Thursday 3 October 2024

অনির ডাইরি সেপ্টেম্বর, ২০২৪

 অনির ডাইরি ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি


“সাঁতার কেটে ফিরলাম। মাথায় মধ্যে কাঁসর ঘণ্টা বাজছে, নাকে আমার সমুদ্র।“ বেলা শেষে আপিসের কাজ গুছাচ্ছি, এমন সময় কন্যার বার্তাঘাত। রোজই এই সময় নাগাদ সামান্য নিদ্রালু হয়ে পড়ে মাসি, সেই সুযোগে তাঁর মুঠোফোনটা হাতিয়ে মায়ের সাথে খানিক বকবক করে নেয় তুত্তুরী। যার বেশির ভাগ জুড়েই থাকে নানা ইমোজি আর স্টিকার। আর মাঝেমাঝেই, “Mommy পাত্তা” লিখে পাঠান তিনি। Mommy তাঁর সোহাগের সম্বোধন, অর্থাৎ, সব কাজ ফেলে মাকে এখন তার দুলালীকে পাত্তা দিতে হবে। এই ছায়া মাধ্যমে, ৭৫ কিলোমিটার দূর থেকে কি ভাবে যে তাঁকে আলাদা করে পাত্তা দেব, বুঝতে খানিক সময় লেগেছিল, তাঁর থেকেই শিখলাম, গুচ্ছ গুচ্ছ হৃদপিণ্ডের ইমোজি পাঠালেই দ্রবীভূত হয়ে যায় আমার কন্যা। সাথে যদি গুটি কয়েক বেবি হাতু, প্যান্ডা বা কোয়ালার ছবি থুড়ি স্টিকার পাঠাই, তাহলে তো তিনি বাস্তবিকই আহ্লাদে আট টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েন। 


তবে ব্যাপারটা হল কি, রোজ দিন আমাদের কথোপকথন এমন মধুর সুরে শেষ হয় না। মাঝে মধ্যেই তিনি অন্যায্য দাবী করেন, অনুনয়-বিনয় দিয়ে শুরু হয়ে, ব্যাপারটা ধমক-চমক-হুমকিতে গিয়ে শেষ হয়। এসব ক্ষেত্রে দাবী একটাই থাকে, সেই দিনটির মত তাঁকে পড়াশোনা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আর হুমকি বলতে বাবা এবং মাম্মামের (দিদার) কাছে আমার নামে নালিশ করা। যাতে ওরা আচ্ছা সে আমার কান মুলে দিতে পারে, আর কি। 


আজও মাথায় কাঁসর, নাকে সমুদ্রের পর যে সেই একই দাবী আসতে চলেছে বেশ বুঝতে পারলাম। এত্ত এত্ত শরীর খারাপের খবর শুনেও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিছু বলছি না দেখে, তিনি পুনরায় লিখলেন, “কানটাও কটকট করছে Mommy।“ সাথে যথারীতি গোটা দশেক ক্রন্দনরত ইমোজি।  কি আর করি, বললাম, “রেস্ট নাও। একটু ঘুমিয়ে নাও। দরকার হলে একটু রাত করে পড়তে বসো।“


কিছুক্ষণ কোন জবাব এল না, অতঃপর তিনি লিখলেন, “আমি একটা হাঁচলাম আর মাসির মুঠোফোনটা জলে ভিজে গেল। কিসের জল বুঝতে পারছ তো?” সেটা দিব্য বুঝলেও, হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারি না। তিনি লেখেন, “Excuse me, আমায় এখন একটা ন্যাকড়া যোগাড় করে ফোনটা সাফ করতে হবে। তোমার সাথে পরে কথা বলছি।“ 


পরের কথাটা যখন ফুটে ওঠে মুঠোফোনের পর্দায়, ততোক্ষণে সন্ধ্যা গড়িয়ে নামছে রাত। তিনি লিখলেন, “পড়তে বসছি। তুমি কত দূরে?” জানাই সবে নন্দকুমার মোড়, বাড়ি ঢুকতে আরও এক ঘণ্টা তো বটেই। তিনি লেখেন, “তাড়াতাড়ি এসো। তোমার সাথে চা খাব বলে বসে আছি।“


 বুঝতে পারি, কন্যার ঝাঁপিতে প্রচুর গল্প জমে আছে আজ, গল্পেগল্পেই না রাত কাবার হয়। লক্ষ্য করে দেখেছি,  তুত্তুরীর সন্ধ্যাবেলার গল্পগুলির একটি সুনির্দিষ্ট ক্রমপর্যায় থাকে। অর্থাৎ গল্প গুলো ধাপে ধাপে আসে। 

প্রথম পর্যায়ে থাকে ইস্কুলের গল্প। গত কালই বলছিল, কি যেন পড়াতে গিয়ে স্যার সঙ্ঘবদ্ধতা শব্দের অর্থ জানতে চান। শ্রীমতী তুত্তুরী উঠে দাঁড়িয়ে অর্থ বলার পর, উদাহরণ হিসেবে তিলোত্তমার কথা বলে। বিচারের দাবীতে কেমন সঙ্ঘবদ্ধ  হয়েছে সুশীল সমাজ, এই মুহূর্তে এই শব্দটির এর থেকে ভালো উদাহরণ আর কি হতে পারে। মুস্কিল হল, তিলোত্তমার নাম করার সাথে সাথেই ফোঁৎ করে ওঠে পিছন বেঞ্চের দুটো ছেলে। “কোন ছেলে গুলো জানো তো মা, সেই যে পরীক্ষা শেষের দিন, যারা তিলোত্তমাকে নিয়ে অশ্লীল আলোচনা করছিল বলে যাদের আমি ঝেড়েছিলাম। আজও ফোঁৎ শুনে ঝাড়তেই যাচ্ছিলাম, তার আগেই এক লাফে স্যার গিয়ে দাঁড়ালেন ওদের সামনে। তারপর কোমরে হাত দিয়ে, জলদগম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন, ‘Do you think it's funny?’ কি বকান যে বকলেন মা, কি বলব তোমায়। তবে ওদের কোন লজ্জা নেই, স্যার চলে যাবার পর বলল, ‘কি দিনই এল, সঞ্জয় রায় বলছে তিলোত্তমার প্রতি empathetic হও।‘ স্যারের নাম সঞ্জয় রায়, কি না।”

