অনির ডাইরি ৩০ শে মার্চ, ২০২৫
এক পুরাতন বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সেই কাকভোরে বেরিয়েছি কাঁথি থেকে, বন্ধু বেশ অনেকদিন ধরেই ডাকছে, Evolution of Women Empowerment in India অর্থাৎ ভারতে নারী স্বশক্তিকরণের বিবর্তনের ওপর কিছু বলার জন্য, অর্থবর্ষ শেষের চক্করে এত দিন সময়ই দিতে পারিনি বেচারীকে। একের পর এক ডেট দিয়েছি আর বাতিল করেছি।
আজ গুণে গুণে পাঁচ ছটা কাজ নিয়ে এসেছি মহানগর। সঙ্গে এনেছি একডজন আর্জি, দশ পনেরো কিলো দপ্তরী কাগজ, আর দু দুটো ইন্সপেক্টর। মুকুলকে আমি অঙ্কুরহাটি থেকে তুলেছি, মণীশ নিজেই চলে এসেছে গঙ্গা পেরিয়ে। এত ব্যস্ততা চলছে মাস জুড়ে, যে প্রায় কিছুই পড়ে আসিনি আমি। অবশ্য টপিকটা আমার এত প্রিয় যে এর ওপর এমনিই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বকে যেতে পারি, তাও এখন মনে হচ্ছে একটু দেখে এলে বোধহয় ভালো হত।
ভেবেছিলাম বন্ধুকে বলব, এসো গল্প করি। দুই সবলা স্বাধীনচেতা নারীর বাক্যালাপে, স্মৃতিচারণে আপসে উঠে আসবে মেয়েদের বিবর্তনের ইতিহাস। এসে দেখি বন্ধুটি আজ দর্শক এবং শ্রোতা, আমার সাথে গোল টেবিলে সামিল এক নবোঢ়া তরুণী। এবং তিনি পুরোদস্তুর প্রস্তুত সম্মুখ সমরের জন্য। আড়ষ্ট ভাবে আলোচনা শুরু হলেও, কখন যেন মেয়েলি আড্ডাতেই দাঁড়িয়ে গেল ব্যাপারটা। কিছু আমি বললাম,কিছু মেয়েটা। অনুষ্ঠান শেষে দেখি, কখন যেন ম্যাডাম থেকে দিদি হয়ে গেছি আমি। মেয়েটা বলছে, " দিদি তোমার কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল তুমি যেন আমার হয়েই বলছ, বিশ্বাস করো গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।"
বিয়ের জল শুকাতে না শুকাতেই শাশুড়িকে হারায় মেয়েটি। অনভিজ্ঞ ফুটফুটে নতুন বউকে রাতারাতি হয়ে উঠতে হয় বাড়ির জাঁদরেল গিন্নী। বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত আর পেশাদারিত্বের ভারসাম্য রক্ষায় আপাতত নাজেহাল মেয়েটা, সাধ্যাতীত করছে, তাও যেন মুঠো ভর্তি জলের মত সব যেন বেরিয়ে যাচ্ছে আয়ত্বের বাইরে।
নতুন বিয়ের পর, এই পরিবর্তন, এই অবসাদ খুব স্বাভাবিক। বড় বেশী মানিয়ে নিতে হয় এই সময় মেয়েদের। মজার কথা হল এ এমন এক অগ্নিপরীক্ষা, যাতে কোন পাশ নেই, শুধুই ফেল। এক সিনিয়র দিদি একবার বলেছিল, " বিয়ে ব্যাপারটা হল অনেকটা যেন একটা ডালপালাওয়ালা পরিণত বয়সী গাছকে শিকড় থেকে উপড়ে অন্য পরিবেশে পুনঃ রোপন করে বলা, এতকালের শিক্ষা, সংস্কার, রীতিনীতি সব রাতারাতি ভুলে গিয়ে,নতুন পরিমণ্ডলে নতুন নিয়মে বাঁচ।"
