Tuesday 6 August 2024

অনির ডাইরি আগস্ট, ২০২৪

অনির ডাইরি ২৮শে আগস্ট, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 

আজ আবার বনধ থুড়ি ধর্মঘট। মহামহিমের নির্দেশে আজ আপিস যাওয়া বাধ্যতামূলক। ঘুম যখন ভাঙল, তখনও পুরো ফর্সা হয়নি আকাশ। গতরাতে পই পই করে বলেছিল শৌভিক, "তোর ওই পাকিস্তানি মেলোড্রামা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়, সকালে উঠতে পারবি না।" শুনিনি এবং এই মুহূর্তে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, গরীবের কথা বাসি হলে কতটা মিষ্টি হয়। 


ঘুমন্ত চক্ষু জোড়াকে টেনে খুলে, এক কাপ হাকুচ কালো চা গলায় ঢেলে, ঝটিতি কাক স্নান সেরে বেরোতে বেরোতেই ঘড়ির কাঁটা ছাড়িয়ে গেল সাড়ে ছটার ঘর। এখনও পুজো বাকি, হে ঈশ্বর আজ নমঃনমঃ করে পুজো করলে কি একেবারেই হবে নি? কোনমতে বাসি ফুল ফেলে, তুলসীতলায় জল দিয়ে,মাথা পিছু একটা করে ফুল তুলে একটা ধূপ জ্বেলে বললাম, আজকের মত মার্জনা করো আমায়। ঘড়ির কাঁটা পৌনে সাত ছাড়াল বুঝি। দেরী হলে কি যে হবে আজ। ওরা তো শুনবে না, তোমরাই একটু বোঝ প্রভু।   


বেরোতে বেরোতে বেজে গেল প্রায় সোয়া সাত। ছটার মধ্যে বেরোতে বলেছিল শৌভিক, সোয়া ঘণ্টা লেট। এতটা পথ যাব, কি যে হবে। মুঠো ফোন বলছে ট্রেন লাইনে অবরোধ শুরু হয়ে গেছে। অফিস যাবার দীর্ঘ পথটায়ও জায়গায় জায়গায় কমলা দেখাচ্ছে গুগল ম্যাপ। ঘুম ভেঙে, বাসি মুখে, প্রাতঃকৃত্য না সেরেই অবরোধ করতে চলে এল নাকি জনগণ। 


গাড়ি স্টার্ট নিতেই মনে পড়ল, জনৈক সহকর্মীর কথা। কাছেই থাকে ছেলেটি, গত বৃহস্পতিবার থেকে ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত। গতকাল সকালেও মেসেজ করেছিল ছেলেটা, "ম্যাডাম খুব দুর্বল। আজও অফিসে যেতে পারছি না। আমার বাড়ির সবাই আক্রান্ত।" ধরেই নিয়েছিলাম আজ যাবে না, ড্রাইভার বলল, " ওই স্যার মনে হয় যাবেন। একটু আগে ফোন করে জানতে চাইছিলেন আপনি বেরিয়েছেন কি না।" 


এই এক জ্বালা, এত বছর আধিকারিকগিরি করেও, কিছুতেই ওরটা ও বুঝে নেবে ভেবে উঠতে পারি না আমি। ফোন করলাম, মুঠো ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল অসুস্থ কাতর কন্ঠস্বর। প্রশ্ন করলাম, তুমি কি যেতে পারবে? ছেলেটি বলল, "পারব ম্যাম, কিন্তু একটু সময় লাগবে। ভাইরালে গোটা বাড়ি অসুস্থ, বিশেষ করে মা একদম কাহিল। চোখে দেখতে পাচ্ছে না। মায়ের নৈমিত্তিক কাজ গুলো করে বেরোতে আরো মিনিট দশ লাগবে। এখান থেকে রূপসী বাইপাস পৌঁছাতে আরো মিনিট দশ ধরুন।"  


মনে মনে হিসাব করলাম আরো আধ ঘণ্টা, অর্থাৎ পৌনে আটটা। অফিসে ঢুকতে ঢুকতে নয় সোয়া নয়, অবরোধকারীদের প্রিয় সময়। হিসেব করলাম বটে, মুখে বললাম, তুমি মায়ের পরিচর্যা করে বেরিয়ে এসো, আমরা যতটা পারি ডিট্যুর করে তোমার বাড়ির কাছ দিয়ে যাচ্ছি। 


আমার কথা মত ড্রাইভার সাহেবও খুব আস্তে আস্তে ডিট্যুরের রাস্তা ধরলেন। আমার মন আপাতত খোলা আকাশ। হুহু করে যাচ্ছে আসছে, ভাবনা চিন্তা আর স্মৃতির দল। কম ধর্মঘট তো পার করলাম না এই জীবনে। এই তো সেদিনের কথা, আমার কর্মজীবনের প্রথম ধর্মঘট। সময়টা ২০০৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধ। শিল্প ও বাণিজ্য দপ্তরে অবর বর্গীয় সহায়ক হিসেবে সদ্য জয়েন করেছি। বুঝতে পারছি অন্তত আরো এক ডজন সরকারী চাকরী পেতে চলেছি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে। এতদিন প্রচুর হ্যাটা দিয়েছে আত্মীয়স্বজন, বেশ কিছু সহপাঠিনী। এমনকি এই চাকরি নিয়েও শুনিয়েছে, রাজ্য সরকারী L.D র আর ক'পয়সা বেতন আর কিই বা ইনক্রিমেন্ট। এবার জবাব দেবার পালা। রীতিমত স্বয়ম্বর সভা বসতে চলেছে সরকারী চাকরি গুলোর। সুতরাং " আজকাল পাঁও জমি পর নেহি পড়তে মেরে -"।


