Friday, 11 July 2025

অনির ডাইরি জুন, ২০২৫

 অনির ডাইরি ২৮ শে জুন, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



যাবেন নাকি? রথের মেলায়? মেলা বসেছে আমাদের হাওড়া ময়দানে। টানা হবে মস্ত বড় রথ, রথে আসীন সহোদর সহোদরা সমেত জগন্নাথ দেব। কত কি যে বিক্রি হয় সেই মেলায় - গরম গরম জিলিপি, পাঁপড় ভাজা, খোলায় ভাজা বাদাম, চুড়ো করে রাখা নিমকি, কুচো গজা আরও কত কি। বিক্রি হয় বঁটি, কুরুনি, লোহার কড়া, চাটু, ,রুটি বেলার চাকিবেলুন, হাতা- খুন্তি, সাঁড়াশি এমন কি টিয়াপাখি, খরগোশও। আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই, জ্যান্ত টিয়া পাখি।


সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। ফি বছর রথের দিনে কেন যে বৃষ্টি হয়। দুপুর যত নিশুতি হয়, ততোই বাড়ে বৃষ্টির দাপট। জ্যাঠাইমা বলে, "তোদের এবছর রথ দেখা হয়েছে আর কি - এই আবহাওয়ায় ছোট বউ কি করে তিনটে বাচ্ছাকে নিয়ে বেরোবে বাপু!" ছোট বউ অর্থাৎ ছোট কাকী, পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। আপিস টাইমে বসত কাকিদের স্কুল, ছুটি হতে গড়িয়ে যেত দুপুর। অধীর আগ্রহে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে বসে থাকি আমরা তিন খুড়তুতো জেঠুতুতো ভাইবোন। গায়ে এসে লাগে মিহি বৃষ্টির ঝাঁট। তিন নাটিনাতনীকে শান্ত করতে জগু- বলু আর সুভুর গল্প শোনাতে বসে ঠাকুমা। 


নির্দিষ্ট সময়েই বাড়ি ফেরে ছোট কাকী। সঙ্গে দিতু মাসি আর তাঁর দুই পুত্র। দিতু মাসি সম্পর্কে কাকিমার বড় দিদি। পাঁচপাঁচটা গেঁড়িগুগলি বাচ্ছাকে নিয়ে রথ দেখতে বেরোয় দুই বোন। হাওড়া ময়দানে আজ দমচাপা ভিড়, আমাদের দুই চোখে উছলে পড়া লোভ।  কাগজের পাখা থেকে তালপাতার বাঁশি যাই দেখি তারই প্রেমে হাবুডুবু খাই। দূর থেকে শোরগোল শোনা যায়, "রথ আসছে, রথ আসছে।" চেপে আমাদের হাত ধরে ছোট কাকী আর দিতু মাসি। নখ কামড়ে থুতু দেওয়া হয় সবার গায়ে, আহা নজর লাগে যদি। বুবাই দাদা সবথেকে বড়, কেউই আঙুল কামড়ায় না ওর। বেচারা নিজেই নিজের আঙুল কামড়ে থুতু দিতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়।


রাজার মত চলে যান জগন্নাথ দেব। আমাদেরও সুযোগ জোটে রথের দড়ি টানার। একরাশ ভালোলাগা নিয়ে বাড়ি ফিরেই গরম গরম জিলিপি। দুর্যোগের মধ্যেই কখন যেন বেরিয়ে কিনে এনেছে জেঠাইমা। অফিস ফেরৎ ঋষি ময়রার জিলিপি কিনে আনে বাবা। সর্ষের তেলে ভাজা ইয়া মোটা মোটা জিলিপি - সুগার ভুলে টপাটপ জিলিপি সাঁটায় জেঠু। আজ রথ বলেই বোধহয় নীরব থাকে জেঠাইমা। বেঁচে যাওয়া জিলিপি রাখা থাকে বাবার জন্য, রাতে দুধ দিয়ে ফুটিয়ে দেবে মা। 


"একটা টিয়া পাখি কিনে দাও বাবা" বলে পিছন পিছন ঘুরি আমি। মাসের শেষ, হাত খালি বাবার। ঝুপ করে নিভে যায় আলো, একটু ঝড়ো হাওয়া দিলেই চলে যায় আমাদের ডিসি কারেন্ট। নিকষ আঁধারে সাময়িক ডুবে যায় শতাধিক বছরের পুরান ভাঙ্গা বাড়িটা। লম্ফ ধরায় ঠাকুমা। খালি ওষুধের শিশির ঢাকায় ফুটো করে ছেঁড়া কাপড়ের সলতে গলিয়ে বানানো ঘরোয়া লম্ফ। একটু ভুষো বেশি পড়ে বলে ঘরে নয় রোয়াকে রাখা হয়, আলো দেয় ফাটিয়ে। ঘরের ভিতর হ্যারিকেন ধরিয়ে পড়তে বসায় মা। আজ যেন একদম মন বসে না পড়ায়। খালি ভুল করি - 


মায়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাবা বলে, "চল আরেকবার ঘুরে আসি, রথের মেলা থেকে -"।রাত আটটার ভাঙ্গা মেলা, তাও কি ভিড়। ফুচকা খাই আমরা বাপমেয়েতে। একটাকায় দশটা ফুচকা। শেষে একটা ফাউ -। ফেরার সময় একটা টিয়া নিয়েই ফিরি আমরা। ঘন সবুজ তার গায়ের রং, গলায় লাল কণ্ঠী। তেলাকুচো খায় কিনা জিজ্ঞাসা করি আমি। আমাদের পশ্চিমের বাগান জোড়া তেলাকুচো গাছের ঝাড়। সকাল বিকেল কত যে পাখি আসে খেতে -।


পাখি না, ও আমার প্রাণ। সাধ করে নাম রাখি মদনমোহন। পাক্কা কুড়ি টাকা দিয়ে কিনে দিয়েছে বাবা। রাতে খেতে বসে মা বলছিল, এক সপ্তাহের বাজার হয়, কুড়ি টাকায়- । ভোর বেলায় স্কুল আমার, ছুটি হতে হতে গড়িয়ে যায় আপিস টাইম। দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরি আজকাল আমি, আমার অপেক্ষায় আছে যে আমার মদনমোহন। জল দিই, ভিজে ছোলা দিই। স্নান করাই, বেড়াল তাড়াই যাতে ভয় না পায় আমার মদনমোহন। সারা দুপুর তার সাথে গল্প করি। আমার নিঃসঙ্গ দুপুরগুলো যেন আচমকাই হয়ে ওঠে গোলাপী। 


আর তারপর? তারপর যা হয় আর কি, কেউ কথা রাখে না। মদনমোহন ও একদিন চলে যায়। আত্মা মিলিয়ে যায় পরমাত্মায়। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলি আমি, খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিই আমি। আমাকে শান্ত করতে কতগুলো যে পাখি কিনে আনে জেঠাইমা, তার ইয়ত্তা নেই। কারো লাল রঙের মাথা তো কারো নীল, কারো বা মাথার রং হলুদ। সবাই সুন্দর, কিন্তু এরা কেউ আমার মদনমোহন নয়। কেমন যেন নির্মোহী হয়ে পড়ি আমি, বুকের ভিতর চাপা কষ্টটা যেন আর যায়ই না। তারপর একদিন ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি, খাটের ওপর রাখা আছে সাদা ধপধপে একটা খাম। খামের ওপর গোটা গোটা করে লেখা আমার নাম। খামের এক কোনায় আটকানো ডাকটিকিটে নিশ্চিন্দিপুরের ঠিকানা। আমার মদনমোহনের বর্তমান সাকিন। বড় ভালো আছে সেথা মদনমোহন। ছত্রে ছত্রে নিশ্চিন্দিপুরের গল্প শোনায় সে। "সে এক রূপকথারই দেশ, ফাগুন সেথা হয় না কভু শেষ-"। সেথা নেই কোন অভাব, কেউ ভোগে না নিঃসঙ্গতায় শোনায়- । মদনমোহন বলে, সেই স্বপ্নের দেশেও তার মন কেমন করে, শুধু আমার জন্য। আমি যে তার প্রথম বন্ধু, আমি কাঁদলে, আমি উদাস থাকলে কি করে ভালো থাকবে আমার পাখি। 


পড়তে পড়তে কখনও হাসি, কখনও কাঁদি আমি। বোধহয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন, দুপুরবেলা লুকিয়ে সিনে এডভ্যান্স, আলোকপাত পড়ি, মৃত পোষ্য যে আমায় চিঠি লিখতে পারে না, সেটা খুব ভালোমত বুঝি। তাও কানায় কানায় ভরে ওঠে মন। যে ছেড়ে গেছে সে আর ফিরে আসবে না, তার শোকে, যারা আমায় ঘিরে আছে এত ভালোবাসা অগ্রাহ্য করি কেমনে - ।


অনির ডাইরি ২৫শে জুন, ২০২৫

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


দরজা খুলে মুখ বাড়াল সৌম্য, " ম্যাডাম, ওনারা এসে গেছেন। আসতে বলব?" ইশারায় সম্মতি জানিয়ে, গুছিয়ে বসি। চেম্বারে প্রবেশ করেন সাদাসিধে করে শাড়ি পরা এক বৃদ্ধা, বাজারের ব্যাগ হাতে এক মধ্যবয়সী পুরুষ আর দুই প্রবীণ ব্যক্তি। প্রবীণ দ্বয় আমার পূর্ব পরিচিত, কোন একটি ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য। প্রায়ই হানা দেন আমাদের আপিসে। 


ইশারায় বলি বসুন। ভদ্রমহিলা থতমত খেয়ে বসে পড়েন, বসে পড়েন প্রবীণ নেতাদ্বয় ও। মধ্যবয়সী ব্যক্তিটি তখনও দণ্ডায়মান, দাঁড়িয়ে আছে আজকের নাটকের নায়ক, আমার কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর শ্রী সৌম্য মুখোপাধ্যায় ও। উভয়কেই পুনরায় বসতে বলে, ভদ্রমহিলার দিকে তাকাই, প্রশ্ন করি, " আপনিই নিদ্রা সামন্ত?" পান খাওয়া খয়াটে দাঁত বার করে হাসেন বৃদ্ধা, দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানান। মধ্যবয়সী ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে শুধাই, " আপনি?" সৌম্য এবং লোকটি একসাথে বলে ওঠে, উনি বৃদ্ধার জ্যেষ্ঠ পুত্র। সৌম্য আরও একধাপ এগিয়ে জানায়, " উনিই আসতেন ম্যাডাম, ব্লকে নিয়মিত খোঁজখবর নিতে।" ভদ্রমহিলা মিনমিন করে বলেন, " বুড়ো হইছি মা, আমি আর অত ছুটাদৌড়া পারিনি -"। 


'ছুটাদৌড়া' ই বটে, বাপরে বাপ! কি যে গেছে বিগত কিছু দিন। কোলাঘাট সাগরবার পঞ্চায়েতের বাসিন্দা শ্রীমতী সামন্ত পেশায় ছিলেন একজন নির্মাণ কর্মীর সহায়িকা। ষাট বছর অতিক্রান্ত হবার পর তিনি হলেন পেনশনের হকদার। সে অনেক কাল আগের কথা, তৎকালীন কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর সাহেব সেই মত ওনার কাগজ পত্র চেক করে পাঠালেন আমাদের আপিসে। আমার কোন এক পূর্বসুরী সেই আবেদন পত্র পুনরায় চেক করে, পেনশনের অনুমোদন দেবার সুপারিশ সহ পাঠালেন মহানগর। মহানাগরিক অধিকর্তাবৃন্দও দেখলেন সব ঠিক আছে, মঞ্জুর হল ওনার পেনশন। 


বেশ কিছুদিন পর উনি এলেন ব্লকে খোঁজ নিতে, " সার আমার ট্যাকা কবে ঢুকবে?" ইন্সপেক্টর সাহেব আধার নম্বর দিয়ে সার্চ করে দেখলেন, পেনশন তো নিয়মিত ছাড়ছে কলকাতা। সেই পেনশন ঢুকছেও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এ, কারণ সাকসেস ফেলিয়র রিপোর্ট নিয়মিত পাঠায় কলকাতা আর তাতে ওনার পাশে সফলতার টিক চিহ্ন জ্বলজ্বল করে। ওনাকে বলা হয়, টাকা তো ঢুকছে, আপনি বুঝতে পারছেন না। গ্রামের দিকে একেক জনের একাউন্টে একসাথে অনেকগুলো পেনশন বা অনুদান ঢোকে,ফলে জট পাকিয়ে যাওয়াটাই দস্তুর। কখনও আমরা ভাবি হয়তো লাইফ সার্টিফিকেট দেননি, তাই ঢোকেনি। নতুন করে নেওয়া হয় লাইফ সার্টিফিকেট। 


এই ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে, কিন্তু সুরাহা হয় না কিছুতেই। শেষে বিরক্ত হয়ে সৌম্য একদিন বলে," কাল পাশবইটা নিয়ে আসবেন, আমি নিজে দেখব। " দীর্ঘ দুই তিন বছরের হিসেব নিকেশের পাতা উল্টে ও নজরে আসে না পেনশনের খতিয়ান। কেস টা কি হল? এই নিয়ে আমার ঘরে যেদিন প্রথম আলোচনায় বসলাম আমরা, সব শুনে বেদজ্যোতি বলল, " সৌম্য দা একটা কাজ করো দিকি, পোর্টালে ওনার একাউন্ট নম্বরটা একবার চেক করো তো -"। চেক করতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। খুব ছোট্ট একটা ভুল উল্টেপাল্টে গেছে দুটি সংখ্যা আর তার জেরে টাকা ঢুকে গেছে অন্য কারো খাতায়। দুই চারশ টাকা নয়, ৬৪ হাজার টাকা।


কি ভুল, কার ভুল সেই চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আগে মহানগরে চিঠি লিখি আমি, এই মুহূর্তে বন্ধ করা হোক নিদ্রা সামন্তের পেনশন। মহানগর সাফ জানিয়ে দেয়, আগে উদ্ধার করো ঐ টাকা, তারপর অন্য কথা। উদ্ধার করো বললেই তো আর উদ্ধার করা যায় না, আমরা নিছক সিভিল লোকজন, না আমরা অস্ত্রধারী পুলিশ না রিকভারি এজেন্ট। যাই হোক, অনেক খুঁজে পেতে দেখা যায় যে একাউন্টে টাকা ঢুকেছে, সেটি কোলঘাটের দেউলিয়া বাজারের ইন্ডিয়ান ব্যাংকের। ব্যাংকের সাথে কথা বলে বেরোয় একাউন্ট মালিকের নাম ঠিকানা। দেখা যায় তিনিও কোলাঘাটেরই বাসিন্দা, পঞ্চায়েতের নাম পুলসিটা। 


এত বড় পঞ্চায়েত এলাকা, হাজার হাজার মানুষ, এর মধ্যে একজনকে খুঁজে বার করা কি মুখের কথা। পুলসিটা পঞ্চায়েতের SLO মিতাংশু বাবুর শরণাপন্ন হই আমরা। অসামান্য দক্ষতায় শুধু লোকটিকে খুঁজে বার করেন উনি তাই নয়, যোগাড় করে আনেন তাঁর ফোন নম্বর ও। অতঃপর? আমি বলি, চিঠি পাঠাও, যা হয়েছে তাতে তোমার আমার প্রত্যক্ষ কোন ভূমিকা নেই বটে, তবে আমরা যে সব জেনেও ফেলে রাখিনি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ থাকা জরুরী। সৌম্য কাকুতিমিনতি করতেই থাকে, " প্লিজ ম্যাডাম, একবার ফোন করি? মিতাংশু বাবু বললেন লোকটিও আমাদের স্কিমের বেনিফিশিয়ারি, বললে নির্ঘাত শুনবে -"। 


শোনা তো দূরের কথা, লোকটির ভাই নাকি দাদা ফোন কেড়ে নিয়ে যাচ্ছেতাই কথা শোনায় সৌম্যকে। " দেব না টাকা, কি করবেন করে নিন"। দেয় হুমকি ও। সৌম্য নিরুত্তাপ গলায় একটাই কথা বলে যায়, " আপনার যা করার আপনি করতে পারেন,তবে সরকারের টাকা হজম করা এত সোজা নয়। আজ নয়তো কাল আপনাকে টাকা ফেরৎ দিতেই হবে। আমি ভালো কথায় বলছি, ম্যাডামের কানে গেলে উনি কিন্তু পুলিশ পাঠাবেন। গ্রামে থাকেন আপনারা, সকলের সামনে পুলিশ গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লে আপনাদের পরিবারের সম্মান থাকবে তো -"।


সত্যিই পুলিশের হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে আর পঞ্চায়েতকে জড়িয়ে একজনের টাকা উদ্ধার করেছিলাম আমরা। দিন তিনেক বাদে লোকটি ঘুরে ফোন করে সৌম্যকে, " স্যার আমার ভাই আপনার সাথে খুব খারাপ আচরণ করে ফেলেছে সেদিন। ক্ষমা করবেন আজ্ঞে -। কিন্তু ট্যাকা তো নাই। সে আমি খরচ করে ফেলিচি। ফেরৎ দিতে অপারগ - ।" 


সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না বুঝে ওনার আধার নম্বর দিয়ে স্থানীয় ব্যাঙ্ক গুলিতে খোঁজ নিতে থাকি আমরা। একটা একাউন্ট উনি ফাঁকা করে দিয়েছেন তার মানে এই নয় অন্য কোন একাউন্ট নেই। দীর্ঘ সাড়ে তিন বছরে কিছু তো চিনেছি আমরা এই জেলার মানুষগুলোকে। এরা পূর্ব মেদিনীপুর হতে পারে, সৌম্য আর আমিও হাওড়া। পাশের জেলা, হাড়ে হাড়ে চিনি এদের। ঠিক বেরোয় অন্য একাউন্ট, সেখানে ঢোকে কৃষকবন্ধু ইত্যাদি প্রকল্পের টাকা। চিঠি দিয়ে ফ্রিজ করানো হয় সেই একাউন্ট। এবার যাবে কোথায় বাছাধন - 


লোকটি এসে কেঁদে পড়ে সৌম্যর কাছে। সৌম্য বলে, " মনে করুন আপনি ধার নিয়েছেন সরকারের থেকে। শোধ আপনাকে দিতেই হবে। তফাৎ হল এক্ষেত্রে আপনাকে সুদটা দিতে হচ্ছে না।" লোকটি নিমরাজি হয়ে জানান, ফেরৎ দেবেন বটে, তবে গোটাটা নয়, কিছু কমসম করে দেবেন, দেবেন ১২টা কিস্তিতে। একেকটা কিস্তি জমা হবে তিন চার মাস ছাড়া ছাড়া। ইল্লি আর কি - 


শেষে অনেক কাণ্ড করে তিন কিস্তিতে পুরো টাকাটা ফেরৎ দেয় লোকটি। তার জন্য অনেক অনুনয়-বিনয়, হুঙ্কার-চিৎকার, ইড়িমিড়ি বাঁধনের গপ্প ফাঁদতে হয় অবশ্য আমাদের। সে সব এখন অতীত। আপাতত মহানগর টাকা ফেরৎ পেয়ে, পুনরায় চালু করেছে নিদ্রাদেবীর পেনশন। ঐ ৬৪ হাজার টাকা শুধু তাই নয়, উনি পেতে চলেছেন বন্ধ করে রাখা বছর গুলির পেনশন এরিয়ারটাও। 


 যার জন্য এত লড়াই, তাঁকে একবার স্বচক্ষে দেখার লোভ যেমন আমার ছিল, আজ শুনলাম উনিও আমাকে দেখার জন্য ততোটাই ব্যগ্র ছিলেন। সৌম্য বলল, " আপনি কাল ফোন করে না আসতে বললে আমিই ফোন করতাম আপনাকে। টাকা ঢোকা ইস্তক এই মাসিমা রোজ ফোন করছেন আর আপনার কথা জিজ্ঞাসা করছেন।" আমরা হলাম পরিযায়ী পাখি, আজ এই জেলায়, কাল না জানি কোন জেলায়। উড়ে যাবার আগে এত জটিল একটা গ্রন্থি যে খুলে যেতে পারলাম এটাই সবথেকে আনন্দের। সৌজন্য অবশ্যই আমার টিম। টিমে খেলার এটাই মজা - 


ছবিতে শ্রীমতী নিদ্রা দেবী এবং তার টাকা উদ্ধারকারী লোকজন 😊


অনির ডাইরি ২৪ শে জুন, ২০২৫

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


ওনারা ছয় জন। পাঁচ জন মহিলা একজন পুরুষ। প্রত্যেকেই বিভিন্ন ব্লকের বাসিন্দা। সকলেই হারিয়েছেন কোন না কোন প্রিয়জন। তবে সেটা আজকের কথা নয়, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ এর ঘটনা। মৃত ব্যক্তির নমিনি হিসেবে এনারা প্রত্যেকেই পেয়েছেন ৫০ হাজার টাকার এককালীন অনুদান। অন্তত আমাদের অফিসের কাগজপত্র তো তাই বলে - 



কিন্তু এনারা শোনান অন্য কাহিনী। কারোরই নাকি টাকা ঢোকেনি। বললেই হল নাকি? মুখের কথায় কে বিশ্বাস করে মশাই। নিয়ে আসুন দেখি ঐ সময়কার ব্যাংক স্টেটমেন্ট। ব্যাপারটা বলতে যত সহজ, একজন অসংগঠিত শ্রমিকের পক্ষে করা অতটাও সহজ নয়। আমাদের ছাপোষা আপিসে আসতেই থতমত খান ওনারা, এমনকি জুতো খুলেও ঢুকতে দেখেছি মানুষকে। সেখানে ঝাঁ চকচকে ব্যাংকে গিয়ে এত পুরাণ লেনদেনের হিসেব চাওয়াটা বেশ কঠিন ব্যাপার। সময় লেগেছে হয়তো, তাও নিয়ে এসেছেন ওনারা। দেখা যায় সত্যিই ঢোকেনি কোন বড় টাকা। 



তাহলে কি ক্রেডিট ফেলিয়র হল, অর্থাৎ আমাদের পাঠানো টাকা কোন কারণবশত আবার আমাদেরই একাউন্টে ফেরৎ পাঠালো ব্যাংক? ক্রেডিট ফেল ব্যাপারটা যে কোন আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের কাছেই দুঃস্বপ্নের মত। তবে এমন বাপু কোথাও দেখিনি। এখানে আমাদের ঐ সময়ের ব্যাংক স্টেটমেন্ট

চেক করতে গিয়ে আমাদের তো চক্ষু চড়ক গাছ, বিশ তথা বিষের বছরে কয়েক ক্ষেপে থোক টাকা ফেরৎ দিয়েছে ব্যাংক, কিন্তু তার উৎস কি, অর্থাৎ কোন একাউন্টে না ঢুকে তা ফেরৎ এল তার কোন হাল হদিশ নাই। 



এই নিয়ে দীর্ঘ দৌড়াদৌড়ি, চিঠিচাপাটি, বার বার ব্যাংকে যাওয়া, দিন ভর বসে থাকা, প্রয়োজনে গায়ে গতরে খেটে ওনাদের ফাইল পত্র খোঁজা, আমাদের রেকর্ডের সাথে ওনাদের রেকর্ড মেলানো ইত্যাদি প্রভৃতি করে যখন আমরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছি, হঠাৎ ইউরেকা ! 



ঈশ্বরের মতোই ব্যাংক ও বোধহয় "works in mysterious way", নইলে হঠাৎ এতদিন পরে কি করে উদ্ধার হয় এত পুরাণ এতগুলি কেস। তাও আবার এক সাথে - ।



আজ ডাকা হয়েছিল প্রিয়জন হারা মানুষগুলোকে। ইতিমধ্যে সকলেরই শুকিয়ে গেছে চোখের জল, সকলেই হারিয়ে ফেলেছেন আশা, সরকারি আপিসে, " এ তো আকছার ঘটে, সাদা কালো লং শটে", কার টাকা, পকেটে পুরে বাড়ি নিয়ে যায় যে কে (চন্দ্রবিন্দুর মধ্যবিত্ত ভীরু প্রেমের সুরে পড়বেন কিন্তু)। বললেই খ্যাঁক করে ওঠে সৌম্য, আজও বলছিল, " সরকারের দেয় একটা টাকাও মারা যায় না। আপনার টাকা আপনারই, কেউ পকেটে পুরতে পারবে না। হ্যাঁ সময় হয়তো লাগে -।" 



এতদিন মাথা নত করে থাকতাম আমরা, অপারগতার দায়ে লজ্জিত থাকতাম আমরা, আজ সবার একগাল হাসি, আমাদেরও, ওদেরও। বললাম, বেশি না আর দুয়েক দিনের মধ্যেই ঢুকে যাবে টাকা। যদি না ঢোকে, আগামী সপ্তাহের মধ্যে অবশ্যই জানাবেন। আর যাবার সময় এই ছেলেটাকে ভালো করে আশীর্বাদ করে যাবেন, মূলত এর চেষ্টায়ই উদ্ধার হয়েছে আপনাদের টাকা। এমন জ্বালান জ্বালিয়েছে ব্যাংককে, বাপরে বাপ - আর ব্যাটাকে ঢুকতে দিলে হয়।


অনির ডাইরি ২১ শে জুন, ২০২৫
#অনিরডাইরি #কলকাতার_কড়চা 

ঠিক করেছিলাম বাসেই যাব, সেই মত দেড় ঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে যেতে সময় লাগবে আধটি ঘণ্টা। শৌভিক বার বার বলেছিল ক্যাব নিতে, সকাল থেকে যে দেখিনি তাও নয়, একটায় ভাড়া দেখাচ্ছিল ৩৮০, অন্যটায় ৪৪৫। "কিপটে/ চাকরি করিস কেন" ইত্যাদি বলে এক গাদা গালি দিয়ে বেরোনোর সময় আমার বর বলে গেছে, " আড়াইটে থেকে প্রোগ্রাম হলে, তোকে কিন্তু সোয়া একটার মধ্যে বাসে চেপে বসতে হবে।" 
একটা থেকে দাঁড়িয়েই আছি, সারা পৃথিবীর সব বাস আমার চোখের সামনে দিয়ে নাচতে নাচতে যাচ্ছে, আমার বাসটারই দেখা নেই ভগবান। দেড়টা নাগাদ আর রিস্ক নিলাম না। অফিস টাইম নয় বলেই হয়তো ভাড়াটাও দেখলাম অনেক নীচে নেমেছে। সবথেকে সস্তার ক্যাব, ভেতরটা ধুলোয় ভর্তি, তবে গাড়িওয়ালা অমায়িক এবং বাঙালি। 

আমার গন্তব্য মৌলালি যুব কেন্দ্র। বিগত জানুয়ারি মাসে একটা ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, সেই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের আলোচনা সভা। যদিও আমাকে অফিসিয়ালি আমন্ত্রণ জানিয়েছে প্রয়াস নামক একটি এনজিও, কিন্তু আমি যাচ্ছি শুধু পারমিতার আহবানে। পারমিতার সাথে আলাপ হয়েছিল চন্দননগরের বড় সাহেবের মাধ্যমে। তখন আমি চুঁচুড়ায়। পারমিতা তখন হয় দুর্বার নয়তো পরিচিতি নামক এনজিওতে যুক্ত। তারপর গঙ্গা রূপনারায়ণ দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল, আমরাও একসাথে করে ফেলেছি অনেকগুলি নারী ক্ষমতায়নের কর্মশালা, শ্রমিক মেলা আরও কত কি। এতদিন আমি ডেকেছি পারমিতা এসেছে, আজ উল্টো পুরাণের দিন। 

দুটো দশের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, এই প্রথম মৌললি যুব কেন্দ্রে এলাম আমি। আমার ভেবলে যাওয়া মূর্তি দেখেই হয়তো ট্রিপ শেষ করার পরও একটু এগিয়ে দিল ড্রাইভার। যুব কেন্দ্রের ছোট হলটায় আমাদের আজকের সমাবেশ। কি নিয়ে সমাবেশ সেটা বলতে গেলে পিছিয়ে যেতে হয় বেশ অনেক গুলো বছর, সেটা ২০১৬ সাল, অক্টোবর মাস, উত্তরাখণ্ডের দেরাদুন শহরের নিবাসী অজয় মালিক এক প্লেসমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে একটি আদিবাসী মেয়েকে তাঁর সরকারি নিবাসে গৃহপরিচারিকা হিসেবে নিয়োগ করেন। শ্রী মালিক পেশায় ছিলেন DRDO র একজন বিজ্ঞানী। 

২০১৭ র মার্চ মাস নাগাদ পেশার টানে শ্রী মালিককে কিছুদিনের জন্য কানপুর যেতে হয়। স্ত্রী, দুই পুত্রসহ মালিক বাবু তো রওনা দিলেন কানপুর, বাড়ি পাহারা দেওয়া তথা সাফসুতরো রাখার জন্য রেখে গেলেন পরিচারিকা মেয়েটিকে। এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল, কিন্তু পাছে মেয়েটি এই সুযোগে বাড়ি সাফ করে পালিয়ে যায়, তাই সদর দরজায় লাগিয়ে গেলেন একটা মস্ত বড় তালা। চাবিটা দিয়ে গেলেন প্রতিবেশী তথা বন্ধু অশোক কুমারকে। তিনি দিনে একবার আসেন, মেয়েটিকে খাবারজল দিয়ে যান, বাড়িটা ঠিক আছে কিনা দেখে যান আর যাবার সময় আবার লাগিয়ে যান তালাটা। এই ভাবে এক সপ্তাহ চলার পর ব্যাপারটা জানাজানি হয় এবং পুলিশ গিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে। সেই নিয়েই FIR এবং মামলা- 

যে মামলায় উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট অজয় মালিক এবং অশোক কুমার দুজনকেই অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করে শাস্তি বিধান করে। সেই শাস্তির বিরুদ্ধেই ওনারা আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টে। ইতিমধ্যে অবশ্য মেয়েটি হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে যে তার আর এনাদের প্রতি কোন অভিযোগ নেই এবং এনারাও কোর্টকে জানিয়ে দিয়েছেন যে বাড়ির পিছন দিকে একটা খিড়কি দুয়ার ছিল, মেয়েটি চাইলে সেখান দিয়েও পালাতে পারত ইত্যাদি প্রভৃতি যেমন হয় আর কি। 

জানুয়ারি ২০২৫ এ মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এই কেসে ৩৬ পাতার রায় দিয়েছেন। যার ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে ভারতে গৃহপরিচারিকাদের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ। কেন্দ্র সরকারের চারটি দপ্তর যথাক্রমে শ্রম, সামাজিক ন্যায়বিচার, নারী ও শিশু কল্যাণ এবং আইনকে নির্দেশ দিয়েছেন এক বিশেষ কমিটি গঠন করার, যাঁরা বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে গৃহ শ্রমিকদের সামগ্রিক উন্নয়নের এক আইনি রূপরেখা নির্ধারণ করবে। সেই আইনি রূপরেখা কি হতে পারে সেই নিয়েই আজকের আলোচনা সভা। 

অনেক দিন বাদে দেখা হল পারমিতা, শুভ্রা, কাকলিদের সাথে। দেখা হল আমার ভীষণ প্রিয় মানুষ অঞ্চিতাদির সাথে। কলকাতায় গৃহ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ অঞ্চিতাদিই প্রথম শুরু করেছিলেন। আজ সকলেই পরিপাটি হয়ে এসেছেন,আজ সকলকেই ভীষণ সুন্দর লাগছে দেখতে। যুব কেন্দ্রের ছোট হলটা ধীরে ধীরে ভরে উঠছে, কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে আসছেন গৃহসেবিকার দল। আসছেন বিভিন্ন এনজিওর প্রতিনিধিবর্গ। এক ফাঁকে এসে বলে গেল পারমিতা, " আপনার আরও একজন প্রিয় মানুষ আসছেন, ডঃ কিংশুক সরকার।" 

স্যার আমার প্রাক্তন বড় সাহেব, চন্দননগরের বড় সাহেব। চাকরি এবং তার বাইরেও কত কি যে শিখেছি স্যারের থেকে, আমাদের মধ্যপ্রদেশে প্রেমটাও স্যারের হাত ধরে। অনেক বছর হল চাকরি ছেড়েছেন স্যার। বর্তমানে গোয়ায় IIM এর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। উনি চাকরি আর আমি চুঁচুড়া ছাড়ার পরও অনেকদিন যোগাযোগ ছিল স্যারের সাথে, নিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ওনার লেখা প্রবন্ধের লিংক পাঠাতেন স্যার। আমিও ডাকতাম বিভিন্ন কর্মশালায় সেশন নেবার জন্য। তারপর যা হয় আর কি - সময় ধুলো জমিয়েই যায় সব প্রিয় সম্পর্ক গুলোর ওপর। 

জানতাম দেখা হলেই স্যার এই নালিশটাই করবেন, ঠিক তাই করলেন। " ফেসবুকে প্রায়ই দেখি, কত প্রোগ্রাম করছ তুমি। আমায় তো আর ডাকো না।" বল মা তারা, দাঁড়াই কোথা -। গোয়া IIM এর অধ্যাপককে ডাকার মুরোদ কি তমলুকের আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের আধিকারিকার আছে। চাকরি ছাড়ার সাথে সাথে কি আমার আর্থিক অস্বচ্ছলতার কথাও ভুলে গেলেন স্যার? স্যার হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, " আরে পয়সা চাইছে কে? দিও না।" বললাম, আর গাড়ি? আপনাকে কলকাতা থেকে আনতে পাঠাব যে সেই জোর তো থাকতে হবে নাকি। স্যার বললেন," আরে লোকাল ট্রেন ধরে নেব। তুমি জানো আমার এই গুলো ভালো লাগে -"। 

আলোচনা চক্র শুরু হয়। সাতটা জেলায় গৃহসেবিকাদের ওপর চালানো সমীক্ষার রিপোর্ট পেশ করেন একজন। তুলে ধরেন নানা সমস্যার কথা, বেতন বৈষম্য, কাজের সময়, বাথরুম ব্যবহার করতে না দেওয়া, আলাদা কাপে চা, আলাদা বাসনে খেতে দেওয়া, অশ্লীল চাওনি, কিছু হারালেই চুরির বদনাম ঘুরে ফিরে আসে অনেক কথাই। এক দিদি বলেন, " আমরা আর কিছু চাই না, শুধু 'সনমান' চাই।" মালিক পক্ষের প্রতিনিধিরাও পেশ করেন তাদের বক্তব্য। এবার আমাদের পালা - 

সঞ্চালিকার একদিকে স্যার আর আমি, অন্য দিকে দুই এনজিও থেকে আসা দিদি। বেশ ভয়েই ছিলাম, এসব ক্ষেত্রে যা হয় আর কি, সরকার পক্ষের লোকটিকে ধুয়ে দেয় বাকিরা। ভরসা একটাই স্যার আছেন। ডাইনে বাঁয়ে একাই ব্যাট চালালেন স্যার। অপরিসীম জ্ঞান আর বাগ্মিতায় মোহিত করে দিলেন সকলকে। অনুষ্ঠান শেষে এক ভদ্রমহিলা এসে বললেন, ' আমি একটা বাইট নেব আপনার থেকে।' হেসে বললাম, স্যার থাকতে আমি কে রে ভাই। সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে মহানগরের বুকে, যাই বাস ধরি। হে ঠাকুর একটা ফাঁকা বাস পাইয়ে দাও প্রভু। লিফট অবধি এগিয়ে দিলেন স্যার, বললেন, " আর এমপি যাও না?" এবার আমার হাসার পালা, কি বলছেন স্যার, এই তো মাস খানেক আগেই গিয়েছিলাম। তবে এবার ভাবছি এমপিকে ছাড়ব, ওদের সব ভালো, শুধু বাঘ গুলো হেব্বি বেইমান। দেখা দিতে কেন যে এত সমস্যা ব্যাটাদের। অনেক হয়েছে, আর না, এবার অন্য কোন রাজ্যে ঘোরার প্ল্যান বানিয়ে দিন প্লিজ - ।



অনির ডাইরি ১২ই জুন, ২০২৫

#তাম্রলিপ্তকড়চা #worlddayagainstchildlabour 

যেমন হয় আর কি, অর্ডারটা এল শুক্রবার বিকালে। সংশোধনী অর্ডারটা এল সন্ধ্যা নাগাদ। আমি যখন দেখলাম তখন আবাসনের রাস্তায় বাঁশি বাজিয়ে ঘুরছে নৈশ প্রহরীর দল, যোগ্য সঙ্গতে স্থানীয় সারমেয় কুল। দেখলাম আগামী বৃহস্পতিবার বিশ্ব শিশু শ্রমিক বিরোধী দিবস পালন করতে হবে কয়েকটি বিশেষ আপিসকে। তাদের মধ্যে তমলুক নাই -। অতঃপর আর কি, মুঠো ফোন বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। 

শনিবার জলখাবারের পর ঘেমে নেয়ে ঘর ঝাড়ছি, বড় সাহেবের ফোন, " কালকের অর্ডারটা দেখেছ?" জানালাম দেখেছি তো বটেই, এটাও দেখেছি পূব মেদিনীপুরেও করতে হবে বিশেষ অনুষ্ঠান, কিন্তু সেটা তমলুক নয়, হলদিয়া। বড় সাহেবের খাস তালুক। স্যার হেসে বললেন, " কিন্তু আমরা চাইছি, অনুষ্ঠানটা তোমার খাস তালুকে হোক, অবশ্যই সদর দপ্তরের অনুমতি সাপেক্ষে। সেটা সোমবারের আগে জানা যাবে না। তুমি ভেবে রাখো -"। 

কি ভাবি? সময় যে বড়ই স্বল্প। সোমবার যদি সম্মতি মেলেও, সেদিন হবে না কোন কাজ। কারণ সদর দপ্তরের নির্দেশ মত সেই দিন ফিল্ড ইন্সপেকশনে বেরোবে আমার দলবল। তাহলে হাতে রইল মঙ্গল আর বুধ। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ মেসেজ করলাম আমার টিম তাম্রলিপ্ত গ্রুপে, "নভোনীল বাবু এবং ভাইসব শোন, আগামী ১২ ই জুন Internationa Day against Child Labour। জেলায় জেলায় নানা বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হবে, স্যার চাইছেন আমাদের জেলার অনুষ্ঠানটা হোক আমাদের নিমতৌড়ি নব্য প্রশাসনিক ভবনে, অবশ্যি কলকাতার অনুমোদন সাপেক্ষে। সেটা পেতে গড়িয়ে যাবে সোমবার। তাই এখনি কিছু করার নেই শুধু ভেবে রাখো।" 

বেলা ১টা ৮ এ সৌম্য লিখল, " ম‍্যাডাম অনেক কিছুই করা যাবে। আমার মনে হয় হলে আমরা একটা awareness programme/ Seminer আয়োজন করতে পারি। এখানে DM Sir আমন্ত্রিত থাকবেন ও অন‍্যান‍্য officer রাও থাকবেন। দর্শক/ শ্রোতাদের মধ‍্যে স্থানীয় বিদ্যালয়গুলির শিক্ষক(ইকা) এবং ছাত্র ছাত্রীদের নিমন্ত্রণ করা যেতে পারে। এছাড়াও স্থানীয় যে বাজার কমিটি যে গুলি থাকে তাদেরকেও ডাকা যেতে পারে, এছাড়া জেলার বিভিন্ন NGO গুলির ও থাকা উচিৎ।

