অনির ডাইরি ৭ই জানুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
আগে খেয়ে উঠে পড়ল শৌভিক। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এবার ভালো করে খাওয়া যাবে। রাতে বাঁধা কপির তরকারি হয়েছে বলে গরম গরম বেগুন ভেজেছে লতা দি। ছোট ছোট, গোল গোল, চাকা চাকা করে ভাজা শীতের নরম বেগুন। একটার জায়গায় দুটো নিতেই ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল আমার বরের। তিন নম্বরটা নেব বলে হাত বাড়াতেই কটমট করে তাকাল। তখন থেকে আস্তে আস্তে খাচ্ছি। তক্কে তক্কে আছি। হাত ধুতে গেলেই -
কেস জন্ডিস বাঁধাল এই মেয়েটা। বাপ সোহাগী হয়ে কি যে এত কথা বলে, মাঝখান থেকে খাবার ঘরের বেসিনেই হাত ধুয়ে নিল শৌভিক। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকেই যাচ্ছে মেয়ের সাথে, মনের দুঃখে বসে বসে শসা চিবোই আমি। শসা আমার জঘন্য লাগে খেতে, এর থেকে ঘাস খাওয়া ভালো। তাও খাই, অপেক্ষা করি, কখন শেষ হয় এদের বকবক।
গল্প শেষ হবার আগে রুটিটাই শেষ হয়ে গেল, ধুৎ। অগত্যা উঠে পড়তেই হয়, নীরবে রান্না ঘরে গিয়ে প্লেট নামাই। আমায় উঠতে দেখে উঠে পড়ে তুত্তুরীও। থালাবাসন নামিয়ে দাঁত মাজতে যায়, জল খাবার অজুহাতে খাবার ঘরেই থেকে যাই আমি। টেবিলে সাজানো এষার আনা গাজরের হালুয়া, এক ঝোলা পয়রা গুড়, খানিক রিচ ফ্রুট কেক, কৌটো ভর্তি জয়নগরের মোয়া, গোটা দুই চকলেট। নিশি ডাকার মত ডাকছে আমায়।
আপদ বরটা যে কি করছে এখনও, দাঁত মাজতে যা না রে ভাই। কিছুতেই নড়ে না শৌভিক। প্রাক বিবাহ পর্বে ঝাড়ি মারার মত তাকিয়ে আছে আমার দিকে, গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ। থাকতে না পেরে হ্যাংলার মত বলেই ফেলি, " একটা মোয়া খাব?" দীর্ঘশ্বাস ফেলে, দুদিকে মাথা নাড়ায় শৌভিক, চুক চুক আওয়াজ করে মুখে। তারপর বলে, " কথা রাখতে পারলি না?"
কি আবার কথা দিলাম? ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায়, ও হরি কাল রাতে বলেছিলাম বটে, এই বছরে রোগা হবই। তাই আজ থেকে কাঁচা নুন এবং মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দেব। সে প্রতিজ্ঞা তো সেই দুপুর বেলাতেই ভেঙেছি যখন কোলাঘাটের SLO কৌশিক তার বউয়ের হাতে বানানো গরম গরম ফ্রুট কেক এনেছিল। তারপর জহর বাবুর আনা ওনার স্ত্রীর হাতে বানানো পুলি পিঠেগুলোও তো সদ্ব্যবহার করেছি। কি অনুপম পিঠে বানিয়েছিল মাইরি জহর বাবুর গিন্নি। আমার ভালো লেগেছে শুনে শূন্য টিফিন বক্সে চেপে চেপে ভরে দিয়েছিলেন জহর বাবু, " বাড়ি গিয়ে খাবেন ম্যাডাম। স্যারকে দিবেন। খুকীকে দিবেন " করে। স্বাস্থ্য সচেতন স্যার তো ছুঁয়েও দেখেনি। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে চোরাগোপ্তা সেগুলোর দায়িত্ব নিতে হয়েছে এই অধমকেই।
ফিরে আসি বর্তমানে। একটা মোয়া কি পাব না? পাব না একটা মোয়া? শৌভিক বলে, " তুই চারটে বেগুন ভাজা খেলি, আমি কি দেখিনি?" কি মিথ্যে অপবাদ বাপু। আমি মাত্র ইয়ে তিনটে খেয়েছি। বলাতে ফুঁসে ওঠে শৌভিক, " কিন্তু কেন? আমি তো একটাও খাইনি। আমায় দেখে শেখ, এই সব কেক, চকলেট, মোয়া লোকজন তো আমায় উপহার দিয়েছিল। আমি একটাও দাঁতে কাটিনি। এমনকি এই শীতে একদিন গুড় পর্যন্ত খাইনি"।
কি বলি। ও মহাপুরুষ, আমি ঘোর পাতক। আমি খেয়েছি, সব খেয়েছি এবং আমার ঘোরতর সন্দেহ যে সবথেকে বেশি আমিই খেয়েছি। আমি স্বঘোষিত পেটুক, হ্যাংলা এবং ভোজনরসিক। খাবার জিনিস কেউ উপহার দিলে বিরক্তিতে যতটা ভ্রু কুঁচকে যায় শৌভিকের, ততোটাই চওড়া হয় আমার মুখের হাসি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার বরের অগ্নিদৃষ্টির সামনে সংকুচিত হয়ে পড়ি কেমন যেন। সিদ্ধান্ত নিই, নাহ আর নয়। আর হরগিজ হরগিজ নয়। এই মোয়া খানা বাদে এই দণ্ড থেকে মিষ্টি ত্যাগ করলাম আমি। মোয়ার কৌটো ছুঁয়ে বরকে জানিয়েও দিই। আমি না Aquarian, একবার যদি মুখ ফিরিয়ে নিই, আর সেদিকে তাকাই না। বলতে বলতে খেয়াল হয়, এই যা এই মাসেই তো আমার জন্মদিন। একটুখানি সংশোধন করি নিজের প্রতিজ্ঞা, জন্মদিন বাদে আর মিষ্টি খাব না। সেই দিন তো সব চলতা হ্যায়।
চিবিয়ে চিবিয়ে বলে শৌভিক, " বটেই তো। তবে ওটা জন্মদিন নয়, বল জন্মমাস। জানুয়ারি তোর জন্ম মাস, তাই সব চলতা হ্যায়। ফেব্রুয়ারি তোর বিয়ের মাস, তাই সব চলতা হ্যায়। মার্চ ইয়ার এন্ডিং এর মাস, এপ্রিলটা নববর্ষের মাস, মে তে তোর আবার বিয়ে হয়েছিল (একই বরের সাথে অগ্নিসাক্ষী করে), জুন মেয়ে হবার আগের মাস বলে আর জুলাই মেয়ে হয়েছে বলে, আগস্ট স্বাধীনতার মাস বলে, সেপ্টেম্বর পুজোর আগের মাস আর অক্টোবর পুজোর মাস বলে । তারপর তো ব্যাস দিওয়ালি আর ক্রিসমাস। আসছে বছর আবার হবে।"
গভীর মনোযোগের সাথে শুনতে শুনতে টুক করে মোয়াটা মুখে চালান করে দিই, আসছে বছরই যখন হবে বলছে - তাহলে আর কোন দোষ নেই, কি বলেন।
অনির ডাইরি ৪ঠা জানুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
এই তো মনে হয় সেদিনের কথা, কোথাও ঘুরে বেড়িয়ে এসে ছবি পোস্ট করলেই ফোন করত বিন্তিদি ( নামটা বদলে দিলাম)। " ওরে তোকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে রে, আমার ছেলেরও ছবিটা খুব পছন্দ হয়েছে। তোর ইয়ংয়েস্ট এডমায়ারার বুঝলি।" যে ছেলের কথা হচ্ছে, এককালে তাঁকে আমি কোলে তুলে নাচিয়েছি এবং তিনি আমার গায়ে যাবতীয় খারাপ কাজ করেছেন। আমি তখন কাঠবেকার। বিন্তি দি বয়সে সামান্য বড়, তাই দিদি বলি, আসলে নিখাদ বন্ধু। সারা পৃথিবী আমায় অপদার্থ ভাবলেও, বিন্তি দি ছিল কতিপয় ব্যতিক্রমের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাই মাঝেসাঝে মনের দুঃখ ভুলতে ওর সাথে গল্প করতে যেতাম। অতিরিক্ত আকর্ষণ ছিল ওর ছেলে, যাকে সেদিন পর্যন্ত আমি ঘন্টু বলে ডাকতাম। যেন আমার জন্যই বসে থাকত ব্যাটা, কোলে নিলেই ব্যাস -। আর ওর মা একগাল হেসে গড়িয়ে পড়ে বলত, " শিশু নারায়ণ আর ওটা তো গঙ্গাজল।" এহেন ব্যক্তিটি এতোই সুদর্শন ছিলেন, যেন মাখনের তাল। তিনি আমার যতটা না অনুরাগী ছিলেন, আমি তার থেকেও অনেক বেশী অনুরক্ত ছিলাম। তাই না আরেকটু বড় হয়ে যখন চুল টানতেন, ঘুষি মারতেন, খামচে দিতেন কিছু বলিনি। নতুন বিয়ের পর আমার বরের সামনে যেবার থুতু ছিটিয়েছিলেন সেইবার কেবল খুব রেগে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এবার সব সম্পর্ক ছিন্নই করে ফেলব ব্যাটার সাথে।
তবে সে তো কবেকার কথা। ধীরে ধীরে তিনি বড় হতে লাগলেন, তাঁর মায়ের ধারণা ছিল তিনি পরীক্ষায় রসগোল্লা পান্তুয়াই পাবেন, সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দশ ক্লাসের পরীক্ষায় দারুণ ফল করলেন। তারপর হঠাৎ একদিন উদয় হলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, " কে রে ঘন্টু নাকি? তুই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছিস? তোর মা জানে?" মেসেঞ্জারে ঘন্টু বাবু জানালেন, " মা জানে গো মাসি। মা তো নিজেই একটা অ্যাকাউন্ট খুলবে বলে আমায় ধরেছে।" বিন্তি দির অ্যাকাউন্ট খুলতে অবশ্য আরও বছর দুয়েক লেগেছিল। ছেলের দ্বাদশের পরীক্ষার পর, ফেসবুকে আত্মপ্রকাশ করেছিল বিন্তি দি।
নতুন অ্যাকাউন্ট খোলার পর দিন দুয়েক ঘন্টু ওই সব ছবি পোস্ট করল - যেমন বাচ্ছা গুলো করে আর কি। থুতনিতে হাত দেওয়া সেলফি, অন্ধকার অন্ধকার ছবি, বই হাতে ছবি, "Bro"দের সাথে ছবি ইত্যাদি প্রভৃতি এবং একটি সুন্দরী মেয়ের সাথে ছবি। ভাবলাম ইনিও বোধহয় ওই 'Bro' দেরই কেউ হবেন। ভুল ভাঙাল ঘন্টু বাবু স্বয়ং। মেসেঞ্জারে জানালেন," অনি মাসি এই দেখো আমার গার্ল ফ্রেন্ড।" দেখার মতোই মেয়েটা। কি সর্বাঙ্গীন সুন্দর। সনাতনী বাঙালি সৌন্দর্যের পরিমাপে কতটা নম্বর পাবে সেটা বিতর্কমূলক হলেও গ্ল্যামারে কিন্তু হীরকের মতোই উজ্জ্বল। গোছা গোছা ছবি ভেসে বেড়াতে লাগল ফেসবুক থেকে ইন্সটাগ্রামে। লাইক না পেলেই ধেয়ে আসত ঘন্টুর মেসেজ, "অনি মাসি, এই দেখো। একটা লাইক তো বানতা যায়।"
ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসে সব উত্তেজনাই। আমরাও মহানগর ছেড়ে চলে আসি তমলুক। চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয় মানুষ। দুদণ্ড দেখা যে করব, তারও কি উপায় আছে। বিন্তি দি এবং আমি উভয়েই এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকি নিজের নিজের জীবনে -। সেটা রথের দিন, ভাবলাম আজ একটা ফোন করেই ফেলি। ব্যস্ত থাকলে পরে করবে দিদি। যথারীতি ফোন বেজে গেল। সন্ধ্যার ফোনের জবাব পেলাম রাত এগারোটায়। " তুই ফোন করেছিলি? Sorry রে। আসলে তোর ঘন্টুর গার্লফ্রেন্ড আর তার বাবা মা এসেছিল, তাদের আপ্যায়নেই ব্যস্ত ছিলাম।" আরে বাহ। দুই পরিবারের মধ্যেও সেতু বন্ধন হয়ে গেল। তার মানে তো আমাদের ঘন্টু এবং তার সুন্দরী বান্ধবী উভয়েই বেশ সিরিয়াস সম্পর্কটাকে নিয়ে।
বিন্তি দি বলেই চলে, " মেয়েটা খুব ভালো রে। ওর বাবা মা, পরিবারটাও বেশ ভালো। আপাতত ও কেরিয়ারে ফোকাস করতে চায়। আমরাও তাই চাই। তোর সাথে একদিন আলাপ করিয়ে দেব।" হেসে বলি, আমার সাথে আবার আলাপ করাবে কি, আমি তো চিনি। কবে থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছি দুজনকে। কোথায় কোথায় সব প্রেম করতে যায় ব্যাটারা, কি দারুণ দারুণ ছবি তোলে একসাথে। বিন্তি দি একটু থমকায়, গলা ঝাড়ে, তারপর বলে, " নানা তুই ওকে চিনিস না।" আমি বলি আলবাৎ চিনি, তুমি তো কাল কা যোগী, সবে ফেসবুক একাউন্ট খুলেছ।আমি পুরাণ পাপী।
বিন্তি দির গলায় একরাশ অস্বস্তি, " নারে তুই একে দেখিসনি। এ একটু 'পড়াকু' টাইপ। ওই সব সোশ্যাল মিডিয়া ফিডিয়ায় একে পাবি না।" স্পিকার অফ থাকলেও নিশুতি রাতের নৈঃশব্দে সব কথা পাশ থেকে শোনা যায়। শৌভিক মাথায় গাঁট্টা মেরে ইশারায় বলে, ' এটা অন্য মেয়ে।' পুরো বেকুব হয়ে যাই মাইরি। বিন্তি দি 'হবু মেয়ের' গুচ্ছের প্রশংসা করে ফোন রাখে। তড়িঘড়ি ঘন্টুবাবুর একাউন্টটা খুলি। সময়ের পুরু ধুলো জমেছে আমাদের সম্পর্কেও। দীর্ঘদিন আর মেসেঞ্জারে ছবি লাইক করার আব্দার করে না ঘন্টু। মনে পড়ে অনেকদিন কোন নোটিফিকেশনই আসেনি ঘন্টুর থেকে। খুলে দেখি একাউন্টটা আছে বটে, নেই সেই সুন্দর ছবি গুলো। সেই হীরের মত ঝলমলে মেয়েটার কোন নামগন্ধ নেই ঘন্টুর প্রোফাইলে। বুঝি বিন্তি দিই ঠিক।
পরদিন মেসেজ করে জানায় ঘন্টুও, " ওর সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে অনি মাসি। কেবল ঝগড়া করত। আরো অনেক কিছু, it's kinda complicated। তবে ফাইনালি আমি আমার soulmate কে খুঁজে পেয়েছি। And I'm very happy। She inspires me to be a better version of myself। " জানাই, তুই খুশি হলেই আমরা খুশি বাবা। ভালো থাকিস। পড়াশোনাটা ঠিক করে করিস।
তমলুক থেকে কাঁথি সরে আসি আমরা। দূরত্ব আরো বেড়ে যায় বিন্তি দির সাথে। মাঝে মাঝে টুকটাক WhatsApp এ যা কথা হয়। প্রতিবার একই কথা বলে বিন্তি দি, "হ্যাঁ রে, তোরা কি আর কলকাতায় আসবি না? " এই কথার কি জবাব দি। সবই তো মহামহিমের মর্জি। কথা ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করি, তোমার মেয়ের কি খবর? সে কি করছে এখন? বিন্তি দি আকাশ থেকে পড়ে, " কোন মেয়ে রে? আমার তো একটাই ছেলে -"। যাঃ বাবা। খুলে বলি, বিন্তি দি মুখ ঝামটা দেয়, " ছাড় তো। সেসব কবেই চুকেবুকে গেছে। মেয়েটা বাইরে চান্স পেয়ে চলে গেছে। এখন তো আর একটাকে জুটিয়েছে। কেন তুই ফেসবুকে দেখিস নি?" বিন্তি দিকে কি করে বোঝাই, বন্ধু পুত্রকে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টকিং করা ছাড়াও আমার আরো অনেক কাজ থাকে। কথা ঘোরাতে জিজ্ঞেস করি, 'তোমার শাশুড়ি মা কেমন আছেন?' শাশুড়ি হল এমন একটা টপিক যা নিয়ে বিন্তি দি ঝাড়া এক ঘণ্টা বকে যেতে পারে। তাই গেলও, ফোন রাখার আগে বলল, " পারলে একবার দেখিস, ঘন্টুর নতুন বান্ধবীকে।"
ফোন রেখে, খুঁজে ঘন্টুর একাউন্টটা বার করলাম, ডিপি থেকে কভার ফটো সব জায়গায় হাসি মুখে ঘন্টু, পাশে আর একটি অনন্য সুন্দরী তরুণী, কম বেশি সর্বত্র একই ক্যাপশন লেখা, " You help me to grow", "You made me a better person" এবং"soulmate"। ফোন রাখতে রাখতে মনে মনে বলি, ভাগ্যে এই প্রজন্মে জন্মাইনি। একটা নিয়েই ঝালাপালা হয়ে গেলাম বাপস্। বলি, ঘন্টুর নতুন আত্মীয়তা দীর্ঘজীবী হোক। তবে বাবা ঘন্টু, তোর আত্মার যে সাকুল্যে কটা আত্মীয়!
পুনশ্চ - ঘন্টু বাবা জানি এতটা বাংলা তুই পড়তে পারবি না। যদি পড়িস, তো রাগ করিস না সোনা। তোর ভাষাতেই বলি, মাসি হিসেবে এইটুকু লেগ পুল তো বানতা হ্যায়, নাকি 😝😁।
অনির ডাইরি, ৩রা জানুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
এই তো মনে হয় সেদিনের কথা। অবশেষে বিদায় নিতে চলেছে বিশের (বিষের) বছর। আপ্রাণ চেষ্টা করছি সবাই সর্বোতভাবে জীবনকে স্বাভাবিক করে তোলার। সেটা বছরের শেষ দিন। কোন এককালে এমন দিনে আপিস যেতে ডাক ছেড়ে কান্না পেত। একরাশ তিক্ততা নিয়ে মেদিনীপুর লোকালে সওয়ার হয়ে, নবু ওরফে নবনীতার কাঁধে মাথা রেখে সত্যিই কাঁদতে কাঁদতে অফিস যেতাম। জমানাই ছিল ভিন্ন, আর শৌভিকের ভাষায় আপিসটাও ছিল ‘জঘন্যের কাকাবাবু’। এহেন বালখিল্যচিত ছিঁচকাঁদুনে দুঃখবিলাস আজকাল আর অনুভূত হয় না।
তার প্রধান তথা অন্যতম কারণ অবশ্যই আমার তৎকালীন টিম, আমার টিম চুঁচুড়া। আর দ্বিতীয়ত মোদের তখন শিরে সংক্রান্তি। দিন বারো বাদেই আমাদের মেলা," শ্রমিকমেলা, চুঁচুড়া - ২০২১।" সময় কম, লোকবল তলানিতে, আর অর্থ বল? বাজেট কাটতেছাঁটতে যাকে বলে জেরবার আমরা। নির্দয় হাতে ছাঁটা হচ্ছে মেলার যাবতীয় সৌন্দর্যায়ন। প্রতিপদে কেটারার আর ডেকরেটরের সাথে দরদাম করে চলেছে আমার অবশিষ্ট খঞ্জভঙ্গ টিম। শেষে গতকাল উনি হতাশ হয়ে বললেন, “বাজারদর সম্পর্কে আপনাদের কোন ধারণা আছে ম্যাডাম? আলু-পেঁয়াজের দাম জানেন? গ্যাসের দাম জানেন?” আলু-পেঁয়াজের সঠিক দাম না জানলেও, জানি বাজারে লেগেছে আগুন। আর সদ্য অনলাইন গ্যাসের বিল দিয়েছিলাম, তাই এমাসে গ্যাসের দামটা ঠোঁটস্থ। উনি আমাদের সম্মিলিত অত্যাচারে ঐ ঠাণ্ডাতেও ঘেমে উঠছিলেন। কপালের ঘাম মুছে হেসে বললেন, “ওটা তো ডোমেস্টিক ম্যাডাম। কমার্শিয়াল সিলিণ্ডার আরও অনেক বেশী মূল্যবান।” সে হোক। আমরা নিরূপায়। আপনার যা প্রাণ চায় করুন। যা খুশি বিল দিন। আমার এইটুকুই সম্বল-
সকাল আটটা। তড়িঘড়ি রেডি হচ্ছি আপিস যাব বলে, মুঠো ফোনে মধুঝরিয়ে গান ধরেছেন কিশোরকুমার, “ঝটক কে গেঁসু যাঁহা চলে,তো সাথ মেঁ আশমাঁ চলে-।” এমন সময় বেরসিকের মত বেজে উঠল ফোনটা। ছুটে এসে যখন ধরলাম, সিক্ত কেশ গুচ্ছ দিয়ে টপাটপ ঝরে পড়ছে মুক্তোকণা। গানটাকে গত রাতে কিছুতেই খুঁজে পাইনি। আজ সকালে অনুধাবন করলাম, “কেয়া সুরৎ হ্যায়” বলে অন্বেষণ করলে, “জরুরৎ হ্যায়”কে খুঁজে পাওয়া যায় না।
ফোনের ওপারে অতিরিক্ত জেলাশাসক মহোদয়ের ব্যক্তিগত সহায়ক। সদ্য ঘুমভাঙা জড়ানো অসহায় কণ্ঠে জানান, অনিবার্য কারণ বশতঃ আজকের বৈঠক বাতিল। বসের নির্দেশ সবাইকে জানাতে হবে, অথচ ওণার গৃহে বা মোবাইলে কারো নম্বর নেই। লাজুক কণ্ঠে সবিনয় অনুরোধ, যদি বাকি আধিকারিকদের এট্টু জানিয়ে দিই- অত্যন্ত আনন্দের সাথে রাজি হয়ে যাই। বর্ষবরণের প্রাক্কালে বৈঠক বাতিলের সংবাদ বহন অতীব পূণ্যকর্ম।
সকাল নটা। গুড় নিয়ে ফেরে শ্রীমতী তুত্তুরী। তিনি তখন সদ্য দশে পড়েছেন। একটু একটু করে গজাচ্ছে ডানাপাখনা। ঘুম থেকে উঠে লাফাতে লাফাতে গিয়েছিল আবাসনের মার্কেট থেকে আখের গুড় আনতে। কিনে এনেছে ভেলিগুড়। একখানা জাম্বো নারকেল দিয়েছে মা। বেহারী নারকেল। দেশ থেকে এনে দিয়েছে পৌরসভার ঝাড়ুদার। রোজ ময়লা নিতে এসে খোশগল্প করে বাবা আর মায়ের সাথে। যত এদের নিষেধ করি, অপরিচিত- অর্ধপরিচিত মানুষের সাথে এত খোশ গপ্প করো না। জমানা খারাপ। তা শুনলে তো? কদিন আগে বোধহয় মা বলেছিল আমার জামাই আর নাতনী নারকেল নাড়ু খেতে বড় ভালোবাসে। বাজার গিয়ে বাবার পক্ষে নারকেল কিনে আনা প্রায় অসম্ভব। স্থানীয় যারা বাজার নিয়ে বসে তারা তো আর নারকেল বিক্রি করে না।
মায়ের দুঃখে গলে গিয়ে, চারদিন কাজে ডুব মেরে, চার খানা খোক্ষস মার্কা নারকেল এনে দিয়েছে ঝাড়ুদার। দরাদরি অন্তে নগদ ৩৫০টাকায় কেনা চারখানা নারকেল, যার দুখানি নাড়ু রূপে আর একখানি গোটাগুটি এসে হাজির হয়েছেন আমার গৃহে। নারকেল তো পেলাম,ফাটাই কি দিয়ে? ছোট নারকেল হলে বাটনা বাটার নোড়া মেরে ঘায়েল করে লতা দি। এটা যা জাঁদরেল।
রমেশকে বলেছিলাম একটা কাটারি কিনে দিবি বাবা? অত্যুৎসাহী জনগণ যত। নিজের বাড়ির ভারি কাটারিটাই গছিয়েছে দিন কয়েকের জন্য। তিনি এসেছেন তো এসেইছেন। কাজে আর লাগানো হচ্ছে না তাঁকে। মায়ের হাতের নাড়ু শেষ হলে তবে না নতুন নাড়ু পাকাব।
গতকালই লতাদিকে বললাম,যা হয় হোক, এবার কাটারিটা ফেরৎ দিতে হবে। ভেবেছিলাম বছর শেষে আপিস ফেরতা চিনির নাড়ু পাকাব। বাপ-মেয়ের না পসন্দ। সাতসকালে তাই কৌটো নিয়ে দৌড়েছিল তুত্তুরী পাঁচশ আখের গুড় আনতে। তখনও আমরা মহানগরের বাসিন্দা। মেয়েকে দোকানে পাঠাতে খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করত না শৌভিক। ভয় পেত। যা ট্যালা মেয়ে আমাদের। খুব বায়না করলে, টাকাপয়সা ছাড়াই দোকানে পাঠানো হত তুত্তুরীকে। দোকানদার হোয়াটস্ অ্যাপে পাঠিয়ে দিত বিল। তখনও UPI শিখিনি আমরা। আপিস ফেরৎ ক্যাশ টাকায় বিল মিটিয়ে আসত শৌভিক।
আজ দোকানদার অনুপস্থিত। অল্পবয়সী অবাঙালি কর্মচারী আখের গুড় বোঝেনি। পাঁচশ ভেলি গুড় গছিয়েছে। তাই নিয়েই নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেছে আমার কন্যা। আখের গুড়ের পরিবর্তে ভেলি গুড় এনেছে বটে, তবে পথে কোন বুড়ো রিক্সাওয়ালা নাকি মামণি বলে ডেকে বিনামূল্যে বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছে, তাকে দিব্য মায়ের ভয় দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে ফিরে এসেছে ট্যালা মেয়েটা। মনে হল বর্ষ শেষে এটাই কম পাওনা কি? রোমে টিকতে হলে রোমান হতে হয়, আর জঙ্গলে বাস করতে হলে-
বেলা দশটা- “আজ কোথাও যাচ্ছ তোমরা?” ফোনের ওপার থেকে সংকুচিত ভাবে জানতে চাইল উমা। তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ভেলিগুড় বিদায় করে, ধার করা কাটারি বগলে আপিস বেরোতে একটু দেরীই হয়ে গেছে। হাসি চেপে জানালাম, যাচ্ছিই তো। যে যার আপিস। “তাহলে সোনাইকে নিয়ে একটু বেরোব?” আবার জানতে চায় উমা। শ্রীমতী ফুলঝুরি তখনও ঘুমিয়ে আছেন ভবিষ্যতের গর্ভে। বিবাহোত্তর জীবনে উমার প্রিয়তম বন্ধু শ্রীমতী তুত্তুরী ওরফে সোনাই। কাকিমা আর তার সোনাইয়ের মধ্যে সাধারণত ঢুকতাম না আমি। আজও ঢুকি না। যা খুশি কর না বাপু তোরা।
বেলা এগারোটা- আপিসে ঢুকতেই পুরসভার ইন্সপেক্টর সঞ্চিতা বলে ওঠে, “ওরা কিন্তু আসবে ম্যাডাম। দল বেঁধে।” ওরা অর্থাৎ আমার চুঁচুড়ার SLOরা,আসবেই, জানি। গতকাল মেলার সমস্ত দপ্তরী দায়িত্ব থেকে ওদের অব্যাহতি দিয়েছিলাম যে। তারপর থেকেই উত্যক্ত করছে ওরা।
সাংগঠনিক ভাবে মেলা বয়কটের ডাক দিয়েছিল কোন এক সংগঠন। অন্যান্য জেলা, অন্যান্য মেলা থেকে উড়ে আসছিল নানা অপ্রীতিকর গুজব। ভাইরাল হচ্ছিল ক্লিপিং। পরিস্থিতি বিচার করে চন্দননগরের তৎকালীন বড় সাহেব বললেন, ‘তোমার ছেলেমেয়েগুলো ভালো, তোমায় বড় ভালবাসে। তুমি বললে ওরা ফেলতে পারবে না। কিন্তু সাংগঠনিক ভাবে যদি ওরা মেলা বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমাদের চাপ দেওয়া অনুচিত। দেখো কি করবে-।’ আমার ছেলেমেয়ে গুলো সত্যিই ভালো, মেলা নিয়ে আমাদের থেকে ওদের উত্তেজনা বেশী। বলাগড়ের শ্যামল তো রোজই লিখে চলেছে, ‘দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসবে আমাদের মেলা দেখতে। কত লোক চাই ম্যাডাম। আমি আনব।’ ধরে বেঁধে থামাতে হয় এদের। বাপঃ করোণা এখনও আছে কিন্তু।
তবুও ভেসে আসে নানা অপ্রীতিকর বার্তা। অন্য মহকুমার লোকজনের তিক্ত ঝাঁঝালো উক্তি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য পাশের মহকুমার এক SLOকে ফোন করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তৎকালীন RLO ইন্সপেক্টর কৌশিক। “জানেন না আমাদের কি অবস্থা?” অবস্থা আমাদের থেকে ভালো কে জানে? তুচ্ছ ফিল্ড আপিসের ওপর গোঁসা হতেই পারে, কিন্তু ফিল্ড আপিসের অসহায়তা বুঝবি না তোরা? তাহলে কে বুঝবে? ক্ষোভ অভিমান তো আমাদেরও হয়- তাই লিখেছিলাম, মেলা তো তোমাদেরই, অবশ্যই মেলায় এস, মেলার কাজে অংশগ্রহণ করো, কিন্তু স্বেচ্ছায়। এবার অফিশিয়ালি যাবতীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল SLO দের। ‘আপনি আর কপনি’ নিয়েই লড়ে যাব আমরা।
