Monday, 4 November 2024

অনির ডাইরি নভেম্বর, ২০২৪

 অনির ডাইরি ১২ই নভেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



শাড়ি পরব, না সালোয়ার? দোদুল্যমানতায় ভুগি। শৌভিককে জিজ্ঞাসা করব কি? বিয়ের পরপর, শুধালে আমার বরের একটাই উত্তর থাকত, শাড়ি। আজকাল যাই পরি, কিছুই যায় আসে না। এই তো গতকালই একটা নিমন্ত্রণ ছিল যুগলের, শুধালাম, কি পরব রে? জাস্ট কাঁধ ঝাঁকাল। অর্থাৎ যা প্রাণ চায়। ভেবে চিন্তে একটা শাড়িই পরলাম, মানে পরার চেষ্টা করলাম। আপদ শাড়ি, কিছুতেই আর কুঁচি ফেলে না। রেগেমেগে, গলদঘর্ম হয়ে স্বগতোক্তি করলাম, " শাড়ি পরতে ভুলে গেলাম নাকি!" তিনি তো তিন মিনিটে রেডি, ঘড়ি দেখতে দেখতে কেজো সুরে মন্তব্য করলেন, " শাড়ি পরছিস কেন?" জানালাম, তাঁর সঙ্গে যাচ্ছি, তাঁর পরিচিতের পুত্রের অন্নপ্রাশন, তাই তাঁর সম্মানার্থে শাড়ি পরছি। ভাজা মাছ উল্টে না খেতে পাওয়া মুখে তিনি বললেন, " কিন্তু আমি তো শাড়ি পরছি না।" 


এই না হলে আমার বর! তবে সে তো গত কালকের কথা ছিল। আজ আবার একটা নিমন্ত্রণ আছে। আমাদের শুভাশিসের কনিষ্ঠ পুত্রের অন্নপ্রাশন। গোটা আপিসের নিমন্ত্রণ থাকলেও, ইন্সপেক্টর সাহেবরা বোধহয় কেউই যেতে পারবে না। সৌরভকে তো সেই পুজোর পর থেকে আর দেখিনি। গণমাধ্যমে চোরাগোপ্তা ছবি দেখছি কেবল, হাঁটুর কাছে প্যান্ট গুটিয়ে, হাতে ফাইল আর বুক পকেটে পেন গুঁজে বাড়ি বাড়ি ইন্সপেকশন করছে সৌরভ। সেদিন ময়নার এক SLO খবর দিলে," স্যারের খুব জ্বর ম্যাডাম। নোংরা জল ভেঙে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে গিয়ে পায়ে ইনফেকশন হয়েছে। ঘ্যাসঘ্যাস করে চুলকাচ্ছেন আর ইন্সপেকশন করছেন। শনিবার নেই, রবিবার নেই, কালী পুজো নেই। কেবল ভাইফোঁটায় একটা ছুটি পেয়েছেন।"


 শুনি আর ভাবি, কে জানে, ছেলেটাকে আর জ্যান্ত ফেরৎ পাব কি না। বাকিদের অবস্থা ও তথৈবচ। সন্দীপ তো সক্কাল সক্কাল ছবি পাঠিয়েছে, নৌকা করে বাড়ি ইন্সপেকশন করছে। সৌরভের থেকে অন্তত একটু পদের। 


দেড়টা নাগাদ নভোনীল বাবু এসে তাড়া লাগান,  " চলুন ম্যাডাম। আমরা যে কজন আছি, তারাই ঘুরে আসি।" তাহলে আপিসে থাকবে কে? প্রতিবার চঞ্চল আর সৌরভ থেকে যায় আপিস সামলাতে। সৌরভের কথা তো আগেই বলেছি, চঞ্চল এবার ছুটি নিয়ে সকাল থেকে শুভাশিসের বাড়ি গেছে, প্রভুর নামগান করতে। শুভাশিসের বাড়ি গোবর্ধনধারী আসবেন যে।


