Wednesday, 16 June 2021

অনির ডাইরি ১৬ই জুন, ২০২১

 


ঠাকুমা প্রায়ই বলতো,‘জন-জামাই-ভাগনা তিন নয় আপনা।’ কিন্তু নাতজামাইয়ের ক্ষেত্রে বোধহয় এ নিয়ম প্রযোজ্য ছিল না। চাটুজ্জে বাড়ির বড় জামাই শ্রী সিদ্ধার্থ ব্যানার্জী ওরফে আমাদের টুলটুল দাদা ছিল আক্ষরিক অর্থেই সবার নয়নমণি।  


দিদিভাইয়ের যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন আমার বয়স বছর চারেক, বুল্লু বাবুর বাবা শ্রীমান অয়ন তখন সদ্য তিন আর কাকা শ্রীমান অনিন্দ্য সবে দাঁড়াতে শিখেছে। বাকি তুতো ভাইবোনদের অবস্থাও তথৈবচ। ফলে দিদির বিয়ের স্মৃতি বেশ অস্পষ্ট, সাদাকালো,ধোঁয়া-ধোঁয়া।


 শুধু মনে পড়ে, সদর দরজার বাঁ হাতে খোলা বাগানে ম্যারাপ বেঁধে পংক্তিভোজের আয়োজন হয়েছিল। টেবিলে পাতার জন্য যে পাতলা মোম কাগজ কেনা হয়েছিল, তার বেশ কিছু রোল বেঁচে যায়। যা দিয়ে পরবর্তী কালে বাড়ির খাতা বানিয়ে দিত বাবা। বিশাল উঠোনে ম্যারাপ বেঁধে সম্পন্ন হয়েছিল বিবাহের আচারবিধি। স্বহস্তে বড় নাতনীকে সম্প্রদান করেছিলেন ঠাকুমা। 


পশ্চিমের বাগানে বড় বড় মাটির উনুন বানিয়ে হয়েছিল রান্নাবান্না। তবে সবার আগে বসেছিল ‘ভিয়েন’। শুভ কাজ উপলক্ষে বাড়িতেই মিষ্টান্ন প্রস্তুত করাকে আমাদের মধ্য হাওড়ার ভাষায় বলে ভিয়েন। চাটুজ্জে বাড়ির যাবতীয় শুভকাজের বিশেষত্বই ছিল ঘরে তৈরি দরবেশ। লাড্ডু পাকানোর আগে ভেজে তোলা লাল-হলুদ বোঁদের পাহাড়,জীবনে সেই প্রথম দেখা। 


সাবেকী বিশাল রান্নাঘরে মাটির উনুনে গড়ে হয়েছিল নিরামিষ রান্নাবান্না। জগন্নাথ ঠাকুর আদতে ছিলেন উড়িষ্যার বাসিন্দা। এ দেশীয়া রমণীকে বিবাহ করে, গলির মুখে একখানি ‘উড়ের হিন্দু হোটেল’ খুলে বসেছিলেন। যাবতীয় শুভকর্মে নিরামিষ রান্নার দায়িত্ব বরাবরই জগন্নাথ ঠাকুরকেই সমর্পিত হত। মনে আছে নিরামিষ হেঁশেলকে ঘিরে বয়স্কাদের আড্ডা। কে ছিল না তাতে? ঠাকুমা, বড় পিসিমা, মুন্সিরহাটের পিসি, বাবার পিসিরা,বাবার মাইমারা। কে জানে অন্য কোনও জ্যোতিষ্কে হয়তো আজও একই রকম ভাবে আড্ডা বসিয়েছেন তাঁরা। 


মনে আছে দিনের বেলা রান্নাঘরের সামনের রোয়াকে কলাপাতা পেতে খেতে বসানো হয়েছিল যাবতীয় কুচোকাচা তুতো ভাইবোনেদের এবং রীতিমত রাবণের মত অট্টহাস্য করে কেমন আমার পাতে হিসি করে দিয়েছিল বছর দুই আড়াইয়ের পিসতুতো ভাই নয়ন। সেটাই প্রথম বা শেষ নির্যাতন নয়, কেন যে আমার প্রতি এমন প্রেম ছিল ব্যাটার। দিব্যি মনে আছে গায়ে হলুদের অব্যবহিত পূর্বে ছিছি মার্কা অপকর্ম করে ব্যাপক ধোলাই খেয়েছিলাম মায়ের হাতে। 


মনে পড়ে স্বর্গীয় ছোটকাকু আর তাঁর বয়স্য গোপাল কাকুর সাথে বর আনতে গিয়েছিলাম আমিও। মনে পড়ে  দক্ষিণ-পূব-পশ্চিম খোলা দোতলার দালানে এক রাশ ভেলমেটে মোড়া তাকিয়া আর প্রচুর কুচো ফুল ছড়িয়ে বাসর সাজানো হয়েছিল দিদিভাই আর টুলটুল দাদার জন্য। সারা সন্ধ্যা যাতে গড়াগড়ি দিয়ে খেলা করছিলাম আমরা কুচো চিংড়ির দল। বিবাহ কার্য সমাপনে যখন বাসরের দিকে হাঁটা লাগিয়েছে নবদম্পতি, সিঁড়ির দরজা আটকেছিল অন্য দিদিরা। টাকা না দিলে খুলবে না বাসর ঘরের দরজা। বর পক্ষও নাছোড়বান্দা, দরকার কি বাসরঘরের? এই তোরা সিঁড়িতেই বসে পড় তো। ধপ করে কারা যেন বসিয়ে দিল দিদিভাই আর টুলটুল দাদাকে। তারপর কি হল? কারা জিতল? তা অবশ্য জানি না। টুলটুল দাদা কোন টাকাপয়সা দিয়েছিল কি না, তাও জানি না। দিয়ে থাকলেও আমাদের ভাগ দেয়নি কেউ।  আর দিলেও যে সেই টাকা নিয়ে কি করতাম, তাও জানি না। 


পরদিন সবাইকে কাঁদিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে দিদিভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি চলে যাবার কথাও খুব মনে পড়ে। যদিও আজ মনে হয়, ওটা আমার শৈশবের নিছক কল্পনা ছিল, দিদিভাই মোটেই সায়রা বানুর মত ‘ম্যায় চলি, ম্যায় চলি’ করতে করতে শ্বশুরবাড়ি যায়নি। 


বিয়ের পরও চলতে থাকে কত যে অাচার- অনুষ্ঠান। বছরে কতবার যে তত্ত্ব পাঠাত জ্যাঠাইমা আর জেঠু তার ইয়ত্তা নেই।  পুজোয় পোশাকপরিচ্ছদের তত্ত্ব, শীতে গুড়- পাটালি-মোয়ার তত্ত্ব, গরম কালে আম-কাঁঠাল-লীচুর তত্ত্ব। জেঠু-জ্যাঠাইমার সাথে থালা ভর্তি দ্রব্যাদি নিয়ে আমরাও যেতাম। আর যেত দেবীদি আর মনসা দা। দিদিভাইয়ের সমবয়সীই ছিল দেবীদি। এখনকার ভাষায় গৃহশ্রমিক, তবে আমি বা অয়ন- অনিন্দ্য দিদি বলেই জানতাম।  আর মনসা দা ছিল এক নিঃসহায় বৃদ্ধ। সন্ধ্যা বেলা কালিবাড়ির মন্দিরে কাঁসরঘন্টা বাজাত মনসা দা। আর টুকটাক ফাইফরমাশ খাটত।আশির দশকের হাওড়া প্রায়শই ডুবে যেত বিদ্যুৎহীনতার আঁধারে। অন্ধকার গলিঘুঁজি দিয়ে টর্চ হাতে এগোত জেঠু, পিছন পিছন লাইন দিয়ে চার আনা- আট আনার দল। সবার পিছনে অতন্দ্র প্রহরীর মত টর্চ জ্বেলে জেঠাইমা। আমাদের সে কি উৎসাহ দিদিভাইয়ের বাড়ি যাবার বাপস্।  গেলেই দিদিভাইয়ের শাশুড়ী মাতা গরম গরম দুর্লভ কেবিনের মোগলাই পরোটা আর মল্লিক সুইটসের রসগোল্লা খাওয়াবে যে-  


আর জামাই ষষ্ঠী এলে তো কথাই নেই। দেড়শো বছরের ফোকলা বাড়িটা যেন ঝলমলিয়ে উঠত। সক্কাল সক্কাল ফোঁটা নিতে আসত টুলটুল দাদা। ঠাকুমার কাঁপা কাঁপা হাতের ফোঁটার পর, মস্ত পিতলের রেকাবি ভর্তি ছয় রকম ফল সহ বাড়ির একমাত্র জামাইয়ের হাতে হরেকরকম মিষ্টি, নতুন পোশাক তুলে দিত জ্যাঠাইমা। জ্যাঠাইমার মত সাজিয়ে দিত না বটে, তবে শুধু টুলটুল দাদার জন্যই থলে ভরে বাজারের সেরা আম আর সবথেকে বড় মিষ্টি কিনে আনত বাবা। আপিস বেরোবার আগে জামাই ফোঁটা দেবে যে মা। 


আসল ভুরিভোজ জমত রাতে। সারাদিন ধরে টুকটুক করে কত কি যে রান্না করত জ্যাঠাইমা। পিতলের রেকাবি, পিতলের বাটি,কাঁসার গ্লাসে সাজিয়ে দেওয়া হত সুখাদ্য। টোপাটোপা সাদা ময়দার লুচি, খাসির টকটকে ঝাল, মাংসের পুর ভরা পটলের দোলমা আরো কত কি। বরবধূ ছাড়াও আমন্ত্রিত থাকত আরো বেশ কিছু মান্যগণ্য অতিথি। দাদাভাই-সোমাদি অর্থাৎ টুলটুল দাদার দাদা-বৌদি তো ছিল আমাদের ঘরের লোক।  আজও চাটুজ্জে বাড়ির যাবতীয় শুভ কর্মে স্বমহিমায় ভাস্বর থাকেন দোঁহে, ওণারা ছাড়াও আরো অনেকে। খাওয়া দাওয়ার ফাঁকে দিদিভাই আর সোমাদিকে জপাত জ্যাঠাইমা-‘হ্যাঁ রে, মাত্র একটাতেই তোদের হয়ে গেল? এখনও সময় আছে, আরো একটা নে-’। দুই তরুণী জননী শুনেই আঁতকে উঠত, রক্ষা করো মা/মাসি , একে রামে রক্ষে নেই-। 


তারপর কত জল বয়ে গেল গঙ্গা দিয়ে। বদলে গেল কত দশক। হারিয়ে গেলেন কত প্রিয়জন। মুচে গেল কত সম্পর্ক। সাদাকালো জীবনে লাগল রঙের ছোঁয়া। জামাই হয়ে এল শৌভিক। শ্বশুর হয়ে দাদু হয়ে গেল টুলটুল দাদা। সেদিনের 'ম্যায় চলি, ম্যায় চলি' করে হাত নেড়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া দিদিভাই আজ জাঁদরেল শাশুড়ি মা। পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে ফোঁটা দেয় জামাইকে। মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, কুশীলব বদলে গেলেও চিত্রনাট্য বোধহয় থেকে যায় অবিকৃতই।

Saturday, 12 June 2021

অনির ডাইরি, ১০ই জুন, ২০২১

 


#বুনো_তেউড়ির_ফুল


সরকারি চাকরগিরির বৈশিষ্ট্যই হল, বারংবার আপনার অপারগতাটুকুকেই বড় করে দেখা। আর সাফল্যটুকুকে চুপড়ি চাপা দিয়ে রাখা। ওটা তো আপনার কাজ মশাই,নিজের কাজটুকু করার জন্য আবার বাহবা চান নাকি? 


ভাগ্যে আমার ওপরওয়ালারা এমন নন। প্রোবেশন পিরিয়ডের হাকুচ তেঁতো, পাঁচন এবং পিছন মার্কা অভিজ্ঞতা টুকু বাদ দিলে, বারবরই আমার ওপরওয়ালা এবং ওয়ালীরা যুগিয়ে গেছেন পূর্ণ সমর্থন, করে গেছেন চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস। আর নীচের তলা প্রমাণ দিয়ে গেছে অখণ্ড নির্ভরশীলতার। আগের দিনেও বলেছিলেন অরুণ বাবু, ‘ম্যাডাম, এতো গুলো লোক, তারপর যখনই জানাজানি হবে, এখানে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, হামলে পড়বে আসেপাশের মানুষ। আগের দিন এনিয়ে ব্যাপক মারামারি হয়েছে। কি ভাবে সামলাব আমরা? আপনি সিভিক পুলিশ রিকুইজিশন করুন। ’ করিনি আমি। ভরসা ছিল আমার টিমের ওপর, কতজন আসবে? কত লোক আসে আমাদের মেলায়? নূন্যতম হাজার?তারওপর থাকে ভিআইপি আর স্থানীয় সাংবাদিকদের ভিড়, যারা হেলায় ঐ জনপ্লাবন সামলে দেয়, তাদের কাছে এতো নিছক নস্যি।   


কে বলবে লক ডাউন? চলছে না গাড়িঘোড়া? পৌনে দশটার মধ্যেই চুুঁচুড়ার হাইমাদ্রাসায় জমায়েত হয়ে গিয়েছিল আমার টিম। নাঃ আমি যাইনি। আমি বসেছিলাম অফিসে। জনৈক স্নেহশীল বড়দা বারবার বলছিলেন ফোন করে, ‘তুই একবার যা। গিয়ে দেখ তো, কোন সমস্যা হচ্ছে কি না?’ আমি যাইনি। কারণ, জানতাম আমি গেলেই তৈরী হবে সমস্যা। উথলে উঠবে অভিমানের ঝাঁপি। ওরা জানে, আমি পাশেই আছি, যে কোন সমস্যায় শুধু একটা ফোনের দূরত্ব।  


আমার কাজ শুধু মাথা ঠাণ্ডা রাখা, আর ফোন করে যাওয়া পরপর। লোক জমায়েত হল কি? ভ্যাকসিন এল কি? কি বলছেন আরো ল্যাপটপ লাগবে? ওয়াইফাই লাগবে? এই আশঙ্কাই করেছিলাম, কপালের নাম গোপাল। মঙ্গলবারের বজ্রপাতে দেহ রেখেছেন আপিসের অর্ধেক কম্প্যুটার আর যাঁরা জীবিত তাঁরা ইন্টারনেট কি বস্তু বুঝতেই পারছেন না। বাধ্য হয়ে তুত্তুরীর ক্লাশ করার জিওফাইটা ব্যাগ বন্দি করে নিয়ে এসেছি। ও রমেশ, এসে নিয়ে যা বাবা। পাসওয়ার্ড কেবল সোমনাথের মোবাইলেই পাঠাব। বড় ভালো ছেলে আমার সোমনাথ। সাঁওতাল বলেই বোধহয় এত ভালো, এমন সাদাসিধে- ‘সোমনাথ দেখো বাবা,ঐ ওয়াইফাই দিয়ে ইস্কুল করে তুত্তুরী, এমন কিছু কেউ খুলো না,যে তুত্তুরী আমায় প্রশ্ন করে, ‘মা এটা কি বস্তু?’ লজ্জায় মাটিতে মিশে যায় সোমনাথ।  


এগারোটা বেজে যায়, রমরমিয়ে শুরু হয়ে যায় শ্রীরামপুর আর আরামবাগের ছুঁচ ফোটানো কর্মসূচী। চুঁচুড়ার কি হল? নির্মল? অরুণ বাবু? চালু করলেন আপনারা? রমেশ আর বর্মন সাহেবের ল্যাপটপ আর তুত্তুরীর ওয়াইফাই নিয়ে প্রস্তুত আমাদের সোমনাথ আর বাদল, বাইরে জমে উঠেছে জনপ্লাবন, কিন্তু পোর্টালের মুখ ভার যে। ঢুকতেই দিচ্ছে না আমাদের। তা হ্যাঁ পোর্টাল, আমাদের ওপরই কেন এত ক্ষোভ বাপু তোর? শুরু হতে হতে সাড়ে বারোটা বাজালি? আর একটা ল্যাপটপ হলে ভালো হত, শুনে মাটিতে মিশে যাই আমি, আমার ল্যাপটপ খানা আনলেই হত, কিন্তু প্রথম কথা তাতে ক্লাশ করছেন কেউ আর দ্বিতীয়তঃ তার কিবোর্ড থেকে B এবং Z অক্ষর দুটি কে জানে কি ভাবে যেন গায়েব হয়ে গেছে। এই নিয়ে প্রতি দিনই চলে দোষারোপ তথা পাল্টা দোষারোপের পালা। যতক্ষণ না তিতিবিরক্ত শৌভিক চিৎকার জোরে, ‘তোরা দুটোই সমান অলম্বুষ। ’ 


বাইরে থেকে ক্রমেই ঢুকে আসছে অন্য মানুষজন, প্রিয়াঙ্কা-সমীর-প্রদীপ-শান্তনু-আশিস সামলাতে সামলাতে বেদম, ‘দাদা আজ এখানে শুধু লেবার দপ্তরের লোকজনেরই ভ্যাকসিনেশন। ছুঁচ তো গোনাগাঁথা। আপনারা বরং সদর হাসপাতাল বা পৌরসভায় চলে যান। ’ তাও আসতে থাকে অনুরোধের ঠেলা, ‘আমি লেবারের লোক না হলেও, আমার মামাতো কাকার পিসেমশাই লেবারে চাকরি করেন। ’ প্রিয়াঙ্কা গম্ভীর মুখে জানায়,লিস্টে নাম নেই।  কখনও বা আসে মৃদু হুমকি, ‘আমি অমুক দাদার লোক।  দাদা বলে দিয়েছেন।’ দাদা দেখালেই এগিয়ে যায় নির্মল, ‘ভাই আমাদের হাতে তো ছুঁচ নেই, ওটা স্বাস্থ্যদপ্তর দেখবে। আপনারা বরং দাদাকে বলুন, ওণাদের জানাতে। ’ আবার কখনও বা আসে মরমী অভিমান, ‘আমি লেবারের নই বলে কি আমায় দেবেন না? তাহলে শুধু আপনারাই বাঁচুন। আমার আর বেঁচে থেকে লাভ নেই। ’ এত করুণ-কঠোর বাক্যবাণ হজম করতে পারে না আমার টিম। নির্মল তাকে আদর করে বসায়, ‘ভ্যাকসিন নেবেন তো? একটু বসুন। দেখছি।’ তারপর ফোন করে আমায়, ‘একে ফেরাতে পারব না ম্যাডাম। ’ 


সাড়ে বারোটা বেজে যায়। সকাল সকাল এক কৌটো ঘরে তৈরি আমসত্ত্ব দিয়েছিল সায়নী, টেনশনে তার অর্ধেক সাফ করে ফেলি আমি। উপহার হিসেবে পাওয়া যায় এক কৌটো সূর্য মোদকের পান্তুয়া আগেভাগে সরিয়ে রাখে ধীমান। ‘ম্যাডাম এটা খুলবেন না কিন্তু। এটা তুত্তুরীর জন্য। ’


