Monday 4 November 2024

অনির ডাইরি নভেম্বর, ২০২৪

 অনির ডাইরি ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


বেশ কিছুদিন আগের কথা, পাশের অফিসের জনৈক অফিসারকে ফোন করেছি কিছু দরকারে, ফোন ধরেই কেঁদে ফেললেন ভদ্রলোক। রীতিমত থতমত খেয়ে গেলাম আমি, বদমেজাজী, মুখরা বলে আমার প্রচুর বদনাম, কিন্তু ভদ্রলোককে তো এখনও পর্যন্ত, " হ্যালো, অমুক বাবু-" ছাড়া তো কিছুই বলিনি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে রইলাম খানিকক্ষণ, নিজেকে সামলে ভদ্রলোক বললেন, " ম্যাডাম আমি অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছি। বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে -"। ঠিক আছে, সাবধানে যান ছাড়া আর কিছু বলতে পারলাম না। পরে শুনলাম, ভদ্রলোকের নববিবাহিতা কন্যা সন্তানসম্ভবা হয়েছিল, স্থানীয় ডাক্তারের পরামর্শে X-ray করিয়ে সর্বনাশ ঘটে গেছে। মাসখানেক পর বলতে গিয়েও ভিজে উঠছিল ওনার চোখের পাতা। " টুইনস ছিল ম্যাডাম। দুটোই ছেলে। মেয়ে আমায় সব বলে আর এটা বলল না। জাহিল (অশিক্ষিত) অসভ্য পরিবার, আমার মেয়েকে এমন হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল, সব শেষ করে দিল ম্যাডাম। সব শেষ করে দিল।" 


কি বলব বুঝে উঠতে পারি না। সেদিন আমার চেম্বারে বসেই কথা হচ্ছিল। ভদ্রলোক, আমি ছাড়াও উপস্থিত ছিল এক ইন্সপেক্টর। পরে ইন্সপেক্টর সাহেব আমায় আলাদা করে বললেন," এটা খুবই দুঃখের ম্যাডাম। কিন্তু আজও যে কত জায়গায় এটা হয়। অমুককে চেনেন তো, ওর সাথেও হয়েছিল। " এবার যার কথা হচ্ছে, সেই ছেলেটি আমাদেরই এজেন্ট। অবস্থাপন্ন, হাসিখুশি, দিলখোলা ছেলে। হতবাক হয়ে যাই, তার সাথেও এমন হয়েছে? ইন্সপেক্টর সাহেব বলেন, "হ্যাঁ ম্যাডাম। কি আর বলি। অন্য কোন সমস্যা হচ্ছিল হয়তো, তমলুকের নামি ডাক্তার, X-ray করতে বলল -। ব্যাস, ওখানেই শেষ। পরে জানা গেল ছেলে ছিল। " ছেলে হোক বা মেয়ে, সন্তান তো সন্তানই। সান্ত্বনার কথা এটাই যে ছেলেটির আগে থেকেই যমজ বাচ্ছা আছে। দুটোই মেয়ে। ছবিও দেখেছি তাদের বাবার ফোনে। গর্বিত বাবা নিজেই দেখিয়েছিল। তাও, এ ব্যথা যে কি ব্যথা। পৃথিবীর মর্মান্তিকতম ব্যথা। 


এবছর পুজোর আগে, হঠাৎ করে ভাইরাল ফিভারে পড়লাম। যথারীতি শ্রীমতী তুত্তুরী বয়ে এনেছিলেন ইস্কুল থেকে। প্রথমে তাঁর হল, ওই অবস্থায় তাঁকে জড়িয়ে আদর করে, হামি খেয়ে আমিও বাঁধালাম। জ্বর বাঁধালে বাচ্ছা গুলো যেন পাঁচ গুণ মিষ্টি হয়ে যায়, আর আমার সংযম বরাবরই কম। শ্রীমতী তো দুদিনে সুস্থ হয়ে দৌড়াতে লাগলেন, আমি আর উঠতেই পারি না। প্রতিটা লক্ষণ চিৎকার করে বলে, "কোভিড হয়েছে বাপু তোমার। অন্য কিছু লয়।"  তীব্র জ্বর আর গা-হাত-পা ব্যথায় কাতর হয়ে শুয়ে আছি, ঝনঝন করে বেজে উঠল মুঠো ফোন। ওপাশ থেকে জনৈক সহকর্মীর সহমর্মী কন্ঠস্বর, " ম্যাডাম একটা বাজে খবর আছে -"। ছ্যাঁত করে উঠল হৃদয়, সবাই ঠিক আছে তো? ছেলেটি একরাশ দুঃখ গেলা গলায় জানালো, " অমুক দার জোড়া মেয়ের একটা কাল -"। কিঃ? শুনতে পাই না। বিশ্বাস করতে পারি না আমি।


চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেয়েদুটোর জন্মদিনের ছবি। আমাকেও নিমন্ত্রণ করেছিল ওদের বাবা। কিন্তু আগে থেকেই অন্য একজনের নিমন্ত্রণে সাড়া দেওয়া ছিল বলে যেতে পারিনি। মুখপুস্তকে ছবি দেখেছি। ফুটফুটে দুই বোন, একই রকম পোশাক পরে, একই রকম হেসে ছবি তুলেছে। তাদের একজন নেই? কি করে সম্ভব সেটা? কোন মতে জিজ্ঞাসা করি, কি হয়েছিল? জবাব আসে, নিউমোনিয়া। কলকাতার হাসপাতালও ব্যর্থ হয়েছে বাচ্ছাটিকে তার বাপমায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে।


মন চায়, ছেলেটিকে একবার ফোন করি। কিন্তু সদ্য সন্তানহারা পিতাকে কি বলব বুঝে উঠতে পারি না। কি অবস্থায় যে আছে এখন -। অনেক বার ভাবি, অনেক দিন ধরে ভাবি তাও বুঝে উঠতে পারি না। শেষে ওই ব্লকের ইন্সপেক্টর ছেলেটিকে ধরি, আমাকে একবার ওর বাড়ি নিয়ে যাবে? মুঠো ফোনেই কিছু বলে উঠতে পারিনি, মুখোমুখি কি বলব কে জানে। তবুও -। যে দিন যাবার কথা, তার আগের দিনই মুঠো ফোনে খবর এল, দ্বিতীয় বাচ্ছাটিও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। কি হয়েছে কেউ ঠিক বলতে পারল না, ইন্সপেক্টর সাহেব কেবল বললেন, " শিশু হতে পারে, ট্রমা তো ওর ও কিছু কম নয়। দুই বোন কি সুন্দর এক সঙ্গে বেণী দুলিয়ে স্কুল যেত, খেলাধুলো করত -"। সত্যি বড়দের কষ্টের কথা ভাবতে গিয়ে বাচ্ছাটির কথা তো আমরা ভুলেই গেছি। 


যাই হোক, হে ঈশ্বর, এটা যেন সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। অভাগা বাবা মাকে আর যাতনা দিও না প্রভু। বাচ্ছাটা সুস্থ হয়ে ওঠে অচিরেই, কিন্তু আমাদের আর ওদের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠে না। দেখতে দেখতে এসে যান দশভূজা। পুজোর ছুটির পর কটা দিন আপিস তারপরই আমাদের দীপাবলী। আপিস সেজে ওঠে আলোকমালায়, ভিড় জমে ওঠে লোকজনের। সম্মিলিত আনন্দে খুশিতে গরীব আপিস আমার যেন ঝলমলিয়ে ওঠে। এক ফাঁকে ওই ব্লকের ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করি, সেই ছেলেটির কি খবর? ইন্সপেক্টর সাহেব খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেন, " আজ আসবে কিনা, কিছুতো বলেনি ম্যাডাম। দাঁড়ান ফোন করছি -"। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে ছেলেটির কন্ঠ, "হেলো"। ইন্সপেক্টর সাহেব বলেন, " আপনি কি আসছেন? ম্যাডাম খোঁজ নিচ্ছেন।" সদ্য ইন্সপেক্টরটিকে অ্যাপ্রাইজাল দিয়েছি, আমি কাউকে খারাপ নম্বর দিই না। হাঁড়ি উল্টে নম্বর দিই। একেও দিয়েছি, আজ মনে হচ্ছে কেন দিলাম। ব্যাটাকে ভেরি পুওর দেওয়া উচিৎ ছিল। একজন সন্তান হারা পিতাকে এই অনুষ্ঠানে আসতে বলার ধৃষ্টতা আমার আছে? রেগে ফোনটাই কেড়ে নিই ব্যাটার কাছ থেকে। বলি, " আমি তোমাকে একবারও না আসার জন্য খুঁজিনি বাবা। জাস্ট জানতে চেয়েছি তুমি কেমন আছ।" 


ছেলেটির দরাজ গলা ভেসে আসে মুঠোফোনের ওপাশ থেকে,"আমি আসছি ম্যাডাম। সিঁড়িতে।উঠে আপনার চেম্বারে যাচ্ছি।" বরাবরের মতোই হাসি মুখে প্রবেশ করে ছেলেটি। এর ওর পিছনে লাগে সামান্য। সবই বড় বেশি স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকত্ব বড় বেশী আরোপিত, বড় বেশী করুণ। বড় বেশী অস্বাভাবিক। একগাল হাসি নিয়ে আমার উল্টো দিকে বসে ছেলেটি। চুপ করেই থাকি দুজনে। ঘরে আগে থেকেই উপস্থিত দুজন ইন্সপেক্টর, একজন CKCO, এক পিওন সবাই নির্বাক। মাথা নীচু করে যে যার কাজ করে যায়। 


আমিই নীরবতা ভঙ্গ করি, জানাই অনেক বার ভেবেছি এই দুর্দিনে একবার ছেলেটির বাড়ি যাব। কিন্তু ব্যাটে বলে আর হয়নি। ছেলেটি হাসে, তারপর বলে, " আর কি করব ম্যাডাম। স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি, কিন্তু -"। এই কিন্তুর পর আর কিছু বলার থাকে না। ছেলেটি নিজে থেকেই বলে, " বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, কিছু ছিল না। কোন রোগ ব্যধি কিস্যু না। একদিন স্কুল থেকে ফিরল অল্প জ্বর আর সামান্য কাশি নিয়ে। খুকখুকে কাশি। আমি কাজে ছিলাম, ওর মা আমায় ফোন করে বলল, 'একবার ডাক্তার দেখিয়ে নাও। কাশিটা যেন কেমন লাগছে।' সাধারণত এমন হলে আমরা কি করি, বাড়িতে কাশির ওষুধ থাকেই, তাই খাইয়ে দিই।" 


নীরবে সম্মতি জানাই আমি। ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ির মেয়ে আমি, ওষুধ আর ডাক্তারে আমার এমনিতেই ফোবিয়া আছে। কাশি হলে আমার ভরসা আদা মধু আর তুলসী পাতার রস আর গরম জলে গার্গল। একেবারেই না কমলে তবে কফ সিরাপ। ছেলেটি না থেমে বলে চলে, " আমি ফেলে রাখিনি ম্যাডাম।কাজে ছিলাম, কাজ ফেলে এসে স্থানীয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছি। ডাক্তার বলল, কিছু না। কাশির আর জ্বরের ওষুধ দিল। বলল সেরে যাবে। দুয়েক দিন দেখলাম, কাশি কমছে না দেখে নিয়ে এলাম তমলুক, অমুক ডাক্তারের কাছে -"।


 তমলুকের ডাক্তার বাবুর নাম শুনেই সিকেসিও ছেলেটি কপালে হাত ঠেকায়, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, "উনি এই শহরের সেরা শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ম্যাডাম। ডাক্তার নন, সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি।" সদ্য সন্তানহারা ছেলেটি মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দেয়, তারপর বলে, " আমাদের পাড়ার ডাক্তার বাবুও সঙ্গে এসেছিলেন, বড় ডাক্তার বাবু দেখে বললেন, ' তুমি ঠিকই চিকিৎসা করেছ। শুধু সিরাপের বদলে ইনজেকশন দিয়ে দেখ।' আর আমায় কইলেন, দিন সাতেক ওষুধ চলুন, তারপর ওনাকে রিপোর্ট দিতে। সাতদিন কি ম্যাডাম, মেয়ের অবস্থার অবনতি দেখে আমি দেড় দিনের মাথায় আবার নিয়ে গেলাম মেয়েকে। 


এবার আমাদের দেখেই ওনার মুখটা হাঁড়ি হয়ে গেল। গম্ভীর ভাবে শুধু বললেন, ' অবস্থা সুবিধার বুঝছি না। একে এখনি কলকাতা নিয়ে যাও।' বিশ্বাস করবেন নি ম্যাডাম, আমি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি। শুধু কচির মাকে ( তমলুকে ছোট বাচ্ছাদের/ সন্তানকে আদর করে কচি বলা হয়) বললাম দুটো জামা প্যাক করে নাও, আর একজন আত্মীয়কে নিলাম যে এইসব হাসপাতালে কথা বলা, ছুটা দৌড়া (দৌড়াদৌড়ি) করা ভালো পারে। ব্যাস সোজা শিশুমঙ্গল। সেখানেও কেউ খারাপ কিছু বলছে না। মেয়েও দিব্যি কথা বলছে আমাদের সাথে -। " আরও অনেক কিছু বলে চলে ছেলেটি, কেমন করে শিশুমঙ্গল থেকে ছাড়িয়ে কলকাতার মূল্যবানতম হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সেখানেও কেমন স্বাভাবিক ছিল মেয়ে। আজও কানে বাজছে ছেলেটার কথা, " এত বুদ্ধিমান ছিল মেয়েটা কি বলব। আর তেমনি শৌখিন। আর কটা দিন পরই ওর জন্মদিন ছিল। ফ্লিপকার্ট এ জামা অর্ডার করেছিল নিজেই। ওই অবস্থাতেও বলছে, ' বাবা তুমি, মা সব তো এখেনে, আমার জামাটা যদি দিয়ে আসে আজ -'! আমরা ততক্ষণে জানি ও আর কয়েক ঘণ্টা মাত্র। ডাক্তার এবার ভেন্টিলেশনে ঢোকাবে -"। 


শুধু আমি নই, ঘরে উপস্থিত প্রতিটা লোক যেন অন্তঃস্থল থেকে কেঁপে ওঠে। এই দিন, এই মুহূর্ত যেন চরম শত্রুকেও না দেখতে হয়। নিজেকে সামলে নেয় ছেলেটা, বলে, "আমি জোর করেই রাস্তায় বেরিয়েছি ম্যাডাম। কাজে মন দেবার চেষ্টা করছি। কিন্তু বাড়ির যা অবস্থা। একদিকে আমার মা, একদিকে আমার বউ। আমি যে কাকে দেখি -। দুজনেই কেবল কাঁদে। সারাদিন শুয়ে থাকে আর কাঁদে।" বেশ খানিকক্ষণ নীরব থেকে ছেলেটি আবার বলে ওঠে, "তবে একজন কাঁদে না ম্যাডাম। একদিনও কাঁদেনি। দুজনে তো একসঙ্গেই থাকত, এত ভাব ছিল দুজনের। অথচ সে চলে যাবার পর, এ যেন হঠাৎ করে কি বড় হয়ে গেল। রোজ রাতে ওকে জড়িয়ে ওর মা আর আমি কাঁদি। খুব কাঁদি। ও নীরবে আমাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। মাথায় বিলি কেটে দেয়। একটি বারও তার নাম করে না। আমি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ' আমরা কেন কাঁদি জানিস?' বলেছিল, ' জানি তো। বনু নেই। তার জন্য তোমাদের মনে খুব দুঃখ।' বললাম, ' তোর দুঃখ হয় না, বনু যে আর কোনদিন ফিরে আসবে না?' ওই টুকু মেয়ে কি বলল, জানেন ম্যাডাম, ' দুঃখ হয় তো। কিন্তু আমার কি কাঁদার সময় আছে। আমায় যে শক্ত থাকতেই হবে, তোমাদের জন্য। নইলে তোমাদের সামলাবে কে?"'

Thursday 3 October 2024

অনির পুজোর ডাইরি অক্টোবর, ২০২৪

অনির ডাইরি ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪

#অনিরডাইরি #শুভদীপাবলী #তাম্রলিপ্তকড়চা



কে জানে কোন দেবতা রুষ্ট হয়েছেন আমাদের ওপর, টাকাপয়সা তো কিছু আসেই না, উল্টে কেড়ে নেওয়া হয় যখনতখন। বিগত তিন বছরে প্রথম বার ট্রান্সফার TA র অ্যালটমেন্ট এল, ছিটেফোঁটা হলেও অ্যালটমেন্ট তো রে বাবা। মোটামুটি একটা অনুপাতে ভাগ করে সকলের TA বিলের খানিকটা রেডি করা হল। ও বাবা বিল লাগাতে গিয়ে দেখা গেল, তার থেকেও একবাটি তুলে নিয়েছে মহানগর। "এ কি হল, কেন হল, কবে হল -" প্রশ্ন করলে মহানগর একটাই কথা বলে, " জানি না তো।" 


দিন কয়েক আগে মেসেজ পেলাম হাজার পাঁচেক টাকা পাঠানো হয়েছে অফিস খাতে। পোর্টালে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম শুভাশীষ আর আমি, টাকাটা দিল কোন খাতে। যে হেড বলা হয়েছে, তাতে তো কিস্যু দেখাচ্ছে না। শেষে ক্লান্ত হয়ে শুভাশীষ বলল, " মনে হয় টাকা তুলে নিয়েছে ম্যাডাম।" এই ভাবে আপিস চলে মাইরি? 


সামনেই কালীপুজো-দীপাবলী। গরীব আপিস বলে শখ সাধ থাকবে না? দীপাবলী এলেই আমরা অফিসটাকে সাজাই। আলমারির মাথা থেকে ঝেড়েঝুড়ে নামানো হয় আলোর মালা। লেবার আপিসের সস্তাতম আলোক মালা। ফি বছরই তাঁদের কেউ না কেউ পটল তোলেন, আর আমাদের রবি বাবু  টেস্টার, স্ক্রুড্রাইভার ইত্যাদি সহযোগে নেমে পড়েন মৃতসঞ্জীবনী সুধা সংযোজনে। বিভিন্ন কাজে আসা অসংগঠিত শ্রমিক বা তাদের পরিবার বর্গ, ট্রেড ইউনিয়নের লোকজন থমকে দাঁড়ায় রবির কর্মতৎপরতা দেখে। ছুটে আসে, উড়ে আসে নানা অভিমত, নানা বিশেষজ্ঞ মতামত, শেষ পর্যন্ত অবশ্য আপিস তথা রবির মুখোজ্জ্বল করে ঝলমলিয়ে ওঠে প্রতিটা টুনি। 


দীপাবলী হল রং আর আলোর উৎসব। তিন বছর আগে, হুগলী থেকে বদলী হয়ে এসে যখন শুধিয়েছিলাম, তোমরা রঙ্গলি বানাও না। হতবাক হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া জনগণের ইদানিং উৎসাহ দেখে কে? কিন্তু বানাবে কি করে, রঙ কি আর কিছু অবশিষ্ট আছে? তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায় না কিছু। উৎসাহের আতিশয্যে শান্তনু বলে, " রং কিনে লিয়ে পালিয়ে আসব ম্যাডাম। ক প্যাকেট আনব শুধু বলেন?" পালিয়ে আসব শুনে অন্য কিছু ভাবেননি যেন। এই মহকুমার লোকজন ঐ ভাবেই কথা বলে। প্রথম প্রথম আমিও ব্যোমকে যেতাম, যখন জনগণ বলত, " ম্যাডাম আজ হাওড়া যাবেন নাকি? তাইলে আমিও আপনার সাথে পালিয়ে যেতাম।" মনে মনে বলতাম, কিন্তু আমি মোটেই তোমার সাথে পালাতে আগ্রহী নই বাপু।


আলো হল,রং হল, এবার আসল জিনিস। ভোজন। বিভিন্ন ব্লক, পুরসভা থেকে আসবে আমাদের কালেক্টিং এজেন্ট, SLO রা। যদিও আপিস শেষের অনুষ্ঠান, তাও কিছু তো খাওয়াতে হবে। শুকনো মুখে দিওয়ালি হয় নাকি?এদিকে তো ভাঁড়ে মা ভবানী।ধন্য  হক বাবুর অধ্যবসায়, ক্যান্টিনকে শেষমেষ ধারে টিফিন দিতে রাজি করিয়েই ছাড়লেন। যৎসামান্য টিফিন, কোয়ার্টার পাউন্ড পাউরুটি সেঁকে সামান্য মাখন মাখিয়ে, ওপরে অল্প একটু চিনি ছড়িয়ে দেবে। সাথে একটা করে সিঙ্গাপুরী কলা আর ডিম সিদ্ধ। আমরা ওতেই খুশি। 


দিন কয়েক আগে হঠাৎ মনে হল মিষ্টি তৈরির একটা প্রতিযোগিতা করলে কেমন হয়? মুঠো ফোন খুললেই ভেসে আসছে না না ধরণের মিষ্টি তৈরির ভিডিও, আমরাও কি পারি না কিছু বানাতে? যে যা পারবে তাই বানাবে, যতটুকু পারবে, তাই বানাবে। শর্ত একটাই নিজেকে বানাতে হবে। মেয়েরা তো নিজেরাই পারবে, ছেলেদের ও নিজেদেরই বানাতে হবে, মা বা বউয়ের সহযোগিতা ব্যতীত। 


