অনির ডাইরি ২৮ শে জুন, ২০২৫
#অনিরডাইরি
যাবেন নাকি? রথের মেলায়? মেলা বসেছে আমাদের হাওড়া ময়দানে। টানা হবে মস্ত বড় রথ, রথে আসীন সহোদর সহোদরা সমেত জগন্নাথ দেব। কত কি যে বিক্রি হয় সেই মেলায় - গরম গরম জিলিপি, পাঁপড় ভাজা, খোলায় ভাজা বাদাম, চুড়ো করে রাখা নিমকি, কুচো গজা আরও কত কি। বিক্রি হয় বঁটি, কুরুনি, লোহার কড়া, চাটু, ,রুটি বেলার চাকিবেলুন, হাতা- খুন্তি, সাঁড়াশি এমন কি টিয়াপাখি, খরগোশও। আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই, জ্যান্ত টিয়া পাখি।
সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। ফি বছর রথের দিনে কেন যে বৃষ্টি হয়। দুপুর যত নিশুতি হয়, ততোই বাড়ে বৃষ্টির দাপট। জ্যাঠাইমা বলে, "তোদের এবছর রথ দেখা হয়েছে আর কি - এই আবহাওয়ায় ছোট বউ কি করে তিনটে বাচ্ছাকে নিয়ে বেরোবে বাপু!" ছোট বউ অর্থাৎ ছোট কাকী, পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। আপিস টাইমে বসত কাকিদের স্কুল, ছুটি হতে গড়িয়ে যেত দুপুর। অধীর আগ্রহে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে বসে থাকি আমরা তিন খুড়তুতো জেঠুতুতো ভাইবোন। গায়ে এসে লাগে মিহি বৃষ্টির ঝাঁট। তিন নাটিনাতনীকে শান্ত করতে জগু- বলু আর সুভুর গল্প শোনাতে বসে ঠাকুমা।
নির্দিষ্ট সময়েই বাড়ি ফেরে ছোট কাকী। সঙ্গে দিতু মাসি আর তাঁর দুই পুত্র। দিতু মাসি সম্পর্কে কাকিমার বড় দিদি। পাঁচপাঁচটা গেঁড়িগুগলি বাচ্ছাকে নিয়ে রথ দেখতে বেরোয় দুই বোন। হাওড়া ময়দানে আজ দমচাপা ভিড়, আমাদের দুই চোখে উছলে পড়া লোভ। কাগজের পাখা থেকে তালপাতার বাঁশি যাই দেখি তারই প্রেমে হাবুডুবু খাই। দূর থেকে শোরগোল শোনা যায়, "রথ আসছে, রথ আসছে।" চেপে আমাদের হাত ধরে ছোট কাকী আর দিতু মাসি। নখ কামড়ে থুতু দেওয়া হয় সবার গায়ে, আহা নজর লাগে যদি। বুবাই দাদা সবথেকে বড়, কেউই আঙুল কামড়ায় না ওর। বেচারা নিজেই নিজের আঙুল কামড়ে থুতু দিতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়।
রাজার মত চলে যান জগন্নাথ দেব। আমাদেরও সুযোগ জোটে রথের দড়ি টানার। একরাশ ভালোলাগা নিয়ে বাড়ি ফিরেই গরম গরম জিলিপি। দুর্যোগের মধ্যেই কখন যেন বেরিয়ে কিনে এনেছে জেঠাইমা। অফিস ফেরৎ ঋষি ময়রার জিলিপি কিনে আনে বাবা। সর্ষের তেলে ভাজা ইয়া মোটা মোটা জিলিপি - সুগার ভুলে টপাটপ জিলিপি সাঁটায় জেঠু। আজ রথ বলেই বোধহয় নীরব থাকে জেঠাইমা। বেঁচে যাওয়া জিলিপি রাখা থাকে বাবার জন্য, রাতে দুধ দিয়ে ফুটিয়ে দেবে মা।
"একটা টিয়া পাখি কিনে দাও বাবা" বলে পিছন পিছন ঘুরি আমি। মাসের শেষ, হাত খালি বাবার। ঝুপ করে নিভে যায় আলো, একটু ঝড়ো হাওয়া দিলেই চলে যায় আমাদের ডিসি কারেন্ট। নিকষ আঁধারে সাময়িক ডুবে যায় শতাধিক বছরের পুরান ভাঙ্গা বাড়িটা। লম্ফ ধরায় ঠাকুমা। খালি ওষুধের শিশির ঢাকায় ফুটো করে ছেঁড়া কাপড়ের সলতে গলিয়ে বানানো ঘরোয়া লম্ফ। একটু ভুষো বেশি পড়ে বলে ঘরে নয় রোয়াকে রাখা হয়, আলো দেয় ফাটিয়ে। ঘরের ভিতর হ্যারিকেন ধরিয়ে পড়তে বসায় মা। আজ যেন একদম মন বসে না পড়ায়। খালি ভুল করি -
মায়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাবা বলে, "চল আরেকবার ঘুরে আসি, রথের মেলা থেকে -"।রাত আটটার ভাঙ্গা মেলা, তাও কি ভিড়। ফুচকা খাই আমরা বাপমেয়েতে। একটাকায় দশটা ফুচকা। শেষে একটা ফাউ -। ফেরার সময় একটা টিয়া নিয়েই ফিরি আমরা। ঘন সবুজ তার গায়ের রং, গলায় লাল কণ্ঠী। তেলাকুচো খায় কিনা জিজ্ঞাসা করি আমি। আমাদের পশ্চিমের বাগান জোড়া তেলাকুচো গাছের ঝাড়। সকাল বিকেল কত যে পাখি আসে খেতে -।
পাখি না, ও আমার প্রাণ। সাধ করে নাম রাখি মদনমোহন। পাক্কা কুড়ি টাকা দিয়ে কিনে দিয়েছে বাবা। রাতে খেতে বসে মা বলছিল, এক সপ্তাহের বাজার হয়, কুড়ি টাকায়- । ভোর বেলায় স্কুল আমার, ছুটি হতে হতে গড়িয়ে যায় আপিস টাইম। দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরি আজকাল আমি, আমার অপেক্ষায় আছে যে আমার মদনমোহন। জল দিই, ভিজে ছোলা দিই। স্নান করাই, বেড়াল তাড়াই যাতে ভয় না পায় আমার মদনমোহন। সারা দুপুর তার সাথে গল্প করি। আমার নিঃসঙ্গ দুপুরগুলো যেন আচমকাই হয়ে ওঠে গোলাপী।
আর তারপর? তারপর যা হয় আর কি, কেউ কথা রাখে না। মদনমোহন ও একদিন চলে যায়। আত্মা মিলিয়ে যায় পরমাত্মায়। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলি আমি, খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিই আমি। আমাকে শান্ত করতে কতগুলো যে পাখি কিনে আনে জেঠাইমা, তার ইয়ত্তা নেই। কারো লাল রঙের মাথা তো কারো নীল, কারো বা মাথার রং হলুদ। সবাই সুন্দর, কিন্তু এরা কেউ আমার মদনমোহন নয়। কেমন যেন নির্মোহী হয়ে পড়ি আমি, বুকের ভিতর চাপা কষ্টটা যেন আর যায়ই না। তারপর একদিন ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি, খাটের ওপর রাখা আছে সাদা ধপধপে একটা খাম। খামের ওপর গোটা গোটা করে লেখা আমার নাম। খামের এক কোনায় আটকানো ডাকটিকিটে নিশ্চিন্দিপুরের ঠিকানা। আমার মদনমোহনের বর্তমান সাকিন। বড় ভালো আছে সেথা মদনমোহন। ছত্রে ছত্রে নিশ্চিন্দিপুরের গল্প শোনায় সে। "সে এক রূপকথারই দেশ, ফাগুন সেথা হয় না কভু শেষ-"। সেথা নেই কোন অভাব, কেউ ভোগে না নিঃসঙ্গতায় শোনায়- । মদনমোহন বলে, সেই স্বপ্নের দেশেও তার মন কেমন করে, শুধু আমার জন্য। আমি যে তার প্রথম বন্ধু, আমি কাঁদলে, আমি উদাস থাকলে কি করে ভালো থাকবে আমার পাখি।
