Sunday, 8 January 2023

অনির ডাইরি ৭ই জানুয়ারি, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 



পাঁচ ঘন্টা দশ মিনিটের টানা মিটিং, মিটিং চলাকালীন যতবার কোন পক্ষ বলছে, ‘আর পারছি না ম্যাডাম, মাথা ভোঁ ভোঁ করছে-। ’ ততোবার একটাই বুলি আউড়ে যাচ্ছি, আমি পারছি কি করে? আপনাদের তিনচার গুণ দূরত্ব সফর করে এসেছি, আবার এতটাই পথ পেরিয়ে বাড়ি ফিরব। শুধু কি তাই, বাড়ি ফিরে মেয়েটাকে আবার পড়তেও বসাতে হবে। 


তমলুকে অন্তত বিজ্ঞান বিভাগটা পড়ানোর জন্য একজন দিদিমণি ছিলেন, এখানে তো তাও নেই। সেশন শেষ হতে আর খুব জোর বাকি এক মাস, কোন দিদিমণি/মাস্টারমশাই এমন সময়ে আমার গুণধরের দায়িত্ব নেবে মশাই? অগত্যা,  বাংলা, হিন্দি, দুটো ইংরেজি(ভাষা এবং সাহিত্য), অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন,জীববিজ্ঞান,কম্পুটার বিজ্ঞান মায় নাগরিক বিজ্ঞান পর্যন্ত সবাই সদলবলে আমার ঘাড়ে চেপেছেন। সে যে কি চাপ- 


শৌভিকের ভাগে ছিল ইংরেজি সাহিত্য। কিন্তু কাঁথির এমন চাপ সে বেচারা সত্যিই মাথা তুলতে পারে না আজকাল। তাই আমিই পড়িয়ে দিই, বুঝিয়ে দিই। প্রশ্নোত্তর লেখে তুত্তুরী স্বয়ং, চেক অবশ্য শৌভিক করে দেয়। দরকারে টুকটাক লিখেও দেয়। মুস্কিল হয় আমার। এত গুলো বিষয় পড়ানো,লিখতে দেওয়া এবং সেই হোমওয়ার্ক চেক করার জন্য যে সময় এবং অধ্যাবসায় প্রয়োজন,তার কোনটাই আমার নেই। প্রায় দিনই পড়াতে বসে মনে হয়, ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি। 


তাও যদি ছাত্রী একটু পদের হত। পড়তে বসতে কারো যে এত অনীহা থাকতে পারে,মাইরি বলছি তা বাপের জন্মেও দেখিনি। বই নিয়ে আয় বললে তিনি কুঁতিয়েকাতিয়ে শুধু বইটাই নিয়ে এসে হাজির হন। খাতা নিয়ে আসতে বললে, পেন আনেন না। পেন আসে তো পেন্সিল আসে না। জ্যামিতি করাতে বসে দেখি সব পেন্সিলের শিস্  ভাঙা। সারা বাড়ি তোলপাড় করেও জোটে না, পেন্সিল বাড়ার কল। হোমওয়ার্কের পাতায় কি ভাবে যেন জল এমনকি দুধও উল্টে পড়ে মুছে যায় অনেককিছু। সবার ওপর তাঁর নিরন্তর বিড়বিড় করে যাওয়া। কি যে বলেন বুঝি না বটে, তবে গ্রহান্তরের কোন ভাষায় যে অধমের মুণ্ডপাত চলছে তা বেশ বুঝতে পারি। 


তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলেই তাঁর মুখ শুকিয়ে যায়। তখন তিনি দৌড়ে হোমওয়ার্ক করতে বসেন। রাত বাড়লে টোটো পাবার সমস্যা হয় বলে,ফোন করলে বাসস্ট্যান্ডে গাড়িটা পাঠিয়ে দেয় শৌভিক। সামান্য সুবিধা হয়, পাঁচ সাত মিনিটে বাড়ি পৌঁছে যাই আর কি- । তাতেও তার ঘোরতর আপত্তি। বাপকে জপান, ‘গাড়ি পাঠিও না বাবা। এলেই তো- ’ 


এতদিন বাপ একাই হাড় জ্বালাত, এখনও কন্যাও সেই দলে ভিড়েছে। এমনকি আদর করতে গেলেও তিনি আজকাল সন্ধিগ্ধ স্বরে প্রশ্ন করেন,‘ পড়তে বসতে বলবে নাকি?’ আমার বাপের নাম হিটলার হতে পারে, আমার তো নয়। মেয়ের মন পাবার জন্য হরেক রকম কসরৎ করি। হাত ধরে বাগানে হাঁটতে বেরোই দুজনে, জানতে চাই, কোন খেলা খেলবে কি না। শ্রীমতী তুত্তুরীর অন্যতম প্রিয় খেলা অ্যটলাস। অনেকটা অন্তক্ষরীর মত। শুধু শেষ বর্ণটা দিয়ে কোন গান গাইতে হয় না। বলতে হয় কোন দেশ বা জায়গার নাম। প্রায়ই খেলি আমরা এবং শ্রীমতী তুত্তুরী গোহারান হেরে যান। আরে ভাই আমি হলাম সাবেকী বাংলা মিডিয়াম। সবকিছুই এমন ঘাড় ধরে পড়ানো হত আমাদের, তারপাশে সিবিএসসি, আইসিএসসির ছেলেমেয়েরা না সেদিন দাঁড়াতে পারত না আজ পারে। 


আমাকে হারানোর উদগ্র বাসনায় অ্যটলাস বই খুলে রীতিমত দেশের নাম মুখস্থ করে রাখে তুত্তুরী। খুব একটা হেরফের হয় না ফলাফল। তারাসুন্দরী জিন্দাবাদ! রাত বাড়ে, কুয়াশা নামে। বাগানের নিম গাছের ডালের আড়াল থেকে মুখ বার করে শশধর। সজনে ডাঁটার গাছের কোটর থেকে হু হু করে চিৎকার করে ওঠে পেঁচাটা। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে  সারাদিনের ক্লান্তি। বিছানা, বালিশ আর গোলাপী কম্বলটার জন্য আক্ষরিক অর্থে ‘কাঁন্দে প্রতি অঙ্গ মোর।’     


ঘরে ফিরতে উদগ্র মায়ের হাত চেপে ধরে তুত্তুরী। ‘আর একটু খেলো না মা, প্লিজ।’ মেয়ের দুইচোখের চরম আকুতিকে অগ্রাহ্য করা আমার সাধ্যাতীত।  খেলার ফরম্যাট বদলে দেয় তুত্তুরী, অন্তক্ষরী নয়, প্রশ্নোত্তর পর্ব হবে এবার। একে অপরকে একটা করে অক্ষর দেব আমরা, তাই দিয়ে বলতে হবে দেশের নাম। হাই চেপে বলি, বেশ, তবে কেবল দশ দান খেলব কিন্তু। তারপর ঘুমাতে যাব।


 ‘ এম দিয়ে দুটো দেশের নাম বলো’। প্রথম দান দেয় তুত্তুরী। এ আবার কেমন খেলা? দুটো দেশের নাম কেন বলব? থতমত খায় তুত্তুরী, সামান্য ভেবে বলে,‘আচ্ছা একটাই বলো না হয়।’ ততোক্ষণে অবশ্য মালয়েশিয়া হয়ে মালদ্বীপে পৌঁছে গেছি আমি। এবার আমার প্রশ্ন করার পালা, এস দিই আমি তুত্তুরীকে। দুটো দেশেরই নাম বল ব্যাটা।  সুদান থেকে সৌদি আরব হয়ে অস্ট্রেলিয়া, বুরুন্ডি,ডেনমার্ক, এল সালভাডোর, জাপান, কসোভো হয়ে হন্ডুরাসে পৌঁছাই আমরা। দশ দান যে কখন বিশ পঁচিশ হয়ে গেছে খেয়াল থাকে না কারো। 


পঞ্চাশই হয়ে যেত হয়তো, যদি না মাঝে বেরসিকের মত কিছু দেশের রাজধানীর নাম আমি না ধরতাম। বা কোন মহাদেশে অবস্থিত মার্কা বেরসিক প্রশ্ন না করতাম। শোবার সময় সমাগত। রাত এগারোটার মধ্যে আলো নিভিয়ে না শুয়ে পড়লে পরদিন ভোরে উঠতে কাঁদতে হবে। শুয়ে পড়ি দুজনে যে যার ঘরে, নিভে যায় আলো। তন্দ্রা এসে ঘিরে ধরে, সাথে সাথে ঘিরে ধরেন তিনিও। ‘আর একটু খেলো না মা প্লিজ। কাল তো সেই ভোর বেলায় আমায় স্কুলের গেটে ছেড়ে চলে যাবে, তারপর আবার রাতে দেখা হবে।’ 


সেন্টু দিচ্ছে বুঝতে পারি, তাও গলে যায় মায়ের হৃদয়। ভালো করে কম্বলে জড়িয়ে নিই মেয়েকে। খেলতে পারি, তবে আর দেশ-মহাদেশের খেলা নয়। তারথেকে বরং গল্প বানাই চল। সে আবার কেমন খেলা, সন্ধিগ্ধ হয় তুত্তুরী। এই অছিলায় আবার কিছু পড়াতে চাইছে নাকি মা? হেসে বলি, তুইই শুরু কর বরং। পৃথিবীর যে কোন বিষয় নিয়ে। তোর যা ইচ্ছে, সেই গল্প হবে। 


বেশ খানিকক্ষণ, ‘ আমার কিছু মাথায় আসছে না’ করতে করতে শ্রীমতী তুত্তুরী শেষ পর্যন্ত বলেই বসেন। ‘এক যে ছিল রাজা। রাজার সুন্দরী নারীদের প্রতি অসম্ভব ঝোঁক। সুন্দরী মেয়ে পেলেই তাকে বিয়ে করে ফেলে।’ জানলা দিয়ে ঘুম পালায়। এ কেমন গপ্প রে ভাই। আজব দুশ্চরিত্র রাজামশাই মাইরি। আমার দান না আসা পর্যন্ত মুখ খোলা যাবে না। অন্ধকারে দাড়ি থুড়ি থুতনি চুলকাই। ‘রাজার হাতি শালে হাতি, ঘোড়া শালে ঘোড়া, প্রাসাদ ভর্তি রাণী।’ বলে থেমে যায় তুত্তুরী,‘ এবার তুমি বলো।’ 


মাথার ঝিমন্ত কলকব্জাগুলিকে খোঁচাই আমি, গল্প শুরু হলে তাকে শেষ না করে ছাড়া পাপ। অসমাপ্ত কত গল্প যে হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। সিংহলের রাজকন্যা, চিতোরের রাণীকে স্মরণ করে মুখ খুলি আমি, ‘একদিন সেই রাজার সভায় এসে হাজির হল এক চারণ কবি।’ চারণ কবি ব্যাপারটা বোঝাতে কিছুটা সময় যায়। এগোয় গল্প,‘সেই চারণ কবি এসে বলে, রাজা শুনেছি তুই সৌন্দর্যের পৃজারি। দেশের যাবতীয় সুন্দরী রাজকন্যা তোর ঘরনী। তাই নিয়ে তোর বড় অহংকার। কিন্তু জেনে রাখ, এই সসাগরা ধরিত্রীর সবথেকে সুন্দরী রমণী কিন্তু নেই তোর ঐ হারমে।’ 


