ঠিক তুত্তুরীর মতই ছোট থেকেই বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়। স্কুলের দিন গুলোতে ঘন কালো আকাশ, গুরুগুরু মেঘের গর্জন, ঝমঝমে বৃষ্টি, রাস্তায় জমে থাকা হাঁটু জল ছিল পুরো স্বর্গীয় ব্যাপার। কেন জানি না আমাদের ছোট বেলায় আমাদের মধ্য হাওড়ায় জল প্রায় জমতই না। যত টুকু জমত তাতেই ব্যাঙের মত থপাস থপাস করে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরতাম। বড় হবার সাথে সাথে নোংরা জমা জলের প্রতি মোহটা ক্রমশঃ কাটতে লাগল, পরিবর্তে অন্য একটা ব্যাপারে চুম্বকীয় আকর্ষণ তৈরি হল, সেটা হল একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, যখনই বৃষ্টি পড়ত, মনে পড়ত, “এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।” আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, জীবনে কখনও না কখনও, কেউ না কেউ, কোন না কোন বর্ষার দিনে এই কথা গুলো অবশ্যই বলবে। সদ্য শৈশব কাটিয়ে তারুণ্যে পড়েছি, শরৎ চন্দ্রকে হঠিয়ে বুদ্ধদেব গুহ তখন আমার প্রিয়তম লেখক হয়ে উঠেছেন। কি যে পাগলের মত, ওনার সৃষ্ট ন্যাকা ন্যাকা, ওপর চালিয়াৎ, সফিস্টিকেটেড পুরুষ চরিত্রদের প্রেমে পড়তাম। উফ আজো মনে আছে, “অভি”, “শুভ্র” আর “পলু” এই তিন নায়ককে আমি দোলা আর সংযুক্তা আপসে ভাগ করে নিয়েছিলাম। আমার ভাগে কে পড়েছিল সেটা আর বলছি না।
যাই হোক, দেখতে দেখতে নব্বই এর দশক শেষ হয়ে এক বিংশ শতাব্দী এসে গেল, খুব দ্রুত বদলে যেতে লাগল সবকিছু। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে তীব্র জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হল, দোলা আর সংযুক্তা কোথায় ছিটকে গেল, বুদ্ধদেব গুহর হাত ছাড়িয়ে শিডনি শেল্ডন হয়ে ড্যান ব্রাউনের হাত ধরলাম, রবার্ট ল্যাংডনের প্রেমেও কিছুকাল হাবুডুবু খেলাম, কিন্তু কেউ কোন দিন, কোন বর্ষায় বলল না, “এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।” তীব্র রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা, বাড়ির লোকও হঠাৎ করেই ভীষণ উদার হয়ে গেল, মুঠোর মধ্যে মুঠো ফোন ও এসে গেল, এবার তো বল? কেউ তো বল? শৌভিকের সাথে আলাপ, বন্ধুত্ব, ঘনিষ্টতা পর্ব পেরিয়ে দু-দুবার বিয়েও হয়ে গেল (ধর্ম সাক্ষী এবং অগ্নি সাক্ষী) কিন্তু কেউ বলল না। বিয়ের পর প্রথম বর্ষা, মাদপুরের নির্জন কোয়ার্টারে, কিন্তু বৃষ্টি শুরু হলেই শৌভিক কাঁদতে বসত, “এঃ আই হেট রেন।” এটাই ছিল আমার বরের বাঁধা গৎ। কারণ হল, বৃষ্টি মানেই বিডিও র কাছে বন্যার আগমনী, আর বন্যা মানেই আপদকালীন পরিস্থিতি, ত্রান, চিঁড়ে, গুড়, কাপড়, ধুতি, চাল, গামছা (জানি না এটা দেয় কিনা?) ত্রিপল বিতরণ। তাই নিয়ে রাজনৈতিক দল গুলির মন কষাকষি, ঝগড়া ঝাঁটি, ডি এম, এসডিও, রাস্তা অবরোধ ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই অমন দিনে সে আমাকে এক কলি গান শোনাবে, এ প্রত্যাশা নেহাত বাতুলতা মাত্র ছিল।
বিয়ের পর দ্বিতীয় বর্ষায় তুত্তুরীর জন্ম। সে বর্ষায় মাতৃত্বকালীন অবকাশ যাপন কালে ঠিক করলাম, ঢের হয়েছে। আর কেউ বলবে না, ““এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।” কুছ পরোয়া নেই, কুয়ো মহম্মদের কাছে না এলে কি হবে? মহম্মদই কুয়োর কাছে যাবে। আমায় কেউ নাই বলুক আমিই বলব। কিন্তু কাকে? চোখ বন্ধ করলে প্রথমেই যার মুখ মনে ভেসে আসে, তাকে ফোন করতেই, সে নাকে কাঁদতে লাগল, “ এঃ আবার বৃষ্টি হচ্ছে। আজ বৃষ্টি না বন্ধ হলে---। এঃ আই হেট রেন।”
আরও বছর তিনেক কেটে গেছে, আমি এএলসি হিসেবে ট্রান্সপোর্ট বোর্ডে জয়েন করে গেছি, শৌভিকও বিডিও মগরাহাট ওয়ান হিসেবে বছর খানেক কাটিয়ে ফেলেছে। আমরা আলাদাই থাকতাম, আমি মেয়ে নিয়ে মা-বাবার কাছে, আর ও উস্থিতে বিডিও কোয়ার্টারে। এটা ভালো ব্লক, এখানে বন্যা বন্যা হত না। যাই হোক একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি, আকাশ অন্ধকার, চার্চ লেন, কিরণশঙ্কর রায় রোড সব জল থৈথৈ। প্রবল বর্ষণে স্ট্রান্ড রোড স্তব্ধ, অবরুদ্ধ।চারপাশে অফিস ফেরতা লোকজনের চিৎকার, গাড়ি, ট্যাক্সির হর্ন, ধাক্কাধাক্কি সব ছাপিয়ে মনে হল, আজই সেই দিন, আজ বলতেই হবে। ফোন করলাম, ওদিক থেকে উত্তর এল, “একটু পরে করছি অ্যাঁ? এখন দোকান ভাঙছি?” এবার আমার অ্যাঁ বলার পালা। শৌভিক উত্তেজিত হয়ে হড়বড় করে বলল, “ আরে এখানে একটা খাল আছে, সেই খাল সব জবরদখল করে দোকান বানিয়ে ফেলেছে। ফলে আর জল যেতে পারছে না। শিরাকোল সংলগ্ন সমস্ত অঞ্চল কয়েক দিন ধরেই জলমগ্ন হয়ে আছে। আর আজকের বৃষ্টির পর তো হাল আরো খারাপ। এঃ আই হেট রেন।”
ফোনটা কেটে দেবার পর মনে হল, বলতেই হবে কথা গুলো, কিন্তু কাকে? এমন কাউকে যে এই কথা গুলোর যথার্থ মূল্য দিতে পারবে। দ্বিতীয়বার চোখ বন্ধ করতেই যার মুখ ভেসে এল সে আমার সহপাঠী দেবারতি। দেবাকে আড়ালে এবং প্রকাশ্যে আমরা খেপাতাম, রবি ঠাকুর ওরফে দাড়ি বুড়ো ওর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে। দাড়ি বুড়োর যত কবিতা, যত গান দেবা জানে বা জানত তখন আমার চেনা পরিচিত কেউ জানত না। দেবাকেই ফোন করলাম, ও তখন রাজাবাজার সায়ন্স কলেজের মাইক্রোবায়লজি সেকশনের ল্যাবে সাংঘাতিক কিছু নিয়ে রিসার্চ করছে, যা আমার জ্ঞানবুদ্ধির বাইরে। দেবা ধরল, “ হ্যাঁ অনি বল।” ইতস্তস্ত করে বললাম, “দেবা, তোকে একটা কথা বলতে চাই। প্লিজ কিছু মনে করিস না, বাঁ আমায় পাগল ভাবিস না।” “উফ। অনি ভ্যান্তারা না করে বলে ফেল? কি বলবি?” বললাম, “ আমার আজন্ম শখ এমন কোন বর্ষার দিনে কেউ আমায় বলবে, ‘এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।’ আমায় তো কেউ বলল না, তাই আমি তোকে বললাম এই কথা গুলো। জানি এমন দিনে এর সঠিক মুল্য কেবল তুই দিতে পারবি।” দেবাকে এত বিগলিত হতে কখনও দেখিনি।
বলার ছিল, বলে দিলাম, কিন্তু মন ভরল কই? বিচ্ছিরি ঘেঁটে যাওয়া মুড নিয়ে বাসে চাপলাম, যানজটের জন্য বাসের যা গতি, তা শম্বুককেও লজ্জা দেবে, প্রায় পঞ্চাশ মিনিট কেটে গেল, অথচ বাস নিউসেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং এর সামনে থেকে নড়ে নড়ে বড় বাজার পৌঁছতে পারল না। বৃষ্টির জন্য জানলাও বন্ধ করে দিতে হয়েছে, তেঁতো মুখে বসে আছি, শৌভিকের ফোন, ধরতেই বিগলিত গলায় বলল, “ ইয়েস? ইউ ওয়ার সেইং?” নিমপাতা চিবানো স্বরে বললাম, “ছাড় না। তোর শোনার সময় নেই, যখন আমি অন্য কাউকে বলে দিয়েছি।” শৌভিক জিজ্ঞেসও করল না, কি কথা, উল্টে বকবক করতে লাগল, “ উফ যা গেল না আজকের দিনটা। ফুল অন মস্তানি। সোজা কন্ট্রাক্টরকে বললাম, বুলডোজার নিয়ে আয় আর ভেঙে দে সব। সেই সকাল থেকে চলছে ভাঙাভাঙি। সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছি এখানে। হ্যাঃ। কতজন এসে বলে গেল, স্যার আপনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভাঙলেন তাই-।” নিরাসক্ত ভাবে বললাম, “বাঃ।” শৌভিক পাত্তাও দিল না, “না ভাঙলে এখানেও বন্যা পরিস্থিতি হত। যাকগে তা কি বললি? বলেই যখন দিয়েছিস, আর একবার বলতে বাধা কি?” পাশের ভদ্রমহিলার বিকট হাই তোলা দেখতে দেখতে রিডিং পড়ার মত বললাম, “এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।” শৌভিক শুনে হেঁহেঁ করে হাসল, এই হাসিটা ও শুধু আমার আর তুত্তুরীর সামনেই হাসে, আমি ফোনের এপাশ থেকেও অনুভব করলাম। তারপর বলল, “ হ্যাঁ তো। যাক আমি যাই, আবার গিয়ে দেখি ভাঙচুর কতটা এগোল। তুই সাবধানে বাড়ি যা, বুজুর (তুত্তুরী) কাছে। রাতে ফোন করব।” আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, “কাকে বলেছি সেটা জানতে চাইবি না?” ও হেসে বলল, “আমি জানি। বুড়োর দাড়ি চিবানোর লোক তোর একটাই। এখন ছাড়ি? রাতে শুনব দেবারতি কি বলল।”
https://amianindita.blogspot.in/
No comments:
Post a Comment