Saturday, 7 August 2021

তুত্তুরী উবাচ ৭ই আগস্ট, ২০২১

 মধ্যরাতে নীলচে রাতবাতির আলোয় মা মেয়ের কথোপকথন অন্তে-

👧🏻- ব্যাস? হয়ে গেল? মানে শেষ পর্যন্ত কি জানা গেল, অবনী বাড়ি আছে না নেই?

👩🏻- সেটাই তো। তোর শুনে কি মনে হল? 

👧🏻-(বিজ্ঞ স্বরে) আমার মনে হচ্ছে অবনী বাড়ি নেই। নইলে অত কড়া নাড়লে তো যে কোন লোকের ঘুম ভেঙে যায়। 

👩🏻-থাক বাবু, তোকে আর কাব্য সমালোচনা করতে হবে না। আয় ঘুমাই।


তুত্তুরী উবাচ ৭ই আগস্ট, ২০২১

👧🏻-(বিড়বিড় করে শ্লোগান দিতে দিতে) আমাদের নেতা জিতেছে! (মাকে দেখে গলার জোর বেশ খানিকটা উঠিয়ে, মাকে প্রদক্ষিণ করতে করতে) আমাদের নেতা জিতেছে!দুর্গন্ধ কালু জিতেছে। 

👩🏻- (অন্যমনস্কভাবে) অ্যাঁ কে জিতেছে? অলিম্পিকে নতুন কেউ পদক পেল নাকি। 

👧🏻-(হিহি করতে করতে) না না। একটা কার্টুনের কথা বলছি। তাতে একটা লোক শ্লোগান দিচ্ছিল, ‘আমাদের নেতা জিতেছে। দুর্গন্ধ কালু জিতেছে-। 

👩🏻-(হেসে ফেলে) কি নাম রে! দুর্গন্ধ কালু! উফঃ

👧🏻-(প্রশ্রয় পেয়ে) হ্যাঁ গো মা। ওর আসল নাম কালু মণ্ডল। হিন্দিতে বলে কালু সিং। কিন্তু বাকিরা ওকে বলে দুর্গন্ধ কালু। আর হিন্দিতে বলে বদবু কালু। 

👩🏻-বাবা গো! তুই বাংলা আর হিন্দি দুটোই দেখিস। 

👧🏻-(সরল ভাবে) হ্যাঁ। ইংরিজিতে হয় কিনা তাও খুঁজে দেখেছি। ইংরেজিতে দুর্গন্ধ কালুকে কি বলে জানতে। 

👩🏻- কি আর বলবে, স্টিঙ্কি কালু বলে হয়তো  তা কালুর নাম দুর্গন্ধ কালু কেন?

👧🏻-(সোৎসাহে) ওর গায়ে যে ভীষণ দুর্গন্ধ। ওর বগলে, মুখে,পেছনে সর্বত্র ভয়ানক দুর্গন্ধ। তারওপর ঢেউ ঢেউ করে ঠেঁকুর তোলে।  কোন খেলায় নামতে হলে বা মারামারি করতে হলে বিপরীত পক্ষকে ভয় দেখায়, ‘কি রে আমার বগলের গন্ধ শোঁকাব নাকি তোকে-(সটান বগল তুলে)’। আর মাঝেমধ্যে ইয়েও করে, তখন ওর পিছন দিয়ে সবুজ ধোঁয়া বেরোয়। 

👩🏻- আচ্ছা মা, এবার থামো। আমি আর দুর্গন্ধ কালুর দুর্গন্ধপুরাণ শুনতে চাই না। দয়া কর। 🙏🏼

Thursday, 5 August 2021

অনির ডাইরি, ২৬শে জুলাই, ২০২১


জন্মদিন নিয়ে এমনিতে খুব একটা কিছু প্রত্যাশা থাকে না তুত্তুরীর, একটু মায়ের হাতের পায়েস, একটা কেক আর মধ্যাহ্ন ভোজনে পাঁচরকম সাজিয়ে দেওয়া পদ। জন্মদিনের সকালে খেতে বসে বাটি গোনে তুত্তুরী, আর নির্ভেজাল মুখস্থ বলে যায় কোন বছরের জন্মদিনে কটা বাটি সাজিয়ে দিয়েছিলাম আমি। ভিতরের রান্না যতই ছাপোষা ঢ্যাঁড়স সিদ্ধ বা আলু পোস্তই দিই না কেন, শেষ বিচারে বাটির সংখ্যাই নির্ধারণ করে জন্মদিন তথা আমার সেই বছরের মাতৃত্বের সাফল্য। বিগত বছরের জন্মদিন বরবাদ করে অতিমারিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম আমরা মা আর মেয়ে দোঁহে। তাই এবছরের জন্মদিন ঘিরে একটু বেশিই উৎসাহী ছিল কন্যা আমার।


কিন্তু জীবন থোড়াই এগোয় পরিকল্পনা মাফিক। জন্মদিনের ঠিক দু সপ্তাহ আগে ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’। ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি করতে হল মাকে। সাড়ে তিন বছর অবধি বুকে করে তুত্তুরীকে মানুষ করেছে মা। তুত্তুরীর বিরহে তলিয়ে গেছে গভীর মানসিক অবসাদে। আজ এই একাদশ বর্ষ অন্তেও মায়ের প্রাণ ভোমরার নাম শ্রীমতী তুত্তুরী। 


 একদিকে ইনটেনসিভ কেয়ারে লড়াই করছে মা, অপরদিকে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বাড়ি ছাড়ছে শৌভিক। জেনেশুনেই তো এই চাকরীতে ঢুকেছি আমরা, ভোগ করেছি যাবতীয় গৌরব, সুবিধা এবং ক্ষমতা। আজ পারিবারিক বিপর্যয়ের অজুহাতে তাকে আটকাই কোন মুখে। 


ফ্ল্যাট জোড়া শূণ্যতা আর চরম অসহায়তা মেখে পড়ে থাকি আমি আর আমার তুত্তুরী। মায়ের জন্য ছুটি নিই, ছুটির নাম, ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ। ’  হাওড়া-কলকাতা, হাসপাতাল-ঘর, বৃদ্ধ অসহায়তর ভোম্বল বাবা আর জীবনের সাথে লড়াই করা মা সামলে, ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরি রাত আটটা/নটা বা সাড়ে নটা। বৃষ্টি নামলে আগেভাগে ফোন করে সাবধান করে দেয় তুত্তুরী। ‘ওলাতে এসো না কিন্তু।’ 


গভীর রাতে, রাতপ্রদীপের নীলচে আলোয় হাত ধরাধারি করে গল্প করে ক্লান্ত মা, আর মেয়ে। লুকিয়ে চুরিয়ে ওঠে জন্মদিনের কথা। চোখের জল চেপে বলি, ‘বাবা যদি ছুটি না পায়। আর মামমাম যদি হাসপাতাল থেকে না ফেরে-। ’ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মায়ের মা হয়ে, মাকেই সামলাতে বসে তুত্তুরী। ‘কোন ব্যাপার নয় মা। তুমি একটু পায়েস করে দিও শুধু। তাও যদি সময় না পাও, কাকিমা করে দেবে।’ সমঝদার মেয়েকে বুকে আঁকড়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি কে জানে- 


জন্মদিনের ঠিক পাঁচদিন আগে ছাড়া পায় মা। সেই মুহূর্তেই ঠিক করেছিলাম, শৌভিক যদি নাও ছুটি পায় তবুও অন্তত গোটা দশেক বাটি সাজিয়ে দেবোই এবার মেয়েকে। দোকান বাজারের অভ্যাসটা এখনও তেমন রপ্ত হয়নি, তা নাই হোক। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জন্মদিনের আগের সকালেই বাড়ি ফেরে শৌভিক। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামাতেই হাতে ধরাই ফর্দ। টুকটাক জিনিসপত্র কিনেছি বটে, মাছ বিশেষতঃ মাংসটা ওকেই আনতে হবে বাপু। চোখের সামনে মুরগি বা ছাগল কাটলে ওখানেই অক্কা পাব আমি। 