চেনা গল্পের গন্ধ পায় তুত্তুরী। নিজের অংশটুকু মক্স করে মনে মনে। কিন্তু এত সহজে দান ছাড়ব নাকি আমি? আমার গল্প এগোয়,‘রাজা জানতে চায়, কে সেই অনিন্দিতা নারী?’ মায়ের নাম শুনে ফিক্ করে হেসে ওঠে তুত্তুরী। তুত্তুরীর বাংলা শব্দভাণ্ডারের সীমিত রূপ নিয়ে ব্যঙ্গ করি আমি। অতঃপর গল্পে ফিরে যাই দোঁহে। ‘চারণ কবি বলে, তারে আমি চোখে দেখিনি। তার অনেক গল্প শুনেছি। সব চারণ কবিরাই তার কথা জানে। তাকে নিয়ে গান বাঁধে। কিন্তু কেউ তাকে দেখতে পায় না। নগরাজ হিমালয়ের কোন গোপন উপত্যকার রাণী তিনি। তিনি সবাইকে দেখতে পান, তাঁর কাছে সবার খবর থাকে। কিন্তু তাঁর খবর কারো কাছে থাকে না। তাকে খুঁজে বার করা দুঃসাধ্য।’ 


ব্যাস গপ্প শেষ। ঘুমাতে যা বলে ঠেলি মেয়েকে। তুত্তুরী নড়ে না। তুত্তুরীর রাজা বেরিয়ে পড়ে সেই পাহাড়ি সুন্দরীর তত্ত্বতালাশে। সঙ্গে যায় লোকলস্কর, হাতিঘোড়া। রাজা একপা যায় আর পথচলতি মানুষজনকে প্রশ্ন করে, ‘কোথায় পাব তারে?’ অবশেষে রাজা একদিন সেই স্বপ্নসুন্দরীর সন্ধান পান।’ কেলেংকারি মাইরি। এবার নির্ঘাত স্বপ্নসু্ন্দরীকে ঘোড়ায় চাপিয়ে বাড়ি ফিরবে রাজা। অতঃপর হারেমের চার দেওয়ালে দম আটকে মরবে আমার হিমালয়ের রাণী।  কিছুতেই রোম্যান্টিক গল্প হতে দেব না আমি। 


মাঝপথে জোরজবরদস্তি গপ্পে ঢুকে পড়ি আমি। ‘এবার আমার পালা। কিন্তু দেখা যায়, এর আগের উনপঞ্চাশ বারের মত, এবারের তথ্যও ভুল। ভেঙে পড়েন রাজামশাই। ফেরৎ পাঠিয়ে দেন যাবতীয় লোকলস্কর, সৈন্যসামন্ত। রাজবেশ ফেলে দিয়ে পরিধান করেন ফকিরের বসন। ছাড়তে পারেন না কেবল তরবারি আর আদরের ঘোড়াটাকে। ঘোড়ায় চেপে পাহাড়ি পথে একাই পরিভ্রমণ করেন রাজা, ঘুরে বেড়ান এই উপজাতি থেকে ঐ উপজাতির রাজ্যে। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য আতিথ্য দেন ছাপোষা গরীর মানুষের। শিকারে সাহায্য করেন গাঁয়ের পুরুষদের। খেলা করেন ছেঁড়া পোশাকের শিশুদের সাথে। গল্প করেন গাঁওবুড়োদের সঙ্গে। তেমনি এক গাঁওবুড়ো একদিন বলে,‘ আশা ছাড়িস না রাজা। তুই তাকে দেখতে পাচ্ছিস না বটে, সে তোকে দেখছে কিন্তু। তোর কাজে, তোর পরিবর্তনে খুব খুশি হচ্ছে সে। দেখবি ঠিক একদিন তোর সামনে এসে হাজির হবে সে।’ 


আর রাজার কষ্ট সইতে পারে না তুত্তুরী। টেনে নেয় গল্পের রাশি। ‘একদিন রাজা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাচ্ছে, এমন সময় ঘনিয়ে এল রাত। সঙ্গে নামল তুষার ঝড়। কোনমতে একটা গুহায় মাথা গুঁজল রাজা। গুহার মুখে আগুন জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে তো পড়ল রাজা, যখন ঘুম ভাঙল, দেখে সে একটা অন্য জায়গায় শুয়ে আছে।’


এই রে আবার রোম্যান্টিক গল্পের দিকে গড়াল তুত্তুরীর গল্পের গরু। রাশ ধরি আমি,‘ চোখে এসে পড়ছে প্রভাতী সূর্যের কিরণ। রাজা নড়তে গিয়ে বুঝতে পারল, পিচমোড়া করে বাঁধা তার হাত পা। ঘাড় ঘুরিয়ে রাজা এদিক তাকায়, ওদিক তাকায়। যতদূর চোখ যায়, শুধু মেয়ে আর মেয়ে। একটাও পুরুষ নেই। মেয়েরা সবাই সশস্ত্র।এমনকি বালিকারাও।  অস্ত্র নিয়েই কেউ রান্না করছে, কেউ সওদা করছে, কেউ পড়াচ্ছে, কেউ অস্ত্র বানাচ্ছে ইত্যাদি প্রভৃতি। একটা গোল পাথরের চাকার ওপর শুয়ে আছে রাজা। সামান্য নড়তেই, দুজন নারী উঠে এল কাজ ছেড়ে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল, তারপর নম্র অথচ ঋজু সুরে বলল,‘ মার্জনা করবেন, এভাবে রাতের আঁধারে আপনাকে তুলে আনার জন্য। আপনার ঘোটক এবং অস্ত্র আমাদের জিম্মায় সযতনে রক্ষিত আছে। আমাদের রাণী আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী।’


রাজা কো রাণী মিল গ্যয়ার আনন্দে খলবল করে তুত্তুরী। আমি বলি, তুই বলবি বাকিটা। ঘাড় নাড়ে তুত্তুরী। তোমারটা দারুণ হচ্ছে। তুমিই বলো। বেশ, গল্প গড়ায়, পাহাড়ি নদীতে অবগাহন করে রাজা। ফল দিয়ে প্রাতরাশ সারে রাজা। দুচারজন গ্রাম্য মহিলার সাথে কুশল বিনিময় করতে যায় রাজা। কিন্তু ব্যর্থ হয়। সবাই সম্মান দেয়, সবাই হাসে, কিন্তু আপন করে নেয় না রাজাকে। অবশষে আসে সেই পরম কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। দুই প্রহরিনীকে অনুসরণ করে রাজা মশাই এসে উপস্থিত হন এক উঁচু ঢিপির সামনে। ঢিপির গায়ে কাটা ধাপ বেয়ে রাজা ওপরে ওঠেন, ওপরের খোলা চত্বরে চলছে পাঠশালা। মন দিয়ে শাস্ত্র শিক্ষা করছে জনা ছয়েক অপরূপা বালিকা। প্রত্যেকের পাশে রাখা তার নিজস্ব অস্ত্র। কারো তরবারি তো কারো তীরধনুক। যিনি পড়াচ্ছেন তিনিও অপরূপা। পক্ককেশ, কপালে মুখে হাল্কা বলিরেখা, মুখমণ্ডলে মাখামাখি পরম প্রশান্তি। যেন স্নেহময়ী পরমেশ্বরী। দেখলে মন শান্ত হয়। 


কিন্তু রাণী কই? ব্যগ্র হয়ে ওঠেন রাজা। দুই প্রহরীর একজন, গিয়ে অভিবাদন জানায় শিক্ষয়ত্রীকে। ফিসফিসিয়ে কিছু বলে।  তিনি মৃদু হেসে ওঠেন। ঝলমলিয়ে ওঠে যেন পাহাড়ি উপত্যকা। ইশারায় ছাত্রীদের বলেন, ভাগ্। তোদের ছুটি। ইশারায় চলে যেতে বলেন, প্রহরীদেরও। এবার তাকান রাজার দিকে, চোখ নামিয়ে বলেন বসতে। এ আদেশ অমান্য করা শিবেরও অসাধ্য। মাটির ঢিপির ওপর বসে পড়েন রাজা। মুখোমুখি ঢিপির ওপর বসেন সেই বয়োজ্যেষ্ঠা নারী। তারপর জলতরঙ্গ আর সেতারের যুগলবন্দির সুরে বলে ওঠেন,‘এবার বলো তো বাপু, কেন আমায় খুঁজছিলে?’ 


তারপর? সাগ্রহে জানতে চায় তুত্তুরী। ‘সেটা তো তুই বলবি। ভাব, ভাব, ভাবা প্রাকটিশ কর। আপাততঃ মধ্যরাত হতে বসেছে, ঘুমিয়ে আমায় ধন্য করো মা।

অনির ডাইরি ৫ই জানুয়ারি, ২০২৩

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা 

তমলুকে জয়েন করে ইস্তক একাধিক বার শোকজ খেয়েছি ওপর থেকে। সবথেকে প্রথম শোকজটা ছিল একদল এসএলওর নালিশের ভিত্তিতে। নালিশখানা প্রত্যক্ষ ভাবে আমার নামে ছিল না যদিও, ছিল আমার চেয়ারের বিরুদ্ধে। তবুও, শোকজ তো রে বাবা- 


যাঁর সইয়ে শোকজ এর মেলটা এসেছিল, তাকেই  ফোন করে চড়াও হলাম,‘ এত বছর চাকরি করে, শেষে আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ? আর তোমরা সেসব বসে বসে শুনছ?’ উনি অসহায় ভাবে বললেন, ‘ তাও তো নালিশের চিঠিটা তোমায় পাঠাইনি। আরো কদর্য ভাষায় লেখা হয়েছে সে চিঠি।’ তাই নাকি? তা কি এমন কদর্য ভাষায় আমার থুড়ি আমার চেয়ারের বদনাম করেছে ব্যাটারা? উনিও পাঠাবেন না, আমিও ছাড়ব না। অনেক ধস্তাধস্তির পর শেষমেষ চিঠিটা যোগাড় করলাম। 


পড়লাম। নাঃ তেমন খারাপ কিছু লাগল না। ওদের কিছু নালিশ ছিল, সেটা তেমন অন্যায্য কিছু না। চেয়ারে বসার পর, সে কথা আমাকে জানিয়েও ছিল মৌখিক ভাবে। কিন্তু সেই ব্যথায় মলম দেওয়ার সাধ্য আমার ছিল না। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে, আমার ওপরমহলে জানিয়েছে আর কি। শোকজের জবাবে সেকথাই লিখলাম। আর মৌখিক ভাবে ব্যাটাদের ডেকে বললাম, বাপুরে একটু সময় দাও। তোমাদের অভিযোগ গুলোকে যদি ভালোবাসায় না বদলাতে পেরেছি, তো আমি টিম চুঁচুড়ার অনিন্দিতা ম্যাডাম নই। 


তারপর, বদলে গেছে ছটা ঋতু। এদিকে বুড়ো রূপনারায়ণ আর ওদিকে বুড়ি কংসাবতীর বুক দিয়ে বয়ে গেছে কতই না বারি ধারা। সেদিনের নালিশওয়ালাদের থেকে আর কোন নালিশের চিঠি যায়নি কলকাতা। বরং আজকাল ওরা এসে বলে যায়, কথায় কথায় যে ,‘ আপনি আছেন তো, আমাদের অভিভাবক।’ বকলে, ধমকালে, ঘর থেকে দূর করে দিলে, মুখ চুন করে চলে যায়, পরের দিন এসে বত্রিশ পাটি দেখিয়ে বলে, ‘আপনি মায়ের মতো, ভালোবাসেন তাই বকেন।’ 


আর উপহার!সে যে কত পাই তার ইয়ত্তা নেই। আজই যেমন পেলাম, প্রণব বাবু আর লাবণীর থেকে। প্রণব বাবু আমাদের কোলাঘাটের এসএলও। তাঁর কন্যা লাবণী। ভদ্রলোক একদিন এসে বলে গিয়েছিলেন বটে,‘ আমার মেয়েটা  আপনাকে দেখতে চায়। একদিন নিয়ে আসব?’ বলেছিলাম হ্যাঁ, কেন আনবেন না। 


