Friday, 11 April 2025

অনির ডাইরি এপ্রিল, ২০২৫

 অনির ডাইরি ১৪ই এপ্রিল, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



এমন কখনও হয়েছে, আচমকা অপ্রত্যাশিত ভাবে অনেক, অনেকটা ভালোবাসা পেয়ে গেছেন? গাঁট গুণে বলতে পারি বটে, কতবার পেয়েছি, কিন্তু পেয়েছি। এমনিই কথা হত মেয়েটার সাথে, তখনও হোযাটসঅ্যাপ/ মেসেঞ্জার কিস্যু আসেনি। বার্তা বিনিময় বলতে এসএমএস,যার মূল্য ছিল এক টাকা/ প্রতি মেসেজ। আমরা কথা বলতাম ই-মেলে। সদ্য সদ্য ইমেল খুলেছিলাম সকলে, এমনিই ফরওয়ার্ডেড মেসেজ পাঠাতাম একে অপরকে।  তারই ফাঁকে ফাঁকে ওই আর কি,  কি রে কেমন আছিস মার্কা বার্তা বিনিময়।


সেটা প্রেম ভালোবাসার সময়, জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে পা দেব কি দেব না সেই নিয়ে দোদুল্যমানতায় ভোগার সময়। ততোদিনে পেশাগত ভাবে দাঁড়িয়ে গেছি আমরা, ফলে " আজকাল পাঁও জমি পে পড়তে নেহি মেরে -"। পুরো প্রজাপতির মত উড়ছি, ভালো মেয়ে, বাধ্য সুসন্তান হতে গিয়ে বঞ্চিত হয়েছি যে সব নিষিদ্ধ আনন্দ থেকে আশ মিটিয়ে পূরণ করছি সব শখ। ঝপ করে কোঁকড়া চুল সোজা করে ফেললাম একদিন। মা জেঠাইমার তো কপালে করাঘাত - এ কি হল। কেন হল ইত্যাদি। কিন্তু পিকচার যে তখনও বাকি। কিনে ফেললাম ছয় পকেট ওয়ালা জিন্স, পোশাকী নাম কার্গো। সেই যে ট্রায়াল রুম থেকে পরে বেরোলাম,আর ছাড়তেই চাই না। সর্বত্র আমার এক পোশাক। ছোট মাসি মাকে বলেই ফেলল, " ছোট দি, মেয়ে সামলা। একে বিয়ে করবে কে -"। 


এদিকে যে বিয়ে করবে, সে ফিসফিসিয়ে কয়, " এটা পরেই বিয়ে করো। আমিও তাই করব। ধুতি পরার বিড়ম্বনা থেকে তো বেঁচে যাব।" এই সবই লিখতাম মেয়েটাকে। সেও লিখত , কিন্তু সে সব গল্প হত বড় শৌখিন, বড় পরিমার্জিত। মেয়েটিও যে ভীষণ পরিশীলিত, আমার মত ধিঙ্গি নয়।  নিজের প্রগলভতা নিয়ে বেশ কিছুটা সঙ্কোচেই ভুগতাম বলতে পারেন। ভাবতাম আমাকে সহ্য করে কেবল, স্বপ্নেও ভাবিনি মেয়েটি আমাকে পছন্দ করে। সেদিন যখন তার ইমেলে ভেসে এল, " থ্যাংকস অনিন্দিতা। তুই আমার সবথেকে প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে একজন। যেভাবে আমার দুর্দিনে পাশে ছিলি, আমি কোনদিন ভুলব না -। " আকাশ থেকে পড়লাম আমি, এই সফিস্টিকেটেড, সুন্দর মেয়েটা আমায় তার বেস্ট ফ্রেন্ডদের মধ্যে একজন বলল কি? কি করলাম আমি? ছাপোষা ইমেলের জবাবে, ছাপোষা মেসেজই তো পাঠিয়েছি। 


কি যে ভীষণ মূল্যবান মনে হয়েছিল নিজেকে, সেদিন থেকে সুকন্যা - সঞ্চিতা - পম্পা - নবনীতাদের পাশাপশি আর একটা বেস্ট ফ্রেন্ড বাড়ল আমার। তারপর কেটে গেছে প্রায় দুই দশক। ভৌগোলিক দূরত্ব মাইলের পর মাইল হলেও ফাটল ধরেনি আমাদের বন্ধুত্বে। ভালোবাসা যেন ওর দিক থেকেই বেশি। অবাঙালি, অ - হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটা বাঙালি উৎসবে মুঠোফোনে ফুটে ওঠে ওর শুভেচ্ছা। আমার জন্মদিন, বিয়ের দিন, তুত্তুরীর জন্মদিন - শুভেচ্ছা বার্তা আসবেই, আসবে। একদিন মেসেজ করে বলল, " ভালো বাংলা তো পড়তে পারি না অনি, কিন্তু তোর লেখা পড়ি। খুব ভালো লাগে। না পারলে, আমার বরকে দিয়ে পড়াই -"। কি বলব বুঝতে পারিনি, আর আমি? এত অপদার্থ যে মনে করে ব্যাটার জন্মদিনেও শুভেচ্ছা জানাতে পারি না। ভুলেই যাই, ভুলভাল তারিখে জানাই। ভাগ্যিস ভালোবাসা নিক্তি মেপে হয় না।


সম্প্রতি মাতৃহারা হয়েছে বন্ধুটি। অন্য বন্ধু মারফৎ খবর পেয়েও বুঝতে পারিনি কি করব। প্রায় সাড়ে আটশ কিলোমিটার দূর থেকে ছুটে যাওয়া প্রশ্নাতীত, তাহলে ফোন করব কি? ফোন করেই বা কি বলব, " আহা তোর মা -। নিজেকে সামলা,কাকুকে সামলা -"। বিশ্বাস করুন আমি বলে উঠতে পারিনি।পরিচিতদের গ্রুপে তুফান উঠেছে, সকলে জানিয়েছে,' ওনার আত্মার শান্তি কামনা করি ' বা 'শোক সন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানাই। ',   অনেকের প্রিয়জন বিদায়ের মুহূর্তে আমিও তো এগুলোই লিখি, কিন্তু সেদিন কিছুতেই লিখতে পারিনি। কেমন যেন ঠুনকো মনে হচ্ছিল সব কিছু।