ম‍্যাডাম অনুষ্ঠানটা করা যেতে পারে এভাবে:
স্বাগত ভাষণ, প্রদীপ প্রজ্জ্বোলন বা অন‍্যকিছু, এবছরের থিম সম্পর্কে বলা, আমাদের তরফে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে একটি শপথ বাক‍্য পাঠ, এরপর অফিসিয়ালদের বক্তব‍্য, চাইল্ড লেবার রেসকিউ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা শেয়ার বা কোন ডকুমেন্টরি দেখানো, তারপর সমগ্র অংশগ্রহনকারিদের মধ‍্যে interactive আলোচনা থাকতে পারে, স্টুডেন্টদের জন‍্য স্লোগান পোস্টার লেখা, কুইজ কনটেস্ট, এসে কনটেস্ট, নাটক হতে পারে। সেরাদের জন্য কিছু পুরষ্কার থাকবে। চিত্রাকর্ষক কিছু ব‍্যানার তো থাকবেই, যাতে সকলের চোখ টানে।আপাতত এগুলো মনে পড়ছে ম‍্যাডাম।🙏" 

১টা ১৪ নাগাদ মেসেজটা পড়ে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, "আর কি মনে পড়বে বাপ ❤️"। বেলা ১টা ৫৮ এ প্রতিক্রিয়া দিলেন বড় সাহেব, "Excellent! 👌👌"। ব্যাস তাহলে আর কি? সোমবার আপিস খুললেই আগে হলটা তো বুক করা হোক। ডিএম সাহেবের সব থেকে বড় হলটা যদি পাওয়া যায়, অন্তত দুশ লোক ধরে যাবে ওতে। বুকিংয়ের কাজটা হয় করেন হক বাবু, নয় শান্তনু। হক বাবু আপাতত ঈদের ছুটিতে আছেন, তারপর বাড়ির বিয়ের জন্য আরো কিছুদিন ছুটি নিয়েছেন, আর শান্তনু কাহিল মরশুমি জ্বরে, হোক জ্বর বাবা, তাও যা, নাজির খানায় গিয়ে হল বুক করে উদ্ধার কর। শুধু নাজির খানার কাউকে ধরিয়ে আসিস না বাপ, নেক্সট টাইম ওরা আর হল দিবে নি। 














কাশতে কাশতে শান্তনু তো গেল হল বুক করতে, দেখা গেল জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক আগেই বুক করে রেখেছেন আমাদের সাধের মস্ত বড় হলটা। অগত্যা মাঝারি হলটাই ভরসা। ধারণ ক্ষমতা একশ মাত্র। তাই সই, এবার কলকাতা অনুমোদন টুকু দিলে বাঁচা যায়।

পুনশ্চ - নীচের রংবেরংয়ের পোস্টার গুলো লিখেছে আমাদের সৌম্য মুখোপাধ্যায় আর ডিজাইন করেছে আমাদের শান্তনু Santanu Ghara

অনির ডাইরি ১২ই জুন, ২০২৫
#তাম্রলিপ্তকড়চা #worlddayagainstchildlabour 

(প্রথম পর্বের পর)

সৌম্যর আঁকা পথ ধরেই হাঁটি আমরা- 
প্রথম প্রস্তাব ছিল গণসচেতনতা শিবির তথা সেমিনার। তার জন্য হল তো বুক করলাম আমরা, এবার পালা হল ভরানোর। মঙ্গলবার যখন নভোনীল বাবু, সৌম্য, বেদজ্যোতি, শুভাশিস আর আমি গোল টেবিলে বসলাম তখন মূল অনুষ্ঠানটা শুরু হতে বাকি মাত্র ৪৮ টি ঘণ্টা। শান্তনু আজ অনুপস্থিত। আজকের দিনেই ছুটি নিতে হল বাবা তোকে! 

দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল এই অনুষ্ঠানের সূচনা করবেন মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়। অচীরেই রথ, বিশ্বস্ত এবং অবিশ্বস্ত সূত্রের খবর সেই সময় নাকি মাননীয়ার পদধূলি পড়তে চলছে এই জেলায়, তাই এই মুহূর্তে ডিএম স্যারকে পাওয়া প্রায় লটারি জেতার সামিল। সোমবার থেকে বি ব্লকের বাতায়নে দাঁড় করানো আছে আমাদের রবিকে। ডিএম স্যারের গাড়ি এলেই যেন খবর দেয় আমায়। গতকাল মহানগরের অনুমোদন পাওয়া ইস্তক দাঁড়িয়েই আছে রবি, মাঝে মাঝে মাথা চুলকাচ্ছে, এদিক ওদিক যাচ্ছে, আমাকে দেখলেই আবার অ্যাটেনশন, তাও একটা সুখবর দিতে পারেনি ব্যাটা। 

তৃতীয় প্রস্তাব ছিল, আমন্ত্রণ জানানো হবে অন্যান্য আধিকারিকদের। মাননীয় জেলা শাসকের সময় না পেলে কি করে আমন্ত্রণ জানাই বাকিদের। কি করে বলি কোন সময় হবে আমাদের অনুষ্ঠান। তাও গোল
গোল করে ফোন করে রাখি তাঁদের, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত শিশু এবং শ্রমিকদের সাথে। 

চতুর্থ প্রস্তাব ছিল নিমন্ত্রণ জানানো হবে স্থানীয় বিদ্যালয় গুলির মাননীয় শিক্ষক(ইকা) এবং ছাত্রছাত্রীকুলকে। হলদিয়া থেকে দেবাশীষ বাবু বললেন, " ম্যাডাম বাচ্ছা কি আর এখন পাবেন? গ্রীষ্মের ছুটি শেষে খুলে গেছে সব স্কুল, যাতায়াতের পথে মাস্টারমশাই, দিদিমনিদের সাথে কথা বলে দেখেছি ওঁনারা সবাই খুব চাপে আছেন, সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করা নিয়ে -"। কেলো করেছে। বড়দের শুকনো খটখটে আলোচনা ব্যতিরেকে বাকি সবটুকুই তো বাচ্ছাদের নিয়ে পরিকল্পনা করছি আমরা, সেই কোন ফেলে আসা মেয়েবেলায় শিখিয়েছিল বাবা, ছাত্রদের প্রতি জনৈক মহান ব্যক্তির বাণী, " জগৎটা তোমাদের, জগৎটা আমাদেরও, কিন্তু তোমরা হলে সকাল আটটা নটার সূর্য। " ওদের হাতে আছে অনন্ত সময়, জগৎ পাল্টে ফেলার অপরিসীম সম্ভবনা। শুধু একটু ঝাঁকিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা।

আসন্ন সোশ্যাল অডিটের চাপ মাথায় নিয়েই স্কুলে স্কুলে ঘোরে মুকুল। খুলে বলে আমাদের উদ্দেশ্য আর বিধেয়। নন্দকুমারের ইন্সপেক্টর রঞ্জিত আর SLO শিবু মিলে যোগাড় করে ফেলে আরো কিছু বাচ্ছা। দিন শেষে হিসেব করতে বসে মাথা চুলকায় বেদজ্যোতি, " ম্যাডাম এত বাচ্ছাকে বসাবেন কোথায়? বাচ্ছা একটু কমাতে হবে।" শুধু বসানো নয়, আছে টিফিন, আছে টুকটাক উপহার, কিনতে হবে শ্লোগান, পোস্টার আঁকার জিনিস পত্র, বাজেট যে অতি অল্প। কমাও বললেই কমানো যায় নাকি, হেড মাস্টার মশাই/ বড় দিরা কাতর অনুরোধ করেন, " প্লিজ স্যার/ প্লিজ ম্যাডাম আমরা ওদের বলে ফেলেছি যে। এখন নিয়ে যাব না, বললে ওরা দুঃখ পাবে না?" 

বাচ্ছাদের দুঃখ দিলে কি আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হবে, কখনই না। কিন্তু সব মিলিয়ে লোকসংখ্যা যে প্রায় পৌনে দুইশ ছুঁই ছুঁই। এই গরমেও সুদূর কাঁথি থেকে আসতে চাইছেন বাজার কমিটি, NGO র লোকজন। ইঁটভাঁটা মালিক সংগঠন থেকে আসতে চাইছেন অন্তত ২০ জন। কাকে রাখি, কাকে ফেলি? অগত্যা চঞ্চলকে পাঠানো হয়, " দেখ তো পাশের মাঝারি হলটা ফাঁকা আছে কিনা? থাকলে ওটাও নেব আমরা। উদ্বোধন অন্তে বাচ্ছাগুলিকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ঐ ঘরে। ততক্ষণ না হয় একটু দাঁড়িয়েই থাকবে আমাদের ছেলেমেয়েরা। 

আমন্ত্রণ/ নিমন্ত্রণ সারতে সারতেই কেটে গেল মঙ্গলবার। হাতে মাত্র একটা দিন, ২৪ টি ঘণ্টা, কি যে হবে -


অনির ডাইরি ১১ই জুন, ২০২৫
#অনিরডাইরি 

হাকুচ তেঁতো মন নিয়ে বেরিয়েছি, একে তো ভ্যাপসা গরম, তায় মেয়ের থেকে দূরে থাকার বেদনা। গৃহকর্তার বদলী হওয়ার সুবাদে আমাদের পূব মেদিনীপুরের বাস উঠেছে বেশ কিছুকাল। বর্তমান নিবাস থেকে তমলুক আপিস করতে আসা হয়তো অসম্ভব নয়, তবে এই গরমে বড্ড কষ্টকর। তাও যে করিনি, বা আগামী দিনে করব না তা নয়, কিন্তু এই সপ্তাহটা পিত্রালয়ে থেকেই করার চেষ্টা করছি। 

 দক্ষিণ পূর্ব শাখার ট্রেনের ওপর জনগণের অপসৃয়মান ভরসা প্রত্যক্ষ করে একটু সকাল সকালই বেরিয়েছি আজ। এখনও ভালো করে ঘুম ভাঙ্গেনি শ্রমজীবী এই শহরটার। রাস্তা পেরোতে গিয়ে চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল ফাঁকা ৭২ নম্বর বাস খানা। তিতকুটে স্বাদখানা যেন আরো গভীর হল মনের মধ্যে। রাস্তা পেরিয়ে পাওয়া প্রথম টোটো খানাই অবশ্যি রাজি হয়ে গেল দাশনগর যেতে। 

প্রায় দুই দশক পর আবার এই পথে আপিস যাচ্ছি। বিগত বার আমি অবিবাহিত ছিলাম, শ্রীমতী তুত্তুরী ঘুমিয়ে ছিলেন ভবিষ্যতের গর্ভে। বিগত বার আমার পোস্টিং ছিল খড়গপুর।বিগত বার টিফিন আর জলের ভারী ব্যাগটা নিয়ে, "বাবা কেন চাকর" বলতে বলতে রোজ বাসে তুলে দিতে আসত যে বাবা, আজ ঘর থেকে রোয়াকে নামতে টলে যায় সে। 

ভাত না খেয়ে বেরোতেই দিত না মা। কাক ডাকা ভোরে উঠে টুকটুক করে কত কি যে রাঁধত। বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হত বলে দুই দফার টিফিন গুছিয়ে দিত মা। ঠাণ্ডা জলের বোতলের গায়ে জড়িয়ে দিত নরম তোয়ালে। আজ ডবল ডিমের ওমলেট আর বাসী রুটি খেয়ে বেরিয়েছি। লতা দি অবশ্যি অনেক বার বলেছিল, "দুটো ভাত করে দিই বনি? টিফিনে দুটো রুটি করে দিই নিয়ে যাও বনি -।" আমিই নিষেধ করেছি, লতাদির মত ওমলেট কেউ বানাতে পারে না। বাসী রুটি দিয়ে লতাদির হাতের নরম গরম ওমলেট এককথায় অতুলনীয়।

 টিফিন কি খাব, তাও ঠিক করে নিয়েছি, ডিএম আপিসের ক্যান্টিনে অসাধারণ মাখন টোস্ট বানায়। আমার জন্য যখন আনতে যায় রবি বা শান্তনু, ওরা একে তো প্রচুর বাটার লাগায় তারপর করে কি, ব্রেডটাকে স্যান্ডুইচ মেকারে সেঁকে দেয় বেশ করে। ওপরে ছড়িয়ে দেয় হাল্কা করে চিনি আর মরিচের গুঁড়ো। ভাবতে ভাবতে সিক্ত হয়ে ওঠে জিহ্বা।

দক্ষিণ পূর্ব রেলের আজ অশেষ দয়া যে আপিস টাইমের ঢের আগে পৌঁছে দিলেন আমায়। সুইপার মাসি যে কি উৎফুল্ল হল সক্কাল সক্কাল আমায় দেখে। উল্টে দিলে নালিশের ঝুড়ি, " তুমি মা জননী আমায় ভুলেই গেছ, কতদিন বেতন বাড়েনি জানো, সেদিন আমার লাতি আর লাতুনকে নিয়ে এয়েছিলুম তোমায় দেখাব বলে আর তুমিই কি না সেদিন এলে না -", ইত্যাদি প্রভৃতি। যাবার সময় লোকজনের জন্য সুপারিশ ও করে গেল মাসি, " শোন না, মেয়েটা গ্রাজুয়েট, তুমি ওর একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দাও না মা জননী-"। 

সাড়ে বারোটা নাগাদ ডাকা ছিল ওনাদের, সংখ্যায় প্রায় পঞ্চাশ। বয়স ষাট থেকে সত্তরের কোঠায়। নতুন পেনশন চালু হয়েছে সবার। অন্যান্য বারের মত এবারেও বুঝিয়ে বলে দিই আমরা, একবার চালু হওয়া পেনশন কেউ বন্ধ করতে পারে না। কাজেই কেউ যদি হুমকি দেয়,পেনশন বন্ধ করে দেবার ভয় দেখায় মোটেই পাত্তা দিবেন নি। PPO টা লামিনেট করে রাখবেন কিন্তু-। পুতুলের মত ঘোলাটে চোখে তাকায় সবাই, মাথা চুলকায় টুকটাক। নভোনীল বাবু বুঝিয়ে দেন ভালো করে, " বাড়ির দলিল কিভাবে রাখেন? প্লাস্টিকে মুড়ে রাখেন না -"। দম দেওয়া পুতুলের মত মাথা নাড়ে সবাই, ফোকলা দাঁতের ফাঁকে ফোটে শিশুসুলভ হাসি। 

প্রতিবারের মত এবারও প্রশ্ন করি আমি, "একসাথে যখন অনেক টাকা ঢুকবে, তখন কেউ যদি গিয়ে বলে ম্যাডাম টাকা চেয়েছেন, কি করবেন?" পিন ড্রপ নীরবতা ভেঙে সুদূর ময়না থেকে আগত এক বৃদ্ধ বলে ওঠেন, " আপনাকে নালিশ করব আজ্ঞে -"। জ্ঞান বিতরণের এহেন সুযোগ মাঠে মারা যাওয়ায় ছদ্ম ক্রোধে বলি, ধুৎ খেলব না, সব শিখিয়ে পড়িয়ে এনেছে মাইরি ময়নার ইন্সপেক্টর। 

আজকের অনুষ্ঠান শেষে, কালকের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। কাল যে বিশ্ব শিশু শ্রমিক বিরোধী দিবস। মাত্র আট চল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে নামাতে হচ্ছে এত বড় অনুষ্ঠান। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মত অনুপস্থিত আমাদের হক বাবু। নিকটাত্মীয়ের বিয়ে তাই আমাদের ত্যাগ করে বসে আছে লোকটা। 

তারই ফাঁকে এক বৃদ্ধ এসে ছলছল চোখে করজোড়ে বলে যান, " পরম করুণাময় ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন। ম্যাডাম, ভাবিনি কোনদিন পেনশন পাব। পেট চালাতে লোহা বইতাম। এই দেখেন লোহা বয়ে বয়ে কাঁধে আমার গর্ত হয়ে গেছে।" 

একসাথে অনেক গুলো নতুন পেনশন ছাড়ার আনন্দে আরেক দল প্রৌঢ় নেতা এসে দিয়ে যান এত মিষ্টি। বলে যান, " এটা কিন্তু পূব মেদিনীপুরের মিষ্টি নয় ম্যাডাম। খাস পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে আনিয়েছি আপনার পরিবারের জন্য। এই এত্ত বড় বড় রাজভোগ। এটা বাড়ি নিয়ে যাবেন আজ্ঞে।" নিয়ে যাবার সুবিধার্থে একটা ফুলছাপ ব্যাগ ও দিয়ে যায় জনগণ। যদিও আমার বাড়ি ভর্তি মহা হ্যাংলা সুগার রোগী, তাও নিয়েইনি মানুষের ভালোবাসার দান। 

বেলা গড়ায়, পাটে বসেন দিনমণি। জনগণকে গোছা গোছা নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে পড়ি আমি। কে জানে ফেরার পথে কেমন দৌড়াবে দক্ষিণ পূর্ব রেল। আমার প্রত্যাশা পূরণ করেই খোঁড়াতে থাকে ট্রেন। দাঁড়িয়ে পড়ে যত্রতত্র। দিগন্ত বিস্তৃত অন্ধকারে থমকে থাকা ট্রেনের লেডিজ কামরা থেকে মেসেজ করি মেয়েকে, বাবুরে আর আন্দাজ এত ঘণ্টা এত মিনিট পর আবার দেখা হবে তোর সাথে। জবাবে তাঁর লেখা দিনপঞ্জি পাঠান তিনি, শিরোণাম, " Kicking Open Doors"। জানি মা হিসেবে আমি পক্ষপাত দুষ্ট, তবুও মনে হল বড় ভালো লিখেছে মেয়েটা, শুধু আমার লেখার মতই বড্ড বড়। জানি ও আমার মতই লেখা ছোট করতে পারে না, কারণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই লেখাগুলোই যে আমাদের বেঁচে থাকার রসদ।

অনির ডাইরি জুলাই, ২০২৫

 অনির ডাইরি ১০ই জুলাই, ২০২৫


#অনিরডাইরি 

অবশেষে ট্রেন পেলাম। ঝাড়া আধ ঘন্টা পুতিগন্ধময় দাশনগর স্টেশনে পায়চারি করার পর। মাইরি,এর জন্য সাতসকালে উঠে কাকস্নান সেরে, নাকে মুখে গুঁজে দৌড়ে আসা? বিগত আঠারো বছরে স্টেশনটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, নতুন প্লাটফর্ম হয়েছে, পুরান প্লাটফর্মগুলো দৈর্ঘ্যে এবং উচ্চতায় বেড়েছে, নতুন সিঁড়ি, বসার জায়গা, শৌচালয়, পানীয় জলের কল সব হয়েছে। শুধু পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমটা একই আছে। আগেও কোন ঘোষণা হত না, আজও হয় না। হুড়োহুড়ি করে ফাঁকা ট্রেনে উঠে সিট দখল করে খেয়াল হল, একবার শুধিয়েই নিই, মেদিনীপুর লোকাল এত ফাঁকা কেন!


