অনির ডাইরি ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
"ম্যাডাম, আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। আমাদের গ্রামে একজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বাড়ির লোক ডাইরি লেখাতে গিয়েছিল, থানা থেকে ডাইরি নিচ্ছে না।" থানায় ডাইরি করা যে কি অসম্ভব চাপের তা আমি হাড়েহাড়ে জানি। কিছুদিন আগে আমার নাম করে টাকা তোলার নালিশ পেয়েছিলাম একটি ছেলের বিরুদ্ধে, দপ্তরী তদন্ত করিয়ে তার নামে FIR করতে আক্ষরিক অর্থে কাল ঘাম ছুটে গিয়েছিল। পাক্কা এক সপ্তাহ ধরে আমার লোকজনকে ঘুরিয়ে ছিল থানা, তমলুকের মহকুমা শাসক থেকে পুলিশের বড় সাহেব কাকে না বলেছি - সকলে তৎক্ষণাৎ থানায় ফোন ও করেছেন, কিন্তু দিনের শেষে প্রসব হয়েছে অশ্বডিম্ব। অষ্টম দিনে গিয়ে আইসি সাহেবের বদান্যতায় লক্ষ্য ভেদ করি আমরা।
লোকটাকে বলি, কোন রাজনৈতিক নেতাকে গিয়ে ধরুন, উনি ফোন করলে নির্ঘাত নিয়ে নেবে। এই নিয়েও হাতে গরম অভিজ্ঞতা আছে আমার। বাঁশবেড়িয়ার শ্রমিক মেলার মাঠে তুচ্ছ রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে ব্যাপক হুজ্জুতি বাঁধিয়েছিল এক পেঁচো মাতাল নেতা। আমার এক ইন্সপেক্টরকে এই মারে তো সেই মারে। অতিরিক্ত জেলা শাসক থেকে থানার বড় বাবু কাকে না ফোন লাগিয়েছি পাগলের মত। ফল হয়েছে ঐ অশ্বডিম্ব। শেষে বাধ্য হয়ে ফোন করেছিলাম তৎকালীন মন্ত্রী তপন দাশগুপ্তকে। ভোজবাজির মত ফোন কাটার পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে আপদটাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল।
লোকটা তাও যায় না। যে থানার নাম বলছে, সেটা কাঁথি মহকুমার অন্তর্গত, মনোগত ইচ্ছা আমি যদি একটু শৌভিককে বলে দিই, মহকুমা শাসক বললে থানা নির্ঘাত ফেরাবে না। এমন সব আব্দার নিয়ে লোকজন প্রায়ই আসে। শৌভিক তমলুকে থাকতেও আসত, কাঁথি যাবার পরও আসে। অধিকাংশই একটা কাজের দরবার করতে আসে। এই লোকটিও অনেক বার বলেছে, " একটু স্যারকে বলুন না, যে কোন কাজ -। ঝাঁট দেবার কাজ, অফিসে বাথরুম সাফ করার কাজ যা হোক -।" আমি যে শৌভিককে বলিনি তাও নয়। কিন্তু কাউকে কাজ দেখে দেওয়া কি অত সোজা, তাও কাঁথির মত জটিল জায়গায়। লোকটির আবার ডিগ্রি বলতেও কিস্যু নাই। বলে সিক্স পাশ, তারও কোন প্রমাণপত্র নাই।
প্রশ্ন করি, যে নিখোঁজ হয়েছে সে মেয়ে না ছেলে? লোকটি জবাব দেয়, " আজ্ঞে ম্যাডাম, ছেলে মানে লোক। অন্ধ্রপ্রদেশে কাজে গিয়েছিল আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।" বলি, ওখানে চেনাশোনা কেউ নেই? কোন সহকর্মী বা মালিকের নম্বর নেই? লোকটা মাথা চুলকে বলে, " আজ্ঞে ওখানকার কারো নম্বর তো নেই। গাঁয়ের আর একটা ছেলে গিয়েছিল, সে বছর দুয়েক আগে ফিরে এসেছে। আর যায় নাই। সে ফোন করেছিল, মালিক বলেছে, ' কই ও তো আসে নাই।'"
সে আবার কি কথা? ওর নম্বরে ফোন করলে কি বলছে? লোকটা মাথা চুলকায়," ফোনটায় ফোন করলে, কিছু হচ্ছে না। মানে কোন শব্দ আসছে না বলতেছে -"। শুধাই, লোকটার সাথে লাস্ট কবে কথা হয়েছিল বাড়ির লোকের? "আজ্ঞে, মাস আটেক আগে"।
চমকে উঠে শুধাই, মানে? কতদিন ধরে নিখোঁজ? লোকটা জবাব দেয়, " আজ্ঞে আট মাস।" আট মাস ধরে নিখোঁজ! আর বাড়ির লোক আজ গেছে পুলিশে খবর দিতে? লোকটা বলে, " আজ্ঞে। প্রথম দুই আড়াই মাস এরা কিছু ভাবেনি। তারপর যখন সন্দেহ হয়েছে তখন খোঁজখবর করা শুরু করেছে।" কেমন যেন সন্দেহ হয় আমার, বাইরে কাজ করতে গিয়ে একটা লোক আট মাস বাড়িতে ফোন করবে না? অন্য গল্প নেই তো? হয়তো অন্য কারো সাথে ঘর বসিয়েছে অন্য কোথাও। বা হয়তো বউটার এমন কোন সম্পর্ক আছে, তাই মনের দুঃখে গৃহত্যাগী হয়েছে লোকটা।
লোকটা বিষণ্ন ভাবে মাথা নাড়ে, " ঠিকই কইছেন ম্যাডাম। এসব আজকাল ঘরে ঘরে হচ্ছে। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক তো আমাদের গেরামে জল ভাত। আপনাকে গল্প বলেছিলাম না - প্রতিবাদ করায় আমার তুতো ভাইটাকে বেঘোরে মরতে হয়েছিল।" আমাকে এত মানুষ নিত্য এত গপ্প শোনান, ইনি কোন গল্পের কথা বলছেন বুঝতে পারি না।
