Friday 5 July 2024

অনির ডাইরি জুলাই, ২০২৪

অনির ডাইরি ২৬শে জুলাই, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 


যদি শুধান জীবনের সংজ্ঞা কি, তো আমি বলব, "life is a journey, from one celebration to another." অন্তত আমার কাছে তো তাই। মাথার মধ্যে সবসময় গুণগুণ করে হরেক রকম পরিকল্পনা। যেমন ধরুন,  আমাদের বিবাহবার্ষিকীর পরদিন থেকেই আমি মশগুল হয়ে পড়ি শ্রীমতী তুত্তুরীর জন্মদিনের আকাঙ্ক্ষায়। মনে মনে চলে হাজার হিসেব নিকেশ। কি দেব মেয়েটাকে, কি রাঁধব মেয়েটার জন্মদিনে ইত্যাদি প্রভৃতি। আর সেলিব্রেশনের ব্যাপারে মুকেশ আম্বানিই আমার আদর্শ। আহা, হতেই পারে উনি শশধর আর আমি মামুলী শশক, তাই বলে কি শখ থাকবে না, নাকি।


আমাজন থেকে প্রথম উপহারটা যখন এল, তখনও জন্মদিন আসতে এক মাসেরও বেশি দেরী। বেশ অনেক দিন ধরে দেখে শুনে, রিভিউ পড়ে অর্ডার করলাম। একটু সাধ্যের বাইরেই হয়ে গেল বুঝি। আচ্ছা কুরিয়রওয়ালা যদি আপন মনে করে নিয়ে নেয়! কি হবে? এই ভেবে তিন চার রাত ঘুমই এল না আমার। নির্দিষ্ট দিনে কুরিয়রের ছেলেটা যখন ফোন করে বলল, " ওটিপি-টা বলুন ম্যাডাম। প্যাকেজটা বাংলোর সিকিউরিটিকে দিয়ে দিয়েছি-" বিশ্বাসই হল না যেন। যতক্ষণ না সিকিউরিটি ছেলেটি ফোন ধরে আশ্বস্ত করল। বাড়ি ফিরে ভয়ে ভয়ে প্যাকেট খুলে তবে শান্তি। শ্রীমতী  তুত্তুরীর নাকের ডগা দিয়ে ওর জন্মদিনের উপহার আলমারিতে তুলে রাখলাম আমি। তিনি জানতেও পারলেন না, যে এবারের পার্সেলটা তাঁর জন্য এসেছে, আমার না।


দ্বিতীয় উপহারের বেলায় অবশ্য তাঁকে বোকা বানানো গেল না। আমি অফিস থেকে ফেরার সাথে সাথেই তিনি আমার পিছন পিছন নেচে নেচে ঘুরতে লাগলেন। " মা আজ যে পার্সেলটা এসেছে না, ওতে কি আছে? কেমন যেন নরম নরম লাগল।" চালে ভুল করলাম, যখন বললাম, " আমি জানি না। বাবা কিছু অর্ডার দিয়েছে হয়তো।" তিনি বললেন, " উঁহু, প্যাকেটে তোমার নাম লেখা।" সে যাত্রা অবশ্য উদ্ধার করেছিল শৌভিকই, বলেছিল ওতে হ্যান্ড টাওয়েল আছে। " তোর জন্মদিনে আমরা বাথরুমে নতুন হ্যান্ড টাওয়েল ঝোলাব।"


দেখতে দেখতে এসেই গেল দিনটা। আগের দিন সকালে লিস্ট করে ধরিয়ে দিলাম বাংলোয় বাজার করে যে ছেলেটি তাকে। দুটো রেড ভেলভেট পেস্ট্রি আনবে। মোমবাতি একেবারে আনবে না। কি শখে যে আফগানি সেন্টেড ক্যান্ডেল গুলো কিনেছিলাম, লেখা ছিল জ্বাললেই হৃদয়ে তুফান উঠবে। আদতে দেখলাম জ্বালালেই আমার বরের হাঁচি শুরু হয়ে যায়। ওরই মধ্যে একটা জ্বালিয়ে দেব ক্ষণ। বললাম বেলুন আনবে একটু বেশি করে। আমার আধবুড়ি মেয়ে এখনও বেলুন দেখে গলে যায়। 


আনবে তো সই, কিন্তু তাঁর নজর এড়িয়ে ফোলাবে কে? ঘর সাজানোই বা হবে কি করে? তিনি জেনে গেলে তো আর সারপ্রাইজ থাকবে না  ব্যাপারটা। অগত্যা আগের দিন সকালে বসে বসে প্রচুর হোমওয়ার্ক দিলাম। তলায় গোটা গোটা করে লিখে দিলাম, সাড়ে নটার মধ্যে শেষ না করলে, কেটেই ফেলব। যতক্ষণ না হোমওয়ার্ক শেষ হচ্ছে, ঘর থেকে বেরোবি না। 


অফিস থেকে ফিরে, কোন মতে এক কাপ কফি খেয়ে, বাইরের ঘরের দরজায় আগল দিয়ে, পর্দা টেনে নামলাম বেলুন ফোলাতে। জীবনে হ্যাপি বার্থডে লেখা বেলুন ফোলাইনি, সে যে কি ঝঞ্ঝাট।  রাতের রান্না করে যে ছেলেটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সাহায্য করতে এল,  তাই না সাড়ে নটার মধ্যে শেষ হল ব্যাপারটা। ইতিমধ্যে যে কতবার দরজা খটখট করে গেছে তুত্তুরী তার ইয়োত্তা নেই। প্রবেশের অনুমতি কিছুতেই মেলেনি। হয়ে যাবার পরও বাইরে থেকে দরজায় ছিটকানি আটকে রাখলাম। অর্থাৎ শ্রীমতী তুত্তুরীর প্রবেশ নিষেধ (আপাতত)। 


দেখতে দেখতে এসে গেল মধ্যরাত। তখনও গ্যাসে ফুটছে পায়েস, ভাপা দইয়ের জল আর কিছুতেই মরছে না। সারাদিনের পরিশ্রমে বেঁকে যেতে চাইছে পিঠ আর কোমর। তবে ওই যে বললাম মুকেশ জীই আমার আদর্শ। তাঁকে স্মরণ করে, টেবিলের ওপর সাজিয়ে দিলাম পুঁচকে পেস্ট্রি, জ্বালিয়ে দিলাম সুরভিত মোমবাতি। আজ যদি শৌভিক হেঁচেছে তো ওরই একদিন কি আমার একদিন। এক পাশে যত্ন করে সাজালাম আমার আর শৌভিকের দেওয়া উপহার গুলি। এবার অপেক্ষা কেবল তাঁর জন্য। 


শৌভিককে বলে এলাম, আমি ঘর অন্ধকার করে অপেক্ষা করছি, তুই মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে আয়। কাঁপা কাঁপা মোমবাতির আলোয়, প্রায় অন্ধকার ঘরে ক্যামেরা চালিয়ে অপেক্ষা করছি আমি, দরজা খুলল, "হ্যাপি বা -" বলে চিৎকার করে বাকিটা গিলে নিলাম।ক্ষুদেটা কোথায়? এতো ধেড়েটা এসেছে ল্যাপটপ রাখতে। উফ ভগবান! এত কিছুর মাঝে একটা কাজ দিয়েছিলাম, সেটাও করেনি। বিস্তর ধমক খেয়ে মাথা চুলকে শৌভিক বলল, "অ, তুই আমাকে ওকে ডেকে আনতে বলেছিলি! আমি ভাবলাম, কি যে ভাবলাম -"। মাঝপথে আমার রুদ্র মূর্তি দেখে থতমত খেয়ে, " এই তো যাচ্ছি। এখুনি ডেকে আনছি -"। 


অতঃপর তিনি এলেন এবং -


অনির ডাইরি ২৫শে জুলাই, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



লোকটা বলল, "জানেন ম্যাডাম, আমার মনটা খুব খারাপ।" কি যেন ভাবছিলাম গভীর ভাবে, কিন্তু কেউ এমন বললে শুধাতেই হয়, কেন, কি হয়েছে ইত্যাদি। জবাবে লোকটা ম্রিয়মাণ হয়ে বলল, "মেয়েটার শরীরটা একদম ভালো নেই।"


 লোকটা গ্রামে থাকে।  পেটের টানে শহরে আসে। কর্মসূত্রেই আমার সাথে পরিচয়। কিছু জমিজমা আছে, পুকুর আছে। মাঝে মাঝেই বাগানের আখ, শাক, উচ্ছে, থানকুনি পাতা, পুকুরের জ্যান্ত শোল, মৌরলা মাছ নিয়ে আসে আমার জন্য। নিষেধ করলে, বকলে দুঃখ পায়। বদলে লতা দি বাগানের চারটি আম, গাছের কাঁঠাল, ভাঙ্গানো কাজু  এইসব টুকটাক ভরে দেয় লোকটার ব্যাগে। আমি নিজে দিতে গিয়ে দেখেছি ভয়ানক অস্বস্তিতে ভোগে লোকটা। 


কর্মসূত্রে দিনের বেশ অনেকটা সময় এক সাথে কাটাতে হয়। মনের না না দুঃখের কথা এই সময় শোনায় লোকটা। বাবা মায়ের আটকে যাওয়া বার্ধক্য ভাতা, বর্ষায় ত্রিপল না পাওয়া, মালিকের সাথে ঝামেলা ইত্যাদি প্রভৃতি। যেখানে পারি, হস্তক্ষেপ করি, কিন্তু আমার ক্ষমতাও যে বড় সীমিত। 


লোকটার দুই সন্তান, ছেলেটার বয়স সাড়ে চার, মেয়েটা তার থেকে একটু বড়। ছেলেটা দস্যু প্রকৃতির, মেয়েটা ধীর স্থির শান্ত। ছেলেটার শতেক আব্দার, মেয়েটাকে 'বল তোর কি চাই' বললে সে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে তাকে। আমি দুটোর কাউকেই দেখিনি, সবটাই লোকটার মুখে শোনা। 


