এক ঢিলে দুই পাখি,
অর্থাৎ একদিনে দুটি সিনেমা দেখলাম আমরা আজ, সকাল সাড়ে দশটার শোয়ে ব্যোমকেশ পর্ব
এবং বিকাল সাড়ে তিনটের শোয়ে ডবল ফেলুদা। পুরো ব্যাপারটাই শৌভিকের মস্তিষ্ক প্রসূত।
এর আগে আমি যতবার প্রস্তাব করেছি এক দিনে একাধিক সিনেমা দেখা, ততবারই তা নাকচ
হয়েছে। কারণ তাতে নাকি যথার্থ ভাবে কোন সিনেমাটিরই রসাস্বাদন করা যায় না। কিন্তু
এবারে যখন শৌভিক নিজে থেকেই প্রস্তাব দিল, আমি তো একপায়ে খাড়া। তা নাহলে সত্যি আর
সময় কোথায়? তুত্তুরীকে নিয়েও কোন চিন্তা নেই, কারণ বহুদিন বাদে হাওড়া এসেছি। দাদু-মামমামকে
(দিদা) পেলে তুত্তুরীর আর কাউকেই প্রয়োজন নেই।
সুতরাং ভোর বেলা(অর্থাৎ
বেলা আটটা) উঠে শ্যাম্পু করে (সারাদিন মলে থাকব কি না), চটজলদি প্রাতরাশ করে দুজনে
দৌড়লাম অবনী রিভার সাইড মলের উদ্দেশ্যে। দশটার সময় যখন অবনীতে ঢুকলাম, গোটা মল
ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। সব দোকানপাট বন্ধ এবং অন্ধকার। আমাদের মত জনা কয়েক সিনেমা
পাগল আর মুষ্টিমেয় সিকিওরিটি গার্ড ছাড়া কেউ নেই। ফাঁকা হলে দেখতে বসলাম ব্যোমকেশ
পর্ব। আসল গল্প তো অমৃতের মৃত্যু, টানটান উত্তেজনায় ভরপুর। দেখতে বসেই বেশ হতাশ
হলাম, এখানে গল্পের শুরুতেই ব্যোমকেশ বেশ একচোট ‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে’
মার্কা ডিসুম- ডিসুম করে নিল। প্রচণ্ড রাগে গা রিরি করে উঠল, ব্যোমকেশ বক্সী বড়জোর
এক ঘা ব্রজ মুষ্টি প্রহার করতে পারে, কিন্তু এই ভাবে ভ্যান ডেম বা অক্ষয় কুমার
টাইপ ফাইট করছে এটা আমি কিছুতেই হজম করতে পারলাম না। যদিও আমার বর বলল, “আউট অফ
কন্টেক্সট হলেও বড় খাসা ফাইট করল কিন্তু ব্যোমকেশ।” এরপর শুরু হল ব্যোমকেশ এবং সত্যবতীর ন্যাকা
ন্যাকা দাম্পত্য প্রেম। বহ্নিপতঙ্গ সিনেমাটিতে দেখান হয়েছিল সদ্যবিবাহিত ব্যোমকেশ
এবং সত্যবতীর দুষ্টু মিষ্টি দাম্পত্য প্রেম। সেটা যদিও গল্পে ছিল না, তাও মন্দ
লাগেনি দেখতে। কিন্তু স্যার বিশ্বাস করুন আর নেওয়া যাচ্ছে না। সোহিনী সরকার আমার
অত্যন্ত প্রিয় অভিনেত্রী, কিন্তু ঐ আদুরে আদিখ্যেতা আর স্ফুরিত অধর মার্কা প্রেম
স্রেফ বিবমিষা জাগায়। ব্যোমকেশ আর সত্যবতীর এতখানি অধঃপতন একজন শরদ্বিন্দু ভক্ত