হয়তো আমার মুখ দেখেই ধরে ফেলে লোকটা, " বছর নয় আগের কথা। আমাদের পাশেই ওদের বাড়ি। সম্পর্কে আমার মামা হয়। মামা বাইরে কাজে যেত, মামী আর মামাতো বোনটা বাড়িতেই আসর বসাতো। ভাইটা এত কিছু জানত না। জানার বয়স ও হয়নি। কত আর হবে, বছর আটেকের ছেলে। কি মিষ্টি দেখতে ছিল ম্যাডাম, আপনাকে কি বলব। আমাদের বাড়ি প্রায়ই আসত। ছেলেটা একদিন বোধহয় দিদিকে আর ওই ছেলেটাকে ঘরের মধ্যে অস্বস্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে। ভয় দেখায়, ' বাবাকে বলে দুব।' যেই না বলা অমনি ভাত খাবার পিঁড়ি আছে না ম্যাডাম, ওর দিদি করে কি ওকে ওই পিঁড়ি দিয়ে মাথার পিছনে মারে। মারতেই ও ছিটকে পড়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন দিদি আর ওই ছেলেটা মিলে, চালের বাতার সঙ্গে দড়ি বেঁধে ছেলেটাকে ঝুলিয়ে দেয়।"
মাগো! আঁতকে উঠি আমি। লোকটা বলে, " হ্যাঁ ম্যাডাম। আমি তো তখন ডিউটিতে। ওর দিদি আমায় ফোন করে বলে, শীঘ্র এসো। ভাই ইলেক্ট্রিকের শক খেয়েছে। আমি কি জানি। আমি বলি, শক খেয়েছে তো আমায় বলছিস কেন? দারুয়ায় ( সরকারী হাসপাতাল) নিয়ে যা। ওদের আর সাহস নেই যে হাসপাতালে আনে। শেষে আমি বলে দিলাম, গাঁয়ের কয়েকজন ছেলেছোকরা ওকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করল। হাসপাতাল কি বোকা! ডাক্তার বাবু দেখেই বুঝেছেন, গড়বড় কেস। বলছে শক খেয়েছে, কিন্তু গলায় দড়ির দাগ, কান পট্টির পিছনে আঘাতের চিহ্ন। উনি দিয়েছেন থানায় খবর পাঠিয়ে।
পুলিশ দেখেই তো সব পালিয়েছে। আমার নম্বর দেওয়া ছিল, পুলিশ আমাকেই ফোন করে ডাকল। আমি যা বলার বললাম, যে আমি অমুক জায়গায় কাজ করছিলাম। সবাই সাক্ষী আছে। আর যা জানা আছে নিশ্চয় বলব, আগে ভাইটার দাহসৎকার করি।" শুধাই ওর মা কিছু বলল না? লোকটা ফোঁৎ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, " মা বলল, মরে গেছে? ওকে কাঁথি তেই দাহ করে এসো। গেরামে আর আনতে হবে না।"
তীব্র বিবমিষায় ভুগি আমি, অক্ষম রাগে নিশপিশ করে হাত পা। এরা মা? কত নারী, কত দম্পতি হাজার চেয়েও সন্তানের মুখ দেখতে পায় না। আর ঈশ্বর এদের মুড়িমুরকির মত বাচ্ছা দেয়। ছিঃ। প্রশ্ন করি, তারপর কি হল? পুলিশ নিশ্চয় ওর মা আর দিদিকে মারতে মারতে জিপে তুলে নিয়ে গেল? আদালত নির্ঘাত ফাঁসির সাজা দিল?
লোকটা হাসে। "গেরামে ওসব হয় না ম্যাডাম। গ্রাম অনেক জটিল জায়গা। গ্রামের লোক পুলিশকে আটকে দিল। বললে আমরা দেখে নিচ্ছি। তারপর সভা বসল। ওদের বিচার হল। বিচারে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অনেকটা জমি লিখিয়ে নেওয়া হল গ্রামের নামে।" প্রাণের ক্ষতিপূরণ? হতবাক হয়ে বসে থাকি আমি। লোকটা বলে, " হ্যাঁ। এই নিয়েই তো আমার সাথে গ্রামের ঝামেলা। আমি বলেছিলাম ঐ জমিতে ছেলেটার নামে একটা স্মৃতিসৌধ তৈরি হোক। তা নয়, গ্রাম করল কি একটা শীতলা মন্দির বানালো। খানিকটা জমি বিক্রি করে দেওয়া হল। সেই টাকাটা গ্রামের একাউন্টে রাখা আছে -। এখন বলছে ওই টাকায় একটা লক্ষ্মী মন্দির করবে"।
অনির ডাইরি ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা
দ্রুততম গতিতে প্রস্তুত হই আমি। নেই নেই, সময় নেই। বিকাল সাড়ে পাঁচটা-পৌনে ছটায় লগ্ন। ঘড়িতে ইতিমধ্যেই পাঁচটা বেজে পাঁচ, ধড়াচূড়া পরে প্রস্তুত শৌভিক। রবিবারের এই ভাত ঘুমটাই যত নষ্টের গোড়া। কি যে মরণ ঘুম ধরেছিল আমার, পাশ থেকে কখন উঠে গেছে আমার বর, তৈরি হয়েছে কিচ্ছুটি টের পাইনি আমি। এখন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, "তিন মিনিট সময়, না হলে তোকে ফেলেই চলে যাব।"
ইল্লি আর কি, আমায় ফেলে চলে যাবেন! পাঁউসির অন্তোদ্যয় অনাথ আশ্রমে আজ বসেছে গণবিবাহের আসর, যখন থেকে শুনেছি সেই আসরে আমন্ত্রিত মাননীয় মহকুমা শাসক, তখন থেকে মনস্থ করেছি, বরের লেজুড় হয়ে আমিও যাব।শৌভিকের তো যাবার কোন চাড়ই ছিল না, সপ্তাহ শেষে একটা নিখাদ ছুটির দিন, ব্যাটা ঘরে বসে ভারত পাকিস্তানের ম্যাচ দেখতে বেশি আগ্রহী ছিল। আমার ঘ্যানঘ্যানানির জন্য যেখানে যেতে রাজি হল, আমাকে ফেলেই সেখানে যেতে উদ্যত হয়েছে, এই না হলে আমার বর।
দ্রুত হাতে আলমারি ঘাঁটি আমি, হোক গণবিবাহ, তাও তো বিয়ে বাড়ি রে বাবা। যা হোক পরে তো আর যাওয়া যায় না। পাশ থেকে গজগজ করে শৌভিক, "দুস্থ ছেলেমেয়েদের বিয়ে, সেখানে কি তুই বেনারসী পরে যাবি?" বেনারসী নাহোক, জামদানী পরি একটা, দ্রুত হাতে ঠোঁটে ঘষে নিই সবথেকে ক্যাটক্যাটে লাল লিপস্টিক, পাউডার/ফাউন্ডেশন তো কিছু লাগাতে পারলাম না, এতেই একটু জ্বলজ্বল করবে মুখটা। চোখে বুলিয়ে নিই কাজল। আর কিছু লাগাবার সময় নেই। দুটো ঝুটো কানের দুল, একটা মঙ্গলসূত্র, ঘড়ি আর বালাটা হাতে নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। গাড়িতে পরে নেব ক্ষণ।
