Sunday 25 June 2017

বাবার ডাইরি থেকে (টুকলি করা) ২৫শে জুন ২০১৭



ঝ         ভূত নিয়ে ভৌত তথ্য
        ———————————
বেশ কয়েক মাস পরিবেশ-পরিস্থিতি  আমার চিন্তা-চেতনা কে স্থবির জড়ে পরিণত করে দিয়েছে । বর্তমানের জমিতে  আর ভবিষ্যতের রূপরেখা দেখতে পাচ্ছি না । আমি এখন কিছুটা ভূতাবিষ্ট , অতীত রোমন্থনেই বেঁচে আছি ।
      ১১২ বছর আগে সাড়ে সাত বিঘার ‘ভূতের ভিটে’টা কিনে জঙ্গল সাফকরে আমাদের বর্তমান বাসস্থান টি বানান আমার ঠাকুর্দা । তিনি কিন্তু ভূতটাকে ভিটেছাড়া করেন নি ভূতটা ভীষণ মানুষ সংসর্গী  । জীবিত সবার সাথে সে মিত্রতা চায় । কিন্তু ভৌত-সামাজিক পদ্ধতি-প্রকরণ এত ভয়াবহ  যে সুরুতেই সবাই প্রচন্ড ভয়পেয়ে শতহস্ত দূরে পালায় তার কাছথেকে।
      চার পুরুষের প্রথম প্রজন্মে আমার ঠাকুমাই প্রথম ভূতটাকে বশ করেন। ঠাকুমা ‘তেনা’কে বলতেন ‘মাতুল’। ঠাকুর্দা মাতুল কে তোয়াক্কাই করতেন  না, তার কারণ তাঁর গুরুদেব শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব এই ভিটেতে ক্ষেত্রপাল ‘প্রথিত ’ করে দিয়েছিলেন ।  প্রসঙ্গত  ক্ষেত্রপালও নিরাবয়ব অশরীরী   কিন্তু সাত্বিক যেখানে মাতুল হচ্ছে কিছুটা রজ গুন সম্পন্ন ।
      আমাদের ৪পুরুষের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রতিটি পর্যায়ে ১জনের সাথে ঐ অশরীরি ‘মাতুল’এর একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ  সম্পর্ক  স্থাপিত হয় !
     তথাকথিত  ১ম জন হলেন আমার ঠাকুরমা।  জবরদস্ত জাঁহাবাজ   মহিলা ! ঠাকুর্দা ছিলেন ঠাকুরমা থেকে ২০ বছরের বড়।  সারা মাস বিদেশী ‘হৌসে’ সাহেবদের ‘সেবা’করে ’ ,  ‘ইয়োরস মোষ্ট ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট ’  মাসান্তে দেড়-দিনের জন্য বাড়ি ফিরতেন । ফলশ্রুতি বছর শেষে  আমার বাপ-খুড়ো-জ্যাঠা- পিসির সংখ্যা একজন করে বাড়তো ।
      এদিকে  জেলিয়া-কৈবর্ত আর গো-পালক সম্প্রদায় পরিবৃত অঞ্চলে একক তরুণী  ব্রাহ্মণী ,সন্তান-সন্ততি, আটটি দুধেল গাই,ঢেকিতে ধান ভাঙা,যাঁতায় ডাল ভাঙা,  ফলের বাগান আর সবজির  ক্ষেতের তত্ত্ববধান সবই সামলাতেন দশজন পরিচারক /পরিচারিকার সহায়তায় । যে কোনো জটিল সমস্যাই তিনি অত্যন্ত সহজ সরল পদ্ধতিতে সমাধান করতেন তাঁর অনবয়ব ‘মাতুল’ এর সহায়তায়
     দ্বিতীয় প্রজন্মে আমার মেজপিসিমা ভূতাবিষ্ট হন । ছোটবেলা থেকেই তিনি দুর্বল - চিত্ত , নরম-মনা ,আদুরে ,ঘরকুনো  প্রকৃতির ছিলেন । তাই এবার তিনিই হলেন ভূতের সহজ ‘টারগেট’ ।  কিন্তু মাটির পাত্রে বাঘের দুধ রাখা যায় না,— দুর্ব্বল চিন্তা-চেতনার জন্য মেজপিসিমা আধার হিসাবে  খুবই ভঙ্গুর ছিলেন । ভৌতশক্তির সঞ্চারে তাঁর আভ্যন্তরীণ
বিস্ফোরণ ঘটলো । অধি-মনস্তত্ত্বিক  ক্ষমতার বিকাশ ঘটলেও তিনি পাগল হয়ে গেলেন। মস্তিষ্কের শৃঙ্খলা  (কো-অর্ডিনেশন অফ ব্রেন)ঠিক রাখার জন্য তাঁকে লাল চন্দন গাছের শিকড় বাটা খাওয়ানো হত । চতুর্দিকে পিসিমা  “কি ভয়ানক”,  “কি ভয়ঙ্কর”  দেখতেন ! প্রায়শ তিনি যা বলতেন তাই ঘটতো, বা যা ঘটতে চলেছে তার পূর্বাভাস দিতেন !
      আমার দাদা,আমি  আর ছোট ভাই ,আমরা তিনজন হ‘লাম এ পরিবারের তৃতীয়  পুরুষ মানে থার্ড জেনারেশন । তেলে সেজ বাতির বদলে ইলেকট্রিক  লাইট এসে গেছে ।  দাদা বাবার কাছে, ভাই মায়ের পাশে আর আমি শু‘তাম ঠাকুরমা সাথে ।  tokhon
ও পাখা/ফ্যান বাড়িতে আসে নি ।
       গ্রীষ্মকালে রাতে বাড়ীর কর্ত্তারা বাচ্ছাদের নিয়ে বিশাল দোতলার খোলা ছাতে বিছানাকরে শু‘তেন । মা-কাকিমারা নিচে যে যার ঘরে থাকতেন । ছাতের উত্তর-পূর্ব্ব কোনে ঠাকুরমার পূজার ঘর । আমি ছাড়া আর সবার কাছে ঘরটা ছিল দুষ্প্রবেশ্য । ঘরটার পশ্চিম দিকের দরজাটা খুললেই সামনে বিশাল ছাত ,আর ঠিক মাঝামাঝি  একটা তামার চাকতি বসানো আছে। তাতে কিছু তান্ত্রিক সিম্বল আর অজানা ভাষায় কোনো মন্ত্র লেখা আছে যা সময়ের সাথে সাথে এমন ক্ষয়ে গেছে যে আজ আর ঠিক পড়া যায় না । জায়গাটাকে
বলা হত ‘তিন ধারিয়া’ । (নীচের তিনটি দেওয়ালের সঙ্গম স্থল)
     শোনাকথা—এখানে প্রতি শনিবার মধ্যরাতে ঠাকুর্দা কষ্ঠি পাথরের পরাতে পাঁচসের চালের শিবাভোগ দিতেন — ঠাকুরমার কথা মোট ৫৭৬বার শিবাভোগ দিয়ে ঠাকুরদা তন্ত্রসিদ্ধ হয়েছিলেন।
      তিনধারিয়ার উপর বিছানা পেতে কেউ শুতো না কারণ সেটা খুব সুখকর ছিল না। ঐ বিশেষ তাম্রবিন্দুটা হল ভৌতিক শক্তির জ্বালামুখ । বড়দা শেষবয়সে সাধুসঙ্গ করতেন। ১৯৭৭এ জনৈক বিন্ধাচল ফেরত  তান্ত্রিককে তিনি বাড়ী নিয়ে এলেন । ছাতের ভূতের গল্প শুনে তিনি সবিদ্রূপে  আধখালি কারণের বোতলটি নিয়ে তিনধারিয়ায় বিছানা পেতে শুয়ে পড়লেন । তিনি দাদাকে আশ্বস্ত করলেন, বাকি বোতলটা খালি করেই তিনি ভূতটাকে বোতলে ভরে  নিয়ে,ছিপি এঁটে সকালে দাদাকে ফেরত দেবেন ।
      মাঝরাতে হুড়হুড় দুড়দুড় শব্দে সবাই জেগে উঠে দেখলো , রাত  প্রায় দুটো,দোতলার দালানে , সিদ্ধপুরুষ নাথবাবা ন্যাংটা,ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছেন, ক্রন্দনোদ্যত ।
     তাঁর বক্তব্যনুযায়ী মধ্যরাতের পর কোন একসময়  এক বিশাল বরফের লিঙ্গ ছাত
ভেদকরে তাঁর গুহ্যপ্রহার করেছে !

