Thursday 3 October 2024

অনির পুজোর ডাইরি অক্টোবর, ২০২৪

 অনির পুজোর ডাইরি ১৩ই অক্টোবর, ২০২৪

শুভ মহাষ্টমী #অনিরডাইরি 



"অনি-" ফোনের ওপার থেকে সঞ্চিতার ব্যস্ত কন্ঠ জানতে চাইল " তুই কোথায়?" ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে এগারো। হে ঈশ্বর, সাড়ে এগারোটার মধ্যে তো আমার পৌঁছে যাবার কথা ছিল। আমি তো এখনও বাড়ি থেকেই বেরোইনি। এই লেট হওয়া নিয়ে দিন দুয়েক আগে দুই ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সাথে হেব্বি বাওয়াল হয়ে গেছে। আর আজ আমিই কি না - 


মনে মনে নোট করলাম, আরেক বার ক্ষমা চাইতে হবে ব্যাটাদের কাছে। যদিও ইতিমধ্যেই মার্জনা ভিক্ষার সংখ্যা শ খানেক ছাড়িয়েছে। তবুও, কপটতার একটা সীমা তো থাকে মাইরি। নিজের বেলায় আঁটিশুঁটি, ওদের বেলায় দাঁত কপাটি? সঞ্চিতাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললাম, "এই তো বেরিয়েছি।" সম্মুখে ক্যামেরা হাতে অপেক্ষমান তুত্তুরীর কপালে গভীরতর হয় খাঁজ, মাটা তাহলে মিথ্যুকও। 


কি করি, ওই যে বলে না, বিপদে বুদ্ধিমানেরা অর্ধেক ত্যাগ করে। গোটা পুজোয় বাবা মায়ের সাথে একটাও ছবি তোলা হয়নি, আজ দুজনকেই পটিয়ে, সাজিয়ে গুছিয়ে রাজি করেছি। এই মুহূর্তে একগাল হাসি নিয়ে বাঁ দিকে আমায় জড়িয়ে আছে বাবা, ডানদিকে মা। এই সোনালী মুহূর্তটার জন্য একটু মিথ্যে, একটু হিপোক্রেসি তো চলতেই পারে।


বাড়ি থেকে হলের দূরত্ব হাঁটা পথে মিনিট দশ পনেরো। কিন্তু ঠাকুর দেখার নামে যে অত্যাচার হয়েছে পদ যুগলের ওপর, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমার মত পৃথুলার দেহেও মাসলস্ বলে বস্তু কিছু আছে। তার ওপর কেন যে মরতে উঁচু গোড়ালির জুতোটাই পড়লাম। তৃষিতের মত দুদিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটি, একটা টোটো যদি -। আজ বোধহয় ঈশ্বর সত্যিই সুপ্রসন্ন, এক বয়স্ক কৃশকায় টোটোওয়ালা বসে বিড়ি ফুঁকছিল, সনির্বন্ধ অনুরোধে যেতে তো রাজি হল, শর্ত একটাই, বিড়িটা শেষ করতে দিতে হবে। 


গিয়ে যখন পৌঁছলাম, সঞ্চিতা রাস্তার উপরেই দাঁড়িয়ে। দেখে খুশি হল কি না বুঝতে পারলাম না,ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল, " জল এনেছিস?" একেই বোধহয় বলে, 'এক গাল মাছি '। সঞ্চিতার আর আমার সিনেমা দেখার ইতিহাস তো আজকের নয়। বন্ধুত্বটাই তো আজকের নয়। কত রকম যে পাকদণ্ডি ধরে এগিয়েছে আমাদের সিনেমা দেখার ইতিহাস, তার সাক্ষী হাওড়া শহরের সিনেমা হল গুলো। যাদের মধ্যে শ্রীরূপা, নবরূপম, পার্বতী আর শ্যামশ্রী আজ শুধুই ইতিহাস। শান্তি আর পুষ্পশ্রী অবশ্য আজও টিকে আছে। এদের মধ্যে পুষ্পশ্রী নাকি উন্নীত হয়েছে মাল্টিপ্লেক্সে। একসঙ্গে একাধিক 'বই' চলে আজকাল। আপাতত সবই বাংলা। আমাদের আজকের গন্তব্য ও পুষ্পশ্রী। 


আজ মহাষ্টমী কি না,রাস্তায় বেশ ভিড়। ভিড় কাটিয়ে যুগলে গেলাম জল কিনতে। হাঁটতে হাঁটতে বেজায় হাসি পাচ্ছিল অতীত নানা কথা ভেবে। সেই যে সেবার রাজ -২ দেখতে গিয়েছিলাম আমরা, মায়েদের নিয়ে শান্তিতে। একে তো সাংঘাতিক সাউন্ড সিস্টেম, তায় ছারপোকাদের সম্মিলিত আক্রমণ। আজও সকালে শৌভিক বলছিল, দুটো চটের আসন নিয়ে যেতে। মনে আছে, ভয় পেয়ে বার বার সঞ্চিতাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আমি। আর সঞ্চিতা হুমকি দিচ্ছিল, "আরেকবার জড়িয়ে ধর, আমি উঠেই চলে যাব।" 


এতো তাও ঠিক ছিল, তারপর স্ক্রিনে ইমরান হাশমির প্রবেশ। ইমরানের তৎকালীন নামই ছিল "সিরিয়াল কিসার"। ফলে মায়েদের সে কি দাঁত কিড়মিড়। সেই সব গল্প করতে করতে কখন যে হলের আলো নিভে গেল বুঝতেই পারলাম না। নন্দিতা শিবপ্রসাদের বহুরূপী দেখতে এসেছি আমরা। সঞ্চিতাই দেখাচ্ছে, আমি সঙ্গী। 


তামাক সেবনের কুফল দেখানো শুরু হতে খানিক থমকালো আমাদের বার্তালাপ। নয় নয় করে ভালোই ভিড় হয়েছে। পিছনের সিট সব ভর্তি। সামনেও সামান্যই খালি। " এগুলো কেন দেখায় বলতো?" সামান্য বিরক্তি নিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে সঞ্চিতা। পর্দায় তখন খৈনি সেবনের ফলে কর্কট রোগাক্রান্ত জনৈক ব্যক্তি দুঃখের সঙ্গে ঘোষণা করছেন, " বহুৎ বড়ি গলতি হো গিয়া।" ভদ্রলোকের মুখের যা অবস্থা, তাকানো যাচ্ছে না। চোখ সরিয়ে বলি, যারা সত্যিই এগুলো খায়, তাদের কোন লজ্জা থাকে না। যতই দেখা, ঠিক খাবে। যেমন আমার বাপ। বিগত কয়েকদিন ধরে আমি চিল্লিয়ে যাচ্ছি,বাবার কোন হেল দোল আছে? চুরাশি বছর বয়সে এসেও একটা সিগারেট থেকে আরেকটা ধরায়।


