Monday 23 May 2016

তুত্তুরী উবাচ


তুত্তুরী উবাচ ১৪ই জানুয়ারী ২০১৬
হ্যালো মামমাম্
হ্যাঁ  মা
তোমার মেয়েকে নিয়ে আর পার যায় না খালি বকে মারব বলে ভয় দেখায় সুযোগ পেলেই মারে
কেন রে? কিছু অপাট করোনি তো?”
না  আর কি মায়ের গয়নাগাটি গুলো সব ঢেলে আবার গুছিয়ে রেখেছি
কেন কর মা  মা রেগে যায়  আর কিছু করনি তো?”
নাঃ শুধু একটা টিউব লাইট ধড়াম করে ফেলে দিয়েছি
তা বেশ করেছ  যেমন তোমার হাতের কাছে রাখে
না ঠিক হাতের কাছে নয়, আর কি আলমারির ফাঁকে রাখাছিল
হুঁ  ব্যাস? আর কিছু করোনি তো?”
করেছি তো  মায়ের কি সব মুখে মাখার স্প্রে আছে না? গুলো তুলোয় দিয়ে ঘর মুছেছি
সর্বনাশ   তোকে আজ মা মেরেই ফেলবে
মায়ের লিপস্টিক গুলো খুলে দেখতে গিয়ে কি হল জানি না সব কটা ক্যাতক্যাত করছিল
উফ কি দুরন্ত মেয়েরে বাবা
আর মায়ের ল্যাপটপটায় কি সব টিপেছি, বাবা বলছে, ল্যাপটপটা মরে গেছে যাই হোক তাই বলে আমায় মারবে? তুমি এসে এখুনি তোমার মেয়েকে নিয়ে যাও

তুত্তুরি উবাচ- ২৬ শে জানুয়ারি ২০১৬
"মা, দুর্গা ঠাকুরের পায়ের  কাছে সবসময় একটা মোষ থাকে কেন?"
"মোষ? হ্যাঁ  মোষ তো থাকবেই, ওটা যে মহিষাসুরমর্দিনীরই মূর্তি মহিষাসুর তো মোষের ছদ্মবেশেই আক্রমণ করত গল্পটা বলেছি না?"
"হুঁ মর্দিনী মানে?"
" যে মর্দন অর্থাৎ বিনাশ করেছিল হত্যা করেছিল "
ক্ষণিক নীরবতার পর, “আমি কি মর্দিনী মা?”
তুমি তো আমার দশভূজা জগৎজননী
না আমি পিঁপড়েমর্দিনী আমি পিঁপড়ে মারি
প্রসঙ্গত জগজ্জননী নামটি ওর নিজের বেছে  নেওয়া  আমার চার চারটি নাতি নাতনী লকাই, সরো, কেতো এবং গণা কেতো আর গণা মহাপাজি  প্রায়শই তাদের মা রেগে গিয়ে তাদের জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় লকাই, সরো স্কুলে পড়েদিদিমা অফিস থেকে ফিরলে, আগে মায়ের হোমওয়ার্ক, পরে মেয়েদের হোমওয়ার্ক যেদিন মা, দিদিমার হাতে ঠ্যাঙানি খায়, সেদিন লকাই সরোর কপালের দুঃখ থাকে তাদের মা সেদিন প্লাস্টিকের গদা নিয়ে তাদের হোমওয়ার্ক করাতে বসেন

তুত্তুরি উবাচ-  ৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
মা, আমি আর ঈশাণীর পাশে বসব না
কেন রে?”
বদ
কি করল আবার? ঈশাণী তো তোর প্রাণের বন্ধু এই সেদিন নিজের হাতে এঁকে তোকে গ্রিটিংস্ কার্ড দিল!!!”
হুঁ  কিন্তু আজ ওর দুলে হাত দিতে দেয়নিকি সুন্দর গোল গোল দুল পড়েছিল ভাবলাম একটু ঘুরিয়ে দেখি
সর্বনাশ নির্ঘাত কানে সদ্য ফুটো করেছে এই সময় খুব ব্যথা থাকে তারওপর সোনার দুল ধরে টানাটানি  করলে যদি হারিয়ে  যায়--”
হুঁ
ঝগড়া করেছো ? কি বলেছ?”
ক্ষণিক নীরবতার পরআড়ি  তোর পাশে আর বসব না সব সম্পর্ক শেষ
ওরে বাবা  সম্পর্ক শেষ তা বেশ  তবে যদি মন খারাপ করে, তাহলে কাল ঈশাণীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে নিও
কি চেয়ে নেব? দুল?”
না  না ক্ষমা রে বাবা  মানে সরি বোলো এন্ড গিভ হার টাইট হাগ
আঃ হাগ বোলো না সিংহগুলোও শিখে গেছে, এক্ষুণি ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে
উপস্ ভুলে গিয়েছিলাম, আমার কন্যা যে জগজ্জননী বাড়িতে সিংহ, ময়ুর, পেঁচা গিজগিজ করছে

তুত্তুরী উবাচ- ৬ই মার্চ ২০১৬ 
বারোটা বাজছে কিন্তু , এবার মুখ বন্ধ আর একটা কথা বললেই মারব
ইঃ শুধু মারব আর মারব  ওপাশ ফিরে আহ্লাদী স্বরে, “ বাবা? তোমার ব্যথাটা কমেছে?”
না  আছে একটু
এস আমি মা দুর্গার নাম লিখেদি ব্যথা কমে যাবে
তুই! মা দুর্গার নাম লিখবি?” হাসি চেপে গম্ভীর ভাবে বাবা বলল,“ বানান জানিস?”
হ্যাঁ জানি
কি বানান বল দেখি?”
জানি  কাল সকালে বলব এখন মা কথা বলতে নিষেধ করেছে

তুত্তরী উবাচ ১৪ই মার্চ ২০১৬
মা, দাদা কি বাজে কথা বলে!!”
আবার দাদা কি করল?”
নাঃ কিছু করেনি শুধু বলছিল ভূত বলে কিছু নেই
নেই তো  ঠিকই তো বলেছে
নেই?”
না
মানুষ মরে ভূত হয় না?”
উঁ হুঁ
ব্রহ্মদত্যি? মামদো? ছেঁছো ভূত?কিচ্ছু হয় না?”
নাঃ
শাঁকচুন্নী? পেত্নী?”
ধুস্
আর লুল্লু? একানড়ে হয় না?”
ধুর ধুর  ওতো ত্রৈলোক্য--- ”
হয় না তো?তাহলে তোমরা  কেন ভয় দেখাও? ঘুমিয়ে পড়ো না হলে এক্ষুনি একানড়ে এসে জানলায় ঠকঠক করবে? অ্যাঁ? বল? বল?”

তুত্তুরী  উবাচ ১৭ই মার্চ২০১৬
"মা, মা মনসা কি লাউ ডগার পিঠেও চাপে?"
"চাপতে পারে, এখন কাজের সময় বিরক্ত করো না  "
একটু পরেই প্রবল চিৎকার ,“ মনসা! তোর কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই ?  টুকু একটা লিকলিকে প্রাণীর পিঠে তুই চাপিস?”
প্রবল বকুনি  থামার পর আদুরে গলায় আব্দার, “ মা সরস্বতী শাড়ি ছিঁড়ে ফেলেছে ওকে একটা শাড়ি কিনে দেবে?”
বেশ দেব তা ওর কি একটাই শাড়ি?”
করুণ স্বরে লাল শাড়ি চাইছে মাহ্যাঁ একটাই শাড়ি  ওর বাবা তো শিব  গরীব লোক  গাঁজা খায়, সিদ্ধি খায় আর ধ্যান করে আমি বলেছি চিন্তা করিস না  মা কিনে দেবে
আচ্ছা তা মনসাকে এত বকলি কেন? ”
সব সময় সাপ নিয়ে ঘোরে  লক্ষ্মী ভয় পায় যে গোখরোর গায়ের রঙ তো হলুদ কালো,লক্ষ্মী ভাবে বাঘ এল বুঝি! ওমনি প্যাঁচায় চেপে উড়ে পালিয়ে যায়  হিঃহিঃ
জগজ্জননীর সংসার-
তুত্তুরী উবাচ ২৪শে মার্চ ২০১৬
“বাবা, লক্ষ্মী আর সরস্বতী বলছে ভোটের পর ঊনকোটি যাবে।”
“বাঃ তা যাওয়াই যায়।”
“আমি বলেছি না মরুভূমি দেখতে যাব। সেখানে সিংহটাকে বেশ বালির মধ্যে লুকিয়ে রাখা যাবে।”
“মরুভূমি! মানে রাজস্থান? ভেরি গুড।”
“বোকা গণেশটা বলছে মরুভূমিতে গিয়ে ঊটের জল খাবে।”
বাবা প্রায় বিষম খেয়ে, “ঊটের জল? মানে?”
“হ্যাঁ গো বাবা, ঊটের পীঠে একটা বিরাট জলের কি যেন থাকে, গণেশ বলছিল।”
“ওঃ ঊটের কুঁজ!!! সেটা থেকে শুধু ঊট জল খেতে পারে, তাও বিশেষ পরিস্থিতিতে। না হলে জল খেতে হলে ঊটটাকে কাটতে হবে। তাও পাবি না। ওটা চর্বি হয়ে জমে থাকে।”
“ঊটটাকে কাটতে হবে?” প্রচণ্ড ধমক দিয়ে, “ গণেশ! সাধে কি তোকে বোকা বলি? দিদিরা কবে পড়তে শিখে গেল। তুই এখনও অ আ লিখতে শিখলি না। দাঁড়া তোর শুঁড়টাই কেটে দেব। ” আমাদের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে, “চিন্তা করো না। শিব আবার জুড়ে দেবে।” কয়েক মুহূর্ত পরে স্বাভাবিক স্বরে, “ বাবা, গণেশ বলছে, সিংহটা বালি খুঁড়ে জল বার করে দেবে। কোন চিন্তা নেই। ”

তুত্তুরী উবাচ, ২৯শে মার্চ ২০১৬
"মা, রাবণের কটা হাত?গণেশ বলছে ওর নাকি দশটা হাত?"
"
দুটোই তো জানি। "
"
দশটা মাথা আর দুটো হাত? তাহলে রাবণ দাড়ি কামাতো কি করে?"
"
উফ। কি প্রশ্নের ছিরি। যা বাবাকে জিজ্ঞাসা কর গিয়ে। "
"
বাবা বল না? রাবণ কি করে দাড়ি কামাতো?"
"
গুড কোয়েশ্চন। কামাত না। রাবণ মাকুন্দ ছিল। "
"
মাকুন্দ মানে কি বাবা? "
"
মাকে জিজ্ঞাসা কর?"
"
মা মাকুন্দ মানে কি?"
"
জানি না যা। সক্কাল সক্কাল কি সব অনাসৃষ্টি কথাবার্তা "

তুত্তুরী উবাচ, ২রা এপ্রিল ২০১৬
মা, বলছি যে, বাঁদর থেকে যেমন মানুষ হয়, মানুষ থেকে কি হয়?”
মানুষ থেকে?----- এখনও কিছু হয়নি।
হ্যাঁ হয় তো। মানুষ থেকে ভূত হয়মুচকি হেসে আহ্লাদী স্বরে, “ তুমি ভয় পেয় না। ভূত বলে কিছু হয় না। তোমাকে এপ্রিল ফুল বানালাম।
এপ্রিল ফুল? তারিখ রাতে এপ্রিল ফুল? সে তো পয়লা---”
সবার মন খারাপ ছিল যে--” (** ৩১ শে মার্চ বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুলের পতন) 

