অনির ডাইরি ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
কোথা দিয়ে যে কেটে গেল দিনটা, সারা দিন শুধু ভিসি আর ভিসি। মোটামুটি ৩৬ ঘণ্টা পরই শুরু হতে চলেছে দুয়ারে সরকার। এটা নিয়ে এই জেলায় আমার সপ্তম দুয়ারে সরকার, সবাই মোটামুটি অভিজ্ঞ হয়ে গেছি আমরা। তবুও - কিছু প্রস্তুতি তো লাগেই। লাগে কিছু ভোকাল টনিক - কিছু ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন।
অফিস থেকে যখন বেরোলাম প্রগাঢ় হয়েছে সাঁঝ, আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, তারপরই চিরতরে বিদায় জানাব এই বয়সটাকে। কয়েক বছর আগেও বয়স লুকানোর তীব্র প্রবণতা ছিল, ইদানিং নিজের বয়স নিয়ে গর্ব হয়। গর্ব হয় প্রতিটা পাকা চুল, চোখের নীচের প্রতিটা বলিরেখা, প্রতিটা গোঁফদাড়ি,প্রতিটা স্ট্রেচ মার্কের জন্য। ওটাই তো আসল আমি, ওরাই তো আমার জীবনের যাবতীয় চড়াই উৎরাইয়ের নীরব সাক্ষী, আমার সুসময়-অসময়ের সাথী।
কাঁথি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে সাতটা বেজে গেল। অন্যান্য দিন এই সময় পড়তে বসে যান শ্রীমতী তুত্তুরী। মানে বই খুলে বসে থাকেন আর কি, আজ দেখলাম বাইরের ঘর শুনশান। গতকাল বাবা মাকে নিয়ে এসেছি হাওড়া থেকে, নির্ঘাত পড়াশোনা ডকে তুলে ওদের সাথে গুলগপ্প জুড়েছে তুত্তুরী। কে বলবে পাক্কা এক সপ্তাহ পরই শুরু হতে চলেছে তাঁর বার্ষিক পরীক্ষা। মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে দেখি দাদুদিদার ঘরের দরজা বন্ধ, ভিতরে কি সব যেন করছেন তুত্তুরী, দরজা খুলতে বলেও কোন লাভ হল না।
"আমি দশটা সাবজেক্ট পড়ে রেখেছি মা। আজ প্লিজ আর পড়তে বলো না।" স্কুল করে ফিরে, স্নানাহার, দিবানিদ্রা সেরেও কখন তিনি দশটা সাবজেক্ট পড়ে ফেললেন এই প্রশ্ন করে দয়া করে লজ্জা দেবেন না। এর উত্তর আজও আমার কাছে অধরা। কফি খেতে খেতে ষড়যন্ত্রের সুরে শৌভিক বলল, " কাল তোর জন্মদিন বলে ও কি সব যেন করছে -"। কি সব করবেন, এই ভয় তিনি বিগত এক মাস ধরেই দেখিয়ে আসছেন। তাঁর সম্বল বলতে সাকুল্যে ৬৭৬ টাকা, যেটা তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুরুজনের কাছ থেকে আশীর্বাদ স্বরূপ পেয়েছেন। তাই নিয়েই তাঁর ফুটানি দেখে কে? আম্বানিরাও লজ্জা পাবেন।
রাত গড়ায়, শৌভিকের ওপর দায়িত্ব পড়ে আমায় ঘরে আটকে রাখার। দেখতে দেখতে মহকুমা শাসকের নিবাসে রাতের রান্না করে যে ছেলেটি, শাশুড়ি মাতার আয়া দিদি এবং তুত্তুরীর মাসি সকলে লিপ্ত হয় ষড়যন্ত্রে। ঘরের মধ্যে থেকেও বুঝতে পারি বিপুল কিছু একটা গণ্ডগোল চলছে বাইরে। সবকিছু ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে তুত্তুরীর চিৎকার। শৌভিকের অমনোযোগীতার সুযোগে একবার টুক করে বেরিয়েও যাই আমি, আমাকে দেখেই মুখের ওপর ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয় লতা দি। " কিছু মনে করো না বোনি, সোনা মায়ের হুকুম -"। এই বাড়িতে তো আমার কোন মান সম্মানই নেই দেখছি ধুৎ।
" কাল তাহলে তোর জন্মদিনের প্ল্যানটা কি?" গাঁট্টা মেরে ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে শৌভিক। রাগে গা যেন জ্বলে যায়। হ্যাঁ রে, তোদের জন্মদিন এলে এমন বেখাপ্পা প্রশ্ন শুধাই আমি? কত আগে থেকে ভেবে রাখি সব কিছু, লুকিয়ে লুকিয়ে কিনে রাখি তোদের মনের মত উপহার, নিজের হাতে রান্না করে সাজিয়ে দিই পঞ্চব্যঞ্জন। আর আমার বেলায় আমাকেই মুখ ফুটে বলতে হবে, আমি কি চাই?
বরাবরের মত, আমার বর বুঝতেও পারে না যে আমি ক্ষেপে আছি। নিজের মনে বকে যায়, অনেক গুলো প্ল্যান। যার কোনটায় থাকে লং ড্রাইভ এন্ড ডিনার, কোনটায় ডে আউটিং লাঞ্চ এন্ড ডিনার আরও কত কি। কোনটাই পছন্দ হয় না আমার। বেড়াতে গেলে আলাদা কথা, নইলে এই তিন বুড়োবুড়িকে ফেলে সারা দিন বাইরে ঘুরে রাতে খেয়ে ফেরা মোটেই শোভন নয়। আর তাছাড়া আমি যে এত শখ করে নিজেকে এত সুন্দর একটা জামা, এত উঁচু গোড়ালির জুতো, টকটকে লাল লিপস্টিক, দুল, ব্যাগ এসব উপহার দিলাম, ওগুলো কখন পরব? ওগুলো যে কেবল ডিনার ডেটের জন্যই আদর্শ। তাও কন্টিনেন্টাল -
"বেশ তাই" দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজি হয় শৌভিক। "তাহলে কাল প্রাতঃরাশে কি খাবি? আর লাঞ্চে? মাটন আনাই?" প্রশ্ন করে শৌভিক। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে, বিস্তর তর্কবিতর্কের পর ঠিক হয়, সকালের প্রাতঃরাশ বাসি রুটি ভাজা আর প্রচুর কাঁচা লঙ্কা - পিঁয়াজ ভাজা দিয়ে নরম নরম ডবল ডিমের অমলেট। আর দুপুরে বাকিদের জন্য যা হয় হোক, আমার জন্য বেশি করে লঙ্কা আর সর্ষের তেল দিয়ে কাঁচা পোস্ত বাটা হবে। ওরে আমি জাত ঘটি রে, আমার কাছে এর থেকে সুখাদ্য আর কিছু নেই।
শ্রীমতী তুত্তুরীর নির্দেশ মত, তাঁর বাপের হাত ধরে "কান ধরে তুমি নিয়ে চল সখা" গাইতে গাইতে যখন নিকষ আঁধারে পরিপূর্ণ বাইরের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলাম, তখনও ভাবিনি আমার জন্য এত বড় চমক অপেক্ষা করছে। মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারের দেওয়াল জোড়া কেবল বেলুন আর বেলুন। যার অনেক গুলোর গায়ে কিছু লেখা। হেঁট মুণ্ড ঊর্ধ্ব পদ হয়ে পড়তে পারলে, পড়া যায়, লেখা আছে " I LOVE YOU" এবং"HAPPY BIRTHDAY"। তুত্তুরীর দাবী তিনি ঠিকই আটকে ছিলেন, কিন্তু বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে সস্তার ডবল সাইডেড টেপ। মধ্যরাত্রির অব্যবহিত পূর্বে টপাটপ খুলে পড়েছে বেশ অনেক গুলো লাল বেলুন। তড়িঘড়ি করতে গিয়ে একটু গড়বড় করে ফেলেছেন তিনি। "তুমি কি করে করো মা -" অনুযোগের সুরে শুধান তিনি, আমার অবশ্য কোন সমস্যা বোধহয় না, আপ্লুত হয়ে, হতবাক হয়ে হাত বোলাই মেয়ের ফুসফুস নিংড়ে ফোলানো প্রতিটা বেলুনের গায়ে।
"মা তুমি খুশি তো?" উচ্ছ্বল গলায় প্রশ্ন করে তুত্তুরী। কি বলি? কোন মা এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারে কি? হাতে এক গোছা হলুদ আর রক্ত বর্ণ গোলাপ তুলে দেয় তুত্তুরী। "এটাও তোমার জন্য কিনেছি মা। ওগুলোও -"। ইশারায় দেখায় তুত্তুরী। কাঁচের টেবিলের ওপর এক বাক্স চকলেট, দুটো চকলেট মুজ, দুটো পেস্ট্রি রাখা। "কেক কিনতে পারিনি মা, পয়সা শেষ হয়ে গিয়েছিল।" ৬৭৬ টাকার মধ্যে ৬৭০ টাকাই মায়ের জন্য খরচ করে ফেলেছে তুত্তুরী। এর থেকে বড় উপহার কি হতে পারে একজন মায়ের কাছে? আনন্দে গরবে গলে গলে পড়ি আমি। পাশ থেকে শৌভিক বলে, "কেক আমি এনেছি। এখন কাটবি কি?" মাথা নেড়ে জানাই, নাহ্ কাল সকাল হোক, সবার সামনে কাটব। আজ রাত শুধু মেয়ের আর আমার।
ঝুঁকে পরে এক খাবলা মুস খাই, মন দিয়ে পড়ি শ্রীমতী তুত্তুরীর হাতে লেখা কার্ড। মায়ের এত প্রশস্তি সারা বছর তো করে না মেয়েটা। পাশে একটা সুগন্ধী বাতি রাখা আছে, কার থেকে যেন এটা উপহার পেয়েছিল শৌভিক। তুত্তুরী বোধহয় ভয়ে জ্বালায়নি, তিনি কাঁচুমাচু মুখে বলেন, " ভয়ে নয়, আসলে ভুলে গেছিলাম। তোমার মত পারিনি মা।কি নিখুঁত ভাবে সব কর তুমি, আমি যে কেন তোমার মত পারি না -"। কানে কানে শৌভিক বলে, " সিঙ্গেল মল্ট কিনে রেখেছি, শুধু তোর জন্য -'। এরই মধ্যে ফোন করে অনেক অনেক ভালোবাসা জানায় ছোটদা। দুজনের একই দিনে জন্ম, বছরটা যদিও আগে পরে। ছোটবেলায় নালিশ করত ছোটদা, " তুই আমার জন্মদিনটাকেও ছাড়লি না বল, সেটাতেও ভাগ বসালি শয়তান।" সেই সব কথা মনে করে প্রচুর হাসি দুই ভাইবোনে।
আবেগে, ভালোবাসায় ডুবে যেতে যেতেও খচখচ করে মন, মধ্যরাত তো পেরিয়ে গেল, কই ফোন করল না তো প্রিয় বন্ধুরা। আপদগুলোকে যে এত ভালবাসি, বদলে একটা ফোন করল না শয়তান গুলো, করুক কাল ফোন/মেসেজ ধরবই না, জবাবই দেব না। নাহ্ এযে সত্যি সত্যিই সুখেও কেঁদে ওঠে মন। বড় কত্তা ঠিকই কয়েছিলেন, " জানেও ক্যায়সে লোগ থে জিনকে প্যার কো প্যার মিলা -" ।
অনির ডাইরি ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
