আজ অত্যন্ত খুশির
দিন। মাননীয়া
মুখ্যমন্ত্রীর কলমের একটি আঁচড়ে শৌভিকের বিডিও
গিরি সমাপ্ত
হল। ২০১৩ সাল থেকে শুরু
হওয়া অবর্ণনীয়
যাতনার আজ
অবসান ।
না আমাদের
যৌথ সিদ্ধান্ত
এই নিয়ে
বিন্দুমাত্র আদিখেত্যা
আমরা করব
না। তবু মন বারংবার
স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠছে।
শ্বশুরমশাই এর
কর্কট রোগ
ধরা পড়ার
পর ওণার
সনির্বন্ধ অনুরোধে আইনানুগ বিবাহ চটজলদি
সেরে ফেলা
হলেও অগ্নিসাক্ষী
করে বিয়ে
আরো বেশ
কিছুদিন পরে।
বাবা তখনও জয়েন্ট সেক্রেটারী। আপতকালীন
পরিস্থিতিতে প্রবেশনার শৌভিক বদলি হয়ে
এল সিউড়ি
থেকে আলিপুর। আমি
তখন এএলসি
খড়্গপুর।
সপ্তাহান্তে দেখা হত।
বিয়ের পরও ছয় মাস আলাদা
আলাদা থাকা
। শৈবালদা তখন ডিএলসি খড়্গপুর। ওণার
অনুগ্রহে প্রতি
শুক্রবার ২টা
২৫ এর
খড়্পুর লোকাল
ধরে ৫
টা নাগাদ
সাঁতরাগাছি। সেখান থেকে
হোয়াইট লাইনার
ধরে ট্রাফিক
জ্যাম না
থাকলে সন্ধে ৭টা নাগাদ এয়ারপোর্ট। দুটো
দিন কর্পূরের
মত উবে
যেত। রবিবার
দুপুর থেকে
শুরু করতাম
কান্নাকাটি । সোমবার ভোরে
যখন শৌভিক
হাওড়াগামী ট্যাক্সিতে তুলে দিত, মনে
হত সময়
যেন ওখানেই
থমকে
রয়ে গেল। আজও
মনে আছে
সেদিন মেদিনীপুরে
চাইল্ড লাইনের
কোন অনুষ্ঠান
ছিল। অনুষ্ঠান
শেষে দেবু
সুকন্যার সাথে
গাড়িতে ফিরছি
শৌভিক ফোন
করে জানালো
ওর প্রথম
পোস্টিং হতে
চলেছে লালবাগ।
মস্তকে বজ্রাঘাত। তখনও লালবাগে কোন
আরএলও (Regional Labour Office ) ছিল না।
বহরমপুরের এএলসি লালবাগের
দায়িত্বভার সামলাতেন। যদি কেঁদেককিয়ে
বহরমপুর পাইও
তবু একসাথে
থাকা অসম্ভব
। সে যাত্রা শেষ মুহূর্তে
জমা দেওয়া
বিয়ের নথিপত্র
আমাদের খণ্ডিত
দাম্পত্যকে জোড়া লাগায়।
শৌভিকের প্রথম পোস্টিং বিডিও খড়্গপুর
২ পঞ্চায়েত্
সমিতি।
সবথেকে বেশি
খুশি ছিলেন
আমার শাশুড়ী
মা। আমাদের লালনীল
সংসার হবে। শৌভিক
যোগ দেবার
পর জানা
গেল যে
প্রাক্তন বিডিও আপাতত
কোয়ার্টার ছাড়তে অপারগ। উনি
