Thursday 3 October 2024

অনির পুজোর ডাইরি অক্টোবর, ২০২৪

 অনির পুজোর ডাইরি ১৩ই অক্টোবর, ২০২৪

শুভ মহাষ্টমী #অনিরডাইরি 



"অনি-" ফোনের ওপার থেকে সঞ্চিতার ব্যস্ত কন্ঠ জানতে চাইল " তুই কোথায়?" ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে এগারো। হে ঈশ্বর, সাড়ে এগারোটার মধ্যে তো আমার পৌঁছে যাবার কথা ছিল। আমি তো এখনও বাড়ি থেকেই বেরোইনি। এই লেট হওয়া নিয়ে দিন দুয়েক আগে দুই ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সাথে হেব্বি বাওয়াল হয়ে গেছে। আর আজ আমিই কি না - 


মনে মনে নোট করলাম, আরেক বার ক্ষমা চাইতে হবে ব্যাটাদের কাছে। যদিও ইতিমধ্যেই মার্জনা ভিক্ষার সংখ্যা শ খানেক ছাড়িয়েছে। তবুও, কপটতার একটা সীমা তো থাকে মাইরি। নিজের বেলায় আঁটিশুঁটি, ওদের বেলায় দাঁত কপাটি? সঞ্চিতাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললাম, "এই তো বেরিয়েছি।" সম্মুখে ক্যামেরা হাতে অপেক্ষমান তুত্তুরীর কপালে গভীরতর হয় খাঁজ, মাটা তাহলে মিথ্যুকও। 


কি করি, ওই যে বলে না, বিপদে বুদ্ধিমানেরা অর্ধেক ত্যাগ করে। গোটা পুজোয় বাবা মায়ের সাথে একটাও ছবি তোলা হয়নি, আজ দুজনকেই পটিয়ে, সাজিয়ে গুছিয়ে রাজি করেছি। এই মুহূর্তে একগাল হাসি নিয়ে বাঁ দিকে আমায় জড়িয়ে আছে বাবা, ডানদিকে মা। এই সোনালী মুহূর্তটার জন্য একটু মিথ্যে, একটু হিপোক্রেসি তো চলতেই পারে।


বাড়ি থেকে হলের দূরত্ব হাঁটা পথে মিনিট দশ পনেরো। কিন্তু ঠাকুর দেখার নামে যে অত্যাচার হয়েছে পদ যুগলের ওপর, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমার মত পৃথুলার দেহেও মাসলস্ বলে বস্তু কিছু আছে। তার ওপর কেন যে মরতে উঁচু গোড়ালির জুতোটাই পড়লাম। তৃষিতের মত দুদিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটি, একটা টোটো যদি -। আজ বোধহয় ঈশ্বর সত্যিই সুপ্রসন্ন, এক বয়স্ক কৃশকায় টোটোওয়ালা বসে বিড়ি ফুঁকছিল, সনির্বন্ধ অনুরোধে যেতে তো রাজি হল, শর্ত একটাই, বিড়িটা শেষ করতে দিতে হবে। 


গিয়ে যখন পৌঁছলাম, সঞ্চিতা রাস্তার উপরেই দাঁড়িয়ে। দেখে খুশি হল কি না বুঝতে পারলাম না,ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল, " জল এনেছিস?" একেই বোধহয় বলে, 'এক গাল মাছি '। সঞ্চিতার আর আমার সিনেমা দেখার ইতিহাস তো আজকের নয়। বন্ধুত্বটাই তো আজকের নয়। কত রকম যে পাকদণ্ডি ধরে এগিয়েছে আমাদের সিনেমা দেখার ইতিহাস, তার সাক্ষী হাওড়া শহরের সিনেমা হল গুলো। যাদের মধ্যে শ্রীরূপা, নবরূপম, পার্বতী আর শ্যামশ্রী আজ শুধুই ইতিহাস। শান্তি আর পুষ্পশ্রী অবশ্য আজও টিকে আছে। এদের মধ্যে পুষ্পশ্রী নাকি উন্নীত হয়েছে মাল্টিপ্লেক্সে। একসঙ্গে একাধিক 'বই' চলে আজকাল। আপাতত সবই বাংলা। আমাদের আজকের গন্তব্য ও পুষ্পশ্রী। 


আজ মহাষ্টমী কি না,রাস্তায় বেশ ভিড়। ভিড় কাটিয়ে যুগলে গেলাম জল কিনতে। হাঁটতে হাঁটতে বেজায় হাসি পাচ্ছিল অতীত নানা কথা ভেবে। সেই যে সেবার রাজ -২ দেখতে গিয়েছিলাম আমরা, মায়েদের নিয়ে শান্তিতে। একে তো সাংঘাতিক সাউন্ড সিস্টেম, তায় ছারপোকাদের সম্মিলিত আক্রমণ। আজও সকালে শৌভিক বলছিল, দুটো চটের আসন নিয়ে যেতে। মনে আছে, ভয় পেয়ে বার বার সঞ্চিতাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আমি। আর সঞ্চিতা হুমকি দিচ্ছিল, "আরেকবার জড়িয়ে ধর, আমি উঠেই চলে যাব।" 


এতো তাও ঠিক ছিল, তারপর স্ক্রিনে ইমরান হাশমির প্রবেশ। ইমরানের তৎকালীন নামই ছিল "সিরিয়াল কিসার"। ফলে মায়েদের সে কি দাঁত কিড়মিড়। সেই সব গল্প করতে করতে কখন যে হলের আলো নিভে গেল বুঝতেই পারলাম না। নন্দিতা শিবপ্রসাদের বহুরূপী দেখতে এসেছি আমরা। সঞ্চিতাই দেখাচ্ছে, আমি সঙ্গী। 


তামাক সেবনের কুফল দেখানো শুরু হতে খানিক থমকালো আমাদের বার্তালাপ। নয় নয় করে ভালোই ভিড় হয়েছে। পিছনের সিট সব ভর্তি। সামনেও সামান্যই খালি। " এগুলো কেন দেখায় বলতো?" সামান্য বিরক্তি নিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে সঞ্চিতা। পর্দায় তখন খৈনি সেবনের ফলে কর্কট রোগাক্রান্ত জনৈক ব্যক্তি দুঃখের সঙ্গে ঘোষণা করছেন, " বহুৎ বড়ি গলতি হো গিয়া।" ভদ্রলোকের মুখের যা অবস্থা, তাকানো যাচ্ছে না। চোখ সরিয়ে বলি, যারা সত্যিই এগুলো খায়, তাদের কোন লজ্জা থাকে না। যতই দেখা, ঠিক খাবে। যেমন আমার বাপ। বিগত কয়েকদিন ধরে আমি চিল্লিয়ে যাচ্ছি,বাবার কোন হেল দোল আছে? চুরাশি বছর বয়সে এসেও একটা সিগারেট থেকে আরেকটা ধরায়।


 শুরু হয় বহুরূপী। ঝকঝকে আবীর চট্টোপাধ্যায়, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে যেন আরো বহুগুণ সুদর্শন। সাধে এই লোকটার ওপর এককালে ক্রাশ খেতাম আমি। ইদানিং তুত্তুরী হাবুডুবু খায় বলে অতিকষ্টে নিজেকে সংবৃত করেছি। আজ না আবার হড়কে যাই, ভগবান। ছবিতে আবীর একজন বিখ্যাত লেখক। কলকাতা বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে তাঁর নতুন বই বহুরূপী। আবির দীর্ঘ দিন রাজ্য পুলিশে কর্মরত ছিলেন, সলভ করেছেন অগণিত কেস। ধরেছেন অসংখ্য চোর,ডাকাত, গ্রন্থিছেদককে। সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়েই লেখা বহুরূপী। আবির নিজেই বলেন, যে বাকি গুলি তাঁর সফলতার গল্প হলেও, বহুরূপী আসলে তাঁর ব্যর্থতার গল্প। 


অতঃপর শুরু হয়, সেই ব্যর্থতার গল্প। মেশে এক চামচ দেশভাগ। দেশভাগের আগে গঙ্গার দুই পাড়ের জুট মিল গুলো কেমন রইরই করে চলত। দেশভাগের সাথে সাথে শুরু হয় অবক্ষয়। পাল্লা দিয়ে গেটের বাইরে শুরু হয় ইউনিয়নের বিক্ষোভ। এমনিই এক জুটমিলের গোবেচারা অ্যাকাউন্ট্যান্ট শিবপ্রসাদ। ট্রেড ইউনিয়নের নেতাকে খুনের মিথ্যা অপরাধে ফেঁসে হাজির হয় আবিরের থানায়। কোন জেরা, কোন প্রশ্নোত্তর না করেই সটান থার্ড ডিগ্রি চালায় আবীর। ফলে তৈরি হয় এক গোপন শত্রুতার বাতাবরণ। 


কাঠগড়ায় মিথ্যা সাক্ষী দেয় শিবপ্রসাদের বাবা - দাদা - বৌদি। ফলে অনিচ্ছাকৃত খুনের দায়ে আদালত পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে শিবপ্রসাদকে। জেলে শিবপ্রসাদ খুঁজে পায় এক স্নেহশীল গডফাদার। যিনি হাতে ধরে শেখান কি ভাবে ব্যাংক ডাকাতি করতে হয়। চেনা চেনা লাগছে কি গল্পটা? বিশ্বাস করুন, প্রতিটা ফ্রেম, প্রতিটা বাঁক ভয়ানক চেনা। ওই নতুন বোতলে পুরাণ মদ আর কি। মদটাও নেহাৎ চোলাই। 


 জেল থেকে বেরিয়ে শিবপ্রসাদ গড়ে তোলে ব্যাংক ডাকাতির দল। ততোদিনে আবীর SI থেকে আইসি হয়ে গেছে। আর জীবনে এসেছে সুন্দরী, সুগায়িকা, গৃহকর্মনিপুনা লক্ষ্মীশ্রী ঋতাভরি। শিবপ্রসাদেরও জীবনে আসে পকেটমার ঝিমলি ওরফে কৌশানী। যেমন নাম, তেমনিই তাঁর হাবভাব। গুটি সাজানো শেষ হলে শুরু হয় চোর পুলিশ খেলা। গোটা সিনেমায় কেবল দুটো সিলভার লাইন আবীর আর শিবপ্রসাদ। বাকিটুকু নাহয় উহ্যই থাক। বুঝতেই তো পারছেন কি হতে চলেছে। 


পুনশ্চ - হাফটাইমে তোলা সেলফি দেখে বুঝতেই পারবেন না মাইরি, সিনেমা শুরুর সময় সব কটা সিট ভর্তি ছিল। এখন এত লোক একসঙ্গে কোথায় গেল, শৌচাগার নাকি -। সে আমরা কি জানি।


অনির পুজোর ডাইরি ৭ই অক্টোবর, ২০২৪

শুভ চতুর্থী 

#অনিরডাইরি 



অবাঙালি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকার ছোট্ট পুজো। হাওড়ার গলি নয় তো ভুলভুলাইয়া, পথ ভুলেই এসে পড়েছি আমরা। ছাপোষা মণ্ডপ, কুমারটুলির সস্তা প্রতিমা। এবড়োখেবড়ো মুখমণ্ডল, ঘাম তেলটাও যেন ভালো করে লাগানো হয়নি। দুই কানের পাশ দিয়ে নেমেছে কেশ গুচ্ছ, কিন্তু মাথা জোড়া টাক। "এটাই দেখা বাকি ছিল, টেকো মমি।" বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে তুত্তুরী। গর্ভধারিনী মা আর জগজ্জননী মা এই দুজনকেই তিনি আদর করে Mommy বলে সম্বোধন করেন কিনা।


গত পরশু বিকালে সবৎসা হাওড়া এসেছি। আসার সময় বলেই এনেছি মেয়েকে, " বাবু দুটো বেলা শুধু আমায় ছেড়ে দিস, বন্ধুদের জন্য। বাকি পুজোটা শুধুই তোর।" সেই দুবেলা খতম হয়েছে গতকাল অপরাহ্নে। কাল বিকাল থেকেই তিনি আমার মস্তকে সমাসীন। দাবী খুবই সামান্য, তাঁকে আশ মিটিয়ে ঠাকুর দেখাতে হবে এবং চর্বচোষ্য খাওয়াতে হবে। 


ঠাকুর দেখায় অবশ্য আমার কোন ক্লান্তি নেই,  গতকাল রাতেই বলেছিলাম, চল পাড়ার ঠাকুরটা অন্তত দেখে আসি। নেহাৎ ঘরের পোশাকে পাড়ায় বেরোনো নিয়ে যুগপৎ বাবা আর মা আপত্তি করল, তাই।  এবার আমাদের পাড়ার ঠাকুরের হেব্বি জাঁকজমক। গতকাল বিকালে শুভশ্রী এবং গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের যুগ্ম হস্তে তাঁর শুভউদ্বোধন হয়েছে। মোড়ের মাথা থেকে পূজা মণ্ডপ অবধি শুভশ্রী আর গর্গ বাবুর ছবি টাঙানো। মায়ের কেয়ার গিভার দিদি পরশু বিকাল থেকে বলেই চলেছিছেন, " শুভশ্রী আসবে আর কে যেন এক মস্ত বড় গায়ক আসবে। ঐ যে গো আপনাদের বামুনদের নামেই নাম।" বেচারা গর্গ। আজ মধ্যাহ্নে যখন তুত্তুরী আর আমি ঠাকুর দেখতে বেরোচ্ছি, তখনও আমার খুড়তুতো ভাই মাকে বোঝাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, " না না, গর্গ দা গানটান গায় না।" 


পাড়ার ঠাকুর দেখতে গিয়ে হোঁচট খেলাম, মণ্ডপের সামনে বিস্তর প্লাস্টিকের চেয়ার উল্টে ব্যারিকেড করা। "যাঃ বাবা, ঢুকতে দেবে না নাকি?" বিরক্ত হয়ে জানতে চায় তুত্তুরী। এখন ভর দুপুর, আসেপাশে কোন জনমনিষ্যি নেই যে শুধাই। বাধ্য হয়ে অন্য মণ্ডপের পথ ধরি। বারে বারে আজ আশাহত করতে থাকে মা। এখনও অসম্পূর্ণ অধিকাংশ মণ্ডপ তথা প্রতিমা। 


একে তো প্রায় এক যুগ শহর ছাড়া আমি, তার ওপর বড় দ্রুত বদলে যাচ্ছে শহরটাও। পুরাণ পথঘাট, গলি সবই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। তেমনি পথ ভুলেই এসে পৌঁছেছি এই পুজোটায়। ঘিঞ্জি এলাকা, চতুর্দিকে বাইক, টোটো, ঠেলার উৎপাত। বাতাসে সস্তা বিরিয়ানির আতরের চড়া সৌরভ। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে পথের সন্ধান তো পেলাম, কন্যা আব্দার করল, এদের পুজোটাও দেখে যাই। যাব তো, কিন্তু যাব কি করে? মাঠ তো জল কাদায় ভর্তি।


গুটি কয়েক স্থানীয় বাচ্ছা ওই জল কাদার মধ্যেই খেলায় মগ্ন। তাদের পদ চিহ্ন অনুসরণ করেই মণ্ডপে প্রবেশ করলাম আমরা। মণ্ডপের ভিতর তেরছা ভাবে পড়ে আছে বিশাল মই। পাকানো তার, কাগজ, কাপড়ের ছড়াছড়ি। মইয়ের এপাশে আড়াআড়ি ভাবে কোমর সমান উচ্চতায় বাঁধা একটা বাঁশ। সেই বাঁশ ধরে গুলতানিতে মত্ত একদল কুচোকাঁচা। সবকটা প্রায় একই উচ্চতার। সবার পরনেই বিবর্ণ পোশাক। পায়ে চটি থাক বা না থাক, সবকটার পাই কাদায় মাখামাখি। কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে গল্প করি তুত্তুরী আমি। গল্প নয়, গসিপ বলতে পারেন। একে তো দেবী টেকো, তায় সিংহটা বড়ই ছোট। হাঁটুতে হাত রাখা সিংহের দিকে অসুরের মুখভঙ্গী যেন, " খামোখা সুড়সুড়ি দিচ্ছিস কেন বাপ --"। মা যেন দাঁত কিড়মিড় করে বলছে, "আবার ফাজলামি হচ্ছে!" 


আসল মা দুর্গা কেমন হবে, সেটা নিয়েও আলোচনা করি আমরা। সুন্দরী পটেশ্বরী তো অবশ্যই নন। আদতে তো তিনি একজন যোদ্ধা, নির্ঘাত পেশীবহুল হবে তাঁর দেহ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে শোভা পাবে বেশ কিছু শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত চিহ্ন। মুক্তকেশী হওয়া কি সম্ভব? শত্রু তো চুলের মুঠি ধরেই কুপোকাত করে দেবে সবার আগে।  ইত্যাদি প্রভৃতি। 


ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে, এখনও বেশ কয়েকটা ঠাকুর দেখা বাকি। তারপর যাব লস্যি খেতে। হাওড়া ময়দানের সেই লস্যির দোকানটা খুঁজে বার করতে হবে, যেখানে প্রাকবিবাহ প্রণয়পর্বে যুগলে লস্যি খেত আমার বাবা মা। আশৈশব যে দোকানের লস্যি খেয়েছি আমি। খাইয়েছি আমার মেয়েকেও। সবথেকে বড় ভাঁড়ে, সবথেকে বেশি মালাই দেওয়া লস্যি। সাথে কয়েক টুকরো বরফ। ভাবতেই উভয়ের  জিভে জল। টাক বাঁচিয়ে টুক করে ঠাকুরের কয়েকটা ছবি তুলে নিই আমি। 


ছবি তোলার জন্য মেয়েকে ছেড়ে কয়েক পা সরে এসেছিলাম, যখন ফিরে গেলাম দেখি, বাঁশের সামনে একা, এক গাল হাসি নিয়ে কয়েকটা ছুটন্ত বাচ্ছার দিকে তাকিয়ে আছে তুত্তুরী। ইশারায় জিজ্ঞাসা করি, কি হল রে, বিগলিত হয়ে তিনি জবাব দেন, " কি মিষ্টি করে বলল মা, কি ইনোসেন্টলি বলল। এতক্ষণ যে বাচ্ছা দুটো এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করছিল না, তারা যাবার সময় ঠাকুরকে কি বলে গেল জানো? বলল, "মেরি দুর্গা মাঈ কো কিসি কি নজর না লাগে।" পলকে কেমন দ্রবীভূত হয়ে গেল হৃদয়, নাহ টেকো হোক আর যাই হোক, ভদ্রমহিলার যাদু কিছু তো আছেই। 


পুনশ্চ - উক্ত মণ্ডপ বা প্রতিমার ছবিটা আর দিলাম না। কিছু জিনিস একান্ত ব্যক্তিগত থাকাই বোধহয় ভালো। থাক ওরা, ওদের মত।  আশ মিটিয়ে খুনশুটি করুক অসুর আর সিংহ। বেশ বাড়াবাড়ি করলে দুটোরই কান মূলে দিক জগজ্জননী। পুঁচকে গুলোর দুগ্গা মাঈ আর তার  ছানাপোনাদের কারো নজর যেন সত্যিই না লাগে।


অনির পুজোর ডাইরি ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪

শুভ দ্বিতীয়া

#অনিরডাইরি 



তিনি লিখলেন, "মা, তুমি কি আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে? তাহলে তোমার সঙ্গে বেরিয়ে একটু আলো দেখতাম।" আলো অর্থাৎ পুজোর আলোকসজ্জা। কয়েকদিন ধরেই ড্রাইভার সাহেব গল্প করছেন, কাঁথি শহরে নাকি সাকুল্যে ৫০টা পুজো হয়। ছোট মফস্বল শহরের পক্ষে সংখ্যাটা নেহাৎ কম নয়। যার মধ্যে নান্দনিক, ইট গিল্ট (ইউথ গিল্ড) আর চৌরঙ্গীর পুজো নাকি সবথেকে বিখ্যাত। 


আর পাঁচটা মফস্বলের মতোই, এখানে এখনও অর্ধ সমাপ্ত অধিকাংশ মণ্ডপ। প্রতিমা ও অনুপস্থিত। তবে আলো যে লাগানো হচ্ছে, সেটা আজ সকালে অফিস আসার সময় আমিও দেখেছি। 


আগামী কাল থেকে ক্যালেন্ডারে লাল দাগ শুরু, কালই বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে সকন্যা পিত্রালয়ে যাব। ভেবেছিলাম যাবার পথে ঢুঁ মেরে যাব ঠাকুর এসেছে এমন কয়েকটা মণ্ডপে। শ্রীমতী তুত্তুরীকে সেকথা বলেও ছিলাম। কিন্তু কন্যার আর ধৈর্য ধরছে না। মুঠো ফোনে ফুটে ওঠে তাঁর কাতর আকুতি, " প্লিজ মা তুমি কি একটু তাড়াতাড়ি -"।


তাড়াতাড়ি আসব কি, আপিসে ঢুকেছিই তো আজ বেশ খানিক বিলম্বে। সেই কবে মানত করেছিলাম দেবী বর্গভীমার কাছে, আমার বর আর আমার ছেলেগুলো যদি সুস্থ ভাবে, সম্মানের সাথে নির্বাচনটা উতরে দিতে পারে,  মায়ের কাছে পুজো দেব, আর সবাই মিলে ভোগ খাব। সেই মত কথাও বলে এসেছিল শুভদীপ্ত। কিন্তু আমার ইন্সপেক্টর বাবুদের আর সময়ই হয় না। একের পর এক আসতে থাকা কাজের দাপটে, ব্যাটাদের এক সঙ্গে পাওয়াটাই হয়ে ওঠে দুর্ঘট। আমরা যবে খাই খাব,মাকে আর কতদিন উপোষী রাখি? 


মন্দিরের সামনেই বিক্রি হয় পুজোর ডালা, কিন্তু শুভদীপ্ত নিষেধ করে, "ওখান থেকে নিবেন নি ম্যাডাম। আর মাখা (সন্দেশ) নিবেন নি, যে সন্দেশ বিক্রি হয় না, সেই গুলো আবার ভালো করে পাক করে, কড়া মিষ্টি দিয়ে মাখা বানিয়ে দেয় শুনেছি। নিলে কলাকাঁধ নিবেন।" যে দোকান থেকে নিতে বলে, তার লোকেশন আর কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। শেষে শুভাশিসকেই ধরি, "চল বাবা একটু।"


খুপরি দোকান, টালির চাল। আমরা ছাড়া আর মুষ্টিমেয় খরিদ্দার। গৌর বর্ণ, সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ দোকানিকে জানালেন, " পিস নয়, আমরা ওজনে বিক্রি করি কালাকাঁধ।" সাথে সাথে ধূপ আর সিঁদুর পাতাও দিলেন বৃদ্ধ। দোকানেই জুতো খুলে, বাকি পথটা হেঁটে, বেশ অনেক গুলি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় মায়ের মন্দিরে। সদ্য নিজেকে উপহার দেওয়া কালো উঁচু গোড়ালির জুতোকে এই ভাবে বাজারের মধ্যে ফেলে যেতে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। প্লিজ ঠাকুর, কেউ যেন আপন মনে করে নিয়ে না নেয়। যা সুন্দর দেখতে -। 


কংক্রিটের সিঁড়ি অন্য দিন হলে তেতে আগুন হয়ে থাকত, মায়ের আশীর্বাদেই হয়তো, আজকের আবহাওয়া এমন সুন্দর মেঘলা, সাথে মৃদুমন্দ বাতাস। মন্দিরে পৌঁছে শুকিয়ে গেল মুখ, যত পুণ্যার্থী কি আজকেই এসে জড় হয়েছে হেথা। যেখানে পা রাখার জায়গা পেলাম, সেখান থেকে মায়ের মুখ দর্শন অসম্ভব। দীর্ঘশ্বাসটা বোধহয় একটু জোরেই ফেলেছিলাম, সামনের অল্প বয়সী ছেলেটি ঘুরে বললে, " যত দিন যাচ্ছে, মানুষের ভক্তি আর চুরি দুটোই বাড়ছে।" 


 শুভাশীষ কোথা থেকে এক টুকরো কাগজ আর পেন এনে জিজ্ঞাসা করে, "ম্যাডাম কার নাম লিখব?" কার নামে পুজো হবে, অনেক ভেবেচিন্তে আমাদের আপিসের নামটাই লিখলাম। ভালো থাক মোদের আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর। প্রায় দেড়শ মানুষের রুজি যোগায় এই আপিসটা। আর আমাদের পরিবার বর্গ ধরলে তো সংখ্যাটা হাসতে হাসতে পাঁচশ ছাড়িয়ে যাবে। 


হয়তো সবই মায়ের কৃপা, যতটা সময় লাগবে ভেবেছিলাম, তার এক চতুর্থাংশ ও লাগল না। নাম লেখা শেষ হবার সাথে সাথেই প্রায়, প্লাস্টিকের ঝুড়ি ভর্তি রক্তজবা নিয়ে এসে হাজির হলেন পট্ট বস্ত্র পরিহিত পুরোহিত। "যারা যারা অঞ্জলি দেবেন, ফুল নিয়ে নিন -"। খপ করে একটা জবা তুলে নিলাম আমি,  এই সুযোগ কি ছাড়া যায়। কে জানে, শাস্ত্র মতে কতটা শুদ্ধ আমি, শাশুড়ি মা প্রায়ই বলেন, "মন শুদ্ধ তো সব শুদ্ধ।" আর মায়ের কাছে আবার সন্তান অশুদ্ধ হয় নাকি? 