হিসেবে মেনে নিতে পারছি না। যাইহোক গল্প এগোয় শম্বুকগতিতে ব্যোমকেশ এবং অজিত
সান্তালগোলায় গিয়ে হাজির হয়, সাথে সত্যবতীও যায়। সেখানে গিয়ে দিব্যি বোরলি মাছ,
টাটকা সব্জি, কচি পাঁঠা, পোলাও ইত্যাদি কেনা, রান্না, খাওয়া, গান গাওয়া চলতে থাকে।
অমৃতের মৃত্যু ঘটে, আমায় শৌভিক ফিসফিস করে আশ্বস্ত করে, ‘এবার গল্প গতি নেবে দেখ’।
কচু পোড়া। সদানন্দ শুর মারা যান। সত্যবতীর সাথে সখ্য জমে ওঠে বিশ্বনাথ মল্লিক রুপী
কৌশিক সেনের ঝিঙ্কু গিন্নী জুন মালিয়ার। ক্লাব পার্টি, পিকনিক, আদিবাসী নাচের তালে
কোমরও দুলিয়ে নেয় দুজনে। রাগে গজগজ করতে থাকি আমি। গল্প আরও এগোয়, সদানন্দ শুর
সম্পর্কে খোঁজ নিতে কোলকাতার লালবাতি এলাকায় এসে সরোজ খানের কোরিওগ্রাফিতে
সায়ন্তিকার কোমর দোলান মুজরা হয়, রেস কোর্সের আস্তাবলে গিয়ে জনৈক বুকির সাথে আরেক
প্রস্ত ঝাড়পিঠ করে অবশেষে ক্লাইম্যাক্সে প্রভূত মারামারি করে ভিলেনকে পাকড়াও করে
ব্যোমকেশ। এবং বেআইনি অস্ত্রব্যবসায়ী ভিলেন পুলিশের ভ্যানে ওঠার আগে এক প্রস্ত
জ্বালাময়ী বক্তৃতাও দেয়, “আমাদের লড়াই চলতেই থাকবে। এ আজাদি ঝুটা হ্যায়” ইত্যাদি
বলে। হল থেকে বেরিয়ে বিশ্বাস করুন কান্না পাচ্ছিল, এতো বাজে সিনেমা দেখব বলে, এই
শীতে লেপের আদর ত্যাগ করে দৌড়ে দৌড়ে এলাম? যেমন খারাপ নির্দেশনা, তেমনি খারাপ
অভিনয়। সুমন্ত মুখোপাধ্যায় আর ঋত্বিক চক্রবর্তী ছাড়া আর কারো অভিনয় বিন্দুমাত্র
দাগ কাটে না। এর থেকে হরিপদ ব্যান্ডওয়ালা দেখলে খুব খারাপ হত না বোধহয়।
দ্বিতীয়
ছবিটি ছিল ডবল ফেলুদা। দুটি গল্প সমাদ্দারের চাবি এবং গোলকধাম রহস্য।যেমন টানটান
গল্প, তেমনি অসাধারণ চরিত্রচিত্রণ তথা নির্দেশনা। নাম দেখানোর সময় থেকেই দর্শকদের
মনোযোগ আকর্ষণ করে। আর সাথে সত্যজিৎ রায়ের সেই বিখ্যাত মিউজিক। কিছু লেখার নেই।
সমালোচনা করার কোন জায়গাই রাখেননি সন্দীপ রায়। বহুদিন বাদে সব্যসাচী চক্রবর্তীকে
আবার ফেলুদা হিসাবে পেলাম। একটু বয়স্ক বটে, তবে অভিনয়ের গুণে তা ঢাকা পড়ে গেছে।
শুধু ফেলু মিত্তিরের ভুঁড়িটা কিছুতেই চাপা দেওয়া যায়নি। তবে এত ভাল সিনেমায় ঐ টুকু
ত্রুটি মার্জনীয়, অন্তত কারো ভুঁড়ি নিয়ে আমি তো কিছু বলতেই পারি না বাবা। সন্দীপ
রায়কে অসংখ্য ধন্যবাদ বর্ষ শেষে এত ভাল একটা সিনেমা উপহার দেবার জন্য।