অনির ডাইরি ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫
#অনিরডাইরি #কলকাতার_কথকতা
হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছি আমরা, চেনা শহরটাকে আরেকবার আপন করে নিতে। কলকাতাকে যতই গালি দিন না কেন, কলকাতার শীত বড়ই মনোহারী। দীর্ঘ চার বছর বাদে মহানগরে প্রত্যাবর্তনের পর তা যেন নতুন করে উপলব্ধি করছি আমরা। নভেম্বর পড়লেই শহরটা এত সুন্দর কি করে হয়ে যায় বলুন দিকি!
পরিকল্পনা তো অনেক, সময় যে বড়ই কম। শীতের বেলা বড্ড ছোট। গন্তব্য এক বিশেষ মনীষীর শেষ বিশ্রাম স্থল দর্শন। যদিও মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট ২০০৩ সালে তাঁর খেতাব কেড়ে নিয়েছেন, তাও আমাদের মত ৮০-৯০ এর দশকে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের মর্মস্থলে আজও তিনি কলকাতার বাবা হিসেবেই স্বীকৃত। ১৯৮৯/৯০ সালে কলকাতার তিনশ বছর পূর্তির সাক্ষী যে আমরা। একটা বিশেষ শাড়িই বেরিয়েছিল সেই সময়, যার নাম কলকাতা - ৩০০। আমার মা বাদে চেনা পরিচিত সকলেই একটা করে কিনেছিলেন মনে আছে। মায়েরও খুব শখ ছিল, কিন্তু যা হয় আর কি বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে -
অজান্তে স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠে মন। একটা সিনেমাও উঠেছিল ভদ্রলোককে নিয়ে। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র, আর কে কে ছিলেন, বা সিনেমার গল্প কি ছিল কিছুই মনে পড়ে না। মনে করতে গেলেই এন্টনি ফিরিঙ্গি আর জাতিস্মর এসে সব ঘেঁটে দেয়। ধুত্তোর -
রাজভবনের উত্তর পশ্চিম কোণে অবস্থিত সেন্ট জনস্ চার্চ, এর ভিতরেই ঘুমিয়ে আছেন কলকাতার জনক। কতদিন এর সামনে দিয়ে হেঁটে আপিস গেছি আমি, ভিতরে প্রবেশ আজই প্রথম। চার্চে ঢুকতে এন্ট্রি ফি লাগে, মাথা পিছু দশ টাকা। গাড়ির জন্য ৫০ টাকা। বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থান চার্চটার। মর্মর ফলকে গোটা গোটা করে লেখা জমিটা দান করেছিলেন শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস খোদ, সন ১৭৮৪। ইতিহাস বলে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারের উত্তর পূর্ব কোণে অবস্থিত সেন্ট মার্টিন ইন দি ফিল্ড চার্চের প্রতিরূপ এই চার্চ। তুত্তুরী বলে, "বেশীরভাগ চার্চ এমনিই তো দেখতে হয়"। সেতো হবেই, ব্রিটিশ আমলে তৈরি অধিকাংশ চার্চই যে এই আদলে তৈরি।
গির্জার উঁচু চূড়ার দিকে ক্যামেরা তাক করে খচখচ করে ছবি তুলছে শৌভিক। তুলছে তুত্তুরীও, তোলার আগে একবার আড় চোখে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে, ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে, কতটা বেঁকে তুলছে বাবা। মাটিতে বসে পড়ল কি? দুটোর মধ্যে নিত্য ঝামেলা হয় এই ছবি তোলা নিয়ে। তুত্তুরীকে যত বলি, বাবাকে নকল করতে যাস না, তাহলে তো একই ছবি উঠবে দুই জনের ক্যামেরায়, তিনি শুনলে তো। ছায়া সঙ্গী হয়ে নকল করে চলেছে বাবাকে আজও। ধুলোতেই বসে পড়লেন ধপ করে -
মেয়েকে টেনে সরিয়ে আনি, শুধু ছবি তুললে হবে, অনুভবও তো করতে হবে নাকি? ১৭৮৪ সাল চিন্তা করতে পারছিস? সতীদাহ কবে বন্ধ হয়েছিল মনে আছে, এতক্ষণে মাথায় ঢোকে তুত্তুরীর, একটু থেমে বলে "১৮২৯।" মোবাইল বার করে কি দেখে, তারপর বলে, " তার মানে রাজা রামমোহন রায় তখন মাত্র ১২ বছর। আমার থেকেও ছোট -"। আর ঈশ্বরচন্দ্র? তাঁর জন্মাতে বাকি প্রায় চার দশক। সিপাই বিদ্রোহ এক অবাস্তব কল্পনা।