মেয়েটা বিষণ্ন ভাবে বলে, "এত করি, তাও কারো মন পাই না দিদি। " বন্ধুটি আর আমি একসাথে হাহা করে উঠি, সর্বনাশ, বৌমা নম্বর ওয়ান হবার লড়াইয়ে একদম নেমো না বাপু। যা পারো, যতটা পারো,যতটা তোমার শরীর, তোমার বিবেক সায় দেয় ততটাই করো। আমরা নারী বটে, তার মানে মোটেই আমরা সব পারি না। বন্ধুটি তার স্বর্গীয় শ্বশুর মশাইয়ের গল্প শোনায়, " বিয়ের পরপরই আমার শ্বশুরমশাই বলেছিলেন, তুমি যতই ভালো রাঁধ, যতই পা টিপে দাও, সংসার এমন একটা জায়গা, সেখানে না কেউ তোমার সুনাম করবে, না তোমায় ভালবাসবে।"
বন্ধুর এই শ্বশুরমশাইটির সঙ্গে আমার কখনও আলাপ হয়নি, শুধু গল্পই শুনেছি। আর গল্প শুনেই ওনার গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে গেছি। বন্ধুটি যখন প্রথম চাকরি পায়, বেতন ছিল খুবই সামান্য। জনসমক্ষে বলার মত নয়। আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি ওর স্বামীও বলেছিল, এই বেতনে এত দূর গিয়ে কাজ করার কি প্রয়োজন। এতে তো রাহাখরচও উঠবে না।বরং বাড়িতে থেকে অন্য চাকরির পরীক্ষা দিক। কিন্তু মেয়েটির ভাষায়, " আমার শ্বশুরমশাই একদিন ডেকে বললেন, শোন, আমি তোমার কাছে, কিচ্ছু চাই না। শুধু কথা দাও, এর থেকে অন্তত একশ টাকা বেশি বেতনের চাকরি তুমি যতদিন না পাচ্ছ, এই চাকরি ছাড়বে না। তোমার যাতায়াতের জন্য যা লাগে, তুমি নিঃসঙ্কোচে আমায় বলবে। আমি যে পেনশন পাই, তার সবটা আমার লাগে না, কিছুটা আমি তোমায় দিতেই পারি।"
ঘড়ির কাঁটা বেবাগা ঘোড়ার মত ছুটছে, এবার উঠতেই হয়, পুঁচকে মেয়েটাকে এতক্ষণ সাহসই দিয়েছি দুজনে, এবার একটু ভয় দেখাই। বাপু হে, এগুলো তো কিছুই নয়, একবার দুই থেকে তিন হও, তারপর বুঝবে জ্বালা কাকে বলে। ভাগ্যে আমার মা ছিল, সাড়ে তিন বছর বয়স অবধি একা হাতে মানুষ করে দিয়েছে তুত্তুরীকে। বন্ধুটির ক্ষেত্রেও একই গল্প প্রযোজ্য, ওর বাবা মার কাছেই মানুষ হচ্ছে ওর ছানা। বন্ধুটি বলে, " দেখো না, বাবা মা চার দিনের জন্য বাড়ি গেছে, আমি আর আমার বর পালা করে ছেলেকে অফিসে নিয়ে আসছি।" আমিও তো নিয়ে যেতাম তুত্তুরীকে, যখন লতা দি ছুটি নিত। নইলে সেই মা'ই ভরসা, উজিয়ে হাওড়া গিয়ে মেয়েকে রেখে তারপর অফিস যেতে হত। ২০১৭ সালের আগষ্ট মাসে শৌভিক কলকাতা ইলেকশনে বদলী হয়ে আসার পর অবশ্য আর ভাবতে হয়নি। প্রয়োজনে ঐ ছুটি নিয়ে মেয়ে সামলাত।