মাঝে একদিন দেখি কি যেন মেসেজ করে ডিলিট করেছে মেয়েটা। সাহস করে লিখি, তোকে কি বলব জানি না রে। এই শোকের কোন সান্ত্বনা হয় না। আশা করিনি জবাব আসবে, কিন্তু আসে, " সবাই মিলে বাবাকে ঠিক রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু মা আর নেই এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না রে।  চেষ্টা করছি স্বাভাবিক থাকার। তুই সাবধানে থাকিস। কাকু কাকিমাকে সাবধানে রাখিস।" মেসেজটা পড়ে সামলাতে পারিনি নিজেকে, প্রিয়জনের প্রিয়জন হারানোর বেদনা এত সংক্রামক কেন হয়। 


দুর্ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর সাহস করে গিয়ে বসলাম বন্ধুর মুখোমুখি। কে যেন বলে গেছেন রাজদ্বারে, শ্মশানে পাশে না থাকলে সে বন্ধুই নয়। পলে পলে অনুভব করছিলাম, কতটা যথার্থ তিনি। আমি কারো বন্ধু হবার যোগ্যই নই। এতো এই সুন্দর সুশীল মেয়েটার মহানুভবতা, যে আজও আমার কুশল সংবাদ নিল। প্রশ্ন করব কি করব না ভাবতে ভাবতে  বোকার মত,  করেই ফেললাম, " কেমন আছেন কাকু?" মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবে বললে, " এখন ভালোই আছেন। সেদিন একটু সমস্যা হয়েছিল -"। বুঝতে পারি কাকিমার মৃত্যুর দিন। 


বরাবরের শান্ত মিতভাষী মেয়েটাকে যেন আজ কথায় পেয়েছে, " সেদিন আসলে প্রচণ্ড প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল, তাই মাথা ঘুরে গিয়েছিল। আসলে অর্ধ শতকের সঙ্গী তো, মা ভীষণ অসুস্থ ছিল, সবাই জানতাম আজ না হলে কাল দিনটা আসবেই। তাও -। ডাক্তার বলেছিল, আরও চেষ্টা করাই যায়, কিন্তু ওনার যা শারীরিক অবস্থা, কতটা নিতে পারবেন জানি না। আমি সেটাই বাবাকে বুঝিয়ে বললাম, যে মা আর নিতে পারত না। আমার কথাটা বোধহয় মাথায় ঢুকেছে জানিস। দেখলাম আত্মীয়স্বজন যাঁরা এসেছেন, তাদের বলছে, ' আর নিতে পারত না।'"

সাধারণত এই সব কথার পর নীরবতা বিরাজ করে, আজ যেন মেয়েটাকে কথায় পেয়েছে, " জানিস অনি, আমি জানতাম। আমরা সবাই জানতাম, মা আর বেশী দিন নেই। তাই মায়ের ভয়েজ রেকর্ড করে রাখতাম। যখনই মা ফোন করত, আমি রেকর্ড করে রাখতাম। কেবল ভয় হত, আর কটা দিন এই গলাটা শুনতে পাব কে জানে।" ওর চোখ শুকনো, আমারও, কিন্তু ভিতরে ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়ে চলে। 


" আমার কাছে সব থেকে বড় সান্ত্বনা কি জানিস, আমি মাকে দেখতে পেয়েছি -"। তোকে চিনতে পেরেছিলেন, শুধাই আমি। মাথা নাড়ে মেয়েটি। " না রে। আমি যখন গিয়ে পৌঁছাই, মা তখন কোমায়। ভাই আমায় পাশ টা দিয়ে কি যেন কাজে চলে গেল। বলে গেল মা অনেকটা স্টেবল। আমি আইসিইউতে ঢুকে দেখি মায়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। নার্সকে ডেকে দেখালাম, এমন কেন হচ্ছে? সে কিছু বলতে পারল না। আইসিইউ এর ডাক্তার এসে আমায় বলল, ' আপনাদের তো বলা হয়েছিল ওনাকে ভেন্টিলেশনে দিতে। আপনারা রাজি হননি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ডিসাইড করে আমায় জানান।' ভাইরে আমি প্রায় ছয় শ কিলোমিটার দূর থেকে সবে গেছি, আমি কি ডিসিশন নেব? তাও পাঁচ মিনিটে? ভাই বলেছিল মায়ের ডাক্তার আলাদা করে নিষেধ করেছে, যে ভেন্টিলেশনে দিলেও আর কোন লাভ হবে না। সেটা জানা সত্ত্বেও আমি ঠিক থাকতে পারিনি। বললাম তাই দিন।" 


" মাঝরাতে ফোন এল, মায়ের অবস্থা খুব খারাপ, কি যেন একটা দিতে হবে। দিলেও কিছু হবে কিনা ঠিক নেই, কিন্তু ডাক্তার নাকি রেকমেন্ড করেছে। তখন আমরা কি বলব বল তো -"। এই পর্যন্ত শুনে, টেবিলের এপার থেকে ছুটে ওপারে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরি আমি। এই অসহায়তা আমার অপরিচিত নয়। মধ্যরাতে এমন ফোন আমার কাছেও এসেছিল। সেই সর্বগ্রাসী আতঙ্ক আর চূড়ান্ত অসহায়তা ভাষায় অপ্রকাশ্য। আমার বাহুবন্ধনে ভেঙে পড়ে মেয়েটা, এত ক্ষণে ধরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা ধুয়ে যায় চোখের জলে।" আমরা কি বলব অনি? মায়ের সেন্স ছিল না, তাও পায়ে হাত বোলাচ্ছিলাম আমরা। আমি হাত দেওয়াতে প্রেশার একটু বাড়ল, ভাই যেই হাত বোলাল, প্রেশার আশি উঠে গেল। আমার ভাইটা বোকার মত জিজ্ঞাসা করছিল সকলকে, ' আমি কি মায়ের পায়ে হাত দিয়েই রাখব?' যদি মা থাকে, যদি আর কটা দিন থেকে যায়। আমরা বললাম দিয়ে দিন, যা দেবার দিয়ে দিন। বিশ্বাস কর, পাঁচ মিনিট পর ফোন করে বলল, " উনি নিতে পারলেন না।"