সাড়ে বারোটা বাজে। পোর্টালের বাঁদরামির জন্য এখনও শুরু হয় না ভ্যাকসিনেশন। আর এক কাপ চা পেলে ভালো হত, কিন্তু কালেক্টরেটের দুই চাওয়ালাকেই জবরদস্তি ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে গেছে ধীমান। স্থানীয় স্বাস্থ্য অধিকর্তা আশ্বস্ত করেন, ‘ঘাবড়াচ্ছেন কেন, আধঘন্টায় আপনার লাইন ফাঁকা করে দেবো আমরা।’ তবে পোর্টালের অভিমান তখনও হয় না দূর।  আপাততঃ ম্যানুয়াল এন্ট্রি মারতে থাকে সোমনাথ আর বাদল। দুটোর মধ্যে ময়দান সাফ। হোয়াটস্অ্যাপ ভরে ওঠে টিম চুঁচুড়ার বিখ্যাত, ‘ভি-সেলফি’তে।  মাম্পি এসে দিয়ে যায় এক ব্যাগ চারাগাছ আর নদীর পলিমাটি।  কি নেই তাতে-মানিপ্ল্যান্ট থেকে লতানে পান, সিঙ্গোনিয়ামের ঝাড় থেকে ক্যালাঞ্চো। কারি পাতা থেকে ইংলিশ ক্রিপার আর একগাদা গুঁড়ি গুঁড়ি ফুলের গাছ। সাথে এক বস্তা বালিও বয়ে এনেছে মেয়েটা, অল্প করে ছড়িয়ে দিতে হবে শিশিতে রাখা গাছের জলে। পাগল মেয়েটার জন্যই এই গরমেও আমাদের অফিসে ডানা মেলেছে থোকা থোকা পুদিনা। লতিয়ে বাড়ছে পার্পল হার্ট। খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কি যেন একটা পাতা বাহার গাছ। এক হাতে গাছ,অন্য হাতে বালি আর বগলে খোন্তা নিয়ে আমার চেম্বারে ঢোকে মেয়েটা। ঢোকার আগে আপিসের গাছগুলোর মাটি খুবলে এসেছে। তিনবার প্রশ্ন করে মেয়েটা, ‘বালি নেবেন না?’ না রে বাবা। এতো গাছ নিয়ে যাবার অপরাধেই হয়তো নির্বাসন দেবে বর আমার-। তারওপর এককলসি বালি কোথায় রাখি? 


গঙ্গাপাড়ের বুড়ো ডাচ কলোনিতে নামে মেঘলা বিকেলের স্নিগ্ধতা । নির্মল জানায়, ওণারা বিদায় নিলেন, এবার আমাদের পোর্টালে এন্ট্রি করা আর মেসেজ পাঠানোর পালা। তাতে লাগবে ঢের সময়। রাত আটটা তো বটেই। জেলাতুতো আধিকারিক বোন আর স্বাস্থ্য দপ্তরের আধিকারিকদের মেসেজে ধন্যবাদ জানাই। এতদিন ধরে আমাকে সহ্য করা কি কম বড় কথা! আর বড়দির কাছে জানাই, রাত আটটা বাজবে মনে হচ্ছে। দুটো ল্যাপটপ আর তিনটে মোবাইল মিলিয়ে কাজ করছে আমার টিম তাও-। বড়দি জানেন, মাঝেমধ্যে অমন সুখী সুখী ঘ্যানঘ্যান করি আমি। বড়দি বলেন ,‘সাবধানে থেকো, মেয়েমেয়েগুলো কিছু ভালোমন্দ খাইয়ে দিও। ’ সে তো দেবোই,তবে আজ না। অন্যদিন, যেদিন কাজের অজুহাতে শুধু খেতেই জমায়েত হব সবাই, আজ খাওয়ালে উপভোগ করতে পারবে না কেউ। আজকের জন্য বড়জোর ঘড়ির মোড়ের ব্যানার্জীর দোকানের রুটি তড়কা বা প্রাক্তন বড় সাহেবের প্রিয় নৈশ ভোজ, রুটি আর আলুপোস্ত। তবে তার আগে, একপ্রস্থ ছবি তোলা হবে না, তা আবার হয়? সারাদিনের উত্তেজনায়, গায়েগতরে খাটুনিতে সবার মুখে জমেছে পুরু তেলের আস্তরণ, অবিন্যস্ত কেশবাস- তবে মুখে ঝলকাচ্ছে খুশির দীপ্তি। এই ছবির নাম থাক, ‘বুনো তেউড়ির ফুল।’ 


পুনশ্চঃ নামটা আমার খুড়তুতো ভাই শ্রী অয়ন চট্টোপাধ্যায়ের থেকে ধার নেওয়া। বাপের বাড়ির বুড়ো আঙিনায় ফুটে থাকা থোকা থোকা রঙবেরঙের একরাশ বুনো ফুলের নাম, অয়ন বাবু রেখেছে বুনো তেউড়ির ফুল। এরাও তেমনি আমার বুনো তেউড়ির ফুল। আর এই ডাইরি হল, উপরওয়ালা হিসেবে আমার বাহবা। খুব ভালো থেকো আমার বুনো তেউড়ির ফুলেরা। তোমাদের ভালোবাসাই এই চাকরি জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। বাকিটা তো নিছক চাকরানী গিরি।

Wednesday, 9 June 2021

অনির ডাইরি ৯ই জুন, ২০২১

 


মা হবার সবথেকে বড় সমস্যা হল, যে কোন সুখাদ্য আস্বাদন করতে গেলেই,  চোখের সামনে ভেসে ওঠে, একজোড়া কচি কচি কুৎকুতে চোখ। খেতে বড় ভালোবাসে মেয়েটা আমার। চুঁচুড়ার স্পাইসির স্পেশাল মটন বিরিয়ানির কাছে ওসব আপনাদের আরসালান, আমিনিয়া বা রহমানিয়া নেহাৎ শিশু। এক কৌটো সুবাসী ভাতের মধ্যে একখণ্ড তুলতুলে তোবলা আলু, তার নীচে লুকিয়ে থাকা একটি সিদ্ধ ডিম আর থুলথুলে একখান মাটন। 


কাল আমাদের মহারণ, তার আগে চাঁদা তুলে বিরিয়ানি খাওয়া। বলির আগে ইয়েকে কচি কাঁঠাল পাতা খাওয়ানোর সমতুল হলেও, খেতে আর পারলাম কই, কয়েক চামচ সুবাসী ভাত আর আলুটা খেলাম বটে, বাকিটা প্যাক করে ব্যাগে ঢোকালাম। বিরিয়ানির আলুটা মোটেই পছন্দ করে না তুত্তুরী, তবে আতরে জবজবে ভাত,মাটন আর ডিমটা বড় ভালোবাসে।


গাড়িতে বসে মোবাইল দেখলে, যেমন মাথা ঘোরে তেমনি গা গুলায়। পাপী পেটের ব্যাপার, ফোন করতে,ফোন ঘাঁটতে,রিপোর্ট মেলাতে, ফোন তুলে লোককে ধমকাতে, চমকাতে, মতামত চাইতে, মতামত দিতে, জনসংযোগ করতে ঘাঁটতেই হয় মোবাইল। অসম্ভব গা গুলোতে থাকায় নেমেই পড়লাম হাই রোডের ধারে। নীল দিগন্তে তখন ম্যাজিক। বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত হতে পারে নাকি কাল, যুগপৎ বাড়িতে শৌভিক আর আপিসে রমেশ ভয় দেখিয়েছে - হলেই চিত্তির। যাবতীয় কৃতকর্মের ওপর আইস টি।


ছোট্ট দোকান, দোকানের সামনের রোয়াকে পা দুলিয়ে বসে গল্প করছে তিন জোড়া কপোতকপোতী। বাকি অংশে  রাখা কয়েকটা হেলমেট। ভিতরে সৌম্য দর্শনা প্রৌঢ়া ছ্যাঁকছোঁক করে কি সব রান্নাবান্না করছেন। গরম অমলেটের সুবাসে মথিত রাজপথ। প্রশ্নের জবাবে ঘাড় নেড়ে জানালেন চা হবে। বড় ভাঁড় না ছোট ভাঁড়। প্রাক্তন বড়সাহেব থাকলে নির্ঘাত বলতেন, ‘সবথেকে বড় ভাঁড়। ’ স্যার অমনি ছিলেন। চা-তাল। তবে আমি বা সুবীর বাবু কেউই অত চা একসাথে খেতে পারি না। তাই একদম এক চুমুকে নিঃশেষ এমন ভাঁড় না হলেই চলে। চায়ের দোকানে কাঁচের বয়ামে রাখা বিস্কুটের প্রতি অসম্ভব শিশুসুলভ লোভ ছিল স্যারের। নিজেও খেতেন,  ড্রাইভার আর আমাকেও জোর করে খাওয়াতেন। কাঁচের বয়ামে রাখলে বিস্কুটগুলো কি একটু বেশী সুস্বাদু হয়ে যায়? রাজপথের ধারে এই চায়ের দোকানগুলোতে কত রকম যে বেকারী বিস্কুট পাওয়া যায়! আর পাওয়া যায় টিফিন কেক। নামী ব্রাণ্ডের দামী কেক নয়। ছোট্ট বেলার পাখির ছবিওয়ালা পার্পল রঙের প্যাকেটে মোড়া ফিলিপস্ বা হলুদ-সবুজ ওরাং-ওটাং রঙা বাপুজী। একটু বেশী মিষ্টি বটে,তবে ওগুলো চায়ে ডুবিয়ে খেলে মনে হয় সাক্ষাৎ অমৃত। সুবীর বাবুকে প্রশ্ন করলাম, ‘বিস্কুট খাবেন? আমি কিন্তু খাব। ’ দোকানের সামনে রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খাচ্ছিলেন উনি, মাথা নেড়ে জানালেন কিচ্ছু চাই না। তারপর ইশারায় সামনের রোয়াকটা দেখিয়ে বললেন, ‘বসুন না ম্যাডাম। ’ যেখানে বসতে বললেন,  সেখানে বিরাজমান দুটি জাব্দা হেলমেট। পাশের ছেলেটি, সঙ্কোচে হেলমেট সরিয়ে বলল ,‘বসুন না। ’ বসেই তো ছিলাম সারাদিন।  বসে বসেই ধরে গেল মাথা। বসব না বলার পর, ছেলেটি ইতঃস্তত করে প্রশ্নটা করেই ফেলল, ‘ট্রেন কবে চলবে?’ সরকারী বাহন দেখেই বোধহয় প্রশ্নটা করেছে ছেলেটা, কিন্তু এই প্রশ্ন তো আমারও। ট্রেন কবে চলবে? কবে চলবে ট্রেন? 


 স্টিলের থালায় দুটি ধুমায়িত ভাঁড় নিয়ে হাজির হলেন ভদ্রমহিলা। গরম চায়ে একচুমুক দিতেই জুড়িয়ে গেল মনপ্রাণ। হেসে বললাম, ‘কি করে জানব বাবা? তুই যেখানে আমিও সেখানে।’ সামনের কাঁচের বয়ামের ভিতরে রাখা বই গজাগুলো বড়ই সুন্দর দেখতে। গজা দিয়ে চা খেলে কি অ্যাসিড হবে? লোকে বলে বটে, তবে হাওড়ার ছেলেমেয়েদের ওসব হয়টয় না বোধহয়। দিদি একটা গজা দিন তো,আর কয়েকটা প্যাকও করে দিন। একটু কিটকিটে মিষ্টি বটে, তবে ভালো লাগবে নির্ঘাত মেয়েটার। নাঃ মা হওয়ার সত্যিই জ্বালা মাইরি!

অনির ডাইরি ৬ই জুন, ২০২১

 

তুত্তুরী বলল, ‘মা আই হ্যাভ আ ক্রাশ।’ আর মাসখানেক বাদে এগারোয় পড়বে, এই বয়সে ক্রাশ না থাকাটাই তো অস্বাভাবিক। আমার তো এর ঢেড় আগে থেকে ছিল। গোবিন্দা আহাঃ! বুধবারের চিত্রহার আর চিত্রহারে গোবিন্দা। দিদি-মাসি- পিসিরা তখন আকণ্ঠ নিমজ্জিত ইমরান খান আর ওয়াসিম আক্রমের প্রেমে। দিশি প্লেবয় বলতে রবি শাস্ত্রী। শাস্ত্রির অডি গাড়ি জেতা এবং শ্যাম্পেনের বোতল খোলা স্বচক্ষে  না দেখলেও, এত গল্প শুনেছিলাম বাপস্। মিঠুনও ছিল বটে। তবে মিঠুনের ভক্তবৃন্দের মধ্যে জুলফি ওড়ানো হুমদোদের সংখ্যাই ছিল বেশী। প্রথম প্রেম যদি কেশব হন, তো দ্বিতীয় প্রেম অবশ্যই ছিল গোবিন্দা। আর ১৯৮৯থেকে তো সবাইকে হঠিয়ে হৃদয়ের দখল নিয়েছিলেন জনৈক পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির মারাঠি ছোকরা।  


যাই হোক, তুত্তুরীর কথায় ফেরা যাক। তুত্তুরীর যে ভয়ানক ক্রাশ তৈরী হয়েছে, তা শৌভিক এবং আমি প্রতিনিয়ত অনুভব করছি। গুগল বা ইউটিউব খুললেই দেখা যায় পদচিহ্ন ছেড়ে গেছেন শ্রীমতী তুত্তুরী। স্টার জলসায় বাংলায় ডাব করে দেখানো রাধা-কৃষ্ণ নামক সিরিয়াল এবং তার কুশীলবদের চূড়ান্ত অনুরাগিনী তুত্তুরী। অনুরাগের মাত্রা এতটাই চিটচিটে যে এক প্রস্থ  দুপুর বেলা বাংলায় দেখার পর, রাত নামলে পুনরায় হিন্দিতে ঐ একই সিরিয়াল দেখেন তিনি। ওই সিরিয়ালের প্রতিটি কুশীলবের নাম  ঠোঁটস্থ তাঁর। কবে, কার জন্মদিন গেল, কবে কে বিয়ে করলেন, সেই বিয়ে বা জন্মদিনের পার্টিতে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন তা সবই শ্রীমতী তুত্তরীর নখদর্পণে। 


সম্প্রতি জনৈক সুমেধ মাডগালকার নামক অভিনেতার প্রতি একটু বেশিই দুর্বল তুত্তুরী। তাঁর চোখের রঙ নাকি সমুদ্র সবুজ। গায়ের রঙ দুধে আলতা। শ্রীকৃষ্ণ অমন দুধেআলতা বরণ কবে হলেন এসব প্রশ্ন করা অর্থহীন। এতে শ্রীমতী তুত্তুরীর উত্তেজনাই শুধু বাড়ে। এমনিতেই যথেষ্ট উত্তেজিত তুত্তুরী, ইউটিউবে কারা যেন সুমেধের সাথে কোন অভিনেত্রীকে জড়িয়ে অনর্থক কুৎসা রটাচ্ছে। ট্রোল করছে। 


যাই হোক, আবার ফিরে যাই, শ্রীমতী তুত্তুরীর ক্রাশের কাছে। খেতে বসে তুত্তুরী যখন জানাল, তাঁর একটি ক্রাশ তৈরী হয়েছে, তখন তো প্রশ্ন করতেই হয়, সেই ব্যক্তিটি কে? মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে দুষ্টু হেসে জবাব দেয় তুত্তুরী, ‘রোহন মাডগালকর’। সে আবার কে? একটাই তো, মাডগালকরের কথা শুনে আসছি এযাবৎ। জবাব পেলাম, ইনি তাঁর প্রিয় পোষ্য বিশেষ। জাতে খাস সোনালী রিট্রিভার। সম্প্রতি সুমেধ মাডগালকরের কোন ভিডিওতে নাকি তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছে তুত্তুরীর।  


দিবারাত্র বোকাবাক্সের কৃষ্ণনাম শুনে শুনে কান পচে গেল মাইরি। তাই বলতে গেলাম, কিছুদিন নাহয় ওকে স্টক করা ছাড়। বলেই পড়লাম ফ্যাসাদে। এবার বোঝাও স্টকিং কারে কয়?ভাগ্যে  গুগল ছিল, গুগল বলে স্টকিং এর সংজ্ঞা হল- মাত্রাতিরিক্ত তথা অযাচিত মনোযোগ দিয়ে কাউকে হয়রান করা। সামান্য ভিডিও দেখে কি করে সুমেধকে হয়রান করা হয়,  এই প্রশ্নের উত্তরে যখন নাকানিচোবানি খাচ্ছি, টেবিলের ওপার থেকে গম্ভীর মুখে বলে ওঠে শৌভিক, ‘এটাকে ঠিক স্টকিং করা বলে না। ও কি জানে তার টয়লেট রুটিন কি বা সে কি টয়লেট ক্লিনার ব্যবহার করে।’ অসাধারণ! এই পৃথিবীর যে কোন আলোচ্য বিষয়কে নিয়েই এরা বাপমেয়ে যে কিভাবে, ‘টয়লেট এক প্রেম কথা' বানাতে পারে, তা বোধহয় এই ডাইনিং টেবিলে না বসলে জানা সম্ভব নয়।  তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে তুত্তুরী।  কিছুতেই পরাস্ত হতে রাজি নন তিনি। সুমেধের প্রাতঃকৃতের শিডিউল তার অজ্ঞাত বটে,তবে তিনি এটা তো জানেন,  যে রোজ সকালে ঘুম  থেকে উঠেই সুমেধ চা বানায়। জবাবে বাবা বলে, ‘তা সে ও চা খেলে তো ওকেই বানাতে হবে।’ নাঃ মোটেই শুধু নিজে খাবে বলে বানায় না, সাথে সাথে   মা আর পিসিকেও চা বানিয়ে খাওয়ায় সুমেধ। তুত্তরী এটাও জানে  যে, চা খেয়ে বাগানে গাছে জল দেয় সুমেধ। তারপর? তারপরের পর্বটা না হয় উহ্যই থাকুক। এত কিছু লিখলে যদি সুমেধ জানতে পেরে যায়। তাহলে সেটা বড়ই লজ্জার ব্যাপার হবে।সুমেধ অবশ্য আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই-ইয়ে আপনারাও বলবেন না কিন্তু।

Sunday, 30 May 2021

অনির ডাইরি ২৯শে মে, ২০২১

 



তুত্তুরীর টিন এজটাকে বড় ভয় আমার। কে জানে কেমন হবে তখন মেয়েটা।  কতটা বনবে আমার সাথে। এখনও যে খুব একটা বনে তা নয়। অবশ্য তাতে আমার অবদানও খুব একটা কম কিছু নয়।  যেমন আজ সকালে, কি যে আজব ভাষায় গান গাইছিল  মেয়েটা। যার না আছে মাথা না মুণ্ড। 'আ লাড়ুম। ইরঙ্গল তুনিড়োরে, পাদঙ্গল তিমিরোড়ে, সি রঙ্ঘলওয়া‘ রঙ্গলওয়া, রঙ্গলওয়া। ভূরি। কড়াঙ্গল দিদু উঙ্গল, কালাম্বিনী মেদুনি আপ্পা, বিদপো, ভিদমনি-’।’ 