আজ সকালে যখন মেয়েটাকে নিয়ে এলেন, তখন তীব্র ব্যস্ততার চোটে সকলের নাভিশ্বাস উঠছে। আড়াইটে থেকে আমাদের বেনিফিট ডিসট্রিবিশন প্রোগ্রাম। হলদিয়ার বড়সাহেব আসবেন, বোর্ডের সিইও স্যার আসবেন। কানাঘুষো চলছে, উপস্থিত থাকবেন নাকি খোদ ডিএম সাহেবও। তাদের খাতির যত্নের সুবন্দোবস্ত করা, রিপোর্ট বানানো, লোকজন যোগাড় করা, ব্যানার, ফ্লেক্স, ডামি চেক, PPO, শংসা পত্র, টিফিন,জল, চা ইত্যাদি প্রভৃতির ধাক্কায় যে যেদিকে পারে দৌড়াচ্ছে। ভুলভাল কাজ এবং কথার জন্য জনৈক ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে উদোম ঝাড়ছি আমি, তারই মধ্যে সকন্যা উপস্থিত প্রণব বাবু। ‘এই যে ম্যাডাম, আমার মেয়ে। সেই যে বলেছিলাম না, ও আপনাকে দেখতে চায়।’ 


একা প্রণব বাবু এলে, সেই মুহূর্তে কপালে সলিড দুঃখ ছিল। কার রাগ যে কার ওপর ঝেড়ে দিতাম। ভাগ্যে মেয়েটা সঙ্গে ছিল। চড়াই থেকে উৎরাইয়ে সুর নামিয়ে বললাম,‘ একটু বাইরে বসুন প্লিজ। ডাকছি।’ তারপর যা হয় আরকি, ব্যস্ততার অভিঘাতে ভুলেই গেলাম। মাঝে প্রণব বাবু এবং জলধরকে ডেকে কি সব নির্দেশও দিলাম আমি। উনিও বললেন না, আমিও বেমালুম ভুলে গেলাম মেয়েটার কথা। বেশ অনেকক্ষণ পর ফাঁকা হয়ে চেম্বার ছেড়ে বেরিয়েছি, দেখি আমার ঘরের সামনের ভিজিটর্স চেয়ারে একদল বেনিফিশিয়ারির মাঝে শুকনো মুখে বসে আছে মেয়েটা। 


তড়িঘড়ি ডেকে পাঠালাম বাপ আর মেয়েকে। মার্জনা চাইলাম নিজের ব্যস্ততা এবং ভুলো মনের জন্য। মেয়েটা একগাল হেসে ব্যাগ থেকে বার করল চারটে অপরূপ সুন্দর গয়নার সেট। সবকটাই কাপড়ের ওপর হাতে আঁকা। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম তুমি এঁকেছ? মেয়েটা সলজ্জ হেসে ঘাড় নাড়ল আর প্রণব বাবু একগাল হেসে বলল,‘ঐ তো করে ম্যাডাম। সারা রাত জেগে।’ বাপরে! শুনলাম মেয়েটি বিএ, এমএ পাশ করে, বিএড ও করে ফেলেছে। বেশ কিছু হাতের কাজের ছবি ও ভিডিও দেখাল। শাড়ি,ব্লাউজে এঁকেছে মেয়েটা, বানিয়েছে ওয়ালহ্যাংগিং। বড়ি দিয়েছে যেন আল্পনা। 

কি যেন ফাইল বগলে ঘরে ঢুকেছিল শুভাশিস, মেয়েটির কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে বলে উঠল,‘তুমি বুটিক খুলেছ? না খুলে থাকলে খুলে ফেল শীঘ্রই। ’ কন্যা গর্বে গর্বিত প্রণব বাবু  বললেন,‘ পাড়ার সব বাচ্ছা স্কুলের হাতের কাজ গুলো ওকে দিয়েই করায়। ’ 


সামনে রাখা চারটে গয়নার মধ্যে একটি সেট তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এটার দাম কত? মেয়ে এবং মেয়ের বাবা হাঁহাঁ করে উঠল। ‘দাম আবার কি ম্যাডাম। এগুলো সব আপনার জন্য এনেছি। উপহার। আপনাকে নিতেই হবে।’ নেব তো অবশ্যই। তাই বলে বিনা মূল্যে কেন? আর এতগুলোই বা কেন? একটা নিই। মেয়েটি নাছোড়বান্দা,‘না ম্যাডাম। বাবার মুখে শুনেছি, আপনি সাজতে ভালোবাসেন,আপনার জন্যই বানিয়ে এনেছি। সব আপনার। মা বলেছে ম্যাডামকে পরিয়ে একটা ছবি তুলে আনবি।’ 


পুরো গলে গেলাম গো। অনলাইনে কেনা কানের ঝুটো দুলটা খুলে তৎক্ষণাৎ পরে ফেললাম মেয়েটার হাতে বানানো গয়না। ভাবলাম উপহার পর্ব সমাপ্ত হল বুঝি। ও হরি! 


ব্যাগ থেকে বেরোল মস্ত বড় ডাব্বা ভর্তি গয়না বড়ি, নিজের হাতে দিয়েছে মেয়েটা। প্রণব বাবু বললেন, ' ওর মাও একটু সাহায্য করিছে বৈকি। ডালটা বেটে দিইছে, ভিডিও তুলে দিইছে।' এটা নিতে কোন ওজর আপত্তি করলাম না। পূর্ব মেদিনীপুরের গয়না বড়ি আমার ভয়ানক প্রিয়। বলতে নেই, তমলুকে আসা অবধি এই বস্তুটা কখনও কিনে খেতে হয়নি। কখনও আশিষ দিয়েছে, তো কখনও অরূপ তো কখনও SDO বাংলোর সিকিউরিটি ছেলেগুলো এনে দিয়েছে কৌটো ভর্তি করে। কারো বউ কারো বা মায়ের হাতে বানানো গয়না বড়ি। কারো মেয়ের হাতের এত নক্সা করা বড়ি আজ অবধি পাইনি। মাথায় ঠেকিয়ে ব্যাগে ঢোকানোর চেষ্টা করছি, বাপ আর মেয়েতে ক্ষণিক চোখে চোখে কি কথা হল, তারপর একরাশ সংকোচ নিয়ে মেয়েটা বলল, " ম্যাডাম রেগে যাবেননি, আপনার জন্য আর একটা জিনিষ আনতেছি।" 


আবার কি? এত মাল নিয়ে বাসে ফিরব কেমন করে? ইতিমধ্যে মেয়েটার ব্যাগ থেকে বেরিয়েছে সোনালী রাংতায় মোড়া একটা মস্ত মণ্ড। প্রণব বাবু বললেন,‘আপনার জন্য ও নিজের হাতে কেক বানিয়ে  আনতেছে ম্যাডাম। এটা আপনাকে নিতেই হবে।’ এমন অমূল্য উপহার কি আদৌ ফেরানো যায়? 


 চেপে চেপে ব্যাগে ঢোকালাম যতটা পারলাম। বড়ির কৌটো উত্তমকুমারকে দিয়ে বললাম,‘ কাল নেবো।  যত্ন করে রেখো। আমার বড়ি ভাঙলে কিন্তু-’। বাক্য সম্পূর্ণ করার পূর্বেই ডাব্বা বগলে কেটে পড়ল উত্তমকুমার। অরূপকে ডেকে বললাম,‘শুধু আমার একার নয়, তিনজনেরই একটা ভালো দেখে ছবি তোলো তো-’। এই ভালোবাসা আর এই মুহূর্ত গুলোর জন্যই তো বেঁচে থাকা। নইলে তো সবটুকুই নেহাৎ চাকরগিরি।

অনির ডাইরি ৩০শে ডিসেম্বর, ২০২২

 

#অনিরডাইরি 

‘হেল্লো শোন না পুপু বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।’ পার্শ্ববর্তিনী তারস্বরে কাকে যেন বললেন। বাসে উঠেই সিট পেয়ে গেছি আজ। দুইজনের সিট। জানলার ধারের অল্প বয়সী ছেলেটি উঠে যাওয়ার পর ভদ্রমহিলা সরে গেছেন জানলার ধারে। পাশের সিটটি দখল করেছি আমি। যদিও ভদ্রমহিলার সেটা খুব একটা পছন্দ হয়েছে বলে মনে হয় না। আমার ডানদিকের তিন সিটের একদম ধারে বসে থাকা বৃদ্ধকে উনি ডেকেছিলেন ওণার পাশের সিটটি অলংকৃত করার জন্য। বৃদ্ধ যাননি। উল্টে হাসি মুখে আমায় বলেছেন,‘তুমি বসে পড়।’ 


রূপসী বাইপাসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, চা জল খেয়ে হুহু করে ছুটছে বাস। ঝড়ের মত সরে সরে যাচ্ছে দুর্মুঠ, দইসাই, মারিশদা, নাচিন্দা, কানাইদীঘি, হেঁড়িয়া, বাজকুল। মহিলা ব্যাগ থেকে প্রচুর ঘেঁটেঘুটে বার করে আনলেন একটা পুঁচকে বোতাম টেপা মুঠো ফোন। শুরু হল খোশগল্প। ভেবেছিলাম আজ বাসে উঠে একটু ঘুমাব। সে আর হবে বলে মনে হয় না। 


পাশের মাসিমার খোশগল্প তো তাও অন্তত কর্ণপটহ বিদারণকারী নয়। গতকাল কি যে সাংঘাতিক একটা সিনেমা চলছিল বাসে, পৌনে দুঘন্টার বাস পথে সাকুল্যে গোটা পঁচিশ ত্রিশ ডায়লগ শুনেছি আমি বাকিটা পুরোটাই ঝাড়পিঠ। লাথি/ঘুঁষির ও যে এমন বজ্রনির্ঘোষ হতে পারে বাপের জন্মে প্রত্যক্ষ করিনি। গোটা সিনেমা জুড়ে নায়ক শুধু কেলিয়েই গেল আর সবাই পড়ে পড়ে মার খেয়েই গেল। ওয়ান ম্যান আর্মি আর কাকে বলে। একাই বিশ/ত্রিশ জনকে কোতল করছে তাও দাঁত খুঁটতে খুঁটতে। এক একটা ঘুঁষি মারছে শত্রু দশ বিশ ফুট উড়ে যাচ্ছে।মার্ভেল কমিকসের হাল্ক কাকাও লজ্জা পাবে ভাই। বাস থেকে যখন নেমেছিলাম রীতিমত মাথা টলছিল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছিল দেশী হাল্কের গুঁতোও। প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল মাথা টনটনানি। ফেরার পথেও নিস্তার মেলেনি, মাথা ব্যথা আরও বাড়াতেই বোধহয়, যে বাসে সওয়ার হয়েছিলাম তাতে গমগম করে চলছিল ঝিনচ্যাক নাচাগানার ভিডিও। উদোম নাচ ছিলেন মিঠুন দা আর গোবিন্দ। 


আজকের বাসেও একটা ভিডিও স্ক্রিন আছে বটে, ঈশ্বরের অশেষ আশির্বাদ যে তিনি এ যাত্রা ঘুমন্ত। ইশ আমিও যদি একটু ঘুমাতে পারতাম! ঘুমাতে না পেরে মাসিমার গল্পে মন দিলাম। বুঝলাম কর্তা গিন্নীতে দীঘায় এসেছিলেন দিন দুয়েকের জন্য। একত্রিশ ডিসেম্বর উপলক্ষে ভিড় বাড়ার আগেই কেটে পড়েছেন মানে মানে। অতঃপর খাওয়াদাওয়া, গ্যাসঅম্বলের গল্প হল খানিক। দীঘায় মাতালদের বাওয়ালের গল্পও হল। ট্রেনে না ফিরে কেন বাসে ফিরছেন সে গল্পও হল বটে। সব শেষে আসল কথা, ‘শোন না পুপু বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।’