এত সকালে ফোন করেছ কেন বাবা? সব ঠিক আছে তো? মুঠো ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে বাবার হেরে যাওয়া কন্ঠস্বর, থেমে থেমে বলে," না ঠিক নেই। তোমার মা -", এই অবধি শুনেই ধপ করে বসে পড়ি আমি। ঘড়ি বলছে আপিস টাইম শুরু হতে এখনও বাকি ঘণ্টা দেড়েক, স্নান সেরে বাগানে পায়চারি করতে যাবে শৌভিক, আর আমি যাব স্নান করতে। এই সন্ধিক্ষণে উভয়েই কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াই, দুচারখানা কথা বলি প্রাণ খুলে। স্বামী স্ত্রী হিসেবে নয় বরং বলতে পারেন দুই সমব্যথী সরকারী আধিকারিক হিসেবে ভাগ করে নিই পাওয়া না পাওয়ার সুখদুখ। আজও তাই করছিলাম দোঁহে -
দিন কয়েক ধরেই ভালো নেই মায়ের শরীর।ভুগছে তীব্র অজীর্ণ ব্যাধিতে। এর মধ্যেই বারে বারে ছুটি নিচ্ছে মায়ের আয়া, সামনেই তার কন্যার শুভবিবাহ, সেও নিরূপায়। বৃদ্ধবৃদ্ধার পক্ষে এঘর ওঘর করাই মুস্কিল, দোকানে গিয়ে ওষুধ কেনা তো দূর অস্ত। এত দূর থেকে কি যে করি আমি। বার বার খুড়তুতো ভাইদের বলতে লজ্জা লাগে, ওদের জন্য তো কিছুই করতে পারি না আমি।
নিয়মিত রক্ত নিয়ে যায়, প্রেসার দেখে দেয় যে ছেলেটি তাকেই ফোন করে ওষুধ আনিয়ে দিয়েছিলাম গতকাল। রাতে শেষ যা কথা হয়েছিল, মা জানিয়েছিল একটু ভালো আছে। তাহলে? বাবা জানায়, ভালো নেই মা। ওষুধ নিষ্ফল। গতকাল সারা রাত শৌচাগারে কেটেছে। ঘুমাতে পারেনি বুড়োবুড়ি কেউই। আজ সকালেও একই অবস্থা। হে ভগবান, কি করি আমি? গাড়ি ডেকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে এতো ডিহাইড্রেশনেই শেষ হয়ে যাবে।
পাশ থেকে সান্ত্বনা দেয় শৌভিক, " দাঁড়া এখন কাঁদতে বসিস না। আগে প্ল্যান করাটা জরুরী।" কি করি, কার কাছে সাহায্য চাই, কে এত সকালে ঘুম থেকে উঠেছে ইত্যাদি অনেক ভেবে সেজদাকেই ফোন করি। আমরা পাঁচ মাসতুতো ভাইবোন এক সাথে বড় হয়ে উঠেছি। দাদাদের ওপর আমার জোর চিরকাল। সর্বোপরি বড় মাসির পারকিনসন ব্যাধি ধরা পড়ার পর থেকে সেজদা সারাক্ষণ ইন্টারনেটে রোগব্যাধি নিয়েই পড়াশোনা করে। কলকাতার যাবতীয় বড় হাসপাতাল, ডাক্তারদের সাথে ওর নিত্য যোগাযোগ। আমার মত গণ্ডমূর্খের কাছে ও হাফ ডাক্তার তো বটেই।
তীব্র সংকোচ নিয়েই ফোন করলাম, সব শুনে সেজদা জানতে চাইল, " কি ওষুধ দিয়ে গেছে জানিস?" তাও তো জানি না ছাই। সন্তান হিসেবে আর কত অধঃপতিত যে হব। ফোন কেটে বাবার থেকে জানতে চাই, কি ওষুধ খাচ্ছে মা? পাশে দাঁড়িয়ে বাবার বলা বর্ণগুলো মুঠো ফোনে পটাপট বসাতে থাকে শৌভিক। খুঁজে পাওয়া যায় ওষুধের নাম। পুনরায় সেজদাকে ফোন করে জানাই। " হুঁ। আমি তোকে দু মিনিটে ফোন করছি" বলে ফোন কেটে দেয় সেজদা।
স্থানুর মত আমি দাঁড়িয়েই থাকি সিঁড়ির সামনে। দুইয়ের জায়গায় পাঁচ মিনিট কেটে যায়। কোন ফোন আসে না। রোয়াকের ওপর থেকে শৌভিক বলে, 'গাড়ি আসতে আসতে চটপট স্নান সেরে নে। গিয়ে দিন দুয়েক থাকতে হবে হিসেব করে ব্যাগ গুছিয়ে নে। সব সামলে গুছিয়ে তবে ফিরিস। পারলে আমিও চলে যেতাম কিন্তু - "। জানি ওর পক্ষে সম্ভব নয়, কাঁথির মহকুমা শাসকের ওপর এমনিতেই মারাত্মক চাপ তারওপর আবার কি যেন মামলায় মহামান্য উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছে এক পঞ্চায়েত প্রধানের চার্জ নিতে হবে আমার বরকে। একটু আগে সেই কথাই আলোচনা করছিলাম দোঁহে, শৌভিক বলছিল, "এটাই বাকি ছিল। যাই গিয়ে পঞ্চায়েত প্রধান হই।"
তবে হাইকোর্টের গুঁতো না থাকলেও শৌভিক যেতে পারত না, কারণ শাশুড়ি মাতা এখনও শয্যাশায়ী। পায়ে অস্ত্রোপচার হয়ে ফিরে আসার পর থেকেই কেমন যেন শিশুসুলভ হয়ে পড়েছেন ভদ্রমহিলা। একেকটা মুহূর্ত কাটে যেন একেক যুগ। সেজদার ফোন আর আসে না। মিনিট দশ বাদে উঠেই পড়ি, নাহ এই ভাবে বিহ্বল হয়ে বসে থাকার বিলাসিতা আমায় পোষায় না। স্নানে যেতে আরেকবার বাড়িতে ফোন করি, রিং হতে না হতেই ধরে নেয় বাবা। গলায় যেন একটু ফিরে আসা জোর টের পাই, নাকি আমারই মনের ভুল। বাবা বলে, " সেজদা এসেছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে ওষুধ কিনে এনেছে। মাকে খাইয়েও দিয়েছে -"।
আবেগে বুজে আসে গলা, এই ঘোর কলিতে আপন সহোদর/ সহোদরার কাছে এমন সহমর্মিতা পায় না মানুষ, যা আমি আমার মাসতুতো দাদার কাছে পেলাম। বাবার হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয় সেজদা, চিৎকার করে বলে, " তোর কোন চিন্তা নেই। আমি আছি। আমি বেলা একটা অবধি থাকব, মাসিকে লক্ষ্য করব। তারপরও ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর নেব। তোকে এখনি দৌড়ে আসতে হবে না।তুই নিশ্চিন্তে থাক -"। ধরা গলায় থ্যাঙ্ক ইউ বলে ঝাড় খাই সেজদার কাছে। " আমাকে থ্যাঙ্ক ইউ দিচ্ছিস কেন রে হোঁদলু কোথাকার?"
সেজদা সত্যিই ঘণ্টায় ঘণ্টায় খোঁজ নিতে থাকে, রিলে করতে থাকে হাওড়া থেকে কাঁথি। এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচেই যায় মা। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অন্যত্র, আয়া দিদি যে দশ বারো দিনের জন্য ছুটিতে যাবে। কে দেখবে ওদের ওই সময়? আগে ঠিক ছিল কাঁথি নিয়ে আসব আমি, কিন্তু এই শারীরিক অবস্থায় কি আসতে পারবে মা? বাবা তো এমনিতেই নিজ ভিটে ছেড়ে আসতে নারাজ।
অগত্যা নতুন আয়া খুঁজি আমি। খুঁজলেই যদি পাওয়া যেত। আজ থেকে বছর চোদ্দ আগে যার থেকে লতা দিকে পেয়েছিলাম, বছর পাঁচেক আগে মায়ের আয়ার সন্ধান দিয়েছিল যে এজেন্সি, তাদেরই ফোন করি। এজেন্সির জাঁদরেল মালকিন আপাতত বুড়ি সিংহী। নেই সেই দাপট। ভালো আর কাজের মেয়েরা সকলেই আপাতত কোথাও না কোথাও যুক্ত। তাও এত পুরাণ সম্পর্কের খাতিরে তড়িঘড়ি একজনকে খুঁজে দেন ভদ্রমহিলা।
শৌভিক বলে, "তাও তুই যা। গিয়ে দেখে আয়, নতুন দিদি যাতে বুঝতে পারে, ওরা একা আর অসহায় নয়। দূরে হলেও আমরা আছি -।" বড় সাহেবের কাছে ছুটির আর্জি জানিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিই আমি। কাল বাদ পরশু শুরু হতে চলেছে দুয়ারে সরকার। জমে আছে পাহাড় প্রমাণ কাজ, এই সময় এই ভাবে ডুব মারতে কি যে চরম অপরাধ বোধে ভুগি। নিজেকে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম আধিকারিক বলে বোধ হয় - । ভাবি গিয়ে ঘণ্টা খানেক থেকেই ফিরে আসব। আড়াইটে নাগাদ যদি ঢুকতে পারি অফিসে, তাহলেও খানিক মুখ বাঁচে -
রাস্তা থেকেই খবর পাই, ভোর বেলা এসে মাকে দেখে গেছে সেজদা। ঘুমন্ত মাসির মাথায় হাত বুলিয়ে ও গেছে খানিক ক্ষণ, মা যদিও কিছুই টের পায়নি। দশটা নাগাদ আবার ফোন করে বাবা, নতুন আয়া দিদি এসে গেছে। নিশ্চিন্ত বোধ করি আমি। তাহলে আধ ঘণ্টা থেকেই বেরিয়ে পড়ব। যত তাড়াতাড়ি অফিসে ফেরা যায় -
রানীহাটির মোড় থেকে শুরু হয় অকথ্য জ্যাম। কোন এক রাজনৈতিক দলের সমাবেশ আছে ব্রিগেডে, তার জন্য পিলপিল করছে লোক। বাড়তে থাকে রক্তচাপ। আচ্ছা বিশ মিনিট থেকেই চলে আসব ক্ষণ। ফেরার পথে এত ভিড় হবে না আশা করি। ভাবতে ভাবতেই মায়ের ফোন, " এ কেমন লোক খুঁজে দিয়েছিস? এতো বেতো রুগী। নিজেই নড়তে পারে না - আমাদের কি দেখবে? একে ছড়িয়ে দে। দশটা দিনের তো ব্যাপার, তারপর আমাদের মেয়েটা ফিরে আসবে। ততোদিন আমরা হোম ডেলিভারি থেকে খাবার আনিয়ে খাব। " ব্যাপারটা বলা যত সোজা, আদতে যদি ততোটা সহজ হত। অধিকাংশ হোম ডেলিভারি এদিকে এক বেলা খাবার দেয়। বেশি খদ্দের না হলে, অনেক সময় এক বেলাও দেয় না। তেমন হলে এরা খাবে কি? আর শুধু দুই বেলার খাবার তো নয়, জলখাবার, চা, ওষুধ ইত্যাদি আরও অনেক কিছু লাগে যে - ।
কি করি? মনে হয় টেনশনে মাথাটা ফেটেই যাবে এবার। তাও যথা সম্ভব ঠাণ্ডা মাথায় বলি, আমার সঙ্গে ফিরে আসবে? মা উত্তর দেবার আগেই বাবা চিৎকার করে ওঠে, " না। আমি জামাই বাড়ি কিছুতেই যাব না।" আর ভাবতে পারছি না, মনে মনে বলি ঠাকুর মাথা ব্যথাটা যখন দিয়েছ তুমি, এর মলমটাও দাও তুমি। বাড়ি ঢুকে দেখি সত্যিই কথা শুনেছে ঠাকুর, অজীর্ণ রোগে ভোগা মায়ের ওপর ভর করেছেন সাক্ষাৎ দনুজ দলনী। কি গলার জোর তার, তার সামনে রীতিমত মিউ মিউ করছে বাবা। শুনতে পেলাম মা বলছে, " আমি মেয়ের সঙ্গে কাঁথি যাবই, যাব। আমার রোগ এই ওষুধে সারবে না। আমার ওষুধ আমার তুত্তুরী। ওকে কাছে না পেলে আমি এমনিই মরে যাব।"
অগত্যা আর কি, বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বুড়োবুড়িকে বগল দাবা করে রওনা দিলাম কাঁথি। অফিসে বোধহয় আর ঢোকা হল না, পথে অন্তত বার তিনেক গাড়ি থামিয়ে বমি করবে বাবা, " ইশ কেন এলাম, আমার জন্যই বুড়োটা এত কষ্ট পাচ্ছে" বলে আক্ষেপ করবে মা, দাদু দিদাকে পেয়ে পড়াশোনা লাটে উঠবে তুত্তুরীর - সে হোক, কিন্তু আপাতত যে অপরিসীম শান্তি পাচ্ছি আমি, তার সাথে কোন কিছু তুলনীয় নয়। থাক ওরা আমার চোখের সামনে থাক। বাপরে বাপ, ঘরে বাইরে এত চাপ নেওয়া যায়। আর আমি কিনা ভাবতাম যে বেকার জীবনটাই ছিল সবথেকে চাপের।
অনির ডাইরি, ১৮ই জানুয়ারী, ২০২৫
#অনিরডাইরি
সে অনেককাল আগের কথা, তখন ফি বছর আমাদের মেলা হত। সরকারি মেলা, নিছক কর্তব্য পালন, তাও আমাদের উৎসাহ দেখে কে। আমরা এমন করতাম, যেন অফিসিয়াল মেলা নয়, বাড়ির দোল- দুর্গোৎসব বা বিয়ে। সামর্থ্য সীমিত তো কি হয়েছে, তারই মধ্যে সেরার সেরা হতে হবে আমাদের মেলা।
কালি পুজো ভাইফোঁটার ছুটি কাটিয়ে এসেই আমরা ব্যাপৃত হয়ে পড়তাম মেলার প্ল্যানিংয়ে। পরিকাঠামো থেকে খাওয়াদাওয়া, অতিথি আপ্যায়ন থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সব কিছুর জন্যই একজন ইন্সপেক্টরকে OC করা হত। প্রত্যেক ওসির থাকত ডেডিকেটেড টিম। যা তৈরি হত তার মনপসন্দ CKCO, SLO আর কালেক্টিং এজেন্টদের নিয়ে। আর রমেশ হত সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা।
তখন বাজার কাঁপাচ্ছে, “টুম্পা সোনা, দুটো হাম্পি দেনা”। মেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যখন ছকা শুরু হল, তখনই আমার ইন্সপেক্টর কৌশিক বলেছিল, ‘বাজেট যতই কম হোক, তবুও যাকে তাকে মঞ্চে তোলা যাবে না। পাগল, তারপর যদি ঐ গান গাইতে শুরু করে?’ তখন বেশ গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করেছিলাম আমি, ‘কেন রে? কি এমন খারাপ গান?’ বেশ মজা লাগে শুনতে। ‘চাঁদনি রাতে,আমি টুম্পার সাথে যাব ডিনার খেতে, পোচ মামলেট খেতে’ মাঝে মাঝেই সুকন্যাকে ফোন করে এই লাইনটা গাইতাম আমি। আহাঃ বললে বিশ্বাস করবেন না, গাইলেই লেবার কমিশনারেটের সু-কন্যা কেমন দনুজদলনী হয়ে উঠত- কারণটা লিখে কোতল হই আর কি?
শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমার যুক্তিতে কেউ কর্ণপাত করেনি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা আমাদের সহশ্রম কমিশনার শ্রীসুখেন বর্মনই দেখতেন। মেলার আগের সন্ধ্যার মাইক টেস্টিংও হত ওণার খালি গলায় গাওয়া- ‘মেরা জীবন কোরা কাগজ, কোরাই রয় গ্যয়া’ দিয়ে। ভুল বললাম, মেলার মাইক টেস্টিং থেকে টিম চুঁচুড়ার পিকনিক সবই শুরু হত আমাদের আদরের বর্মন সাহেবের ঐ গানটা দিয়ে। দু নম্বরে থাকত আমাদের সিকেসিও শুভজিৎ এর "পৃথিবী হারিয়ে যায় মরু সাহারায়-"।
তারপর থাকত আমাদের ধনিয়াখালীর রূপসী এসএলও অমৃতা। গলায় মধু ছিল মেয়েটার। মধু ছিল আমার ধনিয়াখালীর ইন্সপেক্টর চঞ্চলের গলাতেও। এইটুকু রোগা পাতলা একটা ছেলে, ধূমপানে ঝরঝরে যার ফুসফুস, খালি গলায় গান ধরলে ঐ খলবলে ফুসফুসের দম দেখে তাজ্জব হয়ে যেতে হত। জখম ফুসফুস নিয়েও এত চড়া গাইত কি করে ছেলেটা সেটা আজও এক রহস্য। সবই বিড়ি বাবার কৃপা।
চুঁচুড়ার বাকি মক্কেল গুলো কে কেমন গান গাইত বা গায় সেই সম্পর্কে আজও আমার কোন ধারণা নেই। ওদের দর এত বেশী ছিল, যে ঘড়া ঘড়া তেল দিলেও কেউ গান গাইতে চাইত না। এমন ভান করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকত, যেন ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না। তুলনায় এই ব্যাপারে আমার বর্তমান টিম অনেক নিঃসঙ্কোচ।
যাই হোক, ফিরে যাই টুম্পা সোনায়। আমাদের মেলার অব্যবহিত কয়েকদিন পূর্বে আচমকা ভাইরাল হল এক ভিডিও ক্লিপ। কোন এক সরকারি মেলায়, গাওয়া হয়েছে ঐ গানটা। স্থানীয় যে ব্যান্ড গাইছিল, তাদের মুখ্য গায়ক উৎসাহের বশে হাত ধরে টেনে আনে মেলার মুখ্য সংযোজককে। ভিডিও তে দেখা যায়, উদ্দাম গানের সাথে সবাই নাচলেও তিনি নাচেননি, হাসি হাসি মুখে তালে তালে সামান্য হাততালি দিয়েছেন বলতে পারেন। তাই নিয়েই উত্তাল বঙ্গ। এক প্রগতিশীল দলের রক্ষণশীল ট্রেড ইউনিয়ন নেতা তো এসে আমায় বলেই গেলেন, " দেখছেন ম্যাডাম। সমাজের কি অবক্ষয়। সরকারি আধিকারিক হয়ে, ছিঃ। " বলতে পারলাম না, আরেকটু হলেই ঐ আধিকারিকের জায়গায় এই আধিকারিক থাকত। বাঁচিয়ে দিয়েছিল আমার টিম। ভাগ্যে আমাদের টিম চুঁচুড়ায় সবাই রাজা। নইলে আমার কথা শুনে, কে জানে তৈরী হত কোন কেলেঙ্কারি।
দেখতে দেখতে কেটে গেল বেশ অনেক গুলো বছর। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলাম পূর্ব মেদিনীপুরের সঙ্গে, তৈরি হল কত নতুন স্মৃতি। পূর্বের প্রিয় মুখ গুলোর জায়গা দখল করে নেওয়া নতুন মুখ গুলোও পুরাণ হতে বসল। জানুয়ারি এলেই স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ি বড়,শুকনো রুটি আর ফুলকপি আলুর তরকারি দিয়ে টিফিন করতে করতে সেই সবই ভাবছিলাম, হঠাৎ বেজে উঠল মুঠো ফোনখানা। অচেনা নম্বর,অন্যমনস্ক ভাবে ধরে হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে এক পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠল, " নমস্কার ম্যাডাম।" প্রতি নমস্কার জানিয়ে বললাম, বলুন কি দরকার? লোকটি কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে বলল, " ম্যাডাম আমি সোমনাথ বলছি। প্রিয়াঙ্কার হাজব্যান্ড।"
কেজো অফিসিয়াল শীতলতা সহ কোন প্রিয়াঙ্কা, কোন সোমনাথ বলতে গিয়েও থমকে যাই, চোখের ওপর থেকে পলকে সরে যায় সময়ের পর্দা, মনে পড়ে যায়, প্রিয়াঙ্কা আমার চুঁচুড়ার SLO, তার বরের নাম সোমনাথ বটে। বিয়েতে নিমন্ত্রণও করেছিল প্রিয়াঙ্কা। ততদিনে বদলি হয়ে এসেছি এই জেলায়। গুগল ম্যাপ দেখিয়েছিল যেতে ঘণ্টা চারেক লাগবে, ফিরতেও তাই। ফলে ক্ষমা প্রার্থনা করে ফোনেই আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। সেই অভিমান আজও ভোলেনি প্রিয়াঙ্কা। মাঝে মাঝেই খোঁটা দেয়। কদিন আগে বলেছিল বটে, " ম্যাডাম আমার ভালো খবর আছে।" শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম। বলেছিলাম, প্লিজ আমায় জানিও কি হল।
প্রিয়াঙ্কার বর ফোনে বলেই যায়," এইমাত্র অপারেশন শেষ হল ম্যাডাম। এখনও বেডে দেয়নি প্রিয়াঙ্কাকে। বেবির মুখ ও দেখতে দেয়নি আমাদের। শুধু খবর দিল -।" উৎকণ্ঠায় থামিয়ে দিই ছেলেটাকে, বলি আরে ভাই আগে বলো, কি হয়েছে। ছেলেটা নার্ভাস ভাবে হেসে বলে, " আমাদের ঘরে লক্ষ্মী এসেছে ম্যাডাম।" পুরো দিলখুশ খবর। সহর্ষে অভিনন্দন জানাই।
ছেলেটা ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, "OT তে ঢোকার আগে প্রিয়াঙ্কা আপনার নম্বরটা দিয়ে গিয়েছিল আর বলে গিয়েছিল, খবর পেলে প্রথম ফোনটা- আমাদের ম্যাডামকেই করবে। আমি আপনাকেই প্রথম জানাচ্ছি ম্যাডাম।" কি বলব বুঝে উঠতে পারি না। আবেগে বুঝে যায় গলা, এত দিন পরেও এত দূর থেকে এত ভালোবাসা, এত সম্মান পাবার মত কোন কাজ কি আদৌ করেছিলাম - শুধু বলি ভালো থেকো ভাই। খুব ভালো থেকো তোমার লক্ষ্মী আর তার মাকে নিয়ে।
অনির ডাইরি ১৪ই জানুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
নরঘাট ব্রিজের ওপর গাড়িটা উঠতেই ফোঁস করে উঠল শৌভিক, "আমার ওপর চাপাবি না কিন্তু, আইডিয়াটা তোর।" সন্ধ্যা গড়িয়ে নামছে রাত, নীচে দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে হলদি নদী। আমার অপরাধ বলতে, আমি বলেছি,' চল চা আর গরম বেগুনি খেয়ে আসি'।
সেই বিকাল সাড়ে তিনটে থেকে একটা পুঁচকে অফিস ঘরে আবদ্ধ ছিলাম দুজনে। নিকষ আঁধারে গাড়ির ঘড়ি বলছে এখন ছটা। পৌনে ছটা নাগাদ অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়েছে শাশুড়ি মাকে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েই দিয়েছে অপারেশন পর্ব মিটতে সময় লাগবে ঘণ্টা খানেক। তারপর বেড এ দিতে আরো কতক্ষণ লাগবে কে জানে।
আরো অতটা সময় ঐ ঘরটায় বসে থাকতে হবে ভেবেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল যেন আমার। ক্ষিদে ও যে পাচ্ছিল না তা নয়, তাই চা খেতে যাবার কথা বলেছিলাম। তাও তো শৌভিক মহকুমা শাসক বলে আমাদের খাতির করে অফিস ঘরটায় বসতে দিয়েছে এরা, দুটো পুঁচকে জলের বোতল ও দিয়ে গিয়েছিল, এমনকি চা খাব কিনা বার কতক জিজ্ঞাসা ও করেছিল। নইলে তো বাইরে শেডের নীচে পেতে রাখা চেয়ারে বসে মশার কামড় খেতে হত।
দোনোমনো করে রাজি হয়ে গেলেও বিরক্তিটা যায়নি আমার বরের। আলবেয়ার কামুর আউটসাইডার গল্পের নায়কের মত আমার বর ওপর ওপর যতই ভাবলেশহীন থাকুক না কেন, ভিতরে ভিতরে ধিকিধিকি জ্বলছে চাপা উত্তেজনার আগুন। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে তার উত্তাপ আমার গায়েই এসে লাগবে এ আর আশ্চর্য কি।
যা পতনশীল ভদ্রমহিলা আমার শাশুড়ি মাতা। নিত্য দিন ধপাস্। আর ঐ প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তেমনি অবাধ্য। আমাদের বোধহয় আজও নাবালক বলেই গণ্য করেন, বিন্দুমাত্র পাত্তা দেন না। একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি, ওনার পতনের একটা নির্দিষ্ট সময়কাল থাকে এবং তা মোটামুটি ভোর পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে। উনি ব্যতীত যখন নিদ্রামগ্ন থাকে গোটা বাড়ি। কঠোর অনুশাসনে চলা ভদ্রমহিলা নৈশাহার সারেন মোটামুটি সাড়ে আটটার মধ্যে, রাত নটার মধ্যে নিভে যায় ওনার ঘরের আলো। ফলে ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙাই তো স্বাভাবিক।
ঘুম থেকে উঠেই গুটি কয়েক ওষুধ খান, তারপরই স্নান করতে যান এবং ধপাস হন। হাজার বার বলা হয়েছে সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্নান করতে যেও না। একটু বেলা বাড়ুক না, কিঞ্চিৎ সচল হোক না গ্রন্থি গুলো। শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যু ইস্তক আধ্যাত্মিক জগৎকে বিদায় জানিয়েছেন ভদ্রমহিলা। বিপুল অভিমান দেবদ্বিজে। তাই পুজোয়াচ্ছা তো আর করবে না, তাহলে এত সকালে উঠে লাভ কি? কে কার কথা শোনে।
নতুন বছর পড়ার সাথে সাথে উনিও ভূপতিত হলেন। এমন আছাড় খেলেন যে, মাথা ফুলে আলু। পায়েও বিপুল লাগল, নিজেই বললেন, " পা'টা ভাঙল কি না কে জানে।" তড়িঘড়ি ডাক্তারের সাথে কথা বলে বেদনা নিবারক ওষুধ দেওয়া হল, পইপই করে বলা হল, আজকের দিনটা শুয়ে-বসেই থাকো, খাবারদাবার সব মুখের কাছে ধরা হবে। আর যা দরকার পড়বে আমাদের বলো। শৌচালয় যেতে হলেও আমাদের ডাকবে আর লাঠি অবশ্যই নেবে। পুরাণ লাঠিগাছ খানা মহানগরের বাড়িতে কোথায় যেন গুছিয়ে রেখে এসেছেন বলে তৎক্ষণাৎ নতুন লাঠি আনিয়ে দিল শৌভিক। দোহাই, শুধু একটু সাবধানে থাকো।
মুস্কিল হল, এতদিন আমাদের ওপর হুকুম চালিয়ে এসেছেন যিনি, তিনি থোড়াই আমাদের পরোয়া করবেন। সেইদিন বিকালেই, ফল খেয়ে ডিশ নামাতে গিয়ে আবার ধপাস। ছুটির দিন ছিল, সবে দিবানিদ্রাটি জমিয়ে এসেছিল, বিকট শব্দে ধড়ফড় করে দৌড়ে গেলাম সকলে। শৌভিক আতঙ্কের স্বরে বলল, "তোমায় কে প্লেট নামতে বলেছিল? লাঠি কোথায়?" দেখা গেল লাঠি গাছ খানা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা বিছানার কাছে।
ব্যাপারটা যে এত সঙ্গীন তখনও বোঝা যায়নি। উফ্ উফ্ করেও দিব্যি হাঁটছিলেন শাশুড়ি মাতা। কর্ণপাত করছিলেন না শুয়ে বসে থাকার অনুরোধে। দিন দুয়েক পর অবস্থার যেন আরো অবনতি হল। ওয়াকার এর সাহায্য ছাড়া মোটে নড়াচড়া করতে পারেন না ভদ্রমহিলা। অফিস ফেরৎ অ্যাম্বুলেন্স করে এক্সরে করাতে নিয়ে গেল শৌভিক। এক্সরে রিপোর্টে ভাঙা তো দূর চিড় খাবার ও কোন লক্ষণ নেই। এদিকে বিছানা থেকে ওঠানামা করা ক্রমেই দুষ্কর হয়ে উঠছে ওনার। কেনা হল বেড প্যান, প্লাস্টিক শিট মায় হুইল চেয়ার পর্যন্ত।
হুইল চেয়ার ছাড়া আর কিছুই ব্যবহার করতে রাজি নন জেদী বৃদ্ধা। আবার ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া হল, এবারের নিদান সিটি স্ক্যান। পুনরায় মাকে অ্যাম্বুলেন্স করে স্ক্যান করাতে নিয়ে গেল শৌভিক। চূড়ান্ত পেশাগত চাপের মধ্যেও মায়ের প্রতি আমার বরের অখণ্ড দায়িত্ববোধ দেখে কোথায় যেন চূড়ান্ত হীনমন্যতায় ভুগি আমি। সন্তান হিসেবে নিজেকে নিতান্ত সাদামাটা, অক্ষম, অপদার্থ বোধ হয় আমার। মাস গেলে টাকা তুলে দিয়ে আসা আর অনলাইন টুকটাক বিল মেটানো/ রিচার্জ করে দেওয়া ছাড়া আমি তো কিছুই করতে পারি না আমার বুড়ো বাপমায়ের জন্য। বিশ্বাস করুন টাকাপয়সা দিয়ে বাপমায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করা অনেক সহজ। গায়ে গতরে খেটে করতে সত্যিই দম লাগে। আর লাগে অসম্ভব ধৈর্য। যার কোন অভাব আমার বরের নেই।
সিটি স্ক্যানের রিপোর্টে ধরা পড়ে, হিপ জয়েন্ট এ সামান্য চিড়। ডাক্তার নিদান দেয় অস্ত্রোপচার ছাড়া গতি নেই। এই অস্ত্রোপচার আগেও হয়েছে ওনার। বাম পায়ে বসানো আছে টাইটেনিয়াম রড। এবার ডান দিকের পালা। ডাক্তার বলেই দেয়," মাসিমা এবার যদি পড়েন, তো ভাঙ্গবে মেরুদণ্ড। সেখানে কিন্তু কোন ইমপ্ল্যান্ট বসানো যাবে না।"
কাঁথি শহর থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরের এক নার্সিংহোমে আপাতত অস্ত্রোপচার চলছে বৃদ্ধার। কাছেই নন্দকুমার মোড়, অফিস ফেরৎ মাঝেমধ্যেই এখানে চা আর বেগুনি খাই আমি। আজ শনিবার বলে বোধহয় দীঘা মুখী পর্যটকদের ভিড় বেশ বেশী। রাস্তার ধারে সারি সারি দাঁড় করানো মূল্যবান সব গাড়ি। চেনা দোকানের সামনে আর দাঁড়াতে পারি না আমরা। অনেকটা এগিয়ে এসে এক বৃদ্ধ দম্পতির ছোট্ট গুমটির সামনে দাঁড়াই। খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুঁচকে কাগজের কাপে চা আর দুটো মোটকা সুজির বিস্কুট খাই তিনজনে - ড্রাইভার নূপুর বাবু, শৌভিক আর আমি। কাপের সাইজ দেখে শৌভিক হতবাক হয়ে জানতে চায়, " এটাই চা, না এটা চায়ের স্যাম্পল?" হিমেল বাতাস খেলা করে মাথায়, ফুসফুসে ভরে নিই দূষিত আর ধুলোয় মাখামাখি বাতাস। একটু যেন মাথাটা ছাড়ে। রাস্তা পেরিয়ে দৌড়ে গিয়ে কোথা থেকে যেন দুটো বেগুনি কিনে আনেন নূপুর বাবু। কিছুতেই দাম নেন না, " টাকাটা বড় কথা নয়, আমার সাহেব আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেগুনি খেয়েছেন, এযে আমার কি আনন্দ ম্যাডাম।" কে যে কিসে খুশি হয়।
গাড়ি ঘুরিয়ে নার্সিং হোমের দিকে যাত্রা করি আমরা, শৌভিক খোশ মেজাজে গল্প জোড়ে কি সব যেন। বুঝতে পারি এটা আসলে denial mode। মায়ের চিন্তাটাকে মাথার পিছনে চালান করার জন্যই এই সব ফালতু কথা আমদানি করছে আমার বর। পুনরায় নরঘাট ব্রিজে ওঠে গাড়ি, নীচে আবার কুলকুল করে বয়ে যায় হলদি নদী, বরের হাতটা চেপে ধরি আমি, নূপুর বাবুর কান বাঁচিয়ে বলি, সব ঠিক হয়ে যাবে। এত চিন্তা করিস না। এই সব ছুটকোছাটকা উত্থানপতনই তো রঙিন করে জীবন। না হলে নির্বিকল্প সুখ যে বড় বোরিং বাপু।
অনির ডাইরি ৭ই জানুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
আগে খেয়ে উঠে পড়ল শৌভিক। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এবার ভালো করে খাওয়া যাবে। রাতে বাঁধা কপির তরকারি হয়েছে বলে গরম গরম বেগুন ভেজেছে লতা দি। ছোট ছোট, গোল গোল, চাকা চাকা করে ভাজা শীতের নরম বেগুন। একটার জায়গায় দুটো নিতেই ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল আমার বরের। তিন নম্বরটা নেব বলে হাত বাড়াতেই কটমট করে তাকাল। তখন থেকে আস্তে আস্তে খাচ্ছি। তক্কে তক্কে আছি। হাত ধুতে গেলেই -
কেস জন্ডিস বাঁধাল এই মেয়েটা। বাপ সোহাগী হয়ে কি যে এত কথা বলে, মাঝখান থেকে খাবার ঘরের বেসিনেই হাত ধুয়ে নিল শৌভিক। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকেই যাচ্ছে মেয়ের সাথে, মনের দুঃখে বসে বসে শসা চিবোই আমি। শসা আমার জঘন্য লাগে খেতে, এর থেকে ঘাস খাওয়া ভালো। তাও খাই, অপেক্ষা করি, কখন শেষ হয় এদের বকবক।
গল্প শেষ হবার আগে রুটিটাই শেষ হয়ে গেল, ধুৎ। অগত্যা উঠে পড়তেই হয়, নীরবে রান্না ঘরে গিয়ে প্লেট নামাই। আমায় উঠতে দেখে উঠে পড়ে তুত্তুরীও। থালাবাসন নামিয়ে দাঁত মাজতে যায়, জল খাবার অজুহাতে খাবার ঘরেই থেকে যাই আমি। টেবিলে সাজানো এষার আনা গাজরের হালুয়া, এক ঝোলা পয়রা গুড়, খানিক রিচ ফ্রুট কেক, কৌটো ভর্তি জয়নগরের মোয়া, গোটা দুই চকলেট। নিশি ডাকার মত ডাকছে আমায়।
আপদ বরটা যে কি করছে এখনও, দাঁত মাজতে যা না রে ভাই। কিছুতেই নড়ে না শৌভিক। প্রাক বিবাহ পর্বে ঝাড়ি মারার মত তাকিয়ে আছে আমার দিকে, গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ। থাকতে না পেরে হ্যাংলার মত বলেই ফেলি, " একটা মোয়া খাব?" দীর্ঘশ্বাস ফেলে, দুদিকে মাথা নাড়ায় শৌভিক, চুক চুক আওয়াজ করে মুখে। তারপর বলে, " কথা রাখতে পারলি না?"
