Saturday 8 April 2017

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৪ঠা সেপ্টেম্বর  ২০১৭


শরতের রোদে কেমন যেন ঝিম ধরে, জাতীয় সড়ক ধরে কখনও হুহু করে ছুটছে গাড়ি, উড়ছে ধুলো, কখনও বা মৃদু মন্থর গতিতে গড়িয়ে চলেছে।  দুপাশে কোথাও মখমলী সবুজ ধান ক্ষেত, কোথাও বা বন্ধ পলেস্তারা খসা দোকানপাট। হাইওয়ের ওপরেই শুকোচ্ছে পাট। হাওয়ায় পাকিয়ে যাচ্ছে কিন্তু উড়ে পালাচ্ছে না। টলটলে নীল আকাশে উড়ছে চিল। হারিয়েই গিয়েছিলাম- মিশে গিয়েছিলাম প্রকৃতির সামনে। হঠাৎ  ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি, দরজা খুলে মুখ গলাল নির্মল,“নামবেন না ম্যাডাম?” পাশ থেকে সুখেন বাবু বললেন,“চলুন ম্যাডাম জুট মিল এসে গেছে। ” ভুলেই গেছিলাম, অন ডিউটি। রাণ্ড্যাম ইন্সপেক্সন চলছে।

গাড়ির দরজা খুলতেই যেন হলকা লাগল। কি গণগণে রোদ, এই রোদে এতটা হেঁটে যেতে হবে ফ্যাক্টরি অফিসে? গজগজ করতে করতে বলতে গেলাম,“পুজোর আগে এই রোদে পোড়ার কোন মানে হয়? সবাই ফেসিয়াল করে, ট্যান রিমুভাল প্যাক লাগাচ্ছে, আর আমাকে পুড়িয়ে কাঠকয়লা বানাবার ব্যবস্থা হচ্ছে। আর আমার এত দামি চুল? এই ধুলো খেয়ে আর বাঁচবে?” কিন্তু বলতে পারলাম কই? চোখের সামনে ভেসে উঠল আগের কারখানাটা, গরম গণগণে আঁচে বিস্কুট তৈরি হচ্ছে।  মিষ্টি গন্ধে সুরভিত।  আর যারা খাটছেন? কত টাকা বেতন পান, প্রশ্ন করেছিল ইন্সপেক্টর-জবাবটা আর নাই বা লিখলাম।  আমরা বারংবার আশ্বস্ত করে এলাম, আমাদের সাথে কথা বলার  আপনাকে যদি  কিছু বলে- তৎক্ষণাৎ এই নম্বরে ফোন করবেন। ইন্সপেক্টর নিজ হাতে আমাদের সবার নম্বর সেভ করে দিল। দিন কয়েক আগেই একটা কুৎসিত অভিজ্ঞতা হয়েছে, নূন্যতম মজুরী পায় কি না, এই আপাত সাধারণ প্রশ্নের জবাব দেবার  এক অপরাধে এক নামি শপিং মল, সিকিউরিটিকে কর্মচ্যুত করেছে। পুজোর মুখে একটি ছেলের চাকরী এভাবে  ছাড়িয়ে দিতে পারে? সুখেন বাবু, ইন্সপেক্টর এবং আমি পর্যায়ক্রমে বললাম, এই দণ্ডেই লিখিত জানান। তারপর দেখছি, কি করা যায়।

সত্যিই পুজো আসছে।  এদেরও তো পুজো, কিন্তু এ এক অন্য পুজো। শ্রমসেবার(লেবার সার্ভিস) দৌলতে এক দিকে সংগঠিত অপর দিকে অসংগঠিত উভয় ক্ষেত্র নিয়েই আমাদের কারবার। প্রতিনিয়ত সাধারণ খেটে খাওয়া পাতি শ্রমজীবি মানুষের দুঃখ দুর্দশার হাতে গরম অনুভব হয়।  মাঝে মাঝে অসহায় লাগে জানেন, যখন করুণ গলায় কোন বয়ঃজেষ্ঠ্য  বলেন ,“ আপনি আমাদের একটা চাকরী দেবেন ম্যাডাম?আমাদের তো বউ বাচ্ছা আছে, পুজোর আগে বসিয়ে দিল।  আপনাদের এখানে লোক নেবেন না?” সর্ব ক্ষেত্রে যে প্রতিকারের কোন সম্ভাবনা থাকে তাও নয়, সেটা মুখের ওপর বলতে যে কি হৃদয়বিদারক যাতনা হয় তা ভাষায় অবর্ণনীয়।   প্রতিটি দিনের শেষে নতুন করে আর একবার অনুধাবন করি আমি এবং আমরা এখনও কতটা ভালো আছি।
অনির ডাইরি ১০ই জুলাই ২০১৭
কাল নিরবধি। জীবন যে কত ভেল্কি দেখায় ভাবতে বসলে তাজ্জব হয়ে যাই। এককালে সাদা শাড়ি লাল পাড়, কলা বিনুনী বেঁধে মাথা নীচু করে স্কুল যাওয়া নিছক মুখচোরা ভীতু মেয়েটা আজ লেবার চরায়। অসাধারণ গান গাইত যে মেয়েটি, যার খালি গলায় গাওয়া “মন মোর মেঘের সঙ্গী” শুনলেই ঝরঝর করে হেসে উঠত আষাঢ়ের ঘণ বাদল, সে এখন পদার্থবিদ্যার জটিল তত্ত্ব পড়ায়, গুনগুন করার ও ফুরসৎ নেই তার। ঘণঘণ কাল্পনিক প্রেমিক বদলানো মেয়েটা দিব্যি বাবার পছন্দের স্বজাতীয় পাত্রের সাথে সুখে ঘরসংসার করছে। রোগাপাতলা ছোট্ট খাট্ট মেয়েটাকে দেখতে একদমই বালিকাসুলভ ছিল না, পিতৃমাতৃহীন সেই মেয়ে আজ একার কাঁধে টেনে চলেছে বিশাল সংসারের দায়ভার। চূড়ান্ত অগোছালো  মেয়েটা আজ পরের ঘর গোছানো ইন্টিরিয়র ডেকরেটর। এককালে নেহাত সাদামাটা দেখতে মেয়েটার রূপের ছটা আজ তারাদেরও হার মানায়। পড়াশোনা শেষ করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে ইচ্ছুক মেয়েটা, এখন ঘোরতর নারীবাদী।  আজকাল বিয়ের নাম শুনলে ক্ষেপে যায়, বলে ওঠে“ কে বলেছে জীবন কাটাতে গেলে একজন বিশেষ পুরুষের প্রয়োজন?” অসম্ভব কেরিয়ারিস্ট মেয়েটা এক কথায়  চাকরী ছেড়ে দেয় আসন্ন সন্তানের মুখ চেয়ে।  এককালে সবার আগে থাকা মেয়েটা আজ কারো হাত ধরতে চায় না, উচ্চমন্যতা নাকি হীনমন্যতা কে জানে?? আর এরই মাঝে বয়ে চলে সময়, দাবার ঘুঁটির মত খেলে আমাদের নিয়ে- কাল ছিল নেহাৎ  মুখচেনা, আজ বন্ধু, আগামী কাল? কি যে লেখা আছে বিধাতার খাতায় কে জানে? কেই বা পরোয়া করে? এই তো দিব্যি আছি ...

-----–--------------------------------------------------------------------


অনির ডাইরি ৮ই জুলাই ২০১৭


তাহলে? ঘুরে ফিরে সেই ফেসবুক? ফেসবুকই আসল কালপ্রিট কি বলেন? কোথাকার এক ডেঁপো পিছন পাকা ছোকরা ফেসবুকে কি আবোলতাবোল শেয়ার করল, আর অমনি এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। একটা বিশ্রী কালো দাগ পড়ে গেল আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষ শান্তির রাজ্যে। আমাদের রাজ্যে এসব কোনদিন ছিল বলুন? যেখানে যত দাঙ্গাহাঙ্গামা হত, আমরাই তো ডাকতাম নিপীড়িত জনগণকে, “আসুন আসুন,আমাদের সোনার বাংলায় আপনাদের কোন ভয় ডর নেই। আমরা হলাম বাঙালি, দা গ্রেট বাঙালি, “ জন্ম থেকেই সেন্টু খেয়ে শহিদ, শহিদ ভঙ্গী, গুলির আগেই সারেন্ডার আর প্রেমের আগেই লেঙ্গী।“ আমাদের গ্যাস। অম্বল, আমাশা, ডেঙ্গু (নাকি ডেঙ্গি?)  অনেক কিছুই আছে বটে, কিন্তু আমাদের কেউ ক্মুনাল বলতে পারবে না বাওয়া।

কিন্তু এই অপদার্থ গোভূতটা দিল সব শেষ করে।আর তোদেরও বলিহারি যাই বাপ, নাহয় খুব খারাপ কিছু পোস্ট করেইছিল, তাই বলে তোরাও দৌড়বি লুঙ্গি তুলে? একটা মামুলী আচ্ছা চল, চরম অসম্মানজনক পোস্ট  তোদের ধর্মবিশ্বাসে এমন আঘাত করল বাপ, যে শুধু তার বাড়িঘরে আগুন লাগিয়েই শান্তি হল না, তাকে জবাই করাও চাই? পেলি না বলে, দুচারজন নিখাদ গরীবগুর্বো মানুষের বাড়িতেও দিলি আগুন লাগিয়ে?রাস্তা আটকে, টায়ার জ্বালিয়ে, বেছে বেছে বিশেষ সম্প্রদায়ের দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট করে কি লাভ হল? যে বিষ এতদিন তলায় তলায় ছড়াচ্ছিল তা হলাহল হয়ে বেরিয়ে এল। এবার কি হবে? 

বিগত কয়েকদিন ধরে অনেক কিছু পড়লাম। অনেকের লেখা,অনেক গুজব, গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধ,অমৃতবাণী, আমার এবং শৌভিকের বন্ধুতালিকায় থাকা বহু ব্যক্তির জ্ঞানগর্ভ পোস্ট সব সব পড়লাম। গোগ্রাসে গিললাম বলা যায়।ফেসবুক আপাতত দুই ভাগে বিভক্ত। একদল সমানে প্রচার চালাচ্ছে,গুজবে কান দেবেন না, গুজব ছড়াবেন না। বিগত কয়েকদিন ধরে বহুল প্রচারিত ছবি এবং ভিডিও গুলি বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছেন যে সেগুলি আসল নাকি নিছক দাঙ্গা লাগাবার উদ্দেশ্যেই তৈরি। উদ্দেশ্য প্রশ্নাতীত ভাবেই সাধু, কিন্তু কোথাও না কোথাও এদের প্রতিটা পোস্টে লুকিয়ে আছে কেমন যেন “ভাই তুই এটা করতে পারলি?” মার্কা তীব্র অভিমান। নিরপেক্ষ হয়েও কেমন যে পক্ষপাত দুষ্ট। তবু এরাই আমাদের আশার আলো, ঘোর অমানিশিতে এরাই আমাদের জোনাকি।

আর একদল  স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলেই চলেছে,” যাঁরা দাঙ্গা করে তারা আমার বন্ধু নয়,নট ইন মাই নেম,দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে আমার নাম জড়াবেন না, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।“ পড়তে পড়তে রাগ হয় জানেন, হেব্বি রাগ হয়। সুকন্যার শব্দচয়ন তুলনাহীন, এরা বাস্তবিকই ইন্টেলেকচুয়াল আপদ। ধুর মশাই কে বলেছে আপনি দাঙ্গাবাজদের বুজম ফ্রেন্ড? কে বলেছে আপনি গোরক্ষক বাহিনীর সদস্য নন, সে কথা ফেসবুকে পোস্ট করতে? আমরা কোন ব্যাখ্যা চেয়েছি কি? আর ঐ ধুতিপড়া গোরক্ষক বা লুঙ্গি পর দাঙ্গাবাজরা কি আদৌ আপনার ঐ পোস্ট পড়ার জন্য ফেবু আলো করে আছে?