পুরুলিয়া চলে
গেলেও ওণার
পরিবার এখানেই
থাকবে।
অগত্যা শৌভিককে
থাকতে হত
বিডিও অফিস
সংলগ্ন একটি
ছোট্ট
ঘরে। জলচৌকির ওপর
চিটচিটে বিছানায়। আর
আমি যথারীতি ডেইলি
পাষণ্ড । হাওড়া
থেকে
খড়্গপুর। ভাবুন কি
মর্মান্তিক ব্যাপার, রোজ আমার ট্রেন
ওর অফিসের
সামনে দিয়ে
চলে যেত।
তব একঝলক দেখা হত না। আমরা
ঠিক করলাম
খড়্গপুরে বাড়ি
ভাড়া নিয়ে
থাকব। সেই মত বাড়ি
খুজঁতে গিয়ে
বৈদ্যুতিক ঝটকা খেলাম।
খড়্গপুরের বাড়ি ভাড়া
কলকাতার যে
কোন সমৃদ্ধশালী
এলাকার থেকে কম তো নয়ই
বরং বেশি।
সময় কেটে যাচ্ছে হুহু করে।
আমাদের এক বৃদ্ধ পিওন পরামর্শ
দিল মন্দাকিনী
লজে নৈশযাপনের।
লিখতে গিয়ে আজ হাসি পেলেও
সেই সময়
প্রস্তাবটা আমাদের মনঃপূত হয়েছিল। ফোন করে বুক
করাতে হত।
এক রাতের ভাড়া পঞ্চাশ টাকা
মাত্র।
একটা পুচকে
ঘর। ঝুলপরা
বাথরুম। একটা ১৪” টিভি
আর খাট
বিছানা। আর কোন আসবাব
ছিল কিনা
মনে পড়ে
না। যে বাচ্চা ছেলেটি ঘর খুলতে আসত
তাকে টাকা
দিলে সে
নিকটবর্তী কোন দোকান থেকে পরোটা
আর ভাঁড়
ভর্তি ঝাল
আলুরদম এনে
দিত। তারপর
জগৎ বিচ্ছিন্ন
দ্বীপ হয়ে
যেত ঘরটা।
আমরা ছাড়া আর কাউকে কখনও
দেখিনি।
নিজের বিবাহিত
বরের সাথে
লজে শিরশিরে নৈশযাপন
এ অনন্য
অভিজ্ঞতা কজনের
হয় বলুন?
১ লা ডিসেম্বর ২০০৯
আমরা একসাথে
থাকতে শুরু
করলাম।
প্রাক্তন বিডিও
সাহেব সময়ের
অনেক আগেই
কোয়ার্টর খালি
করে দেন।
একটি ঢাউস ব্যাগ নিয়ে যখন
দাশনগর থেকে
ট্রেনে উঠলাম
বাবার চোখ
ছলছল করছিল। সেদিন
বিকাল বেলা
বিডিও অফিসের
ড্রাইভার শৈবালদা
তাঁর দুধ
সাদা অ্যাম্বাসাডর
গাড়ি করে
আমাকে নিয়ে
গেল কোয়ার্টরে। ৬
নং জাতীয়
ধরে বেশ
খানিকটা গিয়ে,
বাঁ দিকে
নয়নমনোহর ইউক্যালিপ্টাসের
জঙ্গল পেরিয়ে
মাদপুর
গ্রাম। ততক্ষণে
সন্ধ্যা ঘনিয়েছে, সভাপতি কাকলি
ভুইঞ্যা সাউ
অপেক্ষা
করছিলেন যুগলকে একত্রে শুভেচ্ছা জানালেন। অতঃপর
গৃহপ্রবেশের পালা। ছিমছাম
একতলা বাড়ি। আম
বাগান দিয়ে
