অনির ডাইরি ৩১শে মে, ২০২৫
#অনিরডাইরি
এই তো গতকাল বিকালের কথা, শনিবারের ভাতঘুম শেষে, এককাপ ধূমায়িত কফি হাতে, একরাশ সংকোচ সহ শৌভিক বলল, " আচ্ছা, আমরা যে কাল যাচ্ছি, ওনারা জানেন তো?" ওনারা অর্থাৎ আমার বৃদ্ধ মাতাপিতা।
হতভম্ব হয়ে জানতে চাই, কেন তোকে ওরা যেতে বলেনি? শৌভিক ঘাবড়ে গিয়ে বলে,"না না, যেতে বলার দরকার নেই। শুধু জানতে চাইছি, ওনারা জানেন কি না।" বরকে আর কিছু বলি না আমি, বুঝি জামাইষষ্ঠীতে জামাইকে আসতে বলতে নির্ঘাত ভুলে বসে আছে আমার বুড়ো বাপমা। এমনিতে আমার বরের কোন জামাইসুলভ ঘ্যাম নেই, আমি বললেই যথেষ্ট, তবুও -
ইদানিং প্রায়ই মনে হয়, তুত্তুরীর পাশাপাশী এই অশীতিপর দম্পতিরও মা হয়ে উঠেছি আমি। বিশ্বাস করুন, বাবা মায়ের বাবা-মা হয়ে ওঠাটা মোটেই খুব সহজ কাজ নয়। মায়ের মা হয়েই ফোন করি মাকে, " হ্যাঁ গো, কাল শৌভিককে যেতে বলো নি -"। একরাশ অভিযোগ নিয়ে ফোনটা ধরেছিল মা, " তোর বাবা আমায় এত কটু কথা শোনাচ্ছে -"। বলতে বলতে হঠাৎ থমকে যায়, " বলেছি তো। সেদিন যে বললাম রবিবার এসো বাবা।"
সেদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার, মাকে নিয়ে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে হাওড়া গিয়েছিলাম আমি। আবহাওয়ার অবস্থা দেখে অফিস ফেরৎ আমাদের আনতে গিয়েছিল শৌভিক। সেদিন মা বলেছিল বটে, কিন্তু বাকি আলোচনায় চাপা পড়ে গিয়েছিল সেই নিমন্ত্রণ। আরেকবার ফোনে বলে দিতে বলে, শুধাই, বাবা তোমায় কটু কথা শোনায় কেন? জবাব আসে, " চা বসিয়েছি, তাই তোর ফোন ধরতে পারিনি। তাই -"। মায়ের ফোন ধরা আর বঙ্গলক্ষী লটারিতে প্রথম পুরষ্কার পাওয়া প্রায় একই, বর্ষীয়ান দম্পতির দাম্পত্য কলহে তাই আর ঢুকি না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে মহানগরের বুকে, এখনও কেনা হয়নি জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে শাশুড়ির উপহার। সময় পেলাম কই। সকাল থেকে পরিকল্পনাই করে চলেছি দোঁহে, কি কেনা যায়। সময়াভাবে শৌভিক অনলাইন অর্ডার দেওয়ার পক্ষে। কয়েক বছর আগেও তিন তিনটে উপহার কিনতাম আজকের দিনে। উপহার মানে শাড়ি। জ্যাঠাইমার জন্য সাদা, মা আর পিসির জন্য উজ্জ্বল রং। বিশের বছর কেড়ে নিয়েছে আমার জ্যাঠাইমাকে।
ঘড়িতে সন্ধ্যা সাত, এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি কি কিনব আমরা। শাড়িই কিনব কি? বেশি দেরি করলে বন্ধ না হয়ে যায় দোকানপাট। এতক্ষণ নির্বাক বসে থাকা শাশুড়ি মাতা হঠাৎ মৌন ব্রত ভঙ্গ করে বলে ওঠেন, " আজ আমাদের বিয়ের দিন -"। সুঁচ পড়লেও বুঝি শোনা যাবে এই মুহূর্তে। হতভম্ব হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাই আমরা। জানি তো, কিন্তু শ্বশুরমশাইকে ছাড়া এটা যে ওনার প্রথম বিবাহবার্ষিকী। তাই মনে থাকা সত্ত্বেও কিছু বলিনি আমরা -
নীরবে বসে থাকি আমরা। বৃদ্ধার মনে থাকল কি করে? এত বছর তো কোনদিনও মনে রাখেননি। এই নিয়ে বড় দুঃখ ছিল শ্বশুর মশাইয়ের। প্রায়ই বলতেন, " তোমাদের মায়ের কিছু মনে থাকে না -"। সত্যিই কিছু মনে থাকে না ওনার, নিজের বা শ্বশুরমশাইয়ের জন্মদিন, বিয়ের দিন, ছেলেদের জন্মদিন, নাতনীদের জন্মদিন কিচ্ছু না। বৃদ্ধের ও যে মনে থাকত, তা নয়, একটা ডায়েরিতে সব লিখে রাখতেন বৃদ্ধ। কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠেই উল্টাতেন সেই ডায়রির পাতা। তাই আমাদের জন্মদিন হোক বা বিয়ের দিন প্রথম ফোনটা শ্বশুরমশাই'ই করতেন। এমনকি জন্মদিনে আমার বাবাকেও প্রথম ফোনটা ওনারই হত।
