Monday, 10 May 2021

অনির ডাইরি ৮ই মে, ২০২১

 



বলতেই পারেন, সুখের অসুখ। মাথার ওপর ছাত আছে, থালা ভরা গরম ভাত আছে, প্রিয়সান্নিধ্য আছে, তুত্তুরীর বকবকম আছে, হাত বাড়ালেই বন্ধু আছে, তবুও কেন জানি না দম বন্ধ হয়ে আসে কেবল। 


নৈমিত্তিক ব্যস্ত জীবন, দুরন্ত বেগে ছুটে চলা সময় আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেলে বোধহয় এমনি হয়। অজান্তেই তৈরি হয়ে যায় অনন্ত, ঘোর কৃষ্ণগহ্বর। অসুস্থ পৃথিবীর গর্ভ থেকে উঠে আসে এক তীব্র ভালো না লাগা, ভালো না থাকার বিষবাষ্প। যাতে ক্রমশঃ আক্রান্ত হয় হৃদয়। ভালো লাগছে না। কিছুই যেন, কিছুই কেন ভালোলাগছে না? 


ভালোলাগে বৈকি, ভালোলাগে ভোরের কাঁচা রোদ মাখা, পেলমেট থেকে ঝুলন্ত আমার সোনা রঙ ঝুমকো লতার দিকে তাকিয়ে থাকতে। ভোরের আলো মেখে আলতো করে কেমন ছুঁয়ে দিয়ে দিল কোণার টবে রাখা মাকড়সা গাছের হাত। বারন্দার একটেরে জানলা গলে যখন মুখ বাড়ায়, একটি দুটি লালচে গোলাপী রঙা নয়নতারা তখন তো দিব্য ভালোলাগে। শিরা-উপশিরা-রক্তজালক থেকে হৃদয়ে সঞ্চারিত হয় গভীর ভালোলাগা-ভালোবাসার তরঙ্গ। ভরে ওঠে মন। ভালোলাগে ঝাঁকড়া অপরাজিতার শাখে শাখে হন্যে হয়ে কুঁড়ি খুঁজে বেড়াতে। ‘ফুল ফোটাবি কি না বল, নইলে ছেঁটেই দেব ব্যাটা তোদের আজ’। এমনকি ভালো লাগে ভোর ভোর রোদে দিতে গিয়ে ক্যাকটাসের কাঁটার খোঁচা খেতেও-  বাকিটা সবটুকুই কেমন যেন নিকষ দমবন্ধ করা আঁধার।


ভাবছি পালিয়েই যাব। মহানগর থেকে অনেকদূর।  ভাবছি মোজাম্মেল সাহেবকে ধরব। একখান চাকরী দেবেন আমায়? ভদ্রলোক আমাদের দপ্তরেরই মজুরী পরিদর্শক ছিলেন, অবসর নেবার পর গ্রামের পৈত্রিক ভিটেতে একখান নার্সারি বানিয়েছেন। যতবার গেছি, একরাশ চারার সাথে সাথে এক অদ্ভূত প্রশান্তি মেখে ফিরেছি নিজ গৃহে। 


 অজগাঁ, চতুর্দিকে ঘন আমবাগানের ভিতর দিয়ে টলটল করতে করতে এগোয় গাড়ি। দিনের বেলাও কেমন যেন ছায়াচ্ছন্ন পথঘাট। আমবাগানে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে বড় গ্রীলের দরজা ঠেলে ঢুকতে হয়। ঢুকতেই বাঁদিকে একখান অতিকায় লিচু গাছ। বয়স তার সত্তর। তিনতলার ছাতে মাথা ঠেকিয়ে দুদণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে বোধধয়। সীমানা বরাবর পাহারা রত মহীরুহের দল আর তাদের মাঝে যতদূর চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ। হরেক রকম পাতাবাহারের গাছ, মরসুমি ফুলের গাছ, বারোমেসে ফুলের গাছ, ফলের গাছ, ত্রিপল আর জাল টাঙিয়ে গুচ্ছ খানেক ক্যাকটাস আর সাক্যুলেন্ট, শ্যাওলা ধরা চৌবাচ্ছায় ঢলঢল পদ্ম-শালুক, কি নেই? কে নেই? 


 অফিস ফেরৎ পড়ন্ত বিকেলে যখন গেছি, তখন গাছে জল দেবার সময়। কান পাতলেই শোনা যায় সদ্যসিক্ত গাছের পাতা থেকে কেমন টুপ করে খসে পড়ে মুক্তোর দানার মত জলকণা। কেমন সোঁদা সোঁদা গন্ধ ছড়ায় গ্রীষ্মের ভিজে মাটি।  


ভালো লাগে না বললে তো আর জীবন শোনে না। কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যেও ঠিক পথ খুঁজে নেয় জীবন।  ভালো লাগিয়ে নিতে হয়। দেহের সাথে সাথে যত্নআত্তি  করতে হয়, খাতির করতে হয় মনটাকেও।  মনকে সেলাম জানিয়ে, মনের যত্ন নিতেই ঠিক করলাম আজ বিরিয়ানি রাঁধব। রাঁধব বললেই তো আর রান্না হয়ে যায় না, বিশেষতঃ এমন বাদশাহী খানা। তার জন্য লাগে সহস্র উপকরণ।  মিটশেফ ঘেঁটে পেলাম আধ প্যাকেট বাসমতী চাল, হাফ বোতল করে গোলাপ আর কেওড়ার জল। সুগন্ধী আতর ভেবে যেটা বেরোল, ভালো করে শুঁকে দেখলাম ঐটি নিম তেল। গাছের পোকা মারতে কিনে এনেছিলাম কবে যেন। 


একখান প্লাস্টিকের কৌটোয় বিরিয়ানি মশলা খানা বানিয়ে রেখেছিলাম, তা হল বেশ কিছুদিন। কিন্তু সে ব্যাটা লুকালো কোথায়। আবাসনে একখান বিশেষ দোকান আছে, তাকে বিরিয়ানী মশলা বললেই, নিঁখুত ভাবে ওজন করে একরাশ গোটা মশলা গছিয়ে দেবে। কি থাকে না তাতে? বড় এলাচ,ছোট এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, জায়ফল, জয়িত্রি, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা, কাবাবচিনি, সাজিরা,সামরিচ আর কি যেন একটা ধুলো-ধুলো ঝুরো ঝুরো পাতা। সবটুকু মশলা চাটুতে নেড়ে,শিলে বেটে গুঁড়ো করে রাখতে হয়। চলেও অনেকদিন। বিগত পুজোয় বানিয়েছিলাম, গেল কোথায় ব্যাটা। কৌটো খুঁজে ঢাকা খুলতেই মন মাতানো সুবাসে ভরে উঠল রান্নাঘর। 


মাস্ক পরে আতর কিনতে নামলাম বটে, আতর শুনলাম মার্কেট থেকে বেপাত্তা। অন্য দোকান থেকে একটা আতর আনিয়ে দিল বটে দোকানি, কিন্তু সাবধান করে দিল, ‘খুব অল্প দেবেন ম্যাডাম। এটা সস্তা আতর, বেশী দিলে গা গুলোবে। ’ 


মশলা তো হল। চালও হল। এবার মাংসের পালা। বিরিয়ানি যে রাঁধব, সে তো বেলা সাড়ে নটায় সিদ্ধান্ত নিলাম। ততোক্ষণে বাজার দোকান সেরে স্নান করতে গেছে শৌভিক। মাংস এনেছে বটে, কিন্তু তা গরগরে ঝোলের মাংস। মাংস আনলেই আলু দিয়ে লম্বা ঝোল করতে বলে শৌভিক, এমন ঝোল যাতে চলে যাবে দুইবেলা।  বাবার ভাষায় এমন ঝোল যাতে গামছা পরে নেমে তুলে আনা যায় মাংসের টুকরো বা হাড়। স্নান করতে যাবার আগে ফরমাইশ ও জানিয়ে গেছে ছাপোষা উচ্ছে আলু ভাতে আর মাংসের ঝোল রাঁধলেই চলবে। পরিশ্রমও কম হবে, আবার বাসনও পড়বে কম। যে বাড়িতে সবাই এত আমার কথা ভাবে, সেই বাড়িতে কি আদৌ মন খারাপ করে থাকা যায়? 


খানিক মাংস তুলে রাখলাম। পরে স্ট্যু বানিয়ে দেবো ক্ষণ। বড় ভালেবাসে এরা মাখন আর চিজ দেওয়া আমার হাতের চিকেন স্ট্যু। বাকি মাংসে তিন টেবল চামচ টক দই, এক চামচ লেবুর রস, নুন,লঙ্কা গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, পরিমাণ মত মধু, রসুন বাটা, অল্প আদা বাটা আর বিরিয়ানি মশলা ভালো করে মাখিয়ে বেশটি করে চটকে মেখে রেখে দিলাম। 


থাকুক ঘন্টা খানেক ব্যাটারা অমনি ভাবে। বাসমতী চালকে তিনবার ধুয়ে, ভিজিয়ে রাখলাম। ওরাও থাকুক। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি আমার সবথেকে ভালো লাগে। আলু থাকে না বটে, তবে ঐ যে বেরেস্তা ছড়ায়, প্রতি গরাসে সুবাসি ভাতের সাথে টুকরো মাংস আর ভাজা পেঁয়াজের তরজা কেমন যেন নবাবী অনুভূতি জাগায়। তবে এ বাড়িতে মাংসের সাথে আলুর যা নিবিড় যোগাযোগ। বিরিয়ানিতে আলু না দিলে ছোটটা কিছু বলবে না হয়তো, বড়টা বড়ই বিমর্ষ হয়ে পড়বে।  অগত্যা- 


সবার আগে খোসা ছাড়ানো গোটা আলুগুলো নুন হলুদ মাখিয়ে সর্ষের তেলে ভেজে, অল্প সিদ্ধ করে তুলে রেখে, ঐ তেলেই গোটা দুই চামচ ঘি, অল্প জিরে, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা আর সামান্য গোটা গরম মশলা দিয়ে কুচানো পেঁয়াজ গুলো ভাজতে দিলাম। প্রাণে ধরে সবটুকু পেঁয়াজ দিতে পারলাম কই, বেরেস্তা বানাব থাক। বেরেস্তাই তো এই বিরিয়ানির প্রাণ। 


পেঁয়াজে রঙ সোনালী হলে মাখিয়ে রাখা মাংস গুলো ঢেলে কষতে হয়, বিরিয়ানি মশলা, টকদই, রসুন আর লঙ্কাগুঁড়োর সংমিশ্রণে ছড়ানো সুবাস, কানে কানে বলে যায়, পথটা ঠিকই ধরেছ যে । আদা বস্তুটা এরা মোটেই দেখতে পারে না, তবুও আরো একছটাক আদা না দিলে কেমন মন কেমন করে যেন। কষা শেষ হয়ে আসলে সামান্য ফেটানো টক দই, আরো খানিক বিরিয়ানি মশলা, অল্প লঙ্কা গুঁড়ো মেশাতে হয় মাংসে।  কষতে কষতে যখন মাংস ফেলে বুড়বুড়ি কেটে লাফিয়ে ওঠে শুধুই তেল, তখন ভেজানো বাসমতী চাল সাবধানে ছড়িয়ে দিতে হয় মাংসের ওপর। হাতা বা ছোট বাটি দিয়ে চেপে চেপে সমান করে দিতে হয় চাল। তারপর ঢালতে হয় নুন মেশানো জল। এই জল ঢালাটাই সবথেকে চাপের ব্যাপার। জল এমন হবে যাতে চাল হবে সুসিদ্ধ, কিন্তু বিরিয়ানি হবে ঝরঝরে। আমার নিজের হিসেব যতকাপ চাল তার থেকে ঠিক এক থেকে দেড় কাপ বেশী জল। 


জল গরম-ঠান্ডা যাই দেওয়া হোক কিছু যায় আসে না। শুধু নুনটা ঠিকমত হয়েছে কিনা দেখে, পাত্র ঢেকে মাঝারি গ্যাসে বেশ কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখা। মাঝে মাঝে ঢাকা খুলে দেখে নেওয়া লবণ কম হয়ে গেল নাতো। যখন ঢাকা খোলা হবে তখন অল্প করে দুধে গোলা জয়িত্রি বা কেশর, আর অল্প বেরেস্তা ছড়িয়ে দেওয়া। যেহেতু চাল হাফ সিদ্ধ, তাই খুন্তি দিয়ে সাবধানে সামান্য নাড়াচাড়া করে নিলেও কোন সমস্যা হয় না। বরং দেখে নেওয়াই ভালো, তলাটা ধরে গেলে গ্যাস কমিয়ে দেওয়া যায় যাতে। বেরেস্তা মেশানো হয়ে গেলে, ভাতও ঝরঝরে হয়ে আসবে, তখন সামান্য গোলাপ আর কেওড়ার জলের সাথে দু-চার ফোঁটা বিরিয়ানির আতর মিশিয়ে দিলেই হবে। চাল সামান্য শক্ত থাকতে থাকতে গ্যাস অফ করে ঢাকা দিয়ে দিতে দিলেই ব্যাস্ প্রায় অনায়াসেই তৈরি হয়ে এক কড়া বিরিয়ানি। 


দেখতে শুনতে তো বেশ ভালোই হয়েছিল, স্বাদেও অতি চমৎকার। অন্তত জনগণ তাই বলল, অবশ্যি ছিঁচকাঁদুনে  বলে এরা যে হারে আমায় প্যাম্পার করে, এদের কথায় না বিশ্বাস করাই ভালো। তবে খেতে বসে পুনরায় অনুধাবন করলাম উদরের সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক বড়ই রগরগে মাইরি। সেই যে মা বলতো না, ‘ভুঁড়ি ঠাণ্ডা তো মুড়ি ঠাণ্ডা’। দেহের বয়স বাড়লেও জীবন হাতেনাতে শিখিয়ে দেয়, মনের বয়স আজো আটকে আছে সেই মায়ের হলুদের গন্ধ মাখা আঁচলের তলে।

Saturday, 1 May 2021

অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২১

 অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২১

তখন অনেক রাত। দেওয়াল ঘড়ির বড় আর ছোট কাঁটা এক হয়েও পুনরায় বিচ্ছিন্ন।  পাশের ঘরে ফুললতা আঁকা মিটমিটে ল্যাম্পের আলোয় মোৎজার্টের কত নম্বর যেন সুরের মূর্ছনায় মোহিত শৌভিক। আধা ঘুমন্ত তুত্তুরীকে ঠেলে তুলে কানে ফোন চেপে ধরল তুত্তুরীর মা। ‘আঃ এখন কেন? যখন ওরা বিয়ে করেছিল তখন শুভেচ্ছা জানাব। ’ গত বছরেও এসব কথা বলত না মেয়েটা।  ইদানিং জ্যাঠাইমার ভাষায় পিপুল পাকছে।  সব বিষয়েই সুচিন্তিত মতামত দেয়, না চাইলেও। যার অধিকাংশই বাবার রঙে রঞ্জিত।  তা হোক। যত বয়স বাড়বে মায়ের সাথে শত্রুতা ততো বাড়বে আমি জানি। কারণ শাসন করার তিক্ত দায়িত্ব যে শুধু মায়ের। বাবা মানে তো অখণ্ড প্রশ্রয় আর অনাবিল বন্ধুত্ব।  


জোর করেই মেয়ের কানে ফোনটা ধরলাম। প্রিয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কখনও পরে বা কাল থাকতে নেই।  কে জানে কাল কি হয়। বিরক্ত হয়ে শুভ বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাল তুত্তুরী। মা অবশ্য তাতেই বিগলিত। বাবাও কিছু মনে করল না দেখি, তবুও অর্বাচীন সন্তানের জননী হিসেবে মার্জনা চাইলাম উভয়ের কাছে। বড্ড বদমেজাজী মেয়েটা আমার। অবশ্য ঐ বয়সে আমিও তাই ছিলাম। ভয়ানক অমিশুক এবং উন্নাসিক। 


ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল বাবার গমগমে গলার ধমক, ‘ নাঃ ও বদমেজাজি নয়। ও ঠিক আমার মতই অভিমানী। তুমি কি জানো আমি ওর বয়সে কি সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটিয়েছিলাম?’ এতরাতে বৃদ্ধবৃদ্ধার ঘুম ভাঙিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি জানলে তুলকালাম করবে শৌভিক। এখনও নেভেনি অবশ্য পাশের ঘরের আলো, কি যেন একখান আফ্রিকান গান চালালো শৌভিক। মাঝে মাঝে আমাকেও ডেকে শোনায়। যাই হোক তার মানে শুতে আসতে দেরী আছে আরো কিছুক্ষণ। 


বলো না বাবা গল্পটা। বেশী পিড়াপিড়ি করতে হল না, বৃদ্ধ বলবে বলেই উঠে এসে বসল ডাইনিং টেবিলে, ‘দাঁড়াও একটা ধূম খাই। ’ ধূম অর্থাৎ সিগারেট। ধোঁয়া ছেড়ে গল্প শুরু করল বাবা, ‘আমি তখন বছর নয়েক।  আমি তখন চতুর্থ শ্রেণী। কি কারণে যেন ভীষণ অভিমান হয়েছিল, সম্ভবতঃ ছোটকাকার কাছে প্যাঁদানি খেয়েছিলাম। তোমাকে তো বলেছি, আড়ালে ছোটকাকাকে আমরা চোরা (মহিষাসুর) বলে ডাকতাম। তেমনি চেহারা ছিল। নিয়মিত মুগুর ভাঁজত। ইয়া বড় বড় ছিল হাতের গুলি। ’ আঃ বাবা, প্রসঙ্গান্তরে যেও না। ‘না। না। তো সুযোগ পেলেই শাসন করত ছোটকাকা। বকা, কানমলা, ঠ্যাঙানি। বাবা-মা কিছুই বলত না। তো সেদিনও তেমন কিছু হয়েছিল বোধহয়। এত অভিমান হল, ভাবলাম গৃহত্যাগ করব। সকাল নটা নাগাদ বেরোলাম স্কুলে যাব বলে। মোড়ের মাথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখি একটা ফাঁকা ঘোড়ার গাড়ি। তখনও পঞ্চানন তলা রোড দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চলত।


গাড়ির পিছনে উঠে বসলাম। গাড়োয়ান গুলো করত কি, মাঝে মাঝে পিছন দিকে ছিপটি গুলো ঘোরাত, যাতে কোন দুষ্টু ছেলে যদি উঠে বসে তার গায়ে লাগবে সপাৎ করে। যতবার গাড়ি আস্তে হয় আমি টুক করে নেমে পড়ি, সপাং করে ছিপটি ঘুরিয়ে যেই গাড়ি স্পিড তোলে, আমিও লাফিয়ে উঠি। এইভাবে কতদূর গেলাম জানি না, হঠাৎ গাড়িটা থেমে গেল। গাড়োয়ানটা বোধহয় চা খেতে গেল, আমি নেমে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি, দেখি একদল লোক এসে বসল গাড়িটায়, গাড়িটাও অমনি তাদের নিয়ে ছেড়ে দিল। 


আমি তো বেকুবের মত দাঁড়িয়ে আছি। দেখি সেটা একটা রেল স্টেশন। সামনের সরু সুড়ঙ্গ দিয়ে মানুষ ওঠা নামা করছে, আমি নেমে ওপাশে উঠে দেখি শ্রীরামপুর স্টেশনে আছি। একটা ট্রেন দাঁড়িয়েছিল, চুপচাপ উঠে পড়লাম। উঠে বসে আছি, তো বসেই আছি। ট্রেন ছুটছে, আচমকা অণ্ডাল স্টেশনে আমায় চেকার ধরল-’। 


অণ্ডাল? সে তো অনেকদূর গো বাবা। তুমি অত দূর চলে গেলে ন- দশ বছর বয়সে? ‘হ্যাঁ। তবে আর বলছি কি। চেকার বলল, টিকিট দেখা। বললাম নেই। সে তো মহা হম্বিতম্বি করে, কান ধরে নামিয়ে স্টেশন মাস্টারের ঘরে নিয়ে গেল। দেখলাম ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, অনেকটা তুলসি চক্রবর্তীর মত দেখতে, ধুতি পরা একটা লোক খালি গায়ে  বসে বসে কি সব কাজ করছে। চেকার বলল, ‘এই দেখুন মাস্টারমশাই, এ হারামজাদা এই বয়স থেকেই  বিনা টিকিটে যাত্রা করছে। ’ মাস্টারমশাই, মাথা তুলে ইশারায় কি বলল, চেকার আমায় দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেল। 


আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। আচমকা লোকটা মুখ তুলে আমার খেঁকিয়ে উঠল, ‘অ্যাই হতভাগা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হাতপাখাটা দেখতে পাচ্ছিস না? বাতাস কর।’  লোকটার মাথার ওপর একটা বোধহয় বৃটিশ আমলের ডিসি পাখা ঘটাং ঘটাং করে ঘুরছিল। তাও দরদর করে ঘামছিল লোকটা। আমি ভয়ে ভয়ে হাতপাখাটা দিয়ে বাতাস করতে লাগলাম।  


বেশ অনেকক্ষণ পর, লোকটার হিসেব বোধহয় মিলল, মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘তুই কে? বাড়ি কোথায়? পালিয়েছিস?’ আমি ভয়ে ভয়ে সব সত্যি কথাই বললাম, তখন লোকটা আমায় নিয়ে গিয়ে পেট ভরে খাইয়ে পরের ট্রেনে গার্ডের কামরায় তুলে দিল। তুলে দেবার সময় জিজ্ঞাসা করল, ‘তোকে হাওড়ায় নামিয়ে দিলে বাড়ি যেতে পারবি?’ আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম পারব। তখন জানতে চাইল ,‘কি ভাবে যাবি?’ আমি বললাম, বেরিয়ে ৫৩নম্বর বাস ধরে চলে যাব। লোকটা আবার প্রশ্ন করল, ‘ভাড়া কত জানিস?’ বললাম এক আনা। লোকটা পকেট থেকে একটা গোটা টাকা আর একটা আনি বার করে আমায় দিয়ে বলল, ‘সাবধানে বাড়ি চলে যাস। আর কোথাও পালাস না বাপ। ’ আর গার্ডকে বলল, ‘এর কাছে টিকিট নেই।  হারামজাদাকে হাওড়া স্টেশন থেকে বার করে ৫৩ নম্বর বাসে তুলে দিয়ে কন্ডাক্টরকে একটু বলে দেবেন ক্ষীরেরতলা স্টপে যেন নামিয়ে দেয়। ছোঁড়া মহা বিচ্ছু। ’ গার্ড আমায় এনে ৫৩নম্বর বাসে তুলে দিল, আমি যখন নাচতে নাচতে বাড়ি ঢুকলাম, তখন সন্ধ্যে ছটা বেজে গেছে। আমার পকেটে তখনও ঠংঠং করছে একটা গোটা টাকা-’।  


এই দুর্ধর্ষ ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রায় অর্ধশতাব্দী যে কি ভাবে ঘর করেছে মা তা বোধহয় কেবল মাই জানে। আজ এঁণাদের বিবাহের পাক্কা ৪৭ বছর পুরো হল। পরিকল্পনা তো ছিল অনেক, থাক না হয় অন্য কখনও হবে। আপাততঃ সুস্থ হয়ে উঠুক পৃথিবী। ততোদিনে আরো গভীর হোক এঁদের প্রেম, আরো মধুর হোক দাম্পত্য। কাটুক মায়ের মনের যাবতীয় মেঘ, সিগারেট ছাড়ুক বাবা, আর পারলে মিষ্টিটাও। বড্ড মিষ্টি খাও মাইরি বাবা তুমি, বললেই অবশ্য গোঁসা হবে তোমার- তা হোক তবুও বলি যেমন আছো তেমনি থাকো তোমরা শুধু সিগারেট আর মিষ্টিটাকে মারো গুলি।



Thursday, 29 April 2021

কোভিড কথা

 কোভিড কথা - ২৯শে এপ্রিল, ২০২১


১। বাতাসের শতকরা ২১ ভাগই হল অক্সিজেন। এমনিতে একজন সুস্থ মানুষ এই ২১ শতাংশ অক্সিজেন নিয়ে দিব্য থাকতে পারে, কিন্তু কোভিডে ধরলে বা শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তা মোটেই যথেষ্ট নয়। তখন প্রয়োজন শতকরা ৯৮ ভাগ বিশুদ্ধ অক্সিজেন। যা পাওয়া যায় অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে এবং বর্তমানে যার তীব্র আকাল সমগ্র দেশ জুড়ে। 


২। জানেন কি, আমাদের দেশে অক্সিজেনের আদতে কোন ঘাটতি নেই? যেখানে এই পরিস্থিতিতেও দেশের মোট চাহিদা দৈনিক ৭০০০ মেট্রিকটন মাত্র, ভারতের  উৎপাদন ক্ষমতা ৭৮০০ মেট্রিকটন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত সরকার যা বাড়িয়ে করেছেন ৯০০০ মেট্রিকটন। 


২। আমাদের সমস্যা উৎপাদন নয়, সমস্যা হল পরিবহন। অক্সিজেন গ্যাসকে তো আর এমনি পরিবহন করা যায় না।  -১৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তরল অক্সিজেন পরিবহন করতে প্রয়োজন বিশেষ ধরণের ট্যাঙ্কার, যাদের বলে ক্রাইওজোনিক ট্যাঙ্কার। 


৩। কি ভাবছেন এই ক্রাইওজেনিক ট্যাঙ্কার আমাদের নেই? নাঃ মশাই,দিব্যি আছে। কিন্তু যখন আচমকা ফিরে এল মহামারী, দেখা গেল সংখ্যা অপ্রতুল হলেও আছে তো, কিন্তু ছড়িয়ে আছে দেশ জুড়ে। 


৪। ভারতে অক্সিজেন মূলতঃ তৈরী হয় রাউড়কেল্লা, দুর্গাপুর, ভাইজাগ ইত্যাদি স্টিল প্ল্যান্ট গুলিতে। খালি ট্যাঙ্কার গুলিকে এই প্ল্যান্টে পৌছানো  এবং ভর্তি ট্যাঙ্কার নিয়ে যাওয়ার জন্য আপাততঃ কোমর বেঁধে নেমেছে ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং ভারতীয় রেল।  


৫। বায়ুসেনার সবথেকে বড় যুদ্ধ বিমান সি-১৭ গ্লোব মাস্টারে ভর্তি করে আনা হচ্ছে খালি ট্যাঙ্কার, আবার ভর্তি ট্যাঙ্কার নিয়ে দৌড়চ্ছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে।  


৬। তেমনি একসাথে অনেকগুলি খালি বা ভর্তি ট্যাঙ্কার বহনের জন্য ভারতীয় রেল চালু করেছে RO-RO Train Service। সোজা কথায় Roll-on/roll-off। শয়ে শয়ে ট্যাঙ্কার একলপ্তে পরিবাহিত হচ্ছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে।  


৭। এছাড়াও সিঙ্গাপুর থেকে বেশ কিছু ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার আমদানি করেছে ভারত। বেশ কিছু ট্যাঙ্কার আনিয়েছে টাটাও।  


৮। পাশে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।ভারতীয় সেনাদের জন্য  DRDOর বানানো বিশেষ ভাবে তৈরী অক্সিজেন সিলিণ্ডারও দেওয়া হচ্ছে নানা হাসপাতালে।  


৯। জার্মানি থেকে ২৫ খানা পোর্টেবল অক্সিজেন জেনারেশন প্ল্যান্ট কিনেছে ভারত। যা ঝটপট বাতাস থেকে নিঙড়ে নেবে বিশুদ্ধ অক্সিজেন।  


১০। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। তবে রাতারাতি তো আর বদলাবে না। বদলাতে লাগবে সময়। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই বারংবার বলে চলেছেন আগামী ১৫-২০শে মে’র মধ্যে শীর্ষে পৌছাবে করোণার দ্বিতীয় ঢেউ। যখন দৈনিক সংক্রমণের মাত্রা ছোঁবে ৫ থেকে ১০ লাখ। প্রত্যহ মারা যাবেন পাঁচ থেকে দশ হাজার মানুষ। তাই এই মুহূর্তে সবথেকে জরুরী যেটা, সেটা হল সাবধানে থাকুন। নিয়ম মেনে চলুন। মাত্র কটা দিন। চায়ের ঠেকের মাতব্বররা যাই বলুক না কেন, সরকার সচেতন হয়েছে, লোহার বাসরঘরের ফুটোও মেরামত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। পরিস্থিতি বদলাবেই।  আপাততঃ যেটা করবেন- 

ক) মাস্ক, স্যানিটাইজার, দূরত্ববিধি ছাড়াও রোজ জিঙ্কওয়ালা একটা ভিটামিন খান নিয়ম করে। 

খ) খান ভিটামিন সি।  

গ) মাপতে থাকুন অক্সিজেন। অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫ এর সামান্য নীচে নামলেই অক্সিজেন খুঁজতে বেরোবেন না। প্রুনিং পোজিশনে শুয়ে পড়ুন। জানেন তো আমাদের দুই ফুসফুসেরই কিছুটা অংশ বিশেষতঃ মাঝের অংশটুকু সাধারণ ভাবে অব্যবহৃত থেকে যায়।  এমতবস্থায় যদি বুকের নীচে দুটো বালিশ রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন, ফুসফুসে যে চাপ পড়ে, তাতে চলতে শুরু করে ঐ অংশটুকুও। সকাল বিকাল আধঘন্টা করে অমন শুয়ে থাকুন। মাঝে মাঝে পাশ ফিরে শোন।  তবে দুটো হাতই যেন একদিকে থাকে। তারপর পীঠে বালিশ ঠেস দিয়ে কিছুক্ষণ বসুন। এতেই কাজ হবে।


সবশেষে বলি আবারও সাবধানে থাকুন, অযথা আতঙ্কিত হবেন না। ভরসা রাখুন। এই অন্ধকারেও আমরা একা নই। বন্ধুরা আছেন। রাশিয়া যেমন কথা দিয়েছে প্রতি সপ্তাহে ৪ লক্ষ করে রেমডেসিভার পাঠাবে। পাঠাবে অক্সিজেন। ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার। এমনকি পাশে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানও। 


ভিরাফিনের গল্প শুনেছেন তো? আমাদের নিজেদের তৈরী ওষুধ, বানায় আমাদের ঘরের কোম্পানি Zydus Cadila। ভিরাফিন কিন্তু অনেক দিন ধরেই বাজারে চলে, হেপাটাইটিস-বি এর ওষুধ হিসেবে। ভিরাফিন যেটা করে তা হল আমাদের শরীরে ইন্টারফেরন আলফা নামক কোষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। যারা মুখোমুখি যুদ্ধ করে শরীরে অনুপ্রবেশকারী যে কোন অবাঞ্ছিত অতিথির সাথে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসও  RNA ভাইরাস আর কোভিডও তাই।  পরীক্ষা করে দেখা গেছে মাত্র সাতদিনে কোভিডকে ঠেঙিয়ে বের করে দেয় এই ওষুধ। রাতারাতি ভারত সরকার অনুমতি দিয়েছে ভিরাফিন ব্যবহারের, তবে শুধু মাত্র হাসপাতাল গুলিতে।  


যাই হোক মোদ্দা কথা আবার বলি- সাবধানে থাকুন। অন্তত ২০শে মে অবধি টিকে থাকুন।  তারপর পরিস্থিতি বদলাবেই।  আমি ভয়ানক আশাবাদী।  


কোভিড কথা- ৩০শে এপ্রিল, ২০২১


আজকের পরিসংখ্যান দেখেছেন নাকি? সরকারি বুলেটিন অনুযায়ী গত ২৪ ঘন্টায় রাজ্যে নতুন করোনা আক্রান্ত ১৭,৪১১, মোট নমুনা পরীক্ষার(৫৩,২৪৮) প্রায় ৩২.৬৯% । মৃত ৯৬ জন।


সারা ভারতের আজকের পরিসংখ্যান এখনও সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু গতকালই আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ লক্ষ ৮৬ হাজার মানুষ। মৃত সাড়ে তিন হাজার। বিগত বেশ কিছুদিন ধরে এই পরিসংখ্যান খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি আমি, দেখাচ্ছি আমার টিমকে। কারণ যাই হোক, আপিসটা তো করতে হবে-। আবার পিতৃদত্ত প্রাণটাও বাঁচাতে হবে।  তো যা বলছিলাম, নিয়মিত পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করলে যেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখা দেয় তা হল, প্রতিনিয়ত যে সংখ্যক মানুষ খাতায়কলমে আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন তার শতকরা ১ ভাগ মানুষ। 


এমতবস্থায় আজকে আত্মপ্রকাশ করা মাননীয় মূখ্য সচীবের যে অর্ডারটিকে (618-ISS/2M-22/2020 dated 30th April, 2021) ঘিরে এত বিতর্ক, এত বিশেষ ভাবে অজ্ঞ মতামতের আদানপ্রদান চলছে, সেটা যদি একটু কষ্ট করে পড়ে দেখেন, তাতে কোথাও 'আংশিক লকডাউন' শব্দবন্ধটি ব্যবহারই করা হয়নি। 


এতে বলা হয়েছে যে বিগত ২৫ এবং ২৯ তারিখে প্রকাশিত ভারত সরকারের স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ দপ্তরের দুটি নির্দেশনামা অনুসারে এবং বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ২২ নং ধারা অনুসারে-


'১। সমস্ত শপিং কমপ্লেক্স, মল, বিউটি পার্লার, সিনেমা হল,  জিম, সুইমিং পুল, স্পা, রেস্তোরাঁ, বার সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।  কিন্তু হোম ডেলিভারি এবং যাবতীয় অনলাইন সার্ভিস খোলা থাকবে।'


অর্থাৎ রেস্তোরাঁ বন্ধ বলে যারা হাহুতাশ বা মুণ্ডপাত করছিলেন, তা কিন্তু যথার্থ নয়। গিয়ে বসে খেতে পারবেন না বটে, সুইগি, জ্যোমাটো কিন্তু এনে দিতেই পারে। মল বন্ধ বটে কিন্তু চলতেই পারে অ্যামজন, মিন্ত্রা বা নাইকাতে শপিং।  


'২।যাবতীয় সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষামূলক বা বিনোদনমূলক জমায়েত নিষিদ্ধ। '


এখন এই নিয়ে যদি আপনার মটকা গরম হয়, তো দাদা/দিদি আইসব্যাগ কিনে নিন না একটা।


 

'৩। বাজার/হাট খোলা থাকবে  সকাল ৭-১০টা আর বিকাল  ৩-৫টা।  কিন্তু যাবতীয় মুদির দোকান, ওষুধের দোকান বা মেডিক্যাল ইকুইমেন্টের দোকান ইত্যাদি আপদকালীন পরিষেবা মূলক দোকানগুলি এই নিয়মের মধ্যে পরে না। '


আর বলা হয়েছে যে 'কাউন্টিং হল বা বিজয়ীদের মিটিং, মিছিল , রালি ইত্যাদি কেবল মাত্র নির্বাচন কমিশনের ২৭ শে এপ্রিলের নির্দেশ নামা মেনেই হবে। বলা হয়েছে কেউ যদি এই নির্দেশনামা উলঙ্ঘন করেন তবে বিপর্যয় মেকাবিলা আইন এবং আইপিসি অনুসারে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'  


মোটামুটি আক্ষরিক তর্জমা করে দিলাম, অর্ডার নম্বরটিও দিলাম, পারলে একবার আসল অর্ডারটি পড়ে নিন। ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে নিজগুণে মার্জনা করবেন। 


এখন আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন এই নির্দেশনামা কবে থেকে বলবৎ হবে? উত্তর হল আজ থেকেই। পড়তে গেলেই দেখতে পাবেন লেখাই আছে, ‘This order will take immediate effect’।  কতদিন পর্যন্ত? যতদিন না পরবর্তী নির্দেশনামা বেরোচ্ছে।  ততদিন পর্যন্ত সাবধানে থাকুন, নিয়ম মেনে চলুন, মাস্ক পরুন, হাত সাফ রাখুন, ভিটামিন খান, অক্সিজেন মাপুন আর প্লিজ প্লিজ উল্টোপাল্টা গুজব ছড়াবেন না বা তাতে কান দেবেন না। কেমন?

 অনির ডাইরি ২৭শে এপ্রিল, ২০২১


একসাথে দল বেঁধে সাঁতার কাটত হাঁসগুলো। নালার দৈর্ঘ্য বরাবর গাঁয়ের এমুড়ো থেকে ও মুড়ো অবধি সাঁতরে যেত আবার ফিরে আসত। 'ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে, তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে', দাওয়া থেকে হাঁক পাড়ত দিদা, ‘ আয়- আয়- আয়- চৈ-চৈ-চৈ’। কি ভাবে বুঝত কে জানে, হাঁক শুনলেই, ঠিক দিদার হাঁসগুলো দলচ্যুত হয়ে উঠে আসত পাড়ে। তারপর পশ্চাদ্দেশ বেমক্কা উঁচু করে, উন্নাসিক সুন্দরীদের মত গিয়ে সেঁদিয়ে যেত আপন বাসায়। শেষ হাঁসটা ঢুকে পড়লেই ঝাঁপ ফেলে দিত দিদা। ঝাঁপের ওপর লেখা ছিল, ‘হাঁসেদের বোটেকখানা’-সৌজন্য সেজদা। প্রসঙ্গতঃ বোটেকখানা হল আপনাদের বৈঠকখানা। 


বছরে একবারই যেতাম দিদার বাড়ি। সারা বছর তীর্থের কাকের মত পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত দিদা। অপেক্ষা করত শেষ বাসের জন্য। যদি কেউ নামে। শেষ বাস চলে গেলে অপেক্ষা করত পোস্টম্যানের জন্য। যদি আসে কারো চিঠি- দাদপুরের স্বর্গীয় শিক্ষক মনোরঞ্জন দাশের কন্যা স্বর্গীয়া সুনীতি রাণী ঘোষের মনের জোর ছিল সাংঘাতিক। 


বড় দূরে থাকত দিদা। সেই উত্তরবঙ্গের সীমান্ত ঘেঁষা অজগ্রাম রামনগর। যাবার হ্যাপা কি কম? বেশ কদিনের ছুটি ছাড়া যাওয়া যায় নাকি? কাশ আর শিউলি ফুটলে তবে না যাব দিদার বাড়ি। কাক না ডাকা ভোরে ঘুম থেকে তুলে রেডি করে দিত মা। বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে আমরা যখন বেরোতাম তখন রাতপাহারা শেষে ঘুমের তোরজোর করত পাড়ার নেড়িরা। 


সৎসঙ্গের সামনে থেকে মিনিট তিনেক হেঁটে গলির মোড়। মোড়ের মাথায় তখনও ঝাঁপ বন্ধ সারি সারি দোকান। বরাবরের দিলখোলা বেহিসেবী বাবা, আর কিঞ্চিৎ  বুঝে চলা ঘোর সংসারী মায়ের ছুটকো দাম্পত্য কলহের ফাঁকে চাতক পাখির মত চেয়ে থাকা, হে ভগবান, হে মা দুগ্গা, হে শিবঠাকুর একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পাঠিয়ে দাও- 


ট্যাক্সির ফালতু খরচ ভাঁজ ফেলত মায়ের প্লাক না করা ভ্রু যুগলে। বাবার মুখের দরাজ হাসি দেখে বেশ বুঝতে পারতাম, ‘আজি প্রাতে সূর্য ওঠা, সফল হল কার ’। নিজের শহরকে ছেড়ে যাবার যাবতীয় বিষাদকে জানলা দিয়ে উড়িয়ে হলদে ট্যাক্সি দৌড়ত হাওড়া ব্রীজের পেট চিরে। মহাত্মা গান্ধী রোড তখন প্রথম আলোয় সদ্যস্নাত। কলেজ স্ট্রিটের মুখে ডাঁই করে রাখা সবুজ ডাবের পাহাড়, মেহবুব ব্যাণ্ডের বন্ধ দোকান ছাড়িয়ে শিয়ালদা। সকাল আটটার লালগোলা প্যাসেঞ্জার। কুলিকে টাকা দিয়ে চলন্ত ট্রেনে সিট রাখত বাবা। জানলার ধারের সিট। রাণাঘাট অবধি ডিজেল ইঞ্জিন, রাণাঘাট থেকে কয়লা। নাকি উল্টোটা? আজ আর মনে আছে থোড়াই। শুধু এটুকু মনে আছে কয়লার ইঞ্জিন হলে হাওয়ার দিকে বসলে চোখে এসে পড়ত কুটো।  


প্রথম দিকে রান্না করে নিয়ে যেত মা। অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন কৌটো ভরে লুচি তরকারী আর সুজি। কেউ ছুঁতাম না আমরা। ট্রেনে উঠে ঘরের খাবার খাব ক্যান। নৈহাটির ঝালমুড়ি দিয়ে শুরু হত মুখচলা। ঠোঙা ভর্তি কুন্দ ফুলের মত মুড়ি, মাখামাখি ঝাঁঝালো সর্ষের তেল, পেঁয়াজ কুচি, মুড়ি মশলা আর লাল বাদামে। সবার ওপর কাস্তের মত একখানি নারকেলের টুকরো। ঝাঁঝালো তেলের স্বাদে গন্ধে নাকের জলে মিশত চোখের জল।  উঠত কাঁচের বাক্স ভর্তি মিষ্টি। শালপাতার দোনায় কি ছানার রসালো মিষ্টির সোয়াদ বেড়ে যায়?  উঠত মিষ্টি ডালমুট। সুতো দিয়ে কাটা গরম সিদ্ধ ডিম। রাণাঘাটে ইঞ্জিন বদলাত, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত গাড়ি। প্লাটফর্মে বিক্রি হওয়া কচুরি, ঝোল ঝোল কুচো আলুর তরকারী আর ছানার জিলিপি কিনে আনত সেজোমাসি।


খেতে খেতে কখন যে এসে পড়ত দেবগ্রাম ইস্টিশন। আর দুটো ইস্টিশন পরেই নামতে হবে আমাদের।  মাঝে পড়বে পাগলাচণ্ডী নদী। নাকি নদ? ভিখারির মত হাত পেতে বসে থাকতাম যদি একটা পাঁচ বা দশ পয়সা দেয় বাবা। নিদেনপক্ষে যদি ২ পয়সাই দেয়,  ছুঁড়ে ফেলব নীচে নদীর বুকে। ছোট মেসো একবার পঁচিশ পয়সা দিয়েছিল, কি বকেছিল মা সেবার। আর একবার মাকে লুকিয়ে পাক্কা একটি টাকা গছিয়েছিল ছোট মেসো, সেদিনের ফূর্তির কথা ভেবে আজও লিখতে লিখতে হাসির ঢেউ খেলে যাচ্ছে আধবুড়ো ওষ্ঠাধরে।  যাই বলুন শৈশব বড় দামাল, বড় বাচাল, বড় বেশী বেহিসেবী। তাই বুঝি শৈশব এমন মূল্যবান। হারিয়েও হারায় না।  


শৈশব যে সত্যিই হারায় না, বারবার ফিরে ফিরে আসে, তা আমার বৃদ্ধ বাবা-মা-পিসি-শ্বশুর আর শাশুড়িমাতাকে নিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বাপস্!পাঁচ-পাঁচটা ধেড়ে খোকাখুকুকে সামলাতে রীতিমত নাকের জলে চোখের জলে তুত্তুরীর বাবা-মা। তাও আমাদের দাবী অতি সামান্য, দয়া করে ভ্যাকসিনটি নিয়ে আমাদের ধন্য করো। 


যখনই ভ্যাকসিন নেবার দিন ঠিক হয়, কোথা থেকে যে সমস্যা পেড়ে আনে এরা। ওদিক থেকে বাবা হুঙ্কার ছাড়ে, ‘আমাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেবে না’। তো এদিকে শ্বশুরমশাই বাঁধান জ্বর। তা হ্যাঁ বাবা, যতবার ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে যাব বলব, ততোবার জ্বর বাঁধাবেন আপনি। ওঃ থুড়ি, আজকাল আপনি বললে হেব্বি রেগে যাচ্ছে বৃদ্ধ। বারো বছরের অভ্যেস রাতারাতি বদলে আমায় কইতে হবে তুমি। যতই বলি, ওরে বাবা, আমি সাবেকী বাড়ির মেয়ে, ঠাকুমার কাছে মানুষ,স্বভাব চরিত্রে যতই উগ্র নারীবাদী হই না কেন, মানুষটা বেশ সেকেলে। সময় তো দিতে হবে। রাতারাতি কাউকে আপনি থেকে তুমি আর তুমি থেকে তুই বলতে পারি না আমি। উমা তো সেই কবে থেকে ভয় দেখাচ্ছে, 'আমাকে তুই বলবে কি না,বলো।' তাকেই পারি না। এই তুই কই,তো এই তুমি।  


শেষ পর্যন্ত অবশ্যি শ্বশুরমশাইকে ছাড়াই বাকিদের ছুঁচ ফুটিয়ে আনলাম আমরা। যথারীতি ভ্যাকসিন নেবার দিন সকাল থেকে জ্বরে শালিকপাখির মত চিচি করছিলেন শ্বশুরমশাই। দীনু খুড়োও বলল, ‘জিতেন দাকে তোরা এবার ছাড়। দেখ না মাস তিনেক পর,পাড়ার দোকানে বিক্রি হবে ভ্যাকসিন। তখন শঙ্কর এসে দিয়ে যাবে খন। ’ দা গ্রেট দীনু খুড়োর নির্দেশ শিরোধার্য। লোকটাকে যে বেজায় ভালোবাসি মাইরি- 


চার চারটে নড়বড়ে মানুষকে ভ্যাকসিন ফুটিয়ে গাড়িতে তুলে যার যার কুলায় ফিরিয়ে দিতে দিতে আর দ্বিতীয় ডোজটা নেওয়া হয়নি আমার। গোটা রাস্তা শাশুড়ী মা দুঃখ করতে করতে এলেন, ‘আমাদের সামলাতে গিয়ে তোমারই আর নেওয়া হল না। ’ বোঝাতে পারলাম না, বাবা মা হলে তো এমনিই হয়। তোমরাই তো শিখিয়েছ। 


আর যেটা ওণাকে বলতে পারিনি তা হল,আমার পরিবার যে আসলে বিরাট বড়। শুধু কি রক্ত আর বৈবাহিক সম্পর্কে আমি জননী? দপ্তরী সম্পর্কে নই? তাহলে আপিস মাস্টার মানে কি? নিছক প্রভু? কেবল প্রভুত্ব করব? ভালোবাসব না? 


প্রায় কান ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম গোটা টিমকে ভ্যাকসিন দিতে। চুঁচুড়ার ইমামবাড়া হাসপাতালের এসিটেন্ট সুপারের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। নাঃ কোন ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দেননি উনি আমাদের এযাত্রা। প্রথম ডোজের সময় দিতে পারলেও, এ যাত্রা দিতে অপারগ তা প্রথমেই জানাতে কসুর করেননি। আমরাও চাইনি, সকাল থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো অশীতিপর মানুষদের নাকের ডগা দিয়ে গটগট করে ভ্যাকসিন নিতে। তাই কতজন ভ্যাকসিন নেবো জানিয়ে, সুপার সাহেবের বেঁধে দেওয়া সময়ে দলবেঁধে হাজির হয়েছিলাম আমরা। তারপরও হয়তো বেশ খানিকক্ষণ বসতে হয়েছে, দাঁড়াতে হয়েছে। আমাদের সঞ্চিতা আর সায়নী টেনশন করেছে,যদি ভ্যাকসিন ফুরিয়ে যায়।  আমাদের ধীমান টেনশন করেছে যদি লোক বেশি বলে ওকে ফিরিয়ে দেয় ওরা। কৌশিক টেনশন করেছে যদি ভ্যাকসিন নেবার পরও করোণা হয়? বাদল, সোমনাথ আর আমি টেনশন করেছি যদি আবার খুব লাগে? 


সব টেনশন মিটিয়ে প্রায় সন্ধে ছটা নাগাদ ভ্যাকসিন নেওয়া আমরা। ফিরিঙ্গী ভাষায় আমার ফুল অফিস ভ্যাকসিনেটেড, ফুললি ভ্যাকসিনেটেড। এই ভাবেই চলুক না জীবন, কিছুটা শৈশব আর কিছুটা অভিভাবক হয়ে।



Thursday, 22 April 2021

অনির ডাইরি ২২শে এপ্রিল, ২০২১

 

বেশ চিন্তিত ছিলেন শ্রীমতী তুত্তুরী। মা যেসব রাতে না ফিরতে পারে, মাসি অন্তত থাকে। কিন্তু এবারে যে মা আর মাসির নির্বাচন একই নির্ঘন্টে। কার কাছে থাকবে তুত্তুরী? এমনিতে মা আর মাসির সাথে যত খুনসুটি, বাবার সাথে ততোটাই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শ্রীমতী তুত্তুরীর। তাই বলে বাবা নামক ব্যক্তির সাথে একাকী দিনযাপন অসম্ভব। লোকটা কেমন যেন কলিযুগের হিটলার টাইপ। সবকিছু তার চলে নিখাদ নিয়ম মেনে। মাকে কাবু করতে না পারলেও, তু্ত্তুরীকে কেবলই নিয়মের বেড়াজালে বাঁধতে চায় বাবা। ‘দিনে তিন দান দাবা খেলবি, মিষ্টি খাবি না, দুঘন্টা গল্পের বই পড়বি আর আমার সাথে দেড় ঘন্টা ব্যায়াম করবি’- তুত্তুরীর জন্য এই হল বাবার ফরমান। সবথেকে বড় কথা- ‘অপ্রয়োজনে বেশী বকবক করবি না।’ হ্যাঁ বাবার সেবা করলে থুড়ি বাবাকে আমেজ করে দিলে যেমন ধরুন চুল ঘেঁটে দিলে, কান মুলে দিলে, হাতের বা পায়ের আঙুলগুলিকে টেনে লম্বা করে দিলে অবশ্য আনলিমিটেড বকবকানির অনুমতি মেলে, তবে তা ততক্ষণই স্থায়ী হয়, যতক্ষণ চলে আমেজ। 


এত ঝঞ্ঝাটের পর কেবল আধঘন্টা মোবাইল দেখার অনুমতি মেলে শ্রীমতী তুত্তুরীর। ভাগ্যে মাসির মোবাইলটা সারাদিন গড়াগড়ি যায় হেথায়-হোথায়। মাঝেমধ্যে মুখ বন্ধ রাখার শর্তে অবশ্য মোবাইল দেয় মাও। 


যাই হোক এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মা এবং মাসির অনুপস্থিতিতে শ্রীমতী তুত্তুরী থাকবে কুথায়? নির্বাচনী নির্ঘণ্ট জারি হওয়ার সাথে সাথেই হাওড়া থেকে দাদু বলেছিল বটে, ‘ওকে এখানে রেখে যা’। কিন্তু নিজের দোষেই সেই সুযোগ হারাল তুত্তুরী। ভর সন্ধ্যে বেলা এমন হাঁউমাউ জুড়ল মাসি, ‘সোনা মা এটা কি?’ তুত্তুরী যতই বোঝায় ও কিছু নয়, নিছক  গুগল অ্যাসিস্টান্ট। তুত্তুরীকে সহায়তা করতে চায়, মাসি তো ভয়েই সারা। মোবাইল খুললেই কেবল অনামুখো গুগল বলে, ‘হ্যালো পুরোযা ভট্টাচার্য, আজ কি গান শুনবে? একটু অরিজিৎ সিং শুনে দেখবে নাকি? বা হাড্ডিগুডুম গাড্ডিগুডুম।’ যা না মা পড়তে পারে, না মাসি। উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত কটকটিয়ে ওঠে। 


যাই হোক কথাটা মায়ের থেকে গিয়ে পৌঁছাল বাবার কানে। গম্ভীর মুখে মাসির মোবাইলটায় চোখ বুলিয়ে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে ফয়সালা শুনিয়ে দিল বাবা, ‘হাওড়া যাওয়া ক্যান্সেল। ’ একটা দুটো রাতেরই তো ব্যাপার, তুত্তুরী দিনের বেলা থাকবে ঠাম্মা-দাদুর বাড়ি, রাতে আপিস ফেরতা ফেরৎ আনবে বাবা। 


কাকিমা থাকলে এই প্রস্তাবে ধেই ধেই করে নাচত তুত্তুরী। কিন্তু কাকিমা যে সেই সুদূর দুর্গাপুরে।  ঠাম্মার সাথে অবশ্য ভালোই জমে, কিন্তু ঠাম্মা সারাদিন বড় ব্যস্ত থাকে। আর বাবার বাবা, এক্কেবারে বাবার মত। তাঁর সাথে চলে না আবোলতাবোল গল্প। মা দুর্গা বা শ্রীকৃষ্ণের গল্প জুড়লেই দাদু খুলে বসে গীতবিতান। নাহলে শোনায় ম্যাকবেথ বা জুলিয়াস সিজারের হত্যা রহস্য। তারপর গছায় একখান বই, ‘এটা পড় তো চেতা। ’ আর বই দেখলেই পিলে চমকায় চেতা ওরফে শ্রীমতী তুত্তুরীর। 


বাবাকে পটানোর দিনরাত চেষ্টা চালায় তুত্তুরী, আমেজ করে দেয় আশ মিটিয়ে, পাঁচন খাওয়া মুখে উপেন্দ্র কিশোরের ছোটদের রামায়ন খুলে বসে, এমনকি বীরাঙ্গনা হয়ে হাওয়াই চটি দিয়ে পটাশ করে বাথরুমে উড়ন্ত আরশোলাও হত্যা করে তুত্তুরী। মরা পেচকে যাওয়া আরশোলা দেখে মা ভির্মি খাবে বলে ফুলঝাড়ু আর বেলচা দিয়ে তুলে ডাস্টবিনেও ফেলে আসে তুত্তুরী। এহেন বীরবত্তায় রীতিমত প্রীত হয়ে বাবাজীবন অনুমতি দেন, হাওড়া যাবার। উপরন্তু অনুমতি দেন নিছক দু-এক দিন নয়, পাক্কা ছয় দিন পাঁচ রাত হাওড়ায় থাকতে পারে তুত্তুরী। শর্ত শুধু একটা, ভুঁড়ি না বাড়ে। রোজ ব্যায়াম করতে হবে, আর মিষ্টি খাওয়া একদম নিষেধ। বাধ্য কন্যার মত ঘাড় নাড়ে তুত্তুরী। সেই মত হাওড়ায় দফায় দফায় ফোন করে বলা হয়ে যায়- ‘দাদু মিষ্টি কোল্ডড্রিংক কিচ্ছু এনো না যেন। না চকলেটও নয়। বাবা বারণ করেছে। ’


আপিস যাবার পথে ৯ তারিখ সকালে ব্যাগব্যাগেজ সমেত কন্যাকে বাপের বাড়ি পৌঁছাতে গিয়ে দেখি, ডাইনিং টেবিলের ওপর ইয়া বড় এক বাক্স দেশবন্ধুর দরবেশ রাখা। পাশে এককেজির লাল ঘণ ক্ষীর দই। কিছু বলতে যাবার আগেই ধমকে ওঠে বাবা, ‘আঃ আমি খাব। কেন আমি খেতে পারি না?’ তা তো পারেই, আশি পেরিয়ে সুগারের ঘোড়া টগবগ করে ছুটছে, প্রবল ধূমপানে ফুসফুস আধা জখম, তিনি মিষ্টি খাবেন না তো, কে খাবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ফ্রিজের দরজা খুলে যথারীতি দর্শন পেলাম দুই লিটার থামস্ আপ আর পুঁচকে বোতলে মাজা। মাখন রাখার তাকে গোটা চারেক ডেয়ারি মিল্ক রাখা, ফ্রীজের মাথায় গোটা কয়েক প্যাকেট ওরিও আর অন্যান্য ক্রিম বিস্কুট। একটা ডেয়ারি মিল্ক ব্যাগে ঢোকাতে গিয়ে তড়িদাহত হলাম। খ্যাঁক করে উঠল মা। ঝুলি থেকে বেরোল বেড়াল। তুত্তুরীর জন্য আনা চকলেট আমি ব্যাগে ঢোকাই কোন মুখে! কেমন মা আমি? হ্যাংলা। মধ্যস্থতা করার সুরে বাবা বলল, ‘আচ্ছা নিক। আমি ওবেলা এনে দেবো।’ 


গাড়িতে উঠে শৌভিককে ফোন করলাম, ওগো আমায় তুমি ছাড়া আর কেউ ভালোবাসে না গো।

Tuesday, 20 April 2021

বই পড়ি-

বই পড়ি- ২০শে এপ্রিল, ২০২১


‘২২শে ফেব্রুয়ারি, সন ১৯৪১। কাবুল শহরে তখন বিকেল। আচমকা কাবুলের ইতালীয় দূতাবাসের পিছনের দরজায় কড়া নাড়ল এক স্থানীয় ব্যক্তি। পরিষ্কার করে দাড়িগোঁফ কামানো, ছোট্টখাট্ট চেহারার  আপাতঃ সাধারণ লোকটার মাথায় কারাকুলি আফগান টুপি, পরণে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কুর্তা আর ঢোলা পাজামা। ধূমপানের জন্য পিছনের দরজায় ভিড় জমানো দূতাবাসের আফগান কর্মচারীদের একবারও সন্দেহ হল না, লোকটি স্থানীয় বাসিন্দা নয়। 


সমস্ত রকম যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে বহুদূর,আফগানিস্তান তখন নিরপেক্ষ দেশ।  ১৭ মাস আগে শুরু হওয়া মহাশক্তি সংগ্রাম তখনও পরিণত হয়নি মহাযুদ্ধে। ইউরোপে নাৎসীরা ক্রমেই দুর্দম হয়ে উঠছে, একলা বৃটেন কেবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার সাথে টক্কর দেবার। আপোসে পোল্যাণ্ডকে ভাগাভাগি করে, হিটলার এবং স্ট্যালিন তখনও পরষ্পরের পরম মিত্র। আমেরিকার সাথেও জাপানের সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ। ‘ আমাদের ছেলেরা কোন তৃতীয় দেশের যুদ্ধে লড়তে যাবে না’ এই মর্মে আমেরিকার মাতা- পিতাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সদ্য সদ্য তৃতীয়বারের জন্য আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট।

 


লোকটির ইতালীয় রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করা ভীষণ দরকার। কিন্তু এইভাবে এসে দেখা করতে চাইলেই তো আর দেখা হয় না। লোকটি রক্ষীদের জানাল, সে পেশায় পাচক, তাকে হুজুরের সাথে দেখা করতে বলা হয়েছে। 


রক্ষীর পিছুপিছু উঁচু শিলিংওয়ালা যে ঘরটিতে লোকটা প্রবেশ করল, তার দেওয়ালে টাঙানো ইতালীয় পতাকা আর বড় করে বাঁধানো ইতালীয় স্বৈরাচারী শাসক বেনিতো মুসোলিনির ছবি। মস্ত বড় ডেস্কের উল্টোদিকে বসে থাকা ইতালীয় রাষ্ট্রদূত মোটেই খুশি হলেন না লোকটাকে দেখে। কাবুলের বসবাসকারী অন্যান্য কূটনৈতিকদের মতই তিনিও অনাহূত স্থানীয় আগন্তকদের বেশ ভয় পেতেন। ব্যাটারা হয় সরকারী চর,নয়তো অন্যদেশের গুপ্তচর হয়। এই লোকটাও গুপ্তচর কি না তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না।  এমনকি লোকটি যখন জানাল যে ‘কাবুল সিমেন্সের হের থমাস আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। ’ তখনও বিশেষ স্বস্তি বোধ করতে পারলেন না তিনি। 


“কেন পাঠিয়েছে’ খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি। লোকটি অত্যন্ত ঋজু ভাবে বলল, ‘তা জানি না।  আমাকে বলা হয়েছে, এসে আপনার সাথে দেখা করতে। ’ লোকটির গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, যাতে ইতালীর রাষ্ট্রদূতের বুঝতে বাকি রইল না, এ কোন সাধারণ আফগান হয়। কি মনে করে উনি ফোন করলেন থমাস সাহেবকে।  দুজনের মধ্যে জার্মান ভাষায় বেশ খানিকক্ষণ ফিসফিসিয়ে কথা হল। যার বিন্দুবিসর্গও বুঝলে না আগন্তুক। তবে এটুকু খেয়াল করল যে, বেশী কথা থমাস সাহেব ওপাশ থেকে বলে গেল, আর রাষ্ট্রদূত চুপচাপ শুনে গেল।  


ফোন নামিয়ে, ব্যক্তিগত আর্দালি এবং অন্যান্য কর্মচারীদের বাইরে যেতে ইশারা করলেন রাষ্ট্রদূত। ঘরের দরজা বন্ধ হতেই তিনি ইশারায় আগন্তুককে আসন গ্রহণ করতে বললেন, তারপর ভাঙা ইংরাজিতে বললেন, ‘আমি পিয়েত্রো কুয়ারোনি। আমি কাবুলে ইতালীয় রাষ্ট্রদূত। ’  


আগন্তুক তার পরিচয় দিল। নাম রহমত খাঁ। আফগান নয়, বরং জন্মসূত্রে ভারতীয়।  নামটা সঠিক না হলেও বাকি তথ্যে কোন ভ্রান্তি ছিল না। আগন্তুক জানাল পেশোয়ার থেকে কাবুল এই দীর্ঘ ২০০ মাইল দুর্গম পথ সে পদব্রজে পার হয়ে এসেছে দুর্ধর্ষ তথা দুর্দম উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার মধ্যে দিয়ে যারা বৃটিশ ভারত এবং আফগানিস্তানের মধ্যে রচনা করে সীমানা। 


গত ২৭শে জানুয়ারী সে কাবুলে এসে পৌঁচেছে। তবে একা আসেনি, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে ভারতীয় বিপ্লবী সুভাষ চন্দ্র বোসকেও। সুভাষের পথপ্রদর্শক  তথা দেহরক্ষী হিসেবেই খাঁয়ের কাবুলে আগমন। খাঁ আরো জানাল যে আপাততঃ কাবুলেই আত্মগোপন  করে আছে সুভাষ, কাবুল থেকে সীমান্ত টপকে রাশিয়া হয়ে বার্লিন যেতে চান সুভাষ, ভারতকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করার জন্য জার্মান সহায়তা চাইতে।  


কাবুলে এসেই তাঁরা জার্মান দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করেন, বেশ কয়েকবার মিটিং হয়, কিন্তু ফলপ্রসূ হয় না কিছুই।  এদিকে সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে কাবুলে এসেছেন সুভাষ আর রহমত খাঁ।  না আছে তাদের পাশপোর্ট বা অন্যান্য দরকারী কাগজপত্র, কোনমতে এক আফগান পুলিশ আপিসারকে ঘুষ দিয়ে গ্রেপ্তার এড়িয়ে আত্মগোপন করে আছেন তাঁরা।  যত দিন কাটছে, ততোই বাড়ছে তাদের বিপদ। এই ভাবে বেশীদিন গ্রেপ্তারী এড়ানো অসম্ভব।  আর আফগান পুলিশ একবার ধরতে পারলেই, সোজা তুলে দেবে বৃটিশ সরকারের হাতে। এমতবস্থায় কুয়ারনিই তাদের একমাত্র ভরসা।  


জার্মানদের মত ঝুলিয়ে রাখল না কুয়ারনি। পরবর্তী তিনটি সপ্তাহ আর কয়েকটি মিটিং এর পরই ইতালীয় কূটনৈতিক পাশপোর্ট সমেত সুভাষকে নিরাপদে পার করিয়ে দেওয়া হল আফগান সীমান্ত। তুলে দেওয়া হল মস্কোগামী ট্রেনে। তারপর বোসের কি হল, অথবা হল না আমরা সবাই জানি অথবা জানি না। কিন্তু যে সঙ্গীকে তিনি ছেড়ে গেলেন কাবুলে তাঁর গপ্পও বোসের থেকে কিছু কম চিত্তাকর্ষক নয়। ”

তবে সে গল্প আবার কাল, অথবা পরশু বা কখনই নয়। কে জানে- 


পুনশ্চঃ সবটুকুই মিহির বোসের দা ইন্ডিয়ান স্পাই থেকে।  পাতা- ১৩-১৫।


বই পড়ি- ২৩শে এপ্রিল, ২০২১


“সুভাষ বোস ইউরোপ রওণা দেবার অল্পদিনের মধ্যেই,  রহমত খাঁয়ের পদোন্নতি  ঘটল, নিছক দেহরক্ষী থেকে গুপ্তচর। কাবুলের ইতালীয় রাষ্ট্রদূত পিয়েত্র কুয়ারোনি বহুদিন থেকেই এমনি এক অস্ত্রের সন্ধানে ছিলেন, যার মাধ্যমে  ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর সরাসরি আঘাত হানা যায়। কুয়ারোনির বদ্ধমূল ধারণা ছিল, বৃটিশ সাম্রাজ্য নামক শিকলের সবথেকে দুর্বল, সবথেকে নড়বড়ে আংটা হল ভারত।  এখানে ঠিকঠাক আঘাত করলে শিকল ছিঁড়তে বাধ্য।  


যাবার সময়, বোস যখন ইতালীয়দের সাথে সহযোগীতা করার জন্য খাঁকে তাঁর এজেন্ট নিয়োগ করে গেলেন, কুয়ারোনি এই সুযোগ ছাড়লেন না। কয়েক মাসের মধ্যেই আরেক অক্ষশক্তি জার্মানিও খাঁকে তাদের চর হিসেবে নিযুক্ত করল। ইতালী এবং জার্মানি দুই ফ্যাসিস্ট দেশের হয়ে কাজ করলে বা পারিশ্রমিক নিলেও খাঁ কিন্তু আদতে ছিল গোঁড়া কম্যুনিস্ট। ফলে প্রথম থেকেই খাঁ দুই দেশকে ভুলভাল তথ্য সরবরাহ করে আসত। 


এই ভুল তথ্য পরিবেশন প্রথমদিকে স্বতঃপ্রণোদিত হলেও, ‘অপারেশন বার্বারোসা’র পর অর্থাৎ হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের পর, খাঁ হাত মেলায় রাশিয়ার সাথে এবং রাশিয়ানদের সরবরাহ করা তথ্য নাৎসি বাহিনীর কাছে পৌঁছে তাদের ভুল পথে পরিচালনা করতে থাকে।  


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে  খাঁ ইংরেজদের হয়েও কাজ করতে থাকে। বৃটিশরাই তাঁর নাম দেয়, ‘সিলভার’। যাঁকে ব্যঙ্গ করে রহমত খাঁর নাম রাখা হয়েছিল সিলভার, সেই আসল মিঃ সিলভার ছিলেন এক ওপরতলার বৃটিশ অফিসার, যিনি ইংলণ্ডে বসে সমগ্র ভারতে যাবতীয় আণ্ডার কভার অপারেশনের তদারকি করতেন। 


জার্মানরা কোনদিন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে সিলভার তাদের ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল তথ্য পরিবেশন করছে। তারা সিলভারকে এতটাই বিশ্বাস করত এবং তার কাজে এতটাই সন্তুষ্ট ছিল, যে সিলভারকে তৎকালীন জার্মানির সবথেকে বড় মিলিটারি পুরষ্কার, ‘ দা আয়রণ ক্রস’ প্রদান করা হয়। জার্মানরা সিলভারকে একটি ট্রান্সমিটারও দিয়েছিল,যার মাধ্যমে সিলভার সরাসরি বার্লিনে হিটলারের স্পেশাল সিক্রেট সার্ভিস, Abwehr এর সদর দপ্তরের সাথে কথা বলতে পারত। জার্মানরা এক মুহূর্তের জন্য সন্দেহ করেনি যে সিলভারের প্রদত্ত যাবতীয় মিলিটারি তথ্য আসলে বৃটিশ সিক্রেট সার্ভিসের বানানো গপ্প। যা ফাঁদা হত খোদ দিল্লীতে ভাইসরয়ের প্রাসাদে বসে। 


যুদ্ধ শেষের আগে সিলভার কিছুদিন জাপানের হয়েও গুপ্তচরবৃত্তি করেন। একসাথে পাঁচ পাঁচটা দেশের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির এহেন নজির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।” 

- Pg-16, The Indian Spy, The True Story of the Most Remarkable Secret Agent of World War II by Mihir Bose.


  বই পড়ি- ৩, ২৫শে এপ্রিল, ২০২১


"১৫ কোটি পাউণ্ড, ১১লক্ষ লোকলস্কর সহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে বৃটেনের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। যার মধ্যে ১লক্ষ ৩৮ হাজার সেপাই লড়েছিল শুধু ইউরোপেরই নানা রণাঙ্গনে। মূলতঃ ভারতীয়দের জন্যই বৃটিশ সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়েছিল রাশিয়ার দক্ষিণে ট্রান্স ক্যাস্পিয়ান আর ককেশিয়া এবং পারস্য ছাড়িয়ে সুদূর মেসোপটেমিয়া। ভারতীয়দের জন্যই ইরাক দখল করে বৃটেন, পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে বেশ কিছুদিনের জন্য ভারতীয় টাকাই ছিল ইরাকের জাতীয় মুদ্রা।  এমনকি যে সৈন্যসামন্ত নিয়ে প্যালেস্টাইনের যুদ্ধে অ্যালেনবি তুরস্ককে পরাস্ত করেছিল তার পদাতিক বাহিনীর দুই তৃতীয়াংশ আর অশ্বারোহী সেনাদলের এক তৃতীয়াংশই ছিল ভারতীয়। যুদ্ধে বৃটেনের পাশে দাঁড়াতে ভারতীয়দের অনুপ্ররণা দেবার জন্য গান্ধীজী কাইজার- এ-হিন্দ এর শিরোপাও পান।  


 অগণিত লস্কর, নাবিক, জাহাজী ছাড়াও ষাট হাজারের বেশী ভারতীয় সৈন্য নিহত হয় এই যুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে যে ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারিতে(* স্প্যানিশ ফ্লু) আক্রান্ত হয় বিশ্ব, ভারতে তা তেমন ভাবে দেখা না গেলেও প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান ১কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ, যা ছিল তৎকালীন মোট জনসংখ্যা ৫শতাংশ। এত চড়া হারে মৃত্যুর একটাই কারণ ছিল, দেশের অধিকাংশ ডাক্তার আর নার্সকে খেয়ে বসেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। 


এতকিছুর পর, নূন্যতম ধন্যবাদের বদলে ভারতের কপালে জুটল বেত্রাঘাত। গান্ধীজী সমেত গোটা ভারতবর্ষই ভেবে বসেছিল, মহাযুদ্ধে এমন সর্বাত্মক সহায়তার পর, নিশ্চয় হোমরুলের দাবী মেনে নেবে বৃটেন। অন্যান্য সাদা উপনিবেশ গুলি যথা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড, কানাডা বা সাউথ আফ্রিকা যেমন বহু আগে থেকে ভোগ করে আসছে স্বায়ত্তশাসন। এমনকি দীর্ঘ সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে আয়ার্ল্যাণ্ডও স্বাধীনতা পেল, শিকে ছিঁড়ল না কেবল ভারতের ভাগ্যে।  


বদলে ভারতবাসী দেখল, আরো কঠোর, আরো নির্মম হয়ে উঠেছে বৃটিশ শাসন। যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই, ডিফেন্স অব ইণ্ডিয়া অ্যাক্টের প্রতিক্রিয়াশীল ধারাগুলি আরো কঠোর ভাবে বলবৎ করল বৃটিশ সরকার। হৃত হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মিটিং মিছিলের ওপর চেপে বসল নিষেধাজ্ঞা, চালু হল পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার, বিনা বিচারে একবছর অবধি হাজতবাস। যার মেয়াদ বাড়ানো একেবারেই কতৃপক্ষের ইচ্ছাধীন। এমনকি কারো কাছে দেশদ্রোহ মূলক কোন ইস্তেহার পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার হবার পর স্বপক্ষে উকিল নিয়োগ করারও অধিকার কেড়ে নিল বৃটিশ সরকার।  লোকে বলত, ‘না দলিল, না ভকিল, না আপিল।’ বৃটিশদের প্রতি আনুগত্য ঝেড়ে ফেলে রাতারাতি বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন গান্ধীজী।  ডাক দিলেন দেশ জোড়া গণ আন্দোলনের।  


আর এই গণবিক্ষোভকে কেন্দ্র করেই ১৩ই এপ্রিল ১৯১৯, সিলভারের গ্রাম গল্লা ঢেড় থেকে মাত্র ২৫০ মাইল দূরে অমৃতসর শহরে ঘটে গেল এক পাশবিক হত্যাকাণ্ড। বৃটিশদের প্রায় দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে এত নৃশংস, এত ন্যক্কারজনক ঘটনা কখনও প্রত্যক্ষ করেনি এই উপমহাদেশবাসী।


নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গণবিক্ষোভ চলছিলই, এমতবস্থায় পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে অমৃতসর শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব  তুলে দেওয়া হল আর্মির হাতে। জ্যুলাণ্ডার ব্রিগেডের কম্যাণ্ডার, ব্রিগেডিয়ার  জেনারেল রেজিন্যিল্ড ডায়ার অমৃৎসর শহরের দায়িত্ব নেবার সাথে সাথেই জারি করলেন মার্শাল ল। এমন সময়ে তাঁর কাছে খবর এল, তাঁর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে জালিয়ানওয়ালা বাগে সমবেত হয়েছে এক বিশাল জনতা। জালিয়ানওয়ালা বাগ ছিল এক অতিকায় মুক্তাঙ্গন, কিন্তু প্রবেশ বা প্রস্থানের পথ কেবল একটি।  তাও অত্যন্ত সরু এক গলি বরাবর। খবর পাওয়া মাত্রই ডায়ার লোকলস্কর নিয়ে হাজির হলেন এই সরু রাস্তার মুখে। 


প্রায় হাজার বিশেক নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ জনতা জমায়েত হয়ে শুনছিল নেতাদের বক্তব্য। দিনটি ছিল বৈশাখী, সমগ্র উত্তরভারত জুড়েই ঐ দিনটি উৎসব হিসেবে পালিত হয়, তাই জমা হওয়া জনতার মধ্যে কতজন ঠিক রাজনৈতিক কারণে জমা হয়েছিল বলা দুষ্কর। ছিলেন শিশু সন্তান কোলে অগণিত মহিলা। সবথেকে বড় কথা, প্রত্যেকেই ছিল নিরস্ত্র। তাতে অবশ্য জেনারেল ডায়ারের কিছু যায় আসেনি।  


ডায়ার যখন দেখলেন এত সরু রাস্তায় তার সাজোয়া গাড়ি ঢুকবে না, তখন তিনি গাড়িগুলি রাস্তার মুখে দাঁড় করিয়ে, গুর্খা সেপাইদের নির্দেশ দিলেন রাস্তা আটকে, গুলি চালাতে।  কোন সচেতনবাণী ছাড়াই।


এম্যুনিশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামেনি গুলিবর্ষণ। শুধু সরকারী হিসেবেই মারা গিয়েছিলেন ৩৩৭ জন পুরুষ, ৪১ জন মহিলা এবং একটি ৭ সপ্তাহের দুধের শিশু। আহত ১৫০০।  কংগ্রেসের মতে মৃতের সংখ্যা  ছিল হাজারের অনেক বেশী।


ডায়ারের কৃতকর্মের তালিকা বেশ লম্বা। নানা অজুহাতে এদেশীয়দের চাবুকপেটা করা ছাড়াও তিনি কুখ্যাত ছিলেন, ‘ক্রলিং অর্ডার’ এর জন্য। জনৈকা শ্বেতাঙ্গ রমণী আক্রান্ত হয়েছিলেন একদল এদেশীয়দের দ্বারা, যেখানে এই ঘটনাটি ঘটেছিল, ডায়ার নির্দেশ দেন, সেই পথে যাতায়াত করতে হলে ভারতীয় পুরুষদের যেতে হবে বুকে হেঁটে। অন্যথা হলেই জুটবে বেধড়ক মার এমনকি বেয়নেটের খোঁচাও। বৃটিশ লাইব্রেরিতে রাখা একটি ছবিতে দেখা যায়, এইভাবে সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে চলা ভারতীয়দের বেয়নেটের খোঁচা মারছে ২৫ তম রেজিমেন্টের গোরা সেপাইরা। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়, ‘রাস্তাটা অনেকটাই লম্বা, এইভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে, হাত আর কাঁধে ভর দিয়ে বুক ঘষটে সরীসৃপের মত চলতে থাকা বেশ দুরূহ এবং ভীষণ কষ্টকর। কারো পাছা মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে উঠলেই লাথি মারছিল টহলদার গোরা সেপাইরা। ’ 


এতকিছুর পরেও ভারতবাসীর কাছে যেটা সবথেকে বেদনাদায়ক ছিল তা হল, যদিও ডায়ারকে আর্মি ছাড়তে হয়, কিন্তু তাছাড়া তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূূলক ব্যবস্থা নেওয়া হল না। তাকে সসম্মানে অবসর গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হল, এমনকি অবসর নেবার পর তার পেনশন ইত্যাদিও চালু করা হল। 


যেটুকু সামান্য শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তার জন্যও বৃটিশ পার্লামেন্টে ঝড় ওঠে। জালিয়ানওয়ালা বাগ নিয়ে আলেচনার প্রস্তাব বিপুল ভোটে খারিজ হয়ে যায় হাউস অব কমনস্ এমনকি হাউস অব লর্ডসেও। এই নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেবার জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সেদেশের সরকার। আসলে এদেশে বা ইংলণ্ডে বসবাসকারী গোরাদের চোখে ডায়ার ছিল নায়ক। তিনি যা করেছিলেন তা বৃটিশ রাজের মঙ্গলের জন্যই করেছিলেন এই মতবাদ আজও  খোলাখুলি ভাবে অনেক বৃটিশ লেখক পোষণ করে থাকেন। 


ডায়ারের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। তাঁর জন্য একটি বিশেষ তহবিল খোলা হয় যাতে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি অর্থপ্রদান করেন। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লেখক রুডিয়ার্ড কিপলিং। কারণ শতিনেক নিরস্ত্র ভারতীয়কে হত্যা করার পিছনে তাঁরা কোন অনৈতিকতা, কোন অন্যায় খুঁজে পাননি। “ 


 Pg- 35-37, The Indian Spy, The True Story of the Most Remarkable Secret Agent of World War-II by Mihir Bose.

Tuesday, 13 April 2021

অনির ডাইরি, ১৩ই এপ্রিল, ২০২১

 



বলেছিলাম, আগামী কাল নীল, একটা বেল এনো তো। তা এনেছেন বটে, তবে আমার সুবিধার কথা ভেবে বেলটিকে ফাটিয়ে এনেছেন।  তাই দিলাম ঠাকুরকে, 'প্রভু, তোমার যা অভিরুচি'। 


এই বাড়ির নিয়মকানুন কিছুই জানি না। শ্বশুরমশাই যেমন কড়া নাস্তিক, শাশুড়ীমা তেমনি প্রগতীশীলা। উপোসতিরেস প্রসঙ্গে প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘তোমার যা প্রাণ চায়,কোরো-’। এমনিতে যে আমি খুব ধর্মপরায়ন লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে তা নই, বরং সর্বার্থে লক্ষ্মীছাড়া, অলবড্ডে তথা হদ্দ কুঁড়ে ‘নারী বদ’ বলে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি, তবুও বছরে ছটা ষষ্ঠী অার দুটো অষ্টমী করেই ফেলি টুকটুক করে। সবটুকুই আমার বাপের বাড়ির নিয়ম মেনে।  কেন করি? এ প্রশ্ন বিগত এক যুগে আমার শ্বশুরমশাই তথা তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র অগণিত বার করেছেন- জবাবটা আমিও ঠিক জানি না। করি, কারণ মা করত, থুড়ি এখনও করে। আর করি, মেয়েটার শিকড়ে খানিক বাঙালীয়ানার মাটি জোগাতে। বড় বেশি ট্যাশ তৈরি হচ্ছে এরা, একটু তো বাঙালী হোক, বারো মাসে বাঙালির তেরো পার্বণের সাথে কিছুটা তো আলাপ জমুক। 


জৈষ্ঠ্যে আসে জামাইষষ্ঠী। ভাদ্রে চাপড়া ষষ্ঠী। দুর্গা ষষ্ঠীর ঠিক একমাস আগে। কি দারুণ মিষ্টি মিষ্টি মুগডালের বড়া বানাত ঠাকুমা, চাপড়া ষষ্ঠী এলেই। মিষ্টি দই মাখিয়ে সেই বড়ার আস্বাদ আজও কোথাও জেগে আছে স্বাদকোরকের কোন গহীন অংশে। রান্নাঘরের মস্ত শিলনোড়াখানি এই সময় রাতারাতি হয়ে যেত মা ষষ্ঠী। গোটা ফল দিয়ে পুজো হত তাঁর। কোলের বাছাদের স্নান করতে নিষেধ করত ঠাকুমা। সন্ধ্যা ঢললে, যখন পশ্চিমের নিম গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারত বুড়ি চাঁদ, উঠোনের লাগোয়া দখিন খোলা রোয়াকে আঁচল বিছিয়ে শুয়ে, চাপড়া ষষ্ঠীর গল্প শোনাত ঠাকুমা। কোলের কাছে বিড়ালছানার মত ঘেঁষে থাকতাম আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। সব কি আর মনে আছে, স্মৃতিপটে জমেছে বিস্তর ধূলিকণা। এই দিনে নাকি গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে সন্তান হারায় কোন এয়োস্ত্রী। আচমকা আসা বান খালি করে যায় কোল। সন্তানহারা জননীর করুণ আর্তিতে আবির্ভূত হন ষষ্ঠীদেবী স্বয়ং। তারপর জানা যায়, আপন পাপেই সন্তান হারিয়েছে নারী। বাছার দুধের বাটিতে ঠোঁট ডোবানো বিড়ালছানাকে চ্যালাকাঠ পিটিয়ে হত্যা করারই মাসুল গুণছে রমণী। পরিত্রাণের উপায় আছে বটে, তবে তা ভয়ানক। ঘাটেই পড়ে থাকা আধপচা, পোকা কিলবিল করা মরা বেড়ালছানার দেহে মিষ্টি দই ঢেলে চাটতে হবে তাঁকে। ঠিক যেমন সোহাগ করে চেটে দিত ছানাটার মা বেড়াল। পুত্রশোকে মূহ্যমান নারী অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন মা ষষ্ঠীর নিদান। পরিণতি, আবার আসে বান, মায়ের আঁচল ধরে ভেসে ওঠে ডুবে যাওয়া শিশু। 


আশ্বিনে দুর্গা ষষ্ঠী। মাঘে আসে শীতল বা শেতল ষষ্ঠী। সরস্বতী পুজোর ঠিক পরের দিন। এই একটিই ষষ্ঠী যেদিন ভাত খায় মায়েরা। গরম ভাত নয় অবশ্য, আগের রাতে করে রাখা, জল ঢালা ভাত, অথবা সকালে করেও জলে ভিজানো ভাত। সাথে আর যাই থাকুক না কেন গোটাসিদ্ধ আর মিষ্টি দই থাকবেই। 


পরপর দুটো ষষ্ঠী আসে চৈত্রে। বাসন্তী পুজোর ষষ্ঠী বা অশোক ষষ্ঠী। আগে থেকে তুলে রাখা, শুকনো ছখানি অশোকফুল, কাঁঠালি কলার খণ্ডিতাংশে চটকিয়ে কপ্ করে গিলে খেতে হয় সকালে। জল দিয়ে গিললে হবে না, আবার না গিলতে পেরে ওয়াক তুললেও হবে না।  সদ্য সদ্য মা হবার পর, প্রথম অশোক ষষ্ঠী পড়েছিল যখন, তখন আমি বিডিওর ঘরণী। খড়্গপুরের উপান্তে এক ছোট্ট গাঁয়ে মোদের ঘরসংসার। সারা গাঁ ঘুরে কোথাও জুটল না অশোকফুল। কি করি? পিসি নিদেন দিল, ছটা কাঁচা মুগকড়াই কলায় চটকে গিলে খেতে। তারপর থেকে অবশ্য কখনও সমস্যা হয়নি। আমাদের আবাসনেই আছে ঝাঁকড়া অশোকগাছ। ইস্কুল ফেরৎ রিক্সামামাকে দিয়ে পাড়িয়ে আনে তুত্তুরী।  


চৈত্র মাসে দ্বিতীয় তথা বছরের শেষ ষষ্ঠী আজ। শ্বশুরমশাই প্রত্যেকবার মাথা চুলকান, “তিথি গত ভাবে আজ তো ষষ্ঠী নয়। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন নীল তথা শিবের উপাসনা হয় বটে, তাকে খামোখা তোমরা ষষ্ঠী বানাও কেন?” এ প্রশ্নের সদুত্তর কি ছাই আমার কাছে আছে? আমাদের মধ্যহাওড়ায় নীলের সাথে সাথে ষষ্ঠীরও উপাসনা যে হয় আজকের দিনে। পঞ্চানন তলার লালবর্ণ বুড়ো পঞ্চাননের পাশে ছেলে কোলে বসে থাকেন তন্বী ষষ্ঠীদেবী। 


আগে নিয়ম অনেক কঠোর ছিল, মধ্যাহ্ন অবধি জলগ্রহণ পর্যন্ত করতেন না জেনানাকুল। বেলা বারোটা বাজলে তবে শিবের মাথায় কাঁচাদুধ মেশানো গঙ্গাজল ঢেলে, ধুঁতরো ফুল, আকন্দ ফুলের মালা, সিদ্ধি পাতা, পাঁচরকম ফল আর পৈতে দিয়ে বুড়ো শিবের উপাসনা করে, চরণামৃত সহযোগে উপবাস ভঙ্গ করতেন তাঁরা। উপাচার একই আছে, তবে বেলা বারোটা অবধি অপেক্ষা করার নিয়ম বর্তমানে অনেক শিথিল। 


বরাবর নীলের দোসর আমার পিসি। পুজোর যাবতীয়  যোগাড় করে রাখে পিসি। আমার করণীয় বলতে শুধু ধরাচূড়া পড়ে নীলের সকালে পিসির হাত ধরে পিতলের কমণ্ডুল ভর্তি দুধ গঙ্গাজল আর সাদা রুমাল ঢাকা ফুলফলের টুকরি নিয়ে বুড়ো শিবের দুয়ারে হাজির হওয়া। এবারে অবশ্য হাওড়া যাওয়া বা মন্দিরে গিয়ে পুজো দেওয়ার বিলাসিতা আর হয়ে ওঠেনি। ঘরেই নমঃ নমঃ করে পুজো সারা। ধুতরো ফল, সিদ্ধি পাতা বা আকন্দ ফুলের মালা আনতে বলে আর বিব্রত করিনি নিজের বরকে। 


 পুজো শেষে বানাতে বসেছিলাম বেলের শরবৎ , নীল আর বেলের শরবৎ বা পানা কেমন যেন একে অপরের সম্পূরক।  বাড়ির গাছের বেল সন্তর্পনে ফাটিয়ে হাতে করে জলে গুলে, পরিষ্কার সাদা কাপড়ে ছেঁকে, পরিমাণ মত মিষ্টি, সামান্য নুন আর কয়েকফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে যে অমৃত তৈরী করত ঠাকুমা, অবিকল তেমন না হলেও কাছাকাছি তো এসেইছে ব্যাপারটা। সমস্যা একটাই, ব্যাপারখানা বেলের পানা না হয়ে, কেমনি যেন বেলের স্মুদি হয়ে গেছে। তা হোক, প্রতি চুমুকে না হয়, আরেকটু ঘন হয়ে আসুক হারিয়ে ফেলা শৈশব, আর হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো।