Wednesday, 26 February 2025

অনির ডাইরি ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

 অনির ডাইরি ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


"ম্যাডাম, আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। আমাদের গ্রামে একজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বাড়ির লোক ডাইরি লেখাতে গিয়েছিল, থানা থেকে ডাইরি নিচ্ছে না।" থানায় ডাইরি করা যে কি অসম্ভব চাপের তা আমি হাড়েহাড়ে জানি। কিছুদিন আগে আমার নাম করে টাকা তোলার নালিশ পেয়েছিলাম একটি ছেলের বিরুদ্ধে, দপ্তরী তদন্ত করিয়ে তার নামে FIR করতে আক্ষরিক অর্থে কাল ঘাম ছুটে গিয়েছিল। পাক্কা এক সপ্তাহ ধরে আমার লোকজনকে ঘুরিয়ে ছিল থানা, তমলুকের মহকুমা শাসক থেকে পুলিশের বড় সাহেব কাকে না বলেছি - সকলে তৎক্ষণাৎ থানায় ফোন ও করেছেন, কিন্তু দিনের শেষে প্রসব হয়েছে অশ্বডিম্ব। অষ্টম দিনে গিয়ে আইসি সাহেবের বদান্যতায় লক্ষ্য ভেদ করি আমরা। 


লোকটাকে বলি, কোন রাজনৈতিক নেতাকে গিয়ে ধরুন, উনি ফোন করলে নির্ঘাত নিয়ে নেবে। এই নিয়েও হাতে গরম অভিজ্ঞতা আছে আমার। বাঁশবেড়িয়ার শ্রমিক মেলার মাঠে তুচ্ছ রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে ব্যাপক হুজ্জুতি বাঁধিয়েছিল এক পেঁচো মাতাল নেতা। আমার এক ইন্সপেক্টরকে এই মারে তো সেই মারে। অতিরিক্ত জেলা শাসক থেকে থানার বড় বাবু কাকে না ফোন লাগিয়েছি পাগলের মত। ফল হয়েছে ঐ অশ্বডিম্ব। শেষে বাধ্য হয়ে ফোন করেছিলাম তৎকালীন মন্ত্রী তপন দাশগুপ্তকে। ভোজবাজির মত ফোন কাটার পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে আপদটাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল। 


লোকটা তাও যায় না। যে থানার নাম বলছে, সেটা কাঁথি মহকুমার অন্তর্গত, মনোগত ইচ্ছা আমি যদি একটু শৌভিককে বলে দিই, মহকুমা শাসক বললে থানা নির্ঘাত ফেরাবে না। এমন সব আব্দার নিয়ে লোকজন প্রায়ই আসে। শৌভিক তমলুকে থাকতেও আসত, কাঁথি যাবার পরও আসে। অধিকাংশই একটা কাজের দরবার করতে আসে। এই লোকটিও অনেক বার বলেছে, " একটু স্যারকে বলুন না, যে কোন কাজ -। ঝাঁট দেবার কাজ, অফিসে বাথরুম সাফ করার কাজ যা হোক -।" আমি যে শৌভিককে বলিনি তাও নয়। কিন্তু কাউকে কাজ দেখে দেওয়া কি অত সোজা, তাও কাঁথির মত জটিল জায়গায়। লোকটির আবার ডিগ্রি বলতেও কিস্যু নাই। বলে সিক্স পাশ, তারও কোন প্রমাণপত্র নাই। 


প্রশ্ন করি, যে নিখোঁজ হয়েছে সে মেয়ে না ছেলে? লোকটি জবাব দেয়, " আজ্ঞে ম্যাডাম, ছেলে মানে লোক। অন্ধ্রপ্রদেশে কাজে গিয়েছিল আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।" বলি, ওখানে চেনাশোনা কেউ নেই? কোন সহকর্মী বা মালিকের নম্বর নেই? লোকটা মাথা চুলকে বলে, " আজ্ঞে ওখানকার কারো নম্বর তো নেই। গাঁয়ের আর একটা ছেলে গিয়েছিল, সে বছর দুয়েক আগে ফিরে এসেছে। আর যায় নাই। সে ফোন করেছিল, মালিক বলেছে, ' কই ও তো আসে নাই।'" 


সে আবার কি কথা? ওর নম্বরে ফোন করলে কি বলছে? লোকটা মাথা চুলকায়," ফোনটায় ফোন করলে, কিছু হচ্ছে না। মানে কোন শব্দ আসছে না বলতেছে -"। শুধাই, লোকটার সাথে লাস্ট কবে কথা হয়েছিল বাড়ির লোকের? "আজ্ঞে, মাস আটেক আগে"। 


চমকে উঠে শুধাই, মানে? কতদিন ধরে নিখোঁজ? লোকটা জবাব দেয়, " আজ্ঞে আট মাস।" আট মাস ধরে নিখোঁজ! আর বাড়ির লোক আজ গেছে পুলিশে খবর দিতে? লোকটা বলে, " আজ্ঞে। প্রথম দুই আড়াই মাস এরা কিছু ভাবেনি। তারপর যখন সন্দেহ হয়েছে তখন খোঁজখবর করা শুরু করেছে।" কেমন যেন সন্দেহ হয় আমার, বাইরে কাজ করতে গিয়ে একটা লোক আট মাস বাড়িতে ফোন করবে না? অন্য গল্প নেই তো? হয়তো অন্য কারো সাথে ঘর বসিয়েছে অন্য কোথাও। বা হয়তো বউটার এমন কোন সম্পর্ক আছে, তাই মনের দুঃখে গৃহত্যাগী হয়েছে লোকটা। 


লোকটা বিষণ্ন ভাবে মাথা নাড়ে, " ঠিকই কইছেন ম্যাডাম। এসব আজকাল ঘরে ঘরে হচ্ছে। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক তো আমাদের গেরামে জল ভাত। আপনাকে গল্প বলেছিলাম না - প্রতিবাদ করায় আমার তুতো ভাইটাকে বেঘোরে মরতে হয়েছিল।" আমাকে এত মানুষ নিত্য এত গপ্প শোনান, ইনি কোন গল্পের কথা বলছেন বুঝতে পারি না। 


হয়তো আমার মুখ দেখেই ধরে ফেলে লোকটা, " বছর নয় আগের কথা। আমাদের পাশেই ওদের বাড়ি। সম্পর্কে আমার মামা হয়। মামা বাইরে কাজে যেত, মামী আর মামাতো বোনটা বাড়িতেই আসর বসাতো। ভাইটা এত কিছু জানত না। জানার বয়স ও হয়নি। কত আর হবে, বছর আটেকের ছেলে। কি মিষ্টি দেখতে ছিল ম্যাডাম, আপনাকে কি বলব। আমাদের বাড়ি প্রায়ই আসত। ছেলেটা একদিন বোধহয় দিদিকে আর ওই ছেলেটাকে ঘরের মধ্যে অস্বস্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে। ভয় দেখায়, ' বাবাকে বলে দুব।' যেই না বলা অমনি ভাত খাবার পিঁড়ি আছে না ম্যাডাম, ওর দিদি করে কি ওকে ওই পিঁড়ি দিয়ে মাথার পিছনে মারে। মারতেই ও ছিটকে পড়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন দিদি আর ওই ছেলেটা মিলে, চালের বাতার সঙ্গে দড়ি বেঁধে ছেলেটাকে ঝুলিয়ে দেয়।" 


মাগো! আঁতকে উঠি আমি। লোকটা বলে, " হ্যাঁ ম্যাডাম। আমি তো তখন ডিউটিতে। ওর দিদি আমায় ফোন করে বলে, শীঘ্র এসো। ভাই ইলেক্ট্রিকের শক খেয়েছে। আমি কি জানি। আমি বলি, শক খেয়েছে তো আমায় বলছিস কেন? দারুয়ায় ( সরকারী হাসপাতাল) নিয়ে যা। ওদের আর সাহস নেই যে হাসপাতালে আনে। শেষে আমি বলে দিলাম, গাঁয়ের কয়েকজন ছেলেছোকরা ওকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করল। হাসপাতাল কি বোকা! ডাক্তার বাবু দেখেই বুঝেছেন, গড়বড় কেস। বলছে শক খেয়েছে, কিন্তু গলায় দড়ির দাগ, কান পট্টির পিছনে আঘাতের চিহ্ন। উনি দিয়েছেন থানায় খবর পাঠিয়ে।


পুলিশ দেখেই তো সব পালিয়েছে। আমার নম্বর দেওয়া ছিল, পুলিশ আমাকেই ফোন করে ডাকল। আমি যা বলার বললাম, যে আমি অমুক জায়গায় কাজ করছিলাম। সবাই সাক্ষী আছে। আর যা জানা আছে নিশ্চয় বলব, আগে ভাইটার দাহসৎকার করি।" শুধাই ওর মা কিছু বলল না? লোকটা ফোঁৎ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, " মা বলল, মরে গেছে? ওকে কাঁথি তেই দাহ করে এসো। গেরামে আর আনতে হবে না।" 


তীব্র বিবমিষায় ভুগি আমি, অক্ষম রাগে নিশপিশ করে হাত পা। এরা মা? কত নারী, কত দম্পতি হাজার চেয়েও সন্তানের মুখ দেখতে পায় না। আর ঈশ্বর এদের মুড়িমুরকির মত বাচ্ছা দেয়। ছিঃ। প্রশ্ন করি, তারপর কি হল? পুলিশ নিশ্চয় ওর মা আর দিদিকে মারতে মারতে জিপে তুলে নিয়ে গেল? আদালত নির্ঘাত ফাঁসির সাজা দিল? 


লোকটা হাসে। "গেরামে ওসব হয় না ম্যাডাম। গ্রাম অনেক জটিল জায়গা। গ্রামের লোক পুলিশকে আটকে দিল। বললে আমরা দেখে নিচ্ছি। তারপর সভা বসল। ওদের বিচার হল। বিচারে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অনেকটা জমি লিখিয়ে নেওয়া হল গ্রামের নামে।" প্রাণের ক্ষতিপূরণ? হতবাক হয়ে বসে থাকি আমি। লোকটা বলে, " হ্যাঁ। এই নিয়েই তো আমার সাথে গ্রামের ঝামেলা। আমি বলেছিলাম ঐ জমিতে ছেলেটার নামে একটা স্মৃতিসৌধ তৈরি হোক। তা নয়, গ্রাম করল কি একটা শীতলা মন্দির বানালো। খানিকটা জমি বিক্রি করে দেওয়া হল। সেই টাকাটা গ্রামের একাউন্টে রাখা আছে -। এখন বলছে ওই টাকায় একটা লক্ষ্মী মন্দির করবে"।


অনির ডাইরি ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 




দ্রুততম গতিতে প্রস্তুত হই আমি। নেই নেই, সময় নেই। বিকাল সাড়ে পাঁচটা-পৌনে ছটায় লগ্ন। ঘড়িতে ইতিমধ্যেই পাঁচটা বেজে পাঁচ, ধড়াচূড়া পরে প্রস্তুত শৌভিক। রবিবারের এই ভাত ঘুমটাই যত নষ্টের গোড়া। কি যে মরণ ঘুম ধরেছিল আমার, পাশ থেকে কখন উঠে গেছে আমার বর, তৈরি হয়েছে কিচ্ছুটি টের পাইনি আমি। এখন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, "তিন মিনিট সময়, না হলে তোকে ফেলেই চলে যাব।" 


ইল্লি আর কি, আমায় ফেলে চলে যাবেন! পাঁউসির অন্তোদ্যয় অনাথ আশ্রমে আজ বসেছে গণবিবাহের আসর, যখন থেকে শুনেছি সেই আসরে আমন্ত্রিত মাননীয় মহকুমা শাসক, তখন থেকে মনস্থ করেছি, বরের লেজুড় হয়ে আমিও যাব।শৌভিকের তো যাবার কোন চাড়ই ছিল না, সপ্তাহ শেষে একটা নিখাদ ছুটির দিন, ব্যাটা ঘরে বসে ভারত পাকিস্তানের ম্যাচ দেখতে বেশি আগ্রহী ছিল। আমার ঘ্যানঘ্যানানির জন্য যেখানে যেতে রাজি হল, আমাকে ফেলেই সেখানে যেতে উদ্যত হয়েছে, এই না হলে আমার বর। 


দ্রুত হাতে আলমারি ঘাঁটি আমি, হোক গণবিবাহ, তাও তো বিয়ে বাড়ি রে বাবা। যা হোক পরে তো আর যাওয়া যায় না। পাশ থেকে গজগজ করে শৌভিক, "দুস্থ ছেলেমেয়েদের বিয়ে, সেখানে কি তুই বেনারসী পরে যাবি?" বেনারসী নাহোক, জামদানী পরি একটা, দ্রুত হাতে ঠোঁটে ঘষে নিই সবথেকে ক্যাটক্যাটে লাল লিপস্টিক, পাউডার/ফাউন্ডেশন তো কিছু লাগাতে পারলাম না, এতেই একটু জ্বলজ্বল করবে মুখটা। চোখে বুলিয়ে নিই কাজল। আর কিছু লাগাবার সময় নেই। দুটো ঝুটো কানের দুল, একটা মঙ্গলসূত্র, ঘড়ি আর বালাটা হাতে নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। গাড়িতে পরে নেব ক্ষণ। 


বাবা-মা- তুত্তুরী গভীর নিদ্রামগ্ন, শাশুড়ি মাতা জেগেছিলেন, তাঁকেই বলে বেরোই দুজনায়। ঘড়িতে পাঁচটা কুড়ি, পাটে বসেছেন সূর্য দেব। আমাদের গন্তব্য কাঁথি থেকে খুব একটা দূরে নয়, কুড়ি-একুশ কিলোমিটারের মতো হবে। 


দীঘা-নন্দকুমার রোড ধরে সোজা চলতে চলতে, কালীনগরের মোড় থেকে বাম দিকে বেঁকে যাই আমরা। ক্যানেলের পাশ ঘেঁষে সরু পিচের রাস্তা, রাস্তার দুই ধারে ইউক্যালিপটাসের সারি। সেই সারি ভেদ করে যতদূর চোখ যায়, ঘন সবুজ ভেলভেটের মত বিছিয়ে থাকা ধান ক্ষেত। ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যাতেও তাদের রূপে জুড়িয়ে যায় প্রাণ।


 এই পথে আমার খুব বেশি আসা হয়নি, এর আগে একবারই এসেছিলাম ২০২৩ সালের মার্চ মাসে, এই আশ্রমেরই বসন্তোৎসবে। আজও মনে আছে, বাংলায় "অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রম" লেখা বোর্ড টাঙ্গানো বিশাল গেটের ভেতর দিয়ে যখন ঢুকেছিলাম, একনজরে বুঝতে পারিনি, ওটা অনাথ আশ্রম না কোন রিজর্ট! সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা আর যত্নের ছাপ, থোকায় থোকায় ফুটে ছিল কেয়ারি করা মরশুমি ফুলের দল। মনে আছে, একটা শেডের তলায় দাঁড় করানো ছিল, অনেকগুলি ছোট বড় গাড়ি। ড্রাইভার নূপুর বাবু বলেছিলেন, "ওই দেখুন বসন্তোৎসবে কত মানুষ এসেছে। দেশবিদেশ থেকে এনারা প্রচুর অনুদান পান।"


হলুদ গোল গলা গেঞ্জি আর সাদা সুতির পাজামা পরিহিত এক ভদ্রলোক দৌড়ে এসেছিলেন আমাদের স্বাগত জানাতে। এক মাথা অবিন্যস্ত কাঁচা পাকা চুল, খালি পা, মুখে এক গাল হাসি। জেনেছিলাম উনিই বলরাম করণ, এই আশ্রমের প্রাণপুরুষ। বলরাম বাবু সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে, নিয়ে গিয়েছিলেন আশ্রমের ভিতরে। বিশাল এলাকা জুড়ে আশ্রম। বেশ অনেকটা রাস্তা হেঁটেছিলাম আমরা। একদিকে মস্তপুকুর আর অন্যদিকে বড় বড় বিল্ডিং আর বাগান। লক্ষ্য করেছিলাম সবকিছুই বেশ হাইটেক এখানে। কোথাও তাচ্ছিল্য বা অবহেলা বা দীনতার কোন ছাপ নেই। 


সেবার বলরাম বাবুর মুখেই শুনেছিলাম অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রমের গল্প। স্ত্রী আর তিন মেয়ে ময়না-চায়না আর মণিকে সঙ্গী করে একার চেষ্টায় এই আশ্রমটি গড়ে তোলেন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন আবাসিকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সামর্থ ছিল নগন্য। একটি মাত্র ঘর সম্বল। মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র কিনা, তাই জেদ অদম্য। পিছু হটেননি বলরাম বাবু। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, দিয়ে এসেছেন একটি করে মাটির হাঁড়ি। ওণার ভাষায়, মা লক্ষীরভান্ডার। আর অনুরোধ করেছেন বাড়ির মা বউদের, " মাগো, তোমরা যখন তোমাদের ছেলেমেয়ের জন্য ভাত বসাবে, তখন আমার অনাথ শিশু গুলোর কথাও একটু ভেবো। একমুঠো চাল ওদের জন্য ফেলে দিও এই হাঁড়িতে। মাসের শেষে এসে, সেই হাঁড়ির চাল নিয়ে যাব আমি। তাই দিয়েই ভরবে আমার বাচ্ছাগুলোর পেট।" 


এই ভাবেই লড়েছেন কিন্তু পিছু হটেননি। বন্ধ হয়নি আশ্রম। আনন্দবাজার পত্রিকার স্থানীয় প্রতিবেদক শ্রী সুব্রত গুহ, যখন জানতে পারেন বলরামবাবু আর ওনার এই লক্ষ্মীর ভান্ডারের গল্প, তখন উনি এই নিয়ে একটি লম্বা প্রতিবেদন লেখেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায়, ২০০৪ সালে আট কলম জুড়ে ছাপা হয় সেই প্রতিবেদন। তারপরে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি বলরাম বাবুকে। ২০২৩ সালে এই আশ্রমে ৫০ জন বালক এবং ৫০ জন বালিকা থাকত। পাশেই আর একটি আশ্রম গড়ে তুলেছেন বলরাম বাবু। সেখানে থাকত আরো ৬৫ জন মেয়ে ও শিশু।


সেবার আলাপ হয়েছিল আশ্রমের বহু শুভানুধ্যায়ীর সাথে। এনারা যে শুধু যে নগদ অর্থে সাহায্য করেছেন বা করে চলেছেন তাই নয়, এমনও মানুষের সাথেও আলাপ হয়, যিনি ছেড়ে দিয়েছেন কলকাতায় তাঁর ব্যক্তিগত দোতলা বাড়ি। সেখানে খোলা হয়েছে আশ্রমের একটি টেম্পোরারি অফিস। আশ্রমের কোন শিশু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ওখানে রেখে ডাক্তার দেখানো হয়। যে সমস্ত আবাসিক বালক বা বালিকা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে, তারা ওখানে থেকেই পড়াশোনা করে। শুনেছিলাম তখন নার্সিং পড়ছিল বেশ কয়েকজন মেয়ে। শুনেছিলাম অনাথ আশ্রম চালানো ছাড়াও আরো অনেক কিছু করেন ওনারা। বিনামূল্যে ছানি অপারেশন শিবির করেন, গণবিবাহ দেন, ইত্যাদি প্রভৃতি। তেমনি এক গণবিবাহে আজ শৌভিক আমন্ত্রিত, আর আমি তার প্লাস ওয়ান বলতে পারেন। 


গন্তব্যে পৌঁছে যাই আমরা, আবার সেই বাংলায় বোর্ড লেখা বিশাল লোহার গেট। আজ সেই গেটের ওপর জ্বলজ্বল করছে হ্যালোজেন আলো। অগুনতি ফুলের মালা দিয়ে নববধূর মত সাজানো হয়েছে তাকে। গেট থেকে এঁকেবেঁকে ভিতরে যাওয়ার রাস্তায় গাড়ি প্রবেশ করার সাথেই জ্বলে উঠল শয়ে শয়ে আলো। যেন আমাদেরই প্রতীক্ষায় ঘুমিয়ে ছিল তারা। দৌড়ে এলেন বলরাম বাবু, আজ তাঁর পরণে বুনিয়াদি পাজামা পাঞ্জাবি। 


বিগত বারের মতই বলরাম বাবুকে অনুসরণ করে অনেকটা পথ হাঁটলাম আমরা। আপাত শান্ত আশ্রম আজ গমগম করছে সুবেশ নারী পুরুষের সমাগমে, বরযাত্রী এবং কনেযাত্রীর দল। পরণে তাদের সবথেকে নতুন, সবথেকে মূল্যবান পোশাক খানা। আহা আজ বিয়ে বাড়ি যে! রাস্তার বাঁকে মাথায় প্রদীপ নিয়ে নাচছে আদিবাসী রমণীর দল, মাইকে ভেসে আসছে বেদমন্ত্র। আশ্রমের টিনের শেড খানি আজ ভোল বদলে হয়েছে বিবাহমণ্ডপ। চতুর্দিকে রোশনাই, একই সাথে বিয়ে হচ্ছে এগারো জন কন্যার। যাদের মধ্যে তিনজন আশ্রমবালা, বাকিরা আশেপাশের গ্রামের মেয়ে। 


বলরামবাবু বলতে থাকেন," জানেন স্যার, বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে রীতিমত প্রচার করি আমরা। আশেপাশে যত গাঁ আছে, আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাই, তোমরা গরীব তো কি? নাবালিকা মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিবে? মেয়েটাকে বড় হতে দিবেনি? লেখাপড়া শিখতে দিবেনি? ওকে পড়তে দাও, সময় হলে আমি দুব ওর বিয়ে।" শৌভিক জিজ্ঞাসা করে, আজ যাদের বিয়ে হচ্ছে, তাদের বয়স কত। বলরাম বাবু জবাব দেন, ১৯ থেকে ২৪। শৌভিক আবার প্রশ্ন করে, ছেলেগুলো কি সব স্থানীয়? বলরাম বাবু জানান, অধিকাংশই পূব মেদিনীপুরের বাসিন্দা। জনা দুয়েক বাঁকুড়ার ছেলেও আছে। 


গোটা শেডটাকে আজ মুড়ে দেওয়া হয়েছে রংবেরঙের কাপড়, ফুলে আর রোশনাইয়ে। বানানো হয়েছে এগারোটা সুসজ্জিত মণ্ডপ। প্রতিটা মণ্ডপে রাখা আছে স্টিলের খাট, খাটের ওপর নতুন ম্যাট্রেস, নতুন সাইকেল, দানের বাসন আরও কত কি। প্রায় প্রতিটি খাটের ওপর বসে আছে টুকটুকে লাল বেনারসী পরা সুন্দরী কনের দল। সাধ্যমত গহনা পরেছে সকলেই, মাথায় লাল চেলী, চেলীর ওপর শোলার মুকুট, কপালে-কপোলে শ্বেত চন্দনের কল্কা। বরবাবাজীরা আসনপিঁড়ি নিয়ে বসেছে মাটিতে। মুখোমুখি বসেছেন পুরুত ঠাকুর, চলছে শুভ পরিণয়ের বিভিন্ন আচার। যাঁরা কন্যা সম্প্রদান করবেন,তাঁরাও বসেছেন পুরুত ঠাকুরের পাশে। 


খানিকক্ষণ বসে বসে বিয়ে দেখলাম আমরা। অতঃপর বলরাম বাবু ডেকে নিয়ে গেলেন বাইরে। খোলা মাঠে মঞ্চ বেঁধে চলছে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রচুর জন সমাগমে পরিপূর্ণ মাঠখানি। এক পাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জনা চার পাঁচ ফুচকাওয়ালা। তাদের ঘিরে ভিড় জমিয়েছেন বিভিন্ন বয়সী রমণীরা।আছে চা, কফি, লস্যি। মেয়েদের বিয়ের আয়োজনে কোন ত্রুটি রাখেননি বলরাম বাবু। 


সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান স্থগিত রেখে মঞ্চে তোলা হল আমাদের। লাল-গোলাপী বেনারসী পরিহিত দুই পল্লীবালা এসে চন্দনের টিকা, উত্তরীয় আর পুষ্প স্তবক দিয়ে বরণ করে নিল আমাদের। বরণ করা হল উপস্থিত অন্যান্য মান্যগণ্য অতিথিদের, যাঁদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক সুব্রত বাবুও। সেই সুব্রত গুহ, আনন্দবাজারে যাঁর লেখা প্রতিবেদন রাতারাতি বদলে দেয় পাঁউসির অন্তোদ্যয় অনাথ আশ্রমের ভবিষ্যৎ। সম্প্রতি তিনি একটি বইও লিখেছেন, বলরাম বাবু এবং এই আশ্রমকে নিয়ে। হয় সংক্ষিপ্ত বার্তা বিনিময়, ছোট্ট করে বক্তব্য রাখে আমার বরও, এবার ঘরে ফেরার পালা। ছুটে আসেন বলরাম বাবু, "স্যার না খেয়ে তো যেতে দিব না। রান্না প্রায় শেষ, দুটি খেয়ে যান।মেয়েগুলোর কল্যাণ হবে।" 


নবদম্পতিদের প্রতি একরাশ আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে করজোড়ে মাপ চেয়ে বেরিয়ে আসি আমরা, বাড়িতে তিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর একটা ঘণ্টু যে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আসার সময় একটা বাক্স হাতে তুলে দেন বলরাম বাবু, "স্যার এটা কিন্তু নিতেই হবে, আমার আশ্রমের ছেলেদের হাতে বানানো-"। দুহাত পেতে ওনার উপহার আর একরাশ ভিন্ন স্বাদের ভালোলাগা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি আমরা, বাড়ি ফিরে জানতে পারি, ম্যাচটা ইন্ডিয়াই জিতেছে।


অনির ডাইরি ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, কার যেন উত্তেজিত কথাবার্তায় চমকে উঠে বসলাম। ঘাড়টা ব্যথা হয়ে গেছে, সোফার ওপর এক পা মুড়ে, রেলিংয়ে মাথা রেখে ঘুমানোর ফল। হাঁটুটাও টনটন করছে। 

সেই হাসপাতাল, সেই ছোট্ট অফিস ঘর, সেই শৌভিক আর আমি। ভোর পাঁচটায় উঠেছি আমরা, তারপর এক কাপ কালো কফি খেয়ে, শ্রীমতী তুত্তুরীকে ঘুম থেকে টেনে তুলে, ভালো করে পরীক্ষা দেবার সদুপদেশ দিয়ে ছটা নাগাদ বেরিয়েছি কাঁথি থেকে। সাতটা থেকে তাঁর কম্পিউটার সায়েন্সের পরীক্ষা, সাতটা থেকে শাশুড়ি মায়ের অস্ত্রোপচার। কিছু দিন আগে যে পায়ে অপারেশন হয়েছিল, আবার সেই পায়েই ছুরি কাঁচি চালাচ্ছেন ডাক্তার বাবু।


কপালের নাম গোপাল একেই বলে। ওনার বয়সের কথা ভেবেই, আগের বার ছোট করে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ডাক্তার বাবু। বল সকেট না পাল্টে, স্ক্রু দিয়ে জুড়ে দিয়েছিলেন হাড় খানা। বলেছিলেন শতকরা ৯০-৯২ ভাগ কেসে এতেই জুড়ে যায় হাড়। আমরা পড়ে গেছি বাকি ৮-১০ শতাংশে।


পকেটে হাত ঢুকিয়ে কোণাকুণি উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে সিসিটিভি মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে শৌভিক। খোঁজার চেষ্টা করছে শাশুড়ি মাকে কোন ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে কি না। আমরা যখন এসেছিলাম জনবিরল ছিল হাসপাতালটা, ক্রমে বাড়ছে জনকাকলি। আমাকে জেগে উঠতে দেখে আমার পাশে এসে বসে শৌভিক, বলে, " আরো খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারিস। বড় ডাক্তার বাবু এখনও এসে পৌঁছায়নি।" বড় ডাক্তার বাবুটি কোন মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। গেল বার শাশুড়ি মাতার অপারেশন করেছিলেন যে ডাক্তার, তাঁর মাস্টারমশাই। 


আমরা ব্যাপারটা কপালের ফের বলেই মেনে নিয়েছি, কিন্তু গেল বারের অপারেশন বিফল হওয়ায়, ডাক্তার বাবু থেকে হাসপাতালের সকলে অত্যন্ত সংকুচিত। ডাক্তার বাবু তো বলেই ফেললেন, " বিশ্বাস করুন স্যার, আমি দু রাত ঘুমাতে পারিনি। আমার বউও আমায় খুব বকছে -"। সেই দুরাত না ঘুমানো ডাক্তারই আপাতত ছুরি চালাচ্ছেন শাশুড়ি মায়ের পায়ে, পুরাণ ইমপ্ল্যান্টটা খোলার কাজ চলছে। 


বসে বসে কি যেন সব আবোলতাবোল বকি আমরা, পরিকল্পনা করি, যেদিন "ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে,"সেদিন কোথায় কোথায় ঘুরতে যাব আমরা। একটি ছেলে এসে খবর দিয়ে যায়, বড় ডাক্তার বাবু এসে গেছেন, নতুন ইমপ্ল্যান্ট বসানোর কাজ এবার শুরু হবে। জানতে চায়, চা খাব কি না। দুজনে একসাথে মাথা নাড়ি, আমরা ইতিমধ্যেই বড় জ্বালাচ্ছি এদের, আর নয়। দরজা বন্ধ হতেই দৌড়ে সিসিটিভি মনিটরের কাছে গিয়ে বড় ডাক্তার বাবুর গাড়িটা খোঁজে শৌভিক। ছেলেদের গাড়ি নিয়ে যে কেন এত উৎসাহ, আজও বুঝলাম না।  


আবার আমার পাশে এসে বসে শৌভিক, কিছু ক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি দুজনে, অস্ত্রোপচার শেষ হতে বেলা নটা সাড়ে নটা বাজবে। অক্সিজেনের কি হঠাৎ অভাব দেখা দিল? নিঃশ্বাস নিতে এত কষ্ট হয় কেন? প্যানিক অ্যাটাক হল নাকি? শৌভিক এমনিতেই এত চাপে আছে, আমার জন্য আর বিব্রত করতে চাই না। উঠে পড়ি সোফা থেকে, জিজ্ঞাসু শৌভিককে ইশারায় বলি, একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি - 


ভোরের কুয়াশা কাটিয়ে পূব আকাশে জ্বলজ্বল করছে কমলা সোনালী সূয্যি মামা। তাঁর প্রকাশে যেন ঝলমলিয়ে উঠছে ধরা। বাতাসে এখনও রয়েছে সামান্য শৈত্য - বুক ভরে নিই তাজা বাতাস। " চাইলে এখানেও থাকতে পারিস-" বলে শৌভিক, উঠে এসেছে আমার পিছু পিছু। বলি, চল চা খেয়ে আসি। হাইরোডের ধারে ঘুপচি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাই দুজনে, এক ভাঁড় উত্তপ্ত দুধ চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। বিস্কুটে কামড় মারার সাথে সাথেই জিভে জড়িয়ে যায় বনস্পতি। পায়ের কাছে ন্যাজ নাড়ানো ভুলুটাকে খানিক ভেঙে দিলাম। সেও দেখি মুখ ঘুরিয়ে নিল। 


রাস্তার উল্টো দিকে অজানা মহীরুহদের সারির ফাঁকফোকর গলে যতদূর দুচোখ যায় কেবল সবুজ আর সবুজ। সদ্য বপন করা হয়েছে কচি ধান গাছের চারা। গাছের ডালে ডালে আসর জমিয়েছে ফিঙে,শালিক, ছাতারে, বেনে বউ আর বুলবুলিদের গুষ্টি। মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে পরিযায়ী হাঁসের দল। রাস্তা দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটছে বাস, লরি, চারচাকা, বাইক এমন কি সাইকেল ও। কারো সময় নেই, কেউ দুই দণ্ড থমকে দাঁড়াচ্ছে না, তাকিয়ে দেখছে না, কি অনুপম রূপের ডালি নিয়ে হাজির হয়েছে প্রকৃতি। ব্যতিক্রম আমরা, প্রতিটা রোমকূপে ভরে নিই প্রকৃতির দান। "কাছাকাছি কোন জলাশয় আছে মনে হয় -"আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে শৌভিক। "নাহলে এত পরিযায়ী পাখি আসত না।" 


চা শেষ হয়ে যায়, তাও নড়ি না আমরা। মাধ্যমিক পরীক্ষা সংক্রান্ত কি কারণে যেন ফোন করে কেউ। ফোনটা রাখার পর মাধ্যমিক নিয়েই আলোচনা করতে থাকি আমরা। তার মাধ্যমিক, আমার মাধ্যমিক। সম্ভবতঃ ১ লা মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের মাধ্যমিক। তার অব্যবহিত পূর্বে, সম্ভবত ১২ই ফেব্রুয়ারি নিউমোনিয়া ঘটিত জ্বর আর তীব্র শ্বাসকষ্টের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় বাবাকে। মাসিরা, দাদারা, দিদিভাই, জামাইবাবু, তাঁর দাদা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে না পড়লে বাবাকে ফিরিয়ে আনতে পারতাম না সেবার। 


শুধু কি তাই, মঙ্গল না বুধবার থেকে পরীক্ষা শুরু, শনিবার থেকে কানের যন্ত্রণায় পাগল পাগল আমি। সারা রাত জেগে সেঁক দিচ্ছি কানে, কমে আর না। বাবা তখনও পুরো সুস্থ নয়, তাও সারা রাত জেগেছিল আমার জন্য। আমার কষ্ট দেখে পরদিন বড়দা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। কার মাসতুতো দাদা এত করে রে, বলতে বলতে ছলছলিয়ে ওঠে আমার চোখ। 


শৌভিক হাসি চেপে বলে, "আর আমি কি করেছিলাম জানিস না তো? অ্যাডমিট কার্ড ফেলেই একদিন চলে গিয়েছিলাম পরীক্ষা দিতে।" বাপরে, বলে লাফিয়ে উঠি আমি। জানতে চাই, তারপর? শৌভিক বলে, "তারপর আর কি? আমি তো একাই যেতাম পরীক্ষা দিতে, হলে ঢোকার আগে সব মিলিয়ে নিতে গিয়ে দেখি কার্ডটা নেই। নম্বরটা মুখস্থ ছিল। গার্ড দেবে যে স্যার, তাঁকে বললাম -। তিনি বললেন, 'কাউকে বলো, বাড়ি থেকে এসে দিয়ে যাবে -।' বললাম, আমার বাড়িতে এমন কেউ নেই, যে দিয়ে যেতে পারে। বাবা অফিসে, ভাই খুব ছোট, আমার টেন মানে ও থ্রি/ফোর এ পড়ে। মা ওকে ফেলে তো আসতে পারবে না। আর সল্টলেক মা অত ভালো চিনতও না। সব শুনে, আমার এক বন্ধুর দাদা বলল, 'তোমার বাড়িটা কোথায় বলো, আমি গিয়ে এনে দিচ্ছি।'" 

ভালো মানুষের বোধহয় কোনদিনই আকাল পড়ে না, বলি আমি। শৌভিক হেসে বলে, " হ্যাঁ, কিন্তু মা তাকে দেয়নি। আমরা তখন বিধান আবাসনে থাকতাম, ভাইকে নিয়ে নাকি বাড়িতে একা রেখে আজ আর মনে নেই, কিন্তু মা এসেছিল, অ্যাডমিট কার্ডটা নিয়ে -" বলতে বলতে বোকার মত হাসে শৌভিক। " ততক্ষণে অবশ্য এক ঘন্টা পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মা এসেছিল -"। 


আশেপাশের লোকজন, ছুটন্ত গাড়ি, লেজ নাড়া ভুলু, পাখিদের ঝাঁককে অগ্রাহ্য করে নিজের বরকে জড়িয়ে ধরি আমি। এটা বুঝি ভ্যালেন্টাইন উইক, আকাশে, বাতাসে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মাখামাখি ভালোবাসার রং, তাজ্জব লাগে, জীবনের প্রতিটা দশক ভেদে কত পাল্টে যায় ভালোবাসার সংজ্ঞা। লম্বা লম্বা টেলিফোন, সাংকেতিক বার্তা চালাচালি, সপ্তাহান্তে দেখা, হাতে হাত রেখে ভালোবাসার মিছিলে সামিল হওয়া, ফুল, চকলেট, সুগন্ধী, লং ড্রাইভ, মোমবাতির আলোয় নৈশভোজ সবকিছু কি বালখিল্য লাগে আজকাল। কত এগিয়ে গেছি আমরা। আজকাল প্রেম হয় ওষুধের নাম আর UPI এর স্ক্রীনশটে, আজকাল আব্দার হয় এডাল্ট ডায়াপার, বেড প্যান, লাঠি আর হুইলচেয়ার কেনার। আজকাল দুজনে একসাথে ভাবি, কিছুই তো খায় না বুড়োবুড়ি গুলো, কিভাবে মেটাই ওদের প্রোটিনের চাহিদা। আপাতত বাবামায়েদের জন্য ভাবি, জানি কিছুবছর বাদে নিজেদের জন্যও এগুলোই ভাবতে হবে। এই প্রবাহমানতাই তো জীবন। এই প্রবাহমানতা, এই ছুটে চলার মধ্যেই বেঁচে থাকুক ভালোবাসা, যত খুশি রূপান্তরিত হোক, শুধু হারিয়ে না যায়। সত্যি করে বলুন তো " ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি -"

অনির সরস্বতী পুজোর ডাইরি, ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


কাক ডাকা ভোরে উঠে শ্যাম্পু করা, কোঁকড়া চুলকে বশে আনা যে কি কঠিন কাজ! দুই বার করে কন্ডিশনার লাগাতে হয়, যার একটা ধুতে হয় অন্যটা নয়। তারপর আবার বিশেষ ব্রাশ দিয়ে আঁচড়ানো তবে না স্প্রিং এর মত পাকিয়ে থাকবে ব্যাটারা। 


আমার সাজ আপাতত এই টুকুই, এবার নিদ্রিত কন্যাকে ঠেলে তোলার পালা। গত ২৬ শে জানুয়ারি অপরাহ্ন থেকে হাসপাতাল নিবাসী আমার বাবা, এখনও নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারছেন না শাশুড়ি মাতা, বাড়ির অবস্থা লণ্ডভণ্ড। পুজো যে আদৌ হবে সেটাই ঠিক হয়েছে মাত্র ২৪ থেকে ২৬ ঘণ্টা আগে। ঈশ্বর মঙ্গল করুন, শৌভিকের নাজির বাবু, CA সাহেব এবং অন্যান্য সহকর্মীদের, কি অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে যে সব আয়োজন করেছে ওরা। যেন ওনাদের বাড়ির পুজো। 


গত শনিবার থেকে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে মেয়েটার। বাড়ির এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে সবথেকে অবহেলিত বোধহয় আমার মেয়েটাই। মূলতঃ তাঁরই জন্য পুজোয় সম্মতি দিয়েছেন মহকুমা শাসক মহোদয়। বছরে তো একটা দিনই শাড়ি পরে তুত্তুরী, তাও এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি আমি, কি শাড়ি পরবে মেয়েটা। 

এখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে শৌভিক। অন্তত ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। সদ্যোত্থিত মেয়েকে বাপের পাশে বসিয়ে একটার পর একটা শাড়ি বার করি আমি, এটা পরবি? নাকি এটা? শেষ পর্যন্ত দুটো শাড়ি পছন্দ করেন শ্রীমতী তুত্তুরী, ফাইনাল ডিসিশন নাকি নেবেন তাঁর বাপ। তাই না বটে, সব করলাম আমি, আর মেয়ে কোন শাড়ি পরবে সেটা ফাইনাল করবে বাবা। মেয়ে গুলো জাত বেইমান হয় মাইরি। 

শেষ পর্যন্ত আমার ফুলশয্যার তত্ত্বে পাঠানো লাল পাড় টিয়াপাখি সবুজ কাঞ্জিভরম টাকেই বেশি পছন্দ হয় বাবার। মেয়েকে শাড়ি পরিয়ে, সাজিয়ে গুছিয়ে হাসপাতাল ছুটি আমি। একবার দেখে আসি আমার বাপ টাকে অন্তত। যত সুস্থ হয়ে উঠছে, ততো অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন তিনি। পারলে আমার সাথেই বেরিয়ে পড়ে হাসপাতাল থেকে। তাঁকে বাবা বাছা বলে, বুঝিয়ে শুনিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম, ছুটে এল তুত্তুরী, " মা, মা ঠাম্মা আমায় বারবার তুমি ভাবছে। বার বার ডাকছে অনিন্দিতা, অনিন্দিতা করে। বলছে, ' অনিন্দিতা তুমি হাসপাতাল যাবে না? বলছে অনিন্দিতা তুমি সিঁদুর পরনি?' বললাম, আমি অনিন্দিতা নই, আমি অনিন্দিতার ছানা। তো বলল, ওমা, তোমায় তো একেবারে অনিন্দিতার মত লাগছে -"।


অনির ডাইরি ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


বই মেলায় যাব না, এটাই ঠিক ছিল। ওনারা ডাকাডাকি করছিলেন বেশ অনেক দিন ধরেই, এই নিয়ে ষষ্ঠ সংখ্যা প্রকাশিত হতে চলেছে। ইতিপূর্বে পাঁচটি সংখ্যায় স্থান পেয়েছিল আমার লেখা। এবারেও ঠাঁই নাড়া হয়নি এই অধম। এই সাহিত্যপ্রেমী মানুষগুলো,এই ভিন্নধারার লেখালিখি, এই লিটল ম্যাগাজিনগুলোই তো আজও বাঁচিয়ে রেখেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি মণীষাকে। যেতে তো ইচ্ছে করে, কিন্তু বড্ড দূর যে। গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে, এক পিঠ যেতেই লাগবে ঘণ্টা চারেক। বাপরে - 


হঠাৎ একদিন ঘোষণা হল, প্রকাশিতব্য লেখাগুলিকে নিয়ে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা হয়েছিল। যাতে আমার লেখাটি প্রথম হয়েছে। পুরস্কার দেবেন গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার, পুরস্কারের নাম ওনার অকালপ্রয়াত স্ত্রীর নামে। আমি জানতাম ভদ্রলোকের দুই কন্যা, যখনই কিছু লিখতেন,লেখায় উল্লেখ থাকত" বড় কইন্যা" আর "ছোট কইন্যা"র। দুর্ঘটনা ঘটে যাবার দিন গ্রুপের এক স্নেহময়ী দিদি জানালেন, "নারে, ওর একটাই মেয়ে। বউকে আদর করে বড় কইন্যা বলত।" সেই বড়কইন্যার স্মৃতিভরা প্রথম পুরস্কার, আমার কাছে তা অমূল্য। হাত পেতে না নিতে পারলে শান্ত হবে কি এ হৃদয় - 


যাব যে, কিন্তু যাব কি করে? জীবন যে আপাতত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে আমাদের। এদিকে সদ্য অস্ত্রোপচার হয়ে বাড়ি ফেরা শাশুড়ি, অন্যদিকে আইসিইউতে থাকা বাবা। এদিকে ঐ দিনই শুরু হচ্ছে শ্রীমতী তুত্তুরীর বার্ষিক পরীক্ষা (তাও আবার অঙ্ক) ওদিকে ঐদিনই শেষ হচ্ছে দুয়ারে সরকার। সবার উপরে সরস্বতী পুজো, কি ভাবে সামলাই এত কিছু? 


মাথার মধ্যে ঘোরে নিরন্তর হিসাবনিকাশ। যদি সব ঠিক থাকে, যদি সবকিছু সামলে যেতে পারি, খুঁজে পাব কি? যা ট্যালা হয়ে গেছি আমি। অনেক ভেবে শেষে এক প্রাক্তণ সহপাঠিনীকে মুঠো ফোনে ধরি, গুগল ম্যাপ ধরে মেলাপ্রাঙ্গনে তো পৌঁছে যাব, বাকি পথটুকু তুই একটু নিয়ে যাবি ভাই? একজন পথপ্রদর্শক না থাকলে নির্ঘাত হারিয়ে যাব আমি। 


পরিস্থিতি কিছুতেই আর সামলে ওঠে না যেন, শাশুড়ি মাতার পা উন্নতির বদলে আরো বিগড়ে যায় যেন। ওদিকে বাড়ি ফিরে আসার জন্য পাগল হয়ে ওঠে বাবা। রেগে গিয়ে খুলে ফেলে অক্সিজেন মাস্ক, টলতে টলতে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। 


পরীক্ষা শেষে গালফোলা শ্রীমতী তুত্তুরীকে বাড়ি ফিরিয়ে এনে, হাসপাতালে গিয়ে বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করে, শাশুড়ি মাতাকে জলদি ফিরে আসার আশ্বাস দিয়ে বেরোতে গিয়ে দেখি ধড়াচূড়া পরে রেডি আমার বর। ভেবেছিলাম দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প দেখতে যাচ্ছেন বুঝি, জবাব পেলাম, " নাহ্ ডিএম সাহেবের থেকে অনুমতি পেয়ে গেছি। তাছাড়া অনেকদিন বইমেলাতে যাওয়াও হয়নি -"। ফুসফুসে যেন পলকে ভরে যায় একরাশ তাজা অক্সিজেন। আজ হারিয়ে যাব না অন্তত।  


নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পনেরো আগেই পৌঁছে যাই আমরা। তিন সাড়ে তিন বছরে কত বদলে গেছে শহরটা। আগেও কি এত মানুষ আসতেন বইমেলায়, নাকি স্মৃতির ওপর জমেছে ধূলিকণার আস্তরণ? হাতে হাত রেখে, হতবাক দৃষ্টিতে মেলাপ্রাঙ্গণ পরিক্রমা করতে করতে নিজেদেরই যেন খুঁজি আমরা। বিভিন্ন বয়সের অনি, বিভিন্ন বয়সী শৌভিক। কোথায় তারা - 


ভাগ্যে শৌভিক সঙ্গে এসেছিল, যে বন্ধুর ভরসায় এসেছিলাম, অনুপস্থিত সেই। মুঠোফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে সুন্দরী বান্ধবীর দীর্ঘশ্বাস, "কথা রাখতে পারলাম না অনি রে -"। কি করে কথা রাখবে, প্রিয়জনকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়তে হয়েছিল যে। সমবয়সীদের সমস্যাগুলোও যে সমপর্যায়ের। 

সবথেকে ব্যস্তবন্ধুটি কিন্তু ঠিক খুঁজে বার করে আমাদের, শৌভিকের কান বাঁচিয়ে দেয় একরাশ চোখাচোখা গাল। " অন্তত দশবার ফোন করেছি তোকে, ফোনটা রেখেছিস কেন? ওই দেখ আঁস্তাকুড়, ফেলে দিয়ে আয় এখুনি -"। আমারই ডায়লগ আমাকেই ঘুরিয়ে দেয় চৈতালী।


বই দেখা,বই কেনার পাশাপাশি প্রকাশ পায় আমাদের বই, পুরস্কার হাতে তুলে দেন জনৈকা সুন্দরী সদস্যা। দেখা হয় একরাশ চেনাঅচেনা মুখের সাথে। হয় অনেক গল্প, স্বল্প অবসরে ছোট কইন্যাকে বেশ খানিকটা আদর করে নিই আমি। কি সুন্দর যে দেখতে মেয়েটাকে। এবার ঘরে ফেলার পালা। বেলা ঢলে পড়ার সাথে সাথেই পিলপিল করে লোক ঢুকছে মেলায়, আর বেশীক্ষণ থাকলে সত্যিই হারিয়ে যাব আমরা। 


