Sunday, 29 December 2024

অনির ডাইরি ডিসেম্বর, ২০২৪

 অনির ডাইরি ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



আমি মেয়েকে ছাড়া কোত্থাও যাই না, অফিস ব্যতিরেকে। পার্টি, পিকনিক থেকে মামুলী গেট্টু যাই হোক না কেন শ্রীমতী তুত্তুরী আমার সাথে প্যাকেজ ডিলে থাকেই। এমনকি বিয়েশাদি - জন্মদিন ইত্যাদি উপলক্ষে কেউ আমায় নিমন্ত্রণ করতে এলেই আমি হ্যাংলার মত মুখ করে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকি, একবার শুধু মুখ ফুটে বলার অপেক্ষা, 'তুত্তুরীকেও আনবেন ম্যাডাম'-। 


আজ বড়দিন, স্কুলের বন্ধুদের পিকনিক, অথচ সেই মেয়েকে ছাড়াই আসতে হল আজ। হঠাৎ করেই মেসেজ এসেছে, কাল তাঁর কেমিস্ট্রি এসেসমেন্ট, তাই তিনি কিছুতেই আসতে রাজি হলেন না। গোটা বাংলায় এমন কোন ইংরেজি মিডিয়াম ইস্কুল আছে বাপু, যারা বড়দিনের পরের দিন পরীক্ষা নেয়? বলুন দিকি ব্যাপারটা কি অসৈরণ নয়। কত করে বললাম, চল না, না হয় দিবি না একটা পরীক্ষা, তাতে তিনি, তাঁর বাপ, বাপের মা মিলে আমায় এমন তিরস্কার করলে -। 


এত দূর উজিয়ে পিকনিকে আসার ইচ্ছে আমার শুরু থেকেই ছিল না। কিন্তু জনে জনে এমন ফোন করে উত্যক্ত করতে লাগল, যে আসতেই হল। সিকি শতাব্দী হল ইস্কুল ছেড়েছি আমরা, আজও আমার সহপাঠীরা আমার সঙ্গের জন্য উন্মুখ, ব্যাপারটা ভাবলে রীতিমত আর্দ্র হয়ে ওঠে হৃদয় । এই কায়েমি দুনিয়ায় ভালোবাসা বড় দুর্লভ। সামান্য পথশ্রমের জন্য তার অমর্যাদা করতে অন্তত আমি রাজি নই। 


ভাবলাম  এত দূর উজিয়ে যাবই যখন একটা রাত থেকেই আসি বাড়িতে। আমার বুড়োবুড়ি খুশি হয়ে যাবে। তিলতিল করে কতকিছু যে গোছালাম বাবা মায়ের জন্য - শীতের ডবকা কমলা লেবু, ঝোলা নলেন গুড়, গুড়ের পায়েস, আমলকীর ঝালআচার, মিষ্টি আচার এমনকি কড়াইশুঁটির কচুরির পুর ও। বয়স বড় অশক্ত করে দেয় মানুষকে। আর তো রাস্তায় বেরোতে পারে না বাবা। ভালমন্দ কিছু খেতেও পায় না সেভাবে। ঐ আয়া দিদি যা কিনে আনে, তাতে অবশ্য ওদের কোন ক্ষোভ নেই। দিব্যি ফূর্তিতে আছে দোঁহে, তাও মেয়ের মন - 


ভাবলাম যাবই যখন লতা দিকেও সঙ্গে নিয়ে যাই। অনেক দিন বাড়ি যায়নি মানুষটা। এই উৎসবের দিনে একবার দেখে আসুক নাতি নাতনী গুলোকে। আমি আর লতা দি দুজনেই থাকব না, শুনেই মুখ শুকিয়ে যায় শাশুড়ি মাতার। কত কষ্ট করে যে তাঁকে বোঝাতে হয়, ' আরে বাবা কালই ফিরে আসব। মাত্র একটা  রাতের তো ব্যাপার। তোমার ছেলে তো রইল। আজ উৎসবের দিনে হাওড়ার বাড়িতেও একটু আলো জ্বলুক।' 