কিন্তু কেউ কেন একবারও বলছেন না, যে একটা দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র যদি তেমন কিছু ফেসবুকে শেয়ার করেই থাকে, তারজন্য এতবড় অশান্তির কি আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল? সৌভিক বলে ছেলেটির গ্রাম অর্থাৎ মাগুরখালিতেই যখন এই নিয়ে কারো মাথা ব্যথা ছিল না, তাহলে ঐ লুঙ্গিবাজ দাঙ্গাবাজরা এল কোথা থেকে? কেন এল? ফেসবুকে তো আমরা তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় অনেক কিছুই শেয়ার করে বসি, ধর্মবিশ্বাসে এত আঘাত লাগল যে এত বড় কাণ্ড ঘটে গেল?এত ঠুনকো আপনার আমার ধর্মবিশ্বাস? যে লোকমুখে কে কোথায় কি শেয়ার করেছে শুনেই আপনি লাঠি কাস্তে নিয়ে দৌড়বেন? আর এত দুর্বল আপনার আমার মেরুদণ্ড যে আমরা ঐ সদ্য তরুণ ছেলেটির পোস্ট নিয়ে একটি কথাও বলব না?কত বয়স ওর? আঠারো খুব জোর? আমার আপনার ঘরেওএরকম কেউ না কেউ বড় হচ্ছে। কাল যদি সে যথাযথ গুরুত্ব না বুঝে কিছু শেয়ার করে ফেলে? আমি আপনি জানতেই পারলাম না, কেন, কি বৃত্তান্ত, শুধু ঘুম থেকে উঠে দেখলেন একদল লোক আপনার এবং আপনার নির্দোষতর প্রতিবেশীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছে।হতে তো পারে? বলুন না? শুধু তাই নয়, পোস্ট করার অপরাধে তারা আপনার প্রিয় শিশুটিকে পিটিয়ে মারতে চাইছে। কেন না? সে একদল ধর্মোন্মত্ত ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করেছে।

আমরা যাই বলি না কেন সত্যিটা হল বাঙালি মোটেই শান্তিপ্রিয় ধর্মনিরপেক্ষ জাত নয়। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে বা স্বাধীনতা অব্যবহিত পরবর্তী দাঙ্গার কথা সুকৌশলে আমার আপনার কাছে গোপন করা হয়েছে, যাতে সেই বিষ আমাদের শিরা ধমনিতে না ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বিষ কি সত্যিই ঐভাবে চেপে রাখলে চাপা থাকে? দিনকাল খুব খারাপ আসছে দাদা। আমাদের মত মধ্য তথা নিম্নমেধার নিছক খেটে খাওয়া লোকজনের মনে প্রতিনিয়ত জমছে অজস্র প্রশ্ন। জন্ম নিচ্ছে ভয়। তৈরি হচ্ছে অবিশ্বাস। বাড়ছে ফাটল। আর এই ফাটল ওরা কিছুতেই ভরাট হতে দেবে না, এই অবিশ্বাসের জমিতে চাষ করবে ভয়ের ফসল।

---------------------------------------------------------------------------

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৩রা জুলাই ২০১৭


আজ টমেটোর সাথে দেখা হল। “টমেটো?” টমেটো কে চেনেন না বুঝি? য্যাঃ তাহলে আপনি বাঙালিই নন মশাই। সেই যে টমেটো, যে অবিবাহিত ধনী যুবক বিকাশ রায়কে “বাবা” বলে হঠাৎ আঁকড়ে ধরেছিল? ততোক্ষণ ছাড়েনি যতক্ষণ  না বিকাশ রায় এবং অরুন্ধতী দেবীর প্রণয় যথার্থ পরিণতি পায় এবং তাঁরা যুগলে টমেটোকে তাদের পুত্ররূপে স্বীকার করে নেয়। এবার বুঝেছেন তো? আজ্ঞে হ্যাঁ।  “ছেলে কার” সিনেমার টমেটোর কথাই বলছি।
সেই টমেটো না হলেও  আলুবোখারা তো বটেই। কাজকর্ম, উল্টোরথের নিমন্ত্রণ রক্ষা করে শৌভিক আর আমি দিব্যি খুনসুটি করতে করতে যখন ৬-৪২ এর নৈহাটি লোকালে উঠলাম, ততোক্ষণে সব জানলার ধারের আসন ভর্তি হয়ে গেছে। খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল একটি জানলার ধারে একটি অল্প বয়সী, বছর আট নয় বছরের বালক বসে আছে। তারপাশেই বসলাম দোঁহে। একটু জায়গা ছেড়েই বসলাম, নির্ঘাত বাবা মা কেউ সঙ্গে আছে। যদিও জায়গা রাখা নেই।
ট্রেন ছেড়ে দিল, কেউ এল না। ছেলেটি মাঝে মাঝে মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দেখছে-- শৌভিক ফিসফিস করে বলল,“এই গণুটার সঙ্গে কেউ নেই নাকি?” গণু?আমাদের চয়ন করা নিজস্ব কিছু শব্দ আছে। যার মানে শুধু আমরাই জানি। যেমন গণু। সাধারণত আমরা বাচ্ছা বা শিশু বলতে আদর করে গণু বলি। আমাদের বিয়ের পর বাবা-মা একটা তুলো ভরা “বাল (শিশু) গণেশ দিয়েছিল। যাকে বলে স্টাফড্ গণেশ। যখন জানা গেল আমাদের দুজনের মাঝে কোন এক তৃতীয় ব্যক্তি আসতে চলেছে, তখন সেই অচেনা ব্যক্তিকে আমরা আদর করে গণু বলে ডাকতে থাকি। ধীরে ধীরে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে কোন শিশুকেই আমরা গণু বলে ডাকি। যেমন- আজ ট্রেনে একটা গণু উঠেছিল, পাশের বাড়ির গণুটা কি হল্লা জুড়েছে মাইরি। এমনকি মনুষ্যেতর প্রাণীর শিশুকেও--- যাক গে ছাড়ুন।
তো যাই হোক, শৌভিক বলল, “ এই গণুটা কি একাই যাচ্ছে?” শুনেই হঠাৎ ছেলে কার সিনেমাটার কথা মনে পড়ে গেল। এই রে? এবার নির্ঘাত বাবা-মা বলে জড়িয়ে না ধরে? একটা বাদামওলা উঠল টমেটো বাবু গম্ভীর মুখে আমাদের দেখতে দেখতে বাদাম কিনল এবং পকেট থেকে পয়সাও বার করে মূল্য চোকালো। সত্যি বলছি বেশ হতাশ হলাম। এটা মোটেও টমেটো সুলভ কাজ নয়। আমরা কোথায় ভাবছি সত্যিই যদি ওকে বাড়ি নায়ে যেতে হয়, তুত্তুরী কি বলবে? “চাইছিলাম একটা ল্যাব্রাডর, নিয়ে এলে একটা দাদা?” যদিও টমেটো বাবুকে মোটেই আমাদের মত দেখতে নয়, কিন্তু কোথায় লেখা আছে গৌরবর্ণ(?) পিতামাতার শ্যাম বর্ণ পুত্রকন্যা হতে পারে না?জামাকাপড় ও একটু না হয় মলিন, তাতে কি? সারাদিন ধুলাবালিতে  নোংরা হয়ে যেতেও পারে। মাঝে মাঝে বিবর্ণ জামা তো আমিও পড়ি। বাচ্ছাটা চোখ গোল গোল করে একটা একটা বাদাম খাচ্ছে আর গম্ভীর ভাবে আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে। একবার জুতো সমেত উল্টোদিকের সিটে ঠ্যাং তুলল, শৌভিক সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,“এই টমেটোটা জুতো পরে সিটে পা তুলছে কেন?” বেশ চলছিল ব্যাপারটা। হঠাৎ বেলঘরিয়া আসতে একটা মাথায় ঝুঁটি বাঁধা লোক এসে ডেকে নিয়ে চলে গেল আমাদের টমেটোকে। বিশ্বাস করুন খুব রাগ হচ্ছিল লোকটার ওপর, এমন বিশ্রী যবনিকা পাত?এতোক্ষণ কোথায় ঘাপটি মেরে বসেছিল কে জানে? আর টমেটো তুই? এটা করতে পারলি?

---------------------------------------------------------------------------

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৮ই এপ্রিল ২০১৭


প্রতিদিন কত কিছু ঘটে যায়, কত মজার ঘটনা, মনে মনে নোট নি, এটা লিখতেই হবে, কিন্তু দুষ্টু সময় কিছুতেই বাগ মানে না। যেমন কাল, চুঁচুড়ায় সুতপাদির অন্তিম দিন ছিল। বহুদিন ধরে আমরা দুই এএলসি প্ল্যান করছিলাম, একদিন ধনিয়াখালি যাব, শাড়ি দেখতে এবং কিনতে। ধনিয়াখালি চুঁচুড়া মহকুমার অন্তর্গত একটি ব্লক। শাড়ির জন্য সুপ্রসিদ্ধ।  যেদিনই যাব বলে মনস্থির করি,  আচমকা উটকো ঝামেলা চলে আসে, আজ যাব, কাল যাব করে পিছোতে পিছোতে দেখি আর সময় নেই। আজকের পর আর সুতপাদি থাকবে না---
দুদিকে চোখ জুড়ানো গালিচার মত সবুজ ধান ক্ষেত,  মাঝখান দিয়ে ঝাঁ চকচকে রাস্তা, মাঝে মাঝে দু একটা সাবেকী একচালা মন্দির হাঁ করে গিলতে গিলতে গিয়ে হাজির হলাম ধনিয়াখালি। কৌশিক অর্থাৎ স্থানীয় এসএলওর স্বামী পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল তাঁতীর বাড়ি। তাঁতীর বাড়ি শুনে চমকাবেন না, রীতিমত ঝিনচ্যাক দোতলা বাড়ি। একতলায় দোকান শাটার টানা। বিরক্ত হয়ে ভাবলাম কোথায় আনলো রে বাবা কৌশিক? কৌশিক হাত দেখিয়ে আশ্বস্ত করল। নিঝুম ফাঁকা গনগনে দুপুরে  কৌশিকের পিছু পিছু বন্ধ দোকানের পাশের সরু গলি দিয়ে ঢুকলাম বাড়ির ভিতরে। জানলা দরজা বন্ধ বলে বেশ ঠাণ্ডা ভিতরটা। টাক মাথা, মাঝারি উচ্চতা, চশমা পরা নিরীহ দর্শন এক ভদ্রলোক নিজে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গিয়ে বসালেন। মার্বেলপাতা মেজেতে বিশাল মাদুর পাতা। চারপাশে থরে থরে সাজানো শুধু শাড়ি আর শাড়ি। টুল আর চেয়ার দেওয়া সত্ত্বেও আমরা মাটিতে বসলাম। শুরু হল শাড়ি দেখানো। সাবেকী বাঙালি তাঁত। ওরা বলে একশ সুতোর শাড়ি। প্রচুর শাড়ি দেখাচ্ছিলেন ভদ্রলোক, আমার আব্দার সাদা শাড়ি চাই। শাশুড়ি মা সাদা ছাড়া পরেন না। উনি আনতে গেলেন বাইরে থেকে, এমন সময়,  কৌশিক দুটো ডাব নিয়ে হাজির। গাছের ডাব,  খেতেই হবে। আপত্তি চলবে না। কি মিষ্টি ঠান্ডা ডাবের জল।কিন্তু এত শাড়ি খোলা আছে যদি দাগ লেগে যায়? ভয়ে ভয়ে আমরা একটু সরে বসলাম শাড়ির  থেকে। ভদ্রলোক কয়েকটা সাদা শাড়ি নিয়ে ঢুকলেন যখন,  সুতপাদি একটা কম দামী শাড়ির নীচে হাত রেখে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা দাদা জল পড়লে কিছু হবে না তো?”
ভদ্রলোক নার্ভাসভাবে  চশমাটাকে নাকের ওপর তুলে দুবার ঠোঁট চেটে হাত কচলে বললেন,“ এজ্ঞে, জল? তা জল পড়লে একটু  দাগ হবে। ” আমিও একটা শাড়ি দেখছিলাম, ফট করে হাত সরিয়ে নিলাম। সর্বনাশ জল পড়লে দাগ হবে? মানে কি? পাড়ের রঙ খোলে লেগে যাবে? ভদ্রলোক একই রকম নার্ভাসভাবে  বললেন, “কাচলেও উঠবে না। মনে হয় আজ্ঞে। ডাবের জল তো!” আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম, আর সুতপাদি কপালে করাঘাত করে বললেন, “হে ভগবান সে নয়। ডাবের জলের কথা কে জিজ্ঞাসা করেছে,  বলছি জল- জল । জলে কাচলে খারাপ হবে না তো?”