(To be continued)

Sunday 18 June 2017

পাশের বাড়ির মেয়ে


সঞ্চারী বলল, “আমায় নিয়ে একটা গল্প লিখবি অনি?” আড় চোখে তাকিয়ে দেখি, বরের ভ্রূতে ইতিমধ্যে দুটি কুঞ্চন পড়ে গেছে, আর বেশিক্ষণ বকলে, কপালে দুঃখ আছে ঘড়ির কাঁটা এগারোটা টপকে গেছে বেশ কয়েক মিনিট আগে, আমাদের এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে এগারোটা মানেই মধ্যরাত্রিসৌর কিছুতেই বোঝে না, যে এগারোটার পরই আমার বন্ধুরা অনলাইন হয়, রান্না-বান্না, খাওয়াদাওয়া সেরে, বিছানা করে, ঘর গুছিয়ে, বর বাচ্ছাকে ঘুম পাড়িয়ে তবে না মেয়েদের সময় হয় বন্ধুদের সাথে খোশগল্প করার? তাও বা কতক্ষণ? আধ ঘণ্টা এক ঘণ্টা?ফলে কারো সাথেই সেভাবে কথা হয় না আমার। সকাল বেলা অফিস যাবার পথে বাসি চ্যাট পড়ে জানতে পারি কার জীবনে কি চলছে।
 “আমায় নিয়ে একটা গল্প লিখবি অনি?” সঞ্চারী নাছোড়বান্দা। মনে মনে ভাবলাম, কি করে লিখি বলতো, তোর গল্প মানেই তো ঘোরতর প্রাপ্তবয়স্কদের গল্প। প্রাপ্তবয়স্কসুলভ গল্প লেখার মূল সমস্যা হল, পাঠক গল্পের চরিত্রের সাথে আমাকে তথা আমার বরকে একাত্ম করে ফেলবে। এর আগে একবারই চেষ্টা করেছিলাম, “পরকীয়া” বলে একটি অ্যাডাল্ট গপ্প লেখার, এবং ফলশ্রুতি যা হয়েছিল তা আর কহতব্য নয়। গপ্পটি ছিল এক চূড়ান্ত উদার স্বামী এবং তার বহুগামিনী স্ত্রীর গল্প। পড়ার পর একদল চিৎকার করতে লাগল,বরেরা এত উদার আদপেই হয় না, অপরদল উদগ্র ভাবে জানতে চাইল, আমার বর কি আদৌ গল্পটি পড়েছে? যদি পড়ে থাকে এ বিষয়ে তার কি অভিমত? বোঝ? গল্পটি কেউ একজন শেয়ার ও করেছিল তাতে জনৈক মাসীমা তো বলেই বসলেন, “ছিঃ। থাক আর বেশি এগিয়ে কাজ নেই, ভুললে চলবে না এটা ফেবু।“ নেহাত ফেবুতে ঝগড়া করা ছেড়ে দিয়েছি তাই, না হলে লিখতাম, “হ্যাঁ গো মাসি, জানি এটা ফেবু। প্রাপ্তবয়স্ক না হলে এখানে ঢোকা যায় না, অবশ্য কেউ যদি বয়স ভাঁড়িয়ে ঢোকে-“।
যাই হোক ঐ রাস্তায় দ্বিতীয় বার কে হাঁটবে বাবা? সঞ্চারী আমার সাথে স্কুলে পড়ত। সাদামাটা মুখশ্রী,মোটামুটি ফর্সা গায়ের রঙ, ভীতু ভীতু লাজুক সঞ্চারী বরাবর আমার পিছনের বেঞ্চে বসত। পড়াশোনাতে আহামরি কিছু ছিল না, তবে ফেল ও কখনও করেনি।সর্বার্থে সাধারণ পাশের বাড়ির মেয়ে বলতে যা বোঝায়, সঞ্চারী ছিল তাই।
পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে যখন আমরা জীবন সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছি শুনলাম সঞ্চারীর বিয়ে। বিয়ে? এত তাড়াতাড়ি? নিমন্ত্রণ করতে এসে লাজুক হেসে সঞ্চারী জানাল,হাওড়ারই ছেলে। কোন এক বিয়ে বাড়িতে বীতশোক আর সঞ্চারীর আলাপ, প্রথম দর্শনেই প্রেম অন্তত বীতশোকের তরফ থেকে। বীতশোক তার মাকে জানায়, এবং তিনি সঞ্চারীর বাবা-মার সাথে কথা বলেন, এরপর আর কি? দুবাড়ির সম্মতিতে কিছুদিন ডেটিং পর্ব চলে অবশেষে শুভ বিবাহ সমাসন্ন। শুনে সুখী হলাম, হাওড়ার ছেলে, অর্থাৎ বাবা-মার কাছাকাছি থাকতে পারবে সঞ্চারী। শুধু একটাই খটকা লাগল, বীতশোক বলেছে, সঞ্চারীকে চাকরি ছাড়তে হবে। একটা বেসরকারি বাচ্ছাদের স্কুলে বেশ কয়েক বছর ধরে পড়াচ্ছিল সঞ্চারী, মাইনে পত্র যে খুব ভালো ছিল তাও নয়, তবে খুব ভালবেসে বাচ্ছা গুলোকে পড়াত ও। সেই চাকরী ছেড়ে দিতে হবে? কেন? সঞ্চারী জানালো মায়ের জন্য গৃহবধূই চাই বীতশোকের। মা যদিও চাকুরীরতা ছিলেন এবং সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন। বীতশোকের মতে সারা জীবন ‘মা’ অনেক খেটেছেন, চাকরী সংসার দুই সমান তালে সামলেছেন, একা হাতে ছেলেকে মানুষ করেছেন, এবার তাঁর আরামের সময়। পুত্রবধূ এহেন শাশুড়ির সেবা করবে সেটাই তো কাম্য। তা নয় সেও যদি ঢ্যাং ঢ্যাং করে চাকুরী করতে বেরোয় তাহলে মাকে দেখবে কে? সংসার সামলাবে কে? আবার সেই মাকেই তাহলে সংসারের হাল ধরতে হবে? এ আদৌ অভিপ্রেত নয়, অতএব সঞ্চারীকে চাকরী ছাড়তে হবে।
আমার মত আখাম্বা নারীবাদীর কানে যুক্তিটা অদ্ভুত শোনালো। তবে সঞ্চারীর যখন আপত্তি নেই, শুধু শুধু কানে সুমন্ত্রণা দিয়ে লাভ কি?বিয়ে হয়ে গেল ধুমধাম করে,দারুণ মানিয়েছিল দুজনকে।এরপর আরো দু একবার দেখা হয়েছিল সঞ্চারীর সাথে। শুনলাম ফুলশয্যার রাত্রে ওর বরের প্রথম সংলাপ ছিল, “আমার মা বিরাট বড়লোকের মেয়ে ছিল। বাগ বাজারের দত্ত বাড়ির মেয়ে, কপাল বৈগুণ্যে আমাদের বাড়ি বিয়ে হয়ে এসে অনেক যাতনা সয়েছে, দেখ মাকে যেন কোনদিন কষ্ট দিও না।“ অসাধারণ! কোথায় যেন পড়েছিলাম, ভাল সন্তান না হলে ভাল স্বামী বা ভাল পিতা হওয়া যায় না। বীতশোক যে অসাধারণ ভালো পুত্র সে বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। বলা মাত্র সঞ্চারী ক্যাঁক করে উঠল, “আর আমি? আমি যে আমার বাবা-মা,ঠাকুমা, কাকু- কাকিমা, ভাইবোন,পোষা বেড়াল, আমার বাড়ি, চেনা বালিশ- বিছানা,মায়ের গায়ের গন্ধ, চেনা গলি,পাড়া মহল্লা ছেড়ে ওদের বাড়ি গিয়ে উঠলাম, সবকিছু ছেড়ে শুধু একটা লোকের ভরসায়? আমার বুঝি কোন মুল্য নেই অনি? আগেই ধরে নিল আমি ওর মাকে কষ্ট দেব? যদি উনি দেন? দিতেই তো পারেন? উনি তো ওনার নিজের বাড়িতেই আছেন, আমিই বহিরাগত। তুইই বল অনি কোন মেয়ে আগ বাড়িয়ে তার শ্বশুর- শাশুড়িকে অসম্মান করতে পারে, যদি তাদের ছেলে তাকে সেই সুযোগ না দেয়?” কে জানে? সদ্য চাকরী পেয়েছি, বিয়ে তো ঢের দূর।
কিছুদিন বাদে শুনলাম সঞ্চারী হনিমুনে গেছে। রাজস্থান। দাঁড়ান শুধু সঞ্চারী আর বীতশোক যায়নি, সঙ্গে বীতশোকের মা এবং সঞ্চারীর বাবা-মা ও গেছেন। হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। রথের দিন হাওড়া ময়দানে দেখা, বললাম, “ কি রে? সপরিবারে মধুচন্দ্রিমা?বড়িয়া হ্যায়।“ চিরপরিচিত ভীতু লাজুক সঞ্চারী ফোঁস করে উঠল, “বীতশোক ওর মাকে ছেড়ে যাবে না। ওর বাবা-মাও নাকি রাজস্থানে হনিমুন করতে গিয়েছিলেন। তাই মাকে ফেলে নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে রাজস্থান যেতে ওর বুক ফেটে আট টুকরো হয়ে যাচ্ছিল শালা।“ চমকে উঠলাম। “শালা?” সঞ্চারীর মুখে অসংস্কৃত শব্দ? কি হল আমাদের মিষ্টি লাজুক সোনা মেয়েটার, এত তিক্ততা কোথা থেকে এল? সঞ্চারী বলেই চলেছে, “বললাম চলো ছোট করে কোথাও ঘুরে আসি, পরে মাকে নিয়ে না হয় রাজস্থানে যাওয়া যাবে, তা নয়। আমার কথা শুনে রাতে নিমরাজি হয়, সকালে মা আবার ব্রেন ওয়াশ করে দেয়। শেষে যখন দেখলাম মাকে নিয়েই যাবে, তখন বললাম আমিও আমার বাবা-মাকে সঙ্গে নেব। তুই ভাবতে পারবি, গোটা রাজস্থান উনি ছেলের হাত ধরে ঘুরেছেন। কেন? ওনার নাকি পায়ে ব্যথা।বীতশোক আসে পাশে না থাকলে কিন্তু দিব্যি গটগটিয়ে হাঁটছে, ছেলেকে দেখলেই খোঁড়াতে লাগল। আমার মা বলেছে,’ আসুন দিদি আমি আপনার হাত ধরছি, না। তাতে চলবে না, সোনাবাবুকেই চাই।“ সোনাবাবু বুঝলাম বীতশোকের ডাক নাম। ক্ষুব্ধ স্বরে সঞ্চারী বলেই যাচ্ছে, “আমাকে আবার বলে কি,’ আজ থেকে পচিশ ছাব্বিশ বছর আগে এই বাগানেই তোমার শ্বশুর মশাইয়ের হাত ধরে ঘুরেছিলাম।’ আমি আর থাকতে পারিনি জানিস, কটকট করে শুনিয়ে দিয়েছি, “হ্যাঁ। তুমি তখন তোমার বরের হাত ধরে ঘুরেছিল আর এখন আমার বরের হাত ধরে ঘুরছ। আর আমি আমার হনিমুনে তোমাদের তল্পিবাহক হয়ে ঘুরছি।“ বুঝলাম সঞ্চারী বদলে যাচ্ছে, ভীষণ দ্রুত বদলে যাচ্ছে সেই ভীতু লাজুক পাশের বাড়ির মেয়েটা।       
বেশ কিছুদিন পরের কথা, প্রচণ্ড গরমের পর সদ্য নেমেছে স্বস্তির বৃষ্টি, মধুপর্ণা আর আমি গেছি যথারীতি হাওড়া ময়দানে ফুচকা খেতে মধু আমার প্রিয়তম বান্ধবী, সদ্য স্কুলে চাকরী পেয়েছে, আমার ভাগ্যে তখনও শিকে ছেঁড়েনি হঠাৎ দেখা সঞ্চারীর সাথে আমরা দেখতে পাইনি, ঐ ডাকল চিৎকার করে সন্ধ্যার ব্যস্ত ট্র্যাফিকের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমাদের বলল পড়ে ফিরছে, আবার এম এ পড়াটা শুরু করেছে শরৎসদনের প্রায়ান্ধকার বাগানে প্রেমালাপমগ্ন যুগলদের মধ্যে বসে বহুক্ষণ আড্ডা মারলাম আমরা
মধুর চাকরীর খবরে উচ্ছ্বসিত হয়ে সঞ্চারী জানালো ও চাকরী খুঁজছেচাকরী?” মধু আর আমি সমস্বরে চিৎকার করে উঠলাম, “তুই না চাকরী ছেড়ে দিয়েছিলি?” সঞ্চারী মুখ বেঁকিয়ে হাত পা ছুঁড়ে বলল, “হ্যাঁ তো আমার মহান শাশুমার তখন নেহাতই শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট গৃহবধূর প্রয়োজন ছিল উনি ওনার পুরানো কলিগ, বন্ধুবান্ধবীদের সাথে প্রজাপতির মত ঝাড়া হাত পা হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াবেন, আজ নন্দনে সিনেমা, কাল গিরীশ মঞ্চে থিয়েটার, তরশু রবীন্দ্রসদনে ব্রততীর কবিতা পাঠ, আর সংসার সামলাব আমি কিন্তু এখন ওনারই ইচ্ছা যে আমি চাকরী করি, বাইরে বেরোই ঘরে থেকে থেকে নাকি আমি জটিল কুচুটে হয়ে যাচ্ছি ভাব? নিজেরা বলে কয়ে চাকরী ছাড়াল, তারপর প্রতিনিয়ত শুনতে হত, চাকুরীরতা মেয়েরা অনেক উদারচেতা, বুদ্ধিমান হয়, আর গৃহবধূ মানেই প্যাঁচালো সারদিন বাড়িতে বসে প্যাঁচ কষিপ্যাঁচ? প্যাঁচালো? সঞ্চারী? ওর থেকে প্রাণোচ্ছল মিষ্টি মেয়ে খুব কম দেখেছি, আয়নার থেকেও সাফ মন ওর সঞ্চারী অবশ্য বলতে বলতে হেসে গড়াগড়ি গেল, “কি পাগল ভাব? আমাকে মাঝে বলে কি, ‘তুমি শাড়ির ব্যবসাও তো করতে পারো? সারাদিন ঘরে বসে কি কর?” “কে? বীতশোকদা বলল?” “নাঃ আমার শাশুড়ি, আবার কে? বীতশোক খুব ভালো ছেলে শুধু বড্ড কুঁড়ে খালি ঘুমোতে পারলে আর কিছু চায় না বুঝলি?” চোখ টিপে বলল সঞ্চারী কি বুঝলাম কে জানে, শুধু এ টুকু বুঝলাম এ সঞ্চারী আমাদের পুরানো সঞ্চারী নয়, এ অনেক তীক্ষ্ণ, শাণিত, পোড় খাওয়া সঞ্চারী 
এরপর দেখা আরো বেশ কয়েক বছর পর ফেসবুকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল সঞ্চারী, ধরতে পেরে আপ্লুত হয়ে গেলাম ইনবক্স মেসেজ ভরে গেলে ভার্চুয়াল চুমুতে মেয়েরা মশাই তিন লাইন চ্যাট করলে পাঁচটা চুমু পাঠায়, আমি সঞ্চারী বা মধুপর্ণা কেউই তার ব্যতিক্রম নই মোবাইল নম্বর আদান প্রদান পর্ব মিটতে না মিটতেই হোয়াটস অ্যাপে গ্রুপ তৈরি হয়ে গেল। কত কত যে গপ্প জমেছিল সবার। এত বছরে কে কি করল, এখন কে কি করছে, ছানাপোনা কটা, কত বড় থেকে আজ কি খেলি, কোথায় গেলি, কি কিনলি, বর আদর করল কি না ইত্যাদি প্রভৃতি গপ্পের কি আর শেষ আছে মশাই। সঞ্চারী দেখলাম বিগত কয়েক বছরে সম্পূর্ণ বদলে গেছে, কর্পোরেট সেক্টরে বড় চাকরী করে সঞ্চারী, সারাদিন দম ফেলার ফুরসৎ নেই। সেই সর্বার্থে সাধারণ দেখতে মেয়েটা কি করে জানি না চোখ ধাঁধানো সুন্দরী হয়ে গেছে। সঞ্চারী যে এতটা লম্বা আগে বোঝা যেত না, মাছি পিছলে যাবার মত গৌর সুন্দর মুখ, নিয়মিত সাঁতার এবং জিম করার ফলে চাবুকের মত ফিগার,কে বলবে এক সন্তানের জননী? সুন্দর ফিগারকে কি করে আরো সুন্দর দেখাতে হয়, সেটা বোধহয় সঞ্চারীর থেকে ভালো কেউ জানে না। হাঁটু ছেঁড়া জিন্স, ট্যাঙ্ক টপ, স্প্যাগেটি টপ, হট প্যান্ট, ব্যাকলেস মিনি ড্রেস ইত্যাদি অত্যাধুনিক জামা কাপড় পরা সঞ্চারীর ছবিতে নিত্য ভরে উঠতে লাগল গ্রুপ। শুধু আমি না, গ্রুপের সব মেয়েই মুগ্ধ সঞ্চারীর রূপে, সঞ্চারীর বৈভবেএতকিছু সত্ত্বেও ছিটেফোঁটা অহংকার নেই মেয়েটার।
আপাতত রূপকথার মত ঈর্ষনীয় জীবন সঞ্চারীর, শুধু একটাই সমস্যা বরটা সাংঘাতিক অলস, তাকিয়েও নাকি দেখে না সঞ্চারীর দিকে। প্রথম দিকে সবাই হেসেই উড়িয়ে দিল, এ আর একটা সমস্যা হল? আট দশ বছর বিবাহিত জীবন একসাথে কাটাবার পর স্বামীস্ত্রী ভাইবোন হয়ে যায়, প্রিয়তমের স্পর্শ আর মায়ের স্পর্শে খুব বেশি তফাৎ থাকে না। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে এতকিছুর পর ও কিছু একটা থেকে যায়, যার নাম দম্পতিভেদে ভালোবাসা থেকে গভীর ভালোবাসা। সেটাই সঞ্চারীকে বোঝাবার চেষ্টা করে সবাই, কিন্তু ধীরে ধীরে বোঝা যায় ব্যাপারটা এত সহজ নয়। সঞ্চারী এবং বীতশোকের মধ্যে ন্যূনতম শারীরিক সংসর্গ নেই বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে। কেন রে বাবা? এত সুন্দরী বউ, অজস্র অনুরাগী, স্তাবক যার আগে পিছে ভনভন করছে তার বর এতো উদাসী কেন?