সময় যে কোথা দিয়ে কেটে গেল জানি না। উঠে পড়ি, আবার এতটা পথ উজিয়ে ফিরতে হবে। রাস্তা অবধি এগিয়ে আসে বন্ধু, বিদায়ী আলিঙ্গনের পর বলে, "কাকু কাকিমাকে যে নিজের কাছে নিয়ে গেছিস অনি, আর যেতে দিস না। যা পারিস, যতটা পারিস ওদের দিয়ে যা, করে যা। ভালবেসে যা। এ যে কি জিনিষ, যার হারায় সেই বোঝে। সব যেন কেমন শূন্য হয়ে যায় -" ।


অনির ডাইরি ১২ই এপ্রিল, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


সবে সকাল হয়েছে, পূব আকাশে এক রাশ লালিমা ছড়িয়ে পড়লেও, এখনও উদয় হননি সূর্যদেব। বাতাসে মিষ্টি একটা শীতলতা, গাড়ির জানলার ফাঁক গলে আসা হাওয়ায় ঝিম ধরে যাচ্ছে আমার, ওদিকে গোমড়াথেরিয়াম হয়ে বসে আছে তুত্তুরী। কারণ আর কিছুই নয়, আজ মহাবীর জয়ন্তী, ক্যালেন্ডারে জ্বলজ্বল করছে লাল দাগ, অথচ ছুটি দেয়নি তুত্তুরীদের স্কুল। মোটেই আজকের দিনে ইস্কুলে আসার ইচ্ছে ছিল না তুত্তুরীর, গতরাতে এই নিয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করেছিল আমাদের কাছে, যদি ছাড় পাওয়া যায়। আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেও, পটেনি শৌভিক। ওকেও বেরোতে হবে যে, জেলায় মস্ত মিটিং আছে। 


বাবা বাছা বলতে বলতে, গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে এসে পড়ে মেয়ের স্কুল। গাড়ি থেকে নামার আগে তিনি বলে যান, " মা আজ কিন্তু তুমি আনতে আসবে - আর সঙ্গে তোমার থলথলে মাকেও নিয়ে আসবে। ফেরার পথে আইসক্রিম খাব কিন্তু।" 


দিদিমাকে আদর করে তিনি ওই সবই বলে থাকেন। আজন্ম কৃশকায়, আন্ডারওয়েট মা ইদানিং সত্যিই বেশ পৃথুলা হয়ে উঠেছে, নাতনীর সেটা বড়ই পছন্দ। সুযোগ পেলেই তিনি দিদিমাকে আক্রমন করেন এবং  ধামসান। এর আগে আমার এবং তুত্তুরীর যুগপৎ জোরাজুরিতে বার দুয়েক মা এসেছে, ছুটির পর নাতনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ফেরার পথে মাথা গুণে বাড়ি শুদ্ধ সবার জন্য কিনে নিয়ে গেছে আইসক্রিম। আজও সেই আব্দার নিয়েই বাড়ি ফিরলাম।


কিন্তু আজ সে আব্দার সটান নাকচ হয়ে গেল। "আমি যেতে পারব না বাবা, আমার শরীরটা কেমন যেন আনচান করছে।" অকালে হার্ট ফেল হয়ে চলে গিয়েছিলেন মাতামহ, মায়ের এই শরীর আনচানকে আমি তাই বড় ভয় করি। পরশুই ডাক্তার দেখিয়ে এনেছি। পরীক্ষা নিরীক্ষা কিছু হয়েছে, কিছু এখনও বাকি। তাই আর জোর করতে পারি না। বাবাকে ধরি, " তুমি চল তাহলে -"। নাতনীর আব্দার ফেলতে অপারগ বাবা নিমরাজি হয়। অতঃপর শশব্যস্ত হয়ে মাকে বলে, " আমাকে এখুনি পাঁচশ টাকা বার করে দাও, আইসক্রিম কিনতে হবে -"। 


বৃদ্ধ বৃদ্ধার খুনসুটি দেখে হেসে বাঁচি না। শ্রীমতী তুত্তুরীর ছুটি হতে এখনও পাঁচ ঘণ্টা বাকি -। হাসতে হাসতে হাল্কা চালে শাশুড়ি মাতাকে জিজ্ঞাসা করি, " তুমি যাবে? নাতনীকে স্কুল থেকে আনতে? ফেরার পথে আইসক্রিম খাওয়াব -।" বিগত জানুয়ারী মাসে, ডান পায়ে পর পর দুটি বড় অপারেশন হয়েছে শাশুড়ি মায়ের। বসাতে হয়েছে ধাতব বল সকেট জয়েন্ট। আজও ভালো করে হাঁটতে পারেন না বৃদ্ধা। ওয়াকার নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনমতে হাঁটেন। নাহ অস্ত্রোপচার জনিত কোন সমস্যা নেই, আপাতত সমস্যা হাঁটু জোড়াকে নিয়ে। মাস দুয়েক শয্যাশায়ী থাকার দরুণ হাল ছেড়েছে হাঁটু জোড়া। তিনি যে এক কথায় রাজি হয়ে যাবেন, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। 