বরেরা একটু সমব্যথী, সংবেদনশীল না হলে আমাদের মত কর্মরতা মায়েদের যে কি হত। এগিয়ে দিতে দিতে বন্ধুটি বলে, " একদম ঠিক বলেছ দিদি। আমি এক সন্তান, আজ বেশ কয়েকবছর হয়ে গেল বাবা মাকে আমার কাছে এনে রেখেছি। প্রথম দিকে কিছুতেই থাকতে চাইত না ওরা, বিশ্বাস করবে, দরজায় তালা দিয়ে আটকে ছিলাম আমার বুড়োবুড়িকে। আজকাল তাঁরা আমাদের ছেড়ে কোথাও থাকতে চায় না। একসাথেই থাকি সবাই, একই তলায়। এই নিয়ে আমার বরের তরফ থেকে কোন অস্বস্তি, প্রতিবাদ, ক্ষোভ কোনদিন কিচ্ছু অনুভব করিনি। সত্যিই ও আমার সবথেকে বড় ভরসাস্থল।"
শুনতে শুনতে মনে হল, এ তো আমার গল্প, আমাদের গল্প। আমিও তো জেদ করেই নিয়ে এসেছি বাবা মাকে। শ্বশুর মশাইয়ের মৃত্যুর পর নিয়ে এসেছি শাশুড়ি মাকে। আমাদের ছোট্ট আণবিক পরিবারটা রাতারাতি যৌথ পরিবার হয়ে গেছে। তাতেও তিল মাত্র বদলায়নি মোদের সম্পর্ক। আমার মতই, হয়তো আমার থেকেও ভালো করে ঘর-বাহির সমান তালে সামলাচ্ছে শৌভিক। মাঝে মাঝে তো মনে হয়, আমার থেকেও বেশি ঘরোয়া, গৃহকর্মনিপুণ আমার বর। নাহ যাই বলুন, বিগত দুয়েক শ বছরে নারী স্বশক্তিকরণের যতটা বিবর্তন ঘটেছে, পুরুষ সংবেদনশীলতা-সহমর্মিতার বিবর্তনও প্রায় ততোটাই ঘটেছে।
অনির ডাইরি ২৭ শে মার্চ, ২০২৫
#অনিরডাইরি
"ওর স্কুলে কি হয়েছে দেখেছ" পিছন থেকে বলল লতা দি। রবিবারের দুপুর, ভরপেট মাংস ভাত খেয়ে, জমিয়ে নিদ্রাদেবীর আরাধনায় বসেছিলাম থুড়ি শুয়েছিলাম। কিন্তু ফ্রিজে রাখা মিষ্টি গুলো এমন ডাকাডাকি শুরু করলে, তাই সকলের অলক্ষ্যে লুকিয়ে একটা কালো জাম খাচ্ছিলাম। লতা দির কথায় ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম, তার স্কুলে আবার কি হয়েছে? কই তিনি তো আমায় কিছু বলেননি।
আমার মুখের ভাব দেখে লতা দি থেমে থেমে বলল, "একটা ছেলে - ওরই ক্লাসের।" বাকিটা আর বলতে হয় না। মুখের ভিতর দিদিভাইয়ের দেওয়া অমৃতসমান কালোজাম হঠাৎ যেন তেতো হয়ে ওঠে। স্বনামধন্য বাংলা ইংরাজি সংবাদ পত্রের সাথে সাথে কিছু স্থানীয় কাগজও আমাদের বাড়ি আসে। কেন আসে, কেউ জানে না। তেমনি একটা কাগজ আমার হাতে তুলে দেয় লতা দি। প্রথম নাকি দ্বিতীয় পাতা( আজ আর মনে নেই) তলার দিকে বড় বড় করে ছাপা হয়েছে খবরটা। ছেলেটার নামটা পড়ে, ধপ করে বসে পড়লাম। এই ছেলেটার নাম তো শুনেছি মেয়ের মুখে। ভালো বাস্কেটবল খেলে ছেলেটা, ভালো ভায়োলিন বাজায়। ভীষণ জনপ্রিয় ছেলেটা। অগণিত বন্ধুবান্ধব ছেলেটার। কিছুদিন আগে একে নিয়ে একটা ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখেছিল তুত্তুরী। লেখার মুখ্য বিষয় ছিল এক উঠতি খেলোয়াড়ের জীবনের টানাপোড়েন। ছেলেটা শুধু খেলেই যেতে চায়, আর মা বলে, ' পড় বাবু। নইলে খাবি কি?'
