অনির ঝাড়গ্রাম- ঘাটশিলার ডাইরি ২৩.১২.২০১৭
( পর্ব- ১)
পশ্চিম মেদিনীপুরের
সাথে আমাদের সম্পর্ক বেশ প্রাচীন। আমি নিজে প্রায় সাড়ে চার বছর (২০০৭-১১) এবং শৌভিক দু বছর (২০০৯-২০১১) কর্মসূত্রে পশ্চিম মেদিনীপুরে কাটালেও
কখনই ঝাড়গ্রাম যাবার সৌভাগ্য হয়নি। আমার প্রাণাধিকা বান্ধবী সুকন্যা ভট্টাচার্য
তখন ছিল ঝাড়গ্রামের এএলসি। বিয়ের আগে সু বারংবার আমাকে ডাকাডাকি
করত, “একবার এস। ঘুরে যাও”। যাচ্ছি- যাব করতে করতে কখন যে সময় গড়িয়ে গেল বুঝলাম না। তলায় তলায় বোধহয় জমছিল অসন্তোষ, চোরাগোপ্তা আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চললেও তা আমার কানে আসত না। আচমকা একরাতে, গোয়ালতোড়ে যাত্রা ফেরত একদল আপাত নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরাপত্তা
বাহিনী। বেদম মারের হাত থেকে বাঁচল না স্কুলের
১২-১৩ বছরের ছাত্রও। মেরে নাক মুখ থেঁতো করে দেওয়া হল, ব্যস তারপরই রাতারাতি উত্তাল হয়ে উঠল
জঙ্গলমহল। আর শৌভিক যখন মেদিনীপুরে গেল, ততদিনে জঙ্গল মহলের রঙ্গমঞ্চ দাপাচ্ছেন
কিষেন জী।
আপাতত এরিখ
মারিয়া রিমার্কের ভাষায় “অল কোয়ায়েট ইন দা জঙ্গল মহল”। ইতিমধ্যে ঝাড়গ্রাম আলাদা জেলা হিসাবেও স্বীকৃতি
পেয়েছে, সুতরাং এবার গন্তব্য ঝাড়গ্রাম। ঝাড়গ্রাম যাবার সবথেকে ভালো ট্রেন
হচ্ছে,সম্বলপুর-হাওড়া ইস্পাত এক্সপ্রেস। হাওড়া থেকে সকাল ৬.৫৫ এ ছেড়ে ঝাড়গ্রাম
ঢোকে মোটামুটি সোয়া ৯টা নাগাদ। আমাদের ট্রেন যদিও ঢুকতে ঢুকতে সাড়ে নটা বাজিয়ে
দিয়েছিল। স্টেশনেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন রবিন বাবু। শ্রী রবিন চক্রবর্তী
বর্তমানে ঝাড়গ্রামের এএলসি। প্রায় অভিভাবকের মত আমাদের নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলে
দিলেন,শুধু তাই নয় যে কটি দিন আমরা ওখানে ছিলাম, রোজ নিয়ম করে রবিন বাবু ফোন করে
খোঁজ খবর নিতেন।
ঝাড়গ্রাম
শহরটি বেশ মনোরম। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা বনফুলের গল্পে বর্ণিত রাঢ় বাংলা বা
তৎকালীন বিহারের ছোট্ট শহর গুলির মত। বেশ ফাঁকা ফাঁকা, পিচ রাস্তার দুপাশে লাল
কাঁকুড়ে মাটি সদর্পে জানান দিচ্ছে আপনি রাঢ় বঙ্গে পদার্পণ করেছেন। প্রচুর প্রচুর
গাছগাছালিতে প্রায় সবুজ শহর ঝাড়গ্রাম। আমরা থাকব বাঁদরভুলা প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রে। ঝাড়গ্রাম
ষ্টেশন থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরত্বে অপেক্ষাকৃত নির্জন শালের জঙ্গলের মাঝে
ফরেস্টের গেস্ট হাউস। অনলাইন বুকিং করাই ছিল। পৌঁছে মন ভরে গেল। চতুর্দিকে যতদূর
চোখ যায় লাল মাটি আর সারি সারি শাল গাছ। তিনটি মাত্র কটেজ আছে, নামগুলিও কি মিষ্টি-
সুবর্ণরেখা, ডুলুং এবং কংসাবতী। চেক ইন টাইম বেলা বারোটা। তবে ফাঁকা থাকলে অনেক
সময় আগেই চেক ইন করতে দেয়। যদিও সেদিন আমাদের কটেজটি ফাঁকা ছিল না। কুচ পরোয়া নেই।
এক কাপ কফি খেয়ে আমরা রওনা দিলাম চিল্কিগড়ের জঙ্গলের উদ্দেশ্যে।
চিল্কিগড়ের
কনকদুর্গার মন্দির খুব বিখ্যাত। কথিত আছে যে মধ্যপ্রদেশ থেকে জনৈক সূর্যবংশী
রাজা জগতদেও জঙ্গলমহল আক্রমণ করে স্থানীয়
ধল্ভুমের আদিবাসী রাজা ধবলদেবকে যুদ্ধে পরাস্ত করে তাঁর রাজত্ব এবং রানীকে
অধিগ্রহণ করেন।এই নতুন রাজাও এরপর নাকি রানীমার অনুরোধে “ধবলদেব” উপাধি গ্রহণ
করেন। হয়তো স্থানীয় আদিবাসী প্রজাদের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করাই ছিল মূল
উদ্দেশ্য। এই নব্য ধবলদেব অথবা এনারই কোন উত্তরপুরুষ স্বপ্নে দেবী মহামায়ার দর্শন
পান। দেবী নির্দেশ দেন, অবিলম্বে যেন তাঁর একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। সেই তিন
চারশ বছরের পুরানো মন্দিরের নাম ছিল “ব্রাহ্মণমহল”। আজ শুধু তার ধ্বংস মাত্রই
অবস্থিত আছে। পাশেই গড়ে উঠেছে নতুন কনকদুর্গার মন্দির। কথিত আছে পাথরের মূর্তির
ওপর সোনার আস্তরণ চড়ানোর জন্যই এই নাম।
জঙ্গলের
মুখে গাড়ি ছেড়ে দিতে হয়। পার্কিং ফি ৫০টাকা। আর দর্শনার্থীদের প্রবেশ মুল্য
১০টাকা। জঙ্গলের বুক চিরে পিচের রাস্তা ঢুকে গেছে। দুপাশে প্রায় সাত ফুট সাদা-নীল তারজালের
বেড়া। যাতে কেউ জঙ্গলে না ঢুকে পড়ে। এই জঙ্গলে হরেক রকম দুষ্প্রাপ্য গাছ আছে,
শাল্লকী, রক্তপিতা, মুচকুন্দ, কেলিকদম, কামিনী, কেন্দু ইত্যাদি।পিচের রাস্তা গিয়ে
শেষ হয়েছে অদূরে মন্দিরের সামনে। বিশাল লালচে মাঠকে গোল করে ঘিরে একদিকে বেশ
কয়েকটি দোকান ফুল-মালা-পুজার ডালি বিক্রি হচ্ছে। দোকান এর সারির ডানদিকে একটি
বাচ্ছাদের পার্ক,আর বাঁ দিকে বোটিং এর সাইনবোর্ড দেওয়া। সামনেই প্রাচীন এবং নবীন
দুটি মন্দির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের উল্টোদিকে একটা সাদা পাথর অথবা
সিমেন্টের মূর্তি, যার কোলে কাঁকে ভর্তি হনুমানের দল। এখানকার হনুকূল এবং তাদের
গুণ্ডামি অত্যন্ত সুপ্রসিদ্ধ। ড্রাইভার আমাদের আগেই সাবধান করে দিয়েছিল। হামেশাই
