Tuesday, 16 November 2021

অনির ডাইরি ১৫ই নভেম্বর, ২০২১

 



কোন কোন দিন আমায় রান্নায় পায়। মেয়ের গোল্লায় যেতে বসা পড়াশোনা (সৌজন্য শৌভিকের বদলী, পর্যায়ক্রমে বাবা এবং মায়ের অসুস্থতা তথা হাসপাতালবাস এবং পরিশেষে আমার বদলী), পাট করে না তোলা কাচা জামাকাপড়ের পাহাড়, ঘরের কোণে জমে ওঠা ঝুল আর তাতে দোল খাওয়া শ্যামা পোকার দঙ্গল (কি পোকা এখানে বাপ রে বাপ। গরমে এই মোটকা লাল পিঁপড়ের গুষ্টি জ্বালিয়ে মেরেছিল আর এখন পঙ্গপালের ঝাঁকের মত গোছা গোছা পোকার দল), লুকিয়ে চুরিয়ে পাওয়া নিভৃত দাম্পত্য সব ছেড়ে সেদিন আমি শুধু রান্নাই করে যাই। যেমন ধরুন আজ, দিনটা শুরুই করেছিলাম ক্যারামেল পুডিং দিয়ে।


 বীরসা মুণ্ডার জন্মদিন উপলক্ষে পাওয়া আলগা ছুটির সকাল, মাখন পাঁউরুটি( আমার ভাগে শুধু সেঁকা পাউরুটি আর আলু পটলের তরকারী, ইয়ে করছি কি না), ডিমের পোচ( আমার ভাগে শুধু সাদা, বললাম না ইয়ে করছি, আমার ভাগের কুসুমখানা তাই শ্রীমতী তুত্তুরীই উদরস্থ করলেন, তাও আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে) আর কেলে কফি(আমার জন্য মিষ্টি ছাড়া, আঃ বললাম না আমি ইয়ে করছি) দিয়ে সারা সাহেবী প্রাতরাশ অন্তে ঠিক করলাম পুডিংটা বানিয়েই ফেলি।  কি যে লোভ দেখিয়ে রেখেছে আমার তুতো ভাই অয়ন, তুত্তুরী থেকে থেকেই আব্দার করছে,‘ বড়মামার মত পুডিং বানাও না মা, প্লিজ। ’  


 

বেলা দশটা থেকে তুত্তুরীর পরীক্ষা।  তাঁকে নাকি বেস্ট অব লাক জানাতেই হবে, নিদেন পক্ষে ট্যাঁশ মার্কা ইংরেজিতে গুড লাক। নাহলে পরীক্ষা খারাপ হবেই এবং খারাপ পরীক্ষার জন্য দায়ী থাকব আমি। ঐসব আদিখ্যেতা মিটিয়ে মন দিলাম ক্যারামেল বানানোতে, তিনচামচ চিনিতে দুচামচ জল মিশিয়ে আগুনে বসিয়ে নেড়েই চলতে হয়। না হলেই চিনি পুড়ে কাঠ কয়লা হয়ে যাবে, আর তার গন্ধে বাড়ির মানুষ তো বটেই ভূতও পালাবে।  সাদা চিনি গলে চিনির রস হল, চিনির রস পুড়ে লাল হয়ে তরল সোনা থুড়ি ক্যারামেল। অল্প মাখন মাখিয়ে রাখা স্টীলের বাটিতে টপটপ করে ঝরে পড়ল আগুন গরম ক্যারামেল। তার সঙ্গে যোগ হল আগে থেকে ফেটিয়ে রাখা ডিম আর দুধ-চিনির মিশ্রন।


 পুডিং খেতে সবথেকে বেশি ভালোবাসে আমার বাবা। তবে ওসব সাহেবী ক্যারামেল-ট্যারামেল নয়,ঘন করে গোলা আমূল গুঁড়ো দুধে পরিমাণ মত(পড়ুন বেশ অনেকটা) চিনি, আর ডিমের মিশ্রণ। সাথে উপরি হিসেবে দুফোঁটা ভ্যানিলার তড়কা। এখানে ভ্যানিলা এসেন্স কোথায় পাই, তিনি তো দিব্য নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন আমাদের মহানগরের আবাসনে। তাঁকে ছাড়াই পুডিং চড়ল চুলোয়। নির্দিষ্ট সময়ে নামাতে যাব, ঠিক তার আগের মুহূর্তে কন্যার ফরমায়েশ, তাঁর পরীক্ষার খাতা খানা স্ক্যান করে দিতে হবে মাকে। ইচ্ছে হল বলি, অন্য দিন কি করিস? গিলে নিলুম। মায়েদের এসব প্রশ্ন করতে নেই। 


সাদাকালো নয় রঙিন স্ক্যান ইত্যাদি হাজার খানেক ফরমায়েশ নিয়ে বেশ একচোট ঝাড়পিঠ হল আমাদের মা-মেয়ের মধ্যে। শৌভিক যথারীতি সমস্ত অশান্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে বিদ্যাদেবীর আরাধনা রত। বিদ্যাসাগর হয়েই ছাড়বে। সিরিয়াসলি মাইরি পরের জন্মে আমি বাবা হতে চাই। এদিকে তুত্তরী পরীক্ষার খাতা দেখে বেশ ভড়কে যাওয়া আমি। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, সত্যি বলছি হাওড়া পুরসভার ভ্যাট ও এর থেকে পরিচ্ছন্ন হয়। নার্ভাস হয়ে গরম পুডিং এর বাটিটাই হাত ফস্কে সোজা পাপোষের ওপর। 


মেয়ের মুখের খাবার নষ্ট করেছি বলে এমনিতেই মরমে মরে ছিলাম। তারওপর আবার পরীক্ষার খাতাকে পৌরসভার ভ্যাটের সাথে তুলনা করেছি,ফলত দ্বিপ্রাহরিক ভোজনটা মনে হচ্ছিল যেন এজলাসে  সারছি। ঝুড়ি ঝুড়ি নালিশ জমা পড়ল আমার নামে। বাদী ছিমতী তুত্তুরী আর বিচারক তথা জুরি এবং ফাঁসুড়ে আমার বর। তিনি তো পারলে সব কথাতেই আমায় ‘তিন মাসের জেল আর সাত দিনের ফাঁসি’ দেন। 


