Friday 26 May 2017

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি (part 1)২৩মে ২০১৭

এই মে মাসের চাঁদিফাটা দমচাপা গরমে কেউ পুরী যায়? পাগল ছাড়া? দেবশ্রীদি যখন প্রথম প্রস্তাবটা দিয়েছিল এটাই ছিল আমার এবং শৌভিকের যৌথ প্রতিক্রিয়া। দ্বর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলাম আমরা নাচার। প্রথমতঃ শৌভিক ছুটি পাবে না,  দ্বিতীয়তঃ কলকাতার গরমেই অর্ধপক্ক হচ্ছি আর পুরী গিয়ে পূর্ণ পক্ক হবার কোন বাসনা নেই। তাও আবার সাত দিনের জন্য?
দেবশ্রীদি কিন্তু হাল ছাড়ল না। দেখা হলে বা না হলে বারবার বলতে লাগল, “তুমি একটু দেখ। কেন জানি না মন বলছে তুমি চাইলেই যেতে পারবে। ”ব্যাপারটা হচ্ছে গ্রীষ্মের ছুটিতে পুরীতে উজানের সাত দিনের ক্যারাটে স্কুলের সামার ক্যাম্প। উজানকে আত্মনির্ভর করার জন্য এই ক্যাম্পে পাঠাতে ইচ্ছুক হলেও দেবশ্রীদি পুত্রকে একাকী শ্রীক্ষেত্রে পাঠাতে একেবারেই নারাজ। তাই উজান তার গ্রুপের সাথে আসবে, আলাদাই থাকবে কিন্তু উজানের মা ঠিক করল সে আসেপাশেই থাকবে। যাতে সকাল সন্ধ্যা অন্তত এক ঝলকের জন্য ও ছেলেকে দেখতে পায়।  কিন্তু সাত সাতটা দিন একা আলাদা হোটেলে কাটানো অসম্ভব। তাই দেবশ্রীদি তার ঘনিষ্ট বান্ধবীদের প্রস্তাব দেয়, যদি তারাও যেতে রাজি হয় তাহলে সোনায় সোহাগা।
বিদিশা দি এবং সুকন্যা সত্যিই রাজি হয়ে যায়। তারপর সম্মিলিত ত্রিশূল আক্রমণ চলতে থাকে, “ আরে চলোই না। ভালো লাগবে।”
তিনজনই আমার এত প্রিয় যে এদের সম্মিলিত বারংবার অনুরোধ নাকচ করতে খুব খারাপ লাগছিল। শৌভিক বলল,“তুই চলে যা না-মেয়েকে নিয়ে। ” “বাঃ। আর তুই?খাওয়া দাওয়া?” জবাব পেলাম,“ আরেঃ আমার চিন্তা করতে হবে না। কটা দিন আমি দিব্যি চালিয়ে নিতে পারব। তাছাড়া বউ মানেই যে বরের রাঁধুনী বা ধাত্রী নয় এটা যদি তোকে বোঝাতে হয়, তাহলে কাল থেকে নিজেকে ফেমিনিস্ট বলা ছেড়ে দে। ” আঃ এই না হলে আমার বর----
সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু মন যে মানেনা। ভাবলাম একবার মা বাবাকে বলে দেখি। দুজনেরই যা শারীরিক সক্ষমতা এই ধরনের ট্রিপ ওদের জন্য আদর্শ। সাতদিন শুধু সমুদ্র দেখা মন্দ কি?
কিন্তু বাবাকে রাজি করানো আর পাহাড় টলানো প্রায় সমান। বললেই শুনতে হয়, “না মানা। তোরা ঘুুরে আয়। আমাদের আর এই বয়সে কোথাও টানিসনি। আমাদের ঘরই হল অনন্ত শান্তির নীড়। ”
অগত্যা ওরা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে নিজেদের টিকিট হোটেল বুকিং করে ফেলল। আমরা যাচ্ছি না। দেবশ্রীদি অবশ্য এখনও হাল ছাড়েনি ঠিক যে ভাবে হ্যারি পটার পড়ার জন্য আমার পিছনে পড়ে ছিল, যার ফলে আমার জীবনটাই কোথাও বদলে গিয়েছিল তেমনি ভাবেই বলতে লাগল-“একটু দেখ না। একটু চেষ্টা কর না--”

অবশেষে বাবা যখন রাজি হল তখন আর মাসখানেক বাকি মাত্র। দেবশ্রীদি বলল এখুনি টিকিট কাটো। স্টেশনে বা এজেন্ট ধরার আর সময় নেই। সবাব টিকিট দেবশ্রীদিই কেটেছিল কিন্তু সেই মুহূর্তে দেবশ্রীদি যেখানে ছিল সেখান থেকে টিকিট কাটা সম্ভবপর নয়। এইরে আমার আইআরসিটিসি অ্যাকাউন্টটা তো দীর্ঘদিন না ব্যবহারে ঘেঁটে গেছে। বাবার শৌভিকের মেল আইডি দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতোদ্যম হয়ে শেষে আমার বান্ধবীদেরই বললাম, কেউ একটু তার ইউজার আডি আর পাসওয়ার্ডটা যদি দয়া করে শেয়ার করে--।  দয়া শব্দটার জন্য দুটো গালি দিয়ে সুকন্যা তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দিল তার আইডি। অতঃপর আর কি? দিদিরা বলল “যাতে পাচ্ছ তাতেই কাটো”। ধুর ছাই কোনো ট্রেনেই কনফার্ম পেলাম না। হয় ওয়েটিং নয় আরএসি। ওরাও পুরী এক্সপ্রেসে কেটেছে জিজ্ঞাসা করে আমরাও কাটলাম। যথারীতি   আরএসি। প্রতিনিয়ত কতবার যে পিএনআর স্ট্যাটাস চেক করতাম তার ইয়ত্তা নেই। হে ভগবান অন্তত দুটো কনফার্ম করে দাও। তুত্তুরী আর আমি না হয় বসে বা একটা বার্থে দুজন শুয়ে চলে যাব কিন্তু ওরা? আর যদি বার্থ পাইয়েই দাও তাহলে লোয়ার বার্থ দও প্রভু। বাবা মা বা তুত্তুরীর পক্ষে আপার বার্থ তো অভিশাপ মাত্র। ২২তারিখ ট্রেনে উঠে দেখি ঠিক দুটি বার্থই কনফার্মড। বাকি দুজনের জন্য একটি বার্থ এবং মজার কথা হল সবকটিই লোয়ার বার্থ। উফঃ কি যে আনন্দ হচ্ছিল শুধু মনে হল পে কমিশনটাও যদি একই সাথে চেয়ে নিতাম----

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি ২৩মে ২০১৭ (পর্ব ২)
টিকিট তো কাটা হল, এবার হোটেল বুকিং। বুকিং দেবশ্রীদি আগেই করে রেখেছে পুরী হোটেলে কিন্তু আমাদের বিলম্বিত সিদ্ধান্তের ফলে আমরা পড়লাম মহা আতান্তরে। দেবশ্রীদি বারংবার অনুরোধ করতে লাগল, “প্লিজ যাও। পুরী হোটেল বুক করো। আমি কলকাতায় থাকলে না হয় আমিই যেতাম।" কিন্তু সুদূর ফার্ণ রোডে গিয়ে কে বুক করাবে?শৌভিকের এক পরিচিত এজেন্ট চেষ্টা করে বলল ওরা ইমেলের জবাব দিচ্ছে না। যাঃ কি হবে??
চুঁচুড়ায় অফিস করে সপ্তাহের মাঝে কে দৌড়বে ফার্ণ রোড?আর সপ্তাহান্তে গৃহকর্মের যে পাহাড় জমে তা সরিয়ে দৌড়ানো অসম্ভব। অগত্যা সোনালি হোটেলই ভরসা। ম্যাঙ্গো লেনে অফিস, নিউ সেক্রেটারিয়েটে কোন কর্মপোলক্ষে গেলে বুক করানো নস্যি। পেয়েও গেলাম। বাতানুকূল কামরা, মা একদম গরম বরদাস্ত করতে পারে না। তবে সমুদ্রমুখী নয়।

        ইতিপূর্বে সোনালিতে থাকার অভিজ্ঞতা মোটামুটি। তাই বুক করে দিলাম। স্বর্গদ্বারের ওপর। মার পক্ষে বাজার পরিক্রমাও সহজ হবে। টাকা দিয়ে দেবার পর হঠাৎ দেখি ঐ কতৃপক্ষই অপর একটা হোটেল খুলেছে নাম সোনালি রেসিডেন্সি,  পুরী হোটেলের ঠিক পিছনে। ভজহরি মান্নার পাশেই। হোটেল থেকে সমুদ্র দেখা যাবে না বটে তবে নেমে দু কদম হাঁটলেই তো হল। সর্বোপরি পুরী হোটেলের একদম পিছনে, আমার তিন বন্ধুর পাশাপাশি ও থাকা যাবে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম,  সমুদ্র না দেখা গেলে আপত্তি আছে কি না? বাবার জবাব মোটামুটি প্রত্যাশিতই ছিল, “ তোর যা খুশি। ওখানে আমরা যাব শুধু তুত্তুরীর সাথে নিভৃতে সময় কাটাতে, তুই তোর বন্ধুদের সাথেই সময় কাটাস। ” মহানন্দে সোনালি রেসিডেন্সি বুক করে বাড়ি ফিরলাম। শুধু শৌভিক আর দেবশ্রীদি শুনে বলল, “এত কষ্ট করে পুরী যেতে পারছ আর পুরী হোটেল বুক করাতে পারলে না?”
অধীর আগ্রহে তুত্তুরী দিন গুনতে শুরু করল, আমরা চার সখীও যৎপরনাস্তি উল্লসিত, বাঁধনহীন একটা ট্রিপ শুধু প্রিয় বন্ধুদের সাহচর্য মধুর আহাঃ। বাকি তিনজন টুকটাক জামাকাপড় ও কিনতে লাগল বিচে পরার উপযুক্ত, টি শার্ট,  ট্যাঙ্ক টপ, স্কার্ট, ট্রাউজার,  হাফ প্যালাজো, টিউনিক ইত্যাদি ইত্যাদির ট্রায়াল দেবার ছবিতে ভরে উঠল হোয়াটস্ অ্যাপ। আমি কিছুই কিনছিলাম না শুধু প্রার্থনা করছিলাম হে ঠাকুর আর একটু ইয়ে মানে রোগা করে দাও প্রভু।
যাবার ঠিক এক মাস আগে বিনা মেঘে বজ্রপাত, অফিস থেকে বেরিয়ে ট্রেনে উঠে হোয়াটস্ অ্যাপ অন করেছি সুকন্যার মেসেজ,  কাকু আচমকা খাট থেকে পড়ে গেছেন এবং ফিমার বোন ফ্রাকচার্ড। পরবর্তী  কয়েকটা দিন যে কি ভাবে কাটিয়েছে সুকন্যা তা শুধু ঐ জানে। প্রথম চোটে মেদিনীপুরের স্থানীয় নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হল,  সু তখনও বলে যাচ্ছে “টিকিট বাতিল করো না। একটু দেখি। ”
ঠিক ছিল পরের দিন অস্ত্রোপচার হবে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল কিছু শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে, কাকুকে আনা হল পিয়ায়লেস এ। সফল অস্ত্রপচারের পর ডাক্তার বলেই দিলেন তিন সপ্তাহ সম্পূর্ণ বেড রেস্ট। সু তো জানিয়ে দিল টিকিট ক্যানসেল করে দাও, আমরা কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই হাহুতাশ করে চলেছি, ইশ্ সু থাকলে আরো কত আনন্দময় হতো ব্যাপারটা। উটো অর্থাৎ সু’র সুপুত্র থাকলে এক্ষণে তুত্তুরীর সাথে তাল মিলিয়ে কি তুলকালামই না করত।

দেখতে দেখতে ২১তারিখ এসে গেল, কালই ট্রেন। রবিবার দ্বিপ্রহরে রান্না শেষ করে গলদঘর্ম হয়ে সবে স্নানে যাব, দেবশ্রীদির ফোন, “এই কাল তোমাদের ট্রেন কটায়?”  অবাক হয়ে বললাম, “কেন?পুরী এক্সপ্রেস? রাত সাড়ে দশটায়?” দেবশ্রীদি আতঙ্কিত হয়ে বলল,“সর্বনাশ। আমাদেরও পুরী এক্সপ্রেস। কিন্তু ট্রেন তো সাড়ে আটটায়? এই দেখলাম। বিদিশা তো দিব্যি সাড়ে নটায় হাওড়া স্টেশন পৌছবে বলে বসে আছে?” জটচলদি আইআরসিটিসি খুলে দেখি সত্যিই দুটোই পুরী এক্সপ্রেস। একটা দৈনিক আর একটা সাপ্তাহিক। গণ্ডোগোলটা এখানেই হয়েছে।  যাক কি আর করা? তাহলে আলাদা আলাদাই যাই। বিদিশাদি শুধু সারাদিন আতঙ্কিত হয়ে বারবার বলছিল, “ওরে কি সর্বনাশ হতো রে। ট্রেন মিস করলে মাথা নীচু করে ফিরে আসতাম রে। কি ট্যালারে আমরা। মা বেপোট চেল্লাচ্ছে, কুড়িটা তিরিশ আর বাইশটা তিরিশের তফাৎ বুঝতে পারিনি বা খেয়াল করিনি বলে।” ভয়ে নিজের বাড়িতে আর ঘটনাটা জানালাম না, মায়ের এমনি বদ্ধমূল  ধারণা যে আমি ট্যালা চূড়ামণি, যদি জানতে পারে যে বন্ধুবান্ধবও তথৈবচ তাহলে হয়তো শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসবে। কি দরকার বাপ?এই বেশ ভালো আছি----
অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি ২৩মে ২০১৭ (পর্ব ৩)