ওঃ হরি, এটা আমতা লোকাল। যে দিদিমনিকে শুধিয়েছিলাম, তিনি সাবধান করলেন, "এখনি ছাড়বে, নামতে যাবেন না। রামরাজাতলায় নেমে যাবেন।" দক্ষিণ পূর্ব রেলের ওপর ভরসা রেখে নেমেই পড়লাম, পিছন পিছন আরেক ভদ্রমহিলাও নামলেন। নেমে চোখে চোখ পড়তেই একগাল হেসে শুধালেন, " কোথায় যাবে দিদি?" সাতসকালে এই জঘন্য নোংরা ইস্টিশনে দাঁড়িয়ে খেজুরে গল্প করতে একদম ইচ্ছে করছে না, কেজো গলায়, " মেছেদা" বলে সরে গেলাম। 


ভদ্রমহিলাকে দেখেই মনে হয়েছিল গপ্পে বুড়ি, কর্মক্ষেত্রেও দেখলাম আমার অনুমান নির্ভুল। কপাল বৈগুণ্যে তিনি আমার ট্রেনেই উঠলেন এবং গুঁতোগুঁতি করে আমার পাশেই বসলেন। " মেচেদায় তোমার বাড়ি দিদি?" ঘাড় নেড়ে বললাম, নাহ্ আপিস। অযাচিত ভাবেই জানালেন, ওনার বাড়ি মেদিনীপুর লাইনে একটা ছোট স্টেশনে। স্টেশনে নেমে আগে হাঁটতে হত, এখন টোটো যায়। ওনার শ্বশুরবাড়ি গাঁয়ের খুব সম্ভ্রান্ত পরিবার। গোপাল আছে, তিনি মন্দিরে অধিষ্ঠাত। তাঁর নিত্য সেবা করতে হয় শরিকদের। 


"আমি আর পারি না দিদি, মূল্য ধরে দিই।শ্বশুরশাশুড়ি যতদিন জীবিত ছিলেন, অনেক করেছি। এখন গিয়ে বামুন ঠাকুরকে টাকা দিয়ে আসি। তিনিই ফল দুধটুধ কিনে পুজো করেন।" সস্তার কাপড়ের ব্যাগ থেকে বেরোয় একটি বিবর্ণ সাদা প্লাস্টিকের কৌটো, কৌটোর ওপর লেখা রেস্টুরেন্টের নামটা বিবর্ণতর। কৌটো ভর্তি মুড়ি, " খাবে দিদি? খাও না?" সভয়ে মাথা নাড়ি। আমি ট্যালা বটে, এতটাও নয়।


 ভদ্রমহিলা নিজেই একগাল মুখে দেন, খানিক চিবোন তারপর বলেন, "এই কাজটা নতুন, তাও একটা দিন ছুটি করতে হল -"। এত বোর হচ্ছি যে ভাবছি কি করি, ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি, নাকি কানে হেড ফোন গুঁজে বসি। 


হে ঈশ্বর, কার মুখ দেখে যে আজ বেরিয়েছি, না আছে ব্যাগে হেড ফোন, মটকা মেরে থাকলেও ইনি ডেকে কথা বলছেন। কত কিছু যে জেনে ফেললাম উলুবেড়িয়া আসতে আসতে। ভদ্রমহিলার শ্বশুরমশাই হোটেলের রাঁধুনী ছিলেন, উনি রান্নাবান্না যা শিখেছেন স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইযের থেকেই শিখেছেন। স্বর্গীয় শ্বশুর লোকটি দেবতুল্য ছিলেন, জীবনে মদ বিড়ি সিগারেট কিচ্ছু স্পর্শ করেননি। পরনারীর দিকে চোখ তুলে তাকাননি। সবটুকু পুষিয়ে দিয়েছে অবশ্য ওনার ছেলে, ভদ্রমহিলার সোয়ামী। "দুটো ছোট বাচ্ছা সমেত আমায় ফেলে চলে যায় দিদি, কি কষ্ট করে যে বাচ্ছাদের মানুষ করেছি --"। বলতে বলতে চোখ মোছেন ভদ্রমহিলা। 


সাতসকালে এই কান্নাকাটি, ফ্যাঁচফ্যাঁচানির ভয়টাই আমি পাচ্ছিলাম। এত বছরের পাবলিক সার্ভিস, কম মানুষের সাথে তো মিশিনি, সমস্যার গন্ধ আমি দূর থেকে পাই। মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা, হাত ভর্তি শাঁখাপলা, সিঁথি ভর্তি ডগডগে সিঁদুর, সস্তার সোয়েটের টিপ, ছিট কাপড়ের রং জ্বলা সালোয়ারকামিজ, মুখ চোখে জেবড়ে বসা কালিমা, আর "হৃদয়ের কথা কহিতে ব্যাকুল" মনোভাব আমার কাছে অন্তত বহুক্ষণ আগেই প্রকাশ করেছে ওনার পরিচয়। 


"এক ডাক্তার বাবুর বাড়িতে কাজ করতাম দিদি। কাজ করতে করতে আমি নিজেও অনেক ডাক্তারি শিখে গেছি -"। বলতে বলতে হেঁহেঁ করে হাসেন মহিলা। " চার বছর ছিলাম ওদের বাড়ি, ওনার বাবা খুব অসুস্থ, শয্যাশায়ী, নাক দিয়ে নল ঢুকিয়ে খাওয়াতে হয়। সব আমি করতাম। ডাক্তার বাবু আর বৌদি আমায় ভালবাসত কত! সেই কাজ ছেড়ে দিলাম -, কেন বল তো? আমার মেয়ে একদিন রাতে হঠাৎ এসে হাজির হল দুটো বাচ্ছা সমেত।  বরের সাথে ঝগড়া করে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছে। তাদের আমি অতরাতে কোথায় পাঠাই? বুড়ি মাসিমাকে জিজ্ঞাসা করে, ওদের দুটি খেতে দিলাম আর রাতে একটু শুতে দিলাম। ব্যাস পরদিন ডাক্তারবাবুর বোন এসে আমায় কি কথা যে শোনাল দিদি, কি বলি -"। 


ডাক্তারবাবু কিছু বললেন না, শুধাই আমি। " উনি তো কলকাতায় থাকেন। মাঝে মাঝে আসেন। বাবামায়ের দেখাশোনা বোনই করে। আমার এত দুঃখ হল দিদি, যাদের জন্য এত করি, তারা আমার এত বড় বিপদে, এইটুকু করল না। পরদিন আমিও বেরিয়ে এলাম ওদের বাড়ি ছেড়ে -।"


"চুপি চুপি তোমায় বলি, বেরিয়ে এসে খুব ভয় পাচ্ছিলাম দিদি। যদি আর কাজ না পাই। ঠাকুরের দয়ায় এটা পেয়ে গেছি এই আর কি। বেতন ও ভালোই দেয়, এখুনি ছুটি করতে চাইছিলাম না, কিন্তু আমার মেয়েটা এত জ্বালাচ্ছে দিদি তোমায় কি বলব। "


তোমার মেয়ে আবার ফিরে গেছে তার বরের কাছে? জানতে চাই আমি। " না,না যেতে চাইলেও আমি যেতে দেব না।" এই প্রথম রাগতস্বরে কথা বলেন ভদ্রমহিলা। " তোমায় কি বলব দিদি, জঘন্য নোংরা লোক একটা -"। গায়ে হাত তোলে? আবার জিজ্ঞাসা করি আমি।  ভদ্রমহিলার মুখে ফুটে ওঠে অবিমিশ্র ঘৃণা। " আরে দিদি লোকটার বয়স প্রায় ষাট।"


মুখে অভাব আর সময় যতই বলিরেখা কেটে যাক না কেন,এই ভদ্রমহিলার বয়স মেরেকেটে পঞ্চাশ হবে। আর এনার জামাতার বয়স ষাট! তিতকুটে ঘৃণায় ভরে ওঠে আমার মন। মনের ছাপ বোধহয় মুখে পড়েছিল, ভদ্রমহিলা ঘাড় নাড়েন। জানতে চাই, " সম্বন্ধ করে?" উনি রেগে বলেন, " না, না। প্রেম।পনেরো বছর বয়সে উনি প্রেম করে পালিয়ে যান ঐ ঘাটের মড়ার সাথে। যার কত গুলো যে বিয়ে আর কতগুলো যে সম্পর্ক তার ঠিক নেই,জমিজমা ট্যাকাপয়সা কিস্যু নাই, ভাড়া বাড়িতে থাকে, কি কাজ করে ঠাকুর জানে, এমন মিনসের সাথে কেউ পালায় দিদি? তারপর দুই দুটা বাচ্ছা নিয়ে এখন ফিরে এসেছেন মায়ের ঘাড়ে। এখন নাকি তিনি আর এই লোকটার সাথে থাকতে পারছেন না। কি বলবে তুমি বল -"।


আমি আর কি বলব, ভদ্রমহিলা বলতে দিলে তো। "আমি বলেছি দিদি, প্রেম করার সময় মনে ছিল না? কোথায় বুড়ি মাকে তুই দেখবি, না আমাকে তোকে দেখতে হচ্ছে। তুমি বললি বিশ্বাস করবে না দিদি, বাচ্ছা গুলো হওয়া ইস্তক সব দায়িত্ব আমি পালন করে এসেছি। ওদের দুধ, হাগিস, জামাকাপড়, বইখাতা, ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া সব আমি করেছি। সেই বইখাতা গুলো পর্যন্ত বরের ঘরে ফেলে এসেছে। একটা জামা কাপড় পর্যন্ত নিয়ে আসেনি। আমার ভালো সালোয়ার, নাইটি যা ছিল সব দিলাম। একটা বাড়ি ভাড়া করে রেখে এলাম, যে এখানে থেকে নতুন করে জীবন শুরু কর।" 


"বললাম, ভালো রান্না জানিস, ঠাকুরদার থেকে শিখেছিলি, তুই বরং লোকের বাড়ি রান্না করে খা। ও বাবা, বলে কিনা, রান্নার লোক আমি হবনি। আমি রুগী দেখব। রুগী দেখবে ও? রুগী দেখার কাজে হ্যাপা কম? আর চাইলেই সে কাজ পাবে কোথায়? কে রাখবে ওকে?" 


ট্রেন ঝমঝম করে রূপনারায়ণ পেরোয়। আড়মোড়া ভাঙি আমি, কোলাঘাট আসছে, এবার উঠতে হবে। ভদ্রমহিলা করুণ ভাবে আমার হাতটা চেপে ধরেন, " শোন না দিদি, কাল কি হয়েছে। নাতিনাতনী দুটোকে যে দিদিমণির কাছে পড়তে দিয়েছি, তিনি আমায় ফোন করে বললেন কি, যে, ' কাকিমা, তোমার মেয়ে এসে বাচ্ছাগুলোকে মাঝপথে নিয়ে চলে গেল।' আমি বলি, এ আবার কি। মেয়েকে ফোন করি, সে ধরে না। ধরে না। তারপর বলে কি, যে জামাই তাকে ফোন করে ডেকেছে, তার পরিচিত লোকজনের উপস্থিতিতে সালিশী করার জন্য। আমার মেয়ে তখন বলেছে, ঠিক আছে, তবে যা কথা হবে বাচ্ছাদের সামনে হবে। বলে বাচ্ছা গুলোকে পড়া থেকে টেনে নিয়ে গেছে ঐ সভায় -"। 


মানে? জানতে চাই, তোমার নাতিনাতনীর বয়স কত? " দশ এগারো। কি মিষ্টি ওরা দিদি কি বলব। পড়ালেখায় কি ভালো -"। আর তাদের পড়া থেকে তুলে নিয়ে গেছে বাবামায়ের নোংরা কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি দেখার জন্য? ভদ্রমহিলা এই প্রথম একজনের সমর্থন পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, " এই কথাটাই আমি বলেছি দিদি। বলল, না ওর বাচ্ছা তো ওর মতোই হবে।ওদের জানা দরকার ওদের বাপ কেমন -" 


গা গুলিয়ে ওঠে আমার, আর তোমার মেয়ের বাচ্ছা নয়? ঈশ্বর এদের কেন বাচ্ছা দেয় কে জানে। বলেই বুঝি অনধিকার চর্চা করে ফেললাম। জিভ কেটে সরি বলে উঠে পড়ি, এমনিতেই মেছেদা আসছে, ভদ্রমহিলা খপ করে ধরে ফেলেন আমার দুটো হাত, " সরি বলো না দিদি। আমিও এটাই বলি ঠাকুরকে। এদের তুমি কেন দাও ঠাকুর। কত মানুষ সারাজীবন চেয়েও সন্তানসুখ পায় না। আর এরা পেয়েও তার মর্যাদা দেয় না। বাচ্ছা মানুষ করার জন্য আমি যে কি করিনি তুমি জানো না। এমন অনেক কাজ করেছি, যা বললে তুমি ঘেন্নায় কুঁকড়ে যাবে, কিন্তু আমার কোন উপায় ছিল না দিদি। দুটো বাচ্ছা, বুড়ো শ্বশুর শাশুড়ির জন্য অনেক নীচে নেমেছি দিদি -"। 


এতবছরের অভিজ্ঞতা চিৎকার করে বলে আর একটু সময় পেলেই ভদ্রমহিলা তাঁর নৈতিক অবনমনের কথাটা বলে বসবেন। এবার আমি ওনার হাতে মৃদু চাপ দিই, বলি, যা করেছ বেশ করেছ। তোমার প্রিয়জনদের জন্যই তো করেছ? আর তোমার কাজের ফল অন্য কারো ওপর তো চাপাও নি? তাহলে কি? তুমি এখন যাও, গিয়ে নাতিনাতনি সামলাও। 


 আবেগে গলে পড়ে বলেন ভদ্রমহিলা, " আশীর্বাদ করো দিদি, যেন পারি। মেয়ের প্রতি আমার আর কোন দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু ওরা তো নিষ্পাপ শিশু। আমি খুব চেষ্টা করছি ওদের একটা হোস্টেলে ভর্তি করে দেবার।" ঝমঝম করে ট্রেন মেছেদা ঢোকে, হেসে হাত ছাড়িয়ে নিই আমি। এবার নামতে হবে, সামনে আবার অন্য যুদ্ধ।

Wednesday, 21 May 2025

অনির ডাইরি মে, ২০২৫

 অনির ডাইরি ৩১শে মে, ২০২৫ 

#অনিরডাইরি 


এই তো গতকাল বিকালের কথা, শনিবারের ভাতঘুম শেষে, এককাপ ধূমায়িত কফি হাতে, একরাশ সংকোচ সহ শৌভিক বলল, " আচ্ছা, আমরা যে কাল যাচ্ছি, ওনারা জানেন তো?" ওনারা অর্থাৎ আমার বৃদ্ধ মাতাপিতা। 


হতভম্ব হয়ে জানতে চাই, কেন তোকে ওরা যেতে বলেনি? শৌভিক ঘাবড়ে গিয়ে বলে,"না না, যেতে বলার দরকার নেই। শুধু জানতে চাইছি, ওনারা জানেন কি না।" বরকে আর কিছু বলি না আমি, বুঝি জামাইষষ্ঠীতে জামাইকে আসতে বলতে নির্ঘাত ভুলে বসে আছে আমার বুড়ো বাপমা। এমনিতে আমার বরের কোন জামাইসুলভ ঘ্যাম নেই, আমি বললেই যথেষ্ট, তবুও - 

 

ইদানিং প্রায়ই মনে হয়, তুত্তুরীর পাশাপাশী এই অশীতিপর দম্পতিরও মা হয়ে উঠেছি আমি। বিশ্বাস করুন, বাবা মায়ের বাবা-মা হয়ে ওঠাটা মোটেই খুব সহজ কাজ নয়। মায়ের মা হয়েই ফোন করি মাকে, " হ্যাঁ গো, কাল শৌভিককে যেতে বলো নি -"। একরাশ অভিযোগ নিয়ে ফোনটা ধরেছিল মা, " তোর বাবা আমায় এত কটু কথা শোনাচ্ছে -"। বলতে বলতে হঠাৎ থমকে যায়, " বলেছি তো। সেদিন যে বললাম রবিবার এসো বাবা।" 


সেদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার, মাকে নিয়ে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে হাওড়া গিয়েছিলাম আমি। আবহাওয়ার অবস্থা দেখে অফিস ফেরৎ আমাদের আনতে গিয়েছিল শৌভিক। সেদিন মা বলেছিল বটে, কিন্তু বাকি আলোচনায় চাপা পড়ে গিয়েছিল সেই নিমন্ত্রণ। আরেকবার ফোনে বলে দিতে বলে, শুধাই, বাবা তোমায় কটু কথা শোনায় কেন? জবাব আসে, " চা বসিয়েছি, তাই তোর ফোন ধরতে পারিনি। তাই -"। মায়ের ফোন ধরা আর বঙ্গলক্ষী লটারিতে প্রথম পুরষ্কার পাওয়া প্রায় একই, বর্ষীয়ান দম্পতির দাম্পত্য কলহে তাই আর ঢুকি না। 


সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে মহানগরের বুকে, এখনও কেনা হয়নি জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে শাশুড়ির উপহার। সময় পেলাম কই। সকাল থেকে পরিকল্পনাই করে চলেছি দোঁহে, কি কেনা যায়। সময়াভাবে শৌভিক অনলাইন অর্ডার দেওয়ার পক্ষে। কয়েক বছর আগেও তিন তিনটে উপহার কিনতাম আজকের দিনে। উপহার মানে শাড়ি। জ্যাঠাইমার জন্য সাদা, মা আর পিসির জন্য উজ্জ্বল রং। বিশের বছর কেড়ে নিয়েছে আমার জ্যাঠাইমাকে। 


ঘড়িতে সন্ধ্যা সাত, এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি কি কিনব আমরা। শাড়িই কিনব কি? বেশি দেরি করলে বন্ধ না হয়ে যায় দোকানপাট। এতক্ষণ নির্বাক বসে থাকা শাশুড়ি মাতা হঠাৎ মৌন ব্রত ভঙ্গ করে বলে ওঠেন, " আজ আমাদের বিয়ের দিন -"। সুঁচ পড়লেও বুঝি শোনা যাবে এই মুহূর্তে। হতভম্ব হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাই আমরা। জানি তো, কিন্তু শ্বশুরমশাইকে ছাড়া এটা যে ওনার প্রথম বিবাহবার্ষিকী। তাই মনে থাকা সত্ত্বেও কিছু বলিনি আমরা - 


নীরবে বসে থাকি আমরা। বৃদ্ধার মনে থাকল কি করে? এত বছর তো কোনদিনও মনে রাখেননি। এই নিয়ে বড় দুঃখ ছিল শ্বশুর মশাইয়ের। প্রায়ই বলতেন, " তোমাদের মায়ের কিছু মনে থাকে না -"। সত্যিই কিছু মনে থাকে না ওনার, নিজের বা শ্বশুরমশাইয়ের জন্মদিন, বিয়ের দিন, ছেলেদের জন্মদিন, নাতনীদের জন্মদিন কিচ্ছু না। বৃদ্ধের ও যে মনে থাকত, তা নয়, একটা ডায়েরিতে সব লিখে রাখতেন বৃদ্ধ। কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠেই উল্টাতেন সেই ডায়রির পাতা। তাই আমাদের জন্মদিন হোক বা বিয়ের দিন প্রথম ফোনটা শ্বশুরমশাই'ই করতেন। এমনকি জন্মদিনে আমার বাবাকেও প্রথম ফোনটা ওনারই হত।


শ্বশুরমশাইয়ের জন্যই সেলিব্রেট করতাম আমরা। সেলিব্রেশন আর কি, একটা কেক, একটু মিষ্টি। তুত্তুরীর হাতে আঁকা একটা ইকড়িমিকড়ি কার্ড আর স্মৃতিচারণা ব্যাস এইটুকুই। তাতেই কি যে খুশি হয়ে যেত বৃদ্ধ। নীরবে অংশ নিতেন শাশুড়ি মাতা, কোনদিন দেখাতেন না কোন উচ্ছ্বাস। আর আজ - 