বেলা একটা- তুত্তুরীর ফোন আর থামেই না। দারুণ কাটছে আজকের দিনটা। পিছনের কেরিয়ারে সোনাইকে বসিয়ে সারা আবাসন সাইকেলে চক্কর মেরেছে কাকিমা। জীবনে কখনও সাইকেলের কেরিয়ারে বসেনি তুত্তুরী। তারপর পাড়ার ছোট্ট পার্কে ঢুকে এক অবাঙালি শিশুর থেকে ধার করা ফুটবল নিয়ে হুল্লোড়বাজি, দোলনায় চড়া, ঢেঁকিতে চড়া আর তারপর মাঠে রোদ পোয়াতে আসা জনৈক দাদুর আদরের থলথলে ল্যাব্রাডর কুতুয়াকে ধার নিয়ে আশ মিটিয়ে চটকেছে দোঁহে। আদরের দাপটে নাজেহাল কুতুয়া মাঝে একবার পালিয়ে গিয়ে পাশের গাছে পা তুলে কিভাবে ইয়ে করেছে সেই গল্পও শোনায় তুত্তুরী। সারা বেলা টইটই করে ঘুরে, হাফ প্যাডেল শেখা তথা শেখানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টান্তে বাড়ি ফিরেছে দুজনে। ' উফঃ এমন দিন কেন যে রোজ আসে না-', একসাথে চিৎকার করে দুটোতে, সাধে ব্যাটাদের মধ্যে ঢুকি না।
বেলা তিনটে- কালো হয়ে আসা মুখগুলিতে মাখামাখি আব্দার আর আর্তি। রমেশ, সমীর, প্রদীপ, শ্যামল, মাম্পি, প্রিয়াঙ্কা, অমৃতা আরো যেন কারা কারা। “ও ম্যাডাম, রাগ করবেন না।” “দুঃখ পাবেন না। মেলা থেকে প্লিজ আমাদের সরিয়ে দেবেন না। আমরা আসব হ্যাঁ-”। হ্যাংলার মত বলে মগরার SLO প্রিয়াঙ্কা। ওটাই পালের গোদা যে। পোলবা-বাঁশবেড়িয়ার কালেক্টিং এজেন্ট দিদিরাও এসেছে ওদের সাথে। মহুয়াদি বলেন, " আমরা তো SLO নই ম্যাডাম। আমরা তো CA। আমাদের কেন বাদ দিচ্ছেন ম্যাডাম -"।ওদের মেলা থেকে ওদের বাদ দেবার ক্ষমতা কি আমার আছে? কত বড় শক্তিধর আমি? আর রাগ? রাগ হলেও তার স্থায়িত্ব কতক্ষণ এরা ভালোমতই জানে। মন কষাকষি, মান অভিমান, রাগ-অনুরাগ মিটতে মেটাতে গড়িয়ে যায় বেলা। ALC সুখেন বর্মন সাহেব গলা ঝেড়ে, হাত কচলে, জানান দেন, "সব তো হল, এবার একটু কিছু খাওয়া দাওয়া হবে না? আজ যে বছর শেষ।" বুঝতে বাকি থাকে না, বাইরে থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে সবাই মিলে। ইন্সপেক্টর থেকে SLO, এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার সব্বাই। ছদ্ম গাম্ভীর্যের প্রসাধনের আড়ালে ফিক করে হেসে ওঠে হৃদয়,‘ এমনি ভাবেই কাটুক না বছর গুলো, কিছু নরমে, কিছু গরমে। কিছুটা লোহায় আর বাকিটা নিখাদ সোনায়।’
বিগত কয়েক বছরে বদলে গেছে কতকিছুই, চাকরী ছেড়েছেন আমাদের চন্দননগরের বড় সাহেব, টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সেদিনের টিম চুঁচুড়া। অবসর নিয়েছেন বর্মন সাহেব। আমি বদলী হয়ে এসেছি তমলুক, সঞ্চিতা গেছে ব্যারাকপুর, কৌশিক - নির্মল - চঞ্চল ও ছিটকে গেছে বিভিন্ন জেলায়। সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে চলে গেছে ধীমান। রয়ে গেছে কেবল স্মৃতিগুলো।
অনির ডাইরি ২ রা জানুয়ারি, ২০২৫
#অনিরডাইরি
এই তো সেদিনের কথা। বোধহয় সেটা সেপ্টেম্বর মাস, বহুরূপীর মত ভোল বদলাচ্ছিল প্রকৃতি। এই টিকি পোড়ানো গরম, তো এই ভেসে গেল বুঝি ধরা। এই থিকথিক করছে ভিড়, তো এই শুনশান আমাদের আপিস। তেমনি এক সায়াহ্নে স্কুলের বন্ধুদের মেসেজ করলাম, " ভাবছি ঘুমিয়ে পড়ি -"। জানলার বাইরে ঝুলছে, মসিকৃষ্ণ মেঘের পর্দা, বাজের দাপটে বন্ধ সব কম্পিউটার, আমরা গুটি কয় হতভাগ্য কর্মচারী ভিন্ন আপিস প্রায় জনশূন্য।
ঘুমিয়েও পড়তাম হয়তো, যদি না বড়সাহেব মেসেজ করে জানতে চাইতেন, "বারখোদা কার এলাকা জানো?" গুগল করে দেখলাম, আমার এবং মুকুলের। মহকুমা আমার আর ব্লক মুকুলের। একজনের নাম দিয়ে স্যার বললেন, 'খোঁজ নিয়ে দেখো তো, এই লোকটি ওই অঞ্চলের বাসিন্দা কি না। যদি হয়, তাহলে কেমন আছে?" এমন মেসেজ তো সচরাচর করেন না বড়সাহেব, প্রতিবেশী দেশের সৌজন্যে সেই সময় যত্রতত্র বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর হামলা হচ্ছে, এটাও কি তেমন কিছু নাকি? জানতে চাইবার আগেই জানালেন বড়সাহেব, আমার অনুমানই সঠিক, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক, ভিন রাজ্যে ফুলের কাজ করত। মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছে -
অন্যান্য মহকুমা গুলোতে ভুরি ভুরি এমন কেস আসছিল, তমলুক তুলনামূলক ভাবে বর্ধিষ্ণু মহকুমা বলেই হয়তো, এর আগে এই রকম একটাই কেস এসেছিল, ময়নার ছেলে। খবর এসেছিল পিটুনি খেয়েছে, কাজ হারিয়েছে।বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে তো আমার লোকজনেরই পিটুনি খাবার উপক্রম। ছেলে ভালো আছে, বিদেশবিভূঁইয়ে থাকে, হোটেলে কাজ করে, মাসে মাসে ভালো টাকা পাঠায়, খামোখা কেন আমরা ফোন করে বা বাড়ি এসে উৎপাত করছি? অনেক কথা শুনিয়েছিল বাড়ির লোক। ভাবলাম, এটাও তেমনি হবে হয়তো। প্রার্থনা করলাম, এটাও তেমনিই হোক। আর আমিও একটু ঘুমিয়ে নিই, বড় মুখ করে বললাম বন্ধুদের। আগের বার ইন্সপেক্টর সৌরভ আর এসএলও রঞ্জন খিস্তি খেয়েছিল, এবার না হয় মুকুল আর মতিবুল দুটো গাল খাক, লোকটা যেন ভালো থাকে ঠাকুর।
বৃষ্টির দাপট একটু কমেছে, দল বেঁধে ছাতা নিয়ে টিফিন করতে যাচ্ছিল আমার লোকজন। দৌড়ে গিয়ে বললাম, দুমিনিট দাঁড়া বাবা। একটু খোঁজ নিয়ে দেখে নিই, লোকটা ঠিক আছে কিনা। মতিবুলকে ফোনেই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না আশেপাশের পঞ্চায়েতের জনা দুই তিন এসএলওকেও। বাজ আর বৃষ্টির দাপটে সবাই ফোন বন্ধ করে বসে আছে নাকি? বাকিদের খেতে পাঠালাম, শান্তনু একা রয়ে গেল ফোন করার জন্য।
বেশ কিছুক্ষণ পর বাজল মতিবুলের ফোন। নামটা বলল শান্তনু, ওপাশ থেকে কি জবাব ভেসে এল জানি না, ফ্যালফ্যাল করে খানিক আমার দিকে তাকিয়ে শান্তনু বলল, "ম্যাডাম মতিবুল বলতেছে, ছেলেটা মরে গেছে।" কি বাজে বকছ, বলে ফোনটা কেড়ে নিই আমি। মতিবুল তখনও ধরে আছে ফোনটা, আবার শুধালাম আমি, ও কি ছেলেটাকে চেনে? ছেলেটা কি সত্যিই পরিযায়ী শ্রমিক? কেমন আছে ছেলেটা? আবার জবাব দিল মতিবুল, " হ্যাঁ ম্যাডাম, চিনি তো। আমার বাড়ির পাশেই থাকে। পিটিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিছে, আর বেঁচে নেই -। আমি আপনাকে ছবি পাঠাচ্ছি।"
ক্লান্ত, পরাজিত হয়ে মাথা নীচু করে চেম্বারে ফিরে আসি, ভারী মন, ভারী গলায় বড়সাহেবকে দুঃসংবাদটা দিই। জানাই মতিবুল ছবি পাঠাচ্ছে, মিলিয়ে নেওয়ার জন্য। বড় সাহেব আঁতকে ওঠেন, "কিসের ছবি?" বলি, ছেলেটার বা তার আধার, ভোটার কার্ডেরই হবে। স্যার বলেন, "না। ওর বর্তমান অবস্থার। আমিও পেয়েছি ওই ছবিগুলো, ইচ্ছে করেই তোমায় পাঠাইনি। এত বীভৎস, তুমি প্লিজ ওগুলো দেখো না -"। স্যারের ফোন শেষ হবার আগেই, দৌড়তে দৌড়তে আসে শান্তনু, " ম্যাডাম, মতিবুল কি সাংঘাতিক সব ছবি পাঠিয়েছে -। একদম দেখবেননি। একটা দেখেই আমার মাথা ঘুরছে -"।
কেমন দেখতে হয়, গণপ্রহারে মৃত মানুষকে? আমার দেখার ইচ্ছে হয়নি। জানি সহ্য করতে পারব না। অপরিসীম ক্লান্তির সাথে সাথে এক অক্ষম রাগ আমাকে তিলে তিলে গিলে খাচ্ছিল। কেন? কেন? কেন? আধার নম্বর জোগাড় করে ততক্ষণে পোর্টাল খুঁজে দেখে ফেলেছে বেদজ্যোতি, আছে, ছেলেটি আছে। সরকারী প্রকল্পে নথিভুক্তও আছে। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে দুলক্ষ টাকা পাবে ছেলেটির উত্তরাধিকারী। তাতে কি? কত টাকা মূল্য হয় একটা প্রাণের? আদৌ কি কোন মূল্য হয় প্রিয়জন বিরহের -।
তারপর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস, ঘুরে গেছে বছরও। মাননীয়ার ভার্চুয়াল মিটিং উপলক্ষে আজ আমাদের অফিসে এসেছিলেন বড় সাহেব, মিটিং শেষে যেমন হয় আর কি, চায়ের কাপে খানিক আড্ডা বসে। আড্ডা জুড়েও থাকে আপিস, কাজ কেমন চলছে, কেমন চলছে না। কেন চলছে না ইত্যাদি প্রভৃতি। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ বড় সাহেব শুধালেন, " আচ্ছা অনিন্দিতা, সেই কেসটার কি হল?" চায়ের কাপ নামিয়ে সোজা হয়ে বসি, জানতে চাই, কোন কেস? উনি বলেন, "সেই যে ট্রেন থেকে মেরে ফেলে দিয়েছিল -। তাদের টাকা দিয়ে দিয়েছ?"
বিস্তর ভেবে, মাথা চুলকেও মনে করতে পারি না। বিগত কয়েক মাসে কত কেসই তো ছাড়লাম, তার মধ্যে বেরিয়ে গেল কি? বেল বাজিয়ে শান্তনুকে ডাকি, সে একবার বলে হ্যাঁ, একবার না। তারপর আমার থেকেও দ্রুততায় মাথা চুলকায়। যেমন অফিসার তেমনি তার CKCO। এই আপিসে কি গণ খুশকি হল নাকি! অবস্থা সামলে বেদজ্যোতি পাশ থেকে বলে, " না না, আমার মনে আছে। ওরা এখনও অ্যাপ্লাই'ই করেনি।" যাঃ বাবা, কেন রে ভাই? বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, "একটু দেখ" বলে বেরিয়ে পড়েন স্যার।
ততক্ষণে মুকুলকে ফোন করে ফেলেছে শান্তনু। ব্লকে বসে বিস্তর মাথা চুলকে ফেলেছে আমার ইন্সপেক্টরও। তারপর বলেছে, " ওরা তো অ্যাপ্লাই করেনি।" আরে বাবা, সেটাই তো জানতে চাইছি। কেন করেনি? কাগজপত্রের কোন সমস্যা হয়েছে কি? মুকুল জবাব দেয়, "না ম্যাডাম। না ম্যাডাম। করেনি কারণ ছেলেটা ইয়ে (ঢোঁক গিলে) মানে বেঁচে আছে।" অ্যাঁ!সত্যি! এও কি সত্যি হতে পারে? গণপিটুনির পর চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিলেও মানুষ বেঁচে যেতে পারে? ঈশ্বর কি সত্যিই এমন করুণাময়? সেদিন কি তিনি সত্যিই শুনে ফেলেছিলেন আমার মনের কথা? বুকের মধ্যে বেজে ওঠে সন্দেহ অবিশ্বাসের বাদ্যি। জানতে চাই তোমায় কে বলল? মুকুল ঘাবড়ে গিয়ে বলে, "মতিবুল ম্যাডাম!"
মতিবুলই তো আগের বার বলেছিল আর বেঁচে নেই ছেলেটা। তাহলে কি কোন ভুল হচ্ছে? আমার মুখে সন্দেহের আলোছায়া দেখে সটান মতিবুলকেই ফোন করে শান্তনু। এবার একটা রিংয়েই ফোনটা ধরে মতিবুল। একরাশ খুশি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শান্তনু বলে "ম্যাডাম মতিবুল ও বলতেছে, ছেলেটা বেঁচে গেছে।" উত্তেজনা চাপতে না পেরে, এবারেও ফোনটা কেড়েই নিই আমি। মতিবুল তখনও ধরে আছে ফোনটা, আবার শুধাই আমি, ঐ ছেলেটাই তো? সত্যিই বেঁচে গেছে তো? আবার জবাব দেয় মতিবুল, " হ্যাঁ ম্যাডাম, সেই ছেলেটাই। আমার বাড়ির পাশেই থাকে। পিটিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছিল, সবাই ধরে নিয়েছিল আর বেঁচে নেই -। কিন্তু উপরওয়ালার দয়ায় ও বেঁচে গেছে ম্যাডাম।"
ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ি আমি, এত নির্ভার বহুযুগ বোধ করিনি। মৃত্যুকালীন অনুদান ছাড়া আমার সবথেকে অপছন্দের কাজ। প্রতিটা মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় না জানি কতই না গল্পকথা। টিপ সই বা আঁকাবাঁকা হাতে লেখা অনুদানের আবেদন পত্র, ডেথ সার্টিফিকেট, কজ অফ ডেথ, পুলিশ রিপোর্ট, পোস্টমর্টেম ইত্যাদি ঘাঁটতে রীতিমত আতঙ্ক লাগে আমার। বিমর্ষ বোধ করি আমি। আজ বছরের প্রথম কর্মদিবসে ছেলেটির বেঁচে থাকাটা যেন ব্যক্তিগত ভাবে আমারই জিৎ। বিরাট সুখবর। ভালো থাকুক বাবা ছেলেটা, আলো করে থাকুক সুখী গৃহকোণ। ভালো থাকুক পেটের টানে বিদেশবিভূঁইয়ে কাজ করতে যাওয়া প্রতিটা মানুষ।
No comments:
Post a Comment