বাবা-মা- তুত্তুরী গভীর নিদ্রামগ্ন, শাশুড়ি মাতা জেগেছিলেন, তাঁকেই বলে বেরোই দুজনায়। ঘড়িতে পাঁচটা কুড়ি, পাটে বসেছেন সূর্য দেব। আমাদের গন্তব্য কাঁথি থেকে খুব একটা দূরে নয়, কুড়ি-একুশ কিলোমিটারের মতো হবে।
দীঘা-নন্দকুমার রোড ধরে সোজা চলতে চলতে, কালীনগরের মোড় থেকে বাম দিকে বেঁকে যাই আমরা। ক্যানেলের পাশ ঘেঁষে সরু পিচের রাস্তা, রাস্তার দুই ধারে ইউক্যালিপটাসের সারি। সেই সারি ভেদ করে যতদূর চোখ যায়, ঘন সবুজ ভেলভেটের মত বিছিয়ে থাকা ধান ক্ষেত। ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যাতেও তাদের রূপে জুড়িয়ে যায় প্রাণ।
এই পথে আমার খুব বেশি আসা হয়নি, এর আগে একবারই এসেছিলাম ২০২৩ সালের মার্চ মাসে, এই আশ্রমেরই বসন্তোৎসবে। আজও মনে আছে, বাংলায় "অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রম" লেখা বোর্ড টাঙ্গানো বিশাল গেটের ভেতর দিয়ে যখন ঢুকেছিলাম, একনজরে বুঝতে পারিনি, ওটা অনাথ আশ্রম না কোন রিজর্ট! সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা আর যত্নের ছাপ, থোকায় থোকায় ফুটে ছিল কেয়ারি করা মরশুমি ফুলের দল। মনে আছে, একটা শেডের তলায় দাঁড় করানো ছিল, অনেকগুলি ছোট বড় গাড়ি। ড্রাইভার নূপুর বাবু বলেছিলেন, "ওই দেখুন বসন্তোৎসবে কত মানুষ এসেছে। দেশবিদেশ থেকে এনারা প্রচুর অনুদান পান।"
হলুদ গোল গলা গেঞ্জি আর সাদা সুতির পাজামা পরিহিত এক ভদ্রলোক দৌড়ে এসেছিলেন আমাদের স্বাগত জানাতে। এক মাথা অবিন্যস্ত কাঁচা পাকা চুল, খালি পা, মুখে এক গাল হাসি। জেনেছিলাম উনিই বলরাম করণ, এই আশ্রমের প্রাণপুরুষ। বলরাম বাবু সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে, নিয়ে গিয়েছিলেন আশ্রমের ভিতরে। বিশাল এলাকা জুড়ে আশ্রম। বেশ অনেকটা রাস্তা হেঁটেছিলাম আমরা। একদিকে মস্তপুকুর আর অন্যদিকে বড় বড় বিল্ডিং আর বাগান। লক্ষ্য করেছিলাম সবকিছুই বেশ হাইটেক এখানে। কোথাও তাচ্ছিল্য বা অবহেলা বা দীনতার কোন ছাপ নেই।
সেবার বলরাম বাবুর মুখেই শুনেছিলাম অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রমের গল্প। স্ত্রী আর তিন মেয়ে ময়না-চায়না আর মণিকে সঙ্গী করে একার চেষ্টায় এই আশ্রমটি গড়ে তোলেন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন আবাসিকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সামর্থ ছিল নগন্য। একটি মাত্র ঘর সম্বল। মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র কিনা, তাই জেদ অদম্য। পিছু হটেননি বলরাম বাবু। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, দিয়ে এসেছেন একটি করে মাটির হাঁড়ি। ওণার ভাষায়, মা লক্ষীরভান্ডার। আর অনুরোধ করেছেন বাড়ির মা বউদের, " মাগো, তোমরা যখন তোমাদের ছেলেমেয়ের জন্য ভাত বসাবে, তখন আমার অনাথ শিশু গুলোর কথাও একটু ভেবো। একমুঠো চাল ওদের জন্য ফেলে দিও এই হাঁড়িতে। মাসের শেষে এসে, সেই হাঁড়ির চাল নিয়ে যাব আমি। তাই দিয়েই ভরবে আমার বাচ্ছাগুলোর পেট।"
এই ভাবেই লড়েছেন কিন্তু পিছু হটেননি। বন্ধ হয়নি আশ্রম। আনন্দবাজার পত্রিকার স্থানীয় প্রতিবেদক শ্রী সুব্রত গুহ, যখন জানতে পারেন বলরামবাবু আর ওনার এই লক্ষ্মীর ভান্ডারের গল্প, তখন উনি এই নিয়ে একটি লম্বা প্রতিবেদন লেখেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায়, ২০০৪ সালে আট কলম জুড়ে ছাপা হয় সেই প্রতিবেদন। তারপরে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি বলরাম বাবুকে। ২০২৩ সালে এই আশ্রমে ৫০ জন বালক এবং ৫০ জন বালিকা থাকত। পাশেই আর একটি আশ্রম গড়ে তুলেছেন বলরাম বাবু। সেখানে থাকত আরো ৬৫ জন মেয়ে ও শিশু।
সেবার আলাপ হয়েছিল আশ্রমের বহু শুভানুধ্যায়ীর সাথে। এনারা যে শুধু যে নগদ অর্থে সাহায্য করেছেন বা করে চলেছেন তাই নয়, এমনও মানুষের সাথেও আলাপ হয়, যিনি ছেড়ে দিয়েছেন কলকাতায় তাঁর ব্যক্তিগত দোতলা বাড়ি। সেখানে খোলা হয়েছে আশ্রমের একটি টেম্পোরারি অফিস। আশ্রমের কোন শিশু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ওখানে রেখে ডাক্তার দেখানো হয়। যে সমস্ত আবাসিক বালক বা বালিকা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে, তারা ওখানে থেকেই পড়াশোনা করে। শুনেছিলাম তখন নার্সিং পড়ছিল বেশ কয়েকজন মেয়ে। শুনেছিলাম অনাথ আশ্রম চালানো ছাড়াও আরো অনেক কিছু করেন ওনারা। বিনামূল্যে ছানি অপারেশন শিবির করেন, গণবিবাহ দেন, ইত্যাদি প্রভৃতি। তেমনি এক গণবিবাহে আজ শৌভিক আমন্ত্রিত, আর আমি তার প্লাস ওয়ান বলতে পারেন।