হতবাক হয়ে চার্চের গম্বুজের দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা মা মেয়ে। মনে মনে কথা বলার চেষ্টা করি, তদানীন্তন কোন পূর্বজের সাথে। আছেন কি কেউ আসেপাশে, নাহ নেটিভদের তো প্রবেশই নিষিদ্ধ ছিল এইসব স্থানে। দূর থেকে সসম্ভ্রমে"পাথুরে গির্জা" বলে ডাকতেন তাঁরা। ইতিপূর্বে এমন পাথরের তৈরি ইমারত ছিল কোথায় নরম কলকাতায়। গির্জা গাত্রে খোদিত আছে, নদী পথে এই সব সব পাথর আনা হয়েছিল গৌড় থেকে। ইতিহাস বলে মাত্র তিন বছর লেগেছিল নাকি চার্চটি তৈরি হতে, ব্যয় হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। টাকাটা পুরোটাই উঠেছিল পাবলিক লটারির মাধ্যমে। মোদ্দা কথা, নেটিভদের স্থাপত্য ভেঙে, তাদের দান করা জমিতে, তাদেরই অর্থে গড়ে উঠেছে শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের উপাসনালয়।
১৭৪ ফুট গম্বুজের মাথায় এখনও টক টক করে ছুটছে বিশাল গোল ঘড়ি খানা। আজও রোজ দম দেওয়া হয় এই ঘড়িটায়। গম্বুজটা নাকি আরো বড়, আরো জাঁদরেল হবার কথা ছিল, কিন্তু কলকাতার নরম মাটি, এর থেকে বেশী ভার বহনে অপারগ। ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত এটাই ছিল কলকাতার ক্যাথিড্রাল।
কে বলবে অফিস পাড়ার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই চার্চ, গেট দিয়ে ঢুকে আসা ইস্তক কানে আসেনি কোন গাড়ির আওয়াজ, বা জন কাকলি। সময় যেন থমকে গেছে প্রাচীরের এই পাশে। চার্চের ভিতরে অখণ্ড নীরবতা, সারি সারি ফাঁকা বেঞ্চ বসে আছে উপাসকের অপেক্ষায়। পায়ের কাছে গুছিয়ে রাখা ছোট ছোট ফুট স্টুল। চার্চের জানলায় রঙিন কাঁচের ফাঁক গলে আসা সূর্যালোক তৈরি করেছে অনুপম বর্ণালী। এই গির্জার অল্টারের নীচে ঘুমিয়ে আছেন কলকাতার প্রথম বিশপ থমাস মিডলটন। গির্জার দেওয়াল জোড়া অগণিত মর্মর ফলক । মৃত প্রিয়জনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে কোথাও ভাইপোর জন্য ফলক বসিয়েছে কাকা, কোথাও স্ত্রীর জন্য স্বামী, ছেলের জন্য বাবা ইত্যাদি। প্রতিটি ফলকে লুকিয়ে আছে কত যে গল্প -।
জেমস্ পাটেল এর গল্পটা আমি জানি। ইনি সম্পর্কে আমার প্রিয় লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পল সাহেবের পূর্বপুরুষ। কোথায় যেন পড়েছিলাম ডালরিম্পল সাহেবের ঊর্ধ্বতন সাত পুরুষ নাকি কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন, যাঁদের মধ্যে অন্তত তিনজন ঘুমিয়ে আছেন এই চার্চ সংলগ্ন সমাধি ক্ষেত্রে। জেমস্ পাটেল অবশ্য থেকেও নেই। ওনাকে বলা হত, " the greatest liar in India", ভদ্রলোক কি করেছিলেন জানি না, কিন্তু বলা হয়, উনি নাকি এতই পতিত ছিলেন যে মৃত্যুর পর স্বয়ং ডেভিল ও ওনাকে নিজের ছত্রছায়ায় নিতে চাননি। মৃত্যুর পর তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুসারে, ওনার মরদেহকে সুরায় চুবিয়ে রওনা দেয় জাহাজ ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। মাঝরাতে সেই সুরা সিক্ত মৃতদেহ হঠাৎ উঠে বসে সটান। সেই দেখেই ওনার স্ত্রী হার্টফেল করে মারা যান। সংরক্ষণের স্বার্থে তাঁকেও চোবাতে হয় সেই সুরা ভাণ্ডে। এই করতে গিয়েই বাঁধে গোল, গোটা জাহাজ আমোদিত হয়ে ওঠে সুরার সুবাসে। নাবিক কুল টের পায়, কি অমৃত সুধা লুকিয়ে আছে জাহাজে। এত দামী মদ কি ফালতু নষ্ট হবে, কফিনে ফুটো করে বার করে দেদার পান করা হয় মদ। এরপর যা হয় আর কি, মাতাল জাহাজ গিয়ে ধাক্কা মারে চড়ায়। জাহাজের সাথেই জ্বলে যান পাটল দম্পতি ও।