প্রসঙ্গতঃ গোবর্ধনধারী হলেন বালক শ্রীকৃষ্ণ, নাড়ুগোপাল আর রাধাস্বামীর মাঝামাঝি।  কষ্টি পাথরে নির্মিত, রুপার চোখ, মাথায় প্রকাণ্ড মুকুট, সর্বাঙ্গ গহনায় মোড়া। গোবর্ধনধারীর প্রবল ডিমান্ড এই চত্বরে। কোলাঘাট ব্লকের দেরিয়াচকে ওনার মন্দির। কিন্তু সেই মন্দিরে মোটেই থাকেন না গোবর্ধনধারী, তিনি ঘুরে বেড়ান ভক্তদের বাড়ি বাড়ি। কারো বাড়িতে শুভ কাজ হলে আগেভাগে ডেট নিতে হয় গোবর্ধনধারীর। পাঁচ ছয় মাসের আগে কোন ডেট মেলা ভার। একেক দিনে চার পাঁচ বাড়িতে দর্শন দেন গোবর্ধনধারী। আর এই পথ উনি অতিক্রম করেন পালকিতে। সেই পালকি বহনের ও নির্দিষ্ট লোক থাকে। তবে শর্ত একটাই, গোবর্ধনধারী নদী পার হবেন না। 


শেষ পর্যন্ত জনা তিনেক রয়ে গেল আপিসে। আমরা কথা দিয়ে গেলাম, ফেরার সময় গোবর্ধনধারীর প্রসাদ সঙ্গে করে নিয়ে আসব। আপিস থেকে খুব বেশি দূর নয়, হবে না হবে না করেও নেহাৎ কম লোক হয়নি। গাড়ির দরজা কোন মতে চেপে চুপে বন্ধ করতে হল। নভেম্বর মাসের অপরাহ্নের সূর্যের একটা আলাদাই রঙ থাকে। একটু বেশীই দেরী করে ফেলেছি আমরা, কে জানে গোবর্ধনধারীর সাথে সাক্ষাৎ হবে কি না। যা ব্যস্ত থাকেন ভদ্রলোক। শুভাশিস আমাদের কথা ভেবেই, বার বার অনুরোধ করেছে, একটু যেন বেশী ক্ষণ থাকেন গোবর্ধনধারী। বাকি তাঁর ইচ্ছা। 


ফাঁকা হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলা গাড়ি, হঠাৎ টলমল করে ডিভাইডারে উঠে উল্টো লেনে ঢুকে পড়ে। আমি কিছু বলার আগেই বেদজ্যোতি বলে," এই কাটটা স্থানীয় মানুষজনই বানিয়েছে ম্যাডাম। নাহলে প্রায় দশ কিলোমিটার আরও ফালতু ঘুরতে হয়।" কাট বলা বাতুলতা, ডিভাইডারের খানিকটা চেঁচে সমতল করার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। গাড়ি উল্টো লেনে খানিক যেতেই দৌড়ে এসে হাত দেখায় রঞ্জিত। প্রথমার্ধে ইন্সপেকশন সেরে, বাইক নিয়ে সোজা চলে এসেছে। আমাদের জন্যই প্রতীক্ষা করছিল। আমরা টিম তাম্রলিপ্ত, যেখানে যাই, একসাথে যাই। 


ডান হাতে লাল মোরামঢালা ছোট মাঠ,  বাম হাতে সরু ঢালাই রাস্তা। এই রাস্তা ধরে মিনিট দশেক গেলে তবে শুভাশিসের বাড়ি। রাস্তা দেখে ড্রাইভার সাহেবের কপালে ভাঁজ গভীরতর হয়। এই রাস্তায় চার চাকা কি আদৌ যাবে? নিজেদের মধ্যেই বিতণ্ডা বেঁধে যায়,  একদল বলে আলবৎ যাবে, আরেকদল বলে, পাগল নাকি। ফেঁসে গেলে কি হবে? দুই দলই শুভাশিসকে ফোন করে। তাতেও মেটে না জটিলতা।


উল্টে সামনের চায়ের দোকানে আড্ডারত লোকজন সামিল হয়ে যান আমাদের বিতর্কে। গ্রামের দিকে যেমন হয় আর কি। " শুভাশিসের বাড়ি যাবেন নাকি? কে বলেছে গাড়ি যাবেনি। আলবৎ যাবে। গাড়িতে বসেন, গাড়িতে বসেন। আমরা পথ দেখিয়ে লিয়ে যাইছি।"  একজন বাইকওয়ালা পথপ্রদর্শক হয়ে খানিক এগিয়েও যায় -  


 আমরাও সবাই হুড়মুড় করে আবার গাড়িতে উঠে বসি, এমন সময় বাইক নিয়ে উদয় হয় স্বয়ং শুভাশিস। " গাড়ি যাবেনি, গাড়ি যাবেনি। ম্যাডাম আপনি আমার বাইকে আসুন, বাকিরা হেঁটে চলো"। শুভাশিসের পরনে সুদৃশ্য লাল পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, পা খালি। বুঝতে পারি হরিনামের আসর ছেড়ে এসেছে শুধু আমাদের জন্য। শুভাশিসের বাইকটা বেশ উঁচু, আর আমি বাইকে বসতে মোটেই সড়গড় নই। ইতস্ততঃ করছি দেখে, পাশ থেকে হেলমেট পরা কে যেন বলে, "ম্যাডাম আমার বাইকে আসুন। এটায় আপনার উঠতে সুবিধা হবে।" গলার আওয়াজে চিনতে পারি, এটা আমাদের  সন্দীপ। প্রথমার্ধে ইন্সপেকশন সেরে ছুটে এসেছে আমাদের সাথে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। 


দুদিকে ঘন সবুজ ধানক্ষেতে ইতিউতি লেগেছে সোনা রঙ, মাঝ খান দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে সরু ঢালাই রাস্তা। ধান ক্ষেত থেকে উঠে আসছে প্রাণ জুড়ান শীতল বাতাস। বেশ খানিক দূর থেকেই শোনা যাচ্ছে হরিনামের বোল। রঙিন কাপড় দিয়ে বানানো গেটের সামনে ছাড়া রয়েছে অসংখ্য জুতো। ভিতরে খোলকরতালের সাথে চলছে উদ্বাহু নৃত্য। পাশের দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করি আমরা। সিঁড়ির নীচে জুতো খুলে, সোজা দোতলায়। সেখানেই সিংহাসন আলো করে বসে আছেন তিনি, আসল নাড়ুগোপাল। পোশাকি নাম স্বস্তিক। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, নধর কান্তি, পরণে মেরুন ধুতি আর তসররঙা পাঞ্জাবি। শুভাশিস বা ওর গিন্নীর কোন বাধানিষেধ নেই, যে পারছে গিয়ে কোলে নিচ্ছে ছোট্ট ছানাকে। তারপর আশ মিটিয়ে চটকাচ্ছে। ফলতঃ তিনি যে বেশ বিরক্ত অচীরেই উচ্চঃস্বরে কেঁদে জানান দিলেন। 


ওই অবস্থাতেই কে যেন আমার কোলে দিতে এসেছিল তাঁকে। বললাম, আগে ওর ধড়াচূড়া খুলে নির্ভার করো বাপু, ফাঁক তালে খানিক চটকেও দিলাম। কি নরম পেটু আর কি মসৃন গা। কি মিষ্টি একটা গন্ধ গায়ে। নির্ভার হয়ে, দেখতে দেখতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন মায়ের কোলে। 


গোবর্ধনধারী এসেছেন মানেই নিরামিষ ভোজন। গোবর্ধনধারী যখন আসেন সঙ্গে পাঁচক ঠাকুরও নিয়ে আসেন। প্রয়োজনে যারা হাজার বারোশো নিমন্ত্রিত লোকেরও রান্না করে দেয়। উনি এলে বিনা নিমন্ত্রণেও সেখানে ভিড় জমায় ভক্তবৃন্দ, মাটিতে পাত পেড়ে সেবন করে প্রভুর প্রসাদ। ঠাকুরের মাহাত্ম্য এমনি, যে যতই লোক আসুক না কেন,ভোগ কোনদিন কম পড়ে না। আমাদের জন্য যদিও চেয়ার টেবিলের সুবন্দোবস্ত। গোবর্ধনধারীর প্রিয় খাদ্য,' বিছা কলা', অর্থাৎ বীজ সমেত কাঁচা কলা। রাস্তায় কোথাও যদি বিছা কলার কাঁদি দেখতে পান উনি, তাহলে নাকি এমন লোভ দেন যে পালকি প্রবল ভারী হয়ে যায়, আর তাঁকে নড়ানোই যায় না। মাটির মালসায় করে এনে পাতে পাতে দেওয়া হল বিছা কলার তরকারি। তার সাথে বেগুনি, পোলাও আর চানা পনীর। তারপর আসে ভাত। এরা বলে অন্ন। সাথে শুক্ত, গরম মুগের ডাল, নানা রকম তরকারী, চাটনি, পরমান্ন, রসগোল্লা, মিষ্টি দই ইত্যাদি। 


 খাওয়া যখন প্রায় শেষের পথে, রঞ্জিত বলে, "ম্যাডাম মাইকে যার হরিনাম সংকীর্তন শুনছেন, ওটা কার গলা বলুন দিকি?" সবে পায়েসটা মুখে দিয়েছি, এমন সময় এই ধরণের বদখত প্রশ্ন কেউ করে। কান করে শুনে দেখলাম,গলাটা চেনা চেনা লাগছে বটে। শান্তনু পাশ থেকে ফস করে বলে ওঠে, " ম্যাডাম চঞ্চল দা কেমন গান গাইছে শুনতেছেন। গান গাইতে গাইতে কি নাচ নাচছে ম্যাডাম। একবার দেখে আসুন।" 


জীবন্ত বালগোপালকে কোলে নিয়ে চঞ্চলের গান শুনলাম, নাচ দেখলাম। আর দেখলাম গোবর্ধনধারীকে। অবশেষে দর্শন দিলেন তিনি। আশ মিটিয়ে দেখলাম,  অনুমতি নিয়ে গুটি কয়েক ছবিও তুলে নিলাম। কে জানে আবার কবে দেখা হয়। এবার প্রসাদ বগলে আপিসে ফেরার পালা। আমাদের জন্য আত্মত্যাগ করে আপিস সামলাচ্ছে তিন মহারথী, তাদের কথাও তো ভাবতে হবে।


অনির ডাইরি ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


বেশ কিছুদিন আগের কথা, পাশের অফিসের জনৈক অফিসারকে ফোন করেছি কিছু দরকারে, ফোন ধরেই কেঁদে ফেললেন ভদ্রলোক। রীতিমত থতমত খেয়ে গেলাম আমি, বদমেজাজী, মুখরা বলে আমার প্রচুর বদনাম, কিন্তু ভদ্রলোককে তো এখনও পর্যন্ত, " হ্যালো, অমুক বাবু-" ছাড়া তো কিছুই বলিনি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে রইলাম খানিকক্ষণ, নিজেকে সামলে ভদ্রলোক বললেন, " ম্যাডাম আমি অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছি। বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে -"। ঠিক আছে, সাবধানে যান ছাড়া আর কিছু বলতে পারলাম না। পরে শুনলাম, ভদ্রলোকের নববিবাহিতা কন্যা সন্তানসম্ভবা হয়েছিল, স্থানীয় ডাক্তারের পরামর্শে X-ray করিয়ে সর্বনাশ ঘটে গেছে। মাসখানেক পর বলতে গিয়েও ভিজে উঠছিল ওনার চোখের পাতা। " টুইনস ছিল ম্যাডাম। দুটোই ছেলে। মেয়ে আমায় সব বলে আর এটা বলল না। জাহিল (অশিক্ষিত) অসভ্য পরিবার, আমার মেয়েকে এমন হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল, সব শেষ করে দিল ম্যাডাম। সব শেষ করে দিল।" 


কি বলব বুঝে উঠতে পারি না। সেদিন আমার চেম্বারে বসেই কথা হচ্ছিল। ভদ্রলোক, আমি ছাড়াও উপস্থিত ছিল এক ইন্সপেক্টর। পরে ইন্সপেক্টর সাহেব আমায় আলাদা করে বললেন," এটা খুবই দুঃখের ম্যাডাম। কিন্তু আজও যে কত জায়গায় এটা হয়। অমুককে চেনেন তো, ওর সাথেও হয়েছিল। " এবার যার কথা হচ্ছে, সেই ছেলেটি আমাদেরই এজেন্ট। অবস্থাপন্ন, হাসিখুশি, দিলখোলা ছেলে। হতবাক হয়ে যাই, তার সাথেও এমন হয়েছে? ইন্সপেক্টর সাহেব বলেন, "হ্যাঁ ম্যাডাম। কি আর বলি। অন্য কোন সমস্যা হচ্ছিল হয়তো, তমলুকের নামি ডাক্তার, X-ray করতে বলল -। ব্যাস, ওখানেই শেষ। পরে জানা গেল ছেলে ছিল। " ছেলে হোক বা মেয়ে, সন্তান তো সন্তানই। সান্ত্বনার কথা এটাই যে ছেলেটির আগে থেকেই যমজ বাচ্ছা আছে। দুটোই মেয়ে। ছবিও দেখেছি তাদের বাবার ফোনে। গর্বিত বাবা নিজেই দেখিয়েছিল। তাও, এ ব্যথা যে কি ব্যথা। পৃথিবীর মর্মান্তিকতম ব্যথা। 


এবছর পুজোর আগে, হঠাৎ করে ভাইরাল ফিভারে পড়লাম। যথারীতি শ্রীমতী তুত্তুরী বয়ে এনেছিলেন ইস্কুল থেকে। প্রথমে তাঁর হল, ওই অবস্থায় তাঁকে জড়িয়ে আদর করে, হামি খেয়ে আমিও বাঁধালাম। জ্বর বাঁধালে বাচ্ছা গুলো যেন পাঁচ গুণ মিষ্টি হয়ে যায়, আর আমার সংযম বরাবরই কম। শ্রীমতী তো দুদিনে সুস্থ হয়ে দৌড়াতে লাগলেন, আমি আর উঠতেই পারি না। প্রতিটা লক্ষণ চিৎকার করে বলে, "কোভিড হয়েছে বাপু তোমার। অন্য কিছু লয়।"  তীব্র জ্বর আর গা-হাত-পা ব্যথায় কাতর হয়ে শুয়ে আছি, ঝনঝন করে বেজে উঠল মুঠো ফোন। ওপাশ থেকে জনৈক সহকর্মীর সহমর্মী কন্ঠস্বর, " ম্যাডাম একটা বাজে খবর আছে -"। ছ্যাঁত করে উঠল হৃদয়, সবাই ঠিক আছে তো? ছেলেটি একরাশ দুঃখ গেলা গলায় জানালো, " অমুক দার জোড়া মেয়ের একটা কাল -"। কিঃ? শুনতে পাই না। বিশ্বাস করতে পারি না আমি।


চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেয়েদুটোর জন্মদিনের ছবি। আমাকেও নিমন্ত্রণ করেছিল ওদের বাবা। কিন্তু আগে থেকেই অন্য একজনের নিমন্ত্রণে সাড়া দেওয়া ছিল বলে যেতে পারিনি। মুখপুস্তকে ছবি দেখেছি। ফুটফুটে দুই বোন, একই রকম পোশাক পরে, একই রকম হেসে ছবি তুলেছে। তাদের একজন নেই? কি করে সম্ভব সেটা? কোন মতে জিজ্ঞাসা করি, কি হয়েছিল? জবাব আসে, নিউমোনিয়া। কলকাতার হাসপাতালও ব্যর্থ হয়েছে বাচ্ছাটিকে তার বাপমায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে।


মন চায়, ছেলেটিকে একবার ফোন করি। কিন্তু সদ্য সন্তানহারা পিতাকে কি বলব বুঝে উঠতে পারি না। কি অবস্থায় যে আছে এখন -। অনেক বার ভাবি, অনেক দিন ধরে ভাবি তাও বুঝে উঠতে পারি না। শেষে ওই ব্লকের ইন্সপেক্টর ছেলেটিকে ধরি, আমাকে একবার ওর বাড়ি নিয়ে যাবে? মুঠো ফোনেই কিছু বলে উঠতে পারিনি, মুখোমুখি কি বলব কে জানে। তবুও -। যে দিন যাবার কথা, তার আগের দিনই মুঠো ফোনে খবর এল, দ্বিতীয় বাচ্ছাটিও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। কি হয়েছে কেউ ঠিক বলতে পারল না, ইন্সপেক্টর সাহেব কেবল বললেন, " শিশু হতে পারে, ট্রমা তো ওর ও কিছু কম নয়। দুই বোন কি সুন্দর এক সঙ্গে বেণী দুলিয়ে স্কুল যেত, খেলাধুলো করত -"। সত্যি বড়দের কষ্টের কথা ভাবতে গিয়ে বাচ্ছাটির কথা তো আমরা ভুলেই গেছি। 


যাই হোক, হে ঈশ্বর, এটা যেন সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। অভাগা বাবা মাকে আর যাতনা দিও না প্রভু। বাচ্ছাটা সুস্থ হয়ে ওঠে অচিরেই, কিন্তু আমাদের আর ওদের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠে না। দেখতে দেখতে এসে যান দশভূজা। পুজোর ছুটির পর কটা দিন আপিস তারপরই আমাদের দীপাবলী। আপিস সেজে ওঠে আলোকমালায়, ভিড় জমে ওঠে লোকজনের। সম্মিলিত আনন্দে খুশিতে গরীব আপিস আমার যেন ঝলমলিয়ে ওঠে। এক ফাঁকে ওই ব্লকের ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করি, সেই ছেলেটির কি খবর? ইন্সপেক্টর সাহেব খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেন, " আজ আসবে কিনা, কিছুতো বলেনি ম্যাডাম। দাঁড়ান ফোন করছি -"। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে ছেলেটির কন্ঠ, "হেলো"। ইন্সপেক্টর সাহেব বলেন, " আপনি কি আসছেন? ম্যাডাম খোঁজ নিচ্ছেন।" সদ্য ইন্সপেক্টরটিকে অ্যাপ্রাইজাল দিয়েছি, আমি কাউকে খারাপ নম্বর দিই না। হাঁড়ি উল্টে নম্বর দিই। একেও দিয়েছি, আজ মনে হচ্ছে কেন দিলাম। ব্যাটাকে ভেরি পুওর দেওয়া উচিৎ ছিল। একজন সন্তান হারা পিতাকে এই অনুষ্ঠানে আসতে বলার ধৃষ্টতা আমার আছে? রেগে ফোনটাই কেড়ে নিই ব্যাটার কাছ থেকে। বলি, " আমি তোমাকে একবারও না আসার জন্য খুঁজিনি বাবা। জাস্ট জানতে চেয়েছি তুমি কেমন আছ।" 


ছেলেটির দরাজ গলা ভেসে আসে মুঠোফোনের ওপাশ থেকে,"আমি আসছি ম্যাডাম। সিঁড়িতে।উঠে আপনার চেম্বারে যাচ্ছি।" বরাবরের মতোই হাসি মুখে প্রবেশ করে ছেলেটি। এর ওর পিছনে লাগে সামান্য। সবই বড় বেশি স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকত্ব বড় বেশী আরোপিত, বড় বেশী করুণ। বড় বেশী অস্বাভাবিক। একগাল হাসি নিয়ে আমার উল্টো দিকে বসে ছেলেটি। চুপ করেই থাকি দুজনে। ঘরে আগে থেকেই উপস্থিত দুজন ইন্সপেক্টর, একজন CKCO, এক পিওন সবাই নির্বাক। মাথা নীচু করে যে যার কাজ করে যায়। 


আমিই নীরবতা ভঙ্গ করি, জানাই অনেক বার ভেবেছি এই দুর্দিনে একবার ছেলেটির বাড়ি যাব। কিন্তু ব্যাটে বলে আর হয়নি। ছেলেটি হাসে, তারপর বলে, " আর কি করব ম্যাডাম। স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি, কিন্তু -"। এই কিন্তুর পর আর কিছু বলার থাকে না। ছেলেটি নিজে থেকেই বলে, " বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, কিছু ছিল না। কোন রোগ ব্যধি কিস্যু না। একদিন স্কুল থেকে ফিরল অল্প জ্বর আর সামান্য কাশি নিয়ে। খুকখুকে কাশি। আমি কাজে ছিলাম, ওর মা আমায় ফোন করে বলল, 'একবার ডাক্তার দেখিয়ে নাও। কাশিটা যেন কেমন লাগছে।' সাধারণত এমন হলে আমরা কি করি, বাড়িতে কাশির ওষুধ থাকেই, তাই খাইয়ে দিই।" 


নীরবে সম্মতি জানাই আমি। ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ির মেয়ে আমি, ওষুধ আর ডাক্তারে আমার এমনিতেই ফোবিয়া আছে। কাশি হলে আমার ভরসা আদা মধু আর তুলসী পাতার রস আর গরম জলে গার্গল। একেবারেই না কমলে তবে কফ সিরাপ। ছেলেটি না থেমে বলে চলে, " আমি ফেলে রাখিনি ম্যাডাম।কাজে ছিলাম, কাজ ফেলে এসে স্থানীয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছি। ডাক্তার বলল, কিছু না। কাশির আর জ্বরের ওষুধ দিল। বলল সেরে যাবে। দুয়েক দিন দেখলাম, কাশি কমছে না দেখে নিয়ে এলাম তমলুক, অমুক ডাক্তারের কাছে -"।


 তমলুকের ডাক্তার বাবুর নাম শুনেই সিকেসিও ছেলেটি কপালে হাত ঠেকায়, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, "উনি এই শহরের সেরা শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ম্যাডাম। ডাক্তার নন, সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি।" সদ্য সন্তানহারা ছেলেটি মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দেয়, তারপর বলে, " আমাদের পাড়ার ডাক্তার বাবুও সঙ্গে এসেছিলেন, বড় ডাক্তার বাবু দেখে বললেন, ' তুমি ঠিকই চিকিৎসা করেছ। শুধু সিরাপের বদলে ইনজেকশন দিয়ে দেখ।' আর আমায় কইলেন, দিন সাতেক ওষুধ চলুন, তারপর ওনাকে রিপোর্ট দিতে। সাতদিন কি ম্যাডাম, মেয়ের অবস্থার অবনতি দেখে আমি দেড় দিনের মাথায় আবার নিয়ে গেলাম মেয়েকে। 


এবার আমাদের দেখেই ওনার মুখটা হাঁড়ি হয়ে গেল। গম্ভীর ভাবে শুধু বললেন, ' অবস্থা সুবিধার বুঝছি না। একে এখনি কলকাতা নিয়ে যাও।' বিশ্বাস করবেন নি ম্যাডাম, আমি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি। শুধু কচির মাকে ( তমলুকে ছোট বাচ্ছাদের/ সন্তানকে আদর করে কচি বলা হয়) বললাম দুটো জামা প্যাক করে নাও, আর একজন আত্মীয়কে নিলাম যে এইসব হাসপাতালে কথা বলা, ছুটা দৌড়া (দৌড়াদৌড়ি) করা ভালো পারে। ব্যাস সোজা শিশুমঙ্গল। সেখানেও কেউ খারাপ কিছু বলছে না। মেয়েও দিব্যি কথা বলছে আমাদের সাথে -। " আরও অনেক কিছু বলে চলে ছেলেটি, কেমন করে শিশুমঙ্গল থেকে ছাড়িয়ে কলকাতার মূল্যবানতম হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সেখানেও কেমন স্বাভাবিক ছিল মেয়ে। আজও কানে বাজছে ছেলেটার কথা, " এত বুদ্ধিমান ছিল মেয়েটা কি বলব। আর তেমনি শৌখিন। আর কটা দিন পরই ওর জন্মদিন ছিল। ফ্লিপকার্ট এ জামা অর্ডার করেছিল নিজেই। ওই অবস্থাতেও বলছে, ' বাবা তুমি, মা সব তো এখেনে, আমার জামাটা যদি দিয়ে আসে আজ -'! আমরা ততক্ষণে জানি ও আর কয়েক ঘণ্টা মাত্র। ডাক্তার এবার ভেন্টিলেশনে ঢোকাবে -"। 


শুধু আমি নই, ঘরে উপস্থিত প্রতিটা লোক যেন অন্তঃস্থল থেকে কেঁপে ওঠে। এই দিন, এই মুহূর্ত যেন চরম শত্রুকেও না দেখতে হয়। নিজেকে সামলে নেয় ছেলেটা, বলে, "আমি জোর করেই রাস্তায় বেরিয়েছি ম্যাডাম। কাজে মন দেবার চেষ্টা করছি। কিন্তু বাড়ির যা অবস্থা। একদিকে আমার মা, একদিকে আমার বউ। আমি যে কাকে দেখি -। দুজনেই কেবল কাঁদে। সারাদিন শুয়ে থাকে আর কাঁদে।" বেশ খানিকক্ষণ নীরব থেকে ছেলেটি আবার বলে ওঠে, "তবে একজন কাঁদে না ম্যাডাম। একদিনও কাঁদেনি। দুজনে তো একসঙ্গেই থাকত, এত ভাব ছিল দুজনের। অথচ সে চলে যাবার পর, এ যেন হঠাৎ করে কি বড় হয়ে গেল। রোজ রাতে ওকে জড়িয়ে ওর মা আর আমি কাঁদি। খুব কাঁদি। ও নীরবে আমাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। মাথায় বিলি কেটে দেয়। একটি বারও তার নাম করে না। আমি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ' আমরা কেন কাঁদি জানিস?' বলেছিল, ' জানি তো। বনু নেই। তার জন্য তোমাদের মনে খুব দুঃখ।' বললাম, ' তোর দুঃখ হয় না, বনু যে আর কোনদিন ফিরে আসবে না?' ওই টুকু মেয়ে কি বলল, জানেন ম্যাডাম, ' দুঃখ হয় তো। কিন্তু আমার কি কাঁদার সময় আছে। আমায় যে শক্ত থাকতেই হবে, তোমাদের জন্য। নইলে তোমাদের সামলাবে কে?"'

No comments:

Post a Comment