এ বছরের মত বইমেলা শেষ। যথারীতি এবারেও যাওয়া হল না। তাতে যে আদৌ কোন দুঃখবোধ আছে তা নয়। বেঁচে থাকুক অ্যামাজন আর ফ্লিপকার্ট। কথাটা বোধহয় আঙুর ফল টক মার্কা হয়ে গেল না? আসলে বইমেলা হল বাঙালির জাতীয় উৎসব। এই উৎসবে অংশগ্রহণ না করা যে কত বড় পাপ তা যারা নিয়মিত জান তাঁদের পক্ষে অনুধাবন করা দুষ্কর। যেমন বিশেষ দিনে আমরা শুভ বিজয়া বা হ্যাপি নিউ ইয়ার বলে একে অপরকে সম্ভাষণ জানাই, মেলা চলাকালে বাঙালি ( ক্ষেত্র বিশেষে কিছু অবাঙালিও) “বই মেলায় গিয়েছিলেন নাকি?” বলে কথা শুরু করেন। আর যদি না বলেছেন, এমন করুণার দৃষ্টিতে তাকাবে যে মনে হবে আপনি নেহাৎ অপাংক্তেয় অস্পৃশ্য ব্যক্তি।
বইমেলা চলাকালীন বন্ধুদের মেলায় তোলা সুদৃশ্য নিজস্বী আর সদ্য কেনা বইয়ের ছবি দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে শৌভিককে বললাম “ছুটির দিন দেখে চল না”। জবাব প্রত্যাশিত ,“ওরে বাবা ঐ দিনগুলোয় যা ভিড় হয়। আর সেল্ফি তুলতে বা খিচুড়ি খেতে আর বইমেলায় যাবি কেন?” ষাট টাকায় দেবভোগ্য আড়াই ডাবু খিচুড়ি সাথে বেগুন ভাজা, পাঁপড় ভাজা, কষা আলুর দম আর চাটনি পাওয়া যাচ্ছে এই তথ্যটা আমাদের বাসের সান্যাল বাবু মারফৎ জানা গিয়েছিল। অতএব মুখ বুঝে হজম করতে বাধ্য হলাম।
বইমেলা এলেই কত যে অতীত স্মৃতি ভিড় করে আসে। আমার ছোটবেলায় বইমেলা মানেই অন্তত এক গণ্ডা নতুন গল্পের বই- সৌজন্য আমার মেজদা। নিয়মিত খবরের কাগজ দেখে লিস্ট তৈরি করত, আমার জন্য কি কি বই কেনা হবে। আমার যেটুকু শিশুসাহিত্য সংগ্রহ আছে তার বিশাল অংশই মেজদার উপহার। কলেজে উঠে বন্ধুদের সাথে বইমেলা যাবার রোমাঞ্চ অবর্ণনীয়। চূড়ান্ত রক্ষণশীল পরিবেশে লালিত ন্যাদোশ মার্কা মেয়ে বন্ধুদের সাথে বইমেলা গেছে এটা খুব সহজপাচ্য ছিল না। নেহাৎ মেলার আগে বই শব্দটা ছিল। তাই অনুমতি পেতে সমস্যা হয়নি। তবে আমার জ্যাঠাইমার গভীর আশঙ্কা ছিল, নির্ঘাত পথ ভুল করব। এক তাড়া বই কিনে বাড়ি ফিরে দেখি, কোথা থেকে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে এনে সদর দরজার সামনে পাংশু মুখে বসে আছে জ্যাঠাইমা। আমাকে দেখে বলে উঠল, “বাবু এলি? আর যাসনি বাবা। যা দিনকাল পড়েছে, আমার কি ভয় লাগে। ” সেদিন বেপোট রেগে গিয়েছিলাম আজ ভাবতেই দুঃখ হয়। জেঠু চলে গেছে প্রায় বছর ঘুরে গেল, জ্যাঠাইমা সেই থেকে নানা ব্যাধিতে শয্যাশায়ী। সেই অন্ধ স্নেহ আর ভালবাসার অধিকারের বড় অভাব বোধ করি।
সেদিন জ্যাঠাইমা আমাদের যতই অবলা গোবেচারা ভন্দু ভাবুক না কেন, আদতে আমরা ছিলাম যথার্থ দুর্বৃত্ত । আট জন মেয়ের গ্রুপ ছিল আমাদের। আমাদের প্রিয় অবকাশযাপন ছিল লোকের সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করা। যারা কখনও দলবদ্ধভাবে বিনাকারণে ঝগড়া করেননি বা ঝাড়ি মারেননি তাদের নারী জন্মই বৃথা। একদিনের ক্ষণিক বইমেলা সফরেরে গসিপ চলত কমপক্ষে দেড় মাস। কোন কোন সেলিব্রিটির
একঝলক কে দেখেছে, কোন স্টলে কে কাকে কিভাবে গুঁতিয়ে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে, ইয়ে মার্কা বুকস্টলে কি বই বিক্রি হচ্ছিল এবং কারা কিনবে বলে লাইন দিয়েছিল। ফাল্গুনি তো একবার এক বৃদ্ধকে বলেই বসল,“ কি দাদু? নাতির জন্য নাকি?” সে কি ক্যাচাল বাপরে। আজ শুধু মিতা আর ফাল্গুনী ছাড়া বাকিদের নামটুকুও মনে নেই, যোগাযোগ তো দূরের কথা। এরই নাম জীবন কালিদা।
যাই হোক বইমেলা তখনও প্রবল বিক্রমে চললেও মোদ্দা কথা হল এবছর বইমেলা যাওয়া হচ্ছে না। গৃহকর্তা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আগে ইলেকশন তারপর বই পড়া। মে মাস অবধি ইলেকশন ম্যানুয়াল ছাড়া আর কিছু পড়ার সুযোগ নেই। সহকর্মী বা বন্ধুদের সাথে যাওয়াই যায়, কিন্তু শৌভিককে ছেড়ে? নাঃ থাক। আসন্ন নির্বাচনের স্বার্থে এটুকু ত্যাগ তো স্বীকার করাই যায়। মনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পোস মানালাম। সেদিন অফিসে কাজ করছি, হঠাত এক অচেনা নম্বর থেকে ফোন। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে প্রবল উচ্ছাস নিয়ে একজন বলে উঠল, “হ্যালো? হ্যাঁ হ্যালো অনিন্দিতা?”
“কে বলছেন?”
“আরে আমি নজরুলদা বলছি। ”
বিরস বদনে ফোন ধরেছিলাম, ওণার স্বস্নেহ স্বরে হঠাৎ খুশি হয়ে উঠলাম। নজরুল ইসলাম বহুদিন বাদে ফোন করলেন। শ্রমিক আমিতে ওণার কথা বলেছিলাম। অবসরপ্রাপ্ত সহ শ্রম কমিশনার। আমি ছিলাম ওণার চরম স্নেহের পাত্রী। আমার কাছে প্রবল বকুনি খেয়েও বলতেন,“ ধূর। তোমার কথায় কিচ্ছু মনে করিনা। তুমি আমার মেয়ের বয়সী। তোমাকে দেখলেই ওর কথা মনে পড়ে। ”
একট হতভম্ব হলাম। উনি কোনদিন ফোন করেননা। বরাবরি যোগাযোগ রাখা আমার দায়। উৎসবে পরবে ফোন না করলে ভয়ানক অভিমান হয় ওণার, শিশুর মত প্রত্যাশা করেন অনিন্দিতা ফোন করবে। যাই হোক জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, কেমন আছেন, উনি অসহিষ্ণু ভাবে বললেন, “শোন না। এবছর বইমেলায় আমার কবিতার একটি বই বেড়িয়েছে। ”
খুব খুশি হলাম। কিন্তু মন খারাপ হয়ে গেল, যাওয়া হচ্ছে না। বলতে গেলাম উনি কর্ণপাত করলেন না। বললেন,” শোন, আমাদের পাড়ার অমুকের হাতে তোমার জন্য স্পেশাল কপি পাঠিয়েছি। সে তোমার দপ্তরের তমুক বাবুকে দেবে। তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নিও প্লিজ। ”
আপ্লুত হয়ে গেলাম। কিছু বলতে গেলাম, উনি থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ পেলে এই নম্বরে জানিও। আমার ফোন খারাপ। আর দু তিন দিন বাদে জানিও কেমন লাগল। ”
বাধ্য কিশোরীর মত জানালাম অবশ্যই জানাবো। ফোন রাখতে রাখতে বললেন,“ভালো থেকো সোনা। করুণাময় তোমার মঙ্গল করুন। আমার আশির্বাদ রইল। ”
ফোনটা রাখার পর দুটো কথা মনে হল, এক ভালবাসা হারায় না। ফিরে ফিরে আসে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মাধ্যমে। আর দুই হল পিপাসার্ত কুয়োর কাছে না যেতে পারলো তো কি? কুয়োই চলে এল পিপাসার্তের কাছে। মেলা প্রাঙ্গণে পদার্পণ করতে পারিনি বটে, মেলা আমার ঘোরা হয়ে গেছে।
#Anirdiary #Aninditasblog