মেয়েটাকে নিয়ে লোকটার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এই কিছুদিন আগে স্কুলে আরেকটা বাচ্ছা মেয়েটির হাতের ওপর ভারী দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। কচি হাত যে ভাঙেনি এই ঈশ্বরের আশীর্বাদ। তারপর কিছুদিন পর বেপোট জ্বর আর বমি নিয়ে  হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। এখন আবার এই অগ্নিমান্দ্য। কি আর বলি, বললাম, ওর যা ভালো লাগে তাই খেতে দিন। মুখরোচক কিছু যদি খায় -


লোকটা বিমর্ষ ভাবে বলল, " সব বলেছি ম্যাডাম। কিছুতেই খেতে চাইছে না। ঘরের দুধের ঘি, বলছি ঘি ভাত খা। তো কইছে, না। টাটকা পুকুরের মাছ ধরে ভেজে দিতে চাইছি, তাও খাবে না। বলছি কি খাবি বল? ম্যাগি খাবি? চাউমিন খাবি? মাংস আনব? সবেতেই না।" 


বললাম, তাহলে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিন। পেটে কৃমি থাকতে পারে। এমনকি জন্ডিস হলেও এটা হয় দেখেছি। লোকটা চিন্তিত ভাবে বললে, " আর একটা জিনিস দেখছি। রোজ রাতে কি ভয় পাচ্ছে মেয়েটা। মাঝে মাঝেই ঘুম থেকে উঠে আমাদের কাছে চলে আসছে। আর বলছে, ' আমার খুব ভয় লাগছে।'" গল্পটা কোন দিকে গড়াচ্ছে বুঝেও, অন্য দিকে ঘোরাই, আবার বলি ডাক্তার দেখান। একটা অল্পবয়সী মেয়ে রাতে ভয় পাচ্ছে তার অনেক কারণ থাকতে পারে। মন বড় জটিল জিনিস। প্রার্থনা করি, খারাপ কিছু যেন না হয়।


পরের দিন আবার শুধাই মেয়েটার খবর। জবাব পাই একই রকম আছে। সেই খাদ্যে অনীহা, রাতে ভয়। লোকটা বলে, " বাড়ির লোক কইছে, হাওয়া বাতাস লেগিছে নির্ঘাত।" বলেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নেয় লোকটা, " আমি ওসব মানি না ম্যাডাম। বাড়ির বউ-ঝি'রা কইছে আরকি। আমি ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। ওষুধটা পাল্টে দিলে।" 


সেটা বোধহয় শুক্রবার ছিল। সোমবার অফিসে বেরিয়েছি, লোকটা বলল, " মেয়েকে ঝাড়ালাম ম্যাডাম। " মহানগরে বসে এই সব ব্যাপার নিয়ে যতটা খিল্লি করা যায়, এই পল্লী বাংলায় বসে সেটা করতে পারলাম না আমি। সবথেকে বড় কথা, মেয়েটা ওনার। শুধু শুধালাম, " মেয়েটাকে মারধর করেনি তো? মেয়েটা ভালো আছে তো? যা হয়েছে আপনাদের সামনেই হয়েছে তো? ওকে একা ছাড়েননি তো গুণীন টুনিনের সাথে -"।


মেয়েটা ভালো আছে ছাড়া সবকটার জবাবেই না বলল লোকটা। বলল, " শনিবার যা হল ম্যাডাম আপনাকে কি আর বলি। রাতে সে মেয়ে যা করতে লাগল, কেবল বলছে ভয় লাগছে। বলছে আর গোটা বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পাগলের মত ছুটছে। তখন আমি বললাম, দাঁড়াও তো দেখি। বলে দুটো লঙ্কা পুড়িয়ে যেই ধোঁয়াটা দিয়েছি, মেয়ে দৌড়ল সোজা সদর দরজার দিকে। বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে যাবে। আমার মা, বউ তাকে ধরে রাখতেই পারে না। তখন আমি করলাম কি, গেলাম ঝাঁটা নিয়ে -।" 


আঁতকে উঠি আমি, ঝাঁটা মানে? মুড়ো খ্যাংড়া? মারলেন মেয়েটাকে? লোকটা আঁতকে উঠে বলে, "না না ম্যাডাম, খেজুর পাতার ঝাড়ু। মারিনি, গায়ে বুলিয়েছি মাত্র। ঝাঁট দিবার মত করে -। তাতেই মেয়ের কি ছটফটানি, ' উরি বাবা গো, মা গো, বুকে কি ব্যথা গো '। চোখ গুলো যেন কোটর থিকে ঠেলে বেরিয়ে আসে। বাড়িতে তো কান্নার রোল উঠে গেল। সবাই আমায় এই মারে, কি সেই মারে। 'গুণিন ডাকবি কি না বল -'। 

 

ভয়ে দৌড়ালাম ওঝার কাছে। সে তো শুনে আমায় মারতে এল। বলল, মন্ত্র তন্ত্র না পড়ে কেন লঙ্কার ধুঁয়া দিছু? বলল আড়াই হাজার টাকা নিবে। আমি বললাম তাই সই। তারপর রাত তিনটের সময়, তেমাথার মোড়ে তিন ঘড়া জল দিয়ে ওকে স্নান করিয়ে, ঝাড়া হল।" মারেনি তো? আবার প্রশ্ন করি আমি। লোকটা জিভ কেটে বলে," নানা আমরা সবাই ছিলাম। ঝাড়া হতেই মেয়ে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আজ সকাল থেকে দিব্য খাচ্ছে সব।" 


তারপর কেটে গেছে বেশ অনেক গুলো দিন।রোজ শুধাই আমি, মেয়েটা কেমন আছে। খাওয়া দাওয়া করছে কি না। জবাব ইতিবাচকই আসে। আজ একটু অন্য জবাব এল। লোকটা বলল, " শরীর ঠিকই আছে, কিন্তু মেয়েটার খুব মন খারাপ। এত কানছিল আজ সকালে।" উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করি, কাঁদছিল কেন? লোকটা এক রাশ বিরক্তি চেপে বলল, " এই যে আমার ছেলেটা, একেবারে গাছ বাঁদর। ওর মা ঠিকই করে পেটায়। আজ ও কি মার মারল ছেলেটাকে।" 


বাধা দিয়ে বলি, মেয়েটার কি হল রে বাবা। লোকটা জিভ কেটে বলে, " সেটাই কইঠি ম্যাডাম। ছেলেটা এত বদমাশ, মেয়েটা যখন ঘুমাচ্ছিল, ওরই ( মেয়েটার) স্কুল ব্যাগ থেকে কাগজ কাটা কাঁচি বার করে দিয়েছে এক খাপলা চুল কেটে। একদম সামনের চুল ম্যাডাম। এমন কেটিছে পুরো টাক দেখা যাইতেছে। মেয়েটাকে ন্যাড়া করা ছাড়া কোন গতি নেই।"


ছেলেটার গুণ কীর্তন আরো কিছুক্ষণ চলত, মাঝ পথে থামিয়ে দিই আমি, বলি, " ওই যে মেয়েটার মাথা থেকে যাকে ঝেড়ে নামিয়েছেন, সেই চেপেছে ওর মাথায়। চেপেই বুঝেছে, যে কোথায় এলাম। কোনটা যে মানুষ, আর কোনটা যে ভূত। কে যে কার মাথায় চাপল।"




অনির ডাইরি ২৩শে জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


লাদাখ থেকে ফিরেই ডাকে দুই খানা চিঠি পেলাম। দুটিই এসেছে জেলা শাসকের পাবলিক গ্রিভান্স সেল থেকে। প্রথম চিঠিতে কোন এক শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধির নামে কিছু গোল গোল নালিশ লেখা। কে লিখেছে, কোথা থেকে লিখেছে কিছু লেখা নেই। অভিযোগকারী জেলা শাসককে লিখেছেন, তিনি শ্রম দপ্তর সংক্রান্ত চিঠি দেখে আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন।


 Dদ্বিতীয় চিঠিটি ও একই ব্যক্তির নামে লেখা, তবে এটি অনেক গোছানো। প্রেরক নিজের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, অন্যান্য তথ্য সহ বেশ সুন্দর করে লিখেছেন যে তিনি একজন বর্ষীয়ান নাগরিক, এককালে পেশায় নির্মাণ কর্মী ছিলেন। আমাদের দপ্তরের উপভোক্তা। নিয়মিত পেনশন পান। কিন্তু এই Rপেনশন পাবার জন্য তাঁকে নিয়মিত ঐ ব্যক্তিকে টাকা দিতে হয়। যা পান তার শতকরা বেশ বড় একKটা শতাংশ। শুধু তাই নয়, ওনার স্ত্রীও আমাদের নথিভুক্ত শ্রমিক ছিলেন, যার অকালমৃত্যুর পর মনোনীত উত্তরাধিকারী হিসেবে ভদ্রলোকের প্রাপ্য থেকেও ছেলেটি বেশ মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেছে, কারণ অফিস তথা ম্যাDডামকে দিতে হবে। 


এই অবধি পড়ে Rরীতিমত টলে গেলাম। এই মহকুমায় শ্রম দপ্তরের মাথায় যে একজন ম্যাডাম Kআছেন, তা এক অজ গাঁয়ের বুড়ো রাজমিস্ত্রির তো জানার কথা নয়। এই সব ক্ষেত্রে যা করি সাধারণত, প্রথমেই মৌখিক ভাবে বড় সাহেবকে জানালাম, অতঃপর গোপন ফাইল খুলে  গঠন করলাম এক তদন্তকারী কমিটি। লিখলাম, দেখে শুনে আগামী দশ পনেরো দিনের মধ্যে রিপোর্ট দাও দেখি। 