এমনিতেই বড় মন খারাপ নিয়ে এসেছি আজ মায়ের চৌকাঠে। বিগত দিন চারেক ধরে অসুস্থ আমার গর্ভধারিণী। অসুস্থতার তীব্রতা যে কতটা সেটা আজ বৃদ্ধ বৃদ্ধা উভয়ের সাথে কথা বলেই বুঝতে পেরেছি। মন চাইছে, সব ফেলে ছুটে হাওড়া চলে যাই। কিন্তু আজ আমি না গেলে যে ছাড়া যাবে না ২৫/২৬ লাখ টাকা। যে টাকার অধিকাংশ জুড়ে আছে কারো কাজের মজুরী, কারো বোনাস, কারো বকেয়া, কারো জমা পুঁজি ফেরৎ, তো কারো মৃত্যুকালীন অনুদান। যত টাকাপয়সা অ্যালটমেন্ট সব যেন গতকাল আর আজকেই ঢুকছে বানের জলের মত। যত তাড়াতাড়ি ব্যাংক বা ট্রেজারিতে পাঠানো যায় ততোই মঙ্গল। দ্বিতীয়ার্ধে পাঠালে, কেউই নেবে না, উল্টে দাঁত কিড়মিড় করবে। 


মাইক্রোফোনে ভেসে আসা মন্ত্রে চমকে উঠি, শুরু হয়ে গেছে অঞ্জলি। একবারই মন্ত্রপাঠ হয়, অতঃপর পুনরায় ঝুড়ি নিয়ে হাজির হয় পুরোহিত মহোদয়, দিয়ে যাওয়া পুষ্প ফেরৎ নেবার জন্য। হাতের ফুল মায়ের দিকে ছোঁড়া এমনিতেও অসম্ভব, এত দূরে আছেন তিনি। অঞ্জলি শেষে, শুরু হয় পুজো। সামনের লোকজন ঝটিতি সরে যায় সামনে থেকে। পুজোর লাইন বাম দিকে। ভিড় খালি হয়ে যেতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের অনিন্দ্য সুন্দর মুখচন্দ্র। 


পুজোর লাইনে ভিড় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মন্ত্র পড়তে পড়তে পুজোর ডালা নিচ্ছেন পুরোহিত মশাই, খানিকটা মিষ্টি সরিয়ে রাখছেন, না রাখছেন না বুঝতে পারলাম না। এক মুঠো রক্তজবা প্যাকেটে ভরে, আমায় ফিরিয়ে দিলেন পুজো। এখানে নাম গোত্র ধরে যে পুজো হয় না, সেটা তিন বছর আগে থেকেই দেখে আসছি। মানত তো আর প্রথমবার করলাম না মায়ের কাছে।


মন্দির থেকে বেরিয়েই আমার গর্ভধারিণী মাকে ফোন করি। কেমন আছ মা? মিনিট চল্লিশ আগেও যার গলার আওয়াজ বেরোচ্ছিল না, তিনি বেশ ফুরফুরে কন্ঠে জানান, " ভালো আছি। সেজদা এসেছে। গল্প করছি।" ওপাশ থেকে সেজদার দরাজ গলা ভেসে আসে, " চিন্তা করিস না, আমি আছি। মাসি ভালো আছে। ওষুধপত্র সব আমি দেখে নিয়েছি। কাল আবার আসব মাসিকে দেখতে। তুই না আসা পর্যন্ত আমি সাপোর্ট দিয়ে যাব।" আমরা পাঁচ ভাইবোন একসাথেই বেড়ে উঠেছি, মাসতুতো শব্দটা কোনদিন আমাদের মধ্যে ঢুকতে সাহস পায়নি। নাহলে এই ঘোর কলিতে কার মাসতুতো দাদা এ কথা বুক বাজিয়ে বলতে পারে। 


অফিসের কাজ মিটতে মিটতে প্রায় ছটা। তাও সব মিটল কি? কোনদিন কোন সরকারী আপিসে মেটে নাকি? লাখ ছয়েক টাকা এসে ঢুকল পৌনে ছটার সময়। ধুৎ তেরি। বাড়ি যখন ফিরলাম, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে মন আর মাথা। এখনও গোছগাছ কিস্যু হয়নি। কি যে হবে ভাবতে ভাবতে বাড়ি ঢুকে দেখি তিনি নীলাম্বরী হয়ে ঘুরছেন। কোথা থেকে যেন গেল বছরে বড় মামার দেওয়া জামাটা বার করে, পরিপাটি করে চুল বেঁধে বাগানে পায়চারি করছেন, কখন মা আসবে, আর আলো দেখতে নিয়ে যাবে।


অগত্যা, আবার জুতো গলিয়ে বেরোতেই হয়, মা হওয়া কি মুখের কথা রে বাবা। সাথে জবরদস্তি লতাদিকেও ধরে নিয়ে যাই আমরা। থাক পড়ে সব কাজ, অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য। সারাদিন আমার কন্যা আর আমার শাশুড়ি মাতার দেখা শোনা করে মানুষটা, একটু আলো দেখা তো তারও প্রয়োজন।



অনির পুজোর ডাইরি ৩রা অক্টোবর, ২০২৪

শুভ প্রতিপদ 

#অনিরডাইরি 



মোটামুটি অর্ধেক পৃথিবীর মতোই, আমারও J.K Rowling এর সাথে প্রথম পরিচয় হ্যারির মাধ্যমে। আজ্ঞে হ্যাঁ, the Harry Potter। হ্যারি পটার সিরিজ যখন প্রকাশিত হয়েছিল, একটা বইও আমার কেনা বা পড়া হয়নি। কি করেই বা কিনি/ পড়ি। সারা বিশ্ব তখন কাঁপছে হ্যারি উন্মাদনায়। আকাশ ছোঁয়া দামে প্রকাশ পাচ্ছে একেকটা বই। আমি তখনও তারাসুন্দরী, আমার তখনও লাল পাড় সাদা শাড়ি। লাল ফিতে দিয়ে বিনুনি বেঁধে দিত পিসি, ভারী ব্যাগ কাঁধে, নতমস্তকে গুটি গুটি পায়ে ইস্কুল যাই আমি। ওদিকে প্রভাতী আনন্দবাজারের বইয়ের পাতা থেকে এগোতে এগোতে প্রথম পাতার তলার দিকে স্থান পেতে থাকে হ্যারি। প্রতিটা খণ্ড বাজারে আসার আগে, বইয়ের দোকানের সামনে সে কি বিশাল লাইন কচিকাঁচাদের। আমার তাতে কি? আমি দাদা বাংলা মিডিয়াম। ঐ জাব্দা ইংরেজি বই পড়া কি আমার সাধ্য নাকি? 


বই থেকে হ্যারির পদোন্নতি হল চলচ্চিত্রে। পর্দা কাঁপিয়ে দিল ড্যানিয়েল-এমা-রুপার্ট গ্রিন্ট এন্ড আদার্স। গরীবের উঠোনেও একদিন হানা দিলে wizrad কুল। ২১ ইঞ্চি রঙিন টিভি, পাড়ার বিপুল কাকার কেবল লাইন, সুযোগ পেলেই HBO/AXN/ Star Movies দেখে বেড়াই আমি। রাতে প্রাইম টাইমে ভালো ভালো সিনেমা দিত চ্যানেল গুলো। তখন তো পড়া ছেড়ে রিমোটে হাত দিলে হেট মুণ্ডু ঊর্ধ্বপদ করে দেবে মা। আমার সম্বল বলতে দুপুরের রিপিট টেলিকাস্ট। কলেজ থেকে ফিরে, ডালমুড়ির বাটি( আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি অর্ধেক হাওড়া আর অর্ধেক মুর্শিদাবাদী, আমি মুড়ি খেতে দিব্য ভালবাসি) বগলে, টিভিটা যখন চালিয়েছিলাম বিশ্বাস করুন কোন প্রত্যাশা ছিল না। প্রথম থেকে দেখতেও পাইনি সিনেমাটা। যখন শেষ হল, মনে হল আমি যেন তড়িতাহত হয়েছি। এমনও হয়? এমনও কিছু কল্পনা করা সম্ভব? 


তাই বলে বই কেনা বা পড়ার কথা ভাবলাম ভাববেন নি যেন। বললাম না দাদা আমি বাংলা মিডিয়াম। খটমট ইংরেজি সিনেমা দেখতে শিখেছি বলে কি পড়বার ও স্বপন দেখব নাকি? তাজ্জব মাইরি। 


J.K. Rowling আমার প্রিয়তম লেখিকা হলেও, ইংরেজি বই পড়ার সাহস প্রথম যিনি দিলেন তাঁর নাম Dan Brown। সদ্য চাকরি পেয়েছি কয়েকমাস। প্রথম পোস্টিং খড়গপুর। অফিস তথা যাত্রাপথটা কিছুতেই আর হজম করতে পারছিলাম না। সবকিছু কেমন যেন তেতো হাকুচ। রীতিমত মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিলাম। মেদিনীপুর লোকালের লেডিস কম্পার্টমেন্টে সদ্য আলাপ এক সমবয়সী দিদিমণি প্রথম বলল, " বই পড়।মন ভালো হয়ে যাবে"। জন্ম থেকে বই পোকা আমি। আর কি পড়ি? ওকেই শুধালাম, কিছু বইয়ের নাম বল। সৌমি নাম ছিল মেয়েটার, আজও মনে আছে, সৌমি মণ্ডল। সৌমি বলল, " Dan Brown পড়। দা ভিঞ্চি কোড।" নামটা না শোনার মতোও গবা আমি নই। কিন্তু যতদূর জানি, বইটার বিরাট দাম। সৌমি বলল, " দূর, গ্র্যান্ড হোটেলের তলায় চলে যা, ওরা ফটোকপি করে বিক্রি করে। দর করে কিনবি। ১০০ টাকার বেশি মোটেও দিবি না।"


পরের শনিবারই গিয়ে হানা দিলাম, ধর্মতলায়। গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে হেব্বি কেত মারা দোকানি, এমন ফরফরিয়ে ইংরেজি বলে যে মনে হয়, ধরিত্রী দ্বিধা হও। দাম শুরু হল সাড়ে পাঁচশ টাকা থেকে। যত বলি পাঁচটা নয়, একটা নিব রে ভাই, দর আর কমেই না। প্রায় আধঘন্টা চাপানউতোর শেষে একশ পনেরো টাকা দিয়ে বই কিনে বাড়ি ফিরলাম। এবার আপনি বলতেই পারেন, তুমি তো বাছা বাংলা মিডিয়াম। সে ভাবনা কি আমার মাথাতেও আসেনি, কিন্তু পচা আপিস আর নিত্যযাত্রার চাপ এমনি যে বাড়ি ফিরেই খুলে বসলাম বইটা। বাকিটা ইতিহাস, অন্তত আমার কাছে। সারা দিন, সারা রাত জেগে পড়ে থুড়ি গিলে যখন বইটা শেষ করলাম, অভিজিতের সেই গানটা মনে পড়ে গেল, " শালা ম্যায় তো সাহাব বান গয়া "। প্রেম/ ক্রাশের তালিকায় আরেকজন যোগ হলেন, প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন। 


পরের দুই মাসের মধ্যে ড্যান ব্রাউনের তৎকালীন সব বই শেষ করে ফেললাম আমি। লোকাল মিস করে এক্সপ্রেস ধরতে বাধ্য হলাম যেদিন, আবিষ্কার করলাম, বালতি করে বই বিক্রি হয় এই লাইনে। ভদ্রলোকের এক কথা, সব বই একশ টাকা। তবে কিনা, সস্তার তিন অবস্থা, ট্রেন থেকে কেনা Digital Fortress এর মাঝের কয়েক পাতা মিরর প্রিন্ট পেয়েছিলাম। এমন নেশা, যে ফেস পাউডারের পুঁচকে আয়না দিয়ে দেখে পাঠোদ্ধার করেছিলাম আমি, তাও ছাড়িনি। 


দেখতে দেখতে বাবার বাড়ির আলমারি ভরে উঠল, Lee Child, John Grishm, David Baldacci, Steig Larson থেকে দেশী Aswin Danghi, Amish ইত্যাদিতে। কিন্তু J.K. Rowling তখনও বহুৎ দূর। 


প্রিয়তম লেখিকার সাথে গাঁট ছড়া বাঁধল দেবশ্রী দি। ভাগ্যক্রমে প্রায় একই সাথে কলকাতায় বদলী হয়ে এসেছিলাম আমরা কয়েকজন মহিলা অফিসার। বই, সিনেমা নিয়ে আমাদের নিত্য আলোচনা হত। এমনি এক আড্ডায় ডি দি একদিন ঘোষণা করল, " আমি হ্যারি পটার পড়ছি জানো তো। তোমরাও পড়ে দেখতে পারো -।" বিদিশা দি তো জাস্ট উড়িয়েই দিল প্রথম চোটে, আমিও তাই করলাম। সিনেমা গুলো দেখেছি তো, আর বই কিনে কি হবে? ঠিক যে অর্ডারে প্রতিবাদ করেছিলাম আমরা, সেই ক্রমেই হ্যারি পটার পড়তে শুরু করলাম আমরা। পড়তে পড়তে যেন অন্য কোন ইউনিভার্সে ঢুকে গেলাম আমরা। বইয়ে যা পেলাম, তার একটা নগন্য অংশ কেবল সিনেমা গুলোতে পেয়েছি এতদিন। দিন রাত শুধু একই আলোচনা আমাদের। কাজ - কম্ম - সংসার কিছুতে মন নেই আমাদের। 


সিরিয়াস ব্ল্যাকের মৃত্যুর পর সেকি কান্না আমার। মুঠো ফোনের ওপার থেকে কতক্ষণ যে দেবশ্রী দি আমার কাউন্সেলিং করেছিল সেদিন। দুজনের কারো মনে হয়নি যে ওটা তো একটা কাল্পনিক চরিত্র কেবল। আর ডাম্বলডোরের মৃত্যুর কথাটা নাহয় উহ্যই থাক। 


দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল সাত সাতটা বই। অতঃপর সে যে কি অপরিসীম শূন্যতা, কেবল পটারহেডরাই অনুভব করতে পারে। সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। ইতিপূর্বে এই শূন্যতা যতবার দেখা দিয়েছে, ডিটক্স হিসেবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেবার যে কি হল, ব্যোমকেশ, বরদা, তুমি সন্ধ্যার মেঘ সব ব্যর্থ, মন কেবল Joanne Kathleen Rowling কেই চায়। কিন্তু তিনি যে ঘোষণা করে দিয়েছেন আর লিখবেন না। হে ঈশ্বর আমার দিকে একটু তো মুখ তুলে চাও। 


বর্তমান এক্স, তৎকালীন টুইটারে যে কত শত বার মেসেজ করেছি ওনাকে। প্লিজ ম্যাম, এভাবে অনাহারে মারবেন না। জবাবে পেয়েছি হিরন্ময় নীরবতা। Dumbledore, Sirius Black ছাড়ুন যে নারী হাসতে হাসতে Fred Weasley, Lupin, Nymphadora Tonks এমনকি Dobby , Hedwig কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে, তার থেকে আর কিই বা প্রত্যাশা করব, বলতে পারেন? 


ধুর ধুর বেঁচে থেকে আর কোন লাভ নেই, বলে ধরেই নিয়েছি, এমন সময় পটারহেডদের গ্রুপে গ্রুপে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল, আসছেন, তিনি আসছেন। তবে স্বনামে নয়, ছদ্ম নামে। আসছেন Robert Galbraith। বইয়ের নাম The Cuckoo's Calling। ততদিনে তো আমি রীতিমত উপার্জনশীল নারী, পে কমিশন ও হয়ে গেছে, সবার ওপর এসে গেছে আমাজন-ফ্লিপকার্ট। ফ্লিপকার্ট এককালে এক টাকার বই কিনলেও বাড়ি পৌঁছে দেবে বলে বিজ্ঞাপন দিত। কাকে অর্ডার করেছিলাম আজ আর মনে নেই,যদিও। 


হাতে পেয়ে কিঞ্চিৎ নিরাশ হলাম, এর সাথে পটার বা wizards দের কোন সম্পর্কই নাই। এতো নিছক muggle দের গোয়েন্দা গল্প যা দেখি। ধ্যাৎ তেরি! তবুও শুরু করলাম পড়া। আলাপ হল Cormoran Strike এর সাথে। জনৈক বিখ্যাত গায়কের অবৈধ সন্তান। মা ছিল পাক্কা সত্তরের দশকের "হরে কৃষ্ণা হরে রাম" মার্কা হিপ্পি। অগুনতি পুরুষসঙ্গী, মদ, ড্রাগস। শেষ পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবনেই মৃত্যু। স্ট্রাইকের বদ্ধমূল ধারণা যেটা আসলে সুপরিকল্পিত হত্যা। 


মায়ের অবর্তমানে মামা মামীর যত্নে বড় হয়ে মিলিটারি পুলিশ হিসেবে যোগদান করে স্ট্রাইক। আফগানিস্তান অভিযানের সময় বোমা বিস্ফোরণে হাঁটুর নীচে থেকে উড়ে যায় একটা পা। 


হঠাৎ করে বেকার হয়ে যাওয়া, প্রতিবন্ধী তকমা পাওয়া স্ট্রাইক পেটের ধান্ধায় ঠিক করে একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলবে। খুলতে গেলেও যে ন্যূনতম মূলধনের প্রয়োজন, সেটার জন্যও হাত পাততে হয়,কোনদিন কোন তত্ত্বতালাশ না করা জন্মদাতার সামনে। অপমানজনক শর্তে জোগাড় হয়, টাকা। 


ফোন ধরা এবং টুকটাক কাজের জন্য মাত্র কয়েকদিনের অস্থায়ী সহযোগী হিসেবে এজেন্সিতে যোগ দেয় Robin Ellacot। মফঃস্বলের মেয়ে রবিন, বয়সে প্রায় বছর দশেকের ছোট। ইউনিভার্সিটি ড্রপ আউট। কলেজে পড়ার সময় ধর্ষিত হয়ে, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল দীর্ঘ দিন। নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল চার দেওয়ালের মধ্যে। পরিবার তথা বয়ফ্রেন্ড ম্যাথুর সহমর্মিতা আর সাহচর্যে নতুন করে জীবনের সাথে আলাপ করতে সম্মত হয়েছে রবিন। সেক্রেটারি হিসেবে নাম লিখিয়েছে একটা সংস্থায়। সেখান থেকেই টেম্প হিসেবে, মাত্র কয়েক দিনের জন্য এই অফিসে পাঠানো হয় তাকে। পাকাপাকি সেক্রেটারি রাখার মুরোদ কোথায় স্ট্রাইকের। 


যেমন ডিটেকটিভ, তেমনি তার এসিস্ট্যান্ট। দুজনেই এক্কেবারে সাধারণ, না কারোর মগজাস্ত্র আছে, না কোন আগ্নেয়াস্ত্র। এমন চরিত্র এর আগে কোথাও পড়েছি বলে মনেই পড়ে না। ধীরে ধীরে জড়িয়ে যেতে থাকি Cormoran Strike আর Robin এর সাথে। গল্প এগোতে থাকে এঁকে বেঁকে। কখনও স্ট্রাইক এর সাথে খোঁড়াতে থাকি আমরা, প্রস্থেটিক্স আর কাটা পায়ের সংযোগ স্থলে ফোস্কা পড়ে যায় আমাদের। কখনও রবিন এর সাথে অর্থহীন জীবনে নতুন করে অর্থ খুঁজতে বেরোই আমরা। লন্ডনের জঘন্য আবহাওয়ায় তিতিবিরক্ত হয়ে যাই আমরা। স্ট্রাইক এর সাথে Doom Bar আর Fish N Chips সাঁটাই আমরা। এই করতে করতে কখন যে গল্প শেষ হয়ে যায় একরাশ ক্ষিদে রেখে, বেশ বুঝতে পারি, হতাশ করেননি প্রিয় লেখিকা। 


২০১৪ সালে এলো The Silkworm। ততোদিনে রাউলিং যাদুতে আচ্ছন্ন আমার বরও। বই/সিনেমা/ ওয়েব সিরিজ নিয়ে শৌভিক আর আমার কোনদিন মতের মিল হয়না। স্ট্রাইক বোধহয় একমাত্র ব্যতিক্রম। ২০১৫ য় যখন Career of Evil প্রকাশিত হল, ঐ কিনল দৌড়ে গিয়ে।পাক্কা তিন বছরের প্রতীক্ষা অন্তে এল The Lethal White। এই অবধিই ক্রম মেনে পড়েছি আমরা, তারপর এল অতিমারির বছর। প্রকাশ পেল Cormoran Strike series এর নতুন বই। আলোচনা - সমালোচনায় উত্তাল হল বই পাড়া, আমরা নিরূপায়। বড্ড দাম বাপু, আর বড্ড বড় ও। হাজার পাতা, ইয়ার্কি নাকি?


২০২২ এ এলো The Ink Black Heart। ব্যক্তিগত জীবনে এমন তুফান চলছে তখন আমাদের, মাত্র ৪৮ ঘণ্টার নোটিশে তমলুক থেকে কাঁথি বদলী হয়ে গেল শৌভিক। মাঝপথে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হল মেয়েকে। নিত্য ১৫০ কিলোমিটার আপিস যাত্রা শুরু হল আমার - ইত্যাদি প্রভৃতি ছাড়াও, বড্ড দাম আর তেমনি বড়। 


২০২৩ এ এল The Running Grave, ততোদিনে অনেক পিছিয়ে পড়েছি আমরা। ছিঁড়ে গেছে মুগ্ধতার মায়াজাল। "আর কি কখনও কবে "-মাঝে মাঝেই আলোচনা করি আমরা। ব্যাস ওই টুকুই।


গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম এই বছর সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ। সামনেই শৌভিক এর জন্মদিন, মাঝে মধ্যেই বলে, "একটা একটা করে কিনেই ফেলব বইগুলো। এখন দাম ও একটু কমেছে। Kindle এ কিনলে তো আরো সস্তা হবে। পুজোর সময় কিনব বরং, আমাকে তো এখানেই থাকতে হবে, তোরাও থাকবি না - ।" ধুৎ স্ট্রাইক এর গল্প আবার kindle এ পড়ে নাকি? এত হিসাব করলে জীবন চলে নাকি। ফেললাম কিনে তিনটি বই। পেপার ব্যাক গুলোর দামও এখন সাধ্যের মধ্যে। নাহলে ও বাকি, বরের জন্মদিন বলে কতা। 


জন্মদিনের রাতে মোড়ক খুলে শৌভিক খুশি হল কিনা বুঝলাম না বাপু। প্রথমটা খুলে বলল, " এ হে হে, এটা তো শেষটা। এর আগের গুলো - আচ্ছা থাক, আমিই কিনে নেব।" দাঁত কিড়মিড় করলেও বললুম না কিছু। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মোড়ক খুলে বলল, " একেবারে তিনটে না কিনলেও হতো। তিনটে বই কিনবি জানলে আমি অন্য একটা চাইতাম। Dalrymple এর নতুন বইটা -"। ব্যাটাকে জীবনে খুশি করা যায় না মাইরি। তিনি কি সাধে বলেছেন, " যতোই দাও, ততোই চাই।"


দিন যায়, হপ্তা যায়, উপহার দেওয়া চকলেট গুলো একটা একটা করে বেপাত্তা হয়ে যায়। রোজ রাত্তিরে রক্ত চক্ষু দেখায় শৌভিক, কাউকে কিছু দিয়ে ফেরৎ নিলে কি হয়,মনে করিয়ে দেয়। যতই বলি আমি খাইনি, এবাড়িতে আমি ছাড়াও আরো দুজন মিষ্টি খোর আছে, সম্পর্কে ঠাকুমা এবং নাতনি, তাদেরও তো শুধাও। তার বেলায় বোবা এবং কালা হয়ে যায় আমার বর। বই গুলো কেবল অস্পৃশ্য হয়ে পড়ে থাকে, খাস কামরা (অর্থাৎ মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বার) এর বুড়ো টেবিলের ওপর। বললেই শৌভিক বলে, " কখন পড়ব বলতে পারিস?" সত্যিই বেচারার সময় বড় অভাব। মহকুমা শাসকের পাশাপাশি দীঘার দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে দম ফেলার ফুরসৎ পায় না আজকাল। আশ্বস্ত করে, পুজোর ছুটি পড়লে পাতা উল্টে দেখবে। তবে সে আর কতটুকু পড়া হবে?ক্যালেন্ডারের লাল দেখে তো আর সত্যিই ছুটি পাবে না ব্যাটা। 


ইতস্ততঃ করে একদিন নিজেই তুলে নিলাম প্রথম খণ্ড খানা। ট্রাবলড ব্লাড, Cormoran Strike এর প্রথম কোল্ড কেস। চল্লিশ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এক মহিলার কন্যার সনির্বন্ধ অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে বাধ্য হয় স্ট্রাইক। শর্ত একটাই, এক বছরের মধ্যে যদি সমাধান হয় তো ভালো, নইলে ফান্ড তুলে নেবে ক্লায়েন্ট। হাতে থাকা আরো চারটে হাই প্রোফাইল কেসের পাশাপাশি তদন্ত শুরু হয় এই কেসেরও। কিন্তু চল্লিশ বছর আগে নিখোঁজ এক মহিলাকে খুঁজে বার করা কি এতোই সহজ! বিগত চার দশকে আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেছে সবকিছু, হারিয়ে গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তথা সাক্ষী। মারা ও গেছেন কতজন। কি ভাবে সম্ভব এই কেসের তদন্ত। 


১০৭৪ পাতা আক্ষরিক অর্থেই গোগ্রাসে গিলে সদ্য শেষ করলাম বইটা। কেন যে Joanne Kathleen Rowling ই আমার প্রিয়তম লেখক আরেক বার নতুন করে অনুভব করলাম। সাথে সাথে হেব্বি গর্ব ও হল মাইরি নিজের জন্য, জীবনের এই সন্ধিক্ষণে সব দিক সামলে, সব দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে ও হাজার পাতার ইংরেজি বই শেষ করা কি চাট্টি খানি কথা। ইশ নব্বইয়ের দশকের মেয়েটা যদি জানত, যে বাংলা মিডিয়াম হলেও জলের মত পড়া যায় সব ফিরিঙ্গি সাহিত্য। 


যাই হোক, শুভ প্রতিপদ। মা আসছেন বছর ঘুরে। কেটে যাক সকল আঁধার।

অনির ডাইরি সেপ্টেম্বর, ২০২৪

 অনির ডাইরি ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি


“সাঁতার কেটে ফিরলাম। মাথায় মধ্যে কাঁসর ঘণ্টা বাজছে, নাকে আমার সমুদ্র।“ বেলা শেষে আপিসের কাজ গুছাচ্ছি, এমন সময় কন্যার বার্তাঘাত। রোজই এই সময় নাগাদ সামান্য নিদ্রালু হয়ে পড়ে মাসি, সেই সুযোগে তাঁর মুঠোফোনটা হাতিয়ে মায়ের সাথে খানিক বকবক করে নেয় তুত্তুরী। যার বেশির ভাগ জুড়েই থাকে নানা ইমোজি আর স্টিকার। আর মাঝেমাঝেই, “Mommy পাত্তা” লিখে পাঠান তিনি। Mommy তাঁর সোহাগের সম্বোধন, অর্থাৎ, সব কাজ ফেলে মাকে এখন তার দুলালীকে পাত্তা দিতে হবে। এই ছায়া মাধ্যমে, ৭৫ কিলোমিটার দূর থেকে কি ভাবে যে তাঁকে আলাদা করে পাত্তা দেব, বুঝতে খানিক সময় লেগেছিল, তাঁর থেকেই শিখলাম, গুচ্ছ গুচ্ছ হৃদপিণ্ডের ইমোজি পাঠালেই দ্রবীভূত হয়ে যায় আমার কন্যা। সাথে যদি গুটি কয়েক বেবি হাতু, প্যান্ডা বা কোয়ালার ছবি থুড়ি স্টিকার পাঠাই, তাহলে তো তিনি বাস্তবিকই আহ্লাদে আট টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েন। 


তবে ব্যাপারটা হল কি, রোজ দিন আমাদের কথোপকথন এমন মধুর সুরে শেষ হয় না। মাঝে মধ্যেই তিনি অন্যায্য দাবী করেন, অনুনয়-বিনয় দিয়ে শুরু হয়ে, ব্যাপারটা ধমক-চমক-হুমকিতে গিয়ে শেষ হয়। এসব ক্ষেত্রে দাবী একটাই থাকে, সেই দিনটির মত তাঁকে পড়াশোনা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আর হুমকি বলতে বাবা এবং মাম্মামের (দিদার) কাছে আমার নামে নালিশ করা। যাতে ওরা আচ্ছা সে আমার কান মুলে দিতে পারে, আর কি। 


আজও মাথায় কাঁসর, নাকে সমুদ্রের পর যে সেই একই দাবী আসতে চলেছে বেশ বুঝতে পারলাম। এত্ত এত্ত শরীর খারাপের খবর শুনেও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিছু বলছি না দেখে, তিনি পুনরায় লিখলেন, “কানটাও কটকট করছে Mommy।“ সাথে যথারীতি গোটা দশেক ক্রন্দনরত ইমোজি।  কি আর করি, বললাম, “রেস্ট নাও। একটু ঘুমিয়ে নাও। দরকার হলে একটু রাত করে পড়তে বসো।“


কিছুক্ষণ কোন জবাব এল না, অতঃপর তিনি লিখলেন, “আমি একটা হাঁচলাম আর মাসির মুঠোফোনটা জলে ভিজে গেল। কিসের জল বুঝতে পারছ তো?” সেটা দিব্য বুঝলেও, হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারি না। তিনি লেখেন, “Excuse me, আমায় এখন একটা ন্যাকড়া যোগাড় করে ফোনটা সাফ করতে হবে। তোমার সাথে পরে কথা বলছি।“ 


পরের কথাটা যখন ফুটে ওঠে মুঠোফোনের পর্দায়, ততোক্ষণে সন্ধ্যা গড়িয়ে নামছে রাত। তিনি লিখলেন, “পড়তে বসছি। তুমি কত দূরে?” জানাই সবে নন্দকুমার মোড়, বাড়ি ঢুকতে আরও এক ঘণ্টা তো বটেই। তিনি লেখেন, “তাড়াতাড়ি এসো। তোমার সাথে চা খাব বলে বসে আছি।“


 বুঝতে পারি, কন্যার ঝাঁপিতে প্রচুর গল্প জমে আছে আজ, গল্পেগল্পেই না রাত কাবার হয়। লক্ষ্য করে দেখেছি,  তুত্তুরীর সন্ধ্যাবেলার গল্পগুলির একটি সুনির্দিষ্ট ক্রমপর্যায় থাকে। অর্থাৎ গল্প গুলো ধাপে ধাপে আসে। 

প্রথম পর্যায়ে থাকে ইস্কুলের গল্প। গত কালই বলছিল, কি যেন পড়াতে গিয়ে স্যার সঙ্ঘবদ্ধতা শব্দের অর্থ জানতে চান। শ্রীমতী তুত্তুরী উঠে দাঁড়িয়ে অর্থ বলার পর, উদাহরণ হিসেবে তিলোত্তমার কথা বলে। বিচারের দাবীতে কেমন সঙ্ঘবদ্ধ  হয়েছে সুশীল সমাজ, এই মুহূর্তে এই শব্দটির এর থেকে ভালো উদাহরণ আর কি হতে পারে। মুস্কিল হল, তিলোত্তমার নাম করার সাথে সাথেই ফোঁৎ করে ওঠে পিছন বেঞ্চের দুটো ছেলে। “কোন ছেলে গুলো জানো তো মা, সেই যে পরীক্ষা শেষের দিন, যারা তিলোত্তমাকে নিয়ে অশ্লীল আলোচনা করছিল বলে যাদের আমি ঝেড়েছিলাম। আজও ফোঁৎ শুনে ঝাড়তেই যাচ্ছিলাম, তার আগেই এক লাফে স্যার গিয়ে দাঁড়ালেন ওদের সামনে। তারপর কোমরে হাত দিয়ে, জলদগম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন, ‘Do you think it's funny?’ কি বকান যে বকলেন মা, কি বলব তোমায়। তবে ওদের কোন লজ্জা নেই, স্যার চলে যাবার পর বলল, ‘কি দিনই এল, সঞ্জয় রায় বলছে তিলোত্তমার প্রতি empathetic হও।‘ স্যারের নাম সঞ্জয় রায়, কি না।”

স্কুলের গল্পের পর আসে আধুনিক ভাষা নিয়ে আলোচনা। যুগ ভেদে বাংলা/ইংরেজি যে কত বিবর্তিত হয়েছে, তিনি না থাকলে আমি জানতেই পারতাম না। মুস্কিল হল, তিনি যা বলেন, তার অর্ধেকের ওপর আমার মাথার ওপর দিয়ে যায়, এই আর কি। তবে মাঝে মধ্যে মনে পড়ে যায়, আর বন্ধুবান্ধবদের সামনে কেত দেখিয়ে বলি বৈকি। সেদিন যেমন এক বন্ধুকে বললাম, “ডেলুলু ইজ দা অনলি সল্যুলু।“ কি বুঝল, ভগবান জানে- 


তৃতীয় তথা অন্তিম পর্যায়ে আসে, খেলার খবর। কোথায় কি খেলা হচ্ছে, কারা খেলছে, কারা জিতছে, কারা হারছে, তাই নিয়ে ছায়ামাধ্যমে কি ঠাণ্ডাগরম যুদ্ধ চলছে, আগামি দিনে জিও-পলিটিক্সে তার কি প্রভাব পড়তে চলেছে, এইসব নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা। কোন কোন দিন চায়ের টেবিলে দীপ্তি জীবনজী আসে, তো কোনদিন সিমরান শর্মা, কোনদিন বা প্রীতি পালের বাবা। তেলেঙ্গানার মেয়ে দীপ্তি মানসিক ভাবে কিছুটা বিকলাঙ্গ। আর পাঁচ জনের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়া দীপ্তিকে তার গ্রামের লোক পাগল, কালিকালটি, ভূতনি, বাঁদরি ইত্যাদি বলে খেপাত। সেই মেয়ে জাপানের কোবে শহরে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে ৪০০ মিটার দৌড়ে গড়ে ফেলল বিশ্বরেকর্ড। সব কোনিরই একজন ক্ষিতদা থাকে, দীপ্তির ক্ষিতদা যখন আনন্দে আত্নহারা হয়ে দৌড়ে গিয়ে খবর দিল, “ঐ মেয়ে তুই বিশ্বরেকর্ড করেছিস রে।” শিশুর সরলতা নিয়ে দীপ্তি প্রশ্ন করেছিল, “কি করেছি? অ। সোনা জিতেছি কি?” 


উত্তরপ্রদেশের সিমরান জন্মান্ধ। দৃষ্টিহীন মেয়েকে  ঘাড় থেকে নামাতে, সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল তার পরিবার। পরিবার অসহযোগিতা করলেও, বর করেনি। বিয়ের পর স্ত্রীর বিশেষ ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে পাশে দাঁড়ায় ছেলেটি। দৌড়ো মেয়ে, দৌড়ো। পূরণ কর স্বপ্নের উড়ান। "জানো মা, একজোড়াই জুতো ছিল লোকটার, রানিং শু। সেটাই সিমরানকে দিয়ে দেয়। সিমরানের ট্রেনিং এর জন্য জমি বেচে দেয়। " নিরাশ করে না সিমরান ও। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা আর প্যারা অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পেয়েছে সিমরান।


মিরাটের মেয়ে প্রীতি পাল, সেরিব্রাল পালসির শিকার। মেয়েটা দু-দুটো ব্রোঞ্জ পেয়েছে প্যারাঅলিম্পিকে, ব্রোঞ্জ প্রতি তিরিশ লাখ হিসেবে ষাট লাখ টাকা ইনাম দিয়েছে সরকার। টাকা পেয়ে প্রীতির বাবা কেবল বলেছে, “টাকাটা আগে থাকলে, আমার মেয়েটাকে আর আজ প্যারাঅলিম্পিকে যেতে হত না।” শুনতে শুনতে কখনও ভিজে যায় চোখের কোন, কখনও বা গর্বে হয়ে পড়ি আত্মহারা। 


আজও তেমনি কিছু শুনব ভেবে বাড়ি ফিরলাম, ফিরেই বুঝলাম ব্যাপার বেশ গুরুতর। আমাকে পোশাক বদল করারও সুযোগ দিলেন না তিনি, হাত ধরে সটান টেনে নিয়ে গেলেন, তাঁর ঘরে। অতঃপর হাতে তুলে দিলেন, একটি পেন। সাদা দেহ, নীল টুপি, এতো আমাদের শৈশবের Reynold। হতবাক হয়ে তাকাই তাঁর দিকে, তিনি খুশিতে ঢলে পড়ে জানান, “এটা উপহার পেয়েছি। ইংরেজি স্যার, একটা গল্প লিখতে দিয়েছিলেন, একটি নির্জন দ্বীপে ৭৯ ঘণ্টা। আমার লেখা গল্পটা ওনার খুব ভালো লেগেছে, তাই উনি আমাকে ওনার ছাত্র জীবনের পেনটা উপহার দিয়েছেন।”


আমাদের ছাত্র জীবনে পেনটার দাম ছিল পাঁচ টাকা। এখন কত হয়েছে জানি না। কিন্তু তুত্তুরীর কাছে যে এটা অমুল্য তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। অভিনন্দন জানিয়ে প্রশ্ন করি, কি গল্প লিখেছিলি? তিনি বলতে থাকেন, “ জাহাজে করে আমরা আন্দামান যাচ্ছি, প্রায় পৌঁছেই গেছি, এমন সময় ভাবলাম, যাই একবার ডেক থেকে ঘুরে আসি। বাবা মা ঘরে থুড়ি কেবিনে ঘুমাচ্ছে, আমি চুপিচুপি আমার ব্যাগপ্যাকটা নিয়ে ডেকে গিয়ে হাজির হলাম। ওমনি উঠল ঝড়, তালে তালে উত্তাল হয়ে উঠল সমুদ্রও -।” এই পর্যন্ত শুনেই ক্ষ্যামা দিই আমি। “তুই ডেকে একা, ব্যাগ প্যাক নিয়ে দাঁড়িয়ে, সমুদ্র উত্তাল আর আমরা ঘুমাচ্ছি?” এক গাল হেসে তিনি বলেন, “তাও তো শ্যামাশ্রীর মত লিখিনি, যে দুষ্টুমি করছিলাম বলে আমার মা আমায় একটা নির্জন দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।”


আর আপনারা বলেন, গতকালই নাকি ছিল কেবল কন্যা দিবস। একবার মায়ের জুতোয় পা গলিয়ে দেখুন মশাই, হাড়ে হাড়ে টের পাবেন, যে প্রতিটা দিনই, প্রতিটা ক্ষণই কন্যা/পুত্র দিবস। তারাই যে আমাদের সূর্য, তাদের ঘিরেই যে আবর্তিত হচ্ছে আমাদের জীবন। তাঁর ভাষায়, "তব নাম লয়ে চন্দ্র তারা অসীম শুন্যে ধাইছে, রবি হতে গ্রহে ঝরিছে প্রেম, গ্রহ হতে গ্রহে ছাইছে।"



অনির ডাইরি ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 





"এমনি চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো -" 


এমন রাত, এমন চাঁদ বারবার আসে না। সারা জীবনে ঠিক কতবার যে আসে, জানি না। এই সব রাতে চাঁদকে সাক্ষী রেখে গোপন ভাঁড়ার ঘরের চাবি খুলে দেয় ধরা। এইসব রাত কান ধরে আরেকবার মনে করিয়ে দেয় যে এই  বিশাল, চূড়ান্ত রহস্যময় পৃথিবীর সামনে কতটা ক্ষুদ্র, কতটা অপাংক্তেয় আমরা। 


শেষ বার এমন চাঁদ উঠেছিল অর্ধযুগ আগে, অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায়। সুকন্যা তখন পুরুলিয়ার পোস্টেড, ওর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সবাই মিলে সদলবলে রওনা দিলাম পুরুলিয়া। বিকালের পুরুলিয়া এক্সপ্রেস বেশ রাত করেই নামাল পুরুলিয়া স্টেশনে। দুটো গাড়ি নিয়ে নিঝুম ইস্টিশনে অপেক্ষা করছিল সপুত্র সুকন্যা। সোজা তুলে নিয়ে গেল বনবিভাগের বড়কর্তার সরকারী আবাসে। তিনিই সুকন্যার গৃহস্বামী কিনা। 


মধ্যরাতে জনা সাতেক অতিথি এসে হাজির হলে বাড়ির লোক একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ই, কাকু-কাকিমাও হচ্ছিলেন বোধহয়, আমরা আশ্বস্ত করলাম, আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে না। আমরা বাড়ির লোকেরও অধম। নিজেরাই খাবার বেড়ে খেয়ে নিই, নিজেরাই মশারি খুঁজে খাটিয়ে নিই,যা লাগে নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিই, আমরা এমনই। সুকন্যা আর অর্ণবদা সেটা খুব ভালো রকমই জানে। 


একরাত পুরুলিয়া শহরে কাটিয়ে, পরদিন সটান অযোধ্যা পাহাড়ের বন বাংলো। দিনের বেলা ঘোরাঘুরি, রাতে জমিয়ে আড্ডা। অর্ণবদা একাই আসর জমিয়ে দিল। এত বছর বন বিভাগে চাকরির সৌজন্যে ঝুলি ভর্তি কত রকমের যে গল্প। বন জঙ্গল আর হাতির গল্পে যতি চিহ্ন পড়ল, যখন দেবশ্রীদি ভূতের গল্প বলা শুরু করল। অখণ্ড নিস্তব্ধতার মাঝে দেবশ্রীদির মুখে শরদ্বিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের ভূতের গল্প, অধমের জীবনের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। পিকু নাম ছিল কি গল্পটার? ফিরে এসে শরদ্বিন্দু অমনিবাস খুঁজে পেতে গল্পটা বার করে আবার পড়েছিলাম আমি, একটুও ভয় পাইনি। কিন্তু সেদিন রাতে হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছিল দেবশ্রীদি। 


গল্পদিদির আসর আর একটু জমতো, কিন্তু ব্যাঘাত ঘটল, যখন সিঁড়ির দেওয়ালে বেরিয়ে থাকা একখানি ধানি লঙ্কার সাইজের পেরেকে পরপর হাত কাটল দুটো পুঁচকে। প্রথমজনেরটা নেহাৎ দুষ্টুমি জনিত দুর্ঘটনা, দ্বিতীয় জনেরটা পরীক্ষা, " কি ভাবে অট্টুকু পেরেক হাত কাটতে পারে?" গল্প মাথায় তুলে তিন খুদেকে নিয়ে পড়ল দেবশ্রী দি আর বিদিশা দি। রাত বাড়ছে, খেতেও তো দিতে হবে। বর গুলো বনজঙ্গল ছেড়ে ক্যামেরা আর ছবি নিয়ে গুলতানি করতে লাগল, সুকন্যা বলল," চল একটু হেঁটে আসি।"


বাংলোর দরজার বাইরে কেবল একটা টিমটিমে আলো, আলোর সীমানা ছাড়ালেই নিকষ আঁধার। মুঠো ফোনের টর্চের আলো পলকে শুষে নেয় সেই অন্ধকার। বেশ কয়েক পা অন্ধকারের সাথে ব্যর্থ লড়াই করে হাল ছেড়ে দিলাম আমরা। সুকন্যা বলল, " একটু সময় দাও, চাঁদের আলোয় চোখ ধাতস্ত হয়ে যাবে।" সত্যিই তাই, আকাশে সোনার থালার মত ওঠা চাঁদের মুখে জমেছিল সামান্য মেঘ, সরে যেতেই যেন ঝলমলিয়ে উঠল চরাচর। জনমানব শূন্য পথঘাট, সকালে এদিকে গুটি কয়েক গুমটি দেখেছিলাম, এখন আর কিছুই খোলা নেই। লোকজন সব গেল কোথায়? এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? মহানগরে তো এখনও বাড়িই ফেরে না অনেকে। 


একটা গুমটির সামনে একটা অতিকায় কালো শুয়োর বাঁধা ছিল সকালে, দেখলাম সেটা এখনও আছে, কিন্তু সেও গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। আরো বেশ খানিক অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে একটা তেমাথা পড়ল। তেমাথার মোড়ে একটা MGNREGA র সিমেন্টের ফলক লাগানো। তার ওপরেই বসলাম দুজনে। হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, আসার আগে কত যে কথা জমিয়ে রেখেছিলাম সবাই, দেখা হওয়া ইস্তক কিছুই আর মনে পড়ছে না। কোন আলোচনা, কোন সমালোচনা কিছুই যেন আর অবশিষ্ট নেই এই দুনিয়ায়। আছে শুধু মসি কৃষ্ণ ঘুমঘুম জঙ্গল, শেষ নভেম্বরের ঠাণ্ডা হাওয়া আর সোনার থালার মত চাঁদ। 


কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না, আচমকা কে যেন ডেকে উঠল, "ম্যাডাম"। দুজনে একসঙ্গে চমকে উঠলাম। অন্ধকার ভেদ করে ফুটে উঠল দুই মনুষ্যকৃতি। হাত জোড় করে নমস্কার করে, সামান্য ঝুঁকে তাঁদেরই একজন বলল, "ম্যাডাম, এবার ফিরে চলুন। আর এই জায়গাটা নিরাপদ নয়। আমরা সেই বন বাংলো থেকে আপনাদের পিছন পিছন আসছি,এতক্ষণ গল্প করছিলেন বলে কিছু বলি নাই, কিন্তু এবার একটু বিরক্ত করছি। রাত বাড়ছে, জন্তু জানোয়াের বেরাতে পারে। তাছাড়া মানুষও তো সবাই ভালো নয়।"


 সময়ের জ্ঞান সত্যি ছিল না, তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম দুজনে। বাকি পথটাও ছেলে দুটি পিছন পিছন এল। পেশায় বনরক্ষী ছেলেদুটো, অন্ধকারে বড়সাহেবের গিন্নী আর তার দোস্তকে বেরোতে দেখে নীরবে অনুসরণ করে এসেছে, আমরা টেরটিও পাইনি। নিজেকে বেশ কেউকেটা বোধ হচ্ছিল মাইরি, সাধে সুকন্যাকে বনবিবি বলে ক্ষ্যাপাই আমি। 


দুই বন্ধুর অবিমৃষ্যকারিতার জন্য বাড়ি ফিরে সেদিন দাদা দিদিদের বকুনি খেলেও  আমাদের বরগুলো কিছুই বলেনি, জানে বউগুলো জন্ম তারকাটা। আজই যেমন প্রকাশ্য সরণীতে হঠাৎ আব্দার জুড়লাম জ্যোৎস্নার প্রকৃত রূপ প্রত্যক্ষ করতে আমাকে কোন অন্ধকার, জনবিহীন সৈকতে নিয়ে যেতে হবে এবং এখুনি। কে জানে কখন আবার মেঘের পর্দায় মুখ লুকাবে শশী। 


সদ্য আপিস থেকে ফিরেছে শৌভিক, ফিরেছে কোথায়, না দীঘায়। কারণ বিগত কয়েকদিনের উত্তমমধ্যম বৃষ্টিতে মাননীয় মহকুমা শাসকের সরকারী আবাসনে ছাত থেকে ইয়া বড় চাঙর খসে পড়েছে। তাও আবার শাশুড়ি মায়ের পিঠের ছয় ইঞ্চি দূরে। একটু আগেই ওই খানে মাথা রেখে শুয়েছিলেন বৃদ্ধা, ঘুম আসছে না দেখে, উঠে চেয়ার টেনে বসে টিভিটা চালিয়েছেন আর অমনি ধপাস! মাথায় পড়লে কি হত ভেবে এখনও হাত পা পেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে আমাদের।


জানলার বাইরে তখন অঝোরে ঝরছে অতি গভীর নিম্নচাপের বারিধারা। আতঙ্কিত শৌভিকের আহ্বানে আবহাওয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দৌড়ে এলেন পূর্ত দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। বাংলোখানা সেই ব্রিটিশ আমলে তৈরি, তাই বোধহয় এখনও টিকে আছে। টুকটাক মেরামতির কাজ যে হয় না, তা নয়, তবে বাহারি নকল ছাতের অন্তরালে তলেতলে অবস্থা এমন সঙ্গীন কেউ বোঝেনি। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অনুরোধে দিন দুয়েক ধরে ছাঁদা বেঁধে বৃদ্ধা শাশুড়ি মাতা সহ সমুদ্র পাড়ে বাসা বেঁধেছি আমরা। 


আমার আপিস, তুত্তুরীর লেখাপড়া, ইস্কুল মাথায় উঠলেও, আপিস গিয়েছিল শৌভিক। দীঘাতেও যে একটা আপিস আছে ব্যাটার। সন্ধ্যে বেলা ফিরে কেলে কফি খেয়ে পুরাণ দীঘার সৈকত বরাবর পায়চারি করছিলাম দোঁহে। আজ সমুদ্র সুন্দরী বেশ ফাঁকা। 


পূর্ণিমার সৌজন্যে কিনা জানি না, একে তো কোটাল এসেছে সমুদ্রে, তায় এটা জোয়ারের সময়, জলের ছিটা উঠছে সুউচ্চ লাইট পোস্টের মাথা ছড়িয়ে। নিয়ন আলো ছাপিয়ে দূরে সমুদ্রের বুকে জায়গায় জায়গায় খাপচা করে সোনার জল করার মত রং করে দিচ্ছে পূর্ণ চন্দ্র। দেখতে দেখতে মনে হল, আজ তেমনি এক রাত। আজ আবার চাঁদকে সাক্ষী রেখে গোপন ভাঁড়ার ঘরের চাবি খুলে দেবে ধরিত্রী। শুধু এমন কোন জায়গায় যদি যাওয়া যেত, যেখানে এত বৈদ্যুতিক আলো আর এত শোরগোল নেই। প্রকাশ্য রাজপথে বরের বাহু আঁকড়ে আব্দার করলাম,  নিয়ে যাবি? প্লিজ? এখনই? বাকিটা জানে কেবল ভাদ্র পূর্ণিমার চাঁদ, নিরালা সৈকত, জোয়ান সমুদ্র আর সুন্দরী বুড়ি পৃথিবী।


অনির ডাইরি ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


আবহাওয়া তো বদলাচ্ছিল বিগত দিন দুয়েক ধরেই। এই টিকি পোড়ানো গরম, তো এই ভেসে গেল ধরা। এই থিকথিক করছে ভিড়, তো এই শুনশান আমাদের আপিস। তেমনি এক সায়াহ্নে স্কুলের বন্ধুদের মেসেজ করলাম, " ভাবছি ঘুমিয়ে পড়ি -"। জানলার বাইরে ঝুলছে, মসিকৃষ্ণ মেঘের পর্দা, বাজের দাপটে বন্ধ সব কম্পিউটার, আমরা গুটি কয় হতভাগ্য কর্মচারী ভিন্ন আপিস প্রায় জনশূন্য। 


ঘুমিয়েও পড়তাম হয়তো, যদি না বড়সাহেব মেসেজ করে জানতে চাইতেন, "বারখোদা কার এলাকা জানো?" গুগল করে দেখলাম, আমার এবং মুকুলের। মহকুমা আমার আর ব্লক মুকুলের। একজনের নাম দিয়ে স্যার বললেন, 'খোঁজ নিয়ে দেখো তো, এই লোকটি ওই অঞ্চলের বাসিন্দা কি না। যদি হয়, তাহলে কেমন আছে?" এমন মেসেজ তো সচরাচর করেন না বড়সাহেব, প্রতিবেশী দেশের সৌজন্যে ইদানিং যত্রতত্র বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর হামলা হচ্ছে, এটাও কি তেমন কিছু নাকি? জানতে চাইবার আগেই জানালেন বড়সাহেব, আমার অনুমানই সঠিক, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক, ভিন রাজ্যে ফুলের কাজ করত। মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছে - 


অন্যান্য মহকুমা গুলোতে ভুরি ভুরি এমন কেস আসছে, তমলুক তুলনামূলক ভাবে বর্ধিষ্ণু মহকুমা বলেই হয়তো, এর আগে এই রকম একটাই কেস এসেছিল, ময়নার ছেলে। খবর এসেছিল পিটুনি খেয়েছে, কাজ হারিয়েছে।বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে তো আমার লোকজনেরই পিটুনি খাবার উপক্রম। ছেলে ভালো আছে, বিদেশবিভূঁইয়ে থাকে, হোটেলে কাজ করে, মাসে মাসে ভালো টাকা পাঠায়, খামোখা কেন আমরা ফোন করে বা বাড়ি এসে উৎপাত করছি? অনেক কথা শুনিয়েছিল বাড়ির লোক। ভাবলাম, এটাও তেমনি হবে হয়তো। প্রার্থনা করলাম, এটাও তেমনিই হোক। আর আমিও একটু ঘুমিয়ে নিই, বড় মুখ করে বললাম বন্ধুদের। আগের বার ইন্সপেক্টর সৌরভ আর এসএলও রঞ্জন খিস্তি খেয়েছিল, এবার না হয় মুকুল আর মতিবুল দুটো গাল খাক, লোকটা যেন ভালো থাকে ঠাকুর।


বৃষ্টির দাপট একটু কমেছে, দল বেঁধে ছাতা নিয়ে টিফিন করতে যাচ্ছিল আমার লোকজন। দৌড়ে গিয়ে বললাম, দুমিনিট দাঁড়া বাবা। একটু খোঁজ নিয়ে দেখে নিই, লোকটা ঠিক আছে কিনা। মতিবুলকে ফোনেই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না আশেপাশের পঞ্চায়েতের জনা দুই তিন এসএলওকেও। বাজ আর বৃষ্টির দাপটে সবাই ফোন বন্ধ করে বসে আছে নাকি? বাকিদের খেতে পাঠালাম, শান্তনু একা রয়ে গেল ফোন করার জন্য। 


বেশ কিছুক্ষণ পর বাজল মতিবুলের ফোন। নামটা বলল শান্তনু, ওপাশ থেকে কি জবাব ভেসে এল জানি না, ফ্যালফ্যাল করে খানিক আমার দিকে তাকিয়ে শান্তনু বলল, "ম্যাডাম মতিবুল বলতেছে, ছেলেটা মরে গেছে।" কি বাজে বকছ, বলে ফোনটা কেড়ে নিই আমি। মতিবুল তখনও ধরে আছে ফোনটা, আবার শুধালাম আমি, ও কি ছেলেটাকে চেনে? ছেলেটা কি সত্যিই পরিযায়ী শ্রমিক? কেমন আছে ছেলেটা? আবার জবাব দিল মতিবুল, " হ্যাঁ ম্যাডাম, চিনি তো। আমার বাড়ির পাশেই থাকে। পিটিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিছে, আর বেঁচে নেই -। আমি আপনাকে ছবি পাঠাচ্ছি।" 


ক্লান্ত, পরাজিত হয়ে মাথা নীচু করে চেম্বারে ফিরে আসি, ভারী মন, ভারী গলায় বড়সাহেবকে দুঃসংবাদটা দিই। জানাই মতিবুল ছবি পাঠাচ্ছে, মিলিয়ে নেওয়ার জন্য। বড় সাহেব আঁতকে ওঠেন, "কিসের ছবি?" বলি, ছেলেটার বা তার আধার, ভোটার কার্ডেরই হবে। স্যার বলেন, "না। ওর বর্তমান অবস্থার। আমিও পেয়েছি ওই ছবিগুলো, ইচ্ছে করেই তোমায় পাঠাইনি। এত বীভৎস, তুমি প্লিজ ওগুলো দেখো না -"। স্যারের ফোন শেষ হবার আগেই, দৌড়তে দৌড়তে আসে শান্তনু, " ম্যাডাম, মতিবুল কি সাংঘাতিক সব ছবি পাঠিয়েছে -। একদম দেখবেননি। একটা দেখেই আমার মাথা ঘুরছে -"। 


কেমন দেখতে হয়, গণপ্রহারে মৃত মানুষকে? আমার দেখার ইচ্ছে নেই। আমার দেখার ক্ষমতা নেই। অপরিসীম ক্লান্তির সাথে সাথে এক অক্ষম রাগ আমাকে গিলে খাচ্ছে। কেন? কেন? কেন? আধার নম্বর জোগাড় করে ততক্ষণে পোর্টাল খুঁজে দেখে ফেলেছে বেদজ্যোতি, আছে, ছেলেটি আছে। সরকারী প্রকল্পে নথিভুক্ত আছে। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে দুলক্ষ টাকা পাবে ছেলেটির উত্তরাধিকারী। তাতে কি? কত টাকা মূল্য হয় একটা প্রাণের? আদৌ কি কোন মূল্য হয় প্রিয়জন বিরহের -।

অনির ডাইরি ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ 


#পায়ের_তলায়_সর্ষে #অনিরডাইরি #ফিরেদেখা 


আমি প্রায় বলি যে আমার জীবনের সবথেকে সেরা মুহূর্ত গুলি না তো ক্যামেরা বন্দী করতে পেরেছি, নাই সোশাল মিডিয়ায় আপলোড করতে পেরেছি। সময়টা ২০০৮। তখনও অবিবাহিত। বেড়াতে এসেছি উত্তর ভারত। বাবা-মা,তিন মাসি, মেসোমশাই,বোন এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ও তাদের বন্ধু পরিবার নিয়ে প্রায় জনা কুড়ির দল।আমাদের মত জনা তিন কেবল কুড়ির কোঠায় বাদে সকলেই বয়োজেষ্ঠ্য। আমরা ওভাবেই যেতাম।আড্ডা দিতে দিতে বেড়ানো আর বেড়াতে বেড়াতে আড্ডা। 


 হলুদ চাটার্ড বাসে রওনা দিলাম হরিদ্বার থেকে। আমাদের বেড়ানোর আর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল,সবসময় অব সিজনের শুরুতে আমরা গিয়ে হাজির হতাম। পর্যটকদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত শহর নগরের আচমকা ক্লান্ত,ঝিমানো রূপ বড়ই মধুর লাগত। ফাঁকা ফাঁকা সড়কে ধুলি উড়িয়ে বেড়ানো শুকনো পাতা, ধরমশালার সার সার তালা বন্ধ ঘরের নিস্তব্ধতা কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দিত। 


সারাদিন বাস গড়াল,পিছনের সিটে বসে এন্তার গান গাওয়া, ছোট মাসীর সহকর্মী ফাল্গুনি কাকু মাঝে মাঝে নামছে আর কমলা গুলি লজেঞ্জ কিনে আনছে। যারই গা গুলোচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে একটা মুখে পুরে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে বদলাল পাহাড়ের প্রকৃতি। বদলাল গাছপালা। নদীর জলের রঙ সাদা থেকে হাল্কা নীল হল যেন। বদলাল রাস্তার চরিত্র। বিকালে নামলাম উত্তরকাশি। ফাঁকা ধুধু করছে। গলি গলি দিয়ে হেঁটে গিয়ে লালকমলী মার্কা ধরমশালায় রাত্রিযাপন। সন্ধ্যের অন্ধকারে হেঁটে গিয়ে টিমটিমে বাল্বের আলোয় বুড়ো মহেশ্বরকে পুজো দেওয়া। পুরোহিত নেই। বাড়ি চলে গেছে। ভোলা মহেশ্বর একা নিঃসঙ্গ বসে আছেন। আবার অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ফেরা। সারা রাত কানের কাছে গঙ্গার গর্জন।সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ঝলমলিয়ে উঠলেন নদীর বুকে বিশাল মহাদেব। 


পরদিন নটার মধ্যে উত্তরকাশিকে বিদায় জানিয়ে আবার বেরিয়ে পড়া।এবার হিমালয় বড় রুখা। বিশাল বিশাল গাছ বহুনীচে থেকে খাড়া উঠে এসেছে। গিরিখাতের বুকে খঞ্জর চালিয়ে এগিয়ে যাওয়া নদীর জলে মিশেছে যেন আকাশ। আর আকাশ এত নীল হয়?টলটলে নীল আকাশ। আর রাস্তা?রাস্তা তো নেই দাদা। শুধু ধ্বংসস্তুপ। ধ্বসে পড়া পাথরকে পিসে দিয়ে টলতে টলতে এগোল বাস। গা গুলোনো বেড়ে গেল বহুদিন। আর দোকানপাট,মানুষজন কিছুই নেই। আছে শুধু হিমালয় আর আমরা। পলকে পলকে বাস বাঁক নিচ্ছে,একবার আর্তনাদ করে উঠল মা,দেখলাম বাসের সামনের একটা চাকা রাস্তায় আর একটা ঝুলন্ত। ড্রাইভারের বিশেষ হেলদোল নেই। হেঁইও-- ঘুরে গেল বাস,হাফ ঝুলে ঝপাং করে রাস্তায় উঠলাম আমরা। 


সন্ধ্যে নামার মুখে গঙ্গোত্রীতে পৌছলাম। ঠাণ্ডার কামড় বেশ বুঝতে পারলাম। চড়চড় করে ফেটে গেল পিঠের চামড়া।জিন্স, সোয়েটার, জ্যাকেট,টুপি চাদরেও হিহি করতে করতে ব্যাগ কাঁধে বাজারের ভিতর দিয়ে গঙ্গার ওপাড়ে যেতে হবে। নামা মাত্রই মা, আর বয়স্ক কয়েকজনের শুরু হল শ্বাসকষ্ট। বাতাসে অক্সিজেন বেশ কম। চোখের সামনে যে পাহাড়,তা আর সবুজ নয়। সবুজ ঝাউ টাইপ গাছের লাইন একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় শেষ। তারওপরে কিছুদূর খসখসে পাথুরে পাহাড়,তারওপর জমাট বাঁধা সাদা বরফ। পড়ন্ত সূর্যের দীপ্তিতে গোলাপী সোনালী সাদা-


গঙ্গোত্রীর এপাশটা বেশ নিরিবিলি। ওপাড়ে ঝলমলে শহর,এপাড়ে নিকষ আঁধার। শীতের কামড়ও বহুগুণ বেশী যেন। যে ধরমশালায় থাকার কথা,গিয়ে জানা গেল তিন দিন ধরে পাওয়ার নেই। জেনারেটর চলে চলে ক্লান্ত।আর তেলও নেই। মোমবাতি ও পাঁচ ছটার বেশী নেই। পুরো ধরমশালায় আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। কয়েকজনের একতলা আর কয়েকজনের দোতলায় ঘর বরাদ্দ হল। অন্ধকার হিমশীতল ঘরে ঢোকা মাত্র হাড়ে হাড়ে কটকটি বাদ্য শুনতে পেলাম। এলসিডি টর্চ তো জ্বললই না। দুম করে চার্জ শেষ হয়ে গেল সবকটা মোবাইলের। টাওয়ার তো উড়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। 


এই অন্ধকারে আলাদা আলাদা থাকা অসম্ভব।কি অসহনীয় নিস্তব্ধতা। কানে যেন তালা ধরে যায়। একটা বড় ঘরে আটজন থাকব ঠিক হল। তিনটি পুঁচকে সিঙ্গল খাটে বাবা-মা আর তিন মাসি ভাগ করে শুল। আর মাটিতে মেসোমশাই,আমার বোন দীপু আর আমি।


 মাটির ওপর একটা তোশক দিয়ে গেল কেয়ারটেকার,যার বয়স বড়জোর তেরো কি চোদ্দ। আর গায়ে দেবার জন্য লেপ। সেই লেপের ওজন কমসেকম দশ কিলো তো হবেই। 

এবার মোমবাতির রেশন হল। রান্নাঘরে একটা,সিঁড়ির সামনে একটা আর তিনটি ঘরে একটি করে। একটি রিজার্ভ রইল রাতের জন্য। আটজন মানুষ একটি ঘরে,উপরন্তু একটি মোমবাতি, অক্সিজেনের সামগ্রিক অভাব বুঝতে লাগল মিনিট পাঁচ। তড়িঘড়ি মোমবাতিটিকে ঘরের বাইরে রেখে এলেন মেসোমশাই। ঐ প্রগাঢ় অন্ধকারে পা থেকে মাথা অবধি উলের জিনিসপত্রে ঢেকে দশ কিলো লেপের তলায় জড়াজড়ি করে শুয়েও ঠকঠক করে কাঁপছিলাম দীপু আর আমি। এমন সময় শুরু হল বাবা আর মায়ের দাম্পত্যকলহ। বাবা চেইন স্মোকার। তারওপর ফুসফুসের অসুখে আক্রান্ত, বার দুয়েক নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। ফলে মায়ের উদ্বিগ্ন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। হাতে গ্লাভস্ পরো আর এই ঠাণ্ডায় সিগারেট খেয়ো না-এই টুকু বলাই ছিল মায়ের অপরাধ। 


বাবা ক্রুদ্ধ হয়ে টুপি,গ্লাভস,মোজা না পরেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বলাইবাহুল্য সিগারেট আর দেশলাই কিন্তু ভোলেনি। মায়ের টেনশন কমাতে অগত্যা আমাকেই উঠতে হল লেপের ওম ছেড়ে বৃদ্ধকে খুঁজতে। ঘরের সামনের মোমবাতির শিখা থিরথির করে কাঁপছে,নিশ্চুপ ভুতুড়ে ধরমশালায় কেবল প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমার পায়ের আওয়াজ। প্যাসেজের মোমবাতি নিভু নিভু। গেল কোথায়?তবে কি এই ঠাণ্ডায় খালি মাথায়,খালি পায়ে রাস্তায় বেরিয়েছে?সর্বনাশ। অবধারিত নিউমোনিয়া। পায়ে পায়ে দরজা খুলে বাইরে এলাম। শীতল হাওয়া যেন পলকে সব পশমী বস্ত্রের আস্তর ভেদ করে ফালা ফালা করে দিল। দূরে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে আছে বাবা। হাতে জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনটা যেন এক জ্বলন্ত জোনাকি। চিৎকার করে ডাকতে গিয়েও পারলাম না,মোহিত হয়ে গেলাম নৈশ প্রকৃতির ভুবনমোহিনী রূপে। মাথার ওপর দিগন্তবিস্তৃত মসিকৃষ্ণ মহাকাশ,আর তার গায়ে খচিত শতসহস্র হীরের কুচির মত ঝকঝকে তারা।যেন হাত বাড়ালেই ধরতে পারি আমার নিজস্ব কোহিনুর। ঘোর অন্ধকারে গঙ্গার ওপাড়ের শহরের টিপ টিপ আলো যেন কালো সিল্কের শাড়িতে খচিত সলমা চুমকির আলপনা। আর অদূরে পাহাড়ের মাথায় বরফের মুকুট -সব মিলিয়ে বোধহয় এই অধমের ক্ষুদ্র জীবনের সবথেকে মোহময়, রোমাঞ্চকর মুহূর্ত ছিল সেটা।


অনির ডাইরি ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


জন্মদিন নিয়ে আমার বরের কোন আলাদা অনুভূতি নেই। অবশ্যি কি নিয়ে যে আছে, ভগবান জানে। সবেতেই কেমন যেন উদাসীন হাবভাব। আর এদিকে আমি হলাম কিনা পাক্কা Aquarian। শিরা - ধমনী - রক্তজালকে আবেগ আর আদিখ্যেতার ছড়াছড়ি। আরে ভাই, "আমার ইনি প্রথম পক্ষ" যে - 


মোটামুটি আগষ্টের বেতন ঢোকার বার্তা পাবার সাথে সাথেই, হন্যে হয়ে ফিরি শপিং সাইট গুলোতে। কি দেওয়া যায় লোকটাকে? গুগলকেও শুধাই, বছর পনেরো ষোলোর বুড়ো বরকে জন্মদিনে কি উপহার দেওয়া যেতে পারে বলো দিকি? ধুর ধুর, সাধ্যের মধ্যে একটাও মনোমত কিছু আসে না। 


জামাকাপড় দেব কি? দিয়ে কি হবে? শৌভিক তো গেল বারের জামাটাও এখনও ভাঙেনি। বিবাহবার্ষিকী বা নববর্ষে দেওয়া গুলো এক আধবার পরেছে কেবল। সব জমানো আছে থরে, থরে। মান্ধাতার আমলের গুলোও। না পরে, না ফেলে। বললেই বলে, 'কোথায় পরব?' কেন অফিসে পরলেই তো হয়, এতবার দীঘা যায়, আজ অমুক কমিটি, কাল তমুক কমিটির সাথে মিটিং করে, কত মাননীয়(ইয়া)দের অভ্যর্থনা জানাতে যায়, পরলেই তো পারে। বললেই শৌভিক বলে, 'ধুৎ!' 


মোদ্দা কথা, জামাকাপড় দিতেই পারি, তবে তার আগে আলমারি সাফ করা বাধ্যতামূলক। লর্ড ক্লাইভ বা বাদশা আকবরের দেওয়া গুলো না হয় থাক, সম্রাট অশোক আর স্কন্ধগুপ্তর আমলেরগুলো এবার বিদায় করতেই হবে। 


বই দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও শৌভিক গোল বাঁধায়, "ফ্রি পিডিএফ পাচ্ছি তো" অথবা "Kindle এ কিনে নেব, অনেক সস্তায় হবে।" ধুর, জন্মদিনে কেউ Kindle এর বই উপহার দেয়? আর দেয় কিভাবে? ও কিনবে আর আমি ওকে টাকাটা দিয়ে দেব? ম্যা গো! উপহার হিসেবে খসখসে পাতা, সোঁদা কাগজের গন্ধওয়ালা নতুন বইয়ের কি কোন তুলনা হয়। কিন্তু কি বই কিনি? জিজ্ঞাসা করলেই শৌভিক ঠোঁট উল্টে বলে, " ও কিছু দিতে হবে না। এই মুহূর্তে এত বই জমে আছে, পুজোর ছুটির আগে দেখা যাবে ক্ষণ।" 


এমন লোককে উপহার দেওয়া শিবের বাবারও কম্ম নয় বাপু। নেহাৎ আমি Aquarian। কিছু কিনি, লুকিয়ে চুরিয়ে। বন্ধুবান্ধবের নাম করে, ঘুরিয়ে শুধিয়ে। বেচারারা কতবার বিষম খায় কে জানে। বক্স খাটের ভিতর, ধূলিমলিন এক পিট্টু ব্যাগে লুকিয়ে রাখি সব কিছু, সারপ্রাইজটো তো দিতে হবে, জন্মদিনের রাতে। আমার এমন কপাল, দিন সাতেক আগে তিনি সেই ব্যাগটি এনে, ভিজে বেড়ালের মত দুষ্টু হেসে আমায় বললেন, " কি সব ভরে রেখেছিস। ব্যাগটা খালি করে দে।" দাঁত কিড়মিড় করে জানতে চাইলাম, এই ব্যাগটাই দরকার পড়ল? তিনি একগাল হেসে বললেন, " হ্যাঁ তো। এতে এক সেট জামা কাপড় নিয়ে দীঘা যাব। আজ হোল ডে ইন্সপেকশন। প্রচুর হাঁটাবেন ডিএম সাহেব। লাঞ্চ ব্রেকে চেঞ্জ করে নেব।" ধুর ধুর, সত্যি মনে হচ্ছিল তখন, বেঁচে থেকে আর লাভ নেই।


এতো গেল উপহার পর্ব, এবার আসি ভোজন পর্বে। আমার বরটি মোটেই ভোজন রসিক নয়। প্রাক বিবাহ প্রণয় কালে একবার প্রশ্ন করেছিলাম, " কি খেতে ভালোবাসো?" প্রচুর মাথা চুলকে, পাক্কা এক সপ্তাহ পর শৌভিক জানিয়েছিল, "পায়েস খেতে ভালবাসি।" পায়েস তো করবই, শৌভিকের মনপসন্দ লাল লাল চাপ চাপ পায়েস। সাথে আর কি? তুত্তুরীর জন্মদিনে, কি রান্না হল তার থেকেও আমার মেয়ের কাছে অধিক গুরুত্বপুর্ণ হয় কটা বাটি দেওয়া হল। শৌভিকের ক্ষেত্রে তাই করলে ডাহা ফেল করব। তিন চারটে বাটি দেখলেই মাথা চুলকাবে ব্যাটা। দুপদে বুঝিয়ে দিতে হবে আজ তোমার স্পেশাল দিন। 


তবে সবার আগে আসে কেক। ক্রিম কেক তাঁর দুচক্ষের বিষ। ঠিক করি, বাটারস্কচ পুডিং কেক বানাব, তার জন্য। বাটারস্কচ তার প্রিয়তম ফ্লেভার। শ্বশুরমশাই গত হবার পর থেকে শাশুড়ি মা আমিষ খাচ্ছেন না। তাই ঠিক করলাম, সবটাই এগলেস বানাব। এগ লেস কেক বা পুডিং বানাতে একটু বেশি খাটতে হয়, তা হোক। 


চার ধাপে বানাতে হয় কেকটা। প্রথম পর্যায়ে পাতি কেক, তারপর ক্যারামেল সস, তৃতীয় পর্যায়ে বাটারস্কচ পুডিং আর অন্তিম ধাপে দুই চামচ চিনিকে ক্যারামেল বানিয়ে, তাতে সামান্য মাখন আর গোটা আটেক রোস্টেড আমন্ড চূর্ণ মিশিয়ে, ঠাণ্ডা করে বেলুন দিয়ে উত্তমমধ্যম দিলেই কুরমুড়ে বাটারস্কচের দানা তৈরি। অফিস থেকে ফিরেই লেগে পড়ি কেক বানাতে। সর্বপ্রথম আধ কাপ ঈষদুষ্ণ দুধে এক চামচ ভিনিগার মিশিয়ে বানাতে হবে বাটার মিল্ক। তাতে একে একে মেশাতে হবে ১/৪ কাপ তেল, আধ কাপের একটু বেশি গুঁড়ো চিনি। আমাদের whisker নাই, কাঁটা চামচই ভরসা। ফেটানোর তালে তালে একে একে মিশবে ভ্যানিলা এসেন্স, বেকিং পাউডার, খাবার সোডা। বাটারস্কচ এসেন্স থাকলে ভালো হত, সে আর এই ভর সন্ধ্যায় কাঁথিতে কোথায় পাই। অগত্যা মদ্যাভাবে গুড় থুড়ি ভ্যানিলাই সই।


এর সাথে ময়দা আর এক চিমটি নুন মিশিয়ে নিলেই কেকের ব্যাটার রেডি। যার চ্যানেল দেখে শিখেছিলাম রেসিপিটা, তিনি পইপই করে বলেছিলেন, এই পর্যায়ে খুব ধীরে ধীরে একই দিকে ঘুরিয়ে মেশাতে হবে সবকিছু। রিবনের মত যখন ঝরে পড়তে থাকে ব্যাটার তখন বুঝি, কাজ শেষ। এবার বেক করার পালা। বড় কড়াইতে লবণ ছড়িয়ে মিনিট দশেক তাতিয়ে নিয়ে, তারওপর মোটা কাঁচের পাত্রটা বসিয়েই দিই ঈশ্বরের নাম করে। হে ঠাকুর, বরের জন্য কেক বানাচ্ছি, দেখো পাত্র ফেটে কেলেঙ্কারি না হয়। 


তিনি বাড়ি ফেরার আগেই আমাদের প্রথম পর্যায় শেষ। কেক ঠাণ্ডা না হলে আপাতত এগোনো যাবে না। গোবেচারা মুখ করে পড়তে এবং পড়াতে বসি আমরা মা মেয়ে। তিনি ঘরে ঢুকেই বেশ কবার নাক টেনে, মিটিমিটি হেসে বলেন, " কেক বানাচ্ছিস বুঝি। আবার পুডিং ও বানাচ্ছিস? গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে যেন"। কেমন রাগটা ধরে, লোকটা সত্যান্বেষী বা টিকটিকি হলেই তো পারে!


শুভ জন্মদিনের বিলম্বিত শুভেচ্ছা বুজুর বাবা। বার বার দিনটা ফিরে ফিরে আসুক, আরো আরো ভালোবাসা নিয়ে। আর ইয়ে বলি কি, কেউ যখন সারপ্রাইজ দিতেই চাইছে, সারপ্রাইজ দিতে এত্ত খাটছে, তখন খানিক সারপ্রাইজড হলেও তো পারো বাপু? দেবানন্দের ভাষায়, ' ঝুটা হি সহি ❤️'।


Tuesday 6 August 2024

অনির ডাইরি আগস্ট, ২০২৪

অনির ডাইরি ২৮শে আগস্ট, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 

আজ আবার বনধ থুড়ি ধর্মঘট। মহামহিমের নির্দেশে আজ আপিস যাওয়া বাধ্যতামূলক। ঘুম যখন ভাঙল, তখনও পুরো ফর্সা হয়নি আকাশ। গতরাতে পই পই করে বলেছিল শৌভিক, "তোর ওই পাকিস্তানি মেলোড্রামা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়, সকালে উঠতে পারবি না।" শুনিনি এবং এই মুহূর্তে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, গরীবের কথা বাসি হলে কতটা মিষ্টি হয়। 


ঘুমন্ত চক্ষু জোড়াকে টেনে খুলে, এক কাপ হাকুচ কালো চা গলায় ঢেলে, ঝটিতি কাক স্নান সেরে বেরোতে বেরোতেই ঘড়ির কাঁটা ছাড়িয়ে গেল সাড়ে ছটার ঘর। এখনও পুজো বাকি, হে ঈশ্বর আজ নমঃনমঃ করে পুজো করলে কি একেবারেই হবে নি? কোনমতে বাসি ফুল ফেলে, তুলসীতলায় জল দিয়ে,মাথা পিছু একটা করে ফুল তুলে একটা ধূপ জ্বেলে বললাম, আজকের মত মার্জনা করো আমায়। ঘড়ির কাঁটা পৌনে সাত ছাড়াল বুঝি। দেরী হলে কি যে হবে আজ। ওরা তো শুনবে না, তোমরাই একটু বোঝ প্রভু।   


বেরোতে বেরোতে বেজে গেল প্রায় সোয়া সাত। ছটার মধ্যে বেরোতে বলেছিল শৌভিক, সোয়া ঘণ্টা লেট। এতটা পথ যাব, কি যে হবে। মুঠো ফোন বলছে ট্রেন লাইনে অবরোধ শুরু হয়ে গেছে। অফিস যাবার দীর্ঘ পথটায়ও জায়গায় জায়গায় কমলা দেখাচ্ছে গুগল ম্যাপ। ঘুম ভেঙে, বাসি মুখে, প্রাতঃকৃত্য না সেরেই অবরোধ করতে চলে এল নাকি জনগণ। 


গাড়ি স্টার্ট নিতেই মনে পড়ল, জনৈক সহকর্মীর কথা। কাছেই থাকে ছেলেটি, গত বৃহস্পতিবার থেকে ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত। গতকাল সকালেও মেসেজ করেছিল ছেলেটা, "ম্যাডাম খুব দুর্বল। আজও অফিসে যেতে পারছি না। আমার বাড়ির সবাই আক্রান্ত।" ধরেই নিয়েছিলাম আজ যাবে না, ড্রাইভার বলল, " ওই স্যার মনে হয় যাবেন। একটু আগে ফোন করে জানতে চাইছিলেন আপনি বেরিয়েছেন কি না।" 


এই এক জ্বালা, এত বছর আধিকারিকগিরি করেও, কিছুতেই ওরটা ও বুঝে নেবে ভেবে উঠতে পারি না আমি। ফোন করলাম, মুঠো ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল অসুস্থ কাতর কন্ঠস্বর। প্রশ্ন করলাম, তুমি কি যেতে পারবে? ছেলেটি বলল, "পারব ম্যাম, কিন্তু একটু সময় লাগবে। ভাইরালে গোটা বাড়ি অসুস্থ, বিশেষ করে মা একদম কাহিল। চোখে দেখতে পাচ্ছে না। মায়ের নৈমিত্তিক কাজ গুলো করে বেরোতে আরো মিনিট দশ লাগবে। এখান থেকে রূপসী বাইপাস পৌঁছাতে আরো মিনিট দশ ধরুন।"  


মনে মনে হিসাব করলাম আরো আধ ঘণ্টা, অর্থাৎ পৌনে আটটা। অফিসে ঢুকতে ঢুকতে নয় সোয়া নয়, অবরোধকারীদের প্রিয় সময়। হিসেব করলাম বটে, মুখে বললাম, তুমি মায়ের পরিচর্যা করে বেরিয়ে এসো, আমরা যতটা পারি ডিট্যুর করে তোমার বাড়ির কাছ দিয়ে যাচ্ছি। 


আমার কথা মত ড্রাইভার সাহেবও খুব আস্তে আস্তে ডিট্যুরের রাস্তা ধরলেন। আমার মন আপাতত খোলা আকাশ। হুহু করে যাচ্ছে আসছে, ভাবনা চিন্তা আর স্মৃতির দল। কম ধর্মঘট তো পার করলাম না এই জীবনে। এই তো সেদিনের কথা, আমার কর্মজীবনের প্রথম ধর্মঘট। সময়টা ২০০৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধ। শিল্প ও বাণিজ্য দপ্তরে অবর বর্গীয় সহায়ক হিসেবে সদ্য জয়েন করেছি। বুঝতে পারছি অন্তত আরো এক ডজন সরকারী চাকরী পেতে চলেছি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে। এতদিন প্রচুর হ্যাটা দিয়েছে আত্মীয়স্বজন, বেশ কিছু সহপাঠিনী। এমনকি এই চাকরি নিয়েও শুনিয়েছে, রাজ্য সরকারী L.D র আর ক'পয়সা বেতন আর কিই বা ইনক্রিমেন্ট। এবার জবাব দেবার পালা। রীতিমত স্বয়ম্বর সভা বসতে চলেছে সরকারী চাকরি গুলোর। সুতরাং " আজকাল পাঁও জমি পর নেহি পড়তে মেরে -"।


এমন সময় বনধ ডাকল কোন এক বিরোধী দল। আজকালকার মত ম্যাদামারা বনধ নয়, চাক্কা জ্যাম মার্কা আগুনে বনধ। আমার তো আনন্দের শেষ নেই। বনধ মানেই ছুটি। একটা দিন অন্তত আর ভোরে উঠে, নাকে মুখে গুঁজে ট্রামবাসে বাদুর ঝোলা হতে হবে না। অর্থাৎ অখণ্ড ল্যাদ আর সদ্য ধর্মতলা থেকে কেনা ১০০ টাকার ড্যান ব্রাউন। মুখ ফসকে বলে ফেলেই বাঁধালাম কেলো। আঁতকে উঠল তৎকালীন সহকর্মীর দল। অতসী ছিল টাইপিস্ট, প্রথম দিন থেকেই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, মাথায় চাঁটি মেরে বলল, " বনধের দিন আসবি না কি রে, ওই দিনই তো আসল মজা। যখন খুশি আয়, এসে সই করে কেটে পড়।" শুধালাম, যদি না আসি কি হবে? জবাব এল, " শোন অন্য পার্টি ডাকলে একটা দিন ছুটি কাটে আর যদি শাসক দল ডাকে, তাহলে আসবি না, জানবি ওটা সবেতন ছুটি।" 


শাসক দলের বন্ধ ছিল না, ফলে একটা ছুটিই তো কাটবে, কাটুক। অফিসে জোর গলায় বলে এলাম বটে, বাড়িতে কেউ পাত্তাই দিল না। নির্দিষ্ট দিনে, আপিস টাইমের একটু পরে কান ধরে রাস্তায় বার করল বাবা। আমাদের বাড়ির মেয়ে হয়ে তুমি এই অশান্ত পরিস্থিতিতে ঘরে বসে থাকবে, ওটি হবে না। যে দল বনধ ডেকেছে, আমাদের মহল্লায় যুগ জন্ম ধরে সেই দলেরই রাজত্ব। দলীয় পতাকায় প্রায় মোড়া প্রতিটা সাবেকী আখাম্বা ল্যাম্পপোস্ট, মোড়ে মোড়ে জমায়েত, হুহু করে জ্বলছে টায়ার, দাঁড়িয়ে আছে কাঁচ ভাঙ্গা ফাঁকা বাস । একটাও বাস বা রিক্সা নেই রাস্তায়, টোটো তো তখনও আবির্ভূতই হয়নি। রাস্তা ভর্তি প্রচুর মানুষ। সবাই প্রায় বাবার পরিচিত। জিন্দাবাদ মুর্দাবাদ করতে করতেই অনেকে সোচ্চারে বাবার কুশল সংবাদ নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার সন্দিগ্ধ হয়ে শুধাচ্ছে, " কোথায় চললেন মেজদা?" ভদ্রলোকের এক কথা, সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাবা সবাইকে একই জবাব দিচ্ছে, " এই যে মেয়েকে বনধ দেখাতে বেরিয়েছি -"। যেন বনধ একটা দেখার মত ব্যাপার আর কি। 


হাঁটতে হাঁটতে হাওড়া ময়দান। ময়দানে দীর্ঘ ক্ষণ দাঁড়িয়ে একটা বাস পেলাম, ধর্মতলা মিনি। প্রায় ফাঁকা বাস, তাতেই তুলে দিল বাবা। আব্দার করছিল, রাইটার্স অবধি সঙ্গে যাবে বলে, অতি কষ্টে নিরস্ত করলাম ডানপিটে বৃদ্ধকে। বন্ধুরা জানলে যা খিল্লি হবে, বাপরে। ফাঁকা রাস্তা ধরে বাদল দিনের পাগল হওয়ার মত ছুটল বাস। হাওড়া ব্রিজ ধুধু করছে। গুটি কয়েক আড্ডারত আইন রক্ষক ছাড়া কাউকে নজরে এল না। বড়বাজার ও ঝাঁপ ফেলা, মিনিট দশেকের মধ্যে বাস এসে দাঁড়াল লাল বাড়ির সামনে। ১নং গেটে কর্তব্যরত আইন রক্ষকদের কেউ ফিরেও তাকাল না আমার দিকে, আই কার্ড না দেখিয়েই দিব্য ঢুকে গেলাম ভিতরে।


বিগত আঠারো বছরে কত বদলে গেছে সবকিছু। ভাবতে ভাবতে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম, সাতটা তেত্রিশ। গেল কোথায় ছেলেটা? এবার তো রাস্তায় আটকে পড়া অবশ্যম্ভাবী। আর আটকে পড়লেও শৌভিককে বলতে পারব না, একটু পুলিশকে বলে দে। বললেই "তোকে ছটায় বেরোতে বলেছিলাম না", বলে কানমলা জুটবে কপালে। ড্রাইভারও দেখছি ফোন করেই যাচ্ছে, ওর অন্য চিন্তা, অবরোধ না হলেও কেউ যদি ইঁট ছোঁড়ে। একটা কাঁচ ভাঙলেই তো মালিক ওকে আস্ত রাখবে না। 


আচমকা শাঁ করে একটা বাইক বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে, ড্রাইভার ও লাফিয়ে উঠে বসল সিটে। সামনের এক পরিচিতের বাড়ির সামনে বাইকটা রেখে, দৌড়ে এল ছেলেটি, ঘড়িতে সাতটা ছেচল্লিশ। ড্রাইভারকে ইশারায় বললাম চলমান অশরীরী হয়ে পঞ্চম গিয়ারে গাড়ি ছোটাও বাবা। হেভিওয়েটরা রাস্তায় নামার আগেই ঢুকে পড়তে হবে অফিসের নিরাপদ গণ্ডিতে। এখুনি ফোন করবেন তিনি, " কি রে পৌঁছাতে পেরেছিস -?" জবাব মনোমত না হলেই গান ধরবেন তিনি, "তোকে বলেছিলাম না ছটায় বেরোতে -"।



অনির ডাইরি ২০শে আগস্ট, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। এমনিতেই আজ বড্ড দেরী করে ফেলেছি, তারওপর শ্রীমতী তুত্তুরী গম্ভীর ভাবে এসে বললেন, " মা তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।" 

আসলে সব দোষ শৌভিকের, রোজ আমায় গুঁতিয়ে বাড়ি থেকে বের করে, তারপর নিজে অফিস যায়। আজ দীঘাতে কিসের যেন মিটিং, তাই তিনি সাতসকালে বেরিয়ে গেছেন। বর আপিসে, মেয়ে ইস্কুলে, আমি মনের আনন্দে ছায়া যুদ্ধ করছিলাম এতক্ষণ। ঠিক কি করলে বেরিয়ে আসবে পেটের খবর, শূলে চড়ানো ভালো নাকি মুখে আলকাতরা মাখিয়ে গাধার পিঠে চাপিয়ে নগর পরিক্রমা করা ভালো ইত্যাদি প্রভৃতি। প্রতিবার যুদ্ধ শেষে সেই হেরেই যাই দূর। নিজেকে বড় অকিঞ্চিৎকর, অবলা বলে মনে হয়।


সেই অকিঞ্চিৎকর আমি, ক্ষুদ্র আমি, নিজের খণ্ড- বিখণ্ডিত টুকরো গুলোকে জোড়া তাড়া দিয়ে সবে আপিস বেরোব, এমন সময় কন্যার এহেন আবেদন। আজ তাঁর ভূগোল পরীক্ষা ছিল। কাল রাতে তিনি,' "ভারখায়নস্ক" এর বানান মুখস্থ করিয়ে দাও' বলে প্রচুর জ্বালিয়েছিলেন আমায়। ভাবলাম সেই সংক্রান্ত বার্তালাপই হবে। চট জলদি ভাত বাড়তে বাড়তে বললাম, " বল না, বল। পরীক্ষা ভালো হয়নি, এই তো?" 


তিনি গম্ভীর ভাবে জবাব দিলেন, "না। তাহলে তোমায় বলতাম না। সক্কাল সক্কাল তুমি আমায়  ঠেঙিয়ে অফিস যাও এটা দুজনের কারো কাছেই অভিপ্রেত নয়।" গোগ্রাসে মুখে ভাতের গ্রাস ঢোকাতে ঢোকাতে ভাবলাম, কথাটা ঠিকই। শব্দ বের করার মত অবস্থা নয় মুখের, ইশারায় জানতে চাইলাম, "তবে?" 


তুত্তুরী বলল, " আজ কয়েকটা ছেলে আলোচনা করছিল, ওই কেসটা নিয়ে।" কোন কেস প্রশ্ন করার আগেই, তিনি জবাব দিলেন, "আরজি কর।" চিবোতে চিবোতে ভ্রু কুঁচকে গেল আমার। আলোচনা করতেই পারে। করাই উচিৎ, ধামাচাপা না দিয়ে সচেতন এবং সংবেদনশীল হওয়া সকলেরই প্রয়োজন। তুত্তুরী বলল, " সংবেদনশীল আলোচনা করলে, আমি তোমায় এই অবস্থায় আটকাতাম না। ওরা হাসাহাসি করছিল, প্রাইভেট পার্টে, সিমেন পাওয়া গেছে বলে।" 


চিবোতে ভুলে গেলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য। চোখের সামনে ভেসে উঠল, গতকাল পাশের দেশের এক ভদ্রলোকের পোস্ট, " গত ২৪ ঘন্টায় পর্ন সাইটগুলিতে ভারতের সবচেয়ে বেশি সার্চ করা নাম হল "মৌমিতা" । পড়ে বিশ্বাস হয়নি, বড় বেশী ছিদ্রন্বেষী ওরা। আমাদের দেশের, আমার ধর্মের সবকিছুতে দোষ ধরাই যেন ওদের একমাত্র বিনোদন। কিন্তু আজ মেয়ের মুখে এই কথা শুনে, বুঝতে পারলাম না, কি ভাবব আর কিই বা বলব। 


আমাকে নীরব দেখে তুত্তুরী বলল, "আমি প্রতিবাদ করেছি মা। সটান উঠে গিয়ে ইংরেজিতে বললাম, ' কোথায় কি বলতে হয় যদি সেই বুদ্ধি ঘটে না থেকে থাকে,তাহলে মুখটা বন্ধ রাখলেই তো পারিস। ঈশ্বর না করুন, কাল তোর কোন প্রিয়জনের সাথে হলে, এমনি হাসতে পারবি তো?" 


নীরব থাকি, কি বলব বুঝতে পারি না। মেয়ে বলে চলে, " ওরা কি বোঝে না, ওদের মা, দিদি, বোন কেউ নিরাপদ নয়।" ঠাকুমা, দিদিমাটা সংযোজন করি আমি। তুত্তুরী বলে, " তিন মাসের বাচ্ছাদেরও ছাড়ে না এরা।" নীরবে মুখ ধুই। টিফিন বাক্স ব্যাগে ভরি। এবার বেরোতেই হবে। এক চোখে আগুন, অন্য চোখে জল নিয়ে কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে থাকে তুত্তুরী। 


তারপর বলে, " একটা লোকের ভ্লগ আমি খুব দেখি, সে নানা কারেন্ট ইস্যু নিয়ে কনটেন্ট বানায়। মূলত এনিমেশন। কাল দেখলাম নির্ভয়া আর তিলোত্তমার কথপোকথন। নির্ভয়া তিলোত্তমাকে প্রশ্ন করে, " ভয় লাগছে না তো?" তিলোত্তমা বলে, " ভয় তো ওই কমিউনিটি রুমে লাগছিল। এখন তো আমি মুক্ত।" ভ্যাঁ  করে কেঁদে ফেলি আমি, যেমন এই মুহূর্তে ছাপিয়ে যাচ্ছে চোখ। 


গলা ভেঙে যায় তুত্তুরীরও। তবু থামে না, " তিলোত্তমা বলে, " কত লোক আমার জন্য কাঁদছে, প্রতিবাদ করছে।" নির্ভয়া বলে, " সে তো দুদিনের ব্যাপার। তারপর সবাই একদিন ভুলে যাবে।" মাঝপথে থামিয়ে তিলোত্তমা বলে ওঠে, " তোমায় তো ভোলেনি। " নির্ভয়া জবাব দেয়, " আমার বিচার পেতে সাত বছর লেগেছিল। তাও তো আমার অপরাধীরা মামুলী বাস কন্ডাক্টর ছিল, আর তোমার -"। এটা দেখার পর থেকে আরো কষ্ট হচ্ছে মা। ভেবেছিলাম আমাদের প্রজন্ম একটু ভিন্ন প্রকৃতির। এদের কথা আর হাসি শুনে মনে হচ্ছিল, কত ভুল ছিলাম আমি। এরা কাল সবাই একেকটা পোটেনশিয়াল R হবে।" 


মেয়েকে মাঝপথে থামিয়ে বলি, " না না, এমন ভাবার দরকার নেই। ওরা অনভিজ্ঞ, পরিস্থিতির গভীরতা উপলব্ধি করতে পারেনি। কেউ বোধহয় ওদের বলেনি,ব্যাপারটা নেহাৎ রসের নয়। যেদিন এরা বাবা মা হবে, সেদিন বুঝবে।" কোমরে হাত দিয়ে জানতে চায় তুত্তুরী, "কে বলবে মা?কে বোঝাবে?" জবাব দিই, ওদের মায়েদেরই সর্বপ্রথম বলা উচিৎ। তারাও নির্ঘাত সোশ্যাল মিডিয়ায় DP কালো করেছে, হয়তো কেউ কেউ মাঝ রাত দখল করতেও গেছে। ঘরে ছেলেটাকে বোঝাবার প্রয়োজন বোধ করেনি। এই আর কি- "।


তুত্তুরী হেসে বলে, " সেদিন অন্য একটা বন্ধু বলল,সে মাকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিল, তার মা বলেছে, যা হচ্ছে হোক, তুমি পড়াশোনায় মন দাও। তোমার এখন এসব জানার দরকার নেই।" অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর দাঁড়ানোর সময় নেই। মেয়ের হাত ছাড়িয়ে জুতো পরতে যাই, পরতে পরতে ভাবি, ধামাচাপা দিতে দিতেই শেষ হয়ে গেল প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কার যেন লাজ নেই, দেখুন্তির লাজ।।


অনির ডাইরি ১৯শে আগস্ট, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি #চুঁচুড়ারদিনগুলি

 #বুনো_তেউড়ির_ফুল


বেশ কটা বছর কলকাতায় কাটিয়ে নতুন করে যখন জেলায় পোস্টিং হল, ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। বেশ বুঝতে পারছিলাম মহানগর আমায় মরচে পড়িয়ে, পচিয়ে দিয়েছে। ফিল্ডের কাজ সব ভুলে গেছি আমি। একটাই আশ্বাস, শৌভিকও আছে ওই জেলায়, যদিও আলাদা আপিস, ভিন্ন দপ্তর। তাও, কেউ তো রইল পাশে। ২রা জানুয়ারি ২০১৭, শৌভিক এর সঙ্গেই প্রথম চুঁচুড়ায় পা রাখলাম আমি। 


আমাদের আপিসের গাড়িটা গিয়ে ওর অফিস থেকে আমায় নিয়ে এল আঞ্চলিক শ্রমদপ্তর চুঁচুড়ায়। আপিসে পা দিয়ে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, এটা আপিস? পুরসভার পিছনের বন্ধ গেটের ফাঁক দিয়ে গলে ঢুকতে হয়, একটা ডাম্প ধরা দোতলা বাড়ি। যার ওপরের তলায় পুরসভার ড্রাইভারদের রেস্ট রুম, নীচে তিনটি পুঁচকে ঘর নিয়ে আপিস। দুই অফিসারের বরাদ্দ একটাই ঘর। পাশেই মস্ত সুইমিং পুল, বিকাল হলেই সেখানে সুন্দরী মা আর তাদের দুষ্টু পুঁচকেদের ভিড়। সম্মিলিত কলকাকলিতে আপিস করাই দায়। 


মন খারাপ করে বসে আছি ফাঁকা আপিসে, জানলার বাইরে ফাঁকা সুইমিং পুলের জলে খেলছে শীতের রোদ, চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকাতেই দেখি, এক গাল হাসি নিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। বয়স আমারই বয়সী কি কিছুটা ছোটই হবে, কৃষ্ণবর্ণ, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল, গালে দিন কয়েকের না কামানো দাড়ি। পরনে পোলো নেক টিশার্ট আর প্যান্ট। চোখে চোখ পড়তেই, প্রবল চিৎকার করে বলে উঠল, "ম্যাডাম, আসব?" অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকে নিজের পরিচয় দিল ছেলেটি, "ম্যাডাম আমি ধীমান। আপনার পিওন।" অতঃপর, " আমি আপনাকে আগে থেকে চিনি ম্যাডাম। আমিও হেড আপিসে কিছু দিন ছিলাম। আপনি আসছেন শুনে এরা সবাই ভয় পাচ্ছে, আমি কিন্তু প্রথম থেকেই বলছি, ম্যাডাম খুব ভালো।" 


ধীমানের সাথে আমার এভাবেই পরিচয়। অগোছাল আপিস, ঢিলেঢালা লোকজন, আমি আর ধীমান। বেশী দিন অবশ্য আপিসটা ওমন রইল না, জেলার মিটিং এ ডিএম সাহেবকে অনুরোধ করে, পুরাণ কালেক্টরেট এ খানিক জায়গা পাওয়া গেল। দ্রুত আপিস সরিয়ে নিলাম আমরা। পুরাণ লোকজন বদলী হয়ে এল নতুন ইন্সপেক্টরের দল। পেলাম নতুন CKCO দের। তৈরি হল টিম চুঁচুড়া। কাজ আর উৎসব আনন্দের মিলন ক্ষেত্র। আমাদের দোল, আমাদের রথের জিলিপি, আমাদের বর্ষার পিকনিক, আমাদের ঘুড়ি উৎসব, আমাদের দীপাবলী, শীতের পিকনিক থেকে আমাদের মেলা। আমরা দেখিয়ে দিলাম সরকারী আপিস এমনও হয়। আর এই টিমের একজন অতি সক্রিয় তথা নির্ভরশীল সদস্য ধীমান। 


এক পুরাণ সহকর্মী একদিন শুধাল, "ধীমান নিয়মিত অফিস, টফিস আসে?" অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কেন? মোটামুটি নিয়মিতই তো অফিস করে ধীমান। মাঝে মধ্যে টুকটাক ছুটি তো আমরা সবাই নিই। তৎকালীন বড় সাহেবের ভাষায়, "ওটা কাজে ফাঁকি মারা নয়, ওটা self indulgence।"এটুকু আস্কারা তো দিয়েই হয় মনকে। সহকর্মী ঠোঁট বেকিয়ে বললে, " ও বাবা, ধীমানকে তুমি জানো না। কলকাতা থেকে বদলি হয়ে আসার পর, ওকে খুঁজেই পাওয়া যেত না অফিসে। তোমার পূর্বসুরী তো নিয়মিত নালিশ করত ডিএলসি সাহেবের কাছে। মিটিং ও হয়েছে ওকে নিয়ে একাধিক বার।" 


হতবাক হয়ে গেলাম, তাই নাকি। আমার অভিজ্ঞতা তো সম্পূর্ণ ভিন্ন রে ভাই। ধীমানকে একদিন ডেকে জিজ্ঞাসাই করে বসলাম, এমন হয়েছিল নাকি? তুমি সত্যি আপিস আসতে না নাকি মিথ্যে বদনাম দিচ্ছে লোকে? ধীমান মাথা চুলকে টুলকে বলল, " আপনাকে সত্যি বলছি ম্যাডাম, আমার অফিস আসতে ইচ্ছে করত না। পুরাণ অফিসটা আপনি দেখেছেন তো? বসার জায়গা ছিল না। কেউ না এলে তার জায়গায় একটু বসতাম, নাহলে কাঁহা তক বাইরে বাইরে ঘোরা যায়? বর্ষায় সাপ বেরোত, বাইরের দেওয়াল দিয়ে কাঁকড়া বিছে ঘুরে বেড়াত। কোন কাজও থাকত না করার মত। বিরক্ত হয়ে বাড়ি চলে যেতাম। কিন্তু আপনাকে কি নালিশের কোন সুযোগ দিয়েছি বলুন?"


আমাকে না দিলেও, দুদিন বাদেই জেলা প্রশাসনকে নালিশের সুযোগ করে দিল ধীমান। চন্দননগরের যে সরকারী আবাসনে সপরিবারে থাকত, তার প্রতিবেশীরা নিত্য রাত দুপুরে ধীমানের হল্লায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে নালিশ করলে তৎকালীন চন্দননগরের মহকুমা শাসকের কাছে। শৌভিক মারফৎ অনুরোধ এল আমার কাছে, যেহেতু ধীমানের বেতন আমার সইতে হয়, সেই অধিকারে যদি ওকে একটু কড়কে দিই আমি। ব্যাপারটা এতোই ব্যক্তিগত, কি ভাবে যে এর মধ্যে ঢুকি ভাবতেই সময় লাগল দিন দুয়েক। তারপর একদিন ডেকে বললাম, " ধীমান তোমার জন্য আমায় ওসি ইলেকশন সাহেবের( শৌভিক) কাছে এত কথা শুনতে হয়েছে। প্লিজ এরকম করো না।" ব্যাস ওই টুকুই। 


চুঁচুড়ার চার বছর দশ মাসে আর কখনও চন্দননগর থেকে কোন নালিশ আসেনি। চুঁচুড়া থেকে অবশ্য এসেছে, ভুরি ভুরি। পিকনিক থাকলে,মেলার শেষ রাতে সবাই বিদেয় নিলে বেসামাল হত বটে ধীমান। কালী আর কারণ দুইই ছিল ধীমানের চূড়ান্ত দুর্বলতা। নিষেধ করলে লাল চোখে, এক গলা জিভ বার করে,কান চুলকে কিরে করত, " আর হবে না ম্যাডাম।" তারপর আবার যেই কে সেই। 


ধীমানের একটা বিরাট গুণ ছিল, ব্যাটা চাইলেই ফেলুদা বা কিরীটি হতে পারত। আমি এবং আমার RLO ইন্সপেক্টর কৌশিক নিত্যদিন কিছু না কিছু হারাতাম, আর সে সব হারানো জিনিস খুঁজে বার করতে ধীমান ছিল তুলনাহীন।


দেখতে দেখতে বেজে গেল বিদায়ের ঘণ্টা। চুঁচুড়ার পাট চুকিয়ে যেদিন তমলুক রওনা দিচ্ছি, খুব কেঁদেছিল ধীমান। "জিনিস পত্র সামলে রাখবেন ম্যাডাম। আমি তো থাকব না, কে আপনার চশমা, ছাতা, পেন, বাথরুমের চাবি খুঁজে দেবে ওখানে -"। নতুন অফিসে জয়েন করার পর ফোন করে মনে করিয়ে দিয়েছিল, " ম্যাডাম এবার কিন্তু আর ব্যাংক ট্রেজারিতে ফুল সিগনেচার পাঠাবেন না। বড় কষ্ট হত এখানে আপনার সই করতে -"। 


 আজ সকালে যখন ফোনটা এল, তড়িঘড়ি তুত্তুরীকে স্কুল থেকে আনতে বেরোচ্ছি আমি। যে জুনিয়র ভাই ফোনটা করেছিল, সে নেহাৎ খেজুর করতে ফোন করে না। তাই দুদণ্ড থমকে দাঁড়ালাম, ছেলেটি গলা ঝেড়ে বলল, " দিদি তোমাকে একটা বাজে খবর দিই, ধীমান বাবু আর নেই।" নেই মানে? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না যেন, কোথায় গেল? মদ খেয়ে কোথাও পড়ে আছে নির্ঘাত।  যা কালী ভক্ত, কোন মায়ের মন্দিরের খবর পেয়েছে হয়তো, দেখো সেখানেই গেছে নির্ঘাত। ভাইটি আবার বলল, " না দিদি, ধীমান বাবু মারা গেছেন।"


এমনিতেই এমন ভারী আবহাওয়া, দম বন্ধ করা পরিস্থিতি, "তোমার নাম, আমার নাম, আরজি কর",ওদিকে ঝাড়গ্রামে গর্ভবতী হাতির জঠরে জ্বলন্ত অগ্নি শলাকা,সবার ওপরে ধীমানের এই ভাবে চলে যাওয়া। এও কি সম্ভব? কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হল, বধির হয়ে পড়েছি বুঝি, কি বলছে ছেলেটা ফোনের ওপারে, একটা কথাও কানে ঢুকছে না।  চোখের সামনে যেন ঝুলছে ঝাপসা মোটা একটা পর্দা। কানের কাছে বাজছে একজনের উদাত্ত কন্ঠস্বর, " আপনিই বলুন ম্যাডাম,আমি কি আপনাকে নালিশের কোন সুযোগ দিয়েছি?"



অনির ডাইরি ১১ই আগস্ট, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন, চলছে এক সার্বভৌম দেশে। তাতে কি? এই নিয়ে বিশেষ(ভাবেঅ)জ্ঞ অভিমত দিতে আপনি বাধ্য। আপনি বলুন, আপনি এর পক্ষে কি না। ক্ষমতা থাকলে "না" বলে দেখান দিকি। একি আপনার চায়ের দোকানের ঠেক পেয়েছেন নাকি, যেখানে বিরুদ্ধ মত চলবে? হুঁ হুঁ বাওয়া এহল আধুনিক গণ মাধ্যম। আবহাওয়া বুঝে হাওয়া মোরগ হওয়াটাই এখানে দস্তুর। 


তবে ঘাবড়াবেন না, এখানে হাওয়া বদলাতে দেরী লাগে না। অয় দেখুন, আপনার দেশ বিরোধী মন্তব্য করছে কেউ। আসুন, আসুন দল বেঁধে আসুন, দেশের সম্মান রক্ষার্থে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। "কে বা আগে প্রাণ -" মার্কা একখান ঝক্কাস আগুনে লেখা নামান। না পারলেও চিন্তা কি, নিজ গৃহের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে কাল্পনিক তরোয়াল নিয়ে নেমে পড়ুন কমেন্ট যুদ্ধে। প্রতিপক্ষ দারুণ দমদার। ওরাও গুলি কামান ছুঁড়ছে আমারও ছুঁড়ি। কেউ যদি বলতে আসে, " তুমি অধম বলিয়া, আমি উত্তম হইব না কেন" তার কাঁথায় আগুন। 


দাঁড়ান, দাঁড়ান বাজারে লতুন টপিক আইছে। কি সব লুটপাট করছে ওরা। সুন্দর সুন্দর মামনির দল হাসি মুখে ছুটছে সুটকেস ভর্তি বামাল সমেত। হাঁস চুরি করছে, মাছ চুরি করছে, অবলা হরিণ গুলোকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, মায় অন্তর্বাস ও। উফ্, লেখার থুড়ি ঝগড়া করার কত কত উপাদান। নেমে পড়ুন ওদের পিতৃ পরিচয় বিশ্লেষণ করতে। লিখে ফেলুন, ওদের আম্মুকে কি করেছিলেন আপনি। আরে দাদা, ওই লোকটা তো আপনারই সমবয়সী, তাহলে ওর আম্মুকে ইয়ে করলেন কবে? ভূমিষ্ঠ হবার পূর্বেই? এসব প্রশ্ন, কে করে রে? নির্ঘাত তার মামাবাড়ি ওই দেশে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, ঘ্যাস ঘ্যাস করে চুলকাতে চুলকাতে, ঢেউ ঢেউ করে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে, দুমদাম করে পবন নিষ্ক্রমণ করতে করতে চল ব্যাটা তোকে সীমান্ত পার করিয়ে আসি। 


উরি, উরি বাবা। এসব কি আসছে মার্কেটে, ওসব চুরি টুরি ছাড়ুন, ওরা ওদের রাষ্ট্রনায়কের মূর্তি ভাঙছে গো। মাথায় উঠে আক্ষরিক অর্থে মুতে দিচ্ছে মাইরি। এসব দেখে যদি আপনার নিস্তরঙ্গ একঘেঁয়ে জীবনে আগুন না লাগে, তাহলে এই শিক্ষিত বঙ্গ সমাজ কি আপনাকে মেনে লিবে? শিক্ষিত মানে মস্ত মস্ত ডিগ্রী লয় দাদা, জানেন নি, সোশ্যাল মিডিয়ায় একাউন্ট থাকলেই আজকাল আপনে শিক্ষিত। যদি কেউ বলতে আসে, ভাই রে ওটা সার্বভৌম রাষ্ট্র, তার কাঁথায় আগুন। সীমান্ত পার, সীমান্ত পার ছাড়া এদের কোন শাস্তি হতেই পারে না। 


উত্তেজনার পাহাড় থিতু হবার আগেই, মার্কেটে এসে পড়ল ওপারের হিন্দুদের দুরবস্থা। সমধর্মের মানুষের জন্য আপনার, আমার প্রাণ কাঁদবেই। চলুন তাদের পাশে দাঁড়াই। চলা মানে সত্যি সত্যিই চলা ভাবলেন নাকি? কোথাকার আ ইয়ে মাইরি আপনি। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব আছে কি করতে। যেখানে যেখানে আপনার একাউন্ট আছে লিখুন, #SaveBangladeshiHindus । ব্যাস? হয়ে গেল? আপনার এই লেখা পড়বে এবং অন্য কেউ যাবে ওদের বাঁচাতে? নাকি কাল পর্যন্ত যাদের আম্মু তুলে খিস্তি দিলেন, আপনার কলম নির্গত অগ্নি বাণে রাতারাতি চিত্তশুদ্ধি হবে তাদের? আর আপনি কি করবেন? আরো অগ্নিবাণ বানাবেন? 


কি হল? ও মশাই? আপনার আগুনে বাণ এমন সেঁতিয়ে গেল কেন? অ বুদ্ধবাবু মারা গেছেন তাই? এটাই আপাতত হেপ এবং হ্যাপেনিং? কাঁদতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়া ভাসিয়ে দিতে হবে চোখের জলে। লিখতে হবে কমরেড লাল সেলাম। সত্যি মাইরি। এত সমর্থন, এত সমবেদনা যে এত জনের হৃদয়ে লুক্কায়িত ছিল নির্বাচনী ফলাফলে যে কেন বোঝা গেল না। যাকগে, কিন্তু ওই বাংলাদেশী হিন্দু গুলোর কি হল? ওদের বাঁচাবেন না? কি কইছেন? বাজারে নতুন হাওয়া? ও আরজি কর? এবার ওটা নিয়ে নামাতে হবে? এবার ওটার বিচার চাই? যতক্ষণ না পরের উত্তেজক ঘটনাবলী আমাদের হিলিয়ে দেয়, তাই তো? বড়িয়া হ্যায়। দাদা/ দিদি সিম্পলি বড়িয়া হ্যায়।


অনির ডাইরি ৬ই আগস্ট, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


প্রায় এক যুগ আগের কথা। জনৈক সহকর্মী প্রায় দিনই ওই দেশটার প্রশংসা করতেন।  হুগলী জেলার খানদানি মুসলমান। ১৯৪৬-৪৭ এর দাঙ্গায় ওনার দাদা ( পিতামহের) দোকানে আগুন লাগানো হয়, তাই বলে দেশ ছেড়ে যাবার কথা কখনও ভাবেননি ওনাদের পরিবার। সত্তরের দশকে ওনার এক ভাই প্রথম সীমানা টপকান, কিছু দিন বাদে বিবাহ সূত্রে ওপারে রওনা দেয় ওনার বোনও। দুই ভাইবোনই ওখানে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের সূত্রেই ভদ্রলোকের ওই দেশে যাতায়াত। 


ভদ্রলোক আমারই মত ছাপোষা সরকারী নৌকর, সীমান্তপারে ভাইবোনের আর্থিক স্বচ্ছলতায়, প্রাচুর্যে উনি গর্বিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, নিছক ভাষার জন্য সৃষ্ট একটা দেশের প্রতি ভদ্রলোকের ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সেটাই ভাগ করে নিতেন আমার সাথে। মুস্কিল হল, আমার পিতৃকুল - মাতৃকুলে কেউ কোন দিন ওদিকের বাসিন্দা ছিল না। আমি জন্ম থেকেই মোহনবাগানের মেয়ে। প্রশংসনীয় দেশটা আমার কাছে নিছক এক প্রতিবেশী দেশ মাত্র।  গল্প শুনতে বসে আলাদা কোন আবেগ আমার আসত না। তাও শুনতাম, কারণ ভদ্রলোক গল্প বলতেন বেড়ে। আর সীমানার দুই পাড়ে থেকেও ওনাদের ভাইবোনদের একে অপরের প্রতি টান আর ভালবাসা আমায় মুগ্ধ করত। 


একদিন টিফিন টাইমে এমনি উত্তাল প্রশংসার ঝড় উঠেছে, উনি বললেন, " বুঝলেন ম্যাডাম, সীমানা পেরোলেই জুড়িয়ে যাবে চোখ। সব সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা আর গ্রাম বাংলার এমন সুন্দর শ্যামল রূপ -"। মাঝপথে হঠাৎ কি মনে হল, জিজ্ঞাসা করলাম, " আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, দেশভাগের পর ওপার থেকে আসা হিন্দুদের এখানে যেমন বাঙাল বলা হয়, তেমন এপার থেকে যাওয়া মুসলমানদের কি বলে ওরা?" 


ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ থতমত খেলেন, তারপর জবাব দিলেন, "ইন্ডিয়ান"। হেসে উঠি আমি, " বলেন কি? ইন্ডিয়ার সঙ্গে ঝগড়া করে ভেন্ন হয়ে, শেষে ইন্ডিয়ান?" ভদ্রলোক বিমর্ষ ভাবে মাথা নাড়ান। " হ্যাঁ গো। খুব তাচ্ছিল্য করে ওরা এই ইন্ডিয়ানদের। আমার ভাই বোনকে এই পরিচয় লুকাতে অনেক মেহনত করতে হয়েছিল। কেউ আজকাল তাই স্বীকার করে না যে এদিক থেকে সীমান্ত পেরিয়ে গেছে।" 


খানিক চুপ করে বসে থাকি আমি, দম নিই তারপর বলি, " আর এদেশে? তিনপুরুষ এই দেশের অন্ন জল বাতাসে লালিত পালিত হয়েও, লোকে দাবী করে যে তারা আসলে ফরিদপুর বা বরিশালের লোক। সদম্ভে ঘোষণা করে, তারা উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন এই দেশে। এই দেশের কি কোন তুলনা হয় মশাই?"

Friday 5 July 2024

অনির ডাইরি জুলাই, ২০২৪

অনির ডাইরি ২৬শে জুলাই, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 


যদি শুধান জীবনের সংজ্ঞা কি, তো আমি বলব, "life is a journey, from one celebration to another." অন্তত আমার কাছে তো তাই। মাথার মধ্যে সবসময় গুণগুণ করে হরেক রকম পরিকল্পনা। যেমন ধরুন,  আমাদের বিবাহবার্ষিকীর পরদিন থেকেই আমি মশগুল হয়ে পড়ি শ্রীমতী তুত্তুরীর জন্মদিনের আকাঙ্ক্ষায়। মনে মনে চলে হাজার হিসেব নিকেশ। কি দেব মেয়েটাকে, কি রাঁধব মেয়েটার জন্মদিনে ইত্যাদি প্রভৃতি। আর সেলিব্রেশনের ব্যাপারে মুকেশ আম্বানিই আমার আদর্শ। আহা, হতেই পারে উনি শশধর আর আমি মামুলী শশক, তাই বলে কি শখ থাকবে না, নাকি।


আমাজন থেকে প্রথম উপহারটা যখন এল, তখনও জন্মদিন আসতে এক মাসেরও বেশি দেরী। বেশ অনেক দিন ধরে দেখে শুনে, রিভিউ পড়ে অর্ডার করলাম। একটু সাধ্যের বাইরেই হয়ে গেল বুঝি। আচ্ছা কুরিয়রওয়ালা যদি আপন মনে করে নিয়ে নেয়! কি হবে? এই ভেবে তিন চার রাত ঘুমই এল না আমার। নির্দিষ্ট দিনে কুরিয়রের ছেলেটা যখন ফোন করে বলল, " ওটিপি-টা বলুন ম্যাডাম। প্যাকেজটা বাংলোর সিকিউরিটিকে দিয়ে দিয়েছি-" বিশ্বাসই হল না যেন। যতক্ষণ না সিকিউরিটি ছেলেটি ফোন ধরে আশ্বস্ত করল। বাড়ি ফিরে ভয়ে ভয়ে প্যাকেট খুলে তবে শান্তি। শ্রীমতী  তুত্তুরীর নাকের ডগা দিয়ে ওর জন্মদিনের উপহার আলমারিতে তুলে রাখলাম আমি। তিনি জানতেও পারলেন না, যে এবারের পার্সেলটা তাঁর জন্য এসেছে, আমার না।


দ্বিতীয় উপহারের বেলায় অবশ্য তাঁকে বোকা বানানো গেল না। আমি অফিস থেকে ফেরার সাথে সাথেই তিনি আমার পিছন পিছন নেচে নেচে ঘুরতে লাগলেন। " মা আজ যে পার্সেলটা এসেছে না, ওতে কি আছে? কেমন যেন নরম নরম লাগল।" চালে ভুল করলাম, যখন বললাম, " আমি জানি না। বাবা কিছু অর্ডার দিয়েছে হয়তো।" তিনি বললেন, " উঁহু, প্যাকেটে তোমার নাম লেখা।" সে যাত্রা অবশ্য উদ্ধার করেছিল শৌভিকই, বলেছিল ওতে হ্যান্ড টাওয়েল আছে। " তোর জন্মদিনে আমরা বাথরুমে নতুন হ্যান্ড টাওয়েল ঝোলাব।"


দেখতে দেখতে এসেই গেল দিনটা। আগের দিন সকালে লিস্ট করে ধরিয়ে দিলাম বাংলোয় বাজার করে যে ছেলেটি তাকে। দুটো রেড ভেলভেট পেস্ট্রি আনবে। মোমবাতি একেবারে আনবে না। কি শখে যে আফগানি সেন্টেড ক্যান্ডেল গুলো কিনেছিলাম, লেখা ছিল জ্বাললেই হৃদয়ে তুফান উঠবে। আদতে দেখলাম জ্বালালেই আমার বরের হাঁচি শুরু হয়ে যায়। ওরই মধ্যে একটা জ্বালিয়ে দেব ক্ষণ। বললাম বেলুন আনবে একটু বেশি করে। আমার আধবুড়ি মেয়ে এখনও বেলুন দেখে গলে যায়। 


আনবে তো সই, কিন্তু তাঁর নজর এড়িয়ে ফোলাবে কে? ঘর সাজানোই বা হবে কি করে? তিনি জেনে গেলে তো আর সারপ্রাইজ থাকবে না  ব্যাপারটা। অগত্যা আগের দিন সকালে বসে বসে প্রচুর হোমওয়ার্ক দিলাম। তলায় গোটা গোটা করে লিখে দিলাম, সাড়ে নটার মধ্যে শেষ না করলে, কেটেই ফেলব। যতক্ষণ না হোমওয়ার্ক শেষ হচ্ছে, ঘর থেকে বেরোবি না। 


অফিস থেকে ফিরে, কোন মতে এক কাপ কফি খেয়ে, বাইরের ঘরের দরজায় আগল দিয়ে, পর্দা টেনে নামলাম বেলুন ফোলাতে। জীবনে হ্যাপি বার্থডে লেখা বেলুন ফোলাইনি, সে যে কি ঝঞ্ঝাট।  রাতের রান্না করে যে ছেলেটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সাহায্য করতে এল,  তাই না সাড়ে নটার মধ্যে শেষ হল ব্যাপারটা। ইতিমধ্যে যে কতবার দরজা খটখট করে গেছে তুত্তুরী তার ইয়োত্তা নেই। প্রবেশের অনুমতি কিছুতেই মেলেনি। হয়ে যাবার পরও বাইরে থেকে দরজায় ছিটকানি আটকে রাখলাম। অর্থাৎ শ্রীমতী তুত্তুরীর প্রবেশ নিষেধ (আপাতত)। 


দেখতে দেখতে এসে গেল মধ্যরাত। তখনও গ্যাসে ফুটছে পায়েস, ভাপা দইয়ের জল আর কিছুতেই মরছে না। সারাদিনের পরিশ্রমে বেঁকে যেতে চাইছে পিঠ আর কোমর। তবে ওই যে বললাম মুকেশ জীই আমার আদর্শ। তাঁকে স্মরণ করে, টেবিলের ওপর সাজিয়ে দিলাম পুঁচকে পেস্ট্রি, জ্বালিয়ে দিলাম সুরভিত মোমবাতি। আজ যদি শৌভিক হেঁচেছে তো ওরই একদিন কি আমার একদিন। এক পাশে যত্ন করে সাজালাম আমার আর শৌভিকের দেওয়া উপহার গুলি। এবার অপেক্ষা কেবল তাঁর জন্য। 


শৌভিককে বলে এলাম, আমি ঘর অন্ধকার করে অপেক্ষা করছি, তুই মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে আয়। কাঁপা কাঁপা মোমবাতির আলোয়, প্রায় অন্ধকার ঘরে ক্যামেরা চালিয়ে অপেক্ষা করছি আমি, দরজা খুলল, "হ্যাপি বা -" বলে চিৎকার করে বাকিটা গিলে নিলাম।ক্ষুদেটা কোথায়? এতো ধেড়েটা এসেছে ল্যাপটপ রাখতে। উফ ভগবান! এত কিছুর মাঝে একটা কাজ দিয়েছিলাম, সেটাও করেনি। বিস্তর ধমক খেয়ে মাথা চুলকে শৌভিক বলল, "অ, তুই আমাকে ওকে ডেকে আনতে বলেছিলি! আমি ভাবলাম, কি যে ভাবলাম -"। মাঝপথে আমার রুদ্র মূর্তি দেখে থতমত খেয়ে, " এই তো যাচ্ছি। এখুনি ডেকে আনছি -"। 


অতঃপর তিনি এলেন এবং -


অনির ডাইরি ২৫শে জুলাই, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



লোকটা বলল, "জানেন ম্যাডাম, আমার মনটা খুব খারাপ।" কি যেন ভাবছিলাম গভীর ভাবে, কিন্তু কেউ এমন বললে শুধাতেই হয়, কেন, কি হয়েছে ইত্যাদি। জবাবে লোকটা ম্রিয়মাণ হয়ে বলল, "মেয়েটার শরীরটা একদম ভালো নেই।"


 লোকটা গ্রামে থাকে।  পেটের টানে শহরে আসে। কর্মসূত্রেই আমার সাথে পরিচয়। কিছু জমিজমা আছে, পুকুর আছে। মাঝে মাঝেই বাগানের আখ, শাক, উচ্ছে, থানকুনি পাতা, পুকুরের জ্যান্ত শোল, মৌরলা মাছ নিয়ে আসে আমার জন্য। নিষেধ করলে, বকলে দুঃখ পায়। বদলে লতা দি বাগানের চারটি আম, গাছের কাঁঠাল, ভাঙ্গানো কাজু  এইসব টুকটাক ভরে দেয় লোকটার ব্যাগে। আমি নিজে দিতে গিয়ে দেখেছি ভয়ানক অস্বস্তিতে ভোগে লোকটা। 


কর্মসূত্রে দিনের বেশ অনেকটা সময় এক সাথে কাটাতে হয়। মনের না না দুঃখের কথা এই সময় শোনায় লোকটা। বাবা মায়ের আটকে যাওয়া বার্ধক্য ভাতা, বর্ষায় ত্রিপল না পাওয়া, মালিকের সাথে ঝামেলা ইত্যাদি প্রভৃতি। যেখানে পারি, হস্তক্ষেপ করি, কিন্তু আমার ক্ষমতাও যে বড় সীমিত। 


লোকটার দুই সন্তান, ছেলেটার বয়স সাড়ে চার, মেয়েটা তার থেকে একটু বড়। ছেলেটা দস্যু প্রকৃতির, মেয়েটা ধীর স্থির শান্ত। ছেলেটার শতেক আব্দার, মেয়েটাকে 'বল তোর কি চাই' বললে সে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে তাকে। আমি দুটোর কাউকেই দেখিনি, সবটাই লোকটার মুখে শোনা। 


মেয়েটাকে নিয়ে লোকটার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এই কিছুদিন আগে স্কুলে আরেকটা বাচ্ছা মেয়েটির হাতের ওপর ভারী দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। কচি হাত যে ভাঙেনি এই ঈশ্বরের আশীর্বাদ। তারপর কিছুদিন পর বেপোট জ্বর আর বমি নিয়ে  হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। এখন আবার এই অগ্নিমান্দ্য। কি আর বলি, বললাম, ওর যা ভালো লাগে তাই খেতে দিন। মুখরোচক কিছু যদি খায় -


লোকটা বিমর্ষ ভাবে বলল, " সব বলেছি ম্যাডাম। কিছুতেই খেতে চাইছে না। ঘরের দুধের ঘি, বলছি ঘি ভাত খা। তো কইছে, না। টাটকা পুকুরের মাছ ধরে ভেজে দিতে চাইছি, তাও খাবে না। বলছি কি খাবি বল? ম্যাগি খাবি? চাউমিন খাবি? মাংস আনব? সবেতেই না।" 


বললাম, তাহলে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিন। পেটে কৃমি থাকতে পারে। এমনকি জন্ডিস হলেও এটা হয় দেখেছি। লোকটা চিন্তিত ভাবে বললে, " আর একটা জিনিস দেখছি। রোজ রাতে কি ভয় পাচ্ছে মেয়েটা। মাঝে মাঝেই ঘুম থেকে উঠে আমাদের কাছে চলে আসছে। আর বলছে, ' আমার খুব ভয় লাগছে।'" গল্পটা কোন দিকে গড়াচ্ছে বুঝেও, অন্য দিকে ঘোরাই, আবার বলি ডাক্তার দেখান। একটা অল্পবয়সী মেয়ে রাতে ভয় পাচ্ছে তার অনেক কারণ থাকতে পারে। মন বড় জটিল জিনিস। প্রার্থনা করি, খারাপ কিছু যেন না হয়।


পরের দিন আবার শুধাই মেয়েটার খবর। জবাব পাই একই রকম আছে। সেই খাদ্যে অনীহা, রাতে ভয়। লোকটা বলে, " বাড়ির লোক কইছে, হাওয়া বাতাস লেগিছে নির্ঘাত।" বলেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নেয় লোকটা, " আমি ওসব মানি না ম্যাডাম। বাড়ির বউ-ঝি'রা কইছে আরকি। আমি ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। ওষুধটা পাল্টে দিলে।" 


সেটা বোধহয় শুক্রবার ছিল। সোমবার অফিসে বেরিয়েছি, লোকটা বলল, " মেয়েকে ঝাড়ালাম ম্যাডাম। " মহানগরে বসে এই সব ব্যাপার নিয়ে যতটা খিল্লি করা যায়, এই পল্লী বাংলায় বসে সেটা করতে পারলাম না আমি। সবথেকে বড় কথা, মেয়েটা ওনার। শুধু শুধালাম, " মেয়েটাকে মারধর করেনি তো? মেয়েটা ভালো আছে তো? যা হয়েছে আপনাদের সামনেই হয়েছে তো? ওকে একা ছাড়েননি তো গুণীন টুনিনের সাথে -"।


মেয়েটা ভালো আছে ছাড়া সবকটার জবাবেই না বলল লোকটা। বলল, " শনিবার যা হল ম্যাডাম আপনাকে কি আর বলি। রাতে সে মেয়ে যা করতে লাগল, কেবল বলছে ভয় লাগছে। বলছে আর গোটা বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পাগলের মত ছুটছে। তখন আমি বললাম, দাঁড়াও তো দেখি। বলে দুটো লঙ্কা পুড়িয়ে যেই ধোঁয়াটা দিয়েছি, মেয়ে দৌড়ল সোজা সদর দরজার দিকে। বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে যাবে। আমার মা, বউ তাকে ধরে রাখতেই পারে না। তখন আমি করলাম কি, গেলাম ঝাঁটা নিয়ে -।" 


আঁতকে উঠি আমি, ঝাঁটা মানে? মুড়ো খ্যাংড়া? মারলেন মেয়েটাকে? লোকটা আঁতকে উঠে বলে, "না না ম্যাডাম, খেজুর পাতার ঝাড়ু। মারিনি, গায়ে বুলিয়েছি মাত্র। ঝাঁট দিবার মত করে -। তাতেই মেয়ের কি ছটফটানি, ' উরি বাবা গো, মা গো, বুকে কি ব্যথা গো '। চোখ গুলো যেন কোটর থিকে ঠেলে বেরিয়ে আসে। বাড়িতে তো কান্নার রোল উঠে গেল। সবাই আমায় এই মারে, কি সেই মারে। 'গুণিন ডাকবি কি না বল -'। 

 

ভয়ে দৌড়ালাম ওঝার কাছে। সে তো শুনে আমায় মারতে এল। বলল, মন্ত্র তন্ত্র না পড়ে কেন লঙ্কার ধুঁয়া দিছু? বলল আড়াই হাজার টাকা নিবে। আমি বললাম তাই সই। তারপর রাত তিনটের সময়, তেমাথার মোড়ে তিন ঘড়া জল দিয়ে ওকে স্নান করিয়ে, ঝাড়া হল।" মারেনি তো? আবার প্রশ্ন করি আমি। লোকটা জিভ কেটে বলে," নানা আমরা সবাই ছিলাম। ঝাড়া হতেই মেয়ে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আজ সকাল থেকে দিব্য খাচ্ছে সব।" 


তারপর কেটে গেছে বেশ অনেক গুলো দিন।রোজ শুধাই আমি, মেয়েটা কেমন আছে। খাওয়া দাওয়া করছে কি না। জবাব ইতিবাচকই আসে। আজ একটু অন্য জবাব এল। লোকটা বলল, " শরীর ঠিকই আছে, কিন্তু মেয়েটার খুব মন খারাপ। এত কানছিল আজ সকালে।" উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করি, কাঁদছিল কেন? লোকটা এক রাশ বিরক্তি চেপে বলল, " এই যে আমার ছেলেটা, একেবারে গাছ বাঁদর। ওর মা ঠিকই করে পেটায়। আজ ও কি মার মারল ছেলেটাকে।" 


বাধা দিয়ে বলি, মেয়েটার কি হল রে বাবা। লোকটা জিভ কেটে বলে, " সেটাই কইঠি ম্যাডাম। ছেলেটা এত বদমাশ, মেয়েটা যখন ঘুমাচ্ছিল, ওরই ( মেয়েটার) স্কুল ব্যাগ থেকে কাগজ কাটা কাঁচি বার করে দিয়েছে এক খাপলা চুল কেটে। একদম সামনের চুল ম্যাডাম। এমন কেটিছে পুরো টাক দেখা যাইতেছে। মেয়েটাকে ন্যাড়া করা ছাড়া কোন গতি নেই।"


ছেলেটার গুণ কীর্তন আরো কিছুক্ষণ চলত, মাঝ পথে থামিয়ে দিই আমি, বলি, " ওই যে মেয়েটার মাথা থেকে যাকে ঝেড়ে নামিয়েছেন, সেই চেপেছে ওর মাথায়। চেপেই বুঝেছে, যে কোথায় এলাম। কোনটা যে মানুষ, আর কোনটা যে ভূত। কে যে কার মাথায় চাপল।"




অনির ডাইরি ২৩শে জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


লাদাখ থেকে ফিরেই ডাকে দুই খানা চিঠি পেলাম। দুটিই এসেছে জেলা শাসকের পাবলিক গ্রিভান্স সেল থেকে। প্রথম চিঠিতে কোন এক শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধির নামে কিছু গোল গোল নালিশ লেখা। কে লিখেছে, কোথা থেকে লিখেছে কিছু লেখা নেই। অভিযোগকারী জেলা শাসককে লিখেছেন, তিনি শ্রম দপ্তর সংক্রান্ত চিঠি দেখে আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন।


 Dদ্বিতীয় চিঠিটি ও একই ব্যক্তির নামে লেখা, তবে এটি অনেক গোছানো। প্রেরক নিজের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, অন্যান্য তথ্য সহ বেশ সুন্দর করে লিখেছেন যে তিনি একজন বর্ষীয়ান নাগরিক, এককালে পেশায় নির্মাণ কর্মী ছিলেন। আমাদের দপ্তরের উপভোক্তা। নিয়মিত পেনশন পান। কিন্তু এই Rপেনশন পাবার জন্য তাঁকে নিয়মিত ঐ ব্যক্তিকে টাকা দিতে হয়। যা পান তার শতকরা বেশ বড় একKটা শতাংশ। শুধু তাই নয়, ওনার স্ত্রীও আমাদের নথিভুক্ত শ্রমিক ছিলেন, যার অকালমৃত্যুর পর মনোনীত উত্তরাধিকারী হিসেবে ভদ্রলোকের প্রাপ্য থেকেও ছেলেটি বেশ মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেছে, কারণ অফিস তথা ম্যাDডামকে দিতে হবে। 


এই অবধি পড়ে Rরীতিমত টলে গেলাম। এই মহকুমায় শ্রম দপ্তরের মাথায় যে একজন ম্যাডাম Kআছেন, তা এক অজ গাঁয়ের বুড়ো রাজমিস্ত্রির তো জানার কথা নয়। এই সব ক্ষেত্রে যা করি সাধারণত, প্রথমেই মৌখিক ভাবে বড় সাহেবকে জানালাম, অতঃপর গোপন ফাইল খুলে  গঠন করলাম এক তদন্তকারী কমিটি। লিখলাম, দেখে শুনে আগামী দশ পনেরো দিনের মধ্যে রিপোর্ট দাও দেখি। 


কি যে ভীষণ মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম সেদিন। আমি বিশ্ব হ্যাংলা। যদি বলত ম্যাডাম সিঙ্গারা জিলিপি খায়, তো সত্যিই কিছু মনে করতাম না। তাই বলে বুড়ো পেনশনারের টাকা, মরা মানুষের টাকা খাই? ছিঃ ছিঃ। বাড়ি ফিরে ঘর অন্ধকার করে বসে রইলাম খানিক ক্ষণ, শৌভিক বাড়ি ঢুকতেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কোন মতে এক হাতে আমায় জড়িয়ে, অন্য হাতে পকেট থেকে ফোন, মানিব্যাগ বার করতে করতে শৌভিক বলল, " আমার যে কি হল সে তো জানিস না। আমি গেছি দীঘা, একগাদা লোক আজ এসেছে, হাজার সমস্যা নিয়ে। মোবাইল,টিভি দেখার সুযোগই পাইনি। হঠাৎ দুপুর বেলা ডিএম সাহেবের ফোন। ' এসব কি শুনছি গো, আমি তো মাটিতে পুঁতে গেলাম।'"


Dবরকে ছেড়ে খাটে জুত করে বসি আমি, কেস তো বেশ জটিল মনে হচ্ছে। শৌভিক বলে, " শোন না, আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না। বললাম কি হয়েছে স্যার? স্যার বললেন, ' তুমি অমুক টিভি দেখো নি ?' বললাম, সকাল থেকে সময়ই তো পাইনি। স্যার বললেন, ' মোবাইলে দেখতে পারবে?'  সম্মতি জানিয়ে খুলে দেখি, তমুক পান্ডা পুরো পর্দা কাঁপাচ্ছে। কি না, মহকুমা শাসক লিখিত ভাবে অমুক কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থার কাছে বারো লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছে।" 


কি! Rছিটকে উঠি আমি। Kশৌভিক ঘাড়


নেড়ে বলে, " ভাব। এসডিও'র এমন দুর্দিন এল যে লিখিত ভাবে ঘুষ চাইতে হল। তারপর বুঝলাম, ব্যাপারটা। ওই কেন্দ্রীয় সংস্থা উপকূল বরাবর কিছু কাজ করবে। তার জন্য কিছু মানুষকে সরাতে হবে। যাদের সরানো হবে, তাদের কি হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, সেটাও ওরা জানিয়েছিল। সেই অনুযায়ী আমার বিডিও'রা হিসেব করে আমায় পাঠায়, আমি কম্পাইল করে ডিএম সাহেবকে পাঠাই। তিনি যেখানে পাঠানোর পাঠিয়ে দেন। মনে পড়ল সেটার পরিমাণ ছিল বারো লাখ বটে।" 


হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। যেমন চ্যানেল, তেমন নেতা। শৌভিক হাসতে হাসতে খানিক দাড়ি চুলকে বলে, "শোন না। কাহিনী আভি বাকি হ্যায়। আমি ডিএম সাহেবকে ফোন করে জানালাম, বারো লাখের গল্পটা। স্যার যে কি রেগে গেলেন, কি বলব। তারপর ফোন রেখে, আবার চ্যানেলটা খুলে দেখি, অন্য সুর ধরেছে আর আমার নাম করছে না। এবার স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাদের নামে চিল্লাচ্ছে, বলছে আসলে ওরাই নাকি ঘুষ চেয়েছে।"


দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম, ভাগ্যে দুজনে দুটো আলাদা আপিস তথা দপ্তরে চাকরি করি। যখনই মনে হয়, যত অখাদ্য যমের অরুচি ঘটনাবলী কি কেবল আমার সাথেই ঘটে, পাশ থেকে আশ্বস্ত করে শৌভিক, না এটা কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। আশ্বস্ত করে, সাহস দেয় ঘনিষ্ট আধিকারিক বন্ধুবান্ধবও -"এমন তো আকছার ঘটে, সাদা কালো লং শটে।"  ওপরওয়ালার নামেই তো তোলা তোলে লোকজন। 


রাত গড়ায়, দিন যায়। তদন্ত করে আসে আমার দলবল। সূর্য তখন ঢলে পড়ছে পশ্চিমে, ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে তদন্তকারীরা বলে, "একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম ম্যাডাম। গাড়ি ও যায় না। আমরা গাড়ি থেকে নেমে টোটো করে গেলাম। লোকটা একেবারে গোবেচারা প্রকৃতির। সে তো আমাদের দেখে ভয়েই অস্থির।" অপরজন বলে, " যা বুঝলাম ম্যাডাম, এরা স্কিম সম্বন্ধে কিস্যু জানে না। লাইফ সার্টিফিকেট কি তাই বোঝে না। সময়মত বেঁচে থাকার প্রমাণ দিতে পারেনি বলে ওর পেনশন আটকে গিয়েছিল। এটা এমন কিছুই নয়, গুচ্ছ গুচ্ছ এমন কেস আসে। আপনি লিখে পাঠিয়ে দিলেই বোর্ড ছেড়ে দেয়। লোকটা সেটা না জানার জন্য, দালালের খপ্পরে পড়ে ছিল।" 


বিশদে শুনতে শুনতে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে হৃদয়। বলি ডাকো দেখি বাবু বিবিদের। যোগাযোগের অভাবেই তৈরি হয়, যত অভিযোগ। এবার থেকে আমার সইয়ে যে যা সুবিধা বা অনুদান পাবে, তাকে একবার অন্তত প্রত্যক্ষ হাজিরা দিতে হবে আমার সামনে। আমি নিজে মুখে একবার বুঝিয়ে বলে দেব,  কি ভাবে প্রতি নভেম্বরে এসে জমা করতে হয় বেঁচে থাকার প্রমাণ। যদি কেউ না পারেন, তাতেও ভয় পাবার কোন কারণ নেই। আমি আছি তো। আছে আমার টিম। আর আপনার কানা কড়িটিও আমার বা আমার টিমের চাই না। আমরা শুধু চাই, আপনারা ভালো থাকুন।


অনির ডাইরি ২২শে জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



"That day can be regarded as one of the most memorable days of my school life—November 14, 2022. There was the excitement of going to school in a colorful dress and without any books, but there was also the grief of leaving my school. That was the first and last children's day and last day in my previous school, "Tamralipta Public School."


I only spent six months at that school, but everyone felt so close to my heart. Just like every other day, I reached the school at ten; the school was supposed to be over by one, unlike other days. As I walked through the corridor, I saw the students wearing colorful dresses; it seemed that they were the colorful blossoms of an orchard.


As I entered the classroom, I noticed that the class had been decorated by my classmates, mainly using balloons. I sat with my best friend Shimly and took a walk down memory lane. We were both about to cry but somehow swallowed it. I distributed chocolates among all my friends and asked them to forget all the bitter memories and together cherish the good ones.


At twelve o'clock, we were served our meal of rice and chicken curry. The happiness of eating together and all the other emotions made the meal seem tastier. Finally, the moment came that I knew would happen one day but was never ready for. I hugged my friends and touched the feet of my teachers. With a final look at my classroom, I came down the stairs and out of the gate. It has been almost two years since that day, but I still remember the smallest of details. That day was just special for me.


গত সোমবার রচনা লিখতে দিয়ে গিয়েছিলাম, "One day at school." বাধ্য ছাত্রীর মত তিনি লিখে তো রেখেছিলেন, কিন্তু তাঁর বাবার আর দেখার সময় হয়নি। বললেই বলেন, " আমি সময়টা কোথায় পাচ্ছি বল?" তা অবশ্যি ঠিক। একে মহকুমা শাসক তায় আবার ঘাড়ে চেপেছে সমুদ্র সুন্দরীর গুরুদায়িত্ব। ফলে অবসর সময় তাঁর আপাতত অত্যন্ত সীমিত। তাই বলে একটা রচনা এক সপ্তাহেও দেখে দিতে পারবে না? 


রাগ করে আজ নিজেই বসলাম চেক করতে। পড়তে পড়তে কখন যে ভিজে গেল দুই চোখ। এটা কি লিখেছে মেয়েটা। আমি যে প্রত্যক্ষ সাক্ষী সেই দিনটার। আমিই তো আনতে গিয়েছিলাম সেদিন মেয়েকে স্কুল থেকে। ট্রান্সফার সার্টিফিকেট তুলে, একরাশ উদ্বেগ নিয়ে প্রতীক্ষা করছিলাম মস্ত স্কুল বাড়িটার সামনে। ভয় পাচ্ছিলাম, কতটা কান্নাকাটি করবে মেয়েটা। প্রশান্ত মুখে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে সামান্য মাথা নীচু করে গুটগুট করে হেঁটে এল মেয়েটা। আমার হাত ধরে কয়েক পা এগিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। শেষ বারের মত ঘুরে তাকাল স্কুল বিল্ডিংটার দিকে, বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়েই রইল, বাইরে থেকে যেন নিজের ক্লাস রুমটাই খোঁজার চেষ্টা করল খানিক। তারপর একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, মাথা নেড়ে ইশারা করল, "চল যাই।" 


সন্তানের অব্যক্ত বেদনায় সেদিন হৃদয় বিদীর্ণ হলেও দুই জনের শিক্ষায় সামলে নিতে পেরেছিলাম নিজেকে এবং মেয়েকেও। প্রথম জন আমার বাবা, যিনি ছোট থেকে শিখিয়েছেন, "Look back in anger"। এগোতে গেলে, মাঝে মাঝে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই হয়। যদি না তাকাতে পারো, তাহলে আর এগোলে কোথায়? 


দ্বিতীয় জন শৌভিকের বাবা, আমার স্বর্গীয় শ্বশুরমশাই। কোন এক উঠতি লেখকের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে, একদা তিনি বলেছিলেন, " আজ যতই প্রশংসা পাক না কেন, এ ছেলে বেশী দূর যাবে না। কারণ এর জীবনে কোন দুঃখ নেই।" নিপাট, নিখাদ সুখ মানুষকে বড় ভদভদে, ম্যাদামারা করে তোলে। দুঃখ হল সেই আগুন,যা যাবতীয় খাদ গলিয়ে শুদ্ধ করে আমাদের চিন্তা এবং চেতনাকে। থাক না কিছুটা দুঃখ তুত্তুরীর ও। ভাবতে শিখুক তলিয়ে,  উপলব্ধি করতে শিখুক জীবনের প্রতিটা রূপ রস গন্ধ। তবেই না কৃতজ্ঞ থাকতে শিখবে, জীবনের প্রতিটা মানবিক সমীকরণের জন্য। নিজেকে সামলে নতুন হোমওয়ার্ক দিই, " An embarrassing moment", লেখ ব্যাটা দেখি কি লিখিস। এবার তো কাঁদালি, পরের বার হাসিয়ে দেখা দিকি।


অনির ডাইরি ১৫ই জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



মাস দুয়েক আগের কথা। দিন তিনেক হল চলে গেছেন শ্বশুরমশাই। মহানগরের বুকে প্রগাঢ় হচ্ছে সন্ধ্যা। ভিডিও কলে উমার সাথে গল্প করছিলাম আমরা, অর্থাৎ আমি আর তুত্তুরী। বাড়ি ফাঁকা, আজ সকালেই দুর্গাপুর রওনা দিয়েছে ওরা। কাল আমাদের পালা। "বন্দরের কাল হল শেষ-" মহানগরের পাঠ চুকিয়ে, এতদিনের বিশ্বস্ত গৃহসেবিকাদের ছুটি দিয়ে, বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে কাল সকালেই কাঁথি ফিরব আমরা। আবার কবে সামনাসামনি দেখা হবে কে জানে। শ্বশুরমশাইয়ের এভাবে অকস্মাৎ চলে যাওয়াটা যেন কেমন রাতারাতি বদলে দিয়েছে আমাদের জীবন। 


বার্তালাপের মধ্যেই হঠাৎ করে সবিতাদির আগমন, " অ বড়বৌদি, কে যেন এইয়েছেন। তোমাদের কোন জ্ঞাতিই হবেন বোধহয়।" গত পরশু রাত থেকে লোক আর ফোন আসার বিরাম নেই। আত্মীয়স্বজন, শ্বশুরমশাইয়ের সুহৃদ, আবাসনে অধিবাসী বৃন্দ, শুভানুধ্যায়ীগণ - কে না আসছে, দুমিনিট শাশুড়ি মা বা তাঁর ছেলেদের সাথে কথা বলতে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য শেষের কয়েক বছর গৃহবন্দী থাকলেও, নিজ গুণে কি যে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন ভদ্রলোক, প্রতি মুহূর্তে তা উপলব্ধি করছি আমরা।


গিয়ে দেখি, বসার ঘরের সোফায় বসে আছেন এক প্রৌঢ়, এক মাথা কাঁচা পাকা চুলে সাদারই আধিক্য। মাঝারি উচ্চতা, রোদে পোড়া শ্যাম বর্ণ। চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা। গালে দুয়েকদিনের না কামানো কাঁচাপাকা দাড়ি।পরনে প্রায় বিবর্ণ  পোলো নেক টিশার্ট আর ঢলঢলে প্যান্ট। কাঁধে একটি শান্তিনিকেতনী ঝোলা। 


ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছেন। চেনা চেনা লাগলেও, কিছুতেই চিনতে পারছি না আমি। শেষে বিস্তর মাথাটাথা চুলকে শুধালাম, " আপনি কি শ্বশুরমশাইয়ের বন্ধু?" ভদ্রলোক একই রকম মিটিমিটি হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, " তা বলতেই পারো। আমার নাম  -"। 


ভদ্রলোকের নাম শুনে চমকে উঠলাম, নামটা অত্যন্ত পরিচিত। ভদ্রলোক এই আবাসনেরই বাসিন্দা। অবসর প্রাপ্ত  আইএএস অফিসার। ডিএম ছিলেন বেশ কিছু বছর। শুনেছি বেশ দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেলাশাসক ছিলেন ভদ্রলোক।


খাতির করার মত কিছুই নেই বাড়িতে, তবুও সসম্ভ্রমে বলি, "একটু চা বলি।" উনি একই রকম ভাবে হেসে, হাত নেড়ে বলেন, " না না, তুমি বসো।" প্রথমেই শৌভিকের তত্ত্বতলাশ করেন ভদ্রলোক। ঠিক এই মুহূর্তেই হাঁটতে বেরিয়েছে শৌভিক। আবাসনে কয়েক পা হেঁটে, টুকিটাকি এক গাদা জিনিস কিনে ফিরবে। বুড়োবুড়ির ছাপোষা সংসারে অনেক কিছুই বাড়ন্ত। ফোন করে বললেই দিয়ে যায় স্থানীয় দোকানদার, হঠাৎ অসুস্থতার জন্য সেটুকুও বলে যেতে পারেননি শ্বশুরমশাই। বিগত দুদিন তুত্তুরীকে বগল দাবা করে উমাই দোকানবাজার করছিল। আজ শৌভিক গেছে। 


শৌভিকের সাথে কথা বলার সুযোগ না পেয়ে দৃশ্যতই মুষড়ে পড়লেন ভদ্রলোক। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে শুধালেন, " তোমার শাশুড়ি মাতা -"। শাশুড়ি মা বাড়িতেই আছেন, কাল চলে যাবেন বলে টুকটুক করে কতকিছু যে গোছাচ্ছেন। একটু আগে শ্বশুর মশাইয়ের না খাওয়া ওষুধ গুলো ব্যাগে ঢোকানো নিয়ে সবিতা দির সাথে এক প্রস্থ ঝামেলা করলেন। সবিতা দি ভালোমানুষের মতোই বলতে গিয়েছিল, " অ মাসিমা, ওগুলা তো মেসোমশাইয়ের ওষুধ। ওগুলো নিয়া কি করবা? ওগুলা খাবা না যেন।" আমিও নিষেধ করলাম, কিন্তু বৃদ্ধা বড় জেদি। তাঁর বক্তব্য, জ্যেষ্ঠ পুত্রকে না দেখিয়ে খাবেন না বটে, তাই বলে এত গুলি ওষুধ অকারণে ফেলেই বা যাবেন কেন। শুধু কি ওষুধ, শ্বশুরমশাইয়ের হাত ঘড়ি, পেন, পাথরের পেনস্ট্যান্ড, মুখে মাখার মেডিকেটেড ক্রিম আরও কতকিছু যে ব্যাগে ভরছেন তার ইয়ত্তা নেই। আর থেকে থেকে বলছেন, "কোন কিছুই তো বলে গেল না। কিছুই তো বলে গেল না।" 


সেভাবে কান্নাকাটি আর করছেন না বটে, কিন্তু যে মানুষটা চলে গেছে,তাঁর ফেলে যাওয়া জিনিসপত্রের মধ্যেই যেন তাঁকে খুঁজে চলেছেন শাশুড়ি মা। কি কি ভাবে যে শোক প্রকাশ করে মানুষ। গতকাল কে যেন বলে গেছে, " তুমি খুব শক্ত মেয়ে -"। যিনি বলেছেন তিনি নিঃসন্দেহে শাশুড়ি মাতার তারিফ করতেই বলেছেন, কিন্তু তারিফ করতে গিয়ে অজান্তেই আহত করে গেছেন বৃদ্ধাকে। কাল থেকে বার বার বলে চলেছেন শাশুড়ি মা, " কান্নাকাটি না করলে কি শোক হয় না? আমার শক্ত না হয়ে উপায় আছে, বলো তো? আমি যদি এখন কান্নাকাটি করি, তোমরা সবাই যে আমায় নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়বে।" 


সেই কথাই বলি ভদ্রলোককে। উনিও মাথা নাড়েন, " শোক বড় ব্যক্তিগত ব্যাপার বুঝলে। এই যে আমার কথাই ধর না, আমার স্ত্রী মারা গেছেন আজ বেশ কয়েক বছর হল। আমি একাই থাকি। মাঝে মধ্যেই ছেলেমেয়েদের কাছে চলে যাই।  নিজেই ড্রাইভ করি, গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। লোকে ভাবে আমি খুব ভালো আছি। কেমন সুন্দর ঝাড়া হাত পা। কেউ বোঝে না, আমি কতটা নিঃসঙ্গ। 


আমার স্ত্রী ভীষণ ঘুরতে ভালবাসত জানো। সারা জীবন সরকারী চাকরগিরি করেছি, একে তো ছুটি পেতাম না। তারপর ঐ মাইনেতে দুটো বাচ্ছাকে বড় করা। ফ্ল্যাট কেনা -"। বলতে বলতে হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে ফেলেন ভদ্রলোক, "জানো এখানে ফ্ল্যাট কেনার মূলে ছিলেন আমার বাবা। বাবা বলত, 'এয়ারপোর্টের পাশে ফ্ল্যাট কেন', যাতে তাঁর নাতনীরা প্লেন থেকে নেমেই বাড়ি ঢুকে পড়তে পারে। বাবার কথা শুনে ফ্ল্যাট কিনলাম। অথচ বাবাই সেভাবে ভোগ করতে পারলেন না।" 


চুপ করে থাকি আমি। ভদ্রলোক গলা ঝেড়ে আবার শুরু করেন, " এত কিছু করতে গিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা আর সেভাবে হয়নি। বাচ্ছারা বড় হয়ে যাবার পর, আমার স্ত্রীর ইচ্ছে ছিল ওর ষাট বছর হলে, দুজনেই সিনিয়র সিটিজেন কোটায় ছাড় পাব, তখন ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে করে সারা ভারত ঘুরব, শুধু দুজনে। ৫৯ পুরো হবার আগেই ক্যান্সার ধরা পড়ল। ৬২র মধ্যে সব শেষ।"

 কি বলব বুঝতে পারি না। জীবন কেন যে এত অনিত্য। নাম, যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি, প্রেম, বন্ধুত্ব, এমনকি পরিবারও সবই কেমন যেন এই টক্কা, তো এই সব ফক্কা। তবুও কেমন ডিনায়াল মোডে থাকি আমরা। বাস করে চলি মূর্খের স্বর্গে।

অনির ডাইরি, ১১ই জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



"ম্যাডাম, অমুক পিকনিকে যাবে নি বলতেছে।" ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল শান্তনু। বর্ষার পিকনিক আসতে আর মাত্রই দিন দুয়েক বাকি।  যাদের জন্য এত হ্যাপা করে পিকনিক, তারাই বলছে পিকনিকে যাবে না?  বললাম ডাকো ব্যাটাকে, দেখি তার আবার কি হল। 


সামান্য ভয়ে ভয়েই ঘরে ঢুকল ছেলেটি, " ম্যাডাম ডাকতেছিলেন?" শুধাই, পিকনিকে কেন যাবে না, বাবা। ছেলেটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জবাব দেয়, " সত্যি বলছি ম্যাডাম, যাবার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু অত সকালে যে বেরোতে পারব না ম্যাডাম।" 


সকাল সকালই বটে, ছেলেটির বাড়ির সামনে দিয়ে আমাদের দীঘামুখী বাস বেরোবে ভোর ছটায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, " একদিন একটু কষ্ট করে সকালে উঠতে পারবে নি?" ছেলেটি হেসে বলল, "কেন পারব না ম্যাডাম, আমি তো রোজ আরো ভোরে উঠি। যেতে পারব না, আমার মায়ের জন্য। মাকে স্নানটা না করিয়ে যে বেরোতে পারব না ম্যাডাম।" 

শুধালাম, "তোমার বাড়িতে এমন কেউ নেই, যে তোমার মাকে একদিন স্নান করিয়ে দিতে পারবে?" ছেলেটি জবাব দিল, " মা অন্য কারো কাছে করবে না ম্যাডাম।" 


 খানিক দম নিয়ে, ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল ছেলেটি, তারপর বলল, "আপনাকে সব বলা যায় ম্যাডাম। আমার মায়ের বয়স প্রায় নব্বই।আমরা বেশ অনেকগুলি ভাইবোন। আমি সবথেকে ছোট। মা যে কি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে আমাদের বড় করেছিল ম্যাডাম, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আজ সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, সকলেরই চলে যায় ভালো ভাবে। বাবার মৃত্যুর পর, সবাই মিলে বসা হয়েছিল, মা কার কাছে কদিন থাকবে এই নিয়ে। 


সেদিন মা আমায় আলাদা করে ডেকে বলেছিলেন, ' আমি তোর কাছেই থাকব। তুই যা খাবি, আমাকেও দুটি দিস।' সেই থেকে মা আমার কাছেই থাকেন। 


আপনি এই অফিসে আসার পর একবার আমি আপনাকে ফোন করে জানালাম না, যে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি - সেই যে স্ট্রোক হল মায়ের,শরীরের ডান দিকটা একদম পড়ে গেল ম্যাডাম। সে যে কি অবস্থা কি বলি। মা পুরো শয্যাশায়ী, মল মূত্র সবই বিছানায় করে ফেলছে, আমি আর আমার বউ হাতে করে সেই সব সাফ করছি। সত্যি বলতে কি ম্যাডাম, ওর কাছে এতটা আশা আমি করিনি। ও যে আমার মায়ের জন্য এতটা করবে আমি ভাবতেও পারিনি ম্যাডাম। 


এখন ফিজিও থেরাপি করে মা অনেক ভালো আছে, আমার হাত ধরে সামান্য হলেও অন্তত হাঁটতে তো পারছে। এখন সমস্যা কি বলুন তো ম্যাডাম, মায়ের কোষ্ঠকাঠিন্য আছে। ফলে রোজ রাতে একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধ খায়। ভোর হলেই মায়ের পায়খানা পায়। সে যে কি দুর্গন্ধ ম্যাডাম কি বলব। পুরো বাড়ি ছাড়ুন, মহল্লায় টেকা যায় না। সেই সব সাফ করে, মাকে চান করিয়ে টিভিটা চালিয়ে দিয়ে তবে বেরোতে পারি আমি। এত কিছু তো ভোর ছটার মধ্যে হবে না ম্যাডাম।" 


ইশারায় বলি, ভালোই সেন্টু দিলে বাবা, তোমায় আর পিকনিকে যেতে বলে কে? বলি এবার কেটে পড়। ছেলেটা হাসতে হাসতে উঠে যেতে যেতে বলে, "জানেন ম্যাডাম, মা না পুরো ছেলেমানুষ হয়ে গেছে। মায়ের জন্য একটা সোফা কিনতে হল আমায়। স্নান করিয়ে মাকে সোফায় বসিয়ে, টিভিটা অন করে দিয়ে আমি বেরিয়ে আসি। মা সারাদিন টিভি দেখে -"। 


হাসতে গিয়েও হাসতে পারি না। কুশীলব ভিন্ন হলেও বৃদ্ধ মা আর ছেলের এই গল্পটা যে আমার ভীষণ পরিচিত। শ্বশুর মশাই মারা যাবার রাতে, ঠিক এমনি ভাবেই বলছিল শৌভিক, "মাকে একা রাখা যাবে না।" তখন বোধহয় রাত এগারোটা। শুনশান  নাচিন্দা মন্দির চত্বর এক পলকে পেরিয়ে গেলাম আমরা। রাস্তার আলো আঁধারির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম আমি, একা সত্যিই ওনাকে রাখা যাবে না। কানে প্রায় বধির। হাঁটুর ব্যথায় প্রায় স্থবির। চোখের জ্যোতিও তেমন নেই। সব থেকে বড় কথা, কিছুই তো জানেন না, বোঝেন না ভদ্রমহিলা। 


সাথে সাথে মনে হল, কাজটা মোটেও সহজ নয়। বাড়িটা যে বৃদ্ধার প্রাণভোমরা। নিজের হাতে সাজিয়েছেন প্রতিটা কোনা। নিজের হাতে তকতকে সাফ রেখেছেন আজ এই মধ্য সত্তরেও। শরিকি বাড়িতে বেড়ে ওঠা শাশুড়ি মাতা, আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন, একটা বাড়ি হবে, যা হবে একান্তই ওনার। 


শ্বশুর মশাইয়ের কর্মসূত্রে জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে বিভিন্ন সরকারী আবাসনে। ওই যে অবসর নেবার সময় চিঠি আসবে, সরকারী আবাস ছেড়ে দাও, এটা শাশুড়ি মাতার কাছে ছিল মূর্তিমান দুঃস্বপ্ন। কত দাম্পত্য কলহ যে হয়েছে এটা নিয়ে। ১৯৭৯ সালে বাসু ভট্টাচার্যের একটা সিনেমা এসেছিল, নাম গৃহপ্রবেশ। তার মুখ্য চরিত্র মানসী ওরফে শর্মিলা ঠাকুর হয়ে উঠেছিলেন যেন শাশুড়ি মা। শ্বশুরমশাই অবশ্য অমর বা সঞ্জীব কুমার হয়ে উঠতে পারেননি। প্রিয়াকে তুষ্ট করে, অবসর নেবার বেশ কিছু বছর আগেই ফ্ল্যাটটা কেনেন শ্বশুর মশাই। কর্জ করেও যে দামে কেনেন, বর্তমানে শুনলে হাসি পাবে। তা পাক, কিন্তু ওই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিতে তো আর পড়তে হয়নি। বাড়িটা ওনার এতোই প্রিয়, বাড়ি ছেড়ে একবেলার জন্য ও কোথাও যেতে চান না ভদ্রমহিলা। এখন কি হবে কে জানে।  যা জেদি বৃদ্ধা।


ভেবেছিলাম, বোঝাতে হবে, হয়তো ছেলেদের একটু রাগও দেখাতে হবে। বাস্তব বড়ই বিচিত্র। কল্পনার থেকে একেবারেই আলাদা।শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যুর পরের দিন, আমরা আর জনা দুই গৃহসেবিকা ছাড়া বাড়ি ফাঁকা। শৌভিক গেছে কি যেন দপ্তরী ট্রেনিংএ। ঠিক হয়েছে রাতে দুজনে একসাথে কথাটা পাড়ব। সদ্য স্নান সেরে বেরিয়েছেন শাশুড়ি মা। এতদিনের চেনা মুখের দিকে আর তাকাতে পারছি না যেন। বিমর্ষ ভাবে  নড়বড় করতে করতে গিয়ে সোফায় বসলেন শাশুড়ি মা,  অতঃপর ইশারায় ডাকলেন আমায়। উনি বসে, আমি দাঁড়িয়ে। কৃপা প্রার্থীর মত আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলেন, তারপর বললেন, "আমি তোমাদের সাথেই চলে যাব কেমন। এই ফ্ল্যাট জুড়ে তোমার শ্বশুর মশাইয়ের এত এত স্মৃতি। এখানে আর থাকতে পারব না। তোমরা আমায় নিয়ে যাবে তো - । " 


প্রায় দুই মাস হতে চলল, কাঁথিতে আছেন শাশুড়ি মা, আপাতদৃষ্টিতে ভালোই তো আছেন। স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইয়ের মতোই যতনে রেখেছে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র। এই বৃদ্ধাও ভোগেন কোষ্ঠকাঠিন্যে। এনার পুত্রও মায়ের জন্য কিনে আনেন আয়ুর্বেদিক ঔষধ। শাশুড়ি মাও যথেষ্ট সাবধানী, সবথেকে প্রশংসনীয় ওনার নিয়মানুবর্তিতা। ঘড়ির কাঁটা ধরে ভোর পাঁচটায় উঠে পড়েন ঘুম থেকে। ছটায় দুটো সুগার ফ্রি দিয়ে এক কাপ কালো চা খেয়েই স্নানে চলে যান। স্নান সেরে দৈনিক খবরের কাগজটা নিয়ে কাটান কিছুটা সময়। পৌনে নটায় প্রাতঃরাশ, পৌনে একটায় দ্বিপ্রাহরিক আহার, চারটে নাগাদ ফল, সন্ধ্যে ছটায় চা, রাত পৌনে নটায় নৈশ ভোজ সেরে, ঠিক নটায় ঘুমিয়ে পড়েন শাশুড়ি মা। সারাদিন হয় সোফায় বসে ঝিমান, নয়তো বই পড়েন শাশুড়ি মা। টিভি দেখার তেমন নেশা নেই, দূরদর্শনের সন্ধ্যে সাতটার খবরটা দেখেন আর দেখেন দিদি নম্বর ওয়ান। 


নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার দিন খুব টেনশনে ছিলেন, যদি রচনা না আসতে পারেন শো করতে। প্রোগ্রাম শেষে এক গাল হাসি বৃদ্ধার, " যাক এত ব্যস্ততার মধ্যেও তো রচনা ব্যানার্জি এসেছে বলো।" এই নির্বিকল্প রেজিমেন্টেড রুটিনের মধ্যেও মাঝে মধ্যেই ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নেন বৃদ্ধা, আমরা আছি তো? আমরা কে কোথায় আছি? খেয়াল রাখেন, কে কখন বেরোচ্ছি।  বেরোবার আগে আসছি বললেই, এক গাল হেসে শুধান, " আজ আর দেরী হবে না তো? ও অনিন্দিতা, আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে তো?"