কি আবার কথা দিলাম? ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায়, ও হরি কাল রাতে বলেছিলাম বটে, এই বছরে রোগা হবই। তাই আজ থেকে কাঁচা নুন এবং মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দেব। সে প্রতিজ্ঞা তো সেই দুপুর বেলাতেই ভেঙেছি যখন কোলাঘাটের SLO কৌশিক তার বউয়ের হাতে বানানো গরম গরম ফ্রুট কেক এনেছিল। তারপর জহর বাবুর আনা ওনার স্ত্রীর হাতে বানানো পুলি পিঠেগুলোও তো সদ্ব্যবহার করেছি। কি অনুপম পিঠে বানিয়েছিল মাইরি জহর বাবুর গিন্নি। আমার ভালো লেগেছে শুনে শূন্য টিফিন বক্সে চেপে চেপে ভরে দিয়েছিলেন জহর বাবু, " বাড়ি গিয়ে খাবেন ম্যাডাম। স্যারকে দিবেন। খুকীকে দিবেন " করে। স্বাস্থ্য সচেতন স্যার তো ছুঁয়েও দেখেনি। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে চোরাগোপ্তা সেগুলোর দায়িত্ব নিতে হয়েছে এই অধমকেই।
ফিরে আসি বর্তমানে। একটা মোয়া কি পাব না? পাব না একটা মোয়া? শৌভিক বলে, " তুই চারটে বেগুন ভাজা খেলি, আমি কি দেখিনি?" কি মিথ্যে অপবাদ বাপু। আমি মাত্র ইয়ে তিনটে খেয়েছি। বলাতে ফুঁসে ওঠে শৌভিক, " কিন্তু কেন? আমি তো একটাও খাইনি। আমায় দেখে শেখ, এই সব কেক, চকলেট, মোয়া লোকজন তো আমায় উপহার দিয়েছিল। আমি একটাও দাঁতে কাটিনি। এমনকি এই শীতে একদিন গুড় পর্যন্ত খাইনি"।
কি বলি। ও মহাপুরুষ, আমি ঘোর পাতক। আমি খেয়েছি, সব খেয়েছি এবং আমার ঘোরতর সন্দেহ যে সবথেকে বেশি আমিই খেয়েছি। আমি স্বঘোষিত পেটুক, হ্যাংলা এবং ভোজনরসিক। খাবার জিনিস কেউ উপহার দিলে বিরক্তিতে যতটা ভ্রু কুঁচকে যায় শৌভিকের, ততোটাই চওড়া হয় আমার মুখের হাসি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার বরের অগ্নিদৃষ্টির সামনে সংকুচিত হয়ে পড়ি কেমন যেন। সিদ্ধান্ত নিই, নাহ আর নয়। আর হরগিজ হরগিজ নয়। এই মোয়া খানা বাদে এই দণ্ড থেকে মিষ্টি ত্যাগ করলাম আমি। মোয়ার কৌটো ছুঁয়ে বরকে জানিয়েও দিই। আমি না Aquarian, একবার যদি মুখ ফিরিয়ে নিই, আর সেদিকে তাকাই না। বলতে বলতে খেয়াল হয়, এই যা এই মাসেই তো আমার জন্মদিন। একটুখানি সংশোধন করি নিজের প্রতিজ্ঞা, জন্মদিন বাদে আর মিষ্টি খাব না। সেই দিন তো সব চলতা হ্যায়।
চিবিয়ে চিবিয়ে বলে শৌভিক, " বটেই তো। তবে ওটা জন্মদিন নয়, বল জন্মমাস। জানুয়ারি তোর জন্ম মাস, তাই সব চলতা হ্যায়। ফেব্রুয়ারি তোর বিয়ের মাস, তাই সব চলতা হ্যায়। মার্চ ইয়ার এন্ডিং এর মাস, এপ্রিলটা নববর্ষের মাস, মে তে তোর আবার বিয়ে হয়েছিল (একই বরের সাথে অগ্নিসাক্ষী করে), জুন মেয়ে হবার আগের মাস বলে আর জুলাই মেয়ে হয়েছে বলে, আগস্ট স্বাধীনতার মাস বলে, সেপ্টেম্বর পুজোর আগের মাস আর অক্টোবর পুজোর মাস বলে । তারপর তো ব্যাস দিওয়ালি আর ক্রিসমাস। আসছে বছর আবার হবে।"
গভীর মনোযোগের সাথে শুনতে শুনতে টুক করে মোয়াটা মুখে চালান করে দিই, আসছে বছরই যখন হবে বলছে - তাহলে আর কোন দোষ নেই, কি বলেন।
অনির ডাইরি ৪ঠা জানুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
এই তো মনে হয় সেদিনের কথা, কোথাও ঘুরে বেড়িয়ে এসে ছবি পোস্ট করলেই ফোন করত বিন্তিদি ( নামটা বদলে দিলাম)। " ওরে তোকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে রে, আমার ছেলেরও ছবিটা খুব পছন্দ হয়েছে। তোর ইয়ংয়েস্ট এডমায়ারার বুঝলি।" যে ছেলের কথা হচ্ছে, এককালে তাঁকে আমি কোলে তুলে নাচিয়েছি এবং তিনি আমার গায়ে যাবতীয় খারাপ কাজ করেছেন। আমি তখন কাঠবেকার। বিন্তি দি বয়সে সামান্য বড়, তাই দিদি বলি, আসলে নিখাদ বন্ধু। সারা পৃথিবী আমায় অপদার্থ ভাবলেও, বিন্তি দি ছিল কতিপয় ব্যতিক্রমের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাই মাঝেসাঝে মনের দুঃখ ভুলতে ওর সাথে গল্প করতে যেতাম। অতিরিক্ত আকর্ষণ ছিল ওর ছেলে, যাকে সেদিন পর্যন্ত আমি ঘন্টু বলে ডাকতাম। যেন আমার জন্যই বসে থাকত ব্যাটা, কোলে নিলেই ব্যাস -। আর ওর মা একগাল হেসে গড়িয়ে পড়ে বলত, " শিশু নারায়ণ আর ওটা তো গঙ্গাজল।" এহেন ব্যক্তিটি এতোই সুদর্শন ছিলেন, যেন মাখনের তাল। তিনি আমার যতটা না অনুরাগী ছিলেন, আমি তার থেকেও অনেক বেশী অনুরক্ত ছিলাম। তাই না আরেকটু বড় হয়ে যখন চুল টানতেন, ঘুষি মারতেন, খামচে দিতেন কিছু বলিনি। নতুন বিয়ের পর আমার বরের সামনে যেবার থুতু ছিটিয়েছিলেন সেইবার কেবল খুব রেগে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এবার সব সম্পর্ক ছিন্নই করে ফেলব ব্যাটার সাথে।
তবে সে তো কবেকার কথা। ধীরে ধীরে তিনি বড় হতে লাগলেন, তাঁর মায়ের ধারণা ছিল তিনি পরীক্ষায় রসগোল্লা পান্তুয়াই পাবেন, সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দশ ক্লাসের পরীক্ষায় দারুণ ফল করলেন। তারপর হঠাৎ একদিন উদয় হলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, " কে রে ঘন্টু নাকি? তুই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছিস? তোর মা জানে?" মেসেঞ্জারে ঘন্টু বাবু জানালেন, " মা জানে গো মাসি। মা তো নিজেই একটা অ্যাকাউন্ট খুলবে বলে আমায় ধরেছে।" বিন্তি দির অ্যাকাউন্ট খুলতে অবশ্য আরও বছর দুয়েক লেগেছিল। ছেলের দ্বাদশের পরীক্ষার পর, ফেসবুকে আত্মপ্রকাশ করেছিল বিন্তি দি।
নতুন অ্যাকাউন্ট খোলার পর দিন দুয়েক ঘন্টু ওই সব ছবি পোস্ট করল - যেমন বাচ্ছা গুলো করে আর কি। থুতনিতে হাত দেওয়া সেলফি, অন্ধকার অন্ধকার ছবি, বই হাতে ছবি, "Bro"দের সাথে ছবি ইত্যাদি প্রভৃতি এবং একটি সুন্দরী মেয়ের সাথে ছবি। ভাবলাম ইনিও বোধহয় ওই 'Bro' দেরই কেউ হবেন। ভুল ভাঙাল ঘন্টু বাবু স্বয়ং। মেসেঞ্জারে জানালেন," অনি মাসি এই দেখো আমার গার্ল ফ্রেন্ড।" দেখার মতোই মেয়েটা। কি সর্বাঙ্গীন সুন্দর। সনাতনী বাঙালি সৌন্দর্যের পরিমাপে কতটা নম্বর পাবে সেটা বিতর্কমূলক হলেও গ্ল্যামারে কিন্তু হীরকের মতোই উজ্জ্বল। গোছা গোছা ছবি ভেসে বেড়াতে লাগল ফেসবুক থেকে ইন্সটাগ্রামে। লাইক না পেলেই ধেয়ে আসত ঘন্টুর মেসেজ, "অনি মাসি, এই দেখো। একটা লাইক তো বানতা যায়।"
ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসে সব উত্তেজনাই। আমরাও মহানগর ছেড়ে চলে আসি তমলুক। চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয় মানুষ। দুদণ্ড দেখা যে করব, তারও কি উপায় আছে। বিন্তি দি এবং আমি উভয়েই এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকি নিজের নিজের জীবনে -। সেটা রথের দিন, ভাবলাম আজ একটা ফোন করেই ফেলি। ব্যস্ত থাকলে পরে করবে দিদি। যথারীতি ফোন বেজে গেল। সন্ধ্যার ফোনের জবাব পেলাম রাত এগারোটায়। " তুই ফোন করেছিলি? Sorry রে। আসলে তোর ঘন্টুর গার্লফ্রেন্ড আর তার বাবা মা এসেছিল, তাদের আপ্যায়নেই ব্যস্ত ছিলাম।" আরে বাহ। দুই পরিবারের মধ্যেও সেতু বন্ধন হয়ে গেল। তার মানে তো আমাদের ঘন্টু এবং তার সুন্দরী বান্ধবী উভয়েই বেশ সিরিয়াস সম্পর্কটাকে নিয়ে।
বিন্তি দি বলেই চলে, " মেয়েটা খুব ভালো রে। ওর বাবা মা, পরিবারটাও বেশ ভালো। আপাতত ও কেরিয়ারে ফোকাস করতে চায়। আমরাও তাই চাই। তোর সাথে একদিন আলাপ করিয়ে দেব।" হেসে বলি, আমার সাথে আবার আলাপ করাবে কি, আমি তো চিনি। কবে থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছি দুজনকে। কোথায় কোথায় সব প্রেম করতে যায় ব্যাটারা, কি দারুণ দারুণ ছবি তোলে একসাথে। বিন্তি দি একটু থমকায়, গলা ঝাড়ে, তারপর বলে, " নানা তুই ওকে চিনিস না।" আমি বলি আলবাৎ চিনি, তুমি তো কাল কা যোগী, সবে ফেসবুক একাউন্ট খুলেছ।আমি পুরাণ পাপী।
বিন্তি দির গলায় একরাশ অস্বস্তি, " নারে তুই একে দেখিসনি। এ একটু 'পড়াকু' টাইপ। ওই সব সোশ্যাল মিডিয়া ফিডিয়ায় একে পাবি না।" স্পিকার অফ থাকলেও নিশুতি রাতের নৈঃশব্দে সব কথা পাশ থেকে শোনা যায়। শৌভিক মাথায় গাঁট্টা মেরে ইশারায় বলে, ' এটা অন্য মেয়ে।' পুরো বেকুব হয়ে যাই মাইরি। বিন্তি দি 'হবু মেয়ের' গুচ্ছের প্রশংসা করে ফোন রাখে। তড়িঘড়ি ঘন্টুবাবুর একাউন্টটা খুলি। সময়ের পুরু ধুলো জমেছে আমাদের সম্পর্কেও। দীর্ঘদিন আর মেসেঞ্জারে ছবি লাইক করার আব্দার করে না ঘন্টু। মনে পড়ে অনেকদিন কোন নোটিফিকেশনই আসেনি ঘন্টুর থেকে। খুলে দেখি একাউন্টটা আছে বটে, নেই সেই সুন্দর ছবি গুলো। সেই হীরের মত ঝলমলে মেয়েটার কোন নামগন্ধ নেই ঘন্টুর প্রোফাইলে। বুঝি বিন্তি দিই ঠিক।
পরদিন মেসেজ করে জানায় ঘন্টুও, " ওর সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে অনি মাসি। কেবল ঝগড়া করত। আরো অনেক কিছু, it's kinda complicated। তবে ফাইনালি আমি আমার soulmate কে খুঁজে পেয়েছি। And I'm very happy। She inspires me to be a better version of myself। " জানাই, তুই খুশি হলেই আমরা খুশি বাবা। ভালো থাকিস। পড়াশোনাটা ঠিক করে করিস।
তমলুক থেকে কাঁথি সরে আসি আমরা। দূরত্ব আরো বেড়ে যায় বিন্তি দির সাথে। মাঝে মাঝে টুকটাক WhatsApp এ যা কথা হয়। প্রতিবার একই কথা বলে বিন্তি দি, "হ্যাঁ রে, তোরা কি আর কলকাতায় আসবি না? " এই কথার কি জবাব দি। সবই তো মহামহিমের মর্জি। কথা ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করি, তোমার মেয়ের কি খবর? সে কি করছে এখন? বিন্তি দি আকাশ থেকে পড়ে, " কোন মেয়ে রে? আমার তো একটাই ছেলে -"। যাঃ বাবা। খুলে বলি, বিন্তি দি মুখ ঝামটা দেয়, " ছাড় তো। সেসব কবেই চুকেবুকে গেছে। মেয়েটা বাইরে চান্স পেয়ে চলে গেছে। এখন তো আর একটাকে জুটিয়েছে। কেন তুই ফেসবুকে দেখিস নি?" বিন্তি দিকে কি করে বোঝাই, বন্ধু পুত্রকে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টকিং করা ছাড়াও আমার আরো অনেক কাজ থাকে। কথা ঘোরাতে জিজ্ঞেস করি, 'তোমার শাশুড়ি মা কেমন আছেন?' শাশুড়ি হল এমন একটা টপিক যা নিয়ে বিন্তি দি ঝাড়া এক ঘণ্টা বকে যেতে পারে। তাই গেলও, ফোন রাখার আগে বলল, " পারলে একবার দেখিস, ঘন্টুর নতুন বান্ধবীকে।"
ফোন রেখে, খুঁজে ঘন্টুর একাউন্টটা বার করলাম, ডিপি থেকে কভার ফটো সব জায়গায় হাসি মুখে ঘন্টু, পাশে আর একটি অনন্য সুন্দরী তরুণী, কম বেশি সর্বত্র একই ক্যাপশন লেখা, " You help me to grow", "You made me a better person" এবং"soulmate"। ফোন রাখতে রাখতে মনে মনে বলি, ভাগ্যে এই প্রজন্মে জন্মাইনি। একটা নিয়েই ঝালাপালা হয়ে গেলাম বাপস্। বলি, ঘন্টুর নতুন আত্মীয়তা দীর্ঘজীবী হোক। তবে বাবা ঘন্টু, তোর আত্মার যে সাকুল্যে কটা আত্মীয়!
পুনশ্চ - ঘন্টু বাবা জানি এতটা বাংলা তুই পড়তে পারবি না। যদি পড়িস, তো রাগ করিস না সোনা। তোর ভাষাতেই বলি, মাসি হিসেবে এইটুকু লেগ পুল তো বানতা হ্যায়, নাকি 😝😁।
অনির ডাইরি, ৩রা জানুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
এই তো মনে হয় সেদিনের কথা। অবশেষে বিদায় নিতে চলেছে বিশের (বিষের) বছর। আপ্রাণ চেষ্টা করছি সবাই সর্বোতভাবে জীবনকে স্বাভাবিক করে তোলার। সেটা বছরের শেষ দিন। কোন এককালে এমন দিনে আপিস যেতে ডাক ছেড়ে কান্না পেত। একরাশ তিক্ততা নিয়ে মেদিনীপুর লোকালে সওয়ার হয়ে, নবু ওরফে নবনীতার কাঁধে মাথা রেখে সত্যিই কাঁদতে কাঁদতে অফিস যেতাম। জমানাই ছিল ভিন্ন, আর শৌভিকের ভাষায় আপিসটাও ছিল ‘জঘন্যের কাকাবাবু’। এহেন বালখিল্যচিত ছিঁচকাঁদুনে দুঃখবিলাস আজকাল আর অনুভূত হয় না।
তার প্রধান তথা অন্যতম কারণ অবশ্যই আমার তৎকালীন টিম, আমার টিম চুঁচুড়া। আর দ্বিতীয়ত মোদের তখন শিরে সংক্রান্তি। দিন বারো বাদেই আমাদের মেলা," শ্রমিকমেলা, চুঁচুড়া - ২০২১।" সময় কম, লোকবল তলানিতে, আর অর্থ বল? বাজেট কাটতেছাঁটতে যাকে বলে জেরবার আমরা। নির্দয় হাতে ছাঁটা হচ্ছে মেলার যাবতীয় সৌন্দর্যায়ন। প্রতিপদে কেটারার আর ডেকরেটরের সাথে দরদাম করে চলেছে আমার অবশিষ্ট খঞ্জভঙ্গ টিম। শেষে গতকাল উনি হতাশ হয়ে বললেন, “বাজারদর সম্পর্কে আপনাদের কোন ধারণা আছে ম্যাডাম? আলু-পেঁয়াজের দাম জানেন? গ্যাসের দাম জানেন?” আলু-পেঁয়াজের সঠিক দাম না জানলেও, জানি বাজারে লেগেছে আগুন। আর সদ্য অনলাইন গ্যাসের বিল দিয়েছিলাম, তাই এমাসে গ্যাসের দামটা ঠোঁটস্থ। উনি আমাদের সম্মিলিত অত্যাচারে ঐ ঠাণ্ডাতেও ঘেমে উঠছিলেন। কপালের ঘাম মুছে হেসে বললেন, “ওটা তো ডোমেস্টিক ম্যাডাম। কমার্শিয়াল সিলিণ্ডার আরও অনেক বেশী মূল্যবান।” সে হোক। আমরা নিরূপায়। আপনার যা প্রাণ চায় করুন। যা খুশি বিল দিন। আমার এইটুকুই সম্বল-
সকাল আটটা। তড়িঘড়ি রেডি হচ্ছি আপিস যাব বলে, মুঠো ফোনে মধুঝরিয়ে গান ধরেছেন কিশোরকুমার, “ঝটক কে গেঁসু যাঁহা চলে,তো সাথ মেঁ আশমাঁ চলে-।” এমন সময় বেরসিকের মত বেজে উঠল ফোনটা। ছুটে এসে যখন ধরলাম, সিক্ত কেশ গুচ্ছ দিয়ে টপাটপ ঝরে পড়ছে মুক্তোকণা। গানটাকে গত রাতে কিছুতেই খুঁজে পাইনি। আজ সকালে অনুধাবন করলাম, “কেয়া সুরৎ হ্যায়” বলে অন্বেষণ করলে, “জরুরৎ হ্যায়”কে খুঁজে পাওয়া যায় না।
ফোনের ওপারে অতিরিক্ত জেলাশাসক মহোদয়ের ব্যক্তিগত সহায়ক। সদ্য ঘুমভাঙা জড়ানো অসহায় কণ্ঠে জানান, অনিবার্য কারণ বশতঃ আজকের বৈঠক বাতিল। বসের নির্দেশ সবাইকে জানাতে হবে, অথচ ওণার গৃহে বা মোবাইলে কারো নম্বর নেই। লাজুক কণ্ঠে সবিনয় অনুরোধ, যদি বাকি আধিকারিকদের এট্টু জানিয়ে দিই- অত্যন্ত আনন্দের সাথে রাজি হয়ে যাই। বর্ষবরণের প্রাক্কালে বৈঠক বাতিলের সংবাদ বহন অতীব পূণ্যকর্ম।
সকাল নটা। গুড় নিয়ে ফেরে শ্রীমতী তুত্তুরী। তিনি তখন সদ্য দশে পড়েছেন। একটু একটু করে গজাচ্ছে ডানাপাখনা। ঘুম থেকে উঠে লাফাতে লাফাতে গিয়েছিল আবাসনের মার্কেট থেকে আখের গুড় আনতে। কিনে এনেছে ভেলিগুড়। একখানা জাম্বো নারকেল দিয়েছে মা। বেহারী নারকেল। দেশ থেকে এনে দিয়েছে পৌরসভার ঝাড়ুদার। রোজ ময়লা নিতে এসে খোশগল্প করে বাবা আর মায়ের সাথে। যত এদের নিষেধ করি, অপরিচিত- অর্ধপরিচিত মানুষের সাথে এত খোশ গপ্প করো না। জমানা খারাপ। তা শুনলে তো? কদিন আগে বোধহয় মা বলেছিল আমার জামাই আর নাতনী নারকেল নাড়ু খেতে বড় ভালোবাসে। বাজার গিয়ে বাবার পক্ষে নারকেল কিনে আনা প্রায় অসম্ভব। স্থানীয় যারা বাজার নিয়ে বসে তারা তো আর নারকেল বিক্রি করে না।
মায়ের দুঃখে গলে গিয়ে, চারদিন কাজে ডুব মেরে, চার খানা খোক্ষস মার্কা নারকেল এনে দিয়েছে ঝাড়ুদার। দরাদরি অন্তে নগদ ৩৫০টাকায় কেনা চারখানা নারকেল, যার দুখানি নাড়ু রূপে আর একখানি গোটাগুটি এসে হাজির হয়েছেন আমার গৃহে। নারকেল তো পেলাম,ফাটাই কি দিয়ে? ছোট নারকেল হলে বাটনা বাটার নোড়া মেরে ঘায়েল করে লতা দি। এটা যা জাঁদরেল।
রমেশকে বলেছিলাম একটা কাটারি কিনে দিবি বাবা? অত্যুৎসাহী জনগণ যত। নিজের বাড়ির ভারি কাটারিটাই গছিয়েছে দিন কয়েকের জন্য। তিনি এসেছেন তো এসেইছেন। কাজে আর লাগানো হচ্ছে না তাঁকে। মায়ের হাতের নাড়ু শেষ হলে তবে না নতুন নাড়ু পাকাব।