 সাধ করে বাংলা তর্জমা করেদিলাম, ‘আয় নাড়ু। আকাশে তিমি ওড়ে, দঙ্গল বেঁধে তিমি ওড়ে। কড়ে আঙুলে দিদু ওড়ে। সি মঙ্গলবার, বুধবার, বিষ্যুৎবার। ভুঁড়ি। ’ ভেবেছিলাম খুশি হবে, খুশি তো হলেই না, উল্টে রণে ভঙ্গ দিয়ে বাবার কাছে নালিশ করতে দৌড়ল শ্রীমতী তুত্তুরী। এরা বাপ-মেয়েতে যে তলে তলে যুক্ত ফ্রন্ট খুলেছে তা আমি দিব্য বুঝতে পারি। কাল যখন মনের ভুলে, নুনের কৌটো ফ্রিজে তুলে সারা বাড়ি তোলপাড় করছিলাম আমি, তখনও এরা খুঁজে দেবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে, দল বেঁধে আওয়াজ দিচ্ছিল। 


 এই তো সেদিন পর্যন্তও মেয়েটা বলত,  ‘আমি দিদিকে বিয়ে করব।’ দিদি অর্থাৎ আমার বাবার দিদি। এষার সাথে আলাপ হওয়ার পর, ঠিক করেছিল এষা পিসিকেই বিয়ে করবে। উমা বিয়ে হয়ে আসার পর, এষা পিসিকে ত্যাগ করল না বটে, তবে কাকিমা এবং এষা পিসির মধ্যে রইল দোদুল্যমান হয়ে। প্রায়ই প্রশ্ন করত, দুটো বিয়ে কি একেবারেই করা যাবে না?  তাহলে বিয়েটা ঠিক কাকে করবে? নাকি বড় মামিকেই শেষ পর্যন্ত? বর্তমানে পাত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন কেবল বাবা। দিনান্তে বাবার কান মুলতে মুলতে বা চুল টানতে টানতে, আব্দেরে গলায় ফরমাইশ করে তুত্তুরী, ‘বাবা, আমি কিন্তু তোমাকেই বিয়ে করব, কেমন?’ 


একই দাবী অবশ্য আমিও করতাম। কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগে, ঘুম পাড়াতে উদ্যত মায়ের গলা জড়িয়ে একই রকম আব্দেরে সুরে বলতাম, ‘মা, আমি কিন্তু তোমাকেই বিয়ে করব। ’ মা হবার বোধহয় এটাই সবথেকে বড় মজা, আরেকবার ফিরে যাওয়া যায় নিজের শৈশবে। কে জানে হয়তো একই অনুভূতি অনুভব করে বাবারাও। বারো বছরের দাম্পত্যের উপান্তে এসে তাই বুঝি মাঝেমাঝেই  বড় বেশী বাবা-মা হয়ে উঠি আমরা। তক্কে তক্কে থাকা, চুরি করে পাওয়া, হাতে গোণা একান্ত নিভৃত মুহূর্তে আলোচনা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আলোচনা করে ফেলি তাঁরই কথা। দেশ-দুনিয়ার রাজনীতি, অতিমারি, বই, সিনেমা, অ্যামাজন-না নেটফ্লিক্স ইত্যাদি গুরুগম্ভীর তত্ত্বালোচনা বা নিছক দ্বৈরথের মধ্যেও অনায়াসে ঢুকে পড়েন তিনি। এমনকি কথাবার্তাও তাঁরই ভাষাতেই বলি  আজকাল আমরা। যেমন সেদিন আমার জন্মদিনে উপহার পাওয়া কাঠের যোগাভ্যাসরতা কন্যাটিকে খণ্ডবিখণ্ড করার পর তিনি কাঁদোকাঁদো হয়ে বললেন, ‘লেলেং গঙ্গা হয়ে গেছে’। তারপর থেকে যেকোন জিনিস ধ্বংস হয়ে গেলে, নষ্ট হয়ে গেলে, বরবাদ হয়ে গেলে আমরা বলি, ‘ওটা লেলেং গঙ্গা হয়ে গেছে। ’  যেমন রেগে গেলে তিনি বলেন ,' গররর্'। একটু আগে, ‘এনে ভুঁড়ি’ গেয়ে তুত্তুরীকে বিরক্ত করার পর শৌভিকও এসে বলে গেল, ‘গররর্’।


 কাল পর্যন্ত আমার সামান্য স্পর্শ, একটু সময় আর একটা আলগা চুম্বনের জন্য তৃষিতের মত প্রতীক্ষা করা বাচ্ছা মেয়েটা, আজকাল বড় বেশি বাবার অনুরাগিনী। বাপ-মেয়ের এই সখ্যের দাপটে মাঝেমাঝেই প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায় আমার। প্রায় সমবয়সী দম্পতি আমরা, খুনসুটি থেকে বালিশ নিয়ে উদোম ঝাড়পিটে লুকিয়ে বাড়ে প্রেম। মুস্কিল হচ্ছে আজকাল শৌভিকের সাথে তর্কাতর্কি হলেই, কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে আসেন তিনি। বাবার সাথে ঝাড়পিটের মধ্যে কামড়েও দেন ঘ্যাঁক করে। কবে যে মেয়েটা বাবাকে তার রোল মডেল ঠাওরাল ভাবতে বসে তাজ্জব হয়ে যাই আমি।  মাঝে মধ্যে তীব্র অভিমানে ছলছলিয়ে ওঠে আঁখি। পরমুহূর্তেই উপলব্ধি করি, এটাই তো হবার ছিল। এটাই তো আমার কর্মফল। জ্ঞান হওয়া ইস্তক বাবার মেয়ে ছিলাম আমি। কবে কোন দাম্পত্যকলহে মাকে সমর্থন করেছি মনেই পড়ে না। বাবা মানে অগাদ প্রশ্রয়। বাবা মানে জীবনের একমাত্র পুরুষ, যার চোখে আমি যথার্থই অনিন্দিতা। আর মা মানে, এক অনন্ত শিক্ষয়িত্রী। বেশ জাঁদরেল  ব্যপারসাপার। কেবলই শিক্ষা দিত মা। ‘ তরকারি থেকে বেছে বেছে কুমড়োগুলো ফেললে কেন? অত জোরে হাসবে না। অত বেশি টিভি দেখবে না। অমন ধড়াম করে দরজা বন্ধ করবে না। রাগ হলে অমন দুমদাম করে চলবে না। মুখে মুখে চোপা কাটবে না। বেলা করে ঘুম থেকে উঠবে না। ’ সর্বোপরি 'পড়তে বসো, পড়তে বসো এবং পড়তে বসো।'  এগুলো কে বলত? এগুলো কে বলে? মা না আমি? তারুণ্যে সবথেকে কঠোর সমালোচক ছিলাম যার, তবে কি, ঠিক তারই মত হয়ে উঠছি আমি? 


 আজ সকাল থেকে বায়না জুড়েছেন,  রান্না করতে চান শ্রীমতী তুত্তুরী। নাঃ মোটেই গরম জলে ম্যাগি দেবার মত, বা গলে যাওয়া মাখনে পোচ বানানোর মত সহজসরল কোন রান্না নয়, জম্পেশ করে কোন পদ বানাতে চায় তুত্তুরী। ঠিক যেমন ঐ দাদাটা বানিয়েছে। দাদাটার নামটা না হয় উহ্যই থাকুক, তার মা কোন এক প্রাগৈতিহাসিক যুগে আমার সহপাঠিনী ছিল। যেমন অতুলনীয়া গুণবতী জননী, তেমনি তাঁর সুযোগ্য পুত্র। মা রন্ধনে দ্রৌপদী, পুত্রও তাই। কতই বা বড় হবে ছেলেটা, তুত্তুরীর থেকে বছর দুই? নাকি তাও নয়। এইটুকু পুঁচকে একটা ছেলে, নাক টিপলে দুধ বেরোয়, সে তার মায়ের জন্মদিনে উপলক্ষে যে সব পদ বানিয়েছিল,তা দেখে আমাদেরই চক্ষুচড়কগাছ তো তুত্তরী তো নেহাত ছেলেমানুষ। 


সেই থেকে বায়না জুড়েছে তুত্তরী, জমিয়ে কিছু রান্না করবেন তিনিও। শুধু গ্যাস জ্বালিয়ে দেওয়া ছাড়া যেখানে থাকবে না আমার কোনই ভূমিকা। এতো বেশ আনন্দের কথা। তা রাঁধুক না, আমি নাহয় দাঁড়িয়ে থাকব, চৌকাঠের এপারে। আধ ঘন্টার তীব্র হুমহাম (চিন্তান্বিত মুখে পায়চারি করাকে শাশুড়ি মাতা যে নামে সম্বোধন করেন আর কি) অন্তে করুণ সুরে এসে জানাল তুত্তরী, 'মা কি রাঁধব একটু বলে দাও না।' 


সত্যি কথা বলতে কি,  কালিয়া-কাবাব বানাতে যে সব সামগ্রী লাগে, তাদের লিস্ট একখান যোগাড় করেছি বটে, তবে হাতের কাছে সামান্য গরম মশলা ছাড়া নেই প্রায় কোন উপকরণই। 


তখনই মনে পড়ল পালং চিংড়ির কথা। কোন একটা গ্রুপে পড়েছিলাম। রান্না করাও সহজ, লাগেও যৎসামান্য উপকরণ, আর তা মজুতও আছে ঘরে।  পালং শাককে সামান্য নুন দিয়ে সিদ্ধ করে মিক্সিতে বেটে নিতে হয়। বাটার সময় তার সাথেই পরিমাণ বুঝে একখান মাঝারি বা বড় পেঁয়াজ, গোটা তিন/চার কোয়া রসুন, সামান্য আদা, গোটা দুয়েক কাঁচা লঙ্কা বেটে নিতে হয়। এই বাটা মসলাটাই এত সুগন্ধি হয়, যে মনে হয়, শুধু ওটা দিয়েই খেয়ে নেওয়া যায়, এক থালা ভাত।  