সেই ছেলেটা নেই? ভাবতেই পারছি না। হয়তো একই নাম, হয়তো অন্য ছেলে। তাহলেই বা কি? সেও তো সন্তানতুল্য। খবরটা তুত্তুরীকে জানাব, নাকি জানাব না, এই নিয়ে দোদুল্যমানতায় ভোগে তুত্তুরীর মা আর মাসি। মাসির আপত্তি সত্ত্বেও শেষমেশ মেয়েটাকে জানিয়েই দিই। জীবন বড় রুক্ষ, বড় নির্মম, কতদিন বাঁচিয়ে রাখব মেয়েটাকে।
এই নিয়ে জীবনে দ্বিতীয়বার মৃত্যুশোক পেল মেয়েটা। প্রথম বার গত মে মাসে, শ্বশুরমশাই যখন চলে গেলেন। মৃত পিতামহের সামনে ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা। শুকনো চোখে অবাক হয়ে দেখছিল সকলের কান্নাকাটি। জনৈকা শোকাতুর আত্মীয়া তো বলেই বসলেন, " তোর মা কাঁদছে, আর তুই একটু কাঁদবি না দাদুর জন্য।" ভয়ে অন্য ঘরে গিয়ে বসেছিল মেয়েটা। আমাকে নিভৃতে পেয়ে ফুঁপিয়ে উঠেছিল, " আমি বিশ্বাস করতে পারছি না মা। ইচ্ছে করছে দাদুকে ঠেলে তুলে দিই ঘুম থেকে। একটা মশা উড়ছিল দাদুর মুখের কাছে, ইচ্ছে করছিল ওটাকে মেরে দিই, কিন্তু বিশ্বাস করো মা, কান্না পাচ্ছিল না। আমি কি খুব খারাপ মা -"। আজও কাগজটা পড়ে তেমনি ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল তুত্তুরী, "আমি কি করব মা? আমি কিছু বুঝতেই পারছি না মা।"
সোমবার স্কুল থেকে বিধ্বস্ত হয়ে ফেরে মেয়েটা। অফিস থেকে ফিরতেই বলে, " কাল আর স্কুল যাব না মা। আজ সারাদিন ক্লাসে যা হল-।" মেয়েরা সবাই প্রায় কান্নাকাটি করেছে, ছেলেরা করেছে জটলা। একটি মেয়ের নাম করে তুত্তুরী বলে, " ঐ ছেলেটার এক্স গার্লফ্রেন্ড, কিছুদিন আগেই ওদের ব্রেক আপ হয়েছিল। তখন মেয়েটা জনে জনে বলে বেড়িয়েছিল, 'ও আমায় ডাম্প করেছে, তোরা কেউ ওর সঙ্গে কথা বলবি না' অথচ আজ এমন করুণ ভাবে কাঁদছিল, যে ওকে সামলানোই যাচ্ছিল না।"
শুনতে শুনতে নিজের কৈশোরে ফিরে যাই। আমাদের কঠোর অনুশাসনে মোড়া গার্লস ইস্কুল, এক্স ওয়াই কিছুরই সুযোগ ছিল না। আমার সাদাকালো কৈশোরে একমাত্র রামধনু ছিল আমার একমাত্র বোনঝি মুনাই। কো-এড ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ত মুনাই, আমার জন্য গুছিয়ে আনত হরেকরকম টকমিষ্টি গল্প। প্রেম হোক বা বন্ধুত্ব সেসব ছিল গড়ার গল্প, ভাঙার নয়। যুগটাই আলাদা ছিল বুঝি -
গভীর রাতেও ঘুম আসে না চোখে। উসখুস করে, লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটা। ফিসফিস করে বলে, "জানো মা, অনেকে বলছিল, বিশেষ করে ছেলেরা, যে এমন মূর্খের মত কাজ করে, তাকে নিয়ে আমরা ভাবতে চাই না।" কি বলব বুঝতে পারি না। বড় প্র্যাকটিক্যাল এই প্রজন্ম। হয়তো এটাই ভালো। তুত্তুরী বলে," আমরা ঐ মেয়েটার সাথেও দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওর বর্তমান গার্লফ্রেন্ড -। কেউ কেউ বলছে মেয়েটার বাবা মা জানতে পেরে -"। মেয়ের মুখে হাত চাপা দিই আমি। থাক, আর জানতে চাই না। বলি একটা কবিতা শুনবি? এত রাতে, কবিতা! মা কি পাগল হয়ে গেল ভাবে বুঝি মেয়েটা। বলি, শোন না। তোর মনে যত তুফান উঠছে, সব কেমন জাদুমন্ত্রে শান্ত হয়ে যাবে দেখ - মুঠো ফোনে হেসে ওঠে দাড়ি বুড়ো, মায়ের গলায়, মায়ের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে তুত্তুরী শোনে,
" কেউ বা তোমায় ভালোবাসে, কেউ বা বাসতে পারে না যে,
কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা সিকি পয়সা ধারে না যে,
কতকটা যে স্বভাব তাদের কতকটা বা তোমারো ভাই,
কতকটা এ ভবের গতিক-সবার তরে নহে সবাই।"
ভিজে ওঠে মেয়েটার চোখের কোণ,অঙ্গে অঙ্গে লাগে কাঁপন, কিন্তু মা আর দাড়ি বুড়োর যুগলবন্দী থামে না-
"তোমায় কতক ফাঁকি দেবে তুমিও কতক দেবে ফাঁকি,
তোমার ভোগে কতক পড়বে,পরের ভোগে থাকবে বাকি।
মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম--
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!"