পুণ্যার্থীদের হাত থেকে পুজার ডালি কেড়ে নিয়ে পালায়। বিশেষ করে বাচ্ছাদের ওপর এদের
বেশী আক্রোশ। বাচ্ছাদের হাতে কিছু থাকলে আগে কেড়ে নেয়।
ব্রাহ্মণমহলটির
ভগ্নপ্রায় দশা। ভাঙা মন্দিরের আলগা ফটকে ঝুলছে বিশাল তালা। মন্দিরের ছাত ফাটিয়ে
নেমেছে গাছের শিকড়। ব্রাহ্মণমহলের ঠিক সামনেই শাখাপ্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে একটি
কয়েক শতাব্দীপ্রাচীন বটগাছ। বটগাছের ডালে বাঁধা অজস্র লাল-হ্লুদ সুতা, যার কিছুতে
আবার ঢিল বাঁধা। পুণ্যলোভী ভক্তবৃন্দ সম্ভবত সুতা বেঁধে মানত করে। বটগাছের
ডান পাশে কমলা সাদা রঙের নতুন মন্দিরটি বেশ বিশাল। সামনে বিশাল মঞ্চ সম্ভবত বলি
হয়, এখানে নাকি বলির রক্তের ফোঁটা টেনে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী ডুলুং নদী অবধি।
তবেই নাকি ধরিত্রী উর্বরা হয়ে ওঠে।
জুতা খুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে মন্দিরে ঢুকতে হয়। সামনে এক টুকরো বারন্দা,
তারপর গ্রিলের গেট। সেই গেট হনুমানের ভয়ে সব সময় ভেজানো থাকে। গেটের ওপাশে লাল
মেজের ওপর পূজারী এবং ভক্তিমতীরা বসে আছেন। সামনে সিংহাসনে আসীন দেবী কনকদুর্গা।
এক নজরে পিতলের মূর্তি বলে বোধহয়, নাতি দীর্ঘ উচ্চতা, গাধা অথবা ঘোড়ায় আসীন, চার
হাতের মধ্যে তিনটি দৃশ্যমান। এক হাতে খড়গ, এক হাতে প্রদীপ, অপর হাত মুষ্টিবদ্ধ,
দেখে মনে হয় ঘোড়ার রাশ ধরার জন্য।
আগেই বলেছি, মন্দিরের অদূরেই ডুলুং
নদী। যার নামই এত সুন্দর, তাহলে ভেবে দেখুন সে স্বয়ং কতটা রূপসী হতে পারে।চিল্কিগড়
অরণ্যের সীমানা বরাবর ছোট্ট মেয়ের মত নূপুর বাজিয়ে চলেছে ডুলুং। তিরতিরে স্বচ্ছ
জলের রঙ সবজে নীল। নদীখাত মুলত বালি, নুড়ি আর কাঁকড়ে পরিপূর্ণ। দেখলেই পা ডোবাতে
ইচ্ছা করে।মিষ্টি সোনা রোদে কয়েকজন আদিবাসী নারী পুরুষ স্নান করছে,গোটা দুয়েক
উলঙ্গ বাচ্ছা একবার জলে গা ভিজিয়েই পরক্ষণেই পাড়ের বালিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নাগরিক
জীবন তথা জটিলতা থেকে বহু দূরে সময় যেন এখানে থমকে গিয়েছে।
অনির ঝাড়গ্রাম- ঘাটশিলার ডাইরি ২৪.১২.২০১৭
( পর্ব- ২ )
ব্রাহ্মণমহল অর্থাৎ পুরাতন কনকদুর্গা
মন্দিরের পিছনে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেলে দুটি লাল মাটির পায়ে চলা পথ চোখে পড়ে।
একটি নিয়ে যায় ডুলুং এর কাছে, অপরটি মিশে গেছে জঙ্গলে। ডানদিকের পথে অর্থাৎ ডুলুং
এর দিকে আমরা ছাড়াও আরো কয়েকজন ভ্রমণপিপাসুর পায়ের ছাপ পড়লেও জঙ্গলের রাস্তা
সুনসান। দুষ্টু- মিষ্টি ডুলুং এর সঙ্গ কিছুক্ষণ উপভোগ করে আমরা হাঁটা লাগালাম
জঙ্গলের পথে। জঙ্গল বেশ ঘন। মূল জঙ্গলকে প্রায় সাত ফুট উঁচু নীল-সাদা তারের জাল দিয়ে
আবদ্ধ করার বৃথা চেষ্টা বাঞ্চাল করে, জঙ্গল লাফিয়ে নেমে এসেছে পায়ে চলা পথের ওপর।
রাস্তা জনমানবশূন্য, একটু ভয়ই লাগবে।যদিও পথ হারাবার ভয় প্রায় নেই বললেই চলে, কারণ
পথ ঐ একটি। প্রায় মিনিট চল্লিশ হেঁটে
জঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করে আমরা পাকা রাস্তার কাছে বেরলাম।
তুত্তুরীর আব্দারে আমাদের আবার
জঙ্গলে ঢুকতে হল, বোটিং না করে আমার মেয়ে ফিরবে না। কনকদুর্গা মন্দিরের পাশেই বোটিং এর সাইন আমার কন্যা দেখতে ভোলেনি।
শাখামৃগ কুলের পাশ কাটিয়ে বোটিং এর রাস্তা ধরে দেখলাম, একটা ঘোলা শ্যাওলা ধরা খাল,
তাতে গুটি কয়েক প্যাডল বোট বাঁধা আছে। সামনে একটি অল্পবয়সী ছেলে বসে বসে মোবাইল
ঘাঁটছে। বেশ কয়েকটি কমলা লাইফ জ্যাকেট ঝুলছে। জানা গেল, প্যাডল বোট ছাড়া কিছু নেই।
তাও মাত্র দুই জন বসার মত। বোটিং এর পরিকল্পনা ত্যাগ করে, ভগ্নহৃদয় কন্যাকে পাশের
চিলড্রেন পার্কে নিয়ে গেলাম। পার্কটি বেশ ভালো এবং ঝাঁ চকচকে। দোলনা, শ্লিপ, সি-স
সবই বেশ নতুন এবং রঙচঙে। তবে কতদিন থাকবে জানি না, কারণ বড় বড় করে "১২ বছরের ঊর্ধ্বে চড়া
নিষেধ"”লেখা থাকা সত্ত্বেও বাচ্ছাদের মা-মাসি এমনকি বাবারাও দিব্যি চড়ে দোল
খাচ্ছে। ফেরার পথে এক জায়গায় লেখা শিবমন্দির, এখানে নাকি মাটির তলা
থেকে শিবলিঙ্গ আপনে আপ উঠে আসে। কিন্তু দেখতে হলে আবার জঙ্গলে ঢুকতে হবে,
ইতিমধ্যেই বেলা বাড়ছে, তাই আমরা আর গেলাম না। যদিও পরবর্তী কালে ঝাড়গ্রামের এডিএম সাহেব
বলছিলেন, ওটা দেখে আসা উচিৎ ছিল।লাঞ্চের আগে একবার চিল্কিগড় রাজবাড়ি
ঘুরে যাওয়া হল। চিল্কিগড় রাজবাড়ির কোন ইতিহাস কোথাও
পেলাম না। চৌকো পাল্লাহীন খোলা ফটক দিয়ে ঢুকলে
চোখে পড়ে এক
অপেক্ষাকৃত ছোট অনাড়ম্বর দোতলা বাড়ি। সামনে বিশাল খোলা প্রাঙ্গণ, গরু চড়ছে। রাজবাড়ির একতলায় সর্বশিক্ষা মিশনের
খিচুড়ি স্কুল এবং অফিস। দোতলায় কি জানি না। বাড়িটির পিছনে আর একটি সুদৃশ্য দোতলা
পুরানো বাড়ি দৃশ্যমান, কিন্তু কোথা দিয়ে যেতে হয় বুঝলাম না। শৌভিকের ধমক অগ্রাহ্য
করেও খোলা মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কয়েকটি ভাঙা তোরণ তথা দরজা দিয়ে ঢোকার
চেষ্টা করলাম কিন্তু প্রতিবারই আবদ্ধ উঠান বা কানা গলিতে ধাক্কা খেলাম। যে কোন
কারণেই হোক না কেন সব মিলিয়ে চিল্কিগড় রাজবাড়ি আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।
বাঁদরভুলায় লাঞ্চ বলাই ছিল। কি
যত্ন করে যে এরা খেতে দেয় কি বলব।তেমনি সুস্বাদু রান্না। ঝকঝকে কাঁচের প্লেটে গরম
ভাত, ডাল,মুচমুচে আলু ভাজা, মাখা মাখা আলু পোস্ত, স্যালাড,ডিমের ঝোল, চাটনী আর
পাঁপড়। দ্বি-প্রাহরিক ভুরিভোজের পর, একটু গড়িয়ে নিয়ে আবার বেরলাম আমরা। এবার
গন্তব্য কংসাবতী ক্যানেল। গভীর জঙ্গলের মাঝে লাল মাটির রাস্তা দিয়ে গড়াতে গড়াতে
চলল গাড়ি, ড্রাইভার দেখালো দূরে একটু উঁচুতে পাকা রাস্তা। ঐ রাস্তা দিয়ে গেলে
দূরত্ব অনেক কম হয়, রাস্তাও ভালো, কিন্তু ভয়ানক হাতির উৎপাত। হাতি বেরিয়ে এলে আর
পিছাবার বা গাড়ি ঘোরাবার জো নেই। পাকা রাস্তার এপাশে ঢালু বরাবর ইলেকট্রিক তার
টানা আছে। ঐ তারে নাকি রাতের বেলা বিদ্যুৎ দেওয়া থাকে। যাতে হাতি তারের বাঁধন
ছিঁড়ে এ পাশে না আসে। কিছুদিন আগে নাকি একটা হাতি শক খেয়ে মারা গিয়েছিল। দিনের
বেলা তারে কারেন্ট থাকে না। আমরা নেমে লাফিয়ে তার টপকে ওদিকটা দেখে এলাম। শৌভিক
কিছু ছবিও তুলল। সামনে যে রাস্তা চলে গেছে তার দুপাশে পাহাড়প্রমাণ মন্দিরঝাউ এর
সারি। কি যে অনির্বচনীয় এই সৌন্দর্য তা ভাষায় প্রকাশে আমি অক্ষম। সর্বোপরি
জনশূন্য।
এরপর গন্তব্য আমলাচটি ভেষজ উদ্যান।
কত যে অদ্ভুত অদ্ভুত গাছ, আর তাদের নানা গুণাবলী – কয়েকটির নাম বলছি- গন্ধনাকুলী
(রক্তচাপ কমাতে এবং চর্মরোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়), ধ/ধব (মুখের ক্যান্সার, কলেরা,
সর্দিকাশি), মন্দিরঝাউ (ব্যথা- বেদনা), ফরাস (মুখের ঘা),কাঁঠালিচাঁপা (কলেরা),
শঙ্করজটা (অজীর্ণ) ইত্যাদি। এছাড়াও চেনা বাসক, হরীতকী,অশোক, নাগেশ্বর, বকুল এবং
নানা ধরণের তুলসী গাছ যেমন- মিষ্টি তুলসী, বাবুই তুলসী এবং দুলাল তুলসী গাছও ছিল।
এরপর গোলাপবাগান। ঝাড়গ্রামের মত রুখাশুখা অঞ্চলেও যে কত ধরণের রঙবেরঙের গোলাপ হতে
পারে তা না দেখলে বিশ্বাস হত না। এটা সরকারী সম্পত্তি নয়, প্রবেশ মুল্য ১০টাকা।
এরপর ঝাড়গ্রাম মিনি জু। এখানে দেখার মত প্রায় কিছুই নেই- কিছু নীলগাই, হরিণ, একটা
বাচ্ছা হাতি, গোসাপ আর কিছু পাখি ছাড়া। তুত্তুরীর জন্যই দেখতে যাওয়া। না গেলেও কোন
ক্ষতি ছিল না। অবশেষে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি।
অনির ঝাড়গ্রাম- ঘাটশিলার ডাইরি ২৫.১২.২০১৭
( পর্ব- ৩)
শেষ বিকালে
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি। চিল্কিগড় রাজবাড়ির তুলনায় ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি অনেক জমকালো।আয়তনেও
বিশাল।বিগত কয়েক বছরে আমরা দক্ষিণ বা বলা যায় রাঢ় বঙ্গে যে কটি রাজবাড়ি দেখেছি,
সবকটির ইতিহাসই মোটামুটি একই খাতে বয়। এই রাজবংশ গুলির প্রতিষ্ঠাতারা সকলেই বিভিন্ন
সময়ে দিল্লীর বাদশাহের পাঠানো সেনাবাহিনীর কোন না কোন সেনানায়ক ছিলেন। সকলেই
মোটামুটি রাজপুতানা বা মধ্যপ্রদেশ থেকে বঙ্গদেশে সামরিক অভিযানে আসেন এবং কালক্রমে
বাদশাহের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে নিজেকে বিজিত অঞ্চলের রাজা বলে ঘোষণা করেন। ঝাড়গ্রাম
রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী সর্বেশ্বর সিংহ ও আদতে ছিলেন রাজপুত এবং বাংলার তৎকালীন
দেওয়ান মান সিংহের এক সেনা নায়ক। স্থানীয় মাল রাজাদের পরাস্ত করে ১৫৯২ সালে এই রাজ
বংশের পত্তন করেন। সাবেকী রাজপ্রাসাদটির বর্তমানে ভগ্নপ্রায় দশা, নতুন রাজবাড়িটির
বয়স বেশী নয়। বিংশ শতকে নির্মিত এই রাজবাড়ির একতলাটি বর্তমানে হোটেল এবং দোতলায়
রাজ পরিবার এখনও বসবাস করেন।
রাজবাড়ির
উল্টো দিকে ট্যুরিজমের গেস্ট হাউসটিও বেশ ভালো। এখানেও বেশ কিছু কটেজ আছে। আরো
কিছু নির্মীয়মাণ। জেলা প্রশাসনের নাকি না না পরিকল্পনা আছে এটিকে ভবিষ্যতে বিলাস
ভুল রিসর্ট হিসাবে গড়ে তোলার। তবে আপাতত বাঁদরভুলায় ফরেস্টেরটি নিঃসন্দেহে সেরা।
ঝাড়গ্রাম
রাজবাড়ি পরিদর্শনের পর, আবার বাঁদরভুলায় ফিরে যাওয়া। ততোক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে।
ঝাড়গ্রামের এডিএম ডেভেলাপমেন্ট শ্রী কৌশিক পাল সাহেব আমাদের দুজনেরই পূর্ব পরিচিত।
উনি হুগলী জেলার পিডি ডিআরডিসি ছিলেন। বিগত শ্রমিক মেলায় এবং শ্রম দপ্তরের সিকেসিও
নিয়োগের সময় আমরা ওনার যৎপরনাস্তি সহায়তা এবং সাহচর্য পেয়েছিলাম। অফিস আসা যাওয়ার পথে
লঞ্চ পেরোতে মাঝে মাঝেই স্যারের সাথে দেখা হত। আমরা ঝাড়গ্রাম এসেছি শুনে উনি
কিছুতেই ছাড়লেন না, গাড়ি পাঠিয়ে টেনে নিয়ে গেলেন ওনার কোয়ার্টারে। সন্ধ্যাটা দিব্যি
আড্ডা আর ভুরিভোজে কাটিয়ে প্রায় রাত নটা
নাগাদ ফিরে গেলাম বাঁদরভুলায়।
দ্বিতীয়দিন
সকাল নটার মধ্যে প্রাতরাশ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ঘাটশিলার পথে। বাঁদরভুলায়
ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি। আগের দিন বলে রাখতে হয়, আপনি কি খাবেন। এমনিতে লুচি,
কর্ণফ্লেক্স এবং ব্রেড তিনটিরই অপশন আছে। কেন জানি না ওখানকার ব্রেড বা
কর্নফ্লেক্সকে তেমন ভরসা করতে পারিনি আমরা। ফলতঃ লুচি। এত যত্ন করে খাওয়ায় এরা কি
বলব,তেমনি সুস্বাদু খাবার। ঝকঝকে কাঁচের প্লেটে গরম গরম চারটি ফুলকো আটা-ময়দার
লুচি, দুটি ছোট বাটিতে ছোলার ডাল বা গরম ঘুঘনি এবং হ্লুদ ছাড়া আলুর তরকারী, দুটি
করে সিদ্ধ ডিম, দুটি করে কলা এবং দুটি করে রাজভোগ। ঘর প্রতি দু প্লেট করে
ব্রেকফাস্ট বরাদ্দ। আমরা তিনজনে মিলে দুপ্লেট শেষ করতে পারতাম না। ফলে রোজই একটি
করে ডিম নষ্ট হত এবং কলাগুলি বেঁধে দিতে বলতে হত।রাজভোগগুলির কথা বিশেষ ভাবে না
বললেই নয়, এত ভালো মিষ্টি কলকাতা ছাড়ুন আমাদের হুগলীতেও পাওয়া যায় না। পুরো সলিড ছানার
ডেলা, মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। আহাঃ।
ঝাড়গ্রাম
থেকে ঘাটশিলা যেতে দেড় ঘণ্টা মত লাগে। রাস্তা এমনিতে ঝকঝক করছে, শুধু ঝাড়খণ্ডে
কিছুটা অংশে চার লেনের কাজ চলছে বলে রাস্তা রীতিমত এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে এবং প্রচুর
ধুলোয় আচ্ছন্ন চতুর্দিক। ঘাটশিলায় প্রথম দ্রষ্টব্য ফুল্ডুংরি পাহাড়। পাহাড় বললে
অবশ্য পাহাড় গাল দেবে। ছোট্ট লাল টিলা। গোটা টিলা জুড়ে লম্বা লম্বা শাল গাছের জঙ্গল। আমরা ছাড়া দর্শনার্থী প্রায় নেই বললেই
চলে। ফুলডুংরিতে পায়ে চলা সমতল পথ প্রায় নেই বললেই চলে। যে টুকু আছে পুরো ঢালু এবং
গোল গোল নুড়িতে ভর্তি। পা দিলেই ওঠা ছাড়ুন হড়কে নেমে আসবেন। শৌভিক তরতরিয়ে উঠে গেল
যদিও, আমি আর তুত্তুরী খানিক নীচে দাঁড়িয়ে থাকলাম। চতুর্দিকের নির্জনতায় কেমন গা
ছমছম করে, সাহস করে আমরাও উঠেই পড়লাম। টিলার মাথাটি পাঁচিল দিয়ে গোল করে ঘেরা, কেন
জানি না। ওপর থেকে দৃশ্যপট বেশ সুন্দর, তবে আহামরি কিছু নয়। নামাটা ছিল বেশ কঠিন,
একবার পা হড়কালে ধরার মত কিছু নেই আসে পাশে, সোজা গড়িয়ে নীচে গাড়ির কাছে পৌঁছে
যেতে হবে।
ফুলডুংরির
পর বুরুডি ড্যাম। বুরুডি ঘাটশিলার অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ট্যুরিস্ট স্পট। বেশ ভিড় ছিল। চতুর্দিকে
ঢেউ খেলানো সবুজ টিলার সারি, মাঝখানে বিশাল বুরুডি লেক। লেকের জল নীলচে। ড্যাম
থেকে সিড়ি বেয়ে নীচে নামা যায়। লেকের বুকে একটি ভাসমান জেটি, জেটি অবধি পৌঁছাবার
রাস্তাটি বাঁশ এবং কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি। যার এক ধারে রেলিং এর মত একটি বাঁশ
বাঁধা থাকলেও ওপর দিকটি ন্যাড়া। রীতিমত পা টিপে টিপে যেতে হয় ভাসমান জেটিতে।
এখানেও গুটি চারেক প্যাডেল বোট রাখা আছে। যার মধ্যে দুটিতে চার জন বসতে পারে আর
দুটি দুজন বসার মত। চার জনের বোট দুটিতে এক দল লোক ইতিমধ্যেই চড়ে লেকের ওপাশে
পৌঁছে গেছে। তাদের উচ্চকিত আনন্দ সঙ্গীত (পড়ুন হল্লা) এপাড় থেকেও শোনা যাচ্ছে।
লেকের ধার বরাবর উঁচু উঁচু খাড়াই পাথর জেগে আছে, দেখতে বেশ সুন্দর। জনা দুয়েক
ব্যক্তি ওগুলির ওপর বসে কেতা মেরে সেলফি তুলতে গিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে পশ্চাৎদেশে
হাত বোলাতে বোলাতে ফিরে এল। ঘড়ির কাঁটা প্রায় মধ্যাহ্নের দিকে দৌড়লেও বেশ কুয়াশা
ছিল। রোদের তেজ প্রায় নেই বললেই চলে, শৌভিক কিঞ্চিৎ হতাশ হল বইকি। ভালো ছবি এই
অবস্থায় তোলা গেল না বলে। আমরা বাঁধের ওপর দিয়ে মিষ্টি রোদে ভিজতে ভিজতে এপাড়-ওপাড়
করলাম। এক নজরে ম্যাসাঞ্জোর বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। যদিও ম্যাসাঞ্জোরের তুলনায়
অনেক পরিষ্কার। ড্যামের ওপর জায়গায় জায়গায় প্লাস্টিকের চেয়ারও পাতা, বসে বসে
নৈসর্গিক সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করার জন্য। যদিও চেয়ার গুলিতে যা ধুলো, বসলে জামার
রঙ বদলে যাবে। আমাদের মুগ্ধতার সুযোগে তুত্তুরী অবশ্য মহানন্দে বেশ কয়েকটি চেয়ারে
বসেও নিল এবং হাত বুলিয়ে ধুলোও ঝেড়ে দিল। জনসমক্ষে তো আর ঠ্যাঙানো যায় না। কি আর
করা যাবে। স্যানিটাইজারের বোতল আর টিস্যুই ভরসা।
এবার গন্তব্য গৌরিকুঞ্জ।
অনির
ঝাড়গ্রাম-ঘা্টশিলার ডাইরি ২৬/১২/২০১৭
(পর্ব-৪)
ইতিপূর্বে কখনও ঘাটশিলায় পদার্পণ করিনি, তবুও ঘাটশিলার
নাম শুনলেই মন কেন জানি না অকারণ স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠে। বাঙালী হিসাবে ঘাটশিলায়
এসে
প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভৃষণ বন্দোপাধ্যায়ের
বাড়ি না দেখা অমার্জনীয় অপরাধ।
স্ত্রী পুত্র নিয়ে
দীর্ঘ এক যুগ
উনি ঘাটশিলায় বসবাস করেন। ১৯৫০সালে
এই শহরেই উনি
শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।অশনি সঙ্কেত,দেবযানের মত বইয়ের সাথে রচনাস্থল হিসাবে ওতপ্রোত ভাবে