শ্বশুরমশাইয়ের জন্যই সেলিব্রেট করতাম আমরা। সেলিব্রেশন আর কি, একটা কেক, একটু মিষ্টি। তুত্তুরীর হাতে আঁকা একটা ইকড়িমিকড়ি কার্ড আর স্মৃতিচারণা ব্যাস এইটুকুই। তাতেই কি যে খুশি হয়ে যেত বৃদ্ধ। নীরবে অংশ নিতেন শাশুড়ি মাতা, কোনদিন দেখাতেন না কোন উচ্ছ্বাস। আর আজ -
ঠিক এই গল্পই তো শুনিয়েছিল সদ্য মাতৃহারা এক বন্ধু কিছুদিন আগে। " জানিস অনি, আজ আমার বাবা মায়ের বিয়ের দিন। বাবাকে ফোন তো করেছিলাম, কিন্তু বিবাহবার্ষিকীর কথা কিছু বলিনি আমি। বাবার সাধারণত এইসব কিছু মনে থাকে না। সারাজীবন মাই মনে রেখেছে। আর আজ যখন মা নেই,বাবা বলল কি জানিস - বললে, ' আজ তো আমাদের বিয়ের দিন।'" কুশীলব ভিন্ন বটে, চিত্রনাট্য একই। উভয়েই মিস করছেন হারিয়ে যাওয়া জীবন সঙ্গীকে, যাদের কখনও ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেননি যে ভালোবাসার তীব্রতা উভয়পক্ষেই এক সমান। কেন যে দেননি, কেন যে মানুষ সময় থাকতে বলে না - আমিও তোমায় ভালবাসি।
শৌভিককে বলি একটু মিষ্টি নিয়ে আয়, আমি একছুটে কিনে আনি দুটো শাড়ি,বেশি দেরী করলে বন্ধ না হয়ে যায় দোকানপাট। তারপর চটপট বানিয়ে ফেলব অন্যরকম কিছু। ঘরোয়া ভাবেই হোক না আজ সেলিব্রেশন। জানি শ্বশুরমশাই নেই, থুড়ি তাঁর নশ্বর দেহটা নেই, কিন্তু তিনি আছেন তো বটেই। আশেপাশেই আছেন। এত বছরের ভালোবাসার বাঁধন কাটা কি এতই সোজা -।
অনির ডাইরি ২৭ মে, ২০২৫
#অনিরডাইরি
"তোর পক্ষে কি আর মানুষ হওয়া সম্ভব নয়?" প্রশ্নকর্তাকে একটু আগেই বলেছি, বেশি না, মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ধরে নিই তুই আমায় চিনিস না, আর আমি তোকে চিনি না। আর আমি অপ্রয়োজনে পরপুরুষের সাথে বার্তালাপ করি না। তারপর থেকে তিনি শুরু করেছেন, " কিন্তু আমি করি। এই যে পরনারীর হার, এটাকে আমি জানলা গলিয়ে ফেলে দিই - । এই যে চুলের ব্যান্ড কি বলে যেন স্ক্রাঞ্চি, এটাকেও ফেলে দিই -"।
একে তো আমি চূড়ান্ত অগোছালো, হদ্দ কুঁড়ে, তারওপর বাড়িটাও হয়ে আছে যেন আস্তাকুড়। মহানাগরিক তিন কামরার ফ্ল্যাটে থেকে কখনও যদি সারাইসুরাইয়ের কাজ করিয়ে থাকেন তো বুঝতে পারবেন আমাদের বাড়ির অবস্থা আপাতত কি সাংঘাতিক। যা গুচাই, যতটুকু গুছাই, অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি সব লণ্ডভণ্ড। এই হট্টমন্দিরে আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যে কোথায় রাখি, তাই নিয়েই লেগেছে দাম্পত্য অশান্তি। সেই সন্ধ্যা থেকে, আর নেওয়া যাচ্ছে না বাপু -
এর ওপর আছেন আমার গর্ভধারিনী। দাম্পত্য কলহে জর্জরিত, পথশ্রমের ক্লান্তিতে সম্পৃক্ত হয়ে রাতের রান্না বসিয়েছি এমন সময় তাঁর ফোন, " হ্যাঁরে তুই আমার ফোন টা রিচার্জ করে দিস নি? এই তো মেসেজ পাঠাচ্ছে ১৭ তারিখে রিচার্জ করার দিন ছিল -"। শাশুড়ি মাতা আজ দুধ রুটি দিয়ে উদর পূর্তি করে নিয়েছেন। রান্না কেবল আমাদের দুইজনের জন্য এবং রান্না খুবই সাদামাটা, চীজ ম্যাগী আর ডবল ডিমের পোচ। কিন্তু রান্না ঘরটার এমন অগোছালো দশা যে ঢুকেই কান্না পাচ্ছে। তার ওপর মায়ের ফোনে রীতিমত ব্যোমকে গিয়ে আমাজন ঘেঁটে দেখি, কই রিচার্জ করার রিমাইন্ডার তো দেয়নি। ফোন ও তো দিব্যি ঢুকছে, তাহলে হল কি?