আমি নাকি ভয়ানক মারকুটে এবং দুর্মুখ জননী। ইয়ে দুর্মুখ তো অবশ্যই আর মারকুটেও যে আমি একটু আছি, তাতে কোন দ্বিমত নেই। ছোটবেলায় খোদ এত ধোলাই খেয়েছি, পৃথিবী ছাড়ার আগে, সেগুলো ফেরৎ দিতে হবে তো। কি দিয়ে না ঠেঙিয়েছে মা- ঠাকুরদাদার বিলিতি কাঠের রুলার, যাবতীয় স্কেল, খুন্তি-হাতা, হাতপাখার বাঁট, আরো কি কি যেন আজ আর মনে পড়ে না।  যা হাতের কাছে পেত, তাই দিয়েই মা হাত খুলে ঠেঙিয়েছিল,তাই না এমন শক্তপোক্ত হয়েছি। নাহলে ছিমতী তুত্তুরীর মত লদন্দ(পড়ুন গোবর গণেশ) হতাম। 


বলেই বুঝতে পারলাম, কেস জণ্ডিস করলাম। এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। বাপবেটিতে পত্রপাঠ বাক্যালাপ বন্ধ করল আমার সাথে। তাতে যে আমি খুব একটা মুষড়ে পড়লাম তা নয়, বরং রীতিমত শান্ত ছিল পরিবেশ। ওরা যখন আমার সঙ্গ বর্জনই করল, তখন ভাবলাম ভালোমন্দ কিছু রান্নাই করি বরং। সুগন্ধ ছাড়লে এরা বাপবেটি এমনিতেই আসবে হ্যাংলা বেড়ালের মত রান্নাঘরের চক্কর কাটতে। তখন বলব, ভাব করবি কি না বল? নাহলে খাদ্যকৃচ্ছতার গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো করে সব আমি একাই খাব। 


ছবিতে আমার বর এবং মেয়ের মনপসন্দ বাসন্তী পোলাও, চিকেন রেজালা আর ক্যারামেল পুডিং যা আবার নতুন করে বানিয়েছিলাম। পড়ে যাওয়া পুডিংএর অবশিষ্টাংশটুকুর কি হল, প্লিজ এই সব প্রশ্ন করে লজ্জা দেবেন না। আমি বলে ইয়ে করছি- আজ নিয়ে পাক্কা ছদিন। হ্যাঁ গো একটু রোগা কি হয়েছি, প্রশ্ন করলেই হাসতে হাসতে বিষম খায় এরা বাপ আর মেয়ে।

অনির ডাইরি ১৫ই নভেম্বর,২০১৮

 অনির ডাইরি ১৫ই নভেম্বর,২০১৮

গতকালের কথা, গোটা দেশ উৎসব মোড থেকে বেরিয়ে এলেও চন্দননগর-মানকুণ্ডুর জমকালো জগদ্ধাত্রী পূজা এবং চুঁচুড়া-বাঁশবেড়িয়ার আসন্ন কার্তিক পূজাকে কেন্দ্র করে,এই মাঝ নভেম্বরে গোটা হুগলী জুড়ে খুশি আর উৎসবের আমেজ। চূড়ান্ত খিটখিটে লোক বা মহিলার মুখেও এক



গাল হাসি। পুরো পুজোর কলকাতার মত ঝাঁক বেঁধে সুন্দরী এলোকেশীরা ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছেন। রাস্তায় রাস্তায় গোছা গোছা চলমান ফুলের মেলা। সবে ভাবছি,তাহলে এই মওকায় দেখেই আসি কটা ঠাকুর, দরজা খুলে মুখ বাড়ালেন চাইল্ডলাইন হুগলীর জেলা কোঅর্ডিনেটার শ্রী গোপিবল্লভ শ্যামল মহাশয়।“ম্যাডাম আসতে পারি?” নিয়মিত যাঁরা আসেন,তাদের বহুবার বলেছি,আপনাদের জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই। অবারিত দ্বার। “আসুন। আসুন” বলার আগেই কোঅর্ডিনেটর সাহেবের বাহুমূলের তলা দিয়ে গলে তিন তিন জন মান্যগণ্য অথিতি এই অধমের চেম্বারে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। “আরে এণারা?” সবে আগের দিনই শিশু দিবস উদযাপন  করেছি এক দঙ্গল খুদেকে নিয়ে। আজ আবার কি মনে করে অধমের চেম্বার এঁণাদের পদধুলি ধন্য হল? গোপিবল্লভ বাবু খুলে বললেন, শিশুদিবসের পরের দিন এণারা এসেছেন আমাকে চাইল্ডলাইনের হলুদ ব্যাণ্ড পরাতে। এতবড় সৌভাগ্য! তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালাম। লক্ষ্মী,শ্রেয়া এবং মুসকান নাম্নী তিন গণ্যমান্যা এগিয়ে এসে সযতনে পরিয়ে দিলেন হলুদ ব্যাণ্ড। অতঃপর উপহার স্বরূপ তুলে দিলেন একটি হলুদ চাবির রিঙ। তাতে লেখা “চাইল্ডলাইন সে দোস্তি”। হেল্পলাইন নম্বর ১০৯৮ও দেওয়া আছে। ১৮বছর বয়স পর্যন্ত যে কোন শিশু যে কোন বিপদআপদ বা সমস্যায় যেখানে নির্দ্বিধায় ফোন করতে পারে। সাহায্য অবধারিত। গোপীবল্লভ বাবু পকেট থেকে আর একটি চাবির রিঙ বার করে আমায় দিলেন,“এটা আপনার তুত্তুরীর জন্য।ও জানুক ১০৯৮এর কথা।  ” তুত্তুরী এমনিতেই জানে। তবু সাদরে গ্রহণ করলাম এই স্নেহের দান। 