এত দিক গুছিয়ে যখন রওনা দেব, বেঁকে বসলে আসল লোকটাই। নাতনী যাবে না শুনে যতটা চওড়া হল শাশুড়ি মাতার মুখের হাসি, ততোটাই ম্রিয়মাণ শোনাল আমার মায়ের গলার আওয়াজ। "তুত্তুরী আসবে না? কেন?" দুটো ভারী ব্যাগ সহ আমায় দেখেও উজ্জ্বল হল না মুখ। গেলবার এসে দেখেছিলাম মায়ের তুলসী গাছটা মরে গেছে, মনে করে সেটাও বয়ে এনেছি আমি আর লতা দি, তাও খুশি হয় না কেউ। অন্যমনস্ক ভাবে সিগারেট ধরিয়ে বাবা তো বলেই ফেলে, " তুমিও না এলেই পারতে। তুমি সুখে ঘর সংসার করো, এটাই আমরা চাই। তাছাড়া মাকে ছাড়া থাকতে তুত্তুরীর কি ভালো লাগবে?" 


এমনিতেই মেয়ের জন্য মন খারাপ, তার ওপর এমন অভ্যর্থনা কার ভালো লাগে। বাবামায়ের তাড়নাতেই ফোন করি বাড়িতে। মুঠোফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে বাপ মেয়ের হর্ষিত স্বর। ব্যাডমিন্টন খেলছেন দুজনে। ঠাম্মা রোদ পোয়াচ্ছেন। আমার জন্য মনখারাপ কিনা আর জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করি না। জবাবটা স্পষ্ট। বেলা গড়ায় আমাদের পিকনিক জমে ক্ষীর হয়ে ওঠে। বন্ধুদের সাহচর্যে, ভালোবাসায়,  বন্ধু পুত্রকন্যাদের গানে নাচে, সৌন্দর্যে, মিষ্টতায় মোহিত হতে হতে, দ্রবীভূত হতে হতেও কোথায় যেন একটা কাঁটা ফোটে। ইশ আমার তুত্তুরীটাও যদি আজ এখানে থাকত -


'দিন যায়, সন্ধ্যা ঢলে'। আমায় কেউ ফোন করে না, আমিই হ্যাংলার মত বাড়িতে ফোন করি। "হ্যাঁ রে ঠিক আছিস তো?" জবাব আসে দারুণ আছে দুজনে। মেয়ে কম্পিউটার খুলে প্রজেক্ট করছে, বাবা ড্যালরিম্পল পড়ছে, ঠাম্মা আশাপূর্ণা দেবী পড়ছে। জানতে চাই, কাল সকালে কি খেয়ে ইস্কুলে যাবে, টিফিনে কি নিয়ে যাবে। শৌভিক বলে, " সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তোকে কিছু ভাবতে হবে না।" 

মন খারাপ হয়ে যায়, কেমন যেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। 


ভোর ভোর উঠে খোঁজ নিই, রাতে ঘুম হয়েছে তো? মেয়ে ইস্কুল গেছে তো? কে দিতে গেল? কে আনতে যাবে? টিফিন কি নিল? বুঝতে পারি, আমায় ছাড়াও দিব্যি চলে গেছে সবকিছু। আমায় ছাড়াও দিব্যি চলে সবকিছু। আপিসে ঢু মেরে, বেপোট জ্যাম, অবরোধ কাটিয়ে বাড়ি ফিরতে গড়িয়ে যায় সন্ধ্যা। শাশুড়ি মাকে সবার আগে দর্শন দিই, এবার ভিতরে যাবার পালা। শোবার ঘর থেকে ভেসে আসছে উত্তেজিত কথাবার্তা আর অট্টহাসি। তুত্তুরী এমন কিছু করেছে যে শৌভিক বলছে, " তুই বেরো।" তুত্তুরী হেসে গড়িয়ে পড়ছে আর বলছে, " না বেরোব না।" 


ছবির মত সুখী গৃহকোণ, তবুও বুকের ভেতর কোথায় যেন বিষণ্ণতার সুর বাজে। বড্ড তাড়তাড়ি বড় হয়ে গেল মেয়েটা। মেয়েগুলো বড় বেইমান হয়। কেমন বাপের দলে নাম লিখিয়েছে দেখ। সবই আমার কর্মফল। আমিও যে এমন ছিলাম। মাও নির্ঘাত এমনই নিঃসঙ্গতায় ভুগত। আমার আর কোন জায়গাই নেই এদের দুনিয়ায়। কাষ্ঠ হেসে ব্যাগটা রাখি ব্যাগের জায়গায়। হাতঘড়ি খুলি, খুলি আলগা বালাটা। কানের দুল খোলার আগেই ছুটে আসে শ্রীমতী তুত্তুরী, " মা আমি তোমার জন্যই বসে ছিলাম। তোমাকে কত কিছু যে বলার আছে। জানো আজ বন্ধুরা কি বলছিল, এই স্যার আর ঐ ম্যামের মধ্যে বোধহয় কিছু একটা চলছে -" দম না ফেলেই বলে যায় তুত্তুরী। কোন স্যার, কোন ম্যাম কাউকেই চিনতে পারি না আমি। ততক্ষণে প্রসঙ্গ বদলে গেছে, " পরের দিন অমুক স্যারের ক্লাস থাকলে কিন্তু আমি ছাতা নিয়ে যাব মা। উনি চিৎকার করলেই এমন থুতু ছিটান। আজই একটা ফোঁটা টপ করে পড়ল বেঞ্চে। আমি অমনি লাফিয়ে পাশের মেয়েটার কোলে। স্যার যদিও প্রচণ্ড লজ্জা পেয়ে অনেকবার সরি বললেন। তাও -"। গল্প থামতেই চায় না তুত্তুরীর। ফাঁক পেয়ে টুক করে পালিয়ে যায় শৌভিক। বেরোতে বেরোতে ইশারায় বলে যায়, কাল সারাদিন আমি সামলেছি, এবার তোর পালা। ম্যাও সামলা। আপত্তি করি না আমি, হাত পা না ধুয়েই জমিয়ে বসি আমি, হাঁ করে গালে হাত দিয়ে শুনি আমি। কখনও হাসি আমি, কখনও নৈতিকতার শিক্ষা দিই আমি, আর মনে মনে ভাবি," আছে, আছে, সব আছে।"

ছবি সৌজন্য - আমার বর


অনির ডাইরি ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 


তুচ্ছ কারণে প্রবল ক্রোধান্বিত এবং প্রবলতর ধমকচমক দেবার পর মনে পড়ল, আরে, দিন দুয়েক আগেই তো দেখলাম একটা রিলে, রাগ কমানোর উপায়। এক অতীব রূপসী, তন্বী মহিলা, ঝিম ধরানো স্বরে পাখি পড়া করে শেখালেন," রাগ হলেই ওমন ষাঁড়ের মত চিৎকার করবেন না। তাইলে কি করবেন? চারদিকে তাকিয়ে দেখুন। যে কোন চারটে জিনিসকে লক্ষ্য করুন যাদের আকৃতি আলাদা আলাদা -"।


 অফিসের সামনের করিডরে পায়চারি করতে করতে সত্যিই চারদিকে তাকালাম। আমাদের স্টোর রুমের দরজাটা, একটা নিটোল টেকো লোক ভূমি রাজস্ব না কি যেন দপ্তরের সামনে বসে গভীর মনোযোগ সহকারে আবেদন পত্র লিখছে, তার টাকটা ইত্যাদি প্রভৃতি। হলো চারটে শেপ। এবার দ্বিতীয় ধাপ, চারটে জিনিসের রঙ খেয়াল করতে হবে। তাও করলাম। এবার চারটে গন্ধের কথা ভাবতে হবে -গোলাপ, চন্দন, বিরিয়ানি আর কি যেন একটা ভাবলাম। এবার চারটে খাবারের স্বাদের কথা ভাবতে বলেছিল বোধহয়, হাঁটতে হাঁটতে চোখ বন্ধ করে ভাবি -আহা ভাপা ইলিশ, গরম বিরিয়ানি, সিদ্ধ ডিম দিয়ে মেয়োনিজ (খাইনি যদিও, বানাইওনি, তবে রিলে তো দেখেছি) আর তেল জবজবে করে ভাজা শীতের কচি বেগুন। আহা আহা। মনটা স্বর্গীয় আনন্দে ভসভসিয়ে উঠল। কি ছাগল আমি, এটা তো আগে ভাবলে আর অনর্থক চিৎকার করে সবাইয়ের পিলে চমকাতাম না। মনস্থির করে ফেললাম, এবার থেকে মনকে বেপথু করতে এটাই করব। 


অচীরেই প্রয়োজন পড়ল, মনকে বেপথগামী করার। দুপুরে আজ ভুরিভোজ হয়েছে। ঠিক করেই রেখেছিলাম, আপিস থেকে ফিরে এক কাপ কালো কফি আর রাতে এক কাপ হলুদ দেওয়া দুধ খাব। ব্যাস। আর কিছু নয়। টেবিলে বসে দেখি, সামনে থরে থরে সাজানো কচি শসা পেঁয়াজের স্যালাড, প্রচুর মটরশুঁটি দেওয়া তেলতেলে বাঁধা কপির তরকারী, ক্যাসারল ভর্তি গরম রুটি, ধূমায়িত বেগুন ভাজার গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তেল। বোতলে টলটল করছে সদ্য ওঠা নলেন গুড়, টিফিন কৌটো ভর্তি নারকেল নাড়ু, আজ সন্ধ্যায়ই পাকিয়েছে লতা দি। একটু দুধ দিয়েছে কি? এমন সুন্দর দেখতে হয়েছে কি করে। 


নাহ আমি ওসব কিছুর দিকে তাকাব না। খড়কুটো সন্ধানী ডুবন্ত মানুষের মত, আকুল হয়ে খুঁজি চারটে শেপ, চোখে পড়ে ছোট ছোট গোল গোল নাড়ু, মাঝারি গোল গোল বেগুন ভাজা। রং বলতে চোখে ভাসে হলদে তরকারী, খয়েরি গুড়, কালো বেগুন ভাজা। গন্ধের পর্বে হুড়মুড়িয়ে নাকে উড়ে আসে তাজা গুড়ের গন্ধ। জিভে আপনা থেকেই ভেসে ওঠে আজব আজব সব স্বাদ। হে ত্রিপুরারি রক্ষা করো প্রভু। এই নাক মুলছি, কান মুলছি, ওসব আজেবাজে রিল আমি আর দেখব না ঠাকুর। এই দুর্লভ শীতল মরশুমে এইসব সুখাদ্যের অবমাননা করা ঘোর পাপ। বেঁচে থাকুক আমার রাগ, বেঁচে থাকুক আমার লোভ, ওগুলো ছাড়া বেঁচে থেকে কি লাভ। আগে তো খেয়ে বাঁচি, বাকি কাল বুঝে নেব ক্ষণ।


অনির ডাইরি ১০ই ডিসেম্বর, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


প্রেগন্যান্সি টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসার সাথে সাথেই কেমন যেন বদলে যায় মেয়েদের জীবন। বিশেষ করে সেই মেয়ে যদি কর্মরত হয়। "ভুলেও ভেব না, তোমরা আপিস করবে, আর আমরা তোমাদের বাচ্ছা সামলাব -"। কথা গুলো আজও মনের গভীরে কোথাও মাঝে মধ্যেই ঘাই মারে। ভাগ্যে আমার মা ছিল, নইলে কি যে হত। সদ্যোজাত মেয়েকে নিয়ে কোন অকুলপাথারে যে পড়তাম দোঁহে। 


হাঁড়ি আলাদা হলেও যৌথ পরিবার আমাদের, সদ্যোজাত ছানাকে চটকে সন্দেশ বানাবার জন্য উদগ্র হয়ে অপেক্ষা করছে আমার মা, জ্যাঠাইমা, পিসি থেকে ভাইবউ সব্বাই। তাও শৌভিক গোঁ ধরল, সকলেই বয়স্ক কেন ওদের ওপর ফালতু চাপ দেওয়া। একজন লোক রাখতেই হবে, এমন কেউ যে যথাযথ যত্ন নিতে পারবে ওর মেয়ের। তারপর তো বাকিরা আছেই -। 


লোক চাই, বললেই তো আর লোক মেলে না। আবার বাচ্ছা সামলানোর লোক। মস্ত খোলামেলা বাড়ি আমাদের, লোকগুলো আদ্যপান্ত কাঁচাখোলা, যেখানে সেখানে যাতা ফেলে রাখে, টাকাপয়সা থেকে কুচি কানের দুল। ফলে বিশ্বস্ত হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। পাড়ার যে নার্সিং হোমে শ্রীমতী তুত্তুরীর জন্ম তার দুই আয়া দিদির সাথে হেব্বি দোস্তি হয়ে গিয়েছিল আমার আর মায়ের। ছাড়া পাবার আগে তাদেরই বলল মা। "তোমাদের মত ভালো কাউকে পাওয়া যাবে -"। 


একজন বয়স্কা, অন্যজন তরুণী। দুই দিদিমনি নিজেদের মধ্যে কথা বলে জানালো, " আমাদের তো ডাক্তার দিদি ছাড়বে না। তবে দেখছি, একজনকে খবর দিচ্ছি।" খবর পেয়ে যিনি এলেন, তাঁর যেমন জাঁদরেল চেহারা, তেমনি গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজ। মা আর আমি তো ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। মাফিয়াদের ঢঙে তিনি তো বলে চলে গেলেন, " কোন চিন্তা নেই।" মায়ের আর আমার মুখ শুকিয়ে চুন। ইনি যাবেন নাকি? নার্সিং হোমের দুই দিদি সান্ত্বনা দেয়, " উনি ভীষণ কাজের। ওনাকে পেলে তো কোন চিন্তাই ছিল না। তবে যাকে দেবে সেও ভীষণ ভালো। মিলিয়ে নিবেন মাসিমা।" 


সোমবার ভোরে জন্মানো মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরলাম রবিবার দ্বিপ্রহরে। তখনও শৌভিক বিডিও। সোমবারই ব্লকে ফিরে যাবে। প্রচুর কান্নাকাটি করেও আগে ছুটি পেলাম না। এক প্রবল বর্ষণক্লান্ত সকালে পিতামহের কোলে চেপে মাতুলালয়ে প্রবেশ করলেন শ্রীমতী তুত্তুরী। বাড়িতে ততক্ষণে মেলা বসে গেছে। চাটুজ্জে বাড়ির সব লোক, আমার দিদিভাই, শ্বশুরমশাই আরো যেন কারা কারা। মুখ দেখার সৌজন্যে কত কি যে পেল মেয়েটা। এদিক চা জলখাবার দিতে গিয়ে নাজেহাল আমার মা। দিদিভাই এমনকি আমিও ঐ অবস্থায় হাত লাগিয়েছি। শৌভিক ফিসফিস করে বলেই যাচ্ছে, "ওরে এখনই এত কাজ করতে যাস না। ব্যথা বেড়ে যাবে। তোকে দেখে আমারই পেট ব্যথা করছে। এম্প্যাথেটিক পেন বোধহয় একেই বলে -।" 


সব মিলিয়ে চূড়ান্ত ঘেঁটে যাওয়া মাছের বাজারে এসে উপস্থিত হল এক ছোট্টখাট্ট কৃশকায় ভদ্রমহিলা। পরনে সিনথেটিক শাড়ি, কাঁধে মেরুন রঙের ঝোলা ব্যাগ, হাতে ছাতা। ভেজা ছাতাটা ভাঁজ করে, রকের কল খুলে ভালো করে পা ধুলেন। তারপরে চৌকাঠ ডিঙিয়ে দালানে প্রবেশ করলেন, মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, " মাসিমা আমি লতা। সে কই?" সেই থেকে আজ চোদ্দ বছর ধরে তিনি তুত্তুরীর 'মাসি' আর তুত্তুরী তাঁর সোনা মা। আজ সেই মাসির জন্মদিন। খুব ভালো থাকুক মাসি, সুস্থ থাকুক। অটুট থাকুক মাসি আর তার সোনামার সম্পর্ক আজকের দিনে তুত্তুরীর মায়ের এটাই কামনা।


পুনশ্চ -শ্রীমতী তুত্তুরী তো ধেড়ে হয়ে গেছেন, তাঁকে দেখার ক্ষমতা কি আর মাসির আছে। তিনিই বরং যখন তখন, মোবাইল না দিলে " দেখে নেব" বলে মাসিকে ধমক চমক দেন। বর্তমানে মাসি আর একটি বাচ্ছার দায়িত্ব পেয়েছেন। ঐ যে শ্রীমতী তুত্তুরীর ডান পাশে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন যে ভদ্রমহিলা, তিনিই আপাতত মাসির নতুন এসাইনমেন্ট। বিশ্বাস করুন, দিনের শেষে মাসি কাকে বেশি পাত্তা দিল এই নিয়ে, এই বাড়িতে দুটো বাচ্ছার নিত্য রেষারেষি চলে।