মা কেবল বলেই যাচ্ছে, " কিচ্ছু নড়ছে না। একটাও ছবি খুলছে না/রিল দেখতে পাচ্ছি না।" ভগবান এই ভদ্রমহিলাকে কেন যে আমি ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম। রিল না ড্রাগ কে জানে। বাড়ির কাজ হচ্ছে বলে শ্রীমতী তুত্তুরীকে আজ প্রায় দিন দশেক হল পিত্রালয়ে রেখে এসেছি। উদ্ধারকর্তা হিসেবে তাঁকেই ফোন করি আমি। আমাজন তো বলছে এখনও একমাস বাকি রিচার্জ করতে, কেসটা কি বাঁধালেন ভদ্রমহিলা। ডেটা অফ করে বসে নেই তো? ফোন রিস্টার্ট করে, অনেক ঘেঁটে ঘুটে দেখা গেল তিনি সিম ম্যানেজার থেকে সিম ১ আর সিম ২ এর ফাংশন বদলে বসে আছেন।
যুগপৎ মা এবং বরের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে তুত্তুরীর ফাঁকা ঘরে আলো নিভিয়ে বসে আছি আমি। মনে পড়ছে সারাদিনের হরেক স্মৃতি। অনেক দিন বাদে দেখা হল ছেলেটার সাথে।কর্মসূত্রে আলাপ হলেও খুব ভালোবাসি ছেলেটাকে, ভালবাসি ওর গোটা পরিবারটাকেই। তাই ছেলেটার, " কেমন আছেন ম্যাডাম"এর জবাবে, শতেক প্রশ্ন করেছিলাম আমি, " তুমি কেমন আছ? মা কেমন আছেন? বউ কেমন আছে? ছেলে কেমন আছে? ছেলেটা কতবড় হল -"… ইত্যাদি প্রভৃতি। প্রতিটা প্রশ্নেরই সোৎসাহে জবাব দিয়েছে ছেলেটা। সাথে জানিয়েছে আরো অনেক খবর। ভাইয়ের বিয়ের খবর, জেঠু হবার খবর।
আরেঞ্জড ম্যারেজ ছেলেটার। মেয়ে দেখতে গিয়ে জানতে পারে, হবু বউ বয়সে কয়েক মাসের বড়। অজ গাঁয়ের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও বয়সের পার্থক্য জেনে পিছিয়ে আসেনি ছেলেটা। ফিরে এসে বাবাকে - মাকে জানিয়েছে সত্যিটা, সাথে এটাও জানিয়েছে বিয়ে করবে তো এই মেয়েটাকেই করবে, তবে বাবামায়ের আশীর্বাদ এবং অনুমতি সহ। ছেলেটির বাবা মা বিন্দুমাত্র আপত্তি করেনি, এটা শুনে ইস্তক গোটা পরিবারটার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গিয়েছিল।
আজও মনে আছে ছেলেটা বলেছিল, " আমি তো তেমন লেখাপড়া শিখিনি ম্যাডাম, কিন্তু আমার বউ গ্রাজুয়েট। খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছে, লোকের কাছে চেয়েচিন্তে, বই মেগে এনে পড়েছে কিন্তু পাশ তো করেছে।" মেয়েটার ইচ্ছে ছিল সরকারী চাকরি করবে, শিক্ষিকা হবে। সব ইচ্ছা তো আর পূরণ হয় না। ঐ যে অনুপম রায় বলেছে না, "সব পেলে নষ্ট জীবন"। মেয়েটার ছোটবোনটা অবশ্য এত পড়াশোনা করার দিকে যায়নি। ষোড়শী হতে না হতেই পাশের গাঁয়ের সমৃদ্ধশালী পরিবার থেকে তার বিয়ের সম্বন্ধ আসে এবং দিদি জামাইবাবু দাঁড়িয়ে থেকে তার বিয়ে দিয়ে দেয়।
খবরটা শুনেই বলেছিলাম, কাজটা ঠিক করোনি বাপু। বেআইনি কাজ করেছ। নেহাৎ তখন আমি তোমাদের চিনতাম না, চিনলে আমি খোদ ডিস্ট্রিক চাইল্ড প্রোটেকশন ইউনিটকে খবর দিতাম। ছেলেটা বিস্তর মাথা চুলকে বলেছিল, " কি করব ম্যাডাম। বাপ মরা মেয়ে। আমার শাশুড়িটাও তো তেমন জবরদস্ত নয়। কেমন যেন ন্যালাক্ষ্যাপা -। আমাদের ওপর নির্ভরশীল।"
আজ তাঁরও খোঁজ নিলাম, " তোমার শাশুড়ি মা কেমন আছেন?" ছেলেটা কিঞ্চিৎ বিমর্ষ হয়ে বলল, "শাশুড়ি মা তো আর নেই ম্যাডাম। মাস ছয় সাত হল -"। আমার হিসেব মত ভদ্রমহিলার বয়স কোনমতেই ৫০/৫২ র বেশী হতে পারে না। এত অল্পবয়সে কি ভাবে চলে গেলেন? ছেলেটা বলে, " বেশ কিছুদিন ধরেই মাথাটা ঠিক ছিল না। খড়গপুরে একটা আশ্রম আছে ওখানে দিয়েছিলাম। ওরা মাসে ৭ হাজার টাকা নেয়, খাওয়াদাওয়া, ওষুধপথ্য সব ওরাই দেয়। কিন্তু মাসে মাসে এত টাকা দেওয়া কি আমাদের মত ঘরে চাটটি খানি কথা বলুন ম্যাডাম। মাস সাতেক পরে ছাড়িয়ে আনি। এমনিতে ভালোই ছিল। কথা বার্তা ভালোই বলত। ফিরে এসে একাই থাকত। আমার বউ রবিবার করে গিয়ে থেকে আসত। আমিও যেতাম, গিয়ে সপ্তাহের বাজার দোকান করে দিয়ে চলে আসতাম। বউ সোমবার আসত-।"