ঘেরা। পাশেই
পুকুর আর
ধানক্ষেত।
একটু দূরেই
রেললাইন ।
নিরালা নিস্তব্ধতায়
ঘেরা স্বপ্নপুরী।
ঈশ্ অরকূট আর
নেই। থাকলে সেই সব মায়াবী
দিনগুলির কিছু
ছবি পুনরায়
শেয়ার করতে
পারতাম। সবুজ ধানক্ষেত, টলটলে
ডোবা, ঘাড়
বেঁকিয়ে
হেঁটে যাওয়া উদ্ধত
হাঁস আর ভীতু ভীতু মুরগির
দল।
অগুনতি
রঙবেরঙের পাখি আসত।
বারমাস কোকিল ডাকত।
ভোরবেলা সেই তীক্ষ্ন সুরেলা
গান ঘুম ভাঙিয়েই ছাড়ত। রাতে উত্যক্ত
করত ব্যাঙ আর ঝিঝিপোকাদের সম্মিলিত
কোলাহল।
বেশ শ্লথ
গতিতে চলছিল
জীবন। অজগ্রামে
থেকেও যাবতীয়
নাগরিক সুবিধা
ভোগ করা।
বিরাট একটি মাঠকে ডানদিক থেকে
চক্রাকারে ঘিরে ছিল পর্যায়ক্রমে গ্যারেজ,
ফুডের গুদাম,
বিডিওর করণ,
ডোবা যেখানে
শৌভিক শখের
এনআরএজিএ বিল্ডিংটা
আর বানিয়ে
আসতে পারেনি,
আমাদের কোয়ার্টর,
ক্যান্টিন, বিএসএনএলের অফিস আর ব্লক
পশুচিকিৎসকের দপ্তর। অফিস
চত্বর ফুলগাছ
দিয়ে সাজাবার
প্রস্তাব দিলেই স্টাফেরা
হাঁহাঁ করে
উঠত। ইতিপূর্বে
যতবার ঐ
চেষ্টা করা
হয়েছে টিকা
নিতে আসা
গরুর দল
চেটেপুটে সাফ
করে দিয়ে
গেছে।
সন্ধ্যা নামলেই সব
ফাঁকা । অফিসে
অফিসে তালা।
দূরে গেটের কাছে গ্যারেজের ওপর
জয়েন্ট সাহেব
থাকতেন। পাশে বড়বাবু আর
ইন্সপেক্টর বিসিডব্লু। আর কোণাকুণি ন্যাড়া
কোয়ার্টরে আমরা। সেই সময়
কিশনজীর দাপটে
জঙ্গলমহল কাঁপছে।
যৌথ বাহিনী সবে ঘুরিয়ে মারতে
শুরু করেছে,
খবর এল
কিশনজী নাকি
লুকিয়ে আছে
মাদপুরেই।
থানা বহুদূর
প্রায় ১৫
কিমি। তার ওপর
থানায় গাড়ির
তীব্র অভাব
ছিল। পুলিশ
আনতে হলে
বিডিওকেই গাড়ি
পাঠাতে হত। আর
বিডিও অফিসের
নাইট গার্ড?
ছিলেন তো।
তাঁর নাম ছিল বলাই বাবু।
রিটায়ার্ড পঞ্চায়েত্ কর্মী
। সন্ধ্যা
ঘনালে টর্চ,
বালিশ আর
বৃদ্ধা স্ত্রীকে
নিয়ে আসতেন
ডিউটি
দিতে। আজো মনে আছে
সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরছি, বলাই বাবু
গাড়ির জানলা
দিয়ে মুণ্ড গলিয়ে জিজ্ঞাসা
করলেন,“ স্যার
আপনি কবে
ফিরবেন?”
