Sunday, 26 March 2023

অনির ডায়েরি ১৫ ই মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


মোবাইলের ঘড়ি বলছে সোয়া আটটা বাজতে এখনো বাকি কয়েকটা মিনিট, গাড়িতে উঠে বসলাম। আমি না বেরোলে কেউ যে আসর ছেড়ে নড়বেনা, বেশ বুঝতে পারছি। আজ আমাদের চণ্ডীপুরের ইন্সপেক্টর সাহেবের বৌভাত। শান্তনু, সন্দীপ আর মনীষ আমার তিন নবীন ইন্সপেক্টর। ব্যাটাদের চাকরি জীবনের বছর ঘুরে গেছে,অথচ এখনও ঘোঁছেনি "বেবি ইন্সপেক্টরের" তকমা। 

এহেন আমার তিন "বেবি"র মধ্যে শান্তনুরই প্রথম আইবুড়ো নাম ঘুঁচলো। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়া ইস্তক, যেভাবে সকলে শান্তনুর পিছনে লেগেছিল, আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল এমন উৎতপেতে লোকজনকে জীবনের শুভতম দিবসে মোটেই নিমন্ত্রণ জানাবে না শান্তনু। সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে, শেষ পর্যন্ত অবশ্য নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল শান্তনু এবং তাও চূড়ান্ত সরলতা, এক রাশ উষ্ণতা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে।


নিমন্ত্রিত হলে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে এটাই আমার বাবার শিক্ষা। অতিমারি এসে সব চেনা ছক উল্টেপাল্টে দিল তাই, নতুবা কেউ আমার বাবাকে নিমন্ত্রণ করবে আর বাবা যাবে না, এমন ঘটনা আক্ষরিক অর্থেই কোটিকে গুটিক। উপরোধে ঢেঁকি গিলে, এমন কত যে নিমন্ত্রণ বাবা রক্ষা করেছে, যেখানে না গেলেই বোধহয় ভালো হতো। যেখানে কেউ বলেনি,'আসুন', কেউ বলেনি,'খেতে চলুন' বা 'ভালো করে খাবেন।' নীরব অবজ্ঞা উপলব্ধি করে, নীরবেই উপহার প্রদান পূর্বক অভুক্ত অবস্থায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছে বাবা, কিন্তু গেছে।


শুধু যে নিজে গেছে তাই নয় যেতে বাধ্য করেছে মাকে এবং আমাকে। তাচ্ছিল্যে, অবজ্ঞায়, অভদ্রতায় জ্বলে গেছে গা, ভরে উঠেছে চোখ, তাও হাসির মুখোশ পরে দাঁড়াতে হয়েছে সর্বজন সমক্ষে। বৃদ্ধের আমি এতটাই অনুরাগিনী, যে কখনই বৃদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ করার ইচ্ছা বা সাহস হয়নি। আজও হয় না। অবশ্য আমার স্ট্রাইক রেট বাবার মত অত নিখুঁত ও নয়। স্বভাবতঃ কুঁড়ে হওয়ায়, না যেতে পারা নিমন্ত্রণ বাড়ির সংখ্যাও আমার খুব কম কিছু নয়।


আজও কোন বিয়ে বাড়ির ছবি লাগালে, ঠোঁট ফোলায় রমেশ, দুঃখ পায় প্রিয়াঙ্কা। চুঁচুড়া ছেড়ে আসার সময় কথা দিয়ে এসেছিলাম যে, পৃথিবী উল্টে গেলেও ওদের বিয়েতে আমি আসবোই। কথা দিয়েছিলাম তমলুক ব্লকের এসএলও জয়ন্ত বাবুকেও, অবশ্যই হাজির হব ওনার কন্যার শুভবিবাহে। দুখানা কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করেছিলেন জয়ন্ত বাবু, একটা শুধু আমাকে সপরিবারে আর একটা দিয়ে পুরো অফিসকে। 


দিনটা সম্ভবত ছিল রবিবার। প্রস্তুত ছিলাম আমি আর তুত্তুরী। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল কেবল আমরা ছাড়া, অন্য সকলেরই সেদিন অন্য কোন না কোন নিমন্ত্রণ বা ব্যস্ততা আছে। সদ্য বদলি হয়ে এসেছি তাম্রলিপ্ত নগরী, এমতবস্থায় একাকী, অচেনা পরিবেশে, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবার মতন সৎ সাহস সেদিন জোটাতে পারিনি। বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলাম পরিকল্পনা। সবথেকে খারাপ লেগেছিল, যখন কন্যার বিবাহের শত ব্যস্ততার মধ্যেও ফোন করেছিলেন জয়ন্ত বাবু, "ম্যাডাম আসছেন তো? ম্যাডাম কত দূরে আছেন?"  ঠিক যেমন ফোন করেছিল চুঁচুড়া থেকে রমেশ।


পরের দিন আপিসে এসে খুব বকেছিলাম সবকটাকে। কিসের এত গেঁতোমি তোমাদের বাপু? মানছি দূরের লোকেরা ছুটির দিন পরিবার ফেলে আসতে বিপন্ন বোধ করে, কাছাকাছি যারা থাকো তারা গেলে না কেন? সবাই চুপ, শেষে চঞ্চল বলল,' আসলে ম্যাডাম‌ কুন্তল স্যার সবাইকে গাড়ি করে নিয়ে যেত তো-'। কুন্তল আমার পূর্বসূরী এবং ব্যাচমেট এবং সুহৃদ। আজও এদের নয়নমণি। কুন্তলের সাথে নিমন্ত্রণ বাড়ি না যাবার কি সম্পর্ক বুঝলাম না। চঞ্চল বলল,' তার আগে তো, সাহেব ম্যাডামরা সবাই গাড়ি করে চলে যেতেন। স্টাফেরা যে যার মত বাসে করে যেত। একবারই গাড়ি দিয়েছিলেন অমুক আধিকারিক, সবাই খুব আনন্দ করে গিয়েছিল সেবার খেতে, ওমা হঠাৎ তাঁর মনে হল, যে তিনি হলদিয়া যাবেন। ভয়ের চোটে উত্তম তো না খেয়েই উঠে পড়ল।'


কবেকার কথা, তাও উত্তমকে বললাম, 'খেয়ে উঠবে তো? না খেয়ে হলদিয়া নিয়ে যেতে বলেনি তো কেউ।' উত্তম কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ' আপনি জানেননি, উনি পাঁচবার খাবার জায়গায় চলে গেছেন আমায় ডাকতে, শেষে পাতে জল ঢেলে উঠে পড়লুম। যা ভয় পেতুম ম্যাডাম ওনাকে, ওনার ভয়ে বাথরুম পর্যন্ত যেতুমনি, চেপে বসে থাকতুম গাড়িতে। একবার বাথরুম গেছি চাবিটা গাড়িতে লাগানো ছিল, মোবাইলটাও গাড়িতেই রাখা ছিল। দু মিনিট পর ফিরে এসে দেখি, গাড়ি নাই। আমার তো মাথায় হাত, আশেপাশের অন্য সরকারি গাড়ির ড্রাইভাররা বলল, 'তোর বস্, তোর গাড়ি লিয়ে চলে গেছে।' ফোনটাও গাড়িতে রয়ে গেছে, ফোন করতেও পারতেছি নে। পকেটে যা পয়সা ছিল তাই দিয়ে বাসে করে অফিসে এসে দেখি, তিনি তুলকালাম বাঁধিয়েছেন। অমিয় দাকে (গাড়ির মালিক) বলতেছেন, 'হয় উত্তম থাকবে, নয় তোমার গাড়ি থাকবে।' উত্তমকুমারকে অবশ্য, দূর করে দেবার হুমকি, আমিও দিই। প্রতি তিন দিনে একবার তো বটেই। ভাগ্যে গাড়ি চালাতে পারি না- 


 যাইহোক প্রসঙ্গ থেকে সরে আসছি বুঝতে পেরে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা গেলে না কেন? ইতস্তত করে চঞ্চল বলল,' সেবার যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন এত অটো টোটো ছিল না, ওই রোদে দুপুর বেলা সবাইকে হেঁটে অফিস ফিরতে হয়েছিল।' বুঝতে পারলাম আগেকার তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্যই, ওরা সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছে। আশ্বস্ত করে বললাম, কুন্তল স্যার জিন্দাবাদ। আর আমার ফেলে আসা অফিসের লোকজনকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখো,  চুঁচুড়ায় কেমন মুড়ি টিনের মত ঠেসে ঠেসে সবাইকে গাড়িতে তোলা হত। এখানেও তাই হবে। আধিকারিক বা অফিস বদলে গেলেও বদলাবে না নিয়ম।


নিমন্ত্রণ এলে তারপর থেকে মোটামুটি হাজিরা দেয় অধিকাংশই। আজই যেমন সব মিলিয়ে আমরা ১৬ জন এসেছি। কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর সৌম্যর উপর ভার ছিল, কারা কারা যাবে তাদের নামের লিস্ট বানানো। তালিকা শেষ পর্যন্ত যা লম্বা হলো, বেদজ্যোতি-শুভাশিস-নন্দনের মত গুটিকয়েক যদি নানা কারণে যেতে অপারগ না হতো, তাহলে বোধহয় একটা মিনিবাস ভাড়া করতে হত, চাঁদা তুলে।