"আর তোমার শালী -", মাঝ পথে কথা থামিয়ে জানতে চাই আমি। ছেলেটা বলে, " শালী যে কিছু করেনি তা বলব না। করেছে - রোজ রাতে রান্না করে দিয়ে আসত মাকে। তো সেবারে হয়েছে কি, আমার বউ রবিবার গিয়ে থেকে সোমবার ফিরে এসেছে। মঙ্গলবারও ওর কথা হয়েছিল মায়ের সাথে। বুধবার থেকে আর ফোন ধরে না। শুক্রবার প্রতিবেশীরা খবর দিল -। রাতে রান্না করে বোধহয় বাসন মাজতে যাচ্ছিল। তখনি পড়ে গিয়ে -।"
মানে? আঁতকে উঠি আমি, " বুধবারে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন, শুক্রবারে পড়শীরা দেখতে পায়?" ছেলেটি বিষণ্ন ভাবে মাথা নাড়ে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলি আমি, " আর তোমার শালী? সে রাতে খাবার দিতে যায়নি?" ছেলেটি ঢোঁক গিলে বলে, " শেষের দিকে আর খাবার দিতে যেত না। আসলে ম্যাডাম, আমার শাশুড়ি মা বিধবা ভাতা পেত তো। মাসে হাজার টাকা। তাতে কি একটা মানুষের পেট চলে আপনি বলুন? আমার ষাঁড়ু ভাইয়ের এতেই রাগ, শালীকে বলেছিল, ' ওরা তোমার মায়ের সব টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, ওরাই দেখবে। একদম আমাদের বাড়ির খাবার ওবাড়ি পাঠাবে না।'
তুত্তুরীর ঘরের অন্ধকারে বসে এখনও ততোটাই কেঁপে উঠি আমি, যতটা খবরটা শুনে কেঁপেছিলাম। এক সম্পূর্ণ অপরিচিতা জননীর কথা শুনে। আহা সত্যিই কি পড়ে মরেছিলেন তিনি? নাকি বেঁচেছিলেন বেশ কিছুক্ষণ? আশা করেছিলেন শেষবারের মত এক ঝলক দেখবেন নিজের আত্মজাদের -। পথের পাঁচালীর ইন্দির ঠাকুরুনের শেষ মুহূর্তটার কথা কেন যে বারবার মনে পড়ছে আর ছাপিয়ে যাচ্ছে দুই চোখ। খুব সুসন্তান নই আমি, প্রায়ই রেগে যাই মায়ের ওপর, মেজাজ দেখাই, হাঁপিয়ে উঠি মায়ের আব্দারে, দু দুটি বাড়ির দায়িত্বে, কিন্তু এ অবহেলা যে আমার স্বপ্নের অতীত। হে ঈশ্বর, মেয়ে হয়ে জন্মানোর অজুহাতে যারা ব্যস্ত থাকে নিজের সংসারে, অবহেলা করে নিজের বৃদ্ধ অসহায় জনক জননীকে, তুমি তাদের ক্ষমা করো। আর শৌভিক আর আমি যখন বুড়ো হব, প্লিজ একটা ভালো বৃদ্ধাশ্রম খুঁজে দিও আমাদের জন্য। শৌভিকের নাম করতে মনে পড়ল, অনেক হয়েছে। যাই পরপুরুষকে আবার ঘরপুরুষ বানাই। সে ছাড়া আর আছে কে -
অনির ডাইরি ২১ শে মে, ২০২৫
#অনিরডাইরি
" হায় বৌদি, তুমি এই আয়নাটা ফেলে দিবে নাকি?" হতবাক হয়ে শুধায় মেয়েটা। দেখে আমাদের থেকে অনেক বড় মনে হয়, আসলে কিছুটা ছোটই হবে। রোদে জলে খেটে খাওয়া মানুষের ত্বকের বয়স বাড়ে একটু জলদি, আর এই মেয়েটা তো কোন সাজগোজও করে না। রং জ্বলা ম্যাক্সির মত কি যেন একটা পরে গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা। মাথায় বিবর্ণ একটা সুতির ওড়না হিজাবের মত পরা। আজ দুই সপ্তাহ ধরে দেখছি মেয়েটার এই এক সাজ।
আয়নাটা আমাদের বিয়েতে পাওয়া উপহার। ফ্রেমটা ভীষণ সুন্দর দেখতে, কিন্তু কাঁচটার পারা উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। তাই নীচে নামিয়ে রেখেছি। মেয়েটা যেভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে, বলি, তোমার পছন্দ তো তুমি নিয়ে যাও না। মেয়েটা লজ্জা পেয়ে জিভ কেটে বলে, " আমি তো সাজগোজ করি না সোনা। লিয়ে গিয়ে কি করব?"