অনির ডাইরি ৮ই মার্চ, ২০১৫
#অনিরডাইরি #InternationalWomensDay
আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিনটা এলেই বিশেষ কিছু পোস্ট বাজারে ঘোরে। যার প্রথমটি হল, " আমরা নারী, আমরাই পারি।" ইয়ে দাদা দিদিগণ, বলছি কি, আমিও নারী, কিন্তু মোটেই আমি সব পারি না। সব পারার দায় ও আমার নয়। সব পারলেও কেউ আপনাকে মেডেল দেবে না। উল্টে আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যাবে অমূল্য সময়, যা আপনি একান্তই নিজের জন্য খরচ করতে পারতেন।
দ্বিতীয় পোস্ট যেটা কয়েক বছর আগেও মার্কেটে ঘুরত, "নারীদের জন্য বিশেষ দিন আছে। পুরুষদের জন্য নাই।" যে হতভাগ্য ফ্রাস্টু খাওয়া ব্যক্তিবর্গ এই পোস্টগুলি করত, তারা একটু কষ্ট করে গুগল করে দেখত না, যে আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস অবশ্যই আছে, প্রতি বছর ১৯ শে নভেম্বর। ইদানিং অবশ্যি তাঁদের জ্ঞানগম্যি বেড়েছে, তাই দেখলাম লিখছেন, " নারী দিবস আছে, পুরুষ দিবস আছে, মানুষ দিবস নাই।" যদি আপনি তাঁদের দলে পড়েন, তো একটু কষ্ট করে গুগলের সাহায্য নিন কেমন? ১০ই ডিসেম্বর যেন কি দিবস?
তৃতীয় পোস্টদাতারা অধিকাংশই নারী। এনারা সক্কাল সকাল জমিয়ে লিখে দেন, "আমার নারী দিবসের প্রয়োজন নেই।" অথবা "রোজই তো নারী দিবস।" মাইরি? সত্যি? ওরে ভাই, লেখার আগে দিনটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং তাৎপর্য সম্পর্কে তো একটু পড়াশোনা তো করে নিলে পারতিস। মোটেই সব দিন নারী দিবস নয়। সব দিন নারী দিবস হতে পারে না।
আজকের দিনটা হল পিছনে ফিরে তাকানোর দিন। কোথা থেকে কোথায় এসেছি আমরা। চলুন একটু পিছনে ফিরে তাকাই, বেশী নয় মাত্র দুশো বছর আগেও সোয়ামী মারা গেলে চিতায় পুড়িয়ে দেওয়া হত আমাদের মেয়েদের। আচ্ছা আমরা নাহয় কালা আদমি, অশিক্ষিত বর্বর জাতি। পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র গুলিতে হত না ডাইনি দহন? ন্যূনতম ব্যক্তিত্ব, প্রথা ভাঙার সামান্য প্রচেষ্টা দেখলেই তাকে ডাইনি বলে দেগে দেওয়া হত না কি? জোয়ান অফ আর্ক থেকে সালেম উইচ হান্ট যে অন্য কথা বলে দিদি।
চলুন নিজের দেশে ফিরি। চলুন একটু এগোই, বেশী না বছর পঁচিশ। অর্থাৎ পৌনে দুশো বছর আগেও মেয়েরা লিখতে পড়তে চাইলে কি বলা হত জানেন নাকি? চলুন আমিই বলে দিই, বলা হত, মেয়েরা লিখতে পড়তে শিখলে তার বৈধব্যযোগ অবধারিত। আর বিধবা একবার হয়ে গেলে দাঁত নখ বার করে এগিয়ে আসত সমাজ। জাঁতা কলে ফেলে তেল বার করার জন্য। ভাগ্যে তিনি জন্মেছিলেন। বীর সিংহের বীর শিশু। তাই না দুপাতা পড়তে আর দু কলম লিখতে পারছি।
পড়তে যখন শিখেইছেন, তো একটু পড়ুন না। পড়ুন ফুলমণি দাসীর কথা। সেই ১০ বছরের ফুলমণি যার বিয়ে হয়েছিল ৩৫ বছরের হরিমোহন মাইতির সাথে। বিয়ের রাতেই বেড়াল কেটে ছিল হরিমোহন। এমন বলপ্রয়োগ করেছিল বাচ্ছা মেয়েটার ওপর, ফুলশয্যা কণ্টক শয্যা হয়ে গিয়েছিল, মরেই গিয়েছিল মেয়েটা। আমার নারী দিবসের দরকার নেই বলে গলা ফাটানো দিদিমনিরা ভাবতে পারেন? আজ্ঞে হ্যাঁ। এটাই হয়েছিল। এটাই হত। বিশ্বাস না হয় Empress v. Hari Mohan Maiti কেস খুঁজে দেখুন। পড়ুন। দুঃখের কথা কি জানেন? মাত্র এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেই মুক্তি পেয়ে গিয়েছিল হরিমোহন মাইতি। কারণ বৈবাহিক মিলনকে ধর্ষণ বলে মানতে রাজি হয়নি তৎকালীন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সমাজ।
আইন একটা এসেছিল বটে, The Age of Consent Act, 1891 যাতে বলা হয়েছিল, যৌন মিলনের জন্য সম্মতির বয়স মেয়েদের বাড়িয়ে ১০ থেকে ১২ করা হল। শিশুবিবাহ বিরোধী আইন আসতে লেগেছিল আরও চল্লিশ বছর প্রায়। The Child Marriage Restraint Act চালু হয় ১লা এপ্রিল, ১৯৩০ সাল নাগাদ। যাতে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৪ আর ছেলেদের ১৮ ধার্য করা হয়। ভোটাধিকার, সম্পত্তির অধিকার, কাজের ক্ষেত্রে সমবেতনের অধিকার ইত্যাদি পেতে মেয়েদের লেগেছিল আরো অনেক অনেক বছর। খুব সহজে এতটা পেয়ে গেছেন না, তাই হেলায় বলতে/ লিখতে পারেন, এই দিনটা নিষ্প্রয়োজন। কূপমন্ডুকতার বাঁধন ছিঁড়ে তাকিয়ে দেখুন, বাস্তব চিত্র যে ভিন্ন কথা বলে। ২০২৫ এর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের থিম কি জানেন? "Accelerate Action" অর্থাৎ পথ এখনও অনেক বাকি, লিঙ্গ বৈষম্যের লড়াই এখন অনেক জটিল, এখনই অস্ত্র ত্যাগ করলে চলবে নাকি।
অনির ডাইরি ৬ই মার্চ, ২০২৫
#অনিরডাইরি
অঞ্চিতাদির সঙ্গে আলাপ চন্দননগরের তৎকালীন বড় সাহেবের মাধ্যমে। সালটা সম্ভবত ২০১৮ বা ১৯। বড় সাহেব নির্দেশ দিলেন, গৃহসেবিকাদের নিয়ে একটা কর্মশালা সংগঠিত করতে হবে। নির্দেশ মত চুঁচুড়ার নতুন সার্কিট হাউস বুক করলাম আমরা। চন্দননগর এবং চুঁচুড়া মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তত্ত্বতালাশ করে প্রায় ৫০/৬০ জন গৃহশ্রমিক মহিলাকে জোগাড় করলাম আমরা। মূল লক্ষ্য ওদের সামাজিক সুরক্ষা যোজনায় নথিভুক্ত করা, সাথে সাথে গৃহশ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার এবং দাবিদাওয়া বিষয়ে অবহিত করা।
এই দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে আমাদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রয়োজন ও ছিল না। স্যার বললেন, " ওটা তুমি অঞ্চিতাদির ওপর ছেড়ে দাও।" এমন বললে প্রশ্ন করতেই হয়, অঞ্চিতাদি আবার কে? শুনলাম শ্রীমতী অঞ্চিতা ঘটক, পরিচিতি নামক এক এনজিওর মুখ্য কর্ণধার। পরিচিতি মূলতঃ গৃহশ্রমিক যাদের পাতি জনগণ কাজের মাসি বা দিদি বলে সম্বোধন করে, তাদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে ব্যাপ্ত।
নির্দিষ্ট দিনে এসে উপস্থিত হলেন অঞ্চিতা দি, যেমন লম্বা, তেমনি ফর্সা, তেমনি গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর। কিঞ্চিৎ মেদুল এবং প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী। প্রথম আলাপেই বেশ ভাব জমে গেল। মনে হল মানুষটা ভীষণ পজিটিভ। সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন পজিটিভ এনার্জি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। নিজের সম্বন্ধেও আমার তাই ধারণা। সে অর্থে আমরা সমমেরু সম্পন্ন, কিন্তু বিন্দুমাত্র বিকর্ষণ বোধ হল না।আসলে আমি বরাবরই বীরাঙ্গনাদের অনুরাগী।
সেদিন কর্মশালার ফাঁকফোকরে অনেক গল্প হল। শুনলাম আশির দশকের শেষ থেকে মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে লড়ছেন অঞ্চিতা দি। আপাতত গৃহশ্রমিকদের অধিকার নিয়ে সরব হবার পাশাপাশি আরো অনেক গুলি ইস্যু নিয়ে কাজ করছেন। যার মধ্যে অন্যতম অবশ্যই গার্হস্থ্য হিংসার শিকার মহিলাদের পাশে দাঁড়ানো। তবে আমার সবথেকে ভালো লেগেছিল, কলকাতার বিভিন্ন বস্তি এলাকার নিঃসঙ্গ প্রৌঢ়া-বৃদ্ধাদের নিয়ে অবসর বিনোদনের কার্যক্রম। উচ্চ-মধ্য-নিম্নবিত্ত নির্বিশেষে বয়স্ক মহিলারা যে বড় বেশী নিঃসঙ্গ তা আশেপাশে তাকালেই বুঝতে পারি। কেউ তো তাদের কথা ভাবুক।
সেদিনের পর বছর দুয়েক আর অঞ্চিতা দির সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি আমার। তারপর তো রৈরৈ করে এসে গেল কোভিড। ঝাঁপ ফেলে দিল গোটা বিশ্ব। স্তব্ধ হয়ে গেল জীবন। স্তব্ধ হল না কেবল আমার আপিস। সেদিনও আপিস যাচ্ছিলাম, জনশূন্য অলিগলি রাজসড়ক ধরে প্রায় ১২০/১৫০ কিমি বেগে গাড়ি ছোটাচ্ছিল ড্রাইভার ছেলেটি। আচমকা বেজে উঠল মুঠোফোন, আমার নয়, ড্রাইভারের। প্রথম চোটে গাড়ি চালাতে চালাতেই ফোন ধরল ছেলেটা। তারপর স্তব্ধ হল গাড়ির ইঞ্জিন। উত্তেজিত হয়ে দরজা খুলে মাঝরাস্তায় নেমেই গেল ছেলেটি। বাতানুকূল বন্ধ গাড়ির ভিতর থেকে দেখতে লাগলাম প্রবল হাত পা নাড়ছে ছেলেটি, ফুলে উঠছে গলার শির, লাল হয়ে উঠছে মুখ। তারপরই বাঁধ ভেঙে নেমে এল বারি ধারা।
বিশ্বাস করুন, কাঁদলে মেয়েদের থেকে অনেক বেশি অসহায় লাগে ছেলেদের। ফোঁপাতে ফোঁপাতে গাড়িতে ফিরে এল ছেলেটি। কি হয়েছে শুধাতে হল না। গড়বড় করে বলেই ফেলল ছেলেটা। ওর অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে প্রবল মেরেছে ছেলেটির মা আর মাসি মিলে। ছেলেটির মা নাকি এক উঠতি মস্তানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, লকডাউনের আগে প্রকাশ্যে তার বাইকে চেপে ঘুরে বেড়াত, তাই নিয়ে ছেলেবউ এর ঘোরতর আপত্তি ছিল। লকডাউন ঘোষিত হওয়ায় সেটা আর করতে পারছিল না। আজ লোকটি বাড়িতে এসে হাজির হয়। প্রতিবাদ করে বউটি, পরিণামে শাশুড়ি-মাসিশাশুড়ি এমনকি মাসতুতো দেওরটিও আচ্ছা করে ধোলাই দিয়েছে মেয়েটিকে। মাথার চুল ছিঁড়ে দিয়েছে।