আহাঃ এতক্ষণে একটা মনের মত টপিক পেলাম গো। কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম, পুপুর জন্য কি খুঁজছেন মাসিমা ছেলে না মেয়ে। তাতে পুপুর লিঙ্গ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে, আর কিছুই না।মাসিমা বললেন,‘ হ্যাঁ রে, আমরা তো কবে থেকে বলছি, শেষ পর্যন্ত বাবুর মতি ফিরেছে বলতে পারিস। শোন না, ভালো মেয়ে সন্ধানে থাকলে একটু জানাস।’ বুঝলাম পুপু তাহলে ছেলে। মাসিমা নিশ্চয়ই মেয়ের জন্য মেয়ে খুঁজবেন না। এত উদার পাড়ার মাসিমারা বোধহয় এখনও হয়নি। 


মাসিমা এবার কেমন মেয়ে চাই, সেই চরিত্রচিত্রনে নিমগ্ন হলেন। কুমারটুলিতে অর্ডার দিতে হবে নির্ঘাত, ভেবে হাই তুললাম। মাসিমা বললেন,‘ আমাদের পছন্দ অপছন্দ কিছু নেই। পুপুর পছন্দ হলেই হল।দুজনে দুজনকে দেখে বুঝে সিদ্ধান্ত নেবে, ব্যাস।’ এমনি সব গপ্পের চিত্রনাট্যে সাধারণত খুব একটা অদলবদল হয় না। আবার হাই চাপলাম। জনসমক্ষে  হাই  তোলা অভব্যতা, কার যেন লেখায় পড়েছিলাম। সুনীল গাঙ্গুলী কি? নাকি শঙ্কর? 


’অসবর্ণ  হলেও আপত্তি নেই। এমনকি পুপু বলেছে হিন্দু না হলেও কোন সমস্যা নেই। ভালো মুসলমান মেয়ে থাকলেও জানাস।’ চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম আমি। চমকে উঠলাম সহসা। মাসিমা বলে কি? এই বিষে আচ্ছন্ন ধরায় উনি পুত্র বা পুত্রতুল্য কারো জন্য বিবাহযোগ্যা পাত্রী অন্বেষণ করছেন এবং তাও জাত ও ধর্মের ঊর্ধ্বে। অসবর্ণ  বিবাহে আপত্তি নেই তা তো হরদম চোখে পড়ে কিন্তু অস্বধর্মে বিয়ে করতে চায় এ কে ভাই?


নামার সময় হয়ে আসছে। আজও টাইমের গণ্ডগোল করেছি আমি। যত সকাল সকালই বেরোই না কেন, রোজই লেট হয়ে যাচ্ছে। সময়টাকে কিছুতেই মুঠোয় ধরতে পারছি না। পাশের ভদ্রমহিলা ফোন ব্যাগে ভরে চুপচাপ জানলার বাইরে তাকিয়ে আছেন। ইতঃস্তত করে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম,‘কোথায় নামবেন মাসিমা?’স্নেহ মিশ্রিত স্বরে বললেন,‘সাঁতরাগাছি।’ অতঃপর জানতে চাইলেন,‘তুমি কোথায় নামবে মা?’ জানালাম আমি সামনেই নামব। জানতে চাইলাম, ওণারা নেমে ট্রেন ধরবেন নাকি বাস। ভদ্রমহিলা মুখ খোলার আগেই ডান পাশের হাসিমুখ বৃদ্ধ মাঝে ঢুকে পড়ে জানাল,‘সাঁতরাগাছি মানে ঠিক সাঁতরাগাছি নয়, তার থেকে দুটো স্টপেজ পর নামব আমরা।’ জানতে চাইলাম বাকসাড়া না বেলেপোল? ভদ্রমহিলা তাজ্জব হয়ে হাসি মুখে বললেন তুমি চেনো? এবার আমার হাসার পালা,  আমার শহর আর আমি চিনব না!


ভদ্রলোককে ইশারায় আমার সিটটা দখল করতে বলে উঠে পড়লাম। দিন কয়েক আগে এমনি এক শহরবাসীর সাথে গল্প করছিল তুত্তুরী, ছেলেটি এমন সব বিস্ফোরক তথা সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলছিল যে, মাঝপথে শৌভিককে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম আমি,‘সার্ফের জল রেডি রাখিস। বাড়ি গিয়ে মেয়েটার কানে ঢালব। যা ময়লা ঢোকাচ্ছে আমার মেয়ের মাথায়, আক্ষরিক অর্থে ব্রেন ওয়াশ না করে উপায় নেই।’ 


সেদিন বাস্তবিকই মনে হয়েছিল শহরটা পচে গেছে বুঝি, ইউটিউব আর হোয়াটসঅ্যাপর সৌজন্যে পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে সন্দেহ আর বিদ্বেষ। আজ এই ২০২২ এর শেষ কর্মদিবসে এসে মনে হল, নাঃ প্রিয় শহর, একটুও বদলাও নি তুমি। এখনও আশা আছে।

অনির ডাইরি ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২২

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা  #অনিরডাইরি


টিম তাম্রলিপ্তর মুখপাত্র হিসেবে রীতিমত গর্বিত আমি। কি নেই, কে নেই আমার টিমে। ধর্ম নিয়ে আদৌ মাথা না ঘামানো লোকজন আছে, ঘোরতর নাস্তিক আছে, আছেন ধর্মপ্রাণ হিন্দু এবং মুসলমান, devout ক্রিশ্চান আছে, ভারত বর্ষের অন্যতম প্রাচীন ধর্ম যার নাম ‘সারি ধরম’ যেখানে প্রকৃতিই পরম এবং চরম উপাস্য সেই ধর্মের মানুষ আছেন, এমনকি আছে টিকিওয়ালা তিলককাটা বৈষ্ণব ও। মাছ-মাংস-ডিম -পেঁয়াজ-রসুন ছাড়ুন দীক্ষা না নেওয়া মানুষের হাতে অন্ন গ্রহন পর্যন্ত করে না ছেলেটি। একবার দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প দেখে ফেরার পথে প্রবল বিষম খেয়েছিলাম আমি, জুন মাসের বেপোট গরম, ঠিক সেই মুহূর্তে এক ফোঁটাও জল অবশিষ্ট ছিল না আমার বা উত্তমকুমারের বোতলে। ছেলেটা সামনের সিট থেকে চটজলদি নিজের বোতল বার করে ধরেছিল আমার মুখের সামনে। জীবনে প্রথম বার বেজায় ভয় পেয়েছিলাম আমি,‘হ্যাঁ হে তোমার বোতল আমায় দিচ্ছ কেন? আমি তো দূর আমার বাপ-পিতেমহ ও কোনদিন দীক্ষা নেননি আর আমি কি রকম আমিষাশী তো জানোই। তোমার জল ছুঁলে দোষ হবে যে।’ ছেলেটা তাতে রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘আপনি খান  তো।’ 


 এত বিচিত্র ধর্ম এবং বর্ণের সমাহার বলে, ঝোলেঝালে অম্বলে উৎসব লেগেই থাকে এ আপিসে। হোক না দরিদ্র শ্রম দপ্তর। আনন্দ আর উৎসবের আবার কুলীন অকুলীন কি? 


নগর বদল, বাসা পরিবর্তন এবং শ্রীমতী তুত্তুরীর নতুন স্কুলে ভর্তি তথা থিতু হবার জন্য কয়েকদিন ছুটি নিয়েছিলাম। ছুটি কাটিয়ে যখন কাজে ফিরলাম বড়দিনের ছুটি পড়তে বাকি মাত্র দিন চারেক। জনে, জনে আলাদা ভাবে এসে বলে গেল,‘ এদ্দিনে আপিসটা আবার প্রাণ পেল ম্যাডাম।’ কোন এক শ্রমিক সংগঠনের দুই বয়োজ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি তো রীতিমত হুমকি দিয়ে গেল, ‘ স্যার(শৌভিক) গেলেন, গেলেন, আপনাকে আমরা কোথাও যেতে দিচ্ছি না। যত প্রমোশন আছে, সব পান, কিন্তু এখেনেই থাকেন।’ আরেকদল এসে একখানা একটা কাঠের পাল তোলা নৌকা উপহার দিয়ে গেলেন। ‘ অমুক রাজ্যে আমাদের জাতীয় অধিবেশন ছিল, এই ছোট্ট স্মারকটা ওখান থেকে আপনার জন্য কিনে এনিছি।’ 


আমার টিমের পাশাপাশি এদের জন্যও এই উৎসব গুলি করি আমরা। বিশেষ বিশেষ দিনে হাতে সামান্য দুটি টফি ধরিয়ে দিলে বা মণিবন্ধে একটা সস্তা সুতোর রাখি পরিয়ে দিলেও কি যে খুশি হয়ে যান এণারা। খুশি হয় শ্রমিকরাও। অনেকে তো বিশ্বাসই করতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে প্রথম চোটে। ভাবে হয়তো দিয়ে আবার কেড়ে নেব আমরা।  


এতই অল্প পায় আমাদের শ্রমিকরা, তাতেই অভ্যস্থ হয়ে পড়েন। উটকো কিছু পেলেই তাই ভেবলে যান প্রথম চোটে। ভাবতে ভাবতেই মনে হল, এবারের বড়দিনের আগের শেষ কর্মদিবসটা শুক্রবার। ঐদিন এই আপিসে ট্রান্সপোর্টের কাজ হয় বলে সমবেত হন প্রচুর মানুষ। এসএলওরা আসে, আসেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও। ঐদিন যদি সান্টা ক্লজ হো-হো-হো করে এণাদের সকলকে দুটি করে টফি দেন কেমন হয়? বড়দিন  হিসেবে তো আপিস সাজাবই আমরা। গতবছরও সাজিয়ে ছিলাম।  ভাঁড়ার ঘর থেকে ঝেড়ে ঝুড়ে বিগত বছরের ক্রিসমাস ট্রিটা বার করতে লেগেই পড়েছেন জহর বাবু। গতবছর অবশ্য কোন স্যান্টাক্লজ ছিল না। এ বছর তো থাকতেই পারে -


প্রথমে ঠিক হয়েছিল নতুন ইন্সপেক্টর শান্তনু কয়ালকে সান্টা বানানো হবে। তারপর মনে হল এক্কেবারে কচি, যদি দুঃখ পায়। তখনই রঞ্জিতের কথাটা মাথায় এল। ঘর ফাঁকা হতেই ফোন করলাম রঞ্জিতকে। ‘তোমাকে স্যান্টা হতে হবে।’ রঞ্জিতের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটা এখনও কানে,‘ অ্যাঁ? এই রে!’ আসন্ন মাধ্যমিক পরীক্ষা সংক্রান্ত এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ ছিল রঞ্জিত। মিটিং শেষে যখন আপিসে ঢুঁ মারতে এল, দেখলাম ব্যাপারটা নিয়ে বেশ উৎসাহী।


এত বড় স্যান্টার জামাকাপড় পাই কোথায়? তমলুকে পুঁচকে স্যান্টাদের জামাকাপড় বিক্রি হচ্ছিল বটে, সেগুলিরই যা দাম। এত ধেড়ে স্যান্টার জামা কিনতে কিডনি না বেচতে হয় আমাদের। স্যান্টা নিজেই তার সল্যুশন বার করল, ‘একটা লাল জামা পরে নেব ম্যাডাম। আর একটা সাদা বা হাল্কা রঙের প্যান্ট। শুধু দাড়ি আর টুপিটা লাগবে।’ জানতে চাইলাম,লাল জামা তোমার আছে? রঞ্জিতের লাল জামা না থাকলেও দেখা গেল জহর বাবুর একখান লাল পাঞ্জাবি আছে। ওনাকে বলা হল,ওটাকেই কেচে শুকিয়ে নিয়ে আসতে। শুধু টুপি, গোঁফ আর দাড়িটা যোগাড় করতে পারলেই ঝিলিক মারবে আমাদের সান্টা বুড়ো।


যেহেতু যোশুয়ার পরব, তাই আপিস সাজানোর দায়িত্বটাও ওর। সঙ্গতে শান্তনু আর হকবাবু। উফঃ পুরো ভারতের পতাকা মাইরি। মুস্কিল হল, যখন গত বছরের ক্রিশমাস ট্রিটা বার করা হল, দেখা গেল তিনি আর অক্ষতদেহী নন। গরীর আপিসের সস্তার গাছ, একবছরেই তিনি রীতিমত ল্যাংড়াচ্ছেন এবং একটা হাত ভেঙেছেন। বিকল্প হিসেবে ঝাউ গাছের খোঁজ পড়ল। কাছাকাছি কারো বাড়িতে পাওয়া গেল না। একটা নার্সারি দেবে বলল, দাম চাইল পঞ্চাশ টাকা, তাও ভাড়ায়। ছুটির পর খুলে নিয়ে চলে যাবেন ওণারা। যোশুয়া বিরক্ত হয়ে বলল,‘ থাক ম্যাডাম। আমাদেরটা দিব্যি আছে।’ 


ল্যাংড়া ক্রিশমাস ট্রিকে কি ভাবে যেন খাড়া করে ফেলল ওরা, ভাঙা হাতটাও সেট করা হল। সেই হাতে বল, তারা, পুঁচকে স্যান্টা পুতুলও ঝোলানো হল দিব্যি। বাক্সবন্দি দীপাবলীর আলোগুলো নব উদ্দীপনায় জ্বলে উঠল বেথলেহেমের শিশুকে অভর্থ্যনা করার উদ্দেশ্যে। ডিএম আপিসের নকল সিলিং এ ফুটে উঠল নীল সোনালী তারার দল। যোশুয়া বলে বড়দিনের আসল প্রতীক এই তারাদের দল। রাংতার ঝুলঝুলি ঝুলতে লাগল এদিকে-সেদিকে। আমার আর সৌম্যজিতের টেবিলেও ঝুলল ঝিল্লির মালা। সর্বত্র বড়দিন আর বর্ষশেষের সৌরভ। 


সবই হল, সবই পাওয়া গেল, মিলল না কেবল স্যান্টার গোঁফ আর দাড়ি। কি হবে এবার? আমি বললাম, ‘গালে সাদা তুলো চিপকে দাও ব্যাটার’। সৌম্যজিৎ তো আরেক কাঠি সরেস, বলল,‘আর ভুরুতে কোলগেট।’ রঞ্জিতের স্পোর্টিং স্পিরিট তুলনাহীন, রাগ করা তো দূরস্থান। উল্টে সে নিজেও নানা মতামত দিতে লাগল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তেমন কিছু করতে হয়নি। মা বর্গভীমার মন্দিরের কাছের একটা দোকান থেকে মিলল একখান যুৎসই মুখোশ। 


জহর বাবুর লাল পাঞ্জাবি, টুপি আর মুখোশ পরে তৈরি হয়ে গেল আমাদের স্যান্টা। ঝোলা কোথায় পাই, একখান কার্ডবোর্ডের বাক্সেই ঢালা হল ট্রফি। সারাদিন যত অসংগঠিত শ্রমিক এলেন, শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা এল, আমাদের এজেন্ট এসএলরা এল সবার হাতে ধরানো হল দু একখান করে ল্যাবেঞ্চুষ। কতজন যে আমাদের সান্টার সাথে সেলফি তুলল তার ইয়ত্তা নেই। বেচারা রঞ্জিত সারাদিন একবার করে মুখোশ খুলছিল আর একবার করে পরছিল।


 কি সব যেন মিটিং ছিল, কারা যেন লাইফ সার্টিফিকেট সই করাতে এল, কিসের যেন ট্রেনিং হল, বড় সাহেবের রিভিউ মিটিং হল সবেতেই হাসি মুখে হাজির আমাদের স্যান্টা। জীবন বড় ছোট বাবুমশাই, কাল কি হয় কে জানে, সেই চিন্তায় খামোখা আজটাকে নষ্ট করে লাভ কি-।ভালো থাকুক না সবাই। চেতন থেকে অবচেতনে আমরা সবাই বোধহয় সেটাই চাই,তাই না।

Tuesday, 27 December 2022

অনির ডাইরি ২২শে ডিসেম্বর, ২০২২

 

#কাঁথিরকিস্যা 


‘কাল কখন ফিরলেন ম্যাডাম?’ জানতে চাইলেন নূপুর বাবু। সদ্য সদ্য কাঁথির মহকুমা শাসকের সরকারী নিবাসের সীমানা ছেড়ে বেরিয়েছি আমরা।  গন্তব্য দীঘা বাইপাস। 

দীঘা বাইপাস থেকেই বাস ধরব আমি। বেদজ্যোতি তাই বলেছে। বেদজ্যোতি আমার ইন্সপেক্টর,স্থানীয় ছেলে এবং তমলুক- কাঁথি রুটের নিত্যযাত্রী। আপাতত আমার পথপ্রদর্শকও বটে। হতোদ্যম হয়ে পড়লে ওকে দেখে অনুপ্রেরণা পাই।  ও যদি পারে, আমি পারব না কেন?


এতদসত্ত্বেও সকাল থেকে কেন যে গরম হয়ে থাকে মাথা। ভোর বেলাতেই ধমকে দিই মেয়েটাকে সম্পূর্ণ অকারণে। নীরবে, নতমস্তকে মায়ের কটু কথা শুনে, স্কুলের রাস্তা ধরে তুত্তুরী। পলকে শতছিন্ন হয়ে যায় তুত্তুরীর মায়ের হৃদয়। মা হওয়া কি মুখের কথা!


একরাশ মনখারাপ নিয়েই রওণা দিই আপিসের পথে। সঙ্গী বলতে নূপুর বাবু।  গাড়ি চালাতে চালাতে নানা প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক। অনেক মজার মজার কথাও বলেন। যেমন আগের দিনের বাসটা আমায় সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড যাবে বলেও, শেষ পর্যন্ত খড়্গপুর বাইপাসে নামিয়ে দিয়েছে শুনে উনি বললেন,‘ফের যদি এমনি বলে ম্যাডাম, আপনাকে কিছু করতে হবে না, আপনি শুধু বাসের নম্বরটা টুকে নিবেন।’ নম্বর টুকে যে কি করব ভগবান জানে। হাসি চেপে জানলার বাইরে তাকাই আমি। নূপুর বাবু এবার পড়েন, টোটোওয়ালাকে নিয়ে। কেন টোটোওয়ালা আমায় মহকুমা শাসকের করণ অবধি পৌঁছে দেয়নি? ‘লাইসেন্স নিয়েছে আর প্যাসেঞ্জার নিবেনি? বললেই হল? ফের যদি কেউ এমন করে, তাহলে আপনি ম্যাডাম, তাকে আটকে রেখে আমায় ফোন করবেন। আমি ছুট্টে চলে যাব-’।  


ধেড়ে গাড়িটা নিয়ে উনি ছুটে আসবেন আমার হয়ে টোটোওয়ালার সাথে ঝটাপটি করতে,ব্যাপারটা কল্পনা করে হাসি চাপা দায়। মন খারাপ জানলা গলে পালায়।  দূর থেকে দৃশ্যমান হয় দীঘা বাইপাস। চৌমাথায়  হর্ন বাজাচ্ছে একটা বাস। বাসের সামনে গিয়ে দাবাং স্টাইলে গাড়ি দাঁড় করালেন ভদ্রলোক। ‘ম্যাডামকে তুলে লাও তো। নিমতৌড়ি ডিএম আপিসে নাবিয়ে দেবে।’ 


বাসে উঠে গেলাম,বেদজ্যোতির সাথেও দেখা হয়ে গেল। নূপুর বাবু তখনও নীচে দাঁড়িয়ে, ‘তাহলে ম্যাডাম, সব ঠিক আছে তো? আপনি যদি রোজ এক টাইমে বেরোন, তাহলে সেরকম হলে আপনার জন্য একটা সিট বেঁধে রাখতে বলব।’ হাত নেড়ে ইশারায় বলি, এবার যান। রোজ একসময়ে বেরোন আমার অসাধ্য। কোনদিন পাঁচ মিনিট লেট করে ফেলি তো কোনদিন দশ মিনিট আগে হয়ে যায়। লেট হলে বাস পালায়। আর জলদি এলে বাস লেট করে। এযেন এক অলাতচক্র। 


বেদজ্যোতি যদিও আশ্বস্ত করে, ‘বাস অনেক পাবেন ম্যাডাম। একটু দাঁড়িয়ে গেলেই স্টেট বাসও পেয়ে যেতে পারেন। দারুণ আসে বাস গুলো।’ নূপুর বাবু আবার কিছুতেই স্টেট বাসে চাপানোর পক্ষপাতী নন। ‘সব জানলা খোলা, প্রচণ্ড হাওয়া ঢোকে। স্টেট বাস শীতকালে ভালো না। আপনাকে আমি ভালো এসি বাসে তুলে দিব। দেখবেন ভিতরে কেমন ওম পাবেন। উঠে ঘুমিয়ে পড়বেন, ওরা ঠিক ডেকে দেবে। আমি বলে দিব খন।’ 


ঘুমানো অবশ্য অত সহজ নয়। প্রথমদিন যে এসি বাসটিতে উঠেছিলাম, তাতে রমরম করে কি যেম একটা সিনেমা চলছিল। কোন দক্ষিণী ছবির হিন্দি ভাষান্তর। কোনটা নায়ক আর কোনটা যে খলনায়ক বোঝা দায়। কথায় কথায় ধুন্ধুমার। আর না হলে দক্ষিণী নাচগান আর বিটকেল প্রেম। তেমনি সব সংলাপ, যেমন, ‘ভাই রে ভাই,রক্কি ভাই’ বা ‘তু ব্যাড হ্যায়, তো ম্যাঁয় তেরা ড্যাড হ্যায়। সমঝা না!’ বা ‘তু গ্যাংস্টার হ্যায়, তো ম্যায় মনস্টার হ্যায়।’ ইত্যাদি প্রভৃতি। পুরো সিনেমাটাই কেমন যেন ধুলোয় মাখা ধুসর রঙের। দেখব না, দেখব না করেও বেশ খানিকটা দেখেই ফেললাম। পাশ থেকে বেদজ্যোতি বলল, ‘ম্যাডাম এই বাসে রোজ এই সিনেমাটাই চলে।কালও দেখতে পাবেন। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন।’ 


সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ভালো করে ওড়না মুড়ি দিয়ে। ঘন্টা দেড়েক পর যখন ঘুম ভাঙল, বাস কোলাঘাট ব্রীজ পেরোচ্ছে। কি সর্বনাশ! আমরা তো পূব মেদিনীপুরের সীমানা ছাড়িয়ে হাওড়া জেলায় ঢুকে পড়ব গো। কেউ ডাকেও নি। টিকিটও তো কাটেনি।  কি জ্বালা।  


এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি বেদজ্যোতিও ঘুমাচ্ছে। ঠেলে তুললাম ব্যাটাকে। দেউলটিতে নামতে হবে। তারপর উত্তমকুমারকে ডেকে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। ঘুম চোখে জানলার বাইরে খানিক তাকিয়ে থেকে জড়ানো গলায় বেদজ্যোতি বলল,‘ম্যাডাম, এটা তো নরঘাট ব্রীজ। নীচে রূপনারায়ণ নয়, হলদি নদী। এখনও নন্দকুমারই আসেনি। আর একটু ঘুমিয়ে নিন।’ 