তুত্তরী উবাচ ৩রা এপ্রিল ২০১৬
মা। মা। মহাসমস্যা হয়েছে।
কি করেছো?”
আমি না। বোকা গণেশ। খেলতে খেলতে বেগুনী রঙের বালতিতে পড়ে গেছে। এখন সাফ করবো কি করে?”
ওঃ এই। চান করিয়ে দে। 
সানলাইটের জলে চুবিয়ে, কলিন আর ডেটল দিয়ে ধোব? ” 
যা খুশি কর। আমায় কাজ করতে দাও আর খবরদার! কলিন, ডেটলে যেন হাত দিতে না দেখি।
একটু পরে,“ মা একটা দাড়িওলা ভগবানের নাম বল তো?”
কেন? গণেশের দাগ ওঠার সঙ্গে দাড়িওলা ভগবানের কি সম্পর্ক? যাই হোক একটাই তো জানি।
কি?”
প্রজাপতি ব্রহ্মা
কেন লোকনাথ বাবা।
ওঃ। উনি তো মানুষ হয়ে জন্মেছিলেন।
সে যাই হোক। পুজো তো করি।
আবার কিছুক্ষণ পরে, “ মা কোন সম্পর্ক নেই মানে কি?”
মানে- ইয়ে- কোন যোগাযোগ নেই। দুটো জিনিসের মধ্যে অনেক ভেবেও কোন যোগসূত্র না পাওয়া গেলে-”
ওঃ। বুঝেছি। যেমন মা লক্ষ্মী আর দিদি নং ওয়ানের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই?”
আঃ কি গাঁজাখুরি কথাবার্তা। আর একটাও প্রশ্ন নয়। সকাল থেকে বকেবকে--”
না সম্পর্ক আছে মা। দুটো একই চ্যানেলে হয়। দুর্গা আর বিগবস্ যেমন।
আর একটাও কথা নয়। সকাল থেকে বকে বকে মাথাখারাপ করে দিল- ”
বেশ। চলে যাচ্ছি শুধু বল গাঁজাখুরি মানে কি। 
তুত্তরী উবাচ ৪ঠা এপ্রিল ২০১৬
ট্যাক্সিওলাদের মতে উড়াল পুলের পতনের দৌলতে হাওড়া নাাকিপ্রায় দুর্ভেদ্য এয়ারপোর্ট থেকে ভিআইপি রোড ধরে কাঁকুড়গাছি হয়ে, ফুলবাগান, বেলেঘাটা স্পর্শ করে সুরেন ব্যানার্জী রোড হয়ে ধর্মতলা বাসস্টান্ডের মধ্যে দিয়ে কার্জন পার্ক হয়ে রেসকোর্সের পাশ দিয়ে রবীন্দ্র সেতু টপকে বেলেপোল দিয়ে ইছাপুর জলট্যাঙ্কে পৌছে করজোরে বললাম,“ দাদা অনেক হয়েছে কলকাতা ভ্রমণ আমাদের অনুগ্রহ করে এখানেই নামিয়ে দিন
পথে তুত্তরী উবাচ-
মা জানো তো আমাদের স্কুলে দুটো হিন্দু পড়ে!!!”
মানে? হিন্দু তো তুইও, ঈশানী, অদ্রিজা সবাই এতে আশ্চর্য কি আছে?”
আরে নানা হিন্দু না অন্য
সে আবার কি? আবার শুরু করেছিস গাঁজাখুরি গপ্প?”
আঃ মিস্ যখন বলে প্রেপ কপি বার কর, তখন কি আমরা বলি, নেহি হ্যায়?”
ওঃ হিন্দি তে কথা বলে
হ্যাঁ তাই তো বলছি হিন্দু
ওদের হিন্দিভাষী বলে
কয়েক মিনিটের নীরবতার পর, “ মা দাদু বলেছে মুখোশ কিনে রাখবে রাবণের মুখোশ কিন্তু পরব কি করে?”
উফ্ মুখোশ পরতে তুই জানিস না বুঝি? আগে যেন কখনত্ত পরিসনি?”
পরেছি তোচিন্তান্বিত হয়ে, “কিন্তু রাবণেরটা--- কি করে যে পরি? আমার তো আর দশটা মাথা নেই
উফ্ মুখোশে একটাই মাথা থাকে চুপ করে বসো তো আর একটাও কথা বোল না
পাঁচ মিনিটের নীরবতার পর ,“ উঃ বড্ড মশা ট্যাক্সিতে খালি কামড়ায়
কোথায় ? আমায় তো একটাও কামড়াচ্ছে না চুপ করে বস এত নড়ছ কেন?”
হুঃ আমার বোধহয় চুলকুনি হয়েছে মা ঈশ্ জানো তো জানোয়ার গুলো না গিয়ে গাছে গা ঘসে ওদের তো হাত নেই যে সঘস্ করে ইয়ে করবে মা, ওরা নাএক ঝলক ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে, স্বর নামিয়ে, “ ইয়ে করেও ইয়েটা গাছে ঘসে নেয় ইয়ে মানে বুঝলে কি না?”
তুত্তুরী উবাচ ১৪ই এপ্রিল ২০১৬
“আজ পয়লা বৈশাখ,সকাল সকাল পড়তে বসো। জান তো, আমাদের ছোটবেলায় কি বলত, আজ যা করবে সারা বছরই তাই করতে হবে।”
“তাহলে তো রোজ পড়তে বসতে হবে, ওরে বাবা আজ আমি কিছুতেই পড়ব না।”
“বেশ, তবে আজ ঠ্যাঙানি খেলে কিন্তু সারা বছরই-”
“এই শুরু হল। খালি মারব আর মারব। আমাকে কি সারা জীবন ঠ্যাঙাবে?”
“যত দিন বড় না হচ্ছ।”
“শোন মা, বাচ্ছাদের ঠ্যাঙাতে নেই। জান না শিশু নারায়ন! ছ বছর অবধি বাচ্ছারা নারায়ন থাকে, তারপর ছয় থেকে পনেরো তারা শিব হয়ে যায়, তখন তাণ্ডব করে।”
প্রবল হাসি চেপে, “এটা আবার কোথা থেকে আমদানি করলি?”
“হাওড়া থেকে। দাদু বলেছে, পনেরো বছরের পর চিত্রগুপ্ত খাতা খুলে পাপ পুণ্যের হিসেব টোকে। এখন তুমি যতই মায়ের লিপস্টিক নষ্ট কর আর দেওয়ালে ছবি আঁক, চিত্রগুপ্ত কিছুই লিখছে না।”
“যেমন তুই, তেমনি দাদু। একে রামে রক্ষে নেই -”
তুত্তুরী উবাচ ১৮ই এপ্রিল ২০১৬
- হ্যালো বুকু, বাড়ি পৌঁছেচ?
-
বাড়ি না পৌছলে তোমার সাথে কথা বলতাম কি করে? 
-
তাও বটে! তা আজ স্কুলে কি শিখলে?
-
আজ হাঁসজারু আর বকচ্ছপের বিয়ে হবার কথা ছিল, ওমা গিয়ে দেখি ঘোড়াহাতি আর টিয়াবুলবুলির বিয়ে হচ্ছে
-
গল্প বটে কিছু বানাতে পারো তুমি ঘোড়াহাতি আর টিয়াবুলবুলি আবার কোথায় পেলে? পড়াশোনা কি করলে?
-
মা তুমি আজ শাড়ি পরে গেছ তো?
-
এই গরমে শাড়ি? 
-
তুমি এত শাড়ি পড়তে কেন অপছন্দ কর বলতো? জগৎজননীর মা তো শাড়িই পরে নাকি?
-
হু সে সত্য যুগে পরতো
-
জানো তো মা দুর্গা আমায় কাল কি বলেছে? বলেছে, আমি যেমন স্বর্গের দুর্গা, তুই তেমনি মর্তের দুর্গা তোর মা যদি তোকে মারে, আমায় বলিস, আমি তোর মাকে অভিশাপ দিয়ে দেব
-
হাঁ, মা দুর্গা আমায় বলেছে, ওটা একটা বাঁদর, ওকে মানুষ করতে হলে, হাত খুলে ঠ্যাঙাবি
- (
চিন্তান্বিত হয়ে) মা দুর্গা আবার তোমায় কখন বলল? তুমি ভুল শুনেছ
-
না ঠিকি শুনলাম তো
-
না না তুমি ভুলে গেছ কালই বাবাকে বলছিলে না, আজকাল সব ভুলে যাও
তুত্তুরী উবাচ এপ্রিল ২০১৬
-মা, ছাগল কে কাজল পরাতে পারবে?
- উফ ভগবান।
-কোন ভগবানকে ডাকছ? আচ্ছা মা, অভিযোগ করাটাকে তো কমপ্লেন করা বলে, যেটা খায় সেটাকে কি বলে গো?
- কমপ্লান!
- কমপ্লান?
- হুঁ
- খালি কমপ্লান করো।কমপ্লান করো। হরলিক্স করো হরলিক্স করো। মাঝে মাঝে বোর্ণভিটা তো করতে পারিস লক্ষ্মী। (গলা নামিয়ে) জানো তো মা লক্ষ্মীটার খালি নালিশ আর অভিযোগ, কান ঝালাপালা হয়ে গেল
তুত্তুরী উবাচ ২২শে এপ্রিল ২০১৬
-      ওমা, দেখ দেখ কি সুন্দর পতাকা নিয়ে যাচ্ছে।  চল না আমরাও ওদের সাথে হাটি।
-      ঐ রঙের পতাকাধারীদের সাথে হাঁটলে আর বাবার আমার চাকরী থাকবেনা বাবু।
-      কেন? আমিও ভোট দেব মা।
-      তোমাকে ভোট দিতে দেবে না।
-      কেন? আমি মা লক্ষ্মী চিহ্নে ছাপ দেব মা।
-      ঐ সব চিহ্ন হয় না বাবু। আর তোমার আঠারো বছর বয়স না হলে তোমায় ভোট দিতে দেবে না।
-      সেদিন যে বললে আঠারো বছর না হলে বিয়ে করতে দেয় না? ভোটও দিতে দেয় না?
-      না।
-      যাঃ। তুমি কিছু জান না, আমি ভোট দিতে গিয়েছিলাম তো দাদুর সাথে। দাদু শুধু একটা বোতাম টিপল। বোতাম টেপা আর কি শক্ত মা? আমিও পারব। জান তো ভোট দিলে নেলপালিশ পরতে দেয়! আগের বার হাওড়ায়, দাদুকে যখন পরাচ্ছিল, দাদু বলাতে লোকটা আমাকেও পরিয়েছিল।
-      বেশ।
-      আচ্ছা মা, বোতাম টেপার আওয়াজে কি বোঝা যাবে, যে আমি কোন চিহ্নটা টিপলাম?
তুত্তুরী উবাচ ২৪শে এপ্রিল ২০১৬

-      মা, মা লক্ষ্মীর ছেলের নাম কি গো ?
-      মা লক্ষ্মীর ছেলে-মেয়ে আছে কি না জানি না। নেই সম্ভবত। আমাদের বাড়ির লক্ষ্মী পুজোয় লক্ষ্মী- নারায়নের সাথে কুবেরের মূর্তি গড়া হয় বটে, তবে কুবের লক্ষ্মীর নিজের ছেলে নয়।
-      সেকি? লক্ষ্মীর বিয়ে হয়েছে, অথচ--, ব্যাপারটা তো ভাল নয়?
-      বিয়ে হলেই বাচ্ছা হতে হবে? তুই তো দাদুর পিসিমাদের মত কথা বলছিস!
-      হ্যাঁ। যেমন আমি, তোমার বিয়ে হয়েছে, তারপর আমি হয়েছি।
-      শোন বুকু, বিয়ে হলেও বাচ্ছা নাও হতে পারে, আবার বিয়ে না হলেও হতে পারে। এটা বাবা এবং মায়ের ইচ্ছা। কর্ণের গল্প ভুলে গেলে?
-       কর্ণ বলতে মনে পড়ল, মা, সূর্য দেবের গোঁফ থাকে? না দাড়ি থাকে?
-      জানি না। যত ফালতু প্রশ্ন। তবে গোঁফ দেখেছিলাম মনে হচ্ছে কোন একটা ছবিতে।
-      গোঁফ দাড়ি তো কেবল রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর আর ব্রহ্মার ছিল বলো।
-      আঃ। কিসের সাথে কি। সকাল থেকে খালি ঠাকুর আর দেবতা, পাগল করে দিল।
-      আচ্ছা মা, কি করলে যেন, কালীঘাটের কুকুর হয় গো?
-      এটাই শেষ প্রশ্ন তো?কাউকে কিছু দিয়ে ফেরত নিলে।
-      কেন? কুকুর হব কেন? আমার কাউকে ভাল লাগল, ভালবেসে কিছু দিলাম, কাল রাগ হল, ফেরৎ নিতেই পারি।
-      (পাশ থেকে বাবা সহাস্যে) ঠিক বলেছিস। কাউকে কিছু দিস না।
-      (বাবার দিকে ফিরে) বাবা আর কি করলে পুরির কুকুর হয়?
-      (বাবা গম্ভীর স্বরে) রাতে না ঘুমোলে।
-      আঃ। ঘুম পেলে তবে তো ঘুমোব। বলো না, কি করলে বৃন্দাবনের কুকুর হয়?
-       রাতে না ঘুমোলে।
-      আর কাশীর?
-      রাতে না ঘুমোলে।
-      ধুৎ। তুমি জান না, মাই ভালো।
তুত্তুরী উবাচ ২৯শে এপ্রিল ২০১৬
- মা, মাসি একটা মন্ত্র শিখিয়েছে, শুনবে?
- না! রাত বারোটায় আমি কোন মন্ত্রতন্ত্র শুনতে রাজি নই।
-শোনই না।
- মন্ত্র পড়লে কি হবে? বকবক বন্ধ হবে? ঘুম আসবে?
- না। তবে সাধুবাবার স্বপ্ন দেখবে।
- আমি কোন সাধুসন্তর স্বপ্ন দেখতে চাই না।
- আঃ শোনোই না।
- না বলে ছাড়বি না যখন অগত্যা -
- সাধুবাবাজী দুটো মুরগী পুষেছি,
মুরগী দুটোর নাম রেখেছি গরম পেঁয়াজী। হিঃ হিঃ হিঃ
- মাগো। ঈশ্। ছিঃ। ওয়াক্।এটা কি? কি জঘন্য জিনিসপত্র শিখিস।
তুত্তুরী উবাচ ৮ই মে২০১৬
-(সাংঘাতিক গম্ভীর স্বরে)ভয়ানক রকমের দেব চমকে,
ভয় পেয়ে তুই যাবি ব্যোমকে।
-( বাবার তালে তাল মিলিয়ে, ততোধিক গম্ভীর স্বরে)হঠাৎ করে মুণ্ডুটা তোমার ঘচ্ করে ফেলব কেটে।
- এসব কি হচ্ছে রে সাতসকালে?
- উফ্ মা। একটু গান গাইতে ও দেয় না।
- এটা গান!!! হে ভগবান্ আজ যে ২৫শে বৈশাখ।
তুত্তুরী উবাচ ১১ই মে ২০১৬
-      বাবা, তুমি দাড়ি রাখো না কেন?
-      ধুৎ!
-      কেন রাখো না বাবা?
-      দাড়ি রাখলে আমায় দেখতে একদম ভালো লাগবে না।
-      কি করে জানলে? আরেঃ, দাড়িতে তো সব ঢাকা থাকবে, কেউ দেখতেই পাবে না। রবীন্দ্রনাথের কি সুন্দর দাড়ি ছিল, ডাম্বলডোর কি সুন্দর দাড়িতে গার্ডার লাগিয়ে রাখে, তুমিও রাখো না বাবা। প্লিজ দাড়ি রাখো।

তুত্তুরী উবাচ ১২ই মে ২০১৬
-      মা দ্যাখো কত গরু!
-      গরু? তুই কি গরু ছাগলের তফাৎ বুঝিস না? ও গুলো তো ছাগল, সেই যে সুকুমার রায়, “লম্বা লম্বা দাড়ি, ঘন ঘন নাড়ি। সিংহের মামা আমি  নরহরি দাস, পঞ্চাশ বাঘে মোর এক-এক গ্রাস!"
-      (কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর, উদাস স্বরে) কিছুই পুষতে দিলে না।
-      কি পুষবি? ছাগল? ঈশ বোঁদে দেয়।
-      (উল্লসিত হয়ে) বোঁদে! মা!
-      এই রে! এ বোঁদে সে বোঁদে নয়। (রিক্সাওয়ালা মুখ ঘুরিয়ে হাসি চাপল) এ হল, ছাগলের ইয়ে কি বলে ড্রপিং।
-      (রিক্সাওয়ালাকে রাগত স্বরে) এই হাসছ কেন? (আবার মুখ ঘুরিয়ে উৎসুক ভাবে) মিষ্টি হয়?
-      না। ওগুলো খায় না। বোঁদের মত শেপের হয়।
-      তাহলে গরু পুষি?
-      গরু? রাখবি কোথায়?
-      কেন ঠাকুর ঘরে?
-      গোবর ছড়িয়ে রাস্তার কি অবস্থা করেছে দেখছিস? গন্ধে ঠাকুর পালাবে।
-      পটি ট্রেন করব। কমোডে বসতে শেখাব।
-      গরু কে? তুই নিজে একবার হামা দিয়ে কমোডে বসার চেষ্টা করিস তো।
-      ওঃ। (চিন্তান্বিত হয়ে) তাহলে উট? হ্যাঁ উট পুষব।
-      উট বিশাল বড় হয়। ফ্ল্যাটে ধরবে না।
-      হাওড়ায় দাদুর বাড়িতে রাখব।
-      ইঃ। উটের গায়ে খুব গন্ধ হয়।
-      উফ্ মা। (বিরক্ত হয়ে) একটা পদ্মফুলের ওপর রাখব। 
তুত্তুরী  উবাচ
১৪ই মে ২০১৬

-( আর্ত স্বরে) কি সব কদাকার কথাবার্তা শেখাস মেয়েকে?
- ( ঘাবড়ে গিয়ে) কেন কি আবার শেখালাম? তো মা দুর্গা ছাড়া আর কিছুই শিখতে চায় না
- তোকে হাজার বার বলেছি, মুখের ভাষাটা ভদ্রসভ্য কর মা যা বলবে, মেয়েও তাই শিখবে এই মাত্র আমাকে একটা কুৎসিত গালাগাল দিল
- কে? ( চমকে উঠে) বুকু?কি বলেছে?
-( রাগত স্বরে) কি বলেছে আমি আবার বলি আর কি? (ইতস্ততঃ করে) ইয়ে বোকা বলেছে
-বোকা? মানে বোচো? মানে চার অক্ষর? হে ভগবান! এটা কোথা থেকে শিখল?
- ( ব্যঙ্গাত্মক ভাবে) কোথায় আর শিখবে? তোমাদের থেকেই শিখেছে
-অসম্ভব   আমি বা ওর বাবা কোনদিন এই নোংরা গালাগাল দিই না (ঢোঁক গিলে) মানে দিই, কিন্তু ভদ্র ভাবে শব্দগুলো না ব্যবহার করে 
- হুঃ গালাগালি আবার ভদ্রভাবে তোমরা না শেখালে, স্কুল থেকে শিখেছে
- মাগো  স্কুলে কার পাশে বসিস বাবু তুই দাঁড়াও ওকেই জিজ্ঞাসা করি সন্তু----
- (গান গাইতে গাইতে এসে) উফঃ মা  একটু শান্তিতে গানও গাইতে দাও না  কি জলদি বল  লক্ষ্মী সরস্বতী অপেক্ষা করছে
- এই তুই মামমাম্ কে কি বলেছিস?
-কি? (অবাক হয়ে) কই কিছু না তো? বলেছি আমি আজ দাদু মামমাম্ এর সাথে মাটিতে শোব  মশারি  টাঙিয়ে  কি মজা হবে বল লক্ষ্মী!
- আসলে আমরা মশারি  টাঙাই না তো  তাই তোমাদের সাথে মশারি খাটিয়ে শোবে বলে মহানন্দে নাচছে  আর কি বলেছো?
- (মাথা চুলকে) আর কি মনে পড়ছে না তো? মামমাম্ বলল আয় সন্তু মশারির মধ্যে ঢুকে আয়  আমি মশারির চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে  বললাম , না আমি বোকাজোলার মত মশারির ছাত দিয়ে ঢুকব  সেই যে ঘরের মধ্যে ঘর বানিয়েছে, দরজা রেখেছে ছাতের ওপর--- হিঃহিঃ
- কি? বোকাজোলা?  মানে উপেন্দ্র কিশোর? (অপরাধী মত) হ্যাঁ হ্যাঁ ঐটাই বলেছিল আমি ভুল বুঝেছি
-উফ মা আমার হার্ট টাই ফেল করছিল তোমার ভুল শোনার জন্য শুধু শুধু আমার মেয়েটাকে ধমকালাম

তুত্তুরী উবাচ ২১শে মে, ২০১৬
-      উফ একটা ওঝা ডাক। এর মাথা থেকে মা দুর্গাকে নামাতে হবে।
-      (হাঁসি চেপে) ও কোন ব্যাপার নয়। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমিও ওর বয়সে খুব শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত ছিলাম। গোটা বাড়ি শ্রীকৃষ্ণের ছবি আর মূর্তি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিল বাবা।
-      (উৎসুক ভাবে) বড় শ্রীকৃষ্ণ মা? নাকি গোপাল?
-      বড়, ননীচোরা সব। দাদু যেখানেই শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি পেত এনে দিত। দাদু মামমাম্ অফিস বেড়িয়ে গেলে আমি ওদের সাথেই থাকতাম।
-      (আব্দেরে সুরে) আমারও গোপাল চাই মা।
-      ওরে বাবা! এমনি বাবার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, এর ওপর গোপাল আনলে তো কথাই নেই।
-      কেন মা?
-      কেন আবার? গোপাল তো শিশু দেবতা। তার অনেক যত্ন করতে হয়। দুবেলা অন্তত পুজো করতে হবে, কাঁচা দুধ, নাড়ু, কাঁচা মাখন আরো অনেক কিছু দিয়ে।
-      ফাইভ স্টার?
-      না গোপাল ফাইভ স্টার খায় না।
-      অত কিছু খেতে না দিয়ে পুজো করলে কি হবে মা?
-      বললাম না শিশু দেবতা। গোপাল কাঁদবে। ওকে ফেলে বেড়াতে যাওয়া, দাদুর বাড়ি যাওয়া কিচ্ছু হবে না।
-      তাহলে দোকানে যে গোপাল থাকে? তাদের কি খেতে দেয়?
-      ওগুলো তো মূর্তি মাত্র। পুতুলের মত। প্রাণ প্রতিষ্ঠা না হলে...।
-      প্রাণ প্রতিষ্ঠা বলতে?
-      মানে একবার অন্তত পুজো করতে হয়। যাতে ওর মধ্যে প্রাণ আসে, তারপর আর পুতুল থাকে না।
-      সব ঠাকুরেরই প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয় মা? মা দুর্গার ও?
-      হু। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী সবার।
-      অসুরেরও?
-      অ্যাঁ? মানে?
-      মানে, দুর্গা পুজার সময় যখন সবার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন কি মহিষাসুরের ও প্রাণ ফিরে আসে?
-      এই রে? তাই তো। দাদুকে বরং ফোন কর। এই উত্তর আমার জানা নেই।
-       