স্কুলের গল্পের পর আসে আধুনিক ভাষা নিয়ে আলোচনা। যুগ ভেদে বাংলা/ইংরেজি যে কত বিবর্তিত হয়েছে, তিনি না থাকলে আমি জানতেই পারতাম না। মুস্কিল হল, তিনি যা বলেন, তার অর্ধেকের ওপর আমার মাথার ওপর দিয়ে যায়, এই আর কি। তবে মাঝে মধ্যে মনে পড়ে যায়, আর বন্ধুবান্ধবদের সামনে কেত দেখিয়ে বলি বৈকি। সেদিন যেমন এক বন্ধুকে বললাম, “ডেলুলু ইজ দা অনলি সল্যুলু।“ কি বুঝল, ভগবান জানে- 


তৃতীয় তথা অন্তিম পর্যায়ে আসে, খেলার খবর। কোথায় কি খেলা হচ্ছে, কারা খেলছে, কারা জিতছে, কারা হারছে, তাই নিয়ে ছায়ামাধ্যমে কি ঠাণ্ডাগরম যুদ্ধ চলছে, আগামি দিনে জিও-পলিটিক্সে তার কি প্রভাব পড়তে চলেছে, এইসব নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা। কোন কোন দিন চায়ের টেবিলে দীপ্তি জীবনজী আসে, তো কোনদিন সিমরান শর্মা, কোনদিন বা প্রীতি পালের বাবা। তেলেঙ্গানার মেয়ে দীপ্তি মানসিক ভাবে কিছুটা বিকলাঙ্গ। আর পাঁচ জনের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়া দীপ্তিকে তার গ্রামের লোক পাগল, কালিকালটি, ভূতনি, বাঁদরি ইত্যাদি বলে খেপাত। সেই মেয়ে জাপানের কোবে শহরে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে ৪০০ মিটার দৌড়ে গড়ে ফেলল বিশ্বরেকর্ড। সব কোনিরই একজন ক্ষিতদা থাকে, দীপ্তির ক্ষিতদা যখন আনন্দে আত্নহারা হয়ে দৌড়ে গিয়ে খবর দিল, “ঐ মেয়ে তুই বিশ্বরেকর্ড করেছিস রে।” শিশুর সরলতা নিয়ে দীপ্তি প্রশ্ন করেছিল, “কি করেছি? অ। সোনা জিতেছি কি?” 


উত্তরপ্রদেশের সিমরান জন্মান্ধ। দৃষ্টিহীন মেয়েকে  ঘাড় থেকে নামাতে, সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল তার পরিবার। পরিবার অসহযোগিতা করলেও, বর করেনি। বিয়ের পর স্ত্রীর বিশেষ ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে পাশে দাঁড়ায় ছেলেটি। দৌড়ো মেয়ে, দৌড়ো। পূরণ কর স্বপ্নের উড়ান। "জানো মা, একজোড়াই জুতো ছিল লোকটার, রানিং শু। সেটাই সিমরানকে দিয়ে দেয়। সিমরানের ট্রেনিং এর জন্য জমি বেচে দেয়। " নিরাশ করে না সিমরান ও। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা আর প্যারা অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পেয়েছে সিমরান।


মিরাটের মেয়ে প্রীতি পাল, সেরিব্রাল পালসির শিকার। মেয়েটা দু-দুটো ব্রোঞ্জ পেয়েছে প্যারাঅলিম্পিকে, ব্রোঞ্জ প্রতি তিরিশ লাখ হিসেবে ষাট লাখ টাকা ইনাম দিয়েছে সরকার। টাকা পেয়ে প্রীতির বাবা কেবল বলেছে, “টাকাটা আগে থাকলে, আমার মেয়েটাকে আর আজ প্যারাঅলিম্পিকে যেতে হত না।” শুনতে শুনতে কখনও ভিজে যায় চোখের কোন, কখনও বা গর্বে হয়ে পড়ি আত্মহারা। 


আজও তেমনি কিছু শুনব ভেবে বাড়ি ফিরলাম, ফিরেই বুঝলাম ব্যাপার বেশ গুরুতর। আমাকে পোশাক বদল করারও সুযোগ দিলেন না তিনি, হাত ধরে সটান টেনে নিয়ে গেলেন, তাঁর ঘরে। অতঃপর হাতে তুলে দিলেন, একটি পেন। সাদা দেহ, নীল টুপি, এতো আমাদের শৈশবের Reynold। হতবাক হয়ে তাকাই তাঁর দিকে, তিনি খুশিতে ঢলে পড়ে জানান, “এটা উপহার পেয়েছি। ইংরেজি স্যার, একটা গল্প লিখতে দিয়েছিলেন, একটি নির্জন দ্বীপে ৭৯ ঘণ্টা। আমার লেখা গল্পটা ওনার খুব ভালো লেগেছে, তাই উনি আমাকে ওনার ছাত্র জীবনের পেনটা উপহার দিয়েছেন।”


আমাদের ছাত্র জীবনে পেনটার দাম ছিল পাঁচ টাকা। এখন কত হয়েছে জানি না। কিন্তু তুত্তুরীর কাছে যে এটা অমুল্য তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। অভিনন্দন জানিয়ে প্রশ্ন করি, কি গল্প লিখেছিলি? তিনি বলতে থাকেন, “ জাহাজে করে আমরা আন্দামান যাচ্ছি, প্রায় পৌঁছেই গেছি, এমন সময় ভাবলাম, যাই একবার ডেক থেকে ঘুরে আসি। বাবা মা ঘরে থুড়ি কেবিনে ঘুমাচ্ছে, আমি চুপিচুপি আমার ব্যাগপ্যাকটা নিয়ে ডেকে গিয়ে হাজির হলাম। ওমনি উঠল ঝড়, তালে তালে উত্তাল হয়ে উঠল সমুদ্রও -।” এই পর্যন্ত শুনেই ক্ষ্যামা দিই আমি। “তুই ডেকে একা, ব্যাগ প্যাক নিয়ে দাঁড়িয়ে, সমুদ্র উত্তাল আর আমরা ঘুমাচ্ছি?” এক গাল হেসে তিনি বলেন, “তাও তো শ্যামাশ্রীর মত লিখিনি, যে দুষ্টুমি করছিলাম বলে আমার মা আমায় একটা নির্জন দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।”