ভাজার আগে, সামান্য নুন-হলুদ জলে ভাপিয়ে নিতে হয় চিংড়ি মাছগুলি। না হলে তেলে দিলেই বড় শক্ত হয়ে যায়। গরম তেলে, ভাপানো মাছগুলো অল্প নাড়াচাড়া করে তুলে নিয়ে, ঐ তেলেই পাঁচফোড়ন, ২টি শুকনো লঙ্কা, তেজ পাতা ফোড়ন সহ শাক বাটাটা দিয়ে কিছুক্ষণ ভাজা ভাজা করে, তাতে হলুদ গুঁড়ো, সামান্য লঙ্কা গুঁড়ো, টমেটোর রস, একটু জিরে গুঁড়ো মিশিয়ে  কষতে কষতে তেল ছাড়লে, ভাজা চিংড়ি মাছ গুলি দিয়ে, পরিমাণ মত নুন-মিষ্টি চেখে, সামান্য ফুটিয়ে নামিয়ে নিতে হয়। জল দিতে নেই। মানে দেওয়াই যায়, দিলে বড় তরল হয়ে যায় ব্যাপারখানা। নামানোর একটু আগে অল্প কসুরি মেথি ছড়িয়ে দিলে এমনিই সৌরভে মথিত হয় গোটা বাড়ি।


বলা যত সহজ, ব্যাপারটা মোটেই অত সহজ হয়নি শ্রীমতী তুত্তুরীর পক্ষে। প্রথমতঃ কাঁচা মাছের আঁশটে গন্ধেই তিনি ছুট্টে পগার পার। শাক সিদ্ধ এবং বাটার পর যখন পুনরায় মঞ্চে প্রবিষ্ট হলেন, গরম তেলে মাছ ছাড়তে গিয়ে আবার ধাক্কা খেলেন তিনি। যত বলি, হাত নামিয়ে তেলের কাছে এনে টুপ করে ছাড় মাছটা, ততো ভয়ে থরথর করেন তিনি। ছপাৎ করে একখান ছাড়লেন বটে, খানিক তেল গিয়ে পড়ল পাশে রাখা নুনের কৌটোর ঢাকায়।


অগত্যা বলতেই হল, ঢের হয়েছে মা, এবার ক্ষ্যামা দাও।  তুমি বরং তোমার ঐ গানটাই গাও। আমি আর বাংলা তর্জমা করব না। আর আমায় শান্তিতে রাঁধতে দাও। যার কাজ তাকেই সাজে। বলতে গিয়ে মনে হল,  এর আগেও কোথায় যেন শুনেছি কথাটা, অন্য কোন সাদাকালো দশকে, জনৈকা জাঁদরেল ভদ্রমহিলার মুখে।  এই রে, আমি সত্যিসত্যিই ‘মা’ হয়ে উঠছি- সামনে তাহলে বাকি এখনও বহু যুদ্ধ।

Wednesday, 26 May 2021

অনির ডাইরি ২৪শে মে, ২০২১

 

'I set out on a narrow way many years ago,

Hoping I would find true love along the broken road.

But I got lost a time or two,

Wiped my brow and kept pushing through.

I couldn't see how every sign pointed straight to you'


আজ আমার বিয়ের দিন। ধুর কি ভুলভাল বকছি, বিয়ে তো হয়ে গেছে মাস তিনেক আগেই, সরকার বাহাদুরের ছাপ মারা, আগমার্কা বিয়ে। আজকেরটা তো বাবার মন রাখতে নিছক লোকাচার। গতপরশু থেকে গমগম করছে বাড়িটা, রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কাপের পর কাপ চা করেই চলেছে সেজোমাসি। অকারণে সারা বাড়ি চরকি পাক খাচ্ছে জ্যাঠাইমা। ভাঁড়ার সামলাচ্ছে বড়মাসি। অগোছালো বাড়িটা গুছিয়ে গুছিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ছোটমাসি, দীপু আর ছুটকি। বাবাকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়ছে না টুলটুল দাদা, খালি ‘কাকা এটা একবার দেখে নিন। ওটা একবার দেখে নিন’ করে করে পাগল করে ছাড়ল লোকটা।  কোন বাড়ির বড় জামাই, তার খুড়তুতো শালির বিয়েতে এমন কুলিকামিনের মত কোমর বেঁধে খাটে শুনি? 


কাক না ডাকা ভোরে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে কণিকা মাসি।আলো ফোটার আগেই খেয়ে নিতে হবে দধিকর্মা। হাতে বোনা আসনে বসে আধঘুমন্ত অবস্থায় কি যে খেলুম,মনে নেই। জ্যাঠাইমা তো কেঁদেই হাট করল। মা আর জ্যাঠাইমা গতকাল থেকেই কেঁদে হাট করছে।  আগের দিন সন্ধ্যাবেলা যখন কদমতলা বাজার থেকে দুহাত ভর্তি শাঁখা-পলা আর লোহার কড় পরিয়ে নিয়েএল দিদিভাই, উঠোন পেরিয়ে লাল রোয়াকে পা রাখতেই  হু হু করে কেঁদে ভাসিয়েছিল জ্যাঠাইমা। দিদিভাইয়ের বিয়ের পর, আমাকে নিয়েই ভুলে ছিল, এবার যে আমার যাবার পালা।   


নীলপাড় হলুদ রঙের হলহলে একটা সিল্ক পরে একা বসে আছি ঘরে। গায়ে হলুদ এসেছে। জানি সঙ্গে এসেছে আমার দুই দেওর, এক ননদ, আর শৌভিকের পিসেমশাই। কি পাঠিয়েছে তাও জানি। নিজেরাই ঘুরে ফিরে পছন্দ করে কিনেছি যে। যা চেয়েছি, যা ভালো লেগেছে অকাতরে কিনে দিয়েছেন শ্বশুরমশাই। শুধু সাজানোটা দেখিনি। শৌভিকের পিসির ননদ, নাকি অতি যত্ন করে অতি উত্তম রূপে সাজিয়েছেন সবকিছু। সেটাও দেখেই ফেলতাম, যদি বিয়ের দিন চারেক আগে উত্তমমধ্যম ঝগড়াটা না হত। 


তত্ত্ব দেখে সবাই  উচ্ছ্বসিত। আমি ঘরে বন্দী। ওরে আমাকেও কেউ ডেকে দেখা রে বাপ। আমার দুই প্রাণাধিকা সহচরী সঞ্চিতা আর পম্পা একবার ঘরে ঢুকছে, একবার বেরোচ্ছে। কিন্তু আমার এখনও মঞ্চে প্রবেশের সময় হয়নি। দিদিভাই এসে ধরে নিয়ে গেল,ফিসফিস করে বলল, একটু লাজুকলতা হতে।হ্যাংলার মত যেন তত্ত্ব আর মিষ্টি দেখতে না বসে যাই। সাজিয়ে রাখা চেয়ারে ধপ করে বসতে গিয়েও, অতি সন্তর্পণে, অতি যতনে বসার চেষ্টা করলাম। সামনে একটি লাজুক লাজুক পুঁচকে মেয়ে। তারপাশে ভয়ানক গাম্ভীর্য নিয়ে আমাদের উমার ভাবী বর, শ্রীমান টুকলু অর্থাৎ শৌভিকের সহোদর। তার পাশে বিগলিত মুখে আরেক দেওর শ্রীমান সুশান্ত। তারপাশে এক ভয়ানক সুদর্শন ব্যক্তি। তিনি ঠিক কোন পক্ষের লোক বলা মুস্কিল, দিব্যি একহাতে আমার বাবা অপরহাতে আমার মাকে বগলদাবা করে  বলছেন, ‘আমি তো এবাড়ির লোক। কি করতে হবে বলুন শুধু,ব্যাস। ’ এটা আবার কে? আর পিসেমশাইটা গেল কোথায়? যাকে শৌভিকরা ডাকে ছোটেকাকা? বাঙালী বাড়ির বিখ্যাত অবাঙালী জামাই। 

গোটা বাড়ির লোকের সাথে গপ্প করে বরের বাড়ির লোকজন বিদেয় হল।  এবার গায়ে হলুদের পালা। আমার  বৌদিরা এখনও এল না। উফঃ কথাই বলব না আজ ব্যাটাদের সাথে। মানছি দুটো বাচ্ছা নিয়ে নাজেহাল, তাই বলে একমাত্র ননদের বিয়েতে এত দেরী কেউ? ওদের বিয়ের সময় ১০সেকেণ্ডের জন্যও ওদের একলা ছেড়েছি আমি? উফঃ আর কি সেজেগুজে এসেছে মাইরি। বিয়েটা কার? ভাবছে, সরি বললে, আর জড়িয়ে ধরলেই গলে যাব বুঝি। এত সহজে রাগ কমে নাকি? 