এমন সময় বনধ ডাকল কোন এক বিরোধী দল। আজকালকার মত ম্যাদামারা বনধ নয়, চাক্কা জ্যাম মার্কা আগুনে বনধ। আমার তো আনন্দের শেষ নেই। বনধ মানেই ছুটি। একটা দিন অন্তত আর ভোরে উঠে, নাকে মুখে গুঁজে ট্রামবাসে বাদুর ঝোলা হতে হবে না। অর্থাৎ অখণ্ড ল্যাদ আর সদ্য ধর্মতলা থেকে কেনা ১০০ টাকার ড্যান ব্রাউন। মুখ ফসকে বলে ফেলেই বাঁধালাম কেলো। আঁতকে উঠল তৎকালীন সহকর্মীর দল। অতসী ছিল টাইপিস্ট, প্রথম দিন থেকেই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, মাথায় চাঁটি মেরে বলল, " বনধের দিন আসবি না কি রে, ওই দিনই তো আসল মজা। যখন খুশি আয়, এসে সই করে কেটে পড়।" শুধালাম, যদি না আসি কি হবে? জবাব এল, " শোন অন্য পার্টি ডাকলে একটা দিন ছুটি কাটে আর যদি শাসক দল ডাকে, তাহলে আসবি না, জানবি ওটা সবেতন ছুটি।" 


শাসক দলের বন্ধ ছিল না, ফলে একটা ছুটিই তো কাটবে, কাটুক। অফিসে জোর গলায় বলে এলাম বটে, বাড়িতে কেউ পাত্তাই দিল না। নির্দিষ্ট দিনে, আপিস টাইমের একটু পরে কান ধরে রাস্তায় বার করল বাবা। আমাদের বাড়ির মেয়ে হয়ে তুমি এই অশান্ত পরিস্থিতিতে ঘরে বসে থাকবে, ওটি হবে না। যে দল বনধ ডেকেছে, আমাদের মহল্লায় যুগ জন্ম ধরে সেই দলেরই রাজত্ব। দলীয় পতাকায় প্রায় মোড়া প্রতিটা সাবেকী আখাম্বা ল্যাম্পপোস্ট, মোড়ে মোড়ে জমায়েত, হুহু করে জ্বলছে টায়ার, দাঁড়িয়ে আছে কাঁচ ভাঙ্গা ফাঁকা বাস । একটাও বাস বা রিক্সা নেই রাস্তায়, টোটো তো তখনও আবির্ভূতই হয়নি। রাস্তা ভর্তি প্রচুর মানুষ। সবাই প্রায় বাবার পরিচিত। জিন্দাবাদ মুর্দাবাদ করতে করতেই অনেকে সোচ্চারে বাবার কুশল সংবাদ নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার সন্দিগ্ধ হয়ে শুধাচ্ছে, " কোথায় চললেন মেজদা?" ভদ্রলোকের এক কথা, সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাবা সবাইকে একই জবাব দিচ্ছে, " এই যে মেয়েকে বনধ দেখাতে বেরিয়েছি -"। যেন বনধ একটা দেখার মত ব্যাপার আর কি। 


হাঁটতে হাঁটতে হাওড়া ময়দান। ময়দানে দীর্ঘ ক্ষণ দাঁড়িয়ে একটা বাস পেলাম, ধর্মতলা মিনি। প্রায় ফাঁকা বাস, তাতেই তুলে দিল বাবা। আব্দার করছিল, রাইটার্স অবধি সঙ্গে যাবে বলে, অতি কষ্টে নিরস্ত করলাম ডানপিটে বৃদ্ধকে। বন্ধুরা জানলে যা খিল্লি হবে, বাপরে। ফাঁকা রাস্তা ধরে বাদল দিনের পাগল হওয়ার মত ছুটল বাস। হাওড়া ব্রিজ ধুধু করছে। গুটি কয়েক আড্ডারত আইন রক্ষক ছাড়া কাউকে নজরে এল না। বড়বাজার ও ঝাঁপ ফেলা, মিনিট দশেকের মধ্যে বাস এসে দাঁড়াল লাল বাড়ির সামনে। ১নং গেটে কর্তব্যরত আইন রক্ষকদের কেউ ফিরেও তাকাল না আমার দিকে, আই কার্ড না দেখিয়েই দিব্য ঢুকে গেলাম ভিতরে।