আর আপনারা বলেন, গতকালই নাকি ছিল কেবল কন্যা দিবস। একবার মায়ের জুতোয় পা গলিয়ে দেখুন মশাই, হাড়ে হাড়ে টের পাবেন, যে প্রতিটা দিনই, প্রতিটা ক্ষণই কন্যা/পুত্র দিবস। তারাই যে আমাদের সূর্য, তাদের ঘিরেই যে আবর্তিত হচ্ছে আমাদের জীবন। তাঁর ভাষায়, "তব নাম লয়ে চন্দ্র তারা অসীম শুন্যে ধাইছে, রবি হতে গ্রহে ঝরিছে প্রেম, গ্রহ হতে গ্রহে ছাইছে।"



অনির ডাইরি ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 





"এমনি চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো -" 


এমন রাত, এমন চাঁদ বারবার আসে না। সারা জীবনে ঠিক কতবার যে আসে, জানি না। এই সব রাতে চাঁদকে সাক্ষী রেখে গোপন ভাঁড়ার ঘরের চাবি খুলে দেয় ধরা। এইসব রাত কান ধরে আরেকবার মনে করিয়ে দেয় যে এই  বিশাল, চূড়ান্ত রহস্যময় পৃথিবীর সামনে কতটা ক্ষুদ্র, কতটা অপাংক্তেয় আমরা। 


শেষ বার এমন চাঁদ উঠেছিল অর্ধযুগ আগে, অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায়। সুকন্যা তখন পুরুলিয়ার পোস্টেড, ওর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সবাই মিলে সদলবলে রওনা দিলাম পুরুলিয়া। বিকালের পুরুলিয়া এক্সপ্রেস বেশ রাত করেই নামাল পুরুলিয়া স্টেশনে। দুটো গাড়ি নিয়ে নিঝুম ইস্টিশনে অপেক্ষা করছিল সপুত্র সুকন্যা। সোজা তুলে নিয়ে গেল বনবিভাগের বড়কর্তার সরকারী আবাসে। তিনিই সুকন্যার গৃহস্বামী কিনা। 


মধ্যরাতে জনা সাতেক অতিথি এসে হাজির হলে বাড়ির লোক একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ই, কাকু-কাকিমাও হচ্ছিলেন বোধহয়, আমরা আশ্বস্ত করলাম, আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে না। আমরা বাড়ির লোকেরও অধম। নিজেরাই খাবার বেড়ে খেয়ে নিই, নিজেরাই মশারি খুঁজে খাটিয়ে নিই,যা লাগে নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিই, আমরা এমনই। সুকন্যা আর অর্ণবদা সেটা খুব ভালো রকমই জানে। 


একরাত পুরুলিয়া শহরে কাটিয়ে, পরদিন সটান অযোধ্যা পাহাড়ের বন বাংলো। দিনের বেলা ঘোরাঘুরি, রাতে জমিয়ে আড্ডা। অর্ণবদা একাই আসর জমিয়ে দিল। এত বছর বন বিভাগে চাকরির সৌজন্যে ঝুলি ভর্তি কত রকমের যে গল্প। বন জঙ্গল আর হাতির গল্পে যতি চিহ্ন পড়ল, যখন দেবশ্রীদি ভূতের গল্প বলা শুরু করল। অখণ্ড নিস্তব্ধতার মাঝে দেবশ্রীদির মুখে শরদ্বিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের ভূতের গল্প, অধমের জীবনের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। পিকু নাম ছিল কি গল্পটার? ফিরে এসে শরদ্বিন্দু অমনিবাস খুঁজে পেতে গল্পটা বার করে আবার পড়েছিলাম আমি, একটুও ভয় পাইনি। কিন্তু সেদিন রাতে হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছিল দেবশ্রীদি। 


গল্পদিদির আসর আর একটু জমতো, কিন্তু ব্যাঘাত ঘটল, যখন সিঁড়ির দেওয়ালে বেরিয়ে থাকা একখানি ধানি লঙ্কার সাইজের পেরেকে পরপর হাত কাটল দুটো পুঁচকে। প্রথমজনেরটা নেহাৎ দুষ্টুমি জনিত দুর্ঘটনা, দ্বিতীয় জনেরটা পরীক্ষা, " কি ভাবে অট্টুকু পেরেক হাত কাটতে পারে?" গল্প মাথায় তুলে তিন খুদেকে নিয়ে পড়ল দেবশ্রী দি আর বিদিশা দি। রাত বাড়ছে, খেতেও তো দিতে হবে। বর গুলো বনজঙ্গল ছেড়ে ক্যামেরা আর ছবি নিয়ে গুলতানি করতে লাগল, সুকন্যা বলল," চল একটু হেঁটে আসি।"


বাংলোর দরজার বাইরে কেবল একটা টিমটিমে আলো, আলোর সীমানা ছাড়ালেই নিকষ আঁধার। মুঠো ফোনের টর্চের আলো পলকে শুষে নেয় সেই অন্ধকার। বেশ কয়েক পা অন্ধকারের সাথে ব্যর্থ লড়াই করে হাল ছেড়ে দিলাম আমরা। সুকন্যা বলল, " একটু সময় দাও, চাঁদের আলোয় চোখ ধাতস্ত হয়ে যাবে।" সত্যিই তাই, আকাশে সোনার থালার মত ওঠা চাঁদের মুখে জমেছিল সামান্য মেঘ, সরে যেতেই যেন ঝলমলিয়ে উঠল চরাচর। জনমানব শূন্য পথঘাট, সকালে এদিকে গুটি কয়েক গুমটি দেখেছিলাম, এখন আর কিছুই খোলা নেই। লোকজন সব গেল কোথায়? এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? মহানগরে তো এখনও বাড়িই ফেরে না অনেকে। 


একটা গুমটির সামনে একটা অতিকায় কালো শুয়োর বাঁধা ছিল সকালে, দেখলাম সেটা এখনও আছে, কিন্তু সেও গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। আরো বেশ খানিক অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে একটা তেমাথা পড়ল। তেমাথার মোড়ে একটা MGNREGA র সিমেন্টের ফলক লাগানো। তার ওপরেই বসলাম দুজনে। হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, আসার আগে কত যে কথা জমিয়ে রেখেছিলাম সবাই, দেখা হওয়া ইস্তক কিছুই আর মনে পড়ছে না। কোন আলোচনা, কোন সমালোচনা কিছুই যেন আর অবশিষ্ট নেই এই দুনিয়ায়। আছে শুধু মসি কৃষ্ণ ঘুমঘুম জঙ্গল, শেষ নভেম্বরের ঠাণ্ডা হাওয়া আর সোনার থালার মত চাঁদ। 


কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না, আচমকা কে যেন ডেকে উঠল, "ম্যাডাম"। দুজনে একসঙ্গে চমকে উঠলাম। অন্ধকার ভেদ করে ফুটে উঠল দুই মনুষ্যকৃতি। হাত জোড় করে নমস্কার করে, সামান্য ঝুঁকে তাঁদেরই একজন বলল, "ম্যাডাম, এবার ফিরে চলুন। আর এই জায়গাটা নিরাপদ নয়। আমরা সেই বন বাংলো থেকে আপনাদের পিছন পিছন আসছি,এতক্ষণ গল্প করছিলেন বলে কিছু বলি নাই, কিন্তু এবার একটু বিরক্ত করছি। রাত বাড়ছে, জন্তু জানোয়াের বেরাতে পারে। তাছাড়া মানুষও তো সবাই ভালো নয়।"


 সময়ের জ্ঞান সত্যি ছিল না, তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম দুজনে। বাকি পথটাও ছেলে দুটি পিছন পিছন এল। পেশায় বনরক্ষী ছেলেদুটো, অন্ধকারে বড়সাহেবের গিন্নী আর তার দোস্তকে বেরোতে দেখে নীরবে অনুসরণ করে এসেছে, আমরা টেরটিও পাইনি। নিজেকে বেশ কেউকেটা বোধ হচ্ছিল মাইরি, সাধে সুকন্যাকে বনবিবি বলে ক্ষ্যাপাই আমি। 


দুই বন্ধুর অবিমৃষ্যকারিতার জন্য বাড়ি ফিরে সেদিন দাদা দিদিদের বকুনি খেলেও  আমাদের বরগুলো কিছুই বলেনি, জানে বউগুলো জন্ম তারকাটা। আজই যেমন প্রকাশ্য সরণীতে হঠাৎ আব্দার জুড়লাম জ্যোৎস্নার প্রকৃত রূপ প্রত্যক্ষ করতে আমাকে কোন অন্ধকার, জনবিহীন সৈকতে নিয়ে যেতে হবে এবং এখুনি। কে জানে কখন আবার মেঘের পর্দায় মুখ লুকাবে শশী। 


সদ্য আপিস থেকে ফিরেছে শৌভিক, ফিরেছে কোথায়, না দীঘায়। কারণ বিগত কয়েকদিনের উত্তমমধ্যম বৃষ্টিতে মাননীয় মহকুমা শাসকের সরকারী আবাসনে ছাত থেকে ইয়া বড় চাঙর খসে পড়েছে। তাও আবার শাশুড়ি মায়ের পিঠের ছয় ইঞ্চি দূরে। একটু আগেই ওই খানে মাথা রেখে শুয়েছিলেন বৃদ্ধা, ঘুম আসছে না দেখে, উঠে চেয়ার টেনে বসে টিভিটা চালিয়েছেন আর অমনি ধপাস! মাথায় পড়লে কি হত ভেবে এখনও হাত পা পেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে আমাদের।


জানলার বাইরে তখন অঝোরে ঝরছে অতি গভীর নিম্নচাপের বারিধারা। আতঙ্কিত শৌভিকের আহ্বানে আবহাওয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দৌড়ে এলেন পূর্ত দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। বাংলোখানা সেই ব্রিটিশ আমলে তৈরি, তাই বোধহয় এখনও টিকে আছে। টুকটাক মেরামতির কাজ যে হয় না, তা নয়, তবে বাহারি নকল ছাতের অন্তরালে তলেতলে অবস্থা এমন সঙ্গীন কেউ বোঝেনি। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অনুরোধে দিন দুয়েক ধরে ছাঁদা বেঁধে বৃদ্ধা শাশুড়ি মাতা সহ সমুদ্র পাড়ে বাসা বেঁধেছি আমরা। 


আমার আপিস, তুত্তুরীর লেখাপড়া, ইস্কুল মাথায় উঠলেও, আপিস গিয়েছিল শৌভিক। দীঘাতেও যে একটা আপিস আছে ব্যাটার। সন্ধ্যে বেলা ফিরে কেলে কফি খেয়ে পুরাণ দীঘার সৈকত বরাবর পায়চারি করছিলাম দোঁহে। আজ সমুদ্র সুন্দরী বেশ ফাঁকা। 


পূর্ণিমার সৌজন্যে কিনা জানি না, একে তো কোটাল এসেছে সমুদ্রে, তায় এটা জোয়ারের সময়, জলের ছিটা উঠছে সুউচ্চ লাইট পোস্টের মাথা ছড়িয়ে। নিয়ন আলো ছাপিয়ে দূরে সমুদ্রের বুকে জায়গায় জায়গায় খাপচা করে সোনার জল করার মত রং করে দিচ্ছে পূর্ণ চন্দ্র। দেখতে দেখতে মনে হল, আজ তেমনি এক রাত। আজ আবার চাঁদকে সাক্ষী রেখে গোপন ভাঁড়ার ঘরের চাবি খুলে দেবে ধরিত্রী। শুধু এমন কোন জায়গায় যদি যাওয়া যেত, যেখানে এত বৈদ্যুতিক আলো আর এত শোরগোল নেই। প্রকাশ্য রাজপথে বরের বাহু আঁকড়ে আব্দার করলাম,  নিয়ে যাবি? প্লিজ? এখনই? বাকিটা জানে কেবল ভাদ্র পূর্ণিমার চাঁদ, নিরালা সৈকত, জোয়ান সমুদ্র আর সুন্দরী বুড়ি পৃথিবী।


অনির ডাইরি ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


আবহাওয়া তো বদলাচ্ছিল বিগত দিন দুয়েক ধরেই। এই টিকি পোড়ানো গরম, তো এই ভেসে গেল ধরা। এই থিকথিক করছে ভিড়, তো এই শুনশান আমাদের আপিস। তেমনি এক সায়াহ্নে স্কুলের বন্ধুদের মেসেজ করলাম, " ভাবছি ঘুমিয়ে পড়ি -"। জানলার বাইরে ঝুলছে, মসিকৃষ্ণ মেঘের পর্দা, বাজের দাপটে বন্ধ সব কম্পিউটার, আমরা গুটি কয় হতভাগ্য কর্মচারী ভিন্ন আপিস প্রায় জনশূন্য। 