এবার গণ্যমান্যাদের খাতিরের পালা। তুচ্ছ লেবার অফিসের কি এমন সাধ্য আছে,ওণাদের যথোচিত সৎকার করবে,তবু বললাম,“কফি খান অন্তত। সাথে ক্রিম ক্রাকার বিস্কুট চলবে?” আমাদের কালেক্টরেটর চা খেয়ে অডিট টিম যা খচেছিল,তাই চা ওয়ালাকে বললাম,তাঁর আবার এসএসওয়াই কার্ডও করে দিয়েছি আমরা, “দোহাই চা'টা দেবেন না। ভালো কফি দিন। ” যতটা ভাল হয় আরকি। চা কফি খেতে খেতে খানিক খেজুরে গপ্প হল। গোপীবল্লভ বাবু বললেন, এরা সকলেই চাইল্ডলাইনের কটেজের বাসিন্দা। সাধারণতঃ খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলে বা যদি কুমারী মায়ের সন্তান হয় অথবা দেখার কেউ না থাকে বা পরিবার যদি অ্যাবিউসিভ হয় তাহলে বাচ্ছাদের এখানে এনে রাখা হয়। অনেককে তাদের পরিবারও রেখে যায়, প্রতিপালন করার ক্ষমতা না থাকলে। অথিতিদের কাছে জানতে চাইলাম কার বাড়ি কোথায়? এদের সকলেরই বাড়ি আছে। একজনকে মা রেখে গেছে। লোকের বাড়ি বাসন মাজে, বাড়িতে দেখার কেউ নেই। অপর একজন বলল,বাড়িতে মামা আর দিদি আছে। বুঝলাম মামাতো দিদি বা বোন হবে। তৃতীয়ারও মা এবং বোন আছে। মায়ের দেখার ক্ষমতা নেই। জানতে চাইলাম এখানে কেমন আছে? সকলেই বলল,“খুব ভালো। ” সবাই স্কুলে পড়ে। মুসকান এবং শ্রেয়া ক্লাশ ফোর আর লক্ষ্মী ক্লাশ থ্রীতে পড়ে। ওদের হাসিখুশি মুখগুলিই জানিয়ে দিচ্ছে ওরা খুব ভালো আছে। অনুক গল্প হল। মা হওয়ার অভ্যাস বশতঃ খানিক জ্ঞানও দিলাম,“খুব ভালো করে পড়াশোনা করো। তারপর একদিন এসে আমার চেয়ারে বসো।যোগাযোগ রেখো।  আমি আসব তখন ফুল নিয়ে তোমাদের কাছে। ”

Monday, 15 November 2021

অনির ডাইরি, ১৫ই নভেম্বর,২০১৯

 

মোবাইল খুললেই, ফেবুর দেওয়াল জোড়া শুধুই কচিকাঁচার দল। সাধ্যাতীত যত্নে লালিত, ঝিলিক মারা পেলব ত্বক, নিষ্পাপ হাসিতে পূর্ণ চন্দ্রের সুষমা। বড় আদরের ধন আমাদের। নয়নের মণি। এমনি হেসেখেলে ভালোবাসার উত্তাপে কাটুক ওদের  শৈশব। 

আর মোবাইল বন্ধ করলে? বলতে পারি, জানিনা শুনবেন কিনা। গরীবগুর্বো খেটে খাওয়া মানুষের গপ্প।  বছর ঘুরে গেল সেই রাতটার। রীতিমতো রোমহর্ষক রাত। আজও মনে আছে দিনটা ছিল ছুটির। হয়তো রবিবার। কড়াইয়ে বুড়বুড়ি কাটছিল আদরের মাংস। প্রজাপতির মত লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল তুত্তুরী,“ মা কষা হলেই আমাকে দেবে, কিন্তু।  কেমন?” 

গ্যাস কমিয়ে অফিসের ফোনটা যখন ধরলাম, ওপারে এক নাম করা এনজিওর কোঅর্ডিনেটর। “ম্যাডাম একটু হেল্প লাগবে-। ”  একটি হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে হবে, তার মায়ের কোলে। মেয়েটিকে উদ্ধার করেছে পুলিশ কিন্তু মায়ের খোঁজ নেই। তো? আমি কি করব?যেখানে পুলিশ পারেনি, লেবার দপ্তর কি করবে, অ্যাঁ?  আমার গোটা  পাঁচ-ছয়েক আদুরে ইন্সপেক্টর আছে বটে, কিন্তু হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশের কাজ তাদের থোড়াই। 


উনি নাছোড়বান্দা, “দেখুন না একটু। সমত্থ মেয়ে।বছর বারো কি তেরো বয়স।  ইঁটভাঁটার বাচ্ছা। বলছে মায়ের ওপর রাগ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল। পথ ভুলে আর ঘরে ফিরতে পারেনি।” ইমোশন্যাল অত্যাচারটা মাইরি দারুণ পারেন উনি। এমন থেমে থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছেড়ে বললেন, একজন মা হিসেবে কেঁপে উঠল বুকটা। 

তা খুঁজব কেমনে? কিছু বলেছে মেয়েটা? শুধু তিনটে শব্দ-“ভাট্টা,চাচু আর পাণ্ডওয়া”। ভাট্টা আর পাণ্ডুয়া তো বুইলুম। আমারই এলাকা। চাচু বস্তুটি কি? খায় না মাখে? জবাব নেই ওণার কাছেও। 

জনৈক ইন্সপেক্টরের(বিনা অনুমতিতে নাম নিলাম না) এক তুতো কাকার একটি ইঁট ভাঁটা আছে। বেশ কয়েকবার নানা আইনে ইন্সপেকশনও করেছি আমরা। ওকেই ধরলাম। ধরতে কেমন লাগছিল, ছুটির দিনে উটকো আপদ ভাবছে নির্ঘাত। না বেচারার পোস্টিং পাণ্ডুয়া, না ওর কাকার ভাঁটাটা পাণ্ডুয়ায়। তবু ভাবলাম বলেই দেখি না। এত ভালোবাসে এরা আমায়, বললে ফেলবে না নির্ঘাত। 


ওঃ যেমন অফিসার তার তেমন ইন্সপেক্টর। গোটা কথাটা শুনলই না। “দাঁড়ান ম্যাডাম। দেখছি। এই চাচু মাল থুড়ি ব্যাপারটাকে কাল্টিভেট করতে হচ্ছে।” কর বাপ। চাষ আবাদ যা ইচ্ছা কর। মেয়েটার মা’টাকে যদি খুঁজে বার করা যায়- । 

 ইন্সপেক্টর সাহেবের কাকাবাবুর মাধ্যমেই আলাপ হল, মালিক সংগঠনের তাপস বাবুর সাথে। ইন্ডিয়া ভাঁটার মালিক তাপস বাবু, এমনিতে আমাদের প্রতিপক্ষ। সবসময়ই আমরা ওণাদের আর ওণারা আমাদের সন্দেহের চোখে দেখেন। মানুষটাও বেশ  ঠোঁট কাটা। কাটখোঁট্টা প্রকৃতির। তবে আপাত রূঢ় হৃদয়ের মধ্যে বয়ে চলে স্নেহের ফল্গুধারা। আহাঃ “আমার বাড়িতেও তো বাচ্ছা আছে ম্যাডাম। মাঝে মধ্যে রাগটাগও তো করে। ” বিকাল থেকে ওণারা তল্লাশ  শুরু করলেন, কোথায় আছে হারিয়ে যাওয়া মেয়ের চাচুবাবু। পাণ্ডুয়া বেশ বড় এলাকা। ভাঁটার সংখ্যাও বেশ বেশী। বেশী বিহার-ঝাড়খণ্ড থেকে বালবাচ্ছা নিয়ে আসা শ্রমিকের সংখ্যাও। কার বাচ্ছা হারালো, কে খোঁজ রাখে বলুন তো? সন্ধ্যে নামলেই জমে ওঠে “দারু দেশী”র খোয়ারি। ততোক্ষণে আমার আর ইন্সপেক্টর সাহেবের বিশ্বাস ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে, মেয়েটা নির্ঘাত অ্যাসল্টেড হয়েই ভেগেছে। কোঅর্ডিনেটর সাহেবকে উত্যক্ত করছি আমরা চেক করান। কেন পালাল একটা সমত্থ মেয়ে? আর চাচুর নামই বা কেন করল? কে রে ব্যাটা চাচু তুই? মালিকপক্ষের অবিশ্বাস্য প্রচেষ্টা আর আমার ইন্সপেক্টর সাহেবের উদগ্রতার জন্য,

এক রাত আর হাফ বেলার মধ্যেই আবিষ্কৃত হল মেয়েটির মা। চাচু অবশ্য ততোক্ষণে ভাঁটা ডিঙিয়ে পগার পার। 

তাপস বাবু খোদ নিয়ে এলেন মাটিকে, আমার চেম্বারে। ডাকা হল এনজিওর লোকজনকেও। মেয়েটি হোমে। এনজিওর রিপোর্টের ভিত্তিতেই মিলন হতে পারে মা-মেয়ের। মহিলা আদিবাসী গোত্রীয়। ভালো বাংলা বলতে পারেন না। চাচু ওণার এজেন্ট।এরা বলে সর্দার। মহিলার বাড়ি উত্তরবঙ্গের এক আদিবাসী এলাকায়। পিতৃ-মাতৃহীন। স্বামী পরিত্যক্তা। ভুল লিখলাম স্বামী পরিত্যাগিনী। কেন? বরকে ছাড়লে কেন? প্রশ্ন করলেই খিঁচিয়ে ওঠে। “কেনে? খাতি দিবে না, কিলাবে। থাকব কেনে? ওমন বিয়ে আর ওমন বরের মুয়ে আমি ইয়ে-”। হারিয়েে যাওয়া মেয়েটি সম্ভবতঃ বিয়ে করা বরের। সঠিক জানেন না মহিলা। ঘরে আরও দুটি বাচ্ছা। তাদের কোনটা চাচুর হতেও পারে। জানেন না মহিলা। 

ওনার শৈশবে উনিও আসতেন, ফি বচ্ছর, সেই সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে বাবা-মায়ের সাথে ভাঁটায় খাটতে।একবারই আসেননি। তখন ওণার বয়স  আট বা দশ। নানীর কাছে রেখে গিয়েছিল বাপ-মা। বলেছিল তো ফিরবে, ফেরেনি। দিশী বিষ মদ একসাথে কেড়ে নেয় দুজনকেই। সেই থেকে মামার ঘরেই মানুষ। যৌবনের শুরুতে পছন্দ করা ছেলেকে বিয়া করে ভেগে যাওয়া। আর তারপর-

ছোটখাট খর্বকায় চেহারা,ভাঁটার তাপ আর রোদে ঝামাপোড়া রঙ। আদিবাসী রমণীদের মত গাছকোমর বেঁধে পরা শাড়ি। ছোট এক জোড়া চোখ। হয় ঝিমোচ্ছে,নয় ঝলসে উঠছে। যেন পলকে ভস্ম করে দেবে আমায়। আমিই একমাত্র প্রশ্নকারিনী কি না।তিরতিরে নাক। সরু ঠোঁট। হাড় সর্বস্ব দুই হাতে দুটি সরু সোনালী চুড়ি। কোলের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখা। চট করে কোন কথাই শুনছে না। পাত্তাই দিচ্ছে না, ‘ইদের ম্যায়ডাম’কে। পারলে বোধহয় বলেই বসে, “এই তু চুপ কর তো। ” 

জানতে চাইলাম, মেয়েকে ফেরৎ নেবে তো? গাড়ি নিয়ে আমাদের ইন্সপেক্টর সাহেব প্রস্তুত। নিয়ে যাবে হোমে। সঙ্গে যাবেন তাপস বাবু আর এনজিও থেকে আসা ছেলেটি। “নাঃ। ” আধা ঝিমানো গলায় উত্তরটা পেয়ে চমকে উঠলাম। কেন?

জবাব নেই। তাপস বাবু ধমকে উঠলেন, বল না মেয়েটা। মালিক না হলেও মালিকশ্রেণীর তো, তাঁকে খাতির করে মেয়েটি।  ঋজু হয়ে বসে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “কি হবে?উ আবার ভেগে যাবে। এর আগেও ভেগে ছিল।” আগেও পালিয়েছিল মেয়েটি। কেন জানেন? তিনটি বাচ্ছাকে নিয়ে নাজেহাল মা, ভাঁটায় কাজ করতে আসার সময় বড়টিকে রেখে এসেছিল তার নানীর ঘরে। মাকে খুঁজতেই পালিয়েছিল মেয়েটি। কিভাবে যেন সেবার খবর পেয়ে ভাঁটার কাজ, মজুরী পেলে দেশে দৌড়য় মা। কিভাবে যেন খুঁজে বার করে দুলালীকে। আর তারপর? 