বিগত আঠারো বছরে কত বদলে গেছে সবকিছু। ভাবতে ভাবতে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম, সাতটা তেত্রিশ। গেল কোথায় ছেলেটা? এবার তো রাস্তায় আটকে পড়া অবশ্যম্ভাবী। আর আটকে পড়লেও শৌভিককে বলতে পারব না, একটু পুলিশকে বলে দে। বললেই "তোকে ছটায় বেরোতে বলেছিলাম না", বলে কানমলা জুটবে কপালে। ড্রাইভারও দেখছি ফোন করেই যাচ্ছে, ওর অন্য চিন্তা, অবরোধ না হলেও কেউ যদি ইঁট ছোঁড়ে। একটা কাঁচ ভাঙলেই তো মালিক ওকে আস্ত রাখবে না। 


আচমকা শাঁ করে একটা বাইক বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে, ড্রাইভার ও লাফিয়ে উঠে বসল সিটে। সামনের এক পরিচিতের বাড়ির সামনে বাইকটা রেখে, দৌড়ে এল ছেলেটি, ঘড়িতে সাতটা ছেচল্লিশ। ড্রাইভারকে ইশারায় বললাম চলমান অশরীরী হয়ে পঞ্চম গিয়ারে গাড়ি ছোটাও বাবা। হেভিওয়েটরা রাস্তায় নামার আগেই ঢুকে পড়তে হবে অফিসের নিরাপদ গণ্ডিতে। এখুনি ফোন করবেন তিনি, " কি রে পৌঁছাতে পেরেছিস -?" জবাব মনোমত না হলেই গান ধরবেন তিনি, "তোকে বলেছিলাম না ছটায় বেরোতে -"।



অনির ডাইরি ২০শে আগস্ট, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। এমনিতেই আজ বড্ড দেরী করে ফেলেছি, তারওপর শ্রীমতী তুত্তুরী গম্ভীর ভাবে এসে বললেন, " মা তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।" 

আসলে সব দোষ শৌভিকের, রোজ আমায় গুঁতিয়ে বাড়ি থেকে বের করে, তারপর নিজে অফিস যায়। আজ দীঘাতে কিসের যেন মিটিং, তাই তিনি সাতসকালে বেরিয়ে গেছেন। বর আপিসে, মেয়ে ইস্কুলে, আমি মনের আনন্দে ছায়া যুদ্ধ করছিলাম এতক্ষণ। ঠিক কি করলে বেরিয়ে আসবে পেটের খবর, শূলে চড়ানো ভালো নাকি মুখে আলকাতরা মাখিয়ে গাধার পিঠে চাপিয়ে নগর পরিক্রমা করা ভালো ইত্যাদি প্রভৃতি। প্রতিবার যুদ্ধ শেষে সেই হেরেই যাই দূর। নিজেকে বড় অকিঞ্চিৎকর, অবলা বলে মনে হয়।


সেই অকিঞ্চিৎকর আমি, ক্ষুদ্র আমি, নিজের খণ্ড- বিখণ্ডিত টুকরো গুলোকে জোড়া তাড়া দিয়ে সবে আপিস বেরোব, এমন সময় কন্যার এহেন আবেদন। আজ তাঁর ভূগোল পরীক্ষা ছিল। কাল রাতে তিনি,' "ভারখায়নস্ক" এর বানান মুখস্থ করিয়ে দাও' বলে প্রচুর জ্বালিয়েছিলেন আমায়। ভাবলাম সেই সংক্রান্ত বার্তালাপই হবে। চট জলদি ভাত বাড়তে বাড়তে বললাম, " বল না, বল। পরীক্ষা ভালো হয়নি, এই তো?" 


তিনি গম্ভীর ভাবে জবাব দিলেন, "না। তাহলে তোমায় বলতাম না। সক্কাল সক্কাল তুমি আমায়  ঠেঙিয়ে অফিস যাও এটা দুজনের কারো কাছেই অভিপ্রেত নয়।" গোগ্রাসে মুখে ভাতের গ্রাস ঢোকাতে ঢোকাতে ভাবলাম, কথাটা ঠিকই। শব্দ বের করার মত অবস্থা নয় মুখের, ইশারায় জানতে চাইলাম, "তবে?" 


তুত্তুরী বলল, " আজ কয়েকটা ছেলে আলোচনা করছিল, ওই কেসটা নিয়ে।" কোন কেস প্রশ্ন করার আগেই, তিনি জবাব দিলেন, "আরজি কর।" চিবোতে চিবোতে ভ্রু কুঁচকে গেল আমার। আলোচনা করতেই পারে। করাই উচিৎ, ধামাচাপা না দিয়ে সচেতন এবং সংবেদনশীল হওয়া সকলেরই প্রয়োজন। তুত্তুরী বলল, " সংবেদনশীল আলোচনা করলে, আমি তোমায় এই অবস্থায় আটকাতাম না। ওরা হাসাহাসি করছিল, প্রাইভেট পার্টে, সিমেন পাওয়া গেছে বলে।" 


চিবোতে ভুলে গেলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য। চোখের সামনে ভেসে উঠল, গতকাল পাশের দেশের এক ভদ্রলোকের পোস্ট, " গত ২৪ ঘন্টায় পর্ন সাইটগুলিতে ভারতের সবচেয়ে বেশি সার্চ করা নাম হল "মৌমিতা" । পড়ে বিশ্বাস হয়নি, বড় বেশী ছিদ্রন্বেষী ওরা। আমাদের দেশের, আমার ধর্মের সবকিছুতে দোষ ধরাই যেন ওদের একমাত্র বিনোদন। কিন্তু আজ মেয়ের মুখে এই কথা শুনে, বুঝতে পারলাম না, কি ভাবব আর কিই বা বলব। 