Sunday 1 May 2016

আর একটা প্রেমের গল্প-

রাধারানীর কথা
দপ করে মাথায় আগুন জ্বলে উঠল রাধারানীর। চটাস আওয়াজটা এখনও কানে বাজছে। গালটা জ্বলে যাচ্ছে। নপুংসক, হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্ছা, এত বড় সাহস, বউয়ের গায়ে হাত তোলে? কি আমার শিক্ষিত অভিজাত পরিবার রে? ওকে দেখতে গিয়ে শ্বশুর মশাই বলেছিলেন, “আমরা শ্যামবাজারের খুব বর্ধিষ্ণু পরিবার। আমাদের বাড়ির সব ছেলেমেয়েরাই হয় আমলা, নয় অধ্যাপক নাহলে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার।” রাধারানীদের বাড়িতে সোফা ছিল না, কেউ এলে বিছানায় বসতে হত, তাই শাশুড়ি মা নাক কুঁচকে বলেছিলেন, “খাটে বসাটা আমার আবার একদম পছন্দ নয়, বাইরের লোক এসে খাটে বসবে কেন?” রাধারানীর বাবা মাড়োয়ারির গদিতে খাতা লেখে, মা গৃহবধূ, কোথা থেকে আসবে সোফা? কাকামণি না সাহায্য করলে রাধারানী এমএ করার কথা ভাবতেই পারত না। শুধু রাধারানীর পড়াশোনাই নয়, সংসারেও কাকামণি নানা ভাবে সাহায্য করে। বিয়ের সম্বন্ধটাও কাকামণিই এনেছিল। হিমনের দাদা ইমন কাকামণির কলেজেই পড়ায়। রাধারানীর বিয়ে করার খুব একটা অনিচ্ছা ছিল না বটে, তবে এমএ টা শেষ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারলে বেশি খুশি হত। বাবা একদম চায়নি। কিন্তু কাকামণির ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবার মত মেরুদণ্ডের জোর বাবা অনেকদিন আগেই হারিয়েছে। হটাত করে কারখানা বন্ধ হয়ে গেল, প্রাপ্য টাকা পয়সাও কিছুই পেল না, বেশ কিছুদিন উঞ্ছবৃত্তি করার পর মাড়োয়ারির গদি, তাও চূড়ান্ত বৈষম্যের শিকার বাবা। মাড়োয়ারি নিজের দেশোয়ালি ভাইদের যে হারে বেতন দেয়, বাবার কপালে তার থেকে অনেক কম টাকা জোটে। এর পরেও যেটুকু আত্মসম্মান বোধ বাকি ছিল, কাকামনির মাসিক অর্থসাহায্য তাকেও কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। কাকামণি অবশ্য বাবার হাতে টাকা দেয় না, বাবা না থাকলে লুকিয়ে মাকে দিয়ে যায়। মা আর কাকামনি একই স্কুলে পড়ত, বাবার সাথে মায়ের বিয়েটাও কাকামনির ঘটকালীর পরিণাম।
        প্রথম দিন হিমন দেখতে যায়নি। হিমনের বাবা, মা আর দাদা ইমন গিয়েছিল। দ্বিতীয় দিন গিয়েছিল হিমন আর হিমনের বৌদি ঋদ্ধি। সম্বন্ধ পাকা হবার পর হিমন চাইত দেখা করতে,  কোন কফিশপ বা মলে একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে। রাধারানী রাজি হয়নি। বলেছিল “মা ছাড়বে না।” আসলে কফিশপ বা মলে গেলেই ফালতু খরচ। হিমন তিনবার বিল মেটালে অন্তত একবার তো রাধারানীকেও তো দিতে হবে, নিদেন পক্ষে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হবে। ফোনে কথা হত।
হাজার অনটনেও মা নিজের গয়না বেচেনি, মায়ের গয়না পরেই রাধারানীর বিয়ে হল। কিছু গয়নার পালিশ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে শাশুড়ি মৃদু অনুযোগ করেন বটে, তবে আশাতীত ধুমধামের সাথেই বিয়ে হয় হিমন আর রাধারানীর। বাবা নিজের সাধ্যাতীত আয়োজন করেছিল। অন্যান্য কাকা, পিসিরাও সাহায্য করতে কার্পণ্য করেননি।
        বিয়ের পর কিছুদিন মন্দ কাটেনি। ক্রমে রাধারানী বুঝতে পারল যে হিমন সাংঘাতিক রগচটা। পান থেকে চুন খসলেই অশান্তি করে। কথা বলার সময় বিন্দুমাত্র ভাবনা চিন্তা করে না, যে কথাটা যাকে শোনানো হল, সে কতটা আহত হল। রেগে গেলে নিজের মাকেও রেয়াৎ করে না। শুধু বাবাকে একটু সমঝে চলে। হিমনের বায়নাক্কারও শেষ নেই। এবেলার রান্না ওবেলা খাবে না। ঝোলভাত বা একতরকারি ভাত খাবে না, নিজের জিনিসপত্র কিছুই গুছিয়ে রাখবে না, রাধারানীকে গুছিয়ে রাখতে হবে। আবার গুছিয়ে রাখা জিনিস খোঁজার ধৈর্যও হিমনের নেই। খুঁজে না পেলে চিৎকার করে বলবে, “ কোন সাহসে আমার টেবিলে হাত দিয়েছিলে? আর কোনদিন আমার জিনিসে হাত দেবে না।” রাধারানী যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শাশুড়িও তখন নিজের ছেলেরই পক্ষ নেন। শাশুড়ি অবশ্য কোনদিনই রাধারানীকে পছন্দ করতে পারেননি। এমনকি ওর নামটা নিয়েও জেঠ শাশুড়ি, খুড় শাশুড়িদের সাথে হাসাহাসি করতেন। আর সব সময় ঋদ্ধির সাথে তুলনা। ঋদ্ধি কতটা গৃহকর্মনিপুণা, আর রাধারানী কতটা অপদার্থ। এমনকি রাধারানীর মা ফোন করলেও শাশুড়ির মুখ হাঁড়ি হয়ে যেত। রাধারানী ওদের একমাত্র সন্তান, ওরা দিনান্তে এক বার তার খোঁজ নেবে না? তাও তো রাধারানীর মোবাইলে ফোন করে মা, বাড়ির ল্যান্ডলাইনে নয়। শাশুড়ির বদ্ধমূল ধারণা, ওর মা নিয়মিত ফোন করে রাধারানীর মুন্ডু চিবোয়। সুযোগ বুঝে হিমনকেও লাগিয়েছিল বুড়ি, তাই বাবামা ফোন করলেই হিমনের ভ্রূ কুঁচকে যেত। একবার বলেওছিল, “ওনারা এত বার ফোন করেন কেন? তুমি তো আর জলে পড়ে নেই।” এমন কড়া জবাব দিয়েছিল রাধারানী, যে হিমন পালাতে পথ পায়নি।
মাঝে মাঝে অবাক লাগত রাধারানীর, এদের ভন্ডামি দেখে, বিয়ের পর সোহাগ করে জিন্স কিনে দিয়েছিল হিমন, বেশ দামি জিন্স। অথচ সেটা পরে রাস্তায় বেরনোর অনুমতি ছিল না। কেন? না আমাদের বাড়ির বউরা এই মহল্লায় জিন্স পরে না। বেড়াতে গেলে কিন্তু পরে, এবং সেই ছবি ফেসবুকেও দেয়, অথচ মহল্লায় শুধু শাড়ি আর সালোয়ার। উনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে প্রবল খিদে পেত, তাই মেট্রো থেকে নেমে প্রায়ই রোল বা মশলা মুড়ি খেতে খেতে বাড়ি ফিরত, একদিন বড়দা ইমনের চোখে পড়ে গেল, ব্যস অমনি শুরু হল লেকচার, “খিদে পেলে, কিনে বাড়ি নিয়ে এসে খাবি। খেতে খেতে রাস্তা দিয়ে আসবি না। এ বাড়ির মেয়ে বউরা কোনদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে খায় না। অন্তত এই মহল্লায়।” বাড়িতে নাইটি পরা চলবে, তবে রাতে নিজের ঘরে গিয়ে। দিনের বেলা পরতে পার তবে বেলা দশটার পর, বাড়ির ছেলেরা বেড়িয়ে গেলে। তাও পরে বারন্দা বা ছাতে যাওয়া যাবে না। রাধারানীর মনে হত, এরা কি সত্যি একবিংশ শতকের বাসিন্দা? কথায় কথায়, “এ বাড়ির মেয়েরা এটা করে না আর এ বাড়ির মেয়েরা ওটা করে না।” কোন বাড়ি ভাই তোদের? ঠাকুর বাড়ির মেয়েবউদেরও বোধহয় এত বাধা-নিষেধ মানতে হত না।
        শাশুড়ি কাজ ভাগ করে দিলেন, সকালের রান্না আর খেতে দেবার দায়িত্ব ঋদ্ধির আর রাতের বেলা রাধারানীর। মা পইপই করে বলে দিয়েছিল, “আমার মেয়ে সেভাবে রান্নাবান্না কিছুই পারে না, একটু শিখিয়েপড়িয়ে নেবেন।” অথচ রুটি বানাতে জানে না বলে কত কথাই না শুনতে হল। শুধু কি রুটি? মিষ্টি মিষ্টি করে মুগের ডাল, একটা তরকারি, আর সোম-বুধ-শুক্র-রবিবারে ডিম বা মাংস রান্না করা। একটা এমএ পড়া মেয়ের পক্ষে কি এত রান্না করা সম্ভব? একদিন ডালের পরিমাণটা গড়বর হয়ে গিয়েছিল, মেকআপ করার জন্য রাধারানী ফ্রিজে রাখা সকালের ডাল একটু মিশিয়ে দিয়েছিল। শ্বশুর আর ইমন চুপচাপ খেয়ে নিল, হিমন ডাল মুখে দিয়েই নাক সিটকে উঠল। “এঃ বাসি ডাল। কে রেঁধেছে? তোমরা জান না আমি বাসি পচা জিনিস খাই না।” রাধারানী মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল, “ আমি তো রাতেই করেছি।” ব্যস, আগুনে ঘি পড়ল, “তবে কি আমি মিথ্যা বলছি? খাবই না শালা” বলে থালা সমেত খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিল হিমন। তীব্র ঝনঝন শব্দ গোটা খাবারঘরময় এঁটো তরকারি, গড়িয়ে যাওয়া ডাল আর আধভেজা দলা পাকানো রুটির টুকরো, দৃশ্যটা আজো ভুলতে পারেনি রাধারানী। কেউ সহানুভূতি দেখায়নি। ঋদ্ধি অবধি বলেছিল, “ একি রে? ও খেতে পারে না জানিস তাও? ছেলেটা সারাদিন খেটেখুটে ফিরল, না খেয়েই উঠে গেল?” শাশুড়ি চিবিয়ে চিবিয়ে ঋদ্ধিকে বলেছিল, “ ঋদ্ধি তুই দেখ ছোটোকে কিছু খাওয়াতে পারিস কি না।” সেদিন থেকে ঋদ্ধিকে অসহ্য লাগে রাধারানীর। পুরো প্লাস্টিক, নকল, ফেক মাল। সব সময় শ্বশুর শাশুরির মন জুগিয়ে চলা আর তলায় তলায় রাধারানীর নামে চুকলি কাটা।
        হিমনের খাবার ছুঁড়ে ফেলে দেবার কথাটা মাকে জানিয়েছিল, আর কাকেই বা বলবে? বন্ধু বান্ধবদের তো আর ব্যক্তিগত কথা বলা যায় না। মা হতবাক হয়ে গিয়েছিল, “ তুই সারাদিন ক্লাশ করে বাড়ি ফিরে পঞ্চব্যঞ্জন রাঁধলি আর ও ছুঁড়ে ফেলে দিল? ডাল না হয় নাই খেত?” মা বা বাবা বোধহয় কথা প্রসঙ্গে কাকামনিকে জানায়, আর কাকামনি ইমনকে। ইমন বাড়ি এসে মায়ের কানে তুলতেই তুলকালাম কাণ্ড।
বিয়ের মাস তিনেকের মধ্যেই শ্বশুর মশাই মারা গেলেন, আর শ্রাদ্ধশান্তি মিটতে না মিটতেই জানা গেল রাধারানী গর্ভবতী। হিমন জানত, রাধারানী এখুনি সন্তান চায় না। এমএ শেষ করে চাকরী করার তীব্র ইচ্ছা রাধারানীর। শিক্ষিকা হবে। বাবাকে আর বাড়ি ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না, “হ্যাঁ গো, সেজ দিয়ে গেছে?” কতদিন আর কাকামনির অর্থে সংসার চলবে? বাবা মাঝেসাঝে মজা করে বলে, “ইয়ে জিনা ভি কোই জিনা হ্যায়, লাল্লু্” ।আগে বুঝত না, শিশু ছিল, কিন্তু এখন সেই মজার ভিতর লুকানো গোপন বেদনা রাধারানীকে কশাঘাত করে। এসএসসির ফর্ম ফিলাপ করেছে, কিছুদিন বাদে সেই পরীক্ষা, এই মুহূর্তে একটা শিশুর দায়িত্ব নিতে রাধারানী আদপে প্রস্তুত নয়। কিন্তু আবার সেই এক কথা, “এ বাড়ির মেয়েবউরা কোনদিন...।” তার ওপরে যোগ হল, “পাগল নাকি? বাবা ফিরে আসতে চাইছে, আর তুমি তাকে মেরে ফেলতে চাইছ?” ইউনিভার্সিটি যাওয়া বন্ধ হতে দেরি লাগল না। রাধারানীর স্বাস্থ্য নিয়ে ডাক্তার নাকি অতি উদ্বিগ্ন। তাই ঘর বন্দি থাকা। কাজ করা নিষেধ, অথচ কাজ না করার জন্য খোঁটা দিতে কেউ ছাড়ে না। ঋদ্ধির দুঃখে সবাই কাতর, “আহা, ঋদ্ধিটা কি খাটুনিই না খাটে।” “ তোমার সারা জীবন ঋদ্ধির কাচ্ছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।” কেন রে বাবা? ঋদ্ধির কাছে খামোকা কৃতজ্ঞ থাকতে যাবে কেন, রাধারানী? তার কি বাবা-মা নেই? মা তো নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল, এরাই রাজি হয়নি। শাশুড়ি একদিন পিসশাশুড়িকে বলছিল, “এত চালাক না রাধার মা, মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চায়, যাতে আমার ছেলেটা নিয়মিত যাওয়া আসা করে। বশ করতে চাইছে আমার ছেলেকে, বুঝলে ঠাকুরঝি।” কি নিম্নরুচি? এই মহিলাকে মা বলে ডাকা যায়? না সম্মান করা যায়? কথায় কথায় শোনায়, “আমার সব গয়না আমি ঋদ্ধিকে দিয়ে যাব। সব সিল্কের শাড়ি গুলো ঋদ্ধিকে দেব।ঋদ্ধি আমার সোনার মেয়ে।” তোর ঐ শাড়ি-গয়নায় মুতে দেয় রাধারানী দেবনাথ। আর ঋদ্ধি কি করে ওর জন্য, যে রাধারানী তার ওপর কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে থাকবে? করে তো খালি রান্না।ঘরমোছা বাসন মাজার যেমন মাসি আছে। রান্নার লোক রাখো না কেন তোমরা? না ছেলেরা নাকি কাজের লোকের হাতে খেতে পারে না। তবে? রাধারানীর জন্য তো করে না? হিমন থাকলে আদিখ্যেতা করে ডাকে, “ আয় রাধা, খাবি আয়।” আর না থাকলে, খাবার টেবিলে চাপা দিয়ে রেখে দেয়, জানাবার ও প্রয়োজন বোধ করে না।
এক নাগাড়ে ঘরবন্দি, আর পারছে না রাধারানী। সারাদিন একা চুপ করে পড়ে থাকা। একটা কথা বলার সঙ্গী নেই। আজ হিমন অফিস থেকে ফিরতেই ধরেছে, “আমাকে মায়ের কাছে রেখে এস।”
“কেন? এখানে কি সমস্যা? মা আছে, ঋদ্ধি আছে, দেখাশোনার তো কোন অসুবিধে হবার কথা নয়?” ব্যস, লেগে গেল ঝগড়া। হিমন বুঝবে না, আর আজ রাধারানীও ছেড়ে দেবার বাঁদি নয়। হিমন গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, রাধারানী গলা নামিয়ে ঋজু ভঙ্গীতে জবাব দিচ্ছে। হিমনের পারদ চড়ছিল, এবার রাধারানীর বাপের বাড়ি তুলে গালমন্দ শুরু করল। রাধারানীর বাবা নাকি ভিখিরি। বিয়েতে যে সব জিনিস দিয়েছে, তা নাকি এবাড়ির ঝি চাকররাও পরে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করে ওর বাবা, আর রাধারানীর মা, ওর কাকামনির সাথে শোয়, তাই না কাকা হাত উপুড় করে। রাধারানী তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, “হ্যাঁ, যেমন তুমি ঋদ্ধির সাথে শোও!” কথা শেষ হতে না হতেই ঠাস করে এক চড় মারল হিমন। সাময়িক ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেল রাধারানী। বাবাকে ভিখিরি বলা? মা বেশ্যা? গায়ে হাত তোলা? আর এই কুত্তাটার ঔরসজাত ভ্রুন পালিত হচ্ছে ওর গর্ভে? রক্ত মাংস দিয়ে তিলতিল করে গড়ছে তাকে রাধারানী? না কিছুতেই না। এই পাপের সন্তান ও চায় না। দমাদ্দম নিজের স্ফীত গর্ভে ঘুষি মারতে লাগল রাধারানী সাথে সাথে গলা ফাটিয়ে চিৎকার, “ না...।।না......।।না......।।”  
হিমনের কথা
চড়টা মেরেই হিমন বুঝতে পারল, জীবনের সবথেকে বড় অন্যায়টা করে ফেলেছে,  ক্ষমা চাইবে কি, রাধারানীর রূপ দেখে ও আঁতকে উঠল। রাধারানীর চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে, চুল খুলে গেছে, দমাদম নিজের পেটে ঘুষি মারছে সাথে আর্ত চিৎকার। পাড়া প্রতিবেশী কি ভাববে? ছিঃ ছিঃ শরিকি বাড়ি, ছোট কাকিমা নিশ্চয় এতক্ষণে বারন্দায় এসে দাঁড়িয়েছে, কান খাড়া করে। এখুনি ফোন করবে সেজ পিসিকে, ব্যস আর নিউইয়র্ক থেকে হালিশহর পর্যন্ত যেখানে যত আত্মীয়স্বজন আছে, খবর রাষ্ট্র হতে সময় লাগবে দশ মিনিট। তার থেকে বড় কথা পেটের বাচ্ছাটা কেমন আছে, কে জানে? হিমনেরও যে এই মুহূর্তে বাবা হবার খুব ইচ্ছা ছিল তা নয়, বরং রাধারানী নিজের পায়ে দাঁড়ালে তারপর ভাবা যেত, এটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা, রাধারানী এর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইলে ওর কোন আপত্তি ছিল না। চুপচাপ কাজ সেরে রাধারানীকে ওর বাবা মায়ের কাছে রেখে আসলে কেউ জানতেও পারত না। বিয়ের তিন মাসের মধ্যে ইস্যু আসাটা বেশ লজ্জাকর।
মুস্কিল হল ঋদ্ধিকে জানিয়ে। আসলে ঋদ্ধি শুধু ওর বড় বৌদি নয়, হিমনের ছোটবেলার বন্ধু। ওরা একসাথে কিন্ডারগার্ডেনে পড়েছে, তারপর অবশ্য আলাদা আলাদা স্কুলে পড়া। আবার ক্লাশ ইলেভেনে ঋদ্ধির সাথে দেখা, একই স্যারের কাছে ইংলিশ পড়তে গিয়ে, সেবারেই বন্ধুত্বটা আরও মজবুত হয় ওদের। বড়দা ইমন যখন প্রেমে লেঙ্গি খেয়ে, ঘরে খিল দিয়ে বসে থাকত, বাবা-মা পাগল হয়ে উঠেছিল ইমনের বিয়ে দেবার জন্য, তখনি হিমন ঋদ্ধির কথা বলে। রাধারানী ফালতুই নিজের বাবার অবস্থার কথা ভেবে হীনমন্যতায় ভোগে। ঋদ্ধিও বিশাল বড় ঘরের মেয়ে নয়। ওর বাবার একটা মনিহারি দোকান আছে, যেটা একদমই ভাল চলে না। শুধু হিমন আর ঋদ্ধি ছাড়া কেউ জানে না, যে ঋদ্ধির বিয়ের খরচের একটা সিংহভাগই বহন করেছিলেন, ইমন-হিমনের বাবা। শ্বশুরের প্রতি ঋদ্ধির কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না, তাই বাবা মারা যেতে ঋদ্ধি হাউহাউ করে কেঁদেছিল, অথচ রাধারানীর তাই নিয়েও সমস্যা, ঋদ্ধি নাকি পাকা দরের অভিনেত্রী, দিব্যি ঠিক ছিল, যেই আত্মীয়স্বজনদের জমায়েত হল, অমনি শ্বশুরের মৃতদেহের ওপর আছাড় খেয়ে কান্না শুরু করল। হতে পারে, সাংসারিক জটিলতা হিমন বোঝে না। ও শুধু বোঝে যে ঋদ্ধিকে সব কথা বলা যায়, ঋদ্ধি বুঝুক আর নাই বুঝুক শোনার চেষ্টা করে, বোঝা তো দূরের কথা রাধারানী শুনতেও চায় না। আর হিমনের পছন্দ নাপছন্দের বিন্দুমাত্র পরোয়াও করে না। হিমন বোঝে, দোষ মায়েরও কিছু কম নয়, বরং হয়ত বেশিই। মা বৃটিশ সুলভ ডিভাইড এন্ড রুল চালাতে চায়, ইচ্ছা করে ঋদ্ধির সাথে রাধারানীর তুলনা করে, রাধারানীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে যে সব ঋদ্ধিকে দিয়ে যাবে। অথচ মা যে ঋদ্ধিকে দুচক্ষে দেখতে পারে না, এটা রাধারানীকে বারংবার বলেও বোঝানো যায় না। বিয়ের পর ঋদ্ধিও ঠিক একই ভাবে অত্যাচারিত হয়েছে, ঋদ্ধির দোষ ছিল যে ও সব কাজ জানত, তাই পুরো সংসার বড় বউয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল মা। আজো ঋদ্ধি সেই বোঝা বইছে। এমনকি টিপু হবার পর রান্না ঘরে টিপুকে শুইয়ে রান্না করত ঋদ্ধি।  রাধারানী তো ভাগ্যবান, হিমন ওর কথা শোনে, সহমর্মী, ইমন কবে ঋদ্ধির কথা শুনেছে? কন্সিভ করার পর বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ, অথচ তার আগে প্রায় দু একদিন ছাড়া ছাড়াই হিমন ওকে নিয়ে বেরত, কখনও মুভি, কখনও শপিং, কখনও বা শুধুই রাতের কলকাতায় লং ড্রাইভ, সাথে বাইরের খাওয়া। এখনও মাকে লুকিয়ে হিমন কি ওর পছন্দের খাবার কিনে আনে না?
হিমন বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্লান্ত, যে মাকে ও কিছু বলতে পারবে না, কি করে বলবে? সদ্যবিধবা ভদ্রমহিলাকে এই মুহূর্তে কিছু বলতে গেলেই মা ছুঁচোর গু পর্বতে তুলবে। তারপর আছে সেজ পিসিমা,ওনার ছেলে নেই দুই মেয়ে, দুজনেই বিবাহিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত, তাও উনি যে কি আজব কমপ্লেক্সে ভোগেন, কার ছেলে বউ কাকে কি যাতনা দেয়, সব ওনার নখদর্পণে, সব শোনে, আর তারপরি শুরু করে, “উফ ভাগ্যে আমার ছেলে নেই। ছ্যাঃ! ছেলেরা কি বেইমান হয় গো? আমার মেয়েরা ভাই ভীষণ ভাল...।।” আগে মায়ের সাথে সেজ পিসিমার একদম বনত না, ছেলে না থাকার সপক্ষে সেজ পিসিমার লজিক মা সহ্য করতে পারবে কি করে? মাও শুনিয়ে শুনিয়ে বলত, “আমি মেয়ে হওয়া দুচোখে দেখতে পারি না।” এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে, ছেলে বউদের সমালোচনা করার জন্য মায়ের সেজ পিসিকে খুব দরকার।
হিমন খুব ভাল বোঝে যে কেন মা রাধারানীকে রাতে রান্নার দায়িত্ব দিয়েছিল, যাতে হিমন বাড়ি ফিরে বউয়ের সাথে রোম্যান্টিক সময় কাটাতে না পারে। সারাদিন ক্লাশ করার পর রান্না করা কতটা কষ্টকর, তাও হিমন অনুভব করে পারে, তাই ওই রাধারানীকে বুদ্ধি দিয়েছিল, ডাল আর মাখো মাখো ডিমের কারি বা সব সব্জি দিয়ে মাংসের স্টু করে নিলে আর তরকারি করার দরকার হয় না। মাঝে মাঝে ডাল না করে দুধ বা মিষ্টির ব্যবস্থা করা যাবে, সুযোগ পেলেই খিচুড়ি। কিন্তু এত করেও বাঁচা গেল না, যেদিন রাধারানী বাসি ডাল পরিবেশন করল, সেদিনই কি কারণে ওর মাথা গরম ছিল। হিমন মিথ্যা একদম বরদাস্ত করতে পারে না, যদি সত্যি কথা বলে দিত, হয়তো জল এতদূর গড়াত না। এর আগেও খাবারের থালা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, কিন্তু সেদিনের মত মানসিক যাতনা কোনদিন ভোগ করেনি। মাথা ঠাণ্ডা হতে ইচ্ছে করছিল ক্ষমা চাইতে, কিন্তু কি যে অখাদ্য মেল ইগো, মাথা নত করতেও দেয় না।    
বিয়ের পর বারবার হিমন বলেছে, “আই হেট লায়ারস”। আর রাধারানী কি করে, কথায় কথায় মিথ্যে কথা বলে। যেমন ঋতুর ব্যাপারটা। বিয়ের পর থেকেই দেখছে দিনে একাধিক বার ঋতু ফোন করে, কখনও কখনও রাত এগারোটা তেও কল করে। ঋতু নাকি ওর ছোট্ট বেলার বন্ধু, “চাড্ডিবাডি”।ইউনিভার্সিটি যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবার পর তো ফোনের সংখ্যা আরও বেড়ে গেল। আহাঃ বেচারা সারাদিন একা থাকে, আসুক না ঋতু, দেখা করে যাক, মাঝেসাঝে। বলাতে রাধারানী খুশিতে ডগমগ। যেদিন ঋতুর আসার কথা পইপই করে ওকে বলে দিল, “জলদি জলদি ফিরো কিন্তু। ঋতুর সাথে আলাপ করিয়ে দেব। বিয়েতে অবশ্য হয়েছিল, তোমার মনে নেই।” সত্যি জলদি ফিরেছিল হিমন, ফিরে ঋতুকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ। এতো একটা ধুমসো ছোঁড়া। রাধারানী গলে পরে বলেছিল, “এই হল ঋতু। আসলে ঋতব্রত।” এক সাথে পড়ে। এর সাথেই রোজ মৌরিগ্রাম থেকে ইউনিভার্সিটি যেত রাধারানী? অথচ বিয়ের আগে হিমনের সনির্বন্ধ অনুরোধেও একটি বার ওর সাথে ঘুরতে যায়নি! আর ফোন? আজ অবধি কোনদিন  নিজে থেকে ওকে ফোন করেছে? বড়জোর মিসড কল। আর ঋতুর সঙ্গে তো কথা শেষই হয় না। সেদিন ঋতব্রত চলে যাবার পর হিমন স্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছিল, ঋতব্রতর সঙ্গে এত মেলামেশা ওর পছন্দ নয়। এই নিয়ে অশান্তি আজো চলছে।
আজ যেমন, কি গা জ্বালানো গরম, মেট্রো থেকে নেমে এইটুকু রাস্তা হেঁটে আসতে হাল খারাপ, দরদর করে ঘামছিল, কোথায় দুটো মিষ্টি কথা বলবে, সারাদিন তো বাতানুকূল ঘরে শুয়েই ছিল রাধারানী, তা নয়, ঘরে পা দিতে না দিতেই, “আমাকে মা-বাবার কাছে রেখে এস। আমার এক মুহূর্ত এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।” কোন পুরুষ মানুষের না মাথাটা চটাং করে গরম হয়ে যায়? গা দিয়ে টকটক গন্ধ বেরোচ্ছে, কোথায় মুখ-হাত ধোবে, তা নয়, খুকুমণিকে ভোলাতে হবে। আর ওকে যে ও বাড়ি রেখে আসা সম্ভব নয়, তা নিয়ে তো ওদের মধ্যে বহু আলোচনা হয়েছে। মা একদম রাজি নয়। মায়ের যুক্তি অখণ্ডনীয়, ঋদ্ধির বেলায় তো ঋদ্ধি এখানেই ছিল, সব কাজ করেছে, রাধারানীকে তো কোন কাজ করতে হচ্ছে না। দিব্যি এসি ঘরে এলিডি টিভি চালিয়ে গড়াগড়ি খাবে। এখান থেকে ডক্টর, হসপিটাল, অ্যাম্বুলেন্স সব হাতের কাছে। শরিকি বাড়ি বলে বাড়িতে একাধিক গাড়ি আছে, রাতবিরেতে লেবার পেন উঠলে, হসপিটাল পৌঁছানো কোন ব্যাপারই না। রাধারানী সব জানা সত্ত্বেও এই রকম ন্যাকামি শুরু করাতে হিমন বেশ রেগে গিয়েই বলেছিল, “ ওসব ছাড়। ভাল লাগুক আর নাই লাগুক এখানেই থাকতে হবে। আর এখানে থাকতে তোমার সমস্যাটা কি? মা আছে, ঋদ্ধি আছে, টিপু আছে, ওদের সাথে মাঝেমাঝে কথা বলতেও তো পার?” ব্যস শুরু হয়ে গেল ঝগড়া। রেগে গিয়ে হিমন যখন বলল, “ঠিক আছে। অত যদি পীরিত, যাও মরো। আমি দিয়ে আসতে পারব না।” এত জেদি মেয়ে, বলা মাত্র একা একাই ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিল, হিমন হাত ধরে টেনে আনতে যেতে আরও গলার শির ফুলিয়ে ঝগড়া করতে লাগল। দুজনেই নীচে নামছিল, তবে হিমন পেশী আস্ফালনটা বড় বেশি করে ফেলল।
হিমন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, দরজাটা ভেজিয়ে দিল। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল, বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে রাধারানীর কান ফাটানো চিৎকার ভেসে আসছে। স্বল্পক্ষণের মধ্যেই দাদা আর ঋদ্ধি ছুটে এল। এই সময় ঋদ্ধির কাছে কয়েকটা বাচ্ছা পড়তে আসে, ঈশ তারাও নির্ঘাত শুনেছে, লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢাকল হিমন। ছেলেদেরও কান্না পায়, শুধু সমাজের রক্ত চক্ষুর ভয়ে কাঁদতে পারে না। দরজা ঠেলে ইমন আর ঋদ্ধি ভিতরে ঢুকল। ইমন ওকে বোঝাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে হিমন। রাধারানী ফুঁসছে। উগড়ে দিচ্ছে সমস্ত বিষ। হিমন শুনতে পেল, ইমন ঋদ্ধিকে বলছে, “ঋদ্ধি রাধার জন্য এক কাপ গরম চা করে আনো, আমার জন্যও এক কাপ। ততক্ষণে আমরা ভাই বোন একটু কথা বলি। আর হিমনকে বলে দাও ও যা করেছে, বাবা বেঁচে থাকলে আর ওর মুখদর্শন করত না। ও যেন একদম আজ এঘরে ঢোকার চেষ্টা না করে।” ঋদ্ধি নীরবে বেরিয়ে এল। ইশারায় ওকে ডাকল, ঋদ্ধির সাথে নীচে রান্নাঘরে যাবার জন্য। চা বসাতে বসাতে ঋদ্ধি বলল, “কি করলি বলতো? গায়ে হাত তোলার কি দরকার ছিল? তোরা ঠিক কি চাস? একটা প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে তার বাবা-মা, চেনা পরিবেশ থেকে উপড়ে এনে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে এনে ফেলে বলছিস, এত দিন যা শিখে এসেছ সব ভুলে যাও। নতুন করে সব শেখো। শুধু তাই নয়, মানিয়ে নিতে যতই সমস্যা হোক না কেন, তাই নিয়ে টুঁ শব্দটি করা চলবে না। এভাবে তো একটা গাছ হলেও বাঁচে না। আর ও তো একটা মানুষ। ”
হিমন দুহাতে রগ টিপে ধরে বলল, “কি হবে ঋদ্ধি?”
“জানি না। দাদা চেষ্টা করছে ।”

দু বছর কেটে গেছে। হিমন আর রাধারানীর কন্যা পুপু এখন দেড় বছরের। গোটা বাড়ির নয়নমণি, সাংঘাতিক দুরন্ত হয়েছে আর তেমনি বাপ সোহাগি। হিমন অফিস থেকে ফেরার সময় হলেই কি করে বোঝে কে জানে, আগে হামা দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসতে চাইত, ইদানীং টুকটুক করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে, আর এক তলার গ্রিলের দরজা ধরে ঝাঁকায়। হিমন ও গলির মুখ থেকে ‘পুপলি’ , ‘পুপাই’, ‘পুপুমা’ করতে করতে আসে। বাড়ি ঢুকে জামাকাপড় ছাড়তে, চা খেতেও দেয় না, পুপু। ওকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ রাস্তায় বেরোতে হয়। আশেপাশে গলি ঘুঁজি, বাজার, দোকান সব ঘোরা চাই পুপুর। পাড়ার দোকান থেকে পাঁচ টাকার মারি বিস্কুটের প্যাকেট কিনে সারমেয়দের খাওয়াতে হবে, হিমন একটা একটা করে বিস্কুট ছুঁড়ে দেবে আর পুপু আধো আধো গলায় বলবে, ‘আয়, আয়, আয়’। তারপর পুপু আর টিপুর জন্য চকলেট কিনে তবে বাড়ি। শুধু তাই নয়, রাতেও পুপু বাবাকে ছাড়া ঘুমোয় না। রাধারানী অনেক চেষ্টা করে দেখেছে, কিছুতেই ঘুমোয় না, উল্টে ছিল চিৎকার করে, যেই হিমন বুকে নেয়, দশ মিনিটে ঘুমিয়ে পড়ে। শুধু হিমন কেন? ইমনও তাড়াতাড়ি কলেজ থেকে ফিরলে, ‘পুপুমা’ কে কোলে করে ঘুরতে বেরোয়। এমনকি সন্ধে বেলা ঋদ্ধি যখন পড়াতে বসে, সেখানেও পুপু গিয়ে গুণ্ডামি কনে। যতক্ষণ না ঋদ্ধি কোলে তুলে, চুমুতে চুমুতে দম বন্ধ করে দেয়, থামে না। হিমন, ইমনের মা অবশ্য অত আদিখ্যেতা দেখান না। বরং রাধারানীর কোথাও যেন মনে হয়, পুপুর অত্যাচারে উনি একটু বিরক্তই হন। হিমন একবার বলেছিল, ওর মা মেয়েদের দেখতে পারে না, কে জানে? তবে পুপু শোধ তুলে নেয়। বুড়ির চশমা এই দেড় বছরে তিন বার পাল্টাতে হয়েছে। একবার পুপু জানলা গলিয়ে ফেলে দিয়েছিল আর একবার রেগে গিয়ে ঠাকুমার চোখ থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। হিমনের মা ঠিক সেই মুহূর্তে পুপুকে কোলে নিয়ে রাধারানীর সঙ্গে একটা ব্যাপারে তর্ক করছিলেন। সেদিন রাধারানীর যা আনন্দ হয়েছিল না, ভাষায়ে অপ্রকাশ্য।
        যাই হোক, গল্পে ফিরে আসি, হিমন আর রাধারানীর সেই কুৎসিত ঝগড়ার পর আরও দু বছর কেটে গেছে, হঠাৎ একদিন রাধারানী তার শাশুরিকে  বলল, “ মা, ঠাকুমার শরীর খুব খারাপ,আমি কয়েকদিনের জন্য মৌরিগ্রাম থেকে ঘুরে আসব?” রাধারানীর ঠাকুমা যে ঘোরতর অসুস্থ তা অবশ্য, ইমন ও বলছিল। তাই রাধারানীর কাকা কয়েক দিন কলেজও আসছেন না। হিমনের মা, উচ্ছে খাওয়া মুখে বললেন, “যাও, তবে শনিবার চলে এস।” রাধারানী দৃঢ় ভাবে বলল, “শনিবার মা ছাড়বে না, জানই তো। রবিবার ফিরব।” রাতে হিমন যখন শুনল, ওর মুখ শুকিয়ে গেল। রাধারানী বেশ বুঝল, যে পুপুকে ছেড়ে থাকতে হবে তাই হিমনের মন খারাপ হয়ে গেল। রাধারানী যদি একা যেত, তাহলে হয়তো হিমন ওকে কোনদিনই ফিরতে বলত না। এবাড়িতে ও পুপুর আয়া ছাড়া কিছু নয়। কেউ পছন্দ করে না ওকে। কেবল পুপুর জন্য ওকে সবাই সহ্য করে।
        যাইহোক হিমনও বলল, “আবার রবিবার কেন? রবিবার ট্রেন এমনি কম থাকে। আর শোন আনতে তো যাব, কিন্তু তোমার মাকে এক গাদা রান্না করতে নিষেধ কর। সে রকম হলে আমি খেয়েই যাব।” রাধারানী খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “ কেন গো? গরীব শ্বশুর বাড়িতে দুটো অন্নগ্রহণ করতেও তোমার এত অনীহা। মা কত আদর করে তাঁর জামাই এর জন্য রান্না করে রাখে। জানি আমার বাবার সামর্থ্য খুবই অল্প, তাই বলে...” রাধারানী আর কথা শেষ করতে পারল না। উদ্গত কান্না চেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হিমন খানিক ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থেকে বলল, “পুপু, তোর মাকি আমায় কোনদিন বুঝবে না? রবিবার একটা ছুটির দিন, একটু ঘুমোতে চাই, সারা সপ্তাহ কি খাটি বল?” পুপু গভীর মনোযোগের সঙ্গে বাবার নাকে এক কামড় দিল। হিমন আলতো করে ছাড়িয়ে দিয়ে, আনমনা হয়ে বলল, “ আরে বুড়ো মানুষটা আমার জন্য এই রোদে গরমে পঞ্চ ব্যঞ্জন রাঁধবে? আমার সঙ্কোচ হয় না বল? আর মাসের শেষে দু-তিন রকম মাছ, মাংস কেনা, তোর দাদুর ট্যাঁকের অবস্থা কি আমি জানি না?” পুপু আরও মনোযোগ দিয়ে বাবার আঙুল চুষতে লাগল।  
আজ দুদিন হল, পুপুকে নিয়ে রাধারানী চলে গেছে, বাড়িটা যেন কেমন খাঁখাঁ করছে, টিপুও ঘুরে ফিরে বারবার জিজ্ঞেস করছে, “বনু করে আসবে?” হিমন আলগোছে হিসেব করল, আজ বৃহস্পতি বার, আরও দুদিন, রবিবারেই ওরা চলে আসবে। বেশ কিছুদিন পর বাপের বাড়ি গেল রাধারানী, তায় ঠাকুমা অসুস্থ, এমতবস্থায় ফোন করলেই রাধারানী ঝাঁজিয়ে উঠছে। আজ যেমন, অফিস থেকে ফিরে হিমন ফোন করে জিজ্ঞেস করল, “পুপু কেমন আছে?” রাধারানী মুখ ঝামটে বলল, “ কেমন আবার থাকবে? দাদু আম্মার কাছে আছে, ভালই থাকবে।” যাঃ বাবা। কি কথার কি জবাব। তাও হিমন মাথা ঠাণ্ডা করে জিজ্ঞেস করল, “আর তুমি?” “থাক। আর ন্যাকামি করতে হবে না। মেয়ের খবর নিতে ফোন করেছিলে, খবর পেয়েছ তো? ব্যস। রাখছি।” “মানে? কি যাতা বকছ? বড্ড তেজ হয়ে গেছে দেখছি? পয়সা পেল তোমার বাবা আর মাটিতে পা পড়ছে না তোমার?” তীব্র শ্লেষ সহ বলল হিমন। ঘটনা হল, কিছুদিন আগেই রাধারানীর বাবার দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা কারখানা অধিগ্রহণ হয়েছে। রাধারানীর বাবার মত যাঁদের অন্যায় ভাবে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল, হাইকোর্টের নির্দেশে সুদ সমেত তাদের টাকা ফেরত দিতে হয়েছে। পুরোটা না পেলেও লাখ ছয়েক টাকায় সেটেলমেন্ট হয়েছে। ওদের অভাবের সংসারে, সেটাও কম নয়। ওর বাবা মাড়োয়ারির কাজটা ছেড়ে দিয়েছেন। কথাটা রাধারানী পরম বিশ্বাসে ওকে বলেছিল, আজ রাগের মাথায় ফিরিয়ে দিয়েই হিমন বুঝতে পারল, আর একটা চরম অন্যায় করে ফেলল। রাধারানী গলার শির ফুলিয়ে ঝগড়া করতে লাগল। ওর বাড়ি, আত্মীয়স্বজন, ওর মা, ঋদ্ধি, ঋদ্ধির বাবা-মার আগ্রাসন সব কিছু নিয়ে যা নয় তাই বলতে লাগল। ঋদ্ধির বাবা-মাকে হিমনের মা আজকাল খুব খাতির করে, সেটাও যে ভিভাইড এন্ড রুল পলিসি, হিমন একাধিক বার বুঝিয়েছে। ইচ্ছা করে এক বউয়ের বাবা-মাকে নিচু করার জন্য অন্য পুত্রবধূর বাবা-মাকে ওপরে তোলা। ঋদ্ধি বা ওর বাবা-মা যে খুব একটা স্বস্তিতে থাকে তা নয়, ওঁরাও চান না, কিন্তু মেয়ের শাশুড়িকে চটাতে সাহস পান না। যেমন পুপুর মুখে-ভাতে যাবতীয় লোকাচার ঋদ্ধির মা করেছিলেন, এই নিয়ে পিসি-জেঠি-কাকিরাও ক্ষেপে গিয়েছিল কিন্তু মাতো মাই, মায়ের ওপর দিয়ে কে যাবে? রাধারানীর মা বাবা সংকুচিত ভাবে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। এমনকি রাধারানীর খুড়তুতো ভাই মুখে ভাত দেবে ঠিক ছিল, কিন্তু মা বলল, যেহেতু রাধারানীর নিজের ভাই নেই, তাই বড় ভাসুর ইমনই ভাত খাওয়াবে। যাই হোক খুব তিক্ত ঝগড়া হল। যতই হোক, তিনি হিমনের মা, তাঁর নামে খারাপ কথা হিমনই বা সয় কেমন করে।
শুক্রবার হিমন ফোন করেনি। রাধারানীও না। রাগে দুজনেই ফুটছিল। শনিবার অফিস থেকে ফিরতেই ঋদ্ধি বলল, রাধারানীর মা ল্যাণ্ডলাইনে ফোন করে বলেছেন, যে কাল রাধারানী আসবে না। যেদিন আসতে চাইবে ওরা জানাবে। পুপুর জন্য মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল, আর রাধারানীর প্রতি রাগ পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল। এত গুমোর? থাক পড়ে বাপের বাড়ি। নিজে থেকে না বললে হিমন আর যাবেই না আনতে। 
মুখে যাই বলুক, মনে মনে হিমন আশা করেছিল, যে রবিবার সকালে অন্তত রাধারানী একবার ফোন করবে, করে বলবে, ‘এসে আমাদের নিয়ে যাও। মেয়ে নিয়ে একা কি যেতে পারি?’ কিছুই যখন এল না, রাতে হিমন নিজেই ফোন করল, রাধারানী পাঁচন খাওয়া গলায় ফোন ধরল। হিমন একটু দাম্ভিক ভাবেই বলল, ‘ আজ এলে না তো? সারা সপ্তাহ কিন্তু আমি ছুটি পাব না। হারামি সিইওটা এসেছে, দিল্লী থেকে।’ রাধারানী শুধু বলল, ‘ যখন যাব, বলে দেব।’ ‘আঃ; বললে তো হবে না, আমি হপ্তার মাঝে ছুটি নিয়ে যেতে পারব না।’ রাধারানী ভ্রূক্ষেপও করল না। হিমন গলা ঝেড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘পুপু কি করছে? কেমন আছে?’ রাধারানী বিশেষ পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘টিয়া, ভালই আছে। ওর দাদু আম্মার কাছে আছে, খারাপ থাকবে কেন?’ “টিয়া” শুনে চমকে গেল, হিমন। পুপু হবার পর ওর দাদু- দিদিমা ওকে টিয়া বলে ডাকত। হিমনের মা নিষেধ করেছিল। বাবার বাড়ির দেওয়া নামটাই যাতে প্রচলিত হয়, “পলাশপ্রিয়া”, সংক্ষেপে পুপু।
  গোটা সপ্তাহ কেটে গেল, রোজ হিমন ফোন করে, তিন চার বার করলে, রাধারানী একবার ধরে। তাও মাত্র আড়াই মিনিট কথা হয়। হিমন পুপুর কথা জিজ্ঞেস করে, রাধারানী টিয়ার কুশল সংবাদ দেয়। নিজের কথা কিছুই বলে না। হিমন জিজ্ঞাসা করতে গেলে, যে ভাষায় কথা বলে, হিমন আর কথা বাড়াতে সাহস পায় না। তাছাড়া মাথা গরম করে লাভ নেই। আগে মান অভিমান ভুলে ফেরত আসুক তারপর দেখা যাবে। রবিবার দিন আর থাকতে পারল না হিমন, রাধারানীকে ফোন করে বলল, “ আমি আসছি। তৈরি থাকো।” রাধারানী কেটে কেটে বলল, “আমি যাব না।” হিমনের গলা নিজের কানেই অসহায় শোনাল, “কিন্তু কেন?” রাধারানী তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল, “ বলেছি তো যেদিন মনে করব, চলে যাব। বারবার ফোন করে বিরক্ত করবে না।” হিমন জেদি গলায় বলল, “আমি আসছি। দেখি তুমি আস কি না।” রাধারানী গলায় বিষ মিশিয়ে বলল, “ বারণ করছি, এসো না, যদি না অপমানিত হতে চাও।” হিমনকে দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিল রাধারানী। তারপর যতবার হিমন ফোন করল, প্রতিবার সুললিত ছন্দে জনৈক ললনা জানাল, “আপনি যে নম্বরে ফোন করেছেন, সেটি আপাতত বন্ধ আছে...।।” সূর্যদেব যখন পশ্চিমে হেলে পড়ব-পড়ব করছেন, গলদঘর্ম হয়ে হিমন গিয়ে পৌঁছল মৌরিগ্রামে রাধারানীদের বাড়ি। ঘণ্টা বাজাতেই রাধারানীর মা দরজা খুলে দিলেন, ভদ্রমহিলার মুখ দেখে মনে হল, ওনাকে কেউ পাঁচন খাইয়েছে। আধো অন্ধকার বসার ঘরে গিয়ে বসল হিমন, একটা নতুন বেতের সোফা কেনা হয়েছে, সোফার এক কোণে রাধারানীর বাবা লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে বসেছিলেন। হিমনকে দেখে কিছু বললেন না। এর আগে এরকম কখনও হয়নি, বিন্দুমাত্র আদর বা সম্ভাষণ দেখাল না কেউই। হিমন গলা ঝেড়ে বলল, “ইয়ে মানে আমি রাধা আর পুপুকে নিতে এসেছি। ওরা কোথায়?” রাধারানীর বাবা উঠে গেলেন, ওর মা, যতটা সম্ভব ঋজু ভঙ্গীতে জানালেন, “ ওরা যাবে না। বলে দেওয়া হয়েছে তো?” “ওরা কোথায়? কেন যাবে না? সেটা জানতে পারি?” ওর মা নিরুত্তর রইলেন। হিমন চলে আসার আগে কাতর স্বরে বলল, “একবার ডেকে দিন। পুপুকে একবার দেখে যাই।” সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ঘরটা অন্ধকার হয়ে আসছিল, মশাদের ভনভনানি বেড়েই চলছিল। কোন লাভ নেই বুঝতে পেরে হিমন বলল,”চলি।” এবার কোন উত্তর পাওয়া গেল না। হিমন নিচু হয়ে শাশুড়িকে প্রণাম করতে গেল, ভদ্রমহিলা পিছিয়ে গিয়ে, মৃদু স্বরে বললেন, “থাক। থাক। যে আমার স্বামীকে ভিখিরি বলে, বলে যে আমার স্বামী রেল স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করে, আর আমি দেওরের সাথে শুয়ে পয়সা পাই, সেই পয়সায় আমাদের পেট চলে, সে আমাকে স্পর্শ করার থেকে আমার মরে যাওয়াই ভাল।” শেষের দিকে ওনার গলা ভেঙে গেল, মুখে আঁচল দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন উনি।
হিমন বাড়ি ফিরে আসতে, ওর মা, ইমন, ঋদ্ধি সবাই হতবাক হয়ে গেল। সবার মুখে, চোখে একই প্রশ্ন। হিমন কোন জবাব দিল না। জবাব দেবে কি? হিমন নিজেও হতবাক। রাধারানী পারল? নিজেদের ব্যক্তিগত ঝগড়া এভাবে বাবামায়ের সামনে তুলে ধরতে? ছিঃ, হিমন আর কোনদিন পারবে ওনাদের সাথে চোখ মেলাতে? অত স্নেহময়ী শাশুড়ি, তাঁকে কাঁদতে হল, শুধু রাধারানীর অবিমৃশ্যকারিতার জন্য। আরে দাম্পত্যকলহ মিটেই যায়, কিন্তু এ কলঙ্ক, কি কোনদিন মিটবে? রাধারানী কি ওকে কোনদিন বুঝবে না? ও যা বলে সবই রেগে গিয়ে বলে, মন থেকে নয়।
পরদিন ইমন মুখ কালো করে কলেজ থেকে ফিরল।হিমন অফিস যায়নি। সারাদিন নিজের ঘরেই ছিল, খায়ও নি, কারো কোন প্রশ্নের কোন উত্তরও দেয়নি। ইমন জুতো খুলেই ঋদ্ধিকে বলল, “হিমনকে ডাকো। এখুনি।”  হিমন মাথা নিচু করে এসে মায়ের খাটে বসল। ঋদ্ধি আর ওদের মা হাঁ করে তাকিয়ে আছেন, “কি রে, কি হল? বলবি তো?” ইমন জীবনে চিৎকার করে না, আজ আর গলার আওয়াজ কন্ট্রোল করতে পারল না, থরথর করে কাঁপছে হিমন, “ কি আর হবে? তোমার গুণধর ছোট ছেলে, বউয়ের গায়ে হাত তোলে, শাশুড়িকে বেশ্যা বলে। শ্বশুর নাকি রেল লাইনের ধারে ভিক্ষা করে, এমনকি কিঙ্করদা কেও ছাড়েনি। বলেছে, কিঙ্করদা নাকি রাধারানীর মায়ের সাথে শোয়, তাই ওদের সংসার টানে।” হিমন মাথা নিচু করে বসে আছে। ঋদ্ধি ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। ইমন ওর দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপের স্বরে বলল, “ কি ঋদ্ধি? এরকম ভালোবাসা চাই না তোমার? খুব বলতে, দ্যাখো হিমন কেমন নিজের বউকে ঘুরতে নিয়ে যায়, খেতে নিয়ে যায়, শপিং...। চাই নাকি? একটা শাড়ি আর একটা লাথি? আজ অব্দি আমি কোনদিন তোমার বাবা মায়ের নামে কিছু বলেছি? বাবা? বাবা কোনদিন দাদু বা দিদিমার নামে বলেছে মা?” ওদের মা হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন, জবাব দেবেন কি। ইমন বলেই চলেছে, “আমার সন্দেহ হচ্ছিল, কেন মেয়েটা আসতে চাইছে না? আমি হাতে ধরে নিয়ে এসেছিলাম তাকে এবাড়ির বউ বানিয়ে, ছিঃ। কিঙ্কর দাকে আজ জিজ্ঞেস করলাম, কেন ও আসতে চাইছে না? সে বলল, ‘তোমায় দেখে বিয়ে দিয়েছিলাম ইমন, মেয়েটার জীবন বরবাদ করে দিলাম। দাদা বউদির সামনে মুখ দেখাতে পারছি না। এত বদরাগী তোমার ভাই?’ ” হিমনের মা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ঋদ্ধি বলে উঠল, “ ওরা জানলেন কি করে? স্বামী- স্ত্রীর ভেতরের ব্যাপার? হিমন তো আর ওদের ডাইরেক্ট বলেনি, রাধারানী সব সত্যি বলেছে কি না তার স্থিরতা কি?” হিমনের মাও ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন, “হ্যাঁ, এমনিতেই ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে ওদের মেয়ে।” ইমন রাগে গদাম করে চেয়ারে একটা ঘুষি মারল, “মিথ্যা বলে, তাই না? না এবার বলেনি, শেষ দিনে তোমার গুণধর যা বলেছে, সেই কলটা রাধারানী রেকর্ড করে ওর বাবামাকে শুনিয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির কোন বাবা-মা নাহলে মেয়ের ডিভোর্স চায়?” “ডিভোর্স?” ঘরের মধ্য যেন বোম ফাটল, ইমন ধপ করে বসে পড়ল, মাথা নিচু করে বলল, “ও আর ফিরবে না। ওরা ডিভোর্স চায়!”