সবথেকে খুশি বোধহয় আমার বাবা হল, যাক তাহলে বাবাকে আর যেতে হবে না। বাকিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে অনাবিল আনন্দ। যে মহিলাকে ধমকে চমকেও হাঁটানো যায় না, নড়ানো যায় না, তিনি স্বেচ্ছায় নাতনীকে স্কুল থেকে আনতে যাবেন, এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে। 


ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথেই চড়তে থাকে বৃদ্ধার উত্তেজনার পারদ, আমাকে অন্তত চার বার জিজ্ঞাসা করেন, " আচ্ছা এই পোশাকে যাওয়া যাবে তো? পোশাকটা অসভ্য নয় তো?" পোশাক বলতে ঘরে পরার সুতির নাইটি। পায়ের এই অবস্থা বলে শাড়ি আর ওনাকে পরতে দেওয়া হয় না। যাই হোক, বৃদ্ধাকে আশ্বস্ত করি, তুমি তো গাড়িতেই বসে থাকবে, আমি রাস্তা পেরিয়ে মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসব। কে আর দেখছে। আর দেখলেই বা, এই পোশাকে ও দিব্যি সুন্দর লাগছে আমার স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইয়ের প্রিয়তমাকে। 


ঘড়ির কাঁটা পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট সময়ের ঘরে, টুকটুক করে রওনা দিই আমরা। বাংলোর সিকিউরিটি, গাড়ির ড্রাইভার, শাশুড়ি মাতার ২৪ ঘণ্টার আয়া, লতা দি এবং আমি মিলে বৃদ্ধাকে বাড়ি থেকে বার করে, গাড়িতে তুলি। বারন্দা থেকে হাত নাড়ে আমার বৃদ্ধ বাবা মা। হুশ করে বেরিয়ে যায় গাড়ি। প্রায় বধির শাশুড়ি মাতাকে চিৎকার করে চেনাতে থাকি কাঁথি শহরের অন্ধিসন্ধি। কি বোঝেন, কতটুকু শোনেন ঈশ্বর জানেন, শুধু ওষ্ঠাধরে ফুটে ওঠে শিশুর মত নির্মল হাসি। পাশ থেকে ড্রাইভার ছেলেটি বলে, " খুব ভালো করেছেন ম্যাডাম। মাঝে মাঝে মাসিমাকে বার করবেন বাড়ি থেকে। মনটাও ভালো হবে -"। 


ইস্কুলের উল্টো দিকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে যাই আমি। হাত পা নেড়ে বলি, " চুপ করে বসে থাকো, দুষ্টুমি করো না।" ভালো বাচ্ছার মত ঘাড় নাড়ে বৃদ্ধা। তুত্তুরীদের ইস্কুলের সামনে বিশাল ভিড়, বেশ অনেক ক্ষণ দাঁড়াতে হয় তাঁর জন্য। দূর থেকে আমাকে দেখে হাত নাড়েন তিনি। কাছে আসতেই বলি, " তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে রে বাবু। চল দেখবি -"।


গাড়িতে উঠে হতবাক হয়ে যান তিনি, " ঠাম্মা! তুমি এসেছ! আমায় নিতে!" গলা দিয়ে ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ে বিস্ময় মিশ্রিত খুশি। ঠাম্মার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে, তিনি বলেন, " কিন্তু কি ভাবে? ঠাম্মা তো বাড়ি ছেড়ে নড়তেই চায় না। মা তুমি এই মিরাকল টা করলে কিভাবে বলো তো?" কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলি, আমার তো জন্মই মিরাকল ঘটানোর জন্য। আমি অঘটনঘটনপটিয়সী কি না। মেয়ের ভ্রু কুঞ্চন দেখে সিরিয়াস হয়ে বলি, আসল ব্যাপারটা হল মানসিক। আমার মা আর শাশুড়ি মা সমবয়সী। দুজনেই বেতো রুগী। দুজনের মধ্যে একজন যখনই কিছু করে, অন্যজনের মনে হয়, ও পারছে যখন, আম্মো পারব। মা দুদিন এসেছে নাতনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, তাই দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন ইনিও। বুঝলি বাবু, ওসব ওষুধপথ্য না, আসলে এরা একে অপরকে দেখে চাঙ্গা হয়। 


বাজারের ঠেলাওয়ালার থেকে একরাশ আইসক্রিম কিনে বাড়ি ফিরি আমরা, অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল আরেক বৃদ্ধ দম্পতি, আজকের প্রতীক্ষা যতটা না তুত্তুরী আর আমার জন্য, তার থেকে ঢের বেশী শাশুড়ি মাতার জন্য। আবার সকলের সহায়তায় শাশুড়ি মাতাকে গাড়ি থেকে নামানো হয়, বাড়ি ঢুকে ইউনিফর্ম না ছেড়েই আইসক্রিম খেতে বসে তুত্তুরী, সঙ্গতে তিন বুড়োবুড়ি, আর আমি বলি, সব হবে, আগে একটা ছবি তো তুলে নিই, শৌভিকের বৃদ্ধ মা আর ডেঁপো মেয়েটার, তারপর পাঠাই লোকটাকে। পেশাগত ভাবে বড্ড চাপে থাকে লোকটা, বাড়ির পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ লোকটা আজ ছুটির দিনেও দৌড়েছে মিটিং করতে, তাকে জানাই তো, মন দিয়ে আপিস সামলা ভাই, বাড়ির জন্য আমি আছি তো - । বিয়ের ষোল সতেরো বছর বাদে, এটাই তো ভালোবাসা, আর কে যেন বলে গেছেন না, ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি?