কি যে ভীষণ মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম সেদিন। আমি বিশ্ব হ্যাংলা। যদি বলত ম্যাডাম সিঙ্গারা জিলিপি খায়, তো সত্যিই কিছু মনে করতাম না। তাই বলে বুড়ো পেনশনারের টাকা, মরা মানুষের টাকা খাই? ছিঃ ছিঃ। বাড়ি ফিরে ঘর অন্ধকার করে বসে রইলাম খানিক ক্ষণ, শৌভিক বাড়ি ঢুকতেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কোন মতে এক হাতে আমায় জড়িয়ে, অন্য হাতে পকেট থেকে ফোন, মানিব্যাগ বার করতে করতে শৌভিক বলল, " আমার যে কি হল সে তো জানিস না। আমি গেছি দীঘা, একগাদা লোক আজ এসেছে, হাজার সমস্যা নিয়ে। মোবাইল,টিভি দেখার সুযোগই পাইনি। হঠাৎ দুপুর বেলা ডিএম সাহেবের ফোন। ' এসব কি শুনছি গো, আমি তো মাটিতে পুঁতে গেলাম।'"


Dবরকে ছেড়ে খাটে জুত করে বসি আমি, কেস তো বেশ জটিল মনে হচ্ছে। শৌভিক বলে, " শোন না, আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না। বললাম কি হয়েছে স্যার? স্যার বললেন, ' তুমি অমুক টিভি দেখো নি ?' বললাম, সকাল থেকে সময়ই তো পাইনি। স্যার বললেন, ' মোবাইলে দেখতে পারবে?'  সম্মতি জানিয়ে খুলে দেখি, তমুক পান্ডা পুরো পর্দা কাঁপাচ্ছে। কি না, মহকুমা শাসক লিখিত ভাবে অমুক কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থার কাছে বারো লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছে।" 


কি! Rছিটকে উঠি আমি। Kশৌভিক ঘাড়


নেড়ে বলে, " ভাব। এসডিও'র এমন দুর্দিন এল যে লিখিত ভাবে ঘুষ চাইতে হল। তারপর বুঝলাম, ব্যাপারটা। ওই কেন্দ্রীয় সংস্থা উপকূল বরাবর কিছু কাজ করবে। তার জন্য কিছু মানুষকে সরাতে হবে। যাদের সরানো হবে, তাদের কি হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, সেটাও ওরা জানিয়েছিল। সেই অনুযায়ী আমার বিডিও'রা হিসেব করে আমায় পাঠায়, আমি কম্পাইল করে ডিএম সাহেবকে পাঠাই। তিনি যেখানে পাঠানোর পাঠিয়ে দেন। মনে পড়ল সেটার পরিমাণ ছিল বারো লাখ বটে।" 


হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। যেমন চ্যানেল, তেমন নেতা। শৌভিক হাসতে হাসতে খানিক দাড়ি চুলকে বলে, "শোন না। কাহিনী আভি বাকি হ্যায়। আমি ডিএম সাহেবকে ফোন করে জানালাম, বারো লাখের গল্পটা। স্যার যে কি রেগে গেলেন, কি বলব। তারপর ফোন রেখে, আবার চ্যানেলটা খুলে দেখি, অন্য সুর ধরেছে আর আমার নাম করছে না। এবার স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাদের নামে চিল্লাচ্ছে, বলছে আসলে ওরাই নাকি ঘুষ চেয়েছে।"


দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম, ভাগ্যে দুজনে দুটো আলাদা আপিস তথা দপ্তরে চাকরি করি। যখনই মনে হয়, যত অখাদ্য যমের অরুচি ঘটনাবলী কি কেবল আমার সাথেই ঘটে, পাশ থেকে আশ্বস্ত করে শৌভিক, না এটা কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। আশ্বস্ত করে, সাহস দেয় ঘনিষ্ট আধিকারিক বন্ধুবান্ধবও -"এমন তো আকছার ঘটে, সাদা কালো লং শটে।"  ওপরওয়ালার নামেই তো তোলা তোলে লোকজন। 


রাত গড়ায়, দিন যায়। তদন্ত করে আসে আমার দলবল। সূর্য তখন ঢলে পড়ছে পশ্চিমে, ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে তদন্তকারীরা বলে, "একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম ম্যাডাম। গাড়ি ও যায় না। আমরা গাড়ি থেকে নেমে টোটো করে গেলাম। লোকটা একেবারে গোবেচারা প্রকৃতির। সে তো আমাদের দেখে ভয়েই অস্থির।" অপরজন বলে, " যা বুঝলাম ম্যাডাম, এরা স্কিম সম্বন্ধে কিস্যু জানে না। লাইফ সার্টিফিকেট কি তাই বোঝে না। সময়মত বেঁচে থাকার প্রমাণ দিতে পারেনি বলে ওর পেনশন আটকে গিয়েছিল। এটা এমন কিছুই নয়, গুচ্ছ গুচ্ছ এমন কেস আসে। আপনি লিখে পাঠিয়ে দিলেই বোর্ড ছেড়ে দেয়। লোকটা সেটা না জানার জন্য, দালালের খপ্পরে পড়ে ছিল।" 


বিশদে শুনতে শুনতে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে হৃদয়। বলি ডাকো দেখি বাবু বিবিদের। যোগাযোগের অভাবেই তৈরি হয়, যত অভিযোগ। এবার থেকে আমার সইয়ে যে যা সুবিধা বা অনুদান পাবে, তাকে একবার অন্তত প্রত্যক্ষ হাজিরা দিতে হবে আমার সামনে। আমি নিজে মুখে একবার বুঝিয়ে বলে দেব,  কি ভাবে প্রতি নভেম্বরে এসে জমা করতে হয় বেঁচে থাকার প্রমাণ। যদি কেউ না পারেন, তাতেও ভয় পাবার কোন কারণ নেই। আমি আছি তো। আছে আমার টিম। আর আপনার কানা কড়িটিও আমার বা আমার টিমের চাই না। আমরা শুধু চাই, আপনারা ভালো থাকুন।


অনির ডাইরি ২২শে জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



"That day can be regarded as one of the most memorable days of my school life—November 14, 2022. There was the excitement of going to school in a colorful dress and without any books, but there was also the grief of leaving my school. That was the first and last children's day and last day in my previous school, "Tamralipta Public School."


I only spent six months at that school, but everyone felt so close to my heart. Just like every other day, I reached the school at ten; the school was supposed to be over by one, unlike other days. As I walked through the corridor, I saw the students wearing colorful dresses; it seemed that they were the colorful blossoms of an orchard.


As I entered the classroom, I noticed that the class had been decorated by my classmates, mainly using balloons. I sat with my best friend Shimly and took a walk down memory lane. We were both about to cry but somehow swallowed it. I distributed chocolates among all my friends and asked them to forget all the bitter memories and together cherish the good ones.


At twelve o'clock, we were served our meal of rice and chicken curry. The happiness of eating together and all the other emotions made the meal seem tastier. Finally, the moment came that I knew would happen one day but was never ready for. I hugged my friends and touched the feet of my teachers. With a final look at my classroom, I came down the stairs and out of the gate. It has been almost two years since that day, but I still remember the smallest of details. That day was just special for me.


গত সোমবার রচনা লিখতে দিয়ে গিয়েছিলাম, "One day at school." বাধ্য ছাত্রীর মত তিনি লিখে তো রেখেছিলেন, কিন্তু তাঁর বাবার আর দেখার সময় হয়নি। বললেই বলেন, " আমি সময়টা কোথায় পাচ্ছি বল?" তা অবশ্যি ঠিক। একে মহকুমা শাসক তায় আবার ঘাড়ে চেপেছে সমুদ্র সুন্দরীর গুরুদায়িত্ব। ফলে অবসর সময় তাঁর আপাতত অত্যন্ত সীমিত। তাই বলে একটা রচনা এক সপ্তাহেও দেখে দিতে পারবে না? 


রাগ করে আজ নিজেই বসলাম চেক করতে। পড়তে পড়তে কখন যে ভিজে গেল দুই চোখ। এটা কি লিখেছে মেয়েটা। আমি যে প্রত্যক্ষ সাক্ষী সেই দিনটার। আমিই তো আনতে গিয়েছিলাম সেদিন মেয়েকে স্কুল থেকে। ট্রান্সফার সার্টিফিকেট তুলে, একরাশ উদ্বেগ নিয়ে প্রতীক্ষা করছিলাম মস্ত স্কুল বাড়িটার সামনে। ভয় পাচ্ছিলাম, কতটা কান্নাকাটি করবে মেয়েটা। প্রশান্ত মুখে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে সামান্য মাথা নীচু করে গুটগুট করে হেঁটে এল মেয়েটা। আমার হাত ধরে কয়েক পা এগিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। শেষ বারের মত ঘুরে তাকাল স্কুল বিল্ডিংটার দিকে, বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়েই রইল, বাইরে থেকে যেন নিজের ক্লাস রুমটাই খোঁজার চেষ্টা করল খানিক। তারপর একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, মাথা নেড়ে ইশারা করল, "চল যাই।" 


সন্তানের অব্যক্ত বেদনায় সেদিন হৃদয় বিদীর্ণ হলেও দুই জনের শিক্ষায় সামলে নিতে পেরেছিলাম নিজেকে এবং মেয়েকেও। প্রথম জন আমার বাবা, যিনি ছোট থেকে শিখিয়েছেন, "Look back in anger"। এগোতে গেলে, মাঝে মাঝে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই হয়। যদি না তাকাতে পারো, তাহলে আর এগোলে কোথায়? 


