Monday, 6 January 2025

অনির ডাইরি জানুয়ারি, ২০২৫

 অনির ডাইরি ৭ই জানুয়ারি, ২০২৫ 

#অনিরডাইরি 



আগে খেয়ে উঠে পড়ল শৌভিক। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এবার ভালো করে খাওয়া যাবে। রাতে বাঁধা কপির তরকারি হয়েছে বলে গরম গরম বেগুন ভেজেছে লতা দি। ছোট ছোট, গোল গোল, চাকা চাকা করে ভাজা শীতের নরম বেগুন। একটার জায়গায় দুটো নিতেই ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল আমার বরের। তিন নম্বরটা নেব বলে হাত বাড়াতেই কটমট করে তাকাল। তখন থেকে আস্তে আস্তে খাচ্ছি। তক্কে তক্কে আছি। হাত ধুতে গেলেই -


কেস জন্ডিস বাঁধাল এই মেয়েটা। বাপ সোহাগী হয়ে কি যে এত কথা বলে, মাঝখান থেকে খাবার ঘরের বেসিনেই হাত ধুয়ে নিল শৌভিক। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকেই যাচ্ছে মেয়ের সাথে, মনের দুঃখে বসে বসে শসা চিবোই আমি। শসা আমার জঘন্য লাগে খেতে, এর থেকে ঘাস খাওয়া ভালো। তাও খাই, অপেক্ষা করি, কখন শেষ হয় এদের বকবক। 


গল্প শেষ হবার আগে রুটিটাই শেষ হয়ে গেল, ধুৎ। অগত্যা উঠে পড়তেই হয়, নীরবে রান্না ঘরে গিয়ে প্লেট নামাই। আমায় উঠতে দেখে উঠে পড়ে তুত্তুরীও। থালাবাসন নামিয়ে দাঁত মাজতে যায়, জল খাবার অজুহাতে খাবার ঘরেই থেকে যাই আমি। টেবিলে সাজানো এষার আনা গাজরের হালুয়া, এক ঝোলা পয়রা গুড়, খানিক রিচ ফ্রুট কেক, কৌটো ভর্তি জয়নগরের মোয়া, গোটা দুই চকলেট। নিশি ডাকার মত ডাকছে আমায়। 


আপদ বরটা যে কি করছে এখনও, দাঁত মাজতে যা না রে ভাই। কিছুতেই নড়ে না শৌভিক। প্রাক বিবাহ পর্বে ঝাড়ি মারার মত তাকিয়ে আছে আমার দিকে, গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ। থাকতে না পেরে হ্যাংলার মত বলেই ফেলি, " একটা মোয়া খাব?" দীর্ঘশ্বাস ফেলে, দুদিকে মাথা নাড়ায় শৌভিক, চুক চুক আওয়াজ করে মুখে। তারপর বলে, " কথা রাখতে পারলি না?" 


কি আবার কথা দিলাম? ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায়, ও হরি কাল রাতে বলেছিলাম বটে, এই বছরে রোগা হবই। তাই আজ থেকে কাঁচা নুন এবং মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দেব। সে প্রতিজ্ঞা তো সেই দুপুর বেলাতেই ভেঙেছি যখন কোলাঘাটের SLO কৌশিক তার বউয়ের হাতে বানানো গরম গরম ফ্রুট কেক এনেছিল। তারপর জহর বাবুর আনা ওনার স্ত্রীর হাতে বানানো পুলি পিঠেগুলোও তো সদ্ব্যবহার করেছি। কি অনুপম পিঠে বানিয়েছিল মাইরি জহর বাবুর গিন্নি। আমার ভালো লেগেছে শুনে শূন্য টিফিন বক্সে চেপে চেপে ভরে দিয়েছিলেন জহর বাবু, " বাড়ি গিয়ে খাবেন ম্যাডাম। স্যারকে দিবেন। খুকীকে দিবেন " করে। স্বাস্থ্য সচেতন স্যার তো ছুঁয়েও দেখেনি। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে চোরাগোপ্তা সেগুলোর দায়িত্ব নিতে হয়েছে এই অধমকেই। 


ফিরে আসি বর্তমানে। একটা মোয়া কি পাব না? পাব না একটা মোয়া? শৌভিক বলে, " তুই চারটে বেগুন ভাজা খেলি, আমি কি দেখিনি?" কি মিথ্যে অপবাদ বাপু। আমি মাত্র ইয়ে তিনটে খেয়েছি। বলাতে ফুঁসে ওঠে শৌভিক, " কিন্তু কেন? আমি তো একটাও খাইনি। আমায় দেখে শেখ, এই সব কেক, চকলেট, মোয়া লোকজন তো আমায় উপহার দিয়েছিল। আমি একটাও দাঁতে কাটিনি। এমনকি এই শীতে একদিন গুড় পর্যন্ত খাইনি"। 


কি বলি। ও মহাপুরুষ, আমি ঘোর পাতক। আমি খেয়েছি, সব খেয়েছি এবং আমার ঘোরতর সন্দেহ যে সবথেকে বেশি আমিই খেয়েছি। আমি স্বঘোষিত পেটুক, হ্যাংলা এবং ভোজনরসিক। খাবার জিনিস কেউ উপহার দিলে বিরক্তিতে যতটা ভ্রু কুঁচকে যায় শৌভিকের, ততোটাই চওড়া হয় আমার মুখের হাসি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার বরের অগ্নিদৃষ্টির সামনে সংকুচিত হয়ে পড়ি কেমন যেন। সিদ্ধান্ত নিই, নাহ আর নয়। আর হরগিজ হরগিজ নয়। এই মোয়া খানা বাদে এই দণ্ড থেকে মিষ্টি ত্যাগ করলাম আমি। মোয়ার কৌটো ছুঁয়ে বরকে জানিয়েও দিই। আমি না Aquarian, একবার যদি মুখ ফিরিয়ে নিই, আর সেদিকে তাকাই না। বলতে বলতে খেয়াল হয়, এই যা এই মাসেই তো আমার জন্মদিন। একটুখানি সংশোধন করি নিজের প্রতিজ্ঞা, জন্মদিন বাদে আর মিষ্টি খাব না। সেই দিন তো সব চলতা হ্যায়। 


চিবিয়ে চিবিয়ে বলে শৌভিক, " বটেই তো। তবে ওটা জন্মদিন নয়, বল জন্মমাস। জানুয়ারি তোর জন্ম মাস,  তাই সব চলতা হ্যায়। ফেব্রুয়ারি তোর বিয়ের মাস, তাই সব চলতা হ্যায়। মার্চ ইয়ার এন্ডিং এর মাস, এপ্রিলটা নববর্ষের মাস, মে তে তোর আবার বিয়ে হয়েছিল (একই বরের সাথে অগ্নিসাক্ষী করে), জুন মেয়ে হবার আগের মাস বলে আর জুলাই মেয়ে হয়েছে বলে, আগস্ট স্বাধীনতার মাস বলে, সেপ্টেম্বর পুজোর আগের মাস আর অক্টোবর পুজোর মাস বলে । তারপর তো ব্যাস দিওয়ালি আর ক্রিসমাস। আসছে বছর আবার হবে।" 

গভীর মনোযোগের সাথে শুনতে শুনতে টুক করে মোয়াটা মুখে চালান করে দিই, আসছে বছরই যখন হবে বলছে - তাহলে আর কোন দোষ নেই, কি বলেন।


অনির ডাইরি ৪ঠা জানুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


এই তো মনে হয় সেদিনের কথা, কোথাও ঘুরে বেড়িয়ে এসে ছবি পোস্ট করলেই ফোন করত বিন্তিদি ( নামটা বদলে দিলাম)। " ওরে তোকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে রে, আমার ছেলেরও ছবিটা খুব পছন্দ হয়েছে। তোর ইয়ংয়েস্ট এডমায়ারার বুঝলি।" যে ছেলের কথা হচ্ছে, এককালে তাঁকে আমি কোলে তুলে নাচিয়েছি এবং তিনি আমার গায়ে যাবতীয় খারাপ কাজ করেছেন। আমি তখন কাঠবেকার। বিন্তি দি বয়সে সামান্য বড়, তাই দিদি বলি, আসলে নিখাদ বন্ধু। সারা পৃথিবী আমায় অপদার্থ ভাবলেও, বিন্তি দি ছিল কতিপয় ব্যতিক্রমের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাই মাঝেসাঝে মনের দুঃখ ভুলতে ওর সাথে গল্প করতে যেতাম। অতিরিক্ত আকর্ষণ ছিল ওর ছেলে, যাকে সেদিন পর্যন্ত আমি ঘন্টু বলে ডাকতাম। যেন আমার জন্যই বসে থাকত ব্যাটা, কোলে নিলেই ব্যাস -। আর ওর মা একগাল হেসে গড়িয়ে পড়ে বলত, " শিশু নারায়ণ আর ওটা তো গঙ্গাজল।" এহেন ব্যক্তিটি এতোই সুদর্শন ছিলেন, যেন মাখনের তাল। তিনি আমার যতটা না অনুরাগী ছিলেন, আমি তার থেকেও অনেক বেশী অনুরক্ত ছিলাম। তাই না আরেকটু বড় হয়ে যখন চুল টানতেন, ঘুষি মারতেন, খামচে দিতেন কিছু বলিনি। নতুন বিয়ের পর আমার বরের সামনে যেবার থুতু ছিটিয়েছিলেন সেইবার কেবল খুব রেগে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এবার সব সম্পর্ক ছিন্নই করে ফেলব ব্যাটার সাথে।


 তবে সে তো কবেকার কথা। ধীরে ধীরে তিনি বড় হতে লাগলেন, তাঁর মায়ের ধারণা ছিল তিনি পরীক্ষায় রসগোল্লা পান্তুয়াই পাবেন, সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দশ ক্লাসের পরীক্ষায় দারুণ ফল করলেন। তারপর হঠাৎ একদিন উদয় হলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, " কে রে ঘন্টু নাকি? তুই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছিস? তোর মা জানে?" মেসেঞ্জারে ঘন্টু বাবু জানালেন, " মা জানে গো মাসি। মা তো নিজেই একটা অ্যাকাউন্ট খুলবে বলে আমায় ধরেছে।"  বিন্তি দির অ্যাকাউন্ট খুলতে অবশ্য আরও বছর দুয়েক লেগেছিল। ছেলের দ্বাদশের পরীক্ষার পর, ফেসবুকে আত্মপ্রকাশ করেছিল বিন্তি দি। 


নতুন অ্যাকাউন্ট খোলার পর দিন দুয়েক ঘন্টু ওই সব ছবি পোস্ট করল - যেমন বাচ্ছা গুলো করে আর কি। থুতনিতে হাত দেওয়া সেলফি, অন্ধকার অন্ধকার ছবি, বই হাতে ছবি, "Bro"দের সাথে ছবি ইত্যাদি প্রভৃতি এবং একটি সুন্দরী মেয়ের সাথে ছবি। ভাবলাম ইনিও বোধহয় ওই 'Bro' দেরই কেউ হবেন। ভুল ভাঙাল ঘন্টু বাবু স্বয়ং। মেসেঞ্জারে জানালেন," অনি মাসি এই দেখো আমার গার্ল ফ্রেন্ড।" দেখার মতোই মেয়েটা। কি সর্বাঙ্গীন সুন্দর। সনাতনী বাঙালি সৌন্দর্যের পরিমাপে কতটা নম্বর পাবে সেটা বিতর্কমূলক হলেও গ্ল্যামারে কিন্তু হীরকের মতোই উজ্জ্বল। গোছা গোছা ছবি ভেসে বেড়াতে লাগল ফেসবুক থেকে ইন্সটাগ্রামে। লাইক না পেলেই ধেয়ে আসত ঘন্টুর মেসেজ, "অনি মাসি, এই দেখো। একটা লাইক তো বানতা যায়।" 


ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসে সব উত্তেজনাই। আমরাও মহানগর ছেড়ে চলে আসি তমলুক। চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয় মানুষ। দুদণ্ড দেখা যে করব, তারও কি উপায় আছে। বিন্তি দি এবং আমি উভয়েই এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকি নিজের নিজের জীবনে -। সেটা রথের দিন, ভাবলাম আজ একটা ফোন করেই ফেলি। ব্যস্ত থাকলে পরে করবে দিদি। যথারীতি ফোন বেজে গেল। সন্ধ্যার ফোনের জবাব পেলাম রাত এগারোটায়। " তুই ফোন করেছিলি? Sorry রে। আসলে তোর ঘন্টুর গার্লফ্রেন্ড আর তার বাবা মা এসেছিল, তাদের আপ্যায়নেই ব্যস্ত ছিলাম।" আরে বাহ। দুই পরিবারের মধ্যেও সেতু বন্ধন হয়ে গেল। তার মানে তো আমাদের ঘন্টু এবং তার সুন্দরী বান্ধবী উভয়েই বেশ সিরিয়াস সম্পর্কটাকে নিয়ে। 


বিন্তি দি বলেই চলে, " মেয়েটা খুব ভালো রে। ওর বাবা মা, পরিবারটাও বেশ ভালো। আপাতত ও কেরিয়ারে ফোকাস করতে চায়। আমরাও তাই চাই। তোর সাথে একদিন আলাপ করিয়ে দেব।" হেসে বলি, আমার সাথে আবার আলাপ করাবে কি, আমি তো চিনি। কবে থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছি দুজনকে। কোথায় কোথায় সব প্রেম করতে যায় ব্যাটারা, কি দারুণ দারুণ ছবি তোলে একসাথে। বিন্তি দি একটু থমকায়, গলা ঝাড়ে, তারপর বলে, " নানা তুই ওকে চিনিস না।" আমি বলি আলবাৎ চিনি, তুমি তো কাল কা যোগী, সবে ফেসবুক একাউন্ট খুলেছ।আমি পুরাণ পাপী। 


বিন্তি দির গলায় একরাশ অস্বস্তি, " নারে তুই একে দেখিসনি। এ একটু 'পড়াকু' টাইপ। ওই সব সোশ্যাল মিডিয়া ফিডিয়ায় একে পাবি না।" স্পিকার অফ থাকলেও নিশুতি রাতের নৈঃশব্দে সব কথা পাশ থেকে  শোনা যায়। শৌভিক মাথায় গাঁট্টা মেরে ইশারায় বলে, ' এটা অন্য মেয়ে।' পুরো বেকুব হয়ে যাই মাইরি। বিন্তি দি 'হবু মেয়ের' গুচ্ছের প্রশংসা করে ফোন রাখে। তড়িঘড়ি ঘন্টুবাবুর একাউন্টটা খুলি। সময়ের পুরু ধুলো জমেছে আমাদের সম্পর্কেও। দীর্ঘদিন আর মেসেঞ্জারে ছবি লাইক করার আব্দার করে না ঘন্টু। মনে পড়ে অনেকদিন কোন নোটিফিকেশনই আসেনি ঘন্টুর থেকে। খুলে দেখি একাউন্টটা আছে বটে, নেই সেই সুন্দর ছবি গুলো। সেই হীরের মত ঝলমলে মেয়েটার কোন নামগন্ধ নেই ঘন্টুর প্রোফাইলে। বুঝি বিন্তি দিই ঠিক। 


পরদিন মেসেজ করে জানায় ঘন্টুও, " ওর সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে অনি মাসি। কেবল ঝগড়া করত। আরো অনেক কিছু, it's kinda complicated। তবে ফাইনালি আমি আমার soulmate কে খুঁজে পেয়েছি। And I'm very happy। She inspires me to be a better version of myself। " জানাই, তুই খুশি হলেই আমরা খুশি বাবা। ভালো থাকিস। পড়াশোনাটা ঠিক করে করিস। 


তমলুক থেকে কাঁথি সরে আসি আমরা। দূরত্ব আরো বেড়ে যায় বিন্তি দির সাথে। মাঝে মাঝে টুকটাক WhatsApp এ যা কথা হয়। প্রতিবার একই কথা বলে বিন্তি দি, "হ্যাঁ রে, তোরা কি আর কলকাতায় আসবি না? " এই কথার কি জবাব দি। সবই তো মহামহিমের মর্জি। কথা ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করি, তোমার মেয়ের কি খবর? সে কি করছে এখন? বিন্তি দি আকাশ থেকে পড়ে, " কোন মেয়ে রে? আমার তো একটাই ছেলে -"। যাঃ বাবা। খুলে বলি, বিন্তি দি মুখ ঝামটা দেয়, " ছাড় তো। সেসব কবেই চুকেবুকে গেছে। মেয়েটা বাইরে চান্স পেয়ে চলে গেছে।  এখন তো আর একটাকে জুটিয়েছে। কেন তুই ফেসবুকে দেখিস নি?" বিন্তি দিকে কি করে বোঝাই, বন্ধু পুত্রকে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টকিং করা ছাড়াও আমার আরো অনেক কাজ থাকে। কথা ঘোরাতে জিজ্ঞেস করি, 'তোমার শাশুড়ি মা কেমন আছেন?' শাশুড়ি হল এমন একটা টপিক যা নিয়ে বিন্তি দি ঝাড়া এক ঘণ্টা বকে যেতে পারে। তাই গেলও, ফোন রাখার আগে বলল, " পারলে একবার দেখিস, ঘন্টুর নতুন বান্ধবীকে।" 


ফোন রেখে, খুঁজে ঘন্টুর একাউন্টটা বার করলাম, ডিপি থেকে কভার ফটো সব জায়গায় হাসি মুখে ঘন্টু, পাশে আর একটি অনন্য সুন্দরী তরুণী, কম বেশি সর্বত্র একই ক্যাপশন লেখা, " You help me to grow", "You made me a better person" এবং"soulmate"। ফোন রাখতে রাখতে মনে মনে বলি, ভাগ্যে এই প্রজন্মে জন্মাইনি। একটা নিয়েই ঝালাপালা হয়ে গেলাম বাপস্। বলি, ঘন্টুর নতুন আত্মীয়তা দীর্ঘজীবী হোক। তবে বাবা ঘন্টু, তোর আত্মার যে সাকুল্যে কটা আত্মীয়!


পুনশ্চ - ঘন্টু বাবা জানি এতটা বাংলা তুই পড়তে পারবি না। যদি পড়িস, তো রাগ করিস না সোনা। তোর ভাষাতেই বলি, মাসি হিসেবে এইটুকু লেগ পুল তো বানতা হ্যায়, নাকি 😝😁।

অনির ডাইরি, ৩রা জানুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



এই তো মনে হয় সেদিনের কথা। অবশেষে বিদায় নিতে চলেছে বিশের (বিষের) বছর। আপ্রাণ চেষ্টা করছি সবাই সর্বোতভাবে জীবনকে স্বাভাবিক করে তোলার। সেটা বছরের শেষ দিন। কোন এককালে এমন দিনে আপিস যেতে ডাক ছেড়ে কান্না পেত। একরাশ তিক্ততা নিয়ে মেদিনীপুর লোকালে সওয়ার হয়ে, নবু ওরফে নবনীতার কাঁধে মাথা রেখে সত্যিই কাঁদতে কাঁদতে অফিস যেতাম। জমানাই ছিল ভিন্ন, আর শৌভিকের ভাষায় আপিসটাও ছিল ‘জঘন্যের কাকাবাবু’। এহেন বালখিল্যচিত ছিঁচকাঁদুনে দুঃখবিলাস আজকাল আর অনুভূত হয় না।  


তার প্রধান তথা অন্যতম কারণ অবশ্যই আমার তৎকালীন টিম, আমার টিম চুঁচুড়া। আর দ্বিতীয়ত মোদের তখন শিরে সংক্রান্তি। দিন বারো বাদেই আমাদের মেলা," শ্রমিকমেলা, চুঁচুড়া - ২০২১।" সময় কম, লোকবল তলানিতে, আর অর্থ বল? বাজেট কাটতেছাঁটতে যাকে বলে জেরবার আমরা। নির্দয় হাতে ছাঁটা হচ্ছে মেলার যাবতীয় সৌন্দর্যায়ন। প্রতিপদে কেটারার আর ডেকরেটরের সাথে দরদাম করে চলেছে আমার অবশিষ্ট খঞ্জভঙ্গ টিম। শেষে গতকাল উনি হতাশ হয়ে বললেন, “বাজারদর সম্পর্কে আপনাদের কোন ধারণা আছে ম্যাডাম? আলু-পেঁয়াজের দাম জানেন? গ্যাসের দাম জানেন?” আলু-পেঁয়াজের সঠিক দাম না জানলেও, জানি বাজারে লেগেছে আগুন। আর সদ্য অনলাইন গ্যাসের বিল দিয়েছিলাম, তাই এমাসে গ্যাসের দামটা ঠোঁটস্থ। উনি আমাদের সম্মিলিত অত্যাচারে ঐ ঠাণ্ডাতেও ঘেমে উঠছিলেন। কপালের ঘাম মুছে হেসে বললেন, “ওটা তো ডোমেস্টিক ম্যাডাম। কমার্শিয়াল সিলিণ্ডার আরও অনেক বেশী মূল্যবান।” সে হোক। আমরা নিরূপায়। আপনার যা প্রাণ চায় করুন। যা খুশি বিল দিন। আমার এইটুকুই সম্বল- 


সকাল আটটা। তড়িঘড়ি রেডি হচ্ছি আপিস যাব বলে, মুঠো ফোনে মধুঝরিয়ে গান ধরেছেন কিশোরকুমার, “ঝটক কে গেঁসু যাঁহা চলে,তো সাথ মেঁ আশমাঁ চলে-।” এমন সময় বেরসিকের মত বেজে উঠল ফোনটা। ছুটে এসে যখন ধরলাম, সিক্ত কেশ গুচ্ছ দিয়ে টপাটপ ঝরে পড়ছে মুক্তোকণা। গানটাকে গত রাতে কিছুতেই খুঁজে পাইনি। আজ সকালে অনুধাবন করলাম, “কেয়া সুরৎ হ্যায়” বলে অন্বেষণ করলে, “জরুরৎ হ্যায়”কে খুঁজে পাওয়া যায় না। 

ফোনের ওপারে অতিরিক্ত জেলাশাসক মহোদয়ের ব্যক্তিগত সহায়ক। সদ্য ঘুমভাঙা জড়ানো অসহায় কণ্ঠে জানান, অনিবার্য কারণ বশতঃ আজকের বৈঠক বাতিল। বসের নির্দেশ সবাইকে জানাতে হবে, অথচ ওণার গৃহে বা মোবাইলে কারো নম্বর নেই। লাজুক কণ্ঠে সবিনয় অনুরোধ, যদি বাকি আধিকারিকদের এট্টু জানিয়ে দিই- অত্যন্ত আনন্দের সাথে রাজি হয়ে যাই। বর্ষবরণের প্রাক্কালে বৈঠক বাতিলের সংবাদ বহন অতীব পূণ্যকর্ম। 


সকাল নটা। গুড় নিয়ে ফেরে শ্রীমতী তুত্তুরী। তিনি তখন সদ্য দশে পড়েছেন। একটু একটু করে গজাচ্ছে ডানাপাখনা। ঘুম থেকে উঠে লাফাতে লাফাতে গিয়েছিল আবাসনের মার্কেট থেকে আখের গুড় আনতে। কিনে এনেছে ভেলিগুড়। একখানা জাম্বো নারকেল দিয়েছে মা। বেহারী নারকেল। দেশ থেকে এনে দিয়েছে পৌরসভার ঝাড়ুদার। রোজ ময়লা নিতে এসে খোশগল্প করে বাবা আর মায়ের সাথে। যত এদের নিষেধ করি, অপরিচিত- অর্ধপরিচিত মানুষের সাথে এত খোশ গপ্প করো না। জমানা খারাপ। তা শুনলে তো? কদিন আগে বোধহয় মা বলেছিল আমার জামাই আর নাতনী নারকেল নাড়ু খেতে বড় ভালোবাসে। বাজার গিয়ে বাবার পক্ষে নারকেল কিনে আনা প্রায় অসম্ভব। স্থানীয় যারা বাজার নিয়ে বসে তারা তো আর নারকেল বিক্রি করে না।  


মায়ের দুঃখে গলে গিয়ে, চারদিন কাজে ডুব মেরে, চার খানা খোক্ষস মার্কা নারকেল এনে দিয়েছে ঝাড়ুদার। দরাদরি অন্তে নগদ ৩৫০টাকায় কেনা চারখানা নারকেল, যার দুখানি নাড়ু রূপে আর একখানি গোটাগুটি এসে হাজির হয়েছেন আমার গৃহে। নারকেল তো পেলাম,ফাটাই কি দিয়ে? ছোট নারকেল হলে বাটনা বাটার নোড়া মেরে ঘায়েল করে লতা দি। এটা যা জাঁদরেল। 


রমেশকে বলেছিলাম একটা কাটারি কিনে দিবি বাবা? অত্যুৎসাহী জনগণ যত। নিজের বাড়ির ভারি কাটারিটাই গছিয়েছে দিন কয়েকের জন্য। তিনি এসেছেন তো এসেইছেন। কাজে আর লাগানো হচ্ছে না তাঁকে। মায়ের হাতের নাড়ু শেষ হলে তবে না নতুন নাড়ু পাকাব। 


গতকালই লতাদিকে বললাম,যা হয় হোক, এবার কাটারিটা ফেরৎ দিতে হবে। ভেবেছিলাম বছর শেষে আপিস ফেরতা চিনির নাড়ু পাকাব। বাপ-মেয়ের না পসন্দ। সাতসকালে তাই কৌটো নিয়ে দৌড়েছিল তুত্তুরী পাঁচশ আখের গুড় আনতে। তখনও আমরা মহানগরের বাসিন্দা। মেয়েকে দোকানে পাঠাতে খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করত না শৌভিক। ভয় পেত। যা ট্যালা মেয়ে আমাদের। খুব বায়না করলে, টাকাপয়সা ছাড়াই দোকানে পাঠানো হত তুত্তুরীকে। দোকানদার হোয়াটস্ অ্যাপে পাঠিয়ে দিত বিল। তখনও UPI শিখিনি আমরা। আপিস ফেরৎ ক্যাশ টাকায় বিল মিটিয়ে আসত শৌভিক।


আজ দোকানদার অনুপস্থিত। অল্পবয়সী অবাঙালি কর্মচারী আখের গুড় বোঝেনি। পাঁচশ ভেলি গুড় গছিয়েছে। তাই নিয়েই নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেছে আমার কন্যা। আখের গুড়ের পরিবর্তে ভেলি গুড় এনেছে বটে, তবে পথে কোন বুড়ো রিক্সাওয়ালা নাকি মামণি বলে ডেকে বিনামূল্যে বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছে, তাকে দিব্য মায়ের ভয় দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে ফিরে এসেছে ট্যালা মেয়েটা। মনে হল বর্ষ শেষে এটাই কম পাওনা কি? রোমে টিকতে হলে রোমান হতে হয়, আর জঙ্গলে বাস করতে হলে- 


বেলা দশটা- “আজ কোথাও যাচ্ছ তোমরা?” ফোনের ওপার থেকে সংকুচিত ভাবে জানতে চাইল উমা। তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ভেলিগুড় বিদায় করে, ধার করা কাটারি বগলে আপিস বেরোতে একটু দেরীই হয়ে গেছে। হাসি চেপে জানালাম, যাচ্ছিই তো। যে যার আপিস। “তাহলে সোনাইকে নিয়ে একটু বেরোব?” আবার জানতে চায় উমা। শ্রীমতী ফুলঝুরি তখনও ঘুমিয়ে আছেন ভবিষ্যতের গর্ভে। বিবাহোত্তর জীবনে উমার প্রিয়তম বন্ধু শ্রীমতী তুত্তুরী ওরফে সোনাই। কাকিমা আর তার সোনাইয়ের মধ্যে সাধারণত ঢুকতাম না আমি। আজও ঢুকি না। যা খুশি কর না বাপু তোরা।   


বেলা এগারোটা- আপিসে ঢুকতেই পুরসভার ইন্সপেক্টর সঞ্চিতা বলে ওঠে, “ওরা কিন্তু আসবে ম্যাডাম। দল বেঁধে।” ওরা অর্থাৎ আমার চুঁচুড়ার SLOরা,আসবেই, জানি। গতকাল মেলার সমস্ত দপ্তরী দায়িত্ব থেকে ওদের অব্যাহতি দিয়েছিলাম যে। তারপর থেকেই উত্যক্ত করছে ওরা। 


সাংগঠনিক ভাবে মেলা বয়কটের ডাক দিয়েছিল কোন এক সংগঠন। অন্যান্য জেলা, অন্যান্য মেলা থেকে উড়ে আসছিল নানা অপ্রীতিকর গুজব। ভাইরাল হচ্ছিল ক্লিপিং। পরিস্থিতি বিচার করে চন্দননগরের তৎকালীন বড় সাহেব বললেন, ‘তোমার ছেলেমেয়েগুলো ভালো, তোমায় বড় ভালবাসে। তুমি বললে ওরা ফেলতে পারবে না। কিন্তু সাংগঠনিক ভাবে যদি ওরা মেলা বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমাদের চাপ দেওয়া অনুচিত। দেখো কি করবে-।’ আমার ছেলেমেয়ে গুলো সত্যিই ভালো, মেলা নিয়ে আমাদের থেকে ওদের উত্তেজনা বেশী। বলাগড়ের শ্যামল তো রোজই লিখে চলেছে, ‘দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসবে আমাদের মেলা দেখতে। কত লোক চাই ম্যাডাম। আমি আনব।’ ধরে বেঁধে থামাতে হয় এদের। বাপঃ করোণা এখনও আছে কিন্তু। 


তবুও ভেসে আসে নানা অপ্রীতিকর বার্তা। অন্য মহকুমার লোকজনের তিক্ত ঝাঁঝালো উক্তি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য পাশের মহকুমার এক SLOকে ফোন করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তৎকালীন RLO ইন্সপেক্টর কৌশিক। “জানেন না আমাদের কি অবস্থা?” অবস্থা আমাদের থেকে ভালো কে জানে? তুচ্ছ ফিল্ড আপিসের ওপর গোঁসা হতেই পারে, কিন্তু ফিল্ড আপিসের অসহায়তা বুঝবি না তোরা? তাহলে কে বুঝবে? ক্ষোভ অভিমান তো আমাদেরও হয়- তাই লিখেছিলাম, মেলা তো তোমাদেরই, অবশ্যই মেলায় এস, মেলার কাজে অংশগ্রহণ করো, কিন্তু স্বেচ্ছায়। এবার অফিশিয়ালি যাবতীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল SLO দের। ‘আপনি আর কপনি’ নিয়েই লড়ে যাব আমরা। 


বেলা একটা- তুত্তুরীর ফোন আর থামেই না। দারুণ কাটছে আজকের দিনটা। পিছনের কেরিয়ারে সোনাইকে বসিয়ে সারা আবাসন সাইকেলে চক্কর মেরেছে কাকিমা। জীবনে কখনও সাইকেলের কেরিয়ারে বসেনি তুত্তুরী। তারপর পাড়ার ছোট্ট পার্কে ঢুকে এক অবাঙালি শিশুর থেকে ধার করা ফুটবল নিয়ে হুল্লোড়বাজি, দোলনায় চড়া, ঢেঁকিতে চড়া আর তারপর মাঠে রোদ পোয়াতে আসা জনৈক দাদুর আদরের থলথলে ল্যাব্রাডর কুতুয়াকে ধার নিয়ে আশ মিটিয়ে চটকেছে দোঁহে। আদরের দাপটে নাজেহাল কুতুয়া মাঝে একবার পালিয়ে গিয়ে পাশের গাছে পা তুলে কিভাবে ইয়ে করেছে সেই গল্পও শোনায় তুত্তুরী। সারা বেলা টইটই করে ঘুরে, হাফ প্যাডেল শেখা তথা শেখানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টান্তে বাড়ি ফিরেছে দুজনে। ' উফঃ এমন দিন কেন যে রোজ আসে না-', একসাথে চিৎকার করে দুটোতে, সাধে ব্যাটাদের মধ্যে ঢুকি না।  


বেলা তিনটে- কালো হয়ে আসা মুখগুলিতে মাখামাখি আব্দার আর আর্তি। রমেশ, সমীর, প্রদীপ, শ্যামল, মাম্পি, প্রিয়াঙ্কা, অমৃতা আরো যেন কারা কারা। “ও ম্যাডাম, রাগ করবেন না।” “দুঃখ পাবেন না। মেলা থেকে প্লিজ আমাদের সরিয়ে দেবেন না। আমরা আসব হ্যাঁ-”। হ্যাংলার মত বলে মগরার SLO প্রিয়াঙ্কা। ওটাই পালের গোদা যে। পোলবা-বাঁশবেড়িয়ার কালেক্টিং এজেন্ট দিদিরাও এসেছে ওদের সাথে। মহুয়াদি বলেন, " আমরা তো SLO নই ম্যাডাম। আমরা তো CA। আমাদের কেন বাদ দিচ্ছেন ম্যাডাম -"।ওদের মেলা থেকে ওদের বাদ দেবার ক্ষমতা কি আমার আছে? কত বড় শক্তিধর আমি? আর রাগ? রাগ হলেও তার স্থায়িত্ব কতক্ষণ এরা ভালোমতই জানে। মন কষাকষি, মান অভিমান, রাগ-অনুরাগ মিটতে মেটাতে গড়িয়ে যায় বেলা। ALC সুখেন বর্মন সাহেব গলা ঝেড়ে, হাত কচলে, জানান দেন, "সব তো হল, এবার একটু কিছু খাওয়া দাওয়া হবে না? আজ যে বছর শেষ।" বুঝতে বাকি থাকে না, বাইরে থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে সবাই মিলে। ইন্সপেক্টর থেকে SLO, এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার সব্বাই। ছদ্ম গাম্ভীর্যের প্রসাধনের আড়ালে ফিক করে হেসে ওঠে হৃদয়,‘ এমনি ভাবেই কাটুক না বছর গুলো, কিছু নরমে, কিছু গরমে। কিছুটা লোহায় আর বাকিটা নিখাদ সোনায়।’


বিগত কয়েক বছরে বদলে গেছে কতকিছুই, চাকরী ছেড়েছেন আমাদের চন্দননগরের বড় সাহেব, টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সেদিনের টিম চুঁচুড়া। অবসর নিয়েছেন বর্মন সাহেব। আমি বদলী হয়ে এসেছি তমলুক, সঞ্চিতা গেছে ব্যারাকপুর, কৌশিক - নির্মল - চঞ্চল ও ছিটকে গেছে বিভিন্ন জেলায়। সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে চলে গেছে ধীমান। রয়ে গেছে কেবল স্মৃতিগুলো।


অনির ডাইরি ২ রা জানুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



এই তো সেদিনের কথা। বোধহয় সেটা সেপ্টেম্বর মাস, বহুরূপীর মত ভোল বদলাচ্ছিল প্রকৃতি। এই টিকি পোড়ানো গরম, তো এই ভেসে গেল বুঝি ধরা। এই থিকথিক করছে ভিড়, তো এই শুনশান আমাদের আপিস। তেমনি এক সায়াহ্নে স্কুলের বন্ধুদের মেসেজ করলাম, " ভাবছি ঘুমিয়ে পড়ি -"। জানলার বাইরে ঝুলছে, মসিকৃষ্ণ মেঘের পর্দা, বাজের দাপটে বন্ধ সব কম্পিউটার, আমরা গুটি কয় হতভাগ্য কর্মচারী ভিন্ন আপিস প্রায় জনশূন্য। 


ঘুমিয়েও পড়তাম হয়তো, যদি না বড়সাহেব মেসেজ করে জানতে চাইতেন, "বারখোদা কার এলাকা জানো?" গুগল করে দেখলাম, আমার এবং মুকুলের। মহকুমা আমার আর ব্লক মুকুলের। একজনের নাম দিয়ে স্যার বললেন, 'খোঁজ নিয়ে দেখো তো, এই লোকটি ওই অঞ্চলের বাসিন্দা কি না। যদি হয়, তাহলে কেমন আছে?" এমন মেসেজ তো সচরাচর করেন না বড়সাহেব, প্রতিবেশী দেশের সৌজন্যে সেই সময় যত্রতত্র বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর হামলা হচ্ছে, এটাও কি তেমন কিছু নাকি? জানতে চাইবার আগেই জানালেন বড়সাহেব, আমার অনুমানই সঠিক, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক, ভিন রাজ্যে ফুলের কাজ করত। মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছে - 


অন্যান্য মহকুমা গুলোতে ভুরি ভুরি এমন কেস আসছিল, তমলুক তুলনামূলক ভাবে বর্ধিষ্ণু মহকুমা বলেই হয়তো, এর আগে এই রকম একটাই কেস এসেছিল, ময়নার ছেলে। খবর এসেছিল পিটুনি খেয়েছে, কাজ হারিয়েছে।বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে তো আমার লোকজনেরই পিটুনি খাবার উপক্রম। ছেলে ভালো আছে, বিদেশবিভূঁইয়ে থাকে, হোটেলে কাজ করে, মাসে মাসে ভালো টাকা পাঠায়, খামোখা কেন আমরা ফোন করে বা বাড়ি এসে উৎপাত করছি? অনেক কথা শুনিয়েছিল বাড়ির লোক। ভাবলাম, এটাও তেমনি হবে হয়তো। প্রার্থনা করলাম, এটাও তেমনিই হোক। আর আমিও একটু ঘুমিয়ে নিই, বড় মুখ করে বললাম বন্ধুদের। আগের বার ইন্সপেক্টর সৌরভ আর এসএলও রঞ্জন খিস্তি খেয়েছিল, এবার না হয় মুকুল আর মতিবুল দুটো গাল খাক, লোকটা যেন ভালো থাকে ঠাকুর।


বৃষ্টির দাপট একটু কমেছে, দল বেঁধে ছাতা নিয়ে টিফিন করতে যাচ্ছিল আমার লোকজন। দৌড়ে গিয়ে বললাম, দুমিনিট দাঁড়া বাবা। একটু খোঁজ নিয়ে দেখে নিই, লোকটা ঠিক আছে কিনা। মতিবুলকে ফোনেই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না আশেপাশের পঞ্চায়েতের জনা দুই তিন এসএলওকেও। বাজ আর বৃষ্টির দাপটে সবাই ফোন বন্ধ করে বসে আছে নাকি? বাকিদের খেতে পাঠালাম, শান্তনু একা রয়ে গেল ফোন করার জন্য। 


বেশ কিছুক্ষণ পর বাজল মতিবুলের ফোন। নামটা বলল শান্তনু, ওপাশ থেকে কি জবাব ভেসে এল জানি না, ফ্যালফ্যাল করে খানিক আমার দিকে তাকিয়ে শান্তনু বলল, "ম্যাডাম মতিবুল বলতেছে, ছেলেটা মরে গেছে।" কি বাজে বকছ, বলে ফোনটা কেড়ে নিই আমি। মতিবুল তখনও ধরে আছে ফোনটা, আবার শুধালাম আমি, ও কি ছেলেটাকে চেনে? ছেলেটা কি সত্যিই পরিযায়ী শ্রমিক? কেমন আছে ছেলেটা? আবার জবাব দিল মতিবুল, " হ্যাঁ ম্যাডাম, চিনি তো। আমার বাড়ির পাশেই থাকে। পিটিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিছে, আর বেঁচে নেই -। আমি আপনাকে ছবি পাঠাচ্ছি।" 


ক্লান্ত, পরাজিত হয়ে মাথা নীচু করে চেম্বারে ফিরে আসি, ভারী মন, ভারী গলায় বড়সাহেবকে দুঃসংবাদটা দিই। জানাই মতিবুল ছবি পাঠাচ্ছে, মিলিয়ে নেওয়ার জন্য। বড় সাহেব আঁতকে ওঠেন, "কিসের ছবি?" বলি, ছেলেটার বা তার আধার, ভোটার কার্ডেরই হবে। স্যার বলেন, "না। ওর বর্তমান অবস্থার। আমিও পেয়েছি ওই ছবিগুলো, ইচ্ছে করেই তোমায় পাঠাইনি। এত বীভৎস, তুমি প্লিজ ওগুলো দেখো না -"। স্যারের ফোন শেষ হবার আগেই, দৌড়তে দৌড়তে আসে শান্তনু, " ম্যাডাম, মতিবুল কি সাংঘাতিক সব ছবি পাঠিয়েছে -। একদম দেখবেননি। একটা দেখেই আমার মাথা ঘুরছে -"। 


কেমন দেখতে হয়, গণপ্রহারে মৃত মানুষকে? আমার দেখার ইচ্ছে হয়নি। জানি সহ্য করতে পারব না। অপরিসীম ক্লান্তির সাথে সাথে এক অক্ষম রাগ আমাকে তিলে তিলে গিলে খাচ্ছিল। কেন? কেন? কেন? আধার নম্বর জোগাড় করে ততক্ষণে পোর্টাল খুঁজে দেখে ফেলেছে বেদজ্যোতি, আছে, ছেলেটি আছে। সরকারী প্রকল্পে নথিভুক্তও আছে। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে দুলক্ষ টাকা পাবে ছেলেটির উত্তরাধিকারী। তাতে কি? কত টাকা মূল্য হয় একটা প্রাণের? আদৌ কি কোন মূল্য হয় প্রিয়জন বিরহের -।


তারপর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস, ঘুরে গেছে বছরও। মাননীয়ার ভার্চুয়াল মিটিং উপলক্ষে আজ আমাদের অফিসে এসেছিলেন বড় সাহেব, মিটিং শেষে যেমন হয় আর কি, চায়ের কাপে খানিক আড্ডা বসে। আড্ডা জুড়েও থাকে আপিস, কাজ কেমন চলছে, কেমন চলছে না। কেন চলছে না ইত্যাদি প্রভৃতি। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ বড় সাহেব শুধালেন, " আচ্ছা অনিন্দিতা, সেই কেসটার কি হল?" চায়ের কাপ নামিয়ে সোজা হয়ে বসি, জানতে চাই, কোন কেস? উনি বলেন, "সেই যে ট্রেন থেকে মেরে ফেলে দিয়েছিল -। তাদের টাকা দিয়ে দিয়েছ?" 


বিস্তর ভেবে, মাথা চুলকেও মনে করতে পারি না। বিগত কয়েক মাসে কত কেসই তো ছাড়লাম, তার মধ্যে বেরিয়ে গেল কি? বেল বাজিয়ে শান্তনুকে ডাকি, সে একবার বলে হ্যাঁ, একবার না। তারপর আমার থেকেও দ্রুততায় মাথা চুলকায়। যেমন অফিসার তেমনি তার CKCO। এই আপিসে কি গণ খুশকি হল নাকি! অবস্থা সামলে বেদজ্যোতি পাশ থেকে বলে, " না না, আমার মনে আছে। ওরা এখনও অ্যাপ্লাই'ই করেনি।" যাঃ বাবা, কেন রে ভাই? বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, "একটু দেখ" বলে বেরিয়ে পড়েন স্যার। 


ততক্ষণে মুকুলকে ফোন করে ফেলেছে শান্তনু। ব্লকে বসে বিস্তর মাথা চুলকে ফেলেছে আমার ইন্সপেক্টরও। তারপর বলেছে, " ওরা তো অ্যাপ্লাই করেনি।" আরে বাবা, সেটাই তো জানতে চাইছি। কেন করেনি? কাগজপত্রের কোন সমস্যা হয়েছে কি? মুকুল জবাব দেয়, "না ম্যাডাম। না ম্যাডাম। করেনি কারণ ছেলেটা ইয়ে (ঢোঁক গিলে) মানে বেঁচে আছে।" অ্যাঁ!সত্যি! এও কি সত্যি হতে পারে? গণপিটুনির পর চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিলেও মানুষ বেঁচে যেতে পারে? ঈশ্বর কি সত্যিই এমন করুণাময়? সেদিন কি তিনি সত্যিই শুনে ফেলেছিলেন আমার মনের কথা? বুকের মধ্যে বেজে ওঠে সন্দেহ অবিশ্বাসের বাদ্যি। জানতে চাই তোমায় কে বলল? মুকুল ঘাবড়ে গিয়ে বলে, "মতিবুল ম্যাডাম!"


মতিবুলই তো আগের বার বলেছিল আর বেঁচে নেই ছেলেটা। তাহলে কি কোন ভুল হচ্ছে? আমার মুখে সন্দেহের আলোছায়া দেখে সটান মতিবুলকেই ফোন করে শান্তনু। এবার একটা রিংয়েই ফোনটা ধরে মতিবুল। একরাশ খুশি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শান্তনু বলে "ম্যাডাম মতিবুল ও বলতেছে, ছেলেটা বেঁচে গেছে।" উত্তেজনা চাপতে না পেরে, এবারেও ফোনটা কেড়েই নিই আমি। মতিবুল তখনও ধরে আছে ফোনটা, আবার শুধাই আমি, ঐ ছেলেটাই তো? সত্যিই বেঁচে গেছে তো? আবার জবাব দেয় মতিবুল, " হ্যাঁ ম্যাডাম, সেই ছেলেটাই। আমার বাড়ির পাশেই থাকে। পিটিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছিল, সবাই ধরে নিয়েছিল আর বেঁচে নেই -। কিন্তু উপরওয়ালার দয়ায় ও বেঁচে গেছে ম্যাডাম।"


ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ি আমি, এত নির্ভার বহুযুগ বোধ করিনি। মৃত্যুকালীন অনুদান ছাড়া আমার সবথেকে অপছন্দের কাজ। প্রতিটা মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় না জানি কতই না গল্পকথা। টিপ সই বা আঁকাবাঁকা হাতে লেখা অনুদানের আবেদন পত্র, ডেথ সার্টিফিকেট, কজ অফ ডেথ, পুলিশ রিপোর্ট, পোস্টমর্টেম ইত্যাদি ঘাঁটতে রীতিমত আতঙ্ক লাগে আমার। বিমর্ষ বোধ করি আমি। আজ বছরের প্রথম কর্মদিবসে ছেলেটির বেঁচে থাকাটা যেন ব্যক্তিগত ভাবে আমারই জিৎ। বিরাট সুখবর। ভালো থাকুক বাবা ছেলেটা, আলো করে থাকুক সুখী গৃহকোণ। ভালো থাকুক পেটের টানে বিদেশবিভূঁইয়ে কাজ করতে যাওয়া প্রতিটা মানুষ।

Sunday, 29 December 2024

অনির ডাইরি ডিসেম্বর, ২০২৪

 অনির ডাইরি ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



আমি মেয়েকে ছাড়া কোত্থাও যাই না, অফিস ব্যতিরেকে। পার্টি, পিকনিক থেকে মামুলী গেট্টু যাই হোক না কেন শ্রীমতী তুত্তুরী আমার সাথে প্যাকেজ ডিলে থাকেই। এমনকি বিয়েশাদি - জন্মদিন ইত্যাদি উপলক্ষে কেউ আমায় নিমন্ত্রণ করতে এলেই আমি হ্যাংলার মত মুখ করে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকি, একবার শুধু মুখ ফুটে বলার অপেক্ষা, 'তুত্তুরীকেও আনবেন ম্যাডাম'-। 


আজ বড়দিন, স্কুলের বন্ধুদের পিকনিক, অথচ সেই মেয়েকে ছাড়াই আসতে হল আজ। হঠাৎ করেই মেসেজ এসেছে, কাল তাঁর কেমিস্ট্রি এসেসমেন্ট, তাই তিনি কিছুতেই আসতে রাজি হলেন না। গোটা বাংলায় এমন কোন ইংরেজি মিডিয়াম ইস্কুল আছে বাপু, যারা বড়দিনের পরের দিন পরীক্ষা নেয়? বলুন দিকি ব্যাপারটা কি অসৈরণ নয়। কত করে বললাম, চল না, না হয় দিবি না একটা পরীক্ষা, তাতে তিনি, তাঁর বাপ, বাপের মা মিলে আমায় এমন তিরস্কার করলে -। 


এত দূর উজিয়ে পিকনিকে আসার ইচ্ছে আমার শুরু থেকেই ছিল না। কিন্তু জনে জনে এমন ফোন করে উত্যক্ত করতে লাগল, যে আসতেই হল। সিকি শতাব্দী হল ইস্কুল ছেড়েছি আমরা, আজও আমার সহপাঠীরা আমার সঙ্গের জন্য উন্মুখ, ব্যাপারটা ভাবলে রীতিমত আর্দ্র হয়ে ওঠে হৃদয় । এই কায়েমি দুনিয়ায় ভালোবাসা বড় দুর্লভ। সামান্য পথশ্রমের জন্য তার অমর্যাদা করতে অন্তত আমি রাজি নই। 


ভাবলাম  এত দূর উজিয়ে যাবই যখন একটা রাত থেকেই আসি বাড়িতে। আমার বুড়োবুড়ি খুশি হয়ে যাবে। তিলতিল করে কতকিছু যে গোছালাম বাবা মায়ের জন্য - শীতের ডবকা কমলা লেবু, ঝোলা নলেন গুড়, গুড়ের পায়েস, আমলকীর ঝালআচার, মিষ্টি আচার এমনকি কড়াইশুঁটির কচুরির পুর ও। বয়স বড় অশক্ত করে দেয় মানুষকে। আর তো রাস্তায় বেরোতে পারে না বাবা। ভালমন্দ কিছু খেতেও পায় না সেভাবে। ঐ আয়া দিদি যা কিনে আনে, তাতে অবশ্য ওদের কোন ক্ষোভ নেই। দিব্যি ফূর্তিতে আছে দোঁহে, তাও মেয়ের মন - 


ভাবলাম যাবই যখন লতা দিকেও সঙ্গে নিয়ে যাই। অনেক দিন বাড়ি যায়নি মানুষটা। এই উৎসবের দিনে একবার দেখে আসুক নাতি নাতনী গুলোকে। আমি আর লতা দি দুজনেই থাকব না, শুনেই মুখ শুকিয়ে যায় শাশুড়ি মাতার। কত কষ্ট করে যে তাঁকে বোঝাতে হয়, ' আরে বাবা কালই ফিরে আসব। মাত্র একটা  রাতের তো ব্যাপার। তোমার ছেলে তো রইল। আজ উৎসবের দিনে হাওড়ার বাড়িতেও একটু আলো জ্বলুক।' 


এত দিক গুছিয়ে যখন রওনা দেব, বেঁকে বসলে আসল লোকটাই। নাতনী যাবে না শুনে যতটা চওড়া হল শাশুড়ি মাতার মুখের হাসি, ততোটাই ম্রিয়মাণ শোনাল আমার মায়ের গলার আওয়াজ। "তুত্তুরী আসবে না? কেন?" দুটো ভারী ব্যাগ সহ আমায় দেখেও উজ্জ্বল হল না মুখ। গেলবার এসে দেখেছিলাম মায়ের তুলসী গাছটা মরে গেছে, মনে করে সেটাও বয়ে এনেছি আমি আর লতা দি, তাও খুশি হয় না কেউ। অন্যমনস্ক ভাবে সিগারেট ধরিয়ে বাবা তো বলেই ফেলে, " তুমিও না এলেই পারতে। তুমি সুখে ঘর সংসার করো, এটাই আমরা চাই। তাছাড়া মাকে ছাড়া থাকতে তুত্তুরীর কি ভালো লাগবে?" 