মহকুমার গ্রুপে একটা পোল বানিয়ে বললাম, ভোট দাও দিকি, কতজন রাজি আছ। রাজি না থাকলেও নিঃসঙ্কোচে জানাও। সংখ্যা গরিষ্ঠ যা চাইবে তাই হবে। প্রথম ভোট অবশ্যই আমি দিলাম। "Yes"। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভোট দিল শান্তনু। ব্যাটা দুটো নম্বর থেকে দুবার ভোট দিলে। তৃতীয় ভোট শুভাশীষ। শেষ পর্যন্ত শতাধিক জনের গ্রুপে ভোট পড়ল ১৭টা মাত্র। সবই হ্যাঁ। না কেউ দিল না, শান্তনু একগাল হেসে বললে, "আপনার ভয়ে নির্ঘাত না'য়ের বোতাম টেপার সাহস হয়নি কারও"। 


দেখতে দেখতে এসেই গেল দীপাবলী। আর মাত্র ৪৮ ঘণ্টা, তারপরেই গোটা আপিস জুড়ে ফুটে উঠবে হরেক রঙের আল্পনা। ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি যাচ্ছি, শান্তনু এসে বললে, " ম্যাডাম একটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে।" আতঙ্কিত হয়ে জানতে চাই, কি আবার ভুল করলাম আমরা। শান্তনু বলে, " হায়, হায় ম্যাডাম, আজ তো ডিএম আপিসে বিজয়া সম্মিলনী। সবাইকে বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছে। আমরা জানিইনি। বেলা দুটো থেকে তিনটে নাকি কুপন দিছে। এখন জানতে পেরে জহর বাবু গেছেন, যদি দেয়।" 


রেগে আগুন হয়ে ফিরে এলেন জহর বাবু, "সবাই কুপন নিছে, তোমরা কি তখন ঘুমাইছিলে? ওরা কইছে সব আপিসে কুপন দিয়ে গেছে। চঞ্চল,শান্তনু, নন্দন, রবি, রঞ্জিত, বেদজ্যোতি সমস্বরে প্রতিবাদ জানায়, কই এই আপিসে তো কেউ কুপন দিতে আসেনি। যা হবার হয়ে গেছে, শান্তনু আর নন্দনকে বলি, তোমরা একবার গিয়ে বলো। জহর বাবু হাজার হোক অবসরপ্রাপ্ত নাইট গার্ড গুছিয়ে বলতে পারেননি হয়তো। তোমরা গিয়ে বলো, কুপন পাওনি। সবাই তো মুখ চেনা, সবাই তো পরিচিত, নিশ্চিত পেয়ে যাবে। 


মুখ কালো করে ফিরে আসে আমার ছেলেরা। "দিল নি ম্যাডাম। কুপন ছাড়া দিবেনি। শুধু একটা দিয়েছে আপনার জন্য।" ধুৎ আমার জন্য, তোমরা খেতে পাচ্ছ না, আর আমি খাব? ওটা সবাই ভাগ করে খেয়ে নাও। আর কুপন কে দিয়েছে?  সে/তিনি কোথায়? তার নম্বর আছে? সবাই মিলে নিরস্ত করে, "ছেড়ে দিন ম্যাডাম। এক প্যাকেট বিরিয়ানির জন্য -"। আমারটাও কেউ ভাগ নেয় না। বলে তুত্তুরির জন্য লিয়ে যান ম্যাডাম। আপনি আছেন, আজ নয়তো কাল, কিছু না কিছু ব্যবস্থা আমাদের হয়েই যাবে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরি, ইশ যদি কোথাও কিছু টাকাপয়সা থাকত -। 


ঠিক ৪৮ ঘণ্টার মাথায় যখন উপচে পড়ছে আমার আপিস হরেক রকম মিষ্টিতে,  ১৭ জন ভোট দিলেও অন্তত ৩৫/৪০ জন বানিয়ে এনেছে মিষ্টি। পায়েসই এসেছে গোটা পাঁচেক কৌটো, কেউ বানিয়েছে সুজির বরফি, তো কেউ রসমালাই,কেউ মালপোয়া, কেউ সন্দেশ কেউ কলাকান্দ, কেউ ছাপা, কেউ মিহিদানা, কেউ বোঁদে। খেজুর আর ড্রাই ফ্রুট দিয়ে কি অসম্ভব ভালো লাড্ডু বানিয়েছে শুভাশীষ, তমলুকের জয়ন্ত বাবু নারকেল নাড়ু পাকিয়ে এনেছেন এক বালতি।  মনে হল, দাড়ি বুড়ো যথার্থই লিখে গেছেন, "আমার ভাণ্ডার আছে ভ’রে, তোমা সবাকার ঘরে ঘরে "। বদলির চাকরী আমার, আমরা হলাম পরিযায়ী পাখি, আজ এখানে, কাল না জানে কোথায়। যেখানেই থাকি না কেন, অক্ষয়, অবিনশ্বর হোক এই মুহূর্ত গুলো। শুভ হোক দীপাবলী। আলোয় রঙে মিষ্টত্বে উপচে যাক সকলের জীবন


অনির পুজোর ডাইরি ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪

#এলেম_মোগলির_দেশে পর্ব - ৪

#অনিরডাইরি 



ভোর পৌনে ছটার ট্রেন গড়িমসি করে ছাড়ল বেলা বারোটা পঁয়ত্রিশে। ১২২২২ নং হাওড়া পুণে দুরন্ত। হাওড়া থেকে ছাড়ে কেবল হপ্তায় দুই বার, বৃহস্পতি আর শনি। হাওড়ার পর চতুর্থ স্টেশনই নাগপুর। মাঝে কেবল থামে টাটানগর, বিলাসপুর আর রায়পুরে। স্টেশন কম বলেই, টেনে দেবার সম্ভবনা প্রচুর। গেল বার ফেরার পথে শক্তিপুঞ্জের মত অখাদ্য ট্রেনও পাঁচ না সাত ঘণ্টা লেটকে টেনে নামিয়ে ছিল সোয়া ঘণ্টায়, আর এতো দুরন্ত। রেলযাত্রী দেখাচ্ছে নাগপুরে সম্ভাব্য অবতরণ রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ। ড্রাইভারকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে শৌভিক। হোটেল থেকেও ফোন করে জেনে নিয়েছে, আমরা কটা নাগাদ পৌঁছাচ্ছি ইত্যাদি। 


ট্রেনের চাকা গড়ানোর সাথে সাথেই এসে গেছে ভাঁজ করা খবরের কাগজ। তিনজনের জন্য তিনটি এক লিটারের জলের বোতল। দূরন্তে পরিবহনের সাথে খাওয়া ফ্রি। কেটারিং মূল্য টিকিটেই ধরা আছে। বেলা দুটো নাগাদ লাঞ্চ এল, নর্মাল ট্রেনের চিকেন থালি যেমন হয় আর কি। ভাত, ডাল, চৌকো আলুভাজা, চিকেন কারি, দুটো পরোটা। শেষ পাতে আইসক্রিম। খাবার গুণগত মান আমাদের বেশ ভালো লাগল। ট্রেনটা বেশ পরিচ্ছন্ন ও। বার বার এসে সাফাইওয়ালারা সাফ করে যাচ্ছে। শৌচালয়ে জল, সাবান সব যথাযথ। সুগন্ধী স্প্রেও মারা আছে। 


যতই বলুন, প্লেনের থেকে ট্রেন আমার ঢের বেশি প্রিয়। ট্রেন মানেই স্মৃতিমেদুরতা। কেমন সুন্দর কু ঝিকঝিক করতে করতে ছোটে বলুন দিকি। আজকের ট্রেনটা যেন বড্ড ফাঁকা।  খাবার দিতে আসা লোকগুলো বলছিল গোটা কামরায় নাকি মাত্র তেরো জন। এটা ট্রেন না নিদ্রাপুরী ! ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, মাড় দেওয়া ধপধপে সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে, শৌভিকের ডাকে উঠে দেখি, চা দিয়ে গেছে। কাগজের কাপে সিল করা টি ব্যাগ, গুঁড়ো দুধ, চিনির পাউচ আর স্টারার। সাথে ট্রে ভর্তি বিস্কুট, সল্টেড ক্যারামেল পপকর্ন, চিঁড়ে ভাজা। 


খাবার দেখে আমার মুখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠলেও শৌভিকের মুখে অন্ধকার গভীর। ট্রেন আরো ঘন্টা দেড়েক লেটে চলছে। নাগপুরে পৌঁছানোর সময় আপাতত রাত দেড়টা থেকে পৌনে দুটো। অর্থাৎ পেঞ্চ পৌঁছাতে ভোর চারটে। সাফারি শুরু ভোর ছটায়। সাফারির জন্য জিপসি হোটেলে রিপোর্ট করবে ভোর সাড়ে পাঁচটায়। কি যে হবে। আশ্বস্ত করি আমি, তাতে কি? ঘরে পৌঁছে ব্যাগ রেখেই বেরিয়ে পড়ব। আমরা সব পারি। 


রাত দেড়টা বাড়তে বাড়তে অচীরেই রাত দুটো, আড়াইটে হয়ে তিনটে বেজে গেল। অর্থাৎ ভোর পাঁচটায় পেঞ্চ। ড্রাইভারকে প্রতি ঘণ্টায় ফোন করে আর টাইম পিছাতে থাকে শৌভিক। বেচারাকে প্রথমে বলা হয়েছিল সাড়ে নটা, সেটা এখন সাড়ে তিনটেতে এসে ঠেকেছে। সে তো গাঁইগুই করবেই। মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের কলকাতা অফিস তথা হোটেল থেকেও ফোন আসছে। তাঁরা যদিও আশ্বস্ত করেই যাচ্ছে, কোন চিন্তা নেই স্যার। জঙ্গলে সকাল সাতটা অবধি ঢুকতে দেয়।


রাত পৌনে আটটা নাগাদ শৌভিক বলল, "তোর টুইটার আছে না? একটা টুইট করবি?" প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বেড়াতে যাবার গ্রুপে পড়ি রেলমন্ত্রকে উদ্দেশ্য করে টুইট করলেই সব মুস্কিল আসান। আজ দেখাই যাক না। টুইটার থুড়ি X অ্যাকাউন্ট আমার একখান ছিল বটে, দেখলাম শ তিনেক ফলোয়ার আর প্রায় সাড়ে তিন হাজার টুইট ও আছে। কিন্তু সে তো মান্ধাতার আমলের গল্প। ইদানিং শুধু দুয়ারে সরকারের সময়ই ব্যবহার করি অ্যাকাউন্টটাকে, জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক যখন আমাদের দপ্তরের কোন ছবি টুইট করেন, সেটা রিপোস্ট করি। আর তো কিছুই করি না। শব্দের লিমিট এত কম যে টুইটারে লেখা বড় ঝামেলা। তার ওপর হ্যাশ ট্যাগ দিতে হয়। নইলে টার্গেট অডিয়েন্স এর কাছে পৌঁছায় না। 


তাও লিখলাম। আসলে শৌভিকই লিখে দিল, সেটাকে কেটে, ছোট করে  জানালাম, কোন ট্রেনে যাচ্ছি, গন্তব্য কোথায়, PNR নম্বর কত। জানালাম ট্রেন আট ঘণ্টা লেট। এই হারে যেতে থাকলে কাল সকালের সাফারি আমরা মিস করব। যেটা গোটা পরিবারের জন্য বড় যাতনাদায়ক হবে। প্লিজ একটু দেখুন না, অন্তত রাত দুটোর মধ্যেও যদি ট্রেনটা নাগপুরে পৌঁছায়।


শুধু যে টুইট করলাম তাই নয়, গুগল করে পাওয়া নম্বরে SMS করলাম। ১৩৯ নম্বরে ফোন করে রেলমদতে নালিশ ও করলাম। রেলওয়ে সেবা থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমায় জবাব দেওয়া হল, "For necessary action escalated to the concerned official." দেখতেও পেলাম, টুইটটা ফরোয়ার্ড করা হয়েছে DRM চক্রধরপুরকে। তিনিও, "kindly look into the matter" বলে টুইটটা ফরোয়ার্ড করেছেন, সিনিয়র ডিভিশনাল অপারেশনস ম্যানেজার, চক্রধরপুরকে। 


আশায় বুক বাঁধি আমরা। এত তৎপরতা কি আদৌ মিথ্যা হতে পারে! ট্রেনের গতি কি বাড়ল কিঞ্চিৎ? পর্যায়ক্রমে একবার রেলযাত্রী আর একবার টুইটার খুলি দোঁহে। সাড়ে আটটা নাগাদ রাতের খাবার দিয়ে যায়। যাবার সময় তুত্তুরীকে আশ্বস্ত করে যায় ক্যাটারিং এর লোকজন, এবেলা ও আইসক্রিম আছে। সন্ধ্যের খাবার কিছুই খাইনি আমরা, তাও বিন্দু মাত্র ক্ষুধার উদ্রেক হচ্ছে না। সব কেমন যেন শান্ত, নিস্তব্ধ। ট্রেনটা ও আবার ঝিমিয়ে পড়েছে। নাগপুরে পৌঁছানোর সময় ও বেড়েই যাচ্ছে উত্তরোত্তর। সাতটার মধ্যেও যদি পেঞ্চ পৌঁছাতে পারি, হে ভগবান। 


কি আর বলি, ভগবান বোধহয় নিদ্রা গিয়েছিলেন, রেলমদদ থেকে জনৈকা সহায়িকা আবেগহীন কেজো সুরে ফোন করে জানালেন, " অসুবিধা কে লিয়ে খেদ হ্যায়", আমরা বহুৎ দুখিত হ্যায়। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।  টুইটার খুলি, রেল সেবাকে আবার জানাই, প্লিজ হেল্প হ্যাশ ট্যাগ ও দিই, কিন্তু -। পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে বিরাজ করে অখণ্ড নৈঃশব্দ্য। 


রাত বাড়ছে। নটা মানে চলন্ত ট্রেনে মধ্য রাত। গুটি কয়েক সহযাত্রী যাঁরা আছেন, সকলেই খেয়ে দেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছেন। আমাদের অংশটুকু ব্যতিরেকে গোটা কামরা নীল রাতবাতির আলোয় ভেসে যাচ্ছে। ক্যাটারিং এর লোকটি এসে তাগাদা দিয়ে যায়, আমরা নৈশ ভোজ না সারলে আইসক্রিম আনতে পারছে না যে। 


ট্রেনের দুলুনিতে কখন যেন চোখ লেগে গিয়েছিল, উঠে দেখি সবে বিলাসপুর পৌঁছেছে দুরন্ত। বেলা তিনটে নাগাদ পৌঁছানোর কথা ছিল যে স্টেশনে, ঘড়ি বলছে সেখানে আমরা পৌঁছালাম রাত পৌনে দুটোয়। অর্থাৎ প্রায় এগারো ঘন্টা লেট। এখান থেকে নাগপুর পৌঁছাতে আনুষ্ঠানিক ভাবেই ছয় ঘণ্টা লাগার কথা। অর্থাৎ সকাল আটটা। নাহঃ আর কোন আশা নেই।

(চলবে)

 পুজোর ডাইরি ১৬ই অক্টোবর, ২০২৪

#এলেম_মোগলির_দেশে পর্ব - ৩

#অনিরডাইরি 



কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে বেরোব আমরা। হাওড়া থেকে ভোর পৌনে ছটায় ট্রেন। কাঁথি থেকে বেরোতে হবে রাত দুটো নাগাদ। শেষ মুহূর্তের গোছগাছ এবং নৈশভোজ সেরে রাত দশটার মধ্যে শুয়ে পড়া বাধ্যতামূলক। যতটুকু রেস্ট হয়,বাকিটা গাড়িতে আর ট্রেনে ঘুমিয়ে নেব ক্ষণ। অলক্ষ্যে বোধহয় হাসছিলেন বিধাতা পুরুষ, ঠিক রাত সোয়া দশটায় মেসেজ ঢুকল, পৌনে সাত ঘণ্টা লেট আমাদের পুণে হাওড়া দুরন্ত। পৌনে ছটার জায়গায়, ট্রেন ছাড়বে বেলা সাড়ে বারোটায়। 


রেল কোম্পানির আর কি, মেসেজ পাঠিয়ে দিলেই হল। বজ্রাহত বোধহয় একেই বলে। মাথাই যেন চলছিল না, অন্তত কিছুক্ষণ। প্রাথমিক ধাক্কা কাটতেই, শুরু হল নতুন করে ব্যস্ততা। সব কিছু আবার কেঁচে গণ্ডূষ করতে হবে যে। সবার আগে প্রয়োজন গাড়িকে নিষেধ করা। রাত দুটো নয়, বেলা সাড়ে আটটায় বেরোতে হবে এবার। নিষেধ করতে হবে লতা দিকেও। ঠিক ছিল, আমাদের পৌঁছে ফেরার পথে হাওড়া থেকে লতা দিকে তুলে আনবে গাড়ি। মহকুমা শাসকের যতই লোকলস্কর থাকুক, আমাদের অনুপস্থিতিতে লতা দি'ই কেবল পারবে শাশুড়ি মাকে সামলে রাখতে। ভোর ছটা নাগাদ ইছাপুর জলের ট্যাঙ্কে দাঁড়িয়ে থাকবে যে লতা দি। লতা দি এলে ছুটি পাবে শাশুড়ি মায়ের আয়া। চেইন রিয়্যাকশনের মত হবার কথা ছিল সব কিছু, গেল সব ঘেঁটে। 


নতুন করে পর্যায়ক্রম ঠিক করে আবার যখন শুলাম, ঘড়িতে প্রায় রাত পৌনে এগারো। একটু আগেও ঝোলাঝুলি নিয়ে চৌকাঠের কাছে অপেক্ষা করছিলেন নিদ্রা দেবী, এই মুহূর্তে দূরদূরান্ত পর্যন্ত তাঁর কোন হদিশ নেই। " দূরন্ত তো, নন স্টপ, লেট ঠিক ম্যানেজ করে দেবে -" একরাশ আশা নিয়ে স্বগতোক্তি করে শৌভিক। জবাব দিই না। দক্ষিণ পূর্ব রেলের ওপর আমার ছিটেফোঁটাও ভরসা নেই। 


শৌভিক আবার বলে, ইন্টারনেটে দেখাচ্ছে রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ পৌঁছাবে নাগপুর। গাড়ি বুক করা আছে, সে তো সাড়ে নটায় এসে বসে থাকবে নাগপুর স্টেশনে। ঘর বুক করা আছে কিপলিং কোর্টে। বুক করা আছে পরদিন ভোর বেলা তুরিয়া গেটে সাফারি। সব মিলিয়ে কত টাকা যে লোকসান হবে কল্পনা করতেও কান্না পায়। " কি করি বল তো? একবার কি মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমে ফোন করি নাকি?" উঠে বসে প্রশ্ন করে শৌভিক। 


এতবার যাওয়ার জন্য সখ্য গড়ে উঠেছে কলকাতা অফিসের অনেকের সাথেই। বড় সাহেব গোছের একজনকে ফোন করল শৌভিক। রাত তখন এগারোটা। ধন্য মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের পেশাদারিত্ব। ভদ্রলোক আশ্বস্ত করলেন, " ঐ ট্রেনটা অমনিই লেট করে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। গাড়ি দরকারে সারা রাত অপেক্ষা করবে আপনাদের জন্য। শুধু ড্রাইভারের সাথে একবার কথা বলে নেবেন। সাড়ে বারোটায় নামবেন তো, মানে রাত আড়াইটে বাজবে কিপলিং কোর্টে পৌঁছাতে। তাতেও কোন চিন্তা নেই। রাস্তা একদম সুরক্ষিত। ভোর বেলা আপনার জিপসি আর প্রাতরাশ ও রেডি থাকবে সাফারির জন্য।আর যদি অন্য কিছু হয়, তাহলেও আপনি সাফারির পুরো টাকা ফেরৎ পাবেন।" খানিক পরে পেঞ্চ কিপলিং কোর্ট থেকেও ফোন করে একই কথা জানাল। "স্যার বেফিকর থাকুন। আমাদের গাড়ি দরকারে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকবে। আর রাস্তা যদিও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, কিন্তু একদম নিরাপদ।" 


কিছুটা নিশ্চিন্ত, নির্ভার হয়ে শুলাম তো বটে, হয়তো অ্যাড্রেনালিন রাশের জন্যই ঘুম আর এলো কই। রাত দুটো নাগাদ বোধহয় লেগে গিয়েছিল চোখের পাতা,শাশুড়ি মায়ের চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে পড়লাম দুজনে। কি হল আবার, যা পতনশীল ভদ্রমহিলা। প্রায় দিনই আছাড় খান। আজও তেমন কিছু --। তড়িঘড়ি দরজা খুলতেই তিনি পুত্রকে জড়িয়ে ধরে বললেন, " তোরা যাবি না বাবা? রাত আড়াইটে বাজে যে। এলার্ম দিতে ভুলে গিয়েছিলি? এলার্ম বাজে বাজে নি? " কঠোর ভাবে নিয়ম নিষ্ঠ ভদ্রমহিলা তো রাত নটার মধ্যে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন, তারপর যে এতবার ভূমিকম্প আর এতগুলো সুনামি এসে গেছে উনি তার কিছুই টের পাননি। আয়া দিদি সব জানে, বলে নিরস্ত করার চেষ্টাও করেছে, কিন্তু বৃদ্ধা তাঁর কথায় কর্ণপাত ও করেনি। পরম মমতায় মাকে জড়িয়ে ঘরে দিয়ে আসে শৌভিক, ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলে, ট্রেন লেট। কাল কখন বেরোব, কি খেয়ে বেরোব, ইত্যাদি প্রভৃতি। বাকি রাতটা বিনিদ্রই কাটে আমাদের, এক রাতে, এত বার, এত রকম ভাবে পিলে চমকালে আর নিদ্রা দেবীর কি কসুর।