একরাশ মহানাগরিক জাঙ্ক ফুড খাবার প্ল্যান থাকলেও শেষমেষ আর খাওয়া হয় না কিছুই। খাবার স্টলগুলিতেও মাছির মত ভনভন করছিল পুস্তিকপ্রেমীদের ভিড়। শাশুড়ি মায়ের জন্য কেনা প্রোটিন বিস্কুট গোটা তিনেক সঙ্গে নিতে বলেছিল শৌভিক, কিন্তু শেষ মুহূর্তে বরকে আমার ছায়াসঙ্গী হতে দেখে খুশির চোটে সেটা পুরো ভুলে গেছি আমি। অগত্যা নন্দকুমার মোড়ে থেমে চা আর লেড়ো বিস্কুট দিয়ে টিফিন সারি আমরা। 


ঘনায়মান সন্ধ্যা ক্রমে রাতে পর্যবসিত হয়, আরেকবার মুঠো ফোনে বিতর্কে জড়াই সঞ্চিতা আর আমি। ইতিপূর্বে ৫৭৪২ বার পাঠানো বার্তা নতুন করে পাঠায় সঞ্চিতা, "তোকে আর আমি ফোন করব না কোনদিন। ভালো থাকিস - আর আমি বাঁচি-মরি যাই হোক না কেন, তুইও আমার আর কোন খবর নিবি না।" এরপর মান ভাঙাতে আমার ফোন করাটাই দস্তুর। উভয়ের সোহাগী বার্তালাপে ঘুম ভাঙা শৌভিক বিড়বিড় করে, "তুই আর তোর বন্ধুরা -"। 


 পুরস্কার প্রদানকারী ভদ্রলোক মেসেজ করে জানতে চান, " উপহার পছন্দ হয়েছে কি ম্যাডাম?" পুরস্কারের সাথে পাওয়া উপহারটির কথা তো এতক্ষণে ভূলেই বসেছিলাম। মেসেজ পেয়ে, হ্যাংলার মত মোড়কটি খুলে দেখি, গাড়ির জানালা গলে ঢুকে আসা আলোয় জ্বলজ্বল করছে "বাঙালনামা"। সেই দেখে আমার বাঙাল বরের কি খুশি। 


পথ যেন আর ফুরায় না। শ্রীমতী তুত্তুরী ফোন করে জানান, "তোমরা কতদূরে? চিন্তা করো না, ঠাম্মাকে নৈমিত্তিক ইঞ্জেকশন আমি দিয়ে দিয়েছি। সব সাব্জেক্ট ও পড়ে ফেলেছি -।" অর্ধেকটা বিশ্বাস করি, বাকি অর্ধেকটা অর্থাৎ পড়াশোনার অংশটা ভূতেও বিশ্বাস করবে না। যাক গে, বাদশা খানের ভাষায়, হয়তো চলচ্চিত্র এখনও অসমাপ্ত, তবুও এইভাবেই যায় যদি দিন, যাক না।



Monday, 6 January 2025

অনির ডাইরি জানুয়ারি, ২০২৫

 অনির ডাইরি ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



কোথা দিয়ে যে কেটে গেল দিনটা, সারা দিন শুধু ভিসি আর ভিসি। মোটামুটি ৩৬ ঘণ্টা পরই শুরু হতে চলেছে দুয়ারে সরকার। এটা নিয়ে এই জেলায় আমার সপ্তম দুয়ারে সরকার, সবাই মোটামুটি অভিজ্ঞ হয়ে গেছি আমরা। তবুও - কিছু প্রস্তুতি তো লাগেই। লাগে কিছু ভোকাল টনিক - কিছু ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন। 


 অফিস থেকে যখন বেরোলাম প্রগাঢ় হয়েছে সাঁঝ, আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, তারপরই চিরতরে বিদায় জানাব এই বয়সটাকে। কয়েক বছর আগেও বয়স লুকানোর তীব্র প্রবণতা ছিল, ইদানিং নিজের বয়স নিয়ে গর্ব হয়। গর্ব হয় প্রতিটা পাকা চুল, চোখের নীচের প্রতিটা বলিরেখা, প্রতিটা গোঁফদাড়ি,প্রতিটা স্ট্রেচ মার্কের জন্য। ওটাই তো আসল আমি, ওরাই তো আমার জীবনের যাবতীয় চড়াই উৎরাইয়ের নীরব সাক্ষী, আমার সুসময়-অসময়ের সাথী। 


কাঁথি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে সাতটা বেজে গেল। অন্যান্য দিন এই সময় পড়তে বসে যান শ্রীমতী তুত্তুরী। মানে বই খুলে বসে থাকেন আর কি, আজ দেখলাম বাইরের ঘর শুনশান। গতকাল বাবা মাকে নিয়ে এসেছি হাওড়া থেকে, নির্ঘাত পড়াশোনা ডকে তুলে ওদের সাথে গুলগপ্প জুড়েছে তুত্তুরী। কে বলবে পাক্কা এক সপ্তাহ পরই শুরু হতে চলেছে তাঁর বার্ষিক পরীক্ষা। মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে দেখি দাদুদিদার ঘরের দরজা বন্ধ, ভিতরে কি সব যেন করছেন তুত্তুরী, দরজা খুলতে বলেও কোন লাভ হল না। 


"আমি দশটা সাবজেক্ট পড়ে রেখেছি মা। আজ প্লিজ আর পড়তে বলো না।" স্কুল করে ফিরে, স্নানাহার, দিবানিদ্রা সেরেও কখন তিনি দশটা সাবজেক্ট পড়ে ফেললেন এই প্রশ্ন করে দয়া করে লজ্জা দেবেন না। এর উত্তর আজও আমার কাছে অধরা। কফি খেতে খেতে ষড়যন্ত্রের সুরে শৌভিক বলল, " কাল তোর জন্মদিন বলে ও কি সব যেন করছে -"। কি সব করবেন, এই ভয় তিনি বিগত এক মাস ধরেই দেখিয়ে আসছেন। তাঁর সম্বল বলতে সাকুল্যে ৬৭৬ টাকা, যেটা তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুরুজনের কাছ থেকে আশীর্বাদ স্বরূপ পেয়েছেন। তাই নিয়েই তাঁর ফুটানি দেখে কে? আম্বানিরাও লজ্জা পাবেন। 


রাত গড়ায়, শৌভিকের ওপর দায়িত্ব পড়ে আমায় ঘরে আটকে রাখার। দেখতে দেখতে মহকুমা শাসকের নিবাসে রাতের রান্না করে যে ছেলেটি, শাশুড়ি মাতার আয়া দিদি এবং তুত্তুরীর মাসি সকলে লিপ্ত হয় ষড়যন্ত্রে। ঘরের মধ্যে থেকেও বুঝতে পারি বিপুল কিছু একটা গণ্ডগোল চলছে বাইরে। সবকিছু ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে তুত্তুরীর চিৎকার। শৌভিকের অমনোযোগীতার সুযোগে একবার টুক করে বেরিয়েও যাই আমি, আমাকে দেখেই মুখের ওপর ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয় লতা দি। " কিছু মনে করো না বোনি, সোনা মায়ের হুকুম -"। এই বাড়িতে তো আমার কোন মান সম্মানই নেই দেখছি ধুৎ। 


" কাল তাহলে তোর জন্মদিনের প্ল্যানটা কি?" গাঁট্টা মেরে ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে শৌভিক। রাগে গা যেন জ্বলে যায়। হ্যাঁ রে, তোদের জন্মদিন এলে এমন বেখাপ্পা প্রশ্ন শুধাই আমি? কত আগে থেকে ভেবে রাখি সব কিছু, লুকিয়ে লুকিয়ে কিনে রাখি তোদের মনের মত উপহার, নিজের হাতে রান্না করে সাজিয়ে দিই পঞ্চব্যঞ্জন। আর আমার বেলায় আমাকেই মুখ ফুটে বলতে হবে, আমি কি চাই? 


বরাবরের মত, আমার বর বুঝতেও পারে না যে আমি ক্ষেপে আছি। নিজের মনে বকে যায়, অনেক গুলো প্ল্যান। যার কোনটায় থাকে লং ড্রাইভ এন্ড ডিনার, কোনটায় ডে আউটিং লাঞ্চ এন্ড ডিনার আরও কত কি। কোনটাই পছন্দ হয় না আমার। বেড়াতে গেলে আলাদা কথা, নইলে এই তিন বুড়োবুড়িকে ফেলে সারা দিন বাইরে ঘুরে রাতে খেয়ে ফেরা মোটেই শোভন নয়। আর তাছাড়া আমি যে এত শখ করে নিজেকে এত সুন্দর একটা জামা, এত উঁচু গোড়ালির জুতো, টকটকে লাল লিপস্টিক, দুল, ব্যাগ এসব উপহার দিলাম, ওগুলো কখন পরব? ওগুলো যে কেবল ডিনার ডেটের জন্যই আদর্শ। তাও কন্টিনেন্টাল - 


"বেশ তাই" দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজি হয় শৌভিক। "তাহলে কাল প্রাতঃরাশে কি খাবি? আর লাঞ্চে? মাটন আনাই?" প্রশ্ন করে শৌভিক। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে, বিস্তর তর্কবিতর্কের পর ঠিক হয়, সকালের প্রাতঃরাশ বাসি রুটি ভাজা আর প্রচুর কাঁচা লঙ্কা - পিঁয়াজ ভাজা দিয়ে নরম নরম ডবল ডিমের অমলেট। আর দুপুরে বাকিদের জন্য যা হয় হোক, আমার জন্য বেশি করে লঙ্কা আর সর্ষের তেল দিয়ে কাঁচা পোস্ত বাটা হবে। ওরে আমি জাত ঘটি রে, আমার কাছে এর থেকে সুখাদ্য আর কিছু নেই।


শ্রীমতী তুত্তুরীর নির্দেশ মত, তাঁর বাপের হাত ধরে "কান ধরে তুমি নিয়ে চল সখা" গাইতে গাইতে যখন নিকষ আঁধারে পরিপূর্ণ বাইরের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলাম, তখনও ভাবিনি আমার জন্য এত বড় চমক অপেক্ষা করছে। মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারের দেওয়াল জোড়া কেবল বেলুন আর বেলুন। যার অনেক গুলোর গায়ে কিছু লেখা। হেঁট মুণ্ড ঊর্ধ্ব পদ হয়ে পড়তে পারলে, পড়া যায়, লেখা আছে " I LOVE YOU" এবং"HAPPY BIRTHDAY"। তুত্তুরীর দাবী তিনি ঠিকই আটকে ছিলেন, কিন্তু বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে সস্তার ডবল সাইডেড টেপ। মধ্যরাত্রির অব্যবহিত পূর্বে টপাটপ খুলে পড়েছে বেশ অনেক গুলো লাল বেলুন। তড়িঘড়ি করতে গিয়ে একটু গড়বড় করে ফেলেছেন তিনি। "তুমি কি করে করো মা -" অনুযোগের সুরে শুধান তিনি, আমার অবশ্য কোন সমস্যা বোধহয় না, আপ্লুত হয়ে, হতবাক হয়ে হাত বোলাই মেয়ের ফুসফুস নিংড়ে ফোলানো প্রতিটা বেলুনের গায়ে। 


"মা তুমি খুশি তো?" উচ্ছ্বল গলায় প্রশ্ন করে তুত্তুরী। কি বলি? কোন মা এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারে কি? হাতে এক গোছা হলুদ আর রক্ত বর্ণ গোলাপ তুলে দেয় তুত্তুরী। "এটাও তোমার জন্য কিনেছি মা। ওগুলোও -"। ইশারায় দেখায় তুত্তুরী। কাঁচের টেবিলের ওপর এক বাক্স চকলেট, দুটো চকলেট মুজ, দুটো পেস্ট্রি রাখা। "কেক কিনতে পারিনি মা, পয়সা শেষ হয়ে গিয়েছিল।" ৬৭৬ টাকার মধ্যে ৬৭০ টাকাই মায়ের জন্য খরচ করে ফেলেছে তুত্তুরী। এর থেকে বড় উপহার কি হতে পারে একজন মায়ের কাছে? আনন্দে গরবে গলে গলে পড়ি আমি। পাশ থেকে শৌভিক বলে, "কেক আমি এনেছি। এখন কাটবি কি?" মাথা নেড়ে জানাই, নাহ্ কাল সকাল হোক, সবার সামনে কাটব। আজ রাত শুধু মেয়ের আর আমার। 


ঝুঁকে পরে এক খাবলা মুস খাই, মন দিয়ে পড়ি শ্রীমতী তুত্তুরীর হাতে লেখা কার্ড। মায়ের এত প্রশস্তি সারা বছর তো করে না মেয়েটা। পাশে একটা সুগন্ধী বাতি রাখা আছে, কার থেকে যেন এটা উপহার পেয়েছিল শৌভিক। তুত্তুরী বোধহয় ভয়ে জ্বালায়নি, তিনি কাঁচুমাচু মুখে বলেন, " ভয়ে নয়, আসলে ভুলে গেছিলাম। তোমার মত পারিনি মা।কি নিখুঁত ভাবে সব কর তুমি, আমি যে কেন তোমার মত পারি না -"। কানে কানে শৌভিক বলে, " সিঙ্গেল মল্ট কিনে রেখেছি, শুধু তোর জন্য -'। এরই মধ্যে ফোন করে অনেক অনেক ভালোবাসা জানায় ছোটদা। দুজনের একই দিনে জন্ম, বছরটা যদিও আগে পরে। ছোটবেলায় নালিশ করত ছোটদা, " তুই আমার জন্মদিনটাকেও ছাড়লি না বল, সেটাতেও ভাগ বসালি শয়তান।" সেই সব কথা মনে করে প্রচুর হাসি দুই ভাইবোনে।


 আবেগে, ভালোবাসায় ডুবে যেতে যেতেও খচখচ করে মন, মধ্যরাত তো পেরিয়ে গেল, কই ফোন করল না তো প্রিয় বন্ধুরা। আপদগুলোকে যে এত ভালবাসি, বদলে একটা ফোন করল না শয়তান গুলো, করুক কাল ফোন/মেসেজ ধরবই না, জবাবই দেব না। নাহ্ এযে সত্যি সত্যিই সুখেও কেঁদে ওঠে মন। বড় কত্তা ঠিকই কয়েছিলেন, " জানেও ক্যায়সে লোগ থে জিনকে প্যার কো প্যার মিলা -" ।


অনির ডাইরি ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ 

#অনিরডাইরি 



এত সকালে ফোন করেছ কেন বাবা? সব ঠিক আছে তো? মুঠো ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে বাবার হেরে যাওয়া কন্ঠস্বর, থেমে থেমে বলে," না ঠিক নেই। তোমার মা -", এই অবধি শুনেই ধপ করে বসে পড়ি আমি। ঘড়ি বলছে আপিস টাইম শুরু হতে এখনও বাকি ঘণ্টা দেড়েক, স্নান সেরে বাগানে পায়চারি করতে যাবে শৌভিক, আর আমি যাব স্নান করতে। এই সন্ধিক্ষণে উভয়েই কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াই, দুচারখানা কথা বলি প্রাণ খুলে। স্বামী স্ত্রী হিসেবে নয় বরং বলতে পারেন দুই সমব্যথী সরকারী আধিকারিক হিসেবে ভাগ করে নিই পাওয়া না পাওয়ার সুখদুখ। আজও তাই করছিলাম দোঁহে -


দিন কয়েক ধরেই ভালো নেই মায়ের শরীর।ভুগছে তীব্র অজীর্ণ ব্যাধিতে। এর মধ্যেই বারে বারে ছুটি নিচ্ছে মায়ের আয়া, সামনেই তার কন্যার শুভবিবাহ, সেও নিরূপায়। বৃদ্ধবৃদ্ধার পক্ষে এঘর ওঘর করাই মুস্কিল, দোকানে গিয়ে ওষুধ কেনা তো দূর অস্ত। এত দূর থেকে কি যে করি আমি। বার বার খুড়তুতো ভাইদের বলতে লজ্জা লাগে, ওদের জন্য তো কিছুই করতে পারি না আমি। 


নিয়মিত রক্ত নিয়ে যায়, প্রেসার দেখে দেয় যে ছেলেটি তাকেই ফোন করে ওষুধ আনিয়ে দিয়েছিলাম গতকাল। রাতে শেষ যা কথা হয়েছিল, মা জানিয়েছিল একটু ভালো আছে। তাহলে? বাবা জানায়, ভালো নেই মা। ওষুধ নিষ্ফল। গতকাল সারা রাত শৌচাগারে কেটেছে। ঘুমাতে পারেনি বুড়োবুড়ি কেউই। আজ সকালেও একই অবস্থা। হে ভগবান, কি করি আমি? গাড়ি ডেকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে এতো ডিহাইড্রেশনেই শেষ হয়ে যাবে। 


পাশ থেকে সান্ত্বনা দেয় শৌভিক, " দাঁড়া এখন কাঁদতে বসিস না। আগে প্ল্যান করাটা জরুরী।" কি করি, কার কাছে সাহায্য চাই, কে এত সকালে ঘুম থেকে উঠেছে ইত্যাদি অনেক ভেবে সেজদাকেই ফোন করি। আমরা পাঁচ মাসতুতো ভাইবোন এক সাথে বড় হয়ে উঠেছি। দাদাদের ওপর আমার জোর চিরকাল। সর্বোপরি বড় মাসির পারকিনসন ব্যাধি ধরা পড়ার পর থেকে সেজদা সারাক্ষণ ইন্টারনেটে রোগব্যাধি নিয়েই পড়াশোনা করে। কলকাতার যাবতীয় বড় হাসপাতাল, ডাক্তারদের সাথে ওর নিত্য যোগাযোগ। আমার মত গণ্ডমূর্খের কাছে ও হাফ ডাক্তার তো বটেই। 


তীব্র সংকোচ নিয়েই ফোন করলাম, সব শুনে সেজদা জানতে চাইল, " কি ওষুধ দিয়ে গেছে জানিস?" তাও তো জানি না ছাই। সন্তান হিসেবে আর কত অধঃপতিত যে হব। ফোন কেটে বাবার থেকে জানতে চাই, কি ওষুধ খাচ্ছে মা? পাশে দাঁড়িয়ে বাবার বলা বর্ণগুলো মুঠো ফোনে পটাপট বসাতে থাকে শৌভিক। খুঁজে পাওয়া যায় ওষুধের নাম। পুনরায় সেজদাকে ফোন করে জানাই। " হুঁ। আমি তোকে দু মিনিটে ফোন করছি" বলে ফোন কেটে দেয় সেজদা। 


স্থানুর মত আমি দাঁড়িয়েই থাকি সিঁড়ির সামনে। দুইয়ের জায়গায় পাঁচ মিনিট কেটে যায়। কোন ফোন আসে না। রোয়াকের ওপর থেকে শৌভিক বলে, 'গাড়ি আসতে আসতে চটপট স্নান সেরে নে। গিয়ে দিন দুয়েক থাকতে হবে হিসেব করে ব্যাগ গুছিয়ে নে। সব সামলে গুছিয়ে তবে ফিরিস। পারলে আমিও চলে যেতাম কিন্তু - "। জানি ওর পক্ষে সম্ভব নয়, কাঁথির মহকুমা শাসকের ওপর এমনিতেই মারাত্মক চাপ তারওপর আবার কি যেন মামলায় মহামান্য উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছে এক পঞ্চায়েত প্রধানের চার্জ নিতে হবে আমার বরকে। একটু আগে সেই কথাই আলোচনা করছিলাম দোঁহে, শৌভিক বলছিল, "এটাই বাকি ছিল। যাই গিয়ে পঞ্চায়েত প্রধান হই।" 


তবে হাইকোর্টের গুঁতো না থাকলেও শৌভিক যেতে পারত না, কারণ শাশুড়ি মাতা এখনও শয্যাশায়ী। পায়ে অস্ত্রোপচার হয়ে ফিরে আসার পর থেকেই কেমন যেন শিশুসুলভ হয়ে পড়েছেন ভদ্রমহিলা। একেকটা মুহূর্ত কাটে যেন একেক যুগ। সেজদার ফোন আর আসে না। মিনিট দশ বাদে উঠেই পড়ি, নাহ এই ভাবে বিহ্বল হয়ে বসে থাকার বিলাসিতা আমায় পোষায় না। স্নানে যেতে আরেকবার বাড়িতে ফোন করি, রিং হতে না হতেই ধরে নেয় বাবা। গলায় যেন একটু ফিরে আসা জোর টের পাই, নাকি আমারই মনের ভুল। বাবা বলে, " সেজদা এসেছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে ওষুধ কিনে এনেছে। মাকে খাইয়েও দিয়েছে -"। 


আবেগে বুজে আসে গলা, এই ঘোর কলিতে আপন সহোদর/ সহোদরার কাছে এমন সহমর্মিতা পায় না মানুষ, যা আমি আমার মাসতুতো দাদার কাছে পেলাম। বাবার হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয় সেজদা, চিৎকার করে বলে, " তোর কোন চিন্তা নেই। আমি আছি। আমি বেলা একটা অবধি থাকব, মাসিকে লক্ষ্য করব। তারপরও ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর নেব। তোকে এখনি দৌড়ে আসতে হবে না।তুই নিশ্চিন্তে থাক -"। ধরা গলায় থ্যাঙ্ক ইউ বলে ঝাড় খাই সেজদার কাছে। " আমাকে থ্যাঙ্ক ইউ দিচ্ছিস কেন রে হোঁদলু কোথাকার?"