আমাকে নীরব দেখে তুত্তুরী বলল, "আমি প্রতিবাদ করেছি মা। সটান উঠে গিয়ে ইংরেজিতে বললাম, ' কোথায় কি বলতে হয় যদি সেই বুদ্ধি ঘটে না থেকে থাকে,তাহলে মুখটা বন্ধ রাখলেই তো পারিস। ঈশ্বর না করুন, কাল তোর কোন প্রিয়জনের সাথে হলে, এমনি হাসতে পারবি তো?" 


নীরব থাকি, কি বলব বুঝতে পারি না। মেয়ে বলে চলে, " ওরা কি বোঝে না, ওদের মা, দিদি, বোন কেউ নিরাপদ নয়।" ঠাকুমা, দিদিমাটা সংযোজন করি আমি। তুত্তুরী বলে, " তিন মাসের বাচ্ছাদেরও ছাড়ে না এরা।" নীরবে মুখ ধুই। টিফিন বাক্স ব্যাগে ভরি। এবার বেরোতেই হবে। এক চোখে আগুন, অন্য চোখে জল নিয়ে কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে থাকে তুত্তুরী। 


তারপর বলে, " একটা লোকের ভ্লগ আমি খুব দেখি, সে নানা কারেন্ট ইস্যু নিয়ে কনটেন্ট বানায়। মূলত এনিমেশন। কাল দেখলাম নির্ভয়া আর তিলোত্তমার কথপোকথন। নির্ভয়া তিলোত্তমাকে প্রশ্ন করে, " ভয় লাগছে না তো?" তিলোত্তমা বলে, " ভয় তো ওই কমিউনিটি রুমে লাগছিল। এখন তো আমি মুক্ত।" ভ্যাঁ  করে কেঁদে ফেলি আমি, যেমন এই মুহূর্তে ছাপিয়ে যাচ্ছে চোখ। 


গলা ভেঙে যায় তুত্তুরীরও। তবু থামে না, " তিলোত্তমা বলে, " কত লোক আমার জন্য কাঁদছে, প্রতিবাদ করছে।" নির্ভয়া বলে, " সে তো দুদিনের ব্যাপার। তারপর সবাই একদিন ভুলে যাবে।" মাঝপথে থামিয়ে তিলোত্তমা বলে ওঠে, " তোমায় তো ভোলেনি। " নির্ভয়া জবাব দেয়, " আমার বিচার পেতে সাত বছর লেগেছিল। তাও তো আমার অপরাধীরা মামুলী বাস কন্ডাক্টর ছিল, আর তোমার -"। এটা দেখার পর থেকে আরো কষ্ট হচ্ছে মা। ভেবেছিলাম আমাদের প্রজন্ম একটু ভিন্ন প্রকৃতির। এদের কথা আর হাসি শুনে মনে হচ্ছিল, কত ভুল ছিলাম আমি। এরা কাল সবাই একেকটা পোটেনশিয়াল R হবে।" 


মেয়েকে মাঝপথে থামিয়ে বলি, " না না, এমন ভাবার দরকার নেই। ওরা অনভিজ্ঞ, পরিস্থিতির গভীরতা উপলব্ধি করতে পারেনি। কেউ বোধহয় ওদের বলেনি,ব্যাপারটা নেহাৎ রসের নয়। যেদিন এরা বাবা মা হবে, সেদিন বুঝবে।" কোমরে হাত দিয়ে জানতে চায় তুত্তুরী, "কে বলবে মা?কে বোঝাবে?" জবাব দিই, ওদের মায়েদেরই সর্বপ্রথম বলা উচিৎ। তারাও নির্ঘাত সোশ্যাল মিডিয়ায় DP কালো করেছে, হয়তো কেউ কেউ মাঝ রাত দখল করতেও গেছে। ঘরে ছেলেটাকে বোঝাবার প্রয়োজন বোধ করেনি। এই আর কি- "।


তুত্তুরী হেসে বলে, " সেদিন অন্য একটা বন্ধু বলল,সে মাকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিল, তার মা বলেছে, যা হচ্ছে হোক, তুমি পড়াশোনায় মন দাও। তোমার এখন এসব জানার দরকার নেই।" অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর দাঁড়ানোর সময় নেই। মেয়ের হাত ছাড়িয়ে জুতো পরতে যাই, পরতে পরতে ভাবি, ধামাচাপা দিতে দিতেই শেষ হয়ে গেল প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কার যেন লাজ নেই, দেখুন্তির লাজ।।


অনির ডাইরি ১৯শে আগস্ট, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি #চুঁচুড়ারদিনগুলি