ঠিক এই গল্পই তো শুনিয়েছিল সদ্য মাতৃহারা এক বন্ধু কিছুদিন আগে। " জানিস অনি, আজ আমার বাবা মায়ের বিয়ের দিন। বাবাকে ফোন তো করেছিলাম, কিন্তু বিবাহবার্ষিকীর কথা কিছু বলিনি আমি। বাবার সাধারণত এইসব কিছু মনে থাকে না। সারাজীবন মাই মনে রেখেছে। আর আজ যখন মা নেই,বাবা বলল কি জানিস - বললে, ' আজ তো আমাদের বিয়ের দিন।'" কুশীলব ভিন্ন বটে, চিত্রনাট্য একই। উভয়েই মিস করছেন হারিয়ে যাওয়া জীবন সঙ্গীকে, যাদের কখনও ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেননি যে ভালোবাসার তীব্রতা উভয়পক্ষেই এক সমান। কেন যে দেননি, কেন যে মানুষ সময় থাকতে বলে না - আমিও তোমায় ভালবাসি। 


শৌভিককে বলি একটু মিষ্টি নিয়ে আয়, আমি একছুটে কিনে আনি দুটো শাড়ি,বেশি দেরী করলে বন্ধ না হয়ে যায় দোকানপাট। তারপর চটপট বানিয়ে ফেলব অন্যরকম কিছু। ঘরোয়া ভাবেই হোক না আজ সেলিব্রেশন। জানি শ্বশুরমশাই নেই, থুড়ি তাঁর নশ্বর দেহটা নেই, কিন্তু তিনি আছেন তো বটেই। আশেপাশেই আছেন। এত বছরের ভালোবাসার বাঁধন কাটা কি এতই সোজা -।


অনির ডাইরি ২৭ মে, ২০২৫

#অনিরডাইরি 

"তোর পক্ষে কি আর মানুষ হওয়া সম্ভব নয়?" প্রশ্নকর্তাকে একটু আগেই বলেছি, বেশি না, মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ধরে নিই তুই আমায় চিনিস না, আর আমি তোকে চিনি না। আর আমি অপ্রয়োজনে পরপুরুষের সাথে বার্তালাপ করি না। তারপর থেকে তিনি শুরু করেছেন, " কিন্তু আমি করি। এই যে পরনারীর হার, এটাকে আমি জানলা গলিয়ে ফেলে দিই - । এই যে চুলের ব্যান্ড কি বলে যেন স্ক্রাঞ্চি, এটাকেও ফেলে দিই -"। 


একে তো আমি চূড়ান্ত অগোছালো, হদ্দ কুঁড়ে, তারওপর বাড়িটাও হয়ে আছে যেন আস্তাকুড়। মহানাগরিক তিন কামরার ফ্ল্যাটে থেকে কখনও যদি সারাইসুরাইয়ের কাজ করিয়ে থাকেন তো বুঝতে পারবেন আমাদের বাড়ির অবস্থা আপাতত কি সাংঘাতিক।  যা গুচাই, যতটুকু গুছাই, অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি সব লণ্ডভণ্ড। এই হট্টমন্দিরে আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যে কোথায় রাখি, তাই নিয়েই লেগেছে দাম্পত্য অশান্তি। সেই সন্ধ্যা থেকে, আর নেওয়া যাচ্ছে না বাপু - 


এর ওপর আছেন আমার গর্ভধারিনী। দাম্পত্য কলহে জর্জরিত, পথশ্রমের ক্লান্তিতে সম্পৃক্ত হয়ে রাতের রান্না বসিয়েছি এমন সময় তাঁর ফোন, " হ্যাঁরে তুই আমার ফোন টা রিচার্জ করে দিস নি? এই তো মেসেজ পাঠাচ্ছে ১৭ তারিখে রিচার্জ করার দিন ছিল -"। শাশুড়ি মাতা আজ দুধ রুটি দিয়ে উদর পূর্তি করে নিয়েছেন। রান্না কেবল আমাদের দুইজনের জন্য এবং রান্না খুবই সাদামাটা, চীজ ম্যাগী আর ডবল ডিমের পোচ। কিন্তু রান্না ঘরটার এমন অগোছালো দশা যে ঢুকেই কান্না পাচ্ছে। তার ওপর মায়ের ফোনে রীতিমত ব্যোমকে গিয়ে আমাজন ঘেঁটে দেখি, কই রিচার্জ করার রিমাইন্ডার তো দেয়নি। ফোন ও তো দিব্যি ঢুকছে, তাহলে হল কি? 


মা কেবল বলেই যাচ্ছে, " কিচ্ছু নড়ছে না। একটাও ছবি খুলছে না/রিল দেখতে পাচ্ছি না।" ভগবান এই ভদ্রমহিলাকে কেন যে আমি ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম। রিল না ড্রাগ কে জানে। বাড়ির কাজ হচ্ছে বলে শ্রীমতী তুত্তুরীকে আজ প্রায় দিন দশেক হল পিত্রালয়ে রেখে এসেছি। উদ্ধারকর্তা হিসেবে তাঁকেই ফোন করি আমি। আমাজন তো বলছে এখনও একমাস বাকি রিচার্জ করতে, কেসটা কি বাঁধালেন ভদ্রমহিলা। ডেটা অফ করে বসে নেই তো? ফোন রিস্টার্ট করে, অনেক ঘেঁটে ঘুটে দেখা গেল তিনি সিম ম্যানেজার থেকে সিম ১ আর সিম ২ এর ফাংশন বদলে বসে আছেন।


যুগপৎ মা এবং বরের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে তুত্তুরীর ফাঁকা ঘরে আলো নিভিয়ে বসে আছি আমি। মনে পড়ছে সারাদিনের হরেক স্মৃতি। অনেক দিন বাদে দেখা হল ছেলেটার সাথে।কর্মসূত্রে আলাপ হলেও খুব ভালোবাসি ছেলেটাকে, ভালবাসি ওর গোটা পরিবারটাকেই। তাই ছেলেটার, " কেমন আছেন ম্যাডাম"এর জবাবে,  শতেক প্রশ্ন করেছিলাম আমি, " তুমি কেমন আছ? মা কেমন আছেন? বউ কেমন আছে? ছেলে কেমন আছে? ছেলেটা কতবড় হল -"… ইত্যাদি প্রভৃতি। প্রতিটা প্রশ্নেরই সোৎসাহে জবাব দিয়েছে ছেলেটা। সাথে জানিয়েছে আরো অনেক খবর। ভাইয়ের বিয়ের খবর, জেঠু হবার খবর। 


আরেঞ্জড ম্যারেজ ছেলেটার। মেয়ে দেখতে গিয়ে জানতে পারে, হবু বউ বয়সে কয়েক মাসের বড়। অজ গাঁয়ের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও বয়সের পার্থক্য জেনে পিছিয়ে আসেনি ছেলেটা। ফিরে এসে বাবাকে - মাকে জানিয়েছে সত্যিটা, সাথে এটাও জানিয়েছে বিয়ে করবে তো এই মেয়েটাকেই করবে, তবে বাবামায়ের আশীর্বাদ এবং অনুমতি সহ। ছেলেটির বাবা মা বিন্দুমাত্র আপত্তি করেনি, এটা শুনে ইস্তক গোটা পরিবারটার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গিয়েছিল।  


আজও মনে আছে ছেলেটা বলেছিল, " আমি তো তেমন লেখাপড়া শিখিনি ম্যাডাম, কিন্তু আমার বউ গ্রাজুয়েট। খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছে, লোকের কাছে চেয়েচিন্তে, বই মেগে এনে পড়েছে কিন্তু পাশ তো করেছে।" মেয়েটার ইচ্ছে ছিল সরকারী চাকরি করবে, শিক্ষিকা হবে। সব ইচ্ছা তো আর পূরণ হয় না। ঐ যে অনুপম রায় বলেছে না, "সব পেলে নষ্ট জীবন"। মেয়েটার ছোটবোনটা অবশ্য এত পড়াশোনা করার দিকে যায়নি। ষোড়শী হতে না হতেই পাশের গাঁয়ের সমৃদ্ধশালী পরিবার থেকে তার বিয়ের সম্বন্ধ আসে এবং দিদি জামাইবাবু দাঁড়িয়ে থেকে তার বিয়ে দিয়ে দেয়।


খবরটা শুনেই বলেছিলাম, কাজটা ঠিক করোনি বাপু। বেআইনি কাজ করেছ। নেহাৎ তখন আমি তোমাদের চিনতাম না, চিনলে আমি খোদ ডিস্ট্রিক চাইল্ড প্রোটেকশন ইউনিটকে খবর দিতাম। ছেলেটা বিস্তর মাথা চুলকে বলেছিল, " কি করব ম্যাডাম। বাপ মরা মেয়ে। আমার শাশুড়িটাও তো তেমন জবরদস্ত নয়। কেমন যেন ন্যালাক্ষ্যাপা -। আমাদের ওপর নির্ভরশীল।" 


আজ তাঁরও খোঁজ নিলাম, " তোমার শাশুড়ি মা কেমন আছেন?" ছেলেটা কিঞ্চিৎ বিমর্ষ হয়ে বলল, "শাশুড়ি মা তো আর নেই ম্যাডাম। মাস ছয় সাত হল -"। আমার হিসেব মত ভদ্রমহিলার বয়স কোনমতেই ৫০/৫২ র বেশী হতে পারে না। এত অল্পবয়সে কি ভাবে চলে গেলেন? ছেলেটা বলে, " বেশ কিছুদিন ধরেই মাথাটা ঠিক ছিল না। খড়গপুরে একটা আশ্রম আছে ওখানে দিয়েছিলাম। ওরা মাসে ৭ হাজার টাকা নেয়, খাওয়াদাওয়া, ওষুধপথ্য সব ওরাই দেয়। কিন্তু মাসে মাসে এত টাকা দেওয়া কি আমাদের মত ঘরে চাটটি খানি কথা বলুন ম্যাডাম। মাস সাতেক পরে ছাড়িয়ে আনি। এমনিতে ভালোই ছিল। কথা বার্তা ভালোই বলত। ফিরে এসে একাই থাকত। আমার বউ রবিবার করে গিয়ে থেকে আসত।  আমিও যেতাম, গিয়ে সপ্তাহের বাজার দোকান করে দিয়ে চলে আসতাম। বউ সোমবার আসত-।"  


"আর তোমার শালী -", মাঝ পথে কথা থামিয়ে জানতে চাই আমি। ছেলেটা বলে, " শালী যে কিছু করেনি তা বলব না। করেছে - রোজ রাতে রান্না করে দিয়ে আসত মাকে। তো সেবারে হয়েছে কি, আমার বউ রবিবার গিয়ে থেকে সোমবার ফিরে এসেছে। মঙ্গলবারও ওর কথা হয়েছিল মায়ের সাথে। বুধবার থেকে আর ফোন ধরে না। শুক্রবার প্রতিবেশীরা খবর দিল -। রাতে রান্না করে বোধহয় বাসন মাজতে যাচ্ছিল। তখনি পড়ে গিয়ে -।" 


মানে? আঁতকে উঠি আমি, " বুধবারে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন, শুক্রবারে পড়শীরা দেখতে পায়?" ছেলেটি বিষণ্ন ভাবে মাথা নাড়ে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলি আমি, " আর তোমার শালী? সে রাতে খাবার দিতে যায়নি?" ছেলেটি ঢোঁক গিলে বলে, " শেষের দিকে আর খাবার দিতে যেত না। আসলে ম্যাডাম, আমার শাশুড়ি মা বিধবা ভাতা পেত তো। মাসে হাজার টাকা। তাতে কি একটা মানুষের পেট চলে আপনি বলুন? আমার ষাঁড়ু ভাইয়ের এতেই রাগ, শালীকে বলেছিল, ' ওরা তোমার মায়ের সব টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, ওরাই দেখবে। একদম আমাদের বাড়ির খাবার ওবাড়ি পাঠাবে না।' 


তুত্তুরীর ঘরের অন্ধকারে বসে এখনও ততোটাই কেঁপে উঠি আমি, যতটা খবরটা শুনে কেঁপেছিলাম। এক সম্পূর্ণ অপরিচিতা জননীর কথা শুনে। আহা সত্যিই কি পড়ে মরেছিলেন তিনি? নাকি বেঁচেছিলেন বেশ কিছুক্ষণ? আশা করেছিলেন শেষবারের মত এক ঝলক দেখবেন নিজের আত্মজাদের -। পথের পাঁচালীর ইন্দির ঠাকুরুনের শেষ মুহূর্তটার কথা কেন যে বারবার মনে পড়ছে আর ছাপিয়ে যাচ্ছে দুই চোখ। খুব সুসন্তান নই আমি, প্রায়ই রেগে যাই মায়ের ওপর, মেজাজ দেখাই, হাঁপিয়ে উঠি মায়ের আব্দারে, দু দুটি বাড়ির দায়িত্বে, কিন্তু এ অবহেলা যে  আমার স্বপ্নের অতীত। হে ঈশ্বর, মেয়ে হয়ে জন্মানোর অজুহাতে যারা ব্যস্ত থাকে নিজের সংসারে, অবহেলা করে নিজের বৃদ্ধ অসহায় জনক জননীকে, তুমি তাদের ক্ষমা করো। আর শৌভিক আর আমি যখন বুড়ো হব, প্লিজ একটা ভালো বৃদ্ধাশ্রম খুঁজে দিও আমাদের জন্য। শৌভিকের নাম করতে মনে পড়ল, অনেক হয়েছে। যাই পরপুরুষকে আবার ঘরপুরুষ বানাই। সে ছাড়া আর আছে কে -


অনির ডাইরি ২১ শে মে, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


" হায় বৌদি, তুমি এই আয়নাটা ফেলে দিবে নাকি?" হতবাক হয়ে শুধায় মেয়েটা। দেখে আমাদের থেকে অনেক বড় মনে হয়, আসলে কিছুটা ছোটই হবে। রোদে জলে খেটে খাওয়া মানুষের ত্বকের বয়স বাড়ে একটু জলদি, আর এই মেয়েটা তো কোন সাজগোজও করে না। রং জ্বলা ম্যাক্সির মত কি যেন একটা পরে গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা। মাথায় বিবর্ণ একটা সুতির ওড়না হিজাবের মত পরা। আজ দুই সপ্তাহ ধরে দেখছি মেয়েটার এই এক সাজ। 


আয়নাটা আমাদের বিয়েতে পাওয়া উপহার। ফ্রেমটা ভীষণ সুন্দর দেখতে, কিন্তু কাঁচটার পারা উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। তাই নীচে নামিয়ে রেখেছি। মেয়েটা যেভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে, বলি, তোমার পছন্দ তো তুমি নিয়ে যাও না। মেয়েটা লজ্জা পেয়ে জিভ কেটে বলে, " আমি তো সাজগোজ করি না সোনা। লিয়ে গিয়ে কি করব?" 


বলি,কেন করো না। মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ে,প্রায় বধির শাশুড়ি মায়ের গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে, " শুনতেছ কাকিমা, তোমার বউমা কি কয়? আমারে সাজতে বলছে। আমি বলে তালাকশুদা মেয়েমানুষ -"। মেয়েটা যে ডিভোর্সী আমি সত্যিই জানতাম না। বাড়ির গল্প খুব একটা করে না মেয়েটা, অবশ্যি আমার সাথে গল্প করার সময় ওর কোথায়। সেই কাক না ডাকা ভোর থেকে খাটতে বেরোয়, অনেক বাড়ি কাজ করে। কাজ বলতে বাসন মাজা, ঘর ঝাড়ামোছা, বাজার করা এইসব। দুপুর বেলা এক প্রস্থ কাজ সেরে বাজার থেকে ঝড়তিপড়তি সবজি দরদস্তুর করে কিনে বাড়ি গিয়ে রান্না করে, রান্না খাওয়া মিটলে টিউশনি করে, অনেক গুলো গুড়িগুড়ি বাচ্ছাকে আরবি পড়ায়। টিউশনি মিটিয়ে আবার বিকালের কাজে বেরোয়। বেশ বর্ণময় চরিত্র বলতে পারেন। 


স্বনির্ভর সবলা নারীদের আমি বরাবরই অনুরাগিনী। আর এতো শ্বশুরমশাই জীবিত থাকাকালীন ওনার বাড়িতেও কাজ করত, ফলে আমার সাথে সখ্য জমতে বেশি দেরী হয়নি। গল্পের বেশিটা জুড়ে থাকেন স্বর্গীয় শ্বশুরমশাই। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে বৃদ্ধ কার হাতে জল খেয়েছিলেন এই নিয়ে একটা দ্বৈরথ আছে। ও বাড়ির ২৪ ঘণ্টার আয়া মাসি দাবী করেন, " মেসোমশাই আমার হাতে জল খেয়ি স্বর্গে গেছেন" আর এ বলে, "কাকু আমার হাতে পানি খেইয়ে তোমাদের বেহেশতে গেছেন।" 


 মাঝে মাঝে নিজের কথাও বলে মেয়েটা, যেমন সেদিন বলল, " আমি ইচ্ছে করে এত খাটি বৌদি, নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য। যেদিন গতর চলবে না, আমারে যে দেখার কেউ নেই। আমার দুটো মেয়ে, তাদের বিয়ে দিয়েছি, আল্লাহ যেন আমারে তাদের বোঝা না বানায়।" 


 একদিন বলল, " এই যে সবজি দেখছ বৌদি, এই সব আমি বাড়ি গিয়ে রাঁধব। বাড়িতে আমার দিদি আছে, সেও এই আবাসনে কাজ করে, কিন্তু ঐ লোকের বাড়িতেই করে, নিজের বাড়িতে কুটোটাও লারে না। আমি না রাঁধলে, না খেয়েই বসে থাকবে।" একদিন বলল, " বাড়িতে দুটো কুমড়ো গাছ লাগাইছি বৌদি, কি সোন্দর দুটো কচি কুমড়ো ধরিচে। তবে ভাড়ার বাড়ি তো, গাছ লাগিয়ে সুখ নাই।" এইসব ছুটকোছাটকা বার্তালাপ থেকে মেয়েটার জীবনের খণ্ডচিত্র পাই আমি। আর দেখি এই ঘেন্না বিধ্বস্ত উপমহাদেশে দুই ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন অর্থনৈতিক স্তরের মহিলার মধ্যে কতটা চিন্তা ও চেতনার মিল।


মাঝে দুদিনের ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছিল মেয়েটা,বাবাকে দেখতে। যাবার দিন আমার সাথে দেখা হয়নি, আজ তাই জমিয়ে গল্প করার মুডে মাটিতে বসেছে মেয়েটা। ইশারায় বলি, সোফায় বস। শাশুড়ি মাতা এতক্ষণ গম্ভীর মুখে সোফায় বসে কাগজ পড়ছিলেন, চেনা মেয়েটার সাহচর্যে তাঁর মুখেও কিঞ্চিৎ হাসির আভা দেখা দেয়। মেয়েটা বলে, " সরি গো বউদি, তোমারে বলে যেতে পারিনি।" অসুবিধা হয়নি, শাশুড়ি মাতার আয়া মেয়েটি বড়ই কর্মঠ, দিব্যি সামলে দিয়েছে। জানতে চাই, তোমার বাবাকে কেমন দেখলে? মেয়েটি বলে, " বাবা? বাবা ঠিকই আসে। আমি বাবাকে দেখতে যাইনি তো বউদি, আমাদের বাড়িতে ঐ যে তোমাদের যেমন হরিনাম সংকীর্তন হয় না, অমনি আসর বসছিল। আমরা বলি মিলাদ। তাও যেতুম নি। বলেই দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ছোট ভাইপোটা ফোন করে এমন আব্দার করতে লাগল। ছেলেটা আমায় বড় ভালোবাসে বৌদি। আমায় কি বলে ডাকে জানো, ' মেয়ে'। কদিন ধরে আমার সাথে লেউটে ছিল। এক দণ্ডের জন্য ও ছাড়ে নি। আজ ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে পালিয়ে এয়েছি, সমানে ফোন করছে আর কাইঁদছে, ' আমার মেয়ে কোথায় গেল ' করে।" 