 শুরু হয় বহুরূপী। ঝকঝকে আবীর চট্টোপাধ্যায়, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে যেন আরো বহুগুণ সুদর্শন। সাধে এই লোকটার ওপর এককালে ক্রাশ খেতাম আমি। ইদানিং তুত্তুরী হাবুডুবু খায় বলে অতিকষ্টে নিজেকে সংবৃত করেছি। আজ না আবার হড়কে যাই, ভগবান। ছবিতে আবীর একজন বিখ্যাত লেখক। কলকাতা বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে তাঁর নতুন বই বহুরূপী। আবির দীর্ঘ দিন রাজ্য পুলিশে কর্মরত ছিলেন, সলভ করেছেন অগণিত কেস। ধরেছেন অসংখ্য চোর,ডাকাত, গ্রন্থিছেদককে। সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়েই লেখা বহুরূপী। আবির নিজেই বলেন, যে বাকি গুলি তাঁর সফলতার গল্প হলেও, বহুরূপী আসলে তাঁর ব্যর্থতার গল্প। 


অতঃপর শুরু হয়, সেই ব্যর্থতার গল্প। মেশে এক চামচ দেশভাগ। দেশভাগের আগে গঙ্গার দুই পাড়ের জুট মিল গুলো কেমন রইরই করে চলত। দেশভাগের সাথে সাথে শুরু হয় অবক্ষয়। পাল্লা দিয়ে গেটের বাইরে শুরু হয় ইউনিয়নের বিক্ষোভ। এমনিই এক জুটমিলের গোবেচারা অ্যাকাউন্ট্যান্ট শিবপ্রসাদ। ট্রেড ইউনিয়নের নেতাকে খুনের মিথ্যা অপরাধে ফেঁসে হাজির হয় আবিরের থানায়। কোন জেরা, কোন প্রশ্নোত্তর না করেই সটান থার্ড ডিগ্রি চালায় আবীর। ফলে তৈরি হয় এক গোপন শত্রুতার বাতাবরণ। 


কাঠগড়ায় মিথ্যা সাক্ষী দেয় শিবপ্রসাদের বাবা - দাদা - বৌদি। ফলে অনিচ্ছাকৃত খুনের দায়ে আদালত পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে শিবপ্রসাদকে। জেলে শিবপ্রসাদ খুঁজে পায় এক স্নেহশীল গডফাদার। যিনি হাতে ধরে শেখান কি ভাবে ব্যাংক ডাকাতি করতে হয়। চেনা চেনা লাগছে কি গল্পটা? বিশ্বাস করুন, প্রতিটা ফ্রেম, প্রতিটা বাঁক ভয়ানক চেনা। ওই নতুন বোতলে পুরাণ মদ আর কি। মদটাও নেহাৎ চোলাই। 


 জেল থেকে বেরিয়ে শিবপ্রসাদ গড়ে তোলে ব্যাংক ডাকাতির দল। ততোদিনে আবীর SI থেকে আইসি হয়ে গেছে। আর জীবনে এসেছে সুন্দরী, সুগায়িকা, গৃহকর্মনিপুনা লক্ষ্মীশ্রী ঋতাভরি। শিবপ্রসাদেরও জীবনে আসে পকেটমার ঝিমলি ওরফে কৌশানী। যেমন নাম, তেমনিই তাঁর হাবভাব। গুটি সাজানো শেষ হলে শুরু হয় চোর পুলিশ খেলা। গোটা সিনেমায় কেবল দুটো সিলভার লাইন আবীর আর শিবপ্রসাদ। বাকিটুকু নাহয় উহ্যই থাক। বুঝতেই তো পারছেন কি হতে চলেছে। 


পুনশ্চ - হাফটাইমে তোলা সেলফি দেখে বুঝতেই পারবেন না মাইরি, সিনেমা শুরুর সময় সব কটা সিট ভর্তি ছিল। এখন এত লোক একসঙ্গে কোথায় গেল, শৌচাগার নাকি -। সে আমরা কি জানি।


অনির পুজোর ডাইরি ৭ই অক্টোবর, ২০২৪

শুভ চতুর্থী 

#অনিরডাইরি 



অবাঙালি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকার ছোট্ট পুজো। হাওড়ার গলি নয় তো ভুলভুলাইয়া, পথ ভুলেই এসে পড়েছি আমরা। ছাপোষা মণ্ডপ, কুমারটুলির সস্তা প্রতিমা। এবড়োখেবড়ো মুখমণ্ডল, ঘাম তেলটাও যেন ভালো করে লাগানো হয়নি। দুই কানের পাশ দিয়ে নেমেছে কেশ গুচ্ছ, কিন্তু মাথা জোড়া টাক। "এটাই দেখা বাকি ছিল, টেকো মমি।" বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে তুত্তুরী। গর্ভধারিনী মা আর জগজ্জননী মা এই দুজনকেই তিনি আদর করে Mommy বলে সম্বোধন করেন কিনা।


গত পরশু বিকালে সবৎসা হাওড়া এসেছি। আসার সময় বলেই এনেছি মেয়েকে, " বাবু দুটো বেলা শুধু আমায় ছেড়ে দিস, বন্ধুদের জন্য। বাকি পুজোটা শুধুই তোর।" সেই দুবেলা খতম হয়েছে গতকাল অপরাহ্নে। কাল বিকাল থেকেই তিনি আমার মস্তকে সমাসীন। দাবী খুবই সামান্য, তাঁকে আশ মিটিয়ে ঠাকুর দেখাতে হবে এবং চর্বচোষ্য খাওয়াতে হবে। 


ঠাকুর দেখায় অবশ্য আমার কোন ক্লান্তি নেই,  গতকাল রাতেই বলেছিলাম, চল পাড়ার ঠাকুরটা অন্তত দেখে আসি। নেহাৎ ঘরের পোশাকে পাড়ায় বেরোনো নিয়ে যুগপৎ বাবা আর মা আপত্তি করল, তাই।  এবার আমাদের পাড়ার ঠাকুরের হেব্বি জাঁকজমক। গতকাল বিকালে শুভশ্রী এবং গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের যুগ্ম হস্তে তাঁর শুভউদ্বোধন হয়েছে। মোড়ের মাথা থেকে পূজা মণ্ডপ অবধি শুভশ্রী আর গর্গ বাবুর ছবি টাঙানো। মায়ের কেয়ার গিভার দিদি পরশু বিকাল থেকে বলেই চলেছিছেন, " শুভশ্রী আসবে আর কে যেন এক মস্ত বড় গায়ক আসবে। ঐ যে গো আপনাদের বামুনদের নামেই নাম।" বেচারা গর্গ। আজ মধ্যাহ্নে যখন তুত্তুরী আর আমি ঠাকুর দেখতে বেরোচ্ছি, তখনও আমার খুড়তুতো ভাই মাকে বোঝাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, " না না, গর্গ দা গানটান গায় না।" 