সেজদা সত্যিই ঘণ্টায় ঘণ্টায় খোঁজ নিতে থাকে, রিলে করতে থাকে হাওড়া থেকে কাঁথি। এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচেই যায় মা। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অন্যত্র, আয়া দিদি যে দশ বারো দিনের জন্য ছুটিতে যাবে। কে দেখবে ওদের ওই সময়? আগে ঠিক ছিল কাঁথি নিয়ে আসব আমি, কিন্তু এই শারীরিক অবস্থায় কি আসতে পারবে মা? বাবা তো এমনিতেই নিজ ভিটে ছেড়ে আসতে নারাজ।


অগত্যা নতুন আয়া খুঁজি আমি। খুঁজলেই যদি পাওয়া যেত। আজ থেকে বছর চোদ্দ আগে যার থেকে লতা দিকে পেয়েছিলাম, বছর পাঁচেক আগে মায়ের আয়ার সন্ধান দিয়েছিল যে এজেন্সি, তাদেরই ফোন করি। এজেন্সির জাঁদরেল মালকিন আপাতত বুড়ি সিংহী। নেই সেই দাপট। ভালো আর কাজের মেয়েরা সকলেই আপাতত কোথাও না কোথাও যুক্ত। তাও এত পুরাণ সম্পর্কের খাতিরে তড়িঘড়ি একজনকে খুঁজে দেন ভদ্রমহিলা। 


শৌভিক বলে, "তাও তুই যা। গিয়ে দেখে আয়, নতুন দিদি যাতে বুঝতে পারে, ওরা একা আর অসহায় নয়। দূরে হলেও আমরা আছি -।" বড় সাহেবের কাছে ছুটির আর্জি জানিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিই আমি। কাল বাদ পরশু শুরু হতে চলেছে দুয়ারে সরকার। জমে আছে পাহাড় প্রমাণ কাজ, এই সময় এই ভাবে ডুব মারতে কি যে চরম অপরাধ বোধে ভুগি। নিজেকে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম আধিকারিক বলে বোধ হয় - । ভাবি গিয়ে ঘণ্টা খানেক থেকেই ফিরে আসব। আড়াইটে নাগাদ যদি ঢুকতে পারি অফিসে, তাহলেও খানিক মুখ বাঁচে - 


রাস্তা থেকেই খবর পাই, ভোর বেলা এসে মাকে দেখে গেছে সেজদা। ঘুমন্ত মাসির মাথায় হাত বুলিয়ে ও গেছে খানিক ক্ষণ, মা যদিও কিছুই টের পায়নি। দশটা নাগাদ আবার ফোন করে বাবা, নতুন আয়া দিদি এসে গেছে। নিশ্চিন্ত বোধ করি আমি। তাহলে আধ ঘণ্টা থেকেই বেরিয়ে পড়ব। যত তাড়াতাড়ি অফিসে ফেরা যায় - 


রানীহাটির মোড় থেকে শুরু হয় অকথ্য জ্যাম। কোন এক রাজনৈতিক দলের সমাবেশ আছে ব্রিগেডে, তার জন্য পিলপিল করছে লোক। বাড়তে থাকে রক্তচাপ। আচ্ছা বিশ মিনিট থেকেই চলে আসব ক্ষণ। ফেরার পথে এত ভিড় হবে না আশা করি। ভাবতে ভাবতেই মায়ের ফোন, " এ কেমন লোক খুঁজে দিয়েছিস? এতো বেতো রুগী। নিজেই নড়তে পারে না - আমাদের কি দেখবে? একে ছড়িয়ে দে। দশটা দিনের তো ব্যাপার, তারপর আমাদের মেয়েটা ফিরে আসবে। ততোদিন আমরা হোম ডেলিভারি থেকে খাবার আনিয়ে খাব। " ব্যাপারটা বলা যত সোজা, আদতে যদি ততোটা সহজ হত। অধিকাংশ হোম ডেলিভারি এদিকে এক বেলা খাবার দেয়। বেশি খদ্দের না হলে, অনেক সময় এক বেলাও দেয় না। তেমন হলে এরা খাবে কি? আর শুধু দুই বেলার খাবার তো নয়, জলখাবার, চা, ওষুধ ইত্যাদি আরও অনেক কিছু লাগে যে - । 


কি করি? মনে হয় টেনশনে মাথাটা ফেটেই যাবে এবার। তাও যথা সম্ভব ঠাণ্ডা মাথায় বলি, আমার সঙ্গে ফিরে আসবে? মা উত্তর দেবার আগেই বাবা চিৎকার করে ওঠে, " না। আমি জামাই বাড়ি কিছুতেই যাব না।" আর ভাবতে পারছি না, মনে মনে বলি ঠাকুর মাথা ব্যথাটা যখন দিয়েছ তুমি, এর মলমটাও দাও তুমি। বাড়ি ঢুকে দেখি সত্যিই কথা শুনেছে ঠাকুর, অজীর্ণ রোগে ভোগা মায়ের ওপর ভর করেছেন সাক্ষাৎ দনুজ দলনী। কি গলার জোর তার, তার সামনে রীতিমত মিউ মিউ করছে বাবা। শুনতে পেলাম মা বলছে, " আমি মেয়ের সঙ্গে কাঁথি যাবই, যাব। আমার রোগ এই ওষুধে সারবে না। আমার ওষুধ আমার তুত্তুরী। ওকে কাছে না পেলে আমি এমনিই মরে যাব।" 


অগত্যা আর কি, বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বুড়োবুড়িকে বগল দাবা করে রওনা দিলাম কাঁথি। অফিসে বোধহয় আর ঢোকা হল না, পথে অন্তত বার তিনেক গাড়ি থামিয়ে বমি করবে বাবা, " ইশ কেন এলাম, আমার জন্যই বুড়োটা এত কষ্ট পাচ্ছে" বলে আক্ষেপ করবে মা, দাদু দিদাকে পেয়ে পড়াশোনা লাটে উঠবে তুত্তুরীর - সে হোক, কিন্তু আপাতত যে অপরিসীম শান্তি পাচ্ছি আমি, তার সাথে কোন কিছু তুলনীয় নয়। থাক ওরা আমার চোখের সামনে থাক। বাপরে বাপ, ঘরে বাইরে এত চাপ নেওয়া যায়। আর আমি কিনা ভাবতাম যে বেকার জীবনটাই ছিল সবথেকে চাপের।

অনির ডাইরি, ১৮ই জানুয়ারী, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


সে অনেককাল আগের কথা, তখন ফি বছর আমাদের মেলা হত। সরকারি মেলা, নিছক কর্তব্য পালন, তাও আমাদের উৎসাহ দেখে কে। আমরা এমন করতাম, যেন অফিসিয়াল মেলা নয়, বাড়ির দোল- দুর্গোৎসব বা বিয়ে। সামর্থ্য সীমিত তো কি হয়েছে, তারই মধ্যে সেরার সেরা হতে হবে আমাদের মেলা। 


কালি পুজো ভাইফোঁটার ছুটি কাটিয়ে এসেই আমরা ব্যাপৃত হয়ে পড়তাম মেলার প্ল্যানিংয়ে। পরিকাঠামো থেকে খাওয়াদাওয়া, অতিথি আপ্যায়ন থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সব কিছুর জন্যই একজন ইন্সপেক্টরকে OC করা হত। প্রত্যেক ওসির থাকত ডেডিকেটেড টিম। যা তৈরি হত তার মনপসন্দ CKCO, SLO আর কালেক্টিং এজেন্টদের নিয়ে। আর রমেশ হত সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা। 


তখন বাজার কাঁপাচ্ছে, “টুম্পা সোনা, দুটো হাম্পি দেনা”। মেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যখন ছকা শুরু হল, তখনই আমার ইন্সপেক্টর কৌশিক বলেছিল, ‘বাজেট যতই কম হোক, তবুও যাকে তাকে মঞ্চে তোলা যাবে না। পাগল, তারপর যদি ঐ গান গাইতে শুরু করে?’ তখন বেশ গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করেছিলাম আমি, ‘কেন রে? কি এমন খারাপ গান?’ বেশ মজা লাগে শুনতে। ‘চাঁদনি রাতে,আমি টুম্পার সাথে যাব ডিনার খেতে, পোচ মামলেট খেতে’ মাঝে মাঝেই সুকন্যাকে ফোন করে এই লাইনটা গাইতাম আমি। আহাঃ বললে বিশ্বাস করবেন না, গাইলেই লেবার কমিশনারেটের সু-কন্যা কেমন দনুজদলনী হয়ে উঠত- কারণটা লিখে কোতল হই আর কি? 


শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমার যুক্তিতে কেউ কর্ণপাত করেনি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা আমাদের সহশ্রম কমিশনার শ্রীসুখেন বর্মনই দেখতেন। মেলার আগের সন্ধ্যার মাইক টেস্টিংও হত ওণার খালি গলায় গাওয়া- ‘মেরা জীবন কোরা কাগজ, কোরাই রয় গ্যয়া’ দিয়ে। ভুল বললাম, মেলার মাইক টেস্টিং থেকে টিম চুঁচুড়ার পিকনিক সবই শুরু হত আমাদের আদরের বর্মন সাহেবের ঐ গানটা দিয়ে। দু নম্বরে থাকত আমাদের সিকেসিও শুভজিৎ এর "পৃথিবী হারিয়ে যায় মরু সাহারায়-"। 


তারপর থাকত আমাদের ধনিয়াখালীর রূপসী এসএলও অমৃতা। গলায় মধু ছিল মেয়েটার। মধু ছিল আমার ধনিয়াখালীর ইন্সপেক্টর চঞ্চলের গলাতেও। এইটুকু রোগা পাতলা একটা ছেলে, ধূমপানে ঝরঝরে যার ফুসফুস, খালি গলায় গান ধরলে ঐ খলবলে ফুসফুসের দম দেখে তাজ্জব হয়ে যেতে হত। জখম ফুসফুস নিয়েও এত চড়া গাইত কি করে ছেলেটা সেটা আজও এক রহস্য। সবই বিড়ি বাবার কৃপা। 


চুঁচুড়ার বাকি মক্কেল গুলো কে কেমন গান গাইত বা গায় সেই সম্পর্কে আজও আমার কোন ধারণা নেই। ওদের দর এত বেশী ছিল, যে ঘড়া ঘড়া তেল দিলেও কেউ গান গাইতে চাইত না। এমন ভান করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকত, যেন ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না। তুলনায় এই ব্যাপারে আমার বর্তমান টিম অনেক নিঃসঙ্কোচ। 


যাই হোক, ফিরে যাই টুম্পা সোনায়। আমাদের মেলার অব্যবহিত কয়েকদিন পূর্বে আচমকা ভাইরাল হল এক ভিডিও ক্লিপ। কোন এক সরকারি মেলায়, গাওয়া হয়েছে ঐ গানটা। স্থানীয় যে ব্যান্ড গাইছিল, তাদের মুখ্য গায়ক উৎসাহের বশে হাত ধরে টেনে আনে মেলার মুখ্য সংযোজককে। ভিডিও তে দেখা যায়, উদ্দাম গানের সাথে সবাই নাচলেও তিনি নাচেননি, হাসি হাসি মুখে তালে তালে সামান্য হাততালি দিয়েছেন বলতে পারেন। তাই নিয়েই উত্তাল বঙ্গ। এক প্রগতিশীল দলের রক্ষণশীল ট্রেড ইউনিয়ন নেতা তো এসে আমায় বলেই গেলেন, " দেখছেন ম্যাডাম। সমাজের কি অবক্ষয়। সরকারি আধিকারিক হয়ে, ছিঃ। " বলতে পারলাম না, আরেকটু হলেই ঐ আধিকারিকের জায়গায় এই আধিকারিক থাকত। বাঁচিয়ে দিয়েছিল আমার টিম। ভাগ্যে আমাদের টিম চুঁচুড়ায় সবাই রাজা। নইলে আমার কথা শুনে, কে জানে তৈরী হত কোন কেলেঙ্কারি।


দেখতে দেখতে কেটে গেল বেশ অনেক গুলো বছর। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলাম পূর্ব মেদিনীপুরের সঙ্গে, তৈরি হল কত নতুন স্মৃতি। পূর্বের প্রিয় মুখ গুলোর জায়গা দখল করে নেওয়া নতুন মুখ গুলোও পুরাণ হতে বসল। জানুয়ারি এলেই স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ি বড়,শুকনো রুটি আর ফুলকপি আলুর তরকারি দিয়ে টিফিন করতে করতে সেই সবই ভাবছিলাম, হঠাৎ বেজে উঠল মুঠো ফোনখানা। অচেনা নম্বর,অন্যমনস্ক ভাবে ধরে হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে এক পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠল, " নমস্কার ম্যাডাম।" প্রতি নমস্কার জানিয়ে বললাম, বলুন কি দরকার? লোকটি কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে বলল, " ম্যাডাম আমি সোমনাথ বলছি। প্রিয়াঙ্কার হাজব্যান্ড।" 


কেজো অফিসিয়াল শীতলতা সহ কোন প্রিয়াঙ্কা, কোন সোমনাথ বলতে গিয়েও থমকে যাই, চোখের ওপর থেকে পলকে সরে যায় সময়ের পর্দা, মনে পড়ে যায়, প্রিয়াঙ্কা আমার চুঁচুড়ার SLO, তার বরের নাম সোমনাথ বটে। বিয়েতে নিমন্ত্রণও করেছিল প্রিয়াঙ্কা। ততদিনে বদলি হয়ে এসেছি এই জেলায়। গুগল ম্যাপ দেখিয়েছিল যেতে ঘণ্টা চারেক লাগবে, ফিরতেও তাই। ফলে ক্ষমা প্রার্থনা করে ফোনেই আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। সেই অভিমান আজও ভোলেনি প্রিয়াঙ্কা। মাঝে মাঝেই খোঁটা দেয়। কদিন আগে বলেছিল বটে, " ম্যাডাম আমার ভালো খবর আছে।" শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম। বলেছিলাম, প্লিজ আমায় জানিও কি হল। 


প্রিয়াঙ্কার বর ফোনে বলেই যায়," এইমাত্র অপারেশন শেষ হল ম্যাডাম। এখনও বেডে দেয়নি প্রিয়াঙ্কাকে। বেবির মুখ ও দেখতে দেয়নি আমাদের। শুধু খবর দিল -।" উৎকণ্ঠায় থামিয়ে দিই ছেলেটাকে, বলি আরে ভাই আগে বলো, কি হয়েছে। ছেলেটা নার্ভাস ভাবে হেসে বলে, " আমাদের ঘরে লক্ষ্মী এসেছে ম্যাডাম।" পুরো দিলখুশ খবর। সহর্ষে অভিনন্দন জানাই। 


ছেলেটা ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, "OT তে ঢোকার আগে প্রিয়াঙ্কা আপনার নম্বরটা দিয়ে গিয়েছিল আর বলে গিয়েছিল, খবর পেলে প্রথম ফোনটা- আমাদের ম্যাডামকেই করবে। আমি আপনাকেই প্রথম জানাচ্ছি ম্যাডাম।" কি বলব বুঝে উঠতে পারি না। আবেগে বুঝে যায় গলা, এত দিন পরেও এত দূর থেকে এত ভালোবাসা, এত সম্মান পাবার মত কোন কাজ কি আদৌ করেছিলাম - শুধু বলি ভালো থেকো ভাই। খুব ভালো থেকো তোমার লক্ষ্মী আর তার মাকে নিয়ে।

অনির ডাইরি ১৪ই জানুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


নরঘাট ব্রিজের ওপর গাড়িটা উঠতেই ফোঁস করে উঠল শৌভিক, "আমার ওপর চাপাবি না কিন্তু, আইডিয়াটা তোর।" সন্ধ্যা গড়িয়ে নামছে রাত, নীচে দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে হলদি নদী। আমার অপরাধ বলতে, আমি বলেছি,' চল চা আর গরম বেগুনি খেয়ে আসি'। 


সেই বিকাল সাড়ে তিনটে থেকে একটা পুঁচকে অফিস ঘরে আবদ্ধ ছিলাম দুজনে। নিকষ আঁধারে গাড়ির ঘড়ি বলছে এখন ছটা। পৌনে ছটা নাগাদ অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়েছে শাশুড়ি মাকে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েই দিয়েছে অপারেশন পর্ব মিটতে সময় লাগবে ঘণ্টা খানেক। তারপর বেড এ দিতে আরো কতক্ষণ লাগবে কে জানে।  


আরো অতটা সময় ঐ ঘরটায় বসে থাকতে হবে ভেবেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল যেন আমার। ক্ষিদে ও যে পাচ্ছিল না তা নয়, তাই চা খেতে যাবার কথা বলেছিলাম। তাও তো শৌভিক মহকুমা শাসক বলে আমাদের খাতির করে অফিস ঘরটায় বসতে দিয়েছে এরা, দুটো পুঁচকে জলের বোতল ও দিয়ে গিয়েছিল, এমনকি চা খাব কিনা বার কতক জিজ্ঞাসা ও করেছিল। নইলে তো বাইরে শেডের নীচে পেতে রাখা চেয়ারে বসে মশার কামড় খেতে হত। 


দোনোমনো করে রাজি হয়ে গেলেও বিরক্তিটা যায়নি আমার বরের। আলবেয়ার কামুর আউটসাইডার গল্পের নায়কের মত আমার বর ওপর ওপর যতই ভাবলেশহীন থাকুক না কেন, ভিতরে ভিতরে ধিকিধিকি জ্বলছে চাপা উত্তেজনার আগুন। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে তার উত্তাপ আমার গায়েই এসে লাগবে এ আর আশ্চর্য কি। 


যা পতনশীল ভদ্রমহিলা আমার শাশুড়ি মাতা। নিত্য দিন ধপাস্। আর ঐ প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তেমনি অবাধ্য। আমাদের বোধহয় আজও নাবালক বলেই গণ্য করেন, বিন্দুমাত্র পাত্তা দেন না। একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি, ওনার পতনের একটা নির্দিষ্ট সময়কাল থাকে এবং তা মোটামুটি ভোর পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে। উনি ব্যতীত যখন নিদ্রামগ্ন থাকে গোটা বাড়ি। কঠোর অনুশাসনে চলা ভদ্রমহিলা নৈশাহার সারেন মোটামুটি সাড়ে আটটার মধ্যে, রাত নটার মধ্যে নিভে যায় ওনার ঘরের আলো। ফলে ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙাই তো স্বাভাবিক। 


ঘুম থেকে উঠেই গুটি কয়েক ওষুধ খান, তারপরই স্নান করতে যান এবং ধপাস হন। হাজার বার বলা হয়েছে সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্নান করতে যেও না। একটু বেলা বাড়ুক না, কিঞ্চিৎ সচল হোক না গ্রন্থি গুলো। শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যু ইস্তক আধ্যাত্মিক জগৎকে বিদায় জানিয়েছেন ভদ্রমহিলা। বিপুল অভিমান দেবদ্বিজে। তাই পুজোয়াচ্ছা তো আর করবে না, তাহলে এত সকালে উঠে লাভ কি? কে কার কথা শোনে। 


নতুন বছর পড়ার সাথে সাথে উনিও ভূপতিত হলেন। এমন আছাড় খেলেন যে, মাথা ফুলে আলু। পায়েও বিপুল লাগল, নিজেই বললেন, " পা'টা ভাঙল কি না কে জানে।" তড়িঘড়ি ডাক্তারের সাথে কথা বলে বেদনা নিবারক ওষুধ দেওয়া হল, পইপই করে বলা হল, আজকের দিনটা শুয়ে-বসেই থাকো, খাবারদাবার সব মুখের কাছে ধরা হবে। আর যা দরকার পড়বে আমাদের বলো। শৌচালয় যেতে হলেও আমাদের ডাকবে আর লাঠি অবশ্যই নেবে। পুরাণ লাঠিগাছ খানা মহানগরের বাড়িতে কোথায় যেন গুছিয়ে রেখে এসেছেন বলে তৎক্ষণাৎ নতুন লাঠি আনিয়ে দিল শৌভিক। দোহাই, শুধু একটু সাবধানে থাকো। 


মুস্কিল হল, এতদিন আমাদের ওপর হুকুম চালিয়ে এসেছেন যিনি, তিনি থোড়াই আমাদের পরোয়া করবেন। সেইদিন বিকালেই, ফল খেয়ে ডিশ নামাতে গিয়ে আবার ধপাস। ছুটির দিন ছিল, সবে দিবানিদ্রাটি জমিয়ে এসেছিল, বিকট শব্দে ধড়ফড় করে দৌড়ে গেলাম সকলে। শৌভিক আতঙ্কের স্বরে বলল, "তোমায় কে প্লেট নামতে বলেছিল? লাঠি কোথায়?" দেখা গেল লাঠি গাছ খানা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা বিছানার কাছে।


ব্যাপারটা যে এত সঙ্গীন তখনও বোঝা যায়নি। উফ্ উফ্ করেও দিব্যি হাঁটছিলেন শাশুড়ি মাতা। কর্ণপাত করছিলেন না শুয়ে বসে থাকার অনুরোধে। দিন দুয়েক পর অবস্থার যেন আরো অবনতি হল। ওয়াকার এর সাহায্য ছাড়া মোটে নড়াচড়া করতে পারেন না ভদ্রমহিলা। অফিস ফেরৎ অ্যাম্বুলেন্স করে এক্সরে করাতে নিয়ে গেল শৌভিক। এক্সরে রিপোর্টে ভাঙা তো দূর চিড় খাবার ও কোন লক্ষণ নেই। এদিকে বিছানা থেকে ওঠানামা করা ক্রমেই দুষ্কর হয়ে উঠছে ওনার। কেনা হল বেড প্যান, প্লাস্টিক শিট মায় হুইল চেয়ার পর্যন্ত। 


হুইল চেয়ার ছাড়া আর কিছুই ব্যবহার করতে রাজি নন জেদী বৃদ্ধা। আবার ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া হল, এবারের নিদান সিটি স্ক্যান। পুনরায় মাকে অ্যাম্বুলেন্স করে স্ক্যান করাতে নিয়ে গেল শৌভিক। চূড়ান্ত পেশাগত চাপের মধ্যেও মায়ের প্রতি আমার বরের অখণ্ড দায়িত্ববোধ দেখে কোথায় যেন চূড়ান্ত হীনমন্যতায় ভুগি আমি। সন্তান হিসেবে নিজেকে নিতান্ত সাদামাটা, অক্ষম, অপদার্থ বোধ হয় আমার। মাস গেলে টাকা তুলে দিয়ে আসা আর অনলাইন টুকটাক বিল মেটানো/ রিচার্জ করে দেওয়া ছাড়া আমি তো কিছুই করতে পারি না আমার বুড়ো বাপমায়ের জন্য। বিশ্বাস করুন টাকাপয়সা দিয়ে বাপমায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করা অনেক সহজ। গায়ে গতরে খেটে করতে সত্যিই দম লাগে। আর লাগে অসম্ভব ধৈর্য। যার কোন অভাব আমার বরের নেই। 


সিটি স্ক্যানের রিপোর্টে ধরা পড়ে, হিপ জয়েন্ট এ সামান্য চিড়। ডাক্তার নিদান দেয় অস্ত্রোপচার ছাড়া গতি নেই। এই অস্ত্রোপচার আগেও হয়েছে ওনার। বাম পায়ে বসানো আছে টাইটেনিয়াম রড। এবার ডান দিকের পালা। ডাক্তার বলেই দেয়," মাসিমা এবার যদি পড়েন, তো ভাঙ্গবে মেরুদণ্ড। সেখানে কিন্তু কোন ইমপ্ল্যান্ট বসানো যাবে না।" 


কাঁথি শহর থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরের এক নার্সিংহোমে আপাতত অস্ত্রোপচার চলছে বৃদ্ধার। কাছেই নন্দকুমার মোড়, অফিস ফেরৎ মাঝেমধ্যেই এখানে চা আর বেগুনি খাই আমি। আজ শনিবার বলে বোধহয় দীঘা মুখী পর্যটকদের ভিড় বেশ বেশী। রাস্তার ধারে সারি সারি দাঁড় করানো মূল্যবান সব গাড়ি। চেনা দোকানের সামনে আর দাঁড়াতে পারি না আমরা। অনেকটা এগিয়ে এসে এক বৃদ্ধ দম্পতির ছোট্ট গুমটির সামনে দাঁড়াই। খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুঁচকে কাগজের কাপে চা আর দুটো মোটকা সুজির বিস্কুট খাই তিনজনে - ড্রাইভার নূপুর বাবু, শৌভিক আর আমি। কাপের সাইজ দেখে শৌভিক হতবাক হয়ে জানতে চায়, " এটাই চা, না এটা চায়ের স্যাম্পল?" হিমেল বাতাস খেলা করে মাথায়, ফুসফুসে ভরে নিই দূষিত আর ধুলোয় মাখামাখি বাতাস। একটু যেন মাথাটা ছাড়ে। রাস্তা পেরিয়ে দৌড়ে গিয়ে কোথা থেকে যেন দুটো বেগুনি কিনে আনেন নূপুর বাবু। কিছুতেই দাম নেন না, " টাকাটা বড় কথা নয়, আমার সাহেব আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেগুনি খেয়েছেন, এযে আমার কি আনন্দ ম্যাডাম।" কে যে কিসে খুশি হয়। 


গাড়ি ঘুরিয়ে নার্সিং হোমের দিকে যাত্রা করি আমরা, শৌভিক খোশ মেজাজে গল্প জোড়ে কি সব যেন। বুঝতে পারি এটা আসলে denial mode। মায়ের চিন্তাটাকে মাথার পিছনে চালান করার জন্যই এই সব ফালতু কথা আমদানি করছে আমার বর। পুনরায় নরঘাট ব্রিজে ওঠে গাড়ি, নীচে আবার কুলকুল করে বয়ে যায় হলদি নদী, বরের হাতটা চেপে ধরি আমি, নূপুর বাবুর কান বাঁচিয়ে বলি, সব ঠিক হয়ে যাবে। এত চিন্তা করিস না। এই সব ছুটকোছাটকা উত্থানপতনই তো রঙিন করে জীবন। না হলে নির্বিকল্প সুখ যে বড় বোরিং বাপু।


অনির ডাইরি ৭ই জানুয়ারি, ২০২৫ 

#অনিরডাইরি 



আগে খেয়ে উঠে পড়ল শৌভিক। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এবার ভালো করে খাওয়া যাবে। রাতে বাঁধা কপির তরকারি হয়েছে বলে গরম গরম বেগুন ভেজেছে লতা দি। ছোট ছোট, গোল গোল, চাকা চাকা করে ভাজা শীতের নরম বেগুন। একটার জায়গায় দুটো নিতেই ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল আমার বরের। তিন নম্বরটা নেব বলে হাত বাড়াতেই কটমট করে তাকাল। তখন থেকে আস্তে আস্তে খাচ্ছি। তক্কে তক্কে আছি। হাত ধুতে গেলেই -


কেস জন্ডিস বাঁধাল এই মেয়েটা। বাপ সোহাগী হয়ে কি যে এত কথা বলে, মাঝখান থেকে খাবার ঘরের বেসিনেই হাত ধুয়ে নিল শৌভিক। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকেই যাচ্ছে মেয়ের সাথে, মনের দুঃখে বসে বসে শসা চিবোই আমি। শসা আমার জঘন্য লাগে খেতে, এর থেকে ঘাস খাওয়া ভালো। তাও খাই, অপেক্ষা করি, কখন শেষ হয় এদের বকবক। 


গল্প শেষ হবার আগে রুটিটাই শেষ হয়ে গেল, ধুৎ। অগত্যা উঠে পড়তেই হয়, নীরবে রান্না ঘরে গিয়ে প্লেট নামাই। আমায় উঠতে দেখে উঠে পড়ে তুত্তুরীও। থালাবাসন নামিয়ে দাঁত মাজতে যায়, জল খাবার অজুহাতে খাবার ঘরেই থেকে যাই আমি। টেবিলে সাজানো এষার আনা গাজরের হালুয়া, এক ঝোলা পয়রা গুড়, খানিক রিচ ফ্রুট কেক, কৌটো ভর্তি জয়নগরের মোয়া, গোটা দুই চকলেট। নিশি ডাকার মত ডাকছে আমায়। 


আপদ বরটা যে কি করছে এখনও, দাঁত মাজতে যা না রে ভাই। কিছুতেই নড়ে না শৌভিক। প্রাক বিবাহ পর্বে ঝাড়ি মারার মত তাকিয়ে আছে আমার দিকে, গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ। থাকতে না পেরে হ্যাংলার মত বলেই ফেলি, " একটা মোয়া খাব?" দীর্ঘশ্বাস ফেলে, দুদিকে মাথা নাড়ায় শৌভিক, চুক চুক আওয়াজ করে মুখে। তারপর বলে, " কথা রাখতে পারলি না?" 


কি আবার কথা দিলাম? ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায়, ও হরি কাল রাতে বলেছিলাম বটে, এই বছরে রোগা হবই। তাই আজ থেকে কাঁচা নুন এবং মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দেব। সে প্রতিজ্ঞা তো সেই দুপুর বেলাতেই ভেঙেছি যখন কোলাঘাটের SLO কৌশিক তার বউয়ের হাতে বানানো গরম গরম ফ্রুট কেক এনেছিল। তারপর জহর বাবুর আনা ওনার স্ত্রীর হাতে বানানো পুলি পিঠেগুলোও তো সদ্ব্যবহার করেছি। কি অনুপম পিঠে বানিয়েছিল মাইরি জহর বাবুর গিন্নি। আমার ভালো লেগেছে শুনে শূন্য টিফিন বক্সে চেপে চেপে ভরে দিয়েছিলেন জহর বাবু, " বাড়ি গিয়ে খাবেন ম্যাডাম। স্যারকে দিবেন। খুকীকে দিবেন " করে। স্বাস্থ্য সচেতন স্যার তো ছুঁয়েও দেখেনি। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে চোরাগোপ্তা সেগুলোর দায়িত্ব নিতে হয়েছে এই অধমকেই। 


ফিরে আসি বর্তমানে। একটা মোয়া কি পাব না? পাব না একটা মোয়া? শৌভিক বলে, " তুই চারটে বেগুন ভাজা খেলি, আমি কি দেখিনি?" কি মিথ্যে অপবাদ বাপু। আমি মাত্র ইয়ে তিনটে খেয়েছি। বলাতে ফুঁসে ওঠে শৌভিক, " কিন্তু কেন? আমি তো একটাও খাইনি। আমায় দেখে শেখ, এই সব কেক, চকলেট, মোয়া লোকজন তো আমায় উপহার দিয়েছিল। আমি একটাও দাঁতে কাটিনি। এমনকি এই শীতে একদিন গুড় পর্যন্ত খাইনি"। 


কি বলি। ও মহাপুরুষ, আমি ঘোর পাতক। আমি খেয়েছি, সব খেয়েছি এবং আমার ঘোরতর সন্দেহ যে সবথেকে বেশি আমিই খেয়েছি। আমি স্বঘোষিত পেটুক, হ্যাংলা এবং ভোজনরসিক। খাবার জিনিস কেউ উপহার দিলে বিরক্তিতে যতটা ভ্রু কুঁচকে যায় শৌভিকের, ততোটাই চওড়া হয় আমার মুখের হাসি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার বরের অগ্নিদৃষ্টির সামনে সংকুচিত হয়ে পড়ি কেমন যেন। সিদ্ধান্ত নিই, নাহ আর নয়। আর হরগিজ হরগিজ নয়। এই মোয়া খানা বাদে এই দণ্ড থেকে মিষ্টি ত্যাগ করলাম আমি। মোয়ার কৌটো ছুঁয়ে বরকে জানিয়েও দিই। আমি না Aquarian, একবার যদি মুখ ফিরিয়ে নিই, আর সেদিকে তাকাই না। বলতে বলতে খেয়াল হয়, এই যা এই মাসেই তো আমার জন্মদিন। একটুখানি সংশোধন করি নিজের প্রতিজ্ঞা, জন্মদিন বাদে আর মিষ্টি খাব না। সেই দিন তো সব চলতা হ্যায়। 


চিবিয়ে চিবিয়ে বলে শৌভিক, " বটেই তো। তবে ওটা জন্মদিন নয়, বল জন্মমাস। জানুয়ারি তোর জন্ম মাস,  তাই সব চলতা হ্যায়। ফেব্রুয়ারি তোর বিয়ের মাস, তাই সব চলতা হ্যায়। মার্চ ইয়ার এন্ডিং এর মাস, এপ্রিলটা নববর্ষের মাস, মে তে তোর আবার বিয়ে হয়েছিল (একই বরের সাথে অগ্নিসাক্ষী করে), জুন মেয়ে হবার আগের মাস বলে আর জুলাই মেয়ে হয়েছে বলে, আগস্ট স্বাধীনতার মাস বলে, সেপ্টেম্বর পুজোর আগের মাস আর অক্টোবর পুজোর মাস বলে । তারপর তো ব্যাস দিওয়ালি আর ক্রিসমাস। আসছে বছর আবার হবে।" 

গভীর মনোযোগের সাথে শুনতে শুনতে টুক করে মোয়াটা মুখে চালান করে দিই, আসছে বছরই যখন হবে বলছে - তাহলে আর কোন দোষ নেই, কি বলেন।


অনির ডাইরি ৪ঠা জানুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


এই তো মনে হয় সেদিনের কথা, কোথাও ঘুরে বেড়িয়ে এসে ছবি পোস্ট করলেই ফোন করত বিন্তিদি ( নামটা বদলে দিলাম)। " ওরে তোকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে রে, আমার ছেলেরও ছবিটা খুব পছন্দ হয়েছে। তোর ইয়ংয়েস্ট এডমায়ারার বুঝলি।" যে ছেলের কথা হচ্ছে, এককালে তাঁকে আমি কোলে তুলে নাচিয়েছি এবং তিনি আমার গায়ে যাবতীয় খারাপ কাজ করেছেন। আমি তখন কাঠবেকার। বিন্তি দি বয়সে সামান্য বড়, তাই দিদি বলি, আসলে নিখাদ বন্ধু। সারা পৃথিবী আমায় অপদার্থ ভাবলেও, বিন্তি দি ছিল কতিপয় ব্যতিক্রমের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাই মাঝেসাঝে মনের দুঃখ ভুলতে ওর সাথে গল্প করতে যেতাম। অতিরিক্ত আকর্ষণ ছিল ওর ছেলে, যাকে সেদিন পর্যন্ত আমি ঘন্টু বলে ডাকতাম। যেন আমার জন্যই বসে থাকত ব্যাটা, কোলে নিলেই ব্যাস -। আর ওর মা একগাল হেসে গড়িয়ে পড়ে বলত, " শিশু নারায়ণ আর ওটা তো গঙ্গাজল।" এহেন ব্যক্তিটি এতোই সুদর্শন ছিলেন, যেন মাখনের তাল। তিনি আমার যতটা না অনুরাগী ছিলেন, আমি তার থেকেও অনেক বেশী অনুরক্ত ছিলাম। তাই না আরেকটু বড় হয়ে যখন চুল টানতেন, ঘুষি মারতেন, খামচে দিতেন কিছু বলিনি। নতুন বিয়ের পর আমার বরের সামনে যেবার থুতু ছিটিয়েছিলেন সেইবার কেবল খুব রেগে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এবার সব সম্পর্ক ছিন্নই করে ফেলব ব্যাটার সাথে।


 তবে সে তো কবেকার কথা। ধীরে ধীরে তিনি বড় হতে লাগলেন, তাঁর মায়ের ধারণা ছিল তিনি পরীক্ষায় রসগোল্লা পান্তুয়াই পাবেন, সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দশ ক্লাসের পরীক্ষায় দারুণ ফল করলেন। তারপর হঠাৎ একদিন উদয় হলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, " কে রে ঘন্টু নাকি? তুই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছিস? তোর মা জানে?" মেসেঞ্জারে ঘন্টু বাবু জানালেন, " মা জানে গো মাসি। মা তো নিজেই একটা অ্যাকাউন্ট খুলবে বলে আমায় ধরেছে।"  বিন্তি দির অ্যাকাউন্ট খুলতে অবশ্য আরও বছর দুয়েক লেগেছিল। ছেলের দ্বাদশের পরীক্ষার পর, ফেসবুকে আত্মপ্রকাশ করেছিল বিন্তি দি। 


নতুন অ্যাকাউন্ট খোলার পর দিন দুয়েক ঘন্টু ওই সব ছবি পোস্ট করল - যেমন বাচ্ছা গুলো করে আর কি। থুতনিতে হাত দেওয়া সেলফি, অন্ধকার অন্ধকার ছবি, বই হাতে ছবি, "Bro"দের সাথে ছবি ইত্যাদি প্রভৃতি এবং একটি সুন্দরী মেয়ের সাথে ছবি। ভাবলাম ইনিও বোধহয় ওই 'Bro' দেরই কেউ হবেন। ভুল ভাঙাল ঘন্টু বাবু স্বয়ং। মেসেঞ্জারে জানালেন," অনি মাসি এই দেখো আমার গার্ল ফ্রেন্ড।" দেখার মতোই মেয়েটা। কি সর্বাঙ্গীন সুন্দর। সনাতনী বাঙালি সৌন্দর্যের পরিমাপে কতটা নম্বর পাবে সেটা বিতর্কমূলক হলেও গ্ল্যামারে কিন্তু হীরকের মতোই উজ্জ্বল। গোছা গোছা ছবি ভেসে বেড়াতে লাগল ফেসবুক থেকে ইন্সটাগ্রামে। লাইক না পেলেই ধেয়ে আসত ঘন্টুর মেসেজ, "অনি মাসি, এই দেখো। একটা লাইক তো বানতা যায়।" 


ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসে সব উত্তেজনাই। আমরাও মহানগর ছেড়ে চলে আসি তমলুক। চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয় মানুষ। দুদণ্ড দেখা যে করব, তারও কি উপায় আছে। বিন্তি দি এবং আমি উভয়েই এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকি নিজের নিজের জীবনে -। সেটা রথের দিন, ভাবলাম আজ একটা ফোন করেই ফেলি। ব্যস্ত থাকলে পরে করবে দিদি। যথারীতি ফোন বেজে গেল। সন্ধ্যার ফোনের জবাব পেলাম রাত এগারোটায়। " তুই ফোন করেছিলি? Sorry রে। আসলে তোর ঘন্টুর গার্লফ্রেন্ড আর তার বাবা মা এসেছিল, তাদের আপ্যায়নেই ব্যস্ত ছিলাম।" আরে বাহ। দুই পরিবারের মধ্যেও সেতু বন্ধন হয়ে গেল। তার মানে তো আমাদের ঘন্টু এবং তার সুন্দরী বান্ধবী উভয়েই বেশ সিরিয়াস সম্পর্কটাকে নিয়ে। 


বিন্তি দি বলেই চলে, " মেয়েটা খুব ভালো রে। ওর বাবা মা, পরিবারটাও বেশ ভালো। আপাতত ও কেরিয়ারে ফোকাস করতে চায়। আমরাও তাই চাই। তোর সাথে একদিন আলাপ করিয়ে দেব।" হেসে বলি, আমার সাথে আবার আলাপ করাবে কি, আমি তো চিনি। কবে থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছি দুজনকে। কোথায় কোথায় সব প্রেম করতে যায় ব্যাটারা, কি দারুণ দারুণ ছবি তোলে একসাথে। বিন্তি দি একটু থমকায়, গলা ঝাড়ে, তারপর বলে, " নানা তুই ওকে চিনিস না।" আমি বলি আলবাৎ চিনি, তুমি তো কাল কা যোগী, সবে ফেসবুক একাউন্ট খুলেছ।আমি পুরাণ পাপী। 


বিন্তি দির গলায় একরাশ অস্বস্তি, " নারে তুই একে দেখিসনি। এ একটু 'পড়াকু' টাইপ। ওই সব সোশ্যাল মিডিয়া ফিডিয়ায় একে পাবি না।" স্পিকার অফ থাকলেও নিশুতি রাতের নৈঃশব্দে সব কথা পাশ থেকে  শোনা যায়। শৌভিক মাথায় গাঁট্টা মেরে ইশারায় বলে, ' এটা অন্য মেয়ে।' পুরো বেকুব হয়ে যাই মাইরি। বিন্তি দি 'হবু মেয়ের' গুচ্ছের প্রশংসা করে ফোন রাখে। তড়িঘড়ি ঘন্টুবাবুর একাউন্টটা খুলি। সময়ের পুরু ধুলো জমেছে আমাদের সম্পর্কেও। দীর্ঘদিন আর মেসেঞ্জারে ছবি লাইক করার আব্দার করে না ঘন্টু। মনে পড়ে অনেকদিন কোন নোটিফিকেশনই আসেনি ঘন্টুর থেকে। খুলে দেখি একাউন্টটা আছে বটে, নেই সেই সুন্দর ছবি গুলো। সেই হীরের মত ঝলমলে মেয়েটার কোন নামগন্ধ নেই ঘন্টুর প্রোফাইলে। বুঝি বিন্তি দিই ঠিক। 


পরদিন মেসেজ করে জানায় ঘন্টুও, " ওর সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে অনি মাসি। কেবল ঝগড়া করত। আরো অনেক কিছু, it's kinda complicated। তবে ফাইনালি আমি আমার soulmate কে খুঁজে পেয়েছি। And I'm very happy। She inspires me to be a better version of myself। " জানাই, তুই খুশি হলেই আমরা খুশি বাবা। ভালো থাকিস। পড়াশোনাটা ঠিক করে করিস। 


তমলুক থেকে কাঁথি সরে আসি আমরা। দূরত্ব আরো বেড়ে যায় বিন্তি দির সাথে। মাঝে মাঝে টুকটাক WhatsApp এ যা কথা হয়। প্রতিবার একই কথা বলে বিন্তি দি, "হ্যাঁ রে, তোরা কি আর কলকাতায় আসবি না? " এই কথার কি জবাব দি। সবই তো মহামহিমের মর্জি। কথা ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করি, তোমার মেয়ের কি খবর? সে কি করছে এখন? বিন্তি দি আকাশ থেকে পড়ে, " কোন মেয়ে রে? আমার তো একটাই ছেলে -"। যাঃ বাবা। খুলে বলি, বিন্তি দি মুখ ঝামটা দেয়, " ছাড় তো। সেসব কবেই চুকেবুকে গেছে। মেয়েটা বাইরে চান্স পেয়ে চলে গেছে।  এখন তো আর একটাকে জুটিয়েছে। কেন তুই ফেসবুকে দেখিস নি?" বিন্তি দিকে কি করে বোঝাই, বন্ধু পুত্রকে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টকিং করা ছাড়াও আমার আরো অনেক কাজ থাকে। কথা ঘোরাতে জিজ্ঞেস করি, 'তোমার শাশুড়ি মা কেমন আছেন?' শাশুড়ি হল এমন একটা টপিক যা নিয়ে বিন্তি দি ঝাড়া এক ঘণ্টা বকে যেতে পারে। তাই গেলও, ফোন রাখার আগে বলল, " পারলে একবার দেখিস, ঘন্টুর নতুন বান্ধবীকে।" 


ফোন রেখে, খুঁজে ঘন্টুর একাউন্টটা বার করলাম, ডিপি থেকে কভার ফটো সব জায়গায় হাসি মুখে ঘন্টু, পাশে আর একটি অনন্য সুন্দরী তরুণী, কম বেশি সর্বত্র একই ক্যাপশন লেখা, " You help me to grow", "You made me a better person" এবং"soulmate"। ফোন রাখতে রাখতে মনে মনে বলি, ভাগ্যে এই প্রজন্মে জন্মাইনি। একটা নিয়েই ঝালাপালা হয়ে গেলাম বাপস্। বলি, ঘন্টুর নতুন আত্মীয়তা দীর্ঘজীবী হোক। তবে বাবা ঘন্টু, তোর আত্মার যে সাকুল্যে কটা আত্মীয়!


পুনশ্চ - ঘন্টু বাবা জানি এতটা বাংলা তুই পড়তে পারবি না। যদি পড়িস, তো রাগ করিস না সোনা। তোর ভাষাতেই বলি, মাসি হিসেবে এইটুকু লেগ পুল তো বানতা হ্যায়, নাকি 😝😁।

অনির ডাইরি, ৩রা জানুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



এই তো মনে হয় সেদিনের কথা। অবশেষে বিদায় নিতে চলেছে বিশের (বিষের) বছর। আপ্রাণ চেষ্টা করছি সবাই সর্বোতভাবে জীবনকে স্বাভাবিক করে তোলার। সেটা বছরের শেষ দিন। কোন এককালে এমন দিনে আপিস যেতে ডাক ছেড়ে কান্না পেত। একরাশ তিক্ততা নিয়ে মেদিনীপুর লোকালে সওয়ার হয়ে, নবু ওরফে নবনীতার কাঁধে মাথা রেখে সত্যিই কাঁদতে কাঁদতে অফিস যেতাম। জমানাই ছিল ভিন্ন, আর শৌভিকের ভাষায় আপিসটাও ছিল ‘জঘন্যের কাকাবাবু’। এহেন বালখিল্যচিত ছিঁচকাঁদুনে দুঃখবিলাস আজকাল আর অনুভূত হয় না।  


তার প্রধান তথা অন্যতম কারণ অবশ্যই আমার তৎকালীন টিম, আমার টিম চুঁচুড়া। আর দ্বিতীয়ত মোদের তখন শিরে সংক্রান্তি। দিন বারো বাদেই আমাদের মেলা," শ্রমিকমেলা, চুঁচুড়া - ২০২১।" সময় কম, লোকবল তলানিতে, আর অর্থ বল? বাজেট কাটতেছাঁটতে যাকে বলে জেরবার আমরা। নির্দয় হাতে ছাঁটা হচ্ছে মেলার যাবতীয় সৌন্দর্যায়ন। প্রতিপদে কেটারার আর ডেকরেটরের সাথে দরদাম করে চলেছে আমার অবশিষ্ট খঞ্জভঙ্গ টিম। শেষে গতকাল উনি হতাশ হয়ে বললেন, “বাজারদর সম্পর্কে আপনাদের কোন ধারণা আছে ম্যাডাম? আলু-পেঁয়াজের দাম জানেন? গ্যাসের দাম জানেন?” আলু-পেঁয়াজের সঠিক দাম না জানলেও, জানি বাজারে লেগেছে আগুন। আর সদ্য অনলাইন গ্যাসের বিল দিয়েছিলাম, তাই এমাসে গ্যাসের দামটা ঠোঁটস্থ। উনি আমাদের সম্মিলিত অত্যাচারে ঐ ঠাণ্ডাতেও ঘেমে উঠছিলেন। কপালের ঘাম মুছে হেসে বললেন, “ওটা তো ডোমেস্টিক ম্যাডাম। কমার্শিয়াল সিলিণ্ডার আরও অনেক বেশী মূল্যবান।” সে হোক। আমরা নিরূপায়। আপনার যা প্রাণ চায় করুন। যা খুশি বিল দিন। আমার এইটুকুই সম্বল- 


সকাল আটটা। তড়িঘড়ি রেডি হচ্ছি আপিস যাব বলে, মুঠো ফোনে মধুঝরিয়ে গান ধরেছেন কিশোরকুমার, “ঝটক কে গেঁসু যাঁহা চলে,তো সাথ মেঁ আশমাঁ চলে-।” এমন সময় বেরসিকের মত বেজে উঠল ফোনটা। ছুটে এসে যখন ধরলাম, সিক্ত কেশ গুচ্ছ দিয়ে টপাটপ ঝরে পড়ছে মুক্তোকণা। গানটাকে গত রাতে কিছুতেই খুঁজে পাইনি। আজ সকালে অনুধাবন করলাম, “কেয়া সুরৎ হ্যায়” বলে অন্বেষণ করলে, “জরুরৎ হ্যায়”কে খুঁজে পাওয়া যায় না। 

ফোনের ওপারে অতিরিক্ত জেলাশাসক মহোদয়ের ব্যক্তিগত সহায়ক। সদ্য ঘুমভাঙা জড়ানো অসহায় কণ্ঠে জানান, অনিবার্য কারণ বশতঃ আজকের বৈঠক বাতিল। বসের নির্দেশ সবাইকে জানাতে হবে, অথচ ওণার গৃহে বা মোবাইলে কারো নম্বর নেই। লাজুক কণ্ঠে সবিনয় অনুরোধ, যদি বাকি আধিকারিকদের এট্টু জানিয়ে দিই- অত্যন্ত আনন্দের সাথে রাজি হয়ে যাই। বর্ষবরণের প্রাক্কালে বৈঠক বাতিলের সংবাদ বহন অতীব পূণ্যকর্ম। 


সকাল নটা। গুড় নিয়ে ফেরে শ্রীমতী তুত্তুরী। তিনি তখন সদ্য দশে পড়েছেন। একটু একটু করে গজাচ্ছে ডানাপাখনা। ঘুম থেকে উঠে লাফাতে লাফাতে গিয়েছিল আবাসনের মার্কেট থেকে আখের গুড় আনতে। কিনে এনেছে ভেলিগুড়। একখানা জাম্বো নারকেল দিয়েছে মা। বেহারী নারকেল। দেশ থেকে এনে দিয়েছে পৌরসভার ঝাড়ুদার। রোজ ময়লা নিতে এসে খোশগল্প করে বাবা আর মায়ের সাথে। যত এদের নিষেধ করি, অপরিচিত- অর্ধপরিচিত মানুষের সাথে এত খোশ গপ্প করো না। জমানা খারাপ। তা শুনলে তো? কদিন আগে বোধহয় মা বলেছিল আমার জামাই আর নাতনী নারকেল নাড়ু খেতে বড় ভালোবাসে। বাজার গিয়ে বাবার পক্ষে নারকেল কিনে আনা প্রায় অসম্ভব। স্থানীয় যারা বাজার নিয়ে বসে তারা তো আর নারকেল বিক্রি করে না।  


মায়ের দুঃখে গলে গিয়ে, চারদিন কাজে ডুব মেরে, চার খানা খোক্ষস মার্কা নারকেল এনে দিয়েছে ঝাড়ুদার। দরাদরি অন্তে নগদ ৩৫০টাকায় কেনা চারখানা নারকেল, যার দুখানি নাড়ু রূপে আর একখানি গোটাগুটি এসে হাজির হয়েছেন আমার গৃহে। নারকেল তো পেলাম,ফাটাই কি দিয়ে? ছোট নারকেল হলে বাটনা বাটার নোড়া মেরে ঘায়েল করে লতা দি। এটা যা জাঁদরেল। 


রমেশকে বলেছিলাম একটা কাটারি কিনে দিবি বাবা? অত্যুৎসাহী জনগণ যত। নিজের বাড়ির ভারি কাটারিটাই গছিয়েছে দিন কয়েকের জন্য। তিনি এসেছেন তো এসেইছেন। কাজে আর লাগানো হচ্ছে না তাঁকে। মায়ের হাতের নাড়ু শেষ হলে তবে না নতুন নাড়ু পাকাব। 


গতকালই লতাদিকে বললাম,যা হয় হোক, এবার কাটারিটা ফেরৎ দিতে হবে। ভেবেছিলাম বছর শেষে আপিস ফেরতা চিনির নাড়ু পাকাব। বাপ-মেয়ের না পসন্দ। সাতসকালে তাই কৌটো নিয়ে দৌড়েছিল তুত্তুরী পাঁচশ আখের গুড় আনতে। তখনও আমরা মহানগরের বাসিন্দা। মেয়েকে দোকানে পাঠাতে খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করত না শৌভিক। ভয় পেত। যা ট্যালা মেয়ে আমাদের। খুব বায়না করলে, টাকাপয়সা ছাড়াই দোকানে পাঠানো হত তুত্তুরীকে। দোকানদার হোয়াটস্ অ্যাপে পাঠিয়ে দিত বিল। তখনও UPI শিখিনি আমরা। আপিস ফেরৎ ক্যাশ টাকায় বিল মিটিয়ে আসত শৌভিক।


আজ দোকানদার অনুপস্থিত। অল্পবয়সী অবাঙালি কর্মচারী আখের গুড় বোঝেনি। পাঁচশ ভেলি গুড় গছিয়েছে। তাই নিয়েই নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেছে আমার কন্যা। আখের গুড়ের পরিবর্তে ভেলি গুড় এনেছে বটে, তবে পথে কোন বুড়ো রিক্সাওয়ালা নাকি মামণি বলে ডেকে বিনামূল্যে বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছে, তাকে দিব্য মায়ের ভয় দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে ফিরে এসেছে ট্যালা মেয়েটা। মনে হল বর্ষ শেষে এটাই কম পাওনা কি? রোমে টিকতে হলে রোমান হতে হয়, আর জঙ্গলে বাস করতে হলে- 


বেলা দশটা- “আজ কোথাও যাচ্ছ তোমরা?” ফোনের ওপার থেকে সংকুচিত ভাবে জানতে চাইল উমা। তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ভেলিগুড় বিদায় করে, ধার করা কাটারি বগলে আপিস বেরোতে একটু দেরীই হয়ে গেছে। হাসি চেপে জানালাম, যাচ্ছিই তো। যে যার আপিস। “তাহলে সোনাইকে নিয়ে একটু বেরোব?” আবার জানতে চায় উমা। শ্রীমতী ফুলঝুরি তখনও ঘুমিয়ে আছেন ভবিষ্যতের গর্ভে। বিবাহোত্তর জীবনে উমার প্রিয়তম বন্ধু শ্রীমতী তুত্তুরী ওরফে সোনাই। কাকিমা আর তার সোনাইয়ের মধ্যে সাধারণত ঢুকতাম না আমি। আজও ঢুকি না। যা খুশি কর না বাপু তোরা।   


বেলা এগারোটা- আপিসে ঢুকতেই পুরসভার ইন্সপেক্টর সঞ্চিতা বলে ওঠে, “ওরা কিন্তু আসবে ম্যাডাম। দল বেঁধে।” ওরা অর্থাৎ আমার চুঁচুড়ার SLOরা,আসবেই, জানি। গতকাল মেলার সমস্ত দপ্তরী দায়িত্ব থেকে ওদের অব্যাহতি দিয়েছিলাম যে। তারপর থেকেই উত্যক্ত করছে ওরা। 


সাংগঠনিক ভাবে মেলা বয়কটের ডাক দিয়েছিল কোন এক সংগঠন। অন্যান্য জেলা, অন্যান্য মেলা থেকে উড়ে আসছিল নানা অপ্রীতিকর গুজব। ভাইরাল হচ্ছিল ক্লিপিং। পরিস্থিতি বিচার করে চন্দননগরের তৎকালীন বড় সাহেব বললেন, ‘তোমার ছেলেমেয়েগুলো ভালো, তোমায় বড় ভালবাসে। তুমি বললে ওরা ফেলতে পারবে না। কিন্তু সাংগঠনিক ভাবে যদি ওরা মেলা বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমাদের চাপ দেওয়া অনুচিত। দেখো কি করবে-।’ আমার ছেলেমেয়ে গুলো সত্যিই ভালো, মেলা নিয়ে আমাদের থেকে ওদের উত্তেজনা বেশী। বলাগড়ের শ্যামল তো রোজই লিখে চলেছে, ‘দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসবে আমাদের মেলা দেখতে। কত লোক চাই ম্যাডাম। আমি আনব।’ ধরে বেঁধে থামাতে হয় এদের। বাপঃ করোণা এখনও আছে কিন্তু। 


তবুও ভেসে আসে নানা অপ্রীতিকর বার্তা। অন্য মহকুমার লোকজনের তিক্ত ঝাঁঝালো উক্তি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য পাশের মহকুমার এক SLOকে ফোন করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তৎকালীন RLO ইন্সপেক্টর কৌশিক। “জানেন না আমাদের কি অবস্থা?” অবস্থা আমাদের থেকে ভালো কে জানে? তুচ্ছ ফিল্ড আপিসের ওপর গোঁসা হতেই পারে, কিন্তু ফিল্ড আপিসের অসহায়তা বুঝবি না তোরা? তাহলে কে বুঝবে? ক্ষোভ অভিমান তো আমাদেরও হয়- তাই লিখেছিলাম, মেলা তো তোমাদেরই, অবশ্যই মেলায় এস, মেলার কাজে অংশগ্রহণ করো, কিন্তু স্বেচ্ছায়। এবার অফিশিয়ালি যাবতীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল SLO দের। ‘আপনি আর কপনি’ নিয়েই লড়ে যাব আমরা। 


বেলা একটা- তুত্তুরীর ফোন আর থামেই না। দারুণ কাটছে আজকের দিনটা। পিছনের কেরিয়ারে সোনাইকে বসিয়ে সারা আবাসন সাইকেলে চক্কর মেরেছে কাকিমা। জীবনে কখনও সাইকেলের কেরিয়ারে বসেনি তুত্তুরী। তারপর পাড়ার ছোট্ট পার্কে ঢুকে এক অবাঙালি শিশুর থেকে ধার করা ফুটবল নিয়ে হুল্লোড়বাজি, দোলনায় চড়া, ঢেঁকিতে চড়া আর তারপর মাঠে রোদ পোয়াতে আসা জনৈক দাদুর আদরের থলথলে ল্যাব্রাডর কুতুয়াকে ধার নিয়ে আশ মিটিয়ে চটকেছে দোঁহে। আদরের দাপটে নাজেহাল কুতুয়া মাঝে একবার পালিয়ে গিয়ে পাশের গাছে পা তুলে কিভাবে ইয়ে করেছে সেই গল্পও শোনায় তুত্তুরী। সারা বেলা টইটই করে ঘুরে, হাফ প্যাডেল শেখা তথা শেখানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টান্তে বাড়ি ফিরেছে দুজনে। ' উফঃ এমন দিন কেন যে রোজ আসে না-', একসাথে চিৎকার করে দুটোতে, সাধে ব্যাটাদের মধ্যে ঢুকি না।  


বেলা তিনটে- কালো হয়ে আসা মুখগুলিতে মাখামাখি আব্দার আর আর্তি। রমেশ, সমীর, প্রদীপ, শ্যামল, মাম্পি, প্রিয়াঙ্কা, অমৃতা আরো যেন কারা কারা। “ও ম্যাডাম, রাগ করবেন না।” “দুঃখ পাবেন না। মেলা থেকে প্লিজ আমাদের সরিয়ে দেবেন না। আমরা আসব হ্যাঁ-”। হ্যাংলার মত বলে মগরার SLO প্রিয়াঙ্কা। ওটাই পালের গোদা যে। পোলবা-বাঁশবেড়িয়ার কালেক্টিং এজেন্ট দিদিরাও এসেছে ওদের সাথে। মহুয়াদি বলেন, " আমরা তো SLO নই ম্যাডাম। আমরা তো CA। আমাদের কেন বাদ দিচ্ছেন ম্যাডাম -"।ওদের মেলা থেকে ওদের বাদ দেবার ক্ষমতা কি আমার আছে? কত বড় শক্তিধর আমি? আর রাগ? রাগ হলেও তার স্থায়িত্ব কতক্ষণ এরা ভালোমতই জানে। মন কষাকষি, মান অভিমান, রাগ-অনুরাগ মিটতে মেটাতে গড়িয়ে যায় বেলা। ALC সুখেন বর্মন সাহেব গলা ঝেড়ে, হাত কচলে, জানান দেন, "সব তো হল, এবার একটু কিছু খাওয়া দাওয়া হবে না? আজ যে বছর শেষ।" বুঝতে বাকি থাকে না, বাইরে থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে সবাই মিলে। ইন্সপেক্টর থেকে SLO, এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার সব্বাই। ছদ্ম গাম্ভীর্যের প্রসাধনের আড়ালে ফিক করে হেসে ওঠে হৃদয়,‘ এমনি ভাবেই কাটুক না বছর গুলো, কিছু নরমে, কিছু গরমে। কিছুটা লোহায় আর বাকিটা নিখাদ সোনায়।’


বিগত কয়েক বছরে বদলে গেছে কতকিছুই, চাকরী ছেড়েছেন আমাদের চন্দননগরের বড় সাহেব, টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সেদিনের টিম চুঁচুড়া। অবসর নিয়েছেন বর্মন সাহেব। আমি বদলী হয়ে এসেছি তমলুক, সঞ্চিতা গেছে ব্যারাকপুর, কৌশিক - নির্মল - চঞ্চল ও ছিটকে গেছে বিভিন্ন জেলায়। সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে চলে গেছে ধীমান। রয়ে গেছে কেবল স্মৃতিগুলো।


অনির ডাইরি ২ রা জানুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



এই তো সেদিনের কথা। বোধহয় সেটা সেপ্টেম্বর মাস, বহুরূপীর মত ভোল বদলাচ্ছিল প্রকৃতি। এই টিকি পোড়ানো গরম, তো এই ভেসে গেল বুঝি ধরা। এই থিকথিক করছে ভিড়, তো এই শুনশান আমাদের আপিস। তেমনি এক সায়াহ্নে স্কুলের বন্ধুদের মেসেজ করলাম, " ভাবছি ঘুমিয়ে পড়ি -"। জানলার বাইরে ঝুলছে, মসিকৃষ্ণ মেঘের পর্দা, বাজের দাপটে বন্ধ সব কম্পিউটার, আমরা গুটি কয় হতভাগ্য কর্মচারী ভিন্ন আপিস প্রায় জনশূন্য। 


ঘুমিয়েও পড়তাম হয়তো, যদি না বড়সাহেব মেসেজ করে জানতে চাইতেন, "বারখোদা কার এলাকা জানো?" গুগল করে দেখলাম, আমার এবং মুকুলের। মহকুমা আমার আর ব্লক মুকুলের। একজনের নাম দিয়ে স্যার বললেন, 'খোঁজ নিয়ে দেখো তো, এই লোকটি ওই অঞ্চলের বাসিন্দা কি না। যদি হয়, তাহলে কেমন আছে?" এমন মেসেজ তো সচরাচর করেন না বড়সাহেব, প্রতিবেশী দেশের সৌজন্যে সেই সময় যত্রতত্র বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর হামলা হচ্ছে, এটাও কি তেমন কিছু নাকি? জানতে চাইবার আগেই জানালেন বড়সাহেব, আমার অনুমানই সঠিক, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক, ভিন রাজ্যে ফুলের কাজ করত। মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছে - 


অন্যান্য মহকুমা গুলোতে ভুরি ভুরি এমন কেস আসছিল, তমলুক তুলনামূলক ভাবে বর্ধিষ্ণু মহকুমা বলেই হয়তো, এর আগে এই রকম একটাই কেস এসেছিল, ময়নার ছেলে। খবর এসেছিল পিটুনি খেয়েছে, কাজ হারিয়েছে।বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে তো আমার লোকজনেরই পিটুনি খাবার উপক্রম। ছেলে ভালো আছে, বিদেশবিভূঁইয়ে থাকে, হোটেলে কাজ করে, মাসে মাসে ভালো টাকা পাঠায়, খামোখা কেন আমরা ফোন করে বা বাড়ি এসে উৎপাত করছি? অনেক কথা শুনিয়েছিল বাড়ির লোক। ভাবলাম, এটাও তেমনি হবে হয়তো। প্রার্থনা করলাম, এটাও তেমনিই হোক। আর আমিও একটু ঘুমিয়ে নিই, বড় মুখ করে বললাম বন্ধুদের। আগের বার ইন্সপেক্টর সৌরভ আর এসএলও রঞ্জন খিস্তি খেয়েছিল, এবার না হয় মুকুল আর মতিবুল দুটো গাল খাক, লোকটা যেন ভালো থাকে ঠাকুর।


বৃষ্টির দাপট একটু কমেছে, দল বেঁধে ছাতা নিয়ে টিফিন করতে যাচ্ছিল আমার লোকজন। দৌড়ে গিয়ে বললাম, দুমিনিট দাঁড়া বাবা। একটু খোঁজ নিয়ে দেখে নিই, লোকটা ঠিক আছে কিনা। মতিবুলকে ফোনেই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না আশেপাশের পঞ্চায়েতের জনা দুই তিন এসএলওকেও। বাজ আর বৃষ্টির দাপটে সবাই ফোন বন্ধ করে বসে আছে নাকি? বাকিদের খেতে পাঠালাম, শান্তনু একা রয়ে গেল ফোন করার জন্য। 


বেশ কিছুক্ষণ পর বাজল মতিবুলের ফোন। নামটা বলল শান্তনু, ওপাশ থেকে কি জবাব ভেসে এল জানি না, ফ্যালফ্যাল করে খানিক আমার দিকে তাকিয়ে শান্তনু বলল, "ম্যাডাম মতিবুল বলতেছে, ছেলেটা মরে গেছে।" কি বাজে বকছ, বলে ফোনটা কেড়ে নিই আমি। মতিবুল তখনও ধরে আছে ফোনটা, আবার শুধালাম আমি, ও কি ছেলেটাকে চেনে? ছেলেটা কি সত্যিই পরিযায়ী শ্রমিক? কেমন আছে ছেলেটা? আবার জবাব দিল মতিবুল, " হ্যাঁ ম্যাডাম, চিনি তো। আমার বাড়ির পাশেই থাকে। পিটিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিছে, আর বেঁচে নেই -। আমি আপনাকে ছবি পাঠাচ্ছি।" 


ক্লান্ত, পরাজিত হয়ে মাথা নীচু করে চেম্বারে ফিরে আসি, ভারী মন, ভারী গলায় বড়সাহেবকে দুঃসংবাদটা দিই। জানাই মতিবুল ছবি পাঠাচ্ছে, মিলিয়ে নেওয়ার জন্য। বড় সাহেব আঁতকে ওঠেন, "কিসের ছবি?" বলি, ছেলেটার বা তার আধার, ভোটার কার্ডেরই হবে। স্যার বলেন, "না। ওর বর্তমান অবস্থার। আমিও পেয়েছি ওই ছবিগুলো, ইচ্ছে করেই তোমায় পাঠাইনি। এত বীভৎস, তুমি প্লিজ ওগুলো দেখো না -"। স্যারের ফোন শেষ হবার আগেই, দৌড়তে দৌড়তে আসে শান্তনু, " ম্যাডাম, মতিবুল কি সাংঘাতিক সব ছবি পাঠিয়েছে -। একদম দেখবেননি। একটা দেখেই আমার মাথা ঘুরছে -"। 


কেমন দেখতে হয়, গণপ্রহারে মৃত মানুষকে? আমার দেখার ইচ্ছে হয়নি। জানি সহ্য করতে পারব না। অপরিসীম ক্লান্তির সাথে সাথে এক অক্ষম রাগ আমাকে তিলে তিলে গিলে খাচ্ছিল। কেন? কেন? কেন? আধার নম্বর জোগাড় করে ততক্ষণে পোর্টাল খুঁজে দেখে ফেলেছে বেদজ্যোতি, আছে, ছেলেটি আছে। সরকারী প্রকল্পে নথিভুক্তও আছে। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে দুলক্ষ টাকা পাবে ছেলেটির উত্তরাধিকারী। তাতে কি? কত টাকা মূল্য হয় একটা প্রাণের? আদৌ কি কোন মূল্য হয় প্রিয়জন বিরহের -।


তারপর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস, ঘুরে গেছে বছরও। মাননীয়ার ভার্চুয়াল মিটিং উপলক্ষে আজ আমাদের অফিসে এসেছিলেন বড় সাহেব, মিটিং শেষে যেমন হয় আর কি, চায়ের কাপে খানিক আড্ডা বসে। আড্ডা জুড়েও থাকে আপিস, কাজ কেমন চলছে, কেমন চলছে না। কেন চলছে না ইত্যাদি প্রভৃতি। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ বড় সাহেব শুধালেন, " আচ্ছা অনিন্দিতা, সেই কেসটার কি হল?" চায়ের কাপ নামিয়ে সোজা হয়ে বসি, জানতে চাই, কোন কেস? উনি বলেন, "সেই যে ট্রেন থেকে মেরে ফেলে দিয়েছিল -। তাদের টাকা দিয়ে দিয়েছ?" 


বিস্তর ভেবে, মাথা চুলকেও মনে করতে পারি না। বিগত কয়েক মাসে কত কেসই তো ছাড়লাম, তার মধ্যে বেরিয়ে গেল কি? বেল বাজিয়ে শান্তনুকে ডাকি, সে একবার বলে হ্যাঁ, একবার না। তারপর আমার থেকেও দ্রুততায় মাথা চুলকায়। যেমন অফিসার তেমনি তার CKCO। এই আপিসে কি গণ খুশকি হল নাকি! অবস্থা সামলে বেদজ্যোতি পাশ থেকে বলে, " না না, আমার মনে আছে। ওরা এখনও অ্যাপ্লাই'ই করেনি।" যাঃ বাবা, কেন রে ভাই? বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, "একটু দেখ" বলে বেরিয়ে পড়েন স্যার। 


ততক্ষণে মুকুলকে ফোন করে ফেলেছে শান্তনু। ব্লকে বসে বিস্তর মাথা চুলকে ফেলেছে আমার ইন্সপেক্টরও। তারপর বলেছে, " ওরা তো অ্যাপ্লাই করেনি।" আরে বাবা, সেটাই তো জানতে চাইছি। কেন করেনি? কাগজপত্রের কোন সমস্যা হয়েছে কি? মুকুল জবাব দেয়, "না ম্যাডাম। না ম্যাডাম। করেনি কারণ ছেলেটা ইয়ে (ঢোঁক গিলে) মানে বেঁচে আছে।" অ্যাঁ!সত্যি! এও কি সত্যি হতে পারে? গণপিটুনির পর চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিলেও মানুষ বেঁচে যেতে পারে? ঈশ্বর কি সত্যিই এমন করুণাময়? সেদিন কি তিনি সত্যিই শুনে ফেলেছিলেন আমার মনের কথা? বুকের মধ্যে বেজে ওঠে সন্দেহ অবিশ্বাসের বাদ্যি। জানতে চাই তোমায় কে বলল? মুকুল ঘাবড়ে গিয়ে বলে, "মতিবুল ম্যাডাম!"


মতিবুলই তো আগের বার বলেছিল আর বেঁচে নেই ছেলেটা। তাহলে কি কোন ভুল হচ্ছে? আমার মুখে সন্দেহের আলোছায়া দেখে সটান মতিবুলকেই ফোন করে শান্তনু। এবার একটা রিংয়েই ফোনটা ধরে মতিবুল। একরাশ খুশি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শান্তনু বলে "ম্যাডাম মতিবুল ও বলতেছে, ছেলেটা বেঁচে গেছে।" উত্তেজনা চাপতে না পেরে, এবারেও ফোনটা কেড়েই নিই আমি। মতিবুল তখনও ধরে আছে ফোনটা, আবার শুধাই আমি, ঐ ছেলেটাই তো? সত্যিই বেঁচে গেছে তো? আবার জবাব দেয় মতিবুল, " হ্যাঁ ম্যাডাম, সেই ছেলেটাই। আমার বাড়ির পাশেই থাকে। পিটিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছিল, সবাই ধরে নিয়েছিল আর বেঁচে নেই -। কিন্তু উপরওয়ালার দয়ায় ও বেঁচে গেছে ম্যাডাম।"


ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ি আমি, এত নির্ভার বহুযুগ বোধ করিনি। মৃত্যুকালীন অনুদান ছাড়া আমার সবথেকে অপছন্দের কাজ। প্রতিটা মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় না জানি কতই না গল্পকথা। টিপ সই বা আঁকাবাঁকা হাতে লেখা অনুদানের আবেদন পত্র, ডেথ সার্টিফিকেট, কজ অফ ডেথ, পুলিশ রিপোর্ট, পোস্টমর্টেম ইত্যাদি ঘাঁটতে রীতিমত আতঙ্ক লাগে আমার। বিমর্ষ বোধ করি আমি। আজ বছরের প্রথম কর্মদিবসে ছেলেটির বেঁচে থাকাটা যেন ব্যক্তিগত ভাবে আমারই জিৎ। বিরাট সুখবর। ভালো থাকুক বাবা ছেলেটা, আলো করে থাকুক সুখী গৃহকোণ। ভালো থাকুক পেটের টানে বিদেশবিভূঁইয়ে কাজ করতে যাওয়া প্রতিটা মানুষ।

Sunday, 29 December 2024

অনির ডাইরি ডিসেম্বর, ২০২৪

 অনির ডাইরি ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



আমি মেয়েকে ছাড়া কোত্থাও যাই না, অফিস ব্যতিরেকে। পার্টি, পিকনিক থেকে মামুলী গেট্টু যাই হোক না কেন শ্রীমতী তুত্তুরী আমার সাথে প্যাকেজ ডিলে থাকেই। এমনকি বিয়েশাদি - জন্মদিন ইত্যাদি উপলক্ষে কেউ আমায় নিমন্ত্রণ করতে এলেই আমি হ্যাংলার মত মুখ করে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকি, একবার শুধু মুখ ফুটে বলার অপেক্ষা, 'তুত্তুরীকেও আনবেন ম্যাডাম'-। 


আজ বড়দিন, স্কুলের বন্ধুদের পিকনিক, অথচ সেই মেয়েকে ছাড়াই আসতে হল আজ। হঠাৎ করেই মেসেজ এসেছে, কাল তাঁর কেমিস্ট্রি এসেসমেন্ট, তাই তিনি কিছুতেই আসতে রাজি হলেন না। গোটা বাংলায় এমন কোন ইংরেজি মিডিয়াম ইস্কুল আছে বাপু, যারা বড়দিনের পরের দিন পরীক্ষা নেয়? বলুন দিকি ব্যাপারটা কি অসৈরণ নয়। কত করে বললাম, চল না, না হয় দিবি না একটা পরীক্ষা, তাতে তিনি, তাঁর বাপ, বাপের মা মিলে আমায় এমন তিরস্কার করলে -। 


এত দূর উজিয়ে পিকনিকে আসার ইচ্ছে আমার শুরু থেকেই ছিল না। কিন্তু জনে জনে এমন ফোন করে উত্যক্ত করতে লাগল, যে আসতেই হল। সিকি শতাব্দী হল ইস্কুল ছেড়েছি আমরা, আজও আমার সহপাঠীরা আমার সঙ্গের জন্য উন্মুখ, ব্যাপারটা ভাবলে রীতিমত আর্দ্র হয়ে ওঠে হৃদয় । এই কায়েমি দুনিয়ায় ভালোবাসা বড় দুর্লভ। সামান্য পথশ্রমের জন্য তার অমর্যাদা করতে অন্তত আমি রাজি নই। 


ভাবলাম  এত দূর উজিয়ে যাবই যখন একটা রাত থেকেই আসি বাড়িতে। আমার বুড়োবুড়ি খুশি হয়ে যাবে। তিলতিল করে কতকিছু যে গোছালাম বাবা মায়ের জন্য - শীতের ডবকা কমলা লেবু, ঝোলা নলেন গুড়, গুড়ের পায়েস, আমলকীর ঝালআচার, মিষ্টি আচার এমনকি কড়াইশুঁটির কচুরির পুর ও। বয়স বড় অশক্ত করে দেয় মানুষকে। আর তো রাস্তায় বেরোতে পারে না বাবা। ভালমন্দ কিছু খেতেও পায় না সেভাবে। ঐ আয়া দিদি যা কিনে আনে, তাতে অবশ্য ওদের কোন ক্ষোভ নেই। দিব্যি ফূর্তিতে আছে দোঁহে, তাও মেয়ের মন - 


ভাবলাম যাবই যখন লতা দিকেও সঙ্গে নিয়ে যাই। অনেক দিন বাড়ি যায়নি মানুষটা। এই উৎসবের দিনে একবার দেখে আসুক নাতি নাতনী গুলোকে। আমি আর লতা দি দুজনেই থাকব না, শুনেই মুখ শুকিয়ে যায় শাশুড়ি মাতার। কত কষ্ট করে যে তাঁকে বোঝাতে হয়, ' আরে বাবা কালই ফিরে আসব। মাত্র একটা  রাতের তো ব্যাপার। তোমার ছেলে তো রইল। আজ উৎসবের দিনে হাওড়ার বাড়িতেও একটু আলো জ্বলুক।' 


এত দিক গুছিয়ে যখন রওনা দেব, বেঁকে বসলে আসল লোকটাই। নাতনী যাবে না শুনে যতটা চওড়া হল শাশুড়ি মাতার মুখের হাসি, ততোটাই ম্রিয়মাণ শোনাল আমার মায়ের গলার আওয়াজ। "তুত্তুরী আসবে না? কেন?" দুটো ভারী ব্যাগ সহ আমায় দেখেও উজ্জ্বল হল না মুখ। গেলবার এসে দেখেছিলাম মায়ের তুলসী গাছটা মরে গেছে, মনে করে সেটাও বয়ে এনেছি আমি আর লতা দি, তাও খুশি হয় না কেউ। অন্যমনস্ক ভাবে সিগারেট ধরিয়ে বাবা তো বলেই ফেলে, " তুমিও না এলেই পারতে। তুমি সুখে ঘর সংসার করো, এটাই আমরা চাই। তাছাড়া মাকে ছাড়া থাকতে তুত্তুরীর কি ভালো লাগবে?" 


