Wednesday 6 July 2016

অনির ডাইরি ৬ই জুলাই, ২০১৬




উটি সম্পর্কে যদিও কোন সম্যক ধারণা ছিল না, তবু দেবুর প্রস্তাবে অসম্মত হবার মত কিছু পেলাম না। তাছাড়া আমরা উভয়েই দেবুর কাছে একটা ব্যাপারে কৃতজ্ঞ। গত বছরে দেবু আমাদের একটা বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। ব্যাপারটা কি হয়, না, ২০১৪র নভেম্বরে আমাদের পুরি যাবার কথা ছিল। সেই ২০১৩র সেপ্টেম্বরে ৩দিনের শিমলা ট্রেনিং এর দৌলতে দিল্লী-আগ্রা-সিমলা ঘুরে আসার পর আর আমাদের কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। শৌভিকের বিডিও গিরি তখন পুরোমাত্রায় চলছে। প্রায় প্রতিদিনই শুনি, “ এই মাসটাই শেষ, এবার উঠেই যাব। ব্লক থেকে উঠেই বেড়াতে যাব।” করতে করতে বছর ঘুরে গেল, কোথাও আর যাওয়া হল না, শেষে হতাশ হয়ে আমরা ঠিক করলাম, পুরিই যাব। দিন পাঁচেকের জন্য পুরি থেকেই ঘুরে আসা যাক। আমাদের উভয়েরই বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করা হল, ওনারা আমাদের সাথে যেতে ইচ্ছুক কি না? আমার শ্বশুর-শাশুড়ি পত্রপাঠ সে প্রস্তাব নাকচ করে দিলেও আমার বাবা-মা রাজি হয়ে গেলেন। ২৩শে নভেম্বর, ২০১৪ রাতের ট্রেনে যাওয়া এবং ২৯শে নভেম্বর শনিবার প্রাতেঃ ফেরা। সেই মোতাবেক পাঁচ দিন হোটেল বুক করা হল, ট্রেনের টিকিট, আমার ছুটি, মেয়ের স্কুল, কাজের মাসি সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। এমনকি শৌভিকের ছুটিও ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষ মঞ্জুর করে দিল। জীবনে প্রথম বার সমুদ্র দেখবে বলে তুত্তুরি ও প্রবল উত্তেজিত, প্যাকিং ও প্রায় শেষ। শুক্রবার সন্ধ্যা বেলা অফিস থেকে ফিরে অন্তিম পর্যায়ের প্যাকিং করছি, রবিবার সন্ধ্যায় ট্রেন, শৌভিক ব্লক থেকে সবে ফিরেছে, এমন সময় বড় সাহেবের ফোন। ছুটি ক্যান্সেল নয় বটে, তবে এখন না যাওয়াই ভাল। সামারি রিভিশন চলছে, ইলেকশন কমিশন কখন কি চেয়ে বসে, এমতবস্থায় বিডিও তাঁর দপ্তরে না থাকলে কি করে হবে। শৌভিক যথাসম্ভব করুণ সুরে বোঝাতে চেষ্টা করল, বাড়িতে বউ-বাচ্চা মানসিক ভাবে বেড়াতে যাবার জন্য তৈরি, আর অফিস নিয়েও কোন সমস্যা হবে না। প্রয়োজনে দুরাভাসের মাধ্যমেই ও সব রিপোর্ট পাঠাতে পারবে---। কোন লাভ হল না। শেষ মুহূর্তে বিরাট টাকা গুনাগার দিয়ে ট্রেনের টিকিট গুলো কান্সেল করা গেলেও, হোটেল বুকিং কান্সেল হল না। ওরা লিখে দিল, এক বছরের জন্য বুকিং পিছিয়ে দেওয়া হল।  এক বছরের মধ্যে যে, কোন সময় আমরা যেতে পারি। তবে কোন টাকা ফেরত ওরা দেবে না। নভেম্বর থেকে আমরা ব্যগ্র হয়ে অপেক্ষা করছি, পুরী যেতেই হবে, কিন্তু শারীরিক কারণে আমার বাবা-মা আর কিছুতেই যেতে রাজি হলেন না, বহু কাকুতিমিনতি করেও লাভ হল না। নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি টপকে এপ্রিল- মে মাস এসে গেল, ওঁদের সিদ্ধান্ত বদল হল না। কি হবে? পাঁচ দিনের জন্য একটা গোটা ঘরের ভাড়া গোনা হবে, অথচ সেই ঘরে কেউ থাকবে না? অগত্যা শৌভিক বলল, দুজনেরই বন্ধুবান্ধবদের বলে দেখা হোক, যদি কাউকে না পাওয়া যায় তাহলে সেই আপনি আর কপনিই ভরসা। শেষ পর্যন্ত সে যাত্রা দেবু আমাদের উদ্ধার করেছিল।
দেবুর ফোনটা সেদিন রাতে যখন এল, তখন আমরা নৈশ ভোজ সারছি, উটি সম্পর্কে আমার বিশেষ কোন ধারণা ছিল না। দেবু স্পষ্ট জানাল, “ দেখ আমরা করমণ্ডল এক্সপ্রেস ধরে চেন্নাই যাব, করমণ্ডল চেন্নাই পৌছয় বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, সেখান থেকে রাত নটা নাগাদ নীলগিরি এক্সপ্রেস ছাড়ে, পর দিন ভোর বেলা পৌছয় মেট্টুপাল্লাম। মেট্টুপাল্লাম থেকে টয় ট্রেনে উটি। রাজি আছিস তো বল?” আমি সবে তেই রাজি, গৃহকর্তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মুহূর্তের জন্য নাক সিটকে, কাঁধ ঝাঁকালেন, অর্থাৎ যা ভাল বোঝ কর। দেবু কে জানিয়ে দিলাম, আমরা যেতে রাজি।
আমাদের ট্রেন ২৬শে জুন দুপুর বেলা ২।৫০এ। মাঝের কয়েকটা মাস, নির্বাচন এবং অন্যান্য উত্তেজনায় কেটে গেল, ২৪শে জুন  অফিস  থেকে ফিরবার সময় বাসে জানালাম, আগামী কয়েকদিন থাকছি না। জনৈক উৎসুক সহযাত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যাবেন? বললাম, শুনে উনি খুশি হয়ে বললেন, “ বেশ মোটা গরম জামা নিতে ভুলবেন না কিন্তু।” গরম জামা? গরম জামা কেন নিতে যাব খামোখা? কলকাতা গরমে সিদ্ধ হচ্ছে, গুগল বলছে উটির সর্বনিম্ন তাপমাত্রা মাত্র ২০ ডিগ্রী, ঐ তাপমাত্রায় বাচ্ছার একটা ফুলহাতা জামা নিলেই তো হয়? অবিশ্বাসীর সুরে প্রশ্ন করলাম, “আপনি কবে গিয়েছিলেন, মানে কোন ঋতুতে?” উনি মাতব্বরি ঢং এ বললেন, “ঘোর গরমে। ভাল কথা বলছি, না শুনলে বাচ্ছা নিয়ে বিপদে পড়বেন।” প্যাকিং প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাও তুত্তুরির একটা ফুলহাতা সোয়েটার নিলাম, আমার চাদর, শৌভিকের গুগুলের ওপর অখন্ড বিশ্বাস, তাই ওর কিছুই নেওয়া হল না। ফুল হাতা শার্টই নাকি যথেষ্ট। রবিবার বেলা এগারোটার মধ্যেই দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষ করে গড়াগড়ি খাচ্ছি সকলে, ভাবলাম, অন্তিম মুহূর্তে একবার ফেসবুকটা দেখেই নি, বন্ধুরা কে কি করছে, পড়তে পড়তে দেখি, আমারই এক সহপাঠী উটির ছবি লাগিয়েছে, মোবাইলের ছোট স্ক্রীনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিছু না বুঝলেও একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম, ওঁরা সপরিবারে মোটা মোটা উলের সোয়েটার, জ্যাকেট পরেছে এবং তার ওপর চাদর জড়িয়েছে। সর্বনাশ, চুলোয় যাক দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা, ট্রেনে ঘুমোবার অনেক সময় পাব, আগে গরম জামা গোছাই। অতঃপর পুনরায় দৌড়াদৌড়ি, নতুন করে সব প্যাকিং করে যখন আমরা তালাচাবি মেরে ওলায় উঠলাম, ঘড়ির কাটা দেড়টা ছুঁইছুঁই।
[চলবে]