 #বুনো_তেউড়ির_ফুল


বেশ কটা বছর কলকাতায় কাটিয়ে নতুন করে যখন জেলায় পোস্টিং হল, ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। বেশ বুঝতে পারছিলাম মহানগর আমায় মরচে পড়িয়ে, পচিয়ে দিয়েছে। ফিল্ডের কাজ সব ভুলে গেছি আমি। একটাই আশ্বাস, শৌভিকও আছে ওই জেলায়, যদিও আলাদা আপিস, ভিন্ন দপ্তর। তাও, কেউ তো রইল পাশে। ২রা জানুয়ারি ২০১৭, শৌভিক এর সঙ্গেই প্রথম চুঁচুড়ায় পা রাখলাম আমি। 


আমাদের আপিসের গাড়িটা গিয়ে ওর অফিস থেকে আমায় নিয়ে এল আঞ্চলিক শ্রমদপ্তর চুঁচুড়ায়। আপিসে পা দিয়ে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, এটা আপিস? পুরসভার পিছনের বন্ধ গেটের ফাঁক দিয়ে গলে ঢুকতে হয়, একটা ডাম্প ধরা দোতলা বাড়ি। যার ওপরের তলায় পুরসভার ড্রাইভারদের রেস্ট রুম, নীচে তিনটি পুঁচকে ঘর নিয়ে আপিস। দুই অফিসারের বরাদ্দ একটাই ঘর। পাশেই মস্ত সুইমিং পুল, বিকাল হলেই সেখানে সুন্দরী মা আর তাদের দুষ্টু পুঁচকেদের ভিড়। সম্মিলিত কলকাকলিতে আপিস করাই দায়। 


মন খারাপ করে বসে আছি ফাঁকা আপিসে, জানলার বাইরে ফাঁকা সুইমিং পুলের জলে খেলছে শীতের রোদ, চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকাতেই দেখি, এক গাল হাসি নিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। বয়স আমারই বয়সী কি কিছুটা ছোটই হবে, কৃষ্ণবর্ণ, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল, গালে দিন কয়েকের না কামানো দাড়ি। পরনে পোলো নেক টিশার্ট আর প্যান্ট। চোখে চোখ পড়তেই, প্রবল চিৎকার করে বলে উঠল, "ম্যাডাম, আসব?" অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকে নিজের পরিচয় দিল ছেলেটি, "ম্যাডাম আমি ধীমান। আপনার পিওন।" অতঃপর, " আমি আপনাকে আগে থেকে চিনি ম্যাডাম। আমিও হেড আপিসে কিছু দিন ছিলাম। আপনি আসছেন শুনে এরা সবাই ভয় পাচ্ছে, আমি কিন্তু প্রথম থেকেই বলছি, ম্যাডাম খুব ভালো।" 


ধীমানের সাথে আমার এভাবেই পরিচয়। অগোছাল আপিস, ঢিলেঢালা লোকজন, আমি আর ধীমান। বেশী দিন অবশ্য আপিসটা ওমন রইল না, জেলার মিটিং এ ডিএম সাহেবকে অনুরোধ করে, পুরাণ কালেক্টরেট এ খানিক জায়গা পাওয়া গেল। দ্রুত আপিস সরিয়ে নিলাম আমরা। পুরাণ লোকজন বদলী হয়ে এল নতুন ইন্সপেক্টরের দল। পেলাম নতুন CKCO দের। তৈরি হল টিম চুঁচুড়া। কাজ আর উৎসব আনন্দের মিলন ক্ষেত্র। আমাদের দোল, আমাদের রথের জিলিপি, আমাদের বর্ষার পিকনিক, আমাদের ঘুড়ি উৎসব, আমাদের দীপাবলী, শীতের পিকনিক থেকে আমাদের মেলা। আমরা দেখিয়ে দিলাম সরকারী আপিস এমনও হয়। আর এই টিমের একজন অতি সক্রিয় তথা নির্ভরশীল সদস্য ধীমান। 


এক পুরাণ সহকর্মী একদিন শুধাল, "ধীমান নিয়মিত অফিস, টফিস আসে?" অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কেন? মোটামুটি নিয়মিতই তো অফিস করে ধীমান। মাঝে মধ্যে টুকটাক ছুটি তো আমরা সবাই নিই। তৎকালীন বড় সাহেবের ভাষায়, "ওটা কাজে ফাঁকি মারা নয়, ওটা self indulgence।"এটুকু আস্কারা তো দিয়েই হয় মনকে। সহকর্মী ঠোঁট বেকিয়ে বললে, " ও বাবা, ধীমানকে তুমি জানো না। কলকাতা থেকে বদলি হয়ে আসার পর, ওকে খুঁজেই পাওয়া যেত না অফিসে। তোমার পূর্বসুরী তো নিয়মিত নালিশ করত ডিএলসি সাহেবের কাছে। মিটিং ও হয়েছে ওকে নিয়ে একাধিক বার।" 


হতবাক হয়ে গেলাম, তাই নাকি। আমার অভিজ্ঞতা তো সম্পূর্ণ ভিন্ন রে ভাই। ধীমানকে একদিন ডেকে জিজ্ঞাসাই করে বসলাম, এমন হয়েছিল নাকি? তুমি সত্যি আপিস আসতে না নাকি মিথ্যে বদনাম দিচ্ছে লোকে? ধীমান মাথা চুলকে টুলকে বলল, " আপনাকে সত্যি বলছি ম্যাডাম, আমার অফিস আসতে ইচ্ছে করত না। পুরাণ অফিসটা আপনি দেখেছেন তো? বসার জায়গা ছিল না। কেউ না এলে তার জায়গায় একটু বসতাম, নাহলে কাঁহা তক বাইরে বাইরে ঘোরা যায়? বর্ষায় সাপ বেরোত, বাইরের দেওয়াল দিয়ে কাঁকড়া বিছে ঘুরে বেড়াত। কোন কাজও থাকত না করার মত। বিরক্ত হয়ে বাড়ি চলে যেতাম। কিন্তু আপনাকে কি নালিশের কোন সুযোগ দিয়েছি বলুন?"