হেসে বলি, তাহলে তো বাপু তুমি তোমার বাবাকেই দেখতে গিয়েছিলে। তা এই নতুন বাবাটার বয়স কত? জবাব আসে, ছয় বছর মাত্র। শুধাই কোথায় থাকেন তিনি? জবাব আসে হারোয়া। মেয়েটি গড়গড় করে বলে চলে, " এমন কিচু দূর লয় বৌদি, বাসে এক ঘন্টা। কিন্তু আমি তো বাসে চাপতে পারি না। অটো পাল্টে পাল্টে যাই। অনেক সময় লাগে। টাকাও খরচ হয় তেমন।" বলি, বাসে যাও না কেন? মেয়েটি হেসে কুটোপুটি হয়ে বলে, " বাসে উঠলেই আমি বমি করি গো। অটোতেও করি, তবে একটু কম।"


কথা বলতে বলতে উঠে পড়ে মেয়েটা। বুঝি সময় শেষ, এবার বাড়ি গিয়ে রান্না চড়াবে। বুড়ো আয়নাটার গায়ে মায়া মাখানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠিক করে নেয় মাথার হিজাব। আবার বলি, আয়নাটা তুমিই নিয়ে যাও বরং। মেয়েটা জিভ কেটে বলে, " দূর কি হবে। আজ থেকে বাইশ বচ্ছর আগে আমার বিয়ে হয়েছিল, ওরা লোক ভালো ছেল না। আমার আব্বু শেষে গিয়ে আমার তালাক করিয়ে আনে। সেই সময় আমাদের পরিবারে আর একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। আমার বড় বৌদি, দুটো দুধের বাচ্ছা ফেলে গায়ে আগুন দিয়ে মরি যায়। আমি তখন সেই বাচ্ছা দুটোকে আপন করে নিই।" অবাক হয়ে বলি, তোমার দুটো মেয়ে - , মেয়েটা ৩২ পাটি বার করে বলে, " আসলে আমার ভাইঝি। কিন্তু আমি কোনদিন ওদের মায়ের অভাব বোধ করতে দিইনি। বাপেরও না। ল্যাখাপড়া শিখিয়েছি, বে দিয়েছি। আজ আমি মুক্ত।" 


মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলি, ভালোই তো। এবার নিজের কথা ভাব। তোমাদের সমাজে তো তালাক হওয়া/ বিধবা/ বিপত্নীক মানুষজন পুনর্বিবাহ করেই থাকে। বয়সটা কোন সমস্যাই নয়, আমার পরিচিত কিছু মানুষই করেছেন। বেশ ভালো আছেন। তোমাকেও নির্ঘাত অনেকে বিয়ে করতে চায়। রহস্যময় হেসে মেয়েটা বলে, "তুমি প্রথম নও যে আমার বিয়ে দেবার চেষ্টা করছ বৌদি। আর একজন ও উঠে পড়ে লেগেছিল কয়েক বছর আগে, কে বলো তো?" বেশ খানিকক্ষণ ঝুলে থাকে সাসপেন্সের পর্দা, তারপর হাসতে হাসতে বলে, " কাকিমা গো। কাকিমা। এই যে তোমার শাশুড়ি মা।"



অনির ডাইরি ১৯ মে, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


ঘড়ি বলছে প্রায় পৌনে দুই। মাথার উপর দেদীপ্যমান মধ্যাহ্নের সূর্য, তবে গরম যতটা লাগার কথা, ততোটা কিন্তু লাগছে না। একরাশ ঘণ কালো মেঘ যখন তখন এসে ঢেকে দিচ্ছে সূর্যি মামার মুখমণ্ডল। 


 রাস্তাটা পেরিয়ে উবের ধরলে, পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখেছি অন্তত ৩০/৪০ টাকা কম বিল ওঠে। আজ বরকে সেকথা বলতে গিয়ে হাসির খোরাক হলাম। দীর্ঘ চার/সাড়ে চার বছর পূর্ব মেদিনীপুরবাসী আমি, নিজেকে বড় গ্রাম্য বোধহয় আজকাল। সংকুচিত ভাবে ড্রাইভারকে শুধাই, " ভাই এসি চালাবে তো?" বছর চার পাঁচ আগে মোটেই চালাতে চাইত না ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভার কুল। বললেই বলত অ্যাপে দেখানো ভাড়ায় নাকি এসি চলে না। ঝগড়া করলে নামার সময় ওয়ান স্টার দিত। তৎকালীন টুইটারে ভুরি ভুরি নালিশ করতাম, ফলাফল লবডঙ্কা। গিগ ইকোনমির এটাই তো মাধুর্য - 


আজ অবশ্য সে সমস্যা হল না। একে রবিবার, তায় গরমের আতঙ্ক ফলে পথঘাট প্রায় শুনশান। ট্রাফিক বাতির মৃদু শাসন মেনেও দুদ্দাড় করে ছোটে গাড়ি। আমাদের গন্তব্য কেওড়াতলা মহাশ্মশান। গতকাল ভোর রাতে চলে গেছেন শৌভিকের মেজ জেঠিমা। সকাল সকাল খবর পেয়েও যেতে পারিনি আমরা, কারণ একই সাথে ইলেকট্রিক আর রাজমিস্ত্রিদের ডাকা ছিল। দীর্ঘ সাড়ে চার বছরের অনাবাসে ফ্ল্যাটটা হয়ে উঠেছে হানা বাড়ি। কিছু কাজ না করালেই নয়। 


তাদের ঝটিতি বিদায় করে, প্রায় বধির শাশুড়ি মাতাকে খাইয়েদাইয়ে তবে বেরিয়েছি আমরা। জীবনে প্রথমবার শ্মশানে চলেছি আমি, বুকের মধ্যে কুয়াশার মত ছড়িয়ে পড়ছে মৃদু আতঙ্ক। ফাঁকা ভিআইপি রোড ধরে ছুটতে ছুটতে লেকটাউন থেকে বাঁ হাতের উড়ালপুল ধরে ইএম বাইপাস, মানিস্কোয়ার, সায়েন্স সিটি হয়ে মা ফ্লাইওভার। 


পথের দুধারে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ আর ধান ক্ষেত দেখতে অভ্যস্ত আমার পূর্ব মেদিনীপুরিয়া চোখ ঝলসে যায় মহানগরের জৌলুসে। যতদূর চোখ যায়, কেবল বহুতল আর বহুতল। কি তাদের রূপ, কি তাদের চাকচিক্য। চলন্ত গাড়ি থেকে ঘাড় বেঁকিয়ে তল গুনতে গিয়ে বার বার পর্যুদস্ত হই আমি। চুপ করে বসে থাকে শৌভিক, হয়তো বুঁদ হয়ে থাকে শৈশবের কোন স্মৃতিতে। বহরমপুর থেকে যখন রাতারাতি সল্টলেকে বদলী হলেন শ্বশুরমশাই, শৌভিক তখন সপ্তম শ্রেণী। আর পাঁচটা বদলী হয়ে আসা সরকারী কর্মচারীর মতোই আবাসনের জন্য আবেদন করলেন শ্বশুর মশাই। জানা গেল পাওয়া যাবে বটে, কিন্তু এখুনি না। সময় লাগবে বেশ কয়েক মাস, এদিকে শুরু হয়ে গেছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। তখন ঐ কয়েকমাসের জন্য ছোট ছেলেকে নিয়ে নিয়ে বহরমপুরের ভাড়া বাড়িতেই রয়ে গেলেন শাশুড়ি মা। শালকিয়ার পৈত্রিক বাড়ি থেকে অফিস করতে লাগলেন শ্বশুরমশাই আর শৌভিককে টেনে নিল তার সল্টলেক নিবাসী মেজজেঠু আর মামণি। দুই দিদির সাথে জেঠুর বাড়িতে কাটানো ঐ কয়েকটা মাস আমার বরের শৈশবের অন্যতম প্রিয় স্মৃতি। 


 পার্ক সার্কাস ফ্লাইওভার থেকে নেমেই বাম হাতে ডিএল খান রোডে ঢোকে গাড়িটা। ১৯৩২ সালে নির্মিত ধনধান্যে সেতু পেরিয়ে ডান দিকে বেঁকে যাই আমরা।এতক্ষণের মৌনতা ভঙ্গ করে , আমায় আলিপুরের ডিএম অফিস চেনায় শৌভিক। পেরিয়ে যায় একের পর এক সুদৃশ্য বাংলো। যার কোনটায় পুলিশের ডিজি থাকেন, তো কোনটায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার। চওড়া রাজপথ থেকে ডান দিকে বেঁকে তুলনামূলক সংকীর্ণ একটা রাস্তায় থামে আমাদের গাড়ি। 


নীল সাদা ধাতব দরজা দিয়ে দুরুদুরু বুকে ভিতরে প্রবেশ করি। শ্মশান শুনলেই গল্প উপন্যাস বা সিনেমার যে দৃশ্য ভেসে ওঠে, এক্ষেত্রে অন্তত বাস্তব তার থেকে একেবারেই আলাদা। প্রশস্ত প্রবেশদ্বারের একদিকে পার্ক করা আছে সারি সারি গাড়ি। অন্য দিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিমছাম একটা বাগান। রেলিংয়ের গা ঘেঁষে বসানো গোটা পাঁচেক নারকেল গাছের ছায়ায় বসে গল্প করছে অনেক মানুষ। কারো মুখে শোকের ছাপ নেই, নেই কারো চোখ ভেজা। এরা কি শবদেহের সাথেই এসেছে নাকি স্থানীয় মানুষ এই দুপুরে আড্ডা মারতে এসেছে, বুঝতে পারি না। তবে পরিবেশটা নিমেষে আমার মনের আতঙ্ক কিছুটা কাটিয়ে দেয়।


চতুর্দিকে পরিচ্ছন্নতার ছাপ, এত মানুষ তাও নেই কোন শোরগোল। বাঁধানো রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা গিয়ে বাঁ হাতে গোটা চারেক সিঁড়ি উঠলে একটা বিশাল ঘর। সেই ঘরেই পরপর শোয়ানো আছে মানুষগুলো। মাথার দিকে লোহার রড দিয়ে তৈরি একটা দেওয়াল। দেওয়ালের ওপারে দৃশ্যমান দু দুটো বৈদ্যুতিক চুল্লী। অর্ধবৃত্তাকার লোহার গেট দিয়ে বন্ধ। 


মেরুন বা বাদামী রঙের শাড়ি পরেছে মামণি, ম্যাচিং ব্লাউজ। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল এখনও অনেকটাই কালো। ঠোঁটে মেরুন রঙের লিপস্টিক। বিগত পনেরো বছর ধরে পক্ষাঘাত গ্রস্ত মানুষটি আজ বাঁশের বিছানায় সাদা চাদর পেতে অকাতরে ঘুমাচ্ছে। মুখটা সামান্য ফাঁক, ঠিক যেমন করে ঘুমাচ্ছিলেন শ্বশুর মশাই, পাক্কা একবছর আগে। পঁয়তাল্লিশ/ পঞ্চাশ মিনিট লাগে নাকি একেকটা দাহ সম্পন্ন হতে। চুল্লী ফাঁকা হলে একদম বাম দিকে যিনি শুয়ে আছেন, তিনি প্রবেশ করবেন। ডান দিকে যাঁরা আছেন, তাদের সরিয়ে দেওয়া হবে এক ঘর। জাত/ ধম্ম/ অর্থ/ পারিবারিক পরিচয়/ প্রতিপত্তি এখানে এসে মিলেমিশে হয়ে যায় একসমান। 


সময় এগিয়ে আসে ক্রমশঃ,বর্ষীয়ান মণিকাকা হঠাৎ বলে ওঠে, " চল একটা প্রণাম করে আসি।" ঘুমন্ত মামণির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ছোট দেওরের দল। মুঠো করে রাখা হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিতে থাকে ছোটদি। বড়দি হাত বুলিয়ে দেয় মুখে, গালে, মাথায়। এই তো শেষ বার। সময় আসন্ন জানিয়ে দেয় শ্মশান কর্মচারী ছেলেটি। স্নেহধন্য পালকপুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্র, দেওরপো, ভাসুরপো, জামাইয়ের দল একে এক সরিয়ে দেয় বুকের ওপর জমা হয়ে থাকা ফুলমালার পাহাড়। মাথার তলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বালিশ। শ্মশান কর্মচারীর ইশারায় তোলা হয় মামণিকে। শোয়ানো হয় চুল্লীর সামনে, সবাইকে সামনে থেকে সরে যেতে বলে দূর থেকে লিভারটা তোলে ছেলেটি, পলকে লোহার দরজাটা উঠে গিয়ে বেরিয়ে আসে একরাশ লেলিহান গাঢ় কমলা রঙের অগ্নিশিখা। দুই হাতে চোখ ঢাকি আমি, স্মৃতিপটে ভেসে আসে কিছুকাল আগে মাতৃহারা এক বান্ধবীর কথা, "আমি কাঁদছি না বলে এরা ভেবে নিচ্ছে আমার কোন শোকবোধ নেই। বিশ্বাস কর অনি, আমিও কাঁদতে চাইছি। কিন্তু পারছি না। যতবার চোখ বন্ধ করছি একটাই দৃশ্য ভেসে উঠছে চোখের সামনে, গনগনে আগুনে ঢুকে যাচ্ছে আমার মা।" এই মুহূর্তে বহুদূরে থাকা, নাতনীকে জড়িয়ে সুখে দিবানিদ্রা রত এক মহিলার জন্য ডুকরে ওঠে মন। কেন যে এত অবহেলা করি মাকে, কেন যে এত বিরক্ত হই মায়ের ওপর, কেন যে আর একটু বেশি ভালবাসতে পারি না মাকে।

Friday, 11 April 2025

অনির ডাইরি এপ্রিল, ২০২৫

 অনির ডাইরি ১৪ই এপ্রিল, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



এমন কখনও হয়েছে, আচমকা অপ্রত্যাশিত ভাবে অনেক, অনেকটা ভালোবাসা পেয়ে গেছেন? গাঁট গুণে বলতে পারি বটে, কতবার পেয়েছি, কিন্তু পেয়েছি। এমনিই কথা হত মেয়েটার সাথে, তখনও হোযাটসঅ্যাপ/ মেসেঞ্জার কিস্যু আসেনি। বার্তা বিনিময় বলতে এসএমএস,যার মূল্য ছিল এক টাকা/ প্রতি মেসেজ। আমরা কথা বলতাম ই-মেলে। সদ্য সদ্য ইমেল খুলেছিলাম সকলে, এমনিই ফরওয়ার্ডেড মেসেজ পাঠাতাম একে অপরকে।  তারই ফাঁকে ফাঁকে ওই আর কি,  কি রে কেমন আছিস মার্কা বার্তা বিনিময়।


সেটা প্রেম ভালোবাসার সময়, জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে পা দেব কি দেব না সেই নিয়ে দোদুল্যমানতায় ভোগার সময়। ততোদিনে পেশাগত ভাবে দাঁড়িয়ে গেছি আমরা, ফলে " আজকাল পাঁও জমি পে পড়তে নেহি মেরে -"। পুরো প্রজাপতির মত উড়ছি, ভালো মেয়ে, বাধ্য সুসন্তান হতে গিয়ে বঞ্চিত হয়েছি যে সব নিষিদ্ধ আনন্দ থেকে আশ মিটিয়ে পূরণ করছি সব শখ। ঝপ করে কোঁকড়া চুল সোজা করে ফেললাম একদিন। মা জেঠাইমার তো কপালে করাঘাত - এ কি হল। কেন হল ইত্যাদি। কিন্তু পিকচার যে তখনও বাকি। কিনে ফেললাম ছয় পকেট ওয়ালা জিন্স, পোশাকী নাম কার্গো। সেই যে ট্রায়াল রুম থেকে পরে বেরোলাম,আর ছাড়তেই চাই না। সর্বত্র আমার এক পোশাক। ছোট মাসি মাকে বলেই ফেলল, " ছোট দি, মেয়ে সামলা। একে বিয়ে করবে কে -"। 


এদিকে যে বিয়ে করবে, সে ফিসফিসিয়ে কয়, " এটা পরেই বিয়ে করো। আমিও তাই করব। ধুতি পরার বিড়ম্বনা থেকে তো বেঁচে যাব।" এই সবই লিখতাম মেয়েটাকে। সেও লিখত , কিন্তু সে সব গল্প হত বড় শৌখিন, বড় পরিমার্জিত। মেয়েটিও যে ভীষণ পরিশীলিত, আমার মত ধিঙ্গি নয়।  নিজের প্রগলভতা নিয়ে বেশ কিছুটা সঙ্কোচেই ভুগতাম বলতে পারেন। ভাবতাম আমাকে সহ্য করে কেবল, স্বপ্নেও ভাবিনি মেয়েটি আমাকে পছন্দ করে। সেদিন যখন তার ইমেলে ভেসে এল, " থ্যাংকস অনিন্দিতা। তুই আমার সবথেকে প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে একজন। যেভাবে আমার দুর্দিনে পাশে ছিলি, আমি কোনদিন ভুলব না -। " আকাশ থেকে পড়লাম আমি, এই সফিস্টিকেটেড, সুন্দর মেয়েটা আমায় তার বেস্ট ফ্রেন্ডদের মধ্যে একজন বলল কি? কি করলাম আমি? ছাপোষা ইমেলের জবাবে, ছাপোষা মেসেজই তো পাঠিয়েছি। 


কি যে ভীষণ মূল্যবান মনে হয়েছিল নিজেকে, সেদিন থেকে সুকন্যা - সঞ্চিতা - পম্পা - নবনীতাদের পাশাপশি আর একটা বেস্ট ফ্রেন্ড বাড়ল আমার। তারপর কেটে গেছে প্রায় দুই দশক। ভৌগোলিক দূরত্ব মাইলের পর মাইল হলেও ফাটল ধরেনি আমাদের বন্ধুত্বে। ভালোবাসা যেন ওর দিক থেকেই বেশি। অবাঙালি, অ - হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটা বাঙালি উৎসবে মুঠোফোনে ফুটে ওঠে ওর শুভেচ্ছা। আমার জন্মদিন, বিয়ের দিন, তুত্তুরীর জন্মদিন - শুভেচ্ছা বার্তা আসবেই, আসবে। একদিন মেসেজ করে বলল, " ভালো বাংলা তো পড়তে পারি না অনি, কিন্তু তোর লেখা পড়ি। খুব ভালো লাগে। না পারলে, আমার বরকে দিয়ে পড়াই -"। কি বলব বুঝতে পারিনি, আর আমি? এত অপদার্থ যে মনে করে ব্যাটার জন্মদিনেও শুভেচ্ছা জানাতে পারি না। ভুলেই যাই, ভুলভাল তারিখে জানাই। ভাগ্যিস ভালোবাসা নিক্তি মেপে হয় না।


সম্প্রতি মাতৃহারা হয়েছে বন্ধুটি। অন্য বন্ধু মারফৎ খবর পেয়েও বুঝতে পারিনি কি করব। প্রায় সাড়ে আটশ কিলোমিটার দূর থেকে ছুটে যাওয়া প্রশ্নাতীত, তাহলে ফোন করব কি? ফোন করেই বা কি বলব, " আহা তোর মা -। নিজেকে সামলা,কাকুকে সামলা -"। বিশ্বাস করুন আমি বলে উঠতে পারিনি।পরিচিতদের গ্রুপে তুফান উঠেছে, সকলে জানিয়েছে,' ওনার আত্মার শান্তি কামনা করি ' বা 'শোক সন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানাই। ',   অনেকের প্রিয়জন বিদায়ের মুহূর্তে আমিও তো এগুলোই লিখি, কিন্তু সেদিন কিছুতেই লিখতে পারিনি। কেমন যেন ঠুনকো মনে হচ্ছিল সব কিছু।


মাঝে একদিন দেখি কি যেন মেসেজ করে ডিলিট করেছে মেয়েটা। সাহস করে লিখি, তোকে কি বলব জানি না রে। এই শোকের কোন সান্ত্বনা হয় না। আশা করিনি জবাব আসবে, কিন্তু আসে, " সবাই মিলে বাবাকে ঠিক রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু মা আর নেই এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না রে।  চেষ্টা করছি স্বাভাবিক থাকার। তুই সাবধানে থাকিস। কাকু কাকিমাকে সাবধানে রাখিস।" মেসেজটা পড়ে সামলাতে পারিনি নিজেকে, প্রিয়জনের প্রিয়জন হারানোর বেদনা এত সংক্রামক কেন হয়। 


দুর্ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর সাহস করে গিয়ে বসলাম বন্ধুর মুখোমুখি। কে যেন বলে গেছেন রাজদ্বারে, শ্মশানে পাশে না থাকলে সে বন্ধুই নয়। পলে পলে অনুভব করছিলাম, কতটা যথার্থ তিনি। আমি কারো বন্ধু হবার যোগ্যই নই। এতো এই সুন্দর সুশীল মেয়েটার মহানুভবতা, যে আজও আমার কুশল সংবাদ নিল। প্রশ্ন করব কি করব না ভাবতে ভাবতে  বোকার মত,  করেই ফেললাম, " কেমন আছেন কাকু?" মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবে বললে, " এখন ভালোই আছেন। সেদিন একটু সমস্যা হয়েছিল -"। বুঝতে পারি কাকিমার মৃত্যুর দিন। 


বরাবরের শান্ত মিতভাষী মেয়েটাকে যেন আজ কথায় পেয়েছে, " সেদিন আসলে প্রচণ্ড প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল, তাই মাথা ঘুরে গিয়েছিল। আসলে অর্ধ শতকের সঙ্গী তো, মা ভীষণ অসুস্থ ছিল, সবাই জানতাম আজ না হলে কাল দিনটা আসবেই। তাও -। ডাক্তার বলেছিল, আরও চেষ্টা করাই যায়, কিন্তু ওনার যা শারীরিক অবস্থা, কতটা নিতে পারবেন জানি না। আমি সেটাই বাবাকে বুঝিয়ে বললাম, যে মা আর নিতে পারত না। আমার কথাটা বোধহয় মাথায় ঢুকেছে জানিস। দেখলাম আত্মীয়স্বজন যাঁরা এসেছেন, তাদের বলছে, ' আর নিতে পারত না।'"

সাধারণত এই সব কথার পর নীরবতা বিরাজ করে, আজ যেন মেয়েটাকে কথায় পেয়েছে, " জানিস অনি, আমি জানতাম। আমরা সবাই জানতাম, মা আর বেশী দিন নেই। তাই মায়ের ভয়েজ রেকর্ড করে রাখতাম। যখনই মা ফোন করত, আমি রেকর্ড করে রাখতাম। কেবল ভয় হত, আর কটা দিন এই গলাটা শুনতে পাব কে জানে।" ওর চোখ শুকনো, আমারও, কিন্তু ভিতরে ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়ে চলে। 


" আমার কাছে সব থেকে বড় সান্ত্বনা কি জানিস, আমি মাকে দেখতে পেয়েছি -"। তোকে চিনতে পেরেছিলেন, শুধাই আমি। মাথা নাড়ে মেয়েটি। " না রে। আমি যখন গিয়ে পৌঁছাই, মা তখন কোমায়। ভাই আমায় পাশ টা দিয়ে কি যেন কাজে চলে গেল। বলে গেল মা অনেকটা স্টেবল। আমি আইসিইউতে ঢুকে দেখি মায়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। নার্সকে ডেকে দেখালাম, এমন কেন হচ্ছে? সে কিছু বলতে পারল না। আইসিইউ এর ডাক্তার এসে আমায় বলল, ' আপনাদের তো বলা হয়েছিল ওনাকে ভেন্টিলেশনে দিতে। আপনারা রাজি হননি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ডিসাইড করে আমায় জানান।' ভাইরে আমি প্রায় ছয় শ কিলোমিটার দূর থেকে সবে গেছি, আমি কি ডিসিশন নেব? তাও পাঁচ মিনিটে? ভাই বলেছিল মায়ের ডাক্তার আলাদা করে নিষেধ করেছে, যে ভেন্টিলেশনে দিলেও আর কোন লাভ হবে না। সেটা জানা সত্ত্বেও আমি ঠিক থাকতে পারিনি। বললাম তাই দিন।" 


" মাঝরাতে ফোন এল, মায়ের অবস্থা খুব খারাপ, কি যেন একটা দিতে হবে। দিলেও কিছু হবে কিনা ঠিক নেই, কিন্তু ডাক্তার নাকি রেকমেন্ড করেছে। তখন আমরা কি বলব বল তো -"। এই পর্যন্ত শুনে, টেবিলের এপার থেকে ছুটে ওপারে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরি আমি। এই অসহায়তা আমার অপরিচিত নয়। মধ্যরাতে এমন ফোন আমার কাছেও এসেছিল। সেই সর্বগ্রাসী আতঙ্ক আর চূড়ান্ত অসহায়তা ভাষায় অপ্রকাশ্য। আমার বাহুবন্ধনে ভেঙে পড়ে মেয়েটা, এত ক্ষণে ধরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা ধুয়ে যায় চোখের জলে।" আমরা কি বলব অনি? মায়ের সেন্স ছিল না, তাও পায়ে হাত বোলাচ্ছিলাম আমরা। আমি হাত দেওয়াতে প্রেশার একটু বাড়ল, ভাই যেই হাত বোলাল, প্রেশার আশি উঠে গেল। আমার ভাইটা বোকার মত জিজ্ঞাসা করছিল সকলকে, ' আমি কি মায়ের পায়ে হাত দিয়েই রাখব?' যদি মা থাকে, যদি আর কটা দিন থেকে যায়। আমরা বললাম দিয়ে দিন, যা দেবার দিয়ে দিন। বিশ্বাস কর, পাঁচ মিনিট পর ফোন করে বলল, " উনি নিতে পারলেন না।"


সময় যে কোথা দিয়ে কেটে গেল জানি না। উঠে পড়ি, আবার এতটা পথ উজিয়ে ফিরতে হবে। রাস্তা অবধি এগিয়ে আসে বন্ধু, বিদায়ী আলিঙ্গনের পর বলে, "কাকু কাকিমাকে যে নিজের কাছে নিয়ে গেছিস অনি, আর যেতে দিস না। যা পারিস, যতটা পারিস ওদের দিয়ে যা, করে যা। ভালবেসে যা। এ যে কি জিনিষ, যার হারায় সেই বোঝে। সব যেন কেমন শূন্য হয়ে যায় -" ।


অনির ডাইরি ১২ই এপ্রিল, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


সবে সকাল হয়েছে, পূব আকাশে এক রাশ লালিমা ছড়িয়ে পড়লেও, এখনও উদয় হননি সূর্যদেব। বাতাসে মিষ্টি একটা শীতলতা, গাড়ির জানলার ফাঁক গলে আসা হাওয়ায় ঝিম ধরে যাচ্ছে আমার, ওদিকে গোমড়াথেরিয়াম হয়ে বসে আছে তুত্তুরী। কারণ আর কিছুই নয়, আজ মহাবীর জয়ন্তী, ক্যালেন্ডারে জ্বলজ্বল করছে লাল দাগ, অথচ ছুটি দেয়নি তুত্তুরীদের স্কুল। মোটেই আজকের দিনে ইস্কুলে আসার ইচ্ছে ছিল না তুত্তুরীর, গতরাতে এই নিয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করেছিল আমাদের কাছে, যদি ছাড় পাওয়া যায়। আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেও, পটেনি শৌভিক। ওকেও বেরোতে হবে যে, জেলায় মস্ত মিটিং আছে। 


বাবা বাছা বলতে বলতে, গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে এসে পড়ে মেয়ের স্কুল। গাড়ি থেকে নামার আগে তিনি বলে যান, " মা আজ কিন্তু তুমি আনতে আসবে - আর সঙ্গে তোমার থলথলে মাকেও নিয়ে আসবে। ফেরার পথে আইসক্রিম খাব কিন্তু।" 


দিদিমাকে আদর করে তিনি ওই সবই বলে থাকেন। আজন্ম কৃশকায়, আন্ডারওয়েট মা ইদানিং সত্যিই বেশ পৃথুলা হয়ে উঠেছে, নাতনীর সেটা বড়ই পছন্দ। সুযোগ পেলেই তিনি দিদিমাকে আক্রমন করেন এবং  ধামসান। এর আগে আমার এবং তুত্তুরীর যুগপৎ জোরাজুরিতে বার দুয়েক মা এসেছে, ছুটির পর নাতনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ফেরার পথে মাথা গুণে বাড়ি শুদ্ধ সবার জন্য কিনে নিয়ে গেছে আইসক্রিম। আজও সেই আব্দার নিয়েই বাড়ি ফিরলাম।


কিন্তু আজ সে আব্দার সটান নাকচ হয়ে গেল। "আমি যেতে পারব না বাবা, আমার শরীরটা কেমন যেন আনচান করছে।" অকালে হার্ট ফেল হয়ে চলে গিয়েছিলেন মাতামহ, মায়ের এই শরীর আনচানকে আমি তাই বড় ভয় করি। পরশুই ডাক্তার দেখিয়ে এনেছি। পরীক্ষা নিরীক্ষা কিছু হয়েছে, কিছু এখনও বাকি। তাই আর জোর করতে পারি না। বাবাকে ধরি, " তুমি চল তাহলে -"। নাতনীর আব্দার ফেলতে অপারগ বাবা নিমরাজি হয়। অতঃপর শশব্যস্ত হয়ে মাকে বলে, " আমাকে এখুনি পাঁচশ টাকা বার করে দাও, আইসক্রিম কিনতে হবে -"। 


বৃদ্ধ বৃদ্ধার খুনসুটি দেখে হেসে বাঁচি না। শ্রীমতী তুত্তুরীর ছুটি হতে এখনও পাঁচ ঘণ্টা বাকি -। হাসতে হাসতে হাল্কা চালে শাশুড়ি মাতাকে জিজ্ঞাসা করি, " তুমি যাবে? নাতনীকে স্কুল থেকে আনতে? ফেরার পথে আইসক্রিম খাওয়াব -।" বিগত জানুয়ারী মাসে, ডান পায়ে পর পর দুটি বড় অপারেশন হয়েছে শাশুড়ি মায়ের। বসাতে হয়েছে ধাতব বল সকেট জয়েন্ট। আজও ভালো করে হাঁটতে পারেন না বৃদ্ধা। ওয়াকার নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনমতে হাঁটেন। নাহ অস্ত্রোপচার জনিত কোন সমস্যা নেই, আপাতত সমস্যা হাঁটু জোড়াকে নিয়ে। মাস দুয়েক শয্যাশায়ী থাকার দরুণ হাল ছেড়েছে হাঁটু জোড়া। তিনি যে এক কথায় রাজি হয়ে যাবেন, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। 


সবথেকে খুশি বোধহয় আমার বাবা হল, যাক তাহলে বাবাকে আর যেতে হবে না। বাকিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে অনাবিল আনন্দ। যে মহিলাকে ধমকে চমকেও হাঁটানো যায় না, নড়ানো যায় না, তিনি স্বেচ্ছায় নাতনীকে স্কুল থেকে আনতে যাবেন, এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে। 


ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথেই চড়তে থাকে বৃদ্ধার উত্তেজনার পারদ, আমাকে অন্তত চার বার জিজ্ঞাসা করেন, " আচ্ছা এই পোশাকে যাওয়া যাবে তো? পোশাকটা অসভ্য নয় তো?" পোশাক বলতে ঘরে পরার সুতির নাইটি। পায়ের এই অবস্থা বলে শাড়ি আর ওনাকে পরতে দেওয়া হয় না। যাই হোক, বৃদ্ধাকে আশ্বস্ত করি, তুমি তো গাড়িতেই বসে থাকবে, আমি রাস্তা পেরিয়ে মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসব। কে আর দেখছে। আর দেখলেই বা, এই পোশাকে ও দিব্যি সুন্দর লাগছে আমার স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইয়ের প্রিয়তমাকে। 


ঘড়ির কাঁটা পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট সময়ের ঘরে, টুকটুক করে রওনা দিই আমরা। বাংলোর সিকিউরিটি, গাড়ির ড্রাইভার, শাশুড়ি মাতার ২৪ ঘণ্টার আয়া, লতা দি এবং আমি মিলে বৃদ্ধাকে বাড়ি থেকে বার করে, গাড়িতে তুলি। বারন্দা থেকে হাত নাড়ে আমার বৃদ্ধ বাবা মা। হুশ করে বেরিয়ে যায় গাড়ি। প্রায় বধির শাশুড়ি মাতাকে চিৎকার করে চেনাতে থাকি কাঁথি শহরের অন্ধিসন্ধি। কি বোঝেন, কতটুকু শোনেন ঈশ্বর জানেন, শুধু ওষ্ঠাধরে ফুটে ওঠে শিশুর মত নির্মল হাসি। পাশ থেকে ড্রাইভার ছেলেটি বলে, " খুব ভালো করেছেন ম্যাডাম। মাঝে মাঝে মাসিমাকে বার করবেন বাড়ি থেকে। মনটাও ভালো হবে -"। 


ইস্কুলের উল্টো দিকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে যাই আমি। হাত পা নেড়ে বলি, " চুপ করে বসে থাকো, দুষ্টুমি করো না।" ভালো বাচ্ছার মত ঘাড় নাড়ে বৃদ্ধা। তুত্তুরীদের ইস্কুলের সামনে বিশাল ভিড়, বেশ অনেক ক্ষণ দাঁড়াতে হয় তাঁর জন্য। দূর থেকে আমাকে দেখে হাত নাড়েন তিনি। কাছে আসতেই বলি, " তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে রে বাবু। চল দেখবি -"।


গাড়িতে উঠে হতবাক হয়ে যান তিনি, " ঠাম্মা! তুমি এসেছ! আমায় নিতে!" গলা দিয়ে ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ে বিস্ময় মিশ্রিত খুশি। ঠাম্মার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে, তিনি বলেন, " কিন্তু কি ভাবে? ঠাম্মা তো বাড়ি ছেড়ে নড়তেই চায় না। মা তুমি এই মিরাকল টা করলে কিভাবে বলো তো?" কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলি, আমার তো জন্মই মিরাকল ঘটানোর জন্য। আমি অঘটনঘটনপটিয়সী কি না। মেয়ের ভ্রু কুঞ্চন দেখে সিরিয়াস হয়ে বলি, আসল ব্যাপারটা হল মানসিক। আমার মা আর শাশুড়ি মা সমবয়সী। দুজনেই বেতো রুগী। দুজনের মধ্যে একজন যখনই কিছু করে, অন্যজনের মনে হয়, ও পারছে যখন, আম্মো পারব। মা দুদিন এসেছে নাতনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, তাই দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন ইনিও। বুঝলি বাবু, ওসব ওষুধপথ্য না, আসলে এরা একে অপরকে দেখে চাঙ্গা হয়। 


বাজারের ঠেলাওয়ালার থেকে একরাশ আইসক্রিম কিনে বাড়ি ফিরি আমরা, অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল আরেক বৃদ্ধ দম্পতি, আজকের প্রতীক্ষা যতটা না তুত্তুরী আর আমার জন্য, তার থেকে ঢের বেশী শাশুড়ি মাতার জন্য। আবার সকলের সহায়তায় শাশুড়ি মাতাকে গাড়ি থেকে নামানো হয়, বাড়ি ঢুকে ইউনিফর্ম না ছেড়েই আইসক্রিম খেতে বসে তুত্তুরী, সঙ্গতে তিন বুড়োবুড়ি, আর আমি বলি, সব হবে, আগে একটা ছবি তো তুলে নিই, শৌভিকের বৃদ্ধ মা আর ডেঁপো মেয়েটার, তারপর পাঠাই লোকটাকে। পেশাগত ভাবে বড্ড চাপে থাকে লোকটা, বাড়ির পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ লোকটা আজ ছুটির দিনেও দৌড়েছে মিটিং করতে, তাকে জানাই তো, মন দিয়ে আপিস সামলা ভাই, বাড়ির জন্য আমি আছি তো - । বিয়ের ষোল সতেরো বছর বাদে, এটাই তো ভালোবাসা, আর কে যেন বলে গেছেন না, ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি?

অনির ডাইরি ১১ই এপ্রিল, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


কদিন ধরেই খুঁজছিলাম ছেলেটাকে। আজ দেখা হতেই শুধালাম, " সেই মেয়েটার কি খবর গো?" কোন মেয়েটা? কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে যায় ছেলেটা, তারপরই বুঝতে পারে। মাথা নেড়ে বলে, " নেই ম্যাডাম। ও, ওর বর দুজনেরই -"। 


ব্যস্ত অফিসটাকে যেন হঠাৎ করে ঘিরে ধরে নৈঃশব্দের কালো মেঘ। কোন কথা নেই কারো মুখে। তারপর গলা ঝাড়ে আমার এক ইন্সপেক্টর, কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে, " কোন মেয়েটা ম্যাডাম?" ইন্সপেক্টরটির স্ত্রী সরকারি স্কুলে পার্শ্ব শিক্ষিকা। হুকুমনামা বেরোনোর দিনই বলছিল, " জানেন ম্যাডাম, আমার বউয়ের স্কুলেরও দুজন আছে, এই লিস্টে। তারা দুজনেই কিন্তু খুব ভালো ছাত্র/ছাত্রী। অনেক অনেক নম্বর পাওয়া -।" 

আমরা সরকারের বেতন ভূক চাকর, বুক ফাটলেও মুখ খোলা পাপ। তাই চুপ করেই থাকি। ইন্সপেক্টর সাহেব ভয়ে ভয়ে আবার শুধায়, " কোন মেয়েটা?" 


এবার মুখ খুলতেই হয়, মেয়েটার কথা শুনেছিলাম বছর খানেক, নাকি তারও আগে -, জনৈক সহকর্মীর স্ত্রীর মুখে। বউটি বড় ভালো, সাদাসিধে, প্রাণ খোলা। বরের বদরাগী বস হিসেবে আমাকে ভয় তো পায়ই না, উল্টে ভালো কিছু রাঁধলেই পাঠিয়ে দেয় কৌটো করে, দেখা হলেই পাকড়াও করে শোনায় একরাশ প্রাণের কথা। গাঁট গুণে বলতে পারি আজ অবধি কবার দেখা হয়েছে বউটির সাথে, কিন্তু এর মধ্যেই ওদের প্রেম কাহিনী থেকে শুরু করে যাবতীয় সাংসারিক জটিলতা, অস্থিরতা, সুখ দুঃখের খতিয়ান জমা পড়েছে আমার কাছে। আমাকে দেখলেই যেন, নরম পানীয়ের মত ভুসভুস করে বেরিয়ে আসে প্রাণের কথা। 


তেমন কথা প্রসঙ্গেই একবার শুনেছিলাম ওর এক বান্ধবীর কথা। দুজনেই সাহিত্যে মাস্টার্স। দুজনেই একসাথে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল, এর হয়নি, বন্ধুটির হয়ে যায়। চাকরি পাবার পরই ফোন করে একরাশ কথা শোনায় মেয়েটি। ততোদিন প্রিয় পুরুষের সাথে পরিণয় পাশে আবদ্ধ হয়েছে বউটি। বাল্যপ্রেম, দীর্ঘ প্রেমপর্বের পর বিয়ে। বর সরকারী আপিসের ছাপোষা চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী। এই দিয়েই প্রথম আক্রমণ করে মেয়েটি, " তুই এটা কি করলি? এত তাড়াতাড়ি এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেললি? তোর কত কিছু হতে পারত রে -। চাকরি পেয়ে বিয়ে করা উচিৎ ছিল। আমায় দেখ, আমি কেমন স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছি, মাস গেলে এত টাকা বেতন। আর তুই -"।


এইটা শোনার পর বউটির মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। ওর বর পরে আমায় বলেছিল, " কি ভাবে যে সেদিন বউকে সামলেছিলাম ম্যাডাম। সে তো এই সুইসাইড করে, কি সেই সুইসাইড করে।" একজন কর্মরতা নারী হিসেবে অপর একজন কর্মরতা নারীর কৃতকর্মে মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল সেদিন। অনুপার্জনকারী নিছক গৃহবধূদের প্রতি কর্মরতা নারীদের অসুয়া চিরন্তন।।ব্যাপারটা উল্টো দিক থেকেও সত্যি। তেনারাও ভাবেন আমরা গৃহকর্মে অ-নিপুণ/অক্ষম স্ত্রী/ অপদার্থ পুত্রবধূ/ জঘন্য মা। এ এমন এক দ্বৈরথ যেখানে মেয়েরা কেউ জেতে না, শুধুই হারে। 


সেদিনও হারলাম, বউটি এবং আমি। কিন্তু ওই যে বাদশা খান বলে গেছেন না, চলচ্চিত্র এখনও বাকি, তাকে মান্যতা দিয়েই বোধহয় একদিন দুম করে রায় ঘোষণা করে দিল উচ্চ ন্যায়ালয়। উত্তাল হল রাজ্য রাজনীতি, জল গড়াল সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় অবধি। অধমের জীবন অবশ্য যেমন চলছিল, তেমনি চলতে লাগল। পরিবর্তন বলতে একরাতে বউটির হঠাৎ টেলিফোন, " জানেন ম্যাডাম, আমার সেই বান্ধবীর চাকরি চলে গেছে -"। 


অফিস থেকে ফিরে মাংস কষতে দিয়েছি কড়ায়, তড়িঘড়ি ঢাকা দিয়ে বাগানে নেমে যাই, চাপা গলায় শুধাই, " তুমি জানলে কি করে? এত জনের মধ্যে নাম মিলিয়েছ নাকি?" বউটি থতমত খেয়ে, জিভ কেটে বলে, " না ম্যাডাম, না ম্যাডাম। আমার এক পুরাণ অধ্যাপকের সাথে দেখা হয়েছিল। মন্দিরে গিয়েছিলাম পুজো দিতে, সেখানেই স্যারের সাথে দেখা। স্যার বললেন,' শুনছু, ওর চাকরি চলে গেছে! চাকরী পাবার পর এত বদলে গিয়েছিল, আমার সাথে দেখা হলে তো, চিনতেই পারত না। গায়ে পড়ে, ডেকে কথা বলার চেষ্টা করেও দেখেছি, জুটেছে একরাশ তাচ্ছিল্য।' বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, ভাবতাম আমার প্রতিই যত অসূয়া, স্যারকেও এমন করতো ভাবিনি। প্রাথমিক ধর্ষকাম আনন্দের পর দুঃখই হল। হাজার হোক, প্রাক্তণ সহপাঠী, হঠাৎ চাকরি চলে গেলে, না জানি কত আতান্তরে পড়বে বেচারী। সেই বলতেই ফোন করেছিলাম, লাগল না। মেসেজ করতে গেলাম সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, একাউন্ট ডিএক্টিভেট করে বসে আছে। কি যে করি -"।


তেমন কিছু করতে হয়নি, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের সৌজন্যে অচীরেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ফিরে আসে মেয়েটি।আমাদের ঘরের বউটির সাদাসিধে মেসেজের জবাবে হয় হিরণ্ময় নীরবতা, নয় " তোর তো কিছুই হল না"মার্কা কষাঘাত। বছর, বছর ঘুরে অবশেষে ফয়সালা জানিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। অন্তত বউটির বান্ধবী বা তার স্বামীর ক্ষেত্রে ঘটেনি কোন ইতর বিশেষ। চাকরি গেছে দুজনেরই। অবশ্য সুযোগ আছে, আগামী তিন মাসের মধ্যেই হতে চলেছে নতুন পরীক্ষা। একটু কষ্ট করে তাতে পাস করলেই সব ঠিক। এবার বাদ সাধে আমার সহকর্মী ছেলেটি, " না ম্যাডাম, সব ঠিক হবে না। ওই যে পাঁচ হাজার সাদা খাতা জমার লিস্ট আছে না, তাত্তে ওদের নাম আছে -। চাকরী তো গেলই, সুদ সহ ফেরৎ দিতে হবে সব বেতন।"



অনির ডাইরি ১১ই এপ্রিল, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


কদিন ধরেই খুঁজছিলাম ছেলেটাকে। আজ দেখা হতেই শুধালাম, " সেই মেয়েটার কি খবর গো?" কোন মেয়েটা? কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে যায় ছেলেটা, তারপরই বুঝতে পারে। মাথা নেড়ে বলে, " নেই ম্যাডাম। ও, ওর বর দুজনেরই -"। 


ব্যস্ত অফিসটাকে যেন হঠাৎ করে ঘিরে ধরে নৈঃশব্দের কালো মেঘ। কোন কথা নেই কারো মুখে। তারপর গলা ঝাড়ে আমার এক ইন্সপেক্টর, কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে, " কোন মেয়েটা ম্যাডাম?" ইন্সপেক্টরটির স্ত্রী সরকারি স্কুলে পার্শ্ব শিক্ষিকা। হুকুমনামা বেরোনোর দিনই বলছিল, " জানেন ম্যাডাম, আমার বউয়ের স্কুলেরও দুজন আছে, এই লিস্টে। তারা দুজনেই কিন্তু খুব ভালো ছাত্র/ছাত্রী। অনেক অনেক নম্বর পাওয়া -।" 

আমরা সরকারের বেতন ভূক চাকর, বুক ফাটলেও মুখ খোলা পাপ। তাই চুপ করেই থাকি। ইন্সপেক্টর সাহেব ভয়ে ভয়ে আবার শুধায়, " কোন মেয়েটা?" 


এবার মুখ খুলতেই হয়, মেয়েটার কথা শুনেছিলাম বছর খানেক, নাকি তারও আগে -, জনৈক সহকর্মীর স্ত্রীর মুখে। বউটি বড় ভালো, সাদাসিধে, প্রাণ খোলা। বরের বদরাগী বস হিসেবে আমাকে ভয় তো পায়ই না, উল্টে ভালো কিছু রাঁধলেই পাঠিয়ে দেয় কৌটো করে, দেখা হলেই পাকড়াও করে শোনায় একরাশ প্রাণের কথা। গাঁট গুণে বলতে পারি আজ অবধি কবার দেখা হয়েছে বউটির সাথে, কিন্তু এর মধ্যেই ওদের প্রেম কাহিনী থেকে শুরু করে যাবতীয় সাংসারিক জটিলতা, অস্থিরতা, সুখ দুঃখের খতিয়ান জমা পড়েছে আমার কাছে। আমাকে দেখলেই যেন, নরম পানীয়ের মত ভুসভুস করে বেরিয়ে আসে প্রাণের কথা। 


তেমন কথা প্রসঙ্গেই একবার শুনেছিলাম ওর এক বান্ধবীর কথা। দুজনেই সাহিত্যে মাস্টার্স। দুজনেই একসাথে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল, এর হয়নি, বন্ধুটির হয়ে যায়। চাকরি পাবার পরই ফোন করে একরাশ কথা শোনায় মেয়েটি। ততোদিন প্রিয় পুরুষের সাথে পরিণয় পাশে আবদ্ধ হয়েছে বউটি। বাল্যপ্রেম, দীর্ঘ প্রেমপর্বের পর বিয়ে। বর সরকারী আপিসের ছাপোষা চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী। এই দিয়েই প্রথম আক্রমণ করে মেয়েটি, " তুই এটা কি করলি? এত তাড়াতাড়ি এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেললি? তোর কত কিছু হতে পারত রে -। চাকরি পেয়ে বিয়ে করা উচিৎ ছিল। আমায় দেখ, আমি কেমন স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছি, মাস গেলে এত টাকা বেতন। আর তুই -"।


এইটা শোনার পর বউটির মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। ওর বর পরে আমায় বলেছিল, " কি ভাবে যে সেদিন বউকে সামলেছিলাম ম্যাডাম। সে তো এই সুইসাইড করে, কি সেই সুইসাইড করে।" একজন কর্মরতা নারী হিসেবে অপর একজন কর্মরতা নারীর কৃতকর্মে মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল সেদিন। অনুপার্জনকারী নিছক গৃহবধূদের প্রতি কর্মরতা নারীদের অসুয়া চিরন্তন।।ব্যাপারটা উল্টো দিক থেকেও সত্যি। তেনারাও ভাবেন আমরা গৃহকর্মে অ-নিপুণ/অক্ষম স্ত্রী/ অপদার্থ পুত্রবধূ/ জঘন্য মা। এ এমন এক দ্বৈরথ যেখানে মেয়েরা কেউ জেতে না, শুধুই হারে। 


সেদিনও হারলাম, বউটি এবং আমি। কিন্তু ওই যে বাদশা খান বলে গেছেন না, চলচ্চিত্র এখনও বাকি, তাকে মান্যতা দিয়েই বোধহয় একদিন দুম করে রায় ঘোষণা করে দিল উচ্চ ন্যায়ালয়। উত্তাল হল রাজ্য রাজনীতি, জল গড়াল সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় অবধি। অধমের জীবন অবশ্য যেমন চলছিল, তেমনি চলতে লাগল। পরিবর্তন বলতে একরাতে বউটির হঠাৎ টেলিফোন, " জানেন ম্যাডাম, আমার সেই বান্ধবীর চাকরি চলে গেছে -"। 


অফিস থেকে ফিরে মাংস কষতে দিয়েছি কড়ায়, তড়িঘড়ি ঢাকা দিয়ে বাগানে নেমে যাই, চাপা গলায় শুধাই, " তুমি জানলে কি করে? এত জনের মধ্যে নাম মিলিয়েছ নাকি?" বউটি থতমত খেয়ে, জিভ কেটে বলে, " না ম্যাডাম, না ম্যাডাম। আমার এক পুরাণ অধ্যাপকের সাথে দেখা হয়েছিল। মন্দিরে গিয়েছিলাম পুজো দিতে, সেখানেই স্যারের সাথে দেখা। স্যার বললেন,' শুনছু, ওর চাকরি চলে গেছে! চাকরী পাবার পর এত বদলে গিয়েছিল, আমার সাথে দেখা হলে তো, চিনতেই পারত না। গায়ে পড়ে, ডেকে কথা বলার চেষ্টা করেও দেখেছি, জুটেছে একরাশ তাচ্ছিল্য।' বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, ভাবতাম আমার প্রতিই যত অসূয়া, স্যারকেও এমন করতো ভাবিনি। প্রাথমিক ধর্ষকাম আনন্দের পর দুঃখই হল। হাজার হোক, প্রাক্তণ সহপাঠী, হঠাৎ চাকরি চলে গেলে, না জানি কত আতান্তরে পড়বে বেচারী। সেই বলতেই ফোন করেছিলাম, লাগল না। মেসেজ করতে গেলাম সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, একাউন্ট ডিএক্টিভেট করে বসে আছে। কি যে করি -"।


তেমন কিছু করতে হয়নি, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের সৌজন্যে অচীরেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ফিরে আসে মেয়েটি।আমাদের ঘরের বউটির সাদাসিধে মেসেজের জবাবে হয় হিরণ্ময় নীরবতা, নয় " তোর তো কিছুই হল না"মার্কা কষাঘাত। বছর, বছর ঘুরে অবশেষে ফয়সালা জানিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। অন্তত বউটির বান্ধবী বা তার স্বামীর ক্ষেত্রে ঘটেনি কোন ইতর বিশেষ। চাকরি গেছে দুজনেরই। অবশ্য সুযোগ আছে, আগামী তিন মাসের মধ্যেই হতে চলেছে নতুন পরীক্ষা। একটু কষ্ট করে তাতে পাস করলেই সব ঠিক। এবার বাদ সাধে আমার সহকর্মী ছেলেটি, " না ম্যাডাম, সব ঠিক হবে না। ওই যে পাঁচ হাজার সাদা খাতা জমার লিস্ট আছে না, তাত্তে ওদের নাম আছে -। চাকরী তো গেলই, সুদ সহ ফেরৎ দিতে হবে সব বেতন।"


অনির ডাইরি ৩রা এপ্রিল 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


তিন কুড়ি দশ পড়ছিল শৌভিক। আজ না, বেশ কিছুদিন আগে। অবসর প্রাপ্ত আইসিএস অফিসার অশোক মিত্র মহাশয়ের আত্মজীবনী। পরাধীন, অখণ্ড ভারতের এক মহকুমা শাসকের অভিজ্ঞতার সাথে অদ্ভুত ভাবে মিলে যাচ্ছিল ত্রিখণ্ডিত আধুনিক ভারতের আরেক মহকুমা শাসকের অভিজ্ঞতা। যেন সময়টা ফারাক কয়েক দশক নয়, কয়েকটা দিন মাত্র। সব তো একই আছে, কিছুই তো বদলায়নি।

 

যত মিল খুঁজে পাচ্ছিল, ততো উৎফুল্ল হয়ে উঠছিল আমার বর। এক আধ পাতা পড়ছিল আর বই বন্ধ করে আমায় সবিস্তারে শোনাচ্ছিল মিত্তির মশাই(🙏🏼) এর গপ্প। সেদিন , "মধ্যসত্ত্বভোগী" শব্দটার সাথে যেন নতুন করে আলাপ করিয়ে দিলেন মিত্র সাহেব। সেকালেও প্রান্তিক চাষী থেকে গেরস্থের পাতে পৌঁছাতে যেকোন ভূমিজ পদার্থকে পেরোতে হত, একাধিক মধ্যসত্ত্বভোগী। লাভের গুড় খেয়ে মেদুল হত এই সম্প্রদায়, এদিকে সোনার ফসল ফলিয়েও নিকষ তিমিরে তলিয়ে যেত প্রান্তিক চাষী। ওদিকে বাজারে লাগত আগুন, সংসার টানতে নাভিশ্বাস উঠত মধ্যবিত্তের। এই মধ্যসত্ত্বভোগীদের সংখ্যা ছিল, এলাকা ভেদে বিভিন্ন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বাখরগঞ্জ এলাকায়  ৬৪ জন (সম্ভবত) মধ্যসত্ত্বভোগীর গল্প শুনিয়েছিল লেখক। 


এই গল্প শোনার কিছুদিনের মধ্যেই একটা নালিশ জমা পড়ল আমার দপ্তরে। নালিশ নয়, আর্জি বলতে পারেন। আমার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য, ডিএম সাহেবকে চিঠি লিখলেন এক বৃদ্ধ নির্মাণ কর্মী। আমি নাকি ইচ্ছা করে তাঁর পেনশন আটকে দিই, আমি নাকি তাঁর স্বর্গীয় স্ত্রীর মৃত্যুকালীন অনুদানেও ভাগ চেয়ে পাঠাই। তাও অগ্রিম, কড়কড়ে পাঁচটি হাজার টাকা আমার মনোনীত ব্যক্তিকে দিলে তবে ছাড়া হবে বৃদ্ধার অনুদান। 


চিঠিটা পড়ে বুঝেছিলাম, বজ্রাহত কাকে বলে। "ম্যাডাম" শব্দটা না লিখলে, চিঠিটা আমি হয়তো পাত্তাও দিতাম না। গুজব ভেবেই উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু এই চেয়ারে যে একজন মহিলা আধিকারিক আছে, এটা একটা বুড়ো প্রান্তিক নির্মানকর্মীর তো জানার কথা নয়। 


অতঃপর তদন্ত কমিটি গঠন এবং ইন্সপেকশন। ইন্সপেকশন অন্তে আমার তিন ইন্সপেক্টর ভ্যাবলার মত বসেছিল। " ম্যাডাম, কত জন যে জড়িত আছে, স্তরে, স্তরে।" আরেকপ্রস্থ সেদিন আলাপ হল যেন এই মধ্যসত্ত্বভোগী শব্দটার সাথে। থানা পুলিশ যা করার সে তো আমরা করলামই, আর ঠিক করলাম, এবার থেকে আমার সইয়ে যে যা পাবে, তাকে একটি বার কষ্ট করে পদধূলি দিতেই হবে গরীবের আপিসে। মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যতিরেকে সামনাসামনি হব, সরকারী আপিসের লোকজন আর সাধারণ মানুষ। তারপর দেখাই যাক না - 


সম্প্রতি ১২৪ খানা নির্মাণ কর্মী পেনশন অ্যাপ্রুভ হয়েছে আমাদের। আজ তাঁদের ডেকেছিলাম আমরা। উপস্থিতির হার ছিল শতকরা ৮৩%। কিছু মানুষ কখনই প্রথম বার ডাকলে আসেন না। সরকারি আপিস সম্পর্কে যে কি ভীতি এই গাঁয়ের মানুষগুলোর। তার উপর আমাদের নিমতৌড়ির নব্য প্রশাসনিক ভবন এত বড় আর এত ঝাঁ চকচকে, পথ হারিয়ে ফেলে অনেকে। ভয়ে কুঁকড়ে নীচে দাঁড়িয়ে থাকে অনেক বুড়োবুড়ি। লিফটে উঠতে চায় না, ভয় পায়। 


যাই হোক, যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদেরকেই বললাম, পালা পালা করে, কখনও আমি, কখনও ALC নভোনীল বাবু, কখনও বা IMW সৌম্য বা বেদজ্যোতি। বললাম, আজ থেকে আপনারা সকলে আমাদের পেনশনার। এই যে একবার পেনশন চালু হয়ে গেল, আর তা বন্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই। এমনকি আমারও না। তাই কেউ যদি পেনশন বন্ধ করে দেবার ভয় দেখায়, হুমকি দেয়, মোটে ভয় পাবেন না। প্রয়োজনে আমাদের লিখিত ভাবে জানাবেন। তারপর আমরা দেখব ব্যাটাকে। বললাম, তবে হ্যাঁ, আপনার পেনশন আপনি কিন্তু বন্ধ করতে পারেন। যদি সময়মত বেঁচে থাকার প্রমাণপত্র জমা না করেন। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানের সার্টিফিকেট, আধার আর ব্যাংক পাশবুক এর ফটোকপি নিয়ে মনে করে বছরে একবার আসুন আর সারা বছর নিশ্চিন্তে থাকুন।নিয়মিত দিলে আর আমার কাছে আসতে হবে না, আপনাদের ব্লকে স্থিত শ্রম দপ্তরের আপিসেই দিবেন। এই ইন্সপেক্টর সাহেবদের কাছে।  


বললাম, ভালো করে শুনুন পেনশন চালু হবার অর্থ হল, আপনারা আপাতত ৬০তম বছরের পেনশন টুকু পেয়েছেন। লাইফ সার্টিফিকেট জমা করার সাথে সাথে,যার যতটুকু বিলম্ব হয়েছে পেনশন পেতে, সে ততোদিনের পুরো টাকাটা পাবেন। সেটা অনেক টাকা কিন্তু। একাউন্ট ফেটেও যেতে পারে হয়তো। তখন কেউ যদি অফিসের/ আমার/ ALC সাহেবের/ IMW সাহেবের নাম করে টাকা চায়, দয়া করে দেবেন না। বরং আমাদের লিখিত ভাবে জানাবেন,আমরা তার বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।


ক্ষুদ্র আপিস আমাদের, সাধ আকাশ ছোঁয়া হলেও, সাধ্য বড়ই সীমিত। তবুও, চেষ্টা তো করি, আধিকারিক থেকে প্রান্তিক সুবিধাভোগীর মধ্যে সেতু বন্ধনের। বাকিটা না হয়, সময়ের হাতেই ছাড়া থাক  -