গন্তব্যে পৌঁছে যাই আমরা, আবার সেই বাংলায় বোর্ড লেখা বিশাল লোহার গেট। আজ সেই গেটের ওপর জ্বলজ্বল করছে হ্যালোজেন আলো। অগুনতি ফুলের মালা দিয়ে নববধূর মত সাজানো হয়েছে তাকে। গেট থেকে এঁকেবেঁকে ভিতরে যাওয়ার রাস্তায় গাড়ি প্রবেশ করার সাথেই জ্বলে উঠল শয়ে শয়ে আলো। যেন আমাদেরই প্রতীক্ষায় ঘুমিয়ে ছিল তারা। দৌড়ে এলেন বলরাম বাবু, আজ তাঁর পরণে বুনিয়াদি পাজামা পাঞ্জাবি।
বিগত বারের মতই বলরাম বাবুকে অনুসরণ করে অনেকটা পথ হাঁটলাম আমরা। আপাত শান্ত আশ্রম আজ গমগম করছে সুবেশ নারী পুরুষের সমাগমে, বরযাত্রী এবং কনেযাত্রীর দল। পরণে তাদের সবথেকে নতুন, সবথেকে মূল্যবান পোশাক খানা। আহা আজ বিয়ে বাড়ি যে! রাস্তার বাঁকে মাথায় প্রদীপ নিয়ে নাচছে আদিবাসী রমণীর দল, মাইকে ভেসে আসছে বেদমন্ত্র। আশ্রমের টিনের শেড খানি আজ ভোল বদলে হয়েছে বিবাহমণ্ডপ। চতুর্দিকে রোশনাই, একই সাথে বিয়ে হচ্ছে এগারো জন কন্যার। যাদের মধ্যে তিনজন আশ্রমবালা, বাকিরা আশেপাশের গ্রামের মেয়ে।
বলরামবাবু বলতে থাকেন," জানেন স্যার, বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে রীতিমত প্রচার করি আমরা। আশেপাশে যত গাঁ আছে, আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাই, তোমরা গরীব তো কি? নাবালিকা মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিবে? মেয়েটাকে বড় হতে দিবেনি? লেখাপড়া শিখতে দিবেনি? ওকে পড়তে দাও, সময় হলে আমি দুব ওর বিয়ে।" শৌভিক জিজ্ঞাসা করে, আজ যাদের বিয়ে হচ্ছে, তাদের বয়স কত। বলরাম বাবু জবাব দেন, ১৯ থেকে ২৪। শৌভিক আবার প্রশ্ন করে, ছেলেগুলো কি সব স্থানীয়? বলরাম বাবু জানান, অধিকাংশই পূব মেদিনীপুরের বাসিন্দা। জনা দুয়েক বাঁকুড়ার ছেলেও আছে।
গোটা শেডটাকে আজ মুড়ে দেওয়া হয়েছে রংবেরঙের কাপড়, ফুলে আর রোশনাইয়ে। বানানো হয়েছে এগারোটা সুসজ্জিত মণ্ডপ। প্রতিটা মণ্ডপে রাখা আছে স্টিলের খাট, খাটের ওপর নতুন ম্যাট্রেস, নতুন সাইকেল, দানের বাসন আরও কত কি। প্রায় প্রতিটি খাটের ওপর বসে আছে টুকটুকে লাল বেনারসী পরা সুন্দরী কনের দল। সাধ্যমত গহনা পরেছে সকলেই, মাথায় লাল চেলী, চেলীর ওপর শোলার মুকুট, কপালে-কপোলে শ্বেত চন্দনের কল্কা। বরবাবাজীরা আসনপিঁড়ি নিয়ে বসেছে মাটিতে। মুখোমুখি বসেছেন পুরুত ঠাকুর, চলছে শুভ পরিণয়ের বিভিন্ন আচার। যাঁরা কন্যা সম্প্রদান করবেন,তাঁরাও বসেছেন পুরুত ঠাকুরের পাশে।
খানিকক্ষণ বসে বসে বিয়ে দেখলাম আমরা। অতঃপর বলরাম বাবু ডেকে নিয়ে গেলেন বাইরে। খোলা মাঠে মঞ্চ বেঁধে চলছে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রচুর জন সমাগমে পরিপূর্ণ মাঠখানি। এক পাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জনা চার পাঁচ ফুচকাওয়ালা। তাদের ঘিরে ভিড় জমিয়েছেন বিভিন্ন বয়সী রমণীরা।আছে চা, কফি, লস্যি। মেয়েদের বিয়ের আয়োজনে কোন ত্রুটি রাখেননি বলরাম বাবু।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান স্থগিত রেখে মঞ্চে তোলা হল আমাদের। লাল-গোলাপী বেনারসী পরিহিত দুই পল্লীবালা এসে চন্দনের টিকা, উত্তরীয় আর পুষ্প স্তবক দিয়ে বরণ করে নিল আমাদের। বরণ করা হল উপস্থিত অন্যান্য মান্যগণ্য অতিথিদের, যাঁদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক সুব্রত বাবুও। সেই সুব্রত গুহ, আনন্দবাজারে যাঁর লেখা প্রতিবেদন রাতারাতি বদলে দেয় পাঁউসির অন্তোদ্যয় অনাথ আশ্রমের ভবিষ্যৎ। সম্প্রতি তিনি একটি বইও লিখেছেন, বলরাম বাবু এবং এই আশ্রমকে নিয়ে। হয় সংক্ষিপ্ত বার্তা বিনিময়, ছোট্ট করে বক্তব্য রাখে আমার বরও, এবার ঘরে ফেরার পালা। ছুটে আসেন বলরাম বাবু, "স্যার না খেয়ে তো যেতে দিব না। রান্না প্রায় শেষ, দুটি খেয়ে যান।মেয়েগুলোর কল্যাণ হবে।"
নবদম্পতিদের প্রতি একরাশ আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে করজোড়ে মাপ চেয়ে বেরিয়ে আসি আমরা, বাড়িতে তিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর একটা ঘণ্টু যে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আসার সময় একটা বাক্স হাতে তুলে দেন বলরাম বাবু, "স্যার এটা কিন্তু নিতেই হবে, আমার আশ্রমের ছেলেদের হাতে বানানো-"। দুহাত পেতে ওনার উপহার আর একরাশ ভিন্ন স্বাদের ভালোলাগা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি আমরা, বাড়ি ফিরে জানতে পারি, ম্যাচটা ইন্ডিয়াই জিতেছে।