Tuesday 5 July 2016

অনির ডাইরি ৫ই জুলাই, ২০১৬


পূর্বেই স্থির করেছিলাম, যে এ যাত্রা ডাইরি লিখব। সেই মোতাবেক, শৌভিকের মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও একটি স্থুলাকৃতি প্যাড এবং পেন সঙ্গেও নিয়েছিলাম। কিন্তু গোটা ভ্রমণ পর্বে এক ছত্রও লিখে উঠতে পারিনি। এ বারের যাত্রাপর্বটা শুরু থেকেই ছিল মহা গোলমেলে। মাস দুই-তিন আগে, সম্ভবত তখন এপ্রিল মাস, বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্ব তুঙ্গে, শৌভিক হুগলী জেলার ওসি ইলেকশন, কখন বাড়ি ফেরে, কখন যে অফিস যায়- সাংসারিক কোন দায়দায়িত্বের কথা বলতে গেলেই প্রতিনিয়ত শুনতে হয়, “দাঁড়া আগে ইলেকশন পর্ব মিটুক।” এই চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে ঘুরতে যাবার বায়না যে নেহাত বাতুলতা, তা সহজেই বোধগম্য। বিগত নভেম্বরে ঐ আসাধারণ উত্তর বঙ্গ ভ্রমণের পর, খুব যে একটা বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছিল এমনও নয়। মুস্কিল বাঁধালেন, আমার এক সহযাত্রী। মধ্যবয়সী সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক, কোন এক জাহাজ  কোম্পানিতে সম্ভবত করণিক হিসাবে কর্মরত, মাঝে মধ্যেই ওঠেন আমাদের চার্টার্ড বাসটিতে। উনি এত বেশি গল্প করতে ভালবাসেন, যে ওনাকে দেখলেই আমার আতঙ্ক লাগে। দিব্যি সুখে দিবানিদ্রা দিতে দিতে অফিস যাব, তা নয়, গপ্পে বুড়ো বকেবকে আমার মাথা খারাপ করে দেবে। ওনার গল্পের বিষয় দুটি, প্রথমত ওনার পুত্র, যে কিনা সদ্য মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে, জাহাজ কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে ।ভদ্রলোক নিতান্তই পুত্রগত প্রাণ, উনি আজো নিজের পুত্রের সব কাজ নিজে হাতে করেন, এবং আমাকেও এন্তার জ্ঞান দেন, কি ভাবে সন্তান মানুষ করতে হয়। অস্বীকার করব না, শুনতে মন্দ লাগে না। ওনার গপ্পের দ্বিতীয় প্রিয় বিষয় হল, ভ্রমণ। ওনাদের একটা দল আছে, যারা দীর্ঘ বিশ-পঁচিশ বছর ধরে এক সাথে ঘুরে বেড়ায় এবং এই দলের সংখ্যা ক্রমঃবর্ধমান। উনি আমাকে, শৌভিক এবং তুত্তুরিকে এই দলের সদস্য করে নিতে বদ্ধ পরিকর। যত বলি, “আরে মশাই, আপনি চাইলেই কি আমরা যেতে পারব? আমার অফিস, মেয়ের স্কুল আর বরের দেশোদ্ধার সামলে তবে না দেশভ্রমণ। তার থেকে আমি বরং একটু ঘুমোই-”। ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা, “আরেঃ সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। ইচ্ছেটাই আসল। জান আমরা একবার ট্রেন মিস করেছিলাম। সেই গল্পটা কি তোমাকে বলেছি?” আমার মুখে চোখে বোধহয় সামান্য ঔৎসুক্য ফুটে উঠেছিল, উনি দ্বিগুণ উৎসাহে শুরু করলেন, “ সেবার আমাদের লাদাক যাবার কথা।ঐ প্লেনে উঠলাম আর হুশ করে লাদাকে গিয়ে নামলাম ঐ রকম ছোঁচা প্ল্যান নয়। রীতিমত  হাওড়া থেকে কালকা মেলে চণ্ডীগড়, চণ্ডীগড় থেকে গাড়িতে মানালি হয়ে লাদাক। আর ফেরার সময় কাশ্মীর হয়ে নামা।”  নড়ে চড়ে বসলাম, ঈশ এত ভাল ট্যুর, বলা যায় স্বপ্নের ট্যুরে ট্রেন ফেল, এ গল্প না শোনাই ভাল। খামকা মানসিক অবসাদ বৃদ্ধি করে কি লাভ? এর থেকে একটা ছোট্ট ঘুম দিয়ে নিলে তোফা হত। ভদ্রলোক আমার মনোগত ইচ্ছেকে পাত্তাই দিলেন না, “ শোন না, সন্ধ্যা পৌনে আটটা নাগাদ ট্রেন, আমি অফিস থেকে হাফ ডে নিয়ে বেরোলাম, কোথায় ট্রেনে ডিনার করব বলে, পার্ক সার্কাস আরসেলান থেকে মাটন বিরিয়ানি কিনলাম, অথচ তোমার বৌদি আর সময়ে তৈরি হতেই পারল না। যত বলছি হল? আর দেরী করলে কিন্তু ট্রেন পালাবে, কে শোনে আমার কথা? সব সেরে যখন ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে বেরোলাম তখন সন্ধ্যা সাতটা।” “বাবা গো? পৌনে আটটায় হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়বে, আর আপনারা বাগুইআটি থেকে যাত্রা শুরু করলেন সন্ধ্যা সাতটায়? ঐ অফিস টাইমে?” ভদ্রলোক বিমর্ষ হয়ে বললেন, “কি বলবে বল? ট্রেনটা যে আমার স্বর্গত শ্বশুর মশাইয়ের সম্পত্তি নয়, সেটা কে বোঝাবে। তাও ট্যাক্সি ড্রাইভার বেশ ভালোই চালিয়েছিল। আমরা ঠিক পৌনে আটটায় হাওড়া ষ্টেশন পৌঁছলাম, পোঁছে দেখি চোখের সামনে দিয়ে কালকা বেরিয়ে যাচ্ছে।” “ঈশ। আমি হলে তো কাঁদতে লাগতাম।” “ঐ তো। আমার গিন্নীও তাই করল। আগে আমার গুষ্ঠি উদ্ধার করল, তারপর রেল কোম্পানির। তাতেও যখন হল না, তখন কাঁদতে লাগল।” “ তা তো কাঁদবেই বাবা। অনেক দিন আগের কথা না? আপনার স্ত্রী তখন নিশ্চয় নবঢ়া ছিলেন।” “ কে বলল তোমায়? দু-তিন বছর আগের কথা হে। আমার ছেলে সবে জয়েন্ট পাশ করে হলদিয়া কলেজে ভর্তি হয়েছে।” দেখলাম মন্তব্য করা নিষ্প্রয়োজন। উনি বেশ খানিকটা গজগজ করে আবার শুরু করলেন, “ সে কি অবস্থা। এদিকে ছেলেটা হোঁদলুর মত দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস কাঁদতে কাঁদতে আত্মীয়স্বজনদের ফোন করছে আর আমার নামে নালিশ করছে-”। “আপনার নামে? আপনি কি করলেন?” “ সেটাই তো। কে বোঝাবে বল। গোদের ওপর বিষফোঁড়া আমার অন্যান্য সহযাত্রী বৃন্দ। তারাও আমায় ফোন করে ধমকাচ্ছে, যে আপনি ইচ্ছে করে ট্রেন মিস করেছেন। আপনার আমাদের সাথে যাবার ইচ্ছাই ছিল না।” “ কি জ্বালা বাবা। ওদের এত গাত্রদাহ কেন?” “ আমার কপাল। শোনই না, আমি এত গালাগাল খেয়েও ভেবে চলেছি, কি করে সবদিক সামলানো যায়। আগে আমার সহযাত্রীদের বললাম, আপনারা যান, আমরা আপনাদের দিল্লীতে ধরব। তারপর আমাদের অফিসের যে ট্রাভেল এজেন্ট আছে, তাকে বললাম, কালকে সকালেই দিল্লী যাবার তিনটে টিকিট চাই। প্লেনে বুঝলে কি না! ওর সাথে ধার-বাকি চলে, বললাম বাপু ফিরে এসে তোর টাকা দেব, তুই এ যাত্রা উৎরে দে বাপ। রাতে আর ফ্ল্যাটে ফিরলাম না। পড়শিদের কাছে কি করে মুখ দেখাবে আমার গিন্নী, তাই হাওড়া স্টেশনেই একটা হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন প্লেন ধরলাম।” স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম, “যাক!” ভদ্রলোক বিষণ্ণ ভাবে হেসে বললেন, “কি যাক? কিছুই যায়নি গো। আমরা যখন দিল্লী পৌঁছলাম, কালকা দিল্লী ছেড়ে চলে গেছে।” “হে ভগবান!” “আবার কি। তারপর দিল্লী থেকে বাস ধরে চণ্ডীগড়। রাত আড়াইটে তে পৌঁছলাম। যাক ওখানে ওদের সাথে দেখা হয়ে গেল, বাকি ট্রিপে আর সমস্যা হয়নি।” মানতে বাধ্য হলাম, কি অতুলনীয় ধৈর্য ভদ্রলোকের, ট্রেন ফেল করার গল্প শেষ হলে, উনি মানালি হয়ে লাদাক এবং লাদাক থেকে কাশ্মীর হয়ে নামার গল্প শুরু করলেন। সুন্দরী লাদাকের বর্ণনা শুনে, মোহিত হয়ে গেলাম। অফিসে নেমে দুটো মেসেজ করলাম, একটা শৌভিককে আর একটা দেবুকে, বক্তব্য এক, “চল লাদাক যাই।” শৌভিক তো জবাব দেবার প্রয়োজনই বোধ করল না, বেলা দুটোয় দেবুর জবাব ঢুকল, “ এত ছোট বাচ্ছা নিয়ে লাদাক যাওয়া যায় না।” চ্যাপ্টার ক্লোজড, ভেবে দুটোকেই গালমন্দ করে, কাজে মন দিলাম।
        সেদিন রাত প্রায় পৌনে এগারোটা তখন, শৌভিক সবে ফিরে খেতে বসেছে, দেবুর ফোন, “এই শোন। উটি যাব ভাবছি, যাবি?”
(চলবে?)   

Saturday 18 June 2016

হিমি


চতুর্দিক সাদা। চোখ ঝলসানো ধপধপে সাদা নয়, বরং নরম, কোমল, আরামদায়ক চোখ জুড়ানো সাদা। কি রকম যেন ধোঁয়াটে। চোখ খুলেই হিমির মনে হল, ও নির্ঘাত হাসপাতালে আছে। চোখ বন্ধ করতেই স্মৃতিপটে জেগে উঠল সেই দুটো চোখ। উফ! কি নির্মম, হিমশীতল, ঘন কৃষ্ণবর্ণ এক জোড়া চোখ। বাকি মুখটা কাপড় জড়ানো, পরিষ্কার বাংলায় ওকে প্রশ্ন করেছিল।হিমি আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, উত্তরটা মনে করার, কিন্তু তীব্র আতঙ্ক বারবার ভুলিয়ে দিচ্ছিল সবকিছু। উত্তরটা ওর জানা ছিল। আফ্রিকার কোন শপিং মলে ঠিক এভাবেই ওরা বহু লোককে হত্যা করেছিল। সার দিয়ে সবাইকে দাঁড় করিয়ে, কেবল একটা প্রশ্ন করেছিল, যাতে বোঝা যায় কারা ওদের ধর্মাবলম্বী আর কারা নয়। যারা উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছিল তাদের আর বেঁচে থাকতে দেয়নি ওরা।
        হিমির বস ওদের ধর্মানুসারী, কাগজে আফ্রিকার ঘটনাটা পড়ে এত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল হিমি যে পরদিনই অফিসে গিয়ে বসকে জিজ্ঞাসা করেছিল উত্তরটা। বস ভাবতে এত সময় নিয়েছিলেন যে, হিমি অসহিষ্ণু হয়ে বলেই ফেলেছিল, “এত সময় লাগালে, ওরা আপনাকেও ছাড়বে না!” বাড়ি ফিরে নিজের বরকে আর শিশুকন্যাকে পাখি পড়া করে শিখিয়েছিল উত্তরটা। সৌর বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “এখানে ও সব হবে না রে বাবা। তুই নিশ্চিন্ত থাক।” তাও হিমি আশ্বস্ত হয়নি, কে জানে বাবা, ভারতবর্ষের ওপর সকলের এত রাগ। আর আজ হিমি নিজেই মনে করতে পারছে না! কি বলেছিলেন স্যার, নাফিসা ? নাকি আয়েশা? জবাব দিতে পারবে না হিমি, আতঙ্কের সাথে সাথে তীব্র অভিমান ওর কন্ঠ রোধ করছিল। কেন ওরা এভাবে নির্বিচারে মানুষ খুন করছে?
খুব একটা দামি নয় মলটা, বেশির ভাগই অফিস ফেরতা মধ্যবিত্ত, সবৎসা গৃহবধূ আর কলেজে পরা উঠতি প্রেমিক-প্রেমিকা। হিমিও তো এসেছিল অফিস ফেরত ক্রিম কিনতে। ওর মেয়ে চিকেন ভর্তা খেতে খুব ভালবাসে, ক্রিম দিলে স্বাদটা ভালো হয়। সবে ক্রিম এর কার্টনটা হাতে নিয়েছে এমন সময় প্রবল শোরগোল, ফটফট করে গুলি চালানোর আওয়াজ। লুকানোর সুযোগ দেয়নি ওরা। বাথরুম থেকে টেনে টেনে সবাইকে বার করেছে, ন্যূনতম প্রতিরোধ যারা দেখাতে গেছে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েছে তৎক্ষণাৎ। হিমির চোখের সামনে এক প্রতিবাদী বৃদ্ধ শিখের মাথায় গুলি করল। রক্ত আর ঘিলু ছিটকে এসে লাগল তাকে থরেথরে সাজানো সুদৃশ্য খাবার গুলির গায়ে। থরথর করে কাঁপছিল হিমি। আত্মপক্ষ সমর্থনে কিনা জানে না, কিন্তু উগ্রপন্থীগুলো প্রত্যেককে হত্যা করার সোচ্চারে বলছিল, এটা কিছু বছর আগে ঘটে যাওয়া এক দাঙ্গার প্রতিশোধ। কোথায় একদল পাষণ্ড নির্বিচারে কিছু মানুষকে হত্যা করেছিল, তার জন্য তো হিমি কোন অংশে দায়ী নয়। বরং দাঙ্গাকারীদের যখন কোর্ট কঠিন সাজা দিয়েছিল,  হিমি উল্লসিত বোধ করেছিল। যে গণধর্ষিতা মায়ের চোখের সামনে তার শিশুকন্যাকে আছড়ে মেরেছিল নরাধম পশু গুলো তার বেদনা এই আতাতায়ীদের থেকেও বেশি উপলব্ধি করেছিল হিমি।নিজের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে হুহু করে কেঁদে ফেলেছিল তার দুঃখে।  
এই সব ভাবতে ভাবতেই লোকটা এসে দাঁড়িয়েছিল ওর সামনে, পরিষ্কার বাংলায় প্রশ্ন করেছিল, উদ্যত বন্দুক তাগ করে। হিমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “নাফিসা”। তারপরই চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল দম চাপা আতঙ্কে। শুধু মনে পড়েছিল পুটুস অপেক্ষা করছে।  
এটা যদি হসপিটালই হয়, তাহলে ডাক্তার, নার্স, স্যালাইন কিছুই নেই কেন? এমনকি হাসপাতালের সেই চেনা গন্ধটাও নেই।হিমি একা দাঁড়িয়ে আছে, সকালে যা পরে বেরিয়েছিল, এখনও তাই পরে আছে, শুধু রঙগুলো অস্বাভাবিক হাল্কা প্রায় সাদাটে লাগছে। হয়তো পারিপার্শ্বিকের প্রভাব। কাধের ব্যাগটা নেই। ব্যাগটা কোথায় গেল? ব্যস্ত হয়ে পড়ল হিমি। সৌরকে খবর দেওয়াটা জরুরী। অফিস থেকে বেড়িয়ে জানিয়েছিল মল ঘুরে বাড়ি ফিরবে। সৌর চিন্তা করবে। কখন বাড়ি ফিরতে পারবে কে জানে? পুটুসের মাসির বাড়ি যাবার সময় হয়ে এল কি? কটা দেখতে গিয়ে দেখে হাতে ঘড়িটা নেই। কোথায় ফেঁসেছে ও।
চারিপাশ যেন সাদা মেঘে ঢাকা, না জানি কতক্ষণ ধরে ঘুরছে হিমি, একটাও চেনা লোক দেখতে পেল না। উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে, মনে হাজার প্রশ্ন জবাব দেবার কেউ নেই। ভুল বললাম, চারিদিকে অগণিত মানুষ। অথচ কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। সবাই কি মৌন ব্রত ধারণ করল নাকি? রিমি একাধিক লোককে জিজ্ঞেস করল, কেউ বলতে পারল না ও কোথায় আছে। সবথেকে আশ্চর্যের কথা হল, এখানে নানা প্রজাতির মানুষ আছে, কেউ শ্বেতাঙ্গ, কেউ বা কৃষ্ণাঙ্গ, কেউ পীত বর্ণ, কারো ছোট চোখ থ্যাবড়া নাক আবার কারো শরীরে খাঁটি আর্য রক্ত সোচ্চারে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করছে। মূল্যবান জামাকাপড় পরা মানুষ ও যেমন আছে তেমনি লেঙটি পরা লোকজনেরও অভাব নেই।এমন কি আলখাল্লা পরা আরব দেশীয় লোক ও আছে। হিমি যাকে যে ভাষাতেই প্রশ্ন করুক না কেন, সকলেই বাংলায় জবাব দিল। কেউ বলতে পারল না ও কোথায় আছে। কেউ জানে না। পুটুস বারন্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে, মা কখন আসবে আর পুটুসের মা পথ হারিয়ে ঘুরে মরছে, বুক ফাটা কান্না এত ক্ষণে গলা চিরে বেরিয়ে এল। “আ- হা-হা-হা” করে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে হিমি। গ্রাম্য মহিলাদের মত বুক চাপড়ে চাপড়ে “পুটুস- পুটুস রে” বলে, হঠাৎ এক স্নেহময় হাতের স্পর্শে চমকে উঠল।
সাদা বোরখা পরা এক মধ্যবয়সী মহিলা, পাকিস্তানী বর্ষীয়সী অভিনেত্রী সামিনা পিরজাদার মত দেখতে, ওর পাশে বসে ওর পিঠে হাত বোলাচ্ছে। দেখে ভারতীয় মনে হয় না, মধ্যপ্রাচ্যের বাসিন্দা বোধ হয়। হিমি অশ্রু সজল চোখে তার দিকে তাকাল, মহিলা বাংলায় বলল, “কাঁদে না বেটি। কাঁদে না। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে। প্রিয়জনেদের জন্য দিল খুব দুখবে। ভুলে যাবার চেষ্টা কর। না হলে এগোতে পারবে না। এখানেই আটকে থেকে যাবে।” কি ভুলে যাবে? হিমি আবার জিজ্ঞাসা করল, “ আমি কোথায় মা? এটা কোন জায়গা?” মহিলা করুণ ভাবে বলল, “এটা কোন জায়গা আমিও জানি না। মৃত্যুর অব্যবহিত পরে আমাদের এখানে আসতে হয়। জাগতিক টান যতদিন না কাটে আমরা এখানেই থেকে যাই। তারপর কোথায় যায় জানি না। বেহেস্তে নাকি দোজখে, নাকি আবার পৃথিবীতে ফিরে যায় তাও আমি জানি না। যারা এখান থেকে চলে যায় তারা আর ফিরে আসে না।” হিমির অবিশ্বাসী মন, বেদনাতেও হেসে উঠল, পাগল মহিলা। মহিলা বেদনার্ত চোখে তাকাল, “ না মা। এখানে কেউ পাগল নয়। তবে যারা নতুন আসে তারা কেউ বিশ্বাসই করতে পারে না, যে তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে।” সদ্য মৃত শব্দটা তপ্ত সীসার গুলির মত হিমির কানে প্রবেশ করল। হিমির মন চিৎকার করে উঠল, না না না। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ মা প্লিজ বল কি করে বাড়ি যাব? বাড়িতে আমার ছোট্ট মেয়েটা--” গলা বুজে এল হিমির। মহিলা অল্প হাসলেন, কান্নার চেয়েও করুণ সে হাসি। “ বাড়ির জন্য আমারও বড় মন কেমন করে রে। কবে এসেছি, আজো পৃথিবীর মায়া কাটাতে পারলাম না। জানিস আমাদের দেশে বড় যুদ্ধ চলছে। বারো মাস গুলি গোলা চলে, বোমা ফাটে, আকাশে বোমারু বিমান চক্কর কাটে। বেওয়া  আমি এরই মাঝে কত কষ্ট করে মেয়েটাকে বড় করলাম। বিয়ে দিলাম অথচ সেই মেয়ে আমার তালাকশুদা হয়ে ফিরে এল দু-দুটো বাচ্ছা নিয়ে। যুবতী মেয়ে আমার, তায় রূপবতী, চারিদিকে কাক চিল উড়ছে, আইনশৃঙ্খলার বালাই নেই। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসত না। একদিন রাতে বুকে অসহ্য বেদনা, জ্ঞান হারালাম। চোখ খুলে দেখি এখানে। কত কেঁদেছি জানিস? বুড়া বাবা না থাকলে কি হত কে জানে? নতুন যারা আমার বা তোর মত দিশেহারা হয়ে পড়ে, বুড়া বাবাই তাদের সাহারা।”
মহিলা কিছুই বলতে পারবে না বুঝতে পেরে হিমি ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। মহিলা ওকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। মাথায় আলতো আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, হঠাৎ কাকে দেখে যেন বলে উঠলেন, “ খুব কাঁদছে। নতুন এসেছে তো। আপনিই পারবেন সামলাতে বুড়া বাবা।” মহিলার বুক থেকে মুখ তুলে হিমি অত দুঃখেও হেসে ফেলল। সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে আদৌ বুড়ো নয়। কত হবে বছর পয়তাল্লিশ, মাথায় ছয় ফুট তো বটেই। গৌর বর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসা, ঠোঁটের ওপর পাতলা প্রজাপতি গোঁফ। রীতিমত সুদর্শন। কিন্তু কি পরেছে রে বাবা? মাথায় চকচকে পাথর বসানো উষ্ণীষ, গায়ে সিল্কের ঝলমলে জোব্বা, তলায় চুড়িদার, কোমরে নাচের সময় মেয়েরা যেমন পরে তেমনি সোনালি রঙের কোমরবন্ধনী, তাতে আবার একটা সুদৃশ্য তরোয়ালের খাপ ঝোলানো আছে। যদিও খাপটা খালি। 
(চলবে)