“কেন”
“এজ্ঞে একা থাকতে
বড় ভয়
করে।
”
একরাতে হঠাৎ থানা থেকে
ফোন এল,
গোপন সূত্রের
খবর আজ
রাতেই বিডিও
অফিসে ডাকাত
পড়বে। তখন রাত সাড়ে
আটটা।
শৌভিকের কপালে
গভীর ভাঁজ পড়ল।
থানা জানালো এই মুহূর্তে যথেষ্ট
ফোর্স নেই।
রাত এগারোটার আগে কিছু করা
সম্ভব নয়। একাধিকবার
ফোন করার
পর বলাই
বাবুর সাড়া
পাওয়া গেল,
সব শুনে
তার যা
অবস্থা হল
তা আর
বলছি না।
বিরক্ত শৌভিক শুধু বলল,“ তিন
তলায় তালাচাবি
দিয়ে বসে
থাকুন”। প্রসঙ্গত
সিন্দুক ছিল
দোতলায়।
গা ছমছমে
নিস্তব্ধতা । পাল্লা দিয়ে
ঝিঁঝির ডাক।
খাওয়া দাওয়া মাথায় উঠল। কিছুক্ষণ
অন্তর অন্তর
শৌভিক বারন্দায়
গিয়ে দাঁড়াচ্ছে
আর আতঙ্কে
আমি অবশ
হয়ে যাচ্ছি।
লোহার গেটে দাঁড়ালেই প্রথমেই ওকে
দেখতে পাবে
আর ভাবতে
পারছিলাম না।
শেষে অনেক ভাবনার পর শৌভিক
স্থানীয় এক
দোর্দোণ্ডপ্রতাপ রাজনৈতিক নেতাকে ফোন করল।
তিনি তৎক্ষণাৎ প্রতিশ্রুতি দিলেন
পার্টির ছেলেদের
পাঠাচ্ছেন। “কিচ্ছু
চিন্তা করবেন
না সার।
আমরা আছি। ” আছেন কিনা
কিছুই বুঝিনি
অবশ্য।
কাউকেই দেখতে
পেলাম না।
উৎকণ্ঠার প্রহর আর কাটেই না।
শেষে প্রায় মাঝরাতে গাদা বন্দুকধারী গোটা চার জওয়ান
এসে হাজির।
স্বস্তির শ্বাস নেবো কি, বলাই
বাবু আর
নামেও না,
গেট ও
খোলে না।
বহু ফোন, পুলিশের জীপের হর্ণ
, আমাদের
সম্মিলিত চিৎকার
, ঘটাং ঘটাং
ইত্যাদির পর
বলাই বাবুর
বউ নেমে
এসে গেট
খোলে।
সে রাতেই
শৌভিককে বললাম,
“ বলাইকে কালই
দূর করে
দে।”
বলাই বাবুর
বিরুদ্ধে ক্ষোভ
জমছিল বেশ
কিছুদিন ধরেই।
আমরা না থাকলেই সাধের আম
গাছগুলি ফাঁকা
হয়ে যেত।
অফিস স্টাফেরা একবাক্যে বলাইকে দায়ী
করত। ব্লকের
যে মাসি
আমাদের বাসন
মাজতে আসত,
তার বক্তব্যানুসারে
বলাই তার
মেয়েকে বিরক্ত
করত।
এই নিয়ে
দিনকয়েক আগেই
বলাই বাবুর
বউ খুব
এক চোট
হুজ্জতি করেছিল। এসব
নিয়ে পঞ্চায়েত্
সমিতিও খাপ্পা
ছিল।
সুতরাং সরিয়ে
দেওয়াই যায়। শৌভিক
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“ পারলে এই
দণ্ডেই। কিন্তু
লোক কই?”