আমাকে না দিলেও, দুদিন বাদেই জেলা প্রশাসনকে নালিশের সুযোগ করে দিল ধীমান। চন্দননগরের যে সরকারী আবাসনে সপরিবারে থাকত, তার প্রতিবেশীরা নিত্য রাত দুপুরে ধীমানের হল্লায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে নালিশ করলে তৎকালীন চন্দননগরের মহকুমা শাসকের কাছে। শৌভিক মারফৎ অনুরোধ এল আমার কাছে, যেহেতু ধীমানের বেতন আমার সইতে হয়, সেই অধিকারে যদি ওকে একটু কড়কে দিই আমি। ব্যাপারটা এতোই ব্যক্তিগত, কি ভাবে যে এর মধ্যে ঢুকি ভাবতেই সময় লাগল দিন দুয়েক। তারপর একদিন ডেকে বললাম, " ধীমান তোমার জন্য আমায় ওসি ইলেকশন সাহেবের( শৌভিক) কাছে এত কথা শুনতে হয়েছে। প্লিজ এরকম করো না।" ব্যাস ওই টুকুই। 


চুঁচুড়ার চার বছর দশ মাসে আর কখনও চন্দননগর থেকে কোন নালিশ আসেনি। চুঁচুড়া থেকে অবশ্য এসেছে, ভুরি ভুরি। পিকনিক থাকলে,মেলার শেষ রাতে সবাই বিদেয় নিলে বেসামাল হত বটে ধীমান। কালী আর কারণ দুইই ছিল ধীমানের চূড়ান্ত দুর্বলতা। নিষেধ করলে লাল চোখে, এক গলা জিভ বার করে,কান চুলকে কিরে করত, " আর হবে না ম্যাডাম।" তারপর আবার যেই কে সেই। 


ধীমানের একটা বিরাট গুণ ছিল, ব্যাটা চাইলেই ফেলুদা বা কিরীটি হতে পারত। আমি এবং আমার RLO ইন্সপেক্টর কৌশিক নিত্যদিন কিছু না কিছু হারাতাম, আর সে সব হারানো জিনিস খুঁজে বার করতে ধীমান ছিল তুলনাহীন।


দেখতে দেখতে বেজে গেল বিদায়ের ঘণ্টা। চুঁচুড়ার পাট চুকিয়ে যেদিন তমলুক রওনা দিচ্ছি, খুব কেঁদেছিল ধীমান। "জিনিস পত্র সামলে রাখবেন ম্যাডাম। আমি তো থাকব না, কে আপনার চশমা, ছাতা, পেন, বাথরুমের চাবি খুঁজে দেবে ওখানে -"। নতুন অফিসে জয়েন করার পর ফোন করে মনে করিয়ে দিয়েছিল, " ম্যাডাম এবার কিন্তু আর ব্যাংক ট্রেজারিতে ফুল সিগনেচার পাঠাবেন না। বড় কষ্ট হত এখানে আপনার সই করতে -"। 


 আজ সকালে যখন ফোনটা এল, তড়িঘড়ি তুত্তুরীকে স্কুল থেকে আনতে বেরোচ্ছি আমি। যে জুনিয়র ভাই ফোনটা করেছিল, সে নেহাৎ খেজুর করতে ফোন করে না। তাই দুদণ্ড থমকে দাঁড়ালাম, ছেলেটি গলা ঝেড়ে বলল, " দিদি তোমাকে একটা বাজে খবর দিই, ধীমান বাবু আর নেই।" নেই মানে? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না যেন, কোথায় গেল? মদ খেয়ে কোথাও পড়ে আছে নির্ঘাত।  যা কালী ভক্ত, কোন মায়ের মন্দিরের খবর পেয়েছে হয়তো, দেখো সেখানেই গেছে নির্ঘাত। ভাইটি আবার বলল, " না দিদি, ধীমান বাবু মারা গেছেন।"


এমনিতেই এমন ভারী আবহাওয়া, দম বন্ধ করা পরিস্থিতি, "তোমার নাম, আমার নাম, আরজি কর",ওদিকে ঝাড়গ্রামে গর্ভবতী হাতির জঠরে জ্বলন্ত অগ্নি শলাকা,সবার ওপরে ধীমানের এই ভাবে চলে যাওয়া। এও কি সম্ভব? কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হল, বধির হয়ে পড়েছি বুঝি, কি বলছে ছেলেটা ফোনের ওপারে, একটা কথাও কানে ঢুকছে না।  চোখের সামনে যেন ঝুলছে ঝাপসা মোটা একটা পর্দা। কানের কাছে বাজছে একজনের উদাত্ত কন্ঠস্বর, " আপনিই বলুন ম্যাডাম,আমি কি আপনাকে নালিশের কোন সুযোগ দিয়েছি?"



অনির ডাইরি ১১ই আগস্ট, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন, চলছে এক সার্বভৌম দেশে। তাতে কি? এই নিয়ে বিশেষ(ভাবেঅ)জ্ঞ অভিমত দিতে আপনি বাধ্য। আপনি বলুন, আপনি এর পক্ষে কি না। ক্ষমতা থাকলে "না" বলে দেখান দিকি। একি আপনার চায়ের দোকানের ঠেক পেয়েছেন নাকি, যেখানে বিরুদ্ধ মত চলবে? হুঁ হুঁ বাওয়া এহল আধুনিক গণ মাধ্যম। আবহাওয়া বুঝে হাওয়া মোরগ হওয়াটাই এখানে দস্তুর। 


তবে ঘাবড়াবেন না, এখানে হাওয়া বদলাতে দেরী লাগে না। অয় দেখুন, আপনার দেশ বিরোধী মন্তব্য করছে কেউ। আসুন, আসুন দল বেঁধে আসুন, দেশের সম্মান রক্ষার্থে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। "কে বা আগে প্রাণ -" মার্কা একখান ঝক্কাস আগুনে লেখা নামান। না পারলেও চিন্তা কি, নিজ গৃহের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে কাল্পনিক তরোয়াল নিয়ে নেমে পড়ুন কমেন্ট যুদ্ধে। প্রতিপক্ষ দারুণ দমদার। ওরাও গুলি কামান ছুঁড়ছে আমারও ছুঁড়ি। কেউ যদি বলতে আসে, " তুমি অধম বলিয়া, আমি উত্তম হইব না কেন" তার কাঁথায় আগুন। 


দাঁড়ান, দাঁড়ান বাজারে লতুন টপিক আইছে। কি সব লুটপাট করছে ওরা। সুন্দর সুন্দর মামনির দল হাসি মুখে ছুটছে সুটকেস ভর্তি বামাল সমেত। হাঁস চুরি করছে, মাছ চুরি করছে, অবলা হরিণ গুলোকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, মায় অন্তর্বাস ও। উফ্, লেখার থুড়ি ঝগড়া করার কত কত উপাদান। নেমে পড়ুন ওদের পিতৃ পরিচয় বিশ্লেষণ করতে। লিখে ফেলুন, ওদের আম্মুকে কি করেছিলেন আপনি। আরে দাদা, ওই লোকটা তো আপনারই সমবয়সী, তাহলে ওর আম্মুকে ইয়ে করলেন কবে? ভূমিষ্ঠ হবার পূর্বেই? এসব প্রশ্ন, কে করে রে? নির্ঘাত তার মামাবাড়ি ওই দেশে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, ঘ্যাস ঘ্যাস করে চুলকাতে চুলকাতে, ঢেউ ঢেউ করে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে, দুমদাম করে পবন নিষ্ক্রমণ করতে করতে চল ব্যাটা তোকে সীমান্ত পার করিয়ে আসি। 


উরি, উরি বাবা। এসব কি আসছে মার্কেটে, ওসব চুরি টুরি ছাড়ুন, ওরা ওদের রাষ্ট্রনায়কের মূর্তি ভাঙছে গো। মাথায় উঠে আক্ষরিক অর্থে মুতে দিচ্ছে মাইরি। এসব দেখে যদি আপনার নিস্তরঙ্গ একঘেঁয়ে জীবনে আগুন না লাগে, তাহলে এই শিক্ষিত বঙ্গ সমাজ কি আপনাকে মেনে লিবে? শিক্ষিত মানে মস্ত মস্ত ডিগ্রী লয় দাদা, জানেন নি, সোশ্যাল মিডিয়ায় একাউন্ট থাকলেই আজকাল আপনে শিক্ষিত। যদি কেউ বলতে আসে, ভাই রে ওটা সার্বভৌম রাষ্ট্র, তার কাঁথায় আগুন। সীমান্ত পার, সীমান্ত পার ছাড়া এদের কোন শাস্তি হতেই পারে না। 


উত্তেজনার পাহাড় থিতু হবার আগেই, মার্কেটে এসে পড়ল ওপারের হিন্দুদের দুরবস্থা। সমধর্মের মানুষের জন্য আপনার, আমার প্রাণ কাঁদবেই। চলুন তাদের পাশে দাঁড়াই। চলা মানে সত্যি সত্যিই চলা ভাবলেন নাকি? কোথাকার আ ইয়ে মাইরি আপনি। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব আছে কি করতে। যেখানে যেখানে আপনার একাউন্ট আছে লিখুন, #SaveBangladeshiHindus । ব্যাস? হয়ে গেল? আপনার এই লেখা পড়বে এবং অন্য কেউ যাবে ওদের বাঁচাতে? নাকি কাল পর্যন্ত যাদের আম্মু তুলে খিস্তি দিলেন, আপনার কলম নির্গত অগ্নি বাণে রাতারাতি চিত্তশুদ্ধি হবে তাদের? আর আপনি কি করবেন? আরো অগ্নিবাণ বানাবেন? 