Wednesday 15 June 2016

এই হঠাৎ পাওয়া মন খারাপ

আয়নার সাথে বিশেষ প্রীতি কোনদিনই ছিল না মেয়েটার।
আয়না যে তাকে দেখলেই বলে, "মেয়ে তুই বড় সাধারণ।"
আয়নার কথা শোনার সময় কোথায়, নির্দয় জীবন সংগ্রামে ব্যপ্ত যে-
কদাচিৎ গভীর রাতে গিয়ে বসত, আয়নার কাছে , আলতো হাতে ধুলো ঝাড়ত, আয়না মুখ খুললেই, সে উঠে যেত।

হঠাৎ একদিন প্রশ্ন করল, “ বল দেখি আয়না, কেমন লাগছে?”
প্রভাতী সূর্যের আলোয় চোখ ঝলসে গেল আয়নার, মৃদু হেসে বলল, “মন্দ কি?”
তারপর আয়নাই হল তার প্রিয় সখী। আয়না জানল, কে যেন একটা এসেছে।
তার জন্য বার মাসই বসন্ত, তার জন্যই দুধের সর, মেঘলা রঙের শাড়ি, অপটু প্রসাধন, দুই ভ্রুর মাঝে ছোট্ট কুমকুমের ছোঁয়া।

সেদিন প্রাক বর্ষার বৃষ্টিতে প্লাবিত মহানগর, জল থৈথৈ চরাচর, উদ্বিগ্ন আয়না অপেক্ষা করছিল তার প্রিয় সখীর-
সে এল, ধুয়ে গেছে কুমকুম, ঝরে গেছে প্রসাধন, মাথা নত করে বসে রইল বহুক্ষণ,
বুঝেও নির্বাক রইল আয়না। চোখ তুলে তাকালো সে আয়নার দিকে, “চলে গেছে।”
তার চোখে অকাল শ্রাবণ, “ সে আমার ছিল না। তবু –”
মৃদু হাসল আয়না, মাথা নত করে সে বলল, “ তুমি বলেছিলে। সত্যি বড় সাধারণ আমি। যদি আর একটু –”
“তুমি অনন্যা!” জোর গলায় বলে উঠল আয়না। অবিশ্বাসী চোখে তাকালো সে, মুছে নিল অশ্রুবারি, মেরুদণ্ড ফুলিয়ে বলল, “করুণা করছ? তুমিও”

আবার হাসল আয়না, “ পাগল? কাল আবার সূর্য উঠবে। যত্ন করে আঁকড়ে থেকো এই হঠাৎ পাওয়া মন খারাপ-”
#AninditasBlog
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

Tuesday 7 June 2016

সরিতা ভাবী (part-3)