 জন্মদিন যদিও সোমবার, তবুও রবিবার সকাল থেকেই শুরু তোড়জোড়। চাটনি, পায়েস আমি বরাবরই আগের রাতে করে রাখি। অনেকটা সময় বাঁচে। বেটে রাখি মশলা। থোড়-মোচার ঝামেলা থাকলে কুটে রাখি তাও। আর চেষ্টা করি ম্যারিনেট তো বটেই পারলে কষে রাখতে মাংসটাকে। আগের রাতে কষা মাংসের সোয়াদ কেন জানি না ডবল হয় পরদিন। হয়তো ঝাল মশলাগুলো একটু বেশীই গভীরে প্রবিষ্ট হয়।  


আমি নিজে চিকেন রাঁধতে এবং খেতে ভালোবাসি। কিন্তু কন্যার আব্দার জন্মদিনে মায়ের হাতের তুলতুলে মাটন। কিন্তু মা তো জীবনে মাটন রাঁধেইনি। অন্য বছর হলে ভাগিয়ে দিতাম, এবছর এত পাশে থেকেছে মেয়েটা আমার, মায়ের হাসপাতালবাসের মধ্যেই পরীক্ষা পড়েছিল মেয়েটার, ছিটেফোঁটাও দেখার অবকাশ ছিল না আমার। একাকী পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছে মেয়ে। এমনকি হিন্দিও। যার প্রশ্নপত্রই পড়তে পারছিল না প্রথমে। তাই ঠিক করেছিলাম, শৌভিক যদি নাও আসতে পারে, মাটন তো আসবেই। শ্বশুরমশাই আশ্বস্ত করেছিলেন, চোখের সামনে ছাগল কাটা দেখতে হবে না আমায়।  কারণ, ‘ম্যায় হুঁ না। ’ 


রবিবার সকালে অবশ্য শৌভিকই নিয়ে আসে মাংসটা।  আর আমি তাতে বেশটি করে সর্ষের তেল, বেশ অনেকটা নুন, হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো আর বেশ খানিকটা মধু মাখিয়ে জরতে দিই । মধু মাখালে কেন জানি না, মাংসের স্বাদটাই যায় বদলে। ম্যারিনেট করা মাংস ঢাকা দিয়ে ফ্রিজে তোলার পর মনে পড়ে, একবার পার্লার গেলে মন্দ হয় না। কদিনের ঘোরাঘুরিতে রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে মুখচোখের যা চেহারা হয়েছে- দেখে আঁতকে না ওঠে পার্লারের দিদি, এটাই যা ভয়। 


পার্লার থেকে ফিরে, দ্বিপ্রাহরিক মাছের ঝোল ভাত খেয়ে,বহুদিন বাদে সপরিবারে ছোটখাট দিবানিদ্রা দিয়ে, সূয্যি মামা পাটে বসলে, চাটনি চাপাই আগুনে। প্রথমে ভেবেছিলাম আমের অম্বল করব। কিন্তু কি বাজে মাইরি, এখনকার কাঁচা আমগুলোর সোয়াদ। একেবারে আলুর মত-। তার থেকে সাবেকী টমেটো-খেজুর- আমসত্ত্বের চাটনিই ভালো। 


টমেটো গুলো চার টুকরো করে অল্প নুন ছিটিয়ে ঢাকা দিয়ে সিদ্ধ করতে বসাই, পাশ থেকে চিন্তিত স্বরে তুত্তুরীর মাসি বলে, ‘প্রেশারে দিতে পারতে। এখনকার টমেটো গুলো যা-’। 


অতঃপর ‘হে ঠাকুর টমেটো গুলো সিদ্ধ করে দাও প্রভু’।  প্রার্থনা না নির্মম ভাবে আধসিদ্ধ টমেটো গুলোকে থেঁতলানো কার দয়ায় জানি না, মাসিকে ভুল প্রমাণ করে অচীরেই গলে যায় টমেটোর দল। চিনির কৌটো উল্টে দিই, একফোঁটাও টক খেতে পারে না যে আমার গৃহকর্তা। ছড়াই খেজুর আর অল্প কিশমিস। খেজুর গুলো সামান্য গলে না গেলে কিছুতেই আসে না ঐ অমৃতের স্বাদ আর গন্ধ।  ঠিক উল্টো কথা প্রযোজ্য অবশ্য আমসত্ত্বের ক্ষেত্রে। যাতে গলে না যায়, নামানোর ঠিক আগে মেশাই কেটে রাখা আমসত্ত্বের টুকরো। রান্নাঘরের জানলার বাইরে ঘনায় সন্ধ্যে। দীর্ঘদিন বাদে ঘরে ফেরা  বাবার সাথে দাবা খেলতে খেলতে টেরিয়ে তাকায় তুত্তুরী, ওই চাটনি নামল বুঝি। 


চাটনি শেষে পায়েসের পালা। দুটো পাত্রে দুধ ফোটাতে বসাতে হয়। 'ছোটা সনসার হামার', তেমন বড় পাত্র কোথা পাই। তাই মিটমিটে আঁচে বিটবিট করে ফোটে ভাগের দুধ। লাল লাল চাপচাপ পায়েস ভালোবাসে এরা দাদু থেকে বাপ আর মেয়ে। আর ভালোবাসে কাকিমা। তবে জনা দশেকের জন্য পায়েস বানালে অত ঘন তো করা যাবে না, তারপর যদি কারো ভাগে কম পড়ে। ফ্রিজে রাখলে কিঞ্চিৎ বসে যাবে এটাই যা সান্ত্বনার-। শেষ পর্যন্ত অবশ্যি বেশ জমিয়েই বসেছিলেন তিনি। 


পায়েসের ভাগের দুধ ঘন হয়ে এককাট্টা হয়, অন্য গ্যাসে রাতের রান্না বসায় মাসি। বউয়ের ব্যস্ততা দেখে শৌভিক প্রস্তাব দেয়, রাতের খানা না হয় বাইরে থেকে হোক আনা-। সটান নাকচ করে দেয় মাসি। পাঁচ দিন বয়স থেকে মানুষ করেছে তুত্তুরীকে, মায়ের শাসন থেকে আগলে রেখেছে পাখির মত। তুত্তুরীর পাকযন্ত্র মাসির থেকে ভালো কে বোঝে। কাল যদি ঐ সব চর্ব্য চোষ্য খেতে হয়, আজ রাতে নিছক ডাল-ভাত-আলুসিদ্ধ-ডিম সিদ্ধ খাবে বাড়ি শুদ্ধ সব্বাই।  


রাত সাড়ে নটায়, গ্যাস ফাঁকা পেয়ে অবশেষে চাপে মাংস। সাবেকী পদ্ধতিতে কড়ায় সর্ষের তেল গরম করে, তাতে গুটি চারেক শুকনো লঙ্কা, অল্প গোটা গরম মশলা, তেজপাতা, আর জিরে দিয়ে ভাজতে দিই আগে কুচিয়ে রাখা সরু সরু করে কুচানো পিঁয়াজ। ভাজা হতে থাকা কুচানো পেঁয়াজে মেশে নুন, হলুদ গুঁড়ো, লাল লঙ্কা আর কাশ্মীরী লঙ্কা গুঁড়ো। হলুদ আর লঙ্কা গুঁড়া দিয়ে ভাজলে দারুণ সুন্দর লালচে রঙ আসে মাংসে। এটা আমি আবিষ্কার করেছি ইউটিউব ঘেঁটে। আর যা যা আবিষ্কার করেছিলাম সবই প্রায় ভুল প্রমাণ হলেও, এই টোটকাটা দারুণ কাজে আসে। অল্প তেল মশলায়ও কি লাল গরগরে ঝোল হয় মাইরি। 


কুচানো পেঁয়াজ কাদা হয়ে এলে, তাতে পরপর মেশে রসুন বাটা, আদা বাটা। পড়ে জিরে আর ধনে গুঁড়ো। গ্যাস কমিয়ে মেশাই ফেটানো টক দই। ইয়ে এটাও ইউটিউবের দৌলতে শেখা।  আগে যতবার দিতাম, জল কেটে পুরো ম্যাচাকার হয়ে যেত সব।  আজকাল গ্যাস কমিয়ে বা সময় থাকলে নিভিয়ে মেশাই টকদই।  ভালো করে একবার মিশিয়ে নিন, তারপর বাড়ান না গ্যাস যত চান। কে আটকাচ্ছে আপনাকে। 


তেল ছাড়া কষা মশলায় সবার শেষে মেশে সকাল থেকে ম্যারিনেট করে রাখা মাটন। আর কিচ্ছু করব না। মাঝে মাঝে  হাল্কা নেড়ে দেওয়া ছাড়া। অল্প আঁচে, ঢাকা কড়ায় পাক হতে থাকে তুত্তুরীর মায়ের মাটন। রাত পৌনে বারোটা নাগাদ যখন গ্যাস অফ করি, দু আঙুলে ছিঁড়ে আসে মাটন।


ঘড়ির কাঁটা যখন মধ্যরাতি ছোঁয়, মটকা মেরে পড়ে থাকা মেয়ের ঘাড়ে পড়ে তাকে জন্মদিনের হাজার চুমু দিতে দিতেও একই চিন্তা ঘোরে মাথায়। সবে তিনটি বাটি হল। এখনও বানাতে হবে আরো সাতটা বাটির খানা। ‘কালিয়া- কোর্মা-পোলাও’ না, এমন কিছু, যা হবে, ‘সস্তায় পুষ্টিকর’। 


তুত্তুরীর প্রিয় পেঁয়াজ, পাঁচ ফোড়ন আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে মুসুর ডাল না হয় ভরল চার নম্বর বাটি। পাঁচ নম্বর বাটির জন্য পেঁয়াজ দিয়ে ঝিঙে আলু পোস্ত বানাতে গিয়ে দেখি, ঝিঙেটাই আনেনি শৌভিক বাজার থেকে। বলতে গেলে চোখ রাঙায়। এখন ঝিঙে নাকি এমন পাকা, যে কেউ খায় না।  বদলে চিচিঙে এনেছে আমার বর। তাই সই, পঞ্চম বাটি সাজুক চিচিঙে আলু পোস্তয়।  ষষ্ঠ বাটিতে থাকবে আমার প্রিয় পনীর ভুনা মশলা। ভট্টচার্য বাড়ির কোন ছেলেমেয়ে পনীর ভালোবাসে না। তবে আমরা বউরা তো বাসি। না হয় আলোকিত করবে তুত্তুরীর জন্মদিনের থালা, কিন্তু এটা না হয় বানাব শুধু আমাদেরই জন্য।  


ভুনা মশলা বানাতে হলে আগে ভুনা অর্থাৎ ভেজে নিতে হয় কাঁচা উপকরণ গুলি। যথা কুচানো পেঁয়াজ, গোটা আদা এবং রসুনের কোয়া।  এরপর তাদের বাটতে হয় মিক্সিতে। এইটুকুই যা কাজ।  বাকি ভীষণ সহজ। 


কড়ায় অল্প তেলে একখান বড় এলাচ, অল্প জিরে আর তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে ভুনা মশলাটা সামান্য নাড়াচাড়া করে, তাতে মেশাতে হয় টমেটোর কাত্থ, আর আমাদের চিরকালীন হলুদ- লঙ্কা-জিরে-ধনে গুঁড়ো। আর স্বাদমত সামান্য চিনি। সবার শেষে গ্যাস অফ করে টক দই। টমেটো আর টকদই দুটোই পড়ে তাই একটু সাবধানে করতে হয়, না হলে একে তো টক হয়ে যায় বেশী আর দ্বিতীয়ত জল বেরোয় এক কলসী। এরপর আর কি, কষে তেল বেরোলে, পরিমাণ মত জল দিয়ে ফুটতে থাকলেই মিশিয়ে দিতে হয় আগে থেকে কেটে রাখা পনীরের টুকরো। পনীর গুলো ভাজা হয় না বলে, অসম্ভব নরম আর ক্রিমই হয় বস্তুটা। শেষে গ্যাস অফ করে হাফ চামচ ঘি আর গুটি কয় গোটা চেরা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হয়। করে দেখবেন, যেমন ভালো পোলাও এর সাথে চলে,তেমনিই ভালো চলে তন্দুরী, নান বা হাতে গড়া রুটির সাথে।  


সপ্তম বাটিতে বরং থাকুক তুত্তুরীর প্রিয় মিষ্টি মিষ্টি চিংড়ি পোস্ত। মালাইকারি বানাবারই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু নারকেল আর কোথায় পাই। এখন নারকেল আনতে বললে, ভস্মই করে দেবেন হয়তো গৃহকর্তা।  তাই পোস্তর সাথে মেশাই চার মগজ বাটা। 


বাকি অতি পরিচিত রেসিপি, চাপড়া চিংড়ির খোসা ছাড়িয়ে, সামান্য নুন হলুদ জলে ভাপিয়ে নিয়ে, সর্ষের তেলে অল্প নেড়েই তুলে নিই আমি। মা বলত নাহলে সিঁটে হয়ে যায়। এটা হাওড়া না মুর্শিদাবাদের ভাষা জানি না, সোজা কথায় একটু বেশি ভাজলেই ছিবড়ে হয়ে যায় মাছগুলো। 


মাছ তুলে নেবার পর পড়ে থাকা তেলে, পাঁচ ফোড়ন  পড়ে। অতঃপর ভাজা হয় সামান্য কুচানো পেঁয়াজ। পেঁয়াজের রঙ সোনালী হলে তাতে মেশে হলুদ গুঁড়ো, চারমগজ বাটা আর কাঁচা পোস্ত বাটা। মেশে দই আর চিনি। মশলা কষে জল ঢালার পর আগে থেকে ভেজে রাখা মাছগুলো মিশিয়ে দিই আমি। চিংড়ি- পোস্ত-মগজদানায় মাখো মাখো হয়ে এলে, হাল্কা লালচে তেল ছাড়লে তবে নিভবে গ্যাস। 


 বাড়ছে বেলা। বেদম হচ্ছে পা আর হাঁটু। অষ্টম আর নবম বাটিতে থাকুক ঝালঝাল ঝাঁঝালো ডিম সর্ষে আর মিষ্টি-মিষ্টি দই কাতলা। দুটো রান্নার মালমশলা প্রায় একই।  একদিকের কড়ায় গরম সর্ষের তেলে পড়ে পাঁচফোড়ন আর একটা ছিঁড়ে দেওয়া শুকনো লঙ্কা। ভাজা লঙ্কার সৌরভে রান্নাঘর মথিত হলে তাতে মেশে, বাটা সর্ষে আর কাঁচা লঙ্কার অমৃত মিশ্রণ।  বেশী ঝাঁঝালো হলে নাকের জলে, চোখের জলে হবে কন্যা আমার।  তাই মেশাই সামান্য বাটা পোস্ত। মশলা ভাজা হয়ে এলে মেসে অল্প টক দই আর গোটা লঙ্কা।  কষতে কষতে তেল বেরিয়ে এলে সামান্য জল আছড়া দিয়ে তারওপর জাস্ট রেখে দিই আগে থেকে সিদ্ধ করা শক্ত ডিমটা। বাটিতে ঢালার আগে ভালো করে ওলটপালট করে নিলেই হবে। চুপিচুপি বলি পিসিশাশুড়ীর থেকে শেখা রেসিপিটা তুত্তুরীর থেকেও আমার বেশী প্রিয়। 


পাশের গ্যাসে ভাজা হন কাতলা দেবী। দইকাতলা একেকজন একেক রকম ভাবে রাঁধেন, সবথেকে সহজ আর চটজলদি রেসিপিটাই অনুসরণ করি আমি। নুন-হলুদ মাখিয়ে ভাজা মাছের তেলেই দিই জিরে, শুকনো লঙ্কা আর তেজপাতা, গোটা গরমমশলা ফোড়ন। মাছে পেঁয়াজ দিলে খুব অখুশি হন শাশুড়ি মা। তবে দইকাতলায় একটু পেঁয়াজবাটা না দিলে তেমন স্বাদ আসে না আর গ্রেভিটা ঘনও হয় না।  তাই দিই একটা ছোট্ট বাটা পেঁয়াজ। ভাজা হয়ে এলে মেশাই অল্প আদা বাটা আর মগজদানা বাটা। মেশাই ছিটেফোঁটা হলুদ আর লঙ্কা গুঁড়ো, ঐ অনবদ্য রঙটার জন্য।  কষা হয়ে এলে জল ঢেলে ভাজা মাছগুলো ফুটিয়ে নিলেই রেডি।  


 দশম বাটি নিয়ে চাপ নেই। ওটা তো মিষ্টি আর চকলেটেই ভরে উঠবে। যার চুলচেরা ভাগ হবে পরে। এত কষ্ট করে রান্না করছি কার জন্য? আর সে চকলেটের ভাগ দেবে না, আমায়? 