কি হল? ও মশাই? আপনার আগুনে বাণ এমন সেঁতিয়ে গেল কেন? অ বুদ্ধবাবু মারা গেছেন তাই? এটাই আপাতত হেপ এবং হ্যাপেনিং? কাঁদতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়া ভাসিয়ে দিতে হবে চোখের জলে। লিখতে হবে কমরেড লাল সেলাম। সত্যি মাইরি। এত সমর্থন, এত সমবেদনা যে এত জনের হৃদয়ে লুক্কায়িত ছিল নির্বাচনী ফলাফলে যে কেন বোঝা গেল না। যাকগে, কিন্তু ওই বাংলাদেশী হিন্দু গুলোর কি হল? ওদের বাঁচাবেন না? কি কইছেন? বাজারে নতুন হাওয়া? ও আরজি কর? এবার ওটা নিয়ে নামাতে হবে? এবার ওটার বিচার চাই? যতক্ষণ না পরের উত্তেজক ঘটনাবলী আমাদের হিলিয়ে দেয়, তাই তো? বড়িয়া হ্যায়। দাদা/ দিদি সিম্পলি বড়িয়া হ্যায়।


অনির ডাইরি ৬ই আগস্ট, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


প্রায় এক যুগ আগের কথা। জনৈক সহকর্মী প্রায় দিনই ওই দেশটার প্রশংসা করতেন।  হুগলী জেলার খানদানি মুসলমান। ১৯৪৬-৪৭ এর দাঙ্গায় ওনার দাদা ( পিতামহের) দোকানে আগুন লাগানো হয়, তাই বলে দেশ ছেড়ে যাবার কথা কখনও ভাবেননি ওনাদের পরিবার। সত্তরের দশকে ওনার এক ভাই প্রথম সীমানা টপকান, কিছু দিন বাদে বিবাহ সূত্রে ওপারে রওনা দেয় ওনার বোনও। দুই ভাইবোনই ওখানে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের সূত্রেই ভদ্রলোকের ওই দেশে যাতায়াত। 


ভদ্রলোক আমারই মত ছাপোষা সরকারী নৌকর, সীমান্তপারে ভাইবোনের আর্থিক স্বচ্ছলতায়, প্রাচুর্যে উনি গর্বিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, নিছক ভাষার জন্য সৃষ্ট একটা দেশের প্রতি ভদ্রলোকের ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সেটাই ভাগ করে নিতেন আমার সাথে। মুস্কিল হল, আমার পিতৃকুল - মাতৃকুলে কেউ কোন দিন ওদিকের বাসিন্দা ছিল না। আমি জন্ম থেকেই মোহনবাগানের মেয়ে। প্রশংসনীয় দেশটা আমার কাছে নিছক এক প্রতিবেশী দেশ মাত্র।  গল্প শুনতে বসে আলাদা কোন আবেগ আমার আসত না। তাও শুনতাম, কারণ ভদ্রলোক গল্প বলতেন বেড়ে। আর সীমানার দুই পাড়ে থেকেও ওনাদের ভাইবোনদের একে অপরের প্রতি টান আর ভালবাসা আমায় মুগ্ধ করত। 


একদিন টিফিন টাইমে এমনি উত্তাল প্রশংসার ঝড় উঠেছে, উনি বললেন, " বুঝলেন ম্যাডাম, সীমানা পেরোলেই জুড়িয়ে যাবে চোখ। সব সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা আর গ্রাম বাংলার এমন সুন্দর শ্যামল রূপ -"। মাঝপথে হঠাৎ কি মনে হল, জিজ্ঞাসা করলাম, " আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, দেশভাগের পর ওপার থেকে আসা হিন্দুদের এখানে যেমন বাঙাল বলা হয়, তেমন এপার থেকে যাওয়া মুসলমানদের কি বলে ওরা?" 


ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ থতমত খেলেন, তারপর জবাব দিলেন, "ইন্ডিয়ান"। হেসে উঠি আমি, " বলেন কি? ইন্ডিয়ার সঙ্গে ঝগড়া করে ভেন্ন হয়ে, শেষে ইন্ডিয়ান?" ভদ্রলোক বিমর্ষ ভাবে মাথা নাড়ান। " হ্যাঁ গো। খুব তাচ্ছিল্য করে ওরা এই ইন্ডিয়ানদের। আমার ভাই বোনকে এই পরিচয় লুকাতে অনেক মেহনত করতে হয়েছিল। কেউ আজকাল তাই স্বীকার করে না যে এদিক থেকে সীমান্ত পেরিয়ে গেছে।" 


খানিক চুপ করে বসে থাকি আমি, দম নিই তারপর বলি, " আর এদেশে? তিনপুরুষ এই দেশের অন্ন জল বাতাসে লালিত পালিত হয়েও, লোকে দাবী করে যে তারা আসলে ফরিদপুর বা বরিশালের লোক। সদম্ভে ঘোষণা করে, তারা উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন এই দেশে। এই দেশের কি কোন তুলনা হয় মশাই?"