---------------------------------------------------------------------------


অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৯ই এপ্রিল ২০১৭


গ্রাজুয়িটি এ্যাক্টে আমরা এএলসি রা হলাম কন্ট্রোলিং অথোরিটি। অর্থাৎ আপনি যদি কোন প্রাইভেট সংস্থায় কর্মরত হন এবং কর্মজীবনের অন্তে আপনি আপনার প্রাপ্য গ্রাচুয়িটি না পান বা ন্যায্য  প্রাপ্যর থেকে কম টাকা পান, তাহলে আপনাকে আমাদের কাছেই আসতে হবে। এমনকি এ বিষয়ে আপনি যদি আমাদের কাছে না এসে সরাসরি আদালতের দ্বারস্হ হন, তাহলেও মহামান্য আদালত পত্রপাঠ আপনাকে ফেরৎ পাঠাবে আমাদের কাছে।
লেবার সার্ভিসের যে সব অফিসার যত বেশি গ্রাচুয়িটি কেস সামলেছেন, সু অফিসার হিসাবে তাঁদের সুনাম ততোবেশী। দুর্ভাগ্যবশত আমি ইতিপূর্বে একটিও গ্রাচুয়িটি কেসের সম্মুখীন হইনি। চুঁচুড়াই প্রথম।
এক একদিনে তিনটি চারটি কেসের হিয়ারিং থাকে। একদম কোর্ট কেসেরই মতো। অ্যাপিয়ারেন্স, স্টেটমেন্ট, এভিডেন্স,উইটনেস (ক্ষেত্র বিশেষে), ক্রশ, আর্গুমেন্ট সব কটি সিঁড়ি ভাঙতে পারলে তবেই অর্ডার দেওয়া যায়। বাদী এবং বিবাদী চাইলেই অভিজ্ঞ আইনজীবী  নিয়ে আসতে পারেন, তাঁর হয়ে সওয়াল জবাব করার জন্য।
টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। জন্মলগ্ন থেকেই দৃঢ় বিশ্বাস,  শ্রমিক মানেই অত্যাচারিত এবং মালিক মানেই অত্যাচারী। পশ্চিম মেদিনীপুরে কাটানো সাড়ে চার বছর সেই ধারণাকেই দৃঢ় করেছে মাত্র। মালিকের থেকেও খারাপ যদি কেউ থাকে তবে তারা হল মালিকের পেটোয়া ম্যানেজারের দল।মালিক যদি একশ টাকা বেতন বৃদ্ধিতে রাজি হয়, এরা সেটা কুড়ি টাকার বেশি কিছুতেই বাড়াতে দেয় না।  খড়্গপুরে একবার এক বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা সংক্রান্ত ডিসপিউটের মিটিং এ জানতে পেরেছিলাম, যে বেরোজগার শ্রমিকদের অবস্থা এত খারাপ যে তারা অর্ধাহারে আছে। কয়েকজন সপরিবারে প্রতিদিন স্থানীয় এক লঙ্গরখানায় খেতে যায়। আর শয়তান মালিক কারখানার জমি এবং শেড বেচে দিয়ে পাওনাগণ্ডা  না মিটিয়ে কেটে পড়ার তালে আছে। এবং যাতে কেউ না জানতে পারে তাই তার দুষ্টু ম্যানেজার প্রতিদিন মিটিং এ আসেন আর ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা বলেন।
যাই হোক। হুগলীতে এসে অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন । এখানে যে সমস্ত ম্যানেজাররা মিটিং এ আসেন, তাঁরা অত্যন্ত  সংবেদনশীল । প্রায় সকলেই বলেন,“ম্যাডাম ওদের কষ্ট আমি বুঝি। আমিও তো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই আসছি। ” নিছক গল্পের আবহাত্তয়ায় কেস চলে। সেদিন যেমন একটা কেস এল শ্রমিক সই করে গ্রাচুয়িটির টাকা নিয়ে নিয়েছে। তাতে ইংরাজিতে লেখা ছিল ফুল পেমেন্ট, কিন্তু এখন সে বলছে, কিসে সই করেছি বুঝিনি,  কিন্তু আমি আরো টাকা পাব। কেসটা আমার পূর্বসুরীর কাছে চলছিল। নিয়ম মোতাবেক চেকটা ওর সামনেই দেবার কথা।  ওকে না জানিয়েই বাদী-বিবাদী মিটমাট  করে নিয়েছিল। এখন ঝামেলা বাঁধাতে আবার আমার দ্বারস্থ হয়েছে।
প্রচণ্ড ধমকালাম দুপক্ষকেই। ম্যানেজার সাহেব শুকনো মুখে জানাল, “অন্যায় হয়ে গেছে ম্যাডাম। ” দুজনকেই এভিডেন্সের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে ফাইল বন্ধ করতে যাব, ম্যানেজার সাহেব বললেন, “ম্যাডাম একটা গল্প শুনবেন। আমি তখন লেবার অফিসার হিসাবে সদ্য জয়েন করেছি। একটি ছেলে,  আমাদেরই কর্মচারী, একদিন এসে বলল, ‘স্যার। আমার ভাইকে একটা চাকরী দেন। ’ হাত নেড়ে জানালাম আমি পারব না। আমার সে ক্ষমতাই নেই। আবার কিছুদিন পর এল,  ছেলেটি। সেই একই কথা। আমারও সেই একই জবাব। এরপর দেখলাম ও দমল তো নাই, বরং আরো ঘনঘন আসতে লাগল। একদিন আমি বিরক্ত হয়ে ওকে মারব বলে উঠে দাঁড়িয়েছি, দেখি ও কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আমার নাম করে ইউনিয়ন লিডার ওর থেকে ৩০০০০টাকা ঘুষ নিয়ে নিয়েছে। মায়ের গয়না বেচে সেই টাকা দিয়েছে ওরা। এবার চাকরি না দিলে, ধনে প্রাণে মারা যাবে। আমি শুনে চুপ করে গেলাম। তারপর বললাম, যেমন ভাবে আমি  তোর কলার চেপে ধরেছি, ঠিক এইভাবে গিয়ে সেই লোকটার কলার চেপে ধর। বল তোর টাকা ফেরত দিতে। যদি আদায় করতে পারিস, আসিস আমি দায়িত্ব নিলাম। ওরা চলে গেল, আমি পিছনে লোক লাগালাম। খবর পেলাম প্রচণ্ড ঝামেলা হয়েছে। নেতামশাইকে ভালই জব্দ করেছে। সে বলেছ একটু একটু করে টাকা দিয়ে দেবে।
তিন মাস পরে ছেলেটি এসে বলল, ‘স্যার। ১৮০০০ টাকা পেয়েছি। বলছে আর পারবে না দিতে। ’ খবর ছিল। জানতাম ও আর দিতে পারবে না। চেয়ার ছেড়ে উঠলাম,  ছেলেটির ভাইয়ের হাত ধরলাম, নিয়ে গেলাম মালিকের ঘরে, বললাম, চাকরি দিতেই হবে। আমি কথা দিয়েছি। চাকরি হয়েছিল ম্যাডাম। এখনও চাকরি করে ছেলেটি। এখন তো বুড়ো হয়ে গেছে।
যাই হোক ম্যাডাম আমার কথার দাম আছে।  একটু সময় দিন, আমি দেখছি। কি করতে পারি। ” দিলাম সময়। আগে দেখা যাক---

---------------------------------------------------------------------------

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ১০ই এপ্রিল ২০১৭


কি বিশ্রী প্যাচপেচে  গরম। যদিও জানলার ধারের সিট, এক ফোঁটাও হাওয়া আসছিল না। তবে যতবার ট্রেনের জানলা দিয়ে মুখ বাড়াচ্ছিলাম, দুহাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল সোনার থালার মত এত ব্বড় চাঁদ। কি মোহক জোছনা। মহানগরের কন্ক্রীটের জঙ্গল, আবর্জনার স্তুপ বা উজ্জ্বল হ্যালোজেন আলোর সাধ্য কি তাকে দমায়। এক ঝলকেই নেশা ধরে যায়।
চন্দ্রাহত হয়ে নামলাম উল্টোডাঙা স্টেশনে। আর চাঁদ নেই। তাতে কি ক্ষণিক পূর্বের নেশায় মত্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম অটো স্ট্যান্ডের দিকে, হঠাৎ  কানে এল , এক মধ্যবয়সী মহিলা বলছে,“ চাঁদ দ্যাখ।  উই দ্যাখ চাঁদ। বড়লোকের ঘরে। ” চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি নিকটবর্তী ঝুপড়িবাসী এক মহিলা একটি অর্ধনগ্ন অবাধ্য অপরিচ্ছন্ন শিশুকে চাঁদ দেখাবার চেষ্টা করছেন।  জোছনা কি একটু ম্লান  হয়ে গেল কে জানে? শুধু মনে হল, “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি---”।

---------------------------------------------------------------------------

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৬ই জানুয়ারী২০১৭

কি ভুলভাল দিন মাইরি। সকাল থেকে ট্রেনের গণ্ডোগোল। সকালে বলল কালিনারায়ণপুরে মালগাড়ি উল্টেছে, তাই কল্যাণীর পর আর ট্রেন যাবে না। এ বেলা কোথায় কি উল্টেছে কে জানে?থিকথিক করছে ভিড়। গুতোগুতি করে তিনজনের সীটে চারজন বসেছি। পুরো নিমপাতা চিবানো মুখ করে বসে আছি।  এমন সময় চতুর্থ জন বলল,“ আর একটু চাপা যাবে না?আমরা কেউই তো তেমন মোটা নই। চারজনের আরামসে ধরে যাবে।” ঠিক শুনলাম কি? কেউই তেমন কি নেই? থাক আর বলতে হবে না।  যতদূর সম্ভব হাত পা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে বসলাম। 

চেপে চুপে বসে আছি, দেখি কে যেন মাথায় হাত বোলাচ্ছে তাকিয়ে দেখি জনৈক বৃহন্নলা! আমাকে দেখে এক গাল হেসে বলল,“সুন্দরী!এ্যাই সুন্দরী দুটো টাকা দে না”। সুন্দরী!!! নাঃ একটু আগেও পরিস্থিতি যতটা নারকীয় মনে হচ্ছিল এখন আর ততোটা লাগছে না। ভালোই তো বেশ। 😊😊😊😊😊