পুরীতে যখন নামলাম তখনও জানি না যে কি ভয়ানক অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য। সাতটার ট্রেন পুরী পৌছল বেলা নটায়। মাঝরাতে নাকি ট্রেন এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে  ছিল, যদিও আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। স্টেশন থেকে বেরিয়ে অটো চেপে পৌছলাম সোনালি রেসিডেন্সিতে। বাইরে থেকে মন্দ নয় দেখতে। ভিতরটা অতি সাধারণ,রিশেপসনে সইসাবুদ করার সময় অবাক হলাম কোন আইডি প্রুফ চাইল নাতো? যাই হোক বলা হল তিন তলায় ঘর,রুম নম্বর ৩০২। তিন তলা তা মন্দ কি?লিফট্ আছে নিশ্চয়? রিশেপসনে বসে থাকা ঘন কৃষ্ণবর্ণ ব্যক্তিটি ঘাড় নেড়ে জানালো না লিফট চালু হয়নি। পরে বুঝেছিলাম লিফট্ বসানোর জায়গাই নেই ওদের। সর্বনাশ!লিফট নেই? বাবা এবং মার যা বয়স এবং হাঁটুর যে তথৈবচ অবস্থা ওরা ওঠানামা করবে কি করে?
গজগজ করতে করতে রুমে গেলাম,  বাবা মা ধীরে ধীরে উঠতে লাগল, এবার তো কিছু খেতে হয়।  সকাল থেকে এক কাপ চাও কারো পেটে পড়েনি, ঘড়ির কাঁটা দৌড়চ্ছে সাড়ে নটা থেকে পৌনে দশটার দিকে। ঘরে রাখা ইন্টারকমটি যে শুধু দ্রষ্টব্য বস্তু মাত্র তা বুঝতে বেশি সময় লাগল না। অগত্যা নামলাম একতলায়, তেঁতো মুখে কৃষ্ণকায় রিসেপশনিস্টকে বললাম “  চা আর ব্রেকফাস্ট লাগবে। রুমে পাঠিয়ে দিন। ”লোকটি হেসে উড়িয়া টানে বাঙলায় বলল,“  রুম সার্ভিস তো নেই। বললে বাইরে থেকে চা এনে দেবে। ব্রেকফাস্ট বাইরে গিয়ে করতে হবে। ”
আর নিতে পারছিলাম না। এত অসহায় খুব কমই বোধ হয়েছে। দেবশ্রীদি এবং বিদিশা দি ভোর সাড়ে পাঁচটায় নেমে পুরী হোটেলে চেক ইন করে স্যান্ডউইচ আর চা খেয়ে সমুদ্রে জলকেলি করতে নেমে গেছে আর আমরা? মেসেজ পেলাম ওদের ঘর থেকেই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, আর আমাদের ঘরের একদিকে একটা সরু লম্বা বারন্দা যার ও পাশে দু ফুটের একটা এঁদো নোংরা গলি আর তিন ফুটের পাঁচিল টপকালেই আর একটি হোটেলের সরু বারন্দা এবং সারি সারি ঘর। আর ঘরের অন্যদিকে কাঁচের শাটার টানা দরজার ওপারেও একই রকম দুফুট ছেড়ে একটি কদাচার হোটেলের ঘর। শৌভিককে ফোনে বললাম,শৌভিক শুধু বলল,“কোথ থেকে এমন হোটেল জুটিয়েছিস বাপ?”বাবা পাশ থেকে সান্ত্বনার সুরে বলল, “এসি আছে। ” শুনে শৌভিক অগ্নিশর্মা হয়ে বলল,“এসি তো বাড়িতেই আছে। কষ্ট করে অতদূর যাবার দরকার কি ছিল?”
সত্যিই তাই। বাবা মার কষ্ট দেখে ডাক ছেড়ে কান্না পাচ্ছিল। এখনও চা এনে দেবার লোক পাঠাল না এরা। আবার গেলাম, যে বেয়ারাটি মালপত্র ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল তাকেই ধরলাম। টাকা নিয়ে সে একটি প্লাস্টিকের প্যাকেটে চা আর চারটি কাগজের কাপ এনে দিল। জলখাবার?নীচের রুচিরা নাম্নী রেস্তোরাঁয় খোঁজ নিয়ে জানালো কিচ্ছু নেই। সর্বনাশ বেলা দশটা বাজেনি অথচ প্রাতঃরাশের উপকরণ শেষ?ব্যাগে কেক বিস্কুট ছিল অবশ্য।
দুই দিদিকেই ফোন করলাম, কেউ ধরল না। তীব্র হতাশায় ডুবে ছিলাম বলে এতক্ষণ খেয়াল করিনি যে এসিটা একদম ঠাণ্ডা করতে পারছে না। বিগত এক ঘন্টা ধরে এসি এবং ফ্যান উভয়েই ঘুরে চলেছে, অন্যত্র হলে চাদর মুড়ি দেবার প্রয়োজন হত, এখানে রীতিমতো ভ্যাপসা  লাগছে। ঘরের থেকেও বাইরের তাপমাত্রা অনেক কম বরং। লোক ডাকলাম, দেখে বলে গেল,“চলিছে তো। ঠাণ্ডা হইছে তো। গরম বড় বেশি কি না?” আমি বাঙাল নই বটে তবে এভাবে হাইকোর্ট দেখানোর চেষ্টা মানা যায় না।
কি রকম অদ্ভূত বিষাদ গ্রাস করছিল আমাদের। কি হবে? এই রকম বদ্ধ কূপে কি ভাবে সাতটা দিন কাটাবো আমরা?অ্যাটাচড্ বাথ বলে যেটি আছে তা এতই অপরিসর যে শাওয়ার চালালে শুকনো জামা কাপড় রাখা দায়। কমোড এত অপরিষ্কার যে গা গুলিয়ে ওঠে। নার্ভাস ব্রেকডাউন হবার আঘের মুহূর্তে মনে হল একবার সোনালি হোটেলে কথা বলে দেখি। সাত দিনের জন্য এত টাকা দিয়ে বুক করেছি, যদি ওরা ঐ বিল্ডিং এ শিফট করে দেয়? অতিরিক্ত টাকা না হয় দিয়ে দেওয়া যাবে। ফোন করলাম। একাধিক বার। কলকাতা অফিস ধরলই না। আর সোনালি হোটেলের ম্যানেজার অত্যন্ত অভদ্র ভাবে জানিয়ে দিল যে ওরা অ্যাডজাস্ট করবে না। অর্থাৎ এখানেই পচে মরতে হবে আমাদের। কেন এলাম?বাবা মাকে কি এই বয়সে নিছক শাস্তি দেবার জন্য নিয়ে এলাম???

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি ২৩মে ২০১৭ (পর্ব ৪)

চূড়ান্ত মন খারাপ করে বসে বসে মোবাইল ঘাঁটছিলাম। কি করি?হোটেল পাল্টাবো কি?ঘর পাব কি, পুরীতে এমনিতেই পর্যটক গিজগিজ করছে। আর সবথেকে বড় কথা এরা একটা টাকাও ফেরৎ দেবে না। আমার প্রায় সাতদিনের পুরো ভাড়াই দেওয়া আছে, পুরোটাই লস্ হয়ে যাবে। এমন সময় বিদিশা দির ফোন, স্বভাব সিদ্ধ উচ্ছাসের সাথে জিজ্ঞাসা করল আমরা কোথায়? সমুদ্রস্নানে গেছিলাম কি না?ওরা এই সবে দীর্ঘক্ষণ সমুদ্রে মাতামাতি  করে ঘরে ঢুকেছে। সব বললাম। সমুদ্র দর্শনে গিয়েছিলাম বটে তবে হোটেল সংক্রান্ত তিক্ত কটু অভিজ্ঞতার জন্য মেজাজ এতটাই খারাপ ছিল যে কিছুতেই সমুদ্রটাকে ভালো লাগাতে পারিনি। দশ পনেরো মিনিটের মধ্যেই ঘরে ফিরে এসেছিলাম।
হোটেলে ফিরে একটানা এতটা হেঁটে এসে তিনতলায় উঠতে পারবে না বলে বাবামা নিচের লাউঞ্জে বসে ছিল, তখন দেখলাম আরো একটা পরিবারও প্রবল ঝগড়া বিবাদের পর টাকা পয়সা না দিয়েই হোটেল ছেড়ে চলে গেল।
বিদিশাদির সাথে কথা বলতে বলতেই দেবশ্রীদি স্নান সেরে বেরিয়ে এসে সব শুনে জিজ্ঞাসা করল ওরা খোঁজ নিয়ে দেখবে কি, পুরী হোটেলে কোন ঘর খালি আছে কিনা?হাতে চাঁদ পেলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ঘর আছে। সমদ্রমুখী বাতানুকূল ঘর। দেখতে গিয়ে দেখলাম এটাও তিনতলা এবং লিফট নেই। তা হোক। ঘরের দরজা খুলতেই কনকনে ঠাণ্ডা সামুদ্রিক হাওয়া সব তিক্ততা উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। খোলা বারন্দা দিয়ে উত্তাল নীলচে অমরেন্দ্র বাহুবলী মার্কা সমুদ্র দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে, বাথরুমটা তুলনায় বেশ বড় এবং পরিষ্কার। এসিটাও চলছে বলেই মনে হল। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
ঠিক হল দ্বিপ্রাহরিক আহার ভজহরি মান্নায় সেরে সবাই এই হোটেলেই চলে আসব। একটু রেস্ট নিয়ে মালপত্র আনতে যাব সন্ধ্যা বেলায়।
আমি আর টাকাপয়সা ফেরৎ পাবার আশা না করলেও আমার দুই বান্ধবী এত সহজে ছাড়তে নারাজ। দেবশ্রীদি এবংবিদিশা দি বলল,“তুমি না বলতে পারলেও আমরা বলছি চল। এতগুলো টাকা ইয়ার্কি নাকি। অন্তত গলা  ফাটিয়ে ঝগড়া তো করাই যায়। ” সত্যি ওরা ঐ রোদে আমার সাথে হোটেলে এল। বাবা এবং ওদের মতে আমার হোটেলর রুমটা ছেড়ে দেওয়া অনুচিত। থাক না সাতটা দিন ঘরটা বন্ধ হয়ে। কিন্তু আমার আর একবিন্দুও ওখানে থাকার ইচ্ছা ছিল না।

ওরা সত্যিই ঐ রোদে আমার হয়ে গলা ফাটাতে এল। প্রচুর কথা শোনানো হল, শুনবে কে?হাবাগোবা রিশেপসনিস্ট শুধু একটা কথাই বলতে শিখেছে,“ কেন যাবেন? এসি তো দিব্য চলছে। টাকা কিছু ফেরৎ হবে না। ”
ধুত্তোর বলে বাবা মা আর তুত্তুরীকে নিয়ে গিয়ে উঠলাম পুরী হোটেলে। দুই প্রাণাধিক সখী বলল,“কোন চিন্তা নেই। মালপত্র নিতে যখন আসবে কাকু কাকিমার আসার দরকার নেই। আমরাই আসব সব গুছিয়ে নিয়ে যাব। এবং আর এক প্রস্থ ঝগড়া করে যাব। ”
সত্যিই তাই বিকালে তিনজনে গিয়ে অগোছালো মালপত্র পুনরায় গেছিয়ে নিলাম এবং আর এক দফা আশ মিটিয়ে কথা শুনিয়ে এলাম। আমরা সোশাল মিডিয়ায় দেব। আমরা জনে জনে নিষেধ করব, কেউ যেন সোনালিতে না আসে। আমরা কনজিউমার ফোরামে যাব ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য কোন কিছুতেই ওদের কিছু যায় আসে না বেশ বোঝা গেল।

পুরী হোটেলে পৌছে দেখি তুত্তুরী বারন্দায় বসে প্রবল চিৎকার করে উট ডাকছে। উটের পিঠে চাপবে বলে। পুরীতে তখন সন্ধ্যা নামছে আমরা তিন সখী তুত্তুরীকে নিয়ে হাজির হলাম বালুকাবেলায়। চতুর্দিকে জনারণ্য তবুও মন্দ লাগছিল না। প্রবল হাওয়ায় অবিন্যস্ত জামাকাপড় এলোমেলো চুল তবু পুরী তো বটে।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাও কি মনোরম।
একট উটকে ডাকা হল, উটের গায়ে মই ঠেকিয়ে তুত্তুরী চটপট উঠে গেল। এবার উটওলা নব্য যুবক আমাকে বলল,“তুমিও উঠো। নাহলে বাচ্ছা পড়ে যাবে যে। ” ভালো কথা, বললাম তোমার উটকে বসতে বলো, যেমন লালমোহন বাবু চড়েছিলেন সোনার কেল্লায়, তেমন করে চড়তে পারি, ঐ সটান দাঁড়িয়ে থাকা উটের গায়ে ঠেকানো মই বেয়ে কে উঠবে? জবাব পেলাম, ওর উট বসে না। এভাবেই চড়তে হবে। জননী হবার জ্বালা কিছু কম না। কি করে মেয়েকে একা অচেনা উট এবং উটওয়ালির সাথে ছাড়ি রে বাবা। অগত্যা উটে উঠতে গেলাম। দামাল হাওয়ায় এলোমেলো স্কার্ট সামলে সরু বাঁশের মইয়ে তিন ধাপ চড়ে আর না পারছি উঠতে না নামতে। আরো উপরে উঠব কি করে, ধরব কি?উটকে ধরতে গেলেই সে নড়ে উঠছে। বিদিশা দি হাসতে হাসতে বলল,“ তুমি নামো। আমি চড়ছি তুত্তুরীর সাথে।  ” নামব কি করে রে বাবা? যতই পা ঝোলাই কিছুতেই আর নীচের ধাপে পা পৌছয় না। বিদিশা বললো জাম্প্। ইল্লি আর কি? এত উঁচু থেকে বালিতে লাফালে আর দেখতে হবে না। হাঁটু ছড়ে কেটে পা মচকে কি যে হবে? উটওয়ালা শেষে পা ধরে টানতে লাগল, যাতে নীচের ধাপে পা দিতে পারি। সে কি কেলো। চূড়ান্ত রেগে গিয়ে বললাম হয় পা ছাড় নয় পদাঘাতে তোকেই মাটিতে ফেলে দেব। শেষে কি ভাবে যেন নামলাম বাপরে বাপ। বিদিশা দি চট করে উঠে গেল। আর মরুভূমির জাহাজ ও মসৃণ ভাবে বালির উপর দিয়ে চলতে লাগল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাপসঃ।