লোক তো
তৈরি। যেদিন
আমাদের যুগলে
গৃহপ্রবেশ হয়েছিল, সেদিনই তার সাথে
আলাপ। শৌভিকই
আলাপ করিয়ে
দিয়েছিল,“এই
যে এরাই
আমায় বিগত
এক মাস
ধরে খাইয়ে
পড়িয়ে রেখেছে। নিমাই, শম্ভু আর ইন্দ্র
। ” তিন ভাই, ক্যান্টিন চালায়।
নিমাই লম্বা, রোগা, মুখভর্তি না
কাটা আধপাকা
দাড়িগোঁফ। শম্ভু
মেজ। অতটা লম্বা নয়।
গাঁট্টাগোট্টা ।
গোঁফ আছে। আর ইন্দ্র
নিতান্তই বাচ্ছা
ছেলে। ছোট্টোখাট্টো।
সর্বদা হাসিখুশি । কিন্তু
হাবা।
যাইহোক আমার
বরকে যে
কি খাইয়ে
রেখেছিল পরদিনই
বুঝতে পারলাম।
রান্নার ব্যবস্থা
তখনও হয়নি
তাই সকালের
খাবার ওরাই
তিনভাই মিলে
নিয়ে এল,
লা ওপালার
প্লেটে গরম
ভাত, ঐ
বাটিতে ডাল,
পোস্তোর বড়া,
মাছের ঝাল
আর টমেটোর
অম্বল।
সাথে একটা তরকারি।
এটা বিডিও সাহেবের ইসস্পেশাল রান্না।
পোস্তোর বড়াটা মুখে দিয়েই ঝটকা
খেলাম। “একিরে
এতো রসুনের
গন্ধ। রসুনের
খোলাও আছে। ” শৌভিক
মুচকি হেসে
বলল, “সবে
তো খাওয়া
শুরু।
” তরকারিটা মুখে দিয়ে আঁতকে উঠলাম,“এটা কি?”
শৌভিক হাসি
চেপে বলল,“
কেন? চিনতে
পারছিস না?”
“অখাদ্য।
এটা কি?”
“পেঁপে পোস্তো। ঐযে
ক্যান্টিনের পাশে যে পেঁপে গাছ
আছে, ঐ
পেঁপের পোস্ত। ”
বাপরে বাপ। কেন যে টিকা
নিতে আসা
গরুর
পাল ঐ পেঁপে গাছ গুলোকে মুড়িয়ে
খেত না
কে জানে। খেলে
আমার পৈশাচিক
আনন্দ হত।
আর মাছ?দেশি রুই মাছের
রিং পিসকে
কড়কড়ে করে
ভেজে রসুনগন্ধী
ঝোলে ফোটানো
। এক দুবার খেয়ে
আমার মাছে
ঘেন্না ধরে
গিয়েছিল। সোমবার
সকাল ৭টা১০
এর ট্রেন
ধরে বেলা
৯টা নাগাদ
পৌছতাম। এরপর আর রেঁধে
খেয়ে অফিস
যাবার অবকাশ
থাকত না। অগত্যা
শম্ভু- নিমাই
ভরসা। পইপই করে বলে
আসতাম নিরামিষ
রান্না করতে,
কিন্তু বিডিও
সাহেব আর
ম্যাডামকে নিরামিষ খাওয়াতে ওদের তীব্র
পাপবোধ হত।
ফলতঃ দেশি রুই বাঁধা।
একবার বলে
এলাম ডিমের
ঝোল করতে। এতে
রসুন দিলেও
সমস্যা
নেই। কত খারাপ
আর করবে।
খেতে বসে ভির্মি খেলাম। শৌভিকও
আমার ওপর
ক্ষেপে গেল, ওকে না জিজ্ঞাসা করে নির্দেশ দেবার
জন্য
। কি দেখলাম?
এক বাটি
লালচে হলুদ
ঝোল তাতে
ভাসছে একটি
ডিম এবং
গুটিকয়েক ঝিঙে। ক্যান্টিনের
পিছনে যে
একটি ঝিঙে
গাছ হয়েছে
আমি খেয়াল
করিনি।
যাই হোক
এই শম্ভু
বেশ কিছুদিন
ধরে আমাকে
বারবার অনুরোধ
করছিল, নাইট
গার্ডের পদটির
জন্য।
ব্লকের এফ
ই ও
এবং অমল
বাবু ছিলেন
শৌভিকের ডান
এবং বাঁ
হাত।
দুজনে মিলে
এই কুবুদ্ধিটা
দিয়েছিলেন।
“ম্যাডামকে ধর। ম্যাডামকে বললে
সার না
করবেননি।
”যত বলতাম,“তা তুমিই
বল।
”
“ না আপনি বলেন। ভয়
করে।
”
সেরাতে সত্যই বললাম।
শৌভিক বলল,“জানি। কিন্তু
ও পারবে
না।
”
মুখে যাই বলুক
অচীরেই বলাই
বাবুর জায়গায়
শম্ভু বহাল
হল।
ঠিক এই
সময়ই সপ্তাহখানেক
ছুটি নিতে
হল।
দিন দশেক
পরে অফিস
করে ফিরছি,
দেখি আমার
আগে আগেই
বলাই বাবু
তার বউ,
টর্চ আর
বালিশ নিয়ে
ঢুকছেন। শৌভিক
ফিরতেই জিজ্ঞাসা করলাম,“বলাই বাবু
আবার কি
করতে এলেন?”
“নাইটগার্ড। ”
“শম্ভু?”
“ চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ”
“ মানে? কেন?”
“ বউকে ছেড়ে
থাকতে পারছে
না। বউও নাকি কান্নাকাটি
করছে”।
ধপ্ করে বসে
পড়লাম চেয়ারে। খানিকপরে
আবার জিজ্ঞাসা করলাম,“হ্যাঁরে সত্যি
বউ ছেড়ে
থাকতে পারছে
না? নিজের
বউ? ” শৌভিকের
সেই দমফাটা
হাসি আজো
মনে পড়ে।
♥ পুনশ্চ শম্ভু তখন
মধ্যচল্লিশ তো বটেই।
মন্দ কাটছিল না মাদপুর বাস। সকালে কোকিলের ডাকে ঘুম ভাঙা থেকে নিশুতি রাতে ঝিঝিপোকার ডাকে ঘুমিয়ে পড়া। মিনিট চার হাঁটলেই রেল লাইন, লাইন পেরোলেই বাজার। টাটকা সবজি, দেশী মুরগির ডিম, হরেকরকম শাক। একবার শৌভিককে ওর কোন স্টাফ এক ব্যাগ নিজের ক্ষেতের বাদশাভোগ চাল দিয়েছিল । সে যে কি দেবভোগ্য বস্তু তা ভাষায় অপ্রকাশ্য । অনভিজ্ঞতা বশতঃ চাল শেষ হয়ে যাওয়ায় ঐ চালের ভাত করেছিলাম। গোটা কোয়ার্টর সুরভিত হয়ে উঠেছিল। অতি মূল্যবান বাসমতি চালেও কখনত্ত সে সুগন্ধ পাইনি। বাজার করে দিতেন শৈবাল দা। আমাদের শত অনুরোধেও উনি বেশি করে সব্জি বা মাছ আনতেন না। বললে বলতেন ,“ফ্রীজে রাখা মাছ সবজি খাবেননি স্যার। ” দৈবাৎ শৈবাল দা না থাকলে আমাদের ম্যান ফ্রাইডের নাম ছিল জামাই। কস্মিনকালে কোন স্টাফের তুতো জামাই ছিল হয়তো, জামাই এর একটি জম্পেশ মুসলিম নাম ছিল যা দীর্ঘ আড়াই বছরে আমরা জেনে উঠতে পারিনি। ব্লক অফিসের পাঁচিল ঘেষে ছিল জামাই এর ছোট্ট মণিহারি দোকান । কিন্তু ব্লক অফিসের সর্বঘটে জামাই ছিল কাঁঠালীকলা। ট্যাঙ্কে জল নেই, পাম্প চালাবে কে? লোডশেডিং, জেনারেটর চালাবে কে? ট্রাক থেকে মাল নামাতে লোক ডাকবে কে? মোট কথা জামাইকে ছাড়া ব্লক অফিস কানা শুধু নয় নিতান্তই অক্ষম।
কনকনে শীত। মনোরম পুষ্পশোভিত বসন্ত। মাদপুর অপরূপা। নাম না জানা রঙ বেরঙের কত যে ফুল ফুঠত। শীতে যাত্রা হত। দিন সাতেক আগে থেকে চলত তার ঘোষণা, সাথে তারস্বরে বাজত বাংলা সমসাময়িক সিনেমার গান। একই গান বারবার লাগাতার। সোহম-পায়েল বেশ কয়েকবার ঘুরে গেল, কখনও মাদপুর, কখনত্ত শ্যামচক, কখনত্ত বা বালিচক। সবথেকে বড় হাঙ্গামা হল যে বার বালিচকের ছেলে শ্রীযুক্ত দেবকুমার অধিকারী এলেন মাদপুরে। সেবার উদ্যোক্তারা নাছোরবান্দা বিডিও সাহেবকে দেখতে যেতেই হবে। যায়নি যদিও। চোখের পলকে সপ্তাহ পার হয়ে যেত। শনিবার বিকাল থেকে ঐ নিস্তব্ধতা অসহনীয় হয়ে উঠত।