এমনিতেই মেয়ের জন্য মন খারাপ, তার ওপর এমন অভ্যর্থনা কার ভালো লাগে। বাবামায়ের তাড়নাতেই ফোন করি বাড়িতে। মুঠোফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে বাপ মেয়ের হর্ষিত স্বর। ব্যাডমিন্টন খেলছেন দুজনে। ঠাম্মা রোদ পোয়াচ্ছেন। আমার জন্য মনখারাপ কিনা আর জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করি না। জবাবটা স্পষ্ট। বেলা গড়ায় আমাদের পিকনিক জমে ক্ষীর হয়ে ওঠে। বন্ধুদের সাহচর্যে, ভালোবাসায়,  বন্ধু পুত্রকন্যাদের গানে নাচে, সৌন্দর্যে, মিষ্টতায় মোহিত হতে হতে, দ্রবীভূত হতে হতেও কোথায় যেন একটা কাঁটা ফোটে। ইশ আমার তুত্তুরীটাও যদি আজ এখানে থাকত -


'দিন যায়, সন্ধ্যা ঢলে'। আমায় কেউ ফোন করে না, আমিই হ্যাংলার মত বাড়িতে ফোন করি। "হ্যাঁ রে ঠিক আছিস তো?" জবাব আসে দারুণ আছে দুজনে। মেয়ে কম্পিউটার খুলে প্রজেক্ট করছে, বাবা ড্যালরিম্পল পড়ছে, ঠাম্মা আশাপূর্ণা দেবী পড়ছে। জানতে চাই, কাল সকালে কি খেয়ে ইস্কুলে যাবে, টিফিনে কি নিয়ে যাবে। শৌভিক বলে, " সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তোকে কিছু ভাবতে হবে না।" 

মন খারাপ হয়ে যায়, কেমন যেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। 


ভোর ভোর উঠে খোঁজ নিই, রাতে ঘুম হয়েছে তো? মেয়ে ইস্কুল গেছে তো? কে দিতে গেল? কে আনতে যাবে? টিফিন কি নিল? বুঝতে পারি, আমায় ছাড়াও দিব্যি চলে গেছে সবকিছু। আমায় ছাড়াও দিব্যি চলে সবকিছু। আপিসে ঢু মেরে, বেপোট জ্যাম, অবরোধ কাটিয়ে বাড়ি ফিরতে গড়িয়ে যায় সন্ধ্যা। শাশুড়ি মাকে সবার আগে দর্শন দিই, এবার ভিতরে যাবার পালা। শোবার ঘর থেকে ভেসে আসছে উত্তেজিত কথাবার্তা আর অট্টহাসি। তুত্তুরী এমন কিছু করেছে যে শৌভিক বলছে, " তুই বেরো।" তুত্তুরী হেসে গড়িয়ে পড়ছে আর বলছে, " না বেরোব না।" 


ছবির মত সুখী গৃহকোণ, তবুও বুকের ভেতর কোথায় যেন বিষণ্ণতার সুর বাজে। বড্ড তাড়তাড়ি বড় হয়ে গেল মেয়েটা। মেয়েগুলো বড় বেইমান হয়। কেমন বাপের দলে নাম লিখিয়েছে দেখ। সবই আমার কর্মফল। আমিও যে এমন ছিলাম। মাও নির্ঘাত এমনই নিঃসঙ্গতায় ভুগত। আমার আর কোন জায়গাই নেই এদের দুনিয়ায়। কাষ্ঠ হেসে ব্যাগটা রাখি ব্যাগের জায়গায়। হাতঘড়ি খুলি, খুলি আলগা বালাটা। কানের দুল খোলার আগেই ছুটে আসে শ্রীমতী তুত্তুরী, " মা আমি তোমার জন্যই বসে ছিলাম। তোমাকে কত কিছু যে বলার আছে। জানো আজ বন্ধুরা কি বলছিল, এই স্যার আর ঐ ম্যামের মধ্যে বোধহয় কিছু একটা চলছে -" দম না ফেলেই বলে যায় তুত্তুরী। কোন স্যার, কোন ম্যাম কাউকেই চিনতে পারি না আমি। ততক্ষণে প্রসঙ্গ বদলে গেছে, " পরের দিন অমুক স্যারের ক্লাস থাকলে কিন্তু আমি ছাতা নিয়ে যাব মা। উনি চিৎকার করলেই এমন থুতু ছিটান। আজই একটা ফোঁটা টপ করে পড়ল বেঞ্চে। আমি অমনি লাফিয়ে পাশের মেয়েটার কোলে। স্যার যদিও প্রচণ্ড লজ্জা পেয়ে অনেকবার সরি বললেন। তাও -"। গল্প থামতেই চায় না তুত্তুরীর। ফাঁক পেয়ে টুক করে পালিয়ে যায় শৌভিক। বেরোতে বেরোতে ইশারায় বলে যায়, কাল সারাদিন আমি সামলেছি, এবার তোর পালা। ম্যাও সামলা। আপত্তি করি না আমি, হাত পা না ধুয়েই জমিয়ে বসি আমি, হাঁ করে গালে হাত দিয়ে শুনি আমি। কখনও হাসি আমি, কখনও নৈতিকতার শিক্ষা দিই আমি, আর মনে মনে ভাবি," আছে, আছে, সব আছে।"

ছবি সৌজন্য - আমার বর


অনির ডাইরি ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 


তুচ্ছ কারণে প্রবল ক্রোধান্বিত এবং প্রবলতর ধমকচমক দেবার পর মনে পড়ল, আরে, দিন দুয়েক আগেই তো দেখলাম একটা রিলে, রাগ কমানোর উপায়। এক অতীব রূপসী, তন্বী মহিলা, ঝিম ধরানো স্বরে পাখি পড়া করে শেখালেন," রাগ হলেই ওমন ষাঁড়ের মত চিৎকার করবেন না। তাইলে কি করবেন? চারদিকে তাকিয়ে দেখুন। যে কোন চারটে জিনিসকে লক্ষ্য করুন যাদের আকৃতি আলাদা আলাদা -"।


 অফিসের সামনের করিডরে পায়চারি করতে করতে সত্যিই চারদিকে তাকালাম। আমাদের স্টোর রুমের দরজাটা, একটা নিটোল টেকো লোক ভূমি রাজস্ব না কি যেন দপ্তরের সামনে বসে গভীর মনোযোগ সহকারে আবেদন পত্র লিখছে, তার টাকটা ইত্যাদি প্রভৃতি। হলো চারটে শেপ। এবার দ্বিতীয় ধাপ, চারটে জিনিসের রঙ খেয়াল করতে হবে। তাও করলাম। এবার চারটে গন্ধের কথা ভাবতে হবে -গোলাপ, চন্দন, বিরিয়ানি আর কি যেন একটা ভাবলাম। এবার চারটে খাবারের স্বাদের কথা ভাবতে বলেছিল বোধহয়, হাঁটতে হাঁটতে চোখ বন্ধ করে ভাবি -আহা ভাপা ইলিশ, গরম বিরিয়ানি, সিদ্ধ ডিম দিয়ে মেয়োনিজ (খাইনি যদিও, বানাইওনি, তবে রিলে তো দেখেছি) আর তেল জবজবে করে ভাজা শীতের কচি বেগুন। আহা আহা। মনটা স্বর্গীয় আনন্দে ভসভসিয়ে উঠল। কি ছাগল আমি, এটা তো আগে ভাবলে আর অনর্থক চিৎকার করে সবাইয়ের পিলে চমকাতাম না। মনস্থির করে ফেললাম, এবার থেকে মনকে বেপথু করতে এটাই করব। 


অচীরেই প্রয়োজন পড়ল, মনকে বেপথগামী করার। দুপুরে আজ ভুরিভোজ হয়েছে। ঠিক করেই রেখেছিলাম, আপিস থেকে ফিরে এক কাপ কালো কফি আর রাতে এক কাপ হলুদ দেওয়া দুধ খাব। ব্যাস। আর কিছু নয়। টেবিলে বসে দেখি, সামনে থরে থরে সাজানো কচি শসা পেঁয়াজের স্যালাড, প্রচুর মটরশুঁটি দেওয়া তেলতেলে বাঁধা কপির তরকারী, ক্যাসারল ভর্তি গরম রুটি, ধূমায়িত বেগুন ভাজার গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তেল। বোতলে টলটল করছে সদ্য ওঠা নলেন গুড়, টিফিন কৌটো ভর্তি নারকেল নাড়ু, আজ সন্ধ্যায়ই পাকিয়েছে লতা দি। একটু দুধ দিয়েছে কি? এমন সুন্দর দেখতে হয়েছে কি করে। 


নাহ আমি ওসব কিছুর দিকে তাকাব না। খড়কুটো সন্ধানী ডুবন্ত মানুষের মত, আকুল হয়ে খুঁজি চারটে শেপ, চোখে পড়ে ছোট ছোট গোল গোল নাড়ু, মাঝারি গোল গোল বেগুন ভাজা। রং বলতে চোখে ভাসে হলদে তরকারী, খয়েরি গুড়, কালো বেগুন ভাজা। গন্ধের পর্বে হুড়মুড়িয়ে নাকে উড়ে আসে তাজা গুড়ের গন্ধ। জিভে আপনা থেকেই ভেসে ওঠে আজব আজব সব স্বাদ। হে ত্রিপুরারি রক্ষা করো প্রভু। এই নাক মুলছি, কান মুলছি, ওসব আজেবাজে রিল আমি আর দেখব না ঠাকুর। এই দুর্লভ শীতল মরশুমে এইসব সুখাদ্যের অবমাননা করা ঘোর পাপ। বেঁচে থাকুক আমার রাগ, বেঁচে থাকুক আমার লোভ, ওগুলো ছাড়া বেঁচে থেকে কি লাভ। আগে তো খেয়ে বাঁচি, বাকি কাল বুঝে নেব ক্ষণ।


অনির ডাইরি ১০ই ডিসেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


প্রেগন্যান্সি টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসার সাথে সাথেই কেমন যেন বদলে যায় মেয়েদের জীবন। বিশেষ করে সেই মেয়ে যদি কর্মরত হয়। "ভুলেও ভেব না, তোমরা আপিস করবে, আর আমরা তোমাদের বাচ্ছা সামলাব -"। কথা গুলো আজও মনের গভীরে কোথাও মাঝে মধ্যেই ঘাই মারে। ভাগ্যে আমার মা ছিল, নইলে কি যে হত। সদ্যোজাত মেয়েকে নিয়ে কোন অকুলপাথারে যে পড়তাম দোঁহে। 


হাঁড়ি আলাদা হলেও যৌথ পরিবার আমাদের, সদ্যোজাত ছানাকে চটকে সন্দেশ বানাবার জন্য উদগ্র হয়ে অপেক্ষা করছে আমার মা, জ্যাঠাইমা, পিসি থেকে ভাইবউ সব্বাই। তাও শৌভিক গোঁ ধরল, সকলেই বয়স্ক কেন ওদের ওপর ফালতু চাপ দেওয়া। একজন লোক রাখতেই হবে, এমন কেউ যে যথাযথ যত্ন নিতে পারবে ওর মেয়ের। তারপর তো বাকিরা আছেই -। 


লোক চাই, বললেই তো আর লোক মেলে না। আবার বাচ্ছা সামলানোর লোক। মস্ত খোলামেলা বাড়ি আমাদের, লোকগুলো আদ্যপান্ত কাঁচাখোলা, যেখানে সেখানে যাতা ফেলে রাখে, টাকাপয়সা থেকে কুচি কানের দুল। ফলে বিশ্বস্ত হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। পাড়ার যে নার্সিং হোমে শ্রীমতী তুত্তুরীর জন্ম তার দুই আয়া দিদির সাথে হেব্বি দোস্তি হয়ে গিয়েছিল আমার আর মায়ের। ছাড়া পাবার আগে তাদেরই বলল মা। "তোমাদের মত ভালো কাউকে পাওয়া যাবে -"। 


একজন বয়স্কা, অন্যজন তরুণী। দুই দিদিমনি নিজেদের মধ্যে কথা বলে জানালো, " আমাদের তো ডাক্তার দিদি ছাড়বে না। তবে দেখছি, একজনকে খবর দিচ্ছি।" খবর পেয়ে যিনি এলেন, তাঁর যেমন জাঁদরেল চেহারা, তেমনি গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজ। মা আর আমি তো ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। মাফিয়াদের ঢঙে তিনি তো বলে চলে গেলেন, " কোন চিন্তা নেই।" মায়ের আর আমার মুখ শুকিয়ে চুন। ইনি যাবেন নাকি? নার্সিং হোমের দুই দিদি সান্ত্বনা দেয়, " উনি ভীষণ কাজের। ওনাকে পেলে তো কোন চিন্তাই ছিল না। তবে যাকে দেবে সেও ভীষণ ভালো। মিলিয়ে নিবেন মাসিমা।" 


সোমবার ভোরে জন্মানো মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরলাম রবিবার দ্বিপ্রহরে। তখনও শৌভিক বিডিও। সোমবারই ব্লকে ফিরে যাবে। প্রচুর কান্নাকাটি করেও আগে ছুটি পেলাম না। এক প্রবল বর্ষণক্লান্ত সকালে পিতামহের কোলে চেপে মাতুলালয়ে প্রবেশ করলেন শ্রীমতী তুত্তুরী। বাড়িতে ততক্ষণে মেলা বসে গেছে। চাটুজ্জে বাড়ির সব লোক, আমার দিদিভাই, শ্বশুরমশাই আরো যেন কারা কারা। মুখ দেখার সৌজন্যে কত কি যে পেল মেয়েটা। এদিক চা জলখাবার দিতে গিয়ে নাজেহাল আমার মা। দিদিভাই এমনকি আমিও ঐ অবস্থায় হাত লাগিয়েছি। শৌভিক ফিসফিস করে বলেই যাচ্ছে, "ওরে এখনই এত কাজ করতে যাস না। ব্যথা বেড়ে যাবে। তোকে দেখে আমারই পেট ব্যথা করছে। এম্প্যাথেটিক পেন বোধহয় একেই বলে -।" 


সব মিলিয়ে চূড়ান্ত ঘেঁটে যাওয়া মাছের বাজারে এসে উপস্থিত হল এক ছোট্টখাট্ট কৃশকায় ভদ্রমহিলা। পরনে সিনথেটিক শাড়ি, কাঁধে মেরুন রঙের ঝোলা ব্যাগ, হাতে ছাতা। ভেজা ছাতাটা ভাঁজ করে, রকের কল খুলে ভালো করে পা ধুলেন। তারপরে চৌকাঠ ডিঙিয়ে দালানে প্রবেশ করলেন, মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, " মাসিমা আমি লতা। সে কই?" সেই থেকে আজ চোদ্দ বছর ধরে তিনি তুত্তুরীর 'মাসি' আর তুত্তুরী তাঁর সোনা মা। আজ সেই মাসির জন্মদিন। খুব ভালো থাকুক মাসি, সুস্থ থাকুক। অটুট থাকুক মাসি আর তার সোনামার সম্পর্ক আজকের দিনে তুত্তুরীর মায়ের এটাই কামনা।


পুনশ্চ -শ্রীমতী তুত্তুরী তো ধেড়ে হয়ে গেছেন, তাঁকে দেখার ক্ষমতা কি আর মাসির আছে। তিনিই বরং যখন তখন, মোবাইল না দিলে " দেখে নেব" বলে মাসিকে ধমক চমক দেন। বর্তমানে মাসি আর একটি বাচ্ছার দায়িত্ব পেয়েছেন। ঐ যে শ্রীমতী তুত্তুরীর ডান পাশে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন যে ভদ্রমহিলা, তিনিই আপাতত মাসির নতুন এসাইনমেন্ট। বিশ্বাস করুন, দিনের শেষে মাসি কাকে বেশি পাত্তা দিল এই নিয়ে, এই বাড়িতে দুটো বাচ্ছার নিত্য রেষারেষি চলে।


Monday, 4 November 2024

অনির ডাইরি নভেম্বর, ২০২৪

 অনির ডাইরি ১২ই নভেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



শাড়ি পরব, না সালোয়ার? দোদুল্যমানতায় ভুগি। শৌভিককে জিজ্ঞাসা করব কি? বিয়ের পরপর, শুধালে আমার বরের একটাই উত্তর থাকত, শাড়ি। আজকাল যাই পরি, কিছুই যায় আসে না। এই তো গতকালই একটা নিমন্ত্রণ ছিল যুগলের, শুধালাম, কি পরব রে? জাস্ট কাঁধ ঝাঁকাল। অর্থাৎ যা প্রাণ চায়। ভেবে চিন্তে একটা শাড়িই পরলাম, মানে পরার চেষ্টা করলাম। আপদ শাড়ি, কিছুতেই আর কুঁচি ফেলে না। রেগেমেগে, গলদঘর্ম হয়ে স্বগতোক্তি করলাম, " শাড়ি পরতে ভুলে গেলাম নাকি!" তিনি তো তিন মিনিটে রেডি, ঘড়ি দেখতে দেখতে কেজো সুরে মন্তব্য করলেন, " শাড়ি পরছিস কেন?" জানালাম, তাঁর সঙ্গে যাচ্ছি, তাঁর পরিচিতের পুত্রের অন্নপ্রাশন, তাই তাঁর সম্মানার্থে শাড়ি পরছি। ভাজা মাছ উল্টে না খেতে পাওয়া মুখে তিনি বললেন, " কিন্তু আমি তো শাড়ি পরছি না।" 


এই না হলে আমার বর! তবে সে তো গত কালকের কথা ছিল। আজ আবার একটা নিমন্ত্রণ আছে। আমাদের শুভাশিসের কনিষ্ঠ পুত্রের অন্নপ্রাশন। গোটা আপিসের নিমন্ত্রণ থাকলেও, ইন্সপেক্টর সাহেবরা বোধহয় কেউই যেতে পারবে না। সৌরভকে তো সেই পুজোর পর থেকে আর দেখিনি। গণমাধ্যমে চোরাগোপ্তা ছবি দেখছি কেবল, হাঁটুর কাছে প্যান্ট গুটিয়ে, হাতে ফাইল আর বুক পকেটে পেন গুঁজে বাড়ি বাড়ি ইন্সপেকশন করছে সৌরভ। সেদিন ময়নার এক SLO খবর দিলে," স্যারের খুব জ্বর ম্যাডাম। নোংরা জল ভেঙে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে গিয়ে পায়ে ইনফেকশন হয়েছে। ঘ্যাসঘ্যাস করে চুলকাচ্ছেন আর ইন্সপেকশন করছেন। শনিবার নেই, রবিবার নেই, কালী পুজো নেই। কেবল ভাইফোঁটায় একটা ছুটি পেয়েছেন।"


 শুনি আর ভাবি, কে জানে, ছেলেটাকে আর জ্যান্ত ফেরৎ পাব কি না। বাকিদের অবস্থা ও তথৈবচ। সন্দীপ তো সক্কাল সক্কাল ছবি পাঠিয়েছে, নৌকা করে বাড়ি ইন্সপেকশন করছে। সৌরভের থেকে অন্তত একটু পদের। 


দেড়টা নাগাদ নভোনীল বাবু এসে তাড়া লাগান,  " চলুন ম্যাডাম। আমরা যে কজন আছি, তারাই ঘুরে আসি।" তাহলে আপিসে থাকবে কে? প্রতিবার চঞ্চল আর সৌরভ থেকে যায় আপিস সামলাতে। সৌরভের কথা তো আগেই বলেছি, চঞ্চল এবার ছুটি নিয়ে সকাল থেকে শুভাশিসের বাড়ি গেছে, প্রভুর নামগান করতে। শুভাশিসের বাড়ি গোবর্ধনধারী আসবেন যে।


প্রসঙ্গতঃ গোবর্ধনধারী হলেন বালক শ্রীকৃষ্ণ, নাড়ুগোপাল আর রাধাস্বামীর মাঝামাঝি।  কষ্টি পাথরে নির্মিত, রুপার চোখ, মাথায় প্রকাণ্ড মুকুট, সর্বাঙ্গ গহনায় মোড়া। গোবর্ধনধারীর প্রবল ডিমান্ড এই চত্বরে। কোলাঘাট ব্লকের দেরিয়াচকে ওনার মন্দির। কিন্তু সেই মন্দিরে মোটেই থাকেন না গোবর্ধনধারী, তিনি ঘুরে বেড়ান ভক্তদের বাড়ি বাড়ি। কারো বাড়িতে শুভ কাজ হলে আগেভাগে ডেট নিতে হয় গোবর্ধনধারীর। পাঁচ ছয় মাসের আগে কোন ডেট মেলা ভার। একেক দিনে চার পাঁচ বাড়িতে দর্শন দেন গোবর্ধনধারী। আর এই পথ উনি অতিক্রম করেন পালকিতে। সেই পালকি বহনের ও নির্দিষ্ট লোক থাকে। তবে শর্ত একটাই, গোবর্ধনধারী নদী পার হবেন না। 


শেষ পর্যন্ত জনা তিনেক রয়ে গেল আপিসে। আমরা কথা দিয়ে গেলাম, ফেরার সময় গোবর্ধনধারীর প্রসাদ সঙ্গে করে নিয়ে আসব। আপিস থেকে খুব বেশি দূর নয়, হবে না হবে না করেও নেহাৎ কম লোক হয়নি। গাড়ির দরজা কোন মতে চেপে চুপে বন্ধ করতে হল। নভেম্বর মাসের অপরাহ্নের সূর্যের একটা আলাদাই রঙ থাকে। একটু বেশীই দেরী করে ফেলেছি আমরা, কে জানে গোবর্ধনধারীর সাথে সাক্ষাৎ হবে কি না। যা ব্যস্ত থাকেন ভদ্রলোক। শুভাশিস আমাদের কথা ভেবেই, বার বার অনুরোধ করেছে, একটু যেন বেশী ক্ষণ থাকেন গোবর্ধনধারী। বাকি তাঁর ইচ্ছা। 


ফাঁকা হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলা গাড়ি, হঠাৎ টলমল করে ডিভাইডারে উঠে উল্টো লেনে ঢুকে পড়ে। আমি কিছু বলার আগেই বেদজ্যোতি বলে," এই কাটটা স্থানীয় মানুষজনই বানিয়েছে ম্যাডাম। নাহলে প্রায় দশ কিলোমিটার আরও ফালতু ঘুরতে হয়।" কাট বলা বাতুলতা, ডিভাইডারের খানিকটা চেঁচে সমতল করার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। গাড়ি উল্টো লেনে খানিক যেতেই দৌড়ে এসে হাত দেখায় রঞ্জিত। প্রথমার্ধে ইন্সপেকশন সেরে, বাইক নিয়ে সোজা চলে এসেছে। আমাদের জন্যই প্রতীক্ষা করছিল। আমরা টিম তাম্রলিপ্ত, যেখানে যাই, একসাথে যাই। 


ডান হাতে লাল মোরামঢালা ছোট মাঠ,  বাম হাতে সরু ঢালাই রাস্তা। এই রাস্তা ধরে মিনিট দশেক গেলে তবে শুভাশিসের বাড়ি। রাস্তা দেখে ড্রাইভার সাহেবের কপালে ভাঁজ গভীরতর হয়। এই রাস্তায় চার চাকা কি আদৌ যাবে? নিজেদের মধ্যেই বিতণ্ডা বেঁধে যায়,  একদল বলে আলবৎ যাবে, আরেকদল বলে, পাগল নাকি। ফেঁসে গেলে কি হবে? দুই দলই শুভাশিসকে ফোন করে। তাতেও মেটে না জটিলতা।


উল্টে সামনের চায়ের দোকানে আড্ডারত লোকজন সামিল হয়ে যান আমাদের বিতর্কে। গ্রামের দিকে যেমন হয় আর কি। " শুভাশিসের বাড়ি যাবেন নাকি? কে বলেছে গাড়ি যাবেনি। আলবৎ যাবে। গাড়িতে বসেন, গাড়িতে বসেন। আমরা পথ দেখিয়ে লিয়ে যাইছি।"  একজন বাইকওয়ালা পথপ্রদর্শক হয়ে খানিক এগিয়েও যায় -  


 আমরাও সবাই হুড়মুড় করে আবার গাড়িতে উঠে বসি, এমন সময় বাইক নিয়ে উদয় হয় স্বয়ং শুভাশিস। " গাড়ি যাবেনি, গাড়ি যাবেনি। ম্যাডাম আপনি আমার বাইকে আসুন, বাকিরা হেঁটে চলো"। শুভাশিসের পরনে সুদৃশ্য লাল পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, পা খালি। বুঝতে পারি হরিনামের আসর ছেড়ে এসেছে শুধু আমাদের জন্য। শুভাশিসের বাইকটা বেশ উঁচু, আর আমি বাইকে বসতে মোটেই সড়গড় নই। ইতস্ততঃ করছি দেখে, পাশ থেকে হেলমেট পরা কে যেন বলে, "ম্যাডাম আমার বাইকে আসুন। এটায় আপনার উঠতে সুবিধা হবে।" গলার আওয়াজে চিনতে পারি, এটা আমাদের  সন্দীপ। প্রথমার্ধে ইন্সপেকশন সেরে ছুটে এসেছে আমাদের সাথে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। 


দুদিকে ঘন সবুজ ধানক্ষেতে ইতিউতি লেগেছে সোনা রঙ, মাঝ খান দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে সরু ঢালাই রাস্তা। ধান ক্ষেত থেকে উঠে আসছে প্রাণ জুড়ান শীতল বাতাস। বেশ খানিক দূর থেকেই শোনা যাচ্ছে হরিনামের বোল। রঙিন কাপড় দিয়ে বানানো গেটের সামনে ছাড়া রয়েছে অসংখ্য জুতো। ভিতরে খোলকরতালের সাথে চলছে উদ্বাহু নৃত্য। পাশের দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করি আমরা। সিঁড়ির নীচে জুতো খুলে, সোজা দোতলায়। সেখানেই সিংহাসন আলো করে বসে আছেন তিনি, আসল নাড়ুগোপাল। পোশাকি নাম স্বস্তিক। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, নধর কান্তি, পরণে মেরুন ধুতি আর তসররঙা পাঞ্জাবি। শুভাশিস বা ওর গিন্নীর কোন বাধানিষেধ নেই, যে পারছে গিয়ে কোলে নিচ্ছে ছোট্ট ছানাকে। তারপর আশ মিটিয়ে চটকাচ্ছে। ফলতঃ তিনি যে বেশ বিরক্ত অচীরেই উচ্চঃস্বরে কেঁদে জানান দিলেন। 


ওই অবস্থাতেই কে যেন আমার কোলে দিতে এসেছিল তাঁকে। বললাম, আগে ওর ধড়াচূড়া খুলে নির্ভার করো বাপু, ফাঁক তালে খানিক চটকেও দিলাম। কি নরম পেটু আর কি মসৃন গা। কি মিষ্টি একটা গন্ধ গায়ে। নির্ভার হয়ে, দেখতে দেখতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন মায়ের কোলে। 


গোবর্ধনধারী এসেছেন মানেই নিরামিষ ভোজন। গোবর্ধনধারী যখন আসেন সঙ্গে পাঁচক ঠাকুরও নিয়ে আসেন। প্রয়োজনে যারা হাজার বারোশো নিমন্ত্রিত লোকেরও রান্না করে দেয়। উনি এলে বিনা নিমন্ত্রণেও সেখানে ভিড় জমায় ভক্তবৃন্দ, মাটিতে পাত পেড়ে সেবন করে প্রভুর প্রসাদ। ঠাকুরের মাহাত্ম্য এমনি, যে যতই লোক আসুক না কেন,ভোগ কোনদিন কম পড়ে না। আমাদের জন্য যদিও চেয়ার টেবিলের সুবন্দোবস্ত। গোবর্ধনধারীর প্রিয় খাদ্য,' বিছা কলা', অর্থাৎ বীজ সমেত কাঁচা কলা। রাস্তায় কোথাও যদি বিছা কলার কাঁদি দেখতে পান উনি, তাহলে নাকি এমন লোভ দেন যে পালকি প্রবল ভারী হয়ে যায়, আর তাঁকে নড়ানোই যায় না। মাটির মালসায় করে এনে পাতে পাতে দেওয়া হল বিছা কলার তরকারি। তার সাথে বেগুনি, পোলাও আর চানা পনীর। তারপর আসে ভাত। এরা বলে অন্ন। সাথে শুক্ত, গরম মুগের ডাল, নানা রকম তরকারী, চাটনি, পরমান্ন, রসগোল্লা, মিষ্টি দই ইত্যাদি। 


 খাওয়া যখন প্রায় শেষের পথে, রঞ্জিত বলে, "ম্যাডাম মাইকে যার হরিনাম সংকীর্তন শুনছেন, ওটা কার গলা বলুন দিকি?" সবে পায়েসটা মুখে দিয়েছি, এমন সময় এই ধরণের বদখত প্রশ্ন কেউ করে। কান করে শুনে দেখলাম,গলাটা চেনা চেনা লাগছে বটে। শান্তনু পাশ থেকে ফস করে বলে ওঠে, " ম্যাডাম চঞ্চল দা কেমন গান গাইছে শুনতেছেন। গান গাইতে গাইতে কি নাচ নাচছে ম্যাডাম। একবার দেখে আসুন।" 


জীবন্ত বালগোপালকে কোলে নিয়ে চঞ্চলের গান শুনলাম, নাচ দেখলাম। আর দেখলাম গোবর্ধনধারীকে। অবশেষে দর্শন দিলেন তিনি। আশ মিটিয়ে দেখলাম,  অনুমতি নিয়ে গুটি কয়েক ছবিও তুলে নিলাম। কে জানে আবার কবে দেখা হয়। এবার প্রসাদ বগলে আপিসে ফেরার পালা। আমাদের জন্য আত্মত্যাগ করে আপিস সামলাচ্ছে তিন মহারথী, তাদের কথাও তো ভাবতে হবে।


অনির ডাইরি ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


বেশ কিছুদিন আগের কথা, পাশের অফিসের জনৈক অফিসারকে ফোন করেছি কিছু দরকারে, ফোন ধরেই কেঁদে ফেললেন ভদ্রলোক। রীতিমত থতমত খেয়ে গেলাম আমি, বদমেজাজী, মুখরা বলে আমার প্রচুর বদনাম, কিন্তু ভদ্রলোককে তো এখনও পর্যন্ত, " হ্যালো, অমুক বাবু-" ছাড়া তো কিছুই বলিনি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে রইলাম খানিকক্ষণ, নিজেকে সামলে ভদ্রলোক বললেন, " ম্যাডাম আমি অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছি। বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে -"। ঠিক আছে, সাবধানে যান ছাড়া আর কিছু বলতে পারলাম না। পরে শুনলাম, ভদ্রলোকের নববিবাহিতা কন্যা সন্তানসম্ভবা হয়েছিল, স্থানীয় ডাক্তারের পরামর্শে X-ray করিয়ে সর্বনাশ ঘটে গেছে। মাসখানেক পর বলতে গিয়েও ভিজে উঠছিল ওনার চোখের পাতা। " টুইনস ছিল ম্যাডাম। দুটোই ছেলে। মেয়ে আমায় সব বলে আর এটা বলল না। জাহিল (অশিক্ষিত) অসভ্য পরিবার, আমার মেয়েকে এমন হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল, সব শেষ করে দিল ম্যাডাম। সব শেষ করে দিল।" 


কি বলব বুঝে উঠতে পারি না। সেদিন আমার চেম্বারে বসেই কথা হচ্ছিল। ভদ্রলোক, আমি ছাড়াও উপস্থিত ছিল এক ইন্সপেক্টর। পরে ইন্সপেক্টর সাহেব আমায় আলাদা করে বললেন," এটা খুবই দুঃখের ম্যাডাম। কিন্তু আজও যে কত জায়গায় এটা হয়। অমুককে চেনেন তো, ওর সাথেও হয়েছিল। " এবার যার কথা হচ্ছে, সেই ছেলেটি আমাদেরই এজেন্ট। অবস্থাপন্ন, হাসিখুশি, দিলখোলা ছেলে। হতবাক হয়ে যাই, তার সাথেও এমন হয়েছে? ইন্সপেক্টর সাহেব বলেন, "হ্যাঁ ম্যাডাম। কি আর বলি। অন্য কোন সমস্যা হচ্ছিল হয়তো, তমলুকের নামি ডাক্তার, X-ray করতে বলল -। ব্যাস, ওখানেই শেষ। পরে জানা গেল ছেলে ছিল। " ছেলে হোক বা মেয়ে, সন্তান তো সন্তানই। সান্ত্বনার কথা এটাই যে ছেলেটির আগে থেকেই যমজ বাচ্ছা আছে। দুটোই মেয়ে। ছবিও দেখেছি তাদের বাবার ফোনে। গর্বিত বাবা নিজেই দেখিয়েছিল। তাও, এ ব্যথা যে কি ব্যথা। পৃথিবীর মর্মান্তিকতম ব্যথা। 


এবছর পুজোর আগে, হঠাৎ করে ভাইরাল ফিভারে পড়লাম। যথারীতি শ্রীমতী তুত্তুরী বয়ে এনেছিলেন ইস্কুল থেকে। প্রথমে তাঁর হল, ওই অবস্থায় তাঁকে জড়িয়ে আদর করে, হামি খেয়ে আমিও বাঁধালাম। জ্বর বাঁধালে বাচ্ছা গুলো যেন পাঁচ গুণ মিষ্টি হয়ে যায়, আর আমার সংযম বরাবরই কম। শ্রীমতী তো দুদিনে সুস্থ হয়ে দৌড়াতে লাগলেন, আমি আর উঠতেই পারি না। প্রতিটা লক্ষণ চিৎকার করে বলে, "কোভিড হয়েছে বাপু তোমার। অন্য কিছু লয়।"  তীব্র জ্বর আর গা-হাত-পা ব্যথায় কাতর হয়ে শুয়ে আছি, ঝনঝন করে বেজে উঠল মুঠো ফোন। ওপাশ থেকে জনৈক সহকর্মীর সহমর্মী কন্ঠস্বর, " ম্যাডাম একটা বাজে খবর আছে -"। ছ্যাঁত করে উঠল হৃদয়, সবাই ঠিক আছে তো? ছেলেটি একরাশ দুঃখ গেলা গলায় জানালো, " অমুক দার জোড়া মেয়ের একটা কাল -"। কিঃ? শুনতে পাই না। বিশ্বাস করতে পারি না আমি।


চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেয়েদুটোর জন্মদিনের ছবি। আমাকেও নিমন্ত্রণ করেছিল ওদের বাবা। কিন্তু আগে থেকেই অন্য একজনের নিমন্ত্রণে সাড়া দেওয়া ছিল বলে যেতে পারিনি। মুখপুস্তকে ছবি দেখেছি। ফুটফুটে দুই বোন, একই রকম পোশাক পরে, একই রকম হেসে ছবি তুলেছে। তাদের একজন নেই? কি করে সম্ভব সেটা? কোন মতে জিজ্ঞাসা করি, কি হয়েছিল? জবাব আসে, নিউমোনিয়া। কলকাতার হাসপাতালও ব্যর্থ হয়েছে বাচ্ছাটিকে তার বাপমায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে।


মন চায়, ছেলেটিকে একবার ফোন করি। কিন্তু সদ্য সন্তানহারা পিতাকে কি বলব বুঝে উঠতে পারি না। কি অবস্থায় যে আছে এখন -। অনেক বার ভাবি, অনেক দিন ধরে ভাবি তাও বুঝে উঠতে পারি না। শেষে ওই ব্লকের ইন্সপেক্টর ছেলেটিকে ধরি, আমাকে একবার ওর বাড়ি নিয়ে যাবে? মুঠো ফোনেই কিছু বলে উঠতে পারিনি, মুখোমুখি কি বলব কে জানে। তবুও -। যে দিন যাবার কথা, তার আগের দিনই মুঠো ফোনে খবর এল, দ্বিতীয় বাচ্ছাটিও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। কি হয়েছে কেউ ঠিক বলতে পারল না, ইন্সপেক্টর সাহেব কেবল বললেন, " শিশু হতে পারে, ট্রমা তো ওর ও কিছু কম নয়। দুই বোন কি সুন্দর এক সঙ্গে বেণী দুলিয়ে স্কুল যেত, খেলাধুলো করত -"। সত্যি বড়দের কষ্টের কথা ভাবতে গিয়ে বাচ্ছাটির কথা তো আমরা ভুলেই গেছি। 


যাই হোক, হে ঈশ্বর, এটা যেন সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। অভাগা বাবা মাকে আর যাতনা দিও না প্রভু। বাচ্ছাটা সুস্থ হয়ে ওঠে অচিরেই, কিন্তু আমাদের আর ওদের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠে না। দেখতে দেখতে এসে যান দশভূজা। পুজোর ছুটির পর কটা দিন আপিস তারপরই আমাদের দীপাবলী। আপিস সেজে ওঠে আলোকমালায়, ভিড় জমে ওঠে লোকজনের। সম্মিলিত আনন্দে খুশিতে গরীব আপিস আমার যেন ঝলমলিয়ে ওঠে। এক ফাঁকে ওই ব্লকের ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করি, সেই ছেলেটির কি খবর? ইন্সপেক্টর সাহেব খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেন, " আজ আসবে কিনা, কিছুতো বলেনি ম্যাডাম। দাঁড়ান ফোন করছি -"। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে ছেলেটির কন্ঠ, "হেলো"। ইন্সপেক্টর সাহেব বলেন, " আপনি কি আসছেন? ম্যাডাম খোঁজ নিচ্ছেন।" সদ্য ইন্সপেক্টরটিকে অ্যাপ্রাইজাল দিয়েছি, আমি কাউকে খারাপ নম্বর দিই না। হাঁড়ি উল্টে নম্বর দিই। একেও দিয়েছি, আজ মনে হচ্ছে কেন দিলাম। ব্যাটাকে ভেরি পুওর দেওয়া উচিৎ ছিল। একজন সন্তান হারা পিতাকে এই অনুষ্ঠানে আসতে বলার ধৃষ্টতা আমার আছে? রেগে ফোনটাই কেড়ে নিই ব্যাটার কাছ থেকে। বলি, " আমি তোমাকে একবারও না আসার জন্য খুঁজিনি বাবা। জাস্ট জানতে চেয়েছি তুমি কেমন আছ।" 


ছেলেটির দরাজ গলা ভেসে আসে মুঠোফোনের ওপাশ থেকে,"আমি আসছি ম্যাডাম। সিঁড়িতে।উঠে আপনার চেম্বারে যাচ্ছি।" বরাবরের মতোই হাসি মুখে প্রবেশ করে ছেলেটি। এর ওর পিছনে লাগে সামান্য। সবই বড় বেশি স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকত্ব বড় বেশী আরোপিত, বড় বেশী করুণ। বড় বেশী অস্বাভাবিক। একগাল হাসি নিয়ে আমার উল্টো দিকে বসে ছেলেটি। চুপ করেই থাকি দুজনে। ঘরে আগে থেকেই উপস্থিত দুজন ইন্সপেক্টর, একজন CKCO, এক পিওন সবাই নির্বাক। মাথা নীচু করে যে যার কাজ করে যায়। 


আমিই নীরবতা ভঙ্গ করি, জানাই অনেক বার ভেবেছি এই দুর্দিনে একবার ছেলেটির বাড়ি যাব। কিন্তু ব্যাটে বলে আর হয়নি। ছেলেটি হাসে, তারপর বলে, " আর কি করব ম্যাডাম। স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি, কিন্তু -"। এই কিন্তুর পর আর কিছু বলার থাকে না। ছেলেটি নিজে থেকেই বলে, " বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, কিছু ছিল না। কোন রোগ ব্যধি কিস্যু না। একদিন স্কুল থেকে ফিরল অল্প জ্বর আর সামান্য কাশি নিয়ে। খুকখুকে কাশি। আমি কাজে ছিলাম, ওর মা আমায় ফোন করে বলল, 'একবার ডাক্তার দেখিয়ে নাও। কাশিটা যেন কেমন লাগছে।' সাধারণত এমন হলে আমরা কি করি, বাড়িতে কাশির ওষুধ থাকেই, তাই খাইয়ে দিই।" 


নীরবে সম্মতি জানাই আমি। ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ির মেয়ে আমি, ওষুধ আর ডাক্তারে আমার এমনিতেই ফোবিয়া আছে। কাশি হলে আমার ভরসা আদা মধু আর তুলসী পাতার রস আর গরম জলে গার্গল। একেবারেই না কমলে তবে কফ সিরাপ। ছেলেটি না থেমে বলে চলে, " আমি ফেলে রাখিনি ম্যাডাম।কাজে ছিলাম, কাজ ফেলে এসে স্থানীয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছি। ডাক্তার বলল, কিছু না। কাশির আর জ্বরের ওষুধ দিল। বলল সেরে যাবে। দুয়েক দিন দেখলাম, কাশি কমছে না দেখে নিয়ে এলাম তমলুক, অমুক ডাক্তারের কাছে -"।


 তমলুকের ডাক্তার বাবুর নাম শুনেই সিকেসিও ছেলেটি কপালে হাত ঠেকায়, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, "উনি এই শহরের সেরা শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ম্যাডাম। ডাক্তার নন, সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি।" সদ্য সন্তানহারা ছেলেটি মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দেয়, তারপর বলে, " আমাদের পাড়ার ডাক্তার বাবুও সঙ্গে এসেছিলেন, বড় ডাক্তার বাবু দেখে বললেন, ' তুমি ঠিকই চিকিৎসা করেছ। শুধু সিরাপের বদলে ইনজেকশন দিয়ে দেখ।' আর আমায় কইলেন, দিন সাতেক ওষুধ চলুন, তারপর ওনাকে রিপোর্ট দিতে। সাতদিন কি ম্যাডাম, মেয়ের অবস্থার অবনতি দেখে আমি দেড় দিনের মাথায় আবার নিয়ে গেলাম মেয়েকে। 


এবার আমাদের দেখেই ওনার মুখটা হাঁড়ি হয়ে গেল। গম্ভীর ভাবে শুধু বললেন, ' অবস্থা সুবিধার বুঝছি না। একে এখনি কলকাতা নিয়ে যাও।' বিশ্বাস করবেন নি ম্যাডাম, আমি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি। শুধু কচির মাকে ( তমলুকে ছোট বাচ্ছাদের/ সন্তানকে আদর করে কচি বলা হয়) বললাম দুটো জামা প্যাক করে নাও, আর একজন আত্মীয়কে নিলাম যে এইসব হাসপাতালে কথা বলা, ছুটা দৌড়া (দৌড়াদৌড়ি) করা ভালো পারে। ব্যাস সোজা শিশুমঙ্গল। সেখানেও কেউ খারাপ কিছু বলছে না। মেয়েও দিব্যি কথা বলছে আমাদের সাথে -। " আরও অনেক কিছু বলে চলে ছেলেটি, কেমন করে শিশুমঙ্গল থেকে ছাড়িয়ে কলকাতার মূল্যবানতম হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সেখানেও কেমন স্বাভাবিক ছিল মেয়ে। আজও কানে বাজছে ছেলেটার কথা, " এত বুদ্ধিমান ছিল মেয়েটা কি বলব। আর তেমনি শৌখিন। আর কটা দিন পরই ওর জন্মদিন ছিল। ফ্লিপকার্ট এ জামা অর্ডার করেছিল নিজেই। ওই অবস্থাতেও বলছে, ' বাবা তুমি, মা সব তো এখেনে, আমার জামাটা যদি দিয়ে আসে আজ -'! আমরা ততক্ষণে জানি ও আর কয়েক ঘণ্টা মাত্র। ডাক্তার এবার ভেন্টিলেশনে ঢোকাবে -"। 


শুধু আমি নই, ঘরে উপস্থিত প্রতিটা লোক যেন অন্তঃস্থল থেকে কেঁপে ওঠে। এই দিন, এই মুহূর্ত যেন চরম শত্রুকেও না দেখতে হয়। নিজেকে সামলে নেয় ছেলেটা, বলে, "আমি জোর করেই রাস্তায় বেরিয়েছি ম্যাডাম। কাজে মন দেবার চেষ্টা করছি। কিন্তু বাড়ির যা অবস্থা। একদিকে আমার মা, একদিকে আমার বউ। আমি যে কাকে দেখি -। দুজনেই কেবল কাঁদে। সারাদিন শুয়ে থাকে আর কাঁদে।" বেশ খানিকক্ষণ নীরব থেকে ছেলেটি আবার বলে ওঠে, "তবে একজন কাঁদে না ম্যাডাম। একদিনও কাঁদেনি। দুজনে তো একসঙ্গেই থাকত, এত ভাব ছিল দুজনের। অথচ সে চলে যাবার পর, এ যেন হঠাৎ করে কি বড় হয়ে গেল। রোজ রাতে ওকে জড়িয়ে ওর মা আর আমি কাঁদি। খুব কাঁদি। ও নীরবে আমাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। মাথায় বিলি কেটে দেয়। একটি বারও তার নাম করে না। আমি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ' আমরা কেন কাঁদি জানিস?' বলেছিল, ' জানি তো। বনু নেই। তার জন্য তোমাদের মনে খুব দুঃখ।' বললাম, ' তোর দুঃখ হয় না, বনু যে আর কোনদিন ফিরে আসবে না?' ওই টুকু মেয়ে কি বলল, জানেন ম্যাডাম, ' দুঃখ হয় তো। কিন্তু আমার কি কাঁদার সময় আছে। আমায় যে শক্ত থাকতেই হবে, তোমাদের জন্য। নইলে তোমাদের সামলাবে কে?"'

Thursday, 3 October 2024

অনির পুজোর ডাইরি অক্টোবর, ২০২৪

অনির ডাইরি ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪

#অনিরডাইরি #শুভদীপাবলী #তাম্রলিপ্তকড়চা



কে জানে কোন দেবতা রুষ্ট হয়েছেন আমাদের ওপর, টাকাপয়সা তো কিছু আসেই না, উল্টে কেড়ে নেওয়া হয় যখনতখন। বিগত তিন বছরে প্রথম বার ট্রান্সফার TA র অ্যালটমেন্ট এল, ছিটেফোঁটা হলেও অ্যালটমেন্ট তো রে বাবা। মোটামুটি একটা অনুপাতে ভাগ করে সকলের TA বিলের খানিকটা রেডি করা হল। ও বাবা বিল লাগাতে গিয়ে দেখা গেল, তার থেকেও একবাটি তুলে নিয়েছে মহানগর। "এ কি হল, কেন হল, কবে হল -" প্রশ্ন করলে মহানগর একটাই কথা বলে, " জানি না তো।" 


দিন কয়েক আগে মেসেজ পেলাম হাজার পাঁচেক টাকা পাঠানো হয়েছে অফিস খাতে। পোর্টালে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম শুভাশীষ আর আমি, টাকাটা দিল কোন খাতে। যে হেড বলা হয়েছে, তাতে তো কিস্যু দেখাচ্ছে না। শেষে ক্লান্ত হয়ে শুভাশীষ বলল, " মনে হয় টাকা তুলে নিয়েছে ম্যাডাম।" এই ভাবে আপিস চলে মাইরি? 


সামনেই কালীপুজো-দীপাবলী। গরীব আপিস বলে শখ সাধ থাকবে না? দীপাবলী এলেই আমরা অফিসটাকে সাজাই। আলমারির মাথা থেকে ঝেড়েঝুড়ে নামানো হয় আলোর মালা। লেবার আপিসের সস্তাতম আলোক মালা। ফি বছরই তাঁদের কেউ না কেউ পটল তোলেন, আর আমাদের রবি বাবু  টেস্টার, স্ক্রুড্রাইভার ইত্যাদি সহযোগে নেমে পড়েন মৃতসঞ্জীবনী সুধা সংযোজনে। বিভিন্ন কাজে আসা অসংগঠিত শ্রমিক বা তাদের পরিবার বর্গ, ট্রেড ইউনিয়নের লোকজন থমকে দাঁড়ায় রবির কর্মতৎপরতা দেখে। ছুটে আসে, উড়ে আসে নানা অভিমত, নানা বিশেষজ্ঞ মতামত, শেষ পর্যন্ত অবশ্য আপিস তথা রবির মুখোজ্জ্বল করে ঝলমলিয়ে ওঠে প্রতিটা টুনি। 


দীপাবলী হল রং আর আলোর উৎসব। তিন বছর আগে, হুগলী থেকে বদলী হয়ে এসে যখন শুধিয়েছিলাম, তোমরা রঙ্গলি বানাও না। হতবাক হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া জনগণের ইদানিং উৎসাহ দেখে কে? কিন্তু বানাবে কি করে, রঙ কি আর কিছু অবশিষ্ট আছে? তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায় না কিছু। উৎসাহের আতিশয্যে শান্তনু বলে, " রং কিনে লিয়ে পালিয়ে আসব ম্যাডাম। ক প্যাকেট আনব শুধু বলেন?" পালিয়ে আসব শুনে অন্য কিছু ভাবেননি যেন। এই মহকুমার লোকজন ঐ ভাবেই কথা বলে। প্রথম প্রথম আমিও ব্যোমকে যেতাম, যখন জনগণ বলত, " ম্যাডাম আজ হাওড়া যাবেন নাকি? তাইলে আমিও আপনার সাথে পালিয়ে যেতাম।" মনে মনে বলতাম, কিন্তু আমি মোটেই তোমার সাথে পালাতে আগ্রহী নই বাপু।


আলো হল,রং হল, এবার আসল জিনিস। ভোজন। বিভিন্ন ব্লক, পুরসভা থেকে আসবে আমাদের কালেক্টিং এজেন্ট, SLO রা। যদিও আপিস শেষের অনুষ্ঠান, তাও কিছু তো খাওয়াতে হবে। শুকনো মুখে দিওয়ালি হয় নাকি?এদিকে তো ভাঁড়ে মা ভবানী।ধন্য  হক বাবুর অধ্যবসায়, ক্যান্টিনকে শেষমেষ ধারে টিফিন দিতে রাজি করিয়েই ছাড়লেন। যৎসামান্য টিফিন, কোয়ার্টার পাউন্ড পাউরুটি সেঁকে সামান্য মাখন মাখিয়ে, ওপরে অল্প একটু চিনি ছড়িয়ে দেবে। সাথে একটা করে সিঙ্গাপুরী কলা আর ডিম সিদ্ধ। আমরা ওতেই খুশি। 


দিন কয়েক আগে হঠাৎ মনে হল মিষ্টি তৈরির একটা প্রতিযোগিতা করলে কেমন হয়? মুঠো ফোন খুললেই ভেসে আসছে না না ধরণের মিষ্টি তৈরির ভিডিও, আমরাও কি পারি না কিছু বানাতে? যে যা পারবে তাই বানাবে, যতটুকু পারবে, তাই বানাবে। শর্ত একটাই নিজেকে বানাতে হবে। মেয়েরা তো নিজেরাই পারবে, ছেলেদের ও নিজেদেরই বানাতে হবে, মা বা বউয়ের সহযোগিতা ব্যতীত। 


মহকুমার গ্রুপে একটা পোল বানিয়ে বললাম, ভোট দাও দিকি, কতজন রাজি আছ। রাজি না থাকলেও নিঃসঙ্কোচে জানাও। সংখ্যা গরিষ্ঠ যা চাইবে তাই হবে। প্রথম ভোট অবশ্যই আমি দিলাম। "Yes"। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভোট দিল শান্তনু। ব্যাটা দুটো নম্বর থেকে দুবার ভোট দিলে। তৃতীয় ভোট শুভাশীষ। শেষ পর্যন্ত শতাধিক জনের গ্রুপে ভোট পড়ল ১৭টা মাত্র। সবই হ্যাঁ। না কেউ দিল না, শান্তনু একগাল হেসে বললে, "আপনার ভয়ে নির্ঘাত না'য়ের বোতাম টেপার সাহস হয়নি কারও"। 


দেখতে দেখতে এসেই গেল দীপাবলী। আর মাত্র ৪৮ ঘণ্টা, তারপরেই গোটা আপিস জুড়ে ফুটে উঠবে হরেক রঙের আল্পনা। ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি যাচ্ছি, শান্তনু এসে বললে, " ম্যাডাম একটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে।" আতঙ্কিত হয়ে জানতে চাই, কি আবার ভুল করলাম আমরা। শান্তনু বলে, " হায়, হায় ম্যাডাম, আজ তো ডিএম আপিসে বিজয়া সম্মিলনী। সবাইকে বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছে। আমরা জানিইনি। বেলা দুটো থেকে তিনটে নাকি কুপন দিছে। এখন জানতে পেরে জহর বাবু গেছেন, যদি দেয়।" 


রেগে আগুন হয়ে ফিরে এলেন জহর বাবু, "সবাই কুপন নিছে, তোমরা কি তখন ঘুমাইছিলে? ওরা কইছে সব আপিসে কুপন দিয়ে গেছে। চঞ্চল,শান্তনু, নন্দন, রবি, রঞ্জিত, বেদজ্যোতি সমস্বরে প্রতিবাদ জানায়, কই এই আপিসে তো কেউ কুপন দিতে আসেনি। যা হবার হয়ে গেছে, শান্তনু আর নন্দনকে বলি, তোমরা একবার গিয়ে বলো। জহর বাবু হাজার হোক অবসরপ্রাপ্ত নাইট গার্ড গুছিয়ে বলতে পারেননি হয়তো। তোমরা গিয়ে বলো, কুপন পাওনি। সবাই তো মুখ চেনা, সবাই তো পরিচিত, নিশ্চিত পেয়ে যাবে। 


মুখ কালো করে ফিরে আসে আমার ছেলেরা। "দিল নি ম্যাডাম। কুপন ছাড়া দিবেনি। শুধু একটা দিয়েছে আপনার জন্য।" ধুৎ আমার জন্য, তোমরা খেতে পাচ্ছ না, আর আমি খাব? ওটা সবাই ভাগ করে খেয়ে নাও। আর কুপন কে দিয়েছে?  সে/তিনি কোথায়? তার নম্বর আছে? সবাই মিলে নিরস্ত করে, "ছেড়ে দিন ম্যাডাম। এক প্যাকেট বিরিয়ানির জন্য -"। আমারটাও কেউ ভাগ নেয় না। বলে তুত্তুরির জন্য লিয়ে যান ম্যাডাম। আপনি আছেন, আজ নয়তো কাল, কিছু না কিছু ব্যবস্থা আমাদের হয়েই যাবে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরি, ইশ যদি কোথাও কিছু টাকাপয়সা থাকত -। 


ঠিক ৪৮ ঘণ্টার মাথায় যখন উপচে পড়ছে আমার আপিস হরেক রকম মিষ্টিতে,  ১৭ জন ভোট দিলেও অন্তত ৩৫/৪০ জন বানিয়ে এনেছে মিষ্টি। পায়েসই এসেছে গোটা পাঁচেক কৌটো, কেউ বানিয়েছে সুজির বরফি, তো কেউ রসমালাই,কেউ মালপোয়া, কেউ সন্দেশ কেউ কলাকান্দ, কেউ ছাপা, কেউ মিহিদানা, কেউ বোঁদে। খেজুর আর ড্রাই ফ্রুট দিয়ে কি অসম্ভব ভালো লাড্ডু বানিয়েছে শুভাশীষ, তমলুকের জয়ন্ত বাবু নারকেল নাড়ু পাকিয়ে এনেছেন এক বালতি।  মনে হল, দাড়ি বুড়ো যথার্থই লিখে গেছেন, "আমার ভাণ্ডার আছে ভ’রে, তোমা সবাকার ঘরে ঘরে "। বদলির চাকরী আমার, আমরা হলাম পরিযায়ী পাখি, আজ এখানে, কাল না জানে কোথায়। যেখানেই থাকি না কেন, অক্ষয়, অবিনশ্বর হোক এই মুহূর্ত গুলো। শুভ হোক দীপাবলী। আলোয় রঙে মিষ্টত্বে উপচে যাক সকলের জীবন

অনির পুজোর ডাইরি ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪

#এলেম_মোগলির_দেশে পর্ব -৫

#অনিরডাইরি 


বিলাসপুর থেকে ট্রেন ছাড়ল রাত তখন দুটো। জনা দুয়েক ঢুলন্ত যাত্রী উঠে টলতে টলতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। "যে লোক গুলো যাবে বলে এসেছিল, তারা নির্ঘাত লেট দেখে বাড়ি ফিরে গেছে," আমার উল্টো দিকের সিটে বসতে বসতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে শৌভিক। ঐ চূড়ান্ত বিরক্তিকর পরিস্থিতিতেও হেসে ফেলি আমরা। হিসেব মত তুত্তুরীর-আমার আপার-লোয়ার আর শৌভিকের সাইড লোয়ার বার্থ। যেহেতু কামরার অধিকাংশ সিটই ফাঁকা, তাই সারাদিন ও আমাদের সাথেই ছিল। রাতে শোবার সময় কেবল নিজের আসনে চলে গিয়েছিল। বিলাসপুর থেকে কেউ উঠল না দেখে আবার "আসিছে ফিরিয়া"।


অন্ধকার কামরায় মুখোমুখি দুটো সিটে বসে থাকি আমরা। এটা আমাদের দ্বিতীয় বিনিদ্র রজনী। ঘুমাতে কেউ নিষেধ তো করেনি, কিন্তু ঘুম না এলে কি করি? বাতানুকুল কামরার মোটা কাঁচের জানলা ভেদ করে ঢুকে আসছে কৃষ্ণ প্রতিপক্ষের চাঁদের স্নিগ্ধ জোছনা। জানলার বাইরের ঝোপঝাড়, গাছপালা, দিগন্ত বিস্তৃন মাঠ, টিলা সব কিছুই যেন চুনকাম করে দিচ্ছে কেউ। অনুভব করতে পারলে দমবন্ধ করা সেই সৌন্দর্য। বেশ খানিক ক্ষণ বুঁদ হয়ে বসে থাকি আমরা। তারপর হতাশ গলায় শৌভিক বলে, "একদিনের হোটেল ভাড়া, সাফারির পারমিট, সব বরবাদ। জিপসির ভাড়া ওরা ফেরৎ দেবে, পারমিটটা আর ক্যান্সেল করা হয়নি। বারো ঘণ্টা আগে করতে হত। ভাবছিলাম যদি সাতটা, সাড়ে সাতটাতেও পৌঁছাতে পারি -"। 


আরও কিছুক্ষণ কাটে, তারপর ইতস্তত করে শৌভিক বলে, "অন্য কোন সাফারির স্লট ফাঁকা আছে কি না দেখব?" অত রাতে, চন্দ্রলোকিত জনশূন্য প্রান্তরের বুক চিরে ছুটে চলা ট্রেনে বসে নতুন করে খোলা হয় ওয়েবসাইট। সাকুল্যে তিনদিনের ট্রিপে বুক করা ছিল চারটে সাফারি। আজ সকাল- বিকাল আর আগামী কাল সকাল- বিকাল। পরশু প্রাতরাশ সেরে আমাদের নাগপুর ফিরে আসার কথা। ফেরার পথে আশেপাশে কিছু দর্শনীয় স্থান দেখে, রাতটা হোটেলে কাটিয়ে তরশু   সকাল সাতটার ফ্লাইট ধরে কলকাতা। কলকাতা থেকে কাঁথি ফিরে দ্বিতীয়ার্ধে অফিস। এত টাইট শিডিউলের মধ্যে আর একটা সাফারি ঢোকানো বেশ চাপের। কিন্তু আমার বর জেদ ধরল, " চারটে সাফারি করতে এসেছি, চারটেই করে যাব।"


মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশের ৭৫৮ বর্গ কিমি জুড়ে বিস্তৃত পেঞ্চ অভয়ারণ্যে প্রবেশের জন্য উভয় রাজ্যেই নির্দিষ্ট করা আছে কিছু প্রবেশ দ্বার। যার মধ্যে কিছু দ্বার খোলে কোর এরিয়ায়, যেমন  তুরিয়া, জামতারা আর কর্মঝিরি। আর কিছু বাফার যোনে, যেমন রুখড়, মসুরনালা, খোয়াসা, কুম্ভপানি  এবং তেলিয়া। যে গেটে যত বেশি বাঘ দেখা যায়, সেই গেট ততো বেশি বিখ্যাত। 


আমাদের হোটেল তুরিয়া গেটের পাশেই। কিন্তু তুরিয়া গেটের এমন সুনাম যে বহু আগে থেকে সব পারমিট বুক হয়ে থাকে। সেই মহা মূল্যবান পারমিট আমরা হারিয়েছি ভারতীয় রেলের সৌজন্যে। নতুন করে বুক করতে গিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে শেষে খোয়াসা গেটে পাওয়া যায় সুযোগ। কোর নয়, বাফার। কি আর করা।টাকাপয়সা লেনদেন সম্পন্ন হবার পর কেমন যেন নির্ভার বোধ হয় উভয়েরই। নে দুরন্ত, যত খুশি লেট কর এবার। 


 পাক্কা এগারো ঘন্টা লেট করে, অবশেষে বেলা আটটা নাগাদ নাগপুর পৌঁছায় ট্রেনটা। মহারাষ্ট্র তথা ভারতের অন্যতম প্রাচীন  এবং ভয়াবহ ব্যস্ত স্টেশন নাগপুর (এনজিপি)। কলকাতা-মুম্বাই আর দিল্লী-চেন্নাই রেলপথের জংশন হল নাগপুর। নাগপুরে প্রথম রেল লাইন স্থাপিত হয় সেই ১৮৬৭ সালে। মুম্বাইযের সাথে রেলপথে যুক্ত হয় নাগপুর। তদানীন্তন ভারতের রাজধানী তিলোত্তমা কলকাতার সাথে অবশ্য রেল পথে সংযুক্ত হতে লাগে আরো চোদ্দ বছর। তখন অবশ্য এই স্টেশনটি ছিল না। বেলে পাথরে তৈরি অনুপম স্টেশন বাড়িটি নাগপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান ও বটে। ইতিহাস বলে ১৯০৬ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়,  ১৯২৫ সালে স্টেশনটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন সেন্ট্রাল প্রভিন্সের ছোটলাট।  


কাল রাতের পর আর ড্রাইভারকে ফোন করেনি শৌভিক। সে ব্যাটা আর আছে, না গেছে কে জানে। ঈশ্বরের নাম নিয়ে ফোন করে দেখা গেল, ছেলেটি এখনও আমাদের জন্য প্রতীক্ষারত। তবে সারা রাত স্টেশনে দাঁড়াতে দেয়নি বলে বাইরে কোথাও আছে। বিনীত ভাবে বলল, একটু স্টেশনের বাইরে চলে আসুন। কালো রঙের সেডান গাড়িটি অচীরেই আমাদের নিয়ে রওনা দিল মোগলির জঙ্গলের উদ্দেশ্যে।


৪৪ নং জাতীয় সড়ক বরাবর নাগপুর জংশন স্টেশন থেকে পেঞ্চ অভয়ারণ্যের তুরিয়া প্রবেশদ্বারের দূরত্ব প্রায় ৯৪ কিলোমিটার। সময় লাগবে ঘন্টা দুয়েক। নাগপুর ছড়িয়ে কিছুটা আসার পরপরই শুরু হয়ে যায় জঙ্গল। মধ্যপ্রদেশের সিওনি আর চিন্ডওয়ারা জেলা জুড়ে বিস্তৃত এই জঙ্গলের বেশ কিছুটা অংশ পড়েছে মহারাষ্ট্রে ও। মূলতঃ রুড়িয়ার্ড কিপলিং এর জঙ্গলবুকের পটভূমি হিসেবেই খ্যাত পেঞ্চ। যদিও ইতিহাস বলে, কিপলিং এখানে কখনও আসেননি। 


গল্প শোনাতে শোনাতে নিয়ে যায় ড্রাইভার ভাইটি। অরণ্য তথা বন্যপ্রাণ বাঁচাতে, রাজপথ এখানে যত্রতত্র উঠে গেছে উপরে। অর্থাৎ ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যখন ছুটছি আমরা, নীচে তখন নির্বিঘ্নে খেলা করছে বন্য প্রাণীর দল। তবে সে আর কতটুকু। রাস্তা নীচু হলেই ঘটে যায় নানা দুর্ঘটনা। কিছুদিন আগে খেলতে খেলতে রাজপথে চলে এসেছিল একটি ব্ল্যাক প্যান্থার শিশু। বাচ্ছাকে বাঁচাতে ছুটে আসে মাও। বাচ্ছাটি বেঁচে গেলেও, চলন্ত গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারায় মা'টি। শুনে মন খারাপ হয়ে যায়। ব্ল্যাক প্যান্থার এমনিতেই


দুর্লভ। 

(চলবে)  


আগের পরের পর্বের লিঙ্ক কমেন্ট বক্সে

অনির পুজোর ডাইরি ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪

#এলেম_মোগলির_দেশে পর্ব - ৪

#অনিরডাইরি 



ভোর পৌনে ছটার ট্রেন গড়িমসি করে ছাড়ল বেলা বারোটা পঁয়ত্রিশে। ১২২২২ নং হাওড়া পুণে দুরন্ত। হাওড়া থেকে ছাড়ে কেবল হপ্তায় দুই বার, বৃহস্পতি আর শনি। হাওড়ার পর চতুর্থ স্টেশনই নাগপুর। মাঝে কেবল থামে টাটানগর, বিলাসপুর আর রায়পুরে। স্টেশন কম বলেই, টেনে দেবার সম্ভবনা প্রচুর। গেল বার ফেরার পথে শক্তিপুঞ্জের মত অখাদ্য ট্রেনও পাঁচ না সাত ঘণ্টা লেটকে টেনে নামিয়ে ছিল সোয়া ঘণ্টায়, আর এতো দুরন্ত। রেলযাত্রী দেখাচ্ছে নাগপুরে সম্ভাব্য অবতরণ রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ। ড্রাইভারকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে শৌভিক। হোটেল থেকেও ফোন করে জেনে নিয়েছে, আমরা কটা নাগাদ পৌঁছাচ্ছি ইত্যাদি। 


ট্রেনের চাকা গড়ানোর সাথে সাথেই এসে গেছে ভাঁজ করা খবরের কাগজ। তিনজনের জন্য তিনটি এক লিটারের জলের বোতল। দূরন্তে পরিবহনের সাথে খাওয়া ফ্রি। কেটারিং মূল্য টিকিটেই ধরা আছে। বেলা দুটো নাগাদ লাঞ্চ এল, নর্মাল ট্রেনের চিকেন থালি যেমন হয় আর কি। ভাত, ডাল, চৌকো আলুভাজা, চিকেন কারি, দুটো পরোটা। শেষ পাতে আইসক্রিম। খাবার গুণগত মান আমাদের বেশ ভালো লাগল। ট্রেনটা বেশ পরিচ্ছন্ন ও। বার বার এসে সাফাইওয়ালারা সাফ করে যাচ্ছে। শৌচালয়ে জল, সাবান সব যথাযথ। সুগন্ধী স্প্রেও মারা আছে। 


যতই বলুন, প্লেনের থেকে ট্রেন আমার ঢের বেশি প্রিয়। ট্রেন মানেই স্মৃতিমেদুরতা। কেমন সুন্দর কু ঝিকঝিক করতে করতে ছোটে বলুন দিকি। আজকের ট্রেনটা যেন বড্ড ফাঁকা।  খাবার দিতে আসা লোকগুলো বলছিল গোটা কামরায় নাকি মাত্র তেরো জন। এটা ট্রেন না নিদ্রাপুরী ! ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, মাড় দেওয়া ধপধপে সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে, শৌভিকের ডাকে উঠে দেখি, চা দিয়ে গেছে। কাগজের কাপে সিল করা টি ব্যাগ, গুঁড়ো দুধ, চিনির পাউচ আর স্টারার। সাথে ট্রে ভর্তি বিস্কুট, সল্টেড ক্যারামেল পপকর্ন, চিঁড়ে ভাজা। 


খাবার দেখে আমার মুখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠলেও শৌভিকের মুখে অন্ধকার গভীর। ট্রেন আরো ঘন্টা দেড়েক লেটে চলছে। নাগপুরে পৌঁছানোর সময় আপাতত রাত দেড়টা থেকে পৌনে দুটো। অর্থাৎ পেঞ্চ পৌঁছাতে ভোর চারটে। সাফারি শুরু ভোর ছটায়। সাফারির জন্য জিপসি হোটেলে রিপোর্ট করবে ভোর সাড়ে পাঁচটায়। কি যে হবে। আশ্বস্ত করি আমি, তাতে কি? ঘরে পৌঁছে ব্যাগ রেখেই বেরিয়ে পড়ব। আমরা সব পারি। 


রাত দেড়টা বাড়তে বাড়তে অচীরেই রাত দুটো, আড়াইটে হয়ে তিনটে বেজে গেল। অর্থাৎ ভোর পাঁচটায় পেঞ্চ। ড্রাইভারকে প্রতি ঘণ্টায় ফোন করে আর টাইম পিছাতে থাকে শৌভিক। বেচারাকে প্রথমে বলা হয়েছিল সাড়ে নটা, সেটা এখন সাড়ে তিনটেতে এসে ঠেকেছে। সে তো গাঁইগুই করবেই। মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের কলকাতা অফিস তথা হোটেল থেকেও ফোন আসছে। তাঁরা যদিও আশ্বস্ত করেই যাচ্ছে, কোন চিন্তা নেই স্যার। জঙ্গলে সকাল সাতটা অবধি ঢুকতে দেয়।


রাত পৌনে আটটা নাগাদ শৌভিক বলল, "তোর টুইটার আছে না? একটা টুইট করবি?" প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বেড়াতে যাবার গ্রুপে পড়ি রেলমন্ত্রকে উদ্দেশ্য করে টুইট করলেই সব মুস্কিল আসান। আজ দেখাই যাক না। টুইটার থুড়ি X অ্যাকাউন্ট আমার একখান ছিল বটে, দেখলাম শ তিনেক ফলোয়ার আর প্রায় সাড়ে তিন হাজার টুইট ও আছে। কিন্তু সে তো মান্ধাতার আমলের গল্প। ইদানিং শুধু দুয়ারে সরকারের সময়ই ব্যবহার করি অ্যাকাউন্টটাকে, জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক যখন আমাদের দপ্তরের কোন ছবি টুইট করেন, সেটা রিপোস্ট করি। আর তো কিছুই করি না। শব্দের লিমিট এত কম যে টুইটারে লেখা বড় ঝামেলা। তার ওপর হ্যাশ ট্যাগ দিতে হয়। নইলে টার্গেট অডিয়েন্স এর কাছে পৌঁছায় না। 


তাও লিখলাম। আসলে শৌভিকই লিখে দিল, সেটাকে কেটে, ছোট করে  জানালাম, কোন ট্রেনে যাচ্ছি, গন্তব্য কোথায়, PNR নম্বর কত। জানালাম ট্রেন আট ঘণ্টা লেট। এই হারে যেতে থাকলে কাল সকালের সাফারি আমরা মিস করব। যেটা গোটা পরিবারের জন্য বড় যাতনাদায়ক হবে। প্লিজ একটু দেখুন না, অন্তত রাত দুটোর মধ্যেও যদি ট্রেনটা নাগপুরে পৌঁছায়।


শুধু যে টুইট করলাম তাই নয়, গুগল করে পাওয়া নম্বরে SMS করলাম। ১৩৯ নম্বরে ফোন করে রেলমদতে নালিশ ও করলাম। রেলওয়ে সেবা থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমায় জবাব দেওয়া হল, "For necessary action escalated to the concerned official." দেখতেও পেলাম, টুইটটা ফরোয়ার্ড করা হয়েছে DRM চক্রধরপুরকে। তিনিও, "kindly look into the matter" বলে টুইটটা ফরোয়ার্ড করেছেন, সিনিয়র ডিভিশনাল অপারেশনস ম্যানেজার, চক্রধরপুরকে। 


আশায় বুক বাঁধি আমরা। এত তৎপরতা কি আদৌ মিথ্যা হতে পারে! ট্রেনের গতি কি বাড়ল কিঞ্চিৎ? পর্যায়ক্রমে একবার রেলযাত্রী আর একবার টুইটার খুলি দোঁহে। সাড়ে আটটা নাগাদ রাতের খাবার দিয়ে যায়। যাবার সময় তুত্তুরীকে আশ্বস্ত করে যায় ক্যাটারিং এর লোকজন, এবেলা ও আইসক্রিম আছে। সন্ধ্যের খাবার কিছুই খাইনি আমরা, তাও বিন্দু মাত্র ক্ষুধার উদ্রেক হচ্ছে না। সব কেমন যেন শান্ত, নিস্তব্ধ। ট্রেনটা ও আবার ঝিমিয়ে পড়েছে। নাগপুরে পৌঁছানোর সময় ও বেড়েই যাচ্ছে উত্তরোত্তর। সাতটার মধ্যেও যদি পেঞ্চ পৌঁছাতে পারি, হে ভগবান। 


কি আর বলি, ভগবান বোধহয় নিদ্রা গিয়েছিলেন, রেলমদদ থেকে জনৈকা সহায়িকা আবেগহীন কেজো সুরে ফোন করে জানালেন, " অসুবিধা কে লিয়ে খেদ হ্যায়", আমরা বহুৎ দুখিত হ্যায়। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।  টুইটার খুলি, রেল সেবাকে আবার জানাই, প্লিজ হেল্প হ্যাশ ট্যাগ ও দিই, কিন্তু -। পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে বিরাজ করে অখণ্ড নৈঃশব্দ্য। 


রাত বাড়ছে। নটা মানে চলন্ত ট্রেনে মধ্য রাত। গুটি কয়েক সহযাত্রী যাঁরা আছেন, সকলেই খেয়ে দেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছেন। আমাদের অংশটুকু ব্যতিরেকে গোটা কামরা নীল রাতবাতির আলোয় ভেসে যাচ্ছে। ক্যাটারিং এর লোকটি এসে তাগাদা দিয়ে যায়, আমরা নৈশ ভোজ না সারলে আইসক্রিম আনতে পারছে না যে। 


ট্রেনের দুলুনিতে কখন যেন চোখ লেগে গিয়েছিল, উঠে দেখি সবে বিলাসপুর পৌঁছেছে দুরন্ত। বেলা তিনটে নাগাদ পৌঁছানোর কথা ছিল যে স্টেশনে, ঘড়ি বলছে সেখানে আমরা পৌঁছালাম রাত পৌনে দুটোয়। অর্থাৎ প্রায় এগারো ঘন্টা লেট। এখান থেকে নাগপুর পৌঁছাতে আনুষ্ঠানিক ভাবেই ছয় ঘণ্টা লাগার কথা। অর্থাৎ সকাল আটটা। নাহঃ আর কোন আশা নেই।

(চলবে)

 পুজোর ডাইরি ১৬ই অক্টোবর, ২০২৪

#এলেম_মোগলির_দেশে পর্ব - ৩

#অনিরডাইরি 



কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে বেরোব আমরা। হাওড়া থেকে ভোর পৌনে ছটায় ট্রেন। কাঁথি থেকে বেরোতে হবে রাত দুটো নাগাদ। শেষ মুহূর্তের গোছগাছ এবং নৈশভোজ সেরে রাত দশটার মধ্যে শুয়ে পড়া বাধ্যতামূলক। যতটুকু রেস্ট হয়,বাকিটা গাড়িতে আর ট্রেনে ঘুমিয়ে নেব ক্ষণ। অলক্ষ্যে বোধহয় হাসছিলেন বিধাতা পুরুষ, ঠিক রাত সোয়া দশটায় মেসেজ ঢুকল, পৌনে সাত ঘণ্টা লেট আমাদের পুণে হাওড়া দুরন্ত। পৌনে ছটার জায়গায়, ট্রেন ছাড়বে বেলা সাড়ে বারোটায়। 


রেল কোম্পানির আর কি, মেসেজ পাঠিয়ে দিলেই হল। বজ্রাহত বোধহয় একেই বলে। মাথাই যেন চলছিল না, অন্তত কিছুক্ষণ। প্রাথমিক ধাক্কা কাটতেই, শুরু হল নতুন করে ব্যস্ততা। সব কিছু আবার কেঁচে গণ্ডূষ করতে হবে যে। সবার আগে প্রয়োজন গাড়িকে নিষেধ করা। রাত দুটো নয়, বেলা সাড়ে আটটায় বেরোতে হবে এবার। নিষেধ করতে হবে লতা দিকেও। ঠিক ছিল, আমাদের পৌঁছে ফেরার পথে হাওড়া থেকে লতা দিকে তুলে আনবে গাড়ি। মহকুমা শাসকের যতই লোকলস্কর থাকুক, আমাদের অনুপস্থিতিতে লতা দি'ই কেবল পারবে শাশুড়ি মাকে সামলে রাখতে। ভোর ছটা নাগাদ ইছাপুর জলের ট্যাঙ্কে দাঁড়িয়ে থাকবে যে লতা দি। লতা দি এলে ছুটি পাবে শাশুড়ি মায়ের আয়া। চেইন রিয়্যাকশনের মত হবার কথা ছিল সব কিছু, গেল সব ঘেঁটে। 


নতুন করে পর্যায়ক্রম ঠিক করে আবার যখন শুলাম, ঘড়িতে প্রায় রাত পৌনে এগারো। একটু আগেও ঝোলাঝুলি নিয়ে চৌকাঠের কাছে অপেক্ষা করছিলেন নিদ্রা দেবী, এই মুহূর্তে দূরদূরান্ত পর্যন্ত তাঁর কোন হদিশ নেই। " দূরন্ত তো, নন স্টপ, লেট ঠিক ম্যানেজ করে দেবে -" একরাশ আশা নিয়ে স্বগতোক্তি করে শৌভিক। জবাব দিই না। দক্ষিণ পূর্ব রেলের ওপর আমার ছিটেফোঁটাও ভরসা নেই। 


শৌভিক আবার বলে, ইন্টারনেটে দেখাচ্ছে রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ পৌঁছাবে নাগপুর। গাড়ি বুক করা আছে, সে তো সাড়ে নটায় এসে বসে থাকবে নাগপুর স্টেশনে। ঘর বুক করা আছে কিপলিং কোর্টে। বুক করা আছে পরদিন ভোর বেলা তুরিয়া গেটে সাফারি। সব মিলিয়ে কত টাকা যে লোকসান হবে কল্পনা করতেও কান্না পায়। " কি করি বল তো? একবার কি মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমে ফোন করি নাকি?" উঠে বসে প্রশ্ন করে শৌভিক। 


এতবার যাওয়ার জন্য সখ্য গড়ে উঠেছে কলকাতা অফিসের অনেকের সাথেই। বড় সাহেব গোছের একজনকে ফোন করল শৌভিক। রাত তখন এগারোটা। ধন্য মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের পেশাদারিত্ব। ভদ্রলোক আশ্বস্ত করলেন, " ঐ ট্রেনটা অমনিই লেট করে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। গাড়ি দরকারে সারা রাত অপেক্ষা করবে আপনাদের জন্য। শুধু ড্রাইভারের সাথে একবার কথা বলে নেবেন। সাড়ে বারোটায় নামবেন তো, মানে রাত আড়াইটে বাজবে কিপলিং কোর্টে পৌঁছাতে। তাতেও কোন চিন্তা নেই। রাস্তা একদম সুরক্ষিত। ভোর বেলা আপনার জিপসি আর প্রাতরাশ ও রেডি থাকবে সাফারির জন্য।আর যদি অন্য কিছু হয়, তাহলেও আপনি সাফারির পুরো টাকা ফেরৎ পাবেন।" খানিক পরে পেঞ্চ কিপলিং কোর্ট থেকেও ফোন করে একই কথা জানাল। "স্যার বেফিকর থাকুন। আমাদের গাড়ি দরকারে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকবে। আর রাস্তা যদিও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, কিন্তু একদম নিরাপদ।" 