ঘুমিয়েও পড়তাম হয়তো, যদি না বড়সাহেব মেসেজ করে জানতে চাইতেন, "বারখোদা কার এলাকা জানো?" গুগল করে দেখলাম, আমার এবং মুকুলের। মহকুমা আমার আর ব্লক মুকুলের। একজনের নাম দিয়ে স্যার বললেন, 'খোঁজ নিয়ে দেখো তো, এই লোকটি ওই অঞ্চলের বাসিন্দা কি না। যদি হয়, তাহলে কেমন আছে?" এমন মেসেজ তো সচরাচর করেন না বড়সাহেব, প্রতিবেশী দেশের সৌজন্যে ইদানিং যত্রতত্র বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর হামলা হচ্ছে, এটাও কি তেমন কিছু নাকি? জানতে চাইবার আগেই জানালেন বড়সাহেব, আমার অনুমানই সঠিক, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক, ভিন রাজ্যে ফুলের কাজ করত। মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছে - 


অন্যান্য মহকুমা গুলোতে ভুরি ভুরি এমন কেস আসছে, তমলুক তুলনামূলক ভাবে বর্ধিষ্ণু মহকুমা বলেই হয়তো, এর আগে এই রকম একটাই কেস এসেছিল, ময়নার ছেলে। খবর এসেছিল পিটুনি খেয়েছে, কাজ হারিয়েছে।বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে তো আমার লোকজনেরই পিটুনি খাবার উপক্রম। ছেলে ভালো আছে, বিদেশবিভূঁইয়ে থাকে, হোটেলে কাজ করে, মাসে মাসে ভালো টাকা পাঠায়, খামোখা কেন আমরা ফোন করে বা বাড়ি এসে উৎপাত করছি? অনেক কথা শুনিয়েছিল বাড়ির লোক। ভাবলাম, এটাও তেমনি হবে হয়তো। প্রার্থনা করলাম, এটাও তেমনিই হোক। আর আমিও একটু ঘুমিয়ে নিই, বড় মুখ করে বললাম বন্ধুদের। আগের বার ইন্সপেক্টর সৌরভ আর এসএলও রঞ্জন খিস্তি খেয়েছিল, এবার না হয় মুকুল আর মতিবুল দুটো গাল খাক, লোকটা যেন ভালো থাকে ঠাকুর।


বৃষ্টির দাপট একটু কমেছে, দল বেঁধে ছাতা নিয়ে টিফিন করতে যাচ্ছিল আমার লোকজন। দৌড়ে গিয়ে বললাম, দুমিনিট দাঁড়া বাবা। একটু খোঁজ নিয়ে দেখে নিই, লোকটা ঠিক আছে কিনা। মতিবুলকে ফোনেই পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না আশেপাশের পঞ্চায়েতের জনা দুই তিন এসএলওকেও। বাজ আর বৃষ্টির দাপটে সবাই ফোন বন্ধ করে বসে আছে নাকি? বাকিদের খেতে পাঠালাম, শান্তনু একা রয়ে গেল ফোন করার জন্য। 


বেশ কিছুক্ষণ পর বাজল মতিবুলের ফোন। নামটা বলল শান্তনু, ওপাশ থেকে কি জবাব ভেসে এল জানি না, ফ্যালফ্যাল করে খানিক আমার দিকে তাকিয়ে শান্তনু বলল, "ম্যাডাম মতিবুল বলতেছে, ছেলেটা মরে গেছে।" কি বাজে বকছ, বলে ফোনটা কেড়ে নিই আমি। মতিবুল তখনও ধরে আছে ফোনটা, আবার শুধালাম আমি, ও কি ছেলেটাকে চেনে? ছেলেটা কি সত্যিই পরিযায়ী শ্রমিক? কেমন আছে ছেলেটা? আবার জবাব দিল মতিবুল, " হ্যাঁ ম্যাডাম, চিনি তো। আমার বাড়ির পাশেই থাকে। পিটিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিছে, আর বেঁচে নেই -। আমি আপনাকে ছবি পাঠাচ্ছি।" 


ক্লান্ত, পরাজিত হয়ে মাথা নীচু করে চেম্বারে ফিরে আসি, ভারী মন, ভারী গলায় বড়সাহেবকে দুঃসংবাদটা দিই। জানাই মতিবুল ছবি পাঠাচ্ছে, মিলিয়ে নেওয়ার জন্য। বড় সাহেব আঁতকে ওঠেন, "কিসের ছবি?" বলি, ছেলেটার বা তার আধার, ভোটার কার্ডেরই হবে। স্যার বলেন, "না। ওর বর্তমান অবস্থার। আমিও পেয়েছি ওই ছবিগুলো, ইচ্ছে করেই তোমায় পাঠাইনি। এত বীভৎস, তুমি প্লিজ ওগুলো দেখো না -"। স্যারের ফোন শেষ হবার আগেই, দৌড়তে দৌড়তে আসে শান্তনু, " ম্যাডাম, মতিবুল কি সাংঘাতিক সব ছবি পাঠিয়েছে -। একদম দেখবেননি। একটা দেখেই আমার মাথা ঘুরছে -"। 


কেমন দেখতে হয়, গণপ্রহারে মৃত মানুষকে? আমার দেখার ইচ্ছে নেই। আমার দেখার ক্ষমতা নেই। অপরিসীম ক্লান্তির সাথে সাথে এক অক্ষম রাগ আমাকে গিলে খাচ্ছে। কেন? কেন? কেন? আধার নম্বর জোগাড় করে ততক্ষণে পোর্টাল খুঁজে দেখে ফেলেছে বেদজ্যোতি, আছে, ছেলেটি আছে। সরকারী প্রকল্পে নথিভুক্ত আছে। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে দুলক্ষ টাকা পাবে ছেলেটির উত্তরাধিকারী। তাতে কি? কত টাকা মূল্য হয় একটা প্রাণের? আদৌ কি কোন মূল্য হয় প্রিয়জন বিরহের -।

অনির ডাইরি ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ 


#পায়ের_তলায়_সর্ষে #অনিরডাইরি #ফিরেদেখা 


আমি প্রায় বলি যে আমার জীবনের সবথেকে সেরা মুহূর্ত গুলি না তো ক্যামেরা বন্দী করতে পেরেছি, নাই সোশাল মিডিয়ায় আপলোড করতে পেরেছি। সময়টা ২০০৮। তখনও অবিবাহিত। বেড়াতে এসেছি উত্তর ভারত। বাবা-মা,তিন মাসি, মেসোমশাই,বোন এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ও তাদের বন্ধু পরিবার নিয়ে প্রায় জনা কুড়ির দল।আমাদের মত জনা তিন কেবল কুড়ির কোঠায় বাদে সকলেই বয়োজেষ্ঠ্য। আমরা ওভাবেই যেতাম।আড্ডা দিতে দিতে বেড়ানো আর বেড়াতে বেড়াতে আড্ডা। 