অনির ডাইরি ১১ই এপ্রিল, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


কদিন ধরেই খুঁজছিলাম ছেলেটাকে। আজ দেখা হতেই শুধালাম, " সেই মেয়েটার কি খবর গো?" কোন মেয়েটা? কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে যায় ছেলেটা, তারপরই বুঝতে পারে। মাথা নেড়ে বলে, " নেই ম্যাডাম। ও, ওর বর দুজনেরই -"। 


ব্যস্ত অফিসটাকে যেন হঠাৎ করে ঘিরে ধরে নৈঃশব্দের কালো মেঘ। কোন কথা নেই কারো মুখে। তারপর গলা ঝাড়ে আমার এক ইন্সপেক্টর, কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে, " কোন মেয়েটা ম্যাডাম?" ইন্সপেক্টরটির স্ত্রী সরকারি স্কুলে পার্শ্ব শিক্ষিকা। হুকুমনামা বেরোনোর দিনই বলছিল, " জানেন ম্যাডাম, আমার বউয়ের স্কুলেরও দুজন আছে, এই লিস্টে। তারা দুজনেই কিন্তু খুব ভালো ছাত্র/ছাত্রী। অনেক অনেক নম্বর পাওয়া -।" 

আমরা সরকারের বেতন ভূক চাকর, বুক ফাটলেও মুখ খোলা পাপ। তাই চুপ করেই থাকি। ইন্সপেক্টর সাহেব ভয়ে ভয়ে আবার শুধায়, " কোন মেয়েটা?" 


এবার মুখ খুলতেই হয়, মেয়েটার কথা শুনেছিলাম বছর খানেক, নাকি তারও আগে -, জনৈক সহকর্মীর স্ত্রীর মুখে। বউটি বড় ভালো, সাদাসিধে, প্রাণ খোলা। বরের বদরাগী বস হিসেবে আমাকে ভয় তো পায়ই না, উল্টে ভালো কিছু রাঁধলেই পাঠিয়ে দেয় কৌটো করে, দেখা হলেই পাকড়াও করে শোনায় একরাশ প্রাণের কথা। গাঁট গুণে বলতে পারি আজ অবধি কবার দেখা হয়েছে বউটির সাথে, কিন্তু এর মধ্যেই ওদের প্রেম কাহিনী থেকে শুরু করে যাবতীয় সাংসারিক জটিলতা, অস্থিরতা, সুখ দুঃখের খতিয়ান জমা পড়েছে আমার কাছে। আমাকে দেখলেই যেন, নরম পানীয়ের মত ভুসভুস করে বেরিয়ে আসে প্রাণের কথা। 


তেমন কথা প্রসঙ্গেই একবার শুনেছিলাম ওর এক বান্ধবীর কথা। দুজনেই সাহিত্যে মাস্টার্স। দুজনেই একসাথে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল, এর হয়নি, বন্ধুটির হয়ে যায়। চাকরি পাবার পরই ফোন করে একরাশ কথা শোনায় মেয়েটি। ততোদিন প্রিয় পুরুষের সাথে পরিণয় পাশে আবদ্ধ হয়েছে বউটি। বাল্যপ্রেম, দীর্ঘ প্রেমপর্বের পর বিয়ে। বর সরকারী আপিসের ছাপোষা চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী। এই দিয়েই প্রথম আক্রমণ করে মেয়েটি, " তুই এটা কি করলি? এত তাড়াতাড়ি এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেললি? তোর কত কিছু হতে পারত রে -। চাকরি পেয়ে বিয়ে করা উচিৎ ছিল। আমায় দেখ, আমি কেমন স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছি, মাস গেলে এত টাকা বেতন। আর তুই -"।


এইটা শোনার পর বউটির মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। ওর বর পরে আমায় বলেছিল, " কি ভাবে যে সেদিন বউকে সামলেছিলাম ম্যাডাম। সে তো এই সুইসাইড করে, কি সেই সুইসাইড করে।" একজন কর্মরতা নারী হিসেবে অপর একজন কর্মরতা নারীর কৃতকর্মে মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল সেদিন। অনুপার্জনকারী নিছক গৃহবধূদের প্রতি কর্মরতা নারীদের অসুয়া চিরন্তন।।ব্যাপারটা উল্টো দিক থেকেও সত্যি। তেনারাও ভাবেন আমরা গৃহকর্মে অ-নিপুণ/অক্ষম স্ত্রী/ অপদার্থ পুত্রবধূ/ জঘন্য মা। এ এমন এক দ্বৈরথ যেখানে মেয়েরা কেউ জেতে না, শুধুই হারে। 


সেদিনও হারলাম, বউটি এবং আমি। কিন্তু ওই যে বাদশা খান বলে গেছেন না, চলচ্চিত্র এখনও বাকি, তাকে মান্যতা দিয়েই বোধহয় একদিন দুম করে রায় ঘোষণা করে দিল উচ্চ ন্যায়ালয়। উত্তাল হল রাজ্য রাজনীতি, জল গড়াল সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় অবধি। অধমের জীবন অবশ্য যেমন চলছিল, তেমনি চলতে লাগল। পরিবর্তন বলতে একরাতে বউটির হঠাৎ টেলিফোন, " জানেন ম্যাডাম, আমার সেই বান্ধবীর চাকরি চলে গেছে -"। 


অফিস থেকে ফিরে মাংস কষতে দিয়েছি কড়ায়, তড়িঘড়ি ঢাকা দিয়ে বাগানে নেমে যাই, চাপা গলায় শুধাই, " তুমি জানলে কি করে? এত জনের মধ্যে নাম মিলিয়েছ নাকি?" বউটি থতমত খেয়ে, জিভ কেটে বলে, " না ম্যাডাম, না ম্যাডাম। আমার এক পুরাণ অধ্যাপকের সাথে দেখা হয়েছিল। মন্দিরে গিয়েছিলাম পুজো দিতে, সেখানেই স্যারের সাথে দেখা। স্যার বললেন,' শুনছু, ওর চাকরি চলে গেছে! চাকরী পাবার পর এত বদলে গিয়েছিল, আমার সাথে দেখা হলে তো, চিনতেই পারত না। গায়ে পড়ে, ডেকে কথা বলার চেষ্টা করেও দেখেছি, জুটেছে একরাশ তাচ্ছিল্য।' বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, ভাবতাম আমার প্রতিই যত অসূয়া, স্যারকেও এমন করতো ভাবিনি। প্রাথমিক ধর্ষকাম আনন্দের পর দুঃখই হল। হাজার হোক, প্রাক্তণ সহপাঠী, হঠাৎ চাকরি চলে গেলে, না জানি কত আতান্তরে পড়বে বেচারী। সেই বলতেই ফোন করেছিলাম, লাগল না। মেসেজ করতে গেলাম সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, একাউন্ট ডিএক্টিভেট করে বসে আছে। কি যে করি -"।