হয়তো আরো অনেকের বরই এমন উদাসী, কিন্তু ইতিপূর্বে কেউ এভাবে নিজের বরকে বন্ধুদের সামনে বেআবরু করেনি। কেন? কি করে বীতশোক আর সঞ্চারীর সম্পর্ক স্বাভাবিক করা যায় এ নিয়ে নানা চিন্তাভাবনা চলতে লাগল। বীতশোক আর সঞ্চারীর মাঝে সোনাই শোয়, সোনাই ওদের একমাত্র পুত্র। পরামর্শ মত এক রাতে সঞ্চারী সোনাইকে এক ধারে শুইয়ে ঘুম পাড়াল, আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, এবার? দুজনে পাশপাশি, কাছাকাছি কিছু তো হবে, ও মা মাঝরাতে তীব্র অভিমান নিয়ে সঞ্চারী মেসেজ করল, “বীতশোক ঘুমন্ত ছেলেকে মাঝে টেনে নিয়েছে। ছেলের গায়ের গন্ধ নাকে না ঢুকলে ওর নাকি ঘুম আসে না।“ মেয়েরা যে কি চূড়ান্ত অসহায় এ ব্যাপারে, সমাজ আমাদের ছোট থেকে শেখায়, একটা মেয়ের এই ধরণের চাহিদা থাকতে পারে না। থাকাটা ঘোর অন্যায়, স্বামী চাইলে তবেই সে এই সুখের ভাগীদার হতে পারে তাও শুধু মাত্র সন্তানোৎপাদনের স্বার্থে। ও পর্ব মিটে গেলে, স্বামী স্ত্রী শুধুই বাবা-মা হয়ে বেঁচে থাকে। তার ইচ্ছা- অনিচ্ছা, ভালোলাগা, মন্দলাগা আদৌ বিবেচ্য নয়। নারীর জন্মই শুধু সংসার সামলানো এবং সন্তানোৎপাদনের জন্য। শারীরিক চাহিদা তো কুলটা বারাঙ্গনাদের থাকে, ভদ্র বাড়ির মেয়েদের ও সব থাকতে নেই। হায়রে বাস্তব ও যদি তাই হত? কত মেয়ে যে লোকলজ্জার ভয়ে স্বামীর উদাসীনতা মুখ বুজে সয়ে যায়।
এত সহজে দমবার পাত্রী আমরা নই। এক শনিবার পরিকল্পনা পূর্বক সোনাইকে দিদার কাছে রেখে এল সঞ্চারী। সোনাই তো মহাখুশি দিম্মাকে জড়িয়ে ঘুমাবে, সঞ্চারী মূল্যবান ব্যাকলেশ ডিজাইনার ড্রেস পরে, পারফিউম মেখে, হাতে পায়ে বডি বাটার লাগিয়ে রেডি, সেই ছবি দেখে তো সুমনা বলেই ফেলল, “উফ  সঞ্চারীরে আমিই তোর প্রেমে পাগল হলাম।“ সলজ্জ হাসার ইমোজি পাঠিয়ে সঞ্চারী জানালো “ভাগ শালা।“ যে যার নিজের বরকে জড়িয়ে ঘুমানোর সময় আমরা সকলেই ভাবলাম, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। বেচারা বীতশোক বাবা হতে গিয়ে স্বামী হতে ভুলে গেছে, আজ নির্ঘাত মনে পড়ে যাবে।
কোন লাভ হল না। বীতশোক যথারীতি নাক ডাকিয়ে ঘুমালো। পরদিন সকালে ক্লান্ত, হতাশ সঞ্চারীকে কি সান্ত্বনা দেব আমরা বুঝতে পারছিলাম না। ঋত্বিকা শুধু বলল, “ তুই কিছু বললি না?” “বললাম তো। জিজ্ঞেস করলাম আমায় কেমন দেখাচ্ছে,বই পড়ছিল, মুখ না তুলেই বলল, ‘দারুণ।’ ঘুমোবার তোড়জোড় করছে দেখে প্রশ্ন করলাম, “ ঘুমোবে?” তো কেমন অবাক হয়ে ভেবলে গিয়ে প্রশ্ন করল, ‘হ্যাঁ! তো কি?’ বোঝ?” ঋতি আরো অধৈর্য হয়ে বলল, “বলবি তো কি চাস?” সঞ্চারী করুণ ভাবে বলল, “এটা ও মুখ ফুটে বলতে হবে?এর জন্যও করুণা ভিক্ষা করতে হবে?” সত্যি বহু পুরানো বরের কাছে মুখ ফুটে এই দাবী করা মোটেই সম্মানের নয়। মেয়ে বলে কি কোন ইগো থাকবে না?
পরবর্তী পদক্ষেপ ডাক্তার দেখানো। মধুপর্ণাই কথাটা তুলল, “সঞ্চারী তুই একবার বীতশোক দা কে ডাক্তার দেখা। হয়তো কিছু শারীরিক সমস্যা হচ্ছে বা হরমোনাল কিছু, থাইরয়েডটাও একবার দেখিয়ে নেসুমনা হেসে বলল, “ বরকে ডাক্তার দেখাতে বলছিস? পারবে? শোন এতদিন বলিনি, কারণ সঞ্চারীর মত সব কিছু খুলে বলার সাহস আমার নেই, শুধু এটুকুই বলতে পারি, এ সমস্যা আমাদেরও আছে। সারা সপ্তাহ কিছু বলি না, কারণ অফিস করে ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফেরে, তাই বলে উইকেন্ডেও নাকে তেল দিয়ে ঘুমোবে?এমন কি গায়ে গা লাগলেও এমন বিরক্ত হয়, যেন আমি অচ্যুত, অস্পৃশ্য। কিছু বলতে গেলেই বলে, সারাদিন তো বাড়িতে বসে থাক, অফিস করার ক্লান্তি কি বুঝবে? দীর্ঘ দিন এ ভাবে চলার পর একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম, “চলো একজন ডাক্তারের কাছে যাই।“ তো কি বলে জানিস? বলল, “তুমি মাথার ডাক্তার দেখাও---।“ আর বলি না। ছেড়েই দিয়েছি বলা, এভাবেই চলতে হবে মানিয়ে নিয়ে, মা ঠিকই বলে ‘মেয়েদের আবার এত চাহিদা কিসের?”