এক গা হলুদ মেখে স্নানে ঢুকেছি, জল চলে গেল। কি জ্বালা রে ভাই। সমানে দরজা পিটছে ছোটমাসি,‘বেরো রে। কতক্ষণ ধরে চান করবি?’ জল না এলে কি করব? স্নান না করেই বেরিয়ে যাই? ‘অ্যাই’ ধমকে উঠল ছোট। নতুন বউকে অমন কটকট করে কথা বলতে নেই। 


ঘরের দরজা বন্ধ করে জবরদস্তি চারটে লুচি তরকারী মুখে ঠুসে দিল দিদিভাই। সেই মধ্যরাতের আগে আর খেতে পাব না। পেটে না ঢুকলেও খেতে হবে। এবার সাজার পালা। কনে সাজাতে নাকি অনেকক্ষণ লাগে। ছোটমাসি পইপই করে বলে দিল, বেশী সাজের দরকার নেই।  বিকাল বিকাল যেন পৌঁছে যাই দেবকন্যায়। বড় ব্যাগে বেনারসী, আর গয়নাগাঁটি ভরে টুলটুল দাদার সাথে রওণা দিলাম দিদিভাইয়ের বাড়ি। যেবাড়িতে একদিন কনে সেজে ঢুকেছিল চাটুজ্জে বাড়ির বড় মেয়ে,সেখান থেকেই আজ কনের সাজে বের হবে ছোট মেয়ে।  


আমার সাজ শুরু হবার আগেই ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি আর সোনার চেনে সেজে গুজে প্রস্তুত দাদাভাই। টুলটুল দাদার দাদা, দিদিভাইয়ের ভাসুর যাবে আমার বর আনতে। গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের বুকে গায়ে প্রস্তুত মস্ত বড় কালো টয়োটা কোয়ালিস। সময় গড়াচ্ছে, বাইরে জমছে মেঘের পর মেঘ।  কি যেন একটা ঝড় আসবে, নাম তার আইলা। 


বাবার ধমক খেতে খেতে যখন দেবকন্যায় এসে নামলাম, জড়ো হয়েছেন বেশ কিছু অতিথি। রবিবার হওয়া সত্ত্বেও দল বেঁধে হাজির আমার ব্যাচমেটরা।  দেবু-সুকন্যা-সঞ্জয়-সজল। উপস্থিত খড়্গপুরের আমার তৎকালীন ইন্সপেক্টর আর স্টাফের দল। ধীরে ধীরে বাড়ছে লোক সমাগম। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝড়ের দাপট। 


অঝোর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নামল শৌভিক। কেলেঙ্কারির একশেষ, উল্টো ধুতি পরে বসেছিল ভুল করে, ভাগ্যিস দাদাভাই গিয়েছিল বর আনতে। তাই না আবার খুলিয়ে পরিয়েছে। বৃষ্টি মাথায় বরণ করতে ছুটল জ্যাঠাইমা। পিছনে চোরের মত মা। হবু জামাইকে বরণ করার সুপ্ত ইচ্ছে নিয়ে-। মাথার ওপর বড়দার ধরে মস্ত ছাতা, চূড়ান্ত নার্ভাস মুখে ধুতি সামলাতে সামলাতে স্কুলবয়ের মত ঢুকল শৌভিক। 


পিঁড়িতে বসে, লাল সিঁদুরকৌঠো হাতে, জোড়া পানপাতায় মুখ ঢেকে বরকে প্রদক্ষিণ, শুভদৃষ্টি, মাল্যদান আরো কত কি অনুষ্ঠান ঘটে চলে একের পর এক। ‘ছাউনি নাড়া ফুল’ নিয়ে পাগল হয়ে ওঠে জ্যাঠাইমা। খুব যত্ন করে রাখতে হয় নাকি ঐ ফুল, তারপর খুব বিশ্বস্ত কারো হাত দিয়ে তাকে বিসর্জন দিতে হয় গঙ্গায়। হেসে উঠতে গিয়ে ধমক খেলাম বেজায়। অথচ শৌভিককে কেউ বকছে না কেন? একটাও মন্ত্র পড়ছে না ব্যাটা। কেবল ফিসফিস করে গল্প করে চলেছে আমার সাথে। দুবার ধরিয়ে দিল বড়বৌদি, দুমিনিট গম্ভীর ভাবে মাথাও নাড়ল শৌভিক, তারপর আবার যেই কে সেই। কি দারুণ মেরুন রঙের ধুতি পরে রাজার মত বসে আছে টুকলু।পাশেই লাঠি হাতে, ধপধপে সাদা ধুতি, পাঞ্জাবি, চাদর কাঁধে বসে আছে আমার বড় জেঠু। রূপে আলোকিত গোটা মণ্ডপ। রাজার রাজা। একমনে পর্যবেক্ষণ করছে প্রতিটা লোকাচার। 


সঞ্চিতার পা মচকেছে, এবেলা আর আসতে পারেনি। কাকুকাকিমা এসে আশীর্বাদ করে গেলেন। রূপালী পাড় কাঁচা হলুদ রঙা তাঁত বেনারসি দিয়ে। রাত বাড়ছে, ঝড় বাড়ছে। দেবকন্যা থেকে আবার ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ি।  বাসর ঘরে গান ধরল খুড়তুতো ভাই অয়ন। কি যে ভালো গায় ছেলেটা। খালি গলাতেই মাত। দুচারটে ছুটকো মস্করা করার চেষ্টা করল কারা যেন। কি গম্ভীর বর বাপরেঃ। তেমনি তার দুই বন্ধু। তিনটে আপদে মাটি করল আমার বাসর। 


রাত অনেক, বাইরে ফুঁসছে ঝড়। জানলার কাঁচে আছড়ে পড়ছে বারি ধারা। কাল আয়লা আসবে যে-। অঘোর ঘুমে তলিয়ে গেছে বাসরতুলুনির দল। নিদ্রাহীন শুধু দুটি প্রাণ। এ রাত যে শুধুই কানাকানির। এ রাত যে অাঙুলে আঙুল জড়িয়ে, কানে কানে  বলার- ‘ every long lost dream led me to where you are-/ Others who broke my heart, they were like Northern stars,

Pointing me on my way into your loving arms/This much I know is true

That God blessed the broken road

That led me straight to you.'

Wednesday, 19 May 2021

অনির ডাইরি ১৯শে মে, ২০২১

 

অগ্নিসাক্ষী করে বিয়েটা হয়েছিল নিছক বাবার শখে। মাত্র মাস সাত আট আগেই মস্ত বড় অপারেশন হয়েছিল শ্বশুরমশাইয়ের। বাদ গিয়েছিল খানিকটা পাকস্থলী, তারওপর পর পর তিন-তিনটে কেমো। এমতাবস্থায় লোকাচার মেনে জ্যেষ্ঠপুত্রের বিবাহ দেওয়ার ধকলটা ওণাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। যদি না, আমার কাকা-পিসে শ্বশুর আর শাশুড়ি মাতারা সবাই মিলে বাড়ির ছেলের বিয়ে বলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এত গূঢ় তথ্য অবশ্য জানত না বাবা।


যাই হোক অগ্নিসাক্ষীর বিয়ে নিয়ে শৌভিকের সবথেকে বড় টেনশন ছিল ধুতি পরা। আর আমার? পিঁড়িতে চেপে শৌভিককে প্রদক্ষিণ করা। কে চাগিয়ে তুলবে আমায়? তার থেকে না হয় আমি এমনি পায়ে হেঁটেই--। ছিঃ আমরা না এদেশীয়, পিঁড়িতে চেপে, পান পাতায় মুখ ঢেকে মণ্ডপে প্রবিষ্ট হয় আমাদের বাড়ির মেয়েরা। বিয়ের দিন, আকাশ ভেঙে নেমেছিল বৃষ্টি, পরদিন আসার কথা আয়লার। ওই দুর্যোগ মাথায় নিয়েও কোথা থেকে যে জড় হয়েছিল, এতজন ভাই, দাদা আর মামা। গোলাপি চেলি পরে, পান পাতার আবরণে মুখ ঢেকে পিঁড়িতে চেপে দিব্যি বনবন করে ঘুরলাম শৌভিককে মাঝে রেখে। শূণ্যে দুলতে দুলতেই, নির্দেশমত পান পাতা সরালাম মুখের ওপর থেকে। বিয়েবাড়ির রোশনাই, সানাই, ফুল আর পারফিউমের তীব্র  সুগন্ধ  ছাপিয়ে, সার্চ লাইটের মত আছড়ে পড়ল একজোড়া পরিচিত চোখের খর দৃষ্টি। চারচক্ষুর মিলনে কতটা পুলক জেগেছিল আজ আর মনে নেই, তবে মণ্ডপে উপস্থিত নরনারীগণ যে আমোদে উছলে উঠেছিল তা সম্মিলিত তরল হাসি আর উলুধ্বনির প্রাবল্যে বেশ বুঝতে পারছিলাম।


 এবার মালা বদলের পালা। বিকেল বিকেল সেজেগুজে সিংহাসনে বসার আগে, শালপাতার ডালা খুলে মালাটা সুকন্যাই পরিয়েছিল আমায়। শৌভিককে কে পরিয়েছিল জানি না। জিজ্ঞাসা করলেই শৌভিক বলে, ‘নিজের বিয়ের কথা কারো এত মনে থাকে?’ 