গতকালই লতাদিকে বললাম,যা হয় হোক, এবার কাটারিটা ফেরৎ দিতে হবে। ভেবেছিলাম বছর শেষে আপিস ফেরতা চিনির নাড়ু পাকাব। বাপ-মেয়ের না পসন্দ। সাতসকালে তাই কৌটো নিয়ে দৌড়েছিল তুত্তুরী পাঁচশ আখের গুড় আনতে। তখনও আমরা মহানগরের বাসিন্দা। মেয়েকে দোকানে পাঠাতে খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করত না শৌভিক। ভয় পেত। যা ট্যালা মেয়ে আমাদের। খুব বায়না করলে, টাকাপয়সা ছাড়াই দোকানে পাঠানো হত তুত্তুরীকে। দোকানদার হোয়াটস্ অ্যাপে পাঠিয়ে দিত বিল। তখনও UPI শিখিনি আমরা। আপিস ফেরৎ ক্যাশ টাকায় বিল মিটিয়ে আসত শৌভিক।
আজ দোকানদার অনুপস্থিত। অল্পবয়সী অবাঙালি কর্মচারী আখের গুড় বোঝেনি। পাঁচশ ভেলি গুড় গছিয়েছে। তাই নিয়েই নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেছে আমার কন্যা। আখের গুড়ের পরিবর্তে ভেলি গুড় এনেছে বটে, তবে পথে কোন বুড়ো রিক্সাওয়ালা নাকি মামণি বলে ডেকে বিনামূল্যে বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছে, তাকে দিব্য মায়ের ভয় দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে ফিরে এসেছে ট্যালা মেয়েটা। মনে হল বর্ষ শেষে এটাই কম পাওনা কি? রোমে টিকতে হলে রোমান হতে হয়, আর জঙ্গলে বাস করতে হলে-
বেলা দশটা- “আজ কোথাও যাচ্ছ তোমরা?” ফোনের ওপার থেকে সংকুচিত ভাবে জানতে চাইল উমা। তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ভেলিগুড় বিদায় করে, ধার করা কাটারি বগলে আপিস বেরোতে একটু দেরীই হয়ে গেছে। হাসি চেপে জানালাম, যাচ্ছিই তো। যে যার আপিস। “তাহলে সোনাইকে নিয়ে একটু বেরোব?” আবার জানতে চায় উমা। শ্রীমতী ফুলঝুরি তখনও ঘুমিয়ে আছেন ভবিষ্যতের গর্ভে। বিবাহোত্তর জীবনে উমার প্রিয়তম বন্ধু শ্রীমতী তুত্তুরী ওরফে সোনাই। কাকিমা আর তার সোনাইয়ের মধ্যে সাধারণত ঢুকতাম না আমি। আজও ঢুকি না। যা খুশি কর না বাপু তোরা।
বেলা এগারোটা- আপিসে ঢুকতেই পুরসভার ইন্সপেক্টর সঞ্চিতা বলে ওঠে, “ওরা কিন্তু আসবে ম্যাডাম। দল বেঁধে।” ওরা অর্থাৎ আমার চুঁচুড়ার SLOরা,আসবেই, জানি। গতকাল মেলার সমস্ত দপ্তরী দায়িত্ব থেকে ওদের অব্যাহতি দিয়েছিলাম যে। তারপর থেকেই উত্যক্ত করছে ওরা।
সাংগঠনিক ভাবে মেলা বয়কটের ডাক দিয়েছিল কোন এক সংগঠন। অন্যান্য জেলা, অন্যান্য মেলা থেকে উড়ে আসছিল নানা অপ্রীতিকর গুজব। ভাইরাল হচ্ছিল ক্লিপিং। পরিস্থিতি বিচার করে চন্দননগরের তৎকালীন বড় সাহেব বললেন, ‘তোমার ছেলেমেয়েগুলো ভালো, তোমায় বড় ভালবাসে। তুমি বললে ওরা ফেলতে পারবে না। কিন্তু সাংগঠনিক ভাবে যদি ওরা মেলা বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমাদের চাপ দেওয়া অনুচিত। দেখো কি করবে-।’ আমার ছেলেমেয়ে গুলো সত্যিই ভালো, মেলা নিয়ে আমাদের থেকে ওদের উত্তেজনা বেশী। বলাগড়ের শ্যামল তো রোজই লিখে চলেছে, ‘দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসবে আমাদের মেলা দেখতে। কত লোক চাই ম্যাডাম। আমি আনব।’ ধরে বেঁধে থামাতে হয় এদের। বাপঃ করোণা এখনও আছে কিন্তু।
তবুও ভেসে আসে নানা অপ্রীতিকর বার্তা। অন্য মহকুমার লোকজনের তিক্ত ঝাঁঝালো উক্তি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য পাশের মহকুমার এক SLOকে ফোন করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তৎকালীন RLO ইন্সপেক্টর কৌশিক। “জানেন না আমাদের কি অবস্থা?” অবস্থা আমাদের থেকে ভালো কে জানে? তুচ্ছ ফিল্ড আপিসের ওপর গোঁসা হতেই পারে, কিন্তু ফিল্ড আপিসের অসহায়তা বুঝবি না তোরা? তাহলে কে বুঝবে? ক্ষোভ অভিমান তো আমাদেরও হয়- তাই লিখেছিলাম, মেলা তো তোমাদেরই, অবশ্যই মেলায় এস, মেলার কাজে অংশগ্রহণ করো, কিন্তু স্বেচ্ছায়। এবার অফিশিয়ালি যাবতীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল SLO দের। ‘আপনি আর কপনি’ নিয়েই লড়ে যাব আমরা।
বেলা একটা- তুত্তুরীর ফোন আর থামেই না। দারুণ কাটছে আজকের দিনটা। পিছনের কেরিয়ারে সোনাইকে বসিয়ে সারা আবাসন সাইকেলে চক্কর মেরেছে কাকিমা। জীবনে কখনও সাইকেলের কেরিয়ারে বসেনি তুত্তুরী। তারপর পাড়ার ছোট্ট পার্কে ঢুকে এক অবাঙালি শিশুর থেকে ধার করা ফুটবল নিয়ে হুল্লোড়বাজি, দোলনায় চড়া, ঢেঁকিতে চড়া আর তারপর মাঠে রোদ পোয়াতে আসা জনৈক দাদুর আদরের থলথলে ল্যাব্রাডর কুতুয়াকে ধার নিয়ে আশ মিটিয়ে চটকেছে দোঁহে। আদরের দাপটে নাজেহাল কুতুয়া মাঝে একবার পালিয়ে গিয়ে পাশের গাছে পা তুলে কিভাবে ইয়ে করেছে সেই গল্পও শোনায় তুত্তুরী। সারা বেলা টইটই করে ঘুরে, হাফ প্যাডেল শেখা তথা শেখানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টান্তে বাড়ি ফিরেছে দুজনে। ' উফঃ এমন দিন কেন যে রোজ আসে না-', একসাথে চিৎকার করে দুটোতে, সাধে ব্যাটাদের মধ্যে ঢুকি না।
বেলা তিনটে- কালো হয়ে আসা মুখগুলিতে মাখামাখি আব্দার আর আর্তি। রমেশ, সমীর, প্রদীপ, শ্যামল, মাম্পি, প্রিয়াঙ্কা, অমৃতা আরো যেন কারা কারা। “ও ম্যাডাম, রাগ করবেন না।” “দুঃখ পাবেন না। মেলা থেকে প্লিজ আমাদের সরিয়ে দেবেন না। আমরা আসব হ্যাঁ-”। হ্যাংলার মত বলে মগরার SLO প্রিয়াঙ্কা। ওটাই পালের গোদা যে। পোলবা-বাঁশবেড়িয়ার কালেক্টিং এজেন্ট দিদিরাও এসেছে ওদের সাথে। মহুয়াদি বলেন, " আমরা তো SLO নই ম্যাডাম। আমরা তো CA। আমাদের কেন বাদ দিচ্ছেন ম্যাডাম -"।ওদের মেলা থেকে ওদের বাদ দেবার ক্ষমতা কি আমার আছে? কত বড় শক্তিধর আমি? আর রাগ? রাগ হলেও তার স্থায়িত্ব কতক্ষণ এরা ভালোমতই জানে। মন কষাকষি, মান অভিমান, রাগ-অনুরাগ মিটতে মেটাতে গড়িয়ে যায় বেলা। ALC সুখেন বর্মন সাহেব গলা ঝেড়ে, হাত কচলে, জানান দেন, "সব তো হল, এবার একটু কিছু খাওয়া দাওয়া হবে না? আজ যে বছর শেষ।" বুঝতে বাকি থাকে না, বাইরে থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে সবাই মিলে। ইন্সপেক্টর থেকে SLO, এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার সব্বাই। ছদ্ম গাম্ভীর্যের প্রসাধনের আড়ালে ফিক করে হেসে ওঠে হৃদয়,‘ এমনি ভাবেই কাটুক না বছর গুলো, কিছু নরমে, কিছু গরমে। কিছুটা লোহায় আর বাকিটা নিখাদ সোনায়।’
বিগত কয়েক বছরে বদলে গেছে কতকিছুই, চাকরী ছেড়েছেন আমাদের চন্দননগরের বড় সাহেব, টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সেদিনের টিম চুঁচুড়া। অবসর নিয়েছেন বর্মন সাহেব। আমি বদলী হয়ে এসেছি তমলুক, সঞ্চিতা গেছে ব্যারাকপুর, কৌশিক - নির্মল - চঞ্চল ও ছিটকে গেছে বিভিন্ন জেলায়। সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে চলে গেছে ধীমান। রয়ে গেছে কেবল স্মৃতিগুলো।
অনির ডাইরি ২ রা জানুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
এই তো সেদিনের কথা। বোধহয় সেটা সেপ্টেম্বর মাস, বহুরূপীর মত ভোল বদলাচ্ছিল প্রকৃতি। এই টিকি পোড়ানো গরম, তো এই ভেসে গেল বুঝি ধরা। এই থিকথিক করছে ভিড়, তো এই শুনশান আমাদের আপিস। তেমনি এক সায়াহ্নে স্কুলের বন্ধুদের মেসেজ করলাম, " ভাবছি ঘুমিয়ে পড়ি -"। জানলার বাইরে ঝুলছে, মসিকৃষ্ণ মেঘের পর্দা, বাজের দাপটে বন্ধ সব কম্পিউটার, আমরা গুটি কয় হতভাগ্য কর্মচারী ভিন্ন আপিস প্রায় জনশূন্য।
ঘুমিয়েও পড়তাম হয়তো, যদি না বড়সাহেব মেসেজ করে জানতে চাইতেন, "বারখোদা কার এলাকা জানো?" গুগল করে দেখলাম, আমার এবং মুকুলের। মহকুমা আমার আর ব্লক মুকুলের। একজনের নাম দিয়ে স্যার বললেন, 'খোঁজ নিয়ে দেখো তো, এই লোকটি ওই অঞ্চলের বাসিন্দা কি না। যদি হয়, তাহলে কেমন আছে?" এমন মেসেজ তো সচরাচর করেন না বড়সাহেব, প্রতিবেশী দেশের সৌজন্যে সেই সময় যত্রতত্র বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর হামলা হচ্ছে, এটাও কি তেমন কিছু নাকি? জানতে চাইবার আগেই জানালেন বড়সাহেব, আমার অনুমানই সঠিক, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক, ভিন রাজ্যে ফুলের কাজ করত। মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছে -
অন্যান্য মহকুমা গুলোতে ভুরি ভুরি এমন কেস আসছিল, তমলুক তুলনামূলক ভাবে বর্ধিষ্ণু মহকুমা বলেই হয়তো, এর আগে এই রকম একটাই কেস এসেছিল, ময়নার ছেলে। খবর এসেছিল পিটুনি খেয়েছে, কাজ হারিয়েছে।বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে তো আমার লোকজনেরই পিটুনি খাবার উপক্রম। ছেলে ভালো আছে, বিদেশবিভূঁইয়ে থাকে, হোটেলে কাজ করে, মাসে মাসে ভালো টাকা পাঠায়, খামোখা কেন আমরা ফোন করে বা বাড়ি এসে উৎপাত করছি? অনেক কথা শুনিয়েছিল বাড়ির লোক। ভাবলাম, এটাও তেমনি হবে হয়তো। প্রার্থনা করলাম, এটাও তেমনিই হোক। আর আমিও একটু ঘুমিয়ে নিই, বড় মুখ করে বললাম বন্ধুদের। আগের বার ইন্সপেক্টর সৌরভ আর এসএলও রঞ্জন খিস্তি খেয়েছিল, এবার না হয় মুকুল আর মতিবুল দুটো গাল খাক, লোকটা যেন ভালো থাকে ঠাকুর।
বৃষ্টির দাপট একটু কমেছে, দল বেঁধে ছাতা নিয়ে টিফিন করতে যাচ্ছিল আমার লোকজন। দৌড়ে গিয়ে বললাম, দুমিনিট দাঁড়া বাবা। একটু খোঁজ নিয়ে দেখে নিই, লোকটা ঠিক আছে কিনা। মতিবুলকে ফোনেই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না আশেপাশের পঞ্চায়েতের জনা দুই তিন এসএলওকেও। বাজ আর বৃষ্টির দাপটে সবাই ফোন বন্ধ করে বসে আছে নাকি? বাকিদের খেতে পাঠালাম, শান্তনু একা রয়ে গেল ফোন করার জন্য।
বেশ কিছুক্ষণ পর বাজল মতিবুলের ফোন। নামটা বলল শান্তনু, ওপাশ থেকে কি জবাব ভেসে এল জানি না, ফ্যালফ্যাল করে খানিক আমার দিকে তাকিয়ে শান্তনু বলল, "ম্যাডাম মতিবুল বলতেছে, ছেলেটা মরে গেছে।" কি বাজে বকছ, বলে ফোনটা কেড়ে নিই আমি। মতিবুল তখনও ধরে আছে ফোনটা, আবার শুধালাম আমি, ও কি ছেলেটাকে চেনে? ছেলেটা কি সত্যিই পরিযায়ী শ্রমিক? কেমন আছে ছেলেটা? আবার জবাব দিল মতিবুল, " হ্যাঁ ম্যাডাম, চিনি তো। আমার বাড়ির পাশেই থাকে। পিটিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিছে, আর বেঁচে নেই -। আমি আপনাকে ছবি পাঠাচ্ছি।"
ক্লান্ত, পরাজিত হয়ে মাথা নীচু করে চেম্বারে ফিরে আসি, ভারী মন, ভারী গলায় বড়সাহেবকে দুঃসংবাদটা দিই। জানাই মতিবুল ছবি পাঠাচ্ছে, মিলিয়ে নেওয়ার জন্য। বড় সাহেব আঁতকে ওঠেন, "কিসের ছবি?" বলি, ছেলেটার বা তার আধার, ভোটার কার্ডেরই হবে। স্যার বলেন, "না। ওর বর্তমান অবস্থার। আমিও পেয়েছি ওই ছবিগুলো, ইচ্ছে করেই তোমায় পাঠাইনি। এত বীভৎস, তুমি প্লিজ ওগুলো দেখো না -"। স্যারের ফোন শেষ হবার আগেই, দৌড়তে দৌড়তে আসে শান্তনু, " ম্যাডাম, মতিবুল কি সাংঘাতিক সব ছবি পাঠিয়েছে -। একদম দেখবেননি। একটা দেখেই আমার মাথা ঘুরছে -"।
কেমন দেখতে হয়, গণপ্রহারে মৃত মানুষকে? আমার দেখার ইচ্ছে হয়নি। জানি সহ্য করতে পারব না। অপরিসীম ক্লান্তির সাথে সাথে এক অক্ষম রাগ আমাকে তিলে তিলে গিলে খাচ্ছিল। কেন? কেন? কেন? আধার নম্বর জোগাড় করে ততক্ষণে পোর্টাল খুঁজে দেখে ফেলেছে বেদজ্যোতি, আছে, ছেলেটি আছে। সরকারী প্রকল্পে নথিভুক্তও আছে। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে দুলক্ষ টাকা পাবে ছেলেটির উত্তরাধিকারী। তাতে কি? কত টাকা মূল্য হয় একটা প্রাণের? আদৌ কি কোন মূল্য হয় প্রিয়জন বিরহের -।
তারপর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস, ঘুরে গেছে বছরও। মাননীয়ার ভার্চুয়াল মিটিং উপলক্ষে আজ আমাদের অফিসে এসেছিলেন বড় সাহেব, মিটিং শেষে যেমন হয় আর কি, চায়ের কাপে খানিক আড্ডা বসে। আড্ডা জুড়েও থাকে আপিস, কাজ কেমন চলছে, কেমন চলছে না। কেন চলছে না ইত্যাদি প্রভৃতি। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ বড় সাহেব শুধালেন, " আচ্ছা অনিন্দিতা, সেই কেসটার কি হল?" চায়ের কাপ নামিয়ে সোজা হয়ে বসি, জানতে চাই, কোন কেস? উনি বলেন, "সেই যে ট্রেন থেকে মেরে ফেলে দিয়েছিল -। তাদের টাকা দিয়ে দিয়েছ?"
বিস্তর ভেবে, মাথা চুলকেও মনে করতে পারি না। বিগত কয়েক মাসে কত কেসই তো ছাড়লাম, তার মধ্যে বেরিয়ে গেল কি? বেল বাজিয়ে শান্তনুকে ডাকি, সে একবার বলে হ্যাঁ, একবার না। তারপর আমার থেকেও দ্রুততায় মাথা চুলকায়। যেমন অফিসার তেমনি তার CKCO। এই আপিসে কি গণ খুশকি হল নাকি! অবস্থা সামলে বেদজ্যোতি পাশ থেকে বলে, " না না, আমার মনে আছে। ওরা এখনও অ্যাপ্লাই'ই করেনি।" যাঃ বাবা, কেন রে ভাই? বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, "একটু দেখ" বলে বেরিয়ে পড়েন স্যার।
ততক্ষণে মুকুলকে ফোন করে ফেলেছে শান্তনু। ব্লকে বসে বিস্তর মাথা চুলকে ফেলেছে আমার ইন্সপেক্টরও। তারপর বলেছে, " ওরা তো অ্যাপ্লাই করেনি।" আরে বাবা, সেটাই তো জানতে চাইছি। কেন করেনি? কাগজপত্রের কোন সমস্যা হয়েছে কি? মুকুল জবাব দেয়, "না ম্যাডাম। না ম্যাডাম। করেনি কারণ ছেলেটা ইয়ে (ঢোঁক গিলে) মানে বেঁচে আছে।" অ্যাঁ!সত্যি! এও কি সত্যি হতে পারে? গণপিটুনির পর চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিলেও মানুষ বেঁচে যেতে পারে? ঈশ্বর কি সত্যিই এমন করুণাময়? সেদিন কি তিনি সত্যিই শুনে ফেলেছিলেন আমার মনের কথা? বুকের মধ্যে বেজে ওঠে সন্দেহ অবিশ্বাসের বাদ্যি। জানতে চাই তোমায় কে বলল? মুকুল ঘাবড়ে গিয়ে বলে, "মতিবুল ম্যাডাম!"
মতিবুলই তো আগের বার বলেছিল আর বেঁচে নেই ছেলেটা। তাহলে কি কোন ভুল হচ্ছে? আমার মুখে সন্দেহের আলোছায়া দেখে সটান মতিবুলকেই ফোন করে শান্তনু। এবার একটা রিংয়েই ফোনটা ধরে মতিবুল। একরাশ খুশি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শান্তনু বলে "ম্যাডাম মতিবুল ও বলতেছে, ছেলেটা বেঁচে গেছে।" উত্তেজনা চাপতে না পেরে, এবারেও ফোনটা কেড়েই নিই আমি। মতিবুল তখনও ধরে আছে ফোনটা, আবার শুধাই আমি, ঐ ছেলেটাই তো? সত্যিই বেঁচে গেছে তো? আবার জবাব দেয় মতিবুল, " হ্যাঁ ম্যাডাম, সেই ছেলেটাই। আমার বাড়ির পাশেই থাকে। পিটিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছিল, সবাই ধরে নিয়েছিল আর বেঁচে নেই -। কিন্তু উপরওয়ালার দয়ায় ও বেঁচে গেছে ম্যাডাম।"
ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ি আমি, এত নির্ভার বহুযুগ বোধ করিনি। মৃত্যুকালীন অনুদান ছাড়া আমার সবথেকে অপছন্দের কাজ। প্রতিটা মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় না জানি কতই না গল্পকথা। টিপ সই বা আঁকাবাঁকা হাতে লেখা অনুদানের আবেদন পত্র, ডেথ সার্টিফিকেট, কজ অফ ডেথ, পুলিশ রিপোর্ট, পোস্টমর্টেম ইত্যাদি ঘাঁটতে রীতিমত আতঙ্ক লাগে আমার। বিমর্ষ বোধ করি আমি। আজ বছরের প্রথম কর্মদিবসে ছেলেটির বেঁচে থাকাটা যেন ব্যক্তিগত ভাবে আমারই জিৎ। বিরাট সুখবর। ভালো থাকুক বাবা ছেলেটা, আলো করে থাকুক সুখী গৃহকোণ। ভালো থাকুক পেটের টানে বিদেশবিভূঁইয়ে কাজ করতে যাওয়া প্রতিটা মানুষ।