 হলুদ চাটার্ড বাসে রওনা দিলাম হরিদ্বার থেকে। আমাদের বেড়ানোর আর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল,সবসময় অব সিজনের শুরুতে আমরা গিয়ে হাজির হতাম। পর্যটকদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত শহর নগরের আচমকা ক্লান্ত,ঝিমানো রূপ বড়ই মধুর লাগত। ফাঁকা ফাঁকা সড়কে ধুলি উড়িয়ে বেড়ানো শুকনো পাতা, ধরমশালার সার সার তালা বন্ধ ঘরের নিস্তব্ধতা কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দিত। 


সারাদিন বাস গড়াল,পিছনের সিটে বসে এন্তার গান গাওয়া, ছোট মাসীর সহকর্মী ফাল্গুনি কাকু মাঝে মাঝে নামছে আর কমলা গুলি লজেঞ্জ কিনে আনছে। যারই গা গুলোচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে একটা মুখে পুরে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে বদলাল পাহাড়ের প্রকৃতি। বদলাল গাছপালা। নদীর জলের রঙ সাদা থেকে হাল্কা নীল হল যেন। বদলাল রাস্তার চরিত্র। বিকালে নামলাম উত্তরকাশি। ফাঁকা ধুধু করছে। গলি গলি দিয়ে হেঁটে গিয়ে লালকমলী মার্কা ধরমশালায় রাত্রিযাপন। সন্ধ্যের অন্ধকারে হেঁটে গিয়ে টিমটিমে বাল্বের আলোয় বুড়ো মহেশ্বরকে পুজো দেওয়া। পুরোহিত নেই। বাড়ি চলে গেছে। ভোলা মহেশ্বর একা নিঃসঙ্গ বসে আছেন। আবার অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ফেরা। সারা রাত কানের কাছে গঙ্গার গর্জন।সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ঝলমলিয়ে উঠলেন নদীর বুকে বিশাল মহাদেব। 


পরদিন নটার মধ্যে উত্তরকাশিকে বিদায় জানিয়ে আবার বেরিয়ে পড়া।এবার হিমালয় বড় রুখা। বিশাল বিশাল গাছ বহুনীচে থেকে খাড়া উঠে এসেছে। গিরিখাতের বুকে খঞ্জর চালিয়ে এগিয়ে যাওয়া নদীর জলে মিশেছে যেন আকাশ। আর আকাশ এত নীল হয়?টলটলে নীল আকাশ। আর রাস্তা?রাস্তা তো নেই দাদা। শুধু ধ্বংসস্তুপ। ধ্বসে পড়া পাথরকে পিসে দিয়ে টলতে টলতে এগোল বাস। গা গুলোনো বেড়ে গেল বহুদিন। আর দোকানপাট,মানুষজন কিছুই নেই। আছে শুধু হিমালয় আর আমরা। পলকে পলকে বাস বাঁক নিচ্ছে,একবার আর্তনাদ করে উঠল মা,দেখলাম বাসের সামনের একটা চাকা রাস্তায় আর একটা ঝুলন্ত। ড্রাইভারের বিশেষ হেলদোল নেই। হেঁইও-- ঘুরে গেল বাস,হাফ ঝুলে ঝপাং করে রাস্তায় উঠলাম আমরা। 


সন্ধ্যে নামার মুখে গঙ্গোত্রীতে পৌছলাম। ঠাণ্ডার কামড় বেশ বুঝতে পারলাম। চড়চড় করে ফেটে গেল পিঠের চামড়া।জিন্স, সোয়েটার, জ্যাকেট,টুপি চাদরেও হিহি করতে করতে ব্যাগ কাঁধে বাজারের ভিতর দিয়ে গঙ্গার ওপাড়ে যেতে হবে। নামা মাত্রই মা, আর বয়স্ক কয়েকজনের শুরু হল শ্বাসকষ্ট। বাতাসে অক্সিজেন বেশ কম। চোখের সামনে যে পাহাড়,তা আর সবুজ নয়। সবুজ ঝাউ টাইপ গাছের লাইন একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় শেষ। তারওপরে কিছুদূর খসখসে পাথুরে পাহাড়,তারওপর জমাট বাঁধা সাদা বরফ। পড়ন্ত সূর্যের দীপ্তিতে গোলাপী সোনালী সাদা-


গঙ্গোত্রীর এপাশটা বেশ নিরিবিলি। ওপাড়ে ঝলমলে শহর,এপাড়ে নিকষ আঁধার। শীতের কামড়ও বহুগুণ বেশী যেন। যে ধরমশালায় থাকার কথা,গিয়ে জানা গেল তিন দিন ধরে পাওয়ার নেই। জেনারেটর চলে চলে ক্লান্ত।আর তেলও নেই। মোমবাতি ও পাঁচ ছটার বেশী নেই। পুরো ধরমশালায় আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। কয়েকজনের একতলা আর কয়েকজনের দোতলায় ঘর বরাদ্দ হল। অন্ধকার হিমশীতল ঘরে ঢোকা মাত্র হাড়ে হাড়ে কটকটি বাদ্য শুনতে পেলাম। এলসিডি টর্চ তো জ্বললই না। দুম করে চার্জ শেষ হয়ে গেল সবকটা মোবাইলের। টাওয়ার তো উড়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। 


এই অন্ধকারে আলাদা আলাদা থাকা অসম্ভব।কি অসহনীয় নিস্তব্ধতা। কানে যেন তালা ধরে যায়। একটা বড় ঘরে আটজন থাকব ঠিক হল। তিনটি পুঁচকে সিঙ্গল খাটে বাবা-মা আর তিন মাসি ভাগ করে শুল। আর মাটিতে মেসোমশাই,আমার বোন দীপু আর আমি।


 মাটির ওপর একটা তোশক দিয়ে গেল কেয়ারটেকার,যার বয়স বড়জোর তেরো কি চোদ্দ। আর গায়ে দেবার জন্য লেপ। সেই লেপের ওজন কমসেকম দশ কিলো তো হবেই। 

এবার মোমবাতির রেশন হল। রান্নাঘরে একটা,সিঁড়ির সামনে একটা আর তিনটি ঘরে একটি করে। একটি রিজার্ভ রইল রাতের জন্য। আটজন মানুষ একটি ঘরে,উপরন্তু একটি মোমবাতি, অক্সিজেনের সামগ্রিক অভাব বুঝতে লাগল মিনিট পাঁচ। তড়িঘড়ি মোমবাতিটিকে ঘরের বাইরে রেখে এলেন মেসোমশাই। ঐ প্রগাঢ় অন্ধকারে পা থেকে মাথা অবধি উলের জিনিসপত্রে ঢেকে দশ কিলো লেপের তলায় জড়াজড়ি করে শুয়েও ঠকঠক করে কাঁপছিলাম দীপু আর আমি। এমন সময় শুরু হল বাবা আর মায়ের দাম্পত্যকলহ। বাবা চেইন স্মোকার। তারওপর ফুসফুসের অসুখে আক্রান্ত, বার দুয়েক নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। ফলে মায়ের উদ্বিগ্ন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। হাতে গ্লাভস্ পরো আর এই ঠাণ্ডায় সিগারেট খেয়ো না-এই টুকু বলাই ছিল মায়ের অপরাধ। 


বাবা ক্রুদ্ধ হয়ে টুপি,গ্লাভস,মোজা না পরেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বলাইবাহুল্য সিগারেট আর দেশলাই কিন্তু ভোলেনি। মায়ের টেনশন কমাতে অগত্যা আমাকেই উঠতে হল লেপের ওম ছেড়ে বৃদ্ধকে খুঁজতে। ঘরের সামনের মোমবাতির শিখা থিরথির করে কাঁপছে,নিশ্চুপ ভুতুড়ে ধরমশালায় কেবল প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমার পায়ের আওয়াজ। প্যাসেজের মোমবাতি নিভু নিভু। গেল কোথায়?তবে কি এই ঠাণ্ডায় খালি মাথায়,খালি পায়ে রাস্তায় বেরিয়েছে?সর্বনাশ। অবধারিত নিউমোনিয়া। পায়ে পায়ে দরজা খুলে বাইরে এলাম। শীতল হাওয়া যেন পলকে সব পশমী বস্ত্রের আস্তর ভেদ করে ফালা ফালা করে দিল। দূরে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে আছে বাবা। হাতে জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনটা যেন এক জ্বলন্ত জোনাকি। চিৎকার করে ডাকতে গিয়েও পারলাম না,মোহিত হয়ে গেলাম নৈশ প্রকৃতির ভুবনমোহিনী রূপে। মাথার ওপর দিগন্তবিস্তৃত মসিকৃষ্ণ মহাকাশ,আর তার গায়ে খচিত শতসহস্র হীরের কুচির মত ঝকঝকে তারা।যেন হাত বাড়ালেই ধরতে পারি আমার নিজস্ব কোহিনুর। ঘোর অন্ধকারে গঙ্গার ওপাড়ের শহরের টিপ টিপ আলো যেন কালো সিল্কের শাড়িতে খচিত সলমা চুমকির আলপনা। আর অদূরে পাহাড়ের মাথায় বরফের মুকুট -সব মিলিয়ে বোধহয় এই অধমের ক্ষুদ্র জীবনের সবথেকে মোহময়, রোমাঞ্চকর মুহূর্ত ছিল সেটা।


অনির ডাইরি ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


জন্মদিন নিয়ে আমার বরের কোন আলাদা অনুভূতি নেই। অবশ্যি কি নিয়ে যে আছে, ভগবান জানে। সবেতেই কেমন যেন উদাসীন হাবভাব। আর এদিকে আমি হলাম কিনা পাক্কা Aquarian। শিরা - ধমনী - রক্তজালকে আবেগ আর আদিখ্যেতার ছড়াছড়ি। আরে ভাই, "আমার ইনি প্রথম পক্ষ" যে - 


মোটামুটি আগষ্টের বেতন ঢোকার বার্তা পাবার সাথে সাথেই, হন্যে হয়ে ফিরি শপিং সাইট গুলোতে। কি দেওয়া যায় লোকটাকে? গুগলকেও শুধাই, বছর পনেরো ষোলোর বুড়ো বরকে জন্মদিনে কি উপহার দেওয়া যেতে পারে বলো দিকি? ধুর ধুর, সাধ্যের মধ্যে একটাও মনোমত কিছু আসে না। 


জামাকাপড় দেব কি? দিয়ে কি হবে? শৌভিক তো গেল বারের জামাটাও এখনও ভাঙেনি। বিবাহবার্ষিকী বা নববর্ষে দেওয়া গুলো এক আধবার পরেছে কেবল। সব জমানো আছে থরে, থরে। মান্ধাতার আমলের গুলোও। না পরে, না ফেলে। বললেই বলে, 'কোথায় পরব?' কেন অফিসে পরলেই তো হয়, এতবার দীঘা যায়, আজ অমুক কমিটি, কাল তমুক কমিটির সাথে মিটিং করে, কত মাননীয়(ইয়া)দের অভ্যর্থনা জানাতে যায়, পরলেই তো পারে। বললেই শৌভিক বলে, 'ধুৎ!' 


মোদ্দা কথা, জামাকাপড় দিতেই পারি, তবে তার আগে আলমারি সাফ করা বাধ্যতামূলক। লর্ড ক্লাইভ বা বাদশা আকবরের দেওয়া গুলো না হয় থাক, সম্রাট অশোক আর স্কন্ধগুপ্তর আমলেরগুলো এবার বিদায় করতেই হবে। 


বই দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও শৌভিক গোল বাঁধায়, "ফ্রি পিডিএফ পাচ্ছি তো" অথবা "Kindle এ কিনে নেব, অনেক সস্তায় হবে।" ধুর, জন্মদিনে কেউ Kindle এর বই উপহার দেয়? আর দেয় কিভাবে? ও কিনবে আর আমি ওকে টাকাটা দিয়ে দেব? ম্যা গো! উপহার হিসেবে খসখসে পাতা, সোঁদা কাগজের গন্ধওয়ালা নতুন বইয়ের কি কোন তুলনা হয়। কিন্তু কি বই কিনি? জিজ্ঞাসা করলেই শৌভিক ঠোঁট উল্টে বলে, " ও কিছু দিতে হবে না। এই মুহূর্তে এত বই জমে আছে, পুজোর ছুটির আগে দেখা যাবে ক্ষণ।" 


এমন লোককে উপহার দেওয়া শিবের বাবারও কম্ম নয় বাপু। নেহাৎ আমি Aquarian। কিছু কিনি, লুকিয়ে চুরিয়ে। বন্ধুবান্ধবের নাম করে, ঘুরিয়ে শুধিয়ে। বেচারারা কতবার বিষম খায় কে জানে। বক্স খাটের ভিতর, ধূলিমলিন এক পিট্টু ব্যাগে লুকিয়ে রাখি সব কিছু, সারপ্রাইজটো তো দিতে হবে, জন্মদিনের রাতে। আমার এমন কপাল, দিন সাতেক আগে তিনি সেই ব্যাগটি এনে, ভিজে বেড়ালের মত দুষ্টু হেসে আমায় বললেন, " কি সব ভরে রেখেছিস। ব্যাগটা খালি করে দে।" দাঁত কিড়মিড় করে জানতে চাইলাম, এই ব্যাগটাই দরকার পড়ল? তিনি একগাল হেসে বললেন, " হ্যাঁ তো। এতে এক সেট জামা কাপড় নিয়ে দীঘা যাব। আজ হোল ডে ইন্সপেকশন। প্রচুর হাঁটাবেন ডিএম সাহেব। লাঞ্চ ব্রেকে চেঞ্জ করে নেব।" ধুর ধুর, সত্যি মনে হচ্ছিল তখন, বেঁচে থেকে আর লাভ নেই।


এতো গেল উপহার পর্ব, এবার আসি ভোজন পর্বে। আমার বরটি মোটেই ভোজন রসিক নয়। প্রাক বিবাহ প্রণয় কালে একবার প্রশ্ন করেছিলাম, " কি খেতে ভালোবাসো?" প্রচুর মাথা চুলকে, পাক্কা এক সপ্তাহ পর শৌভিক জানিয়েছিল, "পায়েস খেতে ভালবাসি।" পায়েস তো করবই, শৌভিকের মনপসন্দ লাল লাল চাপ চাপ পায়েস। সাথে আর কি? তুত্তুরীর জন্মদিনে, কি রান্না হল তার থেকেও আমার মেয়ের কাছে অধিক গুরুত্বপুর্ণ হয় কটা বাটি দেওয়া হল। শৌভিকের ক্ষেত্রে তাই করলে ডাহা ফেল করব। তিন চারটে বাটি দেখলেই মাথা চুলকাবে ব্যাটা। দুপদে বুঝিয়ে দিতে হবে আজ তোমার স্পেশাল দিন। 


তবে সবার আগে আসে কেক। ক্রিম কেক তাঁর দুচক্ষের বিষ। ঠিক করি, বাটারস্কচ পুডিং কেক বানাব, তার জন্য। বাটারস্কচ তার প্রিয়তম ফ্লেভার। শ্বশুরমশাই গত হবার পর থেকে শাশুড়ি মা আমিষ খাচ্ছেন না। তাই ঠিক করলাম, সবটাই এগলেস বানাব। এগ লেস কেক বা পুডিং বানাতে একটু বেশি খাটতে হয়, তা হোক। 


চার ধাপে বানাতে হয় কেকটা। প্রথম পর্যায়ে পাতি কেক, তারপর ক্যারামেল সস, তৃতীয় পর্যায়ে বাটারস্কচ পুডিং আর অন্তিম ধাপে দুই চামচ চিনিকে ক্যারামেল বানিয়ে, তাতে সামান্য মাখন আর গোটা আটেক রোস্টেড আমন্ড চূর্ণ মিশিয়ে, ঠাণ্ডা করে বেলুন দিয়ে উত্তমমধ্যম দিলেই কুরমুড়ে বাটারস্কচের দানা তৈরি। অফিস থেকে ফিরেই লেগে পড়ি কেক বানাতে। সর্বপ্রথম আধ কাপ ঈষদুষ্ণ দুধে এক চামচ ভিনিগার মিশিয়ে বানাতে হবে বাটার মিল্ক। তাতে একে একে মেশাতে হবে ১/৪ কাপ তেল, আধ কাপের একটু বেশি গুঁড়ো চিনি। আমাদের whisker নাই, কাঁটা চামচই ভরসা। ফেটানোর তালে তালে একে একে মিশবে ভ্যানিলা এসেন্স, বেকিং পাউডার, খাবার সোডা। বাটারস্কচ এসেন্স থাকলে ভালো হত, সে আর এই ভর সন্ধ্যায় কাঁথিতে কোথায় পাই। অগত্যা মদ্যাভাবে গুড় থুড়ি ভ্যানিলাই সই।


এর সাথে ময়দা আর এক চিমটি নুন মিশিয়ে নিলেই কেকের ব্যাটার রেডি। যার চ্যানেল দেখে শিখেছিলাম রেসিপিটা, তিনি পইপই করে বলেছিলেন, এই পর্যায়ে খুব ধীরে ধীরে একই দিকে ঘুরিয়ে মেশাতে হবে সবকিছু। রিবনের মত যখন ঝরে পড়তে থাকে ব্যাটার তখন বুঝি, কাজ শেষ। এবার বেক করার পালা। বড় কড়াইতে লবণ ছড়িয়ে মিনিট দশেক তাতিয়ে নিয়ে, তারওপর মোটা কাঁচের পাত্রটা বসিয়েই দিই ঈশ্বরের নাম করে। হে ঠাকুর, বরের জন্য কেক বানাচ্ছি, দেখো পাত্র ফেটে কেলেঙ্কারি না হয়। 


তিনি বাড়ি ফেরার আগেই আমাদের প্রথম পর্যায় শেষ। কেক ঠাণ্ডা না হলে আপাতত এগোনো যাবে না। গোবেচারা মুখ করে পড়তে এবং পড়াতে বসি আমরা মা মেয়ে। তিনি ঘরে ঢুকেই বেশ কবার নাক টেনে, মিটিমিটি হেসে বলেন, " কেক বানাচ্ছিস বুঝি। আবার পুডিং ও বানাচ্ছিস? গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে যেন"। কেমন রাগটা ধরে, লোকটা সত্যান্বেষী বা টিকটিকি হলেই তো পারে!


শুভ জন্মদিনের বিলম্বিত শুভেচ্ছা বুজুর বাবা। বার বার দিনটা ফিরে ফিরে আসুক, আরো আরো ভালোবাসা নিয়ে। আর ইয়ে বলি কি, কেউ যখন সারপ্রাইজ দিতেই চাইছে, সারপ্রাইজ দিতে এত্ত খাটছে, তখন খানিক সারপ্রাইজড হলেও তো পারো বাপু? দেবানন্দের ভাষায়, ' ঝুটা হি সহি ❤️'।


No comments:

Post a Comment