এমনিতেই মেয়ের জন্য মন খারাপ, তার ওপর এমন অভ্যর্থনা কার ভালো লাগে। বাবামায়ের তাড়নাতেই ফোন করি বাড়িতে। মুঠোফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে বাপ মেয়ের হর্ষিত স্বর। ব্যাডমিন্টন খেলছেন দুজনে। ঠাম্মা রোদ পোয়াচ্ছেন। আমার জন্য মনখারাপ কিনা আর জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করি না। জবাবটা স্পষ্ট। বেলা গড়ায় আমাদের পিকনিক জমে ক্ষীর হয়ে ওঠে। বন্ধুদের সাহচর্যে, ভালোবাসায়,  বন্ধু পুত্রকন্যাদের গানে নাচে, সৌন্দর্যে, মিষ্টতায় মোহিত হতে হতে, দ্রবীভূত হতে হতেও কোথায় যেন একটা কাঁটা ফোটে। ইশ আমার তুত্তুরীটাও যদি আজ এখানে থাকত -


'দিন যায়, সন্ধ্যা ঢলে'। আমায় কেউ ফোন করে না, আমিই হ্যাংলার মত বাড়িতে ফোন করি। "হ্যাঁ রে ঠিক আছিস তো?" জবাব আসে দারুণ আছে দুজনে। মেয়ে কম্পিউটার খুলে প্রজেক্ট করছে, বাবা ড্যালরিম্পল পড়ছে, ঠাম্মা আশাপূর্ণা দেবী পড়ছে। জানতে চাই, কাল সকালে কি খেয়ে ইস্কুলে যাবে, টিফিনে কি নিয়ে যাবে। শৌভিক বলে, " সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তোকে কিছু ভাবতে হবে না।" 

মন খারাপ হয়ে যায়, কেমন যেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। 


ভোর ভোর উঠে খোঁজ নিই, রাতে ঘুম হয়েছে তো? মেয়ে ইস্কুল গেছে তো? কে দিতে গেল? কে আনতে যাবে? টিফিন কি নিল? বুঝতে পারি, আমায় ছাড়াও দিব্যি চলে গেছে সবকিছু। আমায় ছাড়াও দিব্যি চলে সবকিছু। আপিসে ঢু মেরে, বেপোট জ্যাম, অবরোধ কাটিয়ে বাড়ি ফিরতে গড়িয়ে যায় সন্ধ্যা। শাশুড়ি মাকে সবার আগে দর্শন দিই, এবার ভিতরে যাবার পালা। শোবার ঘর থেকে ভেসে আসছে উত্তেজিত কথাবার্তা আর অট্টহাসি। তুত্তুরী এমন কিছু করেছে যে শৌভিক বলছে, " তুই বেরো।" তুত্তুরী হেসে গড়িয়ে পড়ছে আর বলছে, " না বেরোব না।" 


ছবির মত সুখী গৃহকোণ, তবুও বুকের ভেতর কোথায় যেন বিষণ্ণতার সুর বাজে। বড্ড তাড়তাড়ি বড় হয়ে গেল মেয়েটা। মেয়েগুলো বড় বেইমান হয়। কেমন বাপের দলে নাম লিখিয়েছে দেখ। সবই আমার কর্মফল। আমিও যে এমন ছিলাম। মাও নির্ঘাত এমনই নিঃসঙ্গতায় ভুগত। আমার আর কোন জায়গাই নেই এদের দুনিয়ায়। কাষ্ঠ হেসে ব্যাগটা রাখি ব্যাগের জায়গায়। হাতঘড়ি খুলি, খুলি আলগা বালাটা। কানের দুল খোলার আগেই ছুটে আসে শ্রীমতী তুত্তুরী, " মা আমি তোমার জন্যই বসে ছিলাম। তোমাকে কত কিছু যে বলার আছে। জানো আজ বন্ধুরা কি বলছিল, এই স্যার আর ঐ ম্যামের মধ্যে বোধহয় কিছু একটা চলছে -" দম না ফেলেই বলে যায় তুত্তুরী। কোন স্যার, কোন ম্যাম কাউকেই চিনতে পারি না আমি। ততক্ষণে প্রসঙ্গ বদলে গেছে, " পরের দিন অমুক স্যারের ক্লাস থাকলে কিন্তু আমি ছাতা নিয়ে যাব মা। উনি চিৎকার করলেই এমন থুতু ছিটান। আজই একটা ফোঁটা টপ করে পড়ল বেঞ্চে। আমি অমনি লাফিয়ে পাশের মেয়েটার কোলে। স্যার যদিও প্রচণ্ড লজ্জা পেয়ে অনেকবার সরি বললেন। তাও -"। গল্প থামতেই চায় না তুত্তুরীর। ফাঁক পেয়ে টুক করে পালিয়ে যায় শৌভিক। বেরোতে বেরোতে ইশারায় বলে যায়, কাল সারাদিন আমি সামলেছি, এবার তোর পালা। ম্যাও সামলা। আপত্তি করি না আমি, হাত পা না ধুয়েই জমিয়ে বসি আমি, হাঁ করে গালে হাত দিয়ে শুনি আমি। কখনও হাসি আমি, কখনও নৈতিকতার শিক্ষা দিই আমি, আর মনে মনে ভাবি," আছে, আছে, সব আছে।"

ছবি সৌজন্য - আমার বর


অনির ডাইরি ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 


তুচ্ছ কারণে প্রবল ক্রোধান্বিত এবং প্রবলতর ধমকচমক দেবার পর মনে পড়ল, আরে, দিন দুয়েক আগেই তো দেখলাম একটা রিলে, রাগ কমানোর উপায়। এক অতীব রূপসী, তন্বী মহিলা, ঝিম ধরানো স্বরে পাখি পড়া করে শেখালেন," রাগ হলেই ওমন ষাঁড়ের মত চিৎকার করবেন না। তাইলে কি করবেন? চারদিকে তাকিয়ে দেখুন। যে কোন চারটে জিনিসকে লক্ষ্য করুন যাদের আকৃতি আলাদা আলাদা -"।


 অফিসের সামনের করিডরে পায়চারি করতে করতে সত্যিই চারদিকে তাকালাম। আমাদের স্টোর রুমের দরজাটা, একটা নিটোল টেকো লোক ভূমি রাজস্ব না কি যেন দপ্তরের সামনে বসে গভীর মনোযোগ সহকারে আবেদন পত্র লিখছে, তার টাকটা ইত্যাদি প্রভৃতি। হলো চারটে শেপ। এবার দ্বিতীয় ধাপ, চারটে জিনিসের রঙ খেয়াল করতে হবে। তাও করলাম। এবার চারটে গন্ধের কথা ভাবতে হবে -গোলাপ, চন্দন, বিরিয়ানি আর কি যেন একটা ভাবলাম। এবার চারটে খাবারের স্বাদের কথা ভাবতে বলেছিল বোধহয়, হাঁটতে হাঁটতে চোখ বন্ধ করে ভাবি -আহা ভাপা ইলিশ, গরম বিরিয়ানি, সিদ্ধ ডিম দিয়ে মেয়োনিজ (খাইনি যদিও, বানাইওনি, তবে রিলে তো দেখেছি) আর তেল জবজবে করে ভাজা শীতের কচি বেগুন। আহা আহা। মনটা স্বর্গীয় আনন্দে ভসভসিয়ে উঠল। কি ছাগল আমি, এটা তো আগে ভাবলে আর অনর্থক চিৎকার করে সবাইয়ের পিলে চমকাতাম না। মনস্থির করে ফেললাম, এবার থেকে মনকে বেপথু করতে এটাই করব। 


অচীরেই প্রয়োজন পড়ল, মনকে বেপথগামী করার। দুপুরে আজ ভুরিভোজ হয়েছে। ঠিক করেই রেখেছিলাম, আপিস থেকে ফিরে এক কাপ কালো কফি আর রাতে এক কাপ হলুদ দেওয়া দুধ খাব। ব্যাস। আর কিছু নয়। টেবিলে বসে দেখি, সামনে থরে থরে সাজানো কচি শসা পেঁয়াজের স্যালাড, প্রচুর মটরশুঁটি দেওয়া তেলতেলে বাঁধা কপির তরকারী, ক্যাসারল ভর্তি গরম রুটি, ধূমায়িত বেগুন ভাজার গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তেল। বোতলে টলটল করছে সদ্য ওঠা নলেন গুড়, টিফিন কৌটো ভর্তি নারকেল নাড়ু, আজ সন্ধ্যায়ই পাকিয়েছে লতা দি। একটু দুধ দিয়েছে কি? এমন সুন্দর দেখতে হয়েছে কি করে। 


নাহ আমি ওসব কিছুর দিকে তাকাব না। খড়কুটো সন্ধানী ডুবন্ত মানুষের মত, আকুল হয়ে খুঁজি চারটে শেপ, চোখে পড়ে ছোট ছোট গোল গোল নাড়ু, মাঝারি গোল গোল বেগুন ভাজা। রং বলতে চোখে ভাসে হলদে তরকারী, খয়েরি গুড়, কালো বেগুন ভাজা। গন্ধের পর্বে হুড়মুড়িয়ে নাকে উড়ে আসে তাজা গুড়ের গন্ধ। জিভে আপনা থেকেই ভেসে ওঠে আজব আজব সব স্বাদ। হে ত্রিপুরারি রক্ষা করো প্রভু। এই নাক মুলছি, কান মুলছি, ওসব আজেবাজে রিল আমি আর দেখব না ঠাকুর। এই দুর্লভ শীতল মরশুমে এইসব সুখাদ্যের অবমাননা করা ঘোর পাপ। বেঁচে থাকুক আমার রাগ, বেঁচে থাকুক আমার লোভ, ওগুলো ছাড়া বেঁচে থেকে কি লাভ। আগে তো খেয়ে বাঁচি, বাকি কাল বুঝে নেব ক্ষণ।


অনির ডাইরি ১০ই ডিসেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


প্রেগন্যান্সি টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসার সাথে সাথেই কেমন যেন বদলে যায় মেয়েদের জীবন। বিশেষ করে সেই মেয়ে যদি কর্মরত হয়। "ভুলেও ভেব না, তোমরা আপিস করবে, আর আমরা তোমাদের বাচ্ছা সামলাব -"। কথা গুলো আজও মনের গভীরে কোথাও মাঝে মধ্যেই ঘাই মারে। ভাগ্যে আমার মা ছিল, নইলে কি যে হত। সদ্যোজাত মেয়েকে নিয়ে কোন অকুলপাথারে যে পড়তাম দোঁহে। 


হাঁড়ি আলাদা হলেও যৌথ পরিবার আমাদের, সদ্যোজাত ছানাকে চটকে সন্দেশ বানাবার জন্য উদগ্র হয়ে অপেক্ষা করছে আমার মা, জ্যাঠাইমা, পিসি থেকে ভাইবউ সব্বাই। তাও শৌভিক গোঁ ধরল, সকলেই বয়স্ক কেন ওদের ওপর ফালতু চাপ দেওয়া। একজন লোক রাখতেই হবে, এমন কেউ যে যথাযথ যত্ন নিতে পারবে ওর মেয়ের। তারপর তো বাকিরা আছেই -। 


লোক চাই, বললেই তো আর লোক মেলে না। আবার বাচ্ছা সামলানোর লোক। মস্ত খোলামেলা বাড়ি আমাদের, লোকগুলো আদ্যপান্ত কাঁচাখোলা, যেখানে সেখানে যাতা ফেলে রাখে, টাকাপয়সা থেকে কুচি কানের দুল। ফলে বিশ্বস্ত হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। পাড়ার যে নার্সিং হোমে শ্রীমতী তুত্তুরীর জন্ম তার দুই আয়া দিদির সাথে হেব্বি দোস্তি হয়ে গিয়েছিল আমার আর মায়ের। ছাড়া পাবার আগে তাদেরই বলল মা। "তোমাদের মত ভালো কাউকে পাওয়া যাবে -"। 


একজন বয়স্কা, অন্যজন তরুণী। দুই দিদিমনি নিজেদের মধ্যে কথা বলে জানালো, " আমাদের তো ডাক্তার দিদি ছাড়বে না। তবে দেখছি, একজনকে খবর দিচ্ছি।" খবর পেয়ে যিনি এলেন, তাঁর যেমন জাঁদরেল চেহারা, তেমনি গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজ। মা আর আমি তো ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। মাফিয়াদের ঢঙে তিনি তো বলে চলে গেলেন, " কোন চিন্তা নেই।" মায়ের আর আমার মুখ শুকিয়ে চুন। ইনি যাবেন নাকি? নার্সিং হোমের দুই দিদি সান্ত্বনা দেয়, " উনি ভীষণ কাজের। ওনাকে পেলে তো কোন চিন্তাই ছিল না। তবে যাকে দেবে সেও ভীষণ ভালো। মিলিয়ে নিবেন মাসিমা।" 


সোমবার ভোরে জন্মানো মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরলাম রবিবার দ্বিপ্রহরে। তখনও শৌভিক বিডিও। সোমবারই ব্লকে ফিরে যাবে। প্রচুর কান্নাকাটি করেও আগে ছুটি পেলাম না। এক প্রবল বর্ষণক্লান্ত সকালে পিতামহের কোলে চেপে মাতুলালয়ে প্রবেশ করলেন শ্রীমতী তুত্তুরী। বাড়িতে ততক্ষণে মেলা বসে গেছে। চাটুজ্জে বাড়ির সব লোক, আমার দিদিভাই, শ্বশুরমশাই আরো যেন কারা কারা। মুখ দেখার সৌজন্যে কত কি যে পেল মেয়েটা। এদিক চা জলখাবার দিতে গিয়ে নাজেহাল আমার মা। দিদিভাই এমনকি আমিও ঐ অবস্থায় হাত লাগিয়েছি। শৌভিক ফিসফিস করে বলেই যাচ্ছে, "ওরে এখনই এত কাজ করতে যাস না। ব্যথা বেড়ে যাবে। তোকে দেখে আমারই পেট ব্যথা করছে। এম্প্যাথেটিক পেন বোধহয় একেই বলে -।" 


সব মিলিয়ে চূড়ান্ত ঘেঁটে যাওয়া মাছের বাজারে এসে উপস্থিত হল এক ছোট্টখাট্ট কৃশকায় ভদ্রমহিলা। পরনে সিনথেটিক শাড়ি, কাঁধে মেরুন রঙের ঝোলা ব্যাগ, হাতে ছাতা। ভেজা ছাতাটা ভাঁজ করে, রকের কল খুলে ভালো করে পা ধুলেন। তারপরে চৌকাঠ ডিঙিয়ে দালানে প্রবেশ করলেন, মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, " মাসিমা আমি লতা। সে কই?" সেই থেকে আজ চোদ্দ বছর ধরে তিনি তুত্তুরীর 'মাসি' আর তুত্তুরী তাঁর সোনা মা। আজ সেই মাসির জন্মদিন। খুব ভালো থাকুক মাসি, সুস্থ থাকুক। অটুট থাকুক মাসি আর তার সোনামার সম্পর্ক আজকের দিনে তুত্তুরীর মায়ের এটাই কামনা।


পুনশ্চ -শ্রীমতী তুত্তুরী তো ধেড়ে হয়ে গেছেন, তাঁকে দেখার ক্ষমতা কি আর মাসির আছে। তিনিই বরং যখন তখন, মোবাইল না দিলে " দেখে নেব" বলে মাসিকে ধমক চমক দেন। বর্তমানে মাসি আর একটি বাচ্ছার দায়িত্ব পেয়েছেন। ঐ যে শ্রীমতী তুত্তুরীর ডান পাশে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন যে ভদ্রমহিলা, তিনিই আপাতত মাসির নতুন এসাইনমেন্ট। বিশ্বাস করুন, দিনের শেষে মাসি কাকে বেশি পাত্তা দিল এই নিয়ে, এই বাড়িতে দুটো বাচ্ছার নিত্য রেষারেষি চলে।


Monday, 4 November 2024

অনির ডাইরি নভেম্বর, ২০২৪

 অনির ডাইরি ১২ই নভেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



শাড়ি পরব, না সালোয়ার? দোদুল্যমানতায় ভুগি। শৌভিককে জিজ্ঞাসা করব কি? বিয়ের পরপর, শুধালে আমার বরের একটাই উত্তর থাকত, শাড়ি। আজকাল যাই পরি, কিছুই যায় আসে না। এই তো গতকালই একটা নিমন্ত্রণ ছিল যুগলের, শুধালাম, কি পরব রে? জাস্ট কাঁধ ঝাঁকাল। অর্থাৎ যা প্রাণ চায়। ভেবে চিন্তে একটা শাড়িই পরলাম, মানে পরার চেষ্টা করলাম। আপদ শাড়ি, কিছুতেই আর কুঁচি ফেলে না। রেগেমেগে, গলদঘর্ম হয়ে স্বগতোক্তি করলাম, " শাড়ি পরতে ভুলে গেলাম নাকি!" তিনি তো তিন মিনিটে রেডি, ঘড়ি দেখতে দেখতে কেজো সুরে মন্তব্য করলেন, " শাড়ি পরছিস কেন?" জানালাম, তাঁর সঙ্গে যাচ্ছি, তাঁর পরিচিতের পুত্রের অন্নপ্রাশন, তাই তাঁর সম্মানার্থে শাড়ি পরছি। ভাজা মাছ উল্টে না খেতে পাওয়া মুখে তিনি বললেন, " কিন্তু আমি তো শাড়ি পরছি না।" 


এই না হলে আমার বর! তবে সে তো গত কালকের কথা ছিল। আজ আবার একটা নিমন্ত্রণ আছে। আমাদের শুভাশিসের কনিষ্ঠ পুত্রের অন্নপ্রাশন। গোটা আপিসের নিমন্ত্রণ থাকলেও, ইন্সপেক্টর সাহেবরা বোধহয় কেউই যেতে পারবে না। সৌরভকে তো সেই পুজোর পর থেকে আর দেখিনি। গণমাধ্যমে চোরাগোপ্তা ছবি দেখছি কেবল, হাঁটুর কাছে প্যান্ট গুটিয়ে, হাতে ফাইল আর বুক পকেটে পেন গুঁজে বাড়ি বাড়ি ইন্সপেকশন করছে সৌরভ। সেদিন ময়নার এক SLO খবর দিলে," স্যারের খুব জ্বর ম্যাডাম। নোংরা জল ভেঙে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে গিয়ে পায়ে ইনফেকশন হয়েছে। ঘ্যাসঘ্যাস করে চুলকাচ্ছেন আর ইন্সপেকশন করছেন। শনিবার নেই, রবিবার নেই, কালী পুজো নেই। কেবল ভাইফোঁটায় একটা ছুটি পেয়েছেন।"


 শুনি আর ভাবি, কে জানে, ছেলেটাকে আর জ্যান্ত ফেরৎ পাব কি না। বাকিদের অবস্থা ও তথৈবচ। সন্দীপ তো সক্কাল সক্কাল ছবি পাঠিয়েছে, নৌকা করে বাড়ি ইন্সপেকশন করছে। সৌরভের থেকে অন্তত একটু পদের। 


দেড়টা নাগাদ নভোনীল বাবু এসে তাড়া লাগান,  " চলুন ম্যাডাম। আমরা যে কজন আছি, তারাই ঘুরে আসি।" তাহলে আপিসে থাকবে কে? প্রতিবার চঞ্চল আর সৌরভ থেকে যায় আপিস সামলাতে। সৌরভের কথা তো আগেই বলেছি, চঞ্চল এবার ছুটি নিয়ে সকাল থেকে শুভাশিসের বাড়ি গেছে, প্রভুর নামগান করতে। শুভাশিসের বাড়ি গোবর্ধনধারী আসবেন যে।


প্রসঙ্গতঃ গোবর্ধনধারী হলেন বালক শ্রীকৃষ্ণ, নাড়ুগোপাল আর রাধাস্বামীর মাঝামাঝি।  কষ্টি পাথরে নির্মিত, রুপার চোখ, মাথায় প্রকাণ্ড মুকুট, সর্বাঙ্গ গহনায় মোড়া। গোবর্ধনধারীর প্রবল ডিমান্ড এই চত্বরে। কোলাঘাট ব্লকের দেরিয়াচকে ওনার মন্দির। কিন্তু সেই মন্দিরে মোটেই থাকেন না গোবর্ধনধারী, তিনি ঘুরে বেড়ান ভক্তদের বাড়ি বাড়ি। কারো বাড়িতে শুভ কাজ হলে আগেভাগে ডেট নিতে হয় গোবর্ধনধারীর। পাঁচ ছয় মাসের আগে কোন ডেট মেলা ভার। একেক দিনে চার পাঁচ বাড়িতে দর্শন দেন গোবর্ধনধারী। আর এই পথ উনি অতিক্রম করেন পালকিতে। সেই পালকি বহনের ও নির্দিষ্ট লোক থাকে। তবে শর্ত একটাই, গোবর্ধনধারী নদী পার হবেন না। 


শেষ পর্যন্ত জনা তিনেক রয়ে গেল আপিসে। আমরা কথা দিয়ে গেলাম, ফেরার সময় গোবর্ধনধারীর প্রসাদ সঙ্গে করে নিয়ে আসব। আপিস থেকে খুব বেশি দূর নয়, হবে না হবে না করেও নেহাৎ কম লোক হয়নি। গাড়ির দরজা কোন মতে চেপে চুপে বন্ধ করতে হল। নভেম্বর মাসের অপরাহ্নের সূর্যের একটা আলাদাই রঙ থাকে। একটু বেশীই দেরী করে ফেলেছি আমরা, কে জানে গোবর্ধনধারীর সাথে সাক্ষাৎ হবে কি না। যা ব্যস্ত থাকেন ভদ্রলোক। শুভাশিস আমাদের কথা ভেবেই, বার বার অনুরোধ করেছে, একটু যেন বেশী ক্ষণ থাকেন গোবর্ধনধারী। বাকি তাঁর ইচ্ছা। 