শিলিগুড়িতে এক মাস্টার মশাইয়ের বাড়িতে কাজে লাগিয়ে আবার ভাঁটায় ফিরে আসে মা। ভালো বাড়ি। দুবেলা খেতে দিত। মারধরও করত না। আবার পালায় মেয়েটি। পাণ্ডুয়া নামটা মনে ছিল। বিনি পয়সায় ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষে করে সেই সুদূর শিলিগুড়ি থেকে পাণ্ডুয়া চলে আসে মেয়েটা। মায়ের খোঁজে। 

বাস্তব সত্যিই কল্পনার থেকেও বিচিত্র। কি বলেন?


কি ভেবেছিল মেয়েটা কে জানে? মা খুব আদর করবে? সাবাস সাবাস করবে? কেউ কোনদিন ওর মাকে আদর করেছে? সাবাস বলেছে? ওর মা ওসব শিখবে কি করে? ঘরের কাজে লাগিয়ে দেয় মেয়েটিকে মা। দুই ছোট ভাইবোনের দেখভাল,রসুই। করত। করত না,তা নয়। শুধু চটে যেত, কাজের পর মা আর চাচুর ঘনিষ্ঠতা দেখলে। এক টুকরো ঝুপড়িতে আর কি অবগুণ্ঠন? সবই তো খুল্লামখুল্লা। এই নিয়ে অশান্তি। চাচুও বোধহয় লাগিয়েছিল ঘা কতক। মা যদিও চাচুর কোন দোষই দেখতে পায় না। চাচু নৌকরি দিয়েছে বলেই না খেয়ে পরে বেঁচে আছে। চাচু তো একটু ইয়ে করতেই পারে। তাই বলে ঘর ছেড়ে ভাগবি তুই? ওকে আর নেবে না মা। থাক ও হোমেই থাক। দুবেলা খেতে তো পাবে। পড়ালিখাও শিখবে হয়তো। ভাঁটার শিশু হয়ে তো বাঁচবে না-


বছর ঘুরে গেল। কেমন আছে মেয়েটা কে জানে? আবার তো ভাঁটার মরশুম শুরু হল, মা'টা কি এবারও এসেছে? কে উত্তর দেবে বলুন তো? বড় আশা ছিল, মধুরেন সমাপয়েৎ এর। তবে সব গল্প তো আর মিলনান্তক  হয় না-। জীবন বড়ই বিচিত্র বাবুমশাই।

Sunday, 14 November 2021

অনির ডাইরি, ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২১

 

শৌভিকের জন্মদিনের ডাইরিটা আর লেখা হয়ে ওঠেনি। কতকিছুই তো হয় না। জীবনের সবথেকে নরম মূহূর্তগুলো, সবথেকে তেঁতো- বিস্বাদ, সবথেকে সাদামাটা, সবথেকে রোমাঞ্চকর, সবথেকে পরিপূর্ণ, টলটলে, মনখারাপি কত মুহূর্তই যে থেকে যায় অধরা- 


অথচ কি প্রচণ্ড খেটেছিলাম দিনটার জন্য, প্রিয়জনেদের মাঝে সাজিয়েগুছিয়ে তার সামনে বেড়ে দেব কিছু সুখাদ্য, তারই জন্য পাগলের মত দৌড়েছিলাম উদয়াস্ত। কিছুই তো দাবী করে না লোকটা, বিগত একযুগে সামান্যতম যাতনাও দেয়নি, বরং যখনই রান্না করতে চেয়েছি থামিয়ে দিয়েছে টেনে। থাক না। সিদ্ধ ভাত, এমনকি বাসি রুটিও খেয়ে নিয়েছে মুখটি বুজে।  এবারেও হয়নি তার ব্যতিক্রম, ফাটা রেকর্ডের মত বাজিয়েই গেছে, কি দরকার এত কষ্ট করে, খাবার কিছু আনিয়ে নিলেই তো মিটে যায়।  


মিটে তো যায়,শুধু মন যদি মানত-। এবছর শৌভিকের জন্মদিনটা পড়েছিল শনিবার, অন্যদিনে পড়লে করা হত না কিছুই।  শনিবার বলেই আশায় বেঁধেছিলাম হৃদয়, মাসে তো একবার বাড়ি ফেরে আমার বর, মাননীয় জেলাশাসক নিশ্চয়ই এ হপ্তায় বাড়ি ফিরতে বাধা দেবেন না। 


সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন বাড়ি ফিরল আমার বর, যোগাড় যন্ত্র প্রায় শেষ। গ্যাসের ঢিমে আঁচ ফুটছে লালচে হয়ে আসা পায়েস। চাপচাপ পায়েস বড় ভালোবাসে এরা বাপ আর মেয়ে। আসলে ভালোবাসে গোটা ভট্টাচার্য পরিবারই।  পায়েসে কাজু কিশমিস নিছক ঝঞ্জাল মনে করে এরা। তাই ঢিমে আঁচে ঘন হয়ে আসা দুধে একমুঠো ভিজে গোবিন্দভোগ চাল আর একচামচ ঘি দিয়ে রাঁধি পায়েস। চাল সিদ্ধ হয়ে এলে শুধু মেশে চিনি। অপর গ্যাসে ফুটছে টমেটো,আমসত্ত্ব আর খেজুরের চাটনি। ফ্রিজে ম্যারিনেট করা আছে রেজালার মুর্গি আর বিরিয়ানির খাসি। কাঁচের পাত্রে পেঁয়াজ- আদা-রসুন-কাঁচালঙ্কা-ধনেপাতা আর পুদিনাপাতার প্রলেপ মেখে ঘুমাচ্ছে ভেটকির ফিলে। 


