Wednesday 24 February 2016

অভিসার



চোদ্দ
বছর, চোদ্দ বছর ধরে একজোড়া কাজল কালো চোখ আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়। অশ্রুসজল একজোড়া আশাহত চোখ। তীব্র আকুতি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমার ভীরু আত্মসর্বস্ব চোখ লজ্জায় অবনত হয়ে এসেছিল। ততোদিনে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সহমর্মী হলেও বাবা মার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তার পরম আশ্রয় হতে পারিনি। সে চলে গিয়েছিল, মুখে সরল হাসি কিন্তু চোখে একরাশ অভিমান নিয়ে। 
পরবর্তী চোদ্দ বছর শুধু প্রতিক্ষা। নির্নিমেষে তাকে অনুসরণ করে গেছি আমি। সংসারের চাপে যখনই খেই হারিয়ে ফেলেছি সেই এক জোড়া সরল ছলছলে চোখ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তীব্র কশাঘাতে রক্তাক্ত করেছে আমায়। সে রক্ত আর কেউ দেখেনি শুধু দেবী ছাড়া
মাঝে শুনলাম সে বিয়ে করেছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। কি করি? হে ঈশ্বর তবে কি আমার সব সাধনা ব্যর্থ হল। সামান্য ভীরুতার এত বড় শাস্তি আমাকে কি সারা জীবন একাকী বয়ে বেড়াতে হবে? নিখাদ মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে আমি, কারো সংসার ভাঙার কারণ হতে পারব না। সেদিন দুপুরের চন্দননগরের ঘাট আর পতিতপাবন গঙ্গা সাক্ষী ছিল আমার আকুলতার। সেদিনও দেবী আমার মাথাটা টেনে নিয়েছিল নিজের কাঁধে। চেপে ধরেছিল দুই হাত। ফিসফিস করে বলেছিল, “আর কিছুই না প্রতীক্ষা দীর্ঘতর হল মাত্র একটু থেমে বলেছিল, “ লড়াই তোর একার নয়। উৎসাহ হারিয়ে সংসারে মন দেবার চেষ্টা করেছিলাম। ক্ষণে ক্ষণে সেই দুটো চোখ আমায় আহত করেছে, জোড় করে ঠেলে মন থেকে সরাবার চেষ্টা করতাম। পারতাম না, ভয় লাগত মানসিক সাম্য হারিয়ে না বসি। 
দেবী কিন্তু হাল ছাড়েনি। ছায়ার মত অনুসরণ করে গেছে তাকে। কিছুদিন আগে দেবীই সুসংবাদটা দিল। স্ত্রী কতৃক পরিত্যক্ত হয়েছে সে। আমার মনময়ুরী আনন্দে উন্মাদিনী হয়ে উঠল। ঈশ্বর এতদিনে মুখ তুলে তাকালেন। সে বাবামা সহ আমাদের হাউসিং এরই একটা ফ্ল্যাটে এসে উঠল। বুঝলাম মাহেন্দ্রক্ষণ অনুপস্থিত। আর অনুসরণ না, এবার অনুসৃত হবার পালা
ইচ্ছা করে বাজারে তার পাশে এসে দাঁড়ালাম। ভেবেছিলাম চিনতে পারবে না, একগাল হাসল, ঝকঝকিয়ে উঠল তার চোখ। গল্প হল, ফোন নম্বর চাইল, দিলাম না, আমার বর প্রায়ই আমার মোবাইল ঘাঁটে। মাঝে মাঝেই দেখা হতে লাগল। সেদিন কথা প্রসঙ্গে জানালাম, বর বাইরে যাচ্ছে অফিস টুর্ণামেন্ট খেলতে। যদি ওর বাবা মাও সময় কোথাও যান, তাহলে--- প্রচণ্ড লজ্জা করছিল বলতে। কিন্তু চোদ্দ বছরের প্রতীক্ষা , বলতে আমাকে হবেই। লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকালাম, সে আশ্বাস দিল, সরস্বতী পুজোর দিন বাড়ি ফাঁকা থাকবে। 
আজ সরস্বতী পুজো, অভিসারের রাত, সাড়ে দশটা, কাঁপা হাতে বেল বাজালাম। সে ত্রস্ত হয়ে দরজা খুলে দিল। কালো শাল মুড়ি দিয়ে টুক করে ঢুকে পড়লাম। আমার সাথে দেবীকে দেখে অবাক হল। বোঝালাম একা এত রাতে শাশুড়ী ছাড়তেন না। কামাতুর হাসি খেলে গেল তার চোখে। মদ্যপানের প্রস্তাব দুজনেই নাকচ করলাম। সে একাই গ্লাস নিয়ে বসল, বেডরুমে। কিছুক্ষণ প্রেমালাপ করে, ওয়াশরুমে গেলাম। দেবী প্রেমবর্জিত বার্তালাপ চালাতে লাগল। নিঃশব্দে বেড়িয়ে এলাম ওয়াশরুম থেকে। দেবীর সাথে চোখাচোখি হল। প্রচণ্ড জোড়ে ধড়ফড় করছে বুক, হৃদপিণ্ডটা না ফেটে যায়। গলা থেকে দোপাট্টাটা খুলে আলগোছে মাথা দিয়ে গলিয়ে তার চোখে চাপা দিলাম, শিউরে উঠে হেসে ফেলল সে। সময় নষ্ট না করে দ্রুত গলায় নামিয়ে আনলাম।হাল্কা নট দিলাম। ক্রমশ টানতে লাগলাম, সর্ব শক্তি দিয়ে। কাটা ছাগলের মত ছটফটাল কিছুক্ষণ, তারপর সব শেষ। 
দোপাট্টার প্রান্ত দুটো খাটের রেলিং বাঁধলাম। যাতে মনে হয় বসে বসে গলায় দড়ি দিয়েছে। ঠিক যে ভাবে চোদ্দ বছর আগে খুন করেছিল অঞ্জুকে। অঞ্জু অর্থাৎ অঞ্জনা এর প্রথম স্ত্রী। আর আমাদের প্রাণের বন্ধু। 
চোদ্দ বছর আগে এক সন্ধ্যায় অঞ্জু হাপরের মত হাঁপাচ্ছিল, এক জোড়া দীঘল চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল,“ আমাকে দুটো দিন থাকতে দিবি? আমার যে কোথাও যাবার জায়গা নেই। মা বলছে ফিরে যেতে। আমি জানি ফিরে গেলে আর ফিরে আসব না।