মুস্কিল হল, সব মেয়ে তো আর সুমনার মত লক্ষ্মী মেয়ে নয়। সঞ্চারী ছেলে ঘুমিয়ে পড়ার পর কথাটা তুলল এবং বীতশোকের জবাব প্রত্যাশিতই ছিল, “ডাক্তার? খামোখা ডাক্তার দেখাব কেন? আমি কি অসুস্থ্য নাকি?” সব সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে সঞ্চারী বলল, কেন ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা জরুরি, বীতশোক বলল, “ প্রথমত আমি মনে করি না এই নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার মত জায়গায় আমরা আছি। দ্বিতীয়ত কি ধরণের ডাক্তার দেখানোর কথা বলছ?” এই রে! এই প্রশ্নের জবাব তো আমরা কেউই জানি না। আমাদের জ্ঞান বলতে কিছু লিফলেট আর দেওয়াল লিখন, সঞ্চারী তবু কুঁতিয়ে কাঁতিয়ে বলল, “কেন? সেক্সোলজিস্ট?” বীতশোক প্রবল হাই চেপে বলল, “এরকম কোন ডাক্তার, আই রিপিট পাশ টাশ করা ডাক্তার যদি খুঁজে পাও জানিও। ভেবে দেখব। আর না পেলে বলো সাইক্রায়াটিস্ট কিন্তু চাইলেই পাওয়া যাবে। সেখানে আমি যেতে রাজি, তোমার সঙ্গে, তোমার মাথাটা----।“
ডাক্তারের গল্প শেষ। এবার? মধুপর্ণা বলল, “সঞ্চারী কথাটা যখন বলেই দিয়েছিস, তখন ভালো করেই জিজ্ঞাসা কর। কেন ঘনিষ্ট হতে চায় না? সমস্যাটা কি?” সঞ্চারী বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে প্রশ্ন করলেই বলে কোন সমস্যাই নেই। ইচ্ছে করছে না।“ “সেটাই তো কেন ইচ্ছা করছে না? একদিন দুদিন, এক সপ্তাহ- দু  সপ্তাহ, এক মাস- দু মাস- তিন মাস ইচ্ছে করছে না মানা যায়। কিন্তু এ ভাবে দিনের পর দিন ইচ্ছা না করাটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। ওকে বোঝা সেটা।“ ঋতি আরো ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, “ সত্যি মাইরি, এই ধরণের ছেলে গুলোর বিয়ে করাই উচিৎ নয়। এরা কেন বিয়ে করে রে? বিয়ে করে শুধু শুধু একটা মেয়ের জীবন বরবাদ করা?আচ্ছা সঞ্চারী হঠাৎ একটা কথা মনে হল, কিছু মনে করিস না ভাই, বীতশোকের কি অন্য কারো সাথে কিছু?” সঞ্চারী জোর গলায় প্রতিবাদ করল, “নারে। এরকম কিছু নেই। আমার বর আসলে অলস, হতে পারে আমার প্রতি উৎসাহ নেই, কিন্তু ও এতই ভালো মানুষ যে  এক গলা গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে বললেও বিশ্বাস করব না রে। অফিস কাছাড়ির বাইরে স্কুলের বন্ধুবান্ধব আর বইপড়া এই ওর জীবন বুঝলি।“ ঋতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝলাম। বীতশোক খুব ভালো ছেলে। হিরের টুকরো। আর তুই? তুই কিছু লটঘট বাঁধাসনি তো?”  রহস্যময় হেসে সঞ্চারী জানালো,” আমি প্রেমিক মানুষ সোনা, প্রেম ছাড়া কি থাকতে পারি?”
কথা ছিল ভদ্র ভাবে প্রশ্ন করবে, মেজাজ হারাবে না, কিন্তু সঞ্চারী কথা রাখতে পারল কই? এ কথা সে কথা হতে হতে তুমুল ঝগড়া, জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলা, কান্নাকাটি, ছেলের ঘুম ভেঙে উঠে পড়া এবং বীতশোকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়া, সঞ্চারী আমাদের শুধু জানালো যে, বীতশোক বলেছে সঞ্চারীর সাথে ঘনিষ্ট হতে গেলেই ওর মনে পড়ে যায়, ঝগড়ার মুহূর্তে বলা সঞ্চারীর কটু কর্কশ মন্তব্য গুলির কথা। ও ভুলতে পারে না। তাজ্জব হয়ে গেলাম আমরা? এ কেমন কথা?একজন অপরিচিত নিপাট ভদ্রলোকের সম্বন্ধে এ সব বলা উচিৎ নয়, কিন্তু সুন্দরী স্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ট মুহূর্তে আপনার কোন হলিউড বা বলিউডের নায়িকার কথা মনে পড়তে পারে, কেমন কি পাশের বাড়ির বউদির কথাও মনে পড়তে পারে, কিন্তু ঝগড়ার সময় বলা স্ত্রীর কটুকথা মনে পড়ে কেন? দাম্পত্য কলহের সময় আমরা এমন অনেক কিছুই বলি যে গুলো বেশীর ভাগই অর্থহীন। এবং কলহ পরবর্তী ভাবের সময় ও সব কথা আর কারো মনেই পড়ে না, যতক্ষণ না পুনরায় কলহে বৃত হচ্ছি। মধুপর্ণা আলাদা করে আমাকে বলল, “দ্যাখ অনি, ভাবগতিক সুবিধার ঠেকছে না। সঞ্চারী আমাদের বন্ধু হতে পারে, কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে ওর সাংঘাতিক বদ মেজাজ। প্রচণ্ড জেদি। বেশ কয়েকবার ওদের বাড়ি গিয়ে দেখেছি,বীতশোক দা মাটির মানুষ। ওই বরের কোন কথাই শোনে না। ওর সংসারে আদৌ মন নেই। খালি সাজগোজ, আড্ডা, সিনেমা- থিয়েটার, ফেসবুক আর হোয়াটস অ্যাপ।“ তাতে সমস্যা কোথায় বুঝলাম না যদিও। একটা স্বাধীন সুউপায়ী মেয়ে সাজগোজ করতেই পারে? উচ্চ পদস্থ কর্পোরেট অফিসারকে অফিস আওয়ারসের পরও মিটিং করতে হোটেল বা ক্লাবে যেতে হতেই পারে? এর জন্য যদি তার বরের গোসা হয়, তাহলে দুজনে খোলাখুলি কথা বললেই তো পারে?এভাবে চেপে রাখার কি মানে? এও মন খুলে কথা বলবে না, ও না? এতো ইগো থাকলে বিয়েটা টিকবে কি করে? তাছাড়া কে জানে এমনও তো হতে পারে যে বরের এই অবহেলাই সঞ্চারীকে ঠেলে দিয়েছে বাইরে, করে তুলেছে উদ্ধত, দুর্বিনীত বহির্মুখী?
সময় এগিয়ে চলেছে। সমাধান কিছুই  হচ্ছে না। সঞ্চারী যেন আরো প্রকট আরো উগ্র হয়ে উঠছে, নাকি সবই আমাদের মনের ভুল? সঞ্চারীর বক্তব্য অনুসারে, দেবারতি বলল, “ম্যারেজ কাউন্সিলরের কাছে যা সঞ্চারী।“ চয়নিকা বলল, “ দুজনের কমন ফ্রেন্ড কেউ আছে কি? তাহলে সে দুজনের সাথেই কথা ব্লুক।“নাতনীর মুখের দিকে তাকিয়ে সঞ্চারীর মা- মামা মামি কাকু- কাকিমা চেষ্টা করে দেখল, কোন লাভ হল না। বরফ জমতে জমতে দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর তৈরি হয়ে গেছে এবং যারা এই প্রাচীর লঙ্ঘন করতে পারে, তারা এই বরফ গলাতে আদৌ ইচ্ছুক নয়। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হল বীতশোকের একা একা বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাওয়া। একবার দু বার নয়, বছরে দুই থেকে তিনবার। একি রে বাবা? সঞ্চারীকে আমরা প্রশ্ন করলাম, “তুই অ্যালাও করছিস কেন?” সঞ্চারী উচ্ছে খাওয়া মুখে জবাব দিল, “ও যেন আমার অনুমতির তোয়াক্কা করে? আমাকে আজকাল আর সহ্যই হয়না ওর। সব কিছুতে খুঁত ধরে।আমার সব ভুল। সব ভুল। শালা ঘেন্না ধরে গেল মাইরি। বেঁচে আছি শুধু মা আর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে।“
অতঃপর? আর কি বসন্তদূত হয়ে মঞ্চে প্রেমের প্রবেশ।প্রেম মানে আপনি কি ভাবলেন ভালোবাসা? না মশাই। এ অন্য প্রেম। প্রেম মাড়োয়াড়ি।
প্রেমের সাথে সঞ্চারীর প্রথম আলাপ কবে, কোথায়, কি ভাবে আমরা কেউই জানি না। জীবন গতিময় আমরা সবাই ঘোরতর ব্যস্ত নিজেদের জীবন সংগ্রামে। সঞ্চারী আর বীতশোকের ব্যাপারটা নিয়ে সঞ্চারীও আর কিছু বলত না, আমরাও না। হয়তো অবচেতনে এই ভেবে আশ্বস্ত হতাম, যে সব ঠিক হয়ে গেছে বা যাবে। তাছাড়া প্রত্যহ কারো শয়নকক্ষে উঁকিঝুঁকি মারাটাও তো অনৈতিক। কবে থেকে জানি না গ্রুপে সঞ্চারীর পোস্ট গুলো ক্রমশ অশ্লীল থেকে অশ্লীলতর হয়ে উঠছিল।রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে সঞ্চারীর পাঠানো ছবি বা ভিডিও গুলি ছিল যাকে বলে খোরাক। না দেখে থাকাও যেত না, আবার দেখা মাত্র ডিলিট না করে উপায় থাকত না। গ্রুপে সঞ্চারীর জনপ্রিয়তা বাড়ছিল বটে, তবে পড়া বা দেখার পর সবাই প্রায় ছদ্ম বিরক্তি নিয়ে মন্তব্য করত, “কোথা থেকে পাস এ সব?” সঞ্চারীও রহস্যময় হেসে বলত, “আমার বয় ফ্রেন্ড পাঠায়।“ “বয় ফ্রেন্ড” বলতে এ ক্ষেত্রে আমরা সবাই ধরে নিতাম, এক্স বয় ফ্রেন্ড অর্থাৎ বীতশোক। মাঝে একদিন মজা করে কে যেন বলেই দিল, “এই মধ্য ত্রিশে প্লিজ আর বরকে বয় ফ্রেন্ড বলিস না। বড্ড ন্যাকা ন্যাকা শোনায়।“ সঞ্চারী মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, “মরণ!!! বরকে বয় ফ্রেন্ড বলতে যাব কেন?আমার গলায় দেবার দড়ি জোটে না রে? আমার সত্যিকারের বয় ফ্রেন্ড মানে বন্ধু। ভীষণ ভালো বন্ধু।“
            কি ধরণের পুরুষ বন্ধু, তার মহিলা বন্ধুকে এই ধরণের ছবি বা ভিডিও পাঠাতে পারে, ঠিক বুঝলাম না। যাই হোক হয়তো দু জনের কমফর্ট লেভেল সেই জায়গায় আছে, আমরা আর কেউ খোঁচালাম না। কারণ খোঁচাবার প্রয়োজনও ছিল না, সঞ্চারী শুধু আমাদের প্রশ্ন করার অপেক্ষাতেই ছিল বোধহয়, লাভার মত গড়গড় করে সব বলে দিল। প্রেম কুমার আগরয়ালা না ঝুনঝুনওয়ালা কি যেন, আদতে মাড়োয়ারি, যদিও বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে এই বঙ্গদেশই ওদের ঘরবাড়ি। সঞ্চারীর সাথে কর্মসূত্রেই আলাপ, যদিও সঞ্চারীদের দপ্তরে কর্মরত নয়। বহুদিন ধরে সঞ্চারীর একনিষ্ঠ স্তাবক এবং অনুরাগী। বহু উত্থানপতনে নাকি সঞ্চারীর ছায়াসঙ্গী। বীতশোকেরও অপরিচিত নয়।
ব্যাপারটা সঞ্চারীর কাছে নেহাত বন্ধুত্বের বেশি নয়, তবে প্রেম কুমার নাকি ওকে ভালোবাসে, নিখাদ সে ভালোবাসা। বিয়ে ওলা মহিলাদের প্রতি পরপুরুষের ‘নিখাদ’ ভালোবাসা ঠিক কি, তা আমাদের কারোরই অবোধগম্য নয়, তাও আবার একজন মাড়োয়ারি যুবকের, কিন্তু সঞ্চারীকে বোঝাবে কে?সঞ্চারীর রূপ, অর্থ এবং কন্ট্যাক্ট যে ঈর্ষনীয় এ নিয়ে তো কোন সন্দেহ নেই। যাই হোক, ভাব বেড়েই চলল, সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে লাগল সঞ্চারীর পোস্টের ধরণ।হোয়াটস অ্যাপে অশ্লীল পোস্ট বন্ধ হয়ে, সঞ্চারীর ফেসবুকের দেওয়াল ভরে উঠল শুধুই নানা রকম রোম্যান্টিক কোটেশনে। সব সঞ্চারীই শেয়ার করত অবশ্য, প্রেম ট্রেমের টিকিও দেখা যেত না। বুঝতে পারছিলাম সবাই যে সঞ্চারী ভয়াবহ রকমের প্রেমে পড়েছে।মানতে চাইত না অবশ্য। রোম্যান্টিক কোটেশন  প্রসঙ্গ উঠলেই বলত, “আরে ইয়ার, তোরা তো জানিস আমি প্রেমিক মানুষ। পড়ে ভালো লাগে তাই শেয়ার করি। এর পিছনে প্লিজ কোন রহস্য খুঁজতে যাস না।“ মুস্কিল হল, আমরা কেউই ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না, ভালো লাগলেও অকারণে সারাদিন ধরে শয়ে শয়ে রোম্যান্টিক কোটেশন শেয়ার করে বেড়াবার মত অপ্রাপ্তবয়স্ক আমরা কেউই নই। আর আমরা কিই বা করতে পারি? দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির যদি একে অপরকে ভালো লাগে,তাতে তৃতীয় বা চতুর্থ ব্যক্তির আপত্তির কি কোন জায়গা আছে? ঋতি শুধু কয়েকবার বলেছিল, “বীতশোক কি কিছুই বোঝে না? ও তো সঞ্চারীর ফেসবুক ফ্রেন্ড?” জবাবটা আমরা সকলেই জানতাম, “হায়রে বীতশোকের যদি সত্যি এ ব্যাপারে মাথাব্যথা থাকত?”
গ্রুপ থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছিল সঞ্চারী, মাঝে মধ্যে আসত, দু একটা কথা বলত, আবার হারিয়ে যেত। একদিন মেসেজ করল, “আজ আমি প্রেমের বাড়ি যাচ্ছি।“ “কেন? রে? নিমন্ত্রণ?” সাগ্রহে জানতে চাইলাম সবাই। “নাঃ। একটা কথা তোদের বলা হয়নি, আই থিঙ্ক আই আম ইন লাভ। ইন লাভ উইথ প্রেম।“ ওয়াও! প্রেমের সাথে প্রেম করছে আমাদের সঞ্চারী। কিন্তু প্রেম তো যতদূর শুনেছিলাম বিবাহিত, তাহলে? জবাবটা সঞ্চারীর হয়ে মধুপর্ণাই দিল, “ তো? সে তো সঞ্চারীও ম্যারেড।“ সঞ্চারী জানালো প্রেমের বউ বাপের বাড়ি গেছে, তাই প্রেমের কাতর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অভিসারে চলেছে, আমাদের পাশের বাড়ির সাদাসিধে প্রাণোচ্ছল মেয়েটি যে একদিন আর একজনকে ভালবেসে চাকরী ছেড়ে ঘোরতর সংসারী হয়ে উঠেছিল। সময়ও কি আজব জিনিষ না?