রান্নার আলমারি ঠাসা বাসমতী চাল,মাখানার প্যাকেট, কাশ্মীরি লঙ্কা, চাটমশলা, সামরিচ গুড়ো, মিঠা আতর, কসুরি মেথি ইত্যাদি বিজাতীয় মশলায়। কাক ভোরে ঘুম থেকে উঠে অন্তত বার পাঁচেক বাজারে গেছি, বার দুয়েক টাকা তুলেছি। মিথ্যে নয় মশাই। আমি টাকা তোলার ব্যাপারে বেশ কিপটে আর ইয়ে বাজারদর সম্পর্কে একেবারে অগা। সব বাজারদোকান যে শৌভিক করত-।  


দোকানবাজার সেরে,স্নান সেরে দৌড়েছি মেয়ের স্কুলে রেজাল্ট আনতে। এক বস্তা নম্বর নিয়ে বাড়ি ফিরেই দৌড়েছি সিটি সেন্টার বরের জন্মদিনের উপহার কিনতে। সামনেই পুজো, পুজোর উপহার স্বরূপ কিছু নগদ পেয়েছি বাবার থেকে, কি আর বলব নিজের বাপের কথা, টাকাপয়সা দিয়ে আমায় একফোঁটা বিশ্বাস করে না গো। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পড়েই আছে আমার পিছনে, ‘তুত্তুরী আর শৌভিকেরটা কিনে আন, আমরা দেখে যাই। শেষে- ’। বাকিটা অনুক্ত থাকলেও বুঝতে বাকি থাকে না। শেষে যদি অন্য খাতে উড়িয়ে দিই আমি। 


 এক সপ্তাহের জন্য এসেছিল আমার বাড়ি। আসেনি, মোটামুটি আধহাত নাক খৎ দিয়ে নিয়ে এসেছিলাম কটাদিন হাওয়া বদলের জন্য। আজ জামাই আসার আগেই তেনারা ফিরে যাবেন, দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর রেখে আসতে যাব সেই আমিই, তার আগেই কিনে আনতে হবে জামাতার জামা। বেলা একটা নাগাদ বরের জন্মদিন আর পূজার জামাকাপড় কিনে বাড়ি ফিরে, চাট্টি নাকেমুখে গুঁজে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর লটবহর নিয়ে দৌড়েছি হাওড়া। তাঁদের চাটুজ্জে বাড়িতে নামিয়ে, প্রায় সন্ধ্যে নামার মুখে বাড়ি ঢুকে মুখ হাত পা ধুয়ে শুরু করেছি রান্না। 


ঘড়ি বলে রাত আটটা। টং করে বেজে ওঠা দরজা ঘন্টি। আমি খুলব বলে যুগলে দৌড়ে আসা মা মেয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তুত্তুরীকে কোঁৎকা মেরে দরজা খোলা, চৌকাঠের ওপারে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বর। বাম হাতের ফোনটা বোঝাচ্ছে, সদ্য কেটেছে কলটা। দীর্ঘ অদর্শনের পর প্রিয় সম্ভাষণ ভেসে এল,ভীষণ চেনা, সহস্রবার চাখা ওষ্ঠাধর থেকে-‘ আমায় বোধহয় এখুনি ফিরে যেতে হবে-। ’ 


মুখ কালো করে কোথায় যেন সেঁদিয়ে গেল তুত্তুরী। উদ্গত কান্না চেপে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ারে বসে আছি আমি। পোশাক না বদলে একের পর এক ফোন করে চলেছে শৌভিক। কোথায় যেন লেগেছে মস্ত গোলমাল। কাল জমায়েত হবে কয়েকহাজার লোক। বিঘ্ন ঘটবে আইন শৃঙ্খলায়। আমার অবস্থা দেখে, ভিজে পরাজিত সুরে কাকে যেন বলছে আমার বর, ‘আসলে একমাস পর বাড়ি ফিরলাম তো। কাল আবার আমার জন্মদিন। ’। জানি আমার বরের জন্মদিন নিয়ে মাথাব্যথা নেই বিন্দুবিসর্গও। যাবতীয় মাথাব্যথা শুধু আমার জন্য। আমার ঘেমো,হলুদের ছোপ লাগা, আঁশটে গন্ধওয়ালা হাতটা ধরা একহাতে, আর অপর হাতে ফোন। 


ঐ ভাবেই পাক্কা চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট সালিশি করা। কখনও কাউকে ধমকানো, তো কখনও কাউকে, বাহবা দেওয়া। সবার শেষে দুই অনুজপ্রতিম সহকর্মীর আশ্বাস বাণী,‘এত চিন্তা করছেন কেন স্যার।  আমি/ আমরা তো আছি।’ তবুও উৎকণ্ঠা চেপে কাটানো রাত। ঘুমের ঘোরেও উৎকর্ণ দুই জোড়া কান। এই বুঝি এল কোন অবাঞ্ছিত সংবাদ। ভোর হয়।  বেলা গড়ায়। শুভেচ্ছা বার্তা উপচে পড়ে শৌভিকের মোবাইল, ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপে। কারা কারা যেন ফোনও করে বসে। আমাদের উমারাণী উঁকিঝুঁকি মারে, কি রাঁধছ দিদিভাই। বলোই না।  এসে যায় তাঁর মনের মত ক্রিম ছাড়া জন্মদিনের কেক। সদর থেকে ডেলিভারি আনতে আনতে আমার মুণ্ড চটকান তিনি, ‘আমার জন্মদিনের কেক আনতেও আমায় পাঠালি কেন?’ রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে বিরিয়ানির সৌরভ। রেজালায় মেশে গোলাপ আর কেওড়াও জল। স্পেশাল ব্রেড ক্রাম্বের বিকিনি পরে উত্তপ্ত তেলে স্নান করতে নামেন ফিশফ্রাইয়ের দল। বেকিং পাউডার আর খাবার সোডার কল্যাণে দই দিয়ে মেখে রাখা সাদা ময়দার লেচি, গ্যাসের আগুনে ফুলে ফেঁপে তৈরি হয় নান।  আমার অন্নপ্রাশন উপলক্ষে আমার দিদিমার পাঠানো আশির্বাদী খাগড়ার কাঁসার থালা বাটি গ্লাসে একে একে বেড়েদি তাকে। জীবনের সব রঙ শুধুই যাকে ঘিরে।