বারোটা থেকে মিটিং ডেকেছিলাম। আপিসে ঢুকে দেখি, ১১টা থেকেই লোকজন এসে বসে আছে। কটা দিন ছুটি নিয়েছিলাম নতুন করে সংসার গোছানো আর তুত্তুরীকে নতুন স্কুলে থিতু করানোর জন্য, পালিয়ে তো যাই নি। যাবার আগে ম্যারাথন মিটিং করে প্রায় মিটিয়ে এনেছিলাম সমস্যা গুলো। গুটি কয়েক সিদ্ধান্তে যদিও উপনীত হয়নি কেউই। বলেছিলাম ধৈর্য ধরতে। বলেছিলাম উভয়পক্ষকে সামনাসামনি বসে আরেকদফা আলোচনা করতে। যদি মিটে যায় বা যদি নাও মেটে আমাকে যেন জানায়, তেমন হলে ছুটির মধ্যেই চলে যাব একদিন, শুধু ওদের জন্য। 


বাবুরা আমার কথা খানিক শুনেছেন খানিক শোনেননি। ধৈর্য ধরেননি মোটেই। ঝটপট দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসে পড়েছেন। বসেও যখন কোন সমাধান সূত্র বেরোয়নি, সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা। ঘটেছে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাবলী। নির্মূল হতে বসা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি অঙ্গ থেকে তন্ত্রে। 


ঝাড়া সাড়ে পাঁচ ঘন্টার মিটিং করে আবার পূর্বের জায়গায় ফিরতে ফিরতে রীতিমত কালঘাম ছুটে গেছে আমার। টিফিন করারও অবকাশ হয়নি কারো। বেলা আড়াইটে নাগাদ বলেছিলাম,সবাই চাইলে খেয়ে আসতে পারেন। কেউ রাজি হয়নি নড়তে। খাওয়া বলতে বার তিনেক জহরবাবুর হাতে বানানো আদা দেওয়া কালো চা। কোথা থেকে যে আদা জোগাড় করে এনেছে লোকটা ভগবান জানে। 


 শেষে তিনটে নাগাদ শুভাশিষকে বলতে বাধ্য হলাম, একটু ভালো দুধ চা আর বিস্কুট আনতে পাঠাও। একে খালি পেট তারওপর আমার বকুনি, মরে যাবে যে লোকগুলো। পাঁচটা দশ নাগাদ সবপক্ষ একসাথে করজোড়ে বলল,‘ছেড়ে দিন ম্যাডাম। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।’ 


সবকটাকে তাড়িয়ে টিফিন বাক্স খুলতে যাচ্ছি, জনা ছয়েক নেতা ঢুকে এসে অনুরোধ করল,‘ম্যাডাম, আজকের মিটিং এ কি হল, সেটা শ্রমিকদের যদি আপনি একটু বলে দেন তো খুব ভালো হয়। ’ বলাশোনার পাঠ যখন শেষমেষ মিটল রীতিমত গা গুলোচ্ছে। খাবারটা পচে গেল নাকি কে জানে। উত্তমকুমার বলল,‘ থাক ম্যাডাম আপনাকে আজ আর বাসে গিয়ে কাম নেই। আমি ছেড়ে আসি বরং।’ বেদজ্যোতিকেও সঙ্গে নিলাম আমরা, ওর বাড়ির কাছেই যাচ্ছি যখন। সঙ্গে নিলাম হক বাবুকেও। নন্দকুমার মোড়ে নামিয়ে দেব বলে। ঐ রাস্তাতেই যখন গাড়িটা যাবে, মুড়ির টিনের মত যতজনকে চেপেচুপে  নিয়ে যাওয়া যায়, তুলে নিই আমি। 


গাড়িতে বসে সবে টিফিন কৌটো খুলে মুখে এক গরাস দিয়েছি, উত্তমকুমার জানাল, গাড়ি আজ আর নড়বে না। কি হয়েছে ভগবান জানে,স্টার্টই নিচ্ছে না ব্যাটা। হক বাবু আর বেদজ্যোতিতে মিলে বেশ খানিকটা ঠেলল গাড়িটাকে, বনেট খুলে খুটখাট করল সবাই মিলে। গাড়ি আর নড়েই না।রাত বাড়ছে। এখন বাসে ভিড়ও হবে প্রচণ্ড। আর একটু আগে বেরোলে ভালো হত। আর সময় নষ্ট করা উচিৎ নয়। টিফিন বাক্স বন্ধ করে উঠে পড়লাম আমরা। কালেক্টরেটের গেট দিয়ে বেরোচ্ছি, একটি ছেলে একগাল হেসে বলল, ‘ম্যাডাম আজ হেঁটে যাচ্ছেন?’ ঘাড় নেড়ে বললাম, হ্যাঁ রে বাবা। দেখ না,  আজই গাড়িটা বিগড়েছে। 


নিমতৌড়ি বাসস্ট্যান্ড এখান থেকে হাঁটা পথে বেশ খানিকটা। পাশের হাইরোডে গিয়ে দাঁড়ালাম তিনজনে। তেমন আলো নেই এখানে। কে জানে হাত দেখালে বাস আদৌ দাঁড়ায় কি না। হক বাবু আর বেদজ্যোতি যদিও আশ্বস্ত করল,‘ বাসের বাবা ও দাঁড়ায়।’ একখানা বাস বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে,  উঠতেই যাচ্ছিলাম, বেদজ্যোতি আটকাল। ‘কেমন ভিড় দেখছেন ম্যাডাম। গোটা রাস্তা দাঁড়িয়ে যেতে হবে। একটু দাঁড়ান, পরে আরো বাস পাবেন।’ ঘড়ি দেখে হিসেব করলাম, বাড়ি পৌঁছাব কটায়। খেতে পাব কখন। সকালের ভাত খাবার পর সাড়ে আটঘন্টা কাটতে চলল। 


ব্যাগের মধ্যে ঝনঝনিয়ে উঠল মোবাইল, কিঞ্চিৎ  বিরক্ত হয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে দেখলাম, উত্তমকুমার। বাস পেয়েছি কিনা জানতেই ফোন করছে নির্ঘাত। অনুমাণ অকাট্য, ঠিক তাই বলল উত্তমকুমার,‘বাসে উঠে গেছেন? ’ বললাম না। অতঃপর উত্তমকুমার বললেন,‘উঠবেননি। উঠবেননি ম্যাডাম। আমি আসছি।’ হু হু করে হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটে এল উত্তমকুমারের গাড়ি। উঠে যে যার সিটে বসে, টিফিন বাক্স খুললাম আমি, আর হক বাবু শুধোলেন, ‘তোর গাড়ি চলল কি করে রে উত্তম।’ মহানায়কের স্টাইলে আমাদের উত্তমকুমার বলল,‘আপনারা ঠেলতে পারেননি তাই চলেনি। আমি পাঁচটা ড্রাইভার ডাকলাম, সবাই মিলে হেঁইও করে ঠেলল, ব্যাস অমনি-। স্টার্ট নিতেই আমি ম্যাডামকে ফোন করলাম। ভয় পাচ্ছিলাম, যদি আপনারা বাসে উঠে পড়েন।’ হকবাবু বললেন,‘আবার যদি বন্ধ হয়ে যায়, কি করবি?’ ফোঁৎ করে নিশ্বাস ফেলল উত্তমকুমার, ‘ এই যে স্টার্ট লিয়েছে, আর স্টার্টের বাবাও বন্ধ হবেনি। দেখে নিবেন।’ খোলা জানলা দিয়ে ছুটে আসছে শেষ ডিসেম্বরের সন্ধ্যের হিমেল হাওয়া, সকালে বানানো আলুকপি বিনের তরকারি এক চামচ মুখে দিয়ে প্রবল স্বস্তির শ্বাস নিলাম আমি। চালাও পানসি কাঁথি নগরী। এই তো জীবন কালি দা।

Tuesday, 20 December 2022

অনির ডাইরি ২০শে ডিসেম্বর, ২০২২

 


দাঁড়িয়েই আছি, মিনিট দশেক হয়ে গেল। আমি অবশ্য একা নেই, আসেপাশে দাঁড়িয়ে আছেন আরো অনেকেই। দূর পাল্লার একেকটা বাস আসছে, অমনি ছুটে যাচ্ছে লোকজন। কোনটা এগরা যাচ্ছে তো কোনটা পটাশপুর, কোনটা বা নন্দীগ্রাম।  আমাকে ধরতে হবে দীঘার বাস। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে উত্তমকুমার, বললাম,  চলে যাও। তাও গেল না। আজ দিনের আলো থাকতে থাকতেই বেরিয়েছি, প্রথমবার বাসে ফিরব। সকাল বেলা পাখি পড়া করে বুঝিয়েছে উত্তমকুমার,“অনেক বাস পাবেন ম্যাডাম। দু চারটে ছেড়ে দিবেননি। সিট আছে কিনা দেখে উঠবেন। নিমতৌড়িতে সিট না পেলেও নন্দকুমার মোড়ে পেয়েই যাবেন। কন্টাক্টরকে একটু বলে রাখবেননি।”  


বেশি জল খেতেও নিষেধ করেছে উত্তমকুমার। জল যদিও আমি বেশ কমই খাই। “বুঝে শুনে জল খাবেন ম্যাডাম। অনেকটা রাস্তা। একবার আমার যা হয়েছিল নি-”। পূর্ব মেদিনীপুর সত্যিই কেমন যেন লম্বাটে জেলা। তমলুক এবং কাঁথি যদিও একই জেলার দুইটি শহর, তাও খাতায় কলমে আমার বাসা থেকে আপিসের দূরত্ব প্রায় সত্তর কিলোমিটার ছুঁইছুঁই। 


ঘটাং করে একটা বড় বাস এসে দাঁড়াল। দরজা খুলে ব্রুস লির মত লাফিয়ে নামলেন এক চশমা পরা ভদ্রলোক, অতঃপর হাঁকতে লাগলেন কাঁথি, কাঁথি করে। উত্তমকুমারকে পিছনে ফেলে, হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে কিঞ্চিৎ  ভীতু স্বরে জানতে চাইলাম, ‘সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড?’ লোকটা পাত্তাও দিল না, তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে বলল,‘উঠুন, উঠুন।’ উঠেই পড়লাম, কপাল ঠুকে। সিট থাকলে বাঁচি। 


বেশ উঁচু আর লম্বা দূর পাল্লার বাস। একদিকে তিনজন আর একদিকে দুজন বসার ব্যবস্থা। আমার আগে যারা উঠেছিলেন, তারা পিছন দিকে এগিয়ে গেলেন। দূরপাল্লার বাসের পিছনে বসাটা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বুঝলাম না, তাই সামনে থেকে গুটি কয়েক সিট পরেই যে সিট পেলাম, তাতেই বসে পড়লাম। দুই শুঁটকে চেহারার ভদ্রলোক এতক্ষণে হাত পা ছড়িয়ে বসে গপ্প করছিলেন, ‘দাদা’ বলে আমি গিয়ে দাঁড়াতে, ধারের ভদ্রলোক ভিতরে ঢুকে গেলেন। 


বাস ছাড়ল, ছাড়ার সাথে সাথেই রুদ্ধশ্বাস দৌড়। অধিকাংশ জানলারই কাঁচ বন্ধ, ফলে ভিতরটা একটু গুমোট। জানলার বাইরে ক্রমশঃ কমে আসছে আলো। সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, চমকে উঠলাম কার যেন স্পর্শে। এক বিকলাঙ্গ ব্যক্তি উঠেছেন বাসে, সবার কাছে ভিক্ষা চাইছেন। বাস তো থামেনি এর মধ্যে, নির্ঘাত আগেই উঠে বসেছিলেন।  কয়েকবার মৃদু স্বরে দিদি/মা বলে ডেকেছেন বোধহয়, সাড়া না পেয়ে রড ধরে থাকা হাতটায় টোকা দিয়েছেন। বয়স কম না লোকটার, মসিকৃষ্ণ গাত্রবর্ণ। পিঠে মস্ত কুঁজ। এই শীতেও খালি গা, পরনে একটা ট্যানা। কারা কেন জিজ্ঞাসা করল,‘গরম জামা নেই?’ বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে এগিয়ে যায় লোকটি। 


পাশের লোকটি হঠাৎ বলে ওঠে, ‘ গান্ধী বুড়ি’! বাইরে দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারি নন্দকুমার মোড় ঢুকছি। গোল চক্কর কেটে ডান দিকে বাঁকব আমরা। বাঁদিকে বাঁকলে তমলুক শহর আর সোজা চলে গেলে হলদিয়া। চৌমথার মোড়ে উন্নীত  নিশান কাঁধে দাঁড়িয়ে আছেন তমলুকের ঘরের মেয়ে। সঙ্গে তাঁর অনুগামী বৃন্দ। বাস গুলো এখানে বেশ কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ায়, আগেই বলে রেখেছে উত্তমকুমার। এর মধ্যে একবার ফোন করে খোঁজও নিয়ে নিয়েছে,‘ম্যাডাম সিট পেয়েছেন তো?’ ছোলা,বাদাম,মশলা মুড়ির ঝাঁকা নিয়ে হকাররা ওঠে। অনেকে নেমে গিয়ে চা খেয়ে আসেন, টুকটাক কেনাকাটা করে আনেন পথে খাবার জন্য। 


বেশি ক্ষণ দাঁড়াল না অবশ্যি বাসটা। চাকা গড়াল কাঁথি শহরের দিকে। টিকিট কাটতে এগিয়ে এলেন কন্ডাক্টর দাদা। জানতে চাইলাম, ‘সেন্ট্রাল বাসস্টান্ড কত?’ জবাব এল,‘সেন্ট্রাল বাসস্টান্ড তো যাবেনি। আপনাকে বাইপাসে নামতে হবে।’ কোন বাইপাস রে ভাই? এখানে তো গণ্ডা গণ্ডা বাইপাস। জবাব দিল বটে লোকটি, একে তো কাঁথির লোকের কথা বুঝতে সামান্য একটু সমস্যা হয় আমার তার ওপরে বাসের তীব্র গর্জন। লোকটি আশ্বস্ত করল,‘বেশী দূর নয়। আপনি হেঁটে চলে যাবেন।’ এদিকের লোকের ‘বেশি দূর নয়’ এই সংলাপটিকেও বড় ভয় পাই আমি। কতটা দূর যে ঠিক বেশি দূর এদের কাছে, বুঝতে আজও অপারগ আমি। 


একটু আগেই মেসেজ করেছিলাম শৌভিককে, ‘বাসে উঠেছি। সিট পেয়েছি।’ জবাবে একগাল হাসির ইমোজি পাঠিয়েছিল আমার বর। আবার মেসেজ পাঠালাম, ‘ ওরে, এখন বলছে, এটা সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ড যায় না। কি যেন বাইপাসে নামাবে আমাকে।’ এবার ওদিক থেকে একটা কান্নার ইমোজি এল। রাগে দুঃখে আমারই চোখে জল আসছে তখন। কোন বাইপাসে নামাবে রে বাবা। বাড়ি পৌঁছাব তো ঠিকঠাক- 


নরঘাট ব্রিজ পেরিয়ে যায় গাড়ি, নীচে হলদি নদীতে তখন মিশছে সন্ধের আঁধার। পেরিয়ে যায় বাজে চণ্ডীপুর-চণ্ডীপুর-বাজকুল-হেড়িয়া। দরজার সামনের জোড়া সিটে বসা লোকটি নেমে যেতেই লটবহর সহ তার আসনটি দখল করে বসি আমি। কাতর স্বরে কন্ডাকটরকে মনে করিয়ে দিই, ভাই প্লিজ বোলো। আমি কিন্তু কিছুই চিনি না। তিনি আবার হেল্পারকে বলেন, ‘বৌদিটাকে মনে করে খড়্গপুর বাইপাসে নামিয়ে দিস তো।’ যাক এতক্ষণে বাইপাসটার নামটা অন্তত বুঝলাম। 


বাস ছুটে চলে রুদ্ধশ্বাসে মারিশদা-দুর্মুঠ-নাচিন্দা। কাঁথি বাইপাস বলে চিৎকার করে ওঠে হেল্পার ভদ্রলোক। তড়িঘড়ি উঠতে যাই আমি, পাশের অল্পবয়স্ক সহযাত্রীটি বলে ওঠে,‘দিদি আপনি পরেরটায় নামবেন।’ কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভালো করে কান মাথা ঢেকে নিই। কি প্রচণ্ড হাওয়া ঢুকছে বাসে। ড্রাইভার আমি আর হেল্পার ছাড়া আর কেউ জেগে আছে বলেও মনে হচ্ছে না। প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা হল বাসে উঠেছি। 


পরের চৌরাস্তায় যত্ন করেই নামিয়ে দেয় হেল্পারটি।  আঙুল দিয়ে দেখায় কোন রাস্তাটা ধরব আমি। ছুট্টে রাস্তা পেরিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি আমি। রাত একটু ঘন হয়েছে। রাস্তাও বেশ ফাঁকা মহানগর বা শহরতলীর তুলনায়।কিছুই চিনি না। এবার কি করব? তাকে ফোন করব কি?পরক্ষণেই মত বদলাই, এভাবে নিজেকে তাচ্ছিল্য করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এই সামান্য কারণে তাকে বিব্রত করার মত অসহায়া অবলা অন্তত আমি নই। পাশের চায়ের দোকানের বৃদ্ধকে শুধাই, দাদা অমুক জায়গায় যাব। কি ভাবে যাব একটু বলুন না। 


গনগনে কয়লার উনুনে চায়ের কেটলি চাপাচ্ছিলেন ওণার বৃদ্ধা স্ত্রী, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বললেন,‘ঐ দেখো টোটো দাঁড়িয়ে আছে। ধরে চলে যাও।’ জানতে  চাই ভাড়া কত? হাবলা পেয়ে ঠকায় যদি। সে প্রশ্নেরও  জবাব দেন উনি। টোটোয় উঠি, গন্তব্য জানাই, টোটোওয়ালা জানায়, অত দূর যাবে না। কাছাকাছি একটা জায়গায় নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে মহকুমা শাসকের করণ থুড়ি নিবাস খুব বেশি দূর না। 


রাতের কাঁথি শহরের বুক চিরে হাঁটতে থাকি আমি। দুদিকে আলোকমালায় সাজানো দোকানের সারি। কোথাও গরম পকোড়া ভাজছে তো কোথাও রসে টইটম্বুর জিলিপি। জামাকাপড়-গয়নাগাটি- বইপত্র-চশমার দোকানের সারির বুক চিরে অবশেষে যখন আপিস চত্বরে ঢুকছি, জনৈক টোটোওয়ালা জানতে চাইল, ‘যাবেন নাকি?’ কেমন রাগটা হয়! 


পরপর আপিসগুলোর অনেককটাই তখন অন্ধকারে ডুবেছে। শৌভিকের চেম্বারে যদিও আলো জ্বলছে। গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। দেশোদ্ধার করছেন আমার বর বাবাজী। এর জন্য মহানগর ছেড়ে আসা একেবারে বেকার। একটুও ভালোবাসে না। দুটো সহানুভূতির কথা বলে না, কেবল ইমোজি পাঠায়।  আপদ 


বিড়বিড় করতে করতে খানিকটা এগিয়েই থমকে দাঁড়ালাম, আধো অন্ধকারে গা এলিয়ে বসে আছে দু-দুটো গাব্দা ষাঁড়। তাদের একজন সুপ্ত বটে অপরজন জুলজুল করে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। কোন মতে ইষ্টনাম জপতে জপতে তাদের পাশ কাটিয়ে বাংলোয় ঢুকলাম। ভেবেছিলাম সবাই আহাঃ আহাঃ করবে। উল্টে বাংলোর পাকশালা সামলায় যে ছেলেটি, সে বলল,‘মাত্র দুটো দেখতে পেলেন ম্যাডাম? ওখানে তো পনেরো বিশটা ষাঁড় থাকে। মাঝে মধ্যে কন্টাই বাজারে খেতে যায়। খেয়ে আবার পালিয়ে আসে।’ 


মা গো। আমি আর থাকব না এখানে। রোজ সন্ধ্যে বেলা এই ভাবে, ভোলে বাবা পার করে গা করতে আমি নাচার। আসুক আজ বুজুর বাবা। আগে ষাঁড় তাড়াবে তারপর অন্য কথা। ছেলেটি একগাল হেসে বলল,‘ ওরা কিচ্ছু বলে না ম্যাডাম। এই তো আমি বাজার করে ওর গায়ের পাশ দিয়ে নিয়ে এলুম, কিচ্ছু বলল না।’ দুধের কাপে চুমক দিয়ে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে তুত্তুরী বলল, ‘বলবে না তো। সোজা উঠে গুঁতিয়ে দেবে।’ হে ভগবান সবাই আমার বিপক্ষে- আসুক আজ বুজুর বাপ।

অনির ডাইরি ১৮ই ডিসেম্বর, ২০২২

 

#কাঁথিরকিস্যা 


“একবার তো একটা মেয়ে সুইসাইডই করে ফেলল। রাত তখন আড়াইটা। সে কি ক্যাচাল ম্যাডাম।’ বক্তা  মহকুমা শাসকের বাহন চালক। 


মাস খানেক আগের কথা, তখনও শীত পড়েনি। সদ্য রঙ বদলেছে রোদ। বাতাসে লেগেছে সামান্য হিমেল স্পর্শ। যত্ন করে নতুন সাহেবকে শুঁটকি মাছ চাষ দেখাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। মাছ ধরার পাশাপাশি, মাছ শুকানোও এই উপকূলীয় অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অনভ্যস্ত শহুরে নাক হলে গন্ধটা বড় তীব্র লাগে। আগে জানলে সত্যিই আসতাম না। শৌভিক বলেছিল, পেটুয়াঘাট মৎস বন্দর দেখতে যাবে। বন্দর শুনে  হ্যাংলার মত লেজুড় হয়েছিলাম তুত্তুরী আর আমি। 


বন্দর দেখলাম, শৌলা আর জুনপুটে তারে ঝোলানো সারি সারি শুঁটকি মাছ দেখলাম। রঙবেরঙের ট্রলার দেখলাম। দেখেই অকুল দরিয়ায় ভেসে পড়তে ইচ্ছে করে। সাহস হয় না যদিও। বড় গন্ধ। বাঁধের ওপর দিয়ে পাকা রাস্তা চলে গেছে। পথের দুধারে দিগন্তপ্রসারী ফাঁকা মাঠ। মাঠ জুড়ে চলেছে মাছ শুকানোর কাজ। কোথাও খুঁটি পুঁতে, দড়ি টাঙিয়ে ঝোলানো রয়েছে সারি সারি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, কোথাও বা মাটিতে গর্ত করে পোঁতা, কোথাও বা সেই পুঁতে রাখা মাছকে তুলে ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। মাটি থেকে মাছ আলাদা করে জড় করা হচ্ছে স্তুপাকারে। মাছ শুকানোর কাজ মূলত বাড়ির মহিলারাই করছেন। হাত লাগিয়েছে সদ্য তারুণ্যে উপনীত হওয়া ফ্রক পরা মেয়ের দল ও। 


এদিকের মাটিটা বেশ বালি মেশানো। ড্রাইভার সাহেব বললেন কয়েক দশক পূর্বেও এই অঞ্চল ছিল সমুদ্র গর্ভে। রীতিমত ঢেউ খেলত। বাঁধের গায়ে আছড়ে পড়ত লবণাক্ত জলরাশি। এখন অবশ্য তিনি পিছিয়ে গেছেন বেশ অনেকটা। জোয়ারের সময় অবশ্য বেশ কিছুটা এগিয়ে আসেন আজও।  বাঁধের দুদিকে যত খানাখন্দ আছে, তাদের মধ্যে একদিকের জল মিষ্টি, অন্যদিকে লবণাক্ত। একদিকে প্রচুর সব্জি ফলেছে, অন্যদিকে পুকুর কেটে চলছে মাছ চাষের কাজ। প্রকৃতি হেথায় বড়ই উদার। সবকিছুই দিয়েছেন উজাড় করে। সবকিছুরই বড় প্রাচুর্য হেথা। ড্রাইভার সাহেব বললেন, ‘এদিকের লোককে মাছ কিনে খেতে হয় না স্যার।’ 


দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে, গ্রাম বাংলার রূপ- রস- গন্ধ- বর্ণে মোহিত হয়ে ফিরে চলেছি আমরা কাঁথি শহরের দিকে। একথা অনস্বীকার্য যে সমুদ্র দেখার সুপ্ত ইচ্ছে নিয়ে এসেছিলাম, ব্যর্থ মনোরথ হয়েই ফিরছি, তবে তাই নিয়ে তেমন ক্ষুন্নি বোধ নেই আমাদের। 


বেশ অনেক বছর ধরে কাঁথির মহকুমা শাসকের বাহন চালাচ্ছেন ভদ্রলোক। মহকুমাটাকে হাতের তালুর মত চেনেন। অনেক গল্প জানেন,বলতেও ভালোবাসেন। সাহেবের অনুমতি নিয়ে সামান্য ঘুরপথে নিয়ে চলেছেন আমাদের। উদ্দেশ্য হল মৎস দপ্তরের কি যেন একটা দীঘি দেখানো। সে দীঘি নাকি আয়তনে তেপান্তরের মাঠের সমান। কাকচক্ষুর মত টলটলে তার জল। অতি দক্ষ সাঁতারুও নাকি এপাড়- ওপাড় করতে হারিয়ে ফেলেন দম। চুনোপুঁটিদের পাশাপাশি রাঘববোয়ালরাও সেথা হাত-পা ছড়িয়ে সাঁতার কেটে বেড়ায়। শুধু ছিপ ফেলার অপেক্ষা। অবশ্য ছিপ ফেলতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি লাগে। 


গাড়ি চালাতে চালাতে বিভিন্ন সাহেব-মেমসাহেবদের সময় ঘটে যাওয়া না না ঘটন- অঘটনের গল্প শোনাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। জনৈক সরকারী কর্মচারীর আত্মহত্যা তারই অঙ্গ। কোন এক নিশুতি রাতে গলায় দড়ি দেয় মেয়েটি। পাকেচক্রে কাঁথির তৎকালীন মহকুমা শাসক সে রাতেই কাঁথিতে উপস্থিত ছিলেন না। কি যেন দপ্তরী কাজে আটকে পড়েছিলেন দীঘায়। মধ্যরাত্রি অবধি দিব্যি জেগেই ছিলেন তিনি, ফোন সাইলেন্ট করে শুয়েছেন তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এত বড় অঘটন ঘটায় মেয়েটি।


অকালে ঝরে যাওয়া এক অপরিচিতা কন্যার জন্য বেদনার্ত হয়ে ওঠে হৃদয়। আহা রে। না জানি, কত  যতনে লালনপালন করে বড় করে তুলেছিল বাবা মা। সেই সন্তান যদি এমন অবিবেচকের মত, নিজেকে শেষ করে দেয়, কিছু বলার থাকে না। উনিও সম্মতি জানান,‘ ঠিক বলেছেন ম্যাডাম।’ জানতে চাই, মেয়েটি কেন এমন করেছিল,কারণ জানা গেছে কি? কাজের চাপ নাকি মানসিক অবসাদ? জবাব আসে, ওসব তো ছিলই, সাথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল প্রেম। 


আবার গল্পে ফিরে যান ভদ্রলোক। বলতে থাকেন গভীর রাতে যখন আবিষ্কৃত হয় মেয়েটি অমন অঘটন ঘটিয়েছে, কতৃপক্ষ আতঙ্কিত হয়ে ফোন করে মহকুমা শাসককে। তখন রাত আড়াইটে। ওণার ফোন সাইলেন্ট ছিল, ফলে ফোন ধরতে কিঞ্চিৎ  বিলম্ব হয়। ইত্যবসরে মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মৃত বলে ঘোষিত হয়। পরে যখন সাহেব/মেমসাহেব জানতে পারেন তিনি কিছুক্ষণের জন্য মানসিক ভাবে রীতিমত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এমন নয় যে সেরাতে তিনি ফোন ধরলে মেয়েটি বেঁচে যেত, তবুও-।


 প্রাক্তন ওপরওয়ালা(ঈ) র প্রতি একরাশ মায়া মাখানো কণ্ঠে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক, ‘ আপনিই বলুন স্যার, এতে সাহেব/মেম সাহেবের কি দোষ?  রাত আড়াইটের সময় আপনাকে যদি কেউ ফোন করে, আপনি ধরবেন-’! 


দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, “হ্যাঁ” বলে লম্বা ঘাড় নাড়ে শৌভিক। ‘ আমার ফোন সারা রাত খোলা থাকে, কখনও সাইলেন্ট থাকে না। খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ না থাকলে আমি সব ফোন ধরি।’ থতমত খেয়ে গাড়ি চালানোয় মন দেন ভদ্রলোক। হাসি চাপি আমি, সত্যিই আমার বর ফোন ধরে ভাই। রাতবিরেতে , সময়- অসময়ে সবসময় ধরে। ধরতে পারে না কেবল যখন ইয়ে করতে যায়। কপালের এমন গেরো,যে ওই ঘরের চৌকাঠ ডিঙানো মাত্রই লাইন দিয়ে আসতে থাকে ফোন। ঘন্টি শুনে ছুট্টে এসে দরজার বাইরে থেকে চিল্লাই আমি বা তুত্তুরী, অমুকের ফোন/ তমুকের ফোন/ অজানা নম্বর থেকে আসা ফোন ইত্যাদি প্রভৃতি। 


এই অজানা নম্বর থেকে আসা ফোন গুলির মধ্যে আবার কেউ কেউ থাকেন, যাঁরা ফোনটি না ধরা পর্যন্ত করতেই থাকেন- একবার, দুবার, তিনবার। ওদিকে ফোন চিৎকার করে এদিকে আমি, ‘ওরে আমার বরটাকে ইয়েটা করতে দে বাপ।’ কতবার হয়েছে দাঁত মাজতে মাজতেও ফোন ধরেছে শৌভিক। এমনকি কুলি থুড়ি কুলকুচি করতে করতেও। বিগত বছর দেড়েকে আমাদের দাম্পত্য আলাপ তথা কলহও হয়েছে অমনি, থেমে থেমে, পূর্ণচ্ছেদ, কমা, কোলন, সেমি কোলন ইত্যাদি দিয়ে। ওটা যে কাজেরই অঙ্গ, সেটা বুঝে, মেনে নিয়েছি আমরা। অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা। 


এর মধ্যে শুধু একদিনই ফোন সাইলেন্ট রেখেছিল শৌভিক, যেদিন প্রযুক্তি গত কি যেন গড়বড় হয় আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সংক্রান্ত একটা মেসেজের সাথে সাথে ওর মোবাইল নম্বরটা পৌঁছে যায় তমলুক মহকুমার ঘরে ঘরে, মা লক্ষ্মী দের মুঠোয় রাখা মুঠি ফোনে। পরিণতি সহজেই অনুমেয়।  মিনিটে মিনিটে আছড়ে পড়তে থাকে, ৩০/৪০ খানা ফোন প্রবাহ। একটা ফোন ধরে, ছাড়ার আগেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ কল ওয়েটিং। সে এক রাত গেছে বটে। আক্ষরিক অর্থেই ছেড়ে দে মা (লক্ষ্মী), কেঁদে বাঁচি। 


তখন কি আর জানতাম যে বছর ঘোরার আগেই ঘটতে চলেছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি । দিন তিন চার আগের কথা, কাক ডাকা ভোর থেকে বানের জলের মত আসতে শুরু করল ফোন। সেবার ফোনের ওপারে শুধু মা লক্ষ্মীরা ছিলেন, এবার অবশ্য কোন লিঙ্গবৈষম্য পরিলক্ষিত হল না। সবার একই প্রশ্ন, একই অনুরোধ " স্যার, অমুক প্রকল্পে নাম ওঠেনি। একটু আমার ব্যবস্থা করে দিন স্যার।"  যে প্রকল্পের জন্য ফোন,তা আদৌ মহকুমা শাসকের দপ্তর থেকে দেখা হয় না। প্রথম জনা পঞ্চাশকে সেটাই বলল শৌভিক। শান্ত ভাবে জানাল,কোন অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। এমনকি এটা যে আপাতত কেবল পঞ্চায়েত এলাকায় হচ্ছে, পুরসভায় নয়,তাও বোঝালো কাউকে কাউকে। এই জেলা তথা মহকুমার লোকজন এমনিতে খুব বাধ্য,বললে অযথা তর্ক করে না। অবশ্য ব্যতিক্রম তো সর্বত্র বিদ্যমান। তেমনি এক ব্যক্তি বেশ বকেই দিলেন আমার বরটাকে। " আপনার অফিসে হবে না যখন, আপনার নম্বর দিয়েছেন কেন?"  


কোথায় নম্বর দিলাম রে বাবা,আকাশ থেকে পড়ে শৌভিক। ধীরে ধীরে ঝুলি থেকে বেরোন বাঘের মাসি। এক স্থানীয় সংবাদ পত্রের জনৈক সাংবাদিক মহাশয়, উক্ত প্রকল্পটি নিয়ে এক আগুনে প্রতিবন্ধ লিখেছেন। লিখতে লিখতে উদ্দীপনার বশে তিনি এই জেলার চার মহকুমা শাসকের ব্যক্তিগত নম্বরগুলিও টুকে দিয়েছেন। বিশদ জানতে ফোন করুন বা নালিশ জানান- এই ধরণের কোন শিরোণামে। 


পত্রিকাটি যেহেতু কাঁথিতেই প্রকাশিত হয়, স্থানীয় লোকজনই কেবল পড়েন ফলে নম্বরটা হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের মত। পরিণতি অনুমেয়।আপদে বিপদে মানুষ অবশ্যই ফোন করবে, করেও, কিন্তু তাই বলে ওটা যে আদৌ কোন প্রকল্পের হেল্পলাইন নম্বর নয়, ওই সংক্রান্ত রিপোর্টে করো নম্বর ছাপতে হলে অন্তত তার মৌখিক অনুমতি টুকু নেওয়া দরকার, তথাকথিত সাংবাদিকদের থেকে এইটুকু নৈতিকতা কাঙ্ক্ষিত বটে, কে আর তার মর্যাদা দেয়। ভাগ্যে জনগণের স্মৃতিশক্তি  অত্যন্ত দুর্বল, আজকের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি গুণোত্তর প্রগতিতে হারাতে থাকে তাদের তাৎপর্য, সেটাই আপাতত আমাদের ভরসা।