 দশম বাটিটা এককালে ছিল তুত্তুরীর ভাত খাবার রূপার থালা। অন্নপ্রাশনে উপহার দিয়েছিল দাদু আর মামমাম। এতটুকু থালাতে এই সেদিনও জন্মদিনের ভাত খেতে বসত তুত্তুরী। এবছর সেই দাদুরই নির্দেশে বার করতে হয়েছে আমার বিয়ের দানের কাঁসার বাসনপত্তর। যার মধ্যে দুটো বাটি আমি বাতিল করেছি সাইজ দেখে। বাপস্ পাক্কা দৈত্যের বাটি দিয়েছিল বাবা।  পান নেই যদিও, তবুও সাজিয়ে দিই নর্তকীর মুখের মত দেখতে পানের ডাবরটাও।


শুধু শুভ বিবাহ লেখা পালিশ করা দানের থালাটা সরিয়ে রেখে, বার করেছি আমার মুখে ভাতের কাঁসার থালাটা। সুদূর মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গাঁ রামনগর থেকে পাঠিয়েছিল আমার দিদা। খাস খাগড়ার কাঁসা। পিছনে কালো ছোপ। এতো নিছক থালা নয়। এতে মাখানো আছে আমার দিদার ঘ্রাণ। সবই তো ভাগ করেনি মেয়ের সাথে, আজ ভাগ করে নেবো আমার দিদার স্মৃতি আর আশির্বাদ। 


ভাতের সাথে নাকি পাঁচ রকম ভাজা দেবার নিয়ম, অত আর পারব না বাপু।  ব্যথায় টনটন করছে পায়ের প্রতিটা পেশী আর কোমর। আর তেমনি বেপোট গরম মাইরি। আরেকবার স্নান না করলে গলেই যাব মনে হয়।  এ বছরের মত গোল গোল বেগুনী,  পাঁপড় আর সপ্তাহের বাটা মাছ ভাজা দিয়েই জন্মদিন হোক। পাঁচ আর তিনে কি আর তফাৎ বাপু।  আর তেমন কিছুই নেই ভাজার মত। আলু ছাড়া। যা ভাজতে আমি মোটেই আগ্রহী নই।  ধীরে ধীরে গরম হচ্ছে মটকা। সমাধান বাতলে দেন শ্রীমতী তুত্তুরী স্বয়ং। 'কাকরোল আর করলা ভেজে দাও না মা'। কাকরোল আর করলা? কি অসাধারণ কম্বো মাইরি। এই নাহলে শ্রীমান শৌভিকের আত্মজা।  


রেঁধে বেড়ে সাজিয়ে গুছিয়ে, ছবি তুলিয়ে তো দিলাম, শ্রীমতী তুত্তুরী খেলেন কেবল পায়েস, চাটনি, পাঁপড় ভাজা, ডাল, ভাত আর চিংড়ি মাছ। আহাঃ এই না হলে আমার মেয়ে। বাকি রান্না থাক তোলা। আর রান্নাঘরে ঢুকছি না আপাততঃ দিন তিনেক। অনেক হয়েছে মা। ভাগ্যে জন্মদিন বছরে একবার আসে-

Saturday, 31 July 2021

তুত্তুরী উবাচ ৩১শে জুলাই, ২০২১

 

👧🏻-(ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে, বাংলা সংবাদ পত্রের  শিরোণাম পাঠ) সবুজ পাঠগার। 

👩🏻-কি! ঠিক করে বাংলা পড়তে কবে শিখবি?

👧🏻-(সলজ্জ হেসে) সরি। সবুজ পাঠাগার। (ফিক করে হেসে) পাঠাগার মানে কি মা? যেখানে পাঁঠা থাকে? 

👩🏻-(প্রচণ্ড রেগে) তোর মাথায় কি আছে? পাঠাগার মানে লাইব্রেরি। স্কুল বন্ধ বলে যেখানে যেতে পারিস না আর ভেউ ভেউ করিস। 

👧🏻-(লজ্জিত হয়ে) এঃ দুঃখিত।( কিছুক্ষণ পরে,ভাব জমানোর উদ্দাম বাসনায়) জানো তো মা, তুমি সেই যে আমায় ন্যাড়া করে দিতে না, তাই নিয়ে ক্লাসে ইমন আমায় খুব জ্বালাতন করত। সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলত, ‘সি পুরোযা’স হেয়ার ইজ লাইক গ্রাস-’।  আর অমনি সবাই হো হো করে হাসত। শেষে একদিন বিরক্ত হয়ে গিয়ে বললাম, ‘ইয়েস। আই নো ইটস্ ইওর ফুড। বাট প্লিজ ডোন্ট ইট মাই হেয়ার। ’ 

👩🏻-মানে? তুই ওকে গরু বললি?

👧🏻-(দুষ্টু হাসি চেপে) হ্যাঁ। আসলে মিস একদিন বলেছিল, ‘ইমন ইয়োর হেড ইজ ফুল অব কাউ ডাং।’ তারপর মিস আমাদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ডু ইউ নো হোয়াট ইজ কাউ ডাং?’ সবাই বলছিল পটি। মিস বলল,‘নো ইটস্ নট পটি। ’ তখন আমি হাত তুললাম, ম্যাম ইটস্ গোবর। শুনে সবাই হেসেই অস্থির। ঐযে আমি বলেছিলাম ওর মাথায় গোবর, তাই আমার ওপর রাগ। যখন বললাম, এটা তোর খাবার জানি, তাই বলে আমার চুলটা খাস না দয়া করে, তখন আবার ভ্যাঁ করে গেল ম্যামকে নালিশ করতে। ম্যাম আমায় প্রশ্ন করল, তুমি ওকে গরু বলেছ? আমি বললাম, ও আগে আমার চুলকে ঘাস বলেছে। তাই তো বলেছি, খাবার ভেবে খেয়ে নিস না যেন-


👩🏻- উফঃ বেচারা তোদের ম্যাম।

Wednesday, 28 July 2021

অনির ডাইরি ১৫ই জুলাই, ২০২১

 



দুপুরের খাওয়া শেষ হতে হতে বিকেল চারটে। এটা অবশ্য চাটুজ্জে বাড়ির বরাবরের দস্তুর। সারাদিন গৃহস্থালির কাজ সামলে, স্নান সেরে, কুঁচিয়ে রাখা ধপধপে কাচা কাপড় পরে যখন খেতে বসত তৎকালীন জ্যেষ্ঠ কুলবধূ ওরফে আমাদের ঠাকুমা, তখনও ঘড়ি বলতো চারটে বাজে। ঠাকুমা চলে গেছেন আজ ষোল বছর হল, চাটুজ্জে বাড়ির এই প্রজন্মের বড় বউ অর্থাৎ আমাদের আদরের চৈতি যখন সব সামলে খেতে বসে,তখনও ঘড়ি বলে, চারটে তো বাজল রে।  


মধ্যাহ্নভোজের পাট মিটিয়ে পাওয়া যৎসামান্য অবসরে, বৈঠকি মেজাজে কাঠের সোফায় পাশাপাশি বসি আমি আর পিসি, সমকোণে রাখা বড় কেদারায় আরাম করে বসে সিগারেট ধরায় বাবা। বৃদ্ধ এমনিতে ভয়ানক শক্ত, কিন্তু আপাততঃ যুগপৎ আঘাতে কিঞ্চিৎ হতভম্ব তথা জবুথবু। মায়ের অসুস্থতার জন্য কষ্ট পায় বাবা, কষ্ট পায় আমার দৌড়াদৌড়ি দেখে,  আর কষ্ট পায় নিজের অক্ষমতার জন্য। আশি পেরানো দেহে, কমে আসা গায়ের জোরে, জগৎ জোড়া মহামারীর আতঙ্কে, বদলে যাওয়া পরিমণ্ডলে অসম্ভব অসহায় বোধ করে বাবা। মুখে স্বীকার করে না যদিও- 


পশ্চিমের জানলা গলে এক ঝাঁক মশা সমেত আসে পড়ন্ত সূর্যের কমলা রোদ, কফি টেবিলের ওপর রাখা সিঙ্গোনিয়াম গাছের কচি কলাপাতা রঙের পাতায় ঠিকরে আসে আলো। মা না থাকায়, কিঞ্চিৎ অগোছালো বাড়িটা, অনেকটাই ধূলিমলিন। ওসব ভাবলে আরো খারাপ হয়ে আসে মন। মনখারাপের ভারী পর্দা সরিয়ে রসালো গল্প শোনায় পিসি ।বাবাদের জনৈক তুতো পিসেমশাইয়ের গল্প। যেমন রূপবান ছিলেন তিনি, তেমনি ছিলেন ধনী। আর তাঁর নারীলোলুপতা ছিল প্রায় কিংবদন্তি তুল্য। সদ্য স্বাধীন চূড়ান্ত হতদরিদ্র ভারত, সেই সময় গুণে গুণে তেরটা মোটরগাড়ির মালিক ছিলেন উনি। ছিল দুটি স্ত্রী এবং অন্তত হাফ ডজন রক্ষিতা। 


 প্রবাসী বনেদী বাঙালী পরিবারের ছেলে, বাবা বলে, ‘প্রদীপ কুমারকে দেখেছিস তো? নায়ক। ঠিক অমনি দেখতে ছিলেন, একেবারে রাজপুত্র। যেমন চোখ-নাক- মুখ, তেমনি টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। বোনেদের বিয়ে হয়েছিল গাঙ্গেয় বঙ্গের বিভিন্ন ছোটবড় রাজপরিবারে। ওনারা তিনভাই, মরার সময় ওনার বাপ, উইল করে তিন ছেলের প্রত্যেককে দিয়ে গিয়েছিলেন চল্লিশ হাজার করে টাকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের কথা, তিরিশ সাল ধর, আইন অমান্য আন্দোলনে কাঁপছে ভারত, তখন চল্লিশ হাজার টাকা, মানে বুঝতে পারছিস, এ কালে চল্লিশ লাখ বা চার কোটিও হতে পারে-।’ তারপর? তারপর আর কি, বড় ছেলে ছিল রেসুড়ে। সবটাকা রেস খেলে উড়িয়ে দিয়েছিল।’ 


‘আচ্ছা এখনও কেউ রেস খেলে?’ প্রশ্ন করে পিসি। বেশ খানিকক্ষণ রেস কোর্স আর ঘোড়া নিয়ে চর্চা করে আবার স্বর্গীয় পিসেমশাইতে ফিরে যাই আমরা। । ‘বড় দাদা রেস খেলে সব টাকা ফুঁকে দেয়, আর উনি ফুঁকে দেন বেশ্যা বাড়ি গিয়ে-।তারপর দুই ভাই মিলে, ছোটভাইকে পাগল সাজিয়ে, তার ভাগের টাকাটাও আত্মসাৎ করে। তারপর সেই পাগল ভাই, নাকি একদিন সবার অলক্ষে লোহার শেকল কেটে গোপনে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তোর ঠাকুমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ছোট ভাইকে বড় আর মেজ ভাই মিলে পিটিয়ে মেরে কোথাও পুঁতে দিয়েছিল।'


পড়ন্ত রোদে ভাসমান ধূলিকণাদের দেখতে দেখতে, সম্পুর্ণ অপরিচিত, দীর্ঘকাল আগে মৃত জনৈক হতভাগ্যের জন্য ভারী হয়ে ওঠে হৃদয়। আহা রে!


এমন খুনি, দুশ্চরিত্র, লম্পট ছেলের সম্বন্ধ কে এনেছিল জানতে চাই, ‘ হবু শালার সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। ডিগ্রী নয় কিন্তু। ডিপ্লোমা। সেই সূত্রে ওদের বাড়ি আসা যাওয়া। দেখতে শুনতে ভালো, করিৎকর্মা। তখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে, প্রচুর বিদেশি গাড়ি আসছে, বন্ধুর সাথে সেই গাড়ি সারানোর গ্যারেজ খুলে প্রচুর টাকাও কামাচ্ছিলেন। তারওপর পাল্টি ঘর।  ব্যবহারটাও ছিল খুব ভালো। সবার মন জিতে নিতে দেরী হয়নি। এই সব দেখে মলি পিসির সাথে বিয়ে দেওয়ার পর জানা যায়, সে কি জিনিস! মলি পিসি যখন আসন্নপ্রসবা, তখন জানাজানি হয় যে, তাঁর অবিবাহিত  ছোট বোনও সন্তানসম্ভবা-। আর দুই অনাগত শিশুর পিতা একই-।’ 


বেলা গড়ায় আরো একটু। সূর্যের গায়ে লাগে কমলা ছোপ। ঘড়ি তাড়া দেয়, এবার ফিরতে হবে নিজ গৃহে, কাল ইংরেজি পরীক্ষা শ্রীমতী তুত্তুরীর। আমি না পৌঁছানো পর্যন্ত বইপত্র স্পর্শও করবেন না তিনি। তবুও উঠতে পারি না, জানতে মন চায়, তারপর কি হয়েছিল। 


সিগারেট ধরিয়ে বাবা বলে ,‘এমনিতে লোকটা বেশ ফ্যাসিনেটিং ছিল বুঝলি। সে যুগে, ১৩টা বিলিতি মোটরগাড়ির গল্প তো শুনেইছিস, তাছাড়া কত যে সম্পত্তি কিনেছিল লোকটা তার ইয়ত্তা নেই। পয়সা যেমন উড়িয়েছে, তেমনি কামিয়েও ছিল লোকটা। তবে নৈতিক চরিত্র বলে কিছু ছিল না। যে বন্ধুর সাথে পার্টনারশিপে গ্যারেজ খুলে উপার্জনের হাতেখড়ি, তাকেই একদিন ঠকিয়ে পথে বসাল লোকটা। গুণ্ডা লাগিয়ে গ্যারেজে আগুন লাগিয়ে দিল। বিলিতী বীমা কোম্পানির থেকে মোটা টাকা ক্ষতিপূরণ পেল, কিন্তু পার্টনারকে একটা পয়সাও দিলে না। বেচারা সেই লোকটা এমন ধাক্কা খেল যে আর জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে পারল না। 


শুধু গাড়ি আর যন্ত্রাংশ নয়, আরো না না অবৈধ কাজে যুক্ত ছিলেন ভদ্রলোক, নিঁখুত জাল নোটের ছাঁচ হাতে তৈরী করে লাখো লাখো টাকা উপার্জন করে। তবে ঐ যে বলে না,পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না,  অধঃপতনের কোন স্তরে নেমেছিল লোকটা কেউ জানে না,তবে শোনা যায়, তৎকালীন ভারত সরকারের জনৈক হোমরাচমরা নেতার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন বখরার দ্বন্দ্বে। অসম তথা প্রবল প্রতাপশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে নাকাল হয়ে, গোহারান হেরে অকালে পটাশিয়িম সায়নাইড খেয়ে আত্মহত্যা করতে হয় ওণাকে। রেখে যান দুই স্ত্রী আর কয়েক গণ্ডা বাচ্ছা।আর তারপরই নামে ধস। রাতারাতি উবে যায় কুবেরের ধন। তাতেও হাত ছিল দিল্লির সেই নেতার। মরেও নিস্তার পায়নি লোকটা। মূল্য চোকাতে হয় তার পরিবারকে-।'


 দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিসি বলে, ‘এমন অদূরদর্শী, অবিবেচক লোক দেখিনি, এত টাকা, এত সম্পত্তি অথচ কাউকে কিছু জানিয়ে পর্য্ন্ত যায়নি কোথায় কি ভূসম্পত্তি রেখে গেছে। বাচ্ছাকাচ্চা সমেত বউরা পড়ল অথৈ জলে।  এমনকি জানিস বাস্তু ভিটেটুকুও করে দিয়ে যায়নি। ভাড়া বাড়িতে থাকত ওরা, যখন উনি সুইসাইড করেন-। ভাড়া বাড়িটাও অবশ্য ছিল রাজকীয়। বাড়িতে চারজন ভৃত্য, দুই বউয়ের বাচ্ছা দেখার জনা দুয়েক আয়া, ঠাকুর, দারোয়ান কি ছিল না। দুই গিন্নীকে যা গয়না দিয়েছিল না অকল্পনীয়। গলায় পরার বারোমেসে চেনগুলোই ছিল আঠারো ভরি করে। ছেলেদের কোমরে বাঁধার চেন গুলো ছিল আট-দশ ভরির। ছেলেদের খাবার জন্য বিশাল বিশাল শিশিভর্তি হরলিক্স আসত বম্বে থেকে। অত বড় কাঁচের শিশি আমি জীবনে দেখিনি।  অথচ একটা ছেলেকেও লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেনি লোকটা। ছেলেগুলোর যে  কি পরিণতি হয়েছিল-।'


ঘড়ি বলছে পাঁচটা, এখনই না বেরোলে, অফিস টাইমের জ্যামে পরার সমূহ সম্ভাবনা। উসখুস করছি দেখে সচকিত হয়ে ওঠে পিসি,‘তোর বোধহয় এসব মান্ধাতার আমলের গল্প ভালো লাগছে না, না রে?’ বাবা অভিমানী সুরে সঙ্গত করে,‘বুড়ো হয়েছি তো, একটু বেশীই কথা বলি আমরা-। ’ ব্যাগ সরিয়ে আবার বসে পড়ি, কি করে বোঝাই এদের, গতানুগতিক সাদাকালো দৈনন্দিন জীবনের সবথেকে রঙীন অংশ এই বুড়োবুড়ির গল্প। থাকি না হয় আরো কিয়ৎ ক্ষণ, মন- প্রাণ-কান ভরে শুনি হারিয়ে যাওয়া অতীত আর  ভুলে যাওয়া কিছু চরিত্রের কথা।  যারা আপাদমস্তক সাধারণ হয়েও আসলে ছিল অনন্যসাধারণ।

Monday, 19 July 2021

অনির ডাইরি ১২ই জুলাই, ২০২১

 


আজ দীর্ঘ আটদিন বাদে বাড়ি ফিরলেন জগুদা এন্ড কোং। বিগত এক হপ্তা আটদিন ধরে তেনাদের নিবাস ছিল ঠাম্মার গৃহ। ঠাম্মাই জগুবাবুর মাসি কি না। ফেরার সময় একরাশ দইবড়া, কোল্ড ড্রিঙ্ক, বেলজিয়াম চকলেটের আইসক্রিমও নিয়ে ফিরলেন তিনি। সাথে প্রায় তিনশ টাকার প্রণামী। যার গরিষ্ঠাংশই দুই দাদু এবং কাকাইয়ের দেওয়া। বাকিটুকু দিয়েছে তুত্তুরীর মাসি আর আবাসনের জনৈক দাদু, যিনি রথের দিন তুত্তুরীর কাছে ‘পেসাদ’ চেয়ে হাত পেতেছিলেন। 


অথচ জগুবাবুদের যাত্রাটা কিন্তু মোটেও এমন শুভ হয়নি।  কি সাংঘাতিক যে কেটে ছিল রথের দিনটা। কোন কোন সকাল এমনি আসে, যখন একটু বেলা করে ভাঙে ঘুম। কোন কোন সকাল বয়ে আনে হাল্কা জাতি বিদ্বেষের গন্ধ।  কেমন, দিল তো ইতালী, ইংলণ্ডের নাকে আচ্ছা করে ঝামা ঘষে! 


বেলা গড়ায়, ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসে গত রাতের বাসি উত্তেজনা। আর কি কখনও কবে, এক সাথে কোপা- উইম্বলডন আর ইউরো হবে? সে চিন্তা ঝেড়ে ফেলে চিলেকোঠার গুপ্ত কুঠুরি থেকে সহোদর- সহোদরা সমেত বেরিয়ে আসেন জগন্নাথ। 


বেলা বাড়ে, তুত্তুরীকে ছুটি দেয় না গোঁড়া ক্যাথলিক স্কুল। পড়ার ঘরে ল্যাপটপ চালিয়ে ঘাড় গোঁজ করে পড়তে বসে তুত্তুরী। ব্যাগ গোছাতে বসে শৌভিক। আগামী কালই বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে রওণা দেবে নতুন পোস্টিং এর উদ্দেশ্যে। ব্যাগ গোছাতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয়, টুকটাক কত কিছু কেনা বাকি। চটজলদি বেরোনোর তোড়জোর করি আমরা। তুত্তুরীর ক্লাশ শেষ হবার আগেই ফিরে আসব, মাত্র ঘন্টা খানেকের ব্যাপার। স্নানাহার ফিরে এসেই না হয়- 


ঠিক এগারোটা পয়ত্রিশে বাবার ফোন, আজও ভাসছে কথা গুলো ইথার তরঙ্গে, ‘তুমি কি ব্যস্ত আছ, আসতে পারবে? মা যেন কেমন-’।  ঠিক এই ভয়টাই পাই আমি সবসময়। ঠিক এই কথাগুলোই দুঃস্বপ্নে শুনি আমি, অসময়ে বাড়ি থেকে ফোন এলেই ধড়াস করে ওঠে বুক। যদিও প্রতিবারই প্রমাণ হয়, অকারণ আশঙ্কা করি আমি, আর যেদিন সত্যিই হয়, সেদিন কেন যে বাজে না কোন বিপদঘন্টি।  


এরপরের দৌড়দৌড়ি, মানসিক উত্তেজনা, মনোবেদনার গল্প জানে সময় আর জানি আমরা চার খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাইবোন, আমার বর আর অয়নের গিন্নি তথা আমাদের আদরের ভাই বউ চৈতি।ক্ষয়িষ্ণু হলেও যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠার বোধহয় এটাই সবথেকে বড় সুবিধে, আমি আর শৌভিক পৌঁছানোর আগেই, ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসার পর অ্যাম্বুলেন্স ডেকে, মাকে হাসপাতালে নিয়ে হাজির হয় মায়ের ভাসুর ঝি, দুই দেওর পো আর চৈতি। বাড়িতে নড়বড়ে বাবার কাছে থেকে যায় পিসি আর বুল্লু বাবু। 


হাসপাতালের কাজ মিটিয়ে, বাড়ির পথে যখন গড়াল গাড়ির চাকা, মায়ের পাশাপাশি বড় মন খারাপ করছিল মেয়েটার জন্যও। সারাদিন নাকি, আমাদের অনুপস্থিতিতে ফুলে ফুলে কেঁদেছে মেয়েটা। মামমাম অর্থাৎ দিদার প্রাণ যে তুত্তুরী। তুত্তুরী যদি কাঁদে, মন খারাপ করে থাকে, মামমাম কি আদৌ ভালো থাকতে পারে? 


এত সাধ করে, বাবার হাতে পায়ে পড়ে উঁচু লফট থেকে রথ নামিয়েছিল মেয়েটা। দূরভাষের ওপার থেকে উমা বলল, 'দিদিভাই, পারলে একটু ফুল আনবে?' নমোঃ নমোঃ করেও নাহয় বেরোক তুত্তুরীর রথ-। গত বছরেও করোনার দৌলতে বাক্সবন্দি ছিলেন জগুদা আর তাঁর ভাইবোনেরা। 


সন্ধ্যা নামার মুখে, হাসপাতালের পোশাক বদলে, স্নান সেরে, উদরপূজা করার ফাঁকে ফাঁকে দেখলাম প্রবল কোস্তাকুস্তি করতে করতে কেমনি সেজে উঠছে কাকিমা আর তুত্তুরীর রথ। সেজে ওঠা রথে আসীন হলেন জগুদা এন্ড ফ্যামিলি। প্রথম প্রণামী দিল তুত্তুরীর মাসি, অতঃপর দুই বীরাঙ্গনা রওণা দিলেন রথ এবং জগন্নাথদেব সহ মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে। পড়ন্ত বিকেল, ফাঁকা পথঘাট আর গোটা আবাসন সাক্ষী রইল কাকিমা আর তার সোনাইয়ের খুনসুটি, ঝগড়া আর গভীর বন্ধুত্বের। কে বলবে, এই মেয়েই সারাদিন কেঁদে কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছিল চোখ। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠার এটাই তো সবথেকে বড় সুবিধা, একা থাকে না কেউ।

Thursday, 15 July 2021

অনির ডাইরি, ১৩ই জুলাই, ২০২১

 অনির ডাইরি, ১৩ই জুলাই, ২০২১



পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটার অলিতে-গলিতে, হাড়ে-পিঞ্জরে একা-একা পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে আজও কি যে ভীষণ ভালো লাগে। মনে মনেই চলে কথোপকথন, কখনও আমি ছোটাই কথার ফুলঝুরি, তো কখনও বা কান পেতে শুনি, কি কয় এই বুড়ি শহর। 


এই ভর দুপুরে ঝিম ধরে থাকা এই বাড়িটায় প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় বসত বিশাল সৎসঙ্গের আসর। সিংহাসনারূঢ় প্রায় এক মানুষ সমান অনুকূল ঠাকুরের সাদা-কালো ছবির গলায় ঝুলত টাটকা রজনীগন্ধার মালা। পুষ্পের সুবাসে, আগরবাতির সৌরভে মথিত হয়ে উঠত আমাদের গলি। রাস্তা জুড়ে পাতা সারি সারি কাঠের বেঞ্চে হত বিপুল ভক্ত সমাগম। হত ভজন সংকীর্তন। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত নাতিদীর্ঘ, ছিপছিপে চেহারার বাংলার স্যার শ্রীনাথ বাবু ছিলেন ঋত্বিক। শ্রীনাথ বাবু যখন ঋত্বিক হিসেবে মাইক ধরতেন, পলকে থমকে যেত সব গুঞ্জন। এমনিতে মোটেই মারকুটে নয়, বরং বেশ অমায়িকই ছিলেন স্যার, একবারই কেবল গাঁট্টা খেয়েছিলাম স্যারের হাতে। তখন আমি দশম শ্রেণী, কোচিং ক্লাশের সরস্বতী পুজোর চাঁদা, খামে ভরে, ক্লাশ-ব্যাচ এবং ‘স্বরস্বতী পূজা' লিখে যেই স্যারকে দিয়েছি, ওমনি ঠকাস্। 


আমাদের ক্ষীরেরতলা গলির মুখোমুখি রাস্তার নামটা ভারী সুন্দর, জয়নারায়ণ বাবু আনন্দ দত্ত লেন। এখেনে পা রাখলেই, মনে হয়, কেমন যেন থমকে আছে হারিয়ে যাওয়া সহস্রাব্দ। 


ঢুকতেই বাঁদিকে বড়কালীর পাকা মণ্ডপ।  আমাদের মধ্য হাওড়ার সবথেকে লম্বা কালী বলেই ওণার এমন নাম। ফি বছর বাড়ত বড়কালীর উচ্চতা এবং বিসর্জনের দিন অন্ধকারে নিমজ্জিত হত আমাদের শহর, বিপদের আশঙ্কায় কেটে দেওয়া হত যাবতীয় ওভার হেড তার। এতদসত্ত্বেও বেশ কয়েকবার মাথার চুল পুড়িয়েছিলেন বড়কালী। শেষে ক্লাবের ছেলেরা বলল, 'তুই আর কমপ্ল্যান খাস নে মা।' আজকাল তাই একটু খর্বাকার হয়েছেন বটে, তবুও মায়ের মুখ দেখতে হলে, ব্যথা করে ঘাড়।  


 ডানদিকের ঐ যে বিবর্ণ সবুজ কাঠের দরজাওয়ালা বাড়িটা দেখা যায়, ঐ বাড়ির বুড়ি মালকিনকে দেখতে ছিল পুরো মেম সাহেবদের মত। টকটকে ফর্সা রঙ, লালচে কেশদাম, গোলপানা মুখ, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। কানাকানি শুনতাম যে, অল্প বয়সে রীতিমত ডানাকাটা পরী ছিলেন উনি, বাড়ির অমতে অসবর্ণ বিবাহ করে রীতিমত আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন সে যুগের মধ্য হাওড়ার বুকে। ওনার স্বামীও ছিলেন তেমনি অপরূপ রূপবান, সদ্য স্বাধীন ভারতে জনৈক প্রসিদ্ধ মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির ইস্টার্ন জোনের সবথেকে বড় ম্যানেজার ছিলেন তিনি। কর্পোরেট রেষারেষির জন্য খুব বাজে ভাবে ফেঁসে গিয়ে আত্মহনন করতে বাধ্য হন তিনি। বারান্দায় দাঁড়িয়েই থাকত মেম বুড়ি আর রাস্তায় চেনা পরিচিত যাকেই দেখতে পেত, জুড়ে দিত খোশ গল্প।ছোট্ট বেলায় ওনার পীড়াপীড়িতে বেশ কয়েকবার গেছিও এণাদের বাড়ি। গোটা মহল্লায় তখন শুধু এই একটি বাড়িতেই ছিল টেলিফোন। 


একটু এগোলেই, ইংরেজি ভি অক্ষরের মত দু ভাগ হয়ে গেছে রাস্তাটা। ডানদিকের গলি ধরে খানিক এগোলেই আগে একটা খাটাল পড়ত। ও পথে পা বাড়ালেই, দখিনা পবন বয়ে আনত ভুরভুরে গোবরের গন্ধ। এখন অবশ্য আর নেই খাটালটা। সরকারী নির্দেশে সরে গেছে বহুদিন। 


বাঁদিকের রাস্তাটা ধরব আমি। আগে বাংলা বছরের প্রথম চার মাস জুড়ে এ রাস্তার ধারে শুকাতেন পুঁচকে পুঁচকে মুণ্ডহীনা রক্ষে কালী। পূজার ঠিক দু এক দিন আগে, তাদের ঘাড়ে চাপত মাথা। তারপর হত অঙ্গরাগ। শরৎ নামার সাথে সাথেই, পাট চুকত উলঙ্গিনীর। বিক্রি না হওয়া মূর্তিগুলিই সামান্য ছাঁচ বদলে হয়ে যেতেন কোজাগরি। কার্তিকে একরাশ কালি আর কার্তিক, আর পৌষে শুকাত সরস্বতী। রাস্তার ধারে আজও কিছু অসমাপ্ত খড়ের কাঠামো পড়ে আছে, আকার দেখে মনে হয়, হয়তো কালে কালে বিশ্বকর্মা হবেন তাঁরা। অথবা নব কার্তিক। যাই হোন না কেন,আজ নিছক কন্ধ-কাটা। 


সামনে মল্লিকদের বিশাল অট্টালিকার একতলার ঘর গুলি নিয়ে চলত অজিত বাবুর কোচিং। সাদা কালো দাবার বোর্ডের মত মেঝেতে শতরঞ্জি পেতে গাঁতিয়ে পড়তে বসত ছেলে আর মেয়েদের দল। রামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ের অঙ্কের শিক্ষক অজিত বাবুর  বিশাল নামডাক ছিল সেকালে। মল্লিকদের ঠাকুর বাড়ি ছাড়ালেই বাঁহাতে  ছিল একখানা ভাঙাচোরা ইয়ুথ হোস্টেল। সেটা যে কবে কোথায় হারিয়ে গেল-। কব্জা থেকে ভেঙে ঝুলছে সাবেকী ভারী লোহার গেট আর বাকি ফাঁকা এলাকার দখল নিয়েছে বর্ষার বেবাগা সবুজ জঙ্গল। 


একটু এগোলেই উত্তর খুরুট বারোয়ারির বিশাল রঙচঙে চারতলা ক্লাব ঘর। আরো খানিক এগোলে ডান হাতে একটি বাড়ির গায়ে আজও লাগানো আছে,  একটি ছোট বোর্ড।  যাতে লেখা, ‘এখানে দশম শ্রেণী অবধি যত্ন সহকারে পড়ানো হয়।‘ যোগাযোগের জন্য দেওয়া আছে শম্পার বাবার নাম। শম্পা শুধু আমার সহপাঠীই নয়, লতায়পাতায় তুতো বোনও বটে।  শম্পার ঠাকুমা দনুজদলনী দেবী সম্পর্কে ছিলেন আমার ঠাকুমা স্বর্ণলতা দেবীর মাসতুতো বোন। 


 তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে থাকাকালীন,  স্কুল ছুটি হলেই শম্পাদের বাড়ি যাবার প্রবল বায়না ধরতাম আমি। আর প্রতিদিনই ঢোঁক গিলে, একই কথা বলত শম্পা, ‘না রে অন্য সময় আসিস, এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকে মা।’ চার পুত্রকন্যা সামলে, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের যাবতীয় গৃহকর্ম মিটিয়ে, কয়লা ভেঙে, গুল দিয়ে, বাতিল শাড়ি দিয়ে পর্দা বানিয়ে, শম্পার গৃহশিক্ষিকার দায়িত্বভার সামলাতেন যে মহীয়সী মহিলা, তিনি যদি ব্যস্ত না থাকেন তাহলে ব্যস্ত থাকবে কে? ব্যস্ত থাকতে থাকতেই একদিন মারা যান জেঠিমা, শুনেছি আছড়ে কাপড় কাছতে কাছতেই নাকি ঢলে পড়েন চিরঘুমে। 


জেঠু অর্থাৎ শম্পার বাবার কথাও খুব মনে পড়ে, চাকরী থেকে অবসর নেবার পরও, লম্বা লম্বা পা ফেলে, একটা মস্ত কালো ছাতা মাথায় দিয়ে  সারাদিন টিউশনি করে বেড়াতেন তিনি। পথেঘাটে দেখা হলেই ঢিপ করে প্রণাম করতাম আমি, হাজার হলেও বাবার তুতো দাদা বলে কথা- শেষ খবর পেয়েছিলাম,পক্ষাঘাত গ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন উনি। কে জানে কেমন আছেন! কোথায় আছেন! 


শম্পাদের বাড়ি ছাড়ালেই আমার প্রাণ চায়, সারদামণি ক্লাবের পাশ দিয়ে ডান দিকে বাঁকতে। ঐ ডান হাতি গলি এঁকে বেঁকে গিয়ে দাঁড় করায় রুণাদের বাড়ির সামনে। এককালে কত যে গেছি ও বাড়িতে তার ইয়ত্তা নেই। বন্ধ হয়ে যাওয়া যোগমায়া সিনেমা হলের পাশে, রুনাদের বাড়ি খানা আজও রয়ে গেছে একই রকম। পৌনে দুই দশক হল, বিয়ে হয়ে চলে গেছে রুনা,  কাকুও চলে গেছেন ফিরে না আসার দেশে। তবে কাকিমা আর রুণার পিসিমা আজও আছেন। গিয়ে কড়া নাড়লে কি আদৌ চিনতে পারবেন আমায়? পিসির পরিচয় দিলে নির্ঘাত পারবেন। স্কুলে পৌঁছে দেওয়া-নেওয়ার সূত্রে বড় গভীর বন্ধুত্ব ছিল আমার পিসির সাথে রুণার মায়ের। 


সোজা এগোলে ডান হাতে স্বপ্নের মত একখান মস্ত তিনতলা হলদে রঙের ইস্কুল বাড়ি পড়ত, বাবার মুখে শুনেছি, স্বাধীনতার আগে আমার বড় পিসিমারা স্লেট বগলে এখানে পড়তে আসত, তখন এর নাম ছিল, ‘দুর্গা বাবুর পাঠশালা’। পরবর্তী কালে শ্রীদুর্গা ইস্কুল নামে অন্যত্র সরে যাবার পর, স্বপ্নের মত ইস্কুল বাড়ির দখল নেয়, বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউশন। ওদের প্রাথমিক বিভাগটা দীর্ঘদিন এখানেই বসত। তাঁরা চলে যাবার পরও কি যেন একটা স্কুল বসত এই বাড়িতে। বর্তমানে খণ্ডিত ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে আছে এক ফালি অংশ। বাকিটুকুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কুৎসিত বহুতল। ঐতিহ্য বেচে ফ্ল্যাট কিনেছে হাওড়া বাসী। নাকের বদলে নরুন। 


 আর এগোলে, মা কালীর মন্দির আর বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্যামাশ্রী সিনেমার গায়ে ধাক্কা খাব আমরা। এখান থেকে ডান দিকে বেঁকে যাব আমি। রিশেপশনের ছেলেটা বলেছে, আইসিইউ এর ভিজিটিং আওয়ার আধঘন্টা মাত্র।  অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় আছে জননী আমার। আসছি মা, আর দু মিনিট মাত্র। একটু দাঁড়াও প্রিয় শহর, আধেক ঘন্টা পর, ওষুধপত্র কিনে পৌঁছে দিয়ে আবার এ পথেই তো একলা ফিরব আমি। ফিরব অধীর আগ্রহে বসে থাকা এক ভীতু বৃদ্ধের কাছে, বউকে বড় ভালোবাসে যে সে, জানতে চায়, শুনতে চায় বিশদে,  কেমন আছে তার আব্দেরে আলুভাতে গিন্নি। খুব দ্রুত ফিরতে হবে আমায়, আর একলা ফিরতে আমার যে বড় ভয় করে-। প্লিজ পাশে থেকো-

Friday, 9 July 2021

অনির ডাইরি ৯ই জুলাই, ২০২১



এই তো মার্চ মাসের কথা, মায়ের জন্মদিন ছিল সেদিন। বাবার অগোছালো ঘরে জামাই বরণের সঙ্কোচকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে সদলবলে কেক কাটা হল।  উঠল গোছা গোছা ছবি, নিষেধাজ্ঞা জারি হল সামাজিক মাধ্যমের ওপর। সৌজন্য- মায়ের আজন্ম  লালিত সঙ্কোচবোধ। ছিঃ লোকে দেখলে কি বলবে? ভূতের আবার জন্মবার! 

মাতৃআজ্ঞা আমার শিরোধার্য বটে, তুড়ি মেরে, বাবা অবশ্য দিব্যি পোস্ট করেছিল ফাটিয়ে। নেহাৎ ট্যাগাতে জানে না। সোমাদির হোমবেকড ডার্ক চকলেট কেকের ওপর সাঁটানো আমার মা- আর আমার মেয়ের মিষ্টি মিষ্টি ছবি। প্রথম চোটে তো বাবা- মা বা পিসি বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে, ছবিটাও খাওয়া হবে। টুকরো টুকরো হবার পর, মায়ের ছবির অংশটার ওপর লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তুত্তুরী, হাত বাড়াবার আগেই, ‘আমার বউ’ বলে খপ করে তুলে নিল বাবা। 

মাত্র কমাসেই বদলে গেছে কত কিছু। না, লকডাউন বা বর্ধিত তেলের দাম নয়, বদলে গেছে আমাদের বাচ্ছাগুলো, তালগাছের মত লম্বা হয়ে গেছে বুল্লুটা।  খোলতাই হয়েছে গায়ের রঙ, বেপাত্তা হয়েছে শরীরের যাবতীয় স্নেহ পদার্থ। গলা না ভাঙলেও, আমাদের জেলার ভাষায়  সিড়িঙ্গে, তাল ঢ্যাঙা হয়ে উঠেছে ছেলেটা। বললেই বুল্লুর বাপের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে আমার বাপ বলে, ‘হবে না। পড়া পড়া করে পেঁদিয়েই লম্বা করে দিল ছেলেটাকে-’।  যেন মা আমাকে কম ইয়ে করেছে, তাও যে কেন ----(দীর্ঘশ্বাস)। কত যে ভুল ধারণা থাকে মানুষের, তুত্তুরীর যেমন মনে হয়, ওর গালের যাবতীয় বেবি ফ্যাট নাকি আমার চপেটাঘাতেই ঝরে গেছে। যেন মা আমাকে চপেটাঘাত কিছু কম করেছে- তাও তো----(দীর্ঘশ্বাস)। এখন এসব বলতে বসলেই তো গোঁসা হবে মায়ের,  ছিটকে আসবে যাবতীয় তির্যক মন্তব্য,  ‘হ্যাঁ, জানি তো। মা খুব খারাপ। যত দোষ তো মায়েরই। দাঁড়া, মা যেদিন থাকবে না- ’। কি আশ্চর্য শুনতে শুনতে বড় চেনা মনে হয় শব্দ গুলো, আজ সকালেই কাকে যেন বলছিলাম- ‘মা না থাকলে বুঝবি-’।