তেমন কিছু করতে হয়নি, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের সৌজন্যে অচীরেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ফিরে আসে মেয়েটি।আমাদের ঘরের বউটির সাদাসিধে মেসেজের জবাবে হয় হিরণ্ময় নীরবতা, নয় " তোর তো কিছুই হল না"মার্কা কষাঘাত। বছর, বছর ঘুরে অবশেষে ফয়সালা জানিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। অন্তত বউটির বান্ধবী বা তার স্বামীর ক্ষেত্রে ঘটেনি কোন ইতর বিশেষ। চাকরি গেছে দুজনেরই। অবশ্য সুযোগ আছে, আগামী তিন মাসের মধ্যেই হতে চলেছে নতুন পরীক্ষা। একটু কষ্ট করে তাতে পাস করলেই সব ঠিক। এবার বাদ সাধে আমার সহকর্মী ছেলেটি, " না ম্যাডাম, সব ঠিক হবে না। ওই যে পাঁচ হাজার সাদা খাতা জমার লিস্ট আছে না, তাত্তে ওদের নাম আছে -। চাকরী তো গেলই, সুদ সহ ফেরৎ দিতে হবে সব বেতন।"



অনির ডাইরি ১১ই এপ্রিল, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


কদিন ধরেই খুঁজছিলাম ছেলেটাকে। আজ দেখা হতেই শুধালাম, " সেই মেয়েটার কি খবর গো?" কোন মেয়েটা? কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে যায় ছেলেটা, তারপরই বুঝতে পারে। মাথা নেড়ে বলে, " নেই ম্যাডাম। ও, ওর বর দুজনেরই -"। 


ব্যস্ত অফিসটাকে যেন হঠাৎ করে ঘিরে ধরে নৈঃশব্দের কালো মেঘ। কোন কথা নেই কারো মুখে। তারপর গলা ঝাড়ে আমার এক ইন্সপেক্টর, কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে, " কোন মেয়েটা ম্যাডাম?" ইন্সপেক্টরটির স্ত্রী সরকারি স্কুলে পার্শ্ব শিক্ষিকা। হুকুমনামা বেরোনোর দিনই বলছিল, " জানেন ম্যাডাম, আমার বউয়ের স্কুলেরও দুজন আছে, এই লিস্টে। তারা দুজনেই কিন্তু খুব ভালো ছাত্র/ছাত্রী। অনেক অনেক নম্বর পাওয়া -।" 

আমরা সরকারের বেতন ভূক চাকর, বুক ফাটলেও মুখ খোলা পাপ। তাই চুপ করেই থাকি। ইন্সপেক্টর সাহেব ভয়ে ভয়ে আবার শুধায়, " কোন মেয়েটা?" 


এবার মুখ খুলতেই হয়, মেয়েটার কথা শুনেছিলাম বছর খানেক, নাকি তারও আগে -, জনৈক সহকর্মীর স্ত্রীর মুখে। বউটি বড় ভালো, সাদাসিধে, প্রাণ খোলা। বরের বদরাগী বস হিসেবে আমাকে ভয় তো পায়ই না, উল্টে ভালো কিছু রাঁধলেই পাঠিয়ে দেয় কৌটো করে, দেখা হলেই পাকড়াও করে শোনায় একরাশ প্রাণের কথা। গাঁট গুণে বলতে পারি আজ অবধি কবার দেখা হয়েছে বউটির সাথে, কিন্তু এর মধ্যেই ওদের প্রেম কাহিনী থেকে শুরু করে যাবতীয় সাংসারিক জটিলতা, অস্থিরতা, সুখ দুঃখের খতিয়ান জমা পড়েছে আমার কাছে। আমাকে দেখলেই যেন, নরম পানীয়ের মত ভুসভুস করে বেরিয়ে আসে প্রাণের কথা। 


তেমন কথা প্রসঙ্গেই একবার শুনেছিলাম ওর এক বান্ধবীর কথা। দুজনেই সাহিত্যে মাস্টার্স। দুজনেই একসাথে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল, এর হয়নি, বন্ধুটির হয়ে যায়। চাকরি পাবার পরই ফোন করে একরাশ কথা শোনায় মেয়েটি। ততোদিন প্রিয় পুরুষের সাথে পরিণয় পাশে আবদ্ধ হয়েছে বউটি। বাল্যপ্রেম, দীর্ঘ প্রেমপর্বের পর বিয়ে। বর সরকারী আপিসের ছাপোষা চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী। এই দিয়েই প্রথম আক্রমণ করে মেয়েটি, " তুই এটা কি করলি? এত তাড়াতাড়ি এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেললি? তোর কত কিছু হতে পারত রে -। চাকরি পেয়ে বিয়ে করা উচিৎ ছিল। আমায় দেখ, আমি কেমন স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছি, মাস গেলে এত টাকা বেতন। আর তুই -"।


এইটা শোনার পর বউটির মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। ওর বর পরে আমায় বলেছিল, " কি ভাবে যে সেদিন বউকে সামলেছিলাম ম্যাডাম। সে তো এই সুইসাইড করে, কি সেই সুইসাইড করে।" একজন কর্মরতা নারী হিসেবে অপর একজন কর্মরতা নারীর কৃতকর্মে মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল সেদিন। অনুপার্জনকারী নিছক গৃহবধূদের প্রতি কর্মরতা নারীদের অসুয়া চিরন্তন।।ব্যাপারটা উল্টো দিক থেকেও সত্যি। তেনারাও ভাবেন আমরা গৃহকর্মে অ-নিপুণ/অক্ষম স্ত্রী/ অপদার্থ পুত্রবধূ/ জঘন্য মা। এ এমন এক দ্বৈরথ যেখানে মেয়েরা কেউ জেতে না, শুধুই হারে। 


সেদিনও হারলাম, বউটি এবং আমি। কিন্তু ওই যে বাদশা খান বলে গেছেন না, চলচ্চিত্র এখনও বাকি, তাকে মান্যতা দিয়েই বোধহয় একদিন দুম করে রায় ঘোষণা করে দিল উচ্চ ন্যায়ালয়। উত্তাল হল রাজ্য রাজনীতি, জল গড়াল সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় অবধি। অধমের জীবন অবশ্য যেমন চলছিল, তেমনি চলতে লাগল। পরিবর্তন বলতে একরাতে বউটির হঠাৎ টেলিফোন, " জানেন ম্যাডাম, আমার সেই বান্ধবীর চাকরি চলে গেছে -"। 


অফিস থেকে ফিরে মাংস কষতে দিয়েছি কড়ায়, তড়িঘড়ি ঢাকা দিয়ে বাগানে নেমে যাই, চাপা গলায় শুধাই, " তুমি জানলে কি করে? এত জনের মধ্যে নাম মিলিয়েছ নাকি?" বউটি থতমত খেয়ে, জিভ কেটে বলে, " না ম্যাডাম, না ম্যাডাম। আমার এক পুরাণ অধ্যাপকের সাথে দেখা হয়েছিল। মন্দিরে গিয়েছিলাম পুজো দিতে, সেখানেই স্যারের সাথে দেখা। স্যার বললেন,' শুনছু, ওর চাকরি চলে গেছে! চাকরী পাবার পর এত বদলে গিয়েছিল, আমার সাথে দেখা হলে তো, চিনতেই পারত না। গায়ে পড়ে, ডেকে কথা বলার চেষ্টা করেও দেখেছি, জুটেছে একরাশ তাচ্ছিল্য।' বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, ভাবতাম আমার প্রতিই যত অসূয়া, স্যারকেও এমন করতো ভাবিনি। প্রাথমিক ধর্ষকাম আনন্দের পর দুঃখই হল। হাজার হোক, প্রাক্তণ সহপাঠী, হঠাৎ চাকরি চলে গেলে, না জানি কত আতান্তরে পড়বে বেচারী। সেই বলতেই ফোন করেছিলাম, লাগল না। মেসেজ করতে গেলাম সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, একাউন্ট ডিএক্টিভেট করে বসে আছে। কি যে করি -"।


তেমন কিছু করতে হয়নি, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের সৌজন্যে অচীরেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ফিরে আসে মেয়েটি।আমাদের ঘরের বউটির সাদাসিধে মেসেজের জবাবে হয় হিরণ্ময় নীরবতা, নয় " তোর তো কিছুই হল না"মার্কা কষাঘাত। বছর, বছর ঘুরে অবশেষে ফয়সালা জানিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। অন্তত বউটির বান্ধবী বা তার স্বামীর ক্ষেত্রে ঘটেনি কোন ইতর বিশেষ। চাকরি গেছে দুজনেরই। অবশ্য সুযোগ আছে, আগামী তিন মাসের মধ্যেই হতে চলেছে নতুন পরীক্ষা। একটু কষ্ট করে তাতে পাস করলেই সব ঠিক। এবার বাদ সাধে আমার সহকর্মী ছেলেটি, " না ম্যাডাম, সব ঠিক হবে না। ওই যে পাঁচ হাজার সাদা খাতা জমার লিস্ট আছে না, তাত্তে ওদের নাম আছে -। চাকরী তো গেলই, সুদ সহ ফেরৎ দিতে হবে সব বেতন।"


অনির ডাইরি ৩রা এপ্রিল 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


তিন কুড়ি দশ পড়ছিল শৌভিক। আজ না, বেশ কিছুদিন আগে। অবসর প্রাপ্ত আইসিএস অফিসার অশোক মিত্র মহাশয়ের আত্মজীবনী। পরাধীন, অখণ্ড ভারতের এক মহকুমা শাসকের অভিজ্ঞতার সাথে অদ্ভুত ভাবে মিলে যাচ্ছিল ত্রিখণ্ডিত আধুনিক ভারতের আরেক মহকুমা শাসকের অভিজ্ঞতা। যেন সময়টা ফারাক কয়েক দশক নয়, কয়েকটা দিন মাত্র। সব তো একই আছে, কিছুই তো বদলায়নি।

 

যত মিল খুঁজে পাচ্ছিল, ততো উৎফুল্ল হয়ে উঠছিল আমার বর। এক আধ পাতা পড়ছিল আর বই বন্ধ করে আমায় সবিস্তারে শোনাচ্ছিল মিত্তির মশাই(🙏🏼) এর গপ্প। সেদিন , "মধ্যসত্ত্বভোগী" শব্দটার সাথে যেন নতুন করে আলাপ করিয়ে দিলেন মিত্র সাহেব। সেকালেও প্রান্তিক চাষী থেকে গেরস্থের পাতে পৌঁছাতে যেকোন ভূমিজ পদার্থকে পেরোতে হত, একাধিক মধ্যসত্ত্বভোগী। লাভের গুড় খেয়ে মেদুল হত এই সম্প্রদায়, এদিকে সোনার ফসল ফলিয়েও নিকষ তিমিরে তলিয়ে যেত প্রান্তিক চাষী। ওদিকে বাজারে লাগত আগুন, সংসার টানতে নাভিশ্বাস উঠত মধ্যবিত্তের। এই মধ্যসত্ত্বভোগীদের সংখ্যা ছিল, এলাকা ভেদে বিভিন্ন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বাখরগঞ্জ এলাকায়  ৬৪ জন (সম্ভবত) মধ্যসত্ত্বভোগীর গল্প শুনিয়েছিল লেখক। 


