Sunday 21 May 2017

Throwback


#কণাওতারমেয়েরা
She was a suckling baby, when her mother left... raised by her drunk father and ailing grandmother, who used to curse her mother with every single breath... but she failed to hate her..she prayed that someday her mom would come back....
She had seen her secretly... mesmerized by her beauty.. her charm, her richie rich husband, her beautiful step sister.. who looked like a fairy to her.. she was happy for them.
She grew up... a mediocre girl ... got a descent job... got married to a decent middle class boy... on her wedding she expected her to show up.. with closed eyes she dreamed that her mother was flipping through her veil... getting her ready... but how could she? She wasn't even invited.
Time flies... now she is a mother.. one night land phone rings... she picks it up... someone's weeping on the other side...she begins howling like  an intoxicated wild animal, difficult to tame , all she could say, is "ma kandche" (my mother is crying )

http://amianindita.blogspot.in/2015/07/blog-post.html?m=1

Monday 15 May 2017

সেন দের একদিন


(পর্ব ১)
“পায়েসটা কেমন হয়েছে?” লোভী লোভী চোখে প্রশ্ন করল তৃণা। দিনের বেলাটা যেমন তেমন করে কাটলেও, রাতের খাবারটা ওরা সাধারণত একসাথেই খায়। ওরা অর্থাৎ সোমনাথ, তৃণা, ওদের বছর বারোর পুত্র ঋক এবং বছর সাতেকের কন্যা তনয়া ওরফে মাম্পি।সোমনাথ এক নামি বেসরকারি জীবন বীমা সংস্থায় কর্মরত। তৃণা শিক্ষিকা। ঋক এবং মাম্পি ঠাকুমার হাতেই মানুষ। ঠাকুমা অর্থাৎ রুমেলা দেবী নিজেও শিক্ষিকা ছিলেন। বর্তমানে কন্যার অর্থাৎ তৃণার ননদের বাড়ি কটা দিনের জন্য বেড়াতে গেছেন। তৃণাদের সরকারি স্কুলে গরমের ছুটি পড়ে গেছে। যদিও ঋক মাম্পির বেসরকারি স্কুল এখনও ছুটির নামগন্ধ করছে না।
যাইহোক পরম যত্নে পায়েস বানিয়েছে তৃণা। বর-ছেলে-মেয়ে তিনজনেরই ভীষণ প্রিয়। বানাতে বানাতেই বুঝতে পেরেছে, দুধের তুলনায় চালটা একটু বেশিই পড়ে গেছে আজ। তবু যদি ওদের ভালো লাগে, তাই প্রশ্নটা করল তৃণা।মাম্পি এঁটো মুখেই চকাস করে মায়ের বাজুতে একটা চুমু খেয়ে দুআঙুলে দেখালো, “এক্সেলেন্ট”। সোমনাথ মাথা নেড়ে শারীরিক বিভঙ্গে বোঝাল, “গুড”। ঋকের সঙ্গে সন্ধ্যাবেলাতেই এক চোট ধুন্ধুমার হয়ে গেছে মায়ের, ফলে এমনিতেই চটে ছিল, মাথা নিচু করে চামচ নাড়তে নাড়তে গোঁজ হয়ে বলল, “ভালোই। তবে ঠাম্মার মত নয়।“
মুহূর্তের মধ্যে গোলাপি মুখটা ব্যথায় কালো হয়ে গেল তৃণার। ভালো হয়নি বললেই পারত। তাই বলে ঠাম্মার সাথে তুলনা? সোমনাথ মাথা নেড়ে বলল, “না।না। ভালোই তো হয়েছে।“ ব্যথা পরিণত হল নিদারুণ ক্ষোভে, সেখান থেকে পলকে জন্মালো দুর্নিবার ক্রোধ। গলায় বিষ ঢেলে তৃণা বলল, “থাক। আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না।“ “যাঃ বাবা!! ভালো কথাই তো বললাম?” হতভম্ব হয়ে বলল সোমনাথ। “ অত ভালোর দরকার নেই বুঝলে। বাঙালরা নাকি আবার ভালো হয়?” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল তৃণা। “এর মধ্যে বাঙাল ঘটি এল কোথা থেকে? আর তাছাড়া তোমার বাবা তো জেনে শুনেই আমাদের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন না কি? বৈদ্য ঘটি সুপাত্র জোটে ইয়ে মানে পাননি তাই।“ মুখ ফসকে বলে ফেলেই প্রমাদ গুনল সোমনাথ।
“ও আমার বর জুটছিল না? তুমি দয়া করে বিয়ে করে আমার বাপকে উদ্ধার করেছ নাকি?” ঝগড়া গড়ালো কান্নাকাটিতে। ক্ষণেক পর আবার ঝগড়া, আবার কান্নাকাটি। মায়ের হয়ে বরাবরের মত গলা ফাটালো মাম্পি, বাবার হয়ে ঋক। ডাইনিং রুম হয়ে দাঁড়ালো যুদ্ধক্ষেত্র। ভাইবোনের এক প্রস্থ হাতাহাতির পর, মাম্পিকে নিয়ে স্টাডিরুমে খিল লাগালো তৃণা।ঋক শুলো বাবার সাথে বেডরুমে।
শুয়ে শুয়ে গজগজ করতে লাগল মাম্পি। “দাদাটা খুব বাজে ছেলে মা। একদম বাবার মতো। তুমি বাবাকে ডিভোর্স করে দাও। কেন বিয়ে করেছিলে এমন বাজে লোককে।“ তৃণার মাসতুতো ভাই আর সোমনাথের খুড়তুতো বোনের সাম্প্রতিক বিবাহ বিচ্ছেদের দরুন ডিভোর্স শব্দটা মাম্পি ঋকের কাছে অপরিচিত নয়। মাম্পি বলেই চলেছে, “ চলো বাবাকে ডিভোর্স করে তুমি আর আমি দাদান-দিদানের কাছে গিয়ে থাকি? অ্যাঁ মা?”মাম্পি দাদু-দিদা অন্ত প্রাণ। বাবা মায়ের ঝগড়া হলেই ডিভোর্সের প্রস্তাব দেয়। যাতে মা, দাদুদিদাকে এক সাথে পেতে পারে। তৃণা মেয়ের শুকনো ঠোঁটে চুমু দিয়ে ভাবতে লাগল, সত্যি যদি বিচ্ছেদ চায়? সোমনাথ আপত্তি করবে না, এটুকু নিশ্চিত। মাঝে মাঝেই তো বলে, আজও বলল, “না পোষালে চলে যাও।“ এতদিন ভাবত, ঝগড়ার সময় রাগের মাথায় বলে, আজ ভুল ভাঙল। চলেই যাবে তৃণা। কিন্তু একার মাইনেতে চলবে কি? দুদুটো বাচ্ছার পড়াশোনা, ভবিষ্যৎ। সোমনাথ কিছু তো দেবে? নিতে যতই ঘৃণা লাগুক, ও নেবেই। কিন্তু থাকবে কোথায়? দুদুটো বাচ্ছা সমেত ডিভোর্সি মহিলাকে কে বাড়ি ভাড়া দেবে? বাবা মার কাছে থাকা যাবে না। আত্মীয়স্বজন তাহলে আর বাঁচতে দেবে না। সবার কাছে কি যে খোরাক হবে, অনেকেই উল্লসিত হবে, ওর সর্বনাশের খবরে। আসলে সবাই খুশি হবে, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীবৃন্দ কে হবে না? বলবে বড় বাড় বেড়েছিল, পয়সার দেমাক, রূপের দেমাক সইল না তো? অথচ ঈশ্বর জানেন তৃণার কোন দেমাক নেই। সহকর্মীরা নির্ঘাত তৃণার পুরানো ভেঙে যাওয়া প্রেমের উপাখ্যান বিশ্লেষ করে বলবে, “তৃণা বউ মেটিরিয়ালই নয়। ফুলে ফুলে মধু খাওয়া টাইপ। অথবা সোমনাথের নির্ঘাত কোন অ্যাফেয়ার চলছে?” অ্যাফেয়ার? সোমের ভাবতেই হাসি পায় তৃণার। ঈশ্বর জানেন ওরা কতটা ভালোবাসে একে অপরকে। আচ্ছা বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও সোম ওর বন্ধু থাকবে তো? সোমের থেকে ভালো বন্ধু তো তৃণার কেউ নেই, কোনদিন ছিল না। সমস্যায় পড়লে তৃণা কাকে ফোন করবে? সোমকে করলে সোম ধরবে তো? এত বড় সহমরমী তৃণা আর কি কাউকে কোনদিন পাবে? ভাবতে ভাবতেই ঘুমন্ত মেয়েকে জড়িয়ে হুহু করে কেঁদে ফেলল তৃণা। সোম না থাকলে সমাজের কুকুর বেড়াল গুলো ওকে ছিঁড়ে খেতে আসবে, সব থেকে বড় কথা, ওকি সোমকে ছেড়ে থাকতে পারবে? রাতে সোমকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে না শুলে, সোমের গায়ের গন্ধ নাকে না এলে যে তৃণা ঘুমোতে পারে না। কি হবে?
সেন দের একদিন (পর্ব- ২)
রাগের থেকে বিরক্তি লাগছিল সোমনাথের। মধ্য চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছেও তৃণার এই ছেলেমানুষি গুলো আর নেওয়া যাচ্ছে না। কবে সোমনাথের ঠাকুরদার বাবা কর্মসূত্রে এপাড়ে বাসা বেঁধেছিলেন, দেশভাগ তখন দূর অস্ত। ঠাকুরদা, বাবা সবার জন্ম এ দেশে।ঠাকুমা বর্ধমানের মেয়ে ছিলেন, বোনের বিয়ে হয়েছে ঘটি বাড়িতে আর মা আর তৃণা এখনও ঘটি বাঙাল নিয়ে লড়ে যাচ্ছে। মা শুরু করে, তৃণা ঘরে এসে ধুন্ধুমার বাঁধায়। আর আজ তো মাও ছিল না। আগামি কাল শনিবার, কোথায় এক পাত্র নিয়ে বসবে, সারা সপ্তাহের না বলতে পারা অজস্র কথা জমে আছে দুজনেরই, তারপর একটা বই পড়বে, শোবার আগে আর এক পাত্র, সব ঘেঁটে দিল মেয়েটা ধুৎ। বইটা নিয়ে শুয়েছে অবশ্য, তবে একটা পাতাও শেষ করতে পারেনি, মাথায় হয়তো ঢুকতও, যদি ঋক বকবকটা থামাতো।