দ্বিতীয় জন শৌভিকের বাবা, আমার স্বর্গীয় শ্বশুরমশাই। কোন এক উঠতি লেখকের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে, একদা তিনি বলেছিলেন, " আজ যতই প্রশংসা পাক না কেন, এ ছেলে বেশী দূর যাবে না। কারণ এর জীবনে কোন দুঃখ নেই।" নিপাট, নিখাদ সুখ মানুষকে বড় ভদভদে, ম্যাদামারা করে তোলে। দুঃখ হল সেই আগুন,যা যাবতীয় খাদ গলিয়ে শুদ্ধ করে আমাদের চিন্তা এবং চেতনাকে। থাক না কিছুটা দুঃখ তুত্তুরীর ও। ভাবতে শিখুক তলিয়ে,  উপলব্ধি করতে শিখুক জীবনের প্রতিটা রূপ রস গন্ধ। তবেই না কৃতজ্ঞ থাকতে শিখবে, জীবনের প্রতিটা মানবিক সমীকরণের জন্য। নিজেকে সামলে নতুন হোমওয়ার্ক দিই, " An embarrassing moment", লেখ ব্যাটা দেখি কি লিখিস। এবার তো কাঁদালি, পরের বার হাসিয়ে দেখা দিকি।


অনির ডাইরি ১৫ই জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



মাস দুয়েক আগের কথা। দিন তিনেক হল চলে গেছেন শ্বশুরমশাই। মহানগরের বুকে প্রগাঢ় হচ্ছে সন্ধ্যা। ভিডিও কলে উমার সাথে গল্প করছিলাম আমরা, অর্থাৎ আমি আর তুত্তুরী। বাড়ি ফাঁকা, আজ সকালেই দুর্গাপুর রওনা দিয়েছে ওরা। কাল আমাদের পালা। "বন্দরের কাল হল শেষ-" মহানগরের পাঠ চুকিয়ে, এতদিনের বিশ্বস্ত গৃহসেবিকাদের ছুটি দিয়ে, বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে কাল সকালেই কাঁথি ফিরব আমরা। আবার কবে সামনাসামনি দেখা হবে কে জানে। শ্বশুরমশাইয়ের এভাবে অকস্মাৎ চলে যাওয়াটা যেন কেমন রাতারাতি বদলে দিয়েছে আমাদের জীবন। 


বার্তালাপের মধ্যেই হঠাৎ করে সবিতাদির আগমন, " অ বড়বৌদি, কে যেন এইয়েছেন। তোমাদের কোন জ্ঞাতিই হবেন বোধহয়।" গত পরশু রাত থেকে লোক আর ফোন আসার বিরাম নেই। আত্মীয়স্বজন, শ্বশুরমশাইয়ের সুহৃদ, আবাসনে অধিবাসী বৃন্দ, শুভানুধ্যায়ীগণ - কে না আসছে, দুমিনিট শাশুড়ি মা বা তাঁর ছেলেদের সাথে কথা বলতে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য শেষের কয়েক বছর গৃহবন্দী থাকলেও, নিজ গুণে কি যে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন ভদ্রলোক, প্রতি মুহূর্তে তা উপলব্ধি করছি আমরা।


গিয়ে দেখি, বসার ঘরের সোফায় বসে আছেন এক প্রৌঢ়, এক মাথা কাঁচা পাকা চুলে সাদারই আধিক্য। মাঝারি উচ্চতা, রোদে পোড়া শ্যাম বর্ণ। চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা। গালে দুয়েকদিনের না কামানো কাঁচাপাকা দাড়ি।পরনে প্রায় বিবর্ণ  পোলো নেক টিশার্ট আর ঢলঢলে প্যান্ট। কাঁধে একটি শান্তিনিকেতনী ঝোলা। 


ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছেন। চেনা চেনা লাগলেও, কিছুতেই চিনতে পারছি না আমি। শেষে বিস্তর মাথাটাথা চুলকে শুধালাম, " আপনি কি শ্বশুরমশাইয়ের বন্ধু?" ভদ্রলোক একই রকম মিটিমিটি হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, " তা বলতেই পারো। আমার নাম  -"। 


ভদ্রলোকের নাম শুনে চমকে উঠলাম, নামটা অত্যন্ত পরিচিত। ভদ্রলোক এই আবাসনেরই বাসিন্দা। অবসর প্রাপ্ত  আইএএস অফিসার। ডিএম ছিলেন বেশ কিছু বছর। শুনেছি বেশ দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেলাশাসক ছিলেন ভদ্রলোক।


খাতির করার মত কিছুই নেই বাড়িতে, তবুও সসম্ভ্রমে বলি, "একটু চা বলি।" উনি একই রকম ভাবে হেসে, হাত নেড়ে বলেন, " না না, তুমি বসো।" প্রথমেই শৌভিকের তত্ত্বতলাশ করেন ভদ্রলোক। ঠিক এই মুহূর্তেই হাঁটতে বেরিয়েছে শৌভিক। আবাসনে কয়েক পা হেঁটে, টুকিটাকি এক গাদা জিনিস কিনে ফিরবে। বুড়োবুড়ির ছাপোষা সংসারে অনেক কিছুই বাড়ন্ত। ফোন করে বললেই দিয়ে যায় স্থানীয় দোকানদার, হঠাৎ অসুস্থতার জন্য সেটুকুও বলে যেতে পারেননি শ্বশুরমশাই। বিগত দুদিন তুত্তুরীকে বগল দাবা করে উমাই দোকানবাজার করছিল। আজ শৌভিক গেছে। 


শৌভিকের সাথে কথা বলার সুযোগ না পেয়ে দৃশ্যতই মুষড়ে পড়লেন ভদ্রলোক। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে শুধালেন, " তোমার শাশুড়ি মাতা -"। শাশুড়ি মা বাড়িতেই আছেন, কাল চলে যাবেন বলে টুকটুক করে কতকিছু যে গোছাচ্ছেন। একটু আগে শ্বশুর মশাইয়ের না খাওয়া ওষুধ গুলো ব্যাগে ঢোকানো নিয়ে সবিতা দির সাথে এক প্রস্থ ঝামেলা করলেন। সবিতা দি ভালোমানুষের মতোই বলতে গিয়েছিল, " অ মাসিমা, ওগুলা তো মেসোমশাইয়ের ওষুধ। ওগুলো নিয়া কি করবা? ওগুলা খাবা না যেন।" আমিও নিষেধ করলাম, কিন্তু বৃদ্ধা বড় জেদি। তাঁর বক্তব্য, জ্যেষ্ঠ পুত্রকে না দেখিয়ে খাবেন না বটে, তাই বলে এত গুলি ওষুধ অকারণে ফেলেই বা যাবেন কেন। শুধু কি ওষুধ, শ্বশুরমশাইয়ের হাত ঘড়ি, পেন, পাথরের পেনস্ট্যান্ড, মুখে মাখার মেডিকেটেড ক্রিম আরও কতকিছু যে ব্যাগে ভরছেন তার ইয়ত্তা নেই। আর থেকে থেকে বলছেন, "কোন কিছুই তো বলে গেল না। কিছুই তো বলে গেল না।" 


সেভাবে কান্নাকাটি আর করছেন না বটে, কিন্তু যে মানুষটা চলে গেছে,তাঁর ফেলে যাওয়া জিনিসপত্রের মধ্যেই যেন তাঁকে খুঁজে চলেছেন শাশুড়ি মা। কি কি ভাবে যে শোক প্রকাশ করে মানুষ। গতকাল কে যেন বলে গেছে, " তুমি খুব শক্ত মেয়ে -"। যিনি বলেছেন তিনি নিঃসন্দেহে শাশুড়ি মাতার তারিফ করতেই বলেছেন, কিন্তু তারিফ করতে গিয়ে অজান্তেই আহত করে গেছেন বৃদ্ধাকে। কাল থেকে বার বার বলে চলেছেন শাশুড়ি মা, " কান্নাকাটি না করলে কি শোক হয় না? আমার শক্ত না হয়ে উপায় আছে, বলো তো? আমি যদি এখন কান্নাকাটি করি, তোমরা সবাই যে আমায় নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়বে।" 


সেই কথাই বলি ভদ্রলোককে। উনিও মাথা নাড়েন, " শোক বড় ব্যক্তিগত ব্যাপার বুঝলে। এই যে আমার কথাই ধর না, আমার স্ত্রী মারা গেছেন আজ বেশ কয়েক বছর হল। আমি একাই থাকি। মাঝে মধ্যেই ছেলেমেয়েদের কাছে চলে যাই।  নিজেই ড্রাইভ করি, গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। লোকে ভাবে আমি খুব ভালো আছি। কেমন সুন্দর ঝাড়া হাত পা। কেউ বোঝে না, আমি কতটা নিঃসঙ্গ। 


আমার স্ত্রী ভীষণ ঘুরতে ভালবাসত জানো। সারা জীবন সরকারী চাকরগিরি করেছি, একে তো ছুটি পেতাম না। তারপর ঐ মাইনেতে দুটো বাচ্ছাকে বড় করা। ফ্ল্যাট কেনা -"। বলতে বলতে হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে ফেলেন ভদ্রলোক, "জানো এখানে ফ্ল্যাট কেনার মূলে ছিলেন আমার বাবা। বাবা বলত, 'এয়ারপোর্টের পাশে ফ্ল্যাট কেন', যাতে তাঁর নাতনীরা প্লেন থেকে নেমেই বাড়ি ঢুকে পড়তে পারে। বাবার কথা শুনে ফ্ল্যাট কিনলাম। অথচ বাবাই সেভাবে ভোগ করতে পারলেন না।" 


চুপ করে থাকি আমি। ভদ্রলোক গলা ঝেড়ে আবার শুরু করেন, " এত কিছু করতে গিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা আর সেভাবে হয়নি। বাচ্ছারা বড় হয়ে যাবার পর, আমার স্ত্রীর ইচ্ছে ছিল ওর ষাট বছর হলে, দুজনেই সিনিয়র সিটিজেন কোটায় ছাড় পাব, তখন ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে করে সারা ভারত ঘুরব, শুধু দুজনে। ৫৯ পুরো হবার আগেই ক্যান্সার ধরা পড়ল। ৬২র মধ্যে সব শেষ।"

 কি বলব বুঝতে পারি না। জীবন কেন যে এত অনিত্য। নাম, যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি, প্রেম, বন্ধুত্ব, এমনকি পরিবারও সবই কেমন যেন এই টক্কা, তো এই সব ফক্কা। তবুও কেমন ডিনায়াল মোডে থাকি আমরা। বাস করে চলি মূর্খের স্বর্গে।

অনির ডাইরি, ১১ই জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



"ম্যাডাম, অমুক পিকনিকে যাবে নি বলতেছে।" ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল শান্তনু। বর্ষার পিকনিক আসতে আর মাত্রই দিন দুয়েক বাকি।  যাদের জন্য এত হ্যাপা করে পিকনিক, তারাই বলছে পিকনিকে যাবে না?  বললাম ডাকো ব্যাটাকে, দেখি তার আবার কি হল। 


সামান্য ভয়ে ভয়েই ঘরে ঢুকল ছেলেটি, " ম্যাডাম ডাকতেছিলেন?" শুধাই, পিকনিকে কেন যাবে না, বাবা। ছেলেটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জবাব দেয়, " সত্যি বলছি ম্যাডাম, যাবার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু অত সকালে যে বেরোতে পারব না ম্যাডাম।" 


সকাল সকালই বটে, ছেলেটির বাড়ির সামনে দিয়ে আমাদের দীঘামুখী বাস বেরোবে ভোর ছটায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, " একদিন একটু কষ্ট করে সকালে উঠতে পারবে নি?" ছেলেটি হেসে বলল, "কেন পারব না ম্যাডাম, আমি তো রোজ আরো ভোরে উঠি। যেতে পারব না, আমার মায়ের জন্য। মাকে স্নানটা না করিয়ে যে বেরোতে পারব না ম্যাডাম।" 

শুধালাম, "তোমার বাড়িতে এমন কেউ নেই, যে তোমার মাকে একদিন স্নান করিয়ে দিতে পারবে?" ছেলেটি জবাব দিল, " মা অন্য কারো কাছে করবে না ম্যাডাম।" 


 খানিক দম নিয়ে, ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল ছেলেটি, তারপর বলল, "আপনাকে সব বলা যায় ম্যাডাম। আমার মায়ের বয়স প্রায় নব্বই।আমরা বেশ অনেকগুলি ভাইবোন। আমি সবথেকে ছোট। মা যে কি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে আমাদের বড় করেছিল ম্যাডাম, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আজ সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, সকলেরই চলে যায় ভালো ভাবে। বাবার মৃত্যুর পর, সবাই মিলে বসা হয়েছিল, মা কার কাছে কদিন থাকবে এই নিয়ে। 


সেদিন মা আমায় আলাদা করে ডেকে বলেছিলেন, ' আমি তোর কাছেই থাকব। তুই যা খাবি, আমাকেও দুটি দিস।' সেই থেকে মা আমার কাছেই থাকেন। 


আপনি এই অফিসে আসার পর একবার আমি আপনাকে ফোন করে জানালাম না, যে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি - সেই যে স্ট্রোক হল মায়ের,শরীরের ডান দিকটা একদম পড়ে গেল ম্যাডাম। সে যে কি অবস্থা কি বলি। মা পুরো শয্যাশায়ী, মল মূত্র সবই বিছানায় করে ফেলছে, আমি আর আমার বউ হাতে করে সেই সব সাফ করছি। সত্যি বলতে কি ম্যাডাম, ওর কাছে এতটা আশা আমি করিনি। ও যে আমার মায়ের জন্য এতটা করবে আমি ভাবতেও পারিনি ম্যাডাম। 


এখন ফিজিও থেরাপি করে মা অনেক ভালো আছে, আমার হাত ধরে সামান্য হলেও অন্তত হাঁটতে তো পারছে। এখন সমস্যা কি বলুন তো ম্যাডাম, মায়ের কোষ্ঠকাঠিন্য আছে। ফলে রোজ রাতে একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধ খায়। ভোর হলেই মায়ের পায়খানা পায়। সে যে কি দুর্গন্ধ ম্যাডাম কি বলব। পুরো বাড়ি ছাড়ুন, মহল্লায় টেকা যায় না। সেই সব সাফ করে, মাকে চান করিয়ে টিভিটা চালিয়ে দিয়ে তবে বেরোতে পারি আমি। এত কিছু তো ভোর ছটার মধ্যে হবে না ম্যাডাম।" 


ইশারায় বলি, ভালোই সেন্টু দিলে বাবা, তোমায় আর পিকনিকে যেতে বলে কে? বলি এবার কেটে পড়। ছেলেটা হাসতে হাসতে উঠে যেতে যেতে বলে, "জানেন ম্যাডাম, মা না পুরো ছেলেমানুষ হয়ে গেছে। মায়ের জন্য একটা সোফা কিনতে হল আমায়। স্নান করিয়ে মাকে সোফায় বসিয়ে, টিভিটা অন করে দিয়ে আমি বেরিয়ে আসি। মা সারাদিন টিভি দেখে -"। 


হাসতে গিয়েও হাসতে পারি না। কুশীলব ভিন্ন হলেও বৃদ্ধ মা আর ছেলের এই গল্পটা যে আমার ভীষণ পরিচিত। শ্বশুর মশাই মারা যাবার রাতে, ঠিক এমনি ভাবেই বলছিল শৌভিক, "মাকে একা রাখা যাবে না।" তখন বোধহয় রাত এগারোটা। শুনশান  নাচিন্দা মন্দির চত্বর এক পলকে পেরিয়ে গেলাম আমরা। রাস্তার আলো আঁধারির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম আমি, একা সত্যিই ওনাকে রাখা যাবে না। কানে প্রায় বধির। হাঁটুর ব্যথায় প্রায় স্থবির। চোখের জ্যোতিও তেমন নেই। সব থেকে বড় কথা, কিছুই তো জানেন না, বোঝেন না ভদ্রমহিলা। 


সাথে সাথে মনে হল, কাজটা মোটেও সহজ নয়। বাড়িটা যে বৃদ্ধার প্রাণভোমরা। নিজের হাতে সাজিয়েছেন প্রতিটা কোনা। নিজের হাতে তকতকে সাফ রেখেছেন আজ এই মধ্য সত্তরেও। শরিকি বাড়িতে বেড়ে ওঠা শাশুড়ি মাতা, আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন, একটা বাড়ি হবে, যা হবে একান্তই ওনার। 


শ্বশুর মশাইয়ের কর্মসূত্রে জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে বিভিন্ন সরকারী আবাসনে। ওই যে অবসর নেবার সময় চিঠি আসবে, সরকারী আবাস ছেড়ে দাও, এটা শাশুড়ি মাতার কাছে ছিল মূর্তিমান দুঃস্বপ্ন। কত দাম্পত্য কলহ যে হয়েছে এটা নিয়ে। ১৯৭৯ সালে বাসু ভট্টাচার্যের একটা সিনেমা এসেছিল, নাম গৃহপ্রবেশ। তার মুখ্য চরিত্র মানসী ওরফে শর্মিলা ঠাকুর হয়ে উঠেছিলেন যেন শাশুড়ি মা। শ্বশুরমশাই অবশ্য অমর বা সঞ্জীব কুমার হয়ে উঠতে পারেননি। প্রিয়াকে তুষ্ট করে, অবসর নেবার বেশ কিছু বছর আগেই ফ্ল্যাটটা কেনেন শ্বশুর মশাই। কর্জ করেও যে দামে কেনেন, বর্তমানে শুনলে হাসি পাবে। তা পাক, কিন্তু ওই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিতে তো আর পড়তে হয়নি। বাড়িটা ওনার এতোই প্রিয়, বাড়ি ছেড়ে একবেলার জন্য ও কোথাও যেতে চান না ভদ্রমহিলা। এখন কি হবে কে জানে।  যা জেদি বৃদ্ধা।


ভেবেছিলাম, বোঝাতে হবে, হয়তো ছেলেদের একটু রাগও দেখাতে হবে। বাস্তব বড়ই বিচিত্র। কল্পনার থেকে একেবারেই আলাদা।শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যুর পরের দিন, আমরা আর জনা দুই গৃহসেবিকা ছাড়া বাড়ি ফাঁকা। শৌভিক গেছে কি যেন দপ্তরী ট্রেনিংএ। ঠিক হয়েছে রাতে দুজনে একসাথে কথাটা পাড়ব। সদ্য স্নান সেরে বেরিয়েছেন শাশুড়ি মা। এতদিনের চেনা মুখের দিকে আর তাকাতে পারছি না যেন। বিমর্ষ ভাবে  নড়বড় করতে করতে গিয়ে সোফায় বসলেন শাশুড়ি মা,  অতঃপর ইশারায় ডাকলেন আমায়। উনি বসে, আমি দাঁড়িয়ে। কৃপা প্রার্থীর মত আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলেন, তারপর বললেন, "আমি তোমাদের সাথেই চলে যাব কেমন। এই ফ্ল্যাট জুড়ে তোমার শ্বশুর মশাইয়ের এত এত স্মৃতি। এখানে আর থাকতে পারব না। তোমরা আমায় নিয়ে যাবে তো - । " 


প্রায় দুই মাস হতে চলল, কাঁথিতে আছেন শাশুড়ি মা, আপাতদৃষ্টিতে ভালোই তো আছেন। স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইয়ের মতোই যতনে রেখেছে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র। এই বৃদ্ধাও ভোগেন কোষ্ঠকাঠিন্যে। এনার পুত্রও মায়ের জন্য কিনে আনেন আয়ুর্বেদিক ঔষধ। শাশুড়ি মাও যথেষ্ট সাবধানী, সবথেকে প্রশংসনীয় ওনার নিয়মানুবর্তিতা। ঘড়ির কাঁটা ধরে ভোর পাঁচটায় উঠে পড়েন ঘুম থেকে। ছটায় দুটো সুগার ফ্রি দিয়ে এক কাপ কালো চা খেয়েই স্নানে চলে যান। স্নান সেরে দৈনিক খবরের কাগজটা নিয়ে কাটান কিছুটা সময়। পৌনে নটায় প্রাতঃরাশ, পৌনে একটায় দ্বিপ্রাহরিক আহার, চারটে নাগাদ ফল, সন্ধ্যে ছটায় চা, রাত পৌনে নটায় নৈশ ভোজ সেরে, ঠিক নটায় ঘুমিয়ে পড়েন শাশুড়ি মা। সারাদিন হয় সোফায় বসে ঝিমান, নয়তো বই পড়েন শাশুড়ি মা। টিভি দেখার তেমন নেশা নেই, দূরদর্শনের সন্ধ্যে সাতটার খবরটা দেখেন আর দেখেন দিদি নম্বর ওয়ান। 


নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার দিন খুব টেনশনে ছিলেন, যদি রচনা না আসতে পারেন শো করতে। প্রোগ্রাম শেষে এক গাল হাসি বৃদ্ধার, " যাক এত ব্যস্ততার মধ্যেও তো রচনা ব্যানার্জি এসেছে বলো।" এই নির্বিকল্প রেজিমেন্টেড রুটিনের মধ্যেও মাঝে মধ্যেই ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নেন বৃদ্ধা, আমরা আছি তো? আমরা কে কোথায় আছি? খেয়াল রাখেন, কে কখন বেরোচ্ছি।  বেরোবার আগে আসছি বললেই, এক গাল হেসে শুধান, " আজ আর দেরী হবে না তো? ও অনিন্দিতা, আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে তো?"


অনির ডাইরি ৭ই জুলাই, ২০২৪

#তাম্রলিপ্তকড়চা 



ভোরের এলার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙে গেছে আজ। বলতে পারেন চাপা উত্তেজনায় ভালো ঘুমই হয়নি কাল। হাত বাড়িয়ে মুঠো ফোনটা টেনে নিয়ে whatsapp খুলতেই মেসেজের বন্যা। ভোর ৪টে ৫১য় মেসেজ করেছে বেদজ্যোতি, "শুভ সকাল বন্ধুগণ, সবাই তৈরি হয়ে যাও।" সবার আগে বেরোতে হয়েছে যে ওকে, মাছ, মাংসের যোগাড় করতে। 

৫টা ১৫ - মেসেজ করল সৌরভ, বাস ছাড়ল মানিকতলা থেকে। নীচে বাসের লাইভ লোকেশন শেয়ার করেছে শান্তনু। মানিকতলা থেকে বাস যাবে মেছেদা বাসস্টান্ড। কোলাঘাট আর শহীদ মাতঙ্গিনীর লোকজন ওখান থেকেই বাসে উঠবে। 


সৌরভের মেসেজের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাঁধে হাত দিয়ে এক গাল হেসে ছবি পোস্ট করেছে সৌম্য আর সন্দীপ। অর্থাৎ মোরা হাজির। ভোর ভোর বাইক চালিয়ে চলে এসেছে দুটোতে। সেখান থেকে বাস রামতারক,রাধামনি হয়ে আসবে আমাদের নিমতৌড়ি। ময়নার SLO রা নিমতৌড়ি থেকেই বাসে উঠবে। সকলের জন্য মুড়ি আর চিড়ে বাজার প্যাকেট নিয়ে উঠবে শুভদীপ্ত। কোন সকালে বেরিয়েছে সব। এরপর বাস দাঁড়াবে খঞ্চি। উঠবে নন্দকুমার ব্লকের লোকজন। তারপরের স্টপ নন্দকুমার মোড়। সপরিবারে বাসে উঠবেন হক বাবু। তারপর চণ্ডীপুর, সবার শেষে বাসে উঠব সকন্যা আমি। 


সৌরভের ওপর দায়িত্ব পড়েছে প্রথম বাসে ওঠার। বিস্তর গাঁইগুঁই করছিল সৌরভ, "ম্যাডাম , অত ভোরে বাসস্ট্যান্ডে আসব কি করে? একটা টোটো পাব না।" শান্তনুকে তাই ট্যাগ করা হয় সৌরভের সাথে। জানতাম, আমার RLO ইন্সপেক্টর মুখে যাই বলুক, নিজ দায়িত্বে অবিচল। আমার বিশ্বাসকে যথার্থ প্রমাণ করে ফুটে উঠল সৌরভের মেসেজ, বাস মেছেদা ছাড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই শুভাশিস এর এক গাল হাসিওয়ালা নিজস্বী। পিছনে গাল ফুলিয়ে বসে আছে রঞ্জিত। বাস কেন কোলাঘাট যাবে না এই নিয়ে কাল গোঁসা হয়েছিল বাবুর। রেগে বলেছিল, "যাবই না।" মিনিট দশেক ধরে সকলের বিস্তর কাকুতিমিনতির পর, বিস্তর কান মাথা চুলকে বলে, "ম্যাডাম আবার জানতে পারলে very poor, ACR দিবেন। থাক, বাইক নিয়েই চলে আসব।" এই রগড় এই আপিসে প্রায়ই হয়। যে কোন শুভ কাজের আগে রঞ্জিতের গোঁসা করাটা খুব দরকার। রঞ্জিত চটে গেছে মানে, সব নির্বিঘ্নে হবে। উপরি পাওনা হল, মাথা গরমের মাশুল হিসেবে কাল না হলে পরশু রঞ্জিত অবশ্যই কিছু না কিছু খাওয়াবে। 


ভালোয় ভালোয় যেন কেটে যায় আজকের দিনটা। বিভিন্ন বয়সের এত গুলো মানুষকে নিয়ে চলেছি আমরা। সবাইকে সুস্থ ভাবে বাড়ি না ফেরানো পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। কি যে ঝামেলার মধ্যে দিয়ে হচ্ছে পিকনিকটা।প্রস্তাবটা প্রথম তুলেছিল তমলুক পুরসভার SLO সুতপা, "ম্যাডাম একদিন আমাদের দীঘা নিয়ে চলুন না।" নিয়ে চলুন, বললেই তো বেরিয়ে পড়া যায় না, ইন্সপেক্টর, CKCO, SLO, কালেকটিং এজেন্ট মিলিয়ে শতাধিক সদস্য আমার টিমের। তার ওপরে আছেন তাঁদের পরিবার বর্গ। বিগত শীতের পিকনিকে মাথা ছুঁয়েছিল প্রায় শ দেড়েক। এত জনকে একসাথে নিয়ে যাওয়া, আবার নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া কি চাট্টি খানি কথা? এতো আর নন্দকুমারে পিকনিক করা নয় যে, যে যার মত যাবে, খাবে, গানবাজনা করবে আবার নিজ দায়িত্বে বাড়ি ফিরে যাবে। একই জেলায় হলেও, মেছেদা থেকে দীঘা পৌঁছতে লাগে অন্তত তিন ঘণ্টা। লোক তুলতে তুলতে গেলে, আরো আধেক ঘণ্টা বেশি ধরুন। একদিনে এতটা যাতায়াত করা যায় নাকি, ফলে রাতে থাকতে হবে। সপ্তাহান্তে দীঘায় এতগুলো ঘর পাওয়া কি মুখের কথা? 


সুতপা অনড়, " রাতে থাকব না ম্যাডাম। যাব আর চলে আসব। প্লিজ ম্যাডাম -"। সুতপা চলে যাবার পর সহকর্মীদের নিয়ে একবার বসলাম, এতজনকে এই ভাবে এক বেলার জন্য দীঘা নিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা কতটা বাস্তবসম্মত। জনগণের দেখলাম উৎসাহের শেষ নেই। শান্তনু তখনই চেনা বাসের নম্বর ঘোরাল, "দাদা, তমলুক থিকে দীঘা, যাতায়াত। কত ভাড়া লিবে?" জবাব এল বারো থেকে পনেরো হাজারের আশেপাশে। 


এবার একটা হোটেল খোঁজ দরকার। এতগুলো লোক যাতে একসাথে খেতে বা বসতে পারে। বেদজ্যোতি আর হক বাবু বললেন, "গোটা কয়েক ঘর ও লাগবে ম্যাডাম। ব্যাগপত্তর রাখতে, জামা কাপড় বদলাতে, শৌচাগারের যদি প্রয়োজনে। কারো যদি শরীর খারাপ হয় হঠাৎ -"। 


 দীঘা আমার প্রচণ্ড প্রিয় জায়গা, কিন্তু সপ্তাহান্তে বা ছুটির দিনে দীঘা আমার কাছে বিভীষিকা। এত ভিড় হয় দীঘায় যে তার আগের/ পরের দিন অফিস যেতে জিভ বেরিয়ে যায়। তার থেকে মন্দারমণি, তাজপুর, শঙ্করপুর অনেক ভালো। মন্দারমণিতে একটি হোটেলে আমরা একবার পিকনিক করেছিলাম। রামকৃষ্ণ মিশনের পাশেই, একদম নিরিবিলি। সারাদিন সমুদ্রে দাপালেও কেউ কিছু বলার নেই। রান্নাবান্না ও বেশ ভালো। কেবল একটু শুঁটকি মাছের গন্ধ আসে মাঝেমধ্যে এই যা। 


সেই মত কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খেলাম আমরা। শুধু খেতেই লাগবে মাথাপিছু ৯০০টাকা। হোটেলওয়ালা অমায়িক ভাবে বললেন, "দেখুন সপ্তাহের মাঝে এলে মাথা পিছু ৯০০র বেশি আপনাদের কিছু দিতে হবে না। কিন্তু শনি-রবি'টাই তো আমাদের ব্যবসার সময়। ওই সময় এতজন এলে তো আমরা হোটেলের এমনি আবাসিকদের কোন পরিষেবা দিতে পারব না। তাই গোটা হোটেলটাই আপনাদের নিতে হবে। ভাড়া বেশি নয়, মাত্র ১৪হাজার।" 


সপ্তাহের মাঝে, কি করে যাই? আপিসে তালা মেরে? আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সপ্তাহের মাঝে একটাও ছুটি পড়েনি কি? দেখা গেল এমন দুটি দিন আছে,যার একটিতে পড়েছে মহরম, অন্যটি স্বাধীনতা দিবস। তাহলে উপায়? 