বলি,কেন করো না। মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ে,প্রায় বধির শাশুড়ি মায়ের গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে, " শুনতেছ কাকিমা, তোমার বউমা কি কয়? আমারে সাজতে বলছে। আমি বলে তালাকশুদা মেয়েমানুষ -"। মেয়েটা যে ডিভোর্সী আমি সত্যিই জানতাম না। বাড়ির গল্প খুব একটা করে না মেয়েটা, অবশ্যি আমার সাথে গল্প করার সময় ওর কোথায়। সেই কাক না ডাকা ভোর থেকে খাটতে বেরোয়, অনেক বাড়ি কাজ করে। কাজ বলতে বাসন মাজা, ঘর ঝাড়ামোছা, বাজার করা এইসব। দুপুর বেলা এক প্রস্থ কাজ সেরে বাজার থেকে ঝড়তিপড়তি সবজি দরদস্তুর করে কিনে বাড়ি গিয়ে রান্না করে, রান্না খাওয়া মিটলে টিউশনি করে, অনেক গুলো গুড়িগুড়ি বাচ্ছাকে আরবি পড়ায়। টিউশনি মিটিয়ে আবার বিকালের কাজে বেরোয়। বেশ বর্ণময় চরিত্র বলতে পারেন।
স্বনির্ভর সবলা নারীদের আমি বরাবরই অনুরাগিনী। আর এতো শ্বশুরমশাই জীবিত থাকাকালীন ওনার বাড়িতেও কাজ করত, ফলে আমার সাথে সখ্য জমতে বেশি দেরী হয়নি। গল্পের বেশিটা জুড়ে থাকেন স্বর্গীয় শ্বশুরমশাই। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে বৃদ্ধ কার হাতে জল খেয়েছিলেন এই নিয়ে একটা দ্বৈরথ আছে। ও বাড়ির ২৪ ঘণ্টার আয়া মাসি দাবী করেন, " মেসোমশাই আমার হাতে জল খেয়ি স্বর্গে গেছেন" আর এ বলে, "কাকু আমার হাতে পানি খেইয়ে তোমাদের বেহেশতে গেছেন।"
মাঝে মাঝে নিজের কথাও বলে মেয়েটা, যেমন সেদিন বলল, " আমি ইচ্ছে করে এত খাটি বৌদি, নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য। যেদিন গতর চলবে না, আমারে যে দেখার কেউ নেই। আমার দুটো মেয়ে, তাদের বিয়ে দিয়েছি, আল্লাহ যেন আমারে তাদের বোঝা না বানায়।"
একদিন বলল, " এই যে সবজি দেখছ বৌদি, এই সব আমি বাড়ি গিয়ে রাঁধব। বাড়িতে আমার দিদি আছে, সেও এই আবাসনে কাজ করে, কিন্তু ঐ লোকের বাড়িতেই করে, নিজের বাড়িতে কুটোটাও লারে না। আমি না রাঁধলে, না খেয়েই বসে থাকবে।" একদিন বলল, " বাড়িতে দুটো কুমড়ো গাছ লাগাইছি বৌদি, কি সোন্দর দুটো কচি কুমড়ো ধরিচে। তবে ভাড়ার বাড়ি তো, গাছ লাগিয়ে সুখ নাই।" এইসব ছুটকোছাটকা বার্তালাপ থেকে মেয়েটার জীবনের খণ্ডচিত্র পাই আমি। আর দেখি এই ঘেন্না বিধ্বস্ত উপমহাদেশে দুই ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন অর্থনৈতিক স্তরের মহিলার মধ্যে কতটা চিন্তা ও চেতনার মিল।
মাঝে দুদিনের ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছিল মেয়েটা,বাবাকে দেখতে। যাবার দিন আমার সাথে দেখা হয়নি, আজ তাই জমিয়ে গল্প করার মুডে মাটিতে বসেছে মেয়েটা। ইশারায় বলি, সোফায় বস। শাশুড়ি মাতা এতক্ষণ গম্ভীর মুখে সোফায় বসে কাগজ পড়ছিলেন, চেনা মেয়েটার সাহচর্যে তাঁর মুখেও কিঞ্চিৎ হাসির আভা দেখা দেয়। মেয়েটা বলে, " সরি গো বউদি, তোমারে বলে যেতে পারিনি।" অসুবিধা হয়নি, শাশুড়ি মাতার আয়া মেয়েটি বড়ই কর্মঠ, দিব্যি সামলে দিয়েছে। জানতে চাই, তোমার বাবাকে কেমন দেখলে? মেয়েটি বলে, " বাবা? বাবা ঠিকই আসে। আমি বাবাকে দেখতে যাইনি তো বউদি, আমাদের বাড়িতে ঐ যে তোমাদের যেমন হরিনাম সংকীর্তন হয় না, অমনি আসর বসছিল। আমরা বলি মিলাদ। তাও যেতুম নি। বলেই দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ছোট ভাইপোটা ফোন করে এমন আব্দার করতে লাগল। ছেলেটা আমায় বড় ভালোবাসে বৌদি। আমায় কি বলে ডাকে জানো, ' মেয়ে'। কদিন ধরে আমার সাথে লেউটে ছিল। এক দণ্ডের জন্য ও ছাড়ে নি। আজ ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে পালিয়ে এয়েছি, সমানে ফোন করছে আর কাইঁদছে, ' আমার মেয়ে কোথায় গেল ' করে।"
হেসে বলি, তাহলে তো বাপু তুমি তোমার বাবাকেই দেখতে গিয়েছিলে। তা এই নতুন বাবাটার বয়স কত? জবাব আসে, ছয় বছর মাত্র। শুধাই কোথায় থাকেন তিনি? জবাব আসে হারোয়া। মেয়েটি গড়গড় করে বলে চলে, " এমন কিচু দূর লয় বৌদি, বাসে এক ঘন্টা। কিন্তু আমি তো বাসে চাপতে পারি না। অটো পাল্টে পাল্টে যাই। অনেক সময় লাগে। টাকাও খরচ হয় তেমন।" বলি, বাসে যাও না কেন? মেয়েটি হেসে কুটোপুটি হয়ে বলে, " বাসে উঠলেই আমি বমি করি গো। অটোতেও করি, তবে একটু কম।"
কথা বলতে বলতে উঠে পড়ে মেয়েটা। বুঝি সময় শেষ, এবার বাড়ি গিয়ে রান্না চড়াবে। বুড়ো আয়নাটার গায়ে মায়া মাখানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠিক করে নেয় মাথার হিজাব। আবার বলি, আয়নাটা তুমিই নিয়ে যাও বরং। মেয়েটা জিভ কেটে বলে, " দূর কি হবে। আজ থেকে বাইশ বচ্ছর আগে আমার বিয়ে হয়েছিল, ওরা লোক ভালো ছেল না। আমার আব্বু শেষে গিয়ে আমার তালাক করিয়ে আনে। সেই সময় আমাদের পরিবারে আর একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। আমার বড় বৌদি, দুটো দুধের বাচ্ছা ফেলে গায়ে আগুন দিয়ে মরি যায়। আমি তখন সেই বাচ্ছা দুটোকে আপন করে নিই।" অবাক হয়ে বলি, তোমার দুটো মেয়ে - , মেয়েটা ৩২ পাটি বার করে বলে, " আসলে আমার ভাইঝি। কিন্তু আমি কোনদিন ওদের মায়ের অভাব বোধ করতে দিইনি। বাপেরও না। ল্যাখাপড়া শিখিয়েছি, বে দিয়েছি। আজ আমি মুক্ত।"
মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলি, ভালোই তো। এবার নিজের কথা ভাব। তোমাদের সমাজে তো তালাক হওয়া/ বিধবা/ বিপত্নীক মানুষজন পুনর্বিবাহ করেই থাকে। বয়সটা কোন সমস্যাই নয়, আমার পরিচিত কিছু মানুষই করেছেন। বেশ ভালো আছেন। তোমাকেও নির্ঘাত অনেকে বিয়ে করতে চায়। রহস্যময় হেসে মেয়েটা বলে, "তুমি প্রথম নও যে আমার বিয়ে দেবার চেষ্টা করছ বৌদি। আর একজন ও উঠে পড়ে লেগেছিল কয়েক বছর আগে, কে বলো তো?" বেশ খানিকক্ষণ ঝুলে থাকে সাসপেন্সের পর্দা, তারপর হাসতে হাসতে বলে, " কাকিমা গো। কাকিমা। এই যে তোমার শাশুড়ি মা।"
অনির ডাইরি ১৯ মে, ২০২৫
#অনিরডাইরি
ঘড়ি বলছে প্রায় পৌনে দুই। মাথার উপর দেদীপ্যমান মধ্যাহ্নের সূর্য, তবে গরম যতটা লাগার কথা, ততোটা কিন্তু লাগছে না। একরাশ ঘণ কালো মেঘ যখন তখন এসে ঢেকে দিচ্ছে সূর্যি মামার মুখমণ্ডল।
রাস্তাটা পেরিয়ে উবের ধরলে, পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখেছি অন্তত ৩০/৪০ টাকা কম বিল ওঠে। আজ বরকে সেকথা বলতে গিয়ে হাসির খোরাক হলাম। দীর্ঘ চার/সাড়ে চার বছর পূর্ব মেদিনীপুরবাসী আমি, নিজেকে বড় গ্রাম্য বোধহয় আজকাল। সংকুচিত ভাবে ড্রাইভারকে শুধাই, " ভাই এসি চালাবে তো?" বছর চার পাঁচ আগে মোটেই চালাতে চাইত না ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভার কুল। বললেই বলত অ্যাপে দেখানো ভাড়ায় নাকি এসি চলে না। ঝগড়া করলে নামার সময় ওয়ান স্টার দিত। তৎকালীন টুইটারে ভুরি ভুরি নালিশ করতাম, ফলাফল লবডঙ্কা। গিগ ইকোনমির এটাই তো মাধুর্য -
আজ অবশ্য সে সমস্যা হল না। একে রবিবার, তায় গরমের আতঙ্ক ফলে পথঘাট প্রায় শুনশান। ট্রাফিক বাতির মৃদু শাসন মেনেও দুদ্দাড় করে ছোটে গাড়ি। আমাদের গন্তব্য কেওড়াতলা মহাশ্মশান। গতকাল ভোর রাতে চলে গেছেন শৌভিকের মেজ জেঠিমা। সকাল সকাল খবর পেয়েও যেতে পারিনি আমরা, কারণ একই সাথে ইলেকট্রিক আর রাজমিস্ত্রিদের ডাকা ছিল। দীর্ঘ সাড়ে চার বছরের অনাবাসে ফ্ল্যাটটা হয়ে উঠেছে হানা বাড়ি। কিছু কাজ না করালেই নয়।
তাদের ঝটিতি বিদায় করে, প্রায় বধির শাশুড়ি মাতাকে খাইয়েদাইয়ে তবে বেরিয়েছি আমরা। জীবনে প্রথমবার শ্মশানে চলেছি আমি, বুকের মধ্যে কুয়াশার মত ছড়িয়ে পড়ছে মৃদু আতঙ্ক। ফাঁকা ভিআইপি রোড ধরে ছুটতে ছুটতে লেকটাউন থেকে বাঁ হাতের উড়ালপুল ধরে ইএম বাইপাস, মানিস্কোয়ার, সায়েন্স সিটি হয়ে মা ফ্লাইওভার।
পথের দুধারে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ আর ধান ক্ষেত দেখতে অভ্যস্ত আমার পূর্ব মেদিনীপুরিয়া চোখ ঝলসে যায় মহানগরের জৌলুসে। যতদূর চোখ যায়, কেবল বহুতল আর বহুতল। কি তাদের রূপ, কি তাদের চাকচিক্য। চলন্ত গাড়ি থেকে ঘাড় বেঁকিয়ে তল গুনতে গিয়ে বার বার পর্যুদস্ত হই আমি। চুপ করে বসে থাকে শৌভিক, হয়তো বুঁদ হয়ে থাকে শৈশবের কোন স্মৃতিতে। বহরমপুর থেকে যখন রাতারাতি সল্টলেকে বদলী হলেন শ্বশুরমশাই, শৌভিক তখন সপ্তম শ্রেণী। আর পাঁচটা বদলী হয়ে আসা সরকারী কর্মচারীর মতোই আবাসনের জন্য আবেদন করলেন শ্বশুর মশাই। জানা গেল পাওয়া যাবে বটে, কিন্তু এখুনি না। সময় লাগবে বেশ কয়েক মাস, এদিকে শুরু হয়ে গেছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। তখন ঐ কয়েকমাসের জন্য ছোট ছেলেকে নিয়ে নিয়ে বহরমপুরের ভাড়া বাড়িতেই রয়ে গেলেন শাশুড়ি মা। শালকিয়ার পৈত্রিক বাড়ি থেকে অফিস করতে লাগলেন শ্বশুরমশাই আর শৌভিককে টেনে নিল তার সল্টলেক নিবাসী মেজজেঠু আর মামণি। দুই দিদির সাথে জেঠুর বাড়িতে কাটানো ঐ কয়েকটা মাস আমার বরের শৈশবের অন্যতম প্রিয় স্মৃতি।
পার্ক সার্কাস ফ্লাইওভার থেকে নেমেই বাম হাতে ডিএল খান রোডে ঢোকে গাড়িটা। ১৯৩২ সালে নির্মিত ধনধান্যে সেতু পেরিয়ে ডান দিকে বেঁকে যাই আমরা।এতক্ষণের মৌনতা ভঙ্গ করে , আমায় আলিপুরের ডিএম অফিস চেনায় শৌভিক। পেরিয়ে যায় একের পর এক সুদৃশ্য বাংলো। যার কোনটায় পুলিশের ডিজি থাকেন, তো কোনটায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার। চওড়া রাজপথ থেকে ডান দিকে বেঁকে তুলনামূলক সংকীর্ণ একটা রাস্তায় থামে আমাদের গাড়ি।
