এই তো গতকালই এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল, “ আপেক্ষিক আবর্জনা” অর্থাৎ ভার্চুয়াল ট্রাশ নিয়ে, আমার বন্ধুটি তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিল। না সেই অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ বন্ধু না, ইনি রীতিমত সুন্দরী তরুণী । সোসাল মিডিয়া কাঁপানোর এই তো বয়স। কিন্তু আনন বই এ কোন এক সহকর্মীর অকারণ পিঠ চুলকনিতে আমার প্রিয় বন্ধুটি যৎপরনায় ক্ষুব্ধ । বন্ধুর ক্ষোভ প্রশমন করতে আমি নিজে ঐ স্টাটাস আপডেটটি পড়ে দেখলাম। বেশ গদগদে আবেগসিক্ত। আপাতদৃষ্টিতে উচ্চ প্রশংসাসূচক মনে হলেও অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য যে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাঁধানো তা আমার মত স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মহিলার পক্ষেও অনুমান করা দুষ্কর নয়।
মুস্কিল কি জানেন এই সোশাল মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে ব্যক্তিগত বলে আর কিছু রইল না। আজকাল বাস্তবিকই সকলের তরে সকলে আমরা। আমরা সবাই সেলিব্রীটি। আপনার অম্বল, গ্যাস, খোস পাঁচড়া, চুলকনি, উকুন সবই পাবলিক মায় ফ্রেন্ডস্ তো বটেই। যা ইচ্ছা লিখুন , গোটা দুই লাইক আর গোটা পাঁচেক কমেন্ট তো পাবেনই। পৃথিবীর তাবড় সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবেন আপনি এখানে । ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য কিন্তু । বোকা বোকা সহজ সরল স্টেটাস গুলি পড়তে মন্দ লাগে না। অন্তত তারা নিজেদের হৃদয়ের বদ্ধ দ্বার তো নিঃসঙ্কোচে উন্মোচন করছে। নির্বোধ হওয়াটা আদপে দোষের না।
এই ধরনের পোস্টগুলি আদৌ ট্র্যাশের পর্যায়ভুক্ত না। আপেক্ষিক আবর্জনাতুল্য স্টাটাস আপডেট গুলি দেখলে আগে আমার রাগ হত। আজকাল করুণা হয়। আমার বর্তমান শখ হচ্ছে এই ধরনের পোস্টের নিচে যে কমেন্টগুলি থাকে সেইগুলি পড়া। ব্যাপক রসের খোরাক। জনমানস বুঝতে হলে এর থেকে উন্নীত মাধ্যম আপনি পাবেন না। আজ সকালে এইরূপ একটি কবিতা আমার চিত্তহরণ করেছে। বিষয়বস্তু কুখ্যাত মাতৃভূমি এক্সপ্রেস। সারমর্ম হল, “ “যখনি নারী বিপদে পড়েছে, পাশে থেকেছি আমরা তাও তারা দিল না, ট্রেনের দুটি কামরা” ” ইত্যাদি । নিতান্তই বালখিল্যচিত । কবিতা বলে সম্বোধন করলে কবিতা ক্ষুণ্ণ হবে।
মোদ্দা কথা হল, হে নারীকুল, কি অসম্ভব আত্মকেন্দ্রিক তোমরা। মনে তো নয়, মামুলী ট্রেনে একটু স্থান চেয়েছিলাম, তাও দিলে না? অথচ আমরা তো তোমাদের সব বিপদে আপদে পাশে থাকি, তাও পারলে না এটুকু কষ্টস্বীকার করতে। এতো বড় অনাচার। সত্যি পড়ে আমার হৃদয় ভেঙে গেল। নীচে জনৈক ভদ্রলোক মন্তব্য করেছেন, “চূড়ান্ত অপারচুনিস্ট”। অপারচুনিস্ট অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুবিধাভোগী। নারীদের জন্য সংরক্ষিত একটি গোটা ট্রেন। হজম করতে কি কষ্টটাই না হচ্ছে তথাকথিত প্রগতিশীল বাঙালিদের। কিছুদিন পূর্বে আর একটি অনুরূপ পোস্ট দেখেছিলাম, সেক্ষেত্রে একটি সদ্য চাকরি পাওয়া যুবক লেডিজ স্পেশালে চড়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, প্রথম দিন অফিস যাবার তাড়ায় ভুল করে ঐ ট্রেনে উঠে পড়ে ছেলেটি। যথারীতি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এবং নগদ ৫০০ টাকা ঘুষ দিয়ে ছাড়া পায়। পুলিশ যখন পাকড়াও করে নিয়ে যাচ্ছিল তখন ট্রেনে সওয়ার মহিলারা নানা কটু মন্তব্য শুনে ছেলেটির সাথে সাথে পাঠকও কেঁদে ভাসায়। পরিশেষে ছেলেটি প্রশ্ন করে যে এরা কি ভদ্র বাড়ির মেয়ে?
