Thursday, 6 March 2025

অনির ডাইরি মার্চ, ২০২৫

 অনির ডাইরি ৮ই মার্চ, ২০১৫

#অনিরডাইরি #InternationalWomensDay 



আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিনটা এলেই বিশেষ কিছু পোস্ট বাজারে ঘোরে। যার প্রথমটি হল, " আমরা নারী, আমরাই পারি।" ইয়ে দাদা দিদিগণ, বলছি কি, আমিও নারী, কিন্তু মোটেই আমি সব পারি না। সব পারার দায় ও আমার নয়। সব পারলেও কেউ আপনাকে মেডেল দেবে না। উল্টে আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যাবে অমূল্য সময়, যা আপনি একান্তই নিজের জন্য খরচ করতে পারতেন। 


দ্বিতীয় পোস্ট যেটা কয়েক বছর আগেও মার্কেটে ঘুরত, "নারীদের জন্য বিশেষ দিন আছে। পুরুষদের জন্য নাই।" যে হতভাগ্য ফ্রাস্টু খাওয়া ব্যক্তিবর্গ এই পোস্টগুলি করত, তারা একটু কষ্ট করে গুগল করে দেখত না, যে আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস অবশ্যই আছে, প্রতি বছর ১৯ শে নভেম্বর। ইদানিং অবশ্যি তাঁদের জ্ঞানগম্যি বেড়েছে, তাই দেখলাম লিখছেন, " নারী দিবস আছে, পুরুষ দিবস আছে, মানুষ দিবস নাই।" যদি আপনি তাঁদের দলে পড়েন, তো একটু কষ্ট করে গুগলের সাহায্য নিন কেমন? ১০ই ডিসেম্বর যেন কি দিবস? 


তৃতীয় পোস্টদাতারা অধিকাংশই নারী। এনারা সক্কাল সকাল জমিয়ে লিখে দেন, "আমার নারী দিবসের প্রয়োজন নেই।" অথবা "রোজই তো নারী দিবস।" মাইরি? সত্যি? ওরে ভাই, লেখার আগে দিনটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং তাৎপর্য সম্পর্কে তো একটু পড়াশোনা তো করে নিলে পারতিস। মোটেই সব দিন নারী দিবস নয়। সব দিন নারী দিবস হতে পারে না। 


আজকের দিনটা হল পিছনে ফিরে তাকানোর দিন। কোথা থেকে কোথায় এসেছি আমরা। চলুন একটু পিছনে ফিরে তাকাই, বেশী নয় মাত্র দুশো বছর আগেও সোয়ামী মারা গেলে চিতায় পুড়িয়ে দেওয়া হত আমাদের মেয়েদের। আচ্ছা আমরা নাহয় কালা আদমি, অশিক্ষিত বর্বর জাতি। পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র গুলিতে হত না ডাইনি দহন? ন্যূনতম ব্যক্তিত্ব, প্রথা ভাঙার সামান্য প্রচেষ্টা দেখলেই তাকে ডাইনি বলে দেগে দেওয়া হত না কি? জোয়ান অফ আর্ক থেকে সালেম উইচ হান্ট যে অন্য কথা বলে দিদি। 


চলুন নিজের দেশে ফিরি। চলুন একটু এগোই, বেশী না বছর পঁচিশ। অর্থাৎ পৌনে দুশো বছর আগেও মেয়েরা লিখতে পড়তে চাইলে কি বলা  হত জানেন নাকি? চলুন আমিই বলে দিই, বলা হত, মেয়েরা লিখতে পড়তে শিখলে তার বৈধব্যযোগ অবধারিত। আর বিধবা একবার হয়ে গেলে দাঁত নখ বার করে এগিয়ে আসত সমাজ। জাঁতা কলে ফেলে তেল বার করার জন্য। ভাগ্যে তিনি জন্মেছিলেন। বীর সিংহের বীর শিশু। তাই না দুপাতা পড়তে আর দু কলম লিখতে পারছি।


পড়তে যখন শিখেইছেন, তো একটু পড়ুন না। পড়ুন ফুলমণি দাসীর কথা। সেই ১০ বছরের ফুলমণি যার বিয়ে হয়েছিল ৩৫ বছরের হরিমোহন মাইতির সাথে। বিয়ের রাতেই বেড়াল কেটে ছিল হরিমোহন। এমন বলপ্রয়োগ করেছিল বাচ্ছা মেয়েটার ওপর, ফুলশয্যা কণ্টক শয্যা হয়ে গিয়েছিল, মরেই গিয়েছিল মেয়েটা। আমার নারী দিবসের দরকার নেই বলে গলা ফাটানো দিদিমনিরা ভাবতে পারেন? আজ্ঞে হ্যাঁ। এটাই হয়েছিল। এটাই হত। বিশ্বাস না হয় Empress v. Hari Mohan Maiti কেস খুঁজে দেখুন। পড়ুন। দুঃখের কথা কি জানেন? মাত্র এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেই মুক্তি পেয়ে গিয়েছিল হরিমোহন মাইতি। কারণ বৈবাহিক মিলনকে ধর্ষণ বলে মানতে রাজি হয়নি তৎকালীন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সমাজ। 


আইন একটা এসেছিল বটে, The Age of Consent Act, 1891 যাতে বলা হয়েছিল, যৌন মিলনের জন্য সম্মতির বয়স মেয়েদের বাড়িয়ে ১০ থেকে ১২ করা হল। শিশুবিবাহ বিরোধী আইন আসতে লেগেছিল আরও চল্লিশ বছর প্রায়। The Child Marriage Restraint Act চালু হয় ১লা এপ্রিল, ১৯৩০ সাল নাগাদ। যাতে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৪ আর ছেলেদের ১৮ ধার্য করা হয়। ভোটাধিকার, সম্পত্তির অধিকার, কাজের ক্ষেত্রে সমবেতনের অধিকার ইত্যাদি পেতে মেয়েদের লেগেছিল আরো অনেক অনেক বছর। খুব সহজে এতটা পেয়ে গেছেন না, তাই হেলায় বলতে/ লিখতে পারেন, এই দিনটা নিষ্প্রয়োজন। কূপমন্ডুকতার বাঁধন ছিঁড়ে তাকিয়ে দেখুন, বাস্তব চিত্র যে ভিন্ন কথা বলে। ২০২৫ এর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের থিম কি জানেন? "Accelerate Action" অর্থাৎ পথ এখনও অনেক বাকি, লিঙ্গ বৈষম্যের লড়াই এখন অনেক জটিল, এখনই অস্ত্র ত্যাগ করলে চলবে নাকি।



অনির ডাইরি ৬ই মার্চ, ২০২৫


#অনিরডাইরি 


অঞ্চিতাদির সঙ্গে আলাপ চন্দননগরের তৎকালীন বড় সাহেবের মাধ্যমে। সালটা সম্ভবত ২০১৮ বা ১৯। বড় সাহেব নির্দেশ দিলেন, গৃহসেবিকাদের নিয়ে একটা কর্মশালা সংগঠিত করতে হবে। নির্দেশ মত চুঁচুড়ার নতুন সার্কিট হাউস বুক করলাম আমরা। চন্দননগর এবং চুঁচুড়া মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তত্ত্বতালাশ করে প্রায় ৫০/৬০ জন গৃহশ্রমিক মহিলাকে জোগাড় করলাম আমরা। মূল লক্ষ্য ওদের সামাজিক সুরক্ষা যোজনায় নথিভুক্ত করা, সাথে সাথে গৃহশ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার এবং দাবিদাওয়া বিষয়ে অবহিত করা। 


এই দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে আমাদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রয়োজন ও ছিল না। স্যার বললেন, " ওটা তুমি অঞ্চিতাদির ওপর ছেড়ে দাও।" এমন বললে প্রশ্ন করতেই হয়, অঞ্চিতাদি আবার কে? শুনলাম শ্রীমতী অঞ্চিতা ঘটক, পরিচিতি নামক এক এনজিওর মুখ্য কর্ণধার। পরিচিতি মূলতঃ গৃহশ্রমিক যাদের পাতি জনগণ কাজের মাসি বা দিদি বলে সম্বোধন করে, তাদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে ব্যাপ্ত। 


নির্দিষ্ট দিনে এসে উপস্থিত হলেন অঞ্চিতা দি, যেমন লম্বা, তেমনি ফর্সা, তেমনি গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর। কিঞ্চিৎ মেদুল এবং প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী। প্রথম আলাপেই বেশ ভাব জমে গেল। মনে হল মানুষটা ভীষণ পজিটিভ। সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন পজিটিভ এনার্জি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। নিজের সম্বন্ধেও আমার তাই ধারণা। সে অর্থে আমরা সমমেরু সম্পন্ন, কিন্তু বিন্দুমাত্র বিকর্ষণ বোধ হল না।আসলে আমি বরাবরই বীরাঙ্গনাদের অনুরাগী। 


সেদিন কর্মশালার ফাঁকফোকরে অনেক গল্প হল। শুনলাম আশির দশকের শেষ থেকে মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে লড়ছেন অঞ্চিতা দি। আপাতত গৃহশ্রমিকদের অধিকার নিয়ে সরব হবার পাশাপাশি আরো অনেক গুলি ইস্যু নিয়ে কাজ করছেন। যার মধ্যে অন্যতম অবশ্যই গার্হস্থ্য হিংসার শিকার মহিলাদের পাশে দাঁড়ানো। তবে আমার সবথেকে ভালো লেগেছিল, কলকাতার বিভিন্ন বস্তি এলাকার নিঃসঙ্গ প্রৌঢ়া-বৃদ্ধাদের নিয়ে অবসর বিনোদনের কার্যক্রম। উচ্চ-মধ্য-নিম্নবিত্ত নির্বিশেষে বয়স্ক মহিলারা যে বড় বেশী নিঃসঙ্গ তা আশেপাশে তাকালেই বুঝতে পারি। কেউ তো তাদের কথা ভাবুক। 


সেদিনের পর বছর দুয়েক আর অঞ্চিতা দির সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি আমার। তারপর তো রৈরৈ করে এসে গেল কোভিড। ঝাঁপ ফেলে দিল গোটা বিশ্ব। স্তব্ধ হয়ে গেল জীবন। স্তব্ধ হল না কেবল আমার আপিস। সেদিনও আপিস যাচ্ছিলাম, জনশূন্য অলিগলি রাজসড়ক ধরে প্রায় ১২০/১৫০ কিমি বেগে গাড়ি ছোটাচ্ছিল ড্রাইভার ছেলেটি। আচমকা বেজে উঠল মুঠোফোন, আমার নয়, ড্রাইভারের। প্রথম চোটে গাড়ি চালাতে চালাতেই ফোন ধরল ছেলেটা। তারপর স্তব্ধ হল গাড়ির ইঞ্জিন। উত্তেজিত হয়ে দরজা খুলে মাঝরাস্তায় নেমেই গেল ছেলেটি। বাতানুকূল বন্ধ গাড়ির ভিতর থেকে দেখতে লাগলাম প্রবল হাত পা নাড়ছে ছেলেটি, ফুলে উঠছে গলার শির, লাল হয়ে উঠছে মুখ। তারপরই বাঁধ ভেঙে নেমে এল বারি ধারা। 


বিশ্বাস করুন, কাঁদলে মেয়েদের থেকে অনেক বেশি অসহায় লাগে ছেলেদের। ফোঁপাতে ফোঁপাতে গাড়িতে ফিরে এল ছেলেটি। কি হয়েছে শুধাতে হল না। গড়বড় করে বলেই ফেলল ছেলেটা। ওর অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে প্রবল মেরেছে ছেলেটির মা আর মাসি মিলে। ছেলেটির মা নাকি এক উঠতি মস্তানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, লকডাউনের আগে প্রকাশ্যে তার বাইকে চেপে ঘুরে বেড়াত, তাই নিয়ে ছেলেবউ এর ঘোরতর আপত্তি ছিল। লকডাউন ঘোষিত হওয়ায় সেটা আর করতে পারছিল না। আজ লোকটি বাড়িতে এসে হাজির হয়। প্রতিবাদ করে বউটি, পরিণামে শাশুড়ি-মাসিশাশুড়ি এমনকি মাসতুতো দেওরটিও আচ্ছা করে ধোলাই দিয়েছে মেয়েটিকে। মাথার চুল ছিঁড়ে দিয়েছে।


এইসব ক্ষেত্রে যা হয় আরকি, ৪৯৮ এ ধারায় থানায় বধূ নির্যাতনের নালিশ করতে যায় স্বামী-স্ত্রী মিলে।কেস না নিয়ে, থানা শাশুড়ি এবং তার সঙ্গীকে ডেকে পাঠায়। ব্যাস, তারপর আর কিছুই হয় না। ধামাচাপা পড়ে যায় সব। এদিকে বাড়িতে উত্তোরত্তর বাড়তে থাকে নির্যাতন। যেদিন আমি অফিস যাই, স্বামী স্ত্রী এসে বসে থাকে আমার চেম্বারের বাইরে। " প্লিজ ম্যাডাম, কিছু করুন -"। কি করি আমি? কি করার ক্ষমতা আছে আমার? থানা সহযোগিতা করছে না বলে, পাঠাই নারী উন্নয়ন আধিকারিকের কাছে। তিনি আবার আমারই জেলার মেয়ে, আমারই স্কুলের ছাত্রী। আমার এবং DSWOর যুগপৎ রেফারেন্স সত্ত্বেও সেখান থেকে যে সহমর্মিতা পেয়েছিল ঐ দম্পতি সে আর বলে কাজ নেই। 


এর মধ্যে হল কি, এই নিয়ে বিশদ আলোচনা করার জন্য থানার মেজবাবু মেয়েটিকে একদিন তাঁর কোয়ার্টারে ডেকে পাঠালেন। স্পিকার অন করে বার্তালাপ করার সৌজন্যে সেই আহ্বান শুনল আমার গোটা অফিস। ছেলেমেয়েটি মিলে এবার চেপে ধরলে আমার পা। 'ম্যাডাম বাঁচান। নইলে যুগলে সুইসাইড করব -"। শেষ অস্ত্র হিসেবে ফোন লাগালাম অঞ্চিতা দিকে। নিজের পরিচয় দিলাম, অঞ্চিতা দির কন্ঠে ফুটে উঠল পরিচিত উষ্ণতা। " বলো, বলো অনিন্দিতা। কি খবর।" খুব ছোট করে বললাম। অঞ্চিতা দি বললেন, " আমি একটা ভিসিতে আছি, ভিসি শেষ করেই তোমার সঙ্গে কথা বলছি।" 


আধ ঘন্টা বাদেই কথা হল বিশদে। সব শুনে দিদি প্রশ্ন করলেন, " এই নিয়ে হাজব্যান্ডের স্ট্যান্ড কি? মেয়েটির পক্ষে না বিপক্ষে?" জবাব শুনে বললেন, " হুম, দেখছি। আমাকে মেয়েটির ফোন নম্বর দাও। আসলে আমার মেয়েরা ঠিক এই সময় বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিলিতে ব্যস্ত। দুয়েক দিনের মধ্যেই ওরা যোগাযোগ করবে। মেয়েটিকে নিয়ে থানায় ও যাবে।ওদের কাউন্সেলিং এর ও ব্যবস্থা করবে। তারপর দেখা যাক -"।


পরদিন অফিস যাবার পথে ছেলেটির মুখে শুনলাম সেদিন রাতেই ফোন এসেছিল মেয়েটার কাছে। অনেক ক্ষণ ধরে মনোবল বৃদ্ধির কাজ করেছে পরিচিতির মেয়েরা। দিন দুয়েকের মধ্যেই এসে হাজির হল পারমিতা আর শুভ্রা। মেয়েটির সঙ্গে গেল থানায়। এবারে আর কেস নিতে কোন সমস্যা হল না থানার। 


সেই থেকে অঞ্চিতাদি আর তার মেয়েদের ওপর আমার অগাধ ভরসা। যদি কোন মেয়ে নিজে লড়তে চায়, সহযোদ্ধা হবেই ওরা। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। বিগত পাঁচ বছরে আর যোগাযোগ হয়নি অঞ্চিতাদির সাথে। দীর্ঘ দিন বাদে গত সপ্তাহে ফোন করেছিলাম আমি, " দিদি আসন্ন আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে একটা কর্মশালা করতে হবে আমায়, আসবেন?" কোন ঝানু ট্রেনার নয়, আমি চাই আমার মেয়েরা প্রকৃত যোদ্ধার থেকে শিখুক। 


Vini vidi vici কাকে বলে আজ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলাম। দিদি এলেন, দেখলেন আর হেলায় জয় করে নিলেন উপস্থিত প্রতিটা মেয়ের মন। আর আমি? আমি বললাম, দিদি একটা hug আর একটা সেলফি প্লিজ।