(চলবে)

#এলেম_মোগলির_দেশে পর্ব - ২

#অনিরডাইরি 



শ্বশুর মশাইয়ের মৃত্যুর অব্যবহিত পরপরই কলকাতার পাট চুকিয়ে, শাশুড়ি মাকে নিয়ে যেদিন কাঁথি রওনা দিলাম, প্রিয়জন হারানোর মনোবেদনার থেকেও বেশি ছিল উদ্বেগ। এই বয়সে, বাড়ি থেকে এত দূরে কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন তো বৃদ্ধা? কলকাতার বাড়িটা ছিল ওনার প্রাণ। নিজেই বলতেন, ওনার আজীবনের স্বপ্ন ছিল, একটুকরো বাসা, যেটা হবে একান্তই ওনার। 


শ্বশুর মশাইয়ের কর্মসূত্রে ঘুরে বেরিয়েছেন জেলা থেকে জেলান্তরে। থেকেছেন কখনও ভাড়ার বাসায়, কখনও বা সরকারী আবাসনে। সরকারী আবাসনের নিয়ম হল, নতুন কোয়ার্টার যাকে দেওয়া হবে, তার স্থান হবে হয় একতলায় নয়তো চার তলায়। এরপর যেমন যেমন খালি হবে, উপরে ওঠা বা নামা যাবে। ফলে সব মিলিয়ে প্রায় তেরো বার বাসা বদল করতে হয়েছে ভদ্রমহিলাকে। এটা চতুর্দশতম বার। 


গোটা পথটা ড্রাইভারের পাশের সিটে নিশ্চুপ হয়ে বসে এসেছিলেন শাশুড়ি মাতা। মাঝে মাঝে গায়ে হাত দিয়ে ডেকে কিছু খেজুরে কথা বলছিলাম আমরা। মৃদু হাসি ছাড়া কিছু ফেরৎ আসেনি পরিবর্তে। অবশ্য তার আরও একটি কারণ হল ওনার বধিরতা। যন্ত্র লাগিয়েও তেমন ভালো শোনেন কই। কাঁথি পৌঁছে সেদিন কেবল বলেছিলেন, " বড্ড দূর।" 


ইতিপূর্বে শ্বশুর মশাইয়ের সঙ্গে যতবার এসেছেন যে ঘরে থেকেছেন, সেই ঘরেই ওনার পাকাপাকি থাকার বন্দোবস্ত। ভাগ্যে লতাদি ছিল, আমরা আসার আগেই বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় ইত্যাদি পাল্টে, ঝাড় পোঁচ করিয়ে রেখেছিল ঘরটাকে। গাড়ি থেকে ধরে ধরে নামিয়ে, গোটা চারেক সিঁড়ি ভাঙিয়ে তোলা হল বারন্দায়। এতক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে পা ফুলে গেছে, পাম্প শু টাইপ নরম জুতো কামড়ে বসেছে পায়ে। শ্রীমতী তুত্তুরী মাটিতে বসে টেনে খুলল ঠাম্মার জুতো। ঠাম্মা আপাতত এবাড়ির সবথেকে সম্মানীয় অতিথি যে। ঠাম্মা সদ্য এত বড় শোক পেয়েছে যে। 


 সবাই তটস্থ ঠাম্মাকে নিয়ে। ঘড়ি ধরে পাক্কা ছটায় ঘুম থেকে উঠে পড়ে ঠাম্মা, কোন কোন দিন পাঁচটা- সাড়ে পাঁচটাতেও ঘুম ভেঙে যায়। ছটা নাগাদ দুটো সুগার ফ্রি গুলি দিয়ে এক কাপ কালো চা আর গোটা কয়েক বিস্কুট খেয়েই স্নানে যায় ঠাম্মা। প্রথম দিন জলখাবার খেয়ে বেলা দশটায় স্নানে গিয়েছিল ঠাম্মা, সে কি কেলো। রোদের তাতে পাইপের জল গরম হয়ে গেছে ততক্ষণে, আর ঠাম্মা ভেবেছে কেউ বুঝি ওনার সুবিধার্থে গিজার চালিয়ে রেখেছে। মে মাসে গিজার? এরা কি আমায় পুড়িয়ে মারতে চায়? রেগে আগুন, তেলে বেগুন ঠাম্মাকে অতি কষ্টে যখন বোঝানো গেল ব্যাপারটা, তিনি ঠিক করলেন, এবার থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বেই সেরে ফেলবেন স্নানাদি। রোজ একবার করে নিষেধ করি আমরা, ওগো এত সকালে স্নান করো না, বুড়ো হাড়ে ঠাণ্ডা লেগে যায় যদি। জেদি বৃদ্ধা শুনলে তো - । 


স্নান সেরে, কাচা কাপড় পরে, এলো চুলে অপেক্ষা করেন প্রভাতী সংবাদ পত্রের জন্য। মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বার খানা ওনার স্নিগ্ধ রূপে যেন ঝলমল করে ওঠে। এই মধ্য সত্তরেও ফেটে পড়ে দুধে আলতা রঙ, কোমর ছুঁইছুঁই চুলে খুঁজে পেতে মেলে কিছু রূপালী তার। কাগজে চোখ বুলিয়ে ঘড়ি ধরে নটায় জলখাবার খেতে বসেন ঠাম্মা। 


দাদু ঠাম্মা যখন একসাথে আসত, ঘড়ির কাঁটার দিকে কড়া নজর রাখত দাদু। সেকেন্ডের কাঁটা এদিক থেকে ওদিক গেলেই তুলকালাম করত দাদু। এখন তিনি নেই বলে যেন ঠাম্মার কোন অমর্যাদা না হয়। স্বর্গীয় ব্যক্তিটির জীবন চক্র আবর্তিত হত যাঁকে কেন্দ্র করে, তাকে যত্নে রাখা, ভালো রাখাই বোধহয় তাঁকে সম্মান জানানোর সেরা উপায়। 


ঠাম্মার খাওয়া নিয়ে বড় দুশ্চিন্তা আমাদের। মিষ্টি খাবে না, আলু খাবে না, মাছ-মাংস-ডিম খাবে না, ভাজাভুজি খাবে না। তাহলে খাবে কি? আজীবন উনি ডাল তরিতরকারি ফেলে, ঝোলের এক পিস মাছ তুলে নিয়ে ভাত খেয়ে এসেছেন। সেই তিনিই শ্বশুর মশাই চলে যাবার সাথে সাথেই ঘোষণা করেছেন আর মাছ খাবেন না। অনেক বুঝিয়েছি আমরা, " কার জন্য মাছ ছাড়ছ? বাবার জন্য? লোকটা যে আদ্যন্ত নাস্তিক ছিল ভুলে গেলে? আর আদরের গিন্নী তাঁর শোকে মৎস ত্যাগ করেছে জানলে বৃদ্ধ কি আদৌ ভালো থাকতে পারবে?" কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। যা জেদি বৃদ্ধা। 


বেশ মাছমাংস না হয় নাই খেলে, তরকারি পাতি একটু বেশি করে খাও না বাপু। তাতেও সমস্যা, এক তরকারি দু- তিন দিন হলে খাবেন না। তরকারিতে আলু খাবেন না। আলু ছাড়া মধ্যবিত্ত বাড়ির তরকারি আয়তনে বাড়বে কি করে? ওনার মাথায় ঢুকেছে ওনার হাই সুগার। আর সুগার হলে আলু খেতে নেই। বোঝাতে বোঝাতে মাথার চুল ছেঁড়ে শৌভিক, " আরে বাবা, তোমার সুগার নেই। সুগার রিপোর্ট কারো নিল বা শূন্য আসে না। তাহলে সে মরে যায়।" বৃদ্ধা সব শোনেন, কান এঁটো করে হাসেন। কিন্তু খেতে বসে আলু স্পর্শও করেন না। খাবার বেড়ে দিতে গিয়ে যদি এক কুচিও আলু পড়ে, অমনি রেগে আগুন, তেলে বেগুন ঠাম্মা। ইদানিং আবার ধরেছেন, কুমড়ো খেলে নাকি সুগার বাড়ে। সকাল বিকাল শৌভিককে বলছেন, " একটু ডাক্তারকে শুধাস তো। কুমড়ো খাবো কি না।" 


বেশ তো আমিষ খাবে না, তরকারি খাবে না, তাহলে ডাল,পনীর, স্যালাড এসব খাও একটু বেশি করে। তাতেও নাক সিটকান তিনি। খুশি হন কেবল একটা জিনিস মেলে, মিষ্টি। আজ্ঞে হ্যাঁ। রসগোল্লা, সন্দেশ, মিষ্টি দই, আইসক্রিম এসবে তাঁর না নেই। ওসব খেলে আবার সুগার বাড়ে নাকি? জলখাবার খেয়ে উঠে আবার পড়তে বসেন ঠাম্মা। সকালের না শেষ হওয়া কাগজটা, দু চারটে সাপ্তাহিক পত্রিকা যা শুধু ওনার জন্য দিতে বলেছে শৌভিক, খুঁটিয়ে পড়েন। মাঝে একটু ঘুমিয়েও নেন সময় বুঝে, তারমধ্যেও খেয়াল রাখেন শৌভিক আর আমি বেরিয়ে গেলাম কিনা। বাড়িতে ঢোকা এবং বেরোনোর সময় ওনাকে বলে যাওয়া বাধ্যতামূলক। যদি আমরা বলতে গিয়ে যদি দেখি উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, আর না বলে চলে যাই, সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকেন বৃদ্ধা। বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে শুনতে হয়, সেই মনোবেদনার উপাখ্যান। "আমার সারাদিন কি মনখারাপ, অনিন্দিতা আমায় বলে গেল না?"  শুধু কি তাই, অফিস থেকে ফিরতে যদি একটু রাত হয়, মুঠো ফোনে ভেসে ওঠে স্বর্গীয় শ্বশুর মশাইয়ের নম্বর খানা। ফোন ধরলেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে বৃদ্ধার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর,  " তুমি ঠিক আছ তো? দেরী হবে বাড়ি ফিরতে? কলকাতা গেছ?" 


কর্মসূত্রে আমার কলকাতা যাওয়া আর শৌভিকের দীঘা যাওয়া দুই নিয়েই আতঙ্কে ভোগেন শাশুড়ি মাতা। গেলেই বাড়ি ফিরতে রাত হয় যে।  সামান্য রাত হওয়া নিয়ে যিনি দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যান, তাঁকে রেখে মোগলির দেশে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা। 


(চলবে) 


অনির পুজোর ডাইরি ১৬ই অক্টোবর, ২০২৪

#এলেম_মোগলির_দেশে পর্ব - ১

#অনিরডাইরি 



এখন অনেক রাত। মোগলির জঙ্গলের মাথায় টিমটিম করছে কৃষ্ণ চতুর্থীর ঝিমানো চাঁদ।সদ্য বানানো কফির কাপটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল শৌভিক। এখন রাত দুটো, আর আধ ঘণ্টা বাদেই রওনা দেব আমরা। গন্তব্য নাগপুরের বাবাসাহেব আম্বেদকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আমাদের ঘরে ফেরার প্লেন ভোর সাতটায়, মধ্য প্রদেশ ট্যুরিজমের কিপলিং কোর্ট রিসর্ট থেকে বিমান বন্দর পৌঁছাতে সময় লাগে মোটামুটি ঘণ্টা দুয়েক। পথের গরিষ্ঠাংশই পেঞ্চের মধ্যে দিয়ে। কোর জঙ্গল অবশ্য নয়, বাফার। তাও জঙ্গল তো বটে। 


নিকষ অন্ধকারে, পাশাপাশি দুটো বেতের চেয়ারে বসে আছি দুজনে, বারান্দার ওপারেই জঙ্গল। নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে পেঞ্চ নদী। এই জঙ্গলের জীবন রেখা। এই রাত, এই চাঁদ, এই অপার্থিব নৈঃশব্দ্য আর জঙ্গল, এ অনুভূতি অবর্ণনীয়। এই ভাবে জঙ্গলকে ইতিপূর্বে কখনও অনুভব আমরা। দুজনেরই মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ শৌভিক বলল, " নাহ্ এবার ফিরতে হবে, না?" নীরবে ঘাড় নাড়ি আমি, দেখতে পেল কি? বোধহয় না। শেষ হয়ে যাওয়া কফির কাপটা নিয়ে উঠে পড়ে শৌভিক, উঠতে উঠতে বলে, "আমরা কেমন যেন ট্যুরিস্ট থেকে ট্রাভেলার হয়ে উঠছি দিনদিন।"


ট্যুরিস্ট আর ট্রাভেলার এর মধ্যে কি তফাৎ আমার মোহগ্রস্ত মাথায় ঢোকে না। তবে এটা জানি, দুজনেই ফুল্টু তারকাটা। ওপরওয়ালা কি ভাবে যে খুঁজে খুঁজে গাঁটছড়া বাঁধে। তারকাটা না হলে কেউ এমন প্ল্যান করে? ঠিকই তো ছিল এবার পুজোয় কোথাও যাব না। তাহলে? হঠাৎ মহালয়ার দিন দশেক আগে কি যে ভূত চাপল মাথায়, কে প্রথম বলেছিল আজ আর মনে নেই, আমি না সে, শুধু মনে আছে, একজন বলেছিল, " চল মধ্যপ্রদেশ যাই"। অন্যজন তৎক্ষণাৎ এক পায়ে খাড়া হয়ে গিয়েছিল। 


যাব তো, কিন্তু যাব কোথায়? আমরা তো ইতিমধ্যেই  মধ্যপ্রদেশ চষে ফেলেছি। ফি বছর পুজোয় আমাদের একটাই গন্তব্য মধ্যপ্রদেশ।  ওঁঙ্কারেশ্বর, মহেশ্বর, মান্ডু, উজ্জয়িনী, ইন্দোর, গোয়ালিয়র, ওর্চা, চান্দেরী, ভীমবেটকা, ভোপাল, খাজুরাহ, জব্বলপুর ইত্যাদি সবই তো আমাদের ঘোরা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের লোকগুলো আমাদের প্রায় ব্যক্তিগত ভাবে চিনে গেছে। ওরাও আজকাল কোন নতুন সার্কিট দিতে পারে না আমাদের। সেকথা আমি বলেছিলাম, জবাবে শৌভিক বলল, " কিন্তু জঙ্গল গুলো তো ঘোরা নয়।" 


তাও বটে, জঙ্গল বলতে আমরা ঘুরেছি শুধু পান্না। তাহলে? এবার কোথায়? মোগলির জঙ্গলের প্রস্তাবটা অবশ্যই শৌভিকের ছিল। পেঞ্চ যেতে গেলে নাগপুরে নামতে হয়। কলকাতা থেকে ট্রেন এবং প্লেন উভয়ই আছে, কিন্তু প্লেনের সময় বড় অদ্ভুত, নটা নাগাদ কলকাতা থেকে ছেড়ে, নাগপুর পৌঁছাবে রাত এগারোটায়। তারপর আবার দুই ঘন্টার পথ তাও ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, ভেবেই প্লেনের পরিকল্পনা বাতিল করলাম আমরা। ট্রেনে দেখা গেল AC টু টায়ার পাওয়া যাচ্ছে, সময়সীমা খুব সুবিধাজনক নয়, ভোর পৌনে ছটায় ছেড়ে, সন্ধ্যে পৌনে নটায় নাগপুর। অর্থাৎ রাত এগারোটা নাগাদ পেঞ্চ। তাই সই। ঝটপট করে টিকিট কেটে ফেলে শৌভিক। তখন কি আর জানি, অলক্ষ্যে বিধাতা পুরুষ হাসিতে ফেটে পড়ছেন।

(চলবে?)


অনির ডাইরি ২৪শে অক্টোবর, ২০২৪

#অনিরডাইরি #Dana 

কোন এক ভ্রমণগন্ধী গ্রুপে এক সদাশয় ব্যক্তির পোস্ট দেখে বিশ্বাস করুন, সক্কাল সক্কাল মনটা এক্কেবারে ফুরফুরে হয়ে গেল। উনি লিখেছেন,"সংবাদপত্র বা চ্যানেল গুলোকে একদম বিশ্বাস করবেন না। সব বাজে কথা। পুরী মোটেই জনশূন্য লয়, হ্যাঁ ভিড় এট্টু কম বটেক। এই দেখুন না আমিই তো রয়েছি সপরিবারে।" 


ভ্রমণপিপাসু বাঙালীর দল ওমনি ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ' আহা, আহা - বাহা বাহা! ইশ আমিও কেন গেলাম না রে -'। আবহাওয়া বিশারদ বাঙালীরাও পিছিয়ে থাকেননি, "আরে থাকেন তো মশাই। ওসব ঝড় ফড় কিস্যু হবে না।" ধর্মপ্রাণ বাঙালী জনগণ দেখিয়েছেন প্রভু জগন্নাথকে। স্বয়ং তিনি যেখানে অধিষ্ঠিত, সেখানে কিছু হতে পারে নাকি? "ফণী"র ইতিহাস তো মার্ভেল কমিক্সের গল্প মাত্র, জানেননি নাকি! মহাপ্রভুর তো এই একটাই শখ তথা কাজ, ঝড়ের কানটি মূলে, এমন ইয়ে জনগণকে সপরিবারে সমুদ্র দর্শনের সুবন্দোবস্ত করা।  


যেন তাই হয়। যেন নাই হয়। কারো কোন ক্ষতি যেন নাই হয়। কিন্তু, যদি হঠাৎ বানচাল হয়ে যায় সব হিসেব? হঠাৎ বেসামাল, বেপথু হয়ে পড়ে প্রকৃতি- ? তখন তো সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকার আর প্রশাসনের গুষ্টি উদ্ধার করবেন। কেউ কাজ করে না, সবাই কেবল DA চায়, পেকমিশন চায় বলে সরকারী কর্মচারীদের বাপান্ত করবেন।


আসল কথাটা কি জানেন, আপনি এই রিস্ক নিতে পারেন, সরকার বা প্রশাসন পারে না। সামান্যতম দুর্যোগের পূর্বাভাস পেলেই যে কি অমানুষিক পরিশ্রম করে সরকার তথা প্রশাসন, তা কল্পনাও করতে পারবেন না। প্রশাসন মানে শুধু গুটি কয়েক আধিকারিক বৃন্দ নয়, সবাই, সব্বাই। 


উপগ্রহ চিত্রে সমুদ্রের ওপর হাল্কা গাঢ় ধোঁয়াশা ঘনাবার সাথে সাথেই জেলা- মহকুমা তথা ব্লক স্তরে শুরু হয়ে চূড়ান্ত তৎপরতা। অনর্গল আসে - যায় নির্দেশনামা। বিভিন্ন পর্যায়ে তথা স্তরে খোলা হয় ২৪ ঘণ্টার কন্ট্রোল রুম।


 আপিস যাওয়া আসার পথে বিগত দিন কয়েক ধরেই শুনতে পাচ্ছি অনর্গল ঘোষণা, " ঝড় আসছে, সবাই সময়মত নিরাপদ জায়গায় সরে যান।" নিরাপদ জায়গা বলতে  সাইক্লোন রেসকিউ সেন্টার বা নিকটবর্তী সরকারী বিদ্যালয় গুলি। উপকূলবর্তী জেলা তথা মহকুমা তো, ঝড় হেথা নিত্য অতিথি। তাই এখানে জায়গায় জায়গায় বানানো আছে মজবুত বিশাল কিছু বাড়ি। তাদেরই পোশাকি নাম রেসকিউ সেন্টার। প্রখর দুর্যোগে মানুষ তথা গবাদি পশু সকলের নিশ্চিত আশ্রয়। যাদের আসে পাশে ওমন বাড়ি নেই, তাদের আশ্রয় যোগায় সরকারী বিদ্যালয় গুলো। 


হোটেল মালিকদের সাথে দফায় দফায় মিটিং করে গতকাল বারোটার মধ্যে পর্যটক শূন্য করা হয়েছে দীঘাকে। টহল দিয়েছে পুলিশ। মেলবন্ধন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় বিপর্যয় মোকাবিলা টিমের সাথে রাজ্যের টিমের। সামান্য তালমেলের গোলযোগে ঘটে যেতে পারে অপূরণীয় ক্ষতি। নজর রাখা হয়েছে মৎসজীবীদের ওপর। শতেক গোলযোগ, শতেক নিষেধের রক্তচক্ষু থাকলেও ব্যাটারা ফাঁক পেলেই সমুদ্রে বেরিয়ে পড়ে, পাপী পেটের টানে। জায়গায় জায়গায় মজুত রাখা হয়েছে গাছ কাটার লোক আর গাছ কাটার যন্ত্রপাতি। 


গতকাল সকাল থেকে দফায় দফায় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে হাসপাতাল গুলি। ঝড় উঠলেই তো ছিঁড়বে বিদ্যুতের তার, ঝটপট পুনঃস্থাপিত করতে হবে বিদ্যুৎ সংযোগ। তবে তার জন্যও তো সময় লাগবে, বিদ্যুৎ দপ্তরের লোকজনও তো মানুষ। তাদের ওপর দিয়েও তো বয়ে চলেছে ঝঞ্ঝাবাত। ঝড়ের মধ্যে উড়ে তো আর আসতে যেতে পারবে না। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থাতেও যাতে ফ্রিজে রাখা ওষুধ পত্র নষ্ট না হয়ে যায় তার সুবন্দোবস্ত করতে হয়েছে। 


ঝড় জল হলেই বেরোবে সাপ, বাড়বে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা। তাই চেক করে নিতে হয়েছে antivenom ইঞ্জেকশনের স্টক। শুধু কি তাই, লিস্ট মিলিয়ে দেখা হচ্ছে কোথায় কোথায় আছে আসন্ন প্রসবা জননী। যদি তুফানের মধ্যে হঠাৎ করে প্রসব বেদনা ওঠে? তাদের তুলে এনে হাসপাতাল বা কোন নিরাপদ স্থানে যাতে রাখা যায়, করতে হচ্ছে, ভাবতে হচ্ছে তারও কথা। 


নিমতৌড়িতে আমার অফিসের জানলার বাইরে আপাতত মন খারাপী ঘোলাটে মেঘের পর্দা,  এদিক ওদিক হালকা মাথা নাড়াচ্ছে দেবদারুর দল। মুঠো ফোনে শৌভিকের বার্তা, দীঘা বোধহয় এযাত্রা বেঁচেই গেল। সেক্ষেত্রে এত আয়োজন সবই বৃথা, তাতে কি? সাবধানতা অবলম্বন তো করতেই হবে। প্রতিটা তুফানই যে  সৃষ্টি করে যায় নতুন নতুন ইতিহাস। সেই যে সেবার সবাই বললে, সাইক্লোন বটে, তবে দীঘার কোন চাপ নেই। ঝড় হবে না তেমন, বৃষ্টিও হবে নামমাত্র। প্রবল ঝড় বৃষ্টি সত্যিই হল না বটে, কিন্তু আচমকা বিদায় বেলায় ফুঁসে উঠল সাগর। তীব্র জলোচ্ছ্বাসে ধুয়ে গেল উপকূল।  নতুন নতুন এই জেলায় এসে দেখেছি,দীঘা, শংকরপুর, মন্দারমণি সর্বত্র ধ্বংসের দগদগে ক্ষতচিহ্ন।  বড় বড় বিশ পঞ্চাশ মনি পাথর কংক্রিটের চাঙ্গড় উল্টে পড়ে আছে পথের ধারে। প্রকৃতি বড় নির্মম। 


প্রতিটা তুফান থেকেই শেখে সরকার তথা প্রশাসন, সেই যে সেবার বন্ধের মধ্যেই ঘোষণা হল আসছে  তুফান। দাঁত নখ নিয়ে আছড়ে পড়বে সমুদ্র সুন্দরীর ওপর, দীঘার আজ শেষ দিন। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিকবৃন্দ সহ জেলাশাসক মহোদয় ঘাঁটি গাড়লেন দীঘায়, আসুক ঝড়, জেলাও প্রস্তুত। আপদ ঝড় দীঘায় আর গেলই না। উল্টে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল তমলুক। খবর পেয়ে ডিএম সাহেব যে তমলুক ফিরবেন, রাস্তার ওপর যেন ষড়যন্ত্র করেই আছড়ে পড়তে থাকল একের পর এক মহীরুহ। এক্কেবারে 'আতঙ্ক হি আতঙ্ক' পরিস্থিতি। সেই আতঙ্কেই আজ ভোর ভোর বেরোনোর সময়, গাড়িতে একটা ইলেকট্রিক করাত নিয়ে বেরিয়েছে আমার বর। গতকাল ঐ করাত দিয়ে গাছ কাটার ট্রেনিং নিতে পাঠিয়েছে ড্রাইভার আর সিকিউরিটিকে। সাবধানের মার নেই। অবশ্য  মারেরও সাবধান আছে কি? তবুও একটু দায়িত্ববান নাগরিক হতে ক্ষতি কি!



 অনির পুজোর ডাইরি ১৩ই অক্টোবর, ২০২৪

শুভ মহাষ্টমী #অনিরডাইরি 



"অনি-" ফোনের ওপার থেকে সঞ্চিতার ব্যস্ত কন্ঠ জানতে চাইল " তুই কোথায়?" ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে এগারো। হে ঈশ্বর, সাড়ে এগারোটার মধ্যে তো আমার পৌঁছে যাবার কথা ছিল। আমি তো এখনও বাড়ি থেকেই বেরোইনি। এই লেট হওয়া নিয়ে দিন দুয়েক আগে দুই ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সাথে হেব্বি বাওয়াল হয়ে গেছে। আর আজ আমিই কি না - 


মনে মনে নোট করলাম, আরেক বার ক্ষমা চাইতে হবে ব্যাটাদের কাছে। যদিও ইতিমধ্যেই মার্জনা ভিক্ষার সংখ্যা শ খানেক ছাড়িয়েছে। তবুও, কপটতার একটা সীমা তো থাকে মাইরি। নিজের বেলায় আঁটিশুঁটি, ওদের বেলায় দাঁত কপাটি? সঞ্চিতাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললাম, "এই তো বেরিয়েছি।" সম্মুখে ক্যামেরা হাতে অপেক্ষমান তুত্তুরীর কপালে গভীরতর হয় খাঁজ, মাটা তাহলে মিথ্যুকও। 


কি করি, ওই যে বলে না, বিপদে বুদ্ধিমানেরা অর্ধেক ত্যাগ করে। গোটা পুজোয় বাবা মায়ের সাথে একটাও ছবি তোলা হয়নি, আজ দুজনকেই পটিয়ে, সাজিয়ে গুছিয়ে রাজি করেছি। এই মুহূর্তে একগাল হাসি নিয়ে বাঁ দিকে আমায় জড়িয়ে আছে বাবা, ডানদিকে মা। এই সোনালী মুহূর্তটার জন্য একটু মিথ্যে, একটু হিপোক্রেসি তো চলতেই পারে।


বাড়ি থেকে হলের দূরত্ব হাঁটা পথে মিনিট দশ পনেরো। কিন্তু ঠাকুর দেখার নামে যে অত্যাচার হয়েছে পদ যুগলের ওপর, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমার মত পৃথুলার দেহেও মাসলস্ বলে বস্তু কিছু আছে। তার ওপর কেন যে মরতে উঁচু গোড়ালির জুতোটাই পড়লাম। তৃষিতের মত দুদিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটি, একটা টোটো যদি -। আজ বোধহয় ঈশ্বর সত্যিই সুপ্রসন্ন, এক বয়স্ক কৃশকায় টোটোওয়ালা বসে বিড়ি ফুঁকছিল, সনির্বন্ধ অনুরোধে যেতে তো রাজি হল, শর্ত একটাই, বিড়িটা শেষ করতে দিতে হবে। 


গিয়ে যখন পৌঁছলাম, সঞ্চিতা রাস্তার উপরেই দাঁড়িয়ে। দেখে খুশি হল কি না বুঝতে পারলাম না,ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল, " জল এনেছিস?" একেই বোধহয় বলে, 'এক গাল মাছি '। সঞ্চিতার আর আমার সিনেমা দেখার ইতিহাস তো আজকের নয়। বন্ধুত্বটাই তো আজকের নয়। কত রকম যে পাকদণ্ডি ধরে এগিয়েছে আমাদের সিনেমা দেখার ইতিহাস, তার সাক্ষী হাওড়া শহরের সিনেমা হল গুলো। যাদের মধ্যে শ্রীরূপা, নবরূপম, পার্বতী আর শ্যামশ্রী আজ শুধুই ইতিহাস। শান্তি আর পুষ্পশ্রী অবশ্য আজও টিকে আছে। এদের মধ্যে পুষ্পশ্রী নাকি উন্নীত হয়েছে মাল্টিপ্লেক্সে। একসঙ্গে একাধিক 'বই' চলে আজকাল। আপাতত সবই বাংলা। আমাদের আজকের গন্তব্য ও পুষ্পশ্রী। 


আজ মহাষ্টমী কি না,রাস্তায় বেশ ভিড়। ভিড় কাটিয়ে যুগলে গেলাম জল কিনতে। হাঁটতে হাঁটতে বেজায় হাসি পাচ্ছিল অতীত নানা কথা ভেবে। সেই যে সেবার রাজ -২ দেখতে গিয়েছিলাম আমরা, মায়েদের নিয়ে শান্তিতে। একে তো সাংঘাতিক সাউন্ড সিস্টেম, তায় ছারপোকাদের সম্মিলিত আক্রমণ। আজও সকালে শৌভিক বলছিল, দুটো চটের আসন নিয়ে যেতে। মনে আছে, ভয় পেয়ে বার বার সঞ্চিতাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আমি। আর সঞ্চিতা হুমকি দিচ্ছিল, "আরেকবার জড়িয়ে ধর, আমি উঠেই চলে যাব।" 


এতো তাও ঠিক ছিল, তারপর স্ক্রিনে ইমরান হাশমির প্রবেশ। ইমরানের তৎকালীন নামই ছিল "সিরিয়াল কিসার"। ফলে মায়েদের সে কি দাঁত কিড়মিড়। সেই সব গল্প করতে করতে কখন যে হলের আলো নিভে গেল বুঝতেই পারলাম না। নন্দিতা শিবপ্রসাদের বহুরূপী দেখতে এসেছি আমরা। সঞ্চিতাই দেখাচ্ছে, আমি সঙ্গী। 


তামাক সেবনের কুফল দেখানো শুরু হতে খানিক থমকালো আমাদের বার্তালাপ। নয় নয় করে ভালোই ভিড় হয়েছে। পিছনের সিট সব ভর্তি। সামনেও সামান্যই খালি। " এগুলো কেন দেখায় বলতো?" সামান্য বিরক্তি নিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে সঞ্চিতা। পর্দায় তখন খৈনি সেবনের ফলে কর্কট রোগাক্রান্ত জনৈক ব্যক্তি দুঃখের সঙ্গে ঘোষণা করছেন, " বহুৎ বড়ি গলতি হো গিয়া।" ভদ্রলোকের মুখের যা অবস্থা, তাকানো যাচ্ছে না। চোখ সরিয়ে বলি, যারা সত্যিই এগুলো খায়, তাদের কোন লজ্জা থাকে না। যতই দেখা, ঠিক খাবে। যেমন আমার বাপ। বিগত কয়েকদিন ধরে আমি চিল্লিয়ে যাচ্ছি,বাবার কোন হেল দোল আছে? চুরাশি বছর বয়সে এসেও একটা সিগারেট থেকে আরেকটা ধরায়।


 শুরু হয় বহুরূপী। ঝকঝকে আবীর চট্টোপাধ্যায়, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে যেন আরো বহুগুণ সুদর্শন। সাধে এই লোকটার ওপর এককালে ক্রাশ খেতাম আমি। ইদানিং তুত্তুরী হাবুডুবু খায় বলে অতিকষ্টে নিজেকে সংবৃত করেছি। আজ না আবার হড়কে যাই, ভগবান। ছবিতে আবীর একজন বিখ্যাত লেখক। কলকাতা বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে তাঁর নতুন বই বহুরূপী। আবির দীর্ঘ দিন রাজ্য পুলিশে কর্মরত ছিলেন, সলভ করেছেন অগণিত কেস। ধরেছেন অসংখ্য চোর,ডাকাত, গ্রন্থিছেদককে। সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়েই লেখা বহুরূপী। আবির নিজেই বলেন, যে বাকি গুলি তাঁর সফলতার গল্প হলেও, বহুরূপী আসলে তাঁর ব্যর্থতার গল্প। 


অতঃপর শুরু হয়, সেই ব্যর্থতার গল্প। মেশে এক চামচ দেশভাগ। দেশভাগের আগে গঙ্গার দুই পাড়ের জুট মিল গুলো কেমন রইরই করে চলত। দেশভাগের সাথে সাথে শুরু হয় অবক্ষয়। পাল্লা দিয়ে গেটের বাইরে শুরু হয় ইউনিয়নের বিক্ষোভ। এমনিই এক জুটমিলের গোবেচারা অ্যাকাউন্ট্যান্ট শিবপ্রসাদ। ট্রেড ইউনিয়নের নেতাকে খুনের মিথ্যা অপরাধে ফেঁসে হাজির হয় আবিরের থানায়। কোন জেরা, কোন প্রশ্নোত্তর না করেই সটান থার্ড ডিগ্রি চালায় আবীর। ফলে তৈরি হয় এক গোপন শত্রুতার বাতাবরণ। 


কাঠগড়ায় মিথ্যা সাক্ষী দেয় শিবপ্রসাদের বাবা - দাদা - বৌদি। ফলে অনিচ্ছাকৃত খুনের দায়ে আদালত পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে শিবপ্রসাদকে। জেলে শিবপ্রসাদ খুঁজে পায় এক স্নেহশীল গডফাদার। যিনি হাতে ধরে শেখান কি ভাবে ব্যাংক ডাকাতি করতে হয়। চেনা চেনা লাগছে কি গল্পটা? বিশ্বাস করুন, প্রতিটা ফ্রেম, প্রতিটা বাঁক ভয়ানক চেনা। ওই নতুন বোতলে পুরাণ মদ আর কি। মদটাও নেহাৎ চোলাই। 


 জেল থেকে বেরিয়ে শিবপ্রসাদ গড়ে তোলে ব্যাংক ডাকাতির দল। ততোদিনে আবীর SI থেকে আইসি হয়ে গেছে। আর জীবনে এসেছে সুন্দরী, সুগায়িকা, গৃহকর্মনিপুনা লক্ষ্মীশ্রী ঋতাভরি। শিবপ্রসাদেরও জীবনে আসে পকেটমার ঝিমলি ওরফে কৌশানী। যেমন নাম, তেমনিই তাঁর হাবভাব। গুটি সাজানো শেষ হলে শুরু হয় চোর পুলিশ খেলা। গোটা সিনেমায় কেবল দুটো সিলভার লাইন আবীর আর শিবপ্রসাদ। বাকিটুকু নাহয় উহ্যই থাক। বুঝতেই তো পারছেন কি হতে চলেছে। 


পুনশ্চ - হাফটাইমে তোলা সেলফি দেখে বুঝতেই পারবেন না মাইরি, সিনেমা শুরুর সময় সব কটা সিট ভর্তি ছিল। এখন এত লোক একসঙ্গে কোথায় গেল, শৌচাগার নাকি -। সে আমরা কি জানি।


অনির পুজোর ডাইরি ৭ই অক্টোবর, ২০২৪

শুভ চতুর্থী 

#অনিরডাইরি 



অবাঙালি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকার ছোট্ট পুজো। হাওড়ার গলি নয় তো ভুলভুলাইয়া, পথ ভুলেই এসে পড়েছি আমরা। ছাপোষা মণ্ডপ, কুমারটুলির সস্তা প্রতিমা। এবড়োখেবড়ো মুখমণ্ডল, ঘাম তেলটাও যেন ভালো করে লাগানো হয়নি। দুই কানের পাশ দিয়ে নেমেছে কেশ গুচ্ছ, কিন্তু মাথা জোড়া টাক। "এটাই দেখা বাকি ছিল, টেকো মমি।" বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে তুত্তুরী। গর্ভধারিনী মা আর জগজ্জননী মা এই দুজনকেই তিনি আদর করে Mommy বলে সম্বোধন করেন কিনা।


গত পরশু বিকালে সবৎসা হাওড়া এসেছি। আসার সময় বলেই এনেছি মেয়েকে, " বাবু দুটো বেলা শুধু আমায় ছেড়ে দিস, বন্ধুদের জন্য। বাকি পুজোটা শুধুই তোর।" সেই দুবেলা খতম হয়েছে গতকাল অপরাহ্নে। কাল বিকাল থেকেই তিনি আমার মস্তকে সমাসীন। দাবী খুবই সামান্য, তাঁকে আশ মিটিয়ে ঠাকুর দেখাতে হবে এবং চর্বচোষ্য খাওয়াতে হবে। 


ঠাকুর দেখায় অবশ্য আমার কোন ক্লান্তি নেই,  গতকাল রাতেই বলেছিলাম, চল পাড়ার ঠাকুরটা অন্তত দেখে আসি। নেহাৎ ঘরের পোশাকে পাড়ায় বেরোনো নিয়ে যুগপৎ বাবা আর মা আপত্তি করল, তাই।  এবার আমাদের পাড়ার ঠাকুরের হেব্বি জাঁকজমক। গতকাল বিকালে শুভশ্রী এবং গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের যুগ্ম হস্তে তাঁর শুভউদ্বোধন হয়েছে। মোড়ের মাথা থেকে পূজা মণ্ডপ অবধি শুভশ্রী আর গর্গ বাবুর ছবি টাঙানো। মায়ের কেয়ার গিভার দিদি পরশু বিকাল থেকে বলেই চলেছিছেন, " শুভশ্রী আসবে আর কে যেন এক মস্ত বড় গায়ক আসবে। ঐ যে গো আপনাদের বামুনদের নামেই নাম।" বেচারা গর্গ। আজ মধ্যাহ্নে যখন তুত্তুরী আর আমি ঠাকুর দেখতে বেরোচ্ছি, তখনও আমার খুড়তুতো ভাই মাকে বোঝাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, " না না, গর্গ দা গানটান গায় না।" 


পাড়ার ঠাকুর দেখতে গিয়ে হোঁচট খেলাম, মণ্ডপের সামনে বিস্তর প্লাস্টিকের চেয়ার উল্টে ব্যারিকেড করা। "যাঃ বাবা, ঢুকতে দেবে না নাকি?" বিরক্ত হয়ে জানতে চায় তুত্তুরী। এখন ভর দুপুর, আসেপাশে কোন জনমনিষ্যি নেই যে শুধাই। বাধ্য হয়ে অন্য মণ্ডপের পথ ধরি। বারে বারে আজ আশাহত করতে থাকে মা। এখনও অসম্পূর্ণ অধিকাংশ মণ্ডপ তথা প্রতিমা। 


একে তো প্রায় এক যুগ শহর ছাড়া আমি, তার ওপর বড় দ্রুত বদলে যাচ্ছে শহরটাও। পুরাণ পথঘাট, গলি সবই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। তেমনি পথ ভুলেই এসে পৌঁছেছি এই পুজোটায়। ঘিঞ্জি এলাকা, চতুর্দিকে বাইক, টোটো, ঠেলার উৎপাত। বাতাসে সস্তা বিরিয়ানির আতরের চড়া সৌরভ। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে পথের সন্ধান তো পেলাম, কন্যা আব্দার করল, এদের পুজোটাও দেখে যাই। যাব তো, কিন্তু যাব কি করে? মাঠ তো জল কাদায় ভর্তি।


গুটি কয়েক স্থানীয় বাচ্ছা ওই জল কাদার মধ্যেই খেলায় মগ্ন। তাদের পদ চিহ্ন অনুসরণ করেই মণ্ডপে প্রবেশ করলাম আমরা। মণ্ডপের ভিতর তেরছা ভাবে পড়ে আছে বিশাল মই। পাকানো তার, কাগজ, কাপড়ের ছড়াছড়ি। মইয়ের এপাশে আড়াআড়ি ভাবে কোমর সমান উচ্চতায় বাঁধা একটা বাঁশ। সেই বাঁশ ধরে গুলতানিতে মত্ত একদল কুচোকাঁচা। সবকটা প্রায় একই উচ্চতার। সবার পরনেই বিবর্ণ পোশাক। পায়ে চটি থাক বা না থাক, সবকটার পাই কাদায় মাখামাখি। কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে গল্প করি তুত্তুরী আমি। গল্প নয়, গসিপ বলতে পারেন। একে তো দেবী টেকো, তায় সিংহটা বড়ই ছোট। হাঁটুতে হাত রাখা সিংহের দিকে অসুরের মুখভঙ্গী যেন, " খামোখা সুড়সুড়ি দিচ্ছিস কেন বাপ --"। মা যেন দাঁত কিড়মিড় করে বলছে, "আবার ফাজলামি হচ্ছে!" 


আসল মা দুর্গা কেমন হবে, সেটা নিয়েও আলোচনা করি আমরা। সুন্দরী পটেশ্বরী তো অবশ্যই নন। আদতে তো তিনি একজন যোদ্ধা, নির্ঘাত পেশীবহুল হবে তাঁর দেহ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে শোভা পাবে বেশ কিছু শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত চিহ্ন। মুক্তকেশী হওয়া কি সম্ভব? শত্রু তো চুলের মুঠি ধরেই কুপোকাত করে দেবে সবার আগে।  ইত্যাদি প্রভৃতি। 


ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে, এখনও বেশ কয়েকটা ঠাকুর দেখা বাকি। তারপর যাব লস্যি খেতে। হাওড়া ময়দানের সেই লস্যির দোকানটা খুঁজে বার করতে হবে, যেখানে প্রাকবিবাহ প্রণয়পর্বে যুগলে লস্যি খেত আমার বাবা মা। আশৈশব যে দোকানের লস্যি খেয়েছি আমি। খাইয়েছি আমার মেয়েকেও। সবথেকে বড় ভাঁড়ে, সবথেকে বেশি মালাই দেওয়া লস্যি। সাথে কয়েক টুকরো বরফ। ভাবতেই উভয়ের  জিভে জল। টাক বাঁচিয়ে টুক করে ঠাকুরের কয়েকটা ছবি তুলে নিই আমি। 


ছবি তোলার জন্য মেয়েকে ছেড়ে কয়েক পা সরে এসেছিলাম, যখন ফিরে গেলাম দেখি, বাঁশের সামনে একা, এক গাল হাসি নিয়ে কয়েকটা ছুটন্ত বাচ্ছার দিকে তাকিয়ে আছে তুত্তুরী। ইশারায় জিজ্ঞাসা করি, কি হল রে, বিগলিত হয়ে তিনি জবাব দেন, " কি মিষ্টি করে বলল মা, কি ইনোসেন্টলি বলল। এতক্ষণ যে বাচ্ছা দুটো এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করছিল না, তারা যাবার সময় ঠাকুরকে কি বলে গেল জানো? বলল, "মেরি দুর্গা মাঈ কো কিসি কি নজর না লাগে।" পলকে কেমন দ্রবীভূত হয়ে গেল হৃদয়, নাহ টেকো হোক আর যাই হোক, ভদ্রমহিলার যাদু কিছু তো আছেই। 


পুনশ্চ - উক্ত মণ্ডপ বা প্রতিমার ছবিটা আর দিলাম না। কিছু জিনিস একান্ত ব্যক্তিগত থাকাই বোধহয় ভালো। থাক ওরা, ওদের মত।  আশ মিটিয়ে খুনশুটি করুক অসুর আর সিংহ। বেশ বাড়াবাড়ি করলে দুটোরই কান মূলে দিক জগজ্জননী। পুঁচকে গুলোর দুগ্গা মাঈ আর তার  ছানাপোনাদের কারো নজর যেন সত্যিই না লাগে।


অনির পুজোর ডাইরি ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪

শুভ দ্বিতীয়া

#অনিরডাইরি 



তিনি লিখলেন, "মা, তুমি কি আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে? তাহলে তোমার সঙ্গে বেরিয়ে একটু আলো দেখতাম।" আলো অর্থাৎ পুজোর আলোকসজ্জা। কয়েকদিন ধরেই ড্রাইভার সাহেব গল্প করছেন, কাঁথি শহরে নাকি সাকুল্যে ৫০টা পুজো হয়। ছোট মফস্বল শহরের পক্ষে সংখ্যাটা নেহাৎ কম নয়। যার মধ্যে নান্দনিক, ইট গিল্ট (ইউথ গিল্ড) আর চৌরঙ্গীর পুজো নাকি সবথেকে বিখ্যাত। 


আর পাঁচটা মফস্বলের মতোই, এখানে এখনও অর্ধ সমাপ্ত অধিকাংশ মণ্ডপ। প্রতিমা ও অনুপস্থিত। তবে আলো যে লাগানো হচ্ছে, সেটা আজ সকালে অফিস আসার সময় আমিও দেখেছি। 


আগামী কাল থেকে ক্যালেন্ডারে লাল দাগ শুরু, কালই বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে সকন্যা পিত্রালয়ে যাব। ভেবেছিলাম যাবার পথে ঢুঁ মেরে যাব ঠাকুর এসেছে এমন কয়েকটা মণ্ডপে। শ্রীমতী তুত্তুরীকে সেকথা বলেও ছিলাম। কিন্তু কন্যার আর ধৈর্য ধরছে না। মুঠো ফোনে ফুটে ওঠে তাঁর কাতর আকুতি, " প্লিজ মা তুমি কি একটু তাড়াতাড়ি -"।


তাড়াতাড়ি আসব কি, আপিসে ঢুকেছিই তো আজ বেশ খানিক বিলম্বে। সেই কবে মানত করেছিলাম দেবী বর্গভীমার কাছে, আমার বর আর আমার ছেলেগুলো যদি সুস্থ ভাবে, সম্মানের সাথে নির্বাচনটা উতরে দিতে পারে,  মায়ের কাছে পুজো দেব, আর সবাই মিলে ভোগ খাব। সেই মত কথাও বলে এসেছিল শুভদীপ্ত। কিন্তু আমার ইন্সপেক্টর বাবুদের আর সময়ই হয় না। একের পর এক আসতে থাকা কাজের দাপটে, ব্যাটাদের এক সঙ্গে পাওয়াটাই হয়ে ওঠে দুর্ঘট। আমরা যবে খাই খাব,মাকে আর কতদিন উপোষী রাখি? 


মন্দিরের সামনেই বিক্রি হয় পুজোর ডালা, কিন্তু শুভদীপ্ত নিষেধ করে, "ওখান থেকে নিবেন নি ম্যাডাম। আর মাখা (সন্দেশ) নিবেন নি, যে সন্দেশ বিক্রি হয় না, সেই গুলো আবার ভালো করে পাক করে, কড়া মিষ্টি দিয়ে মাখা বানিয়ে দেয় শুনেছি। নিলে কলাকাঁধ নিবেন।" যে দোকান থেকে নিতে বলে, তার লোকেশন আর কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। শেষে শুভাশিসকেই ধরি, "চল বাবা একটু।"


খুপরি দোকান, টালির চাল। আমরা ছাড়া আর মুষ্টিমেয় খরিদ্দার। গৌর বর্ণ, সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ দোকানিকে জানালেন, " পিস নয়, আমরা ওজনে বিক্রি করি কালাকাঁধ।" সাথে সাথে ধূপ আর সিঁদুর পাতাও দিলেন বৃদ্ধ। দোকানেই জুতো খুলে, বাকি পথটা হেঁটে, বেশ অনেক গুলি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় মায়ের মন্দিরে। সদ্য নিজেকে উপহার দেওয়া কালো উঁচু গোড়ালির জুতোকে এই ভাবে বাজারের মধ্যে ফেলে যেতে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। প্লিজ ঠাকুর, কেউ যেন আপন মনে করে নিয়ে না নেয়। যা সুন্দর দেখতে -। 


কংক্রিটের সিঁড়ি অন্য দিন হলে তেতে আগুন হয়ে থাকত, মায়ের আশীর্বাদেই হয়তো, আজকের আবহাওয়া এমন সুন্দর মেঘলা, সাথে মৃদুমন্দ বাতাস। মন্দিরে পৌঁছে শুকিয়ে গেল মুখ, যত পুণ্যার্থী কি আজকেই এসে জড় হয়েছে হেথা। যেখানে পা রাখার জায়গা পেলাম, সেখান থেকে মায়ের মুখ দর্শন অসম্ভব। দীর্ঘশ্বাসটা বোধহয় একটু জোরেই ফেলেছিলাম, সামনের অল্প বয়সী ছেলেটি ঘুরে বললে, " যত দিন যাচ্ছে, মানুষের ভক্তি আর চুরি দুটোই বাড়ছে।" 


 শুভাশীষ কোথা থেকে এক টুকরো কাগজ আর পেন এনে জিজ্ঞাসা করে, "ম্যাডাম কার নাম লিখব?" কার নামে পুজো হবে, অনেক ভেবেচিন্তে আমাদের আপিসের নামটাই লিখলাম। ভালো থাক মোদের আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর। প্রায় দেড়শ মানুষের রুজি যোগায় এই আপিসটা। আর আমাদের পরিবার বর্গ ধরলে তো সংখ্যাটা হাসতে হাসতে পাঁচশ ছাড়িয়ে যাবে। 


হয়তো সবই মায়ের কৃপা, যতটা সময় লাগবে ভেবেছিলাম, তার এক চতুর্থাংশ ও লাগল না। নাম লেখা শেষ হবার সাথে সাথেই প্রায়, প্লাস্টিকের ঝুড়ি ভর্তি রক্তজবা নিয়ে এসে হাজির হলেন পট্ট বস্ত্র পরিহিত পুরোহিত। "যারা যারা অঞ্জলি দেবেন, ফুল নিয়ে নিন -"। খপ করে একটা জবা তুলে নিলাম আমি,  এই সুযোগ কি ছাড়া যায়। কে জানে, শাস্ত্র মতে কতটা শুদ্ধ আমি, শাশুড়ি মা প্রায়ই বলেন, "মন শুদ্ধ তো সব শুদ্ধ।" আর মায়ের কাছে আবার সন্তান অশুদ্ধ হয় নাকি? 


এমনিতেই বড় মন খারাপ নিয়ে এসেছি আজ মায়ের চৌকাঠে। বিগত দিন চারেক ধরে অসুস্থ আমার গর্ভধারিণী। অসুস্থতার তীব্রতা যে কতটা সেটা আজ বৃদ্ধ বৃদ্ধা উভয়ের সাথে কথা বলেই বুঝতে পেরেছি। মন চাইছে, সব ফেলে ছুটে হাওড়া চলে যাই। কিন্তু আজ আমি না গেলে যে ছাড়া যাবে না ২৫/২৬ লাখ টাকা। যে টাকার অধিকাংশ জুড়ে আছে কারো কাজের মজুরী, কারো বোনাস, কারো বকেয়া, কারো জমা পুঁজি ফেরৎ, তো কারো মৃত্যুকালীন অনুদান। যত টাকাপয়সা অ্যালটমেন্ট সব যেন গতকাল আর আজকেই ঢুকছে বানের জলের মত। যত তাড়াতাড়ি ব্যাংক বা ট্রেজারিতে পাঠানো যায় ততোই মঙ্গল। দ্বিতীয়ার্ধে পাঠালে, কেউই নেবে না, উল্টে দাঁত কিড়মিড় করবে। 


মাইক্রোফোনে ভেসে আসা মন্ত্রে চমকে উঠি, শুরু হয়ে গেছে অঞ্জলি। একবারই মন্ত্রপাঠ হয়, অতঃপর পুনরায় ঝুড়ি নিয়ে হাজির হয় পুরোহিত মহোদয়, দিয়ে যাওয়া পুষ্প ফেরৎ নেবার জন্য। হাতের ফুল মায়ের দিকে ছোঁড়া এমনিতেও অসম্ভব, এত দূরে আছেন তিনি। অঞ্জলি শেষে, শুরু হয় পুজো। সামনের লোকজন ঝটিতি সরে যায় সামনে থেকে। পুজোর লাইন বাম দিকে। ভিড় খালি হয়ে যেতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের অনিন্দ্য সুন্দর মুখচন্দ্র। 


পুজোর লাইনে ভিড় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মন্ত্র পড়তে পড়তে পুজোর ডালা নিচ্ছেন পুরোহিত মশাই, খানিকটা মিষ্টি সরিয়ে রাখছেন, না রাখছেন না বুঝতে পারলাম না। এক মুঠো রক্তজবা প্যাকেটে ভরে, আমায় ফিরিয়ে দিলেন পুজো। এখানে নাম গোত্র ধরে যে পুজো হয় না, সেটা তিন বছর আগে থেকেই দেখে আসছি। মানত তো আর প্রথমবার করলাম না মায়ের কাছে।


মন্দির থেকে বেরিয়েই আমার গর্ভধারিণী মাকে ফোন করি। কেমন আছ মা? মিনিট চল্লিশ আগেও যার গলার আওয়াজ বেরোচ্ছিল না, তিনি বেশ ফুরফুরে কন্ঠে জানান, " ভালো আছি। সেজদা এসেছে। গল্প করছি।" ওপাশ থেকে সেজদার দরাজ গলা ভেসে আসে, " চিন্তা করিস না, আমি আছি। মাসি ভালো আছে। ওষুধপত্র সব আমি দেখে নিয়েছি। কাল আবার আসব মাসিকে দেখতে। তুই না আসা পর্যন্ত আমি সাপোর্ট দিয়ে যাব।" আমরা পাঁচ ভাইবোন একসাথেই বেড়ে উঠেছি, মাসতুতো শব্দটা কোনদিন আমাদের মধ্যে ঢুকতে সাহস পায়নি। নাহলে এই ঘোর কলিতে কার মাসতুতো দাদা এ কথা বুক বাজিয়ে বলতে পারে। 


অফিসের কাজ মিটতে মিটতে প্রায় ছটা। তাও সব মিটল কি? কোনদিন কোন সরকারী আপিসে মেটে নাকি? লাখ ছয়েক টাকা এসে ঢুকল পৌনে ছটার সময়। ধুৎ তেরি। বাড়ি যখন ফিরলাম, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে মন আর মাথা। এখনও গোছগাছ কিস্যু হয়নি। কি যে হবে ভাবতে ভাবতে বাড়ি ঢুকে দেখি তিনি নীলাম্বরী হয়ে ঘুরছেন। কোথা থেকে যেন গেল বছরে বড় মামার দেওয়া জামাটা বার করে, পরিপাটি করে চুল বেঁধে বাগানে পায়চারি করছেন, কখন মা আসবে, আর আলো দেখতে নিয়ে যাবে।


অগত্যা, আবার জুতো গলিয়ে বেরোতেই হয়, মা হওয়া কি মুখের কথা রে বাবা। সাথে জবরদস্তি লতাদিকেও ধরে নিয়ে যাই আমরা। থাক পড়ে সব কাজ, অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য। সারাদিন আমার কন্যা আর আমার শাশুড়ি মাতার দেখা শোনা করে মানুষটা, একটু আলো দেখা তো তারও প্রয়োজন।



অনির পুজোর ডাইরি ৩রা অক্টোবর, ২০২৪

শুভ প্রতিপদ 

#অনিরডাইরি 



মোটামুটি অর্ধেক পৃথিবীর মতোই, আমারও J.K Rowling এর সাথে প্রথম পরিচয় হ্যারির মাধ্যমে। আজ্ঞে হ্যাঁ, the Harry Potter। হ্যারি পটার সিরিজ যখন প্রকাশিত হয়েছিল, একটা বইও আমার কেনা বা পড়া হয়নি। কি করেই বা কিনি/ পড়ি। সারা বিশ্ব তখন কাঁপছে হ্যারি উন্মাদনায়। আকাশ ছোঁয়া দামে প্রকাশ পাচ্ছে একেকটা বই। আমি তখনও তারাসুন্দরী, আমার তখনও লাল পাড় সাদা শাড়ি। লাল ফিতে দিয়ে বিনুনি বেঁধে দিত পিসি, ভারী ব্যাগ কাঁধে, নতমস্তকে গুটি গুটি পায়ে ইস্কুল যাই আমি। ওদিকে প্রভাতী আনন্দবাজারের বইয়ের পাতা থেকে এগোতে এগোতে প্রথম পাতার তলার দিকে স্থান পেতে থাকে হ্যারি। প্রতিটা খণ্ড বাজারে আসার আগে, বইয়ের দোকানের সামনে সে কি বিশাল লাইন কচিকাঁচাদের। আমার তাতে কি? আমি দাদা বাংলা মিডিয়াম। ঐ জাব্দা ইংরেজি বই পড়া কি আমার সাধ্য নাকি? 


বই থেকে হ্যারির পদোন্নতি হল চলচ্চিত্রে। পর্দা কাঁপিয়ে দিল ড্যানিয়েল-এমা-রুপার্ট গ্রিন্ট এন্ড আদার্স। গরীবের উঠোনেও একদিন হানা দিলে wizrad কুল। ২১ ইঞ্চি রঙিন টিভি, পাড়ার বিপুল কাকার কেবল লাইন, সুযোগ পেলেই HBO/AXN/ Star Movies দেখে বেড়াই আমি। রাতে প্রাইম টাইমে ভালো ভালো সিনেমা দিত চ্যানেল গুলো। তখন তো পড়া ছেড়ে রিমোটে হাত দিলে হেট মুণ্ডু ঊর্ধ্বপদ করে দেবে মা। আমার সম্বল বলতে দুপুরের রিপিট টেলিকাস্ট। কলেজ থেকে ফিরে, ডালমুড়ির বাটি( আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি অর্ধেক হাওড়া আর অর্ধেক মুর্শিদাবাদী, আমি মুড়ি খেতে দিব্য ভালবাসি) বগলে, টিভিটা যখন চালিয়েছিলাম বিশ্বাস করুন কোন প্রত্যাশা ছিল না। প্রথম থেকে দেখতেও পাইনি সিনেমাটা। যখন শেষ হল, মনে হল আমি যেন তড়িতাহত হয়েছি। এমনও হয়? এমনও কিছু কল্পনা করা সম্ভব? 


তাই বলে বই কেনা বা পড়ার কথা ভাবলাম ভাববেন নি যেন। বললাম না দাদা আমি বাংলা মিডিয়াম। খটমট ইংরেজি সিনেমা দেখতে শিখেছি বলে কি পড়বার ও স্বপন দেখব নাকি? তাজ্জব মাইরি। 


J.K. Rowling আমার প্রিয়তম লেখিকা হলেও, ইংরেজি বই পড়ার সাহস প্রথম যিনি দিলেন তাঁর নাম Dan Brown। সদ্য চাকরি পেয়েছি কয়েকমাস। প্রথম পোস্টিং খড়গপুর। অফিস তথা যাত্রাপথটা কিছুতেই আর হজম করতে পারছিলাম না। সবকিছু কেমন যেন তেতো হাকুচ। রীতিমত মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিলাম। মেদিনীপুর লোকালের লেডিস কম্পার্টমেন্টে সদ্য আলাপ এক সমবয়সী দিদিমণি প্রথম বলল, " বই পড়।মন ভালো হয়ে যাবে"। জন্ম থেকে বই পোকা আমি। আর কি পড়ি? ওকেই শুধালাম, কিছু বইয়ের নাম বল। সৌমি নাম ছিল মেয়েটার, আজও মনে আছে, সৌমি মণ্ডল। সৌমি বলল, " Dan Brown পড়। দা ভিঞ্চি কোড।" নামটা না শোনার মতোও গবা আমি নই। কিন্তু যতদূর জানি, বইটার বিরাট দাম। সৌমি বলল, " দূর, গ্র্যান্ড হোটেলের তলায় চলে যা, ওরা ফটোকপি করে বিক্রি করে। দর করে কিনবি। ১০০ টাকার বেশি মোটেও দিবি না।"


পরের শনিবারই গিয়ে হানা দিলাম, ধর্মতলায়। গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে হেব্বি কেত মারা দোকানি, এমন ফরফরিয়ে ইংরেজি বলে যে মনে হয়, ধরিত্রী দ্বিধা হও। দাম শুরু হল সাড়ে পাঁচশ টাকা থেকে। যত বলি পাঁচটা নয়, একটা নিব রে ভাই, দর আর কমেই না। প্রায় আধঘন্টা চাপানউতোর শেষে একশ পনেরো টাকা দিয়ে বই কিনে বাড়ি ফিরলাম। এবার আপনি বলতেই পারেন, তুমি তো বাছা বাংলা মিডিয়াম। সে ভাবনা কি আমার মাথাতেও আসেনি, কিন্তু পচা আপিস আর নিত্যযাত্রার চাপ এমনি যে বাড়ি ফিরেই খুলে বসলাম বইটা। বাকিটা ইতিহাস, অন্তত আমার কাছে। সারা দিন, সারা রাত জেগে পড়ে থুড়ি গিলে যখন বইটা শেষ করলাম, অভিজিতের সেই গানটা মনে পড়ে গেল, " শালা ম্যায় তো সাহাব বান গয়া "। প্রেম/ ক্রাশের তালিকায় আরেকজন যোগ হলেন, প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন। 


পরের দুই মাসের মধ্যে ড্যান ব্রাউনের তৎকালীন সব বই শেষ করে ফেললাম আমি। লোকাল মিস করে এক্সপ্রেস ধরতে বাধ্য হলাম যেদিন, আবিষ্কার করলাম, বালতি করে বই বিক্রি হয় এই লাইনে। ভদ্রলোকের এক কথা, সব বই একশ টাকা। তবে কিনা, সস্তার তিন অবস্থা, ট্রেন থেকে কেনা Digital Fortress এর মাঝের কয়েক পাতা মিরর প্রিন্ট পেয়েছিলাম। এমন নেশা, যে ফেস পাউডারের পুঁচকে আয়না দিয়ে দেখে পাঠোদ্ধার করেছিলাম আমি, তাও ছাড়িনি। 


দেখতে দেখতে বাবার বাড়ির আলমারি ভরে উঠল, Lee Child, John Grishm, David Baldacci, Steig Larson থেকে দেশী Aswin Danghi, Amish ইত্যাদিতে। কিন্তু J.K. Rowling তখনও বহুৎ দূর। 


প্রিয়তম লেখিকার সাথে গাঁট ছড়া বাঁধল দেবশ্রী দি। ভাগ্যক্রমে প্রায় একই সাথে কলকাতায় বদলী হয়ে এসেছিলাম আমরা কয়েকজন মহিলা অফিসার। বই, সিনেমা নিয়ে আমাদের নিত্য আলোচনা হত। এমনি এক আড্ডায় ডি দি একদিন ঘোষণা করল, " আমি হ্যারি পটার পড়ছি জানো তো। তোমরাও পড়ে দেখতে পারো -।" বিদিশা দি তো জাস্ট উড়িয়েই দিল প্রথম চোটে, আমিও তাই করলাম। সিনেমা গুলো দেখেছি তো, আর বই কিনে কি হবে? ঠিক যে অর্ডারে প্রতিবাদ করেছিলাম আমরা, সেই ক্রমেই হ্যারি পটার পড়তে শুরু করলাম আমরা। পড়তে পড়তে যেন অন্য কোন ইউনিভার্সে ঢুকে গেলাম আমরা। বইয়ে যা পেলাম, তার একটা নগন্য অংশ কেবল সিনেমা গুলোতে পেয়েছি এতদিন। দিন রাত শুধু একই আলোচনা আমাদের। কাজ - কম্ম - সংসার কিছুতে মন নেই আমাদের। 


সিরিয়াস ব্ল্যাকের মৃত্যুর পর সেকি কান্না আমার। মুঠো ফোনের ওপার থেকে কতক্ষণ যে দেবশ্রী দি আমার কাউন্সেলিং করেছিল সেদিন। দুজনের কারো মনে হয়নি যে ওটা তো একটা কাল্পনিক চরিত্র কেবল। আর ডাম্বলডোরের মৃত্যুর কথাটা নাহয় উহ্যই থাক। 


দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল সাত সাতটা বই। অতঃপর সে যে কি অপরিসীম শূন্যতা, কেবল পটারহেডরাই অনুভব করতে পারে। সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। ইতিপূর্বে এই শূন্যতা যতবার দেখা দিয়েছে, ডিটক্স হিসেবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেবার যে কি হল, ব্যোমকেশ, বরদা, তুমি সন্ধ্যার মেঘ সব ব্যর্থ, মন কেবল Joanne Kathleen Rowling কেই চায়। কিন্তু তিনি যে ঘোষণা করে দিয়েছেন আর লিখবেন না। হে ঈশ্বর আমার দিকে একটু তো মুখ তুলে চাও। 


বর্তমান এক্স, তৎকালীন টুইটারে যে কত শত বার মেসেজ করেছি ওনাকে। প্লিজ ম্যাম, এভাবে অনাহারে মারবেন না। জবাবে পেয়েছি হিরন্ময় নীরবতা। Dumbledore, Sirius Black ছাড়ুন যে নারী হাসতে হাসতে Fred Weasley, Lupin, Nymphadora Tonks এমনকি Dobby , Hedwig কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে, তার থেকে আর কিই বা প্রত্যাশা করব, বলতে পারেন? 


ধুর ধুর বেঁচে থেকে আর কোন লাভ নেই, বলে ধরেই নিয়েছি, এমন সময় পটারহেডদের গ্রুপে গ্রুপে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল, আসছেন, তিনি আসছেন। তবে স্বনামে নয়, ছদ্ম নামে। আসছেন Robert Galbraith। বইয়ের নাম The Cuckoo's Calling। ততদিনে তো আমি রীতিমত উপার্জনশীল নারী, পে কমিশন ও হয়ে গেছে, সবার ওপর এসে গেছে আমাজন-ফ্লিপকার্ট। ফ্লিপকার্ট এককালে এক টাকার বই কিনলেও বাড়ি পৌঁছে দেবে বলে বিজ্ঞাপন দিত। কাকে অর্ডার করেছিলাম আজ আর মনে নেই,যদিও। 


হাতে পেয়ে কিঞ্চিৎ নিরাশ হলাম, এর সাথে পটার বা wizards দের কোন সম্পর্কই নাই। এতো নিছক muggle দের গোয়েন্দা গল্প যা দেখি। ধ্যাৎ তেরি! তবুও শুরু করলাম পড়া। আলাপ হল Cormoran Strike এর সাথে। জনৈক বিখ্যাত গায়কের অবৈধ সন্তান। মা ছিল পাক্কা সত্তরের দশকের "হরে কৃষ্ণা হরে রাম" মার্কা হিপ্পি। অগুনতি পুরুষসঙ্গী, মদ, ড্রাগস। শেষ পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবনেই মৃত্যু। স্ট্রাইকের বদ্ধমূল ধারণা যেটা আসলে সুপরিকল্পিত হত্যা। 


মায়ের অবর্তমানে মামা মামীর যত্নে বড় হয়ে মিলিটারি পুলিশ হিসেবে যোগদান করে স্ট্রাইক। আফগানিস্তান অভিযানের সময় বোমা বিস্ফোরণে হাঁটুর নীচে থেকে উড়ে যায় একটা পা। 


হঠাৎ করে বেকার হয়ে যাওয়া, প্রতিবন্ধী তকমা পাওয়া স্ট্রাইক পেটের ধান্ধায় ঠিক করে একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলবে। খুলতে গেলেও যে ন্যূনতম মূলধনের প্রয়োজন, সেটার জন্যও হাত পাততে হয়,কোনদিন কোন তত্ত্বতালাশ না করা জন্মদাতার সামনে। অপমানজনক শর্তে জোগাড় হয়, টাকা। 


ফোন ধরা এবং টুকটাক কাজের জন্য মাত্র কয়েকদিনের অস্থায়ী সহযোগী হিসেবে এজেন্সিতে যোগ দেয় Robin Ellacot। মফঃস্বলের মেয়ে রবিন, বয়সে প্রায় বছর দশেকের ছোট। ইউনিভার্সিটি ড্রপ আউট। কলেজে পড়ার সময় ধর্ষিত হয়ে, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল দীর্ঘ দিন। নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল চার দেওয়ালের মধ্যে। পরিবার তথা বয়ফ্রেন্ড ম্যাথুর সহমর্মিতা আর সাহচর্যে নতুন করে জীবনের সাথে আলাপ করতে সম্মত হয়েছে রবিন। সেক্রেটারি হিসেবে নাম লিখিয়েছে একটা সংস্থায়। সেখান থেকেই টেম্প হিসেবে, মাত্র কয়েক দিনের জন্য এই অফিসে পাঠানো হয় তাকে। পাকাপাকি সেক্রেটারি রাখার মুরোদ কোথায় স্ট্রাইকের। 


যেমন ডিটেকটিভ, তেমনি তার এসিস্ট্যান্ট। দুজনেই এক্কেবারে সাধারণ, না কারোর মগজাস্ত্র আছে, না কোন আগ্নেয়াস্ত্র। এমন চরিত্র এর আগে কোথাও পড়েছি বলে মনেই পড়ে না। ধীরে ধীরে জড়িয়ে যেতে থাকি Cormoran Strike আর Robin এর সাথে। গল্প এগোতে থাকে এঁকে বেঁকে। কখনও স্ট্রাইক এর সাথে খোঁড়াতে থাকি আমরা, প্রস্থেটিক্স আর কাটা পায়ের সংযোগ স্থলে ফোস্কা পড়ে যায় আমাদের। কখনও রবিন এর সাথে অর্থহীন জীবনে নতুন করে অর্থ খুঁজতে বেরোই আমরা। লন্ডনের জঘন্য আবহাওয়ায় তিতিবিরক্ত হয়ে যাই আমরা। স্ট্রাইক এর সাথে Doom Bar আর Fish N Chips সাঁটাই আমরা। এই করতে করতে কখন যে গল্প শেষ হয়ে যায় একরাশ ক্ষিদে রেখে, বেশ বুঝতে পারি, হতাশ করেননি প্রিয় লেখিকা। 


২০১৪ সালে এলো The Silkworm। ততোদিনে রাউলিং যাদুতে আচ্ছন্ন আমার বরও। বই/সিনেমা/ ওয়েব সিরিজ নিয়ে শৌভিক আর আমার কোনদিন মতের মিল হয়না। স্ট্রাইক বোধহয় একমাত্র ব্যতিক্রম। ২০১৫ য় যখন Career of Evil প্রকাশিত হল, ঐ কিনল দৌড়ে গিয়ে।পাক্কা তিন বছরের প্রতীক্ষা অন্তে এল The Lethal White। এই অবধিই ক্রম মেনে পড়েছি আমরা, তারপর এল অতিমারির বছর। প্রকাশ পেল Cormoran Strike series এর নতুন বই। আলোচনা - সমালোচনায় উত্তাল হল বই পাড়া, আমরা নিরূপায়। বড্ড দাম বাপু, আর বড্ড বড় ও। হাজার পাতা, ইয়ার্কি নাকি?


২০২২ এ এলো The Ink Black Heart। ব্যক্তিগত জীবনে এমন তুফান চলছে তখন আমাদের, মাত্র ৪৮ ঘণ্টার নোটিশে তমলুক থেকে কাঁথি বদলী হয়ে গেল শৌভিক। মাঝপথে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হল মেয়েকে। নিত্য ১৫০ কিলোমিটার আপিস যাত্রা শুরু হল আমার - ইত্যাদি প্রভৃতি ছাড়াও, বড্ড দাম আর তেমনি বড়। 


২০২৩ এ এল The Running Grave, ততোদিনে অনেক পিছিয়ে পড়েছি আমরা। ছিঁড়ে গেছে মুগ্ধতার মায়াজাল। "আর কি কখনও কবে "-মাঝে মাঝেই আলোচনা করি আমরা। ব্যাস ওই টুকুই।


গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম এই বছর সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ। সামনেই শৌভিক এর জন্মদিন, মাঝে মধ্যেই বলে, "একটা একটা করে কিনেই ফেলব বইগুলো। এখন দাম ও একটু কমেছে। Kindle এ কিনলে তো আরো সস্তা হবে। পুজোর সময় কিনব বরং, আমাকে তো এখানেই থাকতে হবে, তোরাও থাকবি না - ।" ধুৎ স্ট্রাইক এর গল্প আবার kindle এ পড়ে নাকি? এত হিসাব করলে জীবন চলে নাকি। ফেললাম কিনে তিনটি বই। পেপার ব্যাক গুলোর দামও এখন সাধ্যের মধ্যে। নাহলে ও বাকি, বরের জন্মদিন বলে কতা। 


জন্মদিনের রাতে মোড়ক খুলে শৌভিক খুশি হল কিনা বুঝলাম না বাপু। প্রথমটা খুলে বলল, " এ হে হে, এটা তো শেষটা। এর আগের গুলো - আচ্ছা থাক, আমিই কিনে নেব।" দাঁত কিড়মিড় করলেও বললুম না কিছু। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মোড়ক খুলে বলল, " একেবারে তিনটে না কিনলেও হতো। তিনটে বই কিনবি জানলে আমি অন্য একটা চাইতাম। Dalrymple এর নতুন বইটা -"। ব্যাটাকে জীবনে খুশি করা যায় না মাইরি। তিনি কি সাধে বলেছেন, " যতোই দাও, ততোই চাই।"


দিন যায়, হপ্তা যায়, উপহার দেওয়া চকলেট গুলো একটা একটা করে বেপাত্তা হয়ে যায়। রোজ রাত্তিরে রক্ত চক্ষু দেখায় শৌভিক, কাউকে কিছু দিয়ে ফেরৎ নিলে কি হয়,মনে করিয়ে দেয়। যতই বলি আমি খাইনি, এবাড়িতে আমি ছাড়াও আরো দুজন মিষ্টি খোর আছে, সম্পর্কে ঠাকুমা এবং নাতনি, তাদেরও তো শুধাও। তার বেলায় বোবা এবং কালা হয়ে যায় আমার বর। বই গুলো কেবল অস্পৃশ্য হয়ে পড়ে থাকে, খাস কামরা (অর্থাৎ মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বার) এর বুড়ো টেবিলের ওপর। বললেই শৌভিক বলে, " কখন পড়ব বলতে পারিস?" সত্যিই বেচারার সময় বড় অভাব। মহকুমা শাসকের পাশাপাশি দীঘার দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে দম ফেলার ফুরসৎ পায় না আজকাল। আশ্বস্ত করে, পুজোর ছুটি পড়লে পাতা উল্টে দেখবে। তবে সে আর কতটুকু পড়া হবে?ক্যালেন্ডারের লাল দেখে তো আর সত্যিই ছুটি পাবে না ব্যাটা। 


ইতস্ততঃ করে একদিন নিজেই তুলে নিলাম প্রথম খণ্ড খানা। ট্রাবলড ব্লাড, Cormoran Strike এর প্রথম কোল্ড কেস। চল্লিশ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এক মহিলার কন্যার সনির্বন্ধ অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে বাধ্য হয় স্ট্রাইক। শর্ত একটাই, এক বছরের মধ্যে যদি সমাধান হয় তো ভালো, নইলে ফান্ড তুলে নেবে ক্লায়েন্ট। হাতে থাকা আরো চারটে হাই প্রোফাইল কেসের পাশাপাশি তদন্ত শুরু হয় এই কেসেরও। কিন্তু চল্লিশ বছর আগে নিখোঁজ এক মহিলাকে খুঁজে বার করা কি এতোই সহজ! বিগত চার দশকে আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেছে সবকিছু, হারিয়ে গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তথা সাক্ষী। মারা ও গেছেন কতজন। কি ভাবে সম্ভব এই কেসের তদন্ত। 


১০৭৪ পাতা আক্ষরিক অর্থেই গোগ্রাসে গিলে সদ্য শেষ করলাম বইটা। কেন যে Joanne Kathleen Rowling ই আমার প্রিয়তম লেখক আরেক বার নতুন করে অনুভব করলাম। সাথে সাথে হেব্বি গর্ব ও হল মাইরি নিজের জন্য, জীবনের এই সন্ধিক্ষণে সব দিক সামলে, সব দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে ও হাজার পাতার ইংরেজি বই শেষ করা কি চাট্টি খানি কথা। ইশ নব্বইয়ের দশকের মেয়েটা যদি জানত, যে বাংলা মিডিয়াম হলেও জলের মত পড়া যায় সব ফিরিঙ্গি সাহিত্য। 


যাই হোক, শুভ প্রতিপদ। মা আসছেন বছর ঘুরে। কেটে যাক সকল আঁধার।

অনির ডাইরি সেপ্টেম্বর, ২০২৪

 অনির ডাইরি ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি


“সাঁতার কেটে ফিরলাম। মাথায় মধ্যে কাঁসর ঘণ্টা বাজছে, নাকে আমার সমুদ্র।“ বেলা শেষে আপিসের কাজ গুছাচ্ছি, এমন সময় কন্যার বার্তাঘাত। রোজই এই সময় নাগাদ সামান্য নিদ্রালু হয়ে পড়ে মাসি, সেই সুযোগে তাঁর মুঠোফোনটা হাতিয়ে মায়ের সাথে খানিক বকবক করে নেয় তুত্তুরী। যার বেশির ভাগ জুড়েই থাকে নানা ইমোজি আর স্টিকার। আর মাঝেমাঝেই, “Mommy পাত্তা” লিখে পাঠান তিনি। Mommy তাঁর সোহাগের সম্বোধন, অর্থাৎ, সব কাজ ফেলে মাকে এখন তার দুলালীকে পাত্তা দিতে হবে। এই ছায়া মাধ্যমে, ৭৫ কিলোমিটার দূর থেকে কি ভাবে যে তাঁকে আলাদা করে পাত্তা দেব, বুঝতে খানিক সময় লেগেছিল, তাঁর থেকেই শিখলাম, গুচ্ছ গুচ্ছ হৃদপিণ্ডের ইমোজি পাঠালেই দ্রবীভূত হয়ে যায় আমার কন্যা। সাথে যদি গুটি কয়েক বেবি হাতু, প্যান্ডা বা কোয়ালার ছবি থুড়ি স্টিকার পাঠাই, তাহলে তো তিনি বাস্তবিকই আহ্লাদে আট টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েন। 


তবে ব্যাপারটা হল কি, রোজ দিন আমাদের কথোপকথন এমন মধুর সুরে শেষ হয় না। মাঝে মধ্যেই তিনি অন্যায্য দাবী করেন, অনুনয়-বিনয় দিয়ে শুরু হয়ে, ব্যাপারটা ধমক-চমক-হুমকিতে গিয়ে শেষ হয়। এসব ক্ষেত্রে দাবী একটাই থাকে, সেই দিনটির মত তাঁকে পড়াশোনা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আর হুমকি বলতে বাবা এবং মাম্মামের (দিদার) কাছে আমার নামে নালিশ করা। যাতে ওরা আচ্ছা সে আমার কান মুলে দিতে পারে, আর কি। 


আজও মাথায় কাঁসর, নাকে সমুদ্রের পর যে সেই একই দাবী আসতে চলেছে বেশ বুঝতে পারলাম। এত্ত এত্ত শরীর খারাপের খবর শুনেও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিছু বলছি না দেখে, তিনি পুনরায় লিখলেন, “কানটাও কটকট করছে Mommy।“ সাথে যথারীতি গোটা দশেক ক্রন্দনরত ইমোজি।  কি আর করি, বললাম, “রেস্ট নাও। একটু ঘুমিয়ে নাও। দরকার হলে একটু রাত করে পড়তে বসো।“


কিছুক্ষণ কোন জবাব এল না, অতঃপর তিনি লিখলেন, “আমি একটা হাঁচলাম আর মাসির মুঠোফোনটা জলে ভিজে গেল। কিসের জল বুঝতে পারছ তো?” সেটা দিব্য বুঝলেও, হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারি না। তিনি লেখেন, “Excuse me, আমায় এখন একটা ন্যাকড়া যোগাড় করে ফোনটা সাফ করতে হবে। তোমার সাথে পরে কথা বলছি।“ 


পরের কথাটা যখন ফুটে ওঠে মুঠোফোনের পর্দায়, ততোক্ষণে সন্ধ্যা গড়িয়ে নামছে রাত। তিনি লিখলেন, “পড়তে বসছি। তুমি কত দূরে?” জানাই সবে নন্দকুমার মোড়, বাড়ি ঢুকতে আরও এক ঘণ্টা তো বটেই। তিনি লেখেন, “তাড়াতাড়ি এসো। তোমার সাথে চা খাব বলে বসে আছি।“


 বুঝতে পারি, কন্যার ঝাঁপিতে প্রচুর গল্প জমে আছে আজ, গল্পেগল্পেই না রাত কাবার হয়। লক্ষ্য করে দেখেছি,  তুত্তুরীর সন্ধ্যাবেলার গল্পগুলির একটি সুনির্দিষ্ট ক্রমপর্যায় থাকে। অর্থাৎ গল্প গুলো ধাপে ধাপে আসে। 

প্রথম পর্যায়ে থাকে ইস্কুলের গল্প। গত কালই বলছিল, কি যেন পড়াতে গিয়ে স্যার সঙ্ঘবদ্ধতা শব্দের অর্থ জানতে চান। শ্রীমতী তুত্তুরী উঠে দাঁড়িয়ে অর্থ বলার পর, উদাহরণ হিসেবে তিলোত্তমার কথা বলে। বিচারের দাবীতে কেমন সঙ্ঘবদ্ধ  হয়েছে সুশীল সমাজ, এই মুহূর্তে এই শব্দটির এর থেকে ভালো উদাহরণ আর কি হতে পারে। মুস্কিল হল, তিলোত্তমার নাম করার সাথে সাথেই ফোঁৎ করে ওঠে পিছন বেঞ্চের দুটো ছেলে। “কোন ছেলে গুলো জানো তো মা, সেই যে পরীক্ষা শেষের দিন, যারা তিলোত্তমাকে নিয়ে অশ্লীল আলোচনা করছিল বলে যাদের আমি ঝেড়েছিলাম। আজও ফোঁৎ শুনে ঝাড়তেই যাচ্ছিলাম, তার আগেই এক লাফে স্যার গিয়ে দাঁড়ালেন ওদের সামনে। তারপর কোমরে হাত দিয়ে, জলদগম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন, ‘Do you think it's funny?’ কি বকান যে বকলেন মা, কি বলব তোমায়। তবে ওদের কোন লজ্জা নেই, স্যার চলে যাবার পর বলল, ‘কি দিনই এল, সঞ্জয় রায় বলছে তিলোত্তমার প্রতি empathetic হও।‘ স্যারের নাম সঞ্জয় রায়, কি না।”

স্কুলের গল্পের পর আসে আধুনিক ভাষা নিয়ে আলোচনা। যুগ ভেদে বাংলা/ইংরেজি যে কত বিবর্তিত হয়েছে, তিনি না থাকলে আমি জানতেই পারতাম না। মুস্কিল হল, তিনি যা বলেন, তার অর্ধেকের ওপর আমার মাথার ওপর দিয়ে যায়, এই আর কি। তবে মাঝে মধ্যে মনে পড়ে যায়, আর বন্ধুবান্ধবদের সামনে কেত দেখিয়ে বলি বৈকি। সেদিন যেমন এক বন্ধুকে বললাম, “ডেলুলু ইজ দা অনলি সল্যুলু।“ কি বুঝল, ভগবান জানে- 


তৃতীয় তথা অন্তিম পর্যায়ে আসে, খেলার খবর। কোথায় কি খেলা হচ্ছে, কারা খেলছে, কারা জিতছে, কারা হারছে, তাই নিয়ে ছায়ামাধ্যমে কি ঠাণ্ডাগরম যুদ্ধ চলছে, আগামি দিনে জিও-পলিটিক্সে তার কি প্রভাব পড়তে চলেছে, এইসব নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা। কোন কোন দিন চায়ের টেবিলে দীপ্তি জীবনজী আসে, তো কোনদিন সিমরান শর্মা, কোনদিন বা প্রীতি পালের বাবা। তেলেঙ্গানার মেয়ে দীপ্তি মানসিক ভাবে কিছুটা বিকলাঙ্গ। আর পাঁচ জনের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়া দীপ্তিকে তার গ্রামের লোক পাগল, কালিকালটি, ভূতনি, বাঁদরি ইত্যাদি বলে খেপাত। সেই মেয়ে জাপানের কোবে শহরে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে ৪০০ মিটার দৌড়ে গড়ে ফেলল বিশ্বরেকর্ড। সব কোনিরই একজন ক্ষিতদা থাকে, দীপ্তির ক্ষিতদা যখন আনন্দে আত্নহারা হয়ে দৌড়ে গিয়ে খবর দিল, “ঐ মেয়ে তুই বিশ্বরেকর্ড করেছিস রে।” শিশুর সরলতা নিয়ে দীপ্তি প্রশ্ন করেছিল, “কি করেছি? অ। সোনা জিতেছি কি?” 


উত্তরপ্রদেশের সিমরান জন্মান্ধ। দৃষ্টিহীন মেয়েকে  ঘাড় থেকে নামাতে, সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল তার পরিবার। পরিবার অসহযোগিতা করলেও, বর করেনি। বিয়ের পর স্ত্রীর বিশেষ ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে পাশে দাঁড়ায় ছেলেটি। দৌড়ো মেয়ে, দৌড়ো। পূরণ কর স্বপ্নের উড়ান। "জানো মা, একজোড়াই জুতো ছিল লোকটার, রানিং শু। সেটাই সিমরানকে দিয়ে দেয়। সিমরানের ট্রেনিং এর জন্য জমি বেচে দেয়। " নিরাশ করে না সিমরান ও। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা আর প্যারা অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পেয়েছে সিমরান।


মিরাটের মেয়ে প্রীতি পাল, সেরিব্রাল পালসির শিকার। মেয়েটা দু-দুটো ব্রোঞ্জ পেয়েছে প্যারাঅলিম্পিকে, ব্রোঞ্জ প্রতি তিরিশ লাখ হিসেবে ষাট লাখ টাকা ইনাম দিয়েছে সরকার। টাকা পেয়ে প্রীতির বাবা কেবল বলেছে, “টাকাটা আগে থাকলে, আমার মেয়েটাকে আর আজ প্যারাঅলিম্পিকে যেতে হত না।” শুনতে শুনতে কখনও ভিজে যায় চোখের কোন, কখনও বা গর্বে হয়ে পড়ি আত্মহারা। 


আজও তেমনি কিছু শুনব ভেবে বাড়ি ফিরলাম, ফিরেই বুঝলাম ব্যাপার বেশ গুরুতর। আমাকে পোশাক বদল করারও সুযোগ দিলেন না তিনি, হাত ধরে সটান টেনে নিয়ে গেলেন, তাঁর ঘরে। অতঃপর হাতে তুলে দিলেন, একটি পেন। সাদা দেহ, নীল টুপি, এতো আমাদের শৈশবের Reynold। হতবাক হয়ে তাকাই তাঁর দিকে, তিনি খুশিতে ঢলে পড়ে জানান, “এটা উপহার পেয়েছি। ইংরেজি স্যার, একটা গল্প লিখতে দিয়েছিলেন, একটি নির্জন দ্বীপে ৭৯ ঘণ্টা। আমার লেখা গল্পটা ওনার খুব ভালো লেগেছে, তাই উনি আমাকে ওনার ছাত্র জীবনের পেনটা উপহার দিয়েছেন।”


আমাদের ছাত্র জীবনে পেনটার দাম ছিল পাঁচ টাকা। এখন কত হয়েছে জানি না। কিন্তু তুত্তুরীর কাছে যে এটা অমুল্য তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। অভিনন্দন জানিয়ে প্রশ্ন করি, কি গল্প লিখেছিলি? তিনি বলতে থাকেন, “ জাহাজে করে আমরা আন্দামান যাচ্ছি, প্রায় পৌঁছেই গেছি, এমন সময় ভাবলাম, যাই একবার ডেক থেকে ঘুরে আসি। বাবা মা ঘরে থুড়ি কেবিনে ঘুমাচ্ছে, আমি চুপিচুপি আমার ব্যাগপ্যাকটা নিয়ে ডেকে গিয়ে হাজির হলাম। ওমনি উঠল ঝড়, তালে তালে উত্তাল হয়ে উঠল সমুদ্রও -।” এই পর্যন্ত শুনেই ক্ষ্যামা দিই আমি। “তুই ডেকে একা, ব্যাগ প্যাক নিয়ে দাঁড়িয়ে, সমুদ্র উত্তাল আর আমরা ঘুমাচ্ছি?” এক গাল হেসে তিনি বলেন, “তাও তো শ্যামাশ্রীর মত লিখিনি, যে দুষ্টুমি করছিলাম বলে আমার মা আমায় একটা নির্জন দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।”


আর আপনারা বলেন, গতকালই নাকি ছিল কেবল কন্যা দিবস। একবার মায়ের জুতোয় পা গলিয়ে দেখুন মশাই, হাড়ে হাড়ে টের পাবেন, যে প্রতিটা দিনই, প্রতিটা ক্ষণই কন্যা/পুত্র দিবস। তারাই যে আমাদের সূর্য, তাদের ঘিরেই যে আবর্তিত হচ্ছে আমাদের জীবন। তাঁর ভাষায়, "তব নাম লয়ে চন্দ্র তারা অসীম শুন্যে ধাইছে, রবি হতে গ্রহে ঝরিছে প্রেম, গ্রহ হতে গ্রহে ছাইছে।"



অনির ডাইরি ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 





"এমনি চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো -" 


এমন রাত, এমন চাঁদ বারবার আসে না। সারা জীবনে ঠিক কতবার যে আসে, জানি না। এই সব রাতে চাঁদকে সাক্ষী রেখে গোপন ভাঁড়ার ঘরের চাবি খুলে দেয় ধরা। এইসব রাত কান ধরে আরেকবার মনে করিয়ে দেয় যে এই  বিশাল, চূড়ান্ত রহস্যময় পৃথিবীর সামনে কতটা ক্ষুদ্র, কতটা অপাংক্তেয় আমরা। 


শেষ বার এমন চাঁদ উঠেছিল অর্ধযুগ আগে, অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায়। সুকন্যা তখন পুরুলিয়ার পোস্টেড, ওর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সবাই মিলে সদলবলে রওনা দিলাম পুরুলিয়া। বিকালের পুরুলিয়া এক্সপ্রেস বেশ রাত করেই নামাল পুরুলিয়া স্টেশনে। দুটো গাড়ি নিয়ে নিঝুম ইস্টিশনে অপেক্ষা করছিল সপুত্র সুকন্যা। সোজা তুলে নিয়ে গেল বনবিভাগের বড়কর্তার সরকারী আবাসে। তিনিই সুকন্যার গৃহস্বামী কিনা। 


মধ্যরাতে জনা সাতেক অতিথি এসে হাজির হলে বাড়ির লোক একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ই, কাকু-কাকিমাও হচ্ছিলেন বোধহয়, আমরা আশ্বস্ত করলাম, আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে না। আমরা বাড়ির লোকেরও অধম। নিজেরাই খাবার বেড়ে খেয়ে নিই, নিজেরাই মশারি খুঁজে খাটিয়ে নিই,যা লাগে নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিই, আমরা এমনই। সুকন্যা আর অর্ণবদা সেটা খুব ভালো রকমই জানে। 


একরাত পুরুলিয়া শহরে কাটিয়ে, পরদিন সটান অযোধ্যা পাহাড়ের বন বাংলো। দিনের বেলা ঘোরাঘুরি, রাতে জমিয়ে আড্ডা। অর্ণবদা একাই আসর জমিয়ে দিল। এত বছর বন বিভাগে চাকরির সৌজন্যে ঝুলি ভর্তি কত রকমের যে গল্প। বন জঙ্গল আর হাতির গল্পে যতি চিহ্ন পড়ল, যখন দেবশ্রীদি ভূতের গল্প বলা শুরু করল। অখণ্ড নিস্তব্ধতার মাঝে দেবশ্রীদির মুখে শরদ্বিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের ভূতের গল্প, অধমের জীবনের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। পিকু নাম ছিল কি গল্পটার? ফিরে এসে শরদ্বিন্দু অমনিবাস খুঁজে পেতে গল্পটা বার করে আবার পড়েছিলাম আমি, একটুও ভয় পাইনি। কিন্তু সেদিন রাতে হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছিল দেবশ্রীদি। 


গল্পদিদির আসর আর একটু জমতো, কিন্তু ব্যাঘাত ঘটল, যখন সিঁড়ির দেওয়ালে বেরিয়ে থাকা একখানি ধানি লঙ্কার সাইজের পেরেকে পরপর হাত কাটল দুটো পুঁচকে। প্রথমজনেরটা নেহাৎ দুষ্টুমি জনিত দুর্ঘটনা, দ্বিতীয় জনেরটা পরীক্ষা, " কি ভাবে অট্টুকু পেরেক হাত কাটতে পারে?" গল্প মাথায় তুলে তিন খুদেকে নিয়ে পড়ল দেবশ্রী দি আর বিদিশা দি। রাত বাড়ছে, খেতেও তো দিতে হবে। বর গুলো বনজঙ্গল ছেড়ে ক্যামেরা আর ছবি নিয়ে গুলতানি করতে লাগল, সুকন্যা বলল," চল একটু হেঁটে আসি।"


বাংলোর দরজার বাইরে কেবল একটা টিমটিমে আলো, আলোর সীমানা ছাড়ালেই নিকষ আঁধার। মুঠো ফোনের টর্চের আলো পলকে শুষে নেয় সেই অন্ধকার। বেশ কয়েক পা অন্ধকারের সাথে ব্যর্থ লড়াই করে হাল ছেড়ে দিলাম আমরা। সুকন্যা বলল, " একটু সময় দাও, চাঁদের আলোয় চোখ ধাতস্ত হয়ে যাবে।" সত্যিই তাই, আকাশে সোনার থালার মত ওঠা চাঁদের মুখে জমেছিল সামান্য মেঘ, সরে যেতেই যেন ঝলমলিয়ে উঠল চরাচর। জনমানব শূন্য পথঘাট, সকালে এদিকে গুটি কয়েক গুমটি দেখেছিলাম, এখন আর কিছুই খোলা নেই। লোকজন সব গেল কোথায়? এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? মহানগরে তো এখনও বাড়িই ফেরে না অনেকে। 


একটা গুমটির সামনে একটা অতিকায় কালো শুয়োর বাঁধা ছিল সকালে, দেখলাম সেটা এখনও আছে, কিন্তু সেও গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। আরো বেশ খানিক অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে একটা তেমাথা পড়ল। তেমাথার মোড়ে একটা MGNREGA র সিমেন্টের ফলক লাগানো। তার ওপরেই বসলাম দুজনে। হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, আসার আগে কত যে কথা জমিয়ে রেখেছিলাম সবাই, দেখা হওয়া ইস্তক কিছুই আর মনে পড়ছে না। কোন আলোচনা, কোন সমালোচনা কিছুই যেন আর অবশিষ্ট নেই এই দুনিয়ায়। আছে শুধু মসি কৃষ্ণ ঘুমঘুম জঙ্গল, শেষ নভেম্বরের ঠাণ্ডা হাওয়া আর সোনার থালার মত চাঁদ। 


কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না, আচমকা কে যেন ডেকে উঠল, "ম্যাডাম"। দুজনে একসঙ্গে চমকে উঠলাম। অন্ধকার ভেদ করে ফুটে উঠল দুই মনুষ্যকৃতি। হাত জোড় করে নমস্কার করে, সামান্য ঝুঁকে তাঁদেরই একজন বলল, "ম্যাডাম, এবার ফিরে চলুন। আর এই জায়গাটা নিরাপদ নয়। আমরা সেই বন বাংলো থেকে আপনাদের পিছন পিছন আসছি,এতক্ষণ গল্প করছিলেন বলে কিছু বলি নাই, কিন্তু এবার একটু বিরক্ত করছি। রাত বাড়ছে, জন্তু জানোয়াের বেরাতে পারে। তাছাড়া মানুষও তো সবাই ভালো নয়।"


 সময়ের জ্ঞান সত্যি ছিল না, তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম দুজনে। বাকি পথটাও ছেলে দুটি পিছন পিছন এল। পেশায় বনরক্ষী ছেলেদুটো, অন্ধকারে বড়সাহেবের গিন্নী আর তার দোস্তকে বেরোতে দেখে নীরবে অনুসরণ করে এসেছে, আমরা টেরটিও পাইনি। নিজেকে বেশ কেউকেটা বোধ হচ্ছিল মাইরি, সাধে সুকন্যাকে বনবিবি বলে ক্ষ্যাপাই আমি। 


দুই বন্ধুর অবিমৃষ্যকারিতার জন্য বাড়ি ফিরে সেদিন দাদা দিদিদের বকুনি খেলেও  আমাদের বরগুলো কিছুই বলেনি, জানে বউগুলো জন্ম তারকাটা। আজই যেমন প্রকাশ্য সরণীতে হঠাৎ আব্দার জুড়লাম জ্যোৎস্নার প্রকৃত রূপ প্রত্যক্ষ করতে আমাকে কোন অন্ধকার, জনবিহীন সৈকতে নিয়ে যেতে হবে এবং এখুনি। কে জানে কখন আবার মেঘের পর্দায় মুখ লুকাবে শশী। 


সদ্য আপিস থেকে ফিরেছে শৌভিক, ফিরেছে কোথায়, না দীঘায়। কারণ বিগত কয়েকদিনের উত্তমমধ্যম বৃষ্টিতে মাননীয় মহকুমা শাসকের সরকারী আবাসনে ছাত থেকে ইয়া বড় চাঙর খসে পড়েছে। তাও আবার শাশুড়ি মায়ের পিঠের ছয় ইঞ্চি দূরে। একটু আগেই ওই খানে মাথা রেখে শুয়েছিলেন বৃদ্ধা, ঘুম আসছে না দেখে, উঠে চেয়ার টেনে বসে টিভিটা চালিয়েছেন আর অমনি ধপাস! মাথায় পড়লে কি হত ভেবে এখনও হাত পা পেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে আমাদের।


জানলার বাইরে তখন অঝোরে ঝরছে অতি গভীর নিম্নচাপের বারিধারা। আতঙ্কিত শৌভিকের আহ্বানে আবহাওয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দৌড়ে এলেন পূর্ত দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। বাংলোখানা সেই ব্রিটিশ আমলে তৈরি, তাই বোধহয় এখনও টিকে আছে। টুকটাক মেরামতির কাজ যে হয় না, তা নয়, তবে বাহারি নকল ছাতের অন্তরালে তলেতলে অবস্থা এমন সঙ্গীন কেউ বোঝেনি। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অনুরোধে দিন দুয়েক ধরে ছাঁদা বেঁধে বৃদ্ধা শাশুড়ি মাতা সহ সমুদ্র পাড়ে বাসা বেঁধেছি আমরা। 


আমার আপিস, তুত্তুরীর লেখাপড়া, ইস্কুল মাথায় উঠলেও, আপিস গিয়েছিল শৌভিক। দীঘাতেও যে একটা আপিস আছে ব্যাটার। সন্ধ্যে বেলা ফিরে কেলে কফি খেয়ে পুরাণ দীঘার সৈকত বরাবর পায়চারি করছিলাম দোঁহে। আজ সমুদ্র সুন্দরী বেশ ফাঁকা। 


পূর্ণিমার সৌজন্যে কিনা জানি না, একে তো কোটাল এসেছে সমুদ্রে, তায় এটা জোয়ারের সময়, জলের ছিটা উঠছে সুউচ্চ লাইট পোস্টের মাথা ছড়িয়ে। নিয়ন আলো ছাপিয়ে দূরে সমুদ্রের বুকে জায়গায় জায়গায় খাপচা করে সোনার জল করার মত রং করে দিচ্ছে পূর্ণ চন্দ্র। দেখতে দেখতে মনে হল, আজ তেমনি এক রাত। আজ আবার চাঁদকে সাক্ষী রেখে গোপন ভাঁড়ার ঘরের চাবি খুলে দেবে ধরিত্রী। শুধু এমন কোন জায়গায় যদি যাওয়া যেত, যেখানে এত বৈদ্যুতিক আলো আর এত শোরগোল নেই। প্রকাশ্য রাজপথে বরের বাহু আঁকড়ে আব্দার করলাম,  নিয়ে যাবি? প্লিজ? এখনই? বাকিটা জানে কেবল ভাদ্র পূর্ণিমার চাঁদ, নিরালা সৈকত, জোয়ান সমুদ্র আর সুন্দরী বুড়ি পৃথিবী।


অনির ডাইরি ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


আবহাওয়া তো বদলাচ্ছিল বিগত দিন দুয়েক ধরেই। এই টিকি পোড়ানো গরম, তো এই ভেসে গেল ধরা। এই থিকথিক করছে ভিড়, তো এই শুনশান আমাদের আপিস। তেমনি এক সায়াহ্নে স্কুলের বন্ধুদের মেসেজ করলাম, " ভাবছি ঘুমিয়ে পড়ি -"। জানলার বাইরে ঝুলছে, মসিকৃষ্ণ মেঘের পর্দা, বাজের দাপটে বন্ধ সব কম্পিউটার, আমরা গুটি কয় হতভাগ্য কর্মচারী ভিন্ন আপিস প্রায় জনশূন্য। 


ঘুমিয়েও পড়তাম হয়তো, যদি না বড়সাহেব মেসেজ করে জানতে চাইতেন, "বারখোদা কার এলাকা জানো?" গুগল করে দেখলাম, আমার এবং মুকুলের। মহকুমা আমার আর ব্লক মুকুলের। একজনের নাম দিয়ে স্যার বললেন, 'খোঁজ নিয়ে দেখো তো, এই লোকটি ওই অঞ্চলের বাসিন্দা কি না। যদি হয়, তাহলে কেমন আছে?" এমন মেসেজ তো সচরাচর করেন না বড়সাহেব, প্রতিবেশী দেশের সৌজন্যে ইদানিং যত্রতত্র বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর হামলা হচ্ছে, এটাও কি তেমন কিছু নাকি? জানতে চাইবার আগেই জানালেন বড়সাহেব, আমার অনুমানই সঠিক, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক, ভিন রাজ্যে ফুলের কাজ করত। মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছে - 


অন্যান্য মহকুমা গুলোতে ভুরি ভুরি এমন কেস আসছে, তমলুক তুলনামূলক ভাবে বর্ধিষ্ণু মহকুমা বলেই হয়তো, এর আগে এই রকম একটাই কেস এসেছিল, ময়নার ছেলে। খবর এসেছিল পিটুনি খেয়েছে, কাজ হারিয়েছে।বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে তো আমার লোকজনেরই পিটুনি খাবার উপক্রম। ছেলে ভালো আছে, বিদেশবিভূঁইয়ে থাকে, হোটেলে কাজ করে, মাসে মাসে ভালো টাকা পাঠায়, খামোখা কেন আমরা ফোন করে বা বাড়ি এসে উৎপাত করছি? অনেক কথা শুনিয়েছিল বাড়ির লোক। ভাবলাম, এটাও তেমনি হবে হয়তো। প্রার্থনা করলাম, এটাও তেমনিই হোক। আর আমিও একটু ঘুমিয়ে নিই, বড় মুখ করে বললাম বন্ধুদের। আগের বার ইন্সপেক্টর সৌরভ আর এসএলও রঞ্জন খিস্তি খেয়েছিল, এবার না হয় মুকুল আর মতিবুল দুটো গাল খাক, লোকটা যেন ভালো থাকে ঠাকুর।


বৃষ্টির দাপট একটু কমেছে, দল বেঁধে ছাতা নিয়ে টিফিন করতে যাচ্ছিল আমার লোকজন। দৌড়ে গিয়ে বললাম, দুমিনিট দাঁড়া বাবা। একটু খোঁজ নিয়ে দেখে নিই, লোকটা ঠিক আছে কিনা। মতিবুলকে ফোনেই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না আশেপাশের পঞ্চায়েতের জনা দুই তিন এসএলওকেও। বাজ আর বৃষ্টির দাপটে সবাই ফোন বন্ধ করে বসে আছে নাকি? বাকিদের খেতে পাঠালাম, শান্তনু একা রয়ে গেল ফোন করার জন্য। 


বেশ কিছুক্ষণ পর বাজল মতিবুলের ফোন। নামটা বলল শান্তনু, ওপাশ থেকে কি জবাব ভেসে এল জানি না, ফ্যালফ্যাল করে খানিক আমার দিকে তাকিয়ে শান্তনু বলল, "ম্যাডাম মতিবুল বলতেছে, ছেলেটা মরে গেছে।" কি বাজে বকছ, বলে ফোনটা কেড়ে নিই আমি। মতিবুল তখনও ধরে আছে ফোনটা, আবার শুধালাম আমি, ও কি ছেলেটাকে চেনে? ছেলেটা কি সত্যিই পরিযায়ী শ্রমিক? কেমন আছে ছেলেটা? আবার জবাব দিল মতিবুল, " হ্যাঁ ম্যাডাম, চিনি তো। আমার বাড়ির পাশেই থাকে। পিটিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিছে, আর বেঁচে নেই -। আমি আপনাকে ছবি পাঠাচ্ছি।" 


ক্লান্ত, পরাজিত হয়ে মাথা নীচু করে চেম্বারে ফিরে আসি, ভারী মন, ভারী গলায় বড়সাহেবকে দুঃসংবাদটা দিই। জানাই মতিবুল ছবি পাঠাচ্ছে, মিলিয়ে নেওয়ার জন্য। বড় সাহেব আঁতকে ওঠেন, "কিসের ছবি?" বলি, ছেলেটার বা তার আধার, ভোটার কার্ডেরই হবে। স্যার বলেন, "না। ওর বর্তমান অবস্থার। আমিও পেয়েছি ওই ছবিগুলো, ইচ্ছে করেই তোমায় পাঠাইনি। এত বীভৎস, তুমি প্লিজ ওগুলো দেখো না -"। স্যারের ফোন শেষ হবার আগেই, দৌড়তে দৌড়তে আসে শান্তনু, " ম্যাডাম, মতিবুল কি সাংঘাতিক সব ছবি পাঠিয়েছে -। একদম দেখবেননি। একটা দেখেই আমার মাথা ঘুরছে -"। 


কেমন দেখতে হয়, গণপ্রহারে মৃত মানুষকে? আমার দেখার ইচ্ছে নেই। আমার দেখার ক্ষমতা নেই। অপরিসীম ক্লান্তির সাথে সাথে এক অক্ষম রাগ আমাকে গিলে খাচ্ছে। কেন? কেন? কেন? আধার নম্বর জোগাড় করে ততক্ষণে পোর্টাল খুঁজে দেখে ফেলেছে বেদজ্যোতি, আছে, ছেলেটি আছে। সরকারী প্রকল্পে নথিভুক্ত আছে। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে দুলক্ষ টাকা পাবে ছেলেটির উত্তরাধিকারী। তাতে কি? কত টাকা মূল্য হয় একটা প্রাণের? আদৌ কি কোন মূল্য হয় প্রিয়জন বিরহের -।

অনির ডাইরি ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ 


#পায়ের_তলায়_সর্ষে #অনিরডাইরি #ফিরেদেখা 


আমি প্রায় বলি যে আমার জীবনের সবথেকে সেরা মুহূর্ত গুলি না তো ক্যামেরা বন্দী করতে পেরেছি, নাই সোশাল মিডিয়ায় আপলোড করতে পেরেছি। সময়টা ২০০৮। তখনও অবিবাহিত। বেড়াতে এসেছি উত্তর ভারত। বাবা-মা,তিন মাসি, মেসোমশাই,বোন এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ও তাদের বন্ধু পরিবার নিয়ে প্রায় জনা কুড়ির দল।আমাদের মত জনা তিন কেবল কুড়ির কোঠায় বাদে সকলেই বয়োজেষ্ঠ্য। আমরা ওভাবেই যেতাম।আড্ডা দিতে দিতে বেড়ানো আর বেড়াতে বেড়াতে আড্ডা। 


 হলুদ চাটার্ড বাসে রওনা দিলাম হরিদ্বার থেকে। আমাদের বেড়ানোর আর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল,সবসময় অব সিজনের শুরুতে আমরা গিয়ে হাজির হতাম। পর্যটকদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত শহর নগরের আচমকা ক্লান্ত,ঝিমানো রূপ বড়ই মধুর লাগত। ফাঁকা ফাঁকা সড়কে ধুলি উড়িয়ে বেড়ানো শুকনো পাতা, ধরমশালার সার সার তালা বন্ধ ঘরের নিস্তব্ধতা কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দিত। 


সারাদিন বাস গড়াল,পিছনের সিটে বসে এন্তার গান গাওয়া, ছোট মাসীর সহকর্মী ফাল্গুনি কাকু মাঝে মাঝে নামছে আর কমলা গুলি লজেঞ্জ কিনে আনছে। যারই গা গুলোচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে একটা মুখে পুরে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে বদলাল পাহাড়ের প্রকৃতি। বদলাল গাছপালা। নদীর জলের রঙ সাদা থেকে হাল্কা নীল হল যেন। বদলাল রাস্তার চরিত্র। বিকালে নামলাম উত্তরকাশি। ফাঁকা ধুধু করছে। গলি গলি দিয়ে হেঁটে গিয়ে লালকমলী মার্কা ধরমশালায় রাত্রিযাপন। সন্ধ্যের অন্ধকারে হেঁটে গিয়ে টিমটিমে বাল্বের আলোয় বুড়ো মহেশ্বরকে পুজো দেওয়া। পুরোহিত নেই। বাড়ি চলে গেছে। ভোলা মহেশ্বর একা নিঃসঙ্গ বসে আছেন। আবার অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ফেরা। সারা রাত কানের কাছে গঙ্গার গর্জন।সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ঝলমলিয়ে উঠলেন নদীর বুকে বিশাল মহাদেব। 


পরদিন নটার মধ্যে উত্তরকাশিকে বিদায় জানিয়ে আবার বেরিয়ে পড়া।এবার হিমালয় বড় রুখা। বিশাল বিশাল গাছ বহুনীচে থেকে খাড়া উঠে এসেছে। গিরিখাতের বুকে খঞ্জর চালিয়ে এগিয়ে যাওয়া নদীর জলে মিশেছে যেন আকাশ। আর আকাশ এত নীল হয়?টলটলে নীল আকাশ। আর রাস্তা?রাস্তা তো নেই দাদা। শুধু ধ্বংসস্তুপ। ধ্বসে পড়া পাথরকে পিসে দিয়ে টলতে টলতে এগোল বাস। গা গুলোনো বেড়ে গেল বহুদিন। আর দোকানপাট,মানুষজন কিছুই নেই। আছে শুধু হিমালয় আর আমরা। পলকে পলকে বাস বাঁক নিচ্ছে,একবার আর্তনাদ করে উঠল মা,দেখলাম বাসের সামনের একটা চাকা রাস্তায় আর একটা ঝুলন্ত। ড্রাইভারের বিশেষ হেলদোল নেই। হেঁইও-- ঘুরে গেল বাস,হাফ ঝুলে ঝপাং করে রাস্তায় উঠলাম আমরা। 


সন্ধ্যে নামার মুখে গঙ্গোত্রীতে পৌছলাম। ঠাণ্ডার কামড় বেশ বুঝতে পারলাম। চড়চড় করে ফেটে গেল পিঠের চামড়া।জিন্স, সোয়েটার, জ্যাকেট,টুপি চাদরেও হিহি করতে করতে ব্যাগ কাঁধে বাজারের ভিতর দিয়ে গঙ্গার ওপাড়ে যেতে হবে। নামা মাত্রই মা, আর বয়স্ক কয়েকজনের শুরু হল শ্বাসকষ্ট। বাতাসে অক্সিজেন বেশ কম। চোখের সামনে যে পাহাড়,তা আর সবুজ নয়। সবুজ ঝাউ টাইপ গাছের লাইন একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় শেষ। তারওপরে কিছুদূর খসখসে পাথুরে পাহাড়,তারওপর জমাট বাঁধা সাদা বরফ। পড়ন্ত সূর্যের দীপ্তিতে গোলাপী সোনালী সাদা-


গঙ্গোত্রীর এপাশটা বেশ নিরিবিলি। ওপাড়ে ঝলমলে শহর,এপাড়ে নিকষ আঁধার। শীতের কামড়ও বহুগুণ বেশী যেন। যে ধরমশালায় থাকার কথা,গিয়ে জানা গেল তিন দিন ধরে পাওয়ার নেই। জেনারেটর চলে চলে ক্লান্ত।আর তেলও নেই। মোমবাতি ও পাঁচ ছটার বেশী নেই। পুরো ধরমশালায় আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। কয়েকজনের একতলা আর কয়েকজনের দোতলায় ঘর বরাদ্দ হল। অন্ধকার হিমশীতল ঘরে ঢোকা মাত্র হাড়ে হাড়ে কটকটি বাদ্য শুনতে পেলাম। এলসিডি টর্চ তো জ্বললই না। দুম করে চার্জ শেষ হয়ে গেল সবকটা মোবাইলের। টাওয়ার তো উড়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। 


এই অন্ধকারে আলাদা আলাদা থাকা অসম্ভব।কি অসহনীয় নিস্তব্ধতা। কানে যেন তালা ধরে যায়। একটা বড় ঘরে আটজন থাকব ঠিক হল। তিনটি পুঁচকে সিঙ্গল খাটে বাবা-মা আর তিন মাসি ভাগ করে শুল। আর মাটিতে মেসোমশাই,আমার বোন দীপু আর আমি।


 মাটির ওপর একটা তোশক দিয়ে গেল কেয়ারটেকার,যার বয়স বড়জোর তেরো কি চোদ্দ। আর গায়ে দেবার জন্য লেপ। সেই লেপের ওজন কমসেকম দশ কিলো তো হবেই। 

এবার মোমবাতির রেশন হল। রান্নাঘরে একটা,সিঁড়ির সামনে একটা আর তিনটি ঘরে একটি করে। একটি রিজার্ভ রইল রাতের জন্য। আটজন মানুষ একটি ঘরে,উপরন্তু একটি মোমবাতি, অক্সিজেনের সামগ্রিক অভাব বুঝতে লাগল মিনিট পাঁচ। তড়িঘড়ি মোমবাতিটিকে ঘরের বাইরে রেখে এলেন মেসোমশাই। ঐ প্রগাঢ় অন্ধকারে পা থেকে মাথা অবধি উলের জিনিসপত্রে ঢেকে দশ কিলো লেপের তলায় জড়াজড়ি করে শুয়েও ঠকঠক করে কাঁপছিলাম দীপু আর আমি। এমন সময় শুরু হল বাবা আর মায়ের দাম্পত্যকলহ। বাবা চেইন স্মোকার। তারওপর ফুসফুসের অসুখে আক্রান্ত, বার দুয়েক নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। ফলে মায়ের উদ্বিগ্ন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। হাতে গ্লাভস্ পরো আর এই ঠাণ্ডায় সিগারেট খেয়ো না-এই টুকু বলাই ছিল মায়ের অপরাধ। 


বাবা ক্রুদ্ধ হয়ে টুপি,গ্লাভস,মোজা না পরেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বলাইবাহুল্য সিগারেট আর দেশলাই কিন্তু ভোলেনি। মায়ের টেনশন কমাতে অগত্যা আমাকেই উঠতে হল লেপের ওম ছেড়ে বৃদ্ধকে খুঁজতে। ঘরের সামনের মোমবাতির শিখা থিরথির করে কাঁপছে,নিশ্চুপ ভুতুড়ে ধরমশালায় কেবল প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমার পায়ের আওয়াজ। প্যাসেজের মোমবাতি নিভু নিভু। গেল কোথায়?তবে কি এই ঠাণ্ডায় খালি মাথায়,খালি পায়ে রাস্তায় বেরিয়েছে?সর্বনাশ। অবধারিত নিউমোনিয়া। পায়ে পায়ে দরজা খুলে বাইরে এলাম। শীতল হাওয়া যেন পলকে সব পশমী বস্ত্রের আস্তর ভেদ করে ফালা ফালা করে দিল। দূরে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে আছে বাবা। হাতে জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনটা যেন এক জ্বলন্ত জোনাকি। চিৎকার করে ডাকতে গিয়েও পারলাম না,মোহিত হয়ে গেলাম নৈশ প্রকৃতির ভুবনমোহিনী রূপে। মাথার ওপর দিগন্তবিস্তৃত মসিকৃষ্ণ মহাকাশ,আর তার গায়ে খচিত শতসহস্র হীরের কুচির মত ঝকঝকে তারা।যেন হাত বাড়ালেই ধরতে পারি আমার নিজস্ব কোহিনুর। ঘোর অন্ধকারে গঙ্গার ওপাড়ের শহরের টিপ টিপ আলো যেন কালো সিল্কের শাড়িতে খচিত সলমা চুমকির আলপনা। আর অদূরে পাহাড়ের মাথায় বরফের মুকুট -সব মিলিয়ে বোধহয় এই অধমের ক্ষুদ্র জীবনের সবথেকে মোহময়, রোমাঞ্চকর মুহূর্ত ছিল সেটা।


অনির ডাইরি ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


জন্মদিন নিয়ে আমার বরের কোন আলাদা অনুভূতি নেই। অবশ্যি কি নিয়ে যে আছে, ভগবান জানে। সবেতেই কেমন যেন উদাসীন হাবভাব। আর এদিকে আমি হলাম কিনা পাক্কা Aquarian। শিরা - ধমনী - রক্তজালকে আবেগ আর আদিখ্যেতার ছড়াছড়ি। আরে ভাই, "আমার ইনি প্রথম পক্ষ" যে - 


মোটামুটি আগষ্টের বেতন ঢোকার বার্তা পাবার সাথে সাথেই, হন্যে হয়ে ফিরি শপিং সাইট গুলোতে। কি দেওয়া যায় লোকটাকে? গুগলকেও শুধাই, বছর পনেরো ষোলোর বুড়ো বরকে জন্মদিনে কি উপহার দেওয়া যেতে পারে বলো দিকি? ধুর ধুর, সাধ্যের মধ্যে একটাও মনোমত কিছু আসে না। 


জামাকাপড় দেব কি? দিয়ে কি হবে? শৌভিক তো গেল বারের জামাটাও এখনও ভাঙেনি। বিবাহবার্ষিকী বা নববর্ষে দেওয়া গুলো এক আধবার পরেছে কেবল। সব জমানো আছে থরে, থরে। মান্ধাতার আমলের গুলোও। না পরে, না ফেলে। বললেই বলে, 'কোথায় পরব?' কেন অফিসে পরলেই তো হয়, এতবার দীঘা যায়, আজ অমুক কমিটি, কাল তমুক কমিটির সাথে মিটিং করে, কত মাননীয়(ইয়া)দের অভ্যর্থনা জানাতে যায়, পরলেই তো পারে। বললেই শৌভিক বলে, 'ধুৎ!' 


মোদ্দা কথা, জামাকাপড় দিতেই পারি, তবে তার আগে আলমারি সাফ করা বাধ্যতামূলক। লর্ড ক্লাইভ বা বাদশা আকবরের দেওয়া গুলো না হয় থাক, সম্রাট অশোক আর স্কন্ধগুপ্তর আমলেরগুলো এবার বিদায় করতেই হবে। 


বই দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও শৌভিক গোল বাঁধায়, "ফ্রি পিডিএফ পাচ্ছি তো" অথবা "Kindle এ কিনে নেব, অনেক সস্তায় হবে।" ধুর, জন্মদিনে কেউ Kindle এর বই উপহার দেয়? আর দেয় কিভাবে? ও কিনবে আর আমি ওকে টাকাটা দিয়ে দেব? ম্যা গো! উপহার হিসেবে খসখসে পাতা, সোঁদা কাগজের গন্ধওয়ালা নতুন বইয়ের কি কোন তুলনা হয়। কিন্তু কি বই কিনি? জিজ্ঞাসা করলেই শৌভিক ঠোঁট উল্টে বলে, " ও কিছু দিতে হবে না। এই মুহূর্তে এত বই জমে আছে, পুজোর ছুটির আগে দেখা যাবে ক্ষণ।" 


এমন লোককে উপহার দেওয়া শিবের বাবারও কম্ম নয় বাপু। নেহাৎ আমি Aquarian। কিছু কিনি, লুকিয়ে চুরিয়ে। বন্ধুবান্ধবের নাম করে, ঘুরিয়ে শুধিয়ে। বেচারারা কতবার বিষম খায় কে জানে। বক্স খাটের ভিতর, ধূলিমলিন এক পিট্টু ব্যাগে লুকিয়ে রাখি সব কিছু, সারপ্রাইজটো তো দিতে হবে, জন্মদিনের রাতে। আমার এমন কপাল, দিন সাতেক আগে তিনি সেই ব্যাগটি এনে, ভিজে বেড়ালের মত দুষ্টু হেসে আমায় বললেন, " কি সব ভরে রেখেছিস। ব্যাগটা খালি করে দে।" দাঁত কিড়মিড় করে জানতে চাইলাম, এই ব্যাগটাই দরকার পড়ল? তিনি একগাল হেসে বললেন, " হ্যাঁ তো। এতে এক সেট জামা কাপড় নিয়ে দীঘা যাব। আজ হোল ডে ইন্সপেকশন। প্রচুর হাঁটাবেন ডিএম সাহেব। লাঞ্চ ব্রেকে চেঞ্জ করে নেব।" ধুর ধুর, সত্যি মনে হচ্ছিল তখন, বেঁচে থেকে আর লাভ নেই।


এতো গেল উপহার পর্ব, এবার আসি ভোজন পর্বে। আমার বরটি মোটেই ভোজন রসিক নয়। প্রাক বিবাহ প্রণয় কালে একবার প্রশ্ন করেছিলাম, " কি খেতে ভালোবাসো?" প্রচুর মাথা চুলকে, পাক্কা এক সপ্তাহ পর শৌভিক জানিয়েছিল, "পায়েস খেতে ভালবাসি।" পায়েস তো করবই, শৌভিকের মনপসন্দ লাল লাল চাপ চাপ পায়েস। সাথে আর কি? তুত্তুরীর জন্মদিনে, কি রান্না হল তার থেকেও আমার মেয়ের কাছে অধিক গুরুত্বপুর্ণ হয় কটা বাটি দেওয়া হল। শৌভিকের ক্ষেত্রে তাই করলে ডাহা ফেল করব। তিন চারটে বাটি দেখলেই মাথা চুলকাবে ব্যাটা। দুপদে বুঝিয়ে দিতে হবে আজ তোমার স্পেশাল দিন। 


তবে সবার আগে আসে কেক। ক্রিম কেক তাঁর দুচক্ষের বিষ। ঠিক করি, বাটারস্কচ পুডিং কেক বানাব, তার জন্য। বাটারস্কচ তার প্রিয়তম ফ্লেভার। শ্বশুরমশাই গত হবার পর থেকে শাশুড়ি মা আমিষ খাচ্ছেন না। তাই ঠিক করলাম, সবটাই এগলেস বানাব। এগ লেস কেক বা পুডিং বানাতে একটু বেশি খাটতে হয়, তা হোক। 


চার ধাপে বানাতে হয় কেকটা। প্রথম পর্যায়ে পাতি কেক, তারপর ক্যারামেল সস, তৃতীয় পর্যায়ে বাটারস্কচ পুডিং আর অন্তিম ধাপে দুই চামচ চিনিকে ক্যারামেল বানিয়ে, তাতে সামান্য মাখন আর গোটা আটেক রোস্টেড আমন্ড চূর্ণ মিশিয়ে, ঠাণ্ডা করে বেলুন দিয়ে উত্তমমধ্যম দিলেই কুরমুড়ে বাটারস্কচের দানা তৈরি। অফিস থেকে ফিরেই লেগে পড়ি কেক বানাতে। সর্বপ্রথম আধ কাপ ঈষদুষ্ণ দুধে এক চামচ ভিনিগার মিশিয়ে বানাতে হবে বাটার মিল্ক। তাতে একে একে মেশাতে হবে ১/৪ কাপ তেল, আধ কাপের একটু বেশি গুঁড়ো চিনি। আমাদের whisker নাই, কাঁটা চামচই ভরসা। ফেটানোর তালে তালে একে একে মিশবে ভ্যানিলা এসেন্স, বেকিং পাউডার, খাবার সোডা। বাটারস্কচ এসেন্স থাকলে ভালো হত, সে আর এই ভর সন্ধ্যায় কাঁথিতে কোথায় পাই। অগত্যা মদ্যাভাবে গুড় থুড়ি ভ্যানিলাই সই।


এর সাথে ময়দা আর এক চিমটি নুন মিশিয়ে নিলেই কেকের ব্যাটার রেডি। যার চ্যানেল দেখে শিখেছিলাম রেসিপিটা, তিনি পইপই করে বলেছিলেন, এই পর্যায়ে খুব ধীরে ধীরে একই দিকে ঘুরিয়ে মেশাতে হবে সবকিছু। রিবনের মত যখন ঝরে পড়তে থাকে ব্যাটার তখন বুঝি, কাজ শেষ। এবার বেক করার পালা। বড় কড়াইতে লবণ ছড়িয়ে মিনিট দশেক তাতিয়ে নিয়ে, তারওপর মোটা কাঁচের পাত্রটা বসিয়েই দিই ঈশ্বরের নাম করে। হে ঠাকুর, বরের জন্য কেক বানাচ্ছি, দেখো পাত্র ফেটে কেলেঙ্কারি না হয়। 


তিনি বাড়ি ফেরার আগেই আমাদের প্রথম পর্যায় শেষ। কেক ঠাণ্ডা না হলে আপাতত এগোনো যাবে না। গোবেচারা মুখ করে পড়তে এবং পড়াতে বসি আমরা মা মেয়ে। তিনি ঘরে ঢুকেই বেশ কবার নাক টেনে, মিটিমিটি হেসে বলেন, " কেক বানাচ্ছিস বুঝি। আবার পুডিং ও বানাচ্ছিস? গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে যেন"। কেমন রাগটা ধরে, লোকটা সত্যান্বেষী বা টিকটিকি হলেই তো পারে!


শুভ জন্মদিনের বিলম্বিত শুভেচ্ছা বুজুর বাবা। বার বার দিনটা ফিরে ফিরে আসুক, আরো আরো ভালোবাসা নিয়ে। আর ইয়ে বলি কি, কেউ যখন সারপ্রাইজ দিতেই চাইছে, সারপ্রাইজ দিতে এত্ত খাটছে, তখন খানিক সারপ্রাইজড হলেও তো পারো বাপু? দেবানন্দের ভাষায়, ' ঝুটা হি সহি ❤️'।