আচ্ছা ভদ্র বাড়ির মেয়ে বলতে ঠিক কী বলতে চেয়েছে, যারা লাল বাতি মহল্লায় থাকেন না? নাকি যে সব পরিবারে বেশ কয়েক পুরুষ ধরে বাগদেবীর আরাধনা হয়ে আসছে সেই সব বাড়ির মেয়ে? দ্বিতীয়টিই হবে আশা করি। তাই যদি হয়, তবে এই সব বাড়ির মেয়েরা কেমন হয়? শান্ত, সংযত, লাজুক পড়ে মার খাওয়া টিপিক্যাল অফিস যাত্রী, শিক্ষিকা বা কলেজে পড়া অবলা। ঠিক যেমন কামদুনির মেয়েটি ছিল? কিন্তু এরা কারা? এরা যেমন মার খায়, তেমনি সুযোগ পেলে মারতেও ছাড়ে না!! “ভদ্র বাড়ির মেয়ে” সংজ্ঞাটাই যেন পাল্টে দিয়েছে এই একটি ট্রেন।
ঐ দেখুন, কথা হচ্ছিল ভারচুয়াল ট্রাশ নিয়ে, আমি আবার মাতৃভূমে ঢুকে পড়লাম। আসলে ঐ অসম সাহসী বীরাঙ্গনা গুলিকে ভোলা বেশ দুষ্কর । ছাপোষা লোকজন, কোথা থেকে এত সাহস পেল যে খালি হাতেই অপেক্ষাকৃত শক্তিধর শত্রুপক্ষের সাথে লড়ে গেল?
যাই হোক শেষ করার পূর্বে একটি অন্তিম আবর্জনার কথা বলি, জনৈক মধ্যবয়সী প্রৌঢ় লিখেছিলেন এবং আমার কোন বন্ধু শেয়ার করেন, পোস্টটি ছিল সেকালের মায়ের সাথে হাল আমলের মায়েদের তুলনা বিষয়ক। বিষয়টি দেখেই আমি ভির্মি খাই। দেখুন মশাই আজকের কাগজে যে মহীয়সী মায়ের খবর তারিয়ে তারিয়ে পড়েছেন, তিনি ব্যতিক্রম ।তাঁর কথা বাদ দিন কিন্তু আপনি কি সত্যি মনে করেন হাল আমলের ফ্যাশানদুরস্ত স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারি কর্মরতা মায়েদের মাতৃস্নেহ সাবেকী গৃহবধু মায়েদের থেকে কম? ভদ্রলোক লিখেছেন সে যুগের মায়েরা নিজের খাবার প্রয়োজনে সন্তানদের খাইয়ে নিজেরা অভুক্ত থেকে পরম আহ্লাদিত হতেন। যা এযুগের মায়েদের থেকে অপ্রত্যাশিত । পড়ে বুঝতে পারছিলাম না হাসব না গালি দেব। আসল কথা হল বুদ্ধিমতী কর্মরতা মায়েদের দশভূজা রূপটি ওণার কাছে ঠিক গ্রহণযোগ্য নয়। নারী অবলা, অসূর্যস্পর্শা, গৃহকর্মনিপুনা হওয়াটাই কাম্য। নারীর জীবন হবে রাঁধার পর খাওয়া আর খাওয়ার পর রাঁধা । স্বভাবে হবে স্বামীর উচ্ছিষ্ট ভোজী। চটরপটর চটি পরে ফটরফটর ইংরাজী বলা মেয়েরা মা হবার যোগ্যই না।
যাক গে। বাবা বলে বিচারর আপনা আপনা। তবু লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। ভাবলাম আমার মত আরো কোন না কোন আধুনিকা মায়ের নিশ্চয় গায়ে লাগবে। কেউ না কেউ তো প্রতিবাদ করবেনই। দেখলাম অগুনতি লোক তাদের সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন এবং প্রায় সকলেই ভদ্রলোককে সাধুবাদ জানিয়েছেন এরকম একখানি যুগান্তকারী স্টেটাস লেখার জন্য। কে জানে আমি কোন ফরিস্তার প্রত্যাশী ছিলাম?
#Anirdiary #aninditasblog
No comments:
Post a Comment