-হাওয়াটা দারুণ না?
-অ্যাঁ?আমায় বললেন?
-হ্যাঁ । বলছি আজ দারুণ হাওয়া দিচ্ছে।
-ও। হ্যাঁ। মানে রোজই কি এমন হাওয়া দেয় না? সমুদ্রের হাওয়া?
-কি জানি? দেয় কি না। আগে কখনও এই অনুভূতিটা হয়নি কি না।
-কি অনুভূতি? কিছু মনে করবেন না, আমার বোধহয় প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি---
-আরে না না। কিছু এমন অন্যায় হয়নি। আপনি এত সঙ্কুচিত বোধ করবেন না।
-সঙ্কোচ?সঙ্কোচই তো আমার একমাত্র সম্বল ভাই, এই দেখুন না জীবনে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার শ্রীক্ষেত্র এলাম, প্রথমবার এসেছিলাম বছর চল্লিশ আগে, তখন আমি নবোঢ়া। স্বামী শ্বাশুড়ি আর স্বামীর আগের পক্ষের তিন ছেলের সঙ্গে। যার বড়টি আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট ছিল-। আর এবার এসেছি আমার মেজবোন,ভগ্নীপতি,তার মা, দাদা-বৌদি,তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে। এখন আমি এক অসহায় নিঃসম্বল গৃহহীন,বিধবা। (প্রৌঢ়া আঁচলের খুঁটে চোখ মুছলেন) মাপ করবেন দাদা আমি আবার আবোলতাবোল বকতে লেগেছি---
-(প্রৌঢ় গলা ঝেড়ে সঙ্কুচিত হয়ে বললেন) আরেঃ না না। আপনি বলুন না-- আমার মন্দ লাগছে না। আসলে আমার কথা বলার কেউ নেই জানেন। উত্তরবঙ্গের এক অজ গাঁয়ের এক ছোট্ট প্রাথমিক স্কুলে মাষ্টারি করি। নিজেই হাত পুড়িয়ে রান্না করি, এখন অবশ্য আর হাত পোড়ে না। হাঃ হাঃ।
-প্রৌঢ়া অল্প হাসলেন। প্রৌঢ় অবাক মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, প্রৌঢ়ার গালে গোলাপী রঙ লাগল। দুজনেই চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। সামনে অতল গভীর বঙ্গোপসাগর ছলাৎ- ছল করে আছঢ়ে পড়ছে তটরেখায়। মহিলা সামলে নিয়ে বললেন,“ তবু ভাল। আপনি স্বনির্ভর। আমি তো লেখাপড়াও তেমন শিখিনি। দাঙ্গার ভয়ে ওপার থেকে পালিয়ে এসেছিল আমাদের পরিবার। পথে বাবাকে ওরা কুপিয়ে খুন করে। মা কোনমতে দুই মেয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে আসে। খাবারই জোটা দায় ছিল তো পড়াশোনা। আমার বর বয়সে অনেক বড় ছিলেন। বিশাল কারবার। প্রথম পক্ষের স্ত্রী তিন ছেলে রেখে হঠাৎ মারা যান। ছেলেদের সামলাবেন না কারবার?অগত্যা আমায় বিয়ে করেন। মা জেনেশুনেই দিয়েছিল। আমার ভাইবোনেরা ভাল ভাবে মানুষ হতে পারে যাতে। বিয়ের পর জানতে পারলাম ওনার অপারেশন করানো আছে। আমি আর কখনও মা হতে পারলাম না। আমার আজ তিনকূলে কেউ নেই জানেন। বোনের বাড়ির নিছক আশ্রিতা আমি_---
-(অখণ্ড নীরবতা, শুধু অবাধ্য বঙ্গোপসাগর একাই ছলাৎ ছল করে আওয়াজ করে চলেছে। )
-(ভদ্রলোক গলা ঝেড়ে বললেন) জানেন আমার ও কেউ নেই। আমরাও পালিয়ে এসেছিলাম দাঙ্গার ভয়ে। বাবা এপাড়ে একটা ছোট্ট মণিহারি দোকান দিয়েছিল। মন্দ চলছিল না। দশ ক্লাশ ভালভাবে পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম। গায়ে বসন্তের হাওয়া লাগল। কলোনীর জলের লাইনে প্রথম দেখা তার সঙ্গে। গাছকোমর বেঁধে ঝগড়া করছিল। দেখেই বুঝতে পারছিলাম এসবে সে অভ্যস্ত নয়। হয়তো ওপাড়ে কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে, এপাড়ে এসে এই পুতিগন্ধময় পরিবেশে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না, তবু ছাড়ছে না। সারভাইভাল অব দা ফিটেস্ট। হাঃ হাঃ হাঃ
-সত্যি বাবা। উফ্ ঐ জলের জন্য সাতসকালে ঝগড়া করা আমারও পছন্দ ছিল না। ঘেন্না লাগত। কিন্তু না করলে উপায় ছিল না। যাই হোক তারপর??