মনোরম মাদপুর রাতারাতি ভোল বদল করল এপ্রিল থেকে। মার্চ মাসেও রাতে হাল্কা গায়ের চাপা লাগত, হঠাৎ শুরু হল তীব্র দাবদাহ। ভয়াবহ চামড়া জ্বালানো রোদ সাথে মারাত্মক আদ্রতা। দিন যাও বা ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যেত,রাত কাটতেই চাইত না। কোয়ার্টর ছাড়ুন খোদ বিডিও অফিসেই কোন বাতানুকূল যন্ত্র ছিল না। কারণ আর কিছুই না, রেল লাইনের ঐ দিকে বিদ্যুত সরবরাহকারী এক অতি দুর্বল ট্রান্সফরমার । বারংবার অনুরোধ, উপরোধ, চিঠি চাপাটি, ধমক, হুমকি সব ব্যর্থ। বাতানুকূল যন্ত্র ছাড়ুন, ভোল্টেজের এত ভয়াবহ অবস্থা ছিল
যে আমরা রীতিমত প্রার্থনা করতাম, যাতে রাতে লোডশেডিং হয়, ইনভার্টররের দৌলতে অন্তত পাখাটা তো জোরে ঘুরবে। শুধু গরম না সাথে দেখা দিল ভয়াবহ পোকামাকড়ের উৎপাত । বিভিন্ন আকৃতি এবং বর্ণের শয়ে শয়ে পোকা। কেউ আসত ঝাঁক বেঁধে কেউ ছিল একাই একশ। সন্ধ্যাবাতি জ্বললেই ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসত পাশের ধান ক্ষেত থেকে। ঐ প্রাণান্তকর গরমেও সব জানলা ঢেকে ফেলা হল হলুদ নাইলনের নেট দিয়ে। বারন্দার দিকের সব দরজা হয় বন্ধ রাখতে হত নতুবা বাতি নিভিয়ে নিকষ আঁধারে খুলতে হত। সব রকম সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও তারা আসত। বিশেষ করে রান্না করার সময় একাকী আমাকে আক্রমন করে তাদের যে কি অপরিসীম উল্লাস হত তা আজো এক রহস্য।
মনে আছে একবার রান্নাঘরে ঢুকেই উচ্চঃস্বরে কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে এসেছি, শৌভিক ইউটিউবে ভিভ রিচার্ডসের খেলা দেখছিল, আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে এল। পটল ভাজতে দিয়ে এক পলকের জন্য রান্নাঘর ছেড়ে এসেছি, ওমনি কোথা থেকে একটি মথ ঝাঁপিয়ে পড়েছে গরম তেলে আত্মহত্যা করতে। গিয়ে দেখি পটল এবং মথ একসাথে পক্ক হচ্ছে!!