অল্টারের কাছেই রাখা, Johann Zoffany র হাতে আঁকা বিশাল তৈল চিত্র, Last Supper। বলাইবাহুল্য অনুপ্রেরণা -লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা দা লাস্ট সাপার। খুঁটিয়ে দেখি আমরা, ছবিটি বেশ বিতর্কিত। প্রভু যীশুর শিষ্যদের নাকি হুবহু তৎকালীন কোম্পানির বড় অফিসারদের মত দেখতে। জলপাত্রটা দেখতে আমাদের থুকদানির মত, একটা ভিস্তিও রাখা আছে টেবিলের ওপর। ছবিতে যীশুর কাঁধে মাথা রেখেছেন যিনি, তাঁকে মহিলা বলে ভ্রম হওয়াই স্বাভাবিক। দা ভিঞ্চি কোড পড়া আমার মন কেবল জানতে চায়, তবে কি Zoffany ও Priory of Sion এর সদস্য ছিলেন? যাদের ওপর ন্যস্ত ছিল প্রভু যীশুর উত্তরসূরিদের রক্ষণাবেক্ষণের গুরুদায়িত্ব।
চার্চের বাইরে ঘুমিয়ে আছেন অনেক মানুষ। লর্ড ব্রেবর্ন, লেডি ক্যানিং নাম গুলো পরিচিত। এনাদের সমাধি গুলিও স্বতন্ত্র। বাকিদের নামে নামে পাতা আছে মার্বেল ফলক। কিছু কিছু ফলকে ইংরাজিতে লেখা, বাকি ল্যাটিনে। আছে বেগম জনসনের কবর, আসল নাম ফ্রান্সেস ক্রোক। সেযুগে চার বার বিয়ে করেছিলেন ভদ্রমহিলা। প্রথম বিয়ে মাত্র ১৩ বছর বয়সে, অল্প দিনের মধ্যেই হারান স্বামী এবং সন্তানদের। পুনরায় বিবাহ করেন। ২২/২৩ এর মধ্যে আবার বিধবা হন তিনি। তৃতীয়বার যাঁর সাথে বিয়ে হয়, তিনি ছিলেন কোম্পানির বড় অফিসার। বাংলা তখন সদ্য হারিয়েছে নবাব আলবর্দি খাঁকে। সিংহাসন দখলের লড়াই তীব্র। এই লড়াইয়ের মাঝে পড়ে আলাদা হয়ে গেলেন ফ্রান্সেস তাঁর স্বামীর থেকে। বন্দী হয়ে দুই সন্তান সহ আশ্রয় পেলেন মৃত নবাবের স্ত্রীর ছত্রছায়ায়। বেগম সাহেবার এমন মাহাত্ম্য যে ফ্রান্সেস বাকি জীবন নিজেকে বেগম বলে পরিচয় দিতে শ্লাঘা বোধ করতেন। যুদ্ধ শেষে অবশ্য স্বামীর সাথে মিলিত হন ফ্রান্সেস। ফিরে যান ইংল্যান্ডে। সেখানে বেশ অনেক বছর একসাথে কাটানোর পর মারা যান ওনার তৃতীয় স্বামী। মধ্য চল্লিশের ফ্রান্সেস একাকী ফিরে আসেন তাঁর ইন্ডিয়ায়। কলকাতায় এসে বিবাহ করেন উইলিয়াম জনসনকে। পাথুরে গির্জার প্রাণ পুরুষ এই উইলিয়াম জনসন। পাবলিক লটারির মাধ্যমে টাকা তোলা থেকে গির্জা নির্মাণ সবটুকুই হয় ওনার একার তত্ত্বাবধানে। গির্জা নির্মাণ সম্পূর্ণ হলে সস্ত্রীক বিলেত ফেরৎ যেতে উদ্যোগী হন জনসন সাহেব। কিন্তু বেঁকে বসেন বেগম সাহেবা। শ্বেতাঙ্গিনী হলেও ইন্ডিয়াই ওনার দেশ, কোনমূল্যেই স্বদেশ ছাড়তে উনি রাজি নন। ডিভোর্স তখনও পাপ বলে গণ্য হত, বিশেষত উইলিয়াম জনসনের মত যাজকদের তো ওপথে হাঁটা অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত মোটা অর্থদণ্ড দিয়ে বরকে দেশে পাঠালেন বেগম জনসন, শর্ত রইল আর কোনদিন ফিরে আসতে পারবে না উইলিয়াম জনসন। ৮৭ বছর বয়সে মারা যান বেগম জনসন, গোটা কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজের নয়নমণি ছিলেন তিনি। সকলে সমবেত হয়েছিল তাঁর শেষ যাত্রায়।
তাঁর সমাধির পাশ দিয়ে কিছুটা গেলেই চোখে পড়বে অষ্টভূজাকৃতি এক ছিমছাম সৌধ। এর নীচেই ঘুমিয়ে আছেন সেই ভদ্রলোক, যাঁর পোশাকী নাম Jobous Charnock। একা নন, পাশেই শুয়ে আছেন তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা। আর শায়িত আছেন উইলিয়াম হ্যামিল্টন, ভারত সম্রাট ফারুকশিয়ারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। কোথাও যেন ঘুমিয়ে আছেন জেমস কার্কপ্যাট্রিক, উইলিয়াম ডালরিম্পলের White Mughal এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। বেগম খয়েরউন্নিসার প্রথম প্রেম। গল্পের সাথে এখানে মিশে যায় ইতিহাস। ইতিহাস গল্প বলে হেথায় -
ছবি সৌজন্য - আমার বর আর আমার ছানা









