আনন্দবাবু সে রাতেই মেল করে জানালেন,“শব্দ সংখ্যা ৫০০। তবে আপনি লিখুন ৮০০ হলেও কোন সমস্যা নেই। এমনকি ১০০০হলেও আমরা খুশি হব। আপনার লেখা অসাধারণ লাগে। ”
এটা পড়ে সাময়িক ভাবে অনিন্দিতার মনে হল ওজন বোধহয় ১০-২০কেজি কমে গেল। ওর গল্প ওর হাতে গোণা বন্ধু বান্ধবের বাইরেও কেউ পড়ে? এবং তাদের অসাধারণ লাগে? হে ভগবান!!!!! বর চেপে না ধরলে ফ্যাতাড়ুর মত হাওয়ায়ই উড়ে যেত হয়তো। গভীর রাতে সব কাজ সেরে অনিন্দতা বসল গল্প বাছাই করতে। প্রথম ছাপার সুযোগ পেলে প্রথম লেখা গল্পটিই তো ছাপা হবার কথা। শব্দ সংখ্যা ৮৮৪। ব্যাস পাঠিয়ে দিল গল্পটা বৈদ্যুতিন চিঠি মারফৎ। বলেছিলাম না বরটা বিশ্ব পাকা!নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গীতে বলল,“চেয়েছিল দুর্গা পুজোর গল্প, পাঠালি লেসবো প্রেমের গল্প?তোর লেখা ছাপা হয়েছে আর কি। ” সর্বনাশ। ঘেমে নেয়ে বাকি গল্প ঘেঁটে ৮০০র মধ্যে কোন গল্পই জুটল না। আর দুর্গা পুজোর সময় লেখা গল্প একটাই “আলতামাধবী”। শব্দ সংখ্যা ১২০০+।  আনন্দবাবুকে জিজ্ঞাসা করে তাই পাঠালো অনিন্দিতা। উনি জানালেন দুটি গল্পই ওণার দারুণ লেগেছে, তবে এ বছরের জন্য “আলতামাধবী”---
পুনশ্চ -অনিন্দিত চ্যাটার্জী তার মুষ্টিমেয় পাঠককে শুধু বলতে চায় - শুধু আপনারা আছেন বলেই লিখি। শত আলস্যেও বাগিয়ে ধরি ল্যাপটপ বা মোবাইল।খুব খুব ভালো থাকুন সবাই-- পুজো কাটুক আনন্দে। শুভ শারদীয়া। শুভ ষষ্ঠী।