Friday 6 January 2017

শ্রমিক আমি (কলকাতা পর্ব) 1-3

শ্রমিক আমি (কলকাতা পর্ব) ৩০.১২.১৬
প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আগে, যেদিন অর্ডারটা বেড়িয়েছিল, আজো মনে আছে, পরপর দুটো এসএমএস পেয়েছিলাম। একটা পাঠিয়েছিলেন ডিএলসি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দীপক দা আর একটা আমার সদ্য প্রাক্তন ডিএলসি শৈবাল দা। বক্তব্য একই, শুধু একটা শব্দ, “কলকাতা”। সময়টা অগস্ট ২০১১, আমি তখন এএলসি খড়গপুর। চার অক্ষরের একটা শব্দ যে এত আনন্দবাহী হতে পারে আগে জানতাম না। ট্রান্সফার অর্ডার বেরনোর পর থেকে শুধু দিন গোনার পালা, কবে মুভমেন্ট অর্ডার বেরোবে, কবে যাব কলকাতায়? সাড়ে চার বছর পশ্চিম মেদিনীপুরে কাটাবার পর মহানগরে প্রবেশের অধিকার পাওয়া গেছে, তাও একা নয়, আমি এবং সুকন্যা দুজনেই কলকাতায় যাচ্ছি, এত আনন্দ রাখি কোথায়? সেই ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে দুজনের গাঁটছড়া বাঁধা।
খড়গপুর থেকে বিদায় নেবার প্রাক্কালে আমার তৎকালীন এবং প্রাক্তন ডিএলসি তীর্থ দা এবং শৈবাল দা দুজনে একই সঙ্গে সাবধান করে দিলেন, কলকাতা খুব সাংঘাতিক জায়গা। মেপে পা ফেলতে হয়, বুঝে কথা বলতে হয়। দশটা পনেরো বেজে গেলেই লাল দাগ আর তিনটে লাল দাগ পড়ে গেলেই একটা সিএল ঘ্যাঁচ। পৌনে ছটার আগে অফিস ছাড়া যাবে না। আজো মনে আছে শৈবাল দা বলেছিলেন, “দেখ বাপু তুমি একটু হাবলা আছ। বুঝে শুনে চলো।”
কলকাতায় তখন “সু” অর্থাৎ সুকন্যা এবং আমার গুরু হচ্ছেন সুমিতা দি। সু আর আমার কলকাতা পোস্টিং হওয়াতে সুমিতা দি প্রচন্ড খুশি হয়েছিলেন। সুমিতা দি ফোন করে জানালেন, “তোমরা যেন ভুলেও ট্রান্সিট লিভ নিও না। চটজলদি নিউ সেক্রেটারিয়েটে এসে আগে একটা ভাল ঘর জোগাড় কর। দেরী করলে কিন্তু সব ভাল ফাঁকা ঘর গুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে।” সুমিতাদির কথা তখন বেদবাক্য। রিলিজ নেবার পরদিনই সকাল পৌনে দশটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং। ফাঁকা লিফটে চড়ে হুশ করে উঠে গেলাম এগারো তলা। লিফট থেকে নেমে ভয় পেয়ে গেলাম, ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। অধিকাংশ ঘর এবং হলঘরের দরজাই খোলেনিলেবার কমিশনারের ঘরের দরজা অবশ্য খোলা এবং আলো ও জ্বলছে। তখন লেবার কমিশনার ছিলেন শ্রী অমল রায়চৌধুরী। উনি দশটার মধ্যেই এসে যেতেন। কি করি? সেকশনে ঢুঁ মারলাম। মাত্র দুজন সবে এসে ব্যাগ রেখে চা খেতে যাচ্ছেন। ওনাদের থেকে জানতে পারলাম, দশটা পনেরো নয়, সাড়ে দশটার পর খাতা লেবার কমিশনারের ঘরে ঢোকে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম, যাক কাল থেকে একটু বেশীক্ষণ ঘুমানো যাবে।
দশটা পনেরোর পর আসতে আসতে সবাই আসতে লাগলেন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম সুকন্যার জন্য। সুদীর্ঘকাল মেদিনীপুরবাসের পর, নিউ সেক্রেটারিয়েটের সুসজ্জিতা সুন্দরীদের পাশে নিজেকে কি হতকুচ্ছিতই যে লাগছিল তা বলার নয়। গতকাল রাত্রেই এই নিয়ে সুকন্যাতে আর আমাতে একপ্রস্ত বিলাপ করেছি। মেদিনীপুরে আমাদের সাজগোজের কোন বালাই ছিল না, রঙ জ্বলা জামা পরে দিনের পর দিন অফিস করে গেলেও কিছু বলার ছিল না। মূলত অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে কাজ, তাদের সামনে সেজে গুজে পটের বিবি সেজে বসলে না তারা স্বচ্ছন্দ্য বোধ করত, না আমরা। আর সবার ওপর আমরা ছিলাম হদ্দ কুঁড়ে। আবার সাজতে হবে? ভাল জামা কাপড় কিনতে হবে? কেন? বিয়েতে যা পেয়েছি আর পুজো – ভাইফোঁটায় যা আমদানি হয় তাতে তো দিব্যি চলে যায়, এই ছিল আমাদের মানসিকতা। কিন্তু কলকাতায় রঙ জ্বলা জামা? কলকাতায় কারা আছে? প্রথমতঃ সুমিতা দি, যাকে সচেতন ভাবেই আমরা আইডলাইজ করতাম। তার ওপর মনীষা দি, শর্মিলা দি, রুমা দি, যার শাড়ির সম্ভার রীতিমত ঈর্ষণীয়। আর সেকশনে যে অগুন্তি সুন্দর সুন্দর মহিলা আছেন তাদের কথা তো বলেই কাজ নেই। সুদূর পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে যখন আসতাম কোন কাজ নিয়ে, রীতিমত হাঁ করে দেখতাম তাঁদের রূপ এবং বেশভূষা। এত সুবেশা সুন্দরীদের মাঝে রীতিমত অসহায় বোধ করছিলাম সুকন্যাকে ছাড়া। সুকন্যাকে তখন ডাক্তার বাসে চড়তে নিষেধ করেছিলেন, বেচারা সোয়া দশটার মধ্যেই অতি কষ্টে ট্যাক্সি জোগাড় করে ছুটতে ছুটতে এল। একটু পরেই এসে হাজির হল শর্মিষ্ঠা, একই অর্ডারে ও এসেছে শ্রীরামপুর থেকে কলকাতা। ভালোই হল, দল ভারি হল।
অতঃপর? খাতায় নাম তোলা। আর সকলের ঘরে ঘরে গিয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ।তখন শ্রী সুবল বিশ্বাস সাহেব অ্যাডিশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ওনার সাথে দেখা করে একে একে রসুল সাহেব, দীপক দা, মনীষা দি, শর্মিলা ম্যাডাম, সুমিতা দির সাথে দেখা করলাম আমরা। সুমিতা দি সটান চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। অনেক প্ল্যান পরিকল্পনা হল একসাথে খেতে যাওয়া, শপিং এর। আমাদের অবশ্য শপিং এই উৎসাহ বেশী ছিল, কারণ দুজনেই যে যার মায়ের শাড়ি ধার করে পড়েছিলাম। পরবর্তী পদক্ষেপ ঘর দখল করা। কোন ঘর দখল করি? সব ঘরেই তো অফিসার রয়েছে, এবং তাঁরা রীতিমত কাজ করছেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই এগারো তলা গমগম করছে নানা ট্রেড ইউনিয়ন, ম্যানেজমেন্ট এবং ওয়ার্কারদের তর্কবিতর্কে। অবশেষে, কোনের একটা সরু ঘর ফাঁকা পেলাম, সেখানেই গিয়ে বসলাম তিনজনে। একটা ঘরে তিনজন অফিসার!! কে নেবে ঘরটা? এ যেন কালনেমির লঙ্কাভাগ।
একফাকে নীচে নেমে মুগল গার্ডেনের এগ রোল খেয়েএলাম তিনজনে।  মুগল গার্ডেনের এগ রোল ছিল তখন আমাদের কাছে এক দেবভোগ্য বস্তু। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখলাম, এত বড় রোল গলদ্ধকরণ মোটেই সহজ কার্য না। টিফিন করে ওপরে এসে তিনজনে গল্প করছি, এমন সময় লেবার কমিশনার সাহেবের জরুরী তলব। তিনজনে একসাথে ওনার ঘরে ঢুকে দেখি, বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে গম্ভীর মুখে বসে আছেন, লেবার কমিশনার, আর তাঁকে ঘিরে ততোধিক গম্ভীর মুখে বসে আছেন আমাদের বড় সাহেবেরা, বিশ্বাস সাহেব, রসুল সাহেব, নাসিম সাহেব এবং আমানুল হক সাহেব। বুঝলাম পরীক্ষা সমাসন্ন।
শ্রমিক আমি (কলকাতা পর্ব-২) ০১.০১.১৭
বর্তমান লেবার কমিশনার জাভেদ আখতার সাহেব বসেন, ওনার চেম্বারে ঢোকার দরজার ঠিক উল্টো দিকে। যে কেউ দরজা ফাঁক করে উঁকি মারলেই ওনার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতে বাধ্য। কিন্তু ওনার পূর্বসূরি রায়চৌধুরী সাহবে বসতেন দরজার বাঁ দিকে দরজার দিকে পিছন করে, ফলে আমরা যখন ওনার চেম্বারে ঢুকলাম, উনি রীতিমত ৯০ ডিগ্রি ঘাড় ঘুড়িয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। ইশারায় বসতে বললেন, আমরা ভয়ে ভয়ে যে যার স্থান দখল করলাম। বসা মাত্রই বিশ্বাস সাহেব অর্থাৎ শ্রী সুবল বিশ্বাস আমাদের পুনঃ পরিচয় করিয়ে দিলেন। সুকন্যার ভূয়সী প্রশংসা করলেন সকলে এমনকি খোদ লেবার কমিশনার পর্যন্ত (অন্তত ওনার মাথা নাড়ানো এবং অন্যান্য শারীরিক বিভঙ্গে তাই বোধ হয়েছিল)। এবং এই প্রতিটি তারিফের যোগ্য হকদার ছিল সুকন্যা ভট্টাচার্য২০০৮ থেকে ২০১১ অবধি একা ঝাড়গ্রাম আরএলও (Regional Labour Office) চালিয়েছে, যখন ঝাড়গ্রাম শব্দটা শুনলেই অনেকের শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে যেত। ঝাড়গ্রাম তখনও প্রায় মুক্তাঞ্চল। আর শর্মিষ্ঠা ঘোষের পরিচয় দেওয়া হল গ্রাচুইটি স্পেশালিষ্ট হিসেবে। একা হাতে শ্রীরামপুরের বহু বন্ধ জুটমিল ওয়ার্কারদের ন্যায্য প্রাপ্য গ্রাচুইটির অর্ডার বেরিয়েছে শর্মিষ্ঠার হাত দিয়ে। লেবার কমিশনার শ্রী অমল রায়চৌধুরী (যিনি বর্তমানে পে-কমিশনের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য) প্রীত স্বরে জানতে চাইলেন, “তোমাদের কার কি ভালো লাগে, স্কীম? না কনসিলিয়েশন?” আমার আর সুকন্যার জবাব ছিল “স্কীম” অর্থাৎ অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য যে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্কীম গুলি শ্রম কমিশনারেট চালায়, যথা- ভবিষ্যনিধি প্রকল্প (সাসফাউ), নির্মাণকর্মী দের জন্য প্রকল্প (বোকয়া) এবং পরিবহন শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। স্কীমের কাজ করতে সত্যি ভাল লাগে, কেন জানি না মনে হয়, প্রত্যক্ষ ভাবে কারো উপকারে আসলাম। অন্যদিকে কনসিলিয়েশন আমার কোনদিন ও ভাল লাগে না। এ যেন বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসির ভূমিকা পালন। সত্যি কথা বলতে কি, কনসিলিয়েশন বস্তুটা আমার দ্বারা হয়ও না। মালিক-শ্রমিক বিবাদে আমি বরাবরই শ্রমিকের পক্ষে,তাদের দুঃখে বিগলিত হয়ে যাই। কনসিলিয়েশন অফিসার খোদ যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে সেই বিবাদের মীমাংসা কি আদৌ হতে পারে? যাইহোক রায়চৌধুরী সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, “তা বললে তো হবে না, কনসিলিয়েশন ও করতে হবে।”
লেবার কমিশনারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের ছোট্ট ঘরটায় ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। শর্মিষ্ঠাকে অবশ্য কি কারণে যেন আবার ডেকে পাঠানো হয়েছিল, কিয়ৎক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, “বাপরে, তোমরা চলে আসার পরও সবাই তোমাদেরই প্রশংসা করছিল” আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার প্রশংসা করছিলেন খোদ রসুল সাহেব, ডিজিটাইজেশন নিয়ে খুব প্রশংসা করছিলেন।” তখন সদ্য সাসফাউ প্রকল্পটির অনলাইন রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়েছিল, এবং খড়গপুরে কাজটা বেশ ভালই দ্রুততার সাথে চলছিল।
যাইহোক লেবার কমিশনার যে কেন, ঐ প্রশ্নটি করেছিলেন, তা বুঝলাম দিন কয়েক পর, যখন আমাদের জব অ্যাসাইনমেন্টের অর্ডার ধরানো হল। সুকন্যাকে বোকয়া এবং আমাকে ট্রান্সপোর্ট বোর্ডে দেওয়া হল। শর্মিষ্ঠার পোস্টিং হল কলকাতা সেন্ট্রালে কনসিলিয়েশন অফিসার হিসাবে। মাঝের কটা দিন যে কি আনন্দে কেটেছে তা বলার নয়, আমাদের ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছিল যে কলকাতায় কোন কাজ নেই। শুধু প্রজাপতির মত ভেসে বেড়ানো। সুমিতা দি ফ্রি থাকলেই ডেকে নিতেন, আড্ডা গল্প মজা আর কেনাকাটার গল্প করে ফিরে আসতাম নিজেদের ঘরে। মাঝে হঠাৎ একদিন সুমিতা দি বললেন, “আমি কটা দিনের জন্য ছুটি নেব, আমার একটা অপারেশন আছে। ফিরে এসে দেখা হবে।” সুমিতা দি ফিরে আসার আগেই অর্ডার বেরিয়ে আমাকে ঐ বাড়ি পাঠানো হল। ঐ বাড়ি অর্থাৎ ৬ নং চার্চ লেন। নিউ সেক্রেটেরিয়েট ছেড়ে যাকেই চার্চ লেন পাঠানো হয়, তারই বোধহয় প্রথম চোটে কান্না পায়। আমারও পেল, চার্চ লেন? ইশ, কি জঘন্য বাড়িটা। যদিও ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়ি, কিন্তু আদৌ কোন সারাইসুরাই হয় না। মালিকদের কি সব কোর্ট কেস চলছে তার জন্য। সামান্য বৃষ্টিতেই ছাদ দিয়ে জল পড়ে, সবথেকে বড় কথা আমার পরবর্তী গন্তব্য হল ঐ বাড়ির পাঁচ তলা, প্রতিটি তলা উঠতে ২৮টি সিঁড়ি ভাঙতে হয়। দুটি লিফটের একটি এখনও জীবিত, তবে তা মাসের মধ্যে ১৫টি কর্ম দিবসেই মৃতপ্রায় হয়ে থাকেন।লিফট চলে সকাল ১০টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত (যেন সবাই পৌনে পাঁচটার মধ্যেই কেটে পড়ে), মাঝে ১-২ টো বন্ধ থাকে। চার্চ লেনের ভাম আর ইঁদুরের উৎপাত তো প্রসিদ্ধ। আর সবথেকে বড় ভয়ের কারণ হলেন আমার হবু বস, ট্রান্সপোর্ট বোর্ডের সিইও মহম্মদ আমানুল হক সাহেব। প্রথমেই আমাকে সবাই সাবধান করে দিল, হক সাহেব কিন্তু ভীষণ স্ট্রিক্ট। ওখানে সত্যি দশটা কুড়িতে লাল দাগ দেবার রেওয়াজ আছে, এবং হক সাহেবের অফিসাররা কেউ ছটার আগে ছাড়া পায় না। উনি নিজেও সন্ধ্যা সাতটা অবধি অফিস করেন। আরো সাংঘাতিক কথা শুনলাম, ও বাড়িতে নাকি ডিসেম্বর মাসে কোন সিএল নেওয়া যায় না, কারণ জানুয়ারি মাসটা আমরা পালন করি সামাজিক সুরক্ষা মাস (Social Security Month) হিসাবে। আরো যে কত কি শুনলাম, আজ আর মনে নেই, তবে মোদ্দা কথায় স্বয়ং হিটলারের অধীনে কাজ করতে যাচ্ছি সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। প্রচন্ড দুঃখ হচ্ছিল সুকন্যাকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু কি করতে পারি? মনখারাপ করে সকলের থেকে বিদায় নিলাম, বিশ্বাস সাহেবের ঘরে বিদায় নিতে গেছি, উনি একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, “কে বলেছিল তোমাকে বলতে যে স্কীম ভালো লাগে?” বুঝলাম স্বখাত সলিলে ডুবেছি। না বলতাম স্কীম ভালো লাগে, না আমাকে পাঠানো হত --- কিন্তু কি আর করা যাবে, তীর ধনুক ছেড়ে বেড়িয়ে গেছে। কাল দশটায় চার্চ লেন।
শ্রমিক আমি (কলকাতা পর্ব- ৩) ০৪/০১/১৭
মহম্মদ আমানুল হক, বিগত পাঁচ বছর চার মাস যাবত আমার বস ছিলেন, এবং একথা আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে পারি, আমার বিগত দশ বছরের এএলসি গিরিতে আমি এত ভালো বস কখনও পাইনি। আজো মনে আছে, প্রথম যেদিন চার্চ লেনে গিয়ে জয়েন করলাম, তার কিছুদিন আগেই ওনার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। স্যারের ঘরে ঢুকে দেখি উনি উদাস স্বরে দুজন বয়স্ক ব্যক্তির সাথে এই নিয়েই কথা বলছেন। আমাকে দেখে, সানন্দে পরিচয় করিয়ে দিলেন বাকি দুজনের সাথে-দুজনেই অত্যন্ত বর্ণময় ব্যক্তিত্ব, প্রথমজন শ্রী সত্য ঘোষ আর দ্বিতীয়জন হলেন শ্রী নজরুল ইসলাম। সত্য বাবু ছিলেন বিশাল বপু( আড়ে এবং বহরে প্রায় সমান), বাজখাই গলা এবং চোখে কালো চশমা। প্রমোটি এএলসি তথা এগ্রি-মিনি অ্যাসোসিয়েশনের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা।সত্য বাবুর সাথে আমার মাঝে মাঝেই ঝামেলা লেগে যেত। কেন যাবে না মশাই? আমাকে এবং সঙ্গীতা মুখার্জ্জীকে (চার্চ লেনের সুন্দরীতম এএলসি) দেখলেই ওনার মনে পড়ে যেত, ডাইরেক্ট অফিসার মাত্রই হোঁৎকা, আইনকানুন জানেও না আর তার ধার ও ধারে না। কোন ডাইরেক্ট এএলসি কে ওনার সংগঠন কোথায় কি ভাবে বংশদণ্ড প্রদান করেছে বা করতে চলেছে একথা আমাদের শোনাতে এলে আমরাই বা কেন ছেড়ে কথা বলব? ফলে লেগে যেত তুলকালাম। আমি আর সঙ্গীতা চিল চিৎকার জুড়তাম, আর সত্য বাবু ফ্লোর কাঁপিয়ে হাসতেন। কিছুদিনের মধ্যেই খেয়াল করলাম, যে উনি আমাদের রাগিয়ে নেহাত মজা পান।