শম্পার বিয়েতে বড়মার দুই মেয়েই এসেছিল, বেশ কিছুদিন ছিলও, যাবার সময়, দুই পিসিমাই বড়মাকে নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলেও বড়মা গেল না। হেসেই উড়িয়ে দিল, “আমি তো দিব্যি আছি রে।আমার রিন্টি- সিন্নি আমায় ছাড়া থাকতে পারবে না। পুজোর সময় ওরা যখন মামার বাড়ি যাবে, তখন দু একদিনের জন্য নিয়ে যাস বরং।” বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বড়মার বড় জামাই, রিন্টি দের বালির পিসিমার বর মারা গেলেন। মেয়ের ঐ ঘোর দুর্দিনে কাঁদতে কাঁদতে বড়মাকে যেতেই হল, যাবার সময়, রিন্টিকে কথা দিয়ে গেল, কাজকর্ম মিটলেই চলে আসবে। শ্রাদ্ধশান্তি মিটলেও বালির পিসিমা ছাড়ল না বড়মাকে। সদ্য বিধবা কন্যাকে ফেলে বড়মাও আসতে পারল না। বালির পিসিমা অত্যন্ত ধনী, বাড়ির লাগোয়া নিজস্ব গঙ্গার ঘাট, ঘাটের লাগোয়া শিবমন্দির, বাড়ি ভর্তি পরিচারক- পরিচারিকা, খিদমৎ খাটার লোক। পিসিমা বোধহয় ভেবেছিলেন বড়মা শেষ জীবনটা গঙ্গাস্নান আর পুজোআচ্চা করে আরামে কাটবে। কিন্তু কাজের মানুষ তো, ও ভাবে শুয়ে বসে থাকতে বোধহয় একদম ভালো লাগত না। কাউকে না বলে, ভোর বেলায়, লুকিয়ে চা করতে গিয়েছিলেন, উনুনে নয় স্টোভে। ৭০% পোড়া অবস্থায় যখন পিজি হসপিটালে আনা হল, ডাক্তার বলেই দিলেন, জরুরীভিত্তিতে চিকিৎসা ওনারা করছেন বটে, তবে বড়মার বয়সে ঐ তীব্র দহনের জ্বালা সহ্য করা প্রায় অসম্ভব। সেদিন সকাল থেকেই মেঘলা ছিল, টিপিটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল, রিন্টির বাবা-মা, কাকা, জেঠু সবাই গিয়েছিল পিজি তে। মেজদাদু মাঝে মাঝে চোখ মুছছিল আর বলছিল, “ ও থাকতে চায়নি। কেন যে জোর করে আটকে দিল।” নিমতলা ঘাটে দাহ করে বাবাদের ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল সেদিন। বাড়ি ফিরেও মা গুনগুন করে কাঁদছিল, “আমরা যখন গেলাম, তখনও প্রাণ ছিল। কাঁচের বাইরে থেকে ঠিক আমায় চিনতে পারল। হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করল রিন্টি- সিন্নি কি করছে।” রিন্টি তখন আট, শুকনো চোখে অবাক হয়ে ভাবছিল, পিসেমশাই এর শ্রাদ্ধের দিনও বড়মা বলছিল, “একদম ভালো লাগছে না এখানে। দাঁড়া না কটা দিন যাক, এরা একটু সামলে নিলেই আমি চলে যাব।”
বড়মার মৃত্যুর কিছুদিন পর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, কাকা-কাকিমা আলাদা হয়ে গেল। তলায় তলায় দ্বন্দ্ব চলছিলই। এত বড় পরিবারে, কিছুটা খাদ্য কৃচ্ছতা থাকেই, রেশ্নের চালের ভাত, রেশ্নের গম ভাঙানো আটার রুটি, মাথা পিছু আধখানা ডিম, এক পিস মাছ তাও সপ্তাহে দুদিন, ছোট ছোট করে কাটা খাসির মাংস, জলজলে পায়েস ইত্যাদি। এই নিয়েই অশান্তি দানা বাঁধছিল। কাকা-কাকিমা দুজনেই কলেজে পড়ান, বেশ ভালো মাইনে পত্র পান, কেন তাদের সন্তানসন্ততি রোজ মাছ খাবে না? বিশেষ করে কাকিমার আপত্তি ছিল নন্তুকে র্যা শন দোকানের চালের ভাত খাওয়াতে। সিন্নির বেলায় কাকিমা আলাদা করে ভাত করে নিত, এবার আর পারবে না। হাঁড়ি আলাদা হয়ে গেল, একদিকে রিন্টির ঠাকুমা, মেজদাদু-মেজঠাম্মা, জেঠু- জেঠিমা, বাবা-মা আর রিন্টি। অন্যদিকে কাকা-কাকিমা-সিন্নি আর নন্তু। কাকাদের খাবার ঘরও আলাদা হয়ে গেল। ছুটির দিন হলে কাকারা কি খেল রিন্টিরা জানতেও পারত না। কিন্তু মুস্কিল হত, যেদিন কাকা-কাকিমা দুজনেই থাকত না। এক সাথে বড় দালানে খেতে বসত রিন্টি আর সিন্নি। রিন্টি দাল-পোস্ত ভাত আর সিন্নি মাছের ঝল-ভাত। তাতে সমস্যাটা কি হত সেটা রিন্টি বুঝত না। মা রোজ রাতে বাবাকে ফিসফিস করে শোনাত আজ কাকাদের কি রান্না হয়েছে, অথচ রিন্টির জন্য একটুও দেয়নি। কেন যে কাকিমা রিন্টির জন্য রাখবে, সেটাই তো রিন্টি বুঝে উঠতে পারত না। কাকিমা কোনদিনই রিন্টিকে পছন্দ করেনি। সিন্নি-নন্তুর জন্য আনা খেলনা তো দূরের কথা, সামান্য গল্পের বইটাও রিন্টিকে পড়তে দিত না। রিন্টি হ্যাংলার মত চাইত, তাও না। সিন্নির জন্য আনা আনন্দমেলা, চাঁদমামা গুলো একটু স্পর্শ করার জন্য রিন্টি হাঁকপাঁক করত, কিন্তু তাও হাত দেবার অনুমতি পেত না। কাকিমার সাফ বুলি, “বই আমি কাউকে দি না। কেউ বই ফেরত দেয় না।” আরে একই তো বাড়ি, একটা বই এ ঘর থেকে ও ঘর গেলে কি হারিয়ে যায়, কিন্তু কাকিমাকে কে বোঝাবে? রিন্টির চোখের সামনে পুরানো বই বেচে দেওয়া হত, তাও ওকে পড়তে দিত না কাকিমা। তবে জেঠুকে দিত। জেঠুর ঘরে লুকিয়ে বই পড়ত রিন্টি। একবার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “মা, কাকিমা জেঠুকে শারদীয়া আনন্দমেলাটা পড়তে দিল, আমায় কেন দিল না মা? আমি ছিঁড়ে ফেলব বলে?” মা খুব স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিয়েছিল, “না। আমরা গরীব বলে।” গরীব মানে কি? বাবার কারখানাটা অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ।বাড়িতে দিনরাত অশান্তি। বাবা-মায়ের ঝগড়া না কোনদিন হাতাহাতির রূপ নেয় রিন্টি সেই ভয়েই আছে।বাবা পাগলের মত টিউশনি খুঁজছে আর মা, গলার বার মাস পড়ার হারটা বেচে একটা সেলাই মেশিন কিনেছে, অবসর সময়ে মেজ ঠাকুমার কাছে শায়া-ব্লাউস, জামা বানানো শিখছে।
বিয়ের পর শম্পাও যেন কেমন বদলে গেছে। ইতিমধ্যে বরের সাথে কিছুদিনের জন্য দামস্কাস আর ডোহায় কাটিয়ে এসে যেন বড়ই উন্নাসিক হয়ে উঠেছে। ওদের পুরানো শহরটাকে আর সহ্যই করতে পারে না শম্পা। হাওড়ার থেকে খারাপ আর নোংরা শহর বুঝি আর পৃথিবীতে হয় না। এ বাড়ির রান্নাও আর শম্পার মুখে রোচে না। এ বাড়ির চা নাকি অখাদ্য, গয়লার দুধে নাকি নর্দমার জল মেশানো, এ বাড়ির আজন্ম ব্যবহৃত স্নানঘর, পায়খানা নাকি ব্যবহারের অযোগ্য। এ শম্পা রিন্টির পরিচিত নয়। রিন্টি বরাবরই দিদির গায়ে ঠেস দিয়ে বসতে ভালবাসত, শম্পা আগে বিরক্ত হত, ঠেলে সরিয়ে দিত। এ শম্পা বিরক্তি প্রকাশ করে না, ঠেলে সরিয়ে দেয় না, বরং এক অদ্ভুত শীতলতার সাথে নীরবে বিচ্ছিন্ন করে নেয়, মৃদু সরে বসে। রিন্টি গায়ে হাত বোলালে, হাসি মুখে তাকায়, কিন্তু অজান্তে শক্ত হয়ে যায় পেশী। রিন্টি গায়ে পড়ে কথা বলে, না বললে, শম্পা সে ভাবে কোন কথাই বলে না। রিন্টি একদিন মাকে বলেই ফেলল, “মা, দিদি যেন কেমন বদলে গেছে না? আজকাল আসেই না। এলেও ভালো করে কথা বলে না।” মা আনমনে সেলাইকল চালাতে চালাতে বলল, “ হ্যাঁ বদলে গেছেই তো। কথায় কথায় শ্বশুর বাড়ির বৈভবের গল্প করে, ও বাড়িতে নাকি মাসের শুরু- শেষ বোঝা যায় না। সারা মাসই মাছ আসে, এত বড় বর পিস। যার যটা ইচ্ছা খাও- এই সব বলছিল আর কি।” কথা বলতে বলতে হঠাৎ মা সোজা হয়ে বসল, “তোকে আজকাল পাত্তা দেয় না, না? দেবেই বা কেন? জানে তোর বাবার কারখানা বন্ধ। গরীব কাকা টিউশনি করে সংসার চালায়। আর তোকে দেখতেও তো তেমন সুন্দর নয়।” দেখতে ভাল নয়, তা রিন্টি জানে, ছোট থেকেই ঠাকুমা বলত, “ভাগ্যে রঙটা কালো হয়নি। নাহলে এর বিয়ে দেওয়া মুস্কিল হত। তবে সর্ব দোষ হরে গোরা।” তবে কি নিষ্কলুষ ভালোবাসার প্রতিদানে কি ভালোবাসা পাওয়া যায় না? প্রিয়জনেদের ভালোবাসাও অর্থ বা রূপের ওপর নির্ভরশীল?
(to be continued)
#AninditasBlog
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

Saturday 4 June 2016

সরিতা ভাবী (part-2)



এক সপ্তাহ স্কুল গেল না শম্পা। পরের রবিবার, সাজো সাজো রব পড়ে গেল, গোটা বাড়িতে। কারা যেন শম্পাকে দেখতে আসবে। বাইরের ঘরে, পেতে রাখা ফরাশে, নতুন ধপধপে চাদর পাতা হল। তেলচিটে তাকিয়া গুলোকে, ওয়াড় খুলে ভালো করে রোদ খাওয়ানো হল। কাকা রিণ্টি আর সিন্নিকে নিয়ে, উঠোনের শ্যাওলা সাফ করতে লাগল। কাকিমা তার কয়েক মাসের সদ্যজাত পুত্রকে কোলে নিয়ে, আলমারি থেকে বিয়েতে পাওয়া মূল্যবান কাঁচের প্লেট, গ্লাস, চামচ, বোন চায়নার কাপ-ডিস বার করতে লাগল। শম্পার হারমোনিয়ামটাকে ঝেরে-ঝুড়ে নামিয়ে এনে বাইরের ঘরের মাটিতে শতরঞ্চি পেতে বসানো হল। মূল্যবান চা পাতা, বিস্কুট, মিষ্টি আনা হল।বিকাল বেলায় তাঁরা এলেন, বেশ কয়েকজন সম্ভ্রান্তদর্শন পুরুষ এবং মহিলা, সঙ্গে একটি বাচ্ছা ছেলেও ছিল। রিণ্টির বাবা এবং কাকা খাতির করে এনে বসালেন পেতে রাখা ফরাশের ওপর। মেজদাদু এসে করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে পাশে রাখা আরাম কেদারায় বসলেন, রিণ্টি এবং সিন্নি, যে যার মার রক্ত চক্ষু অগ্রাহ্য করে হারমোনিয়ামের দুপাশে গুটিগুটি গিয়ে বসল। বড়রা গল্পই করে যাচ্ছে, একি রে বাবা, রিন্টি আর সিন্নি যাত্রা দেখার উত্তেজনা নিয়ে জুলজুল করে তাকাচ্ছে, পাত্রপক্ষের সাথে আসা বাচ্ছা ছেলেটা পর্যায়ক্রমে একবার রিন্টি আর একবার সিন্নিকে মুখ ভ্যাঙাচ্ছে। বিরক্তি চরমে ওঠার ঠিক মুখোমুখি, কাকিমা শম্পাকে নিয়ে ঢুকলেন। পড়ন্ত সূর্যের কনে দেখা আলোয়, ড্যাম্প ধরা হাল্কা সব্জে রঙের চুনকাম করা ঘরটা যেন ঝলমলিয়ে উঠল। কাকিমাই সাজিয়ে দিয়েছে, একটা কাঁচা হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি, কানে দুটো ছোট সোনার ঝুমকো, দু হাতে দুই-দুই করে চারগাছা সোনার চুড়ি, চোখে হাল্কা কাজল, আর কপালে কুমকুমের ছোট্ট টিপ। পায়ের নুপুরে মৃদু রিনিরিনি আওয়াজ করে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল শম্পা। দু-হাত জোড়া করে নীরবে নমস্কার জানিয়ে, মাটিতে পেতে রাখা শতরঞ্চিতে বসতে যাবে, ওনারা হাঁহাঁ করে উঠলেন, ওনাদের পাশে গিয়ে বসল শম্পা। মাথা নিচু করে সব প্রশ্নের জবাব দিল, প্রশ্নোত্তর পর্বের অন্তে মেজদাদুর ছদ্ম অনুরোধে গান ধরল শম্পা, “গোধূলি গগনে মেঘে, ঢেকেছিল তারা----।” রিন্টির বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠল, ওঁরা নিয়ে চলে যাবে ওর দিদিকে? মনের গভীরে রিন্টি বারংবার প্রার্থনা করছিল, “হে মা দুর্গা, হে বাবা পঞ্চানন, হে নারায়ন, দোহাই, দিদিকে যেন ওঁরা নাপসন্দ- নাকচ করে দেয়।” যদিও বেশ ভালই বুঝেছিল, যে তা অসম্ভব।
ওরা চলে গেলেন। জানিয়ে গেলেন, দু একদিনের মধ্যেই খবর পাঠাবেন। শম্পাও আবার স্কুল যাওয়া শুরু করল। ওঁরা সত্যিই খবর পাঠিয়েছিল, শম্পাকে ওদের খুব পছন্দ। কিন্তু বয়সটা বড়ই অল্প, তাই ওঁরা অপারগ। জেঠিমা যখন রিন্টির মাকে কথাটা বলছিল, ওর মা তখন রান্নাঘরে রুটি বেলছিল, আর জেঠিমা সেঁকছিল, ভাগ্যক্রমে সেই সময় রিন্টি ঘুম পেয়েছে বলে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়েছিল । পরের রবিবার আবার একদল দেখতে এল, আগের বারের মত না হলেও এবারেও যথেষ্ট আয়োজন করা হল। এদের খুব পছন্দ হয়ে গেল শম্পাকে। ওনারা জানালেন, বিয়ে পাকা হয়ে যাক, কিন্তু শম্পা বড়ই ছোট। সবে দশম শ্রেণীতে উঠেছে, স্কুল ফাইনাল এবং উচ্চ মাধ্যমিকটা অন্তত পাশ করুক। কলেজে উঠলে বিয়েতে ওনাদের কোন আপত্তি নেই। এবারের সম্পর্কটা এরাই বাতিল করে দিল। অতদিন অপেক্ষা করতে নারাজ জেঠিমা। পরের পরের রবিবার আর একদল দেখতে এলেন। এঁরা অত্যন্ত ধনাঢ্য, দেখেই বোঝা গেল। নাকি শোভাবাজারের অত্যন্ত বনেদী পরিবার। ধপধপে সাদা কন্টেসা গাড়ি চেপে ওঁরা এলেন, অল্প দুচার কথায় সম্পর্ক পাকা হয়ে গেল, পাত্র সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। শম্পার থেকে বয়সে একটু বড়, তা হোক ঠাকুমা বলল, “সোনার আংটি আবার বেঁকা।” শম্পার হবু শাশুড়ি, জেঠিমার দুহাত জড়িয়ে বলে গেলেন, “কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। ও আমাদের মেয়ের মত থাকবে। আমরাই পড়াব।” গিনির মালা দিয়ে আশীর্বাদ করে গেলেন শম্পার হবু শ্বশুর।
দেড় মাসের মাথায়, বিয়ে হয়ে গেল শম্পার। তড়িঘড়ি আয়োজন করতে গিয়ে অনেক গুলো ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙতে হল জেঠুকে। অনেক টাকার সুদ মারা গেল। সঞ্চয়িতা চিট ফান্ডে টাকা রেখে ইতিমধ্যেই একবার বিরাট লোকসান হয়েছিল ওনার, সেই চোট সারার আগেই এত গুলো টাকা হারিয়ে তথা ধনী বেয়াই বাড়ির সাথে সৌহার্দমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে বেপোট প্রেশার- সুগার বাড়িয়ে ফেলল জেঠু। নির্বিঘ্নে বিয়ে করে হাসতে হাসতে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল শম্পা, যাবার সময় এক ফোঁটা কাঁদলও না। সবাই হাউ হাউ করে কাঁদছিল, মেজদাদু, বড়মা, ঠাকুমা, মেজ ঠাম্মা, জেঠু, জেঠিমা, রিন্টির মা, রিন্টি, সিন্নি সবাই। কাকা বা রিন্টির বাবার চোখও ছলছল করছিল। রিন্টির মা একবার বলেই ফেলল, “শম্পা তুই শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছিস। সেই শোভাবাজার। চাইলেও আর আমাদের দেখতে পাবি না। তোর কি কোন কষ্ট হচ্ছে না? একটু তো কাঁদ?” কি অসহায় বোকা বোকা ভাবে তাকাচ্ছিল শম্পা, রিন্টি বেশ বুঝতে পারছিল, হাজার চেষ্টা করেও কাঁদতে পারছে না শম্পা।নীরব বোবা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল, খাঁচায় বন্দী পাখির মত। শুধু বরের গাড়ি যখন ছেড়ে যাচ্ছে, জেঠুর হাতটা জড়িয়ে একবার ডুকরে কেঁদে উঠল, জেঠু ওর মাথায় হাতটা রাখতে গেল, তার আগেই হুস করে বরের গাড়ি এগিয়ে গেছে অনেকটা। ফুল দিয়ে সাজানো সেই সাদা কন্টেসা--।
শম্পা চলে যাবার বছর দেড়েকের মাথায় বড়মাও চলে গেল। সেই কোন তরুণী বয়সে, অকাল বিধবা বড়মা তার দুই নাবালিকা কন্যার হাত ধরে বাপের বাড়ি এসে উঠেছিলেন তা আজ আর কারো মনে নেই। বড়মার দুই মেয়েই রিন্টির জেঠুর থেকে বড়, এ বাড়ি থেকেই তাদের বিয়ে হয়েছে, এবং উভয়ই অত্যন্ত ধনী তথা সমৃদ্ধশালী পরিবারের পুত্রবধূ। তা সত্ত্বেও বড়মা যে কেন তার বাপের ভিটেতে পড়ে থাকত, তা কেউ জানত না। মা, জেঠিমা আর কাকিমা সুযোগ পেলেই মৃদু অভিযোগ করত, যে বড়মার মেয়েরা মায়ের বিন্দুমাত্র খোঁজ খবর রাখে না। বড়মার অবশ্য বিন্দুমাত্র হেলদোল ছিল না। এ বাড়ির প্রতিটা শিশু বড়মার নিজের হাতে মানুষ, রিন্টি, সিন্নি মায় সিন্নির পুঁচকে ভাই নন্তু যখন হল, আঁতুড়ের সব কাজ একা হাতে বড়মা করেছে। সকাল থেকে বড়মা রান্না ঘরে গিয়ে ঢুকত, সবাই অফিস কাছারি বেরিয়ে গেলে ঠাকুমা-মেজ দাদু- মেজ ঠাম্মা আর বড়মা বেলা বারোটায় জল খাবার খেত। কি সাধারণ ছিল সেই জলখাবার, একটু ডাল, হাতে গড়া রুটি আর একটু চিনি না হলে ভেলি গুড়। সারাদিন যে যা বলত ছুটে ছুটে সেই ফরমায়েশ পালন করত বড়মা। বাবা বা কাকা চা করতে বললে কি খুশিই যে হত। বিকাল চারটের আগে ভাত খেত না। চারটের সময়, ভাত, ডাল, একটু নিরামিষ তরকারি আর অম্বল, এই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক আহার। কত রকমের যে অম্বল রাঁধতে জানত বড়মা। কুমড়ো, ঢ্যাঁড়শ, বেগুন, বড়ি দিয়ে, কাঁচা তেঁতুল দিয়ে, শীত কালে মুলো দিয়ে, টমেটো দিয়ে কি অসাধারণ অম্বল রাঁধত বড়মা। কিছু না পেলে পাকা তেঁতুল গুলে চিনি দিয়ে টক। বিকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে, বড়মার পাতে অম্বল দিয়ে মাখানো এক গাল ভাতের স্বাদ বোধহয় জীবনেও রিন্টির মুখ থেকে যাবে না।
সন্ধ্যে বেলা, পড়ার জন্য যে যার মায়ের হাতে ঠ্যাঙানি খেয়ে, কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে বড়মার কোলে আশ্রয় নিত রিন্টি আর সিন্নি। গ্রীষ্ম কালে উঠোনে পেতে রাখা চৌকিতে, বড়মার দুপাশে দুই বোনে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনত, আর শীত কালে, খাটে লেপের তলায় শুয়ে।রামায়ণ, মহাভারত থেকে রাজা-রাণী- রাজপুত্র-রাজকন্যা- রাক্ষস- খোক্কশ-ব্যাঙ্গমাব্যাঙ্গমীর সাথে পরিচয় তো বড়মার মাধ্যমেই। এমনকি ইতিহাসের সাথে প্রাথমিক পরিচয়ও বড়মার হাত ধরে। অ্যালেকজান্ডার- পুরু, চন্দ্রগুপ্ত- কৌটিল্য, চণ্ডাশোক- ধর্মাশোক হয়ে বাদশাহ আকবর, হতভাগ্য শাহ জাহান, নিষ্ঠুর ঔরংজেব, বর্গীদের আক্রমণ, সিপাহী বিদ্রোহ, হয়ে ভারত ছাড় আন্দোলন কিছুই বাদ দিত না বড়মা। গল্পের সাথে সাথে নাটকীয় ভাবে উঠত নামত বড়মার কণ্ঠস্বর, কখনও ভয়ে কুঁকড়ে যেত দুই বোন, কখনও আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠত। গল্প বলতে বলতে বড়মা যার দিকে ফিরে শুত, অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে বড়মার মুখটা টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিত। এই নিয়ে প্রায়ই মারামারি লেগে যেত ওদের। সেই বড়মা যে এত তাড়াতাড়ি ওদের ছেড়ে চলে যাবে রিন্টি স্বপ্নেও ভাবেনি। কেন যে ভালবাসার মানুষ গুলো এত দ্রুত হারিয়ে যায়?
#AninditasBlog

https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/
 

Friday 3 June 2016

সরিতা ভাবী (part-2)

এক সপ্তাহ স্কুল গেল না শম্পা। পরের রবিবার, সাজো সাজো রব পড়ে গেল, গোটা বাড়িতে। কারা যেন শম্পাকে দেখতে আসবে। বাইরের ঘরে, পেতে রাখা ফরাশে, নতুন ধপধপে চাদর পাতা হল। তেলচিটে তাকিয়া গুলোকে, ওয়াড় খুলে ভালো করে রোদ খাওয়ানো হল। কাকা রিণ্টি আর সিন্নিকে নিয়ে, উঠোনের শ্যাওলা সাফ করতে লাগল। কাকিমা তার কয়েক মাসের সদ্যজাত পুত্রকে কোলে নিয়ে, আলমারি থেকে বিয়েতে পাওয়া মূল্যবান কাঁচের প্লেট, গ্লাস, চামচ, বোন চায়নার কাপ-ডিস বার করতে লাগল। শম্পার হারমোনিয়ামটাকে ঝেরে-ঝুড়ে নামিয়ে এনে বাইরের ঘরের মাটিতে শতরঞ্চি পেতে বসানো হল। মূল্যবান চা পাতা, বিস্কুট, মিষ্টি আনা হল।বিকাল বেলায় তাঁরা এলেন, বেশ কয়েকজন সম্ভ্রান্তদর্শন পুরুষ এবং মহিলা, সঙ্গে একটি বাচ্ছা ছেলেও ছিল। রিণ্টির বাবা এবং কাকা খাতির করে এনে বসালেন পেতে রাখা ফরাশের ওপর। মেজদাদু এসে করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে পাশে রাখা আরাম কেদারায় বসলেন, রিণ্টি এবং সিন্নি, যে যার মার রক্ত চক্ষু অগ্রাহ্য করে হারমোনিয়ামের দুপাশে গুটিগুটি গিয়ে বসল। বড়রা গল্পই করে যাচ্ছে, একি রে বাবা, রিন্টি আর সিন্নি যাত্রা দেখার উত্তেজনা নিয়ে জুলজুল করে তাকাচ্ছে, পাত্রপক্ষের সাথে আসা বাচ্ছা ছেলেটা পর্যায়ক্রমে একবার রিন্টি আর একবার সিন্নিকে মুখ ভ্যাঙাচ্ছে। বিরক্তি চরমে ওঠার ঠিক মুখোমুখি, কাকিমা শম্পাকে নিয়ে ঢুকলেন। পড়ন্ত সূর্যের কনে দেখা আলোয়, ড্যাম্প ধরা হাল্কা সব্জে রঙের চুনকাম করা ঘরটা যেন ঝলমলিয়ে উঠল। কাকিমাই সাজিয়ে দিয়েছে, একটা কাঁচা হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি, কানে দুটো ছোট সোনার ঝুমকো, দু হাতে দুই-দুই করে চারগাছা সোনার চুড়ি, চোখে হাল্কা কাজল, আর কপালে কুমকুমের ছোট্ট টিপ। পায়ের নুপুরে মৃদু রিনিরিনি আওয়াজ করে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল শম্পা। দু-হাত জোড়া করে নীরবে নমস্কার জানিয়ে, মাটিতে পেতে রাখা শতরঞ্চিতে বসতে যাবে, ওনারা হাঁহাঁ করে উঠলেন, ওনাদের পাশে গিয়ে বসল শম্পা। মাথা নিচু করে সব প্রশ্নের জবাব দিল, প্রশ্নোত্তর পর্বের অন্তে মেজদাদুর ছদ্ম অনুরোধে গান ধরল শম্পা, “গোধূলি গগনে মেঘে, ঢেকেছিল তারা----।” রিন্টির বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠল, ওঁরা নিয়ে চলে যাবে ওর দিদিকে? মনের গভীরে রিন্টি বারংবার প্রার্থনা করছিল, “হে মা দুর্গা, হে বাবা পঞ্চানন, হে নারায়ন, দোহাই, দিদিকে যেন ওঁরা নাপসন্দ- নাকচ করে দেয়।” যদিও বেশ ভালই বুঝেছিল, যে তা অসম্ভব।
ওরা চলে গেলেন। জানিয়ে গেলেন, দু একদিনের মধ্যেই খবর পাঠাবেন। শম্পাও আবার স্কুল যাওয়া শুরু করল। ওঁরা সত্যিই খবর পাঠিয়েছিল, শম্পাকে ওদের খুব পছন্দ। কিন্তু বয়সটা বড়ই অল্প, তাই ওঁরা অপারগ। জেঠিমা যখন রিন্টির মাকে কথাটা বলছিল, ওর মা তখন রান্নাঘরে রুটি বেলছিল, আর জেঠিমা সেঁকছিল, ভাগ্যক্রমে সেই সময় রিন্টি ঘুম পেয়েছে বলে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়েছিল । পরের রবিবার আবার একদল দেখতে এল, আগের বারের মত না হলেও এবারেও যথেষ্ট আয়োজন করা হল। এদের খুব পছন্দ হয়ে গেল শম্পাকে। ওনারা জানালেন, বিয়ে পাকা হয়ে যাক, কিন্তু শম্পা বড়ই ছোট। সবে দশম শ্রেণীতে উঠেছে, স্কুল ফাইনাল এবং উচ্চ মাধ্যমিকটা অন্তত পাশ করুক। কলেজে উঠলে বিয়েতে ওনাদের কোন আপত্তি নেই। এবারের সম্পর্কটা এরাই বাতিল করে দিল। অতদিন অপেক্ষা করতে নারাজ জেঠিমা। পরের পরের রবিবার আর একদল দেখতে এলেন। এঁরা অত্যন্ত ধনাঢ্য, দেখেই বোঝা গেল। নাকি শোভাবাজারের অত্যন্ত বনেদী পরিবার। ধপধপে সাদা কন্টেসা গাড়ি চেপে ওঁরা এলেন, অল্প দুচার কথায় সম্পর্ক পাকা হয়ে গেল, পাত্র সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। শম্পার থেকে বয়সে একটু বড়, তা হোক ঠাকুমা বলল, “সোনার আংটি আবার বেঁকা।” শম্পার হবু শাশুড়ি, জেঠিমার দুহাত জড়িয়ে বলে গেলেন, “কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। ও আমাদের মেয়ের মত থাকবে। আমরাই পড়াব।” গিনির মালা দিয়ে আশীর্বাদ করে গেলেন শম্পার হবু শ্বশুর।