পাড়ার ঠাকুর দেখতে গিয়ে হোঁচট খেলাম, মণ্ডপের সামনে বিস্তর প্লাস্টিকের চেয়ার উল্টে ব্যারিকেড করা। "যাঃ বাবা, ঢুকতে দেবে না নাকি?" বিরক্ত হয়ে জানতে চায় তুত্তুরী। এখন ভর দুপুর, আসেপাশে কোন জনমনিষ্যি নেই যে শুধাই। বাধ্য হয়ে অন্য মণ্ডপের পথ ধরি। বারে বারে আজ আশাহত করতে থাকে মা। এখনও অসম্পূর্ণ অধিকাংশ মণ্ডপ তথা প্রতিমা। 


একে তো প্রায় এক যুগ শহর ছাড়া আমি, তার ওপর বড় দ্রুত বদলে যাচ্ছে শহরটাও। পুরাণ পথঘাট, গলি সবই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। তেমনি পথ ভুলেই এসে পৌঁছেছি এই পুজোটায়। ঘিঞ্জি এলাকা, চতুর্দিকে বাইক, টোটো, ঠেলার উৎপাত। বাতাসে সস্তা বিরিয়ানির আতরের চড়া সৌরভ। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে পথের সন্ধান তো পেলাম, কন্যা আব্দার করল, এদের পুজোটাও দেখে যাই। যাব তো, কিন্তু যাব কি করে? মাঠ তো জল কাদায় ভর্তি।


গুটি কয়েক স্থানীয় বাচ্ছা ওই জল কাদার মধ্যেই খেলায় মগ্ন। তাদের পদ চিহ্ন অনুসরণ করেই মণ্ডপে প্রবেশ করলাম আমরা। মণ্ডপের ভিতর তেরছা ভাবে পড়ে আছে বিশাল মই। পাকানো তার, কাগজ, কাপড়ের ছড়াছড়ি। মইয়ের এপাশে আড়াআড়ি ভাবে কোমর সমান উচ্চতায় বাঁধা একটা বাঁশ। সেই বাঁশ ধরে গুলতানিতে মত্ত একদল কুচোকাঁচা। সবকটা প্রায় একই উচ্চতার। সবার পরনেই বিবর্ণ পোশাক। পায়ে চটি থাক বা না থাক, সবকটার পাই কাদায় মাখামাখি। কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে গল্প করি তুত্তুরী আমি। গল্প নয়, গসিপ বলতে পারেন। একে তো দেবী টেকো, তায় সিংহটা বড়ই ছোট। হাঁটুতে হাত রাখা সিংহের দিকে অসুরের মুখভঙ্গী যেন, " খামোখা সুড়সুড়ি দিচ্ছিস কেন বাপ --"। মা যেন দাঁত কিড়মিড় করে বলছে, "আবার ফাজলামি হচ্ছে!" 


আসল মা দুর্গা কেমন হবে, সেটা নিয়েও আলোচনা করি আমরা। সুন্দরী পটেশ্বরী তো অবশ্যই নন। আদতে তো তিনি একজন যোদ্ধা, নির্ঘাত পেশীবহুল হবে তাঁর দেহ। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে শোভা পাবে বেশ কিছু শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত চিহ্ন। মুক্তকেশী হওয়া কি সম্ভব? শত্রু তো চুলের মুঠি ধরেই কুপোকাত করে দেবে সবার আগে।  ইত্যাদি প্রভৃতি। 


ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে, এখনও বেশ কয়েকটা ঠাকুর দেখা বাকি। তারপর যাব লস্যি খেতে। হাওড়া ময়দানের সেই লস্যির দোকানটা খুঁজে বার করতে হবে, যেখানে প্রাকবিবাহ প্রণয়পর্বে যুগলে লস্যি খেত আমার বাবা মা। আশৈশব যে দোকানের লস্যি খেয়েছি আমি। খাইয়েছি আমার মেয়েকেও। সবথেকে বড় ভাঁড়ে, সবথেকে বেশি মালাই দেওয়া লস্যি। সাথে কয়েক টুকরো বরফ। ভাবতেই উভয়ের  জিভে জল। টাক বাঁচিয়ে টুক করে ঠাকুরের কয়েকটা ছবি তুলে নিই আমি। 


ছবি তোলার জন্য মেয়েকে ছেড়ে কয়েক পা সরে এসেছিলাম, যখন ফিরে গেলাম দেখি, বাঁশের সামনে একা, এক গাল হাসি নিয়ে কয়েকটা ছুটন্ত বাচ্ছার দিকে তাকিয়ে আছে তুত্তুরী। ইশারায় জিজ্ঞাসা করি, কি হল রে, বিগলিত হয়ে তিনি জবাব দেন, " কি মিষ্টি করে বলল মা, কি ইনোসেন্টলি বলল। এতক্ষণ যে বাচ্ছা দুটো এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করছিল না, তারা যাবার সময় ঠাকুরকে কি বলে গেল জানো? বলল, "মেরি দুর্গা মাঈ কো কিসি কি নজর না লাগে।" পলকে কেমন দ্রবীভূত হয়ে গেল হৃদয়, নাহ টেকো হোক আর যাই হোক, ভদ্রমহিলার যাদু কিছু তো আছেই। 


পুনশ্চ - উক্ত মণ্ডপ বা প্রতিমার ছবিটা আর দিলাম না। কিছু জিনিস একান্ত ব্যক্তিগত থাকাই বোধহয় ভালো। থাক ওরা, ওদের মত।  আশ মিটিয়ে খুনশুটি করুক অসুর আর সিংহ। বেশ বাড়াবাড়ি করলে দুটোরই কান মূলে দিক জগজ্জননী। পুঁচকে গুলোর দুগ্গা মাঈ আর তার  ছানাপোনাদের কারো নজর যেন সত্যিই না লাগে।


অনির পুজোর ডাইরি ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪

শুভ দ্বিতীয়া

#অনিরডাইরি 



তিনি লিখলেন, "মা, তুমি কি আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে? তাহলে তোমার সঙ্গে বেরিয়ে একটু আলো দেখতাম।" আলো অর্থাৎ পুজোর আলোকসজ্জা। কয়েকদিন ধরেই ড্রাইভার সাহেব গল্প করছেন, কাঁথি শহরে নাকি সাকুল্যে ৫০টা পুজো হয়। ছোট মফস্বল শহরের পক্ষে সংখ্যাটা নেহাৎ কম নয়। যার মধ্যে নান্দনিক, ইট গিল্ট (ইউথ গিল্ড) আর চৌরঙ্গীর পুজো নাকি সবথেকে বিখ্যাত। 