অনির ডাইরি ৭ই জুলাই, ২০২৪

#তাম্রলিপ্তকড়চা 



ভোরের এলার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙে গেছে আজ। বলতে পারেন চাপা উত্তেজনায় ভালো ঘুমই হয়নি কাল। হাত বাড়িয়ে মুঠো ফোনটা টেনে নিয়ে whatsapp খুলতেই মেসেজের বন্যা। ভোর ৪টে ৫১য় মেসেজ করেছে বেদজ্যোতি, "শুভ সকাল বন্ধুগণ, সবাই তৈরি হয়ে যাও।" সবার আগে বেরোতে হয়েছে যে ওকে, মাছ, মাংসের যোগাড় করতে। 

৫টা ১৫ - মেসেজ করল সৌরভ, বাস ছাড়ল মানিকতলা থেকে। নীচে বাসের লাইভ লোকেশন শেয়ার করেছে শান্তনু। মানিকতলা থেকে বাস যাবে মেছেদা বাসস্টান্ড। কোলাঘাট আর শহীদ মাতঙ্গিনীর লোকজন ওখান থেকেই বাসে উঠবে। 


সৌরভের মেসেজের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাঁধে হাত দিয়ে এক গাল হেসে ছবি পোস্ট করেছে সৌম্য আর সন্দীপ। অর্থাৎ মোরা হাজির। ভোর ভোর বাইক চালিয়ে চলে এসেছে দুটোতে। সেখান থেকে বাস রামতারক,রাধামনি হয়ে আসবে আমাদের নিমতৌড়ি। ময়নার SLO রা নিমতৌড়ি থেকেই বাসে উঠবে। সকলের জন্য মুড়ি আর চিড়ে বাজার প্যাকেট নিয়ে উঠবে শুভদীপ্ত। কোন সকালে বেরিয়েছে সব। এরপর বাস দাঁড়াবে খঞ্চি। উঠবে নন্দকুমার ব্লকের লোকজন। তারপরের স্টপ নন্দকুমার মোড়। সপরিবারে বাসে উঠবেন হক বাবু। তারপর চণ্ডীপুর, সবার শেষে বাসে উঠব সকন্যা আমি। 


সৌরভের ওপর দায়িত্ব পড়েছে প্রথম বাসে ওঠার। বিস্তর গাঁইগুঁই করছিল সৌরভ, "ম্যাডাম , অত ভোরে বাসস্ট্যান্ডে আসব কি করে? একটা টোটো পাব না।" শান্তনুকে তাই ট্যাগ করা হয় সৌরভের সাথে। জানতাম, আমার RLO ইন্সপেক্টর মুখে যাই বলুক, নিজ দায়িত্বে অবিচল। আমার বিশ্বাসকে যথার্থ প্রমাণ করে ফুটে উঠল সৌরভের মেসেজ, বাস মেছেদা ছাড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই শুভাশিস এর এক গাল হাসিওয়ালা নিজস্বী। পিছনে গাল ফুলিয়ে বসে আছে রঞ্জিত। বাস কেন কোলাঘাট যাবে না এই নিয়ে কাল গোঁসা হয়েছিল বাবুর। রেগে বলেছিল, "যাবই না।" মিনিট দশেক ধরে সকলের বিস্তর কাকুতিমিনতির পর, বিস্তর কান মাথা চুলকে বলে, "ম্যাডাম আবার জানতে পারলে very poor, ACR দিবেন। থাক, বাইক নিয়েই চলে আসব।" এই রগড় এই আপিসে প্রায়ই হয়। যে কোন শুভ কাজের আগে রঞ্জিতের গোঁসা করাটা খুব দরকার। রঞ্জিত চটে গেছে মানে, সব নির্বিঘ্নে হবে। উপরি পাওনা হল, মাথা গরমের মাশুল হিসেবে কাল না হলে পরশু রঞ্জিত অবশ্যই কিছু না কিছু খাওয়াবে। 


ভালোয় ভালোয় যেন কেটে যায় আজকের দিনটা। বিভিন্ন বয়সের এত গুলো মানুষকে নিয়ে চলেছি আমরা। সবাইকে সুস্থ ভাবে বাড়ি না ফেরানো পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। কি যে ঝামেলার মধ্যে দিয়ে হচ্ছে পিকনিকটা।প্রস্তাবটা প্রথম তুলেছিল তমলুক পুরসভার SLO সুতপা, "ম্যাডাম একদিন আমাদের দীঘা নিয়ে চলুন না।" নিয়ে চলুন, বললেই তো বেরিয়ে পড়া যায় না, ইন্সপেক্টর, CKCO, SLO, কালেকটিং এজেন্ট মিলিয়ে শতাধিক সদস্য আমার টিমের। তার ওপরে আছেন তাঁদের পরিবার বর্গ। বিগত শীতের পিকনিকে মাথা ছুঁয়েছিল প্রায় শ দেড়েক। এত জনকে একসাথে নিয়ে যাওয়া, আবার নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া কি চাট্টি খানি কথা? এতো আর নন্দকুমারে পিকনিক করা নয় যে, যে যার মত যাবে, খাবে, গানবাজনা করবে আবার নিজ দায়িত্বে বাড়ি ফিরে যাবে। একই জেলায় হলেও, মেছেদা থেকে দীঘা পৌঁছতে লাগে অন্তত তিন ঘণ্টা। লোক তুলতে তুলতে গেলে, আরো আধেক ঘণ্টা বেশি ধরুন। একদিনে এতটা যাতায়াত করা যায় নাকি, ফলে রাতে থাকতে হবে। সপ্তাহান্তে দীঘায় এতগুলো ঘর পাওয়া কি মুখের কথা? 


সুতপা অনড়, " রাতে থাকব না ম্যাডাম। যাব আর চলে আসব। প্লিজ ম্যাডাম -"। সুতপা চলে যাবার পর সহকর্মীদের নিয়ে একবার বসলাম, এতজনকে এই ভাবে এক বেলার জন্য দীঘা নিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা কতটা বাস্তবসম্মত। জনগণের দেখলাম উৎসাহের শেষ নেই। শান্তনু তখনই চেনা বাসের নম্বর ঘোরাল, "দাদা, তমলুক থিকে দীঘা, যাতায়াত। কত ভাড়া লিবে?" জবাব এল বারো থেকে পনেরো হাজারের আশেপাশে। 


এবার একটা হোটেল খোঁজ দরকার। এতগুলো লোক যাতে একসাথে খেতে বা বসতে পারে। বেদজ্যোতি আর হক বাবু বললেন, "গোটা কয়েক ঘর ও লাগবে ম্যাডাম। ব্যাগপত্তর রাখতে, জামা কাপড় বদলাতে, শৌচাগারের যদি প্রয়োজনে। কারো যদি শরীর খারাপ হয় হঠাৎ -"। 


 দীঘা আমার প্রচণ্ড প্রিয় জায়গা, কিন্তু সপ্তাহান্তে বা ছুটির দিনে দীঘা আমার কাছে বিভীষিকা। এত ভিড় হয় দীঘায় যে তার আগের/ পরের দিন অফিস যেতে জিভ বেরিয়ে যায়। তার থেকে মন্দারমণি, তাজপুর, শঙ্করপুর অনেক ভালো। মন্দারমণিতে একটি হোটেলে আমরা একবার পিকনিক করেছিলাম। রামকৃষ্ণ মিশনের পাশেই, একদম নিরিবিলি। সারাদিন সমুদ্রে দাপালেও কেউ কিছু বলার নেই। রান্নাবান্না ও বেশ ভালো। কেবল একটু শুঁটকি মাছের গন্ধ আসে মাঝেমধ্যে এই যা। 


সেই মত কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খেলাম আমরা। শুধু খেতেই লাগবে মাথাপিছু ৯০০টাকা। হোটেলওয়ালা অমায়িক ভাবে বললেন, "দেখুন সপ্তাহের মাঝে এলে মাথা পিছু ৯০০র বেশি আপনাদের কিছু দিতে হবে না। কিন্তু শনি-রবি'টাই তো আমাদের ব্যবসার সময়। ওই সময় এতজন এলে তো আমরা হোটেলের এমনি আবাসিকদের কোন পরিষেবা দিতে পারব না। তাই গোটা হোটেলটাই আপনাদের নিতে হবে। ভাড়া বেশি নয়, মাত্র ১৪হাজার।" 


সপ্তাহের মাঝে, কি করে যাই? আপিসে তালা মেরে? আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সপ্তাহের মাঝে একটাও ছুটি পড়েনি কি? দেখা গেল এমন দুটি দিন আছে,যার একটিতে পড়েছে মহরম, অন্যটি স্বাধীনতা দিবস। তাহলে উপায়? 


আরো কয়েকটি হোটেল দেখা হল আশেপাশে, এমনকি মিশনেও কথা বললাম আমরা। সর্বত্র আগুন দাম। মাথা পিছু চাঁদা ১৩০০/১৫০০ পড়ে যাচ্ছে। এত টাকা চাঁদা দিয়ে কেউ কি আদৌ যাবে? শুভদীপ্ত গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে বলে, "না ম্যাডাম। কেউ যাবে নি। চাঁদা হাজার টাকা বা তার নীচে রাখলে ভালো হয়।" শুভাশীষ বলে, " ম্যাডাম দীঘাতেই করুন। সস্তা হবে।" 


খুঁজে পেতে এক সরকারী অতিথিশালায় যোগাযোগ করলাম আমরা, " ভাই, শুধু যাব, খাব আর চলে আসব। পাচক আমরাই নিয়ে যাব, নিজেরাই রান্না করে খাবো, আপনাদের ওপর কোন চাপ পড়বে না। আমাদের লাগবে বলতে ডাইনিং হল আর একটা দুটো ঘর।" ছোটখাট যে অধিকর্তার সাথে কথা হল, তিনি আশ্বস্ত করলেন, হয়ে যাবে। টাকাপয়সা কিছু লাগবে না। 


আমরাও পূর্ণোদ্যমে নেমে পড়লাম খাবার মেন্যু, পাচক, বাজার ইত্যাদি নিয়ে। মাঝে দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে লাদাখ যাওয়া, ফিরে এসেই পিকনিক। সব ব্যবস্থা করে, ছুটিতে গেলাম আমি। যেদিন বিমানে উঠব,তার আগের রাতে বার্তা পাঠালেন মাননীয় আধিকারিক মহোদয়, কি সব যেন প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে গেছে সব। আমাদের কোনরূপ সহায়তা করতে ওনারা নাচার। 


কি সর্বনাশ, বাস বুক হয়ে গেছে যে। এক পয়সাও চাঁদা ওঠেনি এখনও, হক বাবু পকেট থেকে টাকা দিয়ে বুক করিয়ে ফেলেছেন বাস খানা। অনেক দরদস্তুর করে সস্তায় মারাত্বক পুষ্টিকর এক ঠাকুর (এখানে বলে পূজারী) বুক করে ফেলেছে বেদজ্যোতি। বুক করিয়ে ফেলেছে দুটি তাগড়াই ছাগল একটা নধর মুর্গি। যাঁরা মাটন খাবেন না, তাঁদের জন্য। ট্রলার ওয়ালার সাথে কথা হয়ে গেছে, ওই দিন সবথেকে বড় সবথেকে টাটকা পমফ্রেট মাছগুলো আমাদের দিতে হবে বলে। সেই মোতাবেক হিসেব করে চাঁদা ও ঠিক হয়ে গেছে। গ্রুপে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। এখন ক্যান্সেল করলে হয়ে নাকি। 


সব খুলে বললাম ও। অনেক পুরাণ বন্ধু, ভেবেছিলাম অনুনয়, বিনয়ে কাজ হবে। ফলাফল একই। বুঝতে পারছি, বন্ধু ও অসহায়। চাকরি মানেই যে চাকরগিরি। এদিকে রাত বাড়ছে, পরদিন ভোরেই রাজ্য ছাড়ব আমরা। অন্য কোথাও জায়গা দেখার অবকাশ আর নেই। কোন মতে অফিসিয়াল গ্রুপে জানিয়ে দিলাম, পিকনিক আপাতত বন্ধ। মুষড়ে পড়া বউকে আদর করে আশ্বস্ত করে শৌভিক, " কেন ঢেউসাগর আছে তো।" 


মিলেনিয়াম পার্কের মতই ঢেউসাগর একটা বিনোদন মূলক পার্ক। সমুদ্রের একদম ধারে। বেশ কয়েকবার গেছি সেখানে শৌভিক এর সাথে। ওখানকার ফুড কোর্টে দারুণ কোল্ড কফি উইথ আইসক্রিম পাওয়া যায়। তাই বলে পিকনিক? বড় ভিড় হয় যে। ঘুরে আবার মেসেজ করি গ্রুপে, ঢেউসাগরে হতে পারে কি? আমি তো থাকছি না, তোমরা একটু দেখবে? 


আমার অনুপস্থিতিতে সত্যিই সবটা ঘুরে দেখেন হকবাবু আর বেদজ্যোতি। কথা বলে ফুড কোর্টের সাথে, শুধু খেতে ভাড়া দিবে নাকি তোমরা? রান্না বাপু আমাদের বুক করা পূজারীই করবে। খুঁজে পেতে একটা হোটেল ও বার করে ওরা, সাধ্যের মধ্যে পাওয়া যায় ঘর। সবকিছু হয়ে যাবার পর আবার প্রশাসনিক জটিলতায় ধাক্কা খাই আমরা। দিন ঠিক করার সময় খেয়াল ছিল না, পরের দিন রথ যে। অনেক বাধা বিঘ্ন কাটিয়ে অবশেষে দিন দুয়েক আগে পাকা হয়েছে পিকনিক। 


টিং করে মেসেজ আসে, হক বাবু লিখেছেন, "আমরা নাচিন্দা মন্দির ছাড়িয়েছি ম্যাডাম।" মিনিট দশেকের মধ্যেই এসে যাবে রূপশ্রী বাইপাস এসে পড়বে বাসটা। এবার আমার বাসে ওঠার পালা। হে ঈশ্বর দিনটা যেন ভালোয় ভালোয় কেটে যায়। সবাই যেন চূড়ান্ত উপভোগ করতে পারে আর হ্যাঁ, দিনান্তে সবাইকে যেন তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারি।



অনির ডাইরি ৫ই জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



"মা, মা"। মুঠো ফোনের ওপারেই শ্রীমতী তুত্তুরী একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ। আপিস থেকে ফিরে, গোটা ছয়েক বীজ গণিত আর গোটা তিরিশেক ভয়েস চেঞ্জ করতে দিয়ে সবে নেটফ্লিক্সটা খুলেছিলাম, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, " বলো মা।" তিনি একখান জাবদা ইতিহাস বই আমায় ধরিয়ে বলেন, অ্যাংলো ফেঞ্চ রাইভালরি ইন কার্ণাটিক'টা একটু বুঝিয়ে দাও তো। কাল স্যার টেস্ট নেবেন ক্লাসে।" 


ধড়মড় করে উঠে বসি, " অ্যা? আর সেটা তুই আমায় এখন বলছিস? ক্লাসে এই চ্যাপ্টারটা পড়ানো হয়ে গেছে? তিনি নৈর্ব্যক্তিক ভাবে নাক চুলকে বললেন, " হয়ে গেছে হয়তো।" অতঃপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে, " আমি সেদিন যাইনি হয়তো। তুমি একটু রেডি করে দাও।" 


বাঃ কি সরল সমাধান। দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ ফরাসী বৈরিতার বিন্দুমাত্র যার মনে নেই, তাকে কিনা সেই চ্যাপ্টারটা পড়ে, বুঝে, পড়িয়ে মুখস্থ করিয়ে দিতে হবে। সাধে বলে, মা হওয়া কি মুখের কথা ! এদিক তাকিয়ে বিস্তর মাথা চুলকে দ্বারস্থ হলাম কন্যার পিতার। " ওগো একটু পড়িয়ে দাও না মেয়েটাকে।" 


প্রসঙ্গত শ্রীমতী তুত্তুরীর কোন গৃহ শিক্ষক নাই। সব বিষয় আমিই পড়াই, ইংরেজি আর ইতিহাসের উত্তর গুলি শৌভিক দেখে দেয় সময় মত। সেই অর্থে এটা তো ওরই পড়ানোর কথা। বেশ অনেকদিন পর আজ মোটামুটি ভদ্র সভ্য সময়ে বাড়ি ফিরেছে শৌভিক, এক কাপ কালো কফি খেয়ে, খানিক গড়িয়ে নিয়ে তিনি আপাতত হাঁটতে বেরোচ্ছেন। এমন সময় ইঙ্গ ফরাসী বৈরিতা বা কন্যার ক্লাস টেস্ট নিয়ে যে তিনি বিন্দুমাত্র ভাবিত নন, সেটা তিনি সুস্পষ্ট ভাবে বুঝিয়েই গেলেন। 


পড়ে রইলাম আমরা মা আর মেয়ে। আমি যে কেন এই ভাবে কেটে পড়তে পারি না, বিড়বিড় করতে করতে বই খুললাম। শুরু হল পড়ানো, " বুঝলি বাবু, সেই যে ভাস্কো দা গামা -", বলে ঢোঁক গিলি আমি, ভ্রু কুঁচকে তুত্তুরী বলে, " তিনি তো পর্তুগালের লোক ছিলেন" । ধড়াম করে বই বন্ধ করে বলি, " ওরকম করলে পড়াবই না। যা বাপের কাছে যা -"। 

 

ক্লাস টেস্টের নাম বাবাজী এবং মা ছাড়া গতি নেই, বুঝে ইশারায় মুখে চাবি লাগায় তুত্তুরী। আমি আবার শুরু করি, " তিনি তো এসে নামলেন কালিকটে, ব্যাস ইউরোপ চিনে গেল ভারতে আসার পথ। পর্তুগিজদের পিছু পিছু ডাচ, ফ্রেঞ্চ, দিনেমার, ব্রিটিশ সবাই একে একে এসে পৌঁছাল আমাদের দেশে। আচ্ছা তোকে সেই গল্পটা বলেছি -"?


 নড়ে চড়ে বসে তুত্তুরী, "কোন গল্প?" সেই যে আমার ঠাকুমার মুখে শোনা গল্পটা। জুত করে বসে বলি, তাহলে শোন, আমার ঠাকুমার পিতামহের নাম ছিল বেণীমাধব মুখার্জি। ধন্য স্মৃতিশক্তি ছিল ওনার। শ্রুতিধর যাকে বলে আর কি। একবার হয়েছে কি, উনি গঙ্গা স্নানে গেছেন, গিয়ে দেখেন, একটা ডাচ আর একটা দিনেমারের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া চলছে। দুজনেই উজাড় করে দিচ্ছে যার যার মাতৃ ভাষার অমূল্য রতন। ঝগড়া আর বেশী ক্ষণ মৌখিক রইল না, অচীরেই শুরু হল হাতাহাতি। দুটো লাল মুখো মারামারি করছে দেখে ছুটে এল গোরা পল্টন। ধরে নিয়ে গেল দুটোকেই। আদালতে কেস উঠল। বেণীমাধব মুখুজ্জে সেযুগে মধ্য হাওড়ার বেশ গণ্য মান্য ব্যক্তি ছিলেন। সাক্ষী হিসেবে ডাক পড়ল ওনার। উনি গিয়ে এজলাসে হুবহু বলে দিলেন, কে কাকে কি বলেছে এবং বললেন ডাচ এবং দিনেমার ভাষায়। জজ সাহেব তো হতবাক, বললেন, "বাবু, তুমি এদের ভাষা জানো?" জবাবে উনি বললেন, "না ধর্মাবতার। আমি শুধু এটা জানি, যে সেদিন কে কি বলেছিল।"


আবার ইতিহাসে ফিরি আমরা, তো যা বলছিলাম, সবাই এলো তো, কিন্তু এল কেন? তুত্তুরীর ওষ্ঠাধরের মধ্যে সামান্য ফাঁক হল, "ব্যবসা?" একদম, হাঁফ ছেড়ে বলি। এই তো সব বুঝে গেছিস। বাকিটা রিডিং পড়ে নিলেই পারবি। চোখ গোল গোল করে ধমকায় তুত্তুরী, "পড়াও।" 


ওই আর কি, আম্বানি আর আদানি কেস। কে একচেটিয়া ব্যবসা করবে তাই নিয়েই যত ক্যাওস বুঝলি কি না। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি না ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বাকি যারা ছিল, সব আপ্পুলিশ, বুঝলি কি না। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপিত হয়েছিল সেই ১৬০০ সালে। তখন ইংল্যান্ডের রাণী ছিলেন প্রথম এলিজাবেথ। হঠাৎ কি যেন মনে পড়ে যায়, এক গাল হেসে বলি, "এই  জানিস, এই এলিজাবেথ কে ছিলেন?" 

শ্রীমতী তুত্তুরী গম্ভীর মুখে ভ্রু দিয়ে ইশারা করে বইয়ের দিকে, মুখে বলে, " জানি, অষ্টম হেনরির মেয়ে ছিলেন। মা অ্যান বোলেন।" হাসিটা অর্ধেক গিলে আবার কিছু বলতে যাই, হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেন শ্রীমতী, " জানি জানি অষ্টম হেনরীর ছটা বউ ছিল। যার মধ্যে দুজনের উনি গর্দান নেন। একজন সন্তান প্রসব করতে গিয়ে রক্তক্ষরণে মারা যান। একজনকে নির্বাসন দেন। একজনকে বোন বলে ঘোষণা করেন ইত্যাদি ইত্যাদি।  " বেশ কিছু বছর আগে অষ্টম হেনরিকে নিয়ে নির্মিত, "টিউডর" বলে একটি ওয়েব সিরিজ দেখেছিলাম। এমন বর্ণময় চরিত্র ছিল লোকটার যে প্রতি এপিসোড শেষেই মেয়েকে গল্প শোনাতাম আজ কি দেখলাম। তারই প্রতিদান পেলাম। 


চিরতা চিবানো মুখে পুনরায় ইংল্যান্ডে প্রবেশ করি, স্যার টমাস রো'র সাথে ১৬১৫ সালে ভারতে আসি। তখন দিল্লীর সিংহাসনে আসীন বাদশাহ জাহাঙ্গীর। উইলিয়াম ডালরিমপ্লের "অ্যানার্কি"র কয়েকটা অনুচ্ছেদ ভেসে ওঠে চোখের সামনে, ভেসে ওঠে বইয়ে পড়া জাহাঙ্গীরের অতুল ঐশ্বর্যের কথা। কেমন করে স্যার টমাস রো'কে  নাকে দড়ি বেঁধে ঘুরিয়েছিলেন ভারত সম্রাট। শেষে দয়া করে ছুঁড়ে দেন বাণিজ্যের অধিকার। 

বই মনে করায়, নিঃশুল্ক বাণিজ্যের অধিকার পেতে গোরাদের লেগেছিল আরো ৭৫ বছর। ভারতের সিংহাসনে তখন জাহাঙ্গীরের সুযোগ্য পৌত্র আওরঙ্গজেব।  তবে সে সুবিধা সীমাবদ্ধ ছিল বঙ্গদেশের চার দেওয়ালের মধ্যে। বঙ্গ- বিহার - উড়িষ্যায় নিঃশুল্ক বাণিজ্যের ফারমান দিলেন বাদশাহ ফারুকশিয়ার। 


ততোদিনে ব্রিটিশদের শক্তপোক্ত উপনিবেশ গড়ে উঠেছে মাদ্রাজে। ১৬৮৮ সালে পর্তুগালের রাজকুমারী ক্যাথরিন ব্রিগ্যাঞ্জাকে বিয়ে করে মুম্বাই যৌতুক পেয়েছেন ইংল্যান্ডের রাজা। রাজার থেকে  বছরে মাত্র ১০ পাউন্ড ভাড়ায় তার স্বত্ত্ব পেয়েছে কোম্পানি। ১৬৯০ এ ভিত্তি স্থাপন হয়েছে আমাদের সাধের কলকাতার। 


ব্রিটিশরা যখন এতটা এগিয়ে গেছে, হঠাৎ এসে উদয় হল ফরাসীরা। ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপিতই হল ১৬৬৪ সালে। বলতে বলতে হঠাৎ খেয়াল হয়, " এই বাবু, সবাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেন খুলছে বলতো?" তুত্তুরীর জবাব পেয়ে চুপসে যাই, আজকালকার বাচ্ছা গুলো কেন যে এত কিছু জানে - সব এই আপদ গুগলের দোষ। 


মঞ্চে প্রবেশ করেন চন্দননগরের বড়সাহেব। কে বলুন তো? ডুপ্লে মশাই, যোশেফ ফ্রাঁসোয়া ডুপ্লে। এই একটি লোকই তো খেলা জমিয়ে দিয়েছিল। ইউরোপে বাঁধল অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকারের যুদ্ধ, ভারতেও ইংরেজদের উদোম পিটিয়ে মাদ্রাজ তথা ব্রিটিশদের ফোর্ট জর্জ কেল্লা দখল করে নিল ডুপ্লে আর তার দলবল। ইংরেজরা আর কি করে, কাঁদতে কাঁদতে  গিয়ে পড়ল, কর্নাটকের নবাব আনোয়ারুদ্দিনের পায়ে। 


নবাব ও তেমনি, তিনি নির্দেশ পাঠালেন, ওদের দুর্গ ওদের ফেরৎ দাও। বয়েই গেছে, কানেই তুললে না ডুপ্লে সাহেব। ক্ষুব্ধ নবাব তখন ফরাসীদের শায়েস্তা করতে পাঠালেন এক বিরাট সেনা দল।  ডুপ্লে আর তার দলবলের কাছে গোহারান হেরে গেল নবাবের সুশিক্ষিত সেনা দল। ব্যাস আর একটু, আর একটু হলেই হয়তো বদলে যেত পরাধীন ভারতের ইতিহাস, কিন্তু - 


ওই যে বলে না রাখে হরি, মারে কে, ঠিক সেই সময়ই ইউরোপে বন্ধ হয়ে গেল যুদ্ধ। দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হল কি যেন জটিল নামের এক চুক্তি। বিনা যুদ্ধে, আপদ ব্রিটিশদের মাদ্রাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হল ডুপ্লে আর তাঁর দলবল। 

 

ইউরোপের ছড়ি খেয়ে যতই এরা ভাব করে নেবার নাটক করুক না কেন, এত বৈরিতা, এত বিষ কি ওমন এক চুক্তিতে যায় নাকি? বছর ঘুরল না লেগে গেল, দ্বিতীয় কর্নাটকের যুদ্ধ। এমনিতেই অবিশ্বাস আর ক্ষোভ ছিলই একে অপরের প্রতি, তারওপর হায়দ্রাবাদ আর কর্নাটকের শাসকদের আভ্যন্তরীন কোন্দল, যাকে বলে,

 "নারদ নারদ খ্যাংরা কাঠি,

 লেগে যা নারদ ঝটাপটি।"

 হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ে তুত্তুরী।


ধমকে বলি, হাসিস না শোন। এদিকে হায়দ্রাবাদে নিজামের ছেলে বনাম নাতি, ওদিকে কর্নাটকের নবাব আনোয়ারুদ্দিন বনাম চাঁদ সাহেব।এক তরফে ব্রিটিশ, অন্য তরফে ফরাসী। সে কি যুদ্ধ। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। যুদ্ধ আর সীমাবদ্ধ থাকে না ইতিহাস বইয়ের পাতায়, নেমে আসে বর্তমানে। লাঠালাঠি যুদ্ধ হয়, পেন পেন্সিল, বালিশ পাশবালিশ দিয়ে। ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে থাকে লাল মুখো গোরার দল। তুত্তুরী আপত্তি তোলে, "ফরাসীরাও কিন্তু লাল মুখো গোরাই ছিল মা।" ক্ষণিক থামি আমি, তাও বটে। উল্টো দিক থেকে মঞ্চে প্রবেশ করেন মির জাফরের হবু দোসর রবার্ট ক্লাইভ, বইয়ের পাতায় ক্লাইভের পুঁচকে তৈল চিত্র দেখে বিমোহিত হয়ে যায় তুত্তুরী, " ওমা কি কিউট দেখতে -"। আর আমায় থামায় কে? আমি বাঙালি, আড়াইশ বছর আগে যে ভুল করেছি, আর সে পথে হাঁটতে নারাজ। ক্লাইভ নয়তো, ক্লাইভ পন্থীই সই, পলাশীর প্রান্তর না হোক, কাঁথিই সই -। 


  হাঁটা শেষ করে ফিরে এসে নেহাৎ শৌভিক জাপটে ধরে নিরস্ত করল তাই, না হলে নির্ঘাত বদলে যেত পরাধীন ভারতের ইতিহাস। মাঝখান থেকে রেগে মেগে বইটাই কেড়ে নিল তুত্তুরী, "অনেক হয়েছে মা,তোমায় আর আমাকে ইতিহাস পড়াতে হবে না। অন্তত যে চ্যাপ্টারে যুদ্ধ আছে, সেই চ্যাপ্টার তো হরগিজ আর পড়ছি না তোমার কাছে।" রাষ্ট্র ভাষায় কি যেন বলে, ভালোর দিনই নেই মাইরি।