এই গল্প শোনার কিছুদিনের মধ্যেই একটা নালিশ জমা পড়ল আমার দপ্তরে। নালিশ নয়, আর্জি বলতে পারেন। আমার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য, ডিএম সাহেবকে চিঠি লিখলেন এক বৃদ্ধ নির্মাণ কর্মী। আমি নাকি ইচ্ছা করে তাঁর পেনশন আটকে দিই, আমি নাকি তাঁর স্বর্গীয় স্ত্রীর মৃত্যুকালীন অনুদানেও ভাগ চেয়ে পাঠাই। তাও অগ্রিম, কড়কড়ে পাঁচটি হাজার টাকা আমার মনোনীত ব্যক্তিকে দিলে তবে ছাড়া হবে বৃদ্ধার অনুদান। 


চিঠিটা পড়ে বুঝেছিলাম, বজ্রাহত কাকে বলে। "ম্যাডাম" শব্দটা না লিখলে, চিঠিটা আমি হয়তো পাত্তাও দিতাম না। গুজব ভেবেই উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু এই চেয়ারে যে একজন মহিলা আধিকারিক আছে, এটা একটা বুড়ো প্রান্তিক নির্মানকর্মীর তো জানার কথা নয়। 


অতঃপর তদন্ত কমিটি গঠন এবং ইন্সপেকশন। ইন্সপেকশন অন্তে আমার তিন ইন্সপেক্টর ভ্যাবলার মত বসেছিল। " ম্যাডাম, কত জন যে জড়িত আছে, স্তরে, স্তরে।" আরেকপ্রস্থ সেদিন আলাপ হল যেন এই মধ্যসত্ত্বভোগী শব্দটার সাথে। থানা পুলিশ যা করার সে তো আমরা করলামই, আর ঠিক করলাম, এবার থেকে আমার সইয়ে যে যা পাবে, তাকে একটি বার কষ্ট করে পদধূলি দিতেই হবে গরীবের আপিসে। মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যতিরেকে সামনাসামনি হব, সরকারী আপিসের লোকজন আর সাধারণ মানুষ। তারপর দেখাই যাক না - 


সম্প্রতি ১২৪ খানা নির্মাণ কর্মী পেনশন অ্যাপ্রুভ হয়েছে আমাদের। আজ তাঁদের ডেকেছিলাম আমরা। উপস্থিতির হার ছিল শতকরা ৮৩%। কিছু মানুষ কখনই প্রথম বার ডাকলে আসেন না। সরকারি আপিস সম্পর্কে যে কি ভীতি এই গাঁয়ের মানুষগুলোর। তার উপর আমাদের নিমতৌড়ির নব্য প্রশাসনিক ভবন এত বড় আর এত ঝাঁ চকচকে, পথ হারিয়ে ফেলে অনেকে। ভয়ে কুঁকড়ে নীচে দাঁড়িয়ে থাকে অনেক বুড়োবুড়ি। লিফটে উঠতে চায় না, ভয় পায়। 


যাই হোক, যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদেরকেই বললাম, পালা পালা করে, কখনও আমি, কখনও ALC নভোনীল বাবু, কখনও বা IMW সৌম্য বা বেদজ্যোতি। বললাম, আজ থেকে আপনারা সকলে আমাদের পেনশনার। এই যে একবার পেনশন চালু হয়ে গেল, আর তা বন্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই। এমনকি আমারও না। তাই কেউ যদি পেনশন বন্ধ করে দেবার ভয় দেখায়, হুমকি দেয়, মোটে ভয় পাবেন না। প্রয়োজনে আমাদের লিখিত ভাবে জানাবেন। তারপর আমরা দেখব ব্যাটাকে। বললাম, তবে হ্যাঁ, আপনার পেনশন আপনি কিন্তু বন্ধ করতে পারেন। যদি সময়মত বেঁচে থাকার প্রমাণপত্র জমা না করেন। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানের সার্টিফিকেট, আধার আর ব্যাংক পাশবুক এর ফটোকপি নিয়ে মনে করে বছরে একবার আসুন আর সারা বছর নিশ্চিন্তে থাকুন।নিয়মিত দিলে আর আমার কাছে আসতে হবে না, আপনাদের ব্লকে স্থিত শ্রম দপ্তরের আপিসেই দিবেন। এই ইন্সপেক্টর সাহেবদের কাছে।  


বললাম, ভালো করে শুনুন পেনশন চালু হবার অর্থ হল, আপনারা আপাতত ৬০তম বছরের পেনশন টুকু পেয়েছেন। লাইফ সার্টিফিকেট জমা করার সাথে সাথে,যার যতটুকু বিলম্ব হয়েছে পেনশন পেতে, সে ততোদিনের পুরো টাকাটা পাবেন। সেটা অনেক টাকা কিন্তু। একাউন্ট ফেটেও যেতে পারে হয়তো। তখন কেউ যদি অফিসের/ আমার/ ALC সাহেবের/ IMW সাহেবের নাম করে টাকা চায়, দয়া করে দেবেন না। বরং আমাদের লিখিত ভাবে জানাবেন,আমরা তার বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।


ক্ষুদ্র আপিস আমাদের, সাধ আকাশ ছোঁয়া হলেও, সাধ্য বড়ই সীমিত। তবুও, চেষ্টা তো করি, আধিকারিক থেকে প্রান্তিক সুবিধাভোগীর মধ্যে সেতু বন্ধনের। বাকিটা না হয়, সময়ের হাতেই ছাড়া থাক  -


No comments:

Post a Comment