দেড় মাসের মাথায়, বিয়ে হয়ে গেল শম্পার। তড়িঘড়ি আয়োজন করতে গিয়ে অনেক গুলো ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙতে হল জেঠুকে। অনেক টাকার সুদ মারা গেল। সঞ্চয়িতা চিট ফান্ডে টাকা রেখে ইতিমধ্যেই একবার বিরাট লোকসান হয়েছিল ওনার, সেই চোট সারার আগেই এত গুলো টাকা হারিয়ে তথা ধনী বেয়াই বাড়ির সাথে সৌহার্দমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে বেপোট প্রেশার- সুগার বাড়িয়ে ফেলল জেঠু। নির্বিঘ্নে বিয়ে করে হাসতে হাসতে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল শম্পা, যাবার সময় এক ফোঁটা কাঁদলও না। সবাই হাউ হাউ করে কাঁদছিল, মেজদাদু, বড়মা, ঠাকুমা, মেজ ঠাম্মা, জেঠু, জেঠিমা, রিন্টির মা, রিন্টি, সিন্নি সবাই। কাকা বা রিন্টির বাবার চোখও ছলছল করছিল। রিন্টির মা একবার বলেই ফেলল, “শম্পা তুই শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছিস। সেই শোভাবাজার। চাইলেও আর আমাদের দেখতে পাবি না। তোর কি কোন কষ্ট হচ্ছে না? একটু তো কাঁদ?” কি অসহায় বোকা বোকা ভাবে তাকাচ্ছিল শম্পা, রিন্টি বেশ বুঝতে পারছিল, হাজার চেষ্টা করেও কাঁদতে পারছে না শম্পা।নীরব বোবা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল, খাঁচায় বন্দী পাখির মত। শুধু বরের গাড়ি যখন ছেড়ে যাচ্ছে, জেঠুর হাতটা জড়িয়ে একবার ডুকরে কেঁদে উঠল, জেঠু ওর মাথায় হাতটা রাখতে গেল, তার আগেই হুস করে বরের গাড়ি এগিয়ে গেছে অনেকটা। ফুল দিয়ে সাজানো সেই সাদা কন্টেসা--।
শম্পা চলে যাবার বছর দেড়েকের মাথায় বড়মাও চলে গেল। সেই কোন তরুণী বয়সে, অকাল বিধবা বড়মা তার দুই নাবালিকা কন্যার হাত ধরে বাপের বাড়ি এসে উঠেছিলেন তা আজ আর কারো মনে নেই। বড়মার দুই মেয়েই রিন্টির জেঠুর থেকে বড়, এ বাড়ি থেকেই তাদের বিয়ে হয়েছে, এবং উভয়ই অত্যন্ত ধনী তথা সমৃদ্ধশালী পরিবারের পুত্রবধূ। তা সত্ত্বেও বড়মা যে কেন তার বাপের ভিটেতে পড়ে থাকত, তা কেউ জানত না। মা, জেঠিমা আর কাকিমা সুযোগ পেলেই মৃদু অভিযোগ করত, যে বড়মার মেয়েরা মায়ের বিন্দুমাত্র খোঁজ খবর রাখে না। বড়মার অবশ্য বিন্দুমাত্র হেলদোল ছিল না। এ বাড়ির প্রতিটা শিশু বড়মার নিজের হাতে মানুষ, রিন্টি, সিন্নি মায় সিন্নির পুঁচকে ভাই নন্তু যখন হল, আঁতুড়ের সব কাজ একা হাতে বড়মা করেছে। সকাল থেকে বড়মা রান্না ঘরে গিয়ে ঢুকত, সবাই অফিস কাছারি বেরিয়ে গেলে ঠাকুমা-মেজ দাদু- মেজ ঠাম্মা আর বড়মা বেলা বারোটায় জল খাবার খেত। কি সাধারণ ছিল সেই জলখাবার, একটু ডাল, হাতে গড়া রুটি আর একটু চিনি না হলে ভেলি গুড়। সারাদিন যে যা বলত ছুটে ছুটে সেই ফরমায়েশ পালন করত বড়মা। বাবা বা কাকা চা করতে বললে কি খুশিই যে হত। বিকাল চারটের আগে ভাত খেত না। চারটের সময়, ভাত, ডাল, একটু নিরামিষ তরকারি আর অম্বল, এই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক আহার। কত রকমের যে অম্বল রাঁধতে জানত বড়মা। কুমড়ো, ঢ্যাঁড়শ, বেগুন, বড়ি দিয়ে, কাঁচা তেঁতুল দিয়ে, শীত কালে মুলো দিয়ে, টমেটো দিয়ে কি অসাধারণ অম্বল রাঁধত বড়মা। কিছু না পেলে পাকা তেঁতুল গুলে চিনি দিয়ে টক। বিকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে, বড়মার পাতে অম্বল দিয়ে মাখানো এক গাল ভাতের স্বাদ বোধহয় জীবনেও রিন্টির মুখ থেকে যাবে না।
সন্ধ্যে বেলা, পড়ার জন্য যে যার মায়ের হাতে ঠ্যাঙানি খেয়ে, কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে বড়মার কোলে আশ্রয় নিত রিন্টি আর সিন্নি। গ্রীষ্ম কালে উঠোনে পেতে রাখা চৌকিতে, বড়মার দুপাশে দুই বোনে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনত, আর শীত কালে, খাটে লেপের তলায় শুয়ে।রামায়ণ, মহাভারত থেকে রাজা-রাণী- রাজপুত্র-রাজকন্যা- রাক্ষস- খোক্কশ-ব্যাঙ্গমাব্যাঙ্গমীর সাথে পরিচয় তো বড়মার মাধ্যমেই। এমনকি ইতিহাসের সাথে প্রাথমিক পরিচয়ও বড়মার হাত ধরে। অ্যালেকজান্ডার- পুরু, চন্দ্রগুপ্ত- কৌটিল্য, চণ্ডাশোক- ধর্মাশোক হয়ে বাদশাহ আকবর, হতভাগ্য শাহ জাহান, নিষ্ঠুর ঔরংজেব, বর্গীদের আক্রমণ, সিপাহী বিদ্রোহ, হয়ে ভারত ছাড় আন্দোলন কিছুই বাদ দিত না বড়মা। গল্পের সাথে সাথে নাটকীয় ভাবে উঠত নামত বড়মার কণ্ঠস্বর, কখনও ভয়ে কুঁকড়ে যেত দুই বোন, কখনও আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠত। গল্প বলতে বলতে বড়মা যার দিকে ফিরে শুত, অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে বড়মার মুখটা টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিত। এই নিয়ে প্রায়ই মারামারি লেগে যেত ওদের। সেই বড়মা যে এত তাড়াতাড়ি ওদের ছেড়ে চলে যাবে রিন্টি স্বপ্নেও ভাবেনি। কেন যে ভালবাসার মানুষ গুলো এত দ্রুত হারিয়ে যায়?
#‎AninditasBlog‬

https://amianindita.blogspot.in