ফাঁকা হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলা গাড়ি, হঠাৎ টলমল করে ডিভাইডারে উঠে উল্টো লেনে ঢুকে পড়ে। আমি কিছু বলার আগেই বেদজ্যোতি বলে," এই কাটটা স্থানীয় মানুষজনই বানিয়েছে ম্যাডাম। নাহলে প্রায় দশ কিলোমিটার আরও ফালতু ঘুরতে হয়।" কাট বলা বাতুলতা, ডিভাইডারের খানিকটা চেঁচে সমতল করার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। গাড়ি উল্টো লেনে খানিক যেতেই দৌড়ে এসে হাত দেখায় রঞ্জিত। প্রথমার্ধে ইন্সপেকশন সেরে, বাইক নিয়ে সোজা চলে এসেছে। আমাদের জন্যই প্রতীক্ষা করছিল। আমরা টিম তাম্রলিপ্ত, যেখানে যাই, একসাথে যাই। 


ডান হাতে লাল মোরামঢালা ছোট মাঠ,  বাম হাতে সরু ঢালাই রাস্তা। এই রাস্তা ধরে মিনিট দশেক গেলে তবে শুভাশিসের বাড়ি। রাস্তা দেখে ড্রাইভার সাহেবের কপালে ভাঁজ গভীরতর হয়। এই রাস্তায় চার চাকা কি আদৌ যাবে? নিজেদের মধ্যেই বিতণ্ডা বেঁধে যায়,  একদল বলে আলবৎ যাবে, আরেকদল বলে, পাগল নাকি। ফেঁসে গেলে কি হবে? দুই দলই শুভাশিসকে ফোন করে। তাতেও মেটে না জটিলতা।


উল্টে সামনের চায়ের দোকানে আড্ডারত লোকজন সামিল হয়ে যান আমাদের বিতর্কে। গ্রামের দিকে যেমন হয় আর কি। " শুভাশিসের বাড়ি যাবেন নাকি? কে বলেছে গাড়ি যাবেনি। আলবৎ যাবে। গাড়িতে বসেন, গাড়িতে বসেন। আমরা পথ দেখিয়ে লিয়ে যাইছি।"  একজন বাইকওয়ালা পথপ্রদর্শক হয়ে খানিক এগিয়েও যায় -  


 আমরাও সবাই হুড়মুড় করে আবার গাড়িতে উঠে বসি, এমন সময় বাইক নিয়ে উদয় হয় স্বয়ং শুভাশিস। " গাড়ি যাবেনি, গাড়ি যাবেনি। ম্যাডাম আপনি আমার বাইকে আসুন, বাকিরা হেঁটে চলো"। শুভাশিসের পরনে সুদৃশ্য লাল পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, পা খালি। বুঝতে পারি হরিনামের আসর ছেড়ে এসেছে শুধু আমাদের জন্য। শুভাশিসের বাইকটা বেশ উঁচু, আর আমি বাইকে বসতে মোটেই সড়গড় নই। ইতস্ততঃ করছি দেখে, পাশ থেকে হেলমেট পরা কে যেন বলে, "ম্যাডাম আমার বাইকে আসুন। এটায় আপনার উঠতে সুবিধা হবে।" গলার আওয়াজে চিনতে পারি, এটা আমাদের  সন্দীপ। প্রথমার্ধে ইন্সপেকশন সেরে ছুটে এসেছে আমাদের সাথে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। 


দুদিকে ঘন সবুজ ধানক্ষেতে ইতিউতি লেগেছে সোনা রঙ, মাঝ খান দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে সরু ঢালাই রাস্তা। ধান ক্ষেত থেকে উঠে আসছে প্রাণ জুড়ান শীতল বাতাস। বেশ খানিক দূর থেকেই শোনা যাচ্ছে হরিনামের বোল। রঙিন কাপড় দিয়ে বানানো গেটের সামনে ছাড়া রয়েছে অসংখ্য জুতো। ভিতরে খোলকরতালের সাথে চলছে উদ্বাহু নৃত্য। পাশের দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করি আমরা। সিঁড়ির নীচে জুতো খুলে, সোজা দোতলায়। সেখানেই সিংহাসন আলো করে বসে আছেন তিনি, আসল নাড়ুগোপাল। পোশাকি নাম স্বস্তিক। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, নধর কান্তি, পরণে মেরুন ধুতি আর তসররঙা পাঞ্জাবি। শুভাশিস বা ওর গিন্নীর কোন বাধানিষেধ নেই, যে পারছে গিয়ে কোলে নিচ্ছে ছোট্ট ছানাকে। তারপর আশ মিটিয়ে চটকাচ্ছে। ফলতঃ তিনি যে বেশ বিরক্ত অচীরেই উচ্চঃস্বরে কেঁদে জানান দিলেন। 


ওই অবস্থাতেই কে যেন আমার কোলে দিতে এসেছিল তাঁকে। বললাম, আগে ওর ধড়াচূড়া খুলে নির্ভার করো বাপু, ফাঁক তালে খানিক চটকেও দিলাম। কি নরম পেটু আর কি মসৃন গা। কি মিষ্টি একটা গন্ধ গায়ে। নির্ভার হয়ে, দেখতে দেখতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন মায়ের কোলে। 


গোবর্ধনধারী এসেছেন মানেই নিরামিষ ভোজন। গোবর্ধনধারী যখন আসেন সঙ্গে পাঁচক ঠাকুরও নিয়ে আসেন। প্রয়োজনে যারা হাজার বারোশো নিমন্ত্রিত লোকেরও রান্না করে দেয়। উনি এলে বিনা নিমন্ত্রণেও সেখানে ভিড় জমায় ভক্তবৃন্দ, মাটিতে পাত পেড়ে সেবন করে প্রভুর প্রসাদ। ঠাকুরের মাহাত্ম্য এমনি, যে যতই লোক আসুক না কেন,ভোগ কোনদিন কম পড়ে না। আমাদের জন্য যদিও চেয়ার টেবিলের সুবন্দোবস্ত। গোবর্ধনধারীর প্রিয় খাদ্য,' বিছা কলা', অর্থাৎ বীজ সমেত কাঁচা কলা। রাস্তায় কোথাও যদি বিছা কলার কাঁদি দেখতে পান উনি, তাহলে নাকি এমন লোভ দেন যে পালকি প্রবল ভারী হয়ে যায়, আর তাঁকে নড়ানোই যায় না। মাটির মালসায় করে এনে পাতে পাতে দেওয়া হল বিছা কলার তরকারি। তার সাথে বেগুনি, পোলাও আর চানা পনীর। তারপর আসে ভাত। এরা বলে অন্ন। সাথে শুক্ত, গরম মুগের ডাল, নানা রকম তরকারী, চাটনি, পরমান্ন, রসগোল্লা, মিষ্টি দই ইত্যাদি। 


 খাওয়া যখন প্রায় শেষের পথে, রঞ্জিত বলে, "ম্যাডাম মাইকে যার হরিনাম সংকীর্তন শুনছেন, ওটা কার গলা বলুন দিকি?" সবে পায়েসটা মুখে দিয়েছি, এমন সময় এই ধরণের বদখত প্রশ্ন কেউ করে। কান করে শুনে দেখলাম,গলাটা চেনা চেনা লাগছে বটে। শান্তনু পাশ থেকে ফস করে বলে ওঠে, " ম্যাডাম চঞ্চল দা কেমন গান গাইছে শুনতেছেন। গান গাইতে গাইতে কি নাচ নাচছে ম্যাডাম। একবার দেখে আসুন।" 


জীবন্ত বালগোপালকে কোলে নিয়ে চঞ্চলের গান শুনলাম, নাচ দেখলাম। আর দেখলাম গোবর্ধনধারীকে। অবশেষে দর্শন দিলেন তিনি। আশ মিটিয়ে দেখলাম,  অনুমতি নিয়ে গুটি কয়েক ছবিও তুলে নিলাম। কে জানে আবার কবে দেখা হয়। এবার প্রসাদ বগলে আপিসে ফেরার পালা। আমাদের জন্য আত্মত্যাগ করে আপিস সামলাচ্ছে তিন মহারথী, তাদের কথাও তো ভাবতে হবে।


অনির ডাইরি ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


বেশ কিছুদিন আগের কথা, পাশের অফিসের জনৈক অফিসারকে ফোন করেছি কিছু দরকারে, ফোন ধরেই কেঁদে ফেললেন ভদ্রলোক। রীতিমত থতমত খেয়ে গেলাম আমি, বদমেজাজী, মুখরা বলে আমার প্রচুর বদনাম, কিন্তু ভদ্রলোককে তো এখনও পর্যন্ত, " হ্যালো, অমুক বাবু-" ছাড়া তো কিছুই বলিনি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে রইলাম খানিকক্ষণ, নিজেকে সামলে ভদ্রলোক বললেন, " ম্যাডাম আমি অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছি। বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে -"। ঠিক আছে, সাবধানে যান ছাড়া আর কিছু বলতে পারলাম না। পরে শুনলাম, ভদ্রলোকের নববিবাহিতা কন্যা সন্তানসম্ভবা হয়েছিল, স্থানীয় ডাক্তারের পরামর্শে X-ray করিয়ে সর্বনাশ ঘটে গেছে। মাসখানেক পর বলতে গিয়েও ভিজে উঠছিল ওনার চোখের পাতা। " টুইনস ছিল ম্যাডাম। দুটোই ছেলে। মেয়ে আমায় সব বলে আর এটা বলল না। জাহিল (অশিক্ষিত) অসভ্য পরিবার, আমার মেয়েকে এমন হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল, সব শেষ করে দিল ম্যাডাম। সব শেষ করে দিল।" 


কি বলব বুঝে উঠতে পারি না। সেদিন আমার চেম্বারে বসেই কথা হচ্ছিল। ভদ্রলোক, আমি ছাড়াও উপস্থিত ছিল এক ইন্সপেক্টর। পরে ইন্সপেক্টর সাহেব আমায় আলাদা করে বললেন," এটা খুবই দুঃখের ম্যাডাম। কিন্তু আজও যে কত জায়গায় এটা হয়। অমুককে চেনেন তো, ওর সাথেও হয়েছিল। " এবার যার কথা হচ্ছে, সেই ছেলেটি আমাদেরই এজেন্ট। অবস্থাপন্ন, হাসিখুশি, দিলখোলা ছেলে। হতবাক হয়ে যাই, তার সাথেও এমন হয়েছে? ইন্সপেক্টর সাহেব বলেন, "হ্যাঁ ম্যাডাম। কি আর বলি। অন্য কোন সমস্যা হচ্ছিল হয়তো, তমলুকের নামি ডাক্তার, X-ray করতে বলল -। ব্যাস, ওখানেই শেষ। পরে জানা গেল ছেলে ছিল। " ছেলে হোক বা মেয়ে, সন্তান তো সন্তানই। সান্ত্বনার কথা এটাই যে ছেলেটির আগে থেকেই যমজ বাচ্ছা আছে। দুটোই মেয়ে। ছবিও দেখেছি তাদের বাবার ফোনে। গর্বিত বাবা নিজেই দেখিয়েছিল। তাও, এ ব্যথা যে কি ব্যথা। পৃথিবীর মর্মান্তিকতম ব্যথা। 


এবছর পুজোর আগে, হঠাৎ করে ভাইরাল ফিভারে পড়লাম। যথারীতি শ্রীমতী তুত্তুরী বয়ে এনেছিলেন ইস্কুল থেকে। প্রথমে তাঁর হল, ওই অবস্থায় তাঁকে জড়িয়ে আদর করে, হামি খেয়ে আমিও বাঁধালাম। জ্বর বাঁধালে বাচ্ছা গুলো যেন পাঁচ গুণ মিষ্টি হয়ে যায়, আর আমার সংযম বরাবরই কম। শ্রীমতী তো দুদিনে সুস্থ হয়ে দৌড়াতে লাগলেন, আমি আর উঠতেই পারি না। প্রতিটা লক্ষণ চিৎকার করে বলে, "কোভিড হয়েছে বাপু তোমার। অন্য কিছু লয়।"  তীব্র জ্বর আর গা-হাত-পা ব্যথায় কাতর হয়ে শুয়ে আছি, ঝনঝন করে বেজে উঠল মুঠো ফোন। ওপাশ থেকে জনৈক সহকর্মীর সহমর্মী কন্ঠস্বর, " ম্যাডাম একটা বাজে খবর আছে -"। ছ্যাঁত করে উঠল হৃদয়, সবাই ঠিক আছে তো? ছেলেটি একরাশ দুঃখ গেলা গলায় জানালো, " অমুক দার জোড়া মেয়ের একটা কাল -"। কিঃ? শুনতে পাই না। বিশ্বাস করতে পারি না আমি।


চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেয়েদুটোর জন্মদিনের ছবি। আমাকেও নিমন্ত্রণ করেছিল ওদের বাবা। কিন্তু আগে থেকেই অন্য একজনের নিমন্ত্রণে সাড়া দেওয়া ছিল বলে যেতে পারিনি। মুখপুস্তকে ছবি দেখেছি। ফুটফুটে দুই বোন, একই রকম পোশাক পরে, একই রকম হেসে ছবি তুলেছে। তাদের একজন নেই? কি করে সম্ভব সেটা? কোন মতে জিজ্ঞাসা করি, কি হয়েছিল? জবাব আসে, নিউমোনিয়া। কলকাতার হাসপাতালও ব্যর্থ হয়েছে বাচ্ছাটিকে তার বাপমায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে।


মন চায়, ছেলেটিকে একবার ফোন করি। কিন্তু সদ্য সন্তানহারা পিতাকে কি বলব বুঝে উঠতে পারি না। কি অবস্থায় যে আছে এখন -। অনেক বার ভাবি, অনেক দিন ধরে ভাবি তাও বুঝে উঠতে পারি না। শেষে ওই ব্লকের ইন্সপেক্টর ছেলেটিকে ধরি, আমাকে একবার ওর বাড়ি নিয়ে যাবে? মুঠো ফোনেই কিছু বলে উঠতে পারিনি, মুখোমুখি কি বলব কে জানে। তবুও -। যে দিন যাবার কথা, তার আগের দিনই মুঠো ফোনে খবর এল, দ্বিতীয় বাচ্ছাটিও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। কি হয়েছে কেউ ঠিক বলতে পারল না, ইন্সপেক্টর সাহেব কেবল বললেন, " শিশু হতে পারে, ট্রমা তো ওর ও কিছু কম নয়। দুই বোন কি সুন্দর এক সঙ্গে বেণী দুলিয়ে স্কুল যেত, খেলাধুলো করত -"। সত্যি বড়দের কষ্টের কথা ভাবতে গিয়ে বাচ্ছাটির কথা তো আমরা ভুলেই গেছি। 


যাই হোক, হে ঈশ্বর, এটা যেন সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। অভাগা বাবা মাকে আর যাতনা দিও না প্রভু। বাচ্ছাটা সুস্থ হয়ে ওঠে অচিরেই, কিন্তু আমাদের আর ওদের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠে না। দেখতে দেখতে এসে যান দশভূজা। পুজোর ছুটির পর কটা দিন আপিস তারপরই আমাদের দীপাবলী। আপিস সেজে ওঠে আলোকমালায়, ভিড় জমে ওঠে লোকজনের। সম্মিলিত আনন্দে খুশিতে গরীব আপিস আমার যেন ঝলমলিয়ে ওঠে। এক ফাঁকে ওই ব্লকের ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করি, সেই ছেলেটির কি খবর? ইন্সপেক্টর সাহেব খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেন, " আজ আসবে কিনা, কিছুতো বলেনি ম্যাডাম। দাঁড়ান ফোন করছি -"। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে ছেলেটির কন্ঠ, "হেলো"। ইন্সপেক্টর সাহেব বলেন, " আপনি কি আসছেন? ম্যাডাম খোঁজ নিচ্ছেন।" সদ্য ইন্সপেক্টরটিকে অ্যাপ্রাইজাল দিয়েছি, আমি কাউকে খারাপ নম্বর দিই না। হাঁড়ি উল্টে নম্বর দিই। একেও দিয়েছি, আজ মনে হচ্ছে কেন দিলাম। ব্যাটাকে ভেরি পুওর দেওয়া উচিৎ ছিল। একজন সন্তান হারা পিতাকে এই অনুষ্ঠানে আসতে বলার ধৃষ্টতা আমার আছে? রেগে ফোনটাই কেড়ে নিই ব্যাটার কাছ থেকে। বলি, " আমি তোমাকে একবারও না আসার জন্য খুঁজিনি বাবা। জাস্ট জানতে চেয়েছি তুমি কেমন আছ।" 


ছেলেটির দরাজ গলা ভেসে আসে মুঠোফোনের ওপাশ থেকে,"আমি আসছি ম্যাডাম। সিঁড়িতে।উঠে আপনার চেম্বারে যাচ্ছি।" বরাবরের মতোই হাসি মুখে প্রবেশ করে ছেলেটি। এর ওর পিছনে লাগে সামান্য। সবই বড় বেশি স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকত্ব বড় বেশী আরোপিত, বড় বেশী করুণ। বড় বেশী অস্বাভাবিক। একগাল হাসি নিয়ে আমার উল্টো দিকে বসে ছেলেটি। চুপ করেই থাকি দুজনে। ঘরে আগে থেকেই উপস্থিত দুজন ইন্সপেক্টর, একজন CKCO, এক পিওন সবাই নির্বাক। মাথা নীচু করে যে যার কাজ করে যায়। 


আমিই নীরবতা ভঙ্গ করি, জানাই অনেক বার ভেবেছি এই দুর্দিনে একবার ছেলেটির বাড়ি যাব। কিন্তু ব্যাটে বলে আর হয়নি। ছেলেটি হাসে, তারপর বলে, " আর কি করব ম্যাডাম। স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি, কিন্তু -"। এই কিন্তুর পর আর কিছু বলার থাকে না। ছেলেটি নিজে থেকেই বলে, " বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, কিছু ছিল না। কোন রোগ ব্যধি কিস্যু না। একদিন স্কুল থেকে ফিরল অল্প জ্বর আর সামান্য কাশি নিয়ে। খুকখুকে কাশি। আমি কাজে ছিলাম, ওর মা আমায় ফোন করে বলল, 'একবার ডাক্তার দেখিয়ে নাও। কাশিটা যেন কেমন লাগছে।' সাধারণত এমন হলে আমরা কি করি, বাড়িতে কাশির ওষুধ থাকেই, তাই খাইয়ে দিই।" 


নীরবে সম্মতি জানাই আমি। ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ির মেয়ে আমি, ওষুধ আর ডাক্তারে আমার এমনিতেই ফোবিয়া আছে। কাশি হলে আমার ভরসা আদা মধু আর তুলসী পাতার রস আর গরম জলে গার্গল। একেবারেই না কমলে তবে কফ সিরাপ। ছেলেটি না থেমে বলে চলে, " আমি ফেলে রাখিনি ম্যাডাম।কাজে ছিলাম, কাজ ফেলে এসে স্থানীয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছি। ডাক্তার বলল, কিছু না। কাশির আর জ্বরের ওষুধ দিল। বলল সেরে যাবে। দুয়েক দিন দেখলাম, কাশি কমছে না দেখে নিয়ে এলাম তমলুক, অমুক ডাক্তারের কাছে -"।


 তমলুকের ডাক্তার বাবুর নাম শুনেই সিকেসিও ছেলেটি কপালে হাত ঠেকায়, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, "উনি এই শহরের সেরা শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ম্যাডাম। ডাক্তার নন, সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি।" সদ্য সন্তানহারা ছেলেটি মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দেয়, তারপর বলে, " আমাদের পাড়ার ডাক্তার বাবুও সঙ্গে এসেছিলেন, বড় ডাক্তার বাবু দেখে বললেন, ' তুমি ঠিকই চিকিৎসা করেছ। শুধু সিরাপের বদলে ইনজেকশন দিয়ে দেখ।' আর আমায় কইলেন, দিন সাতেক ওষুধ চলুন, তারপর ওনাকে রিপোর্ট দিতে। সাতদিন কি ম্যাডাম, মেয়ের অবস্থার অবনতি দেখে আমি দেড় দিনের মাথায় আবার নিয়ে গেলাম মেয়েকে। 


এবার আমাদের দেখেই ওনার মুখটা হাঁড়ি হয়ে গেল। গম্ভীর ভাবে শুধু বললেন, ' অবস্থা সুবিধার বুঝছি না। একে এখনি কলকাতা নিয়ে যাও।' বিশ্বাস করবেন নি ম্যাডাম, আমি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি। শুধু কচির মাকে ( তমলুকে ছোট বাচ্ছাদের/ সন্তানকে আদর করে কচি বলা হয়) বললাম দুটো জামা প্যাক করে নাও, আর একজন আত্মীয়কে নিলাম যে এইসব হাসপাতালে কথা বলা, ছুটা দৌড়া (দৌড়াদৌড়ি) করা ভালো পারে। ব্যাস সোজা শিশুমঙ্গল। সেখানেও কেউ খারাপ কিছু বলছে না। মেয়েও দিব্যি কথা বলছে আমাদের সাথে -। " আরও অনেক কিছু বলে চলে ছেলেটি, কেমন করে শিশুমঙ্গল থেকে ছাড়িয়ে কলকাতার মূল্যবানতম হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সেখানেও কেমন স্বাভাবিক ছিল মেয়ে। আজও কানে বাজছে ছেলেটার কথা, " এত বুদ্ধিমান ছিল মেয়েটা কি বলব। আর তেমনি শৌখিন। আর কটা দিন পরই ওর জন্মদিন ছিল। ফ্লিপকার্ট এ জামা অর্ডার করেছিল নিজেই। ওই অবস্থাতেও বলছে, ' বাবা তুমি, মা সব তো এখেনে, আমার জামাটা যদি দিয়ে আসে আজ -'! আমরা ততক্ষণে জানি ও আর কয়েক ঘণ্টা মাত্র। ডাক্তার এবার ভেন্টিলেশনে ঢোকাবে -"। 


শুধু আমি নই, ঘরে উপস্থিত প্রতিটা লোক যেন অন্তঃস্থল থেকে কেঁপে ওঠে। এই দিন, এই মুহূর্ত যেন চরম শত্রুকেও না দেখতে হয়। নিজেকে সামলে নেয় ছেলেটা, বলে, "আমি জোর করেই রাস্তায় বেরিয়েছি ম্যাডাম। কাজে মন দেবার চেষ্টা করছি। কিন্তু বাড়ির যা অবস্থা। একদিকে আমার মা, একদিকে আমার বউ। আমি যে কাকে দেখি -। দুজনেই কেবল কাঁদে। সারাদিন শুয়ে থাকে আর কাঁদে।" বেশ খানিকক্ষণ নীরব থেকে ছেলেটি আবার বলে ওঠে, "তবে একজন কাঁদে না ম্যাডাম। একদিনও কাঁদেনি। দুজনে তো একসঙ্গেই থাকত, এত ভাব ছিল দুজনের। অথচ সে চলে যাবার পর, এ যেন হঠাৎ করে কি বড় হয়ে গেল। রোজ রাতে ওকে জড়িয়ে ওর মা আর আমি কাঁদি। খুব কাঁদি। ও নীরবে আমাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। মাথায় বিলি কেটে দেয়। একটি বারও তার নাম করে না। আমি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ' আমরা কেন কাঁদি জানিস?' বলেছিল, ' জানি তো। বনু নেই। তার জন্য তোমাদের মনে খুব দুঃখ।' বললাম, ' তোর দুঃখ হয় না, বনু যে আর কোনদিন ফিরে আসবে না?' ওই টুকু মেয়ে কি বলল, জানেন ম্যাডাম, ' দুঃখ হয় তো। কিন্তু আমার কি কাঁদার সময় আছে। আমায় যে শক্ত থাকতেই হবে, তোমাদের জন্য। নইলে তোমাদের সামলাবে কে?"'