শুধু পোকা কেন এত সুপুষ্ট টিকটিকি অন্য কোথাও খুব বেশি দেখিনি। টিকটিকিগুলির আজব বৈশিষ্ট্য ছিল, ঘরের এমন এক কোণায় গিয়ে দেহত্যাগ করত, যে আমরা শত অন্বেষণেও হদিশ পেতাম না। শুধু গন্ধে গোটা বাড়ি ম ম করত। এছাড়াও ছিল ব্যাঙ। যখন তখন বিনানুমতিতে প্রবেশ করত এবং ব্যাপক লম্পঝম্প জুড়ত। হাওয়াই চপ্পল ফটফটিয়ে ব্যাঙ তাড়াতে শৌভিক বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। সাপ অবশ্য প্রথম ঢুকেছিল আমি বদলি হবার পর।
তবে নিঃসন্দেহে মাদপুরে ভিআইপি ছিল ধেড়ে ইঁদুর। প্রায় ছুঁচোর সমান আকৃতি এবং বিডিও কে বিন্দুমাত্র ভয় পেত না। শৈবাল দা খুঁজে খুঁজে বিষ আনত,পরম যত্নে আমার বর কখনত্ত চানাচুর, কখনত্ত বা আটার গুলি দিয়ে তা মেখে টোপ ফেলত। সব চেটেপুটে সাফ করে দিলেও কিছু হত না। ওদের প্রিয় খাদ্য ছিল সাবান। সুগন্ধী সাবান কিন্তু । কাপড়কাচা সাবান স্পর্শও করত না। এমনকি সাবান কেস ও বাদ যেত না। মাঝে মাঝে গভীর রাতে খাটের ওপর দিয়ে শর্টকার্ট নিত। আমি কখনও অনুভব করিনি যদিও। শৌভিকের কষ্টকল্পিত হতেও পারে।
দেখতে দেখতে এসে গেল আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী । সপ্তাহের মাঝে তো আর এস ডিও বা ডিএলসি সাহেবের কাছে বেয়াড়া আবদার করা যায় না। অগত্যা অন্যান্য দিনের মতই যে যার অফিস গেলাম। বন্ধু বান্ধব ,আত্মীয়-স্বজন ফোনে শুভেচ্ছা জানালেন। ডিএলসি শৈবাল দা ঠাট্টার সুরে লেগপুল করলেন, কোথাও ঘুরতে যায়নি বলে। ঐ ঠাঠা রোদে কোথায় বা যেতাম? দুঃখী মনে কাজ করছি হঠাৎ শৌভিকের ফোন,“দূরঃ। জাহান্নামে যাক সব। চল কোথাও ঘুরে আসি। রেডি থাক। আসছি। ”
দুপুর তিনটে নাগাদ আমরা রওনা হলাম। ড্রাইভার শৈবাল দাকে বলা হল আজ আমাদের বিশেষ দিন। একটা জম্পেশ জায়গায় নিয়ে চল। ধূধূ ফাঁকা রাস্তায় লাগাম ছেড়ে দৌড়ল গাড়ি। লাল মোরাম বিছানো পথ ধরে, ঘন নিরিবিলি ঝাউ আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, উচ্চাবচ কালভার্ট পেরিয়ে হারিয়ে যাওয়া। নির্বাক নিশ্ছিদ্র ভালোলাগায় মন যখন কানায় কানায় ভর্তি হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে শৈবাল দা বলল,“যান স্যার খুব ভাল লাগবে। ” তৎকালীন মেদিনীপুরের সবথেকে বড় এবং জনপ্রিয় পার্ক, নাম ঝিলমিল । অল্পবয়সীদের প্রিয় রোমান্টিক ডেসটিনেশন। তবে আদপেই সেন্ট্রাল পার্ক সুলভ নয়। শৌভিক কিছুতেই নামবে না। বেচারা শৈবাল দা হতভম্ব । এমন সুন্দর পার্ক ও সাহেবের নাপসন্দ? আর আমি অসভ্যের মত হেসেই যাচ্ছিলাম।
(চলি?)