ট্রান্সপোর্ট বোর্ডে যখন জয়েন করলাম, হক সাহেব, আমি, সত্য বাবু আর নজরুল ইসলাম ছাড়া বোর্ডে আর কেউ ছিল না। কেউ না। না কোন ইনস্পেক্টর, না ক্লার্ক না গ্রুপ ডি। না ছিল কোন কম্পুটর, ফ্যাক্স, ফোন, ব্রডব্যান্ড বা ফটোকপিয়ার মেশিন। হক সাহেব তখন জয়েন্ট কমিশনার, ওনার চেম্বারের বাইরে দুটো ছোট চেম্বার ছিল, যার একটাতে বসত সঙ্গীতা, আর একটিতে বসতেন নজরুল ইসলাম। স্যার নজরুল সাহেবকে বললেন, “আপনার চেম্বারটা আপনি অনিন্দিতাকে ছেড়ে দিন। ওকে অনেক কাজ করতে হবে।” সদ্য আলাপিত হবার পরই ওনাকে আমার জন্য চেম্বার চ্যুত হতে হল, আমি অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে বললাম, “না। না। ছি ছি। উনি আমার সিনিয়র। আমি ওনার চেম্বার কি করে দখল করতে পারি?” কিন্তু তাতে না স্যার পাত্তা দিলেন না নজরুল সাহেব। নজরুল ইসলাম অত্যন্ত খুশি খুশি ওনার চেম্বারটা আমাকে ছেড়ে দিলেন। ছেড়ে তো দিলেন, কিন্তু সে কি চেম্বার? একখানা ঘুণ ধরা সেমি সেক্রেটারিইয়েট টেবিল, যার ওপরে একটা পুঁচকে কাঁচ পাতা আছে। টেবিলের এক দিকের ভেলভেট ছিঁড়ে খানিকটা উঠে এসেছে। ড্রয়ার খুলতেই এক গাদা আরশোলার ডিম আর নোংরা কাগজ। ভয়ে ড্রয়ারটাই বন্ধ করে দিলাম। এতো গেল টেবিল, আর চেয়ার বলতে বিবর্ণ একখানা রাজকীয় কেদারা। যাতে আমার মত ছোট্ট খাট্টো লোক বসলে মাটিতে পা ঠেকে না। ঘরে আর কিছু নেই। না আলমারি, না পেন স্ট্যান্ড, না পেন বা কাগজ। বেল পর্যন্ত নেই। মন খারাপ করে বসে রইলাম, কিছুক্ষণ, টিফিনের সময় হল, গুটগুট করে রওনা দিলাম নিউ সেক্রেটারিয়েটের দিকে। সুকন্যার সাথে এক সাথে টিফিন করে বেশ খানিক ঘ্যানঘ্যান করে ফিরে এলাম। স্যারকে দেখাও দিয়ে এলাম, টেবিলে এক বোতল জল ও দেয়নি কেউ। সদ্য জেলা থেকে এসেছি, সেখানে আর যাই হোক এসব নিয়ে ভাবতে হয় না। স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমায় কে জল দেবে? স্যার ব্যস্ততার মধ্যে একজনকে পাঠিয়ে দিলেন। একে নিউ সেক্রেটারিয়েটে আগে দেখেছি, আমার বরাবর ধারণা ছিল এ মহিলা, আজ দেখলাম না পুরুষ না হলেও ছেলে তো বটেই। এসেই তার বক্তব্য ছিল সে স্ট্যাটের পিওন, ট্রান্সপোর্টের এএলসিকে কেন জল দেবে? বাবা বাছা করে বললাম, জল দে বাপ। কাল তোতে আমাতে গিয়ে লেবার কমিশনারকে এই প্রশ্নটাই করব আপাতত জল দিয়ে প্রাণ বাঁচা। জল দিল। সেপ্টেম্বর মাসের প্রচন্ড গরম, এক লিটার জল কোথা দিয়ে নেমে গেল বুঝলাম না, আর একবার দিতে বললাম, “বলল, ম্যাডাম, কাল থেকে একটা বড় বোতল আনবেন। তাহলে আর বারবার জল দিতে হবে না।” বুঝলাম সত্যি আমার মহানগরে প্রবেশ হয়েছে। জল দেওয়া নিয়ে নিত্য খিচিরমিচির চলতেই লাগল, ও দেবে না, আর আমিও ছাড়ব না। সেকশনে দাঁড় করিয়ে ঝাড়তাম, তখন জল দিয়ে যেত। যেদিন কিছু বলতাম না, সেদিন নির্জলা। এভাবে অন্যদের দমানো গেলেও অনিন্দিতা চ্যাটার্জীকে (এখন ভট্টাচার্য) দমানো যায় না। তারপর থেকে ঠিক করলাম অফিসে এসে আমার প্রথম কাজই হবে ওকে ডেকে আগাপাস্তলা ঝাড়া। কিছুটা সাইজ হল, একদিন এসে বলে, “ম্যাডাম ১০০টা টাকা দিন তো।খুব দরকার।” বেশ দিলাম। নিয়ে সেই যে বেরিয়ে গেল আর তার পাত্তা নেই দিন দুয়েক। দুদিনের পর অঞ্জন দা (শ্রীমান অঞ্জন মুখোপাধ্যায়, তৎকালীন এএলসি স্ট্যাটিস্টিক্স) দৌড়ে দৌড়ে এসে হাজির হলেন, আমার ঘরে, “তুমি অমুক চন্দ্রকে টাকা দিয়েছ?” ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়লাম। কি করলাম রে বাবা? ১০০টাকা দিয়ে কি আরডিএক্স কিনল নাকি? অঞ্জন দা রাগত স্বরে বলল, “আরে কেন দিয়েছ? ঐ টাকা নিয়ে ও ইয়ে তে যায়।” “কি’য়ে তে?” “ইয়ে মানে খারাপ পাড়ায় যায়।” অঞ্জন দা মুখ লাল করে বললেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না হাসব না কাঁদব। ভগবান! কোথায় এলাম? লোকে আমার টাকায় ইয়েতে যায় আর আমি বসে বসে আরশোলার ডিম গুনি? এঃ 

Sunday 1 January 2017

বীরভূম ডাইরি

বীরভূম ডাইরি ১০/১২/১৬
বীরভূমের সাথে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক বেশ গভীর। না আমরা কেউই বীরভূমের বাসিন্দা নই, তবে আমার বড় জেঠু শ্বশুর এককালে সিউড়িতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, আমার শ্বশুরমশাই এরও প্রবেশন এবং  ব্লক বীরভূমেই। বাবা মহম্মদবাজারের বিডিও ছিলেন, তারপর সিউড়িতেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বীরভূমে ওনারা প্রায় এগারো বছর ছিলেন, বীরভূম জেলা স্কুল থেকেই শৌভিকের ছাত্রজীবন শুরু। আমার দেওরের জন্মও বীরভূমেই। আবার শৌভিক যখন এই চাকরিতে যোগ দিল, ওরও প্রথম পোস্টিং হল সিউড়িসবথেকে মজার কথা হল, আমার দেওর যখন জানালো যে সে বিবাহ করতে ইচ্ছুক, তখন জানা গেল যে তার হবু স্ত্রী বীরভূমেরই ভুমিকন্যা।
যাইহোক টুকলু অর্থাৎ আমার পুঁচকে দেওরের বিবাহের পর ঊমা মানে আমার দেবরানীদের গ্রামে নববিবাহিত দম্পতির জন্য এক বিশাল ভোজের (কলকাতার ভাষায় রিশেপশন) আয়োজন করা হয়, তাতে নিমন্ত্রিত হিসাবেই আমাদের বীরভূম যাওয়া। সেই সময়ে প্রস্তাবটা দেন আমার শ্বশুরমশাই, “তোরা যখন বীরভূম যাচ্ছিসই তখন ছুটি নিয়ে ভালো করে ঘুরে আয়।” কথায় বলে না, ‘একে মা মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ’, শুনেই আমরা নাচতে লাগলাম। সিউড়িতে শৌভিকের ব্যাচমেট আছেন, শ্রী বিল্বদল রায়, ডিএনও এনরেগা (১০০ দিনের কাজ)। উনি প্রায়ই বলেন, “শুধু দিনক্ষণটা ঠিক করে আমায় পাঁচ দিন আগে জানাস, বাকি কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।” আমরাও ভাবলাম, এই সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয়। ইতিপূর্বে বহু বন্ধু বান্ধব আমাদের এভাবে ডাকাডাকি করেছে বা বলা ভালো আজো করেই চলেছে যেমন- মেদিনীপুর থেকে সুকন্যা, মালদা থেকে দেবু, বনগাঁ থেকে অঞ্জন দা, পুরুলিয়া থেকে দেবময়দা তথা অতীতে বাঁকুড়া এবং বর্তমানে এগরা থেকে চিত্রদীপদা। কিন্তু আমরা এতটাই অপদার্থ যে কোন সুযোগেরই আমরা সদ্ব্যবহার করে উঠতে পারিনি। কিন্তু এবারে আমরা কোমর বেঁধে নামলাম, নাঃ এবার আর এ সুযোগ হারাচ্ছি না।
যাব, মনস্থির করে দুরুদুরু বুকে ছুটির অ্যাপ্লিকেশন করেই, প্রথম ফোনটা করলাম, শ্রী শান্তনু সেনকে। শান্তনুদা বর্তমানে বর্ধমান সাউথের এএলসি। আমরা যুগলে শান্তনুদার বিশেষ স্নেহধন্য। শান্তনুদা বহুবার বলেছেন, “যদি কখনও বীরভূমে যাও, ট্যুর প্ল্যানিংটা আমাকে দিয়ে করিও।” প্রায় একসপ্তাহের জন্য যাব, যথাযথ প্ল্যানিং ছাড়া করবটা কি? শান্তনুদা অত্যন্ত খুশি হয়ে প্রায় একুশ মিনিট ধরে প্ল্যান বাতলে দিলেন। সেই প্ল্যান প্লাস গুগলের ভরসায় সোমবার ৫.১২.১৬ ভোর বেলা আমরা বেড়িয়ে পড়লাম।
প্রথম গন্তব্য ঊমাদের গ্রাম একূট। লাভপুরের কাছে এক প্রত্যন্ত গ্রাম। আমরা এবং নবদম্পতি ছাড়াও, ননদ, পিসি-পিসেমশাই, খুড়শ্বশুর, খুড়শাশুড়িরা ছিলেন। মণি কাকা অর্থাৎ শ্রীঅরুণকান্তি ভট্টাচার্য ছিলেন বরকর্তা তথা আমাদের অভিভাবক। গোটা রাস্তা যে কি আনন্দ এবং হইহই করে কাটল তা ভাষায় অবর্ণনীয়। মাঝপথে শক্তিগড়ের কচুরি আর গুড়ের রসগোল্লা, আহা! ভাবলেই জিভে জল আসে। একূটে পৌছতে লাগল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। বহু বছর বাদে এরকম নিখাদ গ্রামে গেলাম গ্রামবাংলার রূপে মন ভরে গেল। মানুষজন এতো সাদাসিধা, শহুরে পালিশবিহীন, যে দুটি কথায় মন জয় করে নেয়। বিশেষত তুত্তুরীর তো আনন্দের সীমা ছিল না। জীবনে প্রথম মাটির বাড়ি, খড়ের গাদা, মোষের গাড়ি দেখল। মণি ঠাম্মার সাথে ছাগলছানার গায়ে হাত বোলানো, ছোট দাদুর সাথে খেয়ে উঠে পুকুরে হাত ধোয়া, মাছ ধরা দেখা আমার কন্যা তো একেবারে পুলকিত হয়ে গেল। ঊমাদের পরিবারের নিয়ম হল, কন্যা যখন শ্বশুরালয়ে যাবে সাথে মাছ, মিষ্টি এবং দই পাঠাতে হয়। ঊমার শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হবে বলেই বিশাল একটি কাতলা মাছকে বড় করা হচ্ছিল এতদিন ধরে। আজ তাকে জল থেকে তোলা হল। মাছের সাইজ দেখে আমরা আঁতকে উঠলাম, এত বড় মাছ খাবে কে? আর কাটবেই বা কে? শেষে নিয়মরক্ষার স্বার্থে মাছটি ওনারা কেটেই দিলেন। সেই মাছ কাটা দেখে তুত্তুরীর আনন্দের আর সীমাপরিসীমা ছিল না। মুড়োর সাইজই এক কেজির বেশি হবে, এবং কাটার পর অন্তত আধঘণ্টা মুড়োটি শ্বাস নিচ্ছিল এই গল্প আমার কন্যা আজো করে চলেছে।
সন্ধ্যাবেলা সকলকে কাঁদিয়ে ঊমা চলল শ্বশুরবাড়ি। ঊমার বৃদ্ধা দিদিমা, অশ্রুসজল চক্ষে নিখাদ সরলতার সাথে করজোড়ে বললেন, “একটু দেখ বাবা। সেই দেড়দিন বয়স থেকে আমিই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি।” এত বছর আমরা স্বাধীন, আজোও মেয়ের বাড়ির লোককেই এই সনির্বন্ধ অনুরোধ করতে হয়। নবদম্পতিসহ শ্বশুর-শাশুড়িদের বাসে তুলে দিয়ে আমরা উঠে বসলাম ডিএনো সাহেবের পাঠানো গাড়িতে, তখন সন্ধ্যা নামছে। পরবর্তী গন্তব্য বোলপুর।

বীরভূম ডাইরি ১০/১২/১৬ (পর্ব ২)
৫ তারিখ রাতটা বোলপুরে কাটিয়ে, ৬ তারিখ সকালে পুরি-সব্জি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে ১০টার মধ্যে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে। শান্তনুদা পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, “গাইড নিয়ে ঘুরো।” শান্তিনিকেতন আমি ইতিপূর্বে একবারই গেছি, শৌভিক বোধহয় এগারো বছরে পঞ্চাশ বার গেছে, তবু আমরা শান্তনুদার কথার অবাধ্য হতে সাহস পেলাম না। শান্তনুদা বলেছিলেন, গাইড নিয়ে শান্তিনিকেতন ঘুরতে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা লাগবে, আর মিউজিয়াম দেখতে আরো ঘণ্টা দেড় দুই। গাড়ি তৈরি ছিল, কালকের গাড়িটাই, ড্রাইভারের নাম গণেশ, সিউড়ির বাসিন্দা।
গাড়ি শান্তিনিকেতনের ঐতিহাসিক বট গাছের কাছে গিয়ে থামতেই জনা দুই ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, ওনারাই গাইড। পাঁচশ টাকার বিনিময়ে গোটা শান্তিনিকেতন ভালো ভাবে ঘুড়িয়ে দেবেন। দরদস্তুর করে সাড়ে তিনশত টাকায় রফা হল। বেশ বুঝতে পারলাম, মঙ্গলবার বলেই সাড়ে তিনশ’য় রাজি হলেন। আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন ভ্রমণপিপাসু ত্রিসীমানায় নেই কিনা। গাইড বললেন, “বেলা একটা অবধি গাছের তলায় ক্লাশ চলে, তখন বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। চলুন আমরা গাড়ি করে অন্যান্য অঞ্চল গুলি ঘুরে আসি।” প্রথম দ্রষ্টব্য ‘প্রতীচী’ অমর্ত্য সেনের বাড়ি। বাইরের দরজা খোলাই ছিল। সারাইসুরাই এর কাজ চলছে। গাইড বললেন, “অমর্ত্য সেন এলে এখনও এখানেই থাকেন। বছরে এক থেকে দুই বার অবশ্যই আসেন এবং এলে সাইকেল চেপে ঘুরে বেড়ান। এখানে কাছেই “কালো”র চায়ের দোকানে ওনার ঠেক। কালো মারা গেছে, তবু উনি ওখানে যান এবং আড্ডা মারেন।” আমরা যুগলে সসম্ভ্রমে দেখছিলাম সবকিছু, তুত্তুরী শুধু বলল, “এই লোকটা এত বকছে কেন?”
শৌভিক কিছু ছবি তুলল, ও যেখানেই যায়, সবকিছুর ছবি তুলে আনে। ওর বাবা এবং মাকে দেখানোর জন্য। শারীরিক অসুস্থ্যতার জন্য বাবা-মা দীর্ঘ দিন কোথাও যেতে পারেন না, আমাদের তুলে আনা ছবিতেই ওনাদের ভ্রমণের স্বাদ মেটে। কিচ্ছু বাদ দেয় না শৌভিক। গাইড বোধহয় ভেবেছিলেন এরা শহুরে দম্পতি সাথে ছোট্ট বাচ্ছা কতটুকু আর দেখবে, তাই কিঞ্চিৎ করুণা ভরে জিজ্ঞাসা করলেন, “কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি দেখবেন নাকি?” আমাদের মাথা এসব ক্ষেত্রে কেবল একদিকেই হেলে। যেতে গিয়ে দেখা গেল, পথটা গাইড মশাইয়েরও ভালো জানা নেই। একে তাকে জিজ্ঞাসা করে পৌঁছলাম আনন্দধারায়। এককালে কণিকা বন্দোপাধ্যায় থাকতেন, এখন গোরা সর্বাধিকারি থাকেন। ফাঁকা নিঝুম লাল মাটির রাস্তার পাশে, ঘুমিয়ে পড়া এক অট্টালিকা। সত্যি এখানে একদিন ধ্বনিত হত, “নিরালায় তোর বনেরও মাঝে, সেথা কি এমন নূপুর বাজে? এমন মধুর গান” ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। অদূরেই দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের তালাবন্ধ কুঠি।
পরের গন্তব্য ইস্টার্ন যোনাল কালচারাল সেন্টার। ডিএনও সাহেব পূর্বেই বলেছিলেন, ওটা যেন অবশ্যই দেখা হয়। বিশাল এলাকা সমান ভাগে ভাগ করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, আন্দামান আর নিকোবরের মাঝে। প্রতিটি খন্ডে আবার এক বা একাধিক মাটির কুটির রয়েছে, স্থানীয় আদিবাসী গৃহের ধাঁচে।জুতো খুলে ঢুকতে হয়। প্রতিটা কুটির ভর্তি রয়েছে, স্থানীয় হস্তশিল্প, আদিবাসী পোশাক, গয়না এবং যন্ত্রপাতিতে। ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ডের মাটির কুঁড়েঘর গুলি অপূর্ব চিত্রাঙ্কিত। তুত্তুরীর আনন্দ দেখে কে? জীবনে প্রথম টোকা, বেতের ঝুড়ি, কুনকে, আদিবাসী তীরধনুক, ছিপ তথা মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম, তাঁতযন্ত্র দেখল। সপ্তাহের শুরুতে বলে কি না জানি না, আমরা ছাড়া আর কোন দর্শকই ছিল না প্রায়। দূরে বিশাল ঝিল, তাতে লম্বা লম্বা গাছের ছায়া পড়েছে, তারই কিনারে বসে এক আনমনা বাউল আপন মনে একতারা বাজিয়ে গান গাইছে। শুনে মনে হল, এখানেই আসনপিঁড়ি পেতে বসে যাই, আর কোথাও যাবার প্রয়োজন কি?
এরপর কোপাই। ফাঁকা ধু ধু কোপাই এঁকে বেঁকে বয়ে যাচ্ছে        , শ্মশানের পাশ দিয়ে। অদূরেই আমার কুটির। গাইড সাহেব বললেন, এই কোপাই দেখেই নাকি রবি ঠাকুর “আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে” লিখেছিলেন। সত্যি মিথ্যা জানি না। উনি আরও শোনালেন, যে সারা বছর নাকি কোপাই নদীতে জল থাকে। তীব্র দাবদাহে যখন বীরভূমের সব নদনদী খালবিল শুকিয়ে যায়, তখনও নাকি কোপাই বইতেই থাকে। বিহারে নাকি এই নদীই “শোন” নামে পরিচিত। যদিও গুগল এই ব্যাপারে বিশেষ আলোকপাত করতে পারল না। বরং দেখলাম কোপাই আসলে ময়ূরাক্ষীর এক উপনদী মাত্র। শীতের মিঠে রোদে আঁকাবাকা  কোপাই অপরূপা, আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিন্তু সেই মুগ্ধতা আক্ষরিক অর্থে চটকে দিল দালের মেহেন্দি। কর্ণপটহ বিদারক স্বরে, “বোল তারা রা রা” গেয়ে উঠে। মাত্র জনা দুই নব্য যুবক, একটি বক্স আর চার বোতল মদ, কোপাই এর সৌন্দর্যে অ্যাসিড ক্ষত সৃষ্টির জন্য এই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের জাতের জাতীয় সঙ্গীত হওয়া উচিত, “চার বোতল ভদকা”।
[চলবে]    
বীরভূম ডাইরি ১১.১২.২০১৬ (পর্ব-৩)
অতঃপর খোয়াই। খোয়াই মূলতঃ প্রসিদ্ধ শনিবারের হাটের জন্য। যাবার সময়ও আমি মৃদু ঘ্যানঘ্যান করছিলাম, আজ আর খোয়াই গিয়ে কি হবে? শনিবার অবধি তো আমরা এখানে থাকছি না। কিন্তু পৌঁছে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। খোয়াইয়ের আসল রূপ দেখতে হলে শনিবার ছাড়া অন্য যে কোন দিন যাওয়াই ভাল। ধুধু করছে ফাঁকা খোয়াই আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। এখানেও একজন উদাস বাউল আপন মনে গান গেয়ে চলেছে, ইজেডসিসির বাউলের মত অতটা সুরেলা গলা নয় যদিও তবু শুনলে মন ভরে যায়। গাইড বললেন,” যান ঘুরে আসুন, তবে বাচ্ছা সামলে, ধারে না যায়।” বরষার জল ভূমিক্ষয় করে যে এরকম অপরূপ সুন্দর দৃশ্যপট সৃষ্টি করতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। তার সাথে অপরূপ নিস্তব্ধতা রীতিমত মনকাড়া। সূর্য ইতিমধ্যে মধ্য গগনে, তীব্র গায়ে জ্বালা ধরানো রোদ, তার ওপর তুত্তুরীর কেবল ধারে যাবার প্রবণতা, মুগ্ধতা কাটিয়ে দেবার জন্য অবশ্য এগুলিই যথেষ্ট। গভীর খাদ, নীচে পড়লে, কোন রাস্তা দিয়ে যে তুলে আনব জানি না। তুত্তুরীকে যদিও বা ধমকধামক দিয়ে সামলানো যায়, শৌভিককে সামলাবে কে? ছবি তোলার এমন নেশা, যে রীতিমত আতঙ্কিত বোধ করছিলাম, যে ছবি তুলতে গিয়ে খাদে না নেমে পড়ে।
এরপরের গন্তব্য, বিশ্বভারতী। সেই শদুয়েক বছরের পুরাতন বট গাছ থেকে শুরু করে, পর্যায়ক্রমে দেহলী, নতুনবাড়ি, আম্রকুঞ্জ, বকুলবীথি, শান্তিনিকেতন কুঠি, সুরুল কুঠি, মহুয়া কুঠি,পূর্ব তোরণ, পশ্চিম তোরণ, ছাতিমতলা, কালো বাড়ি। শান্তিনিকেতন তো শুধু চর্ম চক্ষে দেখার নয়, বরং অনুভবের বস্তু। আমরা যুগলে মন্ত্র মুগ্ধের মত দেখছিলাম এবং শুনছিলাম, কত বছর হয়ে গেল তিনি নেই, অথচ কি ভীষণ ভাবে বিরাজমান। কায়াহীন দাড়িবুড়োর উপস্থিতি অনুভব করে বুঁদ হয়ে ছিলাম আমরা। তিনি নেই, অথচ তার সেই আসনটি যেখানে বসে একদা তিনি ক্লাস নিতেন আজো রয়েছে, ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। শৌভিকের অনুমতি নিয়ে ওনার আসনের উল্টোদিকে বসলাম, যেখানে ছাত্ররা বসে। উনি শিক্ষক আমি ছাত্রী কল্পনা করে রোমাঞ্চিত হলাম, আমার কন্যাকেও বললাম, “বাবু বসো। দেখ ঐ আসনে এককালে রবি ঠাকুর বসতেন।” তুত্তুরী কান্না চেপে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “ আমি আর যাব না। শান্তিনিকেতন বিচ্ছিরি জায়গা। আমি আর হাঁটতে পারছি না। আর ঐ লোকটা এত বকছেই বা কেন?” বেচারা, সেই সকাল থেকে ঘুরছে, এবং এরকম এক লাল মেঠো পথে বাবা মা কেন যে উন্মত্তের মত দৌড়ে বেড়াচ্ছে, তা অনুধাবনের বয়স সত্যি ওর হয়নি। তার ওপর একটু আগে আম্রকুঞ্জে একটি টিয়া পাখি দেখতে পেয়েছিল, যেই তাকে ধরতে গেছে সে ওমনি ফুর করে উড়ে গেছে। তার পিছন পিছন ধাওয়া করার প্রবল বাসনাও চরিতার্থ হয়নি আমাদের উৎপাতে। কাজেই মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক।
ফোঁপানি ক্রমেই কান্নায় রূপ নিচ্ছিল, এদিকে ঘড়ির কাঁটাও দেড়টার ঘর ছাড়িয়েছে, ফলে ভগ্ন হৃদয়ে আমরা বিশ্বভারতীকে বিদায় জানাতে উদ্যত হলাম। তবে কলের বাঁশি না দেখে কি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করা যায়? রামকিঙ্কর বেজের একাধিক অমর সৃষ্টি বিশ্বভারতী জুড়ে ছড়িয়ে আছে। যার কিছু আপাতত সংস্কারের জন্য পর্দাবৃত, যেমন গৌতম বুদ্ধ এবং সুজাতা।  মহাত্মা গান্ধী,কলের বাঁশি আর সাঁওতাল পরিবার  এখনও সংস্কার হয়নি, তবে কেন জানি না দেখে মনে হল আশু সংস্কার জরুরী। সাত বছর পর দেখলাম কেমন যেন বিবর্ণ, ভঙ্গুর লাগল সবকিছু। মহাত্মা গান্ধীর পদতলের করোটির গায়ে যেন শ্যাওলা পড়েছে মনে হল। ২০০৯ এ যিনি আমাদের গাইড ছিলেন, উনি বলেছিলেন, মহাত্মা জী কোপাই নদীর তীরে পরিভ্রমণে গিয়ে না দেখে কোন করোটির ওপর পা দিয়ে ফেলেছিলেন, কাছেই শ্মশান কি না। কেমন যেন অদ্ভুত লেগেছিল শুনে। এবারের গাইড বললেন, “নোয়াখালীর দাঙ্গার পর, মহাত্মা জী যখন সেখানে যান, চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ পড়েছিল। এখানে নোয়াখালীর সেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার স্মৃতিকেই স্মরণ করা হয়েছে।” কে জানে? কোনটা সত্যি, কোনটা নয়। তবে দেশের জনকের চরণতলে নরকরোটি দেখলে কেমন যেন গা শিরশির করে ওঠে।
বিশ্বভারতী ত্যাগ করার পর দ্বিপ্রাহরিক আহারের পালা। বিগতবার শান্তিনিকেতন ভ্রমণকালে এই মধ্যাহ্ন ভোজ নিয়ে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেবার আমরা টুরিস্ট লজেই ছিলাম, টুরিস্ট লজের খাবার যেমন বিস্বাদ, তেমনি দুর্মূল্য। ভ্রমণের অন্তিম দিনে আমরা ঠিক করেছিলাম আজ আর টুরিস্ট লজে খাব না, বাইরে কোথাও খাব। সেই মোতাবেক একটি ভালো হোটেল দেখে সেখানেই মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করা হয়। রান্না এমন কিছু আহামরি ছিল না বটে, তবে আমার বন্ধু সঞ্চিতা তার ভাতের মধ্যে একটি মাছের আঁশ খুঁজে পায়। তার পর সব খাবারেই আমাদের ভয়ানক আঁশটে গন্ধ লাগতে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে বাড়ি ফেরার পথে, গোটা রাস্তা সঞ্চিতার গা গুলাতে থাকে, আর আমার বাবা তো রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে বমি করতে বাধ্য হয়। ফলে বোলপুরে খাওয়া নিয়ে আমি বেশ আতঙ্কিত ছিলাম। শৌভিক যদিও বারবার আশ্বস্ত করছিল, “ ওরে ২০০৮ এর পঞ্চায়েত ইলেকশনে আমার বোলপুরে ব্লক অ্যাটাচমেন্ট ছিল। বেশ কিছুদিন ছিলাম। এত খারাপ ও নয়।” তারওপর ডিএনও সাহেব ও ফোন করে বলেদিয়েছিলেন, বোলপুর সার্কিট হাউসের কাছেই একটি ভালো রেস্তোরাঁ আছে, নাম “ঘরে বাইরে” ওখানেই ভোজনপর্ব সারতে। মন্দ নয় রেস্তরাঁটা। বাটিকের পাঞ্জাবি পরা ওয়েটর এসে অর্ডার নিয়ে গেল, সিরামিকের থালা, বাটি, ভাঁড়ের মত দেখতে গ্লাসে জল। খাবারও যথাযথ, বরং পূর্বের অভিজ্ঞতার তুলনায় অভাবনীয়। ড্রাইভার গণেশ বাবুও বললেন, “সরকারী প্রোগ্রাম হলে এখানেই খাওয়া দাওয়া হয় ম্যাডাম।”
লাঞ্চের পর কি করব? এটা আমাদের প্ল্যানে ছিল না। সন্ধ্যার মধ্যে সিউড়ি ফিরতে হবে, সিউড়ি সার্কিট হাউসে রাত্রিবাস। ঘড়িতে সবে তিনটে বাজছে। কি করা যায়? শৌভিক বলল, “কেদুলি যাবি? গণেশ কেদুলি যেতে কতক্ষণ লাগবে?” গণেশ মাথা চুলকে বলল, “স্যার যেতেই পারেন, কিন্তু এখন তো মেলার সময় নয়। জয়দেব পদ্মাবতীর একটা মন্দির ছাড়া ওখানে কিছুই দেখার নেই।” শৌভিক হাল ছেড়ে বলল, “তাহলে তুমিই বল। কোথায় যাওয়া যায়?” “আমখই যাবেন স্যার?” আমখই কি? কোথাও তো শুনিনি এর নাম। গণেশ বলল, “ওখানে কি যেন পাওয়া গেছে স্যার। ডিএম এডিএম সাহেব মাঝে বেশ কয়েক বার গেছেন। ইলামবাজারের জঙ্গলের মধ্যে একটা আদিবাসী গ্রাম।” জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসী গ্রাম? আহাঃ। আর কি চাই? “চল” আমরা একসাথেই বলে উঠলাম প্রায়।
বীরভূম ডাইরি ১২.১২.২০১৬ (পর্ব-৪)
আমখই যাবার পথটা ভীষণ সুন্দর। গহীন শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লাল মোরামের রাস্তা, খুব চওড়া নয়, যদিও তবু আমাদের গাড়ি বেশ অনায়াসেই  পাকা রাস্তা থেকে ঐ পথে নেমে পড়ল। চারপাশ নিঝুম, অপরাহ্ণের হলুদ সূর্যের আলোয় রহস্যময় প্রকৃতি। বেশ খানিকটা শুনশান জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবার পর আমি আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “আচ্ছা, এই জঙ্গলে কোন জানোয়ার নেই?” শৌভিক হাসি চেপে বলল, “ জানোয়ার মানে? বাঘ, সিংহ, হাতি, গণ্ডার নেই। বেঁজি শেয়াল এই সব থাকতে পারে।” গণেশ বাবু ও ইতস্তত করে বললেন, “আদিবাসী গ্রাম কাছেই, এখানে কোন বড় জন্তু নেই ম্যাডাম।”  সত্যি একটু পরেই দেখলাম, একজন সাইকেল চালিয়ে চলে গেলেন আমাদের পাশ কাটিয়ে।
মিনিট পাঁচ সাত পরে গাড়ি গিয়ে থামল, একটা ফাঁকা জায়গায়। নেমে বেশ হতাশ হলাম, কিছুই তো নেই। কোন ভাঙা মন্দির টন্দির বা মাটি খুঁড়ে পাওয়া কোন মূর্তি, বাসনকোসন বা কোন কিছু। কারণ গোটা পথ শৌভিক গণেশ বাবুকে আমখই নিয়ে নানা প্রশ্ন করেছে, আর প্রতিবারই গণেশ বাবু টাক চুলকে বলেছেন, মাটির তলা থেকে কি সব নাকি পাওয়া গেছে। পশ্চিমমেদিনীপুরের মোগলমারির মত কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাব আশা করেছিলাম। সে গুড়ে বালি। জায়গাটা খুব সুন্দর, শান্ত, বড় বড় বট, অশ্বত্থ আর কাঁটাল গাছ দিয়ে ঘেরা (ঐ কটি গাছই চিনি কি না)। কাছেই একটা সদ্য খনন করা পুকুর, যার জল এখনও ঘোলা। কয়েকটা ছাগল চরছে দেখে আমার মেয়ের তো আর আনন্দ ধরে না। কি যে কাকিমাদের গ্রাম থেকে ছাগল প্রীতি নিয়ে ফিরেছে। জনা পাঁচেক লোক কাজ করছে, কালো ছোট নুড়ি দিয়ে মার্কা করা আছে, এঁকে বেঁকে রাস্তা তৈরি হবে। বেশ কয়েকটা সিমেন্টের বাঁধানো বেদীর ওপর গাছের গুড়ির টুকরো রাখা আছে। গণেশ বাবু ইশারায় দেখালেন, “স্যার ঐ খানে লিখা আছে।” সত্যি দুটি বড় বড় বোর্ডে বাংলা এবং ইংলিশে লেখা আছে। বাংলাটাই পড়লাম, পড়ে যা বুঝলাম, এখান থেকে পাললিক জীবাশ্ম পাওয়া গেছে, যার আনুমানিক বয়স দেড় কোটি বছর। দেড় কোটি বছর আগেকার গাছের গুঁড়ি বন্যার জলে ভেসে এসেছিল তৎকালীন রাজমহল পাহাড় থেকে, এবং দীর্ঘদিন মাটির নীচে থেকে তা ফসিলে পরিণত হয়েছে। যার টেকনিক্যাল নাম হল, “পেট্রিফায়েড উড”।
মোটা মাথায় ভালো ঢুকল না, ভাবলাম, যেমন পাথরে জীবাশ্ম পাওয়া যায়, তেমনি হয়তো কাঠে পাওয়া গেছে। যতদূর পারা যায়, মনোযোগের সাথে দেখার চেষ্টা করলাম, কোথাও আরকেওপ্টেরিক্স মার্কা কিছু আছে কি না। নিদেন পক্ষে মাছি, মশা কিছুতো থাকবে। কিছুই খুঁজে পেলাম না, শুধু মাকড়সার জাল ছাড়া, যার বয়স দেড় দিন হতে পারে, কোটি টটি নয়। খুঁজতে গেলে মনঃসংযোগ করতে হবে, আর মন বসাব কি করে? আমার কন্যা ততোক্ষণে ছাগল ছেড়ে, প্রায় ওর সাইজের এক বিশাল মোটকা মুরগীর পিছে ছুটতে লেগেছে। মুর্গীটা প্রবল চিৎকার করে দৌড়চ্ছে, পিছে পিছে আমার মেয়েও। আমি ধরতে না ধরতেই দুবার আছাড় খেল। শখ করে শান্তিনিকেতন ঘুরব বলে শাড়ি পড়েছিলাম, তাও সাদা। মেয়েকে সামলাতে গিয়ে দুজনেই লালচে হয়ে গেলাম।
মেয়েকে ধমকাতে ধমকাতে তকিয়ে দেখি শৌভিক গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবি তুলছে। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিছু পেলি? জীবাশ্ম টিবাশ্ম?” শৌভিক অবাক হয়ে বলল, “হু। এগুলোই তো! ফসিলাইজড উড। দেখতে কাঠ, কিন্তু আসলে পাথর।” এতক্ষণে জ্ঞান চক্ষু উন্মোচিত হল। সত্যি তো । হাত দিয়ে দেখলাম, সব কাঠের টুকরো গুলি আসলে পাথর। কি অপরূপ দেখতে।
আমখই থেকে পরিতৃপ্ত হয়ে যখন আমরা আবার পাকা রাস্তায় উঠলাম, তখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ছে, রোদের রঙ কমলা মেশানো সোনালী। গণেশের প্রস্তাবমত পরবর্তী গন্তব্য হেতুমপুরের রাজবাড়ি। আমরা এটা কাল যাব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু গণেশ বাবু বললেন, আজই সেরে ফেলা যাবে। আমার ঠাকুমার বাপের বাড়ির কে যেন হেতুমপুরের মহারাণী ছিলেন। ছোটবেলায় এই কথাটা শুনলেই আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই অয়ন খুব হাসতাম। হেতুমপুর? হেতুমপুরের মহারাণী J J Jবড় হয়ে যখন জানতে পারলাম, সত্যি এরকম এক রাজা এবং তাঁর রাজত্ব ছিল, তখন নিজেদের নির্বুদ্ধিতা তথা বালখিল্যপনায় অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছিলাম। সন্দীপ রায়, তাঁর ফেলুদা সিরিজের “ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা” এখানেই স্যুট করেছিলেন।  টিভিতে হেতুমপুরের রাজবাড়ী দেখে সম্পূর্ণ মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু গণেশ বাবুর ভাবভঙ্গীতে মনে হল, খুব একটা দর্শনার্থীদের ভিড় হয় না। অত পোক্ত ড্রাইভারও জানেন না, রাজবাড়ি কোনটা। জোড়া হাতিখচিত একটা তোরণদ্বারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললেন, “স্যার এটাই রাজবাড়ির গেট।” ভালো কথা। রাজ বাড়ি কই? গেটের ভিতর অনেকগুলি হলুদ রঙের একতলা দুতলা বাড়ি। এককালে রাজবাড়ির অংশ হলেও এখন ওখানে স্কুল বসে। আরও খানিকটা এগিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে একটা বড় বাড়ির সামনে এনে দাঁড় করালেন, এখন ঐটি কলেজ। এককালে রাজবাড়ির অংশ ছিল হয়তো, কিন্তু এটা কিছুতেই রাজবাড়ি নয়। আমার চোখে ভাসছে ঘুরঘটিয়ার ঘটনা। এটা সে বাড়ি নয়। শৌভিক হতোদ্যম হয়ে বলল, “চল হয়ে গেছে। এখনও সময় আছে। মামা-ভাগ্নে পাহাড়টা ঘুরে আসা যাবে।” আমি কিছুতেই যাব না।
বীরভূম ডাইরি (পর্ব- ৫) ১৪/১২/১৬
হেতুমপুরের রাজবাড়ি না দেখে যাবই না, আমার এই নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখে, ড্রাইভার গণেশ বাবু আসেপাশের আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে অবশেষে একটা লাল দরজার সামনে গাড়ি দাঁড় করালেন। অনেকটা চার্চের মত দেখতে বেশ বড় লাল দরজা, মাথার ওপর কোন এককালে একটা ঘড়ি ঘর ছিল, আজ শুধু তার কঙ্কালটুকুই অবশিষ্ট আছে। আধভাঙ্গা বিশাল মরচে ধরা বিবর্ণ গ্রীলের গেট, কব্জা থেকে ঝুলে পড়েছে। দরজার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে দেখি, বহুদূরে বিস্তীর্ণ মোরামের মাঠের (এককালে হয়তো বাগান ছিল) ওপারে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে, এই তো সেই বাড়িটা। দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। এই তো এই বাড়িটার সামনেই জীপ (খুব সম্ভবত) থেকে লাফিয়ে নেমেছিলেন ফেলুদা আর তপসে। এখানেই একটা টিয়া পাখি ছিল, যে কারণে অকারণে খালি বলত, “ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন, একটু জিরো”
বিশাল অট্টালিকা। সমান দুই খণ্ডে বিভক্ত। সে বিভাজন শরীকি কি না, জানি না। একাংশে কলেজ, সেই অংশটি সযত্নে রক্ষিত। দেওয়ালে জানলায় দরজায় চকচকে নতুন রঙ। তবে ঐ অংশের সামনের মাঠটির অবস্থা চোখে দেখা যায় না। গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ, এত গাড়ি পড়ুয়াদের বলে মনে হয় না। দুই অংশের বিভাজন এককালে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে তারের জাল দিয়ে করা ছিল, যা বর্তমানে ছিন্নবিচ্ছিন্ন। জাল বরাবর বেশ কিছু গাছও বসানো ছিল, যার অনেকগুলিই আজ মহীরুহে পরিণত।
যে অংশে আমরা প্রবেশ করলাম, সেটি জনহীন। সামনের মাঠের কিছুটা অংশ ঘিরে একটা নির্মীয়মাণ চিল্ড্রেন্স পার্ক। এই ভাবগম্ভীর পরিবেশ যা সাংঘাতিক বেমানান। তবু এই ভেবে শান্তি পেলাম, যে তুত্তুরীর ঘ্যানঘ্যানানির হাত থেকে সাময়িক ভাবে মুক্তি পাব। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একটা দোলনাও এখনও টাঙানো হয়নি এবং স্লিপ গুলির অবস্থাও অকহতব্য। সমস্ত কিছুই ধুলোর চাদরে আচ্ছন্ন।
রাজবাড়ির রূপ এবং গাম্ভীর্য ভাষায় প্রকাশে আমি অপারগ। অপার মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে আসার সময় শুধু দুঃখ হচ্ছিল, যে আমাদের রাজ্যে এত সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা রয়েছে, এগুলিকে হেরিটেজ হোটেল বানিয়ে প্রমোট করতে পারলে কি ভালোই না হত। দিনের শেষ দ্রষ্টব্য, দুবরাজপুরের মামা-ভাগ্নে পাহাড়। শ্বশুর মশাই নিষেধ করেছিলেন যদিও তবুও ড্রাইভার গণেশ বাবুর উৎসাহেই যাওয়া। গিয়ে মনে হল, না গেলেই ভাল হত, বুঝি। মামা-ভাগ্নে পাহাড়ের যে রূপ অভিযান সিনেমায় দেখেছিলাম, আদপে তার সিকি ভাগও সুন্দর নয় জায়গাটা। বেশ কিছ ক্ষয়প্রাপ্ত গোল গোল পাথর, যেমন নোংরা, তেমনি জনাকীর্ণ। প্রতিটি পাথরের গায়ে, প্রেমিক প্রেমিকারা নিজেদের নাম খোদাই করে গেছে। সামনেই দুটি মন্দির, একটি সংকটমোচন হনুমানজীর অপরটি পাহাড়েশ্বর শিবের। মন্দিরগুলির নাকি এ বছরেই দ্বারোদঘাটন হয়েছে, এবং ফলতঃ মোদোমাতালের উৎপাত নাকি একটু কমেছে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই আমরা রওনা দিলাম, সিউড়ির উদ্দেশ্যে। সিউড়ি সার্কিট হাউসেই রাত্রিবাস। গাড়িতে ওটার আগেই ডিএনও সাহেবের ফোন, অভিভাবকের মত জানালেন যে সার্কিট হাউসে সব বন্দোবস্ত করা আছে, প্রশ্ন করলেন রাতে আমরা কি খেতে চাই, সেই মত ব্যবস্থা হয়ে যাবে এবং পরিশেষে জানালেন, যে অফিস থেকে নিস্তার পেলেই উনি আসছেন, সার্কিট হাউসের লাউঞ্জে বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে। আমরা দুজনেই অনুরোধ করলাম যদি উনি একা না এসে সপরিবারে আসেন, তাহলে একজন বন্ধু পেয়ে তুত্তুরীর ঘ্যানঘ্যানানি যদি কমে। ডিএনও সাহেবের গিন্নী অর্থাৎ প্রিয়াঙ্কার সাথে বেশ কয়েকবছর আগে সুন্দরবন ভ্রমণকালে দেখা হয়েছিল এবং বেশ ভাব জমে গিয়েছিল। তুত্তুরীর সাথে ওনার কন্যা “কেটলু” ওরফে “প্রিয়দর্শিনীর”ও জব্বর দোস্তি জমে গিয়েছিল। জানতাম প্রিয়াঙ্কা অবশ্যই আসবে, এবং প্রিয়াঙ্কা ও কেটলু আমাদের আশাহত করেনি। সেদিন সিউড়িতে গানের বড় অনুষ্ঠান ছিল, একাধিক নামী  শিল্পীর আসার কথা, কিন্তু আমাদের সাথে আড্ডা মারার জন্য কেটলু এবং তার জননী সেই অনুষ্ঠান মাঝ পথে ত্যাগ করেই এসে হাজির। প্রাণ খুলে আড্ডা হল প্রায় রাত দশটা পর্যন্ত, রাত দশটায় আমাদের নৈশাহার সাজিয়ে দেওয়া হল টেবিল, ডিএনও সাহেব স্বয়ং তদারকি করলেন। বেচারা কেয়ারটেকার(?) একচোট বকুনিও খেল রাতে বাঁধাকপির তরকারী রান্নার জন্য, যদিও তা খেতে বেশ ভালোই লাগল। অবশেষে আমাদের খেতে বসিয়ে তদারকি করে কেটলু এবং তার পিতামাতা বিদায় নিল। আমরাও তৃপ্ত উদর তথা ততোধিক পরিতৃপ্ত হৃদয়ে গেলাম শুতে। কাল সকালে ম্যাসাঞ্জোর। নাকি বিকালে? সেটা কাল সকালেই ভাবব, সারাদিনের ক্লান্তিতে আপাতত চিন্তা এবং চেতনা আচ্ছন্ন।  
বীরভূম ডাইরি ১৫/১২/১৬ (পর্ব- ৬)
বীরভূমে সেই অর্থে আজ আমাদের তৃতীয় দিন। আজ বুধবার, ৬/১২/১৬। আজকের গন্তব্য মাসাঞ্জোর। ডিএনও সাহেব এবং ওনার গিন্নী উভয়েই জানিয়েছিলেন, যে মাসাঞ্জোর যদি যেতেই হয়, তাহলে বিকাল বেলা যাওয়াই ভালো। ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলায় ময়ূরাক্ষী নদীর ওপর একটা বাঁধের নাম মাসাঞ্জোরমাসাঞ্জোরে সূর্যাস্ত নাকি অত্যন্ত মনোরম। কিন্তু ড্রাইভার গণেশ বাবু এবং আমার শ্বশুরমশাই এর মতে মাসাঞ্জোরে সকাল বেলায় যাওয়াই ভালো। বাবা বললেন, “মাসাঞ্জোরে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। চেতাকে (অর্থাৎ তুত্তুরীকে) নিয়ে গেলে, গোটা অঞ্চল তথা আসেপাশের পাহাড়গুলি ঘুরে দেখার আগেই অন্ধকার নেমে যাবে।” যুক্তি অকাট্য, কাজেই আমরা সকাল সকাল লুচি তরকারী দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে বেরোলাম মাসাঞ্জোরের উদ্দেশ্যে। সার্কিট হাউসের লুচির একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, বহু বছর পর, আটার গুঁড়ি দিয়ে বেলা লুচি খেলাম। তেলে কড়করে করে ভাজা লুচির গায়ে গুড়িগুড়ি ভাজা আটা বা ময়দা, আহাঃ।
 যারা মাইথন গেছেন, তাদের মাসাঞ্জোরকে একনজর দেখলেই মনে হবে মাইথনের ছোট ভাই। তবে দুই পাড় ঐ রকম পাথরের বোল্ডার দিয়ে বাঁধানো নয় (যতটুকু মনে আছে)। বাঁধের ওপর চওড়া ব্রীজ। ব্রীজের ওপর দিয়ে গাড়ি যায় না। পায়ে হেঁটে ব্রীজ পেরোতে হয়। ব্রীজের ওপর দাঁড়ালে একদিকে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি, ওপরদিকে শুকনো খাত। সব কটা লকগেট বন্ধ কি না। ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে গেলে প্রথমেই যা চোখে পড়ে তা হল, রাশি রাশি টিয়া পাখি। ঘন সবুজ ডানা মেলে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে উড়ে যাচ্ছে।  কখনও কখনও ব্রিজের রেলিং এর ওপর ও এসে বসছে। তুত্তুরী যেই ধরতে গেল ওমনি ফুরররর।
যত জনসমাগম সবই এই পাড়ে, ওপারে তেমন কিছুই নেই। গোটা দুয়েক চায়ের দোকান, যাদের বয়ামে রাখা লেড়ো বিস্কুট গুলিকে দেখেই বিক্রি বাটা সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। আর আছে এক ফটোগ্রাফার (ক্যামেরা দেখলাম না যদিও), যিনি নকল ফুলের নানা ফ্রেম সাজাচ্ছিলেন, যা দেখেই বোঝা যায়, যে প্রেমিক-প্রেমিকাদের সেলফি তোলার জন্য। হেঁটে ব্রীজ পেরোতে গিয়ে প্রচণ্ড রোদে প্রায় ঝলসে গিয়েছিলাম আমরা, ওপারে ক্ষয় প্রাপ্ত পাহাড়ের ঢালে গিয়ে বেশ আরাম লাগল। উচ্চাবচ সরু পিচ ঢালা রাস্তা, দুপাশে লাল মোরাম উকি মারছে। একটু হাটার পর দেখি একদল ছেলে মেয়ে একটা টিলার ওপর থেকে নামল। শৌভিক ছবি তোলা থামিয়ে ওদের জিজ্ঞাসা করল, “এই ওপরে কি আছে গো?” ওরা জানালো তেমন কিছুই নেই। শুধু জঙ্গল। ওরা দৃষ্টির অগোচর হতেই শৌভিক বলল, “যাবি?” পরেছি তো লং স্কার্ট এবং চপ্পল, এই পরে আর যাই হোক পাহাড়ে চড়া যায় না। তবু সাহস করে রাজি হয়েই গেলাম। বেশ চড়াই, ধরারও কিছু নেই। অনেকটা উঁচুতে ওঠার পর দেখলাম আর পায়ে চলা পথ নেই, এবার ঘন জঙ্গল। ওপর থেকেও দৃশ্য এমন কিছু আহামরি নয়, তবুও চড়তে পেরে বেশ আনন্দ হচ্ছিল, এই চেহারায়, এই ঝলঝলে জামা কাপড় এবং শৌখিন চটি পরেও যখন পাহাড়ে চড়তে পারলাম, আর কে আমায় ট্রেকিং করা থেকে আটকাচ্ছে। আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু তথা ব্যাচমেট শ্রীমান দেবু কর, মাঝেমাঝেই ওসকায়, “চল অনি, ট্রেকিং করে আসি।” মন তো চায়, কিন্তু যতবার প্রসঙ্গটা ওঠে, তুত্তুরী সাফ জানায়, “বাবা যাক। তুমি যাবে না।”
চড়া তো হল, এবার নামার পালা। নামতে গিয়ে দেখলাম, নামাটা বেশ কঠিন। শৌভিক এবং তুত্তুরীর বাঁধা জুতো,ওরা টরটর করে বেশ খানিকটা নেমে গেল। আমি গেলাম আটকে, কিচ্ছু ধরার নেই, নামতে গেলেই ভয় হচ্ছে গড়িয়ে যাব এবং গড়াতে গড়াতে সোজা খাদে। জানতাম আওয়াজ দেবে, তবু প্রাণ বাঁচাতে শৌভিকেই ডাকলাম, “একটু হাতটা ধরবি। জাস্ট একটা স্টেপ।” শৌভিক গজগজ করতে করতে হাতটা তো বাড়িয়ে দিল, মুখে শুধু বলল, “তুই করবি ট্রেক? দেখছিস তো ব্যাপারটা যত রোম্যান্টিক মনে হয়, আদপে অতটা নয়।”
নীচে নেমে আমরা আরো খানিকটা হাঁটাহাঁটি করলাম, ফাঁকা ঢেউ খেলানো রাস্তা দিগন্ত রেখা অবধি বিস্তৃত। আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন পর্যটক নেই। সত্যি ঝাড়খণ্ড অপরূপা।
আবার রোদে পুড়তে পুড়তে ব্রিজ পেড়িয়ে গাড়িতে ওঠা। গণেশ বাবু বললেন, “জলের কাছে যাবেন স্যার?” সদ্য তৈরি ইউথ হোস্টেলের পাশ দিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা সটান নেমে গেছে জলের কাছে। চোখ ধাধিয়ে গেল, মাসাঞ্জোরের সৌন্দর্যে, যতদূর চোখ যায় জল আর জল, দুদিকে দুটি ব্রীজ অনেকটা এগিয়ে গেছে জলের মধ্যে, ব্রীজের শেষে সাবেকি লাইট হাউসের মত দেখতে দুটি কুঠি,তবে অত উচু নয়। একনজরে মনে হবে, ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ডে এসে গেছি। প্রচুর ছবি তুলে পরিতৃপ্ত হৃদয়ে রওনা দিলাম সিউড়ি সার্কিট হাউসের দিকে। সূর্য তখন মধ্য গগনে, এবার লাঞ্চের পালা, লাঞ্চ সেরে বিকালে যাব রাজনগরের মসজিদ আর ভাঙা রাজবাড়ি দেখতে।
বীরভূম ডাইরি ১৬/১২/১৬ (পর্ব- ৬)
মাসাঞ্জোর থেকে সিউড়ি ফিরে, বেশ একটা জম্পেশ লাঞ্চ আর আধ ঘণ্টার একটা ছোট্ট দিবানিদ্রা দিয়ে বেলা তিনটে নাগাদ আমরা রওনা দিলাম, রাজনগরের উদ্দেশ্যে। ইন্টারনেট ঘেঁটে রাজনগরকে খুঁজে বার করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আমার। সপ্তাহব্যাপী বীরভূম ট্যুরে কি কি দেখা যেতে পারে, তাই নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখি রাজনগরে এক বহু পুরানো মসজিদ আছে। তার ভাঙা প্রবেশদ্বারের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বীরভূমে পৌঁছে দেখলাম, স্থানীয় বাসিন্দারা কেউই রাজনগরের মসজিদের খবর জানে না। তবে আমার এক খুড় শ্বশুর জানালেন, যে রাজনগরে নাকি বিশালাকৃতি রসগোল্লা তৈরি হয়, ঠিক যেমন গুপি-বাঘা খেত।
গণেশ বাবু আমাদের নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন, এক বিশাল মাঠের মাঝে, মাঠের এক পাশে বিশাল জলাশয় এবং সেই জলাশয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, সদ্য চুনকাম করা এক ইমামবাড়া। হুগলী ইমামবাড়ার কাছে, তা নেহাত দুগ্ধপোষ্য শিশু। সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। আমরা যখন উঠছি, একদল বাচ্ছা মাঠে ফুটবল খেলছিল, চেঁচিয়ে বলল, “জুতো খুলে।” আমরা সসম্ভ্রমে জুতো সিঁড়ির ওপর রেখে ঢুকলাম। খোলা ছাদ, অত্যন্ত নোংরা, নুড়ি পাথর, প্লাস্টিকের প্যাকেট পড়ে রয়েছে। বেশ অদ্ভুত ইমামবাড়াটা। দুই দিকে প্রাচীর, প্রাচীর গাত্রে মুখমুখি বড় বড় তিন জোড়া খিলান, কিন্তু দুই প্রাচীরের মাঝে কোন ছাত বা মেঝে নেই। একদম ফাঁকা। কোনকালে কোন স্থাপত্য থাকলেও আজ তার ভগ্নাবশেষটুকুই অবশিষ্ট রয়ে গেছে এবং তা বেশ রহস্যময়।  

ইমামবাড়াটা খুবই সুন্দর, বিশেষত বিশাল ঝিলের ধারে, ঝিলের নাম বড় কালিদহ। কিন্তু যে মসজিদের টানে আমরা ছুটে এসেছি, সেটা কই? ইমামবাড়ার সামনের বিশাল মাঠে নাকি বাজার বসে। অসম্ভব ধুলো। ঐ মাঠের এক কোনে একটা ভাঙা গেট আছে বটে, কিন্তু তার সাথে ইন্টারনেটে দেখা মসজিদের গেটের সাদৃশ্য থাকলেও তা অত্যন্ত সাধারণ। চূড়ান্ত হতাশ হয়ে আমরা ঐ ধুলোয় ভরা মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে যখন চক্কর কাটছি, গণেশ বাবু বললেন, স্যার ঐ বড় কালিদহের মাঝে রাজাদের হাওয়ামহলের ধ্বংসাবশেষ আছে, আর ঐ দিকে রাজাদের ভাঙা বাড়িটাও দেখতে পাবেন। আদপে তুত্তুরী    (চলবে) 

Saturday 24 December 2016

অনির ডাইরি ২৪শে ডিসেম্বর ২০১৬


এক ঢিলে দুই পাখি, অর্থাৎ একদিনে দুটি সিনেমা দেখলাম আমরা আজ, সকাল সাড়ে দশটার শোয়ে ব্যোমকেশ পর্ব এবং বিকাল সাড়ে তিনটের শোয়ে ডবল ফেলুদা। পুরো ব্যাপারটাই শৌভিকের মস্তিষ্ক প্রসূত। এর আগে আমি যতবার প্রস্তাব করেছি এক দিনে একাধিক সিনেমা দেখা, ততবারই তা নাকচ হয়েছে। কারণ তাতে নাকি যথার্থ ভাবে কোন সিনেমাটিরই রসাস্বাদন করা যায় না। কিন্তু এবারে যখন শৌভিক নিজে থেকেই প্রস্তাব দিল, আমি তো একপায়ে খাড়া। তা নাহলে সত্যি আর সময় কোথায়? তুত্তুরীকে নিয়েও কোন চিন্তা নেই, কারণ বহুদিন বাদে হাওড়া এসেছি। দাদু-মামমামকে (দিদা) পেলে তুত্তুরীর আর কাউকেই প্রয়োজন নেই।
সুতরাং ভোর বেলা(অর্থাৎ বেলা আটটা) উঠে শ্যাম্পু করে (সারাদিন মলে থাকব কি না), চটজলদি প্রাতরাশ করে দুজনে দৌড়লাম অবনী রিভার সাইড মলের উদ্দেশ্যে। দশটার সময় যখন অবনীতে ঢুকলাম, গোটা মল ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। সব দোকানপাট বন্ধ এবং অন্ধকার। আমাদের মত জনা কয়েক সিনেমা পাগল আর মুষ্টিমেয় সিকিওরিটি গার্ড ছাড়া কেউ নেই। ফাঁকা হলে দেখতে বসলাম ব্যোমকেশ পর্ব। আসল গল্প তো অমৃতের মৃত্যু, টানটান উত্তেজনায় ভরপুর। দেখতে বসেই বেশ হতাশ হলাম, এখানে গল্পের শুরুতেই ব্যোমকেশ বেশ একচোট ‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে’ মার্কা ডিসুম- ডিসুম করে নিল। প্রচণ্ড রাগে গা রিরি করে উঠল, ব্যোমকেশ বক্সী বড়জোর এক ঘা ব্রজ মুষ্টি প্রহার করতে পারে, কিন্তু এই ভাবে ভ্যান ডেম বা অক্ষয় কুমার টাইপ ফাইট করছে এটা আমি কিছুতেই হজম করতে পারলাম না। যদিও আমার বর বলল, “আউট অফ কন্টেক্সট হলেও বড় খাসা ফাইট করল কিন্তু ব্যোমকেশ।”  এরপর শুরু হল ব্যোমকেশ এবং সত্যবতীর ন্যাকা ন্যাকা দাম্পত্য প্রেম। বহ্নিপতঙ্গ সিনেমাটিতে দেখান হয়েছিল সদ্যবিবাহিত ব্যোমকেশ এবং সত্যবতীর দুষ্টু মিষ্টি দাম্পত্য প্রেম। সেটা যদিও গল্পে ছিল না, তাও মন্দ লাগেনি দেখতে। কিন্তু স্যার বিশ্বাস করুন আর নেওয়া যাচ্ছে না। সোহিনী সরকার আমার অত্যন্ত প্রিয় অভিনেত্রী, কিন্তু ঐ আদুরে আদিখ্যেতা আর স্ফুরিত অধর মার্কা প্রেম স্রেফ বিবমিষা জাগায়। ব্যোমকেশ আর সত্যবতীর এতখানি অধঃপতন একজন শরদ্বিন্দু ভক্ত হিসেবে মেনে নিতে পারছি না। যাইহোক গল্প এগোয় শম্বুকগতিতে ব্যোমকেশ এবং অজিত সান্তালগোলায় গিয়ে হাজির হয়, সাথে সত্যবতীও যায়। সেখানে গিয়ে দিব্যি বোরলি মাছ, টাটকা সব্জি, কচি পাঁঠা, পোলাও ইত্যাদি কেনা, রান্না, খাওয়া, গান গাওয়া চলতে থাকে। অমৃতের মৃত্যু ঘটে, আমায় শৌভিক ফিসফিস করে আশ্বস্ত করে, ‘এবার গল্প গতি নেবে দেখ’। কচু পোড়া। সদানন্দ শুর মারা যান। সত্যবতীর সাথে সখ্য জমে ওঠে বিশ্বনাথ মল্লিক রুপী কৌশিক সেনের ঝিঙ্কু গিন্নী জুন মালিয়ার। ক্লাব পার্টি, পিকনিক, আদিবাসী নাচের তালে কোমরও দুলিয়ে নেয় দুজনে। রাগে গজগজ করতে থাকি আমি। গল্প আরও এগোয়, সদানন্দ শুর সম্পর্কে খোঁজ নিতে কোলকাতার লালবাতি এলাকায় এসে সরোজ খানের কোরিওগ্রাফিতে সায়ন্তিকার কোমর দোলান মুজরা হয়, রেস কোর্সের আস্তাবলে গিয়ে জনৈক বুকির সাথে আরেক প্রস্ত ঝাড়পিঠ করে অবশেষে ক্লাইম্যাক্সে প্রভূত মারামারি করে ভিলেনকে পাকড়াও করে ব্যোমকেশ। এবং বেআইনি অস্ত্রব্যবসায়ী ভিলেন পুলিশের ভ্যানে ওঠার আগে এক প্রস্ত জ্বালাময়ী বক্তৃতাও দেয়, “আমাদের লড়াই চলতেই থাকবে। এ আজাদি ঝুটা হ্যায়” ইত্যাদি বলে। হল থেকে বেরিয়ে বিশ্বাস করুন কান্না পাচ্ছিল, এতো বাজে সিনেমা দেখব বলে, এই শীতে লেপের আদর ত্যাগ করে দৌড়ে দৌড়ে এলাম? যেমন খারাপ নির্দেশনা, তেমনি খারাপ অভিনয়। সুমন্ত মুখোপাধ্যায় আর ঋত্বিক চক্রবর্তী ছাড়া আর কারো অভিনয় বিন্দুমাত্র দাগ কাটে না। এর থেকে হরিপদ ব্যান্ডওয়ালা দেখলে খুব খারাপ হত না বোধহয়।

  দ্বিতীয় ছবিটি ছিল ডবল ফেলুদা। দুটি গল্প সমাদ্দারের চাবি এবং গোলকধাম রহস্য।যেমন টানটান গল্প, তেমনি অসাধারণ চরিত্রচিত্রণ তথা নির্দেশনা। নাম দেখানোর সময় থেকেই দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। আর সাথে সত্যজিৎ রায়ের সেই বিখ্যাত মিউজিক। কিছু লেখার নেই। সমালোচনা করার কোন জায়গাই রাখেননি সন্দীপ রায়। বহুদিন বাদে সব্যসাচী চক্রবর্তীকে আবার ফেলুদা হিসাবে পেলাম। একটু বয়স্ক বটে, তবে অভিনয়ের গুণে তা ঢাকা পড়ে গেছে। শুধু ফেলু মিত্তিরের ভুঁড়িটা কিছুতেই চাপা দেওয়া যায়নি। তবে এত ভাল সিনেমায় ঐ টুকু ত্রুটি মার্জনীয়, অন্তত কারো ভুঁড়ি নিয়ে আমি তো কিছু বলতেই পারি না বাবা। সন্দীপ রায়কে অসংখ্য ধন্যবাদ বর্ষ শেষে এত ভাল একটা সিনেমা উপহার দেবার জন্য।

Sunday 4 December 2016

স্বপ্ন ২


স্বপ্ন দেখলাম, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। না মিত্র-শ্ত্রু পক্ষ মার্কা কিছু পশ্চাৎপক্ক দেশের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা নয়।  আইসিস মার্কা কোন উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির সাথে তথাকথিত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন প্রথম বিশ্বের  মানবতা রক্ষার সংঘাত ও নয়। এ এমন এক যুদ্ধ, যা প্রতিনিয়ত মানবজাতিকে অবলুপ্তির দিকে এক ধাপ করে এগিয়ে দিচ্ছে। কতদিন কোন নবজাত শিশুর কান্না ধ্বনিত হয়নি এই ধরায়। ধরা আজ দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত। একদিকে আমাদের মত মুষ্টিমেয় আশাবাদী মানব সন্তান, যাদের না আছে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা, না কোন মিলিটারি ট্রেনিং। আছে শুধু মনের জোর। আমরা রোজ লড়ি বা, বলা ভাল লড়ার চেষ্টা করি। হারি-জিতি যাই হোক আমরা আশা ছাড়ি না, আমাদের নেতা বলেন, “ যেদিন আমরা আশা ত্যাগ করব, সেদিনটি হবে পৃথিবীতে মানব প্রজাতির অন্তিম দিন।” আমাদের নেতা কোন আর্মি জেনারেল নন। বরং এক ক্ষীণকায়, খর্বাকৃতি, মুণ্ডিতমস্তক, খেটো ধুতি পড়া ন্যুব্জ বৃদ্ধ। গুজরাটের কোন জঙ্গুলে উপজাতির সর্দার ছিলেন এককালে। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষাও জানেন না। চোখে গোল চশমা, যার একটি ডাঁটি ভাঙ্গা, দড়ি দিয়ে কানের পিছনে আটকানো। আমরা আদর করে ডাকি “বাপুজি” বলে।
আমি এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর একজন উদ্ধারক। প্রত্যহ সকালে, বাপুজির নির্দেশ মোতাবেক আমার উদ্ধারকরা ছড়িয়ে পড়ি, পৃথিবীর না না প্রান্তে, যেদিন যেখানে শত্রুপক্ষের হামলা হতে পারে, তার আগাম আভাষ পেয়ে জান বাপুজি। আমরা টেলিপোর্টেশন মারফৎ সেখানে পৌঁছে, সেখানকার জনগণকে নিরাপদে আমাদের এই ক্ষুদ্র ক্যাম্পে নিয়ে আসি। কিন্তু এই ক্যাম্প ও বেশিদিন নিরাপদ থাকে না, ফলে এক্সোডাসের মত, প্রায়ই বাপুজির পিছু পিছু শিবির ত্যাগ করি আমরা। গড়ে তুলি কোন নতুন কলোনি। এই প্রায় যাযাবর জীবনযাপনের ফলে খাদ্যের বড় অভাব আমাদের। যাই হোক আজ সকালেও অপেক্ষা করছিলাম আমার গন্তব্য সংক্রান্ত নির্দেশাবলীর জন্য, আচমকা আমাকে জানানো হল, বাপুজি আমায় ডেকেছেন। চমকে উঠলাম, এক নিতান্ত মামুলী উদ্ধারক আমি। এক- দুই জনের বেশি কাউকে টেলিপোর্ট করার ক্ষমতা আমার নেই। বাপুজি কেন আমার সাথে দেখা করতে চান? আমার মত পৃথুলা, অবলা নারীকেও এই কাজ করতে হচ্ছে, কারণ সমর্থ পুরুষ বা সবলা নারীদের আগেই দখল করে নিয়েছে শত্রুপক্ষ। ভাবতে ভাবতে কখন যে বাপুজির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি খেয়াল করিনি। বাপুজি একটা বড় গাছের তলায় ছেঁড়া আসন পেতে ধ্যান করছিলেন, আমাকে দেখে হেসে নিজের ভাষায় কিছু বললেন, যা আমি আমার মাতৃভাষায় স্পষ্ট শুনতে পেলাম, আমার মাথার মধ্যে। উনি বলছেন, “নিজেকে দয়া করা, মানুষের সবথেকে প্রিয় চিত্তবিনোদন।” জিভ কাটলাম। বাপুজি যে মনের কথা পড়তে পারেন তা ভুলে গেছিলাম।
বাপুজি গলা ঝেড়ে বললেন, “বাংলাদেশে আজ হামলা হবে রে মা।” বাংলাদেশে? মানে কোথায়? ওদিকে তো আজকাল হামলা হয় না। এই রে বাকি উদ্ধারকরা তো বেরিয়ে গেল। বাপুজি বললেন, “ তোমাদের ঐ সব দেশ সীমানা আমি বুঝি না। তোমাদের মহল্লায় হামলা হবে।” মাথাটা টলে গেল। আমাদের মহল্লা? বাবা-মা-তুত্তুরী? আমাদের মহল্লায় এর আগেও একবার হামলা হতে পারে বলে সতর্ক করেছিলেন বাপুজি। আমরা উদ্ধারকরা সকলকে না পারলেও বেশ কিছু মানুষকে নিরাপদে টেলিপোর্ট করতে পেরেছিলাম। তাদের মধ্যে  বাবা-মা-তুত্তুরীও ছিল। ওরা এখানে আমাদের সাথেই ছিল বেশ কিছুদিন। তারপর বাবা উসখুস করতে লাগল। নিজের পিতৃপুরুষের ভিটে, বাবার ঠাকুমা, কাকা, পিসি আমার দাদু-ঠাকুমা,জেঠু, কাকু, পিসির স্মৃতিবিজড়িত। মায়ের বউ হয়ে আসা, আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, বিয়ে, তুত্তুরীর জন্ম, শৈশবের লীলাক্ষেত্র। বাবার প্রাণ কাঁদত ঐ ভিটার জন্য। বাপুজির সাথে ব্যাপক দোস্তি হয়ে গিয়েছিল বাবার। বাপুজির অনুমতি নিয়ে একদিন ফিরে গেল ঐ ভিটেয়। সঙ্গে মা আর তুত্তুরীও। বাবাকে ছেড়ে মা থাকবে না, আর মাকে ছেড়ে তুত্তুরী। আমি তখন উদ্ধারকার্যে ব্যস্ত অন্যত্র। ফিরে এসে প্রবল রাগারাগি করেছিলাম। তারপর মেনে নিলাম। আমাদের ভাঙাচোরা জনমানবহীন শহরে বেশ জমে উঠেছিল ওদের লালনীল সংসার। মাঝে মাঝে আমিও যাই।
শুধু ওদের জন্য আমাদের মহল্লায় হামলা করবে? আমার চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ছে। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। আর একজন উদ্ধারক নেই। আমি একা তিনজনকে আনতে পারব না। কি করি? বাপুজির নির্দেশে ঈশ্বরকে ডাকার পুরানো অভ্যাস ছেড়েছি বহুদিন। বাপুজির মতে ঈশ্বর বড় বিভেদের জন্ম দেয়। মন স্থির করতে না পারলে আমিও পৌছতে পারব না। দরকার হলে তিনবার যাব, আগে তো পৌঁছই।
নীরব জনহীন শহরে, শুধু আমাদের বাড়ি থেকেই প্রবল কলরোল ভেসে আসছে। মা আর তুত্তুরী খাবার নিয়ে কোস্তাকুস্তি করছে। অন্যদিন হলে মাথায় আগুন জ্বলত, যেখানে কেউ পেট ভরে খায় না, সেখানে আমার কন্যা খাওয়া নিয়ে নখরা করছে? আজ প্রবল কান্না পেল। মা আমাকে দেখে খুশি হতে গিয়েও থমকে গেল, “কি রে?” গলায়  ব্যথা ঝেড়ে বললাম, “বাবা কোথায়? এখুনি যেতে হবে।” তুত্তুরী দৌড়ল ভিতরে, “দাদুউউউউউউ। মা ডাকছে।” বাবা সিগারেট লুকোতে লুকোতে দৌড়ে এল, কোথায় পায় কে জানে? আমি কিছু বলার আগেই সদর দরজার অদূরে এসে দাঁড়ালো একটা ট্যাঙ্ক। সারি দিয়ে নামতে লাগল, শত্রু সৈন্যের দল। ভাবলেশহীন রোবটের দল। কোন এককালে আমাদের মত মানুষই ছিল। আজ আর তার কোন অনুভূতিই অবশিষ্ট নেই। ওদের নেতার নির্দেশ মোতাবেক শিকার ধরে নিয়ে যায় ওরা। ওদের কাছে কোন শস্ত্র থাকে না। ট্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এল, ওদের নেতা। এতদিন শুধু গুজব শুনেছি, আজ দেখলাম। নারী না পুরুষ বুঝলাম না। কালো চকচকে ট্রেঞ্চ কোট আর কালো প্যান্ট পরা। শ্বেতাঙ্গ। মাথায় কালো চুল, প্রায় কোমর অবধি। কপাল ঢাকা চূর্ণ কুন্তলে। আমরা চারজনেই আঁতকে উঠলাম চোখ দুটি দেখে। চোখ পুরো সাদা। কোন মণি নেই।
শোনা যায়, এই চোখ দিয়েই নাকি মানুষের আত্মা শোষণ করে নেয়। মানুষটা বেঁচে থাকে, কিন্তু তার মধ্যে কোন ক্ষুধা তৃষ্ণা, সুখ, দুঃখ, ভালবাসা, ব্যথা বেদনার অনুভূতি থাকে না। জড় পদার্থ রোবটে পরিণত হয় মানুষ। রোবটের মত ওনার হুকুম তামিল করে, তারপর একদিন অনাহারে, জলশূন্যতায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঁ বসে বসে মরে যায়। পৃথিবীর অর্ধেকের ওপর জনসংখ্যা এভাবেই শেষ হয়ে গেছে। এবার আমাদের পালা।

কি করি? আমি কি করি? তিনজনকে এক সাথে তো নিয়ে যেতে পারব না। আর ফিরে আসার অবকাশ ওরা আমায় দেবে না।  বাবা সিগারেট ছুড়ে ফেলে বলল, “তুত্তুরী। ওকে বাঁচা।” মেয়েকে বাঁচাব বলে বাবা-মাকে মৃত্যুর মুখে ছেড়ে চলে যাব? পারছি না। কেঁদেই যাচ্ছি। মায়ের মায়া মাখানো মুখ, ছলছল চোখ, বাবার মুখের সিগারেটের গন্ধ আর তুত্তুরীর গা থেকে ভেসে আসা দুধের গন্ধ। এদের বিনিময়ে আমি মরতে রাজি আছি। কিন্তু প্রাণ থাকতে আমি পারব না। “আঃ। তুত্তুরুকে বাঁচা”। বাবা চিৎকার করে উঠল। আমি কেঁদেই যাচ্ছি। বাবা এগিয়ে এসে আমার কাঁধ ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকাতে লাগল, চোখ খুলে দেখি, শৌভিক ঠেলছে, “কাঁদছিস কেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে? এই? কি হল?” কাহিনীর এই অংশটার কথা তো ভুলেই গেছিলাম। উদ্ধারক এসে গেছে। আর চিন্তা নেই। J

Monday 14 November 2016

শুভরাত্রি


ঘরে ঢুকেই দেখলেন মানিনী একগাল হেসে ওনার দিকে তাকিয়ে আছেন। চট করে মাথাটা গরম হয়ে গেল রামদুলাল বাবুর। রাগে গরগর করতে করতে বললেন “সব সময় দাঁত কেলিয়েই আছেন।”মানিনীর হাসি তো কমলই না, উল্টে বোধহয় বেড়েই গেল। কৌতুকের সুরে বললেন, “ কার রাগ কার ওপর ঝাড়ছ শুনি? মেয়ে ফোন করেনি বলে এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? কোনদিন করে না?” “কোনদিন করে না?” ভেঙিয়ে উঠলেন রামদুলাল বাবু। “বুঁচু জানে যে বাবা রাত এগারোটায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ে-।” কথা শেষ করতে পারলেন না, তার আগেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন মানিনী দেবী, “বুঁচু? ইশ। ফের যদি ঐ ঘেটো নামে ডেকেছ।” “বেশ করব। বেশ করব” গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন রামদুলাল বাবু। “ আমি ঘটি। আমার মেয়েও ঘটি। কি আমার বাঙাল এলেন রে? এ দেশে জন্ম কম্ম, শিক্ষা দীক্ষা চাকরি, আর বলার বেলায় ‘আমাগো দ্যাশ’? যাও না। যাও- তোমাগো দ্যাশে গিয়ে থাকো। যদি পারো তো আমি কান কেটে ফেলে দেব। বিয়ের সময় মা বলেছিল, ‘রামু বাবা তুই আর মেয়ে পেলি না? একে বাঙাল তায় চাকরী করে। তার ওপর আবার জাতে সুঁড়ি।”
“ওরে আমার কুলীন কায়েৎ রে। আমার বাবাও বলেছিল, ‘ মানু, এত কষ্ট করে তোদের দুই বোনকে বড় করলাম, লেখাপড়া শেখালাম। তোরা  দুজনেই নিজ চেষ্টায় সরকারি চাকরীও জোটালি। আর শেষে কিনা রামদুলালকে বিয়ে করবি? কোন অংশে ও তোর সমকক্ষ বল দেখি? সারা জীবন তুই ফার্স্ট হলে ও এক থেকে দশের মধ্যেও আসতে পারত না। দিদির বর সেইলের কর্মচারী আর তোর বর মামুলী রাজ্য সরকারী কেরানী। এতো দেখছি তোর সংসারও আমায়ই টানতে হবে।”
“তোমার বাপটা একটা রাম ঢ্যামনা ছিল। শালা মালের দোকানের পয়সা অথচ কোনদিন এক বোতল মাল ও দেয়নি।” হাত ঝেড়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বললেন রামদুলাল বাবু। মানিনী কোমরে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বললেন, “ হাঁ। তাই তো। আমার বাপ ঢ্যামনাই হোক আর যাই হোক, তোমার মায়ের মত বিষধর নয়। ভুলে যেও না, রাকার জন্য যা করার আমার মা-বাবাই করেছে। তোমার মা-বোনের টিকিটিও দেখা যায়নি। ঐ দুর্দিনে মা-বাবা যদি রাকাকে নিজেদের কাছে না নিয়ে গিয়ে রাখত, রাকা বাঁচত? বুকে হাত দিয়ে বল দেখি?” রামদুলাল বাবু গলা ঝেড়ে, রণে ভঙ্গ দেবার গলায় বললেন, “ সেতো আয়াও ছিল বাবা।” “আয়া?” হিসহিসিয়ে উঠলেন মানিনী, “আয়া তো এখানেও ছিল রাম। তোমার মা কি বলেছিলেন মনে আছে? এতটুকু বাচ্ছার দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। আমার বাবা-মাও যদি তাই বলত? কি করতাম আমরা? বাবা তো ঐ জন্যই বলত, সব দায়দায়িত্ব যখন আমাদেরই, তখন, মেয়েটার নামটাও পাল্টে রাকা বসু থেকে রাকা সাহা করে দিলেই তো হয়। আসলে কি জানো তো, নাতিনাতনির ক্ষেত্রে মেয়ের বাবা-মায়েদের সব সময়ই মনে হয়, এটা আমার সন্তানের সন্তান, আর ছেলের বাবা-মায়ের মনে হয় এটা বউমার বাচ্ছা। হুঃ”
ঝগড়ার প্রাথমিক পর্ব মানিনীই জিতছেন, বুঝতে পেরে, অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলেন রামদুলাল বাবু, ধরা ধরা গলায় বললেন, “ সে যাই হোক, সাড়ে এগারোটা বাজে, বু ইয়ে মানে রাকা এখনও কল করল না। বিয়ের পর মেয়েরা সত্যি পর হয়ে যায়।” “হাঃ।” শাণিত ছুরির মত মানিনী বলে উঠলেন, “তোমার মা তো উল্টোটাই বলেন-। ছেলে নাকি বউ অন্ত প্রাণ।”

গাঢ় গলায় রামদুলাল বাবু বলে উঠলেন, “সেটা কি খুব ভুল বলে? আমার জীবনের চার নারী, মা-দিদি-তুমি আর রাকার মধ্যে যে আমি তোমাকেই সবথেকে বেশি ভালোবাসি তা কি আর কোন প্রমাণের অপেক্ষা রাখে?” মানিনী কিছু বললেন না, কৃষ্ণবর্ণ গালে কি অপরূপ আলতার ছোপ ফুটে উঠল, আজ এত বছর পরেও। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন রামদুলাল বাবু তাঁর সাতাশ বছরের পুরানো স্ত্রীর দিকে। তির্যক কটাক্ষে মানিনী বললেন, “ যত বয়স বাড়ছে, বুড়োর ঢলানিও ততো বাড়ছে।” রামদুলাল বাবু হেসে বললেন, “কত বছর কেটে গেল মানু। আমরা বুড়ো হয়ে গেলাম।” মানিনী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন,”তুমি বুড়ো হয়েছ, আমি নই।” সত্যি তো মানিনী বুড়ো হননি, এখনও কোমর ছাপানো এক মাথা ঘন কালো চুল, মুক্তোর মত ঝকঝকে দাঁত, সরু হিলহিলে কোমর, টানাটানা দুটি আয়ত চক্ষু রামদুলাল বাবুর আদরিনী স্ত্রী। রামদুলাল বাবু বললেন, “মানু, আমরা দুজনেই চেয়েছিলাম, জানতাম ও যে মেয়ে হবে। মেয়েই হবে। তোমার সেই ফোলা পেটে হাত রেখে তখনও আমরা ঝগড়া করতাম, আমি বলতাম ওর নাম হবে বুঁচু আর তুমি বলতে কক্ষনও নয় ওর নাম রাকা। সবই হল মানু। শুধু...”। কথা শেষ করতে পারলেন না, ফোনটা বেজে উঠল, “হ্যালো বাবা?” রাকার ফোন, রামদুলাল বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “এত ক্ষণে বুড়ো বাপকে মনে পড়ল?” রাকা হাসি চেপে বলল, “সরি বাবা। মিটিং ছিল। এই শেষ হল। শেষ হতেই হল থেকে বেড়িয়ে তোমায় কল করছি। চিন্তা কোরনা, মহাবীর গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে, আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবে বলে। আর রাতের ব্যাঙ্গালোর অনেক সেফ, তোমাদের কলকাতার মত নয়। আর আমার বর তো আমার সঙ্গেই আছে।” “হু। সাবধানে ফিরিস। আমি জেগেই রইলাম। বাড়ি ফিরে ফোন করিস।” অধৈর্য গলায় রাকা বলে উঠল, “ মেসেজ করে দেব বাবা। নাউ বি আ গুড বয়, ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়। মায়ের ছবির সাথে আর গল্প করতে বস না। প্লিজ বাবা। ইউ নিড আ লাইফ। পচিশ বছর ধরে একটা মৃত মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে বেঁচে আছ। আর কত দিন? মেনে নাও বাবা। শি ইজ নো মোর। মা নেই। কোথাও নেই...। শুভরাত্রি বাবা।” 

https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

Saturday 12 November 2016

স্বপ্ন



স্বপ্ন দেখলাম, পালিয়ে বেড়াচ্ছি।  কার ভয়ে? ইংরেজদের নাকি মুঘলদের জানি না।  আমি একা নই।  রাজা নাকি বাদশাহ জানি না, লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সপরিবারে সাথে কেবল একদল বিশ্বস্ত সৈনিক আর স্বল্প সংখ্যক পরিচারক পরিচারিকার দল। রাজার মাথায় বিঁড়ের মত রাজ উষ্ণীষ ঠিক যেমন টিপু সুলতান পড়ত।রাজা ঠিক লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন না উনি লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন সেই সর্বশক্তিমান সাম্রাজ্যবাদী প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির বিরুদ্ধে ।  সারা দেশ যার কাছে মাথা নত করেছে এক তুচ্ছ রাজার সাধ্য কি তার সাথে লড়ে? পরিণতি অবোধগম্য নয়। রাজা হারছেন বারবার।  আপাততঃ নতুন বাহিনী  গড়ে তোলার মত রসদ রাজার নেই।  তাই কিছুটা মনখারাপ সকলের।  রাজার এক পুত্র। হতে পারে এইটি সদ্য সাবালক হয়েছে বাকি গুলি এখনও দুগ্ধপোষ্য। রণক্লান্ত সেপাহি এবং পালিয়ে বেড়ানো পরিজনদের মনে আনন্দ দেবার জন্য রাজা হঠাৎ  ঘোষণা করলেন পুত্রের বিবাহ দেবেন। পাত্রী কৈ? পাত্রী ঐ ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতেই মওজুৎ আছে, নাম “তারা”।  তারা মূলতঃ রাণীমার ঘর এবং হেঁসেল সামলায়। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত চঞ্চলা কিশোরী। তারা মত সাধারণ কূলশীলের মেয়ের সাথে নিজ পুত্রের বিবাহ দিতে রাণীমার কিঞ্চিৎ  আপত্তি ছিল। তাছাড়া তারা বয়সেও একটু বড়। প্রায়ই রাণীমার অগোচরে ধমকধামক দেয় রাজপুত্রকে ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া না করলে বা জিনিসপত্র অগোছালো  করে রাখলে। যদিও সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা বড়কুমারের জগৎই তো তারাময়। মহল ছেড়ে যেদিন পালাতে হয়েছিল কুমার সেদিন নিজের পাদুকা নিজে পড়তে জানত না।  চতুর্দিকে পালাও পালাও রব।  সব ছুটে পালাচ্ছে, রাজা এবং রাণী পর্যায়ক্রমে কোষাগার এবং শিশু কুমার কুমারীদের সামলাতে ব্যস্ত। বাকি বিশ্বস্ত দাসদাসীরা ঘোড়া হাতি তথা অন্যান্য গৃহস্থালি সামলাতে ব্যস্ত।  কেউ কেউ সুযোগ বুঝে কিছু হাতিয়ে পালাতে ব্যস্ত কিন্তু কেউ বড় কুমারের খোঁজ নিচ্ছে না।  বড়কুমার অস্থির হয়ে পায়ে পা ঘষে চলেছে পায়ের সামনেই হীরক খচিত পাকুদাদ্বয় ব্যগ্র ভাবে কুমারের প্রতিক্ষারত। কিন্তু আজন্মলালিত অভ্যাস কেউ স্বহস্তে  ঐ জুতা রাজকুমারকে না পরিয়ে দিলে সে পরে কেমনে। দূরে বিজয়ীশক্তির পদধ্বনি ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কুমার কি করে? এমন সময় দৌড়ে এল তারা, কোমরে হাত দিয়ে বলল, “যা ভেবেছি।  নিজের পাদুকা নিজে পরা অভ্যেস কর সোনা। ঝুঁকে হাত দিয়ে পায়ের কাছে টেনে নাও আর পা গলাও। দিন পাল্টাচ্ছে সোনা।  নিজেকে না বদলাতে পারলে পচে মরবে। ” চোখ বন্ধ করে তারার নির্দেশ পালন করেছিল কুমার।  এমন কিছু খারাপ লাগেনি তো। বংশের মাথানত হয়েছিল বলেও মনে হয়নি।
আর সেবার? সদ্য যুদ্ধে যাবে কুমার। জীবনের প্রথম যুদ্ধ তাও সেই সর্বশক্তিমান সাম্রাজ্যবাদী প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির বিরুদ্ধে ।  যুদ্ধ বিদ্যার পাঠ অসমাপ্ত রেখেই পালিয়ে আসতে হয়েছিল রাজ্যপাট ছেড়ে। শিবিরে নিয়মিত অস্ত্রবিদ্যার অনুশীলন তো হয় কিন্তু লড়াই করার মানসিকতাই যে নেই কুমারের। কুমার ভালবাসে চাঁদনী রাতে বাঁশি বাজাতে, ভালবাসে উদ্দেশ্যহীনভাবে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে। কাঁচা সোনা রোদে মাঠে শুয়ে নীল  আকাশে সাদা মেঘের কারিকুরী দেখতে। ভালবাসে তারার বকুনি  খেতে। ভালবাসে ছোট ছোট ভাইবোনের সাথে অহেতুক  খুনসুটি করতে। যুদ্ধ, হত্যা,রক্তপাত সইতে পারে না কুমার। তারা বর্ম পরাচ্ছিল এক্ষুণি রাণীমা আসবেন বরণ করতে রক্ততিলক পরাতে। আচমকা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল কুমার। পারবে না, কুমার পারবে না লড়াই করতে।  স্নেহময়ী ধাত্রীর মত কুমারের অশ্রুসিক্ত গালে চকাস করে একটা চুমু খেল তারা। তারপর বলল,“ দেখে নাও কি ভাবে বর্ম বাঁধছি। যদি দেখ পরাস্ত হতে চলেছ, সোজা বর্ম খুলে উষ্ণীষ খুলে এক খাবলা মাটি মুখে হাতে ঘষে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেও। মিশে যেও সাধারণ মানুষের ভিড়ে।” কুমার শিউরে উঠে বলল,“ তারা তুই আমায় রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাতে বলছিস? তাহলে তো সবাই আমায় কাপুরুষ বলবে?” তারা ফোৎ করে একটা বিদ্রুপাত্মক শ্বাস ছেড়ে বলল,“ বলুক গা।  ওরা ভারি বীর পুরুষরে। তোমার বাবার ওপর শত্রুপক্ষের  সাংঘাতিক রাগ। আসমুদ্রহিমাচলে একমাত্র আমাদের রাজামশাই ই ওদের বশ্যতাস্বীকার  করেনি। আমাদের রাজামশাইকে লুকিয়ে লুকিয়ে গোটা দেশ মান্যিগণ্যি করে। তলায় তলায় বহুলোক প্রস্তুত হচ্ছে ওদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য। তোমাকে যদি ওরা একবার পায় কি হবে বুঝতে পারছ? চোখ গেলে দেবে, জিয়ন্ত গায়ের চামড়া খুলে নেবে, ফুটন্ত  তেল ঢেলে দেবে গায়ে। যদি দেখ না পালাতে পারছ ঐ তরোয়াল দিয়ে নিজের গলা নিজে কেটে ফেল তবু ঐ শকুন গুলোর হাতে ধরা পড় না। ”

তারাকে বিয়ে করতে একফোঁটাও আপত্তি ছিল না কুমারের। বিয়ের দিন লুকানো শিবিরে সীমিত  সামর্থ্যের  মধ্যে এলাহি ব্যবস্থা করলেন রাজাজী। বাইরের নিমন্ত্রিত বলতে শুধু দুজন। একজন বড় রাজামশাই, আমাদের রাজার দাদা। শত্রুপক্ষের প্রিয়পাত্র। ওণার রাজ্য শত্রুপক্ষই চালায়, উনি সুরা এবং নারীতে মত্ত। শত্রুপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে মাত্র গোটা পনেরো দেহরক্ষী নিয়ে উনি কি করে এসেছেন জানি না। বিশাল মোটা ঘোড়ায় চাপলে বেচারা ঘোড়া না দেহরক্ষা করে। আর দ্বিতীয় নিমন্ত্রিতা হলেন রাণী পিসিমা।  রাজা মশাইয়ের একমাত্র ভগিনী । ওণার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে শত্রুপক্ষের রীতিমত দহরমমহরম চলে। রাজামশাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওনাদের পরিবার প্রতিবার শত্রুপক্ষের দল ভারী করে। উনি এসেছেন মাত্র চারজন সখী তথা দেহরক্ষীণীকে নিয়ে। এককথায় উনি অপরূপা।  দুধের সরের মত গাত্রবর্ণ । শাঁখের মত টানাটানা দুটি চোখ।  আধেক শুকনো গোলাপ পাপড়ির মত দুটি ঠোঁট। বিধবা তাই পরণে একটিও গহণা নেই।  শুধু দুধসাদা মখমলী শারারা আর মাথায় ওড়ণা যা উর্ধাঙ্গকে ও আবৃত করে রেখেছে।

বিবাহ শুরু হল। তারাকে স্বল্প অলংকারে সাজানো হয়েছে।  বেশ সাধারণ দর্শনা তারা, বিশেষত রাণী পিসি বা আমাদের রাণীমার কাছে। হোক তবু বিয়ের কনে হিসাবে ঝলমল করছে আমাদের তারা। বিয়ের রীতি অনুসারে বড় রাজা অর্থাৎ কুমারের জেঠামশাই একটা হীরকখচিত সোনার টিকুলি পরিয়ে দিলেন তারার মাথায়। বংশের জেষ্ঠ পুত্রবধুর প্রাপ্য ঐটি। জেঠা রাজার কোন ছেলে নেই। তারাই বড় বউ। রাণী পিসি এসে শিরচুম্বন করলেন।নিজের গলা থেকে সাতছড়া হীরের ঝাপটা খুলে পরিয়ে দিলেন তারার গলায়। ভারি হারে একটু কি কুঁজো হয়ে গেল তারা? বীণার মত মিষ্ট সুললিত  স্বরে রাণী পিসি বললেন,“ তোমরা বংশ পরম্পরায় আমাদের সেবা করে আসছ। আশা করব আমাদের কুলতিলকের কোন রকম অযত্ন হবে না। প্রাণ দিয়েও ওকে রক্ষা কর তারা। ”
শুরু হল উৎসব। যে যা পারল তারাকে উপহার দিল। বেশির ভাগই শুভকামনা জানালো। পালিয়ে বেড়ানো লোকজনের দেবার মত কি বা আছে? যেমন আমি। আমি রান্নাঘরে তারার সহযোগী । তারা বাটনা বাটে আমি শিল ধুই। তারা রান্না করে আমি উনুন নিকোই। আজ কেন জানি না প্রচণ্ড  কান্না পাচ্ছে, কান্নার দমক চাপতে গিয়ে থরথর করে কাঁপছি। এবার আমার পালা নববধূকে উপহার বা শুভকামনা জানানোর। তারার কাছে গিয়ে আর চাপতে পারলাম না।  কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “ তুমি জানো তো? আমরা কেউ বাঁচব না।” তারা স্বভাবসিদ্ধ হেসে বলল,“জানি। তাই বলে বাঁচব না?”
#Aninditasblog
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

মধ্যরাতে গড়ের মাঠে



- এতরাত্রে? একা?
- তাতে তোমার কি? যতঃ গায়ে পড়া পাবলিক।
-নাঃ আমার আর কি? ( কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধতার পর) তা হয়েছেটা কি? ব্যর্থ প্রেম নাকি খারাপ রেজাল্ট?
-উফ্ ভগবান।  ( উঠে স্থানবদল)
- কি? ব্যর্থ প্রেম না খারাপ রেজাল্ট?
- সেই আমার পিছন পিছন ?এখানেও এসে জুটেছো? এবার কিন্তু আমি পুলিশ ডাকব বলে দিলাম। তুমি বোধহয় জানো না আমি ক্যারাটে তে ব্ল্যাকবেল্ট।
- বাঃ। তা এত রাত্রে গড়ের মাঠে কেন?ব্যর্থ প্রেম নাকি খারাপ রেজাল্ট?
- আরে বাপরে!!!! ছিনে জোঁক।  দেখ ভাই আই অ্যাম নট ফিলিং ওয়েল।  গিভ মি সাম স্পেস অর আইল বিট দা  শিট আউটা ইউ।
 --এত ইংরাজি বুঝি না বাপু। ইংরেজি গোটাটাই গোবিন্দর দেখে টুকেছিলুম । সে ব্যাটাচ্ছেলে ফেল করে গেল আর আমি করেগেলুম পাশ। জানো গোটা মহল্লায় কেবল আমিই পাশ দিয়েছিলুম।  গোটা মহল্লায় বাবাঃ হুঁ।
-ওক্কে।  গ্লাড টু নো দ্যাট স্যার্। নাউ প্লিজ লিভ মি এলোন।
- ব্যর্থ প্রেম নাকি খারাপ রেজাল্ট? আমার রেজাল্ট ভালো হওয়া সত্ত্বেত্ত, পাশ করা সত্ত্বেত্ত  মা বলল,’ বিনয় বাবা চাকরী খোঁজ।  দেখচিস তো, তোর বাপের শারীরিক  অবস্তা কি করে আগে পরাব বলদিনি? দু দুটো সমর্থ বোন বাড়িতে বসে। ’ এত রাগ হল।  বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এলুম এই গড়ের মাঠে। ঘণ অন্ধকারে বসে রইলুম কতক্ষণ। খুব মনে পড়ছিল মায়ের কথা। কি সোন্দর দেখতে ছিল মা।  আর খেটে খেটে কি হয়ে গেছে।  আর পুঁটু আর ফুলি আমার দুই বোন ঠিক যেন ডল পুতুল গো। আর আমার পঙ্গু বাপ।  কতবার মনে হল ফিরে যাই।  কিন্তু তীব্র অভিমান পথ আটকালো।  পড়তে দেবে না?   আমায়? যাঃ। চাই না পড়তে। চাই না বাঁচতে। ঝুলে পড়লাম গলায় ধুতি জড়িয়ে।  ঐখানে একটা তেঁতুল গাছ ছিল জানো ঐটাতে-
-ওঃ গস্।  প্লিজ ম্যান আয়াম স্কেয়ার্ড।
- ব্যর্থ প্রেম নাকি খারাপ রেজাল্ট? আমার কথা শোনো বাড়ি ফিরে যাও।  মরার পর বুঝেছিলুম কি ভুল করলুম। আমার শোক বাবা নিতে পারেনি। পনেরোদিনের মধ্যেই বাবাও--।  মা দুই সমত্থ মেয়েকে কতদিন আগলাবে? ৪৬ এর রায়টে ছোটটাকে তুলে নিয়ে গেল মোছলমানেরা।
-রায়ট? কি যা তা বলছেন? ১৩৪৬? ১৪৪৬-- ইংরেজি মতে কোন সাল? কলকাতায় তো কোন রায়ট হয় নি।
-বুঝে গেছি ফেল করেছো।  তাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছো।  ১৪৪৬ আসতে এখনও ২৩ বছর বাকি আর ১৩৪৬  কেটে গেছে ৭৭ বছর আগে হুঁঃ।
- ওঃ। ১৯৪৬।  ঐ ডাইরেক্ট অ্যাকশান ডে, নোয়াখালি এন্ড অল দ্যাট।
- এন্ড অল দ্যাট- উফ।  যাক বাপু তোমার সাথে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।  তুমি ভালোয় ভালোয় বাড়ি যাও।  আর দেরি কোর না।  রাত  বাড়লেই ওরা এসে হাজির হয়।  ওরা আমায় ও ডরায় না। ছেলে মেয়ে বাছবিচার ও করে না।  যা পায় ছিঁড়ে খায়।
- এই আমার সত্যি ভয় করছে। একদিকে ওদের ভয় আর একদিকে আপনার আষাঢ়ে গপ্প।
- যাক আপনি বলতে জানো তোমরা। যা বলেছি একবর্ণও মিথ্যা নয়।  আমাদের ধর্মে বলে আত্মহত্যা মহাপাপ।  সে যে কতবড় পাপ যে ভুক্তভুগী সে ছাড়া কেউ বোঝে না। এই ভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছি আজ ৭২ বছর ধরে।  আমার কোথাও যাবার নেই।  কোন মুক্তি নেই। বিগত ৭০ বছরে তোমার মত কতজনকে এই পাপ থেকে বিরত করেছি তার ইয়ত্তা নেই। তবু আমার মুক্তি হয়নি। ( দীর্ঘ নীরবতার পর ধরা গলায়) বাড়ি ফিরে যাও।
- একা যেতে ভয়- ।  বাবা - মা খুব মারবে-
- কেউ কিছু বলবে না।  ফিরে যাও।  আর বললেও মা- বাবার মুখনিঃসৃত বাণী অমৃতবৎ।
- ( ক্যাব বুক করাবার জন্য মোবাইল  অন করল মেয়েটি।  তৎক্ষণাৎ ফোন) (কাঁপা কাঁপা গলায় ফোন ধরল মেয়েটি ) হ্যালো মা।
(আর কথা বলতে পারল না।  কাঁদতে লাগল। )
আমার ভুল হয়ে গেছে মা।  চরম ভুল হয়ে গেছে।  আমায় বাড়ি নিয়ে চল প্লিজ----

- মা বাবা আসছে আমায় নিতে।
-বলেছিলাম।  আমি আসি।
- শুনুন।  আপনার জন্য কিছু করতে পারি?
- এ কথা বহুবার শুনেছি।  কেউ কথা রাখেনা।  তবু যদি পার হাড়কাটা গলির ভিতরে একটা তিনতলা বাড়ি আছে। বিনু নিকেতন নামটা এখনও পড়া যায়। ওখানে বেবুশ্যেরা থাকে। বাড়ির বুড়ি মালকিনের বয়স ৮৫।  নাম সুললিতা দেবী। খুব অসুস্থ । বেশি দিন বাঁচবে না।  ওকে বলো, “ফুলিরে আমায় মাপ করে দিস। ”
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/