আর পাঁচটা মফস্বলের মতোই, এখানে এখনও অর্ধ সমাপ্ত অধিকাংশ মণ্ডপ। প্রতিমা ও অনুপস্থিত। তবে আলো যে লাগানো হচ্ছে, সেটা আজ সকালে অফিস আসার সময় আমিও দেখেছি। 


আগামী কাল থেকে ক্যালেন্ডারে লাল দাগ শুরু, কালই বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে সকন্যা পিত্রালয়ে যাব। ভেবেছিলাম যাবার পথে ঢুঁ মেরে যাব ঠাকুর এসেছে এমন কয়েকটা মণ্ডপে। শ্রীমতী তুত্তুরীকে সেকথা বলেও ছিলাম। কিন্তু কন্যার আর ধৈর্য ধরছে না। মুঠো ফোনে ফুটে ওঠে তাঁর কাতর আকুতি, " প্লিজ মা তুমি কি একটু তাড়াতাড়ি -"।


তাড়াতাড়ি আসব কি, আপিসে ঢুকেছিই তো আজ বেশ খানিক বিলম্বে। সেই কবে মানত করেছিলাম দেবী বর্গভীমার কাছে, আমার বর আর আমার ছেলেগুলো যদি সুস্থ ভাবে, সম্মানের সাথে নির্বাচনটা উতরে দিতে পারে,  মায়ের কাছে পুজো দেব, আর সবাই মিলে ভোগ খাব। সেই মত কথাও বলে এসেছিল শুভদীপ্ত। কিন্তু আমার ইন্সপেক্টর বাবুদের আর সময়ই হয় না। একের পর এক আসতে থাকা কাজের দাপটে, ব্যাটাদের এক সঙ্গে পাওয়াটাই হয়ে ওঠে দুর্ঘট। আমরা যবে খাই খাব,মাকে আর কতদিন উপোষী রাখি? 


মন্দিরের সামনেই বিক্রি হয় পুজোর ডালা, কিন্তু শুভদীপ্ত নিষেধ করে, "ওখান থেকে নিবেন নি ম্যাডাম। আর মাখা (সন্দেশ) নিবেন নি, যে সন্দেশ বিক্রি হয় না, সেই গুলো আবার ভালো করে পাক করে, কড়া মিষ্টি দিয়ে মাখা বানিয়ে দেয় শুনেছি। নিলে কলাকাঁধ নিবেন।" যে দোকান থেকে নিতে বলে, তার লোকেশন আর কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। শেষে শুভাশিসকেই ধরি, "চল বাবা একটু।"


খুপরি দোকান, টালির চাল। আমরা ছাড়া আর মুষ্টিমেয় খরিদ্দার। গৌর বর্ণ, সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ দোকানিকে জানালেন, " পিস নয়, আমরা ওজনে বিক্রি করি কালাকাঁধ।" সাথে সাথে ধূপ আর সিঁদুর পাতাও দিলেন বৃদ্ধ। দোকানেই জুতো খুলে, বাকি পথটা হেঁটে, বেশ অনেক গুলি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় মায়ের মন্দিরে। সদ্য নিজেকে উপহার দেওয়া কালো উঁচু গোড়ালির জুতোকে এই ভাবে বাজারের মধ্যে ফেলে যেতে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। প্লিজ ঠাকুর, কেউ যেন আপন মনে করে নিয়ে না নেয়। যা সুন্দর দেখতে -। 


কংক্রিটের সিঁড়ি অন্য দিন হলে তেতে আগুন হয়ে থাকত, মায়ের আশীর্বাদেই হয়তো, আজকের আবহাওয়া এমন সুন্দর মেঘলা, সাথে মৃদুমন্দ বাতাস। মন্দিরে পৌঁছে শুকিয়ে গেল মুখ, যত পুণ্যার্থী কি আজকেই এসে জড় হয়েছে হেথা। যেখানে পা রাখার জায়গা পেলাম, সেখান থেকে মায়ের মুখ দর্শন অসম্ভব। দীর্ঘশ্বাসটা বোধহয় একটু জোরেই ফেলেছিলাম, সামনের অল্প বয়সী ছেলেটি ঘুরে বললে, " যত দিন যাচ্ছে, মানুষের ভক্তি আর চুরি দুটোই বাড়ছে।" 


 শুভাশীষ কোথা থেকে এক টুকরো কাগজ আর পেন এনে জিজ্ঞাসা করে, "ম্যাডাম কার নাম লিখব?" কার নামে পুজো হবে, অনেক ভেবেচিন্তে আমাদের আপিসের নামটাই লিখলাম। ভালো থাক মোদের আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর। প্রায় দেড়শ মানুষের রুজি যোগায় এই আপিসটা। আর আমাদের পরিবার বর্গ ধরলে তো সংখ্যাটা হাসতে হাসতে পাঁচশ ছাড়িয়ে যাবে। 


হয়তো সবই মায়ের কৃপা, যতটা সময় লাগবে ভেবেছিলাম, তার এক চতুর্থাংশ ও লাগল না। নাম লেখা শেষ হবার সাথে সাথেই প্রায়, প্লাস্টিকের ঝুড়ি ভর্তি রক্তজবা নিয়ে এসে হাজির হলেন পট্ট বস্ত্র পরিহিত পুরোহিত। "যারা যারা অঞ্জলি দেবেন, ফুল নিয়ে নিন -"। খপ করে একটা জবা তুলে নিলাম আমি,  এই সুযোগ কি ছাড়া যায়। কে জানে, শাস্ত্র মতে কতটা শুদ্ধ আমি, শাশুড়ি মা প্রায়ই বলেন, "মন শুদ্ধ তো সব শুদ্ধ।" আর মায়ের কাছে আবার সন্তান অশুদ্ধ হয় নাকি? 


এমনিতেই বড় মন খারাপ নিয়ে এসেছি আজ মায়ের চৌকাঠে। বিগত দিন চারেক ধরে অসুস্থ আমার গর্ভধারিণী। অসুস্থতার তীব্রতা যে কতটা সেটা আজ বৃদ্ধ বৃদ্ধা উভয়ের সাথে কথা বলেই বুঝতে পেরেছি। মন চাইছে, সব ফেলে ছুটে হাওড়া চলে যাই। কিন্তু আজ আমি না গেলে যে ছাড়া যাবে না ২৫/২৬ লাখ টাকা। যে টাকার অধিকাংশ জুড়ে আছে কারো কাজের মজুরী, কারো বোনাস, কারো বকেয়া, কারো জমা পুঁজি ফেরৎ, তো কারো মৃত্যুকালীন অনুদান। যত টাকাপয়সা অ্যালটমেন্ট সব যেন গতকাল আর আজকেই ঢুকছে বানের জলের মত। যত তাড়াতাড়ি ব্যাংক বা ট্রেজারিতে পাঠানো যায় ততোই মঙ্গল। দ্বিতীয়ার্ধে পাঠালে, কেউই নেবে না, উল্টে দাঁত কিড়মিড় করবে। 


মাইক্রোফোনে ভেসে আসা মন্ত্রে চমকে উঠি, শুরু হয়ে গেছে অঞ্জলি। একবারই মন্ত্রপাঠ হয়, অতঃপর পুনরায় ঝুড়ি নিয়ে হাজির হয় পুরোহিত মহোদয়, দিয়ে যাওয়া পুষ্প ফেরৎ নেবার জন্য। হাতের ফুল মায়ের দিকে ছোঁড়া এমনিতেও অসম্ভব, এত দূরে আছেন তিনি। অঞ্জলি শেষে, শুরু হয় পুজো। সামনের লোকজন ঝটিতি সরে যায় সামনে থেকে। পুজোর লাইন বাম দিকে। ভিড় খালি হয়ে যেতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের অনিন্দ্য সুন্দর মুখচন্দ্র। 


পুজোর লাইনে ভিড় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মন্ত্র পড়তে পড়তে পুজোর ডালা নিচ্ছেন পুরোহিত মশাই, খানিকটা মিষ্টি সরিয়ে রাখছেন, না রাখছেন না বুঝতে পারলাম না। এক মুঠো রক্তজবা প্যাকেটে ভরে, আমায় ফিরিয়ে দিলেন পুজো। এখানে নাম গোত্র ধরে যে পুজো হয় না, সেটা তিন বছর আগে থেকেই দেখে আসছি। মানত তো আর প্রথমবার করলাম না মায়ের কাছে।


মন্দির থেকে বেরিয়েই আমার গর্ভধারিণী মাকে ফোন করি। কেমন আছ মা? মিনিট চল্লিশ আগেও যার গলার আওয়াজ বেরোচ্ছিল না, তিনি বেশ ফুরফুরে কন্ঠে জানান, " ভালো আছি। সেজদা এসেছে। গল্প করছি।" ওপাশ থেকে সেজদার দরাজ গলা ভেসে আসে, " চিন্তা করিস না, আমি আছি। মাসি ভালো আছে। ওষুধপত্র সব আমি দেখে নিয়েছি। কাল আবার আসব মাসিকে দেখতে। তুই না আসা পর্যন্ত আমি সাপোর্ট দিয়ে যাব।" আমরা পাঁচ ভাইবোন একসাথেই বেড়ে উঠেছি, মাসতুতো শব্দটা কোনদিন আমাদের মধ্যে ঢুকতে সাহস পায়নি। নাহলে এই ঘোর কলিতে কার মাসতুতো দাদা এ কথা বুক বাজিয়ে বলতে পারে। 


অফিসের কাজ মিটতে মিটতে প্রায় ছটা। তাও সব মিটল কি? কোনদিন কোন সরকারী আপিসে মেটে নাকি? লাখ ছয়েক টাকা এসে ঢুকল পৌনে ছটার সময়। ধুৎ তেরি। বাড়ি যখন ফিরলাম, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে মন আর মাথা। এখনও গোছগাছ কিস্যু হয়নি। কি যে হবে ভাবতে ভাবতে বাড়ি ঢুকে দেখি তিনি নীলাম্বরী হয়ে ঘুরছেন। কোথা থেকে যেন গেল বছরে বড় মামার দেওয়া জামাটা বার করে, পরিপাটি করে চুল বেঁধে বাগানে পায়চারি করছেন, কখন মা আসবে, আর আলো দেখতে নিয়ে যাবে।


অগত্যা, আবার জুতো গলিয়ে বেরোতেই হয়, মা হওয়া কি মুখের কথা রে বাবা। সাথে জবরদস্তি লতাদিকেও ধরে নিয়ে যাই আমরা। থাক পড়ে সব কাজ, অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য। সারাদিন আমার কন্যা আর আমার শাশুড়ি মাতার দেখা শোনা করে মানুষটা, একটু আলো দেখা তো তারও প্রয়োজন।



অনির পুজোর ডাইরি ৩রা অক্টোবর, ২০২৪

শুভ প্রতিপদ 

#অনিরডাইরি 



মোটামুটি অর্ধেক পৃথিবীর মতোই, আমারও J.K Rowling এর সাথে প্রথম পরিচয় হ্যারির মাধ্যমে। আজ্ঞে হ্যাঁ, the Harry Potter। হ্যারি পটার সিরিজ যখন প্রকাশিত হয়েছিল, একটা বইও আমার কেনা বা পড়া হয়নি। কি করেই বা কিনি/ পড়ি। সারা বিশ্ব তখন কাঁপছে হ্যারি উন্মাদনায়। আকাশ ছোঁয়া দামে প্রকাশ পাচ্ছে একেকটা বই। আমি তখনও তারাসুন্দরী, আমার তখনও লাল পাড় সাদা শাড়ি। লাল ফিতে দিয়ে বিনুনি বেঁধে দিত পিসি, ভারী ব্যাগ কাঁধে, নতমস্তকে গুটি গুটি পায়ে ইস্কুল যাই আমি। ওদিকে প্রভাতী আনন্দবাজারের বইয়ের পাতা থেকে এগোতে এগোতে প্রথম পাতার তলার দিকে স্থান পেতে থাকে হ্যারি। প্রতিটা খণ্ড বাজারে আসার আগে, বইয়ের দোকানের সামনে সে কি বিশাল লাইন কচিকাঁচাদের। আমার তাতে কি? আমি দাদা বাংলা মিডিয়াম। ঐ জাব্দা ইংরেজি বই পড়া কি আমার সাধ্য নাকি? 


বই থেকে হ্যারির পদোন্নতি হল চলচ্চিত্রে। পর্দা কাঁপিয়ে দিল ড্যানিয়েল-এমা-রুপার্ট গ্রিন্ট এন্ড আদার্স। গরীবের উঠোনেও একদিন হানা দিলে wizrad কুল। ২১ ইঞ্চি রঙিন টিভি, পাড়ার বিপুল কাকার কেবল লাইন, সুযোগ পেলেই HBO/AXN/ Star Movies দেখে বেড়াই আমি। রাতে প্রাইম টাইমে ভালো ভালো সিনেমা দিত চ্যানেল গুলো। তখন তো পড়া ছেড়ে রিমোটে হাত দিলে হেট মুণ্ডু ঊর্ধ্বপদ করে দেবে মা। আমার সম্বল বলতে দুপুরের রিপিট টেলিকাস্ট। কলেজ থেকে ফিরে, ডালমুড়ির বাটি( আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি অর্ধেক হাওড়া আর অর্ধেক মুর্শিদাবাদী, আমি মুড়ি খেতে দিব্য ভালবাসি) বগলে, টিভিটা যখন চালিয়েছিলাম বিশ্বাস করুন কোন প্রত্যাশা ছিল না। প্রথম থেকে দেখতেও পাইনি সিনেমাটা। যখন শেষ হল, মনে হল আমি যেন তড়িতাহত হয়েছি। এমনও হয়? এমনও কিছু কল্পনা করা সম্ভব? 


তাই বলে বই কেনা বা পড়ার কথা ভাবলাম ভাববেন নি যেন। বললাম না দাদা আমি বাংলা মিডিয়াম। খটমট ইংরেজি সিনেমা দেখতে শিখেছি বলে কি পড়বার ও স্বপন দেখব নাকি? তাজ্জব মাইরি। 


J.K. Rowling আমার প্রিয়তম লেখিকা হলেও, ইংরেজি বই পড়ার সাহস প্রথম যিনি দিলেন তাঁর নাম Dan Brown। সদ্য চাকরি পেয়েছি কয়েকমাস। প্রথম পোস্টিং খড়গপুর। অফিস তথা যাত্রাপথটা কিছুতেই আর হজম করতে পারছিলাম না। সবকিছু কেমন যেন তেতো হাকুচ। রীতিমত মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিলাম। মেদিনীপুর লোকালের লেডিস কম্পার্টমেন্টে সদ্য আলাপ এক সমবয়সী দিদিমণি প্রথম বলল, " বই পড়।মন ভালো হয়ে যাবে"। জন্ম থেকে বই পোকা আমি। আর কি পড়ি? ওকেই শুধালাম, কিছু বইয়ের নাম বল। সৌমি নাম ছিল মেয়েটার, আজও মনে আছে, সৌমি মণ্ডল। সৌমি বলল, " Dan Brown পড়। দা ভিঞ্চি কোড।" নামটা না শোনার মতোও গবা আমি নই। কিন্তু যতদূর জানি, বইটার বিরাট দাম। সৌমি বলল, " দূর, গ্র্যান্ড হোটেলের তলায় চলে যা, ওরা ফটোকপি করে বিক্রি করে। দর করে কিনবি। ১০০ টাকার বেশি মোটেও দিবি না।"


পরের শনিবারই গিয়ে হানা দিলাম, ধর্মতলায়। গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে হেব্বি কেত মারা দোকানি, এমন ফরফরিয়ে ইংরেজি বলে যে মনে হয়, ধরিত্রী দ্বিধা হও। দাম শুরু হল সাড়ে পাঁচশ টাকা থেকে। যত বলি পাঁচটা নয়, একটা নিব রে ভাই, দর আর কমেই না। প্রায় আধঘন্টা চাপানউতোর শেষে একশ পনেরো টাকা দিয়ে বই কিনে বাড়ি ফিরলাম। এবার আপনি বলতেই পারেন, তুমি তো বাছা বাংলা মিডিয়াম। সে ভাবনা কি আমার মাথাতেও আসেনি, কিন্তু পচা আপিস আর নিত্যযাত্রার চাপ এমনি যে বাড়ি ফিরেই খুলে বসলাম বইটা। বাকিটা ইতিহাস, অন্তত আমার কাছে। সারা দিন, সারা রাত জেগে পড়ে থুড়ি গিলে যখন বইটা শেষ করলাম, অভিজিতের সেই গানটা মনে পড়ে গেল, " শালা ম্যায় তো সাহাব বান গয়া "। প্রেম/ ক্রাশের তালিকায় আরেকজন যোগ হলেন, প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন। 


পরের দুই মাসের মধ্যে ড্যান ব্রাউনের তৎকালীন সব বই শেষ করে ফেললাম আমি। লোকাল মিস করে এক্সপ্রেস ধরতে বাধ্য হলাম যেদিন, আবিষ্কার করলাম, বালতি করে বই বিক্রি হয় এই লাইনে। ভদ্রলোকের এক কথা, সব বই একশ টাকা। তবে কিনা, সস্তার তিন অবস্থা, ট্রেন থেকে কেনা Digital Fortress এর মাঝের কয়েক পাতা মিরর প্রিন্ট পেয়েছিলাম। এমন নেশা, যে ফেস পাউডারের পুঁচকে আয়না দিয়ে দেখে পাঠোদ্ধার করেছিলাম আমি, তাও ছাড়িনি। 


দেখতে দেখতে বাবার বাড়ির আলমারি ভরে উঠল, Lee Child, John Grishm, David Baldacci, Steig Larson থেকে দেশী Aswin Danghi, Amish ইত্যাদিতে। কিন্তু J.K. Rowling তখনও বহুৎ দূর। 


প্রিয়তম লেখিকার সাথে গাঁট ছড়া বাঁধল দেবশ্রী দি। ভাগ্যক্রমে প্রায় একই সাথে কলকাতায় বদলী হয়ে এসেছিলাম আমরা কয়েকজন মহিলা অফিসার। বই, সিনেমা নিয়ে আমাদের নিত্য আলোচনা হত। এমনি এক আড্ডায় ডি দি একদিন ঘোষণা করল, " আমি হ্যারি পটার পড়ছি জানো তো। তোমরাও পড়ে দেখতে পারো -।" বিদিশা দি তো জাস্ট উড়িয়েই দিল প্রথম চোটে, আমিও তাই করলাম। সিনেমা গুলো দেখেছি তো, আর বই কিনে কি হবে? ঠিক যে অর্ডারে প্রতিবাদ করেছিলাম আমরা, সেই ক্রমেই হ্যারি পটার পড়তে শুরু করলাম আমরা। পড়তে পড়তে যেন অন্য কোন ইউনিভার্সে ঢুকে গেলাম আমরা। বইয়ে যা পেলাম, তার একটা নগন্য অংশ কেবল সিনেমা গুলোতে পেয়েছি এতদিন। দিন রাত শুধু একই আলোচনা আমাদের। কাজ - কম্ম - সংসার কিছুতে মন নেই আমাদের। 


সিরিয়াস ব্ল্যাকের মৃত্যুর পর সেকি কান্না আমার। মুঠো ফোনের ওপার থেকে কতক্ষণ যে দেবশ্রী দি আমার কাউন্সেলিং করেছিল সেদিন। দুজনের কারো মনে হয়নি যে ওটা তো একটা কাল্পনিক চরিত্র কেবল। আর ডাম্বলডোরের মৃত্যুর কথাটা নাহয় উহ্যই থাক। 


দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল সাত সাতটা বই। অতঃপর সে যে কি অপরিসীম শূন্যতা, কেবল পটারহেডরাই অনুভব করতে পারে। সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। ইতিপূর্বে এই শূন্যতা যতবার দেখা দিয়েছে, ডিটক্স হিসেবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেবার যে কি হল, ব্যোমকেশ, বরদা, তুমি সন্ধ্যার মেঘ সব ব্যর্থ, মন কেবল Joanne Kathleen Rowling কেই চায়। কিন্তু তিনি যে ঘোষণা করে দিয়েছেন আর লিখবেন না। হে ঈশ্বর আমার দিকে একটু তো মুখ তুলে চাও। 


বর্তমান এক্স, তৎকালীন টুইটারে যে কত শত বার মেসেজ করেছি ওনাকে। প্লিজ ম্যাম, এভাবে অনাহারে মারবেন না। জবাবে পেয়েছি হিরন্ময় নীরবতা। Dumbledore, Sirius Black ছাড়ুন যে নারী হাসতে হাসতে Fred Weasley, Lupin, Nymphadora Tonks এমনকি Dobby , Hedwig কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে, তার থেকে আর কিই বা প্রত্যাশা করব, বলতে পারেন? 


ধুর ধুর বেঁচে থেকে আর কোন লাভ নেই, বলে ধরেই নিয়েছি, এমন সময় পটারহেডদের গ্রুপে গ্রুপে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল, আসছেন, তিনি আসছেন। তবে স্বনামে নয়, ছদ্ম নামে। আসছেন Robert Galbraith। বইয়ের নাম The Cuckoo's Calling। ততদিনে তো আমি রীতিমত উপার্জনশীল নারী, পে কমিশন ও হয়ে গেছে, সবার ওপর এসে গেছে আমাজন-ফ্লিপকার্ট। ফ্লিপকার্ট এককালে এক টাকার বই কিনলেও বাড়ি পৌঁছে দেবে বলে বিজ্ঞাপন দিত। কাকে অর্ডার করেছিলাম আজ আর মনে নেই,যদিও। 


হাতে পেয়ে কিঞ্চিৎ নিরাশ হলাম, এর সাথে পটার বা wizards দের কোন সম্পর্কই নাই। এতো নিছক muggle দের গোয়েন্দা গল্প যা দেখি। ধ্যাৎ তেরি! তবুও শুরু করলাম পড়া। আলাপ হল Cormoran Strike এর সাথে। জনৈক বিখ্যাত গায়কের অবৈধ সন্তান। মা ছিল পাক্কা সত্তরের দশকের "হরে কৃষ্ণা হরে রাম" মার্কা হিপ্পি। অগুনতি পুরুষসঙ্গী, মদ, ড্রাগস। শেষ পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবনেই মৃত্যু। স্ট্রাইকের বদ্ধমূল ধারণা যেটা আসলে সুপরিকল্পিত হত্যা। 


মায়ের অবর্তমানে মামা মামীর যত্নে বড় হয়ে মিলিটারি পুলিশ হিসেবে যোগদান করে স্ট্রাইক। আফগানিস্তান অভিযানের সময় বোমা বিস্ফোরণে হাঁটুর নীচে থেকে উড়ে যায় একটা পা। 


হঠাৎ করে বেকার হয়ে যাওয়া, প্রতিবন্ধী তকমা পাওয়া স্ট্রাইক পেটের ধান্ধায় ঠিক করে একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলবে। খুলতে গেলেও যে ন্যূনতম মূলধনের প্রয়োজন, সেটার জন্যও হাত পাততে হয়,কোনদিন কোন তত্ত্বতালাশ না করা জন্মদাতার সামনে। অপমানজনক শর্তে জোগাড় হয়, টাকা। 


ফোন ধরা এবং টুকটাক কাজের জন্য মাত্র কয়েকদিনের অস্থায়ী সহযোগী হিসেবে এজেন্সিতে যোগ দেয় Robin Ellacot। মফঃস্বলের মেয়ে রবিন, বয়সে প্রায় বছর দশেকের ছোট। ইউনিভার্সিটি ড্রপ আউট। কলেজে পড়ার সময় ধর্ষিত হয়ে, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল দীর্ঘ দিন। নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল চার দেওয়ালের মধ্যে। পরিবার তথা বয়ফ্রেন্ড ম্যাথুর সহমর্মিতা আর সাহচর্যে নতুন করে জীবনের সাথে আলাপ করতে সম্মত হয়েছে রবিন। সেক্রেটারি হিসেবে নাম লিখিয়েছে একটা সংস্থায়। সেখান থেকেই টেম্প হিসেবে, মাত্র কয়েক দিনের জন্য এই অফিসে পাঠানো হয় তাকে। পাকাপাকি সেক্রেটারি রাখার মুরোদ কোথায় স্ট্রাইকের। 


যেমন ডিটেকটিভ, তেমনি তার এসিস্ট্যান্ট। দুজনেই এক্কেবারে সাধারণ, না কারোর মগজাস্ত্র আছে, না কোন আগ্নেয়াস্ত্র। এমন চরিত্র এর আগে কোথাও পড়েছি বলে মনেই পড়ে না। ধীরে ধীরে জড়িয়ে যেতে থাকি Cormoran Strike আর Robin এর সাথে। গল্প এগোতে থাকে এঁকে বেঁকে। কখনও স্ট্রাইক এর সাথে খোঁড়াতে থাকি আমরা, প্রস্থেটিক্স আর কাটা পায়ের সংযোগ স্থলে ফোস্কা পড়ে যায় আমাদের। কখনও রবিন এর সাথে অর্থহীন জীবনে নতুন করে অর্থ খুঁজতে বেরোই আমরা। লন্ডনের জঘন্য আবহাওয়ায় তিতিবিরক্ত হয়ে যাই আমরা। স্ট্রাইক এর সাথে Doom Bar আর Fish N Chips সাঁটাই আমরা। এই করতে করতে কখন যে গল্প শেষ হয়ে যায় একরাশ ক্ষিদে রেখে, বেশ বুঝতে পারি, হতাশ করেননি প্রিয় লেখিকা। 


২০১৪ সালে এলো The Silkworm। ততোদিনে রাউলিং যাদুতে আচ্ছন্ন আমার বরও। বই/সিনেমা/ ওয়েব সিরিজ নিয়ে শৌভিক আর আমার কোনদিন মতের মিল হয়না। স্ট্রাইক বোধহয় একমাত্র ব্যতিক্রম। ২০১৫ য় যখন Career of Evil প্রকাশিত হল, ঐ কিনল দৌড়ে গিয়ে।পাক্কা তিন বছরের প্রতীক্ষা অন্তে এল The Lethal White। এই অবধিই ক্রম মেনে পড়েছি আমরা, তারপর এল অতিমারির বছর। প্রকাশ পেল Cormoran Strike series এর নতুন বই। আলোচনা - সমালোচনায় উত্তাল হল বই পাড়া, আমরা নিরূপায়। বড্ড দাম বাপু, আর বড্ড বড় ও। হাজার পাতা, ইয়ার্কি নাকি?


২০২২ এ এলো The Ink Black Heart। ব্যক্তিগত জীবনে এমন তুফান চলছে তখন আমাদের, মাত্র ৪৮ ঘণ্টার নোটিশে তমলুক থেকে কাঁথি বদলী হয়ে গেল শৌভিক। মাঝপথে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হল মেয়েকে। নিত্য ১৫০ কিলোমিটার আপিস যাত্রা শুরু হল আমার - ইত্যাদি প্রভৃতি ছাড়াও, বড্ড দাম আর তেমনি বড়। 


২০২৩ এ এল The Running Grave, ততোদিনে অনেক পিছিয়ে পড়েছি আমরা। ছিঁড়ে গেছে মুগ্ধতার মায়াজাল। "আর কি কখনও কবে "-মাঝে মাঝেই আলোচনা করি আমরা। ব্যাস ওই টুকুই।


গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম এই বছর সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ। সামনেই শৌভিক এর জন্মদিন, মাঝে মধ্যেই বলে, "একটা একটা করে কিনেই ফেলব বইগুলো। এখন দাম ও একটু কমেছে। Kindle এ কিনলে তো আরো সস্তা হবে। পুজোর সময় কিনব বরং, আমাকে তো এখানেই থাকতে হবে, তোরাও থাকবি না - ।" ধুৎ স্ট্রাইক এর গল্প আবার kindle এ পড়ে নাকি? এত হিসাব করলে জীবন চলে নাকি। ফেললাম কিনে তিনটি বই। পেপার ব্যাক গুলোর দামও এখন সাধ্যের মধ্যে। নাহলে ও বাকি, বরের জন্মদিন বলে কতা। 


জন্মদিনের রাতে মোড়ক খুলে শৌভিক খুশি হল কিনা বুঝলাম না বাপু। প্রথমটা খুলে বলল, " এ হে হে, এটা তো শেষটা। এর আগের গুলো - আচ্ছা থাক, আমিই কিনে নেব।" দাঁত কিড়মিড় করলেও বললুম না কিছু। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মোড়ক খুলে বলল, " একেবারে তিনটে না কিনলেও হতো। তিনটে বই কিনবি জানলে আমি অন্য একটা চাইতাম। Dalrymple এর নতুন বইটা -"। ব্যাটাকে জীবনে খুশি করা যায় না মাইরি। তিনি কি সাধে বলেছেন, " যতোই দাও, ততোই চাই।"


দিন যায়, হপ্তা যায়, উপহার দেওয়া চকলেট গুলো একটা একটা করে বেপাত্তা হয়ে যায়। রোজ রাত্তিরে রক্ত চক্ষু দেখায় শৌভিক, কাউকে কিছু দিয়ে ফেরৎ নিলে কি হয়,মনে করিয়ে দেয়। যতই বলি আমি খাইনি, এবাড়িতে আমি ছাড়াও আরো দুজন মিষ্টি খোর আছে, সম্পর্কে ঠাকুমা এবং নাতনি, তাদেরও তো শুধাও। তার বেলায় বোবা এবং কালা হয়ে যায় আমার বর। বই গুলো কেবল অস্পৃশ্য হয়ে পড়ে থাকে, খাস কামরা (অর্থাৎ মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বার) এর বুড়ো টেবিলের ওপর। বললেই শৌভিক বলে, " কখন পড়ব বলতে পারিস?" সত্যিই বেচারার সময় বড় অভাব। মহকুমা শাসকের পাশাপাশি দীঘার দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে দম ফেলার ফুরসৎ পায় না আজকাল। আশ্বস্ত করে, পুজোর ছুটি পড়লে পাতা উল্টে দেখবে। তবে সে আর কতটুকু পড়া হবে?ক্যালেন্ডারের লাল দেখে তো আর সত্যিই ছুটি পাবে না ব্যাটা। 


ইতস্ততঃ করে একদিন নিজেই তুলে নিলাম প্রথম খণ্ড খানা। ট্রাবলড ব্লাড, Cormoran Strike এর প্রথম কোল্ড কেস। চল্লিশ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এক মহিলার কন্যার সনির্বন্ধ অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে বাধ্য হয় স্ট্রাইক। শর্ত একটাই, এক বছরের মধ্যে যদি সমাধান হয় তো ভালো, নইলে ফান্ড তুলে নেবে ক্লায়েন্ট। হাতে থাকা আরো চারটে হাই প্রোফাইল কেসের পাশাপাশি তদন্ত শুরু হয় এই কেসেরও। কিন্তু চল্লিশ বছর আগে নিখোঁজ এক মহিলাকে খুঁজে বার করা কি এতোই সহজ! বিগত চার দশকে আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেছে সবকিছু, হারিয়ে গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তথা সাক্ষী। মারা ও গেছেন কতজন। কি ভাবে সম্ভব এই কেসের তদন্ত। 


১০৭৪ পাতা আক্ষরিক অর্থেই গোগ্রাসে গিলে সদ্য শেষ করলাম বইটা। কেন যে Joanne Kathleen Rowling ই আমার প্রিয়তম লেখক আরেক বার নতুন করে অনুভব করলাম। সাথে সাথে হেব্বি গর্ব ও হল মাইরি নিজের জন্য, জীবনের এই সন্ধিক্ষণে সব দিক সামলে, সব দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে ও হাজার পাতার ইংরেজি বই শেষ করা কি চাট্টি খানি কথা। ইশ নব্বইয়ের দশকের মেয়েটা যদি জানত, যে বাংলা মিডিয়াম হলেও জলের মত পড়া যায় সব ফিরিঙ্গি সাহিত্য। 


যাই হোক, শুভ প্রতিপদ। মা আসছেন বছর ঘুরে। কেটে যাক সকল আঁধার।

1 comment:

  1. দারুন লিখেছিস

    ReplyDelete