কিছুটা নিশ্চিন্ত, নির্ভার হয়ে শুলাম তো বটে, হয়তো অ্যাড্রেনালিন রাশের জন্যই ঘুম আর এলো কই। রাত দুটো নাগাদ বোধহয় লেগে গিয়েছিল চোখের পাতা,শাশুড়ি মায়ের চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে পড়লাম দুজনে। কি হল আবার, যা পতনশীল ভদ্রমহিলা। প্রায় দিনই আছাড় খান। আজও তেমন কিছু --। তড়িঘড়ি দরজা খুলতেই তিনি পুত্রকে জড়িয়ে ধরে বললেন, " তোরা যাবি না বাবা? রাত আড়াইটে বাজে যে। এলার্ম দিতে ভুলে গিয়েছিলি? এলার্ম বাজে বাজে নি? " কঠোর ভাবে নিয়ম নিষ্ঠ ভদ্রমহিলা তো রাত নটার মধ্যে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন, তারপর যে এতবার ভূমিকম্প আর এতগুলো সুনামি এসে গেছে উনি তার কিছুই টের পাননি। আয়া দিদি সব জানে, বলে নিরস্ত করার চেষ্টাও করেছে, কিন্তু বৃদ্ধা তাঁর কথায় কর্ণপাত ও করেনি। পরম মমতায় মাকে জড়িয়ে ঘরে দিয়ে আসে শৌভিক, ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলে, ট্রেন লেট। কাল কখন বেরোব, কি খেয়ে বেরোব, ইত্যাদি প্রভৃতি। বাকি রাতটা বিনিদ্রই কাটে আমাদের, এক রাতে, এত বার, এত রকম ভাবে পিলে চমকালে আর নিদ্রা দেবীর কি কসুর।

(চলবে)

#এলেম_মোগলির_দেশে পর্ব - ২

#অনিরডাইরি 



শ্বশুর মশাইয়ের মৃত্যুর অব্যবহিত পরপরই কলকাতার পাট চুকিয়ে, শাশুড়ি মাকে নিয়ে যেদিন কাঁথি রওনা দিলাম, প্রিয়জন হারানোর মনোবেদনার থেকেও বেশি ছিল উদ্বেগ। এই বয়সে, বাড়ি থেকে এত দূরে কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন তো বৃদ্ধা? কলকাতার বাড়িটা ছিল ওনার প্রাণ। নিজেই বলতেন, ওনার আজীবনের স্বপ্ন ছিল, একটুকরো বাসা, যেটা হবে একান্তই ওনার। 


শ্বশুর মশাইয়ের কর্মসূত্রে ঘুরে বেরিয়েছেন জেলা থেকে জেলান্তরে। থেকেছেন কখনও ভাড়ার বাসায়, কখনও বা সরকারী আবাসনে। সরকারী আবাসনের নিয়ম হল, নতুন কোয়ার্টার যাকে দেওয়া হবে, তার স্থান হবে হয় একতলায় নয়তো চার তলায়। এরপর যেমন যেমন খালি হবে, উপরে ওঠা বা নামা যাবে। ফলে সব মিলিয়ে প্রায় তেরো বার বাসা বদল করতে হয়েছে ভদ্রমহিলাকে। এটা চতুর্দশতম বার। 


গোটা পথটা ড্রাইভারের পাশের সিটে নিশ্চুপ হয়ে বসে এসেছিলেন শাশুড়ি মাতা। মাঝে মাঝে গায়ে হাত দিয়ে ডেকে কিছু খেজুরে কথা বলছিলাম আমরা। মৃদু হাসি ছাড়া কিছু ফেরৎ আসেনি পরিবর্তে। অবশ্য তার আরও একটি কারণ হল ওনার বধিরতা। যন্ত্র লাগিয়েও তেমন ভালো শোনেন কই। কাঁথি পৌঁছে সেদিন কেবল বলেছিলেন, " বড্ড দূর।" 


ইতিপূর্বে শ্বশুর মশাইয়ের সঙ্গে যতবার এসেছেন যে ঘরে থেকেছেন, সেই ঘরেই ওনার পাকাপাকি থাকার বন্দোবস্ত। ভাগ্যে লতাদি ছিল, আমরা আসার আগেই বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় ইত্যাদি পাল্টে, ঝাড় পোঁচ করিয়ে রেখেছিল ঘরটাকে। গাড়ি থেকে ধরে ধরে নামিয়ে, গোটা চারেক সিঁড়ি ভাঙিয়ে তোলা হল বারন্দায়। এতক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে পা ফুলে গেছে, পাম্প শু টাইপ নরম জুতো কামড়ে বসেছে পায়ে। শ্রীমতী তুত্তুরী মাটিতে বসে টেনে খুলল ঠাম্মার জুতো। ঠাম্মা আপাতত এবাড়ির সবথেকে সম্মানীয় অতিথি যে। ঠাম্মা সদ্য এত বড় শোক পেয়েছে যে। 


 সবাই তটস্থ ঠাম্মাকে নিয়ে। ঘড়ি ধরে পাক্কা ছটায় ঘুম থেকে উঠে পড়ে ঠাম্মা, কোন কোন দিন পাঁচটা- সাড়ে পাঁচটাতেও ঘুম ভেঙে যায়। ছটা নাগাদ দুটো সুগার ফ্রি গুলি দিয়ে এক কাপ কালো চা আর গোটা কয়েক বিস্কুট খেয়েই স্নানে যায় ঠাম্মা। প্রথম দিন জলখাবার খেয়ে বেলা দশটায় স্নানে গিয়েছিল ঠাম্মা, সে কি কেলো। রোদের তাতে পাইপের জল গরম হয়ে গেছে ততক্ষণে, আর ঠাম্মা ভেবেছে কেউ বুঝি ওনার সুবিধার্থে গিজার চালিয়ে রেখেছে। মে মাসে গিজার? এরা কি আমায় পুড়িয়ে মারতে চায়? রেগে আগুন, তেলে বেগুন ঠাম্মাকে অতি কষ্টে যখন বোঝানো গেল ব্যাপারটা, তিনি ঠিক করলেন, এবার থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বেই সেরে ফেলবেন স্নানাদি। রোজ একবার করে নিষেধ করি আমরা, ওগো এত সকালে স্নান করো না, বুড়ো হাড়ে ঠাণ্ডা লেগে যায় যদি। জেদি বৃদ্ধা শুনলে তো - । 


স্নান সেরে, কাচা কাপড় পরে, এলো চুলে অপেক্ষা করেন প্রভাতী সংবাদ পত্রের জন্য। মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বার খানা ওনার স্নিগ্ধ রূপে যেন ঝলমল করে ওঠে। এই মধ্য সত্তরেও ফেটে পড়ে দুধে আলতা রঙ, কোমর ছুঁইছুঁই চুলে খুঁজে পেতে মেলে কিছু রূপালী তার। কাগজে চোখ বুলিয়ে ঘড়ি ধরে নটায় জলখাবার খেতে বসেন ঠাম্মা। 


দাদু ঠাম্মা যখন একসাথে আসত, ঘড়ির কাঁটার দিকে কড়া নজর রাখত দাদু। সেকেন্ডের কাঁটা এদিক থেকে ওদিক গেলেই তুলকালাম করত দাদু। এখন তিনি নেই বলে যেন ঠাম্মার কোন অমর্যাদা না হয়। স্বর্গীয় ব্যক্তিটির জীবন চক্র আবর্তিত হত যাঁকে কেন্দ্র করে, তাকে যত্নে রাখা, ভালো রাখাই বোধহয় তাঁকে সম্মান জানানোর সেরা উপায়। 


ঠাম্মার খাওয়া নিয়ে বড় দুশ্চিন্তা আমাদের। মিষ্টি খাবে না, আলু খাবে না, মাছ-মাংস-ডিম খাবে না, ভাজাভুজি খাবে না। তাহলে খাবে কি? আজীবন উনি ডাল তরিতরকারি ফেলে, ঝোলের এক পিস মাছ তুলে নিয়ে ভাত খেয়ে এসেছেন। সেই তিনিই শ্বশুর মশাই চলে যাবার সাথে সাথেই ঘোষণা করেছেন আর মাছ খাবেন না। অনেক বুঝিয়েছি আমরা, " কার জন্য মাছ ছাড়ছ? বাবার জন্য? লোকটা যে আদ্যন্ত নাস্তিক ছিল ভুলে গেলে? আর আদরের গিন্নী তাঁর শোকে মৎস ত্যাগ করেছে জানলে বৃদ্ধ কি আদৌ ভালো থাকতে পারবে?" কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। যা জেদি বৃদ্ধা। 


বেশ মাছমাংস না হয় নাই খেলে, তরকারি পাতি একটু বেশি করে খাও না বাপু। তাতেও সমস্যা, এক তরকারি দু- তিন দিন হলে খাবেন না। তরকারিতে আলু খাবেন না। আলু ছাড়া মধ্যবিত্ত বাড়ির তরকারি আয়তনে বাড়বে কি করে? ওনার মাথায় ঢুকেছে ওনার হাই সুগার। আর সুগার হলে আলু খেতে নেই। বোঝাতে বোঝাতে মাথার চুল ছেঁড়ে শৌভিক, " আরে বাবা, তোমার সুগার নেই। সুগার রিপোর্ট কারো নিল বা শূন্য আসে না। তাহলে সে মরে যায়।" বৃদ্ধা সব শোনেন, কান এঁটো করে হাসেন। কিন্তু খেতে বসে আলু স্পর্শও করেন না। খাবার বেড়ে দিতে গিয়ে যদি এক কুচিও আলু পড়ে, অমনি রেগে আগুন, তেলে বেগুন ঠাম্মা। ইদানিং আবার ধরেছেন, কুমড়ো খেলে নাকি সুগার বাড়ে। সকাল বিকাল শৌভিককে বলছেন, " একটু ডাক্তারকে শুধাস তো। কুমড়ো খাবো কি না।" 


বেশ তো আমিষ খাবে না, তরকারি খাবে না, তাহলে ডাল,পনীর, স্যালাড এসব খাও একটু বেশি করে। তাতেও নাক সিটকান তিনি। খুশি হন কেবল একটা জিনিস মেলে, মিষ্টি। আজ্ঞে হ্যাঁ। রসগোল্লা, সন্দেশ, মিষ্টি দই, আইসক্রিম এসবে তাঁর না নেই। ওসব খেলে আবার সুগার বাড়ে নাকি? জলখাবার খেয়ে উঠে আবার পড়তে বসেন ঠাম্মা। সকালের না শেষ হওয়া কাগজটা, দু চারটে সাপ্তাহিক পত্রিকা যা শুধু ওনার জন্য দিতে বলেছে শৌভিক, খুঁটিয়ে পড়েন। মাঝে একটু ঘুমিয়েও নেন সময় বুঝে, তারমধ্যেও খেয়াল রাখেন শৌভিক আর আমি বেরিয়ে গেলাম কিনা। বাড়িতে ঢোকা এবং বেরোনোর সময় ওনাকে বলে যাওয়া বাধ্যতামূলক। যদি আমরা বলতে গিয়ে যদি দেখি উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, আর না বলে চলে যাই, সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকেন বৃদ্ধা। বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে শুনতে হয়, সেই মনোবেদনার উপাখ্যান। "আমার সারাদিন কি মনখারাপ, অনিন্দিতা আমায় বলে গেল না?"  শুধু কি তাই, অফিস থেকে ফিরতে যদি একটু রাত হয়, মুঠো ফোনে ভেসে ওঠে স্বর্গীয় শ্বশুর মশাইয়ের নম্বর খানা। ফোন ধরলেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে বৃদ্ধার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর,  " তুমি ঠিক আছ তো? দেরী হবে বাড়ি ফিরতে? কলকাতা গেছ?" 


কর্মসূত্রে আমার কলকাতা যাওয়া আর শৌভিকের দীঘা যাওয়া দুই নিয়েই আতঙ্কে ভোগেন শাশুড়ি মাতা। গেলেই বাড়ি ফিরতে রাত হয় যে।  সামান্য রাত হওয়া নিয়ে যিনি দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যান, তাঁকে রেখে মোগলির দেশে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা। 


(চলবে) 


অনির পুজোর ডাইরি ১৬ই অক্টোবর, ২০২৪

#এলেম_মোগলির_দেশে পর্ব - ১

#অনিরডাইরি 



এখন অনেক রাত। মোগলির জঙ্গলের মাথায় টিমটিম করছে কৃষ্ণ চতুর্থীর ঝিমানো চাঁদ।সদ্য বানানো কফির কাপটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল শৌভিক। এখন রাত দুটো, আর আধ ঘণ্টা বাদেই রওনা দেব আমরা। গন্তব্য নাগপুরের বাবাসাহেব আম্বেদকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আমাদের ঘরে ফেরার প্লেন ভোর সাতটায়, মধ্য প্রদেশ ট্যুরিজমের কিপলিং কোর্ট রিসর্ট থেকে বিমান বন্দর পৌঁছাতে সময় লাগে মোটামুটি ঘণ্টা দুয়েক। পথের গরিষ্ঠাংশই পেঞ্চের মধ্যে দিয়ে। কোর জঙ্গল অবশ্য নয়, বাফার। তাও জঙ্গল তো বটে। 


নিকষ অন্ধকারে, পাশাপাশি দুটো বেতের চেয়ারে বসে আছি দুজনে, বারান্দার ওপারেই জঙ্গল। নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে পেঞ্চ নদী। এই জঙ্গলের জীবন রেখা। এই রাত, এই চাঁদ, এই অপার্থিব নৈঃশব্দ্য আর জঙ্গল, এ অনুভূতি অবর্ণনীয়। এই ভাবে জঙ্গলকে ইতিপূর্বে কখনও অনুভব আমরা। দুজনেরই মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ শৌভিক বলল, " নাহ্ এবার ফিরতে হবে, না?" নীরবে ঘাড় নাড়ি আমি, দেখতে পেল কি? বোধহয় না। শেষ হয়ে যাওয়া কফির কাপটা নিয়ে উঠে পড়ে শৌভিক, উঠতে উঠতে বলে, "আমরা কেমন যেন ট্যুরিস্ট থেকে ট্রাভেলার হয়ে উঠছি দিনদিন।"


ট্যুরিস্ট আর ট্রাভেলার এর মধ্যে কি তফাৎ আমার মোহগ্রস্ত মাথায় ঢোকে না। তবে এটা জানি, দুজনেই ফুল্টু তারকাটা। ওপরওয়ালা কি ভাবে যে খুঁজে খুঁজে গাঁটছড়া বাঁধে। তারকাটা না হলে কেউ এমন প্ল্যান করে? ঠিকই তো ছিল এবার পুজোয় কোথাও যাব না। তাহলে? হঠাৎ মহালয়ার দিন দশেক আগে কি যে ভূত চাপল মাথায়, কে প্রথম বলেছিল আজ আর মনে নেই, আমি না সে, শুধু মনে আছে, একজন বলেছিল, " চল মধ্যপ্রদেশ যাই"। অন্যজন তৎক্ষণাৎ এক পায়ে খাড়া হয়ে গিয়েছিল। 


যাব তো, কিন্তু যাব কোথায়? আমরা তো ইতিমধ্যেই  মধ্যপ্রদেশ চষে ফেলেছি। ফি বছর পুজোয় আমাদের একটাই গন্তব্য মধ্যপ্রদেশ।  ওঁঙ্কারেশ্বর, মহেশ্বর, মান্ডু, উজ্জয়িনী, ইন্দোর, গোয়ালিয়র, ওর্চা, চান্দেরী, ভীমবেটকা, ভোপাল, খাজুরাহ, জব্বলপুর ইত্যাদি সবই তো আমাদের ঘোরা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের লোকগুলো আমাদের প্রায় ব্যক্তিগত ভাবে চিনে গেছে। ওরাও আজকাল কোন নতুন সার্কিট দিতে পারে না আমাদের। সেকথা আমি বলেছিলাম, জবাবে শৌভিক বলল, " কিন্তু জঙ্গল গুলো তো ঘোরা নয়।" 


তাও বটে, জঙ্গল বলতে আমরা ঘুরেছি শুধু পান্না। তাহলে? এবার কোথায়? মোগলির জঙ্গলের প্রস্তাবটা অবশ্যই শৌভিকের ছিল। পেঞ্চ যেতে গেলে নাগপুরে নামতে হয়। কলকাতা থেকে ট্রেন এবং প্লেন উভয়ই আছে, কিন্তু প্লেনের সময় বড় অদ্ভুত, নটা নাগাদ কলকাতা থেকে ছেড়ে, নাগপুর পৌঁছাবে রাত এগারোটায়। তারপর আবার দুই ঘন্টার পথ তাও ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, ভেবেই প্লেনের পরিকল্পনা বাতিল করলাম আমরা। ট্রেনে দেখা গেল AC টু টায়ার পাওয়া যাচ্ছে, সময়সীমা খুব সুবিধাজনক নয়, ভোর পৌনে ছটায় ছেড়ে, সন্ধ্যে পৌনে নটায় নাগপুর। অর্থাৎ রাত এগারোটা নাগাদ পেঞ্চ। তাই সই। ঝটপট করে টিকিট কেটে ফেলে শৌভিক। তখন কি আর জানি, অলক্ষ্যে বিধাতা পুরুষ হাসিতে ফেটে পড়ছেন।

(চলবে?)


অনির ডাইরি ২৪শে অক্টোবর, ২০২৪

#অনিরডাইরি #Dana 

কোন এক ভ্রমণগন্ধী গ্রুপে এক সদাশয় ব্যক্তির পোস্ট দেখে বিশ্বাস করুন, সক্কাল সক্কাল মনটা এক্কেবারে ফুরফুরে হয়ে গেল। উনি লিখেছেন,"সংবাদপত্র বা চ্যানেল গুলোকে একদম বিশ্বাস করবেন না। সব বাজে কথা। পুরী মোটেই জনশূন্য লয়, হ্যাঁ ভিড় এট্টু কম বটেক। এই দেখুন না আমিই তো রয়েছি সপরিবারে।" 


ভ্রমণপিপাসু বাঙালীর দল ওমনি ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ' আহা, আহা - বাহা বাহা! ইশ আমিও কেন গেলাম না রে -'। আবহাওয়া বিশারদ বাঙালীরাও পিছিয়ে থাকেননি, "আরে থাকেন তো মশাই। ওসব ঝড় ফড় কিস্যু হবে না।" ধর্মপ্রাণ বাঙালী জনগণ দেখিয়েছেন প্রভু জগন্নাথকে। স্বয়ং তিনি যেখানে অধিষ্ঠিত, সেখানে কিছু হতে পারে নাকি? "ফণী"র ইতিহাস তো মার্ভেল কমিক্সের গল্প মাত্র, জানেননি নাকি! মহাপ্রভুর তো এই একটাই শখ তথা কাজ, ঝড়ের কানটি মূলে, এমন ইয়ে জনগণকে সপরিবারে সমুদ্র দর্শনের সুবন্দোবস্ত করা।  


যেন তাই হয়। যেন নাই হয়। কারো কোন ক্ষতি যেন নাই হয়। কিন্তু, যদি হঠাৎ বানচাল হয়ে যায় সব হিসেব? হঠাৎ বেসামাল, বেপথু হয়ে পড়ে প্রকৃতি- ? তখন তো সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকার আর প্রশাসনের গুষ্টি উদ্ধার করবেন। কেউ কাজ করে না, সবাই কেবল DA চায়, পেকমিশন চায় বলে সরকারী কর্মচারীদের বাপান্ত করবেন।


আসল কথাটা কি জানেন, আপনি এই রিস্ক নিতে পারেন, সরকার বা প্রশাসন পারে না। সামান্যতম দুর্যোগের পূর্বাভাস পেলেই যে কি অমানুষিক পরিশ্রম করে সরকার তথা প্রশাসন, তা কল্পনাও করতে পারবেন না। প্রশাসন মানে শুধু গুটি কয়েক আধিকারিক বৃন্দ নয়, সবাই, সব্বাই। 


উপগ্রহ চিত্রে সমুদ্রের ওপর হাল্কা গাঢ় ধোঁয়াশা ঘনাবার সাথে সাথেই জেলা- মহকুমা তথা ব্লক স্তরে শুরু হয়ে চূড়ান্ত তৎপরতা। অনর্গল আসে - যায় নির্দেশনামা। বিভিন্ন পর্যায়ে তথা স্তরে খোলা হয় ২৪ ঘণ্টার কন্ট্রোল রুম।


 আপিস যাওয়া আসার পথে বিগত দিন কয়েক ধরেই শুনতে পাচ্ছি অনর্গল ঘোষণা, " ঝড় আসছে, সবাই সময়মত নিরাপদ জায়গায় সরে যান।" নিরাপদ জায়গা বলতে  সাইক্লোন রেসকিউ সেন্টার বা নিকটবর্তী সরকারী বিদ্যালয় গুলি। উপকূলবর্তী জেলা তথা মহকুমা তো, ঝড় হেথা নিত্য অতিথি। তাই এখানে জায়গায় জায়গায় বানানো আছে মজবুত বিশাল কিছু বাড়ি। তাদেরই পোশাকি নাম রেসকিউ সেন্টার। প্রখর দুর্যোগে মানুষ তথা গবাদি পশু সকলের নিশ্চিত আশ্রয়। যাদের আসে পাশে ওমন বাড়ি নেই, তাদের আশ্রয় যোগায় সরকারী বিদ্যালয় গুলো। 


হোটেল মালিকদের সাথে দফায় দফায় মিটিং করে গতকাল বারোটার মধ্যে পর্যটক শূন্য করা হয়েছে দীঘাকে। টহল দিয়েছে পুলিশ। মেলবন্ধন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় বিপর্যয় মোকাবিলা টিমের সাথে রাজ্যের টিমের। সামান্য তালমেলের গোলযোগে ঘটে যেতে পারে অপূরণীয় ক্ষতি। নজর রাখা হয়েছে মৎসজীবীদের ওপর। শতেক গোলযোগ, শতেক নিষেধের রক্তচক্ষু থাকলেও ব্যাটারা ফাঁক পেলেই সমুদ্রে বেরিয়ে পড়ে, পাপী পেটের টানে। জায়গায় জায়গায় মজুত রাখা হয়েছে গাছ কাটার লোক আর গাছ কাটার যন্ত্রপাতি। 


গতকাল সকাল থেকে দফায় দফায় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে হাসপাতাল গুলি। ঝড় উঠলেই তো ছিঁড়বে বিদ্যুতের তার, ঝটপট পুনঃস্থাপিত করতে হবে বিদ্যুৎ সংযোগ। তবে তার জন্যও তো সময় লাগবে, বিদ্যুৎ দপ্তরের লোকজনও তো মানুষ। তাদের ওপর দিয়েও তো বয়ে চলেছে ঝঞ্ঝাবাত। ঝড়ের মধ্যে উড়ে তো আর আসতে যেতে পারবে না। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থাতেও যাতে ফ্রিজে রাখা ওষুধ পত্র নষ্ট না হয়ে যায় তার সুবন্দোবস্ত করতে হয়েছে। 


ঝড় জল হলেই বেরোবে সাপ, বাড়বে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা। তাই চেক করে নিতে হয়েছে antivenom ইঞ্জেকশনের স্টক। শুধু কি তাই, লিস্ট মিলিয়ে দেখা হচ্ছে কোথায় কোথায় আছে আসন্ন প্রসবা জননী। যদি তুফানের মধ্যে হঠাৎ করে প্রসব বেদনা ওঠে? তাদের তুলে এনে হাসপাতাল বা কোন নিরাপদ স্থানে যাতে রাখা যায়, করতে হচ্ছে, ভাবতে হচ্ছে তারও কথা। 


নিমতৌড়িতে আমার অফিসের জানলার বাইরে আপাতত মন খারাপী ঘোলাটে মেঘের পর্দা,  এদিক ওদিক হালকা মাথা নাড়াচ্ছে দেবদারুর দল। মুঠো ফোনে শৌভিকের বার্তা, দীঘা বোধহয় এযাত্রা বেঁচেই গেল। সেক্ষেত্রে এত আয়োজন সবই বৃথা, তাতে কি? সাবধানতা অবলম্বন তো করতেই হবে। প্রতিটা তুফানই যে  সৃষ্টি করে যায় নতুন নতুন ইতিহাস। সেই যে সেবার সবাই বললে, সাইক্লোন বটে, তবে দীঘার কোন চাপ নেই। ঝড় হবে না তেমন, বৃষ্টিও হবে নামমাত্র। প্রবল ঝড় বৃষ্টি সত্যিই হল না বটে, কিন্তু আচমকা বিদায় বেলায় ফুঁসে উঠল সাগর। তীব্র জলোচ্ছ্বাসে ধুয়ে গেল উপকূল।  নতুন নতুন এই জেলায় এসে দেখেছি,দীঘা, শংকরপুর, মন্দারমণি সর্বত্র ধ্বংসের দগদগে ক্ষতচিহ্ন।  বড় বড় বিশ পঞ্চাশ মনি পাথর কংক্রিটের চাঙ্গড় উল্টে পড়ে আছে পথের ধারে। প্রকৃতি বড় নির্মম। 


প্রতিটা তুফান থেকেই শেখে সরকার তথা প্রশাসন, সেই যে সেবার বন্ধের মধ্যেই ঘোষণা হল আসছে  তুফান। দাঁত নখ নিয়ে আছড়ে পড়বে সমুদ্র সুন্দরীর ওপর, দীঘার আজ শেষ দিন। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিকবৃন্দ সহ জেলাশাসক মহোদয় ঘাঁটি গাড়লেন দীঘায়, আসুক ঝড়, জেলাও প্রস্তুত। আপদ ঝড় দীঘায় আর গেলই না। উল্টে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল তমলুক। খবর পেয়ে ডিএম সাহেব যে তমলুক ফিরবেন, রাস্তার ওপর যেন ষড়যন্ত্র করেই আছড়ে পড়তে থাকল একের পর এক মহীরুহ। এক্কেবারে 'আতঙ্ক হি আতঙ্ক' পরিস্থিতি। সেই আতঙ্কেই আজ ভোর ভোর বেরোনোর সময়, গাড়িতে একটা ইলেকট্রিক করাত নিয়ে বেরিয়েছে আমার বর। গতকাল ঐ করাত দিয়ে গাছ কাটার ট্রেনিং নিতে পাঠিয়েছে ড্রাইভার আর সিকিউরিটিকে। সাবধানের মার নেই। অবশ্য  মারেরও সাবধান আছে কি? তবুও একটু দায়িত্ববান নাগরিক হতে ক্ষতি কি!



 অনির পুজোর ডাইরি ১৩ই অক্টোবর, ২০২৪

শুভ মহাষ্টমী #অনিরডাইরি 



"অনি-" ফোনের ওপার থেকে সঞ্চিতার ব্যস্ত কন্ঠ জানতে চাইল " তুই কোথায়?" ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে এগারো। হে ঈশ্বর, সাড়ে এগারোটার মধ্যে তো আমার পৌঁছে যাবার কথা ছিল। আমি তো এখনও বাড়ি থেকেই বেরোইনি। এই লেট হওয়া নিয়ে দিন দুয়েক আগে দুই ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সাথে হেব্বি বাওয়াল হয়ে গেছে। আর আজ আমিই কি না - 


মনে মনে নোট করলাম, আরেক বার ক্ষমা চাইতে হবে ব্যাটাদের কাছে। যদিও ইতিমধ্যেই মার্জনা ভিক্ষার সংখ্যা শ খানেক ছাড়িয়েছে। তবুও, কপটতার একটা সীমা তো থাকে মাইরি। নিজের বেলায় আঁটিশুঁটি, ওদের বেলায় দাঁত কপাটি? সঞ্চিতাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললাম, "এই তো বেরিয়েছি।" সম্মুখে ক্যামেরা হাতে অপেক্ষমান তুত্তুরীর কপালে গভীরতর হয় খাঁজ, মাটা তাহলে মিথ্যুকও। 


কি করি, ওই যে বলে না, বিপদে বুদ্ধিমানেরা অর্ধেক ত্যাগ করে। গোটা পুজোয় বাবা মায়ের সাথে একটাও ছবি তোলা হয়নি, আজ দুজনকেই পটিয়ে, সাজিয়ে গুছিয়ে রাজি করেছি। এই মুহূর্তে একগাল হাসি নিয়ে বাঁ দিকে আমায় জড়িয়ে আছে বাবা, ডানদিকে মা। এই সোনালী মুহূর্তটার জন্য একটু মিথ্যে, একটু হিপোক্রেসি তো চলতেই পারে।


বাড়ি থেকে হলের দূরত্ব হাঁটা পথে মিনিট দশ পনেরো। কিন্তু ঠাকুর দেখার নামে যে অত্যাচার হয়েছে পদ যুগলের ওপর, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমার মত পৃথুলার দেহেও মাসলস্ বলে বস্তু কিছু আছে। তার ওপর কেন যে মরতে উঁচু গোড়ালির জুতোটাই পড়লাম। তৃষিতের মত দুদিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটি, একটা টোটো যদি -। আজ বোধহয় ঈশ্বর সত্যিই সুপ্রসন্ন, এক বয়স্ক কৃশকায় টোটোওয়ালা বসে বিড়ি ফুঁকছিল, সনির্বন্ধ অনুরোধে যেতে তো রাজি হল, শর্ত একটাই, বিড়িটা শেষ করতে দিতে হবে। 


গিয়ে যখন পৌঁছলাম, সঞ্চিতা রাস্তার উপরেই দাঁড়িয়ে। দেখে খুশি হল কি না বুঝতে পারলাম না,ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল, " জল এনেছিস?" একেই বোধহয় বলে, 'এক গাল মাছি '। সঞ্চিতার আর আমার সিনেমা দেখার ইতিহাস তো আজকের নয়। বন্ধুত্বটাই তো আজকের নয়। কত রকম যে পাকদণ্ডি ধরে এগিয়েছে আমাদের সিনেমা দেখার ইতিহাস, তার সাক্ষী হাওড়া শহরের সিনেমা হল গুলো। যাদের মধ্যে শ্রীরূপা, নবরূপম, পার্বতী আর শ্যামশ্রী আজ শুধুই ইতিহাস। শান্তি আর পুষ্পশ্রী অবশ্য আজও টিকে আছে। এদের মধ্যে পুষ্পশ্রী নাকি উন্নীত হয়েছে মাল্টিপ্লেক্সে। একসঙ্গে একাধিক 'বই' চলে আজকাল। আপাতত সবই বাংলা। আমাদের আজকের গন্তব্য ও পুষ্পশ্রী। 


আজ মহাষ্টমী কি না,রাস্তায় বেশ ভিড়। ভিড় কাটিয়ে যুগলে গেলাম জল কিনতে। হাঁটতে হাঁটতে বেজায় হাসি পাচ্ছিল অতীত নানা কথা ভেবে। সেই যে সেবার রাজ -২ দেখতে গিয়েছিলাম আমরা, মায়েদের নিয়ে শান্তিতে। একে তো সাংঘাতিক সাউন্ড সিস্টেম, তায় ছারপোকাদের সম্মিলিত আক্রমণ। আজও সকালে শৌভিক বলছিল, দুটো চটের আসন নিয়ে যেতে। মনে আছে, ভয় পেয়ে বার বার সঞ্চিতাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আমি। আর সঞ্চিতা হুমকি দিচ্ছিল, "আরেকবার জড়িয়ে ধর, আমি উঠেই চলে যাব।" 


এতো তাও ঠিক ছিল, তারপর স্ক্রিনে ইমরান হাশমির প্রবেশ। ইমরানের তৎকালীন নামই ছিল "সিরিয়াল কিসার"। ফলে মায়েদের সে কি দাঁত কিড়মিড়। সেই সব গল্প করতে করতে কখন যে হলের আলো নিভে গেল বুঝতেই পারলাম না। নন্দিতা শিবপ্রসাদের বহুরূপী দেখতে এসেছি আমরা। সঞ্চিতাই দেখাচ্ছে, আমি সঙ্গী। 


তামাক সেবনের কুফল দেখানো শুরু হতে খানিক থমকালো আমাদের বার্তালাপ। নয় নয় করে ভালোই ভিড় হয়েছে। পিছনের সিট সব ভর্তি। সামনেও সামান্যই খালি। " এগুলো কেন দেখায় বলতো?" সামান্য বিরক্তি নিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে সঞ্চিতা। পর্দায় তখন খৈনি সেবনের ফলে কর্কট রোগাক্রান্ত জনৈক ব্যক্তি দুঃখের সঙ্গে ঘোষণা করছেন, " বহুৎ বড়ি গলতি হো গিয়া।" ভদ্রলোকের মুখের যা অবস্থা, তাকানো যাচ্ছে না। চোখ সরিয়ে বলি, যারা সত্যিই এগুলো খায়, তাদের কোন লজ্জা থাকে না। যতই দেখা, ঠিক খাবে। যেমন আমার বাপ। বিগত কয়েকদিন ধরে আমি চিল্লিয়ে যাচ্ছি,বাবার কোন হেল দোল আছে? চুরাশি বছর বয়সে এসেও একটা সিগারেট থেকে আরেকটা ধরায়।


 শুরু হয় বহুরূপী। ঝকঝকে আবীর চট্টোপাধ্যায়, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে যেন আরো বহুগুণ সুদর্শন। সাধে এই লোকটার ওপর এককালে ক্রাশ খেতাম আমি। ইদানিং তুত্তুরী হাবুডুবু খায় বলে অতিকষ্টে নিজেকে সংবৃত করেছি। আজ না আবার হড়কে যাই, ভগবান। ছবিতে আবীর একজন বিখ্যাত লেখক। কলকাতা বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে তাঁর নতুন বই বহুরূপী। আবির দীর্ঘ দিন রাজ্য পুলিশে কর্মরত ছিলেন, সলভ করেছেন অগণিত কেস। ধরেছেন অসংখ্য চোর,ডাকাত, গ্রন্থিছেদককে। সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়েই লেখা বহুরূপী। আবির নিজেই বলেন, যে বাকি গুলি তাঁর সফলতার গল্প হলেও, বহুরূপী আসলে তাঁর ব্যর্থতার গল্প। 


অতঃপর শুরু হয়, সেই ব্যর্থতার গল্প। মেশে এক চামচ দেশভাগ। দেশভাগের আগে গঙ্গার দুই পাড়ের জুট মিল গুলো কেমন রইরই করে চলত। দেশভাগের সাথে সাথে শুরু হয় অবক্ষয়। পাল্লা দিয়ে গেটের বাইরে শুরু হয় ইউনিয়নের বিক্ষোভ। এমনিই এক জুটমিলের গোবেচারা অ্যাকাউন্ট্যান্ট শিবপ্রসাদ। ট্রেড ইউনিয়নের নেতাকে খুনের মিথ্যা অপরাধে ফেঁসে হাজির হয় আবিরের থানায়। কোন জেরা, কোন প্রশ্নোত্তর না করেই সটান থার্ড ডিগ্রি চালায় আবীর। ফলে তৈরি হয় এক গোপন শত্রুতার বাতাবরণ। 


কাঠগড়ায় মিথ্যা সাক্ষী দেয় শিবপ্রসাদের বাবা - দাদা - বৌদি। ফলে অনিচ্ছাকৃত খুনের দায়ে আদালত পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে শিবপ্রসাদকে। জেলে শিবপ্রসাদ খুঁজে পায় এক স্নেহশীল গডফাদার। যিনি হাতে ধরে শেখান কি ভাবে ব্যাংক ডাকাতি করতে হয়। চেনা চেনা লাগছে কি গল্পটা? বিশ্বাস করুন, প্রতিটা ফ্রেম, প্রতিটা বাঁক ভয়ানক চেনা। ওই নতুন বোতলে পুরাণ মদ আর কি। মদটাও নেহাৎ চোলাই। 


 জেল থেকে বেরিয়ে শিবপ্রসাদ গড়ে তোলে ব্যাংক ডাকাতির দল। ততোদিনে আবীর SI থেকে আইসি হয়ে গেছে। আর জীবনে এসেছে সুন্দরী, সুগায়িকা, গৃহকর্মনিপুনা লক্ষ্মীশ্রী ঋতাভরি। শিবপ্রসাদেরও জীবনে আসে পকেটমার ঝিমলি ওরফে কৌশানী। যেমন নাম, তেমনিই তাঁর হাবভাব। গুটি সাজানো শেষ হলে শুরু হয় চোর পুলিশ খেলা। গোটা সিনেমায় কেবল দুটো সিলভার লাইন আবীর আর শিবপ্রসাদ। বাকিটুকু নাহয় উহ্যই থাক। বুঝতেই তো পারছেন কি হতে চলেছে। 


পুনশ্চ - হাফটাইমে তোলা সেলফি দেখে বুঝতেই পারবেন না মাইরি, সিনেমা শুরুর সময় সব কটা সিট ভর্তি ছিল। এখন এত লোক একসঙ্গে কোথায় গেল, শৌচাগার নাকি -। সে আমরা কি জানি।


অনির পুজোর ডাইরি ৭ই অক্টোবর, ২০২৪

শুভ চতুর্থী 

#অনিরডাইরি 



অবাঙালি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকার ছোট্ট পুজো। হাওড়ার গলি নয় তো ভুলভুলাইয়া, পথ ভুলেই এসে পড়েছি আমরা। ছাপোষা মণ্ডপ, কুমারটুলির সস্তা প্রতিমা। এবড়োখেবড়ো মুখমণ্ডল, ঘাম তেলটাও যেন ভালো করে লাগানো হয়নি। দুই কানের পাশ দিয়ে নেমেছে কেশ গুচ্ছ, কিন্তু মাথা জোড়া টাক। "এটাই দেখা বাকি ছিল, টেকো মমি।" বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে তুত্তুরী। গর্ভধারিনী মা আর জগজ্জননী মা এই দুজনকেই তিনি আদর করে Mommy বলে সম্বোধন করেন কিনা।


গত পরশু বিকালে সবৎসা হাওড়া এসেছি। আসার সময় বলেই এনেছি মেয়েকে, " বাবু দুটো বেলা শুধু আমায় ছেড়ে দিস, বন্ধুদের জন্য। বাকি পুজোটা শুধুই তোর।" সেই দুবেলা খতম হয়েছে গতকাল অপরাহ্নে। কাল বিকাল থেকেই তিনি আমার মস্তকে সমাসীন। দাবী খুবই সামান্য, তাঁকে আশ মিটিয়ে ঠাকুর দেখাতে হবে এবং চর্বচোষ্য খাওয়াতে হবে। 


ঠাকুর দেখায় অবশ্য আমার কোন ক্লান্তি নেই,  গতকাল রাতেই বলেছিলাম, চল পাড়ার ঠাকুরটা অন্তত দেখে আসি। নেহাৎ ঘরের পোশাকে পাড়ায় বেরোনো নিয়ে যুগপৎ বাবা আর মা আপত্তি করল, তাই।  এবার আমাদের পাড়ার ঠাকুরের হেব্বি জাঁকজমক। গতকাল বিকালে শুভশ্রী এবং গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের যুগ্ম হস্তে তাঁর শুভউদ্বোধন হয়েছে। মোড়ের মাথা থেকে পূজা মণ্ডপ অবধি শুভশ্রী আর গর্গ বাবুর ছবি টাঙানো। মায়ের কেয়ার গিভার দিদি পরশু বিকাল থেকে বলেই চলেছিছেন, " শুভশ্রী আসবে আর কে যেন এক মস্ত বড় গায়ক আসবে। ঐ যে গো আপনাদের বামুনদের নামেই নাম।" বেচারা গর্গ। আজ মধ্যাহ্নে যখন তুত্তুরী আর আমি ঠাকুর দেখতে বেরোচ্ছি, তখনও আমার খুড়তুতো ভাই মাকে বোঝাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, " না না, গর্গ দা গানটান গায় না।" 


পাড়ার ঠাকুর দেখতে গিয়ে হোঁচট খেলাম, মণ্ডপের সামনে বিস্তর প্লাস্টিকের চেয়ার উল্টে ব্যারিকেড করা। "যাঃ বাবা, ঢুকতে দেবে না নাকি?" বিরক্ত হয়ে জানতে চায় তুত্তুরী। এখন ভর দুপুর, আসেপাশে কোন জনমনিষ্যি নেই যে শুধাই। বাধ্য হয়ে অন্য মণ্ডপের পথ ধরি। বারে বারে আজ আশাহত করতে থাকে মা। এখনও অসম্পূর্ণ অধিকাংশ মণ্ডপ তথা প্রতিমা। 


একে তো প্রায় এক যুগ শহর ছাড়া আমি, তার ওপর বড় দ্রুত বদলে যাচ্ছে শহরটাও। পুরাণ পথঘাট, গলি সবই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। তেমনি পথ ভুলেই এসে পৌঁছেছি এই পুজোটায়। ঘিঞ্জি এলাকা, চতুর্দিকে বাইক, টোটো, ঠেলার উৎপাত। বাতাসে সস্তা বিরিয়ানির আতরের চড়া সৌরভ। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে পথের সন্ধান তো পেলাম, কন্যা আব্দার করল, এদের পুজোটাও দেখে যাই। যাব তো, কিন্তু যাব কি করে? মাঠ তো জল কাদায় ভর্তি।


গুটি কয়েক স্থানীয় বাচ্ছা ওই জল কাদার মধ্যেই খেলায় মগ্ন। তাদের পদ চিহ্ন অনুসরণ করেই মণ্ডপে প্রবেশ করলাম আমরা। মণ্ডপের ভিতর তেরছা ভাবে পড়ে আছে বিশাল মই। পাকানো তার, কাগজ, কাপড়ের ছড়াছড়ি। মইয়ের এপাশে আড়াআড়ি ভাবে কোমর সমান উচ্চতায় বাঁধা একটা বাঁশ। সেই বাঁশ ধরে গুলতানিতে মত্ত একদল কুচোকাঁচা। সবকটা প্রায় একই উচ্চতার। সবার পরনেই বিবর্ণ পোশাক। পায়ে চটি থাক বা না থাক, সবকটার পাই কাদায় মাখামাখি। কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে গল্প করি তুত্তুরী আমি। গল্প নয়, গসিপ বলতে পারেন। একে তো দেবী টেকো, তায় সিংহটা বড়ই ছোট। হাঁটুতে হাত রাখা সিংহের দিকে অসুরের মুখভঙ্গী যেন, " খামোখা সুড়সুড়ি দিচ্ছিস কেন বাপ --"। মা যেন দাঁত কিড়মিড় করে বলছে, "আবার ফাজলামি হচ্ছে!" 


আসল মা দুর্গা কেমন হবে, সেটা নিয়েও আলোচনা করি আমরা। সুন্দরী পটেশ্বরী তো অবশ্যই নন। আদতে তো তিনি একজন যোদ্ধা, নির্ঘাত পেশীবহুল হবে তাঁর দেহ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে শোভা পাবে বেশ কিছু শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত চিহ্ন। মুক্তকেশী হওয়া কি সম্ভব? শত্রু তো চুলের মুঠি ধরেই কুপোকাত করে দেবে সবার আগে।  ইত্যাদি প্রভৃতি। 


ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে, এখনও বেশ কয়েকটা ঠাকুর দেখা বাকি। তারপর যাব লস্যি খেতে। হাওড়া ময়দানের সেই লস্যির দোকানটা খুঁজে বার করতে হবে, যেখানে প্রাকবিবাহ প্রণয়পর্বে যুগলে লস্যি খেত আমার বাবা মা। আশৈশব যে দোকানের লস্যি খেয়েছি আমি। খাইয়েছি আমার মেয়েকেও। সবথেকে বড় ভাঁড়ে, সবথেকে বেশি মালাই দেওয়া লস্যি। সাথে কয়েক টুকরো বরফ। ভাবতেই উভয়ের  জিভে জল। টাক বাঁচিয়ে টুক করে ঠাকুরের কয়েকটা ছবি তুলে নিই আমি। 


ছবি তোলার জন্য মেয়েকে ছেড়ে কয়েক পা সরে এসেছিলাম, যখন ফিরে গেলাম দেখি, বাঁশের সামনে একা, এক গাল হাসি নিয়ে কয়েকটা ছুটন্ত বাচ্ছার দিকে তাকিয়ে আছে তুত্তুরী। ইশারায় জিজ্ঞাসা করি, কি হল রে, বিগলিত হয়ে তিনি জবাব দেন, " কি মিষ্টি করে বলল মা, কি ইনোসেন্টলি বলল। এতক্ষণ যে বাচ্ছা দুটো এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করছিল না, তারা যাবার সময় ঠাকুরকে কি বলে গেল জানো? বলল, "মেরি দুর্গা মাঈ কো কিসি কি নজর না লাগে।" পলকে কেমন দ্রবীভূত হয়ে গেল হৃদয়, নাহ টেকো হোক আর যাই হোক, ভদ্রমহিলার যাদু কিছু তো আছেই। 


পুনশ্চ - উক্ত মণ্ডপ বা প্রতিমার ছবিটা আর দিলাম না। কিছু জিনিস একান্ত ব্যক্তিগত থাকাই বোধহয় ভালো। থাক ওরা, ওদের মত।  আশ মিটিয়ে খুনশুটি করুক অসুর আর সিংহ। বেশ বাড়াবাড়ি করলে দুটোরই কান মূলে দিক জগজ্জননী। পুঁচকে গুলোর দুগ্গা মাঈ আর তার  ছানাপোনাদের কারো নজর যেন সত্যিই না লাগে।


অনির পুজোর ডাইরি ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪

শুভ দ্বিতীয়া

#অনিরডাইরি 



তিনি লিখলেন, "মা, তুমি কি আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে? তাহলে তোমার সঙ্গে বেরিয়ে একটু আলো দেখতাম।" আলো অর্থাৎ পুজোর আলোকসজ্জা। কয়েকদিন ধরেই ড্রাইভার সাহেব গল্প করছেন, কাঁথি শহরে নাকি সাকুল্যে ৫০টা পুজো হয়। ছোট মফস্বল শহরের পক্ষে সংখ্যাটা নেহাৎ কম নয়। যার মধ্যে নান্দনিক, ইট গিল্ট (ইউথ গিল্ড) আর চৌরঙ্গীর পুজো নাকি সবথেকে বিখ্যাত। 


আর পাঁচটা মফস্বলের মতোই, এখানে এখনও অর্ধ সমাপ্ত অধিকাংশ মণ্ডপ। প্রতিমা ও অনুপস্থিত। তবে আলো যে লাগানো হচ্ছে, সেটা আজ সকালে অফিস আসার সময় আমিও দেখেছি। 


আগামী কাল থেকে ক্যালেন্ডারে লাল দাগ শুরু, কালই বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে সকন্যা পিত্রালয়ে যাব। ভেবেছিলাম যাবার পথে ঢুঁ মেরে যাব ঠাকুর এসেছে এমন কয়েকটা মণ্ডপে। শ্রীমতী তুত্তুরীকে সেকথা বলেও ছিলাম। কিন্তু কন্যার আর ধৈর্য ধরছে না। মুঠো ফোনে ফুটে ওঠে তাঁর কাতর আকুতি, " প্লিজ মা তুমি কি একটু তাড়াতাড়ি -"।


তাড়াতাড়ি আসব কি, আপিসে ঢুকেছিই তো আজ বেশ খানিক বিলম্বে। সেই কবে মানত করেছিলাম দেবী বর্গভীমার কাছে, আমার বর আর আমার ছেলেগুলো যদি সুস্থ ভাবে, সম্মানের সাথে নির্বাচনটা উতরে দিতে পারে,  মায়ের কাছে পুজো দেব, আর সবাই মিলে ভোগ খাব। সেই মত কথাও বলে এসেছিল শুভদীপ্ত। কিন্তু আমার ইন্সপেক্টর বাবুদের আর সময়ই হয় না। একের পর এক আসতে থাকা কাজের দাপটে, ব্যাটাদের এক সঙ্গে পাওয়াটাই হয়ে ওঠে দুর্ঘট। আমরা যবে খাই খাব,মাকে আর কতদিন উপোষী রাখি? 


মন্দিরের সামনেই বিক্রি হয় পুজোর ডালা, কিন্তু শুভদীপ্ত নিষেধ করে, "ওখান থেকে নিবেন নি ম্যাডাম। আর মাখা (সন্দেশ) নিবেন নি, যে সন্দেশ বিক্রি হয় না, সেই গুলো আবার ভালো করে পাক করে, কড়া মিষ্টি দিয়ে মাখা বানিয়ে দেয় শুনেছি। নিলে কলাকাঁধ নিবেন।" যে দোকান থেকে নিতে বলে, তার লোকেশন আর কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। শেষে শুভাশিসকেই ধরি, "চল বাবা একটু।"


খুপরি দোকান, টালির চাল। আমরা ছাড়া আর মুষ্টিমেয় খরিদ্দার। গৌর বর্ণ, সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ দোকানিকে জানালেন, " পিস নয়, আমরা ওজনে বিক্রি করি কালাকাঁধ।" সাথে সাথে ধূপ আর সিঁদুর পাতাও দিলেন বৃদ্ধ। দোকানেই জুতো খুলে, বাকি পথটা হেঁটে, বেশ অনেক গুলি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় মায়ের মন্দিরে। সদ্য নিজেকে উপহার দেওয়া কালো উঁচু গোড়ালির জুতোকে এই ভাবে বাজারের মধ্যে ফেলে যেতে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। প্লিজ ঠাকুর, কেউ যেন আপন মনে করে নিয়ে না নেয়। যা সুন্দর দেখতে -। 


কংক্রিটের সিঁড়ি অন্য দিন হলে তেতে আগুন হয়ে থাকত, মায়ের আশীর্বাদেই হয়তো, আজকের আবহাওয়া এমন সুন্দর মেঘলা, সাথে মৃদুমন্দ বাতাস। মন্দিরে পৌঁছে শুকিয়ে গেল মুখ, যত পুণ্যার্থী কি আজকেই এসে জড় হয়েছে হেথা। যেখানে পা রাখার জায়গা পেলাম, সেখান থেকে মায়ের মুখ দর্শন অসম্ভব। দীর্ঘশ্বাসটা বোধহয় একটু জোরেই ফেলেছিলাম, সামনের অল্প বয়সী ছেলেটি ঘুরে বললে, " যত দিন যাচ্ছে, মানুষের ভক্তি আর চুরি দুটোই বাড়ছে।" 


 শুভাশীষ কোথা থেকে এক টুকরো কাগজ আর পেন এনে জিজ্ঞাসা করে, "ম্যাডাম কার নাম লিখব?" কার নামে পুজো হবে, অনেক ভেবেচিন্তে আমাদের আপিসের নামটাই লিখলাম। ভালো থাক মোদের আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর। প্রায় দেড়শ মানুষের রুজি যোগায় এই আপিসটা। আর আমাদের পরিবার বর্গ ধরলে তো সংখ্যাটা হাসতে হাসতে পাঁচশ ছাড়িয়ে যাবে। 


হয়তো সবই মায়ের কৃপা, যতটা সময় লাগবে ভেবেছিলাম, তার এক চতুর্থাংশ ও লাগল না। নাম লেখা শেষ হবার সাথে সাথেই প্রায়, প্লাস্টিকের ঝুড়ি ভর্তি রক্তজবা নিয়ে এসে হাজির হলেন পট্ট বস্ত্র পরিহিত পুরোহিত। "যারা যারা অঞ্জলি দেবেন, ফুল নিয়ে নিন -"। খপ করে একটা জবা তুলে নিলাম আমি,  এই সুযোগ কি ছাড়া যায়। কে জানে, শাস্ত্র মতে কতটা শুদ্ধ আমি, শাশুড়ি মা প্রায়ই বলেন, "মন শুদ্ধ তো সব শুদ্ধ।" আর মায়ের কাছে আবার সন্তান অশুদ্ধ হয় নাকি? 


এমনিতেই বড় মন খারাপ নিয়ে এসেছি আজ মায়ের চৌকাঠে। বিগত দিন চারেক ধরে অসুস্থ আমার গর্ভধারিণী। অসুস্থতার তীব্রতা যে কতটা সেটা আজ বৃদ্ধ বৃদ্ধা উভয়ের সাথে কথা বলেই বুঝতে পেরেছি। মন চাইছে, সব ফেলে ছুটে হাওড়া চলে যাই। কিন্তু আজ আমি না গেলে যে ছাড়া যাবে না ২৫/২৬ লাখ টাকা। যে টাকার অধিকাংশ জুড়ে আছে কারো কাজের মজুরী, কারো বোনাস, কারো বকেয়া, কারো জমা পুঁজি ফেরৎ, তো কারো মৃত্যুকালীন অনুদান। যত টাকাপয়সা অ্যালটমেন্ট সব যেন গতকাল আর আজকেই ঢুকছে বানের জলের মত। যত তাড়াতাড়ি ব্যাংক বা ট্রেজারিতে পাঠানো যায় ততোই মঙ্গল। দ্বিতীয়ার্ধে পাঠালে, কেউই নেবে না, উল্টে দাঁত কিড়মিড় করবে। 


মাইক্রোফোনে ভেসে আসা মন্ত্রে চমকে উঠি, শুরু হয়ে গেছে অঞ্জলি। একবারই মন্ত্রপাঠ হয়, অতঃপর পুনরায় ঝুড়ি নিয়ে হাজির হয় পুরোহিত মহোদয়, দিয়ে যাওয়া পুষ্প ফেরৎ নেবার জন্য। হাতের ফুল মায়ের দিকে ছোঁড়া এমনিতেও অসম্ভব, এত দূরে আছেন তিনি। অঞ্জলি শেষে, শুরু হয় পুজো। সামনের লোকজন ঝটিতি সরে যায় সামনে থেকে। পুজোর লাইন বাম দিকে। ভিড় খালি হয়ে যেতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের অনিন্দ্য সুন্দর মুখচন্দ্র। 


পুজোর লাইনে ভিড় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মন্ত্র পড়তে পড়তে পুজোর ডালা নিচ্ছেন পুরোহিত মশাই, খানিকটা মিষ্টি সরিয়ে রাখছেন, না রাখছেন না বুঝতে পারলাম না। এক মুঠো রক্তজবা প্যাকেটে ভরে, আমায় ফিরিয়ে দিলেন পুজো। এখানে নাম গোত্র ধরে যে পুজো হয় না, সেটা তিন বছর আগে থেকেই দেখে আসছি। মানত তো আর প্রথমবার করলাম না মায়ের কাছে।


মন্দির থেকে বেরিয়েই আমার গর্ভধারিণী মাকে ফোন করি। কেমন আছ মা? মিনিট চল্লিশ আগেও যার গলার আওয়াজ বেরোচ্ছিল না, তিনি বেশ ফুরফুরে কন্ঠে জানান, " ভালো আছি। সেজদা এসেছে। গল্প করছি।" ওপাশ থেকে সেজদার দরাজ গলা ভেসে আসে, " চিন্তা করিস না, আমি আছি। মাসি ভালো আছে। ওষুধপত্র সব আমি দেখে নিয়েছি। কাল আবার আসব মাসিকে দেখতে। তুই না আসা পর্যন্ত আমি সাপোর্ট দিয়ে যাব।" আমরা পাঁচ ভাইবোন একসাথেই বেড়ে উঠেছি, মাসতুতো শব্দটা কোনদিন আমাদের মধ্যে ঢুকতে সাহস পায়নি। নাহলে এই ঘোর কলিতে কার মাসতুতো দাদা এ কথা বুক বাজিয়ে বলতে পারে। 


অফিসের কাজ মিটতে মিটতে প্রায় ছটা। তাও সব মিটল কি? কোনদিন কোন সরকারী আপিসে মেটে নাকি? লাখ ছয়েক টাকা এসে ঢুকল পৌনে ছটার সময়। ধুৎ তেরি। বাড়ি যখন ফিরলাম, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে মন আর মাথা। এখনও গোছগাছ কিস্যু হয়নি। কি যে হবে ভাবতে ভাবতে বাড়ি ঢুকে দেখি তিনি নীলাম্বরী হয়ে ঘুরছেন। কোথা থেকে যেন গেল বছরে বড় মামার দেওয়া জামাটা বার করে, পরিপাটি করে চুল বেঁধে বাগানে পায়চারি করছেন, কখন মা আসবে, আর আলো দেখতে নিয়ে যাবে।


অগত্যা, আবার জুতো গলিয়ে বেরোতেই হয়, মা হওয়া কি মুখের কথা রে বাবা। সাথে জবরদস্তি লতাদিকেও ধরে নিয়ে যাই আমরা। থাক পড়ে সব কাজ, অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য। সারাদিন আমার কন্যা আর আমার শাশুড়ি মাতার দেখা শোনা করে মানুষটা, একটু আলো দেখা তো তারও প্রয়োজন।



অনির পুজোর ডাইরি ৩রা অক্টোবর, ২০২৪

শুভ প্রতিপদ 

#অনিরডাইরি 



মোটামুটি অর্ধেক পৃথিবীর মতোই, আমারও J.K Rowling এর সাথে প্রথম পরিচয় হ্যারির মাধ্যমে। আজ্ঞে হ্যাঁ, the Harry Potter। হ্যারি পটার সিরিজ যখন প্রকাশিত হয়েছিল, একটা বইও আমার কেনা বা পড়া হয়নি। কি করেই বা কিনি/ পড়ি। সারা বিশ্ব তখন কাঁপছে হ্যারি উন্মাদনায়। আকাশ ছোঁয়া দামে প্রকাশ পাচ্ছে একেকটা বই। আমি তখনও তারাসুন্দরী, আমার তখনও লাল পাড় সাদা শাড়ি। লাল ফিতে দিয়ে বিনুনি বেঁধে দিত পিসি, ভারী ব্যাগ কাঁধে, নতমস্তকে গুটি গুটি পায়ে ইস্কুল যাই আমি। ওদিকে প্রভাতী আনন্দবাজারের বইয়ের পাতা থেকে এগোতে এগোতে প্রথম পাতার তলার দিকে স্থান পেতে থাকে হ্যারি। প্রতিটা খণ্ড বাজারে আসার আগে, বইয়ের দোকানের সামনে সে কি বিশাল লাইন কচিকাঁচাদের। আমার তাতে কি? আমি দাদা বাংলা মিডিয়াম। ঐ জাব্দা ইংরেজি বই পড়া কি আমার সাধ্য নাকি? 


বই থেকে হ্যারির পদোন্নতি হল চলচ্চিত্রে। পর্দা কাঁপিয়ে দিল ড্যানিয়েল-এমা-রুপার্ট গ্রিন্ট এন্ড আদার্স। গরীবের উঠোনেও একদিন হানা দিলে wizrad কুল। ২১ ইঞ্চি রঙিন টিভি, পাড়ার বিপুল কাকার কেবল লাইন, সুযোগ পেলেই HBO/AXN/ Star Movies দেখে বেড়াই আমি। রাতে প্রাইম টাইমে ভালো ভালো সিনেমা দিত চ্যানেল গুলো। তখন তো পড়া ছেড়ে রিমোটে হাত দিলে হেট মুণ্ডু ঊর্ধ্বপদ করে দেবে মা। আমার সম্বল বলতে দুপুরের রিপিট টেলিকাস্ট। কলেজ থেকে ফিরে, ডালমুড়ির বাটি( আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি অর্ধেক হাওড়া আর অর্ধেক মুর্শিদাবাদী, আমি মুড়ি খেতে দিব্য ভালবাসি) বগলে, টিভিটা যখন চালিয়েছিলাম বিশ্বাস করুন কোন প্রত্যাশা ছিল না। প্রথম থেকে দেখতেও পাইনি সিনেমাটা। যখন শেষ হল, মনে হল আমি যেন তড়িতাহত হয়েছি। এমনও হয়? এমনও কিছু কল্পনা করা সম্ভব? 


তাই বলে বই কেনা বা পড়ার কথা ভাবলাম ভাববেন নি যেন। বললাম না দাদা আমি বাংলা মিডিয়াম। খটমট ইংরেজি সিনেমা দেখতে শিখেছি বলে কি পড়বার ও স্বপন দেখব নাকি? তাজ্জব মাইরি। 


J.K. Rowling আমার প্রিয়তম লেখিকা হলেও, ইংরেজি বই পড়ার সাহস প্রথম যিনি দিলেন তাঁর নাম Dan Brown। সদ্য চাকরি পেয়েছি কয়েকমাস। প্রথম পোস্টিং খড়গপুর। অফিস তথা যাত্রাপথটা কিছুতেই আর হজম করতে পারছিলাম না। সবকিছু কেমন যেন তেতো হাকুচ। রীতিমত মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিলাম। মেদিনীপুর লোকালের লেডিস কম্পার্টমেন্টে সদ্য আলাপ এক সমবয়সী দিদিমণি প্রথম বলল, " বই পড়।মন ভালো হয়ে যাবে"। জন্ম থেকে বই পোকা আমি। আর কি পড়ি? ওকেই শুধালাম, কিছু বইয়ের নাম বল। সৌমি নাম ছিল মেয়েটার, আজও মনে আছে, সৌমি মণ্ডল। সৌমি বলল, " Dan Brown পড়। দা ভিঞ্চি কোড।" নামটা না শোনার মতোও গবা আমি নই। কিন্তু যতদূর জানি, বইটার বিরাট দাম। সৌমি বলল, " দূর, গ্র্যান্ড হোটেলের তলায় চলে যা, ওরা ফটোকপি করে বিক্রি করে। দর করে কিনবি। ১০০ টাকার বেশি মোটেও দিবি না।"


পরের শনিবারই গিয়ে হানা দিলাম, ধর্মতলায়। গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে হেব্বি কেত মারা দোকানি, এমন ফরফরিয়ে ইংরেজি বলে যে মনে হয়, ধরিত্রী দ্বিধা হও। দাম শুরু হল সাড়ে পাঁচশ টাকা থেকে। যত বলি পাঁচটা নয়, একটা নিব রে ভাই, দর আর কমেই না। প্রায় আধঘন্টা চাপানউতোর শেষে একশ পনেরো টাকা দিয়ে বই কিনে বাড়ি ফিরলাম। এবার আপনি বলতেই পারেন, তুমি তো বাছা বাংলা মিডিয়াম। সে ভাবনা কি আমার মাথাতেও আসেনি, কিন্তু পচা আপিস আর নিত্যযাত্রার চাপ এমনি যে বাড়ি ফিরেই খুলে বসলাম বইটা। বাকিটা ইতিহাস, অন্তত আমার কাছে। সারা দিন, সারা রাত জেগে পড়ে থুড়ি গিলে যখন বইটা শেষ করলাম, অভিজিতের সেই গানটা মনে পড়ে গেল, " শালা ম্যায় তো সাহাব বান গয়া "। প্রেম/ ক্রাশের তালিকায় আরেকজন যোগ হলেন, প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন। 


পরের দুই মাসের মধ্যে ড্যান ব্রাউনের তৎকালীন সব বই শেষ করে ফেললাম আমি। লোকাল মিস করে এক্সপ্রেস ধরতে বাধ্য হলাম যেদিন, আবিষ্কার করলাম, বালতি করে বই বিক্রি হয় এই লাইনে। ভদ্রলোকের এক কথা, সব বই একশ টাকা। তবে কিনা, সস্তার তিন অবস্থা, ট্রেন থেকে কেনা Digital Fortress এর মাঝের কয়েক পাতা মিরর প্রিন্ট পেয়েছিলাম। এমন নেশা, যে ফেস পাউডারের পুঁচকে আয়না দিয়ে দেখে পাঠোদ্ধার করেছিলাম আমি, তাও ছাড়িনি। 


দেখতে দেখতে বাবার বাড়ির আলমারি ভরে উঠল, Lee Child, John Grishm, David Baldacci, Steig Larson থেকে দেশী Aswin Danghi, Amish ইত্যাদিতে। কিন্তু J.K. Rowling তখনও বহুৎ দূর। 


প্রিয়তম লেখিকার সাথে গাঁট ছড়া বাঁধল দেবশ্রী দি। ভাগ্যক্রমে প্রায় একই সাথে কলকাতায় বদলী হয়ে এসেছিলাম আমরা কয়েকজন মহিলা অফিসার। বই, সিনেমা নিয়ে আমাদের নিত্য আলোচনা হত। এমনি এক আড্ডায় ডি দি একদিন ঘোষণা করল, " আমি হ্যারি পটার পড়ছি জানো তো। তোমরাও পড়ে দেখতে পারো -।" বিদিশা দি তো জাস্ট উড়িয়েই দিল প্রথম চোটে, আমিও তাই করলাম। সিনেমা গুলো দেখেছি তো, আর বই কিনে কি হবে? ঠিক যে অর্ডারে প্রতিবাদ করেছিলাম আমরা, সেই ক্রমেই হ্যারি পটার পড়তে শুরু করলাম আমরা। পড়তে পড়তে যেন অন্য কোন ইউনিভার্সে ঢুকে গেলাম আমরা। বইয়ে যা পেলাম, তার একটা নগন্য অংশ কেবল সিনেমা গুলোতে পেয়েছি এতদিন। দিন রাত শুধু একই আলোচনা আমাদের। কাজ - কম্ম - সংসার কিছুতে মন নেই আমাদের। 


সিরিয়াস ব্ল্যাকের মৃত্যুর পর সেকি কান্না আমার। মুঠো ফোনের ওপার থেকে কতক্ষণ যে দেবশ্রী দি আমার কাউন্সেলিং করেছিল সেদিন। দুজনের কারো মনে হয়নি যে ওটা তো একটা কাল্পনিক চরিত্র কেবল। আর ডাম্বলডোরের মৃত্যুর কথাটা নাহয় উহ্যই থাক। 


দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল সাত সাতটা বই। অতঃপর সে যে কি অপরিসীম শূন্যতা, কেবল পটারহেডরাই অনুভব করতে পারে। সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। ইতিপূর্বে এই শূন্যতা যতবার দেখা দিয়েছে, ডিটক্স হিসেবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেবার যে কি হল, ব্যোমকেশ, বরদা, তুমি সন্ধ্যার মেঘ সব ব্যর্থ, মন কেবল Joanne Kathleen Rowling কেই চায়। কিন্তু তিনি যে ঘোষণা করে দিয়েছেন আর লিখবেন না। হে ঈশ্বর আমার দিকে একটু তো মুখ তুলে চাও। 


বর্তমান এক্স, তৎকালীন টুইটারে যে কত শত বার মেসেজ করেছি ওনাকে। প্লিজ ম্যাম, এভাবে অনাহারে মারবেন না। জবাবে পেয়েছি হিরন্ময় নীরবতা। Dumbledore, Sirius Black ছাড়ুন যে নারী হাসতে হাসতে Fred Weasley, Lupin, Nymphadora Tonks এমনকি Dobby , Hedwig কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে, তার থেকে আর কিই বা প্রত্যাশা করব, বলতে পারেন? 


ধুর ধুর বেঁচে থেকে আর কোন লাভ নেই, বলে ধরেই নিয়েছি, এমন সময় পটারহেডদের গ্রুপে গ্রুপে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল, আসছেন, তিনি আসছেন। তবে স্বনামে নয়, ছদ্ম নামে। আসছেন Robert Galbraith। বইয়ের নাম The Cuckoo's Calling। ততদিনে তো আমি রীতিমত উপার্জনশীল নারী, পে কমিশন ও হয়ে গেছে, সবার ওপর এসে গেছে আমাজন-ফ্লিপকার্ট। ফ্লিপকার্ট এককালে এক টাকার বই কিনলেও বাড়ি পৌঁছে দেবে বলে বিজ্ঞাপন দিত। কাকে অর্ডার করেছিলাম আজ আর মনে নেই,যদিও। 


হাতে পেয়ে কিঞ্চিৎ নিরাশ হলাম, এর সাথে পটার বা wizards দের কোন সম্পর্কই নাই। এতো নিছক muggle দের গোয়েন্দা গল্প যা দেখি। ধ্যাৎ তেরি! তবুও শুরু করলাম পড়া। আলাপ হল Cormoran Strike এর সাথে। জনৈক বিখ্যাত গায়কের অবৈধ সন্তান। মা ছিল পাক্কা সত্তরের দশকের "হরে কৃষ্ণা হরে রাম" মার্কা হিপ্পি। অগুনতি পুরুষসঙ্গী, মদ, ড্রাগস। শেষ পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবনেই মৃত্যু। স্ট্রাইকের বদ্ধমূল ধারণা যেটা আসলে সুপরিকল্পিত হত্যা। 


মায়ের অবর্তমানে মামা মামীর যত্নে বড় হয়ে মিলিটারি পুলিশ হিসেবে যোগদান করে স্ট্রাইক। আফগানিস্তান অভিযানের সময় বোমা বিস্ফোরণে হাঁটুর নীচে থেকে উড়ে যায় একটা পা। 


হঠাৎ করে বেকার হয়ে যাওয়া, প্রতিবন্ধী তকমা পাওয়া স্ট্রাইক পেটের ধান্ধায় ঠিক করে একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলবে। খুলতে গেলেও যে ন্যূনতম মূলধনের প্রয়োজন, সেটার জন্যও হাত পাততে হয়,কোনদিন কোন তত্ত্বতালাশ না করা জন্মদাতার সামনে। অপমানজনক শর্তে জোগাড় হয়, টাকা। 


ফোন ধরা এবং টুকটাক কাজের জন্য মাত্র কয়েকদিনের অস্থায়ী সহযোগী হিসেবে এজেন্সিতে যোগ দেয় Robin Ellacot। মফঃস্বলের মেয়ে রবিন, বয়সে প্রায় বছর দশেকের ছোট। ইউনিভার্সিটি ড্রপ আউট। কলেজে পড়ার সময় ধর্ষিত হয়ে, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল দীর্ঘ দিন। নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল চার দেওয়ালের মধ্যে। পরিবার তথা বয়ফ্রেন্ড ম্যাথুর সহমর্মিতা আর সাহচর্যে নতুন করে জীবনের সাথে আলাপ করতে সম্মত হয়েছে রবিন। সেক্রেটারি হিসেবে নাম লিখিয়েছে একটা সংস্থায়। সেখান থেকেই টেম্প হিসেবে, মাত্র কয়েক দিনের জন্য এই অফিসে পাঠানো হয় তাকে। পাকাপাকি সেক্রেটারি রাখার মুরোদ কোথায় স্ট্রাইকের। 


যেমন ডিটেকটিভ, তেমনি তার এসিস্ট্যান্ট। দুজনেই এক্কেবারে সাধারণ, না কারোর মগজাস্ত্র আছে, না কোন আগ্নেয়াস্ত্র। এমন চরিত্র এর আগে কোথাও পড়েছি বলে মনেই পড়ে না। ধীরে ধীরে জড়িয়ে যেতে থাকি Cormoran Strike আর Robin এর সাথে। গল্প এগোতে থাকে এঁকে বেঁকে। কখনও স্ট্রাইক এর সাথে খোঁড়াতে থাকি আমরা, প্রস্থেটিক্স আর কাটা পায়ের সংযোগ স্থলে ফোস্কা পড়ে যায় আমাদের। কখনও রবিন এর সাথে অর্থহীন জীবনে নতুন করে অর্থ খুঁজতে বেরোই আমরা। লন্ডনের জঘন্য আবহাওয়ায় তিতিবিরক্ত হয়ে যাই আমরা। স্ট্রাইক এর সাথে Doom Bar আর Fish N Chips সাঁটাই আমরা। এই করতে করতে কখন যে গল্প শেষ হয়ে যায় একরাশ ক্ষিদে রেখে, বেশ বুঝতে পারি, হতাশ করেননি প্রিয় লেখিকা। 


২০১৪ সালে এলো The Silkworm। ততোদিনে রাউলিং যাদুতে আচ্ছন্ন আমার বরও। বই/সিনেমা/ ওয়েব সিরিজ নিয়ে শৌভিক আর আমার কোনদিন মতের মিল হয়না। স্ট্রাইক বোধহয় একমাত্র ব্যতিক্রম। ২০১৫ য় যখন Career of Evil প্রকাশিত হল, ঐ কিনল দৌড়ে গিয়ে।পাক্কা তিন বছরের প্রতীক্ষা অন্তে এল The Lethal White। এই অবধিই ক্রম মেনে পড়েছি আমরা, তারপর এল অতিমারির বছর। প্রকাশ পেল Cormoran Strike series এর নতুন বই। আলোচনা - সমালোচনায় উত্তাল হল বই পাড়া, আমরা নিরূপায়। বড্ড দাম বাপু, আর বড্ড বড় ও। হাজার পাতা, ইয়ার্কি নাকি?


২০২২ এ এলো The Ink Black Heart। ব্যক্তিগত জীবনে এমন তুফান চলছে তখন আমাদের, মাত্র ৪৮ ঘণ্টার নোটিশে তমলুক থেকে কাঁথি বদলী হয়ে গেল শৌভিক। মাঝপথে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হল মেয়েকে। নিত্য ১৫০ কিলোমিটার আপিস যাত্রা শুরু হল আমার - ইত্যাদি প্রভৃতি ছাড়াও, বড্ড দাম আর তেমনি বড়। 


২০২৩ এ এল The Running Grave, ততোদিনে অনেক পিছিয়ে পড়েছি আমরা। ছিঁড়ে গেছে মুগ্ধতার মায়াজাল। "আর কি কখনও কবে "-মাঝে মাঝেই আলোচনা করি আমরা। ব্যাস ওই টুকুই।


গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম এই বছর সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ। সামনেই শৌভিক এর জন্মদিন, মাঝে মধ্যেই বলে, "একটা একটা করে কিনেই ফেলব বইগুলো। এখন দাম ও একটু কমেছে। Kindle এ কিনলে তো আরো সস্তা হবে। পুজোর সময় কিনব বরং, আমাকে তো এখানেই থাকতে হবে, তোরাও থাকবি না - ।" ধুৎ স্ট্রাইক এর গল্প আবার kindle এ পড়ে নাকি? এত হিসাব করলে জীবন চলে নাকি। ফেললাম কিনে তিনটি বই। পেপার ব্যাক গুলোর দামও এখন সাধ্যের মধ্যে। নাহলে ও বাকি, বরের জন্মদিন বলে কতা। 


জন্মদিনের রাতে মোড়ক খুলে শৌভিক খুশি হল কিনা বুঝলাম না বাপু। প্রথমটা খুলে বলল, " এ হে হে, এটা তো শেষটা। এর আগের গুলো - আচ্ছা থাক, আমিই কিনে নেব।" দাঁত কিড়মিড় করলেও বললুম না কিছু। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মোড়ক খুলে বলল, " একেবারে তিনটে না কিনলেও হতো। তিনটে বই কিনবি জানলে আমি অন্য একটা চাইতাম। Dalrymple এর নতুন বইটা -"। ব্যাটাকে জীবনে খুশি করা যায় না মাইরি। তিনি কি সাধে বলেছেন, " যতোই দাও, ততোই চাই।"


দিন যায়, হপ্তা যায়, উপহার দেওয়া চকলেট গুলো একটা একটা করে বেপাত্তা হয়ে যায়। রোজ রাত্তিরে রক্ত চক্ষু দেখায় শৌভিক, কাউকে কিছু দিয়ে ফেরৎ নিলে কি হয়,মনে করিয়ে দেয়। যতই বলি আমি খাইনি, এবাড়িতে আমি ছাড়াও আরো দুজন মিষ্টি খোর আছে, সম্পর্কে ঠাকুমা এবং নাতনি, তাদেরও তো শুধাও। তার বেলায় বোবা এবং কালা হয়ে যায় আমার বর। বই গুলো কেবল অস্পৃশ্য হয়ে পড়ে থাকে, খাস কামরা (অর্থাৎ মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বার) এর বুড়ো টেবিলের ওপর। বললেই শৌভিক বলে, " কখন পড়ব বলতে পারিস?" সত্যিই বেচারার সময় বড় অভাব। মহকুমা শাসকের পাশাপাশি দীঘার দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে দম ফেলার ফুরসৎ পায় না আজকাল। আশ্বস্ত করে, পুজোর ছুটি পড়লে পাতা উল্টে দেখবে। তবে সে আর কতটুকু পড়া হবে?ক্যালেন্ডারের লাল দেখে তো আর সত্যিই ছুটি পাবে না ব্যাটা। 


ইতস্ততঃ করে একদিন নিজেই তুলে নিলাম প্রথম খণ্ড খানা। ট্রাবলড ব্লাড, Cormoran Strike এর প্রথম কোল্ড কেস। চল্লিশ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এক মহিলার কন্যার সনির্বন্ধ অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে বাধ্য হয় স্ট্রাইক। শর্ত একটাই, এক বছরের মধ্যে যদি সমাধান হয় তো ভালো, নইলে ফান্ড তুলে নেবে ক্লায়েন্ট। হাতে থাকা আরো চারটে হাই প্রোফাইল কেসের পাশাপাশি তদন্ত শুরু হয় এই কেসেরও। কিন্তু চল্লিশ বছর আগে নিখোঁজ এক মহিলাকে খুঁজে বার করা কি এতোই সহজ! বিগত চার দশকে আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেছে সবকিছু, হারিয়ে গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তথা সাক্ষী। মারা ও গেছেন কতজন। কি ভাবে সম্ভব এই কেসের তদন্ত। 


১০৭৪ পাতা আক্ষরিক অর্থেই গোগ্রাসে গিলে সদ্য শেষ করলাম বইটা। কেন যে Joanne Kathleen Rowling ই আমার প্রিয়তম লেখক আরেক বার নতুন করে অনুভব করলাম। সাথে সাথে হেব্বি গর্ব ও হল মাইরি নিজের জন্য, জীবনের এই সন্ধিক্ষণে সব দিক সামলে, সব দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে ও হাজার পাতার ইংরেজি বই শেষ করা কি চাট্টি খানি কথা। ইশ নব্বইয়ের দশকের মেয়েটা যদি জানত, যে বাংলা মিডিয়াম হলেও জলের মত পড়া যায় সব ফিরিঙ্গি সাহিত্য। 


যাই হোক, শুভ প্রতিপদ। মা আসছেন বছর ঘুরে। কেটে যাক সকল আঁধার।