Saturday 25 March 2017

বস্ পুরাণ


বস্ অর্থাৎ ওপরওয়ালা। হোয়াট্স্ অ্যাপের দৌলতে প্রতিনিয়ত বন্ধুমহলে যে আলোচনা হয়, তার গরিষ্ঠাংশ জুড়েই থাকে নানা বন্ধুর বিভিন্ন  ধরনের  বসের গপ্প। আমরা যারা সরকারি চাকুরে তারা ধারণাই করতে পারব না, বেসরকারি ক্ষেত্রে ওপরওয়ালা এবং অধস্তন কর্মচারীর সম্পর্ক ঠিক কেমন হয়।একটা ছোট উদাহরণ দিই, ঠিক এই মুহূর্তে আমার এক বন্ধু হোয়াট্স্ অ্যাপে প্রবল ভাবে তার বসের মৃত্যুকামনা করে যাচ্ছে,  যা লিখছে , তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়,“গোটা অফিসের পরিবেশ দূষিত করে দিচ্ছে। মালটা মরে না কেন? মরলে হাড় জুড়োয়। মরুক। মরুক।  মরুক। ”মুস্কিল হচ্ছে শকুনের অভিশাপে গরু তো আর সবসময়---

এই বন্ধুটি আমার এএমআইইর বন্ধু। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আগে গুরুগ্রামে কর্মরত ছিল। সেখানে ওর বস্ ছিল এক অপরূপ দর্শন মধ্যবয়সী জাঠ। উচ্চতায় আমার বন্ধুটির প্রায় দ্বিগুণ। আপেলের মত ফর্সা গায়ের রঙ। রীতিমত জিমে গিয়ে শরীরচর্চা করা চেহারা। গোটা অফিসের সব মেয়ে বসের প্রেমে হাবুডুবু খেত, শুধু আমার বন্ধুটি বাদে। যেহেতু ওর প্রত্যক্ষ বস, তাই হয়তো ওর সাথে লোকটির একদম পটত না। রোজ সকাল থেকে বন্ধুটি মেসেজ পাঠাতে শুরু করত,“ ‘আমার হারামি বস্’ আজ এই করেছে, কাল এই করেছিল। আজ অমুককে নিয়ে ঘুরতে গেল। কাল তমুকের কোমর জড়িয়ে ঘুরছিল--”। মজার কথা হল, গ্রুপের বাকি সদস্যরাও না জেনে শুনেই এক সম্পূর্ণ অপরিচিত লোককে আশ মিটিয়ে গালমন্দ করত।  আমার লাভ এই হত, যে রোজ নতুন নতুন গসিপ আর গালি শিখতাম।
যাই হোক, বিগত বৈশাখ মাসে বন্ধুটি তার ‘হারামি বসের’ চাকরি ছেড়ে হায়দ্রাবাদে একটি ভাল চাকরি নিয়ে চলে যায়। এখানে বস একজন মহিলা। ইনিও মধ্যবয়সী। তবে প্রথাগত সুন্দরী নন। কিছুদিন গ্রুপটা আলুনি গেল, কারণ বন্ধু আর বসের গপ্প করে না। ভাবলাম চলো মেয়েটি শান্তিতে কাজ করুক। রথের পর থেকেই শুরু হল, পুনরায় বসের মুণ্ডপাত। মহিলা নাকি মহা ছকবাজ। অফিসে এসেই কেটে পড়েন, সন্ধার মুখে ঢোকেন এবং মাতব্বরি করেন। মাতব্বরি তো ঠিক আছে, কিন্তু সমস্যা হল, মহিলা একা কেটে পড়েন না, প্রায়শঃ কোন নব্য পুরুষ কর্মচারীকে বগলদাবা করে কেটে পড়েন। এমনকি অফিসে থাকলেও নানা রূপ দৃশ্যদূষণ ঘটান। ফলে অফিসে দিনরাত ফিসফাস চলে। এবং সবাই পর্যায়ক্রমে এসে আমার বন্ধুটিকে নালিশ করে যায়।

এতো গেল এক বন্ধুর বসের গপ্প। আর এক বন্ধু, যে এই মুহূর্তে প্রবলভাবে বসের মৃত্যুকামনা করে চলেছে তার গল্পটা একটু বলি। এই বন্ধুবর একটি ছেলে। যার বস্ মধ্যবয়সী এবং বাঙালি। মোটামুটি সুদর্শন এবং ওনার দৃঢ় বিশ্বাস, ঐ অফিসের সব মহিলা কর্মীই ওনার প্রেমে হাবুডুবু খায়। প্রতিদিন ঘোর ব্যস্ততার মুহূর্তে বস্ ডেকে পাঠায় এবং নিজের নানা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে ফলাও করে গল্প করে। একই গল্প বারবার লাগাতার--শুনে শুনে বন্ধু তো দূর আমাদের এমন কি আমার মুখে শুনে শৌভিকেরও মুখস্থ  হয়ে গেছে। বসের ধারণা মেয়েরা ওনাকে দেখলে প্রেমে না পড়ে থাকতেই পারে না। কত মেয়ে ওনার জন্য ঘর সংসার স্বামী ত্যাগ  করে পথে নামতে রাজি হয়েছে কিন্তু উনি কারো সংসার ভাঙেননি। আর বন্ধু কি বলে? ওর মেসেজ গুলি একটু শেয়ার করছি, যথাবিহিত সেন্সর করে,“ হারামজাদা বলে কি রে? সবাই ওর প্রেমে হাবুডুবু খায়?কে খায় বাপ?পঞ্চাশ বছুরে বুড়ো ভাম। চোখের তলায় কালি। চামড়া ঝুলে গেছে। মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলেই ঘাড় কাৎ করে অর্ধেক নিমিলিত চোখে মুচকি হাসে, ভাবে হেব্বি সেক্সি লাগছে, মেয়ে গুলো বাথরুমে গিয়ে বমি করে নির্ঘাত। কোন দিন হ্যারাসমেন্টের কেসে সিওর ফাঁসবে মাইরি--। কারো ঘর ভাঙেনি!! ন্যাকা__ ক্ষমতাই নেই তো ভাঙবে কি?-”। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

তবে এই দুই বন্ধুকে নিয়ে আমার খুব বেশি মাথা ব্যথা নেই। বস যতই বুনো ওল হোক, এরা বাঘা তেঁতুলের বাপ। সমস্যা আমার অপর এক নিরিহ গোবেচারা বন্ধুকে নিয়ে। মেয়েটি বড় ভালো। কিছুদিন আগেই প্রোমশন পেয়ে হেড অব দা অফিস হয়েছিল। সম্প্রতি জয়পুর থেকে মালিকের ভাই এসে বড় সাহেব হয়ে বসেছে। অদ্ভুত কেস, সব অধিকার ওনার, সব দায় এই মেয়েটির। মেয়েটির জমানায় অফিসে বেশ এক ফ্যামিলি ফিলিং ছিল। সবাই মনের আনন্দে কাজ করত। ঝামেলা হলেও আপোসে মিটমাট হয়ে যেত। বস এসেই এক নীচু তলার কর্মীর সাথে প্রণয়জালে আবদ্ধ হলেন। মেয়েটি আমার বন্ধুর ভাষায় অতি চতুর। যদিও বিবাহিতা তবু ইতিপূর্বে অপর এক সহকর্মীর সাথেও প্রেমজালে জড়িয়ে নানা জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। বন্ধুবর সুকৌশলে ম্যানেজ করেছিল। কিন্তু এবারে পরিস্থিতি এতটাই জটিল, যে ওর হাতে আর কিছু নেই। মেয়েটি স্বেচ্ছায় স্বামীকে এবং প্রাক্তন প্রেমিককে ছেড়ে নব্য প্রেমিকের সঙ্গে থাকবে বলে বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে গৃহত্যাগী হয়েছে। ফলে দফায় দফায় লোকজন এসে আমার বন্ধুটিকে নানা কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। যার কোন কিছুর জন্যই ও দায়ী নয়। বন্ধুর প্রেশার দড়াম করে নেমে গেছে। চাকরী টার্গেট সংসার মাথায় উঠেছে।  বন্ধু ক্ষোভে নিজের মৃত্যুকামনা করছে আজকাল।

কথা প্রসঙ্গে শৌভিককে গল্পটা বলছিলাম, নৈশাহারের সময় রোজই বলি সবই বলি। সেদিন শৌভিক বলল, "এর একটাই সমাধান আছে। তোর বন্ধুকে এই লিঙ্কটা পাঠিয়ে দে। এক আমেরিকান(?) ভদ্রমহিলা কি ভাবে বসকে শায়েস্তা করেছে। "

বন্ধুকে পাঠাবার আগে একপ্রস্থ নিজেই পড়ে দেখি। কি পাঠাচ্ছি যেনে বুঝে পাঠানোই ভাল। পড়ে দেখি এক মহিলা তিন  মিলিয়ন ডলার লোট্ট জিতেছিল। জেতার পরদিনই মহিলা গেলেন পদত্যাগ  করতে। পদত্যাগপত্র লিখে বসের চেম্বারে  গিয়ে দেখেন বস্ চেম্বারে নেই।  মাথায় কি দুষ্ট বুদ্ধি চাপল জানি না, চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে, মহিলা এক অপকর্ম করে বসলেন। উনি বসের টেবলে মলত্যাগ  করে,  মনের আনন্দে বেরোতে যাবেন ঠিক সেই মুহূর্তে মঞ্চে বসের প্রবেশ। প্রবল ঝগড়া ঝাঁটির পর পুলিশ ডাকলেন বস। মহিলা গ্রেপ্তার হলেন, আদালতে পেশ করা হল। আদালতে বিচারকের সামনে মহিলা গলা বাজিয়ে বললেন,   “হ্যাঁ করেছি। আমি এতটুকু লজ্জিত নই। বিগত পাঁচ বছর ধরে আমি ওর ‘শিট্’ ঘাঁটতে বাধ্য হয়েছি। জীবনে অন্তত একটিবার, একটিবার ও আমার ‘শিট্’ ঘাঁটুক। ”

https://amianindita.blogspot.in

Saturday 25 February 2017

বেণু-রতন

-হাওয়াটা দারুণ না?
-অ্যাঁ?আমায় বললেন?
-হ্যাঁ । বলছি আজ দারুণ হাওয়া দিচ্ছে।
-ও। হ্যাঁ। মানে রোজই কি এমন হাওয়া দেয় না? সমুদ্রের হাওয়া?
-কি জানি? দেয় কি না। আগে কখনও এই অনুভূতিটা হয়নি কি না।
-কি অনুভূতি? কিছু মনে করবেন না, আমার বোধহয় প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি---
-আরে না না। কিছু এমন অন্যায় হয়নি। আপনি এত সঙ্কুচিত  বোধ করবেন না।
-সঙ্কোচ?সঙ্কোচই তো আমার একমাত্র সম্বল ভাই, এই দেখুন না জীবনে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার শ্রীক্ষেত্র এলাম, প্রথমবার এসেছিলাম বছর  চল্লিশ  আগে, তখন আমি নবোঢ়া। স্বামী শ্বাশুড়ি আর স্বামীর আগের পক্ষের তিন ছেলের সঙ্গে। যার বড়টি আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট ছিল-।  আর এবার এসেছি আমার মেজবোন,ভগ্নীপতি,তার মা, দাদা-বৌদি,তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে। এখন আমি এক অসহায় নিঃসম্বল গৃহহীন,বিধবা। (প্রৌঢ়া আঁচলের খুঁটে চোখ মুছলেন) মাপ করবেন দাদা আমি আবার আবোলতাবোল  বকতে লেগেছি---
-(প্রৌঢ় গলা ঝেড়ে সঙ্কুচিত  হয়ে বললেন) আরেঃ না না। আপনি বলুন না-- আমার মন্দ লাগছে না। আসলে আমার কথা বলার কেউ নেই জানেন। উত্তরবঙ্গের এক অজ গাঁয়ের এক ছোট্ট প্রাথমিক স্কুলে মাষ্টারি করি। নিজেই হাত পুড়িয়ে রান্না  করি, এখন অবশ্য আর হাত পোড়ে না। হাঃ হাঃ।
-প্রৌঢ়া অল্প হাসলেন। প্রৌঢ় অবাক মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, প্রৌঢ়ার গালে গোলাপী রঙ লাগল। দুজনেই চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। সামনে অতল গভীর বঙ্গোপসাগর ছলাৎ-  ছল করে আছঢ়ে পড়ছে তটরেখায়। মহিলা সামলে নিয়ে বললেন,“ তবু ভাল। আপনি স্বনির্ভর। আমি তো লেখাপড়াও তেমন শিখিনি। দাঙ্গার ভয়ে ওপার থেকে পালিয়ে এসেছিল আমাদের পরিবার। পথে বাবাকে ওরা কুপিয়ে খুন করে। মা কোনমতে দুই মেয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে আসে। খাবারই জোটা দায় ছিল তো পড়াশোনা। আমার বর বয়সে অনেক বড় ছিলেন। বিশাল কারবার। প্রথম পক্ষের স্ত্রী তিন ছেলে রেখে হঠাৎ  মারা যান। ছেলেদের সামলাবেন না কারবার?অগত্যা আমায় বিয়ে করেন। মা জেনেশুনেই দিয়েছিল। আমার ভাইবোনেরা ভাল ভাবে মানুষ হতে পারে যাতে। বিয়ের পর জানতে পারলাম ওনার অপারেশন করানো আছে। আমি আর কখনও মা হতে পারলাম না। আমার আজ তিনকূলে কেউ নেই জানেন। বোনের বাড়ির নিছক আশ্রিতা আমি_---
-(অখণ্ড নীরবতা, শুধু অবাধ্য বঙ্গোপসাগর একাই ছলাৎ ছল করে আওয়াজ করে চলেছে। )
-(ভদ্রলোক গলা ঝেড়ে বললেন) জানেন আমার ও কেউ নেই। আমরাও পালিয়ে এসেছিলাম দাঙ্গার ভয়ে। বাবা এপাড়ে একটা ছোট্ট মণিহারি দোকান দিয়েছিল। মন্দ চলছিল না। দশ ক্লাশ ভালভাবে পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম। গায়ে বসন্তের হাওয়া লাগল। কলোনীর জলের লাইনে প্রথম দেখা তার সঙ্গে। গাছকোমর বেঁধে ঝগড়া করছিল। দেখেই বুঝতে পারছিলাম এসবে সে অভ্যস্ত  নয়। হয়তো ওপাড়ে কোন সম্ভ্রান্ত  পরিবারের মেয়ে, এপাড়ে এসে এই পুতিগন্ধময় পরিবেশে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না, তবু ছাড়ছে না। সারভাইভাল অব দা ফিটেস্ট।  হাঃ হাঃ হাঃ
-সত্যি বাবা। উফ্ ঐ জলের জন্য সাতসকালে ঝগড়া করা আমারও পছন্দ ছিল না। ঘেন্না লাগত। কিন্তু না করলে উপায় ছিল না। যাই হোক তারপর??
-তার আর পর নেই। পড়াশোনা মাথায় উঠল। বন্ধুর থেকে ধার করা  সাইকেল নিয়ে তার ঘরের চারপাশে ঘোরা---এক ঝলক দেখতে পেলেই দিন সার্থক।
-হ্যাঁ তখন তো ছেলেরা তাই করত। আমাদের কলোনীতেও এমন একজন ছিল। আমার সখীরা বলতো সে নাকি আমায় ----(প্রৌঢ়ার মুখ সিঁদুর বর্ণ ধারণ করল) যত বাজে কথা। বুড়ো বরকে কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হইনি প্রথমে জানেন। শুধু তার কথা ভেবে। অবশেষে একদিন রাতে তাকেই বলেই বসলাম, পারবে না আমার দায়ভার নিতে? তো বলে খাব কি? রাখব কোথায়? আর কথা বাড়াইনি। মুরোদ বোঝা গেছিল।
-প্রৌঢ় হেসে বললেন,“এরম বলবেন না। মুরোদ থাকলে কি কেউ ফেরায়?আমার তিনিও আমায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন একদিন। তখন গভীর রাত, নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে হাজির হলাম তাদের হোগলার ঘরের পিছনে। সেদিন শুক্লা চতুর্দশী। নোংরা পুতিগন্ধময় কলোনী ভেসে যাচ্ছে শশধরের চাঁদনীতে। বুকে তীব্র কম্পন ধরিয়ে সে এল। জংলা ছাপ শাড়ি ঘরোয়া ভাবে পড়া,  একমাথা কোঁকড়া চুল একটা বিশাল খোঁপায় জড়ানো। দুটো প্রেমের কথা বলব কোথায়, গলা দিয়ে আওয়াজই বের হল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বুঝলাম সে কাঁদছে। মুখ খুলতে যাবার আগেই সে দুহাতে আমার হাত চেপে ধরল। তারপর আমার হাতে মাথা ঠুকতে লাগল। টপটপ করে অশ্রুকণা ঝড়ে পড়তে লাগল আমার হাতে----।
-মহিলা ছটপট করে উঠলেন। “থাক না।শুধু শুধু ও সব কথা”
-হুঁ। ঠিকই বলেছেন। সেও সেদিন বলেছিল তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে---পারিনি। বিশ্বাস করুন। তার জন্যই পারিনি। কোথায় রাখতাম তাকে?কি খাওয়াতাম? একবার তো উদ্বাস্তু হয়েইছে আবার কি ছিন্নমূল  হত আমার জন্য?তাই ফিরিয়ে দিলাম। চোরের মত পালিয়ে এলাম। সারারাত শুধু কেঁদেছি। পরদিন সকালে দৌড়ে গেছি তার কাছে, ফিরিয়ে নিয়ে যাব বলে। কিন্তু -----। আজ এত বছর পর শুধু আপনাকেই বলছি। কেন জানি না।  পালিয়ে গেছি, সবকিছু ছেড়ে। হিমালয়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে চেয়েছি,মিশে যেতে চেয়েছি। কিন্তু পারলাম কই?অন্য নারীসঙ্গও তাকে ভোলাতে পারেনি। সেই স্পর্শ, সেই অশ্রুকণার উষ্ণতা, সিক্ততা আজও একই রকম ভাবে অনুভব করি। ভুলতে পারিনি----
-ভোলা যায় না। আমিই কি পেরেছি?শুধু ঐ স্মৃতিটুকুই যা অমৃত বাদবাকি সবই গরল। খুব ইচ্ছা ছিল বিয়ের পর শ্রীক্ষেত্র আসব তার সাথে মধুচন্দ্রিমা যাপনে--- সেই এলাম। কিন্তু  😔😔
-কি আশ্চর্য ওর ও তাই ইচ্ছা ছিল বলে শুনেছি পরে ওর ঘনিষ্ঠ সখীর কাছে----
-ফুল  মাসিইইই ---দূর থেকে কে যেন ডাকল,মহিলা শশব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন। ভদ্রলোক অসাড় হয়ে বসে রইলেন কতক্ষণ, তারপর খেয়াল হল ইশ্ নামটা তো জানা হল না? একই কথা ভাবছিলেন প্রৌঢ়াও-__ বঙ্গোপসাগর ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল এদের নির্বুদ্ধিতায়। “যাক্ কাল আবার আসতে হবে, ঠিক এই সময়” ভাবল প্রৌঢ়। “ইশ্ কালই ফিরে যাওয়া-” ভাবল প্রৌঢ়া।
https://amianindita.blogspot.in

Wednesday 22 February 2017

একূট

প্রচণ্ড ব্যস্ত,সকাল বেলায় ডিএম সাহেবের ওখানে মিটিং করে এলাম, বিকালে যেতে হবে চন্দননগর। ডিএলসি সাহেবের মিটিং।মাঝে নটা গ্রাজুইটি কেসের হিয়ারিং। দুঁদে উকিল বাবুর মনে হয়েছিল গোলুমলু নতুন ম্যাডাম এসেছেন ধমক ধামক দিয়ে কাজ উদ্ধার করবেন, কিন্তু ম্যাডাম ও যে ধমকাতে পারেন এবং ওণার চেয়েও জোরে এটা বোধহয় ভাবেননি। প্রবল মাথা গরম করে উকিল বাবু বিদায় হলেন। মন বলল ধুৎ তেরি। অনেক হয়েছে, অফিসের পাশের সুইমিং পুলে ঝাঁপ মারি--- কিন্তু যা শ্যাওলা, বেঁচে থাকলে দাদ, হাজা, চুলকানি অবধারিত। তার ওপর সাঁতারটাও জানি কি না।
তিতকুটে মুখে বসে আছি, আবার মুঠোফোনের চিৎকার। ধুত্তোর বলে ধরতে গিয়ে মনটা হঠাৎ  খুশি হয়ে গেল--- চৈতালী। পর মুহূর্তে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, অফিস টাইমে তো কোনদিন ফোন করে না। তবে? কি হল রে বাবা?
ভয়ে ভয়ে ধরতেই ওপাশে চৈতালীর কেজো সুর,“শোন না, তোর সীমাকে মনে আছে?  আমাদের সাথেই পড়ত?”  দিব্যি মনে আছে। যোগাযোগ নেই যদিও। ওরা এককালে বিশাল ধনী ছিল, ওদের বাড়িটা ছিল প্রাসাদতুল্য, সামনে একটা কালো গাড়ি রাখা থাকত। আর ছিল একটা জাঁদরেল কুকুর। তার নাম ল্যান্ডো। সীমা অর্থাৎ সীমন্তিকার বাবা মা খুব অল্প বয়সে মারা যান। ওর ঠাকুমাই ওকে মানুষ করেছিল। ঠাকুমা ছিলেন অপরূপ রূপসী। ধপধপে সাদা শাড়ি পরতেন, গায়ের রঙ ছিল মাখন। যাই হোক বললাম,“   হ্যাঁ।  মনে আছে তো। কেন?” চৈতালী বলল, “জানিস তো সীমার ঠাকুমা যেন বীরভূমের কোথাকার একটা রাজকুমারী ছিলেন”।  এটাও জানি। চৈতালী বলেই চলেছে,“ ঠাকুমার ঐ বাপের বাড়ি মানে রাজবাড়িটা ওরা বিক্রি করে দিচ্ছে। ” মনে মনে ভাবলাম,“তো? তুই কিনবি নাকি? না আমায় কিনতে হবে?” মুখে বললাম,“ ঠিক কি বলতে চাস, পরিষ্কার করে বল না বাপু। ”
“শোন না ঐ বাড়িটায় নাকি ইয়ে আছে। পরপর দুটি লোক ওখানে মারা গেছে সাম্প্রতিক কালে। দুটোই অস্বাভাবিক মৃত্যু । একজন মারা গেছেন সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে। তার নাকি ঘাড়টা উল্টোদিকে ঘুরে গিয়েছিল। আর একজন গলায় দড়ি দেন। ”
“সেকি রে?”
“হুঁ। আরো আছে মামা। এই দুজনেই ছিল এক নামি হোটেল চেইনের কর্মচারী। ওরা গিয়েছিল ঐ বাড়িটা দেখতে। ওরা ঠিক রিপোর্ট দিলে বাড়িটা সীমাদের থেকে ঐ হোটেল কোম্পানী কিনে নিত। ”
“বাপস্। তা দুজন কি একই সঙ্গে----?”
“না বে। সেটাই তো রহস্য। প্রথমজন মারা যাবার বেশ কয়েক মাস পর দ্বিতীয় ব্যক্তি যায় এবং সে ও---”
একটু দম নিয়ে চৈতালী আবার বলল,“যাবি নাকি?   আমরা তো বসন্তপূর্ণিমা আর বেনারস ঘুরে এসেছি--। ” হ্যাঁ। এর আগে আমরা দুবার ভূতের বাড়িতে রাত কাটিয়েছি বটে, তবে কোনটাই তেমন খুনী টাইপ ছিল না। ইতঃস্তত করছি, চৈতালী বিরক্ত  হয়ে বলল,“বল না বে?  তুই বললে আমি অন্তুর (অন্তরা) সাথে কথা বলব, আর তুই সঞ্চির(সঞ্চিতা) সাথে কথা বল। সীমাও যাবে। সরেজমিন তদন্ত করতে। ওর ধারণা এটা ভূত টুত না। কোন দুষ্টু লোকের কারসাজি। ”
“প্রাণটা এতক্ষণ বোধহয় এর জন্যই হাঁকপাঁক  করছিল রে,চল যাই।  তবে এখুনি পারব না বস্। আমার মেয়ে আর অন্তুর ছেলের পরীক্ষা । তার ওপর আমি ডিডিও। মার্চ মাসের মধ্যে সরকারের সব টাকা না খরচা করতে পারলে গর্দান যাবে--- এপ্রিলে চল। ”
“চল্।  ডান” বলল চৈতালী। এবার সঞ্চিকে ফোন করার পালা,“ও সঞ্চিতা যাবি তো?”
https://amianindita.blogspot.in

Wednesday 1 February 2017

অনির পুরুলিয়া ডাইরি


অনির পুরুলিয়া ডাইরি ৩১শে জানুয়ারি ২০১৭

চলেছি পুরুলিয়া। বিকাল ৪টে ৫০ এর পুরুলিয়া এক্সপ্রেস যখন হাওড়া ছাড়ার হুইসেল দিচ্ছে শৌভিক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কিছু খাবি? কিনে আনব?চিপস্?” শৌভিক চিপস্ কিনে দিতে চাইছে? প্রথমে বিশ্বাস হল না। আমার স্বাস্থ্য সচেতন বরের কাছে চিপস্ চপ আর বিষে খুব বেশি তফাৎ নেই। বিশেষতঃ খাদক যেখানে আমি।

প্রবল ভাবে মাথা নেড়ে না বললাম। হকার তো উঠবেই। আর আইআরসিটিসি তো আছেই।  কত রকম চপ, মশলা মুড়ি , সিদ্ধ ডিম, বাদাম চিঁড়ে ডালমুট উঠবে। খেতে খেতে যাব। সাথে চা কফি তো থাকবেই। মদন কটকটিও নির্ঘাত উঠবে। খড়্গপুরে থাকাকালীন কম খেয়েছি?

হাওড়া ছাড়ার একটু পরই বাদাম ওলা উঠল। শৌভিক আবার অনুরোধ করল,“খাবি?” দশ টাকার এক প্যাকেট বাদাম ভাগ করে খাওয়া হল তিনজনে। শৌভিক এত খাবার জন্য অধীর হচ্ছে কেন বুঝতে পারলাম না। ওটা তো সাধারণত আমার দপ্তর। এখনও রাত বাকি পথ বাকি, কত কিছু খাওয়া বাকি। খড়্গপুর তো আসুক।

সাড়ে ছটায় খড়্গপুর এল এবং চলেও গেল। সেই কখন খাওয়া চারটি বাদাম কোথায় হারিয়ে গেছে, আমরা দুই ক্ষুধার্ত মা মেয়ে লোভাতুর দৃষ্টিতে একবার এই দিকের দরজার দিকে তাকাচ্ছি একবার ঐ দিক। কেউ ওঠে না কেন? আই আর সি টিসি ওলারা কি মরে গেল নাকি? ট্রেন গিরিময়দান হয়ে মেদিনীপুর, শালবনী, চন্দ্রকণা রোড, গড়বেতা হয়ে বিষ্ণুপুর ঢুকতে চলল কেউ ওঠে না। মাঝে একজন হকার এল চাল ভাজা নিয়ে, তার হাতে বোধহয় সাকুল্যে চারটি প্যাকেট রয়েছে। তুত্তুরী ক্রমশঃ ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ছে, বললাম ব্যাগে বিস্কুট আছে, আপেল আছে খেতে। তাও খেল না।  চালভাজা ওলাকে দেখে ভাবছে আরো কেউ উঠবে হয়তো। উঠল বটে অনেক পরে তবে উলের মোজাওলা। কি ভাগ্যি শৌভিক জলটা হাওড়া থেকেই তুলে নিয়েছিল, না হলে হয়তো নির্জলা থাকতে হত।
প্রায় বাঁকুড়া ঢোকার মুখে যখন কাঁদো কাঁদো মুখে বিস্কুট খেতে বাধ্য হচ্ছি, একজন হকারের প্রবেশ হল। কি যে বিক্রি করছে বোঝা গেল না, তবে গোটা সি ওয়ান বাতানুকূল কামরার সব যাত্রী প্রায় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমরাও কিনলাম। চিঁড়ে পোলাও । ছোট্ট চকমকে প্যাকেট দশটি টাকা। খুলে মুখে দিয়ে দেখি, প্লেন ভাজা চিঁড়ে। সাথে গুটি কয় বাদাম। অল্প ঝুড়ি। আর শুকনো বোঁদে। বোঁদের জন্য কি না জানি না কি প্রচণ্ড মিষ্টি। চিঁড়ে পোলাও নয় এর নাম হওয়া উচিত চিঁড়ের হালুয়া। তুত্তুরী এবং তার বাবা যদিও তোফা তোফা করে গেল। একমুখ চিঁড়ে নিয়ে আধো আধো স্বরে আমার কন্যা বলল, “ কি ভালো খেতে মা। ইয়াম্ ইয়াম্ য়াম্ য়াম”

আদ্রা স্টেশনে পৌছবার কথা ছিল রাত নটা কুড়ি, ঘড়ি ধরে সঠিক সময়ে নামিয়ে দিল পুরুলিয়া এক্সপ্রেস। নামার সময় দেখি বাকি ট্রেন থেকে বাতানুকূল কামরায় ঢোকার ভেস্টিবিউলটা বন্ধ।  ওঃ হরি। তাই কোন হকার উঠতে পারেনি। 
গাড়ি তৈরি ছিল। সবই দেবময় দা থুড়ি এসডিও রঘুনাথপুরের আনুকূল্য ।  গাঢ় অন্ধকারের ভিতর দিয়ে গাড়ি ছুটল গড়পঞ্চকোটের উদ্দেশ্যে। দূরত্ব ২৪কিলোমিটার কিন্তু ড্রাইভার সাহেব জানালেন আধ ঘন্টার  বেশি সময় লাগার কথা নয়। কোথায় থাকব, তাও দেবময় দাই ঠিক করে দিয়েছেন। শৌভিকের বক্তব্যানুসারে দেবময় দা নাকি যে রিসর্টটি আমাদের জন্য বেছে দিয়েছেন, সেটি এই মহল্লার আপাততঃ সবথেকে সুন্দর রিসর্ট। একদম যাকে বলে পাহাড়ের কোলে। ঘুটঘুটে অন্ধকার জনমানবশূন্য পথে হুহু করে দৌড়চ্ছে সুইফট্ আর এদিকে আমার বর আর কন্যা  ফিসফিস  করে আলোচনা করছে পথে হঠাৎ  ডাকাত পড়লে কি হবে? এক মুখ ঝামটায় দুজনকে থামালাম, যতঃ অশুভ কথাবার্তা। রীতিমত ভয় করছে আমার।

অনির পুরুলিয়ার ডাইরি (পর্ব ২) ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নিকষ  অন্ধকারে হুহু করে দৌড়চ্ছে সুইফট, হঠাৎ মনে হল দিগবলয় বরাবর  আবছা পাহাড়ের রেখা দেখা গেল। ঠিক ঠাহর  করতে পারলাম না, শুধু মনে হল এক বিশাল সরীসৃপ ক্রমশঃ আমাদের পেঁচিয়ে ধরছে। এক অদ্ভূত অবর্ণনীয়  শিহরণ খেলে গেল মুহূর্তের জন্য। গাড়ি এসে দাঁড়াল এক বিশাল লোহার গেটের সামনে। হর্ণের আওয়াজ পাওয়া মাত্রই দু তিন জন লোক দৌড়ে এল। এক প্রৌঢ় গায়ে শাল মুড়ি দিয়ে হাতে এক বিশাল সার্চ লাইট নিয়ে এসে চট করে দরজা খুলে দিলেন। ড্রাইভার মধু বাবু, যিনি আবার গাড়ির মালিকও বটে, দৌড়ে আসা একজনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, “স্যার উনি দেবাশীষ দা। ” দেবাশীষ বাবুকেই দেবময় দা আমাদের কথা বলে রেখেছিলেন। ট্রেন থেকে নামার আগেই উনি ফোন ও করেছিলেন। আমাদের খাতির করে নিয়ে গেলেন ভিতরে।

গাড়ি থেকে নেমে দেখি, বিশাল এলাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেটের ঠিক পাশেই এক বিশাল ওয়াচ টাওয়ার। বিরাট সুদৃশ্য লন, মাঝে আঁকাবাঁকা কংক্রীটের পথ। গেটের অপর প্রান্তে অর্ধচন্দ্রাকারে তিনটি ছোট ছোট কটেজ। মাঝে একটি দোতলা বাড়ি। প্রতিটি কটেজের রঙ হলুদ, গায়ে না না ছবি আঁকা। কটেজ গুলিতে তিনটি করে ঘর। আমাদের কটেজে তিনটি ঘর, নাম হল ভাদু, টুসু আর ঝুমুর। টুসুটা আমাদের জন্য বরাদ্দ। ঘরে ঢুকে মন ভরে গেল। বেশ বড় ঘর। মেঝেতে চকচকে টাইলস্ পাতা। কিং সাইজ খাটে পরিপাটী করে পেতে রাখা বিছানা দেখেই রাজ্যের ক্লান্তি ভর করল। সোফা, টিপয়‘ বড় টিভি, ওয়ার্ড রোব, দুদিকে বেড সাইড টেবল, কনসিল্ড লাইট ইত্যাদি ইত্যাদি সহ থ্রি বা ফোর স্টার হোটেলের মত ব্যবস্থা । সবথেকে ভালো লাগল ওঁদের আন্তরিকতা । দেবাশীষ বাবু বললেন,“স্যার অনেক রাত হয়ে গেছে, আজ আর আপনাকে সই সাবুদ করতে হবে না। আগে ডিনার করে রেস্ট নিন। ওসব কাল হবে।” আর ডিনার? ডিনারে ছিল গরম হাতে গড়া রুটি আর দিশি চিকেন কারি। সে যে কি অনবদ্য খেতে কি বলব। একটু ঝাল যদিও।আমরা ছাড়া রিসর্টে আপাতত আর অন্য কোন অথিতি নেই।

পরদিন ভোর বেলা ঘুম ভেঙে গেল। জানলার কাঁচ সরিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল, গাঢ় কুয়াশার চাদর ভেদ করেও চোখে পড়ে ঘণ সবুজ গড়পঞ্চকোট পাহাড়। একদম রিসর্টের গা ঘেষেই উঠে গেছে। চটজলদি স্নান সেরে লুচি আর ফুলকপি আলু মটরশুটির ঝালঝাল তরকারি খেয়ে দৌড়লাম ওয়াচটাওয়ারের উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যে গাড়ি এসে গেছে। আজ জাইলো, ড্রাইভার ও নতুন। একটি অল্প বয়সী ছেলে নাম আমানুল।
কোথাও যাবার আগে শৌভিক সেই জায়গাটা সম্বন্ধে প্রচুর পড়াশোনা করে।  এ ব্যাপারে ওর আদর্শ হল ফেলুদা। আজ্ঞে হ্যাঁ শ্রীমান প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। কোথাও বেড়াতে গিয়ে কবে কি কি দেখব এটা আমার বর আগে থেকেই ছকে রাখে। সেই মত আজ আমরা দেখব বড়ন্তী লেক, কাশিপুর রাজবাড়ি আর জয়চণ্ডী পাহাড়। সেই মোতাবেক আমানুল গাড়ি ঘোরালো বড়ন্তী লেকের দিকে। ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে দশটা ছুইছুই করছে, চারপাশ তখনও আবৃত হাল্কা-গাঢ় কুয়াশার চাদরে।
অনির পুরুলিয়া ডাইরি (পর্ব ৩) ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৭
বড়ন্তী পৌছে প্রথম চোটে বেশ হতাশ হলাম। একটা মাঝারি মাপের টিলা,  তার সামনে একটি বিরাট টলটলে লেক। আমার সহপাঠী দেবু অর্থাৎ শ্রীমতী দেবযানী খানের মুখে প্রায় শুনি পুরুলিয়ার ভয়াবহ জলভাবের গল্প। দেবু স্বাস্থ্য দপ্তরে কর্মরতা, আপাততঃ পুরুলিয়াতেই পোস্টেড। প্রতিবছর গ্রীষ্মে দেবুদের কর্ম ব্যস্ততা বহুগুণ বেড়ে যায়, কারণ তীব্র জলাভাবে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ যে ডোবার জলে শৌচকর্ম করে, সেই জলই পান করতে বাধ্য হয়। পুরুলিয়ায় এসে দেখলাম, সত্যই ইতিমধ্যেই পুকুর-ডোবার জল প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। যে টুকু আছে তাও ঘোলা, সেখানে এত সুন্দর টলটলে লেক দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। কিন্তু বড়ন্তীর যে প্রশংসা শুনেছি, সে তুলনায় কিছুই অনুভব করলাম না। বড় লেক কিন্তু বোটিং এর কোন ব্যবস্থা নেই। আমরা টিলা যার পোশাকী নাম মুরারড়ি হিলের দিকে নামতে যাচ্ছিলাম, আমানুলই নিষেধ করল, “স্যার ছবি তুলবেন তো? ওদিকে যাই-”।  আড়াআড়িভাবে লেককে অতিক্রম করতে গিয়ে জিভ বেরিয়ে গেল। কি জঘন্য মাটির রাস্তা খানাখন্দে ভর্তি। একদিকে লেক আর একদিকে ঢালু খাত। আমানুল বলল, এই রাস্তা দিয়ে লৌহ আকরিক বহনকারী  ট্রাক যায় বলে রাস্তার এই দশা। ছোট গাড়ি হলে নির্ঘাত উল্টে যেত।  আমার বর এবং মেয়ে যথারীতি আলোচনা করতে লাগল, গাড়ি লেকে উল্টে পড়লে কি হবে, আর খাতে উল্টোলে কি হবে? শুভকথা বলতে তো শেখেইনি দুটোতে----

ওপারে গিয়ে যেখানে গাড়ি থেকে নামলাম, বেশ ভাল লাগল। লেকের ধার বরাবর লাল মাটির সরু রাস্তা, প্রচুর রঙ বেরঙের ফুল ফুটে আছে। জলে উল্টো দিকের মুরারডি হিলের হাল্কা প্রতিচ্ছবি পড়ছে। আমানুল হতাশ হয়ে বলল, “স্যার এই কুয়াশাটা যদি না থাকত, তাহলে পাহাড়ের প্রতিটা গাছ- পাথরের ছায়া দেখতে পেতেন। ” সত্যি তো কুয়াশার জন্যই অস্পষ্ট লাগছে, ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম শুধু পাহাঢ় নয়, ওপাড়ের সমস্ত গাছপালারও নিখুঁত প্রতিবিম্ব পড়ছে জলে। লাল মেঠো পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম, বেশ লাগছিল। আমরা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পর্যটক নেই। স্থানীয় গ্রামের সদ্যস্নাত মেয়েরা কাঁখে জল নিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে, মাথার ওপর মিষ্টি সোনা রোদ, ঈষৎ  উষ্ণ বাতাসে দ্রুত অপসৃত হচ্ছে কুয়াশা, সব মিলিয়ে স্বপ্নের পরিবেশ। শৌভিক পটাপট ছবি তুলতে লাগল। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, আমানুল যেখানে আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়েছিল, ওখান থেকেই সবথেকে স্পষ্ট প্রতিবিম্ব দেখা যায়। সব মিলিয়ে বড়ন্তী বড় মায়াময়। পরে এসডিও দেবময় দার মুখে শুনলাম শীঘ্রই এখানে বোটিং ও চালু হতে চলেছে।  
বেশ খানিকক্ষণ বড়ন্তীর রূপসুধা পান করে, ওপাশে মুরারড়ি হিলে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা রওণা দিলাম কাশিপুর রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। পথে দেখলাম অনেক গরু, পিঠে লাল রঙে তিনটি করে টিপ আর লম্বা লাইন কাটা। গরুগুলোকে এমন সঙ সাজানো হয়েছে কেনর জবাবে আমানুল বলল, ঐ গুলিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাশিপুর রাজবাড়ি সংলগ্ন  হাটে। প্রতি বৃহস্পতিবার ওখানে গরুর হাট বসে, যাতে এই গরুগুলি সাধারণ গরুর সাথে না মিশে যায় , তাই লাল রঙে মার্ক করা হয়েছে। অচীরেই কাশিপুর রাজবাড়ির কাছাকাছি এসে পড়লাম। বিশাল এলাকা জুড়ে প্রকাণ্ড প্রাচীর রাজবাটীকে ঘিরে রেখেছে, অনেকটা গুণ্ডিচা বাড়ির  (জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি) প্রাকারের মত দেখতে। দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। গাড়ি এসে দাঁড়ালো বিশাল গেটের সামনে। গেটে ইয়া বড় তালা। গেটের দুপাশে দারোয়ানদের ঘর। ঘরের সামনে বারান্দা। কিন্তু সব খালি। দরজার দুপাশে উঁচু পাঁচিলের ওপর সশস্ত্র প্রহরী বসার খোপ কাটা গোটা প্রাকার বরাবর। কিন্তু আজ তা অরক্ষিতই পড়ে আছে। আমানুল হর্ণ বাজালো, ডাকাডাকি করল কেউ বেড়িয়ে এল না। আমাদের কোন হেলদোল নেই, শৌভিক বাইরে থেকেই সিংহদুয়ারের ছবি তুলতে লাগল। আমরা ঐ ভাব গম্ভীর পরিবেশে অপার মুগ্ধতা নিয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। আমানুল অধৈর্য  হয়ে বলল, গাড়ির মালিক মধু বাবু এসডিও সাহেব অর্থাৎ দেবময়দাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছে, এখানে ঢুকতে গেলে অনুমতি লাগে। কারণ এটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি। দুর্ভাগ্যবশত এসডিও সাহেব ফোন তুলছেন না। আমি শৌভিককে বললাম,“ তুই একবার করবি কি? হয়তো তোর ফোন-”।  শৌভিক হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল। আসলে সে দিন সরস্বতী পুজো, একদিনের জন্য দেবময় দা বাড়ি গেছেন, ঐ দিনই বইমেলায় বৌদির বই প্রকাশিত হবে।  এমতবস্থায় লোকটিকে আর ব্যতিব্যস্ত  করার কোন মানে হয় না। কাশিপুর রাজবাড়ি না দেখা হলেই বা কি????

অনির পুরুলিয়ার ডাইরি  (পর্ব ৪) ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে আমরা দাঁড়িয়ে আছি কাশিপুর রাজবাড়ির সামনে, আমানুল তো গেট ধরেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু খুলবে কে? বিশাল লোহার গেটের ভিতর দিয়ে যতদূর  চোখ যায় ফাগুন মাসের সোনা রোদে মুখভার করে দাঁড়িয়ে থাকা অতিকায় সম্ভ্রম জাগানো রাজপ্রাসাদ ছাড়া জনপ্রাণীর দেখা নেই। শৌভিক একবার সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে দেবময় দাকে ফোন করেই বসল। কিন্তু বার চারেক রিঙ হতেই কেটে দিল। “নাঃ। এইভাবে ছুটির দিনে লোকটাকে জ্বালাতে পারব না। ” আমারও তাই মত। রাজবাড়ি না দেখা হলেই বা ক্ষতি কি? আর দেবময় দা তো কালই অর্থাৎ  ২রা ফেব্রুয়ারি ফিরেই আসছে, সেরকম হলে আমরা ৩ বা ৪ তারিখে ঘুরে নেব।   কিন্তু আমানুল কিছুতেই নড়বে না। “ না স্যার। আরটু দাঁড়ান। মধু বাবু ফোন করেছেন, বিডিও অফিস থিনি লোক আসছে। ” শৌভিক ক্ষেপে বলল, “ আমরা রাজবাড়ি দেখব বলে ছুটির দিনে বিডিও অফিসের লোকজনকে বিব্রত  করার কোন মানে হয়? চল। ” অগত্যা গাড়ি স্টার্ট দিতে বাধ্য হল আমানুল। এমনিতেও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। গেটের লাগোয়া দারোয়ান দে  থাকার ঘর থেকে একটা বিটকেল গন্ধে বমি আসছিল। যা শৌভিকের দাবি মত সুঁটকি মাছের গন্ধ। কিন্তু আমি জানি ঐটা পায়রা/ ঘুঘু এবং পায়রার বিষ্ঠার গন্ধ। আমাদের হাওড়ার বাড়িতে ঐ গন্ধ প্রায় পাওয়া যেত এককালে। এই নিয়ে তর্ক করছিলাম আমরা। আমানুল গাড়ি চালাতে চালাতে হেসে বলল,“ না স্যার। ঐ গুলান হল চামচিকা। নীচের ঘর ভরতি আছে। চিক্ চিক্ আওয়াজ শুনলেননি?”
একটু পরেই দেবময় দার ফোন, “ আরেঃ আমার একদম খেয়াল ছিল না, তোমরা আজই ওখানে যাবে। সকালে ওঁরা আমায় ফোনও করেছিলেন আমার কোন গেস্ট আছে কিনা জানতে। আমি ভুলে বলেছি না।” শৌভিক আশ্বস্ত করল, আমরা পরে যাব খন। শেষ পর্যন্ত তাই ঠিক হল ৩ তারিখ  সকাল১১ টায় যাব রাজবাড়ি দেখতে।
পরের গন্তব্য হল জয়চণ্ডী পাহাড়। রঘুনাথপুর লাগোয়া তিনটি ছোট ছোট পাহাড়। যার একটির মাথায় মা চণ্ডীর মন্দির আছে। কিন্তু মন্দিরে উঠতে হলে প্রায় ৫০০ সিঁড়ি ভাঙতে হয়। সিঁড়ি মানে সুন্দর বাঁধানো গোলাপী সবুজ সিঁড়ি। শৌভিক টরটরিয়ে উঠে গেল।  আমি আর তুত্তুরী টুকটুক করে। মাঝে মাঝেই বিশ্রাম নেবার জন্য সুন্দর বাঁধানো বেঞ্চ রয়েছে। আর সব জায়গায় লেখা আছে,“ বেঞ্চে বসে আড্ডা মারিবেন না। ” এবং সবথেকে ভয়াবহ হল,“জঙ্গলে আগুন লাগাবেন না। ” বাপরে। উঠতে উঠতে দেখলাম বেশ কয়েকটি বেঞ্চে দেবদাস এবং পারোর দল ঘনিষ্ঠ ভাবে প্রেমালাপে মত্ত। আহা দিনটি কি ভাবুন। সরস্বতী পুজো বলে কথা। আতঙ্কিত হলাম দ্বিতীয় সাবধান বাণীটিও না প্রত্যক্ষ করতে হয়। একটু উঠতেই দেখি কয়েকটি জায়গা পুড়ে কালো হয়ে আছে। হরি হরি।

কষ্ট করে উঠলাম যেমন, জয়চণ্ডী পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে তাকিয়ে মন ভরে গেল। দূর দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সে দৃশ্য বড়ই মনোরম।

নীচে নামার পর আমানুল আমাদের জয়চণ্ডী পাহাড়ের পিছন দিকে নিয়ে গেল। বিশাল ফাঁকা প্রান্তর। পিকনিক স্পট বোঝাই যায়। প্রচুর শোলার থালা এবং আনুষঙ্গিক আবর্জনা যত্রতত্র  পড়ে আছে। ঐ টুকু দৃশ্য দুষণ বাদ দিলে এক কথায় অপূর্ব। মাটি থেকেই পরপর তিনখানি খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। কখনও হয়তো ধস নেমেছিল গোটা কয়েক বিশাল শিলা খণ্ড পড়ে আছে। মনোরম জনমানবশূন্য প্রকৃতি।
দিনের আলো থাকতে থাকতেই ফিরে এলাম আমাদের রিসর্টে। কফি আর কড়কড়ে গ্রিল্ড বাটার টোস্ট খেয়ে নিছক অবকাশ যাপন। তুত্তুরী ছোটা ভিম দেখতে লাগল। আমি অনির ডাইরি লিখছিলাম , শৌভিক বের হল হাঁটতে।  একটু পরে আমিও বেরিয়ে এলাম কটেজ ছেড়ে। আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন আবাসিক নেই। রিসর্টের মুখ্য দুয়ারে তালা দিয়ে বৃদ্ধ দারোয়ান নিদ্রা যাচ্ছে। বিশাল কম্পাউন্ড জুড়ে গুটি কয়েক টিউব লাইট জ্বলছে। যা আঁধার কাটাতে ব্যর্থ হলেও সমগ্র পরিস্থিতিকে আরো রহস্যময় করে তুলছে। পিছনেই পঞ্চকোট পাহাড়, প্রগাঢ় অন্ধকারে নিদ্রিত সরীসৃপের মত ঝিম মেরে পড়ে আছে। নিস্তব্ধ চরাচর।  ঝিঁঝিঁর ডাকের সাথে তাল মেলাচ্ছে দূর থেকে ভেসে আসা ধামসার সুর। মাঝে মাঝে কি  একটা পাখি যেন ট্টিহিট্টিহু করে ডেকে উঠছে। শীতল বাতাস ছুটে এসে আলিঙ্গন করে গেল। সে আলিঙ্গন বড় আরামের, আবেশে চোখ বুজে আসে। শিউরে উঠে আকাশের দিকে তাকালাম ঠিক মাথার ওপরেই সপ্তর্ষিমণ্ডল জ্বলজ্বল করছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং কালপুরুষ ।  শৌভিক এসে হাতটা ধরল- তৃপ্তির কলস যেন উছলে পড়ল।

অনির পুরুলিয়ার ডাইরি (পর্ব ৫) ২রা ফেব্রুয়ারি
আজ আমরা অযোধ্যা পাহাড় যাব। ৩১শে জানুয়ারি রাতে আমাদের গড় পঞ্চকোট পৌছবার সময়ই মধু বাবু বলছিলেন,“স্যার আজ এতদূর থেকে এলেন, কাল কাছাকাছি ঘুরে নিন। পরশু না হয় অযোধ্যা যাবেন। অযোধ্যা ঘুরতে সারাদিন লাগবে। যেতেই দুই আড়াই ঘন্টা তো লাগবে। সকাল সাতটা নাগাদ বেরোতে পারলে খুব ভালো হয়। ” সকাল সাতটায় বেরোনো মানে অন্তত ছটায় ঘুম থেকে ওঠা। আর অত সকালে তুত্তুরীকে তুলে স্নান করিয়ে রেডি করা বিশাল চাপের ব্যাপার। জয়চণ্ডী পাহাড় থেকে ফেরার পথে আমানুল অবশ্য আশ্বস্ত করল যে সাড়ে আটটায় বের হলেই চলবে। রাস্তা ভীষণ ভালো। হু হু করে গাড়ি দৌড়য়। ক্ল্যাচ নাকি ধরতেই হয় না।

সাড়ে সাতটায় সপরিবারে রেডি হয়ে প্রাতঃরাশ সেরে কটেজ দেখে বের হয়ে দেখি পুরু কুয়াশার চাদরে আচ্ছন্ন চরাচর। অদূরে ওয়াচ টাওয়ারটিকে ও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ঘড়ির কাঁটা নিজ স্বভাবে এগিয়ে চলেছে। নটা নাগাদ মধু বাবু ফোন করে জানালেন যে এত কুয়াশা যে গাড়ি ছাড়তেই পারেনি। একটু কুয়াশা কাটলেই আমানুল আসছে। আমাদের তাতে কোন হেলদোল ছিল না অবশ্য। কুয়াশাচ্ছন্ন ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে আবছা পাঞ্চেত পাহাড় আর ঘষা কাঁচের মত ধোঁয়াটে প্রকৃতি দারুণ উপভোগ্য । অযোধ্যা পাহাড় না দেখলেই বা কি?
গাড়ি ছাড়ল সাড়ে নটায়। তখনও কুয়াশা ভালো কাটেনি। আমানুল ইশ্ ইশ্ করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছিল। কারণ হল এত কুয়াশা থাকলে পাহাড়ের উপর থেকে নীচের কোন ভিউই পাওয়া যাবে না। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই রোদ উঠছিল। কেটে যাচ্ছিল কুয়াশা। মাঠার ঘণ শালের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দূরে দেখা গেল বিশাল ঘুমন্ত পাহাড়। আমার ধারণা ছিল অযোধ্যা পাহাড় হয়তো পাঞ্চেত হিলস্ এর সাইজের হবে। শুনলাম এবং প্রত্যক্ষ করলাম যে অযোধ্যা পাহাড় বিশাল। ঐদিকে নাকি রাঁচি অবধি চলে গেছে।
প্রথমেই পড়ে পাখি পাহাড়। ছোট, গাছপালা বিবর্জিত পাথুরে টিলা। ঠিক উল্টানো বাটির মত। তবে শিখরটা বেশ খাড়াই। গায়ে অনেক গুলি মইয়ের মত বস্তু আটকানো। শুনলাম ওখানে রক ক্লাইম্বিং কোর্স হয়। আসে পাশে প্রচুর রঙ বেরঙের বুনো ফুল সোচ্চারে ঘোষণা করছে ঋতুরাজের আগমনের বারতা। সোনা রোদে নিখাদ অলসতায় বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম পাখি পাহাড়ের আসে পাশে। তুত্তুরী প্রচন্ড খুশি হল এক পাল ছাগল দেখে। জনৈক আদিবাসী বৃদ্ধ নিতান্ত অলস ভঙ্গীতে একপাল ছাগল নিয়ে যাচ্ছিলেন।  অলসতার ছোঁয়াচ বুঝি ছাগল গুলিকেও ছাড়েনি, কি রাজকীয় ভঙ্গীতে মাথা নাড়াতে নাড়াতে গদাই লস্করী চালে চলে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। একটির গলায় আবার বড় স্টিলের গ্লাস বাঁধা। গ্লাসের ভিতর একটি ভাঙা সাঁড়াশির ডাঁটি ঝুলছে। প্রবল ঢং ঢং শব্দ করে আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল। পিছন পিছন আমার কন্যাও দৌড়ল।
অযোধ্যা পাহাড়ের মূল আকর্ষণ হল তিনটি বাঁধ। যাদের পোশাকি নাম হল -  লোয়ার, মিডল্ এবং আপার ড্যাম। লোয়ার ড্যামটি ভাল তবে আহামরি কিছু নয়। মুগ্ধ হয়ে যেতে হ্য়, মিডল ড্যামটি দেখে। ঘন সবুজ আর লাল পাহাড়ের (যদিও আদতে হয়তো টিলা) মাঝখান দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে যাচ্ছে ঘন নীল জলের ধারা। মাঝে মাঝে ধাঁধা লাগে, হিমালয় বলে ভ্রম হ্য়।

আপার ড্যাম বলতে একটি বিশাল জলাশয়। জলের রঙ এখানেও গাড় নীল। চতুর্দিক শান বাঁধানো রাস্তা দিয়ে ঘেরা। এক প্রান্তে ন্যাড়া খাড়া পাহাড়, বাকিটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। উঁচু রেলিং দিয়ে ঘেরা জলাশয়, লেখাও আছে, জলে নামিবেন না। আমরা ছাড়া যে মুষ্টিমেয় ভ্রমণ পিপাসু সেই মুহূর্তে উপস্থিত ছিলেন, তাদের সবাই প্রায় রেলিং টপকে জলে নামছিলেন। একজন হড়কে পড়েও গেলেন। আমানুল হতাশ হয়ে বলল, “এ তো কিছুই নয় স্যার, জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে এখানে এত লোকের ভিড় হয়, এত লোক স্নান করে কি বলব—।” পরবর্তী গন্তব্য বামনী ফলস। আমানুল মাথা চুলকে বলল, “নামতে পারবেন কি? বিশাল খাড়াই, ধাপ কাটা আছে অবশ্য। পাথরে পা দিয়ে দিয়ে নামতে হয়।” কি আর এমন ব্যাপার? কাল জয়চণ্ডী পাহাড়ে উঠলাম, আর আজ পারব না?
বামনী ফলস সত্যিই বিশাল খাড়াই। নামার সিঁড়ি বলতে পাথরের ধাপ কাটা, কোথাও বা আড়াআড়ি গাছের শিকড়ই সিঁড়ির কাজ করে, জয়চন্ডী হিলের মত, পাশে কোথাও বসার জায়গা নেই। থাকবে কি করে? দুপাশে খাড়া পাহাড় আর জঙ্গল। মাঝে দু জায়গায় খাদের ধারে, গাছের সরু সরু ডাল একত্রে বেঁধে, তলায় দুটি বাঁশ আর ওপরে কাঠের তক্তা দিয়ে বেঞ্চের মত করা আছে। হাজার ক্লান্তি থাকলেও তার অপর বসতে আতঙ্ক হয়। নামা ওঠার রাস্তা এত সরু, যে এক সাথে দুই বা তার বেশি লোক নামতে বা উঠতে পারবে না। শৌভিক তুত্তুরীর হাত ধরে  নামতে লাগল, মুস্কিল হল আমার, নামতে গেলেই ভয় লাগে। কোথাও উঁচু কোথাও নিচু, কোথাও আবার নড়বড়ে পাথর। মাঝে মাঝেই শৌভিককে ডাকতে হচ্ছে, ‘এই, একটু হাত টা ধর-।” শেষে আমানুল বলল, “স্যার আমি বাচ্ছাকে নামাচ্ছি, আপনি ম্যাডামের সঙ্গে নামুন।” সঙ্গে মানে, পাশাপাশি নামা নয়। শুধু চোখের সামনে থাকা, যাতে প্রয়োজনে হাতটা বাড়িয়ে দিতে পারে।
(চলবে)