            কি বলব? কি বলা উচিৎ? একদম মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে আমরা বা বলা চলে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সব, পড়াশোনা তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন থেকে, এত উদারতা এখনও আয়ত্ত করে উঠতে পারলাম কই? বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে শিবানী মুখ খুলল, “সঞ্চারী, আমি তোকে নিষেধ করছি না যেতে, কিন্তু বাবু যা করবি, ভালো করে বুঝে শুনে কর। তোর প্রেমের মনে কতটা প্রেম আছে আমি জানি না। আমার, না শুধু আমার কেন এখানে সবারই মনে হয়, ব্যাপারটা অশালীন ভাষার জন্য মাপ করিস কিন্তু, নিছক বৌদিবাজি।“ সঞ্চারীর কোন জবাব এল না, একটু থেকে শিবানী আবার মেসেজ করল, “সঞ্চারী, আমি জানি তুই অনেক সহ্য করেছিস, কিন্তু এটা তোর বা তোদের একার সমস্যা নয়। আসে পাশে সব দম্পতিই কম বেশী এই সমস্যায় ভোগে সোনা।“  
“না। কেউ ভোগে না। তোদের বরদেরই দ্যাখ না? আমার বরের মত কেউ না। প্লিজ এসব কথা বলিস না। বড় কষ্ট হয়। বীতশোক যদি-”দীর্ঘ নীরবতা পর আবার লিখল, “বড় রিক্ত আমি। বড় শূন্য। রোজ রোজ এই সুখী দম্পতির ভড়ং করে করে ক্লান্ত। প্রেম আমায় ভালোবাসে। হি টোল্ড মি।“ কি বলি এই অবুঝ মেয়েটাকে? শিবানী তাও হাল ছাড়ল না, “সুমনার গল্প তো শুনেছিস। আমারটাও শুনে রাখ- তোরা তো জানিস কোন ছোটবেলায় আমার বিয়ে হয়েছিল, তোরা কেউ ভাবতে পারবি না, কি ভাবে আমার ছেলেটা হয়েছে, হাতেপায়ে ধরে। বিগত ষোল বছর ধরে সম্পূর্ণ সেক্সলেস ম্যারেজে জড়িয়ে আছি আমি।তার জন্য আমার স্বামীর মনে বিন্দুমাত্র শোকতাপ কিছুই নেই। আমি আছি শুধু ছেলের মুখ চেয়ে জানিস। তোর মত, কষ্ট পেয়ে পেয়ে আজ নিজেকে সামলে নিয়েছি। নিজের কাজে মন দিয়েছি, হাসি খুশি থাকি, ওসব নিয় মাথাও ঘামাই না। দ্যাখ সোনা, একটা জিনিষ গড়া খুব শক্ত, ভাঙা ততোটাই সহজ। সিদ্ধান্ত তোর।“
সিদ্ধান্ত সঞ্চারী নিজেই নিল। রাতে শুধু কে যেন জিজ্ঞাসা করল, “কেমন লাগল?” সঞ্চারীর জবাব তখনি ফুটে উঠল, “দারুণণণণ!!!! নিজের বরের সঙ্গে কখনও এত ভালো লাগেনি।“ ঘর কি মুর্গি কথাটা বোধহয় উভয়তই সত্য। মধুপর্ণা জানতে চাইল, “বীতশোক দাকে কি বললি?” “কি আবার বলব?” মুখ ঝামটে উঠল সঞ্চারী, “বরকে কি বলা যায় যে আমি অমুখের সাথে শুয়ে এলাম? রাতে শুধু বললাম, আই লাইক প্রেম আ লট। ও বলল, ‘ও’। আবার বললাম, ‘আই থিঙ্ক আই হ্যাভ ফিলিংস ফর হিম।‘ কি ভাবল, কে জানে, তারপর বলল,’কি রকম ফিলিং?’ বললাম,’ হি ইজ মোর দ্যান আ ফ্রেন্ড টু মি।‘” “তারপর?” সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল ঋতি। “নাথিং। আর কিছুই বলল না।“ 
প্রেমের সঙ্গে সঞ্চারীর সম্পর্কের পরিণতি কি হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়? কিছুই হয়নি এসব ক্ষেত্রে বন্ধুদের পরামর্শ কেন যে কেউ কানে তোলে না? আমি-আপনি হলেও হয়তো তুলতাম না বা তুলিনিআমাদের দূরদৃষ্টি অভ্রান্ত প্রমাণ করেই যেন, প্রেম অচিরেই মেসেজ পাঠালো, “ তুমি ভীষণ ভালো মেয়ে, আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু, কিন্তু এই ব্যাপারটাকে আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় সেদিন যা হয়েছে, তার জন্য আমি অত্যন্ত অনুতপ্ত, নিজের স্ত্রীকে এইভাবে ঠকাতে আমি পারব না তাছাড়া তোমারও তো সংসার আছে, আমার জন্য তোমার সংসার ভেসে যাক এ আমি মেনে নিতে পারব না সবদিক ভেবে, এই মুহূর্তে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না খুব ভালো থাকো সারাজীবন, এই প্রার্থনাই করিশুধু তাই নয়, পরবর্তী পদক্ষেপে হোয়াটস অ্যাপ এবং ফেসবুকে সঞ্চারীকে ব্লক ও করে দিল সঞ্চারী উন্মাদিনীর মত কয়েক দিন ফোন করতে থাকল, বারে বারে, কেউ ধরল না সেই ফোন
            এরপর? কিছুই না, কেমন যেন ঘেঁটে গেল, আমাদের গ্রুপটা সঞ্চারীর কষ্টে, আমাদেরও ব্যথা লাগত কিন্তু আপনি সমস্ত সচেতন বার্তা অগ্রাহ্য করে একাকিনী নিরস্ত্র অবস্থায় ব্যাঘ্র সঙকুল অরণ্যে ঘুরে বেড়াবেন, অথচ বাঘে আপনাকে স্পর্শ করবে না, এতো হতে পারে না আগুনে হাত দিলে, হাত পোড়ে এতো সতত সত্য মাঝে সঞ্চারীরা কটা দিনের জন্য বাইরে থেকে ঘুরে এল, পূর্বপরিকল্পিত ফ্যামিলি ট্রিপ ফেসবুকে সঞ্চারীর দেওয়াল আবার ভরে উঠল, “ছোটা পরিবার, সুখী পরিবারমার্কা ফোটোতে
            তাই বলে কি ভাবছেন, বীতশোক আর সঞ্চারীর মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল? প্রেমের জোয়ার এল? পাগল নাকি? পূর্বেকার আড়ষ্টতা, শীতলতা রয়েই গেল, শুধু দুজনই যে যার মত ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে লাগল বীতশোক তার পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব, ট্রেকিং আর পরিমিত মদ্যপান এই নিয়ে রইল (হয়তো, ভদ্রলোককে তো আর খুব বেশী চিনি না আমরা) আর আমাদের পাশের বাড়ির মেয়ে মনকষ্ট বুকে চেপে মেতে রইল অগুন্তি রূপমুগ্ধ, স্তাবক আর উপাসক দের নিয়ে
ঠিক কতগুলো যে প্রেম করছিল সঞ্চারী তার হিসেব রাখা দায় আমাদের অবশ্য সবই বলতো কখনও কখনও চ্যাট গুলি কপি করে পাঠিয়েও দিত এদের কেউই প্রেম কুমারের জায়গা নিতে পারেনি, সবই ছিল নিছক টাইম পাশ, ঐ যে কি বলে না ক্যাজুয়াল ফ্লিং। হোয়াটস অ্যাপে শুরু হোয়াটস অ্যাপেই শেষ। বড় জোর কোন কফি শপ বা ফ্লুরিজে একটা আধটা ডেট। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সঞ্চারীই যোগাযোগ বন্ধ করে দিত, কদাচিৎ তারাও সঞ্চারীকে ব্লক করে দিত। যেমন এক প্রেমমুগ্ধ পুলিশের বড় বাবুকে গভীর প্রেমের সাথে সঞ্চারী বলেছিল, পুলিশ মাত্রই ইয়ে, মানে ঐ আর কি। এরপর আর কি করে তিনি সঞ্চারীর সাথে ফোন প্রেম চালাতেন?
কাটছিল দিনগুলো মোটামুটি। বিরহ বোধহয় মেয়েদের আরো রূপসী করে তোলে, সঞ্চারীর রূপ যেন ফেটে পড়ছিল। বললেই অবশ্য সঞ্চারী বলত, “সবাই দেখে, সবাই বলে, শুধু আমার বরটাই বোঝে না শালা।“ হঠাৎ একদিন খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন ঘটল। আজ্ঞে হ্যাঁ। শ্রীমান প্রেম কুমার আনব্লক করে, মেসেজ করল, “কেমন আছো সঞ্চারী?” কেমন আছে সঞ্চারী? খুব ভালো আছে, দিব্যি চাকরী, সংসার, বাবা-মা, ছেলে সামলাচ্ছে, বরকে জড়িয়ে নামীদামী রেস্তোরাঁয় ছবি তুলছে,বরের জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীতে ঝিনচ্যাক কেক, ফুলের বুকে দিচ্ছে, ওর জন্মদিনে বর দামি উপহার দিচ্ছে, যার ছবি দেখিয়ে আমরা খিস্তি মেরে আমাদের বরদের কান দিয়ে রক্ত বার করে দিচ্ছি, দুদ্ধর্ষ আছে সঞ্চারী। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, এ গুলো সবই আমাদের অভিমত। সঞ্চারীর নয়।
আমরা পইপই করে নিষেধ করলাম, জবাব দিস না। এই তো তোর অপমান করার সুযোগ। এতদিন মেড়ো বলে যে সব গালি আমাদের কাছে দিচ্ছিলি, আজ ওকে মুখের ওপর দে, দিয়ে ব্লক কর হারামজাদাকে। সঞ্চারী সব শুনল, প্রতিশ্রুতিবদ্ধও  হল, কিন্তু মেসেজ করার সময় বলল, “তুমি আমাকে যে ব্যথা দিয়েছ, তা আমি জীবনেও ভুলব না। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারিনি, ঘুমের ওষুধ ও কাজে আসেনি। আর আজ যখন মানিয়ে নিয়েছি, ভালো থাকার চেষ্টা করছি---“। প্রেম ক্ষমা চাইল, একবার নয়, বারবার, লাগাতার চাইতেই থাকল। প্রতিশ্রুতি দিল আর কখনও ছেড়ে যাবে না। কতদিন অটল থাকত সঞ্চারী? মনের মধ্যে প্রেমের ফল্গুধারা বইছিলই, শুধু লাভার মত ফেটে বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় ছিল। অগ্নুৎপাত শুরু হতে সময় লাগল না। ভাসিয়ে নিয়ে গেল সঞ্চারীকে।
আমরা কেউই প্রেমকে দেখিনি, সঞ্চারীর চোখ দিয়েই প্রেমের সাথে আমাদের আলাপ, এবং সঞ্চারীর মতে এ প্রেম অন্য প্রেম। বিরহের দহনে, সব খাদ গলিয়ে ফেলে টাটকা সোনা হয়ে ফিরেছে প্রেম। আজকাল আর বাড়ি খালি থাকলে সঞ্চারীকে ডাকে না প্রেম,তীব্র ব্যস্ততার মধ্যে সময় করতে পারলে কোন কফিশপে মিট করে দুজনে। সেভাবে কোন নোংরা ভিডিও আর পাঠায় না বোধহয়, বা পাঠালেও তা আমাদের কাছে আসে না সঞ্চারীর মারফৎ।  ফেসবুকেও আজকাল সঞ্চারীর ছবি, পোস্টে লাইক কমেন্ট পাওয়া যায় প্রেম কুমারের। বোঝা যায়, কে দেখল বা কি ভাবল তাই নিয়ে আদৌ ভাবিত নয় দুজনে।
এমনকি ফেসবুকে যে সব মজার প্রশ্নোত্তর থাকে না, যেমন পরখ করে দেখুন আপনার সবথেকে প্রিয়বন্ধু কে? বা কে আপনাকে গোপনে ভালবাসে, এই ধরণের সব প্রশ্নের উত্তরে সঞ্চারী আজকাল প্রেমকেই পায় যেন প্রেম কুমারই ওর জীবনের অভীষ্ট সেই সব উত্তর সোল্লাসে আমাদের সাথে শেয়ারও করে সঞ্চারী, যদিও ফেসবুকে শেয়ার করে না বেচারা সঞ্চারী না বুঝলেও আমরা বুঝি যে কি ভয়াবহ স্নুপিং করে ফেসবুক আমাদের ফোনে যার সাথে আমাদের সবথেকে বেশি বাক্যালাপ বা বার্তালাপ হয়, তাকেই বারবার দেখায়, আপনাকে খুশি করার জন্য
আরো বেশ কিছুদিন কেটে গেল, বড়দিনের ছুটিতে বাপের বাড়ি এসেছি, আজ আমাদের বাড়িতে গার্লস নাইট আউট সবাই বর-বাচ্ছা ফেলে আসতে পারেনি, মধুপর্ণা, চয়নিকা, ঋতি, সঞ্চারী আর আমি আজ একসাথে থাকব তুলতুলি রাতে একতলায় তার দাদু-দিদার কাছে শোবে আর আমরা দোতলায় সারারাত ধরে হৈচৈ করবজব্বর শীত পড়েছে, ঠাকুমার বিয়ের বিশাল খাটে গোটা দুই ভারি লেপের তলায় সবাই মিলে কুঁকড়ে শুয়ে ব্যাপক আড্ডা চলছে মাঝে মাঝেই কার পা কার গায়ে লাগছে, অমনিএই লাথি মারিস না শালা বলে আর একজন পা চালাচ্ছে,” আর হাসির কলরোল উঠছে ঋতির আর আমার বর শুতে যাবার আগে ফোন করল দুজনেরই এক প্রশ্ন, শুধু খানা তো? পিনা টিনা? আমাদের এই কড়ি বরগা ওলা যৌথ পরিবারে পিনার নাম করলেই মা জুতো পেটা করবে আমরা সেটা চেপে, ন্যাকা সুরে বললাম, “পাগল? তোমাকে ছাড়া পিনা? শেষে কাকে নিজের বর ভেবে চুমু খেতে যাব তার ঠিক নেইআবার ছলছলিয়ে হেসে উঠল বাকিরা
বীতশোকদা ও ফোন করল খবর দিল, সোনাই ঘুমিয়ে পড়েছে, শুভরাত্রি জানিয়ে ফোন রাখল প্রশ্নটা অনেকক্ষণ ধরেই পেটে আসছিল, মুখে আসছিল না, ঋতিই করল, “হ্যাঁরে সঞ্চারী, বীতশোক দার সঙ্গে সব ঠিকঠাক?” “ঐ আর কি?” ঠ্যাং ছড়িয়ে আড়ামোড়া ভেঙে বলল সঞ্চারী, “আর কিছু ঠিক বা বেঠিক হবার নেই ছেলের জন্য দুজনে একসাথে আছি সোনাই ওর বাবাকে আর আমাকে একসাথেই চায় আমরা ঝগড়া করলে খুব আপসেট হয়ে পড়ে একদিন দেখলাম, মাঝরাতে উঠে চুপ করে নাইট ল্যাম্পের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, গায়ে হাত বুলিয়ে বললাম, ‘কি হয়েছে বাবু?’ বলল,’কিছু না মা তোমরা কেন এত ঝগড়া কর?আমার যে খুব কষ্ট হয়‘” “আহা রেএক সাথে বলে উঠলাম আমরা সবাই প্রায় সঞ্চারী হাই চেপে বলল, “হু সেদিন থেকে ওর সামনে ঝগড়া করাটা বন্ধ করার চেষ্টা করছি আর এমনি বীতশোক খারাপ লোক তো নয় খুবই ভালো ছেলে ভীষণ ভালো বাবা
বেশ কিছুক্ষণের জন্য কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম আমরা সঞ্চারী আবার বলল, “কটা দিনের জন্য বেড়াতে যাব“ “কোথায়?” “জানি না, কাছে পিঠে কোথাও বীতশোক তো বছরে কতবার বন্ধুদের সাথে ট্রেকিং এ যাচ্ছে, এখানে যাচ্ছে, ওখানে যাচ্ছে, এবার আমার পালা শুধু ছেলেটার ব্রেন ওয়াশ করা দরকার ও আমায় ছেড়ে কখনও থাকেনি তোআমাকে একা কটা দিন কোথাও কাটিয়ে আসতে হবেমধুপর্ণা তীব্র শ্লেষের সুরে বলল, “একা যাবি?” “নাঃ ডারলিং জানোই তো কার সাথে যাবচোখ টিপে বলল সঞ্চারী ঋতি উঠে বসে বলল, “সঞ্চারী ও তোকে বিয়ে করবে?” “পাগল?” হেসে গড়িয়ে গেল সঞ্চারী ওর বাবা-মা দেখে বিয়ে দিয়েছিল, সেই বউকে ওর নাপসন্দ, তবে বাচ্ছা আছে তো তাকে ও ছাড়তে পারবে না ও বলেই দিয়েছে আর তাছাড়া আমিও বোধহয় চাই না, সম্পর্কটার ঐ পরিণতি হোক“ “তাহলে? এই ভাবেই চলবে? ফেসবুকে জনসমক্ষে বীতশোক, আর হোয়াটস অ্যাপে নিভৃতে প্রেম?” মধুর গলার শ্লেষ এখনও কমেনি সঞ্চারী দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “হু এই আমার নিয়তি“ “এটা কি কোন জীবন হল সঞ্চারী?” “জানি না ভাবতেও চাই না, শুধু জানি এতেই আমি ভালো আছি সুখে আছি- আর সুখে থাকার অধিকার তো আমারও আছে বল?” সত্যই তো সুখের সংজ্ঞা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয় আজ আমাদের পাশের বাড়ির সেই ভীতু লাজুক নিপাট ভালো মেয়েটা যদি মেয়েটা যদি নিজের মত করে সুখ খুঁজে নেয় তাতে কার কি বলার আছে সঞ্চারীরা বরাবরই ছিল, আছে, থাকবেও, এরা ঠিক কি ভুল এর জবাব ---- জানেন শুধু মহাকাল দেখাই যাক না---

(শেষ)