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি ২৪মে ২০১৭ (part 5)
পুরীতে আজ আমাদের দ্বিতীয় দিন। দেবশ্রীদি ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে হাজির সমুদ্র সৈকতে। ঠিক ঐ সময় থেকে বালুকাবেলায় উজানদের ক্যারাটে প্র্যাকটিস শুরু হয়। আমি আর বিদিশা দি ঠিক করলাম আমরাও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠব। সাড়ে পাঁচটা না হলেও অন্তত ছটায় উঠে বারন্দা থেকে এক প্রস্থ উজানদের ক্যারাটে অভ্যাস দেখব এবং তারপর সাড়ে ছটা বা সাতটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ব মোহনার উদ্দশ্যে। যাবার সময় পদব্রজেই যাব। ফেরার সময় না হয় অটো নেওয়া যাবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অ্যালার্মকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে যখন চোখ মেললাম ঘড়ি বলছে সময় সাড়ে সাত। তড়িঘড়ি বারন্দায় ঘিয়ে উজানদের প্র্যাকটিস দেখতে দেখতে বিদিশাদিকে ফোন করলাম। তিনতলার বারন্দা থেকে মনে হচ্ছিল সৈকতে একদল সাদা পোশাক পরা পিপিলীকা নৃত্য করছে। চশমা ছাড়া চোখ রগড়ে ভালো করে উজানকে খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। বিদিশাদি আশ্বস্ত করল, ও নিজেই সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে উঠেছে।
প্রাতঃরাশান্তে দেবশ্রীদিও পুত্রের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ফিরে এল। উজান দিব্য মানিয়ে নিচ্ছে পরিস্থিতির সঙ্গে। গতকাল সন্ধ্যাবেলাও ওর মন বেজায় খারাপ ছিল,  বাড়ির লোকের জন্য এবং অবাতানুকূল কামরা তথা ইন্ডিয়ান স্টাইল ইয়ের জন্য। তারওপর একঘরে পাঁচজন ছেলেকে রাখা হয়েছে। যাদের মধ্যে একটি ভারি দুষ্টু , উজান টয়লেটে গেলেই আলো নিভিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল। তবে আজ শুনলাম একটু ধাতস্থ।
এরপর তুত্তুরীকে নিয়ে তিন সখীর সমুদ্রস্নানে যাওয়া ছাড়া আর কি বা বাকি থাকে? পুরীর সমুদ্র আর পাঁচটি বাঙালির মত আমারও ভীষণ প্রিয়। প্রতিবারই গিয়ে দেখি দামাল থেকে দামালতর হয়ে গেছে এবং প্রতিবারই শুনি কোন বাঙালি কাকু বঙ্গীয় টানে হিন্দি ভাষায় নুলিয়াকে প্রশ্ন করছে,“ইয়ে কেয়া সুনামি কা এফেক্ট হ্যায়?” এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। গাঢ় শ্লেট আর ধুসর বর্ণ বাহুবলী মার্কা সমুদ্র তীব্র  বেগে আছড়ে পড়ছে তটভূমিতে। প্রতিবারই বেশ কিছু সংখ্যক মহিলার বস্ত্রহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। কেন যে এরা শাড়ি পরে সমুদ্রে নামেন?অধিকাংশই মধ্যবয়সী বা প্রৌঢ়া। হয়তো এনাদের শাড়ি ভিন্ন অন্য বস্ত্রসম্ভার নেই। কিন্তু শাড়ি পরে সমুদ্রে নামলে ভালো হয় যদি পাড়ে বসে থাকেন। জলকেলি করতে নেমেছেন কি সমুদ্র আপনার শাড়ি খুলে দেবে। শুধু শাড়ি খুলেই ছাড়ে না বাকিটা ধরেও খামোকা টানাটানি করে। আর সবথেকে ভয়ানক হয় যারা নাইটি পরে নামেন। উফ্ ভগবান। গোটা পুরী জুড়ে শুধু নাইটি পরা মহিলা। কেউ গলায় ওড়না দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেউ বা একটা হাউসকোট চাপিয়ে ঘুরছেন। কেউ কেউ এমনি ঘুরছেন এবং এমনি এমনি সমুদ্রেও নেমে পড়ছেন।
আমি তুত্তুরী এবং দেবশ্রীদি পাড়ের কাছাকাছি থেকে  বেপোট সমুদ্র স্নান করলেও বিদিশাদি মাঝ সমুদ্রে সাঁতার কেটে এল নুলিয়ার সহায়তায়। অতঃপর তুত্তুরীও একই নুলিয়ার সাথে টিউবে চড়ে বেশ ভালো করে সমুদ্রকেলি করে এল।
দুপুরে জম্পেশ করে ভাতঘুম দিয়ে দেবশ্রীদি দৌড়ল উজানের সামার ক্যাম্পে। আর আমরা পুরী হোটেলের সামনের বালুকাবেলায় ঘুরঘুর করতে লাগলাম। সাড়ে সাতটা আটটা নাগাদ দেবশ্রীদি ফিরলে তুত্তুরীকে মা বাবার জিম্মায় গছিয়ে আমরা তিন সখী হাঁটতে লাগলাম অন্ধকার সমুদ্রের কিনারা বরাবর। জনাকীর্ণ  অঞ্চল পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা বালুকাবেলায় বসলাম তিনজনে। কত গল্প জমে আছে, কত তিক্ততা,  কত মেজাজ হারানো মন খারাপ করা গল্প। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে বিশাল উদার প্রকৃতির সামনে যে কিছুই মনে পড়ছে না। উদ্দাম হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে জামাকাপড়, উড়ে যাচ্ছে সব মনখারাপ। মাঝে নৈশভোজ করে আবার গিয়ে বসলাম সমুদ্রের ধারে। তুত্তুরী নিষেধ অমান্য করে দুহাতে খুঁড়ে যাচ্ছে বালি আর আমরা তন্ময় হয়ে যাচ্ছি এই নিশি আর সমুদ্রের মিলনে। সাড়ে এগারোটায় বন্ধ হয়ে যায় পুরী হোটেলের গেট। নাইটগার্ড গিয়ে খুঁজে না আনলে তুত্তুরী বোধহয় একটা পাহাড়ই বানিয়ে ফেলত। ভূস্বর্গ বোধহয় আমরা চাইলেই সৃষ্টি করতে পারি।

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি ২৫শে মে ২০১৭ (পর্ব ৬)
আজকের দিনটাও কালকেরই মত শুরু হল। আয়েশ করে একটু বেলা অবধি ঘুমানো। বারন্দা থেকে উজানদের প্রাত্যহিক কসরত দেখা, দেখতে দেখতে পুরী হোটেলের ভয়ানক ফোটানো চা খাওয়া। সাতদিন ধরে সকালবিকাল ঐ সাংঘাতিক চা খেয়ে নির্ঘাত পাকস্থলী এবং অন্ত্রে কালো ছোপ পড়ে গেছে। প্রাতরাশ বলতে হয় পুরী হোটেলের লুচি তরকারি মিষ্টি না হলে হোটেল থেকে বেরিয়ে মিও আমোরের স্মোকি চিকেন রাপ(wrap)। পুরী হোটেলের লুচি তরকারিটা মন্দ হয়। বেশ বড় বড় চারটে লুচি থাকে। আদতে পুরি বলাই সঙ্গত। সাথে ভয়ানক লাল রঙের একটা আলুর তরকারি। যাতে পেঁয়াজ এবং টমেটো কেচাপ ছাড়া অন্য মশলা বোধহয় পড়ে না। খেতে মন্দ না। আর একটি করে রসগোল্লা। একটা প্লেটে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক স্বচ্ছন্দে প্রাতরাশ  করতে পারে। এছাড়া ওদের মশলা ধোসাও বেশ ভালো। আমি অবশ্য খাইনি। মা বাবা খেয়েছিল এবং সেদিন আর দ্বিপ্রাহরিক আহারের প্রয়োজন বোধ করেনি। আলুর পরোটা এবং মুগলাই পরোটাও পাওয়া যায়। যা আমরা ভয়ে কখনও অর্ডার করিনি। তবে ভূলেও ওদের ব্রেড বাটার বা ব্রেড জ্যাম বা কোন স্যান্ডউইচ  অর্ডার করবেন না। বিদিশাদিরা ভেজ স্যান্ডউইচ অর্ডার করে ঠকেছিল এবং আমরা মাখন পাউরুটি। দামের তুলনায় ভয়ানক সাধারণ এবং পরিমাণেও অতি কম।
সমুদ্র স্নান ছিল আবশ্যিক প্রাত্যহিক কর্ম। মাঝে একদিন অমাবস্যা ছিল সেদিন এবং তার পরের দিনের ভরা কোটালে সমুদ্রের রুদ্র  রূপ দেখে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেও তুত্তুরীকে সমলানো যেত না। পিলপিল করে লোক আসত পুণ্যস্নানে।    কিন্তু যত ভিড় বাড়ত সমুদ্র এবং বেলাভূমি ততো নোংরা হয়ে উঠত। জনগন আইসক্রীম খায়, কাঠি ভাসায় সাগরে। মিনারেল ওয়াটারের বোতল তো হরদম ভাসছে। নোংরা প্লাস্টিক ও তাই। মাঝে মাঝে এসে পায়ে জড়িয়ে বিবমিষা জাগায়। একদিন ডাইপার ভাসতে দেখে বিদিশা দি না স্নান করেই পাড়ে বসেছিল। সমুদ্র স্নানে না গেলেও দেবশ্রীদিদের সাততলার ঘরের খাটে হাফ প্যান্ট পরে গড়াগড়ি দিয়ে আড্ডাটাও ছিল অসাধারণ রিলাক্সিং। মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে সমুদ্রকে দেখতাম। কোথাও শ্লেট কোথাও ধুসর, কোথাও নীলচে জেড গ্রীণ। বড় বড় ঢেউয়ের মাথায় ঘন মায়াবী থকথকে সাদা ফেনা। মনে হত স্বর্গে আছি। শুধু তুত্তুরীকে বলতে হত আজ সমুদ্রে নামলে পুলিশে ধরবে তাই নামছি না ।

যখন ভয়ানক ক্ষিদে পেত তখন পাশ থেকে ভজহরি মান্না কেমন যেন সম্মোহিনী জাল বিছাতো। পুরী যাবেন অথচ ভজহরিতে খাবেন না এটা অমার্জনীয় অপরাধ। এই অমৃতের স্বাদের সন্ধান দেবার জন্য আমরা সুকন্যার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ। কলকাতাতেও ভজহরির খাবার খেয়েছি কিন্তু পুরীতে তার স্বাদ অন্তত দেড়গুণ বেশি। বিশেষতঃ মাছের পদ গুলির।  সে পাবদা মাছের ঝালই বলুন বা সর্ষে দিয়ে পার্শে, বা ভেটকি মাছের ঝাল, টাটকা ভেটকি মাছের ফিশ ফ্রাই, তেল কৈ, চিতল মাছ,কাতলা মাছের ঝাল, জাম্বো চিংড়ির মালাইকারি, ডাবচিংড়ি, মাটন ডাকবাংলো সবপদই দেবভোগ্য।  এমনকি শুক্তো, ছানার ডালনা, ঝিঙে পোস্তোর মত নিরামিষ পদ ও তো তুলনারহিত। প্রতিটা মাছ এত টাটকা খেয়ে এক ফোঁটাও শরীর বিগড়োবে না। তবে সবার রাণী ছিল নলেন গুড়ের আইসক্রীম।ছোট প্লাস্টিকের বাটিতে দু স্কুপ আইসক্রীম। মুখে দিলেই খোয়ার অমৃতমধুর স্বাদে চোখ বুঝে আসবে আর নাকে ভুরভুর করবে নলেন গুড়ের সুগ্ধ।  পুরো নেশা ধরে গিয়েছিল সকাল বিকাল ঐ আইসক্রীম খাবার। পুরী হোটেলের খাবার ও মন্দ নয়। ওদের বাটার নান তো বেশ ভালো লাগত।ওদের ফ্রুট কাস্টার্ডের প্রেমে হাবুডুবু খেতাম। কিন্তু ব্যাটারা রোজ বানায় না। ক্যারামেল পুডিং ও বেশ ভালো। চিকেন ভর্তা আর পনির বাটার  মশালাও অতি সুস্বাদু। তবে ওদের চিংড়ি দিয়ে ঝিঙে পোস্ত খেয়ে দেখার দুঃসাহস জোটাতে পারিনি। আর  জাম্বো প্রনে কেমন যেন বাসি গন্ধ ছিল।

বিকাল বেলায় দেবশ্রীদি উজানদের সৈকতে ক্যারাটে অভ্যাস দেখতে যেত। আমরাও সুউচ্ছ বারন্দা থেকে তীব্র কৌতুহল নিয়ে পরিদর্শন করতাম ওদের নানাবিধ কসরত। উজানরা ক্যাম্পে ফিরে গেলে আমরা ঘুরতে বেড়াতাম। স্বর্গদ্বারের বাজার সবসময় বাড়ির পাশের বাজারের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। আমার যেমন কদমতলা বাজারের কথা মনে হয়।  ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় পাড়াতেই তো আছি।প্রতিটা দোকান থেকে সেই একই আন্তরিক সুরে আহ্বান,“দিদি, বড়দি বৌদি, দাদা,  মাসিমা আসেন না।” এবং সাথে সাথেই পিলপিল করে দিদি বৌদি এবং মাসিমারা দোকানে ঢুকেও পরে এবং বিগত বহুবারের মত  সেই একই দ্রব্যাদি কিনে বাক্স বোঝাই করে ফেরে। প্রতিটা দোকানের সামনেই একাধিক রাগী দাদা বা মেসোমশাই বউয়ের মুণ্ডুপাত করে এইসব ছাইভস্ম কেনার জন্য, কি মাসিমারা মহানন্দে কেনাকাটা করে।
পুরীর বাজারের সাথে হরিদ্বারের বাজারে ঘোরা আমার একই রকম বোধ হয়। আদ্যিকালের জামা গুলিই ঝোলানো আছে যা কখনও মাসিরা আমায় কিনে দিত। এখন এলেই তুত্তুরীর জন্য কিনে নিয়ে যায়। সেই একই মুক্তোওলা, যতই বলি কিনব না বাপ মাফ কর, তাও পশ্চাদানুসরণ করে। স্তুপাকৃতি জিভে জল আনা খাজা বা গজার দোকান।শোকেসে শোকেসে রঙবেরঙের কটকী, সম্বলপুরি, ইক্কত, বোমকাই শাড়ি,পাঞ্জাবি, লঙ্ স্কার্ট, চাদরের বাহার। স্তুপাকৃতি পুরীর নানা রকম ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে। হাঁ করে দেখতে বা বলা যায় গিলতে গিলতে যেতাম। মনে হত এই তো বেশ ভালো আছি। না হয় নাই ফিরলাম এই জনাকীর্ণ মহানগরের বিস্বাদ কর্মব্যস্ততায়---

অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি (অন্তিম পর্ব) ২৯ শে মে ২০১৭
আজ আমাদের ফেরার দিন। এতদিন ধরে যাঁরা ধৈর্য ধরে অনির শ্রীক্ষেত্রর ডাইরি পড়ে আসছেন তাঁদের সকলকে অজস্র ধন্যবাদ। লিখে গেছি নিখাদ লেখার আনন্দে। ভাবিনি কেউ সময় অপচয় করে আদৌ তা পড়বেন। না হলে পুরী কে না গেছে? বরং অনেকের কাছেই পুরী দ্বিতীয় ঘরবাড়ি। তবু যে পড়েছেন এবং আমাদের অভিজ্ঞতার সাথে একাত্ম বোধ করেছেন তার জন্য আমি বাস্তবিকই আপ্লুত।
যাই হোক বাকি দিনগুলির আর পুঙ্খানুখ বর্ণনা দিচ্ছি না। মোটামুটি  একই গৎ এ বাঁধা। শুধু দুটি ঘটনার কথা না বললে এই ডাইরি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে--প্রথমটা হল একদিন রাতে জমজমাট ভূতের গল্পের আসর। সম্ভবতঃ সেটা দ্বিতীয় দিন। জম্পেশ নৈশ ভোজের পর আমরা ছয়জনেই পুরী হোটেলের  আঙিনায় গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। ঘড়ির কাঁটা সবে এগারোটা ছাড়িয়েছে। বাইরের শোরগোল সম্পূর্ণ স্তিমিত, আঙিনার আলো গুলিও নিস্তেজ হয়ে ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে আছে। বাইরে  থেকে উত্তাল কালো সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে আর দামাল হাওয়া। বাবাই প্রথম ভূতের প্রসঙ্গ আনল। এতবড় এবং এত পুরাণো হোটেল, নিশ্চয়ই একাধিক ব্যক্তি এখানে মারা গেছেন। কেউ কেউ হয়তো আত্মহত্যাও করেছেন। তাদের প্রেতাত্মা নিশ্চয় আজো এই হোটেল চত্বরে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। বলা মাত্রই একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া মজ্জা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে গেল।  সবাই সমস্বরে আপত্তি করলাম ভূতের গল্প শুনব না। বাবাকে থামায় কে? বাবা নাকি রিশেপশনে কার মুখ থেকে শুনেছে আমাদের ঘরেও এরকম এক বৃদ্ধ বৃদ্ধা একবার ছিলেন এবং বৃদ্ধ হৃদরোগে মারা যান। তারপর নাকি বেশ কিছুদিন ঐ ঘরটা কাউকে দেওয়া হয়নি। মাঝরাতে নাকি এখনও বৃদ্ধ ঘরের দরজা ধাক্কে খোলার চেষ্টা করেন। সত্যি মিথ্যা জানি না সেই মুহূর্তে হাড়ে কম্প দিচ্ছিল আতঙ্কে। তবে সব থেকে ভালো ভূতের গল্প শোনালো দেবশ্রীদি। শরদ্বিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের “পিন্টু”। যাঁরা পড়েছেন জানেন যে পিন্টু ছিল এক নেহাৎ  ভিতু নেড়ি কুকুর। পিন্টুর কাজ ছিল তার মালিকের সাথে শিকারে গিয়ে মরা পাখি খুঁজে বার করা। এক পূর্ণিমার রাতে পিন্টুর মালিক সকলের অনুরোধ উপদেশ নির্দেশ অমান্য করে এক নির্জন জলায় পাখি শিকারে গিয়েছিল। লোকটি ছররা-বন্দুক চালাতেই একটা পাখি ঝপ্ করে একটা ঝোপে গিয়ে পড়ল। পিন্টু দৌড়ল পাখি তুলে আনতে,কিন্তু খানিক গিয়েই দৌড়ে ফিরে এল তার প্রভুর কাছে।আতঙ্কে পিন্টুর সব রোম খাড়া হয়ে গেছে, শারিরীক  বিভঙ্গে সে বারংবার মালিককে অনুরোধ করতে লাগল,“ফিরে চল। ” কিন্তু মালিক নাছোড়বান্দা। পিন্টুকে ভিতু বলে গালি দিয়ে নিজেই অগ্রসর হল সেই কাঁটা ঝোপের দিকে। হঠাৎ দেখল সেই ঝোপ থেকে এক ধপধপে সাদা মূর্তি সেই মরা পাখিটাকে বুকে জড়িয়ে উঠে আসছে, আর তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে রক্ত জল করা এক তীব্র আর্তকান্না “আ-হা-হা”। তারপর কি হল জানতে অনুগ্রহ করে পড়েই নিন। শরদ্বিন্দু অমনিবাসের চতুর্থ খণ্ডে পেয়ে যাবেন। এটুকুই শুধু বলব সেদিন রাতে যতবার ঘুম ভেঙেছে,ভয়ে চোখ খুলিনি। খালি  মনে হচ্ছিল চোখ খুললেই দেখব এক শ্বেত মূর্তি “আ- হা-হা”করে কাঁদছে।

আর দ্বিতীয় ঘটনাটি হল প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পদব্রজে গিয়ে মোহনা দর্শন। গুগল ম্যাপ বলছে পুরী হোটেল থেকে স্টার্লিং হোটেল সাড়ে চার কিমি। স্টার্লিং এর উল্টোদিকে একটু গেলেই ধাওদিয়া নদীর মোহনা। আমরা যখন রওনা দিলাম ঘড়ির কাঁটা সোয়া চারটে সবে টপকেছে। সূর্য দেব মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন যেই রওনা দিলাম ওমনি স্বমহিমায় ফিরে এলেন। বেশ চড়া রোদে সমুদ্রের লাগোয়া বাঁধানো ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোকোপাম রিসর্টের পর রাস্তায় নেমে এলাম। কারণ ফুটপাথ শেষ। এবার ভাঙা এবড়োছেবড়ো সরু পিচের রাস্তা। আমরা রাস্তা থেকে সটান নেমে গেলাম বালির ওপর দিয়ে সমুদ্রের পাশে। ভেজা বালির ওপর দিয়ে হাঁটছি তো হাঁটছি, আমাদের মতই দু চারজন ভবঘুরে ছাড়া আর কেউ কোথাও নেই। শয়ে শয়ে বালি রঙের কাঁকড়া আমাদের দেখে দৌড়ে গর্তে লুকিয়ে পড়ছিল। আবার কেথাও একঝাঁক কাঁকড়া উঁকি মেরে দেখছিল আপদ গুলো বিদেয় হল কি না। সবে বলেছি এখানে লাল কাঁকড়া পাওয়া যায় না, ওমনি সারি সারি লাল কাঁকড়ার দল কোথা থেকে এসে গুড়গুড় করে গর্তে ঢুকে গেল। জনমানবশূণ্য ভিজে বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে অসাধারণ লাগছিল,  ভাঁটা চলছিল বলে সমুদ্র অনেকটা পিছিয়ে গেছে। এখানকার সমুদ্র মোটেই পুরীর মত দামাল দুরন্ত নয়। বরং বেশ ভদ্র সভ্য । জলের রঙ গাঢ় অথচ স্বচ্ছ জেড্ গ্রীন। জেড্ গ্রীন রঙের ঢেউ গুলি গাঢ় সোনালি বালুকাবেলায় আছড়ে পড়ে দুধ সাদা ফেনা তৈরি করছে।
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়বে পড়বে করছে যখন আমরা গিয়ে পৌছলাম মোহনায়।
মোহনায় পৌঁছে হতবাক হয়ে গেলাম। এই তো দুবছর আগেই এসেছিলাম, বেশ চওড়া নদীর খাত গিয়ে মিশেছিল সাগরে। শুনেছিলাম কাছেই লকগেট। জলস্রোত সেখানে বন্দী। খাত প্রায় শূণ্য। জোয়ারের সময় অল্প অল্প সমুদ্রের  জল মোহনা বরাবর ভিতরে ঢুকে আসে। স্পষ্ট মনে আছে, দেবু আর শৌভিক গোড়ালি ঢোবা জলে নেমে ছবি তুলছিল। তুত্তুরীও চটি খুলে খাতে নেমেছিল, কোথায় সেই খাত? মোহনা বস্তুটিরই আর কোন অস্তিত্ব নেই। উঁচু বালির বাঁধ আড়াআড়ি চলে গেছে সমুদ্র বরাবর। উল্টোদিকে স্বচ্ছ পুকুর। হয়তো মাছ চাষ হয়। জনমানব নেই, কাকে জিজ্ঞাসা করব? দুবছরে কি করে চুরি হয়ে গেল মোহনা? কোথায় হারিয়ে গেল নদী। বালির চরে বসেছিলাম তিনজনে বেশ অনেকক্ষণ। সন্ধ্যা নামার মুখে উঠলাম। আবার কাঁকড়াদের দুষ্টুমি দেখতে দেখতে বালির ওপর দিয়ে হেঁটে ফেরা।
আর কি? এবার ঘরে ফেরার পালা। এবারও আরএসি। এবারও আকুল প্রার্থনা এবং সকলের বার্থ পেয়ে যাওয়া এবং এবারও পে কমিশন চাইতে ভুলে যাওয়া।
(সমাপ্ত)

Sunday 21 May 2017

Throwback


#কণাওতারমেয়েরা
She was a suckling baby, when her mother left... raised by her drunk father and ailing grandmother, who used to curse her mother with every single breath... but she failed to hate her..she prayed that someday her mom would come back....
She had seen her secretly... mesmerized by her beauty.. her charm, her richie rich husband, her beautiful step sister.. who looked like a fairy to her.. she was happy for them.
She grew up... a mediocre girl ... got a descent job... got married to a decent middle class boy... on her wedding she expected her to show up.. with closed eyes she dreamed that her mother was flipping through her veil... getting her ready... but how could she? She wasn't even invited.
Time flies... now she is a mother.. one night land phone rings... she picks it up... someone's weeping on the other side...she begins howling like  an intoxicated wild animal, difficult to tame , all she could say, is "ma kandche" (my mother is crying )

http://amianindita.blogspot.in/2015/07/blog-post.html?m=1

Monday 15 May 2017

সেন দের একদিন


(পর্ব ১)
“পায়েসটা কেমন হয়েছে?” লোভী লোভী চোখে প্রশ্ন করল তৃণা। দিনের বেলাটা যেমন তেমন করে কাটলেও, রাতের খাবারটা ওরা সাধারণত একসাথেই খায়। ওরা অর্থাৎ সোমনাথ, তৃণা, ওদের বছর বারোর পুত্র ঋক এবং বছর সাতেকের কন্যা তনয়া ওরফে মাম্পি।সোমনাথ এক নামি বেসরকারি জীবন বীমা সংস্থায় কর্মরত। তৃণা শিক্ষিকা। ঋক এবং মাম্পি ঠাকুমার হাতেই মানুষ। ঠাকুমা অর্থাৎ রুমেলা দেবী নিজেও শিক্ষিকা ছিলেন। বর্তমানে কন্যার অর্থাৎ তৃণার ননদের বাড়ি কটা দিনের জন্য বেড়াতে গেছেন। তৃণাদের সরকারি স্কুলে গরমের ছুটি পড়ে গেছে। যদিও ঋক মাম্পির বেসরকারি স্কুল এখনও ছুটির নামগন্ধ করছে না।
যাইহোক পরম যত্নে পায়েস বানিয়েছে তৃণা। বর-ছেলে-মেয়ে তিনজনেরই ভীষণ প্রিয়। বানাতে বানাতেই বুঝতে পেরেছে, দুধের তুলনায় চালটা একটু বেশিই পড়ে গেছে আজ। তবু যদি ওদের ভালো লাগে, তাই প্রশ্নটা করল তৃণা।মাম্পি এঁটো মুখেই চকাস করে মায়ের বাজুতে একটা চুমু খেয়ে দুআঙুলে দেখালো, “এক্সেলেন্ট”। সোমনাথ মাথা নেড়ে শারীরিক বিভঙ্গে বোঝাল, “গুড”। ঋকের সঙ্গে সন্ধ্যাবেলাতেই এক চোট ধুন্ধুমার হয়ে গেছে মায়ের, ফলে এমনিতেই চটে ছিল, মাথা নিচু করে চামচ নাড়তে নাড়তে গোঁজ হয়ে বলল, “ভালোই। তবে ঠাম্মার মত নয়।“
মুহূর্তের মধ্যে গোলাপি মুখটা ব্যথায় কালো হয়ে গেল তৃণার। ভালো হয়নি বললেই পারত। তাই বলে ঠাম্মার সাথে তুলনা? সোমনাথ মাথা নেড়ে বলল, “না।না। ভালোই তো হয়েছে।“ ব্যথা পরিণত হল নিদারুণ ক্ষোভে, সেখান থেকে পলকে জন্মালো দুর্নিবার ক্রোধ। গলায় বিষ ঢেলে তৃণা বলল, “থাক। আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না।“ “যাঃ বাবা!! ভালো কথাই তো বললাম?” হতভম্ব হয়ে বলল সোমনাথ। “ অত ভালোর দরকার নেই বুঝলে। বাঙালরা নাকি আবার ভালো হয়?” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল তৃণা। “এর মধ্যে বাঙাল ঘটি এল কোথা থেকে? আর তাছাড়া তোমার বাবা তো জেনে শুনেই আমাদের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন না কি? বৈদ্য ঘটি সুপাত্র জোটে ইয়ে মানে পাননি তাই।“ মুখ ফসকে বলে ফেলেই প্রমাদ গুনল সোমনাথ।
“ও আমার বর জুটছিল না? তুমি দয়া করে বিয়ে করে আমার বাপকে উদ্ধার করেছ নাকি?” ঝগড়া গড়ালো কান্নাকাটিতে। ক্ষণেক পর আবার ঝগড়া, আবার কান্নাকাটি। মায়ের হয়ে বরাবরের মত গলা ফাটালো মাম্পি, বাবার হয়ে ঋক। ডাইনিং রুম হয়ে দাঁড়ালো যুদ্ধক্ষেত্র। ভাইবোনের এক প্রস্থ হাতাহাতির পর, মাম্পিকে নিয়ে স্টাডিরুমে খিল লাগালো তৃণা।ঋক শুলো বাবার সাথে বেডরুমে।
শুয়ে শুয়ে গজগজ করতে লাগল মাম্পি। “দাদাটা খুব বাজে ছেলে মা। একদম বাবার মতো। তুমি বাবাকে ডিভোর্স করে দাও। কেন বিয়ে করেছিলে এমন বাজে লোককে।“ তৃণার মাসতুতো ভাই আর সোমনাথের খুড়তুতো বোনের সাম্প্রতিক বিবাহ বিচ্ছেদের দরুন ডিভোর্স শব্দটা মাম্পি ঋকের কাছে অপরিচিত নয়। মাম্পি বলেই চলেছে, “ চলো বাবাকে ডিভোর্স করে তুমি আর আমি দাদান-দিদানের কাছে গিয়ে থাকি? অ্যাঁ মা?”মাম্পি দাদু-দিদা অন্ত প্রাণ। বাবা মায়ের ঝগড়া হলেই ডিভোর্সের প্রস্তাব দেয়। যাতে মা, দাদুদিদাকে এক সাথে পেতে পারে। তৃণা মেয়ের শুকনো ঠোঁটে চুমু দিয়ে ভাবতে লাগল, সত্যি যদি বিচ্ছেদ চায়? সোমনাথ আপত্তি করবে না, এটুকু নিশ্চিত। মাঝে মাঝেই তো বলে, আজও বলল, “না পোষালে চলে যাও।“ এতদিন ভাবত, ঝগড়ার সময় রাগের মাথায় বলে, আজ ভুল ভাঙল। চলেই যাবে তৃণা। কিন্তু একার মাইনেতে চলবে কি? দুদুটো বাচ্ছার পড়াশোনা, ভবিষ্যৎ। সোমনাথ কিছু তো দেবে? নিতে যতই ঘৃণা লাগুক, ও নেবেই। কিন্তু থাকবে কোথায়? দুদুটো বাচ্ছা সমেত ডিভোর্সি মহিলাকে কে বাড়ি ভাড়া দেবে? বাবা মার কাছে থাকা যাবে না। আত্মীয়স্বজন তাহলে আর বাঁচতে দেবে না। সবার কাছে কি যে খোরাক হবে, অনেকেই উল্লসিত হবে, ওর সর্বনাশের খবরে। আসলে সবাই খুশি হবে, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীবৃন্দ কে হবে না? বলবে বড় বাড় বেড়েছিল, পয়সার দেমাক, রূপের দেমাক সইল না তো? অথচ ঈশ্বর জানেন তৃণার কোন দেমাক নেই। সহকর্মীরা নির্ঘাত তৃণার পুরানো ভেঙে যাওয়া প্রেমের উপাখ্যান বিশ্লেষ করে বলবে, “তৃণা বউ মেটিরিয়ালই নয়। ফুলে ফুলে মধু খাওয়া টাইপ। অথবা সোমনাথের নির্ঘাত কোন অ্যাফেয়ার চলছে?” অ্যাফেয়ার? সোমের ভাবতেই হাসি পায় তৃণার। ঈশ্বর জানেন ওরা কতটা ভালোবাসে একে অপরকে। আচ্ছা বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও সোম ওর বন্ধু থাকবে তো? সোমের থেকে ভালো বন্ধু তো তৃণার কেউ নেই, কোনদিন ছিল না। সমস্যায় পড়লে তৃণা কাকে ফোন করবে? সোমকে করলে সোম ধরবে তো? এত বড় সহমরমী তৃণা আর কি কাউকে কোনদিন পাবে? ভাবতে ভাবতেই ঘুমন্ত মেয়েকে জড়িয়ে হুহু করে কেঁদে ফেলল তৃণা। সোম না থাকলে সমাজের কুকুর বেড়াল গুলো ওকে ছিঁড়ে খেতে আসবে, সব থেকে বড় কথা, ওকি সোমকে ছেড়ে থাকতে পারবে? রাতে সোমকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে না শুলে, সোমের গায়ের গন্ধ নাকে না এলে যে তৃণা ঘুমোতে পারে না। কি হবে?
সেন দের একদিন (পর্ব- ২)
রাগের থেকে বিরক্তি লাগছিল সোমনাথের। মধ্য চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছেও তৃণার এই ছেলেমানুষি গুলো আর নেওয়া যাচ্ছে না। কবে সোমনাথের ঠাকুরদার বাবা কর্মসূত্রে এপাড়ে বাসা বেঁধেছিলেন, দেশভাগ তখন দূর অস্ত। ঠাকুরদা, বাবা সবার জন্ম এ দেশে।ঠাকুমা বর্ধমানের মেয়ে ছিলেন, বোনের বিয়ে হয়েছে ঘটি বাড়িতে আর মা আর তৃণা এখনও ঘটি বাঙাল নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। মা শুরু করে, তৃণা ঘরে এসে ধুন্ধুমার বাঁধায়। আর আজ তো মাও ছিল না। আগামি কাল শনিবার, কোথায় এক পাত্র নিয়ে বসবে, সারা সপ্তাহের না বলতে পারা অজস্র কথা জমে আছে দুজনেরই, তারপর একটা বই পড়বে, শোবার আগে আর এক পাত্র, সব ঘেঁটে দিল মেয়েটা ধুৎ। বইটা নিয়ে শুয়েছে অবশ্য, তবে একটা পাতাও শেষ করতে পারেনি, মাথায় হয়তো ঢুকতও, যদি ঋক বকবকটা থামাতো।

“বিলিভ মি বাবা, শি ইজ জাস্ট হরিবল্। আমাকে কথায় কথায় বলে, বাবামা মুখের রক্ত তুলে বড় করবে, আর তারপরই নাকি আমি ভালো চাকরি পেয়ে ফুড়ুৎ--। বিয়ে করলেই নাকি আমি আর তোমাদের চিনতে পারব না। পর হয়ে যাব। আর বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসব। ব্লা ব্লা ব্লা। ক্যান ইউ ইম্যাজিন?” চরম বিরক্তিতেও হেসে ফেলল সোম। তৃণার কল্পনাশক্তি তুলনাহীন। অবশ্য এই সব কথাই ওর মাও ওকে বলেছে কখনও না কখনও। এ গুলো হল টিপিক্যাল বাঙালি মায়েদের ইন্সিকিউরিটি। তৃণা ঋককে অসম্ভব ভালোবাসে বলেই, সর্বদা হারিয়ে ফেলার আতঙ্কে থাকে। মাম্পিকে নিয়েও ত্রাসে থাকে তবে তা অন্যরকম আতঙ্ক। ভালো তো সোমনাথকেও বাসে তৃণা, মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা, তাই এত আঘাত করে। মেয়েরা যে কেন এমন হয়? যাকে ভালোবাসে তাকেই আঘাত করতে ভালোবাসে। তৃণার আঘাতে অবশ্য বিরক্তি ছাড়া আর কোন বেদনাই বোধ হয় না সোমনাথের।

ঋক বাবার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এল, “ তুমি কি করে সহ্য করো বাবা? ঐ জন্যই তো অমুক নায়ক এবং তমুক গায়ক আর গেটিং ডিভোর্সড। অমুক খেলোয়াড়ের ও শুনছি জলদি ডিভোর্স হতে চলেছে। এভাবে থাকা যায় নাকি? রোজ রোজ ঝামেলা করার থেকে একেবারে আলাদা হয়ে যাওয়া ফার বেটার। কি বলো বাবা, অ্যাঁ? আই তো হ্যাভ ডিসাইডেড, আমি বিয়ে করছি না। রোজ রোজ মায়ের সাথে খিটপিট খিটপিট কে সইবে? তবে বাবা বুঝলে লিভ ইন ব্যাপারটা মন্দ নয়।“ সোমনাথ দড়াম করে বই বন্ধ করে হাঁ করে ছেলের দিকে তাকালো, ঋক করুণার দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “লিভ ইন ইউ নো। বিয়ে শাদি না করেও একসাথে থাকা। পোষালে থাকো না পোষালে বাইবাই। তবে একটা স্টেডি গার্ল ফ্রেন্ড চাই। মধুজা টাইপ।“

“বাপরে। এত কিছু শিখলি কোথায় রে? মধুজা টাইপ অ্যাঁ? তাই জন্যই মা বলছে কদিন ধরে ছেলেটা গোল্লায় গেছে তুমি একটু দেখো। মধুজার বাবামায়ের থেকে যদি একটা কমপ্লেন এসেছে, বা স্কুল থেকে, আমি তোমার ছাল ছাড়িয়ে ডুগডুগি বানাব। মাও বাঁচাতে পারবে না। বাবা মায়ের ডিভোর্স? অ্যাঁ? স্টেডি গার্ল ফ্রেন্ড অ্যাঁ? মধুজা? অ্যাঁ? চল মায়ের কাছে----“। চরম নাস্তিক হয়েও মনে মনে  ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালো সোমনাথ। এই সুযোগ ছাড়া চলবে না। এই সব নিয়ে ঋককে ভিলেন বানিয়ে আগে বউকে তো পটানো যাক, তারপর ঋক কি করল মধুজা না আয়েশাকে পটাল নাকি তাও পারল না ঢ্যাঁড়শ ছেলে টা তাই নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নয় সোমনাথ সেন।

ছেলের কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে স্টাডির দরজায় টোকা দেবার আগেই দরজা খুলে দিল তৃণা। কোলে ঘুমন্ত মাম্পি, কয়েক মুহূর্ত দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল, তৃণার মনে হল, “এত ভালোবাসা! এত ভালোবাসা দিয়েছ প্রভু?” আর সোমনাথ ভাবল, “যাক আজকের মত শান্তি। এখনও সময় আছে, তৃণা যদি খেপে না যায়, এক পাত্র হতেই পারে?”



Monday 1 May 2017

তুত্তুরী উবাচ

তুত্তুরী উবাচ ১২ই মে, ২০২০

রাতের বাসন মাজছি, কন্যার প্রবেশ
 -(আদুরে গলায়)মা, অমুকের(জনৈকা মাতৃস্থানীয়া) গাল গুলো না একদম ট্যারান্টুলা মাকড়সার মত-
-(ধড়াম করে হাত ফস্কে একটা বাটি পড়ে গেল) মানে? উনি তোমায় কত ভালোবাসেন আর তুমি ওণার সম্পর্কে এমন কথা বলছ?
 -(হতবাক হয়ে) কি বলেছি? বলছি তো ওর গালগুলো কি দারুণ ফোলা আর কি রোমশ। 
-ট্যারান্টুলার মত গাল বললে কেউ খুশি হয় না বাবু।
-তাহলে কি বলব? পমেরিয়ান পাপির মত থলথলে রোমশ?
- আরে দূরঃ। কোন মহিলার গাল কখনও রোমশ বলতে নেই।  ওটা প্রশংসাসূচক নয়। বলো না।
-(ভাবিত স্বরে) অ। আমি অনেক ভেবে দেখেছি জানো মা, বাচ্ছাদের জীবনের সবথেকে সুন্দর সময়টাতেই তাদের জ্ঞান থাকে না।
-মানে?
-মানে যখন তারা মায়ের পেটে থাকে, কত ভালো থাকে। সারাদিন খেলে আর ঘুমোয়। (আড় চোখে তাকিয়ে) কেউ পড়তে বসতেও বলে না-
-হুঁ বুঝেছি। এবার ব্রাশ করে চুপচাপ শুয়ে পড়। কাল আবার বেরোতে হবে, বাবা গো।
-(বিরক্ত স্বরে) আরে যাও। যাও। আপিস যাও। আমারও কোনদিন স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। আমি কি তাই বলে ঘ্যানঘ্যান করি?

তুত্তুরী উবাচ ৯ই ডিসেম্বর ২০১৯

শীত যদি পড়ে বৃষ্টি তো পড়বেই裸洛। অঝোরে ঝরবে নাকের পানি। সঙ্গতে ঘঙ্ঘঙে কাশি। চিড়চিড়ে মেজাজ। উষ্ণ বদন। ফলশ্রুতি ইস্কুল কামাই। এবং মায়ের অফিস ও।
এতদসত্ত্বেও কথায় কথায় যথাক্রমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এবং ডুগরে ডুগরে কান্না।
-মাসি খুব বাজে郎। মাসি আমায় চান করাতে গিয়ে আঁচড়ে দিয়েছে। মাথায় নখ ফুটিয়ে দিয়েছে।
-বাবু,মাসি তোমায় সেই পাঁচ দিন-
-(টলটলে দুই চোখে ঝলসে ওঠে রাগ)মোটেই পাঁচ না। সাত দিন।
-(জিভ কাটে মা) আচ্ছা।  সাত দিন। সেই সাত দিন বয়স থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। মাসি কি তোমায় নখ ফুটিয়ে বা আঁচড়ে দিতে পারে? তুমি নিজে বিশ্বাস করো?
-(উদগত্ কান্নার বেগ কিঞ্চিৎ বেড়ে গেল) তুমি আমায় বিশ্বাস করো না蠟? আমার অন্য মাসি চাই।
-আচ্ছা বেশ। তাহলে নমিতা মাসি? (প্রসঙ্গতঃ নমিতা মাসির নামটা বদলে দিলাম বটে,তবে নমিতা মাসিও আমাদের বাড়িতে বছর পাঁচেক তো আছেনই। দিনে দুবার আসেন। ঝাড় মোছ বাসন মাজেন,তুত্তুরীর মাসির সঙ্গে তাঁর সাপে নেউলে সম্পর্ক। দুজনেই দুজনার দোষ ধরেন। সর্বোপরি নমিতা মাসি ভয়ানক নোংরা। ধুয়ে যাওয়া বাসনে হয় এঁটো নয়তো সাবান পাওয়া যায়ই। বলাইবাহুল্য তুত্তুরী মোটেই তার অনুগামিনী নয়। তবে আপাততঃ মাসি ফাঁসির যোগ্য অপরাধ করেছে-। অসুস্থ দুর্বল তুত্তুরীকে স্নান করানোর অছিলায় নখ ফুটিয়ে দেওয়া? এক্কেবারে ক্ষমার অযোগ্য। কি বলেন?
ফর্সা ঈষৎ মলিন দুই গণ্ড বেয়ে টপটপ করে ঝরছে মুক্তোর দানার মত অশ্রু বিন্দু। এরই মধ্যে আসছে মায়ের ফোন। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফোঁপানি। বুঝলাম খিদে পেয়েছে। প্রায় জোর করে খেতে বসতে এবং বসাতে হল। একা খাবে না কি তুত্তুরী? শেষে হয়তো বলেই বসবে, আরেকটা মা চাই। 
খেতে বসেই কান্না।
-আমি নাক টানতে পারছি না কেন? ও হো হো। আমার খিদে নেই। এত ভাত দিচ্ছ কেন? ও হো হো। বাবা আমাকে বেশী করে খেতে বলে গেছে। আমি কেন খেতে পারছি না? ও হো হো হো। ভাতের নাম দাও। তবে খাব। ও হো হো হো।
ভাতের নাম? আজ্ঞে হ্যাঁ।  কোন অদূর শৈশবে,শনি-রবিবার যখন তুত্তুরীকে স্বহস্তে খেতে শেখাতাম, ভাত মেখে গাল পাকিয়ে সাজিয়ে রাখতাম চক্রবূহ্যে। তারপর হত তাদের নামকরণ। কখনও কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী অবধি রাজ্যের নামে নাম হত তাদের। কখনও তারা হত কালানুক্রমে মহান ভারতীয় সম্রাটগণ যথা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বা অশোক থেকে ঔরঙ্গজেব। আবার কখনও কোন গল্পের চরিত্র। একঢিলে মারা পড়ত অনেক পাখি। পেট ও ভরত, উপরি পাওনা ইতিহাস ভূগোল বা সাহিত্যচর্চা‍। তাই বলে এই বুড়ো বয়সে? তাই সই। প্রথমে গরম ডাল আর কচি বেগুন ভাজা মাখা ভাতের নাম হল পঞ্চপাণ্ডবের নামে। সাথে জুটলেন দ্রৌপদীও। আমি নামকরণ করার পরও, দুষ্টু পাণ্ডবরা থালায় ছোটাছুটি করে বদলে ফেলল স্বঅবস্থান। এবার চিনব কেমন? চিনতে পারবে কেবল তুত্তুরী।
- কি রে কাকে খেলি?
-উরে বাবারে। মুখের মধ্যে গদা ঘোরাচ্ছে গো। এই ভীম! দাঁড়া! তোকে কচকচিয়ে খাব। ব্যাটা।
(পরের গ্রাস)মা, মুখে তীর ফোটাচ্ছে! এটা অর্জুনই হবে বলো? (পরের গ্রাস) মা নকুলকে চিনব কি করে?
-পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে নকুল সবথেকে রূপবান ছিল।
-হুঁ তাই দেখি। এ এত জামাকাপড়- সাজের জিনিস নিয়ে ঢুকেছে। ভালো করে চিবোই ব্যাটাকে।  আর সহদেব কি পারত মা?
-বোধহয় বল্লম চালাতে পারত।
-হুঁ। তাই বলি। এই গালে এত কি ফুটছে। অর্জুনের তীর অনেক সূক্ষ্ম ছিল। এ ব্যাটা তো হেবি মোটা। উ হুহু। দ্রৌপদী বলছে ও একটা স্পাউজ নিয়ে মুখের মধ্যে ঢুকবে।
- আর কি স্পাউজ বাকি আছে? সব তো তোর পেটে।
- কর্ণ আছে না? (আলু ফুলকপির তরকারী থেকে একটি ফুলকপির ন্যাজ ধরে টেনে তুলে) এই দেখো কর্ণের রথের চাকা।
-টেকনিক্যালি বাবু,কর্ণ ওর স্পাউজ নয়।
-ওঃ। ঐ ভাতটা খাব না। মাছের ঝোল মাখছ কেন? কে খাবে? আমি তখনই খাব যদি ওদের নাম দাও।
- আমার নামের ঝুলি খালি। তুইই দে। কৌরবদের নামে দে।
-আমি কৌরবদের বেশী লোককে চিনি না। 類
-যাদের চিনিস তাদেরই নামে দে। আমি কৌশিক মামার ফোনটা ধরে আসি। ইমপর্টান্ট।

ফোন সেরে বেরিয়ে দেখি,থালা জুড়ে কুরু বংশের রথী মহারথীগণ যুদ্ধে ব্যাপৃত। দুঃশাসনকে শাসন করতে একটু বেশী চিবানো হচ্ছে। দুঃশাসন ছাড়ুন,কন্যার দাঁতের নিরাপত্তা নিয়ে কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন বোধ করলাম। যে হারে কটাং কটাং করে চিবানো হচ্ছে। দেখলাম কর্ণ পুনরায় ফিরে এসেছেন কৌরব শিবিরে এবং সর্বোপরি রুই মাছের পেটিটি হয়েছে পিতামহ ভীষ্ণ। কাঁটা গুলি তাঁর শর শয্যার শর। আর মাছের ছালটি তাঁর ধুতি। মারাই যখন গেছেন আর- ইয়ে মানে ঐ আর কি।
উফ্ কে যেন বলেছিলেন,মা হওয়া কি মুখের কথা? হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, ভগবান।

তুত্তুরী উবাচ, ৪ঠা ডিসেম্বর ২০১৯

-মা, তোমার নতুন লিপ বামটা একটু লাগাব?
-লাগিয়ে দিলাম তো একটু আগে-
- না,আমি নিজে লাগাব।
-একদম না।
-কেন?
-কারণ, আগেরবার একটা গোটা লিপ বাম তুমি খেয়ে নিয়েছিলে।
-অ। সেটা মিষ্টি মিষ্টি ছিল। আমি শুধু নিভিয়ার লিপবাম খাই। মেবিলিন খাই না। 

[গপ্পটা হল,২০১৬সালের কথা (সাল তারিখ তুত্তুরীই ধরিয়ে দিল) শীত পড়ার মুখে মেয়ের খুব ঠোঁট ফাটছিল বলে,ওকে এক টিউব লিপবাম কিনে দেওয়া হয়। শুধু ও ব্যবহার করবে। পরের রাতেই তিনি নিখোঁজ হন। খোঁজাখুজি,ধমক ধামকের পর দলামোচড়া টিউবটা দিনচারেক পর বের হয়। আমাদের ধারণা ছিল ঐ টিউবটি ও রেড্ডিকে মাখিয়েছিল। রেড্ডি একটি রক্তিম বর্ণা তুলোভরা পুতুল ছিল। যাকে তার কদিন আগেই তুত্তুরী এক কৌটো বোরোলীন মাখিয়েছিল। এই নিয়ে মাসি বকতে যাওয়ায় মাসিকে শুনতে হয়,“পুতুল বলে কি রেড্ডি মানুষ না?ওর কি শীত লাগে না? গা ফাটে না?” পরে অবশ্য জানা যায়,বেচারা রেড্ডি নির্দোষ ছিল।]
তুত্তুরী উবাচ-২৮শে নভেম্বর, ২০১৯
-মা জানো, আজ মিস আয়ুষীকে আমাদের পিছন বেঞ্চে বসতে পাঠিয়েছেন।
-ও। তা সেটা ভালো না খারাপ?
-হুঁ। ভেবে দেখতে হবে樂। ভালই বোধহয়।  এতদিন তো আমাদের পিছনে কেউ বসত না-
-মানে? তুই লাস্ট বেঞ্চে বসিস নাকি?廊
-হ্যাঁ। তুমি আর সঞ্চিতা মাসিও তো তাই বসতে?(উঃ ভগবান, কি কুক্ষণে যে নিজেদের মেয়েবেলার গল্প শুনিয়েছিলাম-郎)
-শোনো না মা, আমাদের স্কুলের পাশেই যে বাড়িটা আছে না, ওরা আজ মাটন রাঁধছিল। কি ভুরভুর করে গন্ধ আসছিল-। অমুক মিস তো বেশ কয়েকবার ঐ দিকে তাকিয়ে নাকই টেনে নিল। মানে ঐ স্নিফিং আর কি-
- মিস নাক টানল? আর তোরা কি করছিলি?
-আমরা? আমরা তো চুপটি করে বসেছিলাম। দেখলাম,মিস নাক টানল,জিভ চাটল, তারপর বলল- “এই যা তো,জানলার গ্রীল কেটে ওবাড়ি থেকে একবাটি মাটন নিয়ে আয় তো।”
‍♂️-(বাবা গম্ভীর মুখে রুটি চিবুতে চিবুতে)হুঁ আনতে বলল,মাটন। এল বিফ। (বিফ অর্থাৎ গৌরি। তুত্তুরীর কাল্পনিক গরু। যে সবসময় লতাপাতায় ঘুরে বেড়ায়)
- না গো মা সত্যি। তোমরা তো কিছুই বিশ্বাস করতে চাও না। জানো আজ আরও কি দেখেছি? দেখলাম মৌমিতা মিস আমাদের কাঁচিটা ব্যবহার করে কাগজ কাটছে। (“আমাদের কাঁচি” হল একটি ছোট স্টিলের কাঁচি,যেটিকে হাতের কাজ পরীক্ষার দিন তুত্তুরী স্কুলে হারিয়ে এসেছে। তুত্তুরীর যদিও বক্তব্য মিস ঐটি কেড়ে নিয়েছেন)
-ওটা আমাদের, কি করে বোঝা গেল?樂
-হ্যাঁ মা আমাদেরটাই। মিসের তো একটা লাল কাঁচি ছিল। আমাদের কাঁচি নিয়ে নেওয়া?দাঁড়াও আমিও একদিন চুপচাপ ঐ কাঁচিটা নিয়ে চলে আসব। (প্রসঙ্গতঃ তারপর আমাদের বাড়ি তিন তিনটি কাঁচি কেনা হয়েছে। আর কাঁচি রাখার জায়গা নেই-濫)
-ছিঃ বাবু। না বলে পরের জিনিস নেওয়াকে কি বলে?
-(মাথা নীচু করে) চুরি। 
‍♂️-(বাবা, নিরাসক্ত মুখে রুটি চিবুতে চিবুতে)কিন্তু না বলে নিজের জিনিস ফেরৎ নিয়ে নেওয়াকে চুরি বলে না।
তুত্তুরী ও বিশ্বকাপ ২ ১৬ই জুন ২০১৮
-বাবা বিশ্বকাপ পাঁচ বছর পর পর হয়?
-(বাবা খেলা দেখতে দেখতে) নাঃ। চার বছর। আগেরটা ২০১৪এ হয়েছিল।
-হ্যাঁ আমার মনে আছে। মা বলতো যা বাবার সাথে গিয়ে খেলা দ্যাখ। আর তুমি বলতে যা মাকে গিয়ে জ্বালাতন কর। আর আমি ভাবতাম ওয়ার্ল্ড কাপটা কি রে বাবা? একটা কাপের মধ্যে পৃথিবীটা কি করে ঢুকবে?কাপটা তো ছাতু হয়ে যাবে।
(কিছুক্ষণ পরে)
-মা আমি ইজিপ্টকে সাপোর্ট করছি, তুমি কাকে?
-ইন্ডিয়াকে।
-আহাঃ ইন্ডিয়া তো খেলছেই না। একবার বাবা আর আমি ইন্ডিয়াকে সাপোর্ট করেছিলাম জানো তো, সেবার পাকিস্তান প্রাইজ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।  তুমিও বরং ইজিপ্টকেই করো। ইজিপ্টে পিরামিড আছে। মমি আছে। উরুগয়ায় ওসব নেই। এর আগে নামই তো শুনিনি।

(কিছুক্ষণ পর)
-মা মরোক্কো  কি ইন্ডিয়াতে?
-না।
-তাহলে ইরান?
-না।
-কোনটাই ইন্ডিয়াতে নয় ঠাকুর। তাহলে আমি ইরানকেই সমর্থন করি? মরোক্কোর লোকগুলোর দাড়ি এবং টাক আছে।আর ওরা বড্ড মারামারি করছে। খালি ইরানের খেলোয়াড়দের গুঁতো মারছে।  চিটিং কি না বলো?
(আরো কিছুক্ষণ পর প্রবল চিৎকার) মার। মার। মার। পা দিয়ে না পারিস মাথা দিয়ে মার। গোলকিপারের মাথায় মেরে ওকে অজ্ঞান করে দিতে পারলেই তো গোল। মারঃ। ইয়েস্ গোওওওল।
-(বাবা পাশ থেকে বিরক্ত হয়ে)কিসের গোল?ওটা তো আত্মঘাতী  গোল। সেমসাইড।
- যাই হোক গোল তো বটে। মমি স্পেন আর পর্তুগালের মধ্যে আমি এস্পানিয়াকে সাপোর্ট করব। তুমিও কোরো প্লিজ। আর কাল আর্জিণ্টিনা আর আইসল্যান্ডের ম্যাচে যেন আইসল্যান্ডই জেতে ঠাকুর। বাবার টিম যেন না যেতে।
- বাবু বাবার সামনে এসব বলিস না। বাবার মুখের চেহারা দেখছিস? মেরেই দেবে এবার।
-(বাবা তাচ্ছিল্যের সাথে) তা নয়। অন্য টিমকে সাপোর্ট করাটা অন্যায় নয়। তবে পাশে বসে রানিং কমেন্টারিটা বন্ধ করলে ভালো হয়। শুতে যা।
-সেই ভালো ঘুমিয়ে পড়ি। কাল খেলা দেখব। আইসল্যান্ডের লোকগুলো কোট পরে খেলতে নামবে।
-(বাবা হতভম্ব  হয়ে) খামোকা কোট পরে খেলবে কেন?
-বারে? আইসল্যান্ডে খুব ঠাণ্ডা না?
   
তুত্তুরী ও বিশ্বকাপ ১৪ই জুন ২০১৮
-মা তুমি কার সাপোর্টার? রাশিয়া না আর একটা কি যেন দেশ খেলছে?
-সৌদি আরব বোধহয়।
-হ্যাঁ। তুমি কাকে সাপোর্ট কর মা?
-কাউকেই নয়। আমি কি খেলা দেখছি?
-ও হোঃ। বাবাও বলল কাউকে না। তবুও খেলা দেখছে। (দুঃখ দুঃখ মুখে) মা, রেফারিটা আর্জেন্টিনার। ব্রাজিলের নয়।
-যাঃ বাবা, রেফারি  কোন দেশের তাতে কি আসে যায়?
-তুমিই তো সেদিন বললে, দাদু ব্রাজিলকে সাপোর্ট করে তাই তুমিও- আমিও তোমার দলে,ব্রাজিলকেই সাপোর্ট করি মমি। বাবা খালি আর্জিণ্টিনা।
-(বাবা খেলা দেখতে দেখতে তেতো গলায়) মেলা ভ্যাজোর ভ্যাজোর করিস না তো।
-(বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর) বাইশ জন লোকের একটা বল নিয়ে লাথালাথি করাটা কি ঠিক? বলো মা? আর ঐ লোকটা খামোকা গোল আগলে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
-(বাবা হতভম্ব স্বরে) আরে ওটাইতো ওর কাজ। ও তো গোলকিপার।
-(আবার কিছুক্ষণ পরে)  মাথা দিয়ে বলটাকে মেরে গোলকিপারের মাথাটা ফাটিয়ে দিলেই তো বলটা গোলে পৌছে যাবে। তাহলেই তো গোল।
-(বাবা বিরক্ত হয়ে) উফঃ।
-(বাবাকে মুখ ভেঙিয়ে আমার দিকে ফিরে আদুরে গলায়) গোলকিপারের মাথা ফাটালে ওকে লালকার্ড দেখাবে না তো? রেফারিটা আবার আর্জিণ্টিনার (শ্লেষাত্মক ভঙ্গীতে)।

তুত্তুরী উবাচ ২রা মে ২০১৯
-মা, মে দিবসে কি হয়েছিল গো? ঐদিন বিদ্যাসাগর মেয়েদের অনেক সম্মান দিয়েছিলেন?
-(বাবা পাশ থেকে ব্যঙ্গের সুরে) ওটা মেয়ে দিবস নয় রে হোঁদল-কুৎকুত। মে দিবস। মে মানে মাস। ঐ দিনে অনেক কিছু হয়েছিল, একটু লেখাপড়াটা শেখ তবে না জানতে পারবি।
-(খানিক ভাবনা চিন্তা করে) তুমি আমাকে অশিক্ষিত বললে নাকি?
-(বাবা) অশিক্ষিত না হলেও কোন মতে সাক্ষর তো বটেই।
-(বাবাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে) মা, বিদ্যাসাগর মেয়েদের বেশী সম্মান দিয়েছিলেন না রামমোহন রায়?
-(বাবা একগাল হেসে)এটা কি মায়ের ওজন নাকি যে তুলাদণ্ড দিয়ে মেপে বলবে।  হেঁ হে মানে বলছিলাম আর কি- (এরপরের গৃহযুদ্ধটা একান্তই ব্যক্তিগত )

তুত্তুরী উবাচ ২১শে এপ্রিল,২০১৮
-মা খেতে বসে তোমরা খালি নিজেদের মধ্যেই কথা বল, আমার কথাটা কেউ শুনছ না।
-আচ্ছা বল। কি বলবি।
-রোজ তো তুমি আমায় অঙ্ক করাও,আজ আমি তোমাকে একটা অঙ্ক করতে দি বরং।  মেন্টাল ম্যাথ কিন্তু মা। খুব শক্ত। খাতা পেন্সিল ব্যবহার করতে পারবে না।
-সে তো এঁটো হাতে এমনিই পারব না।
-হুঁ। তবে থালায় আঙুল দিয়ে হিসেব কষতে পারো।
-(বাবা, অধৈর্য স্বরে) উফ্! এত ভ্যানতাড়া না করে, প্রশ্নটা বরং করেই ফেল। মা কি ভাবে করবে, মা বুঝবে।
-হুঁ। খুব শক্ত কিন্তু মা। তুমি মনে হয় পারবে না।
-ছেড়ে দে। তাহলে আর বলে লাভ নেই।
-বাঃ। তাই বলে চেষ্টা করবে না? আমাকে যে বলো,চেষ্টা করলে সব হয়। তুমিও চেষ্টা করেই দেখো না। 
-(মা, ক্লান্ত স্বরে)ওরে বাবা রে। হয় কর, নয়তো ছাড়।
-করছি। করছি। বলো তো, আমি যদি এক হাতা চাউমিন খাই, তুমি যদি দুই হাতা চাউমিন খাও, তাহলে বাবা ক হাতা চাউমিন খাবে?


তুত্তুরী উবাচ ১৯শে এপ্রিল, ২০১৮
-একি রে? প্লাস্টিকের ব্যাঙটাকে এক বালতি জলে ডুবিয়ে রেখেছিস?
-(কার্টুনের মত হেসে উঠে)হিঃ হিঃ। হ্যাঁ মা। যাতে ও জলে ভাসতে শেখে। সাঁতার কাটতে শেখে।
-বাঃ। কি অসাধারণ বুদ্ধি। প্লাস্টিকের ব্যাঙকে এক বালতি জলে চুবিয়ে সাঁতার শেখানো।
-(পাশ থেকে বাবা,নিস্পৃহ স্বরে) আর আমার সাথে যা করেছে, সেটা যদি বলি তো মা তোকে কেটেই ফেলবে।
-(মা-মেয়ে দুজনে সমস্বরে) কি? কি করেছে/করেছি?
-(বাবা রহস্যময় স্বরে) আমার অফিস পরে যাবার কচি কলাপাতা সবুজ শার্টে কে ফেভিকল মুছেছে?
-(মা রাগত স্বরে)সে কি রে?বাবার অফিস যাবার জামায় ফেভিকল?
-(ভিজে বেড়ালের মত মুখ করে)হ্যাঁ। তুমিই তো সকালে বাবাকে বলছিলে, ঐ জামাটা এবার বাতিল কর। বালতি কিনব। বাবা শুনল না। তাই আর কি-
-(মা রাগত স্বরে) তো তাতে ফেভিকল লাগাবি?
-(ভাজা মাছটি উল্টে না খেতে জানা নিষ্পাপ মুখে) না মা। লাগাতে চাইনি। সত্যি। টেবিলে বোতলটা উল্টে গিয়েছিল তো, তাই ভাবলাম-(ঢোঁক গিলে) তুমি বকবে, তাই হাতের কাছে যা পেলাম তাই দিয়ে মুছেদিলাম।
-(বাবা একঘড়া কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন পূর্বক) তাই বলে আমার দামী শার্ট?ভেউ, ভেউ,ভেউ।
-(একপ্রস্ত বকুনি খাবার পর রাগত স্বরে মায়ের উদ্দেশ্যে)খালি বকা আর বকা। সকাল থেকে আমি কত কাজ করি, ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাই, আর তুমি?খালি অফিসে গিয়ে চেয়ারে পা তুলে বসে সবাইকে বকাবকি করো। (মাকে নকল করে,ডাইনিং চেয়ারে বসে)প্রীতি এটা কই?কৌশিক এটা কেন হয়নি?অরিন্দম ফোন কর। (মুখ বেঁকিয়ে )হুঃ। বাড়িতেও বকো। অফিসেও বকো।
-বেশ করি। বকার জন্যই মাইনে পাই তো।
-(সিরিয়াস গলায়)সত্যি মা?বকার জন্য টাকা পাওয়া যায়?
-হঁ। পাই তো। মাইনে।
-কে দেয়?মূখ্যমন্ত্রী?
-হুঁ। তা বলাই যায়।
-কত টাকা দেয় মা?পনেরো ষোল টাকা?
-অা না, তার থেকে একটু বেশীই দেয়।
-ও হ্যাঁ। তুমিতো অনেক লোককে বকো। তাহলে কত দেয় মা?দু-তিন কোটি?
-(বাবা পাশ থেকে ফোড়নের সুরে)তোর মা যে রেটে বকে, আরটু বেশীই দেয় বোধহয়, না রে?
   
তুত্তুরী উবাচ ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২০১৮
-(খাবার টেবিলে) মা একটা গল্প বলি শুনবে?
-বল।
-একটা শৌভিক বলে লোক ছিল। (বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি,বাবা একমনে রুটি চিবিয়ে যাচ্ছে,পাত্তা না পেয়ে আবার মায়ের দিকে ফিরে) সে একদিন অনিন্দিতা বলে একজনকে বিয়ে করল, আর তাদের একটা মেয়ে হল। তার নাম বুজু। বুজুর মা এই একটু চাষটাস করে আর কি)
-(বাবা গম্ভীর ভাবে) কোথায়?
-এই বারন্দাতেই করে (কাঁধ ঝাঁকিয়ে) তো যা বলছি,রোজ তোতাপাখি এসে বুজুর মায়ের ভুট্টা খেয়ে যায়। আর বুজুর মা চিৎকার করে,“দাঁড়া। ধরতে পারলে, ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন দেখিয়ে দেব। ”
-(বাবা গম্ভীর ভাবে উল্টোদিক থেকে আমাকে) তুই কি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে চিনিস?)
-(কোন মতে হাসি চেপে অভিমানী ঠোঁট ফোলানো মেয়ের উদ্দেশ্যে বললাম) বাবার কথা ছাড়, তুই বল।
-হ্যাঁ যেমন বাবা রোজ মশাগুলোকে বলে না?ধরতে পারলেই ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন দেখিয়ে দেব?তেমনি বুজুর মাও বলত। একদিন একটা লেপার্ড-
-(বাবা হতভম্ব হয়ে) লেপার্ড আবার কোথা থেকে এল?
-সুন্দরবন থেকে।
-(বাবা ফোঁৎ করে)সুন্দর বনে লেপার্ড?
-হুঁ। লেপার্ডটা এসে বলল,“বুজুর মা,এই ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধনটা কেমন একটু দেখাও দিকি?”বুজুর মা তো খুব ভয় পেল, কিন্তু মা দুর্গাকে ডেকে বলল, “ দেখাব। আগে একটা থলে, কিছু মুগুর আর একটা দড়ি নিয়ে এস।” তো বাঘটা মার্কেটে গিয়ে স্টাইলে বলল,“হ্যালুম”।
-(বাবা) আবার বাঘ কোথা থেকে এল?লেপার্ড ছিল তো?
-ও সরি। সরি। লেপার্ড আর বাঘ একই রকম লাগে দেখতে কি না। যাই হোক,ঐ  স্টাইলে হ্যাল্লুম শুনে সবাই পড়ি কি মরি করে কেটে পড়ল। তখন বাঘটা মামুলী থলে না নিয়ে একটা ব্বড় ব্যাগ নিয়ে এল। তারপর গিয়ে কাকাই এর ভারি ডাম্বেলগুলো নিয়ে এল। আর হাওড়ায় গিয়ে বাদলের দোকান থেকে একটা সাদা দড়ি নিয়ে এল।
-(বাবা উপহাসের ছলে)দড়ি আনতে হাওড়া?
-(বিরক্তি সহ) উফ্। খালি বিরক্ত করে বাবাটা। হ্যাঁ বাদলের দোকান থেকে দাদু সিগারেট আর দড়ি কেনে। সেই সাদা সাদা দড়ি যেগুলো পাজামায় পড়ে। হ্যাঁ তো মা, এইসব কিনে বাঘটা তো বুজুর মাকে দিল। বুজুর মাও ওমনি,ব্যাগের ভিতর বাঘটাকে ঢুকিয়ে মুগুর দিয়ে-গদাগুম গদাগুম। বাঘ ও ক্যাঁওম্যাঁওঘ্যাও করছে, প্রবল আওয়াজে নিচে থেকে আন্টি(আমাদের তলার ফ্ল্যাটের কালো মেম আন্টি) ছুটে এল। “অ্যাই হোয়াট হ্যাপেন্ড?”বুজুর মা তখন বলল, দেখতে চাও?তাহলে ব্যাগে ঢোকো। আর যেই না আন্টি ব্যাগে ঢুকল- ওমনি গপ্।
-(বাবা) আন্টি বাঘটাকে খেয়ে ফেলল?
-উফ্ বাবা কি বোকা। আন্টি তো ভেজিটারিয়ান। বাঘটাই-।  তারপর বুজুর মা আবার বাঘটাকে উত্তমমধ্যম দিল। তারপর ধোপা মানে ধোপারা যেখানে কাপড় কাচে, সেখানে ফেলে দিয়ে এল আর সুকন্যা মাসিকে ফোন করে দিল?
-(বাবা)আবার সুকন্যা কোথা থেকে জুটল। তোর মায়ের একা পিটিয়ে সাধ মেটেনি বুঝি?
- আঃ সুকন্যা মাসিই তো বনদপ্তরে খবর দেবে। (প্রসঙ্গত সুকন্যার বর বনদপ্তরের বড় সাহেব) যাইহোক একটা মোটকা ধোপা
-(বাবা)তোর মায়ের থেকেও-
- উফ্ বাবা চুপ। একটা ধোপা ভেবেছে অনেক কাপড় আছে বুঝি, কাচবে বলে যেই দড়ি খুলেছে,ওমনি গপ।
-(বাবা)কে কাকে খেল?
-বাঘ ধোপাকে গপ্।
-(ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা দশের ঘর ছুঁচ্ছে, তাড়া লাগালাম বাপমেয়েকে) আর নয়। এবার মুখ বন্ধ। খাওয়া শেষ করো।
-হুঁ। কিন্তু গল্পটা কেমন হয়েছে বলো?
-(আমি বলার আগেই বাবা গম্ভীর মুখে) ভি ই আর ওয়াই জি ও ও
-(একগাল হেসে)ভেরি গুড বাবা?
-(বাবা) ডি টা তো বলিনি।
-তাহলে?ভেরি গু? তার মানে?মা দেখো বাবা আমার গল্পকে কি যাতা বলছে--
তুত্তুরী উবাচ ২০শে ডিসেম্বর ২০১৭
-বাবা গরুরা খড় খায় কেন?তুমি জানো?
-না।
-হুঁ। একদিন একটা গরুকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে।
-আচ্ছা এবার বাইরে গিয়ে খেলা কর
- (অল্পক্ষণ পরে)কেঁউ কেঁউ কেঁউ কেঁউ
-কি হল রে?কুকুরের ডাক ডাকছিস কেন?
-এই দেখ না বাবা,কুকুর ছানাগুলো দিব্যি আমার সাথে খেলছিল, আচমকা আমার পা থেকে চটিটা খুলে নিয়ে পালিয়ে গেল। বললাম,‘এই ওমন করিস না। দে। দে আমার চটি ফিরিয়ে দে’। কথা কানেই নিল না। ইংরেজীতেও বলে দেখলাম কত কিছু। কিছুই বোঝে না। তাই ওদের ভাষায় বলছি, আমার জুতো ফেরৎ দে। কামড়াস না জুতোটাকে। ছিঁড়ে গেলে মা মারবে-কেঁউ কেঁউ কেঁউ

তুত্তুরী উবাচ ১৮ই নভেম্বর ২০১৭
(কালী পুজোর প্রাক্কালে)
-মামমাম(দিদা) বলছি কি না, যে মহিলা এত গয়না কিনতে পারে,সে একটা শাড়ি কিনতে পারে না? মা কালীর কথা বলছি।
আচ্ছা দাদু মা কালী সবসময় নাঙ্গুপাঙ্গু থাকে কেন বলো তো? দাঁড়াও তোমায় বলতে হবে না, আমিই বলছি,শোন, রাত্রিবেলা মা দুর্গা শোবার আগে গয়না খুলতে গিয়ে মনের ভুলে শাড়িটাও খুলে ফেলেছিল। ঠিক এই সময় শিব এসে বলল,‘আমার গাঁজার কল্কেটা দাও তো”।  বলতে এসে জগজ্জননীকে ঐ অবস্থায় দেখে শিব অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। শিবকে তাড়াতাড়ি করে তুলতে গিয়ে ভুল করে আবার শিবের বুকেই পা দিয়ে ফেলল অন্ধকারে,তাই তো মা দুর্গা অ্যাল করে এক গলা জিভ কাটল। বুঝলে তো মামমাম,অন্ধকার বলেই মা দুর্গাকে অমন কালো দেখায়।

(সাম্প্রতিক ডেঙ্গু উপলক্ষে)
-(বাবা গম্ভীর মুখে)সারা দিন ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে রাখবি। মশা যেন একদম না কামড়ায়। মশা কামড়ালেই কিন্তু? কি? ডেঙ্গু।
-(তুত্তুরী অবাক হয়ে) তো আমাকে বলছ কেন?মশাকে বল।

তুত্তুরী উবাচ ১৮ই অক্টোবর ২০১৭
(সময় গতকাল রাত সাড়ে দশটা)
-হ্যালো তুত্তুরী, কি করছ মা?
-কিচ্ছু না মামমাম(দিদা), এই একটু ভূত নামাচ্ছিলাম।
-অ্যাঁ?সেকি কেন?
-কাল ভূত চতুর্দশী তো তাই। তুমিও ভূত নামাও মামমাম।
-না বাবু, আমি ওসব পারি না। (শেষ পর্যন্ত তুত্তুরীর আব্দারের কাছে নতি স্বীকার করে)আচ্ছা তুমি যখন জেদ করছ,‘আয় ভূত, আয়। নাম নাম নাম। ’
-আঃ মামমাম। নাম নাম করলেই নেমেছে আর কি। ওকে কোলে করে নামাও।
- ছি ছি ছি। ভূতকে কোলে নিতে আমার বয়ে গেছে। আমি তোমায় ছাড়া আর কাউকে কোলে নেবো না।
-উফ্ মামমাম। আমি এতঃ ভূত নামিয়েছি, আর তুমি একটাকে নামাতে পারলে না?দাঁড়াও আমিই বলে দিচ্ছি, এই ড্যাবাড্যাবা চোখ ওলা একটা ভূত, ঐখানে আমার মামমাম তোকে ডাকছে, ওর হাত ধরে নেমে পড়।
ঐ যাঃ দুষ্টু ভূত নামার আগে আবার আমার ঘাড়ে একটুু হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল।

তুত্তুরী উবাচ ১৬ই সেপ্টেম্বর  ২০১৭
-মা,তোমার ফোনটা একটু দেবে?বাবারটা তো লক করা তাই।
-আমারটাও তো লকড্।
-ওটার পাসওয়ার্ড আমি জানি। তুমি ফোন খোলার সময় অনেক সময় মুখে বলে বলে খোলো কি না-৯ ৫ ৪৭ এই রকম করে।
-সে যাই হোক। ফোনে হাত দিও না। বলেছি না ফোনে ব্লু হোয়েল আছে। বাচ্ছা পেলেই কচকচিয়ে খেয়ে নেয়।
-সেই জন্যই তো চাইছি মা। আমি একটা রেড হোয়েল বানিয়েছি, তোমার ফোনে ছেড়ে দেব। ঘাপটি  মেরে বসে থাকবে, যেই ব্লু হোয়েল তোমার ফোনে ঢুকতে যাবে, কচকচ করে ওকে কেটে ভেজে খেয়ে নেবে। তুমি ফোনটা তো দাও-দেখাচ্ছি মজা দুষ্টু ব্লু হোয়েলটাকে।
তুত্তুরী উবাচ ২৯শে জুলাই ২০১৭
- মা, জানো তো কাল না মিস খুব হাসছিল, আমার কথা শুনে।
- কাল তো পরীক্ষা ছিল, কি বলেছিস রে যে মিস হাসছিল?
- আরে না না। পরীক্ষার জন্য নয়, এমনি মিস অ্যানিম্যাল কিংডম পড়াতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করছিল, “ পুরোযা ডু ইউ হ্যাভ আ পেট অ্যানিম্যাল?” আমি বললাম, “নো!” তখন মিস জিজ্ঞাসা করল, “ হুইচ অ্যানিম্যাল উড ইউ লাইক টু হ্যাভ অ্যাজ ইয়োর পেট?” আমি বললাম, “আই লাইক টু হ্যাভ আ ডগ।“
- ঠিকই তো বলেছিস। এতে হাসার কি হল?
- আঃ শোনোই না। তারপর আমি বললাম, “ আই লাইক টু হ্যাভ আ ডগ, বাট নট এ নেড়ি ডগ”।
- ওরেঃ বাপরে বাপ। হেসে হেসে পেট ব্যথা হয়ে গেল।
- হ্যাঁ মিস ও খুব হাসছিল, তারপর চশমা খুলে চোখ মুছে বলল, “ বাট হোয়াই নট আ নেড়ি ডগ?” আমি বললাম, “ নেড়ি ডগ আর ঘেউঘেউয়ে। এন্ড দে গেট ম্যাড ইন সামার অ্যান্ড ট্রাই টু বাইট আস।“
- উফঃ মাগো। এবার থাম বাবু।

তুত্তুরী উবাচ ২২শে জুলাই ২০১৭
-বাবা, একটা কথা বলব?
-কি?
-তুমি প্লিজ একবার আমাদের টিচার ইনচার্জের কাছে যাবে?
-কেন রে? এই তো মা মঙ্গলবারই গেল পেরেন্ট টিচার মিটে।
-তা হোক। তুমি যাবে গিয়ে বলবে তুমি স্বর্ণাভ আর গৌরবের বাবা।
-অ্যাঁ? তারা কারা?
-আমার ক্লাসের দুই অতি নচ্চার বদমাইশ। আমায় খুব বিরক্ত করে?
-বিরক্ত করে মানে?
-মারে।
-তুই ও তো মারিস?যে ভাবে ধুলোমেখে ভূত হয়ে বাড়ি ফিরিস!
-হ্যাঁ আমিও দি ঘা কতক। কিন্তু এভাবে কতদিন মারামারি  করব?তাই তুমি গিয়ে বলবে তুমি স্বর্ণাভ আর গৌরবের বাবা। বলে মিসের ছড়িটা কেড়ে নিয়ে ওনাকে বেশ কয়েক ঘা মেরে পালিয়ে আসবে।
-(বাবা প্রবল হাসি চাপতে গিয়ে কেশেই ফেলল) তাতে কি হবে?
-মিস ওদের স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে, আর দেবার আগে  সবার সামনে ওদের পিছনে ছড়ি দিয়ে বেদম মারবে---- কেমন মজা হবে?

তুত্তুরী উবাচ ৪ঠা জুলাই ২০১৭
-মা, জানো তো আমরা স্কুলে ইংলিশে আমপাতা জোড়া জোড়া খেলি।
-ইংলিশে? সে আবার কি? রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস্ নাকি?
-না। না। ওটাই ইংলিশে খেলি। ঈশাণী বলল,“রোজ তো বাংলায় খেলি, চল আজ ইংরাজি তে খেলি। ” তাই আমরা ওটাকে ইংরাজি করে নিলাম। মানে যে কটা শব্দ আমরা জানি সে গুলো দিয়েই আর কি।
-কিছুই বুঝলাম না। কি করে?
-শুনবে? ম্যাঙ্গো লিফ জোড়া জোড়া
মারব চাবুক ছুটবে হর্স।
ওরে বিবি ওয়েট।
মাই ম্যাড হর্স ইজ কামিং।
ম্যাড হর্স রান এন্ড শট গান।
অলরাইট ভেরিগুড্।
মেম ইজ ইটিং টি বিস্কুট। হিঃ হিঃ হিঃ। কেমন মা?
- ওরে আমার ট্যাঁশ গরুরে।

তুত্তুরী উবাচ ১৬ই জুন ২০১৭
-গরমের ছুটিটা পুরো নষ্ট করলি বাবু?এখনও টু থ্রী ফোর এর টেবল মুখস্থ  হল না?
-হয়েছে তো মা। প্রশ্ন কর না?
- সে তো তুই মনে মনে যোগ করে করে বলছিস।
-তো?পারছি তো। আমি তো এক কোটির টেবল্ ও বলতে পারি।
-অ্যাঁ!!! মানে??
-এক কোটি ওয়ানজ্ আর এক কোটি, এক কোটি টুজ্ আর দু কোটি,এক কোটি থ্রীজ্ আর তিন কোটি----
-ওরে থাম বাবা। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেল।
-হেহে আচ্ছা মা, বিসেকসি মানে কি?
-বি--সে-ক-সি? কে জানে?জীবনেও শুনিনি। যারা বি সেকশনে পড়ে তারা নাকি?
-ও। তাহলে মেরি প্যান্ট বিসেকসি মানে কি?
(প্রমাদ গুনলাম। দিন দুয়েক আগে এক বহু প্রাচীন বন্ধু এসেছিল, তুত্তুরী যখন তার কন্যার সাথে ক্রিড়া মগ্ন, দুই মা তখন গপ্প করতে করতে টকিং টম নিয়ে খেলছিলাম। আমাদের বর্ণিত সব গপ্পই টম পুনরায় তার কমিক আওয়াজে আমাদের শোনাচ্ছিল। তখনই কার মাথায় যে দুর্বুদ্ধিটা এল, টমকে গোবিন্দার সেই বিখ্যাত “মেরি প্যান্ট ভি সেক্সী,মেরি শার্ট ভি সেক্সী” গানটি শেখানোর কথা, কে জানে। শিক্ষানবিশী অন্তে টম যখন প্রবল বিক্রমে ঐ গানটি গাইছিল, তুত্তুরী সেই সময় ঘরে এসেছিল বটে, টমের ঐ ভয়ানক গান শুনে প্রবল হেসেওছিল। আজ যে এই পরীক্ষা দিতে হবে কে জানতো?)

তুত্তুরী উবাচ ৩রা জুন ২০১৭
-মা রামায়নের শেষটা আমার একদম ভালো লাগে না।
-কেন?
-রামের জন্য। রাম অহল্যাকে মুক্তি দিল, আর নিজের বউকে বনবাস দিল?
-মানে?
-মানে, অহল্যাকে যখন গৌতম মুনি অভিশাপ দিয়ে পাথর বানিয়ে দিয়েছিল, তখন রামই তো তাকে মুক্তি দিল? পরের বউকে উদ্ধার করে যে, সে কেন নিজের বউকে বনবাসে পাঠাবে?
-বাপরেঃ। তুই তো আমার থেকেও বড় ফেমিনিস্ট হবি বাবু। চালিয়ে যা।

তুত্তুরী উবাচ ১৯মে ২০১৭
-(বাবা রাগত স্বরে) তুই একটা অসভ্য গোভূত।ভদ্র সমাজে মেলামেশার  উপযুক্ত নস্। 
-কেন?
-আবার কেন?খাটের আড়ালে লুকিয়ে নাক খুঁটছিস আবার কেন?
- নাক চুলকোচ্ছে তো?
-আআআঃ। তাই বলে জনসমক্ষে চুলকাতে হয়? বাথরুমে গিয়ে চুলকে হাতে সাবান দিয়ে আসতে হয়।
-শোন বাবা, যার নাক থাকে, সেই নাক খোঁটে। হ্যাঁ শূর্পণকা নির্ঘাত নাক খুঁটত না। কারণ খুঁটতে পারত না।
-

তুত্তুরী উবাচ ১১ই মে ২০১৭
-মা দেখো দেখো, কি ভালো সই করেছি মাইরি।
-(বিষম খেয়ে) কি? কি বললি?
-কি ভালো সই করেছি মাইরি। উরিঃ শালা।
-ছিঃ।  কোথা থেকে এত খারাপ কথা শিখছ?
-তোমার থেকে।
-অ্যাঁ?
-তুমি তো সেদিন বাবাকে বলছিলে, কি জঘন্য খেতে মাইরি। আর দাদু তো সেদিন খেলা দেখতে দেখতে চিৎকার  করে উঠল, “উরিঃ শালা। ” আমি বললেই দোষ? দাদু বলেছে, সব শিখে রাখো। সময় বুঝে ঝাড়বে,  তবে বাইরের লোকের সামনে নয়।
- ভগবানঃ। একে রামে রক্ষে নেই দাদু দোসর।

তুত্তরী উবাচ ৯ই মে ২০১৭
-তুত্তুরী খাবে এস।
-না মা। তুমি প্লিজ আমায় খেতে বোলো না। আমার একদম ক্ষিদে নেই।
-এই গরমে কারোরই ক্ষিদে নেই। খেতেই হবে। কোন কথা শুনব না।
-(অভিযোগের সুরে) বাবাআআ! দেখো না বলছি ক্ষিদে নেই। মা তাও শুনছে না।
-(বাবা ট্যাবে বই পড়তে পড়তে অন্যমনস্ক হয়ে) কেন ক্ষিদে নেই কেন? অল্প কিছু খেয়ে নে। মা এত কষ্ট করে রান্না করেছে--
-খেতে পারব না বাবা।  আমার পেটে একটা বাচ্ছা ঢুকেছে। তাই পেটটা ভর্তি। খাবার এতটুকু জায়গা নেই।
- বার করে দে।
-কি করে বার করব বাবা? পেট কাটতে হবে যে?
-যে ভাবে ঢুকিয়েছিস, সে ভাবেই বার করে দিয়ে খেতে বস।
-(হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাবার মুখে)কি শুরু করেছিস রে ভাই তোরা বাপমেয়ে তে।

তুত্তুরী উবাচ ১লা মে ২০১৭
যারা তুত্তুরী উবাচের পুরানো পাঠক, তারা জানেন যে তুত্তুরী এককালে নিজেকে জগজ্জননী বলে দাবী করত। আমাদের গৃহ পরিপূর্ণ থাকত গেঁজেল জামাই,দুই জোড়া নাতি নাতনী এবং তাদের বাহনাদি দ্বারা। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল, তুত্তুরী আর জগজ্জননী নয়। মা দুর্গার নির্দেশে তুত্তুরী আপাততঃ ‘মদনপুরের পক্ষীরাণী। ” মদনপুর কোথায়?চেনেন না বুঝি? মাসাইমারা থেকে ৪৫কিলোমিটার দূরে তুত্তুরীর নিজস্ব জগৎ মদনপুর। গহীন জঙ্গল। যেন জীবজন্তু নেই যে ওখানে পাবেন না। বাঘ, সিংহ, হাতি ছাড়ুন ক্যাঙারু, প্যাণ্ডা, কোয়ালা এমনকি পেঙ্গুইন পর্যন্ত আছে মদনপুরে। এবং এই সমস্ত জীবজন্তুর দেখাশোনার দায়ভার তুত্তুরীর। তাই তো দাদু তুত্তুরীর নাম দিয়েছে, “লক্ষ্মী মেয়ে পক্ষীরাণী। ” মদনপুরে প্রবেশাধিকার শুধু আমার পিতা এবং আমার কন্যার। দাদুই তো মূখ্য পরামর্শদাতা। না হলে এই যে ক্যাঙ্গারুর  বাচ্ছা গুলো এই গরমে কিছুতেই মায়ের পেটের থলি তে ঢুকছিল না, দাদুর কথা মত তুত্তুরী সোনার অঙ্কুশ নিয়ে তাড়া করল বলেই না-_-_--

সারাদিন আমাদের বাড়িতে মদনপুরের গপ্প চলে। বেঁচে থাক মুকেশ আম্বানী আর জিও কানেকশন,না হলে ফোন বিল দিতেই ফতুর হতাম আর কি। আজো তার ব্যতিক্রম নয়। আজ আবার দাদু-মামমামের অ্যানিভারসারি। মানে বিয়ের জন্মদিন আর কি। গতকাল মধ্যরাতে অভিনন্দন জানানোর পরও তুত্তুরীর শান্তি নেই। ঘুম থেকে উঠেই দাদুকে ফোন--

-হ্যালো দাদু। আজ তো তোমাদের বিয়ের জন্মদিন। আমি তোমাদের তিনটে গোলাপী মুক্তো দিলাম। হুঁ হুঁ মদনপুরের শুক্তির মুক্তো বাবা। একটা দিয়ে তুমি আঙটি করে পরো আর দুটো মামমামের কানের দুল বানাতে বলো।
- বাঃ।
-মামমাম কোথায়? হ্যালো মামমাম? তোমায় একটা সরু সোনার ছাগল (গোট) হার দিলাম। গোটা হার জুড়ে ছোট ছোট সোনার ছাগল। কি পছন্দ?
-হ্যাঁ মা খুব পছন্দ।
-বাঃ। এতে কি হবে? ৪৩ বছরের বিয়েবলে কথা। দাঁড়াও তোমাদের একটা সোনার দোলনা দি। আগে আমি চড়ে দেখি ছেঁড়ে কি না। ক্যাঁচকোঁচ   ক্যাঁচকোঁচ। নাঃ ছিঁড়ল না। দাদু এস। এবার তুমি আর আমি চড়ব।  ক্যাঁচকোঁচ ক্যাঁচকোঁচ। বলো?
-(দাদু অসহায় ভাবে) তা বেশ তো ক্যাঁচকোঁচ। ক্যাঁচকোঁচ।
-হয়েছে। এবার মামমাম এস। বলো ক্যাঁচকোঁচ। 
-স্কুল কেমন চলছে সোনা? পড়তে বসেছো?
-আঃ মামমাম আবার স্কুল টুল কেন।  যাকগে অত গিফট্ দিলাম-- এবার তোমরা আমায় কিছু দেবে না?
- (দাদু মামমাম সমস্বরে) তোমার কি চাই সোনা?
-আ মা র? আমার আবার কি চাই? তোমরা গরীব মানুষ যা দেবে তাই হাত পেতে নেব।
(অতঃপর ফোনটা কেড়ে নেওয়া ছাড়া আর গতি ছিল না।)