শুভ মহালয়া। মহালয়া এলেই ছোট বেলার কথা বড় বেশি মনে পড়ে।
আমাদের সেই পুরানো দেড়-দুশো বছরের ভাঙা বাড়ি, সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই তিন দিক রোয়াক
দিয়ে ঘেরা বিশাল উঠোন। উঠোনের পূবে আর পশ্চিমে খোলা বাগান, যা আমাদের ছোটবেলায়
প্রায় জঙ্গলে পর্যবসিত হয়েছিল। কি গাছ ছিল না আমাদের সেই বাগানে? আম, কাঁঠাল,
নাগকেশর, বেল, যজ্ঞিডুমুর, নিম, বট আর অশ্বত্থ গাছ যুগলে জড়াজড়ি করে উঠেছিল। কৃষ্ণ
এবং রাধাচূড়া দুটোই ছিল পুবের বাগানে। পেয়ারা গাছ ছিল গোটা দুয়েক। এত মিষ্টি
পেয়ারা বাজারে পাওয়া যেত না, আজোও যায় না। এছাড়াও জেঠাইমার লাগানো কত যে ছোট ছোট
গাছ ছিল- যেমন তুলসি, দোপাটি, অপরাজিতা, কৃষ্ণকলি, সন্ধ্যামণি, পয়সাপাতা (যাকে এখন
বলি মানিপ্ল্যান্ট)। কলকে ফুলের গাছ, বাসক পাতার গাছ ও ছিল, আমরা ভাইবোনেরা ছোট
বেলায় কলকে আর বাসক ফুল পেড়ে পিছনের মধুটা সুড়ুত করে চুষে খেতাম। সাবধানে খেতে হত,
অনেক সময় লাল পিঁপড়ের দল আমাদের আগেই ঢুকে বসে থাকত। পাঁচিলে পাঁচিলে হয়ে থাকত
ডুমুর গাছ। কারো সামান্য শরীর বিগড়লেই জেঠাইমা ডুমুর পাড়িয়ে রাখত- আর বেশ কিছুদিন
ধরে তাকে হয় ডুমুরের ঝোল, নয়তো ডুমুর ভাজা আর
নাহলে ডুমুর সিদ্ধ খেতে হত। উত্তরের
পাঁচিলের লাগোয়া ছিল একটা জবা গাছ, লাল টকটকে জবা। থোকা থোকা ফুটে থাকত, তবে পাড়তে
হলে পাঁচিলে উঠতে হত, ভিত হীন নড়বড়ে পাঁচিল আর কেউ উঠলেই পাশের বাড়ির জন দাদার মা
প্রবল হল্লা জুড়ে দিতেন। “ওগো তোমাদের দেবী আর ঝুনু পাঁচিলে উঠেছে গো। পড়ে মরবে
গো।” অনেক বছর হল মারা গেছেন ও বাড়ির জেঠাইমা, দীর্ঘ দিন পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন- জবা
গাছটাও অবশ্য কেটে দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৫-৯৬ এ।
আজ কেন যে ছোট বেলার জন্য এত মন খারাপ করছে? কত লোক ছিল
আমাদের বাড়িতে- ঠাকুমা, মেজ পিসি (যাকে আমরা সবাই ডাকি দিদি বলে) জেঠু, জেঠাইমা,
ছোট কাকু, কাকিমা, বাবা, মা, আর আমরা তিন ভাইবোন। দিদিভাই অর্থাৎ আমাদের জেঠতুতো
দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল সেই আশির দশকের শুরুতে। পড়েছিলাম আমি আর আমার দুই খুড়তুতো
ভাই অয়ন আর অনিন্দ্য। মা-কাকিমা দুজনেই
অফিস বেরিয়ে না যাওয়া অবধি আমরা ভিজে বেড়াল হয়ে থাকতাম, যেই ওঁরা বেরিয়ে যেতেন,
আমাদের আর পায় কে? ঠাকুমা বলত, “বামুন গেল ঘর তো লাঙল তুলে ধর।” কি প্রবল
দুরন্তপনা করতাম আমরা, ঠাকুমা-পিসি হিমশিম খেয়ে যেত। সারা দুপুর কেউ ঘুমতাম না, আর
যেই মায়েরা এসে পড়তে বসাত, অমনি চোখ ঢুলঢুল। বেদম ঠ্যাঙানি খেতাম, ভাইয়েরা একটু
বেশি, আমি একটু কম, কারণ ঠাকুমার ভয়ে সকলের মায়েরাই করত কি, বাচ্ছাদের নিজেদের
ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে পেটাত। আমার দুই ভাই দাঁড়িয়ে মার খেত, আর আমি প্রবল
চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বিশাল সাবেকি খাটটাকে ঘিরে গোল গোল ঘুরতাম। মা লাফিয়ে
খাটে উঠলে আমি খাটের তলায় ঢুকে যেতাম। এত সাবধানতা সত্ত্বেও দু এক ঘা স্কেল বা
হাতপাখার ডান্ডার বাড়ি পড়েই যেত। চিৎকারের কারণ ছিল আমার জেঠু। দোতলার বিশাল
দালানে একটা খাট পাতা ছিল, ওখানে অফিস থেকে ফিরে এসে বা ছুটির দিনে জেঠু শুয়ে শুয়ে
বই পড়ত। মাথার কাছে একটা টেবিল ল্যাম্প তার দিয়ে বাঁধা থাকত। আমার কান্নার আওয়াজ
দরজা টপকে জেঠু অবধি ঠিক পৌঁছত, আর তৎক্ষণাৎ উনি বারন্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে চিৎকার
করতেন, “ওগো শুনছ। মেয়েটাকে সরমা বোধয় মেরেই ফেলল।” জেঠিমা ছিল চিরদিন আমার বিশাল
আশ্রয়। জেঠুর গলা শোনার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই জেঠিমা এসে ধড়াম ধড়াম করে দরজা
পিটত। “খোল। দরজা খোল। মেয়েটাকে মেরে ফেলবি নাকি?” বাধ্য হয়ে মা দরজা খুলে দিত আর
প্রতিবার একই মিথ্যা কথা বলত, “বিশ্বাস কর দিদি, মারিনি। শুধু মারব বলে স্কেলটা
দেখিয়েছি।”
ইশ কি সব দিন ছিল, স্বপ্নের দিন। ভাবিনি মৃত্যু কোনদিন
আমাদের বাড়িতেও থাবা বসাবে, প্রথমেই গেল আমার
দিদা সেটা ১৯৯৮ সাল। তারপর বড় পিসেমশাই,
২০০৪,বয়সে উনি ঠাকুমার থেকেও বড় ছিলেন অবশ্য। তারপর ঠাকুমা ২০০৫ এ, ঐ বছরই সেজো
পিসেমশাই, ২০০৬ এ বড় পিসি, তারপর ২০০৯ এ ছোট পিসেমশাই, ২০১২-১৩এ বড় মেসোমশাই আর ছোট
কাকু আর ২০১৪ এ আমার জেঠু। বাকিরা ঠুকঠুক করে ব্যাটিং করছে বটে, কিন্তু ক্রীজে
থাকার ইচ্ছা কারোরই নেই।
জেঠু সেই ১৯৮২ থেকে হাইসুগারের রুগী ছিলেন, ২০০১-০২ এ
পেসমেকার বসাতে হয়েছিল। কি কষ্ট করে যে জেঠাইমা ওনাকে বাচিয়ে রেখেছিলেন, জেঠিমার
জীবনটাই ঘুরত জেঠুকে কেন্দ্র করে। সকাল থেকে জেঠু কখন কি ওষুধ খাবে, কি দিয়ে
প্রাতঃরাশ সারবে, দুপুরে ক-রকম পদ রান্না হবে ( তেতো, ডাল, একটা ভাজা, একটা পোস্ত,
মাছ/মাংস নাকি ডিম, টক দই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার), দুপুরে কি ফল খাবে (সুগার