যাই হোক এবার আমায় মালা পরানোর পালা। বর এবং কনে পক্ষের মধ্যে এইসময় মোহনবাগান- ইস্টবেঙ্গল মার্কা বৈরিতা প্রকট হয়ে ওঠে। ছড়া কাটে নাপিত। সম্ভবতঃ মেজদা চমকে রেখেছিল আমাদের তরফের নাপিতকে, 'এই ব্যাটা অশ্লীল ছড়া কাটলেই পেটাবো।'  আমার কয়েক মাসের আইনসিদ্ধ বাসী  বর, তাও এত সহজে মালা পরাতে দেবে নাকি, আমাদের বাড়ির লোকেরা। মালা নিয়ে শৌভিক এগোতেই, সটান শূণ্যে তুলে ধরা হল আমায়। সবার মাথার ওপর উঠতে গিয়ে, এমনআর একটু হলেই,  ঝপাং করে গড়িয়ে পড়তাম শৌভিকের ঘাড়ে। হৈচৈ এর মধ্যেই কোনমতে সামলে বসছি পিঁড়ির ওপর, শৌভিক বিড়বিড় করে বলল, ‘এত গুলো আইবুড়ো ভাত!’। 


আমার আইবুড়ো ভাত খাওয়া নিয়ে বরাবরই স্পর্শকাতর শৌভিক। সত্যিই কতগুলো যে আইবুড়ো ভাত খেয়েছিলাম, আজ আর মনেও পড়ে না। প্রতিটা নিমন্ত্রণের পর, কি খেলাম তার পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ দিতাম হবু বরকে, আর শৌভিক বলতো, ‘পরেরটায় আর যেতে হবে না। এই গরমে শেষে বিয়ের দিন পেটখারাপ বাঁধিয়ে বিয়েটাই পণ্ড করবি তুই।' 


 বেশীর ভাগ নিমন্ত্রণই থাকত দিনের বেলা। শুধু দিদিভাইদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল সন্ধ্যাবেলা।২০০৯ সালের মে মাস। গরম পড়েছে ফাটিয়ে, তার ওপর আগের রাত থেকে বিদ্যুৎ বিহীন হাওড়া নগরী। অনুরোধ করেছিলাম, যদি পিছিয়ে দেওয়া যায় ব্যাপারটা। এই গরমে খাবার কি আর গলা দিয়ে নামবে? শুনেই এমন ধমক মারল টুলটুল দাদা। দিদিভাইয়ের যখন বিয়ে হয়, আমি তিন পেরিয়ে চারের পথে। ফলে জামাইবাবু থুড়ি টুলটুল দাদার চোখে আমি শালী নই, কন্যাসমা। একে টুলটুল দাদায় রক্ষে নেই, আছে তাঁরও দাদা। আমাদের দাদাভাই। সকাল থেকে দুইভাই মিলে বাজার করেছে আর দুই বউ রান্না করেছে, এরপরও যদি না যাই, তাহলে যে কুরুক্ষেত্র বাঁধবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।  


সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ যখন বেরোলাম আমি আর ছুটকি, পথঘাট তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছুটকির পরিচয় দিতে গেলে যে বিশেষ্য প্রয়োগ করতে হয়, সম্পর্কটা ছিল তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তুচ্ছ গৃহশ্রমিক নয়, ছুটকি ছিল আমার ছোটবোনের মত। যতটা ভালোবাসতাম, তার থেকে অনেক বেশী ভালোবাসত মেয়েটা আমাকে।  


যাইহোক, বেরোবার সময় জ্যাঠাইমা পইপই করে বলে দিল,গলি নয় বড় রাস্তা ধরতে। আমাদের হাওড়ার গলি বিখ্যাত। ধুর কে আর রাজপথ ধরছে।   এই অন্ধকারে রাজপথও যা আর গলিও তাই। উল্টে গলি দিয়ে পৌঁছান যাবে চটজলদি।  টর্চওলা মোবাইল তখনও স্বপ্ন, হাতে বাবার দুব্যাটারির সরু টর্চ নিয়ে সৎসঙ্গের পাশ দিয়ে, গয়লাপাড়ার ভিতরের সরু গলি দিয়ে কালিপ্রসাদ ব্যানার্জী লেন।কেষ্ট কাকুর দোকান ছাড়িয়ে, প্রাক্তণ এমএলএ যুগল মণ্ডলের বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কদমতলা বাজার। ঘুটঘুটে অন্ধকার পথঘাট, মাঝে মাঝে উল্টো দিক থেকে আসা বাইকের উজ্জ্বল আলো, আর রাস্তার ধারের দোকানগুলোতে জ্বলতে থাকা দেওয়াল গিরির আলোআঁধারীতে পথঘাট কেমন যেন থমথমে রহস্যময়। সমস্ত বাড়ির জানলা খোলা, সমস্ত রোয়াকে, বারান্দায় বসেছে জমজমাট আড্ডা। প্রতিটা বাড়ির ছাদে চক্কর কাটছে প্রমিলাবাহিনী। 


দিদিভাইদের বাড়িতে প্রবেশ করার অনেক গুলো দরজা। বিশাল জমির উপর সুদৃশ্য বাংলো প্যাটার্নের একতলা বাড়ি। বাড়ি নয়তো হাওয়ামহল। চতুর্দিকে গুচ্ছগুচ্ছ জানলা আর দরজা। ইমার্জেন্সি লাইট গুলোর চার্জ প্রায় তলানিতে, যেটুকু আছে শুধু আমাদের খাবার জন্য রেখে, সারা বাড়িতে গুটি কয়েক মোমবাতি জ্বালিয়ে সবাই বসেছিল আমাদের প্রতীক্ষায়।


ও বাড়ির আতিথেয়তা প্রায় প্রবাদপ্রতিম।  কত যে ব্যঞ্জন বানিয়েছিল দিদিভাই আর সোমাদি তার ইয়ত্তা নেই। পোলাও, এই দামড়া ফিশফ্রাই, ইয়া বড় বড় চিংড়ি, খাসির মাংস আর কি কি ছিল আজ আর মনে নেই। তবে ভুরিভোজের থেকেও বেশী জমজমাট হয়েছিল, টিমটিমে মোমবাতির আলোয় গা ছমছমে ভূতের গপ্প। দেশভাগের আগুনে বলি হওয়া বহু মানুষের শেষ আশ্রয় স্থল নাকি ছিল, অদূরের মজে যাওয়া ডোবাটা। তাদের কারো কারো অস্তিত্ব নাকি  টের পাওয়া যায় গভীর রাতে। বাড়ি ভর্তি জাঁদরেল সারমেয়র দল, কিন্তু সন্ধ্যা ঘনালেই আর ছাতে থাকতে চায়না কেউ। বেঁধে রেখে আসলেও হু হু করে কাঁদে আর কাকুতি-মিনতি করে নীচে নিয়ে যাবার জন্য।  


কোনটা সত্যি, কোনটা নিছক গল্প, আজ সবই কেমন যেন আলোআঁধারিতে ঢাকা। সেই বাঙলো প্যাটার্নের ছিমছাম বাড়িটাও আজ আর নেই। হয়তো নেই তেনারাও। অথবা আছেন। ভুরিভোজ সেরে হলুদ পিওর সিল্কের শাড়ি বগলে আবার সেই অন্ধকার গলিঘুঁজি দিয়ে ফেরা। আজ এই প্রায় গৃহবন্দী দশায় ভাবতে বসলে তাজ্জব লাগে, কতটা খোলামেলা, কতটা নিরাপদ, কতটা ঘরোয়া ছিল আমাদের শহরটা।  অতরাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার গলিপথ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল দুটি অল্পবয়সী মেয়ে, এক পলকের জন্যও হয়নি কোন অস্বস্তি, লাগেনি কোন ভয়। বাড়ি ফিরলাম যখন, রাত তখন দশটা। অন্ধকার রোয়াকে চেয়ার পেতে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে জ্যাঠাইমা। অদূরে আরেকটি চেয়ারে রাজার মত বসে বড় জেঠু।  একতলার বসার ঘরে মোমবাতির আলোয় কি যেন লেখাপড়া করছে বাবা আর উল্টোদিকে গালে হাত দিয়ে বসা মা- সবাই কেবল আমারই প্রতীক্ষায়।  


খুঁটিয়ে বলতে হল সবার সামনে, কি খেলাম, কি পেলাম, কেন মা এবং জ্যাঠাইমার যুগপৎ নিষেধ সত্ত্বেও ছাঁদা বেঁধে আনলাম। যেন আমি আনব না বললেই দিদিভাই ছেড়ে দিত। গলা অবধি খাইয়ে,বাড়ির সবার জন্য বেঁধে দেওয়া যে ঐ বাড়ির ট্রাডিশন সবাই জানে, তবুও দফায় দফায় ঝাড় খেয়ে যখন শুতে গেলাম ঘড়ি বলছে রাত এগারোটা। তখনও নিষ্প্রদীপ হাওড়া নগরী। পাওয়ার হাউস থেকে পাওয়া শেষ খবর অনুসারে, আজ রাতেও ফিরবে না বিদ্যুৎ। লাল মেঝেতে জলের ছিটে দিয়ে, তার ওপর বালিশ নিয়ে শুয়ে মোবাইলের কষ্ট করে বাঁচিয়ে রাখা শেষ ১৫-১৭ শতাংশ চার্জটুকুর সদ্ব্যবহার করব এবার। সারাদিন কথা হয়নি তেমন। ঝটপট করে শোনালাম কি খেলাম, কি পেলাম, কি কি গল্প শুনলাম।খুকিখুকি নাকে কান্নাটা সবার শেষে। কারেন্ট না এলে, ঘুমোব কি করে। উফঃ কি গরম। বাপরে। ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল অমৃতবাণী,‘এখুনি চলে আসবে কারেন্ট দেখ না।’ হ্যাঃ কচু আসবে। কতবার যে বাবা ফোন করেছে সিইএসসি দপ্তরে, বারবার শুনতে হয়েছে একই কথা।  আজ আর আসবে না। বলতে না বলতেই, ঘটঘট করে উঠল মাথার ওপরের পাখা। হো-হো রব ভেসে এল চারিদিক থেকে- বাবা আর ছোটকাকু উল্লাসে একসাথে চিৎকার করে উঠল, ‘ওরে এসেছে রে। এসেছে। ’ একই কথার উল্লাসিত প্রতিধ্বনি ভেসে এল আসেপাশের বাড়ির ছাত থেকে। আর ফোনের ওপারে মৃদু হাসি, ‘বলছিলাম না। ’