এইসব ক্ষেত্রে যা হয় আরকি, ৪৯৮ এ ধারায় থানায় বধূ নির্যাতনের নালিশ করতে যায় স্বামী-স্ত্রী মিলে।কেস না নিয়ে, থানা শাশুড়ি এবং তার সঙ্গীকে ডেকে পাঠায়। ব্যাস, তারপর আর কিছুই হয় না। ধামাচাপা পড়ে যায় সব। এদিকে বাড়িতে উত্তোরত্তর বাড়তে থাকে নির্যাতন। যেদিন আমি অফিস যাই, স্বামী স্ত্রী এসে বসে থাকে আমার চেম্বারের বাইরে। " প্লিজ ম্যাডাম, কিছু করুন -"। কি করি আমি? কি করার ক্ষমতা আছে আমার? থানা সহযোগিতা করছে না বলে, পাঠাই নারী উন্নয়ন আধিকারিকের কাছে। তিনি আবার আমারই জেলার মেয়ে, আমারই স্কুলের ছাত্রী। আমার এবং DSWOর যুগপৎ রেফারেন্স সত্ত্বেও সেখান থেকে যে সহমর্মিতা পেয়েছিল ঐ দম্পতি সে আর বলে কাজ নেই।
এর মধ্যে হল কি, এই নিয়ে বিশদ আলোচনা করার জন্য থানার মেজবাবু মেয়েটিকে একদিন তাঁর কোয়ার্টারে ডেকে পাঠালেন। স্পিকার অন করে বার্তালাপ করার সৌজন্যে সেই আহ্বান শুনল আমার গোটা অফিস। ছেলেমেয়েটি মিলে এবার চেপে ধরলে আমার পা। 'ম্যাডাম বাঁচান। নইলে যুগলে সুইসাইড করব -"। শেষ অস্ত্র হিসেবে ফোন লাগালাম অঞ্চিতা দিকে। নিজের পরিচয় দিলাম, অঞ্চিতা দির কন্ঠে ফুটে উঠল পরিচিত উষ্ণতা। " বলো, বলো অনিন্দিতা। কি খবর।" খুব ছোট করে বললাম। অঞ্চিতা দি বললেন, " আমি একটা ভিসিতে আছি, ভিসি শেষ করেই তোমার সঙ্গে কথা বলছি।"
আধ ঘন্টা বাদেই কথা হল বিশদে। সব শুনে দিদি প্রশ্ন করলেন, " এই নিয়ে হাজব্যান্ডের স্ট্যান্ড কি? মেয়েটির পক্ষে না বিপক্ষে?" জবাব শুনে বললেন, " হুম, দেখছি। আমাকে মেয়েটির ফোন নম্বর দাও। আসলে আমার মেয়েরা ঠিক এই সময় বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিলিতে ব্যস্ত। দুয়েক দিনের মধ্যেই ওরা যোগাযোগ করবে। মেয়েটিকে নিয়ে থানায় ও যাবে।ওদের কাউন্সেলিং এর ও ব্যবস্থা করবে। তারপর দেখা যাক -"।
পরদিন অফিস যাবার পথে ছেলেটির মুখে শুনলাম সেদিন রাতেই ফোন এসেছিল মেয়েটার কাছে। অনেক ক্ষণ ধরে মনোবল বৃদ্ধির কাজ করেছে পরিচিতির মেয়েরা। দিন দুয়েকের মধ্যেই এসে হাজির হল পারমিতা আর শুভ্রা। মেয়েটির সঙ্গে গেল থানায়। এবারে আর কেস নিতে কোন সমস্যা হল না থানার।
সেই থেকে অঞ্চিতাদি আর তার মেয়েদের ওপর আমার অগাধ ভরসা। যদি কোন মেয়ে নিজে লড়তে চায়, সহযোদ্ধা হবেই ওরা। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। বিগত পাঁচ বছরে আর যোগাযোগ হয়নি অঞ্চিতাদির সাথে। দীর্ঘ দিন বাদে গত সপ্তাহে ফোন করেছিলাম আমি, " দিদি আসন্ন আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে একটা কর্মশালা করতে হবে আমায়, আসবেন?" কোন ঝানু ট্রেনার নয়, আমি চাই আমার মেয়েরা প্রকৃত যোদ্ধার থেকে শিখুক।
Vini vidi vici কাকে বলে আজ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলাম। দিদি এলেন, দেখলেন আর হেলায় জয় করে নিলেন উপস্থিত প্রতিটা মেয়ের মন। আর আমি? আমি বললাম, দিদি একটা hug আর একটা সেলফি প্লিজ।