ঠিক ছিল, ঠিক চারটের সময় কাঁথি থেকে রওনা দেব আমি। পাঁচটা নাগাদ হক বাবুকে তোলা হবে নন্দকুমার থেকে। নিমতৌড়ি থেকে উঠবে সৌরভ আর CKCO শান্তনু। উপহার সমেত উঠবে শুভদীপ্ত। মেছেদা থেকে উঠবে সুরজিৎ, কোলাঘাট থেকে রঞ্জিৎ, দেউলটি থেকে সৌম্য, বাগনান থেকে রবিবাবু এবং সন্দীপ। সঞ্জয় আর মনীশ আসবে ট্রেনে। উলুবেরিয়া স্টেশন থেকে ওদের তুলে নেব আমরা। কাটায় কাটায় ছটায় পৌছবো আমরা নব দম্পতিকে আশিস এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রথম ব্যাচে খেয়ে ঠিক রাত আটটায় বেরিয়ে পড়ব আমরা।

সেই মতো শনিবার দুপুরে এক ফোঁটাও না ঘুমিয়ে পৌনে চারটের মধ্যে সেজেগুজে তৈরি হয়ে গেলাম আমি। সপরিবারে নিমন্ত্রণ ছিল, শৌভিক আর তুত্তুরী রাজি হলো না এই অবেলায় উলুবেরিয়া যেতে, তাঁরা নাকি যুগলে পাখির ছবি তুলতে যাবেন। সব হলো স্টার্ট নিল না কেবল গাড়িটা। টেনশনে আধ কিলো ঘেমে গেল উত্তম কুমার। বাংলোর সিকিউরিটি ছেলেটি এবং উত্তমে মিলে বিস্তর ঠেলাঠেলিও করল তাও নড়লো না গাড়ি। বিরস বদনে মেসেজ করলাম অফিস গ্রুপে, ভাই সব তোমরা যে যেমন পারো, যেভাবে পারো চলে যাও। মনে হয় না আমি যেতে পারবো।


ভেবেছিলাম এই নিমন্ত্রণ বাড়িটাও বুঝি সংযুক্ত হতে চলেছে অপারগতার তালিকায়। পাঁচটা বেজে গেলে হয়তো সত্যি সত্যি আর যেতামও না। বাঁচিয়ে দিল কাঁথি বাজারের বুড়ো মেকানিক, আসতে একটু দেরি করেছিলেন বটে তবে মাত্র তিন মিনিটে কি যে মৃতসঞ্জীবনী সুধা পান করালেন গাড়িটাকে। গাড়ি একদম রকেট হয়ে দৌড়লো। নির্ধারিত সময়ের মিনিট পঁয়তাল্লিশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমরা।


মেনু কি হতে চলেছে আগেই জেনে নিয়েছিলাম আমরা, যদিও কিছুই আর মনে ছিল না সেদিন। তবে জানতাম এবং মনেও ছিল যে টকটকে লাল লেহেঙ্গা পড়বে নববধূ। লেহেঙ্গার ছবিও দেখিয়েছিল শান্তনু। ছেলেটা এতই ভালোমানুষ গোবলু, যে কে সাজাতে আসবে, কখন সাজাতে আসবে এবং সাজানোর খরচ কত সেসব গল্পও শুনিয়ে ছিল আমাদের। ফলে সুসজ্জিতা নববধূর মঞ্চে অবতীর্ণ হতে, যে বেশ খানিকটা সময় লাগবে, এ ব্যাপারে আমরা ইতিমধ্যেই অবহিত ছিলাম। 


নববধূর আসতে বিলম্ব হলেও ফুচকাওয়ালার যে আসতে বিলম্ব হবে না, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। অবিলম্বে লাইন পড়ে গেল ফুচকাওয়ালার সামনে। একদল কটকটে ঝাল ফুচকা চায়, তো একদল ঝাল বিহীন শুকনো ফুচকা। ফুচকার পাশেই ঢেলে রাখা গরম গরম পনির কাঠি কাবাব। তার পাশে জ্বলন্ত চিকেন মোমো। তার পাশেই কফি। ফুচকার টক জলে পেট টইটুম্বুর, এমতবস্থায় কিছুতেই কফি খাব না আমরা, শান্তনুর মামা বাবুও ছাড়বেন না।  বড় ভালো বানিয়েও ছিল বটে কফিটা। পেট পুরে স্টার্টার সাঁটিয়ে, নববধূর ফাঁকা সিংহাসনে বসে ছবি তুলে, সেলফি কর্নারে গ্রুপি তুলতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেও আমার চোখ ঠিক ঘড়ির ওপর। এতগুলোকে তাড়িয়ে এনেছি যেমন, সালামত ভাবে বাড়ি পৌঁছানোর দায়িত্বও তেমনি আমারই। লজ্জার মাথা খেয়ে শান্তনুর মামাকে শেষ পর্যন্ত আমিই গিয়ে বললাম, রান্না কি সম্পন্ন? তাহলে আমাদের যদি একটু বসিয়ে দেন।


প্রথম ব্যাচে খেতে বসার সবথেকে বড় সুবিধা হল কোন কিছুই ঠান্ডা পাবেন না আপনি। জিভ জ্বালানো ফিস পাঞ্জাবি, আঙুল পোড়ানো মুগমোহন, কিমা মোটর, পোলাও, ভেটকি মাছের পাতুরি, খাসির মাংস, কষা চিকেন, মাছ, পনির ইত্যাদি যখন আসতে শুরু করল পরপর তখন বড় দুঃখ হচ্ছিল জানেন, কেন যে অতগুলো ফুচকা খেলাম। তেঁতুল জল আর এক্সপ্রেসো কফির আভ্যন্তরীণ বিবাদে, বাদ দিতে হলো অনেক কিছুই। তবে সন্দেশটা আর শেষ পর্যন্ত প্রাণে ধরে ছাড়তে পারলাম না। আমাদের হাওড়া জেলার বাগনান-উলুবেরিয়া অঞ্চল এমনিতেই মিষ্টির জন্য সুপ্রসিদ্ধ। এই অসময়েও সন্দেশটা থেকে ভুরভুর করে নলেন গুড়ের সুবাস ছাড়ছিল। প্রতি কামড়ে জিহবা আর তালুতে মিশছিল খাটি ছানার সোহাগ।


শান্তনুদের বাড়ির আতিথেয়তা অসম্ভব উষ্ণ। কতবার, কতজন, কতরকম ভাবে যে বলে গেল, ভালো করে খাবেন, যা ইচ্ছে খাবেন, যতবার ইচ্ছে চেয়ে খাবেন। আমার ছোট কাকুর ভাষায় নির্লজ্জের মত খাবেন অর্থাৎ লজ্জা করে খাবেন না, ইত্যাদি প্রভৃতি । বর বেশে এক ঘর অভ্যাগত দের সামনে অন্তত গোটা পাঁচেক বার তো আমায় প্রণাম করার চেষ্টাই করে ফেলল শান্তনু। পদাধিকার বলে উপরওয়ালা বটে, তাই বলে গুরু ঠাকুর তো নই, আরেকবার প্রণাম করতে এলেই ঠ্যাঙাবো, এই ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করলাম শেষ পর্যন্ত। পাশ থেকে সন্দীপ ফুট কাটল, "ম্যাডাম সাথে সাথে শোকজ টাও করে দিন।" যেন অনাবশ্যক শোকজ করাটাই আমার কাজ। ওটাকেও দু চার ঘা দিলে মন্দ হত না, যা বুঝলাম।


আটটায় বের হব ভেবেছিলাম মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে পেরেছি ব্যাপারটা। তার জন্য তারিফও করলো হক বাবু আর উত্তম। 'এই আপনি তাড়া দিলেন, তাই সব কটা নড়ল।' সেটা দূর থেকেও বুঝতে পারছিলাম বেশ, নতুবা যে হারে নতুন বরকে গোল করে ঘিরে ধরে মন্ত্রণা দিচ্ছিল সব কটা, এত বুদ্ধি আমাদের শান্তনু মাথায় রাখতে পারলে বাঁচি। কিছু রাখবে, কিছু হয়তো মিশে যাবে অপ্রয়োজনীয় স্মৃতির ভিড়ে। সব মিলিয়ে খুব খুব ভালো থাকবে আমাদের শান্তনু আর তার মৌলি, এটাই আপাতত টিম তাম্রলিপ্তর প্রতিটি উপস্থিত এবং অনুপস্থিত সদস্যর একমাত্র কামনা। ভালো থেকো নব দম্পতি। অনেক অনেক ভালোবাসা আর আশীর্বাদ রইল তোমাদের জন্য।

অনির ডাইরি ১০ই মার্চ, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

মাসি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের অফিস ঝাড়পোচ করে আসছে। অফিস স্থানান্তরিত হয়েছে, বদলে গেছে ইন্সপেক্টর থেকে আধিকারিক সকলে। জগদীশ গুপ্ত সাহেব তো মারাও গেছেন। চাকরি ছেড়ে দিয়েছে কত সিকেসিও। নতুন জয়েন করেছে আবার। মাসি শুধু রয়ে গেছে  ধ্রুবক হয়ে। মাসির আসল নাম পুতুল দাস। এককালে চা বিক্রি করতেন, তখন আপিস সাফাই করত অন্য মাসী। সে মাসি গত হলে, ঐ কাজটাও চাপে এই মাসির ঘাড়ে। 


আমি আসার পর মাসির সামান্য চাপ বেড়েছে। মেঝে কতটা সাফ হল, কোথায় ঝুল জমল,ডাস্টবিন কতদিন পর খালি করা হল - পুরুষ আধিকারিকরা এসব দেখে থোড়াই। দুচারদিন ডুব মারলেও কেউ কিছু বলত না। মাসির ভাষায় সবকটা “সাক্ষাৎ ভগবান ছেল”। আমি একাই অসুর। আমি আসার পর হাজিরা খাতা বানানো হয়েছে মাসিরও। অফিসে ঢুকে ঝ্যাঁটা ন্যাতায় হাত দেবার আগেই,সামনে খাতা খুলে ধরেন হক বাবু। নিত্য আমার আর হক বাবুর মুণ্ডপাত করতে করতে সই করতে হয় মাসিকে। লম্বা ছুটি নিলে দিতে হয় একজন প্রতিস্থাপক। ঝাড়পোঁচ করতে হয় একটু ধৈর্য্য ধরে।টেবিলে আঙ্গুল দিয়ে যাতে নাম না লেখা যায়। ঘর মোছার আগে পাল্টাতে হয় জল। কাদাগোলা মেঝে আমার দুচক্ষের বিষ। খালি করতে হয় ডাস্টবিনও। অফিসে ঢুকতেই পচা গন্ধওয়ালা ডাস্টবিন আমার দুচক্ষের বিষ। ইত্যাদি প্রভৃতি। 


এতদসত্ত্বেও মাসি নীবর থাকে, কারণ আপাততঃ মাসির মজুরীটা মাসেমাসেই দিতে পারি আমরা। আগে ঐটি পেতে কালঘাম ছুটত মাসীর। এখন অ্যালটমেন্ট এলেই সর্বাগ্রে আলাদা করে রাখা হয় মাসীর সম্বৎসরের মজুরীর টাকা। পুজোর বোনাসের ব্যবস্থা করা গেছে সময়মত। মাঝেমাঝেই, "মজুরী বাড়াও নাহলে আর আসবুনি" বলে হুমকি দেয় বটে মাসি, ওগুলো নির্বিষ আস্ফালন আমরাও বুঝি। কিন্তু বসন্তোৎসবের পরের দিন মাসির যে রূপ দেখলাম, তা মোটেই ইয়ে মানে শান্ত নয়। হোলির পরের দিন আপিসে ঢুকে দেখি, হক বাবু, জহর বাবু এবং অরূপ সিঁটিয়ে আছে। আলমারি হাঁটকে ছেঁড়া ন্যাকড়া আর পুরাণ ডাস্টার বার করছেন জহর বাবু। মাসি একাই সব্যসাচী। নেহাৎ মজুরীর বিলে আমিই সই করি, তাই আমার ভাগ্যে অমৃত বচন তেমন না জুটলেও, চোখ গোলগোল করে, মনে মনে ব্যাপক ভর্ৎসনা করল মাসি। বেদম হেসে মাসির ধ্যান না ভাঙালে, ভম্মই হয়ে যেতাম নির্ঘাত। 


যত চটছিল মাসি,ততো বাড়ছিল আমার হাসির দমক। যত হাসছিলাম আমি, ততো চটছিল মাসি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হার মেনে নিলাম আমিই। সরি মাসি বলে বেশ খাণিক আদরও করে দিলাম, তাও গলল না বৃদ্ধা। তাও নমনীয় হল না দৃষ্টি। শুধু বলল,‘ মা, মা গো। মা জননী। তোমায় প্রণাম।” 🤕


ছবি - অরূপ এবং বেদজ্যোতি। দুদিন ধরে একই রকম ক্ষেপে আছে মাসি।😔

অনির ডাইরি ৯ই মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা #happywomensday 


প্রতিবছর মার্চ মাসে একটা মোটা টাকার অ্যালটমেন্ট ঢুকত। সাথে সাথে আসতো নির্দেশ নামা, আসন্ন নারী দিবস উপলক্ষে, সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা শ্রমিকদের নিয়ে করতে হবে দুদিনের কর্মশালা। তড়িঘড়ি চুঁচুড়া পুরসভার বাতানুকূল হলটা বুক করে ফেলতাম আমরা। কথা বলতাম নারী-স্বশক্তিকরণ (women empowerment) নিয়ে কাজ করছে এমন বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, এনজিও এবং সরকারি আধিকারিকদের সাথে।


সেশন নিতে ডাকতাম, আমার পরিচিত এমন নারীদের, যাঁরা আমার চোখে প্রকৃতই সবলা। সবাই যে আসতে পারতো তা নয়, আবার অনেকেই চলে আসতো। যেমন এষা বা দেবশ্রী দি। একবার তো DLSA এর তৎকালীন সেক্রেটারি সাহেবের সৌজন্যে, ডিস্ট্রিক্ট জাজ স্বয়ং এসে হাজির আমাদের ক্ষুদ্র অনুষ্ঠানে। কথা বললেন, কথা শুনলেন, প্রয়োজনীয় আইনি পরামর্শ দিলেন মেয়েদের। ভাঙা ঘরে সেদিন আমাদের চাঁদের আলো।


এই জেলায় আসা ইস্তক আর আসে না ওই টাকাটা। কি জানি কেন বিমুখ হয়েছে দপ্তর, অধমের প্রতি। উচ্চতম আধিকারিক থেকে করণিক কার কাছে না অনুরোধ জানায়নি। তাও ভেজেনি চিঁড়ে।


 Women empowerment আমার প্যাশন বলতে পারেন। নিজেকে আমি সেই গুটিকয় empowered women দের মধ্যে ধরি, যাদের ভূমিষ্ঠ হবার পূর্বে তাদের পিতা-মাতার যদি পুত্রাকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, নবজাতিকার মুখদর্শনের সাথে সাথেই তা দূরীভূত হয়েছিল চিরতরে। শৈশবে বা কৈশোরে আমরা কোনদিন সুস্পষ্ট ভাবে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়নি। গোটা ডিমই বলুন বা মাছের পেটি বা খাসির মেটে বা নতুন জামা সবকিছুই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সমান সমান পেয়ে এসেছি। যতদিন পড়তে চেয়েছি, যা নিয়ে পড়তে চেয়েছি অনুমতি এবং উৎসাহ পেয়েছি। বিয়ের জন্য অযথা জোরাজুরি করেনি কেউ। পড়তে গিয়ে যত রাতেই বাড়ি ফিরি না কেন, কোনদিন ঘটেনি কোন অবাঞ্ছিত ঘটনা। চাকরির ফর্ম তোলা থেকে ইন্টারভিউ অব্দি, মহিলা বলে পড়তে হয়নি কোন বিরূপ মনোভাবাপন্ন ব্যক্তির সামনাসামনি। আমাকে কেউ কোনোদিন ঠারেঠোরেও বলেনি যে মহিলা বলে এই পদের আমি অযোগ্য বা অনুপযুক্ত। গ্লাস সিলিং এর সম্মুখীন হতে হয়নি। পুরুষ সহকর্মীদের সাথে নিজেকে প্রমাণ করার সমান সুযোগ পেয়েছি আমি। সমতালে বেড়েছে বেতন। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এসিড নিয়ে ধাওয়া করেনি কেউ। চাকুরীরতা বলে বিয়ে করতে অসম্মত হয়নি কেউ। বিয়ের পরেও কেউ বলেনি চাকরি ছাড়তে। গার্হস্থ হিংসার শিকার হতে হয়নি। কন্যা সন্তানের জন্ম দেবার পর শুনতে হয়নি কোন কটু মন্তব্য। মেটারনিটি লিভ পেয়েছি। চাইল্ড কেয়ার লিভ পাই। আমি তো সমাজের ভাগ্যবান অংশ। আক্ষরিক অর্থেই the creamy layer। 


কিন্তু সবাই যে এত ভাগ্যবান হয় না। 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ'- এ, কন্যা ভ্রূণহত্যা, লিঙ্গবৈষম্য, অশিক্ষা, স্কুল ছুট, বাল্যবিবাহ, গার্হস্থহিংসা (domestic violence), যৌন নির্যাতন ইত্যাদি প্রভৃতি যে আজও আছে। এখনও সমাজের একটা গরিষ্ঠাংশ প্রতি মুহূর্তে যুঝে চলেছে এই দৈত্যগুলির সঙ্গে। সবথেকে বড় কথা হল, এণারা অনেকেই এগুলিকে ভবিতব্য  বলে মেনে নিচ্ছেন। জন্ম থেকেই ধরে নিচ্ছেন নারী মাত্রই অবলা। অবরবর্গীয় মানুষ,বা মনুষ্যপদবাচ্যই নয়। তারা জানতেও পারছেন না, মানতেও পারছেন না যে নিছক জন্ম দিলে বা লালন পালন করলে বা ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলেই গায়ে হাত তোলার অধিকার জন্মায় না কারো। শুধু গায়ে হাত তোলাটাই গার্হস্থ্য হিংসা নয়। মৌখিক এবং মানসিক নির্যাতন যেমন সবার সামনে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, উপহাসের পাত্র বানানো ইত্যাদি ও গার্হস্থ্য হিংসারই অঙ্গ। যেখানে প্রতিমুহূর্তে মেয়েটিকে মনে করানো হয় যে তার অস্তিত্ব একেবারেই তুচ্ছ, একান্তই নিষ্প্রয়োজন। 


এই সমস্ত পিছিয়ে পড়া মেয়েদের একটু স্পেশাল ফিল করানো, একটু সচেতনতা বৃদ্ধি, এইটাই তো হল নারী দিবসের উদ্দেশ্য। কোথা থেকে কোথায় এসেছি আমরা। এইতো সেদিন সম্পত্তির অধিকার ছিল না মেয়েদের, ছিল না মতদানের অধিকার। এমনকি শিক্ষার অধিকারও ছিল না। সেখান থেকে অনেক লড়াই করে আমরা এসেছি তো এতটাদূর। দিল্লি এখনো অনেক দূর হয়তো, তবে রাস্তাটা তো বোঝা যাচ্ছে। আর রাস্তা না থাকলেই বা কি, রাস্তা বানাতে হবে তো!


 জানি দুদিন বা একদিনের ওয়ার্কশপে কোন পরিবর্তনই হয়তো আনতে পারব না। ব্যাপারটা সিন্ধুতে বিন্দু সম। তাই বলে কি চেষ্টা করব না। ফান্ডে রাহু লেগেছে বটে, তবুও ঠিক করলাম যে, সীমিত সামর্থের মধ্যেই ওয়ার্কশপ আমরা করব।  ডিএম সাহেবের মিটিং হল বুক করতে লাগে না কোন টাকা পয়সা। মিটিং হলেই রয়েছে প্রজেক্টর। ল্যাপটপ তো আমাদের অরূপেরই আছে। চা বিস্কুট বা সামান্য দুটি মাছ ভাতের ব্যবস্থা ধারেনগদে হয়ে যাবে ডিএম অফিসের ক্যান্টিনে। রইল এবার কারা অংশগ্রহণ করবে আর কারা ক্লাস নেবে? আমাদের মহিলা এসএলও এবং কালেক্টিং এজেন্টদেরই ডাকা হল শেষ পর্যন্ত। প্রতিদিন অগুনতি মানুষের সাথে কাজ করেন এনারা। যাদের মধ্যে মহিলার সংখ্যাই বেশি। সামান্য শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেই আমার মেয়েরা অনুঘটকের কাজ করতে পারে। এদের মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়তে পারে সামান্য সচেতনতা। 


ট্রেনার হিসেবে ডাকলাম আমার এক প্রিয় দিদি আর এক বন্ধুকে। বন্ধুবর শেষ পর্যন্ত এসে উঠতে পারেনি বটে, কিন্তু তানিয়া দি এসেছিল। জানতাম, এই মহিলার মাথায় আমার মতোই নারী স্বশক্তিকরনের পোকা গিজগিজ করছে। তাই না হাওড়া শিবপুর থেকে ঠেঙিয়ে তমলুক এলো আমার মেয়েদের ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট এবং সেক্সুয়াল হারাসমেন্ট অফ উইমেন অ্যাট ওয়ার্ক প্লেসেস পড়াতে। মালদায় পোস্টিং ভদ্রমহিলার। সেখান থেকে কয়েক দিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছে, ছেলের পরীক্ষা বলে। তার মধ্যে থেকেও একটা বেলা, একটা দিন শুধু আমাদের জন্য খরচ করাটা আমার কাছে মোটেই ছোট কথা নয়। সেটা বললাম ও দিদিকে। 


আর বললাম যে, টাকা পয়সা সেভাবে কিছু দিতে পারবো না। হাল বহুত খারাপ। উল্টে দিদি আমায় মুখ ঝামটা দিল, "তোর সঙ্গে কি আমার টাকা পয়সার সম্পর্ক, অ্যাঁ? রাখ তোর টাকা তোর পকেটে।" সাধে কি বলেছি, ভদ্রমহিলার মাথায় পোকা গিজগিজ করছে। সাধে কি ভদ্রমহিলার সাথে আমার এত প্রেম। দুজনেই হাওড়ার মেয়ে যে। রতনে রতন চেনে মশাই।

অনির ডাইরি ৭ই মার্চ ২০২৩

 


 আজ মায়ের জন্মদিন।  কাগজে কলমে কিন্তু আজ না, জানুয়ারী মাসের তিরিশ তারিখে মায়ের জন্মদিন। এরকম কেন? প্রশ্ন করলেই মা বলে,“ভূতের আবার জম্মবার। ” ভূত অর্থাৎ অদৃশ্য কোন জীব, হ্যাঁ তাই তো থেকেছে মা বরাবর, অদৃশ্য,আত্মগোপনকারী, পিছনের সারিতে মুখ লুকিয়ে বসা আনস্মার্ট চাকচিক্যহীন প্রাণী। যাদের কেউ হিসেবে ধরে না। যারা স্বপ্নেও আশা করেন না, ঝকমকে লাইমলাইট কখনও এসে পড়বে তাঁদেরও ওপর। অথচ তাঁদের জীবন নিয়েই রচিত হয় আধুনিক রূপকথা। 


আপাতদৃষ্টিতে মায়ের গল্পের শুরুতে নতুনত্ব তেমন কিছুই নেই, সদ্য বিভক্ত- দাঙ্গা বিধ্বস্ত স্বাধীন ভারতবর্ষে জন্মানো, ৫০-৬০এর দশকে বড় হওয়া আর পাঁচটা মেয়ের মতই একই গতানুগতিক ছন্দে বাঁধা শৈশব। সুদূর মুর্শিদাবাদে দুকূল ছাপানো ভাগীরথীর তীরে, ঘন সবুজ ধান-পাট-মুসুরি খেত আর ঐতিহাসিক আমবাগানে ঘেরা গণ্ডগ্রাম রামনগর। 


সেখানে ঘোষেদের বিশাল যৌথ পরিবার, পরিবারের মাথা, মায়ের ঠাকুমা হরিমতী দেবী ছিলেন বড়ই জাঁদরেল। দাদু এবং দিদা, হরিমতী দেবীর আতঙ্কে থরহরি কম্প। দাদু থাকতেন কলকাতার মেসে। সপ্তাহান্তে ট্রাঙ্ক হাতে পাড়ি দিতেন দেশে। বাড়ি যখন ঢুকতেন তখন আমবাগানের মাথার ওপর জ্বলজ্বল করত রামনগরের চাঁদ। ঝিঁঝি পোকাদের কলতানে দূর থেকে সানন্দে যোগদান করত শৃগালের দল। সেই শুনে খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠত স্থানীয় সারমেয় কুল। অকুল আঁধারে টেমটেমির আলো জ্বেলে বসে ঢুলত অভুক্ত দিদা। মেয়েরা কখন ঘুমিয়ে কাদা।দাদুর বড় দুঃখ হত। কেন জেগে থাকে না মেয়েরা? কি করে জাগিয়ে রাখা যায় চার কন্যাকে?


 দাদু অঙ্কে ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত দক্ষ, দশ ক্লাশের পরীক্ষায় পাওয়া শংসা পত্র, যত্ন করে রেখেছিল দিদা অনেকদিন। জীবনের অঙ্কে অবশ্য দাদু ছিল বরাবর কাঁচা। না হলে,৬০এর দশকে নিছক মায়ের(হরিমতী দেবী) শখ মেটাতে কেউ কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করে বানায় দোতলা মাটির কেল্লা? 

তো যাই হোক বড় দুঃখ দাদুর, মানসিক অঙ্ক করেই চলেন, কি করে জাগিয়ে রাখা যায়, মেয়েদের?শেষে দিদার কাছে আব্দার  করলেন, যেদিন উনি আসবেন, সেদিন কিছু যেন স্পেশাল রান্না করে দিদা, গভীর রাতে ক্লান্ত দেহে এমন বেঢপ আব্দার শুনে মুখ ঝামটাতেন আমার সাধাসিধে নিরীহ দিদা। মধ্যবিত্তের আবার ইসপেশাল কি হয়? রোজই তো থোড়-বড়ি-খাড়া। হোক না তবুও কিছু-। দাদু বলতেন,“আমি যেদিন আসব, তুমি বরং শুধু সেদিনই ডাল রেঁধো। তাহলে মেয়েরা ভাববে, আজ বাবা আসবে, আজ ডাল হবে!” বলেছিলাম না,বড় সরল,  জীবনের অঙ্কে বড় কাঁচা ছিলেন দাদু। 


মায়ের ভয়ে কোনদিন বউ মেয়েদের কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাননি। বড় বেড়ানোর শখ ছিল দিদার। মাথায় ছোট্ট খাট্টো দিদা আর তালগাছের মত ঢ্যাঙা দাদুর ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো। হঠাৎ একদিন সাহস করে পুরীর টিকিট কেটেই ফেললেন দাদু। ভয়ে ভয়ে সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরে হরিমতী দেবীকে বললেন,“শীলু খুব বায়না করছিল। ঐ টাকা জমিয়েছিল। ” শীলু অর্থৎ শিউলি অর্থাৎ আমার মা। বয়স— বছর বারো। সেই বোধহয় প্রথম এবং শেষ বার দাদুর মিথ্যা বলা। অতঃপর? হাওড়া ইস্টিশন থেকে কু ঝিকঝিক-দৌড়াল স্বপ্নের রেল। শ্রীক্ষেত্রে পদার্পণ করলেন সবৎসা সদানন্দ এবং সুনীতি রাণী ঘোষ। প্রথম সমুদ্র দেখা। প্রথম বাঁধন ছেঁড়া খুশি ভাসিয়ে নিয়ে গেল মা-মাসিদের শৈশব। 


স্থায়ী হল কোথায়? টুক্ করে একদিন চলে গেলেন দাদু। একটা ছোট্ট স্ট্রোক বদলে দিল জীবন। মা তখন নবম শ্রেণী, মায়ের সদ্য শাড়ি।  

 বড় মাসির বাড়িতে একটা বাঁধানো সাদাকালো ছবি ছিল,ফুলে ঢাকা দাদুর শরীর ঘিরে দাঁড়িয়ে-বসে দিদা আর তার চার মেয়ে আর একমাত্র জামাই,আমার বড় মেসোমশাই। সকলের চোখে অসীম শূণ্যতা আর অসহায়তা।থমথম করছে শোক। ব্যতিক্রম শুধু ছোট মাসি। আহাঃ বড়ই ছোট ছিল গো। দিদার কোল থেকে নামতে চাইত না। তখন ঐ ধরণের ছবি তোলার রেওয়াজ ছিল। 


সাদা থান পরা দিদাকে দেখে, জনৈক আত্মীয় নাকি বলছিলেন,“তোমায় খারাপ লাগছে না, বুঝলে। ” হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল সেদিন কিশোরী মা আর মাসিরা। সদ্য সাদা শাড়িপরা মা, যে কোন সন্তানের কাছে বিভীষিকা। এই চূড়ান্ত অসময়ে কি বলছে এরা? সমাজ এত নিষ্ঠুর? 

চোখ মুছে আমার স্বল্প শিক্ষিত, সাড়ে চারফুটের দিদা তার পিতৃহারা মেয়েদের বলেছিল,“একদম কাঁদবি না। আজ থেকে আমিই তোদের মা- আমিই বাবা। আমি যতদিন না মরছি, কেউ কাঁদবি না। ” 


বিমুখ-লোলুপ-পলায়নপর আত্মীয়গোষ্ঠীর ভিড়ে একা প্রহ্লাদ ছিলেন আমার বড় মেশোমশাই স্বর্গীয় অজিত সিংহ। জন্মসূত্রে বিদ্যাসাগরের দেশ ঘাটালের অধিবাসী। স্বভাবেও অনেকটা একই। বাহ্যিক আবেগ ছিটেফোঁটাও ছিল না,ছিল শুধু অটল কর্তব্যপরায়ণতা। অন্তরে, স্নেহের কাঙাল ছিলেন “মেশোই”।  এই নামেই ডাকতাম। আরএমএস এর ছাপোষা বেতনে হাওড়া শহরে বাসা ভাড়া করে পরিবার পালন করতে দম বেরিয়ে যেত- তবু পিছপা হননি দায়িত্ব নিতে। মেশোই এর নির্দেশে একাকী পলাশী স্টেশন থেকে লালগোলা এক্সপ্রেসে হাওড়া পাড়ি দিল সেদিন কিশোরী মা। শিয়ালদায় প্রতীক্ষারত মেশোই, মায়ের ভাষায় দু নম্বর বাবা। সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের সাদাকালো ছবির মত, কয়লার ইঞ্জিনে টানা ট্রেন একরাশ ধোঁয়া উড়িয়ে পৌঁছাল মহানগরে। মেশোই বলল,“এসেছিস! চা খাবি?” “হ্যাঁ জামাইবাবু। ” মাটির খুড়িতে চা খেতে খেতে মেশোই বলল,“চাটা পুড়ে গেছে বল? কেমন যেন পোড়া পোড়া গন্ধ। ” আবার মাথা নাড়ল মা,“হ্যাঁ জামাইবাবু। আপনাকে ঠকিয়েছে। পোড়া চা। ” ঠকাস্ করে পড়ল গাঁট্টা,“ভজহরি! এটাকে বলে কফি। বুঝেছিস। ”মেশোইয়ের প্রিয় শব্দ ভজহরি। সকলেই ভজহরি। যেমন আমি বলি অপদার্থ। 


এরপর শুরু হল আসল জীবন সংগ্রাম। অন্নচিন্তা চমৎকারা। মা এবং তার বোনেদের জীবন চরিত নিয়ে তিনখানা উপন্যাস লেখা যায়। একজোড়া শাড়ি আর এক জোড়া চপ্পল নিয়ে যুদ্ধ জয় করেছে আমার দিদার মেয়েরা। উপার্জনের জন্য মধ্য হাওড়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে বড় বাজার গেছে টিউশ্যনি করতে, শিখেছে হিন্দি টাইপ। পাঁচ দশ পয়সার বিনিময়ে পোস্ট অফিসের বাইরে বসে খাম পোস্টকার্ড- মানি অর্ডার লিখেছে তবু হাল ছাড়েনি সদানন্দ ঘোষের মেয়েরা। এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল হয়ে পোস্ট অফিসে ঢুকে নিরন্তর পড়াশোনা আর পরীক্ষা দিয়ে নিজস্ব শিক্ষাগত যোগ্যতার সেরা পদে উঠে সসম্মানে অবসর নিয়েছে মা। তাও আজ বারো বছর হয়ে গেল। পেয়েছে অগণিত মানুষের ভালোবাসা। যৌথ চাটুজ্জে পরিবারের মেজ বউ হয়ে, কোমর বেঁধে সামলেছে যাবতীয় দায়দায়িত্ব কর্তব্য। 

কি অমানুষিক পরিশ্রম করত মা, ভোর পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা অবধি ছুটেই যেত মা। 

শরীর ভাঙছিল অনেকদিন ধরেই। অম্বল- গরহজম-থাইরয়েড-প্রেশার- হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার ব্যামোর পাশাপাশি, ২০১৩ সালে যুক্ত হল লো সোডিয়াম আর অ্যাকিউট ডিপ্রেশন। বেশ কটাদিন হাসপাতালে কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরল মা, ততোদিনে  ভুলে গেছে সবকিছু, চিনতে পারছিল না সেই পাঁচদিন বয়স থেকে বুকে করে মানুষ করা প্রাণাধিকা তুত্তুরীকে, তখনও মা ভোলেনি, মায়ের গায়ের রঙ কালো। মা ভোলেনি, কালো মেয়ে মানেই অসুন্দর, ভোলেনি গাঁয়ের মেয়ে মানেই আনস্মার্ট আর গাঁইয়া, ভোলেনি চাকরী করা মেয়ে মানেই গৃহকর্মে ঢ্যাঁড়শ। 


  কিছু কিছু ক্ষত বোধহয় এমন গভীর হয়, যা কখনও সারে না। সেদিনের দামী হাসপাতালের নামী মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ বলেছিলেন,“ব্রেনের কিছু সেল শুকিয়ে আসছে। ওষুধে আপাতঃ  সারলেও ধীরে ধীরে বাড়বে এই  ভুলে যাবার প্রবণতা। ধীরে ধীরে আক্রমণ করবে অ্যালঝাইমার্স। ভুলে যাবেন সবকিছুই। ” 

ডাক্তারের ভবিষ্যৎ বাণীকে ভুল প্রমাণ করে আজ দশ বছর বাদেও দিব্যি আছে মা। হ্যাঁ ভুলে যায় খুবই, আমরা কাছাকাছি থাকি না বলে ভোগে চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতায়। 


এই নিরাপত্তাহীনতার জন্যই ২০২১ সালে মস্ত বড় বিপদ বাঁধিয়েছিল মা, ঈশ্বরের অশেষ আশীর্বাদ যে সেই বিপদ থেকে মাকে আমি বার করে আনতে পেরেছি। বাকি জীবনটুকুও যাতে মাকে ভালো রাখতে পারি, এটাই আপাতত ঈশ্বরের কাছে আমার একমাত্র প্রার্থনা। প্রতিটা সফল পুরুষের পিছনে যেমন থাকেন একজন অবগুণ্ঠনবতী, তেমনি প্রতিটি নারীর সফল হয়ে ওঠার পিছনেও থাকে একাধিক পুরুষের অবদান। মায়ের জীবনের প্রথম পুরুষ, আমার স্বর্গীয় বড় মেসোমশাই। দ্বিতীয় পুরুষ আমার বাবা, তৃতীয় পুরুষ, যেন আমি হয়ে উঠতে পারি।

অনির দোলের ডায়েরি ৬ই মার্চ, ২০২৩

 

#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি 


প্রতিবছর ন্যাড়াপোড়াটা আমাদের দোলের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর ন্যাড়াপোড়া মানেই হাওড়া। আমার বেড়ে ওঠার শহর। যে শহর দিয়েছে আমায় শৌভিক। যে শহরে প্রথম ঘুম ভেঙেছে আমার তুত্তুরীর।দূষিত হলেও, ঘিঞ্জি হলেও, আমার প্রাণের শহর। 


দোলের ছুটি পড়ার আগের শেষ কর্ম দিবসে, এক আঁচল রঙ খেলে, ঠিক সন্ধ্যের নামার মুখে সকন্যা হাওড়ায় গিয়ে হাজির হতাম আমি। বৈঠকখানার বড় কাঠের দরজাটা খুলে, উন্মুখ হয়ে আমাদের প্রতীক্ষায় থাকত বাবা আর মা।


ঢুকেই আগে হাঁকতাম, ' মা চা করো।' তারপর কোন মতে, কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে, আবিরে ফাগে জবরজং শাড়িটা বদলে, আমরা লেগে পড়তাম ন্যাড়াপোড়ার জোগাড় করতে। ওই স্বল্প আলোতেই, দুটো ঝাঁটা নিয়ে, পূব আর পশ্চিমের বাগান ঝাঁটিয়ে যত শুকনো পাতা জোগাড় করত তুত্তুরি আর বুল্লু বাবু। অনেক সময় প্রতিবেশীদের বাগান থেকেও চুরি করে আনতো, ঝরে পড়া শুকনো নারকেল পাতা। চোখের সামনে দিয়ে, ঝরা পাতা নিয়ে যেত চোরেরা, দাঁত বার করে হাসত গেরস্ত। আজব পাড়া মাইরি আমাদের। আজব শহর মাইরি, আমাদের হাওড়া।


 অতঃপর, পশ্চিমে দিকে,  বাবার এক ফালি ছোট্ট বাগানে, মরে যাওয়া বেলগাছের একপাশে, স্তূপাকারে জমা করা হতো সেই সব শুকনো পাতা। তার ওপরে ফেলা হতো যত অপ্রয়োজনীয় কাগজ, পুরানো খাতা, দস্তাবেজ, ফেললু জিনিসপত্র। আর তারপর? তারপরের সময়টা ছিল শুধুই প্রতীক্ষার।


থেকে থেকে আমার দুই খুড়তুতো ভাই, অয়ন আর অনিন্দ্যর মোবাইল নম্বরে ফোন করতো তুত্তুরী। "ও বড় মামা। ও ছোট মামা। বলি কখন আসবে তোমরা? জলদি এসো প্লিজ। নাহলে যে আমরা চাঁচড় পোড়াতেই পারছি না।"  সেই যে সেবার অয়ন গিয়েছিল বাঁকুড়া। কথা ছিল বিকাল বিকাল পৌঁছে যাবে বাড়ি। ট্রেন লেট করে, ঢুকতে ঢুকতে গড়িয়ে গেল রাত দশটা, রাত দশটা অবধি আমরা সপরিবারে গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করে গেছি, কখন আসবে অয়ন, তবে পুড়বে শ্রীমান বা শ্রীমতী ন্যাড়া।


ন্যাড়াপোড়ার সময় হলে, একত্রিত হত বাড়ির প্রতিটি সদস্য। বাবা,মা,পিসি,অয়ন,চৈতি,অনিন্দ্য বুল্লু বাবু, তুত্তুরী এবং আমি। বেচারা ন্যাড়া, দোল পূর্ণিমার আগের রাতে, হালকা বাতাসে অল্প একটু শরশর্ শব্দ করা ছাড়া,  মোটামুটি নীরবেই দাঁড়িয়ে থাকত। খবরের কাগজ গোল করে পাকিয়ে, আস্তিন গুটিয়ে তার গায়ে আগুন লাগাতো শ্রীমান অয়ন। দেশলাই বা লাইটার সরবরাও করত আমার বাপ। ধীরে ধীরে একটু একটু করে জ্বলতো ন্যাড়া, তুত্তুরী আর বুল্লুবাবুকে সটান পাঁচিলের ওপরে তুলে দিত অনিন্দ্য, আর সপরিবারে আমরা জুড়তাম প্রবল হল্লা। 


আমরা হাওড়াবাসীরা বলতাম

" আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল। 

পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বল হরি বোল।" 


আর আমার মুর্শিদাবাদী মা বলতো, 

" আজ আমাদের নেড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল।

পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, পাড়ায় গন্ডগোল।"


হাওড়া আর মুর্শিদাবাদের উদ্দাম ঝগড়ায় রেফারির হত আমার বাবা। আমাদের সম্মিলিত চিৎকার ছাপিয়ে শোনা যেত বাবার উল্লাসী আওয়াজ, " লে পচা----"। এক চোট থমকে, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত সকলে। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতো পিসি, " তোর যত উল্টোপাল্টা কথাবার্তা কেবল হিটলার।"


ইদানিং কানে আর তেমন কিছুই শুনতে পায় না পিসি। একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে বললে তবে হয়তো বুঝতে পারে। বাবারও ফুসফুসের সে যোশ আর নেই। স্বাস্থ্যটা ভালো যাচ্ছে না মায়ের ও। এবারে দোলে হাওড়া যায়নি আমরাও। 


আসলে মনটাই ভেঙ্গে গেছে। এইতো সেদিন দেখা হল মেসোমশাইয়ের সঙ্গে। সম্পর্কে আমার ভাই বউ, চৈতীর বাবা। বুল্লু বাবুর পৈতেতে এসেছিলেন সপত্নিক। ছিলেন বেশ কয়েকটা দিন। বুল্লু বাবুর পৈতের যাবতীয় আচার তো আমরা মাসিমাকে অনুসরণ করেই পালন করলাম। উনি যে ভাবে বললেন,উনি যা বললেন, উনি যখন বললেন। বাড়ি ফিরে যাবার কয়েকদিনের মধ্যেই যে এইভাবে একবেলার জ্বরে যে চলে যাবেন ভদ্রলোক আমরা কেউই ভাবতে পারিনি। বিনা মেঘে বজ্রপাত একেই বলে বুঝি। 


এমতবস্থায় শ্রীমতি তুত্তুরীর,মন ভালো রাখার জন্যই ন্যাড়া পোড়ার কথাটা তুলেছিলাম। বাগানে প্রচুর শুকনো পাতা তো পড়েই থাকে, তাদের কয়েকটাকে একত্রিত করে আগুন ধরিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে গেল। ন্যাড়াও পুড়ল, নটে গাছটিও মুড়াল। সমস্যা বাধালেন মহকুমা শাসক স্বয়ং। ওনার অনুমতি ছাড়া, ওনার লোকজন কি আর আমার কথা শুনবে? সকাল থেকে লিটার-লিটার, গ্যালন-গ্যালন তৈল মর্দনের পর অবশেষে সন্ধ্যে সাতটার সময় গররাজি হলেন তিনি। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে, সাধ্যাতীত করলেন আমাদের রঞ্জিত বাবু আর তুত্তুরীর মাসি।এত ভালো ভাবে, এত উপাচার সহযোগে কোনদিন পোড়েনি আমাদের ন্যাড়া। পুড়ল বটে, আনন্দও হল খুব।কিন্তু কোথায় যেন রয়ে গেল খানিকটা বিষন্নতা আর অনেকটা অসম্পূর্ণতা। পরিবার ছাড়া কি আর উৎসব জমে? 

যাই হোক, সকলকে দোল পূর্ণিমার অগ্রিম শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানাই। ভালো কাটুক আপনাদের দোল। রঙিন হোক আগামী প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ।

Friday, 17 March 2023

অনির ডাইরি ৪ঠা মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

বালি ব্রিজ টপকালাম কত দিন বাদে, ব্রিজের নিচে কুচকুচে কালো মা গঙ্গা আর বাঁহাতে ঝকঝকে আলোকোজ্জ্বল মা দক্ষিণেশ্বরী। মা কালী আবার মা গঙ্গার সতীন,একসাথে দুজনকে প্রণাম করা উচিত নয় বোধহয়। এতদিন বাদে দেখা, আশা করি আজ ওরা কেউ কিছু মনে করবে না।


 বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেসওয়ে। রাস্তার দু'ধারে যত চায়ের দোকান ছিল সব ভেঙে দেওয়া হয়েছিল কিছুকাল আগে। প্লাস্টিক টাঙিয়ে তারাই আবার ফিরে এসেছে। উজ্জ্বল বাল্বের আলো হাত বাড়িয়ে ডাকে, "ও দিদি, আসুন না। কতদিন বাদে এলেন কলকাতায়।এক কাপ চা তো খেয়ে যান অন্তত। ঘন দুধে, এলাচ থেঁতো করে, একটু বেশি চিনি আর চা দিয়ে ফুটিয়ে, মাটির ভাঁড়ে মুখ পোড়ানো অনবদ্য দিশি চা। পছন্দ নয় বুঝি? তাহলে না হয় আপনার জন্য বিলিতি চাই বানিয়ে দেব। কষকষে করে ফোটানো গরম জলে দার্জিলিং চায়ের পাতা ভিজিয়ে আপনার জন্য তৈরি করে দেবো, সুগন্ধ কালো চা। তাতে থাকবে ব্যাস এক চিমটে চিনি। আমাদের বিস্কুট গুলো দেখেছেন?  এই যে কাঁচের বয়াম ভর্তি বিস্কুট,  এগুলো কি আপনাকে ডাকছে না ? দেখুন কি না নেই, মুচমুচে লেড়ো বিস্কুট আছে, প্রজাপতি বিস্কুট আছে, ক্রিম রোল আছে, সুজির হরেক রকম বিস্কুট, যাদের আপনারা কুকিজ বলে কেনেন অনেক দামি মল থেকে, সব আছে। আছে চেরি আর চাল কুমড়ার মিঠাই ছড়ানো সস্তা বেকারির কেক।  বলুন তো কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবেন? ও দিদিইইইইইইইইই আসুন নাআআআআআ।"


এয়ারপোর্ট। আড়াই নম্বরের গেট দিয়ে ঢুকতেই একযোগে মেসেজ পাঠালো ওলা এবং উবের। " ও দিদি আসব নাকি? প্রাইম, ম্যাক্স, মিনি, মাইক্রো কি লাগবে বলুন না যা বলবেন তাই নিয়ে এসে হাজির হব। হ্যাঁ, আমাদের ড্রাইভার গুলো একটু ছ্যাঁচড়া বটে, আমাদের নির্ধারিত ভাড়ায় কিছুতেই যেতে চাইবে না ব্যাটারা, বলবে অ্যাপ বন্ধ করে দিন, বলবে ক্যাশ টাকায় ভাড়া না দিলে কিছুতেই নিয়ে যাব না, হাজার বললেও এসি চালাবে না। উল্টে আপনাকে ওয়ান স্টার দেবে। আপনি নালিশ করবেন, আপনি ফেসবুকে লিখবেন, আপনি টুইটারে নালিশ করবেন। কিচ্ছু করবো না আমরা। জাস্ট কিচ্ছু করব না। বড়জোর একটা, " সরি ম্যাডাম, এই তো আমরা ড্রাইভারের মুণ্ডুচ্ছেদ‌ করলাম বলে- " মার্কা একটা গুরুত্বহীন মেসেজ পাবেন।  তাও কেবল টুইটারে। ওখানকার লোকজন একটু বেশিই গালাগাল দেয় কিনা। 


ওসব ছাড়ুন বরং। কতদিন বাদে ফিরলেন এই বুড়ি শহরে, কোথাও যাবেন না নাকি…? হাওড়ায় বুড়ো বাপ মায়ের কাছে অন্তত চলুন। নাকি অন্য কোথাও ঘুরে দেখতে চান? রাতের মহানগর কেমন লাগে? নামমাত্র পয়সায় রাতের মহানগর দেখাবো আপনাকে, তাও এঁকেবেঁকে, অলিগলি দিয়ে। নামমাত্র ভাড়ায়, শুধু ঘেমো হেলমেটটা একটু পরতে হবে। পিছন থেকে বলল রেপিডো।


ভিআইপি রোড। নিয়নের আলোয় পিচ্ছিল রাজপথ, পিছন পিছন তাড়া করেছে সুইগী আর zomato। ও ম্যাডাম কি খাবেন বলুন না। বিরিয়ানি খাবেন, বিরিয়ানি? কোথা থেকে খাবেন একবার বলুন শুধু, আমিনিয়া চলবে? আর্সলান? সিরাজ? রহমানিয়া? বিরিয়ানি বাই কিলো? কাবুলিওয়ালা? নাকি ইন্ডিয়া?

আরেকজন বলল, মোগলাই ছাড়ুন। বড় বেশি তেল আর মসলা, ওভার রেটেড বুঝলেন তো। আপনি তো ইয়ে আবার একটু মানে, স্বাস্থ্যবতী কিনা, চাইনিজ খান বরং।  উচ্চ মানের নুডুলস খাওয়াব দিদি। গ্রেভি চান যদি, গ্রেভি। না হলে হাক্কা।  কতদিন ভালো চাউমিন খাননি ভাবুন। মিক্সড চাউমিন খাবেন? গোটা গোটা প্রণ, মাশরুম, মাখনে ভাজা ওমলেটের কুচি, মাখন-গোলমরিচ দিয়ে সটেড চিকেন আর কুচি কুচি পর্ক।  ওঃ  আপনি তো আবার শুয়োরের মাংসটাংস খান না। ফিস উইথ রেড ওয়াইন নিন সাথে একদম জমে যাবে।


অপরজন পূর্ণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল, বিদেশী জিনিসপত্র ছাড়ুন তো? এতদিন বাদে নিজের শহরে ফিরেছেন নিজের দেশি খাবার খান। বিরিয়ানি ছাড়াও অনেক কিছু আছে মোগলাইএ। বিভিন্ন রকম নান আছে। আর কাবাবের কথা ভুলে গেলে? তোমার প্রিয় কাবাব। এককালে তো ফ্যান্টাসাইজ করতে কাবাবের নামে। শোন, ওসব চিনে খাবার খাওয়ার থেকে সাহেবী খাবার খাও বরং। চিজে লটপট পিজ্জা, পাস্তা, স্প্যাগেটি খাও না, আমরা এনে দেবো তো। 


ফ্ল্যাটের তালা খুলছি আরবান  ক্লাপ বলল,  আজ তুমি বড় ক্লান্ত না? কাল আসি তাহলে? বড় নোংরা হয়েছে তোমার ফ্ল্যাট খান বাপু। বাথরুমে গিয়ে দেখো, কোণায় কোণায় ঝুল, জমা জলের লালচে দাগ। রান্না ঘরে ঢুকে দেখ না, দেখবে কেমন তেলচিটে পড়েছে। সব পরিষ্কার করে দেব। তোমার কোন চিন্তা নেই। এই শোনো না নিজের দিকে কতদিন তাকাও না বলতো, ফাটা গোড়ালি টা দেখেছো আর হাতের নখগুলো? কি কুচ্ছিত রকমের কিউটিকল জমেছে। এত কালোই বা হয়ে গেলে কি করে? বলছি কি একটা ফুল বডি স্পা করে নাও বরং। সাথে একটা দুরন্ত ফেসিয়াল। কোথাও যেতে হবে না তোমায়, আমরাই আসবো বরং। ফোল্ডিং বেড আনব,  ডিস্পোজেবল পোষাক আনব। তোমার শোবার ঘরে, তোমার বাতানুকূল যন্ত্রের শীতল হওয়ায়, দুর্দান্ত মালিশ করে দেবে আমাদের মেয়েরা। রিলাক্স করার জন্য, জ্বালানো হবে তোমার মনের মত সুগন্ধী, পপৌড়ি বা সেজ। নিদেনপক্ষে চন্দন। সামান্য একটু বেশি খরচা হবে, যদি চকলেট রাপ লাগিয়ে নাও, তাহলে দেখবে কি রকম ঝিলিক মারবে তোমার চামড়া।”


পাত্তা না দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করলাম। কতদিন বাদে এলাম। প্রায় দুই মাসেরও পর। শেষ এসেছিলাম বড়দিনের ছুটিতে। বেশ অনেকদিন হয়ে গেল মহানগর ত্যাগ করার। আজকাল সেই টানটা আর অনুভূত হয় না।  উল্টে খুঁত গুলোই বেশি চোখে পড়ে। কথায় কথায় তাচ্ছিল্য করি শহরটাকে। তিনশ তেত্রিশ বছরের বুড়ির আর দেবারই বা কি আছে নতুন করে?নেহাৎ দুই প্রাণের বন্ধু এই মুহূর্তে মহানগরে পোস্টেড,নাহলে আরো বাড়ত খিস্তির তীব্রতা। কিন্তু একটা ব্যাপার প্রতিবারই অনুভব করি,কিছু তো আছে বুড়ির মধ্যে। সাধে তিলোত্তমা বলে না লোকে।বুড়ি বেশ কুহকিনী। সীমানা স্পর্শ করলেই, কেমন যেন আপন করে নেয় বুড়ি। ফিসফিস করে বলতে থাকে মান ভাঙ্গানো আদরের কথা। যাবতীয় ক্ষতে যেন মলম লাগিয়ে দেয় বুড়ি। যত্ত খিস্তিখেউর,রাগ, বিরক্তি, অভিমান সব যেন কেমন গলে গলে যায়। বিরাগটা যে কখন অনুরাগ হয়ে, মাখো মাখো প্রেমে পরিণত হয়ে যায় নিজেই বুঝতে পারি না। দূষিত বিষ বাতাসকেও একটু বেশি ভরে নিই ফুসফুসে। ঘুমিয়ে পড়ি বুড়ির বুকে মাথা রেখে, ময়লা আঁচল খানা জড়িয়ে। কাল সকালে উঠে সেই তো আবার ফিরে যেতে হবে। যতই চেপে ধরি না কেন,কাল সকালে ঠিক হাত ছাড়িয়ে নেবে বুড়ি। আবার ফিরে যেতে হবে পাতানো শহরে। নাককান মূলে ভাব জমাতে হবে আবার। এই তো জীবন কালি দা।

অনির ডাইরি ২রা মার্চ,২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

 মোবাইলে যে টাওয়ার নেই খেয়ালই করিনি। দিব্য শান্তিতে কাজ করছিলাম। মাঝে হাত-পা ছাড়াতে, সেকশনে গিয়ে খানিক খোশগল্প ও করে এলাম সবার সাথে। আমাদের চঞ্চল বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত। তিনবেলা আহ্নিক করে। টিকি রাখে। কপালে তিলক কাটে। আজকের তিলকটা বড়ই নিখুঁত কেটেছে। কিভাবে এমন সুন্দর তিলক কাটা যায়,সেই সংক্রান্ত খাণিক জ্ঞান আহরণও করে এলাম। তিলক নাকি শুধু মাথায় কাটলেই হয় না। শরীরের বারো জায়গায় কাটতে হয়। প্রতিটা তিলক শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন রূপের নামে কাটা হয়। সাথে সাথে পড়তে হয় সংস্কৃত মন্ত্র।  যাতে বলা থাকে শরীরের কোন অংশের তিলক কোন রূপের উদ্দেশ্যে অঙ্কিত। 


শরীরের কোথায় কোথায় তিলক কাটা হয়, ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিকর। আমিও শুনব না। চঞ্চলও ছাড়বে না। “শুনুন না ম্যাডাম। শুনলে পূণ্যি হয়। কপালের তিলক কেশবের নামে। কণ্ঠে শ্রী গোবিন্দ। হৃদমাঝে থাকেন শ্রীমাধব। উদরের এক পার্শ্বে শ্রীবিষ্ণু, অন্যদিকে বামনাবতার। মধ্যে নারায়ণ। এক বাহুতে ত্রিবিক্রম আর মধুসূদন আর অপর বাহুতে হৃষিকেশ আর শ্রীধর। পিঠে থাকেন পদ্মনাভ। কোমরে দামোদর। আর মস্তকে বাসুদেব।” বললাম তেরো হল তো। উৎসাহ পেয়ে গুছিয়ে বলে চঞ্চল,‘ না বারোটাই কাটি। কাটার পর যে টুকু মাটি হাতে লেগে থাকে,সেটা মাথায় মুছেনি বাসুদেবের নামে।’ জানতে চাই কাটো কি দিয়ে? জবাব পাই, ছাঁচ আছে। আবার প্রশ্ন করি, কাটো কি দিয়ে, চন্দন কি? চঞ্চল মাথা নাড়ে গম্ভীর ভাবে। ‘না ম্যাডাম। এটা হল দ্বারকার মাটি। যাতে মিশে আছেন আমাদের প্রভু। কেউ কেউ বৃন্দাবনের মাটি দিয়েও কাটে। সেটা কালো হয়। এটা মঠ ভেদে, আচার ও ভিন্ন হয়।’ 


বেশ ভালো লাগছিল শুনতে। জিজ্ঞাসা করি, মাটিটা পায় কোথা থেকে? উত্তর পাই মায়াপুর থেকে কিনে আনে। ‘বেশি দাম না। একশ টাকা কেজি। একবার কিনলে অনেক দিন চলে যায়। ’ মায়াপুরের কোন মঠে দীক্ষা নিয়েছে চঞ্চল। ইসকন্ নয়। 


বৈষ্ণব ধর্ম নেবার ফলে কি কি পরিবর্তন এসেছে, সে গল্পও শোনাল চঞ্চল। আমিষ ছেড়ে দেবার সাথে সাথে কমেছে তমঃ এবং রজ গুণ। সিগারেট ছেড়েছে। চায়ের নেশা ছিল তাও ছেড়েছে। গল্প আরো গড়াত, যদি না  বড় সাহেব মেসেজ পাঠাতেন, “তোমাকে ফোনে পাচ্ছি না কেন?’ কি সর্বনাশ ভালো করে তাকিয়ে দেখি কখন যে মোবাইলের সবকটা টাওয়ার পড়ে গেছে খেয়ালই করিনি। মোবাইলটা রিস্টার্ট দিলাম আর জহর বাবুকে বললাম এক কাপ চা খাওয়াতে। 


জহর বাবু কোন এককালে আমাদের নাইটগার্ড ছিলেন। অবসর নিয়েছেন বছর ঘুরে গেল। কিন্তু তাও নিত্য অফিস আসেন। অবসর নিয়ে বাড়িতে থাকা বোধহয় এই সব লোকের পোষায় না। সোয়া নটায় অফিসে ঢোকেন। ঝাড়পোঁচ নিয়ে সুইপার মাসির সাথে এক চোট ঝামেলা করেন। তারপর শুরু করেন চা করতে। চায়ের লোভে কত যে বন্ধু আসে জহর বাবুর। আমি গরহাজির বা অন্যমনস্ক থাকলেই  আমাদের ভিজিটর চেয়ার দখল করে তাঁরা বসে পড়েন চা খাবেন বলে। চা খেয়ে চলে গেলেও হয়, তা নয় এরপর শুরু হয় মজলিশি গল্প। ফলে কাকতাড়ুয়ার মত আমাকে চেম্বারের দরজা খুলে মুণ্ডু দেখাতেই হয়। এক ঝাঁকি দর্শনেই সব সাফ। ট্রেড ইউনিয়নের লোকেদের সাথেও ওণার হেব্বি ভাব। ডেপুটেশন দিতে এলেও তাদের বসিয়ে চা খাওয়ান, রসিয়ে সুখদুখ, ভূতভগবানের গল্প করেন জহর বাবু। ফলে আমার ঘরে যখন তাঁরা ঢোকেন, বিক্ষোভের বারুদ ততোক্ষণে ভিজে ন্যাতা। 


এ হেন জহর বাবুর চায়ের কোয়ালিটি নিয়ে কোন কথা হবে না। আমার অধিকাংশ ইন্সপেক্টর সাহেব ও চা ছোঁয়ও না। ঐ চা বর্জন করার বদবুদ্ধি আমাকেও দেয়। নেহাৎ আমি খানদানী চা-তাল। জলে চা মোটামুটি একবার দেন জহরবাবু। বাকিটা ঐ চা পাতাতেই চলে। জলটা বারবার পড়ে নতুন নতুন করে। চিনি থাকলে ভালো, নাহলে কোথা থেকে হরির লুঠের বাতাসা যোগাড় করে চায়ে ফেলে দেন জহরবাবু। চড়াম্ চড়াম্ গুড় বাতাসাও থাকে অনেক সময় চায়ে। থাকে কদমা বা বীরখণ্ডিও। সে যে কি ভয়ানক মিষ্টি, বাপরে। 


মিষ্টি ছাড়াই দিতে বলি আমি। বেশী বেলা হলে অনেক সময় বলি, জহরবাবু এটা চা? না আপনার হাত মোছাটা ফুটিয়ে দিয়েছেন। রাগ করে না বুড়ো। শুধু মাঝেসাঝে বেপোট চিৎকার করে, ‘জয় গৌরনিতাই’ বলে। ‘ইয়া আল্লাহ’ বলেও চিৎকার করেন অনেক সময়। বেলা তিনটে বাজলেই, আমার অগোচরে মোবাইলে সজোরে হয় কালিকীর্তন নয়তো হরিনাম চালান। সাথে নিজেও গলা মেলান। আমি বেরোলেই, সব চুপ।  আসেপাশের দপ্তরের লোকজন নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে ওণার গান শোনে। 


তো যাই হোক, কাগজের কাপে চা দিয়ে গেলেন জহর বাবু। এক চুমুক দিতেই মনে হল চায়ে জোয়ান দিয়েছেন আজ। এ আবার কি নবতম সংযোজন রে বাপু। এমনিতেই চাটার কোন স্বাদ গন্ধ নাই,  নিছক লালচে গরম জলের মত সোয়াদ। তারওপর জোয়ানগন্ধী। ডেকে জানতে চাইলাম, চায়ে জোয়ান দেবার দুর্বুদ্ধিটা কে দিল মশাই আপনাক? জহরবাবু আকাশ থেকে পড়লেন। ‘জোয়ান, আজ্ঞে?’ বললাম জী আজ্ঞে। উনি সাফাই দিলেন, ব্যাগে চাও ছিল,পুজোর বেলপাতাও ছিল। চায়ে নির্ঘাত পুজোর বেলপাতা মিশে গেছে। বেলপাতায় এমন জোয়ানের গন্ধ বেরোয়, বাপের জন্মে শুনিনি বাপু। বললাম, আরেকবার ভালো করে চা বানিয়ে আনুন দেখি। বেলপাতা -চাপাতাটা তার আগে সটান ময়লার বালতিতে ফেলুন। 


আবার চা এল। আবার জোয়ানের গন্ধ। এবার বোধহয় একটা জোয়ানও পড়ল মুখে। জহর বাবুর এক কথা। চায়ে পুজোর বেলপাতা মিশেছে। হতে পারে। আর একটা জিনিস ও হতে পারে,যেটা আমার পুরসভার ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি বলেছিল কিছুদিন আগে, ‘জহরবাবু পান চিবোন তো। হয়তো সেই চিবানো পানই খানিক চায়ে পড়ে গেছে ম্যাডাম।’ আবার ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, জহরবাবু আপনার পান কোথায়? একগাল হেসে বললেন, ‘পান আজ্ঞে?পান তো পকেটে?’ জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, পানে জোয়ান দিয়ে খান না। করলাম না। কিছু প্রশ্নের উত্তর অজ্ঞাত থাকাই শ্রেয়। আপদ বেদজ্যোতি, যত কুচিন্তা ঢোকায় আমার মাথায়। থেকে থেকে চা-পানের পিক আর জোয়ান এই ঘুরতে লাগল সারাটা দিন মাথায়। জহরবাবু যতদিন না মাস্ক পরে চা বানাচ্ছেন, আমি আর চা খাচ্ছি না এই অফিসে।