অনির ডাইরি ১৪ই নভেম্বর, ২০২১

 

আচ্ছা এমন কখনও হয়েছে,সম্পূর্ণ অপরিচিত বা নিছক মুখচেনা কোন মানুষের মৃত্যুতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছেন? অযথা ভারী হয়ে থেকেছে মন আর মাথা দীর্ঘক্ষণ। ভুগেছেন অপরিসীম নিরাপত্তাহীনতায়- । 


কেন যে এমন হয় আজকাল-। খেতে বসে জনৈক মুখ চেনা, নাম শোনা সদ্য প্রয়াত ব্যক্তির চলে যাবার গল্প শোনাচ্ছিল শৌভিক, পরিণত বয়সে, প্রিয়জন পরিবৃত হয়ে যন্ত্রণা বিহীন মৃত্যু। তবুও কি যে হল, কেঁদেই চললাম বেশ অনেকক্ষণ। বেচারা তুত্তরী ঘাবড়ে গিয়ে জানতে চাইল, স্বর্গীয় ভদ্রলোক আমার আত্মীয় হন কিনা। শোককে বোধহয় সবসময় আত্মীয়তার নিরিখে যাচাই করা যায় না। কেজানে কার কপালে লেখা থাকে কার চোখের দুফোঁটা জল- 


 অথচ আমার শোকতাপ বোধ বেশ কমই ছিল শৈশবে। আত্মীয়- স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, বাবা-কাকার বন্ধুবান্ধব মিলে কত মৃত্যু দেখেছি, বাড়ির লোককে কাঁদতে দেখেছি, অথচ ভেজেনি চোখের কোণা। বরং মহিলাদের সীমাহীন বিলাপে বেশ বিরক্তই হতাম শৈশবে। শোক প্রথম স্পর্শ করল দিদা চলে যাবার সময়। সদ্য কলেজে উঠেছি আমি, মোড়ের মাথার ফোন বুথ থেকে কি যেন দরকারে ফোন করেছিলাম বড় মাসির বাড়ি, আজও মনে আছে মেজদা ধরেছিল ফোন। দুচারটে কেজো কথা বলে ফোন রাখতে যাচ্ছি, মেজদা বলল,‘দিদার সাথে কথা বলবি না? তুই ফোন করেছিস শুনে ছুটে আসছে দেখ না-’। একটা কলটাইম তখন শেষ হবার মুখে, দিদার সাথে কথা বলতে হলে আরো তিনটাকা দিতে হবে। তখনও আসেনি সহস্রাব্দ, তৎকালীন তিন টাকা বোধহয় বর্তমান কুড়ি পঁচিশ টাকার সমতুল। পয়সা বাঁচাতে বললাম, সপ্তাহান্তে তো যাবই দিদাকে দেখতে, তখন কথা বলব না হয় আশ মিটিয়ে।  


সেই সপ্তাহান্ত আর আসেনি। হঠাৎ অসুস্থতা, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, আর রাত গভীর হবার আগেই দিদার চলে যাওয়া। বড়মাসির বাড়ির সামনে এনে রাখা খাটে শায়িত বৃদ্ধাকে স্পর্শ করতে পারিনি আমি। পাগলের মত দিদার মুখে চুমু খাচ্ছিল মা আর মাসিরা। ডাকছিল ঠেলে, ঠেলে। বড়দা- মেজদা- সেজদা- ছোটদা না কাঁদার ভান করে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল চোখ লাল করে, আর আমি ভাবছিলাম, কেন সেদিন আর দুমিনিট কথা বলে নিলাম না। আর তো কোনদিন খুলবে না ঐ ভীষণ প্রিয় একজোড়া চোখ। 


কতদিন যে গুমরে গুমরে, ইনস্টলমেন্টে কেঁদেছি দিদার জন্য। ঘুমের ঘোরে নাকে এসেছে দোক্তা পাতা চেবানোর চেনা গন্ধ। আজও লিখতে লিখতে চোখ মুছে চলেছি দুই দশকেরও আগে হারিয়ে যাওয়া এক থপথপে আলুভাতে মার্কা বৃদ্ধার জন্য। 


শোকের দ্বিতীয় স্পর্শ পেয়েছিলাম যেদিন ঠাকুমা চলে গেল। সেদিন আবার আমার জন্মদিন। রাত দশটা নাগাদ প্যারালাল লাইনে ফোন করে নীচে ডাকল বাবা। কিছু কিছু মুহূর্ত বোধহয় ছেনি হাতুড়ি দিয়ে খোদাই করা থাকে স্মৃতিতে। ক্যাম্পখাটে শুয়ে আছে ঠাকুমা। পায়ের কাছে বসে রণক্লান্ত বাবা। একহাতে বাবাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোটকাকু, উল্টোদিকে ঠাকুমার সাবেকী পালংকের এক কোণে জড়ভরতের মত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে পিসি।  অন্যকোনে পা ঝুলিয়ে বসে বিলাপ করছে মা। দিন চারেক আগেই বাড়ি ফিরেছিল ঠাকুমা। নার্সিংহোম থেকে বলেই দিয়েছিল, নিছক সময়ের অপেক্ষা। সান্নিপাতিক রোগে সম্ভবতঃ মারাই গেছে মস্তিষ্ক,একা লড়াই করে চলেছে মূঢ় হৃদপিণ্ড। 


দুবেলা ছাড়ুন, একবেলা আয়া রাখার মত সামর্থ্যেরও তখন বড় অভাব। আর দরকারটাই বা কি? বাড়ি ভর্তি এত লোক আছে তো? মুখে বলা যত সোজা, হাতেকলমে কাজটা করা যে কত কঠিন তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমরা। বিগত চারদিন চোখের পাতা এক করেনি বাবা-দিদি(পিসি)-ছোটকাকু। দিনরাত নির্বিশেষে দুই খুড়তুতো ভাই অনর্গল ছুটে বেরিয়েছে নানা ওষুধ আর যন্ত্রপাতির সন্ধানে। আমার দায়িত্ব ছিল কেবল ওষুধ আর পথ্য দেওয়া। নাকে লাগানো টিউবের মুখটা খুলে, একটা বড় সিরিঞ্জ লাগিয়ে তার মধ্যে ঢেলে দিতাম ওষুধ বা পথ্য। তারপর পিষ্টনটা দিয়ে চাপ দিলেই নেমে যেত নাক দিয়ে ঠাকুমার দেহের ভিতর। কিরকম যেন একটা ঘড়ঘড় শব্দ করত ঠাকুমা, চোখের মণি গুলো যেন স্ফীত হয়ে কাউকে খুঁজত। ডান হাতে স্যালাইন চলত, ছোটকাকু এসে,বাঁ হাতটা ধরে মাঝে মাঝে জানতে চাইত,‘কি হয়েছে মা? কাকে খুঁজছ?’ বাপ-জেঠা-কাকা-পিসিদের মধ্যে ছোটকাকুই যে ছিল  ঠাকুমার প্রিয়তম সন্তান।


উপরোক্ত দুই ভদ্রমহিলাই ছিলেন আমার পরম আত্মীয়। বাবা, মা আর পিসির পর আমার তথা আমাকে সবথেকে ভালোবাসা মানুষ। তাঁদের জন্য শোকাহত হওয়া, চোখের জল ফেলাটা তাও মগজে ঢোকে, কিন্তু এই ভদ্রলোকের জন্য হঠাৎ উথলে ওঠা শোক কেমন যেন ধাঁধা লাগায়। আয়নার দিকে তাকালে, চেনা প্রতিবিম্বের আড়ালে স্পষ্ট দেখতে পাই অন্য একজনের ছায়া। আত্মীয়- অনাত্মীয় নির্বিশেষে যাবতীয় মৃত্যুতে ভেঙে পড়ত যে, ছুটে যেত শেষ বারের মত মৃত ব্যক্তিকে এক ঝলক দেখতে,  'একটা মানুষ চলে গেল, আর তাকে শেষ বারের মত দেখতে যাব না?' তখন মনে হত, নিছক আদিখ্যেতা আর আজ মনে হয়, দেখো মা আমি একদম তোমার মত হয়ে যাচ্ছি দিনদিন।

Monday, 8 November 2021

অনির ডাইরি ৮ই নভেম্বর ২০১৮


কি কুক্ষণে বলেছিলাম,“ ঘুমিয়ে পড় বাবু, তাহলে বিকালে তোকে ভূত সাজিয়ে দেব। ”“দেবে মা?সত্যি দেবে?” বাপের বাড়ি,মায়ের আদর আর অখণ্ড বিশ্রামের আমেজে তখন ভারি হয়ে এসেছে চোখের পাতা,বললাম,হ্যাঁ দেবোই তো। অবশ্যই দেব। এরপর শুরু হল প্রশ্নবান,কাকে ভয় দেখাবো? কি ভাবে ভয় দেখাবো?কি পরব? ভূতেরা কি জামাকাপড় পরে? কেনে কোথা থেকে?বানায় কে? ঘুম জড়ানো গলায় বললাম, বাপের জন্মেও কোন হিন্দি ইংরেজি বা বাংলা সিনেমায় উলঙ্গ ভূত দেখিনি। বরং হিন্দি “লাশ কা মাউন্টেন,খুন কা ফাউন্টেন” মার্কা সিনেমায় বরাবার দেখেছি,যে উদ্ভিন্ন যৌবনা যুবতী সর্বপ্রথম বস্ত্র উন্মোচন করতে উদ্যোগী হয়, ভয়াল আওয়াজ সহ ভূত বাবাজী প্রথমেই তার ঘাড় মটকায়। হুঁ হুঁ বাবা। ভূত অত্যন্ত সংস্কারী। 

এরপর প্রশ্ন তাহলে আমি কি পরব?মামমামের শাড়ি না দাদুর লুঙ্গি?“লুঙ্গি পরা ভূত” কেমন হয় ঘুম চোখে ভাবতে গিয়ে গেল ঘুম চটকে। যদি ভয় দেখাতে গিয়ে ইয়ে লুঙ্গি খুলে টুলে যায়-। তাহলে শাড়িই ভালো। সূর্য  পশ্চিমাকাশে মুখ লুকানোর সাথে সাথে প্রবল বায়না,“দাও। দাও। এখুনি ভূত সাজিয়ে দাও। দাদু আর দিদি(অর্থাৎ আমার পিসিকে) ভয় দেখাব। ” খুঁজে পেতে মায়ের পুরানো সাদা শাড়ি যোগাড় হল। তুত্তুরীর ধারণা ভূতেরা মাত্রই বিধবা। সিনেমায় তো সাদা শাড়ি পরে। এই শাড়িতে যদিও লালের আধিক্য প্রকট। অগত্যা পেত্নী আর শাঁখচু্ন্নির থিয়োরী বোঝালাম। জিন্সের প্যান্ট আর গোলাপী লাভ লেখা টিশার্টের ওপর গিঁট দিয়ে পরানো হল শাড়ি। এবার মেকআপ করে দাও মা। লাল লিপস্টিক ভূতভূতে করে ঠোঁটে মেখে রক্ত সিঞ্চিত ওষ্ঠাধর হল। সাধের কাজল পেন্সিলটিকে দিয়ে চোখে কালি ফেলাতে গিয়ে সেটি মট করে ভাঙল। ইত্যাদি প্রভৃতির পর দুহাত দিয়ে মাথার চুল ঘেঁটে একগলা ঘোমটা দিয়ে তু্ত্তুরী গেল সবাইকে ভয় দেখাতে। শুধু হাঁউমাউখাঁউ করে তেমন জমল না। তখন গল্প ফাঁদল,“আঁমি ১৬৯৯সাঁলে জঁন্মেছি। আঁমায় ইঁংরেজরা পুঁড়িয়ে মেঁরেছিল।” কমবেশী সবাই ভয় পেল শুধু বাবাকে যখন ভিডিও কল করা হল, বাবা বলল,“এত সাজগোজের কি দরকার ছিল?এমনিতেই তো ভূতের ছানা-”। ভিডিও কলে ঠিক ভয় দেখানো জমে না,কি বলেন?