মত জড়িয়ে আছে এই মেঠো শহরের নাম। ঘাটশিলার দহিগোরা অঞ্চলে অবস্থিত
বাড়িটির নাম গৌরিকুঞ্জ।
বাড়ির বাইরের প্রাকারে
প্রস্তরফলকে লেখা আছে যে দীর্ঘদিনের অনাদরে
বাড়িটি ভেঙে পড়ছিল,
স্থানীয় বিধায়ক শ্রী
প্রদীপ কুমার বালমাচুর
উদ্যোগে এবং বিধায়কের তহবিল
থেকে প্রদত্ত অর্থে ২০০৯ সালে বাড়িটির আমূল সংস্কার সাধন করে মিউজিয়ামের
মত গড়ে তোলা হয়। প্রসঙ্গত যদি এ বাড়ির ভাব না ধরতে পারেন, তাহলে
দ্রষ্টব্য কিন্তু কিছুই নেই। সে যুগের এক দরিদ্র, ছাপোষা, সরল স্কুল মাস্টারের
বাড়ি যেমন হবার কথা, গৌরিকুঞ্জ ঠিক এমনই। নিছক সাদামাটা
দোতলা বাড়ি। চওড়া
নীচু গেট ঠেলে
প্রাঙ্গনে ঢুকে
বাঁ দিকে দু
ধাপ সিঁড়ি ভেঙে
দুকামরার বাড়ি। সামনে
একফালি বারন্দা। জুতো খুলে উঠতে
হয়। এক বৃদ্ধ
প্রহরী বারন্দায় চেয়ার নিয়ে বসে
আছেন। ঘর গুলির
মাথায় বাংলায় লেখা
শোবার ঘর, রান্নাঘর
ইত্যাদি। লেখকের ব্যবহৃত
জামাকাপড় এবং
অন্যান্য দ্রব্যাদি যত্ন করে কাঁচের
বাক্সে রাখা। ওণার
লেখা কিছু চিঠিপত্রের
কপিও সুন্দর করে
সাজানো। আমরা ছাড়া
আর একটি বাঙালী
দম্পতি কেবল মাত্র
এসেছিলেন দেখতে। বৃদ্ধ
প্রহরীকে নানা প্রশ্ন
করছিলেন,কিন্তু জবাব
দেয় কে?ঝাড়খণ্ডের
ঝিম্ ধরা শীতের
রোদে বিমোহিত বৃদ্ধ বুঝি বাকহারা।
বাড়িটির বাঁদিকে একই আঙিনায় একটি
বিশাল কনক্রিটের মঞ্চ। হয়তো দুর্গা
মণ্ডপ। কাকেই বা
প্রশ্ন করি। রাজবাড়ি
দেখে অভ্যস্ত তুত্তুরী কিছুতেই বুঝতে পারছিল না
বাবা মা এক
অতি সাধারণ দুকামরার
বাড়ি দেখে কেন
এত পুলকিত। পূর্বোক্ত দম্পতি চলে যাবার পর আমরা যখন নেমে জুতো পড়ছি,
বৃদ্ধের ঘুম ভাঙল। মন্ত্রোচ্চারণের সুরে বললেন, “বড়বাবু এখেনেই থাকতেন। ওনার ছেলে
তারাদাস। তিনিও এখেনে থাকতেন। তিনি মারা গেছেন। কিছু দিন”। বলে দক্ষিণ হস্ত
প্রসারিত করলেন। দশ টাকার নোটটি দিয়ে দেখলাম, ওনার পছন্দ হল না, ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে
প্রশ্ন করলাম, “আপনার নাম কি?” বৃদ্ধ সূর্যের দিকে তাকিয়ে দাড়ি চুলকে বললেন, “অপূর্ব।“
শৌভিক ফিসফিসিয়ে বলল, “অপূর্ব? রায় নয়তো? রায় হলেই সোনায় সোহাগা।“ জিজ্ঞাসা করলাম
না। কিছু কিছু রহস্যকে ভেদ না করাই ভালো। হোক না জীবন একটু রহস্যময়।
সুবর্ণরেখা অর্থাৎ সোনালি নদী। বিয়ের পর পর শ্বশুরমশাই গল্প শোনাতেন, সুবর্ণরেখার বালি অন্য নদীর বালির মত ফ্যাকাশে না। সোনা রঙ তার। সুবর্ণরেখা মানেই চূড়ান্ত নস্টালজিয়া। সুবর্ণরেখা মানেই ঈশ্বর চক্রবর্তীর নিঃসঙ্গতা- সুবর্ণরেখা মানে সীতা আর অভিরামের বাঁধন ছাড়া মেঠো প্রেমের বানভাসি- সুবর্ণরেখা মানেই-ঋত্বিক ঘটক- অভি ভট্টাচার্য-বিজন ভট্টাচার্য-মাধবী। সুবর্ণরেখা মানে খোয়া আর পাওয়ার গোলকধাঁধা। সুবর্ণরেখা মানে প্রলয়ের মাঝেও নতুন করে বাঁচার দিশা। ঘাটশিলার রুক্ষ ধুলিমলিন দেহকে স্পর্শ করে বয়ে চলেছে সেই সুবর্ণরেখা।
ড্রাইভার
এক বিশাল সুউচ্চ
প্রাকার পরিবৃত বাড়ির
দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ বলে বলল,“স্যার
উটা ঘাটশিলার রাজবাড়ি ছিল। এখন
কিছু নাই। সাপখোপের
বাসা। ”সেই সাপখোপের
বাসাকে গোল করে
ঘুরে এক নির্মিয়মান
ফ্লাইওভারের নীচে
থামল গাড়ি। ইঁট
পাথর সিমেন্টের জঞ্জালের ওপাড়ে ঢালু
মাঠের প্রান্তে বইছে সুবর্ণরেখা। কিন্তু এ কে? মোটেই প্রলয়ঙ্করী চঞ্চলা তন্বী
তো না, বরং শ্লথ
পৃথুলা বৃদ্ধা। জলই নেই। নদী
খাত বরাবর জেগে
আছে অসংখ্য পাথর।
পাথরে পা দিয়ে
এক্কাদোক্কা খেলতে
খেলতে নদীর মাঝে
চলে যাওয়া যায়।
চোখ সয়ে গেলে
কিন্তু মন্দ লাগল
না। মুস্কিল হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা
আড়াইটের ঘর ছাড়ালেও
অনেক স্থানীয় লোক,সকলেই বাঙালী
চান করতে নেমেছে।
যত বড় রূপসীই
হোক না কেন
এতগুলি গামছা পড়া
হুমদো যেখানে প্রবল
হল্লা পাকিয়ে চান
করছে, তাকে ভালো
লাগা বেশ কঠিন। দূরে নদীখাতের
দিকে আঙুল দেখিয়ে
শৌভিক বলল,“ওখানে যাবি?”নদীর
বুকে দুটি মাঝারি সাইজের
কংক্রিটের গোল
পাইপ দিয়ে কাজ চালানো সাঁকো।
সেই সাঁকো টপকে
নদীর বুকে জেগে ওঠা একটা চর। চর
জুড়ে শুধুই নানা উচ্চতার উল্লম্ব
পাথর। পাইপ টপকাতে
গিয়ে টলটল করতে
করতে তুত্তুরী থপাস করে জলেই
পা ডুবিয়ে দিল।
তাকে কোনমতে সামলে
ওপাড়ে পৌঁছেই নাক
কুঁচকে গেল। এই
কারণেই এই অংশটি
জনবিরল। স্বচ্ছ ভারতের
কোন প্রভাব এদিকে
পড়েছে বলে মনে
হয় না। ঘাটশিলা আদপেই
নির্মল নয় বাপু।নরোবরে ভর্তি।
কারা এই ভাবে
প্রকাশ্যে পাইপ
টপকে খোলা চত্বরে
প্রাতঃকৃত করতে
আসে ভগবান জানে।
এত সুন্দর অথচ
উল্লম্ব ভাবে এবড়োখেবড়ো অংশে
ঐ কাজ করতে
বসা মোটেই সহজ
নয়। রাগে মুখ
লাল করে গাড়িতে
ফিরল আমার বর।
ড্রাইভার সব শুনে
দাঁত বার করে
বলল,“ঐ জন্যই
তো স্যার। ওপাশে
একটা ঘূর্ণি আছে।
পড়লে কেউ বেঁচে
ফেরে না। পাথরে
চড়লে পাছে আপনারা
পড়ে যান- তাই
আর কি-”। তাই
ইয়ে করে রেখেছে? ইল্লি আর
কি?