আরো কয়েকটি হোটেল দেখা হল আশেপাশে, এমনকি মিশনেও কথা বললাম আমরা। সর্বত্র আগুন দাম। মাথা পিছু চাঁদা ১৩০০/১৫০০ পড়ে যাচ্ছে। এত টাকা চাঁদা দিয়ে কেউ কি আদৌ যাবে? শুভদীপ্ত গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে বলে, "না ম্যাডাম। কেউ যাবে নি। চাঁদা হাজার টাকা বা তার নীচে রাখলে ভালো হয়।" শুভাশীষ বলে, " ম্যাডাম দীঘাতেই করুন। সস্তা হবে।" 


খুঁজে পেতে এক সরকারী অতিথিশালায় যোগাযোগ করলাম আমরা, " ভাই, শুধু যাব, খাব আর চলে আসব। পাচক আমরাই নিয়ে যাব, নিজেরাই রান্না করে খাবো, আপনাদের ওপর কোন চাপ পড়বে না। আমাদের লাগবে বলতে ডাইনিং হল আর একটা দুটো ঘর।" ছোটখাট যে অধিকর্তার সাথে কথা হল, তিনি আশ্বস্ত করলেন, হয়ে যাবে। টাকাপয়সা কিছু লাগবে না। 


আমরাও পূর্ণোদ্যমে নেমে পড়লাম খাবার মেন্যু, পাচক, বাজার ইত্যাদি নিয়ে। মাঝে দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে লাদাখ যাওয়া, ফিরে এসেই পিকনিক। সব ব্যবস্থা করে, ছুটিতে গেলাম আমি। যেদিন বিমানে উঠব,তার আগের রাতে বার্তা পাঠালেন মাননীয় আধিকারিক মহোদয়, কি সব যেন প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে গেছে সব। আমাদের কোনরূপ সহায়তা করতে ওনারা নাচার। 


কি সর্বনাশ, বাস বুক হয়ে গেছে যে। এক পয়সাও চাঁদা ওঠেনি এখনও, হক বাবু পকেট থেকে টাকা দিয়ে বুক করিয়ে ফেলেছেন বাস খানা। অনেক দরদস্তুর করে সস্তায় মারাত্বক পুষ্টিকর এক ঠাকুর (এখানে বলে পূজারী) বুক করে ফেলেছে বেদজ্যোতি। বুক করিয়ে ফেলেছে দুটি তাগড়াই ছাগল একটা নধর মুর্গি। যাঁরা মাটন খাবেন না, তাঁদের জন্য। ট্রলার ওয়ালার সাথে কথা হয়ে গেছে, ওই দিন সবথেকে বড় সবথেকে টাটকা পমফ্রেট মাছগুলো আমাদের দিতে হবে বলে। সেই মোতাবেক হিসেব করে চাঁদা ও ঠিক হয়ে গেছে। গ্রুপে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। এখন ক্যান্সেল করলে হয়ে নাকি। 


সব খুলে বললাম ও। অনেক পুরাণ বন্ধু, ভেবেছিলাম অনুনয়, বিনয়ে কাজ হবে। ফলাফল একই। বুঝতে পারছি, বন্ধু ও অসহায়। চাকরি মানেই যে চাকরগিরি। এদিকে রাত বাড়ছে, পরদিন ভোরেই রাজ্য ছাড়ব আমরা। অন্য কোথাও জায়গা দেখার অবকাশ আর নেই। কোন মতে অফিসিয়াল গ্রুপে জানিয়ে দিলাম, পিকনিক আপাতত বন্ধ। মুষড়ে পড়া বউকে আদর করে আশ্বস্ত করে শৌভিক, " কেন ঢেউসাগর আছে তো।" 


মিলেনিয়াম পার্কের মতই ঢেউসাগর একটা বিনোদন মূলক পার্ক। সমুদ্রের একদম ধারে। বেশ কয়েকবার গেছি সেখানে শৌভিক এর সাথে। ওখানকার ফুড কোর্টে দারুণ কোল্ড কফি উইথ আইসক্রিম পাওয়া যায়। তাই বলে পিকনিক? বড় ভিড় হয় যে। ঘুরে আবার মেসেজ করি গ্রুপে, ঢেউসাগরে হতে পারে কি? আমি তো থাকছি না, তোমরা একটু দেখবে? 


আমার অনুপস্থিতিতে সত্যিই সবটা ঘুরে দেখেন হকবাবু আর বেদজ্যোতি। কথা বলে ফুড কোর্টের সাথে, শুধু খেতে ভাড়া দিবে নাকি তোমরা? রান্না বাপু আমাদের বুক করা পূজারীই করবে। খুঁজে পেতে একটা হোটেল ও বার করে ওরা, সাধ্যের মধ্যে পাওয়া যায় ঘর। সবকিছু হয়ে যাবার পর আবার প্রশাসনিক জটিলতায় ধাক্কা খাই আমরা। দিন ঠিক করার সময় খেয়াল ছিল না, পরের দিন রথ যে। অনেক বাধা বিঘ্ন কাটিয়ে অবশেষে দিন দুয়েক আগে পাকা হয়েছে পিকনিক। 


টিং করে মেসেজ আসে, হক বাবু লিখেছেন, "আমরা নাচিন্দা মন্দির ছাড়িয়েছি ম্যাডাম।" মিনিট দশেকের মধ্যেই এসে যাবে রূপশ্রী বাইপাস এসে পড়বে বাসটা। এবার আমার বাসে ওঠার পালা। হে ঈশ্বর দিনটা যেন ভালোয় ভালোয় কেটে যায়। সবাই যেন চূড়ান্ত উপভোগ করতে পারে আর হ্যাঁ, দিনান্তে সবাইকে যেন তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারি।



অনির ডাইরি ৫ই জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



"মা, মা"। মুঠো ফোনের ওপারেই শ্রীমতী তুত্তুরী একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ। আপিস থেকে ফিরে, গোটা ছয়েক বীজ গণিত আর গোটা তিরিশেক ভয়েস চেঞ্জ করতে দিয়ে সবে নেটফ্লিক্সটা খুলেছিলাম, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, " বলো মা।" তিনি একখান জাবদা ইতিহাস বই আমায় ধরিয়ে বলেন, অ্যাংলো ফেঞ্চ রাইভালরি ইন কার্ণাটিক'টা একটু বুঝিয়ে দাও তো। কাল স্যার টেস্ট নেবেন ক্লাসে।" 


ধড়মড় করে উঠে বসি, " অ্যা? আর সেটা তুই আমায় এখন বলছিস? ক্লাসে এই চ্যাপ্টারটা পড়ানো হয়ে গেছে? তিনি নৈর্ব্যক্তিক ভাবে নাক চুলকে বললেন, " হয়ে গেছে হয়তো।" অতঃপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে, " আমি সেদিন যাইনি হয়তো। তুমি একটু রেডি করে দাও।" 


বাঃ কি সরল সমাধান। দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ ফরাসী বৈরিতার বিন্দুমাত্র যার মনে নেই, তাকে কিনা সেই চ্যাপ্টারটা পড়ে, বুঝে, পড়িয়ে মুখস্থ করিয়ে দিতে হবে। সাধে বলে, মা হওয়া কি মুখের কথা ! এদিক তাকিয়ে বিস্তর মাথা চুলকে দ্বারস্থ হলাম কন্যার পিতার। " ওগো একটু পড়িয়ে দাও না মেয়েটাকে।" 


প্রসঙ্গত শ্রীমতী তুত্তুরীর কোন গৃহ শিক্ষক নাই। সব বিষয় আমিই পড়াই, ইংরেজি আর ইতিহাসের উত্তর গুলি শৌভিক দেখে দেয় সময় মত। সেই অর্থে এটা তো ওরই পড়ানোর কথা। বেশ অনেকদিন পর আজ মোটামুটি ভদ্র সভ্য সময়ে বাড়ি ফিরেছে শৌভিক, এক কাপ কালো কফি খেয়ে, খানিক গড়িয়ে নিয়ে তিনি আপাতত হাঁটতে বেরোচ্ছেন। এমন সময় ইঙ্গ ফরাসী বৈরিতা বা কন্যার ক্লাস টেস্ট নিয়ে যে তিনি বিন্দুমাত্র ভাবিত নন, সেটা তিনি সুস্পষ্ট ভাবে বুঝিয়েই গেলেন। 


পড়ে রইলাম আমরা মা আর মেয়ে। আমি যে কেন এই ভাবে কেটে পড়তে পারি না, বিড়বিড় করতে করতে বই খুললাম। শুরু হল পড়ানো, " বুঝলি বাবু, সেই যে ভাস্কো দা গামা -", বলে ঢোঁক গিলি আমি, ভ্রু কুঁচকে তুত্তুরী বলে, " তিনি তো পর্তুগালের লোক ছিলেন" । ধড়াম করে বই বন্ধ করে বলি, " ওরকম করলে পড়াবই না। যা বাপের কাছে যা -"। 

 

ক্লাস টেস্টের নাম বাবাজী এবং মা ছাড়া গতি নেই, বুঝে ইশারায় মুখে চাবি লাগায় তুত্তুরী। আমি আবার শুরু করি, " তিনি তো এসে নামলেন কালিকটে, ব্যাস ইউরোপ চিনে গেল ভারতে আসার পথ। পর্তুগিজদের পিছু পিছু ডাচ, ফ্রেঞ্চ, দিনেমার, ব্রিটিশ সবাই একে একে এসে পৌঁছাল আমাদের দেশে। আচ্ছা তোকে সেই গল্পটা বলেছি -"?


 নড়ে চড়ে বসে তুত্তুরী, "কোন গল্প?" সেই যে আমার ঠাকুমার মুখে শোনা গল্পটা। জুত করে বসে বলি, তাহলে শোন, আমার ঠাকুমার পিতামহের নাম ছিল বেণীমাধব মুখার্জি। ধন্য স্মৃতিশক্তি ছিল ওনার। শ্রুতিধর যাকে বলে আর কি। একবার হয়েছে কি, উনি গঙ্গা স্নানে গেছেন, গিয়ে দেখেন, একটা ডাচ আর একটা দিনেমারের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া চলছে। দুজনেই উজাড় করে দিচ্ছে যার যার মাতৃ ভাষার অমূল্য রতন। ঝগড়া আর বেশী ক্ষণ মৌখিক রইল না, অচীরেই শুরু হল হাতাহাতি। দুটো লাল মুখো মারামারি করছে দেখে ছুটে এল গোরা পল্টন। ধরে নিয়ে গেল দুটোকেই। আদালতে কেস উঠল। বেণীমাধব মুখুজ্জে সেযুগে মধ্য হাওড়ার বেশ গণ্য মান্য ব্যক্তি ছিলেন। সাক্ষী হিসেবে ডাক পড়ল ওনার। উনি গিয়ে এজলাসে হুবহু বলে দিলেন, কে কাকে কি বলেছে এবং বললেন ডাচ এবং দিনেমার ভাষায়। জজ সাহেব তো হতবাক, বললেন, "বাবু, তুমি এদের ভাষা জানো?" জবাবে উনি বললেন, "না ধর্মাবতার। আমি শুধু এটা জানি, যে সেদিন কে কি বলেছিল।"


আবার ইতিহাসে ফিরি আমরা, তো যা বলছিলাম, সবাই এলো তো, কিন্তু এল কেন? তুত্তুরীর ওষ্ঠাধরের মধ্যে সামান্য ফাঁক হল, "ব্যবসা?" একদম, হাঁফ ছেড়ে বলি। এই তো সব বুঝে গেছিস। বাকিটা রিডিং পড়ে নিলেই পারবি। চোখ গোল গোল করে ধমকায় তুত্তুরী, "পড়াও।" 


ওই আর কি, আম্বানি আর আদানি কেস। কে একচেটিয়া ব্যবসা করবে তাই নিয়েই যত ক্যাওস বুঝলি কি না। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি না ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বাকি যারা ছিল, সব আপ্পুলিশ, বুঝলি কি না। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপিত হয়েছিল সেই ১৬০০ সালে। তখন ইংল্যান্ডের রাণী ছিলেন প্রথম এলিজাবেথ। হঠাৎ কি যেন মনে পড়ে যায়, এক গাল হেসে বলি, "এই  জানিস, এই এলিজাবেথ কে ছিলেন?" 

শ্রীমতী তুত্তুরী গম্ভীর মুখে ভ্রু দিয়ে ইশারা করে বইয়ের দিকে, মুখে বলে, " জানি, অষ্টম হেনরির মেয়ে ছিলেন। মা অ্যান বোলেন।" হাসিটা অর্ধেক গিলে আবার কিছু বলতে যাই, হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেন শ্রীমতী, " জানি জানি অষ্টম হেনরীর ছটা বউ ছিল। যার মধ্যে দুজনের উনি গর্দান নেন। একজন সন্তান প্রসব করতে গিয়ে রক্তক্ষরণে মারা যান। একজনকে নির্বাসন দেন। একজনকে বোন বলে ঘোষণা করেন ইত্যাদি ইত্যাদি।  " বেশ কিছু বছর আগে অষ্টম হেনরিকে নিয়ে নির্মিত, "টিউডর" বলে একটি ওয়েব সিরিজ দেখেছিলাম। এমন বর্ণময় চরিত্র ছিল লোকটার যে প্রতি এপিসোড শেষেই মেয়েকে গল্প শোনাতাম আজ কি দেখলাম। তারই প্রতিদান পেলাম। 


চিরতা চিবানো মুখে পুনরায় ইংল্যান্ডে প্রবেশ করি, স্যার টমাস রো'র সাথে ১৬১৫ সালে ভারতে আসি। তখন দিল্লীর সিংহাসনে আসীন বাদশাহ জাহাঙ্গীর। উইলিয়াম ডালরিমপ্লের "অ্যানার্কি"র কয়েকটা অনুচ্ছেদ ভেসে ওঠে চোখের সামনে, ভেসে ওঠে বইয়ে পড়া জাহাঙ্গীরের অতুল ঐশ্বর্যের কথা। কেমন করে স্যার টমাস রো'কে  নাকে দড়ি বেঁধে ঘুরিয়েছিলেন ভারত সম্রাট। শেষে দয়া করে ছুঁড়ে দেন বাণিজ্যের অধিকার। 

বই মনে করায়, নিঃশুল্ক বাণিজ্যের অধিকার পেতে গোরাদের লেগেছিল আরো ৭৫ বছর। ভারতের সিংহাসনে তখন জাহাঙ্গীরের সুযোগ্য পৌত্র আওরঙ্গজেব।  তবে সে সুবিধা সীমাবদ্ধ ছিল বঙ্গদেশের চার দেওয়ালের মধ্যে। বঙ্গ- বিহার - উড়িষ্যায় নিঃশুল্ক বাণিজ্যের ফারমান দিলেন বাদশাহ ফারুকশিয়ার। 


ততোদিনে ব্রিটিশদের শক্তপোক্ত উপনিবেশ গড়ে উঠেছে মাদ্রাজে। ১৬৮৮ সালে পর্তুগালের রাজকুমারী ক্যাথরিন ব্রিগ্যাঞ্জাকে বিয়ে করে মুম্বাই যৌতুক পেয়েছেন ইংল্যান্ডের রাজা। রাজার থেকে  বছরে মাত্র ১০ পাউন্ড ভাড়ায় তার স্বত্ত্ব পেয়েছে কোম্পানি। ১৬৯০ এ ভিত্তি স্থাপন হয়েছে আমাদের সাধের কলকাতার। 


ব্রিটিশরা যখন এতটা এগিয়ে গেছে, হঠাৎ এসে উদয় হল ফরাসীরা। ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপিতই হল ১৬৬৪ সালে। বলতে বলতে হঠাৎ খেয়াল হয়, " এই বাবু, সবাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেন খুলছে বলতো?" তুত্তুরীর জবাব পেয়ে চুপসে যাই, আজকালকার বাচ্ছা গুলো কেন যে এত কিছু জানে - সব এই আপদ গুগলের দোষ। 


মঞ্চে প্রবেশ করেন চন্দননগরের বড়সাহেব। কে বলুন তো? ডুপ্লে মশাই, যোশেফ ফ্রাঁসোয়া ডুপ্লে। এই একটি লোকই তো খেলা জমিয়ে দিয়েছিল। ইউরোপে বাঁধল অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকারের যুদ্ধ, ভারতেও ইংরেজদের উদোম পিটিয়ে মাদ্রাজ তথা ব্রিটিশদের ফোর্ট জর্জ কেল্লা দখল করে নিল ডুপ্লে আর তার দলবল। ইংরেজরা আর কি করে, কাঁদতে কাঁদতে  গিয়ে পড়ল, কর্নাটকের নবাব আনোয়ারুদ্দিনের পায়ে। 


নবাব ও তেমনি, তিনি নির্দেশ পাঠালেন, ওদের দুর্গ ওদের ফেরৎ দাও। বয়েই গেছে, কানেই তুললে না ডুপ্লে সাহেব। ক্ষুব্ধ নবাব তখন ফরাসীদের শায়েস্তা করতে পাঠালেন এক বিরাট সেনা দল।  ডুপ্লে আর তার দলবলের কাছে গোহারান হেরে গেল নবাবের সুশিক্ষিত সেনা দল। ব্যাস আর একটু, আর একটু হলেই হয়তো বদলে যেত পরাধীন ভারতের ইতিহাস, কিন্তু - 


ওই যে বলে না রাখে হরি, মারে কে, ঠিক সেই সময়ই ইউরোপে বন্ধ হয়ে গেল যুদ্ধ। দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হল কি যেন জটিল নামের এক চুক্তি। বিনা যুদ্ধে, আপদ ব্রিটিশদের মাদ্রাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হল ডুপ্লে আর তাঁর দলবল। 

 

ইউরোপের ছড়ি খেয়ে যতই এরা ভাব করে নেবার নাটক করুক না কেন, এত বৈরিতা, এত বিষ কি ওমন এক চুক্তিতে যায় নাকি? বছর ঘুরল না লেগে গেল, দ্বিতীয় কর্নাটকের যুদ্ধ। এমনিতেই অবিশ্বাস আর ক্ষোভ ছিলই একে অপরের প্রতি, তারওপর হায়দ্রাবাদ আর কর্নাটকের শাসকদের আভ্যন্তরীন কোন্দল, যাকে বলে,

 "নারদ নারদ খ্যাংরা কাঠি,

 লেগে যা নারদ ঝটাপটি।"

 হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ে তুত্তুরী।


ধমকে বলি, হাসিস না শোন। এদিকে হায়দ্রাবাদে নিজামের ছেলে বনাম নাতি, ওদিকে কর্নাটকের নবাব আনোয়ারুদ্দিন বনাম চাঁদ সাহেব।এক তরফে ব্রিটিশ, অন্য তরফে ফরাসী। সে কি যুদ্ধ। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। যুদ্ধ আর সীমাবদ্ধ থাকে না ইতিহাস বইয়ের পাতায়, নেমে আসে বর্তমানে। লাঠালাঠি যুদ্ধ হয়, পেন পেন্সিল, বালিশ পাশবালিশ দিয়ে। ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে থাকে লাল মুখো গোরার দল। তুত্তুরী আপত্তি তোলে, "ফরাসীরাও কিন্তু লাল মুখো গোরাই ছিল মা।" ক্ষণিক থামি আমি, তাও বটে। উল্টো দিক থেকে মঞ্চে প্রবেশ করেন মির জাফরের হবু দোসর রবার্ট ক্লাইভ, বইয়ের পাতায় ক্লাইভের পুঁচকে তৈল চিত্র দেখে বিমোহিত হয়ে যায় তুত্তুরী, " ওমা কি কিউট দেখতে -"। আর আমায় থামায় কে? আমি বাঙালি, আড়াইশ বছর আগে যে ভুল করেছি, আর সে পথে হাঁটতে নারাজ। ক্লাইভ নয়তো, ক্লাইভ পন্থীই সই, পলাশীর প্রান্তর না হোক, কাঁথিই সই -। 


  হাঁটা শেষ করে ফিরে এসে নেহাৎ শৌভিক জাপটে ধরে নিরস্ত করল তাই, না হলে নির্ঘাত বদলে যেত পরাধীন ভারতের ইতিহাস। মাঝখান থেকে রেগে মেগে বইটাই কেড়ে নিল তুত্তুরী, "অনেক হয়েছে মা,তোমায় আর আমাকে ইতিহাস পড়াতে হবে না। অন্তত যে চ্যাপ্টারে যুদ্ধ আছে, সেই চ্যাপ্টার তো হরগিজ আর পড়ছি না তোমার কাছে।" রাষ্ট্র ভাষায় কি যেন বলে, ভালোর দিনই নেই মাইরি।