“বিলিভ মি বাবা, শি ইজ জাস্ট হরিবল্। আমাকে কথায় কথায় বলে, বাবামা মুখের রক্ত তুলে বড় করবে, আর তারপরই নাকি আমি ভালো চাকরি পেয়ে ফুড়ুৎ--। বিয়ে করলেই নাকি আমি আর তোমাদের চিনতে পারব না। পর হয়ে যাব। আর বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসব। ব্লা ব্লা ব্লা। ক্যান ইউ ইম্যাজিন?” চরম বিরক্তিতেও হেসে ফেলল সোম। তৃণার কল্পনাশক্তি তুলনাহীন। অবশ্য এই সব কথাই ওর মাও ওকে বলেছে কখনও না কখনও। এ গুলো হল টিপিক্যাল বাঙালি মায়েদের ইন্সিকিউরিটি। তৃণা ঋককে অসম্ভব ভালোবাসে বলেই, সর্বদা হারিয়ে ফেলার আতঙ্কে থাকে। মাম্পিকে নিয়েও ত্রাসে থাকে তবে তা অন্যরকম আতঙ্ক। ভালো তো সোমনাথকেও বাসে তৃণা, মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা, তাই এত আঘাত করে। মেয়েরা যে কেন এমন হয়? যাকে ভালোবাসে তাকেই আঘাত করতে ভালোবাসে। তৃণার আঘাতে অবশ্য বিরক্তি ছাড়া আর কোন বেদনাই বোধ হয় না সোমনাথের।

ঋক বাবার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এল, “ তুমি কি করে সহ্য করো বাবা? ঐ জন্যই তো অমুক নায়ক এবং তমুক গায়ক আর গেটিং ডিভোর্সড। অমুক খেলোয়াড়ের ও শুনছি জলদি ডিভোর্স হতে চলেছে। এভাবে থাকা যায় নাকি? রোজ রোজ ঝামেলা করার থেকে একেবারে আলাদা হয়ে যাওয়া ফার বেটার। কি বলো বাবা, অ্যাঁ? আই তো হ্যাভ ডিসাইডেড, আমি বিয়ে করছি না। রোজ রোজ মায়ের সাথে খিটপিট খিটপিট কে সইবে? তবে বাবা বুঝলে লিভ ইন ব্যাপারটা মন্দ নয়।“ সোমনাথ দড়াম করে বই বন্ধ করে হাঁ করে ছেলের দিকে তাকালো, ঋক করুণার দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “লিভ ইন ইউ নো। বিয়ে শাদি না করেও একসাথে থাকা। পোষালে থাকো না পোষালে বাইবাই। তবে একটা স্টেডি গার্ল ফ্রেন্ড চাই। মধুজা টাইপ।“

“বাপরে। এত কিছু শিখলি কোথায় রে? মধুজা টাইপ অ্যাঁ? তাই জন্যই মা বলছে কদিন ধরে ছেলেটা গোল্লায় গেছে তুমি একটু দেখো। মধুজার বাবামায়ের থেকে যদি একটা কমপ্লেন এসেছে, বা স্কুল থেকে, আমি তোমার ছাল ছাড়িয়ে ডুগডুগি বানাব। মাও বাঁচাতে পারবে না। বাবা মায়ের ডিভোর্স? অ্যাঁ? স্টেডি গার্ল ফ্রেন্ড অ্যাঁ? মধুজা? অ্যাঁ? চল মায়ের কাছে----“। চরম নাস্তিক হয়েও মনে মনে  ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালো সোমনাথ। এই সুযোগ ছাড়া চলবে না। এই সব নিয়ে ঋককে ভিলেন বানিয়ে আগে বউকে তো পটানো যাক, তারপর ঋক কি করল মধুজা না আয়েশাকে পটাল নাকি তাও পারল না ঢ্যাঁড়শ ছেলে টা তাই নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নয় সোমনাথ সেন।

ছেলের কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে স্টাডির দরজায় টোকা দেবার আগেই দরজা খুলে দিল তৃণা। কোলে ঘুমন্ত মাম্পি, কয়েক মুহূর্ত দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল, তৃণার মনে হল, “এত ভালোবাসা! এত ভালোবাসা দিয়েছ প্রভু?” আর সোমনাথ ভাবল, “যাক আজকের মত শান্তি। এখনও সময় আছে, তৃণা যদি খেপে না যায়, এক পাত্র হতেই পারে?”



Monday 1 May 2017

তুত্তুরী উবাচ

তুত্তুরী উবাচ ১২ই মে, ২০২০

রাতের বাসন মাজছি, কন্যার প্রবেশ
 -(আদুরে গলায়)মা, অমুকের(জনৈকা মাতৃস্থানীয়া) গাল গুলো না একদম ট্যারান্টুলা মাকড়সার মত-
-(ধড়াম করে হাত ফস্কে একটা বাটি পড়ে গেল) মানে? উনি তোমায় কত ভালোবাসেন আর তুমি ওণার সম্পর্কে এমন কথা বলছ?
 -(হতবাক হয়ে) কি বলেছি? বলছি তো ওর গালগুলো কি দারুণ ফোলা আর কি রোমশ। 
-ট্যারান্টুলার মত গাল বললে কেউ খুশি হয় না বাবু।
-তাহলে কি বলব? পমেরিয়ান পাপির মত থলথলে রোমশ?
- আরে দূরঃ। কোন মহিলার গাল কখনও রোমশ বলতে নেই।  ওটা প্রশংসাসূচক নয়। বলো না।
-(ভাবিত স্বরে) অ। আমি অনেক ভেবে দেখেছি জানো মা, বাচ্ছাদের জীবনের সবথেকে সুন্দর সময়টাতেই তাদের জ্ঞান থাকে না।
-মানে?
-মানে যখন তারা মায়ের পেটে থাকে, কত ভালো থাকে। সারাদিন খেলে আর ঘুমোয়। (আড় চোখে তাকিয়ে) কেউ পড়তে বসতেও বলে না-
-হুঁ বুঝেছি। এবার ব্রাশ করে চুপচাপ শুয়ে পড়। কাল আবার বেরোতে হবে, বাবা গো।
-(বিরক্ত স্বরে) আরে যাও। যাও। আপিস যাও। আমারও কোনদিন স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। আমি কি তাই বলে ঘ্যানঘ্যান করি?

তুত্তুরী উবাচ ৯ই ডিসেম্বর ২০১৯

শীত যদি পড়ে বৃষ্টি তো পড়বেই裸洛। অঝোরে ঝরবে নাকের পানি। সঙ্গতে ঘঙ্ঘঙে কাশি। চিড়চিড়ে মেজাজ। উষ্ণ বদন। ফলশ্রুতি ইস্কুল কামাই। এবং মায়ের অফিস ও।
এতদসত্ত্বেও কথায় কথায় যথাক্রমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এবং ডুগরে ডুগরে কান্না।
-মাসি খুব বাজে郎। মাসি আমায় চান করাতে গিয়ে আঁচড়ে দিয়েছে। মাথায় নখ ফুটিয়ে দিয়েছে।
-বাবু,মাসি তোমায় সেই পাঁচ দিন-
-(টলটলে দুই চোখে ঝলসে ওঠে রাগ)মোটেই পাঁচ না। সাত দিন।
-(জিভ কাটে মা) আচ্ছা।  সাত দিন। সেই সাত দিন বয়স থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। মাসি কি তোমায় নখ ফুটিয়ে বা আঁচড়ে দিতে পারে? তুমি নিজে বিশ্বাস করো?
-(উদগত্ কান্নার বেগ কিঞ্চিৎ বেড়ে গেল) তুমি আমায় বিশ্বাস করো না蠟? আমার অন্য মাসি চাই।
-আচ্ছা বেশ। তাহলে নমিতা মাসি? (প্রসঙ্গতঃ নমিতা মাসির নামটা বদলে দিলাম বটে,তবে নমিতা মাসিও আমাদের বাড়িতে বছর পাঁচেক তো আছেনই। দিনে দুবার আসেন। ঝাড় মোছ বাসন মাজেন,তুত্তুরীর মাসির সঙ্গে তাঁর সাপে নেউলে সম্পর্ক। দুজনেই দুজনার দোষ ধরেন। সর্বোপরি নমিতা মাসি ভয়ানক নোংরা। ধুয়ে যাওয়া বাসনে হয় এঁটো নয়তো সাবান পাওয়া যায়ই। বলাইবাহুল্য তুত্তুরী মোটেই তার অনুগামিনী নয়। তবে আপাততঃ মাসি ফাঁসির যোগ্য অপরাধ করেছে-। অসুস্থ দুর্বল তুত্তুরীকে স্নান করানোর অছিলায় নখ ফুটিয়ে দেওয়া? এক্কেবারে ক্ষমার অযোগ্য। কি বলেন?
ফর্সা ঈষৎ মলিন দুই গণ্ড বেয়ে টপটপ করে ঝরছে মুক্তোর দানার মত অশ্রু বিন্দু। এরই মধ্যে আসছে মায়ের ফোন। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফোঁপানি। বুঝলাম খিদে পেয়েছে। প্রায় জোর করে খেতে বসতে এবং বসাতে হল। একা খাবে না কি তুত্তুরী? শেষে হয়তো বলেই বসবে, আরেকটা মা চাই। 
খেতে বসেই কান্না।
-আমি নাক টানতে পারছি না কেন? ও হো হো। আমার খিদে নেই। এত ভাত দিচ্ছ কেন? ও হো হো। বাবা আমাকে বেশী করে খেতে বলে গেছে। আমি কেন খেতে পারছি না? ও হো হো হো। ভাতের নাম দাও। তবে খাব। ও হো হো হো।
ভাতের নাম? আজ্ঞে হ্যাঁ।  কোন অদূর শৈশবে,শনি-রবিবার যখন তুত্তুরীকে স্বহস্তে খেতে শেখাতাম, ভাত মেখে গাল পাকিয়ে সাজিয়ে রাখতাম চক্রবূহ্যে। তারপর হত তাদের নামকরণ। কখনও কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী অবধি রাজ্যের নামে নাম হত তাদের। কখনও তারা হত কালানুক্রমে মহান ভারতীয় সম্রাটগণ যথা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বা অশোক থেকে ঔরঙ্গজেব। আবার কখনও কোন গল্পের চরিত্র। একঢিলে মারা পড়ত অনেক পাখি। পেট ও ভরত, উপরি পাওনা ইতিহাস ভূগোল বা সাহিত্যচর্চা‍। তাই বলে এই বুড়ো বয়সে? তাই সই। প্রথমে গরম ডাল আর কচি বেগুন ভাজা মাখা ভাতের নাম হল পঞ্চপাণ্ডবের নামে। সাথে জুটলেন দ্রৌপদীও। আমি নামকরণ করার পরও, দুষ্টু পাণ্ডবরা থালায় ছোটাছুটি করে বদলে ফেলল স্বঅবস্থান। এবার চিনব কেমন? চিনতে পারবে কেবল তুত্তুরী।
- কি রে কাকে খেলি?
-উরে বাবারে। মুখের মধ্যে গদা ঘোরাচ্ছে গো। এই ভীম! দাঁড়া! তোকে কচকচিয়ে খাব। ব্যাটা।
(পরের গ্রাস)মা, মুখে তীর ফোটাচ্ছে! এটা অর্জুনই হবে বলো? (পরের গ্রাস) মা নকুলকে চিনব কি করে?
-পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে নকুল সবথেকে রূপবান ছিল।
-হুঁ তাই দেখি। এ এত জামাকাপড়- সাজের জিনিস নিয়ে ঢুকেছে। ভালো করে চিবোই ব্যাটাকে।  আর সহদেব কি পারত মা?
-বোধহয় বল্লম চালাতে পারত।
-হুঁ। তাই বলি। এই গালে এত কি ফুটছে। অর্জুনের তীর অনেক সূক্ষ্ম ছিল। এ ব্যাটা তো হেবি মোটা। উ হুহু। দ্রৌপদী বলছে ও একটা স্পাউজ নিয়ে মুখের মধ্যে ঢুকবে।
- আর কি স্পাউজ বাকি আছে? সব তো তোর পেটে।
- কর্ণ আছে না? (আলু ফুলকপির তরকারী থেকে একটি ফুলকপির ন্যাজ ধরে টেনে তুলে) এই দেখো কর্ণের রথের চাকা।
-টেকনিক্যালি বাবু,কর্ণ ওর স্পাউজ নয়।
-ওঃ। ঐ ভাতটা খাব না। মাছের ঝোল মাখছ কেন? কে খাবে? আমি তখনই খাব যদি ওদের নাম দাও।
- আমার নামের ঝুলি খালি। তুইই দে। কৌরবদের নামে দে।
-আমি কৌরবদের বেশী লোককে চিনি না। 類
-যাদের চিনিস তাদেরই নামে দে। আমি কৌশিক মামার ফোনটা ধরে আসি। ইমপর্টান্ট।

ফোন সেরে বেরিয়ে দেখি,থালা জুড়ে কুরু বংশের রথী মহারথীগণ যুদ্ধে ব্যাপৃত। দুঃশাসনকে শাসন করতে একটু বেশী চিবানো হচ্ছে। দুঃশাসন ছাড়ুন,কন্যার দাঁতের নিরাপত্তা নিয়ে কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন বোধ করলাম। যে হারে কটাং কটাং করে চিবানো হচ্ছে। দেখলাম কর্ণ পুনরায় ফিরে এসেছেন কৌরব শিবিরে এবং সর্বোপরি রুই মাছের পেটিটি হয়েছে পিতামহ ভীষ্ণ। কাঁটা গুলি তাঁর শর শয্যার শর। আর মাছের ছালটি তাঁর ধুতি। মারাই যখন গেছেন আর- ইয়ে মানে ঐ আর কি।
উফ্ কে যেন বলেছিলেন,মা হওয়া কি মুখের কথা? হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, ভগবান।

তুত্তুরী উবাচ, ৪ঠা ডিসেম্বর ২০১৯

-মা, তোমার নতুন লিপ বামটা একটু লাগাব?
-লাগিয়ে দিলাম তো একটু আগে-
- না,আমি নিজে লাগাব।
-একদম না।
-কেন?
-কারণ, আগেরবার একটা গোটা লিপ বাম তুমি খেয়ে নিয়েছিলে।
-অ। সেটা মিষ্টি মিষ্টি ছিল। আমি শুধু নিভিয়ার লিপবাম খাই। মেবিলিন খাই না। 

[গপ্পটা হল,২০১৬সালের কথা (সাল তারিখ তুত্তুরীই ধরিয়ে দিল) শীত পড়ার মুখে মেয়ের খুব ঠোঁট ফাটছিল বলে,ওকে এক টিউব লিপবাম কিনে দেওয়া হয়। শুধু ও ব্যবহার করবে। পরের রাতেই তিনি নিখোঁজ হন। খোঁজাখুজি,ধমক ধামকের পর দলামোচড়া টিউবটা দিনচারেক পর বের হয়। আমাদের ধারণা ছিল ঐ টিউবটি ও রেড্ডিকে মাখিয়েছিল। রেড্ডি একটি রক্তিম বর্ণা তুলোভরা পুতুল ছিল। যাকে তার কদিন আগেই তুত্তুরী এক কৌটো বোরোলীন মাখিয়েছিল। এই নিয়ে মাসি বকতে যাওয়ায় মাসিকে শুনতে হয়,“পুতুল বলে কি রেড্ডি মানুষ না?ওর কি শীত লাগে না? গা ফাটে না?” পরে অবশ্য জানা যায়,বেচারা রেড্ডি নির্দোষ ছিল।]
তুত্তুরী উবাচ-২৮শে নভেম্বর, ২০১৯
-মা জানো, আজ মিস আয়ুষীকে আমাদের পিছন বেঞ্চে বসতে পাঠিয়েছেন।
-ও। তা সেটা ভালো না খারাপ?
-হুঁ। ভেবে দেখতে হবে樂। ভালই বোধহয়।  এতদিন তো আমাদের পিছনে কেউ বসত না-
-মানে? তুই লাস্ট বেঞ্চে বসিস নাকি?廊
-হ্যাঁ। তুমি আর সঞ্চিতা মাসিও তো তাই বসতে?(উঃ ভগবান, কি কুক্ষণে যে নিজেদের মেয়েবেলার গল্প শুনিয়েছিলাম-郎)
-শোনো না মা, আমাদের স্কুলের পাশেই যে বাড়িটা আছে না, ওরা আজ মাটন রাঁধছিল। কি ভুরভুর করে গন্ধ আসছিল-। অমুক মিস তো বেশ কয়েকবার ঐ দিকে তাকিয়ে নাকই টেনে নিল। মানে ঐ স্নিফিং আর কি-
- মিস নাক টানল? আর তোরা কি করছিলি?
-আমরা? আমরা তো চুপটি করে বসেছিলাম। দেখলাম,মিস নাক টানল,জিভ চাটল, তারপর বলল- “এই যা তো,জানলার গ্রীল কেটে ওবাড়ি থেকে একবাটি মাটন নিয়ে আয় তো।”
‍♂️-(বাবা গম্ভীর মুখে রুটি চিবুতে চিবুতে)হুঁ আনতে বলল,মাটন। এল বিফ। (বিফ অর্থাৎ গৌরি। তুত্তুরীর কাল্পনিক গরু। যে সবসময় লতাপাতায় ঘুরে বেড়ায়)
- না গো মা সত্যি। তোমরা তো কিছুই বিশ্বাস করতে চাও না। জানো আজ আরও কি দেখেছি? দেখলাম মৌমিতা মিস আমাদের কাঁচিটা ব্যবহার করে কাগজ কাটছে। (“আমাদের কাঁচি” হল একটি ছোট স্টিলের কাঁচি,যেটিকে হাতের কাজ পরীক্ষার দিন তুত্তুরী স্কুলে হারিয়ে এসেছে। তুত্তুরীর যদিও বক্তব্য মিস ঐটি কেড়ে নিয়েছেন)
-ওটা আমাদের, কি করে বোঝা গেল?樂
-হ্যাঁ মা আমাদেরটাই। মিসের তো একটা লাল কাঁচি ছিল। আমাদের কাঁচি নিয়ে নেওয়া?দাঁড়াও আমিও একদিন চুপচাপ ঐ কাঁচিটা নিয়ে চলে আসব। (প্রসঙ্গতঃ তারপর আমাদের বাড়ি তিন তিনটি কাঁচি কেনা হয়েছে। আর কাঁচি রাখার জায়গা নেই-濫)
-ছিঃ বাবু। না বলে পরের জিনিস নেওয়াকে কি বলে?
-(মাথা নীচু করে) চুরি। 
‍♂️-(বাবা, নিরাসক্ত মুখে রুটি চিবুতে চিবুতে)কিন্তু না বলে নিজের জিনিস ফেরৎ নিয়ে নেওয়াকে চুরি বলে না।
তুত্তুরী ও বিশ্বকাপ ২ ১৬ই জুন ২০১৮
-বাবা বিশ্বকাপ পাঁচ বছর পর পর হয়?
-(বাবা খেলা দেখতে দেখতে) নাঃ। চার বছর। আগেরটা ২০১৪এ হয়েছিল।
-হ্যাঁ আমার মনে আছে। মা বলতো যা বাবার সাথে গিয়ে খেলা দ্যাখ। আর তুমি বলতে যা মাকে গিয়ে জ্বালাতন কর। আর আমি ভাবতাম ওয়ার্ল্ড কাপটা কি রে বাবা? একটা কাপের মধ্যে পৃথিবীটা কি করে ঢুকবে?কাপটা তো ছাতু হয়ে যাবে।
(কিছুক্ষণ পরে)
-মা আমি ইজিপ্টকে সাপোর্ট করছি, তুমি কাকে?
-ইন্ডিয়াকে।
-আহাঃ ইন্ডিয়া তো খেলছেই না। একবার বাবা আর আমি ইন্ডিয়াকে সাপোর্ট করেছিলাম জানো তো, সেবার পাকিস্তান প্রাইজ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।  তুমিও বরং ইজিপ্টকেই করো। ইজিপ্টে পিরামিড আছে। মমি আছে। উরুগয়ায় ওসব নেই। এর আগে নামই তো শুনিনি।

(কিছুক্ষণ পর)
-মা মরোক্কো  কি ইন্ডিয়াতে?
-না।
-তাহলে ইরান?
-না।
-কোনটাই ইন্ডিয়াতে নয় ঠাকুর। তাহলে আমি ইরানকেই সমর্থন করি? মরোক্কোর লোকগুলোর দাড়ি এবং টাক আছে।আর ওরা বড্ড মারামারি করছে। খালি ইরানের খেলোয়াড়দের গুঁতো মারছে।  চিটিং কি না বলো?
(আরো কিছুক্ষণ পর প্রবল চিৎকার) মার। মার। মার। পা দিয়ে না পারিস মাথা দিয়ে মার। গোলকিপারের মাথায় মেরে ওকে অজ্ঞান করে দিতে পারলেই তো গোল। মারঃ। ইয়েস্ গোওওওল।
-(বাবা পাশ থেকে বিরক্ত হয়ে)কিসের গোল?ওটা তো আত্মঘাতী  গোল। সেমসাইড।
- যাই হোক গোল তো বটে। মমি স্পেন আর পর্তুগালের মধ্যে আমি এস্পানিয়াকে সাপোর্ট করব। তুমিও কোরো প্লিজ। আর কাল আর্জিণ্টিনা আর আইসল্যান্ডের ম্যাচে যেন আইসল্যান্ডই জেতে ঠাকুর। বাবার টিম যেন না যেতে।
- বাবু বাবার সামনে এসব বলিস না। বাবার মুখের চেহারা দেখছিস? মেরেই দেবে এবার।
-(বাবা তাচ্ছিল্যের সাথে) তা নয়। অন্য টিমকে সাপোর্ট করাটা অন্যায় নয়। তবে পাশে বসে রানিং কমেন্টারিটা বন্ধ করলে ভালো হয়। শুতে যা।
-সেই ভালো ঘুমিয়ে পড়ি। কাল খেলা দেখব। আইসল্যান্ডের লোকগুলো কোট পরে খেলতে নামবে।
-(বাবা হতভম্ব  হয়ে) খামোকা কোট পরে খেলবে কেন?
-বারে? আইসল্যান্ডে খুব ঠাণ্ডা না?
   
তুত্তুরী ও বিশ্বকাপ ১৪ই জুন ২০১৮
-মা তুমি কার সাপোর্টার? রাশিয়া না আর একটা কি যেন দেশ খেলছে?
-সৌদি আরব বোধহয়।
-হ্যাঁ। তুমি কাকে সাপোর্ট কর মা?
-কাউকেই নয়। আমি কি খেলা দেখছি?
-ও হোঃ। বাবাও বলল কাউকে না। তবুও খেলা দেখছে। (দুঃখ দুঃখ মুখে) মা, রেফারিটা আর্জেন্টিনার। ব্রাজিলের নয়।
-যাঃ বাবা, রেফারি  কোন দেশের তাতে কি আসে যায়?
-তুমিই তো সেদিন বললে, দাদু ব্রাজিলকে সাপোর্ট করে তাই তুমিও- আমিও তোমার দলে,ব্রাজিলকেই সাপোর্ট করি মমি। বাবা খালি আর্জিণ্টিনা।
-(বাবা খেলা দেখতে দেখতে তেতো গলায়) মেলা ভ্যাজোর ভ্যাজোর করিস না তো।
-(বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর) বাইশ জন লোকের একটা বল নিয়ে লাথালাথি করাটা কি ঠিক? বলো মা? আর ঐ লোকটা খামোকা গোল আগলে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
-(বাবা হতভম্ব স্বরে) আরে ওটাইতো ওর কাজ। ও তো গোলকিপার।
-(আবার কিছুক্ষণ পরে)  মাথা দিয়ে বলটাকে মেরে গোলকিপারের মাথাটা ফাটিয়ে দিলেই তো বলটা গোলে পৌছে যাবে। তাহলেই তো গোল।
-(বাবা বিরক্ত হয়ে) উফঃ।
-(বাবাকে মুখ ভেঙিয়ে আমার দিকে ফিরে আদুরে গলায়) গোলকিপারের মাথা ফাটালে ওকে লালকার্ড দেখাবে না তো? রেফারিটা আবার আর্জিণ্টিনার (শ্লেষাত্মক ভঙ্গীতে)।

তুত্তুরী উবাচ ২রা মে ২০১৯
-মা, মে দিবসে কি হয়েছিল গো? ঐদিন বিদ্যাসাগর মেয়েদের অনেক সম্মান দিয়েছিলেন?
-(বাবা পাশ থেকে ব্যঙ্গের সুরে) ওটা মেয়ে দিবস নয় রে হোঁদল-কুৎকুত। মে দিবস। মে মানে মাস। ঐ দিনে অনেক কিছু হয়েছিল, একটু লেখাপড়াটা শেখ তবে না জানতে পারবি।
-(খানিক ভাবনা চিন্তা করে) তুমি আমাকে অশিক্ষিত বললে নাকি?
-(বাবা) অশিক্ষিত না হলেও কোন মতে সাক্ষর তো বটেই।
-(বাবাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে) মা, বিদ্যাসাগর মেয়েদের বেশী সম্মান দিয়েছিলেন না রামমোহন রায়?
-(বাবা একগাল হেসে)এটা কি মায়ের ওজন নাকি যে তুলাদণ্ড দিয়ে মেপে বলবে।  হেঁ হে মানে বলছিলাম আর কি- (এরপরের গৃহযুদ্ধটা একান্তই ব্যক্তিগত )

তুত্তুরী উবাচ ২১শে এপ্রিল,২০১৮
-মা খেতে বসে তোমরা খালি নিজেদের মধ্যেই কথা বল, আমার কথাটা কেউ শুনছ না।
-আচ্ছা বল। কি বলবি।
-রোজ তো তুমি আমায় অঙ্ক করাও,আজ আমি তোমাকে একটা অঙ্ক করতে দি বরং।  মেন্টাল ম্যাথ কিন্তু মা। খুব শক্ত। খাতা পেন্সিল ব্যবহার করতে পারবে না।
-সে তো এঁটো হাতে এমনিই পারব না।
-হুঁ। তবে থালায় আঙুল দিয়ে হিসেব কষতে পারো।
-(বাবা, অধৈর্য স্বরে) উফ্! এত ভ্যানতাড়া না করে, প্রশ্নটা বরং করেই ফেল। মা কি ভাবে করবে, মা বুঝবে।
-হুঁ। খুব শক্ত কিন্তু মা। তুমি মনে হয় পারবে না।
-ছেড়ে দে। তাহলে আর বলে লাভ নেই।
-বাঃ। তাই বলে চেষ্টা করবে না? আমাকে যে বলো,চেষ্টা করলে সব হয়। তুমিও চেষ্টা করেই দেখো না। 
-(মা, ক্লান্ত স্বরে)ওরে বাবা রে। হয় কর, নয়তো ছাড়।
-করছি। করছি। বলো তো, আমি যদি এক হাতা চাউমিন খাই, তুমি যদি দুই হাতা চাউমিন খাও, তাহলে বাবা ক হাতা চাউমিন খাবে?


তুত্তুরী উবাচ ১৯শে এপ্রিল, ২০১৮
-একি রে? প্লাস্টিকের ব্যাঙটাকে এক বালতি জলে ডুবিয়ে রেখেছিস?
-(কার্টুনের মত হেসে উঠে)হিঃ হিঃ। হ্যাঁ মা। যাতে ও জলে ভাসতে শেখে। সাঁতার কাটতে শেখে।
-বাঃ। কি অসাধারণ বুদ্ধি। প্লাস্টিকের ব্যাঙকে এক বালতি জলে চুবিয়ে সাঁতার শেখানো।
-(পাশ থেকে বাবা,নিস্পৃহ স্বরে) আর আমার সাথে যা করেছে, সেটা যদি বলি তো মা তোকে কেটেই ফেলবে।
-(মা-মেয়ে দুজনে সমস্বরে) কি? কি করেছে/করেছি?
-(বাবা রহস্যময় স্বরে) আমার অফিস পরে যাবার কচি কলাপাতা সবুজ শার্টে কে ফেভিকল মুছেছে?
-(মা রাগত স্বরে)সে কি রে?বাবার অফিস যাবার জামায় ফেভিকল?
-(ভিজে বেড়ালের মত মুখ করে)হ্যাঁ। তুমিই তো সকালে বাবাকে বলছিলে, ঐ জামাটা এবার বাতিল কর। বালতি কিনব। বাবা শুনল না। তাই আর কি-
-(মা রাগত স্বরে) তো তাতে ফেভিকল লাগাবি?
-(ভাজা মাছটি উল্টে না খেতে জানা নিষ্পাপ মুখে) না মা। লাগাতে চাইনি। সত্যি। টেবিলে বোতলটা উল্টে গিয়েছিল তো, তাই ভাবলাম-(ঢোঁক গিলে) তুমি বকবে, তাই হাতের কাছে যা পেলাম তাই দিয়ে মুছেদিলাম।
-(বাবা একঘড়া কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন পূর্বক) তাই বলে আমার দামী শার্ট?ভেউ, ভেউ,ভেউ।
-(একপ্রস্ত বকুনি খাবার পর রাগত স্বরে মায়ের উদ্দেশ্যে)খালি বকা আর বকা। সকাল থেকে আমি কত কাজ করি, ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাই, আর তুমি?খালি অফিসে গিয়ে চেয়ারে পা তুলে বসে সবাইকে বকাবকি করো। (মাকে নকল করে,ডাইনিং চেয়ারে বসে)প্রীতি এটা কই?কৌশিক এটা কেন হয়নি?অরিন্দম ফোন কর। (মুখ বেঁকিয়ে )হুঃ। বাড়িতেও বকো। অফিসেও বকো।
-বেশ করি। বকার জন্যই মাইনে পাই তো।
-(সিরিয়াস গলায়)সত্যি মা?বকার জন্য টাকা পাওয়া যায়?
-হঁ। পাই তো। মাইনে।
-কে দেয়?মূখ্যমন্ত্রী?
-হুঁ। তা বলাই যায়।
-কত টাকা দেয় মা?পনেরো ষোল টাকা?
-অা না, তার থেকে একটু বেশীই দেয়।
-ও হ্যাঁ। তুমিতো অনেক লোককে বকো। তাহলে কত দেয় মা?দু-তিন কোটি?
-(বাবা পাশ থেকে ফোড়নের সুরে)তোর মা যে রেটে বকে, আরটু বেশীই দেয় বোধহয়, না রে?
   
তুত্তুরী উবাচ ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২০১৮
-(খাবার টেবিলে) মা একটা গল্প বলি শুনবে?
-বল।
-একটা শৌভিক বলে লোক ছিল। (বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি,বাবা একমনে রুটি চিবিয়ে যাচ্ছে,পাত্তা না পেয়ে আবার মায়ের দিকে ফিরে) সে একদিন অনিন্দিতা বলে একজনকে বিয়ে করল, আর তাদের একটা মেয়ে হল। তার নাম বুজু। বুজুর মা এই একটু চাষটাস করে আর কি)
-(বাবা গম্ভীর ভাবে) কোথায়?
-এই বারন্দাতেই করে (কাঁধ ঝাঁকিয়ে) তো যা বলছি,রোজ তোতাপাখি এসে বুজুর মায়ের ভুট্টা খেয়ে যায়। আর বুজুর মা চিৎকার করে,“দাঁড়া। ধরতে পারলে, ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন দেখিয়ে দেব। ”
-(বাবা গম্ভীর ভাবে উল্টোদিক থেকে আমাকে) তুই কি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে চিনিস?)
-(কোন মতে হাসি চেপে অভিমানী ঠোঁট ফোলানো মেয়ের উদ্দেশ্যে বললাম) বাবার কথা ছাড়, তুই বল।
-হ্যাঁ যেমন বাবা রোজ মশাগুলোকে বলে না?ধরতে পারলেই ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন দেখিয়ে দেব?তেমনি বুজুর মাও বলত। একদিন একটা লেপার্ড-
-(বাবা হতভম্ব হয়ে) লেপার্ড আবার কোথা থেকে এল?
-সুন্দরবন থেকে।
-(বাবা ফোঁৎ করে)সুন্দর বনে লেপার্ড?
-হুঁ। লেপার্ডটা এসে বলল,“বুজুর মা,এই ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধনটা কেমন একটু দেখাও দিকি?”বুজুর মা তো খুব ভয় পেল, কিন্তু মা দুর্গাকে ডেকে বলল, “ দেখাব। আগে একটা থলে, কিছু মুগুর আর একটা দড়ি নিয়ে এস।” তো বাঘটা মার্কেটে গিয়ে স্টাইলে বলল,“হ্যালুম”।
-(বাবা) আবার বাঘ কোথা থেকে এল?লেপার্ড ছিল তো?
-ও সরি। সরি। লেপার্ড আর বাঘ একই রকম লাগে দেখতে কি না। যাই হোক,ঐ  স্টাইলে হ্যাল্লুম শুনে সবাই পড়ি কি মরি করে কেটে পড়ল। তখন বাঘটা মামুলী থলে না নিয়ে একটা ব্বড় ব্যাগ নিয়ে এল। তারপর গিয়ে কাকাই এর ভারি ডাম্বেলগুলো নিয়ে এল। আর হাওড়ায় গিয়ে বাদলের দোকান থেকে একটা সাদা দড়ি নিয়ে এল।
-(বাবা উপহাসের ছলে)দড়ি আনতে হাওড়া?
-(বিরক্তি সহ) উফ্। খালি বিরক্ত করে বাবাটা। হ্যাঁ বাদলের দোকান থেকে দাদু সিগারেট আর দড়ি কেনে। সেই সাদা সাদা দড়ি যেগুলো পাজামায় পড়ে। হ্যাঁ তো মা, এইসব কিনে বাঘটা তো বুজুর মাকে দিল। বুজুর মাও ওমনি,ব্যাগের ভিতর বাঘটাকে ঢুকিয়ে মুগুর দিয়ে-গদাগুম গদাগুম। বাঘ ও ক্যাঁওম্যাঁওঘ্যাও করছে, প্রবল আওয়াজে নিচে থেকে আন্টি(আমাদের তলার ফ্ল্যাটের কালো মেম আন্টি) ছুটে এল। “অ্যাই হোয়াট হ্যাপেন্ড?”বুজুর মা তখন বলল, দেখতে চাও?তাহলে ব্যাগে ঢোকো। আর যেই না আন্টি ব্যাগে ঢুকল- ওমনি গপ্।
-(বাবা) আন্টি বাঘটাকে খেয়ে ফেলল?
-উফ্ বাবা কি বোকা। আন্টি তো ভেজিটারিয়ান। বাঘটাই-।  তারপর বুজুর মা আবার বাঘটাকে উত্তমমধ্যম দিল। তারপর ধোপা মানে ধোপারা যেখানে কাপড় কাচে, সেখানে ফেলে দিয়ে এল আর সুকন্যা মাসিকে ফোন করে দিল?
-(বাবা)আবার সুকন্যা কোথা থেকে জুটল। তোর মায়ের একা পিটিয়ে সাধ মেটেনি বুঝি?
- আঃ সুকন্যা মাসিই তো বনদপ্তরে খবর দেবে। (প্রসঙ্গত সুকন্যার বর বনদপ্তরের বড় সাহেব) যাইহোক একটা মোটকা ধোপা
-(বাবা)তোর মায়ের থেকেও-
- উফ্ বাবা চুপ। একটা ধোপা ভেবেছে অনেক কাপড় আছে বুঝি, কাচবে বলে যেই দড়ি খুলেছে,ওমনি গপ।
-(বাবা)কে কাকে খেল?
-বাঘ ধোপাকে গপ্।
-(ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা দশের ঘর ছুঁচ্ছে, তাড়া লাগালাম বাপমেয়েকে) আর নয়। এবার মুখ বন্ধ। খাওয়া শেষ করো।
-হুঁ। কিন্তু গল্পটা কেমন হয়েছে বলো?
-(আমি বলার আগেই বাবা গম্ভীর মুখে) ভি ই আর ওয়াই জি ও ও
-(একগাল হেসে)ভেরি গুড বাবা?
-(বাবা) ডি টা তো বলিনি।
-তাহলে?ভেরি গু? তার মানে?মা দেখো বাবা আমার গল্পকে কি যাতা বলছে--
তুত্তুরী উবাচ ২০শে ডিসেম্বর ২০১৭
-বাবা গরুরা খড় খায় কেন?তুমি জানো?
-না।
-হুঁ। একদিন একটা গরুকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে।
-আচ্ছা এবার বাইরে গিয়ে খেলা কর
- (অল্পক্ষণ পরে)কেঁউ কেঁউ কেঁউ কেঁউ
-কি হল রে?কুকুরের ডাক ডাকছিস কেন?
-এই দেখ না বাবা,কুকুর ছানাগুলো দিব্যি আমার সাথে খেলছিল, আচমকা আমার পা থেকে চটিটা খুলে নিয়ে পালিয়ে গেল। বললাম,‘এই ওমন করিস না। দে। দে আমার চটি ফিরিয়ে দে’। কথা কানেই নিল না। ইংরেজীতেও বলে দেখলাম কত কিছু। কিছুই বোঝে না। তাই ওদের ভাষায় বলছি, আমার জুতো ফেরৎ দে। কামড়াস না জুতোটাকে। ছিঁড়ে গেলে মা মারবে-কেঁউ কেঁউ কেঁউ

তুত্তুরী উবাচ ১৮ই নভেম্বর ২০১৭
(কালী পুজোর প্রাক্কালে)
-মামমাম(দিদা) বলছি কি না, যে মহিলা এত গয়না কিনতে পারে,সে একটা শাড়ি কিনতে পারে না? মা কালীর কথা বলছি।
আচ্ছা দাদু মা কালী সবসময় নাঙ্গুপাঙ্গু থাকে কেন বলো তো? দাঁড়াও তোমায় বলতে হবে না, আমিই বলছি,শোন, রাত্রিবেলা মা দুর্গা শোবার আগে গয়না খুলতে গিয়ে মনের ভুলে শাড়িটাও খুলে ফেলেছিল। ঠিক এই সময় শিব এসে বলল,‘আমার গাঁজার কল্কেটা দাও তো”।  বলতে এসে জগজ্জননীকে ঐ অবস্থায় দেখে শিব অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। শিবকে তাড়াতাড়ি করে তুলতে গিয়ে ভুল করে আবার শিবের বুকেই পা দিয়ে ফেলল অন্ধকারে,তাই তো মা দুর্গা অ্যাল করে এক গলা জিভ কাটল। বুঝলে তো মামমাম,অন্ধকার বলেই মা দুর্গাকে অমন কালো দেখায়।

(সাম্প্রতিক ডেঙ্গু উপলক্ষে)
-(বাবা গম্ভীর মুখে)সারা দিন ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে রাখবি। মশা যেন একদম না কামড়ায়। মশা কামড়ালেই কিন্তু? কি? ডেঙ্গু।
-(তুত্তুরী অবাক হয়ে) তো আমাকে বলছ কেন?মশাকে বল।

তুত্তুরী উবাচ ১৮ই অক্টোবর ২০১৭
(সময় গতকাল রাত সাড়ে দশটা)
-হ্যালো তুত্তুরী, কি করছ মা?
-কিচ্ছু না মামমাম(দিদা), এই একটু ভূত নামাচ্ছিলাম।
-অ্যাঁ?সেকি কেন?
-কাল ভূত চতুর্দশী তো তাই। তুমিও ভূত নামাও মামমাম।
-না বাবু, আমি ওসব পারি না। (শেষ পর্যন্ত তুত্তুরীর আব্দারের কাছে নতি স্বীকার করে)আচ্ছা তুমি যখন জেদ করছ,‘আয় ভূত, আয়। নাম নাম নাম। ’
-আঃ মামমাম। নাম নাম করলেই নেমেছে আর কি। ওকে কোলে করে নামাও।
- ছি ছি ছি। ভূতকে কোলে নিতে আমার বয়ে গেছে। আমি তোমায় ছাড়া আর কাউকে কোলে নেবো না।
-উফ্ মামমাম। আমি এতঃ ভূত নামিয়েছি, আর তুমি একটাকে নামাতে পারলে না?দাঁড়াও আমিই বলে দিচ্ছি, এই ড্যাবাড্যাবা চোখ ওলা একটা ভূত, ঐখানে আমার মামমাম তোকে ডাকছে, ওর হাত ধরে নেমে পড়।
ঐ যাঃ দুষ্টু ভূত নামার আগে আবার আমার ঘাড়ে একটুু হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল।

তুত্তুরী উবাচ ১৬ই সেপ্টেম্বর  ২০১৭
-মা,তোমার ফোনটা একটু দেবে?বাবারটা তো লক করা তাই।
-আমারটাও তো লকড্।
-ওটার পাসওয়ার্ড আমি জানি। তুমি ফোন খোলার সময় অনেক সময় মুখে বলে বলে খোলো কি না-৯ ৫ ৪৭ এই রকম করে।
-সে যাই হোক। ফোনে হাত দিও না। বলেছি না ফোনে ব্লু হোয়েল আছে। বাচ্ছা পেলেই কচকচিয়ে খেয়ে নেয়।
-সেই জন্যই তো চাইছি মা। আমি একটা রেড হোয়েল বানিয়েছি, তোমার ফোনে ছেড়ে দেব। ঘাপটি  মেরে বসে থাকবে, যেই ব্লু হোয়েল তোমার ফোনে ঢুকতে যাবে, কচকচ করে ওকে কেটে ভেজে খেয়ে নেবে। তুমি ফোনটা তো দাও-দেখাচ্ছি মজা দুষ্টু ব্লু হোয়েলটাকে।
তুত্তুরী উবাচ ২৯শে জুলাই ২০১৭
- মা, জানো তো কাল না মিস খুব হাসছিল, আমার কথা শুনে।
- কাল তো পরীক্ষা ছিল, কি বলেছিস রে যে মিস হাসছিল?
- আরে না না। পরীক্ষার জন্য নয়, এমনি মিস অ্যানিম্যাল কিংডম পড়াতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করছিল, “ পুরোযা ডু ইউ হ্যাভ আ পেট অ্যানিম্যাল?” আমি বললাম, “নো!” তখন মিস জিজ্ঞাসা করল, “ হুইচ অ্যানিম্যাল উড ইউ লাইক টু হ্যাভ অ্যাজ ইয়োর পেট?” আমি বললাম, “আই লাইক টু হ্যাভ আ ডগ।“
- ঠিকই তো বলেছিস। এতে হাসার কি হল?
- আঃ শোনোই না। তারপর আমি বললাম, “ আই লাইক টু হ্যাভ আ ডগ, বাট নট এ নেড়ি ডগ”।
- ওরেঃ বাপরে বাপ। হেসে হেসে পেট ব্যথা হয়ে গেল।
- হ্যাঁ মিস ও খুব হাসছিল, তারপর চশমা খুলে চোখ মুছে বলল, “ বাট হোয়াই নট আ নেড়ি ডগ?” আমি বললাম, “ নেড়ি ডগ আর ঘেউঘেউয়ে। এন্ড দে গেট ম্যাড ইন সামার অ্যান্ড ট্রাই টু বাইট আস।“
- উফঃ মাগো। এবার থাম বাবু।