রুগীর সব ফল চলে না, আবার একই ফল রোজ দিলে জেঠু খেতে চাইবে না), রাতে কি খাবে সব
ছকা থাকত জ্যাঠাইমার। এ ছাড়া ছিল চা, কত বার যে চা খেত আমার জ্যাঠামশাই তার ইয়ত্তা
নেই। এত যত্নের পরেও জেঠুর কোষ্ঠ পরিষ্কার হল কিনা এটা ছিল জ্যাঠাইমার সবথেকে বড়
উদ্বেগের কারণ। সব কাজ স্বহস্তে করত, এমনকি বাজার –দোকান, বিল দেওয়া পর্যন্ত। সেই
জেঠিমা, জেঠুর মৃত্যুর পর কেমন যেন জবুথবু হয়ে পড়ল। জ্যাঠাইমার শরীরেও যে এত রকম
রোগ বাসা বেঁধেছে জানতই না কেউ। সব দুধ টুকু ছানা কাটিয়ে জেঠুকে খাইয়ে, চিরদিন
দেখতাম জ্যাঠাইমা চামচ দিয়ে বাটি চেঁচে সর টুকু খাচ্ছে, তাও আমাদের দেখতে পেলে হাঁ
করিয়ে মুখে ঢুকিয়ে দিত। আর আজ ডাক্তার বলছে, ক্যালসিয়ামের অভাবে সব হাড় ক্ষয়ে গেছে,
যে কোন মুহূর্তে দেশলাই কাঠির মত ভেঙে পড়তে পারে।
একই রকম ভালোবাসা দেখেছিলাম বড় মাসি আর মেসোমশাইয়ের
মধ্যে। মেসোমশাইয়ের পারকিনসন্স আর অ্যালজাইমারস দুটো মারণ ব্যাধিই ছিল। ভুলে যেতেন
সবকিছুই, রাতবিরেতে প্রকৃতির আহ্বানে উঠে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াতেন। বাথরুম
খুঁজে পেতেন না, নাই নিজের শোবার ঘর। দাদারা বাড়ির দেওয়ালে, বাথরুমের দরজায় কাগজ
মেরে রাখত, তাও পারতেন না। সেই উদ্বেগে রাতে বড় মাসির ঘুম আসত না। আর দিনের বেলায়ও
ওনাকে চোখের আড়াল করা যেত না, পলকের মধ্যেই দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে যেতেন।
দীর্ঘদিনের পরিচিত মানুষটা হঠাৎ হয়ে উঠেছিলেন একান্ত অপরিচিত এক ব্যক্তি। নিজের
সমস্ত শক্তি-সামর্থ্য-সাধ্য নিকড়ে দিয়েও ওনাকে বাঁচানো গেল না। মেসোমশাইয়ের
মরদেহের পায়ের কাছে বসে সেদিন সম্মিলিত উচ্চ শোকের মাঝে গুনগুণ করে বড় মাসি একটা
কথাই বলছিল মা আর মাসিদের, “আমি কি করব? কাল থেকে আমি কি নিয়ে থাকব? আমার তো আর
কোন কাজ রইল না বল?”
আজ মহালয়ার পুণ্যপ্রভাতে কেন যে এদের জন্য এত মনখারাপ
লাগছে? না যারা চলে গেছেন তাদের জন্য নয়, বরং যারা রয়ে গিয়ে প্রতিনিয়ত নিজের
মৃত্যুকামনা করছেন তাদের জন্য। এই মনখুশি সোনালি রোদ, চকচকে নীল আকাশ আর মায়ের
আগমনী তাদের জীবনকেও উজ্জ্বল করে তুলুক। উৎসবের আনন্দে ঝলমলিয়ে উঠুক সকলের জীবন।
ভালোলাগা আর ভালোবাসার রেশ ছড়িয়ে পড়ুক ঘরের এবং মনের প্রতিটি কোনে, যেখানে অন্য
সময় হয়তো সূর্যেরও প্রবেশ নিষেধ।
(চলবে গোটা পুজো জুড়ে, আশা করি)
No comments:
Post a Comment