অনির ডাইরি ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, কার যেন উত্তেজিত কথাবার্তায় চমকে উঠে বসলাম। ঘাড়টা ব্যথা হয়ে গেছে, সোফার ওপর এক পা মুড়ে, রেলিংয়ে মাথা রেখে ঘুমানোর ফল। হাঁটুটাও টনটন করছে।
সেই হাসপাতাল, সেই ছোট্ট অফিস ঘর, সেই শৌভিক আর আমি। ভোর পাঁচটায় উঠেছি আমরা, তারপর এক কাপ কালো কফি খেয়ে, শ্রীমতী তুত্তুরীকে ঘুম থেকে টেনে তুলে, ভালো করে পরীক্ষা দেবার সদুপদেশ দিয়ে ছটা নাগাদ বেরিয়েছি কাঁথি থেকে। সাতটা থেকে তাঁর কম্পিউটার সায়েন্সের পরীক্ষা, সাতটা থেকে শাশুড়ি মায়ের অস্ত্রোপচার। কিছু দিন আগে যে পায়ে অপারেশন হয়েছিল, আবার সেই পায়েই ছুরি কাঁচি চালাচ্ছেন ডাক্তার বাবু।
কপালের নাম গোপাল একেই বলে। ওনার বয়সের কথা ভেবেই, আগের বার ছোট করে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ডাক্তার বাবু। বল সকেট না পাল্টে, স্ক্রু দিয়ে জুড়ে দিয়েছিলেন হাড় খানা। বলেছিলেন শতকরা ৯০-৯২ ভাগ কেসে এতেই জুড়ে যায় হাড়। আমরা পড়ে গেছি বাকি ৮-১০ শতাংশে।
পকেটে হাত ঢুকিয়ে কোণাকুণি উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে সিসিটিভি মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে শৌভিক। খোঁজার চেষ্টা করছে শাশুড়ি মাকে কোন ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে কি না। আমরা যখন এসেছিলাম জনবিরল ছিল হাসপাতালটা, ক্রমে বাড়ছে জনকাকলি। আমাকে জেগে উঠতে দেখে আমার পাশে এসে বসে শৌভিক, বলে, " আরো খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারিস। বড় ডাক্তার বাবু এখনও এসে পৌঁছায়নি।" বড় ডাক্তার বাবুটি কোন মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। গেল বার শাশুড়ি মাতার অপারেশন করেছিলেন যে ডাক্তার, তাঁর মাস্টারমশাই।
আমরা ব্যাপারটা কপালের ফের বলেই মেনে নিয়েছি, কিন্তু গেল বারের অপারেশন বিফল হওয়ায়, ডাক্তার বাবু থেকে হাসপাতালের সকলে অত্যন্ত সংকুচিত। ডাক্তার বাবু তো বলেই ফেললেন, " বিশ্বাস করুন স্যার, আমি দু রাত ঘুমাতে পারিনি। আমার বউও আমায় খুব বকছে -"। সেই দুরাত না ঘুমানো ডাক্তারই আপাতত ছুরি চালাচ্ছেন শাশুড়ি মায়ের পায়ে, পুরাণ ইমপ্ল্যান্টটা খোলার কাজ চলছে।
বসে বসে কি যেন সব আবোলতাবোল বকি আমরা, পরিকল্পনা করি, যেদিন "ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে,"সেদিন কোথায় কোথায় ঘুরতে যাব আমরা। একটি ছেলে এসে খবর দিয়ে যায়, বড় ডাক্তার বাবু এসে গেছেন, নতুন ইমপ্ল্যান্ট বসানোর কাজ এবার শুরু হবে। জানতে চায়, চা খাব কি না। দুজনে একসাথে মাথা নাড়ি, আমরা ইতিমধ্যেই বড় জ্বালাচ্ছি এদের, আর নয়। দরজা বন্ধ হতেই দৌড়ে সিসিটিভি মনিটরের কাছে গিয়ে বড় ডাক্তার বাবুর গাড়িটা খোঁজে শৌভিক। ছেলেদের গাড়ি নিয়ে যে কেন এত উৎসাহ, আজও বুঝলাম না।
আবার আমার পাশে এসে বসে শৌভিক, কিছু ক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি দুজনে, অস্ত্রোপচার শেষ হতে বেলা নটা সাড়ে নটা বাজবে। অক্সিজেনের কি হঠাৎ অভাব দেখা দিল? নিঃশ্বাস নিতে এত কষ্ট হয় কেন? প্যানিক অ্যাটাক হল নাকি? শৌভিক এমনিতেই এত চাপে আছে, আমার জন্য আর বিব্রত করতে চাই না। উঠে পড়ি সোফা থেকে, জিজ্ঞাসু শৌভিককে ইশারায় বলি, একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি -
ভোরের কুয়াশা কাটিয়ে পূব আকাশে জ্বলজ্বল করছে কমলা সোনালী সূয্যি মামা। তাঁর প্রকাশে যেন ঝলমলিয়ে উঠছে ধরা। বাতাসে এখনও রয়েছে সামান্য শৈত্য - বুক ভরে নিই তাজা বাতাস। " চাইলে এখানেও থাকতে পারিস-" বলে শৌভিক, উঠে এসেছে আমার পিছু পিছু। বলি, চল চা খেয়ে আসি। হাইরোডের ধারে ঘুপচি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাই দুজনে, এক ভাঁড় উত্তপ্ত দুধ চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। বিস্কুটে কামড় মারার সাথে সাথেই জিভে জড়িয়ে যায় বনস্পতি। পায়ের কাছে ন্যাজ নাড়ানো ভুলুটাকে খানিক ভেঙে দিলাম। সেও দেখি মুখ ঘুরিয়ে নিল।
রাস্তার উল্টো দিকে অজানা মহীরুহদের সারির ফাঁকফোকর গলে যতদূর দুচোখ যায় কেবল সবুজ আর সবুজ। সদ্য বপন করা হয়েছে কচি ধান গাছের চারা। গাছের ডালে ডালে আসর জমিয়েছে ফিঙে,শালিক, ছাতারে, বেনে বউ আর বুলবুলিদের গুষ্টি। মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে পরিযায়ী হাঁসের দল। রাস্তা দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটছে বাস, লরি, চারচাকা, বাইক এমন কি সাইকেল ও। কারো সময় নেই, কেউ দুই দণ্ড থমকে দাঁড়াচ্ছে না, তাকিয়ে দেখছে না, কি অনুপম রূপের ডালি নিয়ে হাজির হয়েছে প্রকৃতি। ব্যতিক্রম আমরা, প্রতিটা রোমকূপে ভরে নিই প্রকৃতির দান। "কাছাকাছি কোন জলাশয় আছে মনে হয় -"আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে শৌভিক। "নাহলে এত পরিযায়ী পাখি আসত না।"
চা শেষ হয়ে যায়, তাও নড়ি না আমরা। মাধ্যমিক পরীক্ষা সংক্রান্ত কি কারণে যেন ফোন করে কেউ। ফোনটা রাখার পর মাধ্যমিক নিয়েই আলোচনা করতে থাকি আমরা। তার মাধ্যমিক, আমার মাধ্যমিক। সম্ভবতঃ ১ লা মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের মাধ্যমিক। তার অব্যবহিত পূর্বে, সম্ভবত ১২ই ফেব্রুয়ারি নিউমোনিয়া ঘটিত জ্বর আর তীব্র শ্বাসকষ্টের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় বাবাকে। মাসিরা, দাদারা, দিদিভাই, জামাইবাবু, তাঁর দাদা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে না পড়লে বাবাকে ফিরিয়ে আনতে পারতাম না সেবার।
শুধু কি তাই, মঙ্গল না বুধবার থেকে পরীক্ষা শুরু, শনিবার থেকে কানের যন্ত্রণায় পাগল পাগল আমি। সারা রাত জেগে সেঁক দিচ্ছি কানে, কমে আর না। বাবা তখনও পুরো সুস্থ নয়, তাও সারা রাত জেগেছিল আমার জন্য। আমার কষ্ট দেখে পরদিন বড়দা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। কার মাসতুতো দাদা এত করে রে, বলতে বলতে ছলছলিয়ে ওঠে আমার চোখ।
শৌভিক হাসি চেপে বলে, "আর আমি কি করেছিলাম জানিস না তো? অ্যাডমিট কার্ড ফেলেই একদিন চলে গিয়েছিলাম পরীক্ষা দিতে।" বাপরে, বলে লাফিয়ে উঠি আমি। জানতে চাই, তারপর? শৌভিক বলে, "তারপর আর কি? আমি তো একাই যেতাম পরীক্ষা দিতে, হলে ঢোকার আগে সব মিলিয়ে নিতে গিয়ে দেখি কার্ডটা নেই। নম্বরটা মুখস্থ ছিল। গার্ড দেবে যে স্যার, তাঁকে বললাম -। তিনি বললেন, 'কাউকে বলো, বাড়ি থেকে এসে দিয়ে যাবে -।' বললাম, আমার বাড়িতে এমন কেউ নেই, যে দিয়ে যেতে পারে। বাবা অফিসে, ভাই খুব ছোট, আমার টেন মানে ও থ্রি/ফোর এ পড়ে। মা ওকে ফেলে তো আসতে পারবে না। আর সল্টলেক মা অত ভালো চিনতও না। সব শুনে, আমার এক বন্ধুর দাদা বলল, 'তোমার বাড়িটা কোথায় বলো, আমি গিয়ে এনে দিচ্ছি।'"
ভালো মানুষের বোধহয় কোনদিনই আকাল পড়ে না, বলি আমি। শৌভিক হেসে বলে, " হ্যাঁ, কিন্তু মা তাকে দেয়নি। আমরা তখন বিধান আবাসনে থাকতাম, ভাইকে নিয়ে নাকি বাড়িতে একা রেখে আজ আর মনে নেই, কিন্তু মা এসেছিল, অ্যাডমিট কার্ডটা নিয়ে -" বলতে বলতে বোকার মত হাসে শৌভিক। " ততক্ষণে অবশ্য এক ঘন্টা পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মা এসেছিল -"।
আশেপাশের লোকজন, ছুটন্ত গাড়ি, লেজ নাড়া ভুলু, পাখিদের ঝাঁককে অগ্রাহ্য করে নিজের বরকে জড়িয়ে ধরি আমি। এটা বুঝি ভ্যালেন্টাইন উইক, আকাশে, বাতাসে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মাখামাখি ভালোবাসার রং, তাজ্জব লাগে, জীবনের প্রতিটা দশক ভেদে কত পাল্টে যায় ভালোবাসার সংজ্ঞা। লম্বা লম্বা টেলিফোন, সাংকেতিক বার্তা চালাচালি, সপ্তাহান্তে দেখা, হাতে হাত রেখে ভালোবাসার মিছিলে সামিল হওয়া, ফুল, চকলেট, সুগন্ধী, লং ড্রাইভ, মোমবাতির আলোয় নৈশভোজ সবকিছু কি বালখিল্য লাগে আজকাল। কত এগিয়ে গেছি আমরা। আজকাল প্রেম হয় ওষুধের নাম আর UPI এর স্ক্রীনশটে, আজকাল আব্দার হয় এডাল্ট ডায়াপার, বেড প্যান, লাঠি আর হুইলচেয়ার কেনার। আজকাল দুজনে একসাথে ভাবি, কিছুই তো খায় না বুড়োবুড়ি গুলো, কিভাবে মেটাই ওদের প্রোটিনের চাহিদা। আপাতত বাবামায়েদের জন্য ভাবি, জানি কিছুবছর বাদে নিজেদের জন্যও এগুলোই ভাবতে হবে। এই প্রবাহমানতাই তো জীবন। এই প্রবাহমানতা, এই ছুটে চলার মধ্যেই বেঁচে থাকুক ভালোবাসা, যত খুশি রূপান্তরিত হোক, শুধু হারিয়ে না যায়। সত্যি করে বলুন তো " ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি -"
অনির সরস্বতী পুজোর ডাইরি, ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
কাক ডাকা ভোরে উঠে শ্যাম্পু করা, কোঁকড়া চুলকে বশে আনা যে কি কঠিন কাজ! দুই বার করে কন্ডিশনার লাগাতে হয়, যার একটা ধুতে হয় অন্যটা নয়। তারপর আবার বিশেষ ব্রাশ দিয়ে আঁচড়ানো তবে না স্প্রিং এর মত পাকিয়ে থাকবে ব্যাটারা।
আমার সাজ আপাতত এই টুকুই, এবার নিদ্রিত কন্যাকে ঠেলে তোলার পালা। গত ২৬ শে জানুয়ারি অপরাহ্ন থেকে হাসপাতাল নিবাসী আমার বাবা, এখনও নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারছেন না শাশুড়ি মাতা, বাড়ির অবস্থা লণ্ডভণ্ড। পুজো যে আদৌ হবে সেটাই ঠিক হয়েছে মাত্র ২৪ থেকে ২৬ ঘণ্টা আগে। ঈশ্বর মঙ্গল করুন, শৌভিকের নাজির বাবু, CA সাহেব এবং অন্যান্য সহকর্মীদের, কি অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে যে সব আয়োজন করেছে ওরা। যেন ওনাদের বাড়ির পুজো।
গত শনিবার থেকে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে মেয়েটার। বাড়ির এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে সবথেকে অবহেলিত বোধহয় আমার মেয়েটাই। মূলতঃ তাঁরই জন্য পুজোয় সম্মতি দিয়েছেন মহকুমা শাসক মহোদয়। বছরে তো একটা দিনই শাড়ি পরে তুত্তুরী, তাও এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি আমি, কি শাড়ি পরবে মেয়েটা।
এখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে শৌভিক। অন্তত ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। সদ্যোত্থিত মেয়েকে বাপের পাশে বসিয়ে একটার পর একটা শাড়ি বার করি আমি, এটা পরবি? নাকি এটা? শেষ পর্যন্ত দুটো শাড়ি পছন্দ করেন শ্রীমতী তুত্তুরী, ফাইনাল ডিসিশন নাকি নেবেন তাঁর বাপ। তাই না বটে, সব করলাম আমি, আর মেয়ে কোন শাড়ি পরবে সেটা ফাইনাল করবে বাবা। মেয়ে গুলো জাত বেইমান হয় মাইরি।
শেষ পর্যন্ত আমার ফুলশয্যার তত্ত্বে পাঠানো লাল পাড় টিয়াপাখি সবুজ কাঞ্জিভরম টাকেই বেশি পছন্দ হয় বাবার। মেয়েকে শাড়ি পরিয়ে, সাজিয়ে গুছিয়ে হাসপাতাল ছুটি আমি। একবার দেখে আসি আমার বাপ টাকে অন্তত। যত সুস্থ হয়ে উঠছে, ততো অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন তিনি। পারলে আমার সাথেই বেরিয়ে পড়ে হাসপাতাল থেকে। তাঁকে বাবা বাছা বলে, বুঝিয়ে শুনিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম, ছুটে এল তুত্তুরী, " মা, মা ঠাম্মা আমায় বারবার তুমি ভাবছে। বার বার ডাকছে অনিন্দিতা, অনিন্দিতা করে। বলছে, ' অনিন্দিতা তুমি হাসপাতাল যাবে না? বলছে অনিন্দিতা তুমি সিঁদুর পরনি?' বললাম, আমি অনিন্দিতা নই, আমি অনিন্দিতার ছানা। তো বলল, ওমা, তোমায় তো একেবারে অনিন্দিতার মত লাগছে -"।
অনির ডাইরি ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
বই মেলায় যাব না, এটাই ঠিক ছিল। ওনারা ডাকাডাকি করছিলেন বেশ অনেক দিন ধরেই, এই নিয়ে ষষ্ঠ সংখ্যা প্রকাশিত হতে চলেছে। ইতিপূর্বে পাঁচটি সংখ্যায় স্থান পেয়েছিল আমার লেখা। এবারেও ঠাঁই নাড়া হয়নি এই অধম। এই সাহিত্যপ্রেমী মানুষগুলো,এই ভিন্নধারার লেখালিখি, এই লিটল ম্যাগাজিনগুলোই তো আজও বাঁচিয়ে রেখেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি মণীষাকে। যেতে তো ইচ্ছে করে, কিন্তু বড্ড দূর যে। গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে, এক পিঠ যেতেই লাগবে ঘণ্টা চারেক। বাপরে -
হঠাৎ একদিন ঘোষণা হল, প্রকাশিতব্য লেখাগুলিকে নিয়ে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা হয়েছিল। যাতে আমার লেখাটি প্রথম হয়েছে। পুরস্কার দেবেন গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার, পুরস্কারের নাম ওনার অকালপ্রয়াত স্ত্রীর নামে। আমি জানতাম ভদ্রলোকের দুই কন্যা, যখনই কিছু লিখতেন,লেখায় উল্লেখ থাকত" বড় কইন্যা" আর "ছোট কইন্যা"র। দুর্ঘটনা ঘটে যাবার দিন গ্রুপের এক স্নেহময়ী দিদি জানালেন, "নারে, ওর একটাই মেয়ে। বউকে আদর করে বড় কইন্যা বলত।" সেই বড়কইন্যার স্মৃতিভরা প্রথম পুরস্কার, আমার কাছে তা অমূল্য। হাত পেতে না নিতে পারলে শান্ত হবে কি এ হৃদয় -
যাব যে, কিন্তু যাব কি করে? জীবন যে আপাতত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে আমাদের। এদিকে সদ্য অস্ত্রোপচার হয়ে বাড়ি ফেরা শাশুড়ি, অন্যদিকে আইসিইউতে থাকা বাবা। এদিকে ঐ দিনই শুরু হচ্ছে শ্রীমতী তুত্তুরীর বার্ষিক পরীক্ষা (তাও আবার অঙ্ক) ওদিকে ঐদিনই শেষ হচ্ছে দুয়ারে সরকার। সবার উপরে সরস্বতী পুজো, কি ভাবে সামলাই এত কিছু?
মাথার মধ্যে ঘোরে নিরন্তর হিসাবনিকাশ। যদি সব ঠিক থাকে, যদি সবকিছু সামলে যেতে পারি, খুঁজে পাব কি? যা ট্যালা হয়ে গেছি আমি। অনেক ভেবে শেষে এক প্রাক্তণ সহপাঠিনীকে মুঠো ফোনে ধরি, গুগল ম্যাপ ধরে মেলাপ্রাঙ্গনে তো পৌঁছে যাব, বাকি পথটুকু তুই একটু নিয়ে যাবি ভাই? একজন পথপ্রদর্শক না থাকলে নির্ঘাত হারিয়ে যাব আমি।
পরিস্থিতি কিছুতেই আর সামলে ওঠে না যেন, শাশুড়ি মাতার পা উন্নতির বদলে আরো বিগড়ে যায় যেন। ওদিকে বাড়ি ফিরে আসার জন্য পাগল হয়ে ওঠে বাবা। রেগে গিয়ে খুলে ফেলে অক্সিজেন মাস্ক, টলতে টলতে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে।
পরীক্ষা শেষে গালফোলা শ্রীমতী তুত্তুরীকে বাড়ি ফিরিয়ে এনে, হাসপাতালে গিয়ে বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করে, শাশুড়ি মাতাকে জলদি ফিরে আসার আশ্বাস দিয়ে বেরোতে গিয়ে দেখি ধড়াচূড়া পরে রেডি আমার বর। ভেবেছিলাম দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প দেখতে যাচ্ছেন বুঝি, জবাব পেলাম, " নাহ্ ডিএম সাহেবের থেকে অনুমতি পেয়ে গেছি। তাছাড়া অনেকদিন বইমেলাতে যাওয়াও হয়নি -"। ফুসফুসে যেন পলকে ভরে যায় একরাশ তাজা অক্সিজেন। আজ হারিয়ে যাব না অন্তত।
নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পনেরো আগেই পৌঁছে যাই আমরা। তিন সাড়ে তিন বছরে কত বদলে গেছে শহরটা। আগেও কি এত মানুষ আসতেন বইমেলায়, নাকি স্মৃতির ওপর জমেছে ধূলিকণার আস্তরণ? হাতে হাত রেখে, হতবাক দৃষ্টিতে মেলাপ্রাঙ্গণ পরিক্রমা করতে করতে নিজেদেরই যেন খুঁজি আমরা। বিভিন্ন বয়সের অনি, বিভিন্ন বয়সী শৌভিক। কোথায় তারা -
ভাগ্যে শৌভিক সঙ্গে এসেছিল, যে বন্ধুর ভরসায় এসেছিলাম, অনুপস্থিত সেই। মুঠোফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে সুন্দরী বান্ধবীর দীর্ঘশ্বাস, "কথা রাখতে পারলাম না অনি রে -"। কি করে কথা রাখবে, প্রিয়জনকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়তে হয়েছিল যে। সমবয়সীদের সমস্যাগুলোও যে সমপর্যায়ের।
সবথেকে ব্যস্তবন্ধুটি কিন্তু ঠিক খুঁজে বার করে আমাদের, শৌভিকের কান বাঁচিয়ে দেয় একরাশ চোখাচোখা গাল। " অন্তত দশবার ফোন করেছি তোকে, ফোনটা রেখেছিস কেন? ওই দেখ আঁস্তাকুড়, ফেলে দিয়ে আয় এখুনি -"। আমারই ডায়লগ আমাকেই ঘুরিয়ে দেয় চৈতালী।
বই দেখা,বই কেনার পাশাপাশি প্রকাশ পায় আমাদের বই, পুরস্কার হাতে তুলে দেন জনৈকা সুন্দরী সদস্যা। দেখা হয় একরাশ চেনাঅচেনা মুখের সাথে। হয় অনেক গল্প, স্বল্প অবসরে ছোট কইন্যাকে বেশ খানিকটা আদর করে নিই আমি। কি সুন্দর যে দেখতে মেয়েটাকে। এবার ঘরে ফেলার পালা। বেলা ঢলে পড়ার সাথে সাথেই পিলপিল করে লোক ঢুকছে মেলায়, আর বেশীক্ষণ থাকলে সত্যিই হারিয়ে যাব আমরা।
একরাশ মহানাগরিক জাঙ্ক ফুড খাবার প্ল্যান থাকলেও শেষমেষ আর খাওয়া হয় না কিছুই। খাবার স্টলগুলিতেও মাছির মত ভনভন করছিল পুস্তিকপ্রেমীদের ভিড়। শাশুড়ি মায়ের জন্য কেনা প্রোটিন বিস্কুট গোটা তিনেক সঙ্গে নিতে বলেছিল শৌভিক, কিন্তু শেষ মুহূর্তে বরকে আমার ছায়াসঙ্গী হতে দেখে খুশির চোটে সেটা পুরো ভুলে গেছি আমি। অগত্যা নন্দকুমার মোড়ে থেমে চা আর লেড়ো বিস্কুট দিয়ে টিফিন সারি আমরা।
ঘনায়মান সন্ধ্যা ক্রমে রাতে পর্যবসিত হয়, আরেকবার মুঠো ফোনে বিতর্কে জড়াই সঞ্চিতা আর আমি। ইতিপূর্বে ৫৭৪২ বার পাঠানো বার্তা নতুন করে পাঠায় সঞ্চিতা, "তোকে আর আমি ফোন করব না কোনদিন। ভালো থাকিস - আর আমি বাঁচি-মরি যাই হোক না কেন, তুইও আমার আর কোন খবর নিবি না।" এরপর মান ভাঙাতে আমার ফোন করাটাই দস্তুর। উভয়ের সোহাগী বার্তালাপে ঘুম ভাঙা শৌভিক বিড়বিড় করে, "তুই আর তোর বন্ধুরা -"।
পুরস্কার প্রদানকারী ভদ্রলোক মেসেজ করে জানতে চান, " উপহার পছন্দ হয়েছে কি ম্যাডাম?" পুরস্কারের সাথে পাওয়া উপহারটির কথা তো এতক্ষণে ভূলেই বসেছিলাম। মেসেজ পেয়ে, হ্যাংলার মত মোড়কটি খুলে দেখি, গাড়ির জানালা গলে ঢুকে আসা আলোয় জ্বলজ্বল করছে "বাঙালনামা"। সেই দেখে আমার বাঙাল বরের কি খুশি।
পথ যেন আর ফুরায় না। শ্রীমতী তুত্তুরী ফোন করে জানান, "তোমরা কতদূরে? চিন্তা করো না, ঠাম্মাকে নৈমিত্তিক ইঞ্জেকশন আমি দিয়ে দিয়েছি। সব সাব্জেক্ট ও পড়ে ফেলেছি -।" অর্ধেকটা বিশ্বাস করি, বাকি অর্ধেকটা অর্থাৎ পড়াশোনার অংশটা ভূতেও বিশ্বাস করবে না। যাক গে, বাদশা খানের ভাষায়, হয়তো চলচ্চিত্র এখনও অসমাপ্ত, তবুও এইভাবেই যায় যদি দিন, যাক না।
No comments:
Post a Comment