ডিভোর্স চায় বললেই তো আর ডিভোর্স হয় না। আমাদের দেশে বিয়ে করা যতটা না কঠিন, বিয়ে ভাঙা তার থেকে শতগুণ কঠিন। তারওপর আছে যৌথ পরিবারের ঠাস বুনোন। এমনিতে কারো সাথে কারো মুখ দেখাদেখি না থাকলেও, কারো বাড়ি ডিভোর্স হচ্ছে শুনলেই মাছির মত সব আত্মীয়স্বজন ভনভনিয়ে আসে। নানা জনের নানা মত। সকলেই একবাক্যে রাধারানীকেই দোষী সাব্যস্ত করে, এ কি মেয়েরে বাবা! বরের সাথে ঝগড়া করে, সেই ঝগড়া রেকর্ড করে বাবা-মা- আত্মীয়স্বজন-পাড়াপড়শিকে শুনিয়ে বেড়ায়? আর হুট কথায় এভাবে আর ফিরব না বলে গোসা করে বসে থাকে? সন্তানের কথাও ভাবে না? একলা একটা মেয়ে, সারাজীবন একটা বাচ্ছা নিয়ে কি ভাবে চলবে? বাবা-মা আর কতদিন বাঁচবে? নাকি অন্য কোন গল্প আছে? কোন তৃতীয় কোণ? তা না হলে একটা মেয়ের এত মেরুদণ্ডের জোর তো হয় না? ঋদ্ধিও একদিন জিজ্ঞেস করল, “ অন্য কেউ ছিল তোদের মধ্যে?” হিমন ভ্যাবলার মত তাকাল। ঋদ্ধি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “ দ্যাখ, ঝগড়াঝাঁটি তো তোদের বউভাতের পরদিন থেকেই চলছে, এতবড় পদক্ষেপ কেন? তাও মেয়ে হয়ে যাবার পর?” হিমন বহু ভেবে চিন্তে সেই ঋতু ছাড়া আর কারো কথা ভেবে পেল না। তবে কি সেই ইন্ধন যোগাচ্ছে?
হিমনের বড় জেঠু আর জেঠিমা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গেলেন রাধারানীর বাড়ি, শেষ চেষ্টা করার জন্য, যাতে বিয়েটা বাঁচানো যায়। হিমনের ভয় অমূলক প্রমাণ করে রাধারানী এবং তার বাবা, মা যথেষ্ট ভদ্রব্যবহার করে ওনাদের সাথে। রাধারানীর বাবা, এও বলেন, “সমর্থ মেয়ে বাপের বাড়ি বসে থাকলে, মা-বাবার মনের অবস্থা কি হয় সেতো বোঝেনই। কিন্তু কি করব বলুন? ও যেতে চায় না। সারাজীবন অর্থাভাবে ওর জন্য কিছু করতে পারিনি, গ্রাজুয়েশন হতে না হতেই ভাই ওর বিয়ে দিয়ে দিল, আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারিনি। ভাবলাম মেয়েটা সুখে থাকবে।” লুঙ্গির খুঁটে চোখ মুছে প্রৌঢ়, ধরা গলায় বললেন, “কিন্তু আজ অন্তত দুটো মাছ-ভাত দেবার সামর্থ আমার আছে, আজ আমি ওকে জোর করে পাঠাতে পারব না। ও যদি নিজে থেকে চায়, যাক।” রাধারানী আসতে রাজি হল না। কারণও কিছু বলল না। তবে ওর মা, বললেন, মেয়ের গায়ে হাত তোলে, খাবার ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কথায় কথায় বাপ-মা তুলে গাল দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। বৃদ্ধ জেঠু ফিরে এসে বললেন, “ও যে বউয়ের গায়ে হাত তোলে তোমরা আমাকে কেউ জানাওনি তো? জানলে যেতাম না।”
সমস্যাটা ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ঝুলেই রইল। ছয়-সাত মাস কেটে গেল। হিমনের ঘরে ঢুকলেই কান্না পায়। গোটা ঘরময় পুপুর খেলনা ছড়ানো। জন্সনএর  বেবি পাউডার, তেল, শ্যাম্পু, সাদা ছোট্ট জন্সন সাবান, পুপুর চান করার ছোট্ট গামলা। যাতে ওর মা ওকে নেন্টু করে তেল মাখিয়ে বসিয়ে আর জল ঢেলে দিত, পুপু খিলখিল করে হাসত আর হাত দিয়ে জল থাবড়াত। পুপুর ছোট্ট, ছোট্ট জামা, পেন্টু, সবেতেই কিছুদিন আগেও পুপুর গন্ধ লেগেছিল। এখন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে, গন্ধ গুলো। ক্যামেরা, মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব ভর্তি পুপুর ছবি, নানা পোজে। দেড় বছরের পুপু, যাদের বয়স বাড়েনি। হিমনের চোখ ফেটে জল আসে। হিমন শুয়ে থাকলেই পুপু হামা দিয়ে এসে বাবার বুকে উঠত। কখনও বাবার বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকত, কখনও বা ঘুরতে নিয়ে যেতে বলত, ইশারায়। হিমন না বোঝার ভান করলে, ছোট্ট ছোট্ট হাতে গুমগুম করে মারত। পুপুর জামা কাপড় গুলো নাকের কাছে নিয়ে প্রাণপণ ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করে হিমন, মনে হয় ছোট্ট পুপু যেন ওর বুকে ঘুমোচ্ছে। কেমন অবাক চোখে সব দেখত, রাস্তায় নিয়ে গেলে। রাস্তার কুকুর গুলোকে ভয় পেত আবার  ওদেরই বিস্কুট খাওয়াতে কি ভালোই না বাসত পুপু। “আয়ঃ, আয়ঃ” করে  ডাকত। কেউ না খেলে “উই যেঃ” বলে হিমনকে দেখাত। হুহু করে কেঁদেই ফেলে হিমন ভাবতে ভাবতে। এই ছয় সাত মাসে নিশ্চয়, অনেক বড় হয়ে গেছে পুপু, আর কি বাবাকে চিনতে পারবে? হ্যাঁ পুপাই চিনবে না তার বাবাকে, তাও হয়?  হঠাৎ হিমন মেসেজ পাঠাল, রাধারানীকে, “একবার পুপুর সাথে কথা বলা যাবে?” ফোন করার সাহস হয় না বলে এতদিন হিমন পুপুর জন্য মন খারাপ করলেই রাধারানীকে মেসেজ করত।অবশ্য হাজার কষ্ট হলেও সেই মেসেজের সংখ্যা ছিল দিনে বড় জোর একটি। একথা অনস্বীকার্য,  দু একবার ব্যতিরেকে প্রতিবারই রাধারানী  মেসেজে পুপুর খবর দিয়েছে।  আজ কার মুখ দেখে ঘুম ভেঙেছিল কে জানে,  মোবাইলের কম্পনে চমকে উঠে দেখে রাধারানীর ফোন। হিমন ভয়ে ভয়ে বলল, “হ্যাঁ?”। রাধারানী স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলল, “পুপু ভালো আছে, এ নাও, কথা বলো।” হিমন আপ্লুত হয়ে গেল, “পুপু? পুপাই? পুপলি মা” ওদিক থেকে একটা বাচ্ছার চিল চিৎকার, “নাঃ। নাঃ। নাঃ। কথা বলবে নাঃ।” বাবারে পুপু এত স্পষ্ট কথা বলতে কবে শিখল? কি মিষ্টি করে বলছে। বাপের ওপর অভিমান হয়েছে বেটির। হিমন অভিমান ভাঙাতে গেল, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরল না। রাধারানী সংকুচিত ভাবে বলল, “খুব জেদি। একেবারে বাপের মত। এখন ওর টিভি দেখার সময় তো তাই কথা বলতে চাইল না।” টিভি দেখা? এইটুকু বয়সে? মেয়েটা বিগড়ে যাচ্ছে, প্রথম চোটে এটাই মনে হল হিমনের। খুব ইচ্ছা করছিল, রাধারানীকে জিজ্ঞেস করতে কেমন আছে ও, গলার কাছে আটকে থাকা বেদনা কথা বলতেই দিল না। তীব্র অভিমান হল হিমনের, ‘এতখানি ভুল বুঝলে রাধা আমায়? তোমাকে বলা প্রতিটা শব্দ ঘোরতর অনুচিত ছিল, কিন্তু  আমি ভাবতাম গোটা পৃথিবীতে একমাত্র তুমিই বোঝ আমায়। তুমি বুঝবে, ও গুলো কথার কথা ছিল। তোমার বাবা-মাকে কোনদিন অসম্মান করার কথা ভাবতেও পারতাম না। আর তোমাকে? তোমাকে তো কত ভালবাসতাম। আজও কি বাসি না? শুধু কি পুপুর জন্যই এত বেদনা?’ ও পার থেকে রাধারানীর অসহিষ্ণু গলায় “ হ্যালো? হ্যালো?” শুনে চমক ভাঙল হিমনের। রাধারানী বিরক্ত গলায় বলল, “টিয়া চলে গেছে। রাখছি।”
ফোন রেখে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিল রাধারানী,  কি যে অব্যক্ত বেদনা, ভিতরটা কুরে কুরে খাচ্ছে।  খুব আশা করেছিল, হিমন একবার বলবে, “রাধা ফিরে এস।” বললেই কি ফিরত রাধারানী? কিছুতেই না। ঐ জাঁহাবাজ মহিলার সাথে আর ঐ ন্যাকাচণ্ডী ঋদ্ধির সাথে থাকা অসম্ভব। কিন্তু হিমন?  হিমন যদি একা থাকত? রাধারানীর চোখের কোণ কখন যে ভিজে উঠল, খেয়াল করতে পারল না। আজ হিমনকে ফোন করার আরো একটা কারণ ছিল, আজ রাধারানী একটা চাকরী পেয়েছে, বিশাল কিছু নয়, একটা এনজিও তে, খুবই অল্প বেতন, কিন্তু তবু চাকরী তো। টেট দিতে, এসএসসি দিতে, এমন কি এম এ পরীক্ষার দিন গুলোতেও হিমন ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যেত, আর আজ এই খবরটাই দিতে পারল না। টিয়ার সাথে যেই কথা হয়ে গেল, অমনি চুপ। মুখে তো আর বলতে পারে না, যে কাজ মিটে গেছে, রাখছি, তাই চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। হিমন ওকে কোনদিনও ভালোবাসেনি। রাধারানীও যে কি আশা করে ভগবান জানে?
(to be continued)