সূর্য
ঢলার সাথে সাথে
আমরাও ছুটতে লাগলাম
বাঁদরভুলার পথে।
সারাদিন কিচ্ছু খাওয়া
হয়নি। এদিকে তেমন
ভাতের হোটেল নাকি
নেই। খিদেও পায়নি। সকালের ঐ লুচি-ডাল-তরকারী-ক্লা-ডিম- রাজভোগ
খেয়ে। ড্রাইভার শুধু বলল,“কাল বেলপাহাড়ি
যাবেন তো? তাহলে যাবার পথে
শিলদায় কোন হোটেলে
বলে যাব খন।
বলে রাখলে উরা
ভাত রেখে দেয়। তবে কাল
কিন্তু অনেক কিছু
দেখার আছে স্যার।
এট্টু জলদি বের
হলে ভালো হয়।
”
(চলবে)
অনির
ঝাড়গ্রাম-ঘা্টশিলার ডাইরি ৩০/১২/২০১৭
(পর্ব-৫)
জানেন কি, ঝাড়গ্রাম জেলার সবথেকে সুন্দর অংশটির নাম বেলপাহাড়ি। আগের
দিন এডিএম কৌশিক পাল সাহেব বলছিলেন যে বেলপাহাড়ি কে নিয়ে জেলা প্রশাসনের না না
পরিকল্পনা আছে। উনি বলেইছিলেন,“পারলে ভোর ভোর
বেরিয়ে পড়। সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে। না হলে সব দেখে উঠতে পারবে না।” আমরা যদিও
নটার আগে বেরোতে পারলাম না। লুচি-ছোলার ডাল-হলুদ ছাড়া আলুর তরকারি-সিদ্ধ ডিম আর
জিভে জল আনা রাজভোগ দিয়ে জম্পেশ করে প্রাতরাশ সেরে বেরোতে বেরোতে বেলাই হয়ে গেল।
তাতে সুবিধা যেটা হল, ভোরের কুয়াশা গেল
কেটে। টাটকা সূর্যের গলানো সোনা রঙের আলোয় ঝকঝকিয়ে উঠল চারপাশ।
বেলপাহাড়ি ভয়ানক
সুন্দর। প্রতিটি স্কোয়ার ফুটই ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হতে পারে- যে দিকে তাকাবেন
বটলগ্রীন রঙের শালের জঙ্গল,টেরাকোটা রঙের
মাটি, মাটির ওপর গাছের
শুকনো ঝরা পাতার আল্পনা।অলস গ্রাম বাংলার জীবন গাড়ির
কাঁচ ভেদ করে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসে। মসৃণ রাস্তাঘাট, হুহু করে দৌড়য় গাড়ি।
পাকা রাস্তা থেকে
নেমে টলতে টলতে লালচে মেঠো পথে বেশ খানিকটা গিয়ে গাড়ি যেখানে
নামাল- তার নাম লালজল। লালজল একটি গুহার নাম। একটি ক্ষয়প্রাপ্ত টিলার মাথায় লালজল
নামক গুহায় কোন এককালে জনৈক সাধুবাবা
থাকতেন। কি ভাবে থাকতেন জানি না, বেশ ছোট, অন্ধকার এবং চড়াই উতরাই বেশ চাপের। বেতো হাঁটু থাকলে লালজলে
না চড়াই ভালো। রাস্তা বলতে ক্ষয়ে যাওয়া বড় বড় পাথর। চার হাত পা প্রয়োগ করারও প্রয়োজন পড়তে পারে ক্ষেত্র বিশেষে। লালজলের ওপর থেকে দৃশ্য এমন কিছু আহামরি
নয়। ছোট্ট পুঁচকে টিলার ওপর থেকে আর কিই বা আশা করা যায়?পাহাড়ের নীচে একটি মন্দিরও
আছে। আসলে এলতলা মাটির বাড়ি, টিনের চালা। একজন প্রৌঢ়া থাকেন, প্রথমে
ভেবেছিলাম বুড়ো সাধুর ভৈরবী হবেন হয়তো, নেমে দেখলাম বৈষ্ণব মন্দির।শ্রী চৈতন্য এবং
নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর ছবি রাখা। তুত্তুরী জুতো খুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে প্রণামী দিয়ে
এল। নকুলদানা প্রসাদ পেয়ে মেয়ের আনন্দ দেখে কে?
লালজলের পর
খ্যাদারাণী ড্যাম। বুরুডি বা মাসাঞ্জোরের
সাথে তুলনা করলে কিন্তু বেশ সাদামাটা।একদিকে দিগন্ত ছোঁয়া বিশাল জলরাশি, অন্যদিকে লালচে মেঠো
পথ হারিয়ে গেছে দূরে, হয়তো বা মিশেছে দিগন্তেই। বাঁধের কাছাকাছি অসংখ্য শালুক গাছ।
ফুল যদিও চোখে পড়ল না। হয়তো কেউ তুলে নিয়ে গেছে। পাশে স্থানীয় বিনপুর-২ নম্বর
পঞ্চায়েত সমিতির বোর্ড লাগানো, যাতে স্পষ্ট ভাষায় জলে নামতে নিষেধ করা হয়েছে। লেখা
আছে, দেখে যতই অগভীর ম্নেন হোক না কেন, আসলে এই জলাধার যথেষ্ট গভীর, কাজেই মদ্যপ
অবস্থায় ছাড়ুন সুস্থ অবস্থায়ও জলে নামা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। হোক সাধারণ, তাও
খ্যাদারানীর একটা নিজস্ব সৌন্দর্য তথা মাধুর্য আছে।মহুয়ার মত, যা ধীরে ধীরে আমাদের
স্নায়ুর ওপর প্রভাব বিস্তার করছিল, কিন্তু আচমকা বিকট হিন্দি গানের কান ফাটানো
আওয়াজে সব চটকা ভেঙে দিল। স্থানীয় পিকনিক পার্টি। বিশাল বক্সে তারস্বরে বাজছে হানি
সিং এর ভয়ানক বেসুরো গান। পিকনিক পার্টির দেখা নেই। স্থানীয় ছেলেপিলেদের পিকনিক
বেশ বোঝা যায়।
এরপর আজকের মুখ্য
আকর্ষণ গাড়রাসিনি। কাল থেকেই
ড্রাইভার বারবার বলছিল, “স্যার গাড়রাসিনিতে কি আর উঠতে পারবেন? বেশ খাড়াই।“ উঠতে
পারবেন মানে? আরে ভাই আমরা গড়পঞ্চকোট পাহাড়ে চড়েছি তিনজনে, এই চেহারা এবং ফিটনেস
নিয়ে। পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলের মাঝে হারিয়ে যাওয়া ভগ্নপ্রায় মন্দির আবিষ্কার
করেছি,আমাদের ডিএম সাহেবের ভাষায় ”ইয়ে গাড়রাসিনি কেয়া চিজ হ্যাঁয়?” বেলপাহাড়ি গেলে গাড়রাসিনি অবশ্যই চড়বেন। এটাই
বেলপাহাড়ির সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। প্রথম অর্ধেক পথ জঙ্গল তথা অস্বাভাবিক খাড়া
রাস্তা। পুরোটাই নুড়ি পাথরে ভর্তি, যাকে ইংরাজিতে গ্রেভেলস বলে, ওঠা সহজ, নামার
সময় পা টিপে টিপে নামতে হয়, নাহলেই সোজা গড়াতে গড়াতে সোজা নীচে। আর বাকি অর্ধেক
পথ? সেটাও খাড়াই, কিন্তু সেখানে ওঠার মত কোণ পথ নেই। উঁচুনিচু পাথরের ওপর পা দিয়ে উঠতে হয়, যার মধে কয়েকটি
আবার রীতিমত নড়ে। তবু বলব, গাড়রাসিনির সৌন্দর্য অপরিসীম, জেলা প্রশাসনের কাছে একটাই
অনুরোধ, অনুগ্রহ করে গাড়রাসিনিকে গাড়রাসিনির মতই থাকতে দিন। দয়া করে পুরুলিয়ার
জয়চন্ডী পাহাড়ের মত কংক্রিটের সিঁড়ি করবেন না, বা কোন মাড়োয়াড়ি সংস্থাকেও করতে
দেবেন না। এত কষ্ট করে গাড়রাসিনির মাথায় চড়ার পর আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। নীচে
আমাদের দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি থেকে সুদূর খ্যাদারানী ড্যাম সব স্পষ্ট দেখা যায়। মন ভরে
যায়। গাররাসিনির মাথায় একটি বন্ধ মন্দির এবং একটি গুহা আছে।
নামার পর
ড্রাইভার বিশ্বাসি করছিল না, বার তিনেক প্রশ্ন করল, “স্যার ম্যাডামও চড়ে ছিলেন?”
এবার পেটপুজার পালা। ঘড়িতে আড়াইটে বাজছে, আসার সময় শিলদাতে আর বলে আসা হয়নি, অবশ্য
বাঁদরভুলার ব্রেকফাস্টের সৌজন্যে আমাদের কারো তেমন খিদে বোধ হচ্ছিল না, ড্রাইভার
বিনপুর—২ বিডিও অফিসের সামনে ঘ্যাঁচ করে
গাড়ি দাঁড় করালো, বিডিও অফিসের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে ছোট্ট দোকান, অ্যাসবেস্টস বা
টিনের চাল, গোটা তিনেক প্লাস্টিকের টেবিলের ওপর টেবিল ক্লথ পাতা, টেবিল পিছু
ওলটানও বালতির মত চারটে করে স্টুল পাতা।ভাতের হোটেল। এত বেলায় ঠান্ডা ভাত, পাতলা
ডাল, খোলা শুদ্ধ গুটি কয় পাতলা আলুভাজা, পোস্তর বড়া, মাছের মাথা দিয়ে এক হাতা করে
বাঁধা কপির তরকারী, আর পোস্ত দিয়ে ট্মেটোর চাটনি( যাতে একদানাও চিনি পাবেন না )
ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই খেলাম চারজনে। কি অসম্ভব ভালো রান্না। পোস্তর বড়া খেয়ে তো
আমরা ফিদা। আর আছে কিনা জানতে চাওয়াতে মালিক থেকে রাঁধুনি অত্যন্ত লজ্জায় পড়ে গেল,
কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “ইয়ে স্যার যাবার সময় যদি বলে যেতেন-“। বলেছিলাম না, এখানকার মানুষজন অসম্ভব
অথিতিবৎসল। যদি বেলপাহাড়ি যান, তবে অবশ্যই ঐ দোকানে খাবেন, ওদের পোস্তর বড়া
অতুলনীয়, তবে সবথেকে ভালো ঐ ঝালঝাল ট্মেটো পোস্ত, যাকে ওনারা টমেটোর চাটনি বলেন।
এবার গন্তব্য ঘাগরা
ফলস আর তারাফেনী ড্যাম
(চলবে)
অনির
ঝাড়গ্রাম-ঘা্টশিলার ডাইরি ৩০/১২/২০১৭
(পর্ব-৬)
বিনপুর ২নং বিডিও
অফিসের সীমানা বরাবর টালির চাল আর দরমার তিন দেওয়ালের হোটেলে শালপাতার টাটকা ধোয়া
থালায় ঠাণ্ডা গরম মোটা চালের ভাত, পাতলা প্রায় লবণহীন ডাল, গুটি কয় সরুসরু খোলা সমেত ভাজা নতুন আলুর টুকরো,প্রায় তেল ছাড়া
বাঁধাকপির তরকারি যার মধ্যে শোভিত একটি মাছের কাঁটা সাক্ষ্য দিচ্ছ যে ইহা আসলে
মাছের মাথা দিয়ে বাঁধাকপির তরকারি, জিভে জল আনা ইয়া বড় পেঁয়াজ দিয়ে পোস্তর বড়া আর মিষ্টি
ছাড়া পোস্ত দিয়ে টমেটোর চাটনী দিয়ে বেলা তিন ঘটিকায় গুরুপাক দ্বৈপ্রাহরিক আহার শেষ
করে আমরা তিনমূর্তি রওণা দিলাম ঘাঘরা জলপ্রপাতের উদ্দেশ্য।আমার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী দিনকয়েক
আগে বলেছিল, গাড়রাসিনীকে পাহাড় বললে পাহাড়
গালাগাল দেবে। ঝাড়গ্রাম
থেকে প্রায় ৫০কিমি তথা বেলপাহাড়ি থেকে ৮কিমি দূরে অপেক্ষাকৃত নির্জন বনভূমির মধ্যে
অবস্থিত ঘাঘরার ক্ষেত্রেও কথাটি অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত । ঘাঘরাকে জলপ্রপাত
বলা হয়তো বাতুলতা।ক্ষয়প্রাপ্ত পাথরের বুকে নূপুর পড়া বাচ্ছা নদীর সুললিত নৃত্য বললে বোধহয়
ভালো হত। সেই নাচের ধাক্কায় কোথাও কোথাও পাথর ক্ষয়ে নানা বিচিত্র তথা মনোহারী রূপ
নিয়েছে। বর্ষায় নাকি ঘাঘরার গায়ে যৌবনের ছোঁয়া লাগে। নদী সম্ভবত যার নাম তারাফেনী, তখন হয়ে ওঠে
উদ্দাম। বর্ষা বিদায় নেবার সাথে সাথেই কমতে থাকে তারাফেনীর বয়স। আর এই মাঝ
ডিসেম্বরে নদী নেহাতই চপলা শিশুকন্যা মাত্র। ডুলুং এর নিপাট সরলতা বা সুবর্ণরেখার
গাম্ভীর্য তথা প্রাজ্ঞতার ছিটেফোঁটাও নেই,ফাজিল দুষ্টু নদী নিজের মনে কুলকুলিয়ে বয়ে যাচ্ছে।
আমরা যখন পৌছলাম,সূর্য পশ্চিমে
হেলে পড়েছে, পিকনিক পার্টিও
ডেরাডাণ্ডা গুটিয়ে কেটে পড়েছে। অন্যান্য পর্যটকরাও গাড়ি ঘুরিয়ে কেটে পড়ল এক এক
করে। ঝুপ করে নেমে এল অপার নিস্তব্ধতা। ঘাঘরা চতুর্দিকে নির্জন শাল পিয়ালের জঙ্গল, কেমন যেন একটা গা
ছমছমে অনুভূতি হতে থাকল। কিছুদিন আগেও এইসব অঞ্চল ছিল দুর্ভেদ্য। আসার পথে
ড্রাইভার গল্প বলছিল, সেই সময় একবার
সন্ধ্যা বেলা নিকষ অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বরের গাড়ি নিয়ে যেতে গিয়ে তেনাদের
নিষেধ সত্ত্বেও আলো জ্বেলে ফেলেছিল- পরিণতি?গাড়ি ঘিরে ফেলে বন্দুকবাজের দল। কলার ধরে টেনে নামায়
সকলকে তারপর শুরু হয় গণপ্রহার। হাত এবং বন্দুকের কুঁদো দিয়ে। বলতে ভুলে গেছি
ঘাটশিলা থেকে ফেরার পথে তো সেই গাছটাকেও দেখেছি, জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট ঝোরার ওপর কালভার্ট, তারওপর গাড়ি দাঁড়
করিয়ে ড্রাইভার দেখালো,“স্যার উখানেই
উয়াকে মেরেছিল”। “উয়ার”ভয়েই এককালে
সন্ধ্যাবেলা ইস্পাত চলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। লালগড় বেলপাহাড়ি হয়ে উঠেছিল লাল
মুক্তাঞ্চল। আজ তিনি নেই, তবু এই জনহীন
অঞ্চলে অধিক সময় নষ্ট করা নিছক বোকামি। দুষ্টুমিষ্টি তারাফেনীর সাথে নিভৃতে কিছুটা
সময় কাটিয়ে রওণা দিলাম তারাফেনী ড্যামের দিকে।
বুরুডি,খ্যাঁদারাণী
দেখার পর তারাফেনী ড্যাম আর চোখে লাগে না। ছোট্ট নদীর ওপর আপাত সাধারণ একটা বাঁধ।
কোন অনির্বচনীয়তা নেই যার মধ্যে। আমরা আর নামলাম না। সন্ধ্যা নামছে খুব তাড়াতাড়ি, গাড়ি দৌড়োল
বাঁদরভুলা প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রের পথে। আজ রাতে দেশী মোরগের মাংস খাওয়াবে বলেই
রেখেছে,সাথে হাতে গড়া
গরম রুটি। আহাঃ
পরদিনই বিদায়
জানাতে হবে ঝাড়গ্রামকে। ফেরার ট্রেন ইস্পাত প্রায় চারটেয় ঢোকে ঝাড়গ্রাম। তার আগে
সারাদিন শুধু ঘুরে বেড়ানো। মন মাতানো আটা ময়দার গরম ফুলকো লুচি,ঝাল ঘুঘনি,হলুদ বিহীন আলুর
তরকারি, সিদ্ধ ডিম আর
রাজভোগ দিয়ে যথাবিহিত উদরপূর্তি করে, বাঁদরভুলার অথিতিপরায়ন স্টাফদের বিদায় জানিয়ে মালপত্র
গাড়িতে তুলে আমরা রওনা দিলাম নয়াগ্রাম রামেশ্বরের মন্দিরের পথে। জঙ্গলের মধ্যে
সুবর্ণরেখা নদীর ধারে পুরীর মন্দিরের ধাঁচে সাদা চুনকাম করা নাতিদীর্ঘ মন্দির।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মন্দিরে পৌঁছানোর পথের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশে আমি
অপারগ। ঝাড়গ্রামের অন্যান্য অঞ্চলের বনভূমির সাথে এই জঙ্গলের প্রভেদ বিস্তর। এই
জঙ্গলের কোণ রহস্যময়তা নেই, কেমন যেন মিষ্টি মিষ্টি জঙ্গল, পথের দুপাশে নাতিদীর্ঘ
গাছের সারি, তাতে থোকা থোকা সাদা ফুল ফুটেছে, জানলার কাঁচ নামালেই ছুটে আসে জংলী
ফুলের গন্ধ বাহী হাওয়া, আমরা ছাড়াও আরও অনেকে চলেছে মন্দিরের উদ্দেশ্যে। বেশীর
ভাগই স্থানীয় বাসিন্দা, কলেজে পড়া ছেলেমেয়ের দল। সব মন্দিরের মত রামেশ্বরের
মন্দিরেরও একটা গল্প আছে, কথিত আছে, চৌদ্দ বছরের বনবাস কালে কখনও রাম, সীতা এবং
লক্ষণ ঘুরতে ঘুরতে এই স্থানে এসে উপনীত হন। গভীর জঙ্গল এবং নিঃসঙ্গ সুবর্ণরেখা পলকে
রাম-সীতার মন কেড়ে নেয়। সেই দিনটি ছিল, শির চতুর্দশীর পুণ্যতিথি। সীতা দেবী, সুবর্ণরেখার
তটেই সোনালী বালি দিয়ে দ্বাদশ শিবলিঙ্গ গড়ে ভূতনাথের উপাসনা করেন। উপাসনান্তে যখন
শিবলিঙ্গগুলিকে নদী বক্ষে বিসর্জন দিতে যাবেন, আচমকা দৈববাণী হয়, সেই দৈববাণীর নির্দেশ মত, সীতার আব্দারে রামচন্দ্র
বিশ্বকর্মাকে দিয়ে নির্মাণ করান দ্বাদশ শিবলিঙ্গের মন্দির। বর্তমান মন্দিরটির গায়ে
কোন অলঙ্করণ দেখতে পেলাম না, বেশ ভিড়। পুণ্যার্থী রমণীগণ পূজার ডালি নিয়ে ভিড়
জমিয়েছে মন্দিরের ভিতরে। মন্দিরের সীমানা বরাবর বেশ খানিকটা নীচে কুল্কুলিয়ে বয়ে
যাচ্ছে সুবর্ণরেখা নদী। নদীর তীরে নিভৃত নির্জনতায় অল্পবয়সী কপোতকপোতীদের ভিড়,
আমরা আর নামলাম না। বিকাল চারটেয় ট্রেন, এখনও হাতিবাড়ি আর ঝিল্লিবাঁধ দেখা বাকি-
আমাদের ঝাড়গ্রাম
ঘাটশিলা ট্যুরের সবথেকে সুন্দর অভিজ্ঞতার নাম হাতিবাড়ি। গহিন শাল-পিয়ালের জঙ্গলের
মাঝে নিভৃত ফরেস্ট বাংলো। যার দরজায় ঝুলছে ইয়া বড় তালা। এই ফরেস্ট বাংলোটি অনলাইন
বুক করা যায় না। শুনলাম, এটি নাকি সরাসরি ঝাড়গ্রামের ডিএফও সাহেবের তত্ত্বাবধানে
থাকে। পাশেই আর একটি ফরেস্ট বাংলো আছে, সেটিও জনবিরল, অথচ দরজা হাট করে খোলা।
ভিতরে ডাইনিং রুমে জামাকাপড় শুকোচ্ছে, অথচ ডেকে ডেকেও কাউকে পাওয়া যায় না। পাশেই
বয়ে যাচ্ছে কল্লোলিনী সুবর্ণরেখা, ডেকেই চলেছে আমাদের অথচ যাবার পথই মেলে না। নতুন
বাংলো থেকে যাবার কোন পথ নেই, আর পুরানোটায় তালা দেওয়া। ড্রাইভার অসহিষ্ণু হয়ে
ঘটাং ঘটাং করে বন্ধ দরজা পিটতে লাগল, তাতে শালের মগডাল থেকে উড়ে এল এক ঝাঁক বন্য
কোন পাখি, কিন্তু আমরা ছাড়া কোন জনমনিষ্যির সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। অগত্যা পায়ে
হেঁটেই ঘুরতে লাগলাম জঙ্গলের বুক চিরে। কি দম বন্ধ করা নৈঃশব্দ্য। নৈশব্দের
অত্যাচারেও যে কানের পর্দা ফাটার উপক্রম হয়, তা প্রথম উপলব্ধি করি, বাঁকুড়ার
সুতানে, এখানে নৈশব্দের ঐ দৌরাত্ম নেই, কারণ? এখানে জঙ্গল নিজেই যে নিঃসঙ্গ নয়,
এখানে জঙ্গলের একটা নদী আছে। বেশ খানিকক্ষণ দিগভ্রান্তের মত ঘোরার পর শুকনো পাতায়
ঢাকা একটা সরু পায়ে চলা পথ চোখে পড়ল, সেদিকে পা বাড়াতেই প্রবল উচ্ছ্বাসে চিৎকার
করে উঠল নদী, বেশ খানিকটা নামতেই চোখ ধাধিয়ে গেল পূর্ণ যৌবনা সুবর্ণরেখার উত্তাল
সৌন্দর্যে। আহা কি মায়াময় পরিবেশ, ঝকঝকে সোনালী রোদে টলটলে জলের নীচের প্রতিটি
নুড়ি পাথরও দৃশ্যমান। আমরা ছাড়া দূরে কয়েকজন স্থানীয় কাঠকুড়ানি,কালোকোলো পাথরে
কোঁদা চেহারা। নিভৃতির সুযোগে সদ্য স্নান সেরে উঠেছে কয়েকজন, নদীর বালিতে টানটান
করে মেলা তাদের লাল নীল শাড়ি।কেউ বা সস্তা এনামেলের হাড়ি মাজতে ব্যস্ত। কি সামান্য
আয়োজন বেঁচে থাকার জন্য। কি অসীম যত্নে মাজছিল হাড়িগুলো। কুড়িয়ে পাওয়া শুকনো
ডালপালা আর পাতার বস্তাকে ধীর লয়ে একটা শালতিতে চাপিয়ে রওনা দিল একজন একাকী
রমণী।কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গেল,কি
অবাঞ্ছিত আমরা এখানে।আমাদের উপস্থিতি শুধু এদের বিব্রতই করবে, থাক
জঙ্গলবালিকারা তাদের নিজস্ব বনভূমি আর একলা নদীকে নিয়ে। আমাদেরও একটা জঙ্গল আছে,
ইট কাঠ পাথর আর দূষণের জঙ্গল, হোক না তবুও তো আমাদেরই জঙ্গল, আমাদের অপেক্ষাতেই
অধীর। এবার ঘরে ফেরার পালা। অবশ্য তার আগে ঝিল্লী বাঁধটা ঘুরে নিতে ভুলিনি। ঝিল্লী
বাঁধে এক অপরূপা আদিবাসী রমণীকে দেখেছি জানেন, এমনই শান্ত স্নিগ্ধ তার রূপ, আমার
বর ছাড়ুন, আমিই চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। নাতি দীর্ঘ, প্রথম আষাঢ়ের মেঘের মত গায়ের
রঙ, পরনে লাল পাড় কোরা শাড়ি, যার আঁচল আষ্টেপৃষ্টে গায়ে জড়ানো, মাথায় একঢাল লালচে
কালো চুল একটা হাত খোঁপায় আঁটছিল না। লজ্জাবনত চোখ দুটি যেন ঝিল্লী বাঁধে ফুটে
থাকা গোছা গোছা গোলাপি শালুকের পাপড়ি, ছোট্ট তিরতিরে নাক,পানপাতার মত সুডৌল মুখ।
কোন পুজা শেষে, পূজার ফুল ফেলতে এসেছিল, হয়তো তারপর স্নান করবে, কারণ গোড়ালি ভর
জলে নেমে সাঁওতালি ভাষায় নিজের বরকে সলজ্জ ভাবে কিছু বলল, বরটিকে দেখেও মন ভরে
গেল, পাথরে খোদা নাতিদীর্ঘ শিব ঠাকুর যেন। মেঘলা দুপুরে, দিগন্ত বিস্তৃত ঝিল্লী
বাঁধের ধারে শুধু আমরা ছিলাম আর ছিল তারা- আমাদের উপস্থিতিতে কি অসীম লজ্জা
পাচ্ছিল দোঁহে, দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা লাগালাম গাড়ির দিকে,মনে মনে বললাম, “ভালো
থেকো তোমরা।“
(শেষ)