তুত্তুরী উবাচ ২২শে জুলাই ২০১৭
-বাবা, একটা কথা বলব?
-কি?
-তুমি প্লিজ একবার আমাদের টিচার ইনচার্জের কাছে যাবে?
-কেন রে? এই তো মা মঙ্গলবারই গেল পেরেন্ট টিচার মিটে।
-তা হোক। তুমি যাবে গিয়ে বলবে তুমি স্বর্ণাভ আর গৌরবের বাবা।
-অ্যাঁ? তারা কারা?
-আমার ক্লাসের দুই অতি নচ্চার বদমাইশ। আমায় খুব বিরক্ত করে?
-বিরক্ত করে মানে?
-মারে।
-তুই ও তো মারিস?যে ভাবে ধুলোমেখে ভূত হয়ে বাড়ি ফিরিস!
-হ্যাঁ আমিও দি ঘা কতক। কিন্তু এভাবে কতদিন মারামারি  করব?তাই তুমি গিয়ে বলবে তুমি স্বর্ণাভ আর গৌরবের বাবা। বলে মিসের ছড়িটা কেড়ে নিয়ে ওনাকে বেশ কয়েক ঘা মেরে পালিয়ে আসবে।
-(বাবা প্রবল হাসি চাপতে গিয়ে কেশেই ফেলল) তাতে কি হবে?
-মিস ওদের স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে, আর দেবার আগে  সবার সামনে ওদের পিছনে ছড়ি দিয়ে বেদম মারবে---- কেমন মজা হবে?

তুত্তুরী উবাচ ৪ঠা জুলাই ২০১৭
-মা, জানো তো আমরা স্কুলে ইংলিশে আমপাতা জোড়া জোড়া খেলি।
-ইংলিশে? সে আবার কি? রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস্ নাকি?
-না। না। ওটাই ইংলিশে খেলি। ঈশাণী বলল,“রোজ তো বাংলায় খেলি, চল আজ ইংরাজি তে খেলি। ” তাই আমরা ওটাকে ইংরাজি করে নিলাম। মানে যে কটা শব্দ আমরা জানি সে গুলো দিয়েই আর কি।
-কিছুই বুঝলাম না। কি করে?
-শুনবে? ম্যাঙ্গো লিফ জোড়া জোড়া
মারব চাবুক ছুটবে হর্স।
ওরে বিবি ওয়েট।
মাই ম্যাড হর্স ইজ কামিং।
ম্যাড হর্স রান এন্ড শট গান।
অলরাইট ভেরিগুড্।
মেম ইজ ইটিং টি বিস্কুট। হিঃ হিঃ হিঃ। কেমন মা?
- ওরে আমার ট্যাঁশ গরুরে।

তুত্তুরী উবাচ ১৬ই জুন ২০১৭
-গরমের ছুটিটা পুরো নষ্ট করলি বাবু?এখনও টু থ্রী ফোর এর টেবল মুখস্থ  হল না?
-হয়েছে তো মা। প্রশ্ন কর না?
- সে তো তুই মনে মনে যোগ করে করে বলছিস।
-তো?পারছি তো। আমি তো এক কোটির টেবল্ ও বলতে পারি।
-অ্যাঁ!!! মানে??
-এক কোটি ওয়ানজ্ আর এক কোটি, এক কোটি টুজ্ আর দু কোটি,এক কোটি থ্রীজ্ আর তিন কোটি----
-ওরে থাম বাবা। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেল।
-হেহে আচ্ছা মা, বিসেকসি মানে কি?
-বি--সে-ক-সি? কে জানে?জীবনেও শুনিনি। যারা বি সেকশনে পড়ে তারা নাকি?
-ও। তাহলে মেরি প্যান্ট বিসেকসি মানে কি?
(প্রমাদ গুনলাম। দিন দুয়েক আগে এক বহু প্রাচীন বন্ধু এসেছিল, তুত্তুরী যখন তার কন্যার সাথে ক্রিড়া মগ্ন, দুই মা তখন গপ্প করতে করতে টকিং টম নিয়ে খেলছিলাম। আমাদের বর্ণিত সব গপ্পই টম পুনরায় তার কমিক আওয়াজে আমাদের শোনাচ্ছিল। তখনই কার মাথায় যে দুর্বুদ্ধিটা এল, টমকে গোবিন্দার সেই বিখ্যাত “মেরি প্যান্ট ভি সেক্সী,মেরি শার্ট ভি সেক্সী” গানটি শেখানোর কথা, কে জানে। শিক্ষানবিশী অন্তে টম যখন প্রবল বিক্রমে ঐ গানটি গাইছিল, তুত্তুরী সেই সময় ঘরে এসেছিল বটে, টমের ঐ ভয়ানক গান শুনে প্রবল হেসেওছিল। আজ যে এই পরীক্ষা দিতে হবে কে জানতো?)

তুত্তুরী উবাচ ৩রা জুন ২০১৭
-মা রামায়নের শেষটা আমার একদম ভালো লাগে না।
-কেন?
-রামের জন্য। রাম অহল্যাকে মুক্তি দিল, আর নিজের বউকে বনবাস দিল?
-মানে?
-মানে, অহল্যাকে যখন গৌতম মুনি অভিশাপ দিয়ে পাথর বানিয়ে দিয়েছিল, তখন রামই তো তাকে মুক্তি দিল? পরের বউকে উদ্ধার করে যে, সে কেন নিজের বউকে বনবাসে পাঠাবে?
-বাপরেঃ। তুই তো আমার থেকেও বড় ফেমিনিস্ট হবি বাবু। চালিয়ে যা।

তুত্তুরী উবাচ ১৯মে ২০১৭
-(বাবা রাগত স্বরে) তুই একটা অসভ্য গোভূত।ভদ্র সমাজে মেলামেশার  উপযুক্ত নস্। 
-কেন?
-আবার কেন?খাটের আড়ালে লুকিয়ে নাক খুঁটছিস আবার কেন?
- নাক চুলকোচ্ছে তো?
-আআআঃ। তাই বলে জনসমক্ষে চুলকাতে হয়? বাথরুমে গিয়ে চুলকে হাতে সাবান দিয়ে আসতে হয়।
-শোন বাবা, যার নাক থাকে, সেই নাক খোঁটে। হ্যাঁ শূর্পণকা নির্ঘাত নাক খুঁটত না। কারণ খুঁটতে পারত না।
-

তুত্তুরী উবাচ ১১ই মে ২০১৭
-মা দেখো দেখো, কি ভালো সই করেছি মাইরি।
-(বিষম খেয়ে) কি? কি বললি?
-কি ভালো সই করেছি মাইরি। উরিঃ শালা।
-ছিঃ।  কোথা থেকে এত খারাপ কথা শিখছ?
-তোমার থেকে।
-অ্যাঁ?
-তুমি তো সেদিন বাবাকে বলছিলে, কি জঘন্য খেতে মাইরি। আর দাদু তো সেদিন খেলা দেখতে দেখতে চিৎকার  করে উঠল, “উরিঃ শালা। ” আমি বললেই দোষ? দাদু বলেছে, সব শিখে রাখো। সময় বুঝে ঝাড়বে,  তবে বাইরের লোকের সামনে নয়।
- ভগবানঃ। একে রামে রক্ষে নেই দাদু দোসর।

তুত্তরী উবাচ ৯ই মে ২০১৭
-তুত্তুরী খাবে এস।
-না মা। তুমি প্লিজ আমায় খেতে বোলো না। আমার একদম ক্ষিদে নেই।
-এই গরমে কারোরই ক্ষিদে নেই। খেতেই হবে। কোন কথা শুনব না।
-(অভিযোগের সুরে) বাবাআআ! দেখো না বলছি ক্ষিদে নেই। মা তাও শুনছে না।
-(বাবা ট্যাবে বই পড়তে পড়তে অন্যমনস্ক হয়ে) কেন ক্ষিদে নেই কেন? অল্প কিছু খেয়ে নে। মা এত কষ্ট করে রান্না করেছে--
-খেতে পারব না বাবা।  আমার পেটে একটা বাচ্ছা ঢুকেছে। তাই পেটটা ভর্তি। খাবার এতটুকু জায়গা নেই।
- বার করে দে।
-কি করে বার করব বাবা? পেট কাটতে হবে যে?
-যে ভাবে ঢুকিয়েছিস, সে ভাবেই বার করে দিয়ে খেতে বস।
-(হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাবার মুখে)কি শুরু করেছিস রে ভাই তোরা বাপমেয়ে তে।

তুত্তুরী উবাচ ১লা মে ২০১৭
যারা তুত্তুরী উবাচের পুরানো পাঠক, তারা জানেন যে তুত্তুরী এককালে নিজেকে জগজ্জননী বলে দাবী করত। আমাদের গৃহ পরিপূর্ণ থাকত গেঁজেল জামাই,দুই জোড়া নাতি নাতনী এবং তাদের বাহনাদি দ্বারা। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল, তুত্তুরী আর জগজ্জননী নয়। মা দুর্গার নির্দেশে তুত্তুরী আপাততঃ ‘মদনপুরের পক্ষীরাণী। ” মদনপুর কোথায়?চেনেন না বুঝি? মাসাইমারা থেকে ৪৫কিলোমিটার দূরে তুত্তুরীর নিজস্ব জগৎ মদনপুর। গহীন জঙ্গল। যেন জীবজন্তু নেই যে ওখানে পাবেন না। বাঘ, সিংহ, হাতি ছাড়ুন ক্যাঙারু, প্যাণ্ডা, কোয়ালা এমনকি পেঙ্গুইন পর্যন্ত আছে মদনপুরে। এবং এই সমস্ত জীবজন্তুর দেখাশোনার দায়ভার তুত্তুরীর। তাই তো দাদু তুত্তুরীর নাম দিয়েছে, “লক্ষ্মী মেয়ে পক্ষীরাণী। ” মদনপুরে প্রবেশাধিকার শুধু আমার পিতা এবং আমার কন্যার। দাদুই তো মূখ্য পরামর্শদাতা। না হলে এই যে ক্যাঙ্গারুর  বাচ্ছা গুলো এই গরমে কিছুতেই মায়ের পেটের থলি তে ঢুকছিল না, দাদুর কথা মত তুত্তুরী সোনার অঙ্কুশ নিয়ে তাড়া করল বলেই না-_-_--

সারাদিন আমাদের বাড়িতে মদনপুরের গপ্প চলে। বেঁচে থাক মুকেশ আম্বানী আর জিও কানেকশন,না হলে ফোন বিল দিতেই ফতুর হতাম আর কি। আজো তার ব্যতিক্রম নয়। আজ আবার দাদু-মামমামের অ্যানিভারসারি। মানে বিয়ের জন্মদিন আর কি। গতকাল মধ্যরাতে অভিনন্দন জানানোর পরও তুত্তুরীর শান্তি নেই। ঘুম থেকে উঠেই দাদুকে ফোন--

-হ্যালো দাদু। আজ তো তোমাদের বিয়ের জন্মদিন। আমি তোমাদের তিনটে গোলাপী মুক্তো দিলাম। হুঁ হুঁ মদনপুরের শুক্তির মুক্তো বাবা। একটা দিয়ে তুমি আঙটি করে পরো আর দুটো মামমামের কানের দুল বানাতে বলো।
- বাঃ।
-মামমাম কোথায়? হ্যালো মামমাম? তোমায় একটা সরু সোনার ছাগল (গোট) হার দিলাম। গোটা হার জুড়ে ছোট ছোট সোনার ছাগল। কি পছন্দ?
-হ্যাঁ মা খুব পছন্দ।
-বাঃ। এতে কি হবে? ৪৩ বছরের বিয়েবলে কথা। দাঁড়াও তোমাদের একটা সোনার দোলনা দি। আগে আমি চড়ে দেখি ছেঁড়ে কি না। ক্যাঁচকোঁচ   ক্যাঁচকোঁচ। নাঃ ছিঁড়ল না। দাদু এস। এবার তুমি আর আমি চড়ব।  ক্যাঁচকোঁচ ক্যাঁচকোঁচ। বলো?
-(দাদু অসহায় ভাবে) তা বেশ তো ক্যাঁচকোঁচ। ক্যাঁচকোঁচ।
-হয়েছে। এবার মামমাম এস। বলো ক্যাঁচকোঁচ। 
-স্কুল কেমন চলছে সোনা? পড়তে বসেছো?
-আঃ মামমাম আবার স্কুল টুল কেন।  যাকগে অত গিফট্ দিলাম-- এবার তোমরা আমায় কিছু দেবে না?
- (দাদু মামমাম সমস্বরে) তোমার কি চাই সোনা?
-আ মা র? আমার আবার কি চাই? তোমরা গরীব মানুষ যা দেবে তাই হাত পেতে নেব।
(অতঃপর ফোনটা কেড়ে নেওয়া ছাড়া আর গতি ছিল না।)
   

Saturday 29 April 2017

শ্যামাকালী

শ্যামাকালী (পর্ব- ১)
একি দেখছে শ্যামা? বাবা? বাবা ওর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে? কিন্তু বাবার একি সাংঘাতিক অবস্থা? রুধিরস্নাত দেহ, উদরের মধ্যস্থলে আড়াআড়ি একটা বিশাল ক্ষত, সেখান থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে ঝুলছে, বাবা কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। বের হবে কি করে? গলার নলি কাটা যে। বাবা আকুল ভাবে কিছু বলতে চাইছে, দুই চোখে তীব্র আর্তি, কিন্তু পারছে না। এত রক্ত? এত রক্তক্ষরণ হলে বাবা মরে যাবে যে। “নাআআআআ” বলে চিৎকার করে উঠল শ্যামা।
“শ্যামা? শ্যামা? ওঠো। কি হয়েছে? দুঃস্বপ্ন দেখলে কি?” পঞ্চানন জোরে জোরে ঝাঁকাতে লাগলেন তার নিদ্রিতা অথচ ক্রন্দনরতা স্ত্রীকে। চোখ খুলেই পঞ্চাননকে আঁকড়ে ধরল শ্যামা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। পৃথিবীতে এই একজনই তো আছে, যে শ্যামাকে ভালবাসে। কেউ কোনদিন ভালবাসেনি শ্যামাকে। জন্ম থেকেই ব্রাত্য শ্যামা।

শ্যামার জন্মের পূর্বে, ওদের গ্রামের বৃদ্ধ হরিদেব ঠাকুর নাকি ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন, বংশের মুখ উজ্জ্বল করা সন্তান প্রসব করতে চলেছেন, শ্যামার জননী। রায় বংশের ধারক এবং বাহক, যাকে বলে কুলতিলক। এই সন্তানের হাত ধরেই নাকি অমরত্ব পেতে চলেছে শ্যামার পিতা কৃষ্ণদেব রায়।  হরিদেব ঠাকুরের বচন নাকি অব্যর্থ, কখনও মিথ্যা হয়নি। শ্যামার পিতা ভেবেছিলেন, কুলতিলক অর্থাৎ এক যুগন্ধর পুত্র সন্তান প্রসব করতে চলেছেন, ওনার স্ত্রী। সময় ষোড়শ শতক, স্থান আদিসপ্তগ্রামের নিকট এক ছোট্ট গ্রাম স্বপ্নগোপালপুর । শ্যামার পিতা সেখানে সর্বজন পূজিত। স্বপ্নগোপালপুরের বিখ্যাত বৃন্দাবন রায়ের মন্দিরের মূল উপাসক শ্যামার পিতা। বৃন্দাবন রায় অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরটিও শ্যামাদেরই এক পূর্বপুরুষ নির্মাণ করেছিলেন। শোনা যায় প্রায় আড়াই তিনশ বৎসর পূর্বে, সেই আদি পুরুষ তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে না জানি কোথা থেকে এখানে এসে হাজির হয়েছিলেন। গন্তব্য ছিল কোথায়, তাও অজ্ঞাত। তখন কোথায় স্বপ্নগোপালপুর  কোথায় কি? গোটা অঞ্চলই আবৃত ছিল ঘন জঙ্গলে। পাশ দিয়েই বয়ে যেত পতিতপাবনী গঙ্গা। পথশ্রমে ক্লান্ত স্বামী স্ত্রী, গঙ্গায় ডুব গেলে, দুটি চিঁড়ে মুড়ি খেয়ে, এক বিশাল বট গাছের তলায় নিদ্রা যান। কথিত আছে, নিদ্রিত অবস্থায় যুগলে একি স্বপ্ন দেখেন, যে এক ঘন কৃষ্ণবর্ণ শিশু এসে ওনাদের ধুতি এবং শাড়ি ধরে টানছে, আর কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “আর কতদিন আমাকে মাটি চাপা থাকতে হবে? মাবাবা আমার খিদে লেগেছে।” ঘুম ভাঙতেই সেই শিশু নির্দিষ্ট অঞ্চল খুঁড়তে শুরু করেন ওনারা, এবং বাস্তবিক মাটি খুঁড়ে বার হয়, এক কষ্টি পাথরের কৃষ্ণ মূর্তি। স্বপ্নে পাওয়া গোপাল, তাই সংলগ্ন অঞ্চলের নাম হয় স্বপ্নগোপালপুর। নিকটবর্তী জমিদার বাসুদেব দত্তমশাইয়ের পূর্বপুরুষদের তত্ত্বাবধান তথা পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে এই মন্দির। রায় বংশের পুত্র তাই এখানে শ্রীকৃষ্ণের নামও বৃন্দাবন রায়।
শ্রীশ্রী   বৃন্দাবন রায়ের প্রধান উপাসক কৃষ্ণদেব রায় যখন জানতে পারলেন, যে ওনার স্ত্রী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, তখন বলাইবাহুল্য উনি চূড়ান্ত আশাহত হন। কন্যা? কন্যা কি করে বংশের ধারক ও বাহক হয়? কন্যা কি করে বংশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে? এই কন্যার হাত ধরে উনি অমরত্ব লাভ করবেন? হা হতোস্মি। হতাশার থেকে জন্ম নেয় ক্রোধ।  কৃষ্ণদেব নাকি নিজের প্রথম সন্তানের মুখদর্শন করতে সম্মত ছিলেন না, যাই হোক সম্মিলিত অনুরোধে, মেয়ের মুখ দেখতে গিয়ে উনি আরও ব্যথা পেলেন। এ কে? কার সন্তান? রায় বংশে সকলেই গৌরবর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসা, উচ্চ কপাল তথা দীর্ঘ দেহি। কিন্তু এ কি জন্মেছে? শিশুর গাত্র বর্ণ ঘোর কৃষ্ণ, মুখশ্রীও তথৈবচ। বেঁকা বেঁকা পা দুটি জানিয়েই দিচ্ছে, যে এ মেয়ে বেশি লম্বা হবে না। তীব্র বিতৃষ্ণায় কৃষ্ণদেব রায় কন্যার নাম রাখলেন, “শ্যামাকালী”। বৈষ্ণব বংশে কালী এক অতি তুচ্ছা দেবী মাত্র। নিছক অপাংক্তেয়।

জ্ঞান হওয়া ইস্তক শ্যামা জানত, সে অবাঞ্ছিত। পিতা জীবনে শ্যামার সাথে একটি বাক্যবিনিময়ও করেননি। অথচ শ্যামার পরের দুই ভাই কিন্তু পিতার অপার স্নেহ লাভ করেছে। দুই ভাইয়ের সাথে শ্যামাকেও শাস্ত্র চর্চার সুযোগ দেওয়া হয়। কৃষ্ণদেব রায়ের শেষ আশা ছিল, হয়তো শ্যামা এদিকে কোন  কোন অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেবে। কোন নতুন পুঁথি লিখে বংশের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে যাবে। কিন্তু সেখানেও শ্যামা ব্যর্থ হয়।  শ্যামার অন্যান্য সহচরীদের পটাপট বিয়ে হয়ে যেতে লাগল, কিন্তু শ্যামার আর বিয়ে হয় না। কে নেবে, ঐ ঘোর কৃষ্ণবর্না খর্ব অথচ স্থূলাঙ্গী কন্যাকে? মাঝে মাঝে দুপুর বেলা যখন বৃন্দাবন রায়ের মন্দির দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ থাকত, শ্যামা লুকিয়ে গিয়ে  বৃন্দাবন রায়কে প্রশ্ন করত, “তুমিও কালা, আমিও। তুমি সর্বজন পূজ্য আর আমি কেন নই? যারা তোমার উপাসনা করে, তারাই আমায় ঘৃণা করে কেন? বল প্রভু?” কিন্তু পাথরের বিগ্রহ বরাবর নীরবই থাকত।
শ্যামার যখন প্রায় তের বছর বয়স, তখন নবদ্বীপ নিবাসী বাবু বনবিহারী ভট্ট তাঁর ভাগ্নের জন্য শ্যামার কর প্রাথনা করলেন। কানাঘুষো শোনা গেল, বদলে বেশ কয়েকঘর যজমানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলন, শ্যামার পিতা। বিয়ের পর নৌকা করে নবদ্বীপ পাড়ি দিল পঞ্চানন আর শ্যামা। ঘোমটার আড়াল থেকে অশ্রুসজল চোখে শ্যামা দেখছিল, বাবার চোখ শুকনো খটখটে। নৌকায় ওঠার আগে, যুগলে প্রনাম করল, কৃষ্ণদেব রায়কে। হাসি মুখে আশীর্বাদ করলেন, কৃষ্ণদেব রায়। শ্যামা আর থাকতে পাড়ল না, “বাবা গো!!” বলে আঁকড়ে ধরল নিজের পিতাকে। নাই দেখতে পারুন উনি শ্যামাকে, শ্যামা যে বড় ভালোবাসে তাঁর বাবাঠাকুরকে। দৃশ্যমান আড়ষ্টতার সাথে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কৃষ্ণদেব রায় হাত নেড়ে বরবধূকে ইশারা করলেন, নৌকায় চাপার। মর্মাহত শ্যামা নীরবে নৌকায় উঠলেও পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “ বড় ভুল করলে হে কৃষ্ণ। মাশুল গোনার জন্য প্রস্তুত হও। আমার ভবিষ্যৎ বাণী কখনও মিথ্যা হয় না। ঐ তোমার কুলতিলক।” শ্যামা ঘোমটা সরিয়ে দেখে দৃষ্টিহীন বৃদ্ধ ঠাকুর মশাই, লাঠিতে ভর দিয়ে এসেছেন, শ্যামাকে বিদায় জানাতে।

শ্যামাকালী (পর্ব- ২)
তের বছরের শ্যামাকালী আর উনিশ বছরের পঞ্চাননের ফুলশয্যা, শ্বশুর বাড়িতে পদার্পণ করেই শ্যামা বুঝতে পেরেছিল, এখানেও খুব একটা স্বাগত নয় সে। বনবিহারী ভট্টের স্ত্রী চার পুত্র- পুত্রবধূ, গোটা দশেক নাতিনাতনী নিয়ে বিশাল পরিবার, সেখানে পিতৃমাতৃহীন ভাগ্নে পঞ্চানন নেহাতই পরিচারকতুল্য। তার স্ত্রী হিসেবে শ্যামার গ্রহণযোগ্যতা কতটা হতে পারে তা অননুমেয় নয়। ফুলশয্যার রাত্রে পঞ্চানন ও তাই বলেছিল শ্যামাকে, “হ্যাঁ গা তোমার বাপমায়ের কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই। হাত পা বেঁধে  এত সুন্দর মেয়েটাকে জলে ভাসিয়ে দিল গা?” সুন্দর! শ্যামা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি, ঘোমটা সরিয়ে তাকিয়ে দেখে পঞ্চাননের মুখে একটুও শ্লেষ বা বিদ্রুপের ছায়াও নেই। নিতান্ত সহজ সরল একজোড়া টানাটানা চোখ, ঘন আঁখিপল্লব গভীর সহমর্মিতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্যামার দিকে। শ্যামা করুণ হেসে বলেছিল, “আমার মত বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো মেয়েকে উদ্ধার করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।” পঞ্চানন আরো করুণ ভাবে বলেছিল, “হোক না। খেদাক না, তবু তো তোমার মা-বাবা আছেন। আর আমাকে দেখ, জন্মের আগে বাবা নিরুদ্দেশ, গর্ভবতী অবস্থায় মাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল আমার দাদু-ঠাকুমা। মামাদের গোয়ালের পাশে ছোট্ট আঁতুড় ঘরে আমার জন্ম দিয়ে মাও...। সেই থেকে মামার বাড়িতেই পড়ে আছি। লেখাপড়াও শিখিনি কিছু না। বামুনের ছেলে হয়ে ফাইফরমাশ খাটি, গরু বাছুরের দেখাশোনা করি। হাট বাজার করি...। তোমাকেও খাটতে হবে গো। পঞ্চার বউকে এরা বসিয়ে খাওয়াবে না।”

এদিকে যখন স্বপ্নগোপালপুরের শ্যামার সাথে গভীর প্রেমবন্ধনে জড়িয়ে যাচ্ছে নবদ্বীপের পঞ্চানন, ও দিকে তখন বাংলার আফগান সুলতান সুলেমান কারনানীর কন্যা জেব-উন্নিসার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, কলিঙ্গ-উৎকল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট গজপতি মুকুন্দদেবের প্রধান সেনাপতি শ্রী রাজীবলোচন রায়। সুলেমান কারনানী ছিলেন এক অতি বিচক্ষণ শাসক। সুলতান উপাধি নিলেও উনি নিজস্ব মুদ্রা চালু করেননি। ওনার জমানায় জুম্মা বারে মসজিদে মসজিদে তৎকালীন বাদশাহ আকবরের নামে খুৎবা  পড়া হত। ওনার বড় শখ ছিল কলিঙ্গকে বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত করার। সেই উদ্দেশ্যে যতবারই মহারাজ গজপতি মুকুন্দদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, ততবারই পর্যুদস্ত হয়েছেন গজপতি মুকুন্দদেবের সেনাপতি রাজীবলোচন রায়ের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, বীরত্ব তথা রণ কৌশলের কাছে। অবশেষে ত্রিবেণীর যুদ্ধে পরাস্ত হবার পর সুলতান সুলেমান কারনানী এক ফন্দি আঁটলেন। উনি খবর নিয়ে দেখেছিলেন যে রাজীবলোচনের স্ত্রী শৈশবেই পরলোক গমন করে এবং তারপর আর দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেননি রাজীব। বিবাহযোগ্যা হিন্দু মেয়েদের বয়স সাধারণত সাত আট বা খুব জোর দশ। ঐ টুকু বাচ্ছা মেয়ে আর যাই হোক পচিশ বছরের রাজীবলোচনের মানসী হতে পারে না।
ত্রিবেণীর যুদ্ধ পরবর্তী শান্তি প্রস্তাব আলোচনার জন্য রাজীবলোচনকে নিজের শিবিরে আমন্ত্রণ জানালেন সুলতান। শুদ্ধ উৎকলী ব্রাহ্মণের হাতে তৈরি ভোজন দিয়ে তাঁকে আপ্যায়ন করলেন, সুলতান। ভোজনান্তে যখন শর্তাবলী নিয়ে দরদস্তুর চলছে, শিবিরের পর্দা সরিয়ে প্রবেশ করল এক অপরূপা নারী। বয়স বছর উনিশ। তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ, তুলি দিয়ে আঁকা একজোড়া চোখ, যার মণির রঙ হাল্কা সবুজ মেশানো নীল। গোটা শরীর আবৃত, মস্তকে খাস ঢাকাই মসলিনের স্বচ্ছ ওড়না। যার রঙ অবিকল নারীর চোখের মণির মত। এ নারী যে মধ্যপ্রাচ্যের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজীবলোচনের চোখের পলক পরছিল না। সুলতান সুলেমান, নীরবে হেসে আলাপ করিয়ে দিলেন, “ জনাব এ হল আমার জান, আমার বেটি। জেবা। জেব-উন্নিসা।” জেবা মৃদু হেসে সালাম জানালো। রাজীবলোচনের মুখে বাক সরল না।
সেদিন সুলতান সুলেমানের শিবির থেকে ফিরে রাজীবলোচন বুঝতে পারল, যে সে মদন দেবের শরাহত। জেবাকে না পেলে ওনার জীবন বৃথা। বেশ কয়েকদিন অন্নজল ত্যাগ করে, বিনিদ্র রজনী যাপন করে, রাজীবলোচন আর পারল না। নতমস্তকে করজোড়ে গিয়ে দাঁড়ালো সুলতান সুলেমানের সামনে। জেবাকে বিবাহ করতে চায় রাজীবলোচন। সুলতান সুলেমান বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বললেন, “ জেবাকে পেতে গেলে যে ইসলামকেও কবুল করতে হবে জনাব রাজীবলোচন রায়।” উৎকলী ব্রাহ্মণ রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল, “ কেন? আমি বিধর্মী হব কেন? আপনার কন্যা হিন্দু হবে। স্বামীর ধর্মই নারীর ধর্ম।”  সুলেমান হাসি চেপে বললেন, “যান। আপনাদের রাজামশাই কে জিজ্ঞাসা করুণ আগে। যদি ওনাদের আপত্তি না থাকে আমরা ভেবে দেখব। তবে জেবা প্রাণ থাকতে ইসলাম ত্যাগ করতে পারবে বলে মনে হয় না।”
রাজীবলোচন দৌড়ে গেল, সম্রাট গজপতি মুকুন্দদেবের কাছে। কিন্তু সম্রাট গজপতি মুকুন্দদেবের মন গলল না। উনি উপহাসের সঙ্গে বললেন, “ রাজীব , তোমার কি শেষে ভীমরতি হল? জান না? হিন্দু হওয়া যায় না। যবনী সংসর্গ করতে চাও, করতেই পার। এতদিন নারী সঙ্গ বিবর্জিত জীবন কাটিয়েছ, আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু ঐ যবনী কিছুতেই হিন্দু হতে পারে না।” রাজীবলোচনের সমস্ত অনুনয় বিনয়, চোখের জল কিছুতেই রাজামশাইয়ের মন গলল না।
ভগ্ন হৃদয়ে রাজীবলোচন ফিরে গেল সুলতান সুলেমানের কাছে। সুলেমান হেসে বললেন, “ কি বললেন তোমাদের রাজামশাই? যবনী সংসর্গে দোষ নেই, কিন্তু সেই যবনীকে বিয়ে করা ধর্মে নিষেধ। তাই তো?”
করমচার মত লাল চোখে সুলতানের দিকে তাকিয়ে রাজীবলোচন শুধু বলল, “ যবনী সংসর্গ নয়। আমি জেবাকে ভালবাসি। ওকে নিজের ঘরণী বানাতে চাই, নিছক অঙ্কশায়িনী নয়। আমি ইসলাম গ্রহণ করতে তৈরি।”
ইসলাম গ্রহণ করে রাজীবলোচনের নতুন নাম হল, জালালুদ্দিন। কিন্তু সে নামে তাঁকে কেউ চিনত না, রাজীবলোচন ওরফে জালাল ছিল বিশালাকৃতি, পেশীবহুল এবং ঘোরকৃষ্ণবর্ণ। ইতিহাস তথা তৎকালীন সমাজ তাঁকে ডাকতে লাগল “কালাপাহাড়” নামে।
(চলবে)
#Aninditasblog
https://amianindita.blogspot.com

(চলবে)
#AninditasBlog
https://amianindita.blogspot.in