নীল সাদা ধাতব দরজা দিয়ে দুরুদুরু বুকে ভিতরে প্রবেশ করি। শ্মশান শুনলেই গল্প উপন্যাস বা সিনেমার যে দৃশ্য ভেসে ওঠে, এক্ষেত্রে অন্তত বাস্তব তার থেকে একেবারেই আলাদা। প্রশস্ত প্রবেশদ্বারের একদিকে পার্ক করা আছে সারি সারি গাড়ি। অন্য দিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিমছাম একটা বাগান। রেলিংয়ের গা ঘেঁষে বসানো গোটা পাঁচেক নারকেল গাছের ছায়ায় বসে গল্প করছে অনেক মানুষ। কারো মুখে শোকের ছাপ নেই, নেই কারো চোখ ভেজা। এরা কি শবদেহের সাথেই এসেছে নাকি স্থানীয় মানুষ এই দুপুরে আড্ডা মারতে এসেছে, বুঝতে পারি না। তবে পরিবেশটা নিমেষে আমার মনের আতঙ্ক কিছুটা কাটিয়ে দেয়।
চতুর্দিকে পরিচ্ছন্নতার ছাপ, এত মানুষ তাও নেই কোন শোরগোল। বাঁধানো রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা গিয়ে বাঁ হাতে গোটা চারেক সিঁড়ি উঠলে একটা বিশাল ঘর। সেই ঘরেই পরপর শোয়ানো আছে মানুষগুলো। মাথার দিকে লোহার রড দিয়ে তৈরি একটা দেওয়াল। দেওয়ালের ওপারে দৃশ্যমান দু দুটো বৈদ্যুতিক চুল্লী। অর্ধবৃত্তাকার লোহার গেট দিয়ে বন্ধ।
মেরুন বা বাদামী রঙের শাড়ি পরেছে মামণি, ম্যাচিং ব্লাউজ। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল এখনও অনেকটাই কালো। ঠোঁটে মেরুন রঙের লিপস্টিক। বিগত পনেরো বছর ধরে পক্ষাঘাত গ্রস্ত মানুষটি আজ বাঁশের বিছানায় সাদা চাদর পেতে অকাতরে ঘুমাচ্ছে। মুখটা সামান্য ফাঁক, ঠিক যেমন করে ঘুমাচ্ছিলেন শ্বশুর মশাই, পাক্কা একবছর আগে। পঁয়তাল্লিশ/ পঞ্চাশ মিনিট লাগে নাকি একেকটা দাহ সম্পন্ন হতে। চুল্লী ফাঁকা হলে একদম বাম দিকে যিনি শুয়ে আছেন, তিনি প্রবেশ করবেন। ডান দিকে যাঁরা আছেন, তাদের সরিয়ে দেওয়া হবে এক ঘর। জাত/ ধম্ম/ অর্থ/ পারিবারিক পরিচয়/ প্রতিপত্তি এখানে এসে মিলেমিশে হয়ে যায় একসমান।
সময় এগিয়ে আসে ক্রমশঃ,বর্ষীয়ান মণিকাকা হঠাৎ বলে ওঠে, " চল একটা প্রণাম করে আসি।" ঘুমন্ত মামণির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ছোট দেওরের দল। মুঠো করে রাখা হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিতে থাকে ছোটদি। বড়দি হাত বুলিয়ে দেয় মুখে, গালে, মাথায়। এই তো শেষ বার। সময় আসন্ন জানিয়ে দেয় শ্মশান কর্মচারী ছেলেটি। স্নেহধন্য পালকপুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্র, দেওরপো, ভাসুরপো, জামাইয়ের দল একে এক সরিয়ে দেয় বুকের ওপর জমা হয়ে থাকা ফুলমালার পাহাড়। মাথার তলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বালিশ। শ্মশান কর্মচারীর ইশারায় তোলা হয় মামণিকে। শোয়ানো হয় চুল্লীর সামনে, সবাইকে সামনে থেকে সরে যেতে বলে দূর থেকে লিভারটা তোলে ছেলেটি, পলকে লোহার দরজাটা উঠে গিয়ে বেরিয়ে আসে একরাশ লেলিহান গাঢ় কমলা রঙের অগ্নিশিখা। দুই হাতে চোখ ঢাকি আমি, স্মৃতিপটে ভেসে আসে কিছুকাল আগে মাতৃহারা এক বান্ধবীর কথা, "আমি কাঁদছি না বলে এরা ভেবে নিচ্ছে আমার কোন শোকবোধ নেই। বিশ্বাস কর অনি, আমিও কাঁদতে চাইছি। কিন্তু পারছি না। যতবার চোখ বন্ধ করছি একটাই দৃশ্য ভেসে উঠছে চোখের সামনে, গনগনে আগুনে ঢুকে যাচ্ছে আমার মা।" এই মুহূর্তে বহুদূরে থাকা, নাতনীকে জড়িয়ে সুখে দিবানিদ্রা রত এক মহিলার জন্য ডুকরে ওঠে মন। কেন যে এত অবহেলা করি মাকে, কেন যে এত বিরক্ত হই মায়ের ওপর, কেন যে আর একটু বেশি ভালবাসতে পারি না মাকে।
No comments:
Post a Comment