পড়তে পড়তে কখনও হাসি, কখনও কাঁদি আমি। বোধহয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন, দুপুরবেলা লুকিয়ে সিনে এডভ্যান্স, আলোকপাত পড়ি, মৃত পোষ্য যে আমায় চিঠি লিখতে পারে না, সেটা খুব ভালোমত বুঝি। তাও কানায় কানায় ভরে ওঠে মন। যে ছেড়ে গেছে সে আর ফিরে আসবে না, তার শোকে, যারা আমায় ঘিরে আছে এত ভালোবাসা অগ্রাহ্য করি কেমনে - ।
অনির ডাইরি ২৫শে জুন, ২০২৫
#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা
দরজা খুলে মুখ বাড়াল সৌম্য, " ম্যাডাম, ওনারা এসে গেছেন। আসতে বলব?" ইশারায় সম্মতি জানিয়ে, গুছিয়ে বসি। চেম্বারে প্রবেশ করেন সাদাসিধে করে শাড়ি পরা এক বৃদ্ধা, বাজারের ব্যাগ হাতে এক মধ্যবয়সী পুরুষ আর দুই প্রবীণ ব্যক্তি। প্রবীণ দ্বয় আমার পূর্ব পরিচিত, কোন একটি ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য। প্রায়ই হানা দেন আমাদের আপিসে।
ইশারায় বলি বসুন। ভদ্রমহিলা থতমত খেয়ে বসে পড়েন, বসে পড়েন প্রবীণ নেতাদ্বয় ও। মধ্যবয়সী ব্যক্তিটি তখনও দণ্ডায়মান, দাঁড়িয়ে আছে আজকের নাটকের নায়ক, আমার কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর শ্রী সৌম্য মুখোপাধ্যায় ও। উভয়কেই পুনরায় বসতে বলে, ভদ্রমহিলার দিকে তাকাই, প্রশ্ন করি, " আপনিই নিদ্রা সামন্ত?" পান খাওয়া খয়াটে দাঁত বার করে হাসেন বৃদ্ধা, দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানান। মধ্যবয়সী ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে শুধাই, " আপনি?" সৌম্য এবং লোকটি একসাথে বলে ওঠে, উনি বৃদ্ধার জ্যেষ্ঠ পুত্র। সৌম্য আরও একধাপ এগিয়ে জানায়, " উনিই আসতেন ম্যাডাম, ব্লকে নিয়মিত খোঁজখবর নিতে।" ভদ্রমহিলা মিনমিন করে বলেন, " বুড়ো হইছি মা, আমি আর অত ছুটাদৌড়া পারিনি -"।
'ছুটাদৌড়া' ই বটে, বাপরে বাপ! কি যে গেছে বিগত কিছু দিন। কোলাঘাট সাগরবার পঞ্চায়েতের বাসিন্দা শ্রীমতী সামন্ত পেশায় ছিলেন একজন নির্মাণ কর্মীর সহায়িকা। ষাট বছর অতিক্রান্ত হবার পর তিনি হলেন পেনশনের হকদার। সে অনেক কাল আগের কথা, তৎকালীন কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর সাহেব সেই মত ওনার কাগজ পত্র চেক করে পাঠালেন আমাদের আপিসে। আমার কোন এক পূর্বসুরী সেই আবেদন পত্র পুনরায় চেক করে, পেনশনের অনুমোদন দেবার সুপারিশ সহ পাঠালেন মহানগর। মহানাগরিক অধিকর্তাবৃন্দও দেখলেন সব ঠিক আছে, মঞ্জুর হল ওনার পেনশন।
বেশ কিছুদিন পর উনি এলেন ব্লকে খোঁজ নিতে, " সার আমার ট্যাকা কবে ঢুকবে?" ইন্সপেক্টর সাহেব আধার নম্বর দিয়ে সার্চ করে দেখলেন, পেনশন তো নিয়মিত ছাড়ছে কলকাতা। সেই পেনশন ঢুকছেও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এ, কারণ সাকসেস ফেলিয়র রিপোর্ট নিয়মিত পাঠায় কলকাতা আর তাতে ওনার পাশে সফলতার টিক চিহ্ন জ্বলজ্বল করে। ওনাকে বলা হয়, টাকা তো ঢুকছে, আপনি বুঝতে পারছেন না। গ্রামের দিকে একেক জনের একাউন্টে একসাথে অনেকগুলো পেনশন বা অনুদান ঢোকে,ফলে জট পাকিয়ে যাওয়াটাই দস্তুর। কখনও আমরা ভাবি হয়তো লাইফ সার্টিফিকেট দেননি, তাই ঢোকেনি। নতুন করে নেওয়া হয় লাইফ সার্টিফিকেট।
এই ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে, কিন্তু সুরাহা হয় না কিছুতেই। শেষে বিরক্ত হয়ে সৌম্য একদিন বলে," কাল পাশবইটা নিয়ে আসবেন, আমি নিজে দেখব। " দীর্ঘ দুই তিন বছরের হিসেব নিকেশের পাতা উল্টে ও নজরে আসে না পেনশনের খতিয়ান। কেস টা কি হল? এই নিয়ে আমার ঘরে যেদিন প্রথম আলোচনায় বসলাম আমরা, সব শুনে বেদজ্যোতি বলল, " সৌম্য দা একটা কাজ করো দিকি, পোর্টালে ওনার একাউন্ট নম্বরটা একবার চেক করো তো -"। চেক করতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। খুব ছোট্ট একটা ভুল উল্টেপাল্টে গেছে দুটি সংখ্যা আর তার জেরে টাকা ঢুকে গেছে অন্য কারো খাতায়। দুই চারশ টাকা নয়, ৬৪ হাজার টাকা।
কি ভুল, কার ভুল সেই চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আগে মহানগরে চিঠি লিখি আমি, এই মুহূর্তে বন্ধ করা হোক নিদ্রা সামন্তের পেনশন। মহানগর সাফ জানিয়ে দেয়, আগে উদ্ধার করো ঐ টাকা, তারপর অন্য কথা। উদ্ধার করো বললেই তো আর উদ্ধার করা যায় না, আমরা নিছক সিভিল লোকজন, না আমরা অস্ত্রধারী পুলিশ না রিকভারি এজেন্ট। যাই হোক, অনেক খুঁজে পেতে দেখা যায় যে একাউন্টে টাকা ঢুকেছে, সেটি কোলঘাটের দেউলিয়া বাজারের ইন্ডিয়ান ব্যাংকের। ব্যাংকের সাথে কথা বলে বেরোয় একাউন্ট মালিকের নাম ঠিকানা। দেখা যায় তিনিও কোলাঘাটেরই বাসিন্দা, পঞ্চায়েতের নাম পুলসিটা।
এত বড় পঞ্চায়েত এলাকা, হাজার হাজার মানুষ, এর মধ্যে একজনকে খুঁজে বার করা কি মুখের কথা। পুলসিটা পঞ্চায়েতের SLO মিতাংশু বাবুর শরণাপন্ন হই আমরা। অসামান্য দক্ষতায় শুধু লোকটিকে খুঁজে বার করেন উনি তাই নয়, যোগাড় করে আনেন তাঁর ফোন নম্বর ও। অতঃপর? আমি বলি, চিঠি পাঠাও, যা হয়েছে তাতে তোমার আমার প্রত্যক্ষ কোন ভূমিকা নেই বটে, তবে আমরা যে সব জেনেও ফেলে রাখিনি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ থাকা জরুরী। সৌম্য কাকুতিমিনতি করতেই থাকে, " প্লিজ ম্যাডাম, একবার ফোন করি? মিতাংশু বাবু বললেন লোকটিও আমাদের স্কিমের বেনিফিশিয়ারি, বললে নির্ঘাত শুনবে -"।
শোনা তো দূরের কথা, লোকটির ভাই নাকি দাদা ফোন কেড়ে নিয়ে যাচ্ছেতাই কথা শোনায় সৌম্যকে। " দেব না টাকা, কি করবেন করে নিন"। দেয় হুমকি ও। সৌম্য নিরুত্তাপ গলায় একটাই কথা বলে যায়, " আপনার যা করার আপনি করতে পারেন,তবে সরকারের টাকা হজম করা এত সোজা নয়। আজ নয়তো কাল আপনাকে টাকা ফেরৎ দিতেই হবে। আমি ভালো কথায় বলছি, ম্যাডামের কানে গেলে উনি কিন্তু পুলিশ পাঠাবেন। গ্রামে থাকেন আপনারা, সকলের সামনে পুলিশ গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লে আপনাদের পরিবারের সম্মান থাকবে তো -"।
সত্যিই পুলিশের হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে আর পঞ্চায়েতকে জড়িয়ে একজনের টাকা উদ্ধার করেছিলাম আমরা। দিন তিনেক বাদে লোকটি ঘুরে ফোন করে সৌম্যকে, " স্যার আমার ভাই আপনার সাথে খুব খারাপ আচরণ করে ফেলেছে সেদিন। ক্ষমা করবেন আজ্ঞে -। কিন্তু ট্যাকা তো নাই। সে আমি খরচ করে ফেলিচি। ফেরৎ দিতে অপারগ - ।"
সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না বুঝে ওনার আধার নম্বর দিয়ে স্থানীয় ব্যাঙ্ক গুলিতে খোঁজ নিতে থাকি আমরা। একটা একাউন্ট উনি ফাঁকা করে দিয়েছেন তার মানে এই নয় অন্য কোন একাউন্ট নেই। দীর্ঘ সাড়ে তিন বছরে কিছু তো চিনেছি আমরা এই জেলার মানুষগুলোকে। এরা পূর্ব মেদিনীপুর হতে পারে, সৌম্য আর আমিও হাওড়া। পাশের জেলা, হাড়ে হাড়ে চিনি এদের। ঠিক বেরোয় অন্য একাউন্ট, সেখানে ঢোকে কৃষকবন্ধু ইত্যাদি প্রকল্পের টাকা। চিঠি দিয়ে ফ্রিজ করানো হয় সেই একাউন্ট। এবার যাবে কোথায় বাছাধন -
লোকটি এসে কেঁদে পড়ে সৌম্যর কাছে। সৌম্য বলে, " মনে করুন আপনি ধার নিয়েছেন সরকারের থেকে। শোধ আপনাকে দিতেই হবে। তফাৎ হল এক্ষেত্রে আপনাকে সুদটা দিতে হচ্ছে না।" লোকটি নিমরাজি হয়ে জানান, ফেরৎ দেবেন বটে, তবে গোটাটা নয়, কিছু কমসম করে দেবেন, দেবেন ১২টা কিস্তিতে। একেকটা কিস্তি জমা হবে তিন চার মাস ছাড়া ছাড়া। ইল্লি আর কি -
শেষে অনেক কাণ্ড করে তিন কিস্তিতে পুরো টাকাটা ফেরৎ দেয় লোকটি। তার জন্য অনেক অনুনয়-বিনয়, হুঙ্কার-চিৎকার, ইড়িমিড়ি বাঁধনের গপ্প ফাঁদতে হয় অবশ্য আমাদের। সে সব এখন অতীত। আপাতত মহানগর টাকা ফেরৎ পেয়ে, পুনরায় চালু করেছে নিদ্রাদেবীর পেনশন। ঐ ৬৪ হাজার টাকা শুধু তাই নয়, উনি পেতে চলেছেন বন্ধ করে রাখা বছর গুলির পেনশন এরিয়ারটাও।
যার জন্য এত লড়াই, তাঁকে একবার স্বচক্ষে দেখার লোভ যেমন আমার ছিল, আজ শুনলাম উনিও আমাকে দেখার জন্য ততোটাই ব্যগ্র ছিলেন। সৌম্য বলল, " আপনি কাল ফোন করে না আসতে বললে আমিই ফোন করতাম আপনাকে। টাকা ঢোকা ইস্তক এই মাসিমা রোজ ফোন করছেন আর আপনার কথা জিজ্ঞাসা করছেন।" আমরা হলাম পরিযায়ী পাখি, আজ এই জেলায়, কাল না জানি কোন জেলায়। উড়ে যাবার আগে এত জটিল একটা গ্রন্থি যে খুলে যেতে পারলাম এটাই সবথেকে আনন্দের। সৌজন্য অবশ্যই আমার টিম। টিমে খেলার এটাই মজা -
ছবিতে শ্রীমতী নিদ্রা দেবী এবং তার টাকা উদ্ধারকারী লোকজন 😊
অনির ডাইরি ২৪ শে জুন, ২০২৫
#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা
ওনারা ছয় জন। পাঁচ জন মহিলা একজন পুরুষ। প্রত্যেকেই বিভিন্ন ব্লকের বাসিন্দা। সকলেই হারিয়েছেন কোন না কোন প্রিয়জন। তবে সেটা আজকের কথা নয়, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ এর ঘটনা। মৃত ব্যক্তির নমিনি হিসেবে এনারা প্রত্যেকেই পেয়েছেন ৫০ হাজার টাকার এককালীন অনুদান। অন্তত আমাদের অফিসের কাগজপত্র তো তাই বলে -
কিন্তু এনারা শোনান অন্য কাহিনী। কারোরই নাকি টাকা ঢোকেনি। বললেই হল নাকি? মুখের কথায় কে বিশ্বাস করে মশাই। নিয়ে আসুন দেখি ঐ সময়কার ব্যাংক স্টেটমেন্ট। ব্যাপারটা বলতে যত সহজ, একজন অসংগঠিত শ্রমিকের পক্ষে করা অতটাও সহজ নয়। আমাদের ছাপোষা আপিসে আসতেই থতমত খান ওনারা, এমনকি জুতো খুলেও ঢুকতে দেখেছি মানুষকে। সেখানে ঝাঁ চকচকে ব্যাংকে গিয়ে এত পুরাণ লেনদেনের হিসেব চাওয়াটা বেশ কঠিন ব্যাপার। সময় লেগেছে হয়তো, তাও নিয়ে এসেছেন ওনারা। দেখা যায় সত্যিই ঢোকেনি কোন বড় টাকা।
তাহলে কি ক্রেডিট ফেলিয়র হল, অর্থাৎ আমাদের পাঠানো টাকা কোন কারণবশত আবার আমাদেরই একাউন্টে ফেরৎ পাঠালো ব্যাংক? ক্রেডিট ফেল ব্যাপারটা যে কোন আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের কাছেই দুঃস্বপ্নের মত। তবে এমন বাপু কোথাও দেখিনি। এখানে আমাদের ঐ সময়ের ব্যাংক স্টেটমেন্ট
চেক করতে গিয়ে আমাদের তো চক্ষু চড়ক গাছ, বিশ তথা বিষের বছরে কয়েক ক্ষেপে থোক টাকা ফেরৎ দিয়েছে ব্যাংক, কিন্তু তার উৎস কি, অর্থাৎ কোন একাউন্টে না ঢুকে তা ফেরৎ এল তার কোন হাল হদিশ নাই।
এই নিয়ে দীর্ঘ দৌড়াদৌড়ি, চিঠিচাপাটি, বার বার ব্যাংকে যাওয়া, দিন ভর বসে থাকা, প্রয়োজনে গায়ে গতরে খেটে ওনাদের ফাইল পত্র খোঁজা, আমাদের রেকর্ডের সাথে ওনাদের রেকর্ড মেলানো ইত্যাদি প্রভৃতি করে যখন আমরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছি, হঠাৎ ইউরেকা !
ঈশ্বরের মতোই ব্যাংক ও বোধহয় "works in mysterious way", নইলে হঠাৎ এতদিন পরে কি করে উদ্ধার হয় এত পুরাণ এতগুলি কেস। তাও আবার এক সাথে - ।
আজ ডাকা হয়েছিল প্রিয়জন হারা মানুষগুলোকে। ইতিমধ্যে সকলেরই শুকিয়ে গেছে চোখের জল, সকলেই হারিয়ে ফেলেছেন আশা, সরকারি আপিসে, " এ তো আকছার ঘটে, সাদা কালো লং শটে", কার টাকা, পকেটে পুরে বাড়ি নিয়ে যায় যে কে (চন্দ্রবিন্দুর মধ্যবিত্ত ভীরু প্রেমের সুরে পড়বেন কিন্তু)। বললেই খ্যাঁক করে ওঠে সৌম্য, আজও বলছিল, " সরকারের দেয় একটা টাকাও মারা যায় না। আপনার টাকা আপনারই, কেউ পকেটে পুরতে পারবে না। হ্যাঁ সময় হয়তো লাগে -।"
এতদিন মাথা নত করে থাকতাম আমরা, অপারগতার দায়ে লজ্জিত থাকতাম আমরা, আজ সবার একগাল হাসি, আমাদেরও, ওদেরও। বললাম, বেশি না আর দুয়েক দিনের মধ্যেই ঢুকে যাবে টাকা। যদি না ঢোকে, আগামী সপ্তাহের মধ্যে অবশ্যই জানাবেন। আর যাবার সময় এই ছেলেটাকে ভালো করে আশীর্বাদ করে যাবেন, মূলত এর চেষ্টায়ই উদ্ধার হয়েছে আপনাদের টাকা। এমন জ্বালান জ্বালিয়েছে ব্যাংককে, বাপরে বাপ - আর ব্যাটাকে ঢুকতে দিলে হয়।
অনির ডাইরি ২১ শে জুন, ২০২৫
#অনিরডাইরি #কলকাতার_কড়চা
ঠিক করেছিলাম বাসেই যাব, সেই মত দেড় ঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে যেতে সময় লাগবে আধটি ঘণ্টা। শৌভিক বার বার বলেছিল ক্যাব নিতে, সকাল থেকে যে দেখিনি তাও নয়, একটায় ভাড়া দেখাচ্ছিল ৩৮০, অন্যটায় ৪৪৫। "কিপটে/ চাকরি করিস কেন" ইত্যাদি বলে এক গাদা গালি দিয়ে বেরোনোর সময় আমার বর বলে গেছে, " আড়াইটে থেকে প্রোগ্রাম হলে, তোকে কিন্তু সোয়া একটার মধ্যে বাসে চেপে বসতে হবে।"
একটা থেকে দাঁড়িয়েই আছি, সারা পৃথিবীর সব বাস আমার চোখের সামনে দিয়ে নাচতে নাচতে যাচ্ছে, আমার বাসটারই দেখা নেই ভগবান। দেড়টা নাগাদ আর রিস্ক নিলাম না। অফিস টাইম নয় বলেই হয়তো ভাড়াটাও দেখলাম অনেক নীচে নেমেছে। সবথেকে সস্তার ক্যাব, ভেতরটা ধুলোয় ভর্তি, তবে গাড়িওয়ালা অমায়িক এবং বাঙালি।
আমার গন্তব্য মৌলালি যুব কেন্দ্র। বিগত জানুয়ারি মাসে একটা ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, সেই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের আলোচনা সভা। যদিও আমাকে অফিসিয়ালি আমন্ত্রণ জানিয়েছে প্রয়াস নামক একটি এনজিও, কিন্তু আমি যাচ্ছি শুধু পারমিতার আহবানে। পারমিতার সাথে আলাপ হয়েছিল চন্দননগরের বড় সাহেবের মাধ্যমে। তখন আমি চুঁচুড়ায়। পারমিতা তখন হয় দুর্বার নয়তো পরিচিতি নামক এনজিওতে যুক্ত। তারপর গঙ্গা রূপনারায়ণ দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল, আমরাও একসাথে করে ফেলেছি অনেকগুলি নারী ক্ষমতায়নের কর্মশালা, শ্রমিক মেলা আরও কত কি। এতদিন আমি ডেকেছি পারমিতা এসেছে, আজ উল্টো পুরাণের দিন।
দুটো দশের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, এই প্রথম মৌললি যুব কেন্দ্রে এলাম আমি। আমার ভেবলে যাওয়া মূর্তি দেখেই হয়তো ট্রিপ শেষ করার পরও একটু এগিয়ে দিল ড্রাইভার। যুব কেন্দ্রের ছোট হলটায় আমাদের আজকের সমাবেশ। কি নিয়ে সমাবেশ সেটা বলতে গেলে পিছিয়ে যেতে হয় বেশ অনেক গুলো বছর, সেটা ২০১৬ সাল, অক্টোবর মাস, উত্তরাখণ্ডের দেরাদুন শহরের নিবাসী অজয় মালিক এক প্লেসমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে একটি আদিবাসী মেয়েকে তাঁর সরকারি নিবাসে গৃহপরিচারিকা হিসেবে নিয়োগ করেন। শ্রী মালিক পেশায় ছিলেন DRDO র একজন বিজ্ঞানী।
২০১৭ র মার্চ মাস নাগাদ পেশার টানে শ্রী মালিককে কিছুদিনের জন্য কানপুর যেতে হয়। স্ত্রী, দুই পুত্রসহ মালিক বাবু তো রওনা দিলেন কানপুর, বাড়ি পাহারা দেওয়া তথা সাফসুতরো রাখার জন্য রেখে গেলেন পরিচারিকা মেয়েটিকে। এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল, কিন্তু পাছে মেয়েটি এই সুযোগে বাড়ি সাফ করে পালিয়ে যায়, তাই সদর দরজায় লাগিয়ে গেলেন একটা মস্ত বড় তালা। চাবিটা দিয়ে গেলেন প্রতিবেশী তথা বন্ধু অশোক কুমারকে। তিনি দিনে একবার আসেন, মেয়েটিকে খাবারজল দিয়ে যান, বাড়িটা ঠিক আছে কিনা দেখে যান আর যাবার সময় আবার লাগিয়ে যান তালাটা। এই ভাবে এক সপ্তাহ চলার পর ব্যাপারটা জানাজানি হয় এবং পুলিশ গিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে। সেই নিয়েই FIR এবং মামলা-
যে মামলায় উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট অজয় মালিক এবং অশোক কুমার দুজনকেই অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করে শাস্তি বিধান করে। সেই শাস্তির বিরুদ্ধেই ওনারা আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টে। ইতিমধ্যে অবশ্য মেয়েটি হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে যে তার আর এনাদের প্রতি কোন অভিযোগ নেই এবং এনারাও কোর্টকে জানিয়ে দিয়েছেন যে বাড়ির পিছন দিকে একটা খিড়কি দুয়ার ছিল, মেয়েটি চাইলে সেখান দিয়েও পালাতে পারত ইত্যাদি প্রভৃতি যেমন হয় আর কি।
জানুয়ারি ২০২৫ এ মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এই কেসে ৩৬ পাতার রায় দিয়েছেন। যার ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে ভারতে গৃহপরিচারিকাদের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ। কেন্দ্র সরকারের চারটি দপ্তর যথাক্রমে শ্রম, সামাজিক ন্যায়বিচার, নারী ও শিশু কল্যাণ এবং আইনকে নির্দেশ দিয়েছেন এক বিশেষ কমিটি গঠন করার, যাঁরা বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে গৃহ শ্রমিকদের সামগ্রিক উন্নয়নের এক আইনি রূপরেখা নির্ধারণ করবে। সেই আইনি রূপরেখা কি হতে পারে সেই নিয়েই আজকের আলোচনা সভা।
অনেক দিন বাদে দেখা হল পারমিতা, শুভ্রা, কাকলিদের সাথে। দেখা হল আমার ভীষণ প্রিয় মানুষ অঞ্চিতাদির সাথে। কলকাতায় গৃহ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ অঞ্চিতাদিই প্রথম শুরু করেছিলেন। আজ সকলেই পরিপাটি হয়ে এসেছেন,আজ সকলকেই ভীষণ সুন্দর লাগছে দেখতে। যুব কেন্দ্রের ছোট হলটা ধীরে ধীরে ভরে উঠছে, কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে আসছেন গৃহসেবিকার দল। আসছেন বিভিন্ন এনজিওর প্রতিনিধিবর্গ। এক ফাঁকে এসে বলে গেল পারমিতা, " আপনার আরও একজন প্রিয় মানুষ আসছেন, ডঃ কিংশুক সরকার।"
স্যার আমার প্রাক্তন বড় সাহেব, চন্দননগরের বড় সাহেব। চাকরি এবং তার বাইরেও কত কি যে শিখেছি স্যারের থেকে, আমাদের মধ্যপ্রদেশে প্রেমটাও স্যারের হাত ধরে। অনেক বছর হল চাকরি ছেড়েছেন স্যার। বর্তমানে গোয়ায় IIM এর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। উনি চাকরি আর আমি চুঁচুড়া ছাড়ার পরও অনেকদিন যোগাযোগ ছিল স্যারের সাথে, নিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ওনার লেখা প্রবন্ধের লিংক পাঠাতেন স্যার। আমিও ডাকতাম বিভিন্ন কর্মশালায় সেশন নেবার জন্য। তারপর যা হয় আর কি - সময় ধুলো জমিয়েই যায় সব প্রিয় সম্পর্ক গুলোর ওপর।
জানতাম দেখা হলেই স্যার এই নালিশটাই করবেন, ঠিক তাই করলেন। " ফেসবুকে প্রায়ই দেখি, কত প্রোগ্রাম করছ তুমি। আমায় তো আর ডাকো না।" বল মা তারা, দাঁড়াই কোথা -। গোয়া IIM এর অধ্যাপককে ডাকার মুরোদ কি তমলুকের আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের আধিকারিকার আছে। চাকরি ছাড়ার সাথে সাথে কি আমার আর্থিক অস্বচ্ছলতার কথাও ভুলে গেলেন স্যার? স্যার হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, " আরে পয়সা চাইছে কে? দিও না।" বললাম, আর গাড়ি? আপনাকে কলকাতা থেকে আনতে পাঠাব যে সেই জোর তো থাকতে হবে নাকি। স্যার বললেন," আরে লোকাল ট্রেন ধরে নেব। তুমি জানো আমার এই গুলো ভালো লাগে -"।
আলোচনা চক্র শুরু হয়। সাতটা জেলায় গৃহসেবিকাদের ওপর চালানো সমীক্ষার রিপোর্ট পেশ করেন একজন। তুলে ধরেন নানা সমস্যার কথা, বেতন বৈষম্য, কাজের সময়, বাথরুম ব্যবহার করতে না দেওয়া, আলাদা কাপে চা, আলাদা বাসনে খেতে দেওয়া, অশ্লীল চাওনি, কিছু হারালেই চুরির বদনাম ঘুরে ফিরে আসে অনেক কথাই। এক দিদি বলেন, " আমরা আর কিছু চাই না, শুধু 'সনমান' চাই।" মালিক পক্ষের প্রতিনিধিরাও পেশ করেন তাদের বক্তব্য। এবার আমাদের পালা -
সঞ্চালিকার একদিকে স্যার আর আমি, অন্য দিকে দুই এনজিও থেকে আসা দিদি। বেশ ভয়েই ছিলাম, এসব ক্ষেত্রে যা হয় আর কি, সরকার পক্ষের লোকটিকে ধুয়ে দেয় বাকিরা। ভরসা একটাই স্যার আছেন। ডাইনে বাঁয়ে একাই ব্যাট চালালেন স্যার। অপরিসীম জ্ঞান আর বাগ্মিতায় মোহিত করে দিলেন সকলকে। অনুষ্ঠান শেষে এক ভদ্রমহিলা এসে বললেন, ' আমি একটা বাইট নেব আপনার থেকে।' হেসে বললাম, স্যার থাকতে আমি কে রে ভাই। সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে মহানগরের বুকে, যাই বাস ধরি। হে ঠাকুর একটা ফাঁকা বাস পাইয়ে দাও প্রভু। লিফট অবধি এগিয়ে দিলেন স্যার, বললেন, " আর এমপি যাও না?" এবার আমার হাসার পালা, কি বলছেন স্যার, এই তো মাস খানেক আগেই গিয়েছিলাম। তবে এবার ভাবছি এমপিকে ছাড়ব, ওদের সব ভালো, শুধু বাঘ গুলো হেব্বি বেইমান। দেখা দিতে কেন যে এত সমস্যা ব্যাটাদের। অনেক হয়েছে, আর না, এবার অন্য কোন রাজ্যে ঘোরার প্ল্যান বানিয়ে দিন প্লিজ - ।
অনির ডাইরি ১২ই জুন, ২০২৫
#তাম্রলিপ্তকড়চা #worlddayagainstchildlabour
যেমন হয় আর কি, অর্ডারটা এল শুক্রবার বিকালে। সংশোধনী অর্ডারটা এল সন্ধ্যা নাগাদ। আমি যখন দেখলাম তখন আবাসনের রাস্তায় বাঁশি বাজিয়ে ঘুরছে নৈশ প্রহরীর দল, যোগ্য সঙ্গতে স্থানীয় সারমেয় কুল। দেখলাম আগামী বৃহস্পতিবার বিশ্ব শিশু শ্রমিক বিরোধী দিবস পালন করতে হবে কয়েকটি বিশেষ আপিসকে। তাদের মধ্যে তমলুক নাই -। অতঃপর আর কি, মুঠো ফোন বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
শনিবার জলখাবারের পর ঘেমে নেয়ে ঘর ঝাড়ছি, বড় সাহেবের ফোন, " কালকের অর্ডারটা দেখেছ?" জানালাম দেখেছি তো বটেই, এটাও দেখেছি পূব মেদিনীপুরেও করতে হবে বিশেষ অনুষ্ঠান, কিন্তু সেটা তমলুক নয়, হলদিয়া। বড় সাহেবের খাস তালুক। স্যার হেসে বললেন, " কিন্তু আমরা চাইছি, অনুষ্ঠানটা তোমার খাস তালুকে হোক, অবশ্যই সদর দপ্তরের অনুমতি সাপেক্ষে। সেটা সোমবারের আগে জানা যাবে না। তুমি ভেবে রাখো -"।
কি ভাবি? সময় যে বড়ই স্বল্প। সোমবার যদি সম্মতি মেলেও, সেদিন হবে না কোন কাজ। কারণ সদর দপ্তরের নির্দেশ মত সেই দিন ফিল্ড ইন্সপেকশনে বেরোবে আমার দলবল। তাহলে হাতে রইল মঙ্গল আর বুধ। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ মেসেজ করলাম আমার টিম তাম্রলিপ্ত গ্রুপে, "নভোনীল বাবু এবং ভাইসব শোন, আগামী ১২ ই জুন Internationa Day against Child Labour। জেলায় জেলায় নানা বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হবে, স্যার চাইছেন আমাদের জেলার অনুষ্ঠানটা হোক আমাদের নিমতৌড়ি নব্য প্রশাসনিক ভবনে, অবশ্যি কলকাতার অনুমোদন সাপেক্ষে। সেটা পেতে গড়িয়ে যাবে সোমবার। তাই এখনি কিছু করার নেই শুধু ভেবে রাখো।"
বেলা ১টা ৮ এ সৌম্য লিখল, " ম্যাডাম অনেক কিছুই করা যাবে। আমার মনে হয় হলে আমরা একটা awareness programme/ Seminer আয়োজন করতে পারি। এখানে DM Sir আমন্ত্রিত থাকবেন ও অন্যান্য officer রাও থাকবেন। দর্শক/ শ্রোতাদের মধ্যে স্থানীয় বিদ্যালয়গুলির শিক্ষক(ইকা) এবং ছাত্র ছাত্রীদের নিমন্ত্রণ করা যেতে পারে। এছাড়াও স্থানীয় যে বাজার কমিটি যে গুলি থাকে তাদেরকেও ডাকা যেতে পারে, এছাড়া জেলার বিভিন্ন NGO গুলির ও থাকা উচিৎ।
ম্যাডাম অনুষ্ঠানটা করা যেতে পারে এভাবে:
স্বাগত ভাষণ, প্রদীপ প্রজ্জ্বোলন বা অন্যকিছু, এবছরের থিম সম্পর্কে বলা, আমাদের তরফে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে একটি শপথ বাক্য পাঠ, এরপর অফিসিয়ালদের বক্তব্য, চাইল্ড লেবার রেসকিউ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা শেয়ার বা কোন ডকুমেন্টরি দেখানো, তারপর সমগ্র অংশগ্রহনকারিদের মধ্যে interactive আলোচনা থাকতে পারে, স্টুডেন্টদের জন্য স্লোগান পোস্টার লেখা, কুইজ কনটেস্ট, এসে কনটেস্ট, নাটক হতে পারে। সেরাদের জন্য কিছু পুরষ্কার থাকবে। চিত্রাকর্ষক কিছু ব্যানার তো থাকবেই, যাতে সকলের চোখ টানে।আপাতত এগুলো মনে পড়ছে ম্যাডাম।🙏"
১টা ১৪ নাগাদ মেসেজটা পড়ে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, "আর কি মনে পড়বে বাপ ❤️"। বেলা ১টা ৫৮ এ প্রতিক্রিয়া দিলেন বড় সাহেব, "Excellent! 👌👌"। ব্যাস তাহলে আর কি? সোমবার আপিস খুললেই আগে হলটা তো বুক করা হোক। ডিএম সাহেবের সব থেকে বড় হলটা যদি পাওয়া যায়, অন্তত দুশ লোক ধরে যাবে ওতে। বুকিংয়ের কাজটা হয় করেন হক বাবু, নয় শান্তনু। হক বাবু আপাতত ঈদের ছুটিতে আছেন, তারপর বাড়ির বিয়ের জন্য আরো কিছুদিন ছুটি নিয়েছেন, আর শান্তনু কাহিল মরশুমি জ্বরে, হোক জ্বর বাবা, তাও যা, নাজির খানায় গিয়ে হল বুক করে উদ্ধার কর। শুধু নাজির খানার কাউকে ধরিয়ে আসিস না বাপ, নেক্সট টাইম ওরা আর হল দিবে নি।
কাশতে কাশতে শান্তনু তো গেল হল বুক করতে, দেখা গেল জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক আগেই বুক করে রেখেছেন আমাদের সাধের মস্ত বড় হলটা। অগত্যা মাঝারি হলটাই ভরসা। ধারণ ক্ষমতা একশ মাত্র। তাই সই, এবার কলকাতা অনুমোদন টুকু দিলে বাঁচা যায়।
পুনশ্চ - নীচের রংবেরংয়ের পোস্টার গুলো লিখেছে আমাদের সৌম্য মুখোপাধ্যায় আর ডিজাইন করেছে আমাদের শান্তনু Santanu Ghara
অনির ডাইরি ১২ই জুন, ২০২৫
#তাম্রলিপ্তকড়চা #worlddayagainstchildlabour
(প্রথম পর্বের পর)
সৌম্যর আঁকা পথ ধরেই হাঁটি আমরা-
প্রথম প্রস্তাব ছিল গণসচেতনতা শিবির তথা সেমিনার। তার জন্য হল তো বুক করলাম আমরা, এবার পালা হল ভরানোর। মঙ্গলবার যখন নভোনীল বাবু, সৌম্য, বেদজ্যোতি, শুভাশিস আর আমি গোল টেবিলে বসলাম তখন মূল অনুষ্ঠানটা শুরু হতে বাকি মাত্র ৪৮ টি ঘণ্টা। শান্তনু আজ অনুপস্থিত। আজকের দিনেই ছুটি নিতে হল বাবা তোকে!
দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল এই অনুষ্ঠানের সূচনা করবেন মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়। অচীরেই রথ, বিশ্বস্ত এবং অবিশ্বস্ত সূত্রের খবর সেই সময় নাকি মাননীয়ার পদধূলি পড়তে চলছে এই জেলায়, তাই এই মুহূর্তে ডিএম স্যারকে পাওয়া প্রায় লটারি জেতার সামিল। সোমবার থেকে বি ব্লকের বাতায়নে দাঁড় করানো আছে আমাদের রবিকে। ডিএম স্যারের গাড়ি এলেই যেন খবর দেয় আমায়। গতকাল মহানগরের অনুমোদন পাওয়া ইস্তক দাঁড়িয়েই আছে রবি, মাঝে মাঝে মাথা চুলকাচ্ছে, এদিক ওদিক যাচ্ছে, আমাকে দেখলেই আবার অ্যাটেনশন, তাও একটা সুখবর দিতে পারেনি ব্যাটা।
তৃতীয় প্রস্তাব ছিল, আমন্ত্রণ জানানো হবে অন্যান্য আধিকারিকদের। মাননীয় জেলা শাসকের সময় না পেলে কি করে আমন্ত্রণ জানাই বাকিদের। কি করে বলি কোন সময় হবে আমাদের অনুষ্ঠান। তাও গোল
গোল করে ফোন করে রাখি তাঁদের, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত শিশু এবং শ্রমিকদের সাথে।
চতুর্থ প্রস্তাব ছিল নিমন্ত্রণ জানানো হবে স্থানীয় বিদ্যালয় গুলির মাননীয় শিক্ষক(ইকা) এবং ছাত্রছাত্রীকুলকে। হলদিয়া থেকে দেবাশীষ বাবু বললেন, " ম্যাডাম বাচ্ছা কি আর এখন পাবেন? গ্রীষ্মের ছুটি শেষে খুলে গেছে সব স্কুল, যাতায়াতের পথে মাস্টারমশাই, দিদিমনিদের সাথে কথা বলে দেখেছি ওঁনারা সবাই খুব চাপে আছেন, সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করা নিয়ে -"। কেলো করেছে। বড়দের শুকনো খটখটে আলোচনা ব্যতিরেকে বাকি সবটুকুই তো বাচ্ছাদের নিয়ে পরিকল্পনা করছি আমরা, সেই কোন ফেলে আসা মেয়েবেলায় শিখিয়েছিল বাবা, ছাত্রদের প্রতি জনৈক মহান ব্যক্তির বাণী, " জগৎটা তোমাদের, জগৎটা আমাদেরও, কিন্তু তোমরা হলে সকাল আটটা নটার সূর্য। " ওদের হাতে আছে অনন্ত সময়, জগৎ পাল্টে ফেলার অপরিসীম সম্ভবনা। শুধু একটু ঝাঁকিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা।
আসন্ন সোশ্যাল অডিটের চাপ মাথায় নিয়েই স্কুলে স্কুলে ঘোরে মুকুল। খুলে বলে আমাদের উদ্দেশ্য আর বিধেয়। নন্দকুমারের ইন্সপেক্টর রঞ্জিত আর SLO শিবু মিলে যোগাড় করে ফেলে আরো কিছু বাচ্ছা। দিন শেষে হিসেব করতে বসে মাথা চুলকায় বেদজ্যোতি, " ম্যাডাম এত বাচ্ছাকে বসাবেন কোথায়? বাচ্ছা একটু কমাতে হবে।" শুধু বসানো নয়, আছে টিফিন, আছে টুকটাক উপহার, কিনতে হবে শ্লোগান, পোস্টার আঁকার জিনিস পত্র, বাজেট যে অতি অল্প। কমাও বললেই কমানো যায় নাকি, হেড মাস্টার মশাই/ বড় দিরা কাতর অনুরোধ করেন, " প্লিজ স্যার/ প্লিজ ম্যাডাম আমরা ওদের বলে ফেলেছি যে। এখন নিয়ে যাব না, বললে ওরা দুঃখ পাবে না?"
বাচ্ছাদের দুঃখ দিলে কি আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হবে, কখনই না। কিন্তু সব মিলিয়ে লোকসংখ্যা যে প্রায় পৌনে দুইশ ছুঁই ছুঁই। এই গরমেও সুদূর কাঁথি থেকে আসতে চাইছেন বাজার কমিটি, NGO র লোকজন। ইঁটভাঁটা মালিক সংগঠন থেকে আসতে চাইছেন অন্তত ২০ জন। কাকে রাখি, কাকে ফেলি? অগত্যা চঞ্চলকে পাঠানো হয়, " দেখ তো পাশের মাঝারি হলটা ফাঁকা আছে কিনা? থাকলে ওটাও নেব আমরা। উদ্বোধন অন্তে বাচ্ছাগুলিকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ঐ ঘরে। ততক্ষণ না হয় একটু দাঁড়িয়েই থাকবে আমাদের ছেলেমেয়েরা।
আমন্ত্রণ/ নিমন্ত্রণ সারতে সারতেই কেটে গেল মঙ্গলবার। হাতে মাত্র একটা দিন, ২৪ টি ঘণ্টা, কি যে হবে -
অনির ডাইরি ১১ই জুন, ২০২৫
#অনিরডাইরি
হাকুচ তেঁতো মন নিয়ে বেরিয়েছি, একে তো ভ্যাপসা গরম, তায় মেয়ের থেকে দূরে থাকার বেদনা। গৃহকর্তার বদলী হওয়ার সুবাদে আমাদের পূব মেদিনীপুরের বাস উঠেছে বেশ কিছুকাল। বর্তমান নিবাস থেকে তমলুক আপিস করতে আসা হয়তো অসম্ভব নয়, তবে এই গরমে বড্ড কষ্টকর। তাও যে করিনি, বা আগামী দিনে করব না তা নয়, কিন্তু এই সপ্তাহটা পিত্রালয়ে থেকেই করার চেষ্টা করছি।
দক্ষিণ পূর্ব শাখার ট্রেনের ওপর জনগণের অপসৃয়মান ভরসা প্রত্যক্ষ করে একটু সকাল সকালই বেরিয়েছি আজ। এখনও ভালো করে ঘুম ভাঙ্গেনি শ্রমজীবী এই শহরটার। রাস্তা পেরোতে গিয়ে চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল ফাঁকা ৭২ নম্বর বাস খানা। তিতকুটে স্বাদখানা যেন আরো গভীর হল মনের মধ্যে। রাস্তা পেরিয়ে পাওয়া প্রথম টোটো খানাই অবশ্যি রাজি হয়ে গেল দাশনগর যেতে।
প্রায় দুই দশক পর আবার এই পথে আপিস যাচ্ছি। বিগত বার আমি অবিবাহিত ছিলাম, শ্রীমতী তুত্তুরী ঘুমিয়ে ছিলেন ভবিষ্যতের গর্ভে। বিগত বার আমার পোস্টিং ছিল খড়গপুর।বিগত বার টিফিন আর জলের ভারী ব্যাগটা নিয়ে, "বাবা কেন চাকর" বলতে বলতে রোজ বাসে তুলে দিতে আসত যে বাবা, আজ ঘর থেকে রোয়াকে নামতে টলে যায় সে।
ভাত না খেয়ে বেরোতেই দিত না মা। কাক ডাকা ভোরে উঠে টুকটুক করে কত কি যে রাঁধত। বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হত বলে দুই দফার টিফিন গুছিয়ে দিত মা। ঠাণ্ডা জলের বোতলের গায়ে জড়িয়ে দিত নরম তোয়ালে। আজ ডবল ডিমের ওমলেট আর বাসী রুটি খেয়ে বেরিয়েছি। লতা দি অবশ্যি অনেক বার বলেছিল, "দুটো ভাত করে দিই বনি? টিফিনে দুটো রুটি করে দিই নিয়ে যাও বনি -।" আমিই নিষেধ করেছি, লতাদির মত ওমলেট কেউ বানাতে পারে না। বাসী রুটি দিয়ে লতাদির হাতের নরম গরম ওমলেট এককথায় অতুলনীয়।
টিফিন কি খাব, তাও ঠিক করে নিয়েছি, ডিএম আপিসের ক্যান্টিনে অসাধারণ মাখন টোস্ট বানায়। আমার জন্য যখন আনতে যায় রবি বা শান্তনু, ওরা একে তো প্রচুর বাটার লাগায় তারপর করে কি, ব্রেডটাকে স্যান্ডুইচ মেকারে সেঁকে দেয় বেশ করে। ওপরে ছড়িয়ে দেয় হাল্কা করে চিনি আর মরিচের গুঁড়ো। ভাবতে ভাবতে সিক্ত হয়ে ওঠে জিহ্বা।
দক্ষিণ পূর্ব রেলের আজ অশেষ দয়া যে আপিস টাইমের ঢের আগে পৌঁছে দিলেন আমায়। সুইপার মাসি যে কি উৎফুল্ল হল সক্কাল সক্কাল আমায় দেখে। উল্টে দিলে নালিশের ঝুড়ি, " তুমি মা জননী আমায় ভুলেই গেছ, কতদিন বেতন বাড়েনি জানো, সেদিন আমার লাতি আর লাতুনকে নিয়ে এয়েছিলুম তোমায় দেখাব বলে আর তুমিই কি না সেদিন এলে না -", ইত্যাদি প্রভৃতি। যাবার সময় লোকজনের জন্য সুপারিশ ও করে গেল মাসি, " শোন না, মেয়েটা গ্রাজুয়েট, তুমি ওর একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দাও না মা জননী-"।
সাড়ে বারোটা নাগাদ ডাকা ছিল ওনাদের, সংখ্যায় প্রায় পঞ্চাশ। বয়স ষাট থেকে সত্তরের কোঠায়। নতুন পেনশন চালু হয়েছে সবার। অন্যান্য বারের মত এবারেও বুঝিয়ে বলে দিই আমরা, একবার চালু হওয়া পেনশন কেউ বন্ধ করতে পারে না। কাজেই কেউ যদি হুমকি দেয়,পেনশন বন্ধ করে দেবার ভয় দেখায় মোটেই পাত্তা দিবেন নি। PPO টা লামিনেট করে রাখবেন কিন্তু-। পুতুলের মত ঘোলাটে চোখে তাকায় সবাই, মাথা চুলকায় টুকটাক। নভোনীল বাবু বুঝিয়ে দেন ভালো করে, " বাড়ির দলিল কিভাবে রাখেন? প্লাস্টিকে মুড়ে রাখেন না -"। দম দেওয়া পুতুলের মত মাথা নাড়ে সবাই, ফোকলা দাঁতের ফাঁকে ফোটে শিশুসুলভ হাসি।
প্রতিবারের মত এবারও প্রশ্ন করি আমি, "একসাথে যখন অনেক টাকা ঢুকবে, তখন কেউ যদি গিয়ে বলে ম্যাডাম টাকা চেয়েছেন, কি করবেন?" পিন ড্রপ নীরবতা ভেঙে সুদূর ময়না থেকে আগত এক বৃদ্ধ বলে ওঠেন, " আপনাকে নালিশ করব আজ্ঞে -"। জ্ঞান বিতরণের এহেন সুযোগ মাঠে মারা যাওয়ায় ছদ্ম ক্রোধে বলি, ধুৎ খেলব না, সব শিখিয়ে পড়িয়ে এনেছে মাইরি ময়নার ইন্সপেক্টর।
আজকের অনুষ্ঠান শেষে, কালকের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। কাল যে বিশ্ব শিশু শ্রমিক বিরোধী দিবস। মাত্র আট চল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে নামাতে হচ্ছে এত বড় অনুষ্ঠান। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মত অনুপস্থিত আমাদের হক বাবু। নিকটাত্মীয়ের বিয়ে তাই আমাদের ত্যাগ করে বসে আছে লোকটা।
তারই ফাঁকে এক বৃদ্ধ এসে ছলছল চোখে করজোড়ে বলে যান, " পরম করুণাময় ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন। ম্যাডাম, ভাবিনি কোনদিন পেনশন পাব। পেট চালাতে লোহা বইতাম। এই দেখেন লোহা বয়ে বয়ে কাঁধে আমার গর্ত হয়ে গেছে।"
একসাথে অনেক গুলো নতুন পেনশন ছাড়ার আনন্দে আরেক দল প্রৌঢ় নেতা এসে দিয়ে যান এত মিষ্টি। বলে যান, " এটা কিন্তু পূব মেদিনীপুরের মিষ্টি নয় ম্যাডাম। খাস পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে আনিয়েছি আপনার পরিবারের জন্য। এই এত্ত বড় বড় রাজভোগ। এটা বাড়ি নিয়ে যাবেন আজ্ঞে।" নিয়ে যাবার সুবিধার্থে একটা ফুলছাপ ব্যাগ ও দিয়ে যায় জনগণ। যদিও আমার বাড়ি ভর্তি মহা হ্যাংলা সুগার রোগী, তাও নিয়েইনি মানুষের ভালোবাসার দান।
বেলা গড়ায়, পাটে বসেন দিনমণি। জনগণকে গোছা গোছা নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে পড়ি আমি। কে জানে ফেরার পথে কেমন দৌড়াবে দক্ষিণ পূর্ব রেল। আমার প্রত্যাশা পূরণ করেই খোঁড়াতে থাকে ট্রেন। দাঁড়িয়ে পড়ে যত্রতত্র। দিগন্ত বিস্তৃত অন্ধকারে থমকে থাকা ট্রেনের লেডিজ কামরা থেকে মেসেজ করি মেয়েকে, বাবুরে আর আন্দাজ এত ঘণ্টা এত মিনিট পর আবার দেখা হবে তোর সাথে। জবাবে তাঁর লেখা দিনপঞ্জি পাঠান তিনি, শিরোণাম, " Kicking Open Doors"। জানি মা হিসেবে আমি পক্ষপাত দুষ্ট, তবুও মনে হল বড় ভালো লিখেছে মেয়েটা, শুধু আমার লেখার মতই বড্ড বড়। জানি ও আমার মতই লেখা ছোট করতে পারে না, কারণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই লেখাগুলোই যে আমাদের বেঁচে থাকার রসদ।