-তার আর পর নেই। পড়াশোনা মাথায় উঠল। বন্ধুর থেকে ধার করা সাইকেল নিয়ে তার ঘরের চারপাশে ঘোরা---এক ঝলক দেখতে পেলেই দিন সার্থক।
-হ্যাঁ তখন তো ছেলেরা তাই করত। আমাদের কলোনীতেও এমন একজন ছিল। আমার সখীরা বলতো সে নাকি আমায় ----(প্রৌঢ়ার মুখ সিঁদুর বর্ণ ধারণ করল) যত বাজে কথা। বুড়ো বরকে কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হইনি প্রথমে জানেন। শুধু তার কথা ভেবে। অবশেষে একদিন রাতে তাকেই বলেই বসলাম, পারবে না আমার দায়ভার নিতে? তো বলে খাব কি? রাখব কোথায়? আর কথা বাড়াইনি। মুরোদ বোঝা গেছিল।
-প্রৌঢ় হেসে বললেন,“এরম বলবেন না। মুরোদ থাকলে কি কেউ ফেরায়?আমার তিনিও আমায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন একদিন। তখন গভীর রাত, নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে হাজির হলাম তাদের হোগলার ঘরের পিছনে। সেদিন শুক্লা চতুর্দশী। নোংরা পুতিগন্ধময় কলোনী ভেসে যাচ্ছে শশধরের চাঁদনীতে। বুকে তীব্র কম্পন ধরিয়ে সে এল। জংলা ছাপ শাড়ি ঘরোয়া ভাবে পড়া, একমাথা কোঁকড়া চুল একটা বিশাল খোঁপায় জড়ানো। দুটো প্রেমের কথা বলব কোথায়, গলা দিয়ে আওয়াজই বের হল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বুঝলাম সে কাঁদছে। মুখ খুলতে যাবার আগেই সে দুহাতে আমার হাত চেপে ধরল। তারপর আমার হাতে মাথা ঠুকতে লাগল। টপটপ করে অশ্রুকণা ঝড়ে পড়তে লাগল আমার হাতে----।
-মহিলা ছটপট করে উঠলেন। “থাক না।শুধু শুধু ও সব কথা”
-হুঁ। ঠিকই বলেছেন। সেও সেদিন বলেছিল তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে---পারিনি। বিশ্বাস করুন। তার জন্যই পারিনি। কোথায় রাখতাম তাকে?কি খাওয়াতাম? একবার তো উদ্বাস্তু হয়েইছে আবার কি ছিন্নমূল হত আমার জন্য?তাই ফিরিয়ে দিলাম। চোরের মত পালিয়ে এলাম। সারারাত শুধু কেঁদেছি। পরদিন সকালে দৌড়ে গেছি তার কাছে, ফিরিয়ে নিয়ে যাব বলে। কিন্তু -----। আজ এত বছর পর শুধু আপনাকেই বলছি। কেন জানি না। পালিয়ে গেছি, সবকিছু ছেড়ে। হিমালয়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে চেয়েছি,মিশে যেতে চেয়েছি। কিন্তু পারলাম কই?অন্য নারীসঙ্গও তাকে ভোলাতে পারেনি। সেই স্পর্শ, সেই অশ্রুকণার উষ্ণতা, সিক্ততা আজও একই রকম ভাবে অনুভব করি। ভুলতে পারিনি----
-ভোলা যায় না। আমিই কি পেরেছি?শুধু ঐ স্মৃতিটুকুই যা অমৃত বাদবাকি সবই গরল। খুব ইচ্ছা ছিল বিয়ের পর শ্রীক্ষেত্র আসব তার সাথে মধুচন্দ্রিমা যাপনে--- সেই এলাম। কিন্তু 😔😔
-কি আশ্চর্য ওর ও তাই ইচ্ছা ছিল বলে শুনেছি পরে ওর ঘনিষ্ঠ সখীর কাছে----
-ফুল মাসিইইই ---দূর থেকে কে যেন ডাকল,মহিলা শশব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন। ভদ্রলোক অসাড় হয়ে বসে রইলেন কতক্ষণ, তারপর খেয়াল হল ইশ্ নামটা তো জানা হল না? একই কথা ভাবছিলেন প্রৌঢ়াও-__ বঙ্গোপসাগর ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল এদের নির্বুদ্ধিতায়। “যাক্ কাল আবার আসতে হবে, ঠিক এই সময়” ভাবল প্রৌঢ়। “ইশ্ কালই ফিরে যাওয়া-” ভাবল প্রৌঢ়া।
https://amianindita.blogspot.in
What ever I like...what ever I feel.... form movies to books... to music... to food...everything from my point of view.
Saturday, 25 February 2017
বেণু-রতন
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment