Friday 23 September 2016

অনির (পুজোর) ডাইরি ২০১৬, ২৩শে সেপ্টেম্বর

পুজোর ডাইরি, মানেই আনন্দ, উৎসব, হৈচৈ যেখানে শোক দুখের কোন বালাই নেই। এমনিতেও শোক দুঃখ আমার লেখায় খুব একটা পাবেন না, কারণ এই আননবই/ আমার ব্লগে আমি লিখি শুধু মাত্র  আনন্দ- হর্ষটুকু ভাগ করে নিতে, দুঃখ তো একান্তই ব্যক্তিগত। বেদনা ভাগ করা যায় না, সে চেষ্টাটুকুও যে কতখানি হাস্যকর, সেই প্রসঙ্গে একটা গল্প না বলে পারছি না, বছর পাঁচেক আগের কথা, আমার এক বন্ধু হঠাৎ ঠিক করল, অনেক হয়েছে, এবার বিয়ে করে ঘর সংসারী হতে হবে।বিয়ে তো করবে, কিন্তু করবে কাকে? পাত্র খুঁজতে হবে, খুঁজবে কে? কেন আমরা বাকি দুই বন্ধু আছি না। সুপাত্র অন্বেষণ শুরু হল, আমার দৌড় বলতে বাড়িতে শৌভিক আর অফিসে অঞ্জনদা, দুজনকেই বললাম, “ভাল ছেলে/ বন্ধু-বান্ধব থাকলে বলুন/বল।” শৌভিকের বেশ কিছু অবিবাহিত বন্ধু/ সহকর্মী ছিল বটে, কিন্তু আমার বর হাত উল্টে জানিয়ে দিল, “বিডিও গিরি অবধি হচ্ছে, বউয়ের বন্ধুর জন্য ঘটকালী আমার দ্বারা হবে না।” আমি ব্যর্থ হলেও আমাদেরই অপর এক বন্ধু বেশ কিছু সুসম্পর্ক তথা সুপাত্রর খবর জোগাড় করল। খবর পাবার পরের কাজ ছিল, সম্মিলিত ভাবে ফেসবুকে সেই ব্যক্তিটিকে খুঁজে বার করা, এবং তার ছবি, পোস্ট ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে তার সম্পর্কে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেওয়া। বেশ কয়েকজনকে নাকচ করার পর (বেচারারা জানেও না) একটি নব্য(?) সুবেশ যুবাকে সবার পছন্দ হল। বেশ সুদর্শন, নিয়মিত জীবনানন্দ, সুনীল, শক্তির কবিতা-টবিতা শেয়ার-টেয়ার করে, বেশ আঁতেল টাইপ। সব ঠিক-ঠাক এবার বন্ধুর বাবা-মা অর্থাৎ কাকু-কাকিমাকে বলা হবে, হঠাৎ যে বন্ধু সম্বন্ধ এনেছিল, সেই বেঁকে বসল, “এই না। না। না। এ ছেলে চলবে না?” বাকিরা সম্মিলিত ভাবে প্রতিবাদ করলাম (সবই মেসেঞ্জারে, তখন আমাদের হোয়াটস অ্যাপ ছিল না), “কেন? কেন? কেন? এত হ্যান্ডু! তায় আঁতেল।” ঘটকী দাঁত খিঁচিয়ে, যথাসম্ভব শ্রাব্য গালি দিয়ে বলল, “আব্বে দেখ, কয়েক মাস আগে, ছেলেটার হাত কেটে ছিল, সেই হাতের ছবি দিয়ে কি লিখেছে, “গট থ্রি স্টিচেস। ফ্রেন্ডস প্লিজ প্রে ফর মি।” মাত্র তিনটে সেলাই এর জন্য যে ছেলের বন্ধুদের প্রেয়ারের দরকার পরে, তার সাথে কে ঘর করবে ভাই?” নেহাত বোকা বোকা লজিক হয়তো, কিন্তু এই অভিজ্ঞতা আমাকে এই শিখিয়েছিল, যে দুঃখ আমাদের নিছক আপন অত্যন্ত স্পর্শকাতর ব্যাপার। তা ভাগ করে নেওয়া যায় না।
          মা আসতে আর তিন সপ্তাহও বাকি নেই। কিন্তু কেন যেন কিছুদিন ধরে সেভাবে আনন্দ উপভোগই করতে পারছি না। যখনি ডাইরি নিয়ে বসছি, কি এক অব্যক্ত যন্ত্রণা আমার আঙুল গুলোকে আঁকড়ে ধরছে। কিছু বলতে চাই, নিজের মানসিক যন্ত্রণা ভাগ করে নিতে আমি ব্যাকুল কিন্তু ভয় করে, ব্যক্ত করতে গিয়ে কারো ব্যক্তিগত জীবনের চৌহদ্দির মধ্যে না পদার্পণ করে বসি। কারো নিদারুণ ব্যথা না আমার কলম এক্ষেত্রে কি-বোর্ডের মাধ্যমে জনসমক্ষে উন্মোচিত না হয়ে পড়ে। তবু না বললে আমার পুজোর ডাইরি অসম্পূর্ণ।
অ্যালার্ম এর ডাকে বুধবার ভোরে ঘুম চোখে অ্যালার্ম বন্ধ করতে গিয়ে দেখি বসের মেসেজ। কি মর্মান্তিক সেই মেসেজ, মাত্র দুলাইনে স্যার লিখেছেন, ওনার স্ত্রী মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ মারা গেছেন। তাঁকে সমাধিস্থ করতে উনি দেশের বাড়ি যাচ্ছেন। ম্যাডাম বা বউদিকে (স্যার সব সময় বলতেন তোমাদের বউদি) কখনো দেখিনি, কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে স্যারের মুখে ওনার কথা এত শুনেছি, এই মধ্যবয়সী দম্পতির আভ্যন্তরীণ ভালবাসা এত গভীর ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি যে ওনার মেসেজ পড়ে চোখের জল চেপে রাখতে পারলাম না। দীর্ঘদিন ধরে ডায়বেটিসে ভুগছিলেন, সাথে যোগ হয়েছিল নার্ভের অসুখ। অফিসের শত ব্যস্ততার মধ্যেও কি অসীম মমতায় স্যার ওনাকে ফোন করে খোঁজ নিতেন। বৌদি অপারগ হয়ে পড়ার পর বেশ কিছুদিন স্যার স্বয়ং রান্না করে অফিস আসতেন। বউদি একা থাকতে মাঝে মাঝে ভয় পেতেন, তখন ওনার একটা ফোনেই স্যার হাফ ডে দিয়ে বাড়ি চলে যেতেন। নিয়মিত প্রেসক্রিপশন ধরে গোছা গোছা অসুধ কেনাতেন স্যার, একবার ছুটি নিয়ে দক্ষিণ ভারতেও ঘুরে এলেন, যদি একটু ভালো থাকেন বৌদি। বেশ কিছুদিন বাদে আবার যাবার কথা ছিল।  গত সপ্তাহে সিমলা ট্রেনিং এ যাবার আগেও স্যার বলে গেলেন, “ ফিরে এসে তোমার বউদিকে নিয়ে আর একবার দক্ষিণে যাব।”  এই তো বোধহয় সোমবার বা মঙ্গলবারই স্যার আমাকে আর ডিএলসি সাহেব কে পাকড়াও করে শোনাচ্ছিলেন, আয়াদের সাথে বউদির না বনিবনা হবার গল্প। হতাশ হয়ে বলছিলেন, “ আরে একটা আয়াকেও না পছন্দ হলে হয়? যার সাথে সমস্যা তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে আর একজনকে খুঁজে কাজে লাগালাম, এ রান্নাও করবে, চেনা মেয়ে আগে আমাদের বাড়ি কাজ করত। এখন বলছে, একেও না পসন্দ। পুরানো আয়াকেই চাই।” আমরা হাসছিলাম, এ সমস্যা স্যারের কাছে নতুন হলেও আমার মা-শাশুড়ির প্রায়ই হয়। কক্ষনই কোন কাজের লোককে ওদের পছন্দ হয় না। যতক্ষণ তাকে না ছাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, এরা শান্তি পায় না, আর ছাড়িয়ে দিলেই মা’রা ঐ পরিচারিকার গুণকীর্তন শুরু করেন। বললাম, ওনাকে, উনি ভালো করে মাথা চুলকে বললেন, “তোমাদের ছাড়া আর কার সঙ্গেই বা শেয়ার করব বল?”  তার সাথে মঙ্গলবার মধ্যরাতে স্যারের পাঠানো মেসেজকে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। আজো পারছি না। সবথেকে মর্মন্তুদ ব্যাপার হচ্ছে আজি খবর পেলাম, ওনার পদোন্নতি হয়েছে। ইশ আর আড়াইটে দিন আগে যদি এই অর্ডারটা বের হত?
খবরটা বাড়িতে বলতে ফোন করেছিলাম, বাবা শুনে বলল, “ঈশ। মন খারাপ হবার মতই খবর। তবে আমাদের ও একটা খারাপ খবর আছে। জগন্নাথের বউ মারা গেছে।” জগ্ননাথ? অর্থাৎ জগুদা, আমার মাসতুতো দাদার শালা। তার বউ অর্থাৎ জুঁই? সম্পর্কটা শুনতে বা লিখতে যতটা দূরের মনে হয়, আসলে তা নয়। যৌথ বিরাট পরিবারে এগুলো নিতান্তই কাছের কুটুম্ব। দাদার কাছে আমি লেখাপড়া শিখেছি, বাবার পরই আমার দাদা। মাসতুতো শব্দটা নেহাত শব্দ মাত্র, অর্থ কিছু নেই আমার কাছে। দাদার শালা অর্থাৎ জগুদাকে চিনি বিগত আঠারো বছর ধরে, নিতান্ত ভালোমানুষ, গোবেচারা, সাত চড়ে রা কাড়ে না টাইপ ভালো ছেলে।  আর জুঁই? ওকে চিনি তা প্রায় দশ বছর। চোখ ধাঁধানো রূপসী ছিল না বরং স্নিগ্ধ মিষ্টি মাখনের ডেলা ছিল মেয়েটা। ঘাম তেল মাখানো চকচকে ফর্সা রঙ,গোল পানা মুখ আর জগত ভোলানো এক গাল হাসি।  এত সাদাসিধে মেয়ে সত্যি দুর্লভ। যেখানে যেত, নিজ রূপে গুণে সকলের মন জয় করে নিত। জুঁই তো জুঁইই, মিষ্টি মধুর সুগন্ধে ভরিয়ে রেখেছিল গোটা পরিবারকে। জগুদা পাক্কা কর্পোরেট ম্যান,কখন অফিস যায়, কখন ফেরে কোন ঠিক নেই। ফিরতে যত রাতই হোক না কেন, জেগে বারন্দায় অপেক্ষা করত বরের, একসাথে রাতের খাওয়াটুকু সারবে বলে। কি যে গভীর ভালবাসা ছিল দুজনের মাঝে, তা যুগলকে একনজর দেখলেই অনুভব করা যেত। এই তো দু-এক হপ্তা আগেই ফেসবুকে ছবি দেখছিলাম ওরা চাদিপুর বেড়াতে গেছে। হাসি হাসি মুখে, যুগলের ছবি, একা জুঁই, ছেলের হাত ধরে হাসি মুখে জুঁই।
হঠাৎ কি হল? চাদিপুর থেকে ফিরেই জ্বর, পেটের অসুখ আর র‍্যাশ। ফেলে না রেখে পরদিনই হস্পিটালাইসড করা হল মেয়েটাকে। সবাই ভেবেছিল ডেঙ্গু। রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেল, প্লেটলেট কাউন্ট সাড়ে তিন লাখ। জরুরি ভিত্তিতে ডায়লিসিস করা দরকার বলে ছোট নার্সিং হোম তৎক্ষণাৎ রেফার করে বড় হসপিটালে। মধ্য রাতে নিয়ে যাওয়া হয় এশিয়ার সেরা বলে নিজেদের দাবী করে এমন এক সুপার স্পেশালিটি হসপিটালে। সারা রাত এমারজেন্সিতে ফেলে রাখা হল মেয়েটাকে, কারণ কোন ডাক্তার এবং বেড খালি নেই। পরদিন আই সি ইউতে যখন স্থান পেল, ততক্ষণে ইউরিন ফরমেশান স্তব্ধ হয়ে গেছে। বারংবার অনুরোধেও ডায়ালিসিস চালু করল না, বড় হসপিটাল। কারণ ছোট হসপিটালের টেস্টে ওদের ভরসা নেই। ড্রিপ আর ক্যাথেটার লাগিয়ে ফেলে রেখে আবার সব টেস্ট করা হল। ফলাফল জানতে জানতে কেটে গেল সারা বেলা। বিকালে যখন ডায়লিসিস করার সিধান্ত নিল ওরা, ততক্ষণে রোগীর চেতনা লুপ্ত হয়েছে। প্রেসার এত কম, ডায়লিসিস অসম্ভব। অবচেতন মেয়েটাকে বাঁচার সম্ভবনা তখন ওদের ভাষায় মাত্রই ৫%। অন্তিম প্রচেষ্টা করল হসপিটাল, একটা ইঞ্জেকশন, যার মূল্য ৮০ হাজার টাকা। ফুলের মত ফুটফুটে মেয়েটা আর ধকল নিতে পারেনি।
আমার তুত্তুরীর থেকে মাত্র এক বছরের বড় ওদের ছেলেটা। মাকে ছেড়ে কোনদিন থাকেনি। সুপার স্পেশিয়ালিটি হসপিটালকে স্পেশাল অনুরোধ করে, ভেন্টিলেশনে থাকা কালীন অচেতন মাকে একবার দেখিয়ে আনা হয়েছে। যাতে মা কোথায় জিজ্ঞেস করলে কিছু জবাব দেওয়া যায়।

Thursday 22 September 2016

She asked him, "Do you love me?" He could see the enthusiasm in her eyes, he felt miserable that his answer would break her heart, maybe forever, but he had to say. He looked into her eyes and said, "nope. I dont."
Her eyes were flooded but she smiled and said," But I do. I love you.... more than i ever loved anyone in my entire life."

Days passed, they grew older.... together they were the happiest couple in the whole world. Every morning she repeated the same question and he repeated the same answer... for him it was a relationship without any string attached.. and for her? It meant everything.

That morning, the sky was like a bright blue sapphire, the sun was shining like a giant golden football... every single bud in their tiny orchard bloomed and birds started singing in the melodious possible tune... .. his answer was finally changed and he waited imlatiently for her to ask him the same question... he waited ... waited and waited....but she was no where to ask him the stupid question....

That day onwards... whenever he sees a lovely flower he says, "I love you" or he sees a chirping bird, a naughty squirrel, a beautiful butterfly... he says , "I love you... ."

#Aninditasblog
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

Saturday 17 September 2016

অনির (পুজোর) ডাইরি ২০১৬, ১৭ই সেপ্টেম্বর


পুজো নিয়ে আমার উন্মাদনা বরাবরের, তারা সুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের এ সেকশন খুব ভালো ভাবেই পরিচিত ছিল সেই উন্মাদনার সঙ্গে। আর হবে নাই বা কেন মশাই? বিশাল যৌথ পরিবার, জেঠু, কাকু, দিদিভাই, তিন মাসি, বড়দা আর সবার ওপরে বাবা সব মিলিয়ে জামাই পেতাম গোটা দশেক। বাবার বোনাসটা গোটা টাই বোধহয় খরচ হত আমার পিছনে, কম করে পাঁচটা জামা তো দিতই বাবা। অগস্ট মাস নাগাদ বোনাস পেত বাবা, তারপর কোন একটা রবিবার দেখে সপরিবারে হামলা করতাম নিউ মার্কেটে। তখন কোথায় সুপার মার্কেট আর কোথায় মল। নিউ মার্কেট ছিল একাই একশ। কি না কেনা হত, কাপড় শুকানোর ক্লিপ,জামা, চুড়ি, হার, মাথার ক্লি্প‌, হেয়ার ব্যান্ড, ব্যাগ, জুতো ইত্যাদি ইত্যাদি। হাওড়া থেকে বাসটা যখন প্রেস ক্লাবের সামনে নামাতো, আনন্দে মনটা টলটলিয়ে উঠত। মনে হত জীবনের সব সুখ বোধহয় এখানেই লুকানো আছে। বাবার হাত ধরে অবাক বিস্ময়ে তাকাতে তাকাতে পার হয়ে যেতাম মনোহর দাস তড়াগ। ওপারে চৌরঙ্গী পেরিয়েই গ্র্যান্ড হোটেল। গ্র্যান্ডের তলা দিয়ে হাঁটাই দায় হত, এত ভিড় হত, আজো হয় হয়তো। থরে থরে ইংরাজি বই (আজ জানি যার অধিকাংশই পাইরেটেড কপি), ফ্লিম স্টারদের বড় বড় পোস্টার, ঢেলে বিক্রি হওয়া জামাকাপড়, সস্তা হাত ঘড়ি যার ডিজাইন যে কোন দামি ব্র্যান্ডকে টেক্কা দিতে পারে, তার সাথে মিশে থাকা রোল আর ধোসার গন্ধ। আহা! শেষের দিকে একটু মুস্কিল হত এই, যে নিউ মার্কেটের জামা আমার গায়ে আর গলত না।
যাক গে, সে দুঃখের কথা আর বলে কি হবে। মোদ্দা কথা হল পুজো এলেই আমার মনটা নেচে ওঠে, সাথে সাথেই নাচতে থাকি আমিও এবং নাচাতে মানে জ্বালাতে থাকি আমার সব বন্ধু বান্ধবদের। আমার একটা বিশেষ শখ আছে, সেটা হল, প্রতি বছরের একটা পুজো অ্যালবাম থাকবে, এবং তাতে আমার সব বন্ধুদের ছবি থাকবে। মাঝে মধ্যেই সেই অ্যালবাম গুলো আমি দেখি আর নস্টালজিয়ায় ভুগি। ফেসবুকে বিগত চার বছরের অ্যালবাম আছে, তার আগের চার পাঁচ বছরের অ্যালবাম অরকুটের সাথে সাথে উড়ে গেছে। সব বন্ধুদের এই অল্প সময়ে একত্রে এনে হাজির করা অসম্ভব। তবু চেষ্টা করি, অন্তত যারা কাছাকাছি আছে। এর জন্যও বিশাল পরিকল্পনা করতে হয়, কার কবে সময় হয়, কে কোথায় আসবে নাকি আমি যাব পুরো ছক কষতে হয়। অন্যান্য বছর এর মধ্যে আমার পুজোর অ্যালবাম তৈরি হয়ে গোটা পাঁচেক ছবিও লেগে যায়। এবার কিছুই করিনি। ইচ্ছেই হয়নি। একে তো বাড়ি শুদ্ধ লোকের অসুখ- বিসুখ গেল। তার ওপর আমার প্রিয় বন্ধুর সাথে মনোমালিন্য।
আঠাশ বছরের বন্ধুত্ব আমাদের। অন্তত হাজার খানেক বার বিচ্ছেদ হয়েছে আবার পুনর্মিলনও ঘটেছে। আমার একটাও অ্যালবাম নেই যেখানে সঞ্চিতার ছবি নেই। বিগত ষোল বছরে আমরা একে অপরকে ছাড়া ঠাকুর দেখতে বের হয়নি। একে অপরকে ছাড়া পুজো অকল্পনীয়। কি নিয়ে যে ঝগড়া সেটা বলে নিজেদের মানসিক নাবালকত্বের প্রমাণ দিতে চাই না। তবে আমাকে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ সর্বত্র ব্লক করে দিয়েছিল শয়তানটা। এবারও পুজোয় হাওড়া যাব অথচ সঞ্চিতার সাথে দেখা হবে না? পঞ্চমীর দিন সারা রাত জেগে দক্ষিণের ঠাকুর দেখব না? আর ষষ্ঠীর দিন টোটো চেপে হাওড়া? আর সপ্তমীর দিন ফিস্ট? অষ্ঠমীর দিন আমাদের ত্রিভুজের তৃতীয় কোণ পম্পার সাথে দেখা হবে না? নবমীর দিন রাস্তার আধ পোড়া রোল আর ফুচকা হবে না? ধুস বেঁচে থেকেই আর লাভ নেই।
পুজোর আর তিন সপ্তাহও বাকি নেই, শপিং হয়েছে শুধু মাত্র তুত্তুরির আর আমার দুই বাবার তাও অনলাইন। মনের দুঃখে ঠিক করেছি এবার আর কিছু কিনবই না। শৌভিকও তাতে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে রেখেছে, “হ্যাঁ হ্যাঁ। তোর অনেক শাড়ি আছে। ওগুলো পড়িস। আর জামা কাপড় কিনলে এবার রাখার জন্যও আর একটা ফ্ল্যাট কিনতে হবে।” মনের দুঃখে একটা বিষণ্ণ, বিদঘুটে পুজো কাটাব মনস্থির করেই রেখেছি, এমন কি আনন্দমেলা ছাড়া কোন পূজাবার্ষিকীও কিনিনি। পুজোয় ই-বুকই পড়ব, যাঃ। তাও ইংরাজি।
সব যখন ঠিকঠাক, আজ সকালে সঞ্চিতার মেসেজ- “ভাব করবি?”
[চলবে গোটা পুজো জুড়ে। আশা করি ;) ]
#PujorDiary #AnirDiary
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

Friday 9 September 2016

অনির ডাইরি ৯ই সেপ্টেম্বর ২০১৬


ঠিক তুত্তুরীর মতই ছোট থেকেই বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়। স্কুলের দিন গুলোতে ঘন কালো আকাশ, গুরুগুরু মেঘের গর্জন, ঝমঝমে বৃষ্টি, রাস্তায় জমে থাকা হাঁটু জল ছিল পুরো স্বর্গীয় ব্যাপার। কেন জানি না আমাদের ছোট বেলায় আমাদের মধ্য হাওড়ায় জল প্রায় জমতই না। যত টুকু জমত তাতেই ব্যাঙের মত থপাস থপাস করে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরতাম। বড় হবার সাথে সাথে নোংরা জমা জলের প্রতি মোহটা ক্রমশঃ কাটতে লাগল, পরিবর্তে অন্য একটা ব্যাপারে চুম্বকীয় আকর্ষণ তৈরি হল, সেটা হল একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, যখনই বৃষ্টি পড়ত, মনে পড়ত, “এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।” আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, জীবনে কখনও না কখনও, কেউ না কেউ, কোন না কোন বর্ষার দিনে এই কথা গুলো অবশ্যই বলবে। সদ্য শৈশব কাটিয়ে তারুণ্যে পড়েছি, শরৎ চন্দ্রকে হঠিয়ে বুদ্ধদেব গুহ তখন আমার প্রিয়তম লেখক হয়ে উঠেছেন। কি যে পাগলের মত, ওনার সৃষ্ট ন্যাকা ন্যাকা, ওপর চালিয়াৎ, সফিস্টিকেটেড পুরুষ চরিত্রদের প্রেমে পড়তাম। উফ আজো মনে আছে, “অভি”, “শুভ্র” আর “পলু” এই তিন নায়ককে আমি দোলা আর সংযুক্তা আপসে ভাগ করে নিয়েছিলাম। আমার ভাগে কে পড়েছিল সেটা আর বলছি না।

যাই হোক, দেখতে দেখতে নব্বই এর দশক শেষ হয়ে এক বিংশ শতাব্দী এসে গেল, খুব দ্রুত বদলে যেতে লাগল সবকিছু। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে তীব্র জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হল, দোলা আর সংযুক্তা কোথায় ছিটকে গেল, বুদ্ধদেব গুহর হাত ছাড়িয়ে শিডনি শেল্ডন হয়ে ড্যান ব্রাউনের হাত ধরলাম, রবার্ট ল্যাংডনের প্রেমেও কিছুকাল হাবুডুবু খেলাম, কিন্তু কেউ কোন দিন, কোন বর্ষায় বলল না, “এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।” তীব্র রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা, বাড়ির লোকও হঠাৎ করেই ভীষণ উদার হয়ে গেল, মুঠোর মধ্যে মুঠো ফোন ও এসে গেল, এবার তো বল? কেউ তো বল? শৌভিকের সাথে আলাপ, বন্ধুত্ব, ঘনিষ্টতা পর্ব পেরিয়ে দু-দুবার বিয়েও হয়ে গেল (ধর্ম সাক্ষী এবং অগ্নি সাক্ষী) কিন্তু কেউ বলল না। বিয়ের পর প্রথম বর্ষা, মাদপুরের নির্জন কোয়ার্টারে, কিন্তু বৃষ্টি শুরু হলেই শৌভিক কাঁদতে বসত, “এঃ আই হেট রেন।” এটাই ছিল আমার বরের বাঁধা গৎ। কারণ হল, বৃষ্টি মানেই বিডিও র কাছে বন্যার আগমনী, আর বন্যা মানেই আপদকালীন পরিস্থিতি, ত্রান, চিঁড়ে, গুড়, কাপড়, ধুতি, চাল, গামছা (জানি না এটা দেয় কিনা?) ত্রিপল বিতরণ। তাই নিয়ে রাজনৈতিক দল গুলির মন কষাকষি, ঝগড়া ঝাঁটি, ডি এম, এসডিও, রাস্তা অবরোধ ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই অমন দিনে সে আমাকে এক কলি গান শোনাবে, এ প্রত্যাশা নেহাত বাতুলতা মাত্র ছিল।
বিয়ের পর দ্বিতীয় বর্ষায় তুত্তুরীর জন্ম। সে বর্ষায় মাতৃত্বকালীন অবকাশ যাপন কালে ঠিক করলাম, ঢের হয়েছে। আর কেউ বলবে না, ““এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।” কুছ পরোয়া নেই, কুয়ো মহম্মদের কাছে না এলে কি হবে? মহম্মদই কুয়োর কাছে যাবে। আমায় কেউ নাই বলুক আমিই বলব। কিন্তু কাকে? চোখ বন্ধ করলে প্রথমেই যার মুখ মনে ভেসে আসে, তাকে ফোন করতেই, সে নাকে কাঁদতে লাগল, “ এঃ আবার বৃষ্টি হচ্ছে। আজ বৃষ্টি না বন্ধ হলে---। এঃ আই হেট রেন।”
আরও বছর তিনেক কেটে গেছে, আমি এএলসি হিসেবে ট্রান্সপোর্ট বোর্ডে জয়েন করে গেছি, শৌভিকও বিডিও মগরাহাট ওয়ান হিসেবে বছর খানেক কাটিয়ে ফেলেছে। আমরা আলাদাই থাকতাম, আমি মেয়ে নিয়ে মা-বাবার কাছে, আর ও উস্থিতে বিডিও কোয়ার্টারে। এটা ভালো ব্লক, এখানে বন্যা বন্যা হত না। যাই হোক একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি, আকাশ অন্ধকার, চার্চ লেন, কিরণশঙ্কর রায় রোড সব জল থৈথৈ। প্রবল বর্ষণে স্ট্রান্ড রোড স্তব্ধ, অবরুদ্ধ।চারপাশে অফিস ফেরতা লোকজনের চিৎকার, গাড়ি, ট্যাক্সির হর্ন, ধাক্কাধাক্কি সব ছাপিয়ে মনে হল, আজই সেই দিন, আজ বলতেই হবে। ফোন করলাম, ওদিক থেকে উত্তর এল, “একটু পরে করছি অ্যাঁ? এখন দোকান ভাঙছি?” এবার আমার অ্যাঁ বলার পালা। শৌভিক উত্তেজিত হয়ে হড়বড় করে বলল, “ আরে এখানে একটা খাল আছে, সেই খাল সব জবরদখল করে দোকান বানিয়ে ফেলেছে। ফলে আর জল যেতে পারছে না। শিরাকোল সংলগ্ন সমস্ত অঞ্চল কয়েক দিন ধরেই জলমগ্ন হয়ে আছে। আর আজকের বৃষ্টির পর তো হাল আরো খারাপ। এঃ আই হেট রেন।”
ফোনটা কেটে দেবার পর মনে হল, বলতেই হবে কথা গুলো, কিন্তু কাকে? এমন কাউকে যে এই কথা গুলোর যথার্থ মূল্য দিতে পারবে। দ্বিতীয়বার চোখ বন্ধ করতেই যার মুখ ভেসে এল সে আমার সহপাঠী দেবারতি। দেবাকে আড়ালে এবং প্রকাশ্যে আমরা খেপাতাম, রবি ঠাকুর ওরফে দাড়ি বুড়ো ওর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে। দাড়ি বুড়োর যত কবিতা, যত গান দেবা জানে বা জানত তখন আমার চেনা পরিচিত কেউ জানত না। দেবাকেই ফোন করলাম, ও তখন রাজাবাজার সায়ন্স কলেজের মাইক্রোবায়লজি সেকশনের ল্যাবে সাংঘাতিক কিছু নিয়ে রিসার্চ করছে, যা আমার জ্ঞানবুদ্ধির বাইরে। দেবা ধরল, “ হ্যাঁ অনি বল।” ইতস্তস্ত করে বললাম, “দেবা, তোকে একটা কথা বলতে চাই। প্লিজ কিছু মনে করিস না, বাঁ আমায় পাগল ভাবিস না।” “উফ। অনি ভ্যান্তারা না করে বলে ফেল? কি বলবি?” বললাম, “ আমার আজন্ম শখ এমন কোন বর্ষার দিনে কেউ আমায় বলবে, ‘এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।’ আমায় তো কেউ বলল না, তাই আমি তোকে বললাম এই কথা গুলো। জানি এমন দিনে এর সঠিক মুল্য কেবল তুই দিতে পারবি।” দেবাকে এত বিগলিত হতে কখনও দেখিনি।
বলার ছিল, বলে দিলাম, কিন্তু মন ভরল কই? বিচ্ছিরি ঘেঁটে যাওয়া মুড নিয়ে বাসে চাপলাম, যানজটের জন্য বাসের যা গতি, তা শম্বুককেও লজ্জা দেবে, প্রায় পঞ্চাশ মিনিট কেটে গেল, অথচ বাস নিউসেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং এর সামনে থেকে নড়ে নড়ে বড় বাজার পৌঁছতে পারল না। বৃষ্টির জন্য জানলাও বন্ধ করে দিতে হয়েছে, তেঁতো মুখে বসে আছি, শৌভিকের ফোন, ধরতেই বিগলিত গলায় বলল, “ ইয়েস? ইউ ওয়ার সেইং?” নিমপাতা চিবানো স্বরে বললাম, “ছাড় না। তোর শোনার সময় নেই, যখন আমি অন্য কাউকে বলে দিয়েছি।” শৌভিক জিজ্ঞেসও করল না, কি কথা, উল্টে বকবক করতে লাগল, “ উফ যা গেল না আজকের দিনটা। ফুল অন মস্তানি। সোজা কন্ট্রাক্টরকে বললাম, বুলডোজার নিয়ে আয় আর ভেঙে দে সব। সেই সকাল থেকে চলছে ভাঙাভাঙি। সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছি এখানে। হ্যাঃ। কতজন এসে বলে গেল, স্যার আপনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভাঙলেন তাই-।” নিরাসক্ত ভাবে বললাম, “বাঃ।” শৌভিক পাত্তাও দিল না, “না ভাঙলে এখানেও বন্যা পরিস্থিতি হত। যাকগে তা কি বললি? বলেই যখন দিয়েছিস, আর একবার বলতে বাধা কি?” পাশের ভদ্রমহিলার বিকট হাই তোলা দেখতে দেখতে রিডিং পড়ার মত বললাম, “এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।” শৌভিক শুনে হেঁহেঁ করে হাসল, এই হাসিটা ও শুধু আমার আর তুত্তুরীর সামনেই হাসে, আমি ফোনের এপাশ থেকেও অনুভব করলাম। তারপর বলল, “ হ্যাঁ তো। যাক আমি যাই, আবার গিয়ে দেখি ভাঙচুর কতটা এগোল। তুই সাবধানে বাড়ি যা, বুজুর (তুত্তুরী) কাছে। রাতে ফোন করব।” আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, “কাকে বলেছি সেটা জানতে চাইবি না?” ও হেসে বলল, “আমি জানি। বুড়োর দাড়ি চিবানোর লোক তোর একটাই। এখন ছাড়ি? রাতে শুনব দেবারতি কি বলল।”
https://amianindita.blogspot.in/

Friday 2 September 2016

বেরিয়ে পড়লাম যশোধরা,

বেরিয়ে পড়লাম যশোধরা,
অকাতরে ঘুমোচ্ছ তুমি,এই তো সুযোগ। 
নিঃশব্দে আলমারি খুলে বার করে নিলাম ,
এখনও না খরচা হওয়া সংসার খরচের কটা টাকা। 
ব্যাগে গুছিয়ে নিলাম সামান্য কটা জামা,
বেরিয়ে পড়লাম যশোধরা, আমি আর ফিরব না।
ভোরের হাওড়া স্টেশন, টিকিট কাউন্টারের জানলা দিয়ে বাড়িয়ে দিলাম হাত,
একটা টিকিট দিন তো, সবথেকে দূরের একটা টিকিট- 
পাগল ঠাওরালো কি না জানি না, ছুঁড়ে দিল একটা টিকিট, 
বদলে খরচা হয়ে গেল কড়কড়ে দুশো টাকা।
না জানি কতক্ষণ ধরে ছুটেছে ট্রেনটা, আচমকা ক্লান্ত হয়েই বুঝি দাঁড়িয়ে পড়ল। 
মুখ বাড়িয়ে দেখি একটা ছোট্ট স্টেশন,
লাল কাঁকড় মাটির প্লাটফর্ম, দূরে একটা শিমুল গাছ রক্তবর্ষণ করছে। 
বুঝলাম, এটাই আমার গন্তব্য।
আধা গঞ্জ, অদূরেই একটা ছোট নদী ছলাৎ ছলাৎ । 
নীল আকাশ, সোনা রোদ, তপ্ত মাটির গন্ধ ওলা বাতাস, 
লেখাপড়া না জানা কালোকোলো খেটে খাওয়া মানুষজন। 
সব ছাপিয়ে বড় কষ্ট, বড় কষ্ট, তোমার জন্য যশোধরা। 
কি করবে তুমি? সবকটা টাকা তো আমার কাছে-
সংসার চলবে কি করে? আর তোমার পেটর ভ্রূণটা?
মাটি মাখা উলঙ্গ শিশুগুলো যে হঠাৎ মনে করিয়ে দিল তার কথা।
কি করলাম। এ আমি কি করলাম। 
ভাঙাচোরা ওভারব্রীজে হাঁটু মুড়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি আমি। 
এখানে কেউ বাংলা বোঝে না, কেউ এগিয়ে আসবে না সান্তনা দিতে। 
কি করলাম? এ আমি কি করলাম?
একটা উষ্ণ হাতের স্পর্শে চমকে উঠে দেখি,
বৃদ্ধ স্টেশন মাস্টার, সস্নেহ বললেন,“লওট যা বেটা। রাত পৌনে দশটার ট্রেন কলকাত্তা যায়। 
লওট যা।
প্রচণ্ড শীত, আলোয়ান মুড়ি দিয়ে অপেক্ষা করছি,
ঐ আসছে আমার ট্রেন, এক দুর্দম রাক্ষসের মত, ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। 
তোমার কাছে যশোধরা। 
কি যে হল, চলন্ত ট্রেনের সামনে ছুঁড়ে দিলাম আমার অন্তিম বাঁধন। 
বাঁধন ছেঁড়া বিবাগী আমি। 
ফিরব না আর যশোধরা। 
আমি আর ফিরব না। 


ফেবু


রবিবার সকাল আটটা, আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে, ফুল স্পিডে ফ্যান এবং এসি চালিয়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছিল রাই, আচমকা মুঠো ফোনের তীব্র আর্তনাদে ধড়মড়িয়ে উঠে দেখে বাবার ফোন। হ্যালো? হ্যালো? বাবা? কি হয়েছে? অ্যাঁ? মা- তুমি- পিসি সব ঠিক আছ তো? এত সকালে কি ব্যাপার?” ওপাশ থেকে অসহিষ্ণু গলায় বসন্ত বাবু বলে উঠলেন, “ ফাইন। ফাইন। অল ইজ ওয়েল। তোমার গর্ভধারিণী এখনও শয্যা ত্যাগ করে উঠতে পারেননি। আর পিসি বুধুয়া মেথরকে দিয়ে নর্দমা সাফ করাচ্ছে। সকাল থেকে এক কাপ চাও জোটেনি এই বৃদ্ধের। ” “তবে?” হতভম্ব হয়ে বলল রাই।
বসন্ত বাবু হড়বড় করে বললেন,“ আরে কাল থেকে কি যে হয়েছে কিছুই খুলছে না? খালি গোল গোল হয়ে ঘুরেই যাচ্ছে।হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না রাই। কাল থেকে বাবার ফোনে নেট কাজ করছে না, এটাই হল সমস্যা। দোষ সম্পূর্ণ রাইয়ের, সত্তরোর্দ্ধ বৃদ্ধ পিতার হাতে স্মার্ট ফোন ঐ তুলে দিয়েছে। আসলে কাকা, জেঠু, মামা, পিসেমশাই সবাই মারা গেল এক এক করে। বাবার বন্ধুরাও এক এক করে পরলোকে পাড়ি দিতে লাগল। ভীষণ একা হয়ে যেতে লাগল বাবা। মা- পিসির তাও টিভি সিরিয়াল আছে। বাবা কি নিয়ে থাকবে? সকালটুকু প্রাণায়াম আর কাগজ পরে কেটে যায়। দুপুর থেকে সময় আর কাটতেই চায় না। দোকান বাজার ও আজকাল আর যেতে পারে না স্বাস্থ্যের কারণে। বাগবাজারে ওদের বিশাল সাবেকী বাড়ি। রাইয়ের বৃদ্ধ প্রপিতামহের বানানো। মূল ভিটেটা প্রপিতামহের আমলে দুভাগে ভাগ হয়ে পার্টিশন হয়ে গিয়েছিল। রাইয়েরা ছোট তরফ। বড় তরফের সঙ্গে মনোমালিন্য বিগত একশ বছরেও মেটেনি। এখনও দুতরফের কিছু মামলা মোকদ্দমা বিভিন্ন আদালতে ঘুমিয়ে আছে। রাইয়ের বাবা বাদে অন্য ভাইয়েরা কবেই মারা গেছে। রাইয়ের খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোনেরাও কেউ আজ কলকাতায় নেই। বাবা একাই লড়ে যাচ্ছে সম্পত্তি নিয়ে। মাঝে বাবা এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিল যে দিবারাত্র মৃত্যুচিন্তা করত। বাবাকে সেই হতাশা তথা নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচানোর জন্যই রাই বাবার হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিয়েছিল। বেশি কিছু নয় শুধু ফেসবুক।
ফেসবুক প্রথম দিকে কিছুই বুঝতেন না বসন্ত বাবু। রাইই বেশ কিছু পরিচিত তথা আত্মীয় স্বজনের সাথে ফ্রেন্ডশিপ পাতিয়ে দেয়। একটু হাতবশ হবার পর নিজে নিজে খুলতে শিখে ভেবলে যান প্রবলপ্রতাপ বসন্তদূত বন্দোপাধ্যায়। এরা কারা? ভাগনে পটাই, প্যাংলা, আজন্ম নাক দিয়ে সর্দি গড়াত, মেজ মামার ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলত, সে ওণাকে ফেসবুকে সম্বোধন করে মামুজান বলে। আর কি সব ছবি পাঠায়? লাল হাফপ্যান্ট হলুদ গেঞ্জি - ঈশ জাত ঘটির ছেলে হয়ে শেষে লাল হলুদ? আর ভাইঝি মামনি? সে নাকি প্রাউড লেসবি। বিদেশ থেকে নিজের লিভ ইন গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে যে সব ছবি পাঠায় তা সেন্সর্ড হওয়া আবশ্যক। ওণাদের যুগেও হোমো লোকজন ছিল, কিন্তু তারা এসব লুকিয়ে চুরিয়ে চালাত। প্রকাশ্যে রামঃ। আর ওণার আদরের বুল্টি ওরফে রাই? হায়দ্রাবাদে গিয়ে কি হয়ে গেছে মেয়েটা? কি সব পোশাক পরে? প্রকাশ্যে মদ্যপান করে, বিড়ি ফোঁকে, অন্য পুরুষবন্ধুদের জড়িয়ে ছবি তোলে। সে ছবি কে তুলে দেয়? না ওণার আদরেরে জামাই। উচ্ছন্নে গেছে এই জেনরেশন। প্রথম দিকে এই নিয়ে বলতে গিয়ে ব্যাপক ঝাড় খেয়েছিলেন বুল্টির কাছে। আজকাল আর কিছু বলেন না, শুধু স্যাড বা অ্যাঙরি ইমোজি পাঠান।
কি ভাবে জানি না, পাড়ার লোকজনও জেনে গেছে বসন্তদূত বাবু ফেবু তে আছেন আজকাল ভুরি ফ্রেন্ডরিকোয়েস্ট আসছে।বাজারওলা, মাছওলা, পেপারওলা, দুধওলা থেকে মায় যে ছেলেটি বাড়ি এসে চুল দাড়ি কেটে দিয়ে যায়। সবাইকেই অ্যাকসেপ্ট করেন বসন্ত বাবু। ফেবুতে উনি কিছু লিখলেই এদের অনেকেই লাইক করে। আর লাইক পেতে কে না ভালবাসে। কথাও হয় ফেবুতে, কিছু দরকারী কিছু অদরকারী।
কাল বিকালে একটা ফ্রেন্ড রিকয়েস্ট পেয়ে চমকে গেছেন উনি। বন্দোপাধ্যায় বাড়ির বড় তরফের বিধবা বড় বধু নিভাননী ওণার বন্ধু হতে চেয়েছেন। বড় তরফের সাথে ওণাদের মুখ দেখাদেখি বহু দিন বন্ধ। নিভার সাথে জীবনে একবারও বার্তালাপ হয়নি ওণার। দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার আদালত চত্বরে, নিভার বরটা ন্যালাখ্যাপা ছিল। দেখা হলে হাসার চেষ্টা করত, নিভার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই গোমড়া হয়ে যেত। বসন্ত বাবুর কেমন যেন ধারণা ছিল নিভা ওঁকে সইতে পারেন না। একাধিক ব্যক্তির কাছে নিভা ওঁর নামে বিষোদ্গার ও করেছিলেন। তবে? দোনামোনা করে অ্যাকসেপ্ট করেই নিলেন বসন্ত বাবু। তৎক্ষণাৎ মেসেজ এল, “বন্ধুত্বের হাত ধরার জন্য ধন্যবাদ। হৃদপিণ্ডকে ধমকে গতি কমাতে বলে বসন্ত বাবু লিখলেন, “অবাক হয়েছিলাম। মিথ্যা বলব না। ” “কিন্তু কেন? আমরা কি বন্ধু হতে পারি না?তুমি তো কোনদিন এগিয়ে এলে না, তাই অগত্যা আমাকেই--আধ ঘন্টা ধরে ভেবে লম্বা উত্তর লিখলেন বসন্ত বাবু কিন্তু মুখপোড়া হারামজাদা ফোন ফেসবুকটাই খুলছে না গো? সারা রাত ঘুমোতে পারেননি। কি যে হয়েছে ফোনটার কিছু বোঝেন ও না ছাই। সকাল হতেই বুল্টির দ্বারস্হ হয়েছেন, ফোনটা ঠিক করে দে মা। বহু বছর ধরে একজন জবাবের প্রতীক্ষায় আছে আর একজন ব্যগ্র হয়ে আছে জবাব দেবার জন্য। প্লিজ বুল্টি হেল্প।


প্রতিশোধ


বিরক্ত লাগছিল অন্তরার। এত সুন্দর জায়গাটা,জনমানব বিবর্জিত ঘন সবুজ প্রকৃতির মাঝে বিশাল ফাঁকা মাঠ, একটু দূরেই বয়ে যাচ্ছে একটা ছোট নদী, তবে খাত যতটা চওড়া, জল তার সিকি ভাগও নেই। হয়তো বর্ষাকালে থাকে, আপাতত এই ডিসেম্বরের শীতে শুকিয়ে এসেছে। বিয়ের পর থেকেই বিগত এক যুগ ধরে অন্তরা আমেদাবাদের স্থায়ী বাসিন্দা। কিন্তু শহরটাকে কোনদিন ভালবাসতে পারেনি। আমেদাবাদের শোরগোল থেকে পালিয়ে এসে এই অপরূপ নির্জনতা ওর শরীরের কোষে কোষে মিশে যেতে চাইছে। কিন্তু নিসর্গকে উপভোগ করবে কি, জামাইবাবু তখন থেকে বকেই চলেছেন। জামাইবাবু আসলে ওর নন্দাই, ওর বর জয়ের বড় দিদির বর। ওনারা দীর্ঘ দিন ধরে, চাইবাসার বাসিন্দা, জামাইবাবু এখানকার সিমেন্ট প্ল্যান্টের বড় ইঞ্জিনিয়ার। সামনের জানুয়ারিতে ওনাদের বিবাহের কুড়ি বছর পূর্ণ হবে, জানুয়ারিতে জয় আসতে পারবে না বলে, দিদির আব্দারে ক্রিসমাসের ছুটিতে ওরা এসেছে আগাম সেলিব্রেট করতে। চাইবাসার অদূরেই জামাইবাবুদের কোম্পানি আর একটা প্ল্যান্ট খুলছে, যার সব দায়িত্ব নাকি জামাইবাবুর ওপর ন্যস্ত হয়েছে। ব্যাপারটা নিয়ে উনি এবং ওনার স্ত্রী অর্থাৎ অন্তরার ননদিনী যৎপরনাস্তি গর্বিত। আজো জামাইবাবু তাঁর শালা এবং শেলেজকে নিয়ে এসেছেন হবু প্ল্যান্টের সাইট পরিদর্শনে। একে তো এত সুন্দর জায়গাটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে ভাবতেই অন্তরার রাগ হচ্ছিল, তায় তখন থেকে জামাইবাবু বকবক করেই চলেছে। সিইও ওনার ওপর কতটা খুশি, কেন খুশি, উনি নিজের কাজে কতটা দক্ষ, তাই নিয়ে ওনার সহকর্মীরা কতটা ঈর্ষান্বিত ইত্যাদি ইত্যাদি। জয় আর জয়ের দিদি হাঁ করে শুনছে, দিদির ঘাড়টা পতির গর্বে উঁচু হয়ে আছে।
বিরক্ত হয়ে সরে গেল অন্তরা, মাঠের মাঝে সরু পায়ে চলা লাল পথ ধরে পায়ে পায়ে এগোতে লাগল নদীর দিকে। বেশ খানিকটা এগিয়ে একবার পিছন ফিরে দেখল, ওরা তিনজনে এখনও একই ভাবে মগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অন্তরার অনুপস্থিতি কেউ খেয়ালই করেনি। ফুসফুস ভরে টাটকা বাতাস টানল অন্তরা, আমেদাবাদের দুষিত বাতাসে ওর দম আটকে আসে, আদতে চন্দননগরের মেয়ে ও, বিয়ে হয়েছিল শোভাবাজারের ছেলে জয়ের সঙ্গে। স্বপ্নেও ভাবেনি কোনদিন কলকাতা ছেড়ে যেতে হবে, অথচ তাই হল, বিয়ের ছয় মাসের মধ্যেই আমেদাবাদের চাকরিটা পেয়ে গেল জয়। এক ধাক্কায় তিনগুণ বেতন বৃদ্ধির আশ্বাস, অন্তরার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও ছাড়তে হল তিলোত্তমাকে। জয় আশ্বস্ত করেছিল, একটা ভালো অফার পেলেই আবার ফিরে আসবে, কিন্তু মনের গহিনে অন্তরা জানত সে আর কোনদিনই হবে না। ভাবতে ভাবতে অনেকদূর চলে এসেছে, দূরে জয় আর ওর দিদি জামাইবাবুকে দেখে ক্ষুদ্র মানবক মনে হচ্ছে। আসে পাশে আর কেউই নেই, শুধু জঙ্গল, মাঠ, নদী, হুহু হাওয়া আর অন্তরা। এটা যেন অন্তরার রাজত্ব। রাণী অন্তরার নির্দেশেই যেন সদ্য সূর্য ডুবেছে, অথচ এখনও নামেনি সন্ধ্যা। রানীর অন্তরার নির্দেশ ভিন্ন একটা পাতাও আজ নড়বে না, ভাবতে ভাবতে আপন মনেই হেসে ফেলল অন্তরা। রাণীর রাজত্বে এক ক্ষুদ্র প্রজার আগমন ঘটেছে, একটু দূরে নদীর পাড়ে একটি মুসলমানদের বউ। পরনে জংলা প্রিন্টের ছাপা শাড়ি, আঁচলটা হিজাবের মত মাথায় জড়ানো। একটি বাছুরকে গলার দড়ি ধরে টেনে নিয়ে আসছে। ঝুপ ঝুপ করে সন্ধ্যা নামছে, অন্তরা আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে চলেছে নদীর দিকে আর উল্টো দিক থেকে বউটা দুষ্টু বাছুরটাকে টেনে নিয়ে আসছে, দুজনে মুখোমুখি হয়েও পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অন্তরার হঠাৎ মনে হল, বউটি ওর পাশ দিয়ে যাবার সময় পরিষ্কার বাংলায় বলল, “কেউ কথা রাখে না।চমকে উঠে অন্তরা জিজ্ঞেস করল, “আমায় কিছু বলছেন?” বউটি খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল, ওর ডাকে পিছন ফিরে তাকাল, এক সম্পূর্ণ অচেনা মেয়ের মুখ, আচমকা অন্তরার চোখের সামনে বদলে গেল মুখটা, এ কে? এ তো অনু। অনুরাধা, অন্তরার স্কুলের সহপাঠী। কিন্তু অনু তো আজ বারো বছর আগে মৃত। মুহূর্তের মধ্যে অনুর ফর্সা দুর্গা প্রতিমার মত মুখটা অন্তরার চোখের সামনে পুড়তে লাগল। পুড়ে ঝলসে গেল অনু, মুখের চামড়া গুলো পুড়ে গুটিয়ে যেতে লাগল। দুর্গা প্রতিমার মত কপালের ওপর পড়ে থাকা ঘন কোঁকরা চুল পুড়ে পুড়ে উঠে গেল। কি বীভৎস লাগছে অনুকে। অন্তরা চিৎকার করতে গেল, “অনু পালা। অনু তুই পুড়ে যাচ্ছিস। কে আছ? বাঁচাও।একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না। ধকধক করে জ্বলছে অনুর দুটো চোখ। জ্ঞান হারালো অন্তরা।
নামেই ফিস্ট, আসলে মোচ্ছব। ডোমজুড়ের কাছে, বিশাল ফার্ম হাউসে সারা দিন ব্যাপী খানা-পিনা সাথে নাচা-গানা। দেবী অর্থাৎ দেবিকার ভালোই লাগে এই পার্টি গুলো, ফোকটে দামি মাল খাওয়া যায় কোম্পানির পয়সায়। তবে আজো কেন জানি না দু পেগ হুইস্কি খেয়ে আর খেতে ইচ্ছে করল না, বরং একটা বিড়ির জন্য প্রাণটা হাঁকপাঁক করতে লাগল। এত দামি ফার্ম হাউসে বিড়ি খাওয়াটা নেহাৎ বাঁদরামো, চাইলে সিগারেট ধার করাই যায়, যে কোন সহকর্মীর থেকে। কিন্তু সিগারেট খেতে একদম ইচ্ছা করছে না, বিড়িই চাই। চুপচাপ পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে এল দেবী, ঘড়ির কাঁটা বলছে সবে পৌনে পাঁচটা, কিন্তু ডিসেম্বর মাস তাই এখনই বেশ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ক্লাবের বাইরেটা বেশ ফাঁকা, হাইরোডের ধারেই একদম। হাইরোডের ওপাশে বিশাল ফাঁকা চাষের জমি। এখন অবশ্য ফাঁকা। ক্লাবের গেটের একটু দূরেই একটা ছোট্ট দোকান। এক বৃদ্ধ মুসলমান ভদ্রলোক একাই বসে আছেন, খরিদ্দার বিশেষ কেউই নেই। বুড়ো চাচার থেকে গোটা পাঁচেক বিড়ি কিনে, আয়েস করে একটা ধরালও দেবী। মনের আনন্দে কখন যে হাইরোড টপকে ও পাশের খোলা মাঠে চলে গেছে খেয়াল করেনি। হঠাৎ দেখে, দূরে এক স্থানীয় মুসলিম মহিলা একটা বাছুরকে গলার দড়ি ধরে টানতে টানতে আনছে।
রাত আটটা বাজে, কলকাতাতে হয়তো বড়দিনের সময় রাত আটটা এমন কিছুই সময় নয়, কিন্তু চাইবাসাতে যেন মধ্যরাত। অন্তরার ননদের বাড়িটা সাবেকি বাংলো প্যাটার্নের দোতলা বাড়ি, লাল রঙ, বাইরে চতুর্দিকে অনেকটা করে কেয়ারী করা বাগান, বাগানকে ঘিরে উঁচু পাঁচিল, পারিপার্শ্বিক থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে বাড়িটাকে। দোতলার দক্ষিণপূর্ব কোনের ঘরটাই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে জয় আর অন্তরাকে। ওদের ছেলে পুপাই তার পিসতুতো দাদার সাথে শুচ্ছে। জয় এতক্ষণ অন্তরাকে আগলে রেখেছিল, সদ্য নীচে গেল বউ এর জন্য গরম সুপ আর কড়কড়ে টোস্ট আনতে। জয় নেমে যেতেই অন্তরা উঠে নিজের ফোনটাকে সুইচ অন করল। কাউকে কিছু বলেনি অন্তরা, জয়কেও না। বললে হয় হাসবে, নয়তো ওকে পাগল ঠাওরাবে। আজ যা দেখেছে তা শুধু একজনের সাথেই শেয়ার করা যায়। জ্ঞান হওয়া ইস্তক অন্তরা সুযোগ খুজছিল, একটু নিরালা চাই ওর।
সেই বিকাল থেকে পাগল পাগল লাগছে দেবীর, অসভ্যের মত পার্টি ছেড়ে চলে এসেছে, ন্যূনতম বিদায় জানিয়ে আসার সৌজন্যটুকুও ও দেখায়নি। দেখানো সম্ভব ছিল না। মাতালের মত টলতে টলতে ফ্ল্যাটে ঢুকে অবধি অন্তত পঞ্চাশ বার ফোন করেছে, মালটাকে। এত বড় হারামজাদা, ফোনটা পর্যন্ত বন্ধ করে রেখেছে। হোয়াটস অ্যাপে খিস্তির বন্যা বইয়ে দিয়েছে, কিন্তু একটা মেসেজও ডেলিভার হয়নি। আজ দেবী যা প্রত্যক্ষ করেছে, তা ও শুধু একজনের সাথেই শেয়ার করতে পারে।
বিগত দু-আড়াই ঘণ্টায়, দু প্যাকেট সিগারেট ফুঁকেছে দেবী, আর পাড়া যাচ্ছে না। ফ্ল্যাটে এক ফোঁটাও মদ নেই, কিন্তু এমতবস্থায় মদ না গিললে আজ ও চোখ বন্ধ করতে পারবে না। হাফ প্যান্টের ওপর টি- শার্টটা গলিয়ে বেরোতে যাবে, ফোনটা বেজে উঠল। কোথায় ছিলি রে মালটা? ফোন বন্ধ করে কি ইয়ে করছিলি?” খিঁচিয়ে উঠল দেবী। ও পাশ থেকে অন্তরার ক্লান্ত আওয়াজ ভেসে উঠল, “ দেবী আমি আজ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম জানিস।দেবী ব্যঙ্গের সুরে বলল, “ তা বেশ করেছ মামণি। তা আবার সুখবর তো?” অন্তরা কিছু বলতে যাবে, তার আগেই দেবী বলে উঠল, “ শোন, আমার সাথে আজ কি হয়েছে-। সবে দেবী শুরু করেছে, “একটা মুসলমানদের বউ একটা-। ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে অন্তরা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, “তুইও দেখেছিস? তুইও দেখেছিস!দেবী গলার আওয়াজ সপ্তমে উঠে গেছে, হাঁপাতে, হাঁপাতে চিৎকার করল, “তুইও? অন্তু? অনুকে দেখেছিস? ওঃ কি বীভৎস লাগছিল ওকে। কে বলবে আমাদের অনু অত সুন্দরী ছিল। তো মনে আছে, ওর দেহটা যখন শেষবারের মত পিজি থেকে ওদের বাড়ি আনা হল।অন্তরা মন্ত্রমুগ্ধের মত বলল, “ কোনদিন ভুলব না। শুধু চোখ বাদে গোটা মুখ ভয়াবহ ভাবে পোড়া, মাথার চুলের জায়গায় লাল লাল পোড়া পোড়া মাংস। গলার চামড়া পুড়ে থুতনির সাথে আটকে গেছে।দেবী বলল, “তুই তো কেঁদেই যাচ্ছিলি। আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোথাও যদি ঐ শুয়োরের বাচ্ছাটাকে পাই, ল্যাম্প পোস্টে বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেব। হারামি-।অন্তরা বলল, “তোর মনে আছে দেবী, অনুকে শেষ বারের মত ওদের উঠোনে শোয়ানো হল। কাকিমা ওর মৃতদেহের পায়ের কাছে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন। কাকু রোয়াকে বসে অবাক চোখে তাকিয়েছিলেন। তখন শ্রাবণ মাস। হঠাৎ বৃষ্টি এল। সবাই ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘এই বডিটাকে ভেতরে নিয়ে যাও, বডি ভিজছে, বডির যা অবস্থা একে আর পোড়ানো যাবে না।কাকু উদাস স্বরে বললেন, ‘থাক। ভিজুক। বড় জ্বলেছে আমার মেয়েটা। বড় কষ্ট পেয়েছিস না মাম? দেখ এবার ঠাণ্ডা লাগবে।দেবী গলা ঝেড়ে বলল, ‘ হু। তুই, আমি আর কাকু ছাড়া কেউ ভেজেনি। সেদিন আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল কাকিমার ওপর, মেয়েটা বারবার বলত, ‘মা আমি আর শ্বশুর বাড়ি যাব না। ওরা আমায় বড্ড কষ্ট দেয়।কাকিমা কোনদিনের জন্য ওর কথাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। বললেই বলত, ‘ওঃ রকম কত হয়। মানিয়ে নিতে শেখ।মানাতে মানতে মরেই গেল মেয়েটা।দীর্ঘক্ষণ দুজনেই নীরব রইল, তারপর দেবী বলল, “ কিন্তু মরার বারো বছর পর কেন বলতে এল কেউ কথা রাখে না’ ? কি চায়? একা লাগছে নাকি? মরেও আমাদের ছাড়তে চাইছে না? নিয়ে যাবে ভাবছে নাকি বে?” অন্তরা আনমনা হয়ে বলল, “জানি না রে। আমিও ভাবছি। কি চায় ও? কি কথা রাখিনি? আমরা কি ওকে কোন কথা দিয়েছিলাম?”
সেদিন রাতে অন্তরার চোখে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। অনুরাধা, অন্তরা আর দেবিকা ছিল তিন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। তিনজনেই চন্দননগরের কৃষ্ণভাবিনী নারী শিক্ষা মন্দিরের ছাত্রী ছিল। অন্তরা আর দেবিকা বরাবরই ব্যাক বেঞ্চার। পড়াশোনায় কোনদিনই ওদের খুব একটা মনোযোগ ছিল না। ফলে রেজাল্টও হত অতিসাধারণ, তাই নিয়ে দুজনের কেউই ভাবিত ছিল না। কিন্তু অনুরাধা, ছিল অতি সিরিয়াস টাইপ। গাঁতিয়ে পড়ত, কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল বেরোলে দেখা যেত, অন্তরা-দেবিকার সমান সমান এমনকি মাঝে মাঝে দু এক নম্বর কমই পেত। অনুর মা ছিলেন খুব কড়া ধাতের মহিলা, মাকে অনু যমের মত ভয় পেত। ক্লাশ টেন অবধি ওর মা ওকে স্কুলে দিতে এবং আনতে যেতেন। বিকাল বেলায় অন্তরা আর দেবিকা যেত অনুর বাড়ি খেলতে, কারণ ওদের বাড়ির মেয়েরা নাকি রাস্তায় বা মাঠে দৌড়োদৌড়ি করে খেলে না। অনুদের বিশাল সাবেকি বাড়ি, পাশেই গঙ্গা, ওদের ছাতে ওরা তিনজন খেলা করত। তাও কাকিমা পাঁচবার বাহানা করে এসে দেখে যেতেন। মাধ্যমিক পাশ করার পর অনুরাধার পারিবারিক অনুশাসন একটু ঢিলে হল। অন্তরা আর দেবিকার সাথে স্কুল জাওয়া-আসার অনুমতি পেল অনুরাধা।
সেই সময়ের কথা ভাবতে ভাবতে অজান্তেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এল অন্তরার। দেবী বলেছিল, “ শোন, আমরা মাধ্যমিক পাশ করে গেছি। হাঁ কারো রেজাল্টই পাড়াপ্রতিবেশীকে মিষ্টি খাওয়ানোর মত হয়নি বটে, তাওপাশ তো করেছি। উই শুড সেলিব্রেট। চল সিগারেট খাই।গঙ্গার ধারে পদ্মনাভ বাবুদের একটা ভাঙা বাড়ি ছিল, লোকে বলত হানা বাড়ি, সেই বাড়ির প্রায় ধসে পড়া শান বাঁধানো ঘাটটা হয়ে দাঁড়ালো ওদের ঠেক। দেবীই এক পাড়াতুতো দাদার কাছ থেকে চেয়ে এনেছিল তিনটে সিগারেট। উফ প্রথম দিন সিগারেটে টান মেরে তিনজনেরই সে কি কাশি। আর সিগারেট ফুরিয়ে যাবার পর, সে কি আতঙ্ক। বাড়িতে মারা যদি গন্ধ পায়, উদোম কেলাবে। গন্ধ মারতে লেবু পাতা ছাগলের মত কচকচ করে চিবিয়ে খেয়েছিল ওরা। আর বাড়ি গিয়েই সোজা চান ঘরে সেদিয়েছিল।
সে তো একরকম হল, উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর, দেবী বলল, “এত দিনে আমরা সাবালক হলাম। আমাদের সবার নাম ভোটার লিস্টে উঠে গেছে, প্লাস আমরা উচ্চ মাধ্যমিকও উৎরে গেছি। ডবল ধামাকা। এটা সিগারেট বিড়ি দিয়ে সেলিব্রেট করা যায় না। চল মাল খাই।মাল তো খাবে, কিন্তু পাবে কোথায়? এতো আর দু তিনটাকার সিগারেট বিড়ি নয়, যে বাবার প্যাকেট থেকে ঝাড়বে। বা কোন ছেলে বন্ধুকে দিয়ে কেনাবে। শেষে দেবী বলল, “দাঁড়া আমাদের পাড়ার গাবুদাকে বলে দেখি। গাবুদা ডাকসাইটে মাতাল। ওর বাপ ঠাকুরদাও বিখ্যাত মাতাল ছিল। ওদের বাড়িতে নির্ঘাত দু এক বোতল থাকবে, একটা ওষুধের শিশি নিয়ে গিয়ে বলব, গাবু দা একটু দাও বস। যদি পঞ্চাশ একশ টাকা চায় আমরা ভাগ করে দিয়ে দেব। কি বলিস?”
পরের দিন মুখ তেঁতো করে ওদের ঠেকে এল দেবিকা। শালা। রাম ড্যামনা রে গাবু।অন্তরা আর অনুরাধা একত্রে বলে উঠল, “কেন দেবে না?” অনুরাধা ঢোঁক গিলে বলল, “এই বাড়িতে বলে টলে দেবার ভয় দেখায়নি তো? আমার মা মাইরি আমায় কেটে ছাইগাদায় পুঁতে দেবে।দেবী বিরক্ত হয়ে বলল, “ ধুর। সেসব না। ও বলেছে ও আমাদের এক ভিটামিনের শিশি ভর্তি হুইস্কি দেবে, কিন্তুকিন্তু কি? কত টাকা চাইছে? কুড়ি তিরিশের বেশি দিতে পারব না, ভাই।অন্তরা শঙ্কিত হয়ে বলে উঠল। দেবী হেসে বলল, “ না ও বিনা পয়সায়ই দেবে। তবে। অনু রেগে চিৎকার করে উঠল, “বল না, সাসপেন্স অনেক হয়েছে, তবে কি চায়?” দেবী মুচকি হেসে বলল, “একটা চুমু।” “কিঃ?” সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল অনু আর অন্তু। কাকে?” দেবী চোখ মটকে তাকাল অনুরাধার দিকে। অন্তরা হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পড়ল, আর অনুরাধা? তীব্র ক্রোধে মুখ লাল হয়ে গেল প্রথমে, পরক্ষণেই দুচোখ ভরে গেল জলে। এক বোতল মদের জন্য? তোরা? তোরা একটা পেঁচো মাতালকে আমায় অ্যাবিউজ করতে দিবি? সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ?” শেষের দিকে গলার আওয়াজটা ফিসফিসানির পর্যায়ে চলে গেল। অনুরাধা খুব রেগে গেলে তাই হত। ও চেঁচাতে পারত না। অন্তু হেসেই যাচ্ছে, দেবী ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “ লেহ। সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ কাকে বলে জানেই না মামণি, বড় বড় কেতাবি কথা বলছে। চেয়েছে তো একটা চুমু? গালে দিস না?” অনু রেগে ঠেক ছেড়ে বেরিয়ে যেতে গেল। অন্তু তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ওকে ধরল, “ দাঁড়া না। একে তো মাল পাওয়া যাবে নির্ঝঞ্ঝাটে, তায় ফ্রি। এই দেবী আমি রাজি আছি চুমু দিতে।” “ আমি রাজি আছি চুমু দিতেভেঙিয়ে বলল দেবিকা। যেন আমি বলিনি ওকে। ও তোকে চায় না। আরে সেরকম হলে তো আমিই দিয়ে দিতাম। ল্যাঠা চুকে যেত।অন্তরা চোখ বড় বড় করে বলল, “ আমায় চায় না? কেন বে?” দেবী রহস্যময় হেসে বলল, “ তুই রোগা। তাই।” “কিঃ! তোরা আমায় মোটাও বললি?” হাউমাউ করে বাচ্ছাদের মত কাঁদতে লাগল অনুরাধা। সবাই বলে আমি মোটা। আমি নাকি বেশি খাই। আমি নাকি কুঁড়ে। অলস। তোরাও? তোরা আমার প্রানের বন্ধু। তোরাও আমায় আজ তাই বললি?” দেবী আর অন্তু খানিকক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়ল, দেবী, “আব্বে তোকে কখন মোটা বললাম বে? তুই ইয়ে কি যেন বলে ভলাপচুয়াস। তাই ঐ পেঁচো মাতালটার তোকে পছন্দ। তোর ইচ্ছে না থাকলে দেখি কোন শালা তোকে চুমু খায়।পরম নির্ভরতায়ে অনু জিজ্ঞেস করল , “ সত্যি বলছিস তো? গ্রাজুয়েশনের পর হয়তো তোদের পানু দেখতে ইচ্ছে হল, তখন কারো কাছে ক্যাসেট চাইতে গেলি, সে বদলে আমায় চাইল- তখন?” অন্তরা হাসতে হাসতে বলল, “উফ কি ইমাজিনেশন মাইরি!কিন্তু দেবী সিরিয়াস হয়ে বলল, “তাকে কেটেই ফেলব।” “ কথা দিচ্ছিস তো? অন্তু তুই ও তো?” “একদম।অন্তু আর দেবী অনুর হাত ধরে ছদ্ম গাম্ভীর্যের সাথে বলতে লাগল, “আমরা সজ্ঞানে প্রতিজ্ঞা করছি যে কোন শালা যদি তোর ইয়ে তাহলে আমরা তাকে ছাড়ব না।” “গা ছুঁয়ে বললি কিন্তু। কথা রাখবি তো? আমার সাথে কেউ অন্যায় করলে তোরা প্লিজ তাকে যোগ্য জবাব দিস।হাসতে হাসতে বলল অনুরাধা। দম আটকে ছটফটিয়ে ঘুম টা ভেঙে গেল অন্তরার। চাইবাসার ঐ প্রবল ঠাণ্ডায় দরদর করে ঘামছে। জয় ওকে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে, বেড সাইড টেবিলে রাখা ঘড়ি বলছে, সময় রাত দেড়টা। আসতে আসতে জয়ের হাতটা নামিয়ে পাশে টেবিল থেকে মোবাইলটা টেনে নিয়ে সুইচ অন করল, ও জানত মেসেজ আসবে। মিনিট খানেকের মধ্যেই দেবীর মেসেজ ঢুকল, “ কথা আমরা দিয়েছিলাম।
বারো বছর আগে, নিহত বান্ধবীর হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিশোধ মানে কি? খুন? খুন করবে কে? অন্তরা আর দেবিকা? মধ্য তিরিশের দুজন নিতান্ত সাধারণ মেয়ে, যারা জীবনে মশা আর আরশোলা ছাড়া আর কিছুই মারেনি। যারা ক্যারাটে বা জুডোর মত মার্শাল আর্টের অ আ ক খ পর্যন্ত জানে না। আর খুন করবে কাকে? অনুরাধার বরকে ওরা শেষ দেখেছিল অনুর বউভাতের দিন, প্রায় পনেরো বছর আগে। লোকটার নামটুকুও আজ আর মনে নেই। ওদের শুধু এটুকুই মনে আছে যে অনুর শ্বশুরবাড়ি ছিল কোন্নগর। মানতে কষ্ট হলেও অনুর ছিল নিছকই ভালোবাসার বিয়ে। ওরা তখন কলেজে পড়ে, কলেজ এক হলেও তিনজনের সাবজেক্ট ছিল আলাদা। তবুও ওরা চেষ্টা করত, একসাথে কলেজ যাওয়াআসা করার। চন্দননগর থেকে কলেজ স্ট্রিট অনেকটা রাস্তা। থার্ড ইয়ারে উঠে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল দেবী। তখন পাস কোর্স ছিল দুবছরের মাত্র। অন্তরা আর অনুরাধারও সেই ঘনিষ্ঠতা রইল কই? পড়ার চাপে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল ওদের বন্ধুত্ব। কার কখন ক্লাশ, কে কখন আসে, কখন ফেরে তালগোল পাকিয়ে গেল ওদের জীবন। তখন তো আর মোবাইল ছিল না। আর সোশ্যাল মিডিয়াও বহুদূর।
সেদিন কলেজে কোন একটা ফেস্ট ছিল, ক্লাশ-টাস তেমন কিছু হল না দেখে অন্তরা গিয়ে হামলা করল অনুরাধার ডিপার্টমেন্টে। অনুর ডিপার্টমেন্টে গিয়ে অনুকে তো খুঁজে পেলই না, উল্টে অনুর এক বান্ধবী তির্যক হেসে জানাল, যে অনু আজ কলেজ কেটে অ্যাপোকরতে গেছে। অনু গেছে ডেট করতে? কার সাথে? অনুর পক্ষে প্রেম করা অসম্ভব। ওর মা যা কড়া, মায়ের ভয়ে বিগত তিন বছরে অনু নিজের ক্লাশের পুরুষ সহপাঠীদের সাথে বার্তালাপ পর্যন্ত করেনি। মাথা নিচু করে কলেজে ঢোকে, মাথা নিচু করে কলেজ ছাড়ে অনু। তাহলে?
ব্যাপারটা ভালো ঠেকেনি অন্তরার। দেবী যদিও হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। লজ্জা পাচ্ছে মালটা। বুঝলি না। ছেড়ে দে, ও নিজে থেকেই সব বলবে।সত্যি অনু বলেছিল, ততদিনে ওর বিয়ের দিন স্থির হয়ে গেছে। পাকা দেখার জন্য নিমন্ত্রণ করতে হেসে করুণ ভাবে বলেছিল, “দাদার বিয়েতে দেখা, বৌদিদের কি রকম লতায় পাতায় আত্মীয় হয়। পালটি ঘর। মায়েরও আপত্তি নেই।অন্তরা ওকে তখনও ক্ষমা করতে পারেনি, তাই তির্যক হেসে বলেছিল, “তা বিয়েটা মা ঠিক করল? না তুই?” অনু লজ্জায় লাল হয়ে বলেছিল, “ আমারই পছন্দ। মাকে বলেই দিয়েছিলাম, ওকে ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করব না। বাবার অবশ্য একটু আপত্তি ছিল। বয়সটা একটু বেশিই, আর দেখতেও তেমন ভালো নয়। কিন্তু আমার সুন্দর দেখতে ছেলের দরকার নেই অন্তু। আমার এমন কাউকে প্রয়োজন, যে আমার রূপে মুগ্ধ হবে। আমায় ভালবাসবে, যত্নে রাখবে।
অনুর বিয়ের দিন ওর বরকে দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল অন্তু আর দেবী। বয়স অন্তত ত্রিশ তো বটেই, বেশিই হবে হয়তো। অনুর থেকে কমপক্ষে দশ বছরের বড় হবে, আর ততোধিক কুৎসিত। ওরা কেউই বর্ণ বিদ্বেষী নয়, তবে অনুর দুধে আলতা রঙের পাশে বড় বেশি কালো লাগছিল। আর ততোধিক গম্ভীর, প্যাঁচার মত মুখ করে অনুর পাশে বসেছিল, যেন কতই না বিরক্ত হয়েছে। তবে শেষ বিচারে রূপে কি বা আসে যায়? অনু যে প্রচণ্ড খুশি তা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। পূর্ণিমার চাঁদের মত ঝকঝক করছিল অনুরাধা। সেই চাঁদে যে এত শীঘ্র গ্রহণ লাগবে তা ওরা ভাবতেও পারেনি।
বিয়ের পর খুব কমই বাপের বাড়ি এসেছে অনুরাধা। তবু যখনই এসেছে, শত ব্যস্ততার মাঝেও ছুটে গেছে অন্তু আর দেবী। প্রত্যেকবারই অনুকে দেখে মনে হয়েছে ও ভাল নেই। চেহারার সেই ঔজ্জ্বল্য নেই, চোখের তলায় গাড় কালিমা। ওরা গেলে অনু ওদের সাথে একটু নিরালায় কথা বলার জন্য ছটফট করত, কিন্তু অনুর মা গ্যাঁট হয়ে বসে থাকত, ওদের সামনে। পাছে শ্বশুর বাড়ির কোন বদনাম করে বসে অনু। ওরা কোন প্রশ্ন করলে কাকিমাই তার জবাব দিত, অনু মুখ খুলেও বন্ধ করে নিত। যেমন ওরা যদি জানতে চাইত, “ অনু কেমন আছিস?” অনু বলার আগেই কাকিমা লাফ দিয়ে বলতেন, “খুব ভালো আছে। জামাই কত ভালবাসে, শ্বশুর শাশুড়ি তো মাথায় করে রাখে, ওদের কোন মেয়ে নেই কি না।যদি জানতে চাইত, “অনু তোর চোখের নীচে এত কালি পড়ল কি করে?” কাকিমা আগ বাড়িয়ে বলতেন, “ রাতে ঘুমোতে পায় কি? দাঁড়া তোদের বিয়ে হোক-।তবুও এরই ফাঁকে, সুযোগ পেয়ে অনু একবার বলেই ফেলেছিল, “ওরা খুব রাগী। বিয়ের পর সব কাজের লোক ছাড়িয়ে দিয়েছে। সব আমাকে দিয়ে-। কাকিমা মুখ ঝামটে বলেছিল, “নিজের সংসারে খাটবি না? বাইরের লোকের কাছে ঘরের নিন্দা করছিস? তোর ওপর ওনারা রেগে যাবেন না?”
এই অবধি ঘটনা অন্তু দেবী দুজনেই জানে। কিন্তু দেবী জানে না যে, মারা যাবার সপ্তাহখানেক আগে অনু লুকিয়ে অন্তরার সাথে দেখা করতে এসেছিল। দেখা করতে নয়, আসলে এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছিল অনুরাধা। অন্তুর হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করেছিল, ওকে একটু আশ্রয় দেবার জন্য। অন্তরার বিয়ে হতে তখন আর মাত্র দুমাস বাকি। বিয়ের যোগাড় যন্ত্র, নিমন্ত্রণ জোরকদমে চলছে। এর মাঝে কি করে অনুরাধাকে থাকতে দিত ও। অনু কাতর ভাবে বলেছিল, “প্লিজ অন্তু আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই। মা আমাকে জোর করে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়েই ছাড়বে। আর ও বাড়িতে ফিরলে এ বার আমি আর বাঁচব না রে।অন্তরা ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিল না, যে বাড়িটা ওর নয়, ওর বাবার, আর অনুরাধাদের পরিবার এ তল্লাটের বেশ প্রতিপত্তিশালী পরিবার, ওদের সাথে বিরোধ অন্তরার বাবার কখনই কাম্য নয়। অন্তরা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “তুই নিজের বাড়ি ফিরে যা। কাকিমাকে বোঝা। আমাদের বাড়িতে তোকে থাকতে দিলে, তোদের বাড়ির লোকেরা বলে বেড়াবে, যে আমরা তোর সংসার ভেঙেছি। আর তাছাড়া তুই কতদিন থাকবি এভাবে? কে তোর দায়িত্ব বহন করবে? একটা চাকরি বাকরি থাকলেও কথা ছিল-।প্রতিবাদ বা ঝগড়া করায় অনু কোনদিনই দক্ষ ছিল না। মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল, শুধু যাবার আগে, সজল চোখে বলেছিল, “একটা চাকরি খুঁজতে হবে বল?”
অনুরাধা মারা যাবার পর দীর্ঘদিন অনুর সেই সজল চোখ, আর মাথা নিচু করে চলে যাওয়া অন্তরাকে চাবুক মারত। লজ্জায় কোনদিন দেবীকে বলতে পারেনি। আজ বলল, আজ বড়দিন, চাইবাসার ননদের বাড়িতে বিশাল পার্টি। দেবীর অফিসেও পার্টি ছিল, কিন্তু আপাতত ওদের দুজনেরই পার্টি করার মানসিকতা নেই। দেবী অফিস থেকে ফিরে ফোন করেছিল, অন্তরাও নিজের ফোনটা নিয়ে ছাতে চলে এসেছে। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, আজ বোধহয় অমাবস্যা, চাঁদ নেই, কুচকুচে কালো আকাশ। দেবীকে কথাটা বলতে বলতে হুহু করে কেঁদে ফেলল অন্তরা, “বুঝতে পারিনি। বিশ্বাস কর, যদি জানতাম-। দেবীর গম্ভীর গলা ভেসে এল, “কাঁদিস না। ও আমার কাছেও এসেছিল। অনেক রাত, সবে বাড়ি ঢুকেছি, দেখি মালটা বসে আছে। হাতে একতাড়া কাগজ। সব সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছে। আমায় বলল, “দেবী আমায় একটা চাকরি খুঁজে দিবি রে?” অনেক বোঝালাম ঐ ভাবে হুট করে চাকরি হয় না, আর নামে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, আসলে করি তো দোকানে দোকানে ঘুরে ওষুধ বিক্রি। ঐ কাজ ঐ মামণি করতে পারত? আর ওকে কোনমুখে আমার বাড়ি থাকতে দিতাম বল? ওদের ফ্যামিলির সাথে বৈরিতা কে করবে? আর আমাদের নিজেদেরই তখন কি অবস্থা, বাবা হেপো রুগি, মার কেমোথেরাপি চলছে, এত কিছু সামলে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি আমি। তিনজনেরই পেট চলে না, আবার শঙ্করা কে ডাকি আর কি? পরে যতবার ভেবেছি নিজেকে লাথি মারতে ইচ্ছা হয়েছে। ভয়ে তোকে বলিনি, যদি তুই আমায় ঘেন্না করিস-।
অন্তরা গলা ঝেড়ে বলল, “ যাক। খুন তো করতেই হবে। শোন এবার থেকে আমরা নিজেদের ফোন থেকে একে অপরকে এই ব্যাপারে কোন ফোন বা মেসেজ করব না। তুই চাঁদনী থেকে একটা পুরনো ফোন কিনে আমায় পাঠাস। আমি একটা তোকে পাঠাব। ফোনগুলো বন্ধই রাখব আমরা, দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে, কোন জনবহুল জায়গায়, যেটা আমাদের বাড়ি বা অফিসের কাছাকাছি নয় অবশ্যই। যেমন ধর্মতলা বা তোদের করুণাময়ী। সেখানে সুইচ অন করে, শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কথা বলা হবে।
দেবী গা ঝাড়া দিয়ে সহর্ষে বলল, “উরিঃ শালা। কত ভেবেছিস মাইরি। তা মামণি সিম কার্ডটার কথা ভেবেছ? সিম নিতে গেলে ডকুমেন্ট লাগে-লাগে নাঅন্তু সহজ স্বরে বলল। দেখবি কাজের মেয়েরা এক ধরণের সিম ব্যবহার করে, পাঁচ- দশ- পচিশ টাকায় কেনে ওরা। কিছুদিন ব্যবহার করে ফেলে দেয় বা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ফোনে যারা ফ্রড করে তারাও ঐ রকম সিম ব্যবহার করে। ঐ রকম সিম একটা জোগাড় কর। আমিও করছি। অনুর জন্যদৃঢ় ভাবে কথাটা শেষ করল অন্তু। দেবীও ততোধিক দৃঢ়তার সঙ্গে বলে উঠল, “অনুর জন্য!
টিংআওয়াজটায় ঘুমটা ভেঙে গেল প্রণয়ের। মেসজ এসেছে। হোয়াটস অ্যাপ নয়, পাতি এস এম এস। নির্ঘাত কোন প্রমোশনাল মেসেজ, আজকাল কে আর এস এম এস করে। দেখব না দেখব না করেও খুলেই ফেলল ইনবক্সটা। রিমঝিম গিরে শাওন।বুকটা ধড়াস করে উঠল প্রণয়ের। অজানা নম্বর। কে হতে পারে? যদি ধরে নেওয়া যায় এটা কোন মেয়েই পাঠিয়েছে, তাহলে কোন বাঙালি মেয়ে হলে নির্ঘাত রবি ঠাকুরের কোন লাইন পাঠাত। তবে কি? পর্দা সরানো কাঁচের জানলার ওপারে মন কেমন করা আবহাওয়া। সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। এখনও আকাশ কালো, ঘন সবুজ গাছের পাতাগুলো বেয়ে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে মুক্তোর মত জলবিন্দু। এমন দিনে প্রণয়ের কান্না পায়। বৃষ্টি মেঘার খুব প্রিয় ছিল। প্যাচপ্যাচে কাদা, জমা জল কোন কিছুকেই পাত্তা দিত না মেঘা, বৃষ্টি পড়লে ওর ভেজা চাই। বিশেষ করে এরকম মেঘলা সকালে পাগল হয়ে যেত মেঘা। মেঘা আদতে পাঞ্জাবি মেয়ে, বাগুইআটির এক ডান্স বারে ওকে প্রথম দেখে প্রণয়। প্রণয়ের জীবনে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে, পাগল পাগল লাগত এক একটা সময়। অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট খেয়ে খেয়ে ফুলে যাচ্ছিল, তখনই ওর কোন সহকর্মী একদিন ওকে অফিস ফেরতা নিয়ে গিয়েছিল ঐ ডান্স বারে। সেদিন মেঘাকে দেখে বিশেষ কিছুই মনে হয়নি, বেশ লম্বা, ক্ষীণ কটি, গুরু নিতম্ব, গমের মত রঙ, কাটা কাটা মুখশ্রী। কিন্তু সে তো নাকি নর্তকীদেরও তাই। বারে ওর নাম ছিল পায়েল।
বেশ কিছু দিন বাদে আবার দেখা, এবার মল রোডে, একটা গলির মধ্যে। সেদিনও প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল, বর্ষাতিতেও মানছিল না, তাই বাইকটা রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে, একটা দোকানের নীচে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রণয়। ওর পাশেই দাঁড়িয়েছিল মেঘা, একটা চন্দন রঙের শিফনের সালোয়ার কামিজ পরা, খোলা লম্বা তামাটে চুলে মুক্তো কনার মত অসংখ্য জলরাশি। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জল ধরার চেষ্টা করছিল মেঘা, কি যে অপরূপ দেখাচ্ছিল ওকে। নিজের অজান্তেই হাঁ করে দেখছিল প্রণয়, তারপর মেঘার ঘুরে ওর দিকে তাকানো, মিষ্টি করে হাসা, সারা জীবনেও ভুলবে না প্রণয়। আর ভাবতে চাইল না, ভাবলেই কান্না পায়। কে যে নিয়ম বানিয়েছে, যে ছেলেরা কাঁদতে পারবে না। ছেলেরা বুঝি মানুষ নয়, তাদের বুঝি ব্যথা, বেদনা, অনুভূতি কিছুই নেই। আজ বছর ঘুরতে চলল, মেঘা ওকে ছেড়ে চলে গেছে, প্রণয় আজো ভুলতে পারেনি ওকে। সারাদিন মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল একটাই কথা, কে পাঠালো মেসেজটা। সাহস করে ঘুরিয়ে ফোন করতে পারেনি প্রণয়। যদি মেঘা না হয়, তাহলে চূড়ান্ত আশাহত হবে। আর যদি হয়--- তাহলে কি হবে ভাবতেও বুক কাঁপে প্রণয়ের।
দুদিন কিছুই হল না, তৃতীয় দিন আবার মেসেজ, “ ক্যায়সে মুঝে তুম মিল গ্যায়ে?” বুকটা আবার ধড়াস করে উঠল, ফোন করতে গিয়েও করল না প্রণয়। এরপর আরও দুটো তিনটে মেসেজ এল কয়েক দিনের মধ্যে, আজকাল মনটা ফুরফুরে থাকে প্রণয়ের। থেকে থেকেই ফোনটা চেক করে। এর মধ্যে একদিন ঘুরিয়ে ঐ নম্বরটায় ফোন করেছিল প্রণয়, ফোনটা সুইচড অফ। মনের মধ্যে নানা কল্পনার জাল বোনে প্রণয়। একদিন মেসেজ পাঠালো মে আই নো, হু ইজ দিস?” দিন দুয়েক পরে জবাব এল, “ সামওয়ান হু রিয়েলি কেয়ারস ফর ইউ।কে রে বাবা? ওর জন্য কে কেয়ার করে, ভাবতে বেশ হাসিই পেল প্রণয়ের। এক সপ্তাহ কোন মেসেজ এল না, তারপর আবার একটা মেসেজ এল, “ লুকিঞ সো গুড। ব্লু সুটস ইউ।চমকে উঠল প্রণয়। সত্যি নীল পরেছে আজ ও। সমুদ্র নীল রঙের শার্ট, মেঘার পছন্দ করা। তারমানে যে এই মেসজ পাঠায়, সে ওর আসেপাশেই আছে। সঙ্গে সঙ্গে মনটা দমে গেল, মেঘা তো কলকাতায় নেই। কোথায় আছে কেউ জানে না। ওর পরিচিত বন্ধু বান্ধব যে দু একজন ছিল, তারা কেউই বলতে পারেনি। তবে সাম্প্রতিক কালে বম্বের একজন টেকনিশিয়ানের সঙ্গে ওর দোস্তি হয়েছিল। সে ওকে বম্বের টিভি সিরিয়ালে সুযোগ দেবার কথাও বলেছিল। তাই মাঝে মাঝেই প্রণয়ের মনে হয়, হয়তো তার সাথে বম্বেই আছে মেঘা।
এইভাবে আর কতদিন চলে, অবশেষে একদিন ঘুম থেকে উঠে প্রণয় মেসেজ করেই বসল, “মেঘা?” বেলা সাড়ে নটায় ডং করে মেসেজ এল, “ হু দা ফাক ইজ মেঘা?” মনের গভীরে প্রণয় বোধহয় মেনেই নিয়েছিল, তাই খুব একটা আশাহত হল না। জবাব দিল, “মেঘা আমার স্ত্রী।আজ বছর ঘুরতে চলল, সে আমায় ছেড়ে চলে গেছে।জবাব এল, “কিন্তু কেন? তোমার মত স্বামীকে কি করে ত্যাগ করতে পারল? ফরগেট হার, ও তোমার যোগ্যই ছিল না। গিভ মি আ চান্স জানু, আইল মেক ইউ সো হ্যাপি। আই লাভ ইউ সো মাচ।এরপর আর পরিচিত হতে সময় লাগেনি। মেয়েটির নাম আয়েশা। অবাঙালী খানদানি মুসলিম পরিবারের মেয়ে। খুব গোঁড়া ওর পরিবার। না জানি কোন যুগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এদেশে এসেছিল ওর কোন পূর্বপুরুষ, আজ অবধি ওরা সেই রক্তের শুদ্ধতা বজায় রেখে চলেছে। নিজেদের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যেই ওরা বিয়ে শাদি করে। ওদের নাকি দেখলেই বোঝা যায়, যে খাঁটি আর্য রক্ত বইছে ওদের ধমনীতে। ফলপট্টিতে বিশাল কারবার ওর বাবার, পোষা গুন্ডাও আছে, আয়েশার সাথে ওরই এক তুতো দাদার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। সেই দাদা ডাক্তার, আপাতত কাতারে থাকে, আয়েশা এখনও কলেজে পড়ে, মাস্টার ডিগ্রি কমপ্লিট করলেই ওর বিয়ে হয়ে যাবে। আয়েশা এখানে থাকে না, কোন পাহাড়ি এলাকার মিশনারি কলেজে পড়ে, খুব কড়া নজরে রাখা হয় ওকে সর্বক্ষণ। তারই ফাঁকে সুযোগ পেলেই লুকিয়ে প্রণয়কে ফোন আর মেসেজ করে আয়েশা। কিন্তু প্রণয়ের ফোন করা কঠোর ভাবে নিষেধ।
এইভাবে ফোনে শুকনো প্রেম আর কতদিন চলে, আর ওরা ঠিক করেছে এবার দেখা করবেই। সৌভাগ্যক্রমে এবার ইদ পড়েছে বড়দিনের দিন দুয়েক পরেই। ইদের দিন বিশাল দাওয়াত দেয় আয়েশার বাবা। আগের দিন সারারাত ধরে তার তোড়জোড় চলে, পরদিন ভোর থেকেই আত্মীয় স্বজন সবাই আসতে শুরু করে। ঠিক হল, আয়েশা নৈশাহার সমাপ্ত করে, মাথা ধরার বাহানা করে জলদি শুতে যাবে। তারপর রাত সাড়ে দশটা এগারটা নাগাদ, লুকিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে আসবে প্রণয়দের আবাসনে। একত্রে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার ভোর হবার আগেই ফিরে যাবে। প্রণয়ই ছেড়ে আসবে ওকে। প্রণয় ওকে আনতেও চেয়েছিল, কিন্তু আয়েশা রাজি হয়নি। আয়েশার আব্দার রাখতে চটজলদি বাবা-মাকে দেওঘর পাঠিয়ে দিয়েছে প্রণয়, যাতে ইদের আগের রাতটা সত্যি চাঁদরাতহতে পারে।
রাত এগারোটা বাজে, প্রণয়দের ঝিনচ্যাক হাউসিঙ ঘুমে ঢুলছে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছে এবার, ঘন থকথকে কুয়াশা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে কলকাতাকে। সেই সাড়ে দশটা থেকে বিশাল পার্কটায় একা বসে আছে প্রণয়।চারদিকে সুদৃশ্য বিল্ডিংরাজি আর মাঝখানে এই সুসজ্জিত পার্ক। পার্কে কোন আলো নেই, পার্কের চতুর্দিকের রাস্তার আলো কুয়াশা ভেদ করে যেটুকু ঢুকছে, তাতে আরও গাছমছমে রহস্যময় লাগছে পার্কটাকে। দুবার ফোন করেছে, আয়েশার ফোন যথারীতি বন্ধ। পার্কের বেঞ্চে আর বসা যাচ্ছে না, ঠাণ্ডায় আঙুলের ডগা গুলো অসাড় হয়ে যাবে এবার, উঠে যাবে কিনা ভাবছে যখন হঠাৎ উল্টো দিকের ঘন গোলাপ ঝাড়টা ঠেলে একটা মেয়ে প্রবেশ করল। বুকটা ধক করে উঠল প্রণয়ের। এল তাহলে। আধো অন্ধকারে মনে হল, মাঝারি উচ্চতা, একটু ভারি গড়ন, পরনে একটা কালো রঙের ট্রাক প্যান্ট আর কালো হুডেড জ্যাকেট। লাল ও হতে পারে, অন্ধকারে কালোই মনে হচ্ছিল। হুডটা অনেকটা টানা, মুখ প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। প্রণয় সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারছে না, মেয়েটিই এগিয়ে এল, দাঁতে দাঁত চেপে অবাঙালী উচ্চারণে বলল, “ প্রণয়? আই গেস। প্রণয় মাথা নেড়ে এগিয়ে গেল, হঠাৎ মেয়েটা নাক চেপে পিছিয়ে গেল, “ ইইউ। ইউ স্টিঙ্ক। ইয়াক।অস্বীকার করতে পারল না প্রণয়, সন্ধ্যে থেকে এই অভিসারের উত্তেজনা একা একা সইতে পারছিল না, তাই উত্তেজনা কমাতে ছোট করে দুপাত্র মদ্য পান করে এসেছে। ভাগ্যিস করেছিল, নাহলে এই ঠাণ্ডায় জমে আইসক্রিম হয়ে যেত। আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রণয় কিছু বলতে যাবে, তার আগেই মেয়েটি নিজের পকেট থেকে একটা পারফিউমের শিশি বড় করে, প্রণয়ের গায়ে ছিটিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে কাটা কলাগাছের মত ধপ করে পড়ে গেল প্রণয়। দূরের গোলাপ ঝাড় থেকে নিঃশব্দে ছুটে এল কালো শাল মোড়া আর একজন।
দুমাস কেটে গেছে, প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গিয়ে রীতিমত হতাশ লাগে আজকাল ওদের। এই দুমাসে ওরা অনুরাধার বরের নাম বা ঠিকানা কিছুই জোগাড় করতে পারেনি। রোজ নানা পরিকল্পনা করে দেবিকা, আর অন্তরা শোনা মাত্র তা নাকচ করে দেয়। যেমন দেবী হয়তো বলল অনুর মাকেই জিজ্ঞাসা করি না ওর বরের নাম ঠিকানা?” “অনুর মাকেই জিজ্ঞাসা করি নাভেংচে উঠল অন্তরা, “যাতে মালটা টেঁসে যাওয়া মাত্রই পুলিশ আমাদের বাড়ি এসে কড়া নাড়ে? এত বছর হল অনু চলে গেছে, কতবার গেছিস ওদের বাড়ি? আর আজ এক যুগ পরে গিয়ে কি শুধাবি? কাকিমা অনুর বরের নাম ঠিকানাটা দাও তো, মালটাকে ভোগে পাঠাব?” দেবী বিরক্ত হয়ে শেষে একদিন বলল, “এবার তো দেখছি অনুকেই ডাকতে হয়, আর একবার আয় রে মালটা, পেত্নী কাহিকা। তোর বরের নাম-ঠিকানা কিছুই জানি না, তাকে খুন করব কি করে?” “শশশশশহিসিয়ে উঠল অন্তরা, “ডু নট ইউজ দ্যাট ওয়ার্ড।দেবী জিভ কাটল, একটু গোপনীয়তার জন্য কি পাঁপড়ই না বেলছে দুজনে, পুরানো সস্তার ফোন, দুনম্বরী সিম কার্ড, তাও সারাদিন বন্ধ রাখে ওরা। নির্দিষ্ট দিন এবং ক্ষণে বাড়ি তথা অফিস থেকে বেশ দূরের কোন জনবহুল এলাকা থেকে একে অপরকে ফোন করে ওরা, তাও কিয়ৎ ক্ষণের জন্য মাত্র। অন্তরা খানিকক্ষণ নীরব থেকে বলল, “আমি আজকাল রোজই অনুকে স্বপ্নে দেখি জানিস।” “তাই?” সহর্ষে বলল দেবী, “কি দেখিস? ভাল করে ভাব, হয়তো কিছু বলতে চায় ও।আমেদাবাদের ইস্কন মেগা মলে উয়িন্ডো শপিং করতে করতে অন্তরা আনমনে বলল, “না তেমন কিছু নয়। রোজই স্বপ্নে ও আমাদের বাড়ি আসে। আমরা প্রচুর গল্প করি। সেই কলেজের অনুরাধা।” “কি নিয়ে গল্প করিস? কোথায় যাস? বাড়ির কোন বিশেষ জায়গায়?” দেবী উত্তেজিত হয়ে বলল। কোথাও নয়। আমার ঘরে-বলে থমকে গেল অন্তরা, “এই মনে পড়েছে, রোজ আমি বিছানায় বসি আর ও আমার ঘরে রাখা লোহার সিন্দুকটার ওপর বসে। আলতো করে হাত বোলায় ওর গায়ে। সেই লাল লোহার সিন্দুকটা, তোর মনে আছে?” দেবী মুখ ভেটকে বলল, “সেই লোহার ট্রাঙ্কটা? যাতে তুই গল্পের বই আর কাঁচের চুড়ির বাক্স রাখতিস? কিন্তু ভূত তো শুনেছি লোহাকে ভয় পায়? পেত্নিটা কি মাইরি। অন্তরা সিরিয়াস হয়ে বলল, “দেবী তোকে একবার আমাদের বাড়ি যেতে হবে। আমার ঘরে আজকাল আমার ভাইঝি শোয়, কিন্তু ঐ ট্রাঙ্কটার চাবি মা ওকে দেয়নি। ওতে নির্ঘাত কিছু আছে। শোন তুই আমার আসল নম্বরে হোয়াটস অ্যাপ কর যে আমার বাংলা গড ফাদারটা তোর চাই।” “সেই লীলা রায়ের অনুবাদটা? ওটা তো আমার কাছেই আছে। তোর থেকে ঝেড়েছিলাম।জিভ কেটে বলল দেবী। অন্তরা পাত্তা না দিয়ে বলল, “জানি। তাই জন্যই বলছি। আমি মেসেজ করব, বইটা সম্ভবত ট্রাঙ্কে আছে।
শুধু একটা বাংলা গড ফাদারের জন্য চন্দননগর যাওয়াটা আদৌ যুক্তি গ্রাহ্য নয় বলেই, দেবিকা নিজের অসুস্থ ছোটকাকাকে দেখার বাহানা করে ফিরে গেল নিজেদের পুরানো শহরে। সেই চন্দননগর, সেই গঙ্গার ধার, অচেনা হয়ে আসা চেনা চেনা পথঘাট, বুড়ো হয়ে যাওয়া পরিচিত লোকজন, মন খারাপ হয়ে গেল দেবিকার। ওরা ছিল ত্রয়ী, আর আজ কোথায় অনুরাধা, কোথায়ই বা অন্তরা। কাকাকে দেখে, অন্তরার নির্দেশ মত গিয়ে হাজির হল ওদের বাড়ি। অন্তুর মা ওকে দেখে খুশি হলেও অন্তরার বৌদি আদপেই হল না। একাধিক বার চাওয়া সত্ত্বেও অন্তরার ঘরের আলমারি বুককেসের চাবি ওর মা কাছছাড়া করেননি, অথচ অন্তরার বন্ধু এসে চাইতেই এক কথায় দিয়ে দিলেন, ব্যাপারটা বৌদির আদৌ মনঃপূত হয়নি। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল দেবিকার পিছনে, কি নিয়ে যেতে এসেছে দেখার জন্য। দেবী বিরক্ত হয়ে মেসেজ পাঠাল, “ তোর বৌদি একটা স্যাম্পল মাইরি। আমার পিছনে চিটকে গেছে।অন্তরা তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, “ডোন্ট অরি ডার্লিং। একটা আরশোলা বেরোলেই বৌদি পালাবে, ট্রাস্ট মি, ট্রাঙ্কে এক ডজন আরশোলা পাবি।
অন্তরার ভবিষ্যতবাণী যথার্থ প্রমাণ করে আরশোলা দেখা মাত্র বৌদি মূর্ছা পেয়ে পালালেন, দেবিকা একা একাই তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল ট্রাঙ্ক, একগাদা লাল হয়ে যাওয়া গল্পের বই, ডাইরি, কবিতার খাতা, গাদা গাদা কাঁচের চুড়ির বাক্স, ঘাঁটতে ঘাঁটতে চমকে উঠল, ট্রাঙ্কের একদম তলায়, একরাশ আরশোলার নাদির মাঝে পরে আছে একটা প্রায় বিবর্ণ লাল খাম, যার এককোণে হলুদের ফোটাটা আজো অম্লান, আর এককোণে লেখা শুভবিবাহ।
অনুরাধার বিয়ের কার্ড থেকে পাওয়া ঠিকানায় আজ এসেছে দেবিকা, পরনে খাদির সালোয়ার কামিজ, ওড়নাও নিয়েছে। সেই স্কুল ছাড়ার পর থেকে কোনদিন সালোয়ার পড়েনি দেবিকা, ওর পরিচিতরা ওকে দেখলে চিনবে কি না সন্দেহ, কিন্তু অন্তরার হুকুম। তাই চোখে কালো চশমা পরে, ওড়নাটা হিজাবের মত মাথায় জড়িয়েছে। আজকাল রোদ থেকে বাঁচতে অনেকেই এভাবে ওড়না নেয়। বেশ জনবহুল বাজার এলাকা, যদিও গলি, অনুরাধার শ্বশুর বাড়ির কোণাকুণি উল্টো দিকে একটা পানের দোকান, সেখানে গিয়ে, নেকু সুরে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দাদা, ২২/B কোন বাড়িটা?” পানওয়ালা অন্যমনস্ক ভাবে একটা বড় হলুদ বাড়ি দেখাল। বাড়িটা দেবী আগেই দেখে রেখেছে। ওর চাই খবর, অনুর বরের হাল হকিকৎ। পরিতোষ মল্লিক এখানেই থাকেন তো?” পানওয়ালা একটু ভেবে বলল, “এখানে মল্লিক বাড়ি তো একটাই। তবে পরিতোষ-। দেবিকা ঢোঁক গিলে দুখু দুখু স্বরে বলল, “আসলে আমার বাবার বন্ধু, বাবার খুব অসুখ তো তাই বন্ধুকে দেখতে চায়।বলেই জিভ কাটল দেবী, বড্ড জলো হয়ে গেল কি? পানওয়ালা যদিও বিশ্বাস করে নিল, “ পরিতোষ বলে তো কেউ আছে কি? দাঁড়ান দেখছি
সে আবার পাশের মনিহারি দোকানে জিজ্ঞেস করল, দোকানি ঘাড় নেড়ে বলল, “পরিতোষ হল ও বাড়ির সেজ কর্তা। তারা তো বহুদিন হল চলে গেছে, নিজেদের অংশ বেচে দিয়ে।মুহূর্তের জন্য দেবীর মনে হল, ধরণী দ্বিধা হও। ভদ্রলোক বোধহয়, কালো চশমা আর হিজাবের মত জড়ানো ওড়না ভেদ করে পড়তে পারলেন ওর মনের ভাষা, তাই আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে বললেন, “ সেজদা বসত বাড়ি বেচে কলকাতায় চলে গেছেন গো। তবে ব্যবসার অংশ বেচেছেন কি না জানি না। বড় বাজারে ওনাদের বিশাল চুড়ির আড়ত, কাঁচের চুড়ির। ওনাদের মায়ের নামেই দোকান, ক্যানিং স্ট্রিটে খুঁজলেই পাবে।” “কি নাম যদি বলেনদেবী হর্ষ চেপে জিজ্ঞাসা করল, লোকটি হেসে বলল, “ওদের বাড়ির যা নাম স্বর্ণময়ী স্টোরস।
স্বর্ণময়ী ষ্টোরস? ক্যানিং স্ট্রীট?” অন্তরা চিন্তান্বিত হয়ে বলল। হুঁ। দেখি অফিস থেকে একদিন টুক করে ঘুরে আসববলল দেবিকা। ক্ষ্যামা দে মা। তুই যাবি চুড়ির দোকানে, কি করতে চুড়ি কিনতে? তোর ঐ ছেলেদের মত বাটি ছাঁট চুল, ফেডেড জিন্স আর সেমি ফর্মাল শার্ট দেখে কোন ছাগলে বিশ্বাস করবে? কানে হাতে গলায় আঙুলে কোথাও কোনদিন কিছু পড়লি না, আর আজ যাবি কাঁচের চুড়ি কিনতে।বিরক্ত হয়ে বলল অন্তরা। তাছাড়া ক্যানিং স্ট্রিটের আড়ত বললি, ওরা আদৌ পাইকারি বিক্রেতা কি না আগে দেখতে হবে। তুই বরং এমনি লোকেশনটা দেখে আয়, আর পাইকারি বিক্রেতা কি না দেখে আয়। কিন্তু কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাস না।” “বেশ! তাহলে কে যাবে মামনি? তুমি আসবে নাকি জিজ্ঞাসাবাদ করতে?” বিদ্রূপের সুরে বলে উঠল দেবিকা। হ্যাঁ। আসব। মার্চ মাসে ছেলের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই কয়েকদিনের জন্য-। আসতে আমাকে হবেই।
মার্চ মাস, দোল গেছে কিছুদিন হল, আপাতত মার্কেট একটু ডাউন, তাই নিয়ে অবশ্য বড় বাজার আদৌ ভাবিত নয়, কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে চৈত্র সেল আর পিলপিল করে খরিদ্দার এসে হাজির হবে। দুপুর তিনটে বাজছে, রোদের আজ বেশ তাত, স্বর্ণময়ী স্টোর এই মুহূর্তে বেশ ফাঁকা। বহুদিনের পুরানো কর্মী ভূদেব বাবু তাই আপাতত চুড়ি দেখানোর সাথে সাথে খোশ গল্প জুড়েছেন খরিদ্দারের সাথে। একটি অল্প বয়সী মেয়ে, পরনে মামুলী সুতির সালোয়ার কামিজ, ভূদেব বাবু ভেবেছিলেন হয়তো কাপড় মিলিয়ে এক দু ডজন চুড়ি কিনবে, কিন্তু মেয়েটি অনেক কিনল। সত্যি কথা বলতে কি ভূদেব বাবু যা যা দেখিয়েছেন কোনটাই মেয়েটি না করতে পারেনি। খরিদ্দারকে এক নজর দেখলেই উনি বুঝে যান, কার কি পছন্দ। বিকিকিনি হয়ে যাবার পরও মেয়েটি উঠল না, হাঁ করে দোকানটা দেখতে দেখতে বলল, ‘ ছোট থেকে এই দোকানের চুড়ি কিনছি জানেন। এটা পরিতোষ কাকুদের দোকান তো, জানেন, উনি বাবার সাথে স্কুলে পড়তেন।ভূদেব বাবু স্বস্নেহে বললেন, “তাই নাকি? সেজ কর্তার বন্ধু নাকি?” মেয়েটি সলজ্জ ভাবে হেসে বলল, “ কেমন আছেন কাকু? আজকাল আর আসেন না দোকানে?” ভূদেব বাবু হেসে বললেন, “ বহুদিন আসেন না। ওনার শেয়ার উনি বাকি তিন ভাইকে বেচে দিয়েছেন।দৃশ্যত আশাহত হয়ে মেয়েটি বলল, ‘ এ বাবা! কেন?” পরক্ষণেই গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্র করার ভঙ্গীতে বলল, “ওনাদের পরিবারে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছিল, তাই জন্য কি?” ভূদেব বাবু মাথা নেড়ে বললেন, “ হ্যাঁ সেই ওনার পুত্রবধূর আত্মহত্যাটা তো? সে সব তো কবেই চুকেবুকে গেছে। মেয়েটির প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে আশনাই ছিল, সুইসাইড নোট পাওয়া গিয়েছিল তো। আদালত বেকসুর খালাস করে দেয় ওর ছেলে কে।মেয়েটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, “যাক বাবা। বে-ক-সু-র খা-লা-স। ভূদেব বাবু উৎসাহিত হয়ে বললেন, “ওনার ছেলে তো আবার বিয়েও করেছে, তাও বেশ অনেক বছরই হল। সেজ বাবু তো কোন্নগরের বাড়িও বেচে দিয়েছেন, এখন ছেলে বউয়ের সাথে থাকেন।” “বাঃ। আসলে ঐ ঘটনার পরই আমরা বিলাসপুর চলে যাই। তারপর তো ওখানেই বিয়েশাদি করে সেটল হলাম, ওনাদের খবর আর নেওয়া হয়নি। বাবা কিছুদিন যোগাযোগ রেখেছিল, তারপর যা হয় আর কি। তা কাকু ওনার কোন ফোন নম্বর পাব আপনার কাছে?” ভূদেব বাবু মাথা নাড়লেন।
যাঃ শালা। কিছুই জানতে পারলি না?” সিগারেটের ধোঁয়া দিয়ে রিং ছাড়তে ছাড়তে বলল দেবী। পুরানো ঠেকে বসেছে দুজনে, সেই গঙ্গার ধার, সেই পদ্মনাভ বাবুদের ভাঙা হানা বাড়ি, এত বছরেও বিক্রি করতে পারেনি ওরা, বা করেনি হয়তো। ভাঙা ঘাটের সিঁড়িতে বসে আনমনে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল অন্তরা। তারপর হঠাৎ ঘুরে বলল, “ আচ্ছা অনু সত্যি সুইসাইড করেনি তো?” “মানে?” সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে খাড়া হয়ে বসল দেবী। কি বলতে চাইছিস?” অন্তরা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “ সত্যি যদি পুরানো প্রেম-।দেবী সিরিয়াস হয়ে বলল, “ স্বয়ং অনু এসেও যদি স্বীকার করে আমি মানব না। অ-নু আর বিবাহ বহির্ভূত প্রেম? আরে গাড়ল ওরা তো ওসব বলবেই। শোন তোর মনে যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে, তুই ফিরে যা। আই উইল অ্যাভেঞ্জ হার এলোন। কোন শালা কে দরকার নেই।অন্তরা শ্বাস ছেড়ে বলল, “গাড়লের মত কথা বলিস না। অনু যতটা তোর ততোটাই আমার। আমি শুধু ভাবছিলাম, যে সত্যি আমরা অনুকে দেখলাম, নাকি সবটাই আমাদের মনের ভুল? তুই তো শালা মাল খেয়ে কি দেখতে কি দেখলি, কিন্তু আমি কি দেখলাম? মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, একটা সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা দেবী রেগে চলে যাচ্ছিল, অন্তু দৌড়ে গিয়ে ধরল, “আসল কথাটা না শুনে চলে যাস না, বাবুসোনা মিত্র এন্ড ব্রায়ানে চাকরি করে।” “ কে বাবুসোনা? মাথাটা গেছে তোর।বিজ্ঞের মত হেসে অন্তরা বলল, “ বাবুসোনা হল শ্রী প্রিয়ব্রত মল্লিক, পরিতোষ মল্লিকের একমাত্র পুত্র।” “গ্রেট গুরু। ফাটিয়ে দিয়েছ মাইরি। মিত্র এন্ড ব্রায়ান চাটারড অ্যাকাউন্ট? মিশন রো এ অফিস, আমার এক বন্ধু ডালিয়া ওখানে চাকরি করে। উফ! এতদিনে মনে হচ্ছে একটু এগোনো গেল।অন্তরা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “ শোন একটা কথা বলি, প্রিয়ব্রত মালটা আবার বিয়ে করেছে, হয়তো বাচ্ছা কাচ্ছাও আছে। এমতবস্থায় ওকে কিছু করলে ওর বউ বাচ্ছা কিন্তু তার ফল ভোগ করবে।” “ফুঃ যুদ্ধে কিছু নিরীহ মানুষও মরে অন্তু।” “না, ওভাবে আমরা দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না। যদি ওর বউ বাচ্ছা থাকে তাহলে কিন্তু কথা শেষ করতে পারল না অন্তু, দেবী হাত তুলে বলে উঠল, “অলরাইট ভেরি গুড। যদি ওর বউ বাচ্ছা থাকে তুই কিছু করিস না, আমি মেরে হারামজাদার হাত-পা ভেঙে দেব।
যত সহজে এগবে ভেবেছিল ওরা, তা হল না। ডালিয়ার অফিসে কোন প্রিয়ব্রত মল্লিক কাজ করে না। শুধু এই খবরটুকুর জন্য দেবী আজ ডালিয়ার বাড়ি এসেছে, সাথে ৪০০/৫০০ টাকার উপহার এনেছে ডালিয়ার কয়েক মাসের ছেলের জন্য। ডালিয়া প্রায় আসতে বলত, দেবী জানত কোনদিনই যাবে না, কিন্তু অনুর জন্যআজ ছুটির দিন ঘুম বাতিল করে ওকে ঠেঙিয়ে আসতে হয়েছে সোদপুর। অন্তু বারবার নিষেধ করে দিয়েছে, তড়িঘড়ি যেন না করে। প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে দন্ত বিকশিত করে ডালিয়ার বাচ্ছার গপ্প শুনেছে, অবশেষে সুযোগ বুঝে যেই প্রশ্ন করেছে, ডালিয়া তো আকাশ থেকে পড়ল। দেবী কিছুক্ষণ হতাশ হয়ে বসে রইল, তারপর মাথায় একটা আইডিয়া এল, “ এই নামটা আমি ভুলও বলতে পারি জানিস। বাবুসোনাদার ভালো নাম অন্য কিছু ও হতে পারে জানিস। আমাদের ওদিককারই ছেলে, সেদিন দেখা হল বলল, মিত্র এন্ড ব্রায়ানেই আছে। আচ্ছা পি মল্লিক বলে কি কেউ নেই তোদের অফিসে।ডালিয়া বোধহয় আবার নিজের ছানার গপ্প শুরু করতে যাচ্ছিল, মাথা চুলকে বলল, “ মল্লিক একজনই আছে রে, প্রণয় মল্লিক। কিন্তু সে তো বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলির ওদিকে একটা ঝিনচ্যাক হাউসিঙ এ থাকে। তোদের মফস্বলের ছেলে নয়।দেবী অস্ফুটে একটা খিস্তি দিল, “শালা থাকিস সোদপুরে আর কোন্নগরকে মফস্বল বলছে!কিন্তু বাইরে দেঁতো হাসি হেসে বলল, “ না রে। আজকাল আর ওরা ওখানে থাকে না। ওনার জীবনে একটা মিসহ্যাপ ঘটেছিল, তারপর ওরা আমাদের শহর ছেড়ে চলে যায়।ডালিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “হু। হতে পারে। ওনার প্রথম পক্ষের বউ মারা গিয়েছিল শুনেছি।হৃদস্পন্দন প্রায় স্তব্ধ হয়ে এল দেবীর, চোরের মত বলল, “ হ্যাঁরে। খুব প্যাথেটিক। তবে আবার বিয়ে করেছে, শুনেছি এখন খুব সুখে আছে।ডালিয়া বিরক্ত হয়ে বলল, “ কে জানে। প্রণয়ি তোর বাবুসোনাদা কি না। খুব গম্ভীর প্রকৃতির, অফিসে কারো সাথে সদ্ভাব নেই।একটু দম নিয়ে, পরচর্চা করার ভঙ্গীতে বলল, “ অনেক দিনই তো বিয়ে হয়েছে, বাচ্ছাকাচ্ছা আছে বলে তো শুনিনি, আর এই বউয়ের সাথেও নাকি বনিবনা নেই। সেও বোধহয় ভেগেছে জানিস। হিঃ হিঃ হিঃ। একটা লোকের একটা বউ সুইসাইড করে আর একটা বউ ভেগে যায় মানে কি বলতোচোখ টিপে জিজ্ঞেস করল ডালিয়া। খুশিতে দেবীর বুকের ভিতর ততক্ষণে পপকর্ণ ফাটছে, মুখে যদিও বলল, “ফোট শালা। এই গসিপ করিস তোরা অফিসে। বাবুসোনাদার নম্বরটা দে।হাত উল্টে ডালিয়া বলল, “ওসব গোমড়াথোরিয়ামের নম্বর আমি রাখি না। দেখতেও যদি ভাল হত!
ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান। না ঠিকানা পাওয়া গেল, না ফোন নম্বর।বলল অন্তরা। দেবিকা চিন্তান্বিত স্বরে বলল, “কি করা যায়? অবশ্য ও কোথায় কাজ করে, সেটা জানি- তো?” খিঁচিয়ে উঠল অন্তরা, “ কি করবি? সোজা ওর অফিসে গিয়ে হাজির হবি? ওতো বড় একটা মুস্কো লোককে ঠেঙাবার মত গায়ের জোর আমার বা তোর নেই। অ্যাক্সেপ্ট ইট। আর না হলে কি করবি? ওকে ফলো করবি? তুই একটা নামি মেডিসিন কোম্পানির সেলস এক্সিকিউটিভ, কোন পেশাদার টিকটিকি নস।দেবিকা তাও মিনমিন করে বলল, “অ্যাটলিস্ট এটুকু জানি যে মালটা বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলি-মাঝপথে অন্তরা আবার খিঁচিয়ে উঠল, “ আঃ। গাধার মত কথা বলিস না। বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলিতে ঝিনচ্যাক হাউসিঙ কটা আছে জানিস? আর একেকটায় কটা ফ্ল্যাট আছে জানিস? কোথায় কোথায় খুজবি?” দেবিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কথাটা ওর মাথাতেও এসেছে। অন্তরা উত্তেজিত হয়ে বকেই যাচ্ছে, দেবী আশাহত হয়ে বলল, “ একটাই ভালো খবর, ওর এই বিয়েটাও সম্ভবত ভাঙছে।অন্তরা কেজো গলায় বলল, “সেটাও শিয়র নস। অফিসে নোংরা গসিপ চলেই। হয়তো ওদের মামুলীদাম্পত্য কলহ চলছে।
শুক্রবার রাতটা এলেই প্রচন্ড আনন্দ লাগে অন্তরার। আগামী দুটো দিন অন্তত একটু আরাম পাওয়া যাবে, আজো রান্নাঘর গুছিয়ে, শোবার ঘরে উঁকি মেরে দেখল ক্লান্ত হয়ে পুপাই ঘুমিয়ে পড়েছে, আনন্দে গান গাইতে ইচ্ছা করছিল অন্তরার, পা টিপে টিপে স্টাডি রুমে উঁকি মেরে দেখল জয় আপন মনে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে, তার মানে জলদি শুতে আসার সম্ভবনা নেই। একটা সিগারেটের জন্য প্রাণটা হাঁকুপাঁকু করতে লাগল, লক্ষ্মী বউয়ের মত জয়কে বলে ছাতে উঠে এল অন্তরা। সিগারেট খাওয়া জয়ের একদম পছন্দ নয়, অগত্যা গৃহবিবাদ এড়াতে লুকিয়ে ধূমপান করতে হয় তাও নমাসে ছমাসে। এই মুহূর্তে অন্তরা ছাড়া আর কেউই নেই ছাতে, দূরে নিওন জলা রাস্তা, এত রাতেও গাড়ির বিরাম নেই। আকাশে হাল্কা মেঘ আছে, চাঁদের মুখ দেখা যাচ্ছে না, আপন মনে সিগারেট ফুঁকছিল অন্তরা, হঠাৎ বেশ শীত শীত লাগতে লাগল। কি হল রে বাবা জ্বর আসছে নাকি? সিগারেটে শেষ টান মেরে ফেলবার আগেই থরথর করে কাঁপতে লাগল অন্তরা, কি অসহ্য দম বন্ধ করা ঠাণ্ডা রে বাবা। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বিপদ সঙ্কেত বুঝে দ্রুত নীচে নামবে বলে পিছন ফিরতেই দেখে, ঠিক ওর পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে অনু। সেই পুড়ে যাওয়া, গলে যাওয়া অনুরাধা। দুচোখে এক অদ্ভুত শীতলতা, অন্তরা পড়ে যেতে যেতে ছাতের কার্নিশটা খপ করে ধরে ফেলল, গোটা শরীর জমে যাচ্ছে, গলায় কথা গুলো পর্যন্ত। অনুই বলল, “ গৃহপ্রবেশ করবি না অন্তু?”
গৃহপ্রবেশ? মানে কি?” অসহিষ্ণু গলায় বলল দেবিকা। অন্তরা বলল, “আমি বুঝেছি ও কি বলতে চায়। শোন আমাদের একটা ফ্ল্যাট আছে, কলকাতায়, এয়ারপোর্টের কাছে। কখনও থাকিনি যদিও। আমার ধারণা প্রিয়ব্রত ওখানেই থাকে।” “ফ্ল্যাট না হাউসিঙ?” দেবী জানতে চাইল। হাউসিঙঅন্তরা একটু থেমে থেমে বলল, একটা জলাকে ঘিরে বিশাল হাউসিং। প্রায় বারোশ ফ্ল্যাট আছে।” “বা-রো- শ? এত লোকের মাঝে খুঁজব কি করে?” দেবী হতাশ গলায় বলল। অন্তরা গলা ঝেড়ে বলল, “ খুঁজতে তো হবেই। না হলে ও আবার আমায় বা তোকে দেখা দেবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি ঐ বীভৎস রূপ আর না দেখতে হয়। শোন আমি সব ভেবে রেখেছি। তুই বলছিলি না, তোর ফ্ল্যাটটা রিমডেলিং করাবি, মাস দুই তিন লাগবে, ততদিন অন্য কোথাও ফ্ল্যাট ভাড়া খুঁজছিস। তুই আমাদের ফ্যাল্টে শিফট করে যা। তোর অফিস নিউটাউনে, আমাদের ওখান থেকে সুবিধাই হবে, আর তোর ভাড়াটাও বেঁচে যাবে।
মাস খানেকের মধ্যেই বাড়ি বদল করল দেবিকা। সকাল সন্ধ্যা অন্তরার নির্দেশ মত, জলার চারপাশে হাঁটে ও। এই আবাসন এমনকি আসেপাশের আবাসন থেকেও লোকে হাঁটতে আসে এখানে। সপ্তাহ দুয়েক ব্যর্থ প্রচেষ্টায় কাটার পর, অবশেষে একদিন পাখির দেখা মিলল। চিনতে অসুবিধা হল না। বয়সের সাথে সাথে আরও বৃষস্কন্ধ হয়েছে লোকটা, মাথার চুলগুলো মস্তানদের মত ছোট ছোট করে কাটা, দূর থেকে ওকে অনুসরণ করতে লাগল দেবিকা, লোকটা হাঁটতে আসেনি, অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে। নীরবে বিল্ডিং অবধি অনুসরণ করলেও লিফটে আর উঠল না দেবিকা। দিন দুয়েক পর, দুপুর বেলা গিয়ে হাজির হল ঐ বিল্ডিংয়ে, লিফটে না উঠে পায়ে হেঁটে প্রতিটা ফ্ল্যাট দেখতে লাগল। পাঁচতলা বিল্ডিং, একতলা গ্যারাজ বাদে মোট ষোলটা ফ্ল্যাট, চারতলার একটা ফ্ল্যাটের দরজায় কাগজ সাঁটা মল্লিকবলে।
এর পরের ধাপ ছিল ঐ বাড়ির মাসিকে জোগাড় করা, অন্তরাদের এই হাউসিংয়ে অনেক গুলো কোওপারেটিভ, প্রতিটা কোওপারেটিভের নিজস্ব সিকিউরিটি তথা নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। ভাগ্য ভাল, যে মল্লিকদের ফ্ল্যাট আর অন্তরা দের ফ্ল্যাট বেশ দূরে দূরে হলেও একই কোওপারেটিভের অন্তর্গত। অন্তরার নির্দেশ মত সিকিউরিটির সাথে আগে থেকেই ভাব জমিয়ে রেখেছে দেবিকা। কাজে কাজেই ঐ ফ্ল্যাটে কোন মাসি কাজ করে আর কোন মাসি রান্না করে জানতে কোন সমস্যাই হল না দেবীর। রান্নার মাসির নাম নাজিয়া, সেই দীর্ঘদিন ধরে ও বাড়িতে রান্না করছে। সিকিউরিটির সৌজন্যে নাজিয়া এবাড়িতেও রান্না করতে লাগল। নাজিয়ার হেভি ডিমান্ড, তেমনি খর মেজাজ। রাতে একবার এসে রান্না করে দিয়ে যাবে, সকালে তাই গরম করে খেতে হবে। আর মাসে চারদিন সবেতন ছুটি। সব শর্ত মেনে নিল দেবী। অচিরেই বোঝা গেল, নাজিয়া হচ্ছে গসিপ কুইন। এত বুড়ো বয়সেও দেবী কেন বিয়ে করেনি, এই নিয়ে নাজিয়ার যেমন কৌতূহল, তেমনি হাউসিংয়ের কোন ফ্ল্যাটে কি হচ্ছে সে খবর শোনাতেও সে ব্যগ্র। প্রণয় ওরফে প্রিয়ব্রতর খবর জানতেও বিলম্ব হল না ওদের। প্রিয়ব্রত যে একটা বার ডান্সারকে বিয়ে করেছিল, এবং তাই নিয়ে ওর বাবা-মার সাথে ওদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেছিল সে খবর নাজিয়াই দিল। প্রিয়ব্রতকে নাজিয়া বেশ পছন্দ করে, “দাদা খুব ভাল জান তো দিদি। কিন্তু বউটা ভাল ছেল না। বউ মানুষ, না শাড়ি না সিঁদুর-।দেবী বিরক্ত হয়ে বলল, “ এখানে কোন বউটা শাড়ি শাঁখা পলা সিঁদুর পড়ে গো নাজিয়াদি?” নাজিয়া মুখ বেঁকিয়ে বলল, “ নাই পরুক, তাই বলে বাড়িতে সবাই হাফ প্যান্ট পরে ঘোরে নাকি? সারাদিন বিছানায় গড়াগড়ি দিত, আর নাহলে সাজুগুজু করত। একটা কাজ করত না, চা খেয়েও কাপটা সিঙ্কে নামিয়ে আসত না। আর দাদা তো মেগা মেগা করে অস্থির।” “মেগা? ও আচ্ছা মেঘা হবে।” “ঐ হল। কোন শাশুড়ি বউয়ের ঐ ধিঙ্গিপনা সইবে বলদিনি? কাকা-কাকি তো এখানে আসতো না। সম্পর্কই তুলে দিয়েছিল। পাটুলি না কোথায় ওদের নিজেদের ফ্ল্যাট আছে, সেখানে থাকত। এটা তো ভাড়ার ফ্ল্যাট। বউ ও যেত না জান। তারপর কাকির এমন অসুখ হল, বুড়ো মানুষ কে দেখবে বল? ওদের এখানেই নিয়ে এল দাদা। ব্যস ওমনি অশান্তি লেগে গেল। রোজ রোজ খিটিমিটি। কাকি তো আমার কাছে কাঁদত, বাড়ির বউ মদ খায়? আর ফোন? সারাদিন ফোনে চিপকে থাকত। একদিন গিয়ে দেখি নেই, পাখি উড়ে গেছে। দাদা অবশ্য বলে বাপের বাড়ি গেছে, কিন্তু কাকি বলেছে আমায়, পালিয়েছে, যাবার সময়, দাদা যত দামি দামি জামা, জুতো সাজের জিনিষ আর গয়না দিয়েছিল, সেগুলোও-।বলে কুৎসিত ইশারা করে হাসল নাজিয়া।
ওকে। এবার? এবার কি করণীয়?” জিজ্ঞাসা করল দেবিকা। ফোন নম্বরটা জোগাড় কর।হিসিয়ে উঠল অন্তরা। করেছি। আজই।” “কি ভাবে?” উত্তেজিত হয়ে বলল অন্তরা। জাঙিয়া যখন রান্না করছিল, ওর ফোনটা খাওয়ার টেবিলে পড়ে ছিল। পাতি নোকিয়া। খুলে সার্চ করে দেখলাম।” “জাঙিয়া?” “ঐ গসিপ কুইনকে আর কি নামে ডাকব? কি নোংরা মুখ।হাসতে হাসতে অন্তরা বলল, “ তা বেশ। কিন্তু নম্বরটা ওর বাবার ও তো হতে পারে।” “নারে লাবটা। ওরই। আমি জাঙিয়ার ফোন থেকে ফোন করে দেখেছি।” “বুঝতে পারেনি?” “নাঃ। সাধে কি বলি জাঙিয়া।
প্রিয়ব্রতকে তো খুঁজে পাওয়া গেল, এবার বাকি রইল শুধু তিনটি প্রশ্ন কবে, কোথায় আর কি করে? অনেক ভাবনাচিন্তা বাকবিতণ্ডার পর ওরা সহমত হল। এর পরের কাজ ছিল টোপ ফেলা। নাজিয়ার দৌলতে প্রিয়ব্রতের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর প্রায় সব খুঁটিনাটি ওদের নখদর্পণে, প্রিয়ব্রত ওরফে আজকের প্রণয় যে তার বিরহে কাতর সেটাও ওদের অজানা নয়। সুতরাং মেঘাকে না দেখেও যতদূর সম্ভব মেঘার আদলে তৈরি করা হল আয়েশাকে। পাঠানো হতে থাকল বেনামি এসএমএস। প্রণয় চট করে টোপ গেলেনি । ধীরে ধীরে মিছরির ছুরির মত প্রণয়ের জীবনে ঢুকেছে আয়েশা। অবশেষে আজ মিলনরাত্রি, প্রণয় আর আয়েশার। দিন দুয়েক আগেই বড়দিন গেছে, উদ্দাম আনন্দে ভেসে গেছে এই আবাসন। আবার আগামী কাল খুশির ঈদ, তাই আজকের রাতে যেন একটু তাড়াতাড়িই ঝিমিয়ে পড়েছে ওদের হাউসিং। ঠাণ্ডাও পড়েছে জম্পেশ। শুনশান পথঘাট, অন্তরাদের বিল্ডিং এর সামনেই একটা ছোট পার্ক, সেখানেই প্রণয়কে আসতে বলেছে আয়েশা, পার্কটা নারকেল, সুপারি আর পান্থপাদক গাছ দিয়ে গোল করে ঘেরা। পার্কের মধ্যেও গোলাপ আর মেহেন্দি গাছের একাদিক সাজানো ঝোপ আছে। তেমনি একটা অপেক্ষাকৃত অন্ধকার ঝোপের পিছন থেকে ওরা লক্ষ্য করছিল প্রণয়কে। সাড়ে দশটার আগেই এসে হাজির হয়ে গেছে প্রণয়, অস্থির ভাবে একটা শিশিরে ভেজা বেঞ্চে বসে সিগারেট ধরাল, অস্থির ভাবে পার্কের চারদিকের রাস্তায় গোল চক্কর মেরে এল, ফোন করার চেষ্টা করল, কিন্তু ফোন বন্ধ। এগারোটা পাঁচ নাগাদ, প্রণয় যখন হতাশ হয়ে উঠে যাবে, দেবী ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে এল, পরনে ঘন কালো ট্রাক প্যান্ট,জ্যাকেট, মাথায় হুড তোলা। প্রণয় বিগলিত হয়ে এগিয়ে আসতেই স্প্রে রেডি ছিল। বার চারেক স্প্রে করা মাত্রই প্রণয় কাটা কলা গাছের মত ধপ করে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল অন্তরা, পরনে প্রায় এক পোশাক, ওপরে একটা কালো শাল জড়ানো, দ্রুত প্রণয়কে খাড়া করে ভালো করে শাল মুড়ে নিল দোহে।
সেই মুহূর্তে পার্কের আসেপাশে কেউ থাকলে দেখত, একটা মেয়ে তার মদ্যপ পুরুষসঙ্গীকে জড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর বেশ পিছনে আর একটি মেয়ে কানে ইয়ার ফোন গুঁজে হাঁটতে বেড়িয়েছে। আচমকা পিছনের মেয়েটি ওদের পাশ কাটিয়ে গিয়ে দাঁড়াল একটি বিল্ডিংএর সামনে, পকেট থেকে চাবি বার করে, তালা খুলে ভিতরে ঢুকে দরজাটা হাট করে খুলে দাঁড়াল, তার কয়েক মুহূর্ত পরেই মদ্যপ যুগল সেই বিল্ডিঙেই গিয়ে ঢুকল। একতলা অন্ধকার, প্রকৃতপক্ষে প্রতিটা প্যাসেজই অন্ধকার, সব ফ্লোরেই কোন না কোন ফ্লাটের বাসিন্দা ইতিমধ্যেই আলো গুলো নিভিয়ে দিয়েছে। অন্ধকার প্যাসেজে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল অন্তরা, “ কি ভারি রে শালা। দেবী এবার তুই টেনে নিয়ে চলহিসহিসিয়ে বলল অন্তরা। নিঃসাড়ে লিফটে গিয়ে উঠল ওরা, অচেতন প্রণয়ের শরীরটাকে টানতে টানতে। লিফটে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে অন্তরা বলল, “ আর ইউ সিয়র যে এই সিসিটিভি গুলো এখনও কাজ করে না?” দেবী মাথা নেড়ে বলল, “পসিটিভ। তোদের কোওপারেটিভের ম্যানেজারের সাথে সাধে খোশ গল্প করি? আপাতত শুধু মেন গেটে আর কোওপারেটিভ অফিসের সামনের গুলো ওয়ার্কিং। বাকি গুলো হতে আরও মাস খানেক সময় লাগবে।
প্রবল ঠাণ্ডা জলের ঝাপটায় প্রণয়ের জ্ঞান ফিরে এল, ছটফট করে উঠতে গেল প্রণয় পারল না, শক্ত করে চেয়ারের সাথে বেঁধেছে ওকে, হাত দুটো পিছন দিকে হাতকড়া দিয়ে আটকানো। পুলিশ ছাপ স্টিলের হাতকড়া নয়, রীতিমত ভেলভেট মোড়া পালক বসানো, টেনে খুলতে গেল প্রণয়, বিফল হল, ভিতরে সলিড স্টিল। কোথায় আছে ও? চোখে ঠুলি পরানো, নরম শারটিনের, কিন্তু দুর্ভেদ্য, এক বিন্দু আলোও আসছে না ওর চোখে। কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আয়েশা? এসব কি হচ্ছে? আমি কোথায়?” উল্টো দিক থেকে একটা তীক্ষ্ণ খোনা গলায় কেউ বলে উঠল, “জামাইরাজা।বলার সাথে সাথেই হাঁটুতে এক ঘা পড়ল, যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠতে গেল প্রণয়, গলার কাছে, ঠাণ্ডা ধাতুর স্পর্শ অনুভব করল, কানে কেউ ফিসফিস করে বলে উঠল, “চিল্লিয়েছিস কি মরেছিস।তীব্র আতঙ্কে চিৎকারটা বেমালুম গিলে নিল প্রণয়। কাতর ভাবে বলল, “প্লিজ, তুমি কে? আমি কোথায়? কি চাও?” “এক এক করে জবাব দিছি জামাইরাজা। প্রথম প্রশ্ন? আমি কে? উত্তর হলঅল্প নীরবতার পর আওয়াজটা হেসে বলল, “সেটা তোর জানার দরকার নেই রে কুত্তা।সাথে সাথেই বাঁ পায়ের হাঁটুতে আর এক ঘা। ঐ হাঁটুটা কয়েক বছর আগে ভেঙেছিল, যন্ত্রণায় প্রায় অজ্ঞান হতে বসল প্রণয়, কিন্তু পারল কই, আবার ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা। খোনা গলা আবার বলে উঠল, “দ্বিতীয় প্রশ্ন, তুই কোথায়? জবাব হল,” আবার নীরবতা, আসন্ন বিপদের আতঙ্কে কেঁপে উঠল প্রণয়, কিন্তু খোনা গলা খিকখিক করে হেসে বলল, “ তুমি সোসুর বাড়ি এসেছ সোনা। তোমার সোসুর পাঠিয়েছে আমাদের, তোমাকে রামকেলানি দিয়ে হাত পা ভেঙে গলার নলি কাটার জন্য।বলার সাথে সাথেই গলায় ঠাণ্ডা ধারালো ধাতুর স্পর্শ, গলায় একটু চাপ দিতেই আতঙ্কে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলল প্রণয়। খোনা গলা খিকখিক করে হেসে বলল, “এইতেই মুতে ফেললে সোনার চাঁদ। এখনও তো পুরো রাত বাকি জান।বাচ্ছা ছেলেদের মত হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে প্রণয় বলতে লাগল, “প্লিজ- প্লিজ- প্লিজ আমায় ছেড়ে দাও। কি চাই তোমাদের, টাকা-। মাঝ পথে মস্তকে এক প্রবল বাড়ি খেয়ে থমকে গেল প্রণয়, “এঃ। একে বে? আমাদের টাকা দিবি? টাকা তো অলরেডি দিয়ে রেখেছে তোর সোসুর, তোকে জবাই করার টাকা। তুই ওর মেয়েকে গায়েব করেছিস।
মেঘা?” অবিশ্বাসীর সুরে বলল প্রণয়, “অসম্ভব। মেঘা অনাথ। আমি ছাড়া ওর তিনকুলে কেউ নেই।হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল খোনা গলা। তাহলে তো তুই কিছুই জানিস না। মেঘার বাবা গুরগাওয়ের কুখ্যাত ল্যান্ড মাফিয়া। বাপের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে চায়নি বলেই পালিয়ে নাম ভাঁড়িয়ে কলকাতায় থাকত। তোকে ভালবেসে বিয়ে করল আর তুই কি না তাকেই ভোগে পাঠালি? বল মেঘা কোথায়?” সাথে সাথে ডান হাতের কনুইয়ে আর এক ঘা, ঝনঝন করে উঠল সারা শরীর, চোখে সর্ষে ফুল দেখতে দেখতেও প্রণয় গোঙাতে লাগল, “আমি জানি না। আমি জানি না। মেঘা আমায় ছেড়ে চলে গেছে, বম্বে গেছে এক টিভি সিরিয়ালের প্রডুসারের সাথে, আমি এটুকুই জানি।” “তুই বলবি আর মেনে নেব, আগের বউটাকে কি ভাবে মেরেছিলি আমরা বুঝি জানি না। সত্যি বল, কি করেছিস মেয়েটার সাথে?” আবার বাঁ পায়ের শিন বোনে মার পড়ল, ককাতে ককাতে প্রণয় বলেই চলল, “ আমি মারিনি মেঘাকে। প্লিজ বিশ্বাস কর।কিছুক্ষণের বিরতির পর সবে প্রণয় একটু সামলেছে খোনা গলা বলে উঠল, “বেশ মানলাম। কিন্তু তুই খুনি এটা তো মিথ্যা নয়? আগেরটাকে তো পুড়িয়ে মেরে আত্মহত্যা বলে চালিয়েছিলি। আমাদের কাছে সব খবরই আছে। মিথ্যা বলার চেষ্টা করলেইবলেই গদাম গদাম করে হাঁটু আর কনুইয়ে মারতে লাগল, “সেটাও তো তোর ভালবাসার বিয়ে ছিল নাকি রে হারামজাদা? কি যেন নাম ছিল তার? হ্যাঁ অনুরাধা। তাকেও ফাসিয়েছিলি, মেঘাকেও ফাঁসালি, তাকেও পুড়িয়ে মেরেছিলি, মেঘাকেও-।প্রণয় তড়বড় করে বলে উঠল, “আমি মেঘাকে ভালবাসতাম, তাকে নয়। অনুরাধাকে বিয়ে করার কারণ ছিল ওর বাবা।সবাই চুপ, বিষাক্ত সাপের মত হিসিয়ে উঠল প্রণয়, “ ঐ লোকটাকে শিক্ষা দেবার জন্যই, অনুরাধাকেমানে?” “ মানে? মানে ঐ লোকটার জন্য আমার পিসি, আমার একমাত্র পিসি আত্মহত্যা করেছিল। ছোট থেকে পিসির কাছেই মানুষ, কোলে পিঠে করে বড় করেছিল পিসি। তারপর একদিন বিয়ে করে বসিরহাট চলে গেল। বসিরহাটে বেশ সম্পন্ন পরিবারে বিয়ে হয়েছিল পিসির। ওদের অনেক জমি জায়গা, সেই কাল হল, ভাগাভাগি নিয়ে শরিকি ঝামেলায় খুন হয়ে গেল পিসেমশাই। ওদেরই এক শরিক আর তার ভাইয়েরা মিলে সবার চোখের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মারল। কেস উঠল অনুরাধার বাবার এজলাসে। কেস চলল, চেনা গল্প, অধিকাংশ সাক্ষী বিরূপ হল, কেউ টাকা খেয়ে, কেউ বা ভয়ে। যখন ফল বের হল, সবাইকে বেকসুর খালাস করে দিল অনুরাধার বাবা। পরে জানা গেল, ঐ খুনি গুলোর ছোট ভাইয়ের সাথে অনুরাধার পিসির বিয়ে হয়েছে। অনুরাধার বাবার অসৎ বলে বদনাম ছিল, কিন্তু এ ক্ষেত্রে টাকা পয়সা লেনদেন হয়নি, তার বদলে নিজের কুৎসিত খোঁড়া হেপোরুগি বোনটাকে পাত্রস্থ করেছে অনুরাধার বাবা।সবাই চুপ। কোথাও কোন শব্দ নেই, তারপর তীব্র ঘৃনা মাখানো গলায় কে যেন বলে উঠল, “ তুই মানুষ? লোকটার ওপর রাগ ছিল তো তাকে মারতে পারতিস। তার নিরীহ গোবেচারা মেয়েটা কি দোষ করেছিল? সে তো তোকে ভালবাসত।হাহা করে হেসে উঠল প্রণয়, “ ওকে মারলেই তো ও মরে যেত। তাতো চাইনি। চেয়েছিলাম তিলতিল করে মরুক। তাই ওর একমাত্র মেয়েকে _। আদালতে আসত বুড়ো, বিচার চাইতে, এমন আটঘাট বেঁধে সব করেছিলাম, কিস্যু প্রমাণ করতে পারেনি। কুঁজো নুয়ে পড়া লোকটাকে দেখতাম আর ধর্ষকাম আনন্দ পেতাম। গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল আমার পিসি, আর ওর মেয়েকে জীয়ন্ত জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। তড়পে তড়পে মরেছিল ওর ফুলটুসি মেয়েটা।

আর কিছু বলতে পারল না প্রণয়, একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট ওর মাথায় পড়িয়ে দিল কেউ। ছটফট করতে লাগল প্রণয়, বাঁচার তীব্র আকুতিতে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল শরীরটা, একটু বাতাস, একটু বাতাসের জন্য আকুলি বিকুলি করতে করতে একসময় থেমে গেল প্রণয়।
পরদিন বেলা নটা দশটার সময় যখন লেকের জলে পাওয়া গেল প্রণয়ের মৃতদেহ, ততক্ষণে কলকাতার মাটি ছেড়েছে অন্তরার প্লেন। অসুস্থ্য মাকে দেখতে মাত্র দিন চারেকের জন্য কলকাতা এসেছিল অন্তরা, ভোরে ফ্লাইট বলেই রাতে বন্ধুর কাছে রয়ে গিয়েছিল। রুটিন এনকয়ারি হল, লেকের আসে পাশে বিল্ডিং গুলোতেই বেশি, দেবিকাদের বিল্ডিংয়েও একদিন জিজ্ঞাসাবাদ করতে এল ওরা, মামুলী কিছু প্রশ্ন করে চলে গেল। মাস তিন চার পরে প্রথামত কোওপারেটিভকে জানিয়ে নাকতলায় নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে গেল দেবিকা, কেউ